উত্তর আমেরিকা (কানাডা, মেক্সিকো, গ্রিনল্যান্ড, ক্যারিবিয়ান অঞ্চল ইত্যাদি) ও আর্কটিক সংবাদ

Table of Contents

জাস্টিন ট্রুডোর উত্তরসূরি: মার্ক কার্নির প্রচারণা (সংক্ষিপ্ত) (১৭ জানুয়ারি, ২০২৫)

বাইডেনের কিউবা নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার: নতুন যুগের ইঙ্গিত (সংক্ষিপ্ত) (১৫ জানুয়ারি, ২০২৫)

ডোনাল্ড ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে আমেরিকার সীমানা বিস্তার: সম্ভাবনা ও ভূ-রাজনৈতিক প্রভাব (৯ জানুয়ারি, ২০২৫)

ট্রাম্পের আক্রমণাত্মক ভঙ্গি: পানামা খাল, গ্রিনল্যান্ড ও কানাডা (সংক্ষিপ্ত) (৮ জানুয়ারি, ২০২৫)

অবশেষে কি ডেনমার্ক থেকে গ্রিনল্যান্ড স্বাধীন হবে? (৮ জানুয়ারি, ২০২৫)

কানাডায় নতুন নেতা খোঁজে লিবারেল পার্টি (সংক্ষিপ্ত) (৭ জানুয়ারি, ২০২৫)

কেন ট্রুডো পদত্যাগ করেছেন? পরবর্তীতে কী হতে যাচ্ছে? (৭ জানুয়ারি, ২০২৫)

কানাডায় জাস্টিন ট্রুডোর সম্ভাব্য পদত্যাগ (সংক্ষিপ্ত) (৬ জানুয়ারি, ২০২৫)

মেক্সিকোর অর্থনীতি, বৈষম্য ও পানামা খালের বিকল্প: নিয়ারশোরিংয়ের প্রভাব (৬ জানুয়ারি, ২০২৫)

কানাডায় ট্রুডোর কঠিন সময়: কি ঘটছে এখন? (১৮ ডিসেম্বর, ২০২৪)

ভূমিকা

জাস্টিন ট্রুডো (Justin Trudeau) বর্তমানে খুব একটা ভালো সময় কাটাচ্ছেন না। গত চার বছর ধরেই তার গ্রহণযোগ্যতার হার (approval rating) নেতিবাচক (in the red) অবস্থানে রয়েছে, আর তার লিবারেল পার্টি (Liberal Party) গত তিন বছর ধরে কনজারভেটিভদের (Conservatives) চেয়ে জরিপে পিছিয়ে আছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে ট্রুডোর জন্য, সাম্প্রতিক কয়েক সপ্তাহে পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে।

ডিসেম্বরে অ্যাঙ্গাস রিড (Angus Reid) পরিচালিত সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী, ট্রুডোর নিট অনুমোদন হার (net approval rating) -40 পয়েন্টে গিয়ে ঠেকেছে, যা তার জন্য সর্বকালের সর্বনিম্ন। কানাডিয়ান ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশনের (Canadian Broadcasting Corporation) সর্বশেষ জরিপে দেখা যাচ্ছে যে লিবারেলরা এখন কনজারভেটিভদের চেয়ে ২১ পয়েন্ট পেছনে, যেখানে নভেম্বরে এই ব্যবধান ছিল ১৭ পয়েন্ট। বর্তমান জরিপ অনুযায়ী, কানাডার ফার্স্ট পাস্ট দ্য পোস্ট (first past the post) নির্বাচনী পদ্ধতির প্রেক্ষিতে তারা খুব কম আসন পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

পরিস্থিতি একেবারে চূড়ান্ত আকার নেয় সোমবার, যখন ট্রুডোর ডেপুটি প্রাইম মিনিস্টার (Deputy Prime Minister) এবং অর্থমন্ত্রী (Finance Minister) ক্রিস্টিয়া ফ্রিল্যান্ড (Christia Freeland) আকস্মিকভাবে পদত্যাগ করেন। একই দিনে সরকার স্বীকার করে নেয় যে বাজেট ঘাটতি (deficit) প্রত্যাশার চেয়ে ৫০% বেশি। এমনকি ওই দিনেই ট্রুডো আবার একটি উপনির্বাচনে (by election) পরাজিত হন, যেখানে আগে ওই আসনটি লিবারেলদের নিরাপদ এলাকা হিসেবে বিবেচিত হতো। মাত্র একদিনেই এসব ঘটনার ফলে ট্রুডোর ওপর নতুন করে চাপ সৃষ্টি হয়েছে—তিনি কি পদত্যাগ করবেন, নাকি নির্বাচন ডেকে দেবেন?

এই প্রেক্ষিতে, আমরা এই আর্টিকেলে দেখবো কেন ট্রুডো এতটা অজনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন, এই নতুন সংকটের স্বরূপ কী, এবং সামনে কী ঘটতে পারে।

জনপ্রিয়তা হারানোর পেছনের কারণসমূহ

শুরু করার আগে, সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোর অন্তর্দৃষ্টি পেতে কিছু পটভূমি জানা প্রয়োজন। ট্রুডোর গ্রহণযোগ্যতার হার গত চার বছর ধরে স্থির নিম্নমুখী প্রবণতায় রয়েছে, এবং এখন তিনি বিশ্বের অন্যতম অজনপ্রিয় রাজনীতিবিদদের (unpopular politicians) একজন হয়ে উঠেছেন।

এটির পেছনে অনেকগুলি কারণ রয়েছে। এর মধ্যে একটি হলো ক্ষমতায় দীর্ঘ সময় থাকা থেকে জনগণের ক্লান্তি (incumbency fatigue) — ট্রুডো প্রায় এক দশক ধরে ক্ষমতায় আছেন। আরেকটি হলো মুদ্রাস্ফীতি (inflation), যা বিশ্বজুড়ে সরকারগুলোর জন্য রাজনৈতিকভাবে বিষাক্ত (politically toxic) হয়ে উঠেছে।

তবে কানাডা দু’টি বড় বিষয় ট্রুডোর ক্ষতির কারণ হয়েছে: কানাডার আবাসন সংকট (housing crisis) এবং অভিবাসন (immigration)।

কানাডার আবাসন সংকট (Housing Crisis) এবং অভিবাসন (Immigration)

২০১৫ সালে ট্রুডো ক্ষমতায় আসার পর থেকে কানাডায় বাড়ির দাম প্রায় ৭০% বেড়েছে, যা সমান আকারের অন্যান্য ওইসিডি (OECD) দেশের তুলনায় সবচেয়ে খাড়া বৃদ্ধি, অর্থাৎ দ্রুত বৃদ্ধি। এখন গড় কানাডিয়ান বাড়ির দাম (average Canadian house price) গড় আয়ের অনুপাতে অনেক বেশি। ১৯৯০-এর দশকে যেখানে মধ্যম গড় বাড়ির দাম ও মধ্যম গড় আয়ের (median house price to median wages) অনুপাত ছিল প্রায় ৩, এখন তা প্রায় ৬-এ পৌঁছেছে। টরন্টোতে (Toronto) এটি ৯, এবং ভ্যাঙ্কুভারে (Vancouver) এই অনুপাত প্রায় ১২। এর একটি বড় কারণ হলো জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে তুলনা করলে বাড়ি নির্মাণের গতি খুব ধীর। আর এখান থেকেই আসে দ্বিতীয় বড় বিষয়—অভিবাসন (immigration)।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কানাডায় অভিবাসন ব্যাপকভাবে বেড়েছে, স্থায়ী বাসিন্দা (permanent residents) বৃদ্ধির পাশাপাশি অস্থায়ী অভিবাসীর (non-permanent resident) সংখ্যাও উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। বর্তমানে অস্থায়ী অভিবাসীর সংখ্যা প্রায় ৩০ লক্ষ, যা কানাডার মোট জনসংখ্যার প্রায় ৭.৩%। এই অভিবাসী প্রবাহ অর্থনৈতিক সংকটকে আড়াল করে রেখেছে, কারণ সামগ্রিক জিডিপি (GDP) বৃদ্ধি উচ্চ অভিবাসনের কারণে জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফল, প্রকৃতপক্ষে মাথাপিছু জিডিপি (GDP per capita) গত দুই বছর ধরে কমছে।

যদিও ঐতিহ্যগতভাবে কানাডিয়ানরা অভিবাসন-বান্ধব (pro-immigrant), তবু এখন তারা কম অভিবাসন চায়। কারণ বাড়ির বাজারে (housing market) অসম্ভব চাপ সৃষ্টি হয়েছে এবং ধারণা আছে যে অস্থায়ী কর্মীরা (temporary workers) মজুরি কমিয়ে রাখছে। ট্রুডো প্রতিক্রিয়ায় বাড়ি নির্মাণ বাড়ানোর এবং অভিবাসন কমানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, বিশেষ করে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী (international students) ও বিদেশি কর্মী ভিসা (foreign worker visas) কমানোর মাধ্যমে। কিন্তু এই নীতিগুলোও সফলতার মুখ দেখছে না। বার্ষিক বাড়ি নির্মাণের হার এখনো তার নির্ধারিত নতুন লক্ষ্যের অর্ধেকেরও কম, আর অভিবাসন এখনো রেকর্ড হারে চলছে।

এই সমস্ত বিষয় ট্রুডোকে দু’দিক থেকেই চাপে ফেলেছে। ডানপন্থী (right leaning) কানাডিয়ানরা, যারা এর আগেই পরিচয়-রাজনীতি (identity politics) ও সবুজনীতির (green policies) মতো বিষয় বা কার্বন ট্যাক্স (carbon tax) নিয়ে ক্ষুব্ধ ছিল, তারা আরও বিমুখ হয়েছে। অন্যদিকে বামপন্থী (left leaning) কানাডিয়ানরা মনে করছেন যে আবাসন সংকট বৈষম্য (inequality) বাড়ায় এবং অস্থায়ী শ্রমিক স্কীম মজুরি কমিয়ে রাখে, যা নিম্ন আয়ের মানুষের ক্ষতি করছে।

সাম্প্রতিক রাজনৈতিক বিপর্যয়

ট্রুডো বেশ কিছুদিন ধরেই সমস্যায় আছেন, কিন্তু গত দেড় মাস বা তারও বেশি সময়ে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে।

নভেম্বরে ডোনাল্ড ট্রাম্প (Donald Trump) ঘোষণা করেন যে তিনি কানাডার ওপর ২৫% শুল্ক (tariffs) আরোপের পরিকল্পনা করছেন এবং মশকরায় বলেন, কানাডা যেন যুক্তরাষ্ট্রের ৫১তম রাজ্য হয়ে যায়, আর ট্রুডো যেন সেখানে গভর্নর হন।

