চীন তাদের সামরিক ব্যয় নিয়ে মিথ্যা বলছে

ভূমিকা

চীনের কমিউনিস্ট পার্টি (Chinese Communist Party) তাদের প্রতিরক্ষা খাতে (defense spending) আসল অঙ্কের চেয়ে অনেক বেশি ব্যয় করছে, অথচ তারা সঠিক তথ্য প্রকাশ করছে না। ২০২৪ সালের ৫ মার্চ, চীন ঘোষণা করে যে তারা তাদের সামরিক বাজেট প্রায় ২৩০ বিলিয়ন ডলার নির্ধারণ করেছে। এটি গত বছরের তুলনায় ৭% বেশি বৃদ্ধি। তবে তারা দাবি করে যে এটি যুক্তরাষ্ট্রের (United States) ৮৪০ বিলিয়ন ডলারের প্রতিরক্ষা ব্যয়ের মাত্র ২৫%। অনেকেই বলে থাকেন যে আমেরিকা একাই বিশ্বের পরবর্তী ১০টি দেশের মিলিত প্রতিরক্ষা ব্যয়ের চেয়ে বেশি খরচ করে। কিন্তু এতে কি পুরো চিত্রটা স্পষ্ট হয়? বিশ্লেষকরা বহুদিন ধরে বলে আসছেন যে চীনের আসল প্রতিরক্ষা ব্যয় তাদের ঘোষিত সংখ্যার চেয়ে বহুগুণ বেশি। কেন এবং কীভাবে তারা এই ব্যয় লুকিয়ে রাখছে—ঠিক সেই বিষয়টি নিয়েই এখানে আলোচনা করব। সবশেষে আমি একটি আনুমানিক অঙ্ক হাজির করব, যা দেখে আপনি অবাক হবেন।

এটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ, চীনের সত্যিকারের সামরিক ব্যয় কতটা, তার ওপর তাদের সামরিক ক্ষমতার (military power) বাস্তব দৃশ্য অনেকখানি নির্ভর করে। একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা ব্যয়ের হিসাবকেও এটি সরাসরি প্রভাবিত করে।

সরকারি ঘোষণা বনাম বাস্তবতা: কী দাবি করছে চীন?

  • সরকারি ঘোষণা
    ২০২৪ সালের ৫ মার্চ চীন জানায়, তাদের প্রতিরক্ষা বাজেট প্রায় ২৩০ বিলিয়ন ডলার। ২০২৩ সালের তুলনায় এটি ৭% বেশি।
  • যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তুলনা
    যুক্তরাষ্ট্রের ২০২৪ সালের প্রতিরক্ষা বাজেট প্রায় ৮৪০ বিলিয়ন ডলার। চীনের দাবি অনুযায়ী, তাদের বাজেট যুক্তরাষ্ট্রের ব্যয়ের মাত্র ২৫%।

কিন্তু বিভিন্ন গবেষণা ও বিশ্লেষক মন্তব্য করছেন যে, এই ঘোষিত বাজেট চীন ইচ্ছাকৃতভাবে কম দেখায়। কয়েকটি প্রধান কারণ রয়েছে:

  • ১) সামরিক ব্যয় অন্য খাতে দেখানো।
  • ২) তথ্য স্বচ্ছ না রেখে অস্পষ্টভাবে উপস্থাপন করা।
  • ৩) ক্রয়ক্ষমতার সমতা (Purchasing Power Parity, সংক্ষেপে PPP) ঠিকমতো বিবেচনা না করা।
  • ৪) সামরিক দিকের কিছু খরচ সরাসরি প্রতিরক্ষা বাজেটে না দেখিয়ে আলাদা সংস্থার মাধ্যমে করা।

