Table of Contents
জেনারেশনসমূহের বিবরণ
ভূমিকা
“তোমাদের এই টিকটক (TikTok) নিয়ে লাফালাফি! এই বয়সে আমরা খনিতে কাজ করতাম!” — গ্র্যান্ডপা মুখভর্তি ম্যাশড পটেটো খেতে খেতে এই কথাগুলো বলছিলেন। আর এটা শুনে আপনার ১২ বছর বয়সী রিলেটিভ আইফোন থেকে চোখ না তুলেই জবাব দেয়, “ওকে, বুমার (Okay, boomer)!”
আর এই সময়ে আপনি হয়তো চাকরির তালিকা স্ক্রোল করে যাচ্ছেন, একটা সাইড হাসল খুঁজছেন একটু স্বস্তিতে বাঁচার জন্য। কিন্তু কীভাবে আমরা এখানে এলাম? কেন এখন মনে হয় প্রজন্মগুলোর মধ্যে যেন এক অদৃশ্য যুদ্ধ চলছে? সব সময় তো এমন ছিল না। গত ১৮০০ শতকেও হয়তো অনেকে অভিযোগ করত যে ঐ ‘১৮১২-দের (1812-ers)’ কারবারে কীভাবে রেভোল্যুশনারি ওয়ার (Revolutionary War) প্রজন্মের অর্জনগুলো ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু প্রজন্মভিত্তিক লেবেলিং (labeling) আর সেটাকে সাংস্কৃতিক সংঘাতে পরিণত করার প্রবণতা আসলে ২০শ শতাব্দীরই একটা আবিষ্কার।
আগে প্রজন্মের ধারণা ছিল স্রেফ পারিবারিক বয়সভিত্তিক স্তর নির্দেশের জন্য। তারপর কেউ একজন ভাবল, “চলুন, এটা নিয়ে পড়াশোনা করি… আর একটু তর্ক করি!” এভাবেই সাতটা স্বতন্ত্র প্রজন্ম গড়ে উঠল, যার প্রত্যেকেই মনে করে যে তারাই সবকিছু ঠিকমতো করছে। কিন্তু কেন যেন সবকিছু দেখে মনে হচ্ছে, এ যেন কোনো দোষারোপের যুদ্ধ, আর যুদ্ধের বিষয়টি হচ্ছে “কে এই পৃথিবীর সমস্যার জন্য বেশি দায়ী?”
দ্য গ্রেটেস্ট জেনারেশন (The Greatest Generation) – ১৯০১ থেকে ১৯২৭
এই প্রজন্ম জন্মেছিল উনিশ শতকের শেষপ্রান্তে, এক নতুন শতাব্দীর (new century) শুরুতে—যেখানে মানুষ আশা, অগ্রগতি আর উত্তেজনা নিয়ে দিন শুরু করেছিল। কিন্তু ইতিহাসের হয়তো তাদের নিয়ে ভিন্ন পরিকল্পনাই ছিল। এই প্রজন্মের শুরুর দিকের লোকেরা বড় হওয়ার সময় চোখের সামনে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ঘটতে দেখেছে অনেকে। সেই সাথে স্প্যানিশ ফ্লু (Spanish Flu) মহামারির আতঙ্কও এদের পিছু ছাড়েনি। তবু একই সময়ে তারা ‘রোরিং টুয়েন্টিজ’ (roaring twenties) নামক একরকম সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ঝড় তুলেছিল, আর জ্যাজ (Jazz) ও সুইং (Swing) এর সুরে মানুষকে মুগ্ধ করেছিল।
কিন্তু উত্থানের পরপরই নেমে এসেছিল তীব্র ধস। এই প্রজন্ম কৈশোর পেরিয়ে প্রায় পূর্ণবয়স্ক হওয়ার পথে তখন মহামন্দা (Great Depression) আঘাত হানে। সারা বিশ্বের অর্থনীতিকেই অন্ধকারে ঠেলে দিয়েছিল এই মহামন্দা। তারপর শুরু হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্বাভাস…
এভাবেই এই প্রজন্ম তাদের ‘গ্রেটেস্ট’ নামটি অর্জন করে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে এদের বেশির ভাগই যুদ্ধে যাওয়ার বয়সে ছিল। আমেরিকার ইতিহাসে যুদ্ধক্ষেত্রে তাদের যে বিজয়গাথা, তা ছিল সবচেয়ে আইকনিক। যদিও বহু মানুষের জীবন অকালে ঝরে গেছে, তবু যারা ফিরে এসেছিল, তাদের বীরের মর্যাদা আর উদযাপন জানানো হয়েছিল। দেশে ফিরে ব্যবসা, সংস্কৃতি (culture) বা নানা ক্ষেত্রে তারা সাফল্য অর্জন করে। এই প্রজন্মের লোকেরা প্রায়ই নতুন প্রজন্মের লোকেদেরকে একটা ‘গুড ওল্ড ডেজ’ (good old days) গল্প শুনিয়ে থাকে।
যাই হোক, এই অসামান্য উত্তরাধিকারের (legacy) পরের প্রজন্ম কিছুটা যেন তাদের ছায়ায় ঢাকা পড়ে যায়।
সাইলেন্ট জেনারেশন (Silent Generation) – ১৯২৮ থেকে ১৯৪৫
সাইলেন্ট জেনারেশনকেও একই ঐতিহাসিক ঘটনার ছাপ বইতে হয়েছে, তবে এদের বেড়ে ওঠা একইভাবে হয়নি। অর্থনৈতিক মন্দা (depression) তাদের শৈশবে বড় প্রভাব ফেলেছিল, অনেকেই পরিবারসহ দুঃস্থ ও অস্থির অবস্থায় বেড়ে উঠেছে। যুদ্ধ (war) চলায় রেশনিং (wartime rationing) চালু ছিল, এবং অনেকে পিতামাতাকে যুদ্ধক্ষেত্রে হারিয়েছে। এদের বেড়ে ওঠার সময় চারপাশের পরিবেশ ছিল তীব্র দেশপ্রেমে (patriotic) ভরা—সরকারবিরোধী কথা বলাকে তেমন উৎসাহিত করা হতো না। সমাজের প্রতি এক ধরনের সমষ্টিগত দায়বদ্ধতা (collectivism) এদের মধ্যে গড়ে ওঠে।
এভাবেই তাদের “সাইলেন্ট (Silent)” আখ্যা দেওয়া হয়। এক যুদ্ধ (World War II) শেষ হওয়ার সাথে সাথেই আরেক যুদ্ধ (Cold War) শুরু হয়। এই প্রজন্ম মূলত ঠান্ডা যুদ্ধের (Cold War) যুগে বেড়ে উঠেছে। যখন সোভিয়েত ইউনিয়ন পরমাণু অস্ত্র পেয়ে গেল, তখন আমেরিকায় শুরু হলো আরও বড় বিপদের আশঙ্কা। ম্যাকার্থি যুগে (McCarthy era) তারা মুখ বন্ধ করে থাকতে পছন্দ করত—যেন কোনো ঝামেলায় জড়াতে না হয়—এবং শৈশব থেকেই এরা কঠোর পরিশ্রমের (work ethic) শিক্ষা পেয়েছিল।
এরপর শুরু হয় ‘বেবি বুমার্স (Baby Boomers)’ যুগ।
বেবি বুমার্স (Baby Boomers) – ১৯৪৬ থেকে ১৯৬৪
‘বেবি বুম (Baby Boom)’ কথাটা এসেছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে (late 1940s and 1950s) জন্মহার বেড়ে যাওয়ার ফলস্বরূপ। যুদ্ধফেরত সৈন্যরা বাড়ি ফিরে এলো, অবসাদগ্রস্ত অর্থনীতি (economy) আবার ঘুরে দাঁড়াতে থাকল, উন্নতি হল বাণিজ্য ও প্রযুক্তিতে (commerce and technology)। আর এই সময়ে ব্যাপক আকারে “woo-hoo” শব্দের আনন্দোৎসবও ঘটল! ফলস্বরূপ জন্মহার বৃদ্ধি পেল। শুধু আমেরিকাতেই ৭৬ মিলিয়নেরও বেশি মানুষ এই প্রজন্মে জন্মেছে, যা তখন পর্যন্ত সর্ববৃহৎ প্রজন্ম হিসাবে ধরা হয়।
এরা এমন একটা যুগে বড় হয়েছে, যখন অতি দ্রুত সামাজিক অগ্রগতিগুলো ঘটছিল। স্পেস রেস (Space Race), সিভিল রাইটস মুভমেন্ট (Civil Rights Movement), উডস্টক (Woodstock)—এসব সাংস্কৃতিক হাইলাইট তৈরি করছে “টিপিক্যাল আমেরিকান চাইল্ডহুড” ধারণা। কিন্তু একই সময়ে, পারমাণবিক যুদ্ধের (nuclear annihilation) আতঙ্ক সারাক্ষণ ছিল। কেউ “ডাক অ্যান্ড কভার (Duck and Cover)” কথা শুনলে যদি সাথে সাথে টেবিলের নিচে ঢুকে পড়তে চায়, তবে সে সম্ভবত বেবি বুমার! কারণ, কিউবান মিসাইল সংকট (Cuban Missile Crisis) যেমন পরিস্থিতি তৈরি করেছিল, তাতে মানুষ ভয়ে তটস্থ ছিল।
সেই সময়ে ভিয়েতনাম যুদ্ধের (Vietnam war) মতো বিতর্কিত যুদ্ধও চলেছে, এবং বিশাল এক যুদ্ধবিরোধী আন্দোলনও (anti-war movement) দানা বেঁধেছিল—যা এদের রাজনৈতিক মানসিকতা গড়ে তুলতে বিরাট ভূমিকা রাখে। এই প্রজন্ম থেকে অন্তত চারজন প্রেসিডেন্ট এসেছেন – ক্লিনটন (Clinton), বুশ জুনিয়র (Bush Jr.), ওবামা (Obama) ও ট্রাম্প (Trump)। অনেকে মনে করে এরা রক্ষণশীল (conservative) ঝোঁকের, বিশেষ করে তুলনামূলকভাবে আর্থসামাজিক সুবিধা বেশি পাওয়ার কারণে। কিন্তু এদের মধ্যেও যেমন বিভিন্ন আদর্শিক দল আছে, ঠিক তেমনই এদের বিপুল জনসংখ্যার কারণে এখনও এরা রাজনীতি এবং সমাজে অগাধ প্রভাব ধরে রেখেছে।
বেবি বুমার্সদের বিশাল ছায়ার কারণে পরবর্তী প্রজন্মে যেন কিছুটা “চিলড আউট” ভাব এসেছে।
জেনারেশন এক্স (Generation X) – ১৯৬৫ থেকে ১৯৮০
পুরোনোদের ভাষায় এই প্রজন্ম নাকি “স্ল্যাকার জেনারেশন (slacker generation)”, কারণ এদের তেমন কোনো বিশাল যুদ্ধে (major war) জড়িয়ে পড়তে হয়নি। বেবি বুমারদের অনেকে ভিয়েতনাম যুদ্ধে গেছে, কিন্তু জেনারেশন এক্স বেড়ে উঠেছে যখন ঠান্ডা যুদ্ধের উত্তেজনা ধীরে ধীরে কমছিল। গালফ ওয়ার (Gulf War) ঘটলেও তা ছিল একটি সীমিত পর্যায়ের যুদ্ধ, কোনো বাধ্যতামূলক নিয়োগ বা ড্রাফট (draft) ছিল না। তাই এদের মনোযোগ বেশি ছিল গার্হস্থ্য বিষয়গুলোতে (domestic affairs) এবং রাষ্ট্রযন্ত্রকে প্রশ্নবিদ্ধ করা বা সমালোচনা করার ব্যাপারে এরা হয়ে ওঠে বেশ সরব।
এই সময় এলজিবিটি (LGBT) অধিকার নিয়ে জোর আলোচনা শুরু হয়, যখন এইডস (AIDS) মহামারি প্রতিটি বাড়ির আশঙ্কার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বিশ্ব হয়তো আর ‘নিশ্চিত পারমাণবিক ধ্বংসের (nuclear annihilation)’ দ্বারপ্রান্তে ছিল না, কিন্তু সামাজিক বড় পরিবর্তন খুব দ্রুত ঘটতে থাকে।
এ সময়ের বড় একটা সাংস্কৃতিক মোড়ক হলো—টেলিভিশন (TV)।
জেনারেশন এক্স মানেই মনে করা হয়, এরা কী দেখতো (MTV) আর কী শুনতো (grunge music)। এই যুগেই এমটিভি (MTV) শুরু হয়, গ্রাঞ্জ (grunge) মিউজিকের উত্থান ঘটে। অন্যদিকে শিশুদের অপহরণ বেড়ে যায় (rise in kidnappings), স্যাটানিক প্যানিক (Satanic Panic) নামে অদ্ভুত এক ভয় ঢুকে যায় সমাজে। ফলে পিতামাতা সন্তানের ব্যাপারে আগের চেয়ে বেশি শঙ্কিত হয়ে পড়ে, ‘ফ্রি-রেঞ্জ (free-range childhood)’ বেড়ে ওঠার দিন শেষ হয়ে গেল, ‘হেলিকপ্টার প্যারেন্টিং (helicopter parenting)’ চলে এলো। মানে এই সময় থেকে বাবা-মা আগের তুলনায় সন্তানদের অনেক বেশি দেখে শুনে রাখার বা নজর দারিতে রাখা শুরু করল। সাইলেন্ট জেনারেশনের মতো, জেনারেশন এক্স-ও আগের ও পরের প্রজন্মের মধ্যে কিছুটা আড়ালে রয়ে গেল—এদের মধ্য থেকে এখনও কোনো মার্কিন প্রেসিডেন্ট (President) পাওয়া যায়নি, যদিও এদের অনেকেই এখন প্রায় ষাটোর্ধ্ব।
এবার আমাদের মনোযোগ যাবে সেসব প্রজন্মের দিকে, যাদের একসময় “বাচ্চা” ভাবা হতো—কিন্তু তারা এখন কত বড় হয়ে গেছে!
মিলেনিয়ালস (Millennials) – ১৯৮১ থেকে ১৯৯৬
ঠান্ডা যুদ্ধ (Cold War) প্রায় শেষের পথে যখন এই প্রজন্ম বড় হতে শুরু করে, তখনই এক নতুন যুগের সূচনা হয়। মিলেনিয়াল প্রজন্ম মানেই প্রযুক্তির (technology) সাথে বেড়ে ওঠা। শৈশবে তারা হয়তো টয়’আর আস (Toys ‘R Us) আর ওয়াল ফোন (wall phones) দেখেছে, কিন্তু বড় হওয়ার সাথে সাথে দেখেছে ইন্টারনেটের (internet) আবির্ভাব, এবং কলেজ বা উচ্চবিদ্যালয়ে থাকা অবস্থায় তারা ঢুকে পড়েছে এক নতুন ডিজিটাল দুনিয়ায়। ২০০০ সাল শুরু হওয়ার সময় তাদের চোখে ছিল সোনালী ভবিষ্যতের স্বপ্ন—সবকিছুই হয়তো এখন থেকে উন্নতির দিকে যাবে! কিন্তু ইতিহাসের নাটকীয় অনিশ্চয়তা তাদের মাথায় আঘাত হানে।
নতুন সহস্রাব্দ (new millennium) শুরু হওয়ার পরই ২০০০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নিয়ে বহু বিতর্ক হল, হাড্ডাহাড্ডি ফলাফল ও আইনি জটিলতা দেখে অনেক মিলেনিয়াল রাজনীতি নিয়ে হতাশ বা উদাসীন হয়ে পড়ে। তারপর ৯/১১ হামলা (9/11 attacks) নিউ ইয়র্ক ও ওয়াশিংটনে আঘাত হানে, শুরু হয় গ্লোবাল ওয়ার অন টেরর (global war on terror)—পুরোনো প্রজন্মের মতো বাধ্যতামূলক ড্রাফট হয়নি বটে, কিন্তু সন্ত্রাস ও যুদ্ধের ছায়া এদের তারুণ্যে গাঢ় প্রভাব ফেলে। এরপর ২০০৮ সালে বিশ্বের অর্থনৈতিক মন্দা (financial crisis) তাদের পেশাগত পরিকল্পনায় বড় বাধা সৃষ্টি করে। পূর্ববর্তী প্রজন্মের তুলনায় অনেক মিলেনিয়ালকে বাবা-মায়ের সাথে একই বাড়িতে থাকতে হয়েছে, দীর্ঘমেয়াদি চাকরি পেতে কষ্ট করতে হয়েছে।
এই প্রজন্মের রাজনৈতিক ঝোঁক তাই তুলনামূলকভাবে বেশি উদারপন্থী (liberal) হয়ে উঠেছে। যেমন, অ্যালেক্সান্ড্রিয়া ওকাসিও-কোর্টেজের (Alexandria Ocasio-Cortez) মতো তরুণ রাজনৈতিক নেতারা বেশ আইকনোক্লাস্ট। যদিও এখনও অনেক সময় ‘মিলেনিয়াল’ শব্দটা ব্যবহার করা হয় ‘তরুণদের’ বোঝাতে, কিন্তু বাস্তবে পুরোনো মিলেনিয়ালরা ইতোমধ্যেই ৪০ পার করে ফেলেছে—কেউ কেউ তো গ্র্যান্ডপা-গ্র্যান্ডমাও হয়ে গেছেন!
তাই এখন এরাও অনেক সময় “ওকে, মিলেনিয়াল (Okay, Millennial)” কথাটা শুনতে পারে।
জেনারেশন জি (Generation Z) – ১৯৯৭ থেকে ২০১০
মিলেনিয়ালরা যে প্রযুক্তির উত্তাল ধাপটা সামনে পেয়েছিল, জেন জি (Gen Z) সেটাকে প্রায় জন্মগতভাবেই পেয়েছে—ডিজিটাল নেটিভস (digital natives) হিসেবে। এই প্রজন্মের বেশির ভাগ শিশু-কিশোর বয়সেই সেলফোন (cell phones) পেয়েছে, আর অল্প সময়ের মধ্যে স্মার্টফোন (smartphones) এসে সব পাল্টে গেছে—এখন সারাক্ষণ পকেটে একটা কম্পিউটার (computer) নিয়ে ঘুরছে তারা। যখন বুমাররা “আজকালকার বাচ্চারা জানে না টাইপরাইটার (typewriter) কী, বা পত্রিকায় সিনেমার সময় খোঁজার কষ্ট কী” এসব বলে আফসোস করে, জেন জি হয়তো বলবে, “সেগুলো আমাদের লাগবেই বা কেন?”
কিন্তু তা বলে ভাববেন না যে এরা বাস্তবতা থেকে দূরে সরে আছে।
এই প্রজন্ম সামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয়ে বরাবরই বেশ সক্রিয় (highly engaged)। ইন্টারনেট তাদের জানার পরিধি অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে। তারা যুদ্ধবিরোধী আন্দোলন (anti-war), বন্দুক নিয়ন্ত্রণ (gun control), বা জলবায়ু পরিবর্তন (anti-climate change) নিয়ে সরব। তবে ঐতিহ্যবাহী ভোট বা রাজনৈতিক সংগঠনের পরিবর্তে তারা প্রতিবাদ (protest movements) আর অনলাইন মাধ্যমকেই বেশি প্রাধান্য দেয়। এতে পুরোনো প্রজন্ম কিছুটা বিরক্ত হলেও যুগের পরিবর্তনকে তো আর থামানো যায় না। তারা বয়ঃপ্রাপ্ত হয়ে রাজনীতি আর বিশ্বপরিবেশে কী প্রভাব ফেলবে, সেটা সময়ই বলে দেবে।
জেন আলফা (Gen Alpha) – ২০১১ থেকে ?
এই নতুন প্রজন্ম এখনো সবে শুরু করেছে। অনেকের মতে, জেন আলফা (Gen Alpha) আরও একধাপ এগিয়ে—এরা ‘স্মার্টফোন নেটিভস (smartphone natives)।’ একটা সার্বক্ষণিক তথ্যপ্রবাহ (constant stream of information) ছাড়া এরা অন্য কোনো পৃথিবী দেখেনি। অনেক শিক্ষকের মতে, এতে তাদের মনোযোগ বা পড়ার অভ্যাসের (attention span) ক্ষতি হতে পারে, কারণ তারা ছোট ছোট ভিডিও কনটেন্টের (short-form video like TikTok) উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। ঠিক একই সময়েই এরা বড় হচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) প্রযুক্তির উত্থানের মাঝে, যা মানুষের কাজ ও শিক্ষার ধরন পাল্টে দিতে শুরু করেছে।
তবে প্রতিটি প্রজন্মের মতোই, এখানেও অন্য এক দিক আছে।
জেন আলফা আগের চেয়ে অনেক বেশি সামাজিক ও পরিবেশগত (activism and justice) বিষয় নিয়ে সচেতন—তারা যে শুধু ডিজিটাল কনটেন্ট ব্যবহার করে তাই নয়, অনেকে নিজেই প্রযুক্তি তৈরি বা কোডিং করছে (creating it)। রোব্লক্স (Roblox)-এর মতো প্ল্যাটফর্মে লাখো শিশুই খেলা শেখার পাশাপাশি প্রোগ্রামিং (coding) করছে। তবে একই সাথে, বিশ্ব আজ আরও অস্থিতিশীল—দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধ, রাজনৈতিক মেরুকরণ ও তথ্যভিত্তিক বিভ্রান্তি তাদের বেড়ে ওঠার সময়কে জটিল করে তুলছে। অনেকে আশঙ্কা করছেন, এদের মধ্যে উগ্রপন্থা (radicalized) দুই ধারাতেই বাড়তে পারে। কিন্তু তারা যখন উচ্চবিদ্যালয় (high school) ও কলেজে (college) প্রবেশ করবে, তখনই বোঝা যাবে পৃথিবীতে তাদের প্রভাব আসলে কেমনভাবে ফুটে ওঠে।
তথ্যসূত্র
- https://en.wikipedia.org/wiki/Generation
- https://www.parents.com/parenting/better-parenting/style/generation-names-and-years-a-cheat-sheet-for-parents/
- https://en.wikipedia.org/wiki/Greatest_Generation
- https://en.wikipedia.org/wiki/Silent_Generation
- https://en.wikipedia.org/wiki/Baby_boomers
- https://en.wikipedia.org/wiki/Generation_X
- https://en.wikipedia.org/wiki/Millennials
- https://en.wikipedia.org/wiki/Generation_Z
- https://en.wikipedia.org/wiki/Generation_Alpha
মিলেনিয়াল বনাম জেন জি – পার্থক্য কোথায়?
ভূমিকা
মিলেনিয়ালস (Millennials) বা জেনারেশন ওয়াই (Generation Y) হল সেই প্রজন্ম যারা মূলত ১৯৮০ থেকে ১৯৯০-এর দশকের মধ্যভাগে জন্মগ্রহণ করেছেন। এই সময়ে উল্লেখযোগ্য হারে জন্মহার বৃদ্ধি পাওয়ায় তাদেরকে মাঝে মাঝে ইকো বুমারস (Echo Boomers)-ও বলা হয়।
অন্যদিকে, জেনারেশন জি (Generation Z) বা জেন জি (Gen Z) হল সেই প্রজন্ম যারা ১৯৯০-এর দশকের মধ্যভাগ থেকে ২০০০-এর দশকের মধ্যভাগ পর্যন্ত সময়ে জন্মগ্রহণ করেছেন। তাদের আইজেনারেশন (iGeneration) বা পোস্ট-মিলেনিয়ালস (Post-Millennials) নামেও ডাকা হয়।
ইন্টারনেটের ব্যাপক বিস্তার ও ডিজিটাল বিপ্লবের অগ্রগতির কারণে দুটি প্রজন্ম পার্শ্ববর্তী হওয়া সত্ত্বেও তাদের অভিজ্ঞতা ও দৃষ্টিভঙ্গিতে একাধিক পার্থক্য দেখা যায়। উপরন্তু, ভিন্ন সময়ের অভিভাবকদের প্রভাবও তাদের মনোভাব ও আচরণে পার্থক্য সৃষ্টি করেছে। গবেষণালব্ধ তথ্যের আলোকে এই নিবন্ধে থাকছে দশটি দিক, যেখানে মিলেনিয়াল ও জেন জি ভিন্ন।
১. মনোযোগের স্থায়িত্ব (Attention Span)
- জেন জি খুব দ্রুত তথ্য প্রক্রিয়াকরণ করতে পারে, এমনকি মিলেনিয়াল-দের থেকেও দ্রুত।
- জেনারেশন জি অনেক অ্যাপ—যেমন ভাইন (Vine ) এবং স্ন্যাপচ্যাট (Snapchat)—ব্যবহার করে বেড়ে উঠেছে, যেখানে দ্রুতগতিতে তথ্য আদান-প্রদান হয়। ফলে তাদের মনোযোগের স্থায়িত্ব তুলনামূলকভাবে ছোট।
- এক গবেষণায় দেখা গেছে, মাত্র ৪% মিলেনিয়ালস ও তার আগের প্রজন্ম মনে করে যে ১৩ বছর বয়সেই স্মার্টফোন ব্যবহার শুরু করা যায়, বিপরীতে জেনারেশন জি-এর ১৮% সদস্য মনে করে এটি স্বাভাবিক।
২. বহুকাজ সম্পাদনের দক্ষতা (Multi-Tasking)
- মনোযোগের স্থায়িত্ব কম হলেও, জেন জি-এর শক্তি হলো তারা একই সাথে বহু কাজ করতে পারে।
- জেনারেশন জি কম্পিউটারে লেখাপড়ার কাজ করার সময় ট্যাবলেটে তথ্য খুঁজে দেখতে পারে, আবার সেই সঙ্গে নোট নেওয়াও চালিয়ে যেতে পারে।
- এমনকি সন্ধ্যায় তারা টিভিতে সিনেমা চালিয়ে ফোন বা ল্যাপটপে ফেসবুক মেসেঞ্জারে বন্ধুর সাথে চ্যাটও চালিয়ে যায়।
৩. স্বাধীনতা বনাম সহযোগিতাপূর্ণ প্রবণতা (Independent vs Collaborative)
- ৭১% জেনারেশন জি বিশ্বাস করে, “If you want it done right, then do it yourself (যদি কাজটি সঠিকভাবে করতে চাও, নিজে করো)”—এই নীতিতে।
- জেনারেশন জি প্রতিযোগিতামূলক মনোভাবাপন্ন এবং ব্যক্তিগত বা পেশাগত কাজে ‘Do it yourself (নিজে করো)’ মানসিকতা রাখে।
- কর্মক্ষেত্রে ৬৯% জেনারেশন জি নিজের আলাদা ওয়র্কস্পেস (workspace) পছন্দ করে, যেখানে মিলেনিয়ালস সহকর্মীদের সাথে একত্রে কাজ করতে বা কোনো সহযোগী পরিবেশে কাজ করতে বেশি স্বচ্ছন্দ।
৪. ডিজিটাল অগ্রজ (The Digital Pioneers)
- ৪০% জেনারেশন জি মনে করে, নিরবচ্ছিন্ন ওয়াই-ফাই নিরবচ্ছিন্ন বাথরুম সুবিধার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
- পিউ রিসার্চ অনুযায়ী, ১৯৯৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের মাত্র ১৪% পূর্ণবয়স্কের ইন্টারনেটে প্রবেশাধিকার ছিল, যা ২০১৪ সালে ৮৭%-এ পৌঁছে।
- মিলেনিয়াল ডিজিটাল যুগের অগ্রজ হিসেবে সোশ্যাল মিডিয়া, স্মার্টফোন, ইনস্ট্যান্ট মেসেজিং, ইন্টারনেট সার্চিং—এসবের উত্থান প্রত্যক্ষ করেছে।
- জেনারেশন জি জন্মের পর থেকেই ডিজিটাল পরিবেশে বড় হওয়ায় তাদের দৃষ্টিভঙ্গি মিলেনিয়ালদের থেকে একেবারেই ভিন্ন।
৫. সরাসরি মুখোমুখি কথা বলা নাকি ডিজিটাল চ্যাট? (Face to Face or Digital Chat)
- প্রযুক্তির ব্যাপক ব্যবহার এই দুই প্রজন্মের যোগাযোগের ধরনেও বৈচিত্র্য এনেছে। কর্মক্ষেত্রে সহকর্মীদের সাথে ৭৪% জেনারেশন জি মুখোমুখি কথা বলা পছন্দ করে।
- মিলেনিয়ালস বিভিন্ন ডিজিটাল যোগাযোগ মাধ্যমের উত্থানের সাক্ষী; তারা প্রযুক্তিগত উপায়ে কাজ করলেও জেনারেশন জি ব্যক্তিগত সংযোগকেও গুরুত্ব দেয়।
- ফলে ভবিষ্যতে অনলাইন ও অফলাইন যোগাযোগের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার ক্ষেত্রে জেনারেশন জিের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে।
৬. ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি (Optimistic Vision)
- ২০১৬ সালে লিংকন ফাইন্যানশিয়াল গ্রুপ (Lincoln Financial Group)-এর এক জরিপে দেখা গেছে, জেনারেশন জি মিলেনিয়ালদের তুলনায় অনেক বেশি আশাবাদী।
- ৫০% জেনারেশন জি বলে, “আমেরিকা সঠিক পথেই এগোচ্ছে,” যেখানে মিলেনিয়ালদের ক্ষেত্রে এ হার ৪২%।
- আর্থিক ভবিষ্যৎ নিয়ে জেনারেশন জি ১৩ বছর বয়স থেকেই আলোচনা ও গবেষণা শুরু করে, এবং একবার পরিকল্পনা করা শুরু করলে তাদের ৯৫% নিজের সামগ্রিক ভবিষ্যৎ নিয়ে আশাবাদী থাকে।
৭. সুবিধা-সুবিধা বনাম ব্র্যান্ড (Convenience over brands)
- অ্যাকসেঞ্চার (Accenture)-এর গবেষণায় উঠে এসেছে, জেনারেশন জি দ্রুত ও প্রযুক্তিনির্ভর কেনাকাটার অভিজ্ঞতা যেমন “ওয়ান-আওয়ার ডেলিভারি” (1-hour delivery), “অ্যাক্টিভেটেড শপিং” (activated shopping), ইন-স্টোর “কিওস্ক” (kiosks) ইত্যাদি পছন্দ করে।
- ব্র্যান্ড (brand) তাদের কাছে কম গুরুত্বপূর্ণ; বরং যে খুচরা বিক্রেতা বা রিটেইলার এ ধরনের সুবিধা দিতে পারে, তারা সেই ব্র্যান্ড বেছে নেয়।
- তারা কেনাকাটাকে সামাজিক অভিজ্ঞতা (social experience) হিসেবে দেখে, বন্ধুবান্ধবের মতামত নিয়ে সিদ্ধান্ত নেয় এবং কোনও কারণে খারাপ অভিজ্ঞতা হলে কঠোর রিভিউ দেয়।
- পণ্য কেনার আগে তারা মিলেনিয়ালদের দ্বিগুণ হারে ইউটিউব (YouTube) দেখে মতামত সংগ্রহ করে।
৮. শেখার ভিন্নতা (Different ways of learning)
- স্পার্কস অ্যান্ড হানি (Sparks & Honey)-এর তথ্যানুযায়ী, জেনারেশন জি-এর ৭৫% মনে করে, কলেজে না গিয়েও ভালো শিক্ষার বিকল্প আছে।
- মিলেনিয়ালদের মধ্যে অনেকেই এখন বড় অঙ্কের শিক্ষাঋণ (student debt) মাথায় নিয়ে কাজ করছেন, যেখানে ৪৪% নতুন স্নাতক ডিগ্রিধারী এমন চাকরিতে আছেন যেখানে ডিগ্রির প্রয়োজনই নেই।
- জেনারেশন জি, এই অভিজ্ঞতা সামনে রেখে তাদের শিক্ষাগত সিদ্ধান্ত নেয়।
৯. সহনশীলতা (Tolerance)
- মিলেনিয়ালরা তুলনামূলকভাবে বেশি সহনশীল বলে মনে করা হয়, কারণ বাস্তবে তারা বিভিন্ন বিপত্তি ও সমস্যার মুখোমুখি হয়েছে।
- জেনারেশন জির লক্ষ্য কাজটি দ্রুত সম্পন্ন করা। কোনো সমস্যায় পড়লে তারা হয়তো অন্যত্র চলে যায়।
- উদাহরণস্বরূপ, অনলাইনে কেনাকাটার সময় কারিগরি ত্রুটির সম্মুখীন হলে জেনারেশন জি সেই ওয়েবসাইট ব্যবহার করা বন্ধ করে দেবে, কিন্তু মিলেনিয়াল দ্বিতীয়বার সুযোগ দিতে পারে।
১০. সামাজিক ‘ইনফ্লুয়েন্সার’-ই আধুনিক সেলিব্রিটি (Social influencers are today’s celebrities)
- জেনারেশন জি টিভি বা সিনেমা হলে সময় না কাটিয়ে ইউটিউবে সময় ব্যয় করতে বেশি আগ্রহী।
- ৬৩% জেনারেশন জি তাদের বিজ্ঞাপনে সত্যিকারের মানুষ দেখতে পছন্দ করে, সেলিব্রিটি নয়।
- এর মাধ্যমে বোঝা যায়, আজকের ডিজিটাল দুনিয়ায় সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সারদের (social media influencers) কদর অনেক বেড়েছে।
তথ্যসূত্র
- https://www.huffingtonpost.com/george-beall/8-key-differences-between_b_12814200.html
- https://www.inc.com/ryan-jenkins/generation-z-vs-millennials-the-8-differences-you-.html
- https://en.wikipedia.org/wiki/Generation_Z
- https://en.wikipedia.org/wiki/Millennials
- https://www.magnani.com/blog/generationz
- https://www.socialmediatoday.com/news/comparing-the-differences-between-generation-z-and-millennials-infographic/517903/
কেন কোম্পানিগুলো জেন-জি কর্মীদের ছাটাই করছে?
