Table of Contents
ভূমিকা
নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়েছে। তিনি বারবার ঘোষণা দিয়েছেন যে প্রেসিডেন্ট হিসেবে তার প্রথম কাজগুলোর একটি হবে ইউক্রেনে চলমান যুদ্ধের অবসান ঘটানো। ট্রাম্প জোর দিয়েছেন যে ২০২০ সালে যদি তিনি জিততেন, তবে এই যুদ্ধ কখনোই শুরু হতো না। তাছাড়া তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন মাত্র “২৪ ঘণ্টার (24 hours)” মধ্যে যুদ্ধ থামানোর একটা উপায় বের করবেন।
এই নিবন্ধে আমরা বিশদভাবে দেখবো, ট্রাম্প কেন ইউক্রেনের যুদ্ধ বন্ধ করতে চান, কী তার পরিকল্পনা, এবং কীভাবে তিনি জেলেনস্কি (Zelensky) ও পুতিনকে (Putin) এক টেবিলে বসাতে চাইছেন।
ট্রাম্প কেন ইউক্রেন যুদ্ধ শেষ করতে চান
ট্রাম্প নিজেকে একজন “স্বঘোষিত বিচ্ছিন্নতাবাদী (isolationist)” বলে দাবি করে আসছেন। যুদ্ধ বন্ধ করা বা ইউক্রেনকে দেওয়া সমর্থন কমিয়ে আনা তার সমর্থকগোষ্ঠীর কাছে জনপ্রিয়, কারণ ২০২৩ সালের ডিসেম্বরের হিসাব অনুযায়ী, রিপাবলিকানদের (Republicans) ৪৮% মনে করে যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনকে খুব বেশি সহায়তা দিচ্ছে। ধারণা করা হয়, এর পর থেকে এ ধারণা আরও শক্তিশালী হয়েছে। একই সঙ্গে, ট্রাম্পের মিত্ররা আরও কিছু ভূকৌশলগত (geostrategic) কারণ দেখান। আমেরিকা ফার্স্ট পলিসি ইনস্টিটিউটে (America First Policy Institute) ট্রাম্পের সাবেক দুই জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার (national security chiefs) লেখা এক গবেষণাপত্র থেকে স্পষ্ট হয়, তাদের মতে যুদ্ধ শেষ করার অন্তত তিনটি প্রধান কারণ আছে:
- ইউক্রেনের বিজয় অনিশ্চিত: ইউক্রেনের সামনে বিজয় অর্জনের সম্ভাবনা খুব কম বলে তাদের ধারণা, কারণ যুদ্ধক্ষেত্র স্থবির হয়ে আছে।
- রাশিয়া, চীন, ইরান ও উত্তর কোরিয়ার বন্ধন মজবুত হওয়ার আশঙ্কা: দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ রাশিয়া-চীন-ইরান-উত্তর কোরিয়ার জোটকে শক্তিশালী করতে পারে। সাম্প্রতিককালে ন্যাটো (NATO)-র প্রতিবেদনে দেখা গেছে, প্রতিরক্ষা চুক্তির পর রাশিয়ায় ইরানের ড্রোন (drone) বড় পরিসরে ব্যবহার হচ্ছে।
- যুক্তরাষ্ট্রের গোলাবারুদ স্বল্পতা: ইসরায়েল (Israel) ও ইউক্রেন দু’দেশকেই সামরিক সহায়তা দিতে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের গোলাবারুদের মজুদ বেশ নিচে নেমে গেছে। ভবিষ্যতে চীনের (China) সঙ্গে কোনো সংঘাতের আশঙ্কা থাকলে যুক্তরাষ্ট্রকে এখনই সংরক্ষণে যেতে হবে। ট্রাম্পের সাবেক উপদেষ্টা এলব্রিজ কোলবি (Elbridge Colby) প্রায়ই বলেন, ইসরায়েল ও ইউক্রেনকে সমর্থন দিতে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের গোলাবারুদ ও অস্ত্রভাণ্ডার বিপজ্জনকভাবে কমে যাচ্ছে। র্যান্ড কর্পোরেশনের (RAND