Table of Contents
তুরস্ক কি আবার সিরিয়া আক্রমণ করতে যাচ্ছে? (২১ ডিসেম্বর, ২০২৪)
ভূমিকা
যখন আসাদের (Assad) শাসন প্রশাসন পতনের মুখে পড়ল, তখন এক বড় প্রশ্ন ছিল—সিরিয়ার উত্তর-পূর্বাঞ্চলে যে কার্যত (de facto) কুর্দি রাষ্ট্র গড়ে উঠেছে, তার ভবিষ্যৎ কী হতে পারে। প্রথমদিকে মনে হচ্ছিল, কুর্দিরা নিরাপদ থাকবে। নতুন বিদ্রোহী সরকার (rebel government) বারবার জানিয়েছিল যে তারা সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষা করবে, আর শোনা যাচ্ছিল যে তুরস্কের (Turkey) মদদপুষ্ট বাহিনী এবং কুর্দি বাহিনীর (Kurdish forces) মধ্যে ইউফ্রেটিস (Euphrates) নদীর কাছাকাছি একটি মার্কিন (US) মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতির (ceasefire) সম্ভাবনা রয়েছে।
কিন্তু সাম্প্রতিক কয়েক দিনে, তুরস্ক-সমর্থিত (Turkish proxies) গোষ্ঠীগুলো আবার কুর্দি অবস্থানগুলোর উপর হামলা শুরু করেছে। একই সময়ে, ওয়াল স্ট্রিট জার্নালকে দেওয়া মার্কিন কর্মকর্তাদের বক্তব্য অনুযায়ী, তুরস্ক-সিরিয়া সীমান্তে (Turkish Syria border) তুর্কি সেনাদের সমাবেশ দেখে মনে হচ্ছে যে একটি আক্রমণ খুব দ্রুত শুরু হতে পারে।
এই লেখায় আমরা দেখব—কেন সিরিয়ার উত্তর-পূর্বাঞ্চলে কার্যত গড়ে ওঠা এই কুর্দি রাষ্ট্রের সঙ্গে তুরস্কের দীর্ঘদিনের বিরোধ রয়েছে , কেন তারা আবার এক আক্রমণের পরিকল্পনা করে থাকতে পারে এবং এরপর কী ঘটতে পারে।
সিরিয়া কীভাবে কার্যত দুটি অংশে বিভক্ত হল?
তুরস্ক কেন সিরিয়ায় আক্রমণ করতে চাইছে বলে মনে করা হচ্ছে, তা বুঝতে হলে জানতে হবে—সিরিয়া এখন কার্যত (de facto) দুটি অঞ্চলে বিভক্ত। বিষয়টি হল, ২০১০ সালের শুরুর দিকে সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ (civil war) শুরু হলে, দেশের উত্তরের (north) কুর্দি সংখ্যালঘু (Kurdish minority), যারা বরাবরই বেশি রাজনৈতিক স্বায়ত্তশাসন (political autonomy) চাইত, সুযোগ বুঝে সিরিয়ার উত্তর-পূর্বাঞ্চলে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের ঘোষণা দেয়।
এই রাষ্ট্রের সরকারিভাবে নাম রাখা হয়েছিল অটোনোমাস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন অব নর্থ অ্যান্ড ইস্ট সিরিয়া (Autonomous Administration of North and East Syria), তবে সাধারণভাবে এটি রোজাভা (Rojava) নামেই পরিচিত। রোজাভা (Rojava) আসলে কুর্দি রাষ্ট্র নয় বলেই প্রচার করা হয়; এর সংবিধানে (constitution) বলা আছে যে অঞ্চলের সব জাতিগোষ্ঠীর (ethnic groups) মধ্যে সমতা রক্ষা করা হবে। এমনকি, সেখানে কুর্দিরা সংখ্যাগরিষ্ঠ কি না, সেটিও স্পষ্ট নয়। তবে এর সামরিক বাহিনী—সিরিয়ান ডেমোক্র্যাটিক ফোর্সেস (Syrian Democratic Forces বা SDF)—মূলত কুর্দি বাহিনীর নেতৃত্বে পরিচালিত, আর অঞ্চলের প্রধান রাজনৈতিক দল, ডেমোক্র্যাটিক ইউনিয়ন পার্টি (Democratic Union Party), কুর্দিদের দল।
রোজাভার প্রধান রাজনৈতিক গোষ্ঠীগুলো জোর দিয়ে বলে যে তারা স্বাধীনতা চায় না। বরং তারা চায়—একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় (federal) সিরিয়ার (Syria) মধ্যে রোজাভা স্বায়ত্তশাসিত (autonomous) থাকুক (সম্ভবত ইরাকের (Iraq) কুর্দিস্তান অঞ্চলের (Kurdistan region) মতো) আর তারা মনে করে তাদের বর্তমান শাসনব্যবস্থা (governance structure) সমগ্র সিরিয়ার জন্য একটি মডেল হতে পারে। তবুও সবার অনুমান ছিল—যদি রোজাভাকে উল্লেখযোগ্য মাত্রার স্বায়ত্তশাসন না দেওয়া হয়, তবে তারা সিরিয়ার বাকি অংশের সঙ্গে একীভূত হওয়ার চেষ্টা সহজে মেনে নেবে না।
গৃহযুদ্ধ চলাকালে রোজাভার সীমানা ধীরে ধীরে সম্প্রসারিত হয়েছে, বিশেষ করে ২০১৭ সালে যখন যুক্তরাষ্ট্র (US) এসডিএফের (SDF) সঙ্গে জোট বাঁধে আইএসআইএসকে (ISIS) মধ্য সিরিয়া থেকে হটাতে। এসডিএফ তখন নবদখলকৃত এলাকাগুলোকে রোজাভার অংশ হিসেবেই ঘোষণা করে। বর্তমানে, এসডিএফ ইউফ্রেটিস নদীর পূর্বদিকের প্রায় সব এলাকা নিয়ন্ত্রণ করে, এমনকি পশ্চিম তীরে (western bank) কিছু শহরও তাদের দখলে আছে—যার মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হল মান্বিজ (Manbij) এবং দেইর ইজ্ জোর (Deir EZ Zur)।
তুরস্কের দীর্ঘদিনের কুর্দি-সংকট
রোজাভার এই বিস্তার তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রেচেপ এরদোয়ানকে (Recep Erdogan) প্রবলভাবে বিচলিত করেছিল। কারণ, তুরস্ক বহুদিন ধরে দেশের পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত কুর্দি বিচ্ছিন্নতাবাদী (Kurdish separatist) আন্দোলনের সঙ্গে লড়ে আসছে, যেখানে প্রায় ২ কোটি কুর্দি বাস করে। আশির দশকে এই সংকট তীব্র রূপ নেয়, যখন পিকেকে (PKK) নামে পরিচিত প্রো-ইন্ডিপেনডেন্স কুর্দি ওয়ার্কার্স পার্টি (Kurdish Workers Party) তুর্কি সরকারের বিরুদ্ধে একটি সশস্ত্র বিদ্রোহ (insurgency war) শুরু করে।
আশির দশকের শেষ দিকে ধারাবাহিক অন্তর্দ্বন্দ্ব (serial infighting) এবং সাধারণ কুর্দিদের মধ্যে জনপ্রিয়তা কমে যাওয়ার কারণে পিকেকে সাময়িকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছিল। কিন্তু ১৯৯১ সালে ইরাকের উত্তরে (Northern Iraq) একটি স্বায়ত্তশাসিত কুর্দি অঞ্চল (autonomous Kurdish region) গঠনের পর পিকেকে আবার উদ্দীপনা পায়। ওই সময়ে জাতিসংঘ (UN) সমর্থিত একটি নো-ফ্লাই জোন (no fly zone) ওই অঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় ইরাকি কুর্দিস্তান (Iraqi Kurdistan) পিকেকের জন্য একটি নিরাপদ আশ্রয় এবং অনুপ্রেরণা হয়ে দাঁড়ায়। ফলে ২০০০-এর দশকে এসে তাদের বিদ্রোহ আবার জোরদার হয়।
প্রায় ৫০ বছর ধরে চলমান এই দ্বন্দ্ব যেখানে প্রায় ৪০ হাজারের বেশি লোকের প্রাণ গেছে, সেখানে ‘কুর্দি প্রশ্ন’ (Kurdish question) যে তুরস্কের প্রধান পররাষ্ট্রনীতির অগ্রাধিকার হবে, তা আর আশ্চর্যের কিছু নয়। সুতরাং এরদোয়ান স্বাভাবিকভাবেই উদ্বিগ্ন ছিলেন যে দেশের দক্ষিণ সীমান্তে একটি কুর্দি রাষ্ট্র গড়ে উঠলে তুরস্কের অভ্যন্তরে কুর্দি বিচ্ছিন্নতাবাদী (separatist) মানসিকতা আরও উসকে দিতে পারে এবং কুর্দি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলো এই রাষ্ট্রকে ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করতে পারে।
২০১৯ সালের তুরস্কের আগ্রাসন ও বাফার জোন
এই উদ্বেগ থেকেই ২০১৯ সালে তুরস্ক রোজাভায় আক্রমণ চালায়, উদ্দেশ্য ছিল একটি ‘বাফার জোন’ (buffer zone) তৈরি করা। বর্তমানে তুর্কি রাষ্ট্র কার্যত সিরিয়ার উত্তরে দুটি বিচ্ছিন্ন ভূখণ্ড নিয়ন্ত্রণ করে, যেখানে স্থানীয়দের মধ্যে লিরা (lira) চালু আছে, সরকারী কর্মচারীরা (civil servants) বেতন পায় তুরস্ক সরকারের কাছ থেকে, আর বিদ্যুৎ (electricity) আসে তুরস্কের দক্ষিণাঞ্চলের বিদ্যুৎ-গ্রিড (electricity grid) থেকে।
এ ছাড়া তুরস্ক উত্তর-পশ্চিম সিরিয়ায় বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোকে (rebel groups) সহায়তা করেছিল কুর্দিদের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য। তুরস্ক এইচটিএসকে (HTS – Hay’at Tahrir al-Sham) সমর্থন দিয়েছিল, যারা বিদ্রোহীদের পক্ষে আসাদ সরকারকে (Assad) উৎখাত করার সাম্প্রতিক অভিযানে (offensive) নেতৃত্ব দেয়। কিন্তু তারা আরেক বিদ্রোহী গোষ্ঠী সিরিয়ান ন্যাশনাল আর্মিকে (Syrian National Army বা SNA) (যা আগে ইদলিবে (Idlib) অবস্থান করত) আরও বেশি সমর্থন দিয়েছিল। বর্তমানে এসএনএ (SNA) প্রায় তুরস্কের প্রক্সি বাহিনীতে (Turkish proxy group) পরিণত হয়েছে, এবং তাদের প্রধান কাজ কুর্দিদের বিরুদ্ধে লড়াই করা।
এই কারণেই, যখন এইচটিএস (HTS) আলেপ্পো (Aleppo) থেকে দামাস্কাসের (Damascus) দিকে এগোচ্ছিল, এসএনএ (SNA) ঠিক সেই সময়ে ইউফ্রেটিসের পশ্চিম পাড়ে অবস্থিত কয়েকটি কুর্দি ঘাঁটির মধ্যে অন্যতম মানবিজে (Manbij) কুর্দি বাহিনীর উপর আক্রমণ করে। এই মানবিজ ছিল ইউফ্রেটিসের পশ্চিম তীরে (west of the Euphrates) কুর্দিদের হাতে থাকা অল্প কয়েকটি এলাকাগুলোর অন্যতম।
এইচটিএস ক্ষমতায় আসার পর রোজাভার ভবিষ্যৎ
যখন এটা স্পষ্ট হয়ে উঠল যে এইচটিএস এবং তাদের নেতা আবু মোহাম্মদ আল জোলানি (Abu Mohammed Al Jilani) সিরিয়ার বেশিরভাগ অঞ্চল দখলে নিয়েছে, তখন অনেকে প্রশ্ন তুলেছিলেন—রোজাভার ভবিষ্যৎ কী হবে? প্রথম দেখায় মনে হয়েছিল যে রোজাভা নিরাপদ থাকবে, কারণ এইচটিএস ও জোলানি বারবার বলেছিল যে তারা সিরিয়ার সংখ্যালঘুদের (minorities) অধিকারকে সম্মান করতে চায় এবং নতুন সিরিয়ায় রোজাভাকে অন্তত কিছুটা স্বায়ত্তশাসন দেবে বলে ইঙ্গিত করেছিল।
কিন্তু এইচটিএস (HTS) মুখে যতই বন্ধুত্বপূর্ণ লাগুক না কেন, তুরস্ক-সমর্থিত এসএনএ (SNA) কুর্দি অবস্থানের উপর হামলা চালিয়ে যেতে থাকে। তখন কুর্দিরা যুক্তরাষ্ট্রের (US) কাছে সাহায্য চায়, যাদের এখনো আনুমানিক ৯০০ সৈন্য (troops) সিরিয়ার উত্তর-পূর্বাঞ্চলে মোতায়েন রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র তুরস্কের সঙ্গে একটি সমঝোতা করার চেষ্টা করেছিল, যার সারকথা ছিল কুর্দিদেরকে ইউফ্রেটিসের পূর্বদিকে (east of the Euphrates) পিছু হটতে রাজি করানো—বিনিময়ে তুরস্ক ও তাদের সমর্থিত বাহিনী যেন কুর্দিদের উপর আর আক্রমণ না করে।
কিন্তু এ নিয়ে বার্তা মিশ্র (mixed) ছিল। পেন্টাগন (Pentagon) প্রথমে দাবি করেছিল যে তুরস্কের তরফ থেকে কোনো বড় ধরনের উত্তেজনা (escalation) থেকে বিরত থাকার প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে, যেন যুক্তরাষ্ট্রের বাহিনী ও তাদের সহযোগীদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত না হয়। কিন্তু এসডিএফের (SDF) পক্ষ থেকে বলা হয়, তুরস্ক-সমর্থিত এসএনএ (SNA) ইউফ্রেটিসের পূর্বদিকে, বিশেষ করে কোবানির (Kobani) আশপাশে, কুর্দি অবস্থানের উপর আক্রমণ অব্যাহত রেখেছে। কোবানি তুরস্কের সীমান্তের ঠিক দক্ষিণে অবস্থিত, এবং বাফার জোনের (buffer zones) মধ্যবর্তী অঞ্চলে পড়ে।
এর চেয়েও বেশি উদ্বেগের বিষয় হল, বৃহস্পতিবার তুরস্কের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় (Turkish Defence Ministry) জানায় যে কোনো যুদ্ধবিরতি চুক্তি (ceasefire deal) হয়নি, আর তারা এসডিএফের সঙ্গে কোনো সমঝোতায় যাবে না। একই সময়ে, মার্কিন (US) কর্মকর্তারা জানিয়েছেন যে তুরস্ক সিরিয়া সীমান্তে সৈন্য সমাবেশ করছে, যা দেখে মনে হয় যে কোনও মুহূর্তে একটি পূর্ণমাত্রার আক্রমণ (full scale invasion) শুরু হতে পারে।
সামনে কী হতে যাচ্ছে
পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে বলা যায়, তুরস্কের আক্রমণ এখন বেশ সম্ভাব্য হয়ে উঠেছে। এরদোয়ান অতীতেও সিরিয়ার ভূখণ্ড দখল করতে পিছপা হননি, আর বর্তমান সৈন্য-সমাবেশ ২০১৯ সালের মতোই মনে হচ্ছে, যখন শেষমেশ রোজাভায় আক্রমণ করা হয়েছিল।
মূল প্রশ্ন হল—এই আক্রমণের মাত্রা কতটা বিস্তৃত হবে? মোটাদাগে, এরদোয়ানের সামনে দুটি পথ খোলা আছে –
প্রথমত, তুরস্ক তাদের ইতোমধ্যে থাকা দুটি বিচ্ছিন্ন বাফার জোনকে একত্রিত করার জন্য শুধুমাত্র প্রয়োজনীয় পরিমাণ ভূখণ্ড দখল করতে পারে। এইভাবে তারা সিরিয়ার উত্তরে একটি সংযুক্ত (contiguous) বাফার জোন তৈরি করবে।
দ্বিতীয়ত, আরেকটি পথ হল, রোজাভা পুরোপুরি দখল করে (full scale invasion) ওই অঞ্চলে থাকা সব কুর্দি বাহিনীকে (Kurdish forces) নির্মূল করা—যা এরদোয়ানের দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত লক্ষ্যের মধ্যে পড়ে।
আমাদের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, প্রথম বিকল্পটি বর্তমানে বেশি সম্ভাবনা রাখে। কারণ এরদোয়ান হয়তো সম্পূর্ণ আক্রমণ চালানোর আগে ডোনাল্ড ট্রাম্পের (Trump) ক্ষমতায় বসার জন্য অপেক্ষা করতে পারেন—যদি ট্রাম্প আবার ক্ষমতায় আসেন, তিনি হয়তো এই ৯০০ মার্কিন সৈন্য (US troops)-কে সিরিয়া থেকে সরিয়ে নেবেন। কারণ তার প্রথম মেয়াদকালে ট্রাম্প কুর্দিদের প্রতি সেভাবে ইতিবাচক ছিলেন না এবং তুর্কি অনুরোধে সিরিয়া থেকে সেনা প্রত্যাহারে আগ্রহী ছিলেন। ওই মার্কিন সৈন্যরা এখন কার্যত কুর্দিদের জন্য একটি নরম নিরাপত্তা-জাল (soft security guarantee) হিসেবে কাজ করছে।
তথ্যসূত্র
1 – https://en.wikipedia.org/wiki/Autonomous_Administration_of_North_and_East_Syria
2 – https://en.wikipedia.org/wiki/Syrian_Democratic_Forces
3 – https://www.economist.com/middle-east-and-africa/2019/10/14/turkeys-invasion-has-thrown-a-once-stable-corner-of-syria-into-chaos
4 – https://www.economist.com/middle-east-and-africa/2021/03/13/ten-years-of-war-have-broken-syria-into-pieces
5 – https://www.ft.com/content/a14241de-8dbf-4a69-b064-2991f5992503
6 – https://arabcenterdc.org/resource/syrias-kurds-facing-dangerous-headwinds/
7 – https://x.com/ragipsoylu/status/1869672287827603760
8 – https://www.jpost.com/middle-east/article-833777
এইচটিএস সরকার ক্ষমতায় আসার পর সিরিয়ায় কারা জিতলো আর কারা হারলো? (২০ ডিসেম্বর, ২০২৪)
ভূমিকা
সিরিয়ায় আল-আসাদ (al-Assad) শাসনের পতন এবং আবু মুহাম্মদ আল-জুলানির (Abu Muhammad al-Julani) নেতৃত্বাধীন এইচটিএস নিও-জিহাদিস্ট (HTS Neo-jihadists) গোষ্ঠীর ক্ষমতায় উদয় মধ্যপ্রাচ্যের মানচিত্র আবারো ওলট-পালট করে দিয়েছে। এখন সিরিয়া চরমপন্থী একটি গোষ্ঠীর অধীনে, যারা কয়েকদিন ধরে কিছুটা অদ্ভুত বার্তা প্রচার করে আসছে। অদ্ভুত এ কারণে যে তারা আদতে এমন এক সালাফিস্ট (Salafist) দলের মত, যাদের উত্স আল-কায়েদা (al-Qaeda) সংগঠনে, এবং স্বাভাবিকভাবে এদের কাছ থেকে এমন বার্তা প্রত্যাশিত নয়।
দেখুন, সিরিয়ার নতুন সরকার দেশের ব্যবসায়িক নেতাদের জানিয়েছে যে তারা একটি মুক্তবাজার (Free market) মডেল গ্রহণ করবে এবং দেশকে বৈশ্বিক অর্থনীতির সঙ্গে সংযুক্ত করবে। এটি গত কয়েক দশকের দুর্নীতিগ্রস্ত রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ থেকে বিরাট এক মোড় ঘোরার ইঙ্গিত দেয়। এই ঘোষণা প্রচণ্ড বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছে। কেননা সম্পূর্ণ মুক্তবাজার ব্যবস্থা শরিয়া (Shariah (Islamic law))-এর কঠোর ব্যাখ্যার সঙ্গে মেলে না, যেখানে ইসলামী আইন অর্থনৈতিক মুনাফাকে (Economic profit) কঠোরভাবে সীমিত করে।
কিন্তু বিষয়টা এখানেই শেষ নয়। সম্প্রতি সিএনএন (CNN) এ আল-জুলানি (al-Julani)-র দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে (যেটি গ্রহণ করেছিলেন এক নারী সাংবাদিক) এই নতুন সিরীয় নেতা নিজেকে এক ধরনের আধুনিক শাসক হিসাবে উপস্থাপন করেছেন। এমনকি তিনি তার চেহারা ও পোশাকেও আরও পশ্চিমা ঢঙ এনেছেন। তদুপরি, গত কয়েকদিনে তিনি ক্ষমতার ভারসাম্যকে একজন ব্যক্তির উপর নির্ভর না করে প্রতিষ্ঠানের উপর নির্ভরশীল করার পক্ষে সাফাই গেয়েছেন। সেইসঙ্গে, তার অতীত উগ্র জিহাদি পরিচয় মাথায় রাখলে কিছু অবাক করা কথাও বলেছেন। যেমন:
“কেউ কারো অস্তিত্ব মুছতে পারে না। এই সমস্ত সাম্প্রদায়িক সংখ্যালঘুরা শত শত বছর ধরে এই অঞ্চলে সহাবস্থান করেছে এবং কাউকে তাদের নিশ্চিহ্ন করার অধিকার দেওয়া হয়নি। বিশের কোঠায় থাকা একজন মানুষের ব্যক্তিত্ব ত্রিশ বা চল্লিশের কোঠায় থাকা মানুষের থেকে আলাদা হবে, আর পঞ্চাশ বছর বয়সে এসে তা আরও আলাদা হবে। আমি মানুষকে বলি, শব্দ দিয়ে নয়, কর্ম দিয়ে বিচার করুন।”
এ সমস্তই অত্যন্ত বিভ্রান্তিকর। কেউই ঠিক জানে না কী ঘটতে যাচ্ছে সিরিয়ায় এই লোকগুলোর হাতে। কিন্তু পরিষ্কার করে বললে, যারা আল-কায়েদা (al-Qaeda)-র মতো সংগঠন থেকে উঠে এসেছে এবং মৌলবাদী (Fundamentalism) পরিবেশে বাস করে, তাদের কথার উপর বিশ্বাস রাখা অসম্ভব। হঠাৎ এমন মধ্যপন্থী সাজ নেওয়া দেখতে পাওয়াও অস্বস্তিকর। আমরা সত্যিই কী দেখছি তা কেবল সময়ই বলতে পারবে। অতএব, আমরা খুব সতর্কভাবেই এই ঘটনাপ্রবাহ পর্যবেক্ষণ করবো।
আমি আল-আসাদের (al-Assad) পতনে স্বস্তি প্রকাশ করলেও, এই নতুন শাসকদের কোনো অলৌকিক রূপান্তর ঘটেছে বলে প্রত্যয় রাখতে চাই না। যাই হোক, আপাতত আমরা যা জানি তা হলো, এইচটিএস (HTS) গোষ্ঠীর ক্ষমতায় আরোহন মধ্যপ্রাচ্যে এক বিশাল রাজনৈতিক ভূমিকম্প ঘটিয়েছে এবং ওই অঞ্চলের ভঙ্গুর নিরাপত্তা ভারসাম্যকে নাড়া দিয়ে দিয়েছে। ইরান (Iran), ইসরায়েল (Israel), তুরস্ক (Turkey) সহ আরও অনেক দেশ সরাসরি এই পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্ত বা প্রভাবিত হয়েছে।
এখন প্রশ্ন হলো, সিরিয়ায় তারা কী ভূমিকা পালন করছে? এই পুরো ঘটনায় কারা আসলে বড় বিজয়ী আর কারা বড় পরাজিত? এখন থেকে আমরা আর কী প্রত্যাশা করতে পারি?
