বিশ্ববাজারে তেল ও গ্যাসের শক্তির পরিবর্তন: যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি আরব ও রাশিয়ার ভূ-রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা

ভূমিকা

বিশ্বরাজনীতিতে (Geopolitics) একটি সাধারণ নিয়ম সবসময় প্রাসঙ্গিক থেকেছে— ক্ষমতা (Power) আসে জ্বালানি (Energy) থেকে। অর্থনীতি (Economy) ও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা বহুলাংশে নির্ভর করে পর্যাপ্ত জ্বালানি সম্পদের প্রাপ্যতার ওপর। যে কেউ জ্বালানি নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবহার করতে পারবে, সেই অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে পারবে, প্রভাব খাটাতে পারবে এবং প্রতিদ্বন্দ্বীদের পেছনে ফেলতে পারবে। তাই তেল (Oil) ও গ্যাস (Gas) জিওপলিটিক্সে একটি শক্তিশালী অস্ত্র (Weapon) এবং রাষ্ট্রশক্তির (State Power) জন্য অতি মূল্যবান সম্পদ।

বিশেষ করে ২০২০-এর দশকে এই সত্য আরও স্পষ্ট হয়েছে। কোভিড-১৯ মহামারি (Pandemic) এবং ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যে (Middle East) যুদ্ধের প্রাদুর্ভাবে বিশ্ব ক্রমেই অস্থির হয়ে উঠেছে। একদিকে দীর্ঘমেয়াদি নেট জিরো (Net Zero) বাস্তবায়নের স্বপ্ন কিছুটা থমকে গেছে, অন্যদিকে রাষ্ট্রগুলোকে তড়িঘড়ি করে শক্তি-নিরাপত্তা (Energy Security) পুনরুদ্ধারে মনোযোগী হতে হচ্ছে। ভাগ্যক্রমে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রে (US) শেল বুম (Shale Boom) হওয়ায় প্রচুর পরিমাণে তেল ও গ্যাস সরবরাহ রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র এখন বিশ্বে অপরিশোধিত তেল (Crude Oil) এবং গ্যাস উৎপাদনে শীর্ষস্থানীয়। ফলে যে ত্রিমুখী ক্ষমতার সমীকরণ—সৌদি আরব (Saudi Arabia), রাশিয়া (Russia) এবং যুক্তরাষ্ট্র (US)—তারা মিলে বিশ্বে মোট অপরিশোধিত তেলের ৪০% ও প্রাকৃতিক গ্যাসের (Natural Gas) ৪৩% উৎপাদন করে। এদের সঙ্গে জোটগত সম্পর্ক ও বৈদেশিক বিনিয়োগের (Foreign Investment) সূত্রে বিশ্ববাজারের (Global Market) আরও বড় একটি অংশকে নিয়ন্ত্রণ করে। অন্যান্য দেশও অবশ্য তেল-গ্যাস উৎপাদন করে, তবে প্রকৃত কর্তৃত্বে তারাই প্রধান শক্তি।

বর্তমান অস্থিরতা এবং পরিবর্তনের সময়ে, এই তিন শক্তি তেল-গ্যাস বাণিজ্যের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সংগ্রামে লিপ্ত। যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপীয় বাজার (European Market) রাশিয়ার কাছ থেকে কেড়ে নিচ্ছে এবং বৈশ্বিক বাজারের মূল্য-ব্যবস্থাপক হিসেবে সৌদি আরব ও ওপেকের (OPEC) কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করছে। যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বিষয়টি লাভজনক হলেও রাশিয়া ও সৌদি আরবের জন্য তেল-গ্যাস শুধু অর্থনীতির অংশ নয়; সেটাই আসলে তাদের অর্থনীতি। তাদের প্রধান ক্ষমতার উৎস। তাই তাদের আয় যখন হুমকিতে পড়ে, তখন তারা পাল্টা পদক্ষেপ নিতেই বাধ্য হয়। রাশিয়ার ক্ষেত্রে আমরা ইতোমধ্যেই এর উদাহরণ দেখেছি। আর ইতিহাস বলে, সৌদি আরবের পক্ষ থেকেও যে কোনো সময় বড় ধরনের প্রতিশোধাত্মক পদক্ষেপ নেওয়া অসম্ভব নয়। বিশেষ করে এমন কিছু, যা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বিপর্যয়কর হতে পারে।