Corporation) হিসেবে, তাইওয়ানের (Taiwan) ওপর যুদ্ধ শুরু হলে যুক্তরাষ্ট্র মাত্র তিন থেকে চার সপ্তাহের মধ্যেই গোলাবারুদের মজুদ শেষ করে ফেলতে পারে। শুধু মজুদ পুনরায় পূরণ করতেই বহু বছর লেগে যাবে, তাছাড়া মূল কাঁচামালের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সরবরাহশৃঙ্খল চীন ও রাশিয়ার ওপর বেশি নির্ভরশীল, যা যুক্তরাষ্ট্রের শিল্পখাতকে (industrial base) নাজুক অবস্থায় ফেলেছে।
শান্তি পরিকল্পনার (peace plan) মূল অন্তর্নিহিত অংশ
এখন প্রশ্ন, ট্রাম্প ঠিক কীভাবে যুদ্ধ থামাতে চান? এখনো পর্যন্ত তিনি নিজে খুব বেশি বিশদ তথ্য দেননি, কিন্তু তার উপদেষ্টারা কিছুটা ইঙ্গিত দিয়েছেন। সেপ্টেম্বরে শন রায়ান শো (the Sean Ryan show)-তে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ট্রাম্পের ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স (J.D. Vance) বেশ স্পষ্টভাবে কিছু ধারণা তুলে ধরেন। বিস্তারিতভাবে বলতে গেলে, তার পরিকল্পনার দুটো দিক আছে:
- বর্তমান সামনের সারিতে (front line) সম্পূর্ণ যুদ্ধবিরতি (ceasefire) করা
- ইউক্রেনের নিরপেক্ষতা (neutrality) নিশ্চিত করা
ভ্যান্সের যুক্তি অনুযায়ী, বর্তমান সামনের সারি ধরে যুদ্ধের অগ্নিসংযোগ বন্ধ করা (freeze) হলে একটি বেসামরিকীকৃত অঞ্চল (demilitarized zone) গড়ে তোলার পথ তৈরি হবে। এটা উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়ার মাঝে যে ধরনের অঞ্চলের মতো, প্রায় ৪ কিলোমিটার চওড়া এবং অত্যন্ত সুরক্ষিত। ফলে ইউক্রেনকে প্রায় এক-পঞ্চমাংশ ভূমি ছেড়ে দিতে হবে, যা বর্তমানে রাশিয়ার দখলে আছে। এর মধ্যে ক্রিমিয়া (Crimea) অন্তর্ভুক্ত, যা রাশিয়া ২০১৪ সালে দখল করেছিল; লুহানস্ক (Luhansk) ও দোনেৎস্ক (Donetsk) অঞ্চলের বড় অংশ; এবং দক্ষিণের জাপোরিঝঝিয়া (Zaporizhzhia) ও খেরসন (Kherson) অঞ্চলের প্রায় ৭০% এলাকা।
ট্রাম্পের দ্বিতীয় পরিকল্পনা হল ইউক্রেনকে নিরপেক্ষ রাখা, অর্থাৎ ন্যাটোতে (NATO) যোগ না দেওয়া। ট্রাম্প, ভ্যান্স এবং ইলন মাস্ক (Elon Musk) (যিনি ২০২২ সালের শেষদিকে এ ধরনের প্রস্তাব দিয়েছিলেন) প্রত্যেকে মনে করেন, ইউক্রেনকে ন্যাটোতে না নেওয়াই ভালো, যাতে পশ্চিমা বিশ্বকে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধে (World War Three) জড়াতে না হয়, আর পুতিনকেও বেশি উসকানি দেওয়া না হয়। পুতিন বরাবরই ইউক্রেনের ন্যাটোতে যোগদানের বিরোধী, কারণ তিনি রাশিয়ার কথিত প্রভাববলয়ের (sphere of influence) মধ্যে ইউক্রেনকে রাখতে চান।
