ব্যবসা সংবাদ

Table of Contents

নেটফ্লিক্স গোপনে কেন তাদের সবকিছু মুছে ফেলছে? (১৮ জানুয়ারি, ২০২৫)

বিলিয়নিয়ারদের মহাকাশ প্রতিযোগিতা: ব্লু অরিজিনের সাফল্য ও সীমাবদ্ধতা (সংক্ষিপ্ত) (১৬ জানুয়ারি, ২০২৫)

মার্কিন সুপ্রিম কোর্টে টিকটক নিষেধাজ্ঞা ও “রেডনোট” এর উত্থান (সংক্ষিপ্ত) (১৫ জানুয়ারি, ২০২৫)

টিকটকের ভবিষ্যৎ: ইলন মাস্কের সম্ভাব্য কেনার পরিকল্পনা (সংক্ষিপ্ত) (১৪ জানুয়ারি, ২০২৫)

মেটার নীতি পরিবর্তন: ট্রাম্পের প্রতি সৌজন্য? (সংক্ষিপ্ত) (৮ জানুয়ারি, ২০২৫)

কেন চীন বিশ্বের নবায়নযোগ্য জ্বালানি প্রযুক্তিতে নেতৃত্ব দিচ্ছে? (৩ জানুয়ারি, ২০২৫)

ওনলি-ফ্যানস: প্রাপ্তবয়স্ক কনটেন্টের সাবস্ক্রিপশন বিপ্লব ও ডিজিটাল কমার্সের নতুন দিগন্ত (৩১ ডিসেম্বর, ২০২৪)

ভূমিকা

ইন্টারনেটে যৌন-সামগ্রী (Adult content) অনেক দিন ধরেই মানুষের জন্য “ফ্রি” অর্থাৎ বিনামূল্যে পাওয়া গেছে। তবে “ওনলি-ফ্যানস” (OnlyFans) নামের একটি প্ল্যাটফর্ম এই ধারণাটিকে একেবারে পাল্টে দিয়েছে—তারা ব্যবহারকারীদের দিয়ে এই ধরণের কনটেন্টের জন্য টাকা আদায়ে সমর্থ হয়েছে এবং অভাবনীয় লাভ করেছে। মাত্র কয়েক বছরে তাদের রাজস্ব (Revenue) ২০০০%-এরও বেশি বেড়েছে, ২০২৩ সালে ৬.৬ বিলিয়ন ডলার আয় করেছে।

শুরুতে অনেকের ভাবনা ছিল, পুরনো পদ্ধতিতে যেসব ওয়েবসাইট বিনামূল্যে “এডাল্ট কনটেন্ট” সরবরাহ করে, তাদের সঙ্গেই ওনলি-ফ্যানসের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হবে। অথচ ওনলি-ফ্যানস সামগ্রিকভাবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের (Social media platform) মতো দেখালেও, এর আড়ালে ভিন্ন এক ব্যবসায়িক কাঠামো (Business model) কাজ করে।

তারা অ্যাপলের (Apple) অ্যাপ স্টোরে নেই, গুগলের (Google) প্লে স্টোরেও নয়—যা মূলধারার বেশিরভাগ অ্যাপ প্ল্যাটফর্মের জন্য অত্যাবশ্যক। তা সত্ত্বেও, তারা কীভাবে বিপুল পরিমাণ অর্থ আয় করছে? কী তাদের মূলমন্ত্র? এই নিবন্ধে আমরা খুঁটিনাটি দেখব—কেন ওনলি-ফ্যানস ইতালির কোনো দোকান বা অন্যকিছু নয়, বরং ডিজিটাল মার্কেটে এক আধিপত্যশীল প্রবেশদ্বার হতে পেরেছে।

ব্যবসায়িক মডেলের (Business Model) ভিন্নতা

ফ্রি কনটেন্টের যুগে সশুল্ক (Paywall) প্রতিষ্ঠা: অনেক কোম্পানি চেষ্টা করেছে “ইন্টারনেটে নগ্নতা বা যৌন বিষয়” (Being naked online) থেকে অর্থ উপার্জন করার। অনেক ক্ষেত্রে দর্শক অভ্যস্ত “ফ্রি” পর্নোগ্রাফি (Pornography) বা বিনামূল্যের কনটেন্টে। ওনলি-ফ্যানস এই ধারনায় ছেদ এনেছে।

  • “ফ্রি”-র বদলে গ্রাহক (Subscriber) সরাসরি কনটেন্ট নির্মাতাকে (Creator) অর্থ প্রদান করে।
  • এটি “সোশ্যাল মিডিয়া”র মতো দেখালেও সব টাকা আসে মূলত সাবস্ক্রিপশন ও কাস্টম-সামগ্রী থেকে, বিজ্ঞাপন (Advertisement) নয়।
  • ওনলি-ফ্যানসের CEO বা শীর্ষ কর্মকর্তারা বলে থাকেন, “আমরা তখনই উপার্জন করি, যখন ক্রিয়েটর উপার্জন করে” (We only make money when creators make money)।

সরাসরি আয় ও রাজস্ব ভাগাভাগি (Direct Payment & Revenue Share): ক্রিয়েটর (Creator) তাদের ফ্যানদের কাছে মাসিক ৫০ ডলার (50$) পর্যন্ত সাবস্ক্রিপশন ফি ধার্য করতে পারেন। এর ২০% ওনলি-ফ্যানস রাখে, বাকি ৮০% পান ক্রিয়েটর। এটি অন্যান্য সোশ্যাল প্ল্যাটফর্মে প্রচলিত কঠিন নিয়মের (যেমন: নির্দিষ্ট সাবস্ক্রাইবার বা ভিউ এর মাইলস্টোন পেরোতে হবে) চেয়ে সহজতর। ৪ বছরে ওনলি-ফ্যানসের (OnlyFans) রাজস্ব ২০০০%+ বেড়েছে। ২০২৩ সালে তারা ৬.৬ বিলিয়ন ডলার আয় করে। এদিকে অন্যান্য সোশ্যাল মিডিয়া কোম্পানি যেমন ফেসবুক (Facebook) বা ইনস্টাগ্রাম (Instagram) প্রধানত বিজ্ঞাপন থেকেই (Advertising) টাকা উপার্জন করে। ওনলি-ফ্যানস বেশ কৌশলী। তারা সবকিছু সোজাসুজি ফ্যান ও ক্রিয়েটরের মাঝে আর্থিক লেনদেনের (Financial transaction) মাধ্যমে চালায়। যেহেতু এটি কাজ করছে, অন্য প্ল্যাটফর্মগুলো—যেমন টুইটার (Twitter/X), ইনস্টাগ্রাম—এখন সাবস্ক্রিপশন ফিচার আনছে। কিন্তু ওনলি-ফ্যানসের মতে, সাবস্ক্রিপশন শুধু পুরো মডেলের একটা খণ্ডমাত্র; এর বাইরে রয়েছে “পে-পার-ভিউ” (Pay-per-view), টিপ (Tip), কাস্টম ম্যাসেজ (Custom messaging) ইত্যাদি।

লোকের ভুল ধারণা: “শুধু নগ্ন ছবি দিলেই টাকা আসবে?”: কিছু মানুষ ভাবে, ওনলি-ফ্যানসে “কিছু সেক্সি পোশাকে ছবি দিলেই” (Taking some sexy pictures in lingerie) অঢেল টাকা আসবে। কিন্তু আসলে এটি অনেক জটিল। একজন সফল ক্রিয়েটরকে অনেক খাটতে হয়—নিয়মিত কনটেন্ট তৈরি, ফ্যানদের সঙ্গে বার্তা বিনিময়, সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচার (Promotion), বিপণন (Marketing), ইত্যাদি। একজন প্রতিষ্ঠিত ক্রিয়েটর যেমন Louise বলেছেন, “অনেক কাজ—আমি যদি কনটেন্ট তৈরি না করি, তখন আমি মেসেজিং করছি, মার্কেটিং করছি। ভাগ্যিস আধা ঘণ্টা টিভি দেখতে পারি।”

ওনলি-ফ্যানসের সূচনা ও অনন্য লাইসেন্সিং কৌশল

প্রতিষ্ঠা ও সোশ্যাল মিডিয়া থেকে ভিন্নতা: ২০১৬ সালে ওনলি-ফ্যানস চালু হয়। আগে যেমন Patreon, কেনিয়ান (Kenyans?), ইত্যাদি প্ল্যাটফর্ম ছিল, যারা ফ্যানদের কাছ থেকে সমর্থন নিতে দিত, ওনলি-ফ্যানস সেটিকে আরও নিখুঁতভাবে “এডাল্ট কনটেন্ট” (Adult content) সমর্থনের দিকে নিয়ে যায়। একটি বড় পার্থক্য হলো—ফেসবুক, ইউটিউব বা ইনস্টাগ্রামের মতো যেখানে বিজ্ঞাপন প্রধান, সেখানে ওনলি-ফ্যানস আয় করে সরাসরি ফ্যানদের থেকে, কোনো বিজ্ঞাপন নেই। ২০১৮ সালের দিকে টাম্বলর (Tumblr) প্রাপ্তবয়স্ক কনটেন্ট নিষিদ্ধ করে, ফলে অনেক ক্রিয়েটর প্ল্যাটফর্ম থেকে বিদায় নেয়। কোভিড-১৯ (2020) সময়ে অনেকেই ডিজিটাল আয়ের পথ খুঁজতে গিয়ে ওনলি-ফ্যানসে আসে, ফলে প্ল্যাটফর্ম দ্রুত বিকশিত হয়।

অ্যাপ স্টোর থেকে দূরে থাকা: অনেক বড় সোশ্যাল অ্যাপ—ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, টিকটক—অ্যাপলের (Apple) অ্যাপ স্টোর ও গুগল প্লে স্টোরে (Google Play Store) আছে। ওনলি-ফ্যানস সেখানে নেই, কারণ অ্যাপলের নীতিমালা (Terms of Service) পূর্ণাঙ্গ পর্নোগ্রাফি সমর্থন করে না। এতে ওনলি-ফ্যানসকে কিছুটা “স্রোতের প্রতিকূলে সাঁতার” কাটতে হচ্ছে (Swimming against the current)। তবে এতে তারা ১৫-৩০% অ্যাপ স্টোর কমিশন দেওয়ার বাধ্যবাধকতা এড়াতে পারছে। ফলে তাদের ৮০-২০ ভাগাভাগির (Split) মডেল বজায় রাখা সহজ হয়েছে। যদি অ্যাপলে থাকত, তাহলে তাদের ২০% এর মধ্যেও আরও ৩০% কেটে নিতে হতো—অর্থাৎ লাভ কমে যেত।

অন্যান্য সোশ্যাল মিডিয়ার ওপর নির্ভরতা: তবে বিশাল ইউজারবেস (User base) ধরে রাখার জন্য ওনলি-ফ্যানস ক্রিয়েটরদের ওপর নির্ভর করে, যারা অন্যান্য সোশ্যাল মিডিয়াতেই নিজেদের প্রচার করে। আপনি যদি একজন নতুন ক্রিয়েটর হন এবং আপনার সোশ্যাল মিডিয়ায় ফলোয়ার না থাকে, তাহলে ওনলি-ফ্যানসে স্রেফ উপস্থিতি দিয়ে খুব একটা সাফল্য মিলবে না। একজন ক্রিয়েটর বলেন, “আপনাকে নিজেই গ্রাহক (Customer) নিয়ে আসতে হবে—মার্কেটিং, কনটেন্ট শেয়ার, ইত্যাদি আপনি করেন, ওনলি-ফ্যানস স্রেফ প্ল্যাটফর্ম দেয়।” অবশ্য ২০২১ সালে ওনলি-ফ্যানস “OFTV” নামে এক নিরাপদ (Safe-for-work) প্ল্যাটফর্ম চালু করে, কিন্তু সেটিও মূলত নিয়মিত কনটেন্টের সহযোগী প্রচার মাধ্যম হিসেবে কাজ করে।

সার্চ ব্যবস্থা কঠিন: ওনলি-ফ্যানসের সার্চ ফিচার (Search function) ইচ্ছাকৃতভাবে সীমিত করা হয়েছে বলে কোম্পানি বলছে। আইনগত সীমার (Legal line) কাছাকাছি থাকতে চায় তারা—অর্থাৎ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ কনটেন্ট না রেখে, বরং নিরাপদ দূরত্বে থাকতে। “Yoga” সার্চ করলে দেখা যাবে, খুব সামান্য ফলাফল পাওয়া যায়, অ্যালগরিদমিক সাজেশন নেই। হোমপেজে (Homepage) বা সাজেস্টেড অ্যাকাউন্টে (Suggested accounts) সবচেয়ে জনপ্রিয় অ্যাকাউন্টগুলো দেখা যায়, কিন্তু ব্যক্তিগত ডেটা বা ব্যবহার অনুসারে কাস্টমাইজ করা হয় না।

মাইক্রো-লেনদেন (Microtransactions) ও সবকিছুর থেকে আয়

সাবস্ক্রিপশন ছাড়াও এককালীন কেনাকাটা (One-off Purchases) বাড়ছে: ওনলি-ফ্যানস এখন শুধু মাসিক সাবস্ক্রিপশন (Monthly subscription) থেকেই বেশি আয় করছে না; তাদের অনেকটাই আসে পে-পার-ভিউ ম্যাসেজ (Pay-per-view messaging), টিপ (Tips), পেইড ডাইরেক্ট ম্যাসেজ (Paid direct messaging), পেইড লাইভস্ট্রিম (Paid livestream), পেইড ভয়েস নোট (Paid voice notes) ইত্যাদি থেকে। ২০২৪ সালের চিত্র অনুযায়ী, ওনলি-ফ্যানসের বেশি আয় এমন ছোট ছোট লেনদেনে (Microtransactions) এসেছে। এর অর্থ কী? — গ্রাহকরা সাবস্ক্রিপশন নিলেও, প্রিয় ক্রিয়েটরকে অতিরিক্ত পরিশোধের মাধ্যমে বিশেষ কনটেন্ট বা ব্যক্তিগত বার্তা পেতে রাজি।

কেন মানুষ অর্থ ব্যয় করে?: বেশি পরিমাণ অর্থের পেছনে অনেকে “ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক” (Deeper relationship) বা “আনন্দদায়ক কথোপকথন” কামনা করেন। কেউ কেউ “একাকীত্ব দূর করতেও” (Someone to talk to) ওনলি-ফ্যানসে যান। এই ধরণের সংযোগমূলক সুবিধাই অন্য ফ্রি পর্নোগ্রাফির চাইতে ওনলি-ফ্যানসের অফারকে আলাদা করে তোলে। ব্যবহারকারীরা সরাসরি মেসেজ/রেসপন্স পান, যা অনেকের কাছে বেশি মূল্যবান।

গড় আয়ের তথ্য (Average Earnings) ও বাস্তবতা: কোম্পানি “গড় ক্রিয়েটরের” আয়ের (Average creator’s earnings) স্পষ্ট কোনও সংখ্যা দেয় না। কিন্তু ফাউন্ডার ও কর্মকর্তারা বলেন, এখানে কেউ কেউ বিশাল পরিমাণ উপার্জন করেন, আবার কেউ সামান্য কিছু, অনেকের মাঝামাঝি। সফল উদাহরণ হতে পারেন কেউ, যিনি আগে শিক্ষকতা করতেন, খাদ্যব্যাংকে (Food bank) সহায়তা নিতেন; পরে ওনলি-ফ্যানসে এসে তিনি “এক মিলিয়ন ডলার” (Million) আয় পার করেছেন। তবে এমন অনেকে আছেন, যাদের আয় সামান্য।

ব্যাংক ও অর্থপ্রদানের চ্যালেঞ্জ

২০২১ সালের অ্যাডাল্ট কন্টেন্ট নিষিদ্ধের চেষ্টা: ২০২১ সালে ওনলি-ফ্যানসের CEO “অ্যাডাল্ট কনটেন্ট” নিষিদ্ধের (Banned adult content) সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, যা কয়েক দিনের মধ্যে আবার ফিরিয়ে নেওয়া হয়। কারণ মূল সমস্যা ছিল, বড় ব্যাংক ও পেমেন্ট প্রসেসরদের (Payment processors) সাথে কাজ করা কঠিন হয়ে পড়েছিল। এর আগে কোম্পানি অনেক দ্রুত বড় হয়েছে, “অতিরিক্ত রাজস্ব” দেখে অনেকে ভয় পেয়েছে। কিছু ব্যাংক “সেক্স ওয়ার্ক” (Sex work) বা প্রাপ্তবয়স্ক কনটেন্ট প্ল্যাটফর্মকে “হাই-রিস্ক” (High-risk) ধরে, তাই তারা উচ্চ ফি বা সেবাই দেয় না। বর্তমান CEO ক্লেইলি (Keily) বলেন, এখন তারা ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছে দেখাতে পেরেছেন যে তাদের “নিরাপত্তা ও নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা” শক্তিশালী। ফলে ধীরে ধীরে তারা আবার সম্পর্ক স্থাপন করতে পারছেন।

কেন উচ্চ ঝুঁকি?: পেমেন্ট প্রসেসররা বলে, প্রাপ্তবয়স্ক বাণিজ্যে “বাধ্যতামূলক ছলে প্রতারণা,” “রিফান্ড/চার্জব্যাক” (Chargebacks) বা “আইনি ও নৈতিক ঝুঁকি” থাকে—এসবের জন্য তারা অধিক ফি নেয়। অনেক ক্ষেত্রে ১-৩% এর জায়গায় ১০% পর্যন্ত কেটে নেয়। ওনলি-ফ্যানস একই সঙ্গে বহু পেমেন্ট প্রোভাইডার (Payment provider) ব্যবহার করে বিভিন্ন অঞ্চলে কাজ করতে। আর সাথে সাথে তারা নিশ্চিত করতে চায়, কোনো “অবৈধ কনটেন্ট” (Illegal content) যেন না থাকে। “আইনি সামগ্রী” (Legal) রাখার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ কোম্পানি সরাসরি নগদ লেনদেনে যুক্ত।

বয়স যাচাই (Age Verification) ও নিরাপত্তা

ওনলি-ফ্যানসে ক্রিয়েটর (Creator) হতে চাইলে ৯টি প্রমাণপত্র (ID) জমা দিয়ে প্রমাণ করতে হয় যে আপনি ১৮ বছরের ওপরে। কিন্তু দর্শকের (Viewer) জন্য অনেকটা সহজ।

ইমেইল ঠিকানা ও পেমেন্ট পদ্ধতি (Payment method) দিলেই অ্যাকাউন্ট তৈরি করা যায়। পরে স্বয়ংক্রিয়ভাবে মুখ স্ক্যান (Face scan) করতে হয়, যা শুধুমাত্র যাচাই করে আপনি কি ১৮ বছরের ওপর? — তারপর তাৎক্ষণিকভাবেই এক্সপ্লিসিট (Explicit) কনটেন্টে প্রবেশ।

বলা হয়, প্রত্যেকটি কনটেন্ট স্বয়ংক্রিয় ও মানুষ (Automated + human) দ্বারা পরীক্ষা করা হয়। তবে ভুল বা ফাঁক থেকে যেতেই পারে। যুক্তরাজ্যের (UK) নিয়ন্ত্রক সংস্থা ওনলি-ফ্যানসের এই মুখ স্ক্যান পদ্ধতি যথেষ্ট কি না, তা নিয়ে তদন্ত করছে।

অন্যান্য ধাঁচের ক্রিয়েটর ও ভবিষ্যৎ

প্রাপ্তবয়স্ক কনটেন্ট ছাড়াও: ওনলি-ফ্যানস নিজেকে শুধু “এডাল্ট” প্ল্যাটফর্ম নয়, বরং সাধারণ ক্রিয়েটর ইকোনমির (Creator economy) অংশ বলে চিহ্নিত করছে, যার বাজার ২৫০ বিলিয়ন ডলারের বেশি। এখন সেখানে খেলোয়াড়, কৌতুকশিল্পী (Athletes, comedians), ইত্যাদি সবাই যুক্ত হতে পারে। সিইও কেলি (CEO Keily) বলেন, “আমি চাই সবধরণের ক্রিয়েটর ওনলি-ফ্যানসে আসুক। আমাদের গল্পটা যেন এখানে একটা বড় বিজনেস সাকসেস।” রাইটার্স, গেমার, শেফ—যারাই ব্যক্তিগত পেইড কনটেন্ট বিক্রি করতে চান, তাদের জন্য ওনলি-ফ্যানস পথ খুলে দিতে চায়।

ব্যবসায়িক সাফল্য: “কিছুটা নোংরা” হলেও সত্য?:

কিছু সমালোচক বলছেন, ওনলি-ফ্যানস একধরনের “কুসংস্কার ভাঙার” (They treat business, not dirty) শক্তি দেখিয়েছে—তারা ব্যবসাটা দেখছে একেবারে মূল ধারার মতো, “নোংরা” নয়, বরং আইনি ও স্বচ্ছ উপায়ে। অন্যরা বলছেন, অন্য কেউ যেন ওনলি-ফ্যানসের মতন সেবা টেকওভার করতে পারছে না। কারণ এই আঙ্গিকে এই ব্যবসা “কঠিন” কিন্তু ওনলি-ফ্যানস তুলনামূলক সফল।

অ্যাপ স্টোর এড়িয়ে ৬.৬ বিলিয়ন ডলার

ওনলি-ফ্যানসের বলছে, “আমরা না থাকলে অনেক এডাল্ট কনটেন্ট নির্মাতাই মূল্যবান আয়ের পথ হারাতেন। আমরা ২০ বিলিয়ন ডলার (20 billion) ইতোমধ্যে ক্রিয়েটরদের পরিশোধ করেছি।” তাদের গ্রাহক ৩০ কোটি এর বেশি, ক্রিয়েটর ৪০ লাখ। অ্যাপ স্টোর বা প্লে স্টোর এড়িয়ে তারা ৮০-২০ ভাগাভাগি বজায় রাখতে পারছে, যা ক্রিয়েটরদের কাছে আকর্ষণীয়। একইসাথে, অন্য সোশ্যাল প্ল্যাটফর্ম (টুইটার, টিকটক) ব্যবহার করে ক্রিয়েটররা ওনলি-ফ্যানসের গ্রাহক টেনে আনেন। কাজেই, ওনলি-ফ্যানস অন্যদিকে এসইও (SEO) বা ইন্টারনাল সার্চের দক্ষতা কম রেখেছে, যেন অ্যাপ স্টোরের বিধিনিষেধ বা আইনগত জটিলতা এড়িয়ে চলতে পারে।

স্পষ্ট অবস্থান—“অ্যাডাল্ট কন্টেন্ট নিষিদ্ধ নয়”

২০২১ সালে সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য প্রাপ্তবয়স্ক কনটেন্ট নিষিদ্ধের (Adult content ban) ঘোষণা নিয়ে বিতর্ক হলেও, ওনলি-ফ্যানস আবার তা ফিরিয়ে নিয়েছে। তারা নিশ্চিত করেছে, “আমরা অ্যাডাল্ট কনটেন্ট নিষিদ্ধ করছি না।” একটি বড় চ্যালেঞ্জ হলো ব্যাংক ও পেমেন্ট প্রসেসরদের সাথে সম্পর্ক, যারা “উচ্চ ঝুঁকি” বিবেচনায় ফি বা সেবা প্রদানে সমস্যা তৈরী করে। কিন্তু ওনলি-ফ্যানস দাবি করে, তাদের সিকিউরিটি ও ঝুঁকি-নিয়ন্ত্রণ উচ্চমাত্রার, তাই ধীরে ধীরে অনেকে তাদের পরিষেবা দিচ্ছে। এক আইনি বিশেষজ্ঞের ভাষায়, “আপনি যখন সরাসরি পর্নোগ্রাফির অর্থের সঙ্গে যুক্ত, তখন আপনাকে নিশ্চিত করতে হবে সবকিছু বৈধ ও নিরাপদ; নইলে বিরাট ঝুঁকি।”

বৃহত্তর ক্রিয়েটর অর্থনীতি ও ভবিষ্যতের পরিকল্পনা

ক্রীড়াবিদ থেকে গায়ক, সকলের জন্য:

এখন ওনলি-ফ্যানস শুধু প্রাপ্তবয়স্ক বিষয় না, বরং খেলোয়াড়, গায়ক, কমেডিয়ান—সবার জন্য “সাবস্ক্রিপশন পদ্ধতি” অফার করছে। ২৫০ বিলিয়ন ডলারের বৃহত্তর ক্রিয়েটর ইকোনমিতে (Creator economy) তারা নিজেদের অন্যতম বড় প্লেয়ার করতে চায়। যদিও একসময় কেউ ভাবত, এটি “এডাল্ট” মুখ্য প্ল্যাটফর্ম; এখন তারা ইঙ্গিত দিচ্ছে, ভবিষ্যতে আরও বহুমুখী কনটেন্ট আসবে। একই সঙ্গে ফ্যানেরা “প্রিয় তারকা” বা “সেলিব্রিটি”-কে সরাসরি অর্থ দিয়ে যোগাযোগ বা এক্সক্লুসিভ কনটেন্ট পাবেন।

“ব্যবসায়িক সাফল্যের গল্প”:

CEO কেলি বলেছেন, “আমি চাই সবাই আমাদের ব্যবসায়িক সাফল্যের গল্পটি চিনুক—এখানে শুধু এডাল্ট কনটেন্ট নয়, বরং নতুন ধাঁচের ডিজিটাল অর্থনীতি।” অনেকে মনে করছেন, ওনলি-ফ্যানস ভবিষ্যতে আরও mainstream হতে পারে, যদিও এডাল্ট কনটেন্ট তাদের মুখ্য চালিকাশক্তি।

উপসংহার

ওনলি-ফ্যানস (OnlyFans) “অ্যাপ স্টোরের বাইরের” (Outside Apple’s App Store) একটি প্ল্যাটফর্ম হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলেছে, যেখানে সরাসরি ভোক্তা-ক্রিয়েটর লেনদেন হয়। পর্নোগ্রাফি বা প্রাপ্তবয়স্ক কনটেন্টকে (Adult content) সশুল্ক পদ্ধতিতে জনপ্রিয় করে তোলার জন্য তারা অন্যতম অগ্রগামী কোম্পানি।

তবে তাদের সাফল্যের পেছনে রয়েছে—

  1. স্বতন্ত্র ব্যবসায়িক মডেল (Distinct business model): বিজ্ঞাপন নয়, বরং সরাসরি সাবস্ক্রিপশন, পে-পার-ভিউ, টিপ ইত্যাদি থেকে অর্জিত আয়।
  2. অ্যাপ স্টোর এড়িয়ে স্বাধীনতা (Avoiding app stores): অ্যাপলের ৩০% চার্জ থেকে মুক্ত থেকে তারা ৮০-২০ ভাগাভাগি মডেল বজায় রাখতে পেরেছে।
  3. উচ্চঝুঁকি যৌনসামগ্রী থেকে আইনি নিরাপত্তা (Legal compliance for adult content): যেখানে ব্যাংক ও পেমেন্ট প্রসেসরের সাথে ভাল সম্পর্ক রক্ষায় নিরাপত্তা ও যাচাই (ID verification, monitoring) ব্যবস্থায় বড় বিনিয়োগ।
  4. সাবস্ক্রিপশন + মাইক্রো-লেনদেন (Subscription + microtransactions): মানুষের “ঘনিষ্ঠ সংযোগ” চাহিদা মেটানোর মাধ্যমে উচ্চ পরিমাণ আয়।
  5. নতুন বৈচিত্র্যময় কনটেন্ট (Diversification): ক্রীড়া অনুষ্ঠান, মিউজিশিয়ান, অন্যান্য স্রষ্টা যুক্ত হতে পারে—এতে ভবিষ্যতে “সেক্স ওয়ার্ক” ছাড়াও অন্যান্য কনটেন্টের বাজার পাকা হবে।

ব্যবসায়িকভাবে ওনলি-ফ্যানস ইতিমধ্যে বিশাল সাফল্য দেখিয়েছে—২০২৩ সালে ৬.৬ বিলিয়ন ডলার (6.6 Billion) আয়। ২০২৪-এর পরিস্থিতিতে তারা আরও বিস্তারে যাচ্ছে। এর মধ্যে কোনো “নোংরা” লেবেল থাকার পরও, বাস্তবে এটিকে “প্রযুক্তি-ভিত্তিক পরিসেবার উদ্ভাবনী মডেল” হিসেবে দেখা যায়। “Apple বা Google প্লে স্টোরে না থেকেও কিভাবে এই বিশাল অর্থ অর্জন?”—উত্তর হলো, ওনলি-ফ্যানস নিজের পথ বেছে নিয়েছে: সরাসরি ওয়েবসাইট, নিজস্ব পেমেন্ট সিস্টেম, ক্রিয়েটরদের অন্যান্য সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচার করার স্বাধীনতা। তারাই দেখিয়ে দিয়েছে, “এডাল্ট” বা যেকোনো প্রাইভেট কনটেন্ট ফ্রি পদ্ধতিকে পাল্টে দেওয়া সম্ভব, যদি একজন ক্রিয়েটর ও দর্শকের মাঝে সরাসরি সংযোগের মানসিকতা গড়ে তোলা যায়। শেষমেশ, বৃহত্তর “ক্রিয়েটর ইকোনমি”র এক উল্লেখযোগ্য অংশ এখন ওনলি-ফ্যানসের নেতৃত্বে পরিচালিত হচ্ছে।

সাবস্ক্রাইবারেরা বারবার চিৎকার করে বললেও, “গুগল প্লে বা অ্যাপ স্টোরে চলে আসুন”—ওনলি-ফ্যানসের CEO ও মালিকপক্ষ এটিতে ইচ্ছাকৃত আগ্রহ দেখায় না। এভাবেই তারা এ খাতের অন্যান্য প্রতিদ্বন্দ্বী থেকে বিভিন্নতর রয়ে গেছে, এবং গ্রাহকদের কাস্টমাইজড অভিজ্ঞতার (Custom experience) জন্য ফি নেওয়া চালিয়ে যাচ্ছে। সব মিলিয়ে, “ওনলি-ফ্যানস কি কেবলই এডাল্ট কনটেন্টের জন্য?”—অংশত হ্যাঁ, তবে এটি যে ডিজিটাল জগতে বড় মাত্রায় কমার্স (Commerce) পরিবর্তন করে দিয়েছে, তাতে সন্দেহ নেই। বড় বিনিয়োগকারী ও সোশ্যাল প্ল্যাটফর্মগুলোও এখন সাবস্ক্রিপশন পদ্ধতি আনছে, তবে ওনলি-ফ্যানস এরই মধ্যে বিপুল ধন-সম্পদ ও লয়্যাল ক্রিয়েটর-ভিত্তি গড়ে তুলেছে। সেইসাথে তারা আরও “মূলধারায়” প্রবেশের চেষ্টা করছে—যেমন: ক্রীড়াবিদ, সংগীতশিল্পী, মডেল ইত্যাদির জন্য ব্যবহৃত হতে।

শীঘ্রই যদি কোনো বড় স্ক্যান্ডাল বা আইনি বাধা না আসে, তাহলে ওনলি-ফ্যানস তার অনন্য পদ্ধতিতে ডিজিটাল কনটেন্ট বাজারে “সেচুরেটেড” হতে পারবে—এবং অ্যাপলের ৩০% ছাড়াই, অত্যধিক লাভ ধরে রাখবে। এভাবেই ওনলি-ফ্যানস সম্ভবত অনেকদিন “শীর্ষ সাবস্ক্রিপশন-কেন্দ্রিক” প্ল্যাটফর্ম হিসেবে টিকে থাকবে।

ওয়ারেন বাফেটের টেজারি বিল (২৮ ডিসেম্বর, ২০২৪)

গত গ্রীষ্মে খবর এলো যে, ওয়ারেন বাফেটের বার্কশায়ার হ্যাথাওয়ে (Berkshire Hathaway) বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভের (Federal Reserve) চেয়েও বেশি ট্রেজারি বিল (T-Bills) হাতে রেখেছে। এটি মূলত ইঙ্গিত দেয় যে বাফেট তার লগ্নি পোর্টফোলিওতে বিপুল পরিমাণ নগদ (cash) জমিয়ে রাখছেন এবং সম্ভবত শেয়ারবাজার নিয়ে কিছুটা সংশয়ে আছেন। জুনের শেষে, বার্কশায়ার ২৩৪ বিলিয়ন ডলারের ট্রেজারি বিল ধারণ করছিল, যেখানে ফেডের হাতে ছিল ১৯৫ বিলিয়ন ডলারের বিল।

এই অঙ্ক ব্রাজিল, মেক্সিকো ও জার্মানিসহ একাধিক দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চেয়ে বেশি। পাশাপাশি বার্কশায়ারের মোট নগদ মজুত ৩২৫ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে—যা দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ মূল্যবান পাবলিক কোম্পানিগুলোর (public companies) মধ্যে ২৫টির বাইরে বাকি সবকটিকেই কিনে ফেলা যায়, যেমন গোল্ডম্যান স্যাশ (Goldman Sachs), ডিজনি (Disney), ফাইজার (Pfizer), বা এটিঅ্যান্ডটি (AT&T)।

অন্যদিকে, এ বছর বাফেট তার দুইটি উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগ—অ্যাপল (Apple) ও ব্যাংক অব আমেরিকার (Bank of America)—শেয়ার আংশিক বিক্রি করেছেন। অনেকেই ভাবছেন, বাফেট এমন কী দেখছেন যা আমরা দেখতে পাচ্ছি না?

উল্লেখযোগ্য আরেকটি তথ্য হলো, বার্কশায়ার হ্যাথাওয়ের হাতে এখন যে পরিমাণ নগদ আছে, তা ১০ বছর আগের বার্কশায়ার হ্যাথাওয়ের মোট বাজারমূল্যের (market value) চেয়েও বেশি! কেউ কেউ মজা করে বলছেন—চীনা শর্ট-ভিডিও প্ল্যাটফর্ম টিকটক (TikTok) কিনে নেওয়ার মতো আর্থিক সামর্থ্যও তার রয়েছে, যদিও সেটি তার বিনিয়োগধারার সঙ্গে যায় কি না, সে প্রশ্ন রয়েই যায়।

স্পোর্টস গ্যাম্বলিং (Sports Gambling) ও এর প্রভাব (২৮ ডিসেম্বর, ২০২৪)

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সুপ্রিম কোর্ট ২০১৮ সালে স্পোর্টস বেটিংকে কার্যত বৈধতা দেওয়ার পর থেকেই এই খাত ব্যাপক বিস্তৃত হয়েছে। তবে ২০২৪ সালে প্রকাশিত দুইটি গবেষণা থেকে জানা গেল, এর ফলে ব্যক্তিগত আর্থিক নিরাপত্তার ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।

এক গবেষণা বলছে, যেসব আমেরিকান স্পোর্টস বেটিংয়ে (sports betting) অর্থ ব্যয় করেন, তারা শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থ তুলে নিয়ে বেটিং অ্যাকাউন্টে ঢালছেন। ফলাফল, স্পোর্টস বেটিংয়ে প্রত্যেক ১ ডলার ব্যয়ের বিপরীতে শেয়ারের মতো আর্থিক অ্যাসেটে (financial assets) নিট বিনিয়োগ ২ ডলারেরও বেশি কমে যাচ্ছে।

আরেকটি গবেষণা বলছে, যে সব অঙ্গরাজ্যে (state) স্পোর্টস বেটিং বৈধ, সেখানে মানুষের গড় ক্রেডিট স্কোর (credit score) ০.৩% কমে গেছে। আর অনলাইনে বেটিংয়ের (online sports betting) অনুমতি থাকলে ১% পর্যন্ত পতন হয়েছে।

এত বড় অঙ্কের অর্থ যখন বেটিংয়ে চলে যাচ্ছে, তখন বাজারের সুযোগ-ব্যয় (opportunity cost) বিশাল। পেশাদার জুয়াড়িরা (gamblers) এমনকি আসক্ত (addiction) ব্যক্তিদের অনলাইন আচরণ নকল করে (যেমন: মাঝরাতে অ্যাপে লগইন করা) বেটিং অ্যাপে বাড়তি বোনাস বা স্পেশাল অফার পেতে শুরু করেছিলেন—কারণ অ্যাপ মনে করে, এ ধরনের ব্যবহার বেটিং আসক্ত ব্যক্তির লক্ষণ, যাদের কিছু ‘বিশেষ অফার’ দিলে তারা আরও বেশি খেলবে।

আগামী দিনে এসব বিষয় নিয়ে আইনপ্রণেতারা (lawmakers) কঠোরতর নিয়ন্ত্রণ আনতে পারেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। কারণ, স্পোর্টস গ্যাম্বলিং শিল্প এখন এক বিশাল আকার নিয়েছে। ২০২৪ সালে আমেরিকানরা স্পোর্টস বেটিংয়ে ১৫০ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করার পথে রয়েছে, যা ২০১৮ সালে বৈধতার আগে মোটে ৭ বিলিয়ন ডলারের মতো ছিল। এমনকি ফ্যানডুয়েলের (FanDuel) মালিকানা প্রতিষ্ঠান ফ্লাটার (Flutter) বছরের শুরুতে বাজারমূল্যে (market cap) লাস ভেগাস স্যান্ডসের (Las Vegas Sands) মতো বিশ্বের বৃহত্তম ফিজিক্যাল ক্যাসিনোকেও ছাড়িয়ে গেছে।

বিদ্যুৎচালিত গাড়ি (Electric Vehicles) ও নরওয়ে (২৮ ডিসেম্বর, ২০২৪)

২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে নরওয়ে বিশ্বের প্রথম দেশ হয়ে উঠল, যেখানে রাস্তায় থাকা গাড়ির অর্ধেকেরও বেশি ইলেকট্রিক। দুনিয়ার ইভি (EV) খাতে নরওয়েকে নেতা বলার একটা বড় কারণ হলো—সরকারি নানা প্রণোদনা (government incentives): ইভি মালিকদের বাস লেইন ব্যবহারের সুযোগ, ট্যাক্স ছাড়, ইত্যাদি।

তবে অন্য অনেক দেশে এই রূপান্তর খুব মসৃণ নয়। যুক্তরাষ্ট্রে জেডি পাওয়ার (J.D. Power) আগেই ২০২৪ সালের ইভি-র সেলস অনুমান ১২% থেকে নামিয়ে ৯%-এ এনেছে। কারণ, আগামীতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত ডোনাল্ড ট্রাম্প (President-elect Trump) ৭,৫০০ ডলারের ইভি ট্যাক্স ক্রেডিট (EV tax credit) প্রত্যাহার করবেন বলে জানিয়েছেন। ইউরোপের অন্যান্য দেশেও (নরওয়ে বাদে) ইভি বিক্রি ক্রমহ্রাসমান—শুধু ১৫% বৃদ্ধির লক্ষণ দেখা গেছে।

নরওয়ের বিষয়টি নিঃসন্দেহে অনন্য। দেশটি অনেক ধনী এবং তাদের বেশিরভাগ ইভি-সুবিধা (যেমন ট্যাক্স ছাড়) আসলে তেল-গ্যাস রপ্তানি থেকে আসা রাজস্ব দিয়েই অর্থায়ন করা হয়। লক্ষ্য হলো—গ্যাসচালিত গাড়ি বিক্রির পথ সম্পূর্ণ বন্ধ করা। কিন্তু দুনিয়ার অন্য দেশগুলোর জন্য এটি কতটা বাস্তবসম্মত, সে প্রশ্ন রয়েই যায়।

অন্যদিকে চীন তার বিশাল ভোক্তা বাজার আর সরকারি সহায়তার জোরে দ্রুত ইভি-র দিকে এগোচ্ছে। সেখানে বৃদ্ধির হার প্রায় ৫০%। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে চীনের ইভি রপ্তানি অনেকটাই শুল্ক (tariffs) বা নিষেধাজ্ঞার চাপে রয়েছে। পশ্চিমা গাড়ি নির্মাতারা চীনা কোম্পানিগুলোর সঙ্গে মূলত দাম ও উৎপাদন সক্ষমতার দিক থেকে পিছিয়ে পড়ছে।

কিভাবে ওনলি-ফ্যানস অ্যাপ স্টোর ছাড়াই ৬.৬ বিলিয়ন ডলার আয় করল? (৩১ ডিসেম্বর, ২০২৪)

ভূমিকা

ইন্টারনেটে যৌন-সামগ্রী (Adult content) অনেক দিন ধরেই মানুষের জন্য “ফ্রি” অর্থাৎ বিনামূল্যে পাওয়া গেছে। তবে “ওনলি-ফ্যানস” (OnlyFans) নামের একটি প্ল্যাটফর্ম এই ধারণাটিকে একেবারে পাল্টে দিয়েছে—তারা ব্যবহারকারীদের দিয়ে এই ধরণের কনটেন্টের জন্য টাকা আদায়ে সমর্থ হয়েছে এবং অভাবনীয় লাভ করেছে। মাত্র কয়েক বছরে তাদের রাজস্ব (Revenue) ২০০০%-এরও বেশি বেড়েছে, ২০২৩ সালে ৬.৬ বিলিয়ন ডলার আয় করেছে।

শুরুতে অনেকের ভাবনা ছিল, পুরনো পদ্ধতিতে যেসব ওয়েবসাইট বিনামূল্যে “এডাল্ট কনটেন্ট” সরবরাহ করে, তাদের সঙ্গেই ওনলি-ফ্যানসের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হবে। অথচ ওনলি-ফ্যানস সামগ্রিকভাবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের (Social media platform) মতো দেখালেও, এর আড়ালে ভিন্ন এক ব্যবসায়িক কাঠামো (Business model) কাজ করে।

তারা অ্যাপলের (Apple) অ্যাপ স্টোরে নেই, গুগলের (Google) প্লে স্টোরেও নয়—যা মূলধারার বেশিরভাগ অ্যাপ প্ল্যাটফর্মের জন্য অত্যাবশ্যক। তা সত্ত্বেও, তারা কীভাবে বিপুল পরিমাণ অর্থ আয় করছে? কী তাদের মূলমন্ত্র? এই নিবন্ধে আমরা খুঁটিনাটি দেখব—কেন ওনলি-ফ্যানস ইতালির কোনো দোকান বা অন্যকিছু নয়, বরং ডিজিটাল মার্কেটে এক আধিপত্যশীল প্রবেশদ্বার হতে পেরেছে।

ব্যবসায়িক মডেলের (Business Model) ভিন্নতা

ফ্রি কনটেন্টের যুগে সশুল্ক (Paywall) প্রতিষ্ঠা: অনেক কোম্পানি চেষ্টা করেছে “ইন্টারনেটে নগ্নতা বা যৌন বিষয়” (Being naked online) থেকে অর্থ উপার্জন করার। অনেক ক্ষেত্রে দর্শক অভ্যস্ত “ফ্রি” পর্নোগ্রাফি (Pornography) বা বিনামূল্যের কনটেন্টে। ওনলি-ফ্যানস এই ধারনায় ছেদ এনেছে।

  • “ফ্রি”-র বদলে গ্রাহক (Subscriber) সরাসরি কনটেন্ট নির্মাতাকে (Creator) অর্থ প্রদান করে।
  • এটি “সোশ্যাল মিডিয়া”র মতো দেখালেও সব টাকা আসে মূলত সাবস্ক্রিপশন ও কাস্টম-সামগ্রী থেকে, বিজ্ঞাপন (Advertisement) নয়।
  • ওনলি-ফ্যানসের CEO বা শীর্ষ কর্মকর্তারা বলে থাকেন, “আমরা তখনই উপার্জন করি, যখন ক্রিয়েটর উপার্জন করে” (We only make money when creators make money)।