তাহলে কীভাবে যুক্তরাষ্ট্রের উদীয়মান তেলশিল্প (Oil Industry) পুরনো শক্তির ভারসাম্য বদলে দিচ্ছে? কেন রাশিয়ার ডার্ক ফ্লিট (Dark Fleet) জাহাজগুলো তাদের অবস্থান গোপন বা ভুয়া লোকেশন দেখিয়ে তেল ও গ্যাস সরবরাহ করছে? এবং কীভাবে সৌদি আরব যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়াকে চাপে ফেলে আবারও ক্ষমতার শীর্ষে ফেরার চেষ্টা করতে পারে?

যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরবের পুরনো সম্পর্ক

বর্তমান বৈশ্বিক শক্তি সরবরাহের পালাবদল বুঝতে হলে জানতে হবে যে সৌদি আরব ও যুক্তরাষ্ট্র কখনোই এমন প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল না। আসলে তেলের বিশ্বে এই দুই দেশের সম্পর্ক প্রায় ১০০ বছরের পুরনো, এবং শুরুতে তা ছিল পারস্পরিক লাভজনকতার ভিত্তিতে। মহামন্দা (Great Depression) কাটিয়ে ওঠার সময় যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি যখন দ্রুতগতিতে শিল্পায়িত হচ্ছিল, তখন জ্বালানির চাহিদা বাড়তে থাকে। তাই যুক্তরাষ্ট্রের তেল কোম্পানিগুলো বিদেশি উৎসে তেল খুঁজতে ঝুঁকে পড়ে।

এরপর আসে ১৯৩২ সাল। মধ্যপ্রাচ্যের (Middle East) চারটি অঞ্চলকে একীভূত করে ইবনে সাউদ (Ibn Saud) নামে এক শাসকের অধীনে জন্ম নেয় নতুন একটি দেশ—যা আজকের সৌদি আরব। সদ্য প্রতিষ্ঠিত রাজ্যটি উন্নয়ন ও আধুনিকায়নের স্বপ্ন দেখছিল। তাই ১৯৩৩ সালে সৌদি আরব স্ট্যান্ডার্ড অয়েল অব ক্যালিফোর্নিয়াকে (Standard Oil of California) তাদের ভূখণ্ডে তেল অনুসন্ধানের অধিকার দেয়। এর মাধ্যমেই তৈরি হয় ক্যালিফোর্নিয়া-আরাবিয়ান স্ট্যান্ডার্ড অয়েল কোম্পানি, যা পরে অ্যারাবিয়ান-আমেরিকান অয়েল কোম্পানি নাম নেয়। সংক্ষেপে যার নাম—আরামকো (Aramco)। আজকের দিনে সৌদি আরবের সবচেয়ে বড় রাষ্ট্রীয় তেল কোম্পানি (State Control Industry) আরামকো একসময় ১০০% আমেরিকান মালিকানাধীন ছিল, এবং এর নামেই সেই ঐতিহাসিক বন্ধনের ছাপ রয়ে গেছে।

১৯৩৮ সালে প্রথম বড় তেলক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয় এবং এর পরবর্তী কয়েক দশক ধরে সৌদি আরবের তেলশিল্প দ্রুত প্রসারিত হয়। এ সময়টি ছিল সৌদি সরকারের, যুক্তরাষ্ট্রের বড় বড় তেল কোম্পানি এবং মার্কিন সরকারের পরস্পর নির্ভরশীলতার যুগ—সৌদি শাসকের নিরাপত্তায় (Military Protection) সাহায্য করত যুক্তরাষ্ট্র, আর বিনিময়ে তারা পেত তেল। কিন্তু সৌদিরা ধীরে ধীরে উপলব্ধি করে যে তাদের কাছে বিশাল সম্পদ রয়েছে, আর এ সম্পদ অন্যের নিয়ন্ত্রণে রাখতে তারা নারাজ। ফলে ১৯৬০ ও ১৯৭০-এর দশকে তেলের মালিকানা আস্তে আস্তে মার্কিন কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে সৌদি সরকারের হাতে চলে যায়। সৌদির তেলমন্ত্রী আহমেদ জাকি ইয়ামানি (Ahmed Zaki Yamani) এই পথনির্দেশনা দিয়েছিলেন।

