Table of Contents
ভূমিকা
সোমালিয়া (Somalia) আন্তর্জাতিক অঙ্গনে খুব একটা ভালো সুনাম উপভোগ করে না। এটি বিশ্বের অন্যতম দরিদ্র ও সহিংস দেশগুলোর মধ্যে একটি, এবং ১৯৯১ সালে স্বৈরশাসক সিয়াদ বারে (Siad Barre) সরকারের পতনের পর থেকে দেশটি ক্রমাগত সংকটে ডুবে আছে। কিন্তু এই অস্থির দেশটির উত্তর-পশ্চিম প্রান্তে এমন একটি অঞ্চল রয়েছে, যেখানে প্রকৃতপক্ষে একটি কার্যকরী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বিদ্যমান। এই অঞ্চলটি সোমালিল্যান্ড (Somaliland), যা বিগত ৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে প্রকৃতপক্ষে স্বাধীনভাবে পরিচালিত হচ্ছে এবং মাত্র গত মাসেই সেখানে শান্তিপূর্ণভাবে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে।
তারপরও, এত প্রচেষ্টা সত্ত্বেও সোমালিল্যান্ডকে এখনো কোনো জাতিসংঘ (UN) সদস্য রাষ্ট্র স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি। কিন্তু শীঘ্রই এই পরিস্থিতি বদলে যেতে পারে। সম্প্রতি খবর পাওয়া গেছে যে ডোনাল্ড ট্রাম্প (Donald Trump) যুক্তরাষ্ট্রকে (US) প্রথম দেশ হিসেবে সোমালিল্যান্ডকে স্বীকৃতি দিতে পারেন। এই প্রবন্ধে সংক্ষেপে সোমালিল্যান্ডের ইতিহাস, ট্রাম্প কেন এটিকে স্বীকৃতি দিতে চান, এবং সেটি আদৌ একটি ভালো পদক্ষেপ হবে কিনা—তা বিশ্লেষণ করা হবে।
সোমালিল্যান্ডের (Somaliland) সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
সোমালিল্যান্ডের গল্প বুঝতে হলে কিছু প্রেক্ষাপট জানা দরকার। সংক্ষেপে বললে, আজকের সোমালিয়া (Somalia) এক সময় মূলত দুটি উপনিবেশিক অঞ্চলে বিভক্ত ছিল—পূর্ব দিকে ছিল ইটালিয়ান সোমালিল্যান্ড (Italian Somaliland) এবং উত্তর-পশ্চিমে ছিল ব্রিটিশ সোমালিল্যান্ড (British Somaliland)।
১৯৬০ সালে ব্রিটিশ সোমালিল্যান্ড (British Somaliland) পাঁচদিনের জন্য একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতিও পেয়েছিল, সেই সময়ে ৩৫টি জাতিসংঘ সদস্য রাষ্ট্র এটিকে স্বীকৃতি দেয়। কিন্তু মাত্র পাঁচ দিন পর, ইতালি (Italy) তাদের সোমালিল্যান্ড উপনিবেশ ছেড়ে দিলে ব্রিটিশ সোমালিল্যান্ড ও ইটালিয়ান সোমালিল্যান্ড একত্র হয়ে সোমালি রিপাবলিক (Somali Republic) গঠন করে, যাকে এখন আমরা সোমালিয়া নামে জানি।
পরে দেখা গেল, ব্রিটিশ সোমালিল্যান্ডের দৃষ্টিকোণ থেকে এটি সম্ভবত একটি ভুল পদক্ষেপ ছিল। কারণ ইটালিয়ান সোমালিল্যান্ডের জনসংখ্যা ব্রিটিশ সোমালিল্যান্ডের তুলনায় প্রায় আট গুণ বেশি ছিল, এবং এই নতুন যুক্তরাষ্ট্রে উত্তরের অংশটি (অর্থাৎ সাবেক ব্রিটিশ সোমালিল্যান্ড) প্রায়শই উপেক্ষিত হত। উদাহরণস্বরূপ, সোমালিয়ার প্রথম সংবিধান মূলত দক্ষিণের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করে পাস হয়েছিল।
