বৃহস্পতিবার, বিদায়ী মার্কিন প্রেসিডেন্ট (outgoing US President) জো বাইডেন প্রায় ১,৫০০ জনের সাজা লঘু (commute) করেছেন এবং আরও ৩৯ জনকে পূর্ণ ক্ষমা (pardon) দিয়েছেন। এটিই আধুনিক আমেরিকার ইতিহাসে এক দিনে সর্বোচ্চ সংখ্যক ক্ষমা প্রদান। বাইডেন বলেন, তিনি দয়া (mercy) দেখিয়েছেন তাদের প্রতি যারা অনুশোচনা ও সংশোধনের প্রক্রিয়ায় এগিয়ে গেছে। হোয়াইট হাউস (White House) জানিয়েছে, ৩৯ জন যাদের ক্ষমা করা হয়েছে তারা সবাই সহিংস নয় এমন অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়েছিল। আর দেড় হাজার যাদের সাজা লঘু করা হয়েছে, তারা COVID-19 মহামারির (COVID 19 pandemic) সময় গৃহবন্দিত্ব (home confinement) অবস্থায় ছিল এবং সফলভাবে তাদের পরিবার ও সম্প্রদায়ে পুনঃএকীভূত হয়েছে।
মার্কিন প্রেসিডেন্টদের কাছে ক্ষমা বা সাজার লাঘব করার (commutation) ক্ষমতা থাকে। ক্ষমা (pardon) মানে দোষ ও শাস্তি থেকে পুরো মুক্তি দেওয়া, আর সাজার লাঘব (commute) মানে শাস্তির মেয়াদ কমানো বা বিলুপ্ত করা, তবে অপরাধের অভিযোগ থেকে মুক্তি দেওয়া নয়। সাধারণত বিদায়ী প্রেসিডেন্টরা তাদের মেয়াদের শেষ দিকে এই ক্ষমা প্রদান করেন। তবে চলতি মাসের শুরুর দিকে প্রেসিডেন্ট বাইডেন তার ছেলে হান্টার বাইডেন (Hunter Biden)-কে ক্ষমা করায় (যিনি অস্ত্র ও কর সংক্রান্ত অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়েছিলেন) সমালোচনার মুখে পড়েন।
অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস (Associated Press) জানিয়েছে, বাইডেন বিভিন্ন পক্ষের চাপের মুখে আছেন, যাতে তিনি ডোনাল্ড ট্রাম্প (Donald Trump) জানুয়ারিতে ক্ষমতা নেওয়ার আগে ফেডারেল ডেথ রো (federal death row) সহ বহু ব্যক্তিকে ক্ষমা করে দেন।
সূত্র –
- https://apnews.com/article/biden-pardons-clemency-4432002d67334e6716c2776fd73f3cc8
- https://www.bbc.co.uk/news/articles/c30nq7r0v2mo
- https://www.whitehouse.gov/briefing-room/statements-releases/2024/12/12/fact-sheet-president-biden-announces-clemency-for-nearly-1500-americans/
ট্রাম্প কি সোমালিল্যান্ডকে (Somaliland) স্বীকৃতি দেবেন? (১৩ ডিসেম্বর, ২০২৪)
ভূমিকা
সোমালিয়া (Somalia) আন্তর্জাতিক অঙ্গনে খুব একটা ভালো সুনাম উপভোগ করে না। এটি বিশ্বের অন্যতম দরিদ্র ও সহিংস দেশগুলোর মধ্যে একটি, এবং ১৯৯১ সালে স্বৈরশাসক সিয়াদ বারে (Siad Barre) সরকারের পতনের পর থেকে দেশটি ক্রমাগত সংকটে ডুবে আছে। কিন্তু এই অস্থির দেশটির উত্তর-পশ্চিম প্রান্তে এমন একটি অঞ্চল রয়েছে, যেখানে প্রকৃতপক্ষে একটি কার্যকরী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বিদ্যমান। এই অঞ্চলটি সোমালিল্যান্ড (Somaliland), যা বিগত ৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে প্রকৃতপক্ষে স্বাধীনভাবে পরিচালিত হচ্ছে এবং মাত্র গত মাসেই সেখানে শান্তিপূর্ণভাবে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে।
তারপরও, এত প্রচেষ্টা সত্ত্বেও সোমালিল্যান্ডকে এখনো কোনো জাতিসংঘ (UN) সদস্য রাষ্ট্র স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি। কিন্তু শীঘ্রই এই পরিস্থিতি বদলে যেতে পারে। সম্প্রতি খবর পাওয়া গেছে যে ডোনাল্ড ট্রাম্প (Donald Trump) যুক্তরাষ্ট্রকে (US) প্রথম দেশ হিসেবে সোমালিল্যান্ডকে স্বীকৃতি দিতে পারেন। এই প্রবন্ধে সংক্ষেপে সোমালিল্যান্ডের ইতিহাস, ট্রাম্প কেন এটিকে স্বীকৃতি দিতে চান, এবং সেটি আদৌ একটি ভালো পদক্ষেপ হবে কিনা—তা বিশ্লেষণ করা হবে।
সোমালিল্যান্ডের (Somaliland) সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
সোমালিল্যান্ডের গল্প বুঝতে হলে কিছু প্রেক্ষাপট জানা দরকার। সংক্ষেপে বললে, আজকের সোমালিয়া (Somalia) এক সময় মূলত দুটি উপনিবেশিক অঞ্চলে বিভক্ত ছিল—পূর্ব দিকে ছিল ইটালিয়ান সোমালিল্যান্ড (Italian Somaliland) এবং উত্তর-পশ্চিমে ছিল ব্রিটিশ সোমালিল্যান্ড (British Somaliland)।
১৯৬০ সালে ব্রিটিশ সোমালিল্যান্ড (British Somaliland) পাঁচদিনের জন্য একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতিও পেয়েছিল, সেই সময়ে ৩৫টি জাতিসংঘ সদস্য রাষ্ট্র এটিকে স্বীকৃতি দেয়। কিন্তু মাত্র পাঁচ দিন পর, ইতালি (Italy) তাদের সোমালিল্যান্ড উপনিবেশ ছেড়ে দিলে ব্রিটিশ সোমালিল্যান্ড ও ইটালিয়ান সোমালিল্যান্ড একত্র হয়ে সোমালি রিপাবলিক (Somali Republic) গঠন করে, যাকে এখন আমরা সোমালিয়া নামে জানি।
পরে দেখা গেল, ব্রিটিশ সোমালিল্যান্ডের দৃষ্টিকোণ থেকে এটি সম্ভবত একটি ভুল পদক্ষেপ ছিল। কারণ ইটালিয়ান সোমালিল্যান্ডের জনসংখ্যা ব্রিটিশ সোমালিল্যান্ডের তুলনায় প্রায় আট গুণ বেশি ছিল, এবং এই নতুন যুক্তরাষ্ট্রে উত্তরের অংশটি (অর্থাৎ সাবেক ব্রিটিশ সোমালিল্যান্ড) প্রায়শই উপেক্ষিত হত। উদাহরণস্বরূপ, সোমালিয়ার প্রথম সংবিধান মূলত দক্ষিণের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করে পাস হয়েছিল।
সোমালিল্যান্ডের স্বাধীনভাবে প্রতিষ্ঠার সুযোগ আসে ১৯৯১ সালে, যখন স্বৈরশাসক সিয়াদ বারে (Siad Barre) বিরোধী গোষ্ঠীগুলোর হাতে ক্ষমতা হারান। এই বিরোধীদের মধ্যে ছিল সোমালি ন্যাশনাল মুভমেন্ট (Somali National Movement – SNM), যারা ছিল উত্তরাঞ্চলের একটি সশস্ত্র গোষ্ঠী। তারা বারে সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর ১৯৯১ সালে ব্রিটিশ সোমালিল্যান্ডের সাবেক সীমানা অনুযায়ী সোমালিল্যান্ডকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করে।
২০০১ সালে একটি গণভোট অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে ৯৭% সোমালিল্যান্ডবাসী স্বাধীনতার পক্ষে ভোট দেয়। সেই থেকে সোমালিল্যান্ড মূলত সোমালিয়ার বাইরে স্বশাসিত একটি রাষ্ট্র হিসেবে পরিচালিত হয়ে আসছে, যা অস্থির অঞ্চলে স্থিতিশীলতার এক নিদর্শন। সেখানে একাধিকবার শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। ২০১৭ সালে ফ্রিডম হাউস (Freedom House) সোমালিল্যান্ডকে পূর্ব আফ্রিকায় একমাত্র “স্বাধীন” (free) রাষ্ট্র হিসেবে রেটিং দিয়েছিল।
যদিও দেশটি খুবই দরিদ্র, তবে তাদের নিজস্ব সরকার, মুদ্রা, পাসপোর্ট, পুলিশ বাহিনী, গাড়ির লাইসেন্স প্লেট এবং এমনকি ওয়াশিংটনে (Washington) একটি কনস্যুলেটও আছে। তবু কোনো দেশ সরাসরি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে তাদের স্বীকৃতি দেয়নি। যদিও কিছু পরোক্ষ স্বীকৃতি এসেছে—দক্ষিণ আফ্রিকা (South Africa) সোমালিল্যান্ডের পাসপোর্ট গ্রহণ করে, সংযুক্ত আরব আমিরাত (UAE) ২০১৭ সালে সেখানে সামান্য সামরিক উপস্থিতি স্থাপন করেছে, এবং ইথিওপিয়া (Ethiopia) চলতি বছরের শুরুর দিকে সোমালিল্যান্ড সরকারের সঙ্গে বার্বেরা বন্দর (Berbera Port) ব্যবহারের জন্য একটি চুক্তিও স্বাক্ষর করেছে।
সোমালিল্যান্ডকে স্বীকৃতি দেওয়ার আন্তর্জাতিক আগ্রহ
সোমালিল্যান্ডের সম্ভাব্য স্বাধীনতা স্বীকৃতির বিষয়টি যুক্তরাজ্য (UK) ও যুক্তরাষ্ট্রে (US) বেশ কিছুদিন ধরেই আলোচনা হচ্ছে। যুক্তরাজ্যে ব্রিস্টল (Bristol), শেফিল্ড (Sheffield), কার্ডিফ (Cardiff), লিভারপুল (Liverpool) এবং টাওয়ার হ্যামলেটস (Tower Hamlets) নামের পাঁচটি স্থানীয় কাউন্সিল কোনো এক অদ্ভুত কারণে সোমালিল্যান্ডের স্বাধীনতার অধিকারের স্বীকৃতি সংক্রান্ত প্রস্তাব পাস করেছে।
ডানপন্থী (the right) মহলের মধ্যে বিষয়টি বেশ জনপ্রিয়। নাইজেল ফারাজের (Nigel Farage) ইউকিপ (UKIP) নীতিমালার মধ্যে সোমালিল্যান্ডকে স্বীকৃতি দেওয়ার কথা অন্তর্ভুক্ত ছিল। অন্যদিকে যুক্তরাজ্যের সাবেক প্রতিরক্ষা সচিব গেভিন উইলিয়ামসনও (Gavin Williamson) (তেরেসা মে’র (Theresa May) প্রতিরক্ষা সচিব ছিলেন) এই বিষয়ে সোচ্চার ছিলেন। উইলিয়ামসন রাশিয়াকে (Russia) একসময় “চলে যেতে এবং চুপ থাকার” কথা বলেছিলেন এবং জিব্রাল্টারের (Gibraltar) উপকূলে স্প্যানিশ জাহাজ লক্ষ্য করে পেইন্টবল ছোড়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। এরকম কাজের জন্যই তিনি পরিচিত।
তিনি ২০১৮ সালে যুক্তরাজ্যকে সোমালিল্যান্ডের রাজধানী হারগেইসা (Hargeisa)-তে একটি অফিস খুলতে উদ্বুদ্ধ করেন, এবং ২০১৯ সালে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে সোমালিল্যান্ডকে দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রস্তাবও দেন। তার প্রচেষ্টার স্বীকৃতি হিসেবে তিনি সোমালিল্যান্ডের সম্মানসূচক নাগরিকত্বও পেয়েছেন।
যুক্তরাষ্ট্রে (US) বিষয়টি আবার সামনে আসে ২০২৩ সালের শুরুর দিকে, যখন হাউস ডেমোক্র্যাট (House Democrat) ইলহান ওমর (Ilhan Omar) (যিনি মার্কিন কংগ্রেসের অন্যতম প্রগতিশীল ডেমোক্র্যাট এবং তথাকথিত “স্কোয়াড” (the squad)-এর সদস্য হিসেবে পরিচিত) ইথিওপিয়া (Ethiopia) ও সোমালিয়ার (Somalia) মধ্যে বন্দর চুক্তির সমালোচনা করে বক্তব্য রাখেন। জাতিগতভাবে সোমালি ওমর এক বক্তব্যে বলেন যে, যতদিন তিনি কংগ্রেসে থাকবেন, ততদিন সোমালিয়ার সাগর এলাকার ওপর অন্য কোনো দেশ দখল নিতে পারবে না, এবং যুক্তরাষ্ট্রও (US) সেই কাজে কাউকে সমর্থন করবে না।
কেন ট্রাম্প (Trump) সোমালিল্যান্ডকে স্বীকৃতি দিতে চান?
সম্প্রতি সংবাদমাধ্যম সেমাফোর (Semaphore) জানিয়েছে, ট্রাম্প আবার ক্ষমতায় ফিরলে সোমালিল্যান্ডকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিতে পারেন। কেন হঠাৎ ট্রাম্প এটি করতে চাইছেন?
- প্রথমত, এটি হতে পারে এমন কিছু ব্যক্তিকে বিরক্ত করার উদ্দেশ্যে, যেমন ইলহান ওমরের মত ডেমোক্র্যাট নেতারা। এছাড়াও এটি বাইডেন (Biden) প্রশাসনের প্রতি একপ্রকার কটাক্ষ হতে পারে, কারণ বাইডেন প্রশাসন ট্রাম্পের সময় নেওয়া সোমালিয়া থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত বাতিল করেছে। এ ছাড়া উল্লিখিত গেভিন উইলিয়ামসনও দাবি করেছেন তিনি ট্রাম্পকে এটি করতে রাজি করিয়েছেন।
- আরেকটি কারণ হতে পারে সংযুক্ত আরব আমিরাত (UAE)-এর লবিং। গত কয়েক বছরে মার্কিন-আমিরাত সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হয়েছে, এবং আমিরাতের সাথে সোমালিল্যান্ডেরও তুলনামূলকভাবে ভালো সম্পর্ক আছে।
- তবে মূল এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণ সম্ভবত সোমালিল্যান্ডের কৌশলগত অবস্থান। সোমালিল্যান্ড উত্তর-পশ্চিম আফ্রিকায় লোহিত সাগরের (Red Sea) ঠিক দক্ষিণে এবং এডেন উপসাগরের (Gulf of Aden) কাছাকাছি, ইয়েমেনের (Yemen) বিপরীত তীরে অবস্থিত। লোহিত সাগর একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক বাণিজ্যপথ, যা বিশ্ব বাণিজ্যের উল্লেখযোগ্য শতাংশের জন্য দায়ী। গত এক বছরে ইয়েমেনের হুথি (Houthis) বিদ্রোহীরা এই অঞ্চলে বাণিজ্যিক জাহাজগুলোর উপর আক্রমণ চালিয়েছে, ফলে জাহাজ চলাচল ব্যাহত হয়েছে। সোমালিল্যান্ডে মার্কিন উপস্থিতি থাকলে যুক্তরাষ্ট্র সেখানে হুথি সহ অন্যান্য গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে পারবে, যার ফলে বাণিজ্যিক জাহাজ চলাচল নিরাপদ হবে।
সোমালিল্যান্ডকে স্বীকৃতি দিলে যুক্তরাষ্ট্র-ইথিওপিয়া সম্পর্কের উন্নতি ঘটতে পারে। ইথিওপিয়া সোমালিল্যান্ডের বন্দর ব্যবহার করতে চায়, এবং ইথিওপিয়া আফ্রিকা ও পূর্ব আফ্রিকার কূটনীতি ও স্থিতিশীলতার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। তাই এ অঞ্চলে মার্কিন প্রভাব বিস্তারের জন্য সোমালিল্যান্ডকে স্বীকৃতি একটি কৌশলগত পদক্ষেপ হতে পারে।
স্বীকৃতির কূটনৈতিক প্রভাব
যদিও কৌশলগত দিক থেকে সোমালিল্যান্ডকে স্বীকৃতি যুক্তরাষ্ট্রের জন্য লাভজনক হতে পারে এবং সোমালিল্যান্ড দীর্ঘদিন যাবৎ কার্যত স্বাধীন রাষ্ট্রের মতোই পরিচালিত হচ্ছে, তবু আফ্রিকান ইউনিয়ন (African Union) বা এ ধরনের আঞ্চলিক জোটগুলো সাধারণত এই ধরনের সীমান্ত পুনর্বিন্যাসকে (redrawing borders) সমর্থন করে না। কারণ, আফ্রিকার বর্তমান সীমানাগুলো নিখুঁত নয়, কিন্তু সীমানা পরিবর্তন করার প্রক্রিয়া সাধারণত আরো বেশি অস্থিরতা সৃষ্টি করে।
এ ক্ষেত্রে কেউ বলতে পারে, সোমালিল্যান্ড একটি ব্যতিক্রম। কেননা তারা ৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে স্বাধীনভাবে টিকে আছে, এবং তাদের স্বাধীনতার ফলে সৃষ্ট অস্থিরতার সম্ভাবনা বেশ নগণ্য। কিন্তু সোমালিয়ার (Somalia) মধ্যেই অন্য কিছু স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল রয়েছে যা এই স্বীকৃতি দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে নিজেদের স্বাধীনতার দাবি জোরদার করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, কিছু মাস আগে পুন্টল্যান্ড (Puntland) নামে আরেকটি স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলও একটি বিতর্কিত সাংবিধানিক সংশোধনী প্রসঙ্গে সোমালি সরকারের বিরোধিতায় স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছে।
ঝুঁকি ও উদ্বেগ
ট্রাম্পের সোমালিল্যান্ডকে স্বীকৃতি দেওয়া উচিৎ নয় সেটা বলছি না। তবে এটি ইতোমধ্যে অস্থিতিশীল অঞ্চলে আরও অস্থিরতা তৈরি করতে পারে। সম্ভবত এটি আঞ্চলিক গোষ্ঠীগুলোর (যেমন আফ্রিকান ইউনিয়ন) সাথে সমন্বয় করে করা উচিত, যাতে অপ্রত্যাশিত অশান্তি কমিয়ে আনা যায়।
সর্বোপরি, সোমালিল্যান্ডের স্বীকৃতি আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে একটি জটিল বিষয়। এটি একদিকে মার্কিন কৌশলগত অবস্থানকে শক্তিশালী করতে পারে, অন্যদিকে আফ্রিকান অঞ্চলে আরও অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করতে পারে। এর চূড়ান্ত পরিণতি কী হবে, তা সময়ই বলে দেবে।
ডেমোক্র্যাটদের বিতর্ক: নিয়ম মেনে খেলা নাকি কৌশল বদলানো? (১৩ ডিসেম্বর, ২০২৪)
এই মাসের বড় খবর হল প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন (Joe Biden) তার ছেলে হান্টার বাইডেনকে (Hunter Biden) ক্ষমা (pardon) করেছেন, যা স্বজনপ্রীতি (cronyism) নিয়ে অভিযোগ উসকে দিয়েছে। যাই হোক, এটি ডেমোক্র্যাটদের জন্য একটি বাস্তব সমস্যার দিক নির্দেশ করে: কীভাবে সেই রিপাবলিকানদের (Republicans) মোকাবেলা করা যায়, যারা নিয়ম-নীতি মানতে প্রস্তুত নয়। রিপাবলিকানরা, বিশেষ করে প্রো-ট্রাম্প (pro-Trump) রিপাবলিকানরা, গত কয়েক বছরে রাজনৈতিক নীতি ও রীতিনীতির প্রতি তাদের অবজ্ঞা পরিষ্কারভাবে দেখিয়েছে।
এখন পর্যন্ত ডেমোক্র্যাটরা আমেরিকার (America’s) পবিত্র প্রতিষ্ঠান (sacred institutions) রক্ষায় এবং রিপাবলিকান আক্রমণের (Republican onslaught) বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে নিজেদেরকে “নিয়মের পক্ষে” (pro rule) দল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেছে। এই কারণেই ডেমোক্র্যাটরা মিট রমনি (Mitt Romney) ও ডিক চেইনি (Dick Cheney)-র মতো প্রতিষ্ঠিত রিপাবলিকানদের (establishment Republicans) সমর্থন প্রচার করেছে, যেমনটি করা হয়েছিল কমলা হ্যারিসের (Harris campaign) প্রচারের সময়।
কিন্তু কিছু ডেমোক্র্যাট এখন এই কৌশল নিয়ে সংশয়ে পড়ছে। কারণ তারা মনে করে, যদি তারা নিয়ম মেনে খেলে আর রিপাবলিকানরা না খেলে, তাহলে তারা পিছিয়ে পড়বে। আবার তারা মনে করছে, নিজেদেরকে “স্থিতাবস্থার পক্ষে” (status quo) দল হিসেবে উপস্থাপন করাও ভালো কৌশল নয়, যখন দেশের মানুষ মনে করে আমেরিকার বর্তমান প্রতিষ্ঠানগুলি অকার্যকর (dysfunctional) হয়ে পড়েছে।
এই মতপার্থক্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে যখন এই মাসের শুরুর দিকে সাবেক ওবামা (Obama) ভাষণ লেখক জন লভেট (Jon Lovett) ও বামপন্থী (leftist) স্ট্রিমার হাসান পাইকার (Hasan Piker)-এর মধ্যে একটি বহু-চর্চিত সাক্ষাৎকার ঘটে লভেটের “পড সেভ আমেরিকা” (Pod Save America) পডকাস্টে (podcast)। সেখানে পাইকার যুক্তি দিয়েছিলেন যে বাইডেন (Biden) সরকারে অনেকটা “নরম” আচরণ করছেন এবং তিনি (বাইডেন) যেন ফেডারেল এজেন্সিগুলোকে (federal agencies) তার রাজনৈতিক স্বার্থে কাজে লাগান। উদাহরণস্বরূপ, পাইকার বলেছিলেন, জো মানচিন (Joe Manchin) যখন বিল্ড ব্যাক বেটার অ্যাক্ট (Build Back Better Act) আটকে দিয়েছিলেন, তখন বাইডেন চাইলে এসইসি (SEC – Securities and Exchange Commission) বা এফটিসি (FTC – Federal Trade Commission)-কে মানচিন ও তার পরিবারকে তদন্ত করতে বলতেন। বিল্ড ব্যাক বেটার অ্যাক্ট শেষ পর্যন্ত মানচিনের জেদের কারণে জল মিলিয়ে ইনফ্লেশন রিডাকশন অ্যাক্ট (Inflation Reduction Act)-এ পরিণত হয়।
পাইকারের মূল কথা হল, শুধু নিয়ম মেনে খেলে যখন রিপাবলিকানরা তা করে না, তখন এর কোনো নির্বাচনী লাভ নেই। বরং নিয়ম মেনে চলা প্রক্রিয়াকে রক্ষা করলেও খারাপ ফলাফল হতে পারে। এমনকি যদি পাইকারের পরামর্শগুলো কঠোর মনে হয়, অন্তত এটুকু সত্য যে ডেমোক্র্যাটরা তাদের “ভাল উদ্দেশ্যসম্পন্ন” (well intended) সম্প্রসারিত আস্থাকে আমেরিকার প্রতিষ্ঠানের ওপর অন্ধভাবে চাপিয়ে দেবে না। কারণ আমেরিকার প্রতিষ্ঠানগুলো খুব একটা ভালোভাবে কাজ করছে না, যা গ্যালাপের (Gallup) জরিপ অনুযায়ী সব পর্যায়ে আস্থার সংকট নিয়ে এসেছে।
সম্ভবত ডেমোক্র্যাটদের জন্য উত্তম পথ হলো অন্ধভাবে স্থিতাবস্থা রক্ষার (status quo) মধ্যে আটকে না থেকে একটি মধ্যপন্থা গ্রহণ করা, আবার ডোনাল্ড ট্রাম্পের (Donald Trump) মতো অরাজকতাপূর্ণ (anti-institutional chaos) অবস্থানও না নিয়ে, এমন একটি অবস্থান নেওয়া যা প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস না করে সংস্কার ও উন্নতি করে। এই বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ, কারণ ডেমোক্র্যাটরা প্রতিষ্ঠানের প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গি কেমন রাখবে, সেটি পরবর্তী নির্বাচনে (next election) নির্বাচন নির্ধারক হতে পারে, আর আমেরিকার অকার্যকর প্রতিষ্ঠানগুলিকে সংস্কার করে সেগুলোকে কার্যকর করা এখনকার আমেরিকান রাজনীতির অন্যতম প্রধান কর্তব্য।
ডেমোক্র্যাটদের জন্য একটা ছোট পরামর্শ: যদি আপনি আমেরিকার রাজনীতির কেন্দ্রকে জনগণের স্বার্থে সংস্কার করতে চান, তাহলে কোনো বিলিয়নিয়ারের (billionaire) সঙ্গে হাত মেলানো সম্ভবত সর্বোত্তম পথ নয়।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা দপ্তরের (DoD) সামরিক ব্যয় ও অডিট পাস নিয়ে বিতর্ক এবং বার্নি স্যান্ডার্স – ইলন মাস্কের আশ্চর্য মিত্রতা (১৩ ডিসেম্বর, ২০২৪)
এই নির্বাচন মৌসুম (election season) ছিল নানা চমকে ভরা—হত্যাচেষ্টার (assassination attempts) গল্প, শেষ মুহূর্তে প্রার্থী পরিবর্তন, এবং নাটকীয় ফলাফল। তবে এমন একটি বিষয় ঘটছে যা কেউ কল্পনা করেনি: বিলিয়নিয়ার (billionaire) ইলন মাস্ক (Elon Musk) ও ধনকুবেরদের কড়া সমালোচক বার্নি স্যান্ডার্স (Bernie Sanders) -এর মধ্যে এক ধরনের বন্ধুত্বপূর্ণ মনোভাব (bromance) তৈরি হচ্ছে।
স্যান্ডার্স, যিনি পূর্বে মাস্কের সাথে কর সংক্রান্ত বিষয়ে প্রকাশ্যে বিতণ্ডায় (publicly spat) জড়িয়েছিলেন, তিনি এই মাসে টেসলা সিইও (Tesla CEO) মাস্কের ব্যাপারে বেশ ইতিবাচক মন্তব্য করেছেন, তাকে “খুবই বুদ্ধিমান মানুষ” (very smart guy) বলে প্রশংসা করেছেন। তিনি উৎসাহের সঙ্গে মাস্কের সেই দাবির সাথে একমত হয়েছেন যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা বাজেট (defense budget) মূল্য হিসেবে খুব একটা ফলপ্রসূ নয়।
কেন বার্নি ও মাস্ক একই বিষয়ে একমত হওয়া অস্বাভাবিক নয়? কারণ যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা দপ্তর (Department of Defense – DoD) যে অর্থব্যয়ে খুব একটা মূল্য পাচ্ছে না, তা অস্বীকার করা কঠিন। প্রতিরক্ষা দপ্তর প্রতিবছর মার্কিন করদাতাদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ পায়, প্রায় ৯০০ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি বা তার বেশি, যা অন্য সব উন্নত দেশের তুলনায় আপেক্ষিক ও পরিমাণগত উভয় দিক থেকেই বড়। অধিকাংশ ইউরোপীয় দেশ তাদের জিডিপির (GDP) প্রায় ২% প্রতিরক্ষায় খরচ করে, আর আমেরিকা বিশ্বব্যাপী প্রতিরক্ষা ব্যয়ের প্রায় ৩৭% সম্পদ একা ব্যয় করছে। এটি দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ব্যয়কারী চীনের (China) চেয়েও তিনগুণ বেশি, যেখানে চীন বিশ্বব্যাপী মাত্র ১২% ব্যয়ের জন্য দায়ী।
আপনি ভাবতেই পারেন, যদি কোনো কাজে প্রায় এক ট্রিলিয়ন ডলার ব্যয় করা হয়, তবে নিশ্চয়ই এর মূল্যায়ন হওয়া উচিত। কিন্তু কংগ্রেস (Congress) তেমন মাথা ঘামাচ্ছে না বলেই মনে হয়। সামরিক ব্যয় (military spending) নিয়মিতভাবেই বেড়ে চলেছে, যদিও ডিওডি (DoD) পরপর সাতবার অডিট (audit) পাস করতে ব্যর্থ হয়েছে। সহজ করে বললে, যখন আপনি ডিওডিকে জিজ্ঞাসা করবেন সেই বিপুল ডলার কোথায় গেছে, তারা ঠিকমতো ব্যাখ্যা দিতে পারে না।
ডিওডি (DoD) শুধু ব্যতিক্রমী তাই নয়; বেশিরভাগ ফেডারেল সংস্থা (federal agencies) সহজেই তাদের অডিট পাস করে। অথচ ডিওডি এখনো সে সাফল্য থেকে বহুদূরে রয়েছে। সর্বশেষ বছরে অডিটকৃত ২৮টি “এনটিটি” (entities)-এর মধ্যে মাত্র ৯টি পাস করেছে। এই অবস্থা সংশোধন করা উচিত দ্বিদলীয় উদ্যোগে (bipartisan project)। এক্ষেত্রে স্যান্ডার্স ও মাস্কের মতৈক্য ইতিবাচক দিক নির্দেশ করে। তারা একই ব্যাপারে সহমত পোষণ করছে, যা যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা ব্যয় হ্রাসের ক্ষেত্রে গুরুত্ব বহন করে।
এই বিষয়টি অনুসরণ করা মূল্যবান কেন? কারণ যদি আমেরিকা (America) তার প্রতিরক্ষা ব্যয় কমাতে পারে, তবে সেই সঞ্চিত অর্থ অন্য খাতে ব্যয় করা সম্ভব হবে। আরও ব্যাপকভাবে বলতে গেলে, ফেডারেল বাজেট (federal budget) কাটছাঁট করার যে বৃহত্তর প্রকল্প মাস্ক দেখছেন, সেটিও লক্ষ করার মতো। অবশ্য এই দিক থেকে সন্দেহ করার কারণ আছে—এর আগে অনেকেই সরকারের অপচয় (government waste) কমানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, কিন্তু সফল হননি। কিন্তু যদি মাস্ক এটি করতে পারেন, তবে এটি হবে আমেরিকান করদাতাদের জন্য সুসংবাদ এবং অন্য উন্নত দেশের জন্যও আশার আলো, যারা নিজেদের স্ফীত (ballooning) রাষ্ট্রব্যয় নিয়ে উদ্বিগ্ন।
ট্রাম্পের মন্ত্রিসভা পারিবারিক সংযোগ ও আমেরিকার রাজনৈতিক বংশতালিকার ইতিহাস (১৩ ডিসেম্বর, ২০২৪)
ট্রাম্প (Trump) শুধু বিলিয়নিয়ার বন্ধুদেরই তার আসন্ন মন্ত্রিসভায় জায়গা দিচ্ছেন না; ঠিক তার পূর্ববর্তী ব্যবসাগুলোর মতো, তিনি তার প্রেসিডেন্সিতেও (presidency) পারিবারিক সংযোগ ধরে রাখার চেষ্টা করছেন।
ট্রাম্প ইতোমধ্যেই তার বেশিরভাগ মন্ত্রিসভা সদস্য (cabinet picks) ঘোষণা করেছেন, এবং চোখে পড়ার মতো বিষয় হল তার পরিবারের সদস্যদের অন্তর্ভুক্তি। তিনি তার জামাইয়ের (son-in-law’s) বাবাকে, চার্লস কুশনার (Charles KUSHNER), যুক্তরাষ্ট্রের ফ্রান্স দূত (U.S. ambassador to France) করেছেন, তার অন্য জামাইয়ের বাবাকে হোয়াইট হাউসের সিনিয়র অ্যাডভাইজার (White House Senior Advisor on Arab and Middle Eastern affairs) করেছেন মধ্যপ্রাচ্য (Middle East) ও আরব বিষয়ক উপদেষ্টা হিসেবে। এমনকি গুঞ্জন রয়েছে যে তার কন্যা লারা ট্রাম্প (Lara Trump) ফ্লোরিডা (Florida) থেকে সিনেট (Senate) পদে দাঁড়াতে পারেন, এখন যেহেতু বর্তমান সিনেটর মার্কো রুবিও (Marco Rubio) পররাষ্ট্র মন্ত্রী (Secretary of State) হতে যাচ্ছেন।
সংগত কারণেই অনেক উদারপন্থী (liberal minded) সংবাদমাধ্যম এ নিয়ে শিরোনাম করছে যে ট্রাম্প আমেরিকাকে এক “স্বজনপ্রীতিমূলক প্লুটোক্রাসি” (nepotistic plutocracy) তে পরিণত করছেন। তবে এতটা সরল সমীকরণে বিষয়টি বোঝা যাবে না। আসলে আধুনিক আমেরিকান রাজনীতি বরাবরই কিছুটা বংশানুক্রমিক (dynastic) ছিল।
২০ শতকের শুরুর দিকে রুজভেল্ট (Roosevelts) ও কেনেডি (Kennedys) পরিবারকে ক্ষমতায় দেখা যেত। কেনেডিরা এখনও আরএফকে (RFK) এর মাধ্যমে প্রভাব বিস্তার করছে। সম্প্রতি ক্লিনটন (Clintons) ও বুশ (Bushes) পরিবার আমেরিকার রাজনীতিতে আলোচিত ছিল। এমনকি ওবামারা (Obamas), যারা প্রথমে একধরনের “বিরোধী-প্রতিষ্ঠান” (anti-establishment) ভাবমূর্তি নিয়ে এসেছিলেন, প্রায়ই একটি ডাইনাস্টিতে পরিণত হতে যাচ্ছিলেন। যখন এটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে বাইডেন দ্বিতীয় মেয়াদের জন্য দাঁড়াতে পারবেন না, তখন বেশ আলোচনা ছিল মিশেল ওবামাকে (Michelle Obama) প্রার্থী করার ব্যাপারে যিনি অন্য সব সম্ভাব্য প্রার্থীর চেয়ে ভালো জনসমর্থন পেতেন।
এই রাজনৈতিক পরিবারগুলোর আধিপত্য ট্রাম্পের উত্থানেও কিছুটা ভূমিকা রেখেছে। আশ্চর্যজনকভাবে, ২০২০ ছিল ১৯৭৬ সালের পর প্রথম প্রেসিডেন্ট নির্বাচন যেখানে কোনো বুশ বা ক্লিনটন ছিল না। সম্ভবত ট্রাম্প না থাকলে আবারও কোনো বুশকে টিকিটে দেখা যেত। মনে করিয়ে দিই, জেব বুশ (Jeb Bush) ২০১৬ সালে যে প্রাইমারিতে দাঁড়িয়েছিলেন, সেটি ছিল সম্ভবত ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি অর্থায়নকৃত (well-financed) প্রাইমারি প্রচারণা। তিনি ২০১৫ সালের জুনে প্রার্থী হওয়ার আগেই তার পেছনে অন্য সব রিপাবলিকান প্রার্থীর মোট অর্থের চেয়ে বেশি অর্থ ছিল, বেশিরভাগই তেল ও গ্যাস কোম্পানি থেকে আসা। তিনি কোনো রাজ্য জয় না করেই ফেব্রুয়ারিতে প্রচারণা বন্ধ করেন, ততদিনে ১৩০ মিলিয়ন ডলার খরচ হয়ে গেছে। ট্রাম্পের কারণে এই দৌড় ব্যাহত না হলে, জেব হয়তো জয়ী হতেন বা অন্তত বিজয়ীর রানিংমেট (VP) হওয়ার প্রস্তাব পেতেন তার আর্থিক সক্ষমতা ও পারিবারিক নামের কারণে।
এই পরিবারতান্ত্রিক রাজনীতির কারণেই হয়তো ট্রাম্পের “বিরোধী-প্রতিষ্ঠান” (anti-establishment) প্রচারাভিযান এতটা সাড়া ফেলেছিল প্রাইমারিতে। তিনি একজন বুশের বিরুদ্ধে লড়ছিলেন, আর চূড়ান্ত নির্বাচনে একজন ক্লিনটনের (Clinton) বিরুদ্ধে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত, এই পারিবারিক মনোনয়ন নিয়ে অতিরিক্ত মাথা ঘামানোর দরকার নেই। আমেরিকান রাজনীতিতে পারিবারিক প্রভাব বরাবরই ছিল, আর ট্রাম্প যাকেই মনোনীত করুন না কেন, শেষ পর্যন্ত তারা ট্রাম্প যা চান সেটাই করবেন, তাদের পদবি যাই হোক না কেন।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল: যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ণ সমর্থনে গাজায় গণহত্যা (genocide) চালাচ্ছে ইসরায়েল (৬ ডিসেম্বর, ২০২৪)
ভূমিকা
৫ ডিসেম্বর, বৃহস্পতিবার প্রকাশিত এক ঐতিহাসিক প্রতিবেদনে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল (Amnesty International) ইসরায়েলকে গাজায় ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে গণহত্যা সংঘটনের অভিযোগ এনেছে। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের হামলার পর গাজায় ইসরায়েলের কার্যকলাপকে প্রথমবারের মতো “গণহত্যা (genocide)” বলে আখ্যায়িত করলো কোনো বড় ধরনের মানবাধিকার সংস্থা। তাদের নতুন রিপোর্টকে সংক্ষিপ্তভাবে তুলে ধরতে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল একটি ভিডিও প্রকাশ করেছে, যার শিরোনাম “You Feel Like You Are Subhuman: Israel’s Genocide Against Palestinians in Gaza”। এতে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সেক্রেটারি জেনারেল আনিয়েস ক্যালামার্ড (Agnes Callamard) এবং ইসরায়েল-ফিলিস্তিন বিষয়ক তাদের গবেষক বুদুর হাসান (Budour Hassan) কথা বলেছেন।
ভিডিওটি শুরু হয় ইসরায়েলের সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়াভ গ্যালান্টের (Yoav Gallant) একটি উদ্ধৃতির মাধ্যমে। তিনি বলেছিলেন:
“We are laying complete siege on Gaza. No electricity, no food, no water, no fuel. Everything is closed. We are fighting human animals and we act accordingly.”
তার এই বক্তব্যের মাধ্যমে গাজার ওপর সম্পূর্ণ অবরোধ (siege) আরোপের ঘোষণা স্পষ্ট হয়।
অবরুদ্ধ গাজায় “লাইভ-স্ট্রিমড” গণহত্যা (Genocide)
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলছে, ২০২৩ সালের অক্টোবরের এই আক্রমণের পর থেকে গাজায় যা ঘটছে, অনেকেই তাকে “প্রথম লাইভ-স্ট্রিমড (live-streamed) গণহত্যা” বলে অভিহিত করেছেন। দিন দিন এই নিধনযজ্ঞ বাড়ছে, কিন্তু বিভিন্ন দেশের সরকার কী করছে? ভিডিওতে প্রশ্ন তোলা হয় যে, “আপনার সরকার, আপনার রাজনৈতিক নেতারা কী করছেন এই গণহত্যা প্রতিরোধে?”
অ্যামনেস্টির মতে, ইসরায়েল দীর্ঘদিন ধরে গাজায় ধ্বংসাত্মক ও ভয়াবহ সামরিক অভিযান চালাচ্ছে। ৪৩ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন এবং কয়েক হাজার মানুষ আহত হয়েছেন। গাজায় প্রায় ২০ লাখ লোক বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। প্রচুর অঞ্চল ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। বেসামরিক জনগোষ্ঠীর কাছে প্রয়োজনীয় ত্রাণসামগ্রী ও জীবনরক্ষাকারী উপকরণ পৌঁছানো কঠিন হয়ে পড়েছে।
গণহত্যা (Genocide) শব্দের আইনি সংজ্ঞা
গাজায় ইসরায়েলের কর্মকাণ্ডকে গণহত্যা হিসেবে অভিহিত করার প্রবণতা ক্রমেই বাড়ছে। ১৯৪৮ সালে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতার প্রেক্ষিতে জাতিসংঘ (United Nations) আনুষ্ঠানিকভাবে গণহত্যার সংজ্ঞা দেন ও এটিকে আন্তর্জাতিক আইনে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে ঘোষণা করে। কোনো ঘটনা গণহত্যা কি না, তা বোঝার জন্য দু’টি মূল বিষয় প্রমাণ করতে হয়:
- অন্যায় কর্মকাণ্ডের ধরন: গণহত্যা কনভেনশনে (Genocide Convention) বর্ণিত কমপক্ষে একটি নিষিদ্ধ কাজ সংঘটিত হতে হবে—যেমন জনসমষ্টির সদস্যদের হত্যা, গুরুতর শারীরিক বা মানসিক ক্ষতির সৃষ্টি, এমন পরিস্থিতি তৈরি করা যাতে ঐ জনগোষ্ঠী ধ্বংসের পথে এগোয় ইত্যাদি।
- ধ্বংসের অভিপ্রায়: কাজটি অবশ্যই কোনো জাতীয়, জাতিগত, বর্ণগত বা ধর্মীয় গোষ্ঠীকে সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে ধ্বংস করার সুস্পষ্ট উদ্দেশ্য নিয়ে করতে হবে।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের ভাষ্যমতে, ৭ অক্টোবরের পর থেকে গাজায় অন্তত তিনটি নিষিদ্ধ কাজ সংঘটিত হয়েছে:
- গোষ্ঠীর সদস্যদের হত্যা (killing members of the group)।
- তাদের গুরুতর শারীরিক ও মানসিক ক্ষতি করা (causing serious mental or bodily harm)।
- এমন জীবনধারা বা পরিস্থিতি চাপিয়ে দেওয়া যা গোষ্ঠীর ধ্বংস ডেকে আনে (inflicting conditions of life calculated to bring about their physical destruction)।
এর উদাহরণ হিসেবে গাজায় বাড়ি-ঘর, কৃষিজমি, পানি ও পয়ঃনিষ্কাশনব্যবস্থা ধ্বংস করা, অপরিহার্য বেসামরিক অবকাঠামো ধ্বংস করা, অমানবিক ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বারবার গোষ্ঠীকে স্থানান্তরিত করা, এবং জীবনরক্ষাকারী ত্রাণ-সহায়তা ইচ্ছাকৃতভাবে আটকে দেওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। অ্যামনেস্টি বলছে, ইসরায়েল কর্তৃপক্ষ জেনেশুনে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে যেখানে ক্ষুধা, রোগব্যাধি ও মৃত্যুহারের বিপজ্জনক সমন্বয় তৈরি হয়েছে।
“ধ্বংসের অভিপ্রায়” (Intent to Destroy)
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের ভিডিওতে ৩…২…১ কাউন্টডাউন দিয়ে কিছু বক্তব্য তুলে ধরা হয় যেগুলো ইসরায়েলি নেতারা বা কর্মকর্তারা দিয়েছেন। উদাহরণস্বরূপ:
“It’s an entire nation out there that is responsible. … It’s absolutely not true this rhetoric about civilians not aware, not involved.”
সেনা ও সরকারি কর্মকর্তাদের এমন জাতিবিদ্বেষী (racist), অমানবিক (dehumanizing) ও গণহত্যামূলক (genocidal) মন্তব্যকে গাজায় ফিলিস্তিনিদের নিশ্চিহ্ন করার আহ্বান হিসেবে দেখা হয়েছে। অ্যামনেস্টি বলছে, তারা মোট ১০০টিরও বেশি মন্তব্য পর্যালোচনা করেছে, যার মধ্যে ২২টি সরাসরি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ও সামরিক অফিসারদের কাছ থেকে এসেছে। এদের অনেকেই গাজার বিস্তৃত অঞ্চলে “ভূমি পুড়িয়ে ফেলা (scorched earth)” এবং “কোনো ভবিষ্যৎ নেই”—এই ধরনের বার্তা দিচ্ছেন।
ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর (Israeli soldiers) ভিডিওতে দেখা গেছে, তারা উপাসনালয়, বিশ্ববিদ্যালয়, কৃষিজমি ধ্বংস নিয়ে উল্লাস করছে। এসব ঘটনায় এই প্রশ্ন সামনে আসে: “স্পষ্টতই এটি ধ্বংসের উদ্দেশ্য নিয়েই করা হচ্ছে কি না?” অ্যামনেস্টি বলছে, নিরবচ্ছিন্নভাবে ১৭ বছর ধরে গাজা অবরোধ (blockade) এবং সামগ্রিকভাবে ফিলিস্তিনিদের ওপর আরোপিত বর্ণবৈষম্যমূলক (apartheid) ব্যবস্থা—সব মিলিয়ে এটিকে গণহত্যার (genocide) সুস্পষ্ট প্রমাণ বলে উল্লেখ করা যেতে পারে।
মর্মান্তিক মানবিক বিপর্যয় (Humanitarian Catastrophe)
অ্যামনেস্টি জানিয়েছে, গাজায় আনুষঙ্গিক হারে খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানীয় জলের অভাব, পরিকাঠামোর ধ্বংস, অগণিত পরিবারকে নিজের হাতে সন্তানদের মৃতদেহ উদ্ধারের মর্মান্তিক অভিজ্ঞতা—সবকিছু মিলে এক ভয়াবহ মানবিক সংকট তৈরি হয়েছে। স্বাস্থ্যসেবা (healthcare) ব্যবস্থা পুরোপুরি ভেঙে পড়েছে।
তাদের মতে, এই অবস্থা বন্ধ করতে হলে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে অতি দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রতিটি সরকারকে বলিষ্ঠ ভূমিকা নিতে হবে—অস্ত্র স্থানান্তর (transfer of weapons) বন্ধ করতে হবে, কারণ এসব অস্ত্রই সরাসরি শিশু-সহ হাজার হাজার ফিলিস্তিনিকে হত্যা করছে। যুদ্ধাপরাধী (war criminals) যেন নির্বিঘ্নে বেঁচে যেতে না পারে তা নিশ্চিত করতে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিচারব্যবস্থাকে (National tribunals, Universal jurisdiction, International Criminal Court) সম্পূর্ণরূপে সক্রিয় করতে হবে।
ইসরায়েলের প্রত্যাখ্যান ও মার্কিন প্রতিক্রিয়া
২৯৬ পৃষ্ঠার বিশদ রিপোর্টে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল যে অভিযোগ এনেছে, তা ইসরায়েল সরকার সম্পূর্ণ “মিথ্যা ও বানোয়াট (fabricated and based on lies)” বলে প্রত্যাখ্যান করেছে। ইসরায়েলের উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী (Deputy Minister of Foreign Affairs) শ্যারন হ্যাস্কেল (Sharren Haskel) বলেছেন,
“Amnesty International thinks that you’re stupid … They actually altered and changed the legal terms and definition for what is a genocide because Israel doesn’t meet those criteria.”
