Table of Contents
ভূমিকা
গত সপ্তাহটি সিরিয়ার এখনকার সাবেক একনায়ক বাশার আল-আসাদের (Bashar al-Assad) জন্য অত্যন্ত বিধ্বংসী ছিল। ঘটনাটি শুরু হয় ৩ ডিসেম্বর, যখন বিপ্লবী ইসলামপন্থী মিলিট্যান্ট গ্রুপ হায়াত তাহরির আল-শাম (Hayat Tahrir al-Sham, HTS) একটি আকস্মিক আক্রমণ চালায়। অতি অল্প সময়ের মধ্যে, এই গোষ্ঠী আলেপ্পো (Aleppo) দখল করে, যা তখন সিরিয়ার দক্ষিণ দিকে প্রসারিত হওয়ার ঘাঁটি হিসেবে কাজ করে। পরদিনগুলোতে সিরিয়াজুড়ে এগিয়ে যেতে থাকে তারা। ৭ ডিসেম্বর হোমস (Homs) দখল হওয়ার পর দামাস্কাস (Damascus) অভিমুখে অগ্রযাত্রার পথ সুগম হয়। এর পরের দিনই, অর্থাৎ ৮ ডিসেম্বর, আসাদ তার লোহার মুঠোয় শাসন করা দেশটি লজ্জাজনকভাবে পরিত্যাগ করে পালিয়ে যান। আসাদ শাসনের অবসান হয়েছে। এবং এই পতনের কারণে ইউক্রেনে (Ukraine) রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের (Vladimir Putin) অবস্থান মারাত্মকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছে।
কিন্তু সিরিয়ার এই পতন ইউক্রেনের ক্ষেত্রে কেন বা কীভাবে প্রভাব ফেলবে? এক দেশ থেকে আরেক দেশে এতদূর কীভাবে সামরিক অভিযান প্রভাবিত হতে পারে? এই লেখায় বিশ্লেষণ করা হবে কীভাবে আসাদের পতন রাশিয়ার (Russia) ইউক্রেন দখলের প্রচেষ্টাকে ব্যয়বহুল করে তুলেছে।
আসাদের বর্তমান অবস্থা
আমরা ইতোমধ্যেই আসাদ শাসনের পতনের মূল ঘটনা জেনেছি। এই বিদ্যুৎগতির HTS হামলা সিরিয়াকে (Syria) গ্রাস করে আসাদের ২৪ বছরের শাসনের ইতি টেনেছে। “ইতি টানা” বলতে আসলেই সমাপ্তি—কারণ আসাদ এখন আর দেশে থেকে বিদ্রোহীদের প্রতিহত করার সাহস দেখাচ্ছেন না। তিনি দেশ ত্যাগ করেছেন।
সিরিয়ার সাবেক একনায়ক দেশ ছেড়ে পালানোর আগে চূড়ান্ত আদেশ দিয়েছেন শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তরের। এই নির্দেশ থেকেই স্পষ্ট তিনি কোথায় গিয়েছেন। ৮ ডিসেম্বর রাশিয়ান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় (Russian Foreign Ministry) থেকে প্রকাশিত এক বিবৃতি জানায়, সিরিয়ার একনায়ক রাশিয়ায় আশ্রয় নিয়েছেন—তার দীর্ঘদিনের পৃষ্ঠপোষক ভ্লাদিমির পুতিনের নিরাপদ সান্নিধ্যে।
