প্রেসিডেন্ট ইউন-এর অভিশংসন: দক্ষিণ কোরিয়ার (South Korea) ভবিষ্যৎ কী?

ভূমিকা

শনিবার, দক্ষিণ কোরিয়ার (South Korea) প্রেসিডেন্ট ইউন সুক-ইওল (Yoon Suk Yeol) জাতীয় পরিষদ (national assembly) দ্বারা অভিশংসিত হয়েছেন। এটি এক নাটকীয় ঘটনাক্রমের সর্বশেষ ধাপ, যার সূত্রপাত হয়েছিল দুই সপ্তাহ আগে তার সামরিক শাসন (martial law) জারি করার ব্যর্থ চেষ্টার মাধ্যমে। এই লেখায় আলোচনা করা হবে কীভাবে এই অভিশংসন (impeachment) হয়েছে, পরবর্তী পদক্ষেপগুলো কী, এবং কেন দেশটির রাজনৈতিক অস্থিরতা এখনো কিছুদিন স্থায়ী হতে পারে।

সারসংক্ষেপ ও পূর্বপ্রেক্ষাপট

মঙ্গলবার, ৩ ডিসেম্বর গভীর রাতে, প্রেসিডেন্ট ইউন (Yoon) চার দশক পর প্রথমবারের মতো দেশে সামরিক শাসন (martial law) জারির ঘোষণা দেন। তিনি দাবি করেন, বিরোধী-নিয়ন্ত্রিত জাতীয় পরিষদ (national assembly) সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধেই বারবার অভিশংসন প্রচেষ্টা ও বাজেট নিয়ে অবরোধমূলক ভূমিকা পালন করছে। এটিকে তিনি সামরিক শাসন জারির অজুহাত হিসেবে দাঁড় করান। কিন্তু অচিরেই দেশজুড়ে বিক্ষোভ শুরু হয়। সামরিক বাহিনী আইনপ্রণেতাদের সামরিক শাসন বাতিলের উদ্যোগকে বাধা দিতে সংসদ ভবনে (parliament) মোতায়েন হলে, আইনপ্রণেতারা সেই রাত্রিতে দ্রুত একত্রিত হন এবং সামরিক শাসনাদেশ বাতিলের পক্ষে ভোট দেন। ফলস্বরূপ, সামরিক শাসন জারি করার প্রায় ছয় ঘণ্টার মাথায় ইউনকে (Yoon) এই আদেশ প্রত্যাহারে বাধ্য করা হয়।

প্রথমবার প্রেসিডেন্ট ইউনকে অভিশংসনের চেষ্টা ব্যর্থ হয়, কারণ তার নিজ দলের (কনসারভেটিভ পিপল পাওয়ার পার্টি – Conservative People Power Party) যথেষ্ট সংখ্যক সংসদ সদস্য দলীয় অবস্থান থেকে সরে আসেননি। কিন্তু পরবর্তী সপ্তাহ জুড়ে ব্যাপক গণবিক্ষোভ অব্যাহত থাকে এবং ইউন পদত্যাগে অস্বীকৃতি জানালে গত শনিবার আরেকটি অভিশংসন ভোট হয়। এবার ১২ জন ক্ষমতাসীন দলের সংসদ সদস্য দলীয় অবস্থান ভেঙে অভিশংসনের পক্ষে ভোট দিলে দুই-তৃতীয়াংশের শর্ত পূরণ হয়, এবং ইউনকে অভিশংসিত ঘোষণা করা হয়।

কিন্তু এই অভিশংসনের ভোটই সবকিছুর ইতি টানেনি। দক্ষিণ কোরিয়ার রাজনৈতিক অস্থিরতা এখানেই শেষ নয়, বরং দীর্ঘস্থায়ী হতে চলেছে।