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের (U.S. State Department) মুখপাত্রও বলেছেন যে, তারা অ্যামনেস্টির রিপোর্টের সঙ্গে “অসন্তুষ্ট” এবং “গণহত্যার অভিযোগ (genocide allegations) ভিত্তিহীন” বলে মনে করেন।
অ্যামনেস্টির পক্ষ থেকে বুদুর হাসান (Budour Hassan)
রিপোর্টটির বিষয়ে আরও আলোচনার জন্য অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের ইসরায়েল ও অধিকৃত ফিলিস্তিনি অঞ্চলবিষয়ক গবেষক বুদুর হাসান রামাল্লা (Ramallah, Occupied West Bank) থেকে যুক্ত হন। তিনি বলছেন, ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের এমন প্রতিক্রিয়া নতুন নয়। বরং প্রশ্ন হওয়া উচিত, “এতদিন সময় লাগলো কেন অ্যামনেস্টির এই সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে?” কারণ, গণহত্যার সংজ্ঞাকে অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলার জন্য তারা ব্যাপক তথ্য-উপাত্ত ও বিশ্লেষণের আশ্রয় নিয়েছেন।
তিনি জানান, আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের (International Court of Justice) গ্রহণযোগ্য বিচারধারা (jurisprudence) অনুযায়ী তারা প্রতিবেদন প্রস্তুত করেছেন। মাটিতে থেকে নানা তথ্য-উপাত্ত, স্যাটেলাইট চিত্র, প্রকাশ্য সূত্রে (publicly available evidence) পাওয়া তথ্য সব বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ইসরায়েল নিঃসন্দেহে ফিলিস্তিনিদের হত্যায় লিপ্ত এবং এমন সব ব্যবস্থা নিচ্ছে যা গোষ্ঠীটির ধ্বংস ডেকে আনে।
এরপরের ধাপ ছিল এই প্রশ্ন: “এসব কর্মকাণ্ড কি ইচ্ছাকৃতভাবে (specific intent) ফিলিস্তিনি জনগোষ্ঠীকে ধ্বংস করতে পরিচালিত?” এক্ষেত্রে তারা ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর আক্রমণাত্মক ও পুনরাবৃত্ত হামলা, ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ, বেসামরিক ব্যবস্থাকে ধ্বংস করা এবং সর্বোপরি বিভিন্ন ইসরায়েলি কর্মকর্তার প্রকাশ্য উসকানিমূলক মন্তব্য পর্যালোচনা করেছেন।
মার্কিন প্রেস ব্রিফিংয়ে বিতর্ক
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের (State Department) মুখপাত্র ভেদান্ত প্যাটেল (Vedant Patel) এক প্রেস ব্রিফিংয়ে স্পষ্ট বলেন যে, “গণহত্যার অভিযোগ ভিত্তিহীন (unfounded)।” যদিও প্রেস ব্রিফিংয়ে উপস্থিত সাংবাদিকরা প্রশ্ন তোলেন যে গাজায় প্রায় ২০ লাখ মানুষকে জোর করে সরিয়ে নেওয়া, তথাকথিত “নিরাপদ আশ্রয়” হিসেবে নির্দেশিত স্থানে বোমাবর্ষণ করা, কৃষি খাত থেকে শুরু করে অবকাঠামো সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করা—এগুলো আর কতটা ঘটলে একে গণহত্যা বলে ঘোষণা করা হবে।
তিনি যুক্তি দেন যে যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি এই অভিযোগ সমর্থন করে না। সাংবাদিকদের পাল্টা প্রশ্ন ছিল—আরও কত মানুষকে নির্মূল করতে পারলে যুক্তরাষ্ট্র এই ঘটনাকে গণহত্যা বলে মেনে নেবে? কিন্তু এসব প্রশ্নের সুনির্দিষ্ট উত্তর দেওয়া হয়নি।
যুক্তরাষ্ট্রের দায়
বুদুর হাসান বলেন, “একটি মাত্র দেশ যা ইসরায়েলকে থামাতে পারত, তা হলো যুক্তরাষ্ট্র। কারণ যুক্তরাষ্ট্রের হাতে এত ক্ষমতা ও প্রভাব আছে যে, তারা চাইলে ইসরায়েলের কাছে অস্ত্র সরবরাহ (arm supply) বন্ধ করতে পারত।” কিন্তু বরং তারা ইসরায়েলকে অব্যাহতভাবে সমর্থন করে যাচ্ছে এবং এতে যুক্তরাষ্ট্রকেও গণহত্যার সহযোগী (complicity) হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে।
১৯৯৪ সালে রুয়ান্ডার (Rwanda) গণহত্যার সময়ও যুক্তরাষ্ট্র “গণহত্যা” শব্দটি এড়িয়ে গিয়েছিল, যাতে আন্তর্জাতিকভাবে তাদের হস্তক্ষেপের বাধ্যবাধকতা তৈরি না হয়। পরে যুক্তরাষ্ট্র ক্ষমা চায়। বুদুর হাসান মনে করিয়ে দেন, “এখনও যখন এই ঘটনা চলছে, তারা অস্বীকার করছে; কিন্তু ভবিষ্যতে তারা হয়তো বলবে – ‘আমরা দেখেও কিছু করতে পারিনি, আমরা দুঃখিত।’” কিন্তু ততদিনে হাজার হাজার মানুষ নিধনযজ্ঞের শিকার হবেন।
কেন “গণহত্যা (Genocide)” সংজ্ঞা গুরুত্বপূর্ণ
গণহত্যা আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (International Criminal Court) অধীনে একটি গুরুতর অপরাধ। একে পুরোপুরি অগ্রহণযোগ্য (absolutely prohibited) বলা হয়, বিশেষত সশস্ত্র সংঘাত চলাকালীনও এটা কখনোই সমর্থনযোগ্য নয়। “গণহত্যায় সহযোগীতা (complicity) করাও গণহত্যার কনভেনশনের অধীনে অপরাধ,” বলে উল্লেখ করেন বুদুর হাসান। অর্থাৎ যারা ইসরায়েলকে অস্ত্র দিয়ে যাচ্ছে, তারাও এই অপরাধের অংশীদার হতে পারে।
অধিকৃত পশ্চিম তীরে (Occupied West Bank) চলমান পরিস্থিতি
রামাল্লায় অবস্থানরত বুদুর হাসান জানিয়েছেন, গাজায় সংঘটিত ঘটনার বাইরেও অধিকৃত পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি বাহিনী ও প্রশাসন ভূমি জবরদখল ও দখলদারির (annexation) প্রক্রিয়া চালিয়ে যাচ্ছে। সেখানে সামরিক আদেশ জারি করে বা “স্টেট ল্যান্ড (state land)” হিসেবে ঘোষণা করে ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদ করা হচ্ছে। অক্টোবরের পরে পশ্চিম তীরে প্রায় ৩০০ পরিবার বাস্তুচ্যুত হয়েছে। তাদের মতে, গাজায় গণহত্যা আর পশ্চিম তীরে ধীর গতির (slow but systematic) উচ্ছেদ—দুটিই ফিলিস্তিনিদের মুছে ফেলার লক্ষ্যেই করা হচ্ছে।
ভুক্তভোগীদের সাক্ষ্য ও ন্যায়বিচারের দাবি
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এই রিপোর্ট তৈরির সময় ২২ জনের সাক্ষাৎকার নিয়েছে। কেউ কেউ তাদের পুরো পরিবার, এমনকি সব সন্তানকে হারিয়েছেন। এক পিতা জানিয়েছেন, তিনি সহানুভূতি চান না—তিনি সন্তানদের ফিরে পেতে চান। যদিও তা সম্ভব নয়, অন্তত যারা এই গণহত্যা চালাচ্ছে, তাদেরকে বিচারের আওতায় আনা হোক—এই দাবি তাদের। কেউ কেউ অসংখ্যবার স্থানান্তরিত হয়েছেন, বিশুদ্ধ পানি বা সামান্য রুটি পেতেও ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়াতে হচ্ছে।
বুদুর হাসান বলেন, “এঁরা আমাদের সাক্ষাৎকার দিয়েছেন, কারণ অন্তত কেউ যেন তাদের কষ্টের কথা শুনে, সাক্ষ্য সংরক্ষণ করে এবং এ থেকে আইনি পদক্ষেপের পথ তৈরি করে।”
শেষকথা (Conclusion)
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের এই বিস্তৃত (২৯৬ পৃষ্ঠার) প্রতিবেদন অনুযায়ী, গাজায় ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের এই ধ্বংসযজ্ঞ কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এটা বহু দশকের বর্ণবৈষম্য (apartheid), অবরোধ (blockade) ও দখলদারি (occupation) নীতির ধারাবাহিক ফল। আর এতে যুক্তরাষ্ট্রসহ আরও অনেক রাষ্ট্রের সক্রিয় বা নীরব সমর্থন রয়েছে।
শিরোনাম “You Feel Like You Are Subhuman: Israel’s Genocide Against Palestinians in Gaza” শীর্ষক এই রিপোর্টে স্পষ্ট বার্তা দেওয়া হয়েছে যে, বিশ্ববাসীকে এখনই সোচ্চার হতে হবে। অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্রসহ যে যে দেশ ইসরায়েলকে অস্ত্র সহায়তা জোগাচ্ছে বা কূটনৈতিক সুরক্ষা দিয়ে যাচ্ছে, তাদের থামাতে হবে। এই অপরাধের জন্য জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে।
২০২৩ সালের ২৪ ডিসেম্বর, যখন অ্যামনেস্টির এই বক্তব্য আলোচনায় এসেছে, তখন ইসরায়েল সরকার রিপোর্টটিকে পুরোপুরি “মিথ্যা” বলে দেগে দিয়েছে। অপরদিকে আমেরিকা ও অন্যান্য বড় শক্তিশালী রাষ্ট্র সরাসরি “গণহত্যা” শব্দটি ব্যবহার করতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছে।
ফলে, ফিলিস্তিনিদের বেঁচে থাকার অধিকার রক্ষায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ঐক্যবদ্ধ উদ্যোগের ওপরই নির্ভর করছে গাজার ভাগ্য। যত দিন ইসরায়েলের সামরিক পদক্ষেপ ও মানবিক বিপর্যয় চলবে, তত দিন এই বিতর্ক ও প্রতিবাদ অব্যাহত থাকবে।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল সরাসরি বলছে, “ইসরায়েল গাজায় গণহত্যা (genocide) চালাচ্ছে।” এর বিপরীতে ইসরায়েল সরকার ও যুক্তরাষ্ট্র — উভয়েই এই অভিযোগকে ভিত্তিহীন বলছে। কিন্তু গাজায় ভুক্তভোগী সাধারণ মানুষের আর্তচিৎকার, বেঁচে থাকার লড়াই এবং আন্তর্জাতিক আইনের সুস্পষ্ট সংজ্ঞা, সব মিলিয়ে অ্যামনেস্টির এ বক্তব্যকে সার্বিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করে।
রিপোর্টটি ডাউনলোড করুন এখান থেকে – Israel/Occupied Palestinian Territory: ‘You Feel Like You Are Subhuman’: Israel’s Genocide Against Palestinians in Gaza – Amnesty International
ব্রিকসের নতুন মুদ্রা কি সত্যিই মার্কিন ডলারের বিকল্প হতে পারে? (৩ ডিসেম্বর, ২০২৪)
ভূমিকা
৩০ নভেম্বর, শনিবার যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প (Donald Trump) এক টুইটে হুমকি দেন যে, ‘ব্রিকস’ (BRICS) দেশগুলো যদি মার্কিন ডলারের (US dollar) প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে কোনো নতুন মুদ্রা তৈরি করতে যায়, তবে তাদের পণ্যের ওপর তিনি ১০০% শুল্ক (tariffs) আরোপ করবেন। অনেকের কাছে এটি আকস্মিক মনে হতে পারে, কিন্তু গত কয়েক মাস ধরেই অন্তত ইন্টারনেটের কিছু আলোচ্যাংশে জোর সম্ভাবনা বা জল্পনা ছিল যে, ব্রিকস জোট নাকি ডলারকে প্রতিস্থাপন করার মতো কোনো মুদ্রা আনতে পারে।
এই নিবন্ধে আমরা বিশ্লেষণ করব—
- ১) মার্কিন ডলার কীভাবে “বিশ্বের রিজার্ভ মুদ্রা” (world’s reserve currency) হয়ে উঠেছে এবং ব্রিকস দেশগুলো কেন এতে অসন্তুষ্ট,
- ২) এই সুদৃঢ় ডলারব্যবস্থাকে সত্যিই কি কোনো নতুন ব্রিকস মুদ্রা টলাতে পারবে,
- ৩) কেন যুক্তরাষ্ট্রই (US) হয়তো ডলারের জন্য বড় হুমকি, তার কারণসমূহ।
ব্রিকস (BRICS) কী এবং এর জোট সম্প্রসারণ
“ব্রিকস” (BRICS) হলো ব্রাজিল (Brazil), রাশিয়া (Russia), ভারত (India), চীন (China) ও দক্ষিণ আফ্রিকা (South Africa)-এর আদ্যক্ষর নিয়ে গঠিত একটি পরিচিতি। ২০০১ সালে গোল্ডম্যান স্যাকসের (Goldman Sachs) এক বিশ্লেষক প্রথম এই শব্দটি চালু করেন—তবে তখন এর মধ্যে দক্ষিণ আফ্রিকা ছিল না।
- জোটের উৎস: ২০০৬ সালে ভ্লাদিমির পুতিন (Vladimir Putin) জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের (UN General Assembly) ফাঁকে এক ব্রিকস মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠক আয়োজন করেন। ২০০৯ সালে রাশিয়া প্রথম ব্রিকস সম্মেলন (BRICS summit) আয়োজন করে, যা এরপর থেকে প্রতি বছর অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
- দক্ষিণ আফ্রিকা (South Africa) যোগদান: ২০১০ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা এই জোটে যুক্ত হয়।
- নতুন সদস্য: ২০২৩ সালে আরও চারটি দেশ—মিসর (Egypt), ইথিওপিয়া (Ethiopia), ইরান (Iran), সংযুক্ত আরব আমিরাত (UAE)—ব্রিকস পরিবারে যোগ দিয়েছে।
বর্তমানে এই জোটকে “বৃহত্তর ব্রিকস” বলা যায়, তবে সাধারণত সেই নতুন সদস্যদের অন্তর্ভুক্ত করেও অনেকে “ব্রিকস” নামটি ব্যবহার করে। এরা সম্মিলিতভাবে বিশ্বের জনসংখ্যার প্রায় ৪৫% এবং ক্রয়ক্ষমতা ভিত্তিতে (purchasing power) প্রায় ৩৫% মোট দেশজ উৎপাদন (GDP) উপস্থাপন করে। অনেকে ব্রিকসকে “non-Western counterpoint to the G7″ বলে অভিহিত করেন; যদিও বাস্তবে এরা এখনো মূলত আলোচনা প্ল্যাটফর্ম ছাড়া আর কিছু নয়।
কিন্তু বারবার দেখা গেছে, ব্রিকস সম্মেলনগুলোর অন্যতম সাধারণ আলোচ্য বিষয় হলো যুক্তরাষ্ট্রের ডলার আধিপত্য (dominance of the dollar) সম্পর্কে অসন্তোষ। এটি আবার কোনো নতুন চিন্তা নয়; তবে সাম্প্রতিক সময়ে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা (US sanctions) বৃদ্ধি পাওয়ায় ডলারব্যবস্থার ওপর চাপ ও বিরোধ আরো প্রকাশ্যে এসেছে।
ডলারের রিজার্ভ কারেন্সি (Reserve Currency) মর্যাদা ও এর প্রভাব
মার্কিন ডলারকে বিশ্বের রিজার্ভ মুদ্রা বলা হয়, কারণ সবচেয়ে বেশি কেন্দ্রীয় ব্যাংক (central banks) ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান (financial institutions) তাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে (foreign exchange reserves) ডলার সংরক্ষণ করে। এর মূল কারণ—ডলারকে অপেক্ষাকৃত “নিরাপদ” (safe) ও “নির্ভরযোগ্য” (reliable) মনে করা হয়, আর যুক্তরাষ্ট্র হলো বিশাল ও উন্মুক্ত অর্থনীতির (massive open economy) অধিকারী।
ডলারের এই অবস্থানের কয়েকটি কার্যকরী প্রভাব:
- ডলার তুলনামূলক বেশি মূল্যমান ধরে রাখে—যদি শুধু বাণিজ্য প্রবণতার (trade patterns) ভিত্তিতে মূল্য নির্ধারিত হতো, ডলারের মান এত উঁচুতে থাকতো না। এর মানে, আমেরিকা তুলনামূলকভাবে বেশি আমদানি (import) করতে পারে, যদিও এটি মার্কিন উৎপাদন খাতের (manufacturing) জন্য নেতিবাচক ফল বয়ে আনতে পারে। (উল্লেখ্য, ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজে অতীতে ডলারের মূল্য কমাতে চাওয়ার কথা বলেছেন, যাতে আমেরিকান রপ্তানি প্রতিযোগিতামূলক হয়।)
- ডলারে উঁচু চাহিদা (demand) থাকার ফলে আমেরিকা বেশি ঋণ (debt) নিতে পারে, কারণ বিশ্বজুড়ে সরকারি-বেসরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ডলার ও ডলারে প্রকাশিত যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি বন্ড (US treasuries) কিনতে আগ্রহী। ফলে মার্কিন সরকার অন্য যেকোনো দেশের তুলনায় সহজে ও কম খরচে ঋণ পায়।
- বৈশ্বিক বাণিজ্যের বড় অংশ ডলারে নির্ভরশীল, বিশেষ করে পণ্য বা কৃষি-পণ্য (commodities) বাণিজ্য। এমনকি যেখানে কোনো পক্ষই সরাসরি যুক্তরাষ্ট্র নয়, সেখানেও অনেক সময় পরিশোধ ডলারে হয়, যা মার্কিনিদের বিনিময় হারজনিত (exchange rate) ঝুঁকি থেকে নিরাপদ রাখে।
- মার্কিন নিষেধাজ্ঞার (US sanctions) ক্ষমতা অত্যন্ত উচ্চ, কারণ বিশ্বের ব্যাংকিং ও লেনদেন ব্যবস্থায় ডলারের প্রভাব গুরুতর। যে দেশ বা সংস্থা ডলারের ব্যবস্থার সঙ্গে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, তারা কার্যত গ্লোবাল ফাইনান্সের বিশাল অংশ থেকে বাদ পড়ে।
মার্কিন প্রতিপক্ষ ও এমনকি কোনো কোনো মিত্রদেশ বহুদিন ধরেই ডলারের এই আধিপত্যকে নানাভাবে সমালোচনা করে আসছে। ১৯৬০-এর দশক থেকেই “ডলারের ওপর বিরক্তি” (dollar resentment) রয়েছে, কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আমেরিকা যেভাবে তীব্রহারে নিষেধাজ্ঞা প্রয়োগ করছে, তাতে এই অনুযোগ আরও জোরদার হয়েছে। তারই ফলস্বরূপ, “ব্রিকস বিকল্প মুদ্রা” নিয়ে চর্চা বা গুঞ্জন বেড়েছে, যা এখন ট্রাম্পের দৃষ্টিগোচরে এসেছে, আর তিনি “১০০% শুল্কের” হুমকি দিয়েছেন।
ব্রিকসের বাস্তবতা: নতুন মুদ্রা কি সত্যি সম্ভব?
প্রশ্ন হচ্ছে, ট্রাম্পের উদ্বেগ কি যৌক্তিক? ব্রিকস কি সত্যিই ডলারের স্থলাভিষিক্ত হতে পারবে?
সংক্ষিপ্ত উত্তর: সম্ভবত না। ইতিহাস বলে, একটি সুপ্রতিষ্ঠিত রিজার্ভ মুদ্রাকে অপসারণ করা কঠিন। কারণ “নেটওয়ার্ক এফেক্ট” (network effects) অত্যন্ত শক্তিশালী—আমরা ডলারে লেনদেন করি, কারণ সবাই ডলারে লেনদেন করে। সবাই ডলারে মূল্য পেতে রাজি, কারণ ভবিষ্যতে সেই ডলার অন্য কোথাও বিক্রি বা ব্যবহার করা যাবে।
- ডলারের বিলুপ্তির কথা: ১৯৭০-এর দশক থেকেই ডলারবিনাশী ভবিষ্যদ্বাণী চলে আসছে, বিশেষ করে প্রেসিডেন্ট নিকসন (Richard Nixon) স্বর্ণের মান (gold standard) থেকে ডলারের যোগসূত্র ছিন্ন করার পর থেকেই। কিন্তু এখনো ডলার শক্তিশালী অবস্থানে আছে। গত দু’দশকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে ডলারের শেয়ার সামান্য কমলেও, আন্তর্জাতিক লেনদেনে তা এখনো প্রধান মুদ্রা।
- ইতিহাসে একবার বড় রদবদল: একমাত্র বড় পালাবদল ঘটেছিল ২০শ শতকের গোড়ার দিকে, যখন গ্রেট ব্রিটেনের পাউন্ডকে (British pound) আস্তে আস্তে সরিয়ে ডলার বিশ্বের শীর্ষ অবস্থান দখল করে। এটি ঘটাতে বিশ্বযুদ্ধ (World Wars) সহ নানা বিশাল ভূ-রাজনৈতিক কারণ ছিল, আর যুদ্ধে ব্রিটেনের ঋণদাতা ছিল যুক্তরাষ্ট্র।
ব্রিকসের চ্যালেঞ্জ
ব্রিকসের পক্ষে রিজার্ভ মুদ্রা তৈরির চ্যালেঞ্জ আরও বেশি। বিক্ষিপ্ত উদাহরণ:
- চীনের ভূমিকা ও ইউয়ান (Yuan):
- চীনা অর্থনীতিই ব্রিকসের মধ্যে সবচেয়ে বড় ও শক্তিশালী। সুতরাং যদি কোনো ব্রিকস মুদ্রা তৈরি হয়, তাতে চীনের ইউয়ানের ভূমিকা বিশাল হবে।
- কিন্তু চীন তার মুদ্রা নিয়ন্ত্রণে রাখে (পুঁজি প্রবাহে কড়া নিয়ন্ত্রণ), বিদেশি বিনিয়োগকারীদের সবসময় নিশ্চয়তা নেই যে তারা যখন-তখন টাকা বের করে আনবে না। ফলে রিজার্ভ মুদ্রা হিসেবে ইউয়ানের গ্রহণযোগ্যতা সীমিত।
- উপরন্তু, চীন হয়তো নিজেও চায় না যে ইউয়ান “বিশ্বের প্রধান মুদ্রা” হয়ে যাক; কারণ তখন ইউয়ানকে এমনভাবে স্থিতিশীল রাখতে হবে, যাতে চীনের পক্ষে ইচ্ছামতো মূল্য কমিয়ে রপ্তানি সুবিধা নেওয়া সম্ভব না হয়। তাছাড়া যুক্তরাষ্ট্র রিজার্ভ মুদ্রার মর্যাদা হারালে আমদানি কমাতে শুরু করবে, যা চীনের রপ্তানিকেও আঘাত হানতে পারে—এটা চীন পছন্দ করবে না।
- যুক্ত মুদ্রা (Joint currency) আলোচনা:
মাঝে মাঝে শোনা যায়, ব্রিকস দেশগুলো কোনো “যৌথ মুদ্রা” (joint currency) আনতে পারে, হয়তো স্বর্ণ (gold) বা নানাবিধ মুদ্রার ঝুড়ির (basket of currencies) ওপর ভিত্তি করে। কিন্তু এ ধরনের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা খুবই কঠিন। এখন পর্যন্ত কোনো দৃশ্যমান ঐক্যমত বা ফলাফল আসেনি। - আন্তঃব্যাংক লেনদেন ব্যবস্থা (Interbank system):
সাম্প্রতিক ব্রিকস সম্মেলনে ভ্লাদিমির পুতিন তার নতুন “BRICS Bridge” নামের আন্তঃব্যাংক মেসেজিং সিস্টেম প্রস্তাব করেন, যাতে সুইফ্ট (SWIFT) -এর বিকল্প তৈরি হয় ও মার্কিন নিষেধাজ্ঞার ঝুঁকি থেকে মুক্ত থাকা যায়। কিন্তু অন্য ব্রিকস দেশগুলো তেমন সাড়া দেয়নি। কারণ—- সুইজারল্যান্ড-ভিত্তিক ব্যাংক ফর ইন্টারন্যাশনাল সেটেলমেন্টস (Bank for International Settlements) ইতোমধ্যে “Enbridge” নামে একটি আন্তঃব্যাংক ব্যবস্থা চালু করেছে, যা হয়তো একই কাজ করতে পারে।
- অন্য দেশগুলো এই ভয়ে আছে যে, রাশিয়ার সঙ্গে সহযোগিতা করে “বিকল্প আর্থিক ব্যবস্থা” তৈরি করলে আমেরিকা তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা (sanctions) দিতে পারে।
- বৈচিত্র্যময় রাজনৈতিক উদ্দেশ্য:
ব্রিকস গোষ্ঠী আদর্শিকভাবে খুবই বিচিত্র—রাশিয়া-চীনের লক্ষ্য আলাদা, আবার ভারত ও অন্যদের লক্ষ্য ভিন্ন। যেমন, ভারত (India) মার্কিন ডলার থেকে সরতে খুবই অনিচ্ছুক; তাদের অর্থনীতি ও কূটনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সুসম্পর্ক গুরুত্বপূর্ণ। রাশিয়ার মতো দেশের মতো ভারত ডলার পরিত্যাগে মরিয়া নয়। ফলে রাশিয়ার কিছু “অতি-উদ্ভট পরিকল্পনা” (harebrained schemes) ভারত সহজে মেনে নেবে না, বিশেষ করে যদি তা যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়া ডেকে আনে।
ডলারের সবচেয়ে বড় হুমকি: যুক্তরাষ্ট্র নিজেই?
যদিও অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, বৈশ্বিক পরিসরে ডলারের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বা হুমকি আসতে পারে ব্রিকসের মতো কোনো জোট থেকে, বাস্তবে মার্কিন স্ববিরোধী নীতিগুলো ডলারের অবস্থানকে অনেক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। উদাহরণ:
- যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য একঘেয়েমি ও শুল্কনীতি: ট্রাম্পের আমলের মতো উচ্চ শুল্ক বা সবার সাথে বাণিজ্য-সংঘাত (trade war) চালালে মার্কিন অর্থনীতি আংশিকভাবে বিচ্ছিন্ন (isolated) হয়ে পড়তে পারে। গ্লোবাল চেইন থেকে দূরে সরে গেলে ডলারের মাধ্যমিক ব্যবহারও কমতে পারে।
- নিষেধাজ্ঞার (sanctions) অতিরিক্ত ব্যবহার: অতিরিক্ত একতরফা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলে অন্য দেশগুলোও বিকল্প ব্যাংকিং-পথ বা নতুন মুদ্রা ব্যবস্থার খোঁজ চালাবে। এটি ধীরে ধীরে ডলারের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে আনতে পারে।
- ফেডের রাজনীতিকরণ (Politicizing the Federal Reserve): মার্কিন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের (Fed) স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ হলে বা রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বাড়লে বিনিয়োগকারীরা ডলারে আস্থা হারাতে পারে। রিজার্ভ মুদ্রায় স্থিতিশীলতা ও স্বচ্ছতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
- অতিরিক্ত ফেডারেল ঋণ (unsustainable federal debt): আমেরিকা যদি লাগামছাড়া ধার-দেনার দিকে এগোয়, তাহলে এক সময় বিনিয়োগকারীরা U.S. Treasuries বা ডলার-অধ্যুষিত সম্পদে আস্থা হারাতে শুরু করতে পারে।
- ‘ডলার ব্যবহার করো না হলে শুল্ক দেব’ মার্কা ব্ল্যাকমেইল টুইট: ট্রাম্পের সাম্প্রতিক ১০০% শুল্কের হুমকি দেওয়া টুইট আসলে ডলার ব্যবস্থায় আস্থাকে ক্ষয় করতে পারে। কারণ, সমগ্র বিশ্ব দেখছে যুক্তরাষ্ট্র তাদের আধিপত্য রক্ষায় সরাসরি “চাপে” রাখতে চাইছে—এতে অনেকেই বিকল্প খোঁজার চিন্তা করবে।
উপসংহার
ব্রিকসের যৌথ মুদ্রা বা “ইউয়ান-কেন্দ্রিক” (yuan-centered) কোনো ব্যবস্থা ডলারের বিকল্প হয়ে উঠবে কিনা সেই ব্যাপারে নিরন্তর আলোচনা চলছে। ইতিহাস ও বাস্তবতা বলে, ডলারের মতো সুপ্রতিষ্ঠিত রিজার্ভ মুদ্রাকে হঠাৎ ঠেলে সরানো অত্যন্ত কঠিন। বিশেষ করে ব্রিকসের মতো ভিন্ন স্বার্থ ও আদর্শিক দূরত্ব থাকা দেশগুলো একমত হয়ে নতুন মুদ্রা প্রচলন করাটা আরো দুরূহ।
তার ওপর চীনের নিজস্ব স্বার্থ ও মুদ্রানীতির সীমাবদ্ধতা, ভারতের নিরপেক্ষ অবস্থান, অন্যান্য ব্রিকস দেশের মার্কিন নিষেধাজ্ঞার ভয়—এ সবকিছু মিলে ব্রিকসের মধ্যেই “ডলারবিমুখতা” নিয়ে ঐক্য প্রায় অসম্ভব। যদিও রাশিয়া নতুন আন্তঃব্যাংক মেসেজিং সিস্টেম ও বিকল্প কাঠামো গড়ার চেষ্টা করছে, অন্যরা বাড়তি ঝুঁকি নিতে অনিচ্ছুক।
অবশ্যই ডলারকে দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতিগ্রস্ত করা সম্ভব—কিন্তু তার বড় কারণ হতে পারে যুক্তরাষ্ট্রের নিজেরই নীতি—নিষেধাজ্ঞার মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার, উচ্চ শুল্ক ও বানিজ্য বিরোধ, ফেডের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণকরণ, লাগামছাড়া সরকারি ঋণ, এবং বিশ্বকে ব্ল্যাকমেইল করার মতো কূটনৈতিক আক্রমণাত্মক অবস্থান। এসবের সমাহারে যদি বিশ্ব ডলারের ওপর আস্থা হারায়, তবে তা ধীরে ধীরে বিকল্পের পথ তৈরি করতে পারে।
কিন্তু আজ-কালকের মধ্যে কেবল “ব্রিকস মুদ্রা” গড়ে উঠে ডলারকে অচল করে দেবে—এমন দৃশ্যপট আপাতত অবাস্তব বলেই অধিকাংশ অর্থনীতিবিদের মত। এই অবস্থায় ট্রাম্পের ১০০% শুল্কের হুমকি কিংবা ব্রিকস নেতাদের মাঝেমধ্যে “নতুন মুদ্রার” কথা বলা—সবই সম্ভবত বড় পরিসরের বাস্তবতার তুলনায় তুলনামূলক ছোট ঢেউয়ে রয়ে যাচ্ছে। ভবিষ্যতে দীর্ঘমেয়াদে আসলেই যদি ডলারের পতন ঘটে, তা হবে আরও গভীর কাঠামোগত ও বৈশ্বিক পরির্তনের ফল, যা এক-আধ বছরের মধ্যে আসবে না বলেই বিশ্লেষকেরা বিশ্বাস করেন।
তথ্যসূত্র
1 – https://x.com/realDonaldTrump/status/1863009545858998512
2 – House of Commons Briefing Report on BRICS (and their expansion): https://commonslibrary.parliament.uk/research-briefings/cbp-10136/#:~:text=Four%20further%20countries%20joined%20the,as%20the%20’BRICS%2B‘
3 – Washington Post piece on America’s escalating sanctions habit: https://www.washingtonpost.com/business/interactive/2024/us-sanction-countries-work/
4 – https://www.economist.com/special-report/2024/10/14/chinas-yuan-is-nowhere-close-to-displacing-the-greenback
যুক্তরাষ্ট্রের এক নম্বর তেল উৎপাদক হয়ে ওঠা ও তাদের তেল প্রাচুর্যের সমাপ্তি (১ ডিসেম্বর, ২০২৪)
ভূমিকা
২০১৮ সালে, যুক্তরাষ্ট্র (United States) বিশ্বের বৃহত্তম তেল উৎপাদনকারী দেশে পরিণত হয়। এর এক বছর পরেই তারা সর্বকালের রেকর্ড ভেঙে দৈনিক ১২.৩ মিলিয়ন ব্যারেল তেল উৎপাদন করতে সক্ষম হয়—যা পূর্বে বিশেষজ্ঞদের বিশ্লেষণ অনুযায়ী অসম্ভব বলে মনে করা হয়েছিল। কোভিড-১৯ মহামারির সময় তেলের দাম স্বল্প সময়ের জন্য নেতিবাচক হয়ে গেলেও যুক্তরাষ্ট্রের তেল উৎপাদন আবারও বৃদ্ধি পেতে থাকে। সবচেয়ে অদ্ভুত বিষয় হলো, গত এক দশকে দেশটিতে তেল রিগের (Oil Rigs) সংখ্যা কমতে থাকা সত্ত্বেও উৎপাদন ক্রমাগত বেড়ে চলেছে।
মাত্র দশকের ব্যবধানে রাশিয়া (Russia) ও সৌদি আরব (Saudi Arabia)-এর মতো ভূরাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের পেছনে ফেলে যুক্তরাষ্ট্র বর্তমানে বৈশ্বিক তেলশক্তির নেতৃত্বে। আমদানি-নির্ভরতা থেকে মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই তারা হয়ে উঠেছে বিশ্বের প্রভাবশালী তেল-সুপারপাওয়ার (Oil Superpower)। এমনকি ১৯৪০-এর দশকের পর প্রথমবারের মতো দেশটি এখন নেট রপ্তানিকারক (Net Exporter)। অতীতে তেল আমদানির জন্য যুক্তরাষ্ট্র বরাবরই ভঙ্গুর (Geopolitically Tenuous) সরবরাহকারীদের ওপর নির্ভর করত, যারা ইচ্ছে হলেই তেল সরবরাহ বন্ধ করে দিতে পারত। কিন্তু আজ যুক্তরাষ্ট্র একই সঙ্গে বিশ্বের বৃহত্তম তেল উৎপাদক ও ভোক্তা—বিশ্ববাজারে শক্তিশালী অবস্থান ধরে রাখছে এবং ওপেক (OPEC: Organization of Petroleum Exporting Countries)-এর মতো সংঘের বাজার নিয়ন্ত্রণের সম্ভাব্য প্রভাব থেকেও অনেকাংশে সুরক্ষিত।
তেলের বাজারে যুক্তরাষ্ট্রের এই পুনরুত্থান (Renaissance) দেশের শিল্প খাত ও সাধারণ মানুষের জ্বালানি নিরাপত্তা (Energy Security) জোরদার করেছে। এটি অর্থনীতি ও জীবনযাত্রার মানকে সহায়তা করছে এমন এক সময়ে, যখন জ্বালানি নিরাপত্তা সরকারি এজেন্ডাগুলোর শীর্ষে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, নিজেরা প্রয়োজনের চেয়ে বেশি তেল উৎপাদন করার পরও যুক্তরাষ্ট্র এখনও বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম তেল আমদানিকারক (Importer)। আর বাস্তব সত্য হলো, তেল একটি সীমিত সম্পদ (Finite Resource)। পূর্বানুমান অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রের হাতে প্রায় ১১ বছরের সমপরিমাণ তেল-সংরক্ষণ (Reserves) অবশিষ্ট থাকতে পারে। সুতরাং এত দ্রুত হারে তেল উত্তোলন চললে কত দিন এভাবে উৎপাদন বজায় রাখা সম্ভব? এর সঙ্গে পরিবেশগত চ্যালেঞ্জ এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানির (Renewable Energy) ক্রমবর্ধমান প্রতিযোগিতা তো রয়েই গেছে।
এই প্রেক্ষাপটে কয়েকটি প্রশ্ন উত্থাপিত হয়:
- কীভাবে যুক্তরাষ্ট্র সর্বকালের বৃহত্তম তেল উৎপাদনকারী হয়ে উঠল?
- এত তেল উৎপাদনের পরও যুক্তরাষ্ট্র কেন এত তেল কিনছে?
- বাস্তবিক অর্থে এই উচ্চপর্যায়ের উৎপাদন কত দিন অব্যাহত থাকবে?
তেল উৎপাদন প্রসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরব সম্পর্ক
বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের তেল উৎপাদনের উচ্চপর্যায় দেখে মনে হতে পারে এটি নতুন কোনো ঘটনা। কিন্তু আসল গল্পটি কিছুটা অন্য রকম। বর্তমান বৈশ্বিক শক্তি সরবরাহের ক্ষেত্রে সৌদি আরব ও যুক্তরাষ্ট্রকে যেরকম প্রতিদ্বন্দ্বী অবস্থায় দেখা যায়, দেশ দুটো কখনোই এমন প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল না। আসলে তেলের বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরবের সম্পর্ক প্রায় ১০০ বছরের পুরনো, এবং শুরুতে তা ছিল পারস্পরিক লাভজনকতার ভিত্তিতে। মহামন্দা (Great Depression) কাটিয়ে ওঠার সময় যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি যখন দ্রুতগতিতে শিল্পায়িত হচ্ছিল, তখন জ্বালানির চাহিদা বাড়তে থাকে। তাই যুক্তরাষ্ট্রের তেল কোম্পানিগুলো বিদেশি উৎসে তেল খুঁজতে ঝুঁকে পড়ে।
এরপর আসে ১৯৩২ সাল। মধ্যপ্রাচ্যের (Middle East) চারটি অঞ্চলকে একীভূত করে ইবনে সাউদ (Ibn Saud) নামে এক শাসকের অধীনে জন্ম নেয় নতুন একটি দেশ—যা আজকের সৌদি আরব। সদ্য প্রতিষ্ঠিত রাজ্যটি উন্নয়ন ও আধুনিকায়নের স্বপ্ন দেখছিল। তাই ১৯৩৩ সালে সৌদি আরব স্ট্যান্ডার্ড অয়েল অব ক্যালিফোর্নিয়াকে (Standard Oil of California) তাদের ভূখণ্ডে তেল অনুসন্ধানের অধিকার দেয়। এর মাধ্যমেই তৈরি হয় ক্যালিফোর্নিয়া-আরাবিয়ান স্ট্যান্ডার্ড অয়েল কোম্পানি, যা পরে অ্যারাবিয়ান-আমেরিকান অয়েল কোম্পানি নাম নেয়। সংক্ষেপে যার নাম—আরামকো (Aramco)। আজকের দিনে সৌদি আরবের সবচেয়ে বড় রাষ্ট্রীয় তেল কোম্পানি (State Control Industry) আরামকো একসময় ১০০% আমেরিকান মালিকানাধীন ছিল, এবং এর নামেই সেই ঐতিহাসিক বন্ধনের ছাপ রয়ে গেছে।
১৯৩৮ সালে প্রথম বড় তেলক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয় এবং এর পরবর্তী কয়েক দশক ধরে সৌদি আরবের তেলশিল্প দ্রুত প্রসারিত হয়। এ সময়টি ছিল সৌদি সরকারের, যুক্তরাষ্ট্রের বড় বড় তেল কোম্পানি এবং মার্কিন সরকারের পরস্পর নির্ভরশীলতার যুগ—সৌদি শাসকের নিরাপত্তায় (Military Protection) সাহায্য করত যুক্তরাষ্ট্র, আর বিনিময়ে তারা পেত তেল। কিন্তু সৌদিরা ধীরে ধীরে উপলব্ধি করে যে তাদের কাছে বিশাল সম্পদ রয়েছে, আর এ সম্পদ অন্যের নিয়ন্ত্রণে রাখতে তারা নারাজ। ফলে ১৯৬০ ও ১৯৭০-এর দশকে তেলের মালিকানা আস্তে আস্তে মার্কিন কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে সৌদি সরকারের হাতে চলে যায়। সৌদির তেলমন্ত্রী আহমেদ জাকি ইয়ামানি (Ahmed Zaki Yamani) এই পথনির্দেশনা দিয়েছিলেন।
সে সময় শুধু সৌদিতেই নয়, আরও অনেক দেশে—যেমন ভেনেজুয়েলা (Venezuela), লিবিয়া (Libya), ইরাক (Iraq), কুয়েত (Kuwait)—তেলশিল্প জাতীয়করণ চলছিল। একই সময়ে, সৌদি আরব সোভিয়েত ইউনিয়নের (Soviet Union) প্রভাব থেকেও রেহাই পাচ্ছিল না। ১৯৫০ ও ১৯৬০-এর দশকে সোভিয়েতরা নিজেদের স্যাটেলাইট রাষ্ট্রগুলো (Satellite States)—পূর্ব ইউরোপ (Eastern Europe), উত্তর কোরিয়া (North Korea), কিউবা (Cuba)—এসব জায়গায় তেল সরবরাহ করত। সেই বাড়তি তেল তারা বিশ্ববাজারে ছেড়ে দিয়ে দাম কমিয়ে দিত। এতে সৌদির রপ্তানি (Export) আয়ে চাপ পড়ে। সৌদিরা এই অতিরিক্ত সরবরাহের প্রতিক্রিয়ায় অন্যান্য বড় তেল-রপ্তানিকারী দেশের সঙ্গে সমন্বয় শুরু করে, যাতে তারা নিজেদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যগুলো পুরণ করতে পারে। এভাবেই ১৯৬০ সালে তৈরি হয় অর্গানাইজেশন অব পেট্রোলিয়াম এক্সপোর্টিং কান্ট্রিজ (OPEC), যা আজকের দিনে বিশ্বের প্রমাণিত তেল মজুদের (Proven Oil Reserves) ৮০%-এর বেশি উত্তোলনের হার নিয়ন্ত্রণ করে।
১৯৭৩-এর আরব অয়েল এমবার্গো, নিক্সনের ‘প্রজেক্ট ইন্ডিপেনডেন্স’ ও ব্যর্থতা
১৯৭৩ সালে আরব ও ইসরায়েলের মধ্যে ইয়ম কিপুর যুদ্ধ (Yom Kippur War) চলাকালীন, মিশর (Egypt) ও সিরিয়ার (Syria) বিপরীতে ইসরায়েলকে (Israel) পশ্চিমা বিশ্বের সামরিক সহায়তার প্রতিবাদে সৌদি আরব এবং অন্যান্য আরব ওপেক দেশগুলো যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের বিরুদ্ধে তেল এমবার্গো (Embargo) বা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। ফলস্বরূপ তখন বিশ্ববাজারে তেলের দাম দ্রুত আকাশচুম্বী হয়, মার্কিন ব্যবসাগুলো তেল-সংকটে ধুঁকতে থাকে, আর যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। দৈনন্দিন জীবনে দেখা যায়, পেট্রোল স্টেশনে সংকট দেখা দেয়। ড্রাইভিংয়ের গতি-সীমা (Speed Limit) ৫৫ মাইল-এ নামিয়ে আনতে হয়। এর ছয় বছর পর ইরানে (Iran) বিপ্লব দেখা দিলে আরও একবার বিশ্ব বাজারে তেলের দাম বেড়ে যায়। এটি ছিল প্রথমবারের মতো, কিন্তু শেষবার নয়, যখন যুক্তরাষ্ট্রের ওপর মধ্যপ্রাচ্যের তেলনির্ভরতাকে নগ্নভাবে প্রকাশ করে দিল।
১৯৭৩ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের (United States) প্রেসিডেন্ট এমন একটি কাজ করেছিলেন, যা সে সময় “অচিন্তনীয়” বলে বিবেচিত হয়েছিল। তিনি আক্রমণ করেছিলেন আমেরিকার সবচেয়ে পবিত্র প্রতীকগুলোর একটিকে। আর সেটা ছিল গাড়ি (automobile)। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সাবারবান-বুম (suburban boom) চলাকালীন, অর্থাৎ একের পর এক উপশহর গজিয়ে উঠছিল যখন, তখন জাতীয় টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচারের সময়, নিক্সন (Nixon) নাগরিকদেরকে (যারা কিনা অত্যন্ত স্বাধীনতাপ্রেমী ও অধিক জ্বালানি ব্যবহারকারী (gas-guzzling)) কারপুল (carpool) করতে—অথবা বিশ্বাস করা আরও কঠিন যেটা – প্রয়োজন হলে গণপরিবহন (public transit) ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছিলেন। তিনি বলছিলেন, “আমি আজ রাতে আপনাদের সঙ্গে একটি জাতীয় সমস্যার বিষয়ে কথা বলতে চাই। কতবার আপনারা মহাসড়ক বা ফ্রিওয়ে দিয়ে গিয়েছেন আর দেখেছেন, শত শত গাড়ি চলছে, কিন্তু প্রতিটিতে মাত্র একজন করে মানুষ?”
নিক্সন সেসময় যা করেছিলেন, আজকের দিনে কোনো রাজনীতিবিদ সেটি করার সাহস পেতেন না: একটি জাতীয় গতিসীমা (speed limit) নির্ধারণ করেছিলেন, যা ছিল ঘণ্টায় মাত্র ৫৫ মাইল। এটা পরিবেশের প্রতি আকস্মিক সহমর্মিতা বা আমাদের সম্মিলিত স্বাস্থ্যের ব্যাপারে উদ্বেগ ছিল না। বরং এটা ছিল এক জরুরি অবস্থা—একটি জ্বালানি-সংকট (energy emergency)। সৌদির (Saudi Arabia) নেতৃত্বে একটি তেল-নিষেধাজ্ঞা (oil embargo) আরোপিত হওয়ায় সিয়াটল (Seattle) থেকে সাভানা (Savannah) পর্যন্ত বহু পেট্রোল পাম্পে তেল বলতে গেলে ছিলই না। আর পর্যাপ্ত তেল ছাড়া, দীর্ঘদিন ধরে আমেরিকার যে সমৃদ্ধ জীবনধারা (lifestyle of abundance) চর্চিত হচ্ছিল, তা হঠাৎ করেই থেমে গিয়েছিল।
এতে আমেরিকার মতো একটি সুপারপাওয়ার (superpower) প্রথমবারের মতো তার দুর্বলতার মুখোমুখি হয়েছিল। তারা প্রতিজ্ঞা করেছিল যে এ রকম অবস্থা আর কখনোই হতে দেওয়া যাবে না। তাই নিক্সন ঘোষণা করলেন “প্রজেক্ট ইন্ডিপেনডেন্স” (Project Independence)। তিনি বলেছিলেন, ১৯৮০ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র অন্য কোনো দেশের ওপর জ্বালানির (energy) জন্য নির্ভর করবে না।
তবে বাস্তবে তা ঘটেনি। নিক্সন যে “এনার্জি রেনেসাঁ” (energy renaissance) কথা দিয়েছিলেন, সেই প্রতিশ্রুতির ফলাফল হলো সম্পূর্ণ ভিন্ন। তেল-সংকটের (oil crisis) পর আমেরিকার জন্য শুরু হলো এক পতনের পর্ব—এটি ছিল বিজ্ঞানী এম. কিং হাবার্ট (M. King Hubbert) প্রদত্ত ১৯৫৬ সালের একটি চাঞ্চল্যকর পূর্বাভাসের বাস্তব রূপ, যার নাম “পীক অয়েল” (peak oil)। এই ধারণা বলছে, যুক্তরাষ্ট্রের অপরিশোধিত তেলের (crude oil) উৎপাদন প্রায় ১৯৭০ সালের দিকে সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছাবে, তারপর তা দ্রুতহারে কমতে থাকবে। তখন যে সামান্য তেল বাকি থাকবে, সেটি তুলতে একপ্রকার দৌড়ঝাঁপ শুরু হবে।
কিন্তু এখন পীক অয়েলকে আমরা একরকম মজার ভবিষ্যদ্বাণী হিসেবেই দেখি—যেমন উড়ন্ত গাড়ি (flying cars) বা অতিজনসংখ্যা (overpopulation) নিয়ে অতীতে ভয় পাওয়া হতো। তেলের সর্বনাশ বা “অয়েল অ্যাপোক্যালিপস” (oil apocalypse) যদি এসে থাকে, তাহলে আমেরিকানরা সেটি টের পায়নি। আজ আমেরিকানরা আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি বড় এসইউভি (SUV) ও ট্রাক চালায়। তবে উৎপাদনের হিসাব দেখলেই পার্থক্য বোঝা যায়।
যুক্তরাষ্ট্রের মূল ভূখণ্ডের (lower 48 states) তেল উৎপাদন দেখলে দেখা যায়, সেখানে পীক অয়েল সত্যি ছিল। ১৯৭০ সালে সর্বোচ্চ উৎপাদনের পর তা হুবহু পূর্বাভাস অনুযায়ী কমতে থাকে—১৯৭০ সালে ১১ মিলিয়ন ব্যারেল প্রতিদিন থেকে ২০০৮ সালে মাত্র ৭ মিলিয়ন ব্যারেল প্রতিদিনে পৌঁছায়। অন্যদিকে, “প্রজেক্ট ইন্ডিপেনডেন্স” একেবারে ব্যর্থ হয়েছিল—ছয় বছরের মধ্যেই তেল আমদানি (imports) দ্বিগুণ হয়ে যায়। এমনকি ১৯৭৬ সালের তুলনায় ২০০৬ সালে সৌদি আরব থেকে যুক্তরাষ্ট্র আরও বেশি তেল কিনেছিল। তারপর কিছু একটা পরিবর্তন ঘটতে শুরু করে।
যাই হোক, এই দুর্যোগ সামাল দিতে যুক্তরাষ্ট্র দেশের অভ্যন্তরীণ তেলের ওপর ৪০ বছরের জন্য রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা (Export Ban) দেয়। সৌদি আরব বিশ্বকে দেখিয়ে দিল যে তারাই প্রধান তেল-ক্ষমতা এবং বিশ্বপরিস্থিতিকে নিজেদের পক্ষে নিয়ে আসতে তারা নির্দ্বিধায় নিষেধাজ্ঞা ব্যবহার করতে পারে। পরবর্তী কয়েক দশক এভাবেই চলতে থাকে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের (Collapse of the USSR) আগে এবং পরে, রাশিয়ায় (তখন সোভিয়েত ইউনিয়ন) তেল উৎপাদন কমতে থাকে—বিশেষত ১৯৮০-এর দশকের শেষ ভাগ থেকে ১৯৯০-এর দশক পর্যন্ত—যার ফলে ওপেকের হাতে বাজারের নিয়ন্ত্রণ আরও মজবুত হয়।
এদিকে, ওপেকের ওপর নির্ভরশীলতা থেকে যেন আর বিপাকে পড়তে না হয়, যুক্তরাষ্ট্র জ্বালানি আমদানি (Import) বৈচিত্র্যময় করার কৌশল নেয়। তাদের অভ্যন্তরীণ তেল উৎপাদনও ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছিল। এরই মধ্যে বিশ্লেষক ও সামরিক বিশেষজ্ঞরা বারবার বলে আসছিলেন—যুক্তরাষ্ট্রের জ্বালানি নিরাপত্তা (Oil Security) এবং বিদেশি জ্বালানি উৎপাদনের ওপর নিয়ন্ত্রণহীনতা তাদের একটি প্রধান দুর্বলতা হয়ে উঠেছে। অনেকে মনে করেন, ২০০৩ সালে ইরাকে (Iraq) মার্কিন হামলার অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য ছিল ইরাকের তেলক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের প্রবেশাধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা। কারণ ৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে সেখানে মার্কিন তেল কোম্পানিগুলোর কাজ করার সুযোগ ছিল না। পরবর্তীতে সেখানে হলিবার্টন (Halliburton) নামের একটি তেল পরিষেবা কোম্পানি—যার সঙ্গে তৎকালীন মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট ডিক চেনির (Dick Cheney) সংশ্লিষ্টতা ছিল—তারা আবারও কাজ শুরু করে।
রাষ্ট্রীয়ভাবে তখন যুক্তরাষ্ট্র বলছিল, ইরাকের স্বৈরশাসক সাদ্দাম হুসেইনের (Saddam Hussein) কাছে ব্যাপক বিধ্বংসী অস্ত্র (Weapons of Mass Destruction) আছে এবং তিনি বিশ্বশান্তির জন্য হুমকি। কিন্তু আজ পর্যন্ত সে দাবির কোনো প্রমাণ মেলেনি। যাই হোক, ইরাকে ঢোকার পর যুক্তরাষ্ট্র ইরাকি তেল-আমদানি বাড়ানোর সুযোগ পেল। যদিও এর ফলে বাইরের তেলের ওপর মার্কিন নির্ভরশীলতা বড় কোনো পরিবর্তন হয়নি।
তো, সব মিলে ১৯৭০ সাল থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ৩৮ বছর দেশটির তেল উৎপাদন ক্রমাগত হ্রাস পায়। এ সময় বিশ্ববাণিজ্য আরও আন্তঃসম্পর্কিত হয়ে উঠছিল, বাণিজ্য সংক্রান্ত বিধিনিষেধও কমছিল। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের সহজে উত্তোলনযোগ্য তেলের মজুদ (Easily Accessible Reserves) কমে আসতে থাকে। ফলে তেল আমদানি করা তুলনামূলক সাশ্রয়ী হয়ে দাঁড়ায়—বিশেষ করে কানাডা (Canada), ভেনেজুয়েলা (Venezuela), মেক্সিকো (Mexico), সৌদি আরব এবং ইরাক (Iraq)-এর মতো দেশে তেল সহজলভ্য ও কম খরচে উত্তোলনযোগ্য ছিল। যদিও এই আমদানি-নির্ভরতা পুরোপুরি নিরবচ্ছিন্ন ছিল না। ওপেক (OPEC)-এর মতো সংস্থা তেলের বাজার নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা দেখিয়ে দেয়।
জর্জ বুশের ভবিষ্যদ্বাণী, শেল (Shale) বিপ্লবের সূচনা ও অপ্রত্যাশিত জ্বালানি পুনর্জাগরণ
২০০৭ সালে, তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ (George Bush) ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে, যুক্তরাষ্ট্র কিছু প্রযুক্তিগত সাফল্যের (technological breakthroughs) দ্বারপ্রান্তে রয়েছে, যা আমাদের বিদেশি তেলের (foreign oil) উপর নির্ভরতা নাটকীয়ভাবে কমিয়ে দেবে। তবে সত্যি কথা বলতে, তখন তেমন কোনো কারণ ছিল না যে আমরা তার কথা বিশ্বাস করব। এর আগেও ৩০ বছর আগে রিচার্ড নিক্সন (Richard Nixon) একই রকম দাবি করেছিলেন, অথচ সেসময় যুক্তরাষ্ট্রের তেল ব্যবহার (oil consumption) প্রায় সর্বোচ্চ মাত্রায় পৌঁছেছিল। একই সময়ে, মার্কিন তেল উৎপাদন (US oil production) টানা চার দশক ধরে নিয়মিতভাবে হ্রাস পাচ্ছিল। যুক্তরাষ্ট্র ইতোমধ্যে দেশটির অভ্যন্তরের অধিকাংশ সম্ভাব্য জায়গা থেকে তেল উত্তোলন শেষ করে ফেলেছিল, সমুদ্রের গভীরে খনন কাজও অনেক দিন ধরেই চলছিল, এমনকি আলাস্কার (Alaska) শেষ সঞ্চিত উৎস থেকেও প্রায় সবটুকু তেল তুলে নেওয়া হয়েছিল। ফলে তেলের দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ এতটাই অন্ধকার মনে হচ্ছিল যে, তেল কোম্পানিগুলো হাজার হাজার মাইল দূরের সেন্ট্রাল এশিয়া (Central Asia), ওয়েস্ট আফ্রিকা (West Africa) ও সাউথ আমেরিকার (South America) মতো এলাকায় ‘সবুজ চারণভূমি’ খুঁজতে পাড়ি জমিয়েছিল।
পরিস্থিতি এমন ছিল যে, অঙ্ক কষলে নিশ্চিতভাবেই মনে হতো যুক্তরাষ্ট্র ভবিষ্যতে কম নয়, বরং আরও বেশি পরিমাণে বিদেশি তেলের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়বে। কিন্তু সবার বিস্ময় সত্ত্বেও, বুশ (Bush) ঠিকই বলেছিলেন।
এই ঘটনাগুলো প্রমাণ করে যে, মধ্যপ্রাচ্যের (Middle East) ওপর তেল-নির্ভরতা যুক্তরাষ্ট্রের দুর্বলতা হিসেবে গণ্য হতে থাকে। বিশেষ করে ২০০০-এর দশকে প্রেসিডেন্ট বুশের (Bush) ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ (War on Terror)’ শুরুর পর এটি আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের তেল শিল্পের স্বপ্ন ছিল ঘরোয়া মাটিতেই “কঠিন শিলাস্তরে (Tight Rock Formations)” আটকে থাকা তেল উত্তোলন করা। তবে সেসবে কারিগরি (Technology) ও লাভজনকতার (Profitability) বড় সীমাবদ্ধতা ছিল।
দীর্ঘ দিন ধরেই তাই নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছিল। এরপর আসে ২১ শতকের hydraulic ফ্র্যাকিং (Fracking) আবিষ্কার ও শেল বুম (Shale Boom)। ২১শ শতকের শুরুর দিকে জর্জ মিচেল (George Mitchell) এবং বারনেট শেল (Barnett Shale) সংক্রান্ত গবেষণায় বড় ধরনের সাফল্য আসে। দেখা গেল শেল শিলাস্তর (Shale Rock) ভেঙে তেল ও গ্যাস উত্তোলন সম্ভব—একটি নির্দিষ্ট অনুপাতে জল, বালি এবং রাসায়নিক (Chemicals) মিশ্রণ পাম্প করে শিলা ভেঙে ফেলে তেলের প্রবাহ তৈরি করা হয়, যাকে বলা হয় হাইড্রোলিক ফ্র্যাকিং (Hydraulic Fracking)। পরে এতে যোগ হয় অনুভূমিক খনন বা ড্রিলিং (Horizontal Drilling) প্রযুক্তি—ফলে একটিমাত্র কূপ থেকেই অনেক বেশি পরিমাণ তেল তুলতে শুরু করে।
যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ তেল মজুদ এত বেড়ে গেল যে, ২০১৫ সালে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা (Barack Obama) প্রায় ৪০ বছর পর কাঁচা তেল রপ্তানির নিষেধাজ্ঞা তুলে নেন। যুক্তরাষ্ট্র আবার বড়সড় তেল রপ্তানিকারী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করল। কিন্তু একই সময় সৌদি আরবসহ বড় সব তেল উৎপাদনকারী দেশগুলোও বিপুল পরিমাণে তেল সরবরাহ বাড়িয়ে দিচ্ছিল, যার ফলে ২০১৪-১৫ নাগাদ তেলের দাম প্রায় ৭০% পর্যন্ত পড়ে যায়। এই পরিস্থিতিতে ওপেক (OPEC) বেশ কিছু পদক্ষেপ নেয়। তারা অতিরিক্ত ১০টি তেল-উৎপাদক দেশের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়—যাকে এখন ওপেক প্লাস (OPEC Plus) বলা হয়—যাতে মিলিতভাবে উৎপাদন নিয়ন্ত্রণ করে দাম স্থিতিশীল রাখা যায়। ওই ১০টি দেশের মধ্যে রাশিয়া অন্যতম বড় উৎপাদক। সৌদি আরব ও রাশিয়ার এই ঐক্য প্রমাণ করে যে, যুক্তরাষ্ট্রের শেল বুম তাদের জন্য কতখানি হুমকি তৈরি করেছে।
যাই হোক, এভাবে ২০০৭ সালে বুশের করা ভবিষ্যদ্বাণীর এক বছরেরও কম সময়ের মধ্যে, একটি জ্বালানি ‘পুনর্জাগরণ’ (energy renaissance) শুরু হয়। মাত্র পাঁচ বছরের মাথায় যুক্তরাষ্ট্রের তেল উৎপাদন দ্বিগুণ হয় এবং ১০ বছরের মধ্যে প্রায় তিন গুণ বেড়ে যায়। এটি আমেরিকান অর্থনীতি (American economy) এবং বিশ্বের বুকে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানকে আমূল বদলে দেয়। ২০২৩ সালের মধ্যে, যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার (Russia) তুলনায় দ্বিগুণ পরিমাণ পেট্রোলিয়াম (petroleum) উৎপাদন করছিল— অথচ কিছুদিন আগেই রাশিয়াকে (Russia) একটি “দেশের ছদ্মবেশে গ্যাস স্টেশন (gas station masquerading as a country)” বলে ব্যঙ্গ করা হতো।
প্রায় ২০০৮ সালের কাছাকাছি সময়ে, যুক্তরাষ্ট্রের তেল শিল্পে (oil industry) এমন এক চমকপ্রদ প্রত্যাবর্তন শুরু হয়েছিল, যা কেউই প্রত্যাশা করেনি। আমেরিকা রাতারাতি এক ধরনের জ্বালানি-সুপারপাওয়ার (energy superpower) হয়ে উঠল। দীর্ঘ চার দশকের উৎপাদন-পতন মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যেই উল্টে গেল এবং দিনে ১২ মিলিয়ন ব্যারেল তেল উৎপাদনের নতুন রেকর্ড তৈরি হলো। বছর-কিছু পরপর উৎপাদন শুধু বাড়তেই থাকল। ২০১৮ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র পৃথিবীর এক নম্বর তেল উৎপাদক হয়ে উঠল—কানাডা (Canada), রাশিয়া (Russia), এমনকি তার পুরোনো তেলপ্রতিদ্বন্দ্বী সৌদি আরবকেও (Saudi Arabia) পেছনে ফেলে। এখন সৌদি আরব যুক্তরাষ্ট্রের তেলের চাহিদার ৩%-এরও কম সরবরাহ করে। এর ঠিক দুই বছর পরেই, যুক্তরাষ্ট্র যে পরিমাণ তেল ব্যবহার করে, তার চেয়ে বেশি উৎপাদন শুরু করে—অথচ যুক্তরাষ্ট্রের জ্বালানি ব্যবহার ভারতের (India) ও চীনের (China) সম্মিলিত ব্যবহার থেকেও বেশি। শুধু টেক্সাসের (Texas) একটি তেলক্ষেত্র (oil field) এখন এত বেশি তেল উত্তোলন করে যা বিশ্বের মধ্যে মাত্র দু-একটি দেশের সামগ্রিক উৎপাদনের সমান।
ঐতিহ্যবাহী তেল উত্তোলন বনাম ফ্র্যাকিং (Fracking)
তো কী ঘটেছিল? ২০০৮ সালের আগ পর্যন্ত, সবচেয়ে প্রচলিত তেল উত্তোলন পদ্ধতিটি খুব সহজ ছিল:
- ১. মাটিতে একটি গর্ত (well) খনন করা।
- ২. সেখান থেকে পাম্পের সাহায্যে তেল (oil) উপরিভাগে তুলে আনা।
এটি যেমন সস্তা, তেমনি সহজ। দি তেল কোম্পানিগুলো চিরকাল এভাবেই করে যেতে পারত, তারা তাই করত। কিন্তু ১৯৭০-এর দশক থেকেই ঐতিহ্যবাহী পদ্ধতিতে তেল (conventional oil) কমে আসতে শুরু করে। ২০০০-এর দশকের গোড়ার দিকে সবাই ধরে নিয়েছিল যে আমেরিকার সেরা তেল দিনগুলো শেষ। মনে হচ্ছিল, ১৯৭০ সালে পীক ছোঁয়ার পর থেকে যে গতিতে পতন হচ্ছে, সেটি আর থামবে না। আসলে তেলের অভাব ছিল না; বরফে ঢাকা আর্কটিকের (Arctic) নিচে এখনো প্রচুর তেল আছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, কী পরিমাণ খরচ করলে সেই তেল উত্তোলন অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক (commercially viable) হবে?