সে সময় শুধু সৌদিতেই নয়, আরও অনেক দেশে—যেমন ভেনেজুয়েলা (Venezuela), লিবিয়া (Libya), ইরাক (Iraq), কুয়েত (Kuwait)—তেলশিল্প জাতীয়করণ চলছিল। একই সময়ে, সৌদি আরব সোভিয়েত ইউনিয়নের (Soviet Union) প্রভাব থেকেও রেহাই পাচ্ছিল না। ১৯৫০ ও ১৯৬০-এর দশকে সোভিয়েতরা নিজেদের স্যাটেলাইট রাষ্ট্রগুলো (Satellite States)—পূর্ব ইউরোপ (Eastern Europe), উত্তর কোরিয়া (North Korea), কিউবা (Cuba)—এসব জায়গায় তেল সরবরাহ করত। সেই বাড়তি তেল তারা বিশ্ববাজারে ছেড়ে দিয়ে দাম কমিয়ে দিত। এতে সৌদির রপ্তানি (Export) আয়ে চাপ পড়ে। সৌদিরা এই অতিরিক্ত সরবরাহের প্রতিক্রিয়ায় অন্যান্য বড় তেল-রপ্তানিকারী দেশের সঙ্গে সমন্বয় শুরু করে, যাতে তারা নিজেদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যগুলো পুরণ করতে পারে। এভাবেই ১৯৬০ সালে তৈরি হয় অর্গানাইজেশন অব পেট্রোলিয়াম এক্সপোর্টিং কান্ট্রিজ (OPEC), যা আজকের দিনে বিশ্বের প্রমাণিত তেল মজুদের (Proven Oil Reserves) ৮০%-এর বেশি উত্তোলনের হার নিয়ন্ত্রণ করে।

১৯৭৩-এর আরব অয়েল ইমবার্গো থেকে শেল বুম পর্যন্ত

১৯৭৩ সালে আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ (Yom Kippur War) চলাকালীন, ইসরায়েলকে (Israel) পশ্চিমা বিশ্বের সামরিক সহায়তার প্রতিবাদে সৌদি আরব এবং অন্যান্য আরব ওপেক দেশগুলো যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের বিরুদ্ধে তেল আমবার্গো (Embargo) আরোপ করে। তখন বিশ্ববাজারে তেলের দাম দ্রুত আকাশচুম্বী হয়, মার্কিন ব্যবসাগুলো তেল-সংকটে ধুঁকতে থাকে, আর যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। এটি ছিল প্রথমবারের মতো, কিন্তু শেষবার নয়, যখন যুক্তরাষ্ট্রের ওপর মধ্যপ্রাচ্যের তেলনির্ভরতাকে নগ্নভাবে প্রকাশ করে দিল।

এই দুর্যোগ সামাল দিতে যুক্তরাষ্ট্র দেশের অভ্যন্তরীণ তেলের ওপর ৪০ বছরের জন্য রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা (Export Ban) দেয়। সৌদি আরব বিশ্বকে দেখিয়ে দিল যে তারাই প্রধান তেল-ক্ষমতা এবং বিশ্বপরিস্থিতিকে নিজেদের পক্ষে নিয়ে আসতে তারা নির্দ্বিধায় নিষেধাজ্ঞা ব্যবহার করতে পারে। পরবর্তী কয়েক দশক এভাবেই চলতে থাকে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের (Collapse of the USSR) আগে এবং পরে, রাশিয়ায় (তখন সোভিয়েত ইউনিয়ন) তেল উৎপাদন কমতে থাকে—বিশেষত ১৯৮০-এর দশকের শেষ ভাগ থেকে ১৯৯০-এর দশক পর্যন্ত—যার ফলে ওপেকের হাতে বাজারের নিয়ন্ত্রণ আরও মজবুত হয়।

