ইউরোপ (অন্যান্য) সংবাদ

Table of Contents

যুক্তরাজ্য ও পোল্যান্ড: প্রতিরক্ষা চুক্তি ও ইউরোপের সাথে পুনরায় জোট (সংক্ষিপ্ত) (১৭ জানুয়ারি, ২০২৫)

ঐতিহাসিক বিরোধ নিরসনে ইউক্রেন ও পোল্যান্ডের অগ্রগতি (সংক্ষিপ্ত) (১৬ জানুয়ারি, ২০২৫)

ক্রোয়েশিয়ায় বর্তমান প্রেসিডেন্ট পুনঃনির্বাচিত (সংক্ষিপ্ত) (১৩ জানুয়ারি, ২০২৫)

অবশেষে কি ডেনমার্ক থেকে গ্রিনল্যান্ড স্বাধীন হবে? (৮ জানুয়ারি, ২০২৫)

অস্ট্রিয়ায় কোয়ালিশন সংকট: কট্টর ডানপন্থী দলে নজর (সংক্ষিপ্ত) (৬ জানুয়ারি, ২০২৫)

জর্জিয়ার ব্যাপক বিক্ষোভ কীভাবে শেষ হবে? (১৯ ডিসেম্বর, ২০২৪)

ভূমিকা

গত তিন সপ্তাহ ধরে জর্জিয়ায় (Georgia) ব্যাপক গণবিক্ষোভ চলছে। প্রায় ৪ মিলিয়ন জনসংখ্যার এই ককেশীয় (Caucasus) দেশটি রাশিয়া (Russia), আজারবাইজান (Azerbaijan), আর্মেনিয়া (Armenia) এবং তুরস্কের (Turkey) মাঝখানে অবস্থিত। বহু মাস, এমনকি বছরের পর বছর ধরে চলা রাজনৈতিক অস্থিরতার পর, ২০২৪ সালের শেষের দিকে অনুষ্ঠিত একটি কারচুপিপূর্ণ সংসদীয় নির্বাচনে (parliamentary election) প্রো-রাশিয়ান (pro Russian) দল জর্জিয়ান ড্রিম (Georgian Dream, GD) ক্ষমতা আরো মজবুত করে, যেখানে তারা আনুমানিক ৫৪% ভোট পেয়েছে বলে দাবি করা হয়।

এরপর, শনিবার জর্জিয়ান ড্রিম ঘোষণা করে যে সাবেক ফুটবলার থেকে রাজনীতিবিদ বনে যাওয়া মিখেইল কাভেলাশভিলি (Mikheil Kavelashvili) ২২৫ সদস্যের ইলেক্টোরাল কলেজ থেকে ২২৪ ভোট পেয়ে প্রেসিডেন্ট (President) নির্বাচিত হয়েছেন। কিন্তু এখানে একটা বড় প্রশ্ন হল—তিনি একমাত্র প্রার্থী ছিলেন। কারণ জর্জিয়ার প্রধান চারটি বিরোধী দল পার্লামেন্ট (Parliament) বয়কট করার সিদ্ধান্ত নেয়, দাবি করে যে নির্বাচনের ফলাফল ভুয়া।

এদিকে, পশ্চিমপন্থী (western aligned) বিদায়ী প্রেসিডেন্ট সালোমে জুরাবিশভিলি (Salome Zurabishvili, Salome Zourabichvili) (যিনি প্যারিসে (Paris) জন্মগ্রহণ করেছিলেন) দপ্তর ছাড়তে অস্বীকৃতি জানাচ্ছেন। তিনি অক্টোবরের নির্বাচনের ফলাফলকে “প্রহসন” বলে অভিহিত করে বলেছেন, “আমি কোথাও যাচ্ছি না, কাউকেই ছাড়ব না। আমি এখানে আছি কারণ এই মুহূর্তে এই দেশটিকে বৈধ প্রতিষ্ঠান প্রয়োজন।”

এই নিবন্ধে ব্যাখ্যা করা হবে কিভাবে জর্জিয়ায় বর্তমান রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলার উৎপত্তি হয়েছে, কীভাবে আজকের ব্যাপক বিক্ষোভ শুরু হলো, এবং সম্ভাব্য কোন পথে এই বিক্ষোভের পরিসমাপ্তি হতে পারে।

সাম্প্রতিক রাজনৈতিক অস্থিরতার পটভূমি

জেনে রাখার প্রধান বিষয় হল, জর্জিয়ান ড্রিম (Georgian Dream, GD) দল গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় রয়েছে। ২০১২ সালের নির্বাচনে ছয়টি দলের একটি জোট হিসেবে জয়ী হয়ে তারা ক্ষমতায় আসে। তারা রাশিয়ার সাথে একটি বাস্তববাদী সম্পর্ক বজায় রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, একইসঙ্গে একটি প্রো-পশ্চিমা (pro Western) পররাষ্ট্রনীতি অব্যাহত রাখার কথা বলেছিল।

কিন্তু সময়ের সাথে সাথে দলটি ক্রমশ আরো কর্তৃত্ববাদী (authoritarian) ও রুশপন্থী হয়ে উঠেছে। ২০১৯ সালের জুন মাসে জনগণের অসন্তোষ চরমে ওঠে, যখন জিডি (GD) একজন রুশ এমপি সের্গেই গাভ্রিলভকে (Sergei Gavrilov) খ্রিস্টীয় অর্থোডক্সি (Christian Orthodoxy) নিয়ে পার্লামেন্টে একটি অধিবেশন খোলার আমন্ত্রণ জানায়। ওই সময় গাভ্রিলভ জর্জিয়ার উত্তরের দুটি অঞ্চল—আবখাজিয়া (Abkhazia) এবং সাউথ ওসেটিয়ার (South Ossetia) স্বাধীনতাকে সমর্থনসূচক মন্তব্য করেন। উল্লেখ্য আবখাজিয়া (Abkhazia) এবং সাউথ ওসেটিয়া ২০০৮ সালে রাশিয়ান আগ্রাসনের পর থেকে রাশিয়ার দখলে রয়েছে এবং এগুলো নিয়ে রাশিয়া জর্জিয়ার প্রায় ২০% ভূখণ্ড দখল করে আছে।

যাই হোক, গাভ্রিলভকে এই আমন্ত্রণ জানাবার ফলে পার্লামেন্ট কক্ষে ও বাইরে প্রবল ক্ষোভের সঞ্চার হয়। পার্লামেন্ট ভবনের বাইরে বিক্ষোভ সহিংস হয়ে ওঠে, শত শত মানুষ আহত বা গ্রেফতার হয়। ইউরোপীয় ধাঁচের উদারপন্থী দল ইউরোপীয় জর্জিয়া (European Georgia Party)-এর এমপি এলেনে খোশতারিয়া (Elene Khoshtaria) জর্জিয়ান ড্রিমকে অভিযুক্ত করে বলেন, তারা “রাশিয়ান দখলদারদের” (Russian occupiers) এনে স্পিকারের আসনে বসিয়ে সাম্প্রতিক জর্জিয়ান ইতিহাসকে অপমান করেছে।

মাসের পর মাস ধরে চলা এই বিক্ষোভে জনগণ জিডি (Georgian Dream) সরকারের পদত্যাগ ও নির্বাচনী সংস্কার দাবি করে। কিছু কিছু ছাড় দেওয়া হলেও (যেমন প্রধানমন্ত্রী মামুকা বাকতাদজে (Mamuka Bakhtadze)-র পদত্যাগ এবং সংসদে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (proportional representation) ভিত্তিক আসন বৃদ্ধির প্রতিশ্রুতি) ২০২০ সালের সংসদীয় নির্বাচনের ফলাফল আবারও সহিংস বিক্ষোভের জন্ম দেয়। ছয় মাসেরও বেশি সময় ধরে চলা এই অস্থিরতা বিরোধী দলগুলো ভোট কারচুপি ও জালিয়াতির অভিযোগ তুলেছিল।

শেষপর্যন্ত ইউরোপীয় ইউনিয়ন (EU) হস্তক্ষেপ করে সঙ্কট নিরসনে উদ্যোগী হয়। ইউরোপীয় কাউন্সিলের (European Council) প্রেসিডেন্ট চার্লস মিশেল (Charles Michel) মার্চ মাসে জর্জিয়া সফর করে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইরাকলি গারিবাশভিলি (Irakli Garibashvili) এবং বিরোধী দলের মধ্যে সমঝোতার চেষ্টা করেন।

বর্তমানে কী ঘটছে?

বর্তমানে, জর্জিয়া ব্যাপী টানা তিন সপ্তাহ ধরে বিক্ষোভ চলছে। পুলিশের দ্বারা টিয়ার গ্যাস (tear gas) ও জলকামান (water cannons) ব্যবহারের খবর পাওয়া গেছে। এই বিক্ষোভ মূলত তিনটি বিষয়কে কেন্দ্র করে—

  • ১. অক্টোবরের সংসদীয় নির্বাচনের ফলাফল।
  • ২. কমপক্ষে ২০২৮ সাল পর্যন্ত ইইউ-তে (EU) অন্তর্ভুক্তির আলোচনা স্থগিত করার সিদ্ধান্ত।
  • ৩. ফুটবলার থেকে রাজনীতিবিদ বনে যাওয়া মিখেইল কাভেলাশভিলিকে (Mikheil Kavelashvili) প্রেসিডেন্ট পদে নিয়োগ।

নির্বাচনী কারচুপি ও এর প্রতিক্রিয়া

প্রথমত, ২০২৪ সালের অক্টোবরের নির্বাচনকে ব্যাপকভাবে জালিয়াতিপূর্ণ বলে গণ্য করা হয়, যার ফলে জিডি আনুষ্ঠানিকভাবে ৫৩.৯% ভোট পায়। প্রো-পশ্চিমা কোয়ালিশন ফর চেঞ্জ (Coalition for Change) দ্বিতীয় স্থানে মাত্র ১১% ও পশ্চিমাপন্থী ইউনাইটেড ন্যাশনাল মুভমেন্ট (United National Movement) তৃতীয় স্থানে ১০.২% ভোট পায়। কিন্তু রাজধানী তিবিলিসি (Tbilisi) এবং অন্যান্য বড় শহরে জিডি বিশাল ব্যবধানে হারে।

গ্রামীণ এলাকায় নির্বাচনী জালিয়াতির অভিযোগ মানুষের ক্ষোভকে আরও বাড়িয়ে দেয়। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান ভোটারদের আগেভাগে জিডি মার্কা করা ব্যালট দেওয়া হচ্ছে, জিডি সমর্থকদের একাধিক ব্যালট দেওয়া হচ্ছে, এমনকি ব্যালট বাক্সে জাল ব্যালট ঢুকানো হচ্ছে। প্রেসিডেন্ট জুরাবিশভিলি (Zourabichvili) নির্বাচনের ফলাফলকে “জাল” বলে অভিহিত করেন এবং দাবি করেন দেশটি রাশিয়ান বিশেষ অপারেশনের (Russian special operation) শিকার হয়েছে।

ইইউ-সংযুক্তির আলোচনা স্থগিতের সিদ্ধান্ত

পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়, যখন জিডি সরকার অন্তত ২০২৮ সাল পর্যন্ত ইইউ-তে অন্তর্ভুক্তির (EU accession) আলোচনা স্থগিত করে। জর্জিয়া দীর্ঘদিন ধরে রঙিন বিপ্লবের (colour revolutions) মধ্য দিয়ে গিয়েছে, যা পোস্ট-সোভিয়েত (post Soviet) দেশগুলোতে সরকার ও সমাজ পরিবর্তনের আন্দোলন হিসেবে পরিচিত। ২০০৩ সাল থেকে এই প্রবণতা দেখা গেছে, এবং এর পর থেকে ইইউ-তে যোগদানের পক্ষে জনসমর্থন ৮০% পর্যন্ত বেড়েছে বলে সাম্প্রতিক জরিপে উঠে এসেছে।

২০২৩ সালের নভেম্বরে জর্জিয়ার ইইউ-তে অন্তর্ভুক্তির একটি মর্যাদা (candidate status) পাওয়ার চেষ্টা ছিল, কিন্তু এক বিতর্কিত “ফরেন এজেন্টস ল” (foreign agents law) (যা কোনো এনজিও (NGO) বা মিডিয়া প্রতিষ্ঠান ২০% এর বেশি বিদেশি তহবিল পেলে তাদের “বিদেশি এজেন্ট” হিসেবে নিবন্ধন করতে বাধ্য করে) ইইউ ও জর্জিয়ার সম্পর্কে চির ধরায়। এই আইন রাশিয়ার ২০১২ সালের আইনকে অনুকরণ করে করা হয়েছে বলে মনে করা হয়। ইইউ মনে করে এই আইন তাদের উদ্দেশ্য ও আদর্শের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

ফলে প্রতিবাদ আরও তীব্র হয়েছে। গত সপ্তাহে ইউরোপের বিভিন্ন দেশের ছয়জন এমইপি (MEP, Member of European Parliament) জর্জিয়ায় গিয়ে এই বিক্ষোভে যোগ দেন। ইইউ জর্জিয়ান ড্রিমকে “পরিস্থিতির নিরসন” করে জনগণের জীবনকে নিরাপদ করার আহ্বান জানায়। এদিকে এই মাসের শুরুতে ইউক্রেন (Ukraine), এস্তোনিয়া (Estonia), লাটভিয়া (Latvia) এবং লিথুয়ানিয়া (Lithuania) সহ তিনটি ইইউ সদস্য দেশ জর্জিয়ার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা (sanctions) আরোপ করেছে ক্রমবর্ধমান সহিংসতার প্রতিবাদে।

ফুটবলার থেকে প্রেসিডেন্ট: কাভেলাশভিলি

তৃতীয়ত, মিখেইল কাভেলাশভিলির (Mikheil Kavelashvili) প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচিত হওয়াও বিক্ষোভের আরেকটি প্রধান কারণ। তিনি ম্যানচেস্টার সিটির (Manchester City) সাবেক খেলোয়াড় ছিলেন এবং একমাত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে জয়ী হন, কারণ বিরোধী দলগুলো এই “প্রহসনমূলক” নির্বাচন বর্জন করেছিল। বিক্ষোভকারীরা তিবিলিসির সরকারি স্কয়ারে ফুটবল নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করে, কেউ কেউ ডিগ্রি (university degree) নিয়ে ব্যঙ্গ করে বোঝাতে চায় যে কাভেলাশভিলির শিক্ষাগত যোগ্যতা নেই।

তবে হাসি-ঠাট্টার বাইরে, সমালোচকরা বলেন কাভেলাশভিলির নিয়োগ আসলে জর্জিয়ান ড্রিমের প্রতিষ্ঠাতা প্রো-রাশিয়ান ওলিগার্ক (oligarch) বিদজিনা ইভানিশভিলি (Bidzina Ivanishvili)-র রাষ্ট্রযন্ত্র দখলের চূড়ান্ত পর্যায়।

বিক্ষোভের তীব্রতা ও সম্ভাব্য পরিণতি

বিক্ষোভ দিন দিন তীব্রতর হচ্ছে। এখন পর্যন্ত প্রায় ৪০০ জন বিক্ষোভকারী গ্রেফতার হয়েছেন, যাদের মধ্যে বিরোধী নেতা ও কর্মীও আছেন। ১০০ জনের বেশি আহত হয়েছেন এবং ৫০ জনের বেশি সাংবাদিক সহিংসতার শিকার হয়েছেন বলে জানা গেছে।

এখন প্রশ্ন হল, এই সংকটের পরিসমাপ্তি কীভাবে হবে? কোনো নিশ্চয়তা নেই, কিন্তু কিছু সম্ভাব্য পথ আছে। প্রথমত, ইইউ পার্লামেন্ট (EU Parliament) অক্টোবরের নির্বাচনের পরে যে প্রস্তাবনা করেছিল তার আলোকে আন্তর্জাতিক তত্ত্বাবধানে বা পুরনো কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশনের (Central Election Commission) অধীনে নতুন করে নিরপেক্ষ নির্বাচন করা যেতে পারে। কিন্তু জর্জিয়ার সাংবিধানিক আদালত (Constitutional Court) ইতোমধ্যে সব পুনর্বিবেচনার আবেদন খারিজ করে ৩ ডিসেম্বর নির্বাচনের ফলাফলকে বৈধতা দিয়েছে।

ফলে শীঘ্রই সুষ্ঠু ও স্বাধীন নির্বাচন আয়োজন করা কঠিন। যদি বিদায়ী প্রেসিডেন্ট জুরাবিশভিলি কোনো উপায় বার করতে না পারেন (সম্ভবত ইউরোপীয় কিছু পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সহায়তায়) তবে ২৯ ডিসেম্বর তার ক্ষমতাচ্যুতির পূর্বে কাভেলাশভিলি (Kavelashvili) দায়িত্ব বুঝে নেবেন। এর ফলে বিক্ষোভ আরও চরম রূপ নিতে পারে, হয় তারা ভূগর্ভস্থ প্রতিরোধে যেতে পারে, নয়তো রাষ্ট্রের সহিংস দমন-পীড়নের মাধ্যমে বিক্ষোভ দমিয়ে ফেলা হতে পারে।