তেল বিক্রির সময় আন্তর্জাতিক বাজার (international market) অনেকাংশে তেলের একটি একক দর (global price) নির্ধারণ করে। কিন্তু যখন উত্তোলনের কথা আসে, তখনই বোঝা যায় সব তেল সমান নয়। কিছু তেল সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১০,০০০ ফুট নিচে জলরাশির (underwater) তলায় আটকে থাকে—যা তুলতে প্রচুর খরচ হয়। কিছু তেল গর্ত ফেলে তুলতে গেলে সহজে উঠে আসে—যেখানে খরচ প্রায় নেই বললেই চলে। আবার কিছু তেল ওকলাহোমা (Oklahoma) অঙ্গরাজ্যের রাজধানী ভবনের নিচে আটকে আছে—অবস্থা বেশ বিব্রতকর।
স্বাভাবিকভাবেই, যেখানে খরচ কম—সেই সহজ তেল (conventional oil) সবার আগে উত্তোলন করা হয়। এটি আসে সুবৃহৎ ভূগর্ভস্থ “ঝাঁকে” (vast underground pools) জমা হয়ে থাকা তেল হিসেবে। একটা গর্ত করলেই দ্রুত ও সহজে সেই তেল তোলা যায়। যুক্তরাষ্ট্র এই সহজ-তেল উৎপাদনের সর্বোচ্চ বিন্দুতে (peak conventional) পৌঁছেছিল ১৯৭০ সালে—তারপর থেকেই পতন। পরে তারা আরও ব্যয়বহুল অফশোর (offshore) ড্রিলিংয়ের পথে যায়। আশির দশকে শীতল আলাস্কার (Alaska) তেলখনি থেকে যতটুকু পারা যায় উত্তোলন করা হয়। সব মিলিয়ে যখন এসব উৎস ফুরিয়ে আসে, তখন বাকি ছিল কেবল কঠিন ও ব্যয়বহুল উৎস—“স্ক্র্যাপস”।
যেমন, তেলের বড় একটা অংশ আটকে ছিল শেল (shale) নামে পরিচিত একধরনের ঘন স্তরে (dense sedimentary rock)। ফলে প্রথমে সেই শেল ভাঙতে হবে, তারপর সেখান থেকে তেল বের করতে হবে। মার্কিনিরা জানত কীভাবে তা করা যায়—হাইড্রোলিক ফ্র্যাকচারিং (hydraulic fracturing) বা ফ্র্যাকিং (fracking) যুগান্তকারী কোনো নতুন পদ্ধতি নয়। পঞ্চাশের দশক থেকে এ ধারণা বিদ্যমান। এই পদ্ধতিতে, উচ্চচাপের জল ও বালি (high pressure water and sand) ভূগর্ভস্থ শেল পাথর (shale rock) ভেঙে দেয় এবং এর ভেতরে আটকে থাকা তেলকে বের করে আনে। সাধারণ ড্রিলের মতোই প্রথমে খাড়াভাবে ভূগর্ভে ড্রিল করা হয়। এরপর উচ্চচাপের জল (high-pressure water) পাম্প করা হয়, যা পাথর ভেঙে দেয়। বালি (sand) ছোট ফাটলগুলো খোলা রাখে। তারপর শেলের ভেতরে আটকে থাকা তেল উপরে তোলা হয়। বিষয়টা রকেট বিজ্ঞানের (rocket science) চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়, আবার খরচ কিন্তু প্রায় রকেট বানানোর মতোই ব্যয়বহুল হয়ে দাঁড়ায়। কারণ প্রচলিত বা অফশোর ড্রিলিংয়ের চেয়ে এটি আরও ব্যয়বহুল। কিন্তু তেলের বাজারমূল্য যদি কম হয়, তখন এই পদ্ধতি লাভজনক হয় না। সেই কারণে একসময় ফ্র্যাকিংকে একরকম “অ্যাকাডেমিক কৌতূহল” হিসেবেই দেখা হতো।
এদিকে তেল জগতের বড় বড় প্রতিষ্ঠান (Big Oil) তখন আরও বড় হচ্ছিল। উদাহরণস্বরূপ, ১৯৯৮ সালে এক্সন (Exxon) ও মোবিল (Mobile) মিলে এক্সনমোবিল (ExxonMobil) তৈরি করে। এ ধরনের মেগা-কর্পোরেশনগুলো নতুন, বিশাল তেল-ফিল্ড (oil field) আবিষ্কারের জন্য আরও আগ্রহী ছিল। যুক্তরাষ্ট্রে যে সামান্য তেল পড়ে আছে, তা তুলতে গেলে লাভের চেয়ে খরচই বেশি মনে হচ্ছিল। তখন ব্রাজিল (Brazil), কাজাখস্তান (Kazakhstan), কিংবা ঘানার (Ghana) মতো জায়গায় সহজেই বড় আকারে তেল উত্তোলন করে প্রচুর লাভ করা যেত। ফলে এই বিশাল কোম্পানিগুলো আমেরিকার “পেছনের উঠোন” ফেলে রেখে বিদেশে চলে গিয়েছিল।
ওয়াইল্ডক্যাটার (Wildcatters) ও শেল বিপ্লব
এসবের ফলে যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরে প্রতিদ্বন্দ্বিতা কমে যায়। তখন দেখা দিল ওয়াইল্ডক্যাটাররা (অর্থাৎ ব্যক্তিগতভাবে ড্রিলিং করার উদ্যোগ যাদের) আশায় থাকে তারা “সোনার খনি” (strike gold) আবিষ্কার করবে। তারা ছোট, ক্ষিপ্র ও সর্বোপরি আগ্রহী। এদিকে অন্য এক কারণে চীনের (China) মতো দেশে তেলের চাহিদা বাড়ছিল, ফলে তেলের দাম বাড়ছিল দ্রুত। শেল থেকে তেল উত্তোলনের খরচ আর বিক্রয়মূল্যের মধ্যে আগে যে ব্যবধান, বা “গ্যাপ” অনেক ছিল, সেটি এখন অনেকটাই কমে আসে।
তাই তারা ফ্র্যাকিংয়ের খরচ কমাতে বিভিন্ন পরীক্ষানিরীক্ষা শুরু করে। তাদের প্রথম বড় সাফল্য এলো “হরাইজন্টাল ড্রিলিং” (horizontal drilling) থেকে। ২০০০-এর দশকের শুরুর দিকে “শেল গেইল (Shale Gale)” নামে পরিচিত এই ফ্র্যাকিং প্রযুক্তির প্রসার ঘটে। অনেকে একে বলতেন “ওয়াইল্ডস্পিরিট (Wild-Spirit) স্বাধীন অপারেটরদের যুগ”, যাদের আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতা আসে ব্যক্তিগত ইকুইটি (Private Equity) এবং ভেঞ্চার ক্যাপিটালিস্টদের (Venture Capitalists) কাছ থেকে। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের স্থবির (Stagnant) তেলশিল্প আবারও সচল হয়।
কেবল খাড়াভাবে (vertical) ড্রিল করলে টার্গেট ফসকে গেলে আবার নতুন করে শুরু করতে হতো। কিন্তু শেল (shale formations) ভূমির সমান্তরালে (parallel to the ground) স্তরে থাকে। কাজেই অনুভূমিক ড্রিল করলে (drill horizontally) সেই শেল-স্তরের বৃহৎ অংশ থেকেই তেল তোলা যায়। তারপর তারা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর ড্রিল ব্যবহার শুরু করে—এক মাইল, দুই মাইল, তিন মাইল, এমনকি চার মাইল দূর পর্যন্ত। তারা ক্রমে জানতে পেরে গেল কীভাবে “সুইট স্পট” (sweet spots) চিহ্নিত করতে হবে, কতটা দূরত্বে প্রতিটি ড্রিল বসাতে হবে যাতে একটির সাথে আরেকটির মধ্যে কম বিরোধ সৃষ্টি হয়। তারা জল, বালি ও রাসায়নিকের (chemical mixture) মিশ্রণকেও উন্নত করে তোলার পদ্ধতি বার করল, যাতে শেল সহজে ভেঙে তেলের প্রবাহ আরও বেড়ে যায়। প্রতিটি উদ্ভাবন ব্যয় কমিয়েছে আর উৎপাদন বাড়িয়েছে। পাশাপাশি “একটি করতে গেলে আরেকটি ফ্রি”—তেল উত্তোলনের সময় কিছু প্রাকৃতিক গ্যাস (natural gas) বিনামূল্যে উঠে আসে, যা অনেক সময় বিশাল বোনাস হিসেবে দেখা যায়। কিন্তু একে ঠিকমতো ধারণ (capture) না করলে এটি উল্টে সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়, কারণ তখন মিথেন (methane) জাতীয় গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ বেড়ে যায়।
টেক্সাসের (Texas) পারমিয়ান বেসিন (Permian Basin) হয়ে ওঠে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ তেলক্ষেত্র। উত্তর ডাকোটার (North Dakota) বাক্কেন শেল (Bakken Shale) এলাকাও হয়ে ওঠে তেলের স্বর্ণখনি (Modern-Day Gold Rush)। চাকরির সুযোগ, উচ্চ মজুরি আর নতুন নগরায়ণের (Urban Sprawl) জোয়ারে ছোট ছোট শহরগুলো রাতারাতি বদলে যায়। উইলিস্টন (Williston) আর ওয়াটফোর্ড সিটি (Watford City)-তে মানুষের ভিড় এত বেড়ে গিয়েছিল যে, উত্তর ডাকোটা ছিল একমাত্র অঙ্গরাজ্য যার জনসংখ্যা ২০১০-এর তুলনায় ২০২১ সালে তুলনামূলকভাবে কম বয়সী হয়ে উঠেছিল। ২০০৮ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত রাজ্যটির ছিল যুক্তরাষ্ট্রের সর্বনিম্ন বেকারত্ব (Unemployment) এবং তেল রাজস্ব থেকে তারা বিশাল বাজেট উদ্ধৃত্ত (Fiscal Surplus) উপভোগ করে।
তবে এই সাফল্যের সাথেই এসেছিল চ্যালেঞ্জ। তেল মজুত কেন্দ্রগুলো (Oil Storage Facility) দ্রুত পূর্ণ হয়ে যেতে থাকে। ওকলাহোমার (Oklahoma) কুশিং (Cushing) কেন্দ্র, যেটি উত্তর আমেরিকায় পাইপলাইনের (Pipeline) মূল সংযোগস্থল এবং বৈশ্বিক তেলের বেঞ্চমার্ক নির্ধারণে ব্যবহৃত হয়, ২০১৭ সালে রেকর্ড ৬৯ মিলিয়ন ব্যারেল তেল মজুতের মাইলফলক অতিক্রম করে।
উত্তর ডাকোটার সেই ‘বুম (Boom)’ খুব দ্রুত থেমে যায়—২০১৫ সালে উৎপাদন প্রবৃদ্ধি থমকে যায়। তবে টেক্সাসের উত্থান এখনো অব্যাহত রয়েছে। ২০১০ সাল থেকে টেক্সাসের তেল উৎপাদন পাঁচ গুণ বেড়ে গেছে, যা যুক্তরাষ্ট্রের মোট তেল উৎপাদনের ৪৩%। ফ্র্যাকিং এত দ্রুত বেড়েছে যে, উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় বালির (Sand) অভাব এখন প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে—কারণ শিলাস্তর ভাঙতে প্রচুর বালি লাগে।
ফলাফলস্বরূপ, পুরনো ঐতিহ্যবাহী (Traditional) পদ্ধতিতেও সামান্য উৎপাদন হয় বটে, তবে যুক্তরাষ্ট্রের মোট উৎপাদনের দুই-তৃতীয়াংশই এখন ফ্র্যাকিং থেকে আসে।
কেন ফ্র্যাকিং (Fracking) যুক্তরাষ্ট্রে এত সফল?
কানাডা (Canada) বা আর্জেন্টিনা (Argentina)-তেও ফ্র্যাকিং আছে, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের মতো সাফল্য সেখানে দেখা যায়নি। মূল কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে:
- বড় আকারের শেল অঞ্চলের প্রাপ্যতা (Large Shale Formations): যুক্তরাষ্ট্রে বড় বড় শেল ক্ষেত্র আছে, যা অনেক দেশেরই নেই।
- প্রযুক্তিতে প্রথম উদ্যোগ (First-Mover Advantage): ফ্র্যাকিং-এর উদ্ভাবন হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে, তাই শুরু থেকেই তারা সব সুযোগ কাজে লাগাতে পেরেছে।
- দক্ষ শ্রমশক্তি ও বিদ্যমান অবকাঠামো (Skilled Labor & Infrastructure): দেশটিতে আগে থেকেই পর্যাপ্ত পাইপলাইন (Pipelines) ছিল, যা তেল পরিবহনে কাজ দিয়েছে।
- শিথিল নিয়ন্ত্রক পরিবেশ (Favorable Regulatory Environment): ভূমির মালিকরা (Land Owners) খুব দ্রুত কোম্পানিকে জমি ইজারা দিতে পেরেছেন।
- উদ্যোক্তা ও বিনিয়োগ (Venture Capital & Private Equity): যুক্তরাষ্ট্রের ফাইন্যান্সিয়াল মার্কেটে প্রচুর বেসরকারি বিনিয়োগকারীর উপস্থিতি প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনকে ত্বরান্বিত করেছে।
এসব মিলিয়ে যুক্তরাষ্ট্র খুব দ্রুত ফ্র্যাকিং বুম ঘটাতে পেরেছে। আজ দেশটির তেল উৎপাদন দেশে ভোগের (Consumption) চাহিদার সমান হয়ে গেছে। একসময়কার মার্কিন বাজার যেখানে বৈশ্বিক অস্থিরতার (Market Instability) কারণে তেলের জন্য অন্যের মুখাপেক্ষী ছিল, এখন তারাই শীর্ষ উৎপাদক।
পরিবেশগত বিতর্ক
যথাযথভাবে ধরতে পারলে ফ্র্যাকিংয়ের সময় পাওয়া প্রাকৃতিক গ্যাস কয়লার (coal) বিকল্প হয়ে দূষণ অনেকাংশে কমিয়ে দেয়। কিন্তু লিক হলে (leaked) মিথেন বায়ুমণ্ডলে যায়, যা কার্বন ডাই-অক্সাইডের (carbon dioxide) চেয়ে ৮০ গুণ বেশি উষ্ণতা ধরে রাখতে পারে। যথেষ্ট পরিমাণে মিথেন নিঃসরণ হলে কয়লার বিকল্প হিসেবেও এটি আর পরিবেশবান্ধব থাকে না—বরং ক্ষতিকর হয়ে দাঁড়ায়। এখানেই শেষ নয়। তেল বা গ্যাসের জন্য ফ্র্যাকিং করা বেশ জল (water) ও বালি-নির্ভর (sand-intensive)। একটি কূপে (well) কমপক্ষে ১.৫ মিলিয়ন গ্যালন জল লাগে। কোনো কোনো ড্রিলার কিছুটা জল পুনরায় ব্যবহার করলেও, এই ফ্র্যাক ফ্লুইড (frac fluid) অত্যন্ত বিষাক্ত, এমনকি তেজস্ক্রিয় (radioactive) হতে পারে, যা ছড়িয়ে পড়লে (spilled) ভূগর্ভস্থ জল দূষিত করার ঝুঁকি থাকে। ২০০৯ সালে পেনসিলভানিয়ার (Pennsylvania) একটি ছোট শহরে এমন ঘটনাই ঘটেছিল।
এসব কারণে এবং আরও নানা উদ্বেগ থেকে ফ্র্যাকিং নিয়েই বিতর্ক বয়ে চলে। কিন্তু কোটি কোটি ডলার লবিংয়ে (lobbying) ব্যয় করা ছাড়াও, এই শিল্পের (industry) হাতে রয়েছে আরেকটি শক্তিশালী হাতিয়ার—একটি চমৎকার গল্প। যখন বিশ্বের বড় বড় কর্পোরেশন আমেরিকার ভবিষ্যৎ নিয়ে আশাহত ছিল, তখন সাধারণ ব্যক্তি উদ্যোগপতিরা সেটাকে ভুল প্রমাণ করে দেখিয়ে দিয়েছে যে, এখান থেকে প্রায় শূন্য হাতে এসে কোটি কোটি ডলার আয় করতে পারে, এমনকি পুরো দেশকেই জ্বালানি সুপারপাওয়ার (energy superpower) এ রূপান্তরিত করা সম্ভব। আর সত্যিকার অর্থে, এই সাফল্যের পেছনে রয়েছে ছোট ছোট উদ্যোগের (scrappy entrepreneurial underdogs) অবদান। এমনটা অন্য কোথাও সহজে সম্ভব হতো না।
আমেরিকার অনন্য ভূগোল এবং শেল বিপ্লবের প্রভাব
যুক্তরাষ্ট্রের ৪৮টি সংলগ্ন অঙ্গরাজ্য (contiguous 48 states) পূর্ব দিকে অ্যাপালাচিয়ান (Appalachian) ও পশ্চিমে রকি পর্বতমালা (Rocky Mountains) দ্বারা পরিবেষ্টিত। মাঝের বিশাল সমতলভূমিকে (Great Plains) বলা হয় “গ্রেট প্লেইনস।” ৭ কোটি বছর আগে এই এলাকা ছিল জলমগ্ন। সেখানে মাছ, উদ্ভিদ ও শেওলা (algae) মারা যাওয়ার পর ভূগর্ভে চাপা পড়া জৈব পদার্থ ধীরে ধীরে তেলে পরিণত হয়। এর ফলে জমে ওঠে একের পর এক শেল স্তর, যা ফ্র্যাকিংয়ের জন্য আদর্শ। তাই আজ যে বড় বড় শেল-ফিল্ড দেখা যায়, সেগুলো মূলত মন্টানা (Montana) ও ড্যাকোটা (Dakotas) থেকে শুরু করে দক্ষিণে পশ্চিম টেক্সাস পর্যন্ত বিস্তৃত—সবই এই গ্রেট প্লেইনসের মধ্যে অবস্থিত।
আরও একটি বিষয় লক্ষণীয়। এই অঞ্চল অধিকাংশই জনবিরল (pretty much empty)। ফ্র্যাকিং একটি উচ্চ শব্দযুক্ত, ময়লা সৃষ্টিকারী ও দেখতে বিশ্রী প্রক্রিয়া। মিলিয়ন মিলিয়ন গ্যালন জল বহনকারী ট্রাক চলাচল করবে, কখনো কখনো বিস্ফোরণও (explosion) ঘটতে পারে। জনবহুল এলাকায় হলে প্রতিবাদ বা বিরোধের মাত্রা অনেক বেশি হতো। কিন্তু পার্মিয়ান বেসিন (Permian Basin) (যেখানে আমেরিকার সবচেয়ে বড় শেল তেলক্ষেত্র) যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে জনশূন্য অঞ্চলগুলোর মধ্যে পড়ে। অন্যদিকে শেল উত্তোলনকারীদের কিছু অবকাঠামো (infrastructure) প্রয়োজন—যেমন কর্মী, কর্মীদের জন্য দোকান, সড়কপথ ইত্যাদি। পশ্চিম টেক্সাস একেবারে জনশূন্য নয়— সেখানে ওয়ালমার্ট (Walmart) আছে, মহাসড়ক আছে। কিন্তু রাশিয়ার অনেক তেলক্ষেত্র তো উত্তর মেরু অঞ্চলে (Arctic Circle) অবস্থিত, যেখানে কেবল প্লেনে করেই যাওয়া যায়। ফলে ভৌগোলিকভাবে যুক্তরাষ্ট্র অদ্ভুতভাবে অনেকটা “লটারি জিতেছে” (geographic lottery) — শেল উত্তোলনের জন্য পারফেক্ট গোল্ডিলক্স জোন (perfect Goldilocks zone) পেয়ে গেছে।
এর সঙ্গে যোগ করুন ১৯৭০-এর দশকের ঐতিহ্যবাহী ড্রিলিং পরিকাঠামো, যা তখন থেকেই বিদ্যমান ছিল। সব মিলিয়ে, আমেরিকার নিখুঁত ভূগোল, শেলের “গল্পগাথা,” ২০০০-এর দশকের শুরুর উচ্চ তেলের দাম, এবং বড় সংস্থাগুলোর ফাঁকা করে দেওয়া প্রতিযোগিতার ক্ষেত্র – এসব মিলে গড়ে উঠেছে ইতিহাসের অন্যতম বড় জ্বালানি-বিপ্লব। আর এটি বন্ধ করার মতো রাজনৈতিক সদিচ্ছাও (political appetite) বিশেষ দেখা যায়নি।
রাজনৈতিক সমর্থন ও অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার
একবিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে যুক্তরাষ্ট্রে দুটি দলই (দুই রাজনৈতিক শিবির) শেলের পক্ষে ছিল—কেউ নীরবে, কেউ প্রকাশ্যে। জর্জ বুশ (George Bush) নিজেই একজন “অয়েল ম্যান” ছিলেন। বারাক ওবামা (Barack Obama) দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে “প্রো-ফ্র্যাকিং” (pro-fracking) আইন সই করেছিলেন। ডোনাল্ড ট্রাম্প (Donald Trump) তো এ শিল্পের একরকম মুখপাত্র হিসেবেই কথা বলতেন। এমনকি জো বাইডেন (Joe Biden) তেলের উৎপাদন বাড়াতে কোম্পানিগুলোকে অনুরোধও করেছিলেন।
শেল প্রযুক্তি যেভাবে দেশকে এক নতুন পর্যায়ে নিয়ে গেছে, তাতে দুই দলই একরকম উপকৃত হয়েছে—বিশেষত ২০০৮ সালের মহামন্দা (Great Recession) যখন দেশ কাঁপাচ্ছিল। এ সময়ে শিল্প-কারখানাগুলো চীনে চলে যাচ্ছিল। তখন শেল শিল্প (fracking alone) ২০০৮ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত আমেরিকার মোট জিডিপি (GDP) বৃদ্ধির ৪০%-এর জন্য একাই দায়ী ছিল বলে একটি বিশ্লেষণ ইঙ্গিত দেয়। অর্থাৎ প্রায় সব খাত যখন ধুঁকছিল, শেলই অর্থনীতিকে (economy) চাঙা রেখেছিল। নির্মাণ (manufacturing) খাতে তখন প্রায় ২০ লাখ চাকরি হারিয়েছিল দেশ, কিন্তু শেল শিল্প প্রায় ১০ লাখ নতুন কর্মসংস্থান (সরাসরি ও পরোক্ষ) সৃষ্টি করে, যেটি ক্ষতি পোষাতে অনেকটা সহায়ক হয়েছিল। বিশেষ করে পশ্চিম টেক্সাস, নর্থ ড্যাকোটা, ওকলাহোমা (Oklahoma), কলোরাডো (Colorado), আর নিউ মেক্সিকো (New Mexico)-তে এ প্রভাব বেশি দেখা যায়।
উদাহরণ হিসেবে নর্থ ড্যাকোটা রাজ্যের ছোট্ট শহর উইলিস্টনে (Williston) ২০০৬ সালেই ম্যাকডোনাল্ডস (McDonald’s) কর্মচারীদের ঘণ্টায় ১৫ ডলার দিত, যা সে সময়ের রাজ্যের ন্যূনতম মজুরির দ্বিগুণ। ২০১২ সালে সেখানে কর্মসংস্থানের হার আরও বেড়ে যায়। স্থানীয় বাসিন্দা হন বা বহিরাগত শ্রমিক, সবাই কোনও না কোনওভাবে উপকৃত হয়েছে শেল বুম থেকে। বিশাল রাজস্ব এসেছে কর বাবদ, আমেরিকানরা পেয়েছে তুলনামূলকভাবে বিশ্বের সবচেয়ে সস্তা জ্বালানি (OECD দেশগুলোর মধ্যে)। বাণিজ্য ঘাটতি (trade deficit) কমেছে, উৎপাদন শিল্প (manufacturers) আবার যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে আসার কথা ভাবছে, এবং প্রত্যক্ষভাবে করদাতাদের (taxpayers)-ও সাশ্রয় হয়েছে। কারণ মার্কিন সামরিক বাহিনী (US Military) বিশ্বের সবচেয়ে বড় তেল-ভোক্তা।
যুক্তরাষ্ট্রের লাভ
যুক্তরাষ্ট্র এমনিতেই একটি সুপারপাওয়ার ছিল, এখন হয়েছে “এনার্জি সুপারপাওয়ার” (energy superpower)। এর ফলে আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে তাদের প্রভাব বেড়েছে, মধ্যপ্রাচ্যে (Middle East) লেভারেজ পেয়েছে, আর বিশ্ববাজারে তেলের দাম অপেক্ষাকৃত স্থিতিশীল রাখতে অবদান রেখেছে, যা ঠাণ্ডা যুদ্ধ-পরবর্তী (post–Cold War) তুলনামূলক স্থিতিশীল সময়কে দীর্ঘায়িত করেছে। সেই সাথে বলা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ তেলের দাম আরেকটু কম হলে খুশি হত ঠিকই, কিন্তু ১৯৭৩ সালের মতো সংকট তাদের জীবনে আর আসেনি। ২০২০ সালে তো তেলের দাম কিছু সময়ের জন্য শূন্যের নিচে (negative) নেমে গিয়েছিল। কিন্তু সময়ের সাথে তেলের দামের গ্রাফ দেখলেই বোঝা যায়, এখানে কিছু একটা অস্বাভাবিক ঘটছে—বড়সড় রকমের অনুদান (subsidized) বা ঋণনির্ভর ও টেকসই নয় এমন কিছু।
তাহলে যুক্তরাষ্ট্র এত তেল কিনছে কেন?
অনেকেই ভাববেন—“এত তেল যখন নিজেরাই উৎপাদন করে, তাহলে আর আমদানি করার দরকার কী?” বাস্তবে, যুক্তরাষ্ট্র এখনও বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম তেল আমদানিকারক; শুধু চীনই (China) তাদের চেয়ে বেশি তেল আমদানি করে। যুক্তরাষ্ট্রের মোট পেট্রোলিয়াম (Petroleum) চাহিদার ৪১% এখনও আমদানির মাধ্যমে মেটানো হয়। ফ্র্যাকিং বুমের পর আমদানি কিছুটা কমলেও পরিমাণ এখনো উল্লেখযোগ্য। এর কারণ:
- তেলের বিভিন্ন গ্রেড (Grades of Crude Oil): ফ্র্যাকিং থেকে যে তেল পাওয়া যায়, তা “লাইট সুইট (Light Sweet)”, অর্থাৎ ঘনত্ব কম এবং সালফার (Sulfur) কম। অথচ যুক্তরাষ্ট্রের বেশিরভাগ পরিশোধনাগার (Refinery) তৈরি হয়েছে “হেভি সাওয়ার (Heavy Sour)” তেলের জন্য।
- প্রচলিত পরিশোধনাগারের সীমাবদ্ধতা (Refinery Limitations): ২০ শতকে আমদানিকৃত তেল ছিল ঘনত্ব ও সালফার বেশি, যেমন মেক্সিকো, ভেনেজুয়েলা, সৌদি আরব, কানাডা থেকে আসা তেল। সেই অনুযায়ী পরিশোধনাগারগুলো দীর্ঘদিন ধরে গড়ে তোলা হয়েছে।
- নতুন পরিশোধনাগার তৈরির ঝুঁকি (Risk of Building New Refineries): ফ্র্যাকিং যুগ কত দিন টিকবে, নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে (Renewables) যাওয়ার গতি কেমন হবে—এসব অনিশ্চয়তা থাকায় বিশাল বিনিয়োগে নতুন পরিশোধনাগার তৈরি রীতিমতো ঝুঁকিপূর্ণ।
- রপ্তানি-আমদানির সমন্বয় (Export-Import Coordination): তাই যুক্তরাষ্ট্র লাইট সুইট তেল রপ্তানি করে এবং বদলে হেভি সাওয়ার তেল আমদানি করে। এর ফলে পরিশোধনাগারগুলোর বিদ্যমান অবকাঠামো চালু থাকে এবং একই সঙ্গে লাভজনক ব্যবসায়িক মডেল টিকে যায়।
এছাড়া লাইট সুইট তেলের বাজারদর স্বাভাবিকভাবেই কিছুটা বেশি—কারণ পরিশোধনের প্রক্রিয়া অপেক্ষাকৃত সহজ। অপরদিকে হেভি সাওয়ার সস্তা হলেও পরিশোধন অনেক জটিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত উভয় তেল থেকেই প্রায় একই ধরনের পণ্য তৈরি হয়। সুতরাং যুক্তরাষ্ট্র তুলনামূলক উচ্চমূল্যের লাইট সুইট রপ্তানি করে, আবার কমদামি কাঁচামাল আমদানি করে নিজেরাই পরিশোধন করে। ফলে দেশের ভেতরে শিল্প ও শ্রমবাজার সচল থাকে, আর মুনাফাও বাড়ে। এক্সনমোবিল (ExxonMobil) এবং শেভরন (Chevron)—যুক্তরাষ্ট্রের এই দুই বৃহত্তম তেল কোম্পানিরই লাভ গত এক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে।
বিনিয়োগকারীদের গোপন ক্ষতি ও ৩০০ বিলিয়ন ডলারের বিশাল ঋণ
শেল শিল্পের উত্থানে যদিও প্রায় সব আমেরিকান কোন না কোনভাবে লাভবান হয়েছে, তবে একটি পক্ষ ক্ষতিগ্রস্তও হয়েছে— আর এই পক্ষটি হচ্ছে বিনিয়োগকারী পক্ষ (the investor)। এই অপ্রত্যাশিত ১৫ বছরের বুমের (boom) চেয়েও অবাক করা বিষয় হলো, সম্প্রতি পর্যন্ত এই উত্থান তেল কোম্পানিগুলোকে (oil companies) বিন্দুমাত্র লাভ দিতে পারেনি। বরং ২০১০ সাল থেকে ২০২০ সালের মধ্যে তারা প্রায় ৩০০ বিলিয়ন ডলার (বিলিয়ন=১০^৯) খরচ করে ফেলেছে, যা আবার পুরো পর্তুগালের (Portugal) জিডিপি (GDP) এর চেয়েও বেশি। এই ২০১০ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে, শেল শিল্প প্রতি ১ ডলার আয়ে ১.১৮ ডলার ব্যয় করেছে। অর্থাৎ উৎপাদনের জন্য যত ব্যয় হয়েছে, আয় তার চেয়ে কম ছিল। এত বিশাল উৎপাদন (যা ইতিহাসের যেকোনো দেশের চেয়ে বেশি) করতে প্রচুর বিনিয়োগ (spending) করতে হয়েছে। ২০২০ সাল নাগাদ ৩০০ বিলিয়ন ডলার কার্যত আগুনে পোড়ানোর মতো (set on fire) ব্যয় হয়ে যায়।
এই বিষয়টি অথচ খুব বেশি প্রচার পায়নি। উদাহরণ হিসেবে ধরুন উবার (Uber) এবং উইওয়ার্কের (WeWork) মতো কোম্পানির আর্থিক লস; শেল (shale) ক্ষেত্রে তার তুলনায় যেন শিশুদের খেলা। “উইওয়ার্ক” (Wework), যা অলাভজনকতার (unprofitability) আইকন হিসেবে পরিচিত, ২০১৬ সাল থেকে এখন পর্যন্ত মাত্র ১৫ বিলিয়ন ডলার লোকসান করেছে। অন্যদিকে, আমেরিকানদের গত ১৫ বছরের স্বাচ্ছন্দ্য অনেকাংশে এসেছে এই ৩০০ বিলিয়ন ডলারের ঋণের (debt) ওপর ভর করে—গাড়িতে কম দামে জ্বালানি পেয়েছে তারা, তেল কোম্পানির সিইওরা (CEOs) বিগত দিনের উৎপাদনভিত্তিক বোনাস (production, not profit) পেয়ে মিলিয়ন ডলার আয় করেছেন, এবং জ্বালানি-নির্ভর ব্যবসাগুলো সস্তা জ্বালানি পেয়ে রমরমা ব্যবসা করেছে।
যাই হোক, সত্য কথা হলো, শেল বুম (shale boom) সব সময়ই ছিল কিছু নির্দিষ্ট ও সাময়িক অবস্থার ফল। আজ সেই অবস্থার অনেকটাই বদলে যাচ্ছে। ৩০০ বিলিয়ন ডলারের ঋণের বোঝা এখন মিটিয়ে দেওয়ার সময় এসেছে। আমেরিকা ফ্র্যাকিং শিল্পের দ্বিতীয় ধাপে প্রবেশ করতে চলেছে—যেখানে মৌলিক আর্থিক বাস্তবতা (financial reality) এই খাতকে আঁকড়ে ধরবে, বিনিয়োগকারীরা লাভ (positive returns) চায়। এই ধাপটিও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানকে নতুনভাবে বদলে দেবে, তবে আগের তুলনায় সম্পূর্ণ ভিন্ন পদ্ধতিতে।
ফ্র্যাকিং-এর সমস্যাটা কী? কেন লোকশান হয়? কেনই বা এটা টিকিয়ে রাখতে ঋণের দরকার হয়?
প্রশ্ন ফ্র্যাকিংয়ের একটি বড় সুবিধা হলো এটি অত্যন্ত দ্রুত সময়ের মধ্যে অনেক বেশি তেল উৎপাদন করতে সক্ষম।
উদাহরণস্বরূপ, ঐতিহ্যবাহী একটি তেল কূপ (conventional well) খনন ও তেল ওঠানোর ক্ষেত্রে কিছু সপ্তাহ সময় লাগতে পারে, এরপর একটি মাঝারি মানের উৎপাদন শুরু হয় এবং সেটি ধীরগতিতে কমতে থাকে বহু বছরের ব্যবধানে। অন্যদিকে, ফ্র্যাকিং পদ্ধতিতে একটি শেল কূপ (shale well) স্থাপন করতে মাত্র কয়েক দিন সময় লাগতে পারে, এবং শুরুতেই এটি দুই গুণের বেশি তেল দিতে সক্ষম হতে পারে।
কিন্তু এর একটি বড় সমস্যা আছে। এই উৎপাদন বেশিদিন স্থায়ী হয় না। ঐতিহ্যবাহী কূপগুলোও (conventional well) সময়ের সাথে সাথে উৎপাদন কমে যায় বটে, কিন্তু সেখানে প্রতিবছর প্রায় ১০% হারে ধীরগতির নিম্নগতি দেখা যায়, যা কয়েক দশক ধরে চলতে পারে। অন্যদিকে, ফ্র্যাকিং কূপগুলোর (fracking wells) উৎপাদন শুরুতেই খুব দ্রুত নেমে আসে। প্রথম কয়েক মাস বা এমনকি কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই এর উৎপাদন অনেকখানি কমে যায়। এক বছরের মাথায়, অনেক ক্ষেত্রেই কূপটি অর্ধেকেরও কম উৎপাদন দেয়।
এই পার্থক্য—যদিও ছোটখাটো বলে মনে হতে পারে—তেল শিল্পের অর্থনৈতিক মডেলে (economic model) আমূল পরিবর্তন নিয়ে এসেছে। ঐতিহ্যবাহী পদ্ধতিতে তেল উত্তোলন করা অনেকটা “সেট ইট অ্যান্ড ফরগেট ইট” (set it and forget it) ব্যবসার মতো। বড়সড় মূলধনী বিনিয়োগ (capital investment) দিয়ে একবার কূপ খনন করে নিলে, বহু দশক ধরে একটি স্থিতিশীল আয় পাওয়া যায়। এটা অনেকটা প্যাসিভ ইনকামের (passive income) মতো।
কিন্তু শেল তেলের (shale oil) ক্ষেত্রে বিষয়টি ভিন্ন। এখানে উৎপাদন এত দ্রুত কমে যে, একই মাত্রার তেল পেতে হলে বারবার নতুন কূপ খনন করতে হয়। অর্থাৎ, যেখানে দাঁড়িয়ে আছ, সেখানেই থাকতে গেলেও ‘ফ্র্যাকিং ট্রেডমিল’ (fracking treadmill) নামক এক অবিরাম প্রক্রিয়ায় লিপ্ত থাকতে হয়। এটি অনেক বেশি ম্যানুফ্যাকচারিং ব্যবসার মতো—মেশিন চালিয়ে পণ্য বানানো থামিয়ে দিলে আর অর্থ আসে না। এখানে কোনো প্যাসিভ ইনকামের সুযোগ নেই। এই কারণে, শেল বেশিরভাগ সময়েই উৎপাদন ব্যয় (production cost) তুলনায় কম দামে তেল বিক্রি করে এবং লোকসান দেয়।
শেল (Shale) শিল্পের লোকসান সত্ত্বেও চলার কারণ
তাহলে প্রশ্ন হলো, লোকসান সত্ত্বেও কেন তেল কোম্পানিগুলো খনন (drilling) অব্যাহত রাখে? এর একটি কারণ হলো ম্যানুফ্যাকচারিং ব্যবসার মতোই তারা মনে করে, স্কেল বা বড় আকারে কাজ করলে খরচ (cost) ধীরে ধীরে কমবে, অর্থাৎ ইকনমিজ অব স্কেল (economies of scale) তৈরি হবে। প্রত্যেকটি নতুন কূপ থেকে তারা নতুন কিছু শিখবে, নতুন নতুন ডেটা যোগ হবে, এবং প্রক্রিয়া আরও নিখুঁত হবে।
আসলেই, শিল্পটি তাদের কৌশলে উন্নতি করেছে। উদাহরণস্বরূপ, গড়পড়তা একটি শেল কূপ ২০০৯ সালে যে উৎপাদন দিত, ২০১২ সালে সেটি বেড়েছে, আর ২০১৫ সালে এর উৎপাদন আরও বেড়েছে। রিয়েল-টাইমে শেল কোম্পানিগুলো অগ্রগতি করেছে, যদিও প্রত্যেকটি নতুন উদ্ভাবনের ফল পূর্বের তুলনায় কিছুটা কমে আসছিল (diminishing returns)।
তবে এই আশাবাদের মাঝেই শিল্পটি দুটি বড় সমস্যার সম্মুখীন হয়। প্রথমটি হলো জমি (land) সংক্রান্ত। যুক্তরাষ্ট্রের সম্পত্তি আইন (U.S. property law) ভিন্নধর্মী—যে কেউ চাইলে নিজের বাড়ির নিচের খনিজ সম্পদের (mineral rights) মালিকানা বিক্রি করতে পারে। এমনকি সেজন্য বাড়ি ছাড়তে পর্যন্ত হয় না। যেহেতু যুক্তরাষ্ট্র বড়, জনবহুল (high population) এবং ছড়ানো এলাকা নিয়ে গঠিত, তেল কোম্পানিরা সর্বদাই কাউকে না কাউকে খুঁজে পায় যে জমি বিক্রিতে আগ্রহী।
সমস্যা হলো, মানুষ খুব দ্রুতই বুঝে ফেলে এই জমি কতটা মূল্যবান। এটির ফলে একধরনের বিপরীত ইকনমি অব স্কেল (opposite of an economy of scale) তৈরি হয়: জনপ্রতি জমির মালিক বা জমির দামের দাবিদারদের সংখ্যা বাড়তে থাকে, আর তারা বেশি ভাগ নিতে শুরু করে। ফলে তেল কোম্পানিগুলোর লাভ কমে আসে। উদাহরণস্বরূপ, ২০ বছর আগে ওয়েস্ট টেক্সাস (West Texas) এবং সাউথইস্ট নিউ মেক্সিকোর (southeast New Mexico) জমির দাম ছিল খুবই সস্তা—প্রতি একর মাত্র ৪০০ ডলার। ওই অঞ্চলে বিদ্যুৎ, জল এমনকি ওয়াই-ফাই (wifi) সুবিধা ছিল না, তাই জমির দামও ছিল কম। কিন্তু ২০১৪ সালের দিকে এসেই তা দেশের সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত জমিতে পরিণত হয়, যেখানে এক একরের দাম ৫০,০০০ ডলার পর্যন্ত উঠে যায়।
দ্বিতীয় কারণ—সৌদি আরব (Saudi Arabia)। ২০১২ সালে প্রতিটি শেল তেলের ব্যারেলে (barrel) প্রায় ৬ ডলার লোকসান হতো (ফ্রি ক্যাশ ফ্লো বা free cash flow হিসেবে)। ২০১৪ সালের দিকে এসে এই লোকসান কমে অর্ধেকেরও নিচে নেমে আসে। যদিও তখনো কোম্পানিগুলো তেমন কোনো লাভ করেনি, বরং ঐতিহ্যবাহী তেল যেখানে প্রতিটা ব্যারেলে ১-২ ডলার লাভ করত, সেখানে শেল এখনো আরো খারাপ অবস্থায় ছিল। তবু, শেল শিল্পের জন্য এটি ছিল একপ্রকার সাফল্য; তারা সেই বছর প্রায় ২০ বিলিয়ন ডলার লোকসান দিয়েছে, যা আগের বছরের তুলনায় ছিল কম। ফলে শিল্পটি আশার আলো দেখতে শুরু করে।
কিন্তু সৌদি আরবের ব্যাপারটা ছিল অন্যরকম। তারা এমন এক সংস্থা—অপেক (OPEC)—এর অনানুষ্ঠানিক নেতা, যেখানে তেল রপ্তানিকারক দেশগুলো একত্রে তেলের বাজার নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে। প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক কোনো দেশ আসায় সৌদি আরবের কাছে বিষয়টি ছিল এক বিব্রতকর ব্যাপার। তাই তারা সিদ্ধান্ত নেয়, বাজার প্লাবিত করে দাম নামিয়ে দেবে। এটি সবার জন্যই খারাপ হবে, তবে সবার জন্য সমানভাবে নয়। মধ্যপ্রাচ্যে (Middle East) তেল উত্তোলন তুলনামূলকভাবে অনেক সস্তা—দাসশ্রম (slave labor), বিনামূল্যের জমি (free land) সহ ভৌগোলিক সুবিধা তো রয়েছেই। ফলে শেল উৎপাদনকারী আমেরিকান কোম্পানিগুলো সম্পূর্ণ ধসের মুখে পড়বে, যেখানে সৌদিকে সাময়িক লোকসান দিলেও পরে তারা বাড়তি মুনাফার জন্য বাজার কুক্ষিগত করতে পারবে—সেটাই ছিল সৌদি আরবের পরিকল্পনা।
২০১৬ সালের শুরুর দিকে, অপেক (OPEC) মিলে তেলের দামকে ৭৫% পর্যন্ত কমিয়ে প্রতি ব্যারেল মাত্র ২৫ ডলারে নামিয়ে আনে। এর ফলে ২০০টির বেশি মার্কিন তেল ও গ্যাস কোম্পানি দেউলিয়া (bankrupt) হয়ে যায়, হাজার হাজার মানুষের চাকরি চলে যায়, অনেক শহর বা জনপদ কার্যত বিলুপ্ত হয়ে যায়।
কিন্তু তাদের সবার ভাগ্য একই রকম হয়নি। সৌদি আরবের পরিকল্পনায় একটি বড় ফাঁক ছিল। তারা আমেরিকান শেল বিপ্লবকে (shale revolution) ভুলভাবে বুঝেছিল।
শেল বিপ্লবের (Shale Revolution) আসল চরিত্র: প্রযুক্তিগত নয়, আর্থিক
শেল বিপ্লব আসলে কখনোই বিশাল প্রযুক্তিগত বিপ্লব ছিল না। ফ্র্যাকিং (fracking) কিন্তু অন্তত ১৯৪০-এর দশক থেকে চলে আসছে। দেখতে গেলে, হাইড্রোলিক ফ্র্যাকচারিং (hydraulic fracturing) আগে থেকেই ছিল। তবে গত কয়েক বছরে উৎপাদনশীলতা কিছুটা বেড়েছে, নতুন কৌশল উদ্ভাবিত হয়েছে বটে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে শেল শীর্ষে উঠে এসেছিল মূলত তেলের দামের ঊর্ধ্বগতির সুবাদে।
স্মরণ করুন, ২০১৪ সালের দিকে তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি (barrel) প্রায় ১০০ ডলারে উঠেছিল, যখন শেল তেল প্রায় লাভজনক হওয়ার পথে ছিল। অর্থাৎ, তেলের উচ্চমূল্য ছিল একটি ঘটনার সমাপতন (accident)। আসলে, শেল বিপ্লব ছিল একটা আর্থিক বিপ্লব (financial revolution)।
শেল খাতে সবচেয়ে সফল ড্রিলাররা (drillers) ছিল তারা, যারা সবচেয়ে দক্ষতার সাথে বিনিয়োগকারী (investors) আকর্ষণ করতে পেরেছিল। কারণ ফ্র্যাকিং ট্রেডমিলে (fracking treadmill) টিকে থাকতে লাগাতার মূলধন লাগত। এভাবেই এই খাতে সফল হওয়ার মানে দাঁড়ায় মূলত “কিভাবে বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে আসা যায়”—এই গল্প শোনানোর আর্ট। প্রকৃত তেল উত্তোলন যেন কেবল এক আনুষ্ঠানিকতা। যে কোম্পানিগুলো ব্যাপারটি বুঝতে পারেনি বা খরচ কমবে ভেবে সবকিছু বাজি ধরেছিল, তারা শীঘ্রই দেউলিয়া হয়ে গেছে। বাকিরা “গ্রোথ অ্যাট অল কস্টস (growth at all costs),” “ইনভেস্টর মার্কেটিং (investor marketing),” ও “স্টোরিটেলিং (storytelling)”-এর খেলায় লিপ্ত ছিল।
এমনকি সৌদি আরবের আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার পরও তারা বিনিয়োগকারী টানতে আরও পারদর্শী হয়ে ওঠে, কারণ তখন তাদের প্রমাণ দেখানোর মতো ছিল— “আমরা এত বড় ঝড়ের মধ্যেও টিকেছি, নিশ্চয়ই আমাদের ‘কম্পেটিটিভ অ্যাডভান্টেজ (competitive advantage)’ আছে!” বিনিয়োগকারীরা বুঝতে পারেনি, এই অ্যাডভান্টেজটির মূল ছিল আসলে বড় পকেটওয়ালা মানুষজনকে (deep-pocketed investors) আকর্ষণ করার ক্ষমতা।
সৌদি আরব যা বুঝতে পারেনি, তা হলো এই যে, শেল কোম্পানিগুলো এতদিন লাভ করেনি কারণ তাদের লাভ করতে হয়নি। আগের ঋণ (loan) শোধ করার জন্য তারা নতুন ঋণ গ্রহণ করতে পারত। যে কারণে উইওয়ার্কের (WeWork) প্রতিষ্ঠাতা অ্যাডাম নিউম্যান (Adam Neumann) কোম্পানি দেউলিয়া হওয়ার পরেও ২ বিলিয়ন ডলারের বেশি সম্পদশালী, সেই একই কারণে তেল কোম্পানির সিইও’রাও বিনিয়োগকারীদের জন্য এক টাকাও মুনাফা না করেও বিপুল ধনী হয়ে গেছেন। উদাহরণস্বরূপ, ২০০৮ সালে চেসাপিক এনার্জির (Chesapeake Energy) সিইও ১০০ মিলিয়নের (million=১০^৬)ও বেশি উপার্জন করেছিলেন, যা ওই বছরের সর্বোচ্চ— অথচ সেই বছর তার কোম্পানি বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার হারাচ্ছিল।
ফলে, অজান্তেই, গত ১৫ বছর ধরে আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারী (international investors), তেল সিইও (oil CEOs), এমনকি সৌদি আরব পর্যন্ত মিলে মিশে যুক্তরাষ্ট্রের গাড়ির গ্যাসের খরচ কমিয়ে দিয়েছে এবং দেশটিকে একটি শক্তিশালী জ্বালানি পরাশক্তিতে (energy superpower) পরিণত করেছে। যেভাবে ভেঞ্চার ক্যাপিটালিস্টরা (venture Capitalists) দেশটির লসের বিনিময়ে মাত্র ১০ ডলারে উবার (Uber) রাইড উপভোগ করার সুযোগ দিয়েছে, ঠিক সেভাবেই শেল বিনিয়োগকারীরা দেশটির জনগণের ২-৩ ডলারে গ্যালন প্রতি গ্যাস পেতে সাহায্য করেছে।
অস্থায়ী সহাবস্থান, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদী নয়
সেইসব সময়ের পরিস্থিতি কতটা নড়বড়ে ছিল—এটা ভাবতে হলে মনে রাখতে হবে, বিনিয়োগকারীরা মূলত ৩০০ বিলিয়ন ডলার আমাদের মতো সাধারণ ভোক্তাদের হাতে হস্তান্তর করেছিলেন। গত ১৬ বছরে যুক্তরাষ্ট্রে তেল উৎপাদনের যে অভাবনীয় উল্লম্ফন ঘটেছে, তা দেখে অনেকেই মনে করছেন—“অর্থনীতিতে তেল সম্পদ থাকলে সমৃদ্ধি আসবেই।” কিন্তু ইতিহাস বলে, পৃথিবীর অনেক দেশে তেল সম্পদই হয়ে উঠেছে অভিশাপ। মনে রাখা দরকার, এই সম্পদ (Resource) সীমিত (Finite)। শেল শিলাস্তর (Shale Formations) কখনো না কখনো শেষ হয়ে যাবে। এটা স্পষ্ট যে, শেয়ারবাজারের (S&P 500) উল্লম্ফন সত্ত্বেও তেল ও গ্যাস কোম্পানির শেয়ার (oil and gas stocks) একইভাবে বাড়ছিল না। তবু বিনিয়োগকারীরা হন্যে হয়ে অন্য কোথাও বিনিয়োগের সুযোগ না পেয়ে শেল খাতে টাকা ঢেলেছিল।
এর পেছনে বড় কারণ ছিল ২০০৮ সালের অর্থনৈতিক মন্দা (recession)। তখন বিনিয়োগকারীরা মরিয়া হয়ে এত বড় বড় প্রকল্পে টাকা ঢেলেছিল, কারণ তখনকার সুদের হার (interest rate) ছিল প্রায় শূন্যের কোঠায়, আর বিনিয়োগের মানদণ্ডও ছিল ঢিলেঢালা। তবে শেষমেশ, শেল বিনিয়োগকারীরাও ধৈর্য হারায়। কয়েক বছর আগে তারা চাপে ফেলে কোম্পানিগুলোকে লাভজনক হওয়ার (deliver financially) জন্য চাপ দিতে শুরু করে।
একই সময়ে, যেই আর্থিক পরিবেশের ওপর শেল নির্ভর করেছিল, সেটিও বদলে যায়।
- প্রথমত, এখন আর ‘প্রায় বিনা সুদে’ ঋণ পাওয়া যায় না; ব্যাংকে টাকা রাখলেও সুদ অনেক বেশি।
- দ্বিতীয়ত, উপকরণ ও শ্রমের খরচ (material and labor costs) বেড়েছে।
- তৃতীয়ত, তেলের বাজার সংক্রান্ত যে ‘বৃহত্তর গল্প’ বা ন্যারেটিভ (narrative) ছিল, সেটিও পাল্টে যেতে শুরু করে।
বর্তমানে বাজার কিছুটা একীভূতকরণের (Consolidation) মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। শীর্ষ বড় কোম্পানিগুলো আরও কার্যকরী উৎপাদনের দিকে মনোযোগী হচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, এক্সন (Exxon) সম্প্রতি ৬০ বিলিয়ন ডলারে পারমিয়ান বেসিনের শীর্ষস্থানীয় তেল উত্তোলক পাইওনিয়ার ন্যাচারাল রিসোর্সেস (Pioneer Natural Resources) কিনে নিয়েছে। শেভরনও (Chevron) ৫৩ বিলিয়ন ডলারে হেস (Hess) অধিগ্রহণের চেষ্টায় আছে। মূল উদ্দেশ্য হলো আয়তনে (Economies of Scale) বড় হয়ে উৎপাদন খরচ কমানো ও মুনাফা বাড়ানো। গত পাঁচ বছরে যুক্তরাষ্ট্রে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত (Publicly Traded) তেল ও গ্যাস কোম্পানির সংখ্যা ৬৫ থেকে ৪১-এ নেমে এসেছে, মূলত অধিগ্রহণ (Acquisition) এবং একীভূতকরণের কারণে।
উৎপাদনের ভবিষ্যৎ নিয়ে সরকারি সংস্থা ইউএস এনার্জি ইনফরমেশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (US Energy Information Administration) বলছে, ২০৩০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের তেল ও লিজ কনডেনসেট (Lease Condensate) উৎপাদন সর্বোচ্চে পৌঁছাতে পারে এবং তারপর কয়েক দশক ধরে সেটি মোটামুটি একই পর্যায়ে থাকতে পারে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, ফ্র্যাকিং দ্রুত তেল উত্তোলনে সক্ষম, ফলে মজুদও দ্রুত শেষ হতে পারে।
অনেক হিসাব বলছে, বর্তমান হারে উত্তোলন চললে যুক্তরাষ্ট্রের হাতে প্রমাণিত (Proven) তেল মজুদ প্রায় ১১ বছর টিকবে। অবশ্য ঐতিহ্যবাহী প্রযুক্তির (Traditional Technology) মজুদ হিসাবেই এই গণনা; ফ্র্যাকিং প্রযুক্তির মাধ্যমে নতুন মজুদ উত্তোলন সম্ভব। তবুও এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, এই শিল্প শিগগির পরিণতির দিকে এগোচ্ছে এবং যত দিন পারা যায়, তত দিন দ্রুত উত্তোলন করে লাভ তোলাই ব্যবসায়িক কৌশল হয়ে উঠেছে।
আন্তর্জাতিক জ্বালানি সংস্থার (International Energy Agency বা IEA) পূর্বাভাস অনুযায়ী, বৈশ্বিক তেলের চাহিদা (global oil demand) শীর্ষে পৌঁছবে মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যে—যা প্রায় ২০২৯ সালের কথা বলে। অর্থাৎ, যুক্তরাষ্ট্র হয়তো অবশেষে পিক অয়েলের (peak oil) মুখোমুখি হবে, যদিও আগেরবারের মতো সরবরাহের (supply) অভাবে নয়, বরং চাহিদার (demand) সম্ভাব্য নিম্নমুখিতার কারণে। অনেকে অবশ্য এই ২০২৯ সাল নিয়ে একমত নন। এর বড় অংশ নির্ভর করছে একটি মাত্র ব্যক্তি এবং একটি মাত্র দেশের উপর—চীনের (China) সিদ্ধান্তের উপর। বিগত বছরগুলোতে বেইজিং (Beijing) নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে (renewables) সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ করেছে এবং বৈদ্যুতিক গাড়ির (electric vehicles) সবচেয়ে বড় বাজারও সেখানে। এর মানে হতে পারে, চীনের তেলের ক্ষুধা আস্তে আস্তে কমছে। আবার কেউ কেউ বলেন, এটি ভুল হতে পারে।
তবু এসব পূর্বাভাসই তেল বাজারের গল্পটা বদলে দিচ্ছে। অনেক মার্কিন তেল কোম্পানি (US oil companies) এখন আর দীর্ঘমেয়াদে বিনিয়োগ করতে চাইছে না, কারণ তারা জানে না যে দীর্ঘমেয়াদি বাজার আদৌ থাকবে কিনা।
শেল বিপ্লবের দুই ধাপ: শুরুর উত্থান ও পরবর্তী নগদায়ন
এখন পর্যন্ত, “শেল বিপ্লবের প্রথম ধাপ” হিসেবে যা বলা যায়, সেখানে কোম্পানিগুলো প্রায় ১৪০% নগদ প্রবাহ (cash flow) পুনঃবিনিয়োগ করে গেছে (ঋণ নিয়ে), নতুন নতুন কূপ খননে। কিন্তু ২০২০ সালের দিকে এসে, তারা ক্যাশ আউট (cashing out) করা শুরু করে। অর্থাৎ, যতক্ষণ সংগীত বাজছে, ততক্ষণ নাচার মতোই যত বেশি সম্ভব অর্থ উপার্জন করে নেওয়ার চেষ্টা করছে।
আগে তারা ধীরে-সুস্থে অনেক জায়গায় কূপ খনন করত, কারণ দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ছিল। এখন তারা দ্রুত সবচেয়ে লাভজনক (tier one sweet spots) জায়গাগুলো খুঁজে খুঁজে শেষ করছে, যা সাময়িকভাবে লাভ বাড়াবে ঠিকই, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে শেল রিজার্ভের সুযোগ কমিয়ে দিচ্ছে।
একই সময়ে, কোম্পানিগুলো একীভূত হয়ে যাচ্ছে (consolidation)। বড় কোম্পানিগুলো ছোট শেল কোম্পানিগুলোকে কিনে নিচ্ছে, ফলে প্রতিযোগিতা (competition) কমে যাচ্ছে। এটিই দ্বিতীয় ধাপ বা ‘ফেজ টু’ (phase two)। পূর্বের মতোই, এটি ভূ-রাজনৈতিকভাবে (geopolitically) বিরাট প্রভাব ফেলবে।
যুক্তরাষ্ট্রের “শক্তি স্বয়ংসম্পূর্ণতা” (energy independence) মিথ
যুক্তরাষ্ট্র কিন্তু এখনই তার জ্বালানি স্বাধীনতা হারাবে না, কারণ আসলে সত্যিকার অর্থে সে কখনোই এককভাবে স্বাধীন ছিল না। আজকের দিনে যুক্তরাষ্ট্র যত তেল ব্যবহার করে, প্রায় সমপরিমাণই উৎপাদন করে বটে, কিন্তু তবুও তারা সম্পূর্ণ আত্মনির্ভর নয়।
সমস্যাটি হলো, কাচা তেলকে (crude oil) ব্যবহারযোগ্য জ্বালানিতে (fuel) পরিণত করতে প্রথমে তা শোধন (refine) করতে হয়। উপরন্তু, সব ধরনের কাচা তেল এক রকম নয়—তেল হতে পারে সুইট (sweet) বা সাউর (sour), লাইট (light) বা হেভি (heavy)।
২০০৮ সালের আগে যুক্তরাষ্ট্র যে কাঁচা তেল উৎপাদন করত, তা তুলনামূলকভাবে সাউর ও হেভি ছিল। সে অনুযায়ী দেশের বেশিরভাগ রিফাইনারি (refinery) এই ধরনের তেল প্রক্রিয়াকরণের জন্য তৈরি করা হয়েছিল। কিন্তু শেল তেল (shale oil) সাধারণত লাইট ও সুইট (light and sweet), যা ঐতিহ্যবাহী রিফাইনারিগুলো ব্যবহারের উপযোগী নয়।
অবশ্য যুক্তরাষ্ট্র চাইলে নতুন রিফাইনারি বানাতে বা পুরোনোটি সংস্কার করতে পারত। দেশটি ইচ্ছা করলে তার বন্দর বন্ধ করে নিজের ভেতরেই সবকিছু প্রক্রিয়াকরণ করে নিতে পারত—একধরনের পূর্ণাঙ্গ শক্তি স্বনির্ভরতা (energy independence)। কিন্তু রিফাইনারি বানানো খুব ব্যয়বহুল এবং সময়সাপেক্ষ। সাম্প্রতিক পাঁচ বছরে যুক্তরাষ্ট্রে মাত্র দুটি রিফাইনারি যোগ হয়েছে, আর শতাব্দীর শুরু থেকে এখন পর্যন্ত হয়েছে মাত্র সাতটি।
ফলে, প্রতিটি মার্কিন প্রেসিডেন্ট (নিক্সন থেকে শুরু করে পরবর্তীরা) মুখে মুখে শক্তি স্বয়ংসম্পূর্ণতার কথা বললেও, কেউই সত্যিকারের পদক্ষেপ নিয়ে গ্যাসের দাম বাড়াতে রাজি হয়নি। অতএব, যুক্তরাষ্ট্র প্রতিদিন প্রায় ১০ মিলিয়ন ব্যারেল তেল আমদানি ও রপ্তানি (import and export) করে—সারা বিশ্বের নানা রিফাইনারিতে পাঠায় ও নিয়ে আসে।
শেল যুক্তরাষ্ট্রকে মধ্যপ্রাচ্য (Middle East) থেকে পুরোপুরি মুক্ত করেনি, বরং একে দিয়েছে বিশাল নমনীয়তা (flexibility) ও স্থিতিশীলতা (stability)। যুক্তরাষ্ট্রে তেল কোম্পানিগুলো ব্যক্তিমালিকানাধীন হওয়ায়, সরকার ইচ্ছেমতো ফোন করে তাদেরকে উৎপাদন বাড়াতে বা কমাতে বলতে পারে না—যেমনটি সৌদি আরব সরকার সরাসরি আরামকোর (Aramco) মাধ্যমে করতে পারে। তারপরও, বিশ্ব তেলের বাজার (global oil market) একটি শূন্য-ফলাফলপূর্ণ বা জিরো-সাম প্রতিযোগিতা (zero-sum competition)। এখানে নতুন সরবরাহ যুক্ত হলে, অন্য সরবরাহকারীদের ক্ষমতা আপনা-আপনি কমে যায়।
শেল তেল ও সৌদি আরবের ক্ষমতার সীমা
২০১৪ সালের দামের যুদ্ধ (price war) থেকেই আমরা সৌদি আরবের ক্ষমতার একটা সীমা দেখতে পেয়েছি। আগে অপেক (OPEC) প্রায় ইচ্ছেমতো দাম নির্ধারণ করে ফেলতে পারত, কিন্তু এখন তাদেরকে যুক্তরাষ্ট্রের শেল প্রযোজকদের সঙ্গে পাল্লা দিতে হচ্ছে। শেল কোম্পানিগুলো দ্রুত ও স্বাধীনভাবে উৎপাদন বাড়াতে বা কমাতে পারে, সৌদির পরিকল্পনাকে বানচাল করে দিতে পারে।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, যুক্তরাষ্ট্র কতটা দ্রুত তেল উৎপাদন বাড়াতে বা কমাতে পারে। ঐতিহ্যবাহী তেল স্থাপনা শুরু করতে বছরের পর বছর লেগে যেতে পারে, কিন্তু শেল কূপ (shale wells) তুলনামূলকভাবে অনেক দ্রুত স্থাপনযোগ্য। আগে সৌদি আরবকে (Saudi Arabia) বলা হতো বিশ্বের ‘সুইং প্রডিউসার’ (swing producer), কারণ তারা উৎপাদন বাড়িয়ে বা কমিয়ে বিশ্ব বাজারের দাম নিয়ন্ত্রণ করতে পারত। কিন্তু শেল আসার পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র এই সুবিধাটা অনেকাংশে পেয়ে গেছে।
যদিও মার্কিন তেল কোম্পানিগুলো সরাসরি ওয়াশিংটনের ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থের (geopolitical interests) পক্ষে কাজ করে না—তারা নিজেরাই লাভের আশায় দ্রুত সরবরাহ বাড়ায়। এর ফলেই বিশ্ব বাজার তুলনামূলক স্থিতিশীল থাকে। অন্যথায় নানা আন্তর্জাতিক সংকটে তেলের দাম প্রচণ্ড ওঠানামা করত।
উদাহরণস্বরূপ, আরব বসন্ত (Arab Spring) চলাকালীন লিবিয়া, ইরান, সিরিয়া ও সুদান অঞ্চলে তেলের উৎপাদন ব্যাপকভাবে বন্ধ হয়ে যায়। এটা বিশাল ধাক্কা হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু একই সময়ে যুক্তরাষ্ট্র থেকে অতিরিক্ত তেল সরবরাহ বিশ্ববাজারে যোগ হওয়ায়, দাম বেশি অস্থির হয়নি।
একইভাবে, ২০১১ সালে জাপানের ফুকুশিমা (Fukushima) পরমাণু দুর্ঘটনার (disaster) পর, মার্কিন প্রাকৃতিক গ্যাস (natural gas) জাপানকে অনেক সাহায্য করে। এটি জাপানের জন্য ভালো ছিল, শেল কোম্পানিগুলোর জন্যও লাভজনক ছিল, আমেরিকান ভোক্তারা পাম্পে (pump) কম দাম দিয়েছে, এবং বিশ্বের চোখে যুক্তরাষ্ট্রের ভাবমূর্তি আরও উজ্জ্বল হয়েছে।
এমনকি ২০২২ সালে ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের (invasion of Ukraine) পর ইউরোপে রাশিয়ান তেলের রপ্তানি (exports) কমে গেলে আবারও যুক্তরাষ্ট্র এগিয়ে এসে যোগান দেয়। যুক্তরাষ্ট্রের এই নমনীয়তা (flexibility) জার্মানির মতো দেশগুলিকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে নৈতিক অবস্থান নিতে সহায়তা করেছে।
কিন্তু ড্রিলাররা যারা এতদিন দাম বাড়লেই হুরমুর করে উৎপাদন বাড়াত, বিনিয়োগকারীরা যারা অপেক্ষাকৃত কম দামে তেল সরবরাহ করত, আর সরকার যেটা এই বাজার চাপে রাজনৈতিক সুবিধা পেত—এই সাময়িক মিলন আর স্থায়ী হচ্ছে না।
পরিবেশগত বিবেচনা ও রাজনৈতিক চাপে ভবিষ্যৎ
ফ্র্যাকিং-এর ভবিষ্যৎ অনুমান করা কঠিন, কারণ এর সঙ্গে পরিবেশ রক্ষা, জলবায়ু পরিবর্তন (Global Warming), এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানির (Renewable Energy) উন্নয়নের মতো বিষয় জড়িত। একদিকে সরকার (Federal Administration) বলছে, তারা এই শিল্পকে সমর্থন দিচ্ছে। অন্যদিকে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের (Long-Term Investment) ক্ষেত্রে নানা বিধি-নিষেধ বা নিয়ন্ত্রণ (Regulation) ভবিষ্যতে কঠোর হতে পারে।
কার্বন নিঃসরণ (Carbon Emissions) কমানোর পরিকল্পনায় (Net Zero Ambitions) যুক্তরাষ্ট্র ২০৫০ সালের মধ্যে শূন্য নিঃসরণে পৌঁছাতে চায়। তেল জ্বালানোই শুধু নয়, ফ্র্যাকিং চলাকালে প্রায়ই মিথেন (Methane) গ্যাস লিক হয়, যা কার্বন ডাই-অক্সাইডের (CO₂) চেয়ে ৩০ গুণ বেশি গ্রিনহাউস (Greenhouse) প্রভাব সৃষ্টি করে। তেল উত্তোলনের সময় মাটির নিচের চাপ কমাতে ন্যাচারাল গ্যাস ফ্লেয়ারিং (Natural Gas Flaring) করা হয়, যা আবার বাতাসে গ্যাস জ্বালিয়ে দেয়—ব্যবহার করা হয় না। এ ছাড়া ফ্র্যাকিং-এ প্রচুর পরিমাণে পানি লাগে এবং ব্যবহৃত পানি মাটির নিচে পুনরায় পাম্প করলে তা ভূগর্ভস্থ জল দূষণ (Groundwater Contamination) করতে পারে। এ সব কারণে অনেক উন্নত দেশে ও যুক্তরাষ্ট্রের কিছু অঙ্গরাজ্যে ফ্র্যাকিং নিষিদ্ধ (Ban) বা সীমিত (Moratorium) করা হয়েছে।
এ ছাড়া পারমাণবিক শক্তি (Nuclear Energy) নতুন করে জনপ্রিয়তা পাচ্ছে এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানির পাশাপাশি এটি “নেট জিরো (Net Zero)” লক্ষ্যমাত্রা পূরণে কার্যকর হতে পারে—যুক্তরাষ্ট্র ২০৫০ সালের মধ্যে পারমাণবিক শক্তিকে তিন গুণ বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে। কাজেই, ভবিষ্যতে তেলশিল্পকে বা ফ্র্যাকিংকে নানা চাপে পড়তে হবে এটা স্পষ্ট।
রাশিয়া-ইউক্রেইন যুদ্ধ, ইউরোপীয় বাজার ও মার্কিন ভূমিকায় পরিবর্তন
যুক্তরাষ্ট্রের শেল বুমের আরেকটি ফলাফল হলো—পশ্চিমা বিশ্ব এখন তেলের উৎস নির্বাচন করতে আরও সাবধানী হতে পারছে। রাশিয়া ২০২২ সালে ইউক্রেইনে (Ukraine) আগ্রাসন শুরু করলে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (EU) রুশ তেলের ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে সক্রিয় হয়ে ওঠে। ঐতিহাসিকভাবে রাশিয়া ছিল ইইউর একটি প্রধান জ্বালানি সরবরাহকারী। কিন্তু যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর, রাশিয়ান তেল ও গ্যাস আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা (Sanction) আরোপ করে ইইউ—তাদের ছয় দফা প্যাকেজে (যা ২০২২ ও ২০২৩ সালে কার্যকর হয়) রাশিয়ান সিবর্ন (Seaborn) অপরিশোধিত তেল ও পেট্রোলিয়াম পণ্য আমদানি নিষিদ্ধ করা হয়। এর ফলে ইইউতে রাশিয়ান তেল আমদানি ৯০% পর্যন্ত কমে যায় এবং গ্যাসের ক্ষেত্রেও রাশিয়ান আমদানির হার ৪০% থেকে ১৫%-এ নেমে আসে। এটি আগামীতে আরও কমবে বলে ধারণা করা হচ্ছে, কারণ ইইউ প্রথমবারের মতো রুশ গ্যাসের ওপরও সরাসরি নিষেধাজ্ঞা চাপাতে শুরু করেছে।
এই শূন্যস্থান পূরণে এগিয়ে আসে যুক্তরাষ্ট্র। শেল বুমে তাদের উৎপাদিত অতিরিক্ত তেল ও এলএনজি (LNG) অর্থাৎ লিকুইফায়েড ন্যাচারাল গ্যাস (Liquefied Natural Gas) রপ্তানি করে ইউরোপে বড় সরবরাহকারী হয়ে ওঠে তারা। ইউরোপের কাছে যুক্তরাষ্ট্রের তেল ও গ্যাস কেনা ছিল অপেক্ষাকৃত সহজ একটি সমাধান—কারণ সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিকভাবে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ অনেকটাই সমমনা। এছাড়া সৌদি আরব বা রাশিয়ার মিত্র কাজাখস্তানের (Kazakhstan) মতো রাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীল হওয়ার ঝুঁকি ইউরোপ চায়নি। তাই শুধু নতুন এলএনজি টার্মিনালগুলো দ্রুত তৈরি করে ইউরোপ রাশিয়ান গ্যাসের পরিবর্তে মার্কিন গ্যাস আমদানি শুরু করে। ফলস্বরূপ, রাশিয়া যেসব দেশে মোটামুটি অর্ধেক তেল ও তার বেশি গ্যাস রপ্তানি করত—সেই ইউরোপীয় বাজারে বড় ধাক্কা খায়। নতুন ক্রেতা হিসেবে ভারত (India), চীন (China) ও তুরস্ক (Turkey) রাশিয়ান তেল কিনতে এগিয়ে এলো বটে, তবে রাশিয়াকে তখন বিশ্ববাজারে ব্যাপক ছাড় দিতে হলো।
সৌদি আরবের অবস্থান: ১৯৭৩-এর পুনরাবৃত্তি নেই কেন?
