অনেকেই দাবি করেন, ধর্ম ও বিজ্ঞান সমান্তরালে চলে, এদের একটির সাথে আরেকটির মধ্যে কোন বিরোধ নেই। কিন্তু ব্যাপারটা মোটেও সেরকম নয়, এদের মধ্যে বিরোধ রয়েছে। সেই প্রাচীন গ্রীক প্যানথিওনের মধ্যকার আলোচনা থেকে আজকের যুগের অনলাইনের আলোচনা পর্যন্ত সকল মাত্রার আলোচনায় একটা বিষয় সব সময় পাওয়া যায়। তা হল ধর্ম ও বিজ্ঞানের মধ্যকার বিরোধ নিয়ে আলোচনা। এই সংঘাতটি একই সাথে ধর্মীয়, আদর্শিক, রাজনৈতিক, সামাজিক সহ বিভিন্ন রকম সংঘাতে রূপ নিয়েছে, এর বিভিন্ন আকার আমরা দেখেছি। আবার একজন মানুষের ভেতরের চিন্তাজগতেও এই সংঘাত থাকে, ব্যক্তির মনোজগতের আদর্শ গঠনের ক্ষেত্রে, বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষেত্রে এই সংঘাত কাজ করে, আমাদের চিন্তাজগতে চিন্তার প্রক্রিয়াতেও এই ধর্ম বনাম বিজ্ঞানের সংঘাত কাজ করে। ২০১৬ সালের ২৩ মার্চ মাসে প্রকাশিত হওয়া একটি গবেষণা থেকে এরই সত্যতার প্রমাণ মিলল। দেখা গেল, আমাদের চিন্তাজগতেও বিজ্ঞান ও ধর্মের সংঘাত কাজ করে আর এই সংঘাত তৈরি হয় আমাদের মস্তিষ্কের দুটো নেটওয়ার্কের মধ্যকার সংঘাত থেকে!
আটটি আলাদা আলাদা প্রশ্নোত্তর জরিপ এবং চিন্তন পরীক্ষা বা থট এক্সপেরিমেন্ট থেকে গবেষকগণ এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন। এগুলোর প্রত্যেকটিতেই ১৫৯ জন থেকে ৫২৭ জন অংশগ্রহণকারী ছিলেন। এই অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ঈশ্বর ও ধর্মে বিশ্বাসী ও অবিশ্বাসী উভয়ই ছিলেন। অংশগ্রহণকারীদেরকে নিয়ে প্রশ্নোত্তর জরিপ ও চিন্তন পরীক্ষণগুলো করার পর বিশ্বাসীদের ক্ষেত্রে পরীক্ষাগুলোর ফলাফল ও অবিশ্বাসীদে ক্ষেত্রে পরীক্ষাগুলোর ফলাফল এর মধ্যে তুলনা করা হয়। Case Western Reserve University এবং Babson College এর বিজ্ঞানীগণ তাদের এই গবেষণাটি প্লস ওয়ান জার্নালে প্রকাশ করেছেন।
গবেষণায় দেখা গেছে, যারা ধর্ম বা স্পিরিচুয়ালিটিতে বিশ্বাস করেন তারা এমপ্যাথেটিক থিংকিং (বা বিবেকজনিত বা সহানুভূতিশীল চিন্তা) এ জড়িত হবার জন্য এনালাইটিক থিংকিং (বা বিশ্লেষণী চিন্তা) এর জন্য যে ব্রেইন নেটওয়ার্কটি ব্যবহৃত হয় সেটাকে দমন করে বা বন্ধ করে রাখে। একইভাবে যেসকল লোক নন রেলিজিয়াস বা ঈশ্বর বা ধর্মে বিশ্বাস করেন না তারা নিজেদেরকে এনালাইটিক থিংকিং এ জড়িত করার জন্য এমপ্যাথিক থিংকিং এর জন্য ব্যবহৃত নেটওয়ার্কটিকে দমন করেন।