সরাসরি আয় ও রাজস্ব ভাগাভাগি (Direct Payment & Revenue Share): ক্রিয়েটর (Creator) তাদের ফ্যানদের কাছে মাসিক ৫০ ডলার (50$) পর্যন্ত সাবস্ক্রিপশন ফি ধার্য করতে পারেন। এর ২০% ওনলি-ফ্যানস রাখে, বাকি ৮০% পান ক্রিয়েটর। এটি অন্যান্য সোশ্যাল প্ল্যাটফর্মে প্রচলিত কঠিন নিয়মের (যেমন: নির্দিষ্ট সাবস্ক্রাইবার বা ভিউ এর মাইলস্টোন পেরোতে হবে) চেয়ে সহজতর। ৪ বছরে ওনলি-ফ্যানসের (OnlyFans) রাজস্ব ২০০০%+ বেড়েছে। ২০২৩ সালে তারা ৬.৬ বিলিয়ন ডলার আয় করে। এদিকে অন্যান্য সোশ্যাল মিডিয়া কোম্পানি যেমন ফেসবুক (Facebook) বা ইনস্টাগ্রাম (Instagram) প্রধানত বিজ্ঞাপন থেকেই (Advertising) টাকা উপার্জন করে। ওনলি-ফ্যানস বেশ কৌশলী। তারা সবকিছু সোজাসুজি ফ্যান ও ক্রিয়েটরের মাঝে আর্থিক লেনদেনের (Financial transaction) মাধ্যমে চালায়। যেহেতু এটি কাজ করছে, অন্য প্ল্যাটফর্মগুলো—যেমন টুইটার (Twitter/X), ইনস্টাগ্রাম—এখন সাবস্ক্রিপশন ফিচার আনছে। কিন্তু ওনলি-ফ্যানসের মতে, সাবস্ক্রিপশন শুধু পুরো মডেলের একটা খণ্ডমাত্র; এর বাইরে রয়েছে “পে-পার-ভিউ” (Pay-per-view), টিপ (Tip), কাস্টম ম্যাসেজ (Custom messaging) ইত্যাদি।

লোকের ভুল ধারণা: “শুধু নগ্ন ছবি দিলেই টাকা আসবে?”: কিছু মানুষ ভাবে, ওনলি-ফ্যানসে “কিছু সেক্সি পোশাকে ছবি দিলেই” (Taking some sexy pictures in lingerie) অঢেল টাকা আসবে। কিন্তু আসলে এটি অনেক জটিল। একজন সফল ক্রিয়েটরকে অনেক খাটতে হয়—নিয়মিত কনটেন্ট তৈরি, ফ্যানদের সঙ্গে বার্তা বিনিময়, সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচার (Promotion), বিপণন (Marketing), ইত্যাদি। একজন প্রতিষ্ঠিত ক্রিয়েটর যেমন Louise বলেছেন, “অনেক কাজ—আমি যদি কনটেন্ট তৈরি না করি, তখন আমি মেসেজিং করছি, মার্কেটিং করছি। ভাগ্যিস আধা ঘণ্টা টিভি দেখতে পারি।”

ওনলি-ফ্যানসের সূচনা ও অনন্য লাইসেন্সিং কৌশল

প্রতিষ্ঠা ও সোশ্যাল মিডিয়া থেকে ভিন্নতা: ২০১৬ সালে ওনলি-ফ্যানস চালু হয়। আগে যেমন Patreon, কেনিয়ান (Kenyans?), ইত্যাদি প্ল্যাটফর্ম ছিল, যারা ফ্যানদের কাছ থেকে সমর্থন নিতে দিত, ওনলি-ফ্যানস সেটিকে আরও নিখুঁতভাবে “এডাল্ট কনটেন্ট” (Adult content) সমর্থনের দিকে নিয়ে যায়। একটি বড় পার্থক্য হলো—ফেসবুক, ইউটিউব বা ইনস্টাগ্রামের মতো যেখানে বিজ্ঞাপন প্রধান, সেখানে ওনলি-ফ্যানস আয় করে সরাসরি ফ্যানদের থেকে, কোনো বিজ্ঞাপন নেই। ২০১৮ সালের দিকে টাম্বলর (Tumblr) প্রাপ্তবয়স্ক কনটেন্ট নিষিদ্ধ করে, ফলে অনেক ক্রিয়েটর প্ল্যাটফর্ম থেকে বিদায় নেয়। কোভিড-১৯ (2020) সময়ে অনেকেই ডিজিটাল আয়ের পথ খুঁজতে গিয়ে ওনলি-ফ্যানসে আসে, ফলে প্ল্যাটফর্ম দ্রুত বিকশিত হয়।

অ্যাপ স্টোর থেকে দূরে থাকা: অনেক বড় সোশ্যাল অ্যাপ—ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, টিকটক—অ্যাপলের (Apple) অ্যাপ স্টোর ও গুগল প্লে স্টোরে (Google Play Store) আছে। ওনলি-ফ্যানস সেখানে নেই, কারণ অ্যাপলের নীতিমালা (Terms of Service) পূর্ণাঙ্গ পর্নোগ্রাফি সমর্থন করে না। এতে ওনলি-ফ্যানসকে কিছুটা “স্রোতের প্রতিকূলে সাঁতার” কাটতে হচ্ছে (Swimming against the current)। তবে এতে তারা ১৫-৩০% অ্যাপ স্টোর কমিশন দেওয়ার বাধ্যবাধকতা এড়াতে পারছে। ফলে তাদের ৮০-২০ ভাগাভাগির (Split) মডেল বজায় রাখা সহজ হয়েছে। যদি অ্যাপলে থাকত, তাহলে তাদের ২০% এর মধ্যেও আরও ৩০% কেটে নিতে হতো—অর্থাৎ লাভ কমে যেত।

অন্যান্য সোশ্যাল মিডিয়ার ওপর নির্ভরতা: তবে বিশাল ইউজারবেস (User base) ধরে রাখার জন্য ওনলি-ফ্যানস ক্রিয়েটরদের ওপর নির্ভর করে, যারা অন্যান্য সোশ্যাল মিডিয়াতেই নিজেদের প্রচার করে। আপনি যদি একজন নতুন ক্রিয়েটর হন এবং আপনার সোশ্যাল মিডিয়ায় ফলোয়ার না থাকে, তাহলে ওনলি-ফ্যানসে স্রেফ উপস্থিতি দিয়ে খুব একটা সাফল্য মিলবে না। একজন ক্রিয়েটর বলেন, “আপনাকে নিজেই গ্রাহক (Customer) নিয়ে আসতে হবে—মার্কেটিং, কনটেন্ট শেয়ার, ইত্যাদি আপনি করেন, ওনলি-ফ্যানস স্রেফ প্ল্যাটফর্ম দেয়।” অবশ্য ২০২১ সালে ওনলি-ফ্যানস “OFTV” নামে এক নিরাপদ (Safe-for-work) প্ল্যাটফর্ম চালু করে, কিন্তু সেটিও মূলত নিয়মিত কনটেন্টের সহযোগী প্রচার মাধ্যম হিসেবে কাজ করে।

সার্চ ব্যবস্থা কঠিন: ওনলি-ফ্যানসের সার্চ ফিচার (Search function) ইচ্ছাকৃতভাবে সীমিত করা হয়েছে বলে কোম্পানি বলছে। আইনগত সীমার (Legal line) কাছাকাছি থাকতে চায় তারা—অর্থাৎ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ কনটেন্ট না রেখে, বরং নিরাপদ দূরত্বে থাকতে। “Yoga” সার্চ করলে দেখা যাবে, খুব সামান্য ফলাফল পাওয়া যায়, অ্যালগরিদমিক সাজেশন নেই। হোমপেজে (Homepage) বা সাজেস্টেড অ্যাকাউন্টে (Suggested accounts) সবচেয়ে জনপ্রিয় অ্যাকাউন্টগুলো দেখা যায়, কিন্তু ব্যক্তিগত ডেটা বা ব্যবহার অনুসারে কাস্টমাইজ করা হয় না।

মাইক্রো-লেনদেন (Microtransactions) ও সবকিছুর থেকে আয়

সাবস্ক্রিপশন ছাড়াও এককালীন কেনাকাটা (One-off Purchases) বাড়ছে: ওনলি-ফ্যানস এখন শুধু মাসিক সাবস্ক্রিপশন (Monthly subscription) থেকেই বেশি আয় করছে না; তাদের অনেকটাই আসে পে-পার-ভিউ ম্যাসেজ (Pay-per-view messaging), টিপ (Tips), পেইড ডাইরেক্ট ম্যাসেজ (Paid direct messaging), পেইড লাইভস্ট্রিম (Paid livestream), পেইড ভয়েস নোট (Paid voice notes) ইত্যাদি থেকে। ২০২৪ সালের চিত্র অনুযায়ী, ওনলি-ফ্যানসের বেশি আয় এমন ছোট ছোট লেনদেনে (Microtransactions) এসেছে। এর অর্থ কী? — গ্রাহকরা সাবস্ক্রিপশন নিলেও, প্রিয় ক্রিয়েটরকে অতিরিক্ত পরিশোধের মাধ্যমে বিশেষ কনটেন্ট বা ব্যক্তিগত বার্তা পেতে রাজি।

কেন মানুষ অর্থ ব্যয় করে?: বেশি পরিমাণ অর্থের পেছনে অনেকে “ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক” (Deeper relationship) বা “আনন্দদায়ক কথোপকথন” কামনা করেন। কেউ কেউ “একাকীত্ব দূর করতেও” (Someone to talk to) ওনলি-ফ্যানসে যান। এই ধরণের সংযোগমূলক সুবিধাই অন্য ফ্রি পর্নোগ্রাফির চাইতে ওনলি-ফ্যানসের অফারকে আলাদা করে তোলে। ব্যবহারকারীরা সরাসরি মেসেজ/রেসপন্স পান, যা অনেকের কাছে বেশি মূল্যবান।

গড় আয়ের তথ্য (Average Earnings) ও বাস্তবতা: কোম্পানি “গড় ক্রিয়েটরের” আয়ের (Average creator’s earnings) স্পষ্ট কোনও সংখ্যা দেয় না। কিন্তু ফাউন্ডার ও কর্মকর্তারা বলেন, এখানে কেউ কেউ বিশাল পরিমাণ উপার্জন করেন, আবার কেউ সামান্য কিছু, অনেকের মাঝামাঝি। সফল উদাহরণ হতে পারেন কেউ, যিনি আগে শিক্ষকতা করতেন, খাদ্যব্যাংকে (Food bank) সহায়তা নিতেন; পরে ওনলি-ফ্যানসে এসে তিনি “এক মিলিয়ন ডলার” (Million) আয় পার করেছেন। তবে এমন অনেকে আছেন, যাদের আয় সামান্য।

ব্যাংক ও অর্থপ্রদানের চ্যালেঞ্জ

২০২১ সালের অ্যাডাল্ট কন্টেন্ট নিষিদ্ধের চেষ্টা: ২০২১ সালে ওনলি-ফ্যানসের CEO “অ্যাডাল্ট কনটেন্ট” নিষিদ্ধের (Banned adult content) সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, যা কয়েক দিনের মধ্যে আবার ফিরিয়ে নেওয়া হয়। কারণ মূল সমস্যা ছিল, বড় ব্যাংক ও পেমেন্ট প্রসেসরদের (Payment processors) সাথে কাজ করা কঠিন হয়ে পড়েছিল। এর আগে কোম্পানি অনেক দ্রুত বড় হয়েছে, “অতিরিক্ত রাজস্ব” দেখে অনেকে ভয় পেয়েছে। কিছু ব্যাংক “সেক্স ওয়ার্ক” (Sex work) বা প্রাপ্তবয়স্ক কনটেন্ট প্ল্যাটফর্মকে “হাই-রিস্ক” (High-risk) ধরে, তাই তারা উচ্চ ফি বা সেবাই দেয় না। বর্তমান CEO ক্লেইলি (Keily) বলেন, এখন তারা ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছে দেখাতে পেরেছেন যে তাদের “নিরাপত্তা ও নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা” শক্তিশালী। ফলে ধীরে ধীরে তারা আবার সম্পর্ক স্থাপন করতে পারছেন।

কেন উচ্চ ঝুঁকি?: পেমেন্ট প্রসেসররা বলে, প্রাপ্তবয়স্ক বাণিজ্যে “বাধ্যতামূলক ছলে প্রতারণা,” “রিফান্ড/চার্জব্যাক” (Chargebacks) বা “আইনি ও নৈতিক ঝুঁকি” থাকে—এসবের জন্য তারা অধিক ফি নেয়। অনেক ক্ষেত্রে ১-৩% এর জায়গায় ১০% পর্যন্ত কেটে নেয়। ওনলি-ফ্যানস একই সঙ্গে বহু পেমেন্ট প্রোভাইডার (Payment provider) ব্যবহার করে বিভিন্ন অঞ্চলে কাজ করতে। আর সাথে সাথে তারা নিশ্চিত করতে চায়, কোনো “অবৈধ কনটেন্ট” (Illegal content) যেন না থাকে। “আইনি সামগ্রী” (Legal) রাখার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ কোম্পানি সরাসরি নগদ লেনদেনে যুক্ত।

বয়স যাচাই (Age Verification) ও নিরাপত্তা

ওনলি-ফ্যানসে ক্রিয়েটর (Creator) হতে চাইলে ৯টি প্রমাণপত্র (ID) জমা দিয়ে প্রমাণ করতে হয় যে আপনি ১৮ বছরের ওপরে। কিন্তু দর্শকের (Viewer) জন্য অনেকটা সহজ।

ইমেইল ঠিকানা ও পেমেন্ট পদ্ধতি (Payment method) দিলেই অ্যাকাউন্ট তৈরি করা যায়। পরে স্বয়ংক্রিয়ভাবে মুখ স্ক্যান (Face scan) করতে হয়, যা শুধুমাত্র যাচাই করে আপনি কি ১৮ বছরের ওপর? — তারপর তাৎক্ষণিকভাবেই এক্সপ্লিসিট (Explicit) কনটেন্টে প্রবেশ।

বলা হয়, প্রত্যেকটি কনটেন্ট স্বয়ংক্রিয় ও মানুষ (Automated + human) দ্বারা পরীক্ষা করা হয়। তবে ভুল বা ফাঁক থেকে যেতেই পারে। যুক্তরাজ্যের (UK) নিয়ন্ত্রক সংস্থা ওনলি-ফ্যানসের এই মুখ স্ক্যান পদ্ধতি যথেষ্ট কি না, তা নিয়ে তদন্ত করছে।

অন্যান্য ধাঁচের ক্রিয়েটর ও ভবিষ্যৎ

প্রাপ্তবয়স্ক কনটেন্ট ছাড়াও: ওনলি-ফ্যানস নিজেকে শুধু “এডাল্ট” প্ল্যাটফর্ম নয়, বরং সাধারণ ক্রিয়েটর ইকোনমির (Creator economy) অংশ বলে চিহ্নিত করছে, যার বাজার ২৫০ বিলিয়ন ডলারের বেশি। এখন সেখানে খেলোয়াড়, কৌতুকশিল্পী (Athletes, comedians), ইত্যাদি সবাই যুক্ত হতে পারে। সিইও কেলি (CEO Keily) বলেন, “আমি চাই সবধরণের ক্রিয়েটর ওনলি-ফ্যানসে আসুক। আমাদের গল্পটা যেন এখানে একটা বড় বিজনেস সাকসেস।” রাইটার্স, গেমার, শেফ—যারাই ব্যক্তিগত পেইড কনটেন্ট বিক্রি করতে চান, তাদের জন্য ওনলি-ফ্যানস পথ খুলে দিতে চায়।

ব্যবসায়িক সাফল্য: “কিছুটা নোংরা” হলেও সত্য?:

কিছু সমালোচক বলছেন, ওনলি-ফ্যানস একধরনের “কুসংস্কার ভাঙার” (They treat business, not dirty) শক্তি দেখিয়েছে—তারা ব্যবসাটা দেখছে একেবারে মূল ধারার মতো, “নোংরা” নয়, বরং আইনি ও স্বচ্ছ উপায়ে। অন্যরা বলছেন, অন্য কেউ যেন ওনলি-ফ্যানসের মতন সেবা টেকওভার করতে পারছে না। কারণ এই আঙ্গিকে এই ব্যবসা “কঠিন” কিন্তু ওনলি-ফ্যানস তুলনামূলক সফল।

অ্যাপ স্টোর এড়িয়ে ৬.৬ বিলিয়ন ডলার

ওনলি-ফ্যানসের বলছে, “আমরা না থাকলে অনেক এডাল্ট কনটেন্ট নির্মাতাই মূল্যবান আয়ের পথ হারাতেন। আমরা ২০ বিলিয়ন ডলার (20 billion) ইতোমধ্যে ক্রিয়েটরদের পরিশোধ করেছি।” তাদের গ্রাহক ৩০ কোটি এর বেশি, ক্রিয়েটর ৪০ লাখ। অ্যাপ স্টোর বা প্লে স্টোর এড়িয়ে তারা ৮০-২০ ভাগাভাগি বজায় রাখতে পারছে, যা ক্রিয়েটরদের কাছে আকর্ষণীয়। একইসাথে, অন্য সোশ্যাল প্ল্যাটফর্ম (টুইটার, টিকটক) ব্যবহার করে ক্রিয়েটররা ওনলি-ফ্যানসের গ্রাহক টেনে আনেন। কাজেই, ওনলি-ফ্যানস অন্যদিকে এসইও (SEO) বা ইন্টারনাল সার্চের দক্ষতা কম রেখেছে, যেন অ্যাপ স্টোরের বিধিনিষেধ বা আইনগত জটিলতা এড়িয়ে চলতে পারে।

স্পষ্ট অবস্থান—“অ্যাডাল্ট কন্টেন্ট নিষিদ্ধ নয়”

২০২১ সালে সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য প্রাপ্তবয়স্ক কনটেন্ট নিষিদ্ধের (Adult content ban) ঘোষণা নিয়ে বিতর্ক হলেও, ওনলি-ফ্যানস আবার তা ফিরিয়ে নিয়েছে। তারা নিশ্চিত করেছে, “আমরা অ্যাডাল্ট কনটেন্ট নিষিদ্ধ করছি না।” একটি বড় চ্যালেঞ্জ হলো ব্যাংক ও পেমেন্ট প্রসেসরদের সাথে সম্পর্ক, যারা “উচ্চ ঝুঁকি” বিবেচনায় ফি বা সেবা প্রদানে সমস্যা তৈরী করে। কিন্তু ওনলি-ফ্যানস দাবি করে, তাদের সিকিউরিটি ও ঝুঁকি-নিয়ন্ত্রণ উচ্চমাত্রার, তাই ধীরে ধীরে অনেকে তাদের পরিষেবা দিচ্ছে। এক আইনি বিশেষজ্ঞের ভাষায়, “আপনি যখন সরাসরি পর্নোগ্রাফির অর্থের সঙ্গে যুক্ত, তখন আপনাকে নিশ্চিত করতে হবে সবকিছু বৈধ ও নিরাপদ; নইলে বিরাট ঝুঁকি।”

বৃহত্তর ক্রিয়েটর অর্থনীতি ও ভবিষ্যতের পরিকল্পনা

ক্রীড়াবিদ থেকে গায়ক, সকলের জন্য:

এখন ওনলি-ফ্যানস শুধু প্রাপ্তবয়স্ক বিষয় না, বরং খেলোয়াড়, গায়ক, কমেডিয়ান—সবার জন্য “সাবস্ক্রিপশন পদ্ধতি” অফার করছে। ২৫০ বিলিয়ন ডলারের বৃহত্তর ক্রিয়েটর ইকোনমিতে (Creator economy) তারা নিজেদের অন্যতম বড় প্লেয়ার করতে চায়। যদিও একসময় কেউ ভাবত, এটি “এডাল্ট” মুখ্য প্ল্যাটফর্ম; এখন তারা ইঙ্গিত দিচ্ছে, ভবিষ্যতে আরও বহুমুখী কনটেন্ট আসবে। একই সঙ্গে ফ্যানেরা “প্রিয় তারকা” বা “সেলিব্রিটি”-কে সরাসরি অর্থ দিয়ে যোগাযোগ বা এক্সক্লুসিভ কনটেন্ট পাবেন।

“ব্যবসায়িক সাফল্যের গল্প”:

CEO কেলি বলেছেন, “আমি চাই সবাই আমাদের ব্যবসায়িক সাফল্যের গল্পটি চিনুক—এখানে শুধু এডাল্ট কনটেন্ট নয়, বরং নতুন ধাঁচের ডিজিটাল অর্থনীতি।” অনেকে মনে করছেন, ওনলি-ফ্যানস ভবিষ্যতে আরও mainstream হতে পারে, যদিও এডাল্ট কনটেন্ট তাদের মুখ্য চালিকাশক্তি।

উপসংহার

ওনলি-ফ্যানস (OnlyFans) “অ্যাপ স্টোরের বাইরের” (Outside Apple’s App Store) একটি প্ল্যাটফর্ম হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলেছে, যেখানে সরাসরি ভোক্তা-ক্রিয়েটর লেনদেন হয়। পর্নোগ্রাফি বা প্রাপ্তবয়স্ক কনটেন্টকে (Adult content) সশুল্ক পদ্ধতিতে জনপ্রিয় করে তোলার জন্য তারা অন্যতম অগ্রগামী কোম্পানি।

তবে তাদের সাফল্যের পেছনে রয়েছে—

  1. স্বতন্ত্র ব্যবসায়িক মডেল (Distinct business model): বিজ্ঞাপন নয়, বরং সরাসরি সাবস্ক্রিপশন, পে-পার-ভিউ, টিপ ইত্যাদি থেকে অর্জিত আয়।
  2. অ্যাপ স্টোর এড়িয়ে স্বাধীনতা (Avoiding app stores): অ্যাপলের ৩০% চার্জ থেকে মুক্ত থেকে তারা ৮০-২০ ভাগাভাগি মডেল বজায় রাখতে পেরেছে।
  3. উচ্চঝুঁকি যৌনসামগ্রী থেকে আইনি নিরাপত্তা (Legal compliance for adult content): যেখানে ব্যাংক ও পেমেন্ট প্রসেসরের সাথে ভাল সম্পর্ক রক্ষায় নিরাপত্তা ও যাচাই (ID verification, monitoring) ব্যবস্থায় বড় বিনিয়োগ।
  4. সাবস্ক্রিপশন + মাইক্রো-লেনদেন (Subscription + microtransactions): মানুষের “ঘনিষ্ঠ সংযোগ” চাহিদা মেটানোর মাধ্যমে উচ্চ পরিমাণ আয়।
  5. নতুন বৈচিত্র্যময় কনটেন্ট (Diversification): ক্রীড়া অনুষ্ঠান, মিউজিশিয়ান, অন্যান্য স্রষ্টা যুক্ত হতে পারে—এতে ভবিষ্যতে “সেক্স ওয়ার্ক” ছাড়াও অন্যান্য কনটেন্টের বাজার পাকা হবে।

ব্যবসায়িকভাবে ওনলি-ফ্যানস ইতিমধ্যে বিশাল সাফল্য দেখিয়েছে—২০২৩ সালে ৬.৬ বিলিয়ন ডলার (6.6 Billion) আয়। ২০২৪-এর পরিস্থিতিতে তারা আরও বিস্তারে যাচ্ছে। এর মধ্যে কোনো “নোংরা” লেবেল থাকার পরও, বাস্তবে এটিকে “প্রযুক্তি-ভিত্তিক পরিসেবার উদ্ভাবনী মডেল” হিসেবে দেখা যায়। “Apple বা Google প্লে স্টোরে না থেকেও কিভাবে এই বিশাল অর্থ অর্জন?”—উত্তর হলো, ওনলি-ফ্যানস নিজের পথ বেছে নিয়েছে: সরাসরি ওয়েবসাইট, নিজস্ব পেমেন্ট সিস্টেম, ক্রিয়েটরদের অন্যান্য সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচার করার স্বাধীনতা। তারাই দেখিয়ে দিয়েছে, “এডাল্ট” বা যেকোনো প্রাইভেট কনটেন্ট ফ্রি পদ্ধতিকে পাল্টে দেওয়া সম্ভব, যদি একজন ক্রিয়েটর ও দর্শকের মাঝে সরাসরি সংযোগের মানসিকতা গড়ে তোলা যায়। শেষমেশ, বৃহত্তর “ক্রিয়েটর ইকোনমি”র এক উল্লেখযোগ্য অংশ এখন ওনলি-ফ্যানসের নেতৃত্বে পরিচালিত হচ্ছে।

সাবস্ক্রাইবারেরা বারবার চিৎকার করে বললেও, “গুগল প্লে বা অ্যাপ স্টোরে চলে আসুন”—ওনলি-ফ্যানসের CEO ও মালিকপক্ষ এটিতে ইচ্ছাকৃত আগ্রহ দেখায় না। এভাবেই তারা এ খাতের অন্যান্য প্রতিদ্বন্দ্বী থেকে বিভিন্নতর রয়ে গেছে, এবং গ্রাহকদের কাস্টমাইজড অভিজ্ঞতার (Custom experience) জন্য ফি নেওয়া চালিয়ে যাচ্ছে। সব মিলিয়ে, “ওনলি-ফ্যানস কি কেবলই এডাল্ট কনটেন্টের জন্য?”—অংশত হ্যাঁ, তবে এটি যে ডিজিটাল জগতে বড় মাত্রায় কমার্স (Commerce) পরিবর্তন করে দিয়েছে, তাতে সন্দেহ নেই। বড় বিনিয়োগকারী ও সোশ্যাল প্ল্যাটফর্মগুলোও এখন সাবস্ক্রিপশন পদ্ধতি আনছে, তবে ওনলি-ফ্যানস এরই মধ্যে বিপুল ধন-সম্পদ ও লয়্যাল ক্রিয়েটর-ভিত্তি গড়ে তুলেছে। সেইসাথে তারা আরও “মূলধারায়” প্রবেশের চেষ্টা করছে—যেমন: ক্রীড়াবিদ, সংগীতশিল্পী, মডেল ইত্যাদির জন্য ব্যবহৃত হতে।

শীঘ্রই যদি কোনো বড় স্ক্যান্ডাল বা আইনি বাধা না আসে, তাহলে ওনলি-ফ্যানস তার অনন্য পদ্ধতিতে ডিজিটাল কনটেন্ট বাজারে “সেচুরেটেড” হতে পারবে—এবং অ্যাপলের ৩০% ছাড়াই, অত্যধিক লাভ ধরে রাখবে। এভাবেই ওনলি-ফ্যানস সম্ভবত অনেকদিন “শীর্ষ সাবস্ক্রিপশন-কেন্দ্রিক” প্ল্যাটফর্ম হিসেবে টিকে থাকবে।

২০২৪ সালের প্রথম চতুর্থাংশে ৬০০’র বেশি সিইও (CEO) বরখাস্ত হয়েছিলেন – কেন? (১৪ ডিসেম্বর, ২০২৪)

ভূমিকা

২০২৪ সালের প্রথম চতুর্থাংশে ৬০০’র বেশি প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (CEO) তাদের পদ হারিয়েছেন বা পদত্যাগ করেছেন। বোয়িং (Boeing), স্টারবাকস (Starbucks), প্যারামাউন্ট (Paramount), পেপ্যাল (Paypal)—এই বিশাল কোম্পানিগুলোর সিইওদের কেউ কেউ পদত্যাগ করেছেন, কেউ বা সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। কেন এই শীর্ষপর্যায়ের নেতৃত্ব এত হঠাৎ বিদায় নিচ্ছে? যেসব সিইও এখনও টিকে আছেন, তাদের ভবিষ্যৎ কী? এর পর কি গুগলের (Google) সুন্দর পিচাই (Sundar Pichai) এর পালা আসতে পারে? আসলে, এর পেছনে একটা নির্দিষ্ট কারণ আছে।

বাস্তবতা ও বরখাস্তের ঘটনাবলি

আমি কিছু বিখ্যাত সিইও’র নাম উল্লেখ করেছি, কিন্তু তালিকায় আরও অনেকেই আছেন যারা পদত্যাগ করেছেন বা বরখাস্ত হয়েছেন। নাইকির (Nike) জন ডনাহো (John Donahoe), হার্টজের (Hertz) স্টিফেন শের (Stephen Scherr), মার্সারের (Mercer) মার্টিন ফারল্যান্ড (Martine Ferland), মরগ্যান স্ট্যানলির (Morgan Stanley) জেমস গরম্যান (James Gorman), ওয়ার্নার মিউজিক জাপানের (Warner Music Japan) কাজ কোবায়াশি (Kaz Kobayashi)—এছাড়াও সবচেয়ে চমকপ্রদ ঘটনা যেটা, সনি ইন্টারএকটিভ এন্টারটেইনমেন্টের (Sony Interactive Entertainment) সিইও জিম রায়ান (Jim Ryan) ৩০ বছরের চাকরি শেষে অবসর নিয়েছেন। জিম রায়ানের বিদায়ের অল্প পরেই অন্য সনি (Sony) কর্মকর্তারাও একই পথ অনুসরণ করেন। এপ্রিল মাসে সনি গ্রুপের প্রেসিডেন্ট, সিওও (COO), ও সিএফও (CFO) হিরোকি তোটোকি (Hiroki Totoki) পদত্যাগ করেন।

সিইওরা পদত্যাগ কিংবা চাকরি হারান, এটা স্বাভাবিক ঘটনা। কিন্তু ২০২৪ আলাদা। এ বছর পরিস্থিতি অন্যরকম।

২০২৪ সালের প্রথম চতুর্থাংশে ৬২২ জন সিইও তাদের পদ থেকে সরে গেছেন, যা আগের চতুর্থাংশের তুলনায় ২৭% বেশি, এবং ২০২৩ সালের প্রথম চতুর্থাংশের তুলনায় ৫০% বেশি। এটি একটি রেকর্ড উচ্চতা। ডেটা দেখলে বোঝা যায়, এই সময়ে সিইও পদত্যাগ বা বরখাস্তের হার কতটা অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে, এবং এরপর দ্বিতীয় চতুর্থাংশে হার আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরে।

২০২৪ সালের পুরোটা ধরলে, সিইও পদত্যাগ বা বরখাস্ত ৫০% বেড়েছে। কিছু কিছু খাতে এই প্রবণতা আরও মারাত্মক ছিল। কনজিউমার প্রোডাক্টস (Consumer Products) খাতে ১৩৩% বৃদ্ধি, ফার্মাসিউটিকালস খাতে ২০০% বৃদ্ধি, আর ইন্ডাস্ট্রিয়াল গুডস ম্যানুফ্যাকচারিং খাতে ৩৬৭% বৃদ্ধি দেখা গেছে!

এটা শুধু বড় কোম্পানির ক্ষেত্রেই নয়। সরকারী ও অ-লাভজনক (Government & Non-Profits) খাতেও একই প্রবণতা দেখা গেছে: এই সময়ে সিইও পদত্যাগ বা বরখাস্ত ৭৮% বেড়েছে।

কেন এই হঠাৎ বৃদ্ধি? কেন এত সিইও এক চতুর্থাংশেই সরে গেলেন? এটা কি নিছক বিচ্ছিন্ন ঘটনা, নাকি বৃহত্তর কোনো প্রবাহের অংশ?

বাস্তবে এখানে তিনটি শক্তিশালী চালিকা শক্তি কাজ করেছে। আমি প্রতিটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করব এবং দেখাব কীভাবে এরা মিলিত হয়ে ইতিহাসে সবচেয়ে বড় সিইও পদত্যাগ ও বরখাস্তের ঢেউ তৈরি করেছে।

নতুন বিনিয়োগকারীরা

অর্থনীতি একটি বৈপরীত্যমূলক অবস্থায় আছে। এসঅ্যান্ডপি (S&P) সূচকের কর্মদক্ষতা ইতিহাসের সেরা পর্যায়ে। জিডিপি (GDP, মোট দেশজ উৎপাদন) ও কর্পোরেট মুনাফা (Corporate Profits) পূর্বাভাস ছাড়িয়ে বেড়েছে, ২০২২ সালের তুলনায় উভয়ই বৃদ্ধি পেয়েছে।

কিন্তু মুদ্রার অন্য পিঠেও একটি চিত্র দেখা যায়। সাপ্লাই চেইন (Supply Chains) বড় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি, বিশেষত জ্বালানি ও খাদ্য খাতে। অধিকাংশ অর্থনীতিতে জীবনযাত্রার ব্যয় (Cost of Living) বেড়েছে, মূল্যস্ফীতি ও সুদের হার বৃদ্ধি পেয়েছে, যার ফলে ভোক্তারা (Consumers) অর্থ ব্যয় করতে অনাগ্রহী হয়ে উঠছে।

এর মানে কী? এমন এক পরিবেশে একদল বিশেষ বিনিয়োগকারী (Investors) বেশ শান্তভাবে ক্ষমতা অর্জন করেছে, এবং এখন তারা সরাসরি সিইওদের লক্ষ্যবস্তু বা টারগেট করছে।

এই গ্রুপটি হলো অ্যাকটিভিস্ট বিনিয়োগকারী (Activist Investors)। সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মতো এদের উদ্দেশ্য শুধু নিঃক্রিয় লভ্যাংশ (Passive Returns) নয়। তারা সাধারণত কোনো প্রতিষ্ঠানের বিশাল শেয়ার কেনে এবং কোম্পানির কার্যক্রমের রূপরেখা বদলাতে চায়।

তারা কখনও কখনও আগ্রাসী প্রচারণা চালায়—নতুন সিইও নিয়োগ, কৌশল পরিবর্তন, অপারেশনাল পদ্ধতি পুনর্বিন্যাস, এমনকি নিজেদের প্রতিনিধি বোর্ড অফ ডিরেক্টরস (Board of Directors)-এ বসানোর চেষ্টা করে। প্রায়ই লক্ষ্য থাকে কম মূল্যের শেয়ারকে মূল্যবান করা, কখনও কখনও সামাজিক বা পরিবেশগত কারণে পরিবর্তন চাওয়াও হয়।

অ্যাকটিভিস্ট বিনিয়োগকারীদের মূলমন্ত্র হলো দ্রুত ও ব্যাপক পরিবর্তন আনা। কেন এটা গুরুত্বপূর্ণ? কারণ ২০২৩ ছিল অ্যাকটিভিস্ট বিনিয়োগকারীদের অন্যতম বড় বছর।

২০২৩ সালে অ্যাকটিভিস্ট ক্যাম্পেইন (Activist Campaigns) রেকর্ড ২৫২টিতে পৌঁছেছিল। ২০২৪ সালের গোড়াতেই এটা আরও বেড়েছে। কেন এখন?

কিছু নতুন আইন ও নিয়মকানুন অ্যাকটিভিস্ট বিনিয়োগকারীদের আরও স্বাধীনতা দিয়েছে। অনেক অ্যাকটিভিস্ট বিনিয়োগকারী আবার হেজ ফান্ড (Hedge Funds) থেকে উঠে এসেছে, যা এখন রেকর্ড পরিমাণ মূলধন রাখে, বিলিয়ন বিলিয়ন অতিরিক্ত ডলার হাতে আছে।

এই সম্পদ এখন তাদেরকে প্রচারণা চালিয়ে প্রকৃত পরিবর্তন আনার ক্ষমতা দিয়েছে। সিইওদের উদ্দেশ্যে বার্তা স্পষ্ট: “মূল্য (Value) তৈরি করুন, নাহলে কঠোর পর্যালোচনার মুখোমুখি হবেন।”

তবে ঝুঁকিও আছে। বোর্ডকে সতর্ক থাকতে হবে যাতে স্বল্পমেয়াদী ফলাফলের জন্য দীর্ঘমেয়াদী কৌশল ও স্থায়িত্ব (Sustainability) বিসর্জন না দেওয়া হয়। অনেক কোম্পানি স্বল্পমেয়াদী শেয়ার মূল্য বৃদ্ধির জন্য সিইও আনে, তারা বড় বোনাস নিয়ে চলে যায়, আর কোম্পানি পরে দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এখন অ্যাকটিভিস্ট বিনিয়োগকারীরা স্বল্পমেয়াদী সাফল্যের দিকে আরও জোর দেওয়ায়, এমন ঘটনা আরও বাড়তে পারে।

এতে নিঃসন্দেহে এমন অনেক সিইও বিদায় নিয়েছেন যারা প্রত্যাশা অনুযায়ী পারফর্ম করতে পারেননি। স্টারবাকসের (Starbucks) সিইও সম্প্রতি এ কারণে পরিবর্তিত হয়েছেন। তার জায়গায় আনা হয়েছে চিপোটলের (Chipotle) সাবেক সিইও ব্রায়ান নিকল (Brian Niccol), যিনি চিপোটলকে দুর্দান্ত সফল করে তুলেছিলেন। স্টারবাকস এতটাই আশাবাদী যে তাকে ১১৩ মিলিয়ন ডলার বেতন দিয়েছে।

একটি বিষয় স্পষ্ট: বিনিয়োগকারীরা আগের চেয়ে বেশি আগ্রাসী, বেশি দাবিদার, এবং কম ক্ষমাশীল। কিন্তু সব সিইওকে এভাবে সরিয়ে দেওয়া হয়নি। অনেকে নিজেরাই পদত্যাগ করছেন। এখানেই আসে দ্বিতীয় শক্তি।

প্রজন্মের পরিবর্তন (Changing Generations)

২০১৯ সালে বিভিন্ন শিল্পক্ষেত্রে সিইওদের গড় বয়স ছিল ৫৯ বছর। অন্যান্য নির্বাহী পদগুলোর তুলনায় এটি বেশি। এই গড় বয়সের কারণ হলো সিইওদের বড় অংশই বেবি বুমার (Baby Boomers) প্রজন্মের অন্তর্গত।

একই সময়ে দেখা গেছে, এসঅ্যান্ডপি ৫০০ (S&P 500) তালিকাভুক্ত কোম্পানির ৮০% সিইও বেবি বুমার, এবং এদের এক-তৃতীয়াংশের বয়স ৬৫ বা তার বেশি। তুলনায় জেনারেশন এক্স (Gen X) এর হাতে ১০% এরও কম সিইও পজিশন আছে। কিন্তু এটি বদলাচ্ছে।

বর্তমানে প্রতিদিন গড়ে ১০,০০০ বেবি বুমার অবসরের বয়সে পৌঁছাচ্ছেন। প্রথমবারের মতো জেন জেড (Gen Z) কর্মশক্তিতে বেবি বুমারদের ছাড়িয়ে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। আমরা ট্রেন্ড হিসেবে দেখছি, ২০২২ সাল নাগাদ নতুন নিয়োগ পাওয়া প্রায় এক-তৃতীয়াংশ সিইওর বয়স ৫০’র নিচে, যা ২০১৮ সালের দ্বিগুণ। সিইওদের গড় বয়স এখন ৫৪-তে নেমে এসেছে।

আমরা এখন একটি প্রজন্মগত রূপান্তরের মাঝখানে রয়েছি।

বেবি বুমাররা বিদায় নিচ্ছেন, আর জেন এক্স (Gen X), মিলেনিয়াল (Millennials), এমনকি জেন জেড (Gen Z) এর সদস্যরাও সিইওর আসনে বসছেন। শুধু বয়স নয়, বাজার এখন বেশি প্রযুক্তিনির্ভর, তাই গ্রাহকদের কাছে পৌঁছানোর জন্য অনেক কোম্পানি তরুণ ও প্রযুক্তি-বিষয়ক সচেতন নেতৃত্ব চাইছে।

সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো, এটি আসলে বড় এক পরিবর্তনের ছোট্ট পূর্বাভাস মাত্র। এখনও প্রচুর সিইও আছেন যাদের বয়স ষাটের কোঠায়, এবং অনেকে দীর্ঘদিন ধরে রয়েছেন। শীঘ্রই আমরা একটি “রিটায়ারমেন্ট ক্লিফ” (Retirement Cliff) দেখতে পারি, যখন আরও বেশি সংখ্যায় সিইও অবসরে যাবেন।

কিন্তু এ ব্যাপারটি ভবিষ্যতের জন্য। ২০২৪ সালে এই হঠাৎ পরিবর্তনের আরেকটি কারণ আছে—একটি বৈশ্বিক ঘটনা যা পুরো বিশ্বকে প্রভাবিত করেছে।

মহামারীর (The Pandemic) প্রভাব

অ্যাকটিভিস্ট বিনিয়োগকারী ও প্রজন্মগত পরিবর্তন নিশ্চয়ই ভূমিকা রাখছে, কিন্তু এর পাশাপাশি আছে আরও একটি অন্তর্নিহিত প্রভাব—মহামারী (Pandemic)। “মহামারী তো কয়েক বছর আগের ঘটনা”—এমন প্রশ্ন জাগতেই পারে। কিন্তু ইতিহাসের এমন ঘটনার প্রভাব বছর পেরিয়ে গড়ায়। চলুন কঠিন তথ্য দেখি।

২০২০ সালে, যখন বিশ্ব পুরো দাপটের সাথে মহামারীর মুখোমুখি হচ্ছিল, সিইও বরখাস্ত ও পদত্যাগের হার হঠাৎ ২০১৯ সালের তুলনায় ২০% কমে যায়। পরবর্তী প্রতিটি চতুর্থাংশে সিইও চলে যাওয়ার হার কমতে থাকে। ২০২১ সালেও এটি ১% হ্রাস পায়। অর্থনীতি যেখানে এত অস্থির ছিল, মানুষ চাকরি হারাচ্ছিল, সেখানে সিইওদের চাকরি যাবার হার কেন কমল? এবং এখন, ২০২৪ সালে, এই সংখ্যা হঠাৎ করে ৫০% বেড়ে গিয়েছে! কী ঘটছে?

এর উত্তর অতি সহজ: ঝড়ের মধ্যে নাবিককে বদলানো কঠিন। সংকটের সময় কোম্পানিগুলো সাধারণত নেতৃত্বশূন্য হতে চায় না, বিশেষ করে সিইও পদে। কারণ এটি দিকনির্দেশনাহীনতা সৃষ্টি করবে যখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন কৌশলগত দিকনির্দেশনা। আইন-কানুন বদলাচ্ছিল, বাজার ভেঙে পড়ছিল, ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। সঠিক সিইও কোম্পানিকে উদ্ধার করতে পারে, আবার ভুল সিইও ডোবাতে পারে।

নতুন সিইও খোঁজা ব্যয়বহুল ও সময়সাপেক্ষ, বিশেষ করে অস্থির সময়ে। তাই সংকটকালে সিইওরা বহাল তবিয়তেই ছিলেন। কিন্তু এখন ঝড় থেমেছে, বিশ্ব স্থিতিশীল হয়েছে (যদিও একেবারে আগের মতো নয়)। এখন পরিচালনা পর্ষদ ও বিনিয়োগকারীরা নির্ভয়ে সিইও পরিবর্তন করতে পারছে, এবং আগের সব শক্তি মিলে এটি সিইওদের জন্য নিখুঁত ঝড়ের মতো পরিস্থিতি তৈরি করেছে।

এখন প্রশ্ন: যারা এখনও টিকে আছেন, তাদের জন্য কী অপেক্ষা করছে?

