Table of Contents
জনসংখ্যা হ্রাসের হুমকি
১৭০০ থেকে ১৮০০ সালের মধ্যে পৃথিবীর জনসংখ্যা ৬০০ মিলিয়ন থেকে ১ বিলিয়নে পৌঁছায়। কিন্তু তার পরের ২০০ বছরে এই সংখ্যা ৫ বিলিয়ন পেরিয়ে যায়। ১৯৬১ সালে মারিনার এস. একলস (Marriner S. Eccles), যিনি যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ সিস্টেমের (Federal Reserve System) বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান ছিলেন, তিনি বিশ্বের জনসংখ্যার ক্রমবর্ধমান হারের কথা উল্লেখ করে বলেছিলেন যে এটি বিশ্বের সামনে দাঁড়ানো সবচেয়ে জরুরি সমস্যা। এটি এমনকি পারমাণবিক বা হাইড্রোজেন বোমার চেয়েও বেশি বিস্ফোরক প্রভাব ফেলতে পারে।
আজ আমরা অনেকেই টের পাচ্ছি আসল সত্যটা কী: আমাদের পৃথিবীর সামনে সবচেয়ে বড় হুমকি আসলে জনসংখ্যার আধিক্য (overpopulation) নয়, বরং জনসংখ্যার স্বল্পতা (underpopulation)। গত বছর সারা বিশ্বে মাত্র প্রায় ৭০০,০০০ শিশু জন্মেছিল। এভাবে চলতে থাকলে অবসরপ্রাপ্তদের সংখ্যা কর্মরত মানুষের সংখ্যার চেয়ে বেশি হয়ে যাবে। এমনকি ২০৫০ সালের মধ্যে চীনের মোট জনসংখ্যা ৬৫০ মিলিয়নের নিচে নেমে যেতে পারে।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে—যেমন রাশিয়া (Russia), চীন (China) এবং জাপান (Japan)—জনসংখ্যাগত (demographic) সংকট প্রচণ্ড। এই তিনটি দেশই একমাত্র নয় যাদের জন্মহার (birth rate) কমে যাচ্ছে এবং জনসংখ্যা (population) সঙ্কুচিত হচ্ছে। আসলে, সারাবিশ্বেই এমন প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে। এই লেখায় আমরা বৈশ্বিক (global) পরিসংখ্যানগুলো নিয়ে আলোচনা করব এবং খতিয়ে দেখব যে এটা সত্যিই উদ্বেগের কারণ কি না।
সেই সাথে আমরা আরও কিছু দেখব এখানে। হয়তো আগামী ২০ বছরে বিশ্বের সবচেয়ে বড় সমস্যা হবে জনসংখ্যা হ্রাস (population collapse)। আমরা মানব ইতিহাসের একটি মৌলিক পরিবর্তনের সূচনায় রয়েছি। লেখাটিতে আরও কিছু প্রশ্নের উত্তর দেয়ার চেষ্টা করা হবে, যেমন কীভাবে এমনটা ঘটলো? এটা কি সত্যিই এত বড় সমস্যা? পৃথিবীতে মানুষ কমে গেলে কি পৃথিবীর পরিবেশের জন্য ভালো হবে না? আর মানবজাতির ভবিষ্যৎ তাহলে কী দাঁড়াবে?
বৈশ্বিক জনসংখ্যা বৃদ্ধির সামগ্রিক চিত্র
সামগ্রিকভাবে, বৈশ্বিক পর্যায়ে জনসংখ্যা এখনও বাড়ছে এবং কিছুদিন এভাবে বাড়তে থাকবে। জাতিসংঘের (UN) অনুমান অনুযায়ী,
- ২০২২ সালের নভেম্বরে বিশ্ব জনসংখ্যা আটশ বিলিয়নে পৌঁছায়।
- ২০৩৭ সালের মধ্যে নয়শ (nine) বিলিয়নে পৌঁছানোর সম্ভাবনা রয়েছে।
- তারপর ২০৮০-এর দশকে এই সংখ্যা প্রায় ১০.৪ বিলিয়নে পৌঁছে চূড়ায় (peak) উঠবে,
- এবং সম্ভবত ২১০০ সালের দিকে সমতায় পৌঁছে ধীরে ধীরে কমতে শুরু করবে।
আগামী কয়েক দশক জুড়ে এই জনসংখ্যা বৃদ্ধির পূর্বাভাস সত্ত্বেও বৈশ্বিক উর্বরতার হার (fertility rate) লাগাতার কমতে থাকবে বলে আশা করা হচ্ছে। আজকের দিনে প্রত্যেক মহিলার প্রতি জন্ম (births per woman) ২.৩ হলেও, ২০৫০ সালের মধ্যে এটি ২.১-এ নেমে আসবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