উপসংহার

জর্জিয়ায় চলমান গণবিক্ষোভকে কেন্দ্র করে যে রাজনৈতিক সংকট তৈরি হয়েছে, তার ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। রাশিয়ান প্রভাব, ইইউ-তে অন্তর্ভুক্তির আলোচনা স্থগিত হওয়া, বিতর্কিত আইন এবং একটি প্রশ্নবিদ্ধ প্রেসিডেন্ট নির্বাচন—সব মিলিয়ে দেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ এক সংঘাতময় মোড়ে এসে দাঁড়িয়েছে। ভবিষ্যতে কী ঘটবে, সেটা নির্ভর করছে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক উদ্যোগ, বিরোধী দল ও সাধারণ মানুষের প্রতিরোধের ধরন এবং জর্জিয়ান ড্রিম সরকারের পদক্ষেপের ওপর।

তথ্যসূত্র

Georgian Elections
https://www.bbc.co.uk/news/articles/c5ygejxej28o
https://www.iri.org/news/georgias-electoral-transformation-landmark-elections-under-new-rules/
https://www.zois-berlin.de/en/publications/georgia-on-the-way-to-proportional-representation

Ongoing Protests
https://www.euronews.com/2024/12/11/georgian-anti-government-protests-enter-twelfth-night-amidst-intensifying-policing
https://www.politico.eu/article/georgia-protest-georgian-dream-russia-president-mikheil-kavelashvili/
https://www.economist.com/europe/2024/12/15/protests-threaten-georgias-kremlin-friendly-government
https://www.ft.com/content/2f47848f-be5f-4bc0-a63d-7edc6bf98cfa

Past Protests
https://www.ft.com/content/0cb1cb9a-55c7-45af-88a2-bf5dd5d183d9
https://civil.ge/archives/309180
https://apnews.com/article/0fc953dda67c4535ad18b5c54b3537ac

EU Response
https://www.politico.eu/article/georgia-election-was-not-fair-must-be-re-run-european-parliament-statement-membership-candidacy-eu/
https://www.euronews.com/my-europe/2024/12/13/eu-parliament-delegation-visits-georgia-and-marches-with-pro-eu-protesters
https://www.politico.eu/article/estonia-latvia-lithuania-baltic-countries-sanctions-georgian-officials-protests-violence-georgia-eu-accession-enlargement/
https://www.consilium.europa.eu/en/policies/enlargement/georgia/

How does it end?
https://ecfr.eu/article/time-is-running-out-for-the-eu-to-help-safeguard-georgias-future/

আয়ারল্যান্ড (Ireland)-ইসরায়েল (Israel) কূটনৈতিক বিরোধের ক্রমবর্ধমান উত্তেজনা (১৮ ডিসেম্বর, ২০২৪)

আয়ারল্যান্ড (Ireland) এবং ইসরায়েল (Israel)-এর মধ্যে বিদ্যমান কূটনৈতিক বিরোধ আরও গভীরতর হয়েছে। ইসরায়েল (Israel) সম্প্রতি ডাবলিনে (Dublin) অবস্থিত নিজেদের দূতাবাস বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ইসরায়েলের (Israel) পররাষ্ট্রমন্ত্রী গিদিয়ন সা’র (Gideon Saar) এই সিদ্ধান্তের কারণ হিসেবে আয়ারল্যান্ডের (Ireland) সরকারকে চিহ্নিত করেছেন, যাদের নীতিকে তিনি চরম পর্যায়ের “অ্যান্টি-ইসরায়েল (anti Israel)” বলে বর্ণনা করেছেন। ইসরায়েলি (Israeli) পররাষ্ট্রমন্ত্রীর অভিযোগ অনুযায়ী, আয়ারল্যান্ড (Ireland) ফিলিস্তিন (Palestinian) রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেওয়া, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে (International Criminal Court – ICC) ইসরায়েলি (Israeli) নেতাদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলাকে সমর্থন করা, এবং আন্তর্জাতিক আদালতে বিচার (International Court of Justice – ICJ)-এ ইসরায়েলের (Israel) বিরুদ্ধে দক্ষিণ আফ্রিকার (South Africa) মামলাকে সহযোগিতা করা—এসবই ইসরায়েলের (Israel) প্রতি আয়ারল্যান্ডের (Ireland) শত্রুতামূলক মনোভাবের প্রমাণ।

ইসরায়েলের (Israel) ডাবলিন দূতাবাস জানায় যে আয়ারল্যান্ড (Ireland) বৈধ সমালোচনার সীমা অতিক্রম করেছে এবং তাদের কর্মকাণ্ড ও ভাষ্য ইসরায়েলকে (Israel) প্রশ্নবিদ্ধ ও অগ্রহণযোগ্যভাবে হেয় করার চেষ্টা করছে।

অন্যদিকে আয়ারল্যান্ডের (Ireland) তাইশাখ (Taoiseach) বা প্রধানমন্ত্রী সাইমন হ্যারিস (Simon Harris) ইসরায়েলের (Israel) এই পদক্ষেপকে “বিভ্রান্তিকর কূটনীতি (diplomacy of distraction)” বলে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, “আপনি জানেন আমি কোন জিনিসটাকে নিন্দা করি? শিশু হত্যা। আমি মনে করি এটি নিন্দনীয়।” তিনি আরও বলেন, গাজায় (Gaza) যে বিপুল সংখ্যক বেসামরিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে তা অত্যন্ত উদ্বেগজনক এবং আয়ারল্যান্ড (Ireland) বরাবরই ফিলিস্তিনিদের (Palestinians) পক্ষ অবলম্বন করে কথা বলে আসছে বলে তিনি গর্বিত।

এই বাদানুবাদের পর ইসরায়েলের (Israel) পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাইমন হ্যারিসকে (Simon Harris) ইহুদিবিদ্বেষী (anti Semitic) বলে আখ্যায়িত করেন এবং ইসরায়েলের (Israel) বিরুদ্ধে উত্থাপিত শিশুদের উপবাসে রাখা বা সাহায্য পাঠাতে বাধা দেওয়ার অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেন। জবাবে সাইমন হ্যারিস (Simon Harris) জানান, তিনি ইসরায়েলি (Israeli) সরকারের কাছ থেকে আসা ব্যক্তি-নির্দিষ্ট এবং মিথ্যা অভিযোগের জবাব দেবেন না।

আয়ারল্যান্ডের (Ireland) প্রেসিডেন্ট মাইকেল ডি. হিগিন্স (Michael D. Higgins) অবশ্য ইসরায়েলি (Israeli) রাজনৈতিক নেতৃত্বের এই ধরনের মন্তব্যের প্রত্যুত্তর দিয়েছেন। মঙ্গলবার একটি অনুষ্ঠানে, যেখানে তিনি ফিলিস্তিনি (Palestinian) রাষ্ট্রদূতের পরিচয়পত্র গ্রহণ করছিলেন, প্রেসিডেন্ট হিগিন্স বলেন, আয়ারল্যান্ডের (Ireland) জনগণকে ইহুদিবিদ্বেষী (antisemitism) বলা “গভীর অপবাদ (deep slander)”। তিনি বলেন, আয়ারল্যান্ড (Ireland) ইসরায়েলি (Israeli) প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর (Benjamin Netanyahu) কর্মপন্থা এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন, প্রতিবেশী তিনটি রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন ইত্যাদি কারণে তার বিরোধিতা করছে। আয়ারল্যান্ডের (Ireland) ইতিহাসের কারণে “উচ্ছেদ (dispossession), দখলদারিত্ব (occupation)” ইত্যাদি শব্দের মর্ম আয়ারল্যান্ডের (Ireland) মানসে গভীরভাবে প্রোথিত।

আইরিশ ইন্ডিপেন্ডেন্ট (Irish Independent) পত্রিকা জানায়, আইরিশ সরকার (Irish government) এই বিরোধের সম্ভাব্য পরিণতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। তারা উল্লেখ করে যে ইসরায়েল (Israel) দূতাবাস বন্ধের ক্ষেত্রে আয়ারল্যান্ডকে (Ireland) বিশেষভাবে বেছে নেওয়া হওয়াটা বেশ তাৎপর্যপূর্ণ।

অন্যদিকে, মধ্যপ্রাচ্য (Middle East) থেকে আসা খবরে গাজায় (Gaza) যুদ্ধবিরতির সম্ভাবনা বাড়ছে বলে জানা যাচ্ছে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও পর্যবেক্ষকরা সতর্ক আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন যে হয়তো শিগগিরই একটি চুক্তি স্বাক্ষর হতে পারে। গাজা (Gaza) স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা সোমবার জানান, গত ১৪ মাস ধরে চলা যুদ্ধের মধ্যে এখন পর্যন্ত বিপুল সংখ্যক মানুষের মৃত্যু হয়েছে।

কেন আয়ারল্যান্ড হচ্ছে ইউরোপীয় ইউনিয়নে সবচেয়ে ফিলিস্তিনপন্থী সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে হলে এখানে যান।

তথ্যসূত্র

হাঙ্গেরিতে এটাই কি ওরবান (Orbán)-এর শাসনের অবসানের সূচনা? (১৭ ডিসেম্বর, ২০২৪)

ভূমিকা

হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর ওরবান (Viktor Orban) এখন তার পঞ্চম মেয়াদে আছেন এবং দীর্ঘদিন ধরেই ইউরোপীয় ইউনিয়নের (EU) “সমস্যাসৃষ্টিকারী” নেতা হিসেবে পরিচিত। ২০১০ সালে তার শাসনের সূচনা থেকে ওরবান-এর জাতীয়তাবাদী রক্ষণশীল দল ফিদেস বা হাঙ্গেরিয়ান সিভিক অ্যালায়েন্স (Fidesz – Hungarian Civic Alliance) বারবার নতুন বিরোধী জোটের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে গেছে। এসব চ্যালেঞ্জ তিনি এতদিন ঝরে ফেলতে পেরেছেন, দেশকে দৃঢ়ভাবে তার হাতের মুঠোয় রেখেছেন। কিন্তু সম্ভবত এই প্রথমবারের মতো বিরোধীরা সত্যিকারের সুযোগ পেতে যাচ্ছে ওরবানকে ক্ষমতা থেকে সরানোর। তার কারণ হচ্ছে কেন্দ্রঘেঁষা টিসজা বা রেস্পেক্ট অ্যান্ড ফ্রিডম পার্টি (TISZA – Respect and Freedom Party) এখন এতটাই গতিময় যে, তার তরুণ ও ক্যারিশম্যাটিক নেতা পিটার মাগইয়ার (Peter Magyar)—যিনি নিজেও একসময় ফিদেস-এর সদস্য ছিলেন—হাঙ্গেরির ২০২৬ সালের নির্বাচনের আগে দৃঢ় অগ্রগতি দেখাচ্ছেন। সম্প্রতি জনমত জরিপে (opinion polls) এই টিসজা পার্টি ফিদেসকে পেছনে ফেলতে সমর্থ হয়েছে।

এই লেখায় সাম্প্রতিক জরিপের তথ্য বিশ্লেষণ করা হবে, ব্যাখ্যা করা হবে কেন ওরবান-এর ফিদেস দলের সমর্থন কমছে এবং এ থেকে সত্যিই ওরবান-এর শাসনের পরিসমাপ্তির আভাস পাওয়া যায় কিনা।

সাম্প্রতিক জনমত জরিপের চিত্র

প্রথমেই আসি সর্বশেষ জরিপের দিকে। পলিটিকো’স পোল এ্যাগ্রেগেটর (Politico’s poll aggregator) অনুযায়ী, ওরবান-এর জাতীয়তাবাদী রক্ষণশীল ফিদেস (Fidesz) দল এক দশকের মধ্যে মাত্র দ্বিতীয়বারের মতো বিরোধীদের কাছে পিছিয়ে পড়েছে (প্রথমবার ছিল ২০২১ সালের শুরুর দিকে অল্প সময়ের জন্য)। ২০২২ সালের জাতীয় নির্বাচনে ফিদেস ৫২.৫% ভোট পেয়েছিল, কিন্তু সেই থেকে তাদের জনপ্রিয়তা দ্রুত কমেছে এবং এখন তা ৩৯%-এ নেমে এসেছে।

নভেম্বরের শেষের দিকে করা কিছু হাঙ্গেরিয়ান জরিপ, যেমন সাজার্দভেগ রিসার্চ (Századvég Research)-এর জরিপ দেখায় ফিদেসের জনপ্রিয়তা ৩৫%-এ নেমে গেছে, যেখানে টিসজা পার্টি (Teaser Party) ৪ পয়েন্টে এগিয়ে আছে। এটি ওরবান ক্ষমতায় আসার পর থেকে ফিদেস-এর সবচেয়ে নিম্নমুখী পর্যায়গুলোর একটি। প্রসঙ্গত, ২০১০ সাল থেকে প্রতি নির্বাচনে ফিদেস প্রায়ই জয়ী হয়ে আসছে, এবং তাদের জনমত সমর্থন খুব কমই মাঝের-৩০ শতাংশের নিচে নামতো।

অন্য আরেকটি হাঙ্গেরিয়ান জরিপ (একটি সংবাদমাধ্যমের দ্বারা পরিচালিত) দেখিয়েছে যে নিশ্চয়ই ভোট দেবেন এমন ভোটারদের মধ্যে টিসজা ৪৭% এবং ফিদেস ৩৬% সমর্থন পাচ্ছে। একই জরিপে দেখা যায়, অক্টোবরের মাঝামাঝি সময়ে মোট ভোটারদের মধ্যে ফিদেসের সমর্থন ছিল ৩২%, যা নভেম্বরের শেষ নাগাদ ২৭%-এ নেমে এসেছে। একইসঙ্গে “সরকার পরিবর্তন চাই” এমন ভোটারের সংখ্যাও বেড়েছে।

এই সাম্প্রতিক নিম্নগতি গত কয়েক মাসের ধারাবাহিক ধীর পতনের ফল। টিসজা পার্টি এ মুহূর্তে এমন গতিশীলতা অর্জন করেছে যা ওরবান প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায় বিরোধী শিবির খুব একটা দেখাতে পারেনি।

ওরবান সরকারের জনপ্রিয়তা কেন কমছে?

যদিও আগেও ওরবান-বিরোধী চ্যালেঞ্জ ছিল, যেমন লেফট ইউনিটি পার্টি, রক্ষণশীল জোব্বিক (Jobbik) পার্টি বা ইউনাইটেড ফর হাঙ্গেরি (United for Hungary) মুভমেন্ট, কিন্তু ওরবান খুব সহজেই তাদের প্রতিহত করেছেন। এর একটি প্রধান কারণ ছিল এদের নেতৃত্বের অদক্ষতা, এলিটধর্মী ভাবমূর্তি, বা কোয়ালিশনগুলোর অত্যধিক মতাদর্শিক বৈচিত্র্য—যেগুলো মূলত “ওরবান-বিরোধিতা” ছাড়া আর কোনও ঐক্যবদ্ধ লক্ষ্য নিয়ে এগোতে পারেনি।

ফিদেস-এর সাম্প্রতিক পতন কমপক্ষে দুটি পরিপূরক বিষয় দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে –

  • প্রথমত, হাঙ্গেরির মানুষ হয়তো ওরবানকে নিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে।
  • দ্বিতীয়ত, পিটার মাগইয়ার (Peter Magyar) নামের এক নতুন মুখের আগমন ঘটেছে, যাকে এখনকার বিরোধী নেতৃত্বের তুলনায় বেশী দক্ষ ও পরিকল্পনামুখী মনে করা হচ্ছে।

ঐতিহ্যবাহী মূল্যবোধের দ্বৈরথ ও রাজনৈতিক কেলেঙ্কারি

ওরবান-এর জনপ্রিয়তার অবনতি নিয়ে প্রথমে বলা যাক। ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে এক রাজনৈতিক কেলেঙ্কারি ঘটে। দেখা যায়, হাঙ্গেরির প্রেসিডেন্ট কাতালিন নোভাক (Katalin Novak) এবং ওরবান-এর বিচারমন্ত্রী জুডিট ভারগা (Judit Varga) পদত্যাগ করেন, কারণ তারা এমন এক ব্যক্তিকে ক্ষমা করেছিলেন যিনি একটি শিশু যৌনকর্মের যৌন নিপীড়ন কেলেঙ্কারি ধামাচাপা দিতে জড়িত ছিলেন। এই ঘটনা দেশজুড়ে বিশাল সরকারবিরোধী আন্দোলনের জন্ম দেয়।

এ নিয়ে এত ক্ষোভের কারণ ছিল যে ফিদেস নিজেকে সর্বদা ঐতিহ্যবাহী খ্রিস্টীয় পারিবারিক মূল্যবোধের রক্ষক হিসেবে তুলে ধরেছে। প্রেসিডেন্ট নোভাকের এই অবমাননাকর আচরণ ওরবান-এর “পরিবার রক্ষা” এজেন্ডাকে মারাত্মকভাবে বিপর্যস্ত করে ফেলে এবং এ ঘটনার পর ফিদেস-এর জনসমর্থন দ্রুত কমে যেতে থাকে, বিশেষ করে মার্চ-এপ্রিল ২০২৪ নাগাদ।

