Table of Contents
তাপ, শক্তি ও খরচের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় নতুন ট্রানজিস্টর প্রযুক্তি (১৮ ডিসেম্বর, ২০২৪)
নতুন প্রযুক্তি
গবেষকরা একটি নতুন ধরনের ট্রানজিস্টর (transistor) উদ্ভাবন করেছেন, যা আধুনিক ইলেকট্রনিকস (electronics)-এর মূল স্তম্ভ হিসেবে পরিচিত। এই নতুন ডিভাইস (device) আগের প্রচলিত ট্রানজিস্টরের তুলনায় প্রায় ১,০০০ গুণ বেশি শক্তি সাশ্রয়ী (energy efficient) এবং প্রায় শূন্য তাপ (heat) উৎপন্ন করে। এটি সম্প্রতি বেশ আগ্রহের সৃষ্টি করেছে, কারণ এই নতুন প্রযুক্তি কম্পিউটিং শিল্পের (Computing industry) কিছু বড় চ্যালেঞ্জ সমাধানে সক্ষম হতে পারে।
চলুন বিষয়টি বিশদভাবে বিশ্লেষণ করি। তাপ (heat) হল আধুনিক কম্পিউটার চিপগুলোর (computer chip) জন্য একটি প্রধান সমস্যা। এটি আপনার ল্যাপটপ (laptop) হোক বা একটি হাই-পারফরম্যান্স জিপিইউ ক্লাস্টার (high performance GPU cluster), কিংবা কোয়ান্টাম কম্পিউটার (Quantum computer)—তাপ উৎপন্ন হওয়া কর্মদক্ষতা (performance) এবং দক্ষতার (efficiency) সীমাবদ্ধতা তৈরি করে। দক্ষতা এখানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। উদাহরণস্বরূপ, বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী সুপারকম্পিউটার ‘ফ্রন্টিয়ার (Frontier)’ এক্সাফ্লপ (exaflop) কর্মদক্ষতার মাইলফলক অর্জন করতে প্রায় ২১ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ ব্যয় করে। সামনে জেটাস্কেল (Zettascale)-এর দিকে তাকালে, এবং যদি আমরা ধরি যে দক্ষতা প্রতি ২ বছরে আনুমানিক দ্বিগুণ হবে, তবে জেটাস্কেল কর্মদক্ষতা অর্জনে প্রায় ৫০০ মেগাওয়াট (500MW) বিদ্যুৎ লাগবে। এক গিগাওয়াট (1GW) বিদ্যুৎ হল একটি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের (nuclear power plant) ক্ষমতার সমান। অর্থাৎ, প্রতিটি ডেটা সেন্টারের (data center) জন্য একটি করে আলাদা পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রয়োজন হয়ে পড়বে। সুতরাং এটি স্পষ্ট যে আমাদের আরও উন্নত সমাধান দরকার।
কোয়ান্টাম কম্পিউটারগুলো (Quantum Computers) আরও বড় সমস্যার সম্মুখীন হয়, কারণ এই যন্ত্রগুলি তাপ একেবারেই সহ্য করতে পারে না। তাপ কোয়ান্টাম অস্থিরতার (Quantum entanglement) সূক্ষ্ম অবস্থা ধ্বংস করে। এজন্য আমরা কোয়ান্টাম সার্কিট (Quantum circuits) শীতল রাখতে বড়, জটিল নির্মাণব্যবস্থা ব্যবহার করি। মূল কথা, এগুলো এমন সব বড় ও জটিল সমস্যা যা সহজে সমাধানযোগ্য নয়। আর ঠিক এই জায়গায় আইবিএম (IBM) এবং সেমিকন (SemiQon) নামক ফিনল্যান্ডের একটি কোম্পানি নতুন ডিভাইস নিয়ে এসেছে।
