তাপ, শক্তি ও খরচের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় নতুন ট্রানজিস্টর প্রযুক্তি

নতুন প্রযুক্তি

গবেষকরা একটি নতুন ধরনের ট্রানজিস্টর (transistor) উদ্ভাবন করেছেন, যা আধুনিক ইলেকট্রনিকস (electronics)-এর মূল স্তম্ভ হিসেবে পরিচিত। এই নতুন ডিভাইস (device) আগের প্রচলিত ট্রানজিস্টরের তুলনায় প্রায় ১,০০০ গুণ বেশি শক্তি সাশ্রয়ী (energy efficient) এবং প্রায় শূন্য তাপ (heat) উৎপন্ন করে। এটি সম্প্রতি বেশ আগ্রহের সৃষ্টি করেছে, কারণ এই নতুন প্রযুক্তি কম্পিউটিং শিল্পের (Computing industry) কিছু বড় চ্যালেঞ্জ সমাধানে সক্ষম হতে পারে।

চলুন বিষয়টি বিশদভাবে বিশ্লেষণ করি। তাপ (heat) হল আধুনিক কম্পিউটার চিপগুলোর (computer chip) জন্য একটি প্রধান সমস্যা। এটি আপনার ল্যাপটপ (laptop) হোক বা একটি হাই-পারফরম্যান্স জিপিইউ ক্লাস্টার (high performance GPU cluster), কিংবা কোয়ান্টাম কম্পিউটার (Quantum computer)—তাপ উৎপন্ন হওয়া কর্মদক্ষতা (performance) এবং দক্ষতার (efficiency) সীমাবদ্ধতা তৈরি করে। দক্ষতা এখানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। উদাহরণস্বরূপ, বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী সুপারকম্পিউটার ‘ফ্রন্টিয়ার (Frontier)’ এক্সাফ্লপ (exaflop) কর্মদক্ষতার মাইলফলক অর্জন করতে প্রায় ২১ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ ব্যয় করে। সামনে জেটাস্কেল (Zettascale)-এর দিকে তাকালে, এবং যদি আমরা ধরি যে দক্ষতা প্রতি ২ বছরে আনুমানিক দ্বিগুণ হবে, তবে জেটাস্কেল কর্মদক্ষতা অর্জনে প্রায় ৫০০ মেগাওয়াট (500MW) বিদ্যুৎ লাগবে। এক গিগাওয়াট (1GW) বিদ্যুৎ হল একটি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের (nuclear power plant) ক্ষমতার সমান। অর্থাৎ, প্রতিটি ডেটা সেন্টারের (data center) জন্য একটি করে আলাদা পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রয়োজন হয়ে পড়বে। সুতরাং এটি স্পষ্ট যে আমাদের আরও উন্নত সমাধান দরকার।

কোয়ান্টাম কম্পিউটারগুলো (Quantum Computers) আরও বড় সমস্যার সম্মুখীন হয়, কারণ এই যন্ত্রগুলি তাপ একেবারেই সহ্য করতে পারে না। তাপ কোয়ান্টাম অস্থিরতার (Quantum entanglement) সূক্ষ্ম অবস্থা ধ্বংস করে। এজন্য আমরা কোয়ান্টাম সার্কিট (Quantum circuits) শীতল রাখতে বড়, জটিল নির্মাণব্যবস্থা ব্যবহার করি। মূল কথা, এগুলো এমন সব বড় ও জটিল সমস্যা যা সহজে সমাধানযোগ্য নয়। আর ঠিক এই জায়গায় আইবিএম (IBM) এবং সেমিকন (SemiQon) নামক ফিনল্যান্ডের একটি কোম্পানি নতুন ডিভাইস নিয়ে এসেছে।

সেমিকন (SemiQon), একটি ফিনিশ (Finnish) কোম্পানি, বিশ্বের প্রথম এমন একটি ট্রানজিস্টর তৈরি করেছে যা প্রায় শূন্য তাপ অপচয়ে (heat dissipation) কাজ করে। এটি প্রচলিত ট্রানজিস্টরের মাত্র ০.১% বিদ্যুৎ ব্যবহার করে, এবং তাপ উৎপাদন প্রায় ১০০০ গুণ কমায়। এই প্রযুক্তির প্রভাব পড়তে পারে শক্তিশালী ডেটা সেন্টার, উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন কম্পিউটিং (high performance computing), স্পেস-গ্রেড ইলেকট্রনিকস (space grade electronics) এমনকি কোয়ান্টাম কম্পিউটিংয়ের (Quantum Computing) ক্ষেত্রেও।

