কেন আমেরিকায় সিইও-রা (Chief Executive Officer) এত বেশি অর্থ উপার্জন করেন?

সিইও বনাম শ্রমিক বৈষম্য

১৯৬৫ সালে, একজন সাধারণ আমেরিকান কোম্পানির CEO (Chief Executive Officer) এক জন সাধারণ কর্মীর তুলনায় ২১ গুণ বেশি আয় করতেন। সময় গড়াতে গড়াতে ২০২২ সালে এসে CEO রা সাধারণ কর্মীর তুলনায় ৩৪৪ গুণ বেশি উপার্জন করতে শুরু করলেন। অভিনন্দন, ভদ্রলোকেরা! কিন্তু প্রশ্ন হলো, এটা কীভাবে ঘটলো?

সিইও-দের (CEO) উপার্জন করার যে সম্ভাবনা থাকে তা অন্যদের ক্ষেত্রে কখনই থাকেনা। ২০২০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ ৩৫০ সিইও (CEO) গড়ে ২৪ মিলিয়ন ডলারের বেশি আয় করেছেন। এটা অন্যান্য কর্মীদের আয়ের তুলনায় অনেক বেশি। কিন্তু সবসময় এমন ছিল না। গত কয়েক দশকে সিইও-ওয়ার্কার বেতনের ব্যবধান (CEO to worker pay gap) ব্যাপকভাবে বেড়েছে। অর্থনৈতিক নীতি ইনস্টিটিউটের (Economic Policy Institute – EPI) হিসাব অনুযায়ী ১৯৭৮ সাল থেকে সিইওদের মোট ক্ষতিপূরণ (compensation) বেড়েছে ১৩২২%, যেখানে সাধারণ শ্রমিকদের বেতন বেড়েছে মাত্র ১৮%। ইনস্টিটিউট ফর পলিসি স্টাডিজ (Institute for Policy Studies) হিসাব করেছে যে এস অ্যান্ড পি ৫০০ (S&P 500) তালিকাভুক্ত ৮০% কোম্পানিতে সিইওদের বেতন সাধারণ শ্রমিকদের চেয়ে ১০০ গুণেরও বেশি। তার মানে, ঐসব কোম্পানির একজন সাধারণ কর্মীকে ১০০ বছর কাজ করতে হবে সিইওর এক বছরের আয় ধরতে, যা অসম্ভব।

সিইও ও শ্রমিকদের বৈষম্য স্বাভাবিকভাবেই উদ্বেগ তৈরি করেছে। পিউ (Pew) রিসার্চ সেন্টারের মতে, বেশিরভাগ আমেরিকান মনে করেন ভবিষ্যৎ প্রজন্ম অর্থনৈতিকভাবে আরো খারাপ অবস্থায় থাকবে। এই উদ্বেগগুলো মূলত যৌক্তিক কিছু প্রশ্নের ওপর দাঁড়িয়ে থাকে। যেমন, এই মাসে আমার বিলগুলো দিতে পারবো কিনা, সন্তানদের আমার চেয়ে ভালো জীবন দিতে পারবো কিনা ইত্যাদি। আর এই প্রশ্নগুলো আসলে আরেকটি প্রধান প্রশ্নের ওপর দাঁড়ানো: “এরপর কী?” (What’s next?)

লরেন্স মিচেল (Lawrence Mitchell) অর্থনৈতিক নীতি ইনস্টিটিউটের (Economic Policy Institute – EPI) একজন ডিস্টিংগুইশড ফেলো (distinguished fellow)। তিনি আগে ইউএস ডিপার্টমেন্ট অফ লেবার (US Department of Labor) এবং কর্নেল ইউনিভার্সিটির (Cornell University) স্কুল অফ ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড লেবার রিলেশন্স এ কাজ করেছেন। সিইও-ওয়ার্কার বেতন ব্যবধান সম্পর্কে তিনি বিশেষজ্ঞের মর্যাদা পান। তিনি তার এক রিপোর্টে তিনটি বড় সংখ্যাগত বিষয় উল্লেখ করেছিলেন –