সেমিকন (SemiQon), একটি ফিনিশ (Finnish) কোম্পানি, বিশ্বের প্রথম এমন একটি ট্রানজিস্টর তৈরি করেছে যা প্রায় শূন্য তাপ অপচয়ে (heat dissipation) কাজ করে। এটি প্রচলিত ট্রানজিস্টরের মাত্র ০.১% বিদ্যুৎ ব্যবহার করে, এবং তাপ উৎপাদন প্রায় ১০০০ গুণ কমায়। এই প্রযুক্তির প্রভাব পড়তে পারে শক্তিশালী ডেটা সেন্টার, উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন কম্পিউটিং (high performance computing), স্পেস-গ্রেড ইলেকট্রনিকস (space grade electronics) এমনকি কোয়ান্টাম কম্পিউটিংয়ের (Quantum Computing) ক্ষেত্রেও।
এখানে উল্লেখযোগ্য বিষয় হল, সাধারণত ট্রানজিস্টরের ক্ষেত্রে এমন অর্ডার-অব-ম্যাগনিটিউড (orders of magnitude) উন্নতি ঘটাতে হলে খুবই দুর্লভ আর্কিটেকচার (exotic architecture) বা অদ্ভুত পদার্থ (exotic materials) ব্যবহার করতে হয়। কিন্তু এবার তা নয়। এই নতুন ডিভাইসগুলো তৈরি হয়েছে তথাকথিত ‘সিলিকন-অন-ইনসুলেটর টেকনোলজি (SOI CMOS technology – Silicon-on-Insulator technology)’ ভিত্তিক CMOS প্রযুক্তি ব্যবহার করে। SOI CMOS ইতোমধ্যেই গাড়ি শিল্প (automotive) এবং ওয়্যারলেস (wireless) শিল্পে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। এর মানে, এই নতুন ট্রানজিস্টরগুলো বিদ্যমান CMOS ফ্যাব্রিকেশন প্ল্যান্টে (CMOS fabrication plants) সহজেই ব্যাপক পরিমাণে উৎপাদন করা যাবে, নতুন কোনো অবকাঠামোর প্রয়োজন হবে না।
এগুলির সাথে ক্লাসিকাল ট্রানজিস্টরের (classical transistor) মিল অনেক। মূল পার্থক্য খালি এই জায়গায় যে, এক্ষেত্রে ক্লাসিকাল ট্রাঞ্জিস্টরের ওপর একটি অতিসূক্ষ্ম সিলিকন স্তর (ultra-thin layer of silicon) একটি ইনসুলেটরের (insulator) উপরে স্থাপন করা হয়, যেখানে প্রচলিত ট্রানজিস্টর বাল্ক সিলিকনের (bulk silicon) উপর নির্মিত হয়। ক্লাসিকাল ট্রানজিস্টরগুলো নিম্ন তাপমাত্রায় ঠিকমতো কাজ করতে পারে না। কারণ তাপমাত্রা কমার সাথে সাথে ট্রানজিস্টর চালু করতে (switch transistor on) প্রয়োজনীয় ভোল্টেজ (voltage) বেড়ে যায়। এ কারণে তাপমাত্রা পরিবর্তনের সাথে ট্রানজিস্টরের কর্মদক্ষতায় অসঙ্গতি দেখা দেয়। এটি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন কম্পিউটিং এবং কোয়ান্টাম যন্ত্রে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়, কারণ উভয় ক্ষেত্রেই নিয়ন্ত্রিত, নিখুঁত কর্মদক্ষতা অত্যন্ত জরুরি।
সেমিকন (SemiQon) দল তাদের নতুন গবেষণাপত্রে দেখিয়েছে কীভাবে তারা নতুন ক্রায়োজেনিক (cryogenic) ডিভাইস ডিজাইন (device design) করে এই সমস্যার সমাধান করেছে। নতুন ট্রানজিস্টরগুলো অত্যন্ত নিম্ন তাপমাত্রায় কাজ করতে পারে এবং তাপমাত্রাগত চাপ (thermal stress) সত্ত্বেও শীতলতা বজায় রাখে।
আইবিএমের উদ্ভাবন এবং এটির তাৎপর্য
