Table of Contents
ভূমিকা
আমাদেরকে অভিবাসন (Immigration) প্রসঙ্গে কথা বলতে হবে। এটি এমন একটি বিষয় যা সাধারণত ব্যাপক মতবিরোধের জন্ম দেয়। তবু বিষয়টি বোঝা ও আলোচনা করা জরুরি। ২০২২ সালে প্রায় ৩.৪ মিলিয়ন নিয়মিত (Regular) ও ৩ লাখ অনিয়মিত (Irregular) অভিবাসী ইউরোপে এসেছে। কেউ এসেছে কাজ করতে, কেউ পড়াশোনা করতে, কেউবা পরিবারের সঙ্গে মিলিত হতে বা যুদ্ধ থেকে বাঁচতে। আবার কিছু লোক এসেছেন “অন্যান্য কারণে” (Other Reasons)—যা ইউরোস্ট্যাট (Eurostat)-এর ভিসা (Visa) পরিসংখ্যানের একটি স্বতন্ত্র বিভাগ।
অনেকেই বলেন, ইউরোপের বয়স্ক জনসংখ্যা (Aging Population) সামাল দিতে অভিবাসন প্রয়োজনীয়; এটি মানবিক (Humanitarian) দায়িত্ব, অথবা বর্তমান বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে এটি আসলে অস্বীকারযোগ্য কোনো বাস্তবতা নয়। অন্যদিকে অনেকে অভিবাসনের সঙ্গে সম্পৃক্ত অপরাধ, সামাজিক অন্তর্ভুক্তি (Integration) নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন এবং ইউরোপের কল্যাণমূলক ব্যবস্থার (Welfare System) ওপর বাড়তি চাপের কথা তুলে ধরে অভিবাসন থামিয়ে দিতে আহ্বান জানান। তবে এই সবকিছুর আগেই প্রয়োজন সংখ্যাগত চিত্র বোঝা। এ কারণেই প্রথমে ইউরোস্ট্যাটের (Eurostat) তথ্য বিশ্লেষণ করে জানার চেষ্টা করা হয়েছে যে, কী পরিমাণ অভিবাসী ইউরোপে আসছেন, কোথা থেকে আসছেন এবং কী করতে আসছেন। শুরুতে সেটা নিয়েই লেখা শুরু করা হচ্ছে।
সেই সাথে ইউরোপের জনমিতিক বিন্যাস (demographic makeup) অভিবাসনের (immigration) কারণে বদলে যাচ্ছে। তথ্য বেশ স্পষ্ট। প্রায় সব ইউরোপীয় দেশে স্থানীয় (native) জনসংখ্যার অনুপাত কমে আসছে। অথচ অনেকেই বিষয়টি অস্বীকার করে বলছে, “আমরা সব সময়ই অভিবাসী (immigrants) এবং শরণার্থী (refugees) পেয়ে এসেছি”—কিন্তু এতে তারা ইউরোপের বাইরের (non-European) অভিবাসনের নজিরবিহীন মাত্রা ও ব্যাপকতাকে উপেক্ষা করছে। আবার অন্যদিকে ষড়যন্ত্রমূলক “রিপ্লেসমেন্ট থিওরি (replacement theory)” বা প্রতিস্থাপন তত্ত্বের মাধ্যমে বলা হচ্ছে, ইউরোপের স্থানীয় জনগণকে স্বেচ্ছায় ইউরোপবহির্ভূত (non-European) লোকজন দ্বারা প্রতিস্থাপন করা হচ্ছে।
এই বিতর্কের প্রেক্ষিতে, কীভাবে অভিবাসন ইউরোপের জাতিগত বিন্যাস (ethnic makeup) বদলে দিচ্ছে তা এই লেখায় খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এর জন্য জাতীয় পরিসংখ্যান দপ্তরগুলো (national statistical databases) এবং সরকারি (government) প্রতিবেদনের (reports) ডেটা দেখা হয়েছে, যেগুলোর মধ্যে ছিল ইউকে সেনসাস ডেটা (UK census data), ইউরোস্ট্যাট (Eurostat), এবং ইউরোপীয় বংশোদ্ভুত নন-ইউরোপীয়দের (non-ethnic Europeans) জন্মসংক্রান্ত বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধসমূহ (scientific papers)। এসব তথ্য নিয়ে এখানে বর্তমান অভিবাসন পরিস্থিতির পূর্ণাঙ্গ চিত্র তৈরি করার চেষ্টা করা হচ্ছে, এবং দেখা হচ্ছে ভবিষ্যতে এটি কীভাবে এগোতে পারে।
ইউরোপে অভিবাসনের ক্রমবর্ধমান চিত্র
শুরুর দিকে আমরা ইউরোপের বিদেশে জন্মগ্রহণকারী (Foreign-born) জনসংখ্যার একটি সাধারণ রেখাচিত্র (Line Chart) দেখতে পাই, যা দেখায় যে ইউরোপীয় ইউনিয়নে (EU) অভিবাসীর সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। কিন্তু এই তথ্য কেবল “সংখ্যা বাড়ছে”—এটুকুই জানায়; কারা আসছেন, সে সম্পর্কে খুব বেশি বলে না।
তাই আমাদের “অভিবাসী” (Immigrant) শব্দটি সঠিকভাবে সংজ্ঞায়িত করা জরুরি। ইউরোপের দেশে সাধারণত তিন ধরণের মানুষ বাস করেন:
- জাতীয় নাগরিক (National Citizens),
- ইউরোপীয় ইউনিয়নের নাগরিক (EU Citizens) এবং
- বিদেশি নাগরিক (Foreign Citizens), যাদেরকে তৃতীয় দেশের নাগরিক (Third-Country Nationals)ও বলা হয়।