রাশিয়া দাবী করছে তারা আসাদের প্রস্থানে কোনো ভূমিকা রাখেনি, শুধু তাকে আশ্রয় দিয়েছে। তারা সিরিয়ার ভেতরে সব পক্ষকে সহিংসতা থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানাচ্ছে, অন্যদিকে পুতিনের বাহিনী ইউক্রেনে অগ্রসর হচ্ছে। এটি এক ধরনের ভণ্ডামিপূর্ণ (hypocritical) বার্তা, কিন্তু পুতিনের শাসন এমন দ্বিমুখী কথাই বলে আসছে। অন্যদিকে HTS বিদ্রোহীরা তাদের বিজয় উদযাপন করছে। হোয়াটসঅ্যাপ (WhatsApp)-এ প্রকাশিত এক বার্তায় গ্রুপটির এক শীর্ষ কমান্ডার লিখেছেন, “আমরা দামাস্কাস শহরকে (Damascus) একনায়ক বাশার আল-আসাদের নিপীড়ন থেকে মুক্ত ঘোষণা করছি। বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে থাকা উদ্বাস্তুদের বলছি, মুক্ত সিরিয়া (Free Syria) এখন আপনাদের জন্য অপেক্ষা করছে।”
‘মুক্ত সিরিয়া’—এই শব্দযুগল দীর্ঘকাল আসাদ পরিবারের শাসনে প্রায় অকল্পনীয় ছিল। সোশ্যাল মিডিয়ায় পাওয়া ভিডিওগুলোতে দেখা যাচ্ছে সিরিয়ায় উৎসবমুখর পরিবেশ বিরাজ করছে। মানুষ রাস্তায় নেচে-গেয়ে, পতাকা উড়িয়ে আর আকাশে গুলি ছুঁড়ে আনন্দ প্রকাশ করছে। গাড়িগুলো হর্ন দিচ্ছে, বিদ্রোহী আর সাধারণ মানুষ একসঙ্গে রাশিয়ান ট্যাঙ্কের (Russian tanks) ধ্বংসাবশেষের ওপর দাঁড়িয়ে সেলফি তুলছে—যেসব ট্যাঙ্ক আসাদ তার পতনোন্মুখ শাসন টিকিয়ে রাখতে ব্যবহার করেছিল।
সিরিয়ার ভবিষ্যৎ এখন দেশটির মানুষের হাতে—এমনটাই বলছেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ গাজি আল-জালালি (Mohammed Ghazi al-Jalali), যিনি আসাদের দ্বারা তিন মাস আগে নিয়োগ পেয়ে দায়িত্ব পালন করছিলেন। যদিও আসাদ পালিয়েছেন, আল-জালালি নিজ বাড়িতেই থেকে গেছেন বিদ্রোহীদের দামাস্কাসে প্রবেশকালে। HTS ঘোষণা করেছে, নতুন সরকার ব্যবস্থা গঠিত না হওয়া পর্যন্ত তিনি অন্তর্বর্তী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। আল-জালালি জানিয়েছেন, তিনি দেশ ছেড়ে যেতে ইচ্ছুক নন। “আমি কেবল শান্তিপূর্ণ উপায়ে স্থানান্তরের মাধ্যমে জনপ্রতিষ্ঠান ও রাষ্ট্রীয় অবকাঠামোর কার্যকারিতা নিশ্চিত করতে চাই, নাগরিকদের নিরাপত্তা ও আশ্বাস দেওয়ার জন্য,”—তিনি বলেন। পাশাপাশি তিনি জানান যে, দেশটির জনগণ যে কোনো সরকার গঠন করবে, তিনি তার সঙ্গে সহযোগিতা করতে প্রস্তুত।
সিরিয়া এখন মুক্ত। যুক্তরাষ্ট্রের (United States) প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন (Joe Biden) বলেছেন, “শেষ পর্যন্ত আসাদ শাসনের পতন ঘটেছে।” কিন্তু এখন স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠে—এর সঙ্গে পুতিনের ইউক্রেন দখল প্রচেষ্টার কী সম্পর্ক?
আসাদের পতন ও পুতিনের ইউক্রেন অভিযান: সম্পর্ক কী?
ইউক্রেনে পুতিনের “বিশেষ সামরিক অভিযান” (special military operation) চলছেই। অন্য দেশে একনায়কের পতন কীভাবে ইউক্রেনের যুদ্ধের গতিপ্রকৃতি প্রভাবিত করতে পারে?