সোমালিল্যান্ডের স্বাধীনভাবে প্রতিষ্ঠার সুযোগ আসে ১৯৯১ সালে, যখন স্বৈরশাসক সিয়াদ বারে (Siad Barre) বিরোধী গোষ্ঠীগুলোর হাতে ক্ষমতা হারান। এই বিরোধীদের মধ্যে ছিল সোমালি ন্যাশনাল মুভমেন্ট (Somali National Movement – SNM), যারা ছিল উত্তরাঞ্চলের একটি সশস্ত্র গোষ্ঠী। তারা বারে সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর ১৯৯১ সালে ব্রিটিশ সোমালিল্যান্ডের সাবেক সীমানা অনুযায়ী সোমালিল্যান্ডকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করে।
২০০১ সালে একটি গণভোট অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে ৯৭% সোমালিল্যান্ডবাসী স্বাধীনতার পক্ষে ভোট দেয়। সেই থেকে সোমালিল্যান্ড মূলত সোমালিয়ার বাইরে স্বশাসিত একটি রাষ্ট্র হিসেবে পরিচালিত হয়ে আসছে, যা অস্থির অঞ্চলে স্থিতিশীলতার এক নিদর্শন। সেখানে একাধিকবার শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। ২০১৭ সালে ফ্রিডম হাউস (Freedom House) সোমালিল্যান্ডকে পূর্ব আফ্রিকায় একমাত্র “স্বাধীন” (free) রাষ্ট্র হিসেবে রেটিং দিয়েছিল।
যদিও দেশটি খুবই দরিদ্র, তবে তাদের নিজস্ব সরকার, মুদ্রা, পাসপোর্ট, পুলিশ বাহিনী, গাড়ির লাইসেন্স প্লেট এবং এমনকি ওয়াশিংটনে (Washington) একটি কনস্যুলেটও আছে। তবু কোনো দেশ সরাসরি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে তাদের স্বীকৃতি দেয়নি। যদিও কিছু পরোক্ষ স্বীকৃতি এসেছে—দক্ষিণ আফ্রিকা (South Africa) সোমালিল্যান্ডের পাসপোর্ট গ্রহণ করে, সংযুক্ত আরব আমিরাত (UAE) ২০১৭ সালে সেখানে সামান্য সামরিক উপস্থিতি স্থাপন করেছে, এবং ইথিওপিয়া (Ethiopia) চলতি বছরের শুরুর দিকে সোমালিল্যান্ড সরকারের সঙ্গে বার্বেরা বন্দর (Berbera Port) ব্যবহারের জন্য একটি চুক্তিও স্বাক্ষর করেছে।
সোমালিল্যান্ডকে স্বীকৃতি দেওয়ার আন্তর্জাতিক আগ্রহ
সোমালিল্যান্ডের সম্ভাব্য স্বাধীনতা স্বীকৃতির বিষয়টি যুক্তরাজ্য (UK) ও যুক্তরাষ্ট্রে (US) বেশ কিছুদিন ধরেই আলোচনা হচ্ছে। যুক্তরাজ্যে ব্রিস্টল (Bristol), শেফিল্ড (Sheffield), কার্ডিফ (Cardiff), লিভারপুল (Liverpool) এবং টাওয়ার হ্যামলেটস (Tower Hamlets) নামের পাঁচটি স্থানীয় কাউন্সিল কোনো এক অদ্ভুত কারণে সোমালিল্যান্ডের স্বাধীনতার অধিকারের স্বীকৃতি সংক্রান্ত প্রস্তাব পাস করেছে।
ডানপন্থী (the right) মহলের মধ্যে বিষয়টি বেশ জনপ্রিয়। নাইজেল ফারাজের (Nigel Farage) ইউকিপ (UKIP) নীতিমালার মধ্যে সোমালিল্যান্ডকে স্বীকৃতি দেওয়ার কথা অন্তর্ভুক্ত ছিল। অন্যদিকে যুক্তরাজ্যের সাবেক প্রতিরক্ষা সচিব গেভিন উইলিয়ামসনও (Gavin Williamson) (তেরেসা মে’র (Theresa May) প্রতিরক্ষা সচিব ছিলেন) এই বিষয়ে সোচ্চার ছিলেন। উইলিয়ামসন রাশিয়াকে (Russia) একসময় “চলে যেতে এবং চুপ থাকার” কথা বলেছিলেন এবং জিব্রাল্টারের (Gibraltar) উপকূলে স্প্যানিশ জাহাজ লক্ষ্য করে পেইন্টবল ছোড়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। এরকম কাজের জন্যই তিনি পরিচিত।