সৌদি আরব মধ্যপ্রাচ্যের ডি-ফ্যাক্টো (De Facto) নেতা এবং ওপেকের মূল চালিকাশক্তি। ১৯৭৩ সালে তারা ইসরায়েলকে সমর্থনকারী পশ্চিমাদের ওপর তেল নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল। এবার যদিও ইসরায়েলের সঙ্গে আবার সংঘাত চলছে, সৌদি আরব এখনো আক্রমণাত্মকভাবে কার্ড খেলেনি। এর কারণ একাধিক। একদিকে, বিগত কয়েক দশকে সৌদি আরব ও যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদার হয়েছে। সৌদি আরব এখন বিনিয়োগে বৈচিত্র্য আনতে চায়—তেলনির্ভরতা কমিয়ে বিনোদন (Entertainment), পর্যটন (Tourism), প্রযুক্তি (Technology) প্রভৃতি ক্ষেত্রে এগোতে চায়। এ সময় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শত্রুতা তাদের ক্ষতি করতে পারে।
অন্যদিকে, পশ্চিমা বিশ্ব এখন সৌদি তেলের ওপর সেই পর্যায়ের নির্ভরশীল নয়। যুক্তরাষ্ট্রের শেল বুমের কল্যাণে আজ ১৯৭০-এর দশকের মতো তেলের ঘাটতি হলে পশ্চিমারা অচল হয়ে যাবে—এমন আশঙ্কা নেই। কাজেই, এখন সৌদি আরব যদি আরেকটি তেল অবরোধ (Embargo) চাপায়ও, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ সহজেই অন্য উৎস থেকে জোগান পেতে পারে। এতে সৌদির নিজেরই ক্ষতি হবে বেশি। তাই এমন কোনো চরম পদক্ষেপ নেওয়া এখন তাদের পক্ষে সঙ্গত নয়।
বিশ্ববাজারে দর-যুদ্ধ: সৌদি আরব বনাম যুক্তরাষ্ট্র
সৌদি আরব ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে দৃশ্যমান মিত্রতা থাকলেও, তেল ও গ্যাসের বিশ্ববাজারে দুটি পক্ষই প্রতিযোগী। গত দুই বছর ধরে সৌদি আরবের নেতৃত্বে ওপেক তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি ১০০ ডলারে নিয়ে যেতে চায়। বাজারে সংকট তৈরি করে দাম বাড়াতে তারা উৎপাদন কেটে (Production Cut) সরবরাহ কমাচ্ছে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা (Canada) এবং নতুন খেলোয়াড় গায়ানা (Guyana)—যার তেলশিল্প মূলত মার্কিন কোম্পানিগুলো পরিচালনা করে—তারা উৎপাদন বাড়িয়ে দিচ্ছে। ফলে বিশ্ববাজারে দাম তেমন বাড়ছে না; ব্যারেলপ্রতি ৭০-৮০ ডলারের আশেপাশেই আটকে থাকছে।
এছাড়া চীনের (China) অর্থনীতিতে চাহিদা দুর্বল হয়েছে, তারা বিশ্ববাজারের সবচেয়ে বড় তেল আমদানিকারক (Importer)। ফলে সৌদির আয় কমছে, আর বাজেট ঘাটতি (Budget Deficit) সামাল দিতে তাদের সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। এখন সৌদি আরবের কাছে দুটি পথ খোলা। এক, তারা চায় যদি মার্কিন শেলের বাজারদখল আর না বাড়ে, তাহলে ওপেক ও ওপেক প্লাসকে (OPEC Plus) নিয়ে করা উৎপাদন কাটা প্রত্যাহার করে তারা উৎপাদন বাড়াতে পারে। সৌদি আরব একাই প্রতিদিন ৩০ লাখ ব্যারেল বেশি তেল উত্তোলন করতে সক্ষম। এমনটা করলে বাজারে সরবরাহ বেড়ে দামের পতন হবে, যাকে বলে প্রাইস ওয়ার (Price War)। স্বল্প মেয়াদে সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তবে উচ্চ খরচের (High-Cost) মার্কিন শেল উৎপাদন সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে পড়বে। আর রাশিয়ার (Russia) ক্ষেত্রেও এই কম দাম যুদ্ধ অর্থায়নে বড় ধাক্কা দেবে।
দ্বিতীয় বিকল্প হলো, সৌদি আরব ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করবে। শেল বুমের চূড়ান্ত স্তর প্রায় পার হয়ে গেছে বলে অনেক বিশ্লেষক মনে করেন। যুক্তরাষ্ট্রের পারমিয়ান বেসিনে (Permian Basin) নতুন কূপের উৎপাদনও কমতে শুরু করেছে। ওয়াল স্ট্রিট (Wall Street) বিনিয়োগে সংযমী হচ্ছে। সৌদি আরবের হাতে যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে প্রায় সাত গুণ বেশি প্রমাণিত তেল মজুদ রয়েছে। দীর্ঘ সময় ধরে উচ্চ উৎপাদন রাখার সক্ষমতা তাদের আছে। তাই যুক্তরাষ্ট্রের রিসার্ভ (Reserve) শেষ হতে শুরু করলে সৌদি আরব বিশ্ব তেলের “লিডিং পাওয়ার (Leading Power)” হিসেবে পুরনো অবস্থান ফিরে পেতে পারে।
২০২২: ভিন্ন রূপের মার্কিন শেল
২০২২ সালে, রাশিয়ার যুদ্ধের ফলাফল হিসেবে তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি ১৩০ ডলারে উঠে, যা ২০১৪ সালের পর সর্বোচ্চ। আগের ১৫ বছরে এমন হলে, মার্কিন তেল কোম্পানিগুলো দ্রুত নতুন কূপ খনন করত বাড়তি মুনাফা লুফে নেওয়ার জন্য। কিন্তু এ সময় তারা বর্ধিত তেলের দাম সত্ত্বেও আগের মতো উৎপাদন বাড়ায়নি। বরং আগের চেয়ে কম উৎপাদন করেছে।
প্রেসিডেন্ট বাইডেন (President Biden) এর জেরে প্রকাশ্যে এই কোম্পানিগুলোকে উৎপাদন বাড়ানোর আহ্বান জানান এবং সরাসরি বলেন, “তারা যুদ্ধের সুযোগে মুনাফা নিচ্ছে।” একেবারে পরিষ্কার ভাষায় তিনি দায় চাপান। এক্সন (Exxon) ও শেভরন (Chevron) কিন্তু কাঁধ ঝাঁকিয়ে চুপ করে থাকে। ভবিষ্যতেও এ ধরনের অবস্থাই অব্যাহত থাকবে।
এর মানে এই নয় যে, যুক্তরাষ্ট্রের তেল উৎপাদন একেবারে বন্ধ হয়ে যাবে বা কমতে থাকবে। বরং দ্রুত বৃদ্ধির যুগ (rapid growth) শেষ হয়ে গেছে। কোম্পানিগুলো এখন আর ভোক্তাদের স্বার্থে বা বেশি উৎপাদনের জন্য হন্যে নয়; তারা এখন লাভ (profit) চাইছে। ২০২১ ও ২০২২ সালে তারা আগের ১৫ বছরে যত লোকসান করেছিল, তার প্রায় সমপরিমাণ মুনাফাই তুলে নিয়েছে—এটা বিশাল অঙ্ক। ফলে বাজারে সহজলভ্য ‘বাফার’ বা ‘কুশন’ আর থাকছে না, বিশ্ববাজারে যুক্তরাষ্ট্রের তুলনামূলক ক্ষমতাও কমে যাচ্ছে। সৌদি আরবের মতো অন্য উৎপাদনকারীরা তুলনামূলকভাবে শক্তিশালী হয়ে উঠছে।
এতে একটি ইতিবাচক দিকও আছে—পরিষ্কার জ্বালানিতে (clean energy) পরিবর্তন হয়তো আরো ত্বরান্বিত হবে। শেল বিপ্লব ছিল একধরনের ‘মিষ্টি বিষ’ (sweet poison)। শেল পাথর (shale rock) ভেঙে তেল ওঠানোর ফলে যুক্তরাষ্ট্র আসলে কয়েক দশক ব্যবহারযোগ্য নতুন তেলের মজুত পেয়েছিল, যার ফলে আবেশে তারা ভুলতে বসেছিল যে তেল একদিন ফুরিয়ে যাবে, এবং তারা ধ্বংস করছে তাদের একমাত্র বাসযোগ্য গ্রহকেই।
কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের বড় এসইউভিগুলো (SUV) আর আগের মতো সস্তায় বা অনায়াসে জ্বালানি পাবে না। অনেকটা ঝড়ের বেগে বাস্তবতার সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষ ঘটতে যাচ্ছে। এই পরিবর্তন অবশ্যই বেদনাদায়ক হবে, তবে হয়তো এই ‘ব্যথা’ই যুক্তরাষ্ট্রের দরকার, যেন তারা টেকসই ভবিষ্যতের দিকে দ্রুত অগ্রসর হতে পারে।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার ও সম্ভাবনা
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (Artificial Intelligence, AI) সাম্প্রতিক সময়ে প্রযুক্তি শিল্পের অন্যতম আলোচিত বিষয় হয়ে উঠেছে এবং এর প্রকৃত সক্ষমতা এখন আমরা বাস্তবে উপলব্ধি করতে শুরু করেছি। বিশ্ব যখন আরও টেকসই ভবিষ্যতের দিকে এগোচ্ছে, তেল ও গ্যাস শিল্পেও বড় ধরনের রূপান্তর ঘটছে। এআই এই খাতে খরচ কমানো, দক্ষতা বৃদ্ধি এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। তেল ও গ্যাস শিল্প বিশ্ব অর্থনীতির অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি হলেও এটি বেশ কয়েকটি বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। কার্বন নিঃসরণ কমানো এবং আরও টেকসই হওয়া, পাশাপাশি অভিজ্ঞ শ্রমিকদের অবসর ও নতুন কর্মীর অভাবজনিত সংকট এর মধ্যে অন্যতম।
এআই বিভিন্নভাবে এই শিল্পকে সাহায্য করতে পারে। ভূতাত্ত্বিক তথ্য বিশ্লেষণের মাধ্যমে নতুন তেল ও গ্যাসের মজুদের সম্ভাব্য অবস্থান দ্রুত শনাক্ত করে অনুসন্ধান খরচ কমানো সম্ভব। উৎপাদন প্রক্রিয়া অপ্টিমাইজ করতে এআই যন্ত্রপাতির ব্যর্থতার পূর্বাভাস দিতে পারে, যা সময়মতো রক্ষণাবেক্ষণ নিশ্চিত করে উৎপাদন বিঘ্নের ঝুঁকি কমায়। এআই সম্ভাব্য নিরাপত্তাজনিত ঝুঁকি শনাক্ত করে দ্রুত সতর্কবার্তা প্রদান করতে সক্ষম হওয়ায় দুর্ঘটনা প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
এই খাতে এআই’র প্রয়োগের মধ্যে উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হলো স্বয়ংক্রিয় ড্রিলিং ব্যবস্থা, যা ড্রিলিং প্রক্রিয়াকে নিরাপদ ও কার্যকর করতে এআই অ্যালগরিদম ব্যবহার করে যন্ত্রপাতি নিয়ন্ত্রণ এবং ঝুঁকি শনাক্ত করে। এর ফলে উৎপাদনশীলতা বাড়ে এবং দুর্ঘটনার ঝুঁকি কমে। প্রেডিক্টিভ মেইনটেন্যান্সের মাধ্যমে এআই যন্ত্রপাতির সম্ভাব্য ত্রুটি শনাক্ত করে আগে থেকেই মেরামতের প্রয়োজনীয়তা নির্দেশ করতে পারে, যা অপারেশনাল খরচ ও অচলকাল কমিয়ে কার্যকারিতা বৃদ্ধি করে। ভূগর্ভস্থ রিজার্ভের আচরণ নির্ধারণেও এআই ব্যবহৃত হয়, যার ফলে উত্তোলন কার্যক্রমের সময় এবং পরিমাণ নির্ধারণ আরও কার্যকর হয়।
এআই ব্যবহারের মাধ্যমে খরচ সাশ্রয়, উৎপাদন প্রক্রিয়া উন্নতকরণ এবং দুর্ঘটনা প্রতিরোধের পাশাপাশি কার্বন নিঃসরণ কমিয়ে টেকসই উন্নয়নের পথে এগোনো সম্ভব। তবে এআই ব্যবহারে কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে। বিশাল আকারের ভূতাত্ত্বিক তথ্য ও সেন্সর ডেটা সঠিকভাবে আয়ত্তে নিয়ে কার্যকর মডেল তৈরি করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। তেল ও গ্যাস শিল্পের ঐতিহ্যবাহী কর্মীরা প্রযুক্তিগত দক্ষতায় অভ্যস্ত না হওয়ায় ডেটা সায়েন্টিস্ট, মেশিন লার্নিং ইঞ্জিনিয়ার এবং সফটওয়্যার বিশেষজ্ঞদের পুনরায় প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। পরিবেশগত নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে কঠোর বিধিনিষেধের মধ্যে থেকে কাজ করতে হবে, যা আইনগত কাঠামোর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে পরিকল্পনা প্রণয়নকে আরও কঠিন করে তুলেছে। তাছাড়া এআই-চালিত সিস্টেম সাইবার আক্রমণের ঝুঁকিতে থাকে, যা মোকাবিলার জন্য উপযুক্ত সাইবার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা জরুরি।
তেল ও গ্যাস শিল্পে এআই’র বিপ্লব ইতোমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে এবং এটি দক্ষতা বাড়ানো, খরচ কমানো এবং নিরাপত্তা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে নতুন সম্ভাবনার দরজা খুলে দিচ্ছে। স্বয়ংক্রিয় ড্রিলিং, প্রেডিক্টিভ মেইনটেন্যান্স এবং রিজার্ভ অপ্টিমাইজেশনের মতো উদ্ভাবনী পদ্ধতির মাধ্যমে অনুসন্ধান খরচ কমছে, উৎপাদন প্রক্রিয়া আরও উন্নত হচ্ছে এবং কার্বন নিঃসরণ কমানোর পথ সুগম হচ্ছে। এআই-নির্ভর উদ্ভাবন তেল ও গ্যাস খাতের ভবিষ্যতকে আরও সমৃদ্ধ ও ঝুঁকিহ্রাসকারী করে তুলেছে। টেকসই ভবিষ্যতের অভিযাত্রায় শামিল হতে এই শিল্পকে প্রযুক্তিগত দক্ষতা বৃদ্ধি, ডেটা ব্যবস্থাপনা এবং সাইবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। তবে একসঙ্গে সঠিক পরিকল্পনা ও প্রয়োগের মাধ্যমে এআই এই শিল্পকে আরও প্রতিযোগিতামূলক ও টেকসই করতে সহায়তা করবে।
উপসংহার
যুক্তরাষ্ট্র জানে যে তারা অনন্তকাল তেলের ওপর নির্ভর করে থাকতে পারবে না। তবুও বর্তমান বৈশ্বিক বাস্তবতায় তারা তেল উৎপাদন, রপ্তানি ও পরিশোধন খাতে ব্যাপকভাবে লাভ করছে। ভূরাজনৈতিক অস্থিরতা ও বিশ্ববাজারের চাহিদা বিবেচনায়, দেশে প্রচুর তেল উৎপাদন করার সক্ষমতা তাদেরকে শক্তিশালী অবস্থানে নিয়ে গেছে। আমদানি নির্ভরতা এখন অনেক কমে গেছে, তবে পরিশোধনাগার কাঠামো ও ব্যবসায়িক কৌশলের কারণে আমদানি পুরোপুরি বন্ধও হচ্ছে না।
এর পাশাপাশি পরিবেশগত ঝুঁকি, ভবিষ্যৎ মজুদের সীমাবদ্ধতা এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানির বিকাশ—এই সবকিছুর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের তেলশিল্পকে মানিয়ে নিতে হবে। এখন পর্যন্ত তারা সুপ্রিম (Supreme) ভুমিকায় থাকলেও, দীর্ঘমেয়াদে টিকে থাকতে হলে উৎসবের পাশাপাশি প্রস্তুতি ও রূপান্তরের পথও খুঁজতে হবে।
তথ্যসূত্র
- The Boom: How Fracking Ignited the American Energy Revolution and Changed the World, Russell Gold
- Windfall: How the New Energy Abundance Upends Global Politics and Strengthens America’s Power, Meghan L. O’Sullivan
- The New Map: Energy, Climate, and the Clash of Nations, Daniel Yergin
- Saudi America: The Truth About Fracking and How It’s Changing the World, Bethany McLean
- https://www.eia.gov/tools/faqs/faq.php?id=709&t=6.
- https://www.oecd-ilibrary.org/docserver/dbf6150b-en.pdf?expires=1728925419&id=id&accname=guest&checksum=58F02ED908492563E05DACF00C1A87D6
- https://ourworldindata.org/grapher/installed-solar-pv-capacity?time=2008..latest&country=CHN~USA
- https://www.wsj.com/business/energy-oil/americas-oil-power-might-be-near-its-peak-5d956a24
- https://www.ft.com/content/84e228a9-9e97-4445-9527-2b7ed80283a7
- https://www.wsj.com/articles/u-s-oil-boom-blunts-opecs-pricing-power-472567f?mod=article_inline
- https://www.wsj.com/articles/the-texas-well-that-started-a-revolution-1530270010?mod=article_inline&mod=article_inline
- https://www.wsj.com/articles/taking-the-fracking-boom-global-1529409963?mod=article_relatedinline
- https://pubs.geoscienceworld.org/aapg/aapgbull/article/107/6/851/623376/M-King-Hubbert-and-the-rise-and-fall-of-peak-oil
- https://www.aei.org/economics/this-is-not-the-world-that-the-peak-oil-energy-doomer-promised/
- https://www.sciencedirect.com/science/article/pii/S2214629621004941?via%3Dihub
- https://www.forbes.com/sites/davidblackmon/2024/09/24/california-targets-exxonmobil-with-plastics-recycling-lawsuit/?
- https://iea.blob.core.windows.net/assets/6ff5beb7-a9f9-489f-9d71-fd221b88c66e/Oil2023.pdf
- https://www.wsj.com/articles/fracking-oil-prices-shale-boom-11643824329
- https://www.bloomberg.com/news/articles/2022-02-18/shale-wildcatters-send-bullish-oil-price-signal-with-output-restraint
- https://www.ft.com/content/030dc3c8-0f25-483e-91aa-9dbd9abc5c4d
- https://www.nytimes.com/2022/07/27/opinion/environment/energy-crisis-oil-gas-fracking.html
- https://www.desmog.com/2015/08/02/once-burned-twice-shy-utica-shale-touted-investors-shale-drillers-continue-posting-losses/
- https://www.desmog.com/2018/04/18/finances-great-american-fracking-bubble/
- https://www.npr.org/2023/06/09/1179415899/oil-production-gas-prices-opec-climate-change-permian-basin-texas
- https://www.gao.gov/products/gao-21-118
- https://www.propublica.org/article/frack-fluid-spill-in-dimock-contaminates-stream-killing-fish-921#photo_correx
- https://apnews.com/article/gas-drilling-fracking-water-pollution-dimock-378d15157b7a53bb34f3633f99f5228f
- https://www.wsj.com/articles/wall-streets-fracking-frenzy-runs-dry-as-profits-fail-to-materialize-1512577420
- https://www.wsj.com/articles/investors-question-oil-output-in-permian-basin-americas-fastest-growing-field-1502325779?mod=article_inline
- https://www.wsj.com/articles/shale-produces-oil-why-not-cash-1498486995?mod=article_inline
- https://www.bloomberg.com/news/articles/2022-05-05/u-s-shale-s-cash-bonanza-is-about-to-wipe-out-300-billion-loss
- https://www.desmog.com/2022/12/07/peak-us-oil-production-shale-boom-ends-bakken-permian/
- https://www.desmog.com/2021/01/28/us-crude-oil-exports-hasten-demise-oil-industry/
- https://www.economist.com/business/2017/03/25/americas-shale-firms-dont-give-a-frack-about-financial-returns
- https://oilprice.com/Energy/Crude-Oil/US-Shale-Oil-Production-Growth-Is-Slowing-Down.html
- https://prospect.org/environment/frackers-restrict-the-flow-and-raise-the-price/
- https://www.wsj.com/articles/SB10000872396390444549204578020602281237088
- https://www.nytimes.com/2019/06/30/business/energy-environment/oil-companies-profit.html
- https://www.bloomberg.com/news/articles/2020-03-09/shale-s-new-reality-almost-all-wells-drilled-now-lose-money
- https://www.economist.com/graphic-detail/2024/03/27/three-reasons-why-oil-prices-are-remarkably-stable
- https://www.wsj.com/business/energy-oil/peak-oil-demand-isnt-on-the-horizon-opec-says-e643ac82?st=GUpwUN&mod=googlenewsfeed
- https://www.economist.com/special-report/2024/03/11/why-oil-supply-shocks-are-not-like-the-1970s-any-more
- https://www.nytimes.com/2024/08/30/business/oil-prices.html
- https://www.nytimes.com/2024/07/16/business/energy-environment/oil-company-profits.html
- https://www.bloomberg.com/news/articles/2024-09-12/us-oil-boom-turns-kamala-harris-into-an-unlikely-fracking-supporter
- https://www.eia.gov/todayinenergy/detail.php?id=61545#
- https://www.eia.gov/todayinenergy/detail.php?id=57020
- https://www.nytimes.com/2023/12/01/business/energy-environment/us-oil-production-record-climate.html
- https://www.bloomberg.com/news/articles/2018-01-25/the-dark-side-of-america-s-rise-to-oil-superpower
- https://www.nytimes.com/interactive/2024/02/03/climate/us-lng-natural-gas-leader.html
- https://www.bakerinstitute.org/research/us-lng-exports-supply-siting-and-bottlenecks
- Oklahoma State Capitol imgae: This file is licensed under the Creative Commons Attribution-Share Alike 4.0 International license. Jno.skinner. Changes were made. https://creativecommons.org/licenses/by-sa/4.0/deed.en
বিশ্ববাজারে তেল ও গ্যাসের শক্তির পরিবর্তন: যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি আরব ও রাশিয়ার ভূ-রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা (৩০ নভেম্বর, ২০২৪)
ভূমিকা
বিশ্বরাজনীতিতে (Geopolitics) একটি সাধারণ নিয়ম সবসময় প্রাসঙ্গিক থেকেছে— ক্ষমতা (Power) আসে জ্বালানি (Energy) থেকে। অর্থনীতি (Economy) ও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা বহুলাংশে নির্ভর করে পর্যাপ্ত জ্বালানি সম্পদের প্রাপ্যতার ওপর। যে কেউ জ্বালানি নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবহার করতে পারবে, সেই অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে পারবে, প্রভাব খাটাতে পারবে এবং প্রতিদ্বন্দ্বীদের পেছনে ফেলতে পারবে। তাই তেল (Oil) ও গ্যাস (Gas) জিওপলিটিক্সে একটি শক্তিশালী অস্ত্র (Weapon) এবং রাষ্ট্রশক্তির (State Power) জন্য অতি মূল্যবান সম্পদ।
বিশেষ করে ২০২০-এর দশকে এই সত্য আরও স্পষ্ট হয়েছে। কোভিড-১৯ মহামারি (Pandemic) এবং ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যে (Middle East) যুদ্ধের প্রাদুর্ভাবে বিশ্ব ক্রমেই অস্থির হয়ে উঠেছে। একদিকে দীর্ঘমেয়াদি নেট জিরো (Net Zero) বাস্তবায়নের স্বপ্ন কিছুটা থমকে গেছে, অন্যদিকে রাষ্ট্রগুলোকে তড়িঘড়ি করে শক্তি-নিরাপত্তা (Energy Security) পুনরুদ্ধারে মনোযোগী হতে হচ্ছে। ভাগ্যক্রমে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রে (US) শেল বুম (Shale Boom) হওয়ায় প্রচুর পরিমাণে তেল ও গ্যাস সরবরাহ রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র এখন বিশ্বে অপরিশোধিত তেল (Crude Oil) এবং গ্যাস উৎপাদনে শীর্ষস্থানীয়। ফলে যে ত্রিমুখী ক্ষমতার সমীকরণ—সৌদি আরব (Saudi Arabia), রাশিয়া (Russia) এবং যুক্তরাষ্ট্র (US)—তারা মিলে বিশ্বে মোট অপরিশোধিত তেলের ৪০% ও প্রাকৃতিক গ্যাসের (Natural Gas) ৪৩% উৎপাদন করে। এদের সঙ্গে জোটগত সম্পর্ক ও বৈদেশিক বিনিয়োগের (Foreign Investment) সূত্রে বিশ্ববাজারের (Global Market) আরও বড় একটি অংশকে নিয়ন্ত্রণ করে। অন্যান্য দেশও অবশ্য তেল-গ্যাস উৎপাদন করে, তবে প্রকৃত কর্তৃত্বে তারাই প্রধান শক্তি।
বর্তমান অস্থিরতা এবং পরিবর্তনের সময়ে, এই তিন শক্তি তেল-গ্যাস বাণিজ্যের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সংগ্রামে লিপ্ত। যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপীয় বাজার (European Market) রাশিয়ার কাছ থেকে কেড়ে নিচ্ছে এবং বৈশ্বিক বাজারের মূল্য-ব্যবস্থাপক হিসেবে সৌদি আরব ও ওপেকের (OPEC) কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করছে। যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বিষয়টি লাভজনক হলেও রাশিয়া ও সৌদি আরবের জন্য তেল-গ্যাস শুধু অর্থনীতির অংশ নয়; সেটাই আসলে তাদের অর্থনীতি। তাদের প্রধান ক্ষমতার উৎস। তাই তাদের আয় যখন হুমকিতে পড়ে, তখন তারা পাল্টা পদক্ষেপ নিতেই বাধ্য হয়। রাশিয়ার ক্ষেত্রে আমরা ইতোমধ্যেই এর উদাহরণ দেখেছি। আর ইতিহাস বলে, সৌদি আরবের পক্ষ থেকেও যে কোনো সময় বড় ধরনের প্রতিশোধাত্মক পদক্ষেপ নেওয়া অসম্ভব নয়। বিশেষ করে এমন কিছু, যা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বিপর্যয়কর হতে পারে।
তাহলে কীভাবে যুক্তরাষ্ট্রের উদীয়মান তেলশিল্প (Oil Industry) পুরনো শক্তির ভারসাম্য বদলে দিচ্ছে? কেন রাশিয়ার ডার্ক ফ্লিট (Dark Fleet) জাহাজগুলো তাদের অবস্থান গোপন বা ভুয়া লোকেশন দেখিয়ে তেল ও গ্যাস সরবরাহ করছে? এবং কীভাবে সৌদি আরব যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়াকে চাপে ফেলে আবারও ক্ষমতার শীর্ষে ফেরার চেষ্টা করতে পারে?
যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরবের পুরনো সম্পর্ক
বর্তমান বৈশ্বিক শক্তি সরবরাহের পালাবদল বুঝতে হলে জানতে হবে যে সৌদি আরব ও যুক্তরাষ্ট্র কখনোই এমন প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল না। আসলে তেলের বিশ্বে এই দুই দেশের সম্পর্ক প্রায় ১০০ বছরের পুরনো, এবং শুরুতে তা ছিল পারস্পরিক লাভজনকতার ভিত্তিতে। মহামন্দা (Great Depression) কাটিয়ে ওঠার সময় যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি যখন দ্রুতগতিতে শিল্পায়িত হচ্ছিল, তখন জ্বালানির চাহিদা বাড়তে থাকে। তাই যুক্তরাষ্ট্রের তেল কোম্পানিগুলো বিদেশি উৎসে তেল খুঁজতে ঝুঁকে পড়ে।
এরপর আসে ১৯৩২ সাল। মধ্যপ্রাচ্যের (Middle East) চারটি অঞ্চলকে একীভূত করে ইবনে সাউদ (Ibn Saud) নামে এক শাসকের অধীনে জন্ম নেয় নতুন একটি দেশ—যা আজকের সৌদি আরব। সদ্য প্রতিষ্ঠিত রাজ্যটি উন্নয়ন ও আধুনিকায়নের স্বপ্ন দেখছিল। তাই ১৯৩৩ সালে সৌদি আরব স্ট্যান্ডার্ড অয়েল অব ক্যালিফোর্নিয়াকে (Standard Oil of California) তাদের ভূখণ্ডে তেল অনুসন্ধানের অধিকার দেয়। এর মাধ্যমেই তৈরি হয় ক্যালিফোর্নিয়া-আরাবিয়ান স্ট্যান্ডার্ড অয়েল কোম্পানি, যা পরে অ্যারাবিয়ান-আমেরিকান অয়েল কোম্পানি নাম নেয়। সংক্ষেপে যার নাম—আরামকো (Aramco)। আজকের দিনে সৌদি আরবের সবচেয়ে বড় রাষ্ট্রীয় তেল কোম্পানি (State Control Industry) আরামকো একসময় ১০০% আমেরিকান মালিকানাধীন ছিল, এবং এর নামেই সেই ঐতিহাসিক বন্ধনের ছাপ রয়ে গেছে।
১৯৩৮ সালে প্রথম বড় তেলক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয় এবং এর পরবর্তী কয়েক দশক ধরে সৌদি আরবের তেলশিল্প দ্রুত প্রসারিত হয়। এ সময়টি ছিল সৌদি সরকারের, যুক্তরাষ্ট্রের বড় বড় তেল কোম্পানি এবং মার্কিন সরকারের পরস্পর নির্ভরশীলতার যুগ—সৌদি শাসকের নিরাপত্তায় (Military Protection) সাহায্য করত যুক্তরাষ্ট্র, আর বিনিময়ে তারা পেত তেল। কিন্তু সৌদিরা ধীরে ধীরে উপলব্ধি করে যে তাদের কাছে বিশাল সম্পদ রয়েছে, আর এ সম্পদ অন্যের নিয়ন্ত্রণে রাখতে তারা নারাজ। ফলে ১৯৬০ ও ১৯৭০-এর দশকে তেলের মালিকানা আস্তে আস্তে মার্কিন কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে সৌদি সরকারের হাতে চলে যায়। সৌদির তেলমন্ত্রী আহমেদ জাকি ইয়ামানি (Ahmed Zaki Yamani) এই পথনির্দেশনা দিয়েছিলেন।
সে সময় শুধু সৌদিতেই নয়, আরও অনেক দেশে—যেমন ভেনেজুয়েলা (Venezuela), লিবিয়া (Libya), ইরাক (Iraq), কুয়েত (Kuwait)—তেলশিল্প জাতীয়করণ চলছিল। একই সময়ে, সৌদি আরব সোভিয়েত ইউনিয়নের (Soviet Union) প্রভাব থেকেও রেহাই পাচ্ছিল না। ১৯৫০ ও ১৯৬০-এর দশকে সোভিয়েতরা নিজেদের স্যাটেলাইট রাষ্ট্রগুলো (Satellite States)—পূর্ব ইউরোপ (Eastern Europe), উত্তর কোরিয়া (North Korea), কিউবা (Cuba)—এসব জায়গায় তেল সরবরাহ করত। সেই বাড়তি তেল তারা বিশ্ববাজারে ছেড়ে দিয়ে দাম কমিয়ে দিত। এতে সৌদির রপ্তানি (Export) আয়ে চাপ পড়ে। সৌদিরা এই অতিরিক্ত সরবরাহের প্রতিক্রিয়ায় অন্যান্য বড় তেল-রপ্তানিকারী দেশের সঙ্গে সমন্বয় শুরু করে, যাতে তারা নিজেদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যগুলো পুরণ করতে পারে। এভাবেই ১৯৬০ সালে তৈরি হয় অর্গানাইজেশন অব পেট্রোলিয়াম এক্সপোর্টিং কান্ট্রিজ (OPEC), যা আজকের দিনে বিশ্বের প্রমাণিত তেল মজুদের (Proven Oil Reserves) ৮০%-এর বেশি উত্তোলনের হার নিয়ন্ত্রণ করে।
১৯৭৩-এর আরব অয়েল ইমবার্গো থেকে শেল বুম পর্যন্ত
১৯৭৩ সালে আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ (Yom Kippur War) চলাকালীন, ইসরায়েলকে (Israel) পশ্চিমা বিশ্বের সামরিক সহায়তার প্রতিবাদে সৌদি আরব এবং অন্যান্য আরব ওপেক দেশগুলো যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের বিরুদ্ধে তেল আমবার্গো (Embargo) আরোপ করে। তখন বিশ্ববাজারে তেলের দাম দ্রুত আকাশচুম্বী হয়, মার্কিন ব্যবসাগুলো তেল-সংকটে ধুঁকতে থাকে, আর যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। এটি ছিল প্রথমবারের মতো, কিন্তু শেষবার নয়, যখন যুক্তরাষ্ট্রের ওপর মধ্যপ্রাচ্যের তেলনির্ভরতাকে নগ্নভাবে প্রকাশ করে দিল।
এই দুর্যোগ সামাল দিতে যুক্তরাষ্ট্র দেশের অভ্যন্তরীণ তেলের ওপর ৪০ বছরের জন্য রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা (Export Ban) দেয়। সৌদি আরব বিশ্বকে দেখিয়ে দিল যে তারাই প্রধান তেল-ক্ষমতা এবং বিশ্বপরিস্থিতিকে নিজেদের পক্ষে নিয়ে আসতে তারা নির্দ্বিধায় নিষেধাজ্ঞা ব্যবহার করতে পারে। পরবর্তী কয়েক দশক এভাবেই চলতে থাকে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের (Collapse of the USSR) আগে এবং পরে, রাশিয়ায় (তখন সোভিয়েত ইউনিয়ন) তেল উৎপাদন কমতে থাকে—বিশেষত ১৯৮০-এর দশকের শেষ ভাগ থেকে ১৯৯০-এর দশক পর্যন্ত—যার ফলে ওপেকের হাতে বাজারের নিয়ন্ত্রণ আরও মজবুত হয়।
এদিকে, ওপেকের ওপর নির্ভরশীলতা থেকে যেন আর বিপাকে পড়তে না হয়, যুক্তরাষ্ট্র জ্বালানি আমদানি (Import) বৈচিত্র্যময় করার কৌশল নেয়। তাদের অভ্যন্তরীণ তেল উৎপাদনও ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছিল। এরই মধ্যে বিশ্লেষক ও সামরিক বিশেষজ্ঞরা বারবার বলে আসছিলেন—যুক্তরাষ্ট্রের জ্বালানি নিরাপত্তা (Oil Security) এবং বিদেশি জ্বালানি উৎপাদনের ওপর নিয়ন্ত্রণহীনতা তাদের একটি প্রধান দুর্বলতা হয়ে উঠেছে। অনেকে মনে করেন, ২০০৩ সালে ইরাকে (Iraq) মার্কিন হামলার অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য ছিল ইরাকের তেলক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের প্রবেশাধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা। কারণ ৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে সেখানে মার্কিন তেল কোম্পানিগুলোর কাজ করার সুযোগ ছিল না। পরবর্তীতে সেখানে হলিবার্টন (Halliburton) নামের একটি তেল পরিষেবা কোম্পানি—যার সঙ্গে তৎকালীন মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট ডিক চেনির (Dick Cheney) সংশ্লিষ্টতা ছিল—তারা আবারও কাজ শুরু করে।
রাষ্ট্রীয়ভাবে তখন যুক্তরাষ্ট্র বলছিল, ইরাকের স্বৈরশাসক সাদ্দাম হুসেইনের (Saddam Hussein) কাছে ব্যাপক বিধ্বংসী অস্ত্র (Weapons of Mass Destruction) আছে এবং তিনি বিশ্বশান্তির জন্য হুমকি। কিন্তু আজ পর্যন্ত সে দাবির কোনো প্রমাণ মেলেনি। যাই হোক, ইরাকে ঢোকার পর যুক্তরাষ্ট্র ইরাকি তেল-আমদানি বাড়ানোর সুযোগ পেল। যদিও এর ফলে বাইরের তেলের ওপর মার্কিন নির্ভরশীলতা বড় কোনো পরিবর্তন হয়নি।
এরপর আসে ২১ শতকের hydraulic ফ্র্যাকিং (Fracking) আবিষ্কার ও শেল বুম (Shale Boom)। যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ তেল মজুদ এত বেড়ে গেল যে, ২০১৫ সালে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা (Barack Obama) প্রায় ৪০ বছর পর কাঁচা তেল রপ্তানির নিষেধাজ্ঞা তুলে নেন। যুক্তরাষ্ট্র আবার বড়সড় তেল রপ্তানিকারী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করল। কিন্তু একই সময় সৌদি আরবসহ বড় সব তেল উৎপাদনকারী দেশগুলোও বিপুল পরিমাণে তেল সরবরাহ বাড়িয়ে দিচ্ছিল, যার ফলে ২০১৪-১৫ নাগাদ তেলের দাম প্রায় ৭০% পর্যন্ত পড়ে যায়।
এই পরিস্থিতিতে ওপেক (OPEC) বেশ কিছু পদক্ষেপ নেয়। তারা অতিরিক্ত ১০টি তেল-উৎপাদক দেশের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়—যাকে এখন ওপেক প্লাস (OPEC Plus) বলা হয়—যাতে মিলিতভাবে উৎপাদন নিয়ন্ত্রণ করে দাম স্থিতিশীল রাখা যায়। ওই ১০টি দেশের মধ্যে রাশিয়া অন্যতম বড় উৎপাদক। সৌদি আরব ও রাশিয়ার এই ঐক্য প্রমাণ করে যে, যুক্তরাষ্ট্রের শেল বুম তাদের জন্য কতখানি হুমকি তৈরি করেছে।
রাশিয়া-ইউক্রেইন যুদ্ধ, ইউরোপীয় বাজার ও মার্কিন ভূমিকায় পরিবর্তন
যুক্তরাষ্ট্রের শেল বুমের আরেকটি ফলাফল হলো—পশ্চিমা বিশ্ব এখন তেলের উৎস নির্বাচন করতে আরও সাবধানী হতে পারছে। রাশিয়া ২০২২ সালে ইউক্রেইনে (Ukraine) আগ্রাসন শুরু করলে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (EU) রুশ তেলের ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে সক্রিয় হয়ে ওঠে। ঐতিহাসিকভাবে রাশিয়া ছিল ইইউর একটি প্রধান জ্বালানি সরবরাহকারী। কিন্তু যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর, রাশিয়ান তেল ও গ্যাস আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা (Sanction) আরোপ করে ইইউ—তাদের ছয় দফা প্যাকেজে (যা ২০২২ ও ২০২৩ সালে কার্যকর হয়) রাশিয়ান সিবর্ন (Seaborn) অপরিশোধিত তেল ও পেট্রোলিয়াম পণ্য আমদানি নিষিদ্ধ করা হয়। এর ফলে ইইউতে রাশিয়ান তেল আমদানি ৯০% পর্যন্ত কমে যায় এবং গ্যাসের ক্ষেত্রেও রাশিয়ান আমদানির হার ৪০% থেকে ১৫%-এ নেমে আসে। এটি আগামীতে আরও কমবে বলে ধারণা করা হচ্ছে, কারণ ইইউ প্রথমবারের মতো রুশ গ্যাসের ওপরও সরাসরি নিষেধাজ্ঞা চাপাতে শুরু করেছে।
এই শূন্যস্থান পূরণে এগিয়ে আসে যুক্তরাষ্ট্র। শেল বুমে তাদের উৎপাদিত অতিরিক্ত তেল ও এলএনজি (LNG) অর্থাৎ লিকুইফায়েড ন্যাচারাল গ্যাস (Liquefied Natural Gas) রপ্তানি করে ইউরোপে বড় সরবরাহকারী হয়ে ওঠে তারা। ইউরোপের কাছে যুক্তরাষ্ট্রের তেল ও গ্যাস কেনা ছিল অপেক্ষাকৃত সহজ একটি সমাধান—কারণ সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিকভাবে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ অনেকটাই সমমনা। এছাড়া সৌদি আরব বা রাশিয়ার মিত্র কাজাখস্তানের (Kazakhstan) মতো রাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীল হওয়ার ঝুঁকি ইউরোপ চায়নি। তাই শুধু নতুন এলএনজি টার্মিনালগুলো দ্রুত তৈরি করে ইউরোপ রাশিয়ান গ্যাসের পরিবর্তে মার্কিন গ্যাস আমদানি শুরু করে। ফলস্বরূপ, রাশিয়া যেসব দেশে মোটামুটি অর্ধেক তেল ও তার বেশি গ্যাস রপ্তানি করত—সেই ইউরোপীয় বাজারে বড় ধাক্কা খায়। নতুন ক্রেতা হিসেবে ভারত (India), চীন (China) ও তুরস্ক (Turkey) রাশিয়ান তেল কিনতে এগিয়ে এলো বটে, তবে রাশিয়াকে তখন বিশ্ববাজারে ব্যাপক ছাড় দিতে হলো।
ডার্ক ফ্লিট (Dark Fleet) ও নিষেধাজ্ঞা রাশিয়ানদের ফাঁকি
ইইউর সিবর্ন রাশিয়ান তেল নিষেধাজ্ঞার পাশাপাশি জি-৭ (G7) একটি মূল্যসীমা (Price Cap) বেঁধে দেয়: প্রতি ব্যারেল রাশিয়ান সিবর্ন তেলের দাম ৬০ ডলারের বেশি হতে পারবে না। যদি কেউ এই সীমার ওপরে রাশিয়ান তেল বিক্রি করে ধরা পড়ে, তাহলে সেই রাশিয়ান তেল ট্যাংকারকে (Tanker) বিমা (Insurance) সেবাদাতা—যেমন আমেরিকা ক্লাব (American Club), ওয়েস্ট অব ইংল্যান্ড (West of England), গার্ড (Guard) ইত্যাদি—বিমা দেবে না। এতে ট্যাংকার চালানো খুবই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়বে।
ফলে রাশিয়ানরা নিষেধাজ্ঞা এড়াতে একটি ডার্ক ফ্লিট গড়ে তুলেছে। ধারণা করা হয়, বিশ্বে মোট অপরিশোধিত তেলবাহী জাহাজের (Crude Oil Vessel) প্রায় ২০%—প্রকৃত হিসাব করা কঠিন বলে “রাফ এস্টিমেট (Rough Estimate)”—এই ডার্ক ফ্লিটের অন্তর্ভুক্ত। এরা জাহাজের ট্র্যাকিং সিস্টেম (Location Signal) বন্ধ বা জাল লোকেশন দেখায় যাতে কেউ বুঝতে না পারে এই ট্যাংকার কোথায় যাচ্ছে, কী করছে। এভাবেই তারা বিশ্ববাজারের নিয়ম ও নিষেধাজ্ঞা এড়িয়ে চলেছে।
নতুন শীতল যুদ্ধ (New Cold War) চলছে কিনা, তা বোঝার এক বড় লক্ষণ হলো—গোপনে থাকা এই রাশিয়ান তেলবাহী জাহাজগুলো “কোভার্ট অপারেশন (Covert Operation)” চালাচ্ছে। কিংবা, ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে নর্ডস্ট্রিম (Nord Stream) গ্যাস পাইপলাইন বিস্ফোরণও তো এ অভিযোগকে দৃঢ় করতে পারে। রাশিয়া থেকে জার্মানিতে (Germany) গ্যাস পরিবহনের জন্য এই পাইপলাইন স্থাপন করা হয়েছিল, যা এখন অচল। কে বা কারা এটি ধ্বংস করেছে, আজও তার কোনো চূড়ান্ত প্রমাণ মেলেনি। জার্মানি, সুইডেন (Sweden) ও ডেনমার্ক (Denmark) তদন্ত চালিয়েও হামলাকারী কে, আদেশ দিয়েছিল কে—এসব প্রশ্নের জবাব পায়নি।
এরই মধ্যে রাশিয়া ইউরোপে তেল ঢোকানোর অন্য উপায় খুঁজে নিয়েছে। ডার্ক ফ্লিটের সাহায্যে রাশিয়ান অপরিশোধিত তেল ভারতে পাঠানো হয়। পরে ভারতে পরিশোধিত (Refined) হলে সেটি আর “রাশিয়ান তেল” হিসেবে গণ্য হয় না। তখন সেই তেল এলোপাথাড়ি ইউরোপেই ফেরত যাচ্ছে। ইইউর নিষেধাজ্ঞা এখানেই ফাঁকি পড়ে। তাই নিষেধাজ্ঞার তোয়াক্কা না করেই রাশিয়া উপার্জন করছে। তবে তা আগের তুলনায় অনেক কম। রাশিয়ার কেন্দ্রীয় তহবিলে (Federal Revenue) তেল-গ্যাস থেকে আগের মতো অঢেল অর্থ আসছে না। এর কারণে ইউক্রেইন যুদ্ধে (War in Ukraine) পুতিনের (Putin) অর্থায়নও চাপে পড়েছে।
মধ্যপ্রাচ্যের অস্থিরতা ও বিশ্ববাজারে প্রভাব
রাশিয়া-ইউক্রেইন যুদ্ধের কারণে বিশ্ব তেল ও গ্যাস বাজারে যে বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে, সেখানে মধ্যপ্রাচ্যও যোগ দিয়েছে। গাজায় (Gaza) সংঘাত এবং লেবাননের (Lebanon) হিজবুল্লাহ (Hezbollah) ও ইরান (Iran) যুক্ত হয়ে ঝুঁকি বাড়িয়েছে। তেলের বাজারে মধ্যপ্রাচ্য বরাবরই গুরুত্বপূর্ণ, কারণ বিশ্বে এক-তৃতীয়াংশ তেল মধ্যপ্রাচ্য থেকে আসে। ইরানের ওপর আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা নতুন কিছু নয়, কিন্তু ইয়েমেনে (Yemen) ইরান-সমর্থিত হুথি (Houthi) বিদ্রোহীরা রেড সি (Red Sea)-তে বাণিজ্যিক জাহাজ হাইজ্যাক ও মিসাইল (Missile) হামলা শুরু করায় ওই রুট দিয়ে তেল পরিবহন কমে গেছে। ফলে অনেক জাহাজই এখন আর রেড সি ব্যবহার করছে না; বরং আফ্রিকার দক্ষিণ প্রান্ত কেপ অব গুড হোপ (Cape of Good Hope) ঘুরে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিচ্ছে। এতে পরিবহন খরচ ও সময়—দুটোই বেড়ে যাচ্ছে।
সৌদি আরবের অবস্থান: ১৯৭৩-এর পুনরাবৃত্তি নেই কেন?