চূড়ান্ত ফলাফল: গুগলের সিইও ও অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ

সুন্দর পিচাই (Sundar Pichai), গুগলের সিইও, এই চাপের মুখে পড়েছেন। গুগল তাদের জেমিনি এআই (Gemini AI) বিপর্যয়ে (Disaster) ৯৬ বিলিয়ন ডলার মূল্য হারিয়েছে। অনেক বিশেষজ্ঞ ভেবেছিলেন পিচাই-ও হয়তো একই পরিণতির শিকার হবেন। কিন্তু তিনি কোনোভাবে তার অবস্থান ধরে রেখেছেন।

তবে তাকে কৌশল বদলাতে হয়েছে। সবকিছুতে এআই (AI) ঢোকানোর চেষ্টার বদলে তিনি এখন বর্ণপরিসরে নিজের শক্তি (যেমন বিজনেস-টু-বিজনেস (B2B) পণ্য, ক্লাউড (Cloud) পরিষেবা) উপর জোর দিচ্ছেন, যাতে আরও স্থিতিশীল রাজস্ব প্রবাহ নিশ্চিত হয়।

এটি ভবিষ্যতের সিইওদের জন্য বড় শিক্ষা। ফলাফল দিতে হবে, চাপ অনেক বেশি। ভুল করার সুযোগ কম। বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার নতুন প্রযুক্তিতে উড়িয়ে দেওয়ার মতো অবকাশ নেই।

সবাই কিন্তু একই পথে যাচ্ছে না। ওপেনএআই (OpenAI) সম্প্রতি বিশাল পুনর্গঠনের মধ্যে দিয়েছে, অ্যাকটিভিস্ট বিনিয়োগকারীদের ঠেকানোর জন্য বা অন্তত তাদের প্রভাব কমাতে। সিইও স্যাম অল্টম্যান (Sam Altman) বরখাস্ত হয়েছিলেন, পরে পুনর্বহাল হয়েছেন, বিনিয়োগকারীদের মধ্যে দ্বন্দ্বের কারণে। মাইক্রোসফট (Microsoft), যাদের কাছে ওপেনএআইয়ের ৪৯% ইকুইটি আছে, বরখাস্তের সিদ্ধান্তে অসন্তুষ্টি প্রকাশ করে। সবাই কিন্তু মাইক্রোসফটের মতো সমর্থন পায় না।

২০২৪ সাল সিইওদের কাছে একটাই কথা বলেছে: ফলাফল দাও, নাহলে বদলে যাও। এটা ভালো না খারাপ, সে বিচার আপনার।

তথ্যসূত্র

  1. https://www.theguardian.com/business/article/2024/aug/15/pay-deal-new-starbucks-ceo-brian-niccol
  2. https://www.linkedin.com/pulse/great-ceo-exodus-2024-what-22-high-profile-might-mean-mark-de-grasse-v6dpc/
  3. https://www.sony.com/en/SonyInfo/News/Press/202309/23-0928E/
  4. https://ceoworld.biz/2024/08/19/50-increase-in-ceo-departures-as-622-chief-executives-step-down-in-the-first-quarter-of-2024/
  5. https://www.russellreynolds.com/en/insights/reports-surveys/global-ceo-turnover-index
  6. https://www.challengergray.com/blog/180-ceos-leave-their-posts-in-march-2024-highest-quarterly-total-on-record/
  7. https://www.weforum.org/publications/global-risks-report-2023/in-full/1-global-risks-2023-today-s-crisis/
  8. https://www.fool.com/investing/2024/10/21/sp-500-record-high-stock-market-will-do-this-next/
  9. https://thehill.com/business/4561631-corporate-hit-record-high-as-economy-boomed-in-fourth-quarter-of-2023/
  10. https://www.lazard.com/research-insights/review-of-shareholder-activism-h1-2024/
  11. https://www.whitecase.com/insight-our-thinking/nine-developments-and-trends-shaping-us-shareholder-activism-2023
  12. https://hfr-wp-s3.s3.amazonaws.com/wp-content/uploads/2024/04/22093421/2024.Q1-HFR-GIR_FINAL.pdf
  13. https://www.kornferry.com/content/dam/kornferry/docs/pdfs/age-tenure-c-suite-infographic.pdf
  14. https://insight.factset.com/what-would-a-transfer-of-power-from-baby-boomers-to-generation-x-look-like
  15. https://www.cnbc.com/2024/05/22/gen-z-is-entering-the-c-suite-heres-what-theyre-changing.html
  16. https://www.mckinsey.com/~/media/mckinsey/email/genz/2023/06/2023-06-20b.html
  17. https://www.challengergray.com/blog/year-end-ceo-turnover-report-exits-down-20-over-record-setting-2019-womens-gains-highest-on-record/
  18. https://www.alinkedin.com/pulse/ceo-turnover-hits-5-year-high-112-2022-nicolas-behbahani/
  19. https://www.foxbusiness.com/markets/google-loses-96b-value-gemini-fallout-ceo-damage-control
  20. https://economictimes.indiatimes.com/news/india/sundar-pichai-google-ceo-gemini-will-be-fired-or-he-will-resign-predicts-this-market-veteran/articleshow/108007445.cms?from=mdr
  21. https://nypost.com/2024/10/09/business/sam-altmans-openai-pursuing-switch-to-for-profit-structure-to-avoid-hostile-takeovers-report/
  22. https://blogs.microsoft.com/blog/2023/11/21/a-statement-from-microsoft-chairman-and-ceo-satya-nadella/
  23. https://www.youtube.com/watch?v=qd1cHni9Is4&t=1s
  24. https://fox5sandiego.com/news/ceos-quitting-at-record-pace-here-are-some-of-the-latest/
  25. https://www.yahoo.com/news/ceos-quitting-record-pace-latest-041021544.html
  26. https://www.nytimes.com/2024/08/13/business/dealbook/starbucks-ceo-out-laxman-narasimhan.html
  27. https://www.theaustralian.com.au/business/companies/the-march-of-passive-investors-and-high-price-of-money-why-activists-are-having-their-way/news-story/812a9f14e294f6069fedde4fe8c425c8
  28. https://www.reuters.com/business/retail-consumer/dominos-australia-franchises-long-serving-ceo-steps-down-shares-drop-2024-11-05/
  29. https://www.investopedia.com/terms/a/activist-investor.asp

এআই নিয়ে নেটফ্লিক্সের উচ্চাকাঙ্ক্ষী পরিকল্পনা (৩১ অক্টোবর, ২০২৪)

ভূমিকা

অনেক হইচই চলছে—ভালো ও খারাপ উভয় দিক থেকেই। প্রশ্ন হচ্ছে এটি কীভাবে বিনোদনশিল্পকে (entertainment industry) প্রভাবিত বা রূপান্তরিত (transform) করবে। আমার মনে হয়, ক্রিয়েটরদের (creators) জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ হলো, এই নতুন টুলগুলো কী, কী করতে পারে—এসব নিয়ে সর্বদা কৌতূহলী থাকা।”

সম্প্রতি নেটফ্লিক্স (Netflix)-এর কো-সিইও (co-CEO) টেড সারান্ডোস (Ted Sarandos), কোম্পানির ত্রৈমাসিক (Q3) আয়-সংক্রান্ত আলোচনায় (earnings call) যখন এআই (AI)-এর প্রভাব প্রসঙ্গে বলছিলেন, তখন এই কথাগুলো উল্লেখ করেন। তিনি আশাবাদী হলেও সাবধানী; তার যুক্তিঃ

“AI-কে একটি গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষায় পাশ করতে হবে: এটি কি বাস্তবেই ভালো শো (shows) ও ভালো সিনেমা (films) তৈরি করতে সাহায্য করতে পারবে?”

হলিউড (Hollywood) ইদানীং এই প্রশ্নটিই ঘুরেফিরে দেখছে। সৃজনশীল (creatives) লোকজন উদ্বিগ্ন—স্টুডিও (studios) যদি এআইয়ের মাধ্যমে অতিরিক্ত অভিনেতা (background actors) বাদ দিয়ে মাঝারি মানের স্ক্রিপ্ট তৈরির চেষ্টা করে, তারপর মানব লেখকদের (human writers) কম মজুরিতে সেটাকে পুনর্লিখন করায়, বা অন্য উপায়ে ব্যয় কেটে নেয়, তবে কী হবে? এ কারণেই সাম্প্রতিক হলিউড ধর্মঘটগুলোর (Hollywood labor strikes) কেন্দ্রে ছিল AI। সম্ভবত সেকারণেই সারান্ডোস বিষয়টি আলতোভাবে বলেছেন—নেটফ্লিক্স চায় নতুন প্রযুক্তি যেন কনটেন্টকে “ভালো” করে তোলে, “সস্তা” নয়।

শেষে সারান্ডোস বলেন, “যে কোনো টুল, যা গুণগত মান (quality) আরও উন্নত করবে, শো ও সিনেমাকে ‘ভালো’ করবে, সেটি শিল্পকে (industry) প্রচুর সাহায্য করবে।”

কিন্তু নেটফ্লিক্সের কাছে এটি নিছক দর্শন নয়; এটি কার্যকর বাস্তবতা। গত তিন মাসে নেটফ্লিক্সের চাকরির (job) বিজ্ঞপ্তি বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, তারা বিভিন্ন কাজে—লাইভ ক্যাপশনিং (live captioning), ব্যক্তিগতকরণ (personalization), কনটেন্ট প্রডাকশন (content production)—এলএলএম (LLM) বা লার্জ ল্যাঙ্গুয়েজ মডেল ও জেনারেটিভ এআই (generative AI) ব্যবহার পরিকল্পনা করছে। এমনকি অভ্যন্তরীণভাবে একটি এআই প্ল্যাটফর্ম (AI platform) বানানোর কথা উল্লেখ আছে, যাতে পুরো কোম্পানিতে জেনারেটিভ এআই অ্যাপ্লিকেশন (generative AI applications) তৈরি করা যায়।

১. অতীতের মেশিন লার্নিং ও বর্তমানের এলএলএম গ্রহণ

নেটফ্লিক্স বহুদিন ধরেই নিজেকে প্রযুক্তি কোম্পানি হিসেবে গড়ে তুলেছে, পরে স্ট্রিমিং ও হলিউডে এক প্রভাবশালী পরাশক্তি হয়েছে। তারা দীর্ঘদিন যাবৎ এআই ও মেশিন লার্নিং (machine learning) ব্যবহার করে আসছে—বিশেষ করে রিকমেন্ডেশন সিস্টেম (recommendations) কিংবা ব্যক্তিগতকরণে। নেটফ্লিক্স অ্যাপ খোলামাত্র আপনি যেসব ব্যক্তিগত সাজেশন (personalized suggestions) দেখেন, সবই মূলত মেশিন লার্নিংয়ের ফসল।

কিন্তু এখন তারা আরও এক ধাপ এগিয়ে, এলএলএম (LLM) ও জেনারেটিভ এআই (generative AI)-র সর্বশেষ অগ্রগতি কাজে লাগাতে চাইছে। বেশ কয়েকটি সাম্প্রতিক জব লিস্টিংয়ে বলা আছে, সার্চ (search) ও ব্যক্তিগতকরণ (personalization)-এ এলএলএম প্রয়োগ হবে।

  • যেমন, এক জব লিস্টিংয়ে বলা, “জেনারেটিভ এআই ও এলএলএমের (LLMs) দ্রুত অগ্রগতিতে এখন নেটফ্লিক্স পণ্যের সার্চ ও সুপারিশ (Search and Recommendations) অভিজ্ঞতা বদলে যাচ্ছে—কনটেন্ট আবিষ্কার (content discovery) এবং সদস্যদের জন্য ব্যক্তিগতকরণে (personalization) নতুন সুযোগ আসছে।” সেখানে আরও বলা, এই টিমটি “এলএলএম, এনএলপি (NLP) এবং মেশিন লার্নিং (Machine Learning)-এর অগ্রভাগে থেকে গবেষণা ও উদ্ভাবন করবে।”
  • আরেকটি লিস্টিংয়ে উল্লেখ করা হয়, “আমরা এক্সসেপশনাল অ্যাপ্লায়েড রিসার্চ ইঞ্জিনিয়ার খুঁজছি, যিনি এলএলএম (LLM)-সংশ্লিষ্ট সর্বশেষ উন্নয়ন কাজে লাগিয়ে ভবিষ্যতের সার্চ ও রেকমেন্ডেশন অভিজ্ঞতা গড়ে তুলতে সাহায্য করবেন।”

২. এআই দিয়ে ক্যাপশনিং (Captioning) ও লোকালাইজেশন (Localization)

নেটফ্লিক্স বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়: Squid Game, Casa de Papel ইত্যাদি বিভিন্ন দেশে হিট। ফলে বহু ভাষায় (multilingual) সাবটাইটেল, ডাবিং (dubbing), UI লোকালাইজেশন দরকার হয়। এখন এআই দিয়ে এগুলো আরও ত্বরান্বিত করতে চায়।

  • এক জব লিস্টিং-এ বলা, “আমরা অভিজ্ঞ রিসার্চ সায়েন্টিস্ট (Research Scientist) খুঁজছি, যিনি মাল্টিমডাল এলএলএম (Multimodal LLM) নিয়ে কাজ করে স্কেলের মধ্যে উচ্চগুণমানের লোকালাইজেশন (localization) অর্জনে সহায়তা করবেন। এটাই সেই বিরল সুযোগ, যেখানে আপনি গবেষণা করবেন কীভাবে মেশিন লার্নিং (Machine Learning) ব্যবহার করে ‘লোকালাইজেশন’ ও গ্লোবাল এন্টারটেইনমেন্টকে (global entertainment) উন্নত করা যায়।”
  • আরেকটি জব লিস্টিং-এ সরাসরি “মাল্টিলিঙ্গুয়াল লাইভ ক্যাপশন ও অনুবাদ (Multilingual Live Caption and Translation) মডেল” তৈরির কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ লাইভ ক্যাপশনিং (live captioning) নিয়ে সামনের দিনগুলোতে এআই পরীক্ষণ/বাস্তবায়ন হবে।

৩. কনটেন্ট প্রডাকশনে (Content Production) এআই: স্পর্শকাতর আলোচনার ক্ষেত্র

হলিউডের অনেকেই শঙ্কিত—এআই কি অভিনেতাদের (actors), অতিরিক্ত (extras) বা লেখকদের (writers) বদলে দেবে? নেটফ্লিক্সের সাম্প্রতিক জব লিস্টিংয়ে এমন কিছু সরাসরি লেখা নেই, তবে এ-ও স্পষ্ট যে তারা প্রোডাকশনের নানা ধাপ এআই দিয়ে সমৃদ্ধ করার চেষ্টা করছে।

  • বহু বছর ধরেই নেটফ্লিক্স নিজস্ব অ্যাপ বানায়, যাতে হলিউডের কাজকর্মে পরিবর্তন আসে (যেমন কাগুজে সময়সূচির বদলে ডিজিটাল পদ্ধতি)। এখন এক নতুন জব লিস্টিংয়ে বলে, “ক্রিয়েটিভদের (creatives) কর্মপ্রবাহে এআই যুক্ত করে নতুন সৃজনশীল সম্ভাবনা আনলক (unlock new creative possibilities) করতে চাই এবং কনটেন্ট সৃষ্টির প্রক্রিয়ায় (content creation process) দক্ষতা (efficiency) বাড়াতে চাই।”
  • আরেকটি নির্দিষ্ট তালিকায় (listing) জেনারেটিভ এআই (generative AI) ভিত্তিতে সিজিআই (CGI) উন্নয়নের কথা আছে। বলা হয়েছে: “আপনি জেনএআই (GenAI) মডেলকে আর্টিস্টদের ওয়ার্কফ্লোতে (artists’ workflows) সংযুক্ত করবেন, যা সৃষ্টিশীল সুযোগ (creative opportunities) বাড়াবে।” এখানে ইমেজ/ভিডিও জেনারেটিভ এআই (image/video generative AI) সম্পর্কে দক্ষতা থাকলে বিশেষ সুবিধা পাওয়া যাবে।

৪. নিজস্ব এআই অবকাঠামো (AI infrastructure) তৈরি করছে নেটফ্লিক্স

এতসব কাজে নেটফ্লিক্স শুধু ওপেনএআই বা জিপিটি (GPT)-র ওপর ভরসা করবে না; বরং তারা নিজস্ব এআই প্ল্যাটফর্ম তৈরির পথে।

  • এক জব লিস্টিংয়ে লেখা, “আমরা জেনারেটিভ এআই-চালিত অভিজ্ঞতা তৈরি করতে যেসব কাজ দরকার, সেই ‘ভারী বোঝা’ (heavy lifting) আমরা বইছি, যাতে কোম্পানির ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণ করা যায়।” সেই প্রোডাক্ট ম্যানেজারকে বলা হয়েছে “মডেল কনজাম্পশন লেয়ার (model consumption layer), কথোপকথনমূলক অ্যাসিস্ট্যান্ট (conversational assistants), এলএলএম অপস (LLMOps), প্রম্পট ম্যানেজমেন্ট (prompt management), প্রোটোটাইপিং টুল (prototyping tools) এবং এআই অ্যাপ উন্নয়ন ফ্রেমওয়ার্ক” পরিচালনা করতে হবে।
  • অন্য একটি তালিকায় ইঞ্জিনিয়ারদের কাজ হবে “থার্ড-পার্টি এলএলএম ও অভ্যন্তরীণ ফাইন-টিউনকৃত এমএল (ML) মডেলের জন্য এপিআই (APIs) ডিজাইন, বিল্ড ও ডিপ্লয়,” এবং “জেনএআই (GenAI) অ্যাপ বানানোর জন্য ফ্রেমওয়ার্ক ও কম্পোনেন্ট ডেভেলপ” করা।

এর মধ্যে কিছু অ্যাপ হয়তো গ্রাহক-সম্মুখীন (consumer-facing) হবে না; “N-Tech” নামের একটি টিম অভ্যন্তরীণ এন্টারপ্রাইজ অ্যাপ তৈরি করে। তারা কোম্পানির বিভিন্ন বিভাগে এআই ও জেনএআইকে “দায়বদ্ধভাবে (responsibly)” প্রয়োগ করবে, এমনটিই বলা আছে।

৫. অতীতের সাফল্য এবং নেটফ্লিক্সের নতুন লক্ষ্যমাত্রা

এআই এখন সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে রেখেছে। নেটফ্লিক্সের মতো বড় একটা প্রতিষ্ঠান যে এলএলএম (LLM) ও জেনারেটিভ এআই (generative AI) নিয়ে কাজ করতে চাইছে, তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। তবে নেটফ্লিক্সের উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হলো—তাদের “টেক ডিএনএ (tech DNA)”। তারা বহু আগেই স্ট্রিমিং প্রতিদ্বন্দ্বীরা ব্যবসায় নেমে পড়ার আগেই কিউরেশন/রিকমেন্ডেশনে মেশিন লার্নিং ব্যবহার করেছে। এখন তারা আবার এআই গবেষণায় আগ্রাসীভাবে (aggressively) নিয়োগ দিচ্ছে। এর মানে, আরেকবার তারা বাজারে প্রতিদ্বন্দ্বীদের পেছনে ফেলতে পারে।

যদি এআই—চিত্র ধারণ, সৃজনশীল সম্পাদনা, ট্রান্সলেশন, ব্যক্তিগতকরণ ইত্যাদি—সবখানেই মূল ভূমিকা নেয়, নেটফ্লিক্স সময়ের আগেই প্রস্তুত হতে চায়। তবে হলিউডের প্রথাগত শ্রম (labor) ও সৃজনশীলতার প্রশ্নগুলোয় কী প্রভাব পড়বে, সেটাই দেখার। সারান্ডোস বলেছেন, তারা শো আর সিনেমাকে “উন্নততর” করতে চান, “সস্তা” বানাতে নয়। ভবিষ্যৎ বলে দেবে, নেটফ্লিক্স এ ক্ষেত্রে কীভাবে ভারসাম্য রাখে।

উপসংহার

সব মিলিয়ে, নেটফ্লিক্স “এআই সর্বত্র” (AI everywhere)—এই নীতিতে অগ্রসর হচ্ছে। এলএলএম ও জেনারেটিভ এআইকে ব্যবহার করে সার্চ, রেকমেন্ডেশন, ক্যাপশনিং, লোকালাইজেশন থেকে শুরু করে সিজিআই প্রোডাকশন পর্যন্ত বিস্তৃত পরিসরে নতুন উদ্যোগ নিচ্ছে। এর জন্য তারা নিজস্ব এআই প্ল্যাটফর্মও তৈরির পরিকল্পনা করছে, যেখানে অভ্যন্তরীণ ও তৃতীয়-পক্ষের (third-party) বড় ল্যাঙ্গুয়েজ মডেল (large language model) ব্যবহারের এপিআই (API) ইত্যাদি থাকবে।

হয়তো তারা ইতিমধ্যে জিপিটি বা অন্যান্য এআই সেবা ব্যবহার করতে পারে, কিন্তু বড় কোম্পানি হিসেবে তারা নিজস্ব পরিকাঠামো গড়ে তুলতে চায়—মডেল ম্যানেজমেন্ট, এআই অ্যাপ ডেভেলপমেন্ট থেকে শুরু করে কাস্টমাইজেশন পর্যন্ত। নেটফ্লিক্স যা করছে, সেটি নতুন নয়—তবে তারা অন্যদের তুলনায় বেশি দ্রুতগতিতে করায় আরেকবার “এআই-ভিত্তিক স্ট্রিমিং নেতা” হওয়ার সম্ভাবনা। হলিউডের ট্রেন্ড যেদিকে যাক, নেটফ্লিক্স আপাতত সময়ের আগেই এই পথ পরিকল্পনা করছে।

তথ্যসূত্র

Netflix’s ambitious AI plans

যুক্তরাষ্ট্রের মেধাবী কর্মীদের কানাডায় অভিবাসন (২৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৪)

যুক্তরাষ্ট্রে দক্ষ প্রযুক্তি কর্মীদের আনার জন্য এইচ-১বি ভিসা প্রোগ্রাম (H-1B visa program) অপরিহার্য। তবে অভিবাসন নীতি নিয়ে আলোচনার পর, দক্ষ প্রযুক্তি কর্মীরা এখন কানাডার দিকে ঝুঁকছেন। অনেকে সতর্ক করে বলছেন যে, যুক্তরাষ্ট্র যদি বিশ্বের সেরা প্রতিভাদের আকৃষ্ট করার উপায় খুঁজে না পায়, তবে কানাডার মতো দেশগুলো সেই সুযোগটি নেবে। কানাডা এই প্রতিভাদের আকৃষ্ট করার জন্য একটি নতুন উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু বিশ্বের বৃহত্তম প্রযুক্তি কোম্পানির দেশ কিভাবে দক্ষ কর্মীদের হারাচ্ছে? এর কারণ যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা প্রক্রিয়ার জটিলতা। প্রতি বছর এইচ-১বি ভিসার জন্য আবেদন করা বেশ চাপের। এটি একটি সরল প্রক্রিয়া নয়, বরং বেশ জটিল এবং দীর্ঘসূত্রিতার। এই ভিসার মাধ্যমে কোনো ব্যক্তির সেই দেশে কাজ করা এবং দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখার সুযোগ একটি লটারির (lottery) উপর নির্ভর করে।

এইচ-১বি ভিসা একটি অ-অভিবাসী ভিসা (nonimmigrant work visa), যা মার্কিন নিয়োগকর্তাদের (US employers) বিশেষ পেশায় বিদেশী কর্মীদের নিয়োগের অনুমতি দেয়। এই ভিসার জন্য কমপক্ষে স্নাতক ডিগ্রি বা সমমানের শিক্ষাগত যোগ্যতা প্রয়োজন। সাধারণত, প্রযুক্তিখাতের দক্ষ কর্মীরা এই ভিসার জন্য আবেদন করেন। ১৯৯০ সালে এই ভিসা চালুর পর থেকে, কংগ্রেস (Congress) প্রতি বছর এইচ-১বি ভিসার সংখ্যা সীমিত করে দিয়েছে। বর্তমানে এর সংখ্যা বছরে ৬৫,০০০, এবং মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর বা ডক্টরেট ডিগ্রিধারীদের জন্য অতিরিক্ত ২০,০০০ ভিসা বরাদ্দ রয়েছে। যেহেতু এই ভিসার স্পন্সর (sponsor) নিয়োগকর্তা, তাই চাকরি হারালে ভিসাধারীদের নতুন চাকরি খুঁজে নিতে ৬০ দিন সময় পান, অন্যথায় তাদের নিজ দেশে ফেরত যেতে হতে পারে। শিবা কৌল (Shiva Koul) ২০১৩ সালে ভারতে থেকে যুক্তরাষ্ট্রে পড়তে এসেছিলেন এবং ২০১৮ সালে মাইক্রোসফটে (Microsoft) কাজ শুরু করেন, যারা তার এইচ-১বি ভিসার স্পন্সর ছিল। এইচ-১বি ভিসা পাওয়া বেশ প্রতিযোগিতামূলক। কর্মী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে নিয়োগকর্তার স্পন্সরশিপ (sponsorship) এবং একটি কঠিন আবেদন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। যোগ্য প্রার্থীদের একটি পুলের (pool) অন্তর্ভুক্ত করা হয়, যাদের মধ্য থেকে লটারির মাধ্যমে ভিসা দেওয়া হয়।

জর্জিয়া স্টেট (Georgia State) থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী এবং এইচ-১বি ভিসাধারী সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হরিন্দর সিংকে (Harinder Singh) তিনবার লটারিতে অংশ নিতে হয়েছে। ২০২১ সালে, প্রায় অর্ধেক যোগ্য আবেদনকারী লটারিতে নির্বাচিত হয়েছিলেন। কিন্তু ২০২৪ সালের জন্য ৭ লক্ষ ৫৮ হাজারটি আবেদনের মধ্যে মাত্র ১ লক্ষ ৮৮ হাজারটি চূড়ান্ত লটারির জন্য নির্বাচিত হয়েছে, অর্থাৎ ২৫% এরও কম ভিসা পেয়েছেন। এইচ-১বি ভিসা পাওয়ার পরেও ভিসাধারীদের অনেক বিধি-নিষেধ মেনে চলতে হয়। এই ভিসাধারীরা চাকরির পরিবর্তন বা অন্য কোনো কাজ করতে পারেন না। এমনকি তাদের স্ত্রী বা সন্তানও কাজের অনুমতি ছাড়া কাজ করতে পারেন না। ফলে অনেক উচ্চশিক্ষিত স্ত্রীকেও যুক্তরাষ্ট্রে বেকার জীবন কাটাতে হয়। স্থায়ী বসবাসের (permanent residency) জন্য গ্রিন কার্ডের (green card) আবেদন করা একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া হলেও, ভারত ও চীনের মতো জনবহুল দেশের ভিসাধারীদের জন্য এটি দীর্ঘমেয়াদি ব্যাপার। যুক্তরাষ্ট্রের আইনে গ্রিন কার্ডের ক্ষেত্রে একটি দেশের জন্য ৭% এর সীমা নির্ধারণ করা আছে, যার কারণে ভারত ও চীনের মতো দেশের এইচ-১বি ভিসাধারীদের দীর্ঘ সময় ধরে অপেক্ষা করতে হয়। ২০২৩ সালে এই অপেক্ষার তালিকা ১৮ লক্ষে পৌঁছেছে, যার মধ্যে ১১ লক্ষই ভারতের নাগরিক। স্থায়ীভাবে বসবাসের সুযোগ কম থাকায়, অনেক এইচ-১বি ভিসাধারী কর্মী কানাডায় যাওয়ার কথা ভাবছেন।

অনেক এইচ-১বি ধারী কর্মী কানাডায় গিয়ে স্থায়ী বাসিন্দা হওয়ার জন্য আবেদন করছেন। বড় প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো প্রচুর পরিমাণে এইচ-১বি ভিসার অনুমোদন করিয়ে থাকে। অ্যামাজন, গুগল, মাইক্রোসফট, অ্যাপল (Apple) এবং মেটা গত দুই বছরে ৬০,০০০-এর বেশি ভিসার অনুমোদন করিয়েছিল। তবে অ্যাপল বাদে বাকি সব কোম্পানি গত বছর বড় ধরনের কর্মী ছাঁটাই করেছে, যার ফলে এইচ-১বি ভিসাধারীরা অনিশ্চয়তায় পড়েছেন। নিয়ম অনুযায়ী, চাকরি হারানোর পরে তাদের ৬০ দিনের মধ্যে দেশ ছাড়তে হয়। ঘানার নাগরিক আনোকিয়ে (Anokye) ২০১৯ সালে স্টুডেন্ট ভিসায় যুক্তরাষ্ট্রে এসেছিলেন। এ বছর মাইক্রন (Micron) থেকে ছাঁটাই হওয়ার পর, তিনি এইচ-১বি ভিসা থেকে ভিজিটর ভিসায় (visitor visa) পরিবর্তন করেছেন এবং নতুন চাকরির সন্ধান করছেন। অক্টোবর ২০২২ থেকে এপ্রিল ২০২৩ পর্যন্ত প্রায় ৫০,০০০ এইচ-১বি ধারী বেকারত্বের কারণে তাদের ভিসা স্ট্যাটাস হারিয়েছেন। এদের মধ্যে ১২,৫০০ জন অন্য কোনো বৈধ ভিসায় স্থানান্তরিত হননি, অর্থাৎ তাদের নতুন স্পন্সর খুঁজে না পেলে ৬০ দিনের মধ্যে দেশ ছাড়তে হতো।

২০২৩ সালের ২৭শে জুন কানাডা ঘোষণা করে যে, তারা বিশ্বের সবচেয়ে মেধাবী কর্মীদের জন্য একটি বিশেষ স্ট্রিম তৈরি করবে, যার মাধ্যমে তারা কাজের প্রস্তাব থাকুক বা না থাকুক, কানাডার প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোতে কাজ করার সুযোগ পাবে। এরপর ১৬ই জুলাই কানাডা একটি পাইলট প্রোগ্রামের (pilot program) অধীনে যুক্তরাষ্ট্রে থাকা ১০,০০০ এইচ-১বি ভিসাধারীকে তিন বছরের জন্য কানাডায় কাজের অনুমতি দেওয়ার জন্য ভিসার আবেদন গ্রহণ শুরু করে। অভূতপূর্ব সাড়া ফেলে প্রথম দিনেই এই প্রোগ্রামের ১০,০০০ ভিসার কোটা পূরণ হয়ে যায়। তবে এই পাইলট প্রোগ্রামটি কানাডার বৃহত্তর পরিকল্পনার একটি অংশ। কানাডার প্রযুক্তি বাজারে ২০২০ সাল থেকে ১৫.৭% প্রবৃদ্ধি হয়েছে, যেখানে যুক্তরাষ্ট্রে এই সময়ে প্রবৃদ্ধি ছিল ১১.৪%। বর্তমানে কানাডায় ১১ লক্ষ প্রযুক্তি কর্মী রয়েছে, যা দেশটির মোট কর্মশক্তির ৬.৫%।

টরন্টো (Toronto) এবং ভ্যাঙ্কুভারকে (Vancouver) যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার সেরা দশটি প্রযুক্তি শহরের মধ্যে স্থান দেওয়া হয়েছে। অটোয়া (Ottawa) এবং মন্ট্রিয়লও (Montreal) আটলান্টা (Atlanta) এবং শিকাগোর (Chicago) মতো বড় শহরগুলোর চেয়ে এগিয়ে আছে। কানাডায় শপিফাইয়ের (Shopify) মতো বড় প্রযুক্তি কোম্পানির পাশাপাশি ডেল (Dell), ইন্টেল (Intel), মাইক্রোসফট এবং অ্যামাজনের মতো কোম্পানিরও কার্যক্রম রয়েছে। কর্মী ছাঁটাইয়ের শিকার হওয়া অনেক কর্মী কানাডার ওয়ার্ক পারমিটের (work permit) জন্য আবেদন করেছেন। কানাডার এই ওয়ার্ক পারমিট কোনো নির্দিষ্ট কাজের জন্য নয়, অর্থাৎ এই ভিসাধারীরা যেকোনো শিল্পে কাজ করতে পারবেন এবং এইচ-১বি ভিসার মতো তাদের আগে থেকে চাকরির ব্যবস্থা করারও প্রয়োজন নেই। সিং অন্য একটি প্রোগ্রামের (program) অধীনে কানাডার ওয়ার্ক পারমিটের জন্য আবেদন করেছিলেন এবং কানাডাকে একটি ব্যাকআপ অপশন (backup option) হিসেবে রেখেছিলেন। কানাডা সরকার অনুমোদিত আবেদনকারীদের কানাডায় পৌঁছানোর পরে ওয়ার্ক পারমিট ইস্যু করে। এখন পর্যন্ত ৬,০০০-এর বেশি ওয়ার্ক পারমিট ইস্যু করা হয়েছে।

কানাডার অভিবাসনমন্ত্রী মার্ক মিলারকে (Marc Miller) সাক্ষাৎকারের জন্য পাওয়া যায়নি, তবে তার একজন মুখপাত্র জানান, কানাডার এইচ-১বি ভিসা আবেদন প্রোগ্রামের প্রতি ব্যাপক আগ্রহ প্রমাণ করে যে, কানাডা বিশ্ব মঞ্চে কতটা প্রতিযোগিতামূলক। ২০৩০ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে স্টেমের (STEM – বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল ও গণিত) চাকরির সংখ্যা ১০.৫% বেড়ে ১ কোটি ১৩ লক্ষে পৌঁছাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে ২০১৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ১৪% স্টেম গ্র্যাজুয়েট স্নাতকের পর স্টেম-সম্পর্কিত (STEM-related) পেশায় কাজ করেছেন। অন্যদিকে, কানাডায় ৬২% কলেজ শিক্ষার্থী স্টেম বিষয়ে পড়াশোনা করেও নন-স্টেম (non-STEM) পেশায় কাজ করেন। কানাডায় বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য স্থায়ীভাবে বসবাসের পথ অনেক সহজ। হাকুনা কোচার (Hakuna Kochar) ভারতের একজন প্রযুক্তি কর্মী, যিনি স্টুডেন্ট ভিসায় কানাডায় এসেছিলেন এবং পরবর্তীতে স্থায়ী বাসিন্দা হয়েছেন। তিনি এমন কোনো দেশে যেতে চাননি, যেখানে তিনি দীর্ঘকাল ধরে বিদেশি হিসেবে পরিচিত হবেন। কানাডার অভিবাসন ব্যবস্থা কিছুটা ত্রুটিপূর্ণ হলেও, এটি বিশ্বায়ন এবং শ্রমবাজারের পরিবর্তনের সাথে দ্রুত সাড়া দেয়। এটি স্থায়ীভাবে বসবাসের ক্ষেত্রে অনেক বেশি নিরাপত্তা ও মানসিক শান্তি দেয়, যা যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান অভিবাসন ব্যবস্থায় সহজে পাওয়া যায় না। অনেকে মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্রে মেধাবী কর্মীদের ধরে রাখার জন্য কংগ্রেসের পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।

ভবিষ্যতে এই প্রযুক্তি কর্মীরা নিজেদের কোথায় দেখতে চান? কেউ যুক্তরাষ্ট্রে থাকতে চান, আবার কেউ কানাডাকে ভালো বিকল্প মনে করেন। কেউ কেউ ইউরোপ (Europe), কানাডা এবং অস্ট্রেলিয়াকে (Australia) পছন্দের তালিকায় রাখছেন। তবে কেউ কেউ মনে করেন, ক্যারিয়ারের অগ্রগতির জন্য যুক্তরাষ্ট্রেই বেশি সুযোগ রয়েছে। আবার অনেকে কানাডাতেই স্থায়ীভাবে বসবাস করতে চান।

আমেরিকায় সম্প্রতি প্রযুক্তি কর্মী ছাঁটাইয়ের গতিপ্রকৃতি (২৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৪)

যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি শক্তিশালী হওয়া সত্ত্বেও কেন ব্যাপক হারে কর্মী ছাঁটাই চলছে?

ব্রিটানি পিটস (Brittany Pietsch) নামক ক্লাউডফ্লেয়ারের (Cloudflare) একজন প্রাক্তন কর্মীর পোস্ট করা একটি ভাইরাল ভিডিওতে (viral video) দেখা যায়, তাকে তার কর্মচ্যুতি সম্পর্কে জানানো হচ্ছে। সান ফ্রান্সিসকো-ভিত্তিক (San Francisco-based) এই টেক কোম্পানিটি থেকে ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে পোস্ট করা ভিডিওটি এত বেশি মনোযোগ আকর্ষণ করে যে, এটি সম্ভবত রিয়েল টাইমে (real time) কর্মী ছাঁটাই দেখার একটি নতুন উপধারা তৈরি করেছে। ২০২৩ সালটি প্রযুক্তি শিল্পের জন্য কঠিন ছিল এবং ২০২৪ সালেও ব্যাপক হারে কর্মী ছাঁটাই অব্যাহত রয়েছে। লিঙ্কডইন (LinkedIn) সম্প্রতি প্রায় ৭০০ জন কর্মীকে ছাঁটাই করেছে। কোয়ালকম (Qualcomm) ১২০০ জনের বেশি কর্মী ছাঁটাই করার পরিকল্পনা করছে। গুগল (Google), অ্যামাজন (Amazon) এবং স্ন্যাপের (Snap) মতো কোম্পানিগুলোও কর্মী ছাঁটাই চালিয়ে যাচ্ছে। নতুন বছরেও কর্মী ছাঁটাইয়ের ঘোষণা, বিশেষ করে প্রযুক্তি শিল্পে, খবরের শিরোনাম হচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্ত ইউনিটগুলোর (units) মধ্যে রয়েছে হার্ডওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং (hardware engineering) এবং বিজ্ঞাপন বিক্রয় বিভাগও (ad sales)।

গুগলের সিইও (CEO) সুন্দর পিচাই (Sundar Pichai) তার কর্মীদের আরও কর্মী ছাঁটাইয়ের জন্য প্রস্তুত থাকতে বলেছেন। অ্যামাজনের একজন মুখপাত্র এই ছাঁটাইয়ের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। প্রাইম (Prime) ও প্রাইম ভিডিও (Prime Video) এবং এমজিএম-এর (MGM) প্রধান একটি মেমোতে (memo) বলেছেন, কোম্পানিটি দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগকে অগ্রাধিকার দেওয়ার জন্য কিছু কর্মী ছাঁটাই করছে। স্বাস্থ্যসেবা (health care), ব্যাংকিং (banking) এবং গণমাধ্যমের (media) মতো শিল্পেও কর্মী ছাঁটাইয়ের ঘটনা ঘটছে। তবে প্রযুক্তি শিল্পে কর্মী ছাঁটাইয়ের বিষয়টি প্রধান আলোচনার বিষয়ে পরিণত হয়েছে। প্রযুক্তি খাতে যা কিছু ঘটছে, তা বেশ স্পষ্ট। একটা সময় ছিল যখন মাইক্রোসফট (Microsoft) বা অ্যামাজন ওয়েব সার্ভিসেসের (AWS) মতো কোম্পানিতে কাজ করা অনেকের কাছে স্বপ্নের মতো ছিল। কিন্তু সেখানে যোগ দেওয়ার পর অনেকেই বুঝতে পারেন যে, এটি অন্য যেকোনো চাকরির মতোই। সুযোগ-সুবিধা ভালো থাকলেও, যেকোনো সময় কোম্পানি চাইলে কর্মীদের বাদ দিতে পারে।

২০২৪ সালের শুরু থেকে এই কর্মী ছাঁটাই প্রযুক্তি শিল্পে একটি বড় ধরনের পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে। ভবিষ্যতে কাজের ধরণ, প্রযুক্তির পরিবর্তন এবং বিনিয়োগকারীদের ঝুঁকি ও প্রবৃদ্ধির তুলনায় মুনাফার দিকে আগ্রহ বেড়ে যাওয়ায় কর্মী ছাঁটাই চলতেই থাকবে। প্রশ্ন হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি কাগজে-কলমে শক্তিশালী দেখালেও কেন বড় বড় প্রযুক্তি কোম্পানি এবং অন্যান্য শিল্প একসঙ্গে হাজার হাজার কর্মীকে ছাঁটাই করছে?