নাগরিকত্বের ধরন: ইউরোপে তিনটি স্তর
ইউরোপীয় ইউনিয়নের নাগরিকরা (EU Citizens) নিজেদের দেশের পাশাপাশি অন্য ইউরোপীয় দেশে যেতে পারেন বা সেখান থেকে ফিরে আসতে পারেন। অন্যদিকে তৃতীয় দেশের নাগরিকদের (Third-Country Nationals) ক্ষেত্রে আলাদা নিয়ম ও ভিসা প্রক্রিয়া রয়েছে।
এই তিন ধরণের নাগরিকের গতিপ্রবাহ (Movement) ২০২২ সালের হিসাবে আমরা প্রতিটি দেশ ধরে একটি চিত্রে উপস্থাপন করতে পারি। প্রথমে যোগ করি যে দেশের বাইরে থেকে আসা অনিয়মিত (Non-EU) নাগরিকদের প্রবাহ, এরপর তার ওপর ইউরোপীয় নাগরিকদের (EU Citizens) প্রবাহ, এবং সবশেষে সেই দেশের নিজস্ব নাগরিকদের (National Citizens) ফিরে আসার প্রবাহ।
এরপর যদি আমরা ওই দেশ ছেড়ে যাওয়া বিদেশি নাগরিক, ইউরোপীয় নাগরিক ও জাতীয় নাগরিকদের সংখ্যা বাদ দিই, তাহলে আমরা পাব নিট (Net) বা চূড়ান্ত অভিবাসনের হিসাব। দেখা যায়, গ্রীস (Greece), রোমানিয়া (Romania), ক্রোয়েশিয়া (Croatia) ও লাটভিয়া (Latvia) ছাড়া প্রায় সব দেশেই নিট অভিবাসন ধনাত্মক (Positive)। অর্থাৎ, প্রায় সব দেশেই বাইরে থেকে আসা মানুষের সংখ্যা, দেশ ছেড়ে যাওয়া মানুষের সংখ্যার চেয়ে বেশি।
সবগুলো দেশের এই নিট অভিবাসনের সংখ্যা যোগ করলে ২০২২ সালে মোট ১২ লাখ (১.২ মিলিয়ন) মানুষের নিট আগমন ঘটে ইউরোপীয় ইউনিয়নে। কিন্তু যখন আমরা নাগরিকত্বের তিনটি ভাগে (জাতীয় নাগরিক, ইউরোপীয় নাগরিক ও তৃতীয় দেশের নাগরিক) আলাদা করে দেখি, তখন কিছু প্রবণতা (Trend) ধরা পড়ে:
- নেদারল্যান্ডস (Netherlands) বা জার্মানি (Germany)-র মতো কিছু দেশে ইউরোপের ভেতর থেকে (EU Countries) আসা অভিবাসীদের সংখ্যাই বেশি।
- অন্যদিকে বহিরাগত (Non-EU) নাগরিকদের প্রধান গন্তব্য হলো ইতালি (Italy), স্পেন (Spain), জার্মানি (Germany) ও ফ্রান্স (France)।
এই পরিসংখ্যানের সঙ্গেই যুক্ত করতে হবে ২০২২ সালে সাময়িক সুরক্ষা (Temporary Protection Status) পাওয়া ইউক্রেনীয়দের (Ukrainians) তথ্য। রাশিয়ার (Russia) হামলার পর ইউক্রেনীয় প্রায় ৪ মিলিয়ন মানুষ ইউরোপীয় ইউনিয়নে আশ্রয় পেয়েছেন, যাদেরকে এই পরিসংখ্যানে যুক্ত করা হয়নি।
অনিয়মিত (Irregular) অভিবাসনের চিত্র
উপরের চিত্র সরকারি বা আনুষ্ঠানিকভাবে নিবন্ধিত মানুষদের নিয়ে, তাই এখানে অনিয়মিত অভিবাসীরা (Irregular Migrants) কম-বেশি বাদ পড়ে যান। তবু ধারণা পেতে আমরা দুইভাবে বিষয়টি দেখতে পারি:
- ইউরোপীয় ইউনিয়নে অনিয়মিত প্রবেশ (Irregular Entries): ২০২২ সালে এই সংখ্যা ছিল প্রায় ৩ লাখ। যদিও এটি “ধরা পড়া” বা পরিপূর্ণভাবে নথিভুক্ত (Processed) হওয়া অভিবাসীদের হিসাব, তাই প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে।
- ইউরোপীয় ইউনিয়নে অনিয়মিত অবস্থান (Irregular Stays): অনেকেই পর্যটন ভিসা (Tourism Visa) বা স্বল্পমেয়াদি কর্মভিসা (Short Term Work Permit) নিয়ে এসে থেকে যান, যদিও তাদের কাগজপত্রের মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। ২০২২ সালে প্রায় ৪ লাখ ৩০ হাজার জনকে ইউরোপ ছাড়ার নির্দেশ (Orders to Leave) দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু মাত্র ৭৩ হাজার আদেশ কার্যকর হয়।
এই দুটি সংখ্যাকে (অনিয়মিত প্রবেশ ও অনিয়মিত অবস্থান) সরাসরি মেলানো মুশকিল; কারণ কেউ অনিয়মিতভাবে আসলেও পরবর্তীতে তারা শরণার্থী আবেদন (Asylum Request) করতে পারেন, বা কিছু দেশে সরকারের নিয়মিতকরণ (Government Regularization Campaign) পদ্ধতিতে বৈধত্ব (Regular Status) পেতে পারেন। ফলে অনিয়মিত প্রবেশকারীদের সবার শেষ পরিণতি এক রকম হয় না।
যদি আমরা নিয়মিত ও অনিয়মিত—দুই ধরণের অভিবাসনের তুলনা করি, দেখতে পাব অনিয়মিত অভিবাসন সামগ্রিক অভিবাসনের তুলনায় একটি ছোট অংশ হলেও রাজনৈতিকভাবে এটি বেশি মনোযোগ পায়।
কোন দেশ থেকে অভিবাসীরা আসছেন?