এদিকে, ওপেকের ওপর নির্ভরশীলতা থেকে যেন আর বিপাকে পড়তে না হয়, যুক্তরাষ্ট্র জ্বালানি আমদানি (Import) বৈচিত্র্যময় করার কৌশল নেয়। তাদের অভ্যন্তরীণ তেল উৎপাদনও ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছিল। এরই মধ্যে বিশ্লেষক ও সামরিক বিশেষজ্ঞরা বারবার বলে আসছিলেন—যুক্তরাষ্ট্রের জ্বালানি নিরাপত্তা (Oil Security) এবং বিদেশি জ্বালানি উৎপাদনের ওপর নিয়ন্ত্রণহীনতা তাদের একটি প্রধান দুর্বলতা হয়ে উঠেছে। অনেকে মনে করেন, ২০০৩ সালে ইরাকে (Iraq) মার্কিন হামলার অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য ছিল ইরাকের তেলক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের প্রবেশাধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা। কারণ ৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে সেখানে মার্কিন তেল কোম্পানিগুলোর কাজ করার সুযোগ ছিল না। পরবর্তীতে সেখানে হলিবার্টন (Halliburton) নামের একটি তেল পরিষেবা কোম্পানি—যার সঙ্গে তৎকালীন মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট ডিক চেনির (Dick Cheney) সংশ্লিষ্টতা ছিল—তারা আবারও কাজ শুরু করে।

রাষ্ট্রীয়ভাবে তখন যুক্তরাষ্ট্র বলছিল, ইরাকের স্বৈরশাসক সাদ্দাম হুসেইনের (Saddam Hussein) কাছে ব্যাপক বিধ্বংসী অস্ত্র (Weapons of Mass Destruction) আছে এবং তিনি বিশ্বশান্তির জন্য হুমকি। কিন্তু আজ পর্যন্ত সে দাবির কোনো প্রমাণ মেলেনি। যাই হোক, ইরাকে ঢোকার পর যুক্তরাষ্ট্র ইরাকি তেল-আমদানি বাড়ানোর সুযোগ পেল। যদিও এর ফলে বাইরের তেলের ওপর মার্কিন নির্ভরশীলতা বড় কোনো পরিবর্তন হয়নি।

এরপর আসে ২১ শতকের hydraulic ফ্র্যাকিং (Fracking) আবিষ্কার ও শেল বুম (Shale Boom)। যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ তেল মজুদ এত বেড়ে গেল যে, ২০১৫ সালে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা (Barack Obama) প্রায় ৪০ বছর পর কাঁচা তেল রপ্তানির নিষেধাজ্ঞা তুলে নেন। যুক্তরাষ্ট্র আবার বড়সড় তেল রপ্তানিকারী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করল। কিন্তু একই সময় সৌদি আরবসহ বড় সব তেল উৎপাদনকারী দেশগুলোও বিপুল পরিমাণে তেল সরবরাহ বাড়িয়ে দিচ্ছিল, যার ফলে ২০১৪-১৫ নাগাদ তেলের দাম প্রায় ৭০% পর্যন্ত পড়ে যায়।

এই পরিস্থিতিতে ওপেক (OPEC) বেশ কিছু পদক্ষেপ নেয়। তারা অতিরিক্ত ১০টি তেল-উৎপাদক দেশের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়—যাকে এখন ওপেক প্লাস (OPEC Plus) বলা হয়—যাতে মিলিতভাবে উৎপাদন নিয়ন্ত্রণ করে দাম স্থিতিশীল রাখা যায়। ওই ১০টি দেশের মধ্যে রাশিয়া অন্যতম বড় উৎপাদক। সৌদি আরব ও রাশিয়ার এই ঐক্য প্রমাণ করে যে, যুক্তরাষ্ট্রের শেল বুম তাদের জন্য কতখানি হুমকি তৈরি করেছে।