কেন পারচেজিং পাওয়ার প্যারিটি (PPP) গুরুত্বপূর্ণ

PPP-কে সহজভাবে বোঝাতে গেলে বলা যায়, এক ডলার দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে যা কেনা যায়, চীনে সেই এক ডলার সমমূল্যের অর্থ দিয়ে তার চেয়ে বেশি কিছু কেনা সম্ভব। অর্থাৎ, একই অঙ্কের টাকা চীনে অনেক দূর এগিয়ে যায়। উদাহরণস্বরূপ যুক্তরাষ্ট্রে ১ ডলারে আপনি হয়তো মাত্র একটি পানীয় (সম্ভবত “রিপ ইট” [Rip It] নামের এনার্জি ড্রিংক) কিনতে পারবেন। কিন্তু চীনে ১ ডলারের সমমূল্যের ইউয়ানে (Yuan) আপনি সেই পানীয় এবং স্ন্যাকস দুই-ই কিনতে পারেন। সুতরাং, চীনের সামরিক বাজেটকে PPP অনুযায়ী সমন্বয় করলে দেখা যায়, তাদের প্রকৃত সক্ষমতা যুক্তরাষ্ট্রের ঘোষিত সামরিক ব্যয়ের তুলনায় অনেক বেশি।

পেন্টাগনের (Pentagon) চায়না মিলিটারি পাওয়ার রিপোর্ট (China Military Power Report) অনুযায়ী, চীন তাদের সামরিক ব্যয় ব্যাপকভাবে কম দেখায়। আমেরিকান এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউট (American Enterprise Institute, সংক্ষেপে AEI)-এর গবেষণায়ও উঠে আসে একই কথা। তারা দেখিয়েছে যে,

  • সামরিক সরঞ্জাম (equipment) খাতে চীনের অফিসিয়াল ৮৫ বিলিয়ন ডলার PPP হারে সমন্বয় করলে ১৩৫ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছায়।
  • প্রশিক্ষণ (training) ও রক্ষণাবেক্ষণ (maintenance) খাতে ৭৬ বিলিয়ন ডলার সমন্বয় করলে ১২১ বিলিয়ন ডলারে গিয়ে দাঁড়ায়।
  • ব্যক্তিগত (personnel) খাতে ৬৮ বিলিয়ন ডলার ঠিকমতো সমন্বয় করলে ২৯৩ বিলিয়ন ডলার হয়, যা প্রায় চার গুণ বেশি!

এই বিশ্লেষণগুলো স্পষ্ট করে যে PPP যোগ করলে চীনের সামরিক ব্যয়ের আকার অনেকটাই বড় হয়। তবে একই সঙ্গে বড় প্রশ্ন থেকে যায়—চীন যে সরঞ্জাম বা প্রযুক্তি (যেমন: ফাইটার জেট) কিনছে, সেগুলো কি একই মানের, নাকি গুণগতমান কম? তাই শুধু PPP দিয়ে পুরো চিত্র বোঝা যায় না। তা সত্ত্বেও, চীনের সামরিক ক্ষমতা ও বাজেটের পূর্ণাঙ্গ মূল্যায়নে PPP অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

চীনের বাজেটের ফাঁকফোকর: কী বাদ পড়ে থাকে?

পেন্টাগন তার বার্ষিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে যে, চীনের সরকারি বাজেটে অনেক ব্যয় উহ্য থেকে যায়। যেমন—

পিপলস আর্মড পুলিশ (People’s Armed Police, সংক্ষেপে PAP): চীনের কেন্দ্রীয় সামরিক কমিশন (Central Military Commission, সংক্ষেপে CMC) সরাসরি নিয়ন্ত্রণ করে এই বাহিনীকে। কিন্তু সরকারি প্রতিরক্ষা বাজেটে এদের ব্যয় অন্তর্ভুক্ত করা হয় না। অথচ এই বাহিনীর কাজ ও কাঠামো দেখে অনেকেই এটিকে চীনের ‘ছদ্ম সামরিক বাহিনী’ বলে আখ্যায়িত করেন।