এখানে উল্লেখযোগ্য বিষয় হল, সাধারণত ট্রানজিস্টরের ক্ষেত্রে এমন অর্ডার-অব-ম্যাগনিটিউড (orders of magnitude) উন্নতি ঘটাতে হলে খুবই দুর্লভ আর্কিটেকচার (exotic architecture) বা অদ্ভুত পদার্থ (exotic materials) ব্যবহার করতে হয়। কিন্তু এবার তা নয়। এই নতুন ডিভাইসগুলো তৈরি হয়েছে তথাকথিত ‘সিলিকন-অন-ইনসুলেটর টেকনোলজি (SOI CMOS technology – Silicon-on-Insulator technology)’ ভিত্তিক CMOS প্রযুক্তি ব্যবহার করে। SOI CMOS ইতোমধ্যেই গাড়ি শিল্প (automotive) এবং ওয়্যারলেস (wireless) শিল্পে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। এর মানে, এই নতুন ট্রানজিস্টরগুলো বিদ্যমান CMOS ফ্যাব্রিকেশন প্ল্যান্টে (CMOS fabrication plants) সহজেই ব্যাপক পরিমাণে উৎপাদন করা যাবে, নতুন কোনো অবকাঠামোর প্রয়োজন হবে না।

এগুলির সাথে ক্লাসিকাল ট্রানজিস্টরের (classical transistor) মিল অনেক। মূল পার্থক্য খালি এই জায়গায় যে, এক্ষেত্রে ক্লাসিকাল ট্রাঞ্জিস্টরের ওপর একটি অতিসূক্ষ্ম সিলিকন স্তর (ultra-thin layer of silicon) একটি ইনসুলেটরের (insulator) উপরে স্থাপন করা হয়, যেখানে প্রচলিত ট্রানজিস্টর বাল্ক সিলিকনের (bulk silicon) উপর নির্মিত হয়। ক্লাসিকাল ট্রানজিস্টরগুলো নিম্ন তাপমাত্রায় ঠিকমতো কাজ করতে পারে না। কারণ তাপমাত্রা কমার সাথে সাথে ট্রানজিস্টর চালু করতে (switch transistor on) প্রয়োজনীয় ভোল্টেজ (voltage) বেড়ে যায়। এ কারণে তাপমাত্রা পরিবর্তনের সাথে ট্রানজিস্টরের কর্মদক্ষতায় অসঙ্গতি দেখা দেয়। এটি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন কম্পিউটিং এবং কোয়ান্টাম যন্ত্রে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়, কারণ উভয় ক্ষেত্রেই নিয়ন্ত্রিত, নিখুঁত কর্মদক্ষতা অত্যন্ত জরুরি।

সেমিকন (SemiQon) দল তাদের নতুন গবেষণাপত্রে দেখিয়েছে কীভাবে তারা নতুন ক্রায়োজেনিক (cryogenic) ডিভাইস ডিজাইন (device design) করে এই সমস্যার সমাধান করেছে। নতুন ট্রানজিস্টরগুলো অত্যন্ত নিম্ন তাপমাত্রায় কাজ করতে পারে এবং তাপমাত্রাগত চাপ (thermal stress) সত্ত্বেও শীতলতা বজায় রাখে।

আইবিএমের উদ্ভাবন এবং এটির তাৎপর্য

এবার আমরা আসি এই প্রযুক্তির গুরুত্ব এবং এর প্রভাবের কথায়। যেহেতু এই ডিভাইসগুলো প্রায় কোনো তাপ তৈরি করে না, তাই এটি শীতলকরণ (cooling) প্রক্রিয়া এবং খরচ উভয়ই নাটকীয়ভাবে হ্রাস করতে পারে। বর্তমানে বিশ্বব্যাপী ডেটা সেন্টারগুলি কুলিং এর পেছনে প্রতিবছর কয়েক বিলিয়ন ডলার ব্যয় করে, এবং এই ব্যয় প্রতি বছর বাড়ছে। নতুন এই প্রযুক্তি টেকসই (sustainable) পথ নির্দেশ করতে পারে এবং ভবিষ্যতে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের দরকার ফুরিয়ে যেতে পারে।

আর কুলিং এর জন্য এত ব্যয়ই হল সেই কারণগুলোর একটি, যেগুলোর জন্য আইবিএম (IBM) ক্রায়োজেনিক ডিভাইস (cryogenic devices) নিয়ে সক্রিয়ভাবে কাজ করে চলেছে। এই ক্রায়োজেনিক ডিভাইসগুলোর যার মধ্যে রয়েছে মেমোরি (memory) এবং ট্রানজিস্টর। তারা দেখেছে যে নিম্ন তাপমাত্রায় এই ডিভাইসগুলো উন্নত কর্মদক্ষতা, কম শক্তি খরচ এবং উন্নত নির্ভরযোগ্যতা (reliability) প্রদর্শন করে।

সাম্প্রতিককালে আইবিএম একটি নতুন ক্রায়োজেনিক প্রয়োগের জন্য তৈরি ট্রানজিস্টর দেখিয়েছে। তারা প্রমাণ করেছে যে ৭৭ কেলভিন (77K) তাপমাত্রায় চালানোর সময় এই ডিভাইস রুম টেম্পারেচারে (room temperature) চালানোর তুলনায় দ্বিগুণ কর্মদক্ষতা (doubled device performance) অর্জন করে।