রাশিয়া-ইউক্রেইন যুদ্ধ, ইউরোপীয় বাজার ও মার্কিন ভূমিকায় পরিবর্তন

যুক্তরাষ্ট্রের শেল বুমের আরেকটি ফলাফল হলো—পশ্চিমা বিশ্ব এখন তেলের উৎস নির্বাচন করতে আরও সাবধানী হতে পারছে। রাশিয়া ২০২২ সালে ইউক্রেইনে (Ukraine) আগ্রাসন শুরু করলে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (EU) রুশ তেলের ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে সক্রিয় হয়ে ওঠে। ঐতিহাসিকভাবে রাশিয়া ছিল ইইউর একটি প্রধান জ্বালানি সরবরাহকারী। কিন্তু যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর, রাশিয়ান তেল ও গ্যাস আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা (Sanction) আরোপ করে ইইউ—তাদের ছয় দফা প্যাকেজে (যা ২০২২ ও ২০২৩ সালে কার্যকর হয়) রাশিয়ান সিবর্ন (Seaborn) অপরিশোধিত তেল ও পেট্রোলিয়াম পণ্য আমদানি নিষিদ্ধ করা হয়। এর ফলে ইইউতে রাশিয়ান তেল আমদানি ৯০% পর্যন্ত কমে যায় এবং গ্যাসের ক্ষেত্রেও রাশিয়ান আমদানির হার ৪০% থেকে ১৫%-এ নেমে আসে। এটি আগামীতে আরও কমবে বলে ধারণা করা হচ্ছে, কারণ ইইউ প্রথমবারের মতো রুশ গ্যাসের ওপরও সরাসরি নিষেধাজ্ঞা চাপাতে শুরু করেছে।

এই শূন্যস্থান পূরণে এগিয়ে আসে যুক্তরাষ্ট্র। শেল বুমে তাদের উৎপাদিত অতিরিক্ত তেল ও এলএনজি (LNG) অর্থাৎ লিকুইফায়েড ন্যাচারাল গ্যাস (Liquefied Natural Gas) রপ্তানি করে ইউরোপে বড় সরবরাহকারী হয়ে ওঠে তারা। ইউরোপের কাছে যুক্তরাষ্ট্রের তেল ও গ্যাস কেনা ছিল অপেক্ষাকৃত সহজ একটি সমাধান—কারণ সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিকভাবে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ অনেকটাই সমমনা। এছাড়া সৌদি আরব বা রাশিয়ার মিত্র কাজাখস্তানের (Kazakhstan) মতো রাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীল হওয়ার ঝুঁকি ইউরোপ চায়নি। তাই শুধু নতুন এলএনজি টার্মিনালগুলো দ্রুত তৈরি করে ইউরোপ রাশিয়ান গ্যাসের পরিবর্তে মার্কিন গ্যাস আমদানি শুরু করে। ফলস্বরূপ, রাশিয়া যেসব দেশে মোটামুটি অর্ধেক তেল ও তার বেশি গ্যাস রপ্তানি করত—সেই ইউরোপীয় বাজারে বড় ধাক্কা খায়। নতুন ক্রেতা হিসেবে ভারত (India), চীন (China) ও তুরস্ক (Turkey) রাশিয়ান তেল কিনতে এগিয়ে এলো বটে, তবে রাশিয়াকে তখন বিশ্ববাজারে ব্যাপক ছাড় দিতে হলো।

ডার্ক ফ্লিট (Dark Fleet) ও নিষেধাজ্ঞা রাশিয়ানদের ফাঁকি

ইইউর সিবর্ন রাশিয়ান তেল নিষেধাজ্ঞার পাশাপাশি জি-৭ (G7) একটি মূল্যসীমা (Price Cap) বেঁধে দেয়: প্রতি ব্যারেল রাশিয়ান সিবর্ন তেলের দাম ৬০ ডলারের বেশি হতে পারবে না। যদি কেউ এই সীমার ওপরে রাশিয়ান তেল বিক্রি করে ধরা পড়ে, তাহলে সেই রাশিয়ান তেল ট্যাংকারকে (Tanker) বিমা (Insurance) সেবাদাতা—যেমন আমেরিকা ক্লাব (American Club), ওয়েস্ট অব ইংল্যান্ড (West of England), গার্ড (Guard) ইত্যাদি—বিমা দেবে না। এতে ট্যাংকার চালানো খুবই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়বে।

