Table of Contents
যুক্তরাজ্য-চীন সম্পর্কের পুনরুজ্জীবন (সংক্ষিপ্ত) (১০ জানুয়ারি, ২০২৫)
চীনের মুদ্রার মূল্য ১৬ মাসের মধ্যে সর্বনিম্নে (সংক্ষিপ্ত) (৮ জানুয়ারি, ২০২৫)
তিব্বতে ভূমিকম্প ও হিমালয় এলাকার অস্থিরতা (সংক্ষিপ্ত) (৭ জানুয়ারি, ২০২৫)
কেন চীন বিশ্বের নবায়নযোগ্য জ্বালানি প্রযুক্তিতে নেতৃত্ব দিচ্ছে? (৩ জানুয়ারি, ২০২৫)
চীনের পারমাণবিক সক্ষমতার দ্রুত বৃদ্ধি (১৯ ডিসেম্বর, ২০২৪)
পেন্টাগনের (Pentagon) সাম্প্রতিক “চায়না মিলিটারি পাওয়ার রিপোর্ট” (China Military Power report) অনুযায়ী, চীনের সক্রিয় পারমাণবিক ওয়ারহেড (nuclear warheads) এর সংখ্যা ৬০০ ছাড়িয়েছে। এটি মাত্র এক বছরে ২০% বৃদ্ধি এবং ২০২০ সালের তুলনায় প্রায় তিনগুণ। পেন্টাগন বলছে, চীন সম্ভবত তাদের পারমাণবিক বাহিনীকে দ্রুত আধুনিকীকরণ, বৈচিত্র্যকরণ এবং সম্প্রসারণ চালিয়ে যাবে। অনুমান করা হচ্ছে যে ২০৩০ সালের মধ্যে চীনের সক্রিয় পারমাণবিক ওয়ারহেড সংখ্যা ১,০০০ ছাড়িয়ে যাবে এবং ২০৩৫ সাল পর্যন্ত এই বৃদ্ধি অব্যাহত থাকবে।
যদিও চীনের পারমাণবিক অস্ত্র ভাণ্ডার দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে, তা এখনো যুক্তরাষ্ট্র (United States) ও রাশিয়ার (Russia) বিশাল ভাণ্ডারের তুলনায় নগণ্য। যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া প্রতিটিরই ৫,৫০০টিরও বেশি পারমাণবিক ওয়ারহেড রয়েছে, যা বিশ্বে বিদ্যমান প্রায় ৯০% পারমাণবিক অস্ত্রেরই মালিক তারা।
পেন্টাগনের এই প্রতিবেদনে চীনা সামরিক বাহিনী পিপলস লিবারেশন আর্মি (People’s Liberation Army বা PLA)-এর আধুনিকীকরণ ও সংস্কার প্রচেষ্টার অগ্রগতি মূল্যায়ন করা হয়েছে। অগ্রগতি সত্ত্বেও, প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে বাহিনীর মধ্যে এখনও উল্লেখযোগ্য দুর্বলতা রয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে কমান্ডারদের দক্ষতার ঘাটতি (commander proficiency), দীর্ঘ-পাল্লার রসদ সরবরাহ (long distance logistics) এবং নগরযুদ্ধে (urban warfare) দক্ষতার অভাব।
চীনা সরকার PLA-এর মধ্যে ২০২৩ সালে শুরু করা একটি নতুন দুর্নীতিবিরোধী অভিযান (anti corruption purge) পরিচালনা করছে। ২০২৩ সালের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত অন্তত ১৫ জন শীর্ষস্থানীয় সামরিক কর্মকর্তা এবং প্রতিরক্ষা শিল্পের নির্বাহী পদ থেকে অপসারিত হয়েছেন পেন্টাগনের বিশ্লেষণ অনুযায়ী। এর মধ্যে ছিল তৎকালীন প্রতিরক্ষামন্ত্রী লি শাংফু (Li Shangfu)-কে অপসারণও।
সামরিক খাতে চীনের বিপুল ব্যয় নিয়ে জানতে চাইলে এখানে যান।
সূত্র –
https://media.defense.gov/2024/Dec/18/2003615520/-1/-1/0/MILITARY-AND-SECURITY-DEVELOPMENTS-INVOLVING-THE-PEOPLES-REPUBLIC-OF-CHINA-2024.PDF
https://www.armscontrol.org/factsheets/nuclear-weapons-who-has-what-glance
https://www.ft.com/content/5290c045-09d1-4da1-844b-166bf227584b
https://www.nytimes.com/2024/12/18/world/asia/china-nuclear-buildup.html
চীনা গোয়েন্দা জাহাজ একটি মার্কিন বিমানবাহী রণতরীর নিকট এগিয়ে আসছে – পরবর্তী পরিস্থিতি কেমন হতে পারে? (৭ ডিসেম্বর, ২০২৪)
ভুমিকা
একটি চীনা গোয়েন্দা জাহাজ খুব দ্রুতগতিতে একটি মার্কিন বিমানবাহী রণতরীর দিকে অগ্রসর হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে রণতরীর নাবিক দল কী করবে? সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্র (US) ও চীনের (China) মধ্যে সমুদ্রে (at Sea) সামরিক উত্তেজনা ও মুখোমুখি অবস্থার সংখ্যা বেড়ে চলেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে উদ্বেগজনক দৃশ্যপটগুলোর একটি হল চীনা গোয়েন্দা জাহাজের কাছাকাছি চলে আসা একটি মার্কিন বিমানবাহী রণতরীর সংলগ্ন। মার্কিন বিমানবাহী রণতরীগুলো (Aircraft Carriers) যুক্তরাষ্ট্রের নৌশক্তির মেরুদণ্ডস্বরূপ। এরা বৈশ্বিক নিরাপত্তা (Global Security) বজায় রাখা ও শক্তি প্রক্ষেপণে (Projecting Force) প্রধান ভূমিকা পালন করে। কিন্তু চীনা নজরদারি জাহাজ (Surveillance Ships) প্রায়ই এই কৌশলগত সম্পদের কাছাকাছি যাওয়ার চেষ্টা করে।
যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে দক্ষিণ চীন সাগরের (South China Sea) উত্তেজনা বৃদ্ধির সাথে সাথে এমন ঘটনা বাড়ছে। কখনও কি ভেবে দেখেছেন, এমন পরিস্থিতিতে কী হতে পারে? যুক্তরাষ্ট্র ও চীন কী পদক্ষেপ নেবে? বিশ্বে সবচেয়ে ক্ষমতাধর দুই দেশের মধ্যে এমন এক অচলাবস্থায় কী ধরনের বিপদ রয়েছে? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর পেতে লেখাটি পড়ুন।
আন্তর্জাতিক আইনি কাঠামো
এই ধরনের সামরিক জাহাজের আচরণ নিয়ন্ত্রণের প্রাথমিক কাঠামো হল সমুদ্রের আন্তর্জাতিক আইন, অর্থাৎ “জাতিসংঘের সমুদ্র আইন সম্মেলন (United Nations Convention on the Law of the Sea – UNCLOS)”। এই নীতিমালার অধীনে, আন্তর্জাতিক জলসীমায় (International Waters) দেশগুলো নৌ চলাচলের স্বাধীনতা (Freedom of Navigation) উপভোগ করে। তবে শান্তি ও নিরাপত্তা (Peace and Security) বজায় রাখার জন্য নির্দিষ্ট কিছু নিয়ম অনুসরণ করতে হয়।
আন্তর্জাতিক সামুদ্রিক আইন (International Maritime Law) অনুযায়ী, সামরিক জাহাজগুলোকে পরস্পরের থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখতে হয়, বিশেষ করে যখন জড়িত দেশগুলোর মধ্যে শত্রুতাপূর্ণ বা উত্তেজনাপূর্ণ সম্পর্ক থাকে। এই নিরাপদ দূরত্ব এমন এক পরিসর যা বিপক্ষ জাহাজের জন্য হুমকি তৈরি করে না বা উসকানি দেয় না। কিন্তু বাস্তবে এই নিয়ম অনেক সময় উপেক্ষিত হয়, বিশেষ করে চীন (China) কিংবা রাশিয়ার (Russia) মতো দেশগুলোর ক্ষেত্রে, যারা নিয়মিতভাবে মার্কিন বিমানবাহী রণতরী বা অন্যান্য সামরিক সম্পদের কাছাকাছি যাওয়ার চেষ্টা করে।
কেন চীন এমন করে?
চীনের এই পদক্ষেপ নিছক ‘সেলফি তোলার’ জন্য নয়, যদিও কখনও কখনও প্রচারমূলক ছবি বা শক্তির প্রদর্শন এ উদ্দেশ্যের অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। আসলে এর পেছনে দুটি মূল কারণ রয়েছে:
১. রাজনৈতিক শক্তি প্রদর্শন (Political Display of Strength): চীন যেন বলতে চায়: “আমরাও শক্তিশালী, আমরা তোমাকে ভয় পাই না।” আপনি হয়তো পৃথিবীর সবচেয়ে আধুনিক সুপার ক্যারিয়ার “ইউএসএস জেরাল্ড আর ফোর্ড (USS Gerald R Ford)” সহ আরও ১০টি পারমাণবিক চালিত রণতরী (Nuclear Carriers) রাখবেন, প্রতিটিই প্রায় ১,০০,০০০ টন ওজনের এবং প্রায় ১০০টি যুদ্ধবিমান (Combat Aircraft) বহন করে। কিন্তু চীন দেখাতে চায় তারাও পরাশক্তি, নিজের প্রভাববলয়ে (Sphere of Influence) পিছপা নয়, আর মার্কিন শীর্ষস্থানীয় নৌ কমান্ডারদেরও নার্ভ টেস্ট করতে সক্ষম। যেমন কেউ যদি সিংহের কেশর ধরে টানে, তাকে কিছুটা হলেও সমীহ করতে হয়।
২. তথ্য ও গোয়েন্দা সংগ্রহ (Intelligence Gathering): এটা শুধু শক্তি প্রদর্শন নয়, বরং চীনা গোয়েন্দা জাহাজ (Chinese Spy Ship) মার্কিন রণতরীর যতটা সম্ভব তথ্য সংগ্রহ করতে চায়। এসব জাহাজে অত্যাধুনিক নজরদারি ব্যবস্থা (Sophisticated Surveillance Systems) থাকে, যা রেডিও বার্তা (Radio Transmissions) শোনা, জাহাজের বিভিন্ন ইলেকট্রনিক সিস্টেমের সংকেত (Electronic Signatures) রেকর্ড করা, উড্ডয়ন ও অবতরণ প্রক্রিয়া নিবিড় পর্যবেক্ষণ, ফ্লাইট প্রস্তুতি নজরদারি ও রণতরীর গতিবিধি বিশ্লেষণ করতে পারে।
দক্ষিণ চীন সাগরে সংঘাতের কারণ
এই উত্তেজনাকর ঘটনাগুলো প্রায়ই দক্ষিণ চীন সাগরে ঘটে। কারণ চীন এই সাগরকে তার একচেটিয়া এলাকা বলে মনে করে। চীনের “Nine-Dash Line (Nine-Dash Line)” নামক একটি মানচিত্রভিত্তিক দাবি রয়েছে, যেখানে পারাসেল দ্বীপপুঞ্জ (Paracel Islands), স্প্রাটলি দ্বীপপুঞ্জ (Spratly Islands) এবং সংশ্লিষ্ট জলসীমাকে তারা নিজেদের এলাকা বলে দেখায়। অথচ ভিয়েতনাম (Vietnam), ফিলিপাইন (Philippines), মালয়েশিয়া (Malaysia), ব্রুনাই (Brunei) ও তাইওয়ান (Taiwan) – এদের প্রত্যেকেরই এই এলাকায় বৈধ অধিকার ও দাবি আছে। আন্তর্জাতিক আইনের (International Law) দিক থেকে এ দেশগুলোর দাবিই বরং বেশি যৌক্তিক। কিন্তু চীন সেই দাবিগুলোকে গ্রাহ্য করে না।
২০১৩ সাল থেকে চীন দক্ষিণ চীন সাগরে ব্যাপকভাবে কৃত্রিম দ্বীপ নির্মাণ শুরু করে। বিশাল ড্রেজিং (Dredging) কার্যক্রমের মাধ্যমে তারা সামরিক ঘাঁটি, বিমানঘাঁটি (Airfields), জাহাজঘাঁটি ইত্যাদি গড়ে তুলেছে। পাশাপাশি অন্য দেশের জাহাজ চলাচলে হস্তক্ষেপ করছে। উদাহরণস্বরূপ, মে ২০১৪ সালে চীন ভিয়েতনামের (Vietnam) দাবিকৃত জলসীমায় তেল উত্তোলন প্ল্যাটফর্ম বসায়, যার ফলে চীনা ও ভিয়েতনামী জাহাজের মধ্যে ধাক্কাধাক্কি ও জলকামান ব্যবহারের মতো সংঘাত ঘটেছিল।
২০১৪ সালের পরে আবার ২০২০ সালে মালয়েশিয়া (Malaysia) যখন একটি বিতর্কিত এলাকায় তেল অনুসন্ধান চালাচ্ছিল, তখন চীন সামরিক জাহাজ পাঠিয়ে মালয়েশীয় জাহাজের কাছাকাছি বিপজ্জনক গতিবিধি প্রদর্শন করে। ভিয়েতনাম, ফিলিপাইন বা মালয়েশিয়া কেউই চীনের অর্থনৈতিক বা সামরিক ক্ষমতার সমান নয়। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসে। এটি শুধু যে নৌ-চলাচলের স্বাধীনতা (Freedom of Navigation) রক্ষার জন্য তা নয়, বরং এর সাথে জড়িত বিশ্ববাণিজ্যের (World Maritime Trade) ৩০% যা এই অঞ্চলের দিয়ে যায়। বছরে ট্রিলিয়ন ডলার মূল্যের পণ্য পরিবহন হয় এই অঞ্চল দিয়েই।