  • ১৯৭৮ সাল থেকে সিইওদের আয় বেড়েছে ১৩২২%, কিন্তু সাধারণ শ্রমিকদের আয় বেড়েছে মাত্র ১৮%।
  • ২০২০ সালে সিইওরা সাধারণ শ্রমিকদের চেয়ে ৩৫১ গুণ বেতন পেয়েছেন।
  • যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ ৩৫০টি প্রতিষ্ঠানের সিইওরা গড়ে ২৪.২ মিলিয়ন ডলার করে পেয়েছেন।

CEO রা এত বেশি আয় করছেন কেন?

“কেন এখনকার CEO রা এত টাকা উপার্জন করেন?”— এর উত্তর দুটি দিক থেকে আসতে পারে।

প্রথম ব্যাখ্যা: রেন্ট-সিকিং (Rent-Seeking): রেন্ট-সিকিং (Rent-seeking) অর্থাৎ অর্থনীতিবিদদের ভাষায় CEO রা অনেকটা সুযোগের সদ্ব্যবহার করে নিজেদের বেতন বাড়াচ্ছেন। তারা আসলে কোম্পানি থেকে সম্পদ শোষণ (extracting resources) করছেন। কারণ তাদের এত বেশি বেতন দেয়া সম্ভব, এবং তারা সেটি আদায় করেও নিচ্ছেন।

দ্বিতীয় ব্যাখ্যা: দক্ষ নির্বাহী বাজার (Efficient Market for Executive Talent): অপরপক্ষের দাবি হলো, এটি এক ধরনের দক্ষ প্রতিযোগিতামূলক বাজার (efficient market) যেখানে সবচেয়ে মেধাবী ও যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিকে CEO করা হয় এবং তাদের ধরে রাখতে প্রচুর অর্থের প্রয়োজন। এজন্য CEO নিয়োগের বাজারে ব্যাপক প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়, এবং “সেরা” জনকে পেতে প্রচুর টাকা গুনতে হয়।

সুতরাং দুটি বিপরীতমুখী ধারণা দেখতে পারি আমরা –

  • ১) CEO রা কোম্পানি থেকে সম্পদ শোষণ করছে।
  • ২) এটি একটি দক্ষ নির্বাহী প্রতিভা বাজার, যেখানে প্রবল প্রতিযোগিতার কারণে বেতন বেশি।

যাচাই করে দেখা যাক আসলে কী ঘটে।

পারফরম্যান্স ভিত্তিক বেতন ও এর বিষফল: শেয়ারদর বৃদ্ধিই কি সবসময় CEO এর দক্ষতার প্রমাণ?

বর্তমান সময়ের সেরা CEO রা তাদের বেশিরভাগ আয় শেয়ার-সংক্রান্ত পদ্ধতিতে পেয়ে থাকেন—যেমন স্টক অপশন (stock options) কিংবা বোনাস (bonus)। এই প্রবণতা শুরু হয়েছিল ৯০-এর দশকে, যখন ক্লিনটন (Clinton) প্রশাসনের একটি নিয়ম উল্টোফলে বুমেরাং হয়ে যায়। একসময় আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ছিলেন বিল ক্লিনটন (Bill Clinton)। ক্লিনটনের উদ্দেশ্য ছিল নির্বাহীদের (executives) অতিরিক্ত বেতন নিয়ন্ত্রণ করা। তিনি একটি নিয়ম চালু করেন—যে কোনও CEO-এর ১ মিলিয়ন ডলারের (1,000,000 USD) বেশি বেতনকে আর “যুক্তিসঙ্গত ব্যবসায়িক খরচ” (reasonable business expense) বলে কর ছাড় (corporate tax deduction) দেয়া হবে না।