ফলে রাশিয়ানরা নিষেধাজ্ঞা এড়াতে একটি ডার্ক ফ্লিট গড়ে তুলেছে। ধারণা করা হয়, বিশ্বে মোট অপরিশোধিত তেলবাহী জাহাজের (Crude Oil Vessel) প্রায় ২০%—প্রকৃত হিসাব করা কঠিন বলে “রাফ এস্টিমেট (Rough Estimate)”—এই ডার্ক ফ্লিটের অন্তর্ভুক্ত। এরা জাহাজের ট্র্যাকিং সিস্টেম (Location Signal) বন্ধ বা জাল লোকেশন দেখায় যাতে কেউ বুঝতে না পারে এই ট্যাংকার কোথায় যাচ্ছে, কী করছে। এভাবেই তারা বিশ্ববাজারের নিয়ম ও নিষেধাজ্ঞা এড়িয়ে চলেছে।

নতুন শীতল যুদ্ধ (New Cold War) চলছে কিনা, তা বোঝার এক বড় লক্ষণ হলো—গোপনে থাকা এই রাশিয়ান তেলবাহী জাহাজগুলো “কোভার্ট অপারেশন (Covert Operation)” চালাচ্ছে। কিংবা, ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে নর্ডস্ট্রিম (Nord Stream) গ্যাস পাইপলাইন বিস্ফোরণও তো এ অভিযোগকে দৃঢ় করতে পারে। রাশিয়া থেকে জার্মানিতে (Germany) গ্যাস পরিবহনের জন্য এই পাইপলাইন স্থাপন করা হয়েছিল, যা এখন অচল। কে বা কারা এটি ধ্বংস করেছে, আজও তার কোনো চূড়ান্ত প্রমাণ মেলেনি। জার্মানি, সুইডেন (Sweden) ও ডেনমার্ক (Denmark) তদন্ত চালিয়েও হামলাকারী কে, আদেশ দিয়েছিল কে—এসব প্রশ্নের জবাব পায়নি।

এরই মধ্যে রাশিয়া ইউরোপে তেল ঢোকানোর অন্য উপায় খুঁজে নিয়েছে। ডার্ক ফ্লিটের সাহায্যে রাশিয়ান অপরিশোধিত তেল ভারতে পাঠানো হয়। পরে ভারতে পরিশোধিত (Refined) হলে সেটি আর “রাশিয়ান তেল” হিসেবে গণ্য হয় না। তখন সেই তেল এলোপাথাড়ি ইউরোপেই ফেরত যাচ্ছে। ইইউর নিষেধাজ্ঞা এখানেই ফাঁকি পড়ে। তাই নিষেধাজ্ঞার তোয়াক্কা না করেই রাশিয়া উপার্জন করছে। তবে তা আগের তুলনায় অনেক কম। রাশিয়ার কেন্দ্রীয় তহবিলে (Federal Revenue) তেল-গ্যাস থেকে আগের মতো অঢেল অর্থ আসছে না। এর কারণে ইউক্রেইন যুদ্ধে (War in Ukraine) পুতিনের (Putin) অর্থায়নও চাপে পড়েছে।

মধ্যপ্রাচ্যের অস্থিরতা ও বিশ্ববাজারে প্রভাব

রাশিয়া-ইউক্রেইন যুদ্ধের কারণে বিশ্ব তেল ও গ্যাস বাজারে যে বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে, সেখানে মধ্যপ্রাচ্যও যোগ দিয়েছে। গাজায় (Gaza) সংঘাত এবং লেবাননের (Lebanon) হিজবুল্লাহ (Hezbollah) ও ইরান (Iran) যুক্ত হয়ে ঝুঁকি বাড়িয়েছে। তেলের বাজারে মধ্যপ্রাচ্য বরাবরই গুরুত্বপূর্ণ, কারণ বিশ্বে এক-তৃতীয়াংশ তেল মধ্যপ্রাচ্য থেকে আসে। ইরানের ওপর আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা নতুন কিছু নয়, কিন্তু ইয়েমেনে (Yemen) ইরান-সমর্থিত হুথি (Houthi) বিদ্রোহীরা রেড সি (Red Sea)-তে বাণিজ্যিক জাহাজ হাইজ্যাক ও মিসাইল (Missile) হামলা শুরু করায় ওই রুট দিয়ে তেল পরিবহন কমে গেছে। ফলে অনেক জাহাজই এখন আর রেড সি ব্যবহার করছে না; বরং আফ্রিকার দক্ষিণ প্রান্ত কেপ অব গুড হোপ (Cape of Good Hope) ঘুরে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিচ্ছে। এতে পরিবহন খরচ ও সময়—দুটোই বেড়ে যাচ্ছে।