“দ্য গ্রেট গেম অফ রিস্ক”
একটি প্রবাদ রয়েছে: “বুদ্ধিমানরা অস্থিরতার সুযোগ নেয়।” ঠিক এটাই সম্ভবত তুরস্ক (Turkey) ও ইসরায়েল (Israel) ভেবেছে। এই দুই আঞ্চলিক শক্তি (যাদের সিরিয়ার সঙ্গে সীমান্ত রয়েছে) হয়তো এইচটিএস (HTS) বিদ্রোহীদের উত্থানকে অসাধারণভাবে লাভজনক মনে করছে। আপনি কি জানেন কারা সবচেয়ে বেশি সুবিধা পাচ্ছে? নির্দিষ্ট করে বললে: তুরস্ক (Turkey)।
তুরস্কের অবস্থান ও কুর্দি সমস্যা
এই পরিবর্তন তুরস্কের সামনে এমন একটি সুযোগ তৈরি করেছে যা তার আধুনিক ইতিহাসে বিরল। এখন আঙ্কারার (Ankara) সামনে সুযোগ এসেছে আঞ্চলিক অঙ্কে ডোর টানার এবং পাশাপাশি কয়েক দশক ধরে ঘাড়ে চেপে থাকা কিছু সমস্যার সমাধান করার, যেমন কুর্দি (Kurdish) সমস্যা।
কুর্দিরা (Kurds) একটি রাষ্ট্রহীন জাতি, যারা তুরস্ক, সিরিয়া, ইরাক (Iraq) ও ইরান (Iran)-এর মাঝে ভাগ হয়ে আছে, ঐতিহাসিকভাবে যাকে কুরদিস্তান (Kurdistan) বলা হয়। ১৯৮০’র দশক থেকে কুর্দিরা তুরস্কের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ চালিয়ে যাচ্ছে, কারণ আঙ্কারা মনে করে তারা বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী যারা তুরস্ককে ভাগ করে নিজেদের স্বায়ত্তশাসিত বা স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন করতে চায়।
বছরের পর বছর ধরে সিরিয়ার উত্তর-পূর্বাঞ্চল কুর্দিদের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ আশ্রয়স্থল ছিল। এখানে সিরিয়ান ডেমোক্রেটিক ফোর্সেস (SDF: Syrian Democratic Forces)-এর মূল ঘাঁটি, যারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র (United States) ও অন্যান্য পশ্চিমা দেশের সহায়তায় ইসলামী জঙ্গি (Islamists) এবং তুর্কি বাহিনীর বিরুদ্ধেও লড়েছে, পাশাপাশি আল-আসাদ (al-Assad) শাসনকেও চ্যালেঞ্জ করেছে।
কিন্তু এখন, যখন সিরিয়ায় নতুন এইচটিএস (HTS) সরকার ক্ষমতায়, তুরস্ক খুব স্পষ্টভাবেই দেখছে যে এটাই সেই সুবর্ণ সুযোগ। তারা অনেকদিন ধরেই চেষ্টা করেছে, এবারও করছে। খবরে দেখা যাচ্ছে, “সিরিয়ার কুর্দিরা নতুন বিশৃঙ্খলার মুখে, তুরস্কের সুন্নি (Sunni) মিত্ররা কোবানির (Kobani) দিকে অগ্রসর”, “এসডিএফ (SDF) নিয়ন্ত্রিত মানবিজ (Manbij) শহর পতনের পরদিনই তুর্কি মদদপুষ্ট বাহিনী কোবানির দিকে অগ্রসর হচ্ছে”।
এটা প্রথম নয়। ২০১৭ সালেও তুর্কি নেতা রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান (Recep Tayyip Erdoğan) সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের সুযোগ নিয়ে সীমান্তের ওপারে কুর্দি ইউনিটগুলোর বিরুদ্ধে অভিযান চালান। কুর্দিদের আক্রমণ করতে তুরস্ক দীর্ঘদিন ধরেই সিরিয়ান ন্যাশনাল আর্মি (Syrian National Army) নামের এক তুলনামূলকভাবে মধ্যপন্থী সুন্নি বিদ্রোহী গোষ্ঠীকে সমর্থন করেছে। এই গোষ্ঠী স্বাভাবিকভাবেই কুর্দিদের শত্রু, এবং সাম্প্রতিক দিনগুলোতে তারা আক্রমণ জোরদার করেছে।
তারা তুর্কি সশস্ত্র বাহিনীর (Turkish Armed Forces) সহযোগিতায় এমনকি বিমান হামলাও চালাচ্ছে। তাদের তাৎক্ষণিক লক্ষ্য হলো কুর্দিদের নিয়ন্ত্রিত সরবরাহ লাইন বিঘ্নিত করা এবং আল-বাব (Al-Bab) ও তেল রিফাত (Tel Rifaat) শহরের মধ্যে করিডোর সংহত করা। ওই অঞ্চল ১ ডিসেম্বর তুর্কি-সমর্থিত বিদ্রোহীদের দখলে যায়। তুরস্কের দাবি, তারা সীমান্ত বরাবর একটি নিরাপত্তা বলয় (Security Zone) স্থাপন করতে চায়।
কিন্তু বাস্তবে কুর্দিদের জন্য অন্ধকার ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে। সিরিয়ান কুর্দি নেতা মাযলুম কোবেইন (Mazlum Kobane) এখন এক কঠিন সন্ধিক্ষণে: হয় গত এক দশকে কুর্দিরা যে অবস্থান ও অপেক্ষাকৃত উদার নিয়মকানুন গড়ে তুলেছে সেগুলোর জন্য রক্তাক্ত প্রতিরোধ চালাবে, নয়তো নতুন সিরীয় ইসলামপন্থী মৌলবাদী (Islamic fundamentalist) সরকারের অধীনে এসে জীবনধারণ করতে হবে, যাদের পেছনে চিরশত্রু তুরস্কের সমর্থন রয়েছে। সিদ্ধান্ত নেওয়া মোটেও সহজ হবে না।
শরণার্থীদের প্রত্যাবর্তন ও সম্ভাব্য পুনর্গঠন
এই সাফল্যই তুরস্কের প্রাপ্তি শেষ নয়। সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ তুরস্কের জন্য বিশাল শরণার্থী সংকট তৈরি করেছিল। তুরস্কে প্রায় ৩০ লাখ সিরীয় শরণার্থী আশ্রয় নিয়েছিল। এত বিপুল পরিমাণ শরণার্থী দেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক আর অবকাঠামো ব্যবস্থায় প্রচণ্ড চাপ তৈরি করেছিল। যদিও ইউরোপীয় ইউনিয়ন (European Union) অর্থনৈতিক সহায়তা দিয়েছিল, তবে অন্য দেশের লাখো শরণার্থী রাখা সবসময়ই কষ্টসাধ্য।
কিন্তু এখন, এইচটিএস (HTS) ক্ষমতায় আসার পর, পরিস্থিতির উন্নতির অজুহাতে সিরীয় শরণার্থীদের স্বদেশ ফেরা শুরু হয়েছে। এতে তুরস্কের দীর্ঘদিনের সংকট লাঘব হওয়ার পথ তৈরি হচ্ছে। প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান (Erdogan) অতিরিক্ত সীমান্ত ক্রসিং খুলে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন, ধারণা করা হচ্ছে স্থিতিশীলতা বাড়লে স্বেচ্ছায় আরো বেশি সিরীয় ফিরবে।
এছাড়াও সিরিয়ার পুনর্গঠন প্রকল্প থেকে তুরস্ক বড় মুনাফা আশা করছে। সিরিয়া পুনর্গঠন কাজে তুর্কি নির্মাণ কোম্পানিগুলো (Turkish construction companies) তাদের ভৌগোলিক নৈকট্যের কারণে বড় সুবিধা পাবে। আকাশছোঁয়া লাভের প্রত্যাশায় তুর্কি নির্মাণ খাতের শেয়ারের দাম ইতোমধ্যেই বেড়েছে, সূচক ৩.৪% বৃদ্ধি পেয়ে রেকর্ড উচ্চতায় পৌঁছেছে।
যদিও বিপরীত দিকও আছে। বড় সংখ্যক শরণার্থী ফিরে গেলে তুরস্ক সস্তা শ্রমের (Cheap labor) সুবিধা হারাবে, কারণ প্রায় ১০ লাখ সিরীয় শরণার্থী তুরস্কের অনানুষ্ঠানিক অর্থনীতিতে কাজ করতো। তবুও তুরস্ক অন্য অর্থনৈতিক সুফল ও গ্যাস পাইপলাইন (Gas pipeline) প্রকল্পের মাধ্যমে ক্ষতি পুষিয়ে নিতে চায়।
কাতার-তুরস্ক গ্যাস পাইপলাইন ও রাশিয়ার ক্ষতি
এখানে মূল বিষয় হলো কাতার-তুরস্ক গ্যাসপাইপলাইন প্রকল্প (Qatar-Turkey gas pipeline project), যা প্রস্তাব করা হয়েছিল ২০০৯ সালে। তখনকার সিরিয়ান প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ (Bashar al-Assad) এই পাইপলাইন নির্মাণের অনুমতি দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। এর প্রস্তাবিত পথ হচ্ছে কাতার (Qatar) থেকে সৌদি আরব (Saudi Arabia), জর্দান (Jordan) হয়ে সিরিয়া (Syria) পেরিয়ে তুরস্কে। এটি ছিল ১৫০০ কিলোমিটার দীর্ঘ পাইপলাইন, আনুমানিক ১০ বিলিয়ন ডলারের প্রকল্প, যা কাতার ও সৌদি আরবের বিশাল প্রাকৃতিক গ্যাস ইউরোপে পাঠাতে পারবে সরাসরি ও সস্তায়।
ইউরোপ (Europe) এতে সরাসরি পাইপলাইনের মাধ্যমে সস্তা গ্যাস পেতে পারবে, আর তুরস্ক পাবে টোল ফি ও সাশ্রয়ী মূল্যে জ্বালানি। স্বাভাবিকভাবেই, এর সবচেয়ে বড় ক্ষতি হবে রাশিয়ার (Russia), কারণ ইউরোপ রাশিয়ান গ্যাসের ওপর নির্ভরতা অনেকাংশে কমাতে পারবে।
আল-আসাদ (al-Assad) এতদিন এই পাইপলাইন আটকে রেখেছিল, কারণ তার গুরুত্বপূর্ণ মিত্র রাশিয়া এটি চাননি। রাশিয়া চায়নি ইউরোপ বিকল্প গ্যাস সরবরাহ পেয়ে তার প্রভাব ও অর্থ হারাক। কিন্তু এখন, আল-আসাদের পতনে এই বাধা সরে যেতে পারে।
সিরিয়ায় রাশিয়ান স্বার্থের অবনতি
রাশিয়ার জন্য সিরিয়া ছিল সামরিক, কৌশলগত এবং রাজনৈতিক স্বার্থের জায়গা। তারা আল-আসাদকে নিরাপত্তা, অস্ত্র ও কৌশলগত সহায়তা দিয়েছিল, বদলে সিরিয়ায় সামরিক ঘাঁটি পরিচালনা করত। লাতাকিয়া (Latakia)-র কাছে হেমাইম (Hmeimim) এয়ারবেস (Airbase) থেকে শুরু করে তারতুস (Tartus) নৌঘাঁটি (Naval base), সবই রাশিয়ান শক্তিপ্রদর্শন ও সরবরাহ কেন্দ্র হিসেবে কাজ করতো। তারা আল-আসাদকে (al-Assad) রক্ষা করতে সন্ত্রাসীগোষ্ঠীর ওপর বিমান হামলা চালাত, কিন্তু এখন সেই সন্ত্রাসীগোষ্ঠী (এইচটিএস (HTS)) ক্ষমতায়।
এই পরিস্থিতে প্রশ্ন হলো, বিদ্রোহীরা কি রাশিয়ানদের অতীতের সব নিপীড়ন ও বোমাবর্ষণ ভুলে তাদের ঘাঁটি রাখতে দেবে? হয়তো টাকার বিনিময়ে কিছুদিন পার পেতে পারে। রাশিয়া সম্প্রতি বিদ্রোহীদের সঙ্গে চুক্তির চেষ্টা করছে বলে খবর রয়েছে। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে বিষয়টি কঠিন। সিরিয়ার জনগণ রাশিয়াকে ঘৃণা করে তাদের নগর এলাকায় নির্বিচার বোমাবর্ষণের জন্য। বিদ্রোহীরাও (HTS) রাশিয়ান হামলার শিকার হয়েছে খুব সম্প্রতি।
এর ওপর আবার ইউক্রেনীয় (Ukrainians) গোয়েন্দারা এইচটিএস (HTS)-কে ড্রোন অপারেশনে সাহায্য করেছে বলে রিপোর্ট রয়েছে। ইউক্রেনের সাহায্য নিয়ে এইচটিএস রাশিয়াকে অপদস্ত করেছে। অতএব, ভবিষ্যতে রাশিয়ান ঘাঁটি টিকে থাকা কঠিন হতে পারে। এদিকে রাশিয়া ইতোমধ্যে কিছু জাহাজ তারতুস থেকে সিরিয়া উপকূল থেকে দূরে নিয়ে গেছে। উপায়ন্তর না পেয়ে তারা হয়তো কূটনৈতিক মীমাংসার আশায় বসে আছে।
ইরানের বড় ধাক্কা: হেজবোল্লাহ ও অস্ত্র সরবরাহে ব্যাঘাত
অপর এক বড় পরাজিত শক্তি হলো ইরান (Iran)। ইরান ও তার ঘনিষ্ঠ মিত্র হেজবোল্লাহ (Hezbollah) লেবাননে (Lebanon) দীর্ঘদিন ধরে আল-আসাদকে (al-Assad) সহায়তা দিয়েছে, সশস্ত্র করেছে। সিরিয়া ছিল ইরানের অস্ত্র ও ক্ষেপণাস্ত্র সরবরাহের মূল পথ। ফাতেহ-১১০ (Fateh-110) থেকে শুরু করে স্কাড (Scud) ধরনের ক্ষেপণাস্ত্র সিরিয়া হয়ে লেবাননে হেজবোল্লাহর কাছে যেত। এভাবে হেজবোল্লাহ ক্রমে শক্তিশালী সেনাবাহিনীতে পরিণত হয়েছিল।
কিন্তু আল-আসাদের পতনে এই সরবরাহ পথ প্রায় বন্ধ হয়ে যেতে পারে। লেবানন কেবল ইসরায়েল (Israel) ও সিরিয়া সীমান্ত দিয়ে স্থল সংযুক্ত। ইসরায়েলি হামলায় বিপর্যস্ত হেজবোল্লাহ এখন নতুন সরবরাহ লাইন পাবে কোথায়? এদিকে ইরানকেও অন্য পথে অস্ত্র চালান নিয়ে চিন্তা করতে হবে। এটি ইরানের আঞ্চলিক প্রভাবের জন্য বড় আঘাত।
ইসরায়েলের নিরাপত্তার সুযোগ: সিরিয়ার সামরিক সম্পদের ধ্বংস ও গোলান অধিকার
অন্যদিকে ইসরায়েল (Israel) এই পুরো পরিস্থিতি কাজে লাগাতে দেরি করেনি। সিরিয়ায় আল-আসাদের পতনের পর, ইসরায়েল ব্যাপক হারে বিমান হামলা চালিয়ে সিরিয়ান সামরিক ক্ষমতার প্রায় ৮০% ধ্বংস করেছে। আইডিএফ (IDF: Israel Defense Forces) জানিয়েছে, তারা গত কিছুদিনে প্রায় পাঁচ শতাধিক লক্ষ্যবস্তুতে হামলা করেছে। এর মধ্যে সিরিয়ান এয়ার ফোর্সের (Syrian Air Force) অবকাঠামো, এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম, অস্ত্র গুদাম, কারখানা, হেলিকপ্টার, ট্যাংক, রাডার, হ্যাঙ্গার – সবই অন্তর্ভুক্ত।
এই “অপারেশন বাশান এরো” (Operation Bashan Arrow) -এর ফলে ইসরায়েল কার্যকরীভাবে সিরিয়াকে সামরিক দিক দিয়ে প্রায় নিষ্ক্রিয় করে ফেলেছে। একই সঙ্গে ইসরায়েল গোলান হাইটস (Golan Heights) এলাকায় কৌশলগত অবস্থান আরও সুসংহত করেছে এবং মাউন্ট হারমোন (Mount Hermon) (যা প্রায় ৩০০০ মিটার উচ্চতা সম্পন্ন, দখল করেছে।) এটি সিরিয়া ও লেবাননের সীমান্তে অবস্থিত এবং রাডার (Radar) কভারেজ বৃদ্ধির মাধ্যমে ইসরায়েলকে আরও কৌশলগত সুবিধা দেবে।
এখন ইসরায়েল ওই পাহাড়ে রাডার ও অ্যান্টি-মিসাইল সিস্টেম বসিয়ে আরও বিস্তৃত এলাকাকে তদারকি করতে পারবে। এছাড়াও, তাত্ত্বিকভাবে এই অবস্থান থেকে দামেস্ক (Damascus)-এ আর্টিলারি হামলার ক্ষমতাও অর্জন করবে ইসরায়েল, যা এক ধরনের শক্তিশালী প্রতিরোধ ক্ষমতা হিসাবে কাজ করবে।
তার চেয়েও বড় কথা, আল-আসাদের পতন লেবাননকে দামেস্ক ও ইরান-সমর্থিত হেজবোল্লাহর প্রভাব থেকে মুক্ত করতে পারে। লেবানন যদি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে পারে বা অন্তত হেজবোল্লাহর দমন থেকে রেহাই পায়, তবে এটা ইসরায়েলের জন্য বিরাট সাফল্য।
অর্থাৎ এই পরিস্থিতে ইসরায়েল তার নিরাপত্তা বেড়েছে, সামরিকভাবে সিরিয়া নিষ্ক্রিয় হয়েছে, ভবিষ্যতে ইরান ও হেজবোল্লাহর হুমকি কমতে পারে।
কারা বিজয়ী আর কারা পরাজিত?
সুতরাং, সারসংক্ষেপে দেখা যাচ্ছে, এই ঘটনা প্রবাহে সবচেয়ে বড় দুই বিজয়ী হলো তুরস্ক (Turkey) ও ইসরায়েল (Israel)। তারা আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক সুযোগ বাড়িয়ে নিতে পেরেছে।
দুই পরাজিত হলো রাশিয়া (Russia) ও ইরান (Iran)। রাশিয়া তার সামরিক ঘাঁটি ও প্রভাব হারানোর শঙ্কায়, আর ইরানের হেজবোল্লাহকে অস্ত্র সরবরাহের পথ প্রায় বন্ধ। এই পুরো বিষয়টি আসলে একটি রিস্ক (Risk) খেলায় পরিণত হয়েছে, যেখানে সবাই স্বার্থ অনুসারে চাল দিচ্ছে।
এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হচ্ছে, পরবর্তীতে কী হবে? যুক্তরাষ্ট্র (United States) ও অন্যান্য অংশীদাররা পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত, এবং কেউ জানে না এইচটিএস (HTS) সরকার আদতে কতটা মধ্যপন্থী বা কতটা চরমপন্থী হয়ে উঠবে। রাশিয়া ও ইরান কি প্রতিশোধ নেওয়ার চেষ্টা করবে? সময়ই বলে দেবে।
সিরিয়ার কুর্দিদের ভবিষ্যৎ কী? (১২ই ডিসেম্বর, ২০২৪)
ভূমিকা
“সিরিয়ার কুর্দিদের (Kurds) ভবিষ্যৎ কী?” – বর্তমান আন্তর্জাতিক আলোচনায় এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ পর্যালোচনা করলে শিরোনামগুলো দেখে মনে হবে যে বিদ্রোহীরা (Rebels) সিরিয়ার (Syria) সমস্ত এলাকা দখল করে নিয়েছে, আসাদ (Assad) ক্ষমতাচ্যুত হয়েছে, গুরুত্বপূর্ণ বড় শহরগুলো বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে, আর বিদ্রোহীদের প্রকৃত নেতা আবু মোহাম্মদ আল জিলানি (Abu Mohammed Al Jilani) দামেস্ক (Damascus)-এ বিজয়ী ভঙ্গিতে ছবি তুলছেন। কিন্তু বাস্তবতা এতটা সরল নয়। যদিও বিদ্রোহীরা এখন সিরিয়ার বেশিরভাগ জনগণকে নিয়ন্ত্রণ করছে, তারা ভূখণ্ডের (Territory) মাত্র অর্ধেকের সামান্য বেশি দখলে রেখেছে। বাকি বড় একটা অংশ — বিশেষ করে ইউফ্রেটিস (Euphrates) নদীর পূর্বদিকে — এখনও কুর্দিদের নিয়ন্ত্রণে আছে।
এই প্রবন্ধে আমরা সিরিয়ার ক্ষমতার বর্তমান বিভাজন, উত্তরপূর্বাঞ্চলে গড়ে ওঠা কুর্দি রাষ্ট্রের (de facto Kurdish state) পরিস্থিতি, এবং সিরিয়া সত্যিই কি দুই ভাগে বিভক্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে কি না, তা খতিয়ে দেখব।
সিরিয়ার ভূগোল: একটি প্রেক্ষাপট
সিরিয়া ভূখণ্ডের দিক থেকে বেশ বড় — প্রায় গ্রেট ব্রিটেনের (Great Britain) সমান — কিন্তু জনসংখ্যা তুলনামূলক কম, মাত্র ২ কোটি ২০ লাখের সামান্য বেশি। একটি জনবিভাগ মানচিত্রে চোখ বোলালে দেখা যাবে, সিরিয়ার বেশিরভাগ মানুষ পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চলে বসবাস করে। বিদ্রোহী আক্রমণ (Rebel Offensive) মূলত এই পশ্চিমাঞ্চলেই সংঘটিত হয়: এটি শুরু হয় উত্তর-পশ্চিমের শহর আলেপ্পো (Aleppo) থেকে এবং দক্ষিণ-পশ্চিমের রাজধানী দামেস্কের দিকে অগ্রসর হয়। বাকি জনসংখ্যার একটি বড় অংশ বাস করে ইউফ্রেটিস (Euphrates) নদীর ধারে — যেখানে রাক্কা (Raqqa) ও ডেইর এযর (Deir Ezur) শহরগুলি অবস্থিত — অথবা উত্তর-পূর্বাঞ্চলে খাবর (Khabr) নদীর তীরে। খাবর হচ্ছে ইউফ্রেটিসের একটি উপনদী, এবং এই অঞ্চলের প্রধান শহরগুলি হল আল হাসাকা (Al Hasaka) ও কামিশলি (Qwamishli), যা সিরিয়া-তুরস্ক (Turkey) সীমানার কাছাকাছি।
সিরিয়ার সুন্নি (Sunni) সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ মোটামুটি সমানভাবে সারা দেশে বিস্তৃত থাকলেও, সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠী ও ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলো নির্দিষ্ট এলাকায় কেন্দ্রীভূত। যেমন, আলাওয়াইট (Alawites) সম্প্রদায় (যে গোষ্ঠী থেকে আসাদ পরিবারের উত্থান) মূলত আনসুরিয়া (Ansuria) পর্বতমালার পশ্চিমদিক, অর্থাৎ তর্তুস (Tartus) ও লাতাকিয়া (Latakia) বন্দরনগরীগুলিতে বসবাস করে। ড্রুজ (Druze) সম্প্রদায় মূলত দক্ষিণে, সিরিয়া-জর্দান (Jordan) সীমান্তের আশপাশে বাস করে। অন্যদিকে, সিরিয়ার জনসংখ্যার প্রায় ১০% কুর্দি জনগোষ্ঠী প্রধানত উত্তরাঞ্চলে কেন্দ্রীভূত।
কুর্দিদের স্বায়ত্তশাসনের আকাঙ্ক্ষা
সিরিয়ার পাশাপাশি অন্যান্য দেশেও কুর্দিরা বরাবরই বেশি রাজনৈতিক স্বায়ত্তশাসন চেয়েছে। আরব বসন্তের (Arab Spring) পরে যখন সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ শুরু হয়, তারা এই সুযোগটি কাজে লাগায় এবং দ্রুতই ইউফ্রেটিস নদীর পূর্বদিকে সিরিয়ার উত্তর-পূর্বাঞ্চলে একটি নতুন স্বশাসিত রাষ্ট্রের ঘোষণা দেয়। এই রাষ্ট্রের আনুষ্ঠানিক নাম ছিল “অটোনোমাস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন অফ নর্থ অ্যান্ড ইস্ট সিরিয়া (Autonomous Administration of North and East Syria)”, তবে সাধারণভাবে এটি রোজাভা (Rojava) নামে পরিচিত।
রোজাভা (Rojava) সরাসরি কুর্দি রাষ্ট্র না হলেও, এটি স্পষ্টতই কুর্দি প্রভাববলয়ভুক্ত। এর সামরিক বাহিনী সিরিয়ান ডেমোক্র্যাটিক ফোর্সেস (Syrian Democratic Forces, সংক্ষেপে SDF) মূলত কুর্দি যোদ্ধাদের নেতৃত্বে পরিচালিত হয়। আবার এই অঞ্চলের প্রধান রাজনৈতিক দল ডেমোক্র্যাটিক ইউনিয়ন পার্টি (Democratic Union Party, সংক্ষেপে PYD) একটি কুর্দি ভিত্তিক সংগঠন। যদিও ২০১২ সাল থেকেই রোজাভা কার্যত স্বাধীনভাবে পরিচালিত হচ্ছে, এখন পর্যন্ত কোনো আন্তর্জাতিক সরকার বা প্রতিষ্ঠান এটিকে স্বীকৃতি দেয়নি, কাতালান (Catalan) সংসদ (Parliament) ২০২১ সালে এককভাবে স্বীকৃতি দেওয়া ছাড়া।
গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, রোজাভার প্রধান রাজনৈতিক গোষ্ঠীগুলো জোর দিয়ে বলছে তারা স্বাধীনতা চায় না; বরং ফেডারেল সিরিয়ার (Federal Syria) মধ্যে একটি স্বয়ত্ত্বশাসিত (Autonomous) অঞ্চল হিসাবে থাকতে চায়। ইরাকের (Iraq) কুর্দিস্তান (Kurdistan) অঞ্চলের মতো একটি মডেল তাদের পছন্দ।
রোজাভার সীমানা সম্প্রসারণ ও বর্তমান অবস্থা
গৃহযুদ্ধ চলাকালীন রোজাভার সীমানা ধীরে ধীরে সম্প্রসারিত হয়। এর পেছনে বড় ভূমিকা রাখে যুক্তরাষ্ট্রের (US) সাথে SDF-এর জোট, যেটি আইএস (ISIS) কে সিরিয়ার মধ্যাঞ্চল থেকে হটিয়ে দিতে কাজ করেছে। আইএস-কে পরাজিত করার ফলে রোজাভার ভূখণ্ড বেড়ে যায়।
২০১৯ সালে তুরস্ক (Turkey) উত্তর সিরিয়ায় একটি বাফার জোন (Buffer Zone) গঠনের লক্ষ্যে অভিযান চালায়, যাতে রোজাভা-তুরস্ক সীমান্তের কুর্দি উপস্থিতি দুর্বল করা যায়। এতে রোজাভা কিছু ভূখণ্ড হারায়। তবু বিগত কয়েক বছর ধরে, এসডিএফ ইউফ্রেটিস নদীর পূর্বদিকে অবস্থিত প্রায় পুরো সিরিয়া, এবং নদীর পশ্চিমে অবস্থিত কয়েকটি শহর নিয়ন্ত্রণ করছে, যেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হল মানবিজ (Manbij) ও ডেইর এযর (Deir Ezur)।
আসাদের পতনের পরের প্রশ্ন
আসাদ পতন হওয়ার আগে কেউ রোজাভার স্বাধীনতা নিয়ে খুব বেশি আলোচনায় যায়নি। কারণ তখন সিরিয়াকে অন্তত চারটি ক্ষুদ্র রাষ্ট্রে বিভক্ত বলা যেত, যার মধ্যে সীমানা পুনর্লিখন করা বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি করত। পাশাপাশি তখনো আশা ছিল আসাদ হয়তো ধীরে ধীরে পুরো দেশ পুনরুদ্ধার করতে পারবে।
কিন্তু এখন, আসাদ ক্ষমতা হারিয়েছে, এবং বিদ্রোহীরা (যাদের নেতৃত্ব দিচ্ছে হায়াত তাহরির আল-শাম (Hay’at Tahrir al-Sham), সংক্ষেপে এইচটিএস (HTS)) ধারণা মতে সিরিয়ার বাকি অংশ নিয়ন্ত্রণ করছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে রোজাভার ভবিষ্যৎ এখন এক অজানা প্রশ্ন। সম্ভাব্য তিনটি দৃশ্যপট এখানে দেখা যেতে পারে:
তিনটি সম্ভাব্য দৃশ্যপট (Three Potential Outcomes)
- বিদ্রোহী সরকার রোজাভাকে বলপূর্বক যুক্ত করা: প্রথম সম্ভাবনা হল নতুন বিদ্রোহী সরকার (Rebel Government) রোজাভাকে জোর করে নিজেদের সাথে যুক্ত করতে চাইতে পারে। এর ফলে বলপ্রয়োগের মাধ্যমে সিরিয়াকে ঐক্যবদ্ধ করা হবে। এটি তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রেচেপ তাইয়েপ এরদোয়ান (Recep Erdogan) সর্বোচ্চ সমর্থন দেবে, কারণ তিনিই বিদ্রোহীদের প্রধান আন্তর্জাতিক পৃষ্ঠপোষক। আসাদের পতনের পর থেকে তুরস্ক-সমর্থিত সিরিয়ান ন্যাশনাল আর্মি (Syrian National Army, সংক্ষেপে SNA) ইতোমধ্যে মানবিজে এসডিএফ অবস্থানের ওপর একটি ব্যর্থ আক্রমণ চালিয়েছে, যা শেষ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় এক অস্ত্রবিরতির (Ceasefire) মাধ্যমে থামে। প্রসঙ্গত, এরদোয়ান কখনই তুরস্কের সীমান্তে একটি স্বতন্ত্র কুর্দি রাষ্ট্রের অস্তিত্ব পছন্দ করে না। কারণ এটি তুরস্কের অভ্যন্তরে কুর্দি বিচ্ছিন্নতাবাদকে (Kurdish Separatist Sentiment) উসকে দিতে পারে, যা দীর্ঘদিন ধরে তুরস্কের রাজনীতিতে স্পর্শকাতর ইস্যু। পাশাপাশি এটি তুরস্কে সক্রিয় কুর্দি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর (Kurdish terror groups) ঘাঁটি হিসাবে কাজ করতে পারে। আসাদকে ক্ষমতা থেকে সরাতে এরদোয়ান বিদ্রোহীদের সমর্থন করেছে বটে, তবে মূল লক্ষ্য ছিল কুর্দিদের শক্তি খর্ব করা। তিনি ইতিমধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়নকে (EU) রোজাভার স্বাধীনতাকে স্বীকৃতি না দেওয়ার জন্য চাপ দিচ্ছেন। তবে এরদোয়ান ও বিদ্রোহীদের ইচ্ছা সত্ত্বেও রোজাভার ওপর পূর্ণাঙ্গ সামরিক আক্রমণের সম্ভাব্যতা এখন কম, কারণ তাতে এইচটিএস (HTS) এর “সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষা” সম্পর্কিত সাম্প্রতিক অবস্থান প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়বে এবং আবার এক গৃহযুদ্ধের পথ খুলে যেতে পারে।
- ফেডারেল কাঠামোর মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক সমন্বয়: দ্বিতীয় সম্ভাবনাটি, যা সম্ভবত সবচেয়ে আকাঙ্ক্ষিত ফলাফল, তা হল এইচটিএস নেতৃত্বাধীন নতুন সরকার রোজাভার সাথে একটি ফেডারেল কাঠামোতে একমত হবে। এতে রোজাভাকে যথেষ্ট স্বায়ত্তশাসন দেওয়া হবে, যেন তারা ফেডারেল সিরিয়ার অঙ্গ হিসাবে শান্তিপূর্ণভাবে যুক্ত হতে পারে। এই মুহূর্তে এটি অসম্ভব নয়, কারণ এইচটিএস সাধারণ মানুষের, বিশেষ করে কুর্দি জনগোষ্ঠীর অধিকার রক্ষা নিয়ে কথাবার্তা বলছে। অন্যদিকে, সাম্প্রতিক এসএনএ (SNA) আক্রমণ স্পষ্ট করেছে যে সামরিক বলপ্রয়োগে রোজাভাকে দখল করাও সহজ হবে না। ফলে ফেডারেল কাঠামোর মাধ্যমে ঐক্য একটি বাস্তবসম্মত সমাধান হতে পারে।
- সমঝোতা ব্যর্থ হলে স্বাধীনতার দিকে ধাবিত রোজাভা:তৃতীয় দৃশ্যপট হল নতুন বিদ্রোহী সরকার ও রোজাভার মধ্যে গ্রহণযোগ্য কোনো ফেডারেল চুক্তি না হওয়া। বিদ্রোহীরা বুঝতে পারবে যে শক্তি প্রয়োগ করে রোজাভাকে দখল করা সম্ভব নয়। এই পরিস্থিতিতে রোজাভা স্বাধীনতার দিকে যেতে পারে। এটি পুরোপুরি অপ্রত্যাশিত হবে না। এখন এইচটিএস সংখ্যালঘুদের অধিকার নিয়ে ইতিবাচক কথা বললেও, তারা ইসলামি আইন (Islamic Law) প্রতিষ্ঠায় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ, যা রোজাভার গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ (Secular) সংবিধানের সাথে সুসংগত নয়। রোজাভা কি বাস্তবিকভাবে স্বাধীন রাষ্ট্র হয়ে উঠতে পারবে, তা অনেকটাই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের স্বীকৃতির ওপর নির্ভর করবে। অন্য দেশগুলো যদি রোজাভার রাষ্ট্রত্ব (Statehood) মেনে নেয়, তবে সেটি চূড়ান্ত রূপ নিতে পারে।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা
এখানে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের (Donald Trump) ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। ধারণা করা হয় ট্রাম্প সিরিয়ায় অবস্থানরত প্রায় ৯০০ মার্কিন সেনা (US troops) সরিয়ে নেবেন, যারা এতদিন কুর্দিদের জন্য নিরাপত্তার গ্যারান্টি হিসেবে কাজ করেছে। যদি ট্রাম্প সত্যিই সৈন্য প্রত্যাহার করেন, তবে কুর্দিরা নিরাপত্তা ঝুঁকিতে পড়বে, বিশেষ করে যদি তারা স্বাধীনতা ঘোষণা করে।
তবে মনে রাখতে হবে, প্রথম মেয়াদে ট্রাম্প সৈন্য সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলেও শেষ পর্যন্ত তা পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি। এমনকি তুরস্ক কুর্দিদের ওপর আক্রমণের চেষ্টা করলে, ট্রাম্প তুরস্কের ওপর ব্যাপক অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা (Massive Sanctions) আরোপ করে এরদোয়ানকে অস্ত্রবিরতিতে বাধ্য করেছিলেন।
আবার যদি ট্রাম্প (বা যুক্তরাষ্ট্র) তুরস্ককে কুর্দিদের বিরুদ্ধে সরাসরি পদক্ষেপ নেওয়া থেকে নিবৃত্ত করতে পারেন, তবে রোজাভার ভবিষ্যৎ তুলনামূলক উজ্জ্বল হতে পারে।
উপসংহার
সিরিয়ার দীর্ঘস্থায়ী সংকটের মাঝে কুর্দিদের ভবিষ্যৎ এক অনিশ্চিত অধ্যায়। আসাদের পতনের পর পরিস্থিতি সম্পূর্ণ নতুন রূপ নিয়েছে। রোজাভা হয় ফেডারেল কাঠামোর মধ্যে থেকে স্বায়ত্তশাসিত হবে, নয়তো বলপ্রয়োগের আশঙ্কা থেকে আবার গৃহযুদ্ধের জন্ম দিতে পারে, অথবা স্বাধীনতার পথে হাঁটতে পারে। সবকিছু নির্ভর করবে বিদ্রোহী সরকার, তুরস্কের অবস্থান, যুক্তরাষ্ট্রের নীতি, এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের স্বীকৃতি ও হস্তক্ষেপের ওপর। সময়ই বলে দেবে, সিরিয়ার কুর্দিরা ভবিষ্যতে ঠিক কোন পথে এগোবে।
তথ্যসূত্র
1 – https://en.wikipedia.org/wiki/List_of_countries_and_dependencies_by_area
2 – https://www.heritageforpeace.org/syria-country-information/geography/
3 – https://en.wikipedia.org/wiki/Autonomous_Administration_of_North_and_East_Syria
4 – https://en.wikipedia.org/wiki/Syrian_Democratic_Forces
5 – https://www.greenleft.org.au/content/catalan-parliament-officially-recognises-rojava-administration
6 – https://x.com/vonderleyen/status/1866514863100703018
7 – https://www.bbc.co.uk/news/world-middle-east-50157439
8 – https://recognizemeproject.org/what-is-aanes/
9 – https://www.noemamag.com/inside-the-feminist-revolution-in-northern-syria/
10 – https://www.opendemocracy.net/en/north-africa-west-asia/journalism-rojava-ii-independent-media-between-freedom-and-control/
এরদোয়ান (Erdogan) কি আজীবনের জন্য তুরস্কের প্রেসিডেন্ট হবেন? (২৫ নভেম্বর, ২০২৪)
ভূমিকা
তাত্ত্বিকভাবে ২০২৮ সালটি তুরস্কের (Turkey’s) দীর্ঘ দশকব্যাপী এরদোয়ান (Erdogan) যুগের সমাপ্তি নির্দেশ করার কথা। তুরস্কের সংবিধান অনুযায়ী তার বর্তমান মেয়াদ ২০২৮ সালে শেষ হওয়ার পর, তিনি আর প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন না। তখন পর্যন্ত তিনি প্রায় ২৫ বছর ধরে তুরস্ককে শাসন করে আসবেন – প্রথমে প্রধানমন্ত্রী (Prime Minister) হিসেবে এবং পরবর্তীতে প্রেসিডেন্ট হিসেবে। তবে এর মধ্যে ব্যাপক জল্পনা-কল্পনা চলছে, বিশেষ করে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান ও তার মিত্রদের (allies) কিছু মন্তব্যকে ঘিরে, যে তিনি হয়তো এই মেয়াদের সীমা এড়িয়ে আরও একবার, এমনকি বারবার প্রেসিডেন্ট পদে প্রার্থী হতে চেষ্টা করবেন।
এই লেখায় আমরা দেখব এরদোয়ান কীভাবে ক্ষমতায় থাকার পথ খুঁজে পেতে পারেন, কীভাবে এটি কুর্দি (Kurdish) সংঘাতের (conflict) সাথে সম্পর্কিত, এবং এটি আদৌ কাজ করবে কিনা।
তুরস্কের বর্তমান সাংবিধানিক কাঠামো (Constitutional Setup) এবং এরদোয়ানের (Erdogan) অবস্থান
এরদোয়ান, একেপি বা ন্যায়বিচার ও উন্নয়ন পার্টির (Justice and Development Party, AKP) নেতা, ২০০৩ সালে তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী (Prime Minister) হিসেবে ক্ষমতায় আসেন, যখন দেশটি একটি সংসদীয় পদ্ধতির (Parliamentary System) রাষ্ট্র ছিল। দলীয় নিয়ম অনুযায়ী তিনি চতুর্থবার প্রধানমন্ত্রী পদে দাঁড়াতে পারতেন না, তাই ২০১৪ সালে তিনি প্রেসিডেন্ট পদে প্রার্থী হন। এটি ছিল তুর্কি প্রজাতন্ত্রের (Republic) ইতিহাসে প্রথম সরাসরি প্রেসিডেন্ট নির্বাচন (direct presidential election)।
যদিও প্রেসিডেন্টের পদটি ঐতিহ্যগতভাবে প্রতীকী (symbolic) ছিল, এরদোয়ান প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেওয়ার পর একটি সক্রিয় প্রেসিডেন্ট হিসেবে সংবিধানপ্রদত্ত সকল ক্ষমতা ব্যবহার করার ঘোষণা দেন। ২০১৬ সালে একটি ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থান (failed coup attempt) থেকে বেঁচে যাওয়ার পর, এরদোয়ান ২০১৭ সালের এক গণভোটে (referendum) অতি অল্প ব্যবধানে পাস করানো সাংবিধানিক সংশোধন (constitutional amendments) তত্ত্বাবধান করেন। এই সংশোধনীগুলো প্রধানমন্ত্রীর পদ (Prime Minister) বিলুপ্ত করে তুরস্ককে একটি প্রেসিডেন্সিয়াল পদ্ধতিতে (Presidential System) রূপান্তর করে, এবং ক্ষমতার বিপুল কেন্দ্রীকরণ এরদোয়ানের হাতে চলে আসে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, নতুন সংশোধিত সংবিধান অনুযায়ী, প্রেসিডেন্টের মেয়াদ হবে পাঁচ বছর, এবং একজন প্রেসিডেন্ট সর্বোচ্চ দুই মেয়াদ দায়িত্ব পালন করতে পারবেন। ২০১৮ সালে এরদোয়ান পুনর্নির্বাচিত হন, এবং ২০২৩ সালে তিনি আবারও পুনর্নির্বাচিত হন।
দ্বিতীয় মেয়াদের বিতর্ক এবং ২০২৩ সালের নির্বাচন
২০২৩ সালের নির্বাচনে এরদোয়ানের প্রার্থীতা নিয়ে বেশ বিতর্ক হয়েছিল। এর কারণ ছিল বিরোধীদের (opponents) দাবি—এরদোয়ান ২০১৪ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত এক মেয়াদ এবং ২০১৮ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত আরেক মেয়াদ পূর্ণ করেছেন। অর্থাৎ ২০২৩ সালের নির্বাচনে দাঁড়ানো তার তৃতীয়বার হতো, যা সংশোধিত সংবিধানের নির্দিষ্ট মেয়াদসীমা (term limit) লঙ্ঘন করত।
কিন্তু এরদোয়ান ও তার দল AKP যুক্তি দেখায় যে, ২০১৮ সালের নির্বাচন ছিল নতুন সংশোধিত সংবিধানের অধীনে অনুষ্ঠিত প্রথম প্রেসিডেন্ট নির্বাচন, তাই ওই নির্বাচনের পূর্ববর্তী সময়কে (২০১৪-২০১৮) এই নতুন আইনের হিসাবের মধ্যে ধরা যাবে না। এর ফলে ২০১৮ সালের নির্বাচনকে প্রথম মেয়াদ হিসেবে গণ্য করে ২০২৩ সালের নির্বাচনকে তার দ্বিতীয় মেয়াদ হিসেবে গণ্য করা সম্ভব হয়।
পরবর্তীতে তুরস্কের সুপ্রিম ইলেক্টোরাল কাউন্সিল (Supreme Electoral Council) বিরোধীদের অভিযোগ খারিজ করে এরদোয়ানের পক্ষে রায় দেয়। ফলশ্রুতিতে এরদোয়ান পুনরায় নির্বাচিত হন।
কেন মনে করা হচ্ছে এরদোয়ান আবারও প্রার্থী হতে চাইবেন?