অভিশংসন পরবর্তী প্রক্রিয়া

তো এখন কী ঘটবে? অভিশংসনের বিষয়টি এখন যাবে সাংবিধানিক আদালতে (Constitutional Court), যেখানে আদালতকে আগামী ১৮০ দিনের মধ্যে সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে অভিশংসন বহাল থাকবে কি না। এই সময়কালে প্রেসিডেন্ট ইউন (Yoon) তাঁর ক্ষমতা ও দায়িত্ব থেকে বরখাস্ত থাকবেন। প্রধানমন্ত্রী হান ডক-সু (Han Deok Soo) আপাতত ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট (acting President) হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন।

যদি সাংবিধানিক আদালত অভিশংসন বাতিল করে, তাহলে ইউন তার পদে ফিরে যাবেন। তবে, যদি আদালত অভিশংসন বহাল রাখে, তাহলে রায়ের ৬০ দিনের মধ্যে নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। অর্থাৎ, পুরো প্রক্রিয়াটি আট মাস পর্যন্ত দীর্ঘায়িত হতে পারে। তবে কিছু বিষয়ে ইঙ্গিত দেয় যে সময়সীমা আরো কম হতে পারে।

সময়সীমা সংক্রান্ত কারণসমূহ

দক্ষিণ কোরিয়ার অতীত অভিশংসন মামলাগুলো তুলনামূলকভাবে দ্রুত নিষ্পত্তি হয়েছে।

  • ২০১৭ সালে, সাবেক প্রেসিডেন্ট পার্ক গিউন-হে (Park Geun-hye) এর অভিশংসন বহাল রাখতে সাংবিধানিক আদালত প্রায় তিন মাস সময় নিয়েছিল।
  • ২০০৪ সালে, প্রেসিডেন্ট নো মু-হিউন (Roh Moo-hyun) এর অভিশংসন বাতিলে প্রায় দুই মাস সময় লেগেছিল।

এছাড়াও আদালতের বর্তমান বিচারপতিদের সংখ্যা গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমানে ৯টি পদের মধ্যে ৬টি পদ পূরণ আছে। এর মধ্যে আবার দুইজন বিচারপতির মেয়াদ এপ্রিল মাসে শেষ হবে। বার্তা সংস্থা রয়টার্স (Reuters) -এর বরাতে আইন বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, আদালত এই মেয়াদোত্তীর্ণের আগেই রায় দিতে চাইতে পারে।

অভিশংসন বহাল রাখতে ৯ জন বিচারকের মধ্যে অন্তত ৬ জনের ভোট প্রয়োজন। কিন্তু এখন যেহেতু মাত্র ৬ জন বিচারক আছেন, তাদের সবাইকেই সম্মত হতে হবে অভিশংসন বহাল রাখার পক্ষে। বিচারক নিয়োগের তিনটি পদ খালি থাকা নিয়ে কিছু সংশয় ছিল, আদালত আদৌ মামলা এগিয়ে নিবে কিনা বা কীভাবে নেবে তা নিয়ে। তবে সোমবার আদালত জানিয়েছে, শূন্যপদ থাকা সত্ত্বেও তারা বিচার প্রক্রিয়া শুরু করবে এবং ২৭ ডিসেম্বর প্রথম শুনানি নির্ধারণ করা হয়েছে।

জাতীয় পরিষদও (national assembly) দ্রুত পদক্ষেপ নিয়ে খালি পদগুলো পূরণ করার চেষ্টা করছে। বছরের শেষ নাগাদ এই প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করার লক্ষ্য রয়েছে। তবু, সাংবিধানিক প্রক্রিয়া থেকে আলাদাভাবে ইউনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ (insurrection) ও ক্ষমতার অপব্যবহারের (abuse of power) জন্য একটি ফৌজদারি তদন্ত (criminal investigation) চলছে, যা অভিশংসনের চেয়েও তাড়াতাড়ি বিপত্তি ডেকে আনতে পারে।

অবিলম্বে সামনে কী অপেক্ষা করছে?