মহামারীর প্রভাব এবং অতিরিক্ত কর্মী নিয়োগ

কোভিড-১৯ (Covid-19) মহামারীর শুরুতে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বেশ খারাপ ছিল। তবে প্রযুক্তি শিল্পে তখন রমরমা অবস্থা। ২০২০ সালে, শীর্ষ সাতটি প্রযুক্তি কোম্পানির সম্মিলিত মূল্য ৩.৪ ট্রিলিয়ন ডলার বেড়েছিল। ফেডারেল রিজার্ভের (Federal Reserve) জরুরি পদক্ষেপ, যেমন সুদের হার প্রায় শূন্যে নামিয়ে আনা, প্রযুক্তি শেয়ারের (tech stocks) দাম বাড়াতে সাহায্য করেছিল। এই পরিস্থিতিতে প্রযুক্তি শিল্প প্রসারিত হয় এবং মানুষ ঘরে বন্দী থাকায় কোম্পানিগুলো কর্মী নিয়োগের হিড়িক ফেলেছিল। অ্যামাজন এই সময়ে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক কর্মী নিয়োগ করে, ২০২১ সালে তাদের কর্মী সংখ্যা ১৬ লাখে পৌঁছেছিল। কর্মী ছাঁটাইয়ের আগের পরিস্থিতিতে, সমস্ত প্রযুক্তি কোম্পানি প্রবৃদ্ধির ওপর জোর দিচ্ছিল। ফলে ঋণ বা পুঁজি পাওয়া সহজ ছিল। কিন্তু যখন সুদের হার বাড়তে শুরু করে এবং দেখা যায় যে কর্মী সংখ্যা বৃদ্ধি মুনাফায় রূপান্তরিত হচ্ছে না, তখন পুঁজি পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। এর ফলস্বরূপ অনেক কোম্পানি আতঙ্কিত হয়ে একসঙ্গে হাজার হাজার কর্মীকে ছাঁটাই করে।

টুইটারের প্রায় ৮০ শতাংশ কর্মী হয় স্বেচ্ছায় চাকরি ছেড়েছেন, নয়তো তাদেরকে কর্মচ্যুত করা হয়েছে। কেউ কেউ ইলন মাস্ককে (Elon Musk) কৃতিত্ব দেন, কারণ তিনি এই ধরনের কর্মী ছাঁটাইকে গ্রহণযোগ্য করে তুলেছেন। অনেক বড় কোম্পানি কর্মীর সংখ্যা কমিয়ে এনে দক্ষ হওয়ার চেষ্টা করছে। প্রযুক্তি প্ল্যাটফর্মগুলোর (tech platforms) আসল ক্ষমতা এখানেই দেখা যায়। তাদের হয়তো অত সংখ্যক কর্মীর প্রয়োজন ছিল না। তারা প্রতিভা জমা করছিল, যা তাদের জন্য একটি সস্তা বিকল্প ছিল। অনেক সিইও (CEO) প্রকাশ্যে ইলন মাস্কের পদক্ষেপের সমালোচনা করলেও, ভেতরে ভেতরে অনেকেই এটিকে একটি দারুণ পদক্ষেপ বলে মনে করেন।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রভাব

২০২৩ সাল ছিল কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (Artificial Intelligence) উত্থানের বছর, এবং ২০২৪ সালে এর প্রভাব আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। প্রযুক্তিখাতে বড় কোম্পানিগুলোর প্রধান নির্বাহীরা (সিইও) এখন এই প্রযুক্তিতে বিনিয়োগের পরিমাণ বাড়াচ্ছেন। যেমন, ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে মেটার (Meta) সিইও মার্ক জাকারবার্গ (Mark Zuckerberg) আর্টিফিশিয়াল জেনারেল ইন্টেলিজেন্স (Artificial General Intelligence – AGI) তৈরির পরিকল্পনার কথা ঘোষণা করেছেন। এই উন্নয়নের ফলে একদিকে যেমন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা-সম্পর্কিত (AI-related) নতুন চাকরির সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে, তেমনই কিছু চিরাচরিত পদে কর্মী ছাঁটাইয়ের ঘটনাও ঘটছে।

ইনডিডের (Indeed) সাম্প্রতিক একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, জেনারেটিভ এআই (Generative AI) শব্দযুক্ত চাকরির পদের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এই ধরনের চাকরির বিজ্ঞাপনের সংখ্যা প্রায় ৫০০% বেড়েছে, এবং এই পদগুলোর জন্য চাকরিপ্রার্থীদের আগ্রহের হার প্রায় ৬০০০% বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে, বর্তমানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা পেশাদারদের (AI professionals) তুলনায় এই ক্ষেত্রে দক্ষ কর্মীর চাহিদা অনেক বেশি। প্রতিটি কোম্পানিই এখন তাদের কর্মপ্রক্রিয়ায় কীভাবে এআই ব্যবহার করা যায়, তা খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে। ধারণা করা হচ্ছে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ভবিষ্যতে অসংখ্য নতুন কাজের সুযোগ তৈরি করবে, যদিও এর ফলস্বরূপ কিছু কাজ স্বয়ংক্রিয় হয়ে যেতে পারে। প্রযুক্তি শিল্পে এর প্রভাব ইতিমধ্যেই স্পষ্ট। অনেক সংস্থাই এখন কর্মীদের পেছনে বছরে ২-৩ লক্ষ ডলার খরচ না করে, সেই একই কাজ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে করিয়ে নিচ্ছে। ফলস্বরূপ, কোম্পানিগুলো তাদের অপ্রয়োজনীয় বিভাগগুলো ছেঁটে ফেলে দ্রুততার সাথে কাজ করার দিকে মনোযোগ দিচ্ছে এবং পুরনো প্রযুক্তিতে দক্ষ প্রকৌশলীদের (engineers) পরিবর্তে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় দক্ষ কর্মীদের নিয়োগে আগ্রহ দেখাচ্ছে।

অন্যদিকে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (AI) ব্যবহারের ফলে কিছু ক্ষেত্রে কর্মীরা আরও বেশি দক্ষতার সাথে কাজ করতে পারছেন। তারা মার্কেটিংয়ের (marketing) সিদ্ধান্ত গ্রহণ, ডেটা বিশ্লেষণ (data analysis) এবং গ্রাহকদের কার্যকরভাবে পরিষেবা দেওয়ার মতো কাজগুলো সহজে করতে পারছেন। তবে, প্রযুক্তিখাতে বর্তমানে যে কর্মী ছাঁটাইয়ের প্রবণতা দেখা যাচ্ছে, তার পেছনে এখনো পর্যন্ত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সরাসরি কোনো বড় প্রভাব দেখা যায়নি। কিছু ব্যবসা হয়তো তাদের ব্যবসায়িক অগ্রাধিকার পরিবর্তন করছে এবং জেনারেটিভ এআই সরঞ্জামগুলোর (generative AI tools) উপর বেশি গুরুত্ব দেওয়ার জন্য কিছু কর্মীকে ছাঁটাই করছে। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে, জেনারেটিভ এআইয়ের কারণেই মূলত মানুষের চাকরি যাচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে, ২০২২ সাল এবং ২০২৩ সালের প্রথমার্ধে প্রযুক্তি খাতে ৩ লক্ষ ৮৬ হাজারের বেশি কর্মী ছাঁটাইয়ের ঘটনা ঘটেছে এবং এই সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। এমনকি গুগলও কর্মী ছাঁটাইয়ের তালিকায় যুক্ত হয়েছে এবং মেটা তাদের কর্মীর সংখ্যা কমাচ্ছে। এই কর্মী ছাঁটাইয়ের ফলে বহু কর্মী হতাশায় ভুগছেন, যেখানে পূর্বে নতুন স্নাতকদের (graduate) জন্য সামান্য পদের বিপরীতে হাজার হাজার আবেদন জমা পড়ত।

প্রযুক্তি শিল্প তার স্বাভাবিক নিয়মেই উত্থান-পতনের মধ্যে দিয়ে যায়। সাম্প্রতিক সময়ে, ক্রিপ্টোকারেন্সির (cryptocurrency) পতন এবং সিলিকন ভ্যালি ব্যাংকের (Silicon Valley Bank) ব্যর্থতার মতো ঘটনা এই শিল্পে বড় ধাক্কা দিয়েছে। সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্টের (software development) চাকরির বিজ্ঞাপন প্রায় ৬০% কমে গেছে, যা মহামারী-পূর্ব (pre-pandemic) স্তরের চেয়েও নিচে নেমে গেছে। তবে, কর্মী ছাঁটাইয়ের এই কঠিন পরিস্থিতির মধ্যেও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বাজার এই শিল্পে নতুন করে আশার আলো দেখাচ্ছে। সান ফ্রান্সিসকোতে (San Francisco) এখন নতুন করে উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়েছে, যা একসময় মোবাইল ফোনের (mobile phone) উত্থানের সময় দেখা গিয়েছিল। বর্তমানে, কফি শপ থেকে শুরু করে রাস্তার সাধারণ আলোচনা পর্যন্ত, সর্বত্র জিপিটি (GPT) এবং এআই (AI) নিয়ে আলোচনা চলছে। ২০২৩ সালের প্রথম ত্রৈমাসিকে জেনারেটিভ এআই স্টার্টআপে (startup) ১২ বিলিয়ন ডলারের বেশি বিনিয়োগ হয়েছে, যেখানে ২০২২ সালে এই বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল মাত্র ৪.৫ বিলিয়ন ডলার। অ্যামাজন, অ্যালফাবেট (Alphabet) এবং মাইক্রোসফটের (Microsoft) মতো কোম্পানিগুলোও এই ক্ষেত্রে বিশাল অঙ্কের বিনিয়োগ করেছে। বিশেষভাবে উল্লেখ্য, যুক্তরাষ্ট্রের প্রযুক্তি শিল্প দেশটির মোট জিডিপির (GDP) ১০% এবং প্রায় ১ কোটি ২০ লক্ষ মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে। এই ব্যবসাগুলি মূলত সান হোসে (San Jose), ওয়াশিংটন ডিসি (Washington DC), সান ফ্রান্সিসকো, বোস্টন (Boston) এবং নিউ ইয়র্ক সিটির (New York City) মতো কয়েকটি উপকূলীয় অঞ্চলে কেন্দ্রীভূত।

মহামারীর পর প্রযুক্তি খাতে কর্মী ছাঁটাই এবং ভবিষ্যতের চাকরির সুযোগ

২০২০ সালের মার্চ মাসে মহামারী শুরু হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে বড় ধরনের ধাক্কা লাগে এবং ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যায়। মে মাস নাগাদ ২ কোটি ৩০ লক্ষ আমেরিকান তাদের চাকরি হারান এবং বেকারত্বের হার ১৪.৭%-এ পৌঁছেছিল, যা মহামন্দার (Great Depression) পর সর্বোচ্চ। তবে প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো ভিন্ন পরিস্থিতিতে ছিল। দূরবর্তী কাজের (remote work) সুযোগ এবং ক্লাউড কম্পিউটিংয়ের (cloud computing) কারণে মানুষজন অনলাইন পরিষেবার দিকে ঝুঁকেছিল, যা তাদের আয় বাড়িয়েছিল। এরপর মাইক্রোসফট, অ্যামাজন, সেলসফোর্স (Salesforce), ফেসবুকের (Facebook) মূল সংস্থা মেটা (Meta) এবং গুগলের মূল সংস্থা অ্যালফাবেট কর্মী নিয়োগের হিড়িক চালায়। ২০২১ সালের শেষে মেটার কর্মী সংখ্যা ছিল প্রায় ৭২,০০০, যা ২০১৯ সালের তুলনায় ৬০% বেশি। ২০২২ সালের শেষে অ্যালফাবেটের কর্মী সংখ্যা ছিল ১ লক্ষ ৯০ হাজারের বেশি, যা ২০১৯ সালের তুলনায় ৫৯% বেশি। কিন্তু কয়েক বছর ধরে একটানা উন্নতির পর, বড় প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর মহামারীকালীন (pandemic bubble) জোয়ার শেষ হয় এবং কোম্পানিগুলো কর্মী ছাঁটাই করতে বাধ্য হয়।

মেটার একজন নিয়োগকর্তা (recruiter) কার্ল হুইটলি (Carl Wheatly) জানান, মেটা এমন একটি কোম্পানি যেখানে তিনি সবসময় কাজ করতে চেয়েছেন। ২০২২ সালের নভেম্বরে মেটা ১১,০০০-এর বেশি কর্মীকে (মোট কর্মীর প্রায় ১৩%) ছাঁটাই করে এবং কয়েক মাস পর আরও ১০,০০০ কর্মী কমানোর ঘোষণা দেয়। অনেক কোম্পানি দ্রুত এই পথে হাঁটে। প্যান্ডেমিকের সময় অ্যামাজন অতিরিক্ত কর্মী নিয়োগ করেছিল। ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে অ্যামাজন ১৮,০০০ কর্মীকে ছাঁটাই করার ঘোষণা দেয় এবং দুই মাস পর আরও ৯,০০০ পদ কমানোর কথা জানায়। একই মাসে অ্যালফাবেট ১২,০০০ কর্মী ছাঁটাই করে, যা তাদের মোট কর্মীর প্রায় ৬%। গুগল এবং অন্যান্য সংস্থায় কর্মরত কর্মীরা সকালে ইমেলের (email) মাধ্যমে তাদের ছাঁটাইয়ের খবর পান এবং অফিসের ল্যাপটপের (laptop) অ্যাক্সেস (access) বন্ধ করে দেওয়া হয়।

অন্যদিকে, অ্যালফাবেটের সিইও সুন্দর পিচাইয়ের ২০২২ সালের আয় ছিল ২২৫ মিলিয়ন ডলার, যা একজন সাধারণ কর্মীর আয়ের চেয়ে প্রায় ৮০০ গুণ বেশি। কর্মী ছাঁটাইয়ের ঘোষণার পর কোম্পানির শেয়ারের দাম বাড়তে থাকে। মাইক্রোসফট, সেলসফোর্স এবং এসএপিও (SAP) তাদের কর্মী সংখ্যা কমিয়েছে। প্রযুক্তি খাতে কর্মী ছাঁটাই বেদনাদায়ক হলেও, অনেক ক্ষেত্রে কর্মীরা ভালো ক্ষতিপূরণ প্যাকেজ (severance package) পেয়েছেন। সম্প্রতি ছাঁটাই হওয়া গুগলের কর্মীরা ১৬ সপ্তাহের বেতন এবং প্রতি বছরের চাকরির জন্য অতিরিক্ত দুই সপ্তাহের বেতন পেয়েছেন। সেলসফোর্সের কর্মীরা কমপক্ষে পাঁচ মাসের বেতন পেয়েছেন। এয়ারটেবিলের (Airtable) সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার স্টিফেন ক্যাম্পবেল (Stephen Campbell) ২০২২ সালের ডিসেম্বরে চাকরিচ্যুত হন। তিনি ক্ষতিপূরণের অর্থ দিয়ে দুটি নতুন ব্যবসা শুরু করেছেন। রেভঅ্যাম্প এআই (RevAmp AI) গ্রাহক ডেটা থেকে তথ্য বের করতে মেশিন লার্নিং (machine learning) এবং জেনারেটিভ এআই (generative AI) ব্যবহার করে। অন্য ব্যবসাটি জেনারেটিভ এআইয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনার জন্য সরাসরি অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।

বর্তমানে সান ফ্রান্সিসকোতে জেনারেটিভ এআই নিয়ে ক্রিপ্টোকারেন্সির মতোই উত্তেজনা দেখা যাচ্ছে। প্রচুর পরিমাণে ভেঞ্চার ক্যাপিটাল (venture capital) জেনারেটিভ এআই স্টার্টআপে বিনিয়োগ করা হচ্ছে। তবে ক্রিপ্টোর (crypto) সাথে জেনারেটিভ এআইয়ের মূল পার্থক্য হলো, এটি বর্তমানে মানুষের সমস্যা সমাধান করছে এবং তাদের জন্য মূল্য তৈরি করছে। যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ ২০টি এআই কোম্পানির মধ্যে ১১টির সদর দপ্তর সান ফ্রান্সিসকোতে। সম্মিলিতভাবে, এই ব্যবসাগুলো ২০০৮ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে ১৫.৭ বিলিয়ন ডলার সংগ্রহ করেছে। বড় প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর অটোমেশন (automation) এবং এআইতে (AI) বিনিয়োগ সাম্প্রতিক কর্মী ছাঁটাইয়ের একটি কারণ হতে পারে। মেটার সিইও মার্ক জাকারবার্গ কর্মীদের জানিয়েছেন যে, এআইয়ের মতো সরঞ্জামগুলোতে বিনিয়োগ প্রকৌশলীদের আরও ভালোভাবে কোড (code) লিখতে, দ্রুত কাজ করতে এবং কাজের চাপ কমাতে সাহায্য করবে। ২০২২ সালে লিন্ডি (Lindy) প্রতিষ্ঠা করেন ক্রিস্টোফার ক্রিভেলো (Christopher Crivello)। তাদের এআই ব্যক্তিগত সহকারী কর্মীদের ইমেল লেখা, ক্যালেন্ডারে (calendar) আমন্ত্রণ পাঠানো এবং মিটিংয়ের (meeting) সময় নোট নেওয়ার মতো কাজগুলো স্বয়ংক্রিয় করতে সাহায্য করে।

জেনারেটিভ এআই বিশ্ব অর্থনীতিতে বছরে ২.৬ থেকে ৪.৪ ট্রিলিয়ন ডলার যোগ করতে পারে। প্রযুক্তিখাতে কর্মী ছাঁটাই হলেও, প্রকৃতপক্ষে এটি কর্মসংস্থান বাড়াতে সাহায্য করবে। অর্থনীতিতে একটি সাধারণ নিয়ম হলো, কোনো জিনিসের দাম কমলে তার পরিপূরক জিনিসের চাহিদা বাড়ে। প্রযুক্তি কর্মীরা এআইয়ের পরিপূরক। এআইয়ের কারণে প্রযুক্তি কর্মীরা আরও বেশি উৎপাদনশীল হবেন এবং যখন কোনো কিছু বেশি মূল্যবান হয়, তখন আমরা তা আরও বেশি পেতে চাই, কম নয়। কর্মী ছাঁটাইয়ের কারণে স্টিফেন ক্যাম্পবেলের খারাপ লাগেনি, বরং এটি তার জন্য একটি ইতিবাচক অভিজ্ঞতা ছিল।

প্রযুক্তি শিল্পে ছাঁটাইয়ের বড় প্রভাব পড়লেও, এই খাতটি উত্থান-পতনের সাথে পরিচিত। প্রযুক্তি শিল্পে সবসময় কর্মীদের পরিবর্তনের হার বেশি থাকে। কর্মীরা যেমন ক্যারিয়ার (career) গড়ার জন্য এক কোম্পানি থেকে অন্য কোম্পানিতে যান, তেমনি প্রযুক্তি শিল্পও বড় ধরনের উত্থান-পতনের শিকার হয়। দুই দশক আগে ডটকম বাবল (dot-com bubble) ফেটে যাওয়ায় ১০ লক্ষেরও বেশি মানুষ চাকরি হারিয়েছিলেন। ২০০৮ সালের মহামন্দার (Great Recession) কারণেও কর্মী ছাঁটাই হয়েছিল। ২০০১ সালের তুলনায় ২০০৮ সালে সিলিকন ভ্যালির (Silicon Valley) প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোতে ১৭% কম কর্মী ছিল। তবে এবারের পরিস্থিতিতে কিছু পার্থক্য রয়েছে। প্রযুক্তি কর্মীদের মধ্যে দুই তৃতীয়াংশ পুরুষ হলেও, ২০২২ এবং ২০২৩ সালে ছাঁটাই হওয়া কর্মীদের মধ্যে অর্ধেকের বেশি ছিলেন নারী। ছাঁটাইয়ের ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন এইচআর (HR) এবং ট্যালেন্ট সোর্সিং (talent sourcing), সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার এবং মার্কেটিংয়ের (marketing) কর্মীরা।

২০১৯ সালে মেটাতে যোগ দিয়েছিলেন বিয়াঙ্কা ব্রাউন (Bianca Brown)। ২০২৩ সালে প্রোগ্রাম ম্যানেজার (program manager) হিসেবে তিনি চাকরি হারান। ছাঁটাইয়ের আগের রাতে তিনি ঘুমাতে পারেননি। সকাল ৮টার দিকে তিনি ইমেল পান। এই পরিস্থিতিতে ভেঙে না পড়ে, তিনি নতুন বাস্তবতার সাথে মানিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। সমীক্ষায় দেখা গেছে, ছাঁটাই হওয়া কর্মীদের মধ্যে ৪৮% এর বয়স ৩০ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে। ৮৯% কর্মী যুক্তরাষ্ট্রের এবং তাদের কাজের গড় অভিজ্ঞতা প্রায় ১২ বছর। দীর্ঘমেয়াদী প্রবণতার তুলনায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রযুক্তি চাকরির সংখ্যা কিছুটা কম থাকলেও, ভবিষ্যতে প্রযুক্তি কর্মীদের চাহিদা বেশি থাকবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ২০২৩ সালের মে মাস পর্যন্ত প্রযুক্তি কর্মীদের বেকারত্বের হার ছিল ২%, যা জাতীয় গড় ৩.৭% এর চেয়ে অনেক কম। ঐ মাসে প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো ৪,৭০০ কর্মী কমালেও, তথ্য প্রযুক্তি পরিষেবা (IT services), ক্লাউড ইনফ্রাস্ট্রাকচার (cloud infrastructure), ডেটা প্রসেসিং (data processing) ও হোস্টিং (hosting) এবং প্রযুক্তি উৎপাদনে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে। ধারণা করা হয়েছে, ২০২১ থেকে ২০৩১ সালের মধ্যে সফটওয়্যার ডেভেলপারদের চাকরির সুযোগ ২৬% বাড়বে, যদি এআই এইসব কাজের সক্ষমতাও অর্জন না করে আরকি।

বর্তমানে প্রযুক্তি কর্মীদের জন্য চাকরির বাজার আগের মতো সহজ না থাকলেও, এই খাতের দক্ষতা এবং অভিজ্ঞতা এখনও অনেক মূল্যবান। প্রযুক্তি কর্মীরা এখন অন্যান্য শিল্পেও কাজ খুঁজে নিচ্ছেন, যেখানে তাদের দক্ষতার প্রয়োজন রয়েছে, যেমন আর্থিক পরিষেবা (financial services), উৎপাদন এবং সরকারি খাত। যুক্তরাষ্ট্রে প্রযুক্তি কর্মীরা বছরে গড়ে ৮৭,০০০ ডলার আয় করেন, যা যুক্তরাষ্ট্রের গড় বেতনের চেয়ে ৬০% বেশি। ক্যালিফোর্নিয়ার (California) প্রযুক্তি কর্মীরা বছরে প্রায় ১,১৭,০০০ ডলার আয় করেন। তা সত্ত্বেও, চাকরিপ্রার্থীদের মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতা দেখা যাচ্ছে। অনেকেই ১৫০টির বেশি চাকরির জন্য আবেদন করেও খুব কম সাক্ষাৎকারের (interview) সুযোগ পাচ্ছেন।

কর্মীদের অভিজ্ঞতা এবং সামাজিক মাধ্যমের ভূমিকা

একসময় প্রযুক্তি শিল্পের চাকরিতে মোটা বেতন এবং সীমাহীন সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যেত, কিন্তু সাম্প্রতিক কর্মী ছাঁটাইয়ের ঘটনা সেই চিত্রটি সম্পূর্ণ ভেঙে দিয়েছে। ব্রিটানি পিটস তার কর্মী ছাঁটাইয়ের ভিডিওটি পোস্ট করার কোনো অনুশোচনা করেননি। তিনি মনে করেন, এর মাধ্যমে তিনি যারা একইরকম পরিস্থিতির শিকার হয়েছেন, তাদের হয়ে কথা বলার সুযোগ পেয়েছেন। ২০-৩০ বছর আগে চাকরিচ্যুত হওয়া অনেক কর্মী এখনও সেই ঘটনার কষ্টের কথা মনে রেখেছেন। এই ধরনের বিষয়গুলো প্রকাশ্যে আনা দরকার, যাতে পরিবর্তন আনা যায়। সামাজিক মাধ্যমের (social media), যেমন টিকটক (TikTok) এবং ইউটিউব শর্টসের (YouTube shorts) প্রসারের কারণে কর্মীরা তাদের অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে দ্বিধা করছেন না। প্রায়ই কর্মী ছাঁটাইয়ের শিকার হওয়া ব্যক্তিরা লজ্জিত বোধ করেন, যদিও এর জন্য কোম্পানির নেতৃত্বেরই ব্যর্থতা দায়ী।

শেয়ার বাজারে ইতিবাচক প্রভাব

যেসব প্রযুক্তি কোম্পানি ব্যাপক হারে কর্মী ছাঁটাই করেছে, তাদের শেয়ারের দাম বেড়েছে। প্রযুক্তি নির্ভর নাসডাকের (Nasdaq) ২০২৩ সালে ৪৩% প্রবৃদ্ধি হয়েছে, যা ২০২০ সালের পর সবচেয়ে বেশি। মেটা বড় প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি লাভ করেছে, তাদের শেয়ারের দাম ১৯৪% এর বেশি বেড়েছে। প্রযুক্তি শেয়ারের এই উল্লম্ফন প্রযুক্তি বিলিয়নিয়ারদের (tech billionaires) সম্পদ বাড়াতেও সাহায্য করেছে। ২০২৩ সালে ধনী সিইওদের সম্পদ ৪৮% বা ৬৫৮ বিলিয়ন ডলার বৃদ্ধি পেয়েছে। গুগলের মতো কোম্পানির জন্য এই পরিস্থিতি কঠিন, কারণ গত ২৫ বছরে তাদের এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়নি। কোম্পানি সবসময় তাদের কর্মীদের নিয়ে ভাবে। কর্মী ছাঁটাই কোনো নেতিবাচক দিক নয়, বরং এটি বৃহত্তর চাহিদা, স্বয়ংক্রিয়তা এবং উৎপাদনশীলতা উন্নতির একটি লক্ষণ। শেয়ার বাজার কর্মী ছাঁটাইয়ের এই পদক্ষেপকে ইতিবাচকভাবে নিয়েছে। বিনিয়োগকারীরা এখন প্রবৃদ্ধির চেয়ে মুনাফাকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন। দুর্ভাগ্যবশত, কর্মী ছাঁটাই এখন একটি নতুন স্বাভাবিকতায় পরিণত হয়েছে।

অন্যান্য শিল্পে কর্মী ছাঁটাই

তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে প্রযুক্তি শিল্পে কর্মী ছাঁটাইয়ের সংখ্যা বাড়তে শুরু করে এবং ২০২৩ সালে তা সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছায়। কিছু অ-প্রযুক্তি খাতেও ব্যাপক কর্মী ছাঁটাই দেখা যাচ্ছে। এর প্রধান উদাহরণ হলো ইউপিএস (UPS)। কুরিয়ার সংস্থাটি জানুয়ারিতে ১২,০০০ কর্মী ছাঁটাইয়ের ঘোষণা করে। গণমাধ্যম শিল্পেও ২০২৩ সালে ২০,০০০-এর বেশি কর্মী ছাঁটাই হয়েছে এবং ২০২৪ সালেও প্যারামাউন্ট (Paramount), এনবিসি (NBC), স্পোর্টস ইলাস্ট্রেটেড (Sports Illustrated), লস অ্যাঞ্জেলেস টাইমসের (Los Angeles Times) মতো বড় সংস্থাগুলো কর্মী ছাঁটাইয়ের ঘোষণা করেছে। ব্যাংকিং খাতেও সিটিগ্রুপ (Citigroup), মর্গান স্ট্যানলি (Morgan Stanley), ডয়েচে ব্যাংকের (Deutsche Bank) মতো বড় সংস্থাগুলো ২০২৪ সালের জন্য কর্মী ছাঁটাইয়ের পরিকল্পনা ঘোষণা করেছে।

এত ব্যাপক হারে কর্মী ছাঁটাইয়ের খবর আলোচনার কেন্দ্রে থাকলেও, শ্রমবাজার এখনও শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছে। জানুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে ৩ লক্ষ ৫৩ হাজার নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে, যা ডাও জোন্সের (Dow Jones) পূর্বাভাসের চেয়ে অনেক বেশি। বেকারত্বের হার ৩.৭%-এ স্থির রয়েছে। প্রযুক্তিখাতে কর্মী ছাঁটাইয়ের এই ধারা অ-প্রযুক্তি খাতেও ছড়িয়ে পড়বে কিনা, তা নিয়ে বিশেষজ্ঞরা বিভক্ত। তবে ২০২৩ সালে প্রযুক্তিখাতে ব্যাপক ছাঁটাই হলেও, এর প্রভাব অন্য খাতে তেমন পড়েনি। প্রকৃতপক্ষে, কর্মী ছাঁটাইয়ের হার ঐতিহাসিকভাবে এখনও বেশ কম। তবে এই ধারা অব্যাহত থাকলে, কোম্পানি এবং ব্যক্তি উভয়কেই ব্যয় কমাতে হবে, যার প্রভাব প্রযুক্তি শিল্পের বাইরেও ছড়িয়ে পড়তে পারে।

ইউটিউব সামনে যা যা আনতে বা করতে যাচ্ছে (১৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৪)

ভূমিকা

ইউটিউবের সাফল্য এর প্রত্যেক ক্রিয়েটর (creator) ও শিল্পীর (artist) মতোই বৈচিত্র্যময়। এটা হতে পারে আত্মপ্রকাশের (self expression) জন্য, সম্প্রদায় গঠন ও খুঁজে পাবার (finding community) উদ্দেশ্যে, বা আর্থিক স্বাধীনতা (financial freedom) অর্জনের জন্য। ইউটিউব চাচ্ছে টেকসই সুযোগ নিয়ে আসতে, যাতে সবাই নিজের গতিপথ গড়ে নিতে পারে।

এবারে ইউটিউব সেই পথে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (AI) রূপান্তরমূলক শক্তিকে যুক্ত করছে। তারা মনে করে এটা তাদের দায়বদ্ধতারই অংশ,  এআই (AI) সৃজনশীলতার নতুন মাত্রা উন্মোচন করবে, আর তার শক্তি যেন ব্যবহারকারীদের সৃজনশীল দৃষ্টিভঙ্গির (creative vision) জন্য কাজে লাগানো যায়।

১. ড্রিম স্ক্রিন (Dream Screen) আরও স্বপ্নময় হবে গুগল ডিপমাইন্ডের ভিও (Veo) দিয়ে

২০২৩ সালে ইউটিউব দেখিয়েছিল কীভাবে ড্রিম স্ক্রিন (Dream Screen) ইউটিউব শর্টসে (YouTube Shorts) কাল্পনিক সব ব্যাকগ্রাউন্ড (backgrounds) তৈরি করতে দেয়—এই পটভূমি কেবল আপনার কল্পনার সীমায় আবদ্ধ। ইতিমধ্যে বিশ্বজুড়ে লাখো মানুষ এটি ব্যবহার করছেন, কিন্তু এটা ভবিষ্যতের অফুরন্ত সম্ভাবনার অগ্রভাগ মাত্র। এটা স্রেফ আপনার সৃজনশীলতাকে (creativity) ক্ষমতায়ন (empowering) করতে, প্রতিস্থাপন (replacing) করতে নয়।

তারা এবারে ইউটিউব শর্টসে গুগল ডিপমাইন্ডের (Google DeepMind) সর্বাধুনিক ভিডিও-জেনারেটিং মডেল, ভিও (Veo) সংযুক্ত করতে যাচ্ছে।

  • আপনি আরও অবিশ্বাস্য ভিডিও ব্যাকগ্রাউন্ড বানাতে পারবেন, এমন ধারণাগুলো বাস্তব করতে যা আগে অসাধ্য ছিল। কল্পনা করুন, একজন বুকটিউবার (BookTuber) ক্লাসিক উপন্যাস The Secret Garden-এর পৃষ্ঠায় ঢুকে যাচ্ছেন, অথবা একজন ফ্যাশন ডিজাইনার (fashion designer) মুহূর্তেই মজার ও উদ্ভাবনী ডিজাইনের ধারণা শেয়ার করছেন।
  • প্রথমবারের মতো, শুধু ব্যাকগ্রাউন্ড নয়, আপনি ৬ সেকেন্ডের স্বতন্ত্র ভিডিও ক্লিপও (standalone video clips) তৈরি করতে পারবেন শর্টসের (Shorts) জন্য, ভিও (Veo)-র সাহায্যে। ধরুন, আপনি নিজের ধারণকৃত ফুটেজের (footage) মধ্যে একটা অংশে কিছু অভাব অনুভব করছেন, যেটা পুরো ভিডিওর সুরের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়—এই ফিচার দিয়ে আপনি সহজেই একটি ক্লিপ তৈরি করতে পারবেন, যা আপনার পুরো কনটেন্টের (content) সঙ্গে মিশে যাবে।
  • এই সৃষ্টিগুলোতে সিংথআইডি (SynthID) ব্যবহার করে ওয়াটারমার্ক (watermark) যোগ করা হবে, সঙ্গে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেওয়া হবে যে এটি “AI দ্বারা তৈরি” (generated with AI)।

২. ইউটিউব ইনস্পিরেশন ট্যাব (YouTube Inspiration Tab)

নতুন আর আকর্ষণীয় ভাবনা পাওয়া কঠিন হতে পারে। তাই তারা এবার ইনস্পিরেশন ট্যাবকে (Inspiration Tab) এক নতুন রূপে সাজাচ্ছে – একটি জেনারেটিভ এআই (generative AI)-চালিত ব্রেইনস্টর্মিং (brainstorming) সাথী হিসেবে। এটি আপনাকে গাইডলাইন বা পরামর্শ দেবে, সেখান থেকে আপনি পূর্ণাঙ্গ প্রকল্প (fully-fledged projects) বানাতে পারবেন—ভিডিও আইডিয়া (video ideas), শিরোনাম (titles), থাম্বনেল (thumbnails) আর আউটলাইন (outlines)—যা আপনার স্টাইলের সঙ্গে মানানসই।

২০২৫ সালে তারা এমন একটি শর্টকাট (shortcut) আনতে যাচ্ছে, যা আপনাকে যেকোনো উৎস থেকে (যেমন, আপনার শীর্ষ মন্তব্য, অন্য ভিডিও, এমনকি নিজের ভিডিয়ো তালিকা) সরাসরি এই ইনস্পিরেশন ট্যাবে নিয়ে যাবে।

৩. আরও গভীর সংযোগ গড়ে তোলা (Building deeper connections)

ইউটিউবে আপনার সবচেয়ে নিবেদিতপ্রাণ ভক্তদের (loyal fans) সঙ্গে এক বিশেষ বন্ধন গড়ে ওঠে—যারা কখনোই আপনার আপডেট মিস করে না। তাদের সঙ্গে সংযোগ আরও গাঢ় করার জন্য কিছু নতুন সুযোগ:

  1. কমিউনিটিজ (Communities): মন্তব্যের (comments) বাইরে এসে ক্রিয়েটরের চ্যানেলগুলোতে (creator’s channels) নিজস্ব এক “ইন্টারনেট কোণ” তৈরি করা হচ্ছে। এটি হবে এক কেন্দ্রস্থল, যেখানে ভিডিও নিয়ে আলোচনা, ফ্যান আর্ট (fan art) শেয়ার, একই মনোভাবাপন্ন মানুষদের (like-minded individuals) সঙ্গে সংযোগ আর একটি প্রাণবন্ত সম্প্রদায় (belonging) গড়ে তুলতে পারবেন। এই ফিচার এখন সীমিত কিছু চ্যানেলে চালু; চলতি বছর আরও বিস্তৃত পরিসরে পরীক্ষা করা হবে, আর ২০২৫ সালের শুরুর দিকে আরও চ্যানেলে বিস্তৃতভাবে চালু হবে।
  2. হাইপ (Hype): নতুন বা উদীয়মান ক্রিয়েটরদের (rising stars) উচ্চতর পরিচিতি দিতে পাবে “হাইপ” ব্যবস্থা। ফ্যানরা “হাইপিং” করে তাদের পছন্দের ক্রিয়েটরকে নতুন দর্শকের কাছে তুলে ধরতে পারে। সবচেয়ে বেশি হাইপ পয়েন্ট পাওয়া ভিডিওগুলো এক বিশেষ লিডারবোর্ডে (leaderboard) উঠবে, যা তাদের আরো আলোচনায় আসতে সাহায্য করবে। আমরা ইতিমধ্যে ব্রাজিল, তুরস্ক ও তাইওয়ানে পরীক্ষা করেছি, শিগগিরই আরও দেশে প্রসারিত করব।
  3. অটো ডাবিং (Auto Dubbing): তারা একটি ডাবিং টুল (dubbing tool) পরীক্ষা করছে, যাতে আপনি আপনার ভিডিওয় অন্য ভাষায় অডিও ট্র্যাক তৈরি করতে পারেন। সীমিত সংখ্যক ক্রিয়েটরদের সঙ্গে পরীক্ষা শুরু হয়েছে, শিগগিরই আরও অনেকের কাছে পৌঁছাবে। এগুলো স্প্যানিশ (Spanish), পর্তুগিজ (Portuguese), ফরাসি (French), ইতালীয় (Italian), হিন্দী (Hindi) ইত্যাদি ভাষা সমর্থন করে, পরে আরও ভাষা যুক্ত হবে। ফলে আরও বেশি মানুষের কাছে আপনার কনটেন্ট (content) পৌঁছানো সহজ হবে। সেই সাথে তারা একটি নতুন ফিচার পাইলট করছে, যা আপনার আসল কণ্ঠস্বরের (tone and intonation) আভা বা পরিবেশ (ambiance) ধরে রাখবে, এবং এর ফলে ডাব করা অডিওকে আরো বেশি প্রাকৃতিক (natural) শোনাবে।
  4. কমিউনিটি ট্যাব (Community Tab) পুর্নগঠন: ইউটিউব স্টুডিও অ্যাপে (YouTube Studio app) কমেন্টস ট্যাবকে (Comments tab) রূপান্তর করে নাম দেয়া হচ্ছে ‘কমিউনিটি’ (Community)। এখানে আরও গভীর ভক্ত-সম্পৃক্ততা (fan engagement) হবে। মন্তব্যের স্তুপে জবাব দেওয়া কঠিন হয়, তাই তারা এআই (AI)-সমর্থিত রিপ্লাই সাজেশন (reply suggestions) দিতে যাচ্ছে, যা আপনার স্টাইলের সঙ্গে মিল রেখে আপনাকে প্রাথমিক খসড়া দেবে, আর আপনি সহজে কাস্টমাইজ করে ফেলতে পারবেন। পাশাপাশি আরও কিছু সময়-সাশ্রয়ী (time-saving) টুল—যেমন কমিউনিটি স্পটলাইট ও দর্শক ম্যাট্রিকস—শিগগিরই আসছে।

৪. ব্যবসা গড়ার আরও নতুন উপায় (Unlocking more avenues to build a business)

বর্তমানে ইউটিউবই (YouTube) একমাত্র প্ল্যাটফর্ম যা বড় পরিসরে (at scale) ক্রিয়েটরদের সঙ্গে রাজস্ব ভাগ করে (revenue sharing), একাধিক ফরম্যাটজুড়ে। ইউটিউব পার্টনার প্রোগ্রাম (YouTube Partner Program) অন্য যেকোনো ম্যানিটাইজেশন প্ল্যাটফর্মের তুলনায় বেশি পরিশোধ করে, গত তিন বছরে তারা $৭০ বিলিয়ন দিয়েছি ক্রিয়েটর (creators), শিল্পী (artists) ও মিডিয়া কোম্পানিগুলোকে। যেহেতু তাদের ক্রিয়েটর-ইকোসিস্টেম (creator ecosystem) বড় হচ্ছে, তারা চাচ্ছে আরও অনেক ক্রিয়েটর যাতে সুযোগ পায়, তারা যেকোন ফরম্যাটে কাজ করুক, যেকোন সময় কাজ শুরু করুক।

(ক) গিফটস (Gifts), জুয়েলস (Jewels): গিফটস চালু হচ্ছে, যে ডিজিটাল আইটেমগুলোর পেছনে জুয়েলস (Jewels) রয়েছে। এগুলো রিয়েল-টাইম ফ্যান এঙ্গেজমেন্ট (fan engagement) ঘটাবে, আর এক নতুন উপায়ে ক্রিয়েটরেরা অর্থ উপার্জন করতে পারবেন। প্রথমে এই ফিচার ভার্টিক্যাল লাইভস্ট্রিম (vertical livestreams)-এ শুরু হবে (US-এ), যাতে দর্শকরা মুহূর্তের উত্তেজনা প্রকাশ করতে পারে।

(খ) ইউটিউব শপিং (YouTube Shopping): ইতিমধ্যে ২৫০,০০০+ ক্রিয়েটর ইউটিউব শপিং-এ যুক্ত আছেন! ইউটিউব শপিং অ্যাফিলিয়েট প্রোগ্রাম (affiliate program) এখন US ও দক্ষিণ কোরিয়ায় (South Korea) সচল, এবং আজ তারা ইন্দোনেশিয়ায় (Indonesia) চালু করছি, সেখানে শপির (Shopee) সঙ্গে অংশীদারিত্বে। অল্প কিছুদিনের মধ্যে থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামে প্রসারিত হবে, যাতে বিশ্বজুড়ে আরও ক্রিয়েটর পছন্দের পণ্য (products) ভক্তদের কাছে তুলে ধরতে পারেন, এবং ব্যবসার (business) বিস্তৃতি ঘটাতে পারেন।

(গ) লিভিং রুমে (Living room) ইউটিউব কনটেন্ট: আজকাল টিভির বড় পর্দায় (TV screens) ইউটিউব দেখা ক্রমশ জনপ্রিয়। অনেক ক্রিয়েটরই এই বড় পর্দার জন্য বিশেষভাবে কনটেন্ট তৈরি করছেন, এবং এতে তাদের আয় (revenue) বৃদ্ধি পাচ্ছে। গত বছরের তুলনায় টিভি পর্দায় আয় করা ক্রিয়েটরের সংখ্যা ৩০% বেড়েছে। তাই ইউটিউব অচিরেই ক্রিয়েটরদের কনটেন্টকে সিজন (seasons) ও এপিসোড (episodes) আকারে বিন্যস্ত করার সুবিধা আনতে যাচ্ছে, যেন দর্শকদের জন্য “ওয়ান-স্টপ” এর মতো হয়ে ওঠে। সঙ্গে আরও কিছু আপডেট আসছে, যেমন ইমারসিভ কনটেন্ট (immersive content) যা সরাসরি ক্রিয়েটরের চ্যানেল থেকে চালু হবে, সাবস্ক্রিপশন সহজতর, ভিডিওর ডিসক্রিপশনে (description) থাকা লিংকে প্রবেশ করা আরও সহজ।

শেষ কথা

ইউটিউব তাদের বৈশ্বিক সম্প্রদায়ের (global community) জন্য নিরলসভাবে নতুনত্ব আনার পথে আছে। ইউটিউব ইতিমধ্যেই স্ট্রিমিং মার্কেটে সবচেয়ে এগিয়ে। এই খাতে তারা নেটফ্লিক্স ও ডিজনিকে টপকে উপরে উঠে গেছে। ইউটিউব চালু হয়েছিল ২০০৫ সালে—গুগল (Google) তা কিনে নেয় ২০০৬ সালে ১.৬৫ বিলিয়ন ডলারে। সে সময় কেউ কল্পনাও করেনি যে এটি একদিন সবচেয়ে শক্তিশালী ভিডিও প্ল্যাটফর্মে পরিণত হবে। যদিও শুরুতে ইউটিউবের মূল পরিচয় ছিল: “যে কেউ ভিডিও আপলোড করতে পারে, আর অন্যরা তা দেখে আনন্দ পেতে পারে”—একটি ব্যবহারকারী-সৃষ্ট কনটেন্টের (user-generated content) প্ল্যাটফর্ম। অনেকেই এটিকে হালকাভাবে নিতেন, ভাবতেন এখানে কেবল বিড়ালের ভিডিও বা বাড়তি বিনোদন মেলে। কিন্তু এখন আর আগের সেই অবস্থা নেই। যুগের পরিবর্তন হয়েছে। প্রথমে মানুষ টেলিভিশন ছেড়ে অনলাইনের স্ট্রিমিং সারভিস যেমন নেটফ্লিক্সে মুভ করেছে, আর তারপর এগুলো দেখার পরিমাণ কমিয়ে দিয়ে ইউটিউবের বিভিন্ন ভিডিওতেই সবচেয়ে বেশি সময় কাটানো শুরু করেছে। আর ইউটিউব সামনে এটা আরও বাড়াবে। বর্তমান এআই বিপ্লবের সম্ভাব্য সকল সুফলই ব্যবহার করবে ইউটিউব। বিশ্ব যখন এআই এর দ্বারা জব রিপ্লেসমেন্টের আতঙ্কে শঙ্কিত, সেখানে ইউটিউব এআই-কে কাজে লাগাতে চাচ্ছে ক্রিয়েটরদের সৃজনশীলতার বিকাশে, মানুষকে আরও সৃষ্টিশীল করার উদ্দেশ্যে। সময়ই বলে দেবে আগামী এআই আমাদের কোন পথে নিয়ে যায়, আর এখানে যদি কোন ইতিবাচক কিছু থাকে, এটুকু বলতে পারি তাতে ইউটিউবের একটা ভাল ভূমিকা থাকবে।

তথ্যসূত্র

A future full of opportunities, Made On YouTube – YouTube Blog

স্ট্রিমিং যুদ্ধে ইউটিউব কীভাবে নেটফ্লিক্স ও ডিজনিকে পেছনে ফেলল? (২৬ জুন, ২০২৪)

ভূমিকা: বিনোদন জগতের রূপান্তর

দীর্ঘদিন ধরে বিনোদন জগতে প্রচলিত টেলিভিশন (television) ছিল গ্রাহকদের কাছে মূল আকর্ষণ। কেবল সংযোগ (cable subscription), উপগ্রহ টিভি (satellite) কিংবা স্থানীয় চ্যানেলে অভ্যস্ত মানুষজন একটা নির্দিষ্ট সময়সূচিতে অনুষ্ঠান দেখেই সন্তুষ্ট থাকতেন। কিন্তু ২১ শতকে এসে ডিজিটাল প্রযুক্তির প্রসার, ইন্টারনেটের গতি বৃদ্ধি ও স্মার্ট ডিভাইসের সর্বব্যাপী উপস্থিতি পুরো চিত্রটি পাল্টে দিয়েছে। ক্রমেই মানুষ টিভি ছেড়ে স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মে (streaming platforms) চলে যাচ্ছেন—যাকে বলা হয় “কর্ড-কাটিং (cord cutting)”: অর্থাৎ ঐতিহ্যবাহী টিভি সংযোগ ছাড়াই সরাসরি ইন্টারনেটের মাধ্যমে কনটেন্ট দেখা।

এই পটভূমিতে একদা ডিভিডি ভাড়া দেওয়ার ব্যবসা থেকে শুরু করে ইন্টারনেট-নির্ভর প্ল্যাটফর্মে রূপান্তরিত হওয়া নেটফ্লিক্স (Netflix) বিশাল আলোড়ন তুলে বসে। স্ট্রিমিং বিষয়ে পথিকৃৎ (pioneer) হিসেবে তারা বিনোদনশিল্পকে (entertainment industry) নতুন করে ভাবতে বাধ্য করে। ফলে এমাজন প্রাইম (Amazon Prime), হুলু (Hulu), ডিজনি+ (Disney+), প্যারামাউন্ট+ (Paramount+) প্রভৃতি উত্থান দেখা যায়। বড় বড় কোম্পানিও নিজেদের স্ট্রিমিং সার্ভিস নিয়ে মাঠে নামে। এভাবে একে বলা হয় “স্ট্রিমিং ওয়ারস (streaming wars)”: কে সব থেকে বেশি গ্রাহক বা দর্শক আকর্ষণ করবে, কে সবচেয়ে জনপ্রিয় হবে।

অনেকদিন ধরেই ধারণা করা হচ্ছিল, সম্ভবত নেটফ্লিক্সই এই সংগ্রামের কেন্দ্রবিন্দু ও রাজা। কারণ তারাই সাবস্ক্রিপশন-ভিত্তিক (subscription-based) স্ট্রিমিং-এর গোড়াপত্তন করেছে, বিশাল গ্রাহকভিত্তি তৈরি করেছে এবং বিশ্বজুড়ে ডিজিটাল কনটেন্ট নিয়ে শীর্ষস্থানে উঠেছে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে দেখা যাচ্ছে অন্য এক প্ল্যাটফর্ম আশ্চর্যজনকভাবে সবাইকে পেছনে ফেলেছে: ইউটিউব (YouTube)। ঠিক কীভাবে এটি ঘটছে, কেন ইউটিউব এখন এত প্রভাবশালী, আর ভবিষ্যতে এর পরিণাম কী—সেই আলোচনাই এই আর্টিকেলের মূল লক্ষ্য।

স্ট্রিমিং যুগে নতুন বাস্তবতা

ঐতিহ্যবাহী টিভির পতন ও স্ট্রিমিং প্রসার

যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক দেশে কেবল টিভি বা স্যাটেলাইট টিভির সাবস্ক্রিপশন হ্রাস পেয়ে চলেছে। কারণ মানুষ পছন্দের অনুষ্ঠান যখন-তখন দেখতে চান, বিজ্ঞাপনের বিরক্তি এড়াতে চান, অথবা মাসিক ব্যয় (subscription fee) কমাতে চান। অন্যদিকে, স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মগুলো (Netflix, Amazon Prime, Disney+, ইত্যাদি) গ্রাহকদের ইচ্ছামতো কনটেন্ট দেখার স্বাধীনতা দেয়, যেখানে আগ্রহী দর্শক মাত্র কয়েকটি বোতাম চেপেই নিজেদের প্রিয় সিরিজ, চলচ্চিত্র বা ডকুমেন্টারি উপভোগ করতে পারেন।

নেটফ্লিক্স এমন একটি প্রতিষ্ঠান যা খুব অল্প সময়ে বিনোদনশিল্পে “মিডিয়া ডিস্টরাপ্টর (media disruptor)” হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। তারা অন্যদের কনটেন্টের লাইসেন্স (license) কেনার পাশাপাশি নিজস্ব অরিজিনাল সিরিজ ও চলচ্চিত্র (Original Content) তৈরি করে বাজারে সাড়া জাগিয়েছে। এর ফলে ঐতিহ্যবাহী বড় বড় স্টুডিও বা টিভি নেটওয়ার্কও স্ট্রিমিং-এ নিজেদের জায়গা পাকা করতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। অনেকে বলছিলেন, “স্ট্রিমিং যুদ্ধের বিজয়ী তো নেটফ্লিক্সই।”