জেন-জি কর্মীদের ছাটাই পরিস্থিতি
সময় সকাল ৯টা ১৭ মিনিট, আর ব্র্যাড শুধু ৯টার মিটিংয়েই দেরি করেনি—সে আসলে অফিসে আসতেই দেরি করেছে। ব্র্যাডের পোশাকের ধরন “ব্যবসায়িক” (business) হওয়া তো দূরের কথা, এর পুরো বিপরীত। চিকন ফিট শার্ট বা স্ল্যাক্স (slacks) পরার বদলে, সে অফিসে ঢুকছে সুপ্রিম (Supreme) লেখা টি-শার্ট আর ছেঁড়া জিন্স পরে। আর যখন ভাবা যাচ্ছিল এর চেয়ে খারাপ আর কী হতে পারে, তখন দেখা গেল গত সপ্তাহান্তে পাহাড়ে হাইকিং (hiking) করতে গিয়ে ময়লা লাগা স্নিকারের (sneakers) দাগ এখনও তার জুতায় লেগে আছে।
মিটিংয়ে, ব্র্যাডের প্রেজেন্টেশন এত বোরিং যে সবাইকে তাকে থামাতে হচ্ছে, নাহলে ঘরে সবাই ঘুমিয়ে পড়ত। তার টেকনিক্যাল দক্ষতা (technical skills) সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। তার মাস্টার্স ডিগ্রি (master’s degree) আছে বটে, কিন্তু এক্সেলে (Excel) সে এতটাই অজ্ঞ যে সে কোন কাজ করতে গেলে দিশেহারা হয়ে পড়ে। টিকটকে (TikTok) স্ক্রল করা গেলেও আউটলুকে (Outlook) “রিপ্লাই অল” (reply all) খুঁজে পেতে সে হিমশিম খায়।
যখন আসল সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়, ব্র্যাড সম্পূর্ণ গুবলেট পাকিয়ে ফেলে। ইউটিউব টিউটোরিয়াল (YouTube tutorial) ছাড়া তার সমস্যার সমাধান দক্ষতা হলো ভিডিও গেমে X বোতাম চেপে রিলোড করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। কিন্তু আসল চমক হলো, ব্র্যাড এতটাই “ক্যাজুয়াল” (casual) যে তা অন্যেরা ঠিকভাবে নিতে পারেনা। সে অফিসে হাঁটে যেন কফি শপে এসেছে, সহকর্মীদের সাথে হাই-ফাইভ করে এবং বসকে ‘ডুড’ (dude) বলে ডাকে।
ব্র্যাড হলো গড়পড়তা জেন জি (Gen Z) স্নাতক, এবং অনেকের মতো সেও সম্ভবত চাকরি হারাবে কিছু মাসের মধ্যেই। তো জানা যাক, কেন কোম্পানিগুলো জেন জি কর্মীদের চাকরি থেকে বের করে দিচ্ছে।
পর্যবেক্ষকরা দেখছেন সাম্প্রতিক স্নাতক নিয়োগে এক বিপর্যয়কর পরিস্থিতি, আর এই খবর জেন জি-দের জন্য ভালো নয়। অফিসের বসরা ক্রমেই নতুন প্রজন্মের কর্মী নিয়োগ করতে অনাগ্রহী হয়ে উঠছেন। পরিস্থিতি এতটাই খারাপ যে কলেজগুলো পর্যন্ত এই সংকট সমাধানে উদ্যোগী হয়েছে। অনেক প্রতিষ্ঠান এখন শিক্ষার্থীদেরকে পেশাগত পরিবেশের জন্য বিশেষভাবে প্রস্তুত করতে অতিরিক্ত কোর্স চালু করেছে।
প্রায় ১,০০০ ব্যবসা, প্রযুক্তি এবং বিজ্ঞান খাতের কর্পোরেট নেতাদের উপর করা এক সাম্প্রতিক সমীক্ষায় দেখা গেছে প্রতি ৬টি কোম্পানির ১টি এখন সাম্প্রতিক স্নাতক নিয়োগে অনিচ্ছুক। এই সমীক্ষায় নিয়োগ প্রক্রিয়া, জনমিতি (demographics), এবং সন্তোষজনক বা অসন্তোষজনক ফলাফলের কারণ সম্পর্কে নির্দিষ্ট প্রশ্ন করা হয়। ৯৪% কোম্পানি জানিয়েছে তারা সাম্প্রতিক স্নাতক নিয়োগ করেছে, কিন্তু মাত্র ২৫% বলেছে যে এই নিয়োগ সফল হয়েছে। বাকি অংশ ছিল অসন্তোষজনক বা সম্পূর্ণ ব্যর্থ। তিন-চতুর্থাংশ কোম্পানি সরাসরি বলেছে যে তারা জেন জি নিয়োগে অসন্তুষ্ট। আরও খারাপ খবর হলো—প্রায় তিন-পঞ্চমাংশ কোম্পানি তাদের জেন জি নিয়োগকে এক বছরের মধ্যেই বরখাস্ত করেছে। এর ফলে বিভিন্ন খাতের ব্যবসা নেতৃত্বের কাছে একটা তিক্ত অভিজ্ঞতা জন্ম নিয়েছে।
সবচেয়ে বড় অভিযোগ হলো যে কলেজ স্নাতকরা অপেশাদার (unprofessional) এবং কাজের জন্য পর্যাপ্তরূপে প্রস্তুত নয়—অনেকেই কর্মক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জের মুখে হিমশিম খাচ্ছে। প্রশ্ন উঠছে, জেন জি কি এতটাই নাজুকভাবে লালিত (coddled) যে তারা আর নিয়োগযোগ্য নয়?
সোসাইটি ফর হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট (Society for Human Resource Management) অনুযায়ী, গড় নিয়োগ সফলতার হার প্রায় ৪৩%। অর্থাৎ ১০০ জন নিয়োগ পেলে, তাদের মধ্যে ৪৩ জন দীর্ঘমেয়াদে কোম্পানিতে কার্যকরভাবে টিকে থাকবে। কিন্তু ইন্টেলিজেন্ট (Intelligent) পরিচালিত সমীক্ষায় দেখা গেছে জেন জি-দের ক্ষেত্রে পরিস্থিতি আরও চিন্তাজনক। ৬০% কোম্পানি জানিয়েছে তারা জেন জি কর্মীকে বরখাস্ত করতে বাধ্য হয়েছে—যার ফলে জেন জি নিয়োগ সফলতার হার গড়ের চেয়েও অনেক কম।
অর্থাৎ, আমরা এক প্রজন্মগত সমস্যার মুখোমুখি—এটা এতটাই গুরুতর যে অনেক জেন জি কর্মীরই হয়তো চাকরি পাওয়া বা ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়বে।
জেন জি কর্মীদের এত অযোগ্য বলে মনে করার কারণ
চলুন দেখা যাক, ঠিক কী কী সমস্যার কারণে জেন জি কর্মীদের এত অযোগ্য বলে মনে হচ্ছে।
প্রোটোকল বা আচরণবিধি (etiquette) প্রশিক্ষণ ও পোশাকআশাক সংক্রান্ত নিয়ম না জানার অভাব
সমীক্ষায় দেখা গেছে ৯০% কোম্পানি মনে করে জেন জি কর্মীদের জরুরিভাবে আরো প্রোটোকল বা আচরণবিধি (etiquette) প্রশিক্ষণের প্রয়োজন। সামগ্রিকভাবে পর্যালোচনা করে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে: জেন জি পেশাগত পরিবেশে কীভাবে চলতে হয়, তা জানে না।
একটি সুশৃঙ্খল কর্মক্ষেত্রের জন্য ভালো আচরণবিধি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি হলো পেশাগত সম্পর্ককে সঠিকভাবে পরিচালনা করা। এর মধ্যে রয়েছে যথাযথ শিরোনাম ব্যবহার, যৌন হয়রানি (sexual harassment) নীতিমালা সম্পর্কে সচেতন থাকা, এবং ফোন বা অনলাইন উভয় জায়গাতেই সঠিক যোগাযোগপদ্ধতি মেনে চলা। কিন্তু জেন জি কর্মস্থলের কথোপকথনকে যেন এক ডিসকর্ড চ্যাটরুম (discord chat room) বলে ভুল করে। মিম (meme) আর ইমোজি (emoji) রেডিট (Reddit) বা ইনস্টাগ্রামের (Instagram) জন্য ভালো হলেও আপনার ৯-টু-৫ (9-to-5) চাকরির জন্য ততটা উপযোগী নয়। ভাবুন তো, একটা হ্যান্ডসাম স্কুইডওয়ার্ড (Handsome Squidward) গিফ (gif) দিয়ে ইমেইলের জবাব দেয়ার কারণে চাকরি হারাতে হলো!
ঠিক তেমনি, পোশাকআশাক সংক্রান্ত নিয়ম জানাও গুরুত্বপূর্ণ। বেশিরভাগ কর্মক্ষেত্রেই বিজনেস ক্যাজুয়াল (business casual) ড্রেসকোড প্রচলিত—যা ফর্মাল পোশাকের হালকা সংস্করণ। ব্যবসায়িক নৈমিত্তিক পোশাক কখনও কখনও জিন্স পরার অনুমতি দেয়, কিন্তু তার সাথে ভালো, পরিপাটি বোতাম লাগানো শার্ট এবং পরিষ্কার জুতো থাকা চাই। গ্রাফিক টি-শার্ট এবং নোংরা স্নিকার একেবারেই চলবে না। যদি আপনি জেন জি প্রজন্মের কেউ হন, কর্মক্ষেত্রকে এমনভাবে নিন যেন আপনি একটি ডেটে যাচ্ছেন—ভালো ছাপ ফেলতে হবে, আবার পুরো স্যুট পরে অদ্ভুতও লাগবে না।
অপেশাদারিত্ব ও অনুপ্রেরণা বা উদ্যোগের অভাব ও তার পেছনে দায়ী সামাজিক অসঙ্গতি
অপেশাদারিত্বের কারণে (lack of professionalism) ৪৬% ক্ষেত্রে জেন জি কর্মীদের চাকরি ধরে রাখা সম্ভব হয়নি। অন্যান্য সমস্যার মধ্যে ছিল অনুপ্রেরণা বা উদ্যোগের অভাব। সমীক্ষায় অংশগ্রহণকারী অর্ধেক কোম্পানি—প্রায় ৫০০টি—বলেছে যে জেন জি কর্মীদের ঘনিষ্ঠ তদারকি প্রয়োজন এবং তারা নিজে থেকে কোনও উদ্যোগ নেয় না।
এটা হতে পারে অনলাইনে বেড়ে ওঠা জেন জি-দের পেশাগত পরিবেশে গিয়ে কালচার শক (culture shock) খাওয়ার ফল। আবার হতে পারে জেন জি সবচেয়ে সরবভাবে শিল্পক্ষেত্রের শোষণকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। অনলাইন জগতে বিচরণ জেন জি-দের হয়তো পেশাদার দুনিয়ার প্রস্তুতি কমিয়েছে, কিন্তু একই সাথে তাদের সচেতনতা বাড়িয়েছে যে কেন এখনো কভার লেটার (cover letter) প্রয়োজন, কেন বেতন তথ্য গোপন রাখা হয়, বা কেন ১৯৭০ সাল থেকে আজ পর্যন্ত জীবনযাত্রার ব্যয় কিংবা শিল্পমূল্যের সাথে মোটেও বেতন বৃদ্ধি সংগতি রাখেনি।
নিয়োগ ব্যবস্থাপকরা হয়তো জেন জি-দের আরও অনুপ্রাণিত দেখতে পেতেন যদি আমেরিকান ড্রিম (American Dream) তাদের নাগালের মধ্যে থাকত। কিন্তু বুমার (Boomers)-রা এটা বহু আগেই নিঃশেষ করে একটা জঞ্জালের স্তূপ রেখে গেছে।
খারাপ যোগাযোগ দক্ষতা ও সমস্যা সমাধানে অক্ষমতা
তবে জেন জি-দের সমালোচনা করার মতো যথেষ্ট যুক্তিও আছে। ৩৯% কোম্পানি বলছে জেন জি কর্মীদের যোগাযোগ দক্ষতা (communication skills) খারাপ, যা বেশ আশ্চর্যের ব্যাপার—কারণ তারা তো ঘণ্টার পর ঘণ্টা কল অব ডিউটি (Call of Duty)-তে হেডসেট পরেই চিৎকার করে কাটায়। যখন বেশিরভাগ অনলাইন লবি পরিণত হয় দোষারোপ আর বর্ণবাদী ও সমকামবিদ্বেষী গালি-গালাজের আখড়ায়, তখন বুঝতে অসুবিধা হয় না কেন জেন জি-দের যোগাযোগ দক্ষতা ঝাঁপসা হতে পারে।
এটা ৩৮% কোম্পানির অভিযোগের সাথে মিলে যায় যারা বলে জেন জি খুব বেশি সংবেদনশীল (overly sensitive) এবং পেশাগত মতামত নিতে হিমশিম খায়। অনলাইন দুনিয়া প্রতিটি মতভেদকে এক জিরো-সাম যুদ্ধের (যেখানে এক পক্ষের ক্ষতির মধ্য দিয়ে আরেক পক্ষের সমান লাভ হয়, ফলে মোট লাভ-লোকশান জিরো) রূপ দিয়েছে, যেখানে আত্মসম্মান রক্ষা করাই মূল—এবং এখন জেন জি কোন প্রতিক্রিয়া পেলে সেটাকে যেন বস তাকে আত্মসম্মানকে আঘাত করেছে ধরে নেয়।
আরও উদ্বেগজনক হলো, ৩৪% নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত জেন জি কর্মীরা সমস্যা সমাধানে অক্ষম (poor problem-solving skills)। ভিডিও গেম (video games) তে দক্ষতা সমস্যা সমাধানে সাহায্য করার কথা—কিন্তু বাস্তব জগতে সমস্যা সমাধান স্কাইরিমের (Skyrim) কোয়েস্ট মার্কার (quest marker) অনুসরণ করার মতো সহজ নয়, বিশেষ করে যখন আপনি ঠিকমতো যোগাযোগও করতে জানেন না।
মৌলিক প্রযুক্তিগত দক্ষতার অভাব
আরও হতাশাজনক হলো যে ৩০% নিয়োগকর্তা জানাচ্ছে জেন জি মৌলিক প্রযুক্তিগত দক্ষতাতেই (basic technical skills) পিছিয়ে আছে, এক্সেল (Excel) আর ওয়ার্ড (Word)-এর মতো পুরোনো প্রোগ্রামগুলো ব্যবহার করতেও তারা হিমশিম খায়। ধারণা করা হচ্ছে, মুঠোফোনে নির্ভরতা এবং গুগল ডক্স (Google Docs)-এর মতো ক্লাউড-ভিত্তিক এডিটরের ব্যবহার জেন জি-দের ঐতিহ্যবাহী ওয়ার্ড প্রসেসিং প্রোগ্রামের মেনু নেভিগেট করা বা সাধারণ ফরম্যাটিং কাজ করতে নিরুৎসাহিত করেছে।
বিদ্রূপের বিষয়, প্রথম সম্পূর্ণ ডিজিটাল প্রজন্ম হওয়া সত্ত্বেও জেন জি-দের টাইপিং দক্ষতা (typing skills) হ্রাস পাচ্ছে। কারণ তারা অটো-কারেক্টের (auto-correct) উপর এতটাই নির্ভরশীল যে বানান কেবল ধারেকাছেই রাখলেই চলছে।
রেডিট (Reddit)-এ এরকম প্রচুর পোস্ট আছে, যেখানে মানুষ জেন জি কর্মীদের কম্পিউটার প্রোগ্রাম বা এমনকি কম্পিউটার ব্যবহার নিয়ে অজ্ঞতার কথা বলছে। এই অভিযোগ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসছে, কেবল আমেরিকা বা পশ্চিমা দেশেই সীমিত নয়।
কিন্তু পুরো দোষ জেন জি-দের উপরে দেয়াও ঠিক নয়। কলেজ আর হাইস্কুলগুলোও শিক্ষার্থীদের আধুনিক কর্মক্ষেত্রের চ্যালেঞ্জের জন্য প্রস্তুত করতে ব্যর্থ হচ্ছে। আগের প্রজন্মরা বাধ্যতামূলক টাইপিং (typing) এবং কম্পিউটার প্রশিক্ষণ পেত, যা তাদের মজবুত ভিত্তি গড়ে দিত। কিন্তু আজ, অনেক স্কুল ধরে নিয়েছে জেন জি প্রযুক্তিতে এমনিতেই দক্ষ, তাই আনুষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ দরকার নেই। ফলত জেন জি তাদের জ্ঞান অনেকটা অনানুষ্ঠানিক এবং স্বশিক্ষিতভাবে অর্জন করছে, যা কর্মক্ষেত্রে কাজে লাগছে না। সম্প্রতি ক্যালিফোর্নিয়া (California) পাবলিক শিক্ষার্থীদের জন্য টাইপিং ক্লাস আবার বাধ্যতামূলক করেছে, যেমন তাদের বাবা-মায়েরা করত।
সামাজিক দক্ষতার সংকট
জেন জি মানসিকভাবে এক সামাজিক দক্ষতার সংকটে ভুগছে। তাদের অনলাইন জীবনে মুখোমুখি মিথস্ক্রিয়া খুবই কম। এ কারণেই দেখা যাচ্ছে “ডেটিং সংকট” (dating crisis) নামে পরিচিত একটি অবস্থা, যেখানে জেন জি প্রকৃত রোমান্টিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে ব্যর্থ। অনলাইন কালচার আপনাকে বিশ্বব্যাপী মানুষের সাথে খেলতে দেয় বটে, কিন্তু বাস্তব যোগাযোগ এখনও গুরুত্বপূর্ণ। মনোবিজ্ঞানী অ্যান্ড্রু থমাসের (Andrew Thomas) এক জরিপ বলছে, ২০১৮ সালে কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে “বিচ্ছিন্ন অনুভব” করার হার ছিল ১৩%, যা ২০২২ সালে বেড়ে ৩০% হয়েছে।
জেন জি মুখোমুখি সামাজিক সাক্ষাৎ এড়িয়ে চলছে। সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল (Center for Disease Control)-এর জরিপ বলছে কিশোররা এখন আগের চেয়ে বেশি সতর্ক—তারা ধূমপান, মাদক সেবন, মদ্যপান, শারীরিক সংঘর্ষ এমনকি যৌন সম্পর্কেও কম আগ্রহী, এবং এই প্রবণতা ১৯৯০ সাল থেকে ক্রমাগত কমছে। প্রথমে শুনতে ভালো লাগলেও, এর খারাপ দিক হলো কিশোররা এখন হাউস পার্টির মতো ব্যক্তিগত জমায়েতে আগের চেয়ে কম যাচ্ছে। এবং বিশাল এক শতাংশ—৫৯%—জেন জি পুরুষ বলেছে তারা গত এক বছরে সামনাসামনি কোনো সম্ভাব্য সঙ্গীর সাথে আলাপও শুরু করেনি।
পরিস্থিতি স্পষ্ট: জেন জি আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে কম সামাজিক, যদিও তারা সোশ্যাল মিডিয়ায় (social media) সবসময় সক্রিয়। আর এই বিষয়টা তাদের পেশাগত জীবনে ক্ষতি করছে। তারা আগের চেয়ে বেশি ভিডিও গেম খেললেও—যা সমস্যার সমাধান ও সমালোচনামূলক চিন্তার দক্ষতা বাড়ায় বলে মনে করা হয়—বাস্তব জীবনের পরিস্থিতিতে এসব দক্ষতা প্রয়োগ করতে পারছে না। ভিডিও গেমের জন্য উপযুক্ত দক্ষতা বেশিরভাগ পেশার জন্য মোটেও মানানসই নয়। যদিও এমন কিছু খাত আছে যেখানে জেন জি উজ্জ্বল করে, যা তাদের অনন্য পরিচয়ের প্রতিফলন।
প্রত্যেক নিয়োগ পরিচালকের মনে এখন প্রশ্ন—কী করা যায়? বিশ্ব যতো ডিজিটাল হচ্ছে, এই নিয়োগ সংকট তত বাড়বে। স্কুলে টাইপিং আর কম্পিউটার পরিচিতি ক্লাস আবার চালু করা ভালো উদ্যোগ, কিন্তু এটা জেন জি-দের সামাজিক দক্ষতা, সমস্যার সমাধানের সামর্থ্য, এবং স্বপ্রণোদিত আগ্রহের অভাব মেটাবে না।
শিল্পের ভবিষ্যৎ অত্যন্ত অনিশ্চিত, আর এই বিষয়টা সবার জন্যই দুশ্চিন্তার কারণ।
দ্য পপুলেশন কলাপ্স: কেন এখন আর কেউ সন্তান নিতে চায় না
জনসংখ্যা হ্রাসের হুমকি
১৭০০ থেকে ১৮০০ সালের মধ্যে পৃথিবীর জনসংখ্যা ৬০০ মিলিয়ন থেকে ১ বিলিয়নে পৌঁছায়। কিন্তু তার পরের ২০০ বছরে এই সংখ্যা ৫ বিলিয়ন পেরিয়ে যায়। ১৯৬১ সালে মারিনার এস. একলস (Marriner S. Eccles), যিনি যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ সিস্টেমের (Federal Reserve System) বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান ছিলেন, তিনি বিশ্বের জনসংখ্যার ক্রমবর্ধমান হারের কথা উল্লেখ করে বলেছিলেন যে এটি বিশ্বের সামনে দাঁড়ানো সবচেয়ে জরুরি সমস্যা। এটি এমনকি পারমাণবিক বা হাইড্রোজেন বোমার চেয়েও বেশি বিস্ফোরক প্রভাব ফেলতে পারে।
আজ আমরা অনেকেই টের পাচ্ছি আসল সত্যটা কী: আমাদের পৃথিবীর সামনে সবচেয়ে বড় হুমকি আসলে জনসংখ্যার আধিক্য (overpopulation) নয়, বরং জনসংখ্যার স্বল্পতা (underpopulation)। গত বছর সারা বিশ্বে মাত্র প্রায় ৭০০,০০০ শিশু জন্মেছিল। এভাবে চলতে থাকলে অবসরপ্রাপ্তদের সংখ্যা কর্মরত মানুষের সংখ্যার চেয়ে বেশি হয়ে যাবে। এমনকি ২০৫০ সালের মধ্যে চীনের মোট জনসংখ্যা ৬৫০ মিলিয়নের নিচে নেমে যেতে পারে।
হয়তো আগামী ২০ বছরে বিশ্বের সবচেয়ে বড় সমস্যা হবে জনসংখ্যা হ্রাস (population collapse)। আমরা মানব ইতিহাসের একটি মৌলিক পরিবর্তনের সূচনায় রয়েছি। কীভাবে এমনটা ঘটলো? এটা কি সত্যিই এত বড় সমস্যা? পৃথিবীতে মানুষ কমে গেলে কি পৃথিবীর পরিবেশের জন্য ভালো হবে না? আর মানবজাতির ভবিষ্যৎ তাহলে কী দাঁড়াবে? এই লেখায় এসব প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করা হবে।
কীভাবে আমরা এই অবস্থায় এলাম?
বিশ্বের জনসংখ্যা ১৯৫০-এর দশক থেকে শুরু করে অত্যন্ত দ্রুত বৃদ্ধির মুখোমুখি হয়। অর্থনীতিবিদ এবং সমাজবিজ্ঞানীরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। এই সময় থেকেই পল আরলিখ (Paul Ehrlich) নামের স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপক ১৯৬৮ সালে লেখেন “দ্য পপুলেশন বম্ব (The Population Bomb)” নামে একটি বই। সেই বইয়ের প্রস্তাবনায় প্রথম লাইনেই ছিল মোটামুটি এমন ধারণা: “সমস্ত মানবজাতিকে খাওয়ানোর যুদ্ধ শেষ, ১৯৭০ ও ১৯৮০ এর দশকে শত শত মিলিয়ন মানুষ অনাহারে মারা যাবে, যতই এখন থেকে জোর প্রচেষ্টা নেওয়া হোক না কেন।”
এই বইয়ের সবচেয়ে বড় উদ্বেগ ছিল যে তখনকার বিদ্যমান জনসংখ্যাকে যথেষ্ট খাওয়ানো যাচ্ছিল না, আর যেহেতু জনসংখ্যা দ্রুত বাড়ছিল, খাদ্য উৎপাদন এর সাথে তাল মিলিয়ে বাড়তে পারবে না; ফলে বিশ্বব্যাপী দুর্ভিক্ষ (famine) দেখা দেবে। এই ভাবনা জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ (population control) নিয়ে সার্বিক জনমতে বড় প্রভাব ফেলেছিল।
যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা (U.S. Agency for International Development বা USAID) তখন পরিবার পরিকল্পনা (family planning) কর্মসূচিকে বিশ্বব্যাপী সমর্থন দিতে থাকে, বিশেষ করে ভারত, বাংলাদেশ, ইন্দোনেশিয়ার মতো দেশে। এর মধ্যে ছিল গর্ভনিরোধক (contraceptives) বিতরণ ও নির্বীজনকরণ (sterilization) ক্যাম্পেইনকে আর্থিক সহায়তা দেওয়া। একই সময়ে চীনে প্রণীত এক সন্তান নীতি (one-child policy) পরিবারের ওপর আর্থিক জরিমানা আরোপ করে যদি তাদের একের বেশি সন্তান থাকে। এছাড়াও, নারীদের শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধির পেছনে এই অতিরিক্ত জনসংখ্যাভীতি ভূমিকা রেখেছিল।
এভাবে বিভিন্ন আইন ও নীতি বাস্তবায়নের ফলে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ২%-এর ওপরে থাকা অবস্থান থেকে এখন প্রায় ০.৮%-এ নেমে এসেছে।
এবার দেখা যাক সেই “পপুলেশন বম্ব” বইয়ের ভবিষ্যদ্বাণী কতটা সত্যি হলো। বিশ্বব্যাপী দুর্ভিক্ষের পূর্বাভাসের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে বাস্তবে দুর্ভিক্ষ পুরোপুরি নির্মূল হয়নি, কিন্তু যেখানে দুর্ভিক্ষ হচ্ছে সেগুলোর মূল কারণ রাজনৈতিক অস্থিরতা, খাদ্যস্বল্পতা নয়। বাস্তবে আজ আমাদের বড় সমস্যা হলো অতিভোজন (over-consumption), খাবারের সংকট নয়। এখন বিশ্বব্যাপী স্থূলতা (obesity) মহামারী দেখা দিয়েছে, ১৯৭০-এর দশক থেকে মাথাপিছু ক্যালরি গ্রহণ গড়ে ২৪% বৃদ্ধি পেয়েছে। এর ফলে টাইপ ২ ডায়াবেটিস (type 2 diabetes) রোগীর সংখ্যা বেড়েছে এবং বিশ্বব্যাপী মৃত্যুহারও ১৯৬৫-৭৪ সময়কালে প্রতি ১০০০ জনে ১৩ জন থেকে ১৯৮৫-৯০ সময়কালে প্রতি ১০০০ জনে ১০ জনে নেমে এসেছে। বলা যায়, সেই ভবিষ্যদ্বাণীগুলো অনেকটাই ভুল প্রমাণিত হয়েছে। যদিও পরিবেশগত ক্ষতির আশঙ্কা যে ভুল ছিল না, তা আমরা এখন অনুভব করছি ক্রমবর্ধমান গরমে জর্জরিত গ্রহে।
কিন্তু এই ভুল পূর্বাভাসের কারণে ভবিষ্যতে আমাদের কী প্রতিক্রিয়া হবে? সেখানেই বিষয়টা হয়ে উঠছে কিছুটা অন্ধকারাচ্ছন্ন।
ভবিষ্যৎ কেমন হতে পারে?