এরদোয়ান পুনরায় নির্বাচন করতে পারেন—এই ধারণায় সম্প্রতি জোর পায় কারণ তার এক মিত্র (ally) মন্তব্য করেন যে, “যদি সন্ত্রাস (terror) নির্মূল করা হয়, মুদ্রাস্ফীতি (inflation) শক্তভাবে নিয়ন্ত্রণে আসে, এবং তুরস্ক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা (stability) অর্জন করে, তাহলে আমাদের প্রেসিডেন্টকে আরেকবার নির্বাচিত করা কি স্বাভাবিক এবং সঠিক পছন্দ হবে না?”
এর পাশাপাশি, এরদোয়ান নিজেই নতুন সংবিধানের (new constitution) কথা বলেছেন এবং ইঙ্গিত দিয়েছেন যে যতদিন আল্লাহ তাকে বাঁচিয়ে রাখবেন এবং জাতি (nation) তাকে সমর্থন দেবে, ততদিন তিনি তুরস্কের সেবা (serve) করে যেতে চান। এগুলো থেকে বোঝা যাচ্ছে যে তিনি হয়তো আবারও প্রার্থী হওয়ার পথ খুঁজছেন।
ক্ষমতায় থাকার সম্ভাব্য আইনগত পথ (Legal Pathways to Stay in Office)
যদি এরদোয়ান ২০২৮ সালের পরে ক্ষমতায় থাকতে চান, তাহলে আইনি দিক থেকে দুটি প্রধান উপায় আছে:
১. সংবিধান সংশোধন (Constitutional Amendment); প্রথম এবং সবচেয়ে সরল পথ হলো, তিনি বা পার্লামেন্ট (Parliament) সংবিধান সংশোধন করতে পারে। সেখানে হয়তো তৃতীয় মেয়াদের অনুমতি যোগ করা হবে, কিংবা মেয়াদসীমা সম্পূর্ণ তুলে দেওয়া হবে। তবে এটি সহজ কাজ নয়। সংবিধান অনুযায়ী, কোনো সংশোধনী পাস করতে পার্লামেন্টে তিন-দুই-ভাগের (2/3) সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রয়োজন, যা ৬০০-সদস্যবিশিষ্ট তুর্কি গ্র্যান্ড ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলিতে (Turkish Grand National Assembly) ৪০০ ভোটের সমান। বিকল্পভাবে, ৩/৫ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্থাৎ ৩৬০ ভোট পাওয়া গেলে ওই সংশোধনী গণভোটে (referendum) দেওয়া যেতে পারে। সুতরাং, সংবিধান পরিবর্তনে কমপক্ষে ৩৬০ ভোট প্রয়োজন। বর্তমানে রয়টার্সের (Reuters) তথ্য অনুযায়ী, এরদোয়ানের AKP ও তার মিত্রদের হাতে ৩২১টি আসন আছে, যা প্রয়োজনের থেকে বেশ কম।
২. আগাম নির্বাচন আহ্বান (Early Elections) এবং মেয়াদের নতুন হিসাব: আরেকটি পথ হলো সাংবিধানিক নিয়ম অনুযায়ী, যদি প্রেসিডেন্টের দ্বিতীয় মেয়াদের (second term) মধ্যে পার্লামেন্ট আগাম নির্বাচন (early election) আহ্বান করে, তবে ওই প্রেসিডেন্ট আবারও প্রার্থী হতে পারেন। অর্থাৎ, মেয়াদ শেষে অপেক্ষা না করে, দ্বিতীয় মেয়াদ চলাকালীন যদি পার্লামেন্ট নির্দিষ্ট সংখ্যাগরিষ্ঠতায় আগাম নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে এরদোয়ানের আবারও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সুযোগ তৈরি হবে। তবে এটিও সহজ নয়, কারণ আগাম নির্বাচন ডাকতে পার্লামেন্টে ৩/৫ সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রয়োজন, যা আবার সেই ৩৬০ ভোটের বাধা সামনে নিয়ে আসে। অর্থাৎ, যে পথই বেছে নেওয়া হোক, এরদোয়ানকে কমপক্ষে ৩৬০ ভোটের সমর্থন জোগাড় করতে হবে, যা তার বর্তমান সংখ্যা থেকে বেশ দূরে।
কুর্দি (Kurdish) সংঘাত এবং অতিরিক্ত ভোট জোগাড়ের কৌশল
এই পর্যায়ে কুর্দি সংঘাত (Kurdish conflict) ও রাজনৈতিক সমীকরণ সামনে আসে। সাম্প্রতিক সময়ে, এরদোয়ান ও তার মিত্ররা কুর্দি দলের সাথে একটি ঐক্যমূলক বা সমঝোতামূলক অবস্থান নিচ্ছেন বলে পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, দেবলেত বাহচেলি (Devlet Bahçeli), যিনি জাতীয়তাবাদী এমএইচপি (MHP) দলের নেতা এবং এরদোয়ানের মিত্র, তিনি সম্প্রতি পার্লামেন্টের অধিবেশনের (opening of Parliament) দিন পিপলস ইকুয়ালিটি অ্যান্ড ডেমোক্রেসি পার্টি (People’s Equality and Democracy Party, DEM)-এর সংসদ সদস্যদের সঙ্গে করমর্দন করেন। এই DEM দলটি একটি প্রো-কুর্দি (pro-Kurdish) দল, যাকে বাহচেলি অতীতে নিষিদ্ধ করার দাবি জানিয়েছেন এবং যাকে তিনি সশস্ত্র ও নিষিদ্ধঘোষিত কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টি (Kurdistan Workers Party, PKK)-এর এক্সটেনশন (extension) বলে মনে করেন।
এছাড়াও, বাহচেলি একটি নজিরবিহীন বক্তব্য দেন—যেখানে তিনি ইঙ্গিত করেন, যদি PKK নেতা আব্দুল্লাহ ওচালান (Abdullah Öcalan) সহিংসতা ত্যাগ করে এবং তার গ্রুপ ভেঙে দেন, তাহলে তাকে প্যারোলে (parole) মুক্তির বিষয়ে ভাবা যেতে পারে। এটা বাহচেলির মতো কট্টরপন্থী জাতীয়তাবাদের ধারক নেতার কাছ থেকে অত্যন্ত অপ্রত্যাশিত ইঙ্গিত।
এরপর এরদোয়ান এই ঘটনাকে “ঐতিহাসিক সুযোগের জানালা” (historic window of opportunity) বলে আখ্যা দেন। এরপর খবর বেরোয় যে ওচালান, যিনি ১৯৯৯ সাল থেকে কারাগারে আছেন, তিনি ৪৩ মাস পর প্রথমবারের মতো পরিবারের সদস্যদের সাথে সরাসরি দেখা করার অনুমতি পেয়েছেন।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, এই ধরনের উদ্যোগ DEM পার্টির সমর্থন আদায়ের উদ্দেশ্যে হতে পারে, যাতে ভবিষ্যতে ৩৬০ ভোট সংগ্রহ করে সংবিধান সংশোধন বা আগাম নির্বাচন ডাকার সুযোগ পাওয়া যায়। এটি এক ধরনের “ক্যারট অ্যান্ড স্টিক” (carrot and stick) কৌশল হতে পারে, যেখানে একদিকে কুর্দিদের প্রতি ইতিবাচক ইঙ্গিত দেওয়া হচ্ছে, অন্যদিকে এখনও কিছু নির্বাচিত কুর্দি স্থানীয় রাজনীতিকদের বরখাস্ত করা হচ্ছে।
আঞ্চলিক ভূ-রাজনীতি (Regional Geopolitics) এবং কুর্দি সমস্যা
এরদোয়ান ও তার মিত্রদের এই কুর্দি সংলাপ শুধুমাত্র নির্বাচনী রাজনীতির জন্য নয়, আঞ্চলিক ভূ-রাজনৈতিক (geopolitical) অবস্থাও এর পেছনে কাজ করছে। মধ্যপ্রাচ্য (Middle East) এখন অস্থির, বিশেষ করে ইরাক (Iraq) ও সিরিয়া (Syria) সংলগ্ন এলাকাগুলো, যেখানে তুরস্কের স্বার্থ জড়িয়ে আছে।
ইরান-সমর্থিত (Iran-backed) গোষ্ঠীগুলো এসব অঞ্চলে দুর্বল হচ্ছে, ইসরায়েল (Israel) তাদের উপর চাপ প্রয়োগ করছে, এবং যুক্তরাষ্ট্র (United States) ইরাকে তাদের আইএস-বিরোধী (anti-IS) মিশন গুটিয়ে আনতে প্রস্তুত হচ্ছে। এতে সিরিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনে থাকা কুর্দি গ্রুপগুলোর উপরও প্রভাব পড়তে পারে। এই প্রেক্ষাপটে, এরদোয়ানের দেশীয় ফ্রন্টকে মজবুত করা এবং তুরস্কের স্বার্থ সুরক্ষিত করা জরুরি হয়ে পড়েছে। কুর্দিদের সাথে একটি সমঝোতা এ ক্ষেত্রে ঘরোয়া স্থিতিশীলতা আনতে পারে।
চার দশকের কুর্দি-তুরস্ক সংঘাতের মীমাংসার কঠিনতা
তবে ৪০ বছরের পুরনো তুরস্ক-PKK সংঘাত (conflict) মেটানো মোটেও সহজ ব্যাপার নয়। এমনকি যখন এই কূটনৈতিক তৎপরতা চলছিল, ঠিক তখনই একটি সন্ত্রাসী হামলায় (terror attack) একটি শীর্ষস্থানীয় তুর্কি প্রতিরক্ষা প্রতিষ্ঠানে (Turkish defense company) বোমা বিস্ফোরণে ৫ জন নিহত হন। কর্তৃপক্ষ এ ঘটনার জন্য PKK-কে দায়ী করে। এই ঘটনার পরপরই তুর্কি সামরিক বাহিনী (Turkish military) ইরাকের উত্তরাঞ্চলে (northern Iraq) কুর্দি লক্ষ্যবস্তুতে পাল্টা আক্রমণ করে।
উপসংহার
২০২৮ সালের পরে এরদোয়ান ক্ষমতায় থাকতে পারবেন কিনা তা এখনো নিশ্চিত নয়। এটি নির্ভর করছে তিনি কি সংবিধান সংশোধন করতে পারবেন, না কি আগাম নির্বাচন ডাকতে সক্ষম হবেন, সেইসাথে পার্লামেন্টে প্রয়োজনীয় ৩৬০ ভোট সংগ্রহ করতে পারবেন কিনা তার উপর। এ ছাড়া কুর্দি সংলাপ, আঞ্চলিক ভূ-রাজনীতি এবং বিভিন্ন অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব মিলে পরিস্থিতি জটিল করছে।
যদিও এরদোয়ান আস্থা প্রকাশ করেছেন যে আল্লাহ তাকে বাঁচিয়ে রাখবেন এবং জাতি তাকে সমর্থন দেবে, তবুও আইনি, রাজনৈতিক এবং কূটনৈতিক বাধাগুলো অতিক্রম করা সহজ হবে না। তুরস্কের ভবিষ্যৎ রাজনীতিতে এই বিষয়গুলো কীভাবে মোড় নেয়, তা সময়ই বলে দেবে।
তথ্যসূত্র
1 – https://www.theguardian.com/world/2014/aug/10/turkey-presidential-election-ergodan
2 – https://bianet.org/haber/presidential-term-limits-don-t-apply-to-erdogan-top-election-body-concludes-276802
3 – https://www.reuters.com/world/middle-east/erdogan-ally-floats-turkey-constitutional-amendment-let-him-extend-his-tenure-2024-11-05/
4 – https://www.turkiyetoday.com/turkiye/erdogan-can-run-for-a-3rd-term-77852/
5 – https://www.dw.com/en/whats-behind-turkish-president-erdogans-outreach-to-kurds/a-70824425
6 – https://apnews.com/article/turkey-nationalist-leader-pkk-parole-edc203115d8e1af1b584faae8cb824ff
7 – https://carnegieendowment.org/emissary/2024/10/turkey-pkk-ocalan-offer-terror-attack-why?lang=en
8 – https://www.duvarenglish.com/jailed-pkk-leader-abdullah-ocalan-allowed-to-meet-family-after-43-months-says-he-has-power-to-move-process-from-violence-to-politics-news-65151
9 – https://www.dw.com/en/whats-behind-turkish-president-erdogans-outreach-to-kurds/a-70824425
10 – https://www.anayasa.gov.tr/media/7258/anayasa_eng.pdf
কেন ট্রাম্প-পরবর্তী সময়ে এরদোয়ান তুরস্কের ইইউ অন্তর্ভুক্তি আলোচনা পুনরায় শুরু করতে চাইছেন (১২ নভেম্বর, ২০২৪)
ভূমিকা
ট্রাম্প (Trump) পরবর্তী সময়ে তুরস্কের (Turkey) ইউরোপীয় ইউনিয়নে (European Union – EU) অন্তর্ভুক্ত হওয়া এক প্রকার অকল্পনীয় বলে মনে হতে পারে। তুরস্ক প্রায় অর্ধ শতাব্দী ধরে ইইউ-তে অন্তর্ভুক্তির অপেক্ষায় আছে। দেশটি প্রথম ইউরোপীয় অর্থনৈতিক সম্প্রদায়ের (European Economic Community – EEC) সাথে যুক্ত হওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছিল অনেক আগেই, কিন্তু একবিংশ শতকের মাঝামাঝি থেকেই এই প্রক্রিয়া কার্যত স্থবির হয়ে আছে।
কিন্তু ২০২৪ সালের মার্কিন নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের (Donald Trump) বিজয়ের পরপরই বুদাপেস্টে (Budapest) অনুষ্ঠিত ইউরোপীয় রাজনৈতিক সম্প্রদায় শীর্ষ সম্মেলনে (European Political Community Summit) (যা ট্রাম্পের জয়ের পরের দিনেই হয়) এরদোয়ান সবার ধারণাকে চমকে দিয়ে পুনরায় ইইউ অন্তর্ভুক্তির ইচ্ছা ব্যক্ত করেন। তিনি জোর দিয়ে বলেন যে, তুরস্ককে যে কোনো নতুন ইউরোপীয় নিরাপত্তা কাঠামোতে (European security architecture) ভূমিকা রাখতে হবে। এই লেখায় তুরস্ক-ইইউ সম্পর্কের ইতিহাস পর্যালোচনা করা হবে, দেখা হবে কীভাবে এরদোয়ান ইউরোপের নিরাপত্তা নিয়ে ট্রাম্প-পরবর্তী উদ্বেগকে কাজে লাগাতে চাইছেন, এবং এ প্রচেষ্টা আদৌ ফলপ্রসূ হতে পারে কিনা।
তুরস্ক-ইইউ সম্পর্কের পটভূমি
তুরস্ক-ইইউ সম্পর্ককে মোটামুটি তিনটি পর্বে ভাগ করা যায়:
- প্রথম পর্ব (২০০৫ সালের পূর্বে),
- দ্বিতীয় পর্ব (২০০৫ সালে আনুষ্ঠানিক আলোচনা শুরুর পর), এবং
- তৃতীয় পর্ব (২০১৬ সাল ও তদপরবর্তীকালে)।
২০০৫ সালের পূর্বে
২০০৫ সালের পূর্বে তুরস্ক ধীরে ধীরে ইউরোপের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল এবং মনে হচ্ছিল একসময় দেশটি ইউরোপীয় সম্প্রদায়ের (European Community) পূর্ণ সদস্যপদ পেতে পারে। তুরস্ক ১৯৬৩ সালে ইউরোপীয় অর্থনৈতিক সম্প্রদায়ের (European Economic Community – EEC) সহযোগী সদস্যপদ লাভ করে। এরপর ১৯৮৭ সালে পূর্ণ সদস্য হওয়ার আবেদন করে। ১৯৯৫ সালে দেশটি ইইউর সাথে শুল্ক ইউনিয়ন (Customs Union) চুক্তি স্বাক্ষর করে। ১৯৯৯ সালে তুরস্ককে আনুষ্ঠানিকভাবে পূর্ণ সদস্যপদের প্রার্থী (Candidate) হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
১৯৯৯ সাল থেকে ২০০৫ পর্যন্ত সময়ে তুরস্কের ইইউ অন্তর্ভুক্তির সম্ভাবনা জোরদার ছিল। ২০০৩ সালে এরদোয়ান (Erdogan) যখন প্রধানমন্ত্রী হন, তখন ইইউ অন্তর্ভুক্তির সম্ভাবনাকে ব্যবহার করে তিনি দেশের সেনাবাহিনীকে রাজনীতি থেকে দূরে রাখতে এবং কিছু অভ্যন্তরীণ সংস্কার চালু করতে সক্ষম হন। এসব সংস্কারের মধ্যে ছিল মৃত্যুদণ্ড বিলুপ্তকরণ এবং কুর্দি ভাষায় (Kurdish language) সম্প্রচার অনুমোদন।
২০০৫ সাল এবং তার পরবর্তী সময়
২০০৫ সালে তুরস্ক আনুষ্ঠানিকভাবে ইইউ অন্তর্ভুক্তির আলোচনা শুরু করে। কিন্তু এরদোয়ানের জন্য দুর্ভাগ্যজনকভাবে, আলোচনা শুরু হতেই স্পষ্ট হয় যে তুরস্কের শীঘ্র ইইউ সদস্য হওয়া প্রায় অসম্ভব। প্রায় দুই দশকের আলোচনায় ৩৫টি প্রয়োজনীয় অধ্যায়ের (Chapters) মধ্যে মাত্র ১৬টিতে আলোচনা শুরু হয়েছে, এবং এর মধ্যে কেবল একটিই – বিজ্ঞান ও গবেষণা (Science and Research) – সাময়িকভাবে সম্পন্ন ঘোষণা করা গেছে।
২০০৫ সালে যখন পরিষ্কার হয়ে যায় যে তুরস্কের অন্তর্ভুক্তি জটিল ও দীর্ঘমেয়াদী হবে, তখন ইউরোপীয় নেতারা আলোচনা অনিশ্চিত ও দীর্ঘমেয়াদী প্রক্রিয়া হিসেবে চিহ্নিত করেন এবং কোনো সুনির্দিষ্ট সময়সীমা বা নিশ্চয়তা দেননি। পরবর্তী প্রায় এক দশক আলোচনা ক্ষীণ গতিতে এগিয়েছে, কিন্তু আসলে ২০১৬ সালে পরিস্থিতি আরও পরিষ্কার হয়ে যায় যে তুরস্ক শীঘ্রই ইইউ সদস্য হবার মতো অবস্থায় নেই।
২০১৬ সাল থেকে উত্তেজনা বৃদ্ধি
২০১৬ সালে ইইউ-তুরস্ক সম্পর্কের ক্ষেত্রে দুটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে।
- প্রথমত, বছরের শুরুতে ইইউ ও তুরস্কের মধ্যে একটি অভিবাসন চুক্তি (Migrant Deal) স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তি অনুযায়ী তুরস্ক মধ্যপ্রাচ্য (Middle East) থেকে ইউরোপে অভিবাসনপ্রত্যাশীদের আগমন নিয়ন্ত্রণ করবে, বিনিময়ে তুরস্ক আর্থিক সহযোগিতা পাবে বিলিয়ন ইউরো পরিমাণ। এই চুক্তি তুরস্কের ইইউ অন্তর্ভুক্তির আলোচনাকে ত্বরান্বিত করার কথা ছিল, কিন্তু তা না হওয়ায় সম্পর্ক আরও খারাপ হয়ে যায়। বরং এই চুক্তি এরদোয়ানের হাতে একপ্রকার বিরক্তিকর চাপ সৃষ্টির ইঙ্গিত দেয়, কারণ অভিবাসন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে তিনি ইউরোপকে চাপে রাখতে পারেন।
- দ্বিতীয়ত, জুলাইয়ে তুরস্কে একটি ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থান (Failed Coup) ঘটে, যা এরদোয়ান অল্পের জন্য এড়িয়ে যান। অভ্যুত্থানের পর ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিক্রিয়া ছিল বেশ মৃদু এবং দেরি। ইইউ এতে যথেষ্ট জোরালোভাবে এরদোয়ানপন্থী অবস্থান নেয়নি, বরং অভ্যুত্থানের পরে সিভিল সার্ভেন্টদের ব্যাপক বহিষ্কার (Purge) এবং দমনমূলক নীতির সমালোচনা করে। এটি এরদোয়ানকে ক্ষুব্ধ করে।
ফলশ্রুতিতে, ২০১৬ সালের পর থেকে তুরস্ক-ইইউ সম্পর্ক ক্রমাগত উত্তেজনাপূর্ণ হয়ে ওঠে। এর সাথে যুক্ত হয়েছে উত্তর সাইপ্রাসে (Turkish Republic of Northern Cyprus) তুরস্কের সমর্থন – একটি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত নয় এমন রাষ্ট্র কাঠামো, ভূমধ্যসাগরের (East Mediterranean) সমুদ্রসীমা নিয়ে তুরস্কের বিস্তৃত দাবি যা সমুদ্র আইন সংক্রান্ত জাতিসংঘ সনদ (UN Convention on the Law of the Sea) লঙ্ঘন করে, এবং উত্তর সিরিয়ায় (Northern Syria) তুর্কি সেনা অভিযানের কারণে সৃষ্ট উত্তেজনা। তুরস্ক এসব অভিযানকে কুর্দি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর (Kurdish terrorist groups) বিরুদ্ধে লড়াই বলে অভিহিত করে থাকে।
এদিকে, এরদোয়ান স্পষ্টভাবে বারবার বলেছেন যে তিনি ইইউতে যোগ দিতে আগ্রহী। উদাহরণস্বরূপ, ২০২৩ সালে তিনি বলেছিলেন যে তিনি সুইডেনকে (Sweden) ন্যাটোতে (NATO) প্রবেশের সুযোগ দেবেন কেবল তখনই, যদি ইইউ তুরস্ককে ইউনিয়নে অন্তর্ভুক্ত করে। এরপর গত সপ্তাহে, বৃহস্পতিবার, বুদাপেস্টে ৫ম ইউরোপীয় রাজনৈতিক সম্প্রদায় শীর্ষ সম্মেলনে (5th European Political Community Summit in Budapest) (যা ট্রাম্পের জয়ের পরের দিনই অনুষ্ঠিত হয়) এরদোয়ান ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাক্রোঁকে (Emmanuel Macron) বলেন যে তিনি এখনও ইইউতে যোগ দিতে ইচ্ছুক। তিনি সাইপ্রাসের প্রেসিডেন্ট নিকোস ক্রিস্তোদুলাইদেস (Nikos Christodoulides), গ্রিসের (Greece) প্রধানমন্ত্রী এবং আলবানিয়ার (Albania) প্রধানমন্ত্রীর সাথেও বৈঠক করেন। এই প্রথমবারের মতো এরদোয়ান সাইপ্রাসের প্রেসিডেন্টের সাথে বৈঠকে বসেন। এটি ইইউর নজরে পড়বে নিশ্চয়ই, কারণ ইইউ অনেকদিন ধরেই তুরস্ককে সাইপ্রিয়ট (Cypriot) সরকারকে স্বীকৃতি দিতে আহ্বান জানিয়ে আসছে।
আরও আকর্ষণীয় হলো, এরদোয়ান সম্প্রতি কুর্দি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের (Kurdish separatists) প্রতি ইতিবাচক সংকেত দিচ্ছেন, যাদের মধ্যে কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টি (Kurdistan Workers’ Party – PKK) অন্তর্ভুক্ত, যা সাধারণভাবে একটি সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে বিবেচিত। অক্টোবরে এরদোয়ান হঠাৎ ঘোষণা করেন, যদি পিকেকে (PKK) নেতা সহিংসতা পরিত্যাগের ঘোষণা দেন, তবে তাকে মুক্ত করা যেতে পারে এবং তথাকথিত “কুর্দি প্রশ্ন” (Kurdish Question) সমাধানে রাজনৈতিক সংলাপ শুরু করা যেতে পারে। এটি ঘটলে ইইউর কাছে একটি ইতিবাচক বার্তা যাবে, কারণ ইইউ পূর্বে তুরস্কের কুর্দি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দমনে কঠোর নীতির সমালোচনা করেছিল।
এরদোয়ানের আকস্মিক আগ্রহের পেছনের কারণ
এরদোয়ানের হঠাৎ ইইউ-তে পুনরায় অন্তর্ভুক্তির আগ্রহের পেছনে কারণ কী? ওই দিন পরে এরদোয়ান সাংবাদিকদের বলেন যে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিরক্ষা প্রচেষ্টায় তুরস্কের পূর্ণ অন্তর্ভুক্তি ইউরোপের শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য অপরিহার্য (Indispensable)। কথা ঘুরিয়ে বললে, এরদোয়ান যেন বোঝাতে চাইছেন যে ট্রাম্প-পরবর্তী সময়ে, ইউরোপ যখন যুক্তরাষ্ট্রের (US) উপর নির্ভরতা কমিয়ে একটি স্বতন্ত্র নিরাপত্তা কাঠামো গড়ে তুলতে চাইছে, তখন তুরস্ক এ ব্যাপারে উপযোগী অংশীদার হতে পারে।
তুরস্কের সামরিক বাহিনীর আকার ইউরোপের যেকোনো দেশের তুলনায় বড়, সেনাসংখ্যা প্রায় ৩৫০,০০০ জনেরও বেশি। এছাড়া তুরস্কের একটি স্বনির্ভর ও বিকশিত প্রতিরক্ষা শিল্প (Military Industrial Complex) রয়েছে। তুর্কি বাইরাক্তার (Bayraktar) ড্রোন সারা বিশ্বেই স্বীকৃত; তুরস্কের নৌবাহিনীর ড্রোন তামালিন (Naval drone Tamalin) ন্যাটো মহড়ায় অংশ নিয়েছে। এরদোয়ান বুঝতে পেরেছেন যে ইউরোপ রাশিয়ার (Russia) সম্ভাব্য আগ্রাসন নিয়ে উদ্বিগ্ন, বিশেষ করে যদি ট্রাম্প ন্যাটো (NATO) থেকে সরে যান বা ন্যাটোকে দুর্বল করেন। এরদোয়ান এই পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে ইউরোপকে একপ্রকার “তুর্কি নিরাপত্তা গ্যারান্টি” দিতে চাইছেন, বিনিময়ে ইইউ অন্তর্ভুক্তি অর্জনের লক্ষ্যে।
এই কৌশল কি ফল দেবে?