এই নিয়মের ফলে ধারণা করা হয়েছিল যে কোম্পানিগুলো CEO-দের বেতন ১ মিলিয়নের ঘরেই রাখবে। কিন্তু এখানে ছিল একটি ফাঁক বা লুপহোল। সেটা হচ্ছে পারফরম্যান্স পে (performance pay), যার মধ্যে স্টক অপশন ও বোনাস অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এটাকে ট্যাক্স ছাড়ের আওতার বাইরে রাখা হয়েছিল। আর এর ফলাফল হচ্ছে, কোম্পানিগুলো CEO দের বাস্তব বেতন কমিয়ে নিয়ে গেলেও, পারফরম্যান্স রিওয়ার্ড (performance rewards) বিশেষত শেয়ার, স্টক অপশন ইত্যাদির মাধ্যমে বিশাল অঙ্কের প্যাকেজ দিতে শুরু করলো।

লরেন্স সিইও-দের এই বাড়তি লাভটাকে সিইও ক্ষতিপূরণ বা সিইও কমপেনসেশন (CEO compensation) নামে অভিহিত করেন। তিনি বলেন, সিইও ক্ষতিপূরণ (CEO compensation) বলতে বেতন (wages), বোনাস (bonuses), দীর্ঘমেয়াদি প্রণোদনা (long-term incentives), এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল সিইও প্রতি বছর যত স্টক অপশন (stock options) নগদায়ন করেন ও ভেস্টেড স্টক অ্যাওয়ার্ডস (vested stock awards) পান, তার পরিমাণকে বোঝায়। হিসাব করে দেখা হয় যে তারা আসলে করের জন্য কতটা আয় দেখান। তাই এটা বাস্তব চিত্র। ১৯৯০-এর দশকে স্টক মার্কেটের উত্থানের সময় সিইওদের আয় ব্যাপক বেড়ে যায়।

লরেন্স বলেন, প্রতিষ্ঠান ভাবে তারা খুব গুরুত্বপূর্ণ এবং তাদের একজন মহান নির্বাহী (executive) চাই। আর যদি তারা সত্যিই মহান হন, তবে নিশ্চয়ই তাকে গড়ের চেয়ে বেশি দিতে হবে। এখন সবাই যদি ভাবে তাদের নির্বাহীকে গড়ের চেয়ে বেশি দিতে হবে, তাহলে একে অপরের পারিশ্রমিক দেখে নিজেদেরটা আরো বাড়াতে থাকে। ফলে এই বেতন সবসময় উপরে উঠতে থাকে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, বোর্ড সদস্য (board members) ও শেয়ারহোল্ডারদের (shareholders) সিইওদের বেশি পারিশ্রমিক দেওয়ার যৌক্তিক কোনো কারণ আছে?

লরেন্স বলেন, ধারণা করা হয় সিইও ক্ষতিপূরণ শেয়ার বাজারের (stock market) সাথে বাঁধা, অর্থাৎ কর্মক্ষমতার (performance) ওপর নির্ভর করে। কিন্তু বাস্তবে এটি সবসময় সত্যি নয়। স্টক মূল্য যদি স্রেফ বেড়ে যায়, সেটাকেই কর্মক্ষমতার চিহ্ন ধরা হয়। কিন্তু স্টক মূল্যের বৃদ্ধি সবসময় সিইওর কৃতিত্ব নয়। যেমন, ট্রাম্প (Trump) যখন বিশাল কর ছাড় দিয়েছিলেন কোম্পানিগুলোকে, স্টক মূল্য বেড়েছিল, সিইওদের আয়ও বেড়েছিল। কিন্তু এটা তাদের কর্মক্ষমতার ফল ছিল না।

এদিকে অনেক বিশেষজ্ঞ বলেন, গত ৩০ বছরে CEO বেতন বেড়েছে মূলত শেয়ারবাজার (stock market) বৃদ্ধির কারণে। তারা তাদের বেতনকে খুব চতুরভাবে শেয়ারবাজারের সামগ্রিক উন্নতির সঙ্গে যুক্ত করেছেন।