সৌদি আরব মধ্যপ্রাচ্যের ডি-ফ্যাক্টো (De Facto) নেতা এবং ওপেকের মূল চালিকাশক্তি। ১৯৭৩ সালে তারা ইসরায়েলকে সমর্থনকারী পশ্চিমাদের ওপর তেল নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল। এবার যদিও ইসরায়েলের সঙ্গে আবার সংঘাত চলছে, সৌদি আরব এখনো আক্রমণাত্মকভাবে কার্ড খেলেনি। এর কারণ একাধিক। একদিকে, বিগত কয়েক দশকে সৌদি আরব ও যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদার হয়েছে। সৌদি আরব এখন বিনিয়োগে বৈচিত্র্য আনতে চায়—তেলনির্ভরতা কমিয়ে বিনোদন (Entertainment), পর্যটন (Tourism), প্রযুক্তি (Technology) প্রভৃতি ক্ষেত্রে এগোতে চায়। এ সময় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শত্রুতা তাদের ক্ষতি করতে পারে।
অন্যদিকে, পশ্চিমা বিশ্ব এখন সৌদি তেলের ওপর সেই পর্যায়ের নির্ভরশীল নয়। যুক্তরাষ্ট্রের শেল বুমের কল্যাণে আজ ১৯৭০-এর দশকের মতো তেলের ঘাটতি হলে পশ্চিমারা অচল হয়ে যাবে—এমন আশঙ্কা নেই। কাজেই, এখন সৌদি আরব যদি আরেকটি তেল অবরোধ (Embargo) চাপায়ও, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ সহজেই অন্য উৎস থেকে জোগান পেতে পারে। এতে সৌদির নিজেরই ক্ষতি হবে বেশি। তাই এমন কোনো চরম পদক্ষেপ নেওয়া এখন তাদের পক্ষে সঙ্গত নয়।
বিশ্ববাজারে দর-যুদ্ধ: সৌদি আরব বনাম যুক্তরাষ্ট্র
সৌদি আরব ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে দৃশ্যমান মিত্রতা থাকলেও, তেল ও গ্যাসের বিশ্ববাজারে দুটি পক্ষই প্রতিযোগী। গত দুই বছর ধরে সৌদি আরবের নেতৃত্বে ওপেক তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি ১০০ ডলারে নিয়ে যেতে চায়। বাজারে সংকট তৈরি করে দাম বাড়াতে তারা উৎপাদন কেটে (Production Cut) সরবরাহ কমাচ্ছে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা (Canada) এবং নতুন খেলোয়াড় গায়ানা (Guyana)—যার তেলশিল্প মূলত মার্কিন কোম্পানিগুলো পরিচালনা করে—তারা উৎপাদন বাড়িয়ে দিচ্ছে। ফলে বিশ্ববাজারে দাম তেমন বাড়ছে না; ব্যারেলপ্রতি ৭০-৮০ ডলারের আশেপাশেই আটকে থাকছে।
এছাড়া চীনের (China) অর্থনীতিতে চাহিদা দুর্বল হয়েছে, তারা বিশ্ববাজারের সবচেয়ে বড় তেল আমদানিকারক (Importer)। ফলে সৌদির আয় কমছে, আর বাজেট ঘাটতি (Budget Deficit) সামাল দিতে তাদের সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। এখন সৌদি আরবের কাছে দুটি পথ খোলা। এক, তারা চায় যদি মার্কিন শেলের বাজারদখল আর না বাড়ে, তাহলে ওপেক ও ওপেক প্লাসকে (OPEC Plus) নিয়ে করা উৎপাদন কাটা প্রত্যাহার করে তারা উৎপাদন বাড়াতে পারে। সৌদি আরব একাই প্রতিদিন ৩০ লাখ ব্যারেল বেশি তেল উত্তোলন করতে সক্ষম। এমনটা করলে বাজারে সরবরাহ বেড়ে দামের পতন হবে, যাকে বলে প্রাইস ওয়ার (Price War)। স্বল্প মেয়াদে সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তবে উচ্চ খরচের (High-Cost) মার্কিন শেল উৎপাদন সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে পড়বে। আর রাশিয়ার (Russia) ক্ষেত্রেও এই কম দাম যুদ্ধ অর্থায়নে বড় ধাক্কা দেবে।
দ্বিতীয় বিকল্প হলো, সৌদি আরব ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করবে। শেল বুমের চূড়ান্ত স্তর প্রায় পার হয়ে গেছে বলে অনেক বিশ্লেষক মনে করেন। যুক্তরাষ্ট্রের পারমিয়ান বেসিনে (Permian Basin) নতুন কূপের উৎপাদনও কমতে শুরু করেছে। ওয়াল স্ট্রিট (Wall Street) বিনিয়োগে সংযমী হচ্ছে। সৌদি আরবের হাতে যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে প্রায় সাত গুণ বেশি প্রমাণিত তেল মজুদ রয়েছে। দীর্ঘ সময় ধরে উচ্চ উৎপাদন রাখার সক্ষমতা তাদের আছে। তাই যুক্তরাষ্ট্রের রিসার্ভ (Reserve) শেষ হতে শুরু করলে সৌদি আরব বিশ্ব তেলের “লিডিং পাওয়ার (Leading Power)” হিসেবে পুরনো অবস্থান ফিরে পেতে পারে।
উপসংহার
এই মুহূর্তে তেল ও গ্যাসের বাজারে যে অস্থিরতা, তা শুধু অর্থনৈতিক নয়—এর সঙ্গে জড়িত ব্যাপক ভূ-রাজনৈতিক (Geopolitical) উত্তেজনা। রাশিয়ার ডার্ক ফ্লিট নিষেধাজ্ঞা এড়িয়ে তেল বেচছে, সৌদি আরব ওপেকের শীর্ষস্থান বজায় রাখার চেষ্টা চালাচ্ছে, আর যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপের বাজারে নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করছে। যে শক্তি গত শতকে একবার আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের সময় বিশ্বকে কাঁপিয়ে দিয়েছে, সেই তেলের প্রভাব যে এখনো অটুট—তা ইতিহাস ও বর্তমান যুগ মিলিয়ে আমরা বারবার দেখছি।
যুক্তরাষ্ট্রের শেল বুম, ইউরোপের নিষেধাজ্ঞা, রাশিয়ার যুদ্ধে অর্থায়নের চেষ্টা, সৌদির নেতৃত্বে দাম নির্ধারণের লড়াই—সবগুলো মিলে আক্ষরিক অর্থেই একটি নতুন সমীকরণ তৈরির পথে। এই সমীকরণে জ্বালানি নিরাপত্তা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি ভূ-রাজনৈতিক অবস্থানও সমান গুরুত্বপূর্ণ। সামনে পৃথিবীর শক্তির ভারসাম্য কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়, তা দেখার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। একদিকে ডার্ক ফ্লিট, অন্যদিকে সৌদি আরবের সম্ভাব্য কৌশলগত পদক্ষেপ—সব মিলিয়ে বৈশ্বিক তেল ও গ্যাস বাণিজ্যের ভবিষ্যৎ যে আরও বেশ কিছু নাটকীয় মোড় নেবে, তা বলাই বাহুল্য।
পারমাণবিক অস্ত্রের প্রত্যাবর্তন (২৯ নভেম্বর, ২০২৪)
ভূমিকা
তিন দশকের বিরতির পরে, যুক্তরাষ্ট্র (United States) আবারও পারমাণবিক অস্ত্র (Nuclear Weapons) তৈরি করছে। শুধু মিসাইল (Missiles) আর বোমা (Bombs) নয়, তৈরি করা হচ্ছে নতুন সাবমেরিন (Submarines), নতুন এয়ারপ্লেন (Airplanes) এবং সেগুলো উৎক্ষেপণের জন্য নতুন ভূগর্ভস্থ সাইলো (Underground Silos)। আগামী তিন দশকে, যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনী প্রায় ২ ট্রিলিয়ন ডলার ব্যয় করবে—ফলে প্রায় পুরোনো সম্পূর্ণ শীতল যুদ্ধের (Cold War) অস্ত্র ভাণ্ডারকে প্রতিস্থাপন করা হবে।
তুলনার জন্য, আসল ম্যানহাটন প্রকল্প (Manhattan Project)–এর খরচ ছিল প্রায় ৩০ বিলিয়ন ডলার, যার মধ্যে মুদ্রাস্ফীতি (Inflation) সমন্বয় করা হয়েছে। অন্যভাবে বললে, পরবর্তী ৩০ বছরের জন্য আমেরিকান জনগণ প্রতি পাঁচ মাসে আরেকটি ম্যানহাটন প্রকল্প-সমমানের খরচ দেবে।
শীতল যুদ্ধের অস্ত্রের সংখ্যা ও পরবর্তী অবস্থা
শীতল যুদ্ধের (Cold War) শেষ ভাগে, যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন (Soviet Union) মিলে মোট ৬০,০০০-এর বেশি পারমাণবিক অস্ত্র জমিয়ে রেখেছিল। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়ার সময় থেকে সংখ্যা কমতে শুরু করে, ২০০৯ সালে গিয়ে দাঁড়ায় প্রায় ১১,০০০-তে। ওই বছর, নতুন নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা (Barack Obama) পারমাণবিক অস্ত্রমুক্ত বিশ্বের ডাক দেন, যার জন্য তিনি নোবেল শান্তি পুরস্কার (Nobel Peace Prize) পান। পরের বছর যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া (Russia) “নিউ স্টার্ট (New Start)” নামে একটি অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ চুক্তি (Arms Control Treaty) স্বাক্ষর করে, যা প্রতিটি দেশের সক্রিয়ভাবে মোতায়েনকৃত (Actively Deployed) ওয়ারহেড (Warheads)–এর সংখ্যা সীমিত করে। তখন অনেকের কাছেই মনে হয়েছিল যে পারমাণবিক অস্ত্র অচিরেই অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়বে। বেশির ভাগ মানুষের ভাবনাতেই বিষয়টি সেখানেই আটকে ছিল।
কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, এই অস্ত্রগুলো ধীরে ধীরে আবারও ফিরে আসছে। রাশিয়ার সাথে সেই চুক্তির অনুমোদন পেতে (Ratify) ওবামা রিপাবলিকান (Republican) সেনেটরদের সঙ্গে এক সমঝোতায় যান—যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্রভাণ্ডারের আধুনিকায়নের (Modernize) জন্য বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার বরাদ্দ করা হয়। আর একবার যখন এই দরজা খুলে গেল, সেটিকে আর বন্ধ করা যায়নি। বিলিয়ন থেকে খরচ গিয়ে দাঁড়াল ট্রিলিয়নে (Trillions)।
পুরোনো অস্ত্রশস্ত্রের আধুনিকায়ন: ‘প্রয়োজনীয় টিউন-আপ’ না অপচয়?
প্রাথমিক যুক্তি ছিল যে, অনেক পারমাণবিক অস্ত্র ৩০, ৪০, এমনকি ৫০ বছর আগের তৈরি—ফলে এগুলো নানাভাবে মেরামত বা আধুনিকায়ন করা দরকার। যেমন ধরুন প্লুটোনিয়াম পিটস (Plutonium Pits)। প্রতিটি পারমাণবিক অস্ত্রের কেন্দ্রভাগে (Inside Every Nuclear Weapon) থাকে বলিং বলের (Bowling Ball) আকারের একটি সংকুচিত প্লুটোনিয়াম গোলক, যেটি বিস্ফোরণের সূচনা ঘটায়। জানা যায়, প্লুটোনিয়াম সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ভেঙে যায়, কিন্তু সঠিকভাবে কতটা সময় লাগে তা অজানা। ২০০৭ সালে একদল স্বাধীন বিজ্ঞানী গবেষণা করে দেখান যে এই পিটস কমপক্ষে ১০০ বছর স্থায়ী হতে পারে। পরবর্তীতে তারা আরও পরীক্ষায় দেখতে পান ১৫০ বছর বয়সী প্লুটোনিয়ামে (Plutonium) তেমন কোনো অপ্রত্যাশিত ত্রুটি দেখা যায়নি।
তবু যুক্তরাষ্ট্র এখন প্রতি বছরে প্রায় ৮০টি নতুন প্লুটোনিয়াম পিটস বানানোর পরিকল্পনা নিয়েছে, যার সম্ভাব্য খরচ ১৮ থেকে ২৪ বিলিয়ন ডলার। এবং এটি হচ্ছে কেবল শুরু।
নিউক্লিয়ার ট্রায়াড (Nuclear Triad): তিন স্তম্ভের একযোগে বদল
আমেরিকার নিউক্লিয়ার ট্রায়াডের তিনটি অংশ রয়েছে—বিমান (Air), সমুদ্র (Sea) এবং স্থল (Land)। এখন এই তিনটিকে একই সঙ্গে প্রতিস্থাপন করা হচ্ছে।
১. বিমান বাহিনী (Air Leg): যুক্তরাষ্ট্রের বিমান বাহিনী (US Air Force) নর্থ ডাকোটা (North Dakota), লুইজিয়ানা (Louisiana), এবং মিসৌরি (Missouri)–এই তিনটি ঘাঁটি (Bomber Bases) থেকে তাদের পারমাণবিক বোমারু বিমান (Nuclear Bomber) পরিচালনা করে। সেখানে আছে প্রায় ৬৬টি পারমাণবিক অস্ত্র বহনে সক্ষম বিমান, যার মধ্যে রয়েছে B52 এবং B2 বোমারু বিমান (Bombers)। এর মধ্যে B52 বিমানগুলো সম্পূর্ণরূপে নতুন B21 মডেলে প্রতিস্থাপিত হবে, আর B2 বিমানগুলোর ইঞ্জিন (Engines) পুনর্বিন্যাস বা উন্নত করা হবে।
২. নৌবাহিনী (Sea Leg): যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীর (US Navy) অধীনে ১৪টি ব্যালিস্টিক মিসাইল সাবমেরিন (Ballistic Missile Submarines) রয়েছে—এর মধ্যে আটটি প্রশান্ত মহাসাগরে (Pacific), ওয়াশিংটন (Washington) অঙ্গরাজ্যে অবস্থান করছে, আর ছয়টি আটলান্টিকে (Atlantic), জর্জিয়া (Georgia) অঙ্গরাজ্যে রয়েছে। এই ওহাইও-ক্লাস (Ohio Class) সাবমেরিনগুলোকে এখন কলাম্বিয়া-ক্লাস (Columbia Class) সাবমেরিন দিয়ে প্রতিস্থাপিত করা হবে, যার সম্ভাব্য খরচ অন্তত ১১২ বিলিয়ন ডলার।
৩. স্থল বাহিনী (Land Leg): মন্টানা (Montana), নর্থ ডাকোটা (North Dakota), ওয়াইওমিং (Wyoming), কলোরাডো (Colorado) এবং নেব্রাস্কা (Nebraska) জুড়ে রয়েছে প্রায় ৪৫০টি সুরক্ষিত খোলা জায়গা, যেগুলো দেখলে সাধারণ কোনো বেড়া দেওয়া ভূমির মতো মনে হয়। কিন্তু এর নিচে রয়েছে সাইলো (Silos), যার ভেতরে রাখা আছে আন্তঃমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক মিসাইল (Intercontinental Ballistic Missiles)। এগুলোকে বলা হয় মিনিটম্যান (Minuteman) মিসাইল, কারণ ৩০ মিনিটের কম সময়ে পৃথিবীর যেকোনো স্থানে আঘাত হানতে পারে। কিন্তু সেটাও নাকি যথেষ্ট নয়। বিমান বাহিনী (Air Force) এখন সবকিছু—মিসাইল, সাইলো, নিয়ন্ত্রণকেন্দ্র (Command Centers) ও তাদের সাথে সংযুক্ত ৭,৫০০ মাইল দীর্ঘ ভূগর্ভস্থ ক্যাবল (Underground Cables)—সবই আপগ্রেড (Upgrade) করছে।
সত্যিকারের প্রয়োজন কী?
এমন একটি যুক্তি দেওয়া যেতে পারে যে, এত বড় ঝুঁকির বিষয় যখন, তখন কিছু প্লুটোনিয়াম পিটস নতুন করে বানানোর পরিকল্পনা খারাপ নয়—এতে আমরা বিশ্বকে দেখাতে পারি যে ৩০ বছর বিরতির পরও আমরা এগুলো বানাতে সক্ষম। যদি বিদ্যমান পিটস সময়ের আগে নষ্ট হতে শুরু করে, তবে এটাই হবে আমাদের ‘ব্যাকআপ প্ল্যান (Backup Plan)’। কিন্তু বছরে ৮০টির মতো প্লুটোনিয়াম পিটস তৈরির যৌক্তিকতা বোঝা কঠিন—এটি বিরাট এবং অত্যন্ত ব্যয়বহুল মাত্রার পুনরাবৃত্তি (Redundancy) বলে মনে হয়।
প্রায় সব আপগ্রেড নিয়েই এমন কথা বলা যায়। কারণ বর্তমানে যেকোনো সময়ে, যে-কোনো দিনে, যুক্তরাষ্ট্রের ১,৭০০ পারমাণবিক ওয়ারহেড সক্রিয় (Deployed) অবস্থায় থাকে—কয়েক ডজন সাবমেরিন সমুদ্রের গভীরে, কয়েকশো মিসাইল সাইলো সঙ্গে সঙ্গে উৎক্ষেপণের (Launch) জন্য প্রস্তুত, আর ডজন ডজন বোমারু বিমান ৫০,০০০ ফুট উচ্চতায় অদৃশ্যভাবে উড়তে সক্ষম। প্রতিটি ওয়ারহেড একটি মাঝারি আকারের শহর ধ্বংস করতে পারে, আর প্রতিটি সাবমেরিন এবং বোমারু বিমানে একাধিক ওয়ারহেড থাকে। অর্থাৎ, আমাদের প্রতিপক্ষ যদি আগে আক্রমণ করে, আমরা পাল্টা আঘাত করার সক্ষমতা অনেক আগেই নিশ্চিত করে রেখেছি। ফলে এই বিশাল আগ্নেয়াস্ত্র-সম্ভার আপগ্রেডের বাড়তি সুবিধা কোথায়, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।
বাজেট, সময়সীমা ও ঝুঁকি
আপগ্রেডগুলো যদি কেবলমাত্র অপচয় (Wasteful) হতো, তাহলে এক কথা ছিল। কিন্তু আসলে সবকিছুই সময়ের চেয়ে পিছিয়ে (Behind Schedule) আর বাজেটের চেয়ে বেশি খরচে (Over Budget) চলছে। উদাহরণস্বরূপ, নতুন আইসিবিএম (ICBMs)–এর খরচ ২০২০ সালের হিসেবের থেকে ৮১% বেড়ে এখন প্রায় ১৪১ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। প্লুটোনিয়াম পিটস তৈরির বাজেট ২০১৭ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে তিনগুণের বেশি বেড়েছে। এর মধ্যে অর্ধ বিলিয়ন ডলারের অপচয়ের কারণ ছিল একটি ছাদের উচ্চতা প্রয়োজনের তুলনায় ১৩ ফুট কম ডিজাইন করা হওয়া!
এছাড়া এই আধুনিকায়ন শুধু অপচয় নয়, বিপজ্জনকও (Dangerous)। নিউক্লিয়ার ট্রায়াডের স্থলভাগ (Land Leg) নিয়ে ভাবুন। একসময় নিশ্চল মিসাইলগুলোকে যৌক্তিক মনে করা হতো “টিকে থাকার” (Survivability) কারণে—সোভিয়েত ইউনিয়ন হয়তো এত বিশাল এলাকায় ছড়িয়ে থাকা সবগুলোকে খুঁজে বের করে ধ্বংস করতে পারবে না, ফলে পাল্টা আক্রমণের ক্ষমতা অটুট থাকবে। কিন্তু আজকের দিনে প্রযুক্তি অনেক উন্নত, আর আমাদের সাবমেরিন তো বটেই, স্টেলথ (Stealth) বোমারু বিমানও অনেক বেশি কার্যকর ও ব্যয়সাশ্রয়ীভাবে একই কাজ করতে পারে। সমুদ্রের তলদেশে লুকিয়ে থাকা মাত্র একটি সাবমেরিনকে খুঁজে বের করে ধ্বংস করা গুগল আর্থে (Google Earth) স্পষ্ট দেখা যায় এমন ৪০০টি সাইলো ধ্বংস করার চেয়ে অনেক বেশি কঠিন।
এখন অনেকে বলছেন, এই স্থলমুখী মিসাইলগুলো রাখার কারণ হলো এগুলো ‘নিউক্লিয়ার স্পঞ্জ (Nuclear Sponge)’ হিসেবে কাজ করবে। যুক্তরাষ্ট্রকে আক্রমণ করতে চাইলে শত্রুপক্ষকে আগে নিজেদের প্রায় ৪০০ অস্ত্র (Warheads) ব্যয় করতে হবে এসব সাইলো ধ্বংস করতে। এটা কোনোভাবেই স্বস্তিদায়ক চিন্তা নয়, কারণ এর ফলে লাখো বা মিলিয়ন মানুষের মৃত্যু হবার সম্ভাবনা রয়েছে— এমনকি যদি কৌশলিকভাবে “কাজও” করে। আপনি হয়তো বিশ্বাস করতে পারেন যে ট্রায়াডের বাকি দুই পা—সাবমেরিন আর বোমারু বিমান—দিয়েই পাল্টা আক্রমণের নিশ্চয়তা রয়েছে, সেক্ষেত্রে আইসিবিএমগুলো পুরোপুরি অর্থহীন বিশাল এক ব্যয়। অথবা আপনি বিশ্বাস করতে পারেন যে আইসিবিএম দরকারি, সেক্ষেত্রে এগুলো আসলে দেশের অভ্যন্তরে পারমাণবিক হামলার লক্ষ্যবস্তু তৈরি করছে। আর যদি তাতেও কোনো ‘মূল্য’ থেকে থাকে, সেটা আবার সংঘাতের সময় একটি ভয়াবহ দুর্ঘটনাপ্রবণ সম্ভাবনাও তৈরি করে। কেননা সাবমেরিন বা বোমারু বিমান মাঝপথে ফিরে আসতে পারে, কিন্তু একবার মিসাইল উৎক্ষেপণ (Launch) হয়ে গেলে আর থামানোর উপায় থাকে না।
শীতল যুদ্ধের তুঙ্গ মুহূর্তে (Heat of the Cold War), সময়ের (Speed) বিষয়টি ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ—কারণ যে কোনও মুহূর্তে পারমাণবিক আক্রমণের ঝুঁকি খুব বেশি ছিল। কিন্তু আজকের দিনে সেই ‘দ্রুততা’ বরং বড় ধরনের দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়াতে পারে।
নতুন অস্ত্র ব্যবস্থা ও প্রতিপক্ষের প্রতিক্রিয়া: আবারও অস্ত্র প্রতিযোগিতা (Arms Race)?
নতুন মিসাইল, সাবমেরিন বা বোমারু বিমান একা হয়তো সরাসরি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের (World War) সূচনা করবে না। কিন্তু প্রতিপক্ষের (Adversaries) কাছে এ যেন একটা বড় ধরনের উসকানি হয়ে দাঁড়ায়। সাধারণত যেসব সরকারি প্রকল্প নিছক অপচয়, সেগুলো ততটা ক্ষতিকর নয়। কিন্তু এই ২ ট্রিলিয়ন ডলারের প্রকল্পের (Project) ক্ষেত্রটি আলাদা। শুরুতে এটিকে বলা হয়েছিল, “পুরনো অবস্থায় ফিরিয়ে আনা, প্রতিরোধ ক্ষমতা (Deterrence) বজায় রাখা এবং পারমাণবিক সাম্যাবস্থা (Nuclear Equilibrium) স্থিত রাখা।” কিন্তু এর মাপ-পরিসর যত বেড়েছে, প্রতিপক্ষের কাছে ততই এটি হুমকি হিসেবে প্রতীয়মান হচ্ছে। পারমাণবিক প্রতিরোধ (Deterrence) সর্বদাই ধারণার ওপর নির্ভর করে, অর্থাৎ অন্যরা কীভাবে বিষয়টি দেখে।
ফলে আমরা হয়তো এমন এক পরিস্থিতিতে আটকে গেছি যেখানে এই নতুন অস্ত্রগুলো আমাদের নিরাপত্তা বৃদ্ধি করছে না; বরং রাশিয়া, চীন (China) আর উত্তর কোরিয়া (North Korea)-এর প্রতিক্রিয়ার (Reaction) কারণে আমাদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হচ্ছে। অন্তত এটুকু পরিষ্কার যে, ২ ট্রিলিয়ন ডলারের এই প্রকল্প বিশ্বকে দেখাচ্ছে, আমরা পারমাণবিক অস্ত্রকে (Nuclear Weapons) শিগগিরই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যেতে দিচ্ছি না। এমন পরিস্থিতিতে মস্কো (Moscow), বেইজিং (Beijing) বা পিয়ংইয়ং (Pyongyang) যদি এই ঘটনায় মনোযোগ না দিত, সেটাই অস্বাভাবিক হতো। বাস্তবে, তারা খুব ভালোভাবেই নজর রাখছে।
আমাদের অস্ত্রভাণ্ডার উন্নত করার পর থেকে শত্রুপক্ষেরাও পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ে আরও বেশি সক্রিয় হয়ে উঠেছে। রাশিয়া, বিশেষ করে ইউক্রেনের (Ukraine) সাথে যুদ্ধের সময় পারমাণবিক হুমকি (Nuclear Blackmail) দিয়েছে, এমনকি তাদের কিছু পারমাণবিক অস্ত্র বেলারুশে (Belarus) স্থানান্তরিত করেছে। তারা নতুন ধরনের অস্ত্রও তৈরি করছে এবং নিউ স্টার্ট (New Start) চুক্তি থেকে পুরোপুরি সরে গেছে—ফলে ২০২৬ সালে চুক্তির মেয়াদ শেষ হলে ইচ্ছেমতো পারমাণবিক অস্ত্র মোতায়েন করতে পারবে। অন্যদিকে চীনের মজুদ এখনো রাশিয়া বা আমেরিকার তুলনায় কম হলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সেটা দ্রুতগতিতে বাড়ছে।
এককভাবে মস্কো, বেইজিং কিংবা ওয়াশিংটন কেউই হয়তো স্বীকার করে না যে তারা আগ্রাসীভাবে অস্ত্র বাড়াচ্ছে। তারা বলবে, “উদীয়মান হুমকি মোকাবিলায়” আমরা শুধু “পুনরায় প্রতিরোধ ক্ষমতা” (Restoring Deterrence) সৃষ্টি করছি। কিন্তু সকলেই যদি একসঙ্গে “পুনরায় প্রতিরোধ ক্ষমতা” সৃষ্টির কথা বলে, সেটাকেই আমরা অস্ত্র প্রতিযোগিতা (Arms Race) বলে থাকি।
উপসংহার
এই হলো সামগ্রিক চিত্র। আমাদের সামনে ৩০ বছরের এক দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা রয়েছে, যেখানে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবস্থার প্রায় প্রতিটি অংশে বিশাল বাজেট, সময়সীমা আর জটিলতার বোঝা যুক্ত হচ্ছে। এদিকে, প্রতিপক্ষেরাও নিশ্চুপ নেই; তারাও নিজস্ব পারমাণবিক অস্ত্রের বিকাশে মনোযোগ বাড়িয়েছে। ইতিহাস বলে, পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতা কারও জন্যই স্বস্তিকর নয়—এতে শুধু ব্যয় কিংবা দুর্ঘটনার ঝুঁকিই নয়, বরং গোটা বিশ্বের নিরাপত্তাও হুমকির মুখে পড়ে।
তথ্যসূত্র
- https://www.foreignaffairs.com/china/crumbling-nuclear-order
- https://www.ft.com/content/561d16ee-5dd5-4ee6-8c42-63372040b37b
- https://www.gao.gov/assets/gao-23-105698.pdf
- https://www.scientificamerican.com/article/the-u-s-s-plans-to-modernize-nuclear-weapons-are-dangerous-and-unnecessary/
- https://www.scientificamerican.com/article/behind-the-scenes-at-a-u-s-factory-building-new-nuclear-bombs/
- https://inkstickmedia.com/does-the-us-need-new-plutonium-pits/
- https://thebulletin.org/2023/04/dealing-with-a-debacle-a-better-plan-for-us-plutonium-pit-production/
- https://armscontrolcenter.org/wp-content/uploads/2021/08/Plutonium-Pit-Production.pdf
- https://www.gao.gov/assets/d24106740.pdf
- https://www.armscontrol.org/act/2021-03/focus/enough-already-no-new-icbms
- https://warontherocks.com/2024/02/how-many-sentinel-missiles-does-the-united-states-need/
- https://fnl.mit.edu/may-june-2021/dont-renew-the-icbm-force-eliminate-it/
- https://armscontrolcenter.org/factsheet-the-nuclear-triad/
- https://thebulletin.org/premium/2024-05/united-states-nuclear-weapons-2024/#post-heading
- https://www.tandfonline.com/doi/epdf/10.1080/00963402.2024.2339170
- https://www.stimson.org/2024/americas-nuclear-weapons-quagmire/
- https://www.popularmechanics.com/military/weapons/a60255563/w93-nuclear-bomb/
- https://www.foreignaffairs.com/china/chinas-misunderstood-nuclear-expansion
- https://www.foreignaffairs.com/united-states/time-rethink-america-nuclear-strategy
- https://www.foreignaffairs.com/united-states/why-america-stands-lose-if-it-resumes-nuclear-testing
- https://www.foreignaffairs.com/united-states/us-nuclear-arsenal-can-deter-both-china-and-russia
- https://www.wsj.com/politics/national-security/u-s-should-prepare-to-expand-its-nuclear-forces-expert-panel-says-3e7b8f42
- https://www.armscontrol.org/issue-briefs/2024-06/2024-presidential-race-and-nuclear-weapons-threat
- https://www.ft.com/content/3ad88a65-cada-4f8a-a28a-70ad80f037e6
- https://www.nytimes.com/interactive/2024/10/10/opinion/nuclear-weapons-us-price.html
- https://thebulletin.org/2021/02/why-is-america-getting-a-new-100-billion-nuclear-weapon/
কী হতে পারে ট্রাম্পের জ্বালানি নীতি? (২৬ নভেম্বর, ২০২৪)
ভূমিকা
দ্বিতীয় মেয়াদের নির্বাচনী প্রচার (campaign trail)-এ ডোনাল্ড ট্রাম্প (Donald Trump) চমকপ্রদভাবে বেশ কয়েকবার তেল (oil) নিয়ে কথা বলেছেন। তিনি দাবি করেছেন, তার প্রথম মেয়াদে (first term) “ইতিহাসে সেরা পরিবেশগত মানদণ্ড, পরিষ্কারতম বায়ু ও পরিষ্কারতম জল” ছিল, অথচ একইসঙ্গে বলেছেন যে তিনি উদারহস্তে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান (drill, baby drill) চালাতে চান। এক্ষেত্রে তার যুক্তি হলো, আমেরিকায় অভ্যন্তরীণভাবে (domestic) বেশি তেল ও গ্যাস উত্তোলন করলে মুদ্রাস্ফীতি (inflation) কমবে, আর মার্কিন জ্বালানি-স্বাধীনতা (energy independence) নিশ্চিত হবে।
এই নিবন্ধে আমরা সংক্ষেপে দেখব, ট্রাম্পের প্রো-অয়েল বা তেলপন্থী (pro oil) জ্বালানি নীতি কেমন, এর পেছনে কী প্রেরণা আছে, আর আসলে কাজ করবে কি না।
ট্রাম্পের জ্বালানি নীতি—তিনটি মূল পরিকল্পনা
ট্রাম্পের কথায়, এখানে তিনটি নীতি উল্লিখিত, যা আলোচনার দাবি রাখে:
- আমেরিকায় অভ্যন্তরীণ তেল ও গ্যাস (oil and gas) উৎপাদন ব্যাপক বাড়ানো
- ইনফ্লেশন রিডাকশন অ্যাক্ট (Inflation Reduction Act) অন্তত আংশিকভাবে বাতিল করা—যা বাইডেনের (Biden) সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য আইনগত সাফল্য বলে বিবেচিত
- পারিস জলবায়ু চুক্তি (Paris Accords) থেকে আবার বেরিয়ে আসা
১. আমেরিকায় তেল ও গ্যাস উৎপাদন বাড়ানোর পরিকল্পনা
ট্রাম্প একাধিকবার বলেছেন, তিনি অফিসে গেলে “ড্রিল, বেবি, ড্রিল (drill, baby, drill)” হবে তার মন্ত্র। তিনি জোর দিয়েছেন, বাইডেনের নতুন তেল-গ্যাস নিয়ন্ত্রণ (regulation) বিশেষ করে শেল (shale) খাতে উঠে যাবে। এমনকি ট্রাম্প দাবি করেছেন, (অন্যান্য উপায় সহ) এই বাড়তি প্রাকৃতিক গ্যাস (natural gas) উৎপাদন এক বছরের মধ্যে প্রাকৃতিক গ্যাস ও বিদ্যুতের (electricity) দাম অর্ধেক করে দেবে, আর যুক্তরাষ্ট্রকে (US) শুধু আত্মনির্ভর নয়, বরং “energy dominant” করে তুলবে।
কিন্তু কিছু সতর্কতা অবলম্বন করতেই হবে এসব শুনতে গেলে। ট্রাম্প ফ্রেমিং করছেন, যেন বাইডেন (Biden) ও “নেট জিরো-উন্মত্ত (net zero obsessed) ডেমোক্র্যাটরা (Democrats)” মার্কিন তেল ও গ্যাস কোম্পানিকে (American oil and gas companies) বাঁধা দিচ্ছে। বাস্তবে ব্যাপারটা অত সরল নয়। এটা সত্য যে, বাইডেন শুরুর দিকে জলবায়ু সচেতন কথা বলেছিলেন—যেমন প্রথম দিনই “কেউ আর ড্রিলিং করবে না” বলে মন্তব্য করেন, কিস্টোন পাইপলাইনের (Keystone pipeline) একটা মূল পারমিটও (permit) বাতিল করেন। কিন্তু তেলের দাম (oil prices) বেড়ে গেলে, ভোটাররা বিরক্ত হলে তিনি দ্রুত ইউ-টার্ন নেন। বাইডেন কোটি কোটি ব্যারেল তেল স্ট্র্যাটেজিক পেট্রোলিয়াম রিজার্ভ (Strategic Petroleum Reserve) থেকে ছেড়ে দেন যাতে দাম কমে। পাশাপাশি তিনি প্রথম মেয়াদে ট্রাম্পের চেয়েও বেশি ড্রিলিং পারমিট (drilling permits) জারি করেন (যদিও ফেডারেল ভূমি লিজ দেয়া কার্যত স্থগিত রেখেছিলেন)।
বাইডেনের শাসনে, যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের সর্বোচ্চ তেল-উৎপাদক (world’s largest oil producer) হয়, এবং ২০২৩ সালে যেকোনো দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ তেল উৎপাদন করে। আমেরিকান তেল ও গ্যাস কোম্পানিগুলো রেকর্ড লভ্যাংশ (record dividends) দিচ্ছে, বিশাল শেয়ার বাইব্যাক (stock buybacks) করছে—যা ইঙ্গিত করে, যদি উৎপাদন বাড়ানো এতই লাভজনক হতো, তারা হয়তো এতটা শেয়ার বাইব্যাকের বদলে উৎপাদনে বিনিয়োগ করত।
বাস্তবতা হচ্ছে শেল তেল-গ্যাস উত্তোলন (shale oil and gas) সৌদি আরবের মতো অঞ্চলে তেলের তুলনায় তুলনামূলক ব্যয়বহুল। আমেরিকায় নাটকীয়ভাবে উৎপাদন বাড়বে কী না, তা নির্ভর করে বিশ্ববাজারে (global oil prices) দামের ওপর। একটা নিট ফল হলো এই যে, উচ্চতর তেলের দাম হলে আমেরিকান শেল আরও অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক হবে। কিন্তু এখানে উৎপাদক আর ট্রাম্পের মধ্যে দ্বন্দ্ব আছে। একদিকে ট্রাম্প রাজনৈতিক কারণে উচ্চ তেলের দাম পছন্দ করেন না—প্রথম মেয়াদে দাম ব্যারেল প্রতি ৭০ ডলার পার হলে তিনি অসন্তুষ্টি প্রকাশ করতেন। আরেকদিকে, উৎপাদন বাড়াতে অনেক বড় মূলধনি বিনিয়োগ (capital investment) দরকার, যার জন্য নিম্ন সুদহারের (low interest rates) দরকার। (উৎপাদন বাড়ানোর জন্য বড় ধরনের মূলধনি বিনিয়োগ (capital investment) প্রয়োজন, যাতে উৎপাদন প্রক্রিয়া বা ব্যবসার সম্প্রসারণে সাহায্য হয়। মূলধনি বিনিয়োগ মানে হলো নতুন যন্ত্রপাতি, প্রযুক্তি বা অবকাঠামোতে অর্থ বিনিয়োগ করা। এই ধরনের বিনিয়োগ করতে হলে, ব্যবসাগুলোকে নিম্ন সুদহারের (low interest rates) সুবিধা প্রয়োজন, অর্থাৎ ঋণের সুদ হার কম হওয়া দরকার। কম সুদের হার হলে ব্যবসাগুলোর জন্য ঋণ নেয়া সহজ ও সস্তা হয়, এবং তারা সহজে বড় ধরনের বিনিয়োগ করতে পারে।) কিন্তু ট্রাম্পের শুল্ক (tariffs) ও করছাড় (tax cuts) প্যাকেজ মুদ্রাস্ফীতি (inflation) বাড়িয়ে ফেডের (Federal Reserve) সুদের হার (rate hikes) বাড়াতে বাধ্য করতে পারে।
২. ইনফ্লেশন রিডাকশন অ্যাক্ট (Inflation Reduction Act) বাতিলের কথা
এটি বাইডেন প্রশাসনের ২০২২ সালে পাস করা একটি আইন। এর উদ্দেশ্য, যুক্তরাষ্ট্রের নেট জিরো (net zero) লক্ষ্য অর্জনকে সহায়তা করা, জ্বালানি পরিকাঠামো (energy infrastructure) উন্নত করা, এবং গ্রিন এনার্জিতে (green energy) উদার ও সীমাহীন ভর্তুকি (subsidies) দেওয়া। এর মধ্যে রয়েছে পারমাণবিক বিদ্যুৎ (nuclear power) প্রতি মেগাওয়াট-আওয়ারে (megawatt hour) ১৫ ডলার করছাড় (tax credit) ও নবায়নযোগ্য বিদ্যুতে (renewables) ৩০% করছাড়। ফলে সৌরবিদ্যুৎ (solar) প্রকল্পের খরচ প্রায় ৬০% কমে গেছে, যার সুবাদে আমেরিকায় সৌর উৎপাদন (solar production) বাড়ছে। হোয়াইট হাউস বলছে, আইনটি ৩৭০ বিলিয়ন ডলার খরচ করবে, কিন্তু গোল্ডম্যান স্যাকস (Goldman Sachs) বলছে ১ ট্রিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে।
ট্রাম্প এটা নিয়ে ঠাট্টা করে বলেছেন, এটা একটা “গ্রিন নিউ স্ক্যাম” (green new scam) আর সম্পূর্ণ বাতিল করবেন বা অন্তত “অব্যয়িত তহবিল” (unspent funds) ফেরত নেবেন। কিন্তু বাস্তবে, প্রচলিত বিশ্লেষকরা মনে করেন, পুরো আইন বাতিল করা খুবই কঠিন হবে। কারণ:
- এটা আমেরিকায় কারখানা (manufacturing) ফিরিয়ে আনতে কার্যকর ভূমিকা রাখছে—চীনকে (China) সাপ্লাই চেইন ছেড়ে দেওয়াটা রাজনৈতিকভাবে ক্ষতিকর হবে।
- এর ভর্তুকির বড় অংশ রিপাবলিকান রাজ্যগুলো (Republican states) পেয়ে আসছে। “ব্লুমবার্গ (Bloomberg)” অনুযায়ী, রেপাবলিকান জেলাগুলো ডেমোক্র্যাট জেলাগুলোর চেয়ে চারগুণ বেশি জলবায়ু তহবিল পেয়েছে, কারণ সেসব জেলায় জমি সস্তা। অন্তত ১৮ জন হাউস রিপাবলিকান (House Republicans) এই এনার্জি ট্যাক্স ক্রেডিট চালিয়ে যেতে অনুরোধ করে চিঠি দিয়েছেন।
৩. পারিস জলবায়ু চুক্তি (Paris Climate Accord) থেকে বেরিয়ে আসা
ট্রাম্প আগের মেয়াদে ইতিমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রকে পারিস চুক্তি থেকে বের করে দিয়েছিলেন, যা তাকে চুক্তি ত্যাগকারী হিসেবে “বিশ্বের প্রথম দেশ” হিসেবে পরিণত করে। বাইডেন প্রথম দিনই সেটি ফিরিয়ে নেন (reverse)। এবার আবারো ট্রাম্প বলছেন তিনি বেরিয়ে আসবেন। কিন্তু আমেরিকা তার লক্ষ্যমাত্রা (emissions target) অর্জন করতে পারবে না। রোডিয়াম গ্রুপের (Rhodium) সাম্প্রতিক রিপোর্ট বলছে, “মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সঠিক গতিতে নেই”। অতএব, চুক্তিতে থাকা বা না-থাকা খুব একটা বাস্তব প্রভাব ফেলতে পারছে না।
সমাপনী আলোচনা—ট্রাম্পের জলবায়ু সংশয়বাদী মনোভাব বনাম বাস্তবতা
ট্রাম্পের কথাবার্তা (rhetoric) বরাবরই জলবায়ু বিষয়ে (climate) সন্দেহপ্রবণ (skeptic), কিন্তু মূল এজেন্ডা, যা তার বক্তব্যে সবচেয়ে জোর পায়, হলো আমেরিকান তেল ও গ্যাসের (oil and gas) ওপর আধিপত্য ফিরিয়ে আনা—যাতে যুক্তরাষ্ট্র সত্যিকারের জ্বালানি স্বাধীনতা (energy independence) পায়। এই আকাঙ্ক্ষা কিন্তু জিমি কার্টার (Jimmy Carter) সময় থেকেই প্রতিটি মার্কিন প্রেসিডেন্টই কমবেশি পোষণ করেছে।
সুতরাং, নিজ ভাষণে তিনি যতই “এবার হবে ড্রিল, বেবি, ড্রিল” বলে চিত্কার করুন না কেন, বাস্তবে তার নীতি হয়তো সব সময়কার সেই সাধারণ কাঠামোর বাইরে নয়। বরং—“কয়েকটি রেগুলেশন বাতিল” ও “পারিস চুক্তি থেকে বেরোনো”—এই দুটো করা সম্ভব, তবে শেল উত্তোলন (shale production) বাড়ানোর সক্ষমতা বিশ্ববাজারে মূল্য (prices) আর সুদের হার (interest rates)-এর মতো আরও বড় ফ্যাক্টরের ওপর নির্ভর করে। এবং এর অনেকগুলোই ট্রাম্পের নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকতে পারে।
সব মিলিয়ে ট্রাম্পের জ্বালানি নীতিকে (energy policy) তিনটি স্তরে বিবেচনা করা যায়:
- অভ্যন্তরীণ তেল-গ্যাস উৎপাদন বাড়ানো: রেগুলেশন শিথিল করে তিনি কিছুটা বাড়াতে পারেন, কিন্তু আমেরিকান শেল/গ্যাস উৎপাদন নির্ভর করবে মূলত বিশ্ববাজারের তেলের দামের ওপর। আবার উচ্চ দাম তিনি রাজনৈতিক কারণে পছন্দ করেন না। সুদের হার বেড়ে গেলে বৃহৎ মূলধনি বিনিয়োগে (capital-intensive investment) সমস্যা হবে।
- ইনফ্লেশন রিডাকশন অ্যাক্ট (IRA) বাতিল: তিনি নির্বাচনকালে বলছেন সম্পূর্ণ বাতিল করবেন, আসলে পুরোপুরি উড়িয়ে দেওয়া কঠিন, কারণ এতে কর্মসংস্থান, স্থানীয় উন্নয়ন, চীনা সরবরাহ চেইনের ওপর নির্ভরতায় কাটছাঁট ইত্যাদি জড়িয়ে আছে। অনেক রিপাবলিকানও এই অ্যাক্ট থেকে সুবিধা পাচ্ছে।
- পারিস চুক্তি থেকে সরে আসা: বাস্তবে এটি তিনি আগেও করেছেন, আবারও করতে পারেন। কিন্তু মার্কিন নিঃসরণ (U.S. emissions) যেভাবে চলছে, চুক্তিতে থাকলেও বাস্তবে লক্ষ্য পূরণে পিছিয়ে। ফলে এটি প্রতীকী গুরুত্বপূর্ণ হলেও বাস্তবে জলবায়ু লক্ষ্য ও অভ্যন্তরীণ নীতির ওপর তুলনামূলক কম প্রভাব ফেলে।
ট্রাম্পের কথাবার্তা শুনলে মনে হবে, তার নীতি অন্যান্য প্রশাসনের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী হবে। কিন্তু আমেরিকান প্রেসিডেন্টরা অনেক বছর ধরেই জ্বালানি স্বাধীনতার (energy independence) স্বপ্ন দেখেছেন, আর বিশ্ববাজারের সাথে সমন্বয় করে কাজ করতে বাধ্য হয়েছেন। তাই তাঁর জ্বালানি নীতি হয়তো বাস্তবে “কাগজে কলমে যত বড় ঝাঁপ” দেওয়ার কথা, ততটা রূপায়িত হবে না।
তথ্যসূত্র
1 – https://heatmap.news/sparks/trump-debate-best-environmental-numbers
2 – https://www.theguardian.com/business/2024/nov/19/trump-oil-gas-prices
3 – https://www.energyindepth.org/why-bidens-oil-drilling-permits-surge-is-not-what-it-seems/
4 – https://www.eia.gov/todayinenergy/detail.php?id=61545
5 – https://energyindemand.com/2024/11/09/initial-views-on-new-trump-administrations-impact-on-climate-policies/
6 – https://www.mckinsey.com/~/media/mckinsey/industries/public%20and%20social%20sector/our%20insights/the%20inflation%20reduction%20act%20heres%20whats%20in%20it/svgz-inflationreductionact-ex4.svgz?cq=50&cpy=Center
7 – https://enerlogics.com/2022/09/how-the-ira-reduces-solar-costs/
8 – https://theoregongroup.com/energy-transition/mining/will-the-inflation-reduction-act-survive-the-us-2024-election/
9 – https://www.cato.org/blog/iras-energy-subsidies-are-more-expensive-you-think
10 – https://democrats.org/news/donald-the-denier-donald-trump-has-repeatedly-called-climate-change-a-hoax/
11 – https://www.bruegel.org/first-glance/trumps-comeback-and-its-implications-eu-climate-and-energy-policy
12 – https://www.taxnotes.com/featured-news/ill-scrap-ira-tax-credits-day-1-trump-says/2023/09/28/7hdjq
13 – https://www.fastmarkets.com/insights/inflation-reduction-act-in-focus-in-trump-presidency-andrea-hotter/
14 – https://www.bloomberg.com/graphics/2024-opinion-biden-ira-sends-green-energy-investment-republican-districts/
15 – https://www.politico.com/news/2024/08/25/republican-fight-inflation-reduction-act-00176223
16 – https://www.nbcnews.com/science/environment/emissions-cuts-us-off-track-paris-goals-rcna163084
কেন ট্রাম্প ডলারের মূল্য কমাতে চান? (২২ নভেম্বর, ২০২৪)
ভূমিকা
নভেম্বরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প (Donald Trump) জয়ী হওয়ার পরপরই ডলারের (dollar) মূল্য আন্তর্জাতিক বাজারে বেড়ে গেছে। বিনিয়োগকারীরা ধারণা করছেন, ট্রাম্পের নতুন শুল্ক (tariffs) আর কর-ছাড় (tax cuts) বিষয়ক নীতিমালা ডলারের মূল্য আরও বাড়াবে। প্রাথমিকভাবে এটা শুনতে ভালো খবর মনে হতে পারে, কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, ট্রাম্প ও তার ভাইস প্রেসিডেন্ট জে.ডি. ভ্যান্স (J.D. Vance) প্রচারণার সময় জোর দিয়েছেন একটি “দুর্বল ডলার” (weak dollar)-এর ওপর। তাদের আশা, ডলারের অবমূল্যায়ন (devaluation) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উৎপাদনমুখী শিল্পখাত বা ম্যানুফ্যাকচারিং সেক্টরকে (manufacturing base) পুনরুজ্জীবিত করতে সহায়তা করবে।
এই লেখায় আমরা বিশ্লেষণ করব কেন ট্রাম্প ডলারের মূল্য কমাতে চান এবং কীভাবে তিনি বিশ্বের রিজার্ভ কারেন্সি (reserve currency) ডলারের মান নামানোর চেষ্টা করতে পারেন।
ট্রাম্প কী বলেছেন?