কীভাবে জনসংখ্যা বাড়ছে যখন জন্মহার কমে যাচ্ছে? জাতিসংঘের ভাষ্য অনুযায়ী, এর প্রধান কারণ হলো পূর্বের উচ্চ জন্মহার সংবলিত জনসংখ্যাগত গতি (population momentum), অর্থাৎ এখনকার জনসংখ্যাগত কাঠামো (youthful age structure) আগের প্রজন্মের তুলনায় তুলনামূলকভাবে তরুণ, যা সামনের বছরগুলোতেও মোট জনসংখ্যা বৃদ্ধি বজায় রাখতে সাহায্য করবে। আসলে, ২০৫০ সালের মধ্যে বৈশ্বিক জনসংখ্যা বৃদ্ধির দুই-তৃতীয়াংশের বেশি এই জনসংখ্যাগত গতির জন্যই ঘটবে।
জনসংখ্যা হ্রাস: প্রধান উদাহরণসমূহ
জনসংখ্যা হ্রাস (shrinking population) ও জন্মহার পতন (falling birth rates) এখন সারা পৃথিবীতেই দেখা গেলেও কিছু দেশে এটি বিশেষভাবে তীব্র। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো চীন, জাপান এবং দক্ষিণ কোরিয়া (South Korea)।
- চীন (China): ২০২২ সালে, বিশ্বের সর্বোচ্চ জনসংখ্যাবহুল এই দেশটিতে ৬০ বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো জনসংখ্যা হ্রাস রেকর্ড করা হয়। ভবিষ্যদ্বাণী অনুসারে, চীনের জনসংখ্যা আগামীতে নাটকীয়ভাবে কমতে পারে।
- জাপান (Japan): জাপানের জনসংখ্যা বহু বছর ধরেই কমছে। পূর্বাভাস অনুযায়ী, ১২৫ মিলিয়ন থেকে ২০৭০ সালের মধ্যে ৮৭ মিলিয়নে নেমে আসতে পারে।
- দক্ষিণ কোরিয়া (South Korea): ২০২২ সালে বিশ্বের সর্বনিম্ন উর্বরতার হার (fertility rate) রেকর্ড করে, যা ছিল ০.৭৮। এটি একমাত্র ওইসিডি (OECD) দেশ যার উর্বরতার হার ১-এরও নিচে। মনে রাখার মতো বিষয় হলো, ২.১ হল “প্রতিস্থাপন হার” (replacement rate), অর্থাৎ জনসংখ্যাকে স্থিতিশীল রাখতে এই হারের প্রয়োজন। সেখানে দক্ষিণ কোরিয়া ওই সীমার অর্ধেকেরও নিচে রয়েছে।
অবশ্য শুধু এশিয়ার এই দেশগুলোতেই নয়, বিশ্বের অন্যান্য উন্নত অর্থনীতিতেও পরিস্থিতি খুব একটা ভালো নয়। বিশ্বব্যাংকের (World Bank) তথ্যানুযায়ী, ইসরায়েল (Israel) ছাড়া বাকি সব ওইসিডি দেশে উর্বরতার হার প্রতিস্থাপন হারের নিচে। বিশ্বজুড়ে প্রায় ৬১ টি দেশ ২০৫০ সালের মধ্যে জনসংখ্যা হ্রাসের মুখে পড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
বার্ধক্যমুখী জনসংখ্যা ও এর প্রভাব
নিম্ন জন্মহার এবং বাড়ন্ত আয়ু (rising life expectancy) মিলিয়ে যে প্রবণতা তৈরি হচ্ছে, তাকে বলে জনসংখ্যার বার্ধক্য (aging population)। এতে প্রবীণদের (older people) অনুপাত ক্রমাগত বাড়ে, আর কর্মক্ষম ও তরুণ জনগোষ্ঠীর (working age and young people) অনুপাত কমে যায়।
বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলেই এই বার্ধক্যমুখী জনসংখ্যা লক্ষ করা যায়। শুধু জাপান, যুক্তরাজ্য (UK), যুক্তরাষ্ট্র (US) নয়, বরং ইতালি (Italy), পুরো ইউরোপীয় ইউনিয়ন (EU), ব্রাজিল (Brazil), মেক্সিকো (Mexico), থাইল্যান্ড (Thailand), চীন এবং আরও অনেক দেশে এই প্রবণতা দেখা যাচ্ছে।
এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম বলতে গেলে একমাত্র আফ্রিকা (Africa)। আসছে কয়েক দশকে এখানে উল্লেখযোগ্য হারে জনসংখ্যা বাড়তে পারে। আসলে, ২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্বের জনসংখ্যা বৃদ্ধির অর্ধেকের বেশি হবে আফ্রিকা মহাদেশে। তবে এক দশক আগের পূর্বাভাসের তুলনায় আফ্রিকায় সম্ভাব্য জনসংখ্যা বৃদ্ধির মাত্রা কমে এসেছে, কারণ সেখানকার উর্বরতার হার আগের চেয়ে দ্রুত পতন হচ্ছে। শুধু আফ্রিকাই নয়, সারাবিশ্বের জন্যই জনসংখ্যা বৃদ্ধির পূর্বাভাস কিছুটা কমিয়ে দেখাচ্ছে জাতিসংঘ।
কীভাবে আমরা এই অবস্থায় এলাম?