গবেষণাটির পরিচালক টনি জ্যাক একটি প্রেস রিলিজে বলেন, “যখন বিশ্বাসের প্রশ্ন আসে, এনালাইটিক পয়েন্ট অব ভিউ (বা বিশ্লেষণী দৃষ্টিকোণ থেকে) একে এবসার্ড (বা বিমূর্ত) মনে হয়। কিন্তু মস্তিষ্ক থেকে আমরা যা জানতে পেরেছি তা বলছে, এনালাইটিকাল থিংকিংকে দমন করে সুপারন্যাচারালে বিশ্বাস আমাদেরকে অধিক সামাজিক এবং আবেগীয় (social and emotional) অন্তর্দৃষ্টি অর্জন করতে সাহায্য করে”। গবেষণা থেকে জানা গেছে, মস্তিষ্কের এই নেটওয়ার্ক দুটোকে ব্যালেন্স করা খুব কঠিন কারণ এগুলোর একটি অপরটিকে দমন করতে অবিরত কাজ করে যায়।
যাই হোক, গবেষকগণ বলেন, প্রকৃতি মানুষের জন্য কোন উপায়ে চিন্তা করাকে অধিক সমর্থন করেছে, বা কোন উপায়ে চিন্তা করাটি প্রাকৃতিক এই প্রশ্নের উত্তরের ক্ষেত্রে কোন একক পদ্ধতিই নিরঙ্কুশ গুরুত্ব পায় না। আমাদের প্রকৃতি আমাদেরকে চিন্তার দুধরণের প্যাটার্নকেই ব্যবহার করেই অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করার সুযোগ করে দিয়েছে। আর এই দুটো পথকে একই সাথে মানুষ এক্সপেরিয়েন্স করতে পারে বলেই, সবসময় ধর্ম এবং বিজ্ঞানকে বিপরীত দুটো শক্তি হিসেবে দেখা যায় না, যেমন অনেক নোবেল প্রাইজ প্রাপ্ত বিজ্ঞানীকেই ঈশ্বরে বিশ্বাস করতে দেখা যায়, অনেক মানুষকেই অনেক সময় বিশ্লেষণী চিন্তা করতে দেখা গেলেও কিছু কিছু সময়ে স্পিরিচুয়ালিটির দিকে ঝুঁকে যান।
জ্যাক বলেন, “কিছু নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে, এমপ্যাথেটিক থিংকিং সাইন্টিফিক ক্রিয়েটিভিটি এবং ইনসাইটকে প্রমোটও করতে পারে”।
প্লস ওয়ান জার্নালে প্রকাশিত হওয়া স্টাডিটির শিরোনাম ছিল “Why Do You Believe in God? Relationships between Religious Belief, Analytic Thinking, Mentalizing and Moral Concern” । স্টাডির প্রধান বিষয়গুলো বলছি:
১। আমাদের নিউরাল আর্কিটেকচার অনুযায়ী মস্তিষ্কে দুই ধরণের নেটওয়ার্ক আছে। টাস্ক পজিটিভ নেটওয়ার্ক (TCP) আর ডিফল্ট মোড নেটওয়ার্ক (DMN). লজিকাল, বিশ্লেষণী, গাণিতিক ধরণের নন-সোশাল কাজগুলোতে TCP একটিভেটেড হয়। সামাজিক, ইমোশনাল, নৈতিক, এম্প্যাথিক কাজগুলোতে DMN একটিভেটেড হয়। এটা মোরাল (নৈতিক) কনসার্ন, এম্প্যাথিক (সহানুভূতি) কনসার্ন এর এই দুটো নেটওয়ার্ক একটা আরেকটার অপোজিট। একটা যখন কাজ করতে চায় তখন সে আরেকটাকে সাপ্রেস বা অবদমিত করে একটিভেটেড হয়। অর্থাৎ একটা একটিভেটেড হলে আরেকটা ডিএকটিভেটেড হয় ।