এখন আমরা অনিয়মিত (Irregular) অংশ ছেড়ে ইউরোপে আসা বৈধ বাসিন্দাদের (Residence Permit Holders) দিকে নজর দিই। ইউরোপের বাইরে থেকে আসা মানুষ কোথা থেকে আসছেন এবং কেন আসছেন, তা বোঝার জন্য আমরা বৈধ রেসিডেন্স পারমিট (Valid Residence Permits) খতিয়ে দেখতে পারি।
রেসিডেন্স পারমিট থাকা অভিবাসীদের আমরা তাদের আগমনকৃত এলাকা অনুযায়ী ভাগ করতে পারি, যেমন:
- সাব-সাহারা আফ্রিকা (Sub-Saharan Africa)
- মধ্যপ্রাচ্য, উত্তর আফ্রিকা, পাকিস্তান ও তুরস্ক (Middle East, North Africa, Pakistan, Turkey)
- বাকি এশিয়া (The Rest of Asia)
- বাকি ইউরোপ (The Rest of Europe)
- ওশেনিয়া, কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্র (Oceania, Canada and the US)
- ল্যাটিন আমেরিকা (Latin America)
এরপর ইউরোপের প্রতিটি দেশে অভিবাসীদের উৎস অঞ্চল কোন দিকে ঝুঁকে আছে, তা দেখা যায়।
- সাব-সাহারা আফ্রিকা: ফ্রান্স (France), সুইডেন (Sweden), বেলজিয়াম (Belgium) ও পর্তুগাল (Portugal)-এ সাব-সাহারান আফ্রিকানদের (Sub-Saharan African) সংখ্যা তুলনামূলক বেশি; এসব দেশে প্রায় ২০-২৫% বৈধ রেসিডেন্স পারমিট তাদের দখলে।
- মধ্যপ্রাচ্য, উত্তর আফ্রিকা, পাকিস্তান ও তুরস্ক: ঐতিহাসিকভাবে অভিবাসীপ্রবণ পশ্চিম ইউরোপীয় দেশগুলোতে এ অঞ্চলের মানুষ বেশি আসেন। পাশাপাশি রোমানিয়া (Romania) ও বুলগেরিয়া (Bulgaria)-তেও এদের কিছু উপস্থিতি আছে, বিশেষ করে তুরস্কের সীমান্ত কাছাকাছি থাকার কারণে। বুলগেরিয়ায় এমনিতেই এক বড় তুর্কি সংখ্যালঘু (Turkish Minority) রয়েছে, যা এ পরিসংখ্যানে প্রভাব ফেলে।
- ল্যাটিন আমেরিকা: মূলত স্পেন (Spain) ও পর্তুগাল (Portugal)-এ আসেন; স্পেনে ৩৩% ও পর্তুগালে ৪৪% বৈধ রেসিডেন্স পারমিটধারী ল্যাটিন আমেরিকান (Latin Americans)।
- বাকি ইউরোপ: মধ্য ও পূর্ব ইউরোপীয় (Central and Eastern European) দেশগুলোতে প্রধানত ইউক্রেন (Ukraine), বেলারুশ (Belarus) ও রাশিয়ার (Russia) অভিবাসীরা আসছেন। যেমন পোল্যান্ড (Poland) বা চেক প্রজাতন্ত্রে (Czech Republic) তারা অ-ইইউ অভিবাসীদের বড় অংশ।
- বাকি এশিয়া: নানা দেশের মধ্যে চীন (China), ভারত (India), ফিলিপাইন (Philippines) ও থাইল্যান্ড (Thailand) উল্লেখযোগ্য উৎস, যাদের ইউরোপের প্রায় সর্বত্রই দেখা যায়।
কেন আসছেন? অর্থাৎ অভিবাসনের উদ্দেশ্য কী?
ইউরোপীয় ইউনিয়ন রেসিডেন্স পারমিটকে সাধারণত পাঁচটি বিভাগে ভাগ করে:
- কাজ (Work)
- পরিবার (Family)
- শিক্ষা (Education)
- আশ্রয়/অভয়ারণ্য (Asylum)
- অন্যান্য (Other)
সামগ্রিক হিসাবে দেখা যায়, ৪২% অভিবাসী কাজের (Worker Permits) কারণে আসেন, ২৪% পরিবার (Family), ১৩% পড়াশোনা (Education), ১১% আশ্রয় (Asylum) ও ১০% অন্যান্য কারণে। তবে দেশভেদে এই অনুপাতের বড় অমিল রয়েছে।
উদাহরণ হিসেবে, পোল্যান্ড (Poland) দীর্ঘদিন ধরেই ইউক্রেনীয়দের (Ukrainians) প্রচুর পরিমাণে কর্মভিসা (Employment Visa) দিচ্ছে। ২০২২ সালে প্রায় ৪ লাখ ৫০ হাজার ওয়ার্ক পারমিট ইস্যু করে পোল্যান্ড একাই সমগ্র ইউরোপীয় ইউনিয়নের ৪০% কর্মভিত্তিক ভিসার যোগান দিয়েছে। অন্যদিকে পশ্চিম ইউরোপের অনেক দেশে (যেমন ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি ইত্যাদি) বেশিরভাগ অভিবাসীর আসার প্রধান কারণ পরিবার পুনর্মিলন (Family Reunification)। বিশেষত ২০০৩ সালের ইউরোপীয় পারিবারিক পুনর্মিলন নির্দেশিকা (Family Reunification Directive) এই প্রবাহ বাড়িয়েছে, কারণ এটি তৃতীয় দেশের নাগরিকদের পরিবারকে সহজে নিয়ে আসার সুযোগ দিয়েছে।