মানবাধিকার কর্মী ও পুতিনের কট্টর সমালোচক বিল ব্রাউডার (Bill Browder) ৮ ডিসেম্বর টাইমস রেডিওর (Times Radio) এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “আসাদ ছিল একজন নৃশংস একনায়ক (brutal dictator), যিনি তার নিজের পাঁচ লাখের বেশি মানুষকে হত্যা করেছেন এবং এক কোটি শরণার্থী সৃষ্টির জন্য দায়ী। তিনি এইসব করেছেন ভ্লাদিমির পুতিন ও ইরানের (Iran) সাথে অংশীদারিত্বে।”
এখানেই প্রথম সূত্র পাওয়া যায়—কেন আসাদের পতন পুতিনের জন্য এত ধ্বংসাত্মক। আসাদকে টিকিয়ে রেখে পুতিন বিশ্বমঞ্চে নিজের ক্ষমতা প্রদর্শন করতে পারছিলেন। সিরিয়া ছিল রাশিয়ার এক ক্লায়েন্ট রাষ্ট্র (client state) বা মক্কেল রাষ্ট্রের মতো। সিএনএন (CNN) বলছে, আসাদের পতন রাশিয়ার মধ্যপ্রাচ্যে ক্ষমতা প্রকল্পের ওপর গুরুতর আঘাত হেনেছে। আসাদ ছিলেন পুতিনের মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে শক্তি প্রক্ষেপণের পাদুকাস্বরূপ।
প্রতীকী তাৎপর্য ও ভূরাজনৈতিক ব্যর্থতা
ইউক্রেনে আসাদের পতন বিশেষ এক প্রতীকী বার্তা দেয়। যখন আসাদ রাশিয়ায় পালাচ্ছেন, তখনই ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি (Volodymyr Zelenskyy) যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট-ইলেক্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প (Donald Trump) ও ফ্রান্সের (France) প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ (Emmanuel Macron)-এর পাশে দাঁড়িয়ে প্যারিসের (Paris) বিখ্যাত নটর ডেম ক্যাথেড্রাল (Notre Dame Cathedral)-এর পুনঃউদ্বোধন অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। ২০১৯ সালে আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত এই স্থাপনার পুনরায় উদ্বোধন পুতিনের পক্ষেই এক পরোক্ষ বার্তা।
একদিকে, আসাদের পতন রাশিয়ান প্রভাবের পতনকে প্রতীকীভাবে তুলে ধরে। ইউক্রেনে পুতিনের সাম্রাজ্যবাদী আকাঙ্ক্ষা এখন স্পষ্ট। তার হাতে সম্পদ ফুরিয়ে আসছে এবং তিনি সিরিয়াসহ কয়েকটি মিত্র রাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীল ছিলেন। আসাদ ছিলেন পুতিনের শুরু থেকেই “বিশেষ সামরিক অভিযানের” উচ্ছ্বসিত সমর্থক। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে অভিযান শুরু হলে আসাদ একে “ইতিহাসের সংশোধন” ও সোভিয়েত ইউনিয়নের (Soviet Union) পতনের পর হারানো ভারসাম্য পুনরুদ্ধার হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন।
কিন্তু এখন সেই আসাদই পালিয়ে গেছে। পুতিনের মধ্যপ্রাচ্যের ভিত্তি ভেঙে পড়েছে। অন্যদিকে, জেলেনস্কি বন্ধু জোগাড়ে সক্ষমতার প্রমাণ দিচ্ছেন। নটর ডেম পুনরুদ্ধারের দিনে জেলেনস্কির উপস্থিতি এই বার্তা দেয়—ইউক্রেনের বৈশ্বিক বন্ধুত্ব এখনও দৃঢ়, whereas রাশিয়ার বন্ধনগুলো ভাঙতে শুরু করেছে।
রুশ বাহিনীর সংস্থান সংকট (Resource Crisis)