এভাবেই আমরা কোটি (Coty) নামক কসমেটিক্স (cosmetics) কোম্পানির CEO সু নাবি (Sue Nabi) এর উদাহরণ পাই। কোটি ব্র্যান্ডের আওতায় গুচি (Gucci), ক্যালভিন ক্লেইন (Calvin Klein), টিফানি (Tiffany) ইত্যাদি রয়েছে। ২০২২ সালে সু নাবি প্রায় ১৫০ মিলিয়ন ডলার উপার্জন করেন, যার মধ্যে ১৪৬ মিলিয়ন ছিল কোটির শেয়ার (Coty Stock) থেকে পাওয়া। এতে তার উপার্জন কোটির একজন সাধারণ কর্মীর চেয়ে ৩০০০ গুণ বেশি।

১৫০ মিলিয়ন ডলার বার্ষিক আয় অদ্ভুত লাগতে পারে, তবে ভাবুন তো—একজন CEO যদি কোম্পানির শেয়ারের দাম বাড়াতে পারেন, তবে তার বড় অঙ্কের পুরস্কৃত হওয়া তো স্বাভাবিক, তাই না?

তত্ত্বগতভাবে, CEO এর ক্ষতি-সাফল্য যেন কোম্পানির সাফল্যের সাথে যুক্ত হয়, তাই এই পারফরম্যান্স-নির্ভর (performance-based) বেতন ব্যবস্থা। যদি কোম্পানির শেয়ারের মূল্য বাড়ে, CEO এর সম্পদও বাড়ে।

কিন্তু বাস্তবে বিষয়টা এত সহজ নয়। দেখা যায়, শেয়ারদর (share price) অনেক কারণে বাড়তে পারে, যা CEO-এর নিয়ন্ত্রণের বাইরেও হতে পারে। সমালোচকরা বলছেন, যদি শেয়ারদর বাড়ে, তা সবসময় CEO এর অনন্য কৃতিত্ব বোঝায় না। উদাহরণস্বরূপ, তেলের দাম (global price of oil) বিশ্ববাজারে বেড়ে গেলে তেল কোম্পানির শেয়ারদরও বেড়ে যাবে। এতে CEO রা বিশাল বেতন পেয়ে যাবেন, অথচ তারা তেলের বিশ্ব দর নিয়ন্ত্রণ করেন না। এটি মূলত সৌভাগ্য ও বিভিন্ন বাহ্যিক ফ্যাক্টরের ওপর নির্ভর করে তাদের আয়কে বাড়িয়ে তোলে।

সুতরাং, দেখা যাচ্ছে শেয়ারবাজার সবকিছুর কেন্দ্রে। কিন্তু আমি তবুও এই ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট নই। আমার অনুসন্ধিৎসু মন আরও গভীরে ঢুকতে চায়।

সীমিত প্রতিভার বাজার ও বন্ধু-বান্ধবীপূর্ণ বোর্ড

“কেন CEO রা এত বেশি বেতন পান?” এই প্রশ্নের আরেকটি উত্তর হলো: হয়তো সত্যিই এমন অনেক কম সংখ্যক মানুষ আছেন যারা এত বড় বড় কোম্পানি পরিচালনা করতে সক্ষম। মানে দক্ষ লোকের সংকট আছে, মানে এক্সিকিউটিভ ট্যালেন্টের জন্য এফিশিয়েন্ট মারকেট আছে আরকি।

সমালোচকরা প্রশ্ন তোলেন—একজন টিম কুক (Tim Cook)-এর মতো দক্ষ CEO এর বিকল্প কি একটু কম বেতনে পাওয়া সম্ভব নয়? কীভাবে এমন নিয়মতান্ত্রিক প্রতিযোগিতা (open competition) তৈরি করা যায়, যাতে কম টাকা দিয়েও একই রকম দক্ষ কাউকে পাওয়া যায়?