কিন্তু সাম্প্রতিক পরিসংখ্যানে উঠে আসছে আরেক নতুন (বা বরং পুরোনো) নাম: ইউটিউব (YouTube)। কিছুদিন আগে পর্যন্ত হয়তো কেউ এটিকে “সোশ্যাল মিডিয়া” বা “ভিডিও শেয়ারিং প্ল্যাটফর্ম” হিসেবেই বেশি দেখতেন। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, সময় ব্যয় (time spent) ও মোট ভিউয়িং (viewing) এর বিচারে ইউটিউব সবার চেয়ে এগিয়ে আছে। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে, ইউটিউব আজ নেটফ্লিক্সকেও পেছনে ফেলেছে।

ইউটিউব: নতুন নয়, তবে নতুন উচ্চতায়

ইউটিউব চালু হয়েছিল ২০০৫ সালে—গুগল (Google) তা কিনে নেয় ২০০৬ সালে ১.৬৫ বিলিয়ন ডলারে। সে সময় কেউ কল্পনাও করেনি যে এটি একদিন সবচেয়ে শক্তিশালী ভিডিও প্ল্যাটফর্মে পরিণত হবে। যদিও শুরুতে ইউটিউবের মূল পরিচয় ছিল: “যে কেউ ভিডিও আপলোড করতে পারে, আর অন্যরা তা দেখে আনন্দ পেতে পারে”—একটি ব্যবহারকারী-সৃষ্ট কনটেন্টের (user-generated content) প্ল্যাটফর্ম। অনেকেই এটিকে হালকাভাবে নিতেন, ভাবতেন এখানে কেবল বিড়ালের ভিডিও বা বাড়তি বিনোদন মেলে।

কিন্তু ২০২০-এর দশকে এসে দেখা যাচ্ছে, ইউটিউব কেবল স্মার্টফোন বা ল্যাপটপে নয়, ঘরের বড় পর্দা—টিভিতেও—ব্যাপকভাবে দেখা হচ্ছে। পরিসংখ্যান বলছে এখন ইউটিউবের অর্ধেকের বেশি ভিউ টিভি স্ক্রিন থেকে আসে। বহু মানুষ, বিশেষত তরুণ প্রজন্ম, কেবল টিভির অনুষ্ঠান দেখার বদলে ইউটিউব চালিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিভিন্ন কনটেন্ট উপভোগ করছেন। ফলত সামগ্রিক টিভি ব্যবহারের (total TV usage) একটি বড় অংশজুড়েই ইউটিউবের আধিপত্য।

হিসাব বলছে, কিছু সময়ের জন্য নেটফ্লিক্স হয়তো সময় খাতে (total usage) ৭%-এর মতো দখল ধরেছিল, কিন্তু ইউটিউব আরো বেশি সময় ও দর্শক ধরে রেখেছে। উপরন্তু, অন্যান্য সব ব্রডকাস্ট বা কেব্‌ল মালিকানাধীন নেটওয়ার্কগুলোর চেয়েও ইউটিউব এগিয়ে—ব্যতিক্রম শুধু ডিজনি, যারা ডিজনি+, হুলু, ইএসপিএন (ESPN), এবিসি (ABC) থেকে শুরু করে আরও বহু কেবল চ্যানেল নিয়ন্ত্রণ করে।

ইউটিউবের মূল শক্তি: ফ্রি মডেল ও বিশাল কনটেন্ট লাইব্রেরি

বিনামূল্যে প্রবেশ ও বিজ্ঞাপন-নির্ভর আয়

অনেক স্ট্রিমিং সার্ভিসে মাসিক ফি (subscription fee) দিতে হয়, যা অনেকের কাছে বোঝা মনে হতে পারে। গ্রাহকদের কাঁধে বেশি খরচ না চাপিয়ে বিনোদন কীভাবে দেওয়া যায়, ইউটিউব সেটির এক অনন্য নজির। কারণ প্ল্যাটফর্মটি বিনামূল্যে (free) ব্যবহার করা যায়, যদিও বিজ্ঞাপন (advertising) দেখানো হয়। তরুণ দর্শকদের জন্য বিজ্ঞাপন দেখা অনেকটা স্বাভাবিক; তারা সাবস্ক্রিপশন ফি না দিয়ে বিজ্ঞাপন মেনে নিতে রাজি।

ইউটিউবের ব্যবসায়িক মডেল বিজ্ঞাপন-নির্ভর হওয়ায় কনটেন্ট দেখার জন্য গ্রাহককে পৃথক খরচ করতে হয় না। একইসঙ্গে কোম্পানিটি বিজ্ঞাপনের আওতা বাড়িয়ে নিয়ে বিশাল আকারের আয় সৃষ্টি করে। ২০২৩ সালের প্রথম প্রান্তিকে (Q1), ইউটিউব বিজ্ঞাপন রাজস্ব (ad revenue) আগের বছরের তুলনায় ২১% বেড়েছে। এটি দেখায় যে ঐতিহ্যবাহী টিভি-নেটওয়ার্ক বা স্ট্রিমিং সার্ভিস যখন বিজ্ঞাপনদাতাদের ধরে রাখার লড়াইয়ে হিমশিম খায়, ইউটিউব তখন অনায়াসে সেই বাজার দখল করে নিচ্ছে।

দর্শকদের জন্য এটি সুবিধাজনক, কারণ বিনামূল্যে অফুরন্ত কনটেন্ট মেলে। যারা বিজ্ঞাপন এড়াতে চান, তারা চাইলে পেইড (paid) সাবস্ক্রিপশন, যেমন ইউটিউব প্রিমিয়াম (YouTube Premium), বেছে নিতে পারেন—কিন্তু সেটি বাধ্যতামূলক নয়। ফলে প্ল্যাটফর্মের ব্যবহারযোগ্যতা (user friendliness) বহুগুণ বেড়ে যায়।

ব্যবহারকারী-সৃষ্ট কনটেন্টের (User-Generated Content) অফুরন্ত ভাণ্ডার

ইউটিউবের বড় শক্তি হলো, প্ল্যাটফর্মটি নিজে কনটেন্ট তৈরি করে না। গোটা দুনিয়ার কোটি কোটি ক্রিয়েটর (creators) প্রতিদিন লাখ লাখ ভিডিও আপলোড করে। হিসাব বলছে প্রতিদিন প্রায় ৩.৭ মিলিয়ন নতুন ভিডিও যুক্ত হয়, যা দিনে ২,৭০,০০০ ঘণ্টারও বেশি কনটেন্ট! এই বিপুল পরিমাণ কনটেন্টের বৈচিত্র্য অকল্পনীয়—শিক্ষামূলক ভিডিও, ভ্রমণ ব্লগ, গেমিং, ডকুমেন্টারি, রান্না, কমেডি, শর্ট ফিল্ম—যা খুশি।

এই বিশাল লাইব্রেরি তৈরি করতে ইউটিউবের (সংস্থা হিসেবে) আলাদা কোনো বড় বাজেটের সিনেমা বা সিরিজ প্রযোজনা করতে হয় না। স্টুডিও কেনা বা পরিচালনা করা, বড় বড় অভিনেতা-অভিনেত্রী বা নির্মাতাকে চুক্তিবদ্ধ করার ঝামেলা নেই। তারা কেবলমাত্র একটি প্ল্যাটফর্ম সরবরাহ করে, যার প্রযুক্তিগত অবকাঠামো (infrastructure) আর অ্যালগরিদম ভিত্তিক সুপারিশ (algorithmic recommendation) দর্শকদের কাছে কনটেন্ট পৌঁছে দেয়। এতে তারা বিশাল অর্থ সাশ্রয় করে, আর বিজ্ঞাপন থেকে আয় বাড়ায়।

অন্যদিকে, ভিডিও নির্মাতারা স্বতন্ত্রভাবে কাজ করেন, নিজেদের চ্যানেল তৈরি করেন, ভিউয়ারের সঙ্গে সরাসরি সংযোগ স্থাপন করেন। এর ফলে কনটেন্টের বৈচিত্র্য নিরন্তর বাড়তে থাকে। গুগল/ইউটিউব এই বিজ্ঞাপন রাজস্বের একটি অংশ “ইউটিউব পার্টনারশিপ প্রোগ্রাম (YouTube Partnership Program)” এর মাধ্যমে নির্মাতাদের দেয়, যা নিয়ে অনেকেই নিজেদের চ্যানেলকে পেশাগতভাবে পরিচালনা করেন। সাম্প্রতিক তথ্যমতে, গত তিন বছরে ইউটিউব নির্মাতাদের (creators) ৭০ বিলিয়ন ডলারের বেশি অর্থ প্রদান করেছে।

ক্রমবর্ধমান টিভি উপস্থিতি

প্রথম দিকে ইউটিউবকে অনেকে ফোন বা কম্পিউটারে দেখার প্ল্যাটফর্ম বলে ভাবতেন। কিন্তু এখন অনেক মানুষ স্মার্ট টিভি (Smart TV), অ্যাপল টিভি (Apple TV), রোকু (Roku) কিংবা গেম কনসোলের (game console) সাহায্যে ইউটিউব চালান বড় পর্দায়। এতে ইউটিউব আর আগের মতো ছোটখাটো “সেকেন্ডারি স্ক্রিন”-এর মাধ্যম নয়; এটি হয়ে উঠেছে পারিবারিক বিনোদনের (family entertainment) মূলমঞ্চ। যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি মাসে ১৫০ মিলিয়ন মানুষ “কনেক্টেড টিভি” (connected TV) ব্যবহার করে ইউটিউব দেখছেন, এবং এই সংখ্যাটি দ্রুত বাড়ছে।

এমনকি যারা নেটফ্লিক্স বা অন্যান্য স্ট্রিমিং-সার্ভিসের গ্রাহক, তারাও প্রায়শ ইউটিউবে সুইচ করে দীর্ঘ সময় কাটাচ্ছেন। কারণ এখানে পছন্দের কোনো ব্লগার, গেমার, রেসিপি তৈরিকারী বা কমেডিয়ানের ভিডিও ধারাবাহিকভাবে পাওয়া যায়। যেকোনো মুহূর্তে নতুন এপিসোড বা আপডেট সরাসরি আপলোড হয়, যেটা ঐতিহ্যবাহী সিরিজ বা শো-এর তুলনায় অনেক বেশি ফ্রেশ অনুভব করে।

তরুণ দর্শকদের আকর্ষণ: নেটফ্লিক্স ও ডিজনি কেন পিছিয়ে?

জেন জি (Gen Z) ও মিলেনিয়ালদের নতুন রুচি

একাধিক জরিপে দেখা গেছে, কিশোর ও তরুণদের মধ্যে ইউটিউবের চাহিদা আকাশছোঁয়া। পিউ রিসার্চ (Pew Research) জানায়, ৭১% কিশোর দৈনিক ইউটিউব ব্যবহার করে, আর প্রায় ২০% বলেছে তারা “প্রায়ই সারাক্ষণ” ইউটিউবে থাকে। এই হার উল্লেখযোগ্যভাবে নেটফ্লিক্স, ডিজনি+ বা অন্য প্ল্যাটফর্মগুলোর চেয়ে বেশি।

কারণ, এখন তরুণরা ইউজার-জেনারেটেড কনটেন্টকে (UGC) প্রাধান্য দেয়। তারা মনে করে, ইউটিউবের ক্রিয়েটরের সাথে সরাসরি যুক্ত হওয়া যায়, তাদের জীবনকাহিনি বা নিয়মিত আপডেটের সঙ্গে পরিচিত হওয়া যায়। এটি একধরনের ব্যক্তিগত সংযোগের (personal connection) অনুভূতি দেয়, যা ঐতিহ্যবাহী টিভি শো-তে তুলনামূলক দুর্লভ।

‘বিগ বাজেট’ বনাম ‘পার্সোনাল টাচ’

নেটফ্লিক্স বা ডিজনির মতো প্ল্যাটফর্মে অসংখ্য বড় বাজেটের সিরিজ ও সিনেমা পাওয়া গেলেও, সেগুলো দেখার জন্য গ্রাহককে মাসিক ফি দিতে হয়, আর সেখানে নির্মাতা ও দর্শকের মাঝে সরাসরি যোগাযোগের সুযোগ থাকে না। অন্যদিকে ইউটিউব ক্রিয়েটরেরা সাধারণত নিয়মিত আপলোড (daily/weekly uploads) করেন, ভিউয়ারের মন্তব্যে (comments) সাড়া দেন, কখনও লাইভ স্ট্রিম (live stream) চালান, কোনো বড় সিজনাল গ্যাপ ছাড়াই কনটেন্ট জারি থাকে। এতে দর্শক এক ‘বন্ধুত্বপূর্ণ’ অনুভূতি পান।

এর পাশাপাশি, কোভিড মহামারির সময় মানুষ ঘরে বন্দি থাকা অবস্থায় ইউটিউব শুধু প্যাসিভ বিনোদন দেয়নি, বরং সামাজিক যোগাযোগের (social connection) একটা বিকল্প হয়ে উঠেছে। কেউ কারও ভিডিওতে লাইভ চ্যাট করে, কেউবা ভ্লগ দেখে একাকিত্ব কাটায়। এতেই বোঝা যায়, তরুণদের কাছে ইউটিউব আরও নৈকট্যময় ও সংগঠিত প্ল্যাটফর্ম।

বিজ্ঞাপনদাতা ও রাজস্বের জোয়ার

টিভি-সাবস্ক্রিপশন ধস নামার ফলে ঐতিহ্যবাহী বিজ্ঞাপনদাতারা নতুন গন্তব্য খুঁজছেন। ইউটিউব অগাধ দর্শকসমুদ্র ও লক্ষ্যভিত্তিক বিজ্ঞাপন (targeted ads) প্রযুক্তি দেয়। তাই এখানে বিজ্ঞাপনকারীরা (advertisers) স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। ফলত ইউটিউবের বিজ্ঞাপন আয় ব্যাপক বৃদ্ধি পায়। শুধু ২০২৩ সালেই ইউটিউবের বার্ষিক গ্লোবাল অ্যাড রেভিনিউ (global advertising revenue) ছিল প্রায় ৩১.৫ বিলিয়ন ডলার, যা বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ মিডিয়া কোম্পানিগুলোর একটির (যেমন প্যারামাউন্ট গ্লোবাল, Paramount Global) পুরো বার্ষিক আয়ের চেয়েও বেশি।

ইউটিউব তার সাফল্য নির্মাতাদের সঙ্গে ভাগ করে নেয়, একে “রেভিনিউ শেয়ারিং (revenue sharing)” বলে। বিশাল সংখ্যক ক্রিয়েটর এই প্ল্যাটফর্মে আয়ের সুযোগ পেয়ে নিজেদের “ইউটিউব ক্যারিয়ার” গড়ে তুলেছে। এটি এমন এক ইকোসিস্টেম (ecosystem) তৈরি করছে, যেখানে ক্রিয়েটররা ধারাবাহিকভাবে ভালো কনটেন্ট বানাচ্ছেন, দর্শকরা বিনা পয়সায় তা দেখছেন, আর ইউটিউব ও বিজ্ঞাপনদাতা দুই পক্ষই লাভবান হচ্ছে।

ক্রিয়েটর ইকোনমি: ইউটিউবের বড় হাতিয়ার

স্বল্প মূলধনে বিপুল কনটেন্ট

ইউটিউবের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো, এখানে নির্মাতারা নিজস্ব উদ্যোগে বিভিন্ন আইডিয়া বাস্তবায়ন করতে পারেন। ঐতিহ্যবাহী টিভি নেটওয়ার্কে কাউকে জায়গা পেতে হলে দীর্ঘ প্রক্রিয়া, বাজেট অনুমোদন, প্রযোজক খোঁজা—এত কিছু দরকার হয়। কিন্তু ইউটিউবে কেবল একটা চ্যানেল বানিয়ে, ক্যামেরা ধরেই যে কেউ শুরু করতে পারেন। এই স্বল্প বাধা বা “লো ব্যারিয়ার টু এন্ট্রি (low barrier to entry)” তরুণ নির্মাতাদের জন্য বিশাল সুযোগ তৈরি করেছে।

ফলে আমরা দেখি, এখানে বৈচিত্র্যের কোনো সীমা নেই—গান, নাচ, রান্না, ভ্লগ, অ্যানিমেশন, শর্ট ফিল্ম, গেমিং, টেক রিভিউ, সায়েন্স এক্সপেরিমেন্ট ইত্যাদি অসংখ্য জনরা (genre) সহ সবাই উপস্থিত। অনেকে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে প্রায় ‘টিভি শো’ সুলভ মানের অনুষ্ঠানের মতো সিরিজ বানাচ্ছেন। বড় বড় ব্র্যান্ড থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ পর্যন্ত—সবার কাছে ইউটিউব আজ এক কেন্দ্রীয় প্ল্যাটফর্ম।

গুণগতমানের (Quality) বিবর্তন

একসময় টিভি এক্সিকিউটিভরা মনে করতেন, “ইউটিউবে যা হয়, সেটা তো নিম্নমানের বা কেবল সময় পাস করার মতো।” কিন্তু বাস্তবে আজ দেখা যাচ্ছে, অনেক ইউটিউব কনটেন্টই প্রায় টিভি প্রোডাকশনের সমান বা কখনো তার চেয়ে উন্নত—বিশেষ করে “মিস্টার বিস্ট (MrBeast)” বা “ম্যাটপ্যাট (MatPat)” প্রমুখ ক্রিয়েটরদের অনুষ্ঠান। তারা বড় বাজেট নিয়ে ভিডিও বানান, বিশেষ এফেক্ট, লোকেশন, এমনকি অতিথি তারকাদের আনা—সব মিলিয়ে এক টিভির মতো অভিজ্ঞতা দিতে সক্ষম হচ্ছেন। একই সঙ্গে নিয়মিত দর্শক-সম্পৃক্ততা (engagement) থাকে, যা ঐতিহ্যবাহী টিভি বা স্ট্রিমিং সিরিজের চেয়ে অনেক বেশি।

পেশাদারিত্বের বিকাশ ও গ্লোবাল প্ল্যাটফর্ম

ইউটিউবের আরও বড় সুবিধা হলো বিশ্বব্যাপী বিস্তার (global reach)। একজন নির্মাতা (creator) যুক্তরাষ্ট্রে বসে ভিডিও বানালেও সেই ভিডিও বাংলাদেশ, ভারত, ব্রাজিল—যে কোনো জায়গায় দেখা সম্ভব। ঐতিহ্যবাহী চ্যানেলে সাধারণত আঞ্চলিক সীমাবদ্ধতা থাকে, স্ট্রিমিং সার্ভিসেও অনেক সময় নির্দিষ্ট অঞ্চলে কনটেন্ট ব্লক থাকে বা লাইসেন্স সমস্যা থাকে। ইউটিউবে সেই সীমাবদ্ধতা খুব কম।

ফলে একটি ছোট চ্যানেলও হঠাৎ বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়তা পেতে পারে, যদি কনটেন্টটি সত্যিই মানুষের মন জয় করে। এরকম ঘটে বহুবার—কোনো গেমিং চ্যানেল বা রান্নার চ্যানেল হঠাৎ করে বিস্ফোরক গতিতে বেড়ে যায়।

ডিজনি ও নেটফ্লিক্সের চ্যালেঞ্জ: ইউটিউবের সঙ্গে সহাবস্থান

প্রতিদ্বন্দ্বিতা নাকি সম্পূরক?

একসময় ঐতিহ্যবাহী বড় মিডিয়া কোম্পানিগুলো নেটফ্লিক্সকে (Netflix) “সহচর” হিসেবে ভাবত, কারণ তারা ভাবত নেটফ্লিক্স শুধু পুরোনো অনুষ্ঠান বা চলচ্চিত্রের লাইসেন্স কিনবে। কিন্তু পরে নেটফ্লিক্স এত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে যে, এসব বড় কোম্পানি বুঝতে পারে, তাদের নিজেদের কনটেন্টও এই প্ল্যাটফর্মে দিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হবে। একইভাবে, ইউটিউব এখন একেকটি বড় কোম্পানির জন্য কী—সহচর (companion) নাকি প্রতিদ্বন্দ্বী (competitor)? সেটাই বড় প্রশ্ন।

ইউটিউব আসলে উভয় ভূমিকা পালন করে। একদিকে এটি প্রচার বা মার্কেটিংয়ের প্ল্যাটফর্ম, যেখানে বড় স্টুডিওরা নিজেদের সিনেমা বা সিরিজের ট্রেলার আপলোড করে, এবং বিজ্ঞাপন থেকেও কিছু আয় করতে পারে। অন্যদিকে, ইউটিউব এত বেশি দর্শক ধরে রেখেছে যে, মানুষ সময় কাটাতে ইউটিউব দেখলেই অন্য কোথাও (যেমন Netflix/Disney+) সময় দিতে কমে যায়। অর্থাৎ এটি আবার স্ট্রিমিং-শিল্পের “টাইম শেয়ার”-এ একটা বড় অংশ ছিনিয়ে নিচ্ছে।

প্রচারমাধ্যম হিসেবে ইউটিউব

অনেক টিভি নেটওয়ার্ক বা স্ট্রিমিং সেবা এখন ইউটিউবকে “প্রমোশনাল ডিভাইস (promotional device)” হিসেবে ব্যবহার করে। যেমন, কোনো নতুন শো বা সিনেমার সংক্ষিপ্ত অংশ, ‘বিহাইন্ড দ্য সিনস’ (behind the scenes) ক্লিপ ইত্যাদি আপলোড করে মানুষের আগ্রহ তৈরি করে। এটি বিশেষ করে তরুণ দর্শকদের কাছে পৌঁছাতে কার্যকর। শীর্ষস্থানীয় ক্রীড়া অনুষ্ঠান, অনুষ্ঠানের হাইলাইট, বা ‘লেট নাইট শো’-র (late night show) কিছু ক্লিপ আপলোড করলে সহজেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়ে যায়, যা ঐ ব্র্যান্ড বা চ্যানেলের জন্য সুসংবাদ।

এছাড়া বহু কেবল নেটওয়ার্ক (যেমন NBC, ABC, CBS) বা নিউজ চ্যানেল (যেমন CNBC) পর্যন্ত নিজেদের গুরুত্বপূর্ণ সেগমেন্ট ইউটিউবে আপলোড করে, যাতে টিভি দর্শক ছাড়াও নতুন এক প্রজন্মের কাছে পৌছানো যায়। ইউটিউব এভাবে তাদের “রিচ (reach)” বা বিস্তৃতি কয়েক গুণ বাড়িয়ে দেয়। আবার এর ফলাফল হলো, মানুষ বাস্তবে ওই অনুষ্ঠান লাইভ টিভিতে না দেখেও পরে ইউটিউবে দেখে নেয়, ফলে ঐতিহ্যবাহী টিভি রেটিং ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।

ক্রীড়া সম্প্রচার ও ছোট ক্লিপের জনপ্রিয়তা

আরেকটি বড় ক্ষেত্র হলো স্পোর্টস (Sports)। ঐতিহাসিকভাবে সরাসরি খেলা দেখার জন্য মানুষ টিভিতে নির্ভর করত, কিন্তু এখন অনেকে শুধু হাইলাইট (highlights) বা “স্ন্যাপশট” দেখতে পছন্দ করে। ডিজনি বা ESPN বড় ম্যাচ সম্প্রচার করতে পারে বটে, কিন্তু তরুণ প্রজন্ম অনেক সময় ৯০ মিনিটের খেলায় বসে থাকে না; বরং ৫-১০ মিনিটের হাইলাইট ইউটিউবে বা অন্য কোথাও খুঁজে নেয়। এতে করে লাইভ ব্রডকাস্টের চাহিদা কমে গিয়ে সাধারণ টিভি রাজস্বে প্রভাব ফেলে।

অনেকে ধারণা করছেন, ভবিষ্যতে হয়তো বড় বড় মিডিয়া কোম্পানি আরও সাশ্রয়ী বাজেটে “ইউজার-জেনারেটেড কনটেন্ট” ধরন ব্যবহার করে নিজেদের প্ল্যাটফর্ম সমৃদ্ধ করবে। অর্থাৎ পূর্ণাঙ্গ জমকালো প্রযোজনা না করে, নিম্নবাজেটের কিন্তু তরুণদের প্রিয় “ইন্টারনেট-স্টাইল” অনুষ্ঠান যুক্ত করবে, যাতে লোকসান (loss) কম হয়।

ভবিষ্যতের চিত্র: ইউটিউবের উত্থান ও স্ট্রিমিং ল্যান্ডস্কেপ

দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব

ইউটিউবের বিকাশ ক্রমাগত বাড়ছে। অনেক বিশেষজ্ঞ বলছেন, এর প্রযুক্তিগত অগ্রগতি, ব্যাপক ডেটা অ্যানালিটিক্স ও পার্সোনালাইজেশনের (personalization) ক্ষমতা ওদের আর থামতে দেবে না। অন্যদিকে, ডিজনি বা নেটফ্লিক্সের মতো প্রতিষ্ঠান এখন টের পাচ্ছে যে, নতুন প্রজন্মের চোখে বিনোদন অনেক বেশি নমনীয় ও আকর্ষণীয় হতে হবে—তারা একঘেয়ে লম্বা সিরিজে মনোযোগ দিতে চায় না, বা বিপুল সাবস্ক্রিপশন ফি দিতে চায় না।

নেটফ্লিক্স ও এমাজন প্রাইম (Amazon Prime) যদিও বিজ্ঞাপন-মডেল (ad-supported model) চালু করে নতুন দর্শকদের আকর্ষণ করার চেষ্টা করছে, কিন্তু সেখানে ইউটিউবের সঙ্গে সরাসরি প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামতে গেলে হিমশিম খেতে হতে পারে। কারণ ইউটিউব তার বিস্তীর্ণ ক্রিয়েটর নেটওয়ার্ক ও বিনামূল্যে ব্যবহারযোগ্য সেবার মাধ্যমে দর্শকদের সম্পূর্ণ অন্যরকম অভিজ্ঞতা দিচ্ছে।

সম্ভাব্য পদক্ষেপ

  • অধিগ্রহণ বা অংশীদারিত্ব (Acquisition/Partnership): বড় কোনো মিডিয়া কোম্পানি হয়তো ইউটিউবের মতো প্ল্যাটফর্ম তৈরির চেষ্টা করতে পারে, কিন্তু বাস্তবে সেটি কার্যত অসম্ভব—ইতিমধ্যে ইউটিউব বিশ্বব্যাপী এত শক্ত অবস্থান তৈরি করেছে যে, এর সঙ্গে পাল্লা দেওয়া দুঃসাধ্য। ফলে ঐতিহ্যবাহী কোম্পানিরা ইউটিউবকে শত্রু ভাবার চাইতে বরং অংশীদার হিসেবে ব্যবহার করতে চায়—প্রমোশনাল মাধ্যম, ক্লিপ আপলোড, ইত্যাদির মাধ্যমে দর্শক ধরার উপায় হিসেবে।
  • নতুন টেক প্ল্যাটফর্মের উদ্ভব: কখনোই অবমূল্যায়ন করা যায় না যে ভবিষ্যতে অন্য কোনো টেক জায়ান্ট নতুন কোনো ভিডিও সার্ভিস চালু করবে না। হয়তো মেটাভার্স (metaverse) বা ভার্চুয়াল রিয়েলিটি (VR)-কেন্দ্রিক কিছু আসবে, যেখানে আরও ইন্টারঅ্যাক্টিভ (interactive) বিনোদন সম্ভব হবে। কিন্তু বর্তমানে ইউটিউবের একচ্ছত্র আধিপত্যকে হুমকি দেওয়া সহজ নয়।
  • কনটেন্টের ধরণে বৈচিত্র্য: স্ট্রিমিং সার্ভিসগুলো এখন বুঝে গেছে, মানুষের সময় তো ২৪ ঘণ্টাই। তাই ঐতিহ্যবাহী দীর্ঘ সিরিজ, চলচ্চিত্রের পাশাপাশি অপেক্ষাকৃত স্বল্পদৈর্ঘ্য, দ্রুত-উপভোগ্য বা ইন্টারঅ্যাক্টিভ কনটেন্ট তৈরির চেষ্টা চলছে। এ কারণেই দেখা যায় ডিজনি+ কিংবা হুলু নানা রকম স্পিন-অফ সিরিজ, শর্ট ফরম্যাট শো বের করছে। সম্ভাবনা আছে যে ইউটিউবের বিশাল ‘UGC ইকোনমি’ থেকে প্রতিভা শোষণ করতে পারে এসব প্ল্যাটফর্ম।

সহাবস্থান নাকি সংর্ঘষ?

ইউটিউব ও ঐতিহ্যবাহী মিডিয়া কোম্পানির সম্পর্ক একদিকে সহযোগিতামূলক, অন্যদিকে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক। উদাহরণস্বরূপ, অনেক কেবল নেটওয়ার্ক বা নিউজ চ্যানেল ইউটিউবে নিজেদের ক্লিপ প্রকাশ করে বিশ্বব্যাপী দর্শক আকর্ষণ করে—যা ব্র্যান্ডিং ও প্রচারের পক্ষে ভালো। একই সঙ্গে, সেই একই সময়ে মানুষ যদি ইউটিউবে ব্যস্ত থাকে, তাহলে হয়তো ঐতিহ্যবাহী চ্যানেল বা স্ট্রিমিং সার্ভিসের সামনে বসছে কম। এভাবেই ইউটিউব “ফ্রেনেমি (Frenemy)” হিসেবে আবির্ভূত—একই সঙ্গে বন্ধু ও প্রতিদ্বন্দ্বী।

তবে সব মিলিয়ে একথা বলাই যায় যে, ইউটিউব ভবিষ্যতে তার আধিপত্য আরও বাড়াবে। কারণ যেকোনো ইন্টারনেট-সংযুক্ত ডিভাইস (smartphone, smart TV, laptop, console) থেকে সহজে অ্যাক্সেস, বিনামূল্যে কনটেন্ট, বিশাল ক্রিয়েটর নেটওয়ার্ক, বিজ্ঞাপন আয়—এসব মিলিয়ে এর আলাদা এক্ষেত্রে দাঁড়িয়েছে। ডিজনি বা নেটফ্লিক্সের মতো কোম্পানি অবশ্যই মহাশক্তিশালী, কিন্তু ইউটিউবের অবস্থান আসলে একটু আলাদা। যেটাকে কাঁচা চোখে স্রেফ “সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম” ভেবেছিল অনেকে, সেটিই এখন বিশ্বের অন্যতম প্রধান স্ট্রিমিং মাধ্যম।

উপসংহার

“স্ট্রিমিং ওয়ারস (Streaming Wars)” বলতে এতদিন মানুষ ভেবেছিল, নেটফ্লিক্স বনাম ডিজনি বনাম এইচবিও ম্যাক্স বনাম প্যারামাউন্ট ইত্যাদির লড়াই। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, ইউটিউব (YouTube) এক অসামান্য প্রতিদ্বন্দ্বী—কিংবা বলা যায়, তারা অন্য লেভেলের খেলোয়াড়। কারণ তাদের আদি কাঠামো ও ব্যবসায়িক মডেল অন্যদের থেকে আলাদা। তারা মূলত বিজ্ঞাপন-ভিত্তিক (ad-based) ফ্রি (free) পদ্ধতিতে খেলে, এবং কোটি কোটি ক্রিয়েটরের কাজকে ব্যবহার করে বিশাল এক ভিডিও ভাণ্ডার গড়ে তুলেছে, যা প্রতিদিন আরও সমৃদ্ধ হচ্ছে।

অন্যদিকে, স্ট্রিমিং সার্ভিসগুলোর মৌলিক চালিকাশক্তি হল গ্রাহকদের সাবস্ক্রিপশন ফি আর নিজেদের প্রযোজিত বা লাইসেন্স করা বিশাল বাজেটের কনটেন্ট। কিন্তু তরুণ প্রজন্মের এক বিশাল অংশ বিনামূল্যে, ব্যবহারকারী-সৃষ্ট (UGC) ভিডিওকে সমর্থন করছে। তাদের কাছে কেবলমাত্র বড় তারকা বা বড় বাজেটের সিনেমা সবসময় আকর্ষণীয় নয়, বরং একজন স্বতন্ত্র ক্রিয়েটরের ব্যক্তিত্ব, নিয়মিত কনটেন্ট, কমিউনিটির অন্তর্ভুক্তি—এই সবকিছুই মুখ্য।

ফলে ভবিষ্যতে ঐতিহ্যবাহী মিডিয়া কোম্পানি, এমনকি নেটফ্লিক্সও এক ধরনের কৌশলগত পুনর্বিন্যাসের কথা ভাবতে বাধ্য হতে পারে:

  • ইউটিউবকে কীভাবে নিজেদের বিপণন (marketing) বা প্রমোশনাল কাজে ব্যবহার করা যায়?
  • কীভাবে তরুণদের মনোযোগ ফেরানো যায়, যাদের বিশাল অংশ গিয়েছে ইউটিউব ও টিকটকের (TikTok) দিকে?
  • অনবরত গভীরতর ইন্টারঅ্যাকশন, দ্রুত আপডেট ও দীর্ঘমেয়াদী “বন্ধু-সুলভ” উপস্থিতি—এসব দিতে পারবে তো ট্র্যাডিশনাল স্ট্রিমিং পদ্ধতি?

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, পরবর্তী দশকে ঐতিহ্যবাহী টেলিভিশন আরও বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। এমাজন প্রাইম ও নেটফ্লিক্স ইতিমধ্যে বিজ্ঞাপন-সমর্থিত (ad-supported) সাবস্ক্রিপশন প্যাকেজ চালু করেছে, যাতে কিছুটা খরচ কমিয়ে তরুণদের আকৃষ্ট করা যায়। কিন্তু ইউটিউবের মতো একটা বিলিয়ন-ডলার আয়ের জায়ান্ট, যেখানে গ্রাহকরা কোনো চার্জ ছাড়াই আনলিমিটেড কনটেন্ট পায়—সেটিকে সরাসরি হারানো খুব কঠিন।

পরিস্থিতি এমন যে, ইউটিউব একদিকে মিডিয়া কোম্পানিদের কনটেন্ট প্রচার করে তাদের সাহায্য করছে, অন্যদিকে নিজেই তাদের শ্রোতা-দর্শক চুরি করে নিচ্ছে। সমালোচকরা বলে থাকেন—এটা ডিজনির “সহযোগী” না “প্রতিযোগী?” আসলে উত্তরটি দুটোই। স্ট্রিমিং ল্যান্ডস্কেপে এই সহাবস্থান ও সংঘর্ষ চলতেই থাকবে।

সব মিলিয়ে, ইউটিউব এখন আর কোনো “নতুন প্ল্যাটফর্ম” নয়। তবে তারা ২০০৫ সালে শুরু হয়ে আজ ২০২০-এর দশকে এক নতুন উচ্চতায় উঠেছে। ওদের কাছে এখন অগণিত ব্যবহারকারী, বহুমুখী কনটেন্ট, সুদৃঢ় বিজ্ঞাপন পদ্ধতি, বৈশ্বিক উপস্থিতি এবং আনলিমিটেড স্কেলিং-এর সুযোগ রয়েছে। আর এ কারণেই “স্ট্রিমিং ওয়ারস”-এর সত্যিকারের রাজা (বা অন্তত বর্তমান সময়ের শীর্ষস্থানীয় খেলোয়াড়) হিসেবে ইউটিউবের নাম উঠে আসছে—নেটফ্লিক্স কিংবা ডিজনি নয়।

কেন আমেরিকায় সিইও-রা (Chief Executive Officer) এত বেশি অর্থ উপার্জন করেন? (৭ জুন, ২০২৪)

সিইও বনাম শ্রমিক বৈষম্য

১৯৬৫ সালে, একজন সাধারণ আমেরিকান কোম্পানির CEO (Chief Executive Officer) এক জন সাধারণ কর্মীর তুলনায় ২১ গুণ বেশি আয় করতেন। সময় গড়াতে গড়াতে ২০২২ সালে এসে CEO রা সাধারণ কর্মীর তুলনায় ৩৪৪ গুণ বেশি উপার্জন করতে শুরু করলেন। অভিনন্দন, ভদ্রলোকেরা! কিন্তু প্রশ্ন হলো, এটা কীভাবে ঘটলো?

সিইও-দের (CEO) উপার্জন করার যে সম্ভাবনা থাকে তা অন্যদের ক্ষেত্রে কখনই থাকেনা। ২০২০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ ৩৫০ সিইও (CEO) গড়ে ২৪ মিলিয়ন ডলারের বেশি আয় করেছেন। এটা অন্যান্য কর্মীদের আয়ের তুলনায় অনেক বেশি। কিন্তু সবসময় এমন ছিল না। গত কয়েক দশকে সিইও-ওয়ার্কার বেতনের ব্যবধান (CEO to worker pay gap) ব্যাপকভাবে বেড়েছে। অর্থনৈতিক নীতি ইনস্টিটিউটের (Economic Policy Institute – EPI) হিসাব অনুযায়ী ১৯৭৮ সাল থেকে সিইওদের মোট ক্ষতিপূরণ (compensation) বেড়েছে ১৩২২%, যেখানে সাধারণ শ্রমিকদের বেতন বেড়েছে মাত্র ১৮%। ইনস্টিটিউট ফর পলিসি স্টাডিজ (Institute for Policy Studies) হিসাব করেছে যে এস অ্যান্ড পি ৫০০ (S&P 500) তালিকাভুক্ত ৮০% কোম্পানিতে সিইওদের বেতন সাধারণ শ্রমিকদের চেয়ে ১০০ গুণেরও বেশি। তার মানে, ঐসব কোম্পানির একজন সাধারণ কর্মীকে ১০০ বছর কাজ করতে হবে সিইওর এক বছরের আয় ধরতে, যা অসম্ভব।

সিইও ও শ্রমিকদের বৈষম্য স্বাভাবিকভাবেই উদ্বেগ তৈরি করেছে। পিউ (Pew) রিসার্চ সেন্টারের মতে, বেশিরভাগ আমেরিকান মনে করেন ভবিষ্যৎ প্রজন্ম অর্থনৈতিকভাবে আরো খারাপ অবস্থায় থাকবে। এই উদ্বেগগুলো মূলত যৌক্তিক কিছু প্রশ্নের ওপর দাঁড়িয়ে থাকে। যেমন, এই মাসে আমার বিলগুলো দিতে পারবো কিনা, সন্তানদের আমার চেয়ে ভালো জীবন দিতে পারবো কিনা ইত্যাদি। আর এই প্রশ্নগুলো আসলে আরেকটি প্রধান প্রশ্নের ওপর দাঁড়ানো: “এরপর কী?” (What’s next?)

লরেন্স মিচেল (Lawrence Mitchell) অর্থনৈতিক নীতি ইনস্টিটিউটের (Economic Policy Institute – EPI) একজন ডিস্টিংগুইশড ফেলো (distinguished fellow)। তিনি আগে ইউএস ডিপার্টমেন্ট অফ লেবার (US Department of Labor) এবং কর্নেল ইউনিভার্সিটির (Cornell University) স্কুল অফ ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড লেবার রিলেশন্স এ কাজ করেছেন। সিইও-ওয়ার্কার বেতন ব্যবধান সম্পর্কে তিনি বিশেষজ্ঞের মর্যাদা পান। তিনি তার এক রিপোর্টে তিনটি বড় সংখ্যাগত বিষয় উল্লেখ করেছিলেন –

  • ১৯৭৮ সাল থেকে সিইওদের আয় বেড়েছে ১৩২২%, কিন্তু সাধারণ শ্রমিকদের আয় বেড়েছে মাত্র ১৮%।
  • ২০২০ সালে সিইওরা সাধারণ শ্রমিকদের চেয়ে ৩৫১ গুণ বেতন পেয়েছেন।
  • যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ ৩৫০টি প্রতিষ্ঠানের সিইওরা গড়ে ২৪.২ মিলিয়ন ডলার করে পেয়েছেন।

CEO রা এত বেশি আয় করছেন কেন?

“কেন এখনকার CEO রা এত টাকা উপার্জন করেন?”— এর উত্তর দুটি দিক থেকে আসতে পারে।

প্রথম ব্যাখ্যা: রেন্ট-সিকিং (Rent-Seeking): রেন্ট-সিকিং (Rent-seeking) অর্থাৎ অর্থনীতিবিদদের ভাষায় CEO রা অনেকটা সুযোগের সদ্ব্যবহার করে নিজেদের বেতন বাড়াচ্ছেন। তারা আসলে কোম্পানি থেকে সম্পদ শোষণ (extracting resources) করছেন। কারণ তাদের এত বেশি বেতন দেয়া সম্ভব, এবং তারা সেটি আদায় করেও নিচ্ছেন।

দ্বিতীয় ব্যাখ্যা: দক্ষ নির্বাহী বাজার (Efficient Market for Executive Talent): অপরপক্ষের দাবি হলো, এটি এক ধরনের দক্ষ প্রতিযোগিতামূলক বাজার (efficient market) যেখানে সবচেয়ে মেধাবী ও যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিকে CEO করা হয় এবং তাদের ধরে রাখতে প্রচুর অর্থের প্রয়োজন। এজন্য CEO নিয়োগের বাজারে ব্যাপক প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়, এবং “সেরা” জনকে পেতে প্রচুর টাকা গুনতে হয়।

সুতরাং দুটি বিপরীতমুখী ধারণা দেখতে পারি আমরা –

  • ১) CEO রা কোম্পানি থেকে সম্পদ শোষণ করছে।
  • ২) এটি একটি দক্ষ নির্বাহী প্রতিভা বাজার, যেখানে প্রবল প্রতিযোগিতার কারণে বেতন বেশি।

যাচাই করে দেখা যাক আসলে কী ঘটে।

পারফরম্যান্স ভিত্তিক বেতন ও এর বিষফল: শেয়ারদর বৃদ্ধিই কি সবসময় CEO এর দক্ষতার প্রমাণ?

বর্তমান সময়ের সেরা CEO রা তাদের বেশিরভাগ আয় শেয়ার-সংক্রান্ত পদ্ধতিতে পেয়ে থাকেন—যেমন স্টক অপশন (stock options) কিংবা বোনাস (bonus)। এই প্রবণতা শুরু হয়েছিল ৯০-এর দশকে, যখন ক্লিনটন (Clinton) প্রশাসনের একটি নিয়ম উল্টোফলে বুমেরাং হয়ে যায়। একসময় আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ছিলেন বিল ক্লিনটন (Bill Clinton)। ক্লিনটনের উদ্দেশ্য ছিল নির্বাহীদের (executives) অতিরিক্ত বেতন নিয়ন্ত্রণ করা। তিনি একটি নিয়ম চালু করেন—যে কোনও CEO-এর ১ মিলিয়ন ডলারের (1,000,000 USD) বেশি বেতনকে আর “যুক্তিসঙ্গত ব্যবসায়িক খরচ” (reasonable business expense) বলে কর ছাড় (corporate tax deduction) দেয়া হবে না।

এই নিয়মের ফলে ধারণা করা হয়েছিল যে কোম্পানিগুলো CEO-দের বেতন ১ মিলিয়নের ঘরেই রাখবে। কিন্তু এখানে ছিল একটি ফাঁক বা লুপহোল। সেটা হচ্ছে পারফরম্যান্স পে (performance pay), যার মধ্যে স্টক অপশন ও বোনাস অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এটাকে ট্যাক্স ছাড়ের আওতার বাইরে রাখা হয়েছিল। আর এর ফলাফল হচ্ছে, কোম্পানিগুলো CEO দের বাস্তব বেতন কমিয়ে নিয়ে গেলেও, পারফরম্যান্স রিওয়ার্ড (performance rewards) বিশেষত শেয়ার, স্টক অপশন ইত্যাদির মাধ্যমে বিশাল অঙ্কের প্যাকেজ দিতে শুরু করলো।

লরেন্স সিইও-দের এই বাড়তি লাভটাকে সিইও ক্ষতিপূরণ বা সিইও কমপেনসেশন (CEO compensation) নামে অভিহিত করেন। তিনি বলেন, সিইও ক্ষতিপূরণ (CEO compensation) বলতে বেতন (wages), বোনাস (bonuses), দীর্ঘমেয়াদি প্রণোদনা (long-term incentives), এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল সিইও প্রতি বছর যত স্টক অপশন (stock options) নগদায়ন করেন ও ভেস্টেড স্টক অ্যাওয়ার্ডস (vested stock awards) পান, তার পরিমাণকে বোঝায়। হিসাব করে দেখা হয় যে তারা আসলে করের জন্য কতটা আয় দেখান। তাই এটা বাস্তব চিত্র। ১৯৯০-এর দশকে স্টক মার্কেটের উত্থানের সময় সিইওদের আয় ব্যাপক বেড়ে যায়।

লরেন্স বলেন, প্রতিষ্ঠান ভাবে তারা খুব গুরুত্বপূর্ণ এবং তাদের একজন মহান নির্বাহী (executive) চাই। আর যদি তারা সত্যিই মহান হন, তবে নিশ্চয়ই তাকে গড়ের চেয়ে বেশি দিতে হবে। এখন সবাই যদি ভাবে তাদের নির্বাহীকে গড়ের চেয়ে বেশি দিতে হবে, তাহলে একে অপরের পারিশ্রমিক দেখে নিজেদেরটা আরো বাড়াতে থাকে। ফলে এই বেতন সবসময় উপরে উঠতে থাকে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, বোর্ড সদস্য (board members) ও শেয়ারহোল্ডারদের (shareholders) সিইওদের বেশি পারিশ্রমিক দেওয়ার যৌক্তিক কোনো কারণ আছে?