অর্থনৈতিক সংকট ও মূল্যস্ফীতি

অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও ওরবান হিমশিম খাচ্ছেন। বিশ্বব্যাপী মুদ্রাস্ফীতি (inflation) যদিও সব সরকারের জন্য সমস্যা, তবে দুর্বল মজুরি বৃদ্ধির কারণে হাঙ্গেরিয়ানরা ইউরোপে সবচেয়ে বেশি ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়ার অভিজ্ঞতা পাচ্ছে। বেতনের ক্রয়ক্ষমতার ব্যাপক পতন তাদের জীবনযাত্রা চাপে ফেলেছে।

ভোটারদের খুশি রাখতে ওরবান সরকার সরকারী ব্যয় বেড়েছে। কিন্তু এটি সেরকম কাজে দেয়নি; বরং জাতীয় ঘাটতি (deficit) বিপজ্জনক স্তরে পৌঁছে দিয়েছে। ২০২৪ সালের জন্য ঘাটতির লক্ষ্যমাত্রা ২.৯% থেকে ৩.৯%-এ উন্নীত করতে হয়েছে, আর জুন মাসের মধ্যেই সরকার নিজের লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। এখন হাঙ্গেরি তথাকথিত ভিশেগ্রাদ ফোর (Visegrád 4)-এর দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বাজেট ঘাটতির সম্মুখীন।

ইইউর (EU) সাথে সংঘাত এবং আন্তর্জাতিক অবস্থান

এছাড়াও, ইইউর (EU) সাথে ওরবান-এর বাকযুদ্ধ তার জনপ্রিয়তায় সহায়ক হয়নি। আইনের শাসনের অবনতি নিয়ে ইইউ উদ্বিগ্ন। এ কারণে হাঙ্গেরির জন্য বরাদ্দ কিছু ইইউ তহবিল আটকে রাখা হয়। একইসময়ে ওরবান ইউক্রেনকে (Ukraine) সহায়তার EU প্যাকেজ বারবার আটকে দেন। শেষ পর্যন্ত ইইউ কিছু অর্থ ছেড়ে দেয়, কিন্তু তাতে প্রকাশ পেয়েছে যে ওরবান মূলত নিজের ক্ষমতা প্রদর্শন ও অন্য ইউরোপীয় রাষ্ট্রের উপর কর্তৃত্ব স্থাপনেই বেশি আগ্রহী, হাঙ্গেরির বাস্তব সমস্যার সমাধানে নয়।

ফলে কিছু হাঙ্গেরীয় ভোটারের মধ্যে ধারণা জন্মেছে যে ওরবান EU-এর সাথে ছোটখাট খেলা ও ক্ষমতার দম্ভ প্রদর্শনে ব্যস্ত, দেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যা সমাধানে নয়। এই ধারণা ওরবান-বিরক্তি আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।

পিটার মাগইয়ার (Peter Magyar) ও নতুন বিরোধী চ্যালেঞ্জ

এখন আসি পিটার মাগইয়ার (Peter Magyar)-এর প্রসঙ্গে। পূর্বে তিনি ফিদেস-এর সদস্য ছিলেন। ফিদেস-এর কেলেঙ্কারির পর বসন্তকালে তিনি ফেসবুক পোস্ট করে দল ত্যাগ করেন, ও ওরবান-এর শাসনকে “একটি রাজনৈতিক পণ্য” হিসেবে অভিহিত করেন। এরপর তিনি ব্যাপক গণমাধ্যম প্রচারে নামেন এবং বারবার দাবি করতে থাকেন যে ওরবান-এর সরকার দুর্নীতিগ্রস্ত।

পিটার মাগইয়ারকে অনেক সময় অতিরিক্ত আক্রমণাত্মক ও অবমাননাকর বলে সমালোচনা করা হয়। কিন্তু আগের বিরোধী নেতাদের তুলনায় তাকে সাধারণত আরও দক্ষ ও কৌশলী মনে করা হয়। উদাহরণস্বরূপ, টিসজা পার্টি, যা ২০২১ সালে গঠিত হলেও মূলত নিস্ক্রিয় ছিল, মাগইয়ারের যোগদানের পর অল্প সম্পদ নিয়েও প্রচারণায় সাফল্য পাচ্ছে। দলটি ২০২৪ সালের জুনে অনুষ্ঠিত ইইউ নির্বাচন (EU elections)-এ প্রায় ৩০% ভোট পায়, যা ফিদেসকে ৫০%-এর নিচে নামায়—জাতীয় নির্বাচনে ২০১০ সালের পর থেকে যা ঘটেনি।

ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনা: ২০২৬ সালের নির্বাচন

২০২৬ সালের পার্লামেন্ট নির্বাচন এখনো অন্তত এক বছর দূরে। তবে এটুকু স্পষ্ট যে হাঙ্গেরির জনসংখ্যার একাংশ ওরবানকে নিয়ে ক্লান্ত। দেশের অভ্যন্তরীণ সংগ্রাম, EU-এর সাথে লাগাতার বিবাদ এবং অর্থনৈতিক অস্থিরতার সাথে এখন এমন এক বিরোধী দলের আবির্ভাব ঘটেছে যা সত্যিকারের হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

তবে টিসজা পার্টির বিজয় নিশ্চিত কিছু নয়। ইতিহাস বলছে, নির্বাচনের সময় ওরবান পূর্ববর্তী জরিপগুলোকে অতিক্রম করে ফল নিজের পক্ষে নিয়ে আসতে পারেন। টিসজা পার্টির প্রধান লক্ষ্য মূলত হাঙ্গেরির রাজনীতিকে শুদ্ধ করা। তাদের ওয়েবসাইটে উল্লেখ আছে তারা “অখণ্ডযোগ্য, ব্ল্যাকমেইল-অযোগ্য, সৎ, সরল, উন্মুক্ত এবং চরমপন্থামুক্ত” হতে চায়। কিন্তু এর বাইরে তাদের নীতিগত অবস্থান স্পষ্ট নয়। অতীতে অন্যান্য বিরোধী জোটগুলোরও এমনই পরিণতি হয়েছে—পরিষ্কার লক্ষ্যের অভাবে তারা নির্বাচনে খারাপ ফল করেছে এবং পরে ভেঙে গেছে।

তারপরও টিসজা পার্টির একটি শক্তিশালী দিক হচ্ছে একজন জনপ্রিয় ও দৃঢ়চেতা নেতা পিটার মাগইয়ার, যিনি ফিদেসের সাথের নিজের আগের সম্পৃক্ততা, বিচারমন্ত্রী জুডিট ভারগা (Judit Varga) (যিনি ওরবান সরকারের সময় কলঙ্কিত হয়েছেন) -র সাথে ব্যক্তিগত সংযোগ (তিনি মাগইয়ার-এর সাবেক স্ত্রী) – এ সকল বিষয়কে কাজে লাগিয়ে নিজেকে “দলত্যাগী-বিরোধী” হিসেবে উপস্থাপন করতে পেরেছেন। তিনি দেখাতে পেরেছেন যে তিনি ফিদেস-এর ভিতর থেকে উঠে এসে নিজের একটি আন্দোলন গড়ে তুলছেন।

উপসংহার

সব মিলিয়ে, সাম্প্রতিক জরিপের পতন, অর্থনৈতিক অস্থিরতা, মূল্যবোধ রক্ষার দাবিতে গড়াপেটা ও কেলেঙ্কারি, EU-এর সাথে বিতর্ক—সবই ওরবান-এর জনপ্রিয়তায় ধস নামাচ্ছে। অন্যদিকে টিসজা পার্টি ও পিটার মাগইয়ার এক নতুন অধ্যায়ের সংকেত দিচ্ছে। তবে হাঙ্গেরির রাজনীতি বরাবরই চ্যালেঞ্জিং, ওরবান প্রতিদ্বন্দ্বীকে চমকে দেওয়ার ক্ষমতা রাখেন। অতএব, ২০২৬ সালের নির্বাচন কি ওরবান শাসনের পরিসমাপ্তি ঘটাবে, নাকি পুরোনো কারিশমায় ওরবান আবারও ফিরবেন—তা এখনই নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না।

তথ্যসূত্র

Hungarian Opinion Polls
https://www.politico.eu/europe-poll-of-polls/hungary/
https://hvg.hu/itthon/20241205_Zavecz-tisza-fidesz-ebx?utm_term=Autofeed&utm_medium=Social&utm_source=Facebook&fbclid=IwZXh0bgNhZW0CMTEAAR11tF71ySKvr7kI_LP3K1j_fD8tQUsc4jgygrO7LtR63XtgRULPFEb2CTE_aem_tMstFkV14D01nOWlELyNWw#Echobox=1733406117
https://m.hvg.hu/360/20241128_Median-kozvelemenykutatas-november-Tisza-Magyar-Peter-Fidesz
https://24.hu/belfold/2024/12/11/tisza-part-fidesz-magyar-peter-orban-viktor-idea-kozvelemeny-kutatas/#

Péter Magyar/Tisza
https://www.politico.eu/article/viktor-orban-fidesz-hungary-challenger-peter-magyar-tisza-party-polls-survey-eu/
https://magyartisza.hu/page/bemutatkozas
https://www.thebulwark.com/p/hungary-orban-scandal-crisis-peter-magyar
https://www.reuters.com/world/europe/orbans-new-challenger-gets-green-light-run-european-elections-2024-04-12/

কিভাবে আইসল্যান্ড তার জিডিপির ৫০% হারায়… এবং সেখান থেকে নিজেদের পুনরুদ্ধারও করে? (১৫ ডিসেম্বর, ২০২৪)

ভূমিকা

২০০৮ সালের বিশ্ব অর্থনৈতিক সংকট (Global Financial Crisis of 2008) বিশ্বজুড়ে এমন প্রভাব ফেলেছিল যা আজও অনুভূত হচ্ছে। এটি কয়েক ডজন দেশ, হাজার হাজার প্রতিষ্ঠান এবং বিলিয়ন মানুষের অর্থনীতিতে মারাত্মক আঘাত হানে। সাধারণভাবে, একটি দেশ যত বেশি আর্থিকীকরণ (financialised) হয়, তার পরিস্থিতি তত খারাপ হয়। যেখানে বেশিরভাগ মনোযোগ ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র (USA) এবং এর ব্যর্থ ব্যাংকগুলোর উপর, সেখানে এমন একটি দেশ ছিল যা এই সংকটের ধাক্কা অন্য যেকোনো দেশের চেয়ে বেশি অনুভব করেছিল। আইসল্যান্ড (Iceland) মাত্র দুই বছরে তার প্রায় অর্ধেক অর্থনৈতিক উৎপাদন (economic output) হারিয়ে ফেলেছিল, যা ইতিহাসের যেকোনো সময়ে একটি উন্নত দেশের জন্য সবচেয়ে বিপর্যয়কর অর্থনৈতিক আঘাতগুলোর মধ্যে অন্যতম। আইসল্যান্ডের নামমাত্র অর্থনৈতিক উৎপাদনে (nominal economic output) জিএফসি’র (GFC) প্রভাব মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে ১০ গুণ বেশি গুরুতর ছিল। এমন নয় যে তাদেরও খুব ভালো সময় যাচ্ছিল।

এত বড় অর্থনৈতিক ব্যর্থতা থেকে অনেক কিছু শেখার আছে, তবে এর চেয়েও বেশি আকর্ষণীয় বিষয় হল দেশটির প্রায় অবিশ্বাস্য প্রত্যাবর্তনের গল্প। যা বেশিরভাগ অর্থনীতির জন্য একটি মারাত্মক আঘাত এবং ইউরোপের বেশিরভাগ অংশের জন্য একটি মোড় পরিবর্তনকারী ঘটনা ছিল, তা এখন এই ছোট দেশটির জন্য একটি স্মৃতি ছাড়া আর কিছুই নয়। দেশটি কেবল জিএফসি (GFC) থেকে সম্পূর্ণরূপে পুনরুদ্ধার করেনি, বরং বিশ্বের অন্যতম ধনী ও উৎপাদনশীল অর্থনীতিতে পরিণত হয়েছে।

প্রশ্ন হচ্ছে এই অসাধারণ পুনরুদ্ধারের পেছনে কী কারণ ছিল? এই সাফল্য কি অন্য অর্থনীতিগুলোতেও প্রতিলিপি করা সম্ভব? এবং সবশেষে, সাফল্যের এই নতুন রাউন্ড কি স্থিতিশীল?

আর্থিক সংকটের পূর্বে আইসল্যান্ডের পরিস্থিতি

জিএফসি’র (GFC) আগের বছরগুলোতে, আইসল্যান্ড (Iceland) গভীরভাবে অর্থবাজারে প্রবেশ করেছিল, ব্যাংকিং (banking) এবং আর্থিক পরিষেবাগুলোতে (financial services) সম্পূর্ণরূপে মনোনিবেশ করেছিল। এবং ন্যায্যভাবে বলতে গেলে, তারা ২০০৮ সালের দিকে এই উন্মাদনায় যোগ দেওয়া একমাত্র দেশ ছিল না। এবং সাবপ্রাইম আর্থিক বিপর্যয়ের (subprime financial crash) পরে, আধুনিক বিশ্বের বেশিরভাগ দেশ মারাত্মক ক্ষতির শিকার হয়েছিল। শুধু আইসল্যান্ডের ক্ষেত্রেই দেখা যায়, তারা সবকিছুতেই সর্বস্ব পণ রেখেছিল। কম শিল্প বৈচিত্র্য (low industrial diversity) এবং ঐতিহাসিকভাবে অস্থির মুদ্রা (volatile currency) থাকার কারণে, সম্ভবত তারা তখনও জানত না, তবে আইসল্যান্ড (Iceland) একটি বিশাল ব্যবধানে বিশ্বব্যাপী লোভের সবচেয়ে বিধ্বস্ত শিকার হতে যাচ্ছিল। প্রকৃতপক্ষে, ২০০৮ সালের দ্বিতীয় প্রান্তিকের (second quarter) শেষের দিকে, অনুভূত ঝুঁকি (perceived risks) এবং বিনিয়োগে (investment) পতনের কারণে আইসল্যান্ডের বাহ্যিক ঋণ ৫৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি বেড়ে গিয়েছিল, যা আজকের অনেক দেশের তুলনায় তেমন বেশি নয়। তবে এটিও মনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ যে আইসল্যান্ড (Iceland) একটি ছোট দেশ। এটির মোট জনসংখ্যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনেক বড় শহরতলির চেয়েও কম, তাই এটি মাথাপিছু ঋণের (debt per capita) একটি বিশাল পরিমাণ ছিল এবং এটি মূলত আটলান্টিকের (Atlantic) সিঙ্গাপুর (Singapore) বানানোর জন্য একটি আর্থিক খাত (financial sector) তৈরি করতে ব্যবহৃত হয়েছিল।

এত অল্প জনসংখ্যার সাথে, অনেক ঐতিহ্যবাহী শিল্পে (traditional industries) প্রতিযোগিতামূলক হওয়া কঠিন, তবে অবশ্যই পেছনের দিকে তাকালে বোঝা যায়, তারা ভুল সময়ে ভুল ব্যবসাকে গ্রহণ করেছিল। এই ঋণের পরিমাণ এতটাই অসাধ্য হয়ে পড়েছিল যে এর কেন্দ্রীয় ব্যাংক (central bank) ব্যাংকগুলোকে মহাবিপর্যয় থেকে বাঁচাতে শেষ অবলম্বনকারী ঋণদাতা (lender of last resort) হিসাবে সরে গিয়েছিল। আরও বেশি আশ্চর্যজনকভাবে, বেশিরভাগ পশ্চিমা দেশ (western countries) যারা এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে বাঁচাতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, তার বিপরীতে আইসল্যান্ডের সরকার মূলত হাত গুটিয়ে নিয়েছিল, এই দৌড়ে অংশ নেওয়া ব্যাংকগুলোকে ব্যর্থ হতে দিয়েছিল। সেই সময়ে, এটি অত্যন্ত বিতর্কিত ছিল, যার ফলে নেদারল্যান্ডস (Netherlands) এবং যুক্তরাজ্যের (UK) সাথে একটি আর্থিক যুদ্ধ হয়েছিল, যা শেষ পর্যন্ত একটি রায়ের মাধ্যমে আইসল্যান্ডকে ডাচ (Dutch) এবং ব্রিটিশ (British) ন্যূনতম ডেপোজিট গ্যারান্টির (minimum deposit guarantees) জন্য দায়ী না হওয়ার অনুমতি দেয়। তবে, তারা অভ্যন্তরীণভাবে এই আমানতগুলোর নিশ্চয়তা দিয়েছিল, একইসাথে তাদের ছায়া ব্যাংকিং ব্যবস্থার (shadow banking system) ধীর, উচ্চ নিয়ন্ত্রিত পুনরুদ্ধারের জন্য আইএমএফ (IMF) এবং এর নর্ডিক প্রতিবেশীদের (Nordic neighbours) কাছ থেকে ৫.১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের ঋণ সুরক্ষিত করেছিল। এমনকি এই প্রক্রিয়ার মধ্যে বেশ কয়েকজন মূল ব্যাংকারকে গ্রেপ্তারও করেছিল। আইসল্যান্ডের অনিয়ন্ত্রিত ব্যাংকিংয়ের প্রতি অতি উৎসাহ জিএফসি (GFC)-এর সময় এবং পরে তাদের বিধ্বস্ত করে, ২০১১ সালে তাদের ঋণ-থেকে-জিডিপি অনুপাত (debt to GDP ratio) ১৩০%-এ পৌঁছেছিল। সেই সময়ে, এই সংখ্যাটি অস্বাভাবিক ছিল। তারা প্রায় একই সময়ে ইইউতে (EU) যোগদানের জন্য অনুরোধও করেছিল, তবে সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোর পরিপ্রেক্ষিতে, ইইউ (EU) এই অনুরোধ স্থগিত করে কারণ তারা পুরো মহাদেশে অর্থনৈতিক সংকট (meltdowns) মোকাবেলা করছিল এবং আইসল্যান্ড (Iceland) খুব গুরুত্বের সাথে একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রে (failed state) পরিণত হওয়ার দ্বারপ্রান্তে ছিল।