এর বাইরেও এখানে বিপুল পরিমাণে তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুদ রয়েছে বলে ধারণা করা হয় – প্রায় ১১ বিলিয়ন ব্যারেল তেল ও ১৯০ ট্রিলিয়ন ঘনফুট (৫ ট্রিলিয়ন ঘনমিটার) প্রাকৃতিক গ্যাস। আবার যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক নেতৃত্ব ধরে রাখার কৌশলগত স্বার্থও এখানে জড়িত। বিশ্বশক্তি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র কারও দ্বারাই প্রতিষ্ঠিত শৃঙ্খলা বিনষ্ট হতে দিতে চায় না, হোক সেটা রাশিয়া, চীন বা ইরান।
এই কারণেই যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ চীন সাগরে টহল দেওয়ার জন্য নিয়মিত বিমানবাহী রণতরী পাঠায় এবং তাইওয়ান (Taiwan), ফিলিপাইন (Philippines) অথবা ভিয়েতনামের (Vietnam) সাথে যৌথ মহড়া করে। হোয়াইট হাউস (White House) জানে যে এসব মিশনে চীনা নজরদারি ও উত্যক্ততা (Harassment) অনিবার্য। এটি অনেকটা বিমানে বসে ট্যাবলেট পড়ার সময় পাশের যাত্রীটি যখন বারবার উঁকিঝুঁকি দিতে থাকে, এমন অস্বস্তিকর পরিস্থিতির মতো।
মার্কিন বাহিনীর প্রতিক্রিয়া কৌশল
চীনা গোয়েন্দা জাহাজ যখন একটি মার্কিন বিমানবাহী রণতরীর দিকে অগ্রসর হয়, তখন রণতরীর নাবিকরা (Crew) একটি নির্দিষ্ট ধাপ অনুসরণ করে। এর লক্ষ্য হুমকি মূল্যায়ন, জাহাজ সুরক্ষা এবং পরিস্থিতি আরো খারাপ হওয়া থেকে ঠেকানো।
পর্যায়ক্রমিক প্রতিক্রিয়া হবে এমন:
- ১. সনাক্তকরণ (Detection): রাডার (Radar), স্বয়ংক্রিয় জাহাজ পরিচয় ব্যবস্থা (Automatic Identification Systems), স্যাটেলাইট নজরদারি (Satellite Surveillance) ইত্যাদি ব্যবহার করে চীনা জাহাজের অবস্থান চিহ্নিত করা হয়। ইলেকট্রনিক যুদ্ধ (Electronic Warfare) বিশেষজ্ঞরা শত্রু জাহাজের সংকেত বিশ্লেষণ করে এর প্রকৃতি ও মিশন বোঝার চেষ্টা করে। অনেক সময় গোয়েন্দা জাহাজ বেসামরিক জাহাজের ছদ্মবেশ নেয়, তাই অতিরিক্ত যাচাই প্রয়োজন হয়।
- ২. তথ্য বিশ্লেষণ (Operations Team Analysis): অপারেশন টিম চীনা জাহাজের গতিপথ, গতি ও গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করে। যদি জাহাজটি সরাসরি রণতরীর দিকে আসে বা নির্দিষ্ট দূরত্ব মেনে চলতে ব্যর্থ হয়, তবে ধরে নেওয়া হয় সেটি হয় গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ করছে, নয়তো উসকানিমূলক আচরণ করছে।
- ৩. কমান্ড পর্যায়ে সিদ্ধান্ত (Command Decision): অবস্থা গুরুতর হলে ক্যাপ্টেন (Captain) উর্ধ্বতন কমান্ড, যেমন ফ্লিট কমান্ড (Fleet Command)-এ খবর দেন।
- ৪. উচ্চ সতর্কতা (Increased Readiness): যদি পরিস্থিতি গুরুতর হয়, তখন জাহাজব্যাপী ঘোষণা “জেনারেল কোয়ার্টার্স (General Quarters)” বা “কন্ডিশন টু (Condition Two)” জারি হয়। এটি যুদ্ধ প্রস্তুতির স্তর নির্দেশ করে, যদিও সঙ্গে সঙ্গে যুদ্ধ শুরু হবে এমন নয়।
- ৫. ইলেকট্রনিক প্রতিরক্ষা (Electronic Warfare): ইলেকট্রনিক যুদ্ধ ইউনিট যোগাযোগের (Communications) বাধা প্রদান বা চীনা জাহাজের ডেটা সংগ্রহে ব্যাঘাত ঘটাতে জ্যামিং (Jamming) সিস্টেম চালু করে।
- ৬. বিমান মোতায়েন (Aircraft Deployment): চীনা জাহাজ যদি হুমকিজনক দূরত্ব, সাধারণত ১২ নটিক্যাল মাইল (প্রায় ২২ কিলোমিটার) এর মধ্যে চলে আসে, তাহলে রণতরী থেকে এফ/এ-১৮ হর্নেট (FA-18 Hornet) বা এফ-৩৫ (F-35) যুদ্ধবিমান, হেলিকপ্টার ইত্যাদি উড়িয়ে চীনা জাহাজের উপর নজরদারি চালানো হয়। তারা ছবি ও ভিডিও সংগ্রহ করে।
- ৭. যোগাযোগ ও হুঁশিয়ারি (Communication and Warning): আন্তর্জাতিক চ্যানেলে (International Channels) চীনা জাহাজকে সতর্কবার্তা পাঠানো হয়। বার্তায় বলা হয় আন্তর্জাতিক আইন (International Maritime Law) মেনে নিরাপদ দূরত্ব রাখার কথা। উদাহরণস্বরূপ: “চীনা সামরিক জাহাজ, এখানে ইউএসএস জেরাল্ড আর ফোর্ড (USS Gerald R Ford) কথা বলছে। আন্তর্জাতিক সামুদ্রিক আইন ও ইউনাইটেড নেশন্স কনভেনশন অন দ্য ল অফ দ্য সি (UNCLOS) অনুযায়ী আপনি নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখতে বাধ্য। আমাদের অপারেশনে বাধা সৃষ্টি করবেন না। আপনার বর্তমান গতিপথ ও দূরত্ব আন্তর্জাতিক নিয়ম লঙ্ঘন করছে। অনুগ্রহ করে কোর্স পরিবর্তন করে দূরত্ব বৃদ্ধি করুন। বার্তার জবাব দিন। ওভার।”
- ৮. দুর্বলতা প্রদর্শনে অস্বীকৃতি (No Show of Weakness): বিমান ও অন্যান্য যুদ্ধজাহাজ দূর থেকে চীনা জাহাজকে অনুসরণ করে, বোঝাতে চায় যে তারা রণতরী রক্ষায় সর্বদা প্রস্তুত। প্রয়োজনে রণতরী নিজেদের গতিপথ বদলে অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতি মোকাবিলার প্রস্তুতি দেখায়। এসকর্ট যুদ্ধজাহাজ (Destroyers, Cruisers) চীনা জাহাজের দিকে এগিয়ে গিয়ে আরও কাছ থেকে নজর রাখে। পরিস্থিতি অনুযায়ী, রণতরীর ক্যাপ্টেন আরও উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ, যেমন প্যাসিফিক ফ্লিট কমান্ড (Pacific Fleet Command) বা ইউএস নেভির অপারেশনাল টাস্ক ফোর্স-এ (US Navy’s Operational Task Force) যোগাযোগ করেন।
- ৯. কূটনৈতিক পদক্ষেপ (Diplomatic Channels): একই সময়ে কূটনৈতিক যোগাযোগ চালু হয়। যুক্তরাষ্ট্র চীনকে আনুষ্ঠানিকভাবে সতর্ক করে জানিয়ে দেয় এই ধরনের কর্মকাণ্ড মেনে নেওয়া হবে না।
পরিস্থিতি আরো খারাপ হলে কী হবে?
যদি রেডিও হুঁশিয়ারি, বিমান ফ্লাইওভার ও অন্যান্য প্রচেষ্টা সত্ত্বেও চীনা জাহাজ এগিয়ে আসা অব্যাহত রাখে, তাহলে কন্ডিশন ওয়ান (Condition One) অর্থাৎ পূর্ণ যুদ্ধ প্রস্তুতি (Full Combat Readiness) ঘোষণা করা হবে। সব অস্ত্র, বিমানের প্রস্তুতি সম্পন্ন করে রাখা হবে।
যদি চীনা জাহাজ কোনোভাবেই পিছিয়ে না যায়, তখন এসকর্ট ডেস্ট্রয়ার বা রণতরীর এয়ারক্রাফ্ট সরাসরি বাধা দিতে পারে। প্রয়োজনে সতর্কতামূলক গুলি (Warning Shots) ছোঁড়া হবে – চীনা জাহাজের সামনে বা পাশ দিয়ে, যাতে সে নিজের পথ বদলাতে বাধ্য হয়।
কিছু ক্ষেত্রে চীন ড্রোন (Drones) বা জলের নিচের স্বয়ংক্রিয় যান (Underwater Vehicles) ব্যবহার করে আরও নিখুঁত গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা করে। যদি এসব ড্রোন খুব কাছে, প্রায় ১ নটিক্যাল মাইলের মধ্যে চলে আসে, মার্কিন পক্ষ সেগুলো ধ্বংস করে।
চূড়ান্ত পর্যায় – প্রাণঘাতী শক্তি প্রয়োগ (Lethal Force)
ধরে নিন চীনা জাহাজ এখনও আগ্রাসীভাবে এগিয়ে আসছে, এমনকি সতর্কতামূলক গুলির পরও। এই ক্ষেত্রে উচ্চ পর্যায়ের অনুমোদন (সম্ভবত পেন্টাগন (Pentagon) বা এমনকি হোয়াইট হাউস (White House) থেকে) নিয়ে চীনা জাহাজের ওপর প্রাণঘাতী হামলা চালানো হতে পারে।
প্রথমে ছোট ক্যালিবারের অস্ত্র, যেমন এমকে৩৮ মড ২ (MK38 Mod 2) ২৫ মিমি অটোমেটিক গান, ফ্যাল্যানক্স সিআইডব্লিউএস (Phalanx CIWS – Close-In Weapon System) ব্যবহৃত হতে পারে। এফ/এ-১৮ হর্নেট (FA-18 Hornet) বা এফ-৩৫ (F-35) যুদ্ধবিমান তাদের এম৬১ ভালকান (M61 Vulcan) বা জিএইউ-২২এ (GAU-22A) গান ব্যবহার করে গুলিবর্ষণ করতে পারে। প্রথমে জাহাজের গায়ে, যদি তাতেও কাজ না হয়, কন্ট্রোল ব্রিজে গুলি চালিয়ে তাকে অচল করার চেষ্টা করা হবে।
যদি তাতেও কাজ না হয়, চীনা জাহাজকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করার নির্দেশ দেওয়া হতে পারে। এফ/এ-১৮ বা এফ-৩৫সি (F-35C) ফাইটার বিমান AGM-84 হারপুন (Harpoon) অ্যান্টি-শিপ মিসাইল বা লেজার-গাইডেড বোমা (Laser-Guided Bomb – GBU-10/12/16 Paveway) দিয়ে হামলা করতে পারে। এছাড়া এসকর্ট যুদ্ধজাহাজ থেকেও হারপুন মিসাইল ছোঁড়া হতে পারে। সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতিতে, ক্যারিয়ার স্ট্রাইক গ্রুপের (Carrier Strike Group) অন্য জাহাজ সামনে গিয়ে বাধা হয়ে দাঁড়াবে, যাতে চীনা জাহাজের সম্ভাব্য আত্মঘাতী হামলার (Suicide Attack) ক্ষেত্রে রণতরী নিরাপদে থাকে।
একটি চীনা টাইপ ৮১৫ (Type 815) গোয়েন্দা জাহাজ প্রায় ৬,০০০ টন ওজনের। যদি এটি বিস্ফোরকভর্তি হয়ে রণতরীর সাথে ধাক্কা খায়, তবে রণতরী ধ্বংস হতে পারে। তা বিশ্বযুদ্ধ শুরুর শামিল হলেও কেউই চায় না প্রথম আঘাতে একটি বিমানবাহী রণতরী হারাতে। কাজেই মার্কিন নৌবহর বরাবরই এমন সম্ভাবনা নাকচ করে দেওয়ার মতো প্রতিরোধ ব্যবস্থা রাখে।
পরবর্তী পদক্ষেপ: ঘটনা শেষ হওয়ার পর, চীনা জাহাজ এলাকাটি ছেড়ে গেলে বা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রিত হলে, রণতরীর ক্রু সম্পূর্ণ ঘটনার মূল্যায়ন করে। সব ডেটা, রেডিও বার্তা, ভিডিও, ছবি সংগ্রহ করে বিশ্লেষণ করা হয়। এর মাধ্যমে পরেরবারের জন্য আরও ভালো প্রস্তুতি নেওয়া হয়। সবাই জানে, এমন ঘটনা আবার ঘটবে, কারণ মার্কিন-চীন মৌলিক বিবাদ এখনও বহাল।
তথ্যসূত্র –
- United Nations Convention on the Law of the Sea (UNCLOS). (1982). Retrieved from https://www.un.org/depts/los/convention_agreements/texts/unclos/unclos_e.pdf
- Erickson, A. S., & Goldstein, L. J. (2012). China’s Type 815 Surveillance Ship Development. Naval War College Review, 65(3), 1–23. Retrieved from https://digital-commons.usnwc.edu
- China Power Team. (2023). What is the Nine-Dash Line? Center for Strategic and International Studies (CSIS). Retrieved from https://chinapower.csis.org
- U.S. Department of Defense. (2022). Annual Report to Congress: Military and Security Developments Involving the People’s Republic of China. Retrieved from https://www.defense.gov
- Congressional Research Service. (2022). U.S.-China Strategic Competition in the South China Sea: Background and Issues for Congress. Retrieved from https://crsreports.congress.gov
- Kaplan, R. D. (2014). Asia’s Cauldron: The South China Sea and the End of a Stable Pacific. Random House.