তিনি ২০১৮ সালে যুক্তরাজ্যকে সোমালিল্যান্ডের রাজধানী হারগেইসা (Hargeisa)-তে একটি অফিস খুলতে উদ্বুদ্ধ করেন, এবং ২০১৯ সালে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে সোমালিল্যান্ডকে দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রস্তাবও দেন। তার প্রচেষ্টার স্বীকৃতি হিসেবে তিনি সোমালিল্যান্ডের সম্মানসূচক নাগরিকত্বও পেয়েছেন।
যুক্তরাষ্ট্রে (US) বিষয়টি আবার সামনে আসে ২০২৩ সালের শুরুর দিকে, যখন হাউস ডেমোক্র্যাট (House Democrat) ইলহান ওমর (Ilhan Omar) (যিনি মার্কিন কংগ্রেসের অন্যতম প্রগতিশীল ডেমোক্র্যাট এবং তথাকথিত “স্কোয়াড” (the squad)-এর সদস্য হিসেবে পরিচিত) ইথিওপিয়া (Ethiopia) ও সোমালিয়ার (Somalia) মধ্যে বন্দর চুক্তির সমালোচনা করে বক্তব্য রাখেন। জাতিগতভাবে সোমালি ওমর এক বক্তব্যে বলেন যে, যতদিন তিনি কংগ্রেসে থাকবেন, ততদিন সোমালিয়ার সাগর এলাকার ওপর অন্য কোনো দেশ দখল নিতে পারবে না, এবং যুক্তরাষ্ট্রও (US) সেই কাজে কাউকে সমর্থন করবে না।
কেন ট্রাম্প (Trump) সোমালিল্যান্ডকে স্বীকৃতি দিতে চান?
সম্প্রতি সংবাদমাধ্যম সেমাফোর (Semaphore) জানিয়েছে, ট্রাম্প আবার ক্ষমতায় ফিরলে সোমালিল্যান্ডকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিতে পারেন। কেন হঠাৎ ট্রাম্প এটি করতে চাইছেন?
- প্রথমত, এটি হতে পারে এমন কিছু ব্যক্তিকে বিরক্ত করার উদ্দেশ্যে, যেমন ইলহান ওমরের মত ডেমোক্র্যাট নেতারা। এছাড়াও এটি বাইডেন (Biden) প্রশাসনের প্রতি একপ্রকার কটাক্ষ হতে পারে, কারণ বাইডেন প্রশাসন ট্রাম্পের সময় নেওয়া সোমালিয়া থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত বাতিল করেছে। এ ছাড়া উল্লিখিত গেভিন উইলিয়ামসনও দাবি করেছেন তিনি ট্রাম্পকে এটি করতে রাজি করিয়েছেন।
- আরেকটি কারণ হতে পারে সংযুক্ত আরব আমিরাত (UAE)-এর লবিং। গত কয়েক বছরে মার্কিন-আমিরাত সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হয়েছে, এবং আমিরাতের সাথে সোমালিল্যান্ডেরও তুলনামূলকভাবে ভালো সম্পর্ক আছে।
- তবে মূল এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণ সম্ভবত সোমালিল্যান্ডের কৌশলগত অবস্থান। সোমালিল্যান্ড উত্তর-পশ্চিম আফ্রিকায় লোহিত সাগরের (Red Sea) ঠিক দক্ষিণে এবং এডেন উপসাগরের (Gulf of Aden) কাছাকাছি, ইয়েমেনের (Yemen) বিপরীত তীরে অবস্থিত। লোহিত সাগর একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক বাণিজ্যপথ, যা বিশ্ব বাণিজ্যের উল্লেখযোগ্য শতাংশের জন্য দায়ী। গত এক বছরে ইয়েমেনের হুথি (Houthis) বিদ্রোহীরা এই অঞ্চলে বাণিজ্যিক জাহাজগুলোর উপর আক্রমণ চালিয়েছে, ফলে জাহাজ চলাচল ব্যাহত হয়েছে। সোমালিল্যান্ডে মার্কিন উপস্থিতি থাকলে যুক্তরাষ্ট্র সেখানে হুথি সহ অন্যান্য গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে পারবে, যার ফলে বাণিজ্যিক জাহাজ চলাচল নিরাপদ হবে।