আশ্চর্যজনক প্রত্যাবর্তন

কিন্তু ২০১৬ সালের মধ্যে, মনে হয়েছিল যেন কিছুই ঘটেনি। শিখর থেকে মাত্র পাঁচ বছর পর, দেশটির মাথাপিছু জিডিপি (per capita GDP) সংকট-পূর্ববর্তী স্তরে ফিরে আসে এবং ২০২৩ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে এর ঋণ-থেকে-জিডিপি ৫০% এর বেশি হ্রাস পায়। এবং এর বেশিরভাগেরই আইসল্যান্ডের (Iceland) অনন্য প্রকৃতির সাথে সম্পর্ক রয়েছে। এটি আজও ভিন্ন ধরণের অস্থিরতার সাথে লড়াই করছে, তবে একটি অদ্ভুত উপায়ে। এর উত্থান-পতনের কারণগুলো প্রায়শই এর পশ্চিমা প্রতিবেশীদের (western neighbours) তুলনায় এত দ্রুত পুনরুদ্ধারের কারণ ছিল। এটি বিশ্বের ১৮তম বৃহত্তম দ্বীপ, যার সীমানা ১০৩,০০০ বর্গ কিলোমিটার এবং যদিও এটি যথেষ্ট পরিমাণ ভূপৃষ্ঠের ক্ষেত্রফল, তবে এর জনসংখ্যা খুবই কম, প্রায় ৩৯৪,০০০। আইসল্যান্ডের জিডিপিও (GDP) খুব কম, প্রায় ৩১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এই সবকিছুই তেমন চিত্তাকর্ষক মনে হয় না, যা কোনও না কোনওভাবে জিএফসি (GFC)-এর সাথে এর অভিজ্ঞতাকে আড়াল করে রেখেছিল। তবে, আইসল্যান্ড (Iceland) কয়েকটি বিষয়ে ভালো করলেও, তা এর সীমিত আকারের জন্য যথেষ্ট। যদিও দেশটিতে শিল্প বৈচিত্র্যের (industrial diversity) মারাত্মক অভাব রয়েছে, তবে আসল কথা হল এটির তেমন বেশি প্রয়োজন নেই। এবং যা আছে, তা অন্য কোথাও থাকলে যা প্রয়োজন হতে পারত তা কার্যকরভাবে পুষিয়ে দেয়।

এক্ষেত্রে ভৌগোলিক অবস্থান তাদের পক্ষে কাজ করেছে। কার্যত কোনও হতাহতের ঘটনা ছাড়াই ধারাবাহিক সংঘাতের মাধ্যমে (যা উপযুক্তভাবে কড যুদ্ধ (cod wars) নামে পরিচিত) আইসল্যান্ড (Iceland) সমুদ্রপথে তার অঞ্চল ব্যাপকভাবে প্রসারিত করেছে এবং যদিও মাছ রপ্তানি (fishing exports) ওঠানামা করে, তবুও তারা ২০২৩ সালে ২.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি যথেষ্ট মুনাফা অর্জনে অবদান রাখে, যা দেশের মোট রপ্তানির ২৫%। এটি চিত্তাকর্ষকই বটে, কিন্তু এই ছোট দেশটি কীভাবে বিশ্ব-নেতৃস্থানীয় শিল্পসহ এর ইউরোপীয় প্রতিপক্ষগুলোর (European peers) বিপরীতে বিশ্ব-নেতৃস্থানীয় জীবনযাত্রার মান বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে, তা এই ব্যাপারটা দ্বারা ব্যাখ্যা করা যায়না।

ভূ-তাপীয় শক্তি: সাফল্যের মূল চাবিকাঠি

যা সত্যিই আইসল্যান্ডকে (Iceland) একটি বিশেষ অবস্থানে রাখে তা হল শক্তি। এবং এই শক্তি, যা কিছু ক্ষেত্রে আইসল্যান্ডকে বিশ্ব নেতায় পরিণত করেছে, তা প্রায় সম্পূর্ণরূপে পুনর্নবীকরণযোগ্য (renewable)। দেশটিতে প্রায় ৩৭টি বড় এবং ২০০টি ছোট জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র (hydroelectric power plants) রয়েছে, যার নির্মাণ ২০ শতকে শুরু হয়েছিল এবং অদূর ভবিষ্যতে আরও নির্মিত হবে। প্রায় একই সময়ে, আরেকটি উৎসের ব্যবহার শুরু হয়েছিল, যা মূলত কৃষকরা তাদের ঘর গরম করার জন্য ব্যবহার করত, এখন অনেক বড় পরিসরে ব্যবহৃত হয়। এটি হল ভূ-তাপীয় শক্তি (geothermal energy)। এখানকার বিদ্যুৎ অবিশ্বাস্যভাবে সস্তা, যার কারণে আইসল্যান্ডের বিদ্যুতের বিল প্রতি মাসে গড়ে মাত্র ৩০ মার্কিন ডলারে পৌঁছায়, যা চরম ঠান্ডার সময় কতটা গরম করার প্রয়োজন হয় তা বিবেচনা করলে বেশ চিত্তাকর্ষক। উভয় শক্তি উৎসকে কাজে লাগিয়ে, আইসল্যান্ড (Iceland) মাথাপিছু অন্য যেকোনো দেশের তুলনায় বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন করে, যা আগামী দশকগুলোতে আরও বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে। অর্থনৈতিক উৎপাদন (economic output) প্রায় পুরোপুরি শক্তি ব্যবহারের সাথে সম্পর্কযুক্ত, কারণ ধনী দেশগুলো আরও আরামদায়ক জীবন যাপনের জন্য বেশি শক্তি ব্যবহার করে, তবে সস্তা শক্তি শিল্প সক্ষমতার ক্ষেত্রেও একটি বিশাল সুবিধা। বিশ্বের অন্যতম ভূতাত্ত্বিকভাবে সক্রিয় অঞ্চল (geologically active regions) হওয়ার কারণে, আইসল্যান্ড (Iceland) সরাসরি ব্যবহারের মাধ্যমে প্রায় ৯০% বাড়ি গরম করে এবং এই শক্তি উৎস গ্রিনহাউসে (greenhouses) মাছ চাষের মতো খাদ্য উৎপাদনেও অবদান রাখে। তবে যা এই শক্তি উৎসকে সত্যিকারের মূল্যবান করে তোলে, বিশেষ করে বিশ্ব মঞ্চে, তা হল কীভাবে এটি বিশ্বের সবচেয়ে বেশি শক্তি-নিবিড় শিল্প অ্যাপ্লিকেশনগুলোর (energy intense industrial applications) প্রক্রিয়ায় সহায়তা করে।

অ্যালুমিনিয়াম উৎপাদন এবং ক্রিপ্টোকারেন্সি

এই শক্তি-নিবিড় শিল্প অ্যাপ্লিকেশনগুলোর প্রথমটি হল অ্যালুমিনিয়াম গলানো (aluminium smelting)। এই প্রক্রিয়ার মধ্যে অ্যালুমিনা (alumina) দ্রবীভূত করা, অ্যানোড (anodes) যোগ করা, বৈদ্যুতিক প্রবাহ (electric current) প্রয়োগ করা এবং গলিত অ্যালুমিনিয়াম (molten aluminum) সরিয়ে নেওয়া যাতে এটি ঢালাই করা যায়। অবশ্যই, একটি অর্থনৈতিক চ্যানেল হওয়ায়, এটি একটি সরলীকৃত ব্যাখ্যা। মূলত, এখনকার জন্য যা বোঝা দরকার তা হল অ্যালুমিনিয়াম (aluminium) উৎপাদনে প্রচুর শক্তির প্রয়োজন হয়, লোহার চেয়ে দ্বিগুণ। একই কাজ করা দেশগুলোর দিকে তাকালে, কেন আইসল্যান্ডের (Iceland) একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ রয়েছে তা স্পষ্ট হয়ে যায়। বর্তমানে, অ্যালুমিনিয়াম উৎপাদনে স্বর্ণপদক চীনের (China), যা বিশ্বের প্রায় ৬০% গলানোর ক্ষমতার অধিকারী, তবে মনে হচ্ছে এটি কিছুটা সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছে যাচ্ছে। এর কারণ হল চীনের (China) মতো একটি দেশকে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ (coal-fired power) এবং প্রাকৃতিক গ্যাসের (natural gas) উপর নির্ভর করতে হয়, যা পরিবেশের উপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে, সেইসাথে জীবাশ্ম জ্বালানি (fossil fuel) একটি অতিরিক্ত খরচ যা তাদের উৎপাদনকে আরও ব্যয়বহুল করে তোলে।

অন্যদিকে, আইসল্যান্ডের (Iceland) এই সমস্যা নেই। যেহেতু ভূ-তাপীয় শক্তি (geothermal) একটি পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তি উৎস, পৃথিবীর তেজস্ক্রিয় কোর (radioactive core) দ্বারা ক্রমাগত তাপের যোগান হতে থাকে, তাই আইসল্যান্ড (Iceland) তাত্ত্বিকভাবে বিলিয়ন বছর ধরে এই শক্তি উৎপাদনের উপর নির্ভর করতে পারে এবং একবার ভূ-তাপীয় কেন্দ্রগুলো (geothermal plants) স্থাপিত হলে, তাদের চলমান খরচ অনেক কম হয়। ক্রমবর্ধমান শিল্পের জন্য বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে তারা আরও ভূ-তাপীয় কেন্দ্র তৈরি করতে পারে, যা তারা করছে, ২০২৫ থেকে ২০২৭ সালের মধ্যে আরও ড্রিলিং (drilling) হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

এই শিল্পের আরেকটি আকর্ষণীয় ব্যবহার, এবং এর অফুরন্ত শক্তি যা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে, তা হল ক্রিপ্টোকারেন্সি (cryptocurrency)। যদিও ক্রিপ্টোকারেন্সি (cryptocurrency) অনেক সমালোচিত হয়েছে, কারণ এর মাইনিংয়ের (mining) জন্য প্রচুর পরিমাণে শক্তির প্রয়োজন হয়, আইসল্যান্ড (Iceland) এমন একটি উদাহরণ যেখানে এই অনুশীলন কেবল টেকসই (sustainable) নয়, দেশটির কোনো নৈতিক প্রতিক্রিয়াও নেই যা কার্যক্রমকে আরও বাড়াতে বাধা দেয়, যেমন অন্য দেশগুলো যারা তাদের উৎপাদনের একটি ভগ্নাংশ অর্জনের জন্য অপুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তির উপর নির্ভর করে।

সাফল্যের স্থায়িত্ব এবং অন্যান্য দিক

এখন, এই সাফল্য টেকসই কিনা, এর উত্তরে হ্যাঁ এবং না উভয়ই বলা যায়। সস্তা, নির্ভরযোগ্য শক্তি যেকোনো অর্থনীতির জন্য সবসময় একটি বিশাল সুবিধা এবং এর অর্থ হল এটি বিভিন্ন শিল্পে সহজেই প্রতিযোগিতামূলক হতে পারে, তাই এর ছোট শ্রমশক্তি (labour force) একটির উপর মনোযোগ দিলেও, তাদের কাছে সবসময় বিকল্প অপশন থাকে। উদাহরণস্বরূপ, এআই (AI) গত কয়েক বছরের মধ্যে একটি ক্রমবর্ধমান শিল্পে পরিণত হয়েছে এবং এটি বিশাল ডেটা সেন্টারগুলোর (data centres) উপর নির্ভরশীল, যা পরিচালনার জন্য প্রচুর পরিমাণে শক্তি খরচ করে। কিছু কোম্পানি আক্ষরিক অর্থে পুরনো পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোকে (nuclear power plants) পুনরায় চালু করছে এবং তাদের বেশিরভাগই কেবল জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়াচ্ছে, তবে আইসল্যান্ড (Iceland), তার অনেক সস্তা এবং সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য শক্তি উৎসসহ, একটি জনপ্রিয় গন্তব্য হয়ে উঠছে, যা গ্রহের দুটি বৃহত্তম অর্থনৈতিক কেন্দ্রের মধ্যে এর অবস্থানের কারণে এবং এর একটি খুব নিরাপদ, স্থিতিশীল সরকার থাকার কারণে অনেক সাহায্য পাচ্ছে।

কার্যত, তাদের ভূ-তাপীয় শক্তি (geothermal power) কেবল আরেকটি প্রাকৃতিক সম্পদ যা বিশাল আর্থিক লাভের জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে, তবে এর তেল জাতীয় সম্পদের চেয়ে দুটি গুরুত্বপূর্ণ সুবিধা রয়েছে। প্রথমত, এটি কখনই শেষ হবে না, অন্তত মানুষ শেষ হওয়ার আগে নয়, তবে দ্বিতীয় কারণ হল এটি বিক্রি করা যায় না। এখন, এটি একটি অসুবিধা মনে হতে পারে, তবে আমার যুক্তি শুনুন। কেবল এই সম্পদটিকে জাহাজে লোড করে কিছু বিদেশী শক্তি কোম্পানির কাছে বিক্রি করে মুনাফা অর্জন করতে না পারার কারণে, আইসল্যান্ড (Iceland) প্রায় বাধ্য হয়েছে তাদের প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহার করে দেশীয় শিল্প গড়ে তুলতে। এর মানে হল যে ডাচ রোগের (Dutch disease) আরেকটি উদাহরণ হওয়ার পরিবর্তে, এটি তার শক্তি সম্পদকে এমনভাবে ব্যবহার করতে সক্ষম হয়েছে যা কম দক্ষ হলেও, দেশীয় অর্থনীতিতে প্রকৃত কার্যকলাপের প্রয়োজন। তাই হ্যাঁ, এর অনেক সুবিধা রয়েছে।

তবে আসল কথা হল, অল্প জনসংখ্যা সত্ত্বেও, দেশটি এখনও তার সীমানার বাইরের অবদানের উপর বেশ নির্ভরশীল। কোনো অত্যুক্তি ছাড়াই বলা যায়, তারা সত্যিই আজকের সাফল্যের গল্প হতে পারত না যদি না এমনটা হত। এবং এটির জিএফসি (GFC) পরবর্তী প্রাপ্ত সহায়তার সাথে কোনও সম্পর্ক নেই। পূর্বে উল্লিখিত গ্রিনহাউস (greenhouses) এবং টেকসই প্রবৃদ্ধি ব্যবস্থা (sustainable growth systems) হয়ত প্রায় ২৩৪,০০০ ডলার মূল্যের ফল রপ্তানি করে, তবে এটি কেবল তার বাসিন্দাদের সুষম খাদ্যাভ্যাস (balanced diet) সরবরাহ করার জন্য প্রায় ৯.২৮ মিলিয়ন ডলারের ফল আমদানি করে। এবং এতে শস্য এবং শাকসবজি অন্তর্ভুক্ত নয়। জাহাজ থেকে শুরু করে মোটরযান, ওষুধপত্র থেকে শুরু করে অ্যালুমিনিয়াম গলানোর জন্য ব্যবহৃত উপাদান যেমন কার্বন ইলেক্ট্রোড (carbon electrodes) পর্যন্ত সবকিছু অন্য দেশের সরবরাহ থেকে আসে। এমনকি মাছও, যে সম্পদের উপর আইসল্যান্ড (Iceland) ২০ শতকের আগে নির্ভর করত, তা দ্বীপের জন্য একটি প্রধান আমদানি পণ্যে পরিণত হয়েছে, জার্মানি (Germany), যুক্তরাজ্য (UK), নেদারল্যান্ডস (Netherlands) এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র (US) থেকে মাছের ফিলেট (fillets) আমদানি করা হয়, এবং মজুদ করার জন্য স্পেন (Spain) থেকে অতিরিক্ত জীবন্ত মাছ আনা হয়। এবং যেহেতু এটি তার মনোরম সৌন্দর্য এবং উষ্ণ প্রস্রবণগুলোর (hot springs) জন্য সুপরিচিত, তাই পর্যটন (tourism) তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে আইসল্যান্ডের অর্থনীতির একটি প্রধান চালিকাশক্তি, যা এর জনসংখ্যার প্রায় ২০% কর্মসংস্থান করে এবং এর জিডিপিতে প্রায় ১০% অবদান রাখে। আমেরিকা (America) এবং ইউরোপের (Europe) মধ্যে ফ্লাইটগুলো প্রায়শই দেশে অস্থায়ী বিরতি নিলে সস্তা হয় এবং এটি মূলত গন্তব্যের মাঝে একটি স্পা-ডে (spa day), সম্ভবত রন্ধনসম্পর্কিত অর্জনগুলো বাদ দিয়ে অন্যান্য সুবিধা যোগ করে। এছাড়াও, পর্যটন ছিল সংকটের পরে দেশের অর্থনৈতিক পুনরুজ্জীবনে দুটি প্রধান অবদানকারীর মধ্যে একটি, ব্যাংকিং ব্যবস্থার (banking system) পুনর্গঠনের পাশাপাশি, তবে এটি আইসল্যান্ডকে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি পর্যটন-নির্ভর দেশে পরিণত করেছে। আরেকটি অনিশ্চিত এবং বিশ্বব্যাপী নির্ভরশীল শিল্পের উপর সম্পূর্ণ নির্ভরতা করোনাভাইরাস মহামারীর (coronavirus epidemic) সময় অর্থনীতিকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছিল এবং একমাত্র জিনিস যা তাদের এই সংকট মোকাবেলায় সাহায্য করেছিল তা হল তারা পূর্বে উল্লেখিত শিল্প থেকে শেখা শিক্ষা।

অনুকরণযোগ্য সাফল্যের গল্প?