বিশ্বের জনসংখ্যা ১৯৫০-এর দশক থেকে শুরু করে অত্যন্ত দ্রুত বৃদ্ধির মুখোমুখি হয়। অর্থনীতিবিদ এবং সমাজবিজ্ঞানীরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। এই সময় থেকেই পল আরলিখ (Paul Ehrlich) নামের স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপক ১৯৬৮ সালে লেখেন “দ্য পপুলেশন বম্ব (The Population Bomb)” নামে একটি বই। সেই বইয়ের প্রস্তাবনায় প্রথম লাইনেই ছিল মোটামুটি এমন ধারণা: “সমস্ত মানবজাতিকে খাওয়ানোর যুদ্ধ শেষ, ১৯৭০ ও ১৯৮০ এর দশকে শত শত মিলিয়ন মানুষ অনাহারে মারা যাবে, যতই এখন থেকে জোর প্রচেষ্টা নেওয়া হোক না কেন।”
এই বইয়ের সবচেয়ে বড় উদ্বেগ ছিল যে তখনকার বিদ্যমান জনসংখ্যাকে যথেষ্ট খাওয়ানো যাচ্ছিল না, আর যেহেতু জনসংখ্যা দ্রুত বাড়ছিল, খাদ্য উৎপাদন এর সাথে তাল মিলিয়ে বাড়তে পারবে না; ফলে বিশ্বব্যাপী দুর্ভিক্ষ (famine) দেখা দেবে। এই ভাবনা জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ (population control) নিয়ে সার্বিক জনমতে বড় প্রভাব ফেলেছিল।
যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা (U.S. Agency for International Development বা USAID) তখন পরিবার পরিকল্পনা (family planning) কর্মসূচিকে বিশ্বব্যাপী সমর্থন দিতে থাকে, বিশেষ করে ভারত, বাংলাদেশ, ইন্দোনেশিয়ার মতো দেশে। এর মধ্যে ছিল গর্ভনিরোধক (contraceptives) বিতরণ ও নির্বীজনকরণ (sterilization) ক্যাম্পেইনকে আর্থিক সহায়তা দেওয়া। একই সময়ে চীনে প্রণীত এক সন্তান নীতি (one-child policy) পরিবারের ওপর আর্থিক জরিমানা আরোপ করে যদি তাদের একের বেশি সন্তান থাকে। এছাড়াও, নারীদের শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধির পেছনে এই অতিরিক্ত জনসংখ্যাভীতি ভূমিকা রেখেছিল।
এভাবে বিভিন্ন আইন ও নীতি বাস্তবায়নের ফলে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ২%-এর ওপরে থাকা অবস্থান থেকে এখন প্রায় ০.৮%-এ নেমে এসেছে।
এবার দেখা যাক সেই “পপুলেশন বম্ব” বইয়ের ভবিষ্যদ্বাণী কতটা সত্যি হলো। বিশ্বব্যাপী দুর্ভিক্ষের পূর্বাভাসের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে বাস্তবে দুর্ভিক্ষ পুরোপুরি নির্মূল হয়নি, কিন্তু যেখানে দুর্ভিক্ষ হচ্ছে সেগুলোর মূল কারণ রাজনৈতিক অস্থিরতা, খাদ্যস্বল্পতা নয়। বাস্তবে আজ আমাদের বড় সমস্যা হলো অতিভোজন (over-consumption), খাবারের সংকট নয়। এখন বিশ্বব্যাপী স্থূলতা (obesity) মহামারী দেখা দিয়েছে, ১৯৭০-এর দশক থেকে মাথাপিছু ক্যালরি গ্রহণ গড়ে ২৪% বৃদ্ধি পেয়েছে। এর ফলে টাইপ ২ ডায়াবেটিস (type 2 diabetes) রোগীর সংখ্যা বেড়েছে এবং বিশ্বব্যাপী মৃত্যুহারও ১৯৬৫-৭৪ সময়কালে প্রতি ১০০০ জনে ১৩ জন থেকে ১৯৮৫-৯০ সময়কালে প্রতি ১০০০ জনে ১০ জনে নেমে এসেছে। বলা যায়, সেই ভবিষ্যদ্বাণীগুলো অনেকটাই ভুল প্রমাণিত হয়েছে। যদিও পরিবেশগত ক্ষতির আশঙ্কা যে ভুল ছিল না, তা আমরা এখন অনুভব করছি ক্রমবর্ধমান গরমে জর্জরিত গ্রহে।
কিন্তু এই ভুল পূর্বাভাসের কারণে ভবিষ্যতে আমাদের কী প্রতিক্রিয়া হবে? সেখানেই বিষয়টা হয়ে উঠছে কিছুটা অন্ধকারাচ্ছন্ন।
ভবিষ্যৎ কেমন হতে পারে?