- O’Rourke, R. (2023). China’s Naval Modernization: Implications for U.S. Navy Capabilities. Congressional Research Service. Retrieved from https://crsreports.congress.gov
- International Maritime Organization. (2022). Maritime Safety and Security Guidelines. Retrieved from https://www.imo.org
চীন তাদের সামরিক ব্যয় নিয়ে মিথ্যা বলছে (৫ ডিসেম্বর, ২০২৪)
ভূমিকা
চীনের কমিউনিস্ট পার্টি (Chinese Communist Party) তাদের প্রতিরক্ষা খাতে (defense spending) আসল অঙ্কের চেয়ে অনেক বেশি ব্যয় করছে, অথচ তারা সঠিক তথ্য প্রকাশ করছে না। ২০২৪ সালের ৫ মার্চ, চীন ঘোষণা করে যে তারা তাদের সামরিক বাজেট প্রায় ২৩০ বিলিয়ন ডলার নির্ধারণ করেছে। এটি গত বছরের তুলনায় ৭% বেশি বৃদ্ধি। তবে তারা দাবি করে যে এটি যুক্তরাষ্ট্রের (United States) ৮৪০ বিলিয়ন ডলারের প্রতিরক্ষা ব্যয়ের মাত্র ২৫%। অনেকেই বলে থাকেন যে আমেরিকা একাই বিশ্বের পরবর্তী ১০টি দেশের মিলিত প্রতিরক্ষা ব্যয়ের চেয়ে বেশি খরচ করে। কিন্তু এতে কি পুরো চিত্রটা স্পষ্ট হয়? বিশ্লেষকরা বহুদিন ধরে বলে আসছেন যে চীনের আসল প্রতিরক্ষা ব্যয় তাদের ঘোষিত সংখ্যার চেয়ে বহুগুণ বেশি। কেন এবং কীভাবে তারা এই ব্যয় লুকিয়ে রাখছে—ঠিক সেই বিষয়টি নিয়েই এখানে আলোচনা করব। সবশেষে আমি একটি আনুমানিক অঙ্ক হাজির করব, যা দেখে আপনি অবাক হবেন।
এটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ, চীনের সত্যিকারের সামরিক ব্যয় কতটা, তার ওপর তাদের সামরিক ক্ষমতার (military power) বাস্তব দৃশ্য অনেকখানি নির্ভর করে। একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা ব্যয়ের হিসাবকেও এটি সরাসরি প্রভাবিত করে।
সরকারি ঘোষণা বনাম বাস্তবতা: কী দাবি করছে চীন?
- সরকারি ঘোষণা
২০২৪ সালের ৫ মার্চ চীন জানায়, তাদের প্রতিরক্ষা বাজেট প্রায় ২৩০ বিলিয়ন ডলার। ২০২৩ সালের তুলনায় এটি ৭% বেশি। - যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তুলনা
যুক্তরাষ্ট্রের ২০২৪ সালের প্রতিরক্ষা বাজেট প্রায় ৮৪০ বিলিয়ন ডলার। চীনের দাবি অনুযায়ী, তাদের বাজেট যুক্তরাষ্ট্রের ব্যয়ের মাত্র ২৫%।
কিন্তু বিভিন্ন গবেষণা ও বিশ্লেষক মন্তব্য করছেন যে, এই ঘোষিত বাজেট চীন ইচ্ছাকৃতভাবে কম দেখায়। কয়েকটি প্রধান কারণ রয়েছে:
- ১) সামরিক ব্যয় অন্য খাতে দেখানো।
- ২) তথ্য স্বচ্ছ না রেখে অস্পষ্টভাবে উপস্থাপন করা।
- ৩) ক্রয়ক্ষমতার সমতা (Purchasing Power Parity, সংক্ষেপে PPP) ঠিকমতো বিবেচনা না করা।
- ৪) সামরিক দিকের কিছু খরচ সরাসরি প্রতিরক্ষা বাজেটে না দেখিয়ে আলাদা সংস্থার মাধ্যমে করা।
কেন পারচেজিং পাওয়ার প্যারিটি (PPP) গুরুত্বপূর্ণ
PPP-কে সহজভাবে বোঝাতে গেলে বলা যায়, এক ডলার দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে যা কেনা যায়, চীনে সেই এক ডলার সমমূল্যের অর্থ দিয়ে তার চেয়ে বেশি কিছু কেনা সম্ভব। অর্থাৎ, একই অঙ্কের টাকা চীনে অনেক দূর এগিয়ে যায়। উদাহরণস্বরূপ যুক্তরাষ্ট্রে ১ ডলারে আপনি হয়তো মাত্র একটি পানীয় (সম্ভবত “রিপ ইট” [Rip It] নামের এনার্জি ড্রিংক) কিনতে পারবেন। কিন্তু চীনে ১ ডলারের সমমূল্যের ইউয়ানে (Yuan) আপনি সেই পানীয় এবং স্ন্যাকস দুই-ই কিনতে পারেন। সুতরাং, চীনের সামরিক বাজেটকে PPP অনুযায়ী সমন্বয় করলে দেখা যায়, তাদের প্রকৃত সক্ষমতা যুক্তরাষ্ট্রের ঘোষিত সামরিক ব্যয়ের তুলনায় অনেক বেশি।
পেন্টাগনের (Pentagon) চায়না মিলিটারি পাওয়ার রিপোর্ট (China Military Power Report) অনুযায়ী, চীন তাদের সামরিক ব্যয় ব্যাপকভাবে কম দেখায়। আমেরিকান এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউট (American Enterprise Institute, সংক্ষেপে AEI)-এর গবেষণায়ও উঠে আসে একই কথা। তারা দেখিয়েছে যে,
- সামরিক সরঞ্জাম (equipment) খাতে চীনের অফিসিয়াল ৮৫ বিলিয়ন ডলার PPP হারে সমন্বয় করলে ১৩৫ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছায়।
- প্রশিক্ষণ (training) ও রক্ষণাবেক্ষণ (maintenance) খাতে ৭৬ বিলিয়ন ডলার সমন্বয় করলে ১২১ বিলিয়ন ডলারে গিয়ে দাঁড়ায়।
- ব্যক্তিগত (personnel) খাতে ৬৮ বিলিয়ন ডলার ঠিকমতো সমন্বয় করলে ২৯৩ বিলিয়ন ডলার হয়, যা প্রায় চার গুণ বেশি!
এই বিশ্লেষণগুলো স্পষ্ট করে যে PPP যোগ করলে চীনের সামরিক ব্যয়ের আকার অনেকটাই বড় হয়। তবে একই সঙ্গে বড় প্রশ্ন থেকে যায়—চীন যে সরঞ্জাম বা প্রযুক্তি (যেমন: ফাইটার জেট) কিনছে, সেগুলো কি একই মানের, নাকি গুণগতমান কম? তাই শুধু PPP দিয়ে পুরো চিত্র বোঝা যায় না। তা সত্ত্বেও, চীনের সামরিক ক্ষমতা ও বাজেটের পূর্ণাঙ্গ মূল্যায়নে PPP অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
চীনের বাজেটের ফাঁকফোকর: কী বাদ পড়ে থাকে?
পেন্টাগন তার বার্ষিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে যে, চীনের সরকারি বাজেটে অনেক ব্যয় উহ্য থেকে যায়। যেমন—
পিপলস আর্মড পুলিশ (People’s Armed Police, সংক্ষেপে PAP): চীনের কেন্দ্রীয় সামরিক কমিশন (Central Military Commission, সংক্ষেপে CMC) সরাসরি নিয়ন্ত্রণ করে এই বাহিনীকে। কিন্তু সরকারি প্রতিরক্ষা বাজেটে এদের ব্যয় অন্তর্ভুক্ত করা হয় না। অথচ এই বাহিনীর কাজ ও কাঠামো দেখে অনেকেই এটিকে চীনের ‘ছদ্ম সামরিক বাহিনী’ বলে আখ্যায়িত করেন।
পিপলস আর্মড পুলিশ দেখতে অনেকটা সামরিক বাহিনীর বিশেষ বাহিনীর (Special Forces) মতোই সজ্জিত। তাদের সদস্য সংখ্যা প্রায় ১.২ মিলিয়ন। যদিও কাগজে-কলমে তাদের কাজ ‘অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা রক্ষা’, কিন্তু বিশাল পরিসরের ও সুসজ্জিত একটি বাহিনীর যে ক্ষমতা, তাতে এটিকে নিছক পুলিশ-শক্তি না বলে ‘প্যারামিলিটারি ফোর্স’ বলা উচিত। এই বাহিনীর অধীনে রয়েছে মেকানাইজড ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশন (mechanized infantry unit) এবং দ্রুত মোতায়েন-যোগ্য হালকা মোটরচালিত পদাতিক ইউনিট (rapid deployment light motorized infantry unit) — এটি যে-কোনো বড় সংঘাতে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে পারে। অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার নামে এই বাহিনীর কাজ হলো সশস্ত্র বিদ্রোহ বা সেনাবাহিনীর (PLA) ভেতরে কোনো বিদ্রোহ হলেও তা দমন করা।২০১৬ সালের সামরিক সংস্কারের পর PAP সরাসরি CMC-এর অধীনে চলে আসে, যা স্পষ্টতই তাদের সামরিক সম্পর্ককে প্রমাণ করে।
উল্লেখযোগ্য যে, চীনা স্থলবাহিনীর (PLA Army) সক্রিয় সদস্য প্রায় ১ মিলিয়ন, যা PAP-এর চেয়েও কম। অনেক সাবেক PLA সৈন্যকে PAP-তে স্থানান্তর করা হয়েছে। ফলে এটি কার্যত PLA-এর একটি ছায়া বাহিনী হিসেবেই গণ্য হতে পারে।
অবকাঠামোগত (infrastructure) প্রকল্প: চীনের “বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (Belt and Road Initiative, সংক্ষেপে BRI)” এর অধীনে ১ ট্রিলিয়ন ডলারেরও বেশি বিনিয়োগ হয়েছে, যা সামরিক কাজেও ব্যবহারযোগ্য—বিশেষ করে বন্দর ও ট্রেন নেটওয়ার্ক নির্মাণে, যা সৈন্য-পরিবহন ও সামরিক সরঞ্জাম পরিবহনে কাজে লাগে।
চীনের ১ ট্রিলিয়ন ডলারের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের বড় অংশই দ্বৈত ব্যবহারের (dual-use) লক্ষ্য নিয়ে তৈরি করা। যেমন, যেসব রেলপথ, সড়ক বা বন্দর তৈরি হচ্ছে, সেগুলো বাণিজ্যিক কাজের পাশাপাশি বড় আকারে সামরিক বাহিনীর troop movement বা সরঞ্জাম পরিবহনেও কাজে লাগতে পারে। আবার আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্য সহ বিভিন্ন অঞ্চলে চীন সামরিক লজিস্টিক সুবিধা (military logistics) প্রতিষ্ঠা করছে, যেমন জিবুতিতে (Djibouti) সামরিক ঘাঁটি।
সরকারি তথ্যের বাইরে থেকে অর্থের যোগান ও সহযোগিতার অনেক অংশই সামরিক বাজেটে সরাসরি দেখানো হয় না। ফলে চীনের প্রকৃত সামরিক সক্ষমতা সম্পর্কে ভুল ধারণা তৈরি হতে পারে।
চীনের প্রতিরক্ষা ব্যয়ের পুনর্বিন্যাস: কেন এটি গুরুত্বপূর্ণ?
যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় ৪০% প্রতিরক্ষা বাজেটই লোকবলের বেতন, সুযোগ-সুবিধা ও পরিচালন-ব্যয় (overhead) হিসেবে ব্যয় হয়। কিন্তু চীনে এই খরচ অনেক কম। উদাহরণস্বরূপ, ১৮ বছর বয়সী একজন নিম্নপদস্থ PLA সৈন্য (lower enlisted soldier) মাসে মাত্র ১০৮ ডলার উপার্জন করে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রে একই স্তরের সৈন্য মাসে কমপক্ষে ১,৭০০ ডলার বা তার বেশি পান (অন্যান্য ভাতা ও সুযোগ-সুবিধা মিলিয়ে)। ক্রয়ক্ষমতার সমতা বিবেচনায় নিলেও দেখা যায়, একজন চীনা নিম্নপদস্থ সৈন্য এখনো একজন আমেরিকান সৈন্যের তুলনায় প্রায় তিনগুণ কম বেতন পান।
চীন সৈন্যদের স্বাস্থ্যসেবা বা অন্যান্য ভাতা খুব কম দেয়। এর ফলে তারা সেই অর্থ গবেষণা, উন্নয়ন এবং নতুন অস্ত্র বা সরঞ্জাম কেনায় (modernization) বেশি বিনিয়োগ করতে পারে। তাই পরিসংখ্যান দিয়ে শুধু বাজেট তুলনা করলে বিভ্রান্তি তৈরি হতে পারে।
চীনের কোস্ট গার্ড (Chinese Coast Guard): আরেকটি ছদ্ম সামরিক শাখা
২০১৮ সালে চীনের কোস্ট গার্ড (CCG) সরাসরি পিপলস আর্মড পুলিশের (PAP) অধীনে আসে। ফলে সরকারি প্রতিরক্ষা বাজেটে এদের বরাদ্দও অন্তর্ভুক্ত নয়। অথচ এরা আকারে ও সক্ষমতায় অনেক দেশের নৌবাহিনীর (Navy) কাছাকাছি।
চীনের কোস্ট গার্ডের ৫০০টির বেশি জাহাজ রয়েছে, যার মধ্যে ১,০০০ টনের ওপর ধারণক্ষমতা সম্পন্ন ১২০টি জাহাজ। তুলনায় যুক্তরাষ্ট্রের কোস্ট গার্ডে রয়েছে ২৪৩টি কাটার (cutter)। চীনা কোস্ট গার্ড দক্ষিণ চীন সাগরে (South China Sea) বারবার আন্তর্জাতিক বিরোধে জড়িয়ে পড়েছে। অনেক সময় সরাসরি নৌবাহিনীর মতোই তারা শক্তি প্রদর্শন করে। CCG-এর প্রায় ৪০,০০০ সক্রিয় সদস্য আছে এবং এরা নৌবাহিনীর পুরনো ফ্রিগেট (frigate) ও করভেট (corvette) সংগ্রহ করে নিজেদের রণক্ষমতা আরও বাড়িয়েছে। ২০২৩ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত তারা নৌবাহিনী থেকে ২২টি টাইপ ৫৬ করভেট পেয়েছে।
এসব মিলিয়ে দেখলে সহজেই বোঝা যায়, কোস্ট গার্ডটিও মূলত সামরিক বাহিনীর একটি সম্প্রসারিত অংশ। কিন্তু সরকারি হিসেবে এগুলো প্রতিরক্ষা বাজেটের বাইরেই থেকে যায়।
অন্যান্য অদৃশ্য সামরিক ব্যয়
- মহাকাশ কর্মসূচি (Space Program): চীনের মহাকাশ বাজেট খুবই গোপনীয়। সামরিক স্যাটেলাইট বা অ্যান্টি-স্যাটেলাইট সক্ষমতার (counter space capability) মতো ব্যয়গুলো সাধারণ বাজেটে দেখানো হয় না। তাদের সামরিক-বেসামরিক সংযুক্তি (military-civil fusion) নীতির কারণে মহাকাশ গবেষণার অনেক অর্থই সামরিক খাতে যায়। ২০১৩ সালে চীনের মহাকাশ বাজেট ছিল ১০ বিলিয়ন ডলার। ২০২২ সালের মধ্যে এটি দ্বিগুণ হয়ে ২১ বিলিয়ন ডলারে গিয়ে পৌঁছাতে পারে।
- অবসরভাতা ও পেনশন (demobilization, retirement, pensions): চীনে এই খাতগুলো প্রতিরক্ষা বাজেটের বাইরে, ‘মিনিস্ট্রি অব সিভিল অ্যাফেয়ার্স’-এর (Ministry of Civil Affairs) মাধ্যমে পরিচালিত হয়। স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট (SIPRI) অনুমান করেছে যে, ২০১৯ সালে এই ব্যয় ছিল ৩৫.৮ বিলিয়ন ডলার।
- সামরিক গবেষণা ও উন্নয়ন (Military R&D): চীনের প্রতিরক্ষা বাজেটে সামরিক R&D-এর কোনো সুস্পষ্ট উল্লেখ নেই। অথচ আমেরিকায় এই খাতে ২০২২ সালে প্রায় ১১৮ বিলিয়ন ডলার ব্যয় হয়েছে, যা মোট প্রতিরক্ষা বাজেটের ২০%। চীনের রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ ও সাইবার গুপ্তচরবৃত্তির (cyber espionage) পরিমাণে বোঝা যায়, আসলে এ খাতে তাদের ব্যয়ও অনেক বিশাল।
সামরিক গবেষণা ও উন্নয়ন (R&D) প্রবণতা
চীনের সামরিক গবেষণা ও উন্নয়ন খাতের তথ্যগুলো যেহেতু খুব গোপন, কোনো কেন্দ্রীয় তথ্যভান্ডারে এগুলো সেভাবে প্রকাশিত হয় না। এর বাইরে—
- আগের গবেষণায় দেখা গেছে, চীনের কেন্দ্রীয় সরকারের R&D ব্যয়ের ৪৫.৩% বিভিন্ন অস্পষ্ট সংস্থায় (non-disclosed agencies) যায়, যা সম্ভবত সামরিক উদ্দেশ্যেই খরচ হয়।
- চীনা কর্তৃপক্ষ সাইবার চুরি ও গুপ্তচরবৃত্তির মাধ্যমে বিদেশি প্রযুক্তি চুরি করে R&D খরচ আরও কমিয়ে আনতে পারে। ফলে তারা অপেক্ষাকৃত কম বিনিয়োগ করেও বড় অর্জন করে ফেলে।
এ কারণে অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন, চীনের অফিসিয়াল বাজেটে R&D বরাদ্দের অঙ্ক শূন্য দেখানো হলেও বাস্তবে এটি অনেক বড়, যা সামরিক সক্ষমতা বাড়াতে বিশেষ ভূমিকা রাখছে।
আমেরিকা বনাম চীনের সামরিক ব্যয়ের প্রকৃত তুলনা
প্রচলিত ধারণা বলে, যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের অন্য সব দেশের চেয়ে বেশি সামরিক ব্যয় করে—যা পরবর্তী ১০টি দেশের সম্মিলিত ব্যয়ের সমান। কিন্তু আমরা যদি চীনের প্রকৃত ব্যয় বিবেচনা করি, দেখা যাবে পার্থক্য অতটা বিস্তর নয়।
- এআই (AEI)-এর মতে সম্ভাব্য প্রকৃত অঙ্ক: চীনের প্রকৃত সামরিক ব্যয় হতে পারে ৫৪৯ বিলিয়ন ডলার, যা সরকারি ঘোষিত ২২৯ বিলিয়নের দ্বিগুণেরও বেশি। এটি আমেরিকার ৮৪০ বিলিয়নের প্রায় ৭৫%। চীনের দাবি করা ২৫%-এর তুলনায় এটি অনেক বেশি বাস্তবসম্মত।
- অন্য গবেষণার মতে: এম. টেলর ফ্রাভেল (M. Taylor Fravel), এমআইটি-এর (MIT) সিকিউরিটি স্টাডিজ প্রোগ্রামের পরিচালক, ধারণা করছেন ২০২৪ সালে চীনের সামরিক ব্যয় প্রায় ৪৭১ বিলিয়ন ডলার। অন্যদিকে SIPRI প্রায় ২৯২ বিলিয়ন ডলারের কথা বলেছে। এআই (AEI)-এর হিসাব অনেক বেশি, ফলে অনেকে মনে করেন তারা ইচ্ছাকৃতভাবে বড় করে দেখাচ্ছে, যাতে আমেরিকা চীনকে মোকাবিলায় আরও বেশি ব্যয় করে।
কিন্তু যা-ই হোক, এটুকু অন্তত নিশ্চিত বলা যায় যে, চীনের প্রকৃত সামরিক ব্যয় এশিয়ার অন্য সব দেশ—যেমন ভারত, রাশিয়া, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া এবং তাইওয়ানের সম্মিলিত সামরিক ব্যয় থেকেও বেশি। সরকারি হিসেবে যত কমই দেখানো হোক না কেন, প্রকৃত ব্যয় অবশ্যই অনেক বেশি।
সামরিক সক্ষমতার মান বনাম পরিমাণ
চীনের সামরিক প্রযুক্তি অনেক ক্ষেত্রেই যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে এক-দুটি প্রজন্ম পিছিয়ে থাকতে পারে। তবে সংখ্যায় তারা ব্যাপক; এতে কিছুটা পিছিয়ে থাকলেও (quantity has a quality of its own) গুরুত্ব কমে না।
১৯৯০-এর দশক থেকে চীন সেনাবাহিনীর লোকবল কমাচ্ছে এবং সেই অর্থ দিয়ে সরঞ্জাম ও প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ বাড়াচ্ছে। বিশেষ করে নৌবাহিনী (Navy) ও মহাকাশ প্রযুক্তিতে বিরাট অগ্রগতি হচ্ছে।
আমেরিকা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নৌবাহিনী বা বিমান বাহিনীর নতুন প্রজেক্টে বড় বিনিয়োগ না করে অনেকখানি মনোযোগ দিয়েছে রক্ষণাবেক্ষণে। ফলে চীন বছরে ১০%-এর বেশি হারে সামরিক সরঞ্জাম খাতে ব্যয় বাড়িয়ে নিজেদেরকে দ্রুতগতিতে শক্তিশালী করে তুলছে।
উপসংহার: আসল চিত্র কোন দিকে ইঙ্গিত করে?
শেষ কথা হলো—যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা বাজেট ৮৪০ বিলিয়ন ডলার বলেও সেটি যে সম্পূর্ণ স্বচ্ছ, তা নয়। অন্যদিকে চীনের বাজেট সরকারি ঘোষণায় ২৩০ বিলিয়ন ডলার বলা হলেও বাস্তবে অনেক অনেক বেশি।
৫৪৯ বিলিয়ন ডলার (এআই-এর অনুমান) থেকে শুরু করে ৪৭১ বিলিয়ন ডলার (এম. টেলর ফ্রাভেল) বা ২৯২ বিলিয়ন ডলার (SIPRI) — বিভিন্ন সংস্থা বা গবেষকের বিভিন্ন হিসাব রয়েছে। কিন্তু মোটাদাগে বলা যায়, চীনের সামরিক ব্যয় সরকারি সংখ্যার দ্বিগুণেরও বেশি হতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে সামরিক প্রতিযোগিতা বাড়লে সারা বিশ্বের ভূ-রাজনীতিতে (geopolitics) বড় ধরনের প্রভাব পড়তে পারে। উভয় দেশই প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় বাড়াচ্ছে, কিন্তু কে কতটা এগিয়ে বা পিছিয়ে আছে—তার সঠিক হিসাব রাখা বেশ কঠিন।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, যারা বলে থাকেন যে যুক্তরাষ্ট্র একাই পরবর্তী ১০টি দেশের চেয়ে বেশি ব্যয় করে, তারা অনেক সময় চীনের আসল ব্যয়ের কথা বিবেচনায় নেন না। চীন এ ক্ষেত্রে তথ্য গোপন করছে, বিভিন্ন উপায়ে সামরিক খাতের অর্থব্যয় অন্যান্য খাতে দেখাচ্ছে, আবার PPP-এর কারণে প্রকৃত সক্ষমতা আরও অনেক বেশি।
অবশ্যই, যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ব্যয়ও অস্বাভাবিক বড়সড়; এ নিয়ে বিতর্কেরও শেষ নেই। তবে এখানে মূল কথা হলো—চীন তাদের সামরিক ব্যয় সম্পর্কে সত্যি তথ্য দিচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে আমাদের আরও সতর্ক ও বিশ্লেষণমূলক হওয়া দরকার।
ট্রাম্পের শুল্কনীতি ও চীনা অর্থনীতির মন্দা: সংকট, প্রভাব এবং ভবিষ্যৎ নীতিনির্ধারণের দ্বিধাদ্বন্দ্ব (১২ নভেম্বর, ২০২৪)
ভূমিকা
চীনা অর্থনীতি (Chinese economy) বর্তমানে সুখকর সময় পার করছে না। টানা দীর্ঘ মন্দা ও মূল্যস্ফীতি-জনিত স্থবিরতার মধ্যে থেকেও চীনের কমিউনিস্ট পার্টি বা সিসিপি (CCP) আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফ (IMF) এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠান থেকে আসা পরামর্শ (যা মূলত সরকারি ব্যয়ের মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ চাহিদা বাড়ানোর সুপারিশ করে) শুনতে চাইছে না। কারণ, তারা মনে করে অতিরিক্ত খরচ করলে বিদ্যমান অর্থনৈতিক বাবলগুলো (bubbles) আবার ফুলে উঠতে পারে। কিন্তু সমস্যাটা হলো, ডোনাল্ড ট্রাম্পের (Donald Trump) পুনর্নির্বাচন চীনের অর্থনীতির জন্য পরিস্থিতিকে আরও খারাপ করে তুলতে পারে। এই প্রবন্ধে আমরা ট্রাম্পের শুল্ককেন্দ্রিক চীন নীতি (tariff centric China policy), কেন তা চীনের বর্তমান উদ্দীপনা-পদ্ধতি বা স্টিমুলাস (stimulus) সমস্যাকে আরও জটিল করে তুলছে, এবং সামনের দিনে কী ঘটতে পারে—সেই বিষয়ে বিশদ আলোচনা করব।
ট্রাম্পের চীনা-বিরোধী অবস্থান ও শুল্কনীতি
ট্রাম্প (Trump) ২০১৫ সালে রাজনীতির মঞ্চে প্রবেশের পর থেকেই চীনের বিরুদ্ধে সরব ছিলেন। তিনি জোর গলায় বলে আসছিলেন যে যুক্তরাষ্ট্র (US) ও চীনের মধ্যে বাণিজ্য ঘাটতি (trade deficit) খুব বেশি। অর্থাৎ, যুক্তরাষ্ট্র চীনের থেকে যে পরিমাণ পণ্য আমদানি (import) করে, চীন তার তুলনায় যুক্তরাষ্ট্র থেকে অনেক কম আমদানি করে। ৮০’র দশক থেকে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় প্রবেশের পর থেকেই চীন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইতিবাচক বাণিজ্য উদ্বৃত্ত (trade surplus) বজায় রেখে আসছে। বিশেষ করে ২০০০ সালের পর এটি ব্যাপক আকার ধারণ করে এবং ২০১৬ সালে ট্রাম্প যখন ক্ষমতায় আসেন, তখন এই উদ্বৃত্তের পরিমাণ ছিল প্রায় ৩৫০ বিলিয়ন ডলার।
২০১৬ সালের নির্বাচনি প্রচারণায় ট্রাম্প প্রতিশ্রুতি দেন যে তিনি এই ‘বাণিজ্য বৈষম্য’ ঘোচাতে শুল্ক আরোপ করবেন। ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে নিউইয়র্ক টাইমসের (New York Times) সম্পাদকীয় বোর্ডের সঙ্গে এক বৈঠকে তিনি পর্যন্ত বলেছিলেন, সমস্ত চীনা আমদানির ওপর ৪৫% হারে শুল্ক (tariff) আরোপ করবেন। তার যুক্তি ছিল, চীনা পণ্যের (Chinese imports) দাম বাড়িয়ে দিলে, সেগুলো আমেরিকান ভোক্তাদের কাছে কম আকর্ষণীয় হবে এবং তারা মার্কিন পণ্য (American made stuff) কিনতে উৎসাহী হবে। এতে করে একই সাথে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ঘাটতি কমবে এবং মার্কিন উৎপাদন খাত পুনরুজ্জীবিত হবে। অবশ্য ভোক্তাদের জন্য এর মূল্যও কিছুটা বাড়বে, কারণ স্বল্পমূল্যের চীনা পণ্যের জায়গায় তুলনামূলক ব্যয়বহুল মার্কিন পণ্য ব্যবহারের সম্ভাবনা তৈরি হবে।