এবং তারপর প্রশ্ন আসে যে আইসল্যান্ড (Iceland) একটি অনুকরণযোগ্য সাফল্যের গল্প নাকি একই ধরনের দেশগুলোর জন্য একটি নীলনকশা যারা তাদের নিজস্ব ভুল থেকে ফিরে আসতে চায়। এবং এর উত্তর হল, তেমনটা নয়। আসল বিষয় হল আইসল্যান্ড (Iceland) একটি সম্পদশালী রাষ্ট্র, শুধু একটু ভিন্ন উপায়ে। সম্ভবত তারা ভাগ্যের সহায়তা পেয়েছে এবং এর অনেক সুবিধার কারণ হল এর আকার এবং ভৌগোলিক অবস্থান। দেশটি এত ছোট যে অন্য দেশগুলোর জন্য এটি একটি নির্ভরযোগ্য অর্থনৈতিক মডেল হতে পারে না। উদাহরণস্বরূপ, এটি প্রতি বছর তার মোট জনসংখ্যার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি পর্যটকদের স্বাগত জানায়, যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের (USA) মতো দেশে সম্ভব নয়। এছাড়াও, দেশটির উপর যে ভূ-তাপীয় সোনার খনি (geothermal goldmine) রয়েছে তা বেশিরভাগ দেশের নাগালের বাইরে, যদিও এটি এমন একটি শিল্প যা আরও গুরুত্বের সাথে নেওয়া হচ্ছে, এমনকি এমন জায়গায় যেখানে এটি তেমন সহজে পাওয়া যায় না। তবে আইসল্যান্ডকে (Iceland) অনুকরণ করতে গেলে, পরিস্থিতি আক্ষরিক অর্থেই নিখুঁত হতে হবে, প্রয়োজনীয় আগ্নেয়গিরির কার্যকলাপ (volcanic activity) এবং তাপের উৎস, সেইসাথে পৃথিবীর কোর (Earth’s core) দ্বারা উত্তপ্ত ভূগর্ভস্থ জলাধার (underground reservoirs) থেকে তরল উত্তোলনের জন্য যথেষ্ট গভীরে ড্রিল করার উপায় থাকতে হবে যা বিদ্যুৎ উৎপাদনে সক্ষম যন্ত্রপাতি চালাতে পারে। এটি গ্রহের বেশিরভাগ অংশে সম্ভব নয়।

প্রযুক্তিগতভাবে, এটি আইসল্যান্ডের (Iceland) জন্য আরেকটি বড় সুবিধা। তাদের শক্তির উৎস বেশিরভাগ প্রত্যাশীদের দ্বারা অনুলিপি করা যায় না এবং অন্যত্র এই সিস্টেমগুলো পরিবহন করতে না পারার কারণে যারা সারা বছর সেখানে বাস করে তাদের জন্য একটি স্থিতিশীল এবং দীর্ঘস্থায়ী কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হয়। এবং আইসল্যান্ডের (Iceland) অর্থনৈতিক যাত্রা থেকে শেখার মতো বিষয়গুলোর মধ্যে একমাত্রটি হল অনিয়ন্ত্রিত এবং অতিরিক্ত আকারের আর্থিক খাত প্রায়শই অন্যথায় লাভজনক দেশগুলোকে পঙ্গু করার ঝুঁকি তৈরি করে। যুক্তি দেওয়া যেতে পারে যে আমদানি আসে এবং যায়, তবে যতক্ষণ দেশের দেওয়ার মতো কিছু থাকে, ততক্ষণ এটি সত্যিকার অর্থে স্বয়ং-টেকসই। দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠান এবং যেখানে প্রয়োজন সেখানে বিনিয়োগের মাধ্যমে, অন্তত আইসল্যান্ডের (Iceland) জন্য উন্নতির পথে আর কোনও বাধা নেই।

রোমানিয়াকে ব্যবহার করে পুতিন কিভাবে ন্যাটোর (NATO) ভিত নাড়িয়ে দিচ্ছেন (১৩ ডিসেম্বর, ২০২৪)

ভূমিকা

কী দুর্দান্ত ৭২ ঘণ্টা পুতিনের (Putin) কেটেছে – এক অস্বস্তি থেকে আরেক অস্বস্তিতে। একদিকে, সিরিয়ায় আল-আসাদ (al-Assad) সরকারের পতন ঘটেছে, যা এখন ঐতিহাসিক অধ্যায় মাত্র। বহু বছরের রুশ হস্তক্ষেপ জলে বিসর্জিত হয়েছে। অন্যদিকে, রোমানিয়ায় ক্রেমলিন (Kremlin) যে শত্রুতাপূর্ণ দখল-চেষ্টার মতো পদক্ষেপ নিয়েছিল, তা এই দেশের সর্বোচ্চ সাংবিধানিক কর্তৃপক্ষের মুখোমুখি পড়েছে। ২০২৪ সালের ৬ই নভেম্বর রোমানিয়ার সাংবিধানিক আদালত (Romania’s Constitutional Court) এক নজিরবিহীন সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচন (Presidential Election) স্থগিত করেছে। কিন্তু কেন?

কারণ রোমানিয়ান গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর (Romanian Intelligence Services) তথ্যানুযায়ী, রাশিয়া (Russia) সরাসরি হস্তক্ষেপ করেছে। ক্রেমলিন (Kremlin) একটি ব্যাপক যোগাযোগ প্রচারণা চালায়, যার ফলে প্রথম দফায় এক মস্কো-অনুগত (Moscow puppet) প্রার্থী জয়ী হয়েছেন, যিনি পুতিনের একটি বোড়ে (pawn of Putin) ছাড়া আর কিছুই নন। অবাক হওয়ার কিছু নেই, তার পুরো নির্বাচনী প্রচার অভিযানের অর্থও তিনি রাশিয়া থেকে পেয়েছিলেন। এটি হাইব্রিড যুদ্ধ (Hybrid Warfare) এবং নির্বাচনী হস্তক্ষেপের সর্বশেষ নিদর্শন।

কিন্তু প্রশ্ন হলো রোমানিয়ায় ঠিক কী ঘটেছে? কিভাবে সম্ভব হলো যে পুতিন এই দেশটিকে গ্রাস করার চেষ্টা করছেন?

নতুন শীতলযুদ্ধের ছায়ায় ইউরোপ

সাম্প্রতিক সময়ে ইউরোপের কিছু স্থানে রাজনৈতিক খবর এমন এক নাটকীয় আবরণে ঢাকা, যা শীতলযুদ্ধের (Cold War) সবচেয়ে টানটান মুহূর্তগুলোর কথা মনে করিয়ে দেয়। আর এই সবকিছুর পটভূমিতে আছেন ভ্লাদিমির পুতিন (Vladimir Putin), যিনি যেন এক “জেনারেল অ্যাল অফ 2.0 (general all of 2.0)” রূপে আবারও পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের হুমকি দিচ্ছেন।

নিঃসন্দেহে কিছু দেশ এখন দ্রুত তাদের সামরিক সক্ষমতা পুনর্গঠনে ব্যস্ত। এর মধ্যে সবচেয়ে স্পষ্ট উদাহরণ হলো পোল্যান্ড (Poland)। তবে মনে রাখবেন, কেবল পোল্যান্ড নয়, আরেকটি দেশ আছে, যে দেশটি ন্যাটোর সরাসরি সহায়তায় নিজেদের সাজিয়ে নিচ্ছে। দেশটি হচ্ছে রোমানিয়ার (Romania)।

পরিকল্পনা অনুসারে রোমানিয়া হয়ে উঠতে যাচ্ছে ইউরোপের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার (Air Defense) কেন্দ্রবিন্দু। এটি তাকে এক দীর্ঘদিন পর আলাদা গুরুত্ব দিয়েছে। এ পরিকল্পনা অনুযায়ী রোমানিয়া হবে পুরোনো মহাদেশের আকাশসীমার সুরক্ষিত “আর্মার্ড গেইট (armored gate)”, যাতে পুতিন বা মস্কোর আর কেউ স্বপ্নেও না ভাবতে পারে এখান দিয়ে হেঁটে বেড়ানোর কথা।

কিন্তু ২৪শে নভেম্বর এমন এক অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটলো যা সমস্ত পরিকল্পনায় জল ঢেলে দিতে পারে। প্রো-রাশিয়া (Pro-Russia) স্বতন্ত্র প্রার্থী রোমানিয়ান নির্বাচনের প্রথম রাউন্ডে জয়ী হলো। হ্যাঁ, আরেকজন প্রো-রাশিয়ান প্রার্থী সামনে চলে এলেন: খেন জর্জেস্কু (Călin Georgescu)। পুতিন এই ব্যক্তিকে বেছে নিয়েছেন রোমানিয়ার ক্ষমতা দখলের চেষ্টা চালাতে। কেউই আশা করেনি যে জাতিসংঘের (UN) সাবেক বিশেষ প্রতিবেদক (special rapporteur) এই ব্যক্তি, যিনি কোনো রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম ছাড়াই স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে দাঁড়িয়েছিলেন, প্রথম রাউন্ডে জয়ী হবেন। জরিপগুলো তাকে সর্বোচ্চ ১০% ভোট দেখিয়েছিল, কিন্তু তিনি প্রায় ২৩% ভোট নিয়ে প্রথম স্থান অর্জন করেন। এটি সম্পূর্ণ পাগলামি ছিল।

আর এই পাগলামির পেছনে রয়েছে মস্কো (Moscow)। জর্জেস্কু মূলত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে (Social Media), বিশেষ করে বিতর্কিত প্ল্যাটফর্ম টিকটকে (TikTok) তার প্রচার চালিয়েছিলেন। খুব অল্প সময়ের মধ্যে তিনি সেখানে ব্যাপক ভাইরাল (Viral) হয়েছিলেন। “অতি অল্প” সময়ে এমন জনপ্রিয়তা সন্দেহজনক। রোমানিয়ান গোয়েন্দা সংস্থাগুলো প্রকাশিত নথিতে দেখা গেছে, ক্রেমলিন জর্জেস্কুর প্রচারাভিযানের জন্য অর্থ সরবরাহ করেছে।

শুধু তাই নয়, তথ্য অনুসারে রাশিয়ান গোয়েন্দা সংস্থাগুলো (Russian Intelligence Services) একটি ব্যাপক প্রচার অভিযান চালিয়েছে, যাতে এই প্রার্থীকে উত্থাপন এবং পশ্চিমবিরোধী (Anti-Western) বার্তা ছড়িয়ে দেওয়া হয়। এ কাজে তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের নানান কৌশল ব্যবহার করে, বিশেষ করে টিকটকে। আমরা কথা বলছি ২৫,০০০ টিকটক অ্যাকাউন্ট ও টেলিগ্রাম (Telegram) গ্রুপের সমন্বয়ে গঠিত এক নেটওয়ার্কের, যা ২০২২ সাল থেকে সক্রিয়ভাবে জর্জেস্কুর উপস্থিতি বাড়িয়ে তুলছিল। ইনফ্লুয়েন্সার (Influencer) কেনা, বট (Bot) সনাক্তকরণ এড়াতে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করা – সবই এই ষড়যন্ত্রের অংশ।

আরও ছিল ৮৫,০০০ সাইবার আক্রমণ (Cyber Attacks) – এগুলো রাশিয়ার বলে সন্দেহ করা হচ্ছে – যেগুলো রোমানিয়াতে পশ্চিমবিরোধী বর্ণনা ছড়াতে সহায়তা করেছে। মোট কথা, টিকটকের মাধ্যমে বিশাল এক প্রভাব বিস্তার করা হয়েছে, যা ইউরোপীয় ইউনিয়নের (European Union) দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। তাই রোমানিয়া এখন ইইউ’কে (EU) অনুরোধ করেছে টিকটকের নির্বাচনী আচরণ তদন্ত করতে।

কিন্তু রাশিয়া কেন এমন করবে? ভেবে দেখুন, যদি কোনো দেশ প্রায় ৫০০ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্ত ভাগ করে থাকে ইউক্রেইনের (Ukraine) সাথে, আর সেই দেশটি যদি এমন এক রাষ্ট্রকে সাহায্য করে যার সাথে পুতিন এখন যুদ্ধে আছে, পাশাপাশি এটি যদি ন্যাটোর একটি ঘাঁটি গড়ে তোলার চেষ্টা করে, তবে পুতিনের কী করার কথা? রোমানিয়া নিঃসন্দেহে রাশিয়ার লক্ষ্য তালিকায় থাকতো।

আর এই কারণেই ক্রেমলিন জর্জেস্কুকে সমর্থন করছে। এই প্রার্থী বিতর্কিত – ২০২২ সালে তিনি রোমানিয়ান প্রসিকিউটরদের (Prosecutors) দ্বারা তদন্তের সম্মুখীন হয়েছিলেন, কারণ তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় রোমানিয়ার প্রধানমন্ত্রী আয়ন অ্যান্টোনেস্কু (Ion Antonescu) যিনি দেশে হলোকাস্ট (Holocaust) ঘটতে সহায়তা করেছিলেন, তাকে প্রশংসা করেন। আশ্চর্য না যে পুতিন, যিনি ইউক্রেইনকে “ডিনাজিফাই” (denazify) করার কথা বলে যুদ্ধ শুরু করেছিলেন, তিনিই এখন এক নব্য-নাৎসী (Neo-Nazi) ভাবধারার ব্যক্তির সাথে ঘনিষ্ঠতা করছেন। মস্কোর বিখ্যাত স্থিতিশীলতার পরিচয়!