২। এনালাইটিক বা বিশ্লেষণী উদ্দিপনাগুলো TCP একটিভেট করে DMN কে ডিএকটিভেট করে। আবার সোশাল বা সামাজিক উদ্দিপনাগুলো DMN কে একটিভেট করে TCP কে ডিএকটিভেট করে। এই দুটি নেটওয়ার্ক একটা আরেকটাকে ইনটারফেয়ার করবে না এরকম সম্ভব অর্থাৎ দুই ক্ষেত্রে একজনের আচরণ দুইরকম মনে হতে পারে। কিন্তু এই দুই নেটওয়ার্ক একে অপরের সাথে কম্পিটিশনে যায় যদি স্টিমুলি বা উদ্দিপনা এম্বিগাস (দ্ব্যর্থক) বা মিক্সড হয় অর্থাৎ এনালাইটিক আর সোশ্যাল স্টিমুলি একটা আরেকটার সাথে জড়িয়ে যায়। যদি এরকমটা হয় তাহলে ব্যক্তি দুটোর একটাতে রেসপন্ড করে। কেউ তার টেনডেন্সি আর এবিলিটিগুলো কিভাবে ব্যালেন্স করে তার উপর নির্ভর করে সে কোন দিকে যাবে। রেলিজিয়াস বা স্পিরিচুয়াল স্টিমুলিগুলো হচ্ছে এরকম এম্বিগাস বা মিক্সড স্টিমুলি (উদ্দিপনা)। (এখান থেকে আস্তিক নাস্তিকের মধ্যে একটা ভাল পার্থক্য টানা যায় )।
৩। ডেটা কালেক্ট করার পর রেগ্রেশন এনালাইসিস করে (বাইভেরিয়েট রিলেশনে বা দুইচলকের সম্পর্কে) দেখা গেছে রেলিজিয়াস আর স্পিরিচুয়াল বিশ্বাসগুলো সোশাল এবং ইমোশনাল কগনিশনের সাথে ধনাত্মকভাবে সম্পর্কিত। অর্থাৎ এদের একটা বেশি হলে আরেকটা বেশি হবে। বলা হয়েছে মস্তিষ্কের যে ক্রিয়ার জন্য মোরাল কনসার্ন, এম্প্যাথি কনসার্ন কাজ করে তার তার বিভিন্ন ডাইমেনশনের মধ্যে কিছু কিছুর জন্য মানুষ রেলিজিয়াস আর স্পিরিচুয়াল ব্যাপারেও বিশ্বাস করে। এক্ষেত্রে উল্যাখ্য সোশ্যাল কগনিশনের অনেক ডাইমেনশন আছে।
৪। এনালাইটিক বা বিশ্লেষণী চিন্তার সাথে রেলিজিয়াস বা স্পিরিচুয়াল বিলিভ একটা আরেকটার সাথে ঋণাত্মকভাবে সম্পর্কিত। অর্থাৎ একটা বাড়লে আরেকটা কমে।
৫। ননরেলিজিয়াসদের বা নাস্তিকদের মোরাল কনসার্ন রেলিজিয়াস বা আস্তিকদের চেয়ে কম দেখা যায়। তাই তারা সাইকোপ্যাথিক ফেনোটাইপের সাথে বেশি ঘনিষ্ঠ।
৬। মেন্টালাইজিং (হিউম্যান বিহ্যাভিয়র বুঝতে পারা ও ইন্টারপ্রেট করার ক্ষমতা) এর সাথে রেলিজিয়াস বিলিফ খুব একটা সম্পর্কিত নয়। তাই কারও মধ্যে অটিস্টিক ফেনোটাইপ (মেন্টালাইজেশনের অভাব) থাকলে সে আস্তিক না নাস্তিক এই টাইপের প্রেডক্ট করা যাবে না।
৭। নারীদের এম্প্যাথিক কনসার্ন পুরুষের চেয়ে বেশি দেখা যায়। এটা তাদের সাধারণত পুরুষদের চেয়ে বেশি রেলিজিয়াস হবার কারণ হতে পারে।
http://journals.plos.org/plosone/article?id=10.1371/journal.pone.0149989
– ভেলোসিটি হেড
Leave a Reply