শেষ পর্যন্ত ট্রাম্প নির্বাচিত হয়ে ২০১৮ সালের জুলাই থেকে চীনা পণ্যের তালিকা ক্রমাগত বাড়িয়ে এর ওপর ৭.৫% থেকে ২৫% পর্যন্ত শুল্ক আরোপ করতে থাকেন। প্রেসিডেন্সির (presidency) শেষ দিকে এসে ট্রাম্প প্রায় ২০% গড় হারে শুল্ক আরোপ করেছিলেন চীনা পণ্যের মোট ৩৮০ বিলিয়ন ডলারের ওপর, যা ২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্র যে ৫৪০ বিলিয়ন ডলারের চীনা পণ্য আমদানি করেছিল, তার প্রায় ৭৫%।
কিন্তু চীনও পাল্টা শুল্ক আরোপ করে, আর যুক্তরাষ্ট্র কিছু ভিন্ন ভিন্ন পণ্য আমদানি করতে শুরু করে যেগুলোর ওপর শুল্কের হার কম বা নেই। ফলে সামগ্রিক বাণিজ্য ঘাটতির ক্ষেত্রে তেমন একটা পরিবর্তন আসেনি। বরং এটি ২০১৭ সালে ৩৭৫ বিলিয়ন ডলার থেকে কিছুটা বেড়ে যায়। পরে আমরা দেখব, এটি সামান্য কমেও গিয়েছিল কিছু সময়ের জন্য।
ট্রাম্পের আমলে বাণিজ্য ঘাটতির ওঠানামা ও বাইডেন প্রশাসনের সময় নতুন শুল্ক
ট্রাম্পের ট্যারিফ আরোপের সময়কাল ধরেই যুক্তরাষ্ট্র-চীন দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ঘাটতির (bilateral trade deficit) ওঠানামা দেখা গেছে।
- এটি ২০১৭ সালে প্রায় ৩৭৫ বিলিয়ন ডলারে ছিল।
- পরে কিছুটা বেড়ে ২০১৮ সালে প্রায় ৩৮০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছায় (অনুমানভিত্তিক সংশোধন)।
- ২০১৯ সালে তা সামান্য কমে প্রায় ৩৪০ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে।
২০২০ সালের জানুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্র ও চীন ‘ফেজ ওয়ান (phase one) ট্রেড ডিল (trade deal)’ স্বাক্ষর করে, যেখানে চীনকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ পণ্য আমদানি করার জন্য সক্রিয়ভাবে অঙ্গীকার করতে হয়। কিন্তু চীন প্রকৃতপক্ষে সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেনি। ২০২০ সালে বৈশ্বিক মহামারির (pandemic) কারণে সামগ্রিক বাণিজ্য ঘাটতি কিছুটা কমে ৩০৮ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে। কিন্তু মহামারি-পরবর্তী সময়ে আবার তা বাড়তে শুরু করে এবং ২০২২ সালে এটি ৩৮২ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছে। ২০২৩ সালে কিছুটা কমলেও বছরের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত গত বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ৫% বেড়েছে। আর সামগ্রিকভাবে চীনের বৈশ্বিক বাণিজ্য উদ্বৃত্ত (overall trade surplus) ২০২৩ সালে প্রায় ৯৫৩ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছাতে পারে বলে অনুমান করা হচ্ছে।
জো বাইডেন (Biden) প্রেসিডেন্ট হওয়ার পরেও ট্রাম্প আরোপিত সব শুল্ক বহাল রেখেছিলেন এবং বছরের শুরুর দিকে কিছু নতুন শুল্কও যোগ করেছেন। এগুলোকে ‘কৌশলগত শুল্ক (strategic tariffs)’ বলা হয়ে থাকে এবং এর আওতায় বৈদ্যুতিক যানবাহন (electric vehicles), সৌর প্যানেল (solar equipment), ব্যাটারি (batteries) ইত্যাদি পড়েছে।
অবশ্য অবাক হওয়ার কিছু নেই; বারাক ওবামা (Obama) ও বাইডেন (Biden) যুগেও চীনের বাণিজ্য কৌশল নিয়ে সমালোচনা কম হয়নি। ওবামা আমলে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় (WTO) চীনের বিরুদ্ধে ২৩টি অভিযোগ দায়ের করা হয়, যা ছিল এক রকমের নজিরবিহীন। ২০০৯ সালে চীনা টায়ারের (Chinese tire) ওপর অ্যান্টি-ডাম্পিং শুল্ক (anti-dumping tariff) আরোপ করার সিদ্ধান্তও ওবামা প্রশাসনেরই ছিল।
ট্রাম্পের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
আবার নির্বাচনে নেমে ট্রাম্প নতুন করে বলছেন যে তিনি বাইডেনের ‘কৌশলগত শুল্ক’কে আরও বিস্তৃত করতে চান। এর মধ্যে নাকি একটি ‘বিশাল শুল্ক (Ring around the collar tariff)’ অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে এবং সমগ্র চীনা পণ্যের ওপর একটি সমতল হারে (flat tariff) শুল্ক আরোপ করা হবে বলে তিনি ইঙ্গিত দিয়েছেন। মিডিয়া বিভিন্ন হারে শুল্কের কথা বলেছে—ওয়াশিংটন পোস্ট (Washington Post) প্রথমে ৬০% বললেও ট্রাম্প নিজে এক সাক্ষাৎকারে ৫০% বলেছেন, আবার ফক্স নিউজে (Fox News) বলেছেন ৬০%-এর বেশি হতে পারে।
চীনও পাল্টা শুল্ক আরোপ করলে এটি স্বল্পমেয়াদে দুই দেশের অর্থনীতির জন্যই ক্ষতিকর হতে পারে। লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্সের (LSE) এক গবেষণায় ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে যে, সব চীনা আমদানির ওপর ৬০% হারে শুল্ক আরোপ করলে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের জিডিপি (GDP) প্রায় ০.৮%-১% হ্রাস পেতে পারে।
চীনের অর্থনীতির বর্তমান মন্দা, দুর্বল অভ্যন্তরীন চাহিদা ও ট্রাম্পের শুল্ক বাস্তবায়নে নেতিবাচক প্রভাব
চীনা অর্থনীতি বর্তমানে একটা দীর্ঘমেয়াদি সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, যেখানে অভ্যন্তরীণ চাহিদা (domestic demand) বেশ দুর্বল এবং ভোক্তাদের আস্থাও (consumer confidence) কম। কিন্তু এই অবস্থায় জিডিপি গ্রোথ বাধাগ্রস্ত হয়। কাজেই এই দুর্বল অভ্যন্তরীন চাহিদার সংকট মেটাতে চীন ক্রমশ রপ্তানিনির্ভর হয়ে পড়ছে, যার ফলে তাদের বাণিজ্য উদ্বৃত্তই মূল চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করছে। কিন্তু ট্রাম্পের সম্ভাব্য নতুন শুল্ক বাস্তবায়ন হলে চীনের রপ্তানিমুখী উন্নয়ন আরও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এক্ষেত্রে সম্ভাব্য নেতিবাচক প্রভাব –
- ১. রপ্তানি হ্রাস (Less Demand for Chinese Exports): চীন যদি দ্রুত নতুন বাজার খুঁজে না পায়, তবে মার্কিন বাজারে শুল্ক বৃদ্ধির কারণে চীনের রপ্তানি কমে যাবে। এখন যেহেতু রপ্তানিই তাদের অর্থনীতির মূল অবলম্বন, এটি অর্থনীতিতে বড় ধাক্কা দিতে পারে।
- ২. আস্থা সংকট আরও বাড়বে (Exacerbated Confidence Problem): ট্রাম্পের শুল্ক আরোপ নিয়ে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ও সাধারণ মানুষের মধ্যে আরও অনিশ্চয়তা তৈরি হবে। ফলে বিনিয়োগ ও ভোগ ব্যয় কমে যেতে পারে, যা অভ্যন্তরীণ চাহিদাকে আরো দুর্বল করে তুলবে এবং মূল্যস্তরকে (deflation) নিচের দিকে নামিয়ে দিতে পারে।
চীনের নীতিনির্ধারকগণের দ্বিধাদ্বন্দ্ব ও সীমিত মধ্যপন্থা
চীনা কর্তৃপক্ষের মূল প্রশ্ন হলো—তারা কি রাজস্ব ব্যয় (fiscal stimulus) বাড়িয়ে অভ্যন্তরীণ চাহিদা উজ্জীবিত করবে, নাকি অর্থনৈতিক বাবল (bubbles) এড়াতে সতর্ক থাকবে? এখন পর্যন্ত সিসিপি (CCP) বিপুল সরকারি ব্যয় করা থেকে বিরত থেকেছে, কারণ তারা আবাসন খাত (housing bubble) সহ বিভিন্ন খাতে বড়সড় বাবল সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা করছে। তবে ট্রাম্পের নতুন শুল্ক কার্যকর হলে চীনের রপ্তানি কমতে পারে এবং ব্যবসায়িক আস্থা আরও দুর্বল হয়ে গিয়ে একটি জাপান-শৈলীর (Japan style) দীর্ঘমেয়াদি মুদ্রাস্ফীতিহীন মন্দা বা মূল্যপতন (deflationary crisis) দেখা দিতে পারে। ফলে এটি তাদের জন্য আরও কঠিন সিদ্ধান্ত হয়ে দাঁড়াবে।
ট্রাম্পের নির্বাচনের ঠিক দুই দিন পর, চীন একটি নতুন উদ্দীপনা প্যাকেজ (stimulus package) ঘোষণা করে। এর আওতায় স্থানীয় সরকারগুলোকে (local governments) মোট ১০ ট্রিলিয়ন ইউয়ান (প্রায় ১.৪ ট্রিলিয়ন ডলার) ঋণ দেওয়া হবে, যাতে তারা তাদের ‘লুকানো ঋণ’ (hidden debts) পুনর্গঠন করতে পারে। আশা করা হয়েছিল, এটি বিনিয়োগকারী ও সাধারণ মানুষের আস্থা বাড়াবে, কিন্তু বাস্তবে ফলাফল তেমন আশাব্যঞ্জক হয়নি। পরবর্তী সোমবার হংকংয়ের (Hong Kong) হ্যাংসেং সূচক (Hang Seng index) ১.৫% পড়ে যায়।
সামনে কী হতে পারে
এখন মূল প্রশ্ন—সিসিপি (CCP) কি আরও বড় ধরনের স্টিমুলাস (stimulus) আনবে, নাকি তারা আবারও সতর্ক অবস্থান নেবে?
- ১. স্টিমুলাসবিরোধী অবস্থান অব্যাহত রাখা (Avoid Further Stimulus): চীনা কর্তৃপক্ষ মনে করতে পারে যে বাবল আবার ফুলে উঠলে দীর্ঘমেয়াদে বিপদ আরও বড় হতে পারে। তাই তারা হয়তো ট্রাম্পের শুল্ককে অগ্রাহ্য করে আগের মতোই সতর্ক অবস্থান নেবে।
- ২. শুল্ক আরোপের পরেই বড় ধরনের স্টিমুলাস (Saving Fiscal Firepower): অন্যদিকে, সিসিপি হতে পারে অপেক্ষায় আছে—যখন ট্রাম্প সত্যি সত্যি বড় শুল্ক আরোপ করবেন, তখনই একটি বড় আকারের সরকারি ব্যয় প্যাকেজ বা উদ্দীপনা প্যাকেজ চালু করা হবে, যাতে অর্থনীতিতে তাৎক্ষণিক গতিশীলতা আসে।
ফলে, ট্রাম্পের পুনর্নির্বাচনের আগের বা পরের সময়টাই চীনের অর্থনৈতিক নীতিনির্ধারণে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। চীনে রপ্তানি কমে যাওয়ার শঙ্কা থাকলে, তারা হয়তো শেষ পর্যন্ত বড় ধরনের উদ্দীপনা নীতি বাস্তবায়নে বাধ্য হবে।
উপসংহার
সবমিলিয়ে, চীনের অর্থনীতি এখন এমনিতেই দুর্বল অভ্যন্তরীণ চাহিদা, রিয়েল এস্টেট সংকট বা হাউজিং বাবল (housing bubble), ও দীর্ঘমেয়াদি মন্দার ঝুঁকি নিয়ে লড়ছে। এর মধ্যে ট্রাম্পের (Trump) সম্ভাব্য পুনর্নির্বাচন এবং তার উচ্চহারের শুল্ক (tariffs) আরোপের হুমকি চীনের জন্য নতুন করে ঝুঁকি তৈরি করেছে। চীন যদি এখনই বড় ধরনের সরকারি ব্যয় করে অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে চায়, তবে তারা বিদ্যমান ঋণ ও আবাসন খাতের বাবলের ঝুঁকি বাড়ানোর আশঙ্কা করছে। আবার শুল্ক আরোপের চাপে রপ্তানি কমে গেলে চাহিদা আরও দুর্বল হবে, যা অর্থনীতিকে দীর্ঘমেয়াদি স্থবিরতায় ফেলে দিতে পারে।
সুতরাং, সামনে কী ঘটবে, তা নির্ভর করছে চীনা কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত এবং ট্রাম্পের শুল্ক আরোপের বাস্তবায়নের ওপর। তারা যদি সতর্ক অবস্থানে থেকে যায়, বাবলের ঝুঁকি হয়তো কম থাকবে, কিন্তু অর্থনীতির স্থবিরতা দীর্ঘায়িত হতে পারে। আর যদি হঠাৎ বিশাল উদ্দীপনা প্যাকেজ নিয়ে আসে, তাহলে হয়তো স্বল্পমেয়াদে অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে পারে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে ঋণ ও বাবলের আশঙ্কা আরও বাড়বে। দু’দিক থেকেই ঝুঁকি বিদ্যমান, তাই আমাদের সবাইকে অপেক্ষা করতে হবে এবং দেখতে হবে—চীনা সরকার ও মার্কিন প্রশাসন পরবর্তী ধাপে কী করে।
তথ্যসূত্র
1 – https://www.weforum.org/stories/2019/05/more-than-30-years-of-us-trade-with-china-in-one-chart/
2 – https://www.reuters.com/world/china/why-chinas-economy-is-more-vulnerable-trump-tariffs-this-time-2024-11-06/
3 – https://www.bloomberg.com/news/articles/2024-11-11/china-approaches-record-1-trillion-trade-surplus-to-world-s-ire
4 – https://www.lse.ac.uk/granthaminstitute/wp-content/uploads/2024/10/Economic-impacts-of-the-Trump-Tariff-Proposals-on-Europe.pdf
5 – https://www.lse.ac.uk/granthaminstitute/publication/the-economic-impacts-of-trumps-tariff-proposals-on-europe/
6 – https://www.census.gov/foreign-trade/balance/c5700.html
অর্থনীতিবিদ ব্যাখ্যা করেছেন কেন ভারত কখনই চীনের মতো উন্নতি করতে পারবে না (২৫ জুন, ২০২৪)
চীন কেন ভারতকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল?