লরেন্স বলেন, ধারণা করা হয় সিইও ক্ষতিপূরণ শেয়ার বাজারের (stock market) সাথে বাঁধা, অর্থাৎ কর্মক্ষমতার (performance) ওপর নির্ভর করে। কিন্তু বাস্তবে এটি সবসময় সত্যি নয়। স্টক মূল্য যদি স্রেফ বেড়ে যায়, সেটাকেই কর্মক্ষমতার চিহ্ন ধরা হয়। কিন্তু স্টক মূল্যের বৃদ্ধি সবসময় সিইওর কৃতিত্ব নয়। যেমন, ট্রাম্প (Trump) যখন বিশাল কর ছাড় দিয়েছিলেন কোম্পানিগুলোকে, স্টক মূল্য বেড়েছিল, সিইওদের আয়ও বেড়েছিল। কিন্তু এটা তাদের কর্মক্ষমতার ফল ছিল না।

এদিকে অনেক বিশেষজ্ঞ বলেন, গত ৩০ বছরে CEO বেতন বেড়েছে মূলত শেয়ারবাজার (stock market) বৃদ্ধির কারণে। তারা তাদের বেতনকে খুব চতুরভাবে শেয়ারবাজারের সামগ্রিক উন্নতির সঙ্গে যুক্ত করেছেন।

এভাবেই আমরা কোটি (Coty) নামক কসমেটিক্স (cosmetics) কোম্পানির CEO সু নাবি (Sue Nabi) এর উদাহরণ পাই। কোটি ব্র্যান্ডের আওতায় গুচি (Gucci), ক্যালভিন ক্লেইন (Calvin Klein), টিফানি (Tiffany) ইত্যাদি রয়েছে। ২০২২ সালে সু নাবি প্রায় ১৫০ মিলিয়ন ডলার উপার্জন করেন, যার মধ্যে ১৪৬ মিলিয়ন ছিল কোটির শেয়ার (Coty Stock) থেকে পাওয়া। এতে তার উপার্জন কোটির একজন সাধারণ কর্মীর চেয়ে ৩০০০ গুণ বেশি।

১৫০ মিলিয়ন ডলার বার্ষিক আয় অদ্ভুত লাগতে পারে, তবে ভাবুন তো—একজন CEO যদি কোম্পানির শেয়ারের দাম বাড়াতে পারেন, তবে তার বড় অঙ্কের পুরস্কৃত হওয়া তো স্বাভাবিক, তাই না?

তত্ত্বগতভাবে, CEO এর ক্ষতি-সাফল্য যেন কোম্পানির সাফল্যের সাথে যুক্ত হয়, তাই এই পারফরম্যান্স-নির্ভর (performance-based) বেতন ব্যবস্থা। যদি কোম্পানির শেয়ারের মূল্য বাড়ে, CEO এর সম্পদও বাড়ে।

কিন্তু বাস্তবে বিষয়টা এত সহজ নয়। দেখা যায়, শেয়ারদর (share price) অনেক কারণে বাড়তে পারে, যা CEO-এর নিয়ন্ত্রণের বাইরেও হতে পারে। সমালোচকরা বলছেন, যদি শেয়ারদর বাড়ে, তা সবসময় CEO এর অনন্য কৃতিত্ব বোঝায় না। উদাহরণস্বরূপ, তেলের দাম (global price of oil) বিশ্ববাজারে বেড়ে গেলে তেল কোম্পানির শেয়ারদরও বেড়ে যাবে। এতে CEO রা বিশাল বেতন পেয়ে যাবেন, অথচ তারা তেলের বিশ্ব দর নিয়ন্ত্রণ করেন না। এটি মূলত সৌভাগ্য ও বিভিন্ন বাহ্যিক ফ্যাক্টরের ওপর নির্ভর করে তাদের আয়কে বাড়িয়ে তোলে।

সুতরাং, দেখা যাচ্ছে শেয়ারবাজার সবকিছুর কেন্দ্রে। কিন্তু আমি তবুও এই ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট নই। আমার অনুসন্ধিৎসু মন আরও গভীরে ঢুকতে চায়।

সীমিত প্রতিভার বাজার ও বন্ধু-বান্ধবীপূর্ণ বোর্ড

“কেন CEO রা এত বেশি বেতন পান?” এই প্রশ্নের আরেকটি উত্তর হলো: হয়তো সত্যিই এমন অনেক কম সংখ্যক মানুষ আছেন যারা এত বড় বড় কোম্পানি পরিচালনা করতে সক্ষম। মানে দক্ষ লোকের সংকট আছে, মানে এক্সিকিউটিভ ট্যালেন্টের জন্য এফিশিয়েন্ট মারকেট আছে আরকি।

সমালোচকরা প্রশ্ন তোলেন—একজন টিম কুক (Tim Cook)-এর মতো দক্ষ CEO এর বিকল্প কি একটু কম বেতনে পাওয়া সম্ভব নয়? কীভাবে এমন নিয়মতান্ত্রিক প্রতিযোগিতা (open competition) তৈরি করা যায়, যাতে কম টাকা দিয়েও একই রকম দক্ষ কাউকে পাওয়া যায়?

কিন্তু বাস্তবে, উচ্চপর্যায়ের CEO পুল (pool) হয়তো অকারণে খুবই ছোট এবং নির্বাচিত কিছু মানুষই ঐ স্থানগুলোতে সুযোগ পায়। আরেকটি বড় কারণ হলো CEO রা নিজেদের বেতন নির্ধারণের প্রক্রিয়ায় প্রভাব রাখতে সক্ষম হন।

তত্ত্বগতভাবে, শেয়ারহোল্ডারদের স্বার্থ দেখার জন্য একটি বোর্ড অব ডিরেক্টরস (board of directors) থাকে, যারা CEO এর বেতন প্যাকেজ নির্ধারণ করেন। কিন্তু বাস্তবে CEO নিজেই বোর্ড সদস্যদের মনোনয়ন করতে পারেন বা তাদের উপর যথেষ্ট প্রভাব রাখতে পারেন। ফলে যাদের কাজ CEO-দের দেখাশোনা করার কথা, তারা হয়ে যান তাদের বন্ধু। একরকম আত্মীয়তা, একধরনের মিত্রতা গড়ে ওঠে। ফলে ন্যায্য সমালোচনা বা বেতনের উপর যথাযথ লাগাম টানা কঠিন হয়ে পড়ে।

ডেলাওয়্যার (Delaware) অঙ্গরাজ্যের একটি ঘটনার কথাই বলা যাক। টেসলা (Tesla) কোম্পানির শেয়ারহোল্ডাররা ইলন মাস্কের ২০১৮ সালের বেতন প্যাকেজকে চ্যালেঞ্জ করে মামলা করেন, দাবি করেন এটি অন্যায্য ও পক্ষপাতদুষ্ট ছিল। এক বিচারক রায় দেন যে বোর্ডের অনেক সদস্যই মাস্কের সাথে খুব ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রেখেছেন, ফলে এই বেতন নির্ধারণ প্রক্রিয়া সঠিক ছিল না।

সব মিলে আমরা দেখতে পারছি সিইও-দের উচ্চবেতনের পেছনে তাদের পারফরমেন্স ও যোগ্যতার চেয়ে সম্পদ শোষণ করার বিষয়টাই প্রধান ভূমিকা পালন করে।

শ্রমিকদের বেতনে বৃদ্ধিতে স্থবিরতা ও বৈষম্য

আরেকটি বিষয় হলো সাধারণ শ্রমিকদের বেতন মাত্র ১৮% বেড়েছে। এই স্থবিরতা কেন? লরেন্স বলেন, গত ৪০ বছরে শ্রমিকদের বেতন ও সুবিধাদি খুব একটা বাড়েনি। উৎপাদনশীলতা (productivity) বৃদ্ধি পেলেও বেতনের সাথে তার সংযোগ নেই। উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির হারে যদি মূল্যায়ন করি, শ্রমিকদের প্রায় ৬০% বৃদ্ধি পেতে পারত, কিন্তু তারা পেয়েছে মাত্র ১৮%। লরেন্স শ্রমিকদের বেতন না বাড়ার পেছনে ছয়টি কারণ উল্লেখ করেছেন –

  • ১. উচ্চ বেকারত্ব (unemployment), যা শ্রমিকদের কম বেতনে কাজ করতে বাধ্য করে।
  • ২. বিশ্বায়ন (globalization), যা কোম্পানিগুলোকে সস্তা শ্রমের জন্য বিদেশে যাওয়ার সুযোগ দেয়।
  • ৩. ইউনিয়ন (unions) দুর্বল হয়ে যাওয়া, ফলে শ্রমিকরা সম্মিলিতভাবে দরকষাকষি করতে পারে না।
  • ৪. নিম্ন শ্রম মানদণ্ড (low labor standards), যেমন অত্যন্ত কম ন্যূনতম মজুরি (minimum wage)।
  • ৫. নন-কমপিট (non-compete) চুক্তির বিস্তার, যা শ্রমিকদের শিল্পের মধ্যে ভালো বেতনের চাকরি খোঁজা কঠিন করে তোলে।
  • ৬. ডোমেস্টিক আউটসোর্সিং (domestic outsourcing), যেখানে কোম্পানি ফ্রিল্যান্সারদের (freelancers) ওপর বেশি নির্ভর করে।

এগুলোর কোনোটাই আমাদের বেশি দক্ষ বা বড় অর্থনীতি (economy) তৈরিতে সাহায্য করে না। এসব পদক্ষেপ শ্রমিকদের একক ও সম্মিলিত দরকষাকষির ক্ষমতা (bargaining power) দুর্বল করে। আর এটা ঘটেছে নিচের ৯০% শ্রমিকদের সাথে, শুধু নিম্নবেতনের শ্রমিকদের নয়, বরং পুরো নিম্ন ৯০ শতাংশের ক্ষেত্রেই।

শ্রমিকদের দাবী, করের প্রস্তাব ও অনুশাসন

ইউনাইটেড অটো ওয়ার্কারস ইউনিয়ন (United Auto Workers Union) শীর্ষ পর্যায়ের কার নির্মাতা কোম্পানিগুলোর সাথে আলোচনায় ৪০% বেতন বৃদ্ধি দাবি করেছিল, যা CEO দের গত চার বছরে বেতন বৃদ্ধির সমান হারে আনার চেষ্টা।

এদিকে বার্নি স্যান্ডার্স (Bernie Sanders) প্রস্তাব করেছিলেন এমন একটি কর ব্যবস্থা (tax) যা সেইসব কোম্পানির ওপর বসবে, যাদের CEO রা সাধারণ কর্মীর চেয়ে ৫০ গুণের বেশি বেতন পান।

কিন্তু শুধু ইউনিয়ন বা তথাকথিত “সোশ্যালিস্ট গ্যান্ডালফরাই” নয়, এমনকি পুঁজিবাদী হাঙ্গরদের (capitalist zaddies) মধ্যেও এই ব্যাপারে অসন্তোষ আছে। কার্ল আইকান (Carl Icahn) বলেছেন যে অনেক CEO কম পারফর্ম করে এবং অতিরিক্ত পারিশ্রমিক পায়। ওয়ারেন বাফেট (Warren Buffett) এই নির্বাহী বেতন প্যাকেজকে “অযৌক্তিক ও অতি মাত্রায় বেশি” বলে অভিহিত করেছেন এবং পরিবর্তন আনতে বৃহত্তর শেয়ারহোল্ডারদের (institutional shareholders) সক্রিয় ভূমিকা চেয়েছেন।

সরকারও এই বিষয়ে মনোযোগ দিচ্ছে। SEC (Securities and Exchange Commission) সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কিছু নিয়ম চালু করেছে যাতে বোর্ডের এই গোপন সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা আনা যায়।

বর্তমান পরিস্থিতি: খুব একটা পরিবর্তন কি সম্ভব?: শেয়ারহোল্ডারদের স্বার্থ ও সাধারণ মানুষের অজ্ঞতা

তবুও অনেকেই মনে করেন এই ব্যবস্থা সহজে বদলাবে না। কেউ কেউ বলেন CEO-দের বেতন বাড়তেই থাকবে। সিস্টেমিক (systemic) পলিসি পরিবর্তন না হলে এটি নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন।

১৯৭৮ সালে সিইওরা ছিলেন সাধারণ শ্রমিকের ৩১ গুণ, ১৯৮৯ সালে ৬১ গুণ, আর এখন ৩৫১ গুণ। যদি এটা এতটাই স্পষ্ট সমস্যা হয়, সমাধান আমাদের সামনে স্পষ্ট হওয়ার কথা। সিইও ক্ষতিপূরণ বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে আনতে নীতিমালা (policy) এবং সম্মিলিত পদক্ষেপ (collective approach) প্রয়োজন। মহামারির (pandemic) সময় যখন মানুষ চাকরি হারিয়েছে, তখন সিইওদের বেতন আরো বেড়েছে। এটা এককথায় লজ্জাজনক।

আমেরিকার বর্তমান প্রশাসন ও কংগ্রেস (Congress) শ্রমিকদের স্বার্থকে কেন্দ্র করে পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছে। প্রথম বিল ছিল আমেরিকান রেসকিউ প্ল্যান (American Rescue Plan), যা ২০২২ সালের শেষ নাগাদ পূর্ণ কর্মসংস্থান (full employment) অর্জনে সাহায্য করেছে। পুনর্মিলন বিল (reconciliation bill) এ এমন বিধান আছে যা কোম্পানিগুলোকে শ্রমিক ইউনিয়নের (worker unions) অধিকারের লঙ্ঘনের জন্য আর্থিক জরিমানা (monetary penalties) করতে চায়, এবং বাইডেনের (Biden) নির্বাহী আদেশ (executive order) এফটিসি (FTC)-কে নির্দেশ দিয়েছিল নিয়ম তৈরি করে নন-কমপিট (non-compete) ক্লজ নিষিদ্ধ বা সীমিত করতে। এরকম নীতিমালাগুলো শ্রমিকদের পক্ষে পাল্লা ভারী করার চেষ্টা করে, যাতে তারা নিয়োগদাতাদের তুলনায় ভালো অবস্থানে আসতে পারে। যদি শ্রমিকরা নিজেদের দাবি প্রতিষ্ঠা করতে পারে, ফলাফল ঘরে তুলতে পারে, তাহলে সিইওদের বিশাল অঙ্কের লাভ ঘরে তোলা কঠিন হয়ে যাবে।

CEO বনাম কর্মী এই দ্বন্দ্ব স্পষ্ট হলেও, প্রকৃতপক্ষে যারা সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, তারা হলো শেয়ারহোল্ডাররা—যারা তাদের বিনিয়োগের সঠিক স্বার্থরক্ষার আশা করে। আর বলতে গেলে সবাইকে এই ব্যাপারে আগ্রহী হওয়া উচিত। কারণ কেউ যদি শেয়ার কেনেন বা তাদের যদি পেনশনের মাধ্যমে কোথাও বিনিয়োগ থাকে, তাহলে বোর্ডের এসব সিদ্বান্ত তাদের স্বার্থকে ক্ষুণ্ণ করতে পারে।

২০১৬ সালে স্ট্যানফোর্ড বিজনেস স্কুল (Stanford Business School) এর একটি জরিপে দেখা যায়, প্রায় ৭০% আমেরিকান বিশ্বাস করে CEO-রা অতিমাত্রায় বেতন পায়। মার্কিনিরা CEO এবং কর্মীদের মধ্যে বেতনের ব্যবধান সম্পর্কে কী ভাবে সেটা নিয়ে জরিপ করে দেখা গেছে ৮৭% মানুষ মনে করে এই ব্যবধান খুব বেশি।

কিন্তু সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, মানুষ CEO-দের আসল বেতন সম্পর্কে কোনো ধারণাই করতে পারে না। স্ট্যানফোর্ডের জরিপ বলছে, সাধারণ আমেরিকানরা CEO দের প্রকৃত বেতনের ১/১০ ভাগ কল্পনা করে! জরিপে দেখা যায় ৭৫% মানুষ ধারণা করে CEO দের বেতন কর্মীদের তুলনায় ১০০ গুণের কম। বাস্তবে এটি ২০০ গুণ বা তারও বেশি। অর্থাৎ বাস্তবতা কল্পনার চেয়েও অনেক বেশি বিষ্ময়কর।

উপসংহার

তো সব মিলে CEO-দের বেতন একটি লাগামহীন ট্রেনের মতো সামনে ছুটছে। আর এটাকে নিয়ন্ত্রণে নেয়া দরকার। এটা করলেই কোম্পানিগুলো আরও লাভজনক (profitable) হতে পারে, অর্থনীতি (economy) কিছুটা বেশি ন্যায়সঙ্গত বা ইকুইটেবল হতে পারে।

একটিভিস্ট বিনিয়োগ (Activist Investing) কী এবং এটি কীভাবে কাজ করে? (২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪)

ভূমিকা

একটিভিস্ট বিনিয়োগ (Activist Investing) সাম্প্রতিক সময়ে পুঁজিবাজারে গুরুত্বপূর্ণ ও আলোচিত একটি ধারণা। আধুনিক বিনিয়োগ পরিবেশে যেখানে বহু মূলধন প্যাসিভ ইনডেক্সে (Passive Index) বিনিয়োগ করা হয়, সেখানে একটিভিস্ট বিনিয়োগকারীরা কোন একটি কোম্পানির শেয়ার বড় পরিমাণে ধরে রেখে সেই প্রতিষ্ঠানের কাঠামো, ব্যবস্থাপনা বা ব্যবসায়িক কৌশল পরিবর্তনে সক্রিয় ভূমিকা নেয়। এর ফলে একদিকে বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষা হয়, অন্যদিকে কোম্পানির দীর্ঘমেয়াদী উন্নয়নেও ইতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। এই লেখায় আমরা একটিভিস্ট বিনিয়োগের মৌলিক ধারণা, এর পটভূমি, প্রভাব ও সম্ভাব্য ঝুঁকি নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা করবো।

একটিভিস্ট বিনিয়োগ (Activist Investing) কী?: প্যাসিভ বনাম একটিভিস্ট বিনিয়োগ

একটিভিস্ট বিনিয়োগ হল এমন একটি পদ্ধতি যেখানে কোনো বিনিয়োগকারী কোনো কোম্পানিতে উল্লেখযোগ্য অংশীদারিত্ব নিয়ে শুধু চুপচাপ শেয়ার ধরে রাখে না, বরং সেই কোম্পানির ভেতরে সংস্কার, উন্নয়ন বা রূপান্তরে সক্রিয় ভূমিকা রাখে। অর্থাৎ, প্যাসিভ ইনডেক্স (Passive Index) ফান্ডের মতো নিঃশব্দভাবে মালিকানা ধরে রাখার পরিবর্তে, একটিভিস্ট বিনিয়োগকারী কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদ (Board) বা ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সরাসরি আলাপ-আলোচনা করে, কখনো পর্ষদে আসন গ্রহণ করে, এবং প্রয়োজনে বড় ধরনের পরিবর্তনের আহ্বান জানায়।

বর্তমান বিশ্বে পুঁজিবাজারের বেশিরভাগ মূলধন প্যাসিভ ইনডেক্স ফান্ডে বিনিয়োগ করা হয়। ইনডেক্স ফান্ড (Index Fund) সাধারণত একটি নির্দিষ্ট সূচকের ভিত্তিতে স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিভিন্ন সিকিউরিটিজ (Securities) কিনে রাখে নির্দিষ্ট অনুপাতে। এখানে মানবিক বিচারবোধ বা সক্রিয় সিদ্ধান্তগ্রহণের সুযোগ থাকে না, এবং এসব ফান্ড সাধারণত কোম্পানির উন্নয়ন বা পরিবর্তনে কোনো ভূমিকা নেয় না।

অন্যদিকে, একটিভিস্ট বিনিয়োগকারীরা বেশ কয়েকটি নির্বাচিত কোম্পানিতে বড় পরিমাণ বিনিয়োগ করে। যেহেতু কোনো একটি প্রতিষ্ঠানে তারা মোট সম্পদের ২০% পর্যন্ত বিনিয়োগ করতে পারে, তাই সেই কোম্পানি সম্পর্কে গভীর জ্ঞান অর্জন করে এবং প্রয়োজনে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে সেই কোম্পানিকে আরো মূল্যবান বা কার্যকর করে তুলতে পদক্ষেপ নেয়।

সূচনা পর্ব

শুরুর দিকে একটিভিস্ট বিনিয়োগকারীদের পরিচিতি বা মূলধন কম থাকায় বড় কোম্পানিগুলোর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে তাদের তুলনামূলকভাবে বেশি “শোরগোল” তুলতে হত। একটি বাস্তব উদাহরণ পারসিং স্কয়ারের (Pershing Square) প্রথম একটিভিস্ট বিনিয়োগ ওয়েন্ডি’স (Wendy’s) কোম্পানিতে। ওই সময় ওয়েন্ডির অধীনে টিম হরটন্স (Tim Hortons) নামে একটি কফি ও ডোনাট চেইন ছিল যা নিজেই খুব মূল্যবান ছিল। ওয়েন্ডি’স-এর বাজারমূল্য ছিল প্রায় ৫ বিলিয়ন ডলার, অথচ তাদের সম্পূর্ণ মালিকানাধীন টিম হরটন্সের মূল্য ছিল ঐ পাঁচ বিলিয়নের চেয়েও বেশি। অর্থাৎ ওয়েন্ডি’স কিনলে টিম হরটন্স আলাদা করলে ওয়েন্ডি’সকে কার্যত নেতিবাচক মূল্যে পাওয়া যেত। এটি ছিল বিনিয়োগের জন্য একটি সুবর্ণ সুযোগ।

পার্থক্য হল, ওয়েন্ডি’স-এর সিইও (CEO) বা ব্যবস্থাপনা প্রথমে ফোন রিটার্ন করে না, কথাও বলে না। তখন একটিভিস্ট দল ব্ল্যাকস্টোন (Blackstone)-এর মতো একটি প্রতিষ্ঠানে অর্থ দিয়ে ফেয়ারনেস ওপিনিয়ন (Fairness Opinion) করিয়ে সেই পরামর্শপত্র ওয়েন্ডি’স কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠায়। এতে দেখানো হয়েছিল যে তাদের প্রস্তাব অনুযায়ী পদক্ষেপ নিলে ওয়েন্ডি’স-এর মূল্য প্রায় ৮০% বেড়ে যাবে। মাত্র ছয় সপ্তাহের মধ্যে কোম্পানি সেই পরামর্শ বাস্তবায়ন করে। এটি একটিভিস্ট বিনিয়োগের প্রাথমিক সাফল্যের একটি উদাহরণ।

মিডিয়া-জনমতের ভূমিকা, বোর্ডে আসন গ্রহণ ও দীর্ঘমেয়াদী সম্পৃক্ততা

ওয়েন্ডি’স-এ সাফল্যের পর পারসিং স্কয়ার মিডিয়ার মনোযোগ পায়। ফলে পরবর্তীতে অন্য কোম্পানিগুলিতেও বিনিয়োগ করে, প্রকাশ্যে পরামর্শ দেয়, মিডিয়ার মাধ্যমে চাপ প্রয়োগ করে, এবং শেষ পর্যন্ত শেয়ারহোল্ডারদের (Shareholders) সমর্থন পেয়ে কোম্পানির কাঠামো বা নেতৃত্ব পরিবর্তনে প্রভাব ফেলে। গণমাধ্যম একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশীদারের ভূমিকায় আসে, এবং কখনো “লজ্জা” বা “সুযোগের” দিক থেকে ব্যবস্থাপনা দলের উপর চাপ সৃষ্টি করে সঠিক পদক্ষেপ নিতে বাধ্য করে।

সময়ের সাথে সাথে একটিভিস্ট বিনিয়োগকারীরা কেবল বাইরের থেকে পরামর্শ দেওয়ার পরিবর্তে সরাসরি বোর্ডের (Board) আসনও গ্রহণ শুরু করে। জেনারেল গ্রোথ (General Growth) নামের একটি কোম্পানিতে বিনিয়োগ করে প্রথমবার তারা বোর্ডে আসন পায়, যেখানে আর্থিক পুনর্গঠন ও পরিচালন ব্যবস্থার উন্নয়নের সুযোগ তৈরি হয়েছিল। এটি ছিল পারসিং স্কয়ারের অন্যতম সেরা বিনিয়োগ, যা বুঝিয়ে দেয় যে বোর্ডের ভেতর থেকে কাজ করে কোম্পানির দীর্ঘমেয়াদী উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব।

পরবর্তীতে, এই ধরনের সরাসরি সম্পৃক্ততা বৃদ্ধি পায়। আর ধীরে ধীরে একটিভিস্ট বিনিয়োগকারীরা ওই কোম্পানিগুলোর কাছেই বিশ্বাসযোগ্য অংশীদারে পরিণত হয়। আগে যেখানে দরজা বন্ধ থাকত, পরে সেখানে বিনিয়োগকারীদের পরামর্শ শুনতে কোম্পানিগুলো স্বেচ্ছায় দরজা খুলে দেয়, বোর্ডের আসন অফার করে এবং অর্থপূর্ণ আলোচনা করে।

মালিক (শেয়ারহোল্ডার) ও সিইও বা ব্যবস্থাপনা ক্ষমতার মধ্যে ভারসাম্য ফিরিয়ে আনা

একটিভিস্ট বিনিয়োগের ভাবনা নতুন নয়। ১৫০ বছর আগে অ্যান্ড্রু কার্নেগি (Andrew Carnegie), জেপি মরগান (J.P. Morgan)-এর যুগে বিশাল বিনিয়োগকারীরা ইউএস স্টিল (U.S. Steel)-এর মতো বড় কোম্পানিতে বড় আকারের শেয়ার ধরতেন। যখন সমস্যা দেখা দিত, তারা নিজে বোর্ড ও ব্যবস্থাপনা বদলে ব্যবসাকে ঠিকঠাক করতেন। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় মিউচুয়াল ফান্ড (Mutual Fund), ইনডেক্স ফান্ড (Index Fund) ইত্যাদির উত্থানের ফলে কোম্পানির প্রকৃত মালিক থেকে শেয়ারহোল্ডাররা অনেক দূরে সরে গেছেন। এতে করে মালিকের ক্ষমতা ব্যাহত হয়, এবং কোম্পানিগুলো নির্দিষ্ট শক্তিশালী মালিকানার অভাবের কারণে দুর্বল পারফরমেন্স দেখাতে পারে। একটিভিস্ট বিনিয়োগ এই ভারসাম্য ফিরিয়ে এনেছে।

একটিভিস্ট বিনিয়োগ কোম্পানি মালিক (শেয়ারহোল্ডার) ও ব্যবস্থাপনার মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছে। মালিকানার প্রকৃত স্বার্থ ও ব্যবস্থাপনার পারফরম্যান্স নিশ্চিত করতে এসব বিনিয়োগকারী কার্যকর চাপ প্রয়োগ করে। এর ফলে মার্কিন পুঁজিবাজারের সামগ্রিক পারফরম্যান্স উন্নত হয়েছে।

একটিভিস্ট বিনিয়োগকারীরা সাধারণত কোনো কোম্পানির ৫ থেকে ১০ শতাংশ মালিকানার বেশি রাখে না। তাই তাদের প্রভাব বিস্তারের জন্য অন্যান্য শেয়ারহোল্ডারদের সমর্থন প্রয়োজন হয়। যেন তারা যৌথভাবে একটি শক্তিশালী মালিকানার মতামত তৈরি করতে পারে। এই পদ্ধতিটি অনেকটা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মতো—শেয়ারহোল্ডারদের সমর্থন পেলে একটিভিস্টরা বোর্ড পরিবর্তন অথবা ম্যানেজমেন্ট বদলাতে পারে।

বিনিয়োগকারীদের বিশ্বাসযোগ্যতা ও ঝুঁকি

একটিভিস্ট বিনিয়োগকারীদের সাফল্য নির্ভর করে তাদের দীর্ঘমেয়াদী দৃষ্টিভঙ্গি ও বিশ্বাসযোগ্যতার উপর। একটিভিস্ট বিনিয়োগকারীরা কখনো কখনো কৌশলগতভাবে ব্যবস্থাপনাকে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নিতে সহায়তা করে। উদাহরণস্বরূপ, কোনো নতুন সিইও (CEO) যদি দীর্ঘমেয়াদে কোম্পানিকে উন্নত করতে চায়, কিন্তু তাতে স্বল্পমেয়াদে মুনাফা কমে যায়, তখন একটিভিস্ট বিনিয়োগকারী বোর্ডে উপস্থিত থেকে অন্যান্য শেয়ারহোল্ডারদের আশ্বস্ত করতে পারে যে এই দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা ভবিষ্যতে কোম্পানিকে আরো মূল্যবান করবে। এভাবে তারা গবেষণা ও উন্নয়ন (R&D), নতুন ফ্যাক্টরি তৈরির মতো দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগে সিইওকে সমর্থন জোগায়, যা সামগ্রিকভাবে শেয়ারহোল্ডারদের মঙ্গল সাধন করে।

কিন্তু সমস্যা তখনই হয় যদি তারা স্বল্পমেয়াদী লাভের আশায় কোম্পানিকে ভুল পথে চালিত করতে চায়। সেক্ষেত্রে অন্যান্য বড় শেয়ারহোল্ডার—যেমন ব্ল্যাকরক (BlackRock), ভ্যানগার্ড (Vanguard), স্টেট স্ট্রিট (State Street)—যারা ইনডেক্স ফান্ড পরিচালনা করে এবং দীর্ঘমেয়াদী স্বার্থ দেখে, তারা এটি রুখতে পারে। তাই বাস্তবে স্বল্পমেয়াদী স্বার্থে ক্ষতিকর একটিভিস্ট চালনা করা বেশ কঠিন। কিন্তু সাম্প্রতিক কালে দেখা গেছে এক্টিভিস্ট বিনিয়োগকারীদের স্বল্পমেয়াদী স্বার্থকে ব্যালেন্স করা হয়নি, আর এর ফলে বিভিন্ন কোম্পানি এর স্বার্থের সাথে মানিয়ে না নিতে পারায় অনেক সিইও-কে পদত্যাগ করতে হয়েছে বা সরিয়ে দেয়া হয়েছে।

কিছু নতুন আইন ও নিয়মকানুন অ্যাকটিভিস্ট বিনিয়োগকারীদের হাতে অনেক স্বাধীনতা দান করে। অনেক অ্যাকটিভিস্ট বিনিয়োগকারী আবার হেজ ফান্ড (Hedge Funds) থেকে উঠে এসেছে, যা এখন রেকর্ড পরিমাণ মূলধন রাখে। এর ফলে এদের হাতে বিলিয়ন বিলিয়ন অতিরিক্ত ডলার হাতে এসেছে। এই সম্পদ এখন তাদেরকে প্রচারণা চালিয়ে প্রকৃত পরিবর্তন আনার ক্ষমতা দিয়েছে। সিইওদের উদ্দেশ্যে তাদের বার্তা স্পষ্ট: “মূল্য (Value) তৈরি করুন, নাহলে কঠোর পর্যালোচনার মুখোমুখি হবেন।” আর এখানেই তৈরি হয়েছে নতুন রকমের ঝুঁকি। বোর্ডকে সতর্ক থাকতে হচ্ছে যাতে স্বল্পমেয়াদী ফলাফলের জন্য দীর্ঘমেয়াদী কৌশল ও স্থায়িত্ব (Sustainability) বিসর্জন না দেওয়া হয়। অনেক কোম্পানি স্বল্পমেয়াদী শেয়ার মূল্য বৃদ্ধির জন্য সিইও আনে, তারা বড় বোনাস নিয়ে চলে যায়, আর কোম্পানি পরে দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এখন অ্যাকটিভিস্ট বিনিয়োগকারীরা স্বল্পমেয়াদী সাফল্যের দিকে আরও জোর দেওয়ায়, এমন ঘটনা আরও বাড়তে পারে।

তাই যদি এক্টিভিস্ট বিনিয়োগকারীরা ব্যবস্থাপনা বা সিইওদের ক্ষমতা খর্ব করে ভারসাম্য নিয়ে আসতে গিয়ে নিজেরাই ভারসাম্য ধ্বংস করে বেশি ক্ষমতাবান হয়ে যায়, তবে তাদের ক্ষমতাকে দমন করেও পুনরায় ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন আছে বৈকি। সংশয় থাকে যে কোনো একটিভিস্ট বিনিয়োগকারী যদি খাটো সময়ের মুনাফার জন্য কোম্পানির দীর্ঘমেয়াদী সম্ভাবনা নষ্ট করে, তখন সেটি ক্ষতিকারক হতে পারে। এক্ষেত্রে ইনডেক্স ফান্ডগুলো সহায়ক হতে পারে, কারণ ইন্ডেক্স ফান্ডগুলো দীর্ঘমেয়াদী স্বার্থের কথা ভাবে এবং সন্দেহজনক স্বল্পমেয়াদী কৌশলকে সমর্থন করে না। এগুলোর উপস্থিতিতে এদের স্বার্থপর চালনা প্রতিরোধ করা যায়। কিন্তু চেক অ্যান্ড ব্যালেন্সের সব কিছু বিজনেসের হাতে ছেড়ে না দিয়ে রাষ্ট্রেরও উচিৎ এখানে নিয়ন্ত্রণ আনার চেষ্টা করার।

উপসংহার

একটিভিস্ট বিনিয়োগ (Activist Investing) মূলত মালিকানার ক্ষমতা ও দায়িত্বকে আবারও সামনে নিয়ে এসেছে। প্যাসিভ বিনিয়োগের যুগে এটি একটি সক্রিয় হাতিয়ার যা ব্যবসা ও বিনিয়োগকারীদের মধ্যে সরাসরি সংযোগ স্থাপন করে, কোম্পানিকে দীর্ঘমেয়াদে শক্তিশালী করে তুলতে পারে। ঝুঁকি ও সম্ভাব্য নেতিবাচক দিক রয়েছেই। তবুও বিশ্বাসযোগ্য একটিভিস্ট বিনিয়োগকারীরা শেয়ারহোল্ডারদের স্বার্থ রক্ষা করে এবং কোম্পানিকে আরও টেকসইভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার উপায় তৈরি করে। যেটা দরকার সেটা হচ্ছে মালিক (শেয়ারহোল্ডার) ও ব্যবস্থাপনার (সিইও ইত্যাদি) মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা, এবং প্রয়োজনে সেই ভারসাম্য রক্ষার জন্য রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে আইন ও রেগুলেশন নিয়ে আসা।

কেন যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা একটি সুবিশাল প্রতারণা বা স্ক্যাম? (৪ আগস্ট, ২০২২)

একটি মানব জীবনের মূল্য কত?

আপনাকে একটা প্রশ্ন করি—একজন মানুষের জীবনের মূল্য আপনি কত ধার্য করবেন? যুক্তরাষ্ট্রের (US) হিসেবে এটার উত্তর প্রতি বছর প্রায় ৭,০০০ ডলার (dollars)। এটি হচ্ছে গড় বার্ষিক স্বাস্থ্যবিমার (health insurance) খরচ। যুক্তরাষ্ট্র অন্য যেকোনো দেশের চেয়ে স্বাস্থ্যসেবায় বেশি খরচ করে, অথচ উন্নত দেশের মধ্যে স্বাস্থ্যসেবার গুণগত মানে সেটি সর্বনিম্ন পর্যায়ে থেকে যায়। এদিকে চিকিৎসা পেতে এখনও দেশটির নাগরিকদের টাকা দিতে হয়। এটি এমন এক ব্যবস্থা যা সম্পূর্ণভাবে মুনাফার ওপর নির্ভরশীল এবং প্রতি বছর রোগীদের কাছ থেকে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার অতিরিক্ত আদায় করে। এ ব্যবস্থায় কে কিভাবে লাভবান হচ্ছে তার ওপর নির্ভর করে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি পর্যন্ত বদলে যায়। যুক্তরাষ্ট্রে চিকিৎসা-কর্মীদের (medical personnel) সেলিব্রেটির মতো দেখা হয়, পেশাজীবীর মতো নয়। উদাহরণস্বরূপ, অ্যান্থনি ফাউচিকে (Anthony Fauci) কেউ কেউ ত্রাণকর্তা হিসেবে দেখে, আবার অন্যদের চোখে তিনি এক খলনায়ক। কিন্তু কেন এই ব্যবস্থা এত ভঙ্গুর? এর পেছনে মূল কারণ অর্থ, আর কিছু কোম্পানি যারা স্বাস্থ্যসেবাকে পরিণত করেছে ট্রিলিয়ন ডলারের প্রতারণার (scam) যন্ত্রে, যেখানে মানুষের জীবনের চেয়ে প্রোফিটকে বেশি মূল্য দেয়া হয়।

কেন যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে

প্রায় সব বিদেশির চোখে যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্যসেবা একটা সম্পূর্ণ নৈরাজ্য (dumpster fire) বলে মনে হয়। অথচ অনেক আমেরিকানের কাছে এটা স্বাভাবিক, এমনকি কারো কারো কাছে বেশ ভালোও লাগে। কিন্তু বাস্তবে এটি স্বাভাবিক থেকে অনেক দূরে। প্রথমে কিছু তথ্যের দিকে তাকাই, যা স্পষ্ট করবে এই পরিস্থিতি কতটা খারাপ।

কানাডায় (Canada) একটি ইনসুলিনের (insulin) ভায়াল (vial) দাম প্রায় ৩০ ডলার, অথচ যুক্তরাষ্ট্রে একই কারখানায় তৈরি একই ওষুধের দাম ১০ গুণ বেশি। অস্ট্রেলিয়ায় (Australia) এইচআইভি (HIV) প্রতিরোধী ওষুধ ট্রুভাডা (Truvada) মাত্র ৮ ডলার, অথচ যুক্তরাষ্ট্রে সেটা ২,০০০ ডলার। এই ধরনের উচ্চ মূল্যের কারণে যুক্তরাষ্ট্রে স্বাস্থ্যবিমা প্রায় অপরিহার্য। কিন্তু বিমা থাকা সত্ত্বেও অনেক আমেরিকানের জন্য চিকিৎসা বিল পরিশোধ করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।

৬৩% ভুক্তভোগী তাদের চিকিৎসার জন্য সঞ্চয়ের (savings) বেশিরভাগ বা সবটুকু ব্যয় করেন, এবং ৪০%-এর বেশি মানুষকে চিকিৎসা খরচ মেটাতে দ্বিতীয় চাকরি নিতে হয়। এতো বিশাল চিকিৎসা ব্যয় এমন এক বিপুল সমস্যার সৃষ্টি করেছে যে যুক্তরাষ্ট্রে ব্যক্তিগত দেউলিয়া-অবস্থার (personal bankruptcies) দুই-তৃতীয়াংশ চিকিৎসা খরচের সাথে জড়িত। প্রতি বছর প্রায় অর্ধ-মিলিয়ন (৫ লক্ষ) পরিবার চিকিৎসা ব্যয়ের কারণে দেউলিয়া হয়ে পড়ে।

অথচ বিশ্বের অন্যত্র এরকম হওয়াটা একটি অস্বাভাবিক বিষয়। আজ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রই একমাত্র উন্নত দেশ, যেখানে সার্বজনীন (universal) স্বাস্থ্যসেবা নেই। এমনকি অনেক অনুন্নত দেশেও নাগরিকদের জন্য বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা আছে, যেমন ইরান (Iran), বতসোয়ানা (Botswana), কিউবা (Cuba), রুয়ান্ডা (Rwanda), পাকিস্তান (Pakistan)। তাই অবিশ্বাস্য হলেও এটাই সত্যি যে, যুক্তরাষ্ট্র এখনো চিকিৎসা নামক একটি মৌলিক মানবাধিকারে (basic human right) বাধা দিচ্ছে। এর কারণ হচ্ছে বিগ বিজনেসের (big business) হাতে পরিচালিত এক অদ্ভুত প্রভাব ও প্ররোচনা, যেখানে প্রথম কুশীলব হচ্ছে স্বাস্থ্যবিমা কোম্পানিগুলো (health insurers)।

স্বাস্থ্যবিমা কোম্পানিগুলোর ম্যানিপুলেশন বা প্রভাব

যুক্তরাষ্ট্রের একটি “স্বাভাবিক” হস্পিটাল বিলের চিত্রটা অনেকটা এরকম – ১১ দিনের হাসপাতাল থাকায় বিল এলো ধরুন ৩,৬০,১০৪ ডলার! কিন্তু ভাগ্যক্রমে এই রোগীর স্বাস্থ্যবিমা ছিল, যা তাকে বিশাল দায় থেকে কিছুটা রেহাই দেয়। প্রথমে বিমা কোম্পানি হাসপাতালের বিল থেকে প্রায় ২,৬০,০০০ ডলার ছাড় (discount) আদায় করে নেয়। ফলে বাকি থাকে ১,০০,১০৪ ডলার। বিমা পরে এখানে থেকে ১,০০,০০০ ডলার পরিশোধ করে, রোগীর কাঁধে থাকে মাত্র ১০৪ ডলার। দেখলে মনে হয় বিমা কি না দারুণ একটা সুবিধা দিল!