ভবিষ্যৎ কীভাবে দেখা যেতে পারে তা বোঝার সহজ উপায় হলো প্রজনন হার প্রতিস্থাপন মাত্রা (fertility rate replacement level) দেখা। এটি হলো প্রতি নারীর জীবদ্দশায় গড়ে যতগুলি সন্তান জন্ম দিতে হবে যাতে তিনি ও তার সঙ্গী মিলে নিজেদের স্থান প্রতিস্থাপন করতে পারেন। এই হার প্রায় ২.১ শিশু প্রতি নারী। যদি একটি দেশের প্রজনন হার ২.১ এ থাকে, তাহলে সেই দেশের জনসংখ্যা বাড়বে না, কমবেও না, অভিবাসন (migration) ছাড়া।
কিন্তু বর্তমানে অনেক দেশের প্রজনন হারই এই প্রতিস্থাপন মাত্রার নিচে। ১৯৭০ সালের কাছাকাছি, অর্থাৎ “পপুলেশন বম্ব” বই প্রকাশের সময়, বিশ্বের প্রায় সব দেশই ধীরে ধীরে ২.১ এর নিচে নেমে যায়। এখন কেবলমাত্র আফ্রিকা এবং ইউরোপ ও দক্ষিণ আমেরিকার কিছু অংশে জনসংখ্যা স্থিতিশীল বা কিছুটা বেড়েছে।
ধরে নিন সারা বিশ্বের প্রজনন হার যদি আজকের যুক্তরাষ্ট্রের মতো হতো, তাহলে কয়েকশো বছরের মধ্যেই আমাদের বৈশ্বিক জনসংখ্যা প্রায় ২ বিলিয়নে নেমে আসবে। অর্থাৎ আমাদের সর্বোচ্চ ৮ বিলিয়ন থেকে প্রায় ৬ বিলিয়ন লোক কমে যাবে। এরপরও এই সংখ্যা আরও কমতে পারে, ফলে গোটা জাতির বিলুপ্তি (extinction) ঘটতে পারে।
কীভাবে আমরা এত নিচু প্রতিস্থাপন হারে চলে এলাম? একটা বই তো এত বিশাল ধ্বংসাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে না! আসলে এর পেছনে অনেকগুলো অপ্রত্যাশিত সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তন একসাথে কাজ করেছে। এসব না বুঝলে পরিস্থিতি পরিবর্তনের সম্ভাবনা খুবই কম।
গ্রামীণ অঞ্চল
এটি মূলত শুরু হয়েছে যখন আমরা গ্রামীণ জীবনধারা (rural lifestyle) থেকে শহুরে (urban) জীবনে ব্যাপক স্থানান্তর ঘটালাম। ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায় গ্রামীণ এলাকায় জনসংখ্যা প্রায়ই স্থিতিশীল থাকে, কিন্তু যেসব এলাকা নগরায়িত হয়েছে (urbanized) সেসব ক্ষেত্রে জন্মহার (birth rate) হ্রাস পেয়েছে।
এর একটি বড় কারণ সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য। গ্রামীণ কৃষি নির্ভর সমাজে বড় পরিবারের গুরুত্ব অনেক বেশি। কারণ কৃষিকাজে পরিবারের সকলের সহায়তা প্রয়োজন হয়। এছাড়া গ্রামীণ সমাজে সবাই সবাইকে চেনে, ফলে সামাজিক নিয়মভঙ্গ করলে সুনাম নষ্ট হবার ভয় থাকে। তাছাড়া গ্রামে নারীরা কম শিক্ষাগত ও কর্মসংস্থানের সুযোগ পায়, ফলে তারা অল্প বয়সেই বিয়ে করে সন্তান নেওয়ায় বেশি আগ্রহী হয়। গ্রামীণ সমাজ সাধারণত বেশি ধার্মিক (religious) ও রক্ষণশীল (conservative), যা বড় পরিবার গড়ার গুরুত্বকে জোর দেয়।
বর্তমানেও অ্যামিশ (Amish) সম্প্রদায়ের দিকে তাকিয়ে দেখতে পারেন। যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থিত এই খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের পরিবারে সাধারণত ৬-৭টি সন্তান থাকে। তারা খুব কঠোরভাবে তাদের ধর্মীয় মূল্যবোধ মেনে চলে এবং বাইরের জগতের প্রভাবের সুযোগ কম। ফলে তাদের মধ্যে একে অপরের প্রতি সহযোগিতার মনোভাব ও স্থিতিশীল পরিবার পরিকল্পনা লক্ষ্য করা যায়।
শহুরে অঞ্চল
এখন শহুরে শিল্পায়িত বিশ্বের দিকে তাকাই, যেখানে প্রায় ৯০% মানুষ বাস করে। এখানে বড় পরিবার রাখার অনুপ্রেরণা অনেক কম। কেন? কারণ শহরে আপনি আসলে কমিউনিটি বা প্রতিবেশী হিসেবে খুব একটা পরিচিতি পান না। আপনার “প্রতিবেশী” বলতে হয়তো আপনার অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিংয়ের হলওয়েতে দেখা হওয়া ব্যক্তিদের বোঝায়। এছাড়া বহু শহর, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রে, এমনভাবে পরিকল্পিত যে আপনাকে সর্বদাই গাড়িতে চড়ে ঘুরতে হয়, ফলে সামাজিক মেলামেশার জন্য তৃতীয় কোনো জায়গা (third place) খুঁজে পাওয়া কঠিন। বাড়ি আর অফিসের বাইরে যেই জায়গাটিতে মানুষ মিলিত হয়ে আড্ডা দিত, তা অনেকাংশেই হারিয়ে গেছে।
অন্যদিকে শহরে শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের সুযোগ বেশি, ফলে নারীরা আর আগের মতো অল্প বয়সে বিয়ে করে সন্তান নেওয়ার ওপর নির্ভরশীল নয়। গর্ভনিরোধক আর জন্মনিয়ন্ত্রণ বড় কোনো অপ্রত্যাশিত গর্ভধারণকে (unintended pregnancy) রোধ করে, যদিও এটি নিম্নআয়ের (low-income) নারীদের ক্ষেত্রে খুব বেশি পার্থক্য আনতে পারেনি।
তরুণরা ক্রমশ ডিজিটাল ডিভাইসে (digital devices) বেশি সময় দিচ্ছে, বাস্তব জগতের মানুষের চেয়ে ভার্চুয়াল ছবিতে মানুষ দেখা, সোশ্যাল মিডিয়ায় সুদৃশ্য মানুষদের দেখে নিজেদের মানদণ্ড উঁচু করা—সব মিলে “সৌন্দর্যের মুদ্রাস্ফীতি (beauty inflation)” তৈরি করেছে। তারা বাস্তব জীবনের গড় মানুষের চেয়ে ভার্চুয়াল জগতের নির্বাচিত সেরা চেহারার মানুষ দেখে আকর্ষণের মান নির্ধারণ করছে। ফলে বাস্তবে কাউকে পছন্দ করা কঠিন হয়ে পড়ছে।
সোশ্যাল মিডিয়া ও ডেটিং অ্যাপ (dating apps) মানুষকে পণ্যের মতো করে ভাবতে উৎসাহিত করছে, যেখানে একজন পার্টনারকে সহজে বাতিলযোগ্য (disposable) হিসেবে দেখা হয়। এর ফলে নারী ও পুরুষের মূল্যবোধের মধ্যে বড় বিভাজন তৈরি হচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, তরুণ পুরুষরা দিন দিন বেশি রক্ষণশীল (conservative) আর তরুণ নারীরা বেশি উদারপন্থী (liberal) হয়ে উঠছে। “মেন গোইং দেয়ার ওন ওয়ে বা মিগটাউ (Men Going Their Own Way বা MGTOW)” আন্দোলন বা দক্ষিণ কোরিয়ার নারীদের মধ্যে “4B মুভমেন্ট (4B movement)” এই বিভাজনের উদাহরণ।
শহুরে সমাজে সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের এরকম খিচুড়ির কারণে ফলস্বরূপ একই দেশের দুইজন মানুষের মূল্যবোধের মিল পাওয়া কঠিন হয়। এর ফলে তারা একত্রে জীবন গড়ার ব্যাপারে অনিচ্ছুক হয়ে পড়ে। এর সাথে যোগ করুন ক্রমবর্ধমান অস্থিরতার খবর, জলবায়ু পরিবর্তন, অর্থনৈতিক অস্থিরতা – যা মিডিয়ায় ক্রমাগত উঠে আসছে, তরুণ প্রজন্মের অনেকেই মনে করে, “এমন একটা অনিশ্চিত বিশ্বে আমি কেন সন্তান আনব?”
এছাড়া জীবনযাত্রার ব্যয় (cost of living) এবং সন্তানের খরচও এক বড় বাধা। একসময় কলেজ ডিগ্রি মানেই ছিল একটা স্থিতিশীল চাকরি ও একটা বাড়ি কেনার সামর্থ্য, যা পরিবার গড়ার পথ সহজ করত। এখন এই নিশ্চয়তা অল্প সংখ্যক মানুষের কাছেই সীমিত। যেসব দেশে জন্মহার সবচেয়ে কম, দেখা যায় সেসব দেশে তরুণ বেকারত্ব (youth unemployment) বেশি এবং বাড়ির দাম আয় অনুপাতে অনেক বেশি। ফলে তরুণদের কাছে বাড়ি কেনা দূরাশা হয়ে দাঁড়ায়।
কেন এটা নিয়ে বেশি আলোচনা হয় না?
তাহলে প্রশ্ন আসতে পারে, এই বিষয়টা নিয়ে কেন বেশি কথা হচ্ছে না? কারণ এখনো বয়স্ক (older) জনসংখ্যা আমাদের মোট জনসংখ্যার বড় অংশ ধরে রেখেছে। মানুষের আয়ু বেড়ে যাওয়ার ফলে মনে হচ্ছে যেন এখনো সবকিছু মোটামুটি স্থিতিশীল বা উন্নতির দিকে। কিন্তু জন্মহার হ্রাসের আসল প্রভাব আমরা সামনে দেখতে পাবো, যখন এই বয়স্কদের পরবর্তী প্রজন্ম যথেষ্ট পরিমাণে আসবে না।
জনসংখ্যা হ্রাসের পরিণতি
জনসংখ্যা হ্রাসের ফলে কী হবে? কম তরুণ কর্মী মানে কম শ্রমশক্তি (labor force) আর কম করদাতা (taxpayer)। কর কমলে প্রাথমিকভাবে ভালো লাগলেও, দীর্ঘমেয়াদে সরকারি সেবায় (public services) কাটছাঁট বা বিদ্যমান মানুষের ওপর কর বাড়ানোর দরকার হতে পারে। তরুণ কর্মী কমে গেলে বৃদ্ধদের দেখাশোনার (healthcare, pension) জন্যও সমস্যা হবে। কারণ অবসরপ্রাপ্ত বৃদ্ধদেরকে সাপোর্ট দেওয়ার জন্য তরুণ কর্মীবাহিনী প্রয়োজন।
কিছু মানুষের ধারণা, জনসংখ্যা কমলে পরিবেশের ওপর চাপ কমবে। কিন্তু অর্থনৈতিক অস্থিরতার কারণে তখন পরিবেশ সংরক্ষণে (environmental protection) বিনিয়োগ করাও কঠিন হতে পারে।
জনসংখ্যা কমলে দেশের উৎপাদনে চাপ পড়ে, তাই ইমিগ্রেশন প্রমোট করার দরকার হয়, আর অনেক সময় বিজাতীয় লোকেদের আগমনের ফলে সামাজিক অস্থিতিশীলতা তৈরি হতে পারে।
আমরা কী করতে পারি?
অনেক নেতিবাচক কথা বললাম। এবার সমাধানের দিকে তাকাই। শুধু অর্থনৈতিক প্রণোদনা (financial incentives) দিয়ে এই সমস্যা মিটবে না। দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, যাদের জন্মহার খুবই কম, তারা সন্তান নেওয়া পরিবারকে আর্থিক সহায়তা দিয়েও খুব একটা সুফল পায়নি। কারণ সমস্যাটি বহুমুখী (multi-faceted)।
আমি নিজে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী (individualist) চিন্তাধারার পক্ষে, এবং গ্লোবালাইজেশন (globalization) তরুণদের ভিন্ন মতামত, ভিন্ন মূল্যবোধ জানার সুযোগ করে দিয়েছে—যা ভালো। তরুণদের এখন আগের মতো কম বয়সেই বিয়ে বা পরিবার গড়তে বাধ্য করা হচ্ছে না। তারা বেশি বিকল্প পাচ্ছে। কিন্তু এই স্বাধীনতার চরম রূপ আবার কিছু খারাপ ব্যাপার নিয়ে এসেছে।
আমার আশা, আমরা আধুনিকতা (modernity) আর ঐতিহ্যবাহী (traditional) মূল্যবোধের মধ্যে একটা ভারসাম্য (balance) আনতে পারবো। মানুষ সবসময় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছে। এখন আমরা অনেক বেশি জটিল বিষয়ে দ্রুত পরিবর্তন আনছি, যা সবসময় কিছু বাধা সৃষ্টি করবে। কিন্তু আমরা এখন শিখতে শুরু করেছি কী কী আমাদের জন্য ক্ষতিকর।
এর অর্থ হলো ডিজিটাল ডিভাইসের ব্যবহার সীমিত করা, যাতে মানুষ বাস্তব সমাজে মেলামেশা করে কমিউনিটি গড়তে পারে। তরুণদের জন্য আরো বেশি সামাজিক পরিসর (third place) তৈরি করা, ডেটিং অ্যাপগুলোকে এমনভাবে ডিজাইন করা যাতে তারা মানুষকে পণ্যের মতো না দেখে, কাজের ঘন্টা কমিয়ে, আয় বাড়িয়ে, সাশ্রয়ী মূল্যের আবাসন তৈরি করা। এছাড়া তরুণদের মধ্যে ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আশা ও বিশ্বাস (hope and faith) ফিরিয়ে আনতে হবে—ধর্ম (religion) না হোক, অন্তত এমন সমাজব্যবস্থা গড়তে হবে যাতে তারা আবার আগ্রহী হয় সামনে এগোতে এবং পরিবার গড়তে।
প্রশ্ন হলো: কীভাবে আমরা আবার সেই সামাজিক পরিবেশের দিকে ফিরব, যেখানে সম্প্রদায়বোধ আর সহযোগিতা ছিল কেন্দ্রে? আমাদের বুঝতে হবে কোন অংশগুলি আধুনিক সমাজে কাজ করছে না এবং সেগুলো সংশোধন করে ইতিবাচক অগ্রগতি বজায় রাখতে হবে।
মানবজাতি ও মহাবিশ্ব সবসময় কোনো না কোনো ভারসাম্যে (equilibrium) ফিরে যেতে চায়। আমাদের জনসংখ্যা দ্রুত কমে যাওয়া এই প্রাকৃতিক পরিবর্তনেরই অংশ, আমাদের পরবর্তী বিবর্তনের (evolution) ধাপ।
উন্নত দেশগুলোতে তরুণ প্রজন্ম কেন তাদের পূর্বপুরুষদের চেয়ে বেশি আবাসন সংকটে রয়েছে?
ভূমিকা
১৯৪৫ সালে মিত্রশক্তি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জয়লাভ করে। এতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের একমাত্র উৎপাদন কেন্দ্রে পরিণত হয়, যা ধ্বংসস্তূপ থেকে অক্ষত ছিল। এর ফলস্বরূপ ইতিহাসের দীর্ঘস্থায়ী অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির সময়কালগুলোর মধ্যে একটি শুরু হয়েছিল, যখন আমেরিকান শিল্প দ্রুত নতুন মধ্যবিত্ত শ্রমিক শ্রেণির জীবনযাত্রার মান উন্নত করে। এই ঘটনা নতুন শিশুর জন্মের হার বৃদ্ধির সঙ্গে মিলে যায়, কারণ মানুষ কয়েক বছরের কঠিন সংঘাতের মধ্য দিয়ে জীবনযাপন করার পর পরিবার শুরু করতে প্রস্তুত ছিল। নতুন শিশুদের এই প্রজন্মের একটি নামকরণের প্রয়োজন ছিল, তবে সেই নামটি কী হবে, তা নিয়ে এখনও আলোচনা চলছে।
প্রজন্মের নামকরণের প্রথা একদিকে সরিয়ে রাখলে, এই যুদ্ধ-পরবর্তী শিশুরা কিছু কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হচ্ছে। জীবনের দুটি দুঃখজনক নিশ্চয়তা হল মৃত্যু ও কর (taxes)। আমরা এখানে এই দুটি বিষয় নিয়েই আলোচনা করব, তবে আপাতত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল ইতিহাসের সবচেয়ে ধনী প্রজন্ম অবসর নিতে এবং মারা যেতে শুরু করেছে। এর মাধ্যমে তারা ইতিহাসের বৃহত্তম সম্পদ স্থানান্তরের (wealth transfer) জন্য দায়ী থাকবে, কারণ তারা সম্মিলিতভাবে ৩০ ট্রিলিয়ন ডলার তাদের সুবিধাভোগীদের কাছে হস্তান্তর করবে, যা আগামী কয়েক দশকে শুধুমাত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই ঘটবে। এই ধরনের পুঁজি স্থানান্তরের অর্থনীতিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলবে, যার কিছু তারা ইতিমধ্যেই অনুভব করতে শুরু করেছে।
তাহলে প্রকৃতপক্ষে কী স্থানান্তরিত হচ্ছে? এই সমস্ত জিনিস কি তাদের নতুন মালিকদের হাতে নিজস্ব মূল্য বজায় রাখবে? এর ওপর কি কর (tax) বসানো উচিত? এবং সবশেষে, এটি কীভাবে একটি বিশাল অর্থনৈতিক সমস্যা হতে পারে?
একটি প্রজন্মের সম্পদ স্থানান্তর সঠিকভাবে মোকাবেলা ও পরিচালনা করা অর্থনীতির জন্য বাঁচা-মরার প্রশ্ন হতে পারে। যদি এটি সঠিকভাবে পরিচালনা করা না হয়, তবে সম্পদ এবং ব্যবসা তাদের পূর্ববর্তী মালিকদের তত্ত্বাবধান ছাড়াই চলতে পারে। তবে এই পুরো বিষয়টির প্রেক্ষাপট বুঝতে প্রথমে এটা বোঝা জরুরি:
যা স্থানান্তরিত হচ্ছে
আগামী কয়েক দশকে প্রত্যাশিত উত্তরাধিকারের সম্মিলিত মূল্য কিছু অনুমান অনুসারে বিশ্বব্যাপী ১০০ ট্রিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি। এই বিশ্বব্যাপী চিত্রটি কিছুটা কম কংক্রিট এবং নির্ভরযোগ্যভাবে নির্ধারণ করা কঠিন। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এই সংক্রান্ত নিয়মকানুন তুলনামূলকভাবে বেশি কঠোর। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আমরা যে সংখ্যাটি দেখছি, তা হল ৩০ ট্রিলিয়ন ডলার, যার মধ্যে প্রায় ৯ ট্রিলিয়ন ডলার রয়েছে সাধারণ লিকুইড এবং আধা-লিকুইড সম্পদের আকারে। এর মধ্যে রয়েছে নগদ, গাড়ি, নৌকা, বিনি বেবি কালেকশন, শেয়ার পোর্টফোলিও এবং বাড়ি।
এই সমস্ত অর্থ হাতবদল হওয়ার কারণে একটি তরুণ প্রজন্মের আর্থিক অবস্থার উন্নতি ঘটবে, যারা স্টুডেন্ট লোনের বোঝা, স্থবির বেতন এবং অস্থির চাকরির বাজারের মতো অর্থনৈতিক প্রতিকূলতার শিকার। আপনি হয়তো মনে করতে পারেন যে এটা দারুণ, অবশেষে এটি মিলেনিয়াল প্রজন্মকে (millennials) তাদের বাড়ি তৈরিতে বা ঋণের বোঝা থেকে মুক্ত হতে বা এমনকি বেশি খরচ করতে সাহায্য করবে। এবং এই স্থানান্তরের ফলে অবশ্যই কিছু ভাল জিনিস ঘটবে, তবে এটি সম্পূর্ণ ভালো খবর নাও হতে পারে।
চাহিদার উপর প্রভাব
এই স্থানান্তরের প্রথম প্রভাব হবে চাহিদার উপর ঊর্ধ্বমুখী চাপ। আমেরিকান ইকোনমিক রিভিউ দ্বারা প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্রে দেখা গেছে যে উত্তরাধিকার সূত্রে অপ্রত্যাশিত অর্থপ্রাপ্তির পরে প্রায় ৭০% পরিবার ৫ বছরের মধ্যে সেই সমস্ত অর্থ খরচ করে ফেলেছে। তাদের তরফে এটি স্পষ্টতই ভয়ানক আর্থিক ব্যবস্থাপনা। তবে বৃহত্তর অর্থনীতির জন্য এই অবাধ খরচ মানুষের জন্য চাকরি এবং ব্যবসার সুযোগ তৈরি করবে। সম্ভবত জেটস্কি শিল্পের সঙ্গে যুক্ত লোকেদের জন্য। এখানে দ্রুত উল্লেখ করা দরকার যে এই গবেষণাপত্রটি বেশ পুরনো। এটি মূলত ১৯৫৯ সালে প্রকাশিত হয়েছিল এবং পরে ১৯৬১ সালের জন্য সংশোধন করা হয়েছিল। তবে তার পর থেকে ভোক্তাদের প্রান্তিক ভোগ প্রবণতা (marginal propensity to consume) আরও বেড়েছে, যার অর্থ হল মানুষ প্রতি অতিরিক্ত ডলার পাওয়ার পরে তা বাঁচানোর চেয়ে বেশি খরচ করছে। এছাড়াও, আরও সাম্প্রতিক কিন্তু কম ব্যাপক গবেষণাগুলোতেও একই চিত্র দেখা গেছে।
এটি একটি আকর্ষণীয় ঘটনা এবং এই স্থানান্তর থেকে কিছু বিষয় আলাদা করে দেখা দরকার। প্রথমত, ছোট আকারের উত্তরাধিকার সম্ভবত অপচয় হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। এখন অবশ্যই কম অর্থ খরচ করা বেশি অর্থ খরচ করার চেয়ে সহজ, তবে এর মূল কারণ হল এই অর্থ কোথায় যায় সেই দিকটা। ১,০০,০০০ ডলারের কম পরিমাণের উত্তরাধিকার বেশিরভাগ মার্কিন নাগরিকের জন্য জীবন পরিবর্তনকারী নাও হতে পারে। ভুল বুঝবেন না, এটি অনেক টাকা, তবে এটি গড়পড়তা ব্যক্তিকে চাকরি ছাড়তে দেবে না এবং সম্ভবত বাড়ি কেনার জন্য যথেষ্টও হবে না। অবশ্যই, ১,০০,০০০ ডলার বিশ্বের প্রায় যেকোনো জায়গায় বাড়ির জন্য ভাল অর্থই। তবে বাকিটা কেনার জন্য অর্থায়নের যোগ্যতা অর্জন করা এখনও উত্তরাধিকারীর উপরই নির্ভর করবে। একটি সম্পদ-ভিত্তিক উত্তরাধিকার সম্ভবত কাউকে কিছু নগদ অর্থ এনে দিতে পারে, তবে এটি তাদের আয় বাড়ায় না বা তাদের ক্রেডিট স্কোর উন্নত করে না। তাই প্রায়শই এই পুঁজি কার্যকরভাবে ব্যবহার করা কঠিন।
অবশ্য, তুলনামূলকভাবে আর্থিকভাবে জ্ঞানীরা সম্ভবত স্টক মার্কেটের মতো বিকল্প বিনিয়োগের কথা উল্লেখ করবেন। এটি খারাপ পরিকল্পনা নয়, তবে বাস্তবে বেশিরভাগ সাধারণ মানুষ সরাসরি শেয়ারে বিনিয়োগ করতে বেশ ভয় পায়। ২০১৬ সালের গ্যালাপ পোলে দেখা গেছে যে প্রায় ২৫% আমেরিকান ৪01k এবং রথ আইআরএ-এর মতো জিনিসগুলির বাইরে সরাসরি শেয়ারে বিনিয়োগ করে। এখন যেহেতু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মধ্যম সারির উত্তরাধিকার প্রায় ৬৯,০০০ ডলার, তাই আশা করা যায় যে এই অর্থের বেশিরভাগ অংশ দীর্ঘমেয়াদে সুবিধাভোগীদের জীবনযাত্রার মান বাড়াতে পারে এমন বিনিয়োগের পরিবর্তে অপচয়ই হবে।
এখানে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উল্লেখ করার মতো। তা হল মধ্যম সারির উত্তরাধিকারের পরিমাণ ৬৯,০০০ ডলার হলেও গড় উত্তরাধিকারের পরিমাণ ৭,০০,০০০ ডলারের বেশি। এর মানে হল যে এই সম্পদ স্থানান্তরের একটি বড় অংশ ধনী পরিবার থেকে আসছে এবং তাদের কাছেই যাচ্ছে।
এখন, নিয়মিত সুবিধাভোগীদের জন্য এই নগদ অর্থ ব্যবহারের জন্য আরও একটি বিকল্প রয়েছে। আর তা হল ঋণ পরিশোধ করা। ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ২০১৯ সালের তথ্য অনুযায়ী, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গড় স্টুডেন্ট লোনের পরিমাণ ৩২,৭৩১ ডলার। এখানে ভোগ্য ঋণকে একেবারেই গণ্য করা হয়নি। এই ধরনের অপ্রত্যাশিত আর্থিক লাভ সম্ভবত মানুষকে ঋণ পরিশোধ করতে উৎসাহিত করতে পারে, যা ব্যক্তিগত স্তরে সম্ভবত বেশ দায়িত্বপূর্ণ। তবে অর্থনীতি-জুড়ে এর অর্থ হল কোনও ভোগ নেই এবং কোনও বিনিয়োগ নেই, যা জিডিপির পরিসংখ্যানকে হতাশাজনক করে তোলে।
প্রাইভেট কোম্পানির ভূমিকা
এতক্ষণ আমরা শুধু ৯ ট্রিলিয়ন ডলার মূল্যের সম্পদের দিকে নজর দিয়েছি। এই ৯ ট্রিলিয়ন ডলার প্রায় যেকোনো ধরনের সম্পদ থেকে আসে যার উপর আপনি একটি মূল্য ট্যাগ লাগাতে পারেন। তাহলে প্রশ্ন জাগে, বাকি ২১ ট্রিলিয়ন ডলার কোথা থেকে আসছে?
আসলে, এটি আসছে ব্যক্তিমালিকানাধীন কোম্পানিগুলোর (private companies) বিশাল সংগ্রহ থেকে। প্রাইভেট কোম্পানি, যেগুলো নিগমবদ্ধ কিন্তু পাবলিকলি তালিকাভুক্ত নয়, ৬৫ বছরের বেশি বয়সী ব্যক্তিদের হাতে থাকা সম্পদের বেশিরভাগ অংশ তৈরি করে। এই ব্যবসাগুলো একটি পারিবারিক রেস্তোরাঁ থেকে শুরু করে কোচ ইন্ডাস্ট্রিজ পর্যন্ত যেকোনো কিছুই হতে পারে, তবে সাধারণত দেখা যায় যে ব্যবসার মালিকরা সম্পদের একটি বৃহত্তর অংশ নিয়ন্ত্রণ করেন।
এখানে আরেকটি বিষয় হল এই হিসাবে ট্রাস্ট স্ট্রাকচারও (trust structures) অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। ট্রাস্ট হল সুবিধাভোগীদের কাছে তাদের অবদানকারীদের মৃত্যুর আগে ও পরে সম্পদ বিতরণের একটি কার্যকর উপায়। এটি মূলত মনোনীত ব্যবস্থাপকদের সঙ্গে সম্পদের ভাণ্ডার যা সুবিধাভোগীদের উপকারের জন্য অর্থ নিয়ন্ত্রণ করে। এই সংস্থাগুলো ধনী ব্যক্তিদের মধ্যে বিশেষভাবে জনপ্রিয়, কারণ এর অর্থ হল তারা তাদের সন্তানদের অর্থ দিতে পারে এবং একই সঙ্গে কোনও ল ফার্মের মতো প্রতিষ্ঠানকে অর্থ ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব দিতে পারে। এর মাধ্যমে তারা অর্থ ব্যবহারের নিয়ম ও সীমাবদ্ধতা নির্ধারণ করতে পারে, যেমন তারা বছরে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ তুলতে পারবে অথবা সুবিধাভোগীকে অর্থ পাওয়ার জন্য কলেজের ডিগ্রি অর্জন করতে হবে অথবা ধনী লোকেরা তাদের সন্তানদের মৃত্যুর পরেও নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে এমন অদ্ভুত ও চমৎকার শর্তাদি রাখতে পারে।
এই কারণেই ধনী সন্তানরা ট্রাস্ট ফান্ডের সুবিধাভোগী হিসাবে পরিচিত হয়। এখন সম্পদের অসমতার যুক্তি একদিকে সরিয়ে রাখলে, ট্রাস্ট ফান্ড এবং ট্রাস্ট ফান্ডের সুবিধাভোগীরা এখানে সমস্যা নয়, বরং সমস্যা হল সেই প্রকৃত ব্যবসাগুলো যেগুলো প্রতিদিন চলছে। একটি অটো মেকানিক্সের দোকানের কথা ভাবুন, সেই ব্যবসার বেশিরভাগ মূল্য আসবে গাড়ি মেরামত করার ক্ষমতা থেকে। যদি এই ব্যবসা উইলের মাধ্যমে হস্তান্তরিত হয়, তবে এর কোনও গ্যারান্টি নেই যে পূর্ববর্তী মালিকের সুবিধাভোগীরা অটো মেরামতের কাজে কারিগরিভাবে দক্ষ হবে। এই সাধারণ উদাহরণে এর অর্থ হবে যে এই ব্যবসা তার মূল্যের একটি বড় অংশ হারাবে। এখন অবশ্যই বড় ব্যবসাগুলোতে এমন কর্মচারী থাকতে পারে যারা দৈনন্দিন কাজ সামলাতে পারে, তবে মালিকের অভাব খুব অস্থিরতা তৈরি করতে পারে। এমন কতগুলো ব্যবসার উদাহরণ আছে যা সিইও-র ছেলে হিসাবে পদোন্নতি পাওয়ার পরে একজন সিইও দ্বারা সফলভাবে পরিচালিত হয়েছে? অবশ্যই, সফল হস্তান্তর দেখা যায়, তবুও এর কোন নিশ্চয়তাও নেই।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেন্সাস ব্যুরোর একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে যে দুই-তৃতীয়াংশ পারিবারিক ব্যবসা প্রথম প্রজন্ম থেকে দ্বিতীয় প্রজন্মে টিকে থাকতে পারে না। আর যেগুলো টিকে থাকে, তাদের মধ্যে মাত্র ৫০% তৃতীয় প্রজন্মে পৌঁছাতে পারে। এমনকি যাদের কাছে আসার মতো কোনও লাভজনক পারিবারিক ব্যবসা নেই, তাদের জন্যও এটি একটি উদ্বেগের বিষয়। পরিবার-পরিচালিত ছোট থেকে মাঝারি আকারের উদ্যোগ ২০১৯ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মোট জাতীয় উৎপাদনের প্রায় ৫০% তৈরি করেছে। বিশ্বের অনেক দেশে এই সংখ্যা আরও বেশি। যদি এই ব্যবসাগুলোর ৫০% ভেঙে যায়, তবে এর অর্থ হবে চাকরি হ্রাস, উৎপাদনশীলতা হ্রাস এবং পুরো বিশ্বের জন্য সরবরাহ শৃঙ্খল বা সাপ্লাই চেইনের সমস্যা। এখন অবশ্যই এমন ব্যবসা থাকবে যা বন্ধ হয়ে যাওয়া ব্যবসাগুলোর প্রতিস্থাপন করবে, তবে এই পরিবর্তন সবসময় নিখুঁত অর্থনৈতিক অনুমানের মতো মসৃণ হয় না। পোস্ট-বুমার যুগে কাঠামোগত অদক্ষতা একটি বড় উদ্বেগের কারণ হবে।
উত্তরাধিকার কর (Estate Tax)
এত কিছু ঝুঁকির মধ্যে থাকার পরে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে যে কীভাবে এটি পরিচালনা করা হচ্ছে… অথবা আরও নির্দিষ্টভাবে, কীভাবে এটির উপর কর (tax) বসানো হচ্ছে?