পিপলস আর্মড পুলিশ দেখতে অনেকটা সামরিক বাহিনীর বিশেষ বাহিনীর (Special Forces) মতোই সজ্জিত। তাদের সদস্য সংখ্যা প্রায় ১.২ মিলিয়ন। যদিও কাগজে-কলমে তাদের কাজ ‘অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা রক্ষা’, কিন্তু বিশাল পরিসরের ও সুসজ্জিত একটি বাহিনীর যে ক্ষমতা, তাতে এটিকে নিছক পুলিশ-শক্তি না বলে ‘প্যারামিলিটারি ফোর্স’ বলা উচিত। এই বাহিনীর অধীনে রয়েছে মেকানাইজড ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশন (mechanized infantry unit) এবং দ্রুত মোতায়েন-যোগ্য হালকা মোটরচালিত পদাতিক ইউনিট (rapid deployment light motorized infantry unit) — এটি যে-কোনো বড় সংঘাতে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে পারে। অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার নামে এই বাহিনীর কাজ হলো সশস্ত্র বিদ্রোহ বা সেনাবাহিনীর (PLA) ভেতরে কোনো বিদ্রোহ হলেও তা দমন করা।২০১৬ সালের সামরিক সংস্কারের পর PAP সরাসরি CMC-এর অধীনে চলে আসে, যা স্পষ্টতই তাদের সামরিক সম্পর্ককে প্রমাণ করে।

উল্লেখযোগ্য যে, চীনা স্থলবাহিনীর (PLA Army) সক্রিয় সদস্য প্রায় ১ মিলিয়ন, যা PAP-এর চেয়েও কম। অনেক সাবেক PLA সৈন্যকে PAP-তে স্থানান্তর করা হয়েছে। ফলে এটি কার্যত PLA-এর একটি ছায়া বাহিনী হিসেবেই গণ্য হতে পারে।

অবকাঠামোগত (infrastructure) প্রকল্প: চীনের “বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (Belt and Road Initiative, সংক্ষেপে BRI)” এর অধীনে ১ ট্রিলিয়ন ডলারেরও বেশি বিনিয়োগ হয়েছে, যা সামরিক কাজেও ব্যবহারযোগ্য—বিশেষ করে বন্দর ও ট্রেন নেটওয়ার্ক নির্মাণে, যা সৈন্য-পরিবহন ও সামরিক সরঞ্জাম পরিবহনে কাজে লাগে।

চীনের ১ ট্রিলিয়ন ডলারের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের বড় অংশই দ্বৈত ব্যবহারের (dual-use) লক্ষ্য নিয়ে তৈরি করা। যেমন, যেসব রেলপথ, সড়ক বা বন্দর তৈরি হচ্ছে, সেগুলো বাণিজ্যিক কাজের পাশাপাশি বড় আকারে সামরিক বাহিনীর troop movement বা সরঞ্জাম পরিবহনেও কাজে লাগতে পারে। আবার আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্য সহ বিভিন্ন অঞ্চলে চীন সামরিক লজিস্টিক সুবিধা (military logistics) প্রতিষ্ঠা করছে, যেমন জিবুতিতে (Djibouti) সামরিক ঘাঁটি।

সরকারি তথ্যের বাইরে থেকে অর্থের যোগান ও সহযোগিতার অনেক অংশই সামরিক বাজেটে সরাসরি দেখানো হয় না। ফলে চীনের প্রকৃত সামরিক সক্ষমতা সম্পর্কে ভুল ধারণা তৈরি হতে পারে।

চীনের প্রতিরক্ষা ব্যয়ের পুনর্বিন্যাস: কেন এটি গুরুত্বপূর্ণ?

যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় ৪০% প্রতিরক্ষা বাজেটই লোকবলের বেতন, সুযোগ-সুবিধা ও পরিচালন-ব্যয় (overhead) হিসেবে ব্যয় হয়। কিন্তু চীনে এই খরচ অনেক কম। উদাহরণস্বরূপ, ১৮ বছর বয়সী একজন নিম্নপদস্থ PLA সৈন্য (lower enlisted soldier) মাসে মাত্র ১০৮ ডলার উপার্জন করে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রে একই স্তরের সৈন্য মাসে কমপক্ষে ১,৭০০ ডলার বা তার বেশি পান (অন্যান্য ভাতা ও সুযোগ-সুবিধা মিলিয়ে)। ক্রয়ক্ষমতার সমতা বিবেচনায় নিলেও দেখা যায়, একজন চীনা নিম্নপদস্থ সৈন্য এখনো একজন আমেরিকান সৈন্যের তুলনায় প্রায় তিনগুণ কম বেতন পান।