ভবিষ্যৎ কীভাবে দেখা যেতে পারে তা বোঝার সহজ উপায় হলো প্রজনন হার প্রতিস্থাপন মাত্রা (fertility rate replacement level) দেখা। এটি হলো প্রতি নারীর জীবদ্দশায় গড়ে যতগুলি সন্তান জন্ম দিতে হবে যাতে তিনি ও তার সঙ্গী মিলে নিজেদের স্থান প্রতিস্থাপন করতে পারেন। এই হার প্রায় ২.১ শিশু প্রতি নারী। যদি একটি দেশের প্রজনন হার ২.১ এ থাকে, তাহলে সেই দেশের জনসংখ্যা বাড়বে না, কমবেও না, অভিবাসন (migration) ছাড়া।
কিন্তু বর্তমানে অনেক দেশের প্রজনন হারই এই প্রতিস্থাপন মাত্রার নিচে। ১৯৭০ সালের কাছাকাছি, অর্থাৎ “পপুলেশন বম্ব” বই প্রকাশের সময়, বিশ্বের প্রায় সব দেশই ধীরে ধীরে ২.১ এর নিচে নেমে যায়। এখন কেবলমাত্র আফ্রিকা এবং ইউরোপ ও দক্ষিণ আমেরিকার কিছু অংশে জনসংখ্যা স্থিতিশীল বা কিছুটা বেড়েছে।
ধরে নিন সারা বিশ্বের প্রজনন হার যদি আজকের যুক্তরাষ্ট্রের মতো হতো, তাহলে কয়েকশো বছরের মধ্যেই আমাদের বৈশ্বিক জনসংখ্যা প্রায় ২ বিলিয়নে নেমে আসবে। অর্থাৎ আমাদের সর্বোচ্চ ৮ বিলিয়ন থেকে প্রায় ৬ বিলিয়ন লোক কমে যাবে। এরপরও এই সংখ্যা আরও কমতে পারে, ফলে গোটা জাতির বিলুপ্তি (extinction) ঘটতে পারে।
কীভাবে আমরা এত নিচু প্রতিস্থাপন হারে চলে এলাম? একটা বই তো এত বিশাল ধ্বংসাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে না! আসলে এর পেছনে অনেকগুলো অপ্রত্যাশিত সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তন একসাথে কাজ করেছে। এসব না বুঝলে পরিস্থিতি পরিবর্তনের সম্ভাবনা খুবই কম।
গ্রামীণ অঞ্চল
এটি মূলত শুরু হয়েছে যখন আমরা গ্রামীণ জীবনধারা (rural lifestyle) থেকে শহুরে (urban) জীবনে ব্যাপক স্থানান্তর ঘটালাম। ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায় গ্রামীণ এলাকায় জনসংখ্যা প্রায়ই স্থিতিশীল থাকে, কিন্তু যেসব এলাকা নগরায়িত হয়েছে (urbanized) সেসব ক্ষেত্রে জন্মহার (birth rate) হ্রাস পেয়েছে।
এর একটি বড় কারণ সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য। গ্রামীণ কৃষি নির্ভর সমাজে বড় পরিবারের গুরুত্ব অনেক বেশি। কারণ কৃষিকাজে পরিবারের সকলের সহায়তা প্রয়োজন হয়। এছাড়া গ্রামীণ সমাজে সবাই সবাইকে চেনে, ফলে সামাজিক নিয়মভঙ্গ করলে সুনাম নষ্ট হবার ভয় থাকে। তাছাড়া গ্রামে নারীরা কম শিক্ষাগত ও কর্মসংস্থানের সুযোগ পায়, ফলে তারা অল্প বয়সেই বিয়ে করে সন্তান নেওয়ায় বেশি আগ্রহী হয়। গ্রামীণ সমাজ সাধারণত বেশি ধার্মিক (religious) ও রক্ষণশীল (conservative), যা বড় পরিবার গড়ার গুরুত্বকে জোর দেয়।
বর্তমানেও অ্যামিশ (Amish) সম্প্রদায়ের দিকে তাকিয়ে দেখতে পারেন। যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থিত এই খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের পরিবারে সাধারণত ৬-৭টি সন্তান থাকে। তারা খুব কঠোরভাবে তাদের ধর্মীয় মূল্যবোধ মেনে চলে এবং বাইরের জগতের প্রভাবের সুযোগ কম। ফলে তাদের মধ্যে একে অপরের প্রতি সহযোগিতার মনোভাব ও স্থিতিশীল পরিবার পরিকল্পনা লক্ষ্য করা যায়।
শহুরে অঞ্চল
এখন শহুরে শিল্পায়িত বিশ্বের দিকে তাকাই, যেখানে প্রায় ৯০% মানুষ বাস করে। এখানে বড় পরিবার রাখার অনুপ্রেরণা অনেক কম। কেন? কারণ শহরে আপনি আসলে কমিউনিটি বা প্রতিবেশী হিসেবে খুব একটা পরিচিতি পান না। আপনার “প্রতিবেশী” বলতে হয়তো আপনার অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিংয়ের হলওয়েতে দেখা হওয়া ব্যক্তিদের বোঝায়। এছাড়া বহু শহর, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রে, এমনভাবে পরিকল্পিত যে আপনাকে সর্বদাই গাড়িতে চড়ে ঘুরতে হয়, ফলে সামাজিক মেলামেশার জন্য তৃতীয় কোনো জায়গা (third place) খুঁজে পাওয়া কঠিন। বাড়ি আর অফিসের বাইরে যেই জায়গাটিতে মানুষ মিলিত হয়ে আড্ডা দিত, তা অনেকাংশেই হারিয়ে গেছে।
