Table of Contents
ভেনেজুয়েলায় প্রেসিডেন্ট মাদুরোর তৃতীয় মেয়াদ (সংক্ষিপ্ত) (১৩ জানুয়ারি, ২০২৫)
ব্রাজিলের মুদ্রার রেকর্ড দরপতন (১৯ ডিসেম্বর, ২০২৪)
অর্থনৈতিক খবরে, ব্রাজিলের (Brazil) মুদ্রার দরপতন প্রেসিডেন্ট লুইজ ইনাসিও লুলা দা সিলভার (Luiz Inacio Lula da Silva) (যিনি লুলা (Lula) নামে অধিক পরিচিত) উপর আর্থিক সংস্কার (fiscal reform) বাস্তবায়নের চাপ বাড়িয়ে দিচ্ছে। তার বামপন্থী সরকার (left wing government) ব্যয়মূলক (tax and spend policies) নীতি গ্রহণের পর ব্যবসায়ী মহলের মধ্যে প্রতিরোধ দেখা দিয়েছে, ফলে সরকার এখন ব্যয়সংকোচনমূলক পদক্ষেপ নিতে আগ্রহী।
এই সপ্তাহে ব্রাজিলের মুদ্রা “রিয়াল” (real) প্রায় ২% দর হারিয়েছে এবং মঙ্গলবার ডলারের বিপরীতে ৬.২১ রিয়ালে নেমে রেকর্ড নিম্নস্তরে পৌঁছেছে। এর ফলে ২০২৪ সালে শুরু থেকে এখন পর্যন্ত মুদ্রাটির দরপতন দাঁড়িয়েছে ২১%, যা জে.পি. মরগান (JP Morgan)-এর উদীয়মান বাজারের মুদ্রাসূচকে (emerging markets currency Index) বছরের সবচেয়ে খারাপ পারফরমার।
রিয়ালের দর ধরে রাখতে মঙ্গলবার ব্রাজিলের কেন্দ্রীয় ব্যাংক (Brazil’s central bank) জরুরি ব্যবস্থা গ্রহণ করে পরপর তৃতীয় দিন কারেন্সি ট্রেডিং অপারেশনে অংশ নেয় এবং ৩ মিলিয়ন ডলারের বেশি বিক্রি করে। প্রসঙ্গত, বিনিয়োগকারীরা লুলার উদ্দীপনা প্যাকেজ (stimulus measures) এবং ক্রমবর্ধমান সরকারি ঋণ নিয়ে উদ্বিগ্ন। সরকারি ঋণ জিডিপির (GDP) প্রায় ১০% এর কাছাকাছি, যা অর্থনীতিবিদদের মতে জনঋণকে (public debt) অস্থিতিশীল পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারে।
যদিও লুলার পদক্ষেপগুলি প্রবৃদ্ধি (growth) বাড়িয়েছে, একইসঙ্গে তা মুদ্রাস্ফীতি (inflation) উস্কে দিয়েছে। এর জবাবে, ব্রাজিলের কেন্দ্রীয় ব্যাংক (BCB) সুদের হার (interest rates) বাড়িয়ে তুলেছে। গত সপ্তাহে মূল সুদের হার এক শতাংশ পয়েন্টের বেশি বাড়ানো হয়েছে, যা প্রত্যাশার চেয়েও বেশি। নীতিনির্ধারকরা ২০২৫ সালেও সুদের হার বৃদ্ধির ইঙ্গিত দিয়েছেন। অর্থনীতিবিদদের মতে, এটি বৈদেশিক বিনিয়োগ (foreign investment) আকর্ষণ করে রিয়ালকে রক্ষা করতে পারে, তবে স্বল্পমেয়াদে অভ্যন্তরীণ চাহিদা কমাবে এবং অর্থনৈতিক কষ্ট ডেকে আনবে।
ব্রাজিলের সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক ইতিহাস ও সম্ভাবনা সম্পর্কে জানতে পড়ুন – কেন ব্রাজিল সুপারপাওয়ার নয় (যদিও হওয়া উচিত!) (২৮ জুলাই, ২০২৪)
লুলার শাসনামলে ব্রাজিলের অর্থনৈতিক গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে জানতে পড়ুন – লুলার আমলে ব্রাজিলের অর্থনৈতিক উন্নতির মূলে কাজ করছে মুলত “ভাগ্য” (১৮ অক্টোবর, ২০২৪)
সূত্র
https://www.ft.com/content/1c67dc52-4791-4c33-9412-6462b81b8078
ম্যাক্রোঁ কি ইউ’র ইতিহাসের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যচুক্তি হত্যা করতে পারবেন? (১৮ ডিসেম্বর, ২০২৪)
ভূমিকা
ইউরোপীয় ইউনিয়ন (European Union – EU) এবং দক্ষিণ আমেরিকার বাণিজ্য ব্লক মেরকোসুর (Mercosur) এর মধ্যে একটি বাণিজ্যচুক্তি চূড়ান্ত করতে দীর্ঘ সময় লেগেছে। বছরের পর বছর ধরে অচলাবস্থার পর অবশেষে কয়েক সপ্তাহ আগে উভয় পক্ষ একটি সমঝোতায় পৌঁছেছে। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ, তবে চূড়ান্ত নয়, এই চুক্তিকে বাস্তবে পরিণত করতে এখনো অনেক পথ বাকি। ইউরোপীয় কমিশনের (European Commission) প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডের লায়েন (Ursula von der Leyen) এই পদক্ষেপকে ঐতিহাসিক মাইলফলক বলে অভিহিত করেছেন।
এখন প্রশ্ন হলো, কেন হঠাৎ করে এই চুক্তির ব্যাপারে আবারও গতি দেখা গেল? এই নতুন চুক্তিতে কী নতুনত্ব আছে? এবং চুক্তির বিরোধীরা কি এখনো এটি আটকে দিতে পারবে?
মেরকোসুর (Mercosur) কী?
ইউরোপীয় ইউনিয়ন (EU) সম্পর্কে মনে করিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন নেই, তবে মেরকোসুর (Mercosur) হয়তো কিছুটা কম পরিচিত হতে পারে। ১৯৯১ সালে প্রতিষ্ঠিত এই দক্ষিণ আমেরিকান বাণিজ্য ব্লকে আর্জেন্টিনা (Argentina), ব্রাজিল (Brazil), প্যারাগুয়ে (Paraguay), উরুগুয়ে (Uruguay) এবং এর নবীনতম সদস্য বলিভিয়া (Bolivia) অন্তর্ভুক্ত। EU এবং মেরকোসুরের মধ্যে বাণিজ্যচুক্তির আলোচনা শুরু হয়েছিল বহু বছর আগে, কিন্তু ২০১৯ সালেই প্রথমবারের মতো এই আলোচনা একটি নীতিগত সমঝোতায় পৌঁছায়। তবুও, ওই সময় থেকে চুক্তি থেমে ছিল, বিশেষত ইউরোপীয় ইউনিয়নের পক্ষের বিরোধিতার কারণে। ফ্রান্স (France) এর মতো দেশ তখন চুক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল পরিবেশগত উদ্বেগ ও ব্রাজিলের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বলসোনারো (Bolsonaro) এবং কৃষি খাতের সম্ভাব্য নেতিবাচক প্রভাবের কারণে।
কিছু বছর বরফের নিচে থাকার পর, ২০২৩ সালে মনে হলো আলোচনায় নতুন গতি এসেছে। এর পেছনে অন্যতম কারণ ছিল ব্রাজিলে পরিবেশবান্ধব (environmentally conscious) সরকারের আগমন। কিন্তু ফ্রান্সের নতুন পরিবেশগত দাবিতে মেরকোসুরের মধ্যে বিরক্তি তৈরি হয়, পাশাপাশি আর্জেন্টিনায় হাভিয়ের মিলেই (Javier Milei) নির্বাচিত হওয়ার পর ব্লকের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দেয়। তবুও, পরবর্তী এক বছরে চুক্তি স্বাক্ষরের চাপ বৃদ্ধি পায়, এবং ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে ভন ডের লায়েন উরুগুয়েতে মেরকোসুরের নেতাদের সাথে চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন।
কেন এখন এই চুক্তি?
বর্তমানে চুক্তি সম্পন্ন হওয়ার পেছনে তিনটি বিস্তৃত কারণ চিহ্নিত করা যায়:
- ফ্রান্সের রাজনৈতিক দুরবস্থা: ফ্রান্স এই চুক্তির সবচেয়ে বড় প্রতিপক্ষ ছিল। সম্প্রতিক সময়ে ফ্রান্স দীর্ঘস্থায়ী রাজনৈতিক সংকটে আছে, এবং প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁর (Emmanuel Macron) কর্তৃত্ব ও প্রভাব দুর্বল হয়ে পড়েছে। এই দুর্বল মুহূর্তে চুক্তি এগিয়ে নেওয়া একটি কৌশলগত সময়োপযোগী পদক্ষেপ। এখন লোহা গরম থাকতে থাকতেই আঘাত হানা হল, যেন দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে থাকা চুক্তিটিকে এগিয়ে নেওয়া যায়।
- ইউরোপীয় নেতৃত্বের অভাব ও ফন ডের লায়েনের অবস্থান: ইউরোপে জাতীয় সরকারের প্রধানদের মধ্যে নেতৃত্বের ঘাটতি রয়েছে। এর মাঝে ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডের লায়েন শক্তিশালী রাজনৈতিক অবস্থানে আছেন। তিনি তার দ্বিতীয় মেয়াদের (second term) শুরুতে, নতুন কমিশন (Commission) গঠনের পর পরই একটি বিজয় অর্জনের সুযোগ খুঁজছিলেন। ফলে এই অবস্থান থেকে তিনি দ্রুত একটি সাফল্য নিশ্চিত করতে পেরেছেন।
- বৈশ্বিক বাণিজ্য পরিস্থিতি (Global Trade Climate) ও সুরক্ষাবাদ (Protectionism): বৈশ্বিক অর্থনীতিতে সুরক্ষাবাদের (protectionism) প্রবণতা বাড়ছে। উদাহরণস্বরূপ, ডোনাল্ড ট্রাম্প (Donald Trump) আবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট হলে তিনি ব্যাপক শুল্ক আরোপ করবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এ ছাড়া বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা রয়েছে। এমন অবস্থায়, EU-মেরকোসুর চুক্তি একটি কৌশলগত পদক্ষেপ। এটি বিশ্ববাণিজ্যে তাদের অবস্থান শক্তিশালী করতে পারে এবং সুরক্ষাবাদের বিপরীতে মুক্তবাণিজ্যের (free trade) পক্ষে যুক্তি তুলে ধরতে পারে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের জন্য সুফল ও কুফল
সুফল (Advantages):
- এই চুক্তির ফলে ইউরোপীয় রপ্তানির জন্য মেরকোসুরের সুরক্ষাবেষ্টিত বাজার খুলে যাবে। এতে অটোমোবাইল (automobiles), ওয়াইন (wine), পনির (cheese) সহ বিভিন্ন বিশেষায়িত কৃষি পণ্য ও প্রক্রিয়াজাত পণ্যের বাজার সম্প্রসারিত হবে।
- চীন (China) ও যুক্তরাষ্ট্র (United States – US) এর সাথে বাণিজ্য সম্পর্ক যখন অনিশ্চিত, তখন এই চুক্তি ইউরোপীয় বাণিজ্য সম্পর্ককে বহুমুখী করবে।
- মেরকোসুরের সম্পদ, বিশেষত জ্বালানি রূপান্তরের (energy transition) জন্য প্রয়োজনীয় গুরুত্বপূর্ণ খনিজ পদার্থের (critical minerals) সরবরাহ নিশ্চিত করা যাবে।
মেরকোসুরের জন্য সুফল (Benefits for Mercosur):
- ইউরোপীয় বাজারে সহজ প্রবেশাধিকার পাবে মেরকোসুরের রপ্তানি, বিশেষ করে কাঁচামাল ও কৃষিপণ্য।
- বাণিজ্যের বহুমুখীকরণ ঘটবে এবং ইউরোপীয় কোম্পানিগুলো দক্ষিণ আমেরিকায় বিনিয়োগে উৎসাহিত হবে।
- EU এর গ্লোবাল গেটওয়ে উদ্যোগ (Global Gateway initiative) এর আওতায় মেরকোসুরের পরিবেশবান্ধব ও ডিজিটাল রূপান্তরে সহায়তা করতে ১.৮ বিলিয়ন ইউরো বরাদ্দ রাখা হয়েছে।
সামগ্রিক চিত্র (Overall Impact): এই চুক্তি প্রায় ৭০০ মিলিয়ন মানুষের একটি বিশাল বাজার তৈরি করবে, দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের ৯০% এরও বেশি শুল্ক বিলুপ্ত করবে, এবং ইউরোপীয় রপ্তানিকারকদের বার্ষিক প্রায় ৪ বিলিয়ন ইউরো সাশ্রয় করবে।
চুক্তির সম্ভাব্য ক্ষতিকর দিক (Drawbacks)
ইউরোপের উদ্বেগ (European Concerns):