আজ বিশ্বের বেশিরভাগ উন্নত দেশে সম্পদ হস্তান্তরের উপর কিছু প্রকারের এস্টেট ট্যাক্স (estate tax) ধার্য করা হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও এর ব্যতিক্রম নয়, যেখানে ১১.৬৮ মিলিয়ন ডলারের বেশি মূল্যের সম্পদের উপর ৪০% ফেডারেল ট্যাক্স ধার্য করা হয়। অবশ্যই, এই উচ্চ মূল্যের কারণে, এই চার্জগুলো ৯৯.৯% উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয় না, তবে যাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, তাদের জন্য এই চার্জগুলো বেশ বেশি।
মাল্টি-মিলিয়ন ডলারের এস্টেটগুলোতে কোনও না কোনও ধরনের পারিবারিক ব্যবসা জড়িত থাকার সম্ভাবনা বেশি, যা সেই সমস্যাগুলোকে আরও বাড়িয়ে তোলে (কারণ ইতিমধ্যেই বলেছি)। যদি কোনও ব্যবসা নেতৃত্ব পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যাওয়ার সময় সমস্যার সম্মুখীন হয়, তবে তাদের শেষ যে জিনিসটির প্রয়োজন হবে, তা হল আঙ্কেল স্যামের (Uncle Sam) হাত বাড়িয়ে তাদের মূল্যের ৪০% নগদ অর্থে পরিশোধ করতে বলা। এর ফলে সুবিধাভোগীরা সম্ভবত ট্যাক্সের বোঝা মেটাতে ব্যবসা বিক্রি করতে বাধ্য হবে, যা আবারও ব্যবসার ক্ষেত্রে অস্থিরতা সৃষ্টি করবে।
এখন এর চারপাশে একটি পুরো শিল্প গড়ে উঠেছে, যেখানে বীমা সংস্থাগুলোর (insurance companies) মতো প্রতিষ্ঠান এস্টেট ট্যাক্সের বোঝা মেটাতে জীবন বীমা পলিসি (life insurance policies) অফার করে। এর বাইরে এটা মনে রাখতে হবে যে পারিবারিক সংস্থাগুলোকে দেওয়া প্রকৃত মূল্যায়ন বেশ পরিবর্তনশীল হতে পারে এবং প্রায়শই এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে রিপোর্টিংয়ের উদ্দেশ্যে সম্ভবত তাদের প্রকৃত মূল্যের চেয়ে কম মূল্যায়ন করা হয়।
আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, ১১ মিলিয়ন ডলারের একটি পারিবারিক ব্যবসার সম্ভবত নির্বাহী পদে অধিষ্ঠিত কর্মীদের নিয়ে কিছু ধরণের উত্তরাধিকার পরিকল্পনা থাকবে। এখন এস্টেট ট্যাক্সের পক্ষে যুক্তি হল যে এটি পরিবর্তনের পর্যায়ে বড় প্রতিষ্ঠানগুলোতে কিছু অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারে, তবে তার জন্য পরিকল্পনা করা যেতে পারে, এমনকি যদি তার জন্য ঋণ নিতে হয়, ব্যবসার কিছু শেয়ার বিক্রি করতে হয় বা সত্যি কথা বলতে কী, কোনও এস্টেট আইনজীবীর সঙ্গে বসে কিছু ফাঁকফোকর খুঁজে বের করতে হয়। এই কর সেই লোকদের থেকে শক্তিশালী রাজস্ব প্রদান করে যারা নিশ্চিতভাবে এটি বহন করতে পারে, যখন ছোট ব্যবসা বা নিয়মিত লোকেদের উপর করের বোঝা কমায়, যাদের তাদের ট্রাস্ট ফান্ডে কেবল কয়েক হাজার ডলারই আসতে পারে। উভয় দিক রক্ষার একটি উপায় হল এই পরিবর্তনের সময়কালে ব্যাপক ব্যাঘাত এড়াতে নিয়মিত কার্যক্রমের সময় বড় ব্যবসার উপর বেশি কর বসানো।
চূড়ান্ত চিন্তা (Final Thoughts)
বৃহৎ সম্পদ স্থানান্তর আসন্ন এবং এটি বিশ্বজুড়ে ব্যক্তি, ব্যবসা এবং কোম্পানিগুলোর উপর খুব গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলবে। যদিও আপনি ব্যক্তিগতভাবে কোনও মোটা অঙ্কের ট্রাস্ট ফান্ডের সুবিধা নাও পেতে পারেন, তবুও এটা জানা দরকার যে এটি দারুণ সুযোগের একটি সময়কাল হবে। বিশৃঙ্খলা একটি সিঁড়ি, আর ব্যবসার হাতবদল, শেয়ার বিক্রি এবং উত্তরাধিকার অপচয় হওয়ার কারণে সৃষ্ট অদক্ষতা তাদের জন্য বিশাল সুযোগ তৈরি করবে যারা এর সুবিধা নিতে যথেষ্ট বুদ্ধিমান।
দীর্ঘমেয়াদে এর প্রভাব কেমন হবে, তা বলা খুব কঠিন। তবে উচ্চ প্রবণতার সঙ্গে সঞ্চয় করা সম্পদ একটি প্রজন্মের হাত থেকে এটি খরচ করার প্রবণতা বেশি এমন প্রজন্মের হাতে সেই অর্থ স্থানান্তর করাটা কোনো না কোনো ধরনের সমৃদ্ধি ডেকে আনবে। তবে আমরা নিশ্চিত নই যে সেটি কোন ধরনের সমৃদ্ধি হবে।
উন্নত দেশগুলোতে তরুণ প্রজন্ম এখন তাদের পূর্বপুরুষদের চেয়ে বেশি আবাসন সংকটে রয়েছে?
ভূমিকা
একটি সমাজ তখনই মহৎ হয়ে ওঠে যখন বৃদ্ধরা এমন গাছের চারা রোপণ করে যার ছায়ায় তারা কখনও বসবে না।
প্রাচীন গ্রিসের একটি প্রবাদ যা আমাদের আধুনিক অর্থনীতির সমস্যা বা অর্থনীতি বিষয়ক জানাশোনার অনেক আগের সময়ের, আজও ততটাই সত্য যতটা হাজার বছর আগে ছিল। কিন্তু আমরা কি সত্যিই এই ধারণা অনুসারে চলি? শিল্প বিপ্লবের পর এই প্রথম কোনো প্রজন্মের উত্তরসূরি তাদের পিতামাতার চেয়ে বেশি ধনী হচ্ছে না। যদিও এই ধারায় কিছু বিপর্যয় এবং ঐতিহাসিক ব্যতিক্রম অবশ্যই ঘটেছে, উন্নত অর্থনীতির অধিকাংশ মানুষের ক্ষেত্রে সমষ্টিগতভাবে এই ব্যাপারটা সত্যই থেকে গেছে। দীর্ঘকাল ধরে এটা প্রত্যাশিত ছিল যে মানুষের সন্তানরা তাদের প্রাপ্তবয়স্ক জীবনে তাদের চেয়ে ভালো জীবনযাপন করবে, কিন্তু আজ সেই প্রত্যাশা আর নেই। প্রকৃতপক্ষে, বেশিরভাগ তরুণ পেশাদাররা কেবল তাদের পিতামাতার জীবনযাত্রার আকাঙ্ক্ষাটাই রাখতে পারে, তার চেয়ে বেশি কিছু চাইতে পারেনা। তরুণ প্রজন্ম নির্ভরযোগ্য চাকরি পাওয়া, আরামদায়ক বাড়ির খরচ বহন করা, পরিবার শুরু করা এবং অবসর জীবনের জন্য সঞ্চয় করা ক্রমশ কঠিন বলে মনে করছে। অথচ বাস্তবতা হলো বিংশ শতাব্দীতে যখন বেবি বুমাররা তাদের অদম্য ভাগ্য গড়ছিলেন, তার চেয়ে আজকের বিশ্ব অনেক বেশি ধনী।
তাহলে এখানে কী ঘটছে? সামগ্রিকভাবে ধনী – এমন একটি বিশ্বেও এমন প্রজন্ম কেন তৈরি হচ্ছে যারা তাদের পূর্বসূরীদের চেয়ে বেশি দরিদ্র? এর কোনো অন্তর্নিহিত কারণ আছে কি? যদি থাকে, তবে তা পালটে দেবার কোনো উপায় আছে কি? আর যদি না থাকে, তার মানে কি আমরা আশা করতে পারি যে এখন থেকে প্রতিটি প্রজন্ম তাদের পূর্ববর্তী প্রজন্মের চেয়ে দরিদ্র হবে? আর আমার মনে হয় সম্ভবত এটাও জিজ্ঞাসা করার মতো বিষয় যে, এতে কি কিছু যায় আসে, যেহেতু সবাই তো শেষ পর্যন্ত মারা যাবে এবং তাদের সম্পদ হস্তান্তর করবেই?
জেনারেশনের ক্ষমতা-সম্পর্ক
আপনাদের সকলের জন্য একটি প্রশ্ন – কোন অবস্থায় জন্ম নেয়াটা ব্যক্তির জন্য ভাল হবে? যেখানে তার মতো অনেকেই জন্মাচ্ছে, মানে তার বয়সের অনেক লোকজন আছে বা তার একই বয়সী অনেক লোকজনের একটি বৃহৎ গোষ্ঠী রয়েছে এরকম একটি জায়গায় তার জন্ম নেওয়া ভালো হবে, নাকি তার বয়সের খুব একটা লোক নেই, মানে নতুন কেউ তেমন জন্মাচ্ছে না, বা বাচ্চারা আসছে না বা চলে যাচ্ছে, এরকম একটা জায়গায় জন্মানো ভাল হবে? প্রশ্নটা হয়তো ভালভাবে করতে পারিনি। আবার নতুনভাবে করছি – যেখানে বাচ্চাদের সংখ্যা বেশি সেখানে বাচ্চা জন্মালে ভালো, নাকি যেখানে বাচ্চাদের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম সেখানে বাচ্চা জন্মালে ভাল? ঐতিহ্যবাহী অর্থনৈতিক তত্ত্বগুলো অনুসারে, বাচ্চাদের সংখ্যা কম, মানে বাচ্চার বড় হবার পর তার সমবয়সীদের পরিমাণ কম থাকবে এরকম একটা স্থানই বেশি পছন্দনীয় হবে। কেননা এর অর্থ এই হবে যে, চাকরি, আবাসন, সামাজিক কর্মসূচি (social programs), ভালো স্কুলে ভর্তির ক্ষেত্রে কম প্রতিযোগিতা এবং সামষ্টিক অর্থনীতিতে (macro level) প্রাকৃতিক সম্পদের মতো মৌলিক জিনিসের জন্যও কম প্রতিযোগিতা থাকবে। কিন্তু সেক্ষেত্রে আপনি বেবি বুমারদের কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন? এরা তো জনসংখ্যার সবচেয়ে বড় বিস্ফোরণের অংশ হওয়া সত্ত্বেও সমষ্টিগতভাবে খুব ধনী।
লর্ড ডেভিড উইলেটস (Lord David Willets) একজন ব্রিটিশ রাজনীতিবিদ (British politician), জনমিতিবিদ (demographer) এবং লেখক। তিনি মনে করেন যে এর বিপরীতটাও সত্য হতে পারে। তার মতে, একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় একটি বৃহত্তর গোষ্ঠীর অংশ হওয়া আসলে বেশি পছন্দনীয় বা বেশি ভাল। কারণ এটি সেই গোষ্ঠীকে প্রজন্মগত দ্বন্দ্বগুলোর ক্ষেত্রে বেশি ভোট দেওয়ার ক্ষমতা প্রদান করে এবং বাজারের ওপরও তারা বেশি প্রভাব ফেলে। যখন বুমাররা তরুণ ছিলেন, তখন তারা এমন নীতিগুলির জন্য ভোট দিয়েছিলেন যা তাদের উপকৃত করেছিল। এগুলোর মধ্যে রয়েছে কম খরচে বা বিনামূল্যে উচ্চশিক্ষা, পারিবারিক সহায়তা ব্যবস্থা (family support systems) এবং শক্তিশালী সামাজিক কল্যাণ। মানে এই জেনারেশন তরুণ অবস্থায় উপকৃত হয়। আবার এই জেনারেশন যখন তাদের কর্মজীবনের শীর্ষে পৌঁছালো তখনও তারা উপকৃত হলো তাদের বৃহত্তর সংখ্যার জন্যই। তখন তারা তাদের নিজেদের স্বার্থে তাদের রাজনৈতিক অভিমুখিতা পরিবর্তন করে নেয়। এবারে তারা তাদের বৃহৎ ভোটারগোষ্ঠীকে ব্যবহার করে কম আয়কর, কম ব্যবসায়িক বিধি-নিষেধ (business regulation), আউটসোর্সিং (outsourcing) এবং বিশ্বব্যাপী প্রতিযোগিতা এড়াতে আরও দেশীয় শিল্প সুরক্ষার (domestic industry protections) পক্ষে চলে গেল। তাদের রাজনৈতিক স্বার্থে ও নিজেদের সংখ্যাগত প্রাধান্যের কারণেই ছোট পরিসরে জোনিং আইনের (zoning laws) মতো আইন তৈরি হয় যা তাদের বাড়ির মূল্য রক্ষা করে, অর্থাৎ বাড়ির দাম যাতে না বেড়ে যায় সেজন্য চেষ্টা করে। এর সুফলও এরা পায়। বাধ্যতামূলক একক-পরিবার ভবন নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা সহ শহরতলির দিকে চাপ দেওয়ার অর্থ হলো বাড়িগুলি বড় হতে শুরু করলো এবং ভালো স্থানগুলি আরও আকাঙ্ক্ষিত হয়ে উঠলো কারণ সেখানে সীমিত সংখ্যক পারিবারিক বাড়ি তৈরি করা যেতে পারত। ১৯৫০-এর দশকে বাড়িগুলি মূলত একটি পণ্য ছিল, ব্যয়ের বেশিরভাগ অংশ বাড়ির কাঠামোটা তৈরিতে যেত এবং পারিবারিক গাড়ির দাম পারিবারিক বাড়ির চেয়ে বেশি হওয়াটা অযৌক্তিক ছিল না। এদিকে পঞ্চাশ বছর পর এখন বাড়িগুলি বসবাসের জায়গার পাশাপাশি বিনিয়োগ হিসেবেও কাজ করেছে, কারণ এগুলোর দাম অনেক বেড়ে গেছে।
যাই হোক। বার্ধক্যেও এই বুমাররা এখন তাদের স্বার্থ রক্ষা করেই ভোট দেয়, এবং এদের সংখ্যাই বেশি হবার কারণে গণতান্ত্রিক সিস্টেমে তাদের পক্ষেই আইন, পলিসি তৈরি হয়। এবারে বৃদ্ধ বুমারদের স্বার্থ হচ্ছে অবসরকালীন সুবিধা, পেনশন প্রকল্প (pension schemes), চিকিৎসা অবকাঠামো (medical infrastructure) এবং সম্পদ কর (wealth taxes) অপসারণ। তারা এসবের পক্ষেই এখন ভোট দিতে শুরু করেছে, এমনকি যৌবনে এদের যে স্বার্থগুলো ছিল সেগুলো যদি কম্প্রোমাইজড হয় তবুও তারা এগুলোতেই ভোট দেয়। বুঝতেই পারছেন এখানে আদর্শ নয়, ম্যাটার করছে নিজেদের স্বার্থ, আর সঙ্গতকারণেই তা হয়ে উঠছে তাদের বয়সগত স্বার্থ।
তো আশা করি ডেভিড উইলেটস আসলে কী বলতে চাচ্ছেন। যদি কোন বাচ্চা এমন পরিবেশে জন্ম নেয় যেখানে তার জন্মের আশপাশের সময়ে অন্যান্য জেনারেশনের তুলনায় প্রচুর বাচ্চার জন্ম হয়েছে বা হচ্ছে, এবং সেখানে গণতান্ত্রিক পরিবেশ কাজ করে, তাহলে সেটা তার জন্য ভাল ফল বয়ে আনবে। এখন ডেভিড উইলেটস তার এই বিশ্লেষণ করেছিলেন বিশেষভাবে যুক্তরাজ্যের (UK) উপর চোখ রেখেই, এবং অবশ্যই এমন বহু লোক আছে যারা নিজেদের সংকীর্ণ স্বার্থের বদলে বৃহত্তর মঙ্গলের জন্যই ভোট দেয়, কিন্তু তবুও গড়পড়তায় সব উন্নত অর্থনীতির দেশেই দেখা যায় যে, মানুষ এরকম ব্যক্তিস্বার্থের ভিত্তিতেই ভোট দিচ্ছে, আর এই উন্নত অর্থনীতির দেশগুলোতে যেহেতু জন্মহার কমছে, বুমার বা বর্তমানে বৃদ্ধ জনসংখ্যার পরিমাণই বেশি, তাই রাষ্ট্রের আইন, নীতিমালা ও অর্থনৈতিক ট্রেন্ডগুলোও এমন হচ্ছে যেগুলো এই বৃদ্ধদের পক্ষেই যাচ্ছে, মানে এই বৃদ্ধদের জেনারেশনটা তরুণ হোক, যুবক হোক বা বৃদ্ধ হোক, বৃহত্তর মঙ্গলের কথা তেমন চিন্তা না করে নিজেদের স্বার্থ অনুযায়ীই ভোট দিয়ে এসেছে।
অস্ট্রেলিয়ার কথাই ধরুন, ২০১৯ সালের ফেডারেল নির্বাচনের ফল নির্ধারিত হয়েছিল মূলত একটি নীতিগত সিদ্ধান্তের দ্বারা যা অস্ট্রেলিয়ান অবসরকালীন অ্যাকাউন্টগুলির (Australian retirement accounts) কর কার্যকারিতা হ্রাস করবে। যে দল বুমার বা বৃদ্ধদের অনুকূল কর কাঠামো বজায় রাখার পক্ষে ছিল, বয়স্ক অস্ট্রেলিয়ান ভোটারদের প্রধান সমর্থনের কারণে শেষ পর্যন্ত তারাই জয়ী হয়। যে দল বৃদ্ধ পক্ষে এই অবসরকালীন অ্যাকাউন্ট ট্যাক্সের পরিবর্তনের বিরুদ্ধে ছিল তারা হেরে গিয়ে বিরোধী দল হয়। এরপর অস্ট্রেলিয়ার আরেকটা নির্বাচনে দেখা যায়, যেই সেই বিরোধী দল অবসরকালীন অ্যাকাউন্টের ট্যাক্স নিয়ে তাদের অবস্থান থেকে সরে আসে সেই তারা আবার খুব স্পষ্টভাবে জয়ী হয়। মানে এই বৃদ্ধরাই নির্বাচনে জয়-পরাজয় নির্ধারণে বিশাল ভূমিকা রাখছে। ২০১৭ সালের একটি ব্রিটিশ নির্বাচন সমীক্ষায় (British election study) দেখা গেছে যে সময়ের সাথে সাথে রক্ষণশীল দলগুলির (conservative parties) ভোট ধনী ও শ্রমিক শ্রেণির মধ্যে বিভক্ত হওয়ার পরিবর্তে তরুণ ও বয়স্কদের মধ্যে বিভক্ত হয়ে গেছে।
এতক্ষণ যা যা আলোচনা করলাম তার বেশিরভাগই সরাসরি উইলেটসের লেখা ‘দ্য পিঞ্চ’ (The Pinch) বইটি এবং রয়্যাল ইনস্টিটিউশনে (The Royal Institution) দেওয়া তার একটি বক্তৃতা থেকে নেওয়া। বইটার পুরো নাম হচ্ছে ” The Pinch: How the Baby Boomers Took Their Children’s Future – and Why They Should Give It Back David Willetts 已下载 The Pinch: How the Baby Boomers Took Their Children’s Future – and Why They Should Give It Back” (পড়তে চাইলে আমাকে জানাবেন, পিডিএফ আছে)। আর লেকচারটার জন্য ইউটিউবে সার্চ করুন “Have the Boomers Pinched Their Children’s Futures? – with Lord David Willetts” লিখে। এই জনসংখ্যাতাত্ত্বিক প্রক্রিয়াগুলিতে (demographic processes) আগ্রহ থাকলে এগুলো অবশ্যই আপনার ভাল লাগবে। যাই হোক, এটাই বলতে চাচ্ছি যে, অনুকূল সরকারি নীতির একটি জীবনকালের বা জেনারেশনের জন্য সম্পদ তৈরিতে বিশাল উপকারী হতে পারে। একবার ভাবুন তো গড়পড়তা মিলেনিয়ালরা (millennials) যদি বিনামূল্যে কলেজ বা মাধ্যমিক শিক্ষা পেতেন তবে তাদের কত সুবিধা হতো। এমনকি অন্য সবকিছু একই থাকলেও কেবল এই সুবিধাটার জন্যই উন্নত দেশগুলোতে মিলেনিয়ালদের হাতে অনেক অর্থ এসে যেত, যার জমিয়ে তারা বাড়ি কিনতে পারতো। আর এবারে আমরা সেটাই আলোচনা করতে যাচ্ছি।
আবাসন বিভাজন
ডেভিড উইলেটস এই বুমারদের একটা বিশেষ সুবিধার বিষয়ে তেমন উল্লেখ করেনি, যেটা করলে আরও ভাল করতেন। সেটা হচ্ছে ওদের কম প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হবার বিষয়টা। ওরা সস্তায় বাড়ি কিনতে পারতো – এটার চেয়েও তাদের বড় সুবিধা ছিল এটাই যে, তারা এখনকার তুলনায় অনেক কম প্রতিযোগিতা ফিল করতো। ১৯৫০ থেকে ১৯৬০ এর দশকে বিশ্ব জনসংখ্যা আজকের তুলনায় প্রায় এক তৃতীয়াংশ ছিল এবং সেই সময় উন্নত বিশ্বে শ্বেতাঙ্গ পুরুষদের প্রতিযোগিতা এখনকার তুলনায় অনেক কম তীব্র ছিল। বর্তমানে চাকরির নিয়োগকর্তারা যেমন এখন অনেক বড় জনসংখ্যা থেকে ইচ্ছামত ছোট অংশকে বাছাই করার সুযোগ পায়, তখন সেরকম পেত না। সেরকম লেবল পুল কম ছিল, মানে শ্রমিক ও কর্মীদের অনেক সুবিধা ছিল, তাদের চাকরি পাওয়াও সহজ ছিল। সেই সাথে তখন নারীদের শ্রমশক্তির অংশগ্রহণও (labour force participation) খুব কম ছিল, যা শ্রমিকদের সরবরাহকে আরও কমিয়ে দিয়েছিল। আর এর ফলস্বরূপ নারী শ্রমিকদের দর কষাকষির ক্ষমতা বা বারগেইনিং পাওয়ার কম ছিল। ফলে নারীদেরকে গৃহস্থালির কাজকর্মের দিকে বেশি ঝুঁকতে হতো। এদিকে পুরুষদের হাতে বেশি অর্থ থাকায় তারাও গৃহস্থালি ক্ষেত্রে বেশি খরচ করতে চাইতো না। মানে হচ্ছে তারা শিশু যত্ন, খাদ্য এবং সাধারণ রক্ষণাবেক্ষণের মতো জিনিসগুলিতে পারিবারিক ব্যয় কমিয়ে দিত। এই উচ্চতর আপেক্ষিক আয় কম ব্যয়ের সাথে মিলিত হওয়ার অর্থ হলো প্রায় এক বছরের আয় দিয়েই প্রায়শই বাড়ির দাম পরিশোধ করা যেত।
হ্যাঁ, তাদের বিশেষ করে ৭০ ও ৮০-এর দশকে উচ্চ সুদের হার সহ্য করতে হয়েছিল, যে সময়টায় তারা সবচেয়ে বেশি বাড়ি কিনেছিল। ১৯৮৫ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে (USA) একটি মাঝারি মানের বাড়ির দাম ছিল ৮২,০০০ ডলার। এটি মাঝারি মানের দাম, তাই ৫০% বাড়ির দাম ছিল এর চেয়ে সস্তা, মানে প্রথমবার যারা বাড়ি কিনছেন তারা এই দামের চেয়েও সস্তায় বাড়ি কিনতে পারতেন। তবে হিসাবটা সহজ করার জন্য ৮২,০০০ ডলারই ধরে নেই। মাঝারি পরিবারের আয়ের জন্য সামঞ্জস্য করলে সেই ৮২,০০০ ডলার ১,০৩,০০০ ডলারে পরিণত হয়। এই সময়ের আশেপাশে গড় বন্ধকের হার বা মর্টগেজ রেইট (mortgage rate) ছিল ১৫% বা বছরে প্রায় ১৫,০০০ ডলার দিতে হয়। কিছু বছরে এটি বেশি ছিল তবে বেশিরভাগ ঋণগ্রহীতা মোটামুটি ১৫% এর সর্বোচ্চ হারেই স্থির ছিলেন তাই এটাকেই সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতি বলা যায়। অন্যদিকে বর্তমানে মাঝারি মানের একটি বাড়ির দাম ৪,৩০,০০০ ডলার এবং গড় সুদের হার ৫%-এর সামান্য বেশি বা শুধুমাত্র সুদ পরিশোধ বাবদ বছরে ২১,৫০০ ডলার তাদের দিতে হয়। আবারও এটি সেই সময়ের মাঝারি আয়ের জন্য সামঞ্জস্য করা হয়েছে তাই দেখে মনে হচ্ছে এগুলো বেশ তুলনীয় বা একই রকম, এবং তার ভিত্তিতে বলা হয় তরুণ প্রজন্মের আসলে এত সাশ্রয়ী মূল্যের আবাসন নিয়ে অভিযোগ করা উচিত নয়।
অনেকে আবার এই তুলনাকে এই বলে উড়িয়ে দেন যে সেই সময়ে মুদ্রাস্ফীতি (inflation) অত্যন্ত বেশি ছিল তাই এই উচ্চতর সুদ পরিশোধের কোনো মানে ছিল না। তবে এটি আসলে সত্য নয়। ১৯৮৫ সালে মুদ্রাস্ফীতি ছিল ৩.৫% এবং ১৯৮০ সালে এটি ১৩.৫% পর্যন্ত বেশি ছিল, এটি ভোক্তা মূল্য সূচক মুদ্রাস্ফীতি (consumer price index inflation), আবাসন মুদ্রাস্ফীতি নয়। এই দশকগুলিতে বাড়ির দাম আসলে তুলনামূলকভাবে কম হারে বেড়েছে, বাকি সবকিছুই ব্যয়বহুল হয়ে উঠছিল। এটি আজকের প্রত্যাশার বিপরীত যেখানে বাড়ির দামের বৃদ্ধি মুদ্রাস্ফীতিকে ছাড়িয়ে যায় তবে ৭০ ও ৮০-এর দশকে এমনটা ছিল না। তাই হ্যাঁ, মুদ্রাস্ফীতির যুক্তিটি পুরোপুরি ন্যায্য নয়, তাহলে বেবি বুমারদের জন্য বাড়ি কেনা কতটা সহজ ছিল তা নিয়ে অভিযোগ করা কি ন্যায্য? ওয়েল না, তাদের আরও দুটি বড় কারণে সুবিধা ছিল। এই উচ্চ সুদের হারই আসলে তাদের কিছুটা সাহায্য করেছিল। একটি অ্যাকাউন্টে জমার জন্য অর্থ সঞ্চয় করা (যা বছরে ১০% সুদ দেয়) সত্যিই সঞ্চয়ের লক্ষ্যে দ্রুত পৌঁছাতে সাহায্য করে। উচ্চ সুদের হার এটাও নিশ্চিত করেছে যে বাড়ির দাম খুব বেশি বাড়বে না, কারণ পরিশোধ করাটাই তখন সাধ্যের বাইরে চলে যেত। আগের উদাহরণে আমরা শুধুমাত্র দুটি সময়ের ঋণের উপর প্রদত্ত সুদ দেখেছি, তবে বন্ধকের বিষয় হলো আপনাকে আসলও পরিশোধ করতে হবে। একটি স্ট্যান্ডার্ড ত্রিশ বছরের ঋণ মেয়াদে ৪,৩০,০০০ ডলারের বন্ধকের আসল পরিশোধ করতে বছরে অতিরিক্ত ১৪,৩০০ ডলার খরচ হবে, যা মোট বার্ষিক পরিশোধের পরিমাণ প্রায় ৩৬,০০০ ডলারে নিয়ে আসবে। ১৯৮৫ সালের বাড়ির আসল পরিশোধ বাবদ বছরে প্রায় ৩,০০০ ডলার খরচ হতো, যা মোট পরিশোধের পরিমাণ ১৮,০০০ ডলারের একটু বেশিতে নিয়ে আসে। এর মানে হচ্ছে সেই সময়ে সুদের হার বর্তমান সময়ের সুদের হারের তিন গুণ হলেও, তাদেরকে বর্তমান সময়ের বাড়ির জন্য যতটা অর্থ পরিশোধ করতে হয়, তাদেরকে করতে হতো তার অর্ধেক। অন্যভাবে বললে, যদি পরিশোধের পরিমাণ সমান রাখা হতো, তবে ১৯৮৫ সালে যিনি বাড়ি কিনছিলেন তিনি ৩০ বছরের পরিবর্তে ৫ বছরেই এটির দাম পরিশোধ করতে পারতেন। তাহলে আমি কেন আবাসনের উপর এত বেশি মনোযোগ দিচ্ছি? ওয়েল, জীবনের একটি খুব গুরুত্বপূর্ণ অংশ হওয়া সত্ত্বেও বাড়িগুলি বিশেষভাবে অনুৎপাদনশীল হচ্ছে।
বাড়িগুলোর অনুৎপাদনশীলতা
রিয়েল এস্টেট (real estate) একটি সম্পদ হিসাবে কিছুটা অনন্য। কারণ এটি মূল্যবান কিছু উৎপাদন করে না। জমির উপর দাঁড়িয়ে থাকা একটি বাড়ির মূল্য বাড়তে পারে এবং এটি তার মালিকদের বাসস্থান বা কোনো বিনিয়োগকারীর জন্য ভাড়ার আয়ের উৎস সরবরাহ করতে পারে। তবে এখান থেকে কিছুই তৈরি হয় না। অবশ্যই ক্রিপ্টোকারেন্সির (crypto currencies) মতো “বিনিয়োগ” আজ বিদ্যমান যা মূল্যবান কিছু উৎপাদন করে না, তবে বিশ্বজুড়ে রিয়েল এস্টেটের বাজারের তুলনায় ক্রিপ্টোকারেন্সির বাজার খুবই ছোট। খুবই ছোট এবং অপ্রাসঙ্গিকও। যদি বিটকয়েনের (bitcoin) দাম দশ লক্ষ ডলারে চলে যায়, তবে এটি সেই লোকেদের জন্য দারুণ যারা এতে বিনিয়োগ করে, আর এর কিছু ছোটখাটো প্রভাব অন্যান্য বাজারেও পড়বে যখন লোকেরা ক্রিপ্টো বিলিয়নেয়াররা (crypto millionaires) যা কেনে তা কেনার জন্য টাকা তুলবে। তবে এতে কেউ রাস্তায় বসবে না। কিন্তু আবাসন সংকটের কারণে মানুষ আসলেই রাস্তায় বসতে পারে এবং এটি পুরো অর্থনীতির অগ্রগতিও ধীর করতে পারে।
বিশ্বের প্রতিটি অর্থনীতি ভালো হোক বা খারাপ, এখনও অর্থনৈতিক কার্যকলাপের বৃহৎ কেন্দ্রগুলির উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে থাকে। অর্থনৈতিক কার্যকলাপের বৃহৎ কেন্দ্রগুলি “শহর” বা সিটি নামে পরিচিত। যদি এই শহরগুলির রিয়েল এস্টেট খুব ব্যয়বহুল হয়ে যায় তবে শ্রমিকদের সেখানে চাকরি ধরে রাখা অসম্ভব হয়ে পড়ে, কারণ সেক্ষেত্রে তাদের আয়ের বেশিরভাগ অংশ কেবল ভাড়া পরিশোধেই চলে যাবে। স্বল্প মেয়াদে এটি উচ্চতর মজুরি দিয়ে পূরণ করা যেতে পারে তবে এই কেন্দ্রগুলি আসলে সেই বাড়িওয়ালাদের উপকারের জন্য পরিচালিত হচ্ছে যারা সেখানে সম্পত্তির মালিক হওয়ার মতো ভাগ্যবান। বাড়িওয়ালারা তাদের সম্পত্তি থেকে যে অর্থ উপার্জন করেন তা কোম্পানির বৃদ্ধিতে পুনরায় বিনিয়োগ করা বা নিয়মিত ভোক্তা ভোগের (consumer consumption) জন্য ব্যয় করার সম্ভাবনা কম যা সেই ব্যবসাগুলিকে টিকিয়ে রাখে, বরং সেই অর্থ আরও বেশি করে সেরকম সম্পত্তিতে ব্যয় হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, যেগুলো এই সম্পত্তিগুলোর বাজারের মূল্য আরও বাড়িয়ে তোলে এবং উৎপাদনশীল কেন্দ্রগুলি থেকে আরও বেশি অর্থ অনুৎপাদনশীল সম্পত্তিতে চলে যায়।
উচ্চতর আবাসন মূল্য সামাজিক ও ভৌগলিক গতিশীলতাও হ্রাস করে। ২০২০ সালের পিউ রিসার্চের (pew research) একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে যে ১৮ থেকে ২৮ বছর বয়সী ৫২% তরুণ আমেরিকান প্রাপ্তবয়স্ক এখনও তাদের পিতামাতার সাথে বাড়িতে থাকেন। যুক্তিসঙ্গতভাবে ধরে নেওয়া যায় যে, কোভিড এবং রেকর্ড সংখ্যক বাড়ির দাম বৃদ্ধির দুই বছর পর এই সংখ্যা আরও বেশি। সেই তরুণ প্রাপ্তবয়স্করা আর্থিকভাবে তাদের পিতামাতার বসবাসের জায়গার সাথে আবদ্ধ। যদি তারা অন্য শহরে সত্যিই একটি ভালো চাকরির প্রস্তাব পায় তবে তাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে বেতন বৃদ্ধি তাদের নিজেদের খরচে থাকার অতিরিক্ত খরচের তুলনায় মূল্যবান কিনা। যদি তারা সিদ্ধান্ত নেয় যে তা নয় তবে তারা একটি ভালো চাকরি এবং একটি ব্যবসা একজন উৎপাদনশীল কর্মীকে হারাবে। একটি নির্দিষ্ট প্রজন্মের মধ্যে সম্পদের কেন্দ্রীভূত হওয়া এমন একটি বিষয় যা পুরো অর্থনীতির জন্য খুব বাস্তব পরিণতি ডেকে আনতে পারে এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে এই প্রভাবগুলি আরও স্পষ্ট হয়ে উঠবে। জাপানের (Japan) মতো স্থানগুলি এর একটি সুস্পষ্ট উদাহরণ এবং পশ্চিমের মতো তাদের আবাসন সমস্যা নেই। তবে দীর্ঘমেয়াদে, এতে কি কিছু যায় আসে?
