Table of Contents
পর্ব ০: প্রিভিউ
ভূমিকা (Intro)
হ্যালো, মনস্তত্ত্ব বা সাইকোলজি শিক্ষায় স্বাগতম। এখানে সাইকোলজির বিভিন্ন টপিক নিয়ে সাধারণ আলোচনা করা হবে, আর সেগুলো পর্বে পর্বে ভাগ করা হবে।
যাই হোক, যখন আমি এই লেখাটা লিখছি তখন আমি বসে আছি একটি নতুন চেয়ারে। আবার এখন শীতকাল বলে আমার গায়ে আছে শীতের জামা, আর এটাও আমি নতুন কিনেছি। কিন্তু আমার কাছে একটা জিনিস আছে যা মোটেও নতুন নয়: আমার মস্তিষ্ক (brain)। কারণ আমার শরীরের বেশিরভাগ কোষ (cells) সময়ের সঙ্গে বদলালেও, আমি যখন শিশু ছিলাম তখন আমার মস্তিষ্কে যে নিউরনগুলো (neurons) ছিল, এখনও সেগুলোই রয়ে গেছে। আমার মৃত্যুর আগ পর্যন্তও এগুলোই থাকবে।
আমাদের মস্তিষ্কই (brain) আসলে আমরা। এগুলো বদলে যায় না। এটাই আমাদের মন (mind)-এর সেই রহস্যময় জগৎ।
সাইকোলজি একটু বেশিই জটিল
অনেকের মতো আমিও বলতে চাই যে সাইকোলজি (psychology) আসলে রসায়ন (chemistry), জীববিজ্ঞান (biology) বা পদার্থবিজ্ঞানের (physics) মতো দৃঢ় বিজ্ঞান নয়। ঠিক আছে, এটা সত্যিই তুলনামূলক “নরম” বিজ্ঞান (softer science)। কারণ এখানে প্রবণতা (tendencies), সম্ভবনা (maybes) আর পরিসংখ্যানগত তাৎপর্য (statistical significance) নিয়ে অনেক বেশি আলোচনার সুযোগ থাকে। কেন এমন? কারণ বিষয়টা আরও বেশি জটিল।
আমাদের মস্তিষ্ক পদার্থবিজ্ঞানের অন্য সবার মতো একই সূত্র মেনে চলে। কিন্তু এর জটিলতা পুরো মহাবিশ্বের বাকি সবকিছুর সমান! (অবশ্য, পৃথিবীতে অন্যান্য অসংখ্য মস্তিষ্কও রয়েছে।)
মস্তিষ্ক বোঝার চেষ্টা
ভাবতে গেলে মনে হয়, যেহেতু সবারই একটা করে মস্তিষ্ক আছে, এবং সবসময় আমরা সেটাই ব্যবহার করছি, তাই আমরা মস্তিষ্ক বোঝার ক্ষেত্রে আমরা বেশ পটুই হবো। আমরা আমাদের ইন্দ্রিয়তন্ত্র (sensing systems) দিয়ে পৃথিবীকে জানি। তবু, দেখা যায় যে আমরা প্রায়ই আমাদের মস্তিষ্ক সম্পর্কে ভুল ধারণা পুষে রাখি! তাই আপনার মাথায় যা আছে, “সব ভুলে যান”—বিজ্ঞান (science) ঠিক সেই কারণেই এখানে আছে।
সাইকোলজির বিজ্ঞান (Science of psychology)
শুরুর দিকে সাইকোলজিস্টরা (psychologists) চেয়েছিলেন যে মানুষের মনকে (mind) “সচেতনার পরমাণু (atoms of consciousness)” হিসেবে ভাগ করে দেখা যাবে। সেটা সম্ভব নয়। তবু, নিজের মনকে সাবধানী গবেষণার মাধ্যমে আংশিক হলেও বোঝা যায়।
সেই সাথে অন্যের মনকেও বোঝা যায়! আমরা অসুস্থকে সুস্থ করতে পারি, বোঝাপড়া বাড়াতে পারি, কাজের দক্ষতা বৃদ্ধিতেও সাহায্য করতে পারি।
মন (Minds)
এর মূল কথা হল: একদল মন (minds) আরেকদল মনকে বোঝার চেষ্টা করছে। কেন আমরা কিছু করি, কেন আমরা এমন ভাবি ও অনুভব করি—এসবই জানার চেষ্টা। ফ্রয়েড (Freud) থেকে শুরু করে উন্নত স্নায়ুবিজ্ঞান বা অ্যাডভান্সড নিউরোসায়েন্স (advanced neuroscience) পর্যন্ত, সুস্থতা থেকে অবসাদ, দৈনন্দিন আচরণ থেকে অবচেতনের (subconscious) গভীর রহস্য—সবই এর অন্তর্ভুক্ত।
পর্ব ১: সাইকোলজির ভূমিকা
ভূমিকা: সাইকোলজি কী?
ডাইনোসরকে (dinosaur) জামা পরা অবস্থায় স্বপ্নে দেখা, বা এমন সব কথা বলা যা আমাদের বোঝা উচিত ছিল যে বলা ঠিক হবে না, বা এমন কথাও যা আমাদের জানা ছিল না যে আমরা বলবো! – এই সব কিছুই আমাদের চেতনার সাথে সম্পর্কিত। আমাদের চেতনার (consciousness) ছোট ছোট চাকা সবসময় ঘুরে চলেছে, আমাদের জীবন আর সমাজকে সচল রাখছে। আমরা যা করতে পেরে খুশি, আর যা না করলেই ভালো হতো—এমন সব কাজই এই চেতনার খেলা।
মানুষের মস্তিষ্ক সবকিছুকে ছাপিয়ে জটিল। এটি এমন এক বস্তু যা আমরা নিজেরাই পুরোপুরি জানি না। হয়ত আমাদের মস্তিষ্ক নিজের জটিলতা ধরতে যথেষ্ট সক্ষম নয়। কিন্তু আমরা তবু চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি!
‘সাইকোলজি (psychology)’ শব্দটি ল্যাটিন (Latin) থেকে এসেছে, যার আক্ষরিক অর্থ “আত্মার অধ্যয়ন (study of the soul)”。 সময়ের সঙ্গে এর আনুষ্ঠানিক সংজ্ঞা পাল্টেছে। আজ আমরা এটিকে “আচরণ (behavior) এবং মানসিক প্রক্রিয়ার (mental processes) বিজ্ঞান” বলে সংজ্ঞায়িত করি।
‘সাইকোলজি’ শব্দটি প্রায় ষোড়শ শতকের দিকে প্রথম ব্যবহার হয়, আর আধুনিক বৈজ্ঞানিক রূপ পায় উনিশ শতকের মাঝামাঝি এসে। যদিও প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ নিজেকে নিয়ে ভাবতে ভালবাসত। অ্যারিস্টটল (Aristotle) মানুষের চেতনার কেন্দ্রস্থল হিসেবে মনে করতেন হৃদয়কে (heart), মাথাকে (head) নয়—যা আমরা এখন জানি পুরোপুরি ভুল ধারণা।
সাইকোলজির প্রাচীন চিন্তাবিদরা
প্রায় দুই হাজার বছর আগে চীনা শাসকরা সরকারি কর্মকর্তাদের ব্যক্তিত্ব (personality) ও বুদ্ধিমত্তা (intelligence) যাচাইয়ের জন্য মানসিক পরীক্ষা নিতেন। আর অষ্টম শতকের শেষভাগে পারস্যের চিকিৎসক মোহাম্মদ ইবনে জাকারিয়া আল-রাজি (Muhammad ibn Zakariya al-Rhazes) (যিনি রাজেস (Rhazes) নামেও পরিচিত) প্রথমদিকের মানসিক অসুস্থতার (mental illness) বর্ণনা দেন এবং বাগদাদের (Baghdad) হাসপাতালে একধরনের মনোরোগ ওয়ার্ড চালাতেন।
প্রাচীন চিন্তা থেকে আজ পর্যন্ত, সাইকোলজি মূলত বড় বড় প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছে:
- কীভাবে মানুষ এত ভয়াবহ কাজ (যেমন গণহত্যা বা নির্যাতন) করতে পারে, আবার কীভাবে বুঝতে পারে এ ধরনের কাজ জঘন্য?
- আমাদের কি স্বাধীন ইচ্ছা (free will) আছে, নাকি আমরা পুরোপুরি পরিবেশ (environment), জীববিজ্ঞান (biology) আর অবচেতন প্রভাব (non-conscious influences) দ্বারা চালিত?
- মানসিক অসুস্থতা (mental illness) কী, আর আমরা কীভাবেই বা এটি প্রতিকার করতে পারি?
- চেতনা (consciousness) বলতে আসলে কী বোঝায়? আর আত্ম বা সেলফ এর ধারণা (notion of self) আসলে কী? আমি যদি নিজের চেতনা হারাই, তাহলে কি আমি মানুষ থাকি?
সামনের বেশ কিছু পর্ব জুড়ে আমরা একসঙ্গে এ ধরনের প্রশ্নের জবাব খোঁজার চেষ্টা করব: কীভাবে মস্তিষ্ক কাজ করে, কীভাবে এটি বিগড়ে যায়, কীভাবে এটিকে সারানো যায়, কেন আমরা এমন আচরণ করি যা আমরা নিজেরাও চাই না, আর কী মানে বেঁচে থাকা, অনুভব করা, ভাবা এবং মানুষ হওয়ার।
ফ্রয়েডের (Sigmund Freud) প্রসঙ্গ
“সাইকোলজি” শব্দটি শুনলে অনেকেরই প্রথম যে ছবিটা ভেসে ওঠে, তা হল একজন থেরাপিস্ট (therapist) সোফায় (couch) শোয়া রোগীর (patient) কথা শুনছেন। হয়ত তার চোখে চশমা (glasses), মুখে সিগার (cigar), হাতে গোঁফের (whiskered) ছোঁয়া! অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আমরা সাইকোলজি ভাবতেই সিগমুন্ড ফ্রয়েড (Sigmund Freud)-এর কথা মনে করি। তিনি ছিলেন সবসময়ের মধ্যে অন্যতম প্রভাবশালী এবং বিতর্কিত চিন্তাবিদ। তিনি আমাদের শৈশব (childhood), ব্যক্তিত্ব (personality), স্বপ্ন (dreams), যৌনতা (sexuality) সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলতে সাহায্য করেছেন। তার কাজ বিস্তর সমর্থন ও বিরোধ—দুই-ই পেয়েছে।
ফ্রয়েডের দীর্ঘ জীবনজুড়ে ঘটে গেছে নানা ঐতিহাসিক ঘটনা: আমেরিকান সিভিল ওয়ার (American Civil War) থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ (World War II) পর্যন্ত। অনেক বড় বিজ্ঞানীর মতো তিনিও আগের কাজের ভিত্তিতে নিজের চিন্তা গড়ে তুলেছিলেন, আর তার পরে বিজ্ঞান কিন্তু থেমে যায়নি।
সাইকোলজির বিভিন্ন শাখা (Disciplines of Psychology)
আসলে সাইকোলজি (psychology) হলো বহুমুখী প্রশ্নের সমাহার, যেখানে নানা পদ্ধতি আর বিভিন্ন চিন্তাধারা মিশে আছে। এটা ঠিক যেন একটা বিশাল মেল্টিং পট (melting pot)।
ফ্রয়েডের সময়ের আশেপাশেই মানুষের মন নিয়ে গবেষণার ভিন্ন ভিন্ন ধারা গড়ে উঠেছিল: স্ট্রাকচারালিজম (structuralism), ফাংশনালিজম (functionalism), আর সাইকোএনালাইসিস (psychoanalysis)।
স্ট্রাকচারালিজম (Structuralism)
বৈজ্ঞানিক সাইকোলজির আনুষ্ঠানিক পথচলা শুরু হয় ১৮৭৯ সালে, জার্মানিতে (Germany), যখন উইলহেম ভুন্ড্ট (Wilhelm Wundt) লাইপজিগ (Leipzig) বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম সাইকোলজি ল্যাব প্রতিষ্ঠা করেন। এর কয়েক বছর আগেই তিনি তাঁর Principles of Physiological Psychology প্রকাশ করেন, যা প্রথম সত্যিকারের সাইকোলজি পাঠ্যপুস্তক হিসেবে বিবেচিত।
ভুন্ড্ট এবং তাঁর শিক্ষার্থী এডওয়ার্ড ব্র্যাডফোর্ড টিচেনার (Edward Bradford Titchener) রসায়নবিদ আর পদার্থবিদদের কাছ থেকে ধারণা নিয়েছিলেন। যেমন ওরা পদার্থকে সহজ মৌলিক উপাদানে ভেঙে ফেলে, তেমনি আমরাও কি মস্তিষ্ককে (brain) ভেঙে দেখতে পারি না?
তারা চেতনার (consciousness) কাঠামো ধরতে চেয়েছিলেন অন্তরদর্শন বা ইনট্রোস্পেকশন (introspection)-এর মাধ্যমে। মানুষকে জিজ্ঞেস করা হতো, “সূর্যাস্ত দেখে বা কফির গন্ধ পেয়ে বা বিড়ালের বাচ্চা তোমাকে চাটলে বা লেহন করলে তোমার কী অনুভূতি হয়?”
টিচেনার তার এই পদ্ধতির নাম দেন “স্ট্রাকচারালিজম (structuralism)”, কিন্তু নামের মতো এটি ততটা ‘ব্যবস্থাপ্রণালীগত’ ছিল না। বরং এটি এতটাই অন্তরদর্শনের উপর নির্ভরশীল ছিল যে শেষ পর্যন্ত এটা খুবই আত্মনির্ভর হয়ে উঠল। কারণ একই ঘটনা (যেমন একই বিড়ালের বাচ্চার লেহন) ভিন্ন মানুষ ভিন্নভাবে অনুভব করতেই পারে। আর একজনের মনের ভেতর ঠিক কী ঘটছে, তা প্রত্যক্ষ করা সম্ভব নয়। এ কারণে স্ট্রাকচারালিজম বেশিদিন স্থায়ী হয়নি।
ফাংশনালিজম (Functionalism)
স্ট্রাকচারালিজমের বিপরীতে আমেরিকান চিকিৎসক ও দার্শনিক উইলিয়াম জেমস (William James) অন্য ধরনের প্রশ্ন তুলেছিলেন: কেন আমরা ভাবি, অনুভব করি, গন্ধ পাই বা এমন সব কাজ করি (যেমন কিছু লেহন) — এটার কাজ কী? চার্লস ডারউইনের (Charles Darwin) অভিযোজনমূলক আচরণ (adaptive behavior) ধারণার ওপর ভিত্তি করে জেমসের নতুন মতবাদ ছিল ফাংশনালিজম (functionalism)। অর্থাৎ, কোনো আচরণের কার্যকর দিকটি প্রজন্মান্তরে টিকে থাকে।
১৮৯০ সালে জেমস তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ The Principles of Psychology প্রকাশ করেন, যেখানে তিনি সাইকোলজিকে “মানসিক জীবনের বিজ্ঞান (science of mental life)” বলে বর্ণনা করেন। এদিকে ঠিক তখনই ফ্রয়েড (Freud) নিজেও তাঁর মৌলিক চিন্তা সামনে আনছিলেন।
সাইকোএনালাইসিস (Psychoanalysis)
সিগমুন্ড ফ্রয়েড তাঁর চিকিৎসাজীবন শুরু করেন ভিয়েনায় (Vienna) একটি হাসপাতালে। কিন্তু ১৮৮৬ সালে তিনি স্নায়বিক সমস্যায় (nervous disorders) বিশেষজ্ঞ হিসেবে নিজের ব্যক্তিগত চেম্বার চালু করেন। সেই সময়ে, ফ্রয়েড তাঁর সহকর্মী যোজেফ ব্রেয়রের (Josef Breuer) এক রোগী “আনা ও (Anna O)”র “টকিং কিওর (talking cure)” পদ্ধতি দেখতে পান। তাঁর লক্ষণগুলো নিয়ে আনা ও যখন খোলামেলা কথা বলতেন, তখন দেখা যেত তাঁর নানা উপসর্গ কমে আসে।
ফ্রয়েড এটা দেখে মুগ্ধ হন। এরপর থেকে তিনি রোগীদের “ফ্রি অ্যাসোসিয়েশন (free association)” পদ্ধতিতে মুক্তভাবে কথা বলতে উৎসাহ দিতেন। এটাই তাঁর পুরো ক্যারিয়ারের ভিত্তি তৈরি করে এবং এর থেকেই একটা বৃহৎ সাইকোলজির ধারা জন্ম নেয়।
১৯০০ সালে তিনি The Interpretation of Dreams বইটি প্রকাশ করেন, যেখানে তিনি সাইকোএনালাইসিস (psychoanalysis) মতবাদ তুলে ধরেন। আমরা প্রায়ই সাইকোএনালাইসিসকে থেরাপি (therapy) হিসেবে ভাবি—রোগী সোফায় শুয়ে কথা বলছে। এটা অবশ্যই এর একটা বড় দিক, তবে ফ্রয়েডের ধারণাটি ছিল অনেক বিস্তৃত।
সাইকোএনালাইসিসের কেন্দ্রীয় বক্তব্য: আমাদের ব্যক্তিত্ব (personality) অজানা অবচেতন (unconscious motives) দ্বারা পরিচালিত। অর্থাৎ আমরা এমন সব মানসিক প্রক্রিয়ায় প্রভাবিত হচ্ছি, যার সম্পর্কে আমরা নিজেরাই ওয়াকিবহাল নই। ১৯০০ সালে এটা ছিল একেবারেই অস্বাভাবিক, আজকের দিনে যতটা স্বাভাবিক শোনাচ্ছে তখন কিন্তু তা ছিল না।
আরো গুরুত্বপূর্ণ হলো, ফ্রয়েড বললেন অবচেতন (unconscious) সত্ত্বেও সেটাকে খুঁজে বের করা সম্ভব। আমরা স্বপ্ন (dreams), প্রজেকশন (projection) বা ফ্রি অ্যাসোসিয়েশন-এর মাধ্যমে সেই চেপে রাখা অনুভূতিগুলোকে বের করে আনতে পারি এবং নিজেকে বুঝতে পারি।
অর্থাৎ, মানসিক রোগ (mental disorders) কথা বলার থেরাপি (talk therapy) ও আত্ম-অনুসন্ধানের (self-discovery) মাধ্যমে সারানো সম্ভব। এটি ছিল বিশাল এক অগ্রগতি। এর আগে মানুষকে স্রেফ পাগলাগারদে (sanatorium) আটকে রাখা হতো, সর্বোচ্চ যা করা হতো তা হলো ছোটখাটো কাজ দেওয়া বা বিছানায় আটকে রাখা।
ফ্রয়েডের মৃত্যু ও উত্তরাধিকার (Freud’s Death & Legacy)
The Interpretation of Dreams প্রকাশের পরে, ফ্রয়েড প্রায় ২০টিরও বেশি বই আর অসংখ্য পেপার প্রকাশ করেন। আর এই সময়টাতে তাঁর বিখ্যাত সিগার (cigar) হাতে থাকতো সবসময়। ধূমপান তাঁকে ভাবতে সাহায্য করতো বলে বিশ্বাস করলেও, শেষ পর্যন্ত এটি তাঁর চোয়ালের ক্যানসার (jaw cancer) ডেকে আনে। শেষ ১৬ বছরে তিনি অন্তত ৩০টি কষ্টকর অপারেশন করান, তবু ধূমপান ছাড়েননি।
১৯৩০-এর শেষভাগে নাৎসিরা (Nazis) অস্ট্রিয়া দখল করলে ফ্রয়েড ও তাঁর ইহুদি পরিবার অল্পের জন্য পালিয়ে ইংল্যান্ডে আশ্রয় নেন। ১৯৩৯ সালের সেপ্টেম্বরে চোয়ালের প্রচণ্ড যন্ত্রণায় তিনি তাঁর ডাক্তার বন্ধুর সহায়তায় মরফিন (morphine) ইনজেকশনের মাধ্যমে আত্মহত্যার পথ বেছে নেন। তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৩।
ফ্রয়েডকে হয়তো কেউ খুব ভালোবাসে, কেউবা ঘৃণা করে—কিন্তু তাঁর প্রভাব ছিল তুলনাহীন। অনেক চিন্তাধারা সময়ের সঙ্গে ফিকে হয়ে গেলেও বা বদলে গেলেও, তাঁর সাইকোএনালাইসিস (psychoanalysis) এখনো সাইকোলজিতে গুরুত্বপূর্ণ।
বিহেভিয়রিজম (Behaviorism)
পরবর্তী বড় পরিবর্তন আসে বিশ শতকের প্রথমার্ধে, যখন বিহেভিয়রিজম (behaviorism) জনপ্রিয়তা পায়। ইভান পাভলোভ (Ivan Pavlov), জন বি. ওয়াটসন (John B. Watson) আর বি. এফ. স্কিনার (B. F. Skinner) ছিলেন এর বড় নাম। ওরা পর্যবেক্ষণযোগ্য আচরণ (observable behavior) নিয়ে কাজ করতেন। স্কিনারের বিখ্যাত কাজ হলো ইঁদুর, পায়রা আর শিশুদের নির্দিষ্ট বাক্সে রেখে শিখিয়ে-কন্ডিশন করে এমন সব আচরণ করানো। ফ্রয়েড যখন নাৎসিদের হাত থেকে বাঁচতে ইংল্যান্ডে পাড়ি জমান, স্কিনার তখন তাঁর Behavior of Organisms বইটি প্রকাশ করেন, যার মধ্য দিয়ে বিহেভিয়রিজমের স্বর্ণযুগ শুরু হয় এবং তা ১৯৬০-এর দশক পর্যন্ত বেশ জনপ্রিয় ছিল।
সাইকোডাইনামিক তত্ত্ব (Psychodynamic Theories)
ওই সময়ের আরেকটি বড় শক্তি ছিল ফ্রয়েডের সাইকোএনালাইসিস (psychoanalysis) এবং এর নানা অনুসারী মতবাদ, যেগুলিকে একত্রে সাইকোডাইনামিক তত্ত্ব (psychodynamic theories) বলা হয়। এরা মূলত শৈশবের অভিজ্ঞতা কীভাবে অবচেতনকে তৈরি করে এবং সেখান থেকে আমাদের ভাবনা, অনুভূতি, আচরণ ও ব্যক্তিত্ব (personality) গড়ে ওঠে—সেটা ব্যাখ্যা করে।
সাইকোলজির অন্যান্য ধারা (Disciplines)
একই সময়ে আরও কিছু বড় বড় মতবাদ গড়ে উঠছিল—যেমন হিউম্যানিস্ট সাইকোলজি (humanist psychology), যা ব্যক্তিগত বিকাশের (personal growth) ওপর গুরুত্ব দেয়; কগনিটিভ সায়েন্স (cognitive science) আর নিউরোসায়েন্স (neuroscience), যেগুলো মানুষের মন নিয়ে আরও ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি যোগ করেছে।
আজকের সাইকোলজির আনুষ্ঠানিক সংজ্ঞা—“আচরণ (behavior) ও মানসিক প্রক্রিয়ার (mental processes) অধ্যয়ন”—আসলে এসব দৃষ্টিভঙ্গির মিশ্রণ। এটি স্বীকার করে যে আমাদের দৃশ্যমান আচরণ (observing and recording behavior) যেমন কান্না, চিৎকার বা কল্পিত স্যাক্সোফোন বাজানো গুরুত্বপূর্ণ, ঠিক তেমনি আমাদের অভ্যন্তরীণ ভাবনা, অনুভূতি আর বিশ্বাসও (যখন আমরা আমাদের কল্পিত বাদ্যযন্ত্র বাজাচ্ছি) ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ।
এ কারণেই সাইকোলজি (psychology) একটি সমন্বিত বিজ্ঞান (integrative science)। মানুষ এখনও বিভিন্ন মতবাদ নিয়ে দ্বিমত পোষণ করে বটে, কিন্তু আসল ব্যাপারটা হলো মনের জটিলতাকে বুঝতে আমাদের নানাভাবে প্রশ্ন তুলতে হয় এবং তথ্য (data) সংগ্রহের বিভিন্ন পদ্ধতি প্রয়োগ করতে হয়।
মানব মস্তিষ্কের অসাধারণ জটিলতা
হার্ভার্ডের জ্যোতির্বিজ্ঞানী (Harvard astronomer) ওয়েন জিঞ্জেরিচ (Owen Gingerich) মহাকাশের দূর দিগন্ত পর্যবেক্ষণ করেছেন। তিনি স্বীকার করেছেন যে আমাদের পরিচিত মহাবিশ্বে সবচেয়ে জটিল পদার্থিক বস্তু হলো মানব মস্তিষ্ক (human brain)। আর আমরা প্রত্যেকেই একটা করে মস্তিষ্ক সাথে নিয়ে ঘুরছি!
আমরা এখানে সামনের কয়েক পর্বে এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করব—কীভাবে সাইকোলজি আমাদের জীবন, মন আর আবেগকে প্রভাবিত করে, কীভাবে এটা আমাদেরকে একে অপরকে, আমাদের জগৎকে, আর নিজেকেও আরও গভীরভাবে বুঝতে সাহায্য করে।
Leave a Reply