- ইউরোপীয় কৃষকরা আশঙ্কা করছেন যে দক্ষিণ আমেরিকার বড় মাপের ও প্রতিযোগিতামূলক গোমাংস (beef), পোলট্রি (poultry) এবং সয়াবিন (soy) উৎপাদকরা ইউরোপীয় কৃষকদেরকে মারাত্মকভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ফেলে দেবে।
- পরিবেশগত দিক থেকেও উদ্বেগ রয়েছে যে দক্ষিণ আমেরিকায় বন ধ্বংস (deforestation) বাড়তে পারে।
চুক্তি স্বাক্ষরের সঙ্গে সঙ্গেই ব্রাসেলস (Brussels) ও অন্যান্য স্থানে কৃষকরা প্রতিবাদ শুরু করেছে। তবে চুক্তি মানে এই নয় যে অবারিত পরিমাণ ব্রাজিলিয়ান গোমাংস ইউরোপে ঢুকবে। এই চুক্তিতে শর্ত রয়েছে যে EU বছরে ৯৯,০০০ টন মেরকোসুরের গোমাংস শুল্ক কমিয়ে মাত্র ৭.৫% করে আমদানি করবে, যা পাঁচ বছরে ধাপে ধাপে কার্যকর হবে। এটি ইউরোপীয় মোট গোমাংস উৎপাদনের মাত্র ১.৬% এবং বর্তমানে মেরকোসুর থেকে আমদানিকৃত পরিমাণের তুলনায় অর্ধেকেরও কম।
মেরকোসুরের উদ্বেগ (Concerns in Mercosur):
- ইউরোপীয় নির্মিত পণ্যের (manufactured goods) সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় মেরকোসুরের স্থানীয় শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
- ইউরোপীয় কোম্পানিরা মেরকোসুরের সরকারি ক্রয় (public procurement) বাজারে প্রবেশাধিকার পাবে, যা স্থানীয় সংস্থাগুলোর জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা বাড়াবে।
সমন্বয়মূলক নতুন ধারা (New Balancing Features)
পরিবেশগত উদ্বেগ মোকাবিলায় এই চুক্তি প্যারিস জলবায়ু চুক্তি (Paris Climate Agreement) অনুসরণের বাধ্যবাধকতা জোরদার করেছে, এবং বন ধ্বংস রোধে স্পষ্ট অঙ্গীকার রেখেছে। কেউ চুক্তি লঙ্ঘন করলে সুবিধা স্থগিত করার ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে।
দুই পক্ষের মধ্যে বিরোধ মীমাংসার জন্য সংশোধনী ব্যবস্থা ও ভারসাম্য রক্ষার (rebalancing mechanism) বিধান যুক্ত করা হয়েছে। এ ছাড়া, ইউরোপীয় কৃষি খাত যদি কোনোভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হয়, তবে এই খাতকে সহায়তা করতে EU একটি ১ বিলিয়ন ইউরোর রিজার্ভ বরাদ্দ রেখেছে।
মেরকোসুর সরকারের ক্রয় সংক্রান্ত বিষয়ে কিছুটা ছাড় পেয়েছে, যাতে স্থানীয় কোম্পানিগুলো সুবিধা পায়। পাশাপাশি ইউরোপীয় গাড়ির ওপর মেরকোসুরের শুল্ক হ্রাসের সময়সীমা ১৮ বছরে পর্যায়ক্রমে কার্যকর হবে, যা মূল ১৫ বছরের চেয়ে দীর্ঘ, এবং এতে স্থানীয় শিল্পের মানিয়ে নেওয়ার বেশি সুযোগ থাকবে।
পরবর্তী ধাপ: অনুমোদনের চ্যালেঞ্জ
চুক্তি স্বাক্ষর মানেই তা বাস্তবায়িত হবে এমন নয়। এখনো কঠিন অনুমোদন প্রক্রিয়া (ratification and implementation) বাকি, বিশেষ করে ইউরোপীয় পক্ষে। স্পেন (Spain) ও জার্মানি (Germany) যারা চুক্তির পক্ষে জোরালো সমর্থন দিয়েছে, তারা এই অগ্রগতিতে খুশি। তবে ফ্রান্স এই চুক্তি আটকে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছে। চুক্তির বিরোধী শিবিরে পোল্যান্ড (Poland), আয়ারল্যান্ড (Ireland) ও অস্ট্রিয়া (Austria)-ও রয়েছে।
EU কাউন্সিলে (European Council), প্রতিটি দেশ তাদের বাণিজ্যমন্ত্রীর মাধ্যমে প্রতিনিধিত্ব করে। চুক্তি ব্যর্থ করতে একটি “ব্লকিং সংখ্যালঘু” (blocking minority) প্রয়োজন; কমপক্ষে চারটি দেশ, যাদের সম্মিলিত জনসংখ্যা EU মোট জনসংখ্যার ৩৫% বা তার বেশি, চুক্তির বিরুদ্ধে ভোট দিলে চুক্তি আটকে যাবে।
ফ্রান্স এক্ষেত্রে ইতালি (Italy)-কে পাশে পেলে পাল্লা ভারী হতে পারে, কারণ ইতালি বড় অর্থনীতির দেশ। কিন্তু এখন পর্যন্ত ইতালি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়নি, বরং সতর্ক অবস্থান নিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনি (Giorgia Meloni) কৃষকদের উদ্বেগের কথা বললেও, ইতালি মেরকোসুরে EU-র দ্বিতীয় বৃহত্তম রপ্তানিকারক। ফলে চুক্তি ইতালীয় ব্যবসার জন্যও সুফল বয়ে আনতে পারে।
এদিকে ফ্রান্স, নিজেই অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে, আদৌ কি একটি কার্যকরী “ব্লকিং সংখ্যালঘু” গঠন করতে পারবে, তা নিয়েও সংশয় রয়েছে। যদি ফ্রান্স ব্যর্থ হয় এবং কাউন্সিলে চুক্তি অনুমোদন পেয়ে যায়, পরবর্তী পদক্ষেপ হবে ইউরোপীয় পার্লামেন্টের (European Parliament) অনুমোদন, যা আবার নতুন রাজনৈতিক লড়াইয়ের ক্ষেত্র হতে পারে।
উপসংহার
সর্বোপরি, EU-মেরকোসুর বাণিজ্যচুক্তি দীর্ঘ পথ পেরিয়ে গুরুত্বপূর্ণ এক পদক্ষেপে এসেছে। কিন্তু এটি নিশ্চিতভাবে বাস্তবায়িত হতে এখনো বহু চ্যালেঞ্জ পার হতে হবে। ইউরোপীয় কৃষি খাতের উদ্বেগ থেকে শুরু করে পরিবেশগত উদ্বেগ, জাতীয় স্বার্থ রক্ষা থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক নেতৃত্বের অভাব—সব কিছুর ভারসাম্য রক্ষা করে এই চুক্তিকে বাস্তবে পরিণত করতে হবে। এখন প্রশ্ন থাকে: ম্যাক্রোঁ ও তার মিত্ররা কি এই ঐতিহাসিক চুক্তিকে আটকে দিতে পারবেন, নাকি ইউরোপ ও দক্ষিণ আমেরিকার মধ্যে আরও দৃঢ় বাণিজ্যিক বন্ধন গড়ে উঠবে? ভবিষ্যতই এর উত্তর দেবে।
তথ্যসূত্র
1 – https://www.euractiv.com/section/economy-jobs/news/eu-seals-long-stalled-mercosur-trade-deal/
2 – https://www.worldpoliticsreview.com/eu-mercosur-trade-deal/
3 – https://www.atlanticcouncil.org/blogs/new-atlanticist/four-questions-and-expert-answers-about-the-eu-mercosur-trade-deal/
4 – https://www.csis.org/analysis/what-are-implications-eu-mercosur-free-trade-agreement
5 – https://ec.europa.eu/commission/presscorner/detail/en/ip_24_6244
6 – https://www.csis.org/analysis/what-are-implications-eu-mercosur-free-trade-agreement
7 – https://www.theguardian.com/world/2024/dec/06/eu-farmers-plan-protests-as-von-der-leyen-approves-mercosur-trade-deal
8 – https://policy.trade.ec.europa.eu/eu-trade-relationships-country-and-region/countries-and-regions/mercosur/eu-mercosur-agreement/factsheet-eu-mercosur-partnership-agreement-opening-opportunities-european-farmers_en
9 – https://www.reuters.com/world/europe/whats-newly-finalised-eu-mercosur-trade-accord-2024-12-06/
10 – https://www.euronews.com/my-europe/2024/12/09/mercosur-whats-new-whats-next-in-the-deal
11 – https://www.economist.com/the-americas/2024/12/12/can-an-agreement-with-the-eu-resurrect-mercosur
12 – https://www.politico.eu/article/giorgia-meloni-italy-emmanuel-macron-france-eu-mercosur-trade-deal-south-america/
আর্জেন্টিনায় মন্দা থেকে বেরিয়ে আসার লক্ষণ (১৭ ডিসেম্বর, ২০২৪)
এবার নজর আর্জেন্টিনায়, যেখানে দেশের অর্থনীতি দীর্ঘ মন্দা (recession) শেষে কিছুটা ঘুরে দাঁড়াচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর সময়কালে, আগের প্রান্তিকের তুলনায় দেশটির জিডিপি (GDP) ৩.৯% বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২৩ সালের শেষ দিকে মন্দায় পতিত হওয়ার পর এটি প্রথম প্রবৃদ্ধি।
জেপি মরগান (JP Morgan) বিশ্লেষকরা আশা করছেন যে ২০২৪ সালে আর্জেন্টিনার অর্থনীতি এখনো ৩% হ্রাস পাবে, তবে ২০২৫ সালে ৫.২% বৃদ্ধির পূর্বাভাস রয়েছে। এই খবর আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্ট জাভিয়ের মিলেই (Javier Milei)-এর জন্য স্বস্তি নিয়ে আসবে। তিনি ক্ষমতায় আসার পর ব্যাপক সরকারি ব্যয় কর্তন (spending cuts) এবং ডেরেগুলেশনের (deregulation) মাধ্যমে উচ্চ মাত্রার মুদ্রাস্ফীতি (inflation) নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হন, ফলে আর্জেন্টিনার সার্বভৌম বন্ডের (sovereign bonds) মূল্য বেড়েছে।
তবে দক্ষিণ আমেরিকার (South American) এই দেশটিতে সবকিছু এখনো সুগম নয়। মিলেই ক্ষমতায় আসার পর রাজস্ব ব্যয় কমানোর পদক্ষেপ নেন, কিন্তু ২০২৪ সালের প্রথমার্ধে দারিদ্র্যের হার (poverty rate) ১১ পয়েন্ট বেড়ে ৫৩%-এ পৌঁছায়। এছাড়াও অনেক কাজ বাকি আছে। তাকে আর্জেন্টিনার মুদ্রা ও মূলধন নিয়ন্ত্রণ (capital and currency controls) তুলে নিতে হবে, যা বিদেশি বিনিয়োগ (foreign investment) বাধাগ্রস্ত করছে এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের (central bank) রিজার্ভ বৃদ্ধির পথে অন্তরায় সৃষ্টি করছে। এসব কাজ সহজ হবে না।
আর্জেন্টিনায় মিলেই-এর সাফল্য সম্পর্কে জানতে এখানে যান।
তথ্যসূত্র
আর্জেন্টিনায় মিলেই-এর সাফল্য কি অন্য কোথাও পুনরাবৃত্তি করা সম্ভব? (১৫ ডিসেম্বর, ২০২৪)
ভূমিকা