এবার আমরা আসি এই প্রযুক্তির গুরুত্ব এবং এর প্রভাবের কথায়। যেহেতু এই ডিভাইসগুলো প্রায় কোনো তাপ তৈরি করে না, তাই এটি শীতলকরণ (cooling) প্রক্রিয়া এবং খরচ উভয়ই নাটকীয়ভাবে হ্রাস করতে পারে। বর্তমানে বিশ্বব্যাপী ডেটা সেন্টারগুলি কুলিং এর পেছনে প্রতিবছর কয়েক বিলিয়ন ডলার ব্যয় করে, এবং এই ব্যয় প্রতি বছর বাড়ছে। নতুন এই প্রযুক্তি টেকসই (sustainable) পথ নির্দেশ করতে পারে এবং ভবিষ্যতে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের দরকার ফুরিয়ে যেতে পারে।
আর কুলিং এর জন্য এত ব্যয়ই হল সেই কারণগুলোর একটি, যেগুলোর জন্য আইবিএম (IBM) ক্রায়োজেনিক ডিভাইস (cryogenic devices) নিয়ে সক্রিয়ভাবে কাজ করে চলেছে। এই ক্রায়োজেনিক ডিভাইসগুলোর যার মধ্যে রয়েছে মেমোরি (memory) এবং ট্রানজিস্টর। তারা দেখেছে যে নিম্ন তাপমাত্রায় এই ডিভাইসগুলো উন্নত কর্মদক্ষতা, কম শক্তি খরচ এবং উন্নত নির্ভরযোগ্যতা (reliability) প্রদর্শন করে।
সাম্প্রতিককালে আইবিএম একটি নতুন ক্রায়োজেনিক প্রয়োগের জন্য তৈরি ট্রানজিস্টর দেখিয়েছে। তারা প্রমাণ করেছে যে ৭৭ কেলভিন (77K) তাপমাত্রায় চালানোর সময় এই ডিভাইস রুম টেম্পারেচারে (room temperature) চালানোর তুলনায় দ্বিগুণ কর্মদক্ষতা (doubled device performance) অর্জন করে।
এই নতুন ট্রানজিস্টর ন্যানোশিট (nanosheet) আর্কিটেকচার ব্যবহার করে তৈরি। এখানে চ্যানেল (channel) একগুচ্ছ পাতলা সিলিকন শীটে বিভক্ত, যেগুলো সম্পূর্ণরূপে গেট (gate) দ্বারা বেষ্টিত। ক্রায়োজেনিক করতে আইবিএম ডুয়াল-মেটাল গেট (dual-metal gates) এবং ডাইপোল (dipoles) সংযুক্ত করেছে। ন্যানোশিট প্রযুক্তি (nanosheet technology) লজিকাল ডিভাইসগুলোকে (logical devices) আরও ক্ষুদ্রায়িত করার পরবর্তী ধাপ। যখন এটি লিকুইড নাইট্রোজেন (liquid nitrogen) কুলিংয়ের সাথে মিলিত হয়, আইবিএম প্রকৃতপক্ষে কর্মদক্ষতাকে দ্বিগুণ করতে পেরেছে।
কোয়ান্টাম প্রযুক্তি এবং ভবিষ্যতের দিগন্ত
অবশ্যই, এই ডিভাইসটি কোয়ান্টাম কম্পিউটার (Quantum computers) উন্নয়নেও বড় মাইলফলক। কোয়ান্টাম কম্পিউটারগুলো খুবই ঠাণ্ডা তাপমাত্রায় পরিচালিত হয়, যা প্রায় অ্যাবসোলিউট জিরো (absolute zero) তাপমাত্রার কাছাকাছি। এখানে তাপ ঢুকে পড়া ঠেকানো খুব কঠিন, কারণ কোয়ান্টাম বিট (qubits) নিয়ন্ত্রণের জন্য যেসব ইলেকট্রনিক্স ব্যবহার করা হয়—সেগুলো ক্লাসিকাল এবং কোয়ান্টামের মধ্যে ইন্টারফেস (interface) হিসেবে কাজ করে, যোগাযোগ করে এবং কিউবিট নিয়ন্ত্রণ করে। বাহ্যিক ইলেকট্রনিক্স ও কন্ট্রোল ওয়্যার (control wires) থেকে আসা তাপ কিউবিটের সূক্ষ্ম অবস্থা বিঘ্নিত করতে পারে।
ভাবুন, যত বড় কোয়ান্টাম সিস্টেম তৈরি হবে, তত বেশি কিউবিট, তত বেশি নিয়ন্ত্রণ তারের দরকার হবে। ফলে তাপমাত্রা কম রাখা আরও কঠিন হবে। এই নতুন ক্রায়োজেনিক ট্রানজিস্টর এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে পারে। যদি আমরা এই ধরনের ক্রায়োজেনিক ট্রানজিস্টর দিয়ে কন্ট্রোল ইলেকট্রনিকস তৈরি করা হয়, তবে সেগুলোকে সরাসরি ক্রায়োস্ট্যাটের (cryostat) ভেতরে বসানো যাবে। এতে বড় আকারের কোয়ান্টাম সিস্টেম তৈরি করা অনেক সহজ হবে এবং অধিক সংখ্যক কিউবিট স্কেল আপ (scale up) করতেও সুবিধা হবে।