নিরাপত্তা ইস্যুকে ব্যবহার করে ইউরোপের উপর প্রভাব বাড়ানোর এই কৌশল আসলে ব্রিটিশ (British) ধাঁচের। যুক্তরাজ্যের (UK) বিভিন্ন প্রধানমন্ত্রী আগে ইউরোপের সাথে সম্পর্কের সময় তাদের সামরিক শক্তিকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করেছেন। উদাহরণস্বরূপ, টনি ব্লেয়ার (Tony Blair) ১৯৯৮ সালের সেন্ট মালো (Saint Malo) ঘোষণার মাধ্যমে ইইউকে একটি শক্তিশালী নিরাপত্তামূলক ফেডারেশন তৈরির প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন। সাম্প্রতিককালে কিয়ার স্টারমার (Keir Starmer) যুক্তরাজ্যের ইইউর সাথে একটি নিরাপত্তা চুক্তির সম্ভাবনা দেখিয়ে ব্রেক্সিট (Brexit) চুক্তি পুনর্বিন্যাসের চেষ্টা করছেন।
কিন্তু এসব প্রচেষ্টা সাধারণত সফল হয় না, কারণ ন্যাটো ইতোমধ্যেই ইউরোপের বেশিরভাগ দেশকে প্রতিরক্ষার নিশ্চয়তা দিচ্ছে। আর তুরস্কের ক্ষেত্রে আরও একটি ব্যাপার আছে: তুরস্ককে ইইউ-তে অন্তর্ভুক্ত করা রাজনৈতিক ও লজিস্টিক্যালি (Logistically and Politically) কঠিন। তুরস্ক ইইউর সদস্য হলে, দেশটি হবে জনসংখ্যার ভিত্তিতে সবচেয়ে বড় সদস্য রাষ্ট্র। এতে করে ইইউর মুক্ত শ্রমবাজার (Freedom of Movement) নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হবে, বিশেষত ইউরোপের কিছু দেশে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের বাসিন্দাদের অবাধ প্রবেশ নিয়ে আগেই উদ্বেগ আছে।
এছাড়া তুরস্ক ইতোমধ্যেই ন্যাটোর সদস্য, ঠিক যেমন যুক্তরাজ্য ছিল। ফলে তুরস্কের জন্যও একই সমস্যা দেখা দেবে। শুধুমাত্র যদি ট্রাম্প সত্যিই ন্যাটো ভেঙে দেন বা ন্যাটো থেকে বের হয়ে যান, তখন তুরস্ক হয়তো তাদের শক্তিশালী সামরিক ক্ষমতা ব্যবহার করে ইইউর সাথে কমপক্ষে আরও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলার সুযোগ পেতে পারে। কিন্তু এখনকার বাস্তবতায়, এটি সহজ হবে না।
উপসংহার
সংক্ষেপে, ট্রাম্প-পরবর্তী ইউরোপীয় নিরাপত্তা উদ্বেগকে কাজে লাগিয়ে তুরস্ক ইইউ অন্তর্ভুক্তির আলোচনায় নতুন করে গতি আনতে চায়। এরদোয়ান জানেন যে ইউরোপ এখন আরও স্বায়ত্তশাসিত নিরাপত্তা কাঠামো গড়তে চাইছে, যেখানে তুরস্কের ব্যাপক সামরিক শক্তি কাজে লাগতে পারে। তবে তা সত্ত্বেও, ইইউর অভ্যন্তরীণ জটিলতা, অভিবাসন-সংশ্লিষ্ট উদ্বেগ, এবং ন্যাটোর উপস্থিতি তুরস্কের অন্তর্ভুক্তিকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলবে। শেষ পর্যন্ত, এই কৌশল ইইউর সাথে সম্পূর্ণ অন্তর্ভুক্তির নিশ্চয়তা না দিলেও, ভবিষ্যতে অন্তত সম্পর্ক উন্নয়নের দরজা কিছুটা উন্মুক্ত রাখতে পারে।
কেন তুরস্ক অবশেষে এরদোয়ানকে নিয়ে বিরক্ত? (১০ অক্টোবর, ২০২৪)
ভূমিকা
পশ্চিমা গণমাধ্যম (western media) সাধারণত খুব একটা স্বীকার করে না, কিন্তু তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রেচেপ তাইয়্যেপ এরদোয়ান (Recep Tayyip Erdogan) তার অধিকাংশ শাসনামলে সত্যিকারের জনপ্রিয় ছিলেন। এরদোয়ানের সংস্কারপন্থী ইসলামবাদ (reformist Islamism) বহু তুর্কি ভোটারের মনে সাড়া জাগিয়েছিল, এবং তিনি এক চিত্তাকর্ষক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি (economic growth) ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার (political stability) সময়কালে দেশ পরিচালনা করেন, বিশেষ করে তুরস্কের মানদণ্ড অনুযায়ী। তা সত্ত্বেও, ২০২৩ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অল্পের জন্য জিতলেও, সাম্প্রতিক জনমত জরিপ ইঙ্গিত দিচ্ছে যে এরদোয়ান ও তার একে পার্টির (AKP party) প্রতি সমর্থন এখন ইতিহাসের সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে গেছে। এই লেখায় আমরা দেখব এরদোয়ানের রাজনৈতিক ক্যারিয়ার, কেন তিনি এত জনপ্রিয় হয়েছিলেন এবং কেন এখন আর তা নেই। উল্লেখ্য, এর পেছনে মূল কারণ হলো অর্থনীতি (the economy)।
এরদোয়ানের উত্থান
প্রাথমিক প্রেক্ষাপট দিয়ে শুরু করা যাক। এরদোয়ান প্রথম জাতীয় পর্যায়ে খ্যাতি অর্জন করেন ১৯৯৪ সালে, যখন তিনি ইস্তানবুলের মেয়র নির্বাচিত হন। তিনি তখন তুরস্কের ইসলামী রাজনৈতিক আন্দোলনের একটি উদীয়মান তারকা ছিলেন। পরিপ্রেক্ষিতে, তুরস্ক প্রধানত মুসলিমপ্রধান দেশ হলেও এটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল একটি ধর্মনিরপেক্ষ প্রজাতন্ত্র (secular republic) হিসেবে, তুরস্কের প্রথম প্রেসিডেন্ট মুস্তাফা কামাল আতাতুর্কের (Mustafa Kemal Ataturk) অধীনে। তখন আতার্তুক যুক্তি দিয়েছিলেন, আধুনিকায়ন ও অর্থনৈতিক সাফল্যের জন্য তুরস্ককে অটোমান সাম্রাজ্যের (Ottoman Empire) ইসলামী রাজনৈতিক ব্যবস্থা ত্যাগ করতে হবে এবং পশ্চিমা ধর্মনিরপেক্ষতা (western secularism) গ্রহণ করতে হবে।
তুরস্কের ধর্মনিরপেক্ষতা (Secularism) ও এর শিকড়
তবে আতার্তুকের ধর্মনিরপেক্ষতার ব্র্যান্ড (যাকে কেমালিজম (Kemalism) বলা হয়) ছিল একটি অত্যন্ত কঠোর ধর্মনিরপেক্ষতা (strict secularism)। এটি শুধু রাষ্ট্র ও ধর্মের পৃথকীকরণ (separation of religion from the state) নয়, বরং রাষ্ট্রের একটি সক্রিয় প্রয়াস ছিল ধর্মকে সম্পূর্ণ প্রায় রাষ্ট্রীয় ও জনপরিসর থেকে দূরে রাখা। ফ্রান্সের লাইসিত (Laïcité) ধারণার সাথে তুলনীয় এই কঠোর ধর্মনিরপেক্ষতার বিরুদ্ধে বরাবরই প্রতিরোধ ছিল। ইসলামীপন্থী এলিট (islamist elites) ছাড়াও তুরস্কের বেশিরভাগ ভোটার বরাবরই তুলনামূলকভাবে বেশি ইসলামী মানসিকতার (islamist minded) দলের পক্ষে ভোট দিয়েছেন। যদিও তারা সচরাচর নিজেদেরকে ‘ইসলামিস্ট’ হিসেবে পরিচয় দিতেন না, বরং ‘রক্ষণশীল (conservative)’ বা ‘জাতীয়তাবাদী (nationalist)’ বলতেই পছন্দ করতেন। যখনই এই দলগুলো কেমালিজম (Kemalism) থেকে অনেক দূরে সরে যেত, সামরিক বাহিনী (the military) হস্তক্ষেপ করে সরকার ফেলে দিত। সামরিক বাহিনী নিজেদের কেমালিজমের রক্ষক বলে মনে করত, এবং ১৯৬০ থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত চারটি সরকার উৎখাত করে।
সামরিক হস্তক্ষেপ, কারাদণ্ড, একে পার্টির (AKP) ক্ষমতা দখল ও স্থিতিশীলতা
এরদোয়ান নিজেও ১৯৯৮ সালে সামরিক-সমর্থিত সরকারের হাতে ধর্মীয় বিদ্রোহ উস্কে দেওয়ার অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত হন, কারণ তিনি একটি ইসলামপন্থী কবিতা উদ্ধৃত করেছিলেন। তাকে দশ মাসের কারাদণ্ড এবং আজীবন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়। তবে তিনি মাত্র চার মাস জেল খেটেছিলেন, এবং ২০০১ সালে সাধারণ ক্ষমার মাধ্যমে তার রাজনৈতিক নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয়।
এরপর তার একে পার্টি (AKP) ২০০২ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়, ৩৪% ভোট পেলেও তুরস্কের ফার্স্ট-পাস্ট-দ্য-পোস্ট সিস্টেম (first past the post system) এবং ১০% থ্রেশহোল্ডের কারণে দুই-তৃতীয়াংশ আসন অধিকার করে। একে পার্টি সেদিন থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত ক্ষমতা ধরে রেখেছে এবং এরদোয়ান নিজেও এই সময়ের বেশিরভাগ অংশে ইতিবাচক জনসমর্থন পেয়েছিলেন। ২০১৪ সালে একটি গণভোটের মাধ্যমে সংবিধান বদলে এরদোয়ান প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন, এবং সেই পদ তিনি এখন পর্যন্ত ধরে রেখেছেন।
জনপ্রিয়তার কারণ: অর্থনীতি ও স্থিতিশীলতা
কেন তিনি এত জনপ্রিয় ছিলেন? দুটি মূল কারণ: শক্তিশালী অর্থনৈতিক রেকর্ড এবং তুলনামূলক রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা (relative political stability)। একে পার্টি ক্ষমতায় আসার আগে ছিল বিধ্বংসী স্টক মার্কেট ক্র্যাশ, প্রায় এক দশক অর্থনৈতিক স্থবিরতা (economic stagnation), এবং সামরিক অভ্যুত্থানের (military coups) দ্বারা চিহ্নিত কয়েক দশকের রাজনৈতিক অস্থিরতা।
এরদোয়ান এই ধারা বদলে দেন। ২০০২ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত মাথাপিছু জিডিপি (GDP per capita) প্রায় চার গুণ বৃদ্ধি পায়। এছাড়া তার রাজনৈতিক আধিপত্য দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিয়ে আসে। সামরিক বাহিনীর সাথে উত্তেজনাময় মুহূর্ত ছিল, কারণ তারা এরদোয়ানের মৃদু ইসলামবাদী (mild Islamism) ধারা পছন্দ করত না, আবার এরদোয়ানের ক্রমবর্ধমান ক্ষমতাও তাদের অস্বস্তিতে ফেলেছিল। এরদোয়ান সবসময় দাবি করতেন তিনি রাজনৈতিক ধর্মনিরপেক্ষতার (political secularism) প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, তবে তিনি তুরস্ককে একটু নরম ধরনের ধর্মনিরপেক্ষতার দিকে ঠেলে দেন। উদাহরণস্বরূপ, হিজাবের উপর নিষেধাজ্ঞা তুলে দেওয়া, মসজিদে রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ, এবং তুরস্কের শিক্ষাব্যবস্থায় ইসলামী শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করা।
২০১৬ সালের ব্যর্থ অভ্যুত্থান প্রচেষ্টা (2016 Coup Attempt)
২০১০-এর দশকে এরদোয়ানের কর্তৃত্ববাদী (authoritarian) ধাঁচের বিস্তার সামরিক সংশয় আরো বাড়িয়ে দেয়, যার চূড়ান্ত পরিণতি দেখা যায় ২০১৬ সালের ব্যর্থ অভ্যুত্থান প্রচেষ্টায় (attempted coup)। কিন্তু এরদোয়ান এই অভ্যুত্থানে টিকে যান, আন্তর্জাতিক টেলিভিশনে ভিডিও কল (facetiming) করে তার সমর্থকদের রাস্তায় নামার আহ্বান জানান। তবু, তুরস্কে এখনো মুক্ত (free), যদিও সম্পূর্ণ স্বচ্ছ নয় এমন নির্বাচন হয়, এবং ২০২৩ সালে দেখে মনে হচ্ছিল তিনি অবশেষে হারতে পারেন।
২০২৩ সালের নির্বাচন ও জনপ্রিয়তার ধস
নির্বাচনের আগে করা জনমত জরিপে দেখা যায় একে পার্টি (AKP) কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ ফলাফলের পথে আছে, আর তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী সিএইচপি (CHP)-এর কেমাল কিলিচদারওলু (Kemal Kılıçdaroğlu) প্রেসিডেন্ট পদে এগিয়ে আছেন। কিন্তু কিলিচদারওলুর একটু নিষ্প্রাণ উপস্থিতির কারণে এরদোয়ান শেষ মুহূর্তে আবারও জয় ছিনিয়ে নেন। তিনি প্রেসিডেন্ট পদে জয়ী হন, কিন্তু পরবর্তী মাসগুলোতে দেখা যায় যে এরদোয়ানের জনপ্রিয়তা শেষ পর্যন্ত কমে যাচ্ছে।
মে মাসে মেট্রোপল (Metropol) পরিচালিত এক জরিপে দেখা যায় এরদোয়ানের নেট অনুমোদন (net approval) রেটিং -১৬ এ নেমে গেছে, যেখানে ৫৬% উত্তরদাতা তার প্রতি অসন্তুষ্ট এবং ৪০% সন্তুষ্ট। মার্চ মাসে এই সূচক ছিল -১০, ফেব্রুয়ারিতে -৪। এর পরের জরিপগুলোতে আরো খারাপ চিত্র দেখা যায়। সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে মরনিং কনসাল্ট (Morning Consult) পরিচালিত জরিপে তার নেট অনুমোদন ছিল -৩১, যা তাকে কিয়ার স্টারমারের (Keir Starmer) চেয়েও কম জনপ্রিয় করে তোলে, এবং এটি তার সর্বনিম্ন অনুমোদনের রেকর্ড। অনুরূপভাবে, গত মাসে করা একটি সোনার (Sonar) জরিপে একে পার্টি মাত্র ২৪%-এ নেমে গেছে, যেখানে সিএইচপি ৩৬%-এ এগিয়ে।
দীর্ঘ শাসন ও ক্লান্তি: ইসলামবাদ বনাম ধর্মনিরপেক্ষতা
কেন এমন হলো? এর আংশিক কারণ হলো প্রায় তিন দশক ক্ষমতায় থাকার পর ভোটাররা তার প্রতি ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। এরদোয়ান এক অর্থে নিজের সাফল্যের শিকার। তিনি যে সমস্ত ইস্যুকে প্রতিদ্বন্দ্বীদের উপর শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতেন, তার অনেকগুলোই এখন নিষ্প্রভ। উদাহরণ হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষতার (secularism) প্রশ্নটি ধরা যাক। ২০০০-এর দশকে অনেক ভোটার এরদোয়ানের নরম ধর্মনিরপেক্ষতার ধারণাকে কেমালিস্ট ধর্মনিরপেক্ষতার চেয়ে পছন্দ করেছিলেন। কিন্তু এখন এমনকি সিএইচপি (CHP) পর্যন্ত এই হালকা ধর্মনিরপেক্ষতার ধারণা মেনে নিয়েছে, ফলে এই ক্ষেত্রে এরদোয়ানের তুলনামূলক সুবিধা আর নেই।
বিতর্কিত অর্থনৈতিক নীতি ও তার পরিণাম
তবে প্রধান কারণ অর্থনীতি। ২০১৮ সাল থেকে এরদোয়ান অত্যন্ত অপ্রচলিত এক অর্থনৈতিক নীতি অনুসরণ করছেন, উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি (high inflation)-র প্রতিক্রিয়ায় সুদের হার কমিয়ে টাকা ছাপানোর (printing money) পথ নিয়েছেন। এতে তুর্কি লিরা (Turkish lira) মারাত্মকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে, ২০১৫ সালের তুলনায় ৯৫% মূল্য হারায়, এবং ২০২২ সালের শেষের দিকে মুদ্রাস্ফীতি প্রায় ৯০%-এ পৌঁছায়।
এই নীতি স্পষ্টতই টেকসই ছিল না, এবং পুনর্বিন্যাস অবশ্যম্ভাবী ছিল। কিন্তু ২০২৩ সালের নির্বাচনের আগে পর্যন্ত এরদোয়ান তুরস্কের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ (foreign exchange reserves) পুড়িয়ে লিরাকে সাময়িকভাবে রক্ষা করে অর্থনৈতিক কষ্ট পিছিয়ে রাখতে পেরেছিলেন। তবে জিতে যাওয়ার পর তিনি চুপিচুপি পিছিয়ে যান। তিনি একজন বেশি প্রচলিত (orthodox) কেন্দ্রীয় ব্যাংক গভর্নর (central bank governor) ও অর্থমন্ত্রী (finance minister) নিয়োগ দেন, যারা সুদের হার ৮.৫% থেকে আজ ৫০%-এ নিয়ে যান।
অবশ্য ৫০% সুদের হার খুবই কষ্টকর একটি বিষয়, আর এটা তুরস্কের প্রবৃদ্ধিকে (growth) কোভিড-পরবর্তী সর্বনিম্ন স্তরে নেমে এসেছে। পরিস্থিতিকে আরো খারাপ করেছে এটাই যে, এই নীতি সঙ্গে সঙ্গে সফল হয়নি। ২০২৩ সালের শেষের দিকে মুদ্রাস্ফীতি আবার বাড়ে, ২০২৩ সালের মে মাসে বাৎসরিক হারে ৭৫% ছুঁয়ে ফেলে। যদিও পরবর্তী চার মাসে কিছুটা কমেছে, এখনো এটি ৬০%-এর বেশি। একই সময়ে লিরা ডলারের বিপরীতে ক্রমাগত পতনশীল, নির্বাচনের পর প্রতি ডলারের বিপরীতে এটি ২৫ থেকে এখন ২৮-এ গিয়ে ঠেকেছে। এতে স্পষ্ট এরদোয়ান এখন তার বিভ্রান্তিকর অর্থনৈতিক নীতির রাজনৈতিক মূল্য দিচ্ছেন, এবং শেষ মুহূর্তের এই সোজা পথে ফিরে আসাটা সম্ভবত অনেক দেরি হয়ে গেছে।
ভবিষ্যৎ পরিপ্রেক্ষিত
এরদোয়ানকে আবারও ছিটকে ফেলা কঠিন হবে মনে করাটা ভুল হবে। পরবর্তী প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ২০২৮ সালে, যদিও সংবিধানিক মেয়াদসীমা (constitutional term limits) এড়াতে আগে ডাকতে হতে পারে। তা সত্ত্বেও, আরেকটি এরদোয়ান বিজয় অসাধারণ পুনরুদ্ধার ছাড়া সম্ভব হবে না, বিশেষ করে ধরে নেওয়া যায় তিনি ২০২৩ সালের মতো একজন অকার্যকর প্রার্থী কেমাল কিলিচদারওলুর (Kemal Kılıçdaroğlu) বিপরীতে মাঠে নামবেন না।
উপসংহার
সংক্ষেপে, এরদোয়ানের জনপ্রিয়তা যে নিম্নমুখী ধারা পেয়েছে তার মূল কারণ অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা। দীর্ঘকালের ইসলামীপন্থী বনাম কেমালিস্ট ধর্মনিরপেক্ষতার লড়াইয়ে তার সুবিধা হ্রাস পেয়েছে, এবং বছরখানেক ধরে চলা ভুল অর্থনৈতিক নীতি এখন প্রতিফলিত হচ্ছে অব্যাহত মুদ্রাস্ফীতি ও লিরার মূল্যহ্রাসে।
তথ্যসূত্র
1 – https://tcf.org/content/report/turkeys-troubled-experiment-secularism/
2 – https://www.economist.com/europe/2012/02/25/a-secularists-lament
3 – https://en.wikipedia.org/wiki/2002_Turkish_general_election#/media/File:2002_Turkish_General_Election_by_Province.svg
4 – https://www.ft.com/content/c10b3f24-1671-4514-83f7-f6f90d87ea5a
5 – https://pro.morningconsult.com/trackers/global-leader-approval
6 – https://twitter.com/metropoll/status/1248290597930242048
7 – https://europeelects.substack.com/p/europe-elects-newsletter-65f
8 – https://tradingeconomics.com/turkey/inflation-cpi
9 – https://www.bloomberg.com/news/articles/2023-05-18/turkish-fx-reserves-shrank-by-record-in-week-before-elections
10 – https://tradingeconomics.com/turkey/interest-rate
11 – https://www.ft.com/content/f324cb00-5803-400f-87a3-944df7caed9f
তুরস্কের সুইডেনকে ন্যাটোতে অনুমোদন, রাশিয়াকে ত্যাগ করে পশ্চিমমুখী হওয়া, এবং এর ইইউ সদস্য হবার দাবি ও সম্ভাবনা (১৪ জুলাই, ২০২৩)
সোমবার তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ এরদোয়ান “তুরস্ক অবশেষে সুইডেনকে ব্লকে প্রবেশ করতে দেবে” – এই ঘোষণা দিয়ে ন্যাটোকে চমকে দিয়েছিলেন। এই আর্টিকেলে এরদোয়ান কী বলেছিলেন, কেন তিনি সুইডেনকে ন্যাটোতে প্রবেশ করতে দিচ্ছেন এবং এর অর্থ তুরস্ক ইইউতে যোগ দিতে চলেছে কিনা তা দেখতে যাচ্ছি। সেই সাথে তুরস্কের রাশিয়ার থেকে দূরে সরে আসা ও পশ্চিমের দিকে সরে আসা নিয়ে, এবং তুরস্ক আসলেই ইইউতে যোগ দিতে পারবে কিনা তা নিয়ে আলোচনা হবে।
সুইডেনকে ন্যাটোতে প্রবেশে তুরস্কের এতদিনের অস্বীকৃতি
গত এক বছর ধরে তুরস্ক সুইডেনকে ন্যাটোতে যোগ দিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে আসছে। গত জুনে ফিনল্যান্ড সহ দুই দেশ ত্রিপক্ষীয় সমঝোতা স্মারকে স্বাক্ষর করে, যেখানে মূলত বলা হয়, তিনটি কাজ করলে তুরস্ক সুইডেনকে ন্যাটোতে যোগ দিতে দেবে। এক্ষেত্রে প্রথমত, সুইডেন এবং ফিনল্যান্ড তুরস্কের কুর্দি বিচ্ছিন্নতাবাদী সহিংসতার জন্য দায়ী কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টির সাথে সম্পর্কিত কিছু কুর্দি সংগঠনকে ও তুর্কি ধর্মীয় নেতা ফেতুলা গুলেনকে (যাকে এরদোয়ান ২০১৬ সালে অভ্যুত্থান চেষ্টার জন্য দায়ী করেছেন) সমর্থন না করার প্রতিশ্রুতি দেয়। দ্বিতীয়ত, ২০১৯ সালে এরদোয়ান সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলে সৈন্য পাঠানোর পর দেশ দুটো তুরস্কের ওপর অনানুষ্ঠানিকভাবে যে অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল তা প্রত্যাহার করে নেয়। এবং তৃতীয়ত, চুক্তিটি ফিনল্যান্ড এবং সুইডেনকে যে কোনও ‘সন্ত্রাসী সন্দেহভাজনকে’ তুরস্কের কাছে হস্তান্তর করতে বাধ্য করে।
সুইডেন এই তিনটি মানদণ্ড পূরণ করেছে বলে দাবি করেছে, তবে এরদোয়ান এবং তুর্কি সরকারের অন্যান্য ব্যক্তিরা দাবি করেছেন যে সুইডেন এখনও পিকেকেকে নীরবে সমর্থন করছে কারণ সুইডিশ কর্তৃপক্ষ কুর্দিপন্থী এবং পিকেকেপন্থী গোষ্ঠীগুলিকে স্টকহোমে বিক্ষোভ করার অনুমতি দিয়েছে এবং গত মাসে সুইডিশ কর্তৃপক্ষ কুরআন পোড়ানো ইনভলবড ছিল এমন প্রতিবাদকে অনুমোদন দেয়ায় তারা বিশেষভাবে বিরক্ত হয়েছে। সুইডেন জোর দিয়ে বলেছে যে তারা এই প্রতিবাদগুলোকে দমন করতে পারে না কারণ পিকেকে এবং কুরআন পোড়ানো বিক্ষোভ সুইডেনে সাংবিধানিকভাবে সুরক্ষিত বাক স্বাধীনতারই প্রকাশ। এখন, এরদোয়ানের বিরক্তি সম্ভবত সত্য, এবং তিনি সম্ভবত চান যে সুইডেন প্রতিবাদ করার জন্য আরও প্রচেষ্টা করুক, হয়তো ইউরোপীয় মানবাধিকার আদালত অব্দি যাক তারা। সন্ত্রাসবাদ ও সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলায় সুইডেনের অবস্থান নিয়ে তুরস্কের উদ্বেগ ছিল। তারা সুইডেনের কাছে স্পষ্টভাবে এই উদ্বেগগুলি প্রকাশ করেছিল এবং সুইডেন অবিলম্বে সেগুলো সমাধানের জন্য তাদের নিজস্ব আইনগুলিতে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন করেছিল। (সুইডেনকে কেন তুরস্ক ন্যাটোতে অন্তর্ভুক্ত করতে চায়নি সেই বিষয়ে ইতিমধ্যে পোস্ট করেছি।)
সুইডেনের ন্যাটোতে প্রবেশকে অনুমোদন দেয়া, বিনিময়ে তুরস্কের দাবি
তবে এটি সর্বজনবিদিত যে সুইডেন এভাবে তার সংবিধান সংশোধন করতে পারে না। তাই এটাও স্পষ্ট হয়ে যায় যে, এরদোয়ানের বিরক্তিটি জেনুইন হয়ে থাকলেও তিনি আসলে সুইডেনের ন্যাটো সদস্যপদের উপর তার প্রভাব ব্যবহার করে অন্যান্য ন্যাটো সদস্যদের কাছ এমন কোন ছাড় খুঁজছেন যার সাথে সুইডেনের ন্যাটোতে অন্তর্ভুক্তির কোন সম্পর্কই নেই। এর একটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হ’ল এফ-16 যুদ্ধবিমান অধিগ্রহণ। তুরস্ক, অন্যান্য অনেক দেশের মতোই তার বিমান বাহিনীর জন্য আমেরিকান এফ-16 এর উপর নির্ভর করে। ২০১০ এর দশকের শেষের দিকে এরদোয়ান উল্লেখযোগ্য সংখ্যক এফ-35 কিনে তুরস্কের বিমান বাহিনীকে উন্নত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, যা মূলত এফ-16 এর উন্নত সংস্করণ। তবে যুক্তরাষ্ট্র তার প্যাট্রিয়ট মিসাইল সিস্টেম তুরস্কে বিক্রি না করায় ২০১৯ সালে তুরস্ক রাশিয়ার তৈরি এস-400 এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম কিনেছিল। এরদোয়ান সম্ভবত ভেবেছিলেন যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রতারণা করছে, কিন্তু তারা তা করেনি। এবং তারা অবিলম্বে তুরস্ককে এফ-35 প্রোগ্রাম থেকে বাদ দিয়েছে, যদিও তুরস্ক ইতিমধ্যে চারটি এফ-400 এর জন্য অর্থ প্রদান করে ফেলেছে, যার দাম ১.৪ বিলিয়ন ডলারের মতো। এর কয়েক বছর পর তুরস্ক আরও ৭০টি এফ-16 বিমান কিনতে চাইলেও কংগ্রেস তার অনুমতি দেয়নি। স্পষ্টতই, এরদোয়ান এতে খুশি ছিলেন না, তবে তিনি এই বছরের শুরু পর্যন্ত এটি সম্পর্কে তুলনামূলকভাবে নীরব ছিলেন। কিন্তু এরপরই তিনি এই বিষয়টি নিয়মিতভাবে উত্থাপন শুরু করেছিলেন। এফ-16 যে দরকষাকষির চিপ হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে তা এপ্রিলে খুব স্পষ্ট হয়ে ওঠে যখন যুক্তরাষ্ট্র তুরস্কের এফ-16 আপগ্রেড সফটওয়্যার বিক্রি করতে সম্মত হওয়ার পরপরই তুরস্ক সুইডেনের সঙ্গে আলোচনা পুনরায় শুরু করতে সম্মত হয়।