গত এক বছর পেরিয়ে গেছে আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্ট জাভিয়ের মিলেই (Javier Milei) দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে, এবং বলা যায় যে তার পরিস্থিতি বেশ ভালোই চলছে। তিনি আর্জেন্টিনার বাণিজ্য ঘাটতি (trade deficit) ও রাজস্ব ঘাটতি (fiscal deficit) উভয়ই ইতিবাচক ধারায় নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছেন। ফলে আর্জেন্টিনা টানা প্রাইমারি সারপ্লাস (primary surpluses) অর্জন করছে, যা বহু বছর ধরে দেখা যায়নি। মুদ্রাস্ফীতি (inflation) তার চূড়ান্ত উচ্চতা থেকে নেমে আসায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক (central bank) শেষ পর্যন্ত সুদের হার (interest rate) কমাতে পেরেছে এবং এভাবে দীর্ঘমেয়াদে মিলেই যে ‘ভি-আকারের পুনরুদ্ধার’ (V shaped recovery) প্রস্তাব করেছিলেন, তার পথ উন্মুক্ত হচ্ছে। কিন্তু সবচেয়ে চমকপ্রদ বিষয় হচ্ছে, সাম্প্রতিক কয়েক মাসে মিলেই-এর গ্রহণযোগ্যতার হার (approval rating) আসলে বেড়েছে। সর্বশেষ ‘মর্নিং কনসাল্ট’ (Morning Consult) জরিপে তিনি অবিশ্বাস্য ৩৭ শতাংশের একটি নিট গ্রহণযোগ্যতার হার (net approval rating) পেয়েছেন।
এই প্রবন্ধে মিলেই-এর প্রেসিডেন্সির দিকে আরেকবার দৃষ্টি নিবদ্ধ করা হবে এবং পর্যালোচনা করা হবে যে তার এই আপাত সাফল্য অন্য কোথাও পুনরায় গড়ে তোলা সম্ভব কিনা।
ক্ষমতায় আসার পটভূমি: সংক্ষিপ্ত পুনরালোচনা
এক বছর আগে মিলেই ক্ষমতায় আসেন। সে সময় তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন যে রাষ্ট্রযন্ত্রের ওপর আক্ষরিক অর্থেই একটি ‘চেইনসো’ (chainsaw)-এর ব্যবহার করবেন—অর্থাৎ রাষ্ট্রের ব্যয়কে কাটছাঁট করে বাজেটের ভারসাম্য (balance the budget) আনা এবং সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা (macroeconomic stability) প্রতিষ্ঠা করবেন। ক্ষমতায় আসার কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই তিনি আর্জেন্টিনার ১৮টি মন্ত্রণালয়ের মধ্যে ১০টি বিলুপ্ত করে দিয়েছেন, বেশিরভাগ সরকারি অবকাঠামো প্রকল্প (public infrastructure projects) স্থগিত করেছেন, এবং প্রাদেশিক সরকারগুলোর (provincial governments) জন্য ভর্তুকি ও অর্থ স্থানান্তর নাটকীয়ভাবে হ্রাস করেছেন।
এছাড়াও তিনি আর্জেন্টিনার মুদ্রা পেসোর (peso) মূল্য এক ধাপে ৫০% অবমূল্যায়ন (devalue) করেন এবং পরবর্তীতে একটি ‘ক্রলিং পেগ’ (crawling peg) ব্যবস্থা প্রয়োগ করেন। এর ফলে পেসোর আনুষ্ঠানিক বিনিময় হার (official value) ধাপে ধাপে বাজারমূল্যের কাছাকাছি নামিয়ে আনা হয়। এই পদক্ষেপের উদ্দেশ্য ছিল আর্জেন্টিনার মুদ্রাব্যবস্থা সহজ করা, যাতে বিনিয়োগ (investment) বৃদ্ধি পায়, এবং আর্জেন্টিনার পরিবার ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোকে আমদানি (import) কমাতে বাধ্য করা।
প্রাথমিক পরিণতি: মন্দা ও দারিদ্র্যের উল্লম্ফন
এই নীতিগুলোর সঙ্গে সঙ্গে দুটি তাৎক্ষণিক ফলাফল দেখা দেয়।
- প্রথমত, জিডিপি (GDP) নাটকীয়ভাবে হ্রাস পায়। সরকারি ব্যয় (government spending) কাটছাঁট হওয়ায় আর্জেন্টিনার সাধারণ মানুষের হাতখরচ কমে যায়, ফলে তারা কম খরচ করে। এর ফলস্বরূপ দেশের অর্থনীতি এ বছর প্রায় ৩.৫% সঙ্কুচিত হয়েছে। একইসঙ্গে দারিদ্র্যহার (poverty rate) ব্যাপকভাবে বেড়েছে, যা ৪০% থেকে বেড়ে ৫৩%-এ পৌঁছেছে।
- দ্বিতীয়ত, পেসোর অবমূল্যায়নের কারণে মুদ্রাস্ফীতি (inflation) হঠাৎ করে বেড়ে যায়। মাসওয়ারি মুদ্রাস্ফীতির হার ২০২৩ সালের নভেম্বরের ১২.৮% থেকে মিলেই ক্ষমতায় আসার প্রথম মাসেই সর্বকালের সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছে যায়। তুলনামূলকভাবে, এটা যদি বার্ষিক হারে (year on year) গণনা করা হয়, তবে প্রায় ১,৪০০% মুদ্রাস্ফীতি হত।
এটি মোটেই অপ্রত্যাশিত ছিল না। মিলেই আগেই সতর্ক করেছিলেন যে তার নীতি বাস্তবায়ন করলে স্বল্পমেয়াদী অর্থনৈতিক অস্থিরতা (economic turmoil) আসবে। কিন্তু বাস্তবে এই পরিবর্তনগুলো বেশ অস্থির পরিবেশ তৈরি করেছিল।
যদিও মিলেই-এর গ্রহণযোগ্যতার হার তখনও উঁচুতে ছিল—অনেক জরিপকারী সংস্থা (pollsters) তাকে দুই মাস আগেও ৫০%-এর বেশি জনপ্রিয়তা দেখাচ্ছিল—তবুও মানুষের ধৈর্য কিছুটা কমতে শুরু করেছিল। তার গ্রহণযোগ্যতা সামান্য কমছিল, মুদ্রাস্ফীতি জেদীভাবে উঁচুতে ছিল, আর মন্দা (recession) গভীরতর হচ্ছিল।
ইতিবাচক মোড়: মুদ্রাস্ফীতির পতন এবং মজুরিবৃদ্ধি
যাই হোক, সাম্প্রতিক কয়েক মাসে পরিস্থিতি কিছুটা বদলাতে শুরু করেছে। মাসওয়ারি মুদ্রাস্ফীতি (month on month inflation) সর্বোচ্চ বিন্দু থেকে ৯% -এ নেমে এসেছে এবং তারপর থেকে গত কয়েক মাসে এটি ক্রমান্বয়ে কমেছে। আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে এটি এখনও অনেক উঁচু, কিন্তু আর্জেন্টিনার ঐতিহাসিক মানদণ্ডে তুলনামূলকভাবে কম। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, এটি এখন আর্জেন্টিনার গড় মজুরি বৃদ্ধির (wage growth) হারের চেয়ে কম। আর্জেন্টিনায় বর্তমানে মজুরি প্রায় ৬% হারে বাড়ছে, অর্থাৎ রিয়াল টার্মে (real terms) মাসিক মজুরি প্রায় ২ বা ৩% হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এটি সাম্প্রতিক সময়ের মধ্যে দ্রুততম বৃদ্ধির হার।
এর ফলে দারিদ্র্যের হারও সাম্প্রতিক চূড়া থেকে কিছুটা কমেছে—জুনে যেখানে দারিদ্র্যের হার ছিল ৫৩%, অক্টোবর নাগাদ তা ৪৯%-এ নেমে এসেছে। নভেম্বর মাসে নিম্ন মুদ্রাস্ফীতির কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রায় ছয় মাস পর প্রথমবারের মতো রেফারেন্স সুদের হার (benchmark rate) ৪০% থেকে ৩৫%-এ নামাতে পেরেছে।
এছাড়াও কিছু সতর্ক ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে যে অর্থনীতি বিনিয়োগ (investment) ও রপ্তানিমুখী (export-oriented) হতে শুরু করেছে, যা মিলেই আশা করেছিলেন। সাধারণত জিডিপি (GDP) গণনা করা হয় চারটি উপাদানকে যোগ করে—ভোগ (consumption), সরকারি ব্যয় (government spending), বিনিয়োগ (investment), এবং নিট রপ্তানি (net exports), অর্থাৎ রপ্তানি (exports) থেকে আমদানি (imports) বাদ দিলে যা থাকে। মিলেই মনে করেন আর্জেন্টিনার জিডিপিতে ভোগ ও সরকারি ব্যয় বেশি এবং তিনি আশা করছেন যে আগামীর পুনরুদ্ধার বিনিয়োগ ও রপ্তানি দ্বারা চালিত হবে।
রপ্তানির উল্লম্ফন ও বাণিজ্য ভারসাম্যের উন্নতি
অর্থনীতিতে ইতিবাচক পরিবর্তনের আলামত কিছুটা দেখা যাচ্ছে। ২০২৪ সালের প্রথম সাত মাসের তথ্য অনুযায়ী, রপ্তানি ৪৫.৪ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ১৪.৮% বৃদ্ধি। অন্যদিকে আমদানি ৩৩.১ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে, যা বছরের ব্যবধানে ২৫.৯% হ্রাস। সামগ্রিকভাবে এর মানে, এই সময়কালে আর্জেন্টিনা ১২.৩ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য উদ্বৃত্ত (trade surplus) পেয়েছে, যেখানে গত বছর একই সময়ে ছিল ৫.২ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য ঘাটতি (trade deficit)।
মিলেই এবং তার সরকার আত্মবিশ্বাসী যে আগামী বছরগুলোতে রপ্তানি আরো বাড়বে। এর পেছনে যুক্তি হলো বিশ্বব্যাপী জ্বালানি রূপান্তর (energy transition) ও সবুজ প্রযুক্তিতে লিথিয়াম (lithium) ও কপার (copper)-এর চাহিদা বাড়ছে, আর এগুলো আর্জেন্টিনায় তুলনামূলকভাবে প্রচুর পরিমাণে আছে। তাছাড়া শেল (shale) সম্পদও আছে। আর্জেন্টিনায় পাটাগোনিয়ান মরুভূমিতে ভাকা মুয়ের্তা (Vaca Muerta) নামের একটি বিশাল শেল তেল ও গ্যাস খনি আছে, যা বিশ্বের অন্যতম বড় শেল মজুদ হিসেবে বিবেচিত। দীর্ঘদিন ধরে অপর্যাপ্ত বিনিয়োগ (underinvestment) ও অদক্ষ ব্যবস্থাপনার (chronic mismanagement) কারণে এই ক্ষেত্রটি তেমন বিকশিত হয়নি। তবুও এই খনি ইতোমধ্যে আর্জেন্টিনাকে ২০১১ সালের পর প্রথমবারের মতো জ্বালানি উদ্বৃত্ত (energy surplus) অর্জনে সাহায্য করেছে—অর্থাৎ দেশের রপ্তানি আমদানির চেয়ে বেশি হচ্ছে।
মিলেই যদি ভাকা মুয়ের্তায় বাড়তে থাকা পাইপলাইন নেটওয়ার্কের (pipeline network) উন্নয়নকে আরো এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেন, তবে ভবিষ্যতে শেল রপ্তানি আরও বৃদ্ধি পাবে।
বিনিয়োগের ধীর লয় পরিবর্তন ও আস্থার পুনর্গঠন
বিনিয়োগের (investment) তথ্য কিছুটা অস্বচ্ছ হলেও আর্জেন্টিনার শেয়ারবাজারে (Argentinian stocks) অর্থ প্রবাহিত হচ্ছে এবং মিলেইয়ের সরকার আশা করছে তাদের সংস্কার (reforms) আগামী বছরে প্রায় ১৫ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ আকর্ষণ করবে। বিনিয়োগকারীদের আস্থা (investor confidence) বৃদ্ধির আরো কিছু লক্ষণ পাওয়া যাচ্ছে। মিলেই ক্ষমতায় আসার পর থেকে আর্জেন্টিনার বন্ডের (bonds) মূল্য দ্বিগুণ হয়েছে, এবং ২০২৪ সালের নভেম্বর মাসে আর্জেন্টিনার ঋণমান (credit rating) উন্নীত হয়েছে, যদিও তা এখনো বিনিয়োগযোগ্য মানের (investment grade) থেকে সাত স্তর নিচে।
এগুলো সবই মিলেই-এর ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তার জন্যও ইতিবাচক বার্তা বয়ে এনেছে। ‘মর্নিং কনসাল্ট’ (Morning Consult)-এর সর্বশেষ জরিপ অনুসারে, তার নিট গ্রহণযোগ্যতার হার (net approval rating) এখন ৩৭%-এ, যা কয়েক মাস আগের চেয়ে ২ পয়েন্ট বেশি এবং বিশ্বের সবচেয়ে উচ্চ গ্রহণযোগ্যতার শীর্ষ দুই নেতার মধ্যে একটিতে পরিণত করেছে। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি (Narendra Modi) ছাড়া আর কারো তুলনায় মিলেই এখন দ্বিতীয় সর্বোচ্চ গ্রহণযোগ্যতার নেতা।
সীমাবদ্ধতা ও চ্যালেঞ্জ: সবকিছু কি নিখুঁত চলছে?