ডেটা সেন্টার এবং কোয়ান্টাম কম্পিউটার ছাড়াও, এই ডিভাইসগুলো মহাকাশেও কার্যকর হবে। কারণ সেগুলো খুব ঠাণ্ডা তাপমাত্রায়ও নির্ভরযোগ্যভাবে কাজ করতে পারবে, অতিরিক্ত কোনো হিটিং (heating) বা কুলিং সিস্টেম ছাড়াই।
যদিও এসব উন্নয়ন রোমাঞ্চকর, তবে কিছু চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। প্রথমত, ল্যাব থেকে ব্যাপক উৎপাদনে নিয়ে যেতে সময় লাগবে। দ্বিতীয়ত, খরচের ব্যাপারও আছে—যদিও এগুলো বিদ্যমান প্রযুক্তি দিয়ে তৈরি করা যাবে, তবু ক্রায়োজেনিক পরিবেশ (cryogenic environment) গড়ে তোলার খরচ আছে, বিশেষ করে যদি ডেটা সেন্টারে এ ধরনের ব্যবস্থা গড়া হয়। আর প্রশ্ন হল, বড় বড় প্রযুক্তি সংস্থাগুলো কি ক্রায়োজেনিক সিস্টেমে বিনিয়োগ করবে, যখন অন্যান্য শক্তি সাশ্রয়ের বিকল্প থাকতে পারে? নাকি তারা পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বানিয়েই এগিয়ে যাবে? এটি একটি জটিল সিদ্ধান্তের বিষয়।
এসব চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক এবং এমন এক ভবিষ্যতের আভাস দেয় যেখানে তাপ আর সিস্টেম স্কেল করার ক্ষেত্রে বাধা হয়ে থাকবে না। যদি এই প্রযুক্তি তার প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে পারে, তবে এটি কোয়ান্টাম কম্পিউটার থেকে শুরু করে ডেটা সেন্টার পর্যন্ত সবকিছু পরিবর্তন করতে পারে।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (AI) সঙ্গে কোয়ান্টাম (Quantum) প্রযুক্তির মিলন: এই নতুন সাফল্য সবকিছু পাল্টে দেবে (১০ ডিসেম্বর, ২০২৪)
ভূমিকা
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (Artificial Intelligence – AI) বিপ্লব দিন দিন প্রসারিত হচ্ছে এবং আমাদের বিশ্বকে নতুনভাবে বিন্যস্ত করছে। ঠিক এমন সময় কোয়ান্টাম (Quantum) প্রযুক্তি কম্পিউটিং (Computing) সম্পর্কিত আমাদের দীর্ঘদিনের ধারণাগুলো পুরোপুরি বদলে দিতে চলেছে। এখন আপনি কল্পনা করুন, যখন এআই (AI) এবং কোয়ান্টাম (Quantum) একত্রিত হয়, তখন কী হতে পারে? আজকের এই আলোচনায় আপনি দেখতে পাবেন যে সবকিছু কত দ্রুত এগোচ্ছে। সম্প্রতি ডিপমাইন্ড (DeepMind) প্রমাণ করেছে যে তারা এমন একটি যুগান্তকারী এআই (AI) মডেল উন্মোচন করেছে, যা ব্যবহারিক কোয়ান্টাম কম্পিউটার (practical quantum computer) বাস্তবতার আরও কাছাকাছি নিয়ে যাচ্ছে। এই আর্টিকেলে ব্যাখ্যা করা হবে এটি কীভাবে কাজ করে, কেন এটি ভবিষ্যতের কোয়ান্টাম কম্পিউটিং (quantum computing)-এর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং এই দুটি যুগান্তকারী প্রযুক্তির মিলনে ৩টি সম্ভাব্য ফলাফল কী হতে পারে।