১৯৮০-এর দশকে যখন চীন এবং ভারতের অর্থনীতি প্রায় একই আকারের ছিল, তখন চীন শীঘ্রই ভারতকে পিছনে ফেলে প্রায় পাঁচগুণ বড় হয়ে ওঠে। তবে, এখন চীনের অর্থনীতিতে মন্দা এবং পশ্চিমা কোম্পানিগুলো তাদের কারখানা অন্য কোথাও সরিয়ে নিতে চাইছে, সেক্ষেত্রে কি ভারতের পক্ষে চীনের উন্নয়নের দৃষ্টান্ত স্থাপন করার পালা? এই প্রশ্নটিই সম্প্রতি ভারত এবং বিশ্ব উভয়কেই ভাবিয়ে তুলেছে। তবে, “দুর্নীতি কমাতে হবে”, “অর্থনীতিকে আরও উদার করতে হবে”, অথবা “শিক্ষা এবং অবকাঠামো বাড়াতে হবে” – এই ধরনের গতানুগতিক উত্তরগুলো এড়িয়ে গিয়ে, এই লেখায় আমি ভারতের দুই বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ, প্রাক্তন সেন্ট্রাল ব্যাংক (Central Bank)-এর সভাপতি অধ্যাপক রঘুরাম রাজন এবং জন হপকিন্স (John Hopkins)-এর অধ্যাপক দেবেশ কাপুরের গবেষণার মূল বিষয়গুলো একত্রিত করেছি। মূলত তিনটি প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছি:
- প্রথমত, কেন আশি ও নব্বইয়ের দশকে উদার অর্থনৈতিক সংস্কারের পর চীনের অর্থনীতি দ্রুত বৃদ্ধি পায়, যেখানে ভারতের অর্থনীতি সেই পথে হাঁটেনি?
- দ্বিতীয়ত, চীনের উন্নয়নের পথ কেন ভারতের জন্য কাজ করবে না?
- এবং সবশেষে, ভারত কি শীঘ্রই তার নিজস্ব উন্নয়নের দৃষ্টান্ত তৈরি করতে সক্ষম হবে?
আমি আনন্দের সাথে জানাচ্ছি যে তাদের গবেষণায় আমি কিছু সত্যিই আশ্চর্যজনক অন্তর্দৃষ্টি খুঁজে পেয়েছি। ভারতের আসল সমস্যা হল এটা জানা ছিল না যে কী করতে হবে, বরং তাদের নিজস্ব অনন্য রাজনৈতিক কাঠামোর কারণে চীনের কৌশল সঠিকভাবে বাস্তবায়নে ব্যর্থ হয়েছে। এই কাঠামোতে স্বল্পসংখ্যক কর্মীযুক্ত স্থানীয় সরকার প্রায়শই জনগণের স্বার্থের চেয়ে স্থানীয় স্বার্থের প্রতি বেশি মনোযোগ দেয়। এই কাঠামোর অর্থ হল ভারতের অনুসরণ করার মতো অন্যান্য প্রবৃদ্ধির মডেল থাকলেও, দেশটি চীনের মতো উন্নতি করতে পারত না এবং এখনও পারবে না। কিন্তু কেন এমন, তা জানতে প্রথমে আমাদের উত্তর দিতে হবে কেন চীন শুরুতে ভারতকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল। অন্য কথায়, ১৯৮০-এর দশকে ভারত ও চীনের মধ্যে এই বিশাল পার্থক্য সৃষ্টির কারণ কী ছিল?
প্রাথমিক শিক্ষাই মূল পার্থক্য
সেই প্রশ্নের উত্তরে, আমি প্রথমে অধ্যাপক রঘুরাম রাজনের কাজের দিকে নজর দিয়েছি। তিনি তুলে ধরেছেন যে ১৯৭০-এর দশকের শেষের দিকেই, চীনা শ্রমিকদের তাদের ভারতীয় প্রতিরূপদের তুলনায় ভালো মানের প্রাথমিক শিক্ষা ছিল। ভালো মানের প্রাথমিক শিক্ষা চীনের কৃষিভিত্তিক সমাজ থেকে আজকের উৎপাদন কেন্দ্রে (manufacturing powerhouse) রূপান্তরিত হওয়ার পথে দুটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদানকে সক্ষম করেছে। প্রথম উপাদানটি হল, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে দ্রুতগতিতে চালিত করতে চীন ১৯৮০ ও ১৯৯০-এর দশকে প্রচুর বিদেশি কারখানা আকৃষ্ট করতে শুরু করে। এই কারখানাগুলোতে সাধারণত কর্মীদের কাছ থেকে অন্তত প্রাথমিক শিক্ষা প্রত্যাশা করা হতো, যাতে তারা সাধারণ নির্দেশনা অনুসরণ করতে পারে। দ্বিতীয় উপাদানটি হল, বিশেষ করে হিসাববিজ্ঞানে (accounting) প্রাথমিক শিক্ষা থাকার কারণে এই শ্রমিকদের অনেকেই পরে নিজেদের কোম্পানি শুরু করতে সক্ষম হন, যা ২০০০-এর দশকে চীনের অর্থনীতিকে পরবর্তী স্তরে উন্নীত করে। তবে ১৯৭০-এর দশকের শেষের দিকে চীনের চেয়ে ভালো মানের প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন প্রচুর দেশ থাকা সত্ত্বেও, শুধু ভালো শিক্ষাই এটা ব্যাখ্যা করা যথেষ্ট নয় যা ব্যাখ্যা করতে পারে কেন চীন বিদেশি কারখানা আকৃষ্ট করতে এবং তার শ্রমিকদের নিজস্ব কারখানা শুরু করতে সক্ষম হয়েছিল, যেখানে ভারত পারেনি।
চীনের অর্থনৈতিক সাফল্যের তিনটি মূল উপাদান
প্রকৃতপক্ষে, বিদেশি কারখানা আকৃষ্ট করে তাদের কাছ থেকে শেখা ছাড়াও, আরও দুটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ছিল যা চীনকে তার অর্থনীতিকে আজকের উৎপাদন পরাশক্তিতে রূপান্তরিত করতে সাহায্য করেছে। প্রথম এবং সর্বাধিক আলোচিত উপাদানটি হল, ১৯৮০-এর দশকে কমিউনিস্ট (communist) চীন তার অর্থনীতিকে উদার করে, বেসরকারি উদ্যোক্তাদের (private entrepreneurs) কোম্পানি শুরু করার অনুমতি দেয় এবং বিদেশি সংস্থাগুলোকে চীনে আসার সুযোগ করে দেয়। চীনা অর্থনৈতিক সাফল্যের জন্য এটি একটি প্রয়োজনীয় শর্ত ছিল। তবে আরও অনেক বেশি উদার অর্থনীতি (liberalized economies) থাকার কারণে, এটি একা চীনের দ্রুত প্রবৃদ্ধি ব্যাখ্যা করতে পারে না। ভারত এর একটি প্রধান উদাহরণ। চীনের পথ অনুসরণ করে, ভারতও ১৯৯০-এর দশকে তার সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতিকে (socialist economy) সাবধানে উদার করে এবং ২০০০-এর দশকে আরও বড় আকারের উদারীকরণ করা হয়। তবে এই সংস্কারগুলোর পরে ভারতের অর্থনীতি অবশ্যই দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে, কিন্তু এটি কখনই চীনের দুই অঙ্কের প্রবৃদ্ধির সংখ্যায় পৌঁছাতে পারেনি। অবশ্যই, আপনি তখন যুক্তি দিতে পারেন যে ভারত যথেষ্ট উদার হয়নি। এবং সেটা সত্যি হতে পারে, তবে চীন আজও ব্যবসা করার জন্য একটি অত্যন্ত সীমাবদ্ধ জায়গা, যখন আমরা অর্থনৈতিক স্বাধীনতার সূচক (index of economic freedom) ব্যবহার করে দুটি দেশের তুলনা করি, তখন তারা প্রায় একই নম্বর পায়। অতএব, দুটি দেশের মধ্যে এই বিশাল পার্থক্য ব্যাখ্যা করার জন্য, আমি মনে করি আমাদের চীনা সাফল্যের দ্বিতীয় এবং তৃতীয় উপাদান নিয়ে কথা বলা দরকার, যা ভারত সেরা উদ্দেশ্য থাকা সত্ত্বেও কখনই পুনরুৎপাদন করতে পারেনি।
বিনিয়োগ-নেতৃত্বাধীন প্রবৃদ্ধি মডেল
চীনা সাফল্যের দ্বিতীয় মূল উপাদানটি হল এমন একটা জিনিস যেটাকে পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ের (Peking University) অধ্যাপক মাইকেল পিটার্স বিনিয়োগ-নেতৃত্বাধীন প্রবৃদ্ধি মডেল (investment led growth model) বলেছেন। আর চীন সেটাকে অনুসরণ করেই সামনে এগিয়ে গেছে। এই প্রবৃদ্ধি মডেলটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, জাপানের মতো দেশগুলোতে সাফল্যের মূলে ছিল এবং পরে চীন এটি গ্রহণ করে।
মূলত, বিনিয়োগ-নেতৃত্বাধীন প্রবৃদ্ধির ধারণাটি হল ১৯৮০-এর দশকে চীন ও ভারতের মতো দরিদ্র দেশগুলোতে বিশাল বিনিয়োগের অভাব ছিল। তাদের এমন জনসংখ্যা ছিল যারা সম্ভবত খুব উৎপাদনশীল হতে পারত, কিন্তু অবকাঠামো, জ্ঞান এবং যন্ত্রপাতি জাতীয় উৎপাদনশীল সম্পদের (productive assets) অভাবে তারা পিছিয়ে ছিল। তাই অলৌকিক গতির (miracle level speed) সাথে উন্নতি করতে, একটি দরিদ্র দেশকে কেবল অবকাঠামো এবং অন্যান্য উৎপাদনশীল সম্পদে অলৌকিক গতির সাথে বিনিয়োগ করতে হবে। কিন্তু একটি দরিদ্র দেশে সেই টাকা কোথা থেকে আসে? সম্ভবত অর্থনীতিবিদ নন এমন লোকদের জন্য অবাক করার মতো বিষয় হল, দরিদ্রতম দেশেও অর্থের অভাব কখনই আসল সমস্যা নয়। সর্বোপরি, একটি ফিয়াট মুদ্রা ব্যবস্থায় (fiat money system), স্থানীয় অর্থ অসীমভাবে পাওয়া যায়, কারণ কেন্দ্রীয় ব্যাংক (central bank) যতক্ষণ খুশি টাকা ছাপাতে পারে এবং সেই টাকা বেকার শ্রমিকদের কাজে লাগাতে ব্যবহার করতে পারে।
তবে, এই বিশাল দেশগুলির কেন্দ্রীয় সরকার একা সেই সমস্ত অর্থ উৎপাদনশীলভাবে ব্যয় করে মুদ্রাস্ফীতি (inflation) রোধ করতে পারে না, তাই তারা মূলত বেশিরভাগ অর্থ তৈরি করার কাজটি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর (commercial banks) ওপর ছেড়ে দিয়েছে, যারা ঋণ হিসাবে অর্থ তৈরি করে। ঋণের সেই অর্থ মুদ্রাস্ফীতি ঘটাবে না এবং যতক্ষণ এটি অর্থনীতিকে প্রসারিত করতে ব্যবহৃত হবে ততক্ষণ ঋণ থেকে জিডিপি (debt to GDP) বাড়াবে না। সুতরাং, চীনের ব্যাংকগুলো যাতে উৎপাদনশীল অবকাঠামো ও কারখানায় বিনিয়োগ করে, তা নিশ্চিত করার জন্য চীন তার স্থানীয় এবং রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোকে কম সুদের হারে মূলত অবকাঠামো ও উৎপাদন খাতে ঋণ দেওয়ার নির্দেশ দেয়। এবং যদিও এই রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপগুলো এখন ব্যাখ্যা করতে পারে কেন চীনে অতিরিক্ত অবকাঠামো এবং এমনকি অতিরিক্ত কারখানার ক্ষমতাও রয়েছে। তবে চীন যখন উন্নয়নশীল দেশ ছিল তখন এটি খুব ভালোভাবে কাজ করেছিল। কিন্তু ভারতের কী হবে? কেন ভারত বিনিয়োগ-নেতৃত্বাধীন প্রবৃদ্ধি মডেল অনুসরণ করার এবং কারখানা ও অবকাঠামোতে বিনিয়োগ দ্রুত করার চেষ্টা করেনি?