স্পষ্ট করে বললে, এর মানে এই নয় যে সবকিছু নিখুঁতভাবে চলছে। দেশের অর্থনীতি এখনো মন্দার (recession) মধ্যে। তবুও মাত্র এক বছরের মধ্যেই মিলেই সফলভাবে আর্জেন্টিনার রাজস্ব ও বাণিজ্য ঘাটতি (fiscal and trade deficits) ঘুরিয়ে দিতে পেরেছেন, সেটাও আবার অত্যন্ত উচ্চ গ্রহণযোগ্যতার হার ধরে রেখে। এটি নিঃসন্দেহে বিস্ময়কর।
মিলেই-এর এই সাফল্য বিশ্বে আলোচনা ছড়িয়েছে যে তার ‘রাষ্ট্রবিরোধী’ (anti state) কর্মসূচি অন্যত্রও বাস্তবায়ন করা সম্ভব কি না। অনেক দেশে—বিশেষ করে ডানপন্থী মহলে—একটি সাধারণ উপলব্ধি রয়েছে যে রাষ্ট্র অতিরিক্ত স্ফীত (bloated)। এলন মাস্ক (Elon Musk), যিনি বর্তমানে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের (Trump) ‘ডিপার্টমেন্ট অব গভর্নমেন্ট এফিশিয়েন্সি’ (Department of Government Efficiency)-র প্রধান হিসেবে কাজ করছেন, তিনিও মিলেই থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছেন।
তবে অন্য রাজনীতিবিদদের জন্য মিলেই-এর সাফল্য পুনরায় সৃষ্টি করা কঠিন হতে পারে অন্তত দুটি কারণে –
- প্রথমত, এটি আসলে অত্যন্ত জটিল এক প্রক্রিয়া। মিলেই-এর আন্তর্জাতিক সমর্থকরা প্রায়ই এমনভাবে কথা বলেন যেন তিনি অনেকগুলো অকাজের সরকারি বিভাগ বিলুপ্ত করেই সব সমস্যার সমাধান করেছেন। কিন্তু ব্যাপারটা এত সহজ নয়। রাষ্ট্রের ব্যয় সংকোচনের পাশাপাশি মিলেই আর্জেন্টিনার মুদ্রাব্যবস্থা এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের (central bank) ক্ষেত্রে জটিল টেকনোক্র্যাটিক (technocratic) সংস্কার বাস্তবায়ন করেছেন। এটি দূর থেকে যতটা সহজ মনে হয়, বাস্তবে তার চেয়ে অনেক বেশি জটিল ছিল।
- দ্বিতীয়ত, আর্জেন্টিনার মানুষ জানতো মিলেই নির্বাচিত হলে কী আসতে পারে। তিনি নির্বাচনী প্রচারে স্বল্পমেয়াদী অর্থনৈতিক কষ্টের বিনিময়ে দীর্ঘমেয়াদী সমৃদ্ধি আনার কথা বলেছিলেন। এই বার্তা তিনি একটি ‘প্রয়োজনীয় প্রতিষেধক’ (necessary antidote) হিসেবে উপস্থাপন করেছিলেন, যা আর্জেন্টিনার দীর্ঘমেয়াদী অর্থনৈতিক অসুস্থতার অবসান ঘটাবে। পশ্চিমা দেশগুলোর কোনো রাজনীতিবিদ এমন বার্তা নিয়ে প্রচারণা চালানো তো দূরের কথা, নির্বাচনে জেতার আশা করাও কঠিন। উদাহরণস্বরূপ, ট্রাম্প (Trump) যখন ক্ষমতায় আসেন, তখন তিনি অবিলম্বে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির (immediate economic boom) প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। সেই ধরনের প্রতিশ্রুতি রেখে মিলেই-এর মতো সংস্কার চালানো ট্রাম্প বা তার মতো অন্যদের পক্ষে কঠিন হবে।
উপসংহার
আর্জেন্টিনায় মিলেই-এর অর্থনৈতিক কর্মসূচি ও রাজনীতি এক বছরের মধ্যেই চমকপ্রদ কিছু সাফল্য দেখিয়েছে। তবে এই সাফল্য অন্য কোথাও হুবহু পুনরায় ঘটানো সহজ হবে না। আর্জেন্টিনার বাস্তবতা, জনসাধারণের প্রত্যাশা, এবং টেকনিক্যাল সংস্কারের জটিলতার কারণে এটি সম্ভব হয়েছে। অন্য দেশে এ ধরণের পদক্ষেপ একইভাবে গ্রহণযোগ্য বা ফলপ্রসূ হবে কিনা, তা সময়ই বলে দেবে।
তথ্যসূত্র
- Economist article on Milei’s reforms a year in https://www.economist.com/the-americas/2024/11/28/javier-milei-free-market-revolutionary
- World Bank predictions for Argentina recession https://www.batimes.com.ar/news/economy/argentinas-recession-is-over-milei-tells-business-leaders.phtml
- Argentina’s Ministry of Trade stats on trade balance Jan-July 2024 https://cancilleria.gob.ar/en/cie/news/argentine-trade-exchange-first-seven-months-2024
- FT article on Argentina’s energy surplus https://www.ft.com/content/437a3a5f-4064-444a-b6da-7bb5aba5956b
- FT article with Milei claim on investment in 2025 https://www.ft.com/content/437a3a5f-4064-444a-b6da-7bb5aba5956b
- Bloomberg article on Fitch upgrade https://www.bloomberg.com/news/articles/2024-11-15/milei-s-turnaround-effort-wins-credit-upgrade-from-fitch
- Graph showing development of Argentine bond prices https://www.hl.co.uk/shares/shares-search-results/a/argentina-0.125-bds-090746-usd1/share-charts
- Morning Consult polling
https://pro.morningconsult.com/trackers/global-leader-approval
লুলার আমলে ব্রাজিলের অর্থনৈতিক উন্নতির মূলে কাজ করছে মুলত “ভাগ্য” (১৮ অক্টোবর, ২০২৪)
ভূমিকা
কয়েক মাসের মধ্যেই রাষ্ট্রপতি লুলা ডি সিলভা (Lula D Silva) তার দায়িত্বের তৃতীয় বছরে পা দেবেন। এক সময় দুর্নীতির অভিযোগ, কেলেঙ্কারি (scandals) এবং বিচারব্যবস্থার (justice system) সমস্যায় জর্জরিত হওয়ার পর ব্রাজিলিয়ান (Brazilian) রাজনীতিতে তিনি সাফল্যময় প্রত্যাবর্তন করেছিলেন। সমাজতান্ত্রিক (socialist) ভাবধারার এই নেতা ২০২২ সালের নির্বাচনে তার প্রতিদ্বন্দ্বী জাইর বলসোনারো (Jair Bolsonaro)–কে পরাজিত করতে সক্ষম হন। তবে এই বিজয়ের সাথে ছিল প্রচুর নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি—যেমন অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার (economic recovery), সরকারি সেবার (public services) পরিসর বৃদ্ধি এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে (international sphere) ব্রাজিলের (Brazil) পুনঃপ্রবেশ নিশ্চিতকরণ। অনেকেই এই লক্ষ্যমাত্রাগুলোকে ফাঁপা বুলির (hot air) সঙ্গে তুলনা করেছিলেন—বাস্তবতা থেকে দূরে, এমন প্রতিশ্রুতি যা কার্যকর হলে দেশটিতে অবশিষ্ট সামান্য স্থিতিশীলতাও ভেঙে পড়বে। কেউ কেউ বলেছিলেন, ‘‘৬ মাসে ব্রাজিল (Brazil) হয়ে উঠবে আর্জেন্টিনা (Argentina), আর এক বছরে হবে ভেনেজুয়েলা (Venezuela)।’’
কিন্তু বাস্তবে, ক্ষমতায় দুই বছর পেরোনোর পর দেখা যাচ্ছে লুলা ডি সিলভা (Lula D Silva) সকলের প্রত্যাশা ছাড়িয়ে গেছেন। কয়েক বছর পেছনে থাকার পর, ব্রাজিলীয় অর্থনীতি (Brazilian economy) আবারও বিশ্বের অষ্টম বৃহত্তম অর্থনীতিতে পরিণত হয়েছে—২০১৭ সালের পর প্রথমবারের মতো কানাডা (Canada) এবং ইতালিকে (Italy) অতিক্রম করেছে। গৃহস্থালি ব্যয় (household consumption) প্রত্যাশার চেয়ে বহুগুণ বেশি হারে বেড়েছে। এবং বিরোধী দলের আশঙ্কার বিপরীতে, বেকারত্ব (unemployment) ও মুদ্রাস্ফীতির (inflation) হার কমেছে। উদাহরণস্বরূপ, বার্ষিক মুদ্রাস্ফীতির হার ২০২২ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে অর্ধেকে নেমে গেছে, আর বেকারত্বের হার ৮%-এ নেমে এসেছে, যা গত ১০ বছরে সর্বনিম্ন। পরিবেশগত এবং বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেও লুলা ডি সিলভা স্বল্প সময়ে সাফল্য দেখিয়েছেন—আমাজনের (Amazon) বননিধনকে (deforestation) উল্লেখযোগ্য মাত্রায় কমিয়ে আবারও আন্তর্জাতিক পরিসরে সম্পৃক্ত হয়েছেন। সবমিলিয়ে পরিসংখ্যান বলে দিচ্ছে যে এই ‘‘আমেরিকান টাইগার’’ (American tiger) যেন নতুন করে জেগে উঠতে শুরু করেছে।
যদিও সবকিছু এতটা উজ্জ্বল মনে হচ্ছে, বাস্তব চিত্র অনেক সময়ই এত সরল নয়। যাই হোক, সামষ্টিক অর্থনীতির দিক থেকে সাফল্য থাকা সত্ত্বেও লুলার (Lula) আমলে সরকারি আর্থিক খাত (government finances) মহামারির পর থেকে সবচেয়ে খারাপ সময় পার করছে। মাত্র এক বছরেই রাজস্ব ঘাটতি (fiscal deficit) ৯৩%-এর বেশি বেড়েছে। নির্বাচনী প্রচারে লুলা (Lula) বলেছিলেন যে তিনি বাজেট-সমতা (budget balance) বজায় রাখবেন, কিন্তু বাস্তবে তার কিছুই হচ্ছে না। আর সবচেয়ে খারাপ দিক হল এই আর্থিক অস্থিরতা (financial instability) বিনিয়োগকারীদের আস্থা (investor confidence) ও দেশের মুদ্রানীতি (monetary policy) উভয়কেই নাড়িয়ে দিচ্ছে।
সুতরাং এখানে আসলে কী ঘটছে? লুলা ডি সিলভার (Lula D Silva) সংস্কারগুলো কি বিশাল এক সাফল্যে পরিণত হয়েছে? নাকি এটি শুধুই ঝড়ের পূর্বের নিস্তব্ধতা? এই লেখায় সেটাই বিশ্লেষণ করা হবে। সেই সাথে ব্রাজিলের প্রধান শিল্পগুলোর (industries) একটি হল তেল (oil)। অবাক করা বিষয় হল, জ্বালানির রূপান্তর নিয়ে বৈশ্বিক উদ্যোগ সত্ত্বেও তেলের ব্যবহার (oil consumption) বেড়েই চলেছে, তেল কোম্পানিগুলোও অবিশ্বাস্য মুনাফা করছে। কীভাবে এটি সম্ভব? এই বিষয়টিও বিশদভাবে ব্যাখ্যা করব।
লুলার প্রেসিডেন্সি
লুলা ডি সিলভা (Lula D Silva) প্রেসিডেন্সির সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হল, বিপুল মাত্রার সরকারি ব্যয় (public spending) করার পাশাপাশি তার ঠান্ডা মাথার এবং হিসাবি রাজনৈতিক বাস্তববোধ (political pragmatism)। কারণ কী? যখন উভয় কক্ষের (legislative Chambers) সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্য আপনার বিপক্ষে, আর সামান্য কিছু ভালো কাজ করলেই আপনাকে নিয়ে জনসমর্থন (approval rating) দোদুল্যমান হয়ে পড়ে, তখন সরকার চালাতে হলে আপনাকে যথেষ্ট সৃজনশীল হতে হবে। লুলার (Lula) ক্ষেত্রে সেটাই ঘটেছে। তিনি মধ্যপন্থী (center) বা এমনকি মধ্য-ডানপন্থী (center right) দলগুলোর সঙ্গে এক বৃহৎ জোট (Coalition) গড়েছেন—যেমন ব্রাজিলিয়ান ডেমোক্র্যাটিক মুভমেন্ট (Brazilian Democratic Movement বা MDB)—যাতে তার সংস্কারগুলো জাতীয় কংগ্রেসে (National Congress) পাস করানো যায়।
এমনকি নতুন প্রেসিডেন্ট এতটাই মরিয়া ছিলেন সমর্থন পাওয়ার জন্য যে, তিনি জেরালদো আল্কমিন (Geraldo Alckmin)–কে সহ-রাষ্ট্রপতি (vice president) পদে নিয়োগ দিয়েছেন। আল্কমিন ব্রাজিলের রক্ষণশীল (conservative) ও বাজারপন্থী (pro-market) ডানপন্থী মহলের সঙ্গে যুক্ত, এবং ২০০৬ সালের নির্বাচনে স্বয়ং লুলা ডি সিলভার (Lula D Silva) বিরুদ্ধেই দাঁড়িয়েছিলেন। বলা বাহুল্য, তিনি লুলার একেবারে বিপরীতধর্মী একজন ব্যক্তি।
এখন প্রশ্ন হল, এগুলো অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার (economic administration) সঙ্গেই-বা কীভাবে যুক্ত? সহজ কথায়, প্রেসিডেন্ট তার ১০০% সংস্কার পাস করাতে পারেননি। তার সরকার আসলে ‘‘সবকিছুর একটা মিশ্রণ, আবার কিছুই নয়’’—রক্ষণশীলরা (conservatives) বলেন যে তিনি অত্যন্ত বামপন্থী (leftwing), আর বামপন্থীরা (leftists) বলেন যে তিনি অত্যন্ত মধ্যপন্থী (moderate)। কিন্তু মজার ব্যাপার হল, যখন গত বছর ব্রাজিলের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি উন্নতি করতে শুরু করল, তখন সবার কথার মোড় ঘুরে গেল। রক্ষণশীলরা বলছেন যে এই সাফল্য আসলে জাইর বলসোনারোর (Jair Bolsonaro) অর্থনৈতিক ধারা থেকে পাওয়া, আর বামপন্থীরা বলছেন এটি প্রেসিডেন্টের সংস্কারের ফল। কিন্তু আসল প্রশ্ন হল, এই সংস্কারগুলো (reforms) আসলে কী এবং কীভাবে নিশ্চিত হচ্ছি যে এগুলোই ব্রাজিলের সাম্প্রতিক সাফল্যের পেছনে চালিকাশক্তি?