তারপর কানাডিয়ান ইউনিয়ন অফ পোস্টাল ওয়ার্কার্স (Canadian Union of Postal Workers) ধর্মঘট (strike) করে, এবং সরকারের হস্তক্ষেপে ইউনিয়নকে কার্যত কাজে ফিরতে বাধ্য করা হয়। ট্রুডোর ভোটারদের খুশি করতে টাকার ছড়াছড়ি করার চেষ্টা (buy off voters) ব্যুমেরাং হয়ে ফিরে আসে।

শনিবার ট্রুডো দুই মাসের একটি ক্রিসমাস ট্যাক্স হলিডে (Christmas tax holiday) ঘোষণা করেন, যার আওতায় বিয়ার (beer), ওয়াইন (wine), ক্যান্ডি (candy) ইত্যাদিতে ট্যাক্স অবকাশ দেওয়া হবে। এছাড়াও তিনি ২০২৩ সালে ১,৫০,০০০ ডলারের কম আয়কারী প্রত্যেক কানাডিয়ানকে ২৫০ ডলার রিবেট (rebate) দেওয়ার প্রস্তাব করছেন।

প্রথমে ভাবা যেতে পারে যে এই ধরনের পদক্ষেপ তাকে জনপ্রিয় করবে, কিন্তু লেজার (Ledger) পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে ৭০% ভোটার মনে করছেন এটি নিছক নির্বাচনকেন্দ্রিক চাল (electioneering), আর মাত্র এক-তৃতীয়াংশ মনে করেন যে এসব পদক্ষেপ তাদের ব্যক্তিগত আর্থিক অবস্থায় অর্থপূর্ণভাবে সাহায্য করবে।

অর্থমন্ত্রী ও উপপ্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ এবং আর্থিক ধাক্কা (Financial Shock)

এই পদক্ষেপগুলোর সাথে ক্রিস্টিয়া ফ্রিল্যান্ড (Christia Freeland) একমত হতে পারেননি। ফলে ডেপুটি প্রাইম মিনিস্টার এবং অর্থমন্ত্রী ফ্রিল্যান্ড সোমবার আকস্মিকভাবে পদত্যাগ করেন। তার আগে রোববারই হাউজিং মন্ত্রী (Housing Minister) শন ফ্রেজার (Shaun Fraser) পদত্যাগ করেন। ফ্রিল্যান্ড তার পদত্যাগপত্রে উল্লেখ করেন যে শুক্রবার ট্রুডো তাকে অর্থমন্ত্রীর পদ থেকে সরে যেতে বলেছিলেন, আর তিনি ইঙ্গিত দেন যে ট্রুডো হয়তো ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে মোকাবেলা করতে পারবেন না।

ফ্রিল্যান্ড সম্ভবত এই কারণেও পদত্যাগ করেন যে একই দিনে তাকে বাজেট সম্পর্কিত একটি খারাপ খবর দিতে হতো। অর্থ মন্ত্রণালয়ের (Finance Ministry) একটি পাঠক্রম (readout) অনুযায়ী, শেষ অর্থবছরে জাতীয় ঘাটতি (national deficit) ৬১.৯ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে, যা প্রত্যাশার চেয়ে ৫০% বেশি এবং সরকারের লক্ষ্য করা ৪০ বিলিয়ন ডলারের চেয়ে অনেক বেশি। এই বিশাল ঘাটতি ট্রুডোর সাম্প্রতিক ৬ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ের (taxpayer $6 billion) যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।

উপনির্বাচনে পরাজয় (By-Election Losses)

এদিকে, একই সোমবার সন্ধ্যায় ভোটগণনা শেষে দেখা গেল ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার (British Columbia) একটি উপনির্বাচনে কনজারভেটিভরা একটি আসন ছিনিয়ে নিয়েছে, যা আগে লিবারেলদের নিরাপদ আসন ছিল। এটি এই বছরের মধ্যে তৃতীয়বারের মতো লিবারেলদের নিরাপদ আসন হারানো।

সামনে কী আসতে পারে?

এখন প্রশ্ন উঠে, পরবর্তীতে কী হবে? অনেকেই বলছেন ট্রুডো হয়তো পদত্যাগ করতে পারেন, তবে তাৎক্ষণিক ভবিষ্যতে সেটি সম্ভবনা কম। আগের উপনির্বাচন পরাজয়ের পরও তিনি পদত্যাগ করেননি, এবং ইতোমধ্যেই ডমিনিক লেব্লঁ (Dominic LeBlanc)-কে অর্থমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন। যদিও ডেপুটি প্রাইম মিনিস্টারের পদ এখনো শূন্য রয়েছে।

তারও ওপরে, পরবর্তী সাধারণ নির্বাচন (general election) অক্টোবরে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা সর্বশেষ সময়সীমা অনুসারে, সুতরাং তার আগে লিবারেলদের পক্ষে দ্রুত কোনো নেতৃত্ব নির্বাচন (leadership election) করা কঠিন হতে পারে। সম্ভাব্য নেতৃত্ব প্রত্যাশীরাও সম্ভবত তাদের শক্তি ধরে রাখবেন পরবর্তী নির্বাচনের জন্য।

তবে ট্রুডো একটি অপ্রত্যাশিত অবস্থায় পড়তে পারেন। যদি কানাডিয়ান পার্লামেন্ট (Canadian Parliament) তার সংখ্যালঘু সরকার (minority government) বিরুদ্ধে অনাস্থা (no confidence motion) প্রস্তাব পাস করে, তবে তাকে নির্বাচন ডাকতেই হবে। কনজারভেটিভ (Conservatives) ও ব্লক কেবেকোয়া (Bloc Quebecois) উভয়েই বলছে ট্রুডোকে উচিত ২০২৫ সালের শুরুর দিকে পার্লামেন্ট ভেঙে দিয়ে (dissolve Parliament) নির্বাচন ডাকা। অন্যদিকে এনডিপি (NDP) নেতা ট্রুডোর পদত্যাগ দাবি করেছেন, তবে তিনি স্পষ্ট করে বলেছেন যে তিনি তৎক্ষণাৎ সরকার পতন ঘটানোর পক্ষে ভোট দেবেন না, বরং সব বিকল্প উন্মুক্ত রাখছেন।

কনজারভেটিভ ও ব্লক সবসময় অনাস্থা প্রস্তাবে ভোট দিয়েছে, কিন্তু এনডিপি সবসময় ট্রুডোকে বাঁচিয়ে রেখেছে। এনডিপির সমর্থন ছাড়া বিরোধীদলগুলোর সংখ্যাগরিষ্ঠতা নেই, তাই এনডিপি সবসময়ই একটি মূল ফ্যাক্টর।

কিন্তু ট্রুডো যদি ক্ষমতায় টিকে থাকেন, সেটি হবে কেবল অবশ্যম্ভাবী পরাজয়ের ক্ষণিক বিলম্ব। প্রকৃত প্রশ্ন হলো, সেই পরাজয় কতটা ভয়াবহ হবে।

সব মিলিয়ে, ট্রুডোর বর্তমান পরিস্থিতি অত্যন্ত জটিল। দীর্ঘ মেয়াদি ক্ষমতায় থাকার ক্লান্তি, উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি, বাড়ির দাম বৃদ্ধি, অভিবাসনজনিত চাপ, অর্থনৈতিক লক্ষ্যচ্যুতি, মন্ত্রীদের পদত্যাগ, এবং পরপর উপনির্বাচনে পরাজয় তার ওপর প্রবল চাপ সৃষ্টি করেছে। সামনের দিনগুলোতে তিনি কী সিদ্ধান্ত নেন, সেটাই এখন দেখার বিষয়।

তথ্যসূত্র

জামাইকার রাজতন্ত্র বিলুপ্তির উদ্যোগ (১৬ ডিসেম্বর, ২০২৪)

জামাইকা (Jamaica) সম্প্রতি পার্লামেন্টে (Parliament) একটি বিল উত্থাপন করেছে যা রাজা তৃতীয় চার্লসকে (King Charles III) রাষ্ট্রপ্রধানের (head of state) পদ থেকে অপসারণ করে, দেশটিকে প্রজাতন্ত্রে (republic) রূপান্তর করার প্রস্তাব দেয়।

জামাইকা ১৯৬২ সাল থেকে স্বাধীন, তবে এর আগে এটি ছিল ব্রিটিশ উপনিবেশ (British colony)। স্বাধীনতার পরেও ব্রিটিশ রাজাকে রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে রাখা হয়েছিল, যার প্রতিনিধি ছিলেন গভর্নর জেনারেল (governor general)। তবে অনেকের কাছে এটি উপনিবেশিক আমলের (colonial legacy) স্মারক হিসেবে বিবেচিত।

জামাইকার আইনি ও সাংবিধানিক বিষয়ক মন্ত্রী (Minister of Legal and Constitutional Affairs) মার্লিন মালাহু ফোর্ট (Marlene Malahoo Forte) গত বুধবার বিলটি উত্থাপন করেন। তিনি বলেন, এটি জামাইকান জনগণের দীর্ঘদিনের দাবি। দ্য গার্ডিয়ান (The Guardian) পত্রিকাকে তিনি বলেন, “প্রতি বছর ৬ই অগাস্ট স্বাধীনতা দিবস (Independence Day) উদ্‌যাপনের সময় আমরা স্বাধীনতার পর কী অর্জন করেছি এবং কী বাকি আছে তা নিয়ে ভাবি। প্রতি বছরই প্রশ্ন ওঠে, কবে আমরা রাজতন্ত্র বিলুপ্ত করে একজন জামাইকানকে রাষ্ট্রপ্রধান করব? দিনশেষে বিষয়টি দলীয় রাজনীতি নিয়ে নয়, জাতি ও জনগণের স্বার্থ নিয়ে, আমাদের দেশের স্বাধীনতাকে সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিত করার ব্যাপার।”

বিলটি আইনে পরিণত হতে গেলে এটি যৌথ কমিটি (joint committee) দ্বারা পর্যালোচনা, পার্লামেন্টে ভোট এবং একটি জাতীয় গণভোট (national referendum) অতিক্রম করতে হবে। যদি পাস হয়, তবে একজন জামাইকান প্রেসিডেন্ট (Jamaican President) আনুষ্ঠানিক রাষ্ট্রপ্রধান হবেন, যা দেশের পূর্ণাঙ্গ প্রজাতন্ত্রে উত্তরণের চিহ্ন হবে।