আন্তঃপ্রজন্মগত সম্পদ
আমি এখানে খুব বেশি হতাশাবাদী হতে চাই না, তবে মানুষ শেষ পর্যন্ত মারা যায় এবং তাদের সম্পদ তাদের সন্তানদের বা অন্য কোনো সুবিধাভোগীর কাছে হস্তান্তরিত হয়। তাই একটি একক প্রজন্মের মধ্যে সম্পদের কেন্দ্রীভূত হওয়া বড়জোর একটি ক্ষণস্থায়ী সমস্যা। হস্তান্তরিত হওয়া বেশিরভাগ সম্পদই ব্যক্তিগত পারিবারিক ব্যবসার (private family businesses) আকারে আসছে। সংক্ষেপে এর সমস্যা হলো প্রায়শই এই ছোট ব্যবসাগুলির পরিচালনার জন্য মালিকের প্রয়োজন হয় এবং যারা এই ব্যবসাগুলির উত্তরাধিকারী হতে চলেছেন তারা হয় অনিচ্ছুক বা অক্ষম। ছোট ব্যবসা অর্থনীতি একটি বিশাল অংশ এবং সেগুলি হারালে অনেক ক্ষতি হবে। এখন এখানে আশার আলো হলো এই যে, এই ব্যবসাগুলি তাদের উত্তরাধিকারীরা সেই লোকদের কাছে বিক্রি করতে পারে যাদের সেগুলি চালানোর জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা এবং আকাঙ্ক্ষা রয়েছে। সম্ভবত তারা সেই লোকদের কাছে বিক্রি করবে যাদের নিজেদের উত্তরাধিকার থেকে ব্যবসা কেনার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ রয়েছে।
বিস্তারিত জানতে এখানে যান – বেবি বুমারদের সম্পদের উত্তরাধিকারসূত্রে স্থানান্তর হবে ইতিহাসের বৃহত্তম সম্পদ স্থানান্তর: এর প্রভাব ও অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ
এখন সমস্যা হলো যারা আসলে এই অর্থ পাবেন তারা আসলে কোন ধরণের লোক সেখানেই। বেশিরভাগ লোক তাদের পিতামাতার মৃত্যুর পরে অর্থ পান না যতক্ষণ না তারা নিজেরাই বেশ বয়স্ক হন, প্রায়শই তাদের কর্মজীবনের শেষের দিকে বা অবসর জীবন শুরু করার কাছাকাছি সময়ে। যদি অর্থ তাদের হাতে তুলে দেওয়া হয় তবে তারা সম্ভবত তাদের নিজস্ব অবসর জীবন নির্বাহের জন্য এটি ব্যবহার করবে এবং তারপরে তাদের বয়স্ক সন্তানদের হাতে তুলে দেবে। বয়স্ক লোকেদের হাতে অর্থ জমা হওয়ার অর্থ হলো তরুণ প্রজন্মের অর্থনীতিকে সচল করতে প্রয়োজনীয় জিনিসগুলি করার সুযোগ কম থাকবে। তরুণদের জন্য দরকার একটি বাড়ি কেনা, একটি ভালো চাকরি পাওয়া এবং একটি পরিবার শুরু করা যাতে অর্থনীতি চালানোর জন্য কর্মীদের অবিরাম সরবরাহ থাকে। আপনারা এমন লোকদের উপর নির্ভর করে অর্থনীতি চালাতে পারেন না যারা তাদের জীবন দিয়ে অবশেষে কিছু করার জন্য যথেষ্ট বয়স্ক হওয়ার জন্য অপেক্ষা করছেন। অর্থনীতিবিদরা এটিকে আন্তঃপ্রজন্মগত সম্পদ সমস্যা (intergenerational wealth problem) বলেন। অনেকে মজা করে এটাকে প্রিন্স চার্লস প্যারাডক্সও (Prince Charles Paradox) বলতে পছন্দ করেন। তবে এটি এমন একটি বিষয় যেটাকে উন্নত দেশগুলোকে, বিশেষ করে আমেরিকাকে মোকাবেলা করতে হবে। এস্টেট ট্যাক্সের (estate taxes) মতো বিষয়গুলি সাধারণত প্রস্তাবিত সমাধান, তবে সেগুলি কাজ করলেও, এগুলো আবার বুমারদের জন্য বা বর্তমান তরুণদের পূর্ববর্তী প্রজন্মগুলোর জন্য খুব কুখ্যাত হবে, যেহেতু পরের প্রজন্মগুলোতে উত্তরাধিকার সূত্রে যাওয়া সম্পত্তির একটা বড় অংশে রাষ্ট্র ভাগ বসাবে। শেষ যে বিষয়টি আমাদের নিজেদেরকে জিজ্ঞাসা করতে হবে তা হলো, এর জন্য কি বুমাররাই দায়ী?
বুমাররাই দায়ী?
এই পরিস্থিতিতে আন্তঃপ্রজন্মগত দ্বন্দ্ব যে অনেক বেড়ে যায়, তরুণদের মধ্যে বুমারদের প্রতি বিদ্বেষও তৈরি হয়। কিন্তু আমাদের বর্তমান অর্থনৈতিক সমস্যাগুলির জন্য একটি নির্দিষ্ট প্রজন্মকে দোষ দেওয়া খুব একটা ফলপ্রসূ হবে না। নিজের সেরা স্বার্থে ভোট দেওয়া এবং সংখ্যাগরিষ্ঠের সেরা স্বার্থে আইন প্রণয়ন করাই গণতন্ত্রের ভিত্তি এবং এবং তাই যৌক্তিকভাবে দেখতে গেলে এটাকে খারাপ বলা যায়ও না। আমার মনে হয় এমন অর্থনীতির উদাহরণ দেখাটাও খুব গুরুত্বপূর্ণ যেখানে এমনটা ঘটেনি। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি চীন (China) একটি চমৎকার বিপরীত উদাহরণ। তাদের প্রজন্মের বেবি বুমাররা স্থানীয়ভাবে ‘হারানো প্রজন্ম’ (lost generation) নামে পরিচিত কারণ তারা তাদের কর্মজীবনের বেশিরভাগ সময় একটি অকার্যকর অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় কাটিয়েছেন। অর্থনীতি উন্মুক্ত হওয়ার পরে দশকগুলিতে যে দ্রুত অর্থনৈতিক সম্প্রসারণ ঘটেছিল, তা থেকে সত্যিকারের সুবিধা পাওয়ার মতো বয়সও তাদের ছিল না। এর মানে হলো জনসংখ্যার একটি বড় অংশ হওয়া সত্ত্বেও তারা তাদের পশ্চিমা সমবয়সীদের মতো অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি উপভোগ করতে পারেনি। পশ্চিমে বুমাররা যে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি উপভোগ করেছেন সেটাও যে তাদের নিয়ন্ত্রণের মধ্যে ছিল এমন না। ঐতিহাসিক মানদণ্ডে বিংশ শতাব্দীর শেষার্ধ খুব শান্তিপূর্ণ ছিল, বিশ্ব আন্তর্জাতিক বাণিজ্য এবং জীবাশ্ম জ্বালানীর (fossil fuels) আকারে প্রচুর সস্তা শক্তির দ্বারা চালিত প্রবৃদ্ধির জন্য উন্মুক্ত হয়েছিল। ভাগ্য গড়ার জন্য এটি একটি দারুণ সময় ছিল এবং লোকেরা তা করেছে। সম্ভবত এটাই এই ধাঁধার শেষ অংশ। বলা হয়, একবার লোকেরা অত্যন্ত ধনী হয়ে গেলে (এখানে কয়েক মিলিয়ন বা বিলিয়নের অধিকারীদের কথা বলছি) তারা সাধারণত আর দরিদ্র হন না। কিন্তু বেবি বুমারদের প্রজন্মের বিলিয়নিয়ারদের স্তূপ এই কথাটাকে হয়তো ভুল প্রমাণ করে। মনে রাখবেন, একজন বিলিয়নিয়ার এবং ৯৯৯ জন সম্পূর্ণ নিঃস্ব লোকের একটি দলে, দলের গড় সদস্য একজন মিলিয়নিয়ার। বেশিরভাগ বিলিয়নিয়ারই বেশ বয়স্ক এবং তাদের এত অর্থের পরিমাণ তাদের জেনারেশনের লোকেদের গড় সম্পদের পরিমাণের পরিসংখ্যানটা অনেক বাড়িয়ে দেয়।
উন্নত দেশগুলোতে প্রজন্মগত সম্পদের ব্যবধান বৃদ্ধি, বৈষম্য ও সম্ভাব্য অর্থনৈতিক সংকট: বেবি বুমার বনাম মিলেনিয়াল
ভূমিকা
প্রত্যেক প্রজন্মের মানুষেরই একটি স্বাভাবিক ও গভীর আকাঙ্ক্ষা থাকে যে তাদের সন্তান এবং নাতি-নাতনি তাদের চেয়ে উন্নত, ধনী এবং সমৃদ্ধ জীবন যাপন করবে। এই মৌলিক মানবিক প্রত্যাশা যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। এই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে মানুষ তাদের সন্তানদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ভবিষ্যৎ সুরক্ষা এবং আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে। তারা জীবন বীমা (life insurance) এবং উত্তরাধিকারের (estate inheritance) মতো দীর্ঘমেয়াদী আর্থিক পরিকল্পনা করে, মূল্যবান সময় ও শ্রম বিনিয়োগ করে। সন্তানদের উন্নত ভবিষ্যতের জন্য তারা তাদের বর্তমানের অনেক আরাম আয়েশ ত্যাগ করতেও প্রস্তুত থাকে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, বিশ্বজুড়ে একটি ক্রমবর্ধমান সংখ্যক মানুষের ক্ষেত্রে এই আন্তরিক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও, তাদের সেই লালিত স্বপ্ন পূরণ হচ্ছে না।
সহনশীল প্রজন্মের সদস্য মিলেনিয়ালরা জেন জি-রা যারা ১৯৮১ থেকে ১৯৯৬ সালের পর জন্মগ্রহণ করেছে, তারা এখন অর্থনৈতিকভাবে একটি কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন। আর্থিক বিশেষজ্ঞদের বিভিন্ন গবেষণা এবং বিশ্লেষণের মাধ্যমে এটি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, মিলেনিয়ালরা তাদের পূর্বসূরী বেবি বুমার (baby boomer) (যারা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে জন্মগ্রহণকারী প্রজন্ম) এবং জেনারেশন এক্স (Gen X) (যারা ১৯৬০-এর দশকের মাঝামাঝি থেকে ১৯৮০-এর দশকের শুরু পর্যন্ত জন্মগ্রহণকারী প্রজন্ম) – উভয়ের চেয়ে উল্লেখযোগ্যভাবে দরিদ্র হতে চলেছে। এই অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতি কেবল মিলেনিয়ালদের ব্যক্তিগত জীবনের জন্যই উদ্বেগের কারণ নয়, বরং এটি সামগ্রিকভাবে সমাজের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং ভবিষ্যতের প্রবৃদ্ধির উপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
অর্থনৈতিক সংকট এবং মিলেনিয়ালদের উপর এর প্রভাব
২০০৮ সালের মর্টগেজ সংকটের (mortgage crisis) চরম পতনের সময় যখন মিলেনিয়ালরা সবেমাত্র কর্মজীবনে প্রবেশ করতে শুরু করেছিল, তখন থেকেই তাদের অর্থনৈতিক যাত্রা শুরু হয় এক কঠিন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে। এই আর্থিক বিপর্যয়ের রেশ কাটতে না কাটতেই বিশ্বব্যাপী কোভিড-১৯ মহামারী এবং এর ফলস্বরূপ অর্থনৈতিক মন্দা মিলেনিয়ালদের জীবনে আরও একটি বড় আঘাত হানে। এই ধারাবাহিক অর্থনৈতিক ধাক্কাগুলোর কারণে বর্তমানে মিলেনিয়ালদের কাছে সম্মিলিতভাবে জাতীয় সম্পদের (national wealth) মাত্র ৩%-ই রয়েছে। অন্যদিকে, বেবি বুমাররা যখন তাদের জীবনের একই পর্যায়ে ছিলেন, তখন তারা জাতীয় সম্পদের ২৭% এর মালিক ছিলেন। এই বিশাল ব্যবধান স্পষ্টভাবে মিলেনিয়ালদের অর্থনৈতিক দুর্বলতাকে তুলে ধরে।
বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে সম্পদের অসম বন্টন (Wealth Inequality): এই হতাশাজনক চিত্র শুধুমাত্র কতিপয় লাটে পান করা মিলেনিয়ালদের জন্য একটি করুণ কাহিনী নয়। একটি বৃহত্তর পরিসরে দেখলে বোঝা যায়, ৪০ বছরের কম বয়সী মানুষের মালিকানাধীন সম্পদের সামগ্রিক অংশেও ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। গত তিন দশকে এই অংশের পরিমাণ ১৩% থেকে কমে ৭% এর নিচে নেমে এসেছে। এই পরিসংখ্যান সমাজের গভীরে প্রোথিত সম্পদের ক্রমবর্ধমান বৈষম্যকেই নির্দেশ করে। যদি আমরা তরুণ পরিবারগুলোর সামাজিক সমস্যাগুলোকে উপেক্ষা করি, যারা তাদের পিতামাতার তুলনায় অর্ধেকেরও কম সম্পদ নিয়ে জীবন ধারণ করতে বাধ্য হচ্ছে, তাহলেও এর সুদূরপ্রসারী এবং গুরুতর অর্থনৈতিক প্রভাব (economic implications) থাকতে পারে।
ভোক্তা বাজারের উপর প্রভাব (Impact on the Consumer Market): তরুণ পরিবারগুলো যখন তাদের জীবন শুরু করে, তখন তারা স্বাভাবিকভাবেই ভোক্তা ব্যয়ের (consumer spending) একটি বিশাল অংশ তৈরি করে। ঐতিহ্যগতভাবে, ২৫ থেকে ৪০ বছর বয়সের মানুষগুলোকে অর্থনীতির জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং সক্রিয় ভোক্তা বাজার হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এই বয়সের মানুষদের সাধারণত পূর্ণকালীন স্থিতিশীল চাকরি থাকে এবং তাদের হাতে কিছু অতিরিক্ত আয়ও থাকে, যা তারা বিভিন্ন পণ্য ও পরিষেবার উপর খরচ করতে সক্ষম। অন্যদিকে, তরুণ ক্রেতাদের অনেকেরই হয়তো ততটা আর্থিক সক্ষমতা থাকে না, আবার বয়স্ক ভোক্তাদের মধ্যে নতুন কিছু কেনার আগ্রহ তুলনামূলকভাবে কম দেখা যায়। তাই, যদি এই নেতিবাচক প্রবণতা অব্যাহত থাকে, তাহলে বিশ্বজুড়ে ব্যবসাগুলো তাদের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য এবং গুরুত্বপূর্ণ ভোক্তা ব্যয়ের সোনালী অঞ্চল (Goldilocks zone) হারাতে শুরু করতে পারে। এর ফলস্বরূপ সামগ্রিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হ্রাস পেতে পারে।
যে কারণে অর্থনৈতিক মন্দা ও কোভিড-১৯ মহামারীর মত আর্থিক বিপর্যয় প্রজন্মগত সম্পদের ব্যবধানের গুরুত্বপূর্ণ কারণ নয়
শিরোনামের পরিসংখ্যানের দিকে খুব মনোযোগ না দিলেও, সাধারণ মানুষ হিসেবে আমরা অনেকেই হয়তো এটা অনুভব করতে পারি যে নতুন প্রজন্ম আর্থিকভাবে তাদের পূর্বসূরীদের তুলনায় ক্রমশ পিছিয়ে পড়ছে। তবে, এই পরিস্থিতির পেছনের সুনির্দিষ্ট কারণগুলো হয়তো অনেকের কাছে স্পষ্ট নয়। নিঃসন্দেহে, দুটি বড় আর্থিক বিপর্যয় – ২০০৮ সালের অর্থনৈতিক সংকট এবং সাম্প্রতিক কোভিড-১৯ মহামারী – এই অবস্থার জন্য দায়ী। কিন্তু যদি গভীরভাবে বিশ্লেষণ করা হয়, তাহলে দেখা যাবে যে এই অর্থনৈতিক মন্দাগুলোর সবচেয়ে বেশি ক্ষতি তো প্রতিষ্ঠিত সম্পদ এবং বয়স্ক প্রজন্মের উপর হওয়ার কথা ছিল, যাদের হারানোর মতো অনেক বেশি সম্পদ ছিল। তরুণ প্রজন্মের, যাদের কর্মজীবনে পুনরুদ্ধারের জন্য এখনো অনেক সময় বাকি, তাদের উপর ক্ষতির প্রভাব তুলনামূলকভাবে কম হওয়ার কথা। তত্ত্বগতভাবে, অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাব বয়স্ক প্রজন্মের উপর বেশি হওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবে তেমনটা ঘটেনি। তাহলে কোন অর্থনৈতিক প্রতিকূলতা (economic headwinds) তরুণ প্রজন্মকে অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে দিচ্ছে? কী কারণে তারা তাদের পূর্বসূরীদের মতো সম্পদ তৈরি করতে পারছে না?
সম্পদ তৈরির অন্যতম মৌলিক ভিত্তি হলো অর্থ সঞ্চয় করতে সক্ষম হওয়া। যদিও মাঝে মাঝে ব্যতিক্রম দেখা যায়, যেমন লটারি বিজয়ী বা অপ্রত্যাশিত উত্তরাধিকার সূত্রে ধনী হওয়া, তবে বেশিরভাগ মিলিয়নিয়ারই কঠোর পরিশ্রম, ভালো আয়, সাশ্রয়ী জীবনযাপন এবং নিয়মিত সঞ্চয়ের মাধ্যমে সম্পদ তৈরি করেছেন। একটি আদর্শ পরিস্থিতিতে (যেখানে অন্যান্য সবকিছু সমান থাকে) এই প্রক্রিয়াটি স্বাভাবিকভাবেই তরুণ বিনিয়োগকারীদের (investors) জন্য উপকারী হওয়ার কথা।
বিষয়টি আরও ভালোভাবে বোঝার জন্য দুইজন সহকর্মীর একটি কাল্পনিক উদাহরণ বিবেচনা করা যাক। ধরা যাক, একজন বেবি বুমার যিনি খুব শীঘ্রই অবসর গ্রহণ করবেন এবং একজন মিলেনিয়াল যিনি সম্প্রতি পদোন্নতি পেয়েছেন – উভয়েরই বার্ষিক $১৫০,০০০ ভালো আয় আছে এবং তারা বীমা বিষয়ক হিসাবরক্ষক (insurance actuaries) হিসেবে কর্মরত। উভয়েই তাদের আয় সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতন এবং ট্যাক্স ও জীবনযাত্রার অন্যান্য খরচ পরিশোধ করার পর বার্ষিক $৫০,০০০ সঞ্চয় করেন।
বয়সের পার্থক্যের কারণে, মিলেনিয়াল কর্মী সবেমাত্র কিছু সম্পদ তৈরি করতে শুরু করেছেন এবং বিভিন্ন স্টক (stocks) -এ বিনিয়োগ করে একটি ডাইভার্স পোর্টফোলিওতে (diverse portfolio) প্রায় $১০০,০০০ সঞ্চয় করেছেন। অন্যদিকে, বুমার কয়েক দশক ধরে ধরে একই কাজ করছেন এবং একটি অনুরূপ পোর্টফোলিওতে ২০ লক্ষ ডলার বিনিয়োগ করেছেন। এছাড়াও তার একটি সম্পূর্ণ পরিশোধিত বা সব টাকা পরিশোধ করে দেয়া হয়েছে এমন পারিবারিক বাড়ি রয়েছে, যার আনুমানিক মূল্য $৫০০,০০০।
এখন ধরা যাক, একটি বড় অর্থনৈতিক মন্দা (economic downturn) দেখা দিল এবং এর ফলে আর্থিক সম্পদ ও রিয়েল এস্টেটের (real estate) দাম ৩০% কমে গেল। এই পরিস্থিতিতে মিলেনিয়াল কর্মী তাদের পোর্টফোলিও থেকে $৩০,০০০ হারাবেন। কিন্তু সেই একই সময়ে, বেবি বুমার তাদের পোর্টফোলিও থেকে $৬০০,০০০ হারাবেন এবং তাদের বাড়ির দামও $১৫০,০০০ কমে যাবে। এই কাল্পনিক উদাহরণে দেখা যাচ্ছে যে, বুমার তাদের মিলেনিয়াল সহকর্মীর চেয়ে ২৫ গুণ বেশি আর্থিক ক্ষতির শিকার হয়েছেন।
এই উদাহরণে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ক্ষতির তাৎপর্য এবং তা পুনরুদ্ধারের জন্য প্রয়োজনীয় সময়। অনেকেই হয়তো বলবেন যে, যতক্ষণ না উভয় পক্ষ তাদের সম্পদ বিক্রি করে দিচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত এই ক্ষতি আসলে অনুভূত হবে না। এবং নিঃসন্দেহে বুমার এখনও মিলেনিয়ালের চেয়ে অনেক বেশি ধনী। তবে পরিস্থিতিটি বিবেচনা করুন: যদি বাজার দ্রুত পুনরুদ্ধার না হয়, তাহলে মিলেনিয়াল তাদের নিয়মিত বার্ষিক $৫০,০০০ সঞ্চয়ের মাধ্যমে এই ক্ষতি এক বছরেরও কম সময়ের মধ্যে পুনরুদ্ধার করতে পারবেন। অন্যদিকে, বুমারের এই আর্থিক ক্ষতি পূরণ করতে ১৫ বছর লেগে যেতে পারে, যা তার আসন্ন অবসর জীবনকে বিবেচনায় নিলে একটি কঠিন পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে। দীর্ঘমেয়াদে বিনিয়োগের রিটার্নের (investment returns) সময়কাল খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ না হলেও, স্বল্প মেয়াদে এটি একটি বড় পার্থক্য তৈরি করতে পারে। তাত্ত্বিকভাবে, যাদের হাতে বেশি সম্পদ রয়েছে, অর্থনৈতিক মন্দা থেকে পুনরুদ্ধার করতে তাদের বেশি সময় লাগে, যা আমরা এই কাল্পনিক উদাহরণের মাধ্যমে প্রমাণ করতে চেষ্টা করেছি।
এত কিছু বলার মূল উদ্দেশ্য হলো, শুধু একথা বলা যথেষ্ট নয় যে মিলেনিয়ালরা তাদের কর্মজীবনের শুরুতে ২০০৮ সালের মর্টগেজ সংকটের মুখোমুখি হয়েছিল এবং এটিকে ক্রমবর্ধমান প্রজন্মগত সম্পদের ব্যবধানের একমাত্র কারণ হিসেবে ধরে নেওয়া যায় না।
প্রজন্মগত সম্পদের ব্যবধানের কারণ অনুসন্ধান
অবশ্যই আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ কারণ রয়েছে। তাহলে, এমন কী কারণ রয়েছে যা তরুণ প্রজন্মের মধ্যে সম্পদের এই নিম্নমুখী চাপের সৃষ্টি করেছে? কেন নতুন প্রজন্ম তাদের পূর্বসূরীদের মতো আর্থিক সমৃদ্ধি অর্জন করতে পারছে না? এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার পাশাপাশি, আমাদের এটাও বিবেচনা করতে হবে যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের (USA) মতো দেশগুলোর ভবিষ্যতের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য এই পরিস্থিতির অর্থ কী? এবং এই প্রজন্মগত সম্পদের ব্যবধান কি কেবল সময়ের অপেক্ষা, যেখানে সম্পদ বয়স্ক প্রজন্ম থেকে তরুণ প্রজন্মের হাতে ধীরে ধীরে হস্তান্তরিত হবে?