তবে এই আইসবার্গ্র চূড়ামাত্র দেখলাম আমরা। জর্জেস্কুর আসল উদ্বেগের বিষয় তার পুতিনের প্রতি মুগ্ধতা এবং ন্যাটোর প্রতি দ্ব্যর্থহীন বিদ্বেষ। এই প্রো-রাশিয়ান স্যাটেলাইট প্রার্থী এক মুহূর্ত দেরি না করে রাশিয়ান স্বৈরশাসককে প্রশংসায় ভাসান। ২০২২ সালে, ইউক্রেইনে আক্রমণের সময়, তিনি বলেছিলেন পুতিন নাকি বিশ্বের হাতে গোনা অল্প কিছু “আসল নেতা”র একজন। একই সময়ে তিনি ন্যাটোকে সমালোচনা করতে কুণ্ঠা করেননি, কারণ তার বিশ্বাস রোমানিয়া যদি কখনো আক্রমণের শিকার হয়, ন্যাটো তার জন্য একটি আঙুলও তুলবে না।

কিন্তু অবাক করার মতো বিষয় হলো: রোমানিয়ার মানুষ কীভাবে একজন প্রো-রাশিয়ান প্রার্থীকে ভোট দিলো? রোমানিয়া তো বরাবরই রাশিয়ার প্রতি নেতিবাচক মনোভাব পোষণ করে। গবেষণায় দেখা গেছে গত ১০ বছরে রোমানিয়ায় রাশিয়ানদের প্রতি সহানুভূতি অর্ধেকে নেমে এসেছে, অপরদিকে ইউক্রেইন ও মোলদোভাকে (Moldova) সমর্থন বেড়েছে। শেষ পর্যন্ত ঘটনাটি এমন পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে যে সাংবিধানিক আদালত (Constitutional Court) নির্বাচনী প্রক্রিয়া স্থগিত করেছে, এই অভিযোগে যে এটি মস্কোর প্রভাব দ্বারা প্রভাবিত ছিল।

এখন প্রশ্ন হলো, রোমানিয়ানদের ভোট কি এই মস্কোপ্রীতি দ্বারা পুরোপুরি নিয়ন্ত্রিত হয়েছিল? নাকি এটি শুধুই একটি অজুহাত, যাতে দ্বিতীয় রাউন্ডে এই প্রার্থী জয়ী হতে না পারে? দুটি প্রশ্নই জটিল। এর উত্তর পেতে আমাদের আগে দেখতে হবে এই প্রার্থী আসলে কতোটা বিপজ্জনক ছিল রোমানিয়া, ইউরোপ এবং ন্যাটোর জন্য। আর কেনই বা রোমানিয়ানরা তাকে ভোট দিলো? চলুন খতিয়ে দেখা যাক।

মিত্রজোটের (Alliance) জন্য এক হুমকি

৮ই ডিসেম্বর রোমানিয়ান প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচনের দ্বিতীয় রাউন্ড হওয়ার কথা ছিল। তবে ভোটের ৪৮ ঘণ্টা আগে যা ঘটলো তা হলো: রোমানিয়ার সাংবিধানিক আদালত প্রথম রাউন্ডের নির্বাচন বাতিল করলো রাশিয়ান হাইব্রিড হামলার (Hybrid Attack) প্রমাণ পাওয়ার পর।

জর্জেস্কুর মোকাবিলা করার কথা ছিল এলেনা লাসোনে (Elena Lasone)-র সাথে, যিনি কেন্দ্র-ডানপন্থী ‘সেভ রোমানিয়া ইউনিয়ন পার্টি’ (Save Romania Union Party)-র প্রার্থী। এই দল তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি প্রো-ইইউ (Pro-EU) ও প্রো-ন্যাটো (Pro-NATO)। অনেক বিশ্লেষক বলছেন, লাসোনে জয়ী হতেন। কিন্তু সাংবিধানিক আদালত কোনো ঝুঁকি নিতে চাইনি, হয়তো আগের অভিজ্ঞতা থেকে।

এই আউটসাইডার (Outsider) প্রার্থীর জয় রোমানিয়ার জন্য অশনি সংকেত। কেন? কারণ যদি তিনি জয়ী হন, রাশিয়া আবারও ব্ল্যাক সি (Black Sea) পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। আর এই পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে কে? ইউক্রেইন।

স্মরণ করুন, ২০২২ সালে রুটি, সূর্যমুখীর তেল, পাস্তা ইত্যাদির দাম সারা বিশ্বে বেড়ে গিয়েছিল। ইউরোপেও এর ধাক্কা লেগেছিল। কারণ যুদ্ধের কারণে বিশ্বের অন্যতম খাদ্যশস্য ভান্ডার ইউক্রেইনের শস্য রপ্তানি থেমে গিয়েছিল। পরে রাশিয়া ও ইউক্রেইন একটি চুক্তিতে আসে যাকে ব্ল্যাক সি গ্রেইন ইনিশিয়েটিভ (Black Sea Grain Initiative) বলে, যাতে ইউক্রেইন থেকে আবার শস্য রপ্তানি সম্ভব হয়। এতে দাম কিছুটা স্থিতিশীল হয়। কিন্তু এটিও আবার বদলে যেতে পারে। জর্জেস্কু ক্ষমতায় এলে ইউক্রেইনের শস্য রপ্তানি আবারও বাধাগ্রস্ত হতে পারে। কেন?

কারণ এক বছরের মাথায় ইউক্রেইনের বাণিজ্যিক জাহাজগুলো রাশিয়ান যুদ্ধজাহাজ, ড্রোন (Drone) এবং বিমান দ্বারা আবারও হয়রানির শিকার হয়। এই অবস্থায় রোমানিয়া ইউক্রেইনকে তাদের ব্ল্যাক সি বন্দর, বিশেষ করে কনস্টান্টা (Constanta) বন্দর ব্যবহার করতে দিয়েছে। ইউক্রেইনকে বিকল্প রুট দিয়েছে যাতে তারা নিরাপদভাবে বসফরাস প্রণালী (Bosphorus Strait) হয়ে বিশ্ববাজারে পণ্য পাঠাতে পারে। মনে রাখবেন, ইউক্রেইনের অর্থনীতিকে টিকিয়ে রাখতে এই রপ্তানি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

রোমানিয়া এই সহায়তা দিয়ে ইউক্রেইনকে অর্থনৈতিকভাবে টিকে থাকতে সাহায্য করেছে। কিন্তু জর্জেস্কু ক্ষমতায় এলে সব পাল্টে যেতে পারে। তিনি হয়তো ইউক্রেইনকে কনস্টান্টা বন্দর ব্যবহারে বাধা দেবেন, কারণ তিনি তো রাশিয়ার মুঠোয়। এমনকি তিনি অজুহাত দিতে পারেন যে ইউক্রেইনের শস্য আমদানি রোমানিয়ান কৃষিকে ধ্বংস করছে। যদিও এই কৃষি সংকট ছিল দুই বছর আগে এবং এখন তা অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে।

ফলাফল কী হবে? ইউক্রেইন আবারও রাশিয়ান হুমকির মুখে পড়বে, জাহাজ চলাচল কঠিন হবে, এবং বৈশ্বিক খাদ্যদ্রব্যের দাম আবার বেড়ে যেতে পারে। আমাদের পকেটে আবার চাপ পড়বে। শুধু তাই নয়, ইউক্রেইনও তাদের অন্যতম আয়ের উৎস হারাবে। আর যদি ভবিষ্যতে আমেরিকান অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ হয় (ট্রাম্পের (Trump) প্রতিশ্রুতির কথা ধরলে) এবং অর্থনৈতিক সক্ষমতাও কমে যায়, তাহলে ইউক্রেইন অত্যন্ত দুর্বল অবস্থায় শান্তি আলোচনা করতে বাধ্য হবে।

কেবল ইউক্রেইনই নয়, ন্যাটোও বড় ধরনের সুবিধা হারাতে পারে। কারণ জর্জেস্কু ন্যাটোর ঘোরবিরোধী। যদিও প্রথম রাউন্ড জয়ের পর তিনি কিছুটা কৌশলী হয়ে ন্যাটো-বিরোধী অবস্থান একটু নরম করার চেষ্টা করছেন। তিনি যে তোমানিয়াকে ন্যাটো থেকে বের করতে চান তা তিনি অস্বীকার করেন।

কিন্তু এই প্রার্থী বছরের পর বছর যা বলে আসছেন তা কি ভুলে যাওয়া সহজ? এমনকি যদি তিনি রোমানিয়াকে সরাসরি ন্যাটো থেকে বের করতে না-ও পারেন, তিনি ন্যাটো-সমর্থিত প্রকল্পগুলোকে বাধাগ্রস্ত করতে পারেন। বিশেষ করে গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হল ন্যাটোর ইউরোপীয় ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা কবচ (Ballistic Missile Shield) যা রোমানিয়ায় দেবেসেলু (Deveselu) অঞ্চলে অবস্থিত। ২০১৬ সালে স্থাপিত এই শিল্ডে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের (United States) ৮০০ মিলিয়ন ডলার খরচ হয়েছে। এখানে এমন রাডার (Radar) এবং এসএম-৩ (SM-3) মিসাইল রয়েছে যা রুশ ক্ষেপণাস্ত্র ভূপাতিত করতে সক্ষম।

জর্জেস্কু বলছেন এই শিল্ড নাকি মস্কোর উসকানি। যদিও বাস্তবে এটি সরিয়ে দেওয়া তার পক্ষে সহজ হবে না, তবে যদি ভবিষ্যতে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পরিবর্তন হয়, ব্যয় কমানোর কথা ওঠে, কে জানে ভবিষ্যতে কী হতে পারে।

রোমানিয়ায় অপর একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটি হচ্ছে এমকে (MK) ঘাঁটি যা ন্যাটোর ইউরোপে সবচেয়ে বড় এয়ারবেস (Air Base) হতে যাচ্ছে – জার্মানির রামস্টেইন (Ramstein) ঘাঁটির চেয়েও বড়। পরিকল্পনা অনুযায়ী এই ঘাঁটিতে ১০,০০০ ন্যাটো সেনা এবং বহু যুদ্ধবিমান থাকবে। এটি ইউরোপে ন্যাটোর আকাশ প্রতিরক্ষার মুকুটমণি হয়ে উঠবে।

কিন্তু জর্জেস্কু ক্ষমতায় এলে কী হবে? তিনি হয়তো এই ঘাঁটির উন্নয়নের জন্য বরাদ্দ ২.৬ বিলিয়ন ডলার তহবিলই কেটে দিতে পারেন। এক রাতের মধ্যে বন্ধ হতে পারে এ প্রকল্প। এটি রাশিয়ার জন্য সত্যিকারের উপহার। কেননা এই ঘাঁটিটি মূলত রাশিয়ান ব্ল্যাক সি নিয়ন্ত্রণ চ্যালেঞ্জ করার জন্য তৈরি হচ্ছে। যদি এই ঘাঁটি গড়ে না ওঠে, পুতিন ফের ব্ল্যাক সি-তে অবাধে বিচরণ করতে পারবেন।

ধরুন ইউক্রেইনের যুদ্ধ শেষ হলো। বিশ্লেষকরা বলছেন, রাশিয়া তখন ব্ল্যাক সি ফ্লিট (Black Sea Fleet) আবার গড়ে তুলতে চেষ্টা করবে। ইউক্রেইন ইতিমধ্যে রাশিয়ার ব্ল্যাক সি ফ্লিটের এক-তৃতীয়াংশ ধ্বংস করেছে। রোমানিয়ায় ন্যাটোর সক্রিয় উপস্থিতি না থাকলে রাশিয়াকে প্রতিহত করা আরও কঠিন হবে।

সবমিলিয়ে জর্জেস্কুর জয় ইউক্রেইন এবং ন্যাটোর জন্য বিরাট মাথাব্যথার কারণ হতে পারতো। তা সত্ত্বেও ২৩% রোমানিয়ান তাকে ভোট দিয়েছে। প্রশ্ন হলো, কেন?

কেন ভোট দিলেন রোমানিয়ানরা?

রোমানিয়ানরা কি সত্যিই রাশিয়াপন্থী? বিশ্লেষকদের মতে না। এই ভোট আসলে ক্লান্তি ও ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। রোমানিয়ানরা তাদের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় ক্লান্ত ও বিরক্ত। কেন?

কারণ অর্থনৈতিক অবস্থার বেহাল দশা। রোমানিয়া ইউরো অঞ্চলের (Euro Zone) সবচেয়ে দরিদ্র দেশ। দেশে প্রায় ১.৯ কোটি জনসংখ্যার মধ্যে ৩২% এখনো দারিদ্র্য বা সামাজিক বঞ্চনার ঝুঁকিতে আছে। যদিও সাম্প্রতিক বছরে বেতন কিছুটা বেড়েছে, কিন্তু মুদ্রাস্ফীতি (Inflation) সেই বৃদ্ধিকে খেয়ে ফেলেছে। ২০২৩ সালে পরিবারের মাসিক আয় ১২% বেড়েছে ঠিকই, কিন্তু এখনো ৫.৪% মুদ্রাস্ফীতি ইউরো জোনে সর্বোচ্চ।

ফলস্বরূপ, ৭০% রোমানিয়ান মনে করেন মুদ্রাস্ফীতি এখন সবচেয়ে বড় সমস্যা। আর সেই সমস্যা নিয়ে সবচেয়ে বেশি কথা বলেছেন কে? জর্জেস্কু। ৯০% রোমানিয়ান পরিবার খরচ কমাতে বাধ্য হয়েছে। তাই জনগণ অসন্তুষ্ট, এবং তারা ঐতিহ্যবাহী দলগুলো থেকে মুখ ফিরিয়ে বিকল্প কাউকে খুঁজছে।

শুধু অর্থনীতি নয়, রাজনৈতিক দুর্নীতিও (Corruption) রোমানিয়ানদের ক্ষুব্ধ করেছে। ডান-বাম নির্বিশেষে প্রতিনিয়ত দুর্নীতি কেলেঙ্কারি প্রকাশিত হয়। “নর্ডিশ কেলেঙ্কারি” (Nordis scandal) তে যেমন সাবেক সমাজতান্ত্রিক প্রধানমন্ত্রী সহ (Prime Minister) অনেকে জড়িত। ২০১৬ সালে ডানপন্থী নেতা বাসেল ব্লাগা (Vasel Blaga) দুর্নীতির অভিযোগে পদত্যাগ করেন। ২০১৯ সালে সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির (Social Democratic Party) সভাপতি লিভিয়া ড্রাগনিয়া (Liviu Dragnea) দুর্নীতির অভিযোগে জেলে যান। এ তালিকা দীর্ঘ।

এতো দুর্নীতির পরিণতি হলো জনগণের হতাশা ও রাগ। তাই তারা জর্জেস্কুর মতো “আউটসাইডার” কে বেছে নিয়েছে ঐতিহ্যবাহী দলগুলোকে শাস্তি দিতে।

এই ঘটনায় আমরা একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা পাই: গণতন্ত্র (Democracy) শুধুই কয়েক বছর পরপর ভোট দেওয়া নয়। যদি শাসনব্যবস্থা সঠিকভাবে সমস্যার সমাধান না করে, দীর্ঘমেয়াদে জনগণ অতিমাত্রায় চরমপন্থী ও পপুলিস্ট (Populist) প্রার্থীদের দিকে ঝোঁকে, যার ফলে স্বাধীনতা ও পশ্চিমা মূল্যবোধ (Western Values) হুমকির মুখে পড়ে।

নির্বাচন স্থগিতকরণ: যুক্তি-পাল্টা যুক্তি

এবার নির্বাচনের স্থগিতকরণ নিয়ে বিতর্ক। একপক্ষে, রাশিয়া নির্বাচনে অন্যায়ভাবে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করেছে, অজস্র ভুল তথ্য (Misinformation) ছড়িয়েছে, আইন লঙ্ঘন করেছে। এটা অস্বচ্ছ ও অন্যায্য প্রতিযোগিতার স্পষ্ট উদাহরণ।

অন্যপক্ষে, মস্কোকে ভোট কেনার বা ভোট গোনা নিয়ন্ত্রণের অভিযোগ করা হচ্ছে না। শেষ পর্যন্ত তো রোমানিয়ানরাই ভোট দিয়েছেন। তারা যা চেয়েছেন তাই ঘটেছে, যদিও সেই সিদ্ধান্ত ভুল তথ্য দ্বারা প্রভাবিত হতে পারে।

আসাদের পতনের ফলে পুতিনের ক্ষতির ব্যাপারে জানতে এখানে যান।

রোমানিয়ার নির্বাচন ব্যাখ্যা: অতিডানপন্থী উত্থান? (২ ডিসেম্বর, ২০২৪)

ভূমিকা

রোমানিয়ার (Romania) রাজনৈতিক অঙ্গন এখন তুমুল আলোচনায় মুখর। প্রায় ১ কোটি ৮০ লাখ যোগ্য ভোটার উচ্চ-ঝুঁকিপূর্ণ সংসদীয় নির্বাচনে ভোট দিতে গিয়েছেন। রোমানিয়ার নির্বাচনগুলি বরাবরই অনিশ্চিত ফলাফলের জন্য পরিচিত; মাত্র গত সপ্তাহেই, ১০ শতাংশের নিচে জনমত জরিপ থাকা এক অপ্রত্যাশিত প্রার্থী (underdog candidate) ভাইরাল টিকটক (TikTok) ক্যাম্পেইনের সুবাদে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রথম পর্বে বিজয় ছিনিয়ে নিয়েছেন। তবে এই অপ্রত্যাশিত জয় ভোট পুনর্গণনা ও অনিয়মের অভিযোগের জন্ম দিয়েছে। এমনকি তারা আবারও নির্বাচন আয়োজনের কথা ভাবছে!