আসলে, তারা করেছিল। যদিও এটি তার কর্পোরেট সেক্টরকে (corporate sector) উদার করেছিল, তবে এটি তার ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে চীনের মতোই মূলত রাষ্ট্রের হাতে রেখেছিল। এবং চীনের মতোই, সেই ব্যাংকিং ব্যবস্থা তখন প্রভাবশালী ব্যবসায়ী শিল্পপতিদের (business tycoons) কাছে ব্যাপক ঋণ দেওয়া শুরু করে। তবে, চীনের সফল উদ্যোক্তাদের (entrepreneurs) বিপরীতে, ভারতের প্রভাবশালী শিল্পপতিরা সেই অর্থ উৎপাদনশীলভাবে ব্যয় করেননি। যার অর্থ হল ২০১৩ সালের দিকে, যখন চীনের কর্পোরেট সংস্থাগুলো বিশ্ব জয় করছিল, তখন ভারতের কর্পোরেট সংস্থাগুলো ব্যর্থ হচ্ছিল এবং একটি রাষ্ট্রীয় ব্যাংকিং ব্যবস্থার কাছে প্রচুর ঋণে জর্জরিত ছিল যা পতনের কাছাকাছি ছিল। যদিও আমাকে বলতে হবে যে তারপর থেকে ভারতের বিনিয়োগ অনেক ভালো হয়েছে। এই পুনরুদ্ধারের পেছনে অধ্যাপক রাজনেরও আংশিক অবদান রয়েছে, যিনি ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান থাকাকালীন এই খারাপ ঋণের (bad debts) অনেকটাই পরিষ্কার করতে সাহায্য করেছিলেন। ২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে মোদীর ভারতের অবকাঠামোতে অনেক নতুন বিনিয়োগের কৃতিত্বও প্রাপ্য। তবে ভারতীয় বিনিয়োগ ও প্রবৃদ্ধি মোটেও খারাপ না হলেও, তা চীনের মতো অলৌকিক ছিল না।
প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের গুরুত্ব এবং ভারতের ব্যর্থতা
অতএব, আমি মনে করি এখন সময় এসেছে চীনের প্রবৃদ্ধির তৃতীয় মূল উপাদান, বিদেশি কারখানা আকৃষ্ট করার বিষয়টি পুনরায় খতিয়ে দেখার, যা প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (Foreign Direct Investment – FDI) নামেও পরিচিত। এফডিআই-এর এই নামটি এসেছে এই কারণে যে আপনি যদি কোথাও একটি কারখানা তৈরি করেন তবে আপনি সেখানে সরাসরি বিনিয়োগ করছেন। যখন এফডিআই-এর কথা আসে, চীন যখন বিশ্বের কারখানায় পরিণত হয়েছিল, ভারত ততটা পরিমাণে এফডিআই আকৃষ্ট করতে ব্যর্থ হয়েছিল। কিন্তু কেন এফডিআই আকর্ষণ করা এত গুরুত্বপূর্ণ এবং কেন চীন এটি করতে সক্ষম হয়েছিল যেখানে ভারত শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়েছিল? এই প্রশ্নের উত্তর দিতে, চলুন ১৯৮০-এর দশকে ভারত ও চীনে ফিরে যাই। তাদের কেবল অবকাঠামো ও মেশিনের অভাব ছিল না, দক্ষ কারখানা কীভাবে কাজ করে সে সম্পর্কে জ্ঞানেরও অভাব ছিল। এমন জ্ঞান যা স্কুলে শেখা যায় না, বরং দক্ষ কারখানায় কাজ করার মাধ্যমে অর্জন করতে হয়। এই কারণেই স্থানীয় জ্ঞানকে দ্রুতগতিতে বাড়াতে বিদেশি কারখানাগুলোকে আকৃষ্ট করা চীনের প্রবৃদ্ধির তৃতীয় মূল উপাদান ছিল। এর উপরে, স্থানীয় অর্থ তাত্ত্বিকভাবে অসীম, কারণ এটি স্থানীয় ব্যাংক এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংক তৈরি করতে পারে। তবে গুরুত্বপূর্ণ আমদানির জন্য বিদেশি অর্থের প্রয়োজন, যেমন চীনের ক্ষেত্রে জার্মান মেশিনের প্রয়োজন ছিল। তাই বেশিরভাগ উন্নয়নের সাফল্যের জন্য প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান কারণ এটি স্থানীয় জ্ঞানকে দ্রুতগতিতে বাড়াতে এবং গুরুত্বপূর্ণ আমদানির জন্য প্রয়োজনীয় মার্কিন ডলার পেতে ব্যবহার করা যেতে পারে। এবং আমরা যেমন আলোচনা করেছি, চীনের প্রাথমিক শিক্ষা সত্যিই এফডিআই-এর জন্য সঠিক পরিবেশ তৈরি করতে সাহায্য করেছে।
স্থানীয় সরকারের ভূমিকা
তবে অধ্যাপক রাজনের মতে, চীন ও ভারতের মধ্যে আসলে একটি গভীর পার্থক্য রয়েছে এবং তা হল তাদের স্থানীয় সরকারগুলো কতটা ভালোভাবে কাজ করে সেটা, যেহেতু চীনা ও ভারতীয় অর্থনীতি উভয়ই বিশাল আকারের বিকেন্দ্রীভূত ব্যবস্থা (decentralized systems)। এটা মনে রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে শিক্ষা, বিনিয়োগ এবং এফডিআই সঠিকভাবে পাওয়াটা ওপর মহল থেকে নির্ধারিত হয় না। এই পরিবর্তনগুলো কার্যকর করার জন্য স্থানীয় পর্যায়ে সরকারগুলোর প্রয়োজন। এবং তার জন্য তাদের সঠিক প্রণোদনা (incentives) দরকার। এবং যদি আমরা চীনের স্থানীয় সরকারগুলো কীভাবে কাজ করে তার দিকে নজর দিই, তাহলে আমরা দেখতে পাব যে স্থানীয় বিনিয়োগ এবং প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ উভয়কেই উৎসাহিত করার জন্য তাদের সঠিক প্রণোদনা ছিল।
প্রথমত, স্থানীয় সরকারগুলো চীনা কমিউনিস্ট পার্টির (Chinese Communist Party) অংশ ছিল এবং স্থানীয় জনগণের কাছে কতটা জনপ্রিয় বা বসের প্রতি কতটা অনুগত তার ওপর ভিত্তি করে তাদের পদোন্নতি বা পদাবনতি হত না, বরং তাদের স্থানীয় অর্থনীতি কতটা বাড়াতে পেরেছে তার ওপর ভিত্তি করে হত। তার উপরে, স্থানীয় সরকারের রাজস্বের একটি বড় অংশ ভূমি বিক্রির মাধ্যমে উৎপন্ন হওয়ার কথা ছিল। এবং যেহেতু সঠিক অবকাঠামো নির্মিত হলে জমির মূল্য বৃদ্ধি পায়, তাই স্থানীয় গভর্নররা যদি পার্টিতে তাদের কর্মজীবনকে আরও উন্নত করতে চাইতেন, তবে তাদের অন্যতম সেরা উপায় ছিল এমন অবকাঠামো তৈরি করা যাতে তারা বেশি রাজস্ব পেতে পারে এবং তাদের প্রদেশ বা শহরের জিডিপি বাড়াতে পারে। এবং সম্ভবত প্রক্রিয়ার মাঝে একটু চুরিও করত। এই প্রণোদনাগুলোর মানে ছিল যে স্থানীয় চীনা গভর্নররা তাদের শহরে বিনিয়োগ করতে চাওয়া বিদেশিদের জন্য সবকিছু যতটা সম্ভব সহজ করতে আগ্রহী ছিলেন।
উদাহরণস্বরূপ, অধ্যাপক রাজন তার বইতে বর্ণনা করেছেন, যখন একজন ভারতীয় ব্যবসায়ী চীনের মাঝারি আকারের একটি শহরে বিনিয়োগ করতে চেয়েছিলেন, তখন তাকে বিমানবন্দরে উপ-মেয়র অভ্যর্থনা জানান, একই দিনে সম্ভাব্য একটি স্থান পরিদর্শনে নিয়ে যাওয়া হয় এবং তারপরে সরাসরি মেয়রের অফিসে নিয়ে যাওয়া হয় যেখানে প্রয়োজনীয় সমস্ত কাগজপত্র ইতিমধ্যে পূরণ করা হয়েছিল এবং তিনি যে কোনও সমস্যার কথা তুলে ধরলে স্থানীয় সরকার তা সমাধান করতে পারত। একইভাবে, যখন ইলন মাস্ক (Elon Musk) চীনে এসেছিলেন, তখন তিনি তার সাংহাইয়ের (Shanghai) কারখানাটি রেকর্ড সময়ে চালু করতে সক্ষম হয়েছিলেন কারণ সাংহাইয়ের স্থানীয় সরকারি কর্মকর্তারা তার জন্য সমস্ত আইনি বাধা দূর করেছিলেন। এর বিপরীতে ভারতে, কেন্দ্রীয় সরকার নাগরিকদের নিশ্চিত করেছিল যে এটি এখন এফডিআই-এর জন্য একটি দুর্দান্ত গন্তব্য। তবে এর স্থানীয় সরকার প্রায়শই ভারতের কঠিন নিয়মকানুন কঠোরভাবে প্রয়োগ করে এবং সেগুলো এড়িয়ে চলা সময়সাপেক্ষ করে বিদেশি সংস্থাগুলোর আগমনকে সক্রিয়ভাবে হতাশ করত।
সংক্ষেপে, অধ্যাপক রাজনের অন্তর্দৃষ্টি অনুসরণ করে বলা যায়, চীন প্রাথমিকভাবে ভারতের চেয়ে দ্রুত উন্নতি করতে পেরেছিল কারণ তাদের শিক্ষার মান ভালো ছিল। এবং উভয় দেশ তাদের অর্থনীতিকে উদার করলেও, শুধুমাত্র চীন বিশাল আকারে সফলভাবে বিনিয়োগ করতে এবং তার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে দ্রুতগতিতে চালিত করতে যথেষ্ট পরিমাণে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছিল। পরিশেষে, ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার বেশি বিনিয়োগ করার ব্যাপারে এবং এফডিআই আকর্ষণ করার ব্যাপারে অবগত ছিল না, এমনটা নয়। না। ভারত কেন চীনের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে পারেনি তার গভীর কারণ হল এর স্থানীয় সরকারগুলো সহযোগিতা করেনি, যেখানে চীনের স্থানীয় গভর্নরদের স্থানীয় বিনিয়োগ এবং এফডিআই উভয়কেই উৎসাহিত করার জন্য সঠিক প্রণোদনা ছিল।
ভারতের স্থানীয় সরকার কেন চীনের মতো উন্নতি করতে পারবে না?