আয়, সঞ্চয় এবং জীবনযাত্রার ব্যয় (Income, Savings, and Cost of Living): এই কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো একটু আগে আর্থিক বিপর্যয়ের উদাহরণটা টানার সময় আমাদের পূর্বে করা কিছু সরলীকরণ। সেখানে আমরা ধরে নিয়েছিলাম যে বিভিন্ন প্রজন্মের এই দুজন সহকর্মী সমান আয় করছেন, সমান পরিমাণ অর্থ সঞ্চয় করছেন এবং শুধুমাত্র তাদের নিয়মিত আয় ব্যবহার করে তাদের সঞ্চয়ে অবদান রাখছেন। কিন্তু বাস্তবে চিত্রটি ভিন্ন। বেবি বুমাররা সাধারণত তাদের কর্মজীবনে মিলেনিয়ালদের চেয়ে বেশি অভিজ্ঞ এবং সেই কারণে তাদের বেতনও বেশি হয়ে থাকে। শুধু তাই নয়, তাদের কর্মজীবনের একই পর্যায়েও বেবি বুমাররা মিলেনিয়ালদের তুলনায় প্রায় ২০% বেশি প্রকৃত টেক-হোম আয় (real take-home income) করতেন।
শিক্ষার খরচ এবং ঋণের বোঝা (Education Costs and the Burden of Debt): আয়ের পার্থক্যের পাশাপাশি, শিক্ষাখাতে ব্যয় এবং ঋণের বোঝাও মিলেনিয়ালদের আর্থিক অবস্থার উপর একটি বড় প্রভাব ফেলেছে। বেবি বুমারদের তুলনায় মিলেনিয়ালদের শিক্ষার জন্য অনেক বেশি খরচ করতে হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ১৯৮০ সালে একজন বীমা বিষয়ক হিসাবরক্ষক হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় গণিত বা পরিসংখ্যানের (mathematics or statistics) একটি ডিগ্রির খরচ ছিল প্রায় $১২,০০০। আজ সেই একই ডিগ্রির জন্য একজন শিক্ষার্থীকে প্রায় $৮০,০০০ খরচ করতে হয়, যার বেশিরভাগটাই শিক্ষা ঋণ বা স্টুডেন্ট লোনের মাধ্যমে পরিশোধ করতে হয়। এমনকি আমাদের পূর্বে উল্লেখিত উচ্চ আয়ের উপার্জনকারীর উদাহরণেও দেখা যাচ্ছে যে, শিক্ষার ব্যয়ের কারণে একজন মিলেনিয়াল তাদের বুমার সহকর্মীর চেয়ে অর্থ সঞ্চয়ের ক্ষেত্রে কমপক্ষে ২ বছর পিছিয়ে আছেন। অন্যদিকে, গড় আয়ের মানুষের জন্য এই পার্থক্য কয়েক দশকেও পূরণ করা সম্ভব নাও হতে পারে।
সঞ্চয়ের সুযোগ এবং জীবনযাত্রার পার্থক্য (Savings Opportunities and Differences in Lifestyle Costs): সঞ্চয়ের সুযোগের ক্ষেত্রেও দুই প্রজন্মের মধ্যে উল্লেখযোগ্য পার্থক্য রয়েছে। যদি আমরা একই পদে থাকা এবং একই বেতন উপার্জনকারী একজন বুমার এবং একজন মিলেনিয়ালের উদাহরণ বিবেচনা করি, তাহলে সেই বুমারের জন্য বার্ষিক $৫০,০০০ সঞ্চয় করা মিলেনিয়ালের তুলনায় অনেক বেশি সহজ হবে। এর অন্যতম প্রধান কারণ হলো বুমারের সম্ভবত একটি সম্পূর্ণ পরিশোধিত পারিবারিক বাড়ি রয়েছে। এর ফলে তিনি একদিকে যেমন রিয়েল এস্টেটের দাম বৃদ্ধি থেকে লাভবান হচ্ছেন, তেমনি অন্যদিকে তাকে আর কোনো ভাড়া পরিশোধ করতে হচ্ছে না। অন্যদিকে, মিলেনিয়ালদের বড় শহরগুলোতে যেখানে হিসাবরক্ষকদের প্রধান কার্যালয়গুলো অবস্থিত, সেখানে প্রতি মাসে কম করে হলেও $১,৫০০ ভাড়া গুনতে হয়। এর অর্থ হলো বুমার হয় একই পরিমাণ সঞ্চয় করার পাশাপাশি আরও উন্নত জীবনযাপন করতে পারেন, অথবা তিনি বছরে অতিরিক্ত $১৯,০০০ করমুক্ত (tax-free) সঞ্চয় করতে পারেন।
বাড়ির মালিকানা এবং সম্পদের সম্পর্ক (Homeownership and the Relationship with Wealth): সম্পদ নির্ধারণের ক্ষেত্রে বাড়ির মালিকানা (home-ownership) একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বাড়ির মালিকদের গড় নেট সম্পদ (net worth) প্রায় $২৩১,৪০০, যেখানে ভাড়াটিয়াদের গড় নেট সম্পদ $৫,০২০ এরও কম। তবে এখানে একটি বিষয় স্পষ্ট করা প্রয়োজন যে, ধনী ব্যক্তিরাই সাধারণত বাড়ির মালিক হতে সক্ষম হন, কারণ তাদের একটি উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থ জমা (deposit) দেওয়ার সামর্থ্য থাকে এবং তারা সহজেই গৃহ ঋণের (home loan) জন্য যোগ্যতা অর্জন করতে পারেন। তাই এই সম্পর্কটি সম্পূর্ণরূপে কার্যকারণ (causation) না হলেও, যারা একবার বাড়ির মালিকানা লাভ করেন, তারা আর্থিকভাবে উল্লেখযোগ্যভাবে উপকৃত হন। এবং এই বিষয়টিই প্রজন্মগত সম্পদের ব্যবধানের একটি অন্যতম কারণ।
বৃহত্তর সম্পদের বৈষম্য: একটি জটিল চিত্র (The Larger Picture of Wealth Inequality): বেবি বুমারদের জন্য নিঃসন্দেহে কিছু সুবিধা ছিল এবং মিলেনিয়ালদের জন্য কিছু প্রতিকূলতা ছিল। তবে এই প্রজন্মগত সম্পদের ব্যবধান আসলে একটি বৃহত্তর আকারের সমস্যার লক্ষণ – একটি নিয়মিত সম্পদের ব্যবধান। বাস্তবতা হলো, এই উভয় দলের কাছেই তেমন কিছুই নেই। কিন্তু যখন আমরা সম্পদের উপরের স্তরের দিকে তাকাই, তখন পার্থক্যটা চোখে পড়ার মতো। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় ৮০ মিলিয়ন মিলেনিয়ালের সম্মিলিত নেট সম্পদ ৬ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার। এই বিপুল পরিমাণ অর্থের মধ্যে যেমন একজন সদ্য পাশ করা মেডিকেল গ্র্যাজুয়েটের সামান্য সঞ্চয় এবং বিশাল স্টুডেন্ট লোনের ঋণ (student loan debt) অন্তর্ভুক্ত, তেমনি মার্ক জুকারবার্গের (Mark Zuckerberg) ব্যক্তিগত সম্পদও এর একটি অংশ, যিনি একাই এই সম্মিলিত সম্পদের প্রায় ১.৫% এর মালিক। অন্যদিকে, মাত্র ৩,০০০ জন ধনী বেবি বুমারের সম্মিলিত সম্পদ এই ৬ ট্রিলিয়ন ডলারের চেয়েও বেশি। এই ৩,০০০ জন বিলিয়নিয়ার (billionaires) -দের বিশাল সম্পদ স্টুডেন্ট লোনের ঋণ, আবাসনের অভাব, চাকরির দুষ্প্রাপ্যতা এবং আর্থিক অস্থিতিশীলতার মতো বিষয়গুলোকে প্রজন্মগত সম্পদের ব্যবধানের কারণ হিসেবে আলোচনার ক্ষেত্রে প্রায় অপ্রাসঙ্গিক করে তোলে। এসব কারণ অর্থনীতির উপর প্রভাব ফেলে ঠিকই, কিন্তু যখন আমরা একটি প্রজন্মের হাতে এত বিপুল পরিমাণ সম্পদ কেন্দ্রীভূত হওয়ার কারণ অনুসন্ধান করি, তখন দেখা যায় যে এর মূল কারণ হলো সেই প্রজন্মের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক অতি ধনী বিলিয়নিয়ারের উপস্থিতি। অন্যান্য বিষয়গুলো পরিস্থিতিকে আরও কঠিন করে তুলতে পারে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত ফলাফলে খুব বেশি পরিবর্তন আসে না। অতিরিক্ত ধনী ব্যক্তিরা সমাজে নতুন কিছু নয়, তবে ইতিহাসে আগে কখনো তারা এত বিপুল পরিমাণ সম্পদের মালিক ছিলেন না। যেহেতু বেবি বুমাররা এমন একটি বয়সে পৌঁছেছেন যেখানে তাদের নিজেদের প্রতিষ্ঠিত বড় কোম্পানি রয়েছে অথবা তাদের পিতামাতার কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে সেই কোম্পানিগুলোর মালিকানা পেয়েছেন, তাই স্বাভাবিকভাবেই তারা এই ব্যতিক্রমী সম্পদশালী ব্যক্তিদের একটি বড় অংশ।
অর্থনীতির বৃহত্তম প্রবৃদ্ধির কাল বহু আগেই পার হয়ে গেছে: এই আলোচনা থেকে এটা স্পষ্ট যে প্রজন্মগত সম্পদের ব্যবধান একটি জটিল অর্থনৈতিক সমস্যা। ধরুন আপনি ওয়ার্ল্ড অফ ওয়ারক্রাফ্টের (World of Warcraft) মতো একটি অনলাইন গেম খেলা শুরু করলেন। যদি আপনি ২০০৪ সালে গেমটি প্রথম প্রকাশের সময় খেলা শুরু করতেন, তাহলে আপনার অগ্রগতি বেশ ভালো হতো। তাত্ত্বিকভাবে, আপনি যদি গেমের প্রথম শূকরটিকেও মারতেন, তাহলে আপনি সেই মুহূর্তের জন্য হলেও গেমের খেলোয়াড়দের মোট সম্পদের ১০০% এর মালিক হতেন। কিন্তু যদি আপনি গেমটি তার প্রকাশের এক দিন পর খেলা শুরু করতেন এবং সেই একই শূকরটিকে মারতেন, তাহলে আপনার অর্জিত সম্পদ গেমের সামগ্রিক অর্থনীতির তুলনায় খুবই সামান্য হতো, কারণ ইতোমধ্যে হাজার হাজার খেলোয়াড় ২৪ ঘণ্টা ধরে গেম খেলে তাদের ক্যারেক্টারকে শক্তিশালী করেছে এবং সম্পদ বৃদ্ধি করেছে। একইভাবে, আপনি যদি এখন এই গেমটি খেলা শুরু করেন, তাহলে আপনি এমন একটি সার্ভারে প্রবেশ করবেন যেখানে বহু খেলোয়াড় ১৬ বছর ধরে খেলছে। সেখানে যদি আপনি সেই একই শূকরটিকে মারেন, তাহলে আপনার অর্জিত সম্পদ গেমের বিশাল অর্থনীতির তুলনায় অগণিত ক্ষুদ্র একটি ভগ্নাংশ হবে। কারণ এই ভার্চুয়াল অর্থনীতি আগের তুলনায় লক্ষ লক্ষ গুণ বেশি ধনী। মিলেনিয়ালদের অবস্থাও অনেকটা তেমনই। তারা জীবনের খেলা শুরু করেছে এবং এমন এক সময়ে নিজেদের উন্নতির চেষ্টা করছে, যখন অর্থনীতির বৃহত্তম প্রবৃদ্ধির কাল বহু আগেই পার হয়ে গেছে।
পূর্ববর্তী প্রজন্মের চিত্র: বুমারদের উত্থান
কিন্তু একটি প্রশ্ন থেকেই যায় – বুমাররা যখন তাদের কর্মজীবন শুরু করেছিলেন, তখন কি পরিস্থিতি এমন ছিল না? তা সত্ত্বেও, একই গড় বয়সে তাদের প্রজন্ম জাতীয় সম্পদের ২৭% এর মালিক ছিল, যেখানে মিলেনিয়ালদের মালিকানা মাত্র ৩%। এর প্রধানত তিনটি কারণ রয়েছে:
১. সম্পদের কেন্দ্রীকরণ: ৪০ থেকে ৭০ বছর বয়সীদের হাতে সম্পদ কেন্দ্রীভূত হওয়ার প্রবণতা গত ১০০ বছরে আর্থিক বাজারের ক্রমাগত উন্নতির ফলে অভূতপূর্ব পর্যায়ে পৌঁছেছে।
২. সুবিধাজনক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি: এটা অনস্বীকার্য যে বেবি বুমাররা তাদের কর্মজীবনে ভালো আয় এবং জীবনযাত্রার কম খরচের সুবিধা পেয়েছেন।
৩. জনসংখ্যার আধিক্য: তবে সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো বেবি বুমারদের সংখ্যা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের (World War 2) পরে জন্ম নেওয়া শিশুদের ব্যাপক বৃদ্ধির কারণে এই প্রজন্ম কর্মজীবনে প্রবেশ করার সময় মোট জনসংখ্যার একটি বিশাল অংশ ছিল। এর মানে হলো, ব্যক্তিগতভাবে তাদের প্রত্যেকের সম্পদ কম থাকলেও, সম্মিলিতভাবে তারা জাতীয় সম্পদের একটি বড় অংশের মালিকানা লাভ করেছিলেন।
সম্পদের ভবিষ্যৎ এবং আন্তঃপ্রজন্ম স্থানান্তর (The Future of Wealth and Intergenerational Transfer)
এই পরিস্থিতিতে সম্পদের ভবিষ্যৎ এবং এর আন্তঃপ্রজন্ম স্থানান্তর নিয়ে আলোচনা করা অপরিহার্য। অনেকেই হয়তো এই ভেবে সান্ত্বনা পেতে পারেন যে, বয়স্ক প্রজন্ম, বিশেষ করে বেবি বুমাররা যখন মারা যাবেন, তখন তাদের বিপুল পরিমাণ সম্পদ স্বাভাবিকভাবেই তাদের উত্তরাধিকারীদের কাছে হস্তান্তরিত হবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, বিষয়টি এত সহজে সমাধান হওয়ার নয়। প্রথমত, এই সম্পদের একটি বড় অংশ বেসরকারি কোম্পানির (private companies) আকারে রয়েছে, যেগুলোর মূল্য তাদের বর্তমান মালিকদের দক্ষতা এবং তত্ত্বাবধানের উপর নির্ভরশীল। উত্তরাধিকারীদের হাতে যাওয়ার পর সেই কোম্পানিগুলোর মূল্য একই থাকবে কিনা, তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। এমনকি যদি ধরে নেওয়া হয় যে এই সম্পদ হস্তান্তর প্রক্রিয়া কোনো প্রকার বাধা ছাড়াই সম্পন্ন হবে, তবুও এটি সমস্যার সম্পূর্ণ সমাধান নয়। কারণ, অর্থনীতিতে নতুন সম্পদ ক্রমাগত তৈরি হতে থাকে এবং বেশিরভাগ মানুষ তাদের অর্জিত সম্পদ তাদের সন্তানদের কাছে হস্তান্তর করেন, যাদের বয়স সাধারণত ৫০ থেকে ৬০ বছরের মধ্যে থাকে। এর ফলে, সম্ভবত জেনারেশন এক্স (Gen X) হবে ইতিহাসের সবচেয়ে ধনী প্রজন্ম, এরপর জেনারেশন ওয়াই (Gen Y) এবং এই ধারা অব্যাহত থাকবে। অন্যদিকে, যারা একেবারে তরুণ প্রজন্ম, যারা হয় শূন্য থেকে শুরু করছে অথবা স্টুডেন্ট লোনের বোঝা নিয়ে কর্মজীবনে প্রবেশ করছে, তারা অর্থনীতির ক্রমবর্ধমান আকারের তুলনায় সম্পদের একটি ক্ষুদ্র ভগ্নাংশের মালিক হতে থাকবে।
বিস্তারিত জানতে এখানে যান – বেবি বুমারদের সম্পদের উত্তরাধিকারসূত্রে স্থানান্তর হবে ইতিহাসের বৃহত্তম সম্পদ স্থানান্তর: এর প্রভাব ও অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ
এই পরিস্থিতি কি আসলেই একটি সমস্যা?
কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই পরিস্থিতি কি আসলেই একটি সমস্যা? অনেক ক্ষেত্রে হয়তো সন্তানদের ধনী হওয়ার স্বপ্ন সত্যি হয়, তবে সেই জন্য তাদের অপেক্ষা করতে হয় যতক্ষণ না তারা তাদের ষাট বছর বয়সে পৌঁছায় এবং উত্তরাধিকার সূত্রে সম্পদ লাভ করে। তবে বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে দেখলে, বিষয়টি উদ্বেগের কারণ হতে পারে। যদি অধিকাংশ সম্পদ বয়স্ক প্রজন্মের হাতে জমা হতে থাকে, তাহলে এর ফলে তরুণ প্রজন্মের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনা মারাত্মকভাবে হ্রাস পেতে পারে। ২৫ থেকে ৫৫ বছর বয়সীরাই সাধারণত নতুন বাড়ি কেনা, সন্তানদের কলেজে পাঠানো, নতুন গাড়ি কেনা এবং ভ্রমণে যাওয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে। যদি এই বয়সের মানুষের হাতে পর্যাপ্ত সম্পদ না থাকে এবং অধিকাংশ সম্পদ বয়স্ক প্রজন্মের হাতে নিষ্ক্রিয় অবস্থায় পড়ে থাকে, যাদের খরচ করার প্রবণতা তুলনামূলকভাবে কম, তাহলে এর ফলে অর্থনীতিতে অর্থের প্রবাহ কমে যেতে পারে এবং তরুণ প্রজন্মের সম্পদ অর্জনের সুযোগ সীমিত হয়ে যেতে পারে।
চূড়ান্ত ভাবনা
প্রজন্মগত সম্পদের ব্যবধান একটি বাস্তব সমস্যা এবং এর কিছু নেতিবাচক দিক রয়েছে। তবে সম্ভবত এই সমস্যাটিকে যতটা বড় করে দেখানো হচ্ছে, ততটা নাও হতে পারে। বিষয়টিকে এভাবে ভাবা যেতে পারে – আমি উইশ ডটকমের (wish.com) ৩০% মালিক হওয়ার চেয়ে অ্যামাজনের (amazon) ৩% মালিক হতে বেশি পছন্দ করব। একইভাবে, বর্তমান প্রজন্মের তরুণরা ১৯৭০-এর দশকের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৩০% সম্পদের মালিক হওয়ার চেয়ে আধুনিক আমেরিকার ৩% সম্পদের মালিক হওয়ায় বেশি সুখী হতে পারে। তবে সবকিছু বিবেচনা করার পর এটাই প্রতীয়মান হয় যে, এই পরিসংখ্যানগুলো হয়তো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরে থাকা বৃহত্তর সম্পদের বৈষম্যের (wealth inequality) একটি ভীতিকর চিত্র মাত্র। এই বৈষম্য নিয়ে বিতর্ক দীর্ঘ এবং বিভাজনমূলক, কিন্তু বিতর্কের উভয় পক্ষকেই এটা অনুধাবন করতে হবে যে, এই প্রজন্মগত সম্পদের সংকট বৃহত্তর অর্থনৈতিক বৈষম্যের একটি ফলাফল মাত্র। স্টুডেন্ট লোনের মওকুফ (student loan forgiveness), ন্যূনতম মজুরি বৃদ্ধি (increased minimum wages) এবং সাশ্রয়ী মূল্যের আবাসন নীতির (affordable housing policies) মতো পদক্ষেপগুলো কি এই পরিস্থিতি কমাতে সাহায্য করবে? অবশ্যই, এই পদক্ষেপগুলো সমস্যার কিছু উপসর্গ কমাতে সহায়ক হতে পারে। তবে অর্থনীতির মৌলিক কাঠামোতে বড় ধরনের পরিবর্তন আনা ছাড়া প্রজন্মগত সম্পদের ব্যবধানের এই ক্রমবর্ধমান ধারাকে সম্পূর্ণরূপে থামানো হয়তো সম্ভব নয়।
আবাসনের অর্থনীতি ও আবাসন সংকট: বিনিয়োগ, ঝুঁকি, কারণ, চ্যালেঞ্জ ও সমাধানের পথ
ভূমিকা
যে কোনও বাজার, যে কোনও এলাকাতেই পরিবারের জন্য একটি বাড়ি হচ্ছে আরামের আশ্রয়, একটি পরিবারকে বড় করার চমৎকার জায়গা এবং সর্বোপরি একটি বিচক্ষণ বিনিয়োগ। বিশ্বের বেশিরভাগ উন্নত দেশে একটি বাড়ি পারিবারিক অর্থনীতির কেন্দ্রবিন্দু। এটি একই সাথে সবচেয়ে বড় বিনিয়োগ এবং প্রায় যেকোনো ব্যক্তির জন্যই এই ক্রমবর্ধমান দুর্লভ বাজারে প্রবেশ করতে পারাটা ভাগ্যের বিষয়। কিন্তু এটা কি সবথেকে ভালো? বাড়িঘর কি জুয়া খেলার চিপসের মতই হয়ে গেছে? কারণ লোকেরা আর সেগুলোকে একটি ক্রমবর্ধমান পরিবারের জন্য আশ্রয় হিসেবে দেখে না, বরং অপ্রত্যাশিত লাভের আশায় বন্য ফটকাবাজির জন্য কেনা সম্পদ হিসেবে দেখে।
২০০৮ সালের শেষ আর্থিক মন্দার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল রিয়াল এস্টেটের বাজার। সম্ভবত আবাসন জগতে কী ঘটছে তা পুনরায় মূল্যায়ন করা জরুরি। এটি করার জন্য, আমাদের সত্যিই কয়েকটি বিষয়ের দিকে কয়েকটি স্তরে নজর দিতে হবে— ক্ষুদ্র অর্থনৈতিক কারণগুলো থেকে, যেমন একটি অতি-উন্নত এবং অতিরিক্ত ঋণগ্রস্ত পরিবার থেকে শুরু করে অর্থনীতি-ব্যাপী বিষয়গুলো পর্যন্ত, যা শেষ পর্যন্ত কয়েকটি মূল প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য সামনে আনা হবে। সেই প্রশ্নগুলো হচ্ছে – একটি শক্তিশালী রিয়াল এস্টেট বাজারের বৃহত্তর অর্থনীতির জন্য কী অর্থ বহন করে? সেখানে কি আরও ভাল বিনিয়োগ আছে? এবং অর্থনীতিগুলো কি এখন অতিরিক্ত ঋণগ্রস্ত? যদি আমরা এই কারণগুলো বুঝতে পারি, তাহলে আমরা আমাদের জীবনের সবচেয়ে বড় বিনিয়োগের সঙ্গে মোকাবেলা করতে আরও ভালভাবে প্রস্তুত হব।
এদিকে আবাসনের দাম যদি অনেক বেড়ে যায় তাহলে মানুষ শহর ত্যাগ করে শহরতলিতে বাড়ি নিতে শুরু করে, যেটা কোভিড-১৯ এর অতিমারীর সময় ভীষণভাবে প্রকট হয়ে উঠেছিল। এই আবাসন সংকটের কারণে শহর থেকে শহরতলির দিকে যাওয়াটারও একটা ইতিহাস আছে। শিল্প বিপ্লবের পর ১৯৫০ সালে প্রথম শহর ছেড়ে মানুষ শহরতলীতে বসবাস করতে শুরু করে। এই সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের গড়পড়তা বাড়ির দাম ছিল ৭,৪০০ ডলার। যেখানে একটি পরিবারের গড় আয় ছিল ২,৯০০ ডলার এবং সাধারণত পরিবারের একজন সদস্যই উপার্জন করত। এই সময় একটি সাধারণ বাড়ির দাম ছিল একটি পরিবারের গড় আয়ের দুই-তৃতীয়াংশের সামান্য বেশি। তাই এটা আশা করা অযৌক্তিক ছিল না যে কিছু মানুষ কয়েক বছরের মধ্যেই তাদের বাড়ির ঋণ পরিশোধ করতে পারবে। কিন্তু বাস্তবে তেমনটা ঘটেনি। সুদের হার তুলনামূলকভাবে কম ছিল। তাই অতিরিক্ত অর্থ পরিশোধ করার তেমন চাপ ছিল না। তাছাড়া, আবাসনকে তখন খুব একটা বড় খরচ হিসেবেও দেখা হতো না।
এই সময় একটি নতুন গাড়ির গড় দাম ছিল প্রায় ২,০০০ ডলার। তাই যদি কোনো পরিবারের বাড়ির সামনে দুটো গাড়িও থাকত, তাহলেও গাড়িগুলোর দাম বাড়ির চেয়ে বেশি হওয়াটা অস্বাভাবিক ছিল না। বিশেষ করে মধ্য-পশ্চিমের (Midwest) মতো জায়গাগুলোতে যেখানে বাড়ির দাম উপকূলবর্তী রাজ্যগুলোর (Coastal states) তুলনায় কম ছিল। অবশ্য, সেই সময় দুটো গাড়ি থাকাটা বেশ আড়ম্বরের বিষয় ছিল, তাই এই পরিস্থিতি খুব একটা স্বাভাবিক ছিল না।
কিন্তু এখনকার দিনে পরিস্থিতিটা প্রায় অবিশ্বাস্য মনে হয়। শিকাগো (Chicago) বা সিয়াটলের (Seattle) শহরতলীর (suburb) বাইরের কোনো সুন্দর এলাকায় একটি সাধারণ বাড়ির ছবি কল্পনা করুন। এমনকি ভ্যাঙ্কুভার (Vancouver), সিডনি (Sydney), অকল্যান্ডের (Auckland) কথাও ভাবতে পারেন। অথবা যদি আরও বাড়াবাড়ি করতে চান তাহলে লন্ডনকে (London) ধরুন। বাড়ির সামনে পার্ক করা গাড়িগুলো যদি ল্যাম্বরগিনিও (lambos) না হয়, তাহলে এই দুটি সম্পদের দামের তুলনা করাও সম্ভব নয়। আমি জানি আপনারা কী ভাবছেন, “হ্যাঁ, বাড়ির দাম বেড়েছে, এতে নতুন কী?”
আমি বুঝতে পারছি, কিন্তু এই তুলনাটি অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। মহামারীর (pandemic) প্রেক্ষাপটে আবাসন সংকট আবারও একটি বিশাল সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। শহরে আবাসনের দাম এত বেড়ে যায় যে, ব্যক্তিগত বসবাসের জন্য বেশি জায়গার প্রয়োজনীয়তা এবং বাড়ি থেকে কাজ করার সুবিধার কারণে মানুষ আবারও শহর ছেড়ে শহরতলীতে যেতে শুরু করে। এতে দাম বাড়তে শুরু করে। আবাসনের দাম বাড়াটা স্বাভাবিক একটা ব্যাপার, কিন্তু এটাকে বাড়তে হবে অন্যান্য পণ্যের মতই স্থিতিশীলভাবে। অস্বাভাবিকভাবে বা অস্থিতিশীলভাবে দাম বাড়াটা অর্থনীতির জন্য খুবই ক্ষতিকর হয়ে দাঁড়ায়। উন্নত দেশগুলোতে এখন যে বাড়ির দাম বাড়ছে, সেগুলোর কারণ ও ফলও আলোচনা করা দরকার, সেই সাথে অতীতের সাথে এর তুলনাও।
উন্নত বিশ্বে আবাসন সংকটের ইতিহাস
১৯৫০-এর দশক: শহর ছেড়ে শহরতলীতে স্থানান্তর
যদি আমরা ১৯৫০-এর দশকে ফিরে যাই, তাহলে দেখব বেশ কিছু কারণে মানুষ শহরের কেন্দ্র ছেড়ে শহরতলীতে বসবাস করতে শুরু করেছিল। শহরের কেন্দ্রগুলোতে মূলত ভাড়াটেরা থাকত, আর শহরতলীতে বাড়ির মালিকানার চল শুরু হয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রে একটি বড় কারণ ছিল তথাকথিত “শ্বেতাঙ্গদের শহর ত্যাগ” (white flight)। মূলত শ্বেতাঙ্গ মধ্যবিত্তরা ভেতরের শহরগুলোকে অপেক্ষাকৃত নিরাপদ মনে করত না, তাই তারা শহরতলীর দিকে চলে গিয়েছিল। “নিরাপদ” বলতে তারা মূলত “আরও বেশি শ্বেতাঙ্গ” বোঝাত। এই পুরো প্রক্রিয়াটি কয়েকটি কারণে দ্রুততর হয়েছিল।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের (World War II) পর উন্নত আন্তঃরাজ্য মহাসড়ক ব্যবস্থা (interstate highway system) তৈরি হওয়ায় মানুষ তাদের নতুন কেনা গাড়ি ব্যবহার করে প্রতিদিন সহজে এবং দ্রুত কর্মস্থলে যাতায়াত করতে পারত। এর কয়েক দশক আগেও শহর থেকে গ্রামাঞ্চলে যেতে হলে ভাগ্যবান হলে ট্রেনে চড়তে হতো, আর ভাগ্য খারাপ হলে ঘোড়ার গাড়িতে যেতে হতো, যা বেশিরভাগ মানুষের দৈনিক যাতায়াতের জন্য বাস্তবসম্মত ছিল না।
পশ্চিমা বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলের জন্যেও একই চিত্র ছিল। অস্ট্রেলিয়া (Australia), কানাডা (Canada) এবং এমনকি যুক্তরাজ্যও (UK) যুক্তরাষ্ট্রের দেখানো পথ অনুসরণ করে মহানগরীর অট্টালিকা ছেড়ে শহরতলীতে জমি কিনে বাড়ি বানানোর দিকে ঝুঁকেছিল। এর এমন একটি প্রভাব ছিল যা আজকের দিনে আমাদের কাছে খুব অদ্ভুত মনে হতে পারে। এর ফলে আবাসন আরও সাশ্রয়ী হয়ে উঠেছিল।
১৯৭০-এর দশকে সাশ্রয়ী আবাসন
দুই দশক পর, ১৯৭০ সালে, যুক্তরাষ্ট্রে একটি গড় বাড়ির দাম ছিল ১৭,০০০ ডলার। যা ১৯৫০-এর দশকের চেয়ে বেশি হলেও খুব বেশি নয়। প্রকৃতপক্ষে, এই সময়ে দাম শুধুমাত্র মুদ্রাস্ফীতির (inflation) সাথে তাল মিলিয়ে চলেছিল। এর বিপরীতে, এই সময়ে গড় বেতন প্রায় তিনগুণ বেড়ে ৮,৭০০ ডলারে পৌঁছেছিল। যার মানে দাঁড়ায় একটি গড় বাড়ির দাম ছিল একটি পরিবারের গড় আয়ের দুই গুণেরও কম। অনেকেই তাদের বার্ষিক আয়ের চেয়েও কম দামে বাড়ি কিনছিলেন। এর কারণ ছিল সরবরাহ বেশি থাকা। শহরগুলো বাড়তে শুরু করেছিল এবং সর্বত্র নতুন বাড়ি তৈরি হচ্ছিল। এর চেয়েও বড় কথা, চাহিদার তুলনায় সরবরাহ বেশি ছিল। আজকের জনসংখ্যার তুলনায় তখন জনসংখ্যা ছিল দুই-তৃতীয়াংশ এবং রিয়েল এস্টেটে (real estate) বিনিয়োগের ধারণাটি তেমন প্রচলিত ছিল না।
সত্তরের দশকে ক্যাশ রেটও (cash rates) ১৩ শতাংশের মতো বেশি ছিল। যার অর্থ দাঁড়ায় নিজের বসবাসের জন্য নেওয়া মর্টগেজ (mortgage) ধরে রাখাই কঠিন ছিল, সেখানে বিনিয়োগের জন্য সম্পত্তি কেনা তো দূরের কথা। রিয়েল এস্টেট ছিল একটি সাধারণ পণ্য। কাঠ, লোহার আকরিক, কমলার রস বা চালের মতো। এটি এমন কিছু ছিল যা মানুষের প্রয়োজন ছিল, মূল্যবান ছিল, তবে একটি যুক্তিসঙ্গত মূল্যে পাওয়া যাবে বলেই আশা করা হতো।
১৯৮০-এর দশকে বিনিয়োগের হাতিয়ার হিসাবে রিয়েল এস্টেট
তবে ১৯৮০-এর দশকে পরিস্থিতি পাল্টে যায়। এই সময়ে রিয়েল এস্টেট সাধারণ পণ্যের চেয়ে বিনিয়োগের হাতিয়ার হিসেবে বেশি কাজ করা শুরু করে। ১৯৮০-এর দশকে বেশ কিছু পরিবর্তন আসে। মানুষ আবারও শহরের দিকে ফিরতে শুরু করে এবং শহরের কাছাকাছি বসবাস করা কিছু শহরতলির জন্য আভিজাত্যের প্রতীক হয়ে ওঠে। ১৯৮১ সালের অর্থনৈতিক মন্দার (recession) পর বিশাল সংখ্যক খেলাপি হওয়া রিয়েল এস্টেট বিক্রি হওয়ার কারণে মানুষ আকৃষ্ট হয় এবং কম দামে কিছু সম্পত্তি কিনে রিয়েল এস্টেটে প্রথমবার বিনিয়োগের সাহস পায়। লুই রেনি’র (Louis Rennie) মর্টগেজ বন্ডের (mortgage bond) ব্যাপক ব্যবহারের ফলে এই প্রক্রিয়া আরও সহজ হয়ে যায়।
এখান থেকেই একটি নতুন প্রবণতা শুরু হয়, যেখানে বাড়ির দামের বৃদ্ধি বেতন বৃদ্ধির হারের চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা হয়ে যায়। তিন দশক পর, যুক্তরাষ্ট্রের গড় বাড়ির দাম গড় বেতনের চারগুণেরও বেশি হয়ে যায়। এবং এই হিসাব ২০১০ সালের, যখন বাড়ির দাম সাব-প্রাইম মর্টগেজ সংকট (sub-prime mortgage crisis) থেকে পুনরুদ্ধার হচ্ছিল।
তবে এটা কিছুটা প্রত্যাশিতই ছিল। এটা ছিল সহজ চাহিদা এবং সরবরাহের বিষয়। মানুষ শুধু বড় বাড়িই চাইছিল না, সেই সাথে শহর কেন্দ্র বা অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার কাছাকাছি বাড়িও চাচ্ছিল। এতে সরবরাহ সীমিত হয়ে যায়। ৩০ বছরের মর্টগেজের ব্যাপক ব্যবহার, কম সুদের হার, বেশি আয় এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানের (finance industry) বেশি বেশি ঋণ দেওয়ার প্রবণতা চাহিদা বাড়িয়ে দেয়। ব্যস!