অন্যদিকে শহরে শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের সুযোগ বেশি, ফলে নারীরা আর আগের মতো অল্প বয়সে বিয়ে করে সন্তান নেওয়ার ওপর নির্ভরশীল নয়। গর্ভনিরোধক আর জন্মনিয়ন্ত্রণ বড় কোনো অপ্রত্যাশিত গর্ভধারণকে (unintended pregnancy) রোধ করে, যদিও এটি নিম্নআয়ের (low-income) নারীদের ক্ষেত্রে খুব বেশি পার্থক্য আনতে পারেনি।
তরুণরা ক্রমশ ডিজিটাল ডিভাইসে (digital devices) বেশি সময় দিচ্ছে, বাস্তব জগতের মানুষের চেয়ে ভার্চুয়াল ছবিতে মানুষ দেখা, সোশ্যাল মিডিয়ায় সুদৃশ্য মানুষদের দেখে নিজেদের মানদণ্ড উঁচু করা—সব মিলে “সৌন্দর্যের মুদ্রাস্ফীতি (beauty inflation)” তৈরি করেছে। তারা বাস্তব জীবনের গড় মানুষের চেয়ে ভার্চুয়াল জগতের নির্বাচিত সেরা চেহারার মানুষ দেখে আকর্ষণের মান নির্ধারণ করছে। ফলে বাস্তবে কাউকে পছন্দ করা কঠিন হয়ে পড়ছে।
সোশ্যাল মিডিয়া ও ডেটিং অ্যাপ (dating apps) মানুষকে পণ্যের মতো করে ভাবতে উৎসাহিত করছে, যেখানে একজন পার্টনারকে সহজে বাতিলযোগ্য (disposable) হিসেবে দেখা হয়। এর ফলে নারী ও পুরুষের মূল্যবোধের মধ্যে বড় বিভাজন তৈরি হচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, তরুণ পুরুষরা দিন দিন বেশি রক্ষণশীল (conservative) আর তরুণ নারীরা বেশি উদারপন্থী (liberal) হয়ে উঠছে। “মেন গোইং দেয়ার ওন ওয়ে বা মিগটাউ (Men Going Their Own Way বা MGTOW)” আন্দোলন বা দক্ষিণ কোরিয়ার নারীদের মধ্যে “4B মুভমেন্ট (4B movement)” এই বিভাজনের উদাহরণ।
শহুরে সমাজে সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের এরকম খিচুড়ির কারণে ফলস্বরূপ একই দেশের দুইজন মানুষের মূল্যবোধের মিল পাওয়া কঠিন হয়। এর ফলে তারা একত্রে জীবন গড়ার ব্যাপারে অনিচ্ছুক হয়ে পড়ে। এর সাথে যোগ করুন ক্রমবর্ধমান অস্থিরতার খবর, জলবায়ু পরিবর্তন, অর্থনৈতিক অস্থিরতা – যা মিডিয়ায় ক্রমাগত উঠে আসছে, তরুণ প্রজন্মের অনেকেই মনে করে, “এমন একটা অনিশ্চিত বিশ্বে আমি কেন সন্তান আনব?”
এছাড়া জীবনযাত্রার ব্যয় (cost of living) এবং সন্তানের খরচও এক বড় বাধা। একসময় কলেজ ডিগ্রি মানেই ছিল একটা স্থিতিশীল চাকরি ও একটা বাড়ি কেনার সামর্থ্য, যা পরিবার গড়ার পথ সহজ করত। এখন এই নিশ্চয়তা অল্প সংখ্যক মানুষের কাছেই সীমিত। যেসব দেশে জন্মহার সবচেয়ে কম, দেখা যায় সেসব দেশে তরুণ বেকারত্ব (youth unemployment) বেশি এবং বাড়ির দাম আয় অনুপাতে অনেক বেশি। ফলে তরুণদের কাছে বাড়ি কেনা দূরাশা হয়ে দাঁড়ায়।
কেন এটা নিয়ে বেশি আলোচনা হয় না?
তাহলে প্রশ্ন আসতে পারে, এই বিষয়টা নিয়ে কেন বেশি কথা হচ্ছে না? কারণ এখনো বয়স্ক (older) জনসংখ্যা আমাদের মোট জনসংখ্যার বড় অংশ ধরে রেখেছে। মানুষের আয়ু বেড়ে যাওয়ার ফলে মনে হচ্ছে যেন এখনো সবকিছু মোটামুটি স্থিতিশীল বা উন্নতির দিকে। কিন্তু জন্মহার হ্রাসের আসল প্রভাব আমরা সামনে দেখতে পাবো, যখন এই বয়স্কদের পরবর্তী প্রজন্ম যথেষ্ট পরিমাণে আসবে না।
উদ্বেগের কারণ কি?
দেশীয় (country level) এবং বৈশ্বিক (global scale)—উভয় ক্ষেত্রেই জনসংখ্যা হ্রাস ও বার্ধক্য কিছু গুরুতর সমস্যা তৈরি করতে পারে।
- শ্রমবাজারের সংকট (Labor Demand Unmet): কর্মক্ষম মানুষের (working age people) অভাব হলে শ্রমবাজারে (labor market) ঘাটতি তৈরি হয়। এতে উৎপাদনশীলতা (productivity) ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি (economic growth) বাধাগ্রস্ত হয়।