ট্রাম্প ডলারকে দুর্বল করতে চাইছেন তা নতুন কোনো ধারণা নয়। তবে সর্বশেষ প্রকাশ্যভাবে তিনি এই বিষয়ে কথা বলেন ২০২৪ সালের জুলাইয়ের শেষ দিকে, ব্লুমবার্গকে (Bloomberg) দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে। সেখানে তিনি বলেছিলেন, ডলারের শক্তিশালী অবস্থান, বিশেষ করে জাপানি ইয়েন (yen) ও চীনা ইউয়ানের (yuan) বিপরীতে ডলারের শক্তিশালী অবস্থান যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বড় সমস্যা তৈরি করছে।
আসলে ট্রাম্প তার প্রথম প্রেসিডেন্ট মেয়াদের সময় থেকেই ডলারের “মূল্য বেশি” (overvalued) হওয়া নিয়ে অভিযোগ করে এসেছেন। তখনও তিনি ফেডারেল রিজার্ভ (Federal Reserve) বা “ফেড”কে সুদের হার (interest rates) কমাতে চাপ দিয়েছিলেন, যাতে ডলারের মান নামানো যায়। ভাইস প্রেসিডেন্ট জে.ডি. ভ্যান্সও (J.D. Vance) একই যুক্তি তুলে ধরেন। ২০২৩ সালে ফেড চেয়ার জেরোম পাওয়েলকে (Jerome Powell) জিজ্ঞাসাবাদ করার সময় তিনি বলেন, “ডলারের মূল্য মৌলিকভাবেই বেশি” (fundamentally overvalued)। একই বছরের এপ্রিলে পলিটিকোকে (Politico) দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি জানান, “ডেভালুয়েশন (devaluing) ভয়ের শব্দ মনে হতে পারে, কিন্তু এটার মানে হলো—মার্কিন রপ্তানি (exports) সাশ্রয়ী বা প্রতিযোগিতামূলক হবে।”
ডলার “বেশি মূল্যায়িত” (Overvalued) কেন?
অনেক অর্থনীতিবিদ ডলারের উচ্চ মূল্যের বিষয়ে একমত। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (IMF) আনুমান করে, ডলার প্রায় ১০% বেশি মূল্যে অবস্থান করছে। গত দুই দশকে তথাকথিত “ব্রড ডলার ইনডেক্স” (Broad Dollar Index) ২৫% বেড়েছে, অথচ এই সময়ে আমেরিকা বড় বাণিজ্য ঘাটতি (trade deficits) সামলাচ্ছে—সাধারণভাবে ভাবলে বেশি আমদানি (import) ও কম রপ্তানির (export) কারণে মুদ্রার মূল্য দুর্বল হওয়ার কথা।
ডলার এত শক্তিশালী থাকার বড় কারণ হলো এর বিশ্ব রিজার্ভ কারেন্সি (world’s reserve currency) হিসেবে মর্যাদা। বিশ্বের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানেরা “নিরাপদ সম্পদ” (safe asset) হিসেবে ডলার সংরক্ষণ করে, যার ফলে ডলারের চাহিদা (demand) আরও বাড়ে এবং স্বাভাবিকভাবেই মূল্যও বেশি থাকে।
তাহলে ট্রাম্প কেন ডলারের মান কমাতে চাইছেন?
প্রথম দৃষ্টিতে ডলারের উচ্চমূল্য দেখে মনে হতে পারে, এটি যুক্তরাষ্ট্রের জন্য সুবিধাজনক—কারণ এতে আমদানি সস্তা হয় এবং বিশ্ববাজারে আর্থিক ক্ষমতাও বেড়ে যায়। রাশিয়া (Russia) ও চীনা (China) নেতারা বরাবরই অভিযোগ করে আসছেন যে যুক্তরাষ্ট্র “ডলারের সুবিধা” নিয়ে বিশ্বব্যাপী প্রভাব বিস্তার করছে। ডলারের উচ্চমূল্যের সুবাদে আমেরিকা ইউনিল্যাটারাল ফিনানশিয়াল স্যাংকশন আরোপ করতে পারে, যা অন্য দেশগুলোর অর্থনীতিতে বড় প্রভাব ফেলে। (ইউনিল্যাটারাল ফিনানশিয়াল স্যাংকশন (Unilateral Financial Sanction) বলতে একটি দেশের দ্বারা অন্য কোনো দেশ, প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির বিরুদ্ধে আরোপিত আর্থিক নিষেধাজ্ঞাকে বোঝায়, যা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সম্মতি ছাড়াই এককভাবে প্রণয়ন করা হয়। এই ধরনের নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে লক্ষ্যবস্তু দেশের অর্থনৈতিক কার্যক্রম সীমিত করা হয়, যেমন তাদের আর্থিক লেনদেন, সম্পদ হস্তান্তর বা আন্তর্জাতিক বাজারে অংশগ্রহণে বাধা সৃষ্টি করা। এ ধরনের নিষেধাজ্ঞা সাধারণত রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক বা নিরাপত্তাজনিত কারণে আরোপিত হয়, তবে আন্তর্জাতিক আইন ও নীতিমালার সাথে সামঞ্জস্য থাকা গুরুত্বপূর্ণ।)
তবু, ডলারের এই “অতিরিক্ত শক্তি” (overvalued) মার্কিন শিল্পখাতের (manufacturing) জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। কারণ, ডলার যত শক্তিশালী, বিদেশে মার্কিন পণ্য (exports) তত ব্যয়বহুল হয়ে ওঠে; পাশাপাশি আমদানি পণ্যগুলো সস্তা হওয়ায় দেশের বাজারে স্থানীয় পণ্যের প্রতিযোগিতা শক্তি কমে যায়। ট্রাম্প ও ভ্যান্স যুক্তি দেন, আমেরিকার ডলার দুর্বল হলে রপ্তানি বাড়বে, শিল্পখাতের বিকাশ হবে। এ নিয়ে এক সাক্ষাৎকারে ট্রাম্প উল্লেখ করেন, অনেক উৎপাদক (manufacturer) অভিযোগ করেন যে তাদের পণ্য খুবই ব্যয়বহুল দেখাচ্ছে, কারণ ডলারের মান অনেক বেশি। ভ্যান্স একে “মার্কিন উৎপাদনের ওপর শুল্কের মতো (massive tax on American producers)” বলে অভিহিত করেছেন।
অনেকেই মনে করেন, চীনের অর্থনৈতিক সাফল্যের পেছনে তাদের মুদ্রার ইচ্ছাকৃত অবমূল্যায়নের (deliberately devaluing) বড় ভূমিকা ছিল। এতে চীনা পণ্য বিশ্ববাজারে সস্তা থেকে প্রতিযোগিতায় টিকে গিয়েছে। অন্যদিকে আমেরিকার ডলারের উচ্চমূল্য দেশের শিল্পকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। তাছাড়া গত কয়েক বছরে যুক্তরাষ্ট্র নানা আর্থিক নিষেধাজ্ঞা (financial sanctions) ব্যবহার করায় অন্য দেশগুলোও ডলারের রিজার্ভ স্ট্যাটাস নিয়ে প্রশ্ন তুলছে।
ট্রাম্পের অন্যান্য অর্থনৈতিক পদক্ষেপ কি ডলার দুর্বল করবে, নাকি শক্তিশালী করবে?
এখানে একটু গোলমাল আছে। কারণ, ট্রাম্পের প্রস্তাবিত অন্যান্য অর্থনৈতিক নীতি (যেমন উচ্চ শুল্ক, বৃহৎ কর ছাড়) বাস্তবায়িত হলে ডলার বরং আরও শক্তিশালী হতে পারে।
- উচ্চ শুল্ক (tariffs): বেশিরভাগ অর্থনীতিবিদ মনে করেন, উচ্চ শুল্ক প্রয়োগ করলে পণ্যের দাম বেড়ে (মূল্যস্ফীতি বা inflation বাড়ায়) ফেড সুদের হার (interest rate) বাড়ানোর দিকে যেতে পারে। আর সুদের হার বাড়লে মুদ্রার মূল্য সাধারণত শক্তিশালী হয়, কারণ সেই মুদ্রায় সঞ্চয় (savings) রাখা বিনিয়োগকারীদের কাছে আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। (বিনিয়োগ ও সঞ্চয়ের জন্য মুদ্রার চাহিদা বাড়লে, সেই মুদ্রার বিনিময় হার শক্তিশালী হয়। অর্থাৎ, অন্যান্য মুদ্রার তুলনায় সেই মুদ্রার মান বৃদ্ধি পায়।) তাছাড়া যেসব দেশ শুল্কের স্বীকার হবে, যেমন চীন, তারা প্রতিক্রিয়া হিসেবে নিজ মুদ্রার মান কমাতে পারে, যার ফলে তুলনামূলকভাবে ডলার আরও শক্তিশালী হয়ে উঠবে। (যখন একটি দেশ, যেমন চীন, তাদের পণ্যের ওপর বিদেশি শুল্কের সম্মুখীন হয়, তখন তাদের রপ্তানি পণ্য বিদেশি ক্রেতাদের জন্য ব্যয়বহুল হয়ে ওঠে। এই পরিস্থিতিতে, চীন তাদের মুদ্রার মান কমিয়ে (মুদ্রার অবমূল্যায়ন) রপ্তানি পণ্যের প্রতিযোগিতামূলকতা বজায় রাখতে পারে।)
- কর ছাড় (tax cuts): কর ছাড়ে মানুষের হাতে বিনিয়োগ/ব্যয় বাড়ার সম্ভাবনা থাকে, যা মূল্যস্ফীতি বাড়াতে পারে। একই যুক্তিতে ফেড সুদের হার বাড়ালে ডলারের মান আরও উঁচুতে উঠতে পারে।
ট্রাম্প ইতোমধ্যে বিশ্ব রিজার্ভ কারেন্সি হিসেবে ডলারের অবস্থান রক্ষা করার ঘোষণাও দিয়েছেন। এমনকি তিনি বলেছেন, যদি কোনো দেশ ডলারের বাইরে চলে যেতে চায়, তিনি ১০০% শুল্ক আরোপ করবেন। এ ছাড়া নিউ ইয়র্কের ইকোনমিক ক্লাবে (Economic Club of New York) দেওয়া এক ভাষণে বলেছেন, “বিশ্ব মুদ্রার (world currency) মর্যাদা হারানো যুদ্ধে পরাজিত হওয়ার সমতুল্য।” এর মানে, ডলারের রিজার্ভ স্ট্যাটাস ধরে রাখতে তিনি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। কিন্তু সেটি বজায় রেখে ডলারকে দুর্বল করা পরস্পরবিরোধী বলে বিশ্লেষকেরা মনে করেন।
ডলারের মান কীভাবে কমানো যায়?
যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডের (Federal Reserve) কাছে একচেটিয়া অধিকার রয়েছে ডলারের জোগান (supply) নিয়ন্ত্রণ করার। ফেড সরকারি হুকুমে ডলারের জোগান বাড়িয়ে বাজারে বিক্রি করে ডলারের মান নামাতে পারে, অথবা সুদের হার কমাতে পারে। কিন্তু বাস্তবতা হলো ফেড স্বশাসিত (operationally independent)—মার্কিন প্রেসিডেন্ট সরাসরি তাদের কী করতে হবে তা বলতে পারেন না। তবে তাত্ত্বিকভাবে কয়েকটি পথ খোলা থাকে:
ফেডকে চাপে রাখা: ট্রাম্প চাইলেই ফেডকে রাজনৈতিক চাপ দিতে পারেন, যেন তারা সুদের হার কাটে বা সরাসরি মুদ্রাবাজারে হস্তক্ষেপ করে (currency intervention)। তবে ফেডের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন হলে বাজারে বড় অস্থিরতা দেখা দিতে পারে, আস্থার সংকট তৈরি হতে পারে।
সরকারি হস্তক্ষেপ (Treasury intervention): যুক্তরাষ্ট্র সরকার নিজেই বিপুল পরিমাণ ডলার ছাপিয়ে (অথবা ধার করে) অন্য মুদ্রা কিনতে পারে, ফলস্বরূপ ডলারের মান কমবে। কিন্তু এজন্য সত্যিই “ট্রিলিয়ন ডলার” পরিমাণ ব্যয় প্রয়োজন হতে পারে, যা নতুন করে সরকারি ঋণ (borrowing) বাড়াবে।
পুঁজি নিয়ন্ত্রণ (Capital Controls) বা ডলারের ওপর ট্যাক্স: সরকার চাইলে বিদেশিদের হাতে কত ডলারভিত্তিক সম্পদ থাকবে, সেটায় সীমা (capital controls) আরোপ করতে পারে, অথবা ডলারভিত্তিক সম্পদের ওপর একটি কর (tax) বসাতে পারে। এতে ডলারের চাহিদা কমে তার মূল্যও নামবে। কিন্তু এর ফলে ডলারের রিজার্ভ স্ট্যাটাস নিয়ে বিশ্বব্যাপী আস্থা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। মার্কিন আর্থিক ব্যবস্থাও তার “উন্মুক্ত” (open financial system) বৈশিষ্ট্য হারাবে।
“প্লাজা অ্যাকর্ড”-সদৃশ সমঝোতা (Multilateral Currency Agreement): সবচেয়ে বাস্তবসম্মত হতে পারে ১৯৮৫ সালের প্লাজা অ্যাকর্ড (Plaza Accord)-এর মতো আন্তর্জাতিক সমঝোতায় পৌঁছানো। তখন ফ্রান্স, পশ্চিম জার্মানি, জাপান, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র একসঙ্গে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ডলারের মান নামাবে। জাপান ও জার্মানি ঘরোয়া চাহিদা বাড়াতে কর ছাড় (tax cuts) দেয়, অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র সরকারি ব্যয় কেটে চাহিদা কমায়। পাশাপাশি সবাই মিলে মুদ্রাবাজারে হস্তক্ষেপ করে ডলারের মান কমিয়েছিল। নিঃসন্দেহে প্লাজা অ্যাকর্ড কার্যকর হয়েছিল, কিন্তু এখনকার সময়ে তা নতুনভাবে কার্যকর করা কঠিন। কারণ, মুদ্রাবাজার এখন অনেক বড় ও ছড়িয়ে পড়া; যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান বাণিজ্যিক অংশীদার চীন, যা যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রদের মতো সহজে আলোচনা টেবিলে বসে যাবে কি না, তা সন্দেহজনক।
উপসংহার
সারসংক্ষেপে, ট্রাম্প ডলারের মান কমাতে চাইছেন মূলতঃ মার্কিন রপ্তানিকে প্রতিযোগিতামূলক করে দেশটির উৎপাদনশীল খাতকে চাঙা করতে। কিন্তু অন্যদিকে তিনি এমন সব নীতি নিচ্ছেন বা নেওয়ার কথা বলছেন—যেমন উচ্চ শুল্ক, বড় করছাড়, ডলারের রিজার্ভ স্ট্যাটাস রক্ষা—যেগুলো ডলারকে আরও শক্তিশালী করতেও পারে। তাছাড়া ফেডের স্বাধীনতা, আন্তর্জাতিক আর্থিক সম্পর্ক, বহুপাক্ষিক সমঝোতা—এসব মিলিয়ে ডলার দুর্বল করা সহজ হবে না।
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে দেখা যাচ্ছে, ডলারের উচ্চমূল্যের কারণে আমেরিকার শিল্পক্ষেত্র ক্ষতিগ্রস্ত হলেও, একে ইচ্ছেমতো নামানো রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে বেশ জটিল। হয়তো কোনও বিন্দুতে ট্রাম্প প্রশাসন “প্লাজা অ্যাকর্ড” ধাঁচের আরেকটি চুক্তি করে বৈশ্বিক মুদ্রাবাজারে ঘাট দেবার চেষ্টা করতে পারে, তবে সেটি আদৌ কতটা বাস্তবে রূপ পাবে, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।
তথ্যসূত্র
1 – https://www.bloomberg.com/features/2024-trump-interview-transcript/?sref=dvYXhtRg
2 – https://www.brookings.edu/articles/unintended-consequences-trump-and-warrens-bipartisan-plan-for-the-us-dollar/
3 – https://fred.stlouisfed.org/series/DTWEXBGS
4 – https://www.vance.senate.gov/press-releases/icymi-senator-vance-questions-chairman-powell-on-the-u-s-dollars-reserve-currency-status/
5 – https://www.ft.com/content/ac708b43-64ae-45b8-b60d-997e7904086a
6 – https://www.ft.com/content/a4d645d0-78cc-4453-8802-1e05d4f91f5e
7 – https://carnegieendowment.org/research/2024/10/trade-intervention-for-freer-trade?lang=en
8 – https://www.investopedia.com/terms/p/plaza-accord.asp
ট্রাম্প কি চাগোস (Chagos) অবরুদ্ধ করতে চলেছেন? (২২ নভেম্বর, ২০২৪)
ভূমিকায়
এই বছরের প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিজয়ের পর, তার পরবর্তী প্রশাসন আসলে কী করবে তা নিয়ে অনেক আলোচনা হচ্ছে। বিশেষ করে যুক্তরাজ্যের (UK) সাথে তার আচরণ কেমন হবে তা নিয়ে বিভিন্ন প্রশ্ন উঠেছে। এই প্রশ্নগুলো ইউকে-ইউএস (UK-US) বাণিজ্য চুক্তি থেকে শুরু করে যুক্তরাষ্ট্র (US) ও যুক্তরাজ্য (UK) সরকারের মধ্যে কাজের সম্পর্ক পর্যন্ত বিস্তৃত। এই লেখায় আমরা ট্রাম্প প্রশাসন কীভাবে আরেকটি বিষয়ে প্রভাব ফেলতে পারে তা বিশ্লেষণ করব। আর তা হচ্রিছে মরিশাসের (Mauritius) সাথে যুক্তরাজ্যের চাগোস দ্বীপপুঞ্জ (Chagos Islands) নিয়ে করা চুক্তি।
চাগোস দ্বীপপুঞ্জের ইতিহাস ও পটভূমি
ট্রাম্প কী করতে পারেন তা বোঝার আগে আমাদের প্রথমে চাগোস দ্বীপপুঞ্জের ইতিহাস এবং কেন যুক্তরাজ্য সম্প্রতি মরিশাসকে সার্বভৌমত্ব ফিরিয়ে দিতে সম্মত হয়েছে তা বুঝতে হবে।
চাগোস দ্বীপপুঞ্জ (Chagos Islands) হলো ভারত মহাসাগরে অবস্থিত কিছু দ্বীপ ও আটল (atolls)। ইতিহাসের বেশিরভাগ সময়েই এই দ্বীপগুলি ছিল জনবসতিহীন। প্রথম পরিচিত বসতি স্থাপন ঘটে ১৭৯৩ সালে, যখন ফরাসিরা সেখানে তামা (copper) খামার (plantation) স্থাপন করে। উল্লেখ্য, তারা এ কাজে দাসশ্রম (slave labour) ব্যবহার করেছিল। যাইহোক, ফরাসিরা মাত্র ২০ বছরের কিছু বেশি সময় এই অঞ্চল প্রশাসন করেছে। কারণ, ১৮১৪ সালে ফ্রান্স ইউরোপে নেপোলিয়নিক যুদ্ধের (Napoleonic Wars) অবসান ঘটানোর লক্ষ্যে প্যারিস চুক্তি (Treaty of Paris) স্বাক্ষর করে। এই চুক্তির অংশ হিসেবে ফ্রান্স মরিশাস এবং চাগোস দ্বীপপুঞ্জ সহ এর অধীনস্থ সব এলাকা ব্রিটিশদের হাতে ছেড়ে দেয়।
পরবর্তী বড় পরিবর্তন আসে ১৯৬৪ সালে, যখন যুক্তরাষ্ট্র যুক্তরাজ্যের কাছ থেকে চাগোসের প্রধান দ্বীপ দিয়েগো গার্সিয়ায় (Diego Garcia) একটি সামরিক ঘাঁটি স্থাপনের অনুমতি চায়। সমস্যা ছিল যে চাগোস দ্বীপপুঞ্জ তখনো মরিশাসের একটি ডিপেন্ডেন্সি (dependency) হিসেবে পরিচালিত হত। অন্যদিকে, ১৯৬০ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ (UN General Assembly) বিশ্বব্যাপী উপনিবেশবাদ বিলোপ (decolonisation) সংক্রান্ত একটি প্রস্তাব পাস করে। ফলে যুক্তরাজ্যকে মরিশাসকে স্বাধীনতার দিকে এগিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করতে হতো।
এই পরিস্থিতি এড়াতে, ১৯৬৫ সালে যুক্তরাজ্য ল্যাঙ্কাস্টার হাউস অ্যাগ্রিমেন্ট (Lancaster House Agreement)-এর মাধ্যমে মরিশাসের কাছ থেকে চাগোস দ্বীপপুঞ্জ কিনে নেয় এবং ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান ওশিন টেরিটরি (British Indian Ocean Territory বা BIOT) তৈরি করে। চাগোস দ্বীপপুঞ্জ এই নতুন সত্তার অধীনে আসে, ফলে আইনীভাবে মরিশাস থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এর ফলে মরিশাস স্বাধীন হতে পারে এবং যুক্তরাষ্ট্র দিয়েগো গার্সিয়ায় সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করতে পারে।
এর এক বছর পর, ১৯৬৬ সালে, যুক্তরাষ্ট্র যুক্তরাজ্যের কাছ থেকে দিয়েগো গার্সিয়ার উপর ৭০ বছরের ইজারা (lease) নেয়। বিনিময়ে যুক্তরাজ্য পোলারিস মিসাইল (Polaris missiles) কেনার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ছাড় পায়। ১৯৭৩ সালে এই ইজারা স্বাক্ষরের পর, যুক্তরাজ্য যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনে চাগোসবাসীদের (Chagasians) জোরপূর্বক নির্বাসিত করে এবং দিয়েগো গার্সিয়ায় একটি নৌঘাঁটি স্থাপন করে।
মরিশাসের সার্বভৌমত্ব দাবি ও আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
১৯৮০-এর দশকে মরিশাস যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের পদক্ষেপকে চ্যালেঞ্জ করতে শুরু করে। তারা যুক্তরাজ্যের সার্বভৌমত্ব দাবি নিয়ে প্রশ্ন তোলে, বিশেষ করে যুক্তি দেয় যে মরিশাস চাপের মুখে দ্বীপগুলি বিক্রি করেছে এবং মরিশাস ও চাগোস দ্বীপপুঞ্জের এই বিচ্ছেদ আন্তর্জাতিক আইনে অবৈধ।
এমনকি ২০১৯ সালেও জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ যুক্তরাজ্যের পদক্ষেপকে অবৈধ বলে ঘোষণা করে, এবং তাদের ৬ মাসের মধ্যে ওই এলাকার ঔপনিবেশিক প্রশাসন তুলে নেওয়ার আহ্বান জানায়। যুক্তরাজ্য এই দাবি উড়িয়ে দেয়। বিষয়টি মেটানোর উদ্দেশ্যে যুক্তরাজ্যের কনজারভেটিভ সরকার মরিশাসের সাথে আলোচনা শুরু করে, যা প্রাথমিকভাবে থেমে যায়। পরে লেবার সরকার (Labour government) ক্ষমতায় এসে আবার আলোচনা শুরু করে।
খবরে প্রকাশ পায়, প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার (Keir Starmer) মরিশাসের সাথে চাগোস দ্বীপপুঞ্জ নিয়ে একটি চূড়ান্ত সমঝোতায় পৌঁছানোর জন্য যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন (Joe Biden)-এর চাপের মধ্যে ছিলেন। কিছু অভ্যন্তরীণ সূত্র জানায়, লেবার পার্টি যদি কোনো চুক্তিতে না যায়, তবে তা যুক্তরাজ্য-যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ সম্পর্ক (special relationship) ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগ ছিল যে যুক্তরাজ্য কোনো রকম চুক্তিতে না গেলে, তারা দিয়েগো গার্সিয়ার সামরিক ঘাঁটি নিয়ন্ত্রণ হারাতে পারে।
ফলে যুক্তরাজ্য এমন একটি চুক্তিতে স্বাক্ষর করে, যার ফলে মরিশাস চাগোস দ্বীপপুঞ্জের সব এলাকা ফিরিয়ে দেবে, তবে দিয়েগো গার্সিয়া যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ৯৯ বছরের জন্য এক অনিবন্ধিত (undisclosed) অর্থমূল্যে ইজারা দেওয়া হবে। এতে যুক্তরাষ্ট্র তাদের সামরিক কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে পারবে। এই চুক্তির সুনির্দিষ্ট শর্ত এখনো পুরোপুরি জানা যায়নি। তবে টেলিগ্রাফ (The Telegraph) জানিয়েছে যে চুক্তিতে একটি ধারাও আছে যা যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্মতি ব্যতিরেকে চীনা (Chinese) প্রভাব রোধ করবে।
চুক্তি নিয়ে রিপাবলিকানদের আপত্তি ও ট্রাম্পের সম্ভাব্য অবস্থান
দিয়েগো গার্সিয়ায় মার্কিন সামরিক ঘাঁটি রক্ষা পেলেও ট্রাম্প এই চুক্তিতে খুশি নাও হতে পারেন। আসলে ট্রাম্পের নির্বাচনের আগেই এই চুক্তি নিয়ে কিছু মনোক্ষুণ্নতা ছিল।
চুক্তি স্বাক্ষরের পরপরই, সিনিয়র কিছু রিপাবলিকান নেতা এর বিরুদ্ধে কথা বলেন। সেনেট ফরেন রিলেশনস কমিটির (Senate Foreign Relations Committee) সদস্য, আইডাহো (Idaho) রাজ্যের সিনেটর, এবং ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমর্থক জেমস রিশ (James Risch) বলেন, চুক্তিটি চীনা ‘লফেয়ার’ (lawfare) বা আইনগত কৌশলের সুযোগ দেবে এবং দায়বদ্ধতা-হীন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর (যেমন ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিস—International Court of Justice) চাপে নতি স্বীকার করার সামিল।
এছাড়াও, শীঘ্রই সেক্রেটারি অব স্টেট (Secretary of State) হওয়া সেনেটর মার্কো রুবিও (Marco Rubio) মন্তব্য করেন যে চুক্তিটি উদ্বেগজনক, কেননা এটি চীনা কমিউনিস্টদের (Communist China) জন্য মরিশাসের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের নৌ-সমর্থন স্থাপনার (naval support facility) মূল্যবান গোয়েন্দা তথ্য পাওয়ার সুযোগ করে দিতে পারে।
মূলত রিপাবলিকানদের আপত্তির কয়েকটি কারণ হলো:
- ১. আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো যেন যুক্তরাষ্ট্রকে নির্দেশ দিতে না পারে—এই অনীহা।
- ২. চুক্তির মাধ্যমে চীন কিছু সুবিধা পেতে পারে বলে আশঙ্কা।
- ৩. মার্কিন সামরিক ঘাঁটির উপর শত্রু পক্ষের নজরদারির সুযোগ সৃষ্টি হওয়ার ভয়।
এই উদ্বেগগুলি নাইজেল ফারাজ (Nigel Farage)-এর সাথেও মেলে, যিনি ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ মিত্র হিসেবে পরিচিত। খবর রয়েছে যে তিনি ট্রাম্পকে স্টারমারের (Starmer) চাগোস দ্বীপপুঞ্জ সংক্রান্ত উদ্যোগে ভেটো (veto) দিতে উৎসাহ দিচ্ছেন। জানা গেছে, ফারাজ ট্রাম্পের দলকে ব্রেক্সিট (Brexit) ক্যাম্পেইনে তার সাথে কাজ করা কিছু বিশেষজ্ঞের দেওয়া আইনি পরামর্শ পাঠিয়েছেন। ফারাজ আশা করছেন, এই আইনি পরামর্শ এবং রিপাবলিকানদের যুক্তি ট্রাম্পকে চাগোস চুক্তি বাধাগ্রস্ত করতে প্ররোচনা দেবে, যাতে যুক্তরাষ্ট্র চাগোস দ্বীপপুঞ্জে তাদের সামরিক ঘাঁটি রক্ষায় নিশ্চিন্ত থাকতে পারে এবং মরিশাস ভবিষ্যতে কী করবে তা নিয়ে আর উদ্বিগ্ন না হতে হয়।
ট্রাম্পের চুক্তি আটকানোর সম্ভাব্য পথ
ট্রাম্প যদি সত্যিই চুক্তি আটকাতে চান, তবে তিনি তিনটি উপায়ে এটি করতে পারেন:
- প্রথম উপায়: চুক্তির সঠিক ধারা যদি অনুমতি দেয়, তবে যুক্তরাষ্ট্র চুক্তিতে তাদের সম্মতি না দিয়েই একে বন্ধ করে দিতে পারে। আমরা এখনো জানি না চুক্তির ভাষা কীভাবে রচিত হয়েছে, তবে যদি এই ধরনের কোনো শর্ত থাকে, সেটি হবে চুক্তি রোধের সবচেয়ে সহজ উপায়।
- দ্বিতীয় উপায়: যুক্তরাষ্ট্র যুক্তরাজ্যের উপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে যাতে তারা মরিশাসের সাথে চুক্তি বাদ দেয়। আগামী চার বছরে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের মধ্যে বহু ক্ষেত্রে সহযোগিতার সুযোগ থাকবে। ট্রাম্প ইঙ্গিত দিতে পারেন যে, স্টারমার এই চুক্তি না বাদ দিলে তিনি যুক্তরাজ্যের সাথে ভবিষ্যৎ সহযোগিতা বানচাল করে দেবেন। তবে এটি হবে একটি প্রকাশ্য এবং বিশেষ সম্পর্কের জন্য একটি পরিষ্কার আঘাত।
- তৃতীয় উপায়: ট্রাম্প যুক্তরাজ্যের লর্ডদের (Lords) একটি দলের পরিকল্পনাকে সমর্থন করতে পারেন, যেটি লর্ড বেলিংহ্যামের (Lord Bellingham) নেতৃত্বে চলছে বলে শোনা যাচ্ছে। এই দলের পরিকল্পনা হলো চুক্তি যুক্তরাজ্যের হাউস অব লর্ডস (House of Lords) দিয়ে পাস হওয়ার সময় একটি সংশোধনী (amendment) যুক্ত করা, যা যুক্তরাজ্যে বসবাসকারী চাগোসবাসীদের (Chagasians) মধ্যে একটি ভোট (vote) আয়োজন করার দাবি করবে। এই ভোট না হওয়া পর্যন্ত চুক্তি পাস হবে না। ফলে চুক্তির বাস্তবায়ন বিলম্বিত হবে এবং ট্রাম্পের জন্য এটি অবরোধের আরও সময় করে দেবে। আর যদি চাগোসবাসীরা ‘না’ ভোট দেয়, তবে চুক্তি পুরোপুরি অকার্যকর হয়ে যেতে পারে।
শেষ কথা
অবশ্য চূড়ান্ত প্রশ্ন হচ্ছে ট্রাম্প আসলে এগুলো করার পথে এগোবেন কিনা। শেষ পর্যন্ত, সময়ই বলে দেবে তিনি এ নিয়ে কী সিদ্ধান্ত নেবেন।
বাণিজ্য ঘাটতি কমানো নিয়ে ইইউকে ট্রাম্পের শুল্ক দেবার হুমকি (২০ নভেম্বর, ২০২৪)
শুক্রবার ট্রাম্প তার নিজস্ব সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ট্রুথ সোশ্যাল (Truth Social)-এ ইউরোপীয় ইউনিয়নকে সতর্কবার্তা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, যদি ইইউ (EU) যুক্তরাষ্ট্র থেকে আরও বেশি পরিমাণে আমেরিকান তেল ও গ্যাস না কেনে এবং যুক্তরাষ্ট্রের সাথে তাদের বাণিজ্য ঘাটতি (Trade Deficit) কমিয়ে না আনে, তবে তাদের ওপর শুল্ক (Tariffs) আরোপ করা হতে পারে।
এর আগে, ব্রাসেলস (Brussels) যুক্তরাষ্ট্র থেকে আরও তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (Liquefied Natural Gas – LNG) কেনার আগ্রহ দেখিয়েছে। রাশিয়া (Russia) ইউক্রেনে (Ukraine) পূর্ণমাত্রার আগ্রাসন শুরু করে ইউরোপের জ্বালানি সরবরাহ সংকুচিত করার পর আমেরিকান গ্যাস ইউরোপের জন্য একটি জীবনরক্ষাকারী সম্পদে পরিণত হয়েছে। গত নভেম্বরে ইউরোপীয় কমিশনের (European Commission) প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লেয়েন (Ursula von der Leyen) বলেছিলেন যে, ইইউ যুক্তরাষ্ট্র থেকে আরও গ্যাস কেনার বিষয়টি বিবেচনা করবে।
ট্রাম্প ইতোমধ্যেই বেশিরভাগ আমদানি পণ্যের ওপর শুল্ক আরোপের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। ইউরোপের দীর্ঘদিনের বাণিজ্য উদ্বৃত্ত (Trade Surplus) যুক্তরাষ্ট্রের সাথে থাকায়, তারা ট্রাম্পের এহেন পদক্ষেপের ফলে বড় ধরনের শুল্কের মুখে পড়তে পারে। ট্রাম্প ইতোমধ্যে কানাডা (Canada), মেক্সিকো (Mexico) এবং চীনের (China) ওপর শুল্ক আরোপের হুমকি দিয়েছেন।
ট্রাম্পের এই মন্তব্যের পর ইউরোপীয় শেয়ারবাজার (European Stocks) উল্লেখযোগ্য ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। সর্ব-বিস্তৃত ইউরোপীয় স্টক্স ৬০০ ইনডেক্স (Stoxx 600 Index) ০.৮% হ্রাস পেয়েছে, যা গত তিন মাসের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ সাপ্তাহিক পারফরম্যান্স। জার্মানির (Germany) ড্যাক্স (Dax) এবং ফ্রান্সের (France) CAC 40 উভয়ই প্রায় ১% কমে গেছে। বিনিয়োগকারীদের উদ্বেগ আরও বেড়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রাস্ফীতি (Inflation) সংক্রান্ত তথ্য ঘিরে, যা ভবিষ্যত সুদের হার (Interest Rates) নির্ধারণে প্রভাব ফেলতে পারে।
আরও দেখুন –
- দ্বিতীয় ট্রাম্প প্রেসিডেন্সি ইউরোপের জন্য কী অর্থ বহন করবে? (৭ নভেম্বর)
- ট্রাম্পের ইউক্রেন শান্তি পরিকল্পনা ব্যাখ্যা (৯ নভেম্বর, ২০২৪)
- ইউরোপে ট্রাম্পের সবচেয়ে বড় মিত্র কারা? (১৩ নভেম্বর, ২০২৪)
- যুক্তরাষ্ট্রের এক নম্বর তেল উৎপাদক হয়ে ওঠা ও তাদের তেল প্রাচুর্যের সমাপ্তি (১ ডিসেম্বর, ২০২৪)
- কী হতে পারে ট্রাম্পের জ্বালানি নীতি? (২৬ নভেম্বর, ২০২৪)
- ট্রাম্পের আমলে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি কীভাবে রূপান্তরিত হতে পারে (২ নভেম্বর, ২০২৪)
- ট্রাম্পের অর্থনৈতিক পরিকল্পনাগুলো এবং এগুলো যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিকে যেভাবে রূপান্তরিত হতে পারে (২ নভেম্বর, ২০২৪)
- ব্রিকসের নতুন মুদ্রা কি সত্যিই মার্কিন ডলারের বিকল্প হতে পারে? (৩ ডিসেম্বর, ২০২৪)
তথ্যসূত্র
https://www.euractiv.com/section/eet/news/trump-wants-eu-to-buy-more-us-oil-and-gas-or-face-tariffs/
https://www.ft.com/content/9e485614-0080-4a09-8fcb-2df6c3d932a5
যুক্তরাষ্ট্রের আইনপ্রণেতারা সরকারী কার্যক্রম বন্ধ হওয়া ঠেকাতে মরিয়া চেষ্টা চালাচ্ছে (২০ নভেম্বর, ২০২৪)
আজ যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে অস্থিরতা চরমে পৌঁছেছে। কংগ্রেস (Congress) সরকার খোলা রাখার উপায় খুঁজছে, কারণ রিপাবলিকান (Republican) নিয়ন্ত্রিত হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভস (House of Representatives) সম্প্রতি সর্বশেষ অর্থায়ন বিল (Funding Bill) নাকচ করে দিয়েছে, যদিও সেটিতে নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের (Donald Trump) সমর্থন ছিল। এই ঘটনায় রিপাবলিকান দলে (Republican Party) গভীর মতপার্থক্য স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
এর আগে, রিপাবলিকান স্পিকার মাইক জনসন (Republican House Speaker Mike Johnson) দুই দলীয় সমঝোতায় (Bipartisan) একটি অর্থায়ন বিল নিয়ে এসেছিলেন, যা ডেমোক্র্যাটদের (Democrats) সমর্থনও পেয়েছিল। সেই বিলটি বর্তমান পর্যায়ে সরকারি সংস্থাগুলোর তহবিল বজায় রাখার পাশাপাশি ১০০ বিলিয়ন ডলার (Billion) প্রাকৃতিক দুর্যোগ ত্রাণ তহবিল (Disaster Relief) এবং ১০ বিলিয়ন ডলার কৃষিখাতে সহায়তা (Farm Aid) দেওয়ার প্রস্তাব করেছিল। এছাড়াও এই বিলটিতে ছিল আরও কিছু অতিরিক্ত বিধান। কিন্তু প্রেসিডেন্ট-ইলেক্টেড ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং তার প্রধান মিত্র ইলন মাস্ক (Elon Musk) এই বিলের বিরুদ্ধে অবস্থান নিলে বহু রিপাবলিকান আইনপ্রণেতা তাদের মত পাল্টে বিলটির বিরোধিতা করে। ফলস্বরূপ বিলটি বৃহস্পতিবার ১৭৪ ভোট পক্ষে এবং ২৩৫ ভোট বিপক্ষে বাতিল হয়।
এরপর একটি ‘প্ল্যান বি’ (Plan B) তৈরি করা হয়, যা ট্রাম্প এবং তার অনুসারীদের কাছে কিছুটা গ্রহণযোগ্য মনে হয়েছিল। স্পিকার জনসনের সমন্বয়ে প্রস্তুতকৃত এই ‘প্ল্যান বি’ বিলটিতে ছিল তিন মাসের জন্য সরকারী ব্যয় মঞ্জুরির মেয়াদ-বৃদ্ধি, একই পরিমাণ দুর্যোগ তহবিল, কৃষি সহায়তা এবং ট্রাম্পের দাবী অনুযায়ী দু’বছরের জন্য ঋণসীমা (Debt Limit) স্থগিত রাখা। (ঋণসীমা বা ডেট লিমিট হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের ঋণ গ্রহণের সর্বোচ্চ সীমা।) কিন্তু ট্রাম্পের এই ঋণসীমা স্থগিতের দাবী অনেক রিপাবলিকান আইনপ্রণেতার মধ্যে অস্বস্তি সৃষ্টি করে। ফলে ‘প্ল্যান বি’ বিলটিও বৃহস্পতিবারের ভোটে ব্যর্থ হয়।
এখন রিপাবলিকানরা ‘প্ল্যান সি’ (Plan C)-র খোঁজে রয়েছে, যখন সরকারী কার্যক্রম বন্ধ হওয়ার সময়সীমা শুক্রবার ২০ ডিসেম্বর শেষ হওয়ার পথে। এখনো অজানা, কীভাবে বা কখন সমঝোতা হবে। তবে এই নাটকীয় এবং দ্রুত পরিবর্তনশীল পরিস্থিতি ট্রাম্পের আসন্ন প্রেসিডেন্সিতে (Presidency) দুটি বিষয়কে স্পষ্ট করেছে। প্রথমত, ট্রাম্প রিপাবলিকান পার্টিকে তার মতবাদে ঢেলে সাজালেও, কংগ্রেসের রিপাবলিকানদের উপরে তার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেই। তাকে তার এজেন্ডা বাস্তবায়নে তাদের সঙ্গে কাজ করতে হবে। দ্বিতীয়ত, বিলিয়নিয়ার (Billionaire) ও ট্রাম্পের মিত্র ইলন মাস্কের রাজনৈতিক প্রভাবও এখন অস্বীকার করা যাচ্ছে না। মাস্কের সক্রিয় প্রচেষ্টায় বহু রিপাবলিকান আইনপ্রণেতা প্রথম দ্বিপক্ষীয় বিলটির বিরুদ্ধে দাঁড়ান।
আরও দেখুন – মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সরকার আংশিক বন্ধের (shutdown) আশঙ্কা
তথ্যসূত্র
https://www.ft.com/content/c42ec427-307a-4fe2-a4b7-9a1fce2de30a
https://thehill.com/homenews/house/5049984-republicans-government-funding-scramble-shutdown-deadline/
https://edition.cnn.com/2024/12/19/politics/trump-johnson-government-funding/index.html
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সরকার আংশিক বন্ধের (shutdown) আশঙ্কা (১৯ নভেম্বর, ২০২৪)
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প (President elect Donald Trump) ওয়াশিংটন ডিসিকে (Washington, D.C.) চাপে রেখেছেন, সম্ভাব্য বড়দিনের (Christmas time) আগেই একটি দ্বিদলীয় বাজেট পরিকল্পনাকে (bipartisan budget plan) ভেস্তে দেওয়ার হুমকি দিয়ে। এই পরিকল্পিত বিলটি বর্তমান বাজেট বরাদ্দ বজায় রাখা, দুর্যোগ ত্রাণে (disaster relief) ১০০ বিলিয়ন ডলার এবং কৃষি সহায়তায় (farm aid) ১০ বিলিয়ন ডলার প্রদান করবে, পাশাপাশি আইনপ্রণেতাদের (lawmakers) বেতন বৃদ্ধি সহ (pay rise) নানা বিষয় অন্তর্ভুক্ত।
বুধবার, ট্রাম্প তার বিলিয়নিয়ার মিত্র এলন মাস্কের (Elon Musk) সাথে (যিনি সম্প্রতি সরকারি কার্যকারিতা বিভাগ (Department of Government Efficiency)-এর প্রধান হিসেবে নিযুক্ত হয়েছেন (tapped as head)) বিতর্কে যোগ দেন। সামাজিক মাধ্যম এক্স (X)-এ তার ২০০ মিলিয়নের বেশি অনুসারীদের সামনে একের পর এক পোস্ট করে তিনি বিলের বিরুদ্ধে ক্ষোভ উসকে দেন। তিনি লেখেন “আপনার করের অর্থ অপহরণ বন্ধ করুন” (“stop the steal of your tax dollars”) এবং সমর্থকদের আইনপ্রণেতাদের সাথে যোগাযোগ করে বিলের বিরোধিতা করতে বলেন। তিনি আরও বলেন, যারা এই বাজেট বিলের পক্ষে ভোট দেবে তাদের পুনর্নির্বাচিত হওয়া উচিত নয়।
ডোনাল্ড ট্রাম্প পরবর্তীতে তার নির্বাচিত ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স (J.D. Vance)-এর সাথে যৌথ বিবৃতিতে বর্তমান বিলের বিরোধিতা করেন। তারা বলেন, কোনও ডেমোক্র্যাটিক ছাড় (Democrat giveaways) ছাড়া একটি সহজতর “স্টপগ্যাপ বিল” (stopgap bill) পাস করা উচিত। তারা আরও যোগ করেন যে এর বাইরে অন্য কিছু অনুমোদন করা “দেশের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা” (betrayal of our country)। ট্রাম্প বিলটিতে ঋণের সীমা (debt ceiling) বাড়ানোর দাবিও তোলেন, যা তাকে ক্ষমতায় আসার পর ব্যয় ও করছাড় (tax cuts) দেওয়ার জন্য বেশি সুযোগ করে দেবে।
তবে হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভস (House) ক্ষীণ ব্যবধানে রিপাবলিকান (Republicans) নিয়ন্ত্রিত এবং সিনেট (Senate) ক্ষীণ ব্যবধানে ডেমোক্র্যাটদের (Democrats) নিয়ন্ত্রিত। ডেমোক্র্যাটদের সমর্থন ছাড়া কোনও বিল পাস অসম্ভব। ট্রাম্পের এই হস্তক্ষেপ স্পিকার মাইক জনসনের (Mike Johnson) জন্য সবচেয়ে কঠিন, যিনি এই বাজেট পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করেছেন কিন্তু এখন ৩ জানুয়ারির (January 3rd) স্পিকারের পদে পুনরায় ভোটের আগে তার অবস্থান নড়বড়ে দেখাচ্ছে। ট্রাম্পের রাজনৈতিক “ব্রিংকসম্যানশিপ” (brinkmanship), মাস্কের বিশাল প্রভাব এবং কংগ্রেস ও ট্রাম্পের মধ্যে ক্রমবর্ধমান উত্তেজনা সম্ভবত ট্রাম্পের আগামীর প্রশাসনের একটি পূর্বাভাস।
সূত্র
https://thehill.com/homenews/administration/5047382-trump-government-spending-deal/
https://apnews.com/article/congress-budget-trump-musk-johnson-5dc9fd8672f9807189032811d4ab0528
https://www.reuters.com/world/us/us-house-speaker-defends-stopgap-spending-some-republicans-musk-balk-2024-12-18/
ইউরোপে ট্রাম্পের সবচেয়ে বড় মিত্র কারা? (১৩ নভেম্বর, ২০২৪)
ভূমিকা
গত ৫ নভেম্বরের মার্কিন নির্বাচন (US election) পরবর্তী সময়ে, সারা বিশ্বের রাজনীতিকেরা ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে ডোনাল্ড ট্রাম্প (Donald Trump) যুক্তরাষ্ট্রের হোয়াইট হাউস (White House) এ ফিরে আসার সম্ভাবনায় প্রস্তুতি নিচ্ছেন। ইউরোপের (Europe) জন্য ট্রাম্পের প্রেসিডেন্সি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের (EU) নেতাদের প্রতিক্রিয়ার ভিন্নতা দেখলেই বোঝা যায়—কেউ কেউ (যেমন নেদারল্যান্ডসের ডানপন্থী নেতা গির্ট উইলডার্স (Geert Wilders) ও হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর অরবান (Viktor Orban)) ট্রাম্পকে নিয়ে উচ্ছ্বসিত, অন্যদিকে জার্মানির চ্যান্সেলর ওলাফ শল্ৎস (Olaf Scholz), ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ (Emmanuel Macron) ও স্পেনের প্রধানমন্ত্রী পেদ্রো সানচেজ (Pedro Sanchez) অপেক্ষাকৃত সংযত প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন। এই প্রবন্ধে আমরা ইউরোপ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক (EU-US relationship), ইউরোপে ট্রাম্পের প্রধান মিত্ররা কারা, এবং এর প্রভাব ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাজনীতিতে (EU politics) কেমন হতে পারে, তা নিয়ে আলোচনা করব।
পটভূমি
দশকজুড়ে ইউরোপ (Europe) ও যুক্তরাষ্ট্রের (US) মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় ছিল। দু’পক্ষই ন্যাটো (NATO) জোটের মাধ্যমে পারস্পরিক প্রতিরক্ষা চুক্তিতে আবদ্ধ, এবং অর্থনৈতিকভাবে তারা একে অপরের বৃহত্তম অংশীদার। ইইউ (EU) হলো যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম বড় বাণিজ্য-অংশীদার, যেখানে উভয় পক্ষেরই প্রায় ৯.৪ মিলিয়ন মানুষ দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যিক সম্পর্কের (bilateral trade) মাধ্যমে প্রত্যক্ষভাবে কর্মসংস্থানে নিয়োজিত। পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউ পরস্পরের বড় বিনিয়োগকারীও বটে—যুক্তরাষ্ট্র এশিয়া প্যাসিফিক (Asia Pacific) অঞ্চলের তুলনায় চার গুণ বেশি বিনিয়োগ করে ইইউতে, অন্যদিকে ইইউ ভারত ও চীনের সম্মিলিত বিনিয়োগের (foreign direct investment) চেয়ে প্রায় দশ গুণ বেশি বিনিয়োগ করে যুক্তরাষ্ট্রে।
তবে ১৯৯০-এর দশকের ‘ট্রান্সআটলান্টিক (Transatlantic) সোনালি যুগ’ বেশ পেছনে ফেলে, ২০২৪ সালের মার্কিন নির্বাচনের প্রস্তুতি পর্বে কিছু সাংবাদিক যুক্তরাষ্ট্র-ইইউ সম্পর্ককে অবসানমুখী বলেও আভাস দিয়েছেন। সিসান্ত (Asia) অঞ্চলের দিকে যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত আগ্রহ বাড়ায় (বিশেষ করে ওবামা প্রশাসনের (Obama administration) সময় থেকে), ইউরোপের গুরুত্ব মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিতে কিছুটা কমেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এই পরিবর্তনের পেছনে একদিকে রয়েছে অর্থনৈতিক কারণ—বিশ্বের আগামী দিনের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির বেশির ভাগই এশিয়া থেকে আসতে পারে বলে আশা করা হচ্ছে, অন্যদিকে ভূ-রাজনৈতিক কারণও আছে—যুক্তরাষ্ট্র চীনকে (China) প্রতিহত করার চেষ্টা চালাচ্ছে এবং ২০২০ সালে চীন পণ্য বাণিজ্যে (trade in goods) ইইউকে ছাড়িয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় অংশীদার হয়ে উঠেছে।
নিউইয়র্কাস ভিনোকুর (Nicolas Vinocure) নামের এক সাংবাদিক পলিটিকোতে (Politico) উল্লেখ করেছেন যে, বিশেষ করে রিপাবলিকান (Republican) নীতিনির্ধারকদের কাছে ইউরোপের গুরুত্ব কিছুটা কমে গেছে, আর ট্রাম্প এই মনোভাবকে আরও তীব্র করে তুলেছেন। উদাহরণস্বরূপ, ন্যাটোকে (NATO) ঘিরে ট্রাম্পের দ্বিধাগ্রস্ত মনোভাব দেখা গেছে; এমনকি তিনি প্রচারণায় বলেছিলেন, যদি কোনো সদস্যদেশ ২% জিডিপি প্রতিরক্ষা ব্যয় লক্ষ্যমাত্রা পূরণ না করে, তবে রাশিয়া (Russia) সে দেশে যা খুশি করতে পারে, তাতে তিনি হস্তক্ষেপ করবেন না। আবার যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউর বাণিজ্যিক সম্পর্কের দিকটিও তার অপছন্দ—কারণ যুক্তরাষ্ট্র ইইউর সাথে বাণিজ্য ঘাটতিতে (trade deficit) আছে। টাম্পের মতে, এটি “অন্যায্য”। তিনি ব্লুমবার্গকে (Bloomberg) এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “স্কটল্যান্ড ও জার্মানিকে আমরা ভালোবাসি, কিন্তু এর বাইরে গেলে, ইইউ আমাদের প্রতি সহিংস আচরণ করে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, কেউ ভাবে না, কিন্তু এটা চীনের মতো।”
এ কারণে স্বাভাবিকভাবেই ট্রাম্প ব্রাসেলসে (Brussels) খুব একটা জনপ্রিয় নন। তবে ইউরোপে তার কিছু কট্টর সমর্থক (continental admirers) আছেন, তাদের মধ্যে সবচেয়ে উচ্চকণ্ঠ সম্ভবত হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর অরবান (Viktor Orban)।
হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর অরবান (Viktor Orban)
ভিক্টর অরবান ট্রাম্পের একজন বড় অনুরাগীই নন, বরং ট্রাম্পের “অনুপ্রেরণার” অন্যতম উৎসও বটে। অরবান সম্প্রতি ট্রাম্পের বিভিন্ন প্রশংসাসূচক বক্তব্যের একটি সংকলন (montage) শেয়ার করেছেন, যেখানে ট্রাম্প তাকে “একজন অত্যন্ত সম্মানিত নেতা,” “দুনিয়ার অন্যতম শক্তিশালী নেতা” ইত্যাদি বলে অভিহিত করেছেন। বাস্তবেও দুই “শক্তি-নেতা” (strong men) অনেক বিষয়ে একই আদর্শ ধারণ করেন।
মার্কিন নির্বাচনের প্রচারণায় ট্রাম্প আংশিকভাবে অরবানের কৌশল অনুসরণ করেছেন—খ্রিস্টীয় মূল্যবোধ (Christian values) ও পশ্চিমা সভ্যতার (Western civilization) রক্ষক হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করা, ষড়যন্ত্রতত্ত্বের (conspiratorial forces) বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া ইত্যাদি। উদাহরণস্বরূপ, ট্রাম্পের কাছে “শত্রু” বা ষড়যন্ত্রকারী “ডিপ স্টেট (deep state)” ও রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে লুকিয়ে থাকা “অশুভ শক্তি,” আর অরবানের কাছে এটি হলেন লিবারাল দাতব্যকারী জর্জ সোরোস (George Soros)।
ট্রাম্প ও অরবান উভয়ই রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের (Putin) সাথে তুলনামূলকভাবে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক রক্ষা করে চলেছেন, এবং ইউক্রেনে (Ukraine) শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। অভিবাসন (migration) ইস্যুতেও তাদের অবস্থান একই রকম কঠোর; ট্রাম্প যেমন মেক্সিকো সীমান্তে দেয়াল নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, অরবান তেমনি ২০১৫ সালে সার্বিয়া ও ক্রোয়েশিয়ার সাথে হাঙ্গেরির সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া দিয়েছিলেন। সম্প্রতি তিনি এ বেড়া আরও বাড়ানোর অঙ্গীকার করেছেন।
অরবানের “প্যাট্রিয়টস ফর ইউরোপ (Patriots for Europe)” নামে ইউরোপীয় পার্লামেন্টের (European Parliament) একটি গ্রুপিং রয়েছে, যেখানে ইতালির উপপ্রধানমন্ত্রী মাত্তেও সালভিনি (Matteo Salvini) -র লেগা (Lega) এবং স্পেনের ভক্স (Vox) পার্টির মতো দল আছে—যারা সকলেই ট্রাম্পঘেঁষা (Trumpophiles)। স্পেনের ভক্স পার্টি চলতি বছরের মে মাসে একটি আন্তর্জাতিক ডানপন্থী সম্মেলনে (right wing summit) প্রো-ট্রাম্প (pro Trump) রিপাবলিকানদের আমন্ত্রণ জানায়।
নেদারল্যান্ডসের গির্ট উইলডার্স (Geert Wilders)
ট্রাম্পের আরেকজন উচ্চৈঃস্বরের অনুরাগী হলেন ডাচ ফ্রিডম পার্টির (Netherlands Freedom Party) নেতা গির্ট উইলডার্স (Geert Wilders)। শুধু ট্রাম্পের আদর্শিক সাদৃশ্যই নয়, উইলডার্স তার চুলের ধরন এবং মেজাজের জন্য “ডাচ ট্রাম্প (Dutch Trump)” নামেও পরিচিত। ট্রাম্পের বিজয়ের পর তিনি উচ্ছ্বাস প্রকাশের পাশাপাশি একটি মেগা (MAGA) ক্যাপ পরে সেলফি তুলে পোস্ট করেছিলেন। অভিবাসন নিয়ে উইলডার্সের অবস্থানও কঠোর; গত সেপ্টেম্বরে তার জোট (coalition) দাবি করে যে, তারা “এ পর্যন্ত সবচেয়ে কঠোর আশ্রয় নীতি (asylum policy)” প্রণয়ন করেছে।
উইলডার্স আসলে নেদারল্যান্ডসের প্রধানমন্ত্রী নন; তার ইসলাম-বিরোধী অবস্থানকে (যা অন্য সরকারি জোটের কাছে অসাংবিধানিক বলে বিবেচিত) ঘিরে বিতর্ক রয়েছে। তা সত্ত্বেও তিনি দেশের সবচেয়ে বড় দলের নেতা হিসেবে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন।
ইতালির প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনি (Giorgia Meloni)
ট্রাম্পের আরেক সম্ভাব্য মিত্র এবং এই তালিকার সবচেয়ে ক্ষমতাধর রাজনীতিক হলেন ইতালির প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনি। তিনি অভিবাসনবিরোধী কঠোর অবস্থান নিয়েছেন এবং তথাকথিত “ইউরোপীয় ঐতিহ্যগত মূল্যবোধ” (traditional European values) রক্ষায় সোচ্চার। সাম্প্রতিককালে তিনি ট্রাম্পের কথিত ডানহাত ইলন মাস্কের (Elon Musk) সাথেও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলেছেন। শোনা যাচ্ছে, মাস্ক তার স্যাটেলাইট ব্যবসা স্পেসএক্স (SpaceX) -এর কার্যক্রম ইতালিতে বাড়াতে আগ্রহী এবং ইতালির সরকার সম্প্রতি স্যাটেলাইট যোগাযোগের (satellite communications) মাধ্যমে একটি রিজার্ভ ট্রান্সমিশন ক্ষমতা গড়ে তোলার জন্য একটি নীতিমালা পাস করেছে।
তবে শুধু প্রযুক্তি বা বাণিজ্য নয়, মাস্ক হয়তো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ নিয়ে (EU vs. social media giants) ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাথে চলমান দ্বন্দ্বেও মেলোনিকে কাছে পেতে চাইছেন। কারণ, ইইউ এর ডিজিটাল নীতিমালার বিরুদ্ধে সমর্থন পেলে মাস্কের প্ল্যাটফর্মগুলো সুবিধাজনক অবস্থান পেতে পারে। অন্যদিকে, মেলোনি নিজেও সম্প্রতি ইউরোপের “কৌশলগত স্বায়ত্তশীলতা” (strategic autonomy) সমর্থন করেছেন। তিনি গত সপ্তাহে বুদাপেস্টে (Budapest) ইউরোপীয় নেতাদের উদ্দেশে বলেছেন, “যুক্তরাষ্ট্র আমাদের জন্য কী করতে পারে তা ভাববেন না, বরং ইউরোপকে কী করতে হবে, সেটা ভাবুন।” এর মাধ্যমে তিনি আকারে বুঝিয়েছেন—ট্রাম্প জিতে গেলে ইউরোপ আর আগের মতো আমেরিকার ওপর নির্ভর করতে পারবে না; বরং সামরিক ও অর্থনৈতিকভাবে ইউরোপকে স্বনির্ভর হতে হবে।
ইইউতে এর সম্ভাব্য প্রভাব
ট্রাম্প জয়ী হওয়ায় তার ইউরোপীয় সমমনা নেতারা আরও সাহস পেতে পারেন এবং বিভিন্ন সদস্যদেশে “ট্রাম্পমতো” নীতি (Trump-like policies) জোরদার করার চেষ্টা করতে পারেন। কিন্তু ব্যবহারিক বাস্তবতায়, ইইউর সংসদীয় নির্বাচন (EU elections) ইতোমধ্যে ২০২৪ সালের জুনে অনুষ্ঠিত হয়েছে। ডানপন্থী দলগুলো ভালো করেছে বটে, তবে বর্তমানে ইউরোপীয় পার্লামেন্ট এখনো মূলধারার (pro-EU centrist) দলগুলোর দখলে।
অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও ট্রাম্পের ১০-২০% হারে শুল্ক (tariffs) আরোপের পরিকল্পনা এবং কৃষি পণ্য (agricultural products) রপ্তানির দাবি ইউরোপে খুব একটা জনপ্রিয় হবে না— এমনকি ট্রাম্পপন্থী মিত্রদের কাছেও। কারণ, ২০২৪ সালের শুরুর দিকে ইউরোপের কৃষকরা (farmers) নানা ইস্যুতে বিরাট বিক্ষোভ করেছেন; অতিরিক্ত কৃষিপণ্য আমদানি এ সমস্যাকে আরও ঘনীভূত করতে পারে।
সবচেয়ে বড় কথা, ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট হলে ইউরোপের কাছে তিনি কীভাবে এগিয়ে যাবেন, সেটি অনেকটাই নির্ভর করবে পরবর্তী চার বছরে ইউরোপের দেশে দেশে কে ক্ষমতায় আসবে তার ওপর। এখনই নিশ্চিতভাবে বলা যাচ্ছে না, তবে ট্রাম্পের প্রেসিডেন্সি ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাজনীতিকে আরও বিভক্ত করতে পারে, আর এই বিভক্তিই হয়তো হবে তার সবচেয়ে বড় প্রভাব।
শেষ কথা
সংক্ষেপে, ইউরোপে ট্রাম্পের বেশ কয়েকজন উচ্চপ্রোফাইল মিত্র থাকলেও (ভিক্টর অরবান, গির্ট উইলডার্স, জর্জিয়া মেলোনি প্রমুখ), ইইউর সামগ্রিক কাঠামোতে তার জনপ্রিয়তা সীমিত। তবু তার ফিরে আসা ইউরোপীয় রাজনীতিতে নানা পরিবর্তনের জন্ম দিতে পারে—অভিবাসন নীতি থেকে শুরু করে বাণিজ্যিক চুক্তি ও প্রতিরক্ষা জোট পর্যন্ত সব কিছুতেই প্রভাব পড়তে পারে।
তথ্যসূত্র
EU-US Relations
https://policy.trade.ec.europa.eu/eu-trade-relationships-country-and-region/countries-and-regions/united-states_en
https://www.politico.eu/article/donald-trump-kamala-harris-jd-vance-tim-waltz-eu-nato-us-elections-weapons/
https://edition.cnn.com/2024/02/10/politics/trump-russia-nato/index.html
https://www.bloomberg.com/features/2024-trump-interview-transcript/
Trump’s EU Allies
https://x.com/PM_ViktorOrban/status/1854206869515944269
https://www.euractiv.com/section/global-europe/news/hungary-ready-to-build-another-fence-on-southern-border/
https://x.com/geertwilderspvv/status/1854054407274475924
https://www.euronews.com/next/2024/09/25/elon-musk-and-giorgia-meloni-what-could-an-alliance-between-the-divisive-figures-mean-for-
https://x.com/elonmusk/status/1837420823340093801
ট্রাম্পের শুল্কনীতি ও চীনা অর্থনীতির মন্দা: সংকট, প্রভাব এবং ভবিষ্যৎ নীতিনির্ধারণের দ্বিধাদ্বন্দ্ব (১২ নভেম্বর, ২০২৪)
ভূমিকা