২০২৪ সালের জুনে দ্য অল-ইন পডকাস্টে (the all in podcast) ট্রাম্প বলেন, বাইডেনের (Biden) রাশিয়াবিরোধী কঠোর মনোভাব এবং আমেরিকা যখন ইউক্রেনকে ন্যাটো সদস্যপদের প্রস্তাব দিচ্ছিল, সেটা ছিল “একটি ভুল (a mistake)” এবং “যুদ্ধ শুরু হবার আসল কারণ।” ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের (Wall Street Journal) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ট্রাম্প একবারে ন্যাটো থেকে ইউক্রেনকে বাদ দেওয়ার পক্ষপাতী না-ও হতে পারেন; বরং অন্তত ২০ বছর এর জন্য ইউক্রেনের সদস্যপদ স্থগিত রাখার প্রস্তাব দেবেন।
এ শান্তি পরিকল্পনায় মাঠে শান্তিরক্ষী বাহিনী (peacekeeping troops) মোতায়েনের মতো কোনো প্রয়োগমুখী ব্যবস্থা (enforcement mechanism) যুক্ত থাকতে পারে। তবে ট্রাম্প বহুদিন ধরেই বলে আসছেন, ইউরোপ তাদের প্রতিরক্ষায় যথেষ্ট খরচ করে না। সুতরাং সম্ভাব্যভাবে ইউরোপকেই এ খরচ বা সৈন্য সরবরাহের দায়িত্ব নিতে হবে।
ইউক্রেন ও রাশিয়াকে রাজি করানোর কৌশল
যদিও ইউক্রেন ও রাশিয়া কেউই আপাতত শান্তি আলোচনা করতে রাজি নয়, তবু ট্রাম্প তাদের রাজি করাতে কী করবেন?
প্রথমত, ইউক্রেনকে আলোচনার টেবিলে টেনে আনার ক্ষেত্রে তিনি হয়তো যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সহায়তা বন্ধ কিংবা উল্লেখযোগ্য হারে কমিয়ে দেওয়ার হুমকি দেবেন। প্রসঙ্গত, যুদ্ধ শুরুর পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র এরই মধ্যে ইউক্রেনকে ৭০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি সামরিক সহায়তা দিয়েছে। ইউরোপ খুব সক্রিয় না হলে যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্য ছাড়া ইউক্রেনের পক্ষে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া কঠিন হবে।
তবে রাশিয়াকে তিনি কীভাবে রাজি করাবেন, সেটা কিছুটা অনিশ্চিত। উপরে বর্ণিত পরিকল্পনায় রাশিয়া ২০% ইউক্রেনের ভূমি পেয়ে যাবে এবং ইউক্রেনকে নিরপেক্ষ রাখার নিশ্চয়তা পাবে। উপরি উপরি এটা রাশিয়ার জন্য লাভজনক মনে হতে পারে, কিন্তু এটি এখনো তাদের ‘সর্বোচ্চ লক্ষ্য (maximalist war aims)’ পূরণ করে না। ২০২২ সালে রাশিয়া লুহানস্ক, দোনেৎস্ক, খেরসন ও জাপোরিঝঝিয়া – এই চারটি অঞ্চলকে সম্পূর্ণ নিজ ভূখণ্ড হিসেবে দাবি করেছে। কিন্তু বর্তমানে রাশিয়া দোনেৎস্ক, খেরসন ও জাপোরিঝঝিয়ার সম্পূর্ণ অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। ফলে বর্তমান সামনের সারি ‘ফ্রিজ’ করলে পুতিনের ঘোষিত লক্ষ্য পূরণ হবে না, বিশেষত যদি সেখানে একটা বড় বাফার জোন থাকে। সম্প্রতি ক্রেমলিন ট্রাম্পের “দ্রুত শান্তিচুক্তি”র দাবিকে “কল্পনার রাজ্য (the realm of fantasy)” হিসেবে প্রত্যাখ্যানও করেছে।