তবে সোমবার এরদোয়ান একটি নতুন দাবি নিয়ে আসেন। ন্যাটো সামিটের জন্য লিথুয়ানিয়ায় যাবার উদ্দেশ্যে রওনা দেবার পূর্বে ইস্তাম্বুলের আতাতুর্ক বিমানবন্দরে এক সংবাদ সম্মেলনে এরদোয়ান বলেন, ‘যদি ন্যাটো সুইডেনকে অন্তর্ভুক্ত করতে চায়, তবে তুরস্ককে আগে ইইউতে প্রবেশ করতে দিতে হবে।’ পরে তিনি তার এই নিজের দাবিকে জাস্টিফাই করার জন্য বলেন, ইইউ ও ন্যাটো সদস্যপদের ক্ষেত্রে অনেক ওভারল্যাপ আছে। এটি সবার জন্য একটি বিশাল বিস্ময় হিসেবেই এসেছিল, অন্তত এজন্য যে, ইইউ-তুরস্ক সম্পর্ক এই মুহুর্তে ভাল নয়। তুরস্ক এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে সম্পর্ক ২০১৬ সাল থেকেই উত্তেজনাপূর্ণ ছিল। সংবাদ সম্মেলনে এরদোয়ান বলেন, ‘যারা ৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে তুরস্ককে ইউরোপীয় ইউনিয়নের দরজায় অপেক্ষা করিয়ে রেখেছে, আমি তাদের আহ্বান জানাচ্ছি। তুরস্কের জন্য পথ প্রশস্ত করুন এবং আমরা সুইডেনের জন্য পথ প্রশস্ত করব।” এর কয়েক ঘণ্টা পর এরদোয়ান হঠাৎ ঘোষণা দেন, “তুরস্ক সুইডেনকে ন্যাটোতে যোগ দিতে দিচ্ছে”। বিনিময়ে, তুরস্ক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে এফ-16 এবং কানাডা থেকে রফতানি নিয়ন্ত্রণ অপসারণ সহ বেশ কয়েকটি লেভারেজ পায়, তবে সেই সাথে কিছু ইইউ-নির্দিষ্ট লেভারেজও পায়। সুইডেন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উভয়ই বলেছে যে, তারা ন্যাটোতে তুরস্কের সদস্যপদকে পুরোপুরি সমর্থন করে এবং এরকমও কিছু সাজেশনের ব্যাপারে শোনা গেছে, অন্ততপক্ষে মিডিয়ায় শোনা গেছে যে, ইইউ তুরস্কের জন্য তার ভিসা প্রত্যাখ্যানের হার হ্রাস করবে।
এই মুহুর্তে ইইউ-তুরস্কের সম্পর্কের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে ভিসা, বিশেষ করে মহামারীর আগের তুলনায় এখন তুর্কি নাগরিকদের ভিসা আরো বেশি করে প্রত্যাখ্যান করা হচ্ছে। মহামারীর আগে ভিসা প্রত্যাখ্যানের হার ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পেলেও ১০% এর নিচে ছিল। তবে মহামারী চলাকালীন সময়ে যখন ইউরোপীয় ইউনিয়নের অনেক দেশ লকডাউনের অধীনে ছিল, তখন তুর্কি নাগরিকদের জন্য ভিসা প্রত্যাখ্যানের হার ১৭%-এ উন্নীত হয়, এবং এখন তুরস্কের নাগরিকদের জন্য ভিসা প্রত্যাহারের হার ১৫% এর উপরে রয়েছে। এক্ষেত্রে ইইউ এর যুক্তি হচ্ছে, এটি মূলত তুর্কি নাগরিকদের পূর্বের চেয়ে বেশি পরিমাণে ইউরোপীয় ইউনিয়নে আশ্রয় বা এসাইলামের আবেদন বৃদ্ধির কারণে হয়েছে। তবে এরদোয়ান এবং অন্যান্য সিনিয়র তুর্কি কর্মকর্তারা দাবি করেছেন যে, এটির আসল কারণ হচ্ছে ইইউ এর তুর্কি-বিরোধী পক্ষপাত। তারা উল্লেখ করেছেন যে, কেবল এসাইলাম-প্রার্থীরাই নয়, সুপরিচিত সাংবাদিক এবং পেশাদারদেরও প্রত্যাখ্যান করা হচ্ছে।
এরপর সোমবার সন্ধ্যায় ন্যাটো মহাসচিব জেনস স্টলটেনবার্গ হঠাৎ ঘোষণা করেন যে, এরদোয়ান সুইডেনের অন্তর্ভুক্তি প্রোটোকলটি এগিয়ে নিতে সম্মত হয়েছেন, ও এর মাধ্যমে অবশেষে সুইডেনের অন্তর্ভুক্তির পথ প্রশস্ত করেছেন। বিনিময়ে, সুইডেন সম্মত হয়েছে যে, তারা তুরস্কের পক্ষে কাস্টমস ইউনিয়ন আপডেট করতে এবং ভিসা উদারীকরণ করতে সক্রিয়ভাবে সমর্থন করবে। এরপর মঙ্গলবার সকালে যুক্তরাষ্ট্র ঘোষণা দেয়, তারা তুরস্কের কাছে এফ-১৬ বিমান হস্তান্তরের পরিকল্পনা করছে।
তুরস্কের এই পরিবর্তনের কারণ
এটি এরদোয়ানের পশ্চিমের দিকে বৃহত্তর পরিবর্তনের অংশ বলে মনে হচ্ছে। এটা অর্থনৈতিক কারণে হতে পারে। তুরস্কের অর্থনীতি বর্তমানে এরদোয়ানের অপ্রচলিত ও সুদ-বিরোধী আর্থিক নীতির পরিণতি ভোগ করছে এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক দেশটির ইকোনোমিক বাঁচিয়ে রাখতে সহায়তা করতে পারে। আরেকটি কারণ হতে পারে রাশিয়ার সাথে তুরস্কের ক্রমবর্ধমান দূরত্ব। একদিকে তুরস্ক একটি ন্যাটোভুক্ত দেশ, অন্যদিকে রাশিয়ার সাথে দেশটির সম্পর্ক তুলনামূলভাবে বেশি বন্ধুত্বপূর্ণ। কাজেই ইউক্রেনে পুতিনের আগ্রাসনের পর থেকে এতোদিন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ এরদোয়ানকে দুই দিকেই ব্যালেন্স মেইনটেইন করে চলতে হয়েছে। তুরস্ক রাশিয়ার ওপর ওয়েস্টার্ন স্যাঙ্কশনে যোগ দিতে অস্বীকৃতি জানায়, এবং ন্যাটোতে সুইডেন ও ফিনল্যান্ডের আবেদনও আটকে রাখে। এসব কাজ নিঃসন্দেহে ন্যাটোকে করে বিরক্ত ও রাশিয়াকে করে খুশি। তবে গত এক সপ্তাহে এরদোয়ান অন্তত তিনটি কাজ করেছেন যা ইঙ্গিত দেয় যে, তিনি মূলত পুতিনকে ত্যাগ করে ন্যাটোকেই বেছে নিয়েছেন, যেগুলোর মধ্যে সম্ভবত সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে অবশেষে সুইডেনকে ন্যাটোতে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া। তাই এরদোয়ানের দু’পক্ষের মধ্যে ব্যালেন্স রক্ষার ইতিহাস কী, কিভাবে এরদোয়ান সম্পত্তি পুতিনকে ত্যাগ করেছেন ও কেন তিনি ওয়েস্ট বা পশ্চিমের দিকে শিফট করতে পারেন এই প্রশ্নগুলোরও উত্তর খোঁজা প্রয়োজন।
তুরস্কের রাশিয়া ও ন্যাটোর সাথে সম্পর্কে ব্যালেন্স রক্ষার ইতিহাস
রাশিয়া-ইউক্রেইন যুদ্ধের আগে এরদোয়ান ও পুতিন এক রকম একে অপরের ফ্রেনেমিস ছিলেন (মানে বন্ধু ও শত্রুর মিশ্রণ)। তারা অনেক বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করেন, বিশেষ করে পররাষ্ট্র নীতি নিয়ে, কিন্তু দুই নেতার মধ্যে এক ধরনের ব্যক্তিগত সম্পর্ক ছিল, যা ২০১৬ সালে তুরস্কে অভ্যুত্থান প্রচেষ্টার পর বিকশিত হয়েছিল। তারা নিয়মিত মিলিত হতেন এবং পুতিন একবার এরদোয়ানকে প্রশংসা করে বলেছিলেন, তিনি এমন একজন নেতা যিনি একজন সত্যিকারের মানুষের মতো প্রতিশ্রুতি পালন করেন। যুদ্ধ শুরু হলে এরদোয়ান ন্যাটো ও রাশিয়ার মধ্যে একটি মধ্যবর্তী স্থানে থাকার চেষ্টা করেন। তুরস্ক ন্যাটোর অন্যান্য দেশের মতো রাশিয়ার ইউক্রেইনের বিরুদ্ধে “বিশেষ সামরিক অভিযানকে” যুদ্ধ হিসাবে বর্ণনা করতে বা স্যাংকসনে যোগ দিতে অস্বীকার করেছিল। কিছুটা হলেও সেটা কাজে দেয়। তুরস্কে ২০২২ সালের মার্চে রাশিয়া ও ইউক্রেইনের মধ্যে শান্তি আলোচনা হয়েছিল, যা ব্যর্থ হয়, ২০২২ সালের জুলাইয়ে তুরস্ক জাতিসংঘের সাথে কৃষ্ণ সাগরের শস্য চুক্তি বা গ্রেইন ডিল সফলভাবে সম্পাদন করেছিল, যা ইউক্রেনের কৃষকদেরকে তুর্কি কর্তৃপক্ষের নজরদারির সাথে তুর্কি প্রণালীর মাধ্যমে তাদের শস্য রফতানি করার অনুমতি দেয়।
এরদোয়ানের এই নিরপেক্ষ অবস্থান থেকে তুরস্কের অর্থনীতিও লাভবান হয়েছে। এর ফলে রাশিয়ার মূলধন তুরস্কে প্রবাহিত হয়েছিল ও আঙ্কারাকে বৈদেশিক মুদ্রার একটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় উত্স সরবরাহ করেছিল, এবং তুরস্ক সস্তায় রাশিয়ান তেল এবং গ্যাস কিনতে সক্ষম হয়েছিল। এটি অবশ্যই এরদোয়ানের জন্য একটি বড় ফ্যাক্টর ছিল। তুর্কি অর্থনীতি তখনও ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতির সংকটে রয়েছে সাথে লড়াই করছিল এবং এরদোয়ান সম্ভবত উপলব্ধি করেছিলেন যে তুর্কি অর্থনীতি তার হাইড্রোকার্বন আমদানির বৃহত্তম উত্সটি বন্ধ করতে পারবে না।
সম্প্রতি তুরস্কের রাশিয়া থেকে দূরে সরে আসা
তবে গত এক সপ্তাহ ধরে মনে হচ্ছে এরদোয়ান পুতিনের কাছ থেকে দূরে সরে যেতে শুরু করেছেন। তিনটি প্রমাণ এটি নির্দেশ করে। প্রথমটি হচ্ছে তুরস্কে থাকা ইউক্রেনীয় যুদ্ধবন্দীদেরকে ইউক্রেনে ফিরিয়ে দেয়া। প্রসঙ্গত, গত বছর নৃশংস যুদ্ধ ও অবরোধের পর রুশ বাহিনী ইউক্রেনের বন্দর নগরী মারিউপোল দখল করে নেয়। ইউক্রেনের আজোভ ব্যাটালিয়নের শত শত সৈন্য আত্মসমর্পণ করে এবং রাশিয়া তাদের যুদ্ধবন্দী হিসাবে নিয়ে যায়। বন্দী বিনিময়ের অংশ হিসাবে নিম্ন স্তরের অনেক সৈন্যকে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল, তবে ইউক্রেন, রাশিয়া এবং তুরস্কের মধ্যে একটি চুক্তি হয়, যা অনুসারে পাঁচজন গুরুত্বপূর্ণ আজোভ কমান্ডারকে তুরস্কে প্রেরণ করা হয়, যেখানে তাদের যুদ্ধের সময়কালটুকু থাকার কথা ছিল বলে ধারণা করা হয়। তবে, গত সপ্তাহে, রাষ্ট্রপতি জেলেনস্কি তুরস্ক সফরে যান ও এই পাঁচ কমান্ডারকে তার সাথে ইউক্রেইনে নিয়ে আসেন, এই পদক্ষেপটিকে ক্রেমলিন ইউক্রেন এবং তুরস্কের মধ্যকার চুক্তির সরাসরি লঙ্ঘন হিসাবে বর্ণনা করেছে।
দ্বিতীয়ত, তুরস্ক একতরফাভাবে শস্য চুক্তি বা গ্রেইন ডিলের মেয়াদ বাড়ানোর কথা ভাবছে বলে খবর পাওয়া গেছে। স্পষ্টতই, রাশিয়া এই চুক্তি থেকে বেরিয়ে যেতে চায়, তবে তুর্কি নৌবাহিনীও বলেছে যে চুক্তি না থাকলেও তারা তুর্কি প্রণালী দিয়ে রফতানি করা ইউক্রেনীয় জাহাজগুলির সাথে থাকবে বা সুরক্ষা প্রদান করবে। এর অর্থ হচ্ছে তুরস্ক একতরফাভাবে ইউক্রেনীয় রফতানিকারকদেরকে রাশিয়ার আগ্রাসন থেকে রক্ষা করবে, যা অবশ্যই মস্কোর ভাল লাগার কথা না।
আর তৃতীয় প্রমাণটি প্রায় সকলেরই জানা। সুইডেন ও ফিনল্যান্ড আনুষ্ঠানিকভাবে আবেদন করার এক বছরেরও বেশি সময় পর এরদোয়ান এ সপ্তাহে ঘোষণা করলেন যে, ন্যাটোতে যোগদানের জন্য সুইডেনের আবেদনের বিরোধিতা থেকে তুরস্ক অবশেষে সরে আসছে। এর মানে এখন তুরস্ক পুতিনকে খুশি করার জন্য যে সুইডেনের ন্যাটোতে অন্তর্ভুক্তিকে বাধা দিয়েছিলেন, তা নয়। বরং এরদোয়ান ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক এবং যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে এফ-১৬ জেট বিমানসহ ন্যাটোর অন্যান্য সদস্য দেশগুলোর কাছ থেকে আনরিলেটেড লেভারেজ পাবার জন্য তার ভেটো ব্যবহারের চেষ্টা করছিলেন। তবে এরদোয়ানের বিরোধিতা পুতিনকে অবশ্যই খুশি করেছিল। আর এরদোয়ানের এই বিরোধিতাকে তুলে নেয়ার ব্যাপারটি অবশ্যই ক্রেমলিনের ভাল লাগেনি, যেখান থেকে বলা হচ্ছে যে, এই পদক্ষেপের পরিণতি অবশ্যই নেতিবাচক হবে।
ন্যাটো ও আজোভ কমান্ডারদের বিরুদ্ধে সাম্প্রতিক পদক্ষেপের প্রতিক্রিয়ায় রাশিয়ার প্রতিরক্ষা ও ব্যয় বিষয়ক ফেডারেশন কাউন্সিল কমিটির প্রধান ভিক্টর বন্দারেভ বলেছেন, তুরস্ক একটি নিরপেক্ষ দেশ থেকে ‘অবন্ধুত্বপূর্ণ দেশের’ দিকে ধাবিত হচ্ছে। এদিকে রাশিয়ার বার্তা সংস্থা তাস জানিয়েছে, ক্রেমলিন তার তুর্কি পার্টনারদেরকে ইউরোপে যাওয়ার সময় গোলাপ রঙের চশমা খুলে ফেলার পরামর্শ দিয়েছে, আর সেই সাথে বলেছে, কেউই তুরস্ককে ইউরোপের অংশ হিসেবে দেখতে চায় না, এমনকি ইউরোপীয়রাও নয়।
কেন তুরস্ক রাশিয়ার থেকে দূরে সরে গিয়ে পশ্চিমের দিকে ঝুঁকছে?
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এরদোয়ান এটা কেন করলেন? কেন এরদোয়ান পুতিনকে ছেড়ে দেওয়ার বা অন্তত পশ্চিম দিকে সরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন? এর তিনটি সম্ভাব্য কারণ রয়েছে। প্রথম এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো তুরস্কের অর্থনীতি। তুর্কি অর্থনীতি বর্তমানে এরদোয়ানের অপ্রচলিত (সুদ-বিরোধী) আর্থিক নীতির পরিণতি ভোগ করছে। তার নীতিগুলোর মধ্যে ছিল মুদ্রাস্ফীতির প্রতিক্রিয়ায় সুদের হার হ্রাস করা, কিন্তু এর ফলে লিরার মূল্য দ্রুত হ্রাস পেয়েছে। আর তুরস্কের অর্থনীতি টিকে আছে কেবল রাশিয়ান ইনফ্লো এবং এরদোয়ানের উপসাগরীয় মিত্রদের উদার বিনিয়োগের কারণে। এই বিনিয়োগ হিসেবে সৌদি আরবের কাছ থেকে ৫ বিলিয়ন ডলারের ঋণ রয়েছে, যারা স্পষ্টতই তুরস্কে দেশে তাদের প্রভাব বাড়ানোর চেষ্টা করছে। এরদোয়ানের নতুন অর্থমন্ত্রী ধীরে ধীরে সুদের হার বাড়াতে শুরু করেছেন, তবে লিরা এখনও হ্রাস পাচ্ছে এবং তুরস্ক আনসাস্টেইনেবল ক্যাপিটাল আউটফ্লোতে ভুগছে। তুরস্ক সম্ভবত আশা করছে যে, দেশটি যদি ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে যোগদানের মাধ্যমে ইইউ সদস্যপদের সাথে জড়িত সমস্ত আর্থিক সহায়তা নাও পায়, তবুও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের মাধ্যমে দেশটি তার অর্থনীতিকে কিছুটা হলেও সচল রাখতে পারবে।
দ্বিতীয়ত, নির্বাচনের পর এরদোয়ানের পলিটিকাল স্পেস বেশি। এরদোয়ান এখন নতুন পাঁচ বছরের মেয়াদের জন্য পুনরায় নির্বাচিত হয়েছেন, যার অর্থ তিনি পশ্চিম দিকে সরে যাবার মতো যথেষ্ট সময় ও পলিটিকাল স্পেইস পেয়েছেন। তবে এর ফলে তার জনপ্রিয়তা তেমন হ্রাস পাবে বলে মনে হয়না। এরদোয়ান অতীতে একজন অসাধারণ চতুর রাজনীতিবিদ হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করেছেন। তিনি তার দুই দশকের ক্ষমতায় ইইউ থেকে শুরু করে কুর্দিশ কোয়েশ্চেন পর্যন্ত সব কিছুতে তার অবস্থান পরিবর্তন করেছেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি সর্বদাই পুনরায় নির্বাচিত হয়েছেন।
তৃতীয় কারণটি হচ্ছে রাশিয়ায় ওয়াগনারের অভ্যুত্থান-প্রচেষ্টা। এই অভ্যুত্থান প্রমাণ করেছে যে রাশিয়ায় সরকার পরিবর্তন বা পলিটিকাল কলাপ্সের ঝুঁকি রয়েছে এবং এটি এরদোয়ানের হিসাবকে প্রভাবিত করতে পারে, কারণ পুতিনের যদি শীঘ্রই ক্ষমতা হারাবার সামান্য সম্ভাবনাও থেকে থাকে, তাহলেও তিনি পুতিনের সাথে সম্পর্কের জন্য খুব বেশি এফোর্ট দিতে চাইবেন চান না, কেননা তিনি অনিরাপদ কোন কিছুর জন্য ন্যাটো ও পশ্চিমাদের সাথে তার সম্পর্ক কম্প্রোমাইজ করবেন না।
শেষ পর্যন্ত, এরদোয়ান পশ্চিম দিকে সরে যাচ্ছেনা এমন অনেক প্রমাণ থাকলেও, এটা ভুলে গেলে চলবে না যে, তিনিই সম্ভবত ভূ-রাজনীতিতে সবচেয়ে অপ্রত্যাশিত ব্যক্তি, এবং তার এই অবস্থানটি যে স্থায়ী হবে এটা বলার সময়ও এখনও আসেনি।
তুরস্ক কি ইইউতে যোগ দিতে পারবে?
যাই হোক, এর মানে কি এই যে, তুরস্ক ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগ দিতে যাচ্ছে? তুরস্কের ইইউতে যোগদানের এই প্রচেষ্টা নিয়ে ২০০৫ সাল থেকেই আলোচনা চলছে। এখন, তুরস্কের ইইউতে প্রবেশের সম্ভাব্যতা নিয়ে আলোচনা করার জন্য ইইউ-তুরস্ক সম্পর্কের একটি সংক্ষিপ্ত ইতিহাস নিয়ে একটু আলোচনা করে নিতে হবে, আর তারপর তুরস্ক আসলেই ইইউতে যোগ দিতে পারবে কিনা সেই আলোচনায় প্রবেশ করা যাবে।
ইইউ-তুরস্ক সম্পর্কের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
ইইউ তুরস্ক সম্পর্ক মূলত তিনটি সময়কালে বিভক্ত করা যেতে পারে: প্রাক-২০০৫, ২০০৫ থেকে ২০১৬, এবং ২০১৬ পরবর্তী। ২০০৫ সালের আগে তুরস্ক ধীরে ধীরে ইউরোপের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল এবং শেষ পর্যন্ত ইউরোপীয় কমিউনিটিতে এর অন্তর্ভুক্তি একটি সম্ভাবনা রয়েছে বলে মনে হয়েছিল। তুরস্ক ১৯৬৩ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়নের পূর্বসূরি ইউরোপিয়ান ইকোনোমিক কমিউনিটির সহযোগী সদস্য বা এসোসিয়েট মেম্বার হয়ে ওঠে এবং ১৯৮৭ সালে পূর্ণ সদস্য হওয়ার জন্য আবেদন করে। তবে তুরস্ক ১৯৯৫ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাথে একটি কাস্টমস ইউনিয়ন চুক্তি স্বাক্ষর করে এবং ১৯৯৯ সালে ইউরোপীয় কাউন্সিলের হেলসিঙ্কি শীর্ষ সম্মেলনে আনুষ্ঠানিকভাবে পূর্ণ সদস্যপদের প্রার্থী হিসাবে স্বীকৃত হয়। ১৯৯৯ সাল থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত ইইউতে তুরস্কের চূড়ান্ত অন্তর্ভুক্তি একটি সম্ভাবনা বলে মনে হয়েছিল। ২০০৩ সালে যখন এরদোয়ান প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তুরস্কের ক্ষমতায় বসেন, তখন তুরস্কে ইইউতে অন্তর্ভুক্তির ব্যাপারটি বেশ জনপ্রিয় ছিল। ইইউতে অন্তর্ভুক্তির নিয়ে এই জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে তিনি সেনাবাহিনীকে রাজনীতি থেকে বের করে দিতে, এবং মৃত্যুদণ্ড বাতিল করা এবং কুর্দি ভাষাকে ব্রডকাস্ট করার অনুমতি প্রদানের মতো বেশ কিছু সুন্দর সংস্কারবাদী অভ্যন্তরীণ নীতি প্রবর্তন করেছিলেন। তুরস্কের ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের মধ্যে তুরস্কের ইইউতে যোগদান নিয়ে ব্যাপক উৎসাহ ছিল এবং তুর্কি নির্মাতারা তাদের পণ্যের রফতানির জন্য একটি বিশাল উন্মুক্ত বাজারের ধারণায় খুব আগ্রহী ছিলেন।
এরপর তুরস্ক যখন আনুষ্ঠানিকভাবে ইইউতে অন্তর্ভুক্তির আলোচনা বা নেগোশিয়েশন শুরু করে, তখন শুরু হয় তুরস্ক-ইইউ সম্পর্কের দ্বিতীয় পর্যায়, মনে ২০০৫ থেকে ২০১৬ সালের পর্যায়। তুরস্ক ইইউতে অন্তর্ভুক্ত হবার আলোচনায় যাবার পর খুব দ্রুত স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, তুরস্কের শীঘ্রই ইইউতে যোগ দেয়ার সম্ভাবনা কম। প্রায় দুই দশকের আলোচনার মধ্যে তুরস্ক প্রয়োজনীয় ৩৫টি অধ্যায়ের মধ্যে মাত্র ১৬টিতে আলোচনা শুরু করেছে এবং বিজ্ঞান ও গবেষণা বিষয়ক মাত্র একটি অধ্যায় নিয়ে দুপক্ষ প্রভিশনালি, মানে অস্থায়ীভাবে বা অন্তত কিছু ক্ষেত্রে একমত হয়েছে (তবে পুরোপুরিভাবে তা ফাইনালাইজড হয়নি)। ২০০৫ সালে ইইউতে তুরস্কের অন্তর্ভুক্তি কতটা কঠিন হবে তা উপলব্ধি করে ইউরোপীয় নেতারা একটি “ওপেন-এন্ডেড প্রসেস” বা “উন্মুক্ত প্রক্রিয়ার” উপর জোর দিয়েছিলেন, যেখানে তুরস্ক আদৌ ইইউতে যোগ দেবে কিনা তা নিয়ে কোন গ্যারান্টি ছিলোনা। পরবর্তী এক দশক ধরে আলোচনা চলতে থাকে, কিন্তু ২০১৬ সালে এটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে তুরস্ক শীঘ্রই ইইউতে যোগ দেবে না।
২০১৬ সালে ইইউ তুরস্কের সম্পর্কের ক্ষেত্রে দুটি বড় ঘটনা ঘটেছিল। প্রথমটি ঘটেছিল বছরের শুরুতে যখন উভয় পক্ষ একটি অভিবাসী চুক্তি বা মাইগ্রেন্ট ডিল স্বাক্ষর করেছিল, যা মূলত ছিল এই যে, তুরস্ক মধ্যপ্রাচ্য থেকে তুরস্ক হয়ে ইউরোপে আসা অভিবাসীদের আটকাবে, কিন্তু বিনিময়ে তুরস্ককে কয়েক বিলিয়ন ইউরোর আর্থিক সহায়তা প্রদান করতে হবে, এবং সাধারণ তুর্কিদের জন্য ইউরোপে প্রায় ভিসা-মুক্ত ভ্রমণের প্রতিশ্রুতি দিতে হবে। এই চুক্তির মাধ্যমে তুরস্কের ইইউতে অন্তর্ভুক্তি নিয়ে আলোচনা ত্বরান্বিত হবার কথা ছিল, তবে হয় উল্টো। চুক্তিটির কার্যকারিতা সত্ত্বেও এটি প্রকৃতপক্ষে তুরস্ক-ইইউ সম্পর্ককে আরও খারাপ করে তোলে। এটি এরদোয়ানকে ইউরোপের উপর অস্বস্তিকর রকমের বেশি সুবিধা দেয়, যা ইউরোপীয় নেতাদেরকে এরদোয়ান সম্পর্কে আরও সতর্ক করে তোলে।
দ্বিতীয় বিষয়টি ছিল, জুলাই মাসে তুরস্কে ঘটা অভ্যুত্থানের প্রচেষ্টা। তুর্কি সেনাবাহিনীর একটি অংশ এরদোয়ানকে ক্ষমতাচ্যুত করার চেষ্টা করেছিল এবং এরদোয়ানকে আক্ষরিক অর্থেই একটি তুর্কি টিভি চ্যানেলে এসে অভ্যুত্থানকারীদের পদত্যাগ করতে এবং তুর্কি জনগণকে তাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে বলেছিল। এরদোয়ান স্পষ্টতই ইউরোপীয় ইউনিয়নের নীরব প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে ক্ষুব্ধ ছিলেন, যারা এরদোয়ানের সমর্থনে এগিয়ে আসতে ধীর ছিল এবং অভ্যুত্থানের পরে বেসামরিক কর্মচারী বা সিভিল সার্ভেন্টদেরকে যে শুদ্ধিকরণ বা পাৰ্জ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় তা নিয়ে সমালোচনা করেছিল। ঠিক এই সময় থেকে তুর্কি মিডিয়া ইইউকে আক্রমণ করতে শুরু করে, এবং ২০১৬ সালের শেষের দিকে এরদোয়ান সাজেস্ট করেন যে, তুরস্ক সাংহাই কোঅপারেশন অর্গানাইজেশনে (এসসিও) যুক্ত হবার ব্যাপারে বিবেচনা করছে, যা ইইউ এর বিকল্প হিসেবে তখন রাশিয়া, চীন. কাজাখস্তান, কিরগিজিস্তান, উজবেকিস্তান নিয়ে গঠিত ছিল, এবং ভারত ও পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্তি শুরু হয়েছিল (২০১৭ সালের মাঝামাঝি এদের অন্তর্ভুক্তি সমাপ্ত হয়)। বিপরীতে, এই সময়েই এরদোয়ান পুতিনের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ হতে শুরু করেছিলেন। অভ্যুত্থানের পর এরদোয়ানের সমর্থনে প্রথম বিশ্ব নেতাদের মধ্যে পুতিন ছিলেন একজন, এবং মাত্র এক বছর আগে ২০১৫ সালে তুর্কি-সিরিয়া সীমান্তের কাছে আকাশসীমা বিরোধের সময় তুর্কি সামরিক বাহিনী রাশিয়ার একটি যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করার পরে তুরস্ক-রাশিয়া সম্পর্ক খুব দ্রুত শত্রুভাবাপন্ন হয়ে উঠেছিল।
তুরস্ক কি আসলেই ইইউতে যোগ দিতে পারবে?