আসাদের পতন ইউক্রেনের সৈন্যদের মনোবলও বাড়াবে। কীভাবে? প্রশ্ন উঠতে পারে, কেন পুতিন আসাদকে রক্ষা করতে এগিয়ে গেল না? এতদিন তো রাশিয়া আসাদের শাসন টিকিয়ে রেখেছে। HTS আক্রমণের শুরুতে রাশিয়া কয়েকটি বিমান হামলা চালিয়েছিল বিদ্রোহীদের অগ্রগতি রুখতে। কিন্তু তারা সফল হয়নি। আলেপ্পোর এক হাসপাতালে (hospital in Aleppo) রাশিয়ান হামলায় ১২ জন নিহত হয়েছিল, এবং ইদলিবে (Idlib) বিদ্রোহী ঘাঁটিতে কিছু ছোটখাট লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানা ছাড়া রাশিয়ার সাফল্য ছিল নামমাত্র।
এর পর আর কিছুই করেনি রাশিয়া। ব্রাউডারের মতে, কারণ রাশিয়ার কাছে সম্পদ ছিল না। তিনি বলেন, “আমি মনে করি না এটি সচেতন সিদ্ধান্ত, বরং পুতিন এখন চরমভাবে চাপের মুখে। তিনি তার প্রায় সব সামরিক সম্পদ ইউক্রেনে নিয়োজিত করেছেন।”
এই বিষয়টি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। পুতিনের জন্য আসাদকে সমর্থন ধরে রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল, কারণ সিরিয়াতে তিনি মধ্যপ্রাচ্যে শক্ত ঘাঁটি বানিয়েছিলেন। তবুও তিনি তা পারেননি। কারণ তার হাতে পর্যাপ্ত সামরিক সম্পদ নেই। পশ্চিমা সমর্থিত ইউক্রেনীয় বাহিনী রুশ বাহিনীর ওপর এত বিশাল ক্ষয়ক্ষতি চাপিয়ে দিয়েছে যে, রাশিয়া এখন তাদের অতি গুরুত্বপূর্ণ মিত্রকেও রক্ষা করতে অক্ষম।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেন ৮ ডিসেম্বর বলেন, “রাশিয়ান বাহিনীর ওপর পশ্চিমা সমর্থিত ইউক্রেনীয় বাহিনীর দ্বারা আঘাত হানা ব্যাপক ক্ষতি (‘massive damage’), যার ফলে আসাদ তার সবচেয়ে কাছের মিত্রের কাছ থেকে সাহায্য পায়নি।” বাইডেনের মতে, ইউক্রেনে রাশিয়ার বিপর্যয়কর ক্ষয়ক্ষতি সিরিয়ায় পুতিনের কর্তৃত্ব ধরে রাখার ক্ষমতাকে দুর্বল করে দিয়েছে।
অন্য মিত্রদের পরিত্যাগ ও দুর্বল জোটনীতির নজির
ব্রাউডার বলেন, এটি সিরিয়া প্রথম নয় যেখানে পুতিন সম্পদ স্বল্পতার কারণে মিত্রদের পরিত্যাগ করেছেন। আগে আর্মেনিয়াকেও (Armenia) তিনি সহযোগিতা করেননি। ২০২৪ সালের গ্রীষ্মে আর্মেনিয়ার প্রধানমন্ত্রী নিকোল পাশিনিয়ান (Nikol Pashinyan) অভিযোগ করেন, রাশিয়া তাদের প্রতিশ্রুতি রক্ষা না করে বরং আজারবাইজানের (Azerbaijan) সঙ্গে ষড়যন্ত্র করছে।
রাশিয়ার সামরিক সম্পদের সংকট শুধু যুদ্ধক্ষেত্রেই নয়, এর তথাকথিত ‘হাইব্রিড যুদ্ধ’ (hybrid warfare) বা নির্বাচনী প্রভাব বিস্তারের ক্ষেত্রেও স্পষ্ট। ব্রাউডার বলেন “মোল্দোভায় (Moldova) সে (পুতিন) নির্বাচনে হেরেছে”। রোমানিয়াতেও (Romania) রুশ প্রভাব বিস্তার ব্যর্থ হয়েছে। রোমানিয়া ৬ ডিসেম্বর তাদের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন স্থগিত করেছে রাশিয়া-নেতৃত্বাধীন “রাজনৈতিক প্রভাব অপারেশন” (political influence operations)-এর অভিযোগে।
যুদ্ধের পরিসংখ্যান ও ইউক্রেনের মনোবল
ইউক্রেনের অর্থ মন্ত্রণালয় (Ministry of Finance) প্রদত্ত পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে রাশিয়া প্রায় ৭,৫৫,০০০ সৈন্য হারিয়েছে, যারা নিহত বা আহত। ৯,৫০০টির বেশি ট্যাঙ্ক অকার্যকর হয়েছে, ২১,০০০-এর বেশি আর্টিলারি ব্যবস্থা ধ্বংস হয়েছে, প্রায় ২০,০০০ সাঁজোয়া যান হারিয়েছে। প্রতিদিন রাশিয়া নতুন করে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে।