কিন্তু আসল ব্যাপার হলো এই “ডিসকাউন্ট” একটি সুপরিকল্পিত প্রতারণা (scam), যা হাসপাতাল ও বিমা কোম্পানির পারস্পরিক সুবিধামূলক চুক্তির ফল। যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্যবিমার প্রধান বিক্রয় কৌশল হলো, তারা নাকি হাসপাতালের সাথে দর-কষাকষি করে খরচ কমাতে পারে, যা রোগীদের হাজার হাজার ডলার সাশ্রয় করে। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে কারো কাছে সঠিক তথ্য ছিল না—কত দাম বিমাহীন (without insurance) রোগীকে দিতে হতো আর বিমাযুক্ত (with insurance) রোগীর জন্য দর কত হতো। ২০২০ সালে ফেডারেল সরকার হাসপাতালগুলোকে বাধ্য করে তাদের বিমা কোম্পানির সাথে দর-কষাকষি করা মূল্যের তালিকা প্রকাশ করতে। এরপরই সুস্পষ্ট হয়ে গেল যে কেন এতদিন এই তথ্য গোপন রাখা হয়েছিল।

একটি হাসপাতালে বিমাহীন এক রোগীর কোলনস্কপি (colonoscopy) খরচ ৭৮২ ডলার, কিন্তু বিমা সহ রোগীর জন্য একই পরীক্ষা ২,০০০ ডলারের বেশি—প্রায় তিন গুণ! বা পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে (University of Pennsylvania Hospital) বিমা নেই এমন রোগীর জন্য একটি প্রেগন্যান্সি টেস্ট (pregnancy test) ১০ ডলার, অথচ বিমাযুক্ত রোগীর জন্য একই পরীক্ষা প্রায় ১০ গুণ বেশি দামি! সহজভাবে বললে, বিমাযুক্ত রোগীদেরকে অনেক ক্ষেত্রে বিমাহীনদের চেয়েও বেশি টাকা গুনতে হচ্ছে। অর্থাৎ বিমা কোম্পানিগুলো আসলে সম্পূর্ণ ডাহা মিথ্যার আশ্রয় নেয়। তারা যে বিশাল ডিসকাউন্ট পাওয়ার দাবি করে, তা মূলত তাদেরই তৈরি কৃট্রিমভাবে স্ফীত ( artificially inflated) দামের ওপর ভিত্তি করে নির্মাণ। ফলে আমেরিকানদের কাছে এই ধারণা তৈরি হয় যে বিমা না থাকলে তারা শেষ – কেননা স্থূলভাবে বাড়ানো দামের ওপর কৃত্রিম ছাড় দেখিয়ে তাদের এই “মূল্যবান” পরিষেবা (service) ধারণাটা গেলানো হয়।

এখন আপনি চাইলে নিজেও এই বিল কমাতে দর-কষাকষি করতে পারেন, কিন্তু সেখানেও আরেক ফাঁদ পাতা থাকে। বিমা নেই এমন একজন রোগী এক ঘণ্টার চিকিৎসার জন্য ৩১,০০০ ডলারের বেশি বিল পেয়ে তা কমাতে চেয়েছিলেন। অথচ যেখানে বিমা কোম্পানিগুলো অনায়াসে ৮০% ছাড় আদায় করে, সেখানে তিনি পেলেন মাত্র ৪৩% ছাড়। একজন চিকিৎসক জানালেন, কারণ ওই রোগীর কোন “প্রতিনিধিত্ব” (representation) নেই। সহজ কথায়, যুক্তরাষ্ট্রে বিমা থাকার আসল সুবিধা হলো আপনি “বিমা ক্লাবের” সদস্য। তখন হাসপাতাল আপনাকে সর্বনিম্ন রেট দিতে রাজি হয়। এক লেখকের ভাষায়, আপনি যদি স্বাস্থ্যবিমা না কেনেন, তবে হাসপাতালগুলো আপনার বিলের ওপর শত শত শতাংশ জরিমানা (surcharge) বসায়। আর যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্যসেবা খাতের মূল্য নির্ধারণে প্রায় কোনো আইনগত বাধ্যবাধকতা নেই—তাই এটি কার্যত একটি বৈধ চাঁদাবাজি।

মোট কথা, হাসপাতাল ও বিমা কোম্পানিগুলো যেন একটি মাফিয়া চক্র (mafia protection racket)। আপনি যদি বিমা ফি না দেন, তবে আপনার আর্থিক ধ্বংসের ঝুঁকি, এমনকি জীবনযাত্রা সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

হাসপাতালগুলোর অতিরিক্ত মূল্য আদায়

এবার আমরা আবার মূল আলোচনায় ফিরি। বিমা ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রে স্বাস্থ্যসেবার মূল্য বহুস্তরে কৃত্রিমভাবে বাড়ানো হয়। এটা ঘটে এমনকি সবচেয়ে মৌলিক স্বাস্থ্যসেবাতেও, যেমন: শিশু জন্মদান (childbirth) ও জরুরি চিকিৎসা (emergency visits)।

যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিদিন প্রায় ১০,০০০ শিশু জন্মায়, যার মধ্যে এক-তৃতীয়াংশ সি-সেকশন (C-section) দ্বারা জন্মগ্রহণ করে। বিশ্বব্যাপী এই হার ১০ থেকে ১৫ শতাংশের মধ্যে থাকলেও যুক্তরাষ্ট্রে এটি দ্বিগুণেরও বেশি। কেন এমন হয়? বিভিন্ন প্রতিবেদনের মতে এর সাথে মা বা শিশুর কল্যাণের কোনো সম্পর্ক নেই। বরং কারণ হচ্ছে সি-সেকশনের জন্য হাসপাতাল গড়ে প্রায় ৫,০০০ ডলার বেশি পায়, যা স্বাভাবিক প্রসবের চেয়ে অনেক লাভজনক। ফলে অপ্রয়োজনীয় হলেও সি-সেকশন করা হয়।

আপনি যদি সি-সেকশনের পর আপনার নবজাতককে বুকে নিতে (skin-to-skin contact) চান, হাসপাতাল আপনাকে তার জন্যও ৪০ ডলার অতিরিক্ত চার্জ করতে পারে। এই অতি-মূল্য-আদায় বা ওভারচার্জিং প্রায় সবখানেই দেখা যায়, এমনকি জরুরি কক্ষ বা ইমার্জেন্সি রুমেও (ER)। যুক্তরাষ্ট্রে ইমার্জেন্সি রুম (ER) সফরের চার্জ রোগীর অবস্থা কতটা গুরুতর তার ওপর নির্ভর করে ১ থেকে ৫ পর্যন্ত কোডিং করা হয়। কোড যত উঁচু, বিল তত বেশি। গত দুই দশকে হাসপাতাল ও ডাক্তাররা শিখে গেছে যে বেশি কোড (upcoding) দিলে বেশি অর্থ মেলে। এক গবেষণায় দেখা গেছে, ৭ বছরের মধ্যে গুরুতর আহত রোগীদের সর্বোচ্চ স্তরের (level 5) ভিজিট ৪৫% বেড়ে গেছে। বীমাকারীরা (insurer) তো আর রোগীর সাথের ঘরে থাকে না, ফলে আসলেই এত গুরুতর অবস্থা ছিল কিনা তা যাচাই করা কঠিন। এতে হাসপাতাল চাইলেই বিল বাড়াতে পারে।

আমরা হয়তো ভাবতে পারি ডাক্তার-নার্সরা (staff) লোভী বলে এমন হয়। কিন্তু আসলে সমস্যা পেছনে আরও গভীরে, যেখানে রয়েছে বিশাল বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানগুলো (investment firms)।

বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর (Investment firms) স্বাস্থ্য খাতে প্রভাব

যুক্তরাষ্ট্রের পুরো স্বাস্থ্যব্যবস্থা মুনাফাকেন্দ্রিক (for-profit), যেটা অন্য কোন দেশে দেখা যাবেনা। অর্থাৎ সেখানে স্বাস্থ্যব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে মানুষের সেবার জন্য নয়, লাভ করার জন্য। ব্ল্যাকস্টোন (Blackstone) হলো বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান (investment firm)। যুক্তরাষ্ট্রে এটি টিম হেলথ (Team Health) নামক এক বৃহত্তম চিকিৎসাকর্মী সরবরাহকারী কোম্পানির (medical staffing company) মালিক। অর্থাৎ আপনি যুক্তরাষ্ট্রে হাসপাতালে গেলে আপনার ডাক্তার বা নার্স সম্ভবত টিম হেলথের কর্মী।

টিম হেলথের দুর্নাম আছে যে, এটি গ্রাহকদের কাছ থেকে অত্যধিক মূল্য আদায় করে, যা অন্যান্য সরবরাহকারীর তুলনায় ৯৫% এর বেশি এবং মেডিকেয়ার (Medicare)-এর তুলনায় ৯ গুণ বেশি। প্রতিষ্ঠানটির এক নির্বাহী (executive) স্বীকার করেছেন, প্রকৃত চিকিৎসা ব্যয় তাদের মূল নির্ধারণে কোনো ভূমিকা রাখে না। অর্থাৎ তারা ইচ্ছেমতো দাম বসিয়ে দিতে পারে, এতে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার গিয়ে পড়ে ব্ল্যাকস্টোন ও অন্যান্য ধনী বিনিয়োগকারীদের পকেটে।

সব মিলিয়ে আমেরিকানদের আসলে বিকল্পের তেমন সুযোগ নেই। প্রায় সব পাবলিকলি ট্রেডেড (publicly traded) হাসপাতাল, মেডিক্যাল ও ফার্মা (pharma) কোম্পানির কিছু অংশের মালিকানা ব্ল্যাকরক (BlackRock) ও ভ্যানগার্ড (Vanguard)-এর মতো প্রতিষ্ঠানের হাতে। এরা যুক্তরাষ্ট্রের গোটা স্বাস্থ্যব্যবস্থার মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণ কার্যত নিজেদের কব্জায় রেখেছে। সহজেই অনুমেয়, এসব মুনাফালোভী বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান নিজেদের অর্থনৈতিক স্বার্থে এই পুরো ব্যবস্থাকে পরিচালনা করছে।

কেন দরিদ্ররা বেশি ভুক্তভোগী?

যখন কোনো ব্যবস্থায় এমন অপব্যবহার ঘটে, তখন সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় দরিদ্র জনগোষ্ঠী। চিকিৎসা ব্যয় বাড়তে থাকায় এক দশকে যুক্তরাষ্ট্রে বিমাহীন মানুষের সংখ্যা ৩৫% বেড়ে গেছে। ফলে অনেকে চিকিৎসা প্রয়োজন হলেও হাসপাতালে যান না, কারণ তারা খরচ বহন করতে পারেন না।

অনেকেই গুরুতর আহত হলেও হাসপাতালে না নিয়ে যাবার অনুরোধ করেন—কারণ হাসপাতাল খরচ মেটানোর সামর্থ্য নেই। মৃগী (Seizure) রোগীরাও এমনিতেই ব্রেসলেট (bracelet) পরে থাকেন যেখানে লেখা থাকে “Do not call an ambulance” (অ্যাম্বুলেন্স ডাকবেন না) কারণ তারা হাজার ডলারের বেশি ভাড়া বহন করতে পারবেন না।

আজ যুক্তরাষ্ট্রে গর্ভপাত (abortion) প্রার্থী নারীদের ৭৫% দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। রো ভার্সাস ওয়েড (Roe versus Wade) উল্টে যাওয়ার পর অর্থনীতিবিদরা বলছেন তাদের অবস্থা আরো খারাপ হবে। কারণ এখন হয়তো দরিদ্র নারীরা বাধ্য হবে অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণ বহন করতে বা ঝুঁকিপূর্ণ পদ্ধতিতে গর্ভপাত করতে। অন্যদিকে ধনী নারীরা অন্য রাজ্য বা দেশে গিয়ে নিরাপদ গর্ভপাত করানোর সামর্থ্য রাখেন, যা দরিদ্র নারীদের জন্য অনুপলব্ধ।

স্বাস্থ্য মেসেজিং-এর (health messaging) নিয়ন্ত্রণ যখন বড় ব্যবসারগুলোর হাতে 

এখন প্রশ্ন হলো, যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্যব্যবস্থা এত ভেঙে পড়ে আছে, তবু কেন অনেক আমেরিকান এটিকে একরকম স্নেহভরে গ্রহণ করছে? কারণ স্বাস্থ্যসেবা শিল্প (medical and pharmaceutical industry) বিজ্ঞাপন (advertising) এবং জনসংযোগে (PR) প্রতি বছর বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ব্যয় করে। এর মাধ্যমে তারা একটি গল্প বা ন্যারেটিভ তৈরি করে, যাতে সবকিছু আগের মতোই থাকে।

যুক্তরাষ্ট্রে মেডিক্যাল ও ফার্মাসিউটিক্যাল ইন্ডাস্ট্রি (pharmaceutical industry) লবিংয়ে (lobbying) যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় করে, অন্য কোনো খাত তার ধারে-কাছেও নেই। অন্য যে কোনো খাতের চেয়ে তারা দ্বিগুণ ব্যয় করে, যাতে এমন আইন প্রণয়ন করা হয় যা তাদের জন্য যত বেশি সম্ভব লাভ নিশ্চিত করে। এরা প্রতিবছর বিজ্ঞাপনে বিলিয়ন ডলার ব্যয় করে আমেরিকানদের এটা বোঝাতে যে, তাদের ব্যবস্থাটা ভালভাবেই কাজ করছে। কিন্তু যদি সত্যিই ভালোভাবে কাজ করতো, তবে পরিসংখ্যান এত হতাশাজনক হতো না।

উন্নত দেশগুলোর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের গড় আয়ু (life expectancy) সবচেয়ে দ্রুত কমছে। যুক্তরাষ্ট্রই একমাত্র উন্নত দেশ যেখানে মাতৃমৃত্যুর হার (maternal mortality rate) কমার বদলে বাড়ছে। যুক্তরাষ্ট্রে চিকিৎসাগত ত্রুটি (medical error) তৃতীয় বৃহত্তম মৃত্যুর কারণ, আর এটা মোট মৃত্যুর ১০% এর জন্য দায়ী। ৯২% চিকিৎসকই (physicians) স্বীকার করেন যে আইনি ঝামেলা এড়াতেই তারা রোগীর সুস্বাস্থ্যকে প্রাধান্য না দিয়ে অন্যান্য অনেক সিদ্ধান্ত নেন। সংক্ষেপে বলা যায়, এই হচ্ছে বাস্তবতা।

আপনি যদি আইসল্যান্ডে বা অস্ট্রেলিয়ায় বা অন্য যে কোন উন্নত দেশে থাকেন তবে আপনি ইচ্ছা করে আঙুল কেটে ফেললেও আপনাকে কোন রকম অর্থের চিন্তা করতে হবে না। সোজা হাসপাতালে যাবেন, চিকিৎসা পাবেন। আপনার বিমা আছে কি না তা আপনাকে ভাবতে হবে না, চিকিৎসার বিল আপনাকে দেউলিয়া করবে—এমন চিন্তা আপনার মাথায়ও আসবেও না। অথচ যুক্তরাষ্ট্রে ঠিক উল্টো। আর এই ব্যবস্থার জন্য দায়ী কারা, আশা করি তা বোঝা এখন আপনার জন্য সহজ হবে।

তাহলে, আবারও সেই একই প্রশ্ন রাখছি — একটি মানব জীবনের মূল্য কত? যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার মতে, এই মূল্যের কোনো ঊর্ধ্বসীমা নেই। যত টাকা খসানো যায়, ততই।

আবাসনের অর্থনীতি ও আবাসন সংকট: বিনিয়োগ, ঝুঁকি, কারণ, চ্যালেঞ্জ ও সমাধানের পথ (৬ মে, ২০২১)

ভূমিকা

যে কোনও বাজার, যে কোনও এলাকাতেই পরিবারের জন্য একটি বাড়ি হচ্ছে আরামের আশ্রয়, একটি পরিবারকে বড় করার চমৎকার জায়গা এবং সর্বোপরি একটি বিচক্ষণ বিনিয়োগ। বিশ্বের বেশিরভাগ উন্নত দেশে একটি বাড়ি পারিবারিক অর্থনীতির কেন্দ্রবিন্দু। এটি একই সাথে সবচেয়ে বড় বিনিয়োগ এবং প্রায় যেকোনো ব্যক্তির জন্যই এই ক্রমবর্ধমান দুর্লভ বাজারে প্রবেশ করতে পারাটা ভাগ্যের বিষয়। কিন্তু এটা কি সবথেকে ভালো? বাড়িঘর কি জুয়া খেলার চিপসের মতই হয়ে গেছে? কারণ লোকেরা আর সেগুলোকে একটি ক্রমবর্ধমান পরিবারের জন্য আশ্রয় হিসেবে দেখে না, বরং অপ্রত্যাশিত লাভের আশায় বন্য ফটকাবাজির জন্য কেনা সম্পদ হিসেবে দেখে।

২০০৮ সালের শেষ আর্থিক মন্দার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল রিয়াল এস্টেটের বাজার। সম্ভবত আবাসন জগতে কী ঘটছে তা পুনরায় মূল্যায়ন করা জরুরি। এটি করার জন্য, আমাদের সত্যিই কয়েকটি বিষয়ের দিকে কয়েকটি স্তরে নজর দিতে হবে— ক্ষুদ্র অর্থনৈতিক কারণগুলো থেকে, যেমন একটি অতি-উন্নত এবং অতিরিক্ত ঋণগ্রস্ত পরিবার থেকে শুরু করে অর্থনীতি-ব্যাপী বিষয়গুলো পর্যন্ত, যা শেষ পর্যন্ত কয়েকটি মূল প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য সামনে আনা হবে। সেই প্রশ্নগুলো হচ্ছে – একটি শক্তিশালী রিয়াল এস্টেট বাজারের বৃহত্তর অর্থনীতির জন্য কী অর্থ বহন করে? সেখানে কি আরও ভাল বিনিয়োগ আছে? এবং অর্থনীতিগুলো কি এখন অতিরিক্ত ঋণগ্রস্ত? যদি আমরা এই কারণগুলো বুঝতে পারি, তাহলে আমরা আমাদের জীবনের সবচেয়ে বড় বিনিয়োগের সঙ্গে মোকাবেলা করতে আরও ভালভাবে প্রস্তুত হব।

এদিকে আবাসনের দাম যদি অনেক বেড়ে যায় তাহলে মানুষ শহর ত্যাগ করে শহরতলিতে বাড়ি নিতে শুরু করে, যেটা কোভিড-১৯ এর অতিমারীর সময় ভীষণভাবে প্রকট হয়ে উঠেছিল। এই আবাসন সংকটের কারণে শহর থেকে শহরতলির দিকে যাওয়াটারও একটা ইতিহাস আছে। শিল্প বিপ্লবের পর ১৯৫০ সালে প্রথম শহর ছেড়ে মানুষ শহরতলীতে বসবাস করতে শুরু করে। এই সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের গড়পড়তা বাড়ির দাম ছিল ৭,৪০০ ডলার। যেখানে একটি পরিবারের গড় আয় ছিল ২,৯০০ ডলার এবং সাধারণত পরিবারের একজন সদস্যই উপার্জন করত। এই সময় একটি সাধারণ বাড়ির দাম ছিল একটি পরিবারের গড় আয়ের দুই-তৃতীয়াংশের সামান্য বেশি। তাই এটা আশা করা অযৌক্তিক ছিল না যে কিছু মানুষ কয়েক বছরের মধ্যেই তাদের বাড়ির ঋণ পরিশোধ করতে পারবে। কিন্তু বাস্তবে তেমনটা ঘটেনি। সুদের হার তুলনামূলকভাবে কম ছিল। তাই অতিরিক্ত অর্থ পরিশোধ করার তেমন চাপ ছিল না। তাছাড়া, আবাসনকে তখন খুব একটা বড় খরচ হিসেবেও দেখা হতো না।

এই সময় একটি নতুন গাড়ির গড় দাম ছিল প্রায় ২,০০০ ডলার। তাই যদি কোনো পরিবারের বাড়ির সামনে দুটো গাড়িও থাকত, তাহলেও গাড়িগুলোর দাম বাড়ির চেয়ে বেশি হওয়াটা অস্বাভাবিক ছিল না। বিশেষ করে মধ্য-পশ্চিমের (Midwest) মতো জায়গাগুলোতে যেখানে বাড়ির দাম উপকূলবর্তী রাজ্যগুলোর (Coastal states) তুলনায় কম ছিল। অবশ্য, সেই সময় দুটো গাড়ি থাকাটা বেশ আড়ম্বরের বিষয় ছিল, তাই এই পরিস্থিতি খুব একটা স্বাভাবিক ছিল না।

কিন্তু এখনকার দিনে পরিস্থিতিটা প্রায় অবিশ্বাস্য মনে হয়। শিকাগো (Chicago) বা সিয়াটলের (Seattle) শহরতলীর (suburb) বাইরের কোনো সুন্দর এলাকায় একটি সাধারণ বাড়ির ছবি কল্পনা করুন। এমনকি ভ্যাঙ্কুভার (Vancouver), সিডনি (Sydney), অকল্যান্ডের (Auckland) কথাও ভাবতে পারেন। অথবা যদি আরও বাড়াবাড়ি করতে চান তাহলে লন্ডনকে (London) ধরুন। বাড়ির সামনে পার্ক করা গাড়িগুলো যদি ল্যাম্বরগিনিও (lambos) না হয়, তাহলে এই দুটি সম্পদের দামের তুলনা করাও সম্ভব নয়। আমি জানি আপনারা কী ভাবছেন, “হ্যাঁ, বাড়ির দাম বেড়েছে, এতে নতুন কী?”

আমি বুঝতে পারছি, কিন্তু এই তুলনাটি অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। মহামারীর (pandemic) প্রেক্ষাপটে আবাসন সংকট আবারও একটি বিশাল সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। শহরে আবাসনের দাম এত বেড়ে যায় যে, ব্যক্তিগত বসবাসের জন্য বেশি জায়গার প্রয়োজনীয়তা এবং বাড়ি থেকে কাজ করার সুবিধার কারণে মানুষ আবারও শহর ছেড়ে শহরতলীতে যেতে শুরু করে।  এতে দাম বাড়তে শুরু করে। আবাসনের দাম বাড়াটা স্বাভাবিক একটা ব্যাপার, কিন্তু এটাকে বাড়তে হবে অন্যান্য পণ্যের মতই স্থিতিশীলভাবে। অস্বাভাবিকভাবে বা অস্থিতিশীলভাবে দাম বাড়াটা অর্থনীতির জন্য খুবই ক্ষতিকর হয়ে দাঁড়ায়। উন্নত দেশগুলোতে এখন যে বাড়ির দাম বাড়ছে, সেগুলোর কারণ ও ফলও আলোচনা করা দরকার, সেই সাথে অতীতের সাথে এর তুলনাও।

উন্নত বিশ্বে আবাসন সংকটের ইতিহাস

১৯৫০-এর দশক: শহর ছেড়ে শহরতলীতে স্থানান্তর

যদি আমরা ১৯৫০-এর দশকে ফিরে যাই, তাহলে দেখব বেশ কিছু কারণে মানুষ শহরের কেন্দ্র ছেড়ে শহরতলীতে বসবাস করতে শুরু করেছিল। শহরের কেন্দ্রগুলোতে মূলত ভাড়াটেরা থাকত, আর শহরতলীতে বাড়ির মালিকানার চল শুরু হয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রে একটি বড় কারণ ছিল তথাকথিত “শ্বেতাঙ্গদের শহর ত্যাগ” (white flight)। মূলত শ্বেতাঙ্গ মধ্যবিত্তরা ভেতরের শহরগুলোকে অপেক্ষাকৃত নিরাপদ মনে করত না, তাই তারা শহরতলীর দিকে চলে গিয়েছিল। “নিরাপদ” বলতে তারা মূলত “আরও বেশি শ্বেতাঙ্গ” বোঝাত। এই পুরো প্রক্রিয়াটি কয়েকটি কারণে দ্রুততর হয়েছিল।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের (World War II) পর উন্নত আন্তঃরাজ্য মহাসড়ক ব্যবস্থা (interstate highway system) তৈরি হওয়ায় মানুষ তাদের নতুন কেনা গাড়ি ব্যবহার করে প্রতিদিন সহজে এবং দ্রুত কর্মস্থলে যাতায়াত করতে পারত। এর কয়েক দশক আগেও শহর থেকে গ্রামাঞ্চলে যেতে হলে ভাগ্যবান হলে ট্রেনে চড়তে হতো, আর ভাগ্য খারাপ হলে ঘোড়ার গাড়িতে যেতে হতো, যা বেশিরভাগ মানুষের দৈনিক যাতায়াতের জন্য বাস্তবসম্মত ছিল না।

পশ্চিমা বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলের জন্যেও একই চিত্র ছিল। অস্ট্রেলিয়া (Australia), কানাডা (Canada) এবং এমনকি যুক্তরাজ্যও (UK) যুক্তরাষ্ট্রের দেখানো পথ অনুসরণ করে মহানগরীর অট্টালিকা ছেড়ে শহরতলীতে জমি কিনে বাড়ি বানানোর দিকে ঝুঁকেছিল। এর এমন একটি প্রভাব ছিল যা আজকের দিনে আমাদের কাছে খুব অদ্ভুত মনে হতে পারে। এর ফলে আবাসন আরও সাশ্রয়ী হয়ে উঠেছিল।

১৯৭০-এর দশকে সাশ্রয়ী আবাসন

দুই দশক পর, ১৯৭০ সালে, যুক্তরাষ্ট্রে একটি গড় বাড়ির দাম ছিল ১৭,০০০ ডলার। যা ১৯৫০-এর দশকের চেয়ে বেশি হলেও খুব বেশি নয়। প্রকৃতপক্ষে, এই সময়ে দাম শুধুমাত্র মুদ্রাস্ফীতির (inflation) সাথে তাল মিলিয়ে চলেছিল। এর বিপরীতে, এই সময়ে গড় বেতন প্রায় তিনগুণ বেড়ে ৮,৭০০ ডলারে পৌঁছেছিল। যার মানে দাঁড়ায় একটি গড় বাড়ির দাম ছিল একটি পরিবারের গড় আয়ের দুই গুণেরও কম। অনেকেই তাদের বার্ষিক আয়ের চেয়েও কম দামে বাড়ি কিনছিলেন। এর কারণ ছিল সরবরাহ বেশি থাকা। শহরগুলো বাড়তে শুরু করেছিল এবং সর্বত্র নতুন বাড়ি তৈরি হচ্ছিল। এর চেয়েও বড় কথা, চাহিদার তুলনায় সরবরাহ বেশি ছিল। আজকের জনসংখ্যার তুলনায় তখন জনসংখ্যা ছিল দুই-তৃতীয়াংশ এবং রিয়েল এস্টেটে (real estate) বিনিয়োগের ধারণাটি তেমন প্রচলিত ছিল না।

সত্তরের দশকে ক্যাশ রেটও (cash rates) ১৩ শতাংশের মতো বেশি ছিল। যার অর্থ দাঁড়ায় নিজের বসবাসের জন্য নেওয়া মর্টগেজ (mortgage) ধরে রাখাই কঠিন ছিল, সেখানে বিনিয়োগের জন্য সম্পত্তি কেনা তো দূরের কথা। রিয়েল এস্টেট ছিল একটি সাধারণ পণ্য। কাঠ, লোহার আকরিক, কমলার রস বা চালের মতো। এটি এমন কিছু ছিল যা মানুষের প্রয়োজন ছিল, মূল্যবান ছিল, তবে একটি যুক্তিসঙ্গত মূল্যে পাওয়া যাবে বলেই আশা করা হতো।

১৯৮০-এর দশকে বিনিয়োগের হাতিয়ার হিসাবে রিয়েল এস্টেট

তবে ১৯৮০-এর দশকে পরিস্থিতি পাল্টে যায়। এই সময়ে রিয়েল এস্টেট সাধারণ পণ্যের চেয়ে বিনিয়োগের হাতিয়ার হিসেবে বেশি কাজ করা শুরু করে। ১৯৮০-এর দশকে বেশ কিছু পরিবর্তন আসে। মানুষ আবারও শহরের দিকে ফিরতে শুরু করে এবং শহরের কাছাকাছি বসবাস করা কিছু শহরতলির জন্য আভিজাত্যের প্রতীক হয়ে ওঠে। ১৯৮১ সালের অর্থনৈতিক মন্দার (recession) পর বিশাল সংখ্যক খেলাপি হওয়া রিয়েল এস্টেট বিক্রি হওয়ার কারণে মানুষ আকৃষ্ট হয় এবং কম দামে কিছু সম্পত্তি কিনে রিয়েল এস্টেটে প্রথমবার বিনিয়োগের সাহস পায়। লুই রেনি’র (Louis Rennie) মর্টগেজ বন্ডের (mortgage bond) ব্যাপক ব্যবহারের ফলে এই প্রক্রিয়া আরও সহজ হয়ে যায়।

এখান থেকেই একটি নতুন প্রবণতা শুরু হয়, যেখানে বাড়ির দামের বৃদ্ধি বেতন বৃদ্ধির হারের চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা হয়ে যায়। তিন দশক পর, যুক্তরাষ্ট্রের গড় বাড়ির দাম গড় বেতনের চারগুণেরও বেশি হয়ে যায়। এবং এই হিসাব ২০১০ সালের, যখন বাড়ির দাম সাব-প্রাইম মর্টগেজ সংকট (sub-prime mortgage crisis) থেকে পুনরুদ্ধার হচ্ছিল।

তবে এটা কিছুটা প্রত্যাশিতই ছিল। এটা ছিল সহজ চাহিদা এবং সরবরাহের বিষয়। মানুষ শুধু বড় বাড়িই চাইছিল না, সেই সাথে শহর কেন্দ্র বা অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার কাছাকাছি বাড়িও চাচ্ছিল। এতে সরবরাহ সীমিত হয়ে যায়। ৩০ বছরের মর্টগেজের ব্যাপক ব্যবহার, কম সুদের হার, বেশি আয় এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানের (finance industry) বেশি বেশি ঋণ দেওয়ার প্রবণতা চাহিদা বাড়িয়ে দেয়। ব্যস!

অর্থনীতিতে আবাসন : বিনিয়োগ ও পণ্য হিসেবে

বিনিয়োগ হিসাবে আবাসন

আবাসনকে কোন বিষয়টি একটি সূক্ষ্ম অর্থনৈতিক স্তরে মূল্যবান করে তোলে, তা বোঝা গুরুত্বপূর্ণ। একটি বাড়ি দুটি জিনিসের কাজ— জমি (যে মাটির প্লটের ওপর এটি দাঁড়িয়ে আছে) এবং কাঠামো (আসল বিল্ডিং, যেখানে শয়নকক্ষ এবং বাথরুম এবং সেই মজাদার জিনিসগুলো রয়েছে)। সাধারণত জমি হল সেই জিনিস যা রিয়েল এস্টেট বাজারে মূল্যবান হয়। যদি জমিটি কোনও আকাঙ্খিত এলাকায় থাকে, যেমন কোনও শহরের কেন্দ্র যেখানে প্রচুর ভালো চাকরির সুযোগ আছে, তাহলে জমির মূল্য বাড়বে।

উদাহরণস্বরূপ, সান ফ্রান্সিসকো (San Francisco) এবং সিলিকন ভ্যালির (Silicon Valley) কথা ধরুন। এই শহরগুলো প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোতে পরিপূর্ণ, যারা নতুন এবং উত্তেজনাপূর্ণ প্রযুক্তি বিকাশের জন্য প্রতি বছর হাজার হাজার ডেভেলপার (developer) এবং ইঞ্জিনিয়ারদের (engineer) লক্ষ লক্ষ ডলার বেতন দেয়। এখন এই প্রযুক্তিবিদদের সকলেরই কোথাও না কোথাও থাকতে হবে, তাই এই অফিসগুলোর কাছাকাছি রিয়েল এস্টেটের প্রচুর চাহিদা রয়েছে। এই উচ্চ আয়ের কারণে, যারা এই বাড়িগুলো চান তাদের কাছে কিছু গুরুতর প্রস্তাব দেওয়ার মতো আর্থিক ক্ষমতাও রয়েছে। ফলস্বরূপ, এই জমিগুলোর দাম অনেক হয়।

সামাজিকভাবে, এটি শিল্পের অংশগ্রহণগ্রহণ করেনা এমন লোকদেরকে এমন একটি শহরের বাজার থেকে ছিটকে দিতে পারে যেখানে তারা সম্ভবত সারাজীবন ধরে বসবাস করেছে এবং সম্ভবত এটি একটি খারাপ জিনিস। তবে এখানে কোনও মৌলিক অর্থনৈতিক সমস্যা নেই। এই অতি উচ্চ জীবনযাত্রার ব্যয়ের এলাকাগুলোতে অতিরিক্ত মুদ্রাস্ফীতি (inflation) নিয়ে ক্রমাগত উদ্বেগ থাকা সত্ত্বেও, আসলে উদ্বিগ্ন হওয়ার মতো তেমন কিছু নেই— যতক্ষণ এই এলাকার আয়ের স্তর একই হারে বাড়তে থাকে। এটা আশা করাই যায় যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ছোট শহরগুলোতেও তাদের সম্পত্তির জন্য উচ্চ মূল্য চাওয়া হবে এবং ধরা যাক সাহারা-নিম্ন আফ্রিকার (Sub-Saharan Africa) রিয়েল এস্টেটের দামের চেয়ে বেশি হবে। এটি কেবল সেই এলাকার বাসিন্দারা কতটা ধনী তার উপর নির্ভর করে।

দ্বিতীয় যে বিষয়টি বিবেচনা করতে হবে তা হল বিদেশী ক্রেতাদের বা ভাড়াটেদের কাছে কোনও এলাকার আবেদন। উদাহরণস্বরূপ, এস্পেন কলোরাডোর (Aspen Colorado) মতো একটি জায়গার কথা ভাবুন। এটি একটি সুন্দর এলাকা, তবে এটি ঠিক বিনিয়োগ ব্যাংক বা প্রযুক্তি স্টার্টআপের কেন্দ্র নয়। এখানকার সম্পত্তিগুলোর এত দাম হওয়ার কারণ হল এই এলাকার বাইরের লোকেরা, তা এই লোকেরা যুক্তরাষ্ট্রের অন্য কোনও এলাকা বা অন্য কোনও দেশ থেকেই হোক না কেন। শীতকালে স্কি ঢালু উপভোগ করতে একটি হলিডে হোম (holiday home) বা মৌসুমী ভাড়ার জন্য অনেক টাকা দিতে রাজি থাকে। পুরো শহরগুলোর ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। সিডনি (Sydney), ভ্যাঙ্কুভার (Vancouver) এবং লন্ডনের (London) মতো শহরগুলোর সম্পত্তি বাজারে বিদেশ থেকে উচ্চ আয়ের উপার্জনকারীদের সম্পত্তি কেনার কারণে উল্লেখযোগ্য প্রভাব পড়েছে।

এখন, এই সব কিছুই জমির মূল্য বাড়িয়ে তোলে। এই অঞ্চলের আশেপাশের জমি শেষ পর্যন্ত একটি সীমিত সম্পদ, যার সরবরাহ সীমাবদ্ধ। সিলিকন ভ্যালি (Silicon Valley) বা ম্যানহাটন (Manhattan) বা এস্পেনের (Aspen) ভিলেজ চেয়ারলিফটের (village chairlift) ৩০ মাইল ব্যাসার্ধের মধ্যে বসবাসযোগ্য স্থানের পরিমাণ সীমিত। তাই, ক্রমবর্ধমান চাহিদা এবং সীমাবদ্ধ সরবরাহ সহ যেকোনো কিছুর মতোই দাম বাড়বে। তাহলে আবাসন কি একটি ভাল বিনিয়োগ? হ্যাঁ, যতক্ষণ না আপনারা একটি বাড়ি কেনার ক্ষেত্রে সেই একই পদ্ধতি অবলম্বন করেন যা আপনারা শেয়ার কেনার ক্ষেত্রে করতেন— এটির কি ভাল প্রমাণপত্র, একটি ভাল ইতিহাস, ভবিষ্যতের বৃদ্ধির একটি ভাল পথ আছে এবং এটি কি বেশি মূল্যবান? যদি এই সমস্ত প্রশ্নের উত্তর হ্যাঁ হয়, তবে এগিয়ে যান। তবে শুধু মনে রাখবেন, এটি অন্য যেকোনো বিনিয়োগের মতোই এবং বৃদ্ধির কোনও গ্যারান্টি নেই।

এছাড়াও, কিছু এলাকায় বন্ধকী পরিশোধ করা আসলে ভাড়া দেওয়ার চেয়ে সস্তা হতে পারে। তাই দাম একেবারেই না বাড়লেও আপনারা শেষ পর্যন্ত লাভবান হবেন। এবং এর উপরে, এটা ভুলে গেলে চলবে না যে মাঝে মাঝে আমাদের ঠান্ডা মাথার অতি-যুক্তিপূর্ণ অর্থনীতিবিদ হওয়া বন্ধ করতে হবে এবং উপলব্ধি করতে হবে যে দিনের শেষে লোকেরা সবসময় সবচেয়ে যৌক্তিক সিদ্ধান্ত নেয় না। মাঝে মাঝে এটা বলা ভালো লাগে যে “আমার বাড়ি আমার দুর্গ” এবং এটি সম্পূর্ণরূপে আমার। এখন ওসব বাদ দিয়ে, আসুন দেখি এই বিনিয়োগটি কোথায় একটু অদ্ভুত হয়ে যায়।

পণ্য হিসাবে আবাসন

অর্থনৈতিক অর্থে একটি বাড়ি কেবল একটি পণ্যের মতো, যেমন একটি গাড়ি বা এক টুকরো সাবান বা এক বোতল জল। এটি এমন একটি জিনিস যা আমরা কিনতে এবং বিক্রি করতে পারি এবং কিছু ধরণের মূল্য পেতে পারি। তবে এটি ঠিক কী ধরণের পণ্য তা সঠিকভাবে সংজ্ঞায়িত করা কিছুটা কঠিন। অনেকে যুক্তি দেবেন যে আবাসন হল অপরিশোধিত তেল বা সোনা বা কফির মতো একটি পণ্য। এটি প্রায়শই ফটকাবাজারগুলোতে লেনদেন করা হয় এবং দিনের শেষে এটি এমন একটি জিনিস যা শেষ ব্যবহারকারীর জন্য একটি লক্ষ্যের মাধ্যম। এখানে প্রধান পার্থক্য হল বাস্তবিকভাবে শুধুমাত্র জমিই এরকম একটি পণ্য যার দাম বাড়ে। অন্যদিকে জমির উপর যে কাঠামোটি থাকে, অর্থাৎ বাড়িটা অন্যান্য ভোগ্যপণ্যের মত কাজ করে যেগুলোর দাম কমে। এটি কাঁচামাল থেকেই তৈরি এবং সময়ের সাথে সাথে একটি গাড়ির মূল্য যেমন হ্রাস পায় তেমনিভাবেই বাড়ির দামও হ্রাস পায়। একটি নতুন বাড়ি শুনতে চমৎকারই লাগে এবং প্রায়শই লোকেরা মনে করে যে বাড়ি এবং জমি উভয়েরই বাজারের সাথে মূল্য বাড়বে। তবে বাস্তবতা হল যে অন্যান্য উন্নত উৎপাদনকারী পণ্যের মতো বাড়িঘরও ভেঙে যায় এবং পুরানো হয়ে যায়। পার্থক্য শুধু এইটুকু যে প্রায়সই কোন বাড়ির মূল্যহ্রাস সেটা যে জমির উপর অবস্থিত তার মূল্যবৃদ্ধির জন্য আড়াল হয়ে যায়। তাই যদি কেউ এমন কোনও এলাকায় থাকে যেখানে জমির মূল্য কাঠামোর মূল্যের সমান বা তার চেয়ে কম, তাহলে জমির মূল্যবৃদ্ধি বনাম কাঠামোর মূল্যহ্রাসের উপর বিবেচনা করতে হবে, কারণ এটি খুব দ্রুত সমস্যা তৈরি করতে পারে। আর এই ব্যাপারটাই আমাদেরকে নিয়ে যায় অর্থনীতির উপর এর প্রভাবের দিকে।

কোভিড-১৯ এর পর আবাসনের সম্প্রতি আকাশচুম্বি দাম ও এর কারণ

আশ্রয় একটি মৌলিক মানবাধিকার (fundamental human right)। একটি উন্নত অর্থনীতিতে আমরা অনেকেই আশা করি আশ্রয় আরামদায়ক ও যথেষ্ট বড় হবে এবং একেবারে অনুপযুক্ত স্থানে হবে না। আকাশচুম্বী দাম সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাওয়ার হুমকি দিচ্ছে। সিডনির মতো শহরগুলোতে দেখা যায়, ১০ বা তার বেশি ছাত্রছাত্রী একটি দুই বেডরুমের অ্যাপার্টমেন্টে গাদাগাদি করে থাকছে আকাশছোঁয়া ভাড়া ভাগ করে নেওয়ার জন্য। একইভাবে, অকল্যান্ডে গত বছর গড় বাড়ির দাম ২০ শতাংশের বেশি বেড়েছে। যার মানে দাঁড়ায়, গড় আয়ের একটি তরুণ দম্পতি যদি তাদের আয়ের পুরোটাই জমাতে পারে, তবুও তাদের পক্ষে বাড়ি কেনার স্বপ্ন ক্রমশ দূরে চলে যাবে।

বৈশ্বিক অতিমারীর (global pandemic) সময় এই পরিস্থিতি বিশেষভাবে অদ্ভুত। সিডনি এবং অকল্যান্ডের পাশাপাশি ভ্যাঙ্কুভার, টরন্টো (Toronto) এবং কিছুটা হলেও লন্ডনের মতো শহরগুলোর পরিস্থিতি বিশেষভাবে আশ্চর্যজনক। কারণ এই শহরগুলো ঐতিহাসিকভাবে বিদেশি অর্থের উপর নির্ভরশীল। বিদেশি প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ (foreign direct investment) এই শহরগুলোর কেন্দ্রস্থলে একটি বড় বিতর্কের বিষয় ছিল। কারণ ধনী বিদেশি বিনিয়োগকারীরা (investors) স্থানীয় বাসিন্দাদের আবাসন বাজারে প্রতিযোগিতায় হারিয়ে দিচ্ছিল। কিন্তু বিশ্বজুড়ে লকডাউনের (lockdown) কারণে এটা সম্ভব হয়নি। অন্তত আগের মতো তো নয়ই। তা সত্ত্বেও, এই শহরগুলোর সম্পত্তি বাজার এবং উন্নত দেশগুলোর বেশিরভাগ প্রধান শহরের কেন্দ্রগুলোতে সাম্প্রতিক মাসগুলোতে আকাশচুম্বী দাম বেড়েছে। সম্প্রতি এই দাম বৃদ্ধির কারণ –