দেশের ভিত্তিতে অভিবাসী-উৎসের বৈচিত্র্য
এবার আমরা অভিবাসীদের আগমন-কারণকে (Purpose) তাদের নিজ নিজ নাগরিকত্বের ভিত্তিতে দেখি। বড় বড় অভিবাসী-উৎস দেশ ধরে রেসিডেন্স পারমিট কীভাবে বিতরণ হয়েছে তা বিশ্লেষণ করলে চোখে পড়ে:
- ইউক্রেন, ভারত, ফিলিপাইন ও চীন: এদের বেশিরভাগই ওয়ার্ক পারমিটে আসেন।
- সিরিয়া ও আফগানিস্তান: প্রধানত শরণার্থী (Refugee) হিসেবে আসেন।
- আলজেরিয়া, মরক্কো ও তুরস্ক: পরিবার পুনর্মিলন (Family Reunification) ও অন্যান্য (Other) ভিসায় আসা বেশি; “অন্যান্য” বিভাগে একাকী আগত অপ্রাপ্তবয়স্কদের (Unaccompanied Minors) বিষয়ও অন্তর্ভুক্ত।
- যুক্তরাজ্য (United Kingdom): ব্রেক্সিটের (Brexit) ফলে ৮০% রেসিডেন্স পারমিট “অন্যান্য” (Other) ক্যাটেগরিতে পড়েছে, কারণ ইউরোপের দেশগুলো ইউকে নাগরিকদের জন্য বিশেষ বসবাসের পরিকল্পনা (Special Resident Schemes) তৈরি করেছিল।
অভিবাসন-সংক্রান্ত নীতির বাস্তবায়ন
এই পরিসংখ্যানগুলো আমাদের কী দেখায়? ইউরোপে অভিবাসন নিয়ে সাধারণীকৃত মন্তব্য বা একপাক্ষিক ধারণাগুলো খুব একটা কার্যকর নয়। প্রথমত, ইউরোপের কোথায় কোন অভিবাসীরা আসছেন এবং কী কারণে আসছেন—এতে বিশাল তারতম্য রয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নে সামগ্রিকভাবে কর্মভিত্তিক অভিবাসন (Labor Migration) সবচেয়ে বেশি হলেও, পোল্যান্ড ও পূর্ব ইউরোপীয় অন্যান্য দেশের কারণে এই সংখ্যা খুব বেশি। আর পশ্চিম ইউরোপে অভিবাসনের প্রধান উদ্দেশ্য পরিবার পুনর্মিলন, যা ঐতিহাসিক অভিবাসী জনসংখ্যার ফলে সৃষ্টি হয়েছে।
উপরন্তু, কোন দেশ থেকে আসা অভিবাসীরা কী উদ্দেশ্য নিয়ে আসছেন, তাতেও ভিন্নতা আছে। যেমন ভারতীয় বা ইউক্রেনীয়রা মূলত কাজের জন্য আসে, সিরিয়ান ও আফগানরা আসে আশ্রয়ের জন্য, আবার মরক্কো বা তুর্কি নাগরিকরা বেশি আসেন পরিবারের সাথে যুক্ত হতে।
এগুলো ইউরোপের ভবিষ্যৎ অভিবাসননীতিতে (Migration Policy) প্রভাব ফেলে। যেমন, ইউরোপের বয়স্ক ও কমতে থাকা জনগোষ্ঠীর ঘাটতি মেটাতে কর্মী নিয়োগের সুযোগ, সামাজিক সুবিধা (Social Benefits) বণ্টন ও “সাংস্কৃতিক সামঞ্জস্য” (Cultural Compatibility) নিয়ে আলোচনা—সবই এ পরিসংখ্যান ও বাস্তবতার সঙ্গে যুক্ত।
ইউরোপের বর্তমান জনমিতি
২০২২ সালে আনুমানিক ১২ লক্ষ মানুষ নিয়মিতভাবে ইউরোপীয় ইউনিয়নে (EU) প্রবেশ করেছে, আর প্রায় ৩ লক্ষ মানুষ অনিয়মিত পথে এসেছে। যুক্তরাজ্যে (UK) এই সংখ্যা ছিল আনুমানিক ৭ লক্ষ অনিয়মিত অভিবাসী (irregular migrants), সাথে প্রায় ৪০ হাজার অনিয়মিত প্রবেশ (irregular entries)। যদি জনসংখ্যার শতাংশের হিসাব করা হয়, তাহলে ইইউর জন্য এটি মোট জনসংখ্যার প্রায় ০.৪% আর যুক্তরাজ্যের জন্য প্রায় ১%।
কিন্তু যেহেতু এই প্রবাহ (flow) বেশ ধারাবাহিকভাবে (pretty constant) চলছে, তাই এই সংখ্যাগুলো যোগ হয়ে বড় হয়ে উঠছে; একই সাথে ইউরোপের বিদেশে জন্মগ্রহণকারী (foreign-born) জনসংখ্যার অনুপাতও বেড়ে চলেছে। আসলে, বহু পশ্চিম ইউরোপীয় (Western European) দেশে বিদেশে জন্মগ্রহণকারীদের অনুপাত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের (United States) তুলনায় বেশি, অথচ অনেক আগে থেকেই আমেরিকাকে অভিবাসনের “রাজা” বলে মনে করা হতো।