চীন সৈন্যদের স্বাস্থ্যসেবা বা অন্যান্য ভাতা খুব কম দেয়। এর ফলে তারা সেই অর্থ গবেষণা, উন্নয়ন এবং নতুন অস্ত্র বা সরঞ্জাম কেনায় (modernization) বেশি বিনিয়োগ করতে পারে। তাই পরিসংখ্যান দিয়ে শুধু বাজেট তুলনা করলে বিভ্রান্তি তৈরি হতে পারে।

চীনের কোস্ট গার্ড (Chinese Coast Guard): আরেকটি ছদ্ম সামরিক শাখা

২০১৮ সালে চীনের কোস্ট গার্ড (CCG) সরাসরি পিপলস আর্মড পুলিশের (PAP) অধীনে আসে। ফলে সরকারি প্রতিরক্ষা বাজেটে এদের বরাদ্দও অন্তর্ভুক্ত নয়। অথচ এরা আকারে ও সক্ষমতায় অনেক দেশের নৌবাহিনীর (Navy) কাছাকাছি।

চীনের কোস্ট গার্ডের ৫০০টির বেশি জাহাজ রয়েছে, যার মধ্যে ১,০০০ টনের ওপর ধারণক্ষমতা সম্পন্ন ১২০টি জাহাজ। তুলনায় যুক্তরাষ্ট্রের কোস্ট গার্ডে রয়েছে ২৪৩টি কাটার (cutter)। চীনা কোস্ট গার্ড দক্ষিণ চীন সাগরে (South China Sea) বারবার আন্তর্জাতিক বিরোধে জড়িয়ে পড়েছে। অনেক সময় সরাসরি নৌবাহিনীর মতোই তারা শক্তি প্রদর্শন করে। CCG-এর প্রায় ৪০,০০০ সক্রিয় সদস্য আছে এবং এরা নৌবাহিনীর পুরনো ফ্রিগেট (frigate) ও করভেট (corvette) সংগ্রহ করে নিজেদের রণক্ষমতা আরও বাড়িয়েছে। ২০২৩ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত তারা নৌবাহিনী থেকে ২২টি টাইপ ৫৬ করভেট পেয়েছে।

এসব মিলিয়ে দেখলে সহজেই বোঝা যায়, কোস্ট গার্ডটিও মূলত সামরিক বাহিনীর একটি সম্প্রসারিত অংশ। কিন্তু সরকারি হিসেবে এগুলো প্রতিরক্ষা বাজেটের বাইরেই থেকে যায়।

অন্যান্য অদৃশ্য সামরিক ব্যয়

  • মহাকাশ কর্মসূচি (Space Program): চীনের মহাকাশ বাজেট খুবই গোপনীয়। সামরিক স্যাটেলাইট বা অ্যান্টি-স্যাটেলাইট সক্ষমতার (counter space capability) মতো ব্যয়গুলো সাধারণ বাজেটে দেখানো হয় না। তাদের সামরিক-বেসামরিক সংযুক্তি (military-civil fusion) নীতির কারণে মহাকাশ গবেষণার অনেক অর্থই সামরিক খাতে যায়। ২০১৩ সালে চীনের মহাকাশ বাজেট ছিল ১০ বিলিয়ন ডলার। ২০২২ সালের মধ্যে এটি দ্বিগুণ হয়ে ২১ বিলিয়ন ডলারে গিয়ে পৌঁছাতে পারে।
  • অবসরভাতা ও পেনশন (demobilization, retirement, pensions): চীনে এই খাতগুলো প্রতিরক্ষা বাজেটের বাইরে, ‘মিনিস্ট্রি অব সিভিল অ্যাফেয়ার্স’-এর (Ministry of Civil Affairs) মাধ্যমে পরিচালিত হয়। স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট (SIPRI) অনুমান করেছে যে, ২০১৯ সালে এই ব্যয় ছিল ৩৫.৮ বিলিয়ন ডলার।
  • সামরিক গবেষণা ও উন্নয়ন (Military R&D): চীনের প্রতিরক্ষা বাজেটে সামরিক R&D-এর কোনো সুস্পষ্ট উল্লেখ নেই। অথচ আমেরিকায় এই খাতে ২০২২ সালে প্রায় ১১৮ বিলিয়ন ডলার ব্যয় হয়েছে, যা মোট প্রতিরক্ষা বাজেটের ২০%। চীনের রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ ও সাইবার গুপ্তচরবৃত্তির (cyber espionage) পরিমাণে বোঝা যায়, আসলে এ খাতে তাদের ব্যয়ও অনেক বিশাল।