কিন্তু বাস্তবে, উচ্চপর্যায়ের CEO পুল (pool) হয়তো অকারণে খুবই ছোট এবং নির্বাচিত কিছু মানুষই ঐ স্থানগুলোতে সুযোগ পায়। আরেকটি বড় কারণ হলো CEO রা নিজেদের বেতন নির্ধারণের প্রক্রিয়ায় প্রভাব রাখতে সক্ষম হন।

তত্ত্বগতভাবে, শেয়ারহোল্ডারদের স্বার্থ দেখার জন্য একটি বোর্ড অব ডিরেক্টরস (board of directors) থাকে, যারা CEO এর বেতন প্যাকেজ নির্ধারণ করেন। কিন্তু বাস্তবে CEO নিজেই বোর্ড সদস্যদের মনোনয়ন করতে পারেন বা তাদের উপর যথেষ্ট প্রভাব রাখতে পারেন। ফলে যাদের কাজ CEO-দের দেখাশোনা করার কথা, তারা হয়ে যান তাদের বন্ধু। একরকম আত্মীয়তা, একধরনের মিত্রতা গড়ে ওঠে। ফলে ন্যায্য সমালোচনা বা বেতনের উপর যথাযথ লাগাম টানা কঠিন হয়ে পড়ে।

ডেলাওয়্যার (Delaware) অঙ্গরাজ্যের একটি ঘটনার কথাই বলা যাক। টেসলা (Tesla) কোম্পানির শেয়ারহোল্ডাররা ইলন মাস্কের ২০১৮ সালের বেতন প্যাকেজকে চ্যালেঞ্জ করে মামলা করেন, দাবি করেন এটি অন্যায্য ও পক্ষপাতদুষ্ট ছিল। এক বিচারক রায় দেন যে বোর্ডের অনেক সদস্যই মাস্কের সাথে খুব ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রেখেছেন, ফলে এই বেতন নির্ধারণ প্রক্রিয়া সঠিক ছিল না।

সব মিলে আমরা দেখতে পারছি সিইও-দের উচ্চবেতনের পেছনে তাদের পারফরমেন্স ও যোগ্যতার চেয়ে সম্পদ শোষণ করার বিষয়টাই প্রধান ভূমিকা পালন করে।

শ্রমিকদের বেতনে বৃদ্ধিতে স্থবিরতা ও বৈষম্য

আরেকটি বিষয় হলো সাধারণ শ্রমিকদের বেতন মাত্র ১৮% বেড়েছে। এই স্থবিরতা কেন? লরেন্স বলেন, গত ৪০ বছরে শ্রমিকদের বেতন ও সুবিধাদি খুব একটা বাড়েনি। উৎপাদনশীলতা (productivity) বৃদ্ধি পেলেও বেতনের সাথে তার সংযোগ নেই। উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির হারে যদি মূল্যায়ন করি, শ্রমিকদের প্রায় ৬০% বৃদ্ধি পেতে পারত, কিন্তু তারা পেয়েছে মাত্র ১৮%। লরেন্স শ্রমিকদের বেতন না বাড়ার পেছনে ছয়টি কারণ উল্লেখ করেছেন –

  • ১. উচ্চ বেকারত্ব (unemployment), যা শ্রমিকদের কম বেতনে কাজ করতে বাধ্য করে।
  • ২. বিশ্বায়ন (globalization), যা কোম্পানিগুলোকে সস্তা শ্রমের জন্য বিদেশে যাওয়ার সুযোগ দেয়।
  • ৩. ইউনিয়ন (unions) দুর্বল হয়ে যাওয়া, ফলে শ্রমিকরা সম্মিলিতভাবে দরকষাকষি করতে পারে না।
  • ৪. নিম্ন শ্রম মানদণ্ড (low labor standards), যেমন অত্যন্ত কম ন্যূনতম মজুরি (minimum wage)।
  • ৫. নন-কমপিট (non-compete) চুক্তির বিস্তার, যা শ্রমিকদের শিল্পের মধ্যে ভালো বেতনের চাকরি খোঁজা কঠিন করে তোলে।
  • ৬. ডোমেস্টিক আউটসোর্সিং (domestic outsourcing), যেখানে কোম্পানি ফ্রিল্যান্সারদের (freelancers) ওপর বেশি নির্ভর করে।