ব্রাজিলের প্রবৃদ্ধি
ব্যক্তি হিসেবে লুলাকে (Lula) নিয়ে যত বিতর্কই থাকুক না কেন, একটি বিষয় স্পষ্ট—গত দুই বছর ছিল এক কথায় ‘‘অলৌকিক’’ (miraculous)। শুধু ২০২৩ সালেই ব্রাজিলের প্রকৃত মোট দেশজ উৎপাদন (real GDP) আইএমএফের (IMF) প্রত্যাশার চেয়েও দ্বিগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এর পর গত জুলাইয়ে আইএমএফ আবার তার পূর্বাভাস সংশোধন করে ২.১% বৃদ্ধির কথা বলেছে—কিন্তু হ্রাস নয়, বরং বাড়িয়ে। আন্তর্জাতিক বাজারে (international markets) অনেকেই ভাবছিলেন যে যুক্তরাজ্যের (UK) মতো ব্রাজিলও হয়তো একটি ভয়াবহ মন্দায় (crash) পড়বে, কিন্তু সেটি ঘটেনি।
তাহলে কি ‘‘মহান নেতা’’ লুলা (Lula) তার বামপন্থী (leftist) নীতিমালার মাধ্যমে ব্রাজিলে আবারও সমৃদ্ধি (Prosperity) ফিরিয়ে এনেছেন? উত্তর হল—হ্যাঁ, কিন্তু পুরোটা না। কারণ, ব্রাজিলের অর্থনীতি অনেকাংশেই নির্ভর করে অন্যান্য দেশে কাঁচামাল (raw materials) রপ্তানির ওপর—যেমন কৃষিজ পণ্য (agricultural commodities) চিনি (sugar), সয়াবিন (soybeans), বা খনিজ পদার্থ (minerals) জ্বালানি তেল (crude oil) ও লোহা আকরিক (iron)। অর্থাৎ, অদূর ভবিষ্যতে বিশ্ববাজার (global economy) কেমন চলবে অথবা প্রতিবছর তারা ঠিক কতটা পরিমাণ কাঁচামাল মাটি থেকে তুলতে পারবে, তার ওপরই ব্রাজিলের প্রবৃদ্ধির হার নির্ভর করে। সহজ করে বললে, স্বল্পমেয়াদে রাজনৈতিক প্রশাসনের (political Administration) প্রভাব সীমিত। বলা চলে, লুলা ডি সিলভা (Lula D Silva) আসলে ‘‘ম্যাক্রোইকোনমিক লটারি’’ (macroeconomic lottery) জিতে গেছেন!
মে এস্টিমেট: ব্রাজিলের ফসল
২০২৩ সালে ব্রাজিলের শস্য, ডাল ও ভোজ্যতেল (cereals, pulses, and vegetable oils) উৎপাদন ৩৫.৪ মিলিয়ন টন ছাড়িয়ে যাওয়ার রেকর্ড পূর্বাভাস দেয়া হয়েছিল। গত বছরের তুলনায় উৎপাদন প্রায় ১৬% বৃদ্ধি পায়, যার পেছনে প্রধান কারণ ছিল অনুকূল আবহাওয়া (weather conditions)। শুধু তাই নয়, এই সময়ে ইউক্রেন (Ukraine) যুদ্ধ তার প্রথম বছরে ছিল বলে গুরুত্বপূর্ণ ইউক্রেনীয় ফসল (Ukrainian Harvest) ততটা ফলন দিতে পারেনি। ফলে সরবরাহের ঘাটতি (shortages) বেড়ে যায়, এবং আন্তর্জাতিক বাজারে দাম (prices) বেড়ে যায়। স্বাভাবিকভাবেই, ব্রাজিলিয়ান রপ্তানিকারকরা (Brazilian exporters) এই সুযোগে তাদের উদ্বৃত্ত ফসল (surpluses) খুব বেশি লাভজনক মূল্যে বিক্রি করতে পেরেছে। একেবারে ‘‘ঠিক জায়গায় ঠিক সময়ে’’ থাকা বলতে যা বোঝায়।
ব্রাজিলিয়ান তেল উৎপাদন
তেল (oil) ও অন্যান্য হাইড্রোকার্বন (hydrocarbons) উৎপাদনও লুলা ক্ষমতায় ফেরার পর থেকে বেড়েছে, ২০২৩ সালের নভেম্বরে ইতিহাসের সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছায়। তেল রপ্তানির (Brazilian exports) ক্ষেত্রেও ইউক্রেনের যুদ্ধজনিত কারণে বিশ্ববাজারে জ্বালানির দাম (fuel prices) বেড়ে যাওয়ায় ব্রাজিল অতিরিক্ত সুবিধা পেয়েছে। এখন প্রশ্ন হল, এই উদ্দীপনাময় শিল্পখাত (industrial success) হঠাৎ এত বাড়ল কীভাবে? সরকার কি কোন বিশেষ নীতি নিয়েছে?
বাস্তবে, এর পেছনে বড় ভূমিকা রয়েছে পেট্রোব্রাসের (Petrobras) আগের বিনিয়োগ (Investments)। বিশেষত, রাষ্ট্রায়ত্ত এই জায়ান্ট সংস্থা (state-owned giant) ২০২০ সাল থেকেই দেশটির ‘‘প্রি-সল্ট লেয়ার’’ (pre-salt layer)–এ তেলের ভাণ্ডার অনুসন্ধানের জন্য পাঁচটি লোডিং ও আনলোডিং জাহাজ (loading and unloading vessels) বসিয়েছে, যেমন এফপিএসও পি৭১ (FPSO P71) ও এফপিএসও আল্মিরান্তে বারোসো (FPSO Almirante Barroso) ইত্যাদি। এর মাধ্যমে বেশ কয়েকটি বৃহৎ ফিল্ড (fields)—যেমন বুজিওস (Buzios) —এর উৎপাদন নতুনভাবে সচল হয়েছে। অর্থাৎ লুলা ডি সিলভা (Lula D Silva) সরকারের অর্থনীতি শুধু ভালো ফসল থেকেই লাভবান হয়নি, বরং জাইর বলসোনারোর (Jair Bolsonaro) শাসনামলে করা বিনিয়োগের সাফল্যও কুড়িয়েছে।
তবে, কৃতিত্বের দাবিদার লুলাও বটে। কারণ, প্রায় ৩%-এর কাছাকাছি বৃদ্ধির হার (expansion) এমনিতেই আকাশ থেকে পড়ে না। তিনি ২০০০ সালের শুরুর দিককার রাষ্ট্রপতি থাকা অবস্থাতেও নিজের ‘‘ভালো সময়’’ (good luck) কাজে লাগিয়েছিলেন ব্রাজিলের অর্থনীতিকে স্থিতিশীল (stabilize) করার জন্য। এবারও সেটিই করেছেন। এবং এর মূল চাবিকাঠি হল অদ্ভুতুড়ে এক মুদ্রানীতি (monetary policy)।
মুদ্রানীতি (Monetary Policy)
মহামারির পরে ব্রাজিলে মুদ্রাস্ফীতি (inflation) খুব উচ্চমাত্রায় পৌঁছায়। ডলারের (dollar) বিপরীতে রিয়ালের (Brazilian real) মূল্য পড়ে যায় প্রায় ২৫%, ফলে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা (purchasing power) বড় ধাক্কা খায়। পরিস্থিতি এতটাই খারাপ হচ্ছিল যে, ২০২০ সালের সংকটের (2020 crisis) প্রভাব কিছুটা কমার পর, ব্রাজিলের কেন্দ্রীয় ব্যাংক (Central Bank of Brazil) সরাসরি মূল্যবৃদ্ধি (price increase) নিয়ন্ত্রণে নেমে পড়ে। কীভাবে? সুদের হার (interest rate) বাড়িয়ে। কারণ, ঋণ (borrow money) নিয়ে বিনিয়োগ (invest) বা খরচ (spend) করার জন্য সুদ হল একটা মূল্য। বাজারের সাধারণ নিয়ম—মূল্য যত বাড়ে, চাহিদা (demand) তত কমে। ফলে কমে যায় ঋণের পরিমাণ (credit), অর্থনীতিতে (economy) কম টাকা ঘোরে, এবং দাম বৃদ্ধির হার (inflation) কমে আসে।
ফলে দেখা গেল, ২% সুদের হার বেড়ে দাঁড়ায় ১৩.৭৫%-এ। এতে মুদ্রাস্ফীতি (inflation) নিয়ন্ত্রণে আসলেও, আরেকটি সমস্যা তৈরি হয়: ‘‘অর্থনৈতিক স্থবিরতা’’ (stagnation)। কারণ, উচ্চ সুদের হার নতুন বিনিয়োগের (private investment) সম্ভাবনাকে কমিয়ে দেয়। আইএমএফ তো ২০২৩ সালে ব্রাজিলের বৃদ্ধির হার কমার পূর্বাভাস দিয়েছিল মূলত এই কারণেই। আপনি একজন উদ্যোক্তা হলে, ব্যাংক থেকে যদি ১৩% বা তারও বেশি সুদে ঋণ নিতে হয়, তাহলে কি নতুন প্রকল্পে (expand operations) বিনিয়োগ করবেন? স্বাভাবিকভাবেই অনেকেই করবে না।
ফলে নতুন রাষ্ট্রপতি লুলা ডি সিলভা তার মেয়াদের শুরুতেই দাঁড়িয়ে গেলেন এক কঠিন দ্বিধায়। একদিকে, যদি তিনি সুদের হার উঁচু রাখতেন, তাহলে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে থাকত, কিন্তু অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি (growth targets) অর্জন করা যেত না, এবং তিনি যতটা সরকারি ব্যয় বাড়ানোর (public spending) প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তা সম্ভব হত না। অন্যদিকে, যদি তিনি অর্থনীতিকে চাঙা করতে সুদের হার কমিয়ে দিতেন, তাহলে তার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি (electoral promise) পূরণের পথ খুলে যেত, কিন্তু আবারও মুদ্রানীতিতে নৈরাজ্য (monetary chaos) ও মুদ্রাস্ফীতির ফেরার ঝুঁকি বাড়ত।
সাধারণ অবস্থায় সরকারের কাছে মাত্র এই দুটো বিকল্পই থাকত। কিন্তু লুলা (Lula) ভাগ্যবান ছিলেন—তাকে কোনোটিই পুরোপুরি বেছে নিতে হয়নি। কেন? কারণ, আগে উল্লেখিত কৃষি ও তেল রপ্তানি (oil and agricultural exports) ‘‘বিস্ফোরণ’’ (explosion) ঘটিয়েছিল রিয়ালের (real) মূল্যে উর্ধ্বগতি। যারা ব্রাজিলীয় পণ্য কিনতে চাচ্ছেন, তাদের ব্রাজিলিয়ান মুদ্রার (Brazilian currency) প্রয়োজন হচ্ছে। ফলে মুদ্রার চাহিদা বাড়ছে, এবং এটি যেন একটি ‘‘কুশন’’ (cushion) হিসেবে কাজ করছে। এতে সুদের হার কিছুটা কমিয়েও রিয়ালের (real) মূল্য রাখা যাচ্ছে, ফলে মুদ্রাস্ফীতির ঝুঁকি অত বাড়ছে না।
২০২৩ সালের গ্রীষ্ম থেকে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন শুরু হয়, যেদিন এই “bumper crop” এর সুবিধা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তখন সুদের হার ১৩.৭৫% থেকে কমিয়ে ১০.৫৫%-এ নামানো হয়। ফলাফল? বিস্ময়কর সাফল্য। আর এতেই এখনকার ‘‘সমৃদ্ধির’’ (Bonanza) অনেকখানি ব্যাখ্যা রয়েছে।
তবে, এই ‘‘অলৌকিক’’ কৌশল কতদিন স্থায়ী হবে? কারণ, এমন তো নয় যে চিরকাল রপ্তানি (exports) এত বেশি থাকবে। এক সময় সরবরাহ (trade surplus) তার স্বাভাবিক মাত্রায় ফিরে আসবেই। তখন আর এইমাত্রায় ডলার (dollars) আসবে না। তখন কী হবে সুদের হারের অবস্থা? তখন যদি কম সুদ রাখা হয়, মুদ্রাস্ফীতি (inflation) মাথাচাড়া দিতে পারে। লুলা ডি সিলভার কাছে এর সমাধান কী? স্বভাবতই তার পছন্দের উপায় হল—নিয়ন্ত্রণ (regulate), কর আরোপ (tax) এবং খরচ করা (spend)। এক কথায়, ‘‘সরকারি ব্যয় বাড়িয়ে যাও’’ (hand over fist)!