কোয়ান্টাম কম্পিউটার (quantum computer)-এর সম্ভাব্যতা এতটাই বিশাল যে, সবচেয়ে জটিল কম্পিউটিং সমস্যা মাত্র কয়েক ঘণ্টা বা এমনকি সেকেন্ডের মধ্যেই সমাধান করতে পারে, যেখানে প্রচলিত কম্পিউটারকে (classical computer) সেই একই কাজ করতে বিলিয়ন বছর লাগতে পারে। তবে ক্লাসিকাল কম্পিউটার (classical computer)-এর বিপরীতে কোয়ান্টাম কম্পিউটার খুবই স্পর্শকাতর, যেকোনো ধরণের শব্দ (noise), তাপ (heat), কম্পন (vibration) বা আশেপাশের অন্যান্য ছোটখাট বিরক্তির কারণে এর হিসাবনিকাশ বিঘ্নিত হতে পারে। এর ফলে কোয়ান্টাম গণনায় (quantum computation) প্রায়ই ভুল (error) দেখা দেয় এবং ফলাফল আর নির্ভরযোগ্য বা ব্যবহারোপযোগী থাকে না।
এই সমস্যার সমাধানে আধুনিক কোয়ান্টাম কম্পিউটিং (modern quantum computing) নানাবিধ ত্রুটিসংশোধন পদ্ধতি (error correction techniques) ব্যবহার করে। এই ক্ষেত্রের অন্যতম সম্মানিত বিজ্ঞানী ডেভিড ডয়চ (David Deutsch) বলেছেন, “Without error correction, all information processing, and hence all knowledge-creation, is necessarily bounded. Error correction is the beginning of infinity.” অর্থাৎ ত্রুটিসংশোধন (error correction) ছাড়া আমাদের জ্ঞানসৃষ্টির পরিসর সীমিতই থেকে যাবে। ত্রুটিসংশোধন হল অসীম সম্ভাবনার শুরু।
সবচেয়ে জনপ্রিয় ত্রুটিসংশোধনী পদ্ধতিগুলোর (error correction methods) একটি হল সার্ফেস কোড (Surface Code) পদ্ধতি। এখানে একক একটি লজিক্যাল কিউবিটের (logical qubit) মান সংরক্ষণ করতে একাধিক ফিজিক্যাল কিউবিট (physical qubit) ব্যবহার করা হয়। এর মাধ্যমে ত্রুটি সনাক্ত (error detection) ও সংশোধন (error correction) করা হয়। এই পদ্ধতি বর্তমানে গুগল (Google) ও আইবিএম (IBM)-এর মতো টেক জায়ান্টরা ব্যবহার করছে।
তবে সমস্যা হল, এই উন্নত পদ্ধতি ব্যবহার করেও আধুনিক, সর্বোন্নত কোয়ান্টাম কম্পিউটার (state-of-the-art quantum computer)-গুলোর প্রতি ১,০০০টি অপারেশনে এখনো প্রায় ১টি ত্রুটি (error) ঘটে। কিন্তু একটি বাস্তবসম্মত কোয়ান্টাম কম্পিউটার (practical quantum computer) যা জটিল ও দীর্ঘ সময়ের হিসাবনিকাশ করতে পারবে, তার জন্য ত্রুটির হার (error rate) কমিয়ে আনতে হবে এক ট্রিলিয়ন (১,০০০,০০০,০০০,০০০) অপারেশনে মাত্র ১টি ত্রুটিতে। আমরা এখনো সেই লক্ষ্যের থেকে অনেক দূরে।
সমস্যার সবচেয়ে জটিল দিকগুলোর মধ্যে একটি হল ডিকোডিং (decoding) প্রক্রিয়া। কারণ কিউবিটে (qubit) উপস্থিত বিশৃঙ্খলা (noise) কোনো নিয়ম মেনে চলে না, আর তা গতিশীল (dynamic) এবং পূর্বানুমান করা কঠিন। ঠিক এই জায়গাটিতেই ডিপমাইন্ডের (DeepMind) নতুন এআই উদ্ভাবন আলফাকিউবিট (AlphaQubit) মডেলটা কাজ করে।
আলফাকিউবিট (AlphaQubit) – কীভাবে এটি কাজ করে?