এই নতুন ট্রানজিস্টর ন্যানোশিট (nanosheet) আর্কিটেকচার ব্যবহার করে তৈরি। এখানে চ্যানেল (channel) একগুচ্ছ পাতলা সিলিকন শীটে বিভক্ত, যেগুলো সম্পূর্ণরূপে গেট (gate) দ্বারা বেষ্টিত। ক্রায়োজেনিক করতে আইবিএম ডুয়াল-মেটাল গেট (dual-metal gates) এবং ডাইপোল (dipoles) সংযুক্ত করেছে। ন্যানোশিট প্রযুক্তি (nanosheet technology) লজিকাল ডিভাইসগুলোকে (logical devices) আরও ক্ষুদ্রায়িত করার পরবর্তী ধাপ। যখন এটি লিকুইড নাইট্রোজেন (liquid nitrogen) কুলিংয়ের সাথে মিলিত হয়, আইবিএম প্রকৃতপক্ষে কর্মদক্ষতাকে দ্বিগুণ করতে পেরেছে।

কোয়ান্টাম প্রযুক্তি এবং ভবিষ্যতের দিগন্ত

অবশ্যই, এই ডিভাইসটি কোয়ান্টাম কম্পিউটার (Quantum computers) উন্নয়নেও বড় মাইলফলক। কোয়ান্টাম কম্পিউটারগুলো খুবই ঠাণ্ডা তাপমাত্রায় পরিচালিত হয়, যা প্রায় অ্যাবসোলিউট জিরো (absolute zero) তাপমাত্রার কাছাকাছি। এখানে তাপ ঢুকে পড়া ঠেকানো খুব কঠিন, কারণ কোয়ান্টাম বিট (qubits) নিয়ন্ত্রণের জন্য যেসব ইলেকট্রনিক্স ব্যবহার করা হয়—সেগুলো ক্লাসিকাল এবং কোয়ান্টামের মধ্যে ইন্টারফেস (interface) হিসেবে কাজ করে, যোগাযোগ করে এবং কিউবিট নিয়ন্ত্রণ করে। বাহ্যিক ইলেকট্রনিক্স ও কন্ট্রোল ওয়্যার (control wires) থেকে আসা তাপ কিউবিটের সূক্ষ্ম অবস্থা বিঘ্নিত করতে পারে।

ভাবুন, যত বড় কোয়ান্টাম সিস্টেম তৈরি হবে, তত বেশি কিউবিট, তত বেশি নিয়ন্ত্রণ তারের দরকার হবে। ফলে তাপমাত্রা কম রাখা আরও কঠিন হবে। এই নতুন ক্রায়োজেনিক ট্রানজিস্টর এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে পারে। যদি আমরা এই ধরনের ক্রায়োজেনিক ট্রানজিস্টর দিয়ে কন্ট্রোল ইলেকট্রনিকস তৈরি করা হয়, তবে সেগুলোকে সরাসরি ক্রায়োস্ট্যাটের (cryostat) ভেতরে বসানো যাবে। এতে বড় আকারের কোয়ান্টাম সিস্টেম তৈরি করা অনেক সহজ হবে এবং অধিক সংখ্যক কিউবিট স্কেল আপ (scale up) করতেও সুবিধা হবে।

ডেটা সেন্টার এবং কোয়ান্টাম কম্পিউটার ছাড়াও, এই ডিভাইসগুলো মহাকাশেও কার্যকর হবে। কারণ সেগুলো খুব ঠাণ্ডা তাপমাত্রায়ও নির্ভরযোগ্যভাবে কাজ করতে পারবে, অতিরিক্ত কোনো হিটিং (heating) বা কুলিং সিস্টেম ছাড়াই।

যদিও এসব উন্নয়ন রোমাঞ্চকর, তবে কিছু চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। প্রথমত, ল্যাব থেকে ব্যাপক উৎপাদনে নিয়ে যেতে সময় লাগবে। দ্বিতীয়ত, খরচের ব্যাপারও আছে—যদিও এগুলো বিদ্যমান প্রযুক্তি দিয়ে তৈরি করা যাবে, তবু ক্রায়োজেনিক পরিবেশ (cryogenic environment) গড়ে তোলার খরচ আছে, বিশেষ করে যদি ডেটা সেন্টারে এ ধরনের ব্যবস্থা গড়া হয়। আর প্রশ্ন হল, বড় বড় প্রযুক্তি সংস্থাগুলো কি ক্রায়োজেনিক সিস্টেমে বিনিয়োগ করবে, যখন অন্যান্য শক্তি সাশ্রয়ের বিকল্প থাকতে পারে? নাকি তারা পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বানিয়েই এগিয়ে যাবে? এটি একটি জটিল সিদ্ধান্তের বিষয়।

এসব চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক এবং এমন এক ভবিষ্যতের আভাস দেয় যেখানে তাপ আর সিস্টেম স্কেল করার ক্ষেত্রে বাধা হয়ে থাকবে না। যদি এই প্রযুক্তি তার প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে পারে, তবে এটি কোয়ান্টাম কম্পিউটার থেকে শুরু করে ডেটা সেন্টার পর্যন্ত সবকিছু পরিবর্তন করতে পারে।

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.