এগুলোর কোনোটাই আমাদের বেশি দক্ষ বা বড় অর্থনীতি (economy) তৈরিতে সাহায্য করে না। এসব পদক্ষেপ শ্রমিকদের একক ও সম্মিলিত দরকষাকষির ক্ষমতা (bargaining power) দুর্বল করে। আর এটা ঘটেছে নিচের ৯০% শ্রমিকদের সাথে, শুধু নিম্নবেতনের শ্রমিকদের নয়, বরং পুরো নিম্ন ৯০ শতাংশের ক্ষেত্রেই।

শ্রমিকদের দাবী, করের প্রস্তাব ও অনুশাসন

ইউনাইটেড অটো ওয়ার্কারস ইউনিয়ন (United Auto Workers Union) শীর্ষ পর্যায়ের কার নির্মাতা কোম্পানিগুলোর সাথে আলোচনায় ৪০% বেতন বৃদ্ধি দাবি করেছিল, যা CEO দের গত চার বছরে বেতন বৃদ্ধির সমান হারে আনার চেষ্টা।

এদিকে বার্নি স্যান্ডার্স (Bernie Sanders) প্রস্তাব করেছিলেন এমন একটি কর ব্যবস্থা (tax) যা সেইসব কোম্পানির ওপর বসবে, যাদের CEO রা সাধারণ কর্মীর চেয়ে ৫০ গুণের বেশি বেতন পান।

কিন্তু শুধু ইউনিয়ন বা তথাকথিত “সোশ্যালিস্ট গ্যান্ডালফরাই” নয়, এমনকি পুঁজিবাদী হাঙ্গরদের (capitalist zaddies) মধ্যেও এই ব্যাপারে অসন্তোষ আছে। কার্ল আইকান (Carl Icahn) বলেছেন যে অনেক CEO কম পারফর্ম করে এবং অতিরিক্ত পারিশ্রমিক পায়। ওয়ারেন বাফেট (Warren Buffett) এই নির্বাহী বেতন প্যাকেজকে “অযৌক্তিক ও অতি মাত্রায় বেশি” বলে অভিহিত করেছেন এবং পরিবর্তন আনতে বৃহত্তর শেয়ারহোল্ডারদের (institutional shareholders) সক্রিয় ভূমিকা চেয়েছেন।

সরকারও এই বিষয়ে মনোযোগ দিচ্ছে। SEC (Securities and Exchange Commission) সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কিছু নিয়ম চালু করেছে যাতে বোর্ডের এই গোপন সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা আনা যায়।

বর্তমান পরিস্থিতি: খুব একটা পরিবর্তন কি সম্ভব?: শেয়ারহোল্ডারদের স্বার্থ ও সাধারণ মানুষের অজ্ঞতা

তবুও অনেকেই মনে করেন এই ব্যবস্থা সহজে বদলাবে না। কেউ কেউ বলেন CEO-দের বেতন বাড়তেই থাকবে। সিস্টেমিক (systemic) পলিসি পরিবর্তন না হলে এটি নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন।

১৯৭৮ সালে সিইওরা ছিলেন সাধারণ শ্রমিকের ৩১ গুণ, ১৯৮৯ সালে ৬১ গুণ, আর এখন ৩৫১ গুণ। যদি এটা এতটাই স্পষ্ট সমস্যা হয়, সমাধান আমাদের সামনে স্পষ্ট হওয়ার কথা। সিইও ক্ষতিপূরণ বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে আনতে নীতিমালা (policy) এবং সম্মিলিত পদক্ষেপ (collective approach) প্রয়োজন। মহামারির (pandemic) সময় যখন মানুষ চাকরি হারিয়েছে, তখন সিইওদের বেতন আরো বেড়েছে। এটা এককথায় লজ্জাজনক।

