গ্র্যান্ড কোয়ালিশন গঠন করা কি ব্যাড আইডিয়া? কী বলছে ইউরোপের রাজনীতি?

ভূমিকা

কেউ কেউ গ্র্যান্ড কোয়ালিশনকে (grand coalition) রাজনীতির সেরা দিক হিসেবে দেখেন—দুই প্রতিদ্বন্দ্বী দল পারস্পরিক বিরোধ ভুলে একসাথে সরকার গঠন করে, হয়তো কোনো সংকটময় সময়ে বা রাজনীতিতে অচলাবস্থা কাটাতে। অন্যদিকে, অনেকের মতে গ্র্যান্ড কোয়ালিশন রাজনৈতিক ব্যবস্থার খারাপ দিকগুলোকেই ফুটিয়ে তোলে—প্রধান ধারার (mainstream) দলগুলো একত্র হয় শুধু ক্ষমতা আঁকড়ে রাখার জন্য, ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয় বিকল্প শক্তিগুলোকে সরকারে আসতে না দেওয়ার উদ্দেশ্যে। যাই হোক, গবেষণায় দেখা যাচ্ছে—ইউরোপের রাজনীতিতে গ্র্যান্ড কোয়ালিশন ক্রমশ একটি সাধারণ চিত্র হয়ে উঠেছে। এই প্রবন্ধে আমরা ইউরোপের কয়েকটি সাম্প্রতিক ও বর্তমান গ্র্যান্ড কোয়ালিশনের উদাহরণ বিশ্লেষণ করব, আর দেখব এগুলো কেন গঠিত হয়, কারা লাভবান হয়, কারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, এবং ইউরোপীয় রাজনীতিতে (European politics) এগুলো কী নির্দেশ করে।

গ্র্যান্ড কোয়ালিশন কী?

একটি সংসদীয় ব্যবস্থায় (parliamentary system), সাধারণত দুই প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী দলের মধ্যে কোয়ালিশন গঠিত হলে তাকে গ্র্যান্ড কোয়ালিশন বলা হয়। উদাহরণস্বরূপ, জার্মানির (Germany) মধ্য-বামপন্থী এসপিডি (SPD) ও মধ্য-ডানপন্থী সিডিইউ (CDU) -এর মধ্যে কোয়ালিশন।

কেন গ্র্যান্ড কোয়ালিশন গঠন করা হয়?

১) সংকটের (crisis) সময়ে:

  • দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ (Second World War) চলাকালীন যুক্তরাজ্য (UK) একটি “ঐক্য সরকারের” (unity government) মাধ্যমে এক ধরনের গ্র্যান্ড কোয়ালিশন গঠন করেছিল, যেখানে কনজারভেটিভ (Conservative) ও লেবার (Labour) পার্টি একসাথে কাজ করেছে।
  • যুদ্ধ-পরবর্তী অস্ট্রিয়ায় (Austria) ১৯৪৫ সালে সামাজিক ঐক্য ও গণতান্ত্রিক স্থিতিশীলতা গড়ে তুলতে সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি (Social Democratic Party) ও কনজারভেটিভ পিপলস পার্টি (Conservative People’s Party বা OVP) একসঙ্গে সরকার গঠন করে। পরে ১৯৪৫-১৯৬৬, ১৯৮৭-২০০০, ২০০৭ ইত্যাদি সময়ে অস্ট্রিয়ায় একাধিকবার গ্র্যান্ড কোয়ালিশন দেখা গেছে।
  • গ্রিসে (Greece) ২০১২ সালে ঋণ সংকটের (debt crisis) সময় মধ্য-ডানপন্থী নিউ ডেমোক্রেসি (New Democracy) ও মধ্য-বামপন্থী পাসোক (PASOK) একসাথে সরকার গঠন করে।

২) অচলাবস্থা (political deadlock) নিরসন: সাম্প্রতিক সময়ে, গ্র্যান্ড কোয়ালিশন প্রায়ই গঠিত হয় রাজনৈতিক অচলাবস্থা দূর করতে, যা কোনো বড় সংকটের চেয়ে বরং নির্বাচন-পরবর্তী ফলাফলের কারণে হতে পারে।

  • জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা মার্কেলের (Angela Merkel) চারটি মেয়াদের মধ্যে তিনটিতেই (২০০৫, ২০১৩, ২০১৭-এর নির্বাচন পরবর্তী) এসপিডি ও সিডিইউর মধ্যে গ্র্যান্ড কোয়ালিশন হয়।
  • ইতালিতে (Italy) ২০১৩ সালের নির্বাচনের পর, এনরিকো লেতা (Enrico Letta) তার মধ্য-বামপন্থী ডেমোক্র্যাটিক পার্টি (Democratic Party) এবং সিলভিও বেরলুসকোনির (Silvio Berlusconi) মধ্য-ডানপন্থী পিপল অব ফ্রিডম (People of Freedom) পার্টিকে নিয়ে সরকার গঠন করেন।
  • আয়ারল্যান্ডে (Ireland) ২০২০ সালের নির্বাচনে পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষে (lower house) অসম ভোটে কেউ সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পাওয়ায়, ঐতিহাসিক প্রতিদ্বন্দ্বী ফিয়ানা ফল (Fianna Fáil) ও ফিনে গেইল (Fine Gael) প্রথমবারের মতো একসাথে গ্র্যান্ড কোয়ালিশন গঠন করে।
  • ফ্রান্সে (France) ২০২২ সালের আইনসভা নির্বাচনের পর প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ (Emmanuel Macron) রাজপাট চালিয়ে যেতে কথিত “রিপাবলিকান কোয়ালিশন” (republican coalition) গঠনের চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু রাজনৈতিক স্পেকট্রামের উভয় প্রান্তের দলগুলোর (বামপন্থী ফ্রান্স আনবাউড (France Unbowed) ও ডানপন্থী ন্যাশনাল র‍্যালি (National Rally)) বিরোধিতায় সেটি সম্ভব হয়নি।

৩) উদীয়মান পপুলিস্ট দলগুলোকে আটকে রাখা (Locking Out Populist Parties): অনেক সময় গ্র্যান্ড কোয়ালিশনের মূল উদ্দেশ্য থাকে নির্বাচনে ভালো করা উদীয়মান দলগুলোকে সরকারে আসতে না দেওয়া।

  • আয়ারল্যান্ডে ২০২০ সালের নির্বাচনে বামপন্থী পপুলিস্ট সিন ফেইন (Sinn Féin) দ্বিতীয় স্থানে থাকায় ফিয়ানা ফল ও ফিনে গেইল পারস্পরিক ঐতিহ্যগত বৈরিতা ভুলে একসাথে সরকার গঠন করে।
  • জার্মানিতে সাম্প্রতিক গ্র্যান্ড কোয়ালিশনগুলো (বিশেষত ২০১৩, ২০১৭) গঠিত হয়েছে মূলধারার এসপিডি ও সিডিইউ উভয়ে চরম বামপন্থী (Left Party) বা চরম ডানপন্থী (AfD) দলের সাথে জোট করতে অস্বীকৃতি জানানোয়। ২০২৫ সালে জার্মানিতে নির্বাচন হলে, আর এএফডি (AfD) যদি বর্তমানের মতো দ্বিতীয় স্থানে থাকার সম্ভাবনা ধরে রাখে, তখন এসপিডি ও সিডিইউর মধ্যে আরেকটি গ্র্যান্ড কোয়ালিশন গঠনের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।
  • ফ্রান্সে ম্যাক্রোঁর কোয়ালিশন চেষ্টাও ছিল বামপন্থী জ্যঁ-লুক মেলঁশোঁ (Jean-Luc Mélenchon) ও ডানপন্থী মারিন লে পেন (Marine Le Pen) -এর দলকে ক্ষমতা থেকে দূরে রাখতে।

গ্র্যান্ড কোয়ালিশনে যোগ দিলে কে লাভবান, কে ক্ষতিগ্রস্ত? (Winners and Losers in Grand Coalitions)

এ বিষয়ে ২০২০ সালে প্রকাশিত এক গবেষণা বলছে—১৯৯০ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত ইউরোপে (Europe) গঠিত ১৭টি গ্র্যান্ড কোয়ালিশনের সদস্যরা পরবর্তী নির্বাচনে গড়ে ৩.৮৪% ভোট হারিয়েছে। বড় দলগুলো এ ধরনের কোয়ালিশনে যোগ দিলে আরও বেশি (গড়ে ৫.৫৪% ভোট) হারায়।

  • গ্রিসের পাসোক (PASOK) ২০১৫ সালে ৭.৫ শতাংশের বেশি ভোট হারায়।
  • ডাচ সিডিএ (CDA) ২০১০ সালে ১৩ শতাংশ পয়েন্ট হারায়।
  • ডাচ পিভিডিএ (PVDA) ২০১৭ সালে ১৯ শতাংশ পয়েন্ট হারায়।

বর্তমান সময়ে ডেনমার্কে (Denmark) সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটদের নেতৃত্বাধীন গ্র্যান্ড কোয়ালিশন (যেখানে সেন্টার-রাইট লিবারাল পার্টি (Liberal Party) ও কেন্দ্রপন্থী মডারেটস (Moderates) আছে) জনপ্রিয়তায় বেশ পিছিয়ে পড়েছে। অন্যদিকে বাম ও ডানপন্থী বিরোধী দলগুলো ক্রমশ সমর্থন পাচ্ছে।

গ্র্যান্ড কোয়ালিশন গঠন করা কি ব্যাড আইডিয়া?