এটি মূলত দু’টি কারণে হয়েছে।
- প্রথমত, শেঙ্গেন এলাকা (Schengen Area) ইউরোপীয় দেশগুলোর মধ্যে সীমান্ত উন্মুক্ত করে দিয়েছে, ফলে ইউরোপের মানুষের মধ্যে এক দেশ থেকে অন্য দেশে যাওয়াটা সহজ হয়েছে।
- দ্বিতীয়ত, গত কয়েক দশকে অভিবাসনের বিভিন্ন ঢেউ ইউরোপে এসেছে—যেমন ৫০ ও ৬০-এর দশকের অতিথি শ্রমিক (guest workers), ৯০-এর দশকে যুগোস্লাভ (Yugoslav) যুদ্ধের সময়কার শরণার্থী (refugees), এবং সাম্প্রতিক বছরগুলোর অভিবাসন সংকট (migration crisis)।
এখন বিদেশে জন্মগ্রহণকারী (foreign-born) জনসংখ্যাকে যদি উৎস অঞ্চলের (region of origin) ভিত্তিতে ভাগ করা হয়—যেমন ইইউভুক্ত (EU) ও ইইউবহির্ভূত (non-EU)—তাহলে কী দেখা যায়? যুক্তরাজ্যও (UK) এইভাবে ভাগ করে থাকে। তবে এতে কিছু ইউরোপীয় নাগরিক হিসেব থেকে বাদ যায়, বিশেষ করে ইউক্রেনীয় (Ukrainian) ও বাল্কান (Balkan) দেশগুলোর নাগরিক, এবং একই সাথে ইইউতে বসবাসরত যুক্তরাজ্যের নাগরিকেরাও। যেমন স্পেনে (Spain) ৩ লক্ষ আর ফ্রান্সে (France) ১ লক্ষ ৬৩ হাজার যুক্তরাজ্যের অভিবাসী (UK migrants) আছেন।
যেসব দেশে ইইউর বাইরে (non-EU) জন্মগ্রহণকারী মানুষের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি, তার মধ্যে রয়েছে সুইডেন (Sweden), আয়ারল্যান্ড (Ireland) এবং মজার বিষয় হলো এস্তোনিয়া (Estonia)। সেখানে জাতিগত রুশ (ethnic Russian) জনগোষ্ঠীকে ‘নাগরিকত্ববিহীন (non-citizens)’ হিসেবে গণনা করা হয়েছে। অন্যদিকে এই তালিকার একেবারে নিচের দিকে রয়েছে হাঙ্গেরি (Hungary), পোল্যান্ড (Poland), স্লোভাকিয়া (Slovakia) আর বুলগেরিয়া (Bulgaria)।
কিন্তু জনমিতিক পরিবর্তন (demographic change) বুঝতে গেলে আমাদের আরো পেছনে তাকাতে হবে। পশ্চিম ইউরোপের কিছু দেশে ইউরোপবহির্ভূত (non-European) অভিবাসন শুরু হয়েছিল ১৯৫০-এর দশকে। অভিবাসীদের সন্তান ও নাতি-নাতনি রয়েছে, তাদেরও যোগ করতে হবে সামগ্রিক নন-ইউরোপীয় বংশোদ্ভুত (non-European descended) জনসংখ্যা বের করতে হলে।
এ বিষয়ে একটা উপায় হল ইইউ লেবার ফোর্স সার্ভে (EU’s Labor Force Survey) দেখা, যা ১৫ থেকে ৬৪ বছর বয়সীদের নিয়ে সমীক্ষা করে এবং তাদেরকে তাদের অভিবাসন পটভূমি (migration background) ও পিতা-মাতার পটভূমি অনুযায়ী শ্রেণিবদ্ধ করে। যদিও এর কিছু সীমাবদ্ধতা আছে, যেমন ১৫ বছরের নিচে যারা তাদের হিসাব এর আওতায় আসে না। ফলে সাম্প্রতিকতম অভিবাসনের শিশুদের (যারা দ্বিতীয় বা তৃতীয় প্রজন্ম) হিসাব এখানে ধরা পড়ে না। একইসাথে প্রাচীন অভিবাসন-ঢেউয়ের তৃতীয় প্রজন্মের মানুষেরাও (third generation) এর বাইরে থেকে যেতে পারে।
ফলে, এই সংখ্যাগুলো প্রকৃত অভিবাসী-বংশোদ্ভুত (immigrant descended) জনসংখ্যার তুলনায় কম, তবে অন্তত ধারা (trend) বোঝার জন্য এগুলো একটি ধারণা দেয়। যে দেশগুলোতে নন-ইউরোপীয় জনসংখ্যার (non-European population) হার সবচেয়ে বেশি, সেগুলো পশ্চিম ও উত্তর ইউরোপে (western and northern Europe)। বেশিরভাগ পশ্চিম ইউরোপীয় দেশে এই হার ১৪ থেকে ১৮ শতাংশের মধ্যে। তবে সুইডেন (Sweden) ও বেলজিয়াম (Belgium) এই হিসাব থেকে বাদ গেছে, কারণ তারা ইউরোস্ট্যাটে (Eurostat) ডেটা এন্ট্রি করতে গিয়ে গোলমাল করে ফেলেছিল, ফলে তাদের মোট সংখ্যা ১০০ শতাংশে মেলেনি!