পুতিন যদি ট্রাম্পের এ শান্তি পরিকল্পনা না-ও মানেন, তখন ট্রাম্প কী করবেন, সেটাও বড় প্রশ্ন। ইউরোপীয় ও ইউক্রেনের অনেক নেতাই মনে করেন, ট্রাম্প হয়তো তখন পুতিনকে আরও ছাড় দেবেন। তবে মনে রাখা দরকার, প্রেসিডেন্ট হিসেবে তার প্রথম মেয়াদে, বন্ধুত্বপূর্ণ কথা কিছুটা বললেও, ট্রাম্প পুতিনের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানও নিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন প্রথম মার্কিন প্রেসিডেন্ট যিনি ইউক্রেনে “প্রাণঘাতী সামরিক সহায়তা (lethal military aid)” পাঠানোর অনুমোদন দিয়েছিলেন। তিনি রাশিয়ান কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিলেন, যারা জার্মানিতে নর্ড স্ট্রিম ২ (Nord Stream 2) গ্যাস পাইপলাইন তৈরি করছিল। সিরিয়ায় রাশিয়ান ভাড়াটে সেনাদের (Russian mercenary groups) ওপর যুক্তরাষ্ট্রের বিমান হামলার নির্দেশও দিয়েছিলেন, এবং একাধিক পরমাণু চুক্তি (nuclear treaties) থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন।
২০২৩ সালে ফক্স নিউজকে (Fox News) দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ট্রাম্প বলেছিলেন, পুতিন যদি চুক্তি না করেন, তবে ইউক্রেনকে “আগের চেয়ে অনেক বেশি” সহায়তা দেবেন বলে হুমকি দিতেন—“আমি পুতিনকে বলতাম, যদি চুক্তি না করো, আমরা ওদের (ইউক্রেনকে) এমন কিছু দেবো যা ওরা কখনোই পায়নি।”
পরিশেষে বলা যায়, ইউক্রেন বা রাশিয়া কেউই তাৎক্ষণিকভাবে এ শান্তিচুক্তিতে গিয়ে রাজি হবে না। বড় প্রশ্ন হলো, প্রেসিডেন্ট হিসেবে ট্রাম্প তাদের কতটা চাপ দিতে পারবেন। তবে ট্রাম্প অন্তত এটুকু স্পষ্ট করেছেন যে, তিনি যুদ্ধ থামাতে বেশ জোর দিয়েই চেষ্টা চালাতে চান।
তথ্যসূত্র
- US aid to Ukraine poll: https://www.pewresearch.org/short-reads/2023/12/08/about-half-of-republicans-now-say-the-us-is-providing-too-much-aid-to-ukraine/
- America First, Russia & Ukraine’ paper: https://americafirstpolicy.com/issues/america-first-russia-ukraine
- US’ weak industrial base: https://foreignpolicy.com/2024/05/21/united-states-defense-pentagon-military-industrial-base-ammunition/
https://www.rand.org/nsrd/projects/NDS-commission.html - US’ low ammunition stockpiles: https://www.eurasiantimes.com/pentagons-achilles-heel-us-arsena/
https://x.com/amuse/status/1830645097672650849 - JD Vance on The Shawn Ryan Show https://www.youtube.com/watch?v=HrgmwtpAsWc
- Territory Russia occupies in Ukraine: https://www.bbc.co.uk/news/world-europe-60506682
- Elon Musk X post on Ukraine-Russia peace: https://x.com/elonmusk/status/1576969255031296000
- Trump’s advisors suggesting freezing Ukraine Nato membership for 20 years: https://x.com/nexta_tv/status/1854440147431080059/photo/1
- Kremlin dismisses quick deal as ‘realm of fantasy’: https://www.aljazeera.com/news/2024/9/17/whats-donald-trumps-plan-to-end-russias-war-on-ukraine
Leave a Reply