অর্থনীতিতে আবাসন : বিনিয়োগ ও পণ্য হিসেবে
বিনিয়োগ হিসাবে আবাসন
আবাসনকে কোন বিষয়টি একটি সূক্ষ্ম অর্থনৈতিক স্তরে মূল্যবান করে তোলে, তা বোঝা গুরুত্বপূর্ণ। একটি বাড়ি দুটি জিনিসের কাজ— জমি (যে মাটির প্লটের ওপর এটি দাঁড়িয়ে আছে) এবং কাঠামো (আসল বিল্ডিং, যেখানে শয়নকক্ষ এবং বাথরুম এবং সেই মজাদার জিনিসগুলো রয়েছে)। সাধারণত জমি হল সেই জিনিস যা রিয়েল এস্টেট বাজারে মূল্যবান হয়। যদি জমিটি কোনও আকাঙ্খিত এলাকায় থাকে, যেমন কোনও শহরের কেন্দ্র যেখানে প্রচুর ভালো চাকরির সুযোগ আছে, তাহলে জমির মূল্য বাড়বে।
উদাহরণস্বরূপ, সান ফ্রান্সিসকো (San Francisco) এবং সিলিকন ভ্যালির (Silicon Valley) কথা ধরুন। এই শহরগুলো প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোতে পরিপূর্ণ, যারা নতুন এবং উত্তেজনাপূর্ণ প্রযুক্তি বিকাশের জন্য প্রতি বছর হাজার হাজার ডেভেলপার (developer) এবং ইঞ্জিনিয়ারদের (engineer) লক্ষ লক্ষ ডলার বেতন দেয়। এখন এই প্রযুক্তিবিদদের সকলেরই কোথাও না কোথাও থাকতে হবে, তাই এই অফিসগুলোর কাছাকাছি রিয়েল এস্টেটের প্রচুর চাহিদা রয়েছে। এই উচ্চ আয়ের কারণে, যারা এই বাড়িগুলো চান তাদের কাছে কিছু গুরুতর প্রস্তাব দেওয়ার মতো আর্থিক ক্ষমতাও রয়েছে। ফলস্বরূপ, এই জমিগুলোর দাম অনেক হয়।
সামাজিকভাবে, এটি শিল্পের অংশগ্রহণগ্রহণ করেনা এমন লোকদেরকে এমন একটি শহরের বাজার থেকে ছিটকে দিতে পারে যেখানে তারা সম্ভবত সারাজীবন ধরে বসবাস করেছে এবং সম্ভবত এটি একটি খারাপ জিনিস। তবে এখানে কোনও মৌলিক অর্থনৈতিক সমস্যা নেই। এই অতি উচ্চ জীবনযাত্রার ব্যয়ের এলাকাগুলোতে অতিরিক্ত মুদ্রাস্ফীতি (inflation) নিয়ে ক্রমাগত উদ্বেগ থাকা সত্ত্বেও, আসলে উদ্বিগ্ন হওয়ার মতো তেমন কিছু নেই— যতক্ষণ এই এলাকার আয়ের স্তর একই হারে বাড়তে থাকে। এটা আশা করাই যায় যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ছোট শহরগুলোতেও তাদের সম্পত্তির জন্য উচ্চ মূল্য চাওয়া হবে এবং ধরা যাক সাহারা-নিম্ন আফ্রিকার (Sub-Saharan Africa) রিয়েল এস্টেটের দামের চেয়ে বেশি হবে। এটি কেবল সেই এলাকার বাসিন্দারা কতটা ধনী তার উপর নির্ভর করে।
দ্বিতীয় যে বিষয়টি বিবেচনা করতে হবে তা হল বিদেশী ক্রেতাদের বা ভাড়াটেদের কাছে কোনও এলাকার আবেদন। উদাহরণস্বরূপ, এস্পেন কলোরাডোর (Aspen Colorado) মতো একটি জায়গার কথা ভাবুন। এটি একটি সুন্দর এলাকা, তবে এটি ঠিক বিনিয়োগ ব্যাংক বা প্রযুক্তি স্টার্টআপের কেন্দ্র নয়। এখানকার সম্পত্তিগুলোর এত দাম হওয়ার কারণ হল এই এলাকার বাইরের লোকেরা, তা এই লোকেরা যুক্তরাষ্ট্রের অন্য কোনও এলাকা বা অন্য কোনও দেশ থেকেই হোক না কেন। শীতকালে স্কি ঢালু উপভোগ করতে একটি হলিডে হোম (holiday home) বা মৌসুমী ভাড়ার জন্য অনেক টাকা দিতে রাজি থাকে। পুরো শহরগুলোর ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। সিডনি (Sydney), ভ্যাঙ্কুভার (Vancouver) এবং লন্ডনের (London) মতো শহরগুলোর সম্পত্তি বাজারে বিদেশ থেকে উচ্চ আয়ের উপার্জনকারীদের সম্পত্তি কেনার কারণে উল্লেখযোগ্য প্রভাব পড়েছে।
এখন, এই সব কিছুই জমির মূল্য বাড়িয়ে তোলে। এই অঞ্চলের আশেপাশের জমি শেষ পর্যন্ত একটি সীমিত সম্পদ, যার সরবরাহ সীমাবদ্ধ। সিলিকন ভ্যালি (Silicon Valley) বা ম্যানহাটন (Manhattan) বা এস্পেনের (Aspen) ভিলেজ চেয়ারলিফটের (village chairlift) ৩০ মাইল ব্যাসার্ধের মধ্যে বসবাসযোগ্য স্থানের পরিমাণ সীমিত। তাই, ক্রমবর্ধমান চাহিদা এবং সীমাবদ্ধ সরবরাহ সহ যেকোনো কিছুর মতোই দাম বাড়বে। তাহলে আবাসন কি একটি ভাল বিনিয়োগ? হ্যাঁ, যতক্ষণ না আপনারা একটি বাড়ি কেনার ক্ষেত্রে সেই একই পদ্ধতি অবলম্বন করেন যা আপনারা শেয়ার কেনার ক্ষেত্রে করতেন— এটির কি ভাল প্রমাণপত্র, একটি ভাল ইতিহাস, ভবিষ্যতের বৃদ্ধির একটি ভাল পথ আছে এবং এটি কি বেশি মূল্যবান? যদি এই সমস্ত প্রশ্নের উত্তর হ্যাঁ হয়, তবে এগিয়ে যান। তবে শুধু মনে রাখবেন, এটি অন্য যেকোনো বিনিয়োগের মতোই এবং বৃদ্ধির কোনও গ্যারান্টি নেই।
এছাড়াও, কিছু এলাকায় বন্ধকী পরিশোধ করা আসলে ভাড়া দেওয়ার চেয়ে সস্তা হতে পারে। তাই দাম একেবারেই না বাড়লেও আপনারা শেষ পর্যন্ত লাভবান হবেন। এবং এর উপরে, এটা ভুলে গেলে চলবে না যে মাঝে মাঝে আমাদের ঠান্ডা মাথার অতি-যুক্তিপূর্ণ অর্থনীতিবিদ হওয়া বন্ধ করতে হবে এবং উপলব্ধি করতে হবে যে দিনের শেষে লোকেরা সবসময় সবচেয়ে যৌক্তিক সিদ্ধান্ত নেয় না। মাঝে মাঝে এটা বলা ভালো লাগে যে “আমার বাড়ি আমার দুর্গ” এবং এটি সম্পূর্ণরূপে আমার। এখন ওসব বাদ দিয়ে, আসুন দেখি এই বিনিয়োগটি কোথায় একটু অদ্ভুত হয়ে যায়।
পণ্য হিসাবে আবাসন
অর্থনৈতিক অর্থে একটি বাড়ি কেবল একটি পণ্যের মতো, যেমন একটি গাড়ি বা এক টুকরো সাবান বা এক বোতল জল। এটি এমন একটি জিনিস যা আমরা কিনতে এবং বিক্রি করতে পারি এবং কিছু ধরণের মূল্য পেতে পারি। তবে এটি ঠিক কী ধরণের পণ্য তা সঠিকভাবে সংজ্ঞায়িত করা কিছুটা কঠিন। অনেকে যুক্তি দেবেন যে আবাসন হল অপরিশোধিত তেল বা সোনা বা কফির মতো একটি পণ্য। এটি প্রায়শই ফটকাবাজারগুলোতে লেনদেন করা হয় এবং দিনের শেষে এটি এমন একটি জিনিস যা শেষ ব্যবহারকারীর জন্য একটি লক্ষ্যের মাধ্যম। এখানে প্রধান পার্থক্য হল বাস্তবিকভাবে শুধুমাত্র জমিই এরকম একটি পণ্য যার দাম বাড়ে। অন্যদিকে জমির উপর যে কাঠামোটি থাকে, অর্থাৎ বাড়িটা অন্যান্য ভোগ্যপণ্যের মত কাজ করে যেগুলোর দাম কমে। এটি কাঁচামাল থেকেই তৈরি এবং সময়ের সাথে সাথে একটি গাড়ির মূল্য যেমন হ্রাস পায় তেমনিভাবেই বাড়ির দামও হ্রাস পায়। একটি নতুন বাড়ি শুনতে চমৎকারই লাগে এবং প্রায়শই লোকেরা মনে করে যে বাড়ি এবং জমি উভয়েরই বাজারের সাথে মূল্য বাড়বে। তবে বাস্তবতা হল যে অন্যান্য উন্নত উৎপাদনকারী পণ্যের মতো বাড়িঘরও ভেঙে যায় এবং পুরানো হয়ে যায়। পার্থক্য শুধু এইটুকু যে প্রায়সই কোন বাড়ির মূল্যহ্রাস সেটা যে জমির উপর অবস্থিত তার মূল্যবৃদ্ধির জন্য আড়াল হয়ে যায়। তাই যদি কেউ এমন কোনও এলাকায় থাকে যেখানে জমির মূল্য কাঠামোর মূল্যের সমান বা তার চেয়ে কম, তাহলে জমির মূল্যবৃদ্ধি বনাম কাঠামোর মূল্যহ্রাসের উপর বিবেচনা করতে হবে, কারণ এটি খুব দ্রুত সমস্যা তৈরি করতে পারে। আর এই ব্যাপারটাই আমাদেরকে নিয়ে যায় অর্থনীতির উপর এর প্রভাবের দিকে।
কোভিড-১৯ এর পর আবাসনের সম্প্রতি আকাশচুম্বি দাম ও এর কারণ
আশ্রয় একটি মৌলিক মানবাধিকার (fundamental human right)। একটি উন্নত অর্থনীতিতে আমরা অনেকেই আশা করি আশ্রয় আরামদায়ক ও যথেষ্ট বড় হবে এবং একেবারে অনুপযুক্ত স্থানে হবে না। আকাশচুম্বী দাম সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাওয়ার হুমকি দিচ্ছে। সিডনির মতো শহরগুলোতে দেখা যায়, ১০ বা তার বেশি ছাত্রছাত্রী একটি দুই বেডরুমের অ্যাপার্টমেন্টে গাদাগাদি করে থাকছে আকাশছোঁয়া ভাড়া ভাগ করে নেওয়ার জন্য। একইভাবে, অকল্যান্ডে গত বছর গড় বাড়ির দাম ২০ শতাংশের বেশি বেড়েছে। যার মানে দাঁড়ায়, গড় আয়ের একটি তরুণ দম্পতি যদি তাদের আয়ের পুরোটাই জমাতে পারে, তবুও তাদের পক্ষে বাড়ি কেনার স্বপ্ন ক্রমশ দূরে চলে যাবে।
বৈশ্বিক অতিমারীর (global pandemic) সময় এই পরিস্থিতি বিশেষভাবে অদ্ভুত। সিডনি এবং অকল্যান্ডের পাশাপাশি ভ্যাঙ্কুভার, টরন্টো (Toronto) এবং কিছুটা হলেও লন্ডনের মতো শহরগুলোর পরিস্থিতি বিশেষভাবে আশ্চর্যজনক। কারণ এই শহরগুলো ঐতিহাসিকভাবে বিদেশি অর্থের উপর নির্ভরশীল। বিদেশি প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ (foreign direct investment) এই শহরগুলোর কেন্দ্রস্থলে একটি বড় বিতর্কের বিষয় ছিল। কারণ ধনী বিদেশি বিনিয়োগকারীরা (investors) স্থানীয় বাসিন্দাদের আবাসন বাজারে প্রতিযোগিতায় হারিয়ে দিচ্ছিল। কিন্তু বিশ্বজুড়ে লকডাউনের (lockdown) কারণে এটা সম্ভব হয়নি। অন্তত আগের মতো তো নয়ই। তা সত্ত্বেও, এই শহরগুলোর সম্পত্তি বাজার এবং উন্নত দেশগুলোর বেশিরভাগ প্রধান শহরের কেন্দ্রগুলোতে সাম্প্রতিক মাসগুলোতে আকাশচুম্বী দাম বেড়েছে। সম্প্রতি এই দাম বৃদ্ধির কারণ –
- কম সুদের হার (low interest rates): প্রথম কারণটি অবশ্যই কম সুদের হার (low interest rates)। এর ফলে বেশি টাকা ধার করা সহজ হয়। যা মানুষকে সম্পত্তি কেনার দর কষাকষিতে আরও বেশি আর্থিক ক্ষমতা দেয়। যেখানে তারা সাধারণত এমন লোকেদের সাথে প্রতিযোগিতা করে যারা সহজেই বেশি টাকা ধার করতে সক্ষম।
- উদ্দীপনা প্যাকেজগুলো (stimulus measures): দ্বিতীয় কারণটিও প্রথমটির মতোই। উদ্দীপনা প্যাকেজগুলো (stimulus measures) অর্থনীতির ভেতরে প্রচুর অর্থ পাঠায় এবং সেই অর্থের একটি বড় অংশ ধনী লোকেদের হাতে যায়। এরা এই অতিরিক্ত অর্থ বাড়ির ডাউন পেমেন্ট (down payment) হিসেবে ব্যবহার করতে পারবে। (ডাউন পেমেন্ট (Down payment) হল কোনো বড় ঋণ বা ক্রয়ের জন্য প্রথমে পরিশোধ করা একটি অর্থের পরিমাণ, যা সাধারণত মোট ক্রয়ের মূল্য বা ঋণের পরিমাণের একটি নির্দিষ্ট শতাংশ হয়। এটি মূলত ঋণের বাকী অংশ পরিশোধের জন্য লোন প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানকে নিশ্চিত করে এবং এটি সাধারণত গৃহ ঋণ (mortgage) বা গাড়ি ঋণের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়। উদাহরণস্বরূপ, যদি আপনি একটি বাড়ি কিনতে চান যার দাম ১,০০,০০,০০০ টাকা এবং আপনার ডাউন পেমেন্ট ২০% (২০,০০,০০০ টাকা) হয়, তবে আপনি প্রথমে ২০,০০,০০০ টাকা প্রদান করবেন এবং বাকী ৮০,০০,০০০ টাকা ঋণ হিসেবে পাবেন। ডাউন পেমেন্টের পরিমাণ বাড়ালে ঋণের পরিমাণ কম হয় এবং পরিশোধের সময়সীমাও কমানো যেতে পারে।) এই পরিস্থিতি শুধু যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। অস্ট্রেলিয়ায় অস্ট্রেলিয়ান সরকার (Australian government) একটি বিতর্কিত পদক্ষেপের মাধ্যমে নাগরিকদের তাদের সুপারঅ্যানুয়েশন (superannuation) বা অবসরকালীন সঞ্চয় থেকে ২০,০০০ অস্ট্রেলিয়ান ডলার পর্যন্ত তোলার অনুমতি দেয়, যা আমেরিকানদের ৪০১(কে) এর সমতুল্য। এই টাকা সাধারণত অবসর নেওয়ার আগে তোলা যেত না। এই অর্থ সংকটে পড়া পরিবারগুলোকে জীবনধারণের জন্য দেওয়ার কথা ছিল, যারা তাদের দোষ ছাড়াই চাকরি হারিয়েছিল। কিন্তু অনেকেই এটি তাদের সেভিংসের পরিমাণ বাড়াতে ব্যবহার করেছে। মজার ব্যাপার হলো, এই নীতি চালু হওয়ার কয়েক মাসের মধ্যে, তরুণ অস্ট্রেলিয়ানদের প্রথম বাড়ি কেনার জন্য প্রয়োজনীয় গড় সেভিংসের পরিমাণ প্রধান শহরগুলোতে ২০,০০০ ডলার বেড়েছে। প্রথম এবং দ্বিতীয় কারণে যে আসলে কেবল সম্পত্তির দামই বেড়ে যায় তা না, এর ফলে বিশ্বজুড়ে মুদ্রার মান কমে যায়।
- মানুষ সত্যিই বাড়ির জন্য বেশি টাকা খরচ করতে চাওয়া: তৃতীয় কারণটি হলো, মানুষ সত্যিই বাড়ির জন্য বেশি টাকা খরচ করতে চাইছে। কোভিডের কারণে প্রায় দেড় বছর ধরে ঘরের ভেতরে আটকে থাকার মানে হলো মানুষ অতিরিক্ত জায়গা চাইছে। এর মানে, যারা এক বেডরুমের অ্যাপার্টমেন্টে থাকে তারা হয়তো এমন একটি অ্যাপার্টমেন্ট চাইছে যেখানে তাদের নিজস্ব হোম অফিস (home office) থাকবে। যারা দুই বেডরুমের অ্যাপার্টমেন্টে থাকে তারা হয়তো একটি টাউন হাউসের (townhouse) বাইরের খোলা জায়গা চাইছে। আর যারা টাউন হাউসে থাকে তারা হয়তো একটি সম্পূর্ণ আলাদা বাড়ি চাইছে, যেখানে তারা তাদের পরিবারের থেকে কিছুটা আড়াল থাকতে পারবে, যাদের সাথে তারা সারাক্ষণ আটকে আছে। সবার বড় বাড়িতে ওঠার আকাঙ্ক্ষা পুরো আবাসন বাজারের চাহিদাকে বাড়িয়ে দিচ্ছে।
- মানুষের সঞ্চয় বৃদ্ধি: চতুর্থ কারণটি হলো, মানুষের সঞ্চয় বেড়েছে। প্রথম সম্পত্তি বা প্রথম বিনিয়োগের সম্পত্তি (investment property) অথবা একটি বড় পারিবারিক বাড়িতে ওঠার পথে সবচেয়ে বড় বাধা হলো ডাউন পেমেন্টের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ সঞ্চয় করা। অনেক পরিবারের জন্য এই বাধা এখন কমতে শুরু করেছে। কারণ যুক্তরাষ্ট্রে কয়েক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ সঞ্চয়ের হার দেখা যাচ্ছে। এর একটা কারণ অবশ্যই মানুষ ভবিষ্যতের বিষয়ে চিন্তিত এবং সরকারি উদ্দীপনা বন্ধ হয়ে গেলে তাদের চাকরি থাকবে কিনা তা নিয়ে শঙ্কিত। তাই মানুষ ভবিষ্যতের জন্য বেশি করে সঞ্চয় করছে। তবে এর একটি বড় অংশ প্রায় সম্পূর্ণ আকস্মিক। ছুটি কাটাতে যেতে না পারা, বাইরে খেতে না পারা বা সপ্তাহান্তে মলে গিয়ে টাকা নষ্ট করতে না পারার সাথে কিছু উদার সরকারি উদ্দীপনা যোগ হওয়ায় মানুষের সঞ্চয় অ্যাকাউন্টে অনেক বেশি টাকা জমা হয়েছে। এই অর্থ পরবর্তীতে ডাউন পেমেন্ট হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে।
- বাড়ি বিক্রি করতে ভয় পাওয়া: পঞ্চম কারণটি বেশ অদ্ভুত। মানুষ বাড়ি বিক্রি করতে ভয় পাচ্ছে। প্রচলিত অর্থনীতি অনুযায়ী, কোনো পণ্যের দাম যত বাড়তে থাকে, ততই বেশি সংখ্যক বাজার অংশগ্রহণকারী সেই উচ্চ মূল্যে চাহিদা মেটাতে ইচ্ছুক হবে। কিন্তু এখানে সমস্যা হলো, আবাসন একটি প্রয়োজনীয় জিনিস। আমরা দেখেছি রিয়েল এস্টেট বর্তমানে বিনিয়োগের হাতিয়ার এবং একটি মৌলিক প্রয়োজনীয় পণ্যের মধ্যেকার সীমারেখাকে অস্পষ্ট করে তুলেছে। এই উভয় শ্রেণিবিন্যাস বাজারের আচরণ সম্পর্কে আমাদের নিখুঁত অর্থনৈতিক ধারণার ফলাফলকে বিকৃত করে। মানুষের জন্য অপরিহার্য হওয়ায়, বাড়ির দাম বাড়লে সবসময় মানুষ তাদের বাড়ি বিক্রি করতে উৎসাহিত হয় না। কারণ তাদের একই বাজারে ফিরে আসতে হবে, ইতিহাসের সবচেয়ে খারাপ ভাড়াটে বাজারে প্রতিযোগিতা করতে হবে অথবা রাস্তায় বসবাস করতে হবে। এই বিকল্পগুলোর কোনটিই তাদের অবস্থার উন্নতি করে না। এর চেয়েও বড় কথা, এই ভয় নিজের উপর আরও বেশি করে চেপে বসে। খুব বেশি মানুষ বিক্রি করছে না, তাই যারা বিক্রি করতে ইচ্ছুক তারা যদি একই বাজারে নতুন বাড়ি কিনতে চায়, তাহলে দ্রুত উপযুক্ত বাড়ি খুঁজে না পাওয়ার ঝুঁকিতে থাকে। এবং এর ফলে বাজারের দাম দ্রুত বেড়ে গেলে তাদের হয় খারাপ মানের বাড়ি কিনতে হবে, না হয় একই মানের সম্পত্তি কিনতে আরও বেশি ঋণে জর্জরিত হতে হবে। এই সবকিছুর মানে হলো মানুষ বিক্রি করা থেকে বিরত থাকতে পছন্দ করে এবং এই চক্র চলতেই থাকে। বাড়ি কেনাবেচার সাথে জড়িত খরচগুলোর কথা বিবেচনা করলে এই প্রক্রিয়া আরও বেড়ে যায়। রিয়েল এস্টেট এজেন্টের কমিশন (real estate agent commissions), মূলধন লাভকর (capital gains taxes), বিক্রয় কর (sales taxes), আইনি ফি (legal fees), সম্পত্তি মূল্যায়ন ফি (property evaluation fees), মালপত্র সরানোর খরচ ইত্যাদি এখানে যুক্ত হয়। এভাবে বাড়ি বদলানো একটি ব্যয়বহুল ব্যাপার হয়ে যায় এবং যতক্ষণ না এর পেছনে যথেষ্ট লাভ থাকে ততক্ষণ মানুষ এটা করে না। অবশ্যই এমন কিছু লোকেরাও আছেন যাদের নিজেদের বসবাসের জন্য কোনো বাড়ি নেই, তারা শুধুমাত্র বিনিয়োগের সম্পত্তি হিসেবে কিনে রেখেছেন। কিন্তু তাদের বিক্রির সিদ্ধান্ত সাধারণ বাজারের নিয়ম-কানুন দ্বারা চালিত হয় না। মানুষের আবেগ তাদের ভালো ফল দেওয়া বিনিয়োগ ধরে রাখতে উৎসাহিত করে। এই স্ববিরোধী বাজার প্রত্যাশা সম্পর্কে জানতে চাইলে ক্রিপ্টোকারেন্সির (cryptocurrencies) দিকে চোখ রাখতে পারেন। অবশ্যই এর একটা সীমা আছে। বিশেষ করে স্থানীয় বাজারে। যদি কোন ব্যক্তি তার বাড়িটি বিক্রির জন্য ১০ মিলিয়ন ডলারের প্রস্তাব পায়, তবে অবশ্যই সেই ব্যক্তি এক মুহূর্তও দেরি না করে রাজি হয়ে যাবেন। কিন্তু সেটা তখনই সম্ভব যখন সম্পত্তির মূল্য তাকে সেই বাজার থেকে বেরিয়ে যাওয়ার মতো যথেষ্ট সম্পদ দেয়।
- নির্মাণ সামগ্রীর (building supplies) মারাত্মক অভাব: ষষ্ঠ কারণটি সাম্প্রতিক কালে প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে। সেটি হলো নির্মাণ সামগ্রীর (building supplies) মারাত্মক অভাব। আন্তর্জাতিক সরবরাহ শৃঙ্খলে (international supply chains) ধীরগতি এবং বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন শিল্পকেন্দ্র বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ফ্রেম তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় কাঠামোর মতো মৌলিক জিনিসের দাম দ্বিগুণ হয়েছে। এমন খবরও পাওয়া যাচ্ছে যে নির্মাতারা কাজ ফিরিয়ে দিচ্ছেন, কারণ জনবলের অভাবের কারণে নয়, বরং তাদের কাজ শেষ করার জন্য প্রয়োজনীয় সরবরাহ নেই। এর ফলে মানুষ যে ধরনের বাড়ি খুঁজছে তার সরবরাহ আরও সীমিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এর মানে হলো যদি কোনো পরিবার আগে থেকে তৈরি করা কোনো বাড়ি কেনা এবং নিজেদের জন্য নতুন বাড়ি তৈরি করার মধ্যে সিদ্ধান্ত নিতে চায়, তাহলে তাকে আগে থেকে তৈরি করা বাড়ি কিনতে হবে, আর তাই ইতিমধ্যে তৈরি করা বাড়ির দামও বেড়ে যায়।
এই ছয়টি কারণের মানে হলো বিশ্ব অর্থনীতিতে এত অস্থিরতা সত্ত্বেও বাড়ির দাম ক্রমাগত বাড়ছে। কিন্তু সম্ভবত এটাই ভালো।
আবাসনের অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধির ফলে অর্থনীতিতে ক্ষতিকর প্রভাবের স্বরূপ
আবাসন, মূল্যস্ফীতি ও বাণিজ্যিক রিয়েল এস্টেটের ভূমিকা
আবাসন সবার জন্য একটি অপরিহার্য পরিষেবা। মানুষের প্রয়োজন অনুসারে আশ্রয় জল, বাতাস এবং খাদ্যের মতোই গুরুত্বপূর্ণ। তবে এই অন্তর্নিহিত প্রয়োজনীয়তার অর্থ এই নয় যে বাজার অতিরিক্ত ঋণ এবং এর সাথে আসা অপ্রীতিকর প্রভাব থেকে মুক্ত। শুরু থেকেই রিয়েল এস্টেটের দাম মুদ্রাস্ফীতির অন্যতম শক্তিশালী চালক। কেন তা ব্যাখ্যা করার জন্য, আমাদের আবাসিক বাজারের বাইরে কিছুক্ষণ দেখতে হবে এবং বাণিজ্যিক রিয়েল এস্টেট সহ রিয়েল এস্টেটের দিকে নজর দিতে হবে। বাণিজ্যিক রিয়েল এস্টেট হল দোকানের সামনের অংশ, অফিসের ভবন এবং গুদাম ঘরের মতো জিনিস। এর বেশিরভাগই এখনও বিনিয়োগকারীদের মালিকানাধীন এবং ব্যবসার জন্য ভাড়া দেওয়া হয়, ঠিক যেভাবে কেউ একটি বাড়ি ভাড়া দিতে পারে। এখন যদি সম্পত্তি বা রিয়াল এস্টেটের বাজার ভাল যায়, দাম বাড়তে থাকে, তাহলে এই বাণিজ্যিক সম্পত্তি বা বাণিজ্যিক রিয়াল এস্টেটগুলোর ভাড়াও বাড়বে। বেশিরভাগ ব্যবসায়, প্রাথমিক ব্যয়ের কেন্দ্র হল কর্মীদের বেতন এবং তারপর ভাড়া। যদি কোনও ব্যবসার ক্ষেত্রে এসব বাণিজ্যিক রিয়াল এস্টেটের ভাড়া প্রতি বছর তিন থেকে চার শতাংশ বৃদ্ধি পায়, তাহলে তাদের হয় সেটিকে লোকসান হিসাবে মেনে নিতে হবে অথবা সেই ব্যয় তাদের ভোক্তাদের উপর আরও বাড়িয়ে দিতে হবে তাদের পণ্য বা সেবার দাম আরও বাড়িয়ে দেবার মাধ্যমে। আর এভাবেই বাণিজ্যিক রিয়াল এস্টেটের দামের বৃদ্ধি মূল্যস্ফীতি ঘটাতে অবদান রাখে। আসলে এটি কার্যকরভাবে খরচ-বৃদ্ধি মুদ্রাস্ফীতির (cost-push inflation) একটি পরোক্ষ রূপ, যেখানে জিনিসগুলোর দাম বাড়ছে কারণ সেগুলো সরবরাহ করা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। অর্থাৎ এই মূল্যস্ফীতি পণ্য বা সেবার চাহিদা বৃদ্ধির জন্য নয় বরং সরবরাহ কঠিন হয়ে যাবার কারণে হচ্ছে। এবং এটি সাধারণত খারাপ ধরনের মুদ্রাস্ফীতি হিসাবে স্বীকৃত, অথবা অন্তত সেই ধরনের মুদ্রাস্ফীতি যা নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন।
অনলাইন কেনাকাটা, কর্মসংস্থান এবং রিয়েল এস্টেটের প্রভাব