তথ্যসূত্র

কানাডার অর্থনৈতিক পতন ও তার কারণ (১৪ অক্টোবর, ২০২৪)

ভূমিকা

কোভিড-১৯ (COVID-19) মহামারির সমাপ্তির পর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের (United States) অর্থনীতি অসাধারণ মাত্রায় প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। অর্থনীতিবিদেরা “আঙ্কল স্যাম” (Uncle Sam) নামেও যাকে সম্বোধন করে, সেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই সাফল্য এতটাই বিস্তৃত যে উত্তর আমেরিকার আরেক শক্তিশালী দেশ কানাডার সাফল্য যেন ছায়াচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে। অথচ কানাডার অর্থনীতি বরাবরই এক সুসংগঠিত, ভালোভাবে চলমান এক “ইঞ্জিন” হিসেবে পরিচিত ছিল। জি-সেভেন (G7) অন্তর্ভুক্ত বেশিরভাগ দেশের তুলনায় কানাডার জিডিপি (GDP) বরাবরই তুলনামূলক দ্রুত হারে বেড়েছে। তাছাড়া ২০২০ সালের মহামারিজনিত সংকটের সময় অন্যান্য দেশের তুলনায় কানাডা তুলনামূলক দ্রুত ঘুরে দাঁড়াতে সক্ষম হয়েছিল।

এই সাফল্যের পেছনে কী আছে? অনেকে হয়তো বলবেন, এর কৃতিত্ব কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর (Justin Trudeau) সরকারের নীতিমালার। আবার কেউ হয়তো বলবেন, এর পেছনে রয়েছে কানাডার ঐতিহাসিকভাবে শক্তিশালী অর্থনৈতিক কাঠামো। আসলে সত্যটা হলো—কানাডায় প্রগতিশীল (Progressive) বা রক্ষণশীল (Conservative) যেই দলই ক্ষমতায় থাকুক না কেন, বিগত কয়েক দশক ধরে বিশ্বের অন্যান্য দেশের অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাব কানাডার ওপর তুলনামূলক কম পড়েছে। ২০০৮ সালের বিশ্বমন্দার (Global Financial Crisis) সময়ও দেখা গেছে, কানাডার জিডিপি অন্য জি-সেভেন দেশের তুলনায় অনেক কম মাত্রায় কমে গেছে।

কিন্তু বর্তমানে পরিস্থিতি অনেকটা বদলে গেছে। এখন যদি আপনি কোনো কানাডিয়ানের সঙ্গে আলাপ করেন এবং বলেন—“কানাডা এখনো বিশ্বের অন্যতম সমৃদ্ধশালী (Prosperous) দেশ,”—তবে হয়তো সেই ব্যক্তি আপনার মুখের ওপর হেসে ফেলবেন। কারণ, মাথাপিছু সম্পদ (Wealth per person) গত কয়েক বছর ধরে স্থবির হয়ে আছে, এমনকি সাম্প্রতিক সময়ে এর প্রকৃত প্রবৃদ্ধি (Real GDP per capita growth) ঋণাত্মক হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২০২৩ সালে, ২০২২ সালের তুলনায় কানাডার প্রকৃত জিডিপি পার ক্যাপিটা (Real GDP per capita) প্রায় ২% কমে গেছে, যা স্পষ্টত একপ্রকার মন্দার (Recession) ইঙ্গিত দেয়।

অর্থাৎ প্রশ্ন স্পষ্ট: কেন কানাডার অর্থনীতি পতনের দিকে যাচ্ছে? কী বদলে গেছে? এবং এর ভবিষ্যৎ কী?

কানাডার অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও বর্তমান বাস্তবতা

অনেক বছর ধরে কানাডার অর্থনীতি “যেন রকেটের মতো উঠে চলা”—এমন ভাবমূর্তি পোষণ করে এসেছে। কিন্তু কেন হঠাৎ এমন মন্থরতা? এর পেছনে আছে কানাডার মাথাপিছু উৎপাদন (Per capita production) এবং উৎপাদনশীলতার (Productivity) দীর্ঘমেয়াদি সমস্যাগুলো। গত এক দশকে কানাডার মাথাপিছু উৎপাদন বেশ কয়েকটি বড় অর্থনীতির চেয়ে খারাপ পারফর্ম করেছে। এমনকি যুক্তরাজ্যের (United Kingdom) মতো “সমস্যায় জর্জরিত” অর্থনীতির থেকেও কিছু সময়ে পিছিয়ে পড়েছে।

যেখানে সামষ্টিক জিডিপি (Aggregate GDP) এক ধরণের প্রবৃদ্ধি দেখিয়েছে, সেখানে মাথাপিছু আয় বা উৎপাদনে আশানুরূপ উন্নতি হয়নি। ফলে সাধারণ কানাডিয়ানদের মধ্যে ক্রয়ক্ষমতা (Purchasing power) এবং জীবনমান (Standard of living) রীতিমতো ঝিমিয়ে পড়েছে।

জনসংখ্যা বৃদ্ধি বনাম উৎপাদনশীলতা (Population Growth vs. Productivity)

কানাডা দীর্ঘদিন ধরে অভিবাসীদের (Immigrants) জন্য এক স্বাগত-উন্মুক্ত দেশ হিসেবেই পরিচিত। ২০১৪ সালেই কানাডা প্রায় দুই লক্ষ পঞ্চাশ হাজারের বেশি মানুষকে স্থায়ীভাবে গ্রহণ করেছিল। ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের (World Bank) তথ্য অনুসারে, ২০১৫ সালে কানাডায় বসবাসরত প্রতি পাঁচজন মানুষের মধ্যে একজন ছিলেন অন্য দেশে জন্মগ্রহণকারী।

প্রথমেই আমাদের মনে হতে পারে, এত বিপুল সংখ্যক অভিবাসীর আগমন বুঝি দেশের অর্থনীতির ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে। তবে সিঙ্গাপুর (Singapore) বা হংকং (Hong Kong)-এর মতো উদাহরণগুলো বলে যে, স্রেফ অভিবাসী প্রবেশই অর্থনীতিকে ধ্বংস করে না; বরং সঠিকভাবে ব্যবস্থাপনা করতে পারলে বিদেশি জনশক্তি GDP বৃদ্ধি ত্বরান্বিতও করতে পারে।

কানাডার ক্ষেত্রে সমস্যা হলো, ইতিবাচকভাবে অভিবাসী প্রবেশ ঘটলেও, অভ্যন্তরীণ উৎপাদনশীলতা বা প্রযুক্তিগত উন্নতি (Technological advancement) সে অনুপাতে বাড়েনি। ফলে সামগ্রিক জিডিপি বাড়লেও, তা মাথাপিছু আয়ের উন্নতি বা অর্থনৈতিক মূল্যসংযোজন (Value addition) বাড়ানোর ক্ষেত্রে তেমন কার্যকর হচ্ছে না।

উৎপাদনশীলতার ক্রমধারা ও ১৯৮০–পরবর্তী বদল

অনেক অর্থনীতিবিদ ইঙ্গিত দেন যে, ১৯৮০ সালের পর থেকে কানাডার উৎপাদনশীলতার ধারা (Productivity trajectory) নিম্নমুখী হতে থাকে। অথচ ১৯৮০ সালের আগ পর্যন্ত কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে উৎপাদনশীলতার ক্ষেত্রে বেশি ফারাক ছিল না। প্রশ্ন জাগে, ঠিক কী ঘটেছিল ১৯৮০’র দশক থেকে, যার ফলে কানাডার উৎপাদনশীলতা স্থবির হতে থাকে?

আধুনিক অর্থনীতিতে উচ্চ উৎপাদনশীলতার অন্যতম প্রধান শর্ত হলো “পুঁজি সঞ্চয় ও বিনিয়োগ (Capital accumulation and investment)”—যার মাধ্যমে কলকারখানা, যন্ত্রপাতি, নেটওয়ার্ক অবকাঠামো (Network infrastructure), গবেষণা ও উন্নয়ন (Research and Development) ইত্যাদিতে টেকসই বিনিয়োগ করা হয়। এসব বিনিয়োগের মাধ্যমে শ্রমিকদের দক্ষতা বেড়ে যায়, উৎপাদন বাড়ে এবং মাথাপিছু আয়ও বৃদ্ধি পায়।

কিন্তু কানাডায় সাম্প্রতিক সময়ে বিনিয়োগের (Investment) অবস্থা খুব একটা ভালো নয়। দেশটির প্রাইভেট সেক্টর (Private sector), বিশেষ করে উদ্যোক্তা (Entrepreneurs) ও ব্যবসা-বাণিজ্যের (Business investment) ক্ষেত্রে উদ্যম আশানুরূপ নয়। বিদেশি বিনিয়োগের (Foreign investment) ক্ষেত্রেও এই প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়।

বিনিয়োগ সংকট ও এর কারণ

বেসরকারি বিনিয়োগের ঘাটতি (Lack of private investment): উন্নত অর্থনীতির দেশগুলোর মধ্যে কানাডার ব্যবসা খাত তুলনামূলকভাবে ছোট এবং বিনিয়োগে “সাবধানী”। ব্যক্তিগত বিনিয়োগ ৫০ শতাংশের নিচে থেকে গেছে, যা অন্য অনেক উন্নত দেশের তুলনায় কম। ফলস্বরূপ, দীর্ঘমেয়াদি মূলধনি পণ্য (Capital goods) কেনা, প্রযুক্তি খাতে (Technology sector) বিনিয়োগ করা কিংবা পণ্যে নতুনত্ব আনার কাজ পর্যাপ্ত হারে হচ্ছে না।

বিদেশি বিনিয়োগের পতন (Decline in foreign capital inflow): অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগের মত বিদেশি বিনিয়োগও (Foreign capital inflow) কমতির দিকে। ২০১৬ সাল থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত কানাডায় বিদেশি বিনিয়োগ থেকে প্রায় ২২৫ বিলিয়ন (Billion) ডলারের ঘাটতি হয়েছে বলে কিছু প্রতিবেদনে উল্লেখ আছে। ২০০০ সালের দিকে যেখানে জিডিপি’র ৯% এর বেশি বাইরে থেকে বিনিয়োগ আসত, এখন তা ৩%-এর নিচে নেমে গেছে। এ ধরনের পতন এককথায় উদ্বেগজনক।

অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণ (Overregulation) ও ব্যুরোক্রেসি

রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ (State interventionism): অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণ (Overregulation) যে কোনো অর্থনীতির জন্য একটি বড় অন্তরায়। কানাডার ক্ষেত্রে এটি আরও বেশি প্রকট। একদিক থেকে দেখলে, বিধিনিষেধ কিছুটা থাকা ভালো—কিন্তু মাত্রাতিরিক্ত নিয়মকানুন কার্যত একটি অর্থনীতিকে শ্বাসরুদ্ধ করে ফেলে।

বিদেশি বিনিয়োগে প্রতিবন্ধকতা (Restrictiveness toward foreign investment): কানাডা বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে দুনিয়ার মধ্যে অন্যতম “বন্ধ” (Closed) দেশ। বিশ্বের ওইসিডি (OECD) ভুক্ত দেশগুলোর গড়ের তুলনায় কানাডায় কয়েকগুণ বেশি বিধিনিষেধ আরোপিত আছে। পেপারওয়ার্ক (Paperwork), লাইসেন্স (License), ফি (Fees), পারমিট (Permits), সর্বত্র করের (Taxes) জটিলতা—এমন এক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে যে কেউ সহজে এখানে বিনিয়োগ করতে ভয় পায়। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে দুগ্ধ (Dairy) ও পোল্ট্রি (Poultry) পণ্যের সাপ্লাই ম্যানেজমেন্ট (Supply Management) ব্যবস্থা। এই ব্যবস্থায় কৃষকদের জন্য নির্ধারিত কোটা (Quota) রয়েছে, যা নির্দিষ্ট পরিমাণের বেশি পণ্য উৎপাদন করতে দেয় না। ফলে বাজারে প্রতিযোগিতা কমে যায়, দাম চড়া থাকে এবং ভোক্তারা কম মূল্যে কেনার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়। একই সঙ্গে বিদেশি পণ্যের আমদানিতেও কড়াকড়ি থাকে, যা মুক্তবাজারের (Free market) মূলনীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

প্রদেশগুলোর মধ্যে বাণিজ্যবাধা (Interprovincial trade barriers): আইএমএফ (IMF) এর গবেষণা বলছে, কানাডার বিভিন্ন প্রদেশের (Provinces) মধ্যে যে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা (Bureaucratic complexity) বিরাজ করছে, তাতে দেশটির অভ্যন্তরীণ বাজার প্রায় ২০ শতাংশ শুল্ক দেয়ার মতো বাধার সম্মুখীন হচ্ছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের মাঝেও যে মাত্রার অভ্যন্তরীণ মুক্ত বাণিজ্য আছে, কানাডার প্রদেশগুলোর মধ্যে সেটুকুও সুষ্ঠুভাবে নেই।

অপর্যাপ্ত গবেষণা ও উন্নয়ন, শিল্পখাতের সংকোচন, উচ্চ কর ও কঠোরতা, এবং মেধাপাচার

গবেষণা ও উন্নয়নে (Research and Development) কম ব্যয়: উন্নত অর্থনীতির দেশগুলোর মধ্যে কানাডা গবেষণা ও উন্নয়নে সবচেয়ে কম ব্যয়কারী দেশগুলোর একটি। জি-সেভেনের মধ্যে ইতালির (Italy) পরেই কানাডার অবস্থান। আধুনিক বিশ্বের প্রতিযোগিতামূলক প্রযুক্তির দুনিয়ায় গবেষণা ও উন্নয়নে ব্যয় কম হলে উচ্চমূল্য সংযোজন (High value addition) বা উচ্চ-প্রযুক্তি পণ্যের (High-tech products) দিকে এগিয়ে যাওয়া কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায়।

শিল্পখাতের সংকোচন (Shrinkage of manufacturing sector): ২০০০-এর দশকের শুরু থেকে শুরু হওয়া এক প্রক্রিয়ায় কানাডার ম্যানুফ্যাকচারিং (Manufacturing) খাত ক্রমশ ছোট হয়ে এসেছে। শিল্পউৎপাদন দেশের জিডিপির ১০%-এরও কমে নেমে এসেছে, যেখানে ২০ বছর আগে তা ১৭%-এর কাছাকাছি ছিল। আধুনিক অর্থনীতিতে উৎপাদন খাত (Manufacturing sector) একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ; কারণ এখানে ব্যাপক কর্মসংস্থান, দক্ষতা উন্নয়ন ও রফতানিযোগ্য পণ্যের সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু বিনিয়োগ ও উদ্ভাবনে দুর্বলতার কারণে কানাডা এই খাত সঠিকভাবে টিকিয়ে রাখতে পারছে না।

কর ও নিয়মকানুনে উচ্চমাত্রার কঠোরতা (High Tax and Regulatory Burden): প্রশ্ন আসে—কানাডিয়ান উদ্যোক্তারা (Entrepreneurs) কেন উঁচুমূল্যের প্রযুক্তি (High-tech) বা অত্যাধুনিক খাতগুলোতে (Cutting-edge sectors) বিনিয়োগে উৎসাহী নন? কারণ, কঠোর নিয়মকানুন ও করের বোঝা (Tax burden) তাদের বেশিরভাগ মুনাফাই (Profit) কেড়ে নেয়। পণ্য বা সেবা বের করার আগে নানা ধরণের অনুমোদন (Approvals) ও খরচের কারণে বিনিয়োগ ঝুঁকি (Risk) বাড়ে। ফলে সেই ঝুঁকি নিতে অনেকেই ভয় পান। একই সঙ্গে, উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগের বদলে অপেক্ষাকৃত কম উদ্ভাবনী (Less innovative) কিন্তু নিরাপদ বাজারে (Safe market) বিনিয়োগের প্রবণতা দেখা যায়। যেমন, আবাসন খাত বা নির্দিষ্ট সেবাখাতে (Services) যেখানে সরকারের নিয়ন্ত্রণ অপেক্ষাকৃত বেশি, কিন্তু প্রতিযোগিতা অপেক্ষাকৃত কম। ফলস্বরূপ, কানাডা উচ্চ-প্রযুক্তির রপ্তানি (High-tech export) বৃদ্ধিতে পিছিয়ে গেছে। ২০০৮ সালের আর্থিক সংকট (Financial crisis) পরবর্তী সময়ে সরকারের নিয়ন্ত্রণ আরও শক্ত হওয়ায় অবস্থার উন্নতি হয়নি, বরং অবনতিই হয়েছে।

মেধাপচার (Brain Drain) সমস্যা: অতিরিক্ত রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ (Excessive state intervention) আর নিয়ন্ত্রণের (Regulation) পাশাপাশি আরেকটি বড় অন্তরায় হলো মেধাপচার (Brain drain)। কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রের ভৌগোলিক অবস্থান এতটাই কাছাকাছি যে উচ্চ দক্ষতাসম্পন্ন পেশাজীবীরা (Highly skilled professionals) অনেক সহজেই সীমান্ত পেরিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে যেতে পারেন। সেখানে বেতন (Salary) তুলনামূলক অনেক বেশি, কর্মক্ষেত্রে উন্নতির সুযোগ (Promotion opportunities) বেশি, এমনকি অনেক অঙ্গরাজ্যে করের হার (Tax rate) কানাডার তুলনায় কম। ফলে কানাডায় প্রতিনিয়ত যে চিকিৎসক, প্রকৌশলী, তথ্যপ্রযুক্তিবিদ বা অন্যান্য উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন পেশাজীবী তৈরি হচ্ছে, তাদের একটি বড় অংশ যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমাচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে, সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, কেবল ১০,৪১৫ জন আমেরিকান (American) কানাডায় এসেছেন স্থায়ীভাবে বসবাসে, অথচ ১,২৬,৫৪০ জনের বেশি কানাডিয়ানই যুক্তরাষ্ট্রে স্থানান্তরিত হয়েছেন। ফলে কানাডিয়ান কোম্পানিগুলো সবচেয়ে মেধাবী ও দক্ষ জনশক্তি ধরে রাখতে পারছে না। এতে দেশের উদ্ভাবনী খাত দুর্বল হয়ে পড়েছে, আর সামগ্রিক অর্থনীতির সক্ষমতা (Overall economic capacity) স্থবির হয়ে আছে।

সবমিলিয়ে দেখা যাচ্ছে, কানাডার অর্থনৈতিক সমস্যার মূল মানদণ্ডগুলোর মধ্যে রয়েছে—

  1. নিম্ন বিনিয়োগ (Low investment)
  2. অতিরিক্ত সরকারি নিয়ন্ত্রণ (Excessive regulation)
  3. উন্নয়ন গবেষণায় কম বরাদ্দ (Low R&D spending)
  4. বাণিজ্যিক উদ্ভাবনের অভাব (Lack of commercial innovation)
  5. প্রতিযোগী বাজারের অনুপস্থিতি (Absence of competitive market in some key sectors)
  6. মেধাপচার (Brain drain) ও দক্ষ জনশক্তির অভাব (Shortage of skilled professionals)

অভিবাসনের কারণে সামষ্টিক (Aggregate) অর্থনীতি কিছুটা বাড়লেও, প্রতিটি নাগরিকের আয় বা জীবনমান এক জায়গায় আটকে আছে। উৎপাদনশীলতা বাড়াতে ব্যর্থ হওয়ায় দেশের সামগ্রিক প্রবৃদ্ধি ঝুঁকির মুখে। গড়ে মাথাপিছু জিডিপি (GDP per capita) কমার অর্থ হলো, বেশিরভাগ মানুষের প্রকৃত ক্রয়ক্ষমতা বা আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য (Financial comfort) কমছে।

ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা ও করণীয়

এই সঙ্কট কাটিয়ে ওঠার জন্য কানাডার নীতি-নির্ধারকদের (Policymakers) বেশ কিছু বিষয়ে উদ্যোগ নিতে হবে:

  1. নিয়ন্ত্রণ হ্রাস ও বাজার উন্মুক্তকরণ (Regulatory reform and market liberalization)
    • অপ্রয়োজনীয় লাইসেন্স ফি, আমলাতান্ত্রিক বাধা ইত্যাদি কমানো প্রয়োজন।
    • ডেয়ারি ও পোল্ট্রি কোটা সিস্টেমের মতো সাপ্লাই ম্যানেজমেন্টে (Supply Management) সংস্কার আনতে হবে, যাতে বাজারে অধিক প্রতিযোগিতা আসে।
    • প্রদেশগুলোর মধ্যে আন্তঃবাণিজ্য সহজীকরণ করে একটি অভ্যন্তরীণ মুক্তবাজার (Internal free market) তৈরি করতে হবে।
  2. কর কাঠামোর সংস্কার (Tax reforms)
    • করের হার (Tax rate) ও প্রক্রিয়া আরও সহজসাধ্য ও প্রতিযোগিতামূলক (Competitive) করতে হবে, যাতে দেশীয় ও বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা যায়।
    • ব্যবসায়িক মুনাফা (Business profit) বা উৎপাদন খাতের (Manufacturing) আয় থেকে বেশি কর কেটে রাখলে বিনিয়োগ কমে যাবে, তাই এখানে ভারসাম্য রক্ষা জরুরি।
  3. গবেষণা ও উন্নয়নে গুরুত্ব বৃদ্ধি (Boosting R&D)
    • সরকার ও বেসরকারি খাত উভয়কেই গবেষণা ও উন্নয়নে (Research and Development) বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।
    • উচ্চ-প্রযুক্তি (High-tech) শিল্প ও স্টার্টআপ (Startup) গুলোকে আর্থিক প্রণোদনা ও ভর্তুকি (Subsidy) দিলে উদ্ভাবন বাড়তে পারে।
  4. মেধাপচার রোধ ও দক্ষতা উন্নয়ন (Retaining talent and upskilling)
    • উচ্চ দক্ষতাসম্পন্ন পেশাজীবীদের দেশে ধরে রাখতে আর্থিক বা অন্যান্য সুযোগসুবিধা (Financial and professional incentives) বাড়াতে হবে।
    • কর কাঠামো ও চাকরির সুযোগ এমন হতে হবে, যাতে তারা সহজে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি না জমান।
    • অভিবাসী শ্রমশক্তিকেও (Immigrant workforce) সঠিক প্রশিক্ষণ ও কারিগরি শিক্ষার সুযোগ দিতে হবে, যাতে তারা দ্রুত উৎপাদনশীল খাতে অবদান রাখতে পারে।
  5. বহুমুখী অর্থনীতির দিকে প্রত্যাবর্তন (Diversifying and reviving manufacturing & high-value sectors)
    • তেল ও গ্যাসের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতাকে কমিয়ে প্রযুক্তি, স্বাস্থ্যসেবা (Healthcare), ও পরিবেশবান্ধব শিল্প (Green industry) ইত্যাদিতে বিনিয়োগ বাড়ানো দরকার।
    • নগর ও আঞ্চলিক প্ল্যানিং (Urban and regional planning) এমনভাবে সাজাতে হবে, যাতে শিল্পবিকাশ সম্ভব হয়।

কানাডার পুনরুত্থানের সম্ভাবনা (Possibility of Canada’s Comeback)

অনেকেই প্রশ্ন করেন—“কানাডা কি আবার ১৯৮০’র দশকের আগের মত উদীয়মান ও উচ্চ উৎপাদনশীলতার দেশে পরিণত হতে পারবে?” অর্থনীতিবিদদের মতে, যদি সঠিক নীতিমালা (Policies) গ্রহণ করা হয়, তবে তা সম্ভব। কেননা কানাডায় প্রাকৃতিক সম্পদের (Natural resources) প্রাচুর্য আছে, শিক্ষিত জনসংখ্যা (Educated population) আছে, অবকাঠামো (Infrastructure) মোটামুটি ভালো।

সমস্যা হলো, সরকার ও ব্যবসায়ী সমাজের মধ্যে সমন্বয়হীনতা (Lack of coordination) এবং অতি-কেন্দ্রিক (Over-centralized) নিয়ন্ত্রণ। এসব জটিলতা কাটিয়ে উঠতে পারলে অন্তত মাথাপিছু আয় ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির পথ সুগম হবে।

গ্রীনল্যান্ড: আর্কটিক অঞ্চলে উত্তেজনা ও লুকানো সম্পদের সন্ধান (৭ জুলাই, ২০২২)

ভূমিকা: রহস্যে ঘেরা গ্রীনল্যান্ড

গ্রীনল্যান্ড (Greenland) বিশ্বের বৃহত্তম, সবচেয়ে আকর্ষণীয় এবং সবচেয়ে রহস্যময় দ্বীপ। ফ্রান্সের চেয়ে তিনগুণেরও বেশি বড় এই দ্বীপটি ৩০০ বছরের বেশি সময় ধরে ডেনমার্ক রাজ্যের অংশ। তাত্ত্বিকভাবে, এটি ডেনমার্ককে একটি আন্তঃমহাদেশীয় দেশে পরিণত করেছে, যা বিশ্বের দ্বাদশতম বৃহত্তম দেশ এবং রাশিয়া ব্যতীত ইউরোপের রাজধানী শহরগুলোর মধ্যে বৃহত্তম।

ইউরোপীয় মহাদেশের উপরে রাখলে গ্রীনল্যান্ডের বিশাল আকার আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে, যা পর্তুগাল থেকে পোল্যান্ড পর্যন্ত প্রায় পুরো এলাকা জুড়ে বিস্তৃত। এত বিশাল আয়তনের পরেও এই বৃহত্তম দ্বীপে মাত্র ৫৬,০০০ মানুষের বসবাস, যা স্পেন এবং ফ্রান্সের মাঝে অবস্থিত ক্ষুদ্র রাষ্ট্র অ্যান্ডোরার (Andorra) জনসংখ্যার চেয়েও কম। এই ৫৬,০০০ গ্রীনল্যান্ডবাসীর প্রায় এক-তৃতীয়াংশই দ্বীপের রাজধানী নুউক (Nuuk) শহরে বসবাস করে।

অবশ্য, এই বিশাল ভূখণ্ডে এত কম সংখ্যক মানুষের বসবাসের প্রধান কারণ হল এর বিশাল অংশ, অন্তত আপাতত, বসবাসের অযোগ্য। দ্বীপের দুই-তৃতীয়াংশ উত্তরে সুদূর আর্কটিক বৃত্তের (Arctic Circle) উপরে প্রসারিত। এই অঞ্চলে সূর্যের আলো অন্যান্য জায়গার তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে কম তীব্রতায় পৌঁছায়। কারণ সূর্যের রশ্মিগুলোকে বায়ুমণ্ডলের মধ্য দিয়ে দীর্ঘ পথ অতিক্রম করতে হয়। এর মানে হল, বিষুবরেখার (equator) কাছাকাছি অবস্থানের তুলনায় এখানে সৌর বিকিরণ কম ঘনীভূত এবং অনেক বড় পৃষ্ঠজুড়ে ছড়িয়ে থাকে। মূলত, এর মানে হল এই গ্রহের এই অংশটি গড় থেকে অনেক বেশি ঠান্ডা।

তবে, উষ্ণ সমুদ্র স্রোত উপসাগরীয় স্রোতের (Gulf Stream) প্রভাবের কারণে (যা মেক্সিকো উপসাগর (Gulf of Mexico) থেকে উত্তর দিকে প্রবাহিত হয়ে উত্তর আটলান্টিক (North Atlantic) পাড়ি দিয়ে ইউরোপের দিকে যায়) গ্রীনল্যান্ডের আবহাওয়া এখানকার অক্ষাংশের তুলনায় অনেক বেশি সহনীয়। রাজধানী এবং বৃহত্তম শহর নুউকের গড় শীতকালীন তাপমাত্রা এখনও মাইনাস নয় ডিগ্রি সেলসিয়াস। কানাডার (Canada) নুনাভুটের (Nunavut) ইকালুইট (Iqaluit) শহরটি প্রায় একই অক্ষাংশে অবস্থিত, তবে উপসাগরীয় স্রোতের উষ্ণতা সৃষ্টিকারী প্রভাব থেকে দূরে থাকার কারণে এখানকার গড় শীতকালীন তাপমাত্রা মাইনাস ২৭ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি এবং তাই গড় হিসেবে নুউকের চেয়ে উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি ঠান্ডা।

তবে, গ্রীনল্যান্ড দ্বীপ সম্পর্কে সবচেয়ে বড় এবং সবচেয়ে রহস্যময় জিনিসটি হল এর বিশাল বরফের চাদর (ice sheet) এবং এর ঠিক নিচে লুকানো অজানা বিস্ময় ও আবিষ্কারগুলো, যা আমাদের দৃষ্টির বাইরে রয়ে গেছে। এটি আমাদের বিশ্বের অন্যতম প্রাকৃতিক বিস্ময়।

গ্রীনল্যান্ডের সুবিশাল বরফের চাদর

এই প্রাচীন বরফের চাদর গ্রীনল্যান্ডের প্রায় ৮০ শতাংশ এলাকা জুড়ে বিস্তৃত এবং এটি প্রায় আলাস্কার (Alaska) আকারের সমান। এর ফলে এটি অ্যান্টার্কটিকার (Antarctica) বিপরীত দিকে অবস্থিত বরফের চাদরের পরে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম বরফের স্তূপ। গ্রীনল্যান্ডে এই বিশাল বরফের স্তূপের গড় পুরুত্ব ১.৫ কিলোমিটার, যেখানে কিছু জায়গায় এটি তিন কিলোমিটার পর্যন্ত পুরু, যা যুগের পর যুগ ধরে জমে থাকা কঠিন বরফ ছাড়া আর কিছুই নয়। সব মিলিয়ে গ্রীনল্যান্ডে প্রায় ২৮,৫০,০০০ ঘনকিলোমিটার বরফ রয়েছে, যার ওজন প্রায় ২.৮৫ কোয়াড্রিলিয়ন মেট্রিক টন, যা আমাদের বোঝার ক্ষমতার বাইরে এক বিশাল পরিমাণ ভর।

পৃষ্ঠের উপরে থাকা সমস্ত বরফের বিশাল ওজনের কারণে দ্বীপের ভেতরের দিকের বেশিরভাগ অন্তর্নিহিত শিলাস্তর সমুদ্রপৃষ্ঠের নিচে চলে গেছে। তবে দ্বীপের চারপাশে অনেক পর্বতমালা থাকার কারণে বরফের চাদরটি মূলত ভৌগোলিকভাবে একটি বিশাল বাটির মতো আবদ্ধ। তাই দ্বীপের উপকূলরেখাগুলো মূলত এই বরফের চাদর এবং এর মারাত্মক ঠান্ডা তাপমাত্রা থেকে মুক্ত। স্বাভাবিকভাবেই, এই কারণেই হাজার হাজার বছর ধরে মানুষের কার্যকলাপ মূলত উপকূলরেখার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল।