এখন ইউক্রেন দেখছে যে, রাশিয়া এতটাই সম্পদ সংকটে যে আসাদকে রক্ষার মতো সামান্য সামর্থ্যও তাদের নেই। এটি ইউক্রেনীয় সেনাদের মনে আশা জোগাচ্ছে। তারা দেখতে পাচ্ছে রাশিয়ান যুদ্ধযন্ত্রের (war machine) বলের ঘাটতি এতটাই চরম যে, পুতিনকে তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মিত্রকেও ত্যাগ করতে হচ্ছে। এ থেকে ধারণা করা যায়, ইউক্রেনে রাশিয়ান যুদ্ধযন্ত্রের থেমে যাওয়ার সময় খুব বেশি দূরে নয়।
পুতিনের মর্যাদাহানি (Prestige Loss)
আসাদের পতন শুধু সম্পদ সংকটকেই নয়, পুতিনের মর্যাদাও ক্ষুন্ন করেছে। ব্রাউডার বলেন, “এই মুহূর্তটি পুতিনের জন্য চূড়ান্ত অপমানজনক। তিনি তার নাম আর সম্পদ আসাদের পেছনে দিয়েছিলেন। এখন আসাদ অপমানিত, আর সেই অপমান পুতিনকেও স্পর্শ করবে।”
দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে পুতিন নিজেকে রাশিয়ান রাজনীতির “শক্তিশালী মানুষ” (strongman) হিসেবে তুলে ধরেছেন—যাকে কেউ স্পর্শ করতে পারবে না। কিন্তু ২০১৫ সালে শুরু হওয়া সিরিয়ায় রুশ সেনা উপস্থিতি পশ্চিমা আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করে পুতিনকে এক “বিশ্ব নিয়ন্ত্রক শক্তি” হিসেবে উপস্থাপন করতে চেয়েছিল। আসাদ তার কৃতজ্ঞতায় পুতিনকে তার তারতুস (Tartous) নৌ ঘাঁটি ও হমেইমিম (Hmeimim) বিমানঘাঁটি ৪৯ বছরের লিজে দিয়েছিল। এখন সেগুলোও হুমকির মুখে।
রাশিয়ান রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে (state TV) দায় চাপানো হচ্ছে সিরিয়ান সেনাবাহিনীর ওপর। উপস্থাপক ইয়েভগেনি কিসেলেভ (Yevgeny Kiselev) বলছেন, রাশিয়ার অগ্রাধিকার এখন “বিশেষ সামরিক অভিযান অঞ্চলে যা ঘটছে” সেটাই। অর্থাৎ, রাশিয়া সম্পদ স্বল্পতায় ভুগছে। পুতিনের বিশ্বব্যাপী শক্তিমত্তার ভাবমূর্তি নষ্ট হয়েছে।
ইউক্রেনে ইতিবাচক বার্তা ও মিত্র সংগ্রহে সুবিধা
ইউক্রেনের যুদ্ধক্ষেত্রে এই বার্তা প্রতিধ্বনিত হবে। ইউক্রেনীয় বাহিনী জানতে পারবে যে তাদের দৃঢ় প্রতিরোধ পুতিনের সাম্রাজ্যবাদী আকাঙ্ক্ষায় শুধু ইউক্রেন নয়, মধ্যপ্রাচ্যেও এক বিরাট ফাটল ধরিয়েছে। অন্য মিত্রদের জন্যও এটি সতর্কবার্তা—রাশিয়া তার মিত্রদের রক্ষা করতে পারছে না।
পুতিনের এই ব্যর্থতা তাকে নতুন জোট গঠনে আরও অক্ষম করে তুলবে। স্বৈরাচারী নেতৃত্বদেরকে পুতিনের দেয়ার মতো মূল সম্পদ যা আছে তা হচ্ছে তার সামরিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতা। এখন যখন সেটি ক্ষয়িষ্ণু, তখন আর্মেনিয়া, সিরিয়ার মতো জায়গায় পুতিনের সমর্থিত নেতারা হয় পতিত হচ্ছেন, নয়তো পেছন ফিরছেন।
মনে রাখতে হবে, পুতিন সম্প্রতি আরও অপমানের শিকার হয়েছেন—যেমন ২০২৪ সালের আগস্টে কুরস্ক (Kursk) আক্রমণ ও মস্কোতে (Moscow) ইউক্রেনীয় ড্রোন হামলার জন্য। রাশিয়ান জনগণও বুঝতে পারছে পুতিন “শক্তিমান” নন, বরং সঙ্কটে আছেন।
পশ্চিমা সমর্থন ও ট্রাম্পের অবস্থান পরিবর্তন