- প্রবীণ জনগোষ্ঠীর ব্যয় (Elderly Population Expenses): তরুণ কর্মী কমে গেলে বৃদ্ধদের দেখাশোনার (healthcare, pension) জন্যও সমস্যা হবে। কারণ অবসরপ্রাপ্ত বৃদ্ধদেরকে সাপোর্ট দেওয়ার জন্য তরুণ কর্মীবাহিনী প্রয়োজন। ফলে তাদের সেবা-যত্ন করার জন্য কর্মীসংখ্যা (caregivers) কমে আসতে থাকে। অন্যদিকে বয়স্ক (elderly) জনগোষ্ঠী যত বাড়ে, ততই সামাজিক নিরাপত্তা (social security) ও স্বাস্থ্যসেবায় (health care) ব্যয় বাড়ে।
- কর (Tax) ও সরকারি ব্যয়: কম তরুণ কর্মী মানে কম শ্রমশক্তি (labor force) আর কম করদাতা (taxpayer)। কর কমলে প্রাথমিকভাবে ভালো লাগলেও, দীর্ঘমেয়াদে সরকারি সেবায় (public services) কাটছাঁট বা বিদ্যমান মানুষের ওপর কর বাড়ানোর দরকার হতে পারে। কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর অনুপাত পেনশনারদের (pensioners) তুলনায় কমে যাওয়ায়, সরকারগুলোকে (governments) হয়ত উচ্চহারে কর (tax) আরোপ করতে হতে পারে, যাতে স্বাস্থ্য ও সামাজিক সেবার মান বজায় রাখা যায়।
- পরিবেশ?: কিছু মানুষের ধারণা, জনসংখ্যা কমলে পরিবেশের ওপর চাপ কমবে। কিন্তু অর্থনৈতিক অস্থিরতার কারণে তখন পরিবেশ সংরক্ষণে (environmental protection) বিনিয়োগ করাও কঠিন হতে পারে।
- অভিবাসন সম্পর্কিত উদ্বেগ: জনসংখ্যা কমলে দেশের উৎপাদনে চাপ পড়ে, তাই ইমিগ্রেশন বা অভিবাসন প্রমোট করার দরকার হয়, আর এর ফলে, বিশেষ করে অ-ইউরোপীয় অঞ্চল থেকে অভিবাসনের ফলে স্থানীয় ও অভিবাসিতদের মধ্যে ভেল্যু বা মূল্যবোধের তারতম্য দেখা যায়, যার ফলে সামাজিক অস্থিতিশীলতা তৈরি হতে পারে।
তবে কিছু ইতিবাচক দিকও আছে। যেমন,
- আয়ুষ্কাল বৃদ্ধির সুফল (Longer Lifespans): উন্নত চিকিৎসা (medicine care) এবং জীবনযাত্রার (lifestyle) কারণে মানুষের গড় আয়ু বাড়ছে। অনেক প্রবীণ মানুষই এখন আগের চেয়ে দীর্ঘ ও স্বাস্থ্যকর জীবন উপভোগ করছেন।
- জন্মহার হ্রাসের সুদূরপ্রসারী প্রভাব (Declining Fertility Rate Benefits): একসময় প্রতি মহিলায় ৫টি সন্তানের জন্ম নেওয়ার হার থেকে আজকের ২.৩ হারে নামার মানে হল গুণগত মান (quality of life) অনেক বেড়েছে। বিশেষ করে নারীরা তাদের প্রজনন সংক্রান্ত সিদ্ধান্তে (reproductive lives) আরও বেশি নিয়ন্ত্রণ (control) রাখতে পারছেন।
সমাধানের দিকে যাব নাকি যাব না?
অতীত অভিজ্ঞতা বলছে, অনেক দেশেই (যেমন সিঙ্গাপুর, জাপান, ইতালি) “প্রো-ন্যাটালিস্ট” (pro-natalist) নীতি গ্রহণ করা হয়েছে— অর্থাৎ এমন নীতি যা জন্মহার বাড়াতে উৎসাহ দেয়। কিন্তু এ পর্যন্ত সেগুলো তেমন কার্যকর প্রমাণ হয়নি। ফলে সামনে আসছে নতুন একটা বাস্তবতা—বিশ্বের জনসংখ্যা কাঠামো বদলে যাচ্ছে এবং এর সঙ্গে মানিয়ে নিতে হবে। এটা স্পষ্ট যে সামনের শতকে (next century) আমরা এমন একটা জগতে প্রবেশ করতে যাচ্ছি যেখানে জনসংখ্যা বৃদ্ধি আর আগের মতো স্বাভাবিক গতিতে চলবে না। এখানে প্রশ্ন হচ্ছে আমরা কী করতে পারি। সংকট চিহ্নিত ও অনুধাবন করা এক জিনিস, আর সেটার সমাধান করতে ইচ্ছুক হওয়া আরেক জিনিস। শেষ পর্যন্ত মানুষ জনসংখ্যার সেই আকারকেই অর্জন করতে চাইবে যেটাকে সে আদর্শ মনে করবে। আর অনেকের কাছেই যেভাবে চলছে সেভাবেই চলতে দেয়া, এমনকি জনসংখ্যা আসলেই কমিয়ে দেয়াটাই আদর্শ –
- কেউ কেউ মনে করেন, বর্তমান (status quo) পরিস্থিতি, অর্থাৎ যেমন চলছে তেমনটাই বজায় রাখা দরকার।
- আবার অনেকে বলেন, জনসংখ্যা কমে গেলে (population decline) পরিবেশের (environment) উপর চাপ কমবে এবং সামগ্রিকভাবে মানবিক (human) কর্মকাণ্ডের প্রভাবও কমে আসবে, যা ইতিবাচক।