আলফাকিউবিট (AlphaQubit) হল একটি নিউরাল নেটওয়ার্ক (neural network) যা লজিক্যাল কিউবিটগুলো (logical qubit) ডিকোডার (decoder) হিসেবে কাজ করতে প্রশিক্ষিত করা হয়েছে। কোয়ান্টাম কম্পিউটার (quantum computer) থেকে প্রাপ্ত প্যারিটি চেক (parity check) তথ্যের মাধ্যমে এটি বুঝতে পারে কোথায় ত্রুটি ঘটেছে। কিন্তু এই ত্রুটির প্যাটার্ন (pattern) বেশ জটিল। আপনি এটিকে কোয়ান্টাম গণনার বানান পরীক্ষক (spell checker) হিসাবে ভাবতে পারেন, যা প্রতিটি ভুল (error) সংশোধন করে নিশ্চিত করে সবকিছু মিলে যাচ্ছে।
আলফাকিউবিট (AlphaQubit) প্রথমে হাজার হাজার সিমুলেটেড কোয়ান্টাম কম্পিউটার উদাহরণে প্রশিক্ষিত করা হয়েছিল, এরপর এটি গুগলের সিকামোর (Google’s Sycamore) কোয়ান্টাম কম্পিউটার থেকে পাওয়া পরীক্ষামূলক ডেটায় (experimental samples) ফাইন-টিউন (fine-tune) করা হয়। উল্লেখ্য, গুগলের সিকামোরকে (Sycamore) সময় কোয়ান্টাম সর্বোচ্চ ক্ষমতার স্বীকৃতি (quantum supremacy) অর্জন করেছিল।
আসলে আলফাকিউবিট (AlphaQubit) কোয়ান্টামের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জগুলোর একটিতে, অর্থাৎ ত্রুটি সংশোধনে (error correction) অবদান রাখছে। একটি কিউবিট (qubit) পরীক্ষার শেষে মূল অবস্থান থেকে পরিবর্তিত হয়েছে কি না তা সনাক্ত করতে, এবং প্রয়োজনে ত্রুটি সংশোধন করতে এটি গুগলের সিকামোর কোয়ান্টাম প্রসেসরে (quantum processor) ব্যবহৃত হয়।
আসুন একটি সহজ উদাহরণে দেখি। ক্লাসিক্যাল তথ্য (classical information) বিটে (bit) সংরক্ষণ করা হয়, যা হয় ০ বা ১ হতে পারে। ধরুন আমি আপনার কাছে ০ বা ১ পাঠাতে চাই, কিন্তু বিশৃঙ্খলা বা নয়েসের (noise) কারণে বিট পরিবর্তিত হতে পারে। তাই আমি হয়তো একটি বিটের মান তিনবার পাঠাব—০০০ বা ১১১। যদি শব্দের কারণে একটি বিট উল্টে যায়, আপনি হয়তো পাবেন ০০১। এখন আপনি ডিকোডার (decoder) হিসেবে বলবেন, তিনটির মধ্যে দুইটি বিট ০, সুতরাং আসল বিট ছিল ০। এটিই ডিকোডার (decoder)-এর কাজ। কিন্তু কোয়ান্টাম বিশ্বে এটি আরও জটিল, কারণ সেখানে কিউবিট ও এর স্টেট আরও বেশি সূক্ষ্ম।
বাস্তবে কোয়ান্টাম ডিকোডিং (quantum decoding) প্রক্রিয়া অনেক বেশি জটিল, কারণ সার্ফেস কোডের (Surface Code) মতো জটিল কোড ব্যবহার করা হয়। এখানে প্রতিটি লজিক্যাল কিউবিট (logical qubit) অনেকগুলো ফিজিক্যাল কিউবিট (physical qubit) দিয়ে উপস্থাপিত হয়। প্রতিটি মাইক্রোসেকেন্ডে এই ফিজিক্যাল কিউবিটগুলোর অবস্থা পড়া হয় এবং সেই পাঠানো ডেটা ৮-বিট (8-bit) সংখ্যায় প্রকাশ পায় (যদি এখানে তিনটি কিউবিট থাকে ধরি)। এই ৮-বিট তথ্য নিউরাল নেটওয়ার্কে (neural network) পাঠানো হয়, যা আগের অবস্থা মনে রেখে নতুন ডেটার সঙ্গে মিলিয়ে কাজ করে। প্রতিটি ধাপে নেটওয়ার্কের (network) অভ্যন্তরীণ অবস্থা হালনাগাদ হয়, এবং পরীক্ষার শেষে এটি বলে দেয় ত্রুটি ঘটেছে কিনা (১ মানে ত্রুটি ঘটেছে, ০ মানে ঘটেনি) এবং সঙ্গে সেই ত্রুটি ঘটার সম্ভাবনাও জানায়।