সোমালিল্যান্ডকে স্বীকৃতি দিলে যুক্তরাষ্ট্র-ইথিওপিয়া সম্পর্কের উন্নতি ঘটতে পারে। ইথিওপিয়া সোমালিল্যান্ডের বন্দর ব্যবহার করতে চায়, এবং ইথিওপিয়া আফ্রিকা ও পূর্ব আফ্রিকার কূটনীতি ও স্থিতিশীলতার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। তাই এ অঞ্চলে মার্কিন প্রভাব বিস্তারের জন্য সোমালিল্যান্ডকে স্বীকৃতি একটি কৌশলগত পদক্ষেপ হতে পারে।
স্বীকৃতির কূটনৈতিক প্রভাব
যদিও কৌশলগত দিক থেকে সোমালিল্যান্ডকে স্বীকৃতি যুক্তরাষ্ট্রের জন্য লাভজনক হতে পারে এবং সোমালিল্যান্ড দীর্ঘদিন যাবৎ কার্যত স্বাধীন রাষ্ট্রের মতোই পরিচালিত হচ্ছে, তবু আফ্রিকান ইউনিয়ন (African Union) বা এ ধরনের আঞ্চলিক জোটগুলো সাধারণত এই ধরনের সীমান্ত পুনর্বিন্যাসকে (redrawing borders) সমর্থন করে না। কারণ, আফ্রিকার বর্তমান সীমানাগুলো নিখুঁত নয়, কিন্তু সীমানা পরিবর্তন করার প্রক্রিয়া সাধারণত আরো বেশি অস্থিরতা সৃষ্টি করে।
এ ক্ষেত্রে কেউ বলতে পারে, সোমালিল্যান্ড একটি ব্যতিক্রম। কেননা তারা ৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে স্বাধীনভাবে টিকে আছে, এবং তাদের স্বাধীনতার ফলে সৃষ্ট অস্থিরতার সম্ভাবনা বেশ নগণ্য। কিন্তু সোমালিয়ার (Somalia) মধ্যেই অন্য কিছু স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল রয়েছে যা এই স্বীকৃতি দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে নিজেদের স্বাধীনতার দাবি জোরদার করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, কিছু মাস আগে পুন্টল্যান্ড (Puntland) নামে আরেকটি স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলও একটি বিতর্কিত সাংবিধানিক সংশোধনী প্রসঙ্গে সোমালি সরকারের বিরোধিতায় স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছে।
ঝুঁকি ও উদ্বেগ
ট্রাম্পের সোমালিল্যান্ডকে স্বীকৃতি দেওয়া উচিৎ নয় সেটা বলছি না। তবে এটি ইতোমধ্যে অস্থিতিশীল অঞ্চলে আরও অস্থিরতা তৈরি করতে পারে। সম্ভবত এটি আঞ্চলিক গোষ্ঠীগুলোর (যেমন আফ্রিকান ইউনিয়ন) সাথে সমন্বয় করে করা উচিত, যাতে অপ্রত্যাশিত অশান্তি কমিয়ে আনা যায়।
সর্বোপরি, সোমালিল্যান্ডের স্বীকৃতি আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে একটি জটিল বিষয়। এটি একদিকে মার্কিন কৌশলগত অবস্থানকে শক্তিশালী করতে পারে, অন্যদিকে আফ্রিকান অঞ্চলে আরও অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করতে পারে। এর চূড়ান্ত পরিণতি কী হবে, তা সময়ই বলে দেবে।
যুক্তরাষ্ট্র নিয়ে অন্যান্য সংবাদ ও বিশ্লেষণ পড়তে যান এখানে
Leave a Reply