চীনা অর্থনীতি (Chinese economy) বর্তমানে সুখকর সময় পার করছে না। টানা দীর্ঘ মন্দা ও মূল্যস্ফীতি-জনিত স্থবিরতার মধ্যে থেকেও চীনের কমিউনিস্ট পার্টি বা সিসিপি (CCP) আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফ (IMF) এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠান থেকে আসা পরামর্শ (যা মূলত সরকারি ব্যয়ের মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ চাহিদা বাড়ানোর সুপারিশ করে) শুনতে চাইছে না। কারণ, তারা মনে করে অতিরিক্ত খরচ করলে বিদ্যমান অর্থনৈতিক বাবলগুলো (bubbles) আবার ফুলে উঠতে পারে। কিন্তু সমস্যাটা হলো, ডোনাল্ড ট্রাম্পের (Donald Trump) পুনর্নির্বাচন চীনের অর্থনীতির জন্য পরিস্থিতিকে আরও খারাপ করে তুলতে পারে। এই প্রবন্ধে আমরা ট্রাম্পের শুল্ককেন্দ্রিক চীন নীতি (tariff centric China policy), কেন তা চীনের বর্তমান উদ্দীপনা-পদ্ধতি বা স্টিমুলাস (stimulus) সমস্যাকে আরও জটিল করে তুলছে, এবং সামনের দিনে কী ঘটতে পারে—সেই বিষয়ে বিশদ আলোচনা করব।
ট্রাম্পের চীনা-বিরোধী অবস্থান ও শুল্কনীতি
ট্রাম্প (Trump) ২০১৫ সালে রাজনীতির মঞ্চে প্রবেশের পর থেকেই চীনের বিরুদ্ধে সরব ছিলেন। তিনি জোর গলায় বলে আসছিলেন যে যুক্তরাষ্ট্র (US) ও চীনের মধ্যে বাণিজ্য ঘাটতি (trade deficit) খুব বেশি। অর্থাৎ, যুক্তরাষ্ট্র চীনের থেকে যে পরিমাণ পণ্য আমদানি (import) করে, চীন তার তুলনায় যুক্তরাষ্ট্র থেকে অনেক কম আমদানি করে। ৮০’র দশক থেকে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় প্রবেশের পর থেকেই চীন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইতিবাচক বাণিজ্য উদ্বৃত্ত (trade surplus) বজায় রেখে আসছে। বিশেষ করে ২০০০ সালের পর এটি ব্যাপক আকার ধারণ করে এবং ২০১৬ সালে ট্রাম্প যখন ক্ষমতায় আসেন, তখন এই উদ্বৃত্তের পরিমাণ ছিল প্রায় ৩৫০ বিলিয়ন ডলার।
২০১৬ সালের নির্বাচনি প্রচারণায় ট্রাম্প প্রতিশ্রুতি দেন যে তিনি এই ‘বাণিজ্য বৈষম্য’ ঘোচাতে শুল্ক আরোপ করবেন। ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে নিউইয়র্ক টাইমসের (New York Times) সম্পাদকীয় বোর্ডের সঙ্গে এক বৈঠকে তিনি পর্যন্ত বলেছিলেন, সমস্ত চীনা আমদানির ওপর ৪৫% হারে শুল্ক (tariff) আরোপ করবেন। তার যুক্তি ছিল, চীনা পণ্যের (Chinese imports) দাম বাড়িয়ে দিলে, সেগুলো আমেরিকান ভোক্তাদের কাছে কম আকর্ষণীয় হবে এবং তারা মার্কিন পণ্য (American made stuff) কিনতে উৎসাহী হবে। এতে করে একই সাথে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ঘাটতি কমবে এবং মার্কিন উৎপাদন খাত পুনরুজ্জীবিত হবে। অবশ্য ভোক্তাদের জন্য এর মূল্যও কিছুটা বাড়বে, কারণ স্বল্পমূল্যের চীনা পণ্যের জায়গায় তুলনামূলক ব্যয়বহুল মার্কিন পণ্য ব্যবহারের সম্ভাবনা তৈরি হবে।
শেষ পর্যন্ত ট্রাম্প নির্বাচিত হয়ে ২০১৮ সালের জুলাই থেকে চীনা পণ্যের তালিকা ক্রমাগত বাড়িয়ে এর ওপর ৭.৫% থেকে ২৫% পর্যন্ত শুল্ক আরোপ করতে থাকেন। প্রেসিডেন্সির (presidency) শেষ দিকে এসে ট্রাম্প প্রায় ২০% গড় হারে শুল্ক আরোপ করেছিলেন চীনা পণ্যের মোট ৩৮০ বিলিয়ন ডলারের ওপর, যা ২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্র যে ৫৪০ বিলিয়ন ডলারের চীনা পণ্য আমদানি করেছিল, তার প্রায় ৭৫%।
কিন্তু চীনও পাল্টা শুল্ক আরোপ করে, আর যুক্তরাষ্ট্র কিছু ভিন্ন ভিন্ন পণ্য আমদানি করতে শুরু করে যেগুলোর ওপর শুল্কের হার কম বা নেই। ফলে সামগ্রিক বাণিজ্য ঘাটতির ক্ষেত্রে তেমন একটা পরিবর্তন আসেনি। বরং এটি ২০১৭ সালে ৩৭৫ বিলিয়ন ডলার থেকে কিছুটা বেড়ে যায়। পরে আমরা দেখব, এটি সামান্য কমেও গিয়েছিল কিছু সময়ের জন্য।
ট্রাম্পের আমলে বাণিজ্য ঘাটতির ওঠানামা ও বাইডেন প্রশাসনের সময় নতুন শুল্ক
ট্রাম্পের ট্যারিফ আরোপের সময়কাল ধরেই যুক্তরাষ্ট্র-চীন দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ঘাটতির (bilateral trade deficit) ওঠানামা দেখা গেছে।
- এটি ২০১৭ সালে প্রায় ৩৭৫ বিলিয়ন ডলারে ছিল।
- পরে কিছুটা বেড়ে ২০১৮ সালে প্রায় ৩৮০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছায় (অনুমানভিত্তিক সংশোধন)।
- ২০১৯ সালে তা সামান্য কমে প্রায় ৩৪০ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে।
২০২০ সালের জানুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্র ও চীন ‘ফেজ ওয়ান (phase one) ট্রেড ডিল (trade deal)’ স্বাক্ষর করে, যেখানে চীনকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ পণ্য আমদানি করার জন্য সক্রিয়ভাবে অঙ্গীকার করতে হয়। কিন্তু চীন প্রকৃতপক্ষে সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেনি। ২০২০ সালে বৈশ্বিক মহামারির (pandemic) কারণে সামগ্রিক বাণিজ্য ঘাটতি কিছুটা কমে ৩০৮ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে। কিন্তু মহামারি-পরবর্তী সময়ে আবার তা বাড়তে শুরু করে এবং ২০২২ সালে এটি ৩৮২ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছে। ২০২৩ সালে কিছুটা কমলেও বছরের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত গত বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ৫% বেড়েছে। আর সামগ্রিকভাবে চীনের বৈশ্বিক বাণিজ্য উদ্বৃত্ত (overall trade surplus) ২০২৩ সালে প্রায় ৯৫৩ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছাতে পারে বলে অনুমান করা হচ্ছে।
জো বাইডেন (Biden) প্রেসিডেন্ট হওয়ার পরেও ট্রাম্প আরোপিত সব শুল্ক বহাল রেখেছিলেন এবং বছরের শুরুর দিকে কিছু নতুন শুল্কও যোগ করেছেন। এগুলোকে ‘কৌশলগত শুল্ক (strategic tariffs)’ বলা হয়ে থাকে এবং এর আওতায় বৈদ্যুতিক যানবাহন (electric vehicles), সৌর প্যানেল (solar equipment), ব্যাটারি (batteries) ইত্যাদি পড়েছে।
অবশ্য অবাক হওয়ার কিছু নেই; বারাক ওবামা (Obama) ও বাইডেন (Biden) যুগেও চীনের বাণিজ্য কৌশল নিয়ে সমালোচনা কম হয়নি। ওবামা আমলে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় (WTO) চীনের বিরুদ্ধে ২৩টি অভিযোগ দায়ের করা হয়, যা ছিল এক রকমের নজিরবিহীন। ২০০৯ সালে চীনা টায়ারের (Chinese tire) ওপর অ্যান্টি-ডাম্পিং শুল্ক (anti-dumping tariff) আরোপ করার সিদ্ধান্তও ওবামা প্রশাসনেরই ছিল।
ট্রাম্পের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
আবার নির্বাচনে নেমে ট্রাম্প নতুন করে বলছেন যে তিনি বাইডেনের ‘কৌশলগত শুল্ক’কে আরও বিস্তৃত করতে চান। এর মধ্যে নাকি একটি ‘বিশাল শুল্ক (Ring around the collar tariff)’ অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে এবং সমগ্র চীনা পণ্যের ওপর একটি সমতল হারে (flat tariff) শুল্ক আরোপ করা হবে বলে তিনি ইঙ্গিত দিয়েছেন। মিডিয়া বিভিন্ন হারে শুল্কের কথা বলেছে—ওয়াশিংটন পোস্ট (Washington Post) প্রথমে ৬০% বললেও ট্রাম্প নিজে এক সাক্ষাৎকারে ৫০% বলেছেন, আবার ফক্স নিউজে (Fox News) বলেছেন ৬০%-এর বেশি হতে পারে।
চীনও পাল্টা শুল্ক আরোপ করলে এটি স্বল্পমেয়াদে দুই দেশের অর্থনীতির জন্যই ক্ষতিকর হতে পারে। লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্সের (LSE) এক গবেষণায় ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে যে, সব চীনা আমদানির ওপর ৬০% হারে শুল্ক আরোপ করলে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের জিডিপি (GDP) প্রায় ০.৮%-১% হ্রাস পেতে পারে।
চীনের অর্থনীতির বর্তমান মন্দা, দুর্বল অভ্যন্তরীন চাহিদা ও ট্রাম্পের শুল্ক বাস্তবায়নে নেতিবাচক প্রভাব
চীনা অর্থনীতি বর্তমানে একটা দীর্ঘমেয়াদি সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, যেখানে অভ্যন্তরীণ চাহিদা (domestic demand) বেশ দুর্বল এবং ভোক্তাদের আস্থাও (consumer confidence) কম। কিন্তু এই অবস্থায় জিডিপি গ্রোথ বাধাগ্রস্ত হয়। কাজেই এই দুর্বল অভ্যন্তরীন চাহিদার সংকট মেটাতে চীন ক্রমশ রপ্তানিনির্ভর হয়ে পড়ছে, যার ফলে তাদের বাণিজ্য উদ্বৃত্তই মূল চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করছে। কিন্তু ট্রাম্পের সম্ভাব্য নতুন শুল্ক বাস্তবায়ন হলে চীনের রপ্তানিমুখী উন্নয়ন আরও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এক্ষেত্রে সম্ভাব্য নেতিবাচক প্রভাব –
- ১. রপ্তানি হ্রাস (Less Demand for Chinese Exports): চীন যদি দ্রুত নতুন বাজার খুঁজে না পায়, তবে মার্কিন বাজারে শুল্ক বৃদ্ধির কারণে চীনের রপ্তানি কমে যাবে। এখন যেহেতু রপ্তানিই তাদের অর্থনীতির মূল অবলম্বন, এটি অর্থনীতিতে বড় ধাক্কা দিতে পারে।
- ২. আস্থা সংকট আরও বাড়বে (Exacerbated Confidence Problem): ট্রাম্পের শুল্ক আরোপ নিয়ে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ও সাধারণ মানুষের মধ্যে আরও অনিশ্চয়তা তৈরি হবে। ফলে বিনিয়োগ ও ভোগ ব্যয় কমে যেতে পারে, যা অভ্যন্তরীণ চাহিদাকে আরো দুর্বল করে তুলবে এবং মূল্যস্তরকে (deflation) নিচের দিকে নামিয়ে দিতে পারে।
চীনের নীতিনির্ধারকগণের দ্বিধাদ্বন্দ্ব ও সীমিত মধ্যপন্থা
চীনা কর্তৃপক্ষের মূল প্রশ্ন হলো—তারা কি রাজস্ব ব্যয় (fiscal stimulus) বাড়িয়ে অভ্যন্তরীণ চাহিদা উজ্জীবিত করবে, নাকি অর্থনৈতিক বাবল (bubbles) এড়াতে সতর্ক থাকবে? এখন পর্যন্ত সিসিপি (CCP) বিপুল সরকারি ব্যয় করা থেকে বিরত থেকেছে, কারণ তারা আবাসন খাত (housing bubble) সহ বিভিন্ন খাতে বড়সড় বাবল সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা করছে। তবে ট্রাম্পের নতুন শুল্ক কার্যকর হলে চীনের রপ্তানি কমতে পারে এবং ব্যবসায়িক আস্থা আরও দুর্বল হয়ে গিয়ে একটি জাপান-শৈলীর (Japan style) দীর্ঘমেয়াদি মুদ্রাস্ফীতিহীন মন্দা বা মূল্যপতন (deflationary crisis) দেখা দিতে পারে। ফলে এটি তাদের জন্য আরও কঠিন সিদ্ধান্ত হয়ে দাঁড়াবে।
ট্রাম্পের নির্বাচনের ঠিক দুই দিন পর, চীন একটি নতুন উদ্দীপনা প্যাকেজ (stimulus package) ঘোষণা করে। এর আওতায় স্থানীয় সরকারগুলোকে (local governments) মোট ১০ ট্রিলিয়ন ইউয়ান (প্রায় ১.৪ ট্রিলিয়ন ডলার) ঋণ দেওয়া হবে, যাতে তারা তাদের ‘লুকানো ঋণ’ (hidden debts) পুনর্গঠন করতে পারে। আশা করা হয়েছিল, এটি বিনিয়োগকারী ও সাধারণ মানুষের আস্থা বাড়াবে, কিন্তু বাস্তবে ফলাফল তেমন আশাব্যঞ্জক হয়নি। পরবর্তী সোমবার হংকংয়ের (Hong Kong) হ্যাংসেং সূচক (Hang Seng index) ১.৫% পড়ে যায়।
সামনে কী হতে পারে
এখন মূল প্রশ্ন—সিসিপি (CCP) কি আরও বড় ধরনের স্টিমুলাস (stimulus) আনবে, নাকি তারা আবারও সতর্ক অবস্থান নেবে?
- ১. স্টিমুলাসবিরোধী অবস্থান অব্যাহত রাখা (Avoid Further Stimulus): চীনা কর্তৃপক্ষ মনে করতে পারে যে বাবল আবার ফুলে উঠলে দীর্ঘমেয়াদে বিপদ আরও বড় হতে পারে। তাই তারা হয়তো ট্রাম্পের শুল্ককে অগ্রাহ্য করে আগের মতোই সতর্ক অবস্থান নেবে।
- ২. শুল্ক আরোপের পরেই বড় ধরনের স্টিমুলাস (Saving Fiscal Firepower): অন্যদিকে, সিসিপি হতে পারে অপেক্ষায় আছে—যখন ট্রাম্প সত্যি সত্যি বড় শুল্ক আরোপ করবেন, তখনই একটি বড় আকারের সরকারি ব্যয় প্যাকেজ বা উদ্দীপনা প্যাকেজ চালু করা হবে, যাতে অর্থনীতিতে তাৎক্ষণিক গতিশীলতা আসে।
ফলে, ট্রাম্পের পুনর্নির্বাচনের আগের বা পরের সময়টাই চীনের অর্থনৈতিক নীতিনির্ধারণে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। চীনে রপ্তানি কমে যাওয়ার শঙ্কা থাকলে, তারা হয়তো শেষ পর্যন্ত বড় ধরনের উদ্দীপনা নীতি বাস্তবায়নে বাধ্য হবে।
উপসংহার
সবমিলিয়ে, চীনের অর্থনীতি এখন এমনিতেই দুর্বল অভ্যন্তরীণ চাহিদা, রিয়েল এস্টেট সংকট বা হাউজিং বাবল (housing bubble), ও দীর্ঘমেয়াদি মন্দার ঝুঁকি নিয়ে লড়ছে। এর মধ্যে ট্রাম্পের (Trump) সম্ভাব্য পুনর্নির্বাচন এবং তার উচ্চহারের শুল্ক (tariffs) আরোপের হুমকি চীনের জন্য নতুন করে ঝুঁকি তৈরি করেছে। চীন যদি এখনই বড় ধরনের সরকারি ব্যয় করে অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে চায়, তবে তারা বিদ্যমান ঋণ ও আবাসন খাতের বাবলের ঝুঁকি বাড়ানোর আশঙ্কা করছে। আবার শুল্ক আরোপের চাপে রপ্তানি কমে গেলে চাহিদা আরও দুর্বল হবে, যা অর্থনীতিকে দীর্ঘমেয়াদি স্থবিরতায় ফেলে দিতে পারে।
সুতরাং, সামনে কী ঘটবে, তা নির্ভর করছে চীনা কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত এবং ট্রাম্পের শুল্ক আরোপের বাস্তবায়নের ওপর। তারা যদি সতর্ক অবস্থানে থেকে যায়, বাবলের ঝুঁকি হয়তো কম থাকবে, কিন্তু অর্থনীতির স্থবিরতা দীর্ঘায়িত হতে পারে। আর যদি হঠাৎ বিশাল উদ্দীপনা প্যাকেজ নিয়ে আসে, তাহলে হয়তো স্বল্পমেয়াদে অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে পারে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে ঋণ ও বাবলের আশঙ্কা আরও বাড়বে। দু’দিক থেকেই ঝুঁকি বিদ্যমান, তাই আমাদের সবাইকে অপেক্ষা করতে হবে এবং দেখতে হবে—চীনা সরকার ও মার্কিন প্রশাসন পরবর্তী ধাপে কী করে।
তথ্যসূত্র
1 – https://www.weforum.org/stories/2019/05/more-than-30-years-of-us-trade-with-china-in-one-chart/
2 – https://www.reuters.com/world/china/why-chinas-economy-is-more-vulnerable-trump-tariffs-this-time-2024-11-06/
3 – https://www.bloomberg.com/news/articles/2024-11-11/china-approaches-record-1-trillion-trade-surplus-to-world-s-ire
4 – https://www.lse.ac.uk/granthaminstitute/wp-content/uploads/2024/10/Economic-impacts-of-the-Trump-Tariff-Proposals-on-Europe.pdf
5 – https://www.lse.ac.uk/granthaminstitute/publication/the-economic-impacts-of-trumps-tariff-proposals-on-europe/
6 – https://www.census.gov/foreign-trade/balance/c5700.html
ট্রাম্পের ইউক্রেন শান্তি পরিকল্পনা ব্যাখ্যা (৯ নভেম্বর, ২০২৪)
ভূমিকা
নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়েছে। তিনি বারবার ঘোষণা দিয়েছেন যে প্রেসিডেন্ট হিসেবে তার প্রথম কাজগুলোর একটি হবে ইউক্রেনে চলমান যুদ্ধের অবসান ঘটানো। ট্রাম্প জোর দিয়েছেন যে ২০২০ সালে যদি তিনি জিততেন, তবে এই যুদ্ধ কখনোই শুরু হতো না। তাছাড়া তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন মাত্র “২৪ ঘণ্টার (24 hours)” মধ্যে যুদ্ধ থামানোর একটা উপায় বের করবেন।
এই নিবন্ধে আমরা বিশদভাবে দেখবো, ট্রাম্প কেন ইউক্রেনের যুদ্ধ বন্ধ করতে চান, কী তার পরিকল্পনা, এবং কীভাবে তিনি জেলেনস্কি (Zelensky) ও পুতিনকে (Putin) এক টেবিলে বসাতে চাইছেন।
ট্রাম্প কেন ইউক্রেন যুদ্ধ শেষ করতে চান
ট্রাম্প নিজেকে একজন “স্বঘোষিত বিচ্ছিন্নতাবাদী (isolationist)” বলে দাবি করে আসছেন। যুদ্ধ বন্ধ করা বা ইউক্রেনকে দেওয়া সমর্থন কমিয়ে আনা তার সমর্থকগোষ্ঠীর কাছে জনপ্রিয়, কারণ ২০২৩ সালের ডিসেম্বরের হিসাব অনুযায়ী, রিপাবলিকানদের (Republicans) ৪৮% মনে করে যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনকে খুব বেশি সহায়তা দিচ্ছে। ধারণা করা হয়, এর পর থেকে এ ধারণা আরও শক্তিশালী হয়েছে। একই সঙ্গে, ট্রাম্পের মিত্ররা আরও কিছু ভূকৌশলগত (geostrategic) কারণ দেখান। আমেরিকা ফার্স্ট পলিসি ইনস্টিটিউটে (America First Policy Institute) ট্রাম্পের সাবেক দুই জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার (national security chiefs) লেখা এক গবেষণাপত্র থেকে স্পষ্ট হয়, তাদের মতে যুদ্ধ শেষ করার অন্তত তিনটি প্রধান কারণ আছে:
- ইউক্রেনের বিজয় অনিশ্চিত: ইউক্রেনের সামনে বিজয় অর্জনের সম্ভাবনা খুব কম বলে তাদের ধারণা, কারণ যুদ্ধক্ষেত্র স্থবির হয়ে আছে।
- রাশিয়া, চীন, ইরান ও উত্তর কোরিয়ার বন্ধন মজবুত হওয়ার আশঙ্কা: দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ রাশিয়া-চীন-ইরান-উত্তর কোরিয়ার জোটকে শক্তিশালী করতে পারে। সাম্প্রতিককালে ন্যাটো (NATO)-র প্রতিবেদনে দেখা গেছে, প্রতিরক্ষা চুক্তির পর রাশিয়ায় ইরানের ড্রোন (drone) বড় পরিসরে ব্যবহার হচ্ছে।
- যুক্তরাষ্ট্রের গোলাবারুদ স্বল্পতা: ইসরায়েল (Israel) ও ইউক্রেন দু’দেশকেই সামরিক সহায়তা দিতে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের গোলাবারুদের মজুদ বেশ নিচে নেমে গেছে। ভবিষ্যতে চীনের (China) সঙ্গে কোনো সংঘাতের আশঙ্কা থাকলে যুক্তরাষ্ট্রকে এখনই সংরক্ষণে যেতে হবে। ট্রাম্পের সাবেক উপদেষ্টা এলব্রিজ কোলবি (Elbridge Colby) প্রায়ই বলেন, ইসরায়েল ও ইউক্রেনকে সমর্থন দিতে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের গোলাবারুদ ও অস্ত্রভাণ্ডার বিপজ্জনকভাবে কমে যাচ্ছে। র্যান্ড কর্পোরেশনের (RAND Corporation) হিসেবে, তাইওয়ানের (Taiwan) ওপর যুদ্ধ শুরু হলে যুক্তরাষ্ট্র মাত্র তিন থেকে চার সপ্তাহের মধ্যেই গোলাবারুদের মজুদ শেষ করে ফেলতে পারে। শুধু মজুদ পুনরায় পূরণ করতেই বহু বছর লেগে যাবে, তাছাড়া মূল কাঁচামালের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সরবরাহশৃঙ্খল চীন ও রাশিয়ার ওপর বেশি নির্ভরশীল, যা যুক্তরাষ্ট্রের শিল্পখাতকে (industrial base) নাজুক অবস্থায় ফেলেছে।
শান্তি পরিকল্পনার (peace plan) মূল অন্তর্নিহিত অংশ
এখন প্রশ্ন, ট্রাম্প ঠিক কীভাবে যুদ্ধ থামাতে চান? এখনো পর্যন্ত তিনি নিজে খুব বেশি বিশদ তথ্য দেননি, কিন্তু তার উপদেষ্টারা কিছুটা ইঙ্গিত দিয়েছেন। সেপ্টেম্বরে শন রায়ান শো (the Sean Ryan show)-তে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ট্রাম্পের ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স (J.D. Vance) বেশ স্পষ্টভাবে কিছু ধারণা তুলে ধরেন। বিস্তারিতভাবে বলতে গেলে, তার পরিকল্পনার দুটো দিক আছে:
- বর্তমান সামনের সারিতে (front line) সম্পূর্ণ যুদ্ধবিরতি (ceasefire) করা
- ইউক্রেনের নিরপেক্ষতা (neutrality) নিশ্চিত করা
ভ্যান্সের যুক্তি অনুযায়ী, বর্তমান সামনের সারি ধরে যুদ্ধের অগ্নিসংযোগ বন্ধ করা (freeze) হলে একটি বেসামরিকীকৃত অঞ্চল (demilitarized zone) গড়ে তোলার পথ তৈরি হবে। এটা উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়ার মাঝে যে ধরনের অঞ্চলের মতো, প্রায় ৪ কিলোমিটার চওড়া এবং অত্যন্ত সুরক্ষিত। ফলে ইউক্রেনকে প্রায় এক-পঞ্চমাংশ ভূমি ছেড়ে দিতে হবে, যা বর্তমানে রাশিয়ার দখলে আছে। এর মধ্যে ক্রিমিয়া (Crimea) অন্তর্ভুক্ত, যা রাশিয়া ২০১৪ সালে দখল করেছিল; লুহানস্ক (Luhansk) ও দোনেৎস্ক (Donetsk) অঞ্চলের বড় অংশ; এবং দক্ষিণের জাপোরিঝঝিয়া (Zaporizhzhia) ও খেরসন (Kherson) অঞ্চলের প্রায় ৭০% এলাকা।
ট্রাম্পের দ্বিতীয় পরিকল্পনা হল ইউক্রেনকে নিরপেক্ষ রাখা, অর্থাৎ ন্যাটোতে (NATO) যোগ না দেওয়া। ট্রাম্প, ভ্যান্স এবং ইলন মাস্ক (Elon Musk) (যিনি ২০২২ সালের শেষদিকে এ ধরনের প্রস্তাব দিয়েছিলেন) প্রত্যেকে মনে করেন, ইউক্রেনকে ন্যাটোতে না নেওয়াই ভালো, যাতে পশ্চিমা বিশ্বকে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধে (World War Three) জড়াতে না হয়, আর পুতিনকেও বেশি উসকানি দেওয়া না হয়। পুতিন বরাবরই ইউক্রেনের ন্যাটোতে যোগদানের বিরোধী, কারণ তিনি রাশিয়ার কথিত প্রভাববলয়ের (sphere of influence) মধ্যে ইউক্রেনকে রাখতে চান।
২০২৪ সালের জুনে দ্য অল-ইন পডকাস্টে (the all in podcast) ট্রাম্প বলেন, বাইডেনের (Biden) রাশিয়াবিরোধী কঠোর মনোভাব এবং আমেরিকা যখন ইউক্রেনকে ন্যাটো সদস্যপদের প্রস্তাব দিচ্ছিল, সেটা ছিল “একটি ভুল (a mistake)” এবং “যুদ্ধ শুরু হবার আসল কারণ।” ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের (Wall Street Journal) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ট্রাম্প একবারে ন্যাটো থেকে ইউক্রেনকে বাদ দেওয়ার পক্ষপাতী না-ও হতে পারেন; বরং অন্তত ২০ বছর এর জন্য ইউক্রেনের সদস্যপদ স্থগিত রাখার প্রস্তাব দেবেন।
এ শান্তি পরিকল্পনায় মাঠে শান্তিরক্ষী বাহিনী (peacekeeping troops) মোতায়েনের মতো কোনো প্রয়োগমুখী ব্যবস্থা (enforcement mechanism) যুক্ত থাকতে পারে। তবে ট্রাম্প বহুদিন ধরেই বলে আসছেন, ইউরোপ তাদের প্রতিরক্ষায় যথেষ্ট খরচ করে না। সুতরাং সম্ভাব্যভাবে ইউরোপকেই এ খরচ বা সৈন্য সরবরাহের দায়িত্ব নিতে হবে।
ইউক্রেন ও রাশিয়াকে রাজি করানোর কৌশল
যদিও ইউক্রেন ও রাশিয়া কেউই আপাতত শান্তি আলোচনা করতে রাজি নয়, তবু ট্রাম্প তাদের রাজি করাতে কী করবেন?
প্রথমত, ইউক্রেনকে আলোচনার টেবিলে টেনে আনার ক্ষেত্রে তিনি হয়তো যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সহায়তা বন্ধ কিংবা উল্লেখযোগ্য হারে কমিয়ে দেওয়ার হুমকি দেবেন। প্রসঙ্গত, যুদ্ধ শুরুর পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র এরই মধ্যে ইউক্রেনকে ৭০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি সামরিক সহায়তা দিয়েছে। ইউরোপ খুব সক্রিয় না হলে যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্য ছাড়া ইউক্রেনের পক্ষে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া কঠিন হবে।
তবে রাশিয়াকে তিনি কীভাবে রাজি করাবেন, সেটা কিছুটা অনিশ্চিত। উপরে বর্ণিত পরিকল্পনায় রাশিয়া ২০% ইউক্রেনের ভূমি পেয়ে যাবে এবং ইউক্রেনকে নিরপেক্ষ রাখার নিশ্চয়তা পাবে। উপরি উপরি এটা রাশিয়ার জন্য লাভজনক মনে হতে পারে, কিন্তু এটি এখনো তাদের ‘সর্বোচ্চ লক্ষ্য (maximalist war aims)’ পূরণ করে না। ২০২২ সালে রাশিয়া লুহানস্ক, দোনেৎস্ক, খেরসন ও জাপোরিঝঝিয়া – এই চারটি অঞ্চলকে সম্পূর্ণ নিজ ভূখণ্ড হিসেবে দাবি করেছে। কিন্তু বর্তমানে রাশিয়া দোনেৎস্ক, খেরসন ও জাপোরিঝঝিয়ার সম্পূর্ণ অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। ফলে বর্তমান সামনের সারি ‘ফ্রিজ’ করলে পুতিনের ঘোষিত লক্ষ্য পূরণ হবে না, বিশেষত যদি সেখানে একটা বড় বাফার জোন থাকে। সম্প্রতি ক্রেমলিন ট্রাম্পের “দ্রুত শান্তিচুক্তি”র দাবিকে “কল্পনার রাজ্য (the realm of fantasy)” হিসেবে প্রত্যাখ্যানও করেছে।
পুতিন যদি ট্রাম্পের এ শান্তি পরিকল্পনা না-ও মানেন, তখন ট্রাম্প কী করবেন, সেটাও বড় প্রশ্ন। ইউরোপীয় ও ইউক্রেনের অনেক নেতাই মনে করেন, ট্রাম্প হয়তো তখন পুতিনকে আরও ছাড় দেবেন। তবে মনে রাখা দরকার, প্রেসিডেন্ট হিসেবে তার প্রথম মেয়াদে, বন্ধুত্বপূর্ণ কথা কিছুটা বললেও, ট্রাম্প পুতিনের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানও নিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন প্রথম মার্কিন প্রেসিডেন্ট যিনি ইউক্রেনে “প্রাণঘাতী সামরিক সহায়তা (lethal military aid)” পাঠানোর অনুমোদন দিয়েছিলেন। তিনি রাশিয়ান কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিলেন, যারা জার্মানিতে নর্ড স্ট্রিম ২ (Nord Stream 2) গ্যাস পাইপলাইন তৈরি করছিল। সিরিয়ায় রাশিয়ান ভাড়াটে সেনাদের (Russian mercenary groups) ওপর যুক্তরাষ্ট্রের বিমান হামলার নির্দেশও দিয়েছিলেন, এবং একাধিক পরমাণু চুক্তি (nuclear treaties) থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন।
২০২৩ সালে ফক্স নিউজকে (Fox News) দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ট্রাম্প বলেছিলেন, পুতিন যদি চুক্তি না করেন, তবে ইউক্রেনকে “আগের চেয়ে অনেক বেশি” সহায়তা দেবেন বলে হুমকি দিতেন—“আমি পুতিনকে বলতাম, যদি চুক্তি না করো, আমরা ওদের (ইউক্রেনকে) এমন কিছু দেবো যা ওরা কখনোই পায়নি।”
পরিশেষে বলা যায়, ইউক্রেন বা রাশিয়া কেউই তাৎক্ষণিকভাবে এ শান্তিচুক্তিতে গিয়ে রাজি হবে না। বড় প্রশ্ন হলো, প্রেসিডেন্ট হিসেবে ট্রাম্প তাদের কতটা চাপ দিতে পারবেন। তবে ট্রাম্প অন্তত এটুকু স্পষ্ট করেছেন যে, তিনি যুদ্ধ থামাতে বেশ জোর দিয়েই চেষ্টা চালাতে চান।
তথ্যসূত্র
- US aid to Ukraine poll: https://www.pewresearch.org/short-reads/2023/12/08/about-half-of-republicans-now-say-the-us-is-providing-too-much-aid-to-ukraine/
- America First, Russia & Ukraine’ paper: https://americafirstpolicy.com/issues/america-first-russia-ukraine
- US’ weak industrial base: https://foreignpolicy.com/2024/05/21/united-states-defense-pentagon-military-industrial-base-ammunition/
https://www.rand.org/nsrd/projects/NDS-commission.html - US’ low ammunition stockpiles: https://www.eurasiantimes.com/pentagons-achilles-heel-us-arsena/
https://x.com/amuse/status/1830645097672650849 - JD Vance on The Shawn Ryan Show https://www.youtube.com/watch?v=HrgmwtpAsWc
- Territory Russia occupies in Ukraine: https://www.bbc.co.uk/news/world-europe-60506682
- Elon Musk X post on Ukraine-Russia peace: https://x.com/elonmusk/status/1576969255031296000
- Trump’s advisors suggesting freezing Ukraine Nato membership for 20 years: https://x.com/nexta_tv/status/1854440147431080059/photo/1
- Kremlin dismisses quick deal as ‘realm of fantasy’: https://www.aljazeera.com/news/2024/9/17/whats-donald-trumps-plan-to-end-russias-war-on-ukraine
দ্বিতীয় ট্রাম্প প্রেসিডেন্সি ইউরোপের জন্য কী অর্থ বহন করবে? (৭ নভেম্বর)
ভূমিকা
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প (Donald Trump) সম্প্রতি বিজয়ী হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। সাধারণত, আমেরিকান নির্বাচন ইউরোপের জন্য সবসময়ই গুরুত্বপূর্ণ; কিন্তু এবার ব্যাপারটা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ কমলা হ্যারিস (Kamala Harris) ও ট্রাম্পের ইউরোপীয় ইউনিয়ন (EU – European Union), ইউক্রেন (Ukraine) এবং ন্যাটো (NATO – North Atlantic Treaty Organization) সংক্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গিতে তফাৎ যথেষ্ট স্পষ্ট। সুতরাং দ্বিতীয় ট্রাম্প প্রশাসন ইউরোপকে কীভাবে প্রভাবিত করতে পারে, ইউরোপ কীভাবে এর জবাব দিতে পারে, এবং এটি ট্রান্সআটলান্টিক অ্যালায়েন্সের (Transatlantic Alliance) শেষের শুরু কিনা – এসব নিয়েই এই বিশ্লেষণ।
ট্রাম্পের দুটি মূল নীতি ও ইউরোপে প্রভাব
নতুন ট্রাম্প প্রশাসন থেকে ইউরোপ সরাসরি কোন কোন বিষয়ে প্রভাবিত হতে পারে? মূলত দুটি নীতিতে এ প্রভাব সবচেয়ে বেশি লক্ষ করা যেতে পারে:
- ট্রাম্পের বৈদেশিক নীতি (Foreign Policy)
- ট্রাম্পের শুল্ক-কেন্দ্রিক অর্থনৈতিক নীতি (Tariff-Centric Economic Policy)
পরবর্তীতে এই দুটি দিক আলাদা ভাবে বিশ্লেষণ করা হলো।
ট্রাম্পের বৈদেশিক নীতি: ইউক্রেন ও ন্যাটোর প্রসঙ্গ
ইউক্রেন (Ukraine) প্রসঙ্গ
ইউরোপের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ট্রাম্পের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈদেশিক নীতির বিষয় হলো ইউক্রেন ও বৃহত্তর পরিসরে ন্যাটো। ট্রাম্পের ইউক্রেন সংক্রান্ত বক্তব্য বেশ কয়েকবার শোনা গেছে – তার মূল অবস্থান হলো যুদ্ধ যত দ্রুত সম্ভব শেষ করা। তিনি একাধিকবার দাবি করেছেন, ক্ষমতায় এসেই কিংবা ক্ষমতা গ্রহণের আগেই রাশিয়া (Russia) ও ইউক্রেনের মধ্যে একটি সমঝোতা চুক্তি (Deal) করে ফেলবেন।
সম্প্রতি লেক্স ফ্রিডম্যান পডকাস্ট (Lex Friedman podcast)-এ ট্রাম্প বলেছেন যে, তার কাছে একটি “খুব নির্দিষ্ট পরিকল্পনা” (A Very Exacting Plan) আছে, যা দিয়ে ইউক্রেন ও রাশিয়ার মধ্যেকার সংঘাত বন্ধ করা সম্ভব। তবে সেই পরিকল্পনা তিনি ফাঁস করতে চান না, কারণ করলে সেটি আর “অবাক করা” হতো না।
এই ধরনের পরিকল্পনা নিয়ে কিইভ (Kyiv) এবং ইউরোপের অন্যান্য রাজধানীতে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। কারণ, এখন যদি কোনো শান্তিচুক্তি (Peace Deal) হয়, তাহলে সেটি রাশিয়ার পক্ষে বেশি সুবিধাজনক হতে পারে, অথবা ইউক্রেনের সর্বোচ্চ দাবিকে (Maximalist War Aims) পূরণ নাও করতে পারে। ইউক্রেন তার ২০১৪ সালের আগের সমস্ত ভূখণ্ড পুনরুদ্ধার করতে চায়, যা বাস্তবতা বিবেচনায় বেশ কঠিন দেখাচ্ছে। ইউক্রেনের এই উদ্বেগকে আরো উসকে দিয়েছে জেডি ভ্যান্স (J.D. Vance)-এর একটি সাক্ষাৎকার। তিনি সেপ্টেম্বরে ‘শোন রায়ান শো’ (Sean Ryan Show)-তে বলেছিলেন, যুদ্ধ শেষ করতে বর্তমান ফ্রন্টলাইন বরাবর একটি ডিমিলিটারাইজড জোন (Demilitarised Zone) গড়ে তোলা হতে পারে। সেইসাথে ইউক্রেনকে নিরপেক্ষ রাষ্ট্রে (Neutral State) পরিণত করার কথা উল্লেখ করেন, যেখানে ইউক্রেন ন্যাটোতে যোগ দিতে পারবে না।
যদিও এখন ন্যাটো ইতোমধ্যেই ইউক্রেনের সদস্যপদ প্রক্রিয়া শুরু করেছে, আর ইউক্রেনের দৃষ্টিতে ভবিষ্যতে রাশিয়ান আগ্রাসন ঠেকানোর সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো ন্যাটো সদস্যপদ নিশ্চিত করা। তবু ট্রাম্প যদি সামরিক সহায়তা বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দেন, তবে ইউক্রেনকে কোনো আপসচুক্তিতে যেতে বাধ্যও করতে পারেন, যেমন তার প্রথম মেয়াদে তিনি সহায়তা আটকে দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। এটি তখনই সম্ভব হবে, যদি অন্য ন্যাটো মিত্ররা একযোগে সহায়তা বাড়িয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ঘাটতি পূরণ না করে বা ইউক্রেন একাই যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার মতো অবস্থান না নেয়।
অন্যদিকে, রাশিয়াও (Kremlin) ট্রাম্পের এই “দ্রুত শান্তি সমাধান” নিয়ে খুব উৎসাহ দেখাচ্ছে না। ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ (Dmitry Peskov) বলেছেন, ট্রাম্পের এই পরিকল্পনা “কল্পনার রাজ্যে” (Realm of Fantasy) অবস্থান করছে। আর জেডি ভ্যান্সের প্রস্তাবিত সমাধান রাশিয়ার পক্ষে কিছুটা ভালো মনে হলেও, এটি পুতিনের (Putin) সর্বোচ্চ দাবির (Maximalist War Aims) কাছাকাছি নয়। ২০২২ সালে রাশিয়া লুহানস্ক (Luhansk), দোনেস্ক (Donetsk), খেরসন (Kherson) ও জাপোরিঝিয়া (Zaporizhzhia) – এই চারটি ওব্লাস্ট (Oblast) সংযুক্ত করে নেওয়ার দাবি জানিয়েছে। এখনো রাশিয়া ডোনেস্ক, খেরসন বা জাপোরিঝিয়ার পুরো এলাকা নিয়ন্ত্রণ করে না, তাই বর্তমান ফ্রন্টলাইন বরাবর যুদ্ধ “ফ্রিজ” (Freeze) করলে পুতিনের ঘোষিত লক্ষ্য পূরণ হবে না, বিশেষত যদি কোনো বাফার জোন (Buffer Zone) তৈরি হয়।
রাশিয়া যদি ট্রাম্পের সম্ভাব্য “দ্রুত শান্তিচুক্তি” প্রত্যাখ্যান করে, তাহলে ট্রাম্প কীভাবে সাড়া দেবেন সেটিও একটি প্রশ্ন। অনেকে মনে করেন, তিনি পুতিনকে (Putin) ছাড় দেবেন। তবে ২০২৩ সালে ফক্স নিউজকে (Fox News) দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ট্রাম্প নিজেই বলেছেন, যদি রাশিয়া চুক্তিতে রাজি না হয়, তিনি ইউক্রেনকে অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে “আরো বেশি” সহায়তা দেবেন যাতে রাশিয়া মেনে নিতে বাধ্য হয়।
ন্যাটো (NATO) প্রসঙ্গ
ট্রাম্পের ন্যাটো-সংক্রান্ত অবস্থানও সম্ভবত আগের মেয়াদের মতোই থেকে যাবে, তবে আরো চরমভাবে। তিনি একাধিকবার বলেছেন, অন্য ন্যাটো সদস্য দেশগুলোকে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হবে, অন্যথায় যুক্তরাষ্ট্র তাদের রক্ষা করবে না। এই অবস্থান ন্যাটোর অনুচ্ছেদ ৫ (Article 5) সম্পর্কে সংশয় সৃষ্টি করতে পারে। অনুচ্ছেদ ৫ অনুযায়ী, কোনো সদস্য রাষ্ট্র আক্রান্ত হলে বাকি সব সদস্য রাষ্ট্র মিলে তাকে রক্ষা করবে। কিন্তু ট্রাম্প সরাসরি জানিয়েছেন, যে দেশ “পর্যাপ্ত অর্থ ব্যয় করবে না” তাকে সুরক্ষা দানে তিনি অনিচ্ছুক।
ট্রাম্পের অর্থনৈতিক নীতি: শুল্ক (Tariff) ও তার প্রভাব
ট্রাম্প আবারও ইউরোপীয় ইউনিয়নের ওপর শুল্ক আরোপের কথা বলেছেন। প্রথম মেয়াদে তিনি কিছু শুল্ক আরোপ করলেও সেগুলো তার ২০১৬ সালের নির্বাচনী প্রচারের ভাষণের তুলনায় বেশ “নরম” ছিল। তবে এবার তিনি যুক্তরাষ্ট্রে আসা সমস্ত পণ্যে ১০% বা ২০% হারে ফ্ল্যাট শুল্ক (Flat Tariff) আরোপের কথাও ভাবছেন। উল্লেখ্য, ফ্ল্যাট শুল্ক (Flat Tariff) হলো একটি নির্দিষ্ট হারের শুল্ক যা কোনো পণ্যের আমদানি বা রপ্তানির ক্ষেত্রে ধার্য করা হয়, পণ্যের ধরন, মূল্য, বা উৎসদেশ নির্বিশেষে। এর মূল বৈশিষ্ট্য হলো এটি একটি অভিন্ন হার (fixed rate) হিসেবে কাজ করে, যেখানে সব পণ্য একই হারে শুল্কের আওতায় পড়ে। যাই হোক, কিছুদিন আগে তিনি ইউরোপীয় ইউনিয়নকে চীনের (China) মতো উল্লেখ করে বলেন, এ দুটো বড় বাণিজ্য উদ্বৃত্ত (Trade Surplus) পরিচালনা করছে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে।
লন্ডন স্কুল অব ইকনমিকস (LSE – London School of Economics)-এর গবেষণায় দেখা গেছে, এসব শুল্ক ইউরোপীয় অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে, তবে চীন বা এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় ইউরোপ অপেক্ষাকৃত কম ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তবে যেসব দেশ যুক্তরাষ্ট্রে বেশি পণ্য রপ্তানি করে, যেমন জার্মানি (Germany), তারা বেশি সমস্যায় পড়বে।
দীর্ঘমেয়াদে আরেকটি উদ্বেগের বিষয় হলো, এসব শুল্ক ইউরোপের চলমান শিল্প-হ্রাস বা বিশিল্পায়ন (Deindustrialization) প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করতে পারে। কারণ বিভিন্ন কোম্পানি হয়তো যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে শুল্কমুক্ত পণ্য বিক্রি করতে আমেরিকাতেই কারখানা স্থানান্তর করে ফেলতে পারে। ফলে ইউরোপের অনেক শিল্পপ্রতিষ্ঠান প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়তে পারে।
ইউরোপের সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া
ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে ইউরোপ কীভাবে সাড়া দেবে, সেটি বড় প্রশ্ন। এখানে মূলত তিনটি ভিন্ন ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি উঠে আসতে পারে।
- আশাবাদী (Optimistic) দৃষ্টিভঙ্গি: কিছু বিশ্লেষক, বিশেষ করে মুজতবা রহমান (Mujtaba Rahman) ‘পলিটিকো’ (Politico)-তে একটি বিতর্কিত লেখায় উল্লেখ করেছেন, দ্বিতীয় ট্রাম্প প্রেসিডেন্সি ইউরোপের জন্য ইতিবাচকও হতে পারে। কারণ এতে ইইউকে (EU) প্রতিরক্ষা, নিরাপত্তা ও অর্থনীতিতে বেশি সহযোগিতা এবং আরো দৃঢ় ব্যবস্থা নিতে বাধ্য করবে। ফ্রান্স (France) দীর্ঘদিন ধরে চেয়েছে যে ইউরোপ যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে স্বয়ংসম্পূর্ণ হোক, যা শুরু করেছিলেন শার্ল দ্য গল (De Gaulle)। ট্রাম্প দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় এলে সেই স্বয়ংসম্পূর্ণতার প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হতে পারে।
- নিরপেক্ষ (Neutral) দৃষ্টিভঙ্গি: আরেকটি সম্ভাবনা হলো, ইইউ আগের মতোই চলবে; তারা ট্রাম্পকে বিরক্ত না করে যতটা সম্ভব সম্পর্ক ঠিকঠাক রাখার চেষ্টা করবে। ২০১৬-২০ মেয়াদে যেমন তারা ক্ষতি নিয়ন্ত্রণে (Damage Control) ব্যস্ত ছিল, এবারও তেমনটাই করা হতে পারে। তারা হয়তো আশা করবে, এরপর যেকোনো নতুন নির্বাচনে আবারো যুক্তরাষ্ট্রে ইউরোপপন্থী (Atlantist) কোনো প্রেসিডেন্ট আসবেন – যেমন ২০২০ সালে বাইডেন (Biden) এসেছিলেন।
- হতাশাবাদী (Pessimistic) দৃষ্টিভঙ্গি: সবচেয়ে খারাপ দৃষ্টিভঙ্গিতে, দ্বিতীয় ট্রাম্প মেয়াদে ইউরোপে বিভাজন বাড়তে পারে। কারণ ভিক্টর অরবান (Viktor Orbán), গের্ট ভিল্ডার্স (Geert Wilders), জর্জিয়া মেলোনি (Giorgia Meloni) প্রমুখ ইউরোপীয় নেতারা অনেকাংশে ট্রাম্পের রাজনীতির সাথে একমত। আগের মেয়াদে ইইউ মোটামুটি ঐক্যবদ্ধ ছিল, কিন্তু এবারে এই “ট্রাম্পপন্থী” (Pro-Trump) গোষ্ঠী আরো বড় হয়ে যাওয়ায় ইউরোপের অভ্যন্তরীণ ঐক্য রক্ষা করা কঠিন হতে পারে।
উপসংহার
ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদ ইউরোপের জন্য এক নতুন চ্যালেঞ্জ হিসাবে আবির্ভূত হতে পারে। তার বৈদেশিক নীতি, বিশেষ করে ইউক্রেন ও ন্যাটো বিষয়ে, ইউরোপকে সুরক্ষা ও কূটনৈতিক বিন্যাস নতুনভাবে ভাবতে বাধ্য করবে। একইভাবে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে শুল্ক আরোপের ফলে ইউরোপের কিছু বড় রপ্তানিকারক দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, আবার দীর্ঘমেয়াদে শিল্প-কারখানা স্থানান্তর বেড়ে যেতে পারে।
সর্বোপরি, ইউরোপের ভাগ্য অনেকটাই নির্ভর করবে ইউরোপীয় দেশগুলো কেমন করে সম্মিলিতভাবে সিদ্ধান্ত নেয় বা নেয় না তার ওপর। এটি একই সাথে সুযোগ ও হুমকি নিয়ে আসছে—কেউ কেউ মনে করেন, দ্বিতীয় ট্রাম্প প্রেসিডেন্সি ইইউকে ঐক্যবদ্ধ ও শক্তিশালী করে তুলতে পারে, আবার অনেকে শঙ্কা করেন যে এটি ইউরোপকে আরো বিভক্ত করবে। এখন দেখার বিষয়, সময়ের সাথে ইউরোপ ঠিক কোন পথে হাঁটে।
তথ্যসূত্র
Trump comments on plan for Ukraine https://www.aljazeera.com/news/2024/9/17/whats-donald-trumps-plan-to-end-russias-war-on-ukraine
JD Vance comments on plan for Ukraine https://www.aljazeera.com/news/2024/9/17/whats-donald-trumps-plan-to-end-russias-war-on-ukraine
Peskov response to Trump plan https://www.aljazeera.com/news/2024/9/17/whats-donald-trumps-plan-to-end-russias-war-on-ukraine
Trump’s threat to quit NATO https://www.politico.eu/article/donald-trump-says-he-wont-quit-nato-if-europe-pays-its-way/
Trump’s comments on not defending NATO members who don’t pay 2% https://edition.cnn.com/2024/02/10/politics/trump-russia-nato/index.html
Trump interview with Bloomberg transcript https://www.bloomberg.com/features/2024-trump-interview-transcript/
LSE research on impact of Trump tariffs https://www.lse.ac.uk/granthaminstitute/publication/the-economic-impacts-of-trumps-tariff-proposals-on-europe/
Mujahtba Rahman piece on why Trump could be good for Europe https://www.politico.eu/article/europe-hope-donald-trump-victory-nato-defense-security-debt/
ট্রাম্পের অর্থনৈতিক পরিকল্পনাগুলো এবং এগুলো যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিকে যেভাবে রূপান্তরিত হতে পারে (২ নভেম্বর, ২০২৪)
ট্রাম্পের অর্থনৈতিক রূপরেখা
ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক ইতিহাসে সবচেয়ে “অস্বাভাবিক” (unorthodox) অর্থনৈতিক নীতি (economic policy) উপস্থাপন করেছেন বলে বিশ্লেষকেরা মনে করছেন। এই আর্টিকেলে আমরা ট্রাম্পের প্রস্তাবিত “বন্য” (wild) অর্থনৈতিক নীতি ও পরিকল্পনাগুলোকে ঘনিষ্ঠভাবে বিশ্লেষণ করব এবং সেগুলো বাস্তবায়িত হলে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে ও বিশ্ব অর্থনীতিতে ঠিক কী প্রভাব ফেলতে পারে তা জানার চেষ্টা করব।
উল্লেখ্য, এখানে ট্রাম্প যা বলছেন সেটির ওপরই আমরা আলোকপাত করছি। বাস্তবে, প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতায় গেলে তিনি হয়তো তার চরম কিছু নীতি বাদ দেবেন, কিংবা কংগ্রেস (Congress) সেগুলো আটকে দিতে পারে। তা সত্ত্বেও, তার দেওয়া বক্তব্যই এখানে আমরা মূল ভিত্তি হিসেবে নিচ্ছি।
ট্রাম্পের সাম্প্রতিক বক্তৃতা ও বিবৃতি অনুযায়ী তার অর্থনৈতিক রূপরেখা মোটের ওপর দুই ধরনের নীতিকে গুরুত্ব দেয় (১ ও ২ নম্বর), তবে তবে এই দুটো ছাড়াও তার ও তার উপদেষ্টাদের কথাবার্তায় আরও ৩টি থিম (themes) বারবার উঠে এসেছে (৩ থেকে ৫ নম্বর)। এগুলো হচ্ছে —
- ১. আমদানির ওপর আরও বেশি শুল্ক (tariffs) আরোপ
- ২. কর (taxes) কমানো
- ৩. ডলার দুর্বল করা
- ৪. কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বায়ত্তশাসন কমানো
- ৫. ক্রিপ্টো-কারেন্সি-পন্থী নীতি
১. শুল্ক বৃদ্ধির পরিকল্পনা
ট্রাম্প যে শুল্ক পছন্দ করেন, তা স্পষ্ট। প্রথম মেয়াদে ট্রাম্প যথেষ্ট শুল্কমুখী ছিলেন। তার ধারণা, শুল্ক আরোপ করলে মার্কিন উৎপাদনকারী (American manufacturers) প্রতিষ্ঠানগুলো সুরক্ষা পাবে এবং আমেরিকার দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ঘাটতি (bilateral trade deficits) কমবে। তবে এবার তিনি যে ধরনের শুল্ক আরোপের কথা বলছেন, তা অভূতপূর্ব –
- চীনা পণ্যে ফ্ল্যাট শুল্ক: ট্রাম্প চীনা পণ্যের ওপর উচ্চহারে “ফ্ল্যাট শুল্ক” বসানোর প্রস্তাব করেছেন। হারের বিষয়ে তিনি স্পষ্ট করে কিছু বলেননি। কোনো কোনো বক্তব্যে তিনি ৫০%, ৬০% বা তার বেশি হারেও শুল্ক আরোপের কথা বলেছেন। “দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট” (The Washington Post) প্রথমে জানায়, তিনি ৬০% হারের কথা ভাবছেন। পরে ট্রাম্প দুবার তা অস্বীকার করে বলেছেন, এটি হয়তো ৫০% হতে পারে। আবার অন্য সাক্ষাৎকারে বলেছেন, “হয়তো ৬০% এর বেশি” হতে পারে। অর্থাৎ, সুনির্দিষ্ট সংখ্যা নিশ্চিত নয়। তবে যেটাই হোক, এত বড় মাপের শুল্ক আরোপ আধুনিককালে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য প্রবাহের এক বিরাট রদবদল তৈরি করতে পারে।
- চীনা বৈদ্যুতিক গাড়িতে (EV) অতিরিক্ত শুল্ক: ট্রাম্প বাইডেন (Biden) প্রশাসন যে চীনা পণ্যের ওপর শুল্ক আরোপ করেছে, বিশেষ করে জ্বালানি রূপান্তর (energy transition)-সংশ্লিষ্ট পণ্যে, সেগুলো আরও বাড়াতে চান। উদাহরণস্বরূপ, চীনা বৈদ্যুতিক গাড়ির (EV) ওপরে এখন ১০০% শুল্ক বিদ্যমান; ট্রাম্প এটি ২০০%-এ তুলতে চান।
- সর্বব্যাপী ১০% থেকে ৫০% শুল্ক: ট্রাম্প আরও বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে আমদানি হওয়া প্রায় “সব ধরনের” পণ্যের ওপর সমান হারে একটি ফ্ল্যাট শুল্ক (flat tariff) বসানো হবে। এক্ষেত্রে সব আমদানি পণ্যের ওপর অন্তত ১০% ফ্ল্যাট শুল্ক আরোপ করা হবে, এমনকি সেগুলো এমনকি ইউরোপীয় ইউনিয়ন (EU)-এর মতো মিত্র দেশ থেকে এলেও। “আমরা স্কটল্যান্ড ও জার্মানিকে (Germany) ভালোবাসি, কিন্তু বাকিরা আমাদের সহিংসভাবে (violently) আচরণ করে”—এই ভাষায় তিনি ইউরোপীয় ইউনিয়নকে এক প্রকার “চীনা” শত্রুর সঙ্গে তুলনা করেছেন। বেশির ভাগ সময়ই তিনি এ হার ১০% বলেই উল্লেখ করেছেন। তবে কিছু বক্তব্যে ২০% এবং আরও সাম্প্রতিক এক বক্তৃতায় ৫০% পর্যন্ত শুল্কের কথা বলেছেন।
এ থেকে স্পষ্ট, ট্রাম্পের কাছে শুল্ক একটা বড় হাতিয়ার, যা তিনি প্রয়োজনে মিত্র বা প্রতিপক্ষ—সবাইকে মোকাবেলা করার জন্যই ব্যবহার করতে প্রস্তুত।
২. কর কমানোর প্রস্তাব
শুল্ক বাড়ানোর পাশাপাশি ট্রাম্প কর কমানোকে (tax cuts) খুবই গুরুত্ব দিচ্ছেন। রিপাবলিকান (Republican) হিসেবে ট্রাম্পের অবস্থান বরাবরই কম করের পক্ষে। ট্রাম্পের যুক্তি, কর কমানো অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে (economic growth) ত্বরান্বিত করে এবং এটিই তাকে অতীতে জনপ্রিয় করেছে।
২০১৭ সালের করছাড় আইন (Tax Cuts and Jobs Act) বাড়ানো: ২০১৭ সালে পাস হওয়া “ট্যাক্স কাটস অ্যান্ড জবস অ্যাক্ট” (Tax Cuts and Jobs Act)-এর মেয়াদ ২০২৫ সালের শেষ নাগাদ শেষ হওয়ার কথা। ট্রাম্প এটিকে বাড়ানোর কথা বলেছেন।
করপোরেট ট্যাক্স কমানো: তিনি করপোরেট ট্যাক্স (corporation tax) ২০% বা ১৫%-এ নামিয়ে আনার পরিকল্পনা করছেন। ২০১৭ সালে তিনি এটি ৩৫% থেকে ২১%-এ নামিয়ে এনেছিলেন। এখন এটি আরও নামানো তার অন্যতম লক্ষ্য।
আয়কর বাতিল ও “সুপার হাই ট্যারিফ” দিয়ে পূরণ: অবশ্য এখানেই শেষ নয়। জুন মাসে কংগ্রেসনাল রিপাবলিকানদের (congressional Republicans) সঙ্গে বৈঠকে তিনি এক ধাপ এগিয়ে বলেছেন, আয়কর (income tax) পুরোপুরি তুলে দেওয়া যেতে পারে এবং শুল্ক অত্যন্ত বাড়িয়ে সেই ঘাটতি পূরণ করা যেতে পারে। এরপর জো রোগান (Joe Rogan)-এর অনুষ্ঠানে এসেও তিনি একই কথা নতুন করে জোর দিয়ে বলেছেন। এক্ষেত্রে তিনি ১৮৯৭ থেকে ১৯০১ পর্যন্ত দায়িত্ব পালনকারী প্রেসিডেন্ট উইলিয়াম ম্যাককিনলির (William McKinley) উদাহরণ টেনেছেন। উল্লেখ্য, ১৮৯৭ সালের “ডিংলে অ্যাক্ট” (Dingley Act) আমদানি শুল্ককে (import duty) ৫০%-এর ওপরে নিয়ে গিয়েছিল, যাতে সরকার আয়কর ছাড়াই রাজস্ব ঘাটতি পূরণ করতে পারে। ট্রাম্পের মতে, ম্যাককিনলি যেটা করেছিলেন, সেটি বর্তমান সময়ে আবার করা যায়। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে সুপার হাই ট্যারিফ দিয়ে আয়কর বাতিলের এই নীতিটির বাস্তবায়ন বাস্তবে কতটা সম্ভব সেটা। আজকের দিনে এসে এটি প্রায় “অসম্ভব” বলে অর্থনীতিবিদেরা মনে করেন। কারণ, ২০২৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র প্রায় ৩ ট্রিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করেছে এবং একই বছরে প্রায় ২ ট্রিলিয়ন ডলার রাজস্ব এসেছে আয়কর খাত থেকে। আয়কর পুরোপুরি তুলতে চাইলে ওই ২ ট্রিলিয়ন ডলারের ঘাটতি সামলাতে “গড়ে” কমপক্ষে ৬৭% শুল্ক বসাতে হবে! তাছাড়া শুল্ক হার যতই বাড়বে, আমদানি ওই অনুপাতে কমতে থাকবে, ফলে শুল্ক আয়ও প্রত্যাশিত মাত্রায় পৌঁছাবে না।
৩. ডলার দুর্বল করা
যুক্তরাষ্ট্রের ডলার (US dollar) বিশ্বের রিজার্ভ মুদ্রা (reserve currency)। ফলে স্বাভাবিকভাবেই ডলারের চাহিদা বেশি, আর এ কারণে ডলারের মান তুলনামূলকভাবে শক্তিশালী থাকে। ঐতিহ্যগতভাবে মার্কিন নীতিনির্ধারকরা এটাকে ভালোই মনে করেছেন; কারণ এতে আমেরিকানরা বেশ সস্তায় আমদানি করতে পারে, আর সরকারও সহজে ঋণ নিতে পারে।
কিন্তু সাম্প্রতিককালে “ট্রাম্পপন্থী” রিপাবলিকানদের মধ্যে এক ধরনের তত্ত্ব জন্ম নিয়েছে যে ডলারের শক্তিশালী অবস্থানই (strong dollar) যুক্তরাষ্ট্রের শিল্পায়ন (industrialization) ব্যাহত করছে, কারণ রপ্তানিতে (exports) অসুবিধা হয়। ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ সহযোগী—উপ-রাষ্ট্রপতি প্রার্থী জে.ডি. ভ্যান্স (JD Vance) এবং অর্থনৈতিক উপদেষ্টা রবার্ট লাইটহাইজার (Robert Lighthizer) সক্রিয়ভাবে ডলার দুর্বল করার কথা বলছেন।
- কীভাবে দুর্বল করবেন?: ডলার বিশ্বের অন্যতম ফ্রিলি ট্রেডেড (freely traded) রিজার্ভ মুদ্রা, যেখানে মূলত বাজার নিজেই বিনিময় হার (exchange rate) নির্ধারণ করে। তাই সাধারণ পদ্ধতিতে পুঁজি নিয়ন্ত্রণ (capital controls) বা সরকারি হস্তক্ষেপ করে ডলারের দাম কমানো খুব কঠিন। ১৯৮৫ সালের “প্লাজা অ্যাকর্ড” (Plaza Accords)-এর উদাহরণ টেনে লাইটহাইজার বলছেন, মিত্রদেশগুলোর সঙ্গে “বৃহৎ সমঝোতা” করা যেতে পারে, যাতে তারা সম্মিলিতভাবে ডলারের মান কমাতে সাহায্য করে। কিন্তু সেই চুক্তিটিও সাময়িক ফল দিয়েছিল এবং তখনকার জাপান (Japan) ও ইউরোপ (Europe) ছিল ঘনিষ্ঠ মার্কিন মিত্র।
- সুদহার (interest rate) কমানো
ডলার দুর্বল করার আরেকটি উপায় হতে পারে সুদহার ব্যাপকভাবে নামিয়ে দেওয়া। কিন্তু এখনকার নিয়মে ফেডারেল রিজার্ভ (Federal Reserve) বা ফেড স্বতন্ত্রভাবে (operationally independent) এই সিদ্ধান্ত নেয়, যা সরাসরি সরকারের আওতায় নেই।
বিস্তারিত জানতে পড়ুন – কেন ট্রাম্প ডলারের মূল্য কমাতে চান?