আমেরিকার বর্তমান প্রশাসন ও কংগ্রেস (Congress) শ্রমিকদের স্বার্থকে কেন্দ্র করে পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছে। প্রথম বিল ছিল আমেরিকান রেসকিউ প্ল্যান (American Rescue Plan), যা ২০২২ সালের শেষ নাগাদ পূর্ণ কর্মসংস্থান (full employment) অর্জনে সাহায্য করেছে। পুনর্মিলন বিল (reconciliation bill) এ এমন বিধান আছে যা কোম্পানিগুলোকে শ্রমিক ইউনিয়নের (worker unions) অধিকারের লঙ্ঘনের জন্য আর্থিক জরিমানা (monetary penalties) করতে চায়, এবং বাইডেনের (Biden) নির্বাহী আদেশ (executive order) এফটিসি (FTC)-কে নির্দেশ দিয়েছিল নিয়ম তৈরি করে নন-কমপিট (non-compete) ক্লজ নিষিদ্ধ বা সীমিত করতে। এরকম নীতিমালাগুলো শ্রমিকদের পক্ষে পাল্লা ভারী করার চেষ্টা করে, যাতে তারা নিয়োগদাতাদের তুলনায় ভালো অবস্থানে আসতে পারে। যদি শ্রমিকরা নিজেদের দাবি প্রতিষ্ঠা করতে পারে, ফলাফল ঘরে তুলতে পারে, তাহলে সিইওদের বিশাল অঙ্কের লাভ ঘরে তোলা কঠিন হয়ে যাবে।

CEO বনাম কর্মী এই দ্বন্দ্ব স্পষ্ট হলেও, প্রকৃতপক্ষে যারা সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, তারা হলো শেয়ারহোল্ডাররা—যারা তাদের বিনিয়োগের সঠিক স্বার্থরক্ষার আশা করে। আর বলতে গেলে সবাইকে এই ব্যাপারে আগ্রহী হওয়া উচিত। কারণ কেউ যদি শেয়ার কেনেন বা তাদের যদি পেনশনের মাধ্যমে কোথাও বিনিয়োগ থাকে, তাহলে বোর্ডের এসব সিদ্বান্ত তাদের স্বার্থকে ক্ষুণ্ণ করতে পারে।

২০১৬ সালে স্ট্যানফোর্ড বিজনেস স্কুল (Stanford Business School) এর একটি জরিপে দেখা যায়, প্রায় ৭০% আমেরিকান বিশ্বাস করে CEO-রা অতিমাত্রায় বেতন পায়। মার্কিনিরা CEO এবং কর্মীদের মধ্যে বেতনের ব্যবধান সম্পর্কে কী ভাবে সেটা নিয়ে জরিপ করে দেখা গেছে ৮৭% মানুষ মনে করে এই ব্যবধান খুব বেশি।

কিন্তু সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, মানুষ CEO-দের আসল বেতন সম্পর্কে কোনো ধারণাই করতে পারে না। স্ট্যানফোর্ডের জরিপ বলছে, সাধারণ আমেরিকানরা CEO দের প্রকৃত বেতনের ১/১০ ভাগ কল্পনা করে! জরিপে দেখা যায় ৭৫% মানুষ ধারণা করে CEO দের বেতন কর্মীদের তুলনায় ১০০ গুণের কম। বাস্তবে এটি ২০০ গুণ বা তারও বেশি। অর্থাৎ বাস্তবতা কল্পনার চেয়েও অনেক বেশি বিষ্ময়কর।

উপসংহার

তো সব মিলে CEO-দের বেতন একটি লাগামহীন ট্রেনের মতো সামনে ছুটছে। আর এটাকে নিয়ন্ত্রণে নেয়া দরকার। এটা করলেই কোম্পানিগুলো আরও লাভজনক (profitable) হতে পারে, অর্থনীতি (economy) কিছুটা বেশি ন্যায়সঙ্গত বা ইকুইটেবল হতে পারে।

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.