দুঃখজনকভাবে, আমরা যদি অধ্যাপক দেবেশ কাপুরের কাজের দিকে তাকাই, তবে আমি আশঙ্কা করছি এটা স্পষ্ট হয়ে যাবে যে অতীতে অকার্যকর স্থানীয় সরকারগুলো কেবল ভারতকেই পিছিয়ে রাখেনি, বরং এর অর্থ হল আজও ভারত কখনই চীনের মতো উন্নতি করতে পারবে না। আচ্ছা, কেন ভারতের স্থানীয় সরকারগুলো চীনের মতো সাফল্য আনতে ব্যর্থ হচ্ছে, তা বোঝার জন্য, চলুন অধ্যাপক কাপুরের দিকে তাকাই যিনি তিনটি সম্ভাব্য ব্যাখ্যা চিহ্নিত করেছেন।
কর্মী সংকট
প্রথম ব্যাখ্যাটি হল ভারতের স্থানীয় সরকারগুলোতে ভয়ানকভাবে কর্মীর অভাব রয়েছে, বিশেষ করে চীনের তুলনায়, যারা তাদের প্রবৃদ্ধির সময় স্থানীয় সরকারের সক্ষমতা ব্যাপকভাবে বাড়িয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে, ভারতের সরকারি কর্মচারীর সংখ্যার কাঠামো মূলত চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের বিপরীত। যেখানে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনে বেশিরভাগ সরকারি কর্মচারী স্থানীয় পর্যায়ে এবং কিছু রাজ্য বা ফেডারেল (federal) পর্যায়ে কাজ করেন, সেখানে ভারতে এর উল্টোটা দেখা যায়। ভারতের বেশিরভাগ সরকারি কর্মচারী রাজ্য এবং কিছু ফেডারেল স্তরে কাজ করেন, যেখানে স্থানীয় পর্যায়ে খুব কম সংখ্যক কর্মচারী কাজ করেন। এটি ব্যাখ্যা করতে পারে কেন ভারতের স্থানীয় সরকারগুলো তাদের চীনা প্রতিপক্ষদের মতো একই পরিমাণে বিনিয়োগ করতে বা বিদেশি বিনিয়োগকারীদের নিয়মকানুন এড়িয়ে চলতে সহায়তা করতে পারেনি। তবে স্থানীয় সক্ষমতাই যদি একমাত্র সমস্যা হত, তাহলে স্থানীয় সরকারগুলোকে আরও বেশি লোক নিয়োগের জন্য বেশি অর্থ দিলেই তো এর সমাধান হয়ে যেত, তাই না? দুঃখজনকভাবে, এতে সমস্যার সম্পূর্ণ সমাধান হবে না। আপনারা জানেন, ভারতের স্থানীয় সরকারগুলোর মধ্যে সত্যিই অদ্ভুত কিছু ঘটছে। উচ্চ বেকারত্বের (unemployment) পরেও, অনেক স্থানীয় সরকারের অধীনে হাজার হাজার পদ খালি রয়েছে। আরও খারাপ বিষয় হল, ভারতের কিছু দরিদ্রতম স্থানীয় সরকার কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে পাওয়া সমস্ত অর্থও ব্যয় করে না।
বর্ণপ্রথা
তাহলে আর কী ঘটছে? আচ্ছা, এটি আমাদের অধ্যাপক কাপুরের দ্বিতীয় ব্যাখ্যাটির দিকে নিয়ে যায় যে কেন ভারতের স্থানীয় সরকারগুলো তাদের সম্ভাবনা অনুযায়ী কাজ করছে না। সেটি হল ভারতের কুখ্যাত বর্ণপ্রথা (caste system), যা মানুষকে তাদের জন্মের ভিত্তিতে সামাজিক শ্রেণিবিন্যাসের (hierarchy of social categories) মধ্যে বিভক্ত করে। তবে এর গভীরে যাওয়ার আগে, আমাদের মনে রাখতে হবে যে বর্ণপ্রথা কার্যকরভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে, তবে তা সত্ত্বেও, দেশের অনেক অংশে এটি এখনও একটি বড় রাজনৈতিক বাস্তবতা। বর্ণপ্রথা তিনটি ভিন্ন উপায়ে ভারতের অকার্যকর স্থানীয় সরকারগুলোকে ব্যাখ্যা করতে পারে।
- প্রথমত, স্থানীয় সরকার পর্যায়ে বর্ণপ্রথার প্রভাব এখনও জোরালো, এটি উপলব্ধি করে ভারতের প্রতিষ্ঠাতারা (founders) ইচ্ছাকৃতভাবে স্থানীয় সরকারগুলোকে খুব বেশি শক্তিশালী করেননি।
- দ্বিতীয়ত, এমনকি যদি কোনও স্থানীয় সরকারের পর্যাপ্ত সক্ষমতা থাকেও, তাদের হয়তো সঠিক প্রণোদনা নাও থাকতে পারে, যার অর্থ তারা সচেতনভাবে কেন্দ্রীয় সরকারের নীতিগুলোর বাস্তবায়নে বাধা দিতে পারে কারণ এটি বর্ণপ্রথার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। উদাহরণস্বরূপ, অধ্যাপক কাপুর উল্লেখ করেছেন যে বেশ কয়েকটি ফেডারেল শিক্ষা কর্মসূচি যেখানে মেয়েদের শিক্ষার উন্নতির জন্য স্কুল তৈরি করা হয়েছিল, স্থানীয় পর্যায়ে তা ব্যর্থ হয়েছে কারণ, তার উদ্ধৃতি অনুসারে, “শ্রেণীকক্ষের ভেতরের ঘটনা বর্ণ ও লিঙ্গীয় রীতিনীতি দ্বারা প্রভাবিত হয়”।
- তৃতীয়ত, কিছু চরম ক্ষেত্রে, বর্ণপ্রথা এমনকি সরকারি পদগুলো ইচ্ছাকৃতভাবে খালি ফেলে রাখার দিকে নিয়ে যায় কারণ সেখানে কেবল উচ্চ বর্ণের প্রার্থীরাই রয়েছেন। উদাহরণস্বরূপ, অধ্যাপক আজমোগলু (Asamoglu) এবং রবিনসন (Robinson) তাদের “দ্য ন্যারো করিডোর” (The Narrow Corridor) বইতে বর্ণনা করেছেন যে ভারতের দরিদ্র রাজ্যগুলোর মধ্যে একটি বিহারে ইঞ্জিনিয়ারদের জন্য হাজার হাজার পদ খালি ছিল যা পূরণ করা হয়নি, যদিও সেখানে উচ্চ বেকারত্ব ছিল। কেন? কারণ যারা ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার যোগ্য তারা সাধারণত উচ্চ বর্ণের, তবে প্রদেশের ক্ষমতাসীন গভর্নর লালু প্রসাদ যাদব যেহেতু নিম্ন বর্ণের ছিলেন, তাই তিনি এই পদগুলো পূরণ করতে অস্বীকার করেছিলেন। অবশ্যই, এর ফলস্বরূপ, সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল কারণ বিহারের সরকার এতটাই স্বল্পসংখ্যক কর্মীযুক্ত ছিল যে স্থানীয় অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য কেন্দ্রীয় সরকার থেকে বরাদ্দ করা সমস্ত অর্থও তারা ব্যয় করতে পারেনি।
অপরিণত গণতন্ত্র
তবে এটি একটি চরম ঘটনা যা সমস্ত রাজ্যের জন্য প্রযোজ্য নাও হতে পারে। কিন্তু যা পুরো ভারতের জন্য প্রযোজ্য, তা হল কেন এর স্থানীয় সরকারগুলো তাদের চীনা প্রতিপক্ষদের মতো ব্যবসাবান্ধব (businesses) নয় সেটার তৃতীয় কারণটি। আর সেটি হল ভারত একটি গণতন্ত্র (democracy)। আমি জোর দিয়ে বলতে চাই যে এটি নিজেই কোনও সমস্যা নয়। নিশ্চিতভাবে বলা যায়, চীনে, পার্টিতে পদোন্নতির প্রণোদনার অর্থ ছিল স্থানীয় গভর্নররা অবকাঠামো তৈরি করতে এবং বিদেশি সংস্থাগুলোকে আকৃষ্ট করার জন্য স্থানীয় উদ্বেগ অগ্রাহ্য করতে পারতেন। তবে, ভালোভাবে কার্যকরী গণতন্ত্রে, এটি কোনও সমস্যা হওয়ারই কথা নয়, কেননা সেখানে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া নিজেই স্থানীয় গভর্নরদের তাদের শহরে বিনিয়োগ করতে এবং বিদেশি সংস্থাগুলোকে আকৃষ্ট করতে উৎসাহিত করতে পারে। সর্বোপরি, আপনি যদি একজন স্থানীয় গভর্নর হিসাবে আপনার অর্থনীতিকে উন্নত করেন, তবে আপনার পুনরায় স্থানীয় গভর্নর নির্বাচিত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
প্রকৃতপক্ষে, গণতন্ত্র পশ্চিম জার্মানি থেকে ইতালি, জাপান এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পর্যন্ত বেশিরভাগ উন্নয়নের সাফল্য এনে দিয়েছে। তবে এই দেশগুলোর বিপরীতে, অধ্যাপক কাপুর দাবি করেন যে ভারত একটি তথাকথিত অপরিণত গণতন্ত্র (precocious democracy), যার অর্থ একটি দেশ সম্ভবত গণতান্ত্রিক হওয়ার জন্য প্রস্তুত হওয়ার আগেই গণতান্ত্রিক হয়ে উঠেছে। অধ্যাপক কাপুর তিনটি কারণ নিয়ে আলোচনা করেছেন ও দেখিয়েছেন কেন এটি ভারতের স্থানীয় সরকারগুলোকে পিছিয়ে রাখছে।
- প্রথমত, একটি অপরিণত গণতন্ত্র একটি দুষ্টচক্রে (vicious cycle) পড়তে পারে যেখানে এটি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সময় স্কুল এবং স্বাস্থ্যসেবার মতো দুর্বল সরকারি পরিষেবা সরবরাহ করে। ফলস্বরূপ, ধনী লোকেরা সরকারি ব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে এসে পরিবর্তে বেসরকারি স্কুল ও হাসপাতাল ব্যবহার করতে শুরু করবে এবং তাই তারা এখন ট্যাক্স দিতে কম ইচ্ছুক হবে, যা স্থানীয় সরকারি পরিষেবাগুলোকে আরও অকার্যকর করে তুলবে। প্রকৃতপক্ষে, অধ্যাপক কাপুর উল্লেখ করেছেন যে ভারতের স্থানীয় সরকারগুলোকে বিশেষভাবে তাদের ট্যাক্স বাড়াতে খুব দ্বিধাগ্রস্ত মনে হয়, যে ট্যাক্সগুলো তাদের শহরগুলোকে উন্নত করার জন্য প্রয়োজন।
- তবে দুঃখজনকভাবে, আরও কিছু বিষয় আছে। অপরিণত গণতন্ত্র হওয়ার কারণে ভারত কেন পিছিয়ে আছে তার দ্বিতীয় কারণ হল ভারত এত বিভক্ত হওয়ায়, তাদের নির্দিষ্ট বর্ণ বা ধর্মীয় গোষ্ঠী বা অন্য কোনও স্বার্থগোষ্ঠীর দ্বারা নির্বাচিত স্থানীয় সরকারি কর্মকর্তারা সার্বজনীন পরিষেবাগুলোতে বিনিয়োগ করার চেয়ে তাদের ভোটারদের ভর্তুকি (subsidies) বা অন্যান্য নির্দিষ্ট সুবিধা দিয়ে পুরস্কৃত করতে বেশি পছন্দ করেন যা সকলের দ্বারা উপভোগ করা যায়।
- পরিশেষে, অপরিণত গণতন্ত্রে, রাজনীতিবিদরা এমন সরকারি পণ্যগুলোর ওপর জোর দেবেন যা অত্যন্ত দৃশ্যমান এবং সরবরাহ করা তুলনামূলকভাবে সহজ। উদাহরণস্বরূপ, তারা শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নতির জন্য বিনিয়োগ করার চেয়ে অত্যাধুনিক মেট্রোতে (metros) বিনিয়োগ করতে পছন্দ করতে পারেন, যার ফলাফল কয়েক বছর পরে দেখা যাবে। অবশ্যই, এটি যেকোনো গণতন্ত্রেই ঘটে, তবে অপরিণত গণতন্ত্রে আরও বেশি ঘটে বলে অধ্যাপক কাপুর যুক্তি দেন।
সুতরাং দৃশ্যত, ভারত চীনের মতো দ্রুত বৃদ্ধি পায়নি কারণ এটির প্রাথমিক শিক্ষার অভাব ছিল, ততটা বিনিয়োগ করেনি এবং ততটা এফডিআই আকর্ষণ করতে পারেনি। তবে এর গভীর কারণ হল ভারতের স্থানীয় সরকারগুলোর শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নতি, প্রচুর বিনিয়োগ এবং এফডিআই আকর্ষণ করার মতো সক্ষমতা বা সঠিক প্রণোদনা ছিল না, যার কারণ কর্মী অভাব এবং বর্ণপ্রথা ও ভারতের অপরিণত গণতন্ত্রের কারণে ভুল প্রণোদনা। দুঃখজনকভাবে, মোদী সরকারের অনেক ভালো উদ্দেশ্য থাকা সত্ত্বেও, ভারতের স্থানীয় সরকারের অকার্যকারিতার এই সমস্ত কারণ এখনও বিদ্যমান। এবং এই কারণেই বলা যায় যে, ভারত কখনই চীনের মতো উন্নতি করতে পারবে না, বিশেষ করে যখন মোদী সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ক্রমবর্ধমানভাবে স্বৈরাচারী (autocratic) হয়ে উঠেছেন, আর সম্ভবত এই কারণে সংসদেও নিজের সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারিয়েছেন।
ভারতের জন্য আশার আলো
তাহলে এর মানে কি ভারতের চীনের সাথে কখনও পাল্লা দেওয়ার কোনও আশা নেই? না, আমি আসলে বেশ আশাবাদী কারণ ভারতের অর্থনীতি সম্পর্কে আশাবাদী হওয়ার আরও কয়েকটি কারণ রয়েছে। প্রথমত, ১৯৮০-এর দশকে ভারতের পরিস্থিতির সাথে যদি আমরা এখনকার ভারতের তুলনা করি, তাহলে আমরা দেখব যে এটি অলৌকিক প্রবৃদ্ধির মধ্য দিয়ে না গেলেও, এখনকার মানুষ আগের চেয়ে বেশি শিক্ষিত এবং এর অবকাঠামো, বিশেষ করে ডিজিটাল (digital) এবং আর্থিক (financial) দিক থেকে বড় ধরনের উন্নতি লাভ করেছে। আর যেহেতু বিদেশি কোম্পানিগুলো ক্রমশ চীনের বিকল্প খুঁজছে, তাই ভারত তাত্ত্বিকভাবে প্রচুর পরিমাণে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করার জন্য সত্যিই ভালো অবস্থানে রয়েছে।
এখন, অবশ্যই, ভারতে এফডিআই এখনও তেমন উল্লেখযোগ্য কিছু নয়, কারণ স্থানীয় সরকারগুলোর জটিল নিয়মকানুনের মধ্য দিয়ে বিদেশি সংস্থাগুলোকে সাহায্য করার মতো সক্ষমতা বা প্রণোদনা নেই। তবে, এখন যেহেতু ভারতে বিজেপির বদলে ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স নামে একটি জোট সরকার (coalition government) নির্বাচিত করেছে (বিজেপি যার একটি অংশ), তাই কেউ কেউ যুক্তি দিয়েছেন যে এর অর্থ হতে পারে যে সংস্কার এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য মোদীকে এখন স্থানীয় সরকারগুলোর সাথে আরও ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করতে হবে। একটি বিভক্ত দেশে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতা ভারতকে কখনই চীনের পথে নিয়ে যাবে না, তবে এটি দেশটিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পথে ফেলতে পারে, যা একটি বৃহৎ বিভক্ত জাতি যা ধীরে, বিশৃঙ্খল প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে গিয়েছিল, তবে শেষ পর্যন্ত যা সর্বকালের সবচেয়ে সফল উন্নয়নের সাফল্য হিসাবে প্রমাণিত হয়েছে। পরিশেষে, সম্ভবত আরও গুরুত্বপূর্ণভাবে, অধ্যাপক কাপুর যেমন উল্লেখ করেছেন, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলা, গ্যাস সংযোগ এবং পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার (sewage system) সাথে সংযোগকারী টয়লেট খোলার মতো বিভিন্ন কর্মসূচির সফল বাস্তবায়ন প্রমাণ করে যে ধীরে ধীরে স্থানীয় সরকারি সক্ষমতা বাড়ছে। তবে হ্যাঁ, আমি খুব শীঘ্রই চীনের মতো অলৌকিক কিছু আশা করি না, তবে আগামী দশকগুলোতে ভারতের উন্নতির সম্ভাবনা নিয়ে আমি এখনও আশাবাদী থাকাই যায়।
তথ্যসূত্র
- Acemoglu, D., & Robinson, J. A. (2019). The narrow corridor: States, societies, and the fate of liberty. Penguin Press. https://www.amazon.com/Narrow-Corridor-States-Societies-Liberty/dp/0735224382
- Rajan, R. G. (2020). The third pillar: How markets and the state leave the community behind. HarperCollins India. https://www.amazon.com/Third-Pillar-Markets-Community-Behind/dp/9353028396
- Rajan, R. G. (2020). “The third pillar: How markets and the state leave the community behind.” Journal of Economic Perspectives, 34(1), 31–56.
https://www.aeaweb.org/articles?id=10.1257%2Fjep.34.1.31
Leave a Reply