যাই হোক, এই লেখায় আমরা সংসদীয় নির্বাচন (parliamentary election) বিশ্লেষণ করব এবং মূল রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থান তুলে ধরব।

প্রধান রাজনৈতিক শক্তিগুলো

সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি (Social Democratic Party, PSD): সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি (PSD) রোমানিয়ার ঐতিহ্যবাহী মধ্য-বামপন্থী (center-left) দল, যারা সামাজিক কল্যাণ, গ্রামীণ সম্প্রদায়ের সমর্থন এবং সরকারি ব্যয় বৃদ্ধির ওপর জোর দেয়। তারা ইউরোপীয় ইউনিয়ন (European Union, EU) এবং ন্যাটো (NATO)-কে সমর্থন করলেও অধিকতর ঘরোয়া বিষয়কে গুরুত্ব দেয়, বিশেষ করে বয়স্ক ও গ্রামাঞ্চলের ভোটারদের আকর্ষণ করে। তবে PSD দুর্নীতি ও কেলেঙ্কারির জন্য কুখ্যাত, বিশেষত বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী মার্সেল চিওলাকু (Marcel Ciolacu)-কে ঘিরে। দলের বিশ্বাসযোগ্যতা সম্প্রতি আরও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে যখন PSD-প্রভাবিত সাংবিধানিক আদালত (Constitutional Court) প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে পুনর্গণনা চালায়, যেখানে চিওলাকু তৃতীয় স্থানে থেকে দ্বিতীয় পর্বে যাওয়ার সুযোগ হারান। আদালতের এই পুনর্গণনা স্বচ্ছতার অভাবে সমালোচিত হয়েছে এবং এটিকে ভোট পালটে দেয়ার চেষ্টা হিসেবে দেখা হচ্ছে। এর ফলে জনসাধারণের মধ্যে অবিশ্বাস বেড়েছে এবং দলের ইতোমধ্যেই ভঙ্গুর সুনামের আরও পতন ঘটেছে।

ন্যাশনাল লিবারাল পার্টি (National Liberal Party, PNL): ন্যাশনাল লিবারেল পার্টি (PNL) রোমানিয়ার প্রধান মধ্য-ডানপন্থী (center-right) দল, যারা মুক্তবাজার অর্থনীতি (free-market policies), ইউরোপীয় ইউনিয়ন (EU) ও ন্যাটো (NATO)-পন্থী নীতি সমর্থন করে। PNL মূলত শহুরে মধ্যবিত্ত ভোটারদের কাছে জনপ্রিয় এবং নিজেদেরকে রোমানীয় রাজনীতির আধুনিকায়নকারী শক্তি হিসেবে উপস্থাপন করে। তবে PNL অভ্যন্তরীণ কোন্দল, অব্যবস্থাপনা, বিশেষ করে অবকাঠামো (infrastructure) ও স্বাস্থ্যসেবা (healthcare) খাতে ব্যর্থতার জন্য সমালোচিত হয়েছে। তাদের বিশ্বাসযোগ্যতার বড় ধরনের পতন ঘটে ২০২০ সালে, যখন PSD-এর বিরুদ্ধে প্রচার চালিয়েও পরবর্তীতে তাদের সাথে জোট বাঁধে। এ কারণে দলটি ভণ্ডামির অভিযোগ ও ভোটারের আস্থা হারিয়েছে।

অ্যালায়েন্স ফর দ্য ইউনিয়ন অফ রোমানিয়ানস (Alliance for the Union of Romanians, AUR): অ্যালায়েন্স ফর দ্য ইউনিয়ন অফ রোমানিয়ানস (AUR) ডানপন্থী (right-wing) জনতোষণবাদী বা পপুলিস্ট (populist) দল, যারা প্রবল জাতীয়তাবাদী (nationalist) এজেন্ডা নিয়ে কাজ করে। তাদের স্লোগান “জাস্টিস ফর রোমানিয়ানস (Justice for Romanians)”—এতে তারা মলডোভা (Moldova)-র সাথে পুনর্মিলন ও রোমানিয়াকে আরও নিরপেক্ষ (neutral) অবস্থানে নিয়ে যেতে চায়। AUR ইইউ (EU) ও ন্যাটো (NATO)-তে সন্দেহপ্রবণ, যা রোমানিয়ার স্বাভাবিক জোট কাঠামো থেকে বেশ ব্যতিক্রমী। তবে AUR-কে ঘিরে বিতর্কও কম নয়। দলের সদস্যদের বিরুদ্ধে সহিংস আচরণের অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে। তাদের নেতা জর্জ সিমিওন (George Simion) তার নাটকীয় চালচলন ও আগ্রাসী বক্তব্যের জন্য পরিচিত। কেউ তাদের ভালোবাসুক বা ঘৃণা করুক, AUR রোমানিয়ান রাজনীতিতে নতুন গতিপথ আনতে শুরু করেছে।

সেভ রোমানিয়া ইউনিয়ন (Save Romania Union, USR): সেভ রোমানিয়া ইউনিয়ন (USR) মধ্য-ডানপন্থী (centre-right), সংস্কারমুখী (reformist) দল, যারা স্বচ্ছতা (transparency), দুর্নীতি দমন (anti-corruption) ও রোমানিয়ার আধুনিকায়নের ওপর জোর দেয়। USR তরুণ, শহুরে ভোটার ও প্রবাসী (diaspora) জনগোষ্ঠীর কাছে জনপ্রিয়। তারা শক্তিশালী ইউরোপীয় ইউনিয়ন (EU) ও ন্যাটো (NATO)-সমর্থক অবস্থানে রয়েছে এবং ঐতিহ্যগত রাজনৈতিক কাঠামোকে চ্যালেঞ্জ করে। তবে, সংস্কারপন্থী ইমেজ সত্ত্বেও, USR অভ্যন্তরীণ বিভাজন এবং এলিটবাদ (elitism), ভণ্ডামি (hypocrisy), ও বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার অভিযোগে জর্জরিত। দলের অনেক সদস্য কর্পোরেট (corporate) পটভূমি থেকে আসায়, তারা সরকারি কার্যক্রমে কর্পোরেট সংস্কৃতি প্রয়োগের চেষ্টা করে। এই পদক্ষেপ অনেক ভোটারকে বিরূপ করে তুলেছে।

এসওএস রোমানিয়া পার্টি (SOS Romania Party): এসওএস রোমানিয়া পার্টি (SOS Romania Party) অতিরিক্ত জাতীয়তাবাদী (ultra-nationalist) ও জনতোষণবাদী (populist) শক্তি, যারা সার্বভৌমত্ব (sovereignty), সামাজিক রক্ষণশীলতা (social conservatism) এবং আরও স্বাধীন পররাষ্ট্র নীতির পক্ষে। এটি ইউরোপীয় ইউনিয়ন-বিরোধী মনোভাব পোষণ করে। দলটি ঐতিহ্যবাহী রাজনীতিতে হতাশ ভোটারদের আকর্ষণ করে এবং রোমানিয়ান মূল্যবোধ ও জাতীয় পরিচয় রক্ষার অঙ্গীকার করে। এর আগ্রাসী নেতা ইউরোপীয় পার্লামেন্টে (European Parliament) বেশ কিছু নাটকীয় কাণ্ড ঘটিয়েছেন, যা দলকে বিতর্কিত ও একঘরে (isolationist) হিসেবে পরিচিতি দিয়েছে।

অন্যান্য দল: ইউডিএমআর (UDMR), রেপার (REPER), সেনস (SENS) ও ফার-রাইট পিওটি (POT): এরপর রয়েছে ডানমুখী কেন্দ্রীয়-ডানপন্থী ইউডিএমআর (UDMR), যা রোমানিয়ার বৃহত্তম জাতিগত হাঙ্গেরীয় (Hungarian) সংখ্যালঘুদের প্রতিনিধিত্ব করে। এছাড়া কেন্দ্রপন্থী রেপার (Centrist REPER) এবং প্রগতিশীল সেনস (SENS) রয়েছে, যারা রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন মাত্রা যোগ করছে। চরম ডানপন্থী ধারা বা চরমপন্থী প্রান্তে রয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন-বিরোধী, বিশ্বায়ন-বিরোধী পিওটি (POT), যা সাম্প্রতিক সময়ে দৃশ্যপটে আসছে।

নির্বাচন পদ্ধতি

ফলাফলের দিকে যাওয়ার আগে দেখা যাক নির্বাচন পদ্ধতি কেমন। রোমানিয়ানরা ভোট দিতে গিয়ে দুটি ব্যালট পেপার হাতে পান: একটি চেম্বার অব ডেপুটিজ (Chamber of Deputies, নিম্নকক্ষ) এবং অন্যটি সিনেট (Senate, উচ্চকক্ষ)-এর জন্য।

ভোটাররা তাদের নির্বাচনী এলাকায় (constituencies) দলের প্রার্থীদের তালিকায় ভোট দেন। প্রতিটি দলের মোট ভোট অনুপাতে সংসদের আসন বণ্টন হয়। মোট আসন হলো সিনেটে ১৩৬টি এবং চেম্বার অব ডেপুটিজ-এ ৩৩০টি। এই নির্বাচনগুলির ফলাফল রোমানিয়ার আইনপ্রণয়ন কাঠামো গঠনে অতি গুরুত্বপূর্ণ।

নির্বাচনের ফলাফল

এবার ফলাফলের দিকে যাওয়া যাক! কে এগিয়ে?

  • প্রথম স্থানে রয়েছে PSD, ২২.৫% ভোট নিয়ে, যা ৪ বছর আগের তুলনায় ৭% কম।
  • দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে AUR, ১৮% ভোট পেয়ে, যা আগের নির্বাচনের তুলনায় ৯% বেশি।
  • তৃতীয় স্থানে রয়েছে PNL, ১৪% ভোট পেয়ে, যা গতবারের তুলনায় বিশাল ১১% কম।
  • এরপর চতুর্থ স্থানে USR, পঞ্চম স্থানে SOS, ষষ্ঠ স্থানে UDMR, এবং সপ্তম স্থানে POT।

প্রায় ৫% ব্যবধানে এগিয়ে থাকা PSD প্রভাব বিস্তার করবে এবং সম্ভবত একটি কোয়ালিশন (coalition) সরকার গঠন করবে, যেখানে PSD থেকে প্রধানমন্ত্রী আসতে পারে। তাদের নেতা মার্সেল চিওলাকু (Marcel Ciolacu) এই জয় উদযাপন করে বলেন, এটি রোমানিয়ানদের পক্ষ থেকে একটি স্পষ্ট বার্তা যে ইউরোপীয় তহবিল (European money) ব্যবহার করে দেশকে উন্নয়নের পাশাপাশি জাতীয় পরিচয়, মূল্যবোধ ও বিশ্বাস রক্ষা করতে হবে।

ডানপন্থী উত্থান ও প্রভাব

তবে চরম ডানপন্থীরা (far-right) মোটেও নগণ্য নয়। তারা উল্লেযোগ্য অগ্রগতি সাধন করেছে। AUR তাদের আগের প্রায় ৯% ভোটকে দ্বিগুণেরও বেশি করে এবার ১৮%-এ নিয়ে গেছে, যা জাতীয়তাবাদী মনোভাবের প্রসারকে নির্দেশ করে। POT (Party of Young People) দলটি, যা ডানপন্থী প্রেসিডেন্ট প্রার্থী জর্জেস্কু (Georgescu)-কে সমর্থন করছে, এবং চরম ডানপন্থী SOS রোমানিয়া—সবাই ৫% ভোট অতিক্রম করে সংসদে প্রবেশের যোগ্যতা অর্জন করেছে। সম্মিলিতভাবে, তারা নতুন সংসদের প্রায় ৩০% আসন দখল করতে পারে, যা একটি উল্লেখযোগ্য এবং ক্রমবর্ধমান বলয়।

AUR নেতা জর্জ সিমিওন (George Simion) এই পরিবর্তনকে স্বাগত জানিয়ে বলেন: “আজ রোমানিয়ান জনগণ সার্বভৌমবাদী শক্তিগুলিকে ব্যাপকভাবে ভোট দিয়েছে… আমরা AUR প্রতিষ্ঠার পর থেকেই যা চেয়েছিলাম: PSD এবং PNL যেন রোমানিয়ানদের ভোটেই সরকারী সংখ্যাগরিষ্ঠতা থেকে বাদ পড়ে।”

কোয়ালিশন গঠন ও ভবিষ্যৎ জোটের সম্ভাবনা

কোনো দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে না পারায় কোয়ালিশন গঠন অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। PSD সম্ভবত ছোট দলগুলির সাথে জোট গঠন করবে। তাদের বর্তমান ক্ষমতার সঙ্গী PNL, যা এবার প্রায় ১৪.৪% ভোট পেয়েছে, হতে পারে এক অংশীদার। তবে আরও একটি পার্টনার দরকার পড়বে।

একটি আকর্ষণীয় সম্ভাবনা হলো PSD এবং USR-এর মধ্যে একটি রাজনৈতিক চুক্তি। এই চুক্তিতে USR সংসদে PSD-এর সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিশ্চিত করার বিনিময়ে চিওলাকু (Ciolacu) আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে USR নেত্রী এলেনা লাসকনি (Elena Lasconi)-কে সমর্থন করতে পারেন। তবে এই জোট USR-এর জন্য বিস্বাদ হতে পারে, কেননা তারা সংস্কারকামী ইমেজ বহন করে, আর PSD ঐতিহ্যগত ক্ষমতাসীন দুর্নীতিগ্রস্ত দলের পরিচয় বহন করে।

তবু USR এই জোটে রাজি হতে পারে রোমানিয়ার প্রো-ওয়েস্টার্ন (pro-Western) নীতিগুলোকে রক্ষা করতে, কেননা উদীয়মান চরম ডানপন্থী দলগুলো প্রায়ই রুশ-সমর্থিত (Russian-friendly) বলে মনে করা হয়। USR নেত্রী বলেন, “স্রষ্টা রোমানিয়াকে আশীর্বাদ করুন ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ন্যাটোর ছত্রছায়ায়,” তিনি আরও বলেন, “আমরা ঐক্যবদ্ধ হলে অলৌকিক ঘটনাও সম্ভব। এক থাকলে টিকটকের রুশ বট (Russian bots) আমাদের গণতন্ত্র ধ্বংস করতে পারবে না।”

ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ ও প্রেসিডেন্ট নির্বাচন

পরিস্থিতি এই নির্বাচনে প্রো-ইইউ (pro-EU) ও প্রো-ন্যাটো (pro-NATO) দলগুলি চরম ডানপন্থীদের ঠেকাতে সক্ষম হলেও, র‌্যাডিকাল (radical) দলের উল্লেখযোগ্য সমর্থন ভবিষ্যতে একটি সম্ভাব্য মোড়ের ইঙ্গিত দেয়। আগামী সপ্তাহের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দ্বিতীয় পর্বে একজন অতি-জাতীয়তাবাদী, রাশিয়া-পন্থী (pro-Russian) প্রার্থী জিততে পারে। এটি রোমানিয়ার রাজনৈতিক ভবিষ্যৎকে আরও অনিশ্চিত করে তুলবে।

কেন আয়ারল্যান্ড হচ্ছে ইউরোপীয় ইউনিয়নে সবচেয়ে ফিলিস্তিনপন্থী (Pro-Palestine) রাষ্ট্র (১০ নভেম্বর, ২০২৪)

ইইউর (EU) অভ্যন্তরে ইসরায়েল-ফিলিস্তিন বিভাজন ও আয়ারল্যান্ডের অবস্থান

যেমনটি আমরা লক্ষ্য করছি, ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংকটের প্রশ্নে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (EU) ভেতরে বিভিন্ন রাষ্ট্রের ভিন্নতা ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠছে। এই প্রেক্ষাপটে আয়ারল্যান্ড উত্থিত হয়েছে ইউরোপের সবচেয়ে ফিলিস্তিনপন্থী (Pro-Palestine) দেশের অন্যতম হিসেবে, যদি না একেবারেই সবচেয়ে ফিলিস্তিনপন্থী দেশ হিসেবেই বিবেচিত হয়।

আসলে আয়ারল্যান্ডের তুলনামূলকভাবে ফিলিস্তিনপন্থী এই অবস্থান নতুন কিছু নয়। আয়ারল্যান্ডের ইসরায়েল-ফিলিস্তিন দ্বন্দ্বে একটি ব্যতিক্রমধর্মী স্বার্থ জড়িয়ে আছে। সাধারণভাবে আয়রিশ রিপাবলিকানরা (Republicans) ফিলিস্তিনের পক্ষে অবস্থান নিয়ে থাকে, অপরদিকে লয়ালিস্টরা (Loyalists) ইসরায়েলের পক্ষে। এমনকি আয়ারল্যান্ডের রিপাবলিকান মিছিলগুলোতে ফিলিস্তিনি পতাকা দেখা যাওয়া অস্বাভাবিক নয়, আবার লয়ালিস্টদের মধ্যে সেগুলো পুড়িয়ে ফেলার ঘটনাও ঘটে। এমনকি কেল্টিক (Celtic) ফুটবল ম্যাচগুলোতেও এই ধরনের পতাকা প্রদর্শন করা হয়। এই অনুভূতি ফিলিস্তিনেও (Palestine) নজরে এড়ায়নি। বিগত এক মাসে অনেক ফিলিস্তিনিও আয়ারল্যান্ডের পতাকা ওড়াচ্ছে।

তবে সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে আয়ারল্যান্ডের সাথে ইসরায়েলের সম্পর্ক আরো তীব্র অবনতির দিকে গেছে। কারণ, ইসরায়েলি রাজনীতিবিদদের একাধিক অ-কূটনৈতিক (Undiplomatic) মন্তব্য পরিস্থিতিকে জটিল করে তুলেছে। ইসরায়েলের ঐতিহ্য মন্ত্রী (Heritage Minister) গাজাবাসীদেরকে (Gazans) “আয়ারল্যান্ড বা মরুভূমিতে (the desert) চলে যেতে” বলেছিলেন, যদি তারা পারমাণবিক হামলা থেকে বাঁচতে চায়। অন্যদিকে আয়ারল্যান্ডে নিযুক্ত ইসরায়েলি একজন শীর্ষ পর্যায়ের কূটনীতিক (Senior Israeli Diplomat) আয়ারল্যান্ডকে হামাসের (Hamas) “সন্ত্রাসী সুড়ঙ্গ” (tunnels of terror) অর্থায়নের অভিযোগ তুলেছেন। এছাড়াও ইসরায়েলের রাষ্ট্রদূত (Ambassador) আয়ারল্যান্ডের প্রেসিডেন্টকে (Irish President) দীর্ঘদিনের নিরপেক্ষতা (Neutrality) নীতিকে লঙ্ঘন করার এবং ভুল তথ্য প্রচারের অভিযোগ এনেছেন, কারণ আয়ারল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট ইসরায়েলকে আন্তর্জাতিক আইন ভঙ্গের অভিযোগে অভিযুক্ত করেছিলেন।