বেশিরভাগ দেশে খুচরা দোকানগুলোর জন্য প্রচুর মানুষের কর্মসংস্থান হয়। কিন্তু আমরা অনলাইন অর্ডারের ব্যাপকতায় এক্ষেত্রে একটি বিশাল পরিবর্তন দেখেছি। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে, অনলাইনে অর্ডার করতে হলে এই দোকানদারদের সাথে কথা বলার প্রয়োজন হয়না। তবে আংশিকভাবে এর কারণ হচ্ছে এই যে, অনলাইনে জিনিসপত্র সস্তা। এগুলো সস্তা কারণ অনলাইনের প্রোডাক্টগুলোর দাম বাণিজ্যিক রিয়াল এস্টেটের ভাড়া বৃদ্ধির ফলে তেমন বাড়েনা। সেই সাথে অনলাইন বিতরণকারীরা রিয়াল এস্টেট সহ খুচরা বিক্রেতাদের তুলনায় অনেক কম লোককে নিয়োগ করে, ফলে সেই খরচটাও কমে যায়। সব মিলে অনলাইন কেনাবেচার প্রোডাক্ট হয় সরাসরি উৎপাদনকারী, না হয় অনলাইন বিতরণকারী কেন্দ্রগুলো থেকে আসে, যেগুলোর সংখ্যা খুচরা বিক্রেতার দোকানগুলোর থেকে অনেক কম, আবার অনলাইন বিতরণকারীর সাথে সম্পর্কিত লোকের সংখ্যা অফলাইনে খুচরা বিক্রির সাথে সম্পর্কিত লোকের সংখ্যার থেকে অনেক কম হয়। এর অর্থ অনলাইন বিক্রির ক্ষেত্রে অফলাইন বিক্রির তুলনায় বাণিজ্যিক রিয়াল এস্টেটের ভাড়া ও কর্মীদের মজুরি দুইই কম লাগে, আর তার ফলে প্রোডাক্টের পেছনে এরকম ব্যয়ও কমে যায়। এর ফলে প্রোডাক্টগুলোর দাম কমে, আর রিয়াল এস্টেটের দাম বৃদ্ধির সাথে পণ্যের দাম বৃদ্ধির সম্পর্কও কমে। যাই হোক, এর ফলে খুচরা বিক্রেতার দোকানগুলোর প্রয়োজনীয়তা কমে যায়, মানে এর সাথে সম্পর্কিত লোকেরা বেকার হয়ে পড়ে। এখন অনেকেই মনে করতে পারে এই ব্যাপারটা প্রযুক্তিগত প্রক্রিয়ার অনিবার্য অগ্রগতির ফল। কিন্তু প্রযুক্তির বাস্তবায়ন তখনই হয় যখন এগুলো আগের ব্যবস্থার চেয়ে সাশ্রয়ী হয়। আর অনলাইন কেনাবেচাকে বেশি সাশ্রয়ী বলে মনে হয়েছে রিয়াল এস্টেটের দাম অনেক বেড়ে যাবার জন্যই। এভাবে আমরা দেখছি রিয়াল এস্টেটের দাম বৃদ্ধির প্রভাব বেকার সমস্যা বৃদ্ধি ঘটায়। শুধু তাই না, অর্থনীতির সমস্ত ক্ষেত্রেই এর প্রভাবটা ছড়িয়ে পড়ে।
ঋণ, রিয়েল এস্টেটের দাম এবং বিনিয়োগের ঝুঁকি
এদিকে সবকিছুর সঙ্গেই ঋণের সম্পর্ক আছে। বর্তমানে ২০২০ সালে অনেক দেশই ঋণের ফাঁদে পড়েছে। রিয়েল এস্টেটের দাম শেষ পর্যন্ত চাহিদা এবং সরবরাহের একটি কাজ এবং চাহিদা নির্ভর করে লোকেরা কতটা উপার্জন করে এবং তারা কতটা ধার করতে পারে তার উপর। যখন উচ্চ আয়ের অঞ্চলে রিয়াল এস্টেটের মূল্যবৃদ্ধি হয়, তখন সেটি ঠিক ছিল কারণ উচ্চ আয়ের কারণে রিয়াল এস্টেটের উচ্চ দাম সমস্যার কিছু ছিল না। তবে বিশ্বের বেশিরভাগ উন্নত দেশগুলোর বেশিরভাগ অঞ্চলে দেখা যায় সেগুলোতে রিয়েল এস্টেটের দাম বাড়ছে, কিন্তু মানুষের মজুরি বা আয় প্রায় স্থিরই রয়েছে, তেমন বাড়েনি। কেন এটা হয়েছে? রিয়াল এস্টেটের দাম অবশ্যই রিয়াল এস্টেটের চাহিদা বৃদ্ধির জন্য বৃদ্ধি পায়। আর চাহিদা বৃদ্ধি পায় ব্যক্তির আয় ও ধার বা ঋণ করার ফলে। যেহেতু আয় তেমন বাড়েনি, সেহেতু ধরে নিতেই হয় যে মানুষের ঋণ গ্রহণ বেড়েছে, অর্থাৎ সেই সব দেশে ঋণদান আরও উদার হয়েছে। অর্থাৎ বলা যায়, কোন দেশে রিয়াল এস্টেটের জন্য ঋণ সুবিধা বেড়ে গেলে রিয়াল এস্টেটের দামও বাড়তে থাকে। আবাসনের জন্য ঋণকে মর্টগেজ বলে।
২০০৮ সালের সাবপ্রাইম মর্টগেজ সংকট (subprime mortgage crisis) ঘটে। এর ফলে পরে ঋণদানে একটি বিশাল কাটছাঁট করা হয়েছিল, কারণ ব্যাংকগুলো সরাসরি দেখেছিল যে কীভাবে দায়িত্বজ্ঞানহীন ঋণদান তাদের আর্থিক অবস্থার ক্ষতি করতে পারে। তবে তারপর থেকে এটি ধীরে ধীরে বাড়তে শুরু করেছে। ২০০৮ সালের সমস্যাটি ছিল এই যে এমন ব্যক্তিদের মর্টগেজ দেওয়া হচ্ছিল যাদের কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা খুবই কম, খারাপ ক্রেডিট (credit) এবং অস্থির ব্যক্তিগত পরিস্থিতি ছিল। সৌভাগ্যবশত সেই পরিস্থিতিটির পুনরাবৃত্তি তেমন হয়নি। তাই পরবর্তীতে ঋণ দানের কারণে সমস্যা হলে অন্য ফ্যাক্টরের জন্য হবে।
অন্য প্রান্তে, ধনী বাড়িওয়ালাদের সাথেও রিয়েল এস্টেটে বিনিয়োগ দুটি কারণে অদ্ভুত— প্রথমত, এটি একটি অত্যন্ত লেভারেজড (leveraged) বিনিয়োগ। যদি কেউ কোনও রিয়াল এস্টেটে ইনভেস্ট করার সময় নিজের টাকা থেকে ১০% দেন, এবং বাকি ৯০% ধার করে দেন, তাহলে সেটা টেন টু ওয়ান লেভারেজ পজিশন হয়ে যায়। এর মানে হচ্ছে এই বিনিয়োগের পর রিয়াল এস্টেটের দাম যদি ১০% বাড়ে, তাহলে ব্যক্তির রিটার্ন ১০০% হচ্ছে, সেখান থেকে তিনি ঋণ পরিশোধ করে অনেক লাভ পাচ্ছেন। কিন্তু এতে যদি লস হয় তাহলে তিনি প্রায় সবই হারিয়ে ফেলছেন। কেউই শেয়ার বাজারে এরকম টেন টু ওয়ান লেভারেজ পজিশনে বিনিয়োগ করেনা। এটা করা হয় কেবল রিয়াল এস্টেটেই কারণ সেক্ষেত্রে বিনিয়োগকারী মনে করেন সবসময়ই জমির দাম বাড়বে। এভাবে দিনের শেষে আবাসন কেবল আরেকটি ফটকা বিনিয়োগই। অনেক বাড়িওয়ালা এমনকি এই সংকটের শুরুতে ধরা পড়েছিলেন কারণ তারা রিয়েল এস্টেটে বিনিয়োগের ধারণা নিয়ে প্রবেশ করেছিলেন যে এটির দাম কেবল বাড়তেই থাকবে, ভাড়া বাড়তেই থাকবে এবং তারা ধনী হয়ে যাবে। তবে বাস্তবতা আঘাত হানে, আর এর মাধ্যমে দেখা যায় যে, রিয়াল এস্টেটে বিনিয়োগও আরেকটি ফটকা বাজার এবং এখানেও রিটার্ন চাইতে গেলে ঝুঁকি নিতেই হবে।
ঋণের উপর নির্ভরতা, বাজেয়াপ্তির ঝুঁকি এবং অর্থনীতির ভিত্তি
আরেকটি বড় সমস্যা আছে। ব্যাংক তো আবাসন কেনার জন্য বা আবাসনে বিনিয়োগ করার জন্য ঋণ এমনি এমনি দেবে না। সেই ঋণ পাবার যোগ্যতা অর্জন করার জন্যেও আপনার অধিকারে থাকা অন্য রিয়াল এস্টেট বা সম্পত্তি থেকে আয় দেখাতে হবে। বিশ্বজুড়ে বেশিরভাগ ব্যাংকই সেই আয়কেই এক্ষেত্রে বিবেচনা করবে যে আয় সেই সম্পত্তিটাকে ভাড়া দিলে পাওয়া যাবে এবং তার ভিত্তিতেই ঋণের আবেদন অনুমোদিত হবে কিনা তা ঠিক হবে। এখন যারা বসবাসের জন্য বাড়ি কিনছেন তাদের জন্য এটা সমস্যা না। কিন্তু যারা বিনিয়োগ করার জন্য বাড়ি কিনতে যাচ্ছেন তাদের জন্য এটা বিশাল সমস্যা তৈরি করে। অনেক লোক চাকরি হারাবার কারণে, বিশেষ করে অনলাইনে বেচাকেনা শুরু হবার ফলে রিয়াল এস্টেটে ভাড়া কমে যায়। এদিকে রিয়াল এস্টেটের বাজারেও এখন আগের চেয়ে বেশি বিনিয়োগকারী এই রিটার্নের উপর নির্ভর করছেন কারণ তাদের কাছে তাদের বন্ধকী পরিশোধ করার মতো নিয়মিত আয় আর থাকছে না। তাই তারা হয় বাজারের মন্দার সময়ে তাদের বাড়ি বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন, যা এই অতিরিক্ত লেভারেজড সম্পদের আরও অবমূল্যায়ন ঘটায়, অথবা তারা তাদের বন্ধকির ঋণে খেলাপি করছেন, যা আর্থিক বাজারে মারাত্মক সমস্যা সৃষ্টি করবে এবং শেষ পর্যন্ত এমন এর ফলে এক সময় তার বাড়ি বাজেয়াপ্ত করা হবে যা বাজারের মন্দার সময়ে বিক্রি করা হবে। আর এটা এই অতিরিক্ত লেভারেজড সম্পদের আরও বেশি অবমূল্যায়ন ঘটাবে।
এখন অনেকেই প্রশ্ন করতে পারেন, ব্যাংকগুলো তো ব্যবসার উদ্যোগের অর্থায়নের জন্যেও নিয়মিত অর্থ ধার দেয়। তাহলে এখানে এত পার্থক্য কেন? পার্থক্য এখানেই যে, ব্যবসাগুলো রিয়াল এস্টেটে বিনিয়োগের মতো প্রাথমিকভাবে এতটা অতিরিক্ত লেভারেজড হয় না। তবে আরও গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য যেটা সেটা হচ্ছে, ব্যবসাগুলো আসলে বৃহত্তর অর্থনীতির জন্য কিছু না কিছু উৎপাদন করে। কিন্তু রিয়াল এস্টেট থেকে আসলে কিছুই উৎপাদিত হয়না। যখন অর্থনীতিবিদরা বিনিয়োগের কথা ভাবেন, তখন তারা সাধারণত মূলধনী পণ্যের (capital goods) কথা ভাবেন। লোকেরা সাধারণত শেয়ারের মাধ্যমে কোনও সংস্থায় বিনিয়োগ করে এবং সেই সংস্থা এই তহবিল ব্যবহার করে উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় নতুন মেশিন ইত্যাদি কিনতে। এগুলো সবই মূলধনী পণ্য, যেমন এমন পণ্য যা আরও পণ্য উৎপাদন করতে ব্যবহৃত হয়। এগুলো সাধারণত বেশ ভাল বিনিয়োগ হয় কারণ আপনারা যদি এমন একটি মেশিন কেনেন যা একটি কাঁচামালকে একটি ভোগ্যপণ্যে পরিণত করে, তাহলে আপনারা ইনপুট (input) এবং আউটপুটের (output) দামের মধ্যে পার্থক্য থেকে লাভ করতে পারেন। এটি হল মূল্য-সংযোজন উৎপাদনের মূল বিষয়। এখন বাড়িঘরকে কখনও কখনও মূলধন হিসাবে বিবেচনা করা হয় ঠিকই, তবে তারা আসলে তেমন কিছুই নয়। বাড়িঘর বা আবাসনগুলো যে জমির উপর বসে আছে সেই জমি এবং কাঠামোটি নিজে কার্যকরভাবে একটি ভোগ্যপণ্য। এটিতে বিনিয়োগ করায় আবাসন ব্যয়বহুল হয়, আর উলটে এই ব্যয়বহুল আবাসন থাকার কারণে শেষ পর্যন্ত জমিকে সত্যিকারের লাভজনক শিল্পের আরেকটি উৎপাদন কারণ হওয়া থেকে বঞ্চিতই করা হচ্ছে, যেটা না হলে পণ্যগুলোতে মূল্য যোগ করে একটি ধনী অর্থনীতি তৈরি করা যেতে পারতো।
অর্থনীতির ভিত্তি হল এই ধারণা যে আমাদের অসীম চাহিদা রয়েছে এবং সেই চাহিদাগুলো পূরণ করার জন্য সীমিত সম্পদ রয়েছে। ভাল অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা একটি জাতির উৎপাদন ক্ষমতা প্রসারিত করার চূড়ান্ত আকাঙ্ক্ষার উপর নির্মিত, যাতে আরও বেশি মানুষের কাছে আরও বেশি সম্পদ উপলব্ধ করা যায়। জমির ব্লকগুলোকে এলোমেলোভাবে সরিয়ে দেওয়া এবং তাদের আরও উচ্চতর মূল্য নির্ধারণ করা মূল্যবান কিছু তৈরি করে না। এটি তার বিশুদ্ধতম রূপে কাগজের সম্পদ। সেরা পরিস্থিতিতে এটি কিছুই অর্জন করে না তবে বাস্তবিকভাবে এটি ভোক্তাদের ঋণে ফেলবে, একটি জাতিকে অতিরিক্ত ঋণগ্রস্ত করবে এবং সত্যিকারের শিল্পকে এমন একটি এলাকায় চালিত করবে যেখানে তারা কম দামে রিয়াল এস্টেট নামক এই গুরুত্বপূর্ণ উৎপাদন কারণটি পেতে পারে।
রিয়াল এস্টেটে বিনিয়োগ করতে চাওয়ার কারণ ও তাতে অর্থনীতিতে সম্ভাব্য লাভ
বাড়ির দাম বেশি হওয়া নিয়ে অভিযোগকারীর অভাব নেই। তবে খুব কম লোকই ভেবে দেখেছে যে এটি আসলে কোনো সমস্যা কিনা। আজকের উন্নত বিশ্বের বেশিরভাগ দেশেই অধিকাংশ মানুষ বাড়ির মালিক। এটা ধরে নেওয়া যুক্তিসঙ্গত যে এই বাড়িগুলোর মালিকরা চাইবেন তাদের সম্পত্তির মূল্য বাড়ুক, তাই না? এই বর্ধিত মূল্য বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করা যেতে পারে (বিক্রির পর আরকি)। মানুষ এই ইক্যুইটি (equity) ব্যবহার করে নির্মাণ বা বিনিয়োগের জন্য অর্থায়ন করতে পারে।
সম্পত্তির দাম বাড়লে মানুষ ধনী অনুভব করে এবং তাদের ভোগের প্রবণতাও বাড়ে। যদি কারও একটি সম্পত্তি থাকে যা তিনি ৫ লক্ষ ডলারে কিনেছেন এবং যার বিপরীতে ৪ লক্ষ ডলার ঋণ আছে, এবং একই সময়ে সেই সম্পত্তির দাম বেড়ে ১০ লক্ষ ডলার হয় এবং তিনি সেই ঋণের ২ লক্ষ ডলার পরিশোধ করেন, তাহলে তিনি কার্যত শুধুমাত্র একটি বাড়িতে বসবাসের মাধ্যমে তার সম্পদের পরিমাণ আটগুণ বাড়িয়েছেন।
এই ধরনের বিশাল লাভের সম্ভাবনা লেভারেজ (leverage) ব্যবহার করে করা সমস্ত বিনিয়োগের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। কিন্তু একটি মর্টগেজের জন্য যে ফাইভ টু ওয়ান লেভারেজ আদর্শ (বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ৫ ভাগের ১ ভাগ নিজের টাকা, বাকিটা ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়া), সেটা দিয়ে স্টক (stocks) কিনলে সাধারণত বেশি সুদের হার এবং মার্জিন কলের (margin calls) মতো ঝুঁকিপূর্ণ চুক্তির শর্ত চলে আসে, যা সাধারণ বিনিয়োগকারীদের জন্য উপযুক্ত নয়। এর চেয়েও বড় কথা, ফাইভ টু ওয়ান লেভারেজের স্টক পোর্টফোলিওতে (stock portfolio) টিকে থাকা সম্ভব না।
সেই সাথে রিয়াল এস্টেট খুবই চমৎকার কারণ এটি অবসরকালীন সঞ্চয়ের (retirement saving) একটি শক্তিশালী হাতিয়ার। গড়পড়তা মানুষ আর্থিকভাবে বেশ বোকা। বেশিরভাগ মানুষই অবসর গ্রহণের জন্য তেমন কোনো চেষ্টা করে না, এমনকি যদি তারা সক্ষমও হয়। তবে একটি পারিবারিক বাড়ির মালিক হওয়ার মাধ্যমে, ৩০ বছর ধরে একটি মর্টগেজ পরিশোধ করার মাধ্যমে মানুষ এমন একটি সম্পদে ইক্যুইটি তৈরি করবে যা অবসরের সময় বিভিন্নভাবে কাজে লাগানো যেতে পারে। ধরে নেওয়া যাক তাদের সন্তানরা বড় হয়ে নিজেদের মতো বেরিয়ে গেছে (যা আজকাল খুব একটা নিশ্চিত নয়)। তারা সেই বাড়ি বিক্রি করে ছোট কোনো বাড়িতে চলে যেতে পারে এবং দামের পার্থক্যটা তাদের অবসরকালীন জীবন নির্বাহের জন্য ব্যবহার করতে পারে। তারা সেই বাড়ি ভাড়া দিয়ে সেই আয়ের মাধ্যমে নিজেরা ছোট কোনো বাসায় থাকতে পারে এবং অবসর জীবন কাটাতে পারে। অথবা তারা তাদের ঋণমুক্ত বাড়িতেই বসবাস করতে পারে। যার মানে তাদের যা কিছু আয় হবে তার বেশিরভাগ অংশ আবাসন বাবদ খরচ করতে হবে না, যা বেশিরভাগ মানুষের বাজেটের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ। এই ধরনের স্ব-অর্থায়িত অবসর (self-funded retirement) আগামী বছরগুলোতে আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে, কারণ বয়স্ক জনসংখ্যা রাষ্ট্র-চালিত অবসর ব্যবস্থার (state-funded retirement systems) উপর আরও বেশি চাপ সৃষ্টি করবে।
আরেকটি যুক্তি সম্পূর্ণরূপে অর্থনৈতিক না হয়ে দার্শনিকও বটে। একটি গণতান্ত্রিক দেশে যেখানে ভোটিং জনসংখ্যার সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশেরই একটি সম্পদ শ্রেণির (asset class) মূল্যবৃদ্ধিতে স্বার্থ আছে, সেখানে সরকারের সেই বৃদ্ধি রোধ করার জন্য নীতিগত পদক্ষেপ নেওয়া কি সত্যিই ন্যায্য? আবারও বলছি, এটি সম্পূর্ণরূপে অর্থনৈতিক যুক্তি নয়, তাই আমি আপনাকে বলতে চাই না কোনটি সঠিক বা কোনটি ভুল।
স্থিতিশীল মূল্য বৃদ্ধিই হলো সম্ভাব্য সমাধান
তাহলে ব্যক্তিগত স্তরে রিয়েল এস্টেট কি একটি ভাল বিনিয়োগ? অবশ্যই না। এটি একটি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ, অত্যন্ত লেভারেজড এবং অ-বৈচিত্র্যপূর্ণ বিনিয়োগ। জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং আরও বেশি ঋণ নেওয়ার অবিরাম চাপ এখানে আছেই। হয়তো অন্তত যে বাড়িতে থাকা হয় সেটি নিজের করে নেওয়া খুব খারাপ ধারণা নাও হতে পারে। তবে ম্যাক্রো লেভেলে একটি শক্তিশালী আবাসন বাজার একটি সত্যিকারের বোঝা। এটি এমন লোকদের কাছ থেকে অর্থ কেড়ে নেয় যারা অন্যথায় পণ্য বা পরিষেবার উপর ব্যয় করতে পারত বা এমন জিনিসগুলোতে বিনিয়োগ করত যার প্রকৃত মূল্য রয়েছে এবং এটি সেই শিল্পগুলোকে শ্বাসরোধ করে যা অর্থনীতিতে একটি শক্তিশালী অবস্থান পাওয়ার চেষ্টা করছে। এর সমাধানগুলো জটিল কারণ প্রায়শই একটি সরকারকে সাশ্রয়ী মূল্যের আবাসন বাজারের দায়বদ্ধতার বিকল্প খুঁজতে হয়। আর এটা করতে গেলে সরকারকে মানুষের এই বৃহত্তম বিনিয়োগের খাতের বিরুদ্ধে যেতে হয়, কিন্তু এটা করলে তার ফল সরকারের পরবর্তী নির্বাচনের ফলে পড়তে পারে। যেটা করা যায় তা হচ্ছে ঋণদানকে দায়িত্বের সাথে পরিচালনা করাটাকে নিশ্চিত করা। রেকর্ড-নিম্ন সুদের হার মানে হল আরও বেশি সংখ্যক লোক আরও বেশি অর্থ ধার করতে পারে এবং মনে করে যে তারা অন্যান্য লোকেদের কাছে জমিটি বিক্রি করার পরে খুব বুদ্ধিমান বিনিয়োগকারীর মতো কাজ করেছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, যারা তার থেকে জমিটি কিনল তারাও আসলে ব্যাংক থেকে কম সুদের হারে ধার করেই কিনলো। সব মিলে এমন কিছুতে বিনিয়োগের জন্য ঋণ নেওয়া যা কিছুই উৎপাদন করে না তা সামষ্টিক অর্থনৈতিক (macroeconomic) স্তরে প্রায় সবসময়ই একটি খারাপ ধারণা। এটি কি কখনও সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রিত হবে? বলা কঠিন। দিনের শেষে ব্যাংকগুলো তাদের নিজস্ব সত্তা এবং তাদের নিজস্ব লাভের উদ্দেশ্য রয়েছে এবং তারা নিশ্চিত করতে চায় যে তারা কোনও ভাল সুযোগ হাতছাড়া করছে না। একই কথা প্রযোজ্য স্বতন্ত্র ফটকাবাজারিদের ক্ষেত্রেও। আর স্বাধীনতা যখন ক্ষতিকর হয়ে যায় তখন রাষ্ট্রের কাজ নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা।
আবাসন সহজলভ্যতার সংকটের (housing affordability crisis) সমাধান কী তা নিয়ে সবার নিজস্ব মতামত রয়েছে। তবে এর আগে জানতে হবে লক্ষ্য কী হওয়া উচিত। নিশ্চিতভাবেই আমরা চাই না যে রিয়াল এস্টেটের দাম কমে যাক। কারণ এতে অনেক মানুষ তাদের হোম লোনের (home loans) চেয়ে বেশি ঋণে ডুবে যাবে এবং ২০০৮ সালে আমরা যেমনটা দেখেছি তেমন আরও অনেক অপ্রীতিকর পরিস্থিতি তৈরি হবে। তবে আমরা সম্ভবত এটাও চাই না যে বাড়িঘর কেবল সমাজের ধনী ব্যক্তিদের জন্য সহজলভ্য হোক। এবং গত দশকে যেভাবে দাম বেড়েছে, তাতে পরিস্থিতি সেদিকেই যাচ্ছে।
আবাসনকে একটি পণ্যের মত দেখেই এর দাম বৃদ্ধির লাভ ক্ষতি বিবেচনা করলে বিষয়টা অনেক স্পষ্ট হয়। একে গমের সাথেই তুলনা করুন। রুটি, পাস্তা বা পিজ্জা তৈরির মাধ্যমে এটি আমাদের মূল্য সরবরাহ করে। মানুষ কমোডিটিস মার্কেটে (commodities markets) এর উপর ফটকা লাগাতে পারে এবং বাস্তবে তা করেও। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কেউ আগামী দশকে এর দাম চারগুণ বেড়ে যাবে এরকম দীর্ঘমেয়াদী লাভের আশায় গম ধরে রাখে না। প্রকৃতপক্ষে, যদি গমের দাম চারগুণ বেড়ে যায় তবে আমরা সম্ভবত এটিকে বাজারের ব্যর্থতা হিসেবেই দেখব। কারণ এতে হঠাৎ করে আমাদের অনেক খাবারের দামই অনেক বেশি হয়ে যাবে। আবাসনকেও সেরকমভাবেই দেখা দরকার। আমরা গমের ক্ষেত্রে যেমন দাম দীর্ঘমেয়াদে চারগুণ বেড়ে যাবে এমনটা আশা করতে পারিনা বা এরকম হলে অর্থনীতির ব্যর্থতা হিসেবে দেখি, আবাসনের ক্ষেত্রেও সেভাবেই দেখা উচিৎ। আর সেভাবেই নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা উচিৎ। আর লক্ষ্য হওয়া উচিৎ যাতে এর মূল্যবৃদ্ধিটা স্থিতিশীল থাকে।
রিয়েল এস্টেট ও আবাসনও একটি পণ্যই। এটি আমাদের বসবাস, কাজ বা চাষাবাদের জন্য জায়গা দেওয়ার মাধ্যমে মূল্য সরবরাহ করে। আমাদের সম্পত্তির মূল্যবৃদ্ধিকেও অন্যান্য পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির মতোই দেখা শুরু করা উচিৎ, অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি হলে তাকে কমিয়ে ফেলার ব্যবস্থা করা উচিৎ। এর অনেক সুবিধা রয়েছে। প্রথমত, যারা সম্পত্তি বাজারে প্রবেশ করতে চাইছে তাদের একটি পরিবর্তনশীল লক্ষ্য থাকবে না, যেখানে তাল মিলিয়ে চলার জন্য তাদের আরও বেশি অর্থ সঞ্চয় করতে হবে। এটি মানুষকে তাদের মর্টগেজ পরিশোধ করে বা ভাড়া সম্পত্তিতে বিনিয়োগ করেও সম্পদ তৈরি করা থেকে বিরত করবে না। কারণ এগুলো এখনও স্থিতিশীল নগদ প্রবাহ সরবরাহ করবে। অধিকতর স্থিতিশীল মূল্যবৃদ্ধি মানে অর্থনৈতিক মন্দার সময় দাম কমার সম্ভাবনাও কম থাকবে। যার মানে মানুষের তাদের মর্টগেজের চেয়ে কম মূল্যের সম্পত্তির মালিক হওয়ার সম্ভাবনা কমবে। এর চেয়েও বড় কথা, স্থিতিশীল মূল্য নির্ধারণের মানে হলো আপনি মূলধন লাভকরের (capital gains taxes) হাত থেকে বাঁচতে পারবেন, যেখানে এটি প্রযোজ্য। এর ফলে যারা তাদের বাড়ি বদল করতে চান তারা আরও সহজে সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন, কারণ তাদের পরিবারের আকার জীবনকালে পরিবর্তিত হতে থাকে।
আপনি হয়তো ভাবতে পারেন এই সমস্ত সুবিধার জন্য দরিদ্র বাড়িওয়ালাদের ক্ষতি হবে। তবে এটি আংশিক সত্য। যে সম্পত্তি বিনিয়োগকারীরা শুধুমাত্র সম্পত্তির উপর বসে থাকে এবং দাম বাড়ার জন্য অপেক্ষা করে, হ্যাঁ, তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তবে তাতে কি? সেই অর্থ উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ করলে অর্থনীতি আরও ভালো ফল পাবে। বরং অর্থ সেই বিনিয়োগকারীদের কাছে যাবে যারা বাজারে মূল্য যোগ করে। ঠিক যেমনটা সাধারণ পণ্যের ক্ষেত্রে হয়। যদি কেউ দক্ষতার সাথে লোহার আকরিক থেকে ইস্পাত তৈরি করে, তবে সেক্ষেত্রে সেই ব্যক্তি যে মূল্য যোগ করেছেন তা থেকে লাভ পাবেন। কেউ যদি যদি গম থেকে রুটি তৈরি করেন তবে তিনি যে মূল্য যোগ করেছেন তা থেকে লাভবান হবেন। এবং কেউ যদি একটি জরাজীর্ণ বাড়িকে অ্যাপার্টমেন্ট ব্লকে (apartment blocks) রূপান্তরিত করেন তবে সেক্ষেত্রে তিনি সেই মূল্য থেকে লাভবান হবেন যা তিনি মানুষকে বসবাসের জন্য জায়গা তৈরি করে যোগ করেছেন, যা আগে ছিল না।
এই কাল্পনিক পরিস্থিতি জাপানের (Japan) বাস্তবতার মতো, যেখানে গত দশকে বাড়ির দাম খুব কমই বেড়েছে। এটাই কি আদর্শ? বাড়ির মালিকদের সংখ্যাগরিষ্ঠকে রাজি করানো কঠিন হতে পারে। তবে এটিকে সম্পূর্ণরূপে বাতিল করা উচিত নয়। বিশেষ করে যখন এটা না করলে মানুষ আরও বেশি করে আবাসনেই বিনিয়োগ করতে থাকবে, আর তাতে এমন এক ভবিষ্যত আসবে যেখানে মানুষ তাদের কর্মজীবনের বেশিরভাগ সময় ধরে প্রায় অসাধ্য ঋণের বোঝা নিয়ে বেঁচে থাকতে বাধ্য হবে, শুধুমাত্র একটি মাথা গোঁজার ঠাঁই পাওয়ার জন্য।
তথ্যসূত্র
- Jowsey, E., 2011. Real estate economics. Macmillan International Higher Education.
- Evans, A.W., 2008. Economics, real estate and the supply of land
- Barlowe, R., 1978. Land resource economics: the economics of real estate.
- DiPasquale, D. and Wheaton, W.C., 1996. Urban economics and real estate markets (Vol. 23, No. 7). Englewood Cliffs, NJ: Prentice Hal
- Wheaton, W.C., 1999. Real estate “cycles”: some fundamentals. Real estate economics
Leave a Reply