বিজ্ঞানী কর্তৃক বরফের চাদর থেকে ড্রিল করে বের করা বরফের কোরগুলো (ice cores) প্রকাশ করেছে যে কোনো না কোনো রূপে একটি বরফের চাদর গত ১৮ মিলিয়ন বছর ধরে গ্রীনল্যান্ডের উল্লেখযোগ্য অংশকে ঢেকে রেখেছে। অন্যদিকে, আজকের দ্বীপের সবচেয়ে পুরনো বরফের বয়স প্রায় এক মিলিয়ন বছর। মানব ইতিহাসের প্রায় পুরোটা জুড়েই এই দ্বীপের বিশাল অংশ বরফের দুর্ভেদ্য প্রাচীরের নিচে সিল করা ছিল এবং এর নিচে আবদ্ধ রহস্যগুলো সম্প্রতি উন্মোচিত হতে শুরু করেছে।

উদাহরণস্বরূপ, ১৯৬৬ সালে বিজ্ঞানীদের দ্বারা ড্রিল করে বের করা বরফের কোরগুলো এমন পললের উপস্থিতি প্রকাশ করেছিল যা ইঙ্গিত দেয় গ্রীনল্যান্ড একসময় প্রায় সম্পূর্ণ বরফমুক্ত ছিল এবং গত এক মিলিয়ন বছরে অন্তত একবার গাছপালা সেখানে জন্মেছিল, যা একটি বিশাল ধাক্কা ছিল। ভূতাত্ত্বিকভাবে (geologically) বলতে গেলে, সেটি খুব বেশি আগের ঘটনা নয়। এটি ইঙ্গিত দেয় যে দ্বীপটি প্রাথমিকভাবে বেশিরভাগ মানুষের ধারণার চেয়ে উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি ভঙ্গুর এবং জলবায়ু পরিবর্তনের (climate change) জন্য সংবেদনশীল।

আজ, গ্রীনল্যান্ডের একমাত্র ছোট বনভূমিটি দ্বীপের একেবারে দক্ষিণে কিনগুয়া উপত্যকায় (Qinngua Valley) অবস্থিত। এই স্থানে গ্রীষ্মের তাপমাত্রা গাছপালা বাঁচিয়ে রাখার জন্য যথেষ্ট বেশি। এখানে ১,৫০০ মিটার উঁচু পর্বতমালা প্রায় চারপাশ থেকে ঘিরে রেখেছে, যা উত্তরের দিকে সামান্য দূরে বরফের চাদরের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ঠান্ডা এবং দ্রুত বাতাস থেকে এটিকে রক্ষা করে। তবে ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এই সামান্য গাছপালা ও বনভূমি ছাড়া বাকি অংশে শুধুই বরফ, পাথর, গুল্ম এবং বিক্ষিপ্তভাবে কিছু মানুষ ও প্রাণীর বসতি দেখা যায়।

তবে ভবিষ্যতে দক্ষিণের এই ক্ষুদ্র প্রাকৃতিক স্থানটি দ্বীপের বাকি অংশে জীবনের বিস্তারের উৎস হতে পারে, কারণ এর বেশিরভাগ অংশ জুড়ে থাকা বিশাল বরফের চাদর ভালো এবং খারাপ উভয় কারণেই বর্তমানে গলতে শুরু করেছে।

বরফের গলে যাওয়া ও এর ফল

নাসার জেট প্রপালশন ল্যাবরেটরির (NASA’s Jet Propulsion Laboratory) গবেষকরা ২০০৬ সালেই রিপোর্ট করেছিলেন যে গ্রীনল্যান্ডের বরফের চাদর এবং হিমবাহগুলো বছরে প্রায় ২১৭ ঘনকিলোমিটার হারে গলছে, যা ২০০১ সালের পাঁচ বছর আগের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ দ্রুত। বিশ্বজুড়ে জলবায়ু ক্রমাগত উষ্ণ হওয়ার সাথে সাথে আর্কটিক অঞ্চলের চেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত আর কোনো স্থান নেই, যেখানে তাপমাত্রা বিশ্ব গড়ের প্রায় দ্বিগুণ হারে বাড়ছে। দ্বীপের দুই-তৃতীয়াংশ আর্কটিক বৃত্তের উপরে বিস্তৃত এবং স্থানীয় গড় তাপমাত্রায় ৩ থেকে ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধির পূর্বাভাস থাকায় গ্রীনল্যান্ডের বরফের চাদর অন্যান্য স্থানের তুলনায় এই উষ্ণতা সৃষ্টিকারী প্রভাবগুলোর জন্য উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি সংবেদনশীল।

বর্তমানে, অনুমান করা হয়েছে যে দ্বীপটি প্রতি বছর প্রায় ২০০ বিলিয়ন মেট্রিক টন বরফ হারাচ্ছে এবং গবেষণা দেখিয়েছে যে এর ফলে এই শতাব্দীর শেষ নাগাদ বিশ্বব্যাপী সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা প্রায় ৩০ সেন্টিমিটার বাড়তে পারে। যদি এই হারে বরফ গলা অব্যাহত থাকে বা বর্তমান প্রবণতা অনুসারে বৃদ্ধি পায়, তবে দ্বীপের পুরো ২৮,৫০,০০০ ঘনকিলোমিটার বরফ কয়েক শতাব্দীর মধ্যেই সম্পূর্ণরূপে গলে যেতে পারে, যা ভূতাত্ত্বিক সময়ের (geological time) বিচারে চোখের পলক ফেলার মতো একটি সময়, যেখানে সাধারণত লক্ষ লক্ষ বছর লেগে যায়।

যদি এমনটা ঘটে, তবে গ্রীনল্যান্ডের বরফের চাদর বিশ্বের মহাসাগরে যে পরিমাণ জল যোগ করবে তা মেক্সিকো উপসাগরের সম্পূর্ণ জলের পরিমাণের চেয়েও বেশি হবে, যার ফলে বিশ্বব্যাপী সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা প্রায় সাত মিটার বাড়বে। এর ফলস্বরূপ আজকের বিশ্বের প্রায় প্রতিটি প্রধান উপকূলীয় শহর ডুবে যাবে এবং পুরো গ্রহের ভূগোল গভীরভাবে পরিবর্তিত হবে। ফ্লোরিডা (Florida) এবং দক্ষিণ লুইসিয়ানা (Louisiana) মায়ামি (Miami) এবং নিউ অরলিন্সের (New Orleans) মতো প্রধান শহরগুলো সহ সমুদ্রের নীচে তলিয়ে যাবে। সান ফ্রান্সিসকো উপসাগর (San Francisco Bay) নাটকীয়ভাবে প্রসারিত হয়ে ক্যালিফোর্নিয়ার (California) সেন্ট্রাল ভ্যালির (Central Valley) বেশিরভাগ অংশ প্লাবিত করবে, যার মধ্যে স্যাক্রামেন্টো (Sacramento) এবং স্টকটনের (Stockton) মতো শহরগুলোও অন্তর্ভুক্ত থাকবে। বাহামার (Bahamas) একটি বড় অংশ সম্পূর্ণরূপে নিমজ্জিত হবে। উত্তর-পশ্চিম ইউরোপের নিচু এলাকা যেমন নেদারল্যান্ডস (Netherlands), বেলজিয়াম (Belgium) এবং উত্তর-পশ্চিম জার্মানি (Germany) ইতালির পো উপত্যকার (Po Valley) উল্লেখযোগ্য এলাকা, ভেনিস (Venice) এবং মিশরের (Egypt) নিম্নভূমি নীলনদের বদ্বীপ (Nile Delta), মিশরের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর আলেকজান্দ্রিয়া (Alexandria) সহ মারাত্মকভাবে প্লাবিত হবে।

দক্ষিণ ইরাকের (Iraq) একটি বড় অংশ, বাংলাদেশ (Bangladesh) এবং ভারতের (India) পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বেশিরভাগ অংশ (যা বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল স্থানগুলোর মধ্যে অন্যতম) ডুবে যাবে। ভিয়েতনামের (Vietnam) নিম্ন মেকং বদ্বীপের (Lower Mekong Delta) একটি বড় অংশ, যার মধ্যে হো চি মিন সিটিও (Ho Chi Minh city) রয়েছে, সম্পূর্ণরূপে প্লাবিত হবে। এছাড়াও পূর্ব চীনের (China) উল্লেখযোগ্য নিচু এলাকা, যার মধ্যে সাংহাই (Shanghai) এবং তিয়ানজিনের (Tianjin) মতো প্রধান বিশ্ব শহরগুলোও রয়েছে, সেগুলোও প্লাবিত হবে।

সংক্ষেপে বলতে গেলে, গ্রীনল্যান্ডের বরফের চাদর যদি কয়েক শতাব্দীর মধ্যে সম্পূর্ণরূপে গলে যায়, তবে এটি বিশ্বজুড়ে বসবাস করা কোটি কোটি মানুষের বাড়িঘর ধীরে ধীরে প্লাবিত করবে এবং আধুনিক মানব সমাজের জন্য একেবারে বিপর্যয়কর প্রমাণিত হবে। হঠাৎ করে এত বিশাল পরিমাণের মিষ্টি জল লবণাক্ত সমুদ্রে যুক্ত হওয়ার কারণে এটি উপসাগরীয় স্রোতের সঞ্চালন পদ্ধতিতে নাটকীয়ভাবে ব্যাঘাত ঘটাতে পারে, যা বর্তমানে ইউরোপে উষ্ণতা নিয়ে আসে এবং অনেকটা বিপরীতভাবে ইউরোপকে আজকের চেয়ে ঠান্ডা মহাদেশে পরিণত করতে পারে।

তবে একই সময়ে গ্রীনল্যান্ডের সমস্ত বরফ অপসারণের ফলে পৃথিবীর অন্যতম বৃহত্তম ভূখণ্ডের ভূমি প্রথমবারের মতো মানুষের কাছে উন্মোচিত হবে এবং এর নীচে লুকিয়ে থাকা সমস্ত রহস্যও প্রকাশ পাবে। তবে সৌভাগ্যবশত, এই রহস্যগুলোর বেশিরভাগ সম্পর্কে জানার জন্য আমাদের সম্ভবত কয়েক শতাব্দী অপেক্ষা করতে হবে না এবং এর মধ্যে অনেক কিছুই ইতিমধ্যে আবিষ্কৃত হয়েছে।

বরফের নিচে লুকানো ঐতিহাসিক নিদর্শন ও প্রাকৃতিক বিস্ময়

১৯৪২ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের (Second World War) সময় একটি আমেরিকান লকহিড পি৩৮ লাইটনিং (American Lockheed P38 Lightning) বিমানকে জরুরি অবতরণ করতে হয়েছিল। ক্রুদের উদ্ধার করা হয়েছিল কিন্তু বিমানটি যেখানে অবতরণ করেছিল সেখানেই পরিত্যক্ত অবস্থায় ছিল এবং সময়ের সাথে সাথে হারিয়ে গিয়েছিল। অর্ধ শতাব্দী পর ১৯৯২ সালে, বহু বছর ধরে অনুসন্ধানের পর একটি দল অবশেষে দীর্ঘকাল ধরে হারিয়ে যাওয়া বিমানটিকে পুনরায় আবিষ্কার করে, যা ততদিনে গ্রীনল্যান্ডের বরফের নীচে চাপা পড়েছিল।