আলফাকিউবিটের ফলাফল
ডিপমাইন্ডের (DeepMind) তথ্যানুযায়ী, আলফাকিউবিট (AlphaQubit) কোয়ান্টাম ত্রুটিসংশোধনে (quantum error correction) বিদ্যমান সব ধরনের ডিকোডারকেই ছাড়িয়ে গেছে। তারা ৯৮.৫% সঠিকতার (accuracy) সঙ্গে ত্রুটিসংশোধন করতে পেরেছে এবং সামগ্রিকভাবে ত্রুটি ৩০% কমিয়েছে, যা আগের সেরা পদ্ধতিগুলোর থেকেও উন্নত।
এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ দীর্ঘ ও জটিল কোয়ান্টাম কম্পিউটিং অপারেশন চালাতে গেলে ত্রুটির হার অত্যন্ত কম হওয়া জরুরি। এটি কোয়ান্টাম কম্পিউটারকে বড় সমস্যাগুলি—যেমন কোয়ান্টাম পদার্থবিজ্ঞান (quantum physics), কোয়ান্টাম রসায়ন (quantum chemistry), এমনকি কোয়ান্টাম ক্রিপ্টোগ্রাফি (quantum cryptography)-এর মতো ক্ষেত্রে জটিল সমস্যার সমাধানে সহায়তা করবে।
পেপারে এই ফলাফল চমৎকার দেখালেও এখনো অনেক চ্যালেঞ্জ বাকি আছে। প্রধান চ্যালেঞ্জগুলোর একটি হল গতি (speed)। সাধারণত সুপারকন্ডাক্টিং কোয়ান্টাম প্রসেসর (superconducting quantum processor) প্রতি সেকেন্ডে লক্ষ লক্ষ সামঞ্জস্য যাচাই (consistency check) করে। এই বিপুল তথ্যকে এত দ্রুত ডিকোডারে (decoder) পাঠানো এবং ব্যবহার করা সহজ নয়। এখনকার ডিকোডারগুলো এই গতির তুলনায় অন্তত ১০ গুণ ধীর। যদিও এগুলো ইতোমধ্যে আগের সেরা ডিকোডারের চেয়ে অনেক দ্রুত, তবু এই গতি বাড়ানো দরকার।
এছাড়া নির্ভুলতাও আরও বাড়াতে হবে। এক্ষেত্রে লক্ষ্যমাত্রা হল এক ট্রিলিয়ন অপারেশনে (one trillion operations) মাত্র ১টি ত্রুটি, যা পরবর্তী বিশাল অর্জনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
সাম্প্রতিক এক মাসে কোয়ান্টাম কম্পিউটিং ক্ষেত্রটি আবার গতি সঞ্চয় করছে বলে মনে হচ্ছে। দেখা যাচ্ছে, অগ্রগতি দ্রুততর হচ্ছে, সম্ভবত এআই (AI) এবং কোয়ান্টাম (Quantum) ক্ষেত্রের অগ্রগতির পারস্পরিক বিনিময়ের কারণে। এটি কোয়ান্টাম হার্ডওয়্যার (quantum hardware), অ্যালগরিদম (algorithm) এবং ত্রুটিসংশোধনে (error correction) উন্নয়নকে আরো ত্বরান্বিত করছে।
ডেভিড ডয়চ (David Deutsch)-এর কথা আবার উল্লেখ করতে চাই, কারণ তিনি সত্যিই অসাধারণ। তিনি বলেছেন, “কোয়ান্টাম কম্পিউশন হল প্রকৃতি ব্যবহার করার একটি বিশেষভাবে নতুন পদ্ধতি। এটি হবে প্রথম প্রযুক্তি যা সমান্তরাল মহাবিশ্বগুলোর মধ্যে সহযোগিতায় উপকারী কাজ সম্পাদন করতে সক্ষম হবে।” এখানে তিনি বহু-বিশ্ব ব্যাখ্যার (many-world interpretation) দিকে ইঙ্গিত করছেন।
এআই এবং কোয়ান্টামের মিলন
এখন প্রশ্ন হল, যখন আমরা এআই (AI) এবং কোয়ান্টাম (Quantum) একত্র করি তখন কী ঘটে? এখানে তিনটি সম্ভাব্য ফলাফল রয়েছে।