ধরে নিই অভিশংসন প্রক্রিয়া এখনো চলছে, দেশের ভবিষ্যৎ অস্থিরতার মধ্যে রয়েছে। জাতীয় নেতৃত্বের এই অনিশ্চয়তা এমন সময়ে ঘটছে যখন দক্ষিণ কোরিয়া (South Korea) বিশ্বের অন্যান্য শক্তির সাথে জটিল সম্পর্ক মোকাবেলা করছে। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের (United States) গুরুত্বপূর্ণ মিত্র হওয়ার কারণে, দক্ষিণ কোরিয়াকে ডোনাল্ড ট্রাম্প (Donald Trump)-এর আবার ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তনের বাস্তবতার মোকাবেলা করতে হবে।

ট্রাম্প জানুয়ারিতে দায়িত্ব নেওয়ার পর দ্রুত দক্ষিণ কোরিয়ার বিরুদ্ধে শুল্কারোপ (tariffs) করতে পারেন, কারণ যুক্তরাষ্ট্রের সাথে দেশটির বাণিজ্য উদ্বৃত্ত (trade surplus) প্রায় ৫০ বিলিয়ন ডলার। তাছাড়া মার্কিন সামরিক বাহিনীর (US military) উপস্থিতির জন্য দক্ষিণ কোরিয়ার কাছ থেকে অতিরিক্ত বিলিয়ন ডলার দাবি করার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এইসব গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জের মুখে একটি স্থায়ীভাবে ক্ষমতাসীন নেতা না থাকা, তার বদলে একজন সাময়িক ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট (acting President) দিয়ে দেশ চালানো কোনমতেই আদর্শ পরিস্থিতি নয়। ট্রাম্পের সাথে কাজ করতে গেলে ব্যক্তিগত সম্পর্ক এবং আলোচনার কৌশল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ—অস্থায়ী নেতৃত্ব এই প্রশ্নে দুর্বল অবস্থানে পড়বে।

দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ও সম্ভাব্য রাজনৈতিক পালাবদল

যদি সাংবিধানিক আদালত অভিশংসন বহাল রাখে এবং নির্বাচন হয়, তাহলে ইউনের মেয়াদ প্রায় দুই বছর আগেই শেষ হয়ে যাবে। এই ক্ষেত্রে, পরবর্তী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনটি দক্ষিণ কোরিয়ার রাজনৈতিক দৃশ্যপটে বড় পরিবর্তন আনতে পারে। বর্তমানে বামঘেঁষা (left-leaning) বিরোধী নেতা লি জে-মিয়ং (Lee Jae-myung) পরবর্তী নির্বাচনে জয়ী হওয়ার সবচেয়ে সম্ভাবনাময় প্রার্থী বলে বিবেচিত।

লি (Lee) এমন একজন জনবাদী (populist) নেতা যাকে অনেকে বার্নি স্যান্ডার্স (Bernie Sanders) এবং ডোনাল্ড ট্রাম্প (Donald Trump) – উভয়ের সাথেই তুলনা করেন। গত কয়েক বছরে তিনি বারবার শিরোনামে এসেছেন, ঠিক যেভাবে ইউন এসেছেন। ২০২২ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে লি খুবই সামান্য ব্যবধানে ইউনের কাছে হেরে যান—যা দক্ষিণ কোরিয়ার ইতিহাসে সবচেয়ে কাছাকাছি ফলের নির্বাচন ছিল। গত বছর, ইউনের নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে লি ২৪ দিনের অনশন (hunger strike) পালন করেন। ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে লি এক হত্যাচেষ্টার (assassination attempt) শিকার হন, যখন তার গলায় ছুরি মেরে আক্রমণ করা হয়েছিল, কিন্তু তিনি বেঁচে যান।