শুধু গ্র্যান্ড কোয়ালিশন বলেই যে বেশি ভোট হারাতে হয়, তা নিশ্চিতভাবে বলা যায় না। একই গবেষণায় দেখা গেছে, সাধারণ (অর্থাৎ আদর্শগতভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ) জোটের ক্ষেত্রেও ক্ষমতাসীন দলগুলো প্রায় কাছাকাছি হারের (ভোট শতাংশ কমে যাওয়া) সম্মুখীন হয়। মূলত ক্ষমতাসীন বা ইনকাম্বেন্ট (incumbent) দলের প্রতি ভোটারদের অসন্তুষ্টি প্রায়ই দেখা যায়, যা একচেটিয়াভাবে গ্র্যান্ড কোয়ালিশনের “সমস্যা” নয়। তাছাড়া, অনেক ক্ষেত্রে বিকল্প ছিল হয় দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক অচলাবস্থা ও বারবার নির্বাচন, নয়তো “চরমপন্থী” (far-left বা far-right) দলগুলোকে সরকারে স্থান দেওয়া—যা অনেক দলই করতে চায় না।

গ্র্যান্ড কোয়ালিশনের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব

যদিও গ্র্যান্ড কোয়ালিশনের মাধ্যমে সাময়িকভাবে সরকার গঠন সহজ হয়, এটা প্রায়ই আরও বেশি পপুলিস্ট (populist) বা অ্যান্টি-এস্ট্যাবলিশমেন্ট (anti-establishment) দলের উত্থানকে ত্বরান্বিত করে। যেমন, জার্মানিতে ২০১৭ সালের নির্বাচনে এএফডি (AfD) আগের গ্র্যান্ড কোয়ালিশনের “বিরোধী শক্তি” হিসেবে ভোট বাড়ায়। ইতালিতে (Italy) ২০২২ সালে জর্জিয়া মেলোনির ব্রাদার্স অব ইতালি (Brothers of Italy) সাফল্যের পেছনে মারিও দ্রাঘির (Mario Draghi) জাতীয় ঐক্য সরকারের (national unity government) বাইরে থেকে ঐ সরকারের বিভিন্ন সিদ্ধান্তের সমালোচনা করে জনসমর্থন অর্জন করাও ভূমিকা রেখেছে।

ইদানীং ডেনমার্কের গ্র্যান্ড কোয়ালিশন জনসমর্থনে পিছিয়ে আছে, আয়ারল্যান্ডের গ্র্যান্ড কোয়ালিশন অব্যাহত রাখার প্রবল সম্ভাবনা আছে, অস্ট্রিয়ায় (Austria) আবারও গ্র্যান্ড কোয়ালিশন চুক্তির আলোচনা চলছে, এবং জার্মানির আসন্ন নির্বাচনে আবারও গ্র্যান্ড কোয়ালিশনের সম্ভাবনা উঁকি দিচ্ছে। সব মিলিয়ে, গ্র্যান্ড কোয়ালিশন এখন ইউরোপীয় রাজনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ এবং এদের সাফল্য অথবা ব্যর্থতা আগামী দিনগুলোতে ইউরোপের রাজনৈতিক গতিপথ নির্ধারণে বড় ভূমিকা রাখবে।

শেষ কথা

গ্র্যান্ড কোয়ালিশনের ইতিহাস বলে, এটি প্রায়ই অচলাবস্থা বা সংকটময় পরিস্থিতিতে একটি কার্যকর উপায় হতে পারে। তবে দীর্ঘমেয়াদে দেখা গেছে, এ ধরনের কোয়ালিশন মৌলিকভাবে ভিন্ন আদর্শের দলগুলোর পার্থক্য অনেক সময় আরও স্পষ্ট করে তোলে, আর এর সুবিধা নেয় পপুলিস্ট দলগুলো। তা সত্ত্বেও, নির্বাচনী বাস্তবতা ও মূলধারার দলগুলোর জন্য বিকল্পের অভাবের কারণে গ্র্যান্ড কোয়ালিশন ইউরোপের রাজনীতিতে বহুলচর্চিত থেকে যাবে।

তথ্যসূত্র

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.