তারপর আমরা ভাবলাম, আরেক ধাপ এগিয়ে দেখা যাক—শুধু দ্বিতীয় প্রজন্ম নয়, বরং নতুন প্রজন্ম (third generation) বা আরও পুরোনো প্রজন্মও গণনায় আনা যাক। এর জন্য আমাদের কিছু দেশের জাতীয় পরিসংখ্যান ডেটাবেসে (national statistical databases) ঢুঁ মারতে হয়েছে, যেসব দেশ আসলে এসব তথ্য প্রকাশ করে।
ইংল্যান্ড ও ওয়েলস (England and Wales) এর ক্ষেত্রে বিষয়টি সহজ, কারণ সরকার জাতি (race) ও ধর্ম (religion) অনুযায়ী মানুষের ওপর বিস্তারিত পরিসংখ্যান সংগ্রহ করে। এই আলোচনার জন্য, মানুষকে চারটি শ্রেণিতে ভাগ করা যাক:
- হোয়াইট ব্রিটিশ আইল্যান্ড নেটিভ (White British Island natives)
- অন্যান্য শ্বেতাঙ্গ (whites, including mixed race)
- নন-মিক্সড নন-হোয়াইট (non mixed non whites)
- মিশ্রিত জাতিগত (mixed race) ব্যাকগ্রাউন্ড
পরিসংখ্যান বলছে, পুরো ব্রিটিশ জনগোষ্ঠীর প্রায় ৭৫% হল নেটিভ শ্বেতাঙ্গ (native white), যেখানে প্রায় ২০% জনগণ নন-ইউরোপীয় (non-European) পটভূমি থেকে এসেছে।
অন্যদিকে মহাদেশীয় (continental) বেশিরভাগ দেশে এমন জাতিগত ডেটা (ethnic data) প্রকাশিত হয় না। অতীতে এগুলো ভুল কাজে ব্যবহৃত হয়েছে—বিশেষ করে ২০শ শতাব্দীর গণহত্যা (genocides) ইত্যাদিতে—তাই তারা এখন এটি করা থেকে বিরত থাকে। তবু, কিছু বিকল্প পদ্ধতি রয়েছে।
ডেনমার্ক (Denmark) উদাহরণস্বরূপ, তারা “পশ্চিমা (Western)” ও “অ-পশ্চিমা (non-western)” অভিবাসী পটভূমি হিসেবে মানুষকে আলাদা করে, এমনকি যদি তারা দেশটির নাগরিকও হয়। এই ‘অ-পশ্চিমা’ (non-Western) চিহ্ন সরানোর একমাত্র উপায় হলো, অন্তত একজন ডেনিশ (Danish) বা পশ্চিমা (Western) পিতা-মাতা থাকতে হবে এবং সেখানেই জন্মগ্রহণ করতে হবে। তাদের হিসেবে ৮৪% মানুষ ছিল “নেটিভ ডেনিশ (native Danish),” আর প্রায় ১০% ছিল “অ-পশ্চিমা (non-Western) বংশোদ্ভুত।”
ফ্রান্সের (France) স্ট্যাটিস্টিকস অফিস জাতিগত পটভূমি নিয়ে একটি গবেষণা প্রকাশ করেছে। সেখানে ৬০ বছরের নিচে জনগোষ্ঠীর তৃতীয় প্রজন্ম পর্যন্ত তথ্য পাওয়া যায়। মনে রাখতে হবে, এখানে যদি কারো বাবা-মা বা গ্র্যান্ডপ্যারেন্টসের (grandparents) মধ্যে একজনও অভিবাসী হন, সেও এতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। সুতরাং অভিবাসী বংশোদ্ভুত (immigrant descended) জনসংখ্যার সংখ্যা এখানে কিছুটা বাড়িয়ে দেখানোর সম্ভাবনা আছে। তথ্যানুযায়ী, প্রায় ৬৭% মানুষের পুরোপুরি স্থানীয় (fully native) বংশ ছিল; প্রায় ১৫% এর অন্তত একজন ইউরোপীয় (European) পূর্বপুরুষ (grandparent) ছিল; আর ১৭% এর অন্তত একজন নন-ইউরোপীয় (non-European) পূর্বপুরুষ ছিল।
ইউরোপের ভবিষ্যত জনসংখ্যা
এখন প্রশ্ন হল, ভবিষ্যতে এই ধারা কীভাবে এগিয়ে যাবে? আগেই উল্লেখ করেছি, অভিবাসীদের (immigrants), বিশেষ করে ইউরোপবহির্ভূত (non-European) অভিবাসীদের জন্মহার (birth rates) স্থানীয়দের (natives) তুলনায় বেশি। তাছাড়া অধিকাংশ স্থানীয় আর ইউরোপীয় অভিবাসীদের গড় বয়স তুলনামূলক বেশি, যা সামগ্রিক জনসংখ্যাকে তুলনামূলক ‘ইউরোপীয়’ (European) দেখায়। কারণ তরুণ প্রজন্ম (younger generations) আরও বৈচিত্র্যপূর্ণ (diverse)।
ভবিষ্যতে ইউরোপের জনমিতি (demographic) কেমন হবে, তা দেখতে গেলে আমাদেরকে বিভিন্ন দেশে জন্মগ্রহণকারীদের সংখ্যা (number of births) দেখতে হবে। এখানেও একই সমস্যা—অনেক দেশ এসব তথ্য প্রকাশ করে না, বা ইউরোপীয় ও অ-ইউরোপীয় (non-European) অভিবাসীকে আলাদা করে ডেটা দেখায় না। যেমন জার্মানি (Germany), ইটালি (Italy), অস্ট্রিয়া (Austria) বা সুইডেন (Sweden) তাদের পরিসংখ্যান প্রকাশ করে না, অথবা ইউরোপীয় ও নন-ইউরোপীয় (non-European) অভিবাসীদের আলাদাভাবে দেখায় না। তাই আবারও আমাদেরকে ইউকে (UK), ডেনমার্ক (Denmark), ফ্রান্স (France) আর নেদারল্যান্ডস (Netherlands) এর ডেটার উপরেই নির্ভর করতে হচ্ছে, কেননা নেদারল্যান্ডস তুলনামূলকভাবে ইউরোপীয় ও অ-ইউরোপীয় এই বিভাজন করে থাকে।