সৌদি আরবের অবস্থান: ১৯৭৩-এর পুনরাবৃত্তি নেই কেন?

সৌদি আরব মধ্যপ্রাচ্যের ডি-ফ্যাক্টো (De Facto) নেতা এবং ওপেকের মূল চালিকাশক্তি। ১৯৭৩ সালে তারা ইসরায়েলকে সমর্থনকারী পশ্চিমাদের ওপর তেল নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল। এবার যদিও ইসরায়েলের সঙ্গে আবার সংঘাত চলছে, সৌদি আরব এখনো আক্রমণাত্মকভাবে কার্ড খেলেনি। এর কারণ একাধিক। একদিকে, বিগত কয়েক দশকে সৌদি আরব ও যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদার হয়েছে। সৌদি আরব এখন বিনিয়োগে বৈচিত্র্য আনতে চায়—তেলনির্ভরতা কমিয়ে বিনোদন (Entertainment), পর্যটন (Tourism), প্রযুক্তি (Technology) প্রভৃতি ক্ষেত্রে এগোতে চায়। এ সময় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শত্রুতা তাদের ক্ষতি করতে পারে।

অন্যদিকে, পশ্চিমা বিশ্ব এখন সৌদি তেলের ওপর সেই পর্যায়ের নির্ভরশীল নয়। যুক্তরাষ্ট্রের শেল বুমের কল্যাণে আজ ১৯৭০-এর দশকের মতো তেলের ঘাটতি হলে পশ্চিমারা অচল হয়ে যাবে—এমন আশঙ্কা নেই। কাজেই, এখন সৌদি আরব যদি আরেকটি তেল অবরোধ (Embargo) চাপায়ও, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ সহজেই অন্য উৎস থেকে জোগান পেতে পারে। এতে সৌদির নিজেরই ক্ষতি হবে বেশি। তাই এমন কোনো চরম পদক্ষেপ নেওয়া এখন তাদের পক্ষে সঙ্গত নয়।

বিশ্ববাজারে দর-যুদ্ধ: সৌদি আরব বনাম যুক্তরাষ্ট্র

সৌদি আরব ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে দৃশ্যমান মিত্রতা থাকলেও, তেল ও গ্যাসের বিশ্ববাজারে দুটি পক্ষই প্রতিযোগী। গত দুই বছর ধরে সৌদি আরবের নেতৃত্বে ওপেক তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি ১০০ ডলারে নিয়ে যেতে চায়। বাজারে সংকট তৈরি করে দাম বাড়াতে তারা উৎপাদন কেটে (Production Cut) সরবরাহ কমাচ্ছে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা (Canada) এবং নতুন খেলোয়াড় গায়ানা (Guyana)—যার তেলশিল্প মূলত মার্কিন কোম্পানিগুলো পরিচালনা করে—তারা উৎপাদন বাড়িয়ে দিচ্ছে। ফলে বিশ্ববাজারে দাম তেমন বাড়ছে না; ব্যারেলপ্রতি ৭০-৮০ ডলারের আশেপাশেই আটকে থাকছে।