সামরিক গবেষণা ও উন্নয়ন (R&D) প্রবণতা

চীনের সামরিক গবেষণা ও উন্নয়ন খাতের তথ্যগুলো যেহেতু খুব গোপন, কোনো কেন্দ্রীয় তথ্যভান্ডারে এগুলো সেভাবে প্রকাশিত হয় না। এর বাইরে—

  • আগের গবেষণায় দেখা গেছে, চীনের কেন্দ্রীয় সরকারের R&D ব্যয়ের ৪৫.৩% বিভিন্ন অস্পষ্ট সংস্থায় (non-disclosed agencies) যায়, যা সম্ভবত সামরিক উদ্দেশ্যেই খরচ হয়।
  • চীনা কর্তৃপক্ষ সাইবার চুরি ও গুপ্তচরবৃত্তির মাধ্যমে বিদেশি প্রযুক্তি চুরি করে R&D খরচ আরও কমিয়ে আনতে পারে। ফলে তারা অপেক্ষাকৃত কম বিনিয়োগ করেও বড় অর্জন করে ফেলে।

এ কারণে অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন, চীনের অফিসিয়াল বাজেটে R&D বরাদ্দের অঙ্ক শূন্য দেখানো হলেও বাস্তবে এটি অনেক বড়, যা সামরিক সক্ষমতা বাড়াতে বিশেষ ভূমিকা রাখছে।

আমেরিকা বনাম চীনের সামরিক ব্যয়ের প্রকৃত তুলনা

প্রচলিত ধারণা বলে, যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের অন্য সব দেশের চেয়ে বেশি সামরিক ব্যয় করে—যা পরবর্তী ১০টি দেশের সম্মিলিত ব্যয়ের সমান। কিন্তু আমরা যদি চীনের প্রকৃত ব্যয় বিবেচনা করি, দেখা যাবে পার্থক্য অতটা বিস্তর নয়।

  • এআই (AEI)-এর মতে সম্ভাব্য প্রকৃত অঙ্ক: চীনের প্রকৃত সামরিক ব্যয় হতে পারে ৫৪৯ বিলিয়ন ডলার, যা সরকারি ঘোষিত ২২৯ বিলিয়নের দ্বিগুণেরও বেশি। এটি আমেরিকার ৮৪০ বিলিয়নের প্রায় ৭৫%। চীনের দাবি করা ২৫%-এর তুলনায় এটি অনেক বেশি বাস্তবসম্মত।
  • অন্য গবেষণার মতে: এম. টেলর ফ্রাভেল (M. Taylor Fravel), এমআইটি-এর (MIT) সিকিউরিটি স্টাডিজ প্রোগ্রামের পরিচালক, ধারণা করছেন ২০২৪ সালে চীনের সামরিক ব্যয় প্রায় ৪৭১ বিলিয়ন ডলার। অন্যদিকে SIPRI প্রায় ২৯২ বিলিয়ন ডলারের কথা বলেছে। এআই (AEI)-এর হিসাব অনেক বেশি, ফলে অনেকে মনে করেন তারা ইচ্ছাকৃতভাবে বড় করে দেখাচ্ছে, যাতে আমেরিকা চীনকে মোকাবিলায় আরও বেশি ব্যয় করে।