- অন্যদিকে, বড় একটি অংশের যুক্তি হলো যে আমাদের আরও বেশি মানুষ দরকার, যাতে শ্রমবাজার (labor demands) পূরণ হয়, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি (economic growth) বজায় থাকে ইত্যাদি।
আদর্শ যদি প্রথম ও দ্বিতীয়টি হয় তাহলে সেক্ষেত্রে নতুন করে কিছু বলার নেই। কিন্তু এই লেখাটিতে জনসংখ্যা হ্রাসের এই সমস্যাটিকে চিহ্নিত করে তার সমাধান খোঁজার চেষ্টা করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে অবশ্যই সরকার, নীতিনির্ধারক (policymakers), এবং সমাজকে (society) একসঙ্গে কাজ করতে হবে নতুন এই জনসংখ্যাগত বাস্তবতার জন্য প্রস্তুত হতে।
সমাধানের সম্ভাব্য পথ
জনসংখ্যাগত এই পরিবর্তন বা সম্ভাব্য পরিবর্তনগুলো সরকারী পর্যায়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করে। বয়স্ক জনগোষ্ঠীর সমস্যার সমাধান তো আর গড় আয়ু (life expectancy) কমিয়ে করা সম্ভব নয়। ফলে সমাধানের দুটো পথই বাকি থাকে—
- অভিবাসন (migration)
- উর্বরতার হার বৃদ্ধির (boost fertility rates) নীতি।
অভিবাসন (Migration): একটি দেশ যদি অভিবাসনের মাধ্যমে কর্মক্ষম মানুষের (working age population) অভাব পূরণ করে, তাহলে উৎপাদনশীলতা ও অর্থনীতিকে সচল রাখতে পারে। তবে যদি বৈশ্বিক (global) পর্যায়েই জনসংখ্যা বয়স্কদের দিকে ঝুঁকে যায়, তাহলে এক দেশের কর্মক্ষম মানুষ অন্য দেশে স্থানান্তরিত হলে মূল দেশে সংকট তৈরি হতে পারে। বিশেষ করে পূর্ব ও দক্ষিণ ইউরোপের (Eastern and Southern Europe) অনেক দেশে তরুণ জনগোষ্ঠী (young population) অভিবাসনের মাধ্যমে অন্যত্র চলে যাওয়ায় এসব দেশের জনসংখ্যা দ্রুত কমছে। সেই সাথে এখানে আছে অন্য একটি সমস্যা। যেসব দেশে জনসংখ্যা হ্রাস হচ্ছে সেই সব দেশের লোকেদের মূল্যবোধের সাথে যেসব অঞ্চল থেকে মানুষ বিভিন্ন কারণে সেই সব অঞ্চলে অভিবাসন করছে সেই সব দেশের লোকেদের মূল্যবোধের মধ্যে সাধারণত পার্থক্য থাকে। ধীরে ধীরে সেই সব অঞ্চলে স্থানীয়দের তুলনায় অভিবাসিতদের সংখ্যা বাড়তে থাকে, আর মূল্যবোধের তারতম্যের কারণে বিভিন্ন রকমের সামাজিক অস্থিতিশীলতা তৈরি হয়।
উর্বরতার হার বৃদ্ধির নীতি (Policies to Boost Fertility Rates): ইতিমধ্যেই বলেছি, অনেক দেশেই (যেমন সিঙ্গাপুর, জাপান, ইতালি) “প্রো-ন্যাটালিস্ট” (pro-natalist) নীতি গ্রহণ করা হয়েছে— অর্থাৎ এমন নীতি যা জন্মহার বাড়াতে উৎসাহ দেয়। কিন্তু এ পর্যন্ত সেগুলো তেমন কার্যকর প্রমাণ হয়নি। এদিকে জাতিসংঘের মত হলো, “একটা নির্দিষ্ট আদর্শ জন্মহার (optimal birth rate) বা জনসংখ্যা (population) ধরে রাখার লক্ষ্যে” কাজ করা ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। তাহলে উপায় কী?
বাবা-মায়েরা (parents) আসলে যে শিশুসংখ্যা চান, তার সাথে বাস্তবতার ব্যবধান কমানোর ওপর জোর দেওয়া উচিত। অনেক উন্নয়নশীল দেশে, বহু নারী (women) তাদের ইচ্ছার চেয়ে বেশি সন্তানের জন্ম দিচ্ছেন; আবার সমৃদ্ধ দেশগুলোতে অনেক নারী (বা দম্পতি) কাঙ্ক্ষিত সন্তানসংখ্যার চেয়েও কম সন্তান নিচ্ছেন। সেই সাথে পরিবারের পরিকল্পনা (family planning), স্বাস্থ্যসেবা (health care) ও দেহ স্বায়ত্তশাসন (bodily autonomy) উন্নত করলে বাবা-মায়েরা তাদের পছন্দসই সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন। অন্যদিকে, উন্নত দেশগুলোতে কর্মজীবনে (career) প্রভাব পড়বে না— এমন নিশ্চয়তা দেওয়া গেলে বাবা-মায়েরা হয়তো সন্তানের সংখ্যা বাড়াতে আগ্রহী হবেন।
আমরা কী করতে পারি?