এছাড়া চীনের (China) অর্থনীতিতে চাহিদা দুর্বল হয়েছে, তারা বিশ্ববাজারের সবচেয়ে বড় তেল আমদানিকারক (Importer)। ফলে সৌদির আয় কমছে, আর বাজেট ঘাটতি (Budget Deficit) সামাল দিতে তাদের সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। এখন সৌদি আরবের কাছে দুটি পথ খোলা। এক, তারা চায় যদি মার্কিন শেলের বাজারদখল আর না বাড়ে, তাহলে ওপেক ও ওপেক প্লাসকে (OPEC Plus) নিয়ে করা উৎপাদন কাটা প্রত্যাহার করে তারা উৎপাদন বাড়াতে পারে। সৌদি আরব একাই প্রতিদিন ৩০ লাখ ব্যারেল বেশি তেল উত্তোলন করতে সক্ষম। এমনটা করলে বাজারে সরবরাহ বেড়ে দামের পতন হবে, যাকে বলে প্রাইস ওয়ার (Price War)। স্বল্প মেয়াদে সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তবে উচ্চ খরচের (High-Cost) মার্কিন শেল উৎপাদন সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে পড়বে। আর রাশিয়ার (Russia) ক্ষেত্রেও এই কম দাম যুদ্ধ অর্থায়নে বড় ধাক্কা দেবে।

দ্বিতীয় বিকল্প হলো, সৌদি আরব ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করবে। শেল বুমের চূড়ান্ত স্তর প্রায় পার হয়ে গেছে বলে অনেক বিশ্লেষক মনে করেন। যুক্তরাষ্ট্রের পারমিয়ান বেসিনে (Permian Basin) নতুন কূপের উৎপাদনও কমতে শুরু করেছে। ওয়াল স্ট্রিট (Wall Street) বিনিয়োগে সংযমী হচ্ছে। সৌদি আরবের হাতে যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে প্রায় সাত গুণ বেশি প্রমাণিত তেল মজুদ রয়েছে। দীর্ঘ সময় ধরে উচ্চ উৎপাদন রাখার সক্ষমতা তাদের আছে। তাই যুক্তরাষ্ট্রের রিসার্ভ (Reserve) শেষ হতে শুরু করলে সৌদি আরব বিশ্ব তেলের “লিডিং পাওয়ার (Leading Power)” হিসেবে পুরনো অবস্থান ফিরে পেতে পারে।

উপসংহার

এই মুহূর্তে তেল ও গ্যাসের বাজারে যে অস্থিরতা, তা শুধু অর্থনৈতিক নয়—এর সঙ্গে জড়িত ব্যাপক ভূ-রাজনৈতিক (Geopolitical) উত্তেজনা। রাশিয়ার ডার্ক ফ্লিট নিষেধাজ্ঞা এড়িয়ে তেল বেচছে, সৌদি আরব ওপেকের শীর্ষস্থান বজায় রাখার চেষ্টা চালাচ্ছে, আর যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপের বাজারে নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করছে। যে শক্তি গত শতকে একবার আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের সময় বিশ্বকে কাঁপিয়ে দিয়েছে, সেই তেলের প্রভাব যে এখনো অটুট—তা ইতিহাস ও বর্তমান যুগ মিলিয়ে আমরা বারবার দেখছি।

যুক্তরাষ্ট্রের শেল বুম, ইউরোপের নিষেধাজ্ঞা, রাশিয়ার যুদ্ধে অর্থায়নের চেষ্টা, সৌদির নেতৃত্বে দাম নির্ধারণের লড়াই—সবগুলো মিলে আক্ষরিক অর্থেই একটি নতুন সমীকরণ তৈরির পথে। এই সমীকরণে জ্বালানি নিরাপত্তা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি ভূ-রাজনৈতিক অবস্থানও সমান গুরুত্বপূর্ণ। সামনে পৃথিবীর শক্তির ভারসাম্য কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়, তা দেখার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। একদিকে ডার্ক ফ্লিট, অন্যদিকে সৌদি আরবের সম্ভাব্য কৌশলগত পদক্ষেপ—সব মিলিয়ে বৈশ্বিক তেল ও গ্যাস বাণিজ্যের ভবিষ্যৎ যে আরও বেশ কিছু নাটকীয় মোড় নেবে, তা বলাই বাহুল্য।

আরও পড়ুন – যুক্তরাষ্ট্রের এক নম্বর তেল উৎপাদক হয়ে ওঠা ও তাদের তেল প্রাচুর্যের সমাপ্তি

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.