  • কম সুদের হার (low interest rates): প্রথম কারণটি অবশ্যই কম সুদের হার (low interest rates)। এর ফলে বেশি টাকা ধার করা সহজ হয়। যা মানুষকে সম্পত্তি কেনার দর কষাকষিতে আরও বেশি আর্থিক ক্ষমতা দেয়। যেখানে তারা সাধারণত এমন লোকেদের সাথে প্রতিযোগিতা করে যারা সহজেই বেশি টাকা ধার করতে সক্ষম।
  • উদ্দীপনা প্যাকেজগুলো (stimulus measures): দ্বিতীয় কারণটিও প্রথমটির মতোই। উদ্দীপনা প্যাকেজগুলো (stimulus measures) অর্থনীতির ভেতরে প্রচুর অর্থ পাঠায় এবং সেই অর্থের একটি বড় অংশ ধনী লোকেদের হাতে যায়। এরা এই অতিরিক্ত অর্থ বাড়ির ডাউন পেমেন্ট (down payment) হিসেবে ব্যবহার করতে পারবে। (ডাউন পেমেন্ট (Down payment) হল কোনো বড় ঋণ বা ক্রয়ের জন্য প্রথমে পরিশোধ করা একটি অর্থের পরিমাণ, যা সাধারণত মোট ক্রয়ের মূল্য বা ঋণের পরিমাণের একটি নির্দিষ্ট শতাংশ হয়। এটি মূলত ঋণের বাকী অংশ পরিশোধের জন্য লোন প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানকে নিশ্চিত করে এবং এটি সাধারণত গৃহ ঋণ (mortgage) বা গাড়ি ঋণের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়। উদাহরণস্বরূপ, যদি আপনি একটি বাড়ি কিনতে চান যার দাম ১,০০,০০,০০০ টাকা এবং আপনার ডাউন পেমেন্ট ২০% (২০,০০,০০০ টাকা) হয়, তবে আপনি প্রথমে ২০,০০,০০০ টাকা প্রদান করবেন এবং বাকী ৮০,০০,০০০ টাকা ঋণ হিসেবে পাবেন। ডাউন পেমেন্টের পরিমাণ বাড়ালে ঋণের পরিমাণ কম হয় এবং পরিশোধের সময়সীমাও কমানো যেতে পারে।) এই পরিস্থিতি শুধু যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। অস্ট্রেলিয়ায় অস্ট্রেলিয়ান সরকার (Australian government) একটি বিতর্কিত পদক্ষেপের মাধ্যমে নাগরিকদের তাদের সুপারঅ্যানুয়েশন (superannuation) বা অবসরকালীন সঞ্চয় থেকে ২০,০০০ অস্ট্রেলিয়ান ডলার পর্যন্ত তোলার অনুমতি দেয়, যা আমেরিকানদের ৪০১(কে) এর সমতুল্য। এই টাকা সাধারণত অবসর নেওয়ার আগে তোলা যেত না। এই অর্থ সংকটে পড়া পরিবারগুলোকে জীবনধারণের জন্য দেওয়ার কথা ছিল, যারা তাদের দোষ ছাড়াই চাকরি হারিয়েছিল। কিন্তু অনেকেই এটি তাদের সেভিংসের পরিমাণ বাড়াতে ব্যবহার করেছে। মজার ব্যাপার হলো, এই নীতি চালু হওয়ার কয়েক মাসের মধ্যে, তরুণ অস্ট্রেলিয়ানদের প্রথম বাড়ি কেনার জন্য প্রয়োজনীয় গড় সেভিংসের পরিমাণ প্রধান শহরগুলোতে ২০,০০০ ডলার বেড়েছে। প্রথম এবং দ্বিতীয় কারণে যে আসলে কেবল সম্পত্তির দামই বেড়ে যায় তা না, এর ফলে বিশ্বজুড়ে মুদ্রার মান কমে যায়।
  • মানুষ সত্যিই বাড়ির জন্য বেশি টাকা খরচ করতে চাওয়া: তৃতীয় কারণটি হলো, মানুষ সত্যিই বাড়ির জন্য বেশি টাকা খরচ করতে চাইছে। কোভিডের কারণে প্রায় দেড় বছর ধরে ঘরের ভেতরে আটকে থাকার মানে হলো মানুষ অতিরিক্ত জায়গা চাইছে। এর মানে, যারা এক বেডরুমের অ্যাপার্টমেন্টে থাকে তারা হয়তো এমন একটি অ্যাপার্টমেন্ট চাইছে যেখানে তাদের নিজস্ব হোম অফিস (home office) থাকবে। যারা দুই বেডরুমের অ্যাপার্টমেন্টে থাকে তারা হয়তো একটি টাউন হাউসের (townhouse) বাইরের খোলা জায়গা চাইছে। আর যারা টাউন হাউসে থাকে তারা হয়তো একটি সম্পূর্ণ আলাদা বাড়ি চাইছে, যেখানে তারা তাদের পরিবারের থেকে কিছুটা আড়াল থাকতে পারবে, যাদের সাথে তারা সারাক্ষণ আটকে আছে। সবার বড় বাড়িতে ওঠার আকাঙ্ক্ষা পুরো আবাসন বাজারের চাহিদাকে বাড়িয়ে দিচ্ছে।
  • মানুষের সঞ্চয় বৃদ্ধি: চতুর্থ কারণটি হলো, মানুষের সঞ্চয় বেড়েছে। প্রথম সম্পত্তি বা প্রথম বিনিয়োগের সম্পত্তি (investment property) অথবা একটি বড় পারিবারিক বাড়িতে ওঠার পথে সবচেয়ে বড় বাধা হলো ডাউন পেমেন্টের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ সঞ্চয় করা। অনেক পরিবারের জন্য এই বাধা এখন কমতে শুরু করেছে। কারণ যুক্তরাষ্ট্রে কয়েক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ সঞ্চয়ের হার দেখা যাচ্ছে। এর একটা কারণ অবশ্যই মানুষ ভবিষ্যতের বিষয়ে চিন্তিত এবং সরকারি উদ্দীপনা বন্ধ হয়ে গেলে তাদের চাকরি থাকবে কিনা তা নিয়ে শঙ্কিত। তাই মানুষ ভবিষ্যতের জন্য বেশি করে সঞ্চয় করছে। তবে এর একটি বড় অংশ প্রায় সম্পূর্ণ আকস্মিক। ছুটি কাটাতে যেতে না পারা, বাইরে খেতে না পারা বা সপ্তাহান্তে মলে গিয়ে টাকা নষ্ট করতে না পারার সাথে কিছু উদার সরকারি উদ্দীপনা যোগ হওয়ায় মানুষের সঞ্চয় অ্যাকাউন্টে অনেক বেশি টাকা জমা হয়েছে। এই অর্থ পরবর্তীতে ডাউন পেমেন্ট হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে।
  • বাড়ি বিক্রি করতে ভয় পাওয়া: পঞ্চম কারণটি বেশ অদ্ভুত। মানুষ বাড়ি বিক্রি করতে ভয় পাচ্ছে। প্রচলিত অর্থনীতি অনুযায়ী, কোনো পণ্যের দাম যত বাড়তে থাকে, ততই বেশি সংখ্যক বাজার অংশগ্রহণকারী সেই উচ্চ মূল্যে চাহিদা মেটাতে ইচ্ছুক হবে। কিন্তু এখানে সমস্যা হলো, আবাসন একটি প্রয়োজনীয় জিনিস। আমরা দেখেছি রিয়েল এস্টেট বর্তমানে বিনিয়োগের হাতিয়ার এবং একটি মৌলিক প্রয়োজনীয় পণ্যের মধ্যেকার সীমারেখাকে অস্পষ্ট করে তুলেছে। এই উভয় শ্রেণিবিন্যাস বাজারের আচরণ সম্পর্কে আমাদের নিখুঁত অর্থনৈতিক ধারণার ফলাফলকে বিকৃত করে। মানুষের জন্য অপরিহার্য হওয়ায়, বাড়ির দাম বাড়লে সবসময় মানুষ তাদের বাড়ি বিক্রি করতে উৎসাহিত হয় না। কারণ তাদের একই বাজারে ফিরে আসতে হবে, ইতিহাসের সবচেয়ে খারাপ ভাড়াটে বাজারে প্রতিযোগিতা করতে হবে অথবা রাস্তায় বসবাস করতে হবে। এই বিকল্পগুলোর কোনটিই তাদের অবস্থার উন্নতি করে না। এর চেয়েও বড় কথা, এই ভয় নিজের উপর আরও বেশি করে চেপে বসে। খুব বেশি মানুষ বিক্রি করছে না, তাই যারা বিক্রি করতে ইচ্ছুক তারা যদি একই বাজারে নতুন বাড়ি কিনতে চায়, তাহলে দ্রুত উপযুক্ত বাড়ি খুঁজে না পাওয়ার ঝুঁকিতে থাকে। এবং এর ফলে বাজারের দাম দ্রুত বেড়ে গেলে তাদের হয় খারাপ মানের বাড়ি কিনতে হবে, না হয় একই মানের সম্পত্তি কিনতে আরও বেশি ঋণে জর্জরিত হতে হবে। এই সবকিছুর মানে হলো মানুষ বিক্রি করা থেকে বিরত থাকতে পছন্দ করে এবং এই চক্র চলতেই থাকে। বাড়ি কেনাবেচার সাথে জড়িত খরচগুলোর কথা বিবেচনা করলে এই প্রক্রিয়া আরও বেড়ে যায়। রিয়েল এস্টেট এজেন্টের কমিশন (real estate agent commissions), মূলধন লাভকর (capital gains taxes), বিক্রয় কর (sales taxes), আইনি ফি (legal fees), সম্পত্তি মূল্যায়ন ফি (property evaluation fees), মালপত্র সরানোর খরচ ইত্যাদি এখানে যুক্ত হয়। এভাবে বাড়ি বদলানো একটি ব্যয়বহুল ব্যাপার হয়ে যায় এবং যতক্ষণ না এর পেছনে যথেষ্ট লাভ থাকে ততক্ষণ মানুষ এটা করে না। অবশ্যই এমন কিছু লোকেরাও আছেন যাদের নিজেদের বসবাসের জন্য কোনো বাড়ি নেই, তারা শুধুমাত্র বিনিয়োগের সম্পত্তি হিসেবে কিনে রেখেছেন। কিন্তু তাদের বিক্রির সিদ্ধান্ত সাধারণ বাজারের নিয়ম-কানুন দ্বারা চালিত হয় না। মানুষের আবেগ তাদের ভালো ফল দেওয়া বিনিয়োগ ধরে রাখতে উৎসাহিত করে। এই স্ববিরোধী বাজার প্রত্যাশা সম্পর্কে জানতে চাইলে ক্রিপ্টোকারেন্সির (cryptocurrencies) দিকে চোখ রাখতে পারেন। অবশ্যই এর একটা সীমা আছে। বিশেষ করে স্থানীয় বাজারে। যদি কোন ব্যক্তি তার বাড়িটি বিক্রির জন্য ১০ মিলিয়ন ডলারের প্রস্তাব পায়, তবে অবশ্যই সেই ব্যক্তি এক মুহূর্তও দেরি না করে রাজি হয়ে যাবেন। কিন্তু সেটা তখনই সম্ভব যখন সম্পত্তির মূল্য তাকে সেই বাজার থেকে বেরিয়ে যাওয়ার মতো যথেষ্ট সম্পদ দেয়।
  • নির্মাণ সামগ্রীর (building supplies) মারাত্মক অভাব: ষষ্ঠ কারণটি সাম্প্রতিক কালে প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে। সেটি হলো নির্মাণ সামগ্রীর (building supplies) মারাত্মক অভাব। আন্তর্জাতিক সরবরাহ শৃঙ্খলে (international supply chains) ধীরগতি এবং বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন শিল্পকেন্দ্র বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ফ্রেম তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় কাঠামোর মতো মৌলিক জিনিসের দাম দ্বিগুণ হয়েছে। এমন খবরও পাওয়া যাচ্ছে যে নির্মাতারা কাজ ফিরিয়ে দিচ্ছেন, কারণ জনবলের অভাবের কারণে নয়, বরং তাদের কাজ শেষ করার জন্য প্রয়োজনীয় সরবরাহ নেই। এর ফলে মানুষ যে ধরনের বাড়ি খুঁজছে তার সরবরাহ আরও সীমিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এর মানে হলো যদি কোনো পরিবার আগে থেকে তৈরি করা কোনো বাড়ি কেনা এবং নিজেদের জন্য নতুন বাড়ি তৈরি করার মধ্যে সিদ্ধান্ত নিতে চায়, তাহলে তাকে আগে থেকে তৈরি করা বাড়ি কিনতে হবে, আর তাই ইতিমধ্যে তৈরি করা বাড়ির দামও বেড়ে যায়।

এই ছয়টি কারণের মানে হলো বিশ্ব অর্থনীতিতে এত অস্থিরতা সত্ত্বেও বাড়ির দাম ক্রমাগত বাড়ছে। কিন্তু সম্ভবত এটাই ভালো।

আবাসনের অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধির ফলে অর্থনীতিতে ক্ষতিকর প্রভাবের স্বরূপ

আবাসন, মূল্যস্ফীতি ও বাণিজ্যিক রিয়েল এস্টেটের ভূমিকা

আবাসন সবার জন্য একটি অপরিহার্য পরিষেবা। মানুষের প্রয়োজন অনুসারে আশ্রয় জল, বাতাস এবং খাদ্যের মতোই গুরুত্বপূর্ণ। তবে এই অন্তর্নিহিত প্রয়োজনীয়তার অর্থ এই নয় যে বাজার অতিরিক্ত ঋণ এবং এর সাথে আসা অপ্রীতিকর প্রভাব থেকে মুক্ত। শুরু থেকেই রিয়েল এস্টেটের দাম মুদ্রাস্ফীতির অন্যতম শক্তিশালী চালক। কেন তা ব্যাখ্যা করার জন্য, আমাদের আবাসিক বাজারের বাইরে কিছুক্ষণ দেখতে হবে এবং বাণিজ্যিক রিয়েল এস্টেট সহ রিয়েল এস্টেটের দিকে নজর দিতে হবে। বাণিজ্যিক রিয়েল এস্টেট হল দোকানের সামনের অংশ, অফিসের ভবন এবং গুদাম ঘরের মতো জিনিস। এর বেশিরভাগই এখনও বিনিয়োগকারীদের মালিকানাধীন এবং ব্যবসার জন্য ভাড়া দেওয়া হয়, ঠিক যেভাবে কেউ একটি বাড়ি ভাড়া দিতে পারে। এখন যদি সম্পত্তি বা রিয়াল এস্টেটের বাজার ভাল যায়, দাম বাড়তে থাকে, তাহলে এই বাণিজ্যিক সম্পত্তি বা বাণিজ্যিক রিয়াল এস্টেটগুলোর ভাড়াও বাড়বে। বেশিরভাগ ব্যবসায়, প্রাথমিক ব্যয়ের কেন্দ্র হল কর্মীদের বেতন এবং তারপর ভাড়া। যদি কোনও ব্যবসার ক্ষেত্রে এসব বাণিজ্যিক রিয়াল এস্টেটের ভাড়া প্রতি বছর তিন থেকে চার শতাংশ বৃদ্ধি পায়, তাহলে তাদের হয় সেটিকে লোকসান হিসাবে মেনে নিতে হবে অথবা সেই ব্যয় তাদের ভোক্তাদের উপর আরও বাড়িয়ে দিতে হবে তাদের পণ্য বা সেবার দাম আরও বাড়িয়ে দেবার মাধ্যমে। আর এভাবেই বাণিজ্যিক রিয়াল এস্টেটের দামের বৃদ্ধি মূল্যস্ফীতি ঘটাতে অবদান রাখে। আসলে এটি কার্যকরভাবে খরচ-বৃদ্ধি মুদ্রাস্ফীতির (cost-push inflation) একটি পরোক্ষ রূপ, যেখানে জিনিসগুলোর দাম বাড়ছে কারণ সেগুলো সরবরাহ করা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। অর্থাৎ এই মূল্যস্ফীতি পণ্য বা সেবার চাহিদা বৃদ্ধির জন্য নয় বরং সরবরাহ কঠিন হয়ে যাবার কারণে হচ্ছে। এবং এটি সাধারণত খারাপ ধরনের মুদ্রাস্ফীতি হিসাবে স্বীকৃত, অথবা অন্তত সেই ধরনের মুদ্রাস্ফীতি যা নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন।

অনলাইন কেনাকাটা, কর্মসংস্থান এবং রিয়েল এস্টেটের প্রভাব

বেশিরভাগ দেশে খুচরা দোকানগুলোর জন্য প্রচুর মানুষের কর্মসংস্থান হয়। কিন্তু আমরা অনলাইন অর্ডারের ব্যাপকতায় এক্ষেত্রে একটি বিশাল পরিবর্তন দেখেছি। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে, অনলাইনে অর্ডার করতে হলে এই দোকানদারদের সাথে কথা বলার প্রয়োজন হয়না। তবে আংশিকভাবে এর কারণ হচ্ছে এই যে, অনলাইনে জিনিসপত্র সস্তা। এগুলো সস্তা কারণ অনলাইনের প্রোডাক্টগুলোর দাম বাণিজ্যিক রিয়াল এস্টেটের ভাড়া বৃদ্ধির ফলে তেমন বাড়েনা। সেই সাথে অনলাইন বিতরণকারীরা রিয়াল এস্টেট সহ খুচরা বিক্রেতাদের তুলনায় অনেক কম লোককে নিয়োগ করে, ফলে সেই খরচটাও কমে যায়। সব মিলে অনলাইন কেনাবেচার প্রোডাক্ট হয় সরাসরি উৎপাদনকারী, না হয় অনলাইন বিতরণকারী কেন্দ্রগুলো থেকে আসে, যেগুলোর সংখ্যা খুচরা বিক্রেতার দোকানগুলোর থেকে অনেক কম, আবার অনলাইন বিতরণকারীর সাথে সম্পর্কিত লোকের সংখ্যা অফলাইনে খুচরা বিক্রির সাথে সম্পর্কিত লোকের সংখ্যার থেকে অনেক কম হয়। এর অর্থ অনলাইন বিক্রির ক্ষেত্রে অফলাইন বিক্রির তুলনায় বাণিজ্যিক রিয়াল এস্টেটের ভাড়া ও কর্মীদের মজুরি দুইই কম লাগে, আর তার ফলে প্রোডাক্টের পেছনে এরকম ব্যয়ও কমে যায়। এর ফলে প্রোডাক্টগুলোর দাম কমে, আর রিয়াল এস্টেটের দাম বৃদ্ধির সাথে পণ্যের দাম বৃদ্ধির সম্পর্কও কমে। যাই হোক, এর ফলে খুচরা বিক্রেতার দোকানগুলোর প্রয়োজনীয়তা কমে যায়, মানে এর সাথে সম্পর্কিত লোকেরা বেকার হয়ে পড়ে। এখন অনেকেই মনে করতে পারে এই ব্যাপারটা প্রযুক্তিগত প্রক্রিয়ার অনিবার্য অগ্রগতির ফল। কিন্তু প্রযুক্তির বাস্তবায়ন তখনই হয় যখন এগুলো আগের ব্যবস্থার চেয়ে সাশ্রয়ী হয়। আর অনলাইন কেনাবেচাকে বেশি সাশ্রয়ী বলে মনে হয়েছে রিয়াল এস্টেটের দাম অনেক বেড়ে যাবার জন্যই। এভাবে আমরা দেখছি রিয়াল এস্টেটের দাম বৃদ্ধির প্রভাব বেকার সমস্যা বৃদ্ধি ঘটায়। শুধু তাই না, অর্থনীতির সমস্ত ক্ষেত্রেই এর প্রভাবটা ছড়িয়ে পড়ে।

ঋণ, রিয়েল এস্টেটের দাম এবং বিনিয়োগের ঝুঁকি

এদিকে সবকিছুর সঙ্গেই ঋণের সম্পর্ক আছে। বর্তমানে ২০২০ সালে অনেক দেশই ঋণের ফাঁদে পড়েছে। রিয়েল এস্টেটের দাম শেষ পর্যন্ত চাহিদা এবং সরবরাহের একটি কাজ এবং চাহিদা নির্ভর করে লোকেরা কতটা উপার্জন করে এবং তারা কতটা ধার করতে পারে তার উপর। যখন উচ্চ আয়ের অঞ্চলে রিয়াল এস্টেটের মূল্যবৃদ্ধি হয়, তখন সেটি ঠিক ছিল কারণ উচ্চ আয়ের কারণে রিয়াল এস্টেটের উচ্চ দাম সমস্যার কিছু ছিল না। তবে বিশ্বের বেশিরভাগ উন্নত দেশগুলোর বেশিরভাগ অঞ্চলে দেখা যায় সেগুলোতে রিয়েল এস্টেটের দাম বাড়ছে, কিন্তু মানুষের মজুরি বা আয় প্রায় স্থিরই রয়েছে, তেমন বাড়েনি। কেন এটা হয়েছে? রিয়াল এস্টেটের দাম অবশ্যই রিয়াল এস্টেটের চাহিদা বৃদ্ধির জন্য বৃদ্ধি পায়। আর চাহিদা বৃদ্ধি পায় ব্যক্তির আয় ও ধার বা ঋণ করার ফলে। যেহেতু আয় তেমন বাড়েনি, সেহেতু ধরে নিতেই হয় যে মানুষের ঋণ গ্রহণ বেড়েছে, অর্থাৎ সেই সব দেশে ঋণদান আরও উদার হয়েছে। অর্থাৎ বলা যায়, কোন দেশে রিয়াল এস্টেটের জন্য ঋণ সুবিধা বেড়ে গেলে রিয়াল এস্টেটের দামও বাড়তে থাকে। আবাসনের জন্য ঋণকে মর্টগেজ বলে।

২০০৮ সালের সাবপ্রাইম মর্টগেজ সংকট (subprime mortgage crisis) ঘটে। এর ফলে পরে ঋণদানে একটি বিশাল কাটছাঁট করা হয়েছিল, কারণ ব্যাংকগুলো সরাসরি দেখেছিল যে কীভাবে দায়িত্বজ্ঞানহীন ঋণদান তাদের আর্থিক অবস্থার ক্ষতি করতে পারে। তবে তারপর থেকে এটি ধীরে ধীরে বাড়তে শুরু করেছে। ২০০৮ সালের সমস্যাটি ছিল এই যে এমন ব্যক্তিদের মর্টগেজ দেওয়া হচ্ছিল যাদের কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা খুবই কম, খারাপ ক্রেডিট (credit) এবং অস্থির ব্যক্তিগত পরিস্থিতি ছিল। সৌভাগ্যবশত সেই পরিস্থিতিটির পুনরাবৃত্তি তেমন হয়নি। তাই পরবর্তীতে ঋণ দানের কারণে সমস্যা হলে অন্য ফ্যাক্টরের জন্য হবে। 

অন্য প্রান্তে, ধনী বাড়িওয়ালাদের সাথেও রিয়েল এস্টেটে বিনিয়োগ দুটি কারণে অদ্ভুত— প্রথমত, এটি একটি অত্যন্ত লেভারেজড (leveraged) বিনিয়োগ। যদি কেউ কোনও রিয়াল এস্টেটে ইনভেস্ট করার সময় নিজের টাকা থেকে ১০% দেন, এবং বাকি ৯০% ধার করে দেন, তাহলে সেটা টেন টু ওয়ান লেভারেজ পজিশন হয়ে যায়। এর মানে হচ্ছে এই বিনিয়োগের পর রিয়াল এস্টেটের দাম যদি ১০% বাড়ে, তাহলে ব্যক্তির রিটার্ন ১০০% হচ্ছে, সেখান থেকে তিনি ঋণ পরিশোধ করে অনেক লাভ পাচ্ছেন। কিন্তু এতে যদি লস হয় তাহলে তিনি প্রায় সবই হারিয়ে ফেলছেন। কেউই শেয়ার বাজারে এরকম টেন টু ওয়ান লেভারেজ পজিশনে বিনিয়োগ করেনা। এটা করা হয় কেবল রিয়াল এস্টেটেই কারণ সেক্ষেত্রে বিনিয়োগকারী মনে করেন সবসময়ই জমির দাম বাড়বে। এভাবে দিনের শেষে আবাসন কেবল আরেকটি ফটকা বিনিয়োগই। অনেক বাড়িওয়ালা এমনকি এই সংকটের শুরুতে ধরা পড়েছিলেন কারণ তারা রিয়েল এস্টেটে বিনিয়োগের ধারণা নিয়ে প্রবেশ করেছিলেন যে এটির দাম কেবল বাড়তেই থাকবে, ভাড়া বাড়তেই থাকবে এবং তারা ধনী হয়ে যাবে। তবে বাস্তবতা আঘাত হানে, আর এর মাধ্যমে দেখা যায় যে, রিয়াল এস্টেটে বিনিয়োগও আরেকটি ফটকা বাজার এবং এখানেও রিটার্ন চাইতে গেলে ঝুঁকি নিতেই হবে।

ঋণের উপর নির্ভরতা, বাজেয়াপ্তির ঝুঁকি এবং অর্থনীতির ভিত্তি

আরেকটি বড় সমস্যা আছে। ব্যাংক তো আবাসন কেনার জন্য বা আবাসনে বিনিয়োগ করার জন্য ঋণ এমনি এমনি দেবে না। সেই ঋণ পাবার যোগ্যতা অর্জন করার জন্যেও আপনার অধিকারে থাকা অন্য রিয়াল এস্টেট বা সম্পত্তি থেকে আয় দেখাতে হবে। বিশ্বজুড়ে বেশিরভাগ ব্যাংকই সেই আয়কেই এক্ষেত্রে বিবেচনা করবে যে আয় সেই সম্পত্তিটাকে ভাড়া দিলে পাওয়া যাবে এবং তার ভিত্তিতেই ঋণের আবেদন অনুমোদিত হবে কিনা তা ঠিক হবে। এখন যারা বসবাসের জন্য বাড়ি কিনছেন তাদের জন্য এটা সমস্যা না। কিন্তু যারা বিনিয়োগ করার জন্য বাড়ি কিনতে যাচ্ছেন তাদের জন্য এটা বিশাল সমস্যা তৈরি করে। অনেক লোক চাকরি হারাবার কারণে, বিশেষ করে অনলাইনে বেচাকেনা শুরু হবার ফলে রিয়াল এস্টেটে ভাড়া কমে যায়। এদিকে রিয়াল এস্টেটের বাজারেও এখন আগের চেয়ে বেশি বিনিয়োগকারী এই রিটার্নের উপর নির্ভর করছেন কারণ তাদের কাছে তাদের বন্ধকী পরিশোধ করার মতো নিয়মিত আয় আর থাকছে না। তাই তারা হয় বাজারের মন্দার সময়ে তাদের বাড়ি বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন, যা এই অতিরিক্ত লেভারেজড সম্পদের আরও অবমূল্যায়ন ঘটায়, অথবা তারা তাদের বন্ধকির ঋণে খেলাপি করছেন, যা আর্থিক বাজারে মারাত্মক সমস্যা সৃষ্টি করবে এবং শেষ পর্যন্ত এমন এর ফলে এক সময় তার বাড়ি বাজেয়াপ্ত করা হবে যা বাজারের মন্দার সময়ে বিক্রি করা হবে। আর এটা এই অতিরিক্ত লেভারেজড সম্পদের আরও বেশি অবমূল্যায়ন ঘটাবে।

এখন অনেকেই প্রশ্ন করতে পারেন, ব্যাংকগুলো তো ব্যবসার উদ্যোগের অর্থায়নের জন্যেও নিয়মিত অর্থ ধার দেয়। তাহলে এখানে এত পার্থক্য কেন? পার্থক্য এখানেই যে, ব্যবসাগুলো রিয়াল এস্টেটে বিনিয়োগের মতো প্রাথমিকভাবে এতটা অতিরিক্ত লেভারেজড হয় না। তবে আরও গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য যেটা সেটা হচ্ছে, ব্যবসাগুলো আসলে বৃহত্তর অর্থনীতির জন্য কিছু না কিছু উৎপাদন করে। কিন্তু রিয়াল এস্টেট থেকে আসলে কিছুই উৎপাদিত হয়না। যখন অর্থনীতিবিদরা বিনিয়োগের কথা ভাবেন, তখন তারা সাধারণত মূলধনী পণ্যের (capital goods) কথা ভাবেন। লোকেরা সাধারণত শেয়ারের মাধ্যমে কোনও সংস্থায় বিনিয়োগ করে এবং সেই সংস্থা এই তহবিল ব্যবহার করে উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় নতুন মেশিন ইত্যাদি কিনতে। এগুলো সবই মূলধনী পণ্য, যেমন এমন পণ্য যা আরও পণ্য উৎপাদন করতে ব্যবহৃত হয়। এগুলো সাধারণত বেশ ভাল বিনিয়োগ হয় কারণ আপনারা যদি এমন একটি মেশিন কেনেন যা একটি কাঁচামালকে একটি ভোগ্যপণ্যে পরিণত করে, তাহলে আপনারা ইনপুট (input) এবং আউটপুটের (output) দামের মধ্যে পার্থক্য থেকে লাভ করতে পারেন। এটি হল মূল্য-সংযোজন উৎপাদনের মূল বিষয়। এখন বাড়িঘরকে কখনও কখনও মূলধন হিসাবে বিবেচনা করা হয় ঠিকই, তবে তারা আসলে তেমন কিছুই নয়। বাড়িঘর বা আবাসনগুলো যে জমির উপর বসে আছে সেই জমি এবং কাঠামোটি নিজে কার্যকরভাবে একটি ভোগ্যপণ্য। এটিতে বিনিয়োগ করায় আবাসন ব্যয়বহুল হয়, আর উলটে এই ব্যয়বহুল আবাসন থাকার কারণে শেষ পর্যন্ত জমিকে সত্যিকারের লাভজনক শিল্পের আরেকটি উৎপাদন কারণ হওয়া থেকে বঞ্চিতই করা হচ্ছে, যেটা না হলে পণ্যগুলোতে মূল্য যোগ করে একটি ধনী অর্থনীতি তৈরি করা যেতে পারতো।

অর্থনীতির ভিত্তি হল এই ধারণা যে আমাদের অসীম চাহিদা রয়েছে এবং সেই চাহিদাগুলো পূরণ করার জন্য সীমিত সম্পদ রয়েছে। ভাল অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা একটি জাতির উৎপাদন ক্ষমতা প্রসারিত করার চূড়ান্ত আকাঙ্ক্ষার উপর নির্মিত, যাতে আরও বেশি মানুষের কাছে আরও বেশি সম্পদ উপলব্ধ করা যায়। জমির ব্লকগুলোকে এলোমেলোভাবে সরিয়ে দেওয়া এবং তাদের আরও উচ্চতর মূল্য নির্ধারণ করা মূল্যবান কিছু তৈরি করে না। এটি তার বিশুদ্ধতম রূপে কাগজের সম্পদ। সেরা পরিস্থিতিতে এটি কিছুই অর্জন করে না তবে বাস্তবিকভাবে এটি ভোক্তাদের ঋণে ফেলবে, একটি জাতিকে অতিরিক্ত ঋণগ্রস্ত করবে এবং সত্যিকারের শিল্পকে এমন একটি এলাকায় চালিত করবে যেখানে তারা কম দামে রিয়াল এস্টেট নামক এই গুরুত্বপূর্ণ উৎপাদন কারণটি পেতে পারে।

রিয়াল এস্টেটে বিনিয়োগ করতে চাওয়ার কারণ ও তাতে অর্থনীতিতে সম্ভাব্য লাভ

বাড়ির দাম বেশি হওয়া নিয়ে অভিযোগকারীর অভাব নেই। তবে খুব কম লোকই ভেবে দেখেছে যে এটি আসলে কোনো সমস্যা কিনা। আজকের উন্নত বিশ্বের বেশিরভাগ দেশেই অধিকাংশ মানুষ বাড়ির মালিক। এটা ধরে নেওয়া যুক্তিসঙ্গত যে এই বাড়িগুলোর মালিকরা চাইবেন তাদের সম্পত্তির মূল্য বাড়ুক, তাই না? এই বর্ধিত মূল্য বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করা যেতে পারে (বিক্রির পর আরকি)। মানুষ এই ইক্যুইটি (equity) ব্যবহার করে নির্মাণ বা বিনিয়োগের জন্য অর্থায়ন করতে পারে। 

সম্পত্তির দাম বাড়লে মানুষ ধনী অনুভব করে এবং তাদের ভোগের প্রবণতাও বাড়ে। যদি কারও একটি সম্পত্তি থাকে যা তিনি ৫ লক্ষ ডলারে কিনেছেন এবং যার বিপরীতে ৪ লক্ষ ডলার ঋণ আছে, এবং একই সময়ে সেই সম্পত্তির দাম বেড়ে ১০ লক্ষ ডলার হয় এবং তিনি সেই ঋণের ২ লক্ষ ডলার পরিশোধ করেন, তাহলে তিনি কার্যত শুধুমাত্র একটি বাড়িতে বসবাসের মাধ্যমে তার সম্পদের পরিমাণ আটগুণ বাড়িয়েছেন।

এই ধরনের বিশাল লাভের সম্ভাবনা লেভারেজ (leverage) ব্যবহার করে করা সমস্ত বিনিয়োগের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। কিন্তু একটি মর্টগেজের জন্য যে ফাইভ টু ওয়ান লেভারেজ আদর্শ (বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ৫ ভাগের ১ ভাগ নিজের টাকা, বাকিটা ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়া), সেটা দিয়ে স্টক (stocks) কিনলে সাধারণত বেশি সুদের হার এবং মার্জিন কলের (margin calls) মতো ঝুঁকিপূর্ণ চুক্তির শর্ত চলে আসে, যা সাধারণ বিনিয়োগকারীদের জন্য উপযুক্ত নয়। এর চেয়েও বড় কথা, ফাইভ টু ওয়ান লেভারেজের স্টক পোর্টফোলিওতে (stock portfolio) টিকে থাকা সম্ভব না।

সেই সাথে রিয়াল এস্টেট খুবই চমৎকার কারণ এটি অবসরকালীন সঞ্চয়ের (retirement saving) একটি শক্তিশালী হাতিয়ার। গড়পড়তা মানুষ আর্থিকভাবে বেশ বোকা। বেশিরভাগ মানুষই অবসর গ্রহণের জন্য তেমন কোনো চেষ্টা করে না, এমনকি যদি তারা সক্ষমও হয়। তবে একটি পারিবারিক বাড়ির মালিক হওয়ার মাধ্যমে, ৩০ বছর ধরে একটি মর্টগেজ পরিশোধ করার মাধ্যমে মানুষ এমন একটি সম্পদে ইক্যুইটি তৈরি করবে যা অবসরের সময় বিভিন্নভাবে কাজে লাগানো যেতে পারে। ধরে নেওয়া যাক তাদের সন্তানরা বড় হয়ে নিজেদের মতো বেরিয়ে গেছে (যা আজকাল খুব একটা নিশ্চিত নয়)। তারা সেই বাড়ি বিক্রি করে ছোট কোনো বাড়িতে চলে যেতে পারে এবং দামের পার্থক্যটা তাদের অবসরকালীন জীবন নির্বাহের জন্য ব্যবহার করতে পারে। তারা সেই বাড়ি ভাড়া দিয়ে সেই আয়ের মাধ্যমে নিজেরা ছোট কোনো বাসায় থাকতে পারে এবং অবসর জীবন কাটাতে পারে। অথবা তারা তাদের ঋণমুক্ত বাড়িতেই বসবাস করতে পারে। যার মানে তাদের যা কিছু আয় হবে তার বেশিরভাগ অংশ আবাসন বাবদ খরচ করতে হবে না, যা বেশিরভাগ মানুষের বাজেটের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ। এই ধরনের স্ব-অর্থায়িত অবসর (self-funded retirement) আগামী বছরগুলোতে আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে, কারণ বয়স্ক জনসংখ্যা রাষ্ট্র-চালিত অবসর ব্যবস্থার (state-funded retirement systems) উপর আরও বেশি চাপ সৃষ্টি করবে।

আরেকটি যুক্তি সম্পূর্ণরূপে অর্থনৈতিক না হয়ে দার্শনিকও বটে। একটি গণতান্ত্রিক দেশে যেখানে ভোটিং জনসংখ্যার সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশেরই একটি সম্পদ শ্রেণির (asset class) মূল্যবৃদ্ধিতে স্বার্থ আছে, সেখানে সরকারের সেই বৃদ্ধি রোধ করার জন্য নীতিগত পদক্ষেপ নেওয়া কি সত্যিই ন্যায্য? আবারও বলছি, এটি সম্পূর্ণরূপে অর্থনৈতিক যুক্তি নয়, তাই আমি আপনাকে বলতে চাই না কোনটি সঠিক বা কোনটি ভুল।

স্থিতিশীল মূল্য বৃদ্ধিই হলো সম্ভাব্য সমাধান 

তাহলে ব্যক্তিগত স্তরে রিয়েল এস্টেট কি একটি ভাল বিনিয়োগ? অবশ্যই না। এটি একটি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ, অত্যন্ত লেভারেজড এবং অ-বৈচিত্র্যপূর্ণ বিনিয়োগ। জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং আরও বেশি ঋণ নেওয়ার অবিরাম চাপ এখানে আছেই। হয়তো অন্তত যে বাড়িতে থাকা হয় সেটি নিজের করে নেওয়া খুব খারাপ ধারণা নাও হতে পারে। তবে ম্যাক্রো লেভেলে একটি শক্তিশালী আবাসন বাজার একটি সত্যিকারের বোঝা। এটি এমন লোকদের কাছ থেকে অর্থ কেড়ে নেয় যারা অন্যথায় পণ্য বা পরিষেবার উপর ব্যয় করতে পারত বা এমন জিনিসগুলোতে বিনিয়োগ করত যার প্রকৃত মূল্য রয়েছে এবং এটি সেই শিল্পগুলোকে শ্বাসরোধ করে যা অর্থনীতিতে একটি শক্তিশালী অবস্থান পাওয়ার চেষ্টা করছে। এর সমাধানগুলো জটিল কারণ প্রায়শই একটি সরকারকে সাশ্রয়ী মূল্যের আবাসন বাজারের দায়বদ্ধতার বিকল্প খুঁজতে হয়। আর এটা করতে গেলে সরকারকে মানুষের এই বৃহত্তম বিনিয়োগের খাতের বিরুদ্ধে যেতে হয়, কিন্তু এটা করলে তার ফল সরকারের পরবর্তী নির্বাচনের ফলে পড়তে পারে। যেটা করা যায় তা হচ্ছে ঋণদানকে দায়িত্বের সাথে পরিচালনা করাটাকে নিশ্চিত করা। রেকর্ড-নিম্ন সুদের হার মানে হল আরও বেশি সংখ্যক লোক আরও বেশি অর্থ ধার করতে পারে এবং মনে করে যে তারা অন্যান্য লোকেদের কাছে জমিটি বিক্রি করার পরে খুব বুদ্ধিমান বিনিয়োগকারীর মতো কাজ করেছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, যারা তার থেকে জমিটি কিনল তারাও আসলে ব্যাংক থেকে কম সুদের হারে ধার করেই কিনলো। সব মিলে এমন কিছুতে বিনিয়োগের জন্য ঋণ নেওয়া যা কিছুই উৎপাদন করে না তা সামষ্টিক অর্থনৈতিক (macroeconomic) স্তরে প্রায় সবসময়ই একটি খারাপ ধারণা। এটি কি কখনও সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রিত হবে? বলা কঠিন। দিনের শেষে ব্যাংকগুলো তাদের নিজস্ব সত্তা এবং তাদের নিজস্ব লাভের উদ্দেশ্য রয়েছে এবং তারা নিশ্চিত করতে চায় যে তারা কোনও ভাল সুযোগ হাতছাড়া করছে না। একই কথা প্রযোজ্য স্বতন্ত্র ফটকাবাজারিদের ক্ষেত্রেও। আর স্বাধীনতা যখন ক্ষতিকর হয়ে যায় তখন রাষ্ট্রের কাজ নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা।

আবাসন সহজলভ্যতার সংকটের (housing affordability crisis) সমাধান কী তা নিয়ে সবার নিজস্ব মতামত রয়েছে। তবে এর আগে জানতে হবে লক্ষ্য কী হওয়া উচিত। নিশ্চিতভাবেই আমরা চাই না যে রিয়াল এস্টেটের দাম কমে যাক। কারণ এতে অনেক মানুষ তাদের হোম লোনের (home loans) চেয়ে বেশি ঋণে ডুবে যাবে এবং ২০০৮ সালে আমরা যেমনটা দেখেছি তেমন আরও অনেক অপ্রীতিকর পরিস্থিতি তৈরি হবে। তবে আমরা সম্ভবত এটাও চাই না যে বাড়িঘর কেবল সমাজের ধনী ব্যক্তিদের জন্য সহজলভ্য হোক। এবং গত দশকে যেভাবে দাম বেড়েছে, তাতে পরিস্থিতি সেদিকেই যাচ্ছে।

আবাসনকে একটি পণ্যের মত দেখেই এর দাম বৃদ্ধির লাভ ক্ষতি বিবেচনা করলে বিষয়টা অনেক স্পষ্ট হয়। একে গমের সাথেই তুলনা করুন। রুটি, পাস্তা বা পিজ্জা তৈরির মাধ্যমে এটি আমাদের মূল্য সরবরাহ করে। মানুষ কমোডিটিস মার্কেটে (commodities markets) এর উপর ফটকা লাগাতে পারে এবং বাস্তবে তা করেও। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কেউ আগামী দশকে এর দাম চারগুণ বেড়ে যাবে এরকম দীর্ঘমেয়াদী লাভের আশায় গম ধরে রাখে না। প্রকৃতপক্ষে, যদি গমের দাম চারগুণ বেড়ে যায় তবে আমরা সম্ভবত এটিকে বাজারের ব্যর্থতা হিসেবেই দেখব। কারণ এতে হঠাৎ করে আমাদের অনেক খাবারের দামই অনেক বেশি হয়ে যাবে। আবাসনকেও সেরকমভাবেই দেখা দরকার। আমরা গমের ক্ষেত্রে যেমন দাম দীর্ঘমেয়াদে চারগুণ বেড়ে যাবে এমনটা আশা করতে পারিনা বা এরকম হলে অর্থনীতির ব্যর্থতা হিসেবে দেখি, আবাসনের ক্ষেত্রেও সেভাবেই দেখা উচিৎ। আর সেভাবেই নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা উচিৎ। আর লক্ষ্য হওয়া উচিৎ যাতে এর মূল্যবৃদ্ধিটা স্থিতিশীল থাকে।

রিয়েল এস্টেট ও আবাসনও একটি পণ্যই। এটি আমাদের বসবাস, কাজ বা চাষাবাদের জন্য জায়গা দেওয়ার মাধ্যমে মূল্য সরবরাহ করে। আমাদের সম্পত্তির মূল্যবৃদ্ধিকেও অন্যান্য পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির মতোই দেখা শুরু করা উচিৎ, অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি হলে তাকে কমিয়ে ফেলার ব্যবস্থা করা উচিৎ। এর অনেক সুবিধা রয়েছে। প্রথমত, যারা সম্পত্তি বাজারে প্রবেশ করতে চাইছে তাদের একটি পরিবর্তনশীল লক্ষ্য থাকবে না, যেখানে তাল মিলিয়ে চলার জন্য তাদের আরও বেশি অর্থ সঞ্চয় করতে হবে। এটি মানুষকে তাদের মর্টগেজ পরিশোধ করে বা ভাড়া সম্পত্তিতে বিনিয়োগ করেও সম্পদ তৈরি করা থেকে বিরত করবে না। কারণ এগুলো এখনও স্থিতিশীল নগদ প্রবাহ সরবরাহ করবে। অধিকতর স্থিতিশীল মূল্যবৃদ্ধি মানে অর্থনৈতিক মন্দার সময় দাম কমার সম্ভাবনাও কম থাকবে। যার মানে মানুষের তাদের মর্টগেজের চেয়ে কম মূল্যের সম্পত্তির মালিক হওয়ার সম্ভাবনা কমবে। এর চেয়েও বড় কথা, স্থিতিশীল মূল্য নির্ধারণের মানে হলো আপনি মূলধন লাভকরের (capital gains taxes) হাত থেকে বাঁচতে পারবেন, যেখানে এটি প্রযোজ্য। এর ফলে যারা তাদের বাড়ি বদল করতে চান তারা আরও সহজে সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন, কারণ তাদের পরিবারের আকার জীবনকালে পরিবর্তিত হতে থাকে।

আপনি হয়তো ভাবতে পারেন এই সমস্ত সুবিধার জন্য দরিদ্র বাড়িওয়ালাদের ক্ষতি হবে। তবে এটি আংশিক সত্য। যে সম্পত্তি বিনিয়োগকারীরা শুধুমাত্র সম্পত্তির উপর বসে থাকে এবং দাম বাড়ার জন্য অপেক্ষা করে, হ্যাঁ, তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তবে তাতে কি? সেই অর্থ উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ করলে অর্থনীতি আরও ভালো ফল পাবে। বরং অর্থ সেই বিনিয়োগকারীদের কাছে যাবে যারা বাজারে মূল্য যোগ করে। ঠিক যেমনটা সাধারণ পণ্যের ক্ষেত্রে হয়। যদি কেউ দক্ষতার সাথে লোহার আকরিক থেকে ইস্পাত তৈরি করে, তবে সেক্ষেত্রে সেই ব্যক্তি যে মূল্য যোগ করেছেন তা থেকে লাভ পাবেন। কেউ যদি যদি গম থেকে রুটি তৈরি করেন তবে তিনি যে মূল্য যোগ করেছেন তা থেকে লাভবান হবেন। এবং কেউ যদি একটি জরাজীর্ণ বাড়িকে অ্যাপার্টমেন্ট ব্লকে (apartment blocks) রূপান্তরিত করেন তবে সেক্ষেত্রে তিনি সেই মূল্য থেকে লাভবান হবেন যা তিনি মানুষকে বসবাসের জন্য জায়গা তৈরি করে যোগ করেছেন, যা আগে ছিল না।

এই কাল্পনিক পরিস্থিতি জাপানের (Japan) বাস্তবতার মতো, যেখানে গত দশকে বাড়ির দাম খুব কমই বেড়েছে। এটাই কি আদর্শ? বাড়ির মালিকদের সংখ্যাগরিষ্ঠকে রাজি করানো কঠিন হতে পারে। তবে এটিকে সম্পূর্ণরূপে বাতিল করা উচিত নয়। বিশেষ করে যখন এটা না করলে মানুষ আরও বেশি করে আবাসনেই বিনিয়োগ করতে থাকবে, আর তাতে এমন এক ভবিষ্যত আসবে যেখানে মানুষ তাদের কর্মজীবনের বেশিরভাগ সময় ধরে প্রায় অসাধ্য ঋণের বোঝা নিয়ে বেঁচে থাকতে বাধ্য হবে, শুধুমাত্র একটি মাথা গোঁজার ঠাঁই পাওয়ার জন্য।

তথ্যসূত্র

  • Jowsey, E., 2011. Real estate economics. Macmillan International Higher Education.
  • Evans, A.W., 2008. Economics, real estate and the supply of land
  • Barlowe, R., 1978. Land resource economics: the economics of real estate.
  • DiPasquale, D. and Wheaton, W.C., 1996. Urban economics and real estate markets (Vol. 23, No. 7). Englewood Cliffs, NJ: Prentice Hal
  • Wheaton, W.C., 1999. Real estate “cycles”: some fundamentals. Real estate economics

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.