সরকারি ব্যয় (Public Spending)
যে কোনো স্বঘোষিত সমাজতান্ত্রিক (socialist) নেতার মতোই, লুলা ডি সিলভা বরাবরই সরকারি ব্যয় (public spending) এবং কল্যাণমূলক রাষ্ট্র (welfare state) ব্যবস্থার পক্ষে। তার আগের আমলেই ব্রাজিলের বিখ্যাত বলসা ফ্যামিলিয়া (Bolsa Familia)–র মতো গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক কর্মসূচির (social programs) সূচনা হয়েছিল। সুতরাং, ২০২২ সালের নির্বাচনে ফিরে এসে তিনি পুনরায় সরকারি ব্যয় বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দেন—উচ্চবিত্তদের (upper class) ওপর বেশি কর (tax) আরোপের কথাও বলেন।
ক্ষমতায় ফিরেই (returned to power) লুলা (Lula) সময় নষ্ট করেননি। ২০২৩ সালের প্রথম চার মাসে সরকারের ব্যয় আগের বছরের তুলনায় ৮% বেড়েছিল, আর এক বছরের ব্যবধানে তা ৪২%-এ পৌঁছেছে। এত টাকা কোথায় যাচ্ছে? মূলত আগের প্রেসিডেন্ট জাইর বলসোনারো (Jair Bolsonaro) বাজেট ঘাটতি (fiscal deficit) নিয়ন্ত্রণের স্বার্থে যে সমস্ত সামাজিক কর্মসূচি কাটছাঁট (cut) বা বাতিল করে দিয়েছিলেন, সেগুলো ফের চালু করার কাজে।
স্বল্পমেয়াদে, অতিরিক্ত ব্যয় (increased spending) এবং রপ্তানির (exports) উচ্চ আয়ে অনেক ব্রাজিলিয়ানের জীবনযাত্রার মান (standard of living) বেড়েছে। কিন্তু কে দেবে এর মূল্য? বহু রাজনীতিকের মতো লুলা ডি সিলভার সহজ উত্তর হল, ‘‘অন্য কেউ দিক!’’ ফলস্বরূপ, ব্রাজিলের সরকারি ঋণ (government debt) মাথাচাড়া দিচ্ছে। ২০২১ সালের প্রায় ৮৪% জিডিপির (GDP) ঋণ অনুপাতে এখন সেটি বেড়ে ৮৬%-এর ওপরে (মাত্র দুই বছরে) পৌঁছেছে।
উন্নত দেশগুলোর (developed countries) ক্ষেত্রে এমন উচ্চঋণের হার (debt level) লম্বা সময়ে সহনীয় হতে পারে, তবে উদীয়মান অর্থনীতিতে (emerging economy) এটি দীর্ঘমেয়াদে বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক (US) রেটিং এজেন্সি স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড পুওরস (Standard and Poor’s) ২০২৪ সালের জন্য ব্রাজিলকে দিয়েছে BB ক্রেডিট স্কোর (credit score), যেখানে জাপান (Japan)-এর ঋণের পরিমাণ জিডিপির ২৫০%-এর বেশি হলেও তাদের স্কোর A। কেন এমন বৈপরীত্য? কারণ, জাপানের অর্থনীতি অনেক বেশি উন্নত (developed), সঞ্চয় (savings) অনেক বেশি, তারা বেশি পরিমাণে ঋণ নিলেও বিনিয়োগকারীরা (investors) ভয় পায় না। কিন্তু ব্রাজিলের (Brazil) ক্ষেত্রে বিনিয়োগকারীরা এখনও শতভাগ নিশ্চিত হতে পারেন না যে তারা বিনিয়োগ করা অর্থ ফেরত পাবেন।
ফলে, লুলা ডি সিলভা যদি আর্থিক ব্যবস্থার (financial system) পতন ঠেকাতে চান, তবে তার কাছে মূলত দুটি পথ—অর্থবাজারের (financial markets) আস্থা সম্পূর্ণ অর্জন করে ঋণ নেওয়া চালিয়ে যাওয়া, অথবা রাজস্ব ঘাটতি (fiscal deficit) কমানো।
দুটি কৌশল
একদিকে, ব্রাজিল সরকার পুনর্গঠন (reindustrialization) এবং উদ্ভাবন (innovation) বৃদ্ধির জন্য বিপুল অর্থ বিনিয়োগের পরিকল্পনা করছে—বিশেষ কিছু ‘‘কৌশলগত’’ (strategic) খাতে সরকারি ভর্তুকি (subsidies) ও স্বল্পসুদে ঋণ (public loans) দেওয়ার মাধ্যমে। এতে ৬০ বিলিয়ন ডলারের বেশি খরচ হতে পারে বলে আশা করা হচ্ছে। অন্যদিকে, প্রেসিডেন্ট (President) খুবই উচ্চাভিলাষী (ambitious) একটি কর সংস্কার (tax reform) পাস করার চেষ্টা করছেন, যাতে মূল্য সংযোজন কর (VAT) সহজভাবে আদায় (collection) করা যায় এবং সরকারি রাজস্ব (State revenues) বাড়ে।
এগুলো কি কাজ দেবে? বলতে গেলে কঠিন। সাধারণত, ইসরায়েল (Israel) বা তাইওয়ান (Taiwan)-এর মতো দু–একটি ব্যতিক্রম ছাড়া সরকারি বিনিয়োগ কর্মসূচি (public investment programs) বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অদক্ষভাবে টাকা খরচ করে থাকে। আর লাতিন আমেরিকার (Latin American) বাস্তবতায় দুর্নীতি (corruption) সংযোজিত হলে ফলাফল আরও খারাপ হতে পারে। তবু, উল্লিখিত কর সংস্কার (fiscal reform) এবং স্থিতিশীল জিডিপি (GDP) বৃদ্ধির হারের কারণে, মনে হচ্ছে ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট অন্তত আংশিকভাবে হলেও অর্থবাজারের (financial Market) আস্থা কিছুটা পুনরুদ্ধার (rebuild) করতে পেরেছেন।
উপসংহার
কিন্তু মাত্র দুই বছর ক্ষমতায় থেকে লুলা ডি সিলভা (Lula D Silva)-র অর্থনৈতিক সংস্কার (economic reforms) সত্যিই সফল কি না, বা ব্যর্থ কি না, সেটি এখনই জোর দিয়ে বলা কঠিন। তার ২০২২ সালের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিগুলো (electoral promises) সত্যি কোনো ‘‘রূপকথার গল্প’’ (fairy tales) ছিল না কি লাতিন আমেরিকায় (Latin America) আরেকটি ‘‘অলৌকিক’’ (miracle) শুরু হচ্ছে – এই প্রশ্নের উত্তর দেবার জন্য আরও সময়ের প্রয়োজন। তবে এখন পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে, ‘‘ভাগ্য’’ লুলার অর্থনীতিতে বড় ভূমিকা রাখছে।
কেন ব্রাজিল সুপারপাওয়ার নয় (যদিও হওয়া উচিত!) (২৮ জুলাই, ২০২৪)
ভূমিকা
২০১৬ সাল, ব্রাজিলের জন্য এটি ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হওয়ার কথা। সেই সময়ে বিশ্বের দ্রুত-বর্ধনশীল অর্থনীতির (economies) মধ্যে ব্রাজিল অন্যতম ছিল। দেশটি তার অর্থনৈতিক উৎপাদন (economic output) দিয়ে ভারত (India) এবং ইতালি (Italy)–কে ছাড়িয়ে গিয়েছিল এবং মোট উৎপাদনের হিসেবে ফ্রান্স (France) ও যুক্তরাজ্যের (UK) কাছাকাছি পৌঁছে যাচ্ছিল।
জীবনমান (life expectancy), স্বাস্থ্যসেবা (healthcare) ও শিক্ষায় প্রবেশাধিকার, গড় আয় (average incomes), বিনিয়োগকারীদের আস্থা (investor confidence), রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা (political stability), বৈশ্বিক প্রভাব (global influence), সামাজিক গতিশীলতা (social mobility) এবং মুদ্রার মান (currency value)—সবকিছুই ঊর্ধ্বমুখী ছিল।
দেশীয় সাফল্যের বাইরে, ব্রাজিল প্রতিশ্রুতি দিচ্ছিল একটি বড় ধরনের আঞ্চলিক হাব হয়ে ওঠার (regional hub) যা দক্ষিণ আমেরিকার (South America) অন্যান্য দেশকেও উপকার করতে পারত। স্থানীয় এক বৃহৎ ভোক্তা বাজার (consumer market) এবং বাণিজ্য-অংশীদার (trade partner) হওয়ার মাধ্যমে গোটা অঞ্চলে এক ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারত। কিন্তু ২০১৬ সালের মধ্যে সেই উত্থান বিলুপ্ত হয়ে যায়।
রিও অলিম্পিক গেমস (Olympic Games) ব্রাজিলের সাফল্যের গল্প বিশ্বকে জানানোর একটি অনন্য সুযোগ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সেটাই হয়ে দাঁড়ায় বিশ্বব্যাপী এক বিব্রতকর উপাখ্যান। প্রায় শেষ মুহূর্তে স্টেডিয়াম ও অন্যান্য সুবিধাদির নির্মাণ সম্পন্ন হয়, এর আশপাশের পরিবেশ আবর্জনায় (waste) পূর্ণ ছিল, আর অলিম্পিক আয়োজনের বিশাল খরচ শহরকে কার্যত দেউলিয়া (bankrupted) করে ফেলে। যারা এই ইভেন্ট বাস্তবায়নে কাজ করছিলেন, তারা (public servants) ঠিক মতো বেতন না পেয়ে ধর্মঘটে (strike) যেতে বাধ্য হয়েছিলেন।
অবশ্য, অলিম্পিক আয়োজনের অর্থনৈতিক গতিশীলতা (economic dynamics) নিজেই একটি বড় চ্যালেঞ্জ। তবে এটি সব সময়ই ছিল এক ধরনের বিশ্বমঞ্চে (global stage) দেশের সেরা চেহারা উপস্থাপন করার (put their best foot forward) সুযোগ—“স্পটলাইট (spotlight) বা অন্য কোনও উপায়ে”। কিন্তু ব্রাজিলের পক্ষে এটি যদি সেরা দিক হয়, তাহলে বোঝা যায় দেশটি কত বড় বড় চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন ছিল—যা আজও তেমন উন্নতি করেনি।
ব্রাজিল তার সর্বোচ্চ উৎপাদনশীলতা থেকে প্রায় অর্ধেকের কাছাকাছি জিডিপি (GDP) হারিয়েছে, যা ২০০০ দশকে দেশটির যে অগ্রগতি হয়েছিল তার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দুর্নীতি কেলেঙ্কারি (corruption scandals) আর রাজনৈতিক অস্থিরতা (political instability), যা আগের সাফল্য ফিরে পাওয়াকে আরো কঠিন করে তুলেছে।
এখন প্রশ্ন, কীভাবে ব্রাজিল বিশ্বের অন্যতম দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতি হয়ে উঠেছিল? কী কারণে এত দ্রুত এর পতন হলো? এবং অবশেষে, ২০০০ দশকের প্রথম ভাগের সাফল্য কি ব্রাজিল পুনরায় অর্জন করতে পারবে?