ডেনমার্কে (Denmark) দেখা যায়, জন্মের অনুপাত মোটামুটি স্থিতিশীল—অর্থাৎ অ-ইউরোপীয় জন্ম (non-European births) ডেনমার্কের জনসংখ্যায় তাদের যে অংশ তার কাছাকাছি।
নেদারল্যান্ডসে (Netherlands) অ-ইউরোপীয় জন্ম (non-European births) মোট জন্মের ১৮%; অথচ ৫৫ বছরের নিচে যারা বিদেশে জন্ম নিয়েছে অথবা বিদেশি বাবা-মা রয়েছে, তাদের অনুপাত প্রায় ১০% এর মতো। তবে এখানে আগের মতই সেই সমস্যা আছে—তৃতীয় প্রজন্ম (third generation) ঠিকমতো ধরা পড়ে না।
যুক্তরাজ্যে (UK) শ্বেতাঙ্গ (white) ও নন-শ্বেতাঙ্গ (nonwhite) জনগোষ্ঠীর মধ্যে আনুমানিক ১০% পয়েন্টের ফারাক দেখা যায় জন্মহার পরিসংখ্যানের ক্ষেত্রে। সেখানে মিশ্রিত জাতিগত (mixed race) ক্যাটাগরি অ-শ্বেতাঙ্গ (nonwhite) বৃদ্ধির অর্ধেকের বেশি অংশের জন্য দায়ী। যুক্তরাজ্যে মিশ্রিত জাতিগত (mixed race) জনগোষ্ঠী মোটের ৯% এবং এর মধ্যে ৬% হচ্ছে শ্বেতাঙ্গ ও অন্য কোন জাতির মিশ্রণ (mixed white ethnicity)।
ফ্রান্সে (France) স্থানীয় ও ইউরোপীয় বংশোদ্ভুত (native and European descended) জনগণের অনুপাত তরুণ প্রজন্মে প্রায় ১৫% কমে গেছে, তবে একই সাথে মিশ্র বংশোদ্ভুত (mixed) সন্তানের হার ৬% পয়েন্ট বেড়েছে। ফ্রান্সে তৃতীয় প্রজন্মের অভিবাসীদের (third generation immigrants) মধ্যে অনেকে মিশ্র বংশোদ্ভুত (mixed ancestry)। উদাহরণস্বরূপ, উত্তর আফ্রিকার (North African) অভিবাসীদের ৭১% ও অন্য আফ্রিকার (African) অভিবাসীদের ৮৯% মানুষেরই ১ বা ২ জন নন-নেটিভ গ্র্যান্ডপ্যারেন্টস (non-native grandparents) ছাড়া অন্যরা স্থানীয় বংশোদ্ভুত।
যেসব দেশের (যেমন জার্মানি, অস্ট্রিয়া ও সুইডেন) ডেটা পাওয়া যায়নি, সেগুলোতে অনুমান করা যায় একই ধারা বজায় আছে। বিশেষত ২০১৫ সালের পরে জার্মানি, অস্ট্রিয়া ও সুইডেনে যে বড় আকারের অ-ইউরোপীয় অভিবাসন ঘটেছে, তাতে তাদের জন্মসংখ্যার অনুপাত ফ্রান্স বা যুক্তরাজ্যের মতো বা তার থেকেও বেশি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
আরেকটি বিষয় মনে রাখতে হবে, জাতীয় (national) স্তরে যা দেখা যায়, শহর এলাকায় (cities) তার থেকে পুরোটাই ভিন্ন হতে পারে। কারণ অভিবাসীরা সাধারণত শহরে ক্লাস্টার আকারে (cluster) থাকতে পছন্দ করে। ফলে সেসব অঞ্চলে অ-ইউরোপীয় বংশোদ্ভুত (non-European descended) জনসংখ্যার শেয়ার অনেক বেশি। যেমন যুক্তরাজ্যের (UK) জাতিগত মানচিত্রে (ethnic maps) দেখা যায়, লন্ডন (London), বার্মিংহাম (Birmingham) ও লেস্টারে (Leicester) শ্বেতাঙ্গ (white) বা ইউরোপীয় (European) বংশোদ্ভুতরা সংখ্যালঘু হয়ে গেছে। ফ্রান্সের সেঁ-সাঁ-দেনি (Seine-Saint-Denis), নেদারল্যান্ডসের আমস্টারডাম ওয়েস্ট (Amsterdam West), বা জার্মানির বার্লিন (Berlin) ইত্যাদি এলাকায়ও এমন দৃশ্য দেখা যায়। তাই যারা ওই এলাকায় থাকেন, তাদের কাছে জনমিতিক পরিবর্তন (demographic shift) অনেক বেশি স্পষ্ট।
পরবর্তীতে কী ঘটবে? তাত্ত্বিকভাবে সামনে দু’টি পথ রয়েছে। একদিকে অ-ইউরোপীয় জনসংখ্যার স্বতন্ত্র সম্প্রদায় (separate and growing ethnic minorities) বাড়তে থাকায়, তারা হয়তো অধিকসংখ্যায় স্বতন্ত্র সংখ্যালঘু গোষ্ঠী হিসেবেই থাকবে। অন্যদিকে, অনেক অভিবাসী স্থানীয়দের (natives) সঙ্গে বিয়ে করে সন্তান নিতে পারে, ফলে সমাজে একটি মিশ্র জনগোষ্ঠী গড়ে উঠবে। আমরা আগেই বলেছি, যুক্তরাজ্যে (UK) মিশ্র জনগোষ্ঠীর (mixed background population) ক্রমবর্ধমান অনুপাত প্রায় ৯%, এবং ফ্রান্সে প্রায় ১২.২% জন্ম মিশ্র জাতিগত পটভূমি থেকে (mixed origin) এসেছে।