বিমানটি পরে পুনরুদ্ধার করা হয়েছিল এবং এমনকি উড়ানের উপযোগী অবস্থায় ফিরিয়ে আনা হয়েছিল এবং অর্ধ শতাব্দী ধরে গ্রীনল্যান্ডের বরফের নীচে চাপা থাকার পরে আবারও আকাশে উড়েছিল। শেষ পর্যন্ত এটি কিছু সময়ের জন্য এখানকার বরফের নিচে হারিয়ে যাওয়া অনেক আমেরিকান নিদর্শনের মধ্যে একটি হয়ে উঠবে।

১৯৬৮ সালে চারটি থার্মোনিউক্লিয়ার বোমা (thermonuclear bombs) বহনকারী একটি আমেরিকান বোমারু বিমান মাঝ আকাশে আগুন ধরে বিধ্বস্ত হয়েছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র (United States) এবং ডেনমার্ক (Denmark) উভয় দেশই একটি ব্যাপক পরিচ্ছন্নতা অভিযান চালায় এবং বিমান এবং পারমাণবিক অস্ত্রের প্রায় সমস্ত অংশ উদ্ধার করা হয়, তবে একটি বিভ্রান্তিকর এবং সম্ভাব্য উদ্বেগজনক অংশ খুঁজে পাওয়া যায়নি। একটি পারমাণবিক বোমার দ্বিতীয় স্তরের সিলিন্ডার যাতে ইউরেনিয়াম (uranium) এবং লিথিয়াম ডিউটেরাইড (lithium deuteride) ছিল, মূলত এটি বোমার পারমাণবিক জ্বালানী বহনকারী অংশ, যা একটি বিয়ার ক্যানের চেয়ে সামান্য বড় আকারের। এই অংশটি পরিচ্ছন্নতা অভিযানে খুঁজে পাওয়া যায়নি এবং সম্ভবত আজও সেই এলাকার কাছাকাছি কোথাও শত শত ফুট বরফের নিচে চাপা পড়ে আছে।

এরপর মাত্র এক দশক আগে ২০১৩ সালে বিজ্ঞানীদের একটি দল গ্রীনল্যান্ডের বরফের নিচে এ যাবতকালের সবচেয়ে আশ্চর্যজনক আবিষ্কারগুলোর মধ্যে একটি করে। নাসার নিজস্ব স্যাটেলাইট (NASA own satellites) থেকে সংগৃহীত বরফ ভেদকারী রাডার ডেটা (ice penetrating radar data) ব্যবহার করে তারা আবিষ্কার করেন যে গ্রীনল্যান্ডের বরফের চাদরের নিচে বিশ্বের দীর্ঘতম গিরিখাত লুকিয়ে রয়েছে, যাকে এখন মেগা ক্যানিয়ন (mega canyon) বলা হয়। তথাকথিত গ্রীনল্যান্ড গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন (Greenland Grand Canyon) দ্বীপের প্রায় ৭৫০ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে বিস্তৃত, যা এমনকি অ্যারিজোনার গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের (Grand Canyon in Arizona) চেয়েও ৩০০ কিলোমিটার বেশি দীর্ঘ। এটি ১০ কিলোমিটার পর্যন্ত প্রশস্ত এবং ১ কিলোমিটার পর্যন্ত গভীর।

ধারণা করা হয় এটি দ্বীপের একটি অত্যন্ত প্রাচীন ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য কারণ সম্ভবত এটি সুদূর অতীতের কোনো শক্তিশালী প্রাচীন নদী ব্যবস্থার দ্বারা গঠিত হয়েছিল, এবং গত কয়েক মিলিয়ন বছরের বরফ বা হিমবাহের কারণে নয়, যা এটিকে হাজার বছর ধরে ভালোভাবে লুকিয়ে রেখেছিল। বরফের চাদর সরিয়ে ফেললে এই গিরিখাতটি পৃথিবীর অন্যতম মহিমান্বিত প্রাকৃতিক বিস্ময় হিসেবে পরিগণিত হতে পারত, তবে এর বেশিরভাগ অংশ বর্তমানে সমুদ্রপৃষ্ঠের নিচে থাকায় বরফের চাদর গলে গেলে এটি সম্ভবত জলে ভরে যাবে।

যদি এবং যখন ভবিষ্যতে বরফের চাদর গলে যায়, তখন গ্রীনল্যান্ডের ভেতরের দিকের বেশিরভাগ অংশ, যা লক্ষ লক্ষ বছর ধরে বরফের চাপে সমুদ্রপৃষ্ঠের নীচে চলে গেছে, তা একটি বিশাল অভ্যন্তরীণ হ্রদ বা সমুদ্রে রূপান্তরিত হতে পারে। এটি সম্ভবত দ্বীপের উষ্ণতা বৃদ্ধির প্রক্রিয়াকে আরও ত্বরান্বিত করতে পারে, তবে একই সময়ে বরফের বিশাল ওজন সরে যাওয়ায় দ্বীপটি আইসোস্ট্যাটিক রিবাউন্ড (isostatic rebound) নামক একটি ধীর প্রক্রিয়া শুরু করবে, যেখানে ভূমি ধীরে ধীরে কয়েক দশক ও শতাব্দীর ব্যবধানে আক্ষরিক অর্থেই সমুদ্রপৃষ্ঠের উপরে উঠে আসবে, অবশেষে লক্ষ লক্ষ বছর ধরে থাকা নিষ্পেষণকারী ওজন থেকে মুক্তি পাবে।

জ্বালানি এবং বিরল মৃত্তিকা মৌল ও খনিজ

বাস্তবে কয়েকশ বছর পর গ্রীনল্যান্ডের ভবিষ্যৎ ভূগোল কেমন হবে তা মূলত যেকোনো মানুষের সেরা অনুমানের উপর নির্ভরশীল। তবে এতে কোনো সন্দেহ নেই যে গ্রীনল্যান্ডের তিন কিলোমিটার বরফের নিচে লুকানো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জিনিসগুলো হল সম্পদ এবং কাঁচামাল এবং বিশেষভাবে হাইড্রোকার্বন (hydrocarbons) এবং বিরল মৃত্তিকা মৌল ও খনিজ (rare earth elements and minerals)।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা (United States Geological Survey) পূর্বে অনুমান করেছিল যে গ্রীনল্যান্ডের পৃষ্ঠের ঠিক নীচে গ্রহের সমস্ত অনাবিষ্কৃত তেলের ২৫ শতাংশ এবং এর সমস্ত অনাবিষ্কৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের ৩০ শতাংশ জমা আছে। যদি এই সম্পদ বিষয়ক অনুমানগুলো সঠিক হয় এবং বাস্তবে পরিণত হয়, তবে গ্রীনল্যান্ড হঠাৎ করেই ইরাকের (Iraq) মতো তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাসের মালিক হবে এবং বিশ্বের পঞ্চম বা ষষ্ঠ বৃহত্তম হাইড্রোকার্বন মজুতের অধিকারী হবে। যেহেতু গ্রীনল্যান্ড এখনও ডেনমার্কের একটি অধীনস্থ অঞ্চল, যা ইউরোপীয় ইউনিয়ন (European Union) এবং ন্যাটো জোটের (NATO member states) সদস্য রাষ্ট্র, তাই এই মজুতগুলো তাত্ত্বিকভাবে রাশিয়া (Russia) বা ইরানের (Iran) মতো অন্যান্য দেশগুলোর উপর ইউরোপের জ্বালানি নির্ভরতা নাটকীয়ভাবে কমাতে সাহায্য করতে পারে।

তবে তেল ও গ্যাসের বাইরে গ্রীনল্যান্ডের নীচে লুকানো আরও আকর্ষণীয় সম্পদগুলো সম্ভবত বিরল মৃত্তিকা মৌল এবং খনিজ। এগুলো পর্যায় সারণীর (periodic table) সেই অংশ যা সম্ভবত হাই স্কুলের রসায়ন ক্লাসের পর থেকে আপনি ভুলে গেছেন। তবে মূল বিষয়টি হল এই সম্পদগুলো আমাদের আধুনিক বিশ্বের প্রযুক্তিকে সচল রাখতে অপরিহার্য, স্মার্টফোন থেকে শুরু করে বৈদ্যুতিক গাড়ি, এমআরআই মেশিন (MRI machines), ফাইটার জেট এবং আরও কয়েক ডজন গুরুত্বপূর্ণ অ্যাপ্লিকেশন তৈরিতে এগুলো লাগে।

একসময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ছিল এই বিরল মৃত্তিকাগুলোর বৃহত্তম উৎপাদক, তবে এখন আর সেই অবস্থা নেই। বর্তমানে এই সম্পদগুলোর প্রায় একচেটিয়া আধিপত্য চীনের (China) হাতে, কারণ তারা বর্তমানে বিশ্বের চাহিদার ৮৫ শতাংশেরও বেশি সরবরাহ করে এবং অ্যান্টিমনি (antimony) ও ব্যারাইটের (barite) মতো অনেক বিরল ধাতু ও খনিজ পদার্থের বৈশ্বিক সরবরাহের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশের উৎস এই দেশ। আমেরিকা, ইউরোপ এবং অন্যান্য পশ্চিমা দেশগুলোর (Western nations) কাছে চীনের কাছ থেকে সরাসরি এই বিরল মৃত্তিকা মৌল এবং খনিজগুলোর বিশাল পরিমাণ আমদানি করা ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই, যাকে সাধারণত ২১ শতকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় ভূ-রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তবে গ্রীনল্যান্ডের উষ্ণতা বৃদ্ধি এবং বরফের চাদর গলে যাওয়ার কারণে এই পুরো হিসেব বদলে যাচ্ছে, কারণ এখন সাধারণভাবে বিশ্বাস করা হয় যে চীনের পরেই গ্রীনল্যান্ডে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পরিমাণে বিরল মৃত্তিকা মজুদ রয়েছে।