ব্রাজিলের আধুনিক অর্থনীতির সংক্ষিপ্ত চিত্র
ব্রাজিলের আধুনিক অর্থনীতি গড়ে উঠেছে বিশেষ কিছু চ্যালেঞ্জ অতিক্রম করার মধ্য দিয়ে, যার শেষ বড় পর্ব দেখা গিয়েছিল ১৯৯০-এর দশকে। ৯০-এর দশকের শুরুতে দেশটিকে হাইপারইনফ্লেশন (hyperinflation) সামলাতে হয়, যার হার ছিল জানুয়ারিতে ৫৬%, ফেব্রুয়ারিতে ৭৩% এবং মার্চে ৮৪%। এমন প্রবল চাপের মুখে ব্রাজিল সরকারকে দ্রুত ও বড় ধরনের ব্যবস্থা নিতে হয়—দ্রব্যের দাম (prices) স্থগিত রাখা, বিনিয়োগ ও বাণিজ্যে উন্মুক্ততা (opening up investments and trade) আনা, এবং অদক্ষ রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পগুলোকে বেসরকারিকরণ (privatise) করা। এসব পদক্ষেপ উৎপাদনশীলতা (productivity) বাড়াতে সাহায্য করে।
আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ ছিল সংসদে ইন্ডেক্সেশন (indexation) পদ্ধতিকে নিষিদ্ধ করা, যা অটোমেটিক্যালি (automatically) মূল্যস্ফীতির (inflation) হারে বেতন ও মজুরি বাড়িয়ে দিত। প্রথমে এটা শ্রমিকশ্রেণির কাছে কঠিন সিদ্ধান্ত মনে হলেও, এটি একটি মজুরি-মূল্য চক্র (wage-price spiral) ঠেকানোর জন্য প্রয়োজনীয় ছিল। সাধারণত, শ্রমিকদের মজুরি বাড়লে পণ্যের দাম বাড়ে, যা আবার মূল্যস্ফীতির কারণ হয়, এবং এর ভিত্তিতে আবার মজুরি আরও বাড়ে—এমন এক চক্র চলে। ইন্ডেক্সেশন পদ্ধতি থাকলে এই চক্রকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ত্বরান্বিত করে তোলে, নিয়ন্ত্রণ করা আরও কঠিন হয়ে পড়ে।
এই সংস্কারের পর ব্রাজিল গেল আরেক ধাপে, যাকে বলা হয় ‘প্লানো রিয়াল (Plano Real)’, যেখানে অর্থনৈতিক হিসাব পরিচালনার জন্য একটি স্বতন্ত্র একক (distinct unit of account) ব্যবহার করা হয়। আগের মুদ্রার মান এত দ্রুত পড়ছিল যে, স্বাভাবিক লেনদেনের জন্য এটি কার্যকারিতা হারায়। ১৯৯৪ সালে একাধিক ধ্বংসাত্মক মূল্যস্ফীতির ধাক্কা সামলে ব্রাজিল নতুন মুদ্রা ‘রিয়াল (Real)’ চালু করে। এটা ছিল স্বাধীনতা লাভের পর বহুবার মুদ্রা বদলানোর আরও একটি উদাহরণ।
এতটাই ভয়াবহ ছিল পূর্ববর্তী হাইপারইনফ্লেশন যে, নতুন মুদ্রাকে পুরনো মুদ্রার (যেগুলো একের পর এক পরিবর্তন হয়েছে) সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যায়, দেশের মূল রিয়ালের (Real) তুলনায় এর মান দাঁড়াত ২.৭৫ কুইন্টিলিয়ন গুণ। তাই মানুষকে বোঝানো দরকার ছিল যে, এবারের মুদ্রা বদলটা আসলেই “অন্যরকম” হতে যাচ্ছে।
শুভসংবাদ হলো, ব্রাজিল একটি বিশাল দেশ (massive) প্রায় ৮.৫ মিলিয়ন বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে বিস্তৃত। এই বিশাল ভূখণ্ডে বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদ (natural resources) মজুত রয়েছে। শ্রমশক্তিও (workforce) ১০৮.৪ মিলিয়নের বেশি, যারা তুলনামূলকভাবে স্বল্প বেতনে (cheap labour) কাজ করে থাকেন। ফলে স্বল্প খরচে প্রচুর পণ্য রফতানি (export) করা এবং রফতানি কাজে শ্রমশক্তিকে যুক্ত করা সম্ভব হয়েছে।
উত্থান ও ২০০০ সালের বুম
স্বাভাবিকভাবেই ব্রাজিল রফতানিনির্ভর অর্থনীতি (export-led economy) ছিল, কিন্তু ২০০০ সালের দিকে দেশটি বড় ধরনের প্রবৃদ্ধি পায়। কারণ, তখন তারা অপেক্ষাকৃত স্থিতিশীল মুদ্রা, আরও উৎপাদনক্ষম বেসরকারিকৃত শিল্প এবং সর্বোপরি দ্রুত শিল্পায়নের পথে এগোনো চীনের (China) কাছ থেকে প্রচুর প্রাকৃতিক সম্পদের চাহিদা লাভ করে।
২০০৭-০৮ সালের বৈশ্বিক আর্থিক মন্দা (global financial crisis বা GFC) যখন বিশ্বের বড় বড় অর্থনীতিকে চাপের মুখে ফেলে, ব্রাজিল তুলনামূলক ভালো করে। কারণ, চীনে তখন বিশাল এক অর্থনৈতিক উদ্দীপনা প্যাকেজ (economic stimulus plan) নেওয়া হয়েছিল—৫৮৬ বিলিয়ন ডলারের – যা মূলত অবকাঠামো নির্মাণে (massive building spree) ব্যয় হতে থাকে। এর ফলে চীনের আকাশচুম্বী কাঁচামালের চাহিদা জোগাতে কানাডা, অস্ট্রেলিয়া এবং ব্রাজিলের মতো দেশগুলোর সুযোগ তৈরি হয়। এই তিন দেশই GFC-র ধাক্কা তুলনামূলকভাবে ভালোভাবে সামলাতে পারে।
তাছাড়া, ব্রাজিলের আর্থিক খাত (financial sector) তখনও বেশ সরল ছিল, কারণ ২০০০-এর দশকের প্রথম ভাগে হাইপারইনফ্লেশন-এর পর নতুন করে গড়ে উঠছিল। ফলে জটিল আর্থিক যন্ত্র (advanced financial instruments) ব্যবহারের মাধ্যমে যে ধরনের পরিস্থিতি যুক্তরাষ্ট্র (USA) ও ইউরোপে সৃষ্টি হয়েছিল, ব্রাজিলে তা ঘটেনি।
ফলে, ২০০৮ সালের শেষ প্রান্তিকে (last quarter) ব্রাজিলের জিডিপি মাত্র ২.৯% পড়ে, আর ২০০৯ সালের প্রথম প্রান্তিকে ০.৯% কমে। এরপর অর্থনীতি আবার দ্রুত বেড়ে ওঠে। কাকতালীয়ভাবে, GFC শুরু হওয়ার ঠিক দুই বছর আগে, ব্রাজিল ক্যালিফোর্নিয়ার (California) সমান আকারের আমাজন (Amazon) রেইনফরেস্ট এলাকা প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণের জন্য (natural resource extraction) বরাদ্দ করে। এটা ছিল পরিবেশগতভাবে বিতর্কিত (controversial) একটি সিদ্ধান্ত, কিন্তু মুনাফা বাড়ে। ওই এলাকায় লোহা আকরিক (iron ore), বক্সাইট (bauxite), ম্যাঙ্গানিজ (manganese) এবং সোনাসহ (gold) নানা মূল্যবান খনিজ ছিল; কাঠ (lumber) নিজেও ছিল রফতানিযোগ্য মূল্যবান সম্পদ।
এছাড়া, সমুদ্রতীরে আবিষ্কৃত হয়েছিল তথাকথিত ‘প্রি-সল্ট (pre-salt)’ বা ‘টু-বি (2B) তেলের খনি’, যা পশ্চিম গোলার্ধে সাম্প্রতিক সময়ে আবিষ্কৃত সবচেয়ে বড় জ্বালানি মজুত। এই উৎসে প্রায় ৮ বিলিয়ন ব্যারেল পুনরুদ্ধারযোগ্য (recoverable) তেল ছিল। ফলে ব্রাজিল উল্লেখযোগ্য আঞ্চলিক শক্তি থেকে বৈশ্বিক পর্যায়ের শক্তিশালী দেশ হওয়ার সম্ভাবনা দেখতে পায়, যদিও এর সঙ্গে রাজনীতিতে অস্থিরতা (political turmoil) আরও বেড়ে যায়।
পতনের কারণ
ব্রাজিল যখন এত বড় একটি বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকট (GFC) কাটিয়ে উঠতে পেরেছিল এবং বিপুল পরিমাণ প্রাকৃতিক সম্পদেরও মালিক, তখনও ২০১৪ সালে এসে সবকিছু ভেঙে পড়ল কেন? এর উত্তর খোঁজার সময় আমাদের রাজনীতির (politics) প্রসঙ্গ এসে পড়ে, এবং দৃশ্যপট এতটা সুন্দর নয়।
ব্রাজিলে ২৬টি রাজ্য (states) এবং ১টি ফেডারেল ডিস্ট্রিক্ট (federal district) রয়েছে, যা ৫টি বৃহত্তর অঞ্চলে (regions) বিভক্ত—উত্তর (North), উত্তরপূর্ব (North East), মধ্য-পশ্চিম (Central West), দক্ষিণ-পূর্ব (South East) এবং দক্ষিণ (South)। যদি এই আঞ্চলিক কাঠামো সমন্বয়ের সঙ্গে কাজ করে, সাধারণ মানুষের কল্যাণে (public interest) কাজ করে—তাহলে দেশ উপকৃত হয়। যুক্তরাষ্ট্র (USA) এর ক্ষেত্রে এরকম অনেক বৈচিত্র্য ও ব্যর্থতার রক্ষাকবচ (redundancy) থাকে, যেখানে কোনও একটি ভুল সিদ্ধান্ত পুরো দেশকে তলিয়ে দেয় না।
কিন্তু যেখানে এই সহযোগিতা ভেঙে যায়, আর সম্পদশালী কোনও ক্ষেত্র থেকে দ্রুত লাভ (easy profit) তোলার সুযোগ থাকে, তখন ব্যবস্থাটি নিজ স্বার্থে কাজ করে। ব্রাজিলের ক্ষেত্রে এটি প্রকটভাবে সামনে আসে ২০১৪ সালে, যখন এক সামান্য ‘কার ওয়াশ (car wash)’ মানি লন্ডারিং (money laundering) তদন্ত থেকে শুরু হয়ে ইতিহাসের অন্যতম বড় রাজনৈতিক দুর্নীতি কেলেঙ্কারি বের হয়ে আসে, অনেকে যাকে আধুনিক পশ্চিমা বিশ্বের সবচেয়ে বড় কেলেঙ্কারি বলে অভিহিত করেন।
শুরুটা হয় নেস্টর সেভেরো (Nesta Severo) নামের পেট্রোব্রাসের (Petrobras) এক সাবেক নির্বাহীকে গ্রেপ্তারের মধ্য দিয়ে। পেট্রোব্রাস হলো ব্রাজিলের জাতীয় তেল কোম্পানি (national oil company), যা ২০০০-এর দশকে বহির্বিশ্বের অনেক বিনিয়োগকারীর সঙ্গে অংশীদারিত্বে কাজ করেছে। প্রথমদিকে সবাই ভেবেছিল, হয়তো সেভেরোকে সামান্য মুচলেকায় মুক্তি দেওয়া হবে বা সামান্য জরিমানা করে ছেড়ে দেওয়া হবে।
কিন্তু অল্প দিনেই দেখা গেল, সেভেরো যে দুর্নীতির জালে যুক্ত ছিলেন, তা অনেক বড়। ‘অপারেশন কার ওয়াশ (Operation Car Wash)’ নামের ফেডারেল তদন্তে (federal investigation) বের হয়ে আসে, দুর্নীতির কারণে বহু উচ্চপর্যায়ের রাজনীতিবিদ অভিযুক্ত হচ্ছেন। পেট্রোব্রাস, যে কোম্পানিকে কখনো ব্রাজিলের জাতীয় অহঙ্কারের প্রতীক (symbol of the country’s entrenched economic nationalism) বলে ধরা হতো, সেটিই দুর্নীতির কেন্দ্রে।
২০১৫ সালের জুন নাগাদ, পেট্রোব্রাসের ‘প্রি-সল্ট (pre-salt)’ তেলের খনি উন্নয়নকাজে চুক্তি সংক্রান্ত এক বিশাল প্রতারণার পরিকল্পনা তদন্তকারীদের নজরে আসে। আরও জানা যায়, বিদ্যুৎ উৎপাদন খাত, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন কোম্পানির কর্মচারীদের পেনশন তহবিল (pension funds) এবং জাতীয় অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন ব্যাংককেও (National Bank of Economic and Social Development) এই তদন্তের আওতায় নেওয়া হয়।
এটি মিলিত হয় আরেকটি পুরনো তদন্তের সঙ্গে, যা ২০০৫ সাল থেকে চলছিল—‘ক্যাশ ফর ভোটস (cash for votes)’ কেস, যেখানে আনুমানিক ৪৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার দুর্নীতির মাধ্যমে আত্মসাৎ করা হয়েছিল। তদন্ত এগোতে থাকায় দেখা গেল, ব্যক্তিগত স্বার্থে এবং নির্বাচনী প্রচারণা তহবিলে (campaign finance) অন্তত ২.১ বিলিয়ন ডলার সরিয়ে ফেলা হয়েছে। পেট্রোব্রাসের সাবেক ‘ডিরেক্টর অফ রিফাইনিং অ্যান্ড সাপ্লাই’ ঘুষ নেওয়ার কথা স্বীকার করে ২৩ মিলিয়ন ডলার ফেরত দেওয়ারও অঙ্গীকার করেন।