আমরা ইতিমধ্যেই দেখতে পারছি যে, শুধু অর্থনৈতিক প্রণোদনা (financial incentives) দিয়ে এই সমস্যা মিটবে না। দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, যাদের জন্মহার খুবই কম, তারা সন্তান নেওয়া পরিবারকে আর্থিক সহায়তা দিয়েও খুব একটা সুফল পায়নি। কারণ সমস্যাটি বহুমুখী (multi-faceted)। আর বিভিন্ন পলিসি প্রণয়ণ, আর্থনৈতিক প্রণোদনার মত রাষ্ট্রের সরাসরি হস্তক্ষেপমূলক কাজ ছাড়াও ব্যক্তি হিসেবেও আমাদের কিছু করার থাকে।
আমি নিজে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী (individualist) চিন্তাধারার পক্ষে, এবং এটি গ্লোবালাইজেশন (globalization) তরুণদের ভিন্ন মতামত, ভিন্ন মূল্যবোধ জানার সুযোগ করে দিয়েছে—যা ভালো। তরুণদের এখন আগের মতো কম বয়সেই বিয়ে বা পরিবার গড়তে বাধ্য করা হচ্ছে না। তারা বেশি বিকল্প পাচ্ছে। কিন্তু এই স্বাধীনতার চরম রূপ আবার কিছু খারাপ ব্যাপার নিয়ে এসেছে।
আমার আশা, আমরা আধুনিকতা (modernity) আর তথাকথিত কিছু “ঐতিহ্যবাহী (traditional) মূল্যবোধের” মধ্যে একটা ভারসাম্য (balance) আনতে পারবো। এই ঐতিহ্যবাহী মূল্যবোধ বা ভেল্যুগুলোর মধ্যে রয়েছে পরিবার, সন্তান প্রসব ও লালন-পালন, ও প্রেমে কমিটমেন্ট বা প্রতিশ্রুতিকে অধিকতর ইতিবাচক মূল্যায়ন। তবে এগুলো ট্রেডিশনাল বলেই যে এগুলো ধারণ করতে হবে এমন না, বরং বর্তমান প্রেক্ষাপটে এগুলোর গুরুত্ব আছে বলে এই ভেল্যুগুলোর গুরুত্ব নতুন করে বৃদ্ধি পাচ্ছে, আর তাই এই ভেল্যুগুলোর উপকারিতার জন্যই এই ভেল্যুগুলো ধারণ করতে হবে। ভবিষ্যতে ইন-ভিট্রো ফার্টিলাইজেশন (IVF) এর মতো প্রযুক্তি, সম্ভাব্য প্রাচুর্য বা অ্যাবান্ডেন্স হয়তো এই পরিস্থিতি মোকাবেলায় অনেক ভূমিকা রাখবে। কিন্তু এর আগ পর্যন্ত এই ভেল্যুগুলোর গুরুত্ব আছেই। মানুষ সবসময় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছে। এখন আমরা অনেক বেশি জটিল বিষয়ে দ্রুত পরিবর্তন আনছি, যা সবসময় কিছু বাধা সৃষ্টি করবে। কিন্তু আমরা এখন শিখতে শুরু করেছি কী কী আমাদের জন্য ক্ষতিকর।
এর অর্থ হলো ডিজিটাল ডিভাইসের ব্যবহার সীমিত করা, যাতে মানুষ বাস্তব সমাজে মেলামেশা করে কমিউনিটি গড়তে পারে। তরুণদের জন্য আরো বেশি সামাজিক পরিসর (third place) তৈরি করা, ডেটিং অ্যাপগুলোকে এমনভাবে ডিজাইন করা যাতে তারা মানুষকে পণ্যের মতো না দেখে, কাজের ঘন্টা কমিয়ে, আয় বাড়িয়ে, সাশ্রয়ী মূল্যের আবাসন তৈরি করা। এছাড়া তরুণদের মধ্যে ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আশা ও বিশ্বাস (hope and faith) ফিরিয়ে আনতে হবে। এজন্য ধর্ম-ঐতিহ্যভিত্তিক সমাজের দরকার নেই, কেবলই অন্তত এমন সমাজব্যবস্থা গড়তে হবে যাতে তারা আবার আগ্রহী হয় সামনে এগোতে এবং পরিবার গড়তে।
প্রশ্ন হলো: কীভাবে আমরা আবার সেই সামাজিক পরিবেশের দিকে ফিরব, যেখানে সম্প্রদায়বোধ আর সহযোগিতা কেন্দ্রে অবস্থান করতো? আমাদের বুঝতে হবে কোন অংশগুলি আধুনিক সমাজে কাজ করছে না এবং সেগুলো সংশোধন করে ইতিবাচক অগ্রগতি বজায় রাখতে হবে।
মানবজাতি ও মহাবিশ্ব সবসময় কোনো না কোনো ভারসাম্যে (equilibrium) ফিরে যেতে চায়। আমাদের জনসংখ্যা দ্রুত কমে যাওয়া এই প্রাকৃতিক পরিবর্তনেরই অংশ, আমাদের পরবর্তী বিবর্তনের (evolution) ধাপ।
তথ্যসূত্র
1 – https://www.un.org/development/desa/pd/sites/www.un.org.development.desa.pd/files/wpp2022_summary_of_results.pdf
2 – https://edition.cnn.com/2023/01/16/economy/china-population-decline-sixty-years-intl-hnk/index.html
3 – https://www.euronews.com/2023/01/17/the-countries-where-population-is-declining
4 – https://www.reuters.com/world/asia-pacific/south-koreas-world-lowest-fertility-rate-drops-again-2023-02-22/
5 – https://www.un.org/en/global-issues/population
6 – https://www.economist.com/leaders/2023/06/01/global-fertility-has-collapsed-with-profound-economic-consequences
7 – https://www.un.org/en/global-issues/population
8 – https://www.economist.com/middle-east-and-africa/2023/04/05/the-worlds-peak-population-may-be-smaller-than-expected
8 – https://www.economist.com/leaders/2023/06/01/global-fertility-has-collapsed-with-profound-economic-consequences
9 – https://www.unfpa.org/swp2023/too-few
10 – https://www.euronews.com/2023/01/17/the-countries-where-population-is-declining
11 – https://www.un.org/en/un-chronicle/global-population-will-soon-reach-8-billion-then-what
12 – https://www.economist.com/leaders/2023/06/01/global-fertility-has-collapsed-with-profound-economic-consequences
13 – https://www.scientificamerican.com/article/population-decline-will-change-the-world-for-the-better/
14 – https://www.ft.com/content/7a558711-c1b8-4a41-8e72-8470cbd117e5
Leave a Reply