আসাদের পতনের পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট-ইলেক্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তার ট্রুথ সোশ্যাল (Truth Social) অ্যাকাউন্টে পোস্ট করে জানান, “আসাদ পালিয়েছে। রাশিয়া, রাশিয়া, রাশিয়া, ভ্লাদিমির পুতিনের নেতৃত্বে তাকে আর রক্ষা করতে চায়নি। ইউক্রেনে বিপুল ক্ষয়ক্ষতির পর তাদের আর কোনো আগ্রহ নেই সিরিয়ায়।”
ট্রাম্প বলেন, “এই যুদ্ধ (ইউক্রেন যুদ্ধ) যা কখনোই শুরু হওয়া উচিত ছিল না, তা অনন্তকাল চলতে পারে।” তিনি অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানান, উল্লেখ করেন যে জেলেনস্কি একটি চুক্তিতে আগ্রহী।
ব্রাউডার বলেন, আগে ট্রাম্প জেলেনস্কির প্রতি কিছুটা অবজ্ঞার স্বর প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু এখন তার পোস্ট দেখে মনে হচ্ছে তিনি ইউক্রেনের পক্ষে কিছুটা ঝুঁকছেন। প্যারিসে জেলেনস্কির পক্ষে উষ্ণ সমর্থনও ট্রাম্পকে প্রভাবিত করতে পারে। জেলেনস্কি এর আগে স্কাই নিউজকে (Sky News) বলেছিলেন, যদি ইউক্রেনের এখনও নিয়ন্ত্রণাধীন অংশগুলো ন্যাটোর (NATO) সুরক্ষায় আসতে পারে, তবে তিনি কূটনৈতিকভাবে ভবিষ্যতে রাশিয়া-নিয়ন্ত্রিত অংশগুলো পুনরুদ্ধারের কথা ভাবতে পারেন। যদিও এটি ট্রাম্পের কথিত পরিকল্পনা (যেখানে কিছু দশক ইউক্রেনের ন্যাটো সদস্যপদ হবে না) থেকে কিছুটা ভিন্ন, তবু এটি দেখায় যে জেলেনস্কি একটি সমঝোতার পথে হাঁটতে ইচ্ছুক।
এই পরিস্থিতে আসাদের পতন পুতিনকে দুর্বল দেখাচ্ছে, যা ইউক্রেনকে শান্তির আলোচনায় ভালো অবস্থান এনে দিতে পারে। এটি ট্রাম্পের মতো প্রভাবশালী নেতাদের সমর্থন অর্জনে সহায়ক হতে পারে।
ইউক্রেনের কৌশলগত সুবিধা
প্যারিসে জেলেনস্কির উষ্ণ অভ্যর্থনা দেখিয়েছে যে বিশ্ব এখনও ইউক্রেনের পাশে আছে। ব্রাউডার বলেন, “ট্রাম্পের নিজেদের চোখে বিশ্বে ইউক্রেনের প্রতি সমর্থন দেখা দরকার ছিল। এটি সম্ভবত ইউক্রেনের জন্য খুবই সহায়ক হয়েছে।”
এখন ইউক্রেন এই দূর্বলতা ও গ্লানি কাজে লাগাতে চাইছে। আসাদের পতনের পর ইউক্রেনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে জানায়, “সিরিয়ায় ঘটে যাওয়া ঘটনা দেখায় পুতিন শাসন কতটা দুর্বল। তারা দুই ফ্রন্টে যুদ্ধ করতে অক্ষম এবং ইউক্রেনের বিরুদ্ধে আগ্রাসন অব্যাহত রাখতে তাদের ঘনিষ্ঠ মিত্রদেরও ছেড়ে দিচ্ছে।” এটি সরাসরি ট্রাম্প ও অন্যান্য দেশের প্রতি বার্তা—রাশিয়ান যুদ্ধযন্ত্র ভেঙে পড়ছে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের (European Union) পররাষ্ট্র ও নিরাপত্তা নীতির উচ্চ প্রতিনিধি কায়া কাল্লাস (Kaja Kallas) এক্স (X, সাবেক টুইটার)-এ ৮ ডিসেম্বর পোস্ট করে বলেছেন, “সিরিয়ান শাসনের পতন দেখিয়ে দিচ্ছে আসাদের পৃষ্ঠপোষক রাশিয়া ও ইরানের দুর্বলতা।” ‘দুর্বলতা’ (weak) শব্দটি বারবার ঘুরে ফিরে আসছে—এটি পুতিনের একেবারেই অপছন্দনীয়।
ইউক্রেন এই সুযোগকে হাতছাড়া করতে চায় না। তারা পশ্চিমা দেশগুলোর কাছে আরও অস্ত্র দাবি করছে, “রাশিয়ান সেনাবাহিনীর ওপর চূড়ান্ত আঘাত হানতে”। একই সাথে তারা আলোচনা করার পথও খোলা রাখছে। অর্থাৎ, জেলেনস্কি দেখাতে চাইছেন যে, তিনি শান্তির পথও রেখেছেন, আবার যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার রসদও রাখছেন—যেখানে রাশিয়ার হাত প্রায় শূন্য।