প্রতিদিন দুর্নীতির নতুন কেস সামনে আসতে থাকায় দেশের অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা (domestic stability) ও বৈদেশিক বিনিয়োগ আস্থা (international confidence) ভেঙে পড়ে। এর সঙ্গে মিলে যায় বিশ্ববাজারে পণ্যমূল্য (commodity prices) পড়ে যাওয়া। ফলে দেশের রফতানি রাজস্ব (export revenue) কমে যায়, যা আবার দেখিয়ে দেয় যে, ব্রাজিল মূলত কাঁচামাল রফতানিতে (raw materials) নির্ভরশীল ছিল, যার সবচেয়ে বড় বাজার ছিল এশিয়ায় (Asia) দ্রুত-বর্ধনশীল অর্থনীতিগুলো।
কমোডিটি দামের পতনে (falling commodity prices) ব্রাজিল সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, কারণ ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে এশিয়ায় পণ্য পাঠানোর জন্য তাদের অতিরিক্ত খরচে পড়ে। ড্রেক প্যাসেজ (Drake Passage) পেরোনো বিশ্বের সবচেয়ে বিপজ্জনক সমুদ্রপথ; অন্যদিকে পানামা খাল (Panama Canal) দিয়ে পণ্য পাঠাতে টোল অনেক বেড়ে গেছে, বিশেষত সাম্প্রতিক জলসংকটের (water crisis) আগেও। উচ্চমূল্যের সময় এই বাড়তি খরচ চালানো সহজ হলেও, দাম পড়ে গেলে লাভের মার্জিন কমে গিয়ে ব্রাজিলের পণ্যে কাটছাঁট করা হয় সবার আগে।
এছাড়া ব্রাজিলের বিস্তৃত ভূখণ্ডও একটি বড় বাধা। অস্ট্রেলিয়া (Australia) বা কানাডা (Canada) বা রাশিয়ার (Russia) মতো মরুভূমি বা তুন্দ্রার মধ্যে দিয়ে সহজে রেলপথ বা সড়ক বানানো যায়, কিন্তু ঘন রেইনফরেস্টে (rainforest) একই পরিকাঠামো গড়া জটিল ও ব্যয়বহুল। আর যেখানেই এই কাজ শুরু করা হয়, সেখানেই আমাজন ধ্বংসের (deforestation) প্রতিবাদে বিশ্বব্যাপী সমালোচনা ওঠে। এমনকি ইউরোপীয় ইউনিয়ন (European Union) এই আমাজন ধ্বংস বেড়ে যাওয়ায় বাণিজ্য-চুক্তি (trade relations) স্থগিত করে রাখে।
মন্দা কাটাতে সরকারের তরফে সুদের হার (interest rates) কমানো এবং ব্যয় (spending) বাড়ানোর মতো সাধারণ উত্তেজক নীতি (stimulating policy) নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু মূল সমস্যা ছিল রফতানি-কেন্দ্রিক অর্থনীতির গঠনগত (structural) দুর্বলতা, যা শুধুমাত্র ভোক্তার আস্থা (consumer confidence) বাড়ালেই সমাধান হয় না। ফলে বিদেশি বিনিয়োগ (investment) কমতে থাকে, লোকাল শিল্পও (local industries) ভেঙে পড়ে, এবং দক্ষ জনবল (skilled employees) দেশত্যাগ করে।
ব্রাজিলিয়ান ডায়াসপোরা ও মেধাপ্রবাহ
এখন অনেকেই ‘ব্রাজিলিয়ান ডায়াসপোরা (Brazilian diaspora)’ বা মেধাপ্রবাহ (brain drain) নিয়ে কথা বলছেন। ব্রাজিলের গণমাধ্যম বলছে, শিক্ষা বা বিজ্ঞান গবেষণায় বিনিয়োগ কমে যাওয়ায় অনেক মেধাবী পেশাজীবী (highly qualified professionals) বিদেশে পাড়ি জমান। যুক্তরাষ্ট্রে (US) অনেকে গেলেও, সবচেয়ে বেশি ভিসা (visa) ইস্যু করেছে চীন (China)—যেখানে ব্রাজিলিয়ান অভিবাসী সংখ্যা ৩২১% বেড়েছে। প্যারাগুয়ে (Paraguay)-তেও অভিবাসন ১৭৫% বেড়েছে।
চীনে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিযোগিতামূলক প্রোগ্রাম (competitive university programs) ও কোম্পানির জন্য নানা করছাড় (tax cuts) আর সুযোগ-সুবিধা থাকায় ব্রাজিলের মেধাবীরা সেখানে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। ব্রাজিল তাদের ধরে রাখতে চাইলে একইরকম নীতি নিতে হবে, যা এখন পর্যন্ত তাদের পক্ষে খুব একটা কাজ করছে না। কর কমিয়ে (lower taxes) ও ব্যয় বাড়িয়ে (increased spending) সরকারের ঋণের বোঝা (debt) বেড়েছে। রিয়াল (Real) মুদ্রার মান পড়ে যাওয়ায় কর বাবদ আয় (taxation) দিয়ে সে ঋণ শোধ করাও কঠিন হয়ে পড়েছে।
বর্তমান সময় পর্যন্ত দেখা গেছে, সরকারের ব্যয় আয় বৃদ্ধির তুলনায় দ্রুত বাড়ছে—বিশেষত পেনশন সুবিধা (pension benefits) বৃদ্ধিতে। রাজস্ব ৯% বাড়লেও ব্যয় ১৪% বেড়েছে, ফলে বাজেট ঘাটতি (budget deficit) আরও বড় হচ্ছে। নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি (negative growth), সরকারি ব্যয় বৃদ্ধি, পণ্যমূল্য বৃদ্ধির চাপ (rising prices), মুদ্রার অবমূল্যায়ন (devaluing currency) এবং কর আদায়ের ঘাটতি (lower tax receipts)—সব মিলিয়ে একটি অস্থিতিশীল অর্থনৈতিক চিত্র তৈরির আশঙ্কা।
এই চিত্রের উজ্জ্বল উদাহরণ রিও অলিম্পিক (Rio Olympics)। কাগজে-কলমে এটি হয়তো কিছু সাফল্যের কথা বলবে, কিন্তু বাস্তবে অলিম্পিক ভেন্যু (venues) আর আশেপাশের বস্তির (slums) বৈপরীত্য আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে ফলাও করে এসেছে। আরও জানা যায়, জায়গা তৈরি করতে দরিদ্র পরিবারগুলিকে সেখান থেকে উচ্ছেদ (kicked out) করা হয়েছে, এবং তাদের বাড়ি ভেঙে সেখানে অলিম্পিকের বিভিন্ন আয়োজনের অবকাঠামো নির্মিত হয়েছে।
এটি ব্রাজিলের ক্রমাগত সংকটেরই প্রতিচ্ছবি—শক্ত জীবনযাত্রা (tough living conditions), দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনৈতিক অস্থিরতা, যার সাম্প্রতিকতম প্রমাণ শেষ নির্বাচনের পর ব্রাসিলিয়ায় (Brasilia) সহিংস বিক্ষোভ এবং লাগাতার দুর্নীতির কেলেঙ্কারি।
ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা: সাফল্য কি আবার আসবে?
রাজনৈতিক অস্থিরতা, বিনিয়োগকারীদের দেশত্যাগ, মেধাপ্রবাহ, রফতানি খাতে ধীরগতি, স্থানীয় শিল্পের পতন ইত্যাদি সত্ত্বেও ব্রাজিল কি আবার ২০০০-এর দশকের শুরুর সাফল্য ফিরে পেতে পারে? সংক্ষেপে বলতে গেলে—হ্যা, এটা সম্ভব।
অর্থনীতিবিদরা ভবিষ্যৎ নির্দিষ্টভাবে বলতে পারেন না, কিন্তু ব্রাজিলের এখনো বিশাল প্রাকৃতিক সম্পদ (resource abundance) রয়েছে। রফতানি খাতটা (export game) আবার চাঙ্গা হয়ে উঠতে পারে ভবিষ্যতে। দেশটি অন্যদের সঙ্গে মিলে ‘ব্রিকস (BRICS)’ গঠন করেছে— ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন, দক্ষিণ আফ্রিকা, ইরান, মিশর, ইথিওপিয়া ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের (UAE) সমন্বয়ে সমন্বয়ে গঠিত একটি আন্তসরকারি সংগঠন (intergovernmental organisation)।
কেউ কেউ মনে করতে পারেন, এটি ভুল সময়ে বিচ্ছিন্ন হওয়ার প্রয়াস, কিন্তু আবার এটিকে চীনের চোখে পছন্দের বাণিজ্য অংশীদার হওয়ার দরজাও খুলে দিতে পারে। চীন এখনো ব্রাজিলের সবচেয়ে বড় ক্রেতা (biggest customer)। তাছাড়া, ব্রিকসের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অন্য দেশগুলো, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রও, হয়তো ব্রাজিলের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রাখতে চাইবে, যাতে ডলারের (US dollar) আধিপত্য খুব ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। যুক্তরাষ্ট্র ভৌগোলিকভাবে ব্রাজিলের কাছাকাছি, এবং ভবিষ্যতে বড় ধরনের অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য প্রচুর কাঁচামালের দরকার হতে পারে।
মহামারির (pandemic) পর আবার অর্থনীতির চাকা ঘুরছে, যদিও ধীরগতিতে। তবে দ্রুত আকাশচুম্বী প্রবৃদ্ধি সব সময় ইতিবাচক নয়; বরং স্থিতিশীল (stable) ও ধীর গতির উন্নয়ন অনেক ক্ষেত্রে ভালো।
উপসংহার
ব্রাজিল এক দশকের বেশি সময় ধরে রাজনৈতিক প্রতারণা এবং অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনার ধাক্কা খাচ্ছে। ব্রাজিল প্রাকৃতিক সম্পদে পরিপূর্ণ একটি দেশ, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নে তাদের অসুবিধা হচ্ছে। প্রচুর মানুষ দেশ ছাড়ছেন, কারণ তারা স্থানীয় ব্যবস্থায় আস্থা রাখতে পারছেন না।
তবে রাজনীতি পরিস্থিতির সঙ্গে বদলায়। ব্রাজিল যদি সত্যিকার অর্থেই দেশীয় স্থিতিশীলতা ও আস্থা পুনর্গঠনে কাজ করে, তাহলে দেশের প্রকৃত সম্ভাবনা বাস্তবায়িত হতে পারে। ব্রিকসের কৌশল (BRICS strategy) যদি সতর্কতার সঙ্গে নেওয়া হয়, রফতানি ক্ষেত্র আবারও শক্তিশালী হতে পারে, এবং সেটা ইতিমধ্যে ফিরে আসার লক্ষণও দেখাচ্ছে।
যেখানে মেধাপ্রবাহ (brain drain) বিপত্তি সৃষ্টি করছে, সেখানে হয়তো অনেকে বলবেন তারা অন্য দেশে চলে যাবেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত “নিজের বাড়ির মতো” আর কিছু নেই। নিরাপত্তা (safety measures), অবকাঠামো (infrastructure), আবাসন (housing) ইত্যাদিতে সরকার পর্যাপ্ত উদ্যোগ নিলে, দেশটি এমন এক পরিবেশ গড়ে তুলতে পারে যেখানে মেধাবীরা ফিরে আসতে চাইবেন।
ব্রাজিল এর আগেও বহুবার উত্থান-পতনের চক্র দেখেছে। অতীতে অনেকবার একইরকম হয়েছে মানেই ভবিষ্যতেও যে তাই হবে—তার কোনও নিশ্চয়তা নেই। আবার এটি পুরোপুরি আলাদা পথ বেছে নেবে—তারও নিশ্চয়তা নেই। সবকিছু নির্ভর করছে কীভাবে দেশটি নিজেদের ভিত গড়ে তুলবে, স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করবে এবং বৈশ্বিক বাণিজ্যে নিজের অবস্থান মজবুত করবে।
Leave a Reply