এই ঘটনাগুলোর প্রতিক্রিয়ায় আয়ারল্যান্ডের বিরোধীদলীয় (Opposition) রাজনীতিবিদরা ইসরায়েলি রাষ্ট্রদূতকে বহিষ্কারের দাবি তুলেছেন। যদিও ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রী লিও ভারাডকার (Leo Varadkar) এখনো সেটা করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। তবে এই বিষয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে তিনি ইসরায়েলকে রাশিয়ার (Russia) সাথে তুলনা করেছেন।

এই প্রেক্ষাপটে, আমরা এই লেখায় দেখবো ইসরায়েল-আয়ারল্যান্ড সম্পর্কের ইতিবৃত্ত, কেন বর্তমান পরিস্থিতি আরো খারাপ হচ্ছে, এবং কেন এই নিম্নমুখী প্রবণতা আগামীতেও অব্যাহত থাকবে।

প্রারম্ভিক সময়: সৌহার্দ্য থেকে তিক্ততার পথে

প্রথমে বলা দরকার যে ইসরায়েল ও আয়ারল্যান্ডের সম্পর্ক সবসময় এতটা তিক্ত ছিল না। প্রকৃতপক্ষে, ১৯২০ ও ১৯৩০-এর দশকে যখন উভয় দেশই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছিল, তখন আয়ারল্যান্ড ছিল ইসরায়েলের অন্যতম জোরালো সমর্থক।

এর একটি বড় কারণ ছিল, ইসরায়েলি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন বা জায়নিজমের (Zionists) সাথে আয়ারল্যান্ডের জাতীয়তাবাদীদের সংযোগ। বিশেষ করে ফিয়ানা ফেইল (Fianna Fáil) প্রেসিডেন্ট ও আয়ারল্যান্ডের রাষ্ট্রপ্রধান এ্যমন ডে ভ্যালেরা (Eamonn d’Evalera)-র মাধ্যমে এই সংযোগ স্থাপিত হয়। ডে ভ্যালেরার ডান হাত হিসেবে কাজ করতেন রবার্ট ব্রিসকো (Robert Briscoe) নামে একজন রিভিশনিস্ট জায়নিস্ট (Revisionist Zionist)। ব্রিসকো পরবর্তীতে সায়নিস্ট যোদ্ধা নেতা মেনাখেম বেগিন (Menahen Begin) – ভবিষ্যতে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী ও বর্তমান ক্ষমতাসীন লিকুদ (Likud) পার্টির প্রতিষ্ঠাতার পরামর্শক হিসেবেও কাজ করেন।

এছাড়াও, সে সময়কার ইসরায়েলের প্রধান রাব্বি (Chief Rabbi) – যিনি আবার বর্তমান ইসরায়েলি প্রেসিডেন্টের পিতামহ ছিলেন – আগে আইরিশ ফ্রি স্টেটের (Irish Free State) প্রধান রাব্বি ছিলেন। তিনি ডে ভ্যালেরাকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধপূর্ব ইউরোপীয় ইহুদিদের জন্য নিরাপদ আশ্রয় দিতে উদ্যোগ নিতে অনুরোধ করেন। এর ফলশ্রুতিতে ১৯৩৭ সালের আয়ারল্যান্ডের সংবিধানে (Irish Constitution) বিশেষভাবে ইহুদিদের (Jews) সুরক্ষার কথা অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

তবে আয়ারল্যান্ডের ইসরায়েলের প্রতি সহানুভূতির মূল কারণ ছিল তাদের উভয়েরই বৃটিশ ঔপনিবেশিক হস্তক্ষেপের শিকার হওয়া। পিল কমিশন (Peel Commission) ১৯৩৭ সালে ফিলিস্তিনকে আরব ও ইহুদি অঞ্চলে ভাগ করার প্রস্তাব করলে আয়ারল্যান্ডের কাছে তা পরাধীনতার স্মৃতিকে উসকে দেয়। আয়ারল্যান্ড স্মরণ করে তাদের নিজেদের ১৯২১ সালের বিভাজন (Partition of Ireland) এবং এই বিভাজনের স্মৃতি তাদের মধ্যে বিশেষ সংবেদনশীলতা জাগিয়ে তোলে। ১৯৩৭ সালে জাতিপুঞ্জের (League of Nations) অধিবেশনে ডে ভ্যালেরা পারটিশন বা দেশভাগকে “প্রস্তাবিত বহু সমাধানের মধ্যে হয়তো সবচেয়ে খারাপ” বলে উল্লেখ করেছিলেন।

শুধু তাই নয়, ২০শ শতকের গোড়ার দিকে আয়ারল্যান্ড ও জায়নিস্টদের অভিজ্ঞতার মধ্যে আরও মিল ছিল। উভয়পক্ষই ইউরোপীয় পূর্বধারণাকে ভুল প্রমাণ করে রাষ্ট্রগঠনের মাধ্যমে নিজেদের পরিচয় প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল, উভয়েরই জাতীয় ভাষার পুনর্জাগরণের উদ্যোগ ছিল, এবং উভয়ের পেছনেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী বড় অভিবাসী গোষ্ঠীর (Diaspora) সমর্থন ছিল।

সম্পর্কের অবনতির শুরু

কিন্তু ১৯৪০-এর দশক থেকে এই সম্পর্ক অবনতি শুরু করে। এর একটি বড় কারণ ছিল ভ্যাটিকানের (the Vatican) আয়ারল্যান্ডের পররাষ্ট্রনীতিতে ব্যাপক প্রভাব। ভ্যাটিকান জেরুজালেমের (Jerusalem) ওপর আন্তর্জাতিক তত্ত্বাবধানে আস্থা রাখতো, যাতে এর বহুজাতিক চরিত্র সুরক্ষিত থাকে।

পরবর্তীতে ১৯৮০-এর দশকে দক্ষিণ লেবাননে (Southern Lebanon) জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনী (UNIFIL) হিসেবে কর্মরত আইরিশ সৈন্যদের সঙ্গে সংঘাতও সম্পর্কের অবনতিকে ত্বরান্বিত করে। ১৯৮৩ সালে ইসরায়েল-সমর্থিত (Israeli-backed) লেবানিজ মিলিশিয়ারা আইরিশ সৈন্যদের হত্যা করে, এবং আয়ারল্যান্ড সরাসরি বা পরোক্ষভাবে এ ঘটনার জন্য ইসরায়েলকে দায়ী করে। ১৯৭৮ থেকে পরবর্তী সময়কালে যেসব আইরিশ সৈন্য নিহত হয়েছিল (মোট ৪৫ জনের মধ্যে কমপক্ষে ১৫ জনের মৃত্যুতে ইসরায়েলকে দায়ী করা হয়), তা আয়ারল্যান্ডের জনগণের মাঝে গভীর ক্ষোভ সৃষ্টি করেছিল।

পরবর্তীতে ২০১০ সালে আরেকটি ঘটনা পরিস্থিতি আরও খারাপ করে তোলে, যখন জানা যায় যে একটি হামাস (Hamas) কর্মকর্তাকে হত্যা করার সময় ইসরায়েলি গুপ্তঘাতকরা জাল আইরিশ পাসপোর্ট (Irish passports) ব্যবহার করেছিল।

আয়ারল্যান্ডের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন: ঔপনিবেশিকতা প্রসঙ্গ

আসল পরিবর্তন এসেছিল যখন ১৯৭০-এর দশকে এসে আয়ারল্যান্ড, বিশ্বের অনেক দেশের মতো, আর ইসরায়েলকে একটি ঔপনিবেশিক শক্তির চাপে থাকা সংখ্যালঘু রাষ্ট্র হিসেবে দেখল না। বরং তারা দেখতে শুরু করল ইসরায়েলকে একধরনের ঔপনিবেশিক (Colonial) রাষ্ট্র হিসেবে, যারা বৃটেনের (Britain) সমর্থন নিয়ে স্থানীয় ফিলিস্তিনিদের ওপর নিপীড়ন চালাচ্ছে।

এখানে ইয়াসির আরাফাতের (Yasser Arafat) ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। তিনি ফিলিস্তিনি জাতীয়তাবাদের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে খ্যাত, যিনি ১৯৫৮ সালে ফাতাহ (Fatah) সংগঠন তৈরি করেন এবং ১৯৬৯ সালে প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশনের (Palestinian Liberation Organization – PLO) চেয়ারম্যান হন। আরাফাত ফিলিস্তিনের সংগ্রামকে আন্তর্জাতিক মঞ্চে নিয়ে আসেন এবং এটিকে স্পষ্টভাবে একটি উপনিবেশবিরোধী (Anti-colonial) লড়াই হিসেবে উপস্থাপন করেন।

১৯৮০ সালে আয়ারল্যান্ড ছিল ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রথম সদস্য রাষ্ট্র, যারা আনুষ্ঠানিকভাবে পিএলও (PLO)-কে স্বীকৃতি দেয়। সেই থেকে আয়ারল্যান্ড একটি দুই-রাষ্ট্র সমাধান (Two-state solution)-এর পক্ষে দৃঢ়ভাবে অবস্থান করে আসছে।

একই সময়ে সম্পর্কের আরো অবনতির কারণ হিসেবে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, এক সময় ইসরায়েলি রাজনীতি বেশ বামপন্থী (Left-wing) ধারা রাখলেও ১৯৭০-এর দশকে তা ক্রমশ ডানপন্থী (Rightward) দিকে মোড় নেয়। অন্যদিকে আইরিশ রিপাবলিকানবাদ (Irish Republicanism) একই সময়ে আরো বাম-ঘেঁষা (Socialist tones) হয়ে ওঠে। এই আদর্শিক বৈপরীত্যও দুই দেশের মধ্যে দূরত্ব বাড়ায়।

সাম্প্রতিককালীন অবনতি ও ফিলিস্তিনি ভূমি দখল প্রসঙ্গ

গত কয়েক বছরে আয়ারল্যান্ড-ইসরায়েল সম্পর্ক আরও অবনতির দিকে গেছে। আয়ারল্যান্ড পশ্চিম তীরে (West Bank) ইসরায়েলি বসতি সম্প্রসারণের (Israeli settlements) সমালোচনা করেছে। ২০২১ সালে আইরিশ পার্লামেন্ট সর্বসম্মতভাবে একটি প্রস্তাব পাস করে, যেখানে ফিলিস্তিনি জমির “আনুষ্ঠানিক দখলদারিত্ব” (De facto annexation) নিন্দা করা হয়। তারা ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রথম সদস্য রাষ্ট্র যারা এই ধরনের পদক্ষেপ নেয়।

এছাড়া আয়ারল্যান্ড ইউরোপীয় কমিশনের (European Commission) হামাস আক্রমণের পর পরই ফিলিস্তিনের প্রতি সহায়তা স্থগিতের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে। আয়ারল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী ভারাডকার ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ফন ডার লেয়েন (Ursula von der Leyen)-কে সমালোচনা করেন ভারসাম্যহীন অবস্থান নেওয়ার জন্য। একইসাথে আয়ারল্যান্ড খুব অল্প কয়েকটি ইইউ রাষ্ট্রের মধ্যে একটি যারা সাময়িক মানবিক বিরতির (Humanitarian pause) পরিবর্তে একটি পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধবিরতি (Ceasefire) দাবি করেছে।

ইসরায়েলি কর্মকর্তা ও মন্ত্রীরা এই সব পদক্ষেপের জবাবে অতি অ-কূটনৈতিক (Undiplomatic) মন্তব্য করেছে। ফলে এখন আয়ারল্যান্ডের বেশিরভাগ বিরোধী দল ইসরায়েলি রাষ্ট্রদূতকে বহিষ্কারের দাবি জানাচ্ছে।

ভবিষ্যৎ পরিপ্রেক্ষিত: আরো অবনতির সম্ভাবনা

ইসরায়েলের জন্য এ পদক্ষেপ কৌশলগতভাবে বিশেষ সুবিবেচনাপ্রসূত নয়। কারণ ইউরোপীয় সমর্থন এখনই কিছুটা টলমল করছে, বিশেষ করে ইসরায়েলি হামলার (Israeli assault) পটভূমিতে। পাশাপাশি, ইইউর অভিন্ন পররাষ্ট্র ও নিরাপত্তা নীতি (Common Foreign and Security Policy) বাস্তবায়নের জন্য ঐক্যমতের প্রয়োজন, অর্থাৎ প্রতিটি সদস্য রাষ্ট্রের ভেটো (Veto) ক্ষমতা আছে। এ কারণে আয়ারল্যান্ডের মত একটি রাষ্ট্রের অবস্থান ইইউর সামগ্রিক নীতিতে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলতে পারে।

আগামীতে এই সম্পর্ক আরো খারাপের দিকেই যেতে পারে। জরিপে দেখা যাচ্ছে যে পরবর্তী আয়ারল্যান্ড নির্বাচনে শিন ফেইন (Sinn Féin) বিজয়ী হতে পারে। শিন ফেইন সম্ভবত ইউরোপের সবচেয়ে ফিলিস্তিনপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর একটি। তারা পূর্বে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে BDS (Boycott, Divestment, Sanctions) আন্দোলন সমর্থন করেছে এবং ২০০৬ সালে তাদের মানবাধিকার বিষয়ক মুখপাত্র ডাবলিনে (Dublin) ইসরায়েলকে “পৃথিবীর অন্যতম জঘন্য এবং ঘৃণ্য শাসনব্যবস্থা” (One of the most abhorrent and despicable regimes) হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন।

এখনো শিন ফেইনের নেতার টুইটার হেডারে (Twitter header) একটি ফিলিস্তিনি পতাকা শোভা পাচ্ছে, এবং তিনি ইসরায়েলকে গাজায় (Gaza) “একটি গণহত্যার (Slaughter) বিচার চলাচ্ছে” বলে অভিযুক্ত করেছেন।

সুতরাং, ইতিহাস, আদর্শগত পার্থক্য, উপনিবেশবিরোধী দৃষ্টিভঙ্গি, ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডের দখল, ইসরায়েলি নেতাদের অ-কূটনৈতিক আচরণ, এবং আয়ারল্যান্ডের রাজনৈতিক গতিপ্রবাহ – সবকিছুই মিলে সংকেত দিচ্ছে যে ইসরায়েল-আয়ারল্যান্ড সম্পর্ক অদূর ভবিষ্যতে সহজে উন্নতি করার সম্ভাবনা কম। বরং এই সম্পর্কের অবনতি অব্যাহত থাকার আশঙ্কাই প্রবল।

তথ্যসূত্র

1 – https://twitter.com/ciarantierney/status/1149745464528560128/photo/1
2 – https://www.breakingnews.ie/ireland/go-to-ireland-or-desert-comments-do-not-represent-israels-policy-ambassador-1548771.html
3 – https://www.independent.ie/irish-news/senior-israeli-diplomat-suggests-ireland-is-funding-hamas-tunnels-in-deleted-post/a1859848361.html
4 – https://www.bbc.co.uk/news/articles/c2x8255n0kzo
5 – https://www.breakingnews.ie/ireland/israeli-ambassador-says-ireland-is-not-politically-neutral-in-gaza-conflict-1549006.html
6 – https://www.breakingnews.ie/ireland/varadkar-warns-against-expelling-israeli-ambassador-to-ireland-1548904.html
7 – https://www.breakingnews.ie/ireland/varadkar-warns-against-expelling-israeli-ambassador-to-ireland-1548904.html
8 – https://en.wikipedia.org/wiki/Robert_Briscoe_(politician)
9 – https://en.wikipedia.org/wiki/History_of_the_Jews_in_Ireland
10 – https://en.wikipedia.org/wiki/Peel_Commission
11 – The Harp and the Shield of David: Ireland, Zionism and the State of Israel. Shulamit Eliash
12 – https://www.tandfonline.com/doi/abs/10.1080/03086534.2017.1294237
13 – https://foreignpolicy.com/2010/06/23/why-the-irish-support-palestine-2/
14 – https://en.wikipedia.org/wiki/At_Tiri_incident
15 – https://foreignpolicy.com/2010/06/23/why-the-irish-support-palestine-2/
16 – https://www.theguardian.com/commentisfree/2023/nov/02/ireland-criticism-israel-eu-palestinian-rights
17 – https://www.irishexaminer.com/news/arid-41264869.html
18 – https://www.theirishstory.com/2013/01/23/a-long-and-oddly-intertwined-history-irish-nationalism-and-zionism/
19 – https://www.aljazeera.com/news/2021/6/7/whats-behind-irelands-support-for-palestine
20 – https://carnegieeurope.eu/strategiceurope/89652
21 – https://www.theguardian.com/commentisfree/2023/nov/02/ireland-criticism-israel-eu-palestinian-rights
22 – https://foreignpolicy.com/2010/06/23/why-the-irish-support-palestine-2/
23 – https://twitter.com/sinnfeinireland/status/1720500639824851222
24 – https://twitter.com/MaryLouMcDonald

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.