উপসংহার
আসাদের পতন রাশিয়ার জন্য বড় ধাক্কা। এটি দেখিয়েছে যে রাশিয়া তার মিত্রদের রক্ষা করতে অক্ষম, রাশিয়ান সম্পদের ঘাটতি আরও গভীর, পুতিনের ভূরাজনৈতিক ক্ষমতা অনিশ্চিত এবং তার মর্যাদা প্রশ্নের সম্মুখীন। ইউক্রেনের জন্য এটি এক সুবর্ণ সুযোগ—এখন তারা আন্তর্জাতিক সমর্থন আরও জোরদার করতে পারবে, সামরিক ও কূটনৈতিক চাপ অব্যাহত রাখতে পারবে এবং পুতিনের সাথে আলোচনায় আরো সুবিধাজনক অবস্থান অর্জন করতে পারবে।
তথ্যসূত্র
-
https://www.bbc.co.uk/news/articles/c2ex7ek9pyeo
-
https://www.youtube.com/watch?v=xYF4Tl0aBvs
-
https://news.sky.com/story/syrian-president-leaves-damascus-on-plane-reports-13269339
-
https://www.nbcnews.com/news/world/syrian-rebels-claim-captured-capital-damascus-rcna183263
-
https://en.wikipedia.org/wiki/Mohammad_Ghazi_al-Jalali
-
https://edition.cnn.com/2024/12/09/europe/syria-russia-bashar-al-assad-analysis-intl-hnk/index.html
-
https://www.independent.co.uk/news/world/notre-dame-reopening-macron-trump-zelensky-live-b2660508.html
-
https://www.friendsofnotredamedeparis.org/notre-dame-cathedral/fire/
-
https://www.aljazeera.com/news/2022/2/25/syrias-assad-praises-russias-ukraine-invasion-as-correction
-
https://kyivindependent.com/biden-russia-syria/
-
https://www.bbc.co.uk/news/articles/czr7rkzz2gmo
-
https://www.politico.eu/article/armenia-ends-military-alliance-with-russia-pm-nikol-pashinyan-confirms/
-
https://news.sky.com/story/russias-hybrid-attack-on-romanian-election-could-trigger-nato-response-if-proven-13268126
-
https://index.minfin.com.ua/en/russian-invading/casualties/
-
https://www.bbc.co.uk/news/articles/clygege97qwo
-
https://www.atlanticcouncil.org/blogs/new-atlanticist/ukraines-kursk-offensive-marks-putins-third-major-humiliation-of-the-war/
-
https://www.bbc.co.uk/news/articles/cx28jd0114ro
-
https://www.yahoo.com/news/trump-sends-warning-shot-putin-142439255.html
-
https://www.nbcnews.com/politics/2024-election/zelenskyys-meeting-harris-spat-trump-reveal-growing-partisan-divide-uk-rcna172648
-
https://news.sky.com/story/zelenskyy-suggests-hes-prepared-to-end-ukraine-war-in-return-for-nato-membership-even-if-russia-doesnt-immediately-return-seized-land-13263085
-
https://www.kyivpost.com/post/41884
-
https://kyivindependent.com/collapse-of-syrias-assad-regime-highlights-weakness-of-russia-and-iran-eu-representative-for-foreign-affairs-says/
-
https://www.removepaywall.com/search?url=https://www.reuters.com/world/ukraine-says-assads-fall-underscores-russian-weakness-2024-12-08/#google_vignette
Leave a Reply