প্রথমত, এআই কোয়ান্টাম কম্পিউটিংয়ের (quantum computing) অগ্রগতিকে ত্বরান্বিত করে, যেটা আমরা একটু আগে দেখলাম। শুধু ত্রুটিসংশোধন নয়, উন্নত কোয়ান্টাম অ্যালগরিদম (quantum algorithm) তৈরিতেও এআই সহায়ক হচ্ছে। যেমন টি-গেট (T-Gate) এর মতো জটিল অপারেশনে উন্নতি।
এআই (AI) ও কোয়ান্টাম (Quantum) পরস্পর-পরিপূরক প্রযুক্তি। এআই কোয়ান্টাম কম্পিউটিংয়ের বিকাশকে গতিময় করতে পারে, কারণ কোয়ান্টাম এখনো অপেক্ষাকৃত তরুণ প্রযুক্তি। আলফাকিউবিট (AlphaQubit) এর সাফল্য এর একটি ভাল উদাহরণ। অপরদিকে, কোয়ান্টাম কম্পিউটিংও এআইকে সহায়তা করতে পারে। কোয়ান্টাম রসায়নে (quantum chemistry) এমন অনেক জটিল ব্যবস্থা রয়েছে যেখানে তীব্র আন্তঃসম্পর্ক (strongly correlated systems) বিদ্যমান। এগুলোকে ক্লাসিকাল কম্পিউটারে সিমুলেট করা অত্যন্ত কঠিন। কিন্তু কোয়ান্টাম কম্পিউটার এই সমস্যার কার্যকর সমাধান দিতে পারে। এর ফলে বাস্তব জীবনে বিশাল প্রভাব পড়তে পারে।
আরেক দিক থেকে দেখা যায়, বর্তমানে এআই-এর বিকাশ ক্লাসিকাল হার্ডওয়্যার (classical hardware) উন্নয়নের চেয়ে দ্রুত এগোচ্ছে। ফলে এত বড় এআই মডেল ট্রেনিং (AI model training) ও পরিচালনা করতে কোয়ান্টাম কম্পিউটিং (quantum computing) ভবিষ্যতে একটি সমাধান হয়ে উঠতে পারে।
আরও একটি বিষয় হল, গবেষকরা দেখিয়েছেন, আমাদের পরিবেশ মূলত কোয়ান্টাম প্রকৃতির (quantum mechanical) এবং কোয়ান্টাম তথ্য থেকে শিখতে (learn from quantum information) কোয়ান্টাম কম্পিউটার ব্যবহার করলে ক্লাসিকাল এআই (classical AI)-এর তুলনায় বহুগুণ বেশি কার্যকর হতে পারে। এটি ক্রমাগত নমুনা বা স্যাম্পল গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা কমিয়ে দেয়।
তবে অন্য কয়েকজন গবেষকের সঙ্গে আলোচনায় উঠে এসেছে, কখনো কখনো এআই (AI) এতটাই শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে যে কিছু কোয়ান্টাম কম্পিউটিং সমস্যাও এআই ব্যবহার করে এমনভাবে সরলীকরণ করা যাবে যাতে সেগুলো ক্লাসিকাল মেশিনেই সমাধানযোগ্য হয়ে ওঠে।
উপসংহার
সব মিলে, এআই (AI) ও কোয়ান্টাম (Quantum) পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী নয়, বরং তারা পরিপূরক। একত্রে কাজ করলে তারা এমন বড় বড় সমস্যা সমাধান করতে সক্ষম হবে যা আলাদাভাবে করা সম্ভব নয়। গুগল (Google), আইবিএম (IBM) এবং অ্যামাজনের (Amazon) মতো বড় কোম্পানিগুলো এই দুটি ক্ষেত্রেই বড় বিনিয়োগ করছে। মনে হচ্ছে, পরবর্তী বড় কম্পিউটিং বিপ্লব হবে এআই এবং কোয়ান্টামের যুগলবন্দী। তবে বিনিয়োগকারীদের কাছে এ দুটি প্রযুক্তি হয়তো প্রতিযোগীর মতো মনে হতে পারে। তাই পোর্টফোলিওতে (portfolio) বৈচিত্র্য রাখাটাও গুরুত্বপূর্ণ।
Leave a Reply