এর মানে কি এই যে, তুরস্ক ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগ দিতে যাচ্ছে? এর সংক্ষিপ্ত উত্তর হল, না। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ইতিমধ্যেই এনলারজমেন্ট ফেটিগ ভুগছে এবং কিছু ইইউ দেশ, বিশেষত ফ্রান্স মনে করে যে আরও কোনও দেশকে নেওয়ার আগে ইইউকে সংস্কার করা দরকার। ইইউ অদূর ভবিষ্যতে ইউক্রেনের সদস্যপদ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে এবং এটি কমপক্ষে আগামী কয়েক বছরের জন্য তাদের অগ্রাধিকার হতে চলেছে। এই এনলারজমেন্ট ফেটিগের কারণেই ইউরোপীয় ইউনিয়ন পশ্চিম বলকানের মতো ছোট দেশগুলিকেও অন্তর্ভুক্ত করতে চাচ্ছে না, তুরস্ক তো দূরের কথা। এমনকি তুরস্ককে ইউরোপীয় ইউনিয়নে আনার লজিস্টিকগুলিও কঠিন, কমপক্ষে এজন্য যে তুরস্ক জনসংখ্যার দিক থেকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বৃহত্তম দেশ হবে। কিন্তু লজিস্টিক্স যদি কঠিন হয়, তাহলে রাজনীতি আরও খারাপ হবে।
তুরস্ক ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে, বিশেষ করে গ্রিসের মধ্যে সাইপ্রাস নিয়ে একটি চলমান সীমান্ত বিরোধ রয়েছে। তুরস্ক বিশ্বের একমাত্র দেশ যা তুর্কিশ রিপাবলিক অফ নর্দার্ন সাইপ্রাসকে স্বীকৃতি দেয়, আর এই উত্তর প্রকৃতপক্ষে সাইপ্রাসের উত্তর অংশ নিয়ন্ত্রণ করে। আর বাকি বিশ্ব এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন এই অঞ্চলটিকে সাইপ্রাসের অংশ হিসাবে বিবেচনা করে। কিন্তু এই দ্বন্দ্বের যদি নিষ্পত্তি হয়ও, তাহলেও যে ইউরোপীয় ইউনিয়ন তুরস্কের সঙ্গে চলাচলের স্বাধীনতা বা ফ্রিডম অফ মুভমেন্টে সম্মত হবে তা কল্পনা করা কঠিন, বিশেষ করে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলো থেকে অভিবাসন নিয়ে ইউরোপের কিছু দেশে উদ্বেগের কারণে। শুধু গত কয়েক মাসেই পুরো ইউরোপ মহাদেশ জুড়ে অভিবাসী বিরোধী বা এন্টি-মাইগ্রেন্ট মনোভাবের ঢেউ দেখা গেছে। পোল্যান্ড এবং হাঙ্গেরি ইউরোপীয় ইউনিয়নের নতুন অভিবাসন চুক্তিতে বা মাইগ্রেশন প্যাক্ট স্বাক্ষর করতে অস্বীকার করেছে, এএফডি জার্মানির নির্বাচনে এগিয়ে যাচ্ছে এবং ফিনল্যান্ডে নেটিভিস্ট ফিন্স পার্টি এই বছরের শুরুতে ফিনল্যান্ডের নির্বাচনে দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেছে এবং এখন সরকারী জোটে রয়েছে (এটা নিয়ে ইতিমধ্যে পোস্ট করা হয়েছে)।
এখন, এর মানে এই নয় যে তুরস্ক কখনই ইইউতে যোগ দেবে না, এবং সম্ভবত এটি এরদোয়ানের জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়নের দিকে স্থায়ী শিফ্টের সূচনা। তবে, বর্তমান পরিস্থিতি অনুযায়ী, শীঘ্রই এটি হওয়ার সম্ভাবনা কম।
তথ্যসূত্র
সুইডেনকে ন্যাটোতে যুক্ত করার কারণ
1 – https://www.nato.int/nato_static_fl2014/assets/pdf/2022/6/pdf/220628-trilat-memo.pdf
2 – https://www.reuters.com/article/us-turkey-sweden-idUSKBN26Y2GX
3 – https://www.independent.co.uk/news/world/americas/us-politics/turkey-f35-fighter-jets-s400-missile-defence-russia-shanahan-a8950361.html
4 – https://www.iiss.org/publications/strategic-comments/2019/turkey-the-s400-and-the-f35
5 – https://twitter.com/ragipsoylu/status/1619763375243935744
6 – https://twitter.com/ragipsoylu/status/1619763375243935744
7 – https://www.ft.com/content/cf7f5967-a524-4e0c-ab12-b2bf4ca70472
8 – https://www.middleeasteye.net/opinion/turkey-eu-schengen-visa-debacle-resolve-how
9 – https://www.middleeasteye.net/opinion/turkey-eu-schengen-visa-debacle-resolve-how
10 – https://twitter.com/jensstoltenberg/status/1678484703060324359?s=20
11 – https://twitter.com/ragipsoylu/status/1678485573663617037
12 – https://www.ft.com/content/cd8e7cc1-30c8-4b53-a605-8524d5815156
13 – https://twitter.com/Maks_NAFO_FELLA/status/1678353423148765184
14 – https://twitter.com/BBCSteveR/status/1678310415087063040?s=20
15 – https://twitter.com/ragipsoylu/status/1677743886066696192?s=20
16 – https://twitter.com/SamRamani2/status/1678529424839278592?s=20
রাশিয়াকে ত্যাগ করা
1 – https://www.europarl.europa.eu/RegData/etudes/BRIE/2021/679090/EPRS_BRI(2021)679090_EN.pdf
2 – https://www.aljazeera.com/news/2023/7/8/ukraines-zelenskyy-returns-azov-commanders-released-to-turkey
3 – https://twitter.com/FHeisbourg/status/1678092036241489922?s=20
4 – https://tass.com/defense/1645291
5 – https://archive.ph/QQtHT
6 – https://tass.com/politics/1645243
7 – https://twitter.com/RobinBrooksIIF/status/1550829073319878657
ইইউতে যুক্ত হবার সম্ভাবনা
1 – https://en.wikipedia.org/wiki/Accession_of_Turkey_to_the_European_Union
2 – https://www.economist.com/europe/2016/10/13/turkeys-bid-to-join-the-eu-is-a-bad-joke-but-dont-kill-it
3 – https://www.consilium.europa.eu/en/policies/enlargement/turkey/
4 – https://www.economist.com/europe/2021/08/26/the-fiction-that-turkey-is-a-candidate-to-join-the-eu-is-unravelling
5 – https://www.economist.com/europe/2016/05/26/europes-murky-deal-with-turkey
6 – https://www.economist.com/europe/2016/12/01/turkeys-effort-to-join-the-eu-is-on-life-support
7 – https://www.ft.com/content/cf7f5967-a524-4e0c-ab12-b2bf4ca70472
ন্যাটোতে তুরস্কের অন্তভুক্তির ইতিহাস, একে নিয়ে সমস্যা, একে জোট থেকে বের করে দেবার সম্ভাবনা (৫ জুলাই, ২০২৩)
ভূমিকা
১৯৫২ সাল থেকে ন্যাটোর সদস্য হওয়া সত্ত্বেও তুরস্ক কখনোই ন্যাটোতে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারেনি। অন্যান্য সদস্যদের নিয়ে ন্যাটো গঠন একরকম প্রাকৃতিকভাবে হয়েছিল। কিন্তু তুরস্ককে সেভাবে ঢোকানো হয়নি, ১৯৫০-এর দশকের গোড়ার দিকে তুরস্ককে ন্যাটোতে ঢোকানো হয়েছিল সুবিধার জন্য। আজ, এরদোয়ান ন্যাটোর অন্যান্য বেশ কয়েকটি সদস্যের সাথে একাধিক বিরোধে জড়িত, সম্প্রতি সংস্থাটিতে সুইডিশ এবং ফিনিশ অন্তর্ভুক্তি নিয়ে, আর তারপর ফিনল্যান্ডের অন্তর্ভুক্তির পর সুইডেনের অন্তর্ভুক্তি নিয়ে। তাই এই আর্টিকেলে আলোচনা করা হবে তুরস্ক কেন ন্যাটোতে যোগ দিয়েছে, ন্যাটো এবং অন্যান্য ন্যাটো সদস্যদের সাথে তুরস্কের বিরোধিতা কেমন, এবং ন্যাটো আসলেই তুরস্ককে জোট থেকে বের করে দিতে পারে কিনা।
তুরস্কের ন্যাটোতে যোগ দেবার কারণ ও ঐতিহাসিক পটভূমি
তুরস্ক কেন ন্যাটোতে যোগ দিয়েছে তা বোঝার জন্য আমাদের কিছুটা ইতিহাস ঘাটতে হবে। তুরস্ক এবং তার পূর্বসূরি অটোমান সাম্রাজ্য কখনোই রাশিয়ানদের সাথে ভাল সম্পর্ক স্থাপন করতে পারেনি। ন্যাটোতে তুরস্কের যোগদানের আগে, অটোমান এবং রাশিয়ান সাম্রাজ্যগুলি ৩০০ বছরের সময়কালে দশটি যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিল, প্রথম রুশো-তুর্কি যুদ্ধ ১৫৬৮ সালে শুরু হয়েছিল এবং শেষটি, অর্থাৎ দশম রুশো-তুর্কি যুদ্ধ ১৮৭৮ সালে শেষ হয়েছিল। এই লড়াইয়ের বেশিরভাগই ককেশাস এবং ক্রিমিয়া উপদ্বীপ নিয়ে ছিল এবং বেশিরভাগ যুদ্ধে রাশিয়ানরা চূড়ান্তভাবে জয়ী হয়েছিল। এই কারণেই, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে, সোভিয়েতরা ককেশাস এবং ক্রিমিয়া উভয়েরই নিয়ন্ত্রণ নিয়েছিল এবং এজন্য অনেক তুর্কিদের মধ্যে রাশিয়ার প্রতি ঐতিহাসিক বিদ্বেষ রয়েছে।
১৯১৩ সালে, অটোমানরা প্রথম বলকান যুদ্ধে পরাজিত হয়েছিল, যেখানে বুলগেরিয়া, সার্বিয়া, গ্রিস এবং মন্টিনিগ্রোর সমন্বয়ে গঠিত বলকান লীগ অটোমানদের ঠেলে দিয়ে ইস্তাম্বুলে সীমাবদ্ধ করে দেয়, যা তখন কনস্টান্টিনোপল নামে পরিচিত ছিল। এই যুদ্ধে অটোমানদের পরাজয়ের কারণে তারা “ইউরোপের অসুস্থ ব্যক্তি” নামটি অর্জন করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছিল যখন তারা অক্ষশক্তির পক্ষ নিয়ে ভুল করেছিল। ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটিয়ে অটোমানরা কৃষ্ণ সাগর হয়ে রাশিয়ানদের বিরুদ্ধে আক্রমণ করে ও দ্রুত পরাজিত হয়, আর এর মধ্যে দিয়েই যুদ্ধ শেষ হয়। ১৯১৮ সালের যুদ্ধবিরতির শর্তাবলীর অধীনে, কনস্টান্টিনোপলকে মিত্র বাহিনী দখল করে নেয়, অটোমান সাম্রাজ্যকে ভেঙে দেওয়া হয়, সালতানাতকে পুরোপুরি বিলুপ্ত করা হয়, এবং ১৯২০ সালে স্বাক্ষরিত আরেকটি চুক্তির মাধ্যমে অটোমানদেরকে এথনিক তুর্কিদের দ্বারা অধিকৃত নয় এমন সমস্ত অঞ্চল ছেড়ে দিতে বাধ্য করা হয়, ও দুটি নতুন স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল তৈরি করা হয় – পূর্বে কুর্দিশ অঞ্চল এবং পশ্চিমে স্মিরনা। উভয় অঞ্চলের নিজস্ব আঞ্চলিক সংসদও ছিল এবং কুর্দিদের স্বাধীনতা এবং স্মির্নার গ্রীসে প্রবেশের বিষয়ে গণভোট অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল।
১৯২৩ সালে, এই চুক্তিটি মিত্র পক্ষকে অটোমানদের জাতীয় অর্থের উপর নিয়ন্ত্রণ দেয় এবং অটোমানদের সামরিক ক্ষমতার উপর ব্যাপক বিধিনিষেধ আরোপ করে। তুর্কিরা এটি খুব বেশি পছন্দ করেনি এবং জেনারেল মোস্তফা কামাল আতাতুর্কের নেতৃত্বাধীন গ্র্যান্ড ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি চুক্তি স্বাক্ষরকারীদের থেকে তাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নিয়েছিল। আতাতুর্ক তখন তুর্কিদের ১৯২২ সালের গ্রিকো-তুর্কি যুদ্ধে বিজয়ের দিকে পরিচালিত করেছিলেন, যা ১৯২৩ সালে লুসান চুক্তির মাধ্যমে শেষ হয়েছিল। তুরস্কের দৃষ্টিকোণ থেকে, লুসান কিছুটা উন্নতি করেছিল কারণ এটি তুরস্ককে আনাতোলিয়ার উপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ দিয়েছিল এবং গ্রিসের সাথে তুরস্কের সীমান্তকে কিছুটা প্রসারিত করেছিল। যাইহোক, এই সব কিছুর মাধ্যমে ২০শ শতাব্দীর গোড়ার দিকে, অটোমান সাম্রাজ্য ইউরোপ, এশিয়া এবং উত্তর আফ্রিকার বৃহত অংশে বিস্তৃত একটি বিশাল সাম্রাজ্য থেকে হ্রাস পেয়েছিল যা মূলত একটি ছোট, ও তুলনামূলকভাবে দরিদ্র রাষ্ট্র ছিল, আর সামরিক বাহিনীর আকার ও অবস্থা ছিল ইউরোপের গড়ের চেয়ে নিচে।
১৯২০ এবং ১৯৩০ এর দশকে তুরস্কের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অনিয়মিত ছিল এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তুরস্কের সামরিক বাহিনী বেশ খারাপ অবস্থায় ছিল, তারা কুর্দি বিদ্রোহ সামলাতে ব্যস্ত ছিল। এর ফলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে শেষ পর্যন্ত তুরস্ককে নিরাপদে খেলতে হয়েছিল এবং দেশটি যুদ্ধের বেশিরভাগ সময় নিরপেক্ষ থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। অক্ষ শক্তিগুলি গ্রিসের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পরে তারা জার্মানির সাথে প্রায় মিত্রতা করেছিল ও ১৯৪১ সালের জার্মান-তুর্কি মৈত্রী চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিল, তবে তারা বুদ্ধিমানের মতোই ১৯৪৫ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত নিরপেক্ষ ছিল। ১৯৪৫ সালের ফেব্রুয়ারি মানে হল, যখন সোভিয়েতরা বার্লিনের কাছাকাছি এসেছিল এবং জার্মান পরাজয় অনিবার্য বলে মনে হয়েছিল। এই সময়ে তুরস্ক নিজের পক্ষ পরিবর্তন কে জার্মানি এবং জাপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিল। এই স্মার্ট কিন্তু “নিন্দনীয়” পদক্ষেপের মাধ্যমে তুরস্ক পরবর্তীতে ন্যাটো গঠন করা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্যের মতো মিত্রদের মতো বড় খেলোয়াড়দের কাছ থেকে কিছুটা সুনাম কুড়িয়েছিল।
যাই হোক, এই প্রেক্ষাপটেই তুরস্ক ৫০-এর দশকের গোড়ার দিকে ন্যাটোতে যোগ দেওয়ার জন্য আবেদন করেছিল। স্নায়ুযুদ্ধ উত্তপ্ত হয়ে উঠছিল এবং তুরস্ক ইউরোপের বাকি অংশের সাথে তুলনামূলকভাবে উষ্ণ সম্পর্কে ছিল। এদিকে তাদের ঐতিহাসিক শত্রু সোভিয়েত ইউনিয়ন মূলত তাদের ঘিরে রেখেছিল। সোভিয়েত সৈন্যরা বলকান এবং ককেশাসে অবস্থান করছিল, যখন সোভিয়েত কূটনীতিকরা কুর্দি বিদ্রোহীদের সমর্থন করছিল যারা সিরিয়া এবং ইরাকে প্রভাব বিস্তার করছিল। তুরস্ক স্পষ্টতই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে, আর নিরপেক্ষ থাকা চলে না, এবং সোভিয়েতদের সঠিকভাবে প্রতিহত করার জন্য তাদেরকে ন্যাটোতে যোগদান করা দরকার।
এদিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরপরই শুরু হয়েছিল স্নায়ুযুদ্ধ, যা ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে একটি রাজনৈতিক, সামরিক এবং মতাদর্শগত সংগ্রাম। সংঘাতের পরে পরাশক্তি হিসাবে আবির্ভূত উভয় জাতিরই যুদ্ধোত্তর বিশ্ব ব্যবস্থার জন্য ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি ছিল: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গণতন্ত্র এবং পুঁজিবাদের পক্ষে ছিল এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন কমিউনিজম এবং রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণকে সমর্থন করেছিল। ন্যাটো গঠন ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের দ্বারা সৃষ্ট হুমকি এবং পূর্ব ইউরোপে এর ক্রমবর্ধমান প্রভাবের প্রত্যক্ষ প্রতিক্রিয়ায় বেলজিয়াম, কানাডা, ডেনমার্ক, ফ্রান্স, আইসল্যান্ড, ইতালি, লুক্সেমবার্গ, নেদারল্যান্ডস, নরওয়ে, পর্তুগাল, যুক্তরাজ্য এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মিলে ১৯৪৯ সালের ৪ এপ্রিলে ন্যাটো গঠন করে, যেখানে সম্ভাব্য আগ্রাসন প্রতিহত করতে এবং সম্মিলিত প্রতিরক্ষার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়। প্রভাব সৃষ্টির জন্য দুই ব্লকের মধ্যে একটি বিশ্বব্যাপী প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছিল, যার ফলে বিশ্বে অসংখ্য প্রক্সি দ্বন্দ্ব দেখা দেয়।
এই ধরনের একটি সংঘাত ছিল কোরিয়ান যুদ্ধ, যা ১৯৫০ সালে শুরু হয়েছিল যখন সোভিয়েত ইউনিয়নের সমর্থিত উত্তর কোরিয়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র দক্ষিণ কোরিয়া আক্রমণ করেছিল। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে সোভিয়েত ইউনিয়ন সাময়িকভাবে অনুপস্থিত ছিল। ফলে জাতিসংঘ উত্তর কোরিয়ার অগ্রগতি প্রতিহত করার জন্য দ্রুত একটি বহুজাতিক বাহিনী গঠনের অনুমোদন দেয়। এর ফলে যে সব দেশ সোভিয়েত ইউনিয়ন ও উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিল তাদের মধ্যে তুরস্কও ছিল, যদিও এই সংঘাতে সরাসরি অংশ নেয়নি। তুরস্ক নিজেকে পশ্চিমের নির্ভরযোগ্য মিত্র হিসাবে স্থাপন করতে এবং আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষা প্রচেষ্টায় অবদান রাখতে আগ্রহী ছিল। জেনারেল তাহসিন ইয়াজিকির নেতৃত্বে, তুর্কি ব্রিগেড, জাতিসংঘ কমান্ডের অংশ হিসাবে কুনু-রি যুদ্ধ সহ বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধে সাহসিকতার সাথে লড়াই করেছিল, প্রচুর হতাহতের শিকার হয়েছিল তবে তাদের সাহস এবং অবদানের জন্য আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জন করেছিল।
কোরীয় যুদ্ধে অংশগ্রহণ তুরস্কের ১৯৫২ সালে ন্যাটোতে প্রবেশের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। দক্ষিণ কোরিয়ার প্রতিরক্ষার প্রতি তাদের অঙ্গীকার ন্যাটো সদস্যদের কাছে সোভিয়েত সম্প্রসারণবাদ দমনে তুরস্কের কৌশলগত মূল্যের পাশাপাশি পশ্চিমা গণতান্ত্রিক নীতির সাথে জোটবদ্ধ হওয়ার ইচ্ছাকে তুলে ধরে। তদুপরি, ইউরোপ এবং এশিয়া দুই জায়গা মিলে তুরস্কের ভৌগোলিক অবস্থান, সোভিয়েত ইউনিয়নের নিকটবর্তী অঞ্চলে ন্যাটোকে একটি গুরুত্বপূর্ণ পজিশন সরবরাহ করেছিল, আর এটি ন্যাটোকে কার্যকরভাবে অনেক কৌশলগত সুবিধা দিয়েছিল। ন্যাটোতে তুরস্কের স্বীকৃতি স্নায়ুযুদ্ধের একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত হিসাবে চিহ্নিত, যা গণতান্ত্রিক পশ্চিম এবং কমিউনিস্ট পূর্বের মধ্যে বিভাজনকে দৃঢ় করেছিল।
অন্যান্য ন্যাটোভুক্ত দেশের সাথে তুরস্কের বিরোধ
কিন্তু এসব সত্ত্বেও তুরস্ক কখনোই ন্যাটোর অন্যান্য সদস্য দেশগুলোর সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পারেনি। গ্রীসের সাথে তুরস্কের এর একটি চলমান সীমান্ত বিরোধ রয়েছে, যা ২০০০ এর দশকে ভূমধ্যসাগরে তেলের মজুদ আবিষ্কারের সাথে বৃদ্ধি পেয়েছিল এবং তা ২০২০ সালের গ্রীষ্মে প্রায় একটি পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধে পরিণত হয়েছিল, যা ফ্রান্সের সাথে গ্রিসের একটি প্রতিরক্ষা চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে রহিত হয়। শুধু তাই নয়, ন্যাটোতে যোগদানের পর থেকে তুরস্ক তিনটি সামরিক অভ্যুত্থানের সম্মুখীন হয়েছে এবং এরদোয়ান সম্প্রতি তুরস্ককে ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্র থেকে দূরে সরিয়ে ইসলামিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে আরও বেশি রাষ্ট্রপতি ব্যবস্থার দিকে ঠেলে দিয়েছেন। ২০১৬ সালে ব্যর্থ অভ্যুত্থানের পর পরিস্থিতি বিশেষভাবে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে, যার জন্য এরদোয়ান ইসলামিক পণ্ডিত ফেতুল্লাহ গুলেনকে দায়ী করেছিলেন। আর এর জন্য গুলেন বর্তমানে পেনসিলভেনিয়ায় বাস করেন, ও যুক্তরাষ্ট্র এখন পর্যন্ত এরদোয়ানের গুলেনকে ফিরিয়ে দেবার দাবি প্রত্যাখ্যান করেছে। তুরস্কের জন্য গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রচার নিয়ে ন্যাটোর ঘোষিত রাজনৈতিক লক্ষ্যগুলির সাথে সামঞ্জস্য করা বেশ কঠিন, পাশাপাশি ন্যাটো এর মেম্বারশিপ একশন প্ল্যানের সাথে তুরস্ক আসলে যায়না, যেখানে মেম্বারশিপ একশন প্ল্যানের জন্য প্রায়শই প্রার্থী দেশগুলির কাছ থেকে যথেষ্ট গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংস্কার প্রয়োজন, যা তুরস্ক নিজেই পূরণ করতে পারে না।
ন্যাটোর বাকি দেশগুলোর ভূরাজনৈতিক স্বার্থ আর তুরস্কের ভূরাজনৈতিক স্বার্থও ভিন্ন। তুরস্ক ন্যাটোর স্বার্থের আগে তার নিজের স্বার্থগুলোকেই অগ্রাধিকার দেয়। ন্যাটোর দেশগুলো, বিশেষ করে ন্যাটো এর ইস্টার্ন ফ্ল্যাঙ্কের দেশগুলো রাশিয়ার দিকে ফোকাস করে, রাশিয়াকে থ্রেট মনে করে। এদিকে তুরস্কের জন্য রাশিয়া তেমন কনসার্ন না, রাশিয়ার সাথে তুরস্কের বেশ ভাল সম্পর্কও আছে। তুরস্ক ফোকাস করে মধ্যপ্রাচ্যের দিকে যেখানে তার স্বার্থ আছে। এদিকে ন্যাটোভুক্ত অন্যান্য দেশগুলো মধ্যপ্রাচ্যকে অত গুরুত্ব দেয়না। ২০১৭ সালে রাশিয়ার আগ্রাসন প্রতিহত করার প্রয়াসে ন্যাটো লিথুয়ানিয়ায় অতিরিক্ত সৈন্য প্রেরণ করেছিল, কিন্তু এরদোয়ান স্পষ্টভাবে এর বিরোধিতা করেছিল। এদিকে ২০১৬ সালে তুরস্ক নমিনালি আইসিস দমনের জন্য (আসল স্বার্থ কুর্দিশ দমন যা তুরস্ক পরে করে) সেনা পাঠাতে চায় ও এজন্য ন্যাটো সদস্যদের কাছে সহায়তা চেয়েছিল, কিন্তু ন্যাটো সদস্যরা তুরস্কে সৈন্য পাঠাতে অস্বীকার করে। তুরস্ক রাশিয়ার বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কেনার পর যুক্তরাষ্ট্র তুরস্কের ওপরও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে এবং পুতিনের সঙ্গে এরদোয়ানের ফ্রেনিমি টাইপ আচরণ ন্যাটোর কিছু নেতার মধ্যে সন্দেহের জন্ম দেয়। সম্প্রতি, তুরস্ক তার ন্যাটো মিত্রদের তুলনায় রাশিয়ার প্রতি নরম অবস্থান নিয়েছে। তুরস্ক মূলত ইউক্রেন এবং রাশিয়ার মধ্যে মধ্যস্থতাকারী হিসাবে নিজেকে স্থাপন করে এবং সংঘাতের প্রথম কয়েক দিনের মধ্যে আক্রমণটিকে যুদ্ধ হিসাবে বর্ণনা করতে অস্বীকার করে মস্কোর লাইনটি অনুসরণ করে। আজ পর্যন্ত তুরস্কই একমাত্র ন্যাটো সদস্য যা রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেনি।
কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টির প্রতি সমর্থনের কারণে তুরস্ক ন্যাটোতে সুইডিশ ও ফিনল্যান্ডের অন্তর্ভুক্তির বিরোধিতা করেছিলেন। সুইডেন এবং ফিনল্যান্ডের মধ্যে কিছু কুর্দি অভিবাসী থাকলেও এরদোয়ানের দাবির সমর্থনে খুব কম প্রমাণ রয়েছে যে সুইডিশ বা ফিনিশ সরকার সক্রিয়ভাবে পিকেকে বা অন্য কোনও কুর্দি জঙ্গি গোষ্ঠীকে সমর্থন করে। তো এরপর তুরস্ক দেশ দুটোকে তিনটি শর্ত দেয়, যার মধ্যে ছিল দেশ দুটো কোন কুর্দি সংগঠনকে সমর্থন করবে না, যেগুলোকে তুরস্ক কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টির সাথে সম্পর্কিত বলে মনে করে, এবং দেশদুটোতে থাকা যে কোনো ‘সন্ত্রাসী সন্দেহভাজনকে’ তুরস্কের কাছে হস্তান্তর করতে হবে। চুক্তিতে কারও নাম উল্লেখ করা হয়নি, তবে চুক্তি স্বাক্ষরের পরের দিন তুরস্কের বিচারমন্ত্রী তুরস্কের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সংবাদ সংস্থাকে বলেছিলেন যে তুরস্ক ফিনল্যান্ডের ১২ জন এবং সুইডেনের ২১ জন সহ ৩৩ জনকে দেশে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছে। যাই হোক, এগুলো মানায় ফিনল্যান্ডকে ন্যাটোতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়, কিন্তু সুইডেনের সাথে দুটো ইস্যুতে নতুন করে সমস্যা তৈরি হয়। (এটা নিয়ে ইতিমধ্যেই একটি পোস্ট করেছি)।
তুরস্ক কি আসলেই ন্যাটো থেকে বহিষ্কার হতে পারে?
যাইহোক, ন্যাটোর বাকি অংশ থেকে এই বিষয়ে তুরস্কের ভিন্নতার মূল কারণ এটাই যে, তুরস্ক কখনই ন্যাটোর প্রাকৃতিক সদস্য ছিল না। কারো কারো মতে, তুরস্ককে ন্যাটো থেকে পুরোপুরি বের করে দেয়া উচিৎ যাতে অধিকতর ন্যাচারাল নর্ডিক প্রার্থীদের জন্য ন্যাটোতে জায়গা তৈরি হয়। তো এখন প্রশ্ন হচ্ছে, তুরস্ক আসলেই ন্যাটো থেকে বহিষ্কার হতে পারে কিনা। এর সংক্ষিপ্ত উত্তর হল না। এরদোয়ান যদি সুইডেনকে ন্যাটোতে অন্তর্ভুক্ত হতে নাও দেন তবুও ন্যাটো থেকে কাউকে বের করে দেওয়ার কোনও আইনি প্রক্রিয়া নেই (তবে কোন সদস্য চাইলে ন্যাটো ত্যাগ করতে পারে)। আর যদি তা করা হয় তবে বিশ্বের সবচেয়ে সফল সামরিক জোটে অপ্রয়োজনীয় অনিশ্চয়তা তৈরি হবে। কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা, ন্যাটোর কাছে তুরস্ক অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
তুর্কি প্রণালীগুলো, মানে বসফোরাস ও দার্দানেলিস প্রণালীর ওপর তুরস্কের নিয়ন্ত্রণ ন্যাটোকে রাশিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করতে সহায়তা করে এবং তুরস্কের সামরিক বাহিনী, জোটের মধ্যে অন্যতম শক্তিশালী সামরিক বাহিনী, যা সম্প্রতি ইউক্রেনে তাদের ড্রোন হামলার সাফল্যের জন্য বিখ্যাত হয়ে উঠেছে। তুরস্ক ইউক্রেইনের সাথে কৌশলগত অংশীদারিত্বের অংশ হিসাবে ২০১৯ সাল থেকে ইউক্রেনকে বায়রাক্তার টিবি-২ ড্রোন সরবরাহ করে আসছে। তুরস্ক ইউক্রেনকে ড্রোন-৩ এর উত্পাদন ক্ষমতা প্রসারিত করতে সহায়তা করেছে। উত্তর ইরাক, সিরিয়া, লিবিয়া এবং নাগোর্নো-কারাবাখের মতো বিভিন্ন সংঘাতে তুরস্ক এবং অন্যান্য দেশ বায়রাক্তার টিবি-২ ড্রোন ব্যবহার করেছে। এগুলি মাঝারি উচ্চতা দীর্ঘ সহনশীলতা (এমএএলই) ড্রোন যা বিভিন্ন ধরণের গোলাবারুদ বহন করতে পারে। ইউক্রেইনে তুরস্কের এরকম সহায়তার কারণে রাশিয়া তার অসন্তুষ্টি প্রকাশও করেছে, আর তুরস্কও এটা নিয়ে বেশ সতর্ক কারণ রাশিয়ার সাথেও দেশটির ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে।
তো এই ভূরাজনৈতিক ও সামরিক কারণেই ন্যাটো তুরস্কের বিভিন্ন ইস্যু ও অভিযোগের প্রতি চোখ বন্ধ করে রেখেছে। আর তাই তুরস্ককে নিয়ে ন্যাটোতে এমন একটি পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে যেখানে ন্যাটোর অন্যান্য সদস্য রাষ্ট্রগুলি তুরস্কের প্রতি ক্রমবর্ধমানভাবে বৈরী হয়ে উঠলেও তারা তাদের এই প্রব্লেমেটিক মেম্বারের থেকে মুক্তি পেতে তেমন কিছুই করতে পারছে না, আর এটা যে কেবল ন্যাটোরই সমস্যা তা নয়, একই সমস্যা ইইউ-তেও আছে (যেমন পোল্যান্ড)।
তুরস্ক কি কখনো সুইডেনকে ন্যাটোতে যোগ দিতে দেবে? বিশেষ করে কোরান পোড়ার ঘটনার পর? (৪ জুলাই, ২০২৩)
ভূমিকা
ফিনল্যান্ড ও সুইডেন যখন গত বছরের মে মাসে ন্যাটোতে যোগ দেওয়ার জন্য আবেদন করেছিল, তখন বেশিরভাগ রাজনীতিবিদ এবং বিশ্লেষকরা আশা করেছিলেন যে বেশিরভাগ ন্যাটো সদস্যের সাথে তাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কারণে তাদের যোগদান তুলনামূলকভাবে সহজ হবে। কিন্তু পশ্চিমাদের জন্য দুর্ভাগ্য যে, তুর্কি প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান এখনও সুইডেনের আবেদন আটকে রেখেছেন এবং মনে হচ্ছে যে, গত কয়েক সপ্তাহে তার দাবিগুলি আরও বেড়েছে। সুতরাং এখানে আলোচনা করা হবে কেন তুরস্ক সুইডেনের আবেদন আটকে রেখেছে, এরদোয়ানের দাবিগুলি কীভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে এবং ভবিষ্যতে ন্যাটোতে সুইডেনের যুক্ত হবার সম্ভাবনা আছে কিনা।
কেন তুরস্ক সুইডেনের আবেদন আটকে রেখেছে?
একটি দ্রুত রিক্যাপ দিয়ে শুরু করা যাক। আপনি সম্ভবত ইতিমধ্যেই জানেন, ফিনল্যান্ড এবং সুইডেন গত বছরের মে মাসে ন্যাটোতে যোগদানের জন্য আবেদন করেছিল। পশ্চিমাদের জন্য হতাশাজনক, তুর্কি রাষ্ট্রপতি এরদোয়ান প্রায় তাত্ক্ষণিকভাবে এই ধারণার প্রতি কিছুটা দ্বিধা প্রকাশ করেছিলেন এবং বলেছিলেন যে তুরস্কের বাইরে সক্রিয় কুর্দি গোষ্ঠীগুলির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান না নিলে তিনি দুটি নর্ডিক দেশের অন্তর্ভুক্তিতে স্বাক্ষর করবেন না।
তবে জুনের শেষের দিকে তিন দেশ ত্রিপক্ষীয় স্মারকলিপিতে স্বাক্ষর করে, যেখানে মূলত বলা হয়েছিল যে তুরস্ক ফিনল্যান্ড এবং সুইডেনকে ন্যাটোতে যোগদানের অনুমতি দেবে যদি তারা তিনটি কাজ করে। প্রথমত, কিছু কুর্দি সংগঠনকে সমর্থন করা যাবে না যেগুলোকে তুরস্ক কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টির সাথে সম্পর্কিত বলে মনে করে, এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাসিত তুর্কী আলেমের সাথে সম্পর্কিত হওয়া যাবে না যাকে এরদোয়ান ২০১৬ সালের অভ্যুত্থান প্রচেষ্টার জন্য দায়ী করেছেন। উল্লেখ্য, কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টি হচ্ছে তুরস্কের কুর্দি বিচ্ছিন্নতাবাদী সহিংসতার জন্য দায়ী কুর্দি জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠী। দ্বিতীয়ত, ২০১৯ সালে এরদোয়ান উত্তর সিরিয়ায় সৈন্য পাঠানোর পর তুরস্কের ওপর দেশ দুটো অনানুষ্ঠানিকভাবে যে অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা আরোপন করেছিল তা প্রত্যাহার করতে হবে। তৃতীয়ত, চুক্তিতে ফিনল্যান্ড ও সুইডেনকে যে কোনো ‘সন্ত্রাসী সন্দেহভাজনকে’ তুরস্কের কাছে হস্তান্তর করতে হবে।
এখন চুক্তিতে কারও নাম উল্লেখ করা হয়নি, তবে চুক্তি স্বাক্ষরের পরের দিন তুরস্কের বিচারমন্ত্রী তুরস্কের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সংবাদ সংস্থাকে বলেছিলেন যে তুরস্ক ফিনল্যান্ডের ১২ জন এবং সুইডেনের ২১ জন সহ ৩৩ জনকে দেশে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছে। তুর্কি বিচার মন্ত্রণালয়ের মতে, তুরস্ক গত পাঁচ বছরে এই সমস্ত ব্যক্তিদের প্রত্যর্পণের জন্য অনুরোধ করেছিল এবং এখন পর্যন্ত তাদের কোনওটিই অনুমোদিত হয়নি।
এখন, ফিনল্যান্ড অবিলম্বে এই সমস্ত মানদণ্ড পূরণ করেছে এবং এপ্রিলে ন্যাটোতে যোগ দিয়েছে, তবে সুইডেনে সমস্যা একটু বেশি ছিল, বিশেষত সেই শেষ মানদণ্ডটি নিয়ে। কারণ সুইডেনের সুপ্রিম কোর্ট সরকারের অন্তত দুটি প্রত্যর্পণ আবেদন প্রত্যাখ্যান করেছে। তখন এরদোয়ান বলেন, তালিকার সবাইকে হস্তান্তর করতে হবে না, তবে তিনি বুলন্দ কেইনস নামের এক সাংবাদিককে ফিরিয়ে দিতে বলেন। ২০১৫ সালে তাকে টুইটারে ‘প্রেসিডেন্টকে অপমান করার’ অভিযোগে তুরস্ক গ্রেপ্তার করে, কিন্তু পরে তিনি পালিয়ে সুইডেনে চলে যান।
এখন, একজন সাংবাদিকের প্রতি এরদোয়ানের এরকম মনোযোগকে অদ্ভুত বলে মনে হয়েছিল এবং অনেক বিশ্লেষক ধরে নিয়েছিলেন যে এরদোয়ান আসন্ন নির্বাচনের দিকে নজর দিচ্ছেন। মূলত, তারা ভেবেছিল যে মুদ্রাস্ফীতি আকাশছোঁয়া হওয়ায় এবং নির্বাচনে বিরোধীদের উত্থানের জন্য এরদোয়ান তুর্কি ভোটারদের ভূ-রাজনৈতিক শক্তি প্রদর্শন করে নিজের জনপ্রিয়তাকে টিকিয়ে রাখতেই সুইডেনের আবেদনটি আটকে রেখেছেন এবং প্রমাণ করছেন যে তিনি ‘দুষ্টু আমেরিকানদের’ দ্বারা বাধ্য হবেন না, যারা তুরস্কে সত্যিই অজনপ্রিয়। তাই বুলন্দ কেইনস এর ব্যাপারটাও একটা এক্সকিউজ মনে হচ্ছিল। তাই আশাও করা হয়েছিল যে নির্বাচনের পরে, রাজনৈতিক চাপ কমে যাওয়ার সাথে সাথে এরদোয়ান নীরবে ইউ-টার্ন নেবেন এবং সুইডেনকে ন্যাটোতে যোগ দিতে দেবেন।
এখন, এটি আশা করার মতো একটি যুক্তিসঙ্গত বিষয়, কারণ তার বিতর্কিত আর্থিক নীতির ক্ষেত্রে তিনি ঠিক এটাই করেছেন। নির্বাচনের আগে তিনি বলেছিলেন যে তিনি কখনই তার নীতি থেকে সরে আসবেন না, আর হাল ছাড়বেন না, কিন্তু নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর তিনি নীরবে ঠিক তাই করেছেন। (এটা নিয়ে ইতিমধ্যেই একটি আর্টিকেল লিখেছি, পড়ে দেখতে পারেন)। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সুইডেনের জন্য এমনটা হয়নি, বরং মনে হচ্ছে সুইডেনের ক্ষেত্রে এরদোয়ানের দাবি আরও বৃদ্ধি পেয়েছে।
এরদোয়ানের দাবিগুলি কীভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে?
এখন, সুইডেন এবং ন্যাটো মহাসচিব জেনস স্টলটেনবার্গ সহ তার ন্যাটো মিত্ররা নিশ্চিত যে দেশটি ত্রিপক্ষীয় স্মারকলিপিতে উল্লিখিত তুরস্কের দাবি পূরণ করেছে। কিন্তু এরদোয়ান ততদিনে সেখান থেকে সরে এসে আরও দুটি দাবি নিয়ে এসেছেন। জুনের মাঝামাঝি সময়ে এরদোয়ান বলেছিলেন যে সুইডেনকে তার দেশে তুরস্ক বিরোধী বিক্ষোভ বন্ধ করতে হবে, আর তা না করা পর্যন্ত তিনি সুইডেনকে ঢুকতে দেবেন না। তিনি বলেছিলেন, সুইডেনের নতুন সন্ত্রাসবিরোধী আইনকে স্বাগত জানানো হলেও তুরস্কের নির্বাচনের রাতে স্টকহোমে অনুষ্ঠিত এরদোয়ান বিরোধী বিক্ষোভ পুলিশের প্রতিরোধ করা উচিত ছিল এবং তুরস্ক সুইডেনকে ন্যাটোতে প্রবেশ করতে দেবে না, যতক্ষণ না তারা এই বিক্ষোভগুলি পুনরায় ঘটতে বাধা দেয়।
এরপর গত সপ্তাহে সুইডিশ কর্তৃপক্ষ ঈদের প্রথম দিনে স্টকহোমের একটি মসজিদের বাইরে কোরান পোড়ানো ইরাকি বংশোদ্ভূত এক শরণার্থীকে বিক্ষোভের অনুমতি দেওয়ার পর আরেকটি নতুন উত্তেজনার বিষয় উঠে আসে। এখন, সুইডিশ কর্তৃপক্ষ ওই ব্যক্তিকে একটি জাতিগত গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে আন্দোলনের জন্য অভিযুক্ত করেছে এবং সুইডিশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এটিকে ইসলামোফোবিক কাজ হিসাবে বর্ণনা করেছে, এবং উল্লেখ করেছে এটি কোনওভাবেই সুইডিশ সরকারের দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রতিফলিত করে না। কিন্তু একই সাথে এও বলা হয়েছে যে, সুইডেন সমাবেশ, মত প্রকাশ এবং প্রদর্শনের স্বাধীনতার অধিকারকে সাংবিধানিকভাবে সুরক্ষা করে, এবং এই কারণে সুইডিশ সরকার কোরান পোড়ানোকে নিষিদ্ধ করতে পারে না।
উল্লেখ্য, সুইডিশ পুলিশ প্রাথমিকভাবে এই বিক্ষোভ নিষিদ্ধ করেছিল, তবে একটি সুইডিশ আপিল আদালত রায় দিয়েছে যে নিষেধাজ্ঞাটি ব্যক্তির মত প্রকাশের স্বাধীনতার লঙ্ঘন। এদিকে এরদোয়ান এর কোনোটাকেই ভালোভাবে নেননি। মুসলিমদের ঈদের ছুটি উপলক্ষে এক ভিডিও বার্তায় তিনি বলেন, ‘আমরা অহংকারী পশ্চিমা জনগণকে শিক্ষা দেব যে, মুসলমানদের পবিত্র মূল্যবোধকে অপমান করা মত প্রকাশের স্বাধীনতা নয়।” শুধু এরদোয়ানই নন, ইরাক, কুয়েত, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং মরক্কো সহ অনেক মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ সুইডিশ রাষ্ট্রদূতদের তলব করেছে এবং বৃহস্পতিবার বাগদাদে সুইডিশ দূতাবাসে বিক্ষোভকারীরা হামলা চালিয়েছে।
ভবিষ্যতে ন্যাটোতে সুইডেনের যুক্ত হবার সম্ভাবনা আছে কি?
যাইহোক, এখন মনে হচ্ছে, মূল তিনটি চুক্তি এবং বিক্ষোভ নিষিদ্ধ করার সাথে সাথে এরদোয়ান এও চান যে, সুইডেন ন্যাটোতে যোগদানের আগে কোরান পোড়ানো নিষিদ্ধ করুক। আর যদি এটাই এরদোয়ানের রেড লাইন হয়, তবে তার জন্য এটি কেবল একটি ম্যাক্সিমালিস্ট বার্গেইনিং স্ট্র্যাটেজি নয়, সেই সাথে এর অর্থ হ’ল সুইডেনের শীঘ্রই ন্যাটোতে যোগদানের সম্ভাবনা কম। কোরান পোড়ানো সহ মত প্রকাশের স্বাধীনতা স্পষ্টতই সুইডেনের সংবিধান দ্বারা সুরক্ষিত এবং এমনকি যদি সুইডিশ সরকার এটি পরিবর্তন করতে চায়ও, তবুও এটি সুইডেনে একটি জনপ্রিয় বিষয় হবে না। এর কারণ হচ্ছে, সুইডিশদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ ন্যাটোতে যোগ দিতে চাইলেও, এবারে তার চেয়েও বড় সংখ্যাগরিষ্ঠ (প্রায় ৮০% সুইডিশ) সুইডেনের সংবিধান ও আইন রক্ষার জন্য অন্তত ন্যাটোর অন্তর্ভুক্তি বিলম্বিত করতে পছন্দ করবে। সুতরাং সুইডিশ সরকার কেবল এরদোয়ানের জন্য পরিস্থিতি পরিবর্তন করতে অনুপ্রাণিত হবে না।
যাইহোক, একটি ভাল সম্ভাবনা রয়েছে যে, এরদোয়ান সত্যিই সুইডেনকে ন্যাটোতে প্রবেশ করতে না দেওয়ার জন্য নতুন অজুহাত নিয়ে আসছেন যাতে তিনি তার সুবিধা সর্বাধিক করতে পারেন এবং যতটা সম্ভব ছাড় পেতে পারেন। উদাহরণস্বরূপ, এরদোয়ান স্পষ্টতই তুরস্ককে এফ-16 এবং এফ-35 দেওয়ার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে চাপ দিতে চান, কেননা এরদোয়ান ২০১৫ সালে রাশিয়ার তৈরি এস-400 এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম কেনার পর থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সেটাকে আটকে রেখেছে। মজার ব্যাপার হলো, শুধু তুরস্কই চাপ প্রয়োগ করছে না, কারণ মনে হচ্ছে পশ্চিমা দেশগুলোও একই ধরনের কিছু করছে। গত সপ্তাহেই রয়টার্স জানায়, সুইডিশ ও আমেরিকান তদন্তকারীরা এরদোয়ানের এক ছেলের বিষয়ে পুনরায় তদন্ত শুরু করেছেন, যেখানে বিশেষ করে দেখা হচ্ছে তুরস্কের বাজারে প্রভাবশালী অবস্থান অর্জনে সহায়তা করার জন্য তিনি একটি মার্কিন কোম্পানির সুইডিশ এফিলিয়েটেড সংস্থার কাছ থেকে ঘুষ নিয়েছেন কিনা।
শেষ পর্যন্ত, সুইডেন শীঘ্রই ন্যাটোতে যোগদানের সুযোগ পাবে কিনা তা নির্ভর করে, সুইডেনের কোরান বিরোধী এবং এরদোয়ান বিরোধী বিক্ষোভ নিষিদ্ধ করা নিয়ে এরদোয়ান কী আশা করছেন তার ওপর, বা এই নতুন দাবিগুলি এরদোয়ানের পক্ষে যতটা সম্ভব ছাড় নেওয়ার বৃহত্তর খেলার অংশ কিনা তার ওপর। যেমনটা আমরা দেখতে পাচ্ছি, এই দুটো সম্ভাবনার মধ্যে পরেরটি হবার সম্ভাবনাই বেশি বলে মনে হচ্ছে, কিন্তু তারপরেও, সুইডেনকে শীঘ্রই ছেড়ে দেয়াটা তুরস্কের জন্য কঠিন হবে। এবং সুইডেনের জন্য একমাত্র সিলভার লাইনিং হচ্ছে, এরদোয়ানের আনপ্রেডিক্টেবিলিটির মানে এই না যে ভবিষ্যতে যেকোন কিছু হওয়া সম্ভব। তবে বরাবরের মতোই, এটি প্রেডিক্ট করা সত্যিই কঠিন।
তথ্যসূত্র
1 – https://www.nato.int/nato_static_fl2014/assets/pdf/2022/6/pdf/220628-trilat-memo.pdf
2 – https://www.reuters.com/article/us-turkey-sweden-idUSKBN26Y2GX
3 – https://www.aljazeera.com/news/2022/6/29/turkey-extraditions-finland-sweden
4 – https://www.aljazeera.com/news/2022/6/29/turkey-extraditions-finland-sweden
5 – https://www.firstpost.com/world/they-impose-sanctions-on-turkey-erdogan-reiterates-opposition-to-nato-membership-for-finland-sweden-10684691.html
6 – https://www.nato.int/nato_static_fl2014/assets/pdf/2022/6/pdf/220628-trilat-memo.pdf
7 – https://m.bianet.org/english/world/271682-sweden-refuses-to-extradite-journalist-bulent-kenes-to-turkiye
8 – https://www.pewresearch.org/short-reads/2014/10/31/the-turkish-people-dont-look-favorably-upon-the-u-s-or-any-other-country-really/
9 – https://www.reuters.com/world/turkey-wont-back-swedish-nato-bid-unless-it-stops-anti-turkish-protests-erdogan-2023-06-14/
10 – https://www.france24.com/en/europe/20230702-swedish-govt-condemns-islamophobic-burning-of-koran-outside-stockholm-mosque
11 – https://www.premiumtimesng.com/news/top-news/607356-saudi-us-iran-others-react-as-man-burns-quran-in-sweden.html
12 – https://www.bloomberg.com/news/articles/2023-06-29/turkey-s-erdogan-slams-sweden-over-koran-burning-in-new-nato-tensions
13 – https://www.dw.com/en/swedens-fraught-path-to-nato-accession/a-66085063
14 – https://www.reuters.com/world/us-swedish-prosecutors-study-graft-complaint-naming-son-turkeys-erdogan-2023-06-26/
এরদোয়ানের ইউ-টার্ন, তুরস্কে সুদের হার বৃদ্ধি, কিন্তু পতনশীল অর্থনীতিকে বাঁচাতে পারবে কি? (২৫ জুন, ২০২৩)
একটি দেশে যদি ইনফ্লেশন বা মুদ্রাস্ফীতির হার বেড়ে যায়, তাহলে এর সমাধান হিসেবে প্রথমেই যেটা করা হয় তা হচ্ছে সুদের হার বাড়িয়ে দেয়া। মূলত দু’ভাবে এটা বর্ধিত ইনফ্লেশন রেটকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে সহায়তা করে – প্রথমত, এর ফলে মানুষ ব্যাংক থেকে কম ঋণ নেয়, ফলে কম ব্যয় করে ও বাজারে অর্থ সরবরাহ কমে যায়, যার ফলে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আসে, আর দ্বিতীয়ত, সুদ বেশি হলে বিদেশী বিনিয়োগ বেশি আসে, কারণ বেশি সুদের দেশে বিনিয়োগ করে লাভ বেশি হয় আর এটাও মুদ্রাস্ফীতিকে নিয়ন্ত্রণে আনায় অবদান রাখে। কিন্তু তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান বরাবরই ভিন্ন রাস্তায় হেঁটেছেন। সুদ বা সুদের হার বৃদ্ধিকে কখনোই তিনি ভাল নজরে দেখেননি। তুরস্কের মারাত্মক অর্থনৈতিক সংকট ও উচ্চ মুদ্রাস্ফীতির পরও তিনি সুদের হার বাড়াতে দেননি, আর তার ফলে তুরস্কের অর্থনৈতিক অবস্থা আরও বাজে হয় [৩]। এর প্রভাব পড়ে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রায়, আর এই নির্বাচনে এরদোয়ানের ভোট পার্সেন্টেজ এত বেশি ড্রপ করার অন্যতম কারণ হিসেবেও তার এই একগুঁয়ে অর্থনৈতিক অবস্থানকেই দায়ী করা হয়। আর সেজন্য এরদোয়ানও এবারে ক্ষমতায় এসে সুদের হার বৃদ্ধি নিয়ে তার নীতির পরিবর্তন করলেন। অবশেষে…
হ্যা, এরদোয়ান ইউ-টার্ন নিয়েছেন। এতদিন খুব কষ্ট করে হলেও সুদের হার না বাড়িয়েই এরদোয়ান একরকম ম্যানেজ করছিলেন, কিন্তু তাতে খুব একটা ভাল কিছু হয়নি, বরং সম্প্রতি দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা খুবই খারাপ দিকে চলে যাচ্ছিল। এরপর গত মাসে তুরস্কের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঘোষণা করে যে তাদের অর্থ শেষ হয়ে যাচ্ছে। তখনই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, দেশটার জন্য বা এরদোয়ানের জন্য এখন ইউ-টার্ন নেয়া অনিবার্য হয়ে উঠেছে। শেষমেষ এই বৃহস্পতিবার দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নতুন গভর্নর সুদের হার ৮.৫% থেকে বাড়িয়ে ১৫% করে দিলেন [১২]। কিন্তু প্রশ্ন হল, দেশটির অর্থনীতি যে অবস্থায় চলে গেছে, এই অবস্থায় একে পুনরায় সচল করার জন্য কি কেবল সুদের হার বৃদ্ধি যথেষ্ট? ঠিক এই বিষয়টি নিয়েই এখন আলোচনা করা হবে। উল্লেখ্য, সুদের হারের এই বৃদ্ধির পরেই দেখা যায় বাজারে লিরার মান আরও কমে গেছে, এখন এখন এক ডলারের দাম ২৫ লিরার উপরে [১৩]।
শুরু থেকে বলছি। তুর্কি অর্থনীতি কয়েক বছর ধরেই খুব বাজে অবস্থায়। লিরার মানের হ্রাস এবং ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতি সত্ত্বেও, এরদোয়ান সুদের হার বাড়াতে অস্বীকার করে এসেছেন কারণ তার চোখে সেটা অনৈসলামিক এবং তথাকথিত ইন্টারেস্ট রেইট লবির ষড়যন্ত্র [৪]। উল্টে তিনি সুদের হার হ্রাস করেছেন এবং কোনও কেন্দ্রীয় ব্যাংকারকে তার বিরোধিতা করলেই তাকে বরখাস্ত করেছেন। আর তার এই নীতিগুলো লিরাকে পঙ্গু করে দেয় ও মুদ্রাস্ফীতি বৃদ্ধি করে [৯]।
তুরস্কের দেখানো হিসেব অনুযায়ী দেশটির মুদ্রাস্ফীতির হার গত বছরের অক্টোবরে শীর্ষ ৮৫.৫%-এ পৌঁছেছিল, আর এই মে মাসে এটি ৪০%-এ নেমে এসেছে। তবে মুদ্রাস্ফীতির হার কমে এলেও এর অর্থ হ’ল গত দুই বছরে দেশটির দ্রব্যমূল্য প্রায় ১৫০% বেড়েছে। তবে এটা তুরস্কের সরকারী হিসাব। আনঅফিশিয়াল হিসাবগুলো অন্য কিছু দেখায়। যেমন Istanbul Ticaret Odasi বলছে মে মাসে ইনফ্লেশন রেইট ছিল ৭৩%, আর ENAG বলছে এটি ছিল ১০৫%, মানে তুরস্ক যা দাবি করেছে, তার থেকে অনেক বেশি [১]।
যাই হোক, এখন সুদের হার তো কমানো যাবে না, তাহলে উপায়? এই অবস্থায় তুরস্কের সরকার এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদের হার না বাড়িয়ে মুদ্রাস্ফীতি কমাতে বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করেছে [৩]। যেমন, দেশটি প্রথমে মূলধন নিয়ন্ত্রণ শুরু করে, কিন্তু সেটা তুর্কি নাগরিক এবং বিজনেসগুলোর জন্য তাদের লিরা বিক্রি করা আরও কঠিন করে তোলে। এরপর এরদোয়ান তার দেশের প্রধান রপ্তানিকারকদেরকে তাদের বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনের কমপক্ষে ২৫%-কে লিরাতে রূপান্তর করতে বাধ্য করে। দেশটি “সোনার বিনিময়ে নতুন লিরা” নাম একটা স্কিম তৈরি করেছিল, যেখানে রাষ্ট্র দেশটির নাগরিকদের সোনার বিনিময়ে নতুন লিরা প্রদান করছিল, উদ্দেশ্য ছিল দেশটিতে স্বর্ণের রিজার্ভ বাড়িয়ে লিরাকে স্থিতিশীল করা [৩]। এদিকে লিরার দাম কমতে থাকায় মানুষ তাদের লিরা দিয়ে ডলার কিনছিল, এরকম পরিস্থিতিতে যা হয় আরকি। কেননা লিরার মান এত দ্রুত বেগে কমার মানে হল আজ ১০০ ডলার যে দামে কিনব, কাল সেই ১০০ ডলার তুলনায় অনেক বেশি দামে বিক্রি করব, মানে লাভ। কিন্তু এরকমটা দেশের অর্থনীতির জন্য খুব ক্ষতিকর, কেননা তাতে মুদ্রাস্ফীতি আরও বেড়ে যায়।
তাই এটা আটকাবার জন্যেও এরদোয়ান লিরা ডিপোজিট স্কিম নাম একটা স্কিম চালু করেন [২]। এক্ষেত্রে ব্যাংক বা ক্রেডিট ইউনিয়নের মতো বিভিন্ন ফাইনান্সিয়াল ইনস্টিটিউশনে যাদের লিরা ডিপোজিট বা লিরা আমানত রয়েছে তাদের এটা সুবিধা দান করে। এক্ষেত্রে ডলারের বিপরীতে যাতে সেই লিরা ডিপোজিটের দাম না কমে তাই লিরার ম্যান কমলে ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়, যাতে লিরার কনফিডেন্স বজায় থাকে, অর্থাৎ এরা লিরা বেচে ডলার না কেনে। তো স্কিমগুলো কতটা ভালভাবে এক্সিকিউট করা হয়েছে কে জানে, কিন্তু যদি ঠিক মত বাস্তবায়ন হয়, বিশেষ করে শেষেরটি ঠিক মত বাস্তবায়ন হয় তাহলে বলতে হবে তা সাধারণ তুর্কি জনগণের আমানতকে ঝুঁকিমুক্ত করেছে, আর এজন্যই এই স্কিমগুলো পপুলারও হয়ে থাকবে। এখন মুদ্রাস্ফীতির মোকাবেলায় এগুলো কতটা কার্যকর সেই আলাপ পরে হবে, কিন্তু কেবল আমানত ঝুঁকিমুক্ত করাটা হয়তো এরদোয়ানকে নির্বাচনের আগে আগে ভালোই পলিটিকাল ক্যাপিটাল দিয়ে থাকবে, যা তার নির্বাচনে জয়লাভ হয়তো অবদান রাখে। (নির্বাচনের আগে পর্যন্ত সুদের হার বৃদ্ধি আটকে রাখাটাও এমনই একটি চাল হয়ে থাকতে পারে, যা দেশের সুদ বা সুদের বর্ধিত হার পছন্দ না করা রক্ষণশীলদের হাতে রাখাকে নিশ্চিত করেছিল। নির্বাচনের পরপরই নিজের অবস্থান থেকে ইউ টার্ন নেয়াটা হয়তো এটাই ইঙ্গিত করে। সেই সাথে অনেকেই বলেন, ইকোনোমি আরো বাজে হয়ে যাতে এরদোয়ানের জনপ্রিয়তা আরও কমিয়ে না দেয় সেই ভয়েই তিনি নির্বাচনের ডেইট ১৮ই জুন থেকে এক মাস এগিয়ে ১৪ই মে-তে নিয়ে আসেন।)
আসল কথায় আসা যাক। এই সমস্ত স্কিমগুলির পরেও, লিরার মানের হ্রাস অব্যাহত ছিল যা কেন্দ্রীয় ব্যাংককে বাধ্য করেছিল বাজারে হস্তক্ষেপ করতে [৩]। মূলত, লিরাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক তার বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বিক্রি করে লিরা কিনতে শুরু করে। এটার উপকারী দিকটা হচ্ছে, এতে লিরার মূল্য কৃত্রিমভাবে বেড়ে যায়, আর তার ফলে মুদ্রাস্ফীতি কম হয়। এই পদ্ধতিকে মুদ্রার রক্ষা বা ডিফেন্ডিং বলে। কিন্তু নির্বাচনের আগে আগেই কেন কেন্দ্রীয় ব্যাংক এভাবে এত এত ফরেইন রিজার্ভ ডিপ্লেট করে এই কাজটা করবে? এর কারণ ছিল – (১) ইনভেস্টর বা বিনিয়োগকারীরা বুঝতে পেরেছিল যে নির্বাচনে এরদোগানই জিতবে, আর তারা এরদোগানের আচরণ সম্পর্কেও ভালোই জানত, জানতো যে এরদোয়ানের যা ইকোনোমিক পলিসি তাতে এরদোয়ান ক্ষমতায় আসার পরও মুদ্রাস্ফীতি চলতে থাকবে, আর তাই তারা তাদের লিরা বিক্রি করতে মরিয়া হয়ে যায় ও বিক্রি করতে শুরু করে। এর ফলে দেশটির ইকোনোমি আরও খারাপ হবার সম্ভাবনা দেখা যায়, মুদ্রাস্ফীতি আরও বৃদ্ধি পাবার সম্ভাবনা তৈরি হয়, যা কেন্দ্রীয় ব্যাংক আটকাবার চেষ্টা করেছিল। আর (২) কেন্দ্রীয় ব্যাংক চায়নি যে নির্বাচনের আগে এরদোয়ান কোন বোরো রকমের ইকোনোমিক ক্রাইসিসের মুখে পড়ুক, আর তাই তারা এরদোয়ানকে বাঁচানোর চেষ্টা করে ও এই স্টেপ নেয় [৫]।
কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংক কেন এর্দোয়ানকে বাঁচাবার চেষ্টা করবে? এর কারণ হতে পারে নির্বাচনের পূর্বে দেশের পলিটিকাল স্ট্যাবিলিটি ধরে রাখা যা ব্যাহত হলে দেশের ইকোনোমিতেও টানাপোড়েনের সৃষ্টি হবে; আবার হতে পারে তারা তুরস্কের সরকার ও এরদোয়ানের প্রেসিডেন্সিয়াল পাওয়ারের রেপুটেশনকে আক্রান্ত হতে দিতে চায়নি, কারণ সেটাও দেশের ইকোনমিতে হুমকির সৃষ্টি করতে পারে। আবার এটাও হতে পারে যে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকও বুঝে গেছিল যে এরদোয়ানই নির্বাচনের পর ক্ষমতায় আসতে যাচ্ছে, আর তাই তারা যদি এরদোয়ানকে সাপোর্ট না দেয় তাহলে পুনরায় ক্ষমতায় এসে এরদোয়ান কেন্দ্রীয় ব্যাংকে হস্তক্ষেপ বাড়াতে পারে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকে ক্ষমতাসীন সরকারের সাপোর্ট কমে গিয়ে ইকোনোমিতে অনিশ্চয়তা ও অস্থিতিশীলতা তৈরি হতে পারে, আর তাছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংককে সবসময় মার্কেট এক্সপেক্টেশন আর পোটেনশিয়াল ইলেকটোরাল আউটকাম মানে সামনের নির্বাচনে কে জিততে পারে তা চিন্তা করেই তাদের সিদ্ধান্ত নিতে হয়, নাহলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মার্কেট কনফিডেন্স কমে যায়, মার্কেট আর্টিসিপেন্টরা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে শুরু করে। সব মিলে বলতে গেলে, সেন্ট্রাল ব্যাংকের অনেক সিদ্ধান্তেই ইকোনমিকসের সাথে পলিটিক্স সম্পর্কিত থাকে, এগুলো বুঝে নিতে হবে।
তো তুরস্কের সেন্ট্রাল ব্যাংক শুধু এই মে মাসেই প্রায় ২৫ বিলিয়ন ডলার এবং নির্বাচনের আগের সপ্তাহে প্রায় ৮ বিলিয়ন ডলার ডিপ্লেট করে দেয় [৬]। আর এভাবে তুরস্ক তাদের নিজস্ব রিজার্ভ শেষ করার পর বন্ধুত্বপূর্ণ দেশগুলির কাছে সহায়তা চাইতে শুরু করে। এর ফলে তুরস্কের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সৌদি আরবের কাছ থেকে ৫ বিলিয়ন ডলারের ডিপোজিট বা আমানত লাভ করে, সেই সাথে সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার, চীন এবং দক্ষিণ কোরিয়ার কাছ থেকে উদার সোয়াপ লাইন লাভ করে [৭]। সোয়াপ লাইন হল সেই ব্যবস্থা যার মাধ্যমে কোন কেন্দ্রীয় ব্যাংক অন্য মুদ্রার সমতুল্য পরিমাণের বিনিময়ে অন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংককে তার মুদ্রার একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ ঋণ দিতে সম্মত হয়। এক্ষেত্রে অর্থের পরিমাণ, সুদের হার এবং সময়কলের সহ বিনিময়ের বিভিন্ন শর্তাবলী থাকে। তুরস্ক দেশগুলোর সাথে যে সোয়াপ লাইনে যায় তার শর্তগুলো তুরস্কের জন্য উদার বা অনুকূলই ছিল।
কিন্তু দুৰ্ভাগ্যজনকভাবে এটাও তুরস্কের অর্থনীতিকে বাঁচানোর জন্য যথেষ্ট ছিল না। আর যখন দেখা যায় এটা যথেষ্ট নয়, তখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক দেশটির কয়েকটি ক্ষুদ্রতর ব্যাংক সহ বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে আরও বৈদেশিক মুদ্রা ধার নেওয়া শুরু করতে হয়েছিল [৮]। জেপি মরগানের বিশ্লেষণে দেখা গেছে, গত মাসে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিট রিজার্ভ নেতিবাচক হয়ে গেছে। এর অর্থ হ’ল তুরস্কের কেন্দ্রীয় ব্যাংক আসলে তার হাতে যত বৈদেশিক মুদ্রার রয়েছে, তার চেয়েও বেশি বৈদেশিক মুদ্রা ধার করেছে, যা দেশটিকে নিয়ে গেছে এক অনিশ্চিত অবস্থানে [৮]। অবশ্য এর মানে এই নয় যে তাদের অর্থ ফুরিয়ে গেছে, কেননা এখনও তারা প্রায় ১০০ বিলিয়ন ডলার মূল্যের সম্পদের মালিক, তবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছে তাদের দেন ১০০ বিলিয়নেরও বেশি। তার মানে তাদের কাছে যত আছে, ধার করেছে তার চেয়ে বেশি। মানে নেট অর্থ নেগেটিভ [৮]।
সব মিলে স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছিল যে, এরদোয়ানের সময় ফুরিয়ে আসছে। তার যা যা করার ছিল, যার যার কাছ থেকে সহায়তা নেবার ছিল, সব ইতিমধ্যে হয়ে গেছে। এদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অবস্থাও খুব বাজে। আর কয়েক সপ্তাহ আগে লিরা মার্কিন ডলারের তুলনায় তদকালীন সময়ের সর্বকালের সর্বনিম্ন স্তরে ট্রেড করছিল, যা ছিল প্রতি ডলারের বিনিময়ে ২৩.৫ লিরা [৫]। অবস্থা যখন এই, তখন এরদোয়ান শেষ পর্যন্ত তার নিজের নীতি থেকে ইউ-টার্ন নেয়া শুরু করেন, যা আলামত পাওয়া যায় মে মাসের শুরুতে অর্থ মন্ত্রণালয় ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকে আগের লোকদের বাদ দিয়ে নতুন লোকজনকে নিয়োগ দেয়ার মাধ্যমে [৪]। নিশ্চিতভাবেই এই ইউ-টার্ন এরদোয়ানের জন্য বিব্রতকর, সেই সাথে তার জনপ্রিয়তাকেও হ্রাস করবে। কিন্তু তাতে এরদোয়ানের কী এমন আসে যায়? ইতিমধ্যেই নির্বাচনে জিতে তিনি আরো ৫ বছরের ক্ষমতা নিশ্চিত করে ফেলেছেন। তাই এই ইউ-টার্ন আর তার নির্বাচনী সম্ভাবনাকে হুমকিতে ফেলছে না [৪]।
তো দেখা যাক তিনি কিভাবে ইউ-টার্নটা নিলেন। এর জন্য তিনি যাদেরকে নিয়োগ দিয়েছিলেন, তাদের মধ্যে দুজন প্রধান নিয়োগপ্রাপ্তদের মধ্যে একজন হচ্ছেন মেহমেত সিমসেক (Mehmet Simsek), যিনি ৩রা জুন তুরস্কের অর্থমন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত হন; আরেকজন হচ্ছেন হাফিজে গায়ে এরকান (Hafize Gaye Erkan), যিনি ৯ই জুন তুরস্কের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রথম নারী গভর্নর হিসেবে নিযুক্ত হন [১০]। এই দুজনই দেশটির মার্কেট পার্টিসিপেন্ট, ইনভেস্টর ও ফাইনান্সিয়াল ইনস্টিটিউশনগুলোর খুব পছন্দের। তারা উভয়ই এটি স্পষ্ট করে দিয়েছে যে তারা এরদোয়ানের অপ্রচলিত আর্থিক নীতির সাথে একেবারেই একমত নন, এবং তারা উভয়ই তাদের ক্যারিয়ারের বেশিরভাগ সময় বড় বড় পশ্চিমা ব্যাংকে কাটিয়েছেন [১০]। তুরস্কের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর হবার আগে এরকান ছিলেন ইউএস এর ফার্স্ট রিপাবলিক ব্যাংকের কো-সিইও এবং প্রেসিডেন্ট, আর তারও আগে তিনি গোল্ডম্যান স্যাকসে কাজ করতেন। আর সিমসেক ২০০৯ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত তুরস্কের অর্থমন্ত্রী হিসাবে নিজের যোগ্যতা প্রদর্শন করেছিলেন, আর তার আগে তিনি ইউএস এর ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক মেরিল লিঞ্চের উদীয়মান বাজার বিভাগ বা এমার্জিং মার্কেট ডিভিশনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন [১০]।
যাই হোক, এই নতুন নিয়োগগুলো স্পষ্টতই তুরস্কের অর্থনৈতিক নীতিতে একটি ইউ-টার্নের ইঙ্গিত দিয়েছিল। বাজার বুঝতে পেরেছিল যে এবারে যোগ্য লোকেরাই দেশটির অর্থনীতির হাল ধরছে [১১]। আর এতে একরকম ফলও পাওয়া যায়। এটা ঠিক যে, জুনের প্রথম কয়েক দিনে, লিরা প্রতি ডলারে ২১ থেকে প্রায় ২৪ লিরাতে নেমে এসেছিল, তবে এরকানের নিয়োগের পরে লিরা সেই স্তরেই স্থিতিশীল হয় [১১]। কয়েক সপ্তাহ পর, সিমসেক অবশেষে এরদোয়ানকে দায়িত্ব হস্তান্তর করতে রাজি করান এবং বৃহস্পতিবার তুরস্কের কেন্দ্রীয় ব্যাংক অবশেষে ঘোষণা করে যে তারা তার বেঞ্চমার্ক রেইট ৮.৫% থেকে বাড়িয়ে ১৫% শতাংশ করবে, আর ইঙ্গিত দেয় যে ভবিষ্যতে তা আরও বৃদ্ধি হবে [১২]।
তবে দুর্ভাগ্যবশত এরপরও এরদোয়ান এবং তুরস্কের জন্য খারাপ সংবাদ এসেছে, এই পরিবর্তন বাজারের সাথে ভাল যায়নি, এবং লিরার মান আরও কমে এখন এক ডলারের দাম ২৫ লিরা [১৩]। কেন এমনটা হল? কারণ বাজারগুলি আশা করেছিল যে, এই সুদের হার বেড়ে ১৫% নয়, আরও বেশি করা হবে, কারণ বাজারগুলো তুরস্কের সরকারি হিসেবে যে ৪০% মুদ্রাস্ফীতির হার দেখানো হয়েছে তা বিশ্বাসই করেনা, তাদের মতে এই হার আরও অনেক বেশি (অনানুষ্ঠানিক মতে এই হার কত তা আগেই বলা হয়েছে)। অর্থাৎ তাদের মতে সুদের হার বা ইন্টারেস্ট রেইট ১৫% করলেও তাতে সমস্যার সমাধান হবে না কেননা দেশটির প্রকৃত ইনফ্লেশন রেইট সরকারের দেখানো ৪০% নয়, বরং আরও বেশি।
ব্যাপারটা বোঝার জন্য নেগেটিভ রিয়্যাল ইনফ্লেশন রেইট নামে একটা কনসেপ্ট বোঝা দরকার। যদি কোন দেশের ইনফ্লেশন রেইট দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দেয়া নমিনাল ইন্টারেস্ট রেইটের চেয়ে বেশি হয় তাহলে নেগেটিভ রিয়্যাল ইনফ্লেশন রেইট তৈরী হয়, আর এর মান পাওয়া যায় দুটোর পার্থক্য থেকেই। কোন দেশে নেগেটিভ রিয়্যাল ইনফ্লেশন রেইট থাকার অর্থ হচ্ছে দেশটির মুদ্রার মূল্য কমছে। আর এর মান যত বেশি হবে মুদ্রার মান তত দ্রুত হ্রাস পায়। তুরস্কের ৪০% ইনফ্লেশন রেইটের সরকারি হিসাব অনুসারে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নমিনাল ইন্টারেস্ট রেইট ১৫% করে দেয়ার পর দেশটির নেগেটিভ রিয়্যাল ইনফ্লেশন রেইট হচ্ছে ৪০-১৫ = ২৫%। কিন্তু তুরস্কের বাজারগুলো এই হিসাব মানে না, তারা মনে করে দেশটির নেগেটিভ রিয়্যাল ইনফ্লেশন রেইট আরও অনেক বেশি (কেননা তাদের মতে দেশটির ইনফ্লেশন রেইট অনেক বেশি। অনানুষ্ঠানিক হিসাব অনুযায়ী সেই ইনফ্লেশন রেইট কত তা ইতিমধ্যেই বলা হয়েছে)। উল্লেখ্য, গোল্ডম্যান স্যাকস পূর্বাভাস দিয়েছিল যে দেশটির নেগেটিভ রিয়্যাল ইনফ্লেশন রেইট ৪০%-এ জাম্প করবে [৯]।
বাজারের এই নতুন মোড়ের কারণে স্পষ্টতই এরদোয়ান ও তার নতুন দলের ওপর ব্যাপক চাপ সৃষ্টি হয়েছে। বাজারগুলি আশা করেছিল যে, ইন্টারেস্ট রেইট বা সুদের হার ১৫% নয়, বরং আরও অনেক বৃদ্ধি পাবে। আর সম্ভবত সেটাই একমাত্র উপায় যা লিরার পতন থামাতে পারে। তবে সুদের হার বৃদ্ধির ফলে তুরস্কের অর্থনীতির মারাত্মক ক্ষতি হবে। উদাহরণস্বরূপ তুরস্কের আবাসন বাজার বা হাউজিং মার্কেটের কথাই ধরা যাক। তুরস্কে বাড়ির দাম সম্প্রতি আকাশছোঁয়া হয়েছে কারণ তুর্কিরা তাদের ক্রমহ্রাসমান লিরাকে কাজে লাগানোর জন্য একটি নিরাপদ জায়গা খুঁজছে। একটু বুঝিয়ে বলি। লিরার মান কমতে থাকা মানে হল আজ একটি জিনিস কিনতে যত লিরা লাগবে, কাল সেটাই কিনতে আরও বেশি লিরা লাগবে। এর মানে হল যা কেনার আছে শীঘ্রই কিনে ফেলতে হবে, আর হাতে লিরা রাখা যাবে না, কেননা হাতে সঞ্চিত লিরা থাকাটা লস, সেই লিরা দিয়ে এখন যা কেনা যায় দুদিন পর তা আর কেনা যাবে না। এদিকে এরদোয়ান তুরস্কতে প্রচুর হাউজিং প্রজেক্ট করেছিল, হাউজিং মার্কেটকে অনেক প্রিভিলেজও দিয়েছিল। ফলে হাউজিং এর ভালোই সাপ্লাই ছিল। এর ফলে তুর্কিরা তাদের লিরা দিয়ে হাউজিং বা আবাসন ক্রয় করতে শুরু করে। ইনফ্লেশন বৃদ্ধির ফলে এভাবে ডিমান্ড বাড়ে, কারণ মানুষ তাদের হাতে থাকা মুদ্রা খরচ করে ফেলতে চায়। আর এর ফলে বাজারে আরও বেশি অর্থ প্রবেশ করে ইনফ্লেশন বা মুদ্রাস্ফীতি আরও বাড়িয়ে দেয়। আর সেটা আটকাতেই ইন্টারেস্ট রেইট বাড়াতে হয়, যার ফলে মানুষ বেশি সুদের হারের কারণে লোন নিয়ে খরচ করতে না পারে।
কিন্তু তুরস্ক ইন্টারেস্ট রেইট বাড়ায়নি। তাই মানুষ উল্টে ক্রয় করা বা লিরা খরচ করা বাড়িয়েছে। আর ইনফ্লেশনও বেড়েছে। যাই হোক, এর ফলে দেশটিতে আবাসনের মূল্যও এখন আকাশছোঁয়া। কিন্তু ইন্টারেস্ট রেইট বাড়িয়ে দিলে স্বভাবতই এই সব মার্কেট ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কেননা যেখানে ইতিমধ্যেই দাম আকাশছোঁয়া সেখানে লোনের ক্ষেত্রে সুদের হারও যদি অনেক বেড়ে যায় তাহলে মানুষ আর এই আবাসনের মত প্রোডাক্ট বা সার্ভিস কিনবেই না, ফলে বাজারই ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। দেশের ইকোনোমিক বাঁচাতে হলে দেশের ইন্টারেস্ট রেইট যতটা বাড়ানো দরকার ততটা বাড়ানো হলে দেশটির হাউজিং মার্কেট ধ্বংস হয়ে যাবার কথা। ব্রেক্সিটের কারণে ইউকে যে অর্থনৈতিক ধাক্কা খেয়েছে, তার ফলে ইউকে বা যুক্তরাজ্যও এই একই রকম ক্রাইসিস ফেইস করছে, কিন্তু তুরস্কের অবস্থাটা আরও অনেক বেশি গুরুতর [৯]।
একটি ইংরেজি প্রবাদ হল “as you sow, so shall you reap” (বাইবেলের গালাতিয়ান ৬:৭ এর “whatsoever a man soweth, that shall he also reap.” থেকে এটা এসেছে, মানে যেরকম বীজ বপন করা হবে, ফসলটাও সেরকম হবে)। এরদোয়ান ঠিক তেমন ফসলই পাচ্ছেন, যেরকম বীজ তিনি বপন করেছিলেন। এরদোয়ান অনেক দিন ধরেই বিভিন্ন উপায়ে দেশটির ইকোনোমিক কলাপ্স আটকে রাখার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু এখন সব অপশন ফুরিয়ে গেছে। এখন যা হবে তা সত্যিই বেদনাদায়ক হতে পারে।
তথ্যসূত্র
- ১। https://www.duvarenglish.com/chamber-of-commerce-reports-istanbul-inflation-rate-as-73-percent-news-62137
- ২। https://enagrup.org/
- ৩। https://www.ft.com/content/246951b4-1bcd-4144-a9c9-33f9f6c3e107
- ৪। https://www.france24.com/en/europe/20230529-from-inflation-to-nato-turkey-s-erdogan-has-stacked-in-tray-for-last-presidential-term
- ৫। https://www.bloomberg.com/news/articles/2023-05-18/turkish-fx-reserves-shrank-by-record-in-week-before-elections
- ৬। https://www.bloomberg.com/news/articles/2023-05-18/turkish-fx-reserves-shrank-by-record-in-week-before-elections
- ৭। https://www.reuters.com/world/middle-east/turkish-cenbank-data-shows-3-bln-inflow-abroad-bankers-2023-06-08/
- ৮। https://www.ft.com/content/246951b4-1bcd-4144-a9c9-33f9f6c3e107
- ৯। https://www.politico.eu/article/end-recep-tayyip-erdogan-economics-turkey-double-interest-rate-inflation/
- ১০। https://en.wikipedia.org/wiki/Hafize_Gaye_Erkan
- ১১। https://www.ft.com/content/4d6a4a42-e000-4cc7-9541-70fd15e405a0
- ১২। https://www.ft.com/content/4d6a4a42-e000-4cc7-9541-70fd15e405a0
- ১৩। https://asia.nikkei.com/Economy/Turkey-raises-interest-rate-to-15-from-8.5-to-fight-inflation
কেন তুরস্কের সামনের সংসদীয় নির্বাচনে এরদোয়ান হারতে পারেন? (১০ মার্চ, ২০২৩)
আগামী কয়েক মাসের মধ্যে তুরস্কে নতুন পার্লামেন্ট নির্বাচনের জন্য নির্বাচন হওয়ার কথা রয়েছে। বর্তমান প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান দুই দশকের বেশির ভাগ সময় ধরে ক্ষমতায় আছেন এবং পশ্চিমে তিনি খুব একটা জনপ্রিয় না হলেও তার ইসলামপন্থী পপুলিজম তুরস্কে সত্যিকার অর্থে জনপ্রিয় প্রমাণিত হয়েছে। তবে জরিপ থেকে জানা যায় গত কয়েক মাস ধরে এরদোয়ানের আবেদন হ্রাস পেতে শুরু করেছে, ও তিনি এখন প্রধান বিরোধী প্রার্থীর পেছনে অবস্থান করছেন। তো এই লেখায় এমন তিনটি কারণের দিকে নজর দেয়া হবে যেগুলির কারণে এরদোয়ান এই নির্বাচনে হেরে যেতে পারেন। কারণ তিনটি হচ্ছে, তুরস্কের বাজে অর্থনীতি, দেশটিতে নতুন একীভূত বিরোধী দল, এবং ভূমিকম্পের পর তার সরকারের নিষ্ক্রিয় প্রতিক্রিয়া। একে একে সব আলোচনা করা যাক… (বিশেষ করে শেষেরটা খুব ইন্টারেস্টিং)
১। তুরস্কের অর্থনীতি মূলত আমদানির উপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল হওয়ায় দেশটির মুদ্রাস্ফীতির হার গত ১৮ মাস ধরে বৃদ্ধি পেয়েছে (কেন তা নিয়ে আগেই লিখেছি)। সাধারণত মুদ্রাস্ফীতি হ্রাস করার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলি মুদ্রাস্ফীতির হার বাড়ায়, তবে এরদোয়ান মনে করেন এই ধারণাটি তথাকথিত সুদের হার লবির দ্বারা পরিচালিত একটি ষড়যন্ত্র ( সেইসাথে উল্লেখ্য, ইসলামে সুদ হারাম, আর তিনি ইসলামিক পপুলিজমের রাজনীতি করেন), তাই পরিবর্তে তিনি সুদের হার হ্রাস করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন এবং এর জন্য দরকার পড়লে তিনি তার সাথে দ্বিমত পোষণ করা যে কোনও কেন্দ্রীয় ব্যাংকারকে বরখাস্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তার এই নীতির ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ২০২১ সালের মার্চ মাসে সুদের হার ১৯ থেকে কমিয়ে আজ, মানে ২০২৩ এর মার্চে ১০.৫ শতাংশে নামিয়ে এনেছে এবং অর্থোডক্স অর্থনীতিবিদরা ভবিষ্যদ্বাণী করে বলেছিলেন ২০২১ এর ডিসেম্বরে দেশটির বার্ষিক মুদ্রাস্ফীতি যে ২০ শতাংশ ছিল তা ২০২২ এর ডিসেম্বরে ৮০ শতাংশেরও বেশি বৃদ্ধি পাবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আসল ফল হয়েছে এর চেয়েও বাজে। ইস্তাম্বুলের চেম্বার অফ কমার্স দ্বারা সংকলিত মুদ্রাস্ফীতি পরিমাপকারী একটি অনানুষ্ঠানিক সূচক অনুসারে দেশটির মুদ্রাস্ফীতির হার হয়েছে ১০৭ শতাংশ, অন্যদিকে একটি স্বাধীন মুদ্রাস্ফীতি গবেষণা গ্রুপ দ্বারা বিকশিত আরেকটি অনানুষ্ঠানিক সূচক অনুসারে দেশটির মুদ্রাস্ফীতি হয়েছে ১৮৫শতাংশ!
যাইহোক, এই ফেব্রুয়ারিতে দেশটির মুদ্রাস্ফীতি কমে ৫৫ শতাংশে নেমে এসেছে, আর দেশটির জিডিপিও স্পষ্টতই তুলনামূলকভাবে ভাল কাজ করছে, তবুও সাধারণ তুর্কি জীবনযাত্রার মান অনেক নিচে নেমে গেছে। এর কারণ হচ্ছে, ২০২২ সালে তুর্কি অর্থনীতি ৫.৬ শতাংশ বৃদ্ধি পেলেও, এই প্রবৃদ্ধির কারণ ছিল – প্রথমত, তুর্কি পরিবারগুলির মরিয়া ভোগের বা ডেসপারেট কনজাম্পশন বিঞ্জ দ্বারা চালিত হওয়া, এবং দ্বিতীয়ত, তুরস্কের তাদের দুর্বল মুদ্রা দ্বারা সক্ষম শক্তিশালী রফতানি। দুটোই ব্যাখ্যা করছি। তুর্কি পরিবারগুলো বুঝতে পেরেছিল যে তাদের মুদ্রা লিরা এভাবে আস্তে আস্তে মূল্যহীন হওয়ার আগেই এগুলো খরচ করে ফেলা দরকার। ফলে মুদ্রার মান কমতে থাকায় তারা বেশি করে ব্যয় করতে থাকে ও বিভিন্ন প্রোডাক্ট বা সার্ভিস ভোগ করতে থাকে, আর সেজন্যই দেশটির জিডিপি অনেক গ্রোথ বাড়ে। অন্যদিকে, মুদ্রার মান কমলে দেশের রফতানি বাড়ে, কারণ অন্যান্য দেশ কম খরচেই সেই দেশ থেকে আমদানি করতে পারছে। সহজ কথা হল, মুদ্রাস্ফীতি বাড়িয়ে জিডিপি বাড়ানো সম্ভব, কিন্তু সেটা কখনোই কাম্য নয়, কারণ তাতে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মান অনেক কমে যায়, কারণ জিনিসপত্রের দাম অনেক বেড়ে যায়, কিন্তু ইনকাম বাড়ে না। সুতরাং প্রবৃদ্ধি বা জিডিপি গ্রোথ ভাল মনে হলেও এর অন্তর্নিহিত কারণগুলি ইতিবাচক নয়। এটা ঠিক যে, এই দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির জন্য ক্রমাগত তুরস্কে ন্যূনতম মজুরি বৃদ্ধি করা হয়েছে, কিন্তু সেই মজুরি বৃদ্ধি বরাবরই দেশটির মুদ্রাস্ফীতির চেয়ে অনেক পিছিয়েই রয়েছে, এবং এভাবে তুর্কিদের একটি বিশাল অংশ তাদের জীবনযাত্রার মানের তীব্র পতনের মধ্যে দিয়েই যাচ্ছে।
২। তবে অর্থনীতিই এরদোয়ানের একমাত্র সমস্যা নয়। পরবর্তী নির্বাচনে তার সম্ভাব্য পরাজয়ের দ্বিতীয় কারণ হ’ল তুরস্কের নতুন একীভূত বিরোধী দল। তুরস্কের বিরোধী দলগুলি কিছুদিন আগে উপলব্ধি করেছে যে, তারা যদি এরদোয়ানকে পরাজিত করতে চায়, তবে তার একমাত্র উপায় হ’ল তাদের একটি অভিন্ন জোট গঠন করতে হবে। এজন্য গত বছরের ডিসেম্বরে ছয়টি প্রধান বিরোধী দল (যা টেবিল অফ সিক্স নামে পরিচিত) ঘোষণা করে যে, তারা সাংবিধানিক সংস্কারের একটি প্যাকেজ নিয়ে একসাথে চলবে, যার প্রাথমিক লক্ষ্য হবে দেশকে সংসদীয় গণতন্ত্রে ফিরিয়ে আনা। উল্লেখ্য, ২০১৭ সালে একটি বিতর্কিত গণভোটের মাধ্যমে এরদোয়ান নিজেই বর্তমান নির্বাহী রাষ্ট্রপতি ব্যবস্থা তৈরি করেছিলেন, যা দেশের রাষ্ট্রপতিকে, মানে এরদোয়ানকে ব্যাপক সাংবিধানিক ক্ষমতা দান করে।
তবে এখানে প্রাথমিকভাবে এরদোয়ানের সৌভাগ্য ছিল এখানে যে, এই ছয় সদস্যের মধ্যে যে প্রধান হবেন তা নিয়ে তাদের মধ্যে টানাপোড়েন শুরু হয়। জরিপে দেখা গেছে, সবচেয়ে জনপ্রিয় দুই প্রার্থী হলেন যথাক্রমে আঙ্কারা ও ইস্তাম্বুলের বিরোধী মেয়র মানসো ইয়াবাশ ও একরাম ইমামোগুল। কিন্তু, তাদের এহেন জনপ্রিয়তা সত্ত্বেও প্রধান বিরোধী দলের নেতা কেমাল কিলিচদারোলু স্পষ্টতই তার চান্স ছাড়তে চাননি। কিন্তু সমস্যা হল, এই কিলিচদারোলু ছিলেন অন্য দুই প্রার্থীর তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে কম জনপ্রিয়, এবং অতীতে তিনি একাধিকবার এরদোয়ানের কাছে পরাজিতও হয়েছেন। গত সপ্তাহে ইস্যুটি এতটাই বড় আকার ধারণ করে যে, জোটটি পুরোপুরি ভেঙে পড়ার ঝুঁকিতে ছিল, আর তুরস্কের ডানপন্থী গুড পার্টির নেতা তো বলেই বসেছিলেন যে, তিনি জোটটি ত্যাগ করতে চান, কারণ মূলত তিনি মনে করেন না যে, কিলিচদারোলু জোটটি নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য উপযুক্ত। তবে শেষপর্যন্ত সোমবার জোটটি অবশেষে ঘোষণা করে যে, তারা একটি নতুন হায়ারার্কি তৈরির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কিলিচদারোলুই তাদের আনুষ্ঠানিক রাষ্ট্রপতি প্রার্থী বা প্রেসিডেন্সিয়াল ক্যান্ডিডেট হবেন, আর ইয়াভাশ ও ইমামোগু হবেন ভাইস প্রেসিডেন্ট ক্যান্ডিডেট। আদৌ এদের জেতার চান্স আছে তো? আছে, কারণ এই নতুন সিদ্ধান্ত এরদোয়ানের জন্য আরও খারাপ খবর, কারণ বিভক্ত বিরোধী দলের চেয়ে ঐক্যবদ্ধ বিরোধী দল স্পষ্টতই বেশি কার্যকরী, সেই সাথে জরিপ থেকে জানা যায় যে, কিলিচদারোলু অন্যান্য প্রার্থীদের মতো অতটা জনপ্রিয় না হলেও তিনিএরই মধ্যে এরদোয়ানের চেয়ে ১৫ পয়েন্ট এগিয়ে আছেন।
৩। তবে এরদোয়ানের সমস্যায় পড়ার আরেকটি কারণ রয়েছে। এই তৃতীয় কারণটি হচ্ছে সাম্প্রতিক ভূমিকম্পে এরদোগানের নিষ্ক্রিয় প্রতিক্রিয়া। আপনি সম্ভবত জেনে থাকবেন, গত মাসে তুরস্ক এবং সিরিয়ায় যে ভূমিকম্পগুলি আঘাত হেনেছে সেগুলো, বিশেষ করে ৭.৮ মাত্রার ভূমিকম্পটি সত্যিই বিপর্যয়কর ছিল। ভূমিকম্পের ফলে ৫৩,৩৬৩ লোক মারা গেছে, যাদের মধ্যে ৪৬,১০০ জনই ছিল তুরস্কের, আর তাই এটি স্থান করে নেয় একবিংশ শতাব্দীর পঞ্চম মারাত্মক ভূমিকম্প হিসেবে। উপরন্তু, এর ফলে ১.২৫ মিলিয়ন মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়েছে, এবং সেই সাথে ইউনাইটেড ন্যাশনস অনুমান দিয়েছে যে, ভূমিকম্পের ফলে ক্ষতির পরিমাণ ১০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে, যা তুরস্কের জিডিপির ১০ শতাংশেরও বেশি। এখন, কেবল একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ কোন চলমান সরকারের জন্য খারাপ খবর হয়না, তুরস্কের ক্ষেত্রেও সেটা হতো না, কেননা ভূমিকম্পটা তো আর এরদোয়ানের দোষে হয়নি। কিন্তু ভূমিকম্পের পর ও আগে এরদোয়ান এই ব্যাপারে যা যা করেছেন, তার পেছনে এরদোয়ানের দোষ আছেই। ভূমিকম্পের পর কেডিয়ানের প্রতিক্রিয়া এবং ভূমিকম্পের আগে এরদোয়ানের কিছু নীতি বেশ সমালোচিত হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, তুরস্কের অনুসন্ধান ও উদ্ধারকারী দলগুলি দুর্যোগ-স্থানে পৌঁছতে দেরি করে, এবং ভূমিকম্পে যে পরিমানে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল সেই তুলনায় তাদের অবদান খুব কমই ছিল। এখন অবস্থা যদি এই হয়, তবে একজন রাষ্ট্রপ্রধানের যা করা উচিত তা হলো নাগরিকের কাছে এই গাফলতির জন্য ক্ষমা চাওয়া, কিন্তু এরদোয়ান তার প্রতিক্রিয়ার জন্য কোনও সমালোচনা গ্রহণ করতে অস্বীকার করলেন। ফলে স্বাভাবিকভাবেই দেশে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সূষ্টি হল, আর পরে তিনি শেষ পর্যন্ত ক্ষমা চাইতে বাধ্য হলেন, আর স্বীকার করলেন যে, “আমরা প্রথম কয়েক দিনে যেভাবে কাজ করতে চেয়েছিলাম সেভাবে কাজ করতে পারিনি এবং এর জন্য আমি ক্ষমা চাইছি”। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে।
এবারে ভূমিকম্পের পূর্বে এরদোয়ানের সরকারের নেয়া নীতিগুলোর দিকে তাকানো যাক। এখানে তিনি বেশ কিছু কারণে সমালোচিত হয়েছেন। প্রথমত, তুরস্কে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বিষয়ক কর রাজস্ব ছিল ৩.৫ বিলিয়ন ডলার, যা এরদোয়ানের সরকার ব্যয় করেনি, মানে প্রাকৃতিক সম্পর্কিত বিষয়ে এই অর্থ ব্যয়ের প্রতিশ্রুতি থাকলেও এরদোয়ানের সরকার সেটা করেনি। দ্বিতীয়ত, আগে বলে নেই ১৯৯৯ সালেও তুরস্কে একটি বড় আকারের ভূমিকম্প সংঘটিত হয়েছিল, আর সেই ভূমিকম্পে যে ব্যাপক আকারে ক্ষয়ক্ষতি সংঘটিত হয়, সেগুলো যেন আর না ঘটে সেজন্য বেশ কিছু সুরক্ষা বিধি তৈরী করা হয়, কিন্তু এরদোয়ান সরকার এইসব সুরক্ষা বিধিগুলি কার্যকরভাবে প্রয়োগ করতে ব্যর্থ হয়েছে। কিভাবে ব্যর্থ হল? এরদোয়ান দ্রুত তুরস্কে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বা জিডিপি গ্রোথ চাচ্ছিলেন, আর সেজন্য তিনি জোর দেন রিয়্যাল এস্টেটে। এর জন্য খুব দ্রুত প্রচুর দালান নির্মাণ করার উদ্যোগ নেন তিনি। কিন্তু এত দ্রুত ও কম খরচে এইসব দালান তৈরী করার চাপের জন্য অনেক বিল্ডিং-এই ভূমিকম্প প্রতিরোধী সেই সব সুরক্ষা বিধিগুলো ঠিকঠাক পালন করা হয়নি। আর এরদোয়ানও এই দোষগুলো ধরেননি, এগুলোর জন্য বরং তিনি এমনেস্টি বা ক্ষমা কার্যকর করেছেন। তো এবারের ভূমিকম্পে যে বিল্ডিংগুলো ভেঙ্গে পড়ে সেগুলোর কিছু ছিল এইসব ক্ষমাপ্রাপ্ত বিল্ডিং, যেখানে সুরক্ষাবিধিগুলো ঠিকঠাক পালন করা হয়নি। আর ভূমিকম্পের ফলে ধ্বসে পড়তে হলো কিনা এগুলোর কয়েকটিকেই। ব্যাস, সমালোচনার বন্যা শুরু। কিন্তু এখানেও আরেকটি ইন্টারেস্টিং ফ্যাক্ট আছে। সেই ১৯৯৯ সালে ঘটে ভূমিকম্পের পরও তদকালীন তুর্কি সরকারের প্রতিক্রিয়া বেশ নিষ্ক্রিয় ছিল, আর সেই সাথে ভূমিকম্পের ফলে দেশ জুড়ে সৃষ্টি হয়েছিল ব্যাপক মুদ্রাস্ফীতি। আর তুরস্কের এই সংকটকে উপজীব্য করেই ২০০৩ সালে ক্ষমতায় এসেছিল এরদোয়ানের একেপি পার্টি। নির্বাচনে জিতবার জন্য এই এর্দোয়ানই প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে, তিনি তার সরকারের দক্ষতা এতটা বৃদ্ধি করবেন যাতে এরকম ঘটনা আর দ্বিতীয়বার না ঘটে! কিরকম আয়রনি খেয়াল করুন, সিচুয়েশন একই, কিন্তু তিনি এবার অপোজিট সাইডে…
তুরস্কের কুর্দিশ জাতীয়তাবাদ-বিদ্বেষ, ফিনল্যান্ড-সুইডেনের সাথে দ্বন্দ্ব, তুরস্ককে সন্তুষ্ট করে দেশ দুটোর ন্যাটোতে প্রবেশ ও তাতে ন্যাটোর লাভ (৬ অক্টোবর, ২০২২)
রাশিয়া ইউক্রেইনের যুদ্ধের একটি ফল ছিল যে ৩০ সদস্য বিশিষ্ট ন্যাটোর শক্তিশালী হয়ে ওঠা। এমনকি দীর্ঘদিন ধরে নিরপেক্ষতা বজায় রাখা দুটো দেশ, সুইডেন ও ফিনল্যান্ডও এর ফলে ন্যাটোর সদস্য হতে চায়, যারা মে মাসের মাঝামাঝিতে ন্যাটোতে অন্তর্ভূক্ত হবার এপ্লিকেশন পাঠায়। কিন্তু এপ্লিকেশন আসার কয়েক দিন পরেই তুরস্ক জানায় যে তারা এই এপ্লিকেশনকে ভিটো করবে ও তাদের মেম্বারশিপকে আটকে দেবে। তবে এরপর বেশ কিছু রেশারেশির পর জুনের শেষের দিকে শেষ পর্যন্ত তুরস্ক ঘোষণা করে যে, দেশ তিনটি তাদের মধ্যকার পার্থক্য ও দ্বন্দ্ব রিজল্ভ করে নিয়েছে ও দেশটি ফিনল্যান্ড ও সুইডেনের ন্যাটোতে যোগদানকে সমর্থন করে।
তো তুরস্ক কেন প্রথম দিকে দেশ দুটোর ন্যাটোতে যোগদান নিয়ে রাগান্বিত ছিল? সুইডেন ও ফিনল্যান্ডের সাথে এরদোয়ানের সমস্যার মূল কারণ ছিল কুর্দিশ জাতীয়তাবাদ, আরও বিশেষভাবে বললে পিকেকে পার্টি। গত চার দশক ধরে তুরস্ক পিকেকে বা কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে আসছে। এরা পূর্ব তুরস্কে কুর্দিশ স্বায়ত্তশাসন দাবি করে আসছে, আর এর ফলে তুরস্কের সরকার এদেরকে টেরোরিস্ট বলে দাবি করছে। এই