তবে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো, লি আদৌ নির্বাচন করতে পারবেন কিনা। কারণ তার বিরুদ্ধে আইনি ঝামেলা রয়েছে। তিনি সম্প্রতি নির্বাচনী আইন (electoral law) লঙ্ঘনের দায়ে দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন, যা কার্যকর থাকলে তাকে বছরের পর বছর নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে বাধা দিতে পারে। এখন বিষয়টি সময়ের হাতে—লি এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেছেন। আপিলের কারণে যদি সময় পাওয়া যায় এবং এর মধ্যে আকস্মিক নির্বাচন (snap election) হয়, লি যদি জয়ী হন, তবে প্রেসিডেন্ট হিসেবে তিনি আইনি রক্ষাকবচ (immunity) পাবেন।

এখানে আরেকটি স্বতন্ত্র গবেষণার বিষয় হতে পারে যে, লি প্রেসিডেন্ট হলে যুক্তরাষ্ট্র (US), জাপান (Japan), উত্তর কোরিয়া (North Korea) এবং চীনের (China) সাথে সম্পর্ক কীরূপ হবে। তবে এতদূর ভাবার আগে আমাদের অপেক্ষা করতে হবে পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহের জন্য।

সাম্প্রতিক মার্শাল ল বিষয়ক ঘটনা ও নাগরিক প্রতিরোধের সাফল্য

শেষে ফিরে তাকাই সাম্প্রতিক মার্শাল ল (martial law) জারি চেষ্টার দিকে। সময়ের সাথে স্পষ্ট হয়ে উঠছে যে, ইউনের এই উদ্যোগ ছিল চরম অদ্ভুত ও অপরিকল্পিত। অন্যদিকে, দক্ষিণ কোরিয়ার জনগণ ও আইনপ্রণেতারা অবিশ্বাস্যরকম দ্রুত ও কার্যকরভাবে এই প্রয়াস প্রতিরোধ করেছে।

এর মধ্যে ছিল সংসদ সদস্যদের (lawmakers) সৈন্যবেষ্টিত সংসদ ভবনের বেড়া টপকানো, সংসদ কর্মচারী ও প্রতিবাদকারীদের (protesters) সৈন্যদের সামনে দৃঢ় অবস্থান, এবং পরবর্তী সপ্তাহগুলোতে নাগরিকদের টানা বিক্ষোভ। বিক্ষোভকারীরা কেপপ (K-pop) লাইটস্টিক, ন্যাড়া মাথা (shaved heads), এমনকি শেষকৃত্যের ফুল (funeral flowers) পর্যন্ত ব্যবহার করে প্রতীকী প্রতিবাদ জানান। অভিশংসনের ফল ঘোষণার পর বিক্ষোভকারীরা উল্লাসে মেতে ওঠে। কিন্তু আমরা যেমন ব্যাখ্যা করেছি, এবং বিক্ষোভকারীরাও জানেন, এই গল্প এখানেই শেষ নয়।

তথ্যসূত্র

Constitutional Court case and timeline:
https://www.reuters.com/world/asia-pacific/south-koreas-constitutional-court-decide-impeached-presidents-fate-2024-12-14/
https://en.yna.co.kr/view/AEN20241216002352315?section=national/politics

South Korea trade surplus:
https://www.reuters.com/markets/south-korean-trade-minister-sees-firms-investing-more-us-if-trump-imposes-2024-11-06/

Lee Jae-myung’s prospects:
https://www.bloomberg.com/news/articles/2024-12-15/yoon-s-fall-gives-nemesis-surprise-path-back-to-lead-south-korea
https://www.koreatimes.co.kr/www/nation/2024/12/113_388495.html
https://www.france24.com/en/live-news/20241215-south-korea-s-yoon-impeached-what-happens-next

Protest tactics:
https://www.theguardian.com/world/2024/dec/12/south-korea-martial-law-protests-k-pop-and-glow-sticks
https://apnews.com/article/south-korea-protesters-photo-gallery-yoon-b17f96063a2635ebc87f35ed9ab5ac5b
https://www.koreatimes.co.kr/www/nation/2024/12/113_388213.html

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.