এ বিষয়ে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ মাপকাঠি হল আন্তঃবিবাহের হার (intermarriage rates)। ২০০৬ সালের একটি গবেষণায় (study) ইউরোপের সাতটি দেশে (seven European countries) অভিবাসী সম্প্রদায়ের “এক্সোগামাস বিহেভিয়র (exogamous behavior)” বা বাইরের গোষ্ঠীতে বিয়ে করার প্রবণতা দেখা হয়েছে। সেখানে দেখা যায়, দ্বিতীয় প্রজন্মের (second generation) অভিবাসীরা প্রথম প্রজন্মের (first generation) তুলনায় বেশি হারে স্থানীয় বা অন্য সম্প্রদায়ে বিয়ে করে।
তবে “কোন গোষ্ঠীর মানুষ কোথায় বিয়ে করছে”—এতে বড় ধরনের সাংস্কৃতিক (cultural) পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। সাধারণত পশ্চিমা (Western) অভিবাসীরা স্থানীয়দের সঙ্গে বিয়ে করার প্রবণতা বেশি। কিন্তু তুরস্ক (Turkey) থেকে আগত অভিবাসীদের মাঝে এ হার সবচেয়ে কম—তারা সাধারণত নিজেদের গোষ্ঠীর মধ্যেই বিয়ে করে।
অবশ্য অন্য গোষ্ঠীর মধ্যে কিছু উল্লেখযোগ্য প্রবণতা দেখা যায়। যেমন যুক্তরাজ্যে, ভারতীয় (Indian) আর ক্যারিবিয়ান (Caribbean) অভিবাসীদের মধ্যে গোষ্ঠীর বাইরে বিয়ের হার তুলনামূলক বেশি। ফ্রান্সে, উত্তর আফ্রিকার (North African) অভিবাসীরা বেলজিয়ামে (Belgium) বসবাসরত মরক্কানদের (Moroccans) তুলনায় প্রায় চার গুণ বেশি হারে স্থানীয়দের সাথে বিয়ে করে। ফ্রান্সের জাতীয় পরিসংখ্যান অফিসের (French statistics office) তথ্যমতে, প্রায় ৪০% বিয়ে স্থানীয়দের (natives) সাথে হচ্ছে। তবে এখানে আরেকটি বিষয় বিবেচ্য—চতুর্থ প্রজন্মের (fourth generation) অনেকে যেহেতু স্থানীয় (native) হিসেবে গণ্য হয়, সেক্ষেত্রে বিয়ের বাইরে আসলে দু’পক্ষই সম্ভবত অভিবাসী বংশোদ্ভুত হতে পারে, কিন্তু কাগজে-কলমে একজনকে “স্থানীয়” ধরায় আন্তঃবিবাহের হারটা বেশি দেখাতে পারে।
নেদারল্যান্ডস সরকারের (Dutch government) ২০২২ সালের আরেকটি প্রতিবেদনে দেখা যায়, মরক্কান (Moroccans) ও তুর্কিদের (Turks) মধ্যে স্থানীয়দের সাথে বিয়ে করার হার কম, কিন্তু ইন্দোনেশীয়দের (Indonesians) ক্ষেত্রে ডাচ (Dutch) নাগরিকদের সাথে বিয়ের হার অনেক বেশি।
সুতরাং, সব মিলিয়ে কী বলা যায়? অ-ইউরোপীয় জন্মের (non-European birth) উচ্চ হার ইঙ্গিত দিচ্ছে যে আগামীতে অ-ইউরোপীয় বংশোদ্ভুত (non-European descended) জনসংখ্যার অনুপাত বাড়বে। তবে ঠিক কতটা বাড়বে, তা নির্ভর করছে কয়েকটি বিষয়ের ওপর। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, অভিবাসী ও তাদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্মহার কেমন হবে এবং স্থানীয়দের জন্মহার কেমন থাকবে। যেমন নেদারল্যান্ডস ও ডেনমার্কে বিদেশী মায়েদের সন্তানের সংখ্যা স্থানীয় মায়েদের তুলনায় খুব বেশি নয়, কোনো ক্ষেত্রে সমান বা কমও হতে পারে। আবার ফ্রান্স, জার্মানি বা যুক্তরাজ্যে এটি তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি।
এছাড়াও ভবিষ্যতে অভিবাসন (immigration) কীভাবে চলবে, সেটিও বড় ফ্যাক্টর। যদি অভিবাসন আরও বাড়ে, তাহলে অবশ্যই অ-ইউরোপীয় (non-European) বংশোদ্ভুত জনসংখ্যা আরও বাড়বে।
সব মিলিয়ে একটি মিশ্র চিত্র পাওয়া যায়। ইউরোপে জনসংখ্যার ক্ষেত্রে স্পষ্টতই একটি বদল (demographic shift) ঘটছে, বিশেষ করে পশ্চিম ইউরোপে (Western Europe) বৈচিত্র্য (diversity) বাড়ছে। কিছু দেশে এসব অভিবাসী সম্প্রদায় মূল জনসংখ্যা থেকে বিচ্ছিন্ন। আবার যুক্তরাজ্য বা ফ্রান্সের মতো দেশে দেখা যাচ্ছে তারা হয়তো ধীরে ধীরে একটা মিশ্র-সাংস্কৃতিক (melting pot) রূপ নিচ্ছে, যেখানে স্থানীয় (native) ও কিছু অ-ইউরোপীয় গোষ্ঠীর মধ্যে আন্তঃবিবাহ (intermarriages) ও মেলবন্ধন তুলনামূলক বেশি। তবে এদের মধ্যে নতুন কোন মূল্যবোধ (values) গড়ে উঠবে, কিংবা সংখ্যালঘু গোষ্ঠীগুলো ইউরোপীয় মূল্যবোধকে (European values) গ্রহণ করবে, নাকি নিজেদের সংস্কৃতিকে টিকিয়ে রাখবে—সেটি এখনও উন্মুক্ত প্রশ্ন। অবশ্য, এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা অন্য আরেকটি আলোচনার বিষয়।
Leave a Reply