বিশেষ কৌশলগত গুরুত্বের দিক থেকে হঠাৎ করেই আলোচনায় উঠে এসেছে দ্বীপের দক্ষিণ উপকূলে অবস্থিত নারসাক (Narsaq) নামের ছোট শহর, যেখানে প্রায় ১৭০০ মানুষের বসবাস। সম্ভবত এটি আজকের বিশ্বের সবচেয়ে কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ ছোট শহর, যেখানে কয়েক হাজারের কম মানুষ বাস করে। কারণ এর আশেপাশে থাকা এবড়োখেবড়ো এবং পাথুরে পাহাড়গুলোতে পৃথিবীর বিরল মৃত্তিকা খনিজগুলোর প্রায় এক চতুর্থাংশ মজুদ রয়েছে বলে অনুমান করা হয়েছে। এই পাহাড়ের ভেতরের একটিমাত্র খনিজ ভাণ্ডার এলাকা, যা কভানেফেল্ড (Kvanefjeld) নামে পরিচিত, সেখানে প্রায় ১১ মিলিয়ন টন বিরল মৃত্তিকা অক্সাইড (rare earth oxides) রয়েছে, যা বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মজুদ এবং প্রায় ২,৭০,০০০ টন ইউরেনিয়াম রয়েছে, যা এখনো পর্যন্ত আবিষ্কৃত ষষ্ঠ বৃহত্তম মজুদ। যদি এই অনুমানগুলো সঠিক হয়, তবে এর মানে হল গ্রীনল্যান্ডের এই একটিমাত্র স্থানে চীনের বাইরে সবচেয়ে বেশি বিরল মৃত্তিকার ঘনত্ব রয়েছে। এটি বিরল মৃত্তিকা মজুদের সংখ্যার দিক থেকে দ্বীপটিকে বিশ্বে চতুর্থ স্থানে এবং প্রায় রাশিয়ার সমতুল্য অবস্থানে নিয়ে আসে। এর মানে এও দাঁড়ায় যে এই স্থানটির শুধুমাত্র ইউরেনিয়াম মজুত চীনের সমস্ত জ্ঞাত মজুতের প্রায় সমান এবং গ্রীনল্যান্ডকে পরিচিত ইউরেনিয়াম মজুতের দিক থেকে বিশ্বে নবম স্থানে নিয়ে যায়, এবং এই সবই একটিমাত্র মজুদের হিসাব।

সম্পূর্ণ স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব অর্জন এবং খনি ও জ্বালানিতে বিনিয়োগ

এই অনুমানের ভিত্তিতে সারা বিশ্বের খনির কোম্পানিগুলো, বিলিয়নেয়াররা এবং সাম্রাজ্যগুলো এখন বহু বছর ধরে গ্রীনল্যান্ডের ছোট গ্রামগুলোর দিকে নজর রাখছে এবং গ্রীনল্যান্ডের অভ্যন্তরে এই বিষয়টি অত্যন্ত বিভেদ সৃষ্টিকারী। একদিকে গ্রীনল্যান্ডের সম্পদ উত্তোলনের শিল্পের প্রসার দ্বীপরাষ্ট্রটিকে প্রচুর পরিমাণে অর্থ এনে দিতে পারে এবং কয়েক শতাব্দীর ঔপনিবেশিক শাসনের পর অবশেষে ডেনমার্ক থেকে তাদের আর্থিক ও আইনি স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে পারে। ১৯৭৯ সালে ৪০ বছরেরও বেশি সময় আগে কোপেনহেগেন (Copenhagen) থেকে গ্রীনল্যান্ডকে স্বায়ত্তশাসন দেওয়া হলেও ডেনমার্ক এখনও দ্বীপের বৈদেশিক নীতি সম্পূর্ণরূপে পরিচালনা করে এবং গ্রীনল্যান্ডের সরকারকে প্রায় ৬০০ মিলিয়ন ডলারের বার্ষিক ভর্তুকি প্রদান করে, যা তাদের পুরো বার্ষিক সরকারি বাজেটের প্রায় ৬০ শতাংশ। তাই গ্রীনল্যান্ডের সরকার এখনও আর্থিকভাবে ডেনমার্কের উপর নির্ভরশীল। খনি এবং হাইড্রোকার্বন উত্তোলন থেকে প্রাপ্ত রাজস্ব এই অবস্থার নাটকীয় পরিবর্তন আনতে পারে এবং ভবিষ্যতে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের পথ প্রশস্ত করতে পারে।

অন্যদিকে দ্বীপের অনেক স্থানীয় বাসিন্দা বিদেশি খনি এবং জ্বালানি কোম্পানিগুলোর আগমন এবং তাদের কার্যক্রম শুরু করার বিষয়ে খুব সতর্ক। এই কার্যক্রমগুলোর কারণে দূষণ, সংক্রমণ এবং স্থানীয় ইনুইটদের (Inuit) ঐতিহ্যবাহী জীবনযাত্রার পরিবর্তন ঘটতে পারে। বিশ্বের পরাশক্তিধর দেশগুলো ইতিমধ্যেই এই সুদূর দ্বীপের দিকে তাদের দীর্ঘ ভূ-রাজনৈতিক দৃষ্টি নিক্ষেপ করতে শুরু করেছে, যাকে ইতিহাস এতদিন খুব কম মনোযোগ দিয়েছিল।

চীনা রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন কোম্পানিগুলো ইতিমধ্যেই দ্বীপের খনির কার্যক্রমে বিনিয়োগের চেষ্টা করছে, যেমন কভানেফেল্ডের মজুতে, এবং এর পাশাপাশি বিমান ও সমুদ্রবন্দরের অবকাঠামোতে বিনিয়োগের প্রস্তাবও দিয়েছে। সর্বোপরি, সম্ভাব্য বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিরল মৃত্তিকার উৎসের সম্পদ কিনে বা বাণিজ্য সম্পর্ক সুরক্ষিত করে তাদের নিজস্ব বিশ্বব্যাপী বিরল মৃত্তিকার একচেটিয়া আধিপত্য ধরে রাখার এর চেয়ে ভালো উপায় আর কী হতে পারে।

নর্দার্ন সি রুট নামক নতুন বাণিজ্যিক পথ

আর্কটিক অঞ্চল ক্রমাগত উষ্ণ হওয়ার সাথে সাথে এখানকার সমুদ্রের বরফ এমন পর্যায়ে গলে যাবে যেখানে সম্ভবত আগামী দশকের শুরুতেই গ্রীষ্মকালে কোনো সমুদ্রের বরফ থাকবে না। এর ফলে রাশিয়ার উত্তরাঞ্চলের জলপথ দিয়ে একটি নতুন বাণিজ্যিক পথ খুলে যাবে, যা নর্দার্ন সি রুট (Northern Sea Route) নামে পরিচিত হবে। এই অবশ্যম্ভাবী ঘটনাটি কার্গোবাহী জাহাজগুলোকে একদিকে পূর্ব এশিয়া এবং অন্যদিকে ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার মধ্যে চলাচল করার জন্য প্রয়োজনীয় দূরত্ব নাটকীয়ভাবে কমিয়ে আনবে। এটি সুয়েজ খাল (Suez Canal) অথবা আফ্রিকার (Africa) দক্ষিণাঞ্চল ঘুরে তাদের মধ্যেকার বর্তমান বাণিজ্য পথের তুলনায় পূর্ব এশিয়া এবং পশ্চিমা বিশ্বের অর্থনীতিগুলোর মধ্যে বাণিজ্যিক সময় উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমিয়ে আনবে এবং এর পাশাপাশি রাশিয়াও ট্রানজিট ফি (transiting fees) থেকে প্রচুর অর্থ উপার্জন করবে।

আগামী দশকের কোনো এক সময়ে এটি সম্ভবত বিশ্বের বৃহত্তম এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক পথ হয়ে উঠবে এবং এটি গ্রীনল্যান্ডের বিশাল, লুকানো কৌশলগত সম্পদগুলোর সহজলভ্যতাও নাটকীয়ভাবে বাড়িয়ে তুলবে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ

নিশ্চয়ই এই সমস্ত কারণ এবং বৈশ্বিক অর্থনীতির জন্য গ্রীনল্যান্ড একদিন কতটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে, সেই জ্ঞানের কারণেই ২০১৯ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ট্রাম্প প্রশাসন (Trump administration) ডেনমার্কের কাছ থেকে দ্বীপটি কিনে নেওয়ার ধারণা প্রকাশ করেছিল এবং ২০২৪ সালে নির্বাচনে জয়ী হয়ে আবারও একই কথা তুলে আনে। সেই সাথে ওয়াশিংটন (Washington) ক্রমাগত কোপেনহেগেনের উপর সমস্ত চীনা কোম্পানির বিনিয়োগ বন্ধ করার জন্য চাপ দিয়ে আসছে। যেহেতু তারা এখনও গ্রীনল্যান্ডের বৈদেশিক নীতি নিয়ন্ত্রণ করে, তাই ডেনমার্ক নুউক এবং ইলুলিসাতে (Ilulissat) বিমানবন্দর নির্মাণের জন্য আসা দুটি চীনা নির্মাণ সংস্থার দরপত্র বাতিল করে আমেরিকার দাবি মেনে নেয়। তারা দ্বীপের দক্ষিণ উপকূলে একটি পরিত্যক্ত নৌঘাঁটি কেনার জন্য চীনের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। তবে তারা সরাসরি দ্বীপটি কেনার জন্য আমেরিকার প্রস্তাব দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে।

এমন নয় যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে এটি কেনার প্রয়োজন আছে, কারণ তাদের ইতিমধ্যেই উত্তরের দিকে থুলেতে (Thule) একটি প্রধান বিমানঘাঁটি রয়েছে, যার মূল উদ্দেশ্য হল রাশিয়া থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মূল ভূখণ্ডের দিকে নিক্ষেপ করা সম্ভাব্য ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের (ballistic missiles) জন্য একটি আগাম সতর্কতা ব্যবস্থা হিসেবে কাজ করা।

তাই ২১ শতকের সবচেয়ে বড় শক্তিগুলো, যা আমাদের পুরো বিশ্বকে নতুন করে আকার দিচ্ছে, তারা সকলেই গ্রীনল্যান্ডে এসে মিলিত হয়েছে। বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দ্রুত উষ্ণতা বৃদ্ধি, বরফ গলে যাওয়া এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, আমাদের আধুনিক সমাজকে সচল রাখার জন্য প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর বিরল মৃত্তিকা সম্পদের ক্রমবর্ধমান চাহিদা এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে উদীয়মান বিশ্ব ভূ-রাজনৈতিক ঠান্ডা যুদ্ধ—এই সবকিছুই গ্রীনল্যান্ডকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হচ্ছে।

বিশাল সম্পদ শতাব্দী ধরে গ্রীনল্যান্ডের নীচে লুকিয়ে ছিল এবং এখন আমরা সবাই তা উপলব্ধি করতে শুরু করেছি।

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.