৪. কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বায়ত্তশাসন কমানো
বর্তমানে ফেডারেল রিজার্ভ (Fed) হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক, যার কার্যক্রমে সরকার সরাসরি হস্তক্ষেপ করতে পারে না। বেশিরভাগ আধুনিক অর্থনীতিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতাকে অপরিহার্য মনে করা হয়, কারণ রাজনৈতিক নেতৃত্ব প্রায়ই “মূল্যস্ফীতি-পন্থী” (pro-inflationary) চাপে থাকে। ফলে তারা সহজে সুদের হার (interest rate) বাড়াতে চায় না, যা মূল্যস্ফীতিকে (inflation) বাড়িয়ে তুলতে পারে।
২০২৪ সালের এপ্রিলে “ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল” (Wall Street Journal) জানায়, ট্রাম্পের উপদেষ্টারা এমন কিছু ব্যবস্থা নিতে চাইছেন, যাতে ট্রাম্প সরাসরি মুদ্রানীতিতে (monetary policy) প্রভাব ফেলতে পারেন। যেমন, ফেডের সুদের হার নির্ধারক কমিটিতে (rate-setting committee) প্রেসিডেন্টের জন্য একটি বিশেষ আসন তৈরি করা, অথবা বর্তমান ফেড চেয়ার জেরোম পাওয়েলকে (Jerome Powell) সরিয়ে দিয়ে আরও বাধ্যকারী কাউকে বসানো।
২০১৭ সালে ট্রাম্পই প্রথম জেরোম পাওয়েলকে নিয়োগ দিয়েছিলেন। কিন্তু ট্রাম্প তখনই প্রকাশ্যে পাওয়েলের ওপর অসন্তোষ জানিয়েছিলেন, কারণ পাওয়েল সুদের হার কমাতে নারাজ ছিলেন। এমনকি মহামারির (pandemic) প্রথম দিকে ট্রাম্প তাকে নিচের পদে নামিয়ে দেওয়ার (demote) কথা ভেবেছিলেন। তবে আইনগতভাবে প্রেসিডেন্টের এমন ক্ষমতা আছে কি না, তা স্পষ্ট নয়।
সাম্প্রতিক ব্লুমবার্গ (Bloomberg) সাক্ষাৎকারে ট্রাম্প বলেছেন, তিনি পাওয়েলকে মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে সরাতে চান না। তবে বাস্তবে ক্ষমতায় গিয়ে যদি ট্রাম্প তার অন্য নীতি—যেমন উচ্চ শুল্ক, দুর্বল ডলার— বাস্তবায়ন করতে যান, সেক্ষেত্রে মূল্যস্ফীতি বাড়ার আশঙ্কা থাকবে। ফেড সেটা নিয়ন্ত্রণ করতে সুদের হার বাড়ালে ট্রাম্পের সঙ্গে সংঘাত চরমে পৌঁছতে পারে।
৫. ক্রিপ্টো-কারেন্সি-পন্থী নীতি
ডোনাল্ড ট্রাম্প, ২০১৬ থেকে ২০২০ পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ছিলেন, কিন্তু তার ক্রিপ্টোকারেন্সি সম্পর্কিত দৃষ্টিভঙ্গি ২০২১ সাল থেকে পরিবর্তিত হয়েছে। আগে তিনি ক্রিপ্টোকারেন্সির প্রতি নেতিবাচক মনোভাব পোষণ করতেন, কিন্তু এখন তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে “বিশ্বের ক্রিপ্টো রাজধানী” হিসেবে গড়ে তোলার কথা বলছেন। তার নতুন দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী, তিনি বিটকয়েনকে “চাঁদে পাঠাতে” চান এবং ফেডারেল রিজার্ভকে বিটকয়েন রিজার্ভ রাখতে বলেন। তিনি এমনকি এসইসি (SEC) চেয়ার গ্যারি গেন্সলারকে বরখাস্ত করার হুমকি দিয়েছেন এবং জাতীয় ঋণ ক্রিপ্টো দিয়ে শোধ করার ইঙ্গিত দিয়েছেন।
ট্রাম্পের ক্রিপ্টো নীতির মধ্যে তিনটি প্রধান প্রস্তাব রয়েছে: প্রথমত, তিনি এসইসি চেয়ার গ্যারি গেন্সলারকে বরখাস্ত করতে চান এবং ক্রিপ্টো-বান্ধব এসইসি চেয়ার বসাতে চান। দ্বিতীয়ত, তিনি ফেডারেল রিজার্ভকে বিটকয়েনকে রিজার্ভ অ্যাসেট হিসেবে সংরক্ষণ করতে বলেন। তৃতীয়ত, তিনি যুক্তরাষ্ট্রে সেন্ট্রাল ব্যাংক ডিজিটাল কারেন্সি (CBDC) বাস্তবায়ন বন্ধ করতে চান, কারণ তিনি মনে করেন যে এটি বিকেন্দ্রীকৃত ক্রিপ্টোকারেন্সির জন্য হুমকি হতে পারে। এই পরিকল্পনাগুলো যদি বাস্তবায়িত হয়, তবে বিটকয়েনের দাম অনেক বাড়তে পারে এবং মার্কিন অর্থনীতি ও বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রভাবের ক্ষেত্রেও পরিবর্তন আসতে পারে।
তবে ট্রাম্পের এই পরিকল্পনাগুলি বাস্তবায়নের পথে বড় বাধা রয়েছে। মার্কিন আর্থিক নীতিতে বিটকয়েন এবং অন্যান্য ক্রিপ্টোকারেন্সির ব্যাপকতা বৃদ্ধি পেলে, ডলারের রিজার্ভ স্ট্যাটাস ক্ষুণ্ণ হতে পারে। ডলার এখনও বিশ্বের প্রধান রিজার্ভ কারেন্সি, এবং যদি ক্রিপ্টোকারেন্সি সরকারি সমর্থন পায়, তবে এটি বৈশ্বিক আর্থিক ব্যবস্থার ওপর প্রভাব ফেলতে পারে। রিপাবলিকান পার্টির মধ্যে এ ব্যাপারে মতপার্থক্য রয়েছে, এবং কংগ্রেস ও অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সমর্থন পেতে হবে। ট্রাম্পের এই “ক্রিপ্টো-উচ্ছ্বাস” বাস্তবায়িত হলে বৈশ্বিক অর্থনীতি বদলে যেতে পারে, তবে তার জন্য অনেক রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে।
বিস্তারিত জানতে পড়ুন – কেন ট্রাম্পের ক্রিপ্টো পরিকল্পনাগুলো ডলারকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে?
সম্ভাব্য প্রভাব: তিনটি বড় প্রভাব
ট্রাম্পের এই অর্থনৈতিক পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়িত হলে বিভিন্ন রকমের ক্ষতির সম্ভাবনা রয়েছে। যেমন এর ফলে বিশ্ব অর্থনীতিতে অনিশ্চয়তা বাড়বে, কারণ এত বড় আকারে শুল্ক আরোপ ও ডলারের নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা সাম্প্রতিক ইতিহাসে দেখা যায়নি। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতি, কর ব্যবস্থায় অস্থিরতা ইত্যাদি নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়বে। সেই সাথে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন হলে তা আর্থিক বাজারের আস্থাকে (investor confidence) ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।
এগুলোর মধ্যে কেবল প্রধান দুটো বড় পরিকল্পনা, অর্থাৎ শুল্ক বৃদ্ধি ও কর কমানোর পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলেই আমেরিকান অর্থনীতিতে যে অন্তত তিনটি বড় ধরনের প্রভাব দেখা দেবে, সে বিষয়ে অর্থনীতিবিদদের মধ্যে মোটামুটি ঐকমত্য রয়েছে। এই তিনটি প্রভাব হলো—
- ১. বৈষম্য (inequality) বৃদ্ধি
- ২. মূল্যস্ফীতি (inflation) বৃদ্ধি
- ৩. জাতীয় ঋণের (national debt) বোঝা আরও ভারী হওয়া
নিম্নে প্রতিটি দিক বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হলো।
১. বৈষম্য (Inequality) বৃদ্ধি
ট্রাম্পের কর ছাঁটাইয়ের (tax cuts) পরিকল্পনা আমেরিকায় আয়বৈষম্য বাড়িয়ে দিতে পারে। কারণ দুটি—
- উচ্চ আয়ের ব্যক্তিরা সরাসরি সবচেয়ে বেশি উপকৃত হবে। বিশেষ করে যারা বছরে ৮ লাখ ডলারের বেশি আয় করেন, তারা সর্বাধিক কর ছাড়ের (tax breaks) সুবিধা পাবেন।
- করপোরেট ট্যাক্স কমানো হলে, বড় কোম্পানির মুনাফা বেড়ে যায়। অতীতে দেখা গেছে, এই মুনাফার বেশির ভাগই চলে যায় কোম্পানির নির্বাহী (corporate executives) এবং শেয়ারহোল্ডারদের (shareholders) পকেটে। ২০১৬ সালে ট্রাম্প বলেছিলেন, করপোরেট ট্যাক্স কমালে তা নিম্নআয়ের শ্রমিকদের মজুরি বাড়াবে এবং ভোক্তাদের জন্য সামগ্রিক পণ্যমূল্য কমে আসবে। কিন্তু পরবর্তী সময়ে একাধিক গবেষণা (academic work) দেখিয়েছে যে, এর বেশির ভাগ সুফলই কোম্পানির উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের লাভে পরিণত হয়েছে, শ্রমিকদের মজুরি বা ভোক্তার জন্য পণ্যমূল্যের ওপর খুব বেশি ইতিবাচক প্রভাব পড়েনি।
২. মূল্যস্ফীতি (Inflation) বৃদ্ধি
ট্রাম্পের পরিকল্পনা যুক্তরাষ্ট্রে মূল্যস্ফীতির হারকে বাড়িয়ে তুলতে পারে দুটি কারণে—
- প্রথমত, কর কমানো হলে মানুষের হাতে ক্রয়ক্ষমতা বেড়ে যায়; ফলে ভোগ ব্যয় (consumer spending) বেড়ে যায়। চাহিদা বেড়ে গেলে স্বাভাবিক নিয়মেই পণ্যের দাম বৃদ্ধির দিকে যায়।
- দ্বিতীয়ত, শুল্ক বাড়লে আমদানি করা পণ্যগুলো আরো ব্যয়বহুল হয়ে পড়ে। যেকোনো পণ্য আমদানি করতে গেলে বাড়তি শুল্ক দিতে হবে, কিংবা সেই পণ্য দেশীয়ভাবে উৎপাদন করতে হবে, যা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ব্যয়বহুল।
নিরপেক্ষ গবেষণা প্রতিষ্ঠান পিটারসন ইনস্টিটিউট ফর ইন্টারন্যাশনাল ইকোনমিকস (Peterson Institute for International Economics) অনুমান করেছে যে, ট্রাম্পের এইসব শুল্কনীতির কারণে বর্তমান পরিস্থিতির তুলনায় মূল্যস্ফীতি অতিরিক্ত ০.৫% থেকে ১% পর্যন্ত বেড়ে যেতে পারে। এ হার নির্ভর করবে শুল্কের মাত্রা এবং অন্য দেশগুলো কীভাবে পাল্টা ব্যবস্থা নেয় তার ওপর।
তবে দীর্ঘমেয়াদে কী ঘটবে, তা নিয়ে মতভেদ রয়েছে। মুক্তবাণিজ্যের (free trade) পক্ষে থাকা অর্থনীতিবিদদের মতে, শুল্কের কারণে সুরক্ষাবাদ (protectionism) বাড়বে, ফলে যুক্তরাষ্ট্র অনেক পণ্য উৎপাদনে কখনোই বিশ্ববাজারের মতো দক্ষতা অর্জন করতে পারবে না; তাই দাম স্থায়ীভাবে বেশি থাকবে। অন্যদিকে, সুরক্ষাবাদী (protectionist) অর্থনীতিবিদরা বলছেন, শুরুতে দাম কিছুটা বাড়লেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র স্থানীয় উৎপাদনে সক্ষম হয়ে উঠবে। আর স্থানীয় উৎপাদন বৃদ্ধিতে দেশের অভ্যন্তরে ভালো মানের ও উচ্চ-মজুরির (well-paid) চাকরি তৈরি হবে, এতে অনেক আমেরিকান ভোক্তা মোটের ওপর উপকৃত হবেন।
৩. ঋণ (Debt) বৃদ্ধি
যুক্তরাষ্ট্র ইতিমধ্যেই বিশাল বাজেট ঘাটতি (deficit) এবং মার্কিন জাতীয় ঋণের (national debt) ভারি বোঝা বইছে। কর কমালে স্বাভাবিকভাবেই ফেডারেল সরকারের রাজস্ব (revenue) কমে যাবে, ফলে বাজেট ঘাটতি এবং ঋণের বোঝা বাড়বে। বিশেষ করে যদি আয়কর সম্পূর্ণভাবে তুলে দেওয়ার মতো র্যাডিক্যাল (radical) সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, তাহলে পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা ভাবাই কঠিন।
উদাহরণস্বরূপ, ২০২৩ সালে আমেরিকার মোট আমদানি ছিল প্রায় ৩ ট্রিলিয়ন ডলার। একই বছরে ব্যক্তিগত আয়কর থেকে এসেছে প্রায় ২ ট্রিলিয়ন ডলার। তার মানে, শুধু আয়কর বাতিল করে ওই ঘাটতি (২ ট্রিলিয়ন ডলার) পুষিয়ে নিতে হলে আমদানিকৃত সব পণ্যের ওপর গড়ে ৬৭% শুল্ক আরোপ করতে হবে। কিন্তু বাস্তবে, শুল্কের হার যত বাড়বে, আমদানি ততই কমবে, ফলে শুল্ক থেকে আয়ও প্রত্যাশিত পরিমাণে উঠবে না।
অর্থাৎ, আয়কর পুরোপুরি বাতিল করলে যুক্তরাষ্ট্রের বাজেট ঘাটতি বিপুলভাবে লাফিয়ে উঠতে পারে। কমিটি ফর রেসপনসিবল ফেডারেল বাজেট (Committee for Responsible Federal Budget) -এর অক্টোবরের শেষের দিকে করা একটি বিশ্লেষণ অনুযায়ী, ট্রাম্পের সামগ্রিক পরিকল্পনা ২০২৫ থেকে ২০২৯ সালের মধ্যে মার্কিন জাতীয় ঋণ প্রায় ৮ ট্রিলিয়ন ডলার পর্যন্ত বাড়িয়ে তুলতে পারে। এটি কমলা হ্যারিসের (Kamala Harris) প্রস্তাবিত নীতিগুলোর কারণে যে পরিমাণ ঋণ বাড়তে পারে তার প্রায় দ্বিগুণ।
ফলে যুক্তরাষ্ট্রের বাৎসরিক বাজেট ঘাটতি, যা বর্তমানে জিডিপির (GDP) প্রায় ৫% বা ১.৫ ট্রিলিয়ন ডলারের সমান, তা প্রায় ১০% বা ৩ ট্রিলিয়ন ডলারে গিয়ে ঠেকবে।
অবশ্য এখানে বড় একটি “ক্যাভিয়াট” (caveat) আছে। ট্রাম্প বলেছেন, ইলন মাস্ক (Elon Musk) একটি নতুন “ডিপার্টমেন্ট অব গভর্নমেন্ট এফিশিয়েন্সি” (Department of Government Efficiency) পরিচালনা করবেন, যার কাজ হবে সরকারী ব্যয় ২ ট্রিলিয়ন ডলার কমিয়ে ফেলা। মাস্ক নিজে দাবি করছেন, তিনি ফেডারেল সরকারের প্রায় ৭ ট্রিলিয়ন ডলারের বার্ষিক বাজেট থেকে ২ ট্রিলিয়ন ডলার কেটে দিতে পারবেন। তবে এটি আদতে বাস্তবায়ন করা সহজ নয়। এর জন্য প্রতিরক্ষা খাত (defense spending) বা সামাজিক নিরাপত্তা (Social Security)-সংক্রান্ত কল্যাণমূলক কর্মসূচিগুলোর বরাদ্দে বড় ধরনের কাটছাঁট প্রয়োজন হতে পারে। ইতিহাস বলে, যিনিই ক্ষমতায় আসুন না কেন, এত বিশাল অঙ্কের সরকারি ব্যয় (government spending) কাটা খুব কঠিন রাজনৈতিক বাধার সম্মুখীন হয়।
উপসংহার
ট্রাম্পের অর্থনৈতিক নীতিগুলো “চরমপন্থী” (unorthodox) হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে, যা তার শুল্কনীতি ও করনীতিতে স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। আমদানি পণ্যের ওপর উচ্চ শুল্ক আরোপ, আয়কর বাতিলের মতো প্রস্তাব কিংবা করপোরেট ট্যাক্স কমিয়ে আনার ভাবনা—এই সব মিলিয়ে তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে একটি ভিন্ন অর্থনৈতিক পথে পরিচালিত করার পরিকল্পনা করছেন। তার মতে, এসব পদক্ষেপ যুক্তরাষ্ট্রের শিল্প পুনর্গঠন, আমদানি নিয়ন্ত্রণ এবং অভ্যন্তরীণ প্রবৃদ্ধি বাড়াতে সহায়ক হবে। তবে, বাস্তবতা হলো, প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতায় গেয়ে তিনি এ ধরনের পরিকল্পনার কতটা বাস্তবায়ন করতে পারবেন, তা কংগ্রেস ও অন্যান্য রাজনৈতিক সীমাবদ্ধতার ওপর নির্ভর করবে। কংগ্রেসে সমর্থন জোগাড় করা বা নির্বাহী ক্ষমতার মাধ্যমে তার পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে কিনা, সেটি একটি বড় প্রশ্ন। আবার, ফেডের স্বাধীনতার সঙ্গে তার নীতির দ্বন্দ্ব তৈরি হলে তা কী প্রভাব ফেলবে, তাও দেখার বিষয়। তার নীতিগুলোর বাস্তবায়ন হলে স্বল্পমেয়াদে আয়বৈষম্য, মূল্যস্ফীতি এবং জাতীয় ঋণ বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা প্রবল, তবে দীর্ঘমেয়াদে যুক্তরাষ্ট্রের স্থানীয় শিল্প-কারখানা ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধি হতে পারে। অনেক অর্থনীতিবিদ মনে করেন, এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা কঠিন হতে পারে, এবং কর-শুল্ক কাঠামোর বড়সড় পরিবর্তনের ফলে বৈশ্বিক সরবরাহ ব্যবস্থা, মুদ্রানীতি এবং বাণিজ্যে ব্যাপক অস্থিরতা সৃষ্টি হতে পারে।
তথ্যসূত্র
1 – https://abcnews.go.com/Business/trump-proposes-eliminating-personal-income-taxes-work/story?id=115217463
2 – https://www.bloomberg.com/features/2024-trump-interview-transcript/
3 – https://www.bloomberg.com/news/articles/2024-02-04/trump-floats-chinese-goods-tariff-of-more-than-60-if-elected
4 – https://www.nber.org/system/files/working_papers/w28680/w28680.pdf
5 – https://economics.yale.edu/sites/default/files/2023-01/The%20Efficiency-Equity%20Tradeoff%20of%20the%20Corporate%20Income%20Tax.pdf
6 – https://www.piie.com/blogs/realtime-economics/2024/how-much-would-trumps-plans-deportations-tariffs-and-fed-damage-us
7 – https://www.theatlantic.com/politics/archive/2024/09/economic-arguments-tariffs-trump/680015/
8 – https://www.piie.com/blogs/realtime-economics/2024/can-trump-replace-income-taxes-tariffs
9 – https://www.crfb.org/papers/fiscal-impact-harris-and-trump-campaign-plans
10 – https://x.com/johnauthers/status/1812400675277426710/photo/1
11 – https://www.bloomberg.com/features/2024-trump-interview-transcript/
12 – https://en.wikipedia.org/wiki/Dingley_Act
13 – https://en.wikipedia.org/wiki/Wilson%E2%80%93Gorman_Tariff_Act
14 – https://www.piie.com/blogs/realtime-economics/2024/can-trump-replace-income-taxes-tariffs
15 – https://x.com/GavinBade/status/1812950510372012246/photo/1
16 – https://x.com/DanielaGabor/status/1812973919542124737
17 – https://www.bloomberg.com/news/articles/2020-03-14/trump-says-no-plans-to-demote-powell-but-asserts-right-to
কেন ট্রাম্পের ক্রিপ্টো পরিকল্পনাগুলো ডলারকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে (৭ অক্টোবর, ২০২৪)
ভূমিকা
ডোনাল্ড ট্রাম্প (Donald Trump) ২০১৬ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত প্রথম মেয়াদে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ছিলেন, কিন্তু তখন তার “ক্রিপ্টো ব্রো (crypto bro)” ভাবমূর্তি ছিল না বললেই চলে। বরং ২০১৯ সালে তিনি টুইটারে লিখেছিলেন, “বিটকয়েন (bitcoin) ও অন্যান্য ক্রিপ্টোকারেন্সি (cryptocurrencies) টাকা নয়; এগুলোর মূল্য ব্যাপকভাবে অস্থিতিশীল এবং ‘thin air’ বা ভিত্তিহীন কোনো কিছুর ওপর দাঁড়িয়ে আছে।” ২০২১ সালে ফক্স বিজনেস (Fox Business)-কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি ক্রিপ্টোকে (crypto) “একটি আসন্ন বিপর্যয়” (a disaster waiting to happen) হিসেবে বর্ণনা করেন, এবং এসইসি (SEC: Securities and Exchange Commission)-কে “খুব, খুব কঠোর” নিয়ন্ত্রণ আরোপ করার পরামর্শ দিয়েছিলেন।
দুই ক্ষেত্রেই তিনি ক্রিপ্টোকে ডলারের (dollar) আধিপত্যের জন্য হুমকি বলে উল্লেখ করেন—ফক্স বিজনেসের কথোপকথনে এটিকে “ডলারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র (scam against the dollar)” আখ্যা দিয়েছিলেন। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে, গত এক বছরে ট্রাম্পের দৃষ্টিভঙ্গি আমূল বদলে গেছে বলে মনে হচ্ছে; এখন তিনি বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রকে “বিশ্বের ক্রিপ্টো রাজধানী (crypto capital of the planet)” বানাতে চান, এবং বিটকয়েনকে (bitcoin) “চাঁদে পাঠাতে (to the moon)” চান! তিনি এমনকি ফেডারেল রিজার্ভ (Fed)-কে বিটকয়েন রিজার্ভ রাখার কথা বলেছেন, এসইসি চেয়ার গ্যারি গেন্সলার (Gary Gensler)-কে বরখাস্ত করার হুমকি দিয়েছেন, আর কোনোভাবে জাতীয় ঋণ (national debt) ক্রিপ্টো দিয়ে শোধ করার ইঙ্গিত দিয়েছেন।
এই নিবন্ধে আমরা ঠিক সেসব “উদ্ভট” (wild) ক্রিপ্টো নীতি (crypto policies) কী, কীভাবে সেগুলো বাস্তবায়িত হলে ডলারের ওপর প্রভাব পড়তে পারে—বিশেষত ডলারের রিজার্ভ কারেন্সি মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হওয়ার আশঙ্কা আছে কি না—সেই বিষয়গুলো বিশদভাবে আলোচনা করব।
ট্রাম্পের তিনটি প্রধান ‘ক্রিপ্টো-ঘনিষ্ঠ’ (crypto-adjacent) নীতি
আমাদের পর্যবেক্ষণে, ট্রাম্পের ক্রিপ্টো-সম্পর্কিত প্রস্তাবসমূহকে তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়:
- এসইসি (SEC) চেয়ার গ্যারি গেন্সলারকে বরখাস্ত (replace Gensler): এসইসি হলো যুক্তরাষ্ট্রে আর্থিক সম্পদ (financial assets) নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা। গ্যারি গেন্সলার এর বর্তমান প্রধান, যিনি গত বছরখানেক ধরে ক্রিপ্টো সম্পদের ওপর ব্যাপক কড়াকড়ি আরোপ করেছেন। ট্রাম্প ওই কঠোর নিয়ম শিথিল করতে চান, তাই হয়তো গেন্সলারকে বরখাস্ত করে “ক্রিপ্টো বান্ধব” (crypto-friendly) কাউকে বসাতে চান।
- নতুন বিটকয়েন রিজার্ভ (bitcoin reserve) গঠন: ট্রাম্প ফেডকে (Federal Reserve) সোনা (gold) রাখার মতোই বিটকয়েনকে এক ধরনের রিজার্ভ অ্যাসেট (reserve asset) হিসেবে সংরক্ষণ করতে বাধ্য করতে চান।
- সেন্ট্রাল ব্যাংক ডিজিটাল কারেন্সি (CBDC) বাস্তবায়ন বন্ধ করা: অর্থাৎ ট্রাম্প চান, মার্কিন ট্রেজারি (Treasury Department) যেন কোনও “ডিজিটাল ডলার” (digital dollar) তৈরি না করে। কারণ অনেক ক্রিপ্টো সমর্থক মনে করেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডিজিটাল মুদ্রা (central bank digital currency) আসলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিকেন্দ্রীভূত (decentralized) ক্রিপ্টোকারেন্সির বিকল্প হিসেবে কাজ করে এবং সেগুলোকে বাজার থেকে হটিয়ে দিতে পারে।
নিম্নে প্রতিটি নীতি-প্রস্তাবের বিস্তারিত ব্যাখ্যা করা হলো।
১) এসইসির সংস্কার ও গ্যারি গেন্সলারকে বরখাস্ত করা
ট্রাম্পের সাম্প্রতিক ক্রিপ্টো-উৎসাহের (crypto enthusiasm) পেছনে বড় চালিকাশক্তি মনে করা হচ্ছে তার এসইসি-সংস্কার পরিকল্পনা। কিছু মাস আগে ২০২৪ সালের বিটকয়েন কনফারেন্সে (Bitcoin conference in Nashville) তিনি মঞ্চে এসে বলেন, “প্রথম দিনই গ্যারি গেন্সলারকে বরখাস্ত করতে চাই।” এতে শোনার সঙ্গে সঙ্গে শ্রোতারা দাঁড়িয়ে উল্লাস করে।
যদিও বাস্তবে “বরখাস্ত করা” কতটা সহজ হবে, সেটি প্রশ্নসাপেক্ষ। এসইসি গঠনের পর থেকে ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট পরিবর্তন হলে সাধারণত এসইসির প্রধানও স্বয়ংক্রিয়ভাবে পাল্টে যান—যেমন, রাজনৈতিক দায়বদ্ধতাও রদবদল হয়। ফলে ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর তার নতুন প্রশাসন স্বাভাবিকভাবেই এসইসির নতুন প্রধান নিয়োগ করতে পারবে। তবে ট্রাম্পের অন্তত কথাবার্তা স্পষ্ট করছে—তিনি এমন কাউকে বসাবেন, যিনি ক্রিপ্টো-বান্ধব।
গ্যারি গেন্সলারের কঠোর অবস্থান: গ্যারি গেন্সলার দায়িত্বে আসার পর থেকে ক্রিপ্টো সম্পদের ওপর নজিরবিহীন কড়াকড়ি আরোপ করেছেন। মূল দ্বন্দ্বের বিষয় হচ্ছে এই যে, ক্রিপ্টোকারেন্সিগুলো সিকিউরিটি (security) হিসেবে গণ্য হবে কি না। আইন অনুযায়ী সিকিউরিটি হল এমন কোনো আর্থিক সম্পদ, যার ওপর এসইসির নিয়ন্ত্রণ প্রযোজ্য। ১৯৪৬ সালের সুপ্রিম কোর্টের একটি রায় (‘Howey test’) অনুসারে যদি কোনো বিনিয়োগের ফলে লাভ (profit) আসে মূলত অন্যের প্রচেষ্টার (efforts of others) ওপর নির্ভর করে, তবে সেটি সিকিউরিটি হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। গেনসলারের এসইসি মনে করে, অন্তত কিছু ক্রিপ্টো অ্যাসেট সেই সংজ্ঞার মধ্যে পড়ে। কিন্তু ক্রিপ্টো সম্প্রদায়ের (crypto bros) বক্তব্য, এগুলোকে স্টক বা বন্ডের মতো দেখা ঠিক নয়; বরং এগুলো নতুন প্রযুক্তি কিংবা ডিজিটাল পণ্য (digital commodity)। এই আইনগত ও দৃষ্টিভঙ্গিগত মতপার্থক্যের জেরে ক্রিপ্টোকারেন্সি কোম্পানিগুলো এসইসির বিধিনিষেধে বিব্রত।
ক্রিপ্টো-বান্ধব এসইসি চেয়ার ও সম্ভাব্য প্রভাব: যদি এসইসির নতুন চেয়ার ক্রিপ্টোর প্রতি সহনশীল হন, তবে হয়তো অনেক ক্রিপ্টোকারেন্সিকে আর “সিকিউরিটি” বলে গণ্য করা হবে না। ফলে সেগুলো কেনা-বেচা (trading) সহজ হবে, মূল্যও (value) বাড়তে পারে। ট্রাম্প নিজেও এর থেকে ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হতে পারেন, কারণ তার সংশ্লিষ্ট “ওয়ার্ল্ড লিবার্টি ফিনানশিয়াল (World Liberty Financial)” নামের একটি ক্রিপ্টো কোম্পানির সাথে তার ও তার পরিবারের নাম জড়িত আছে।
ওয়ার্ল্ড লিবার্টি ফিনানশিয়াল (World Liberty Financial) প্রসঙ্গ: ট্রাম্প সরাসরি এই কোম্পানির মালিক নন, বরং এটি নিবন্ধিত দুই ব্যক্তির মালিকানাধীন। তারা এর আগে ‘Doe Finance’ নামক একটি ব্লকচেইন অ্যাপের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, যেটি সম্প্রতি হ্যাকিং-এর শিকার হয়েছিল। এছাড়া তাদের একজন আগে ইউটিউবে “পিকআপ আর্টিস্ট (pickup artist)” ছিলেন, যার নাম জ্যাক ফোকম্যান (Zack Folkman) ও তিনি একসময় ‘Date Hotter Girls LLC’ নামের প্রতিষ্ঠান চালাতেন। ওয়ার্ল্ড লিবার্টির পরিকল্পনা হলো ক্রিপ্টো টোকেন (crypto tokens) ছাড়া, যার ৭০% সংরক্ষণ থাকবে “ইনসাইডারদের” কাছে—এদের মধ্যে ট্রাম্প ও তার ছেলেরা আছেন। টোকেনগুলো নন-ট্রান্সফারেবল (non-transferable), যাতে এসইসি সিকিউরিটি আখ্যা না দেয়। কিন্তু যদি এসইসির নিয়ন্ত্রণ শিথিল হয়, ট্রাম্প পরিবার হয়তো সহজেই সেগুলো বাজারে বেচে বিপুল অর্থ লাভ করতে পারবেন।
২) ফেডের “স্ট্র্যাটেজিক বিটকয়েন রিজার্ভ” (Strategic Bitcoin Reserve)
ট্রাম্পের দ্বিতীয় প্রস্তাব হলো, যুক্তরাষ্ট্র সরকার যেন বিটকয়েনকে সোনার মতোই (gold-like reserve asset) সংরক্ষণ করে। প্রো-ক্রিপ্টো সিনেটর সিনথিয়া লুমিস (Cynthia Loomis) তার “বিটকয়েন অ্যাক্ট” (Bitcoin Act) নামে একটি বিলের খসড়া উত্থাপন করেছেন, যেখানে যুক্তরাষ্ট্রকে ৫ বছরের মধ্যে ১০ লাখ বা এক মিলিয়ন বিটকয়েন কিনে রিজার্ভে রাখার কথা বলা হয়েছে, এবং অন্তত ২০ বছর তা ধরে রাখার প্রস্তাব রয়েছে।
বর্তমানে ট্রেজারির (Treasury) কাছে আনুমানিক ২ লাখ বিটকয়েন আছে—যেগুলো অবৈধ কার্যক্রম থেকে জব্দ করা হয়েছে। অতিরিক্ত ৮ লাখ বিটকয়েন কিনতে এখনকার বাজারমূল্য অনুযায়ী প্রায় ৫০ বিলিয়ন ডলার লাগতে পারে। তবে সরকারের এমন ঘোষণায় বিটকয়েনের দামই হয়তো আকাশচুম্বী হয়ে যাবে, ফলে প্রকৃত ব্যয় আরও বেড়ে যেতে পারে।
রিজার্ভ অ্যাসেট হিসেবে বিটকয়েন: বিটকয়েনকে সাধারণত রিজার্ভ অ্যাসেট হিসেবে দেখা হয় না—মূলত এর দামের অস্থিতিশীলতার (price volatility) কারণে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র সরকার এভাবে যদি বিটকয়েনের বিশাল ভাণ্ডার কিনতে শুরু করে, তাহলে আর্থিক প্রতিষ্ঠানসহ বিশ্বের অন্য অনেক দেশ হয়তো এটিকে গুরুত্বপূর্ণ রিজার্ভ ধরে নেবে; কারণ তাদের ধারণা হবে, “আমেরিকা নিজে যখন বিশাল বিটকয়েন কিনছে, তখন বাজারে এটিকে সমর্থন দেবে।” এর ফলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিটকয়েনের গ্রহণযোগ্যতা (acceptance) বাড়বে, দামও বাড়তে পারে। যুক্তরাষ্ট্র এত বিশাল ক্রেতা (buyer) হয়ে দাঁড়ালে অন্যরাও আশা করবে যে বিটকয়েনের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল।
ডলারের রিজার্ভ স্ট্যাটাসে প্রভাব: তবে অনেকে শঙ্কা প্রকাশ করছেন, এটি ডলারের রিজার্ভ কারেন্সি মর্যাদাকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। যদি যুক্তরাষ্ট্র সরকার বিটকয়েনকে “সরকারি স্তরে” অনুমোদন দেয়, তাহলে কি ডলারের পরিবর্তে বিটকয়েনের আধিপত্য বাড়বে? কেউ কেউ মনে করেন, ডলার আপাতত নিরাপদ—কারণ বিটকয়েনের বদলে ডলারই ব্যাপক ব্যবহৃত হয়; আবার কেউ মনে করেন, “ডলারের রিজার্ভ স্ট্যাটাস” চিরস্থায়ী কিছু নয়, এবং বিটকয়েনের মাধ্যমেই একদিন তা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে। সরাসরি বলতে গেলে, বিশ্ব রিজার্ভ কারেন্সি ধরে রাখার মতো বিশাল দেশে (যুক্তরাষ্ট্র) আবার একই সঙ্গে বিটকয়েনকে (যা মূলত কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যবস্থার বিপরীতে তৈরি) স্বীকৃতি দেওয়া—এ এক অদ্ভুত দ্বৈরথ বা বৈপরীত্য।
৩) সিবিডিসি (CBDC) চালু করাটাকে বন্ধ করা
ট্রাম্পের তৃতীয় পরিকল্পনা হলো: যুক্তরাষ্ট্র যেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডিজিটাল মুদ্রা (Central Bank Digital Currency, সংক্ষেপে CBDC) তৈরি না করে। ফেডারেল রিজার্ভ বর্তমানে “ডিজিটাল ডলার (digital dollar)” নিয়ে গবেষণা করছে।
কেন CBDC?: সিবিডিসি কাগুজে অর্থের ডিজিটাল সংস্করণ, যেখানে রাষ্ট্র প্রয়োজনে লেনদেনের সব রেকর্ড সহজে ট্র্যাক করতে পারে। ফলে কর ফাঁকি (tax evasion), মানি লন্ডারিং (money laundering), সন্ত্রাসী অর্থায়ন (terrorist financing) মোকাবেলায় রাষ্ট্র কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবে। অর্থনীতির গতিপ্রকৃতি নিয়েও নীতিনির্ধারকেরা বিশদ ডেটা পাবেন।
ক্রিপ্টো সম্প্রদায়ের আপত্তি: বিকেন্দ্রীকৃত ক্রিপ্টো-সমর্থকেরা (decentralized crypto advocates) বিশ্বাস করে, সরকারি ডিজিটাল মুদ্রা এলে স্বাধীন, ব্যক্তি-নিয়ন্ত্রিত ক্রিপ্টোকারেন্সি বাধার মুখে পড়বে। কারণ মানুষ সরকারি ডিজিটাল ডলারের দিকে ঝুঁকতে পারে, যেখানে ঝুঁকিও কম, আইনগত স্বীকৃতিও বেশি। ক্রিপ্টোদের উদ্বেগ হলো, এতে বিটকয়েন বা অন্যান্য বিকেন্দ্রীকৃত টোকেনের বিস্তার আটকে যাবে।
ট্রাম্পের বক্তব্য, তিনি CBDC চালুতে বাধা দিতে চান। একদিকে নিজে বিটকয়েনকে রাষ্ট্রীয় রিজার্ভে যুক্ত করার কথা বলছেন, অন্যদিকে সিবিডিসির সম্ভাবনা খারিজ করে দিচ্ছেন—এতে ক্রিপ্টো সম্প্রদায় খুশি হবে, কারণ তারা প্রতিযোগী রাষ্ট্র-নিয়ন্ত্রিত ডিজিটাল মুদ্রা চায় না।
সম্ভাব্য ফলাফল: ডলারের ওপর প্রভাব ও বাস্তবতা
ট্রাম্প ক্ষমতায় বসার পর তার এই সব “অস্বাভাবিক” (wild) ক্রিপ্টো পরিকল্পনা বাস্তবে বিটকয়েনের দরকে আক্ষরিক অর্থেই “চাঁদে” (to the moon) পাঠাতে পারে এবং তিনি এই ব্যাপারে কংগ্রেসনাল রিপাবলিকানদেরও রাজি করাতে পারেন। তবে মনে রাখা দরকার, ঐতিহ্যগতভাবে রিপাবলিকান পার্টি (Republicans) আর্থিক নীতিতে অনেক বেশি রক্ষণশীল (orthodox) অবস্থান পছন্দ করে, তাই পার্টির ভেতরে সবাই যে ট্রাম্পের এই ক্রিপ্টো নীতিতে একমত হবেন, তা অনিশ্চিত।
এর বাইরে, ডলারের রিজার্ভ স্ট্যাটাস রক্ষা করা যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থের বড় অংশ। আবার, ট্রাম্প নিজেই আগে বলেছিলেন, “ক্রিপ্টো ডলারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র”—এখন উল্টো ক্রিপ্টোকে রাষ্ট্র সমর্থন দিতে গেলে কীভাবে ডলারের মর্যাদাকে অক্ষুণ্ণ রাখা যাবে, সেটি বড় প্রশ্ন।
উপসংহার
সর্বোপরি, ডোনাল্ড ট্রাম্পের ক্রিপ্টো পরিকল্পনাগুলো যথেষ্ট চমকপ্রদ ও রদবদল ঘটাতে পারে। গ্যারি গেন্সলারকে বরখাস্ত করে এসইসির নিয়ম শিথিল করা, ফেডের রিজার্ভে বিপুল পরিমাণ বিটকয়েন যুক্ত করা, সিবিডিসি জন্ম নেবার পথে বাধা সৃষ্টি করা—এই সবকিছুই মার্কিন আর্থিক নীতিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে পারে। বিটকয়েন সহ অন্যান্য ক্রিপ্টোর মূল্য স্ফীত হতে পারে, ট্রাম্প ও তার পরিবারের ব্যক্তি স্বার্থও রক্ষা পেতে পারে।
কিন্তু এর বিরুদ্ধ দিক হলো, ডলারের দীর্ঘকালীন আধিপত্যে ফাটল ধরতে পারে, যা বৈশ্বিক আর্থিক ব্যবস্থার কেন্দ্রে মার্কিন প্রভাবকে ক্ষুণ্ণ করবে কি না, সেই প্রশ্ন তুলবেন অনেকেই—এবং এটা নিয়ে রিপাবলিকান পার্টির মূলধারার মধ্যে বিতর্ক হওয়াও স্বাভাবিক। সত্যি বলতে, কংগ্রেস ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সমর্থন পেতে হবে, যা সহজ পথ নয়। তবু আপাতদৃষ্টিতে দেখা যাচ্ছে, ট্রাম্পের এই “ক্রিপ্টো-উচ্ছ্বাস” বেশ উচ্চাভিলাষী, এবং বাস্তবায়ন সম্ভব হলে বৈশ্বিক অর্থনীতির চালচিত্র অনেকাংশে বদলে দিতে পারে।
তথ্যসূত্র
1 – https://twitter.com/realDonaldTrump/status/1149472282584072192
2 – https://www.nytimes.com/2024/10/02/opinion/donald-trump-crypto-bro.html
3 – https://www.bbc.co.uk/news/business-57392734
4 – https://adamtooze.substack.com/p/chartbook-302-kamala-v-crypto-is
5 – https://www.economist.com/finance-and-economics/2024/08/01/gary-gensler-is-the-most-controversial-man-in-american-finance
6 – https://blogs.law.ox.ac.uk/oblb/blog-post/2024/06/future-cryptocurrency-regulation-lessons-sec-v-coinbase
7 – https://www.ft.com/content/d3c26478-4e51-4c21-9dce-a82ac795048a
8 – https://www.ft.com/content/a80005e6-07a7-4dae-ac34-5c1d98f6d4a4
9 – https://twitter.com/realDonaldTrump/status/1840772362209251611
10 – https://www.coindesk.com/business/2024/09/03/inside-the-trump-crypto-project-linked-to-a-2m-defi-hack-and-former-pick-up-artist/
11 – https://www.youtube.com/watch?v=aEhRSm9aXpo
12 – https://popular.info/p/trump-teams-up-with-pickup-artist
13 – https://www.lummis.senate.gov/press-releases/lummis-introduces-strategic-bitcoin-reserve-legislation/
14 – https://www.lummis.senate.gov/wp-content/uploads/BITCOIN-Act-FINAL.pdf
Leave a Reply