কিন্তু যা-ই হোক, এটুকু অন্তত নিশ্চিত বলা যায় যে, চীনের প্রকৃত সামরিক ব্যয় এশিয়ার অন্য সব দেশ—যেমন ভারত, রাশিয়া, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া এবং তাইওয়ানের সম্মিলিত সামরিক ব্যয় থেকেও বেশি। সরকারি হিসেবে যত কমই দেখানো হোক না কেন, প্রকৃত ব্যয় অবশ্যই অনেক বেশি।

সামরিক সক্ষমতার মান বনাম পরিমাণ

চীনের সামরিক প্রযুক্তি অনেক ক্ষেত্রেই যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে এক-দুটি প্রজন্ম পিছিয়ে থাকতে পারে। তবে সংখ্যায় তারা ব্যাপক; এতে কিছুটা পিছিয়ে থাকলেও (quantity has a quality of its own) গুরুত্ব কমে না।

১৯৯০-এর দশক থেকে চীন সেনাবাহিনীর লোকবল কমাচ্ছে এবং সেই অর্থ দিয়ে সরঞ্জাম ও প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ বাড়াচ্ছে। বিশেষ করে নৌবাহিনী (Navy) ও মহাকাশ প্রযুক্তিতে বিরাট অগ্রগতি হচ্ছে।

আমেরিকা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নৌবাহিনী বা বিমান বাহিনীর নতুন প্রজেক্টে বড় বিনিয়োগ না করে অনেকখানি মনোযোগ দিয়েছে রক্ষণাবেক্ষণে। ফলে চীন বছরে ১০%-এর বেশি হারে সামরিক সরঞ্জাম খাতে ব্যয় বাড়িয়ে নিজেদেরকে দ্রুতগতিতে শক্তিশালী করে তুলছে।

উপসংহার: আসল চিত্র কোন দিকে ইঙ্গিত করে?

শেষ কথা হলো—যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা বাজেট ৮৪০ বিলিয়ন ডলার বলেও সেটি যে সম্পূর্ণ স্বচ্ছ, তা নয়। অন্যদিকে চীনের বাজেট সরকারি ঘোষণায় ২৩০ বিলিয়ন ডলার বলা হলেও বাস্তবে অনেক অনেক বেশি।

৫৪৯ বিলিয়ন ডলার (এআই-এর অনুমান) থেকে শুরু করে ৪৭১ বিলিয়ন ডলার (এম. টেলর ফ্রাভেল) বা ২৯২ বিলিয়ন ডলার (SIPRI) — বিভিন্ন সংস্থা বা গবেষকের বিভিন্ন হিসাব রয়েছে। কিন্তু মোটাদাগে বলা যায়, চীনের সামরিক ব্যয় সরকারি সংখ্যার দ্বিগুণেরও বেশি হতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে সামরিক প্রতিযোগিতা বাড়লে সারা বিশ্বের ভূ-রাজনীতিতে (geopolitics) বড় ধরনের প্রভাব পড়তে পারে। উভয় দেশই প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় বাড়াচ্ছে, কিন্তু কে কতটা এগিয়ে বা পিছিয়ে আছে—তার সঠিক হিসাব রাখা বেশ কঠিন।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, যারা বলে থাকেন যে যুক্তরাষ্ট্র একাই পরবর্তী ১০টি দেশের চেয়ে বেশি ব্যয় করে, তারা অনেক সময় চীনের আসল ব্যয়ের কথা বিবেচনায় নেন না। চীন এ ক্ষেত্রে তথ্য গোপন করছে, বিভিন্ন উপায়ে সামরিক খাতের অর্থব্যয় অন্যান্য খাতে দেখাচ্ছে, আবার PPP-এর কারণে প্রকৃত সক্ষমতা আরও অনেক বেশি।

অবশ্যই, যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ব্যয়ও অস্বাভাবিক বড়সড়; এ নিয়ে বিতর্কেরও শেষ নেই। তবে এখানে মূল কথা হলো—চীন তাদের সামরিক ব্যয় সম্পর্কে সত্যি তথ্য দিচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে আমাদের আরও সতর্ক ও বিশ্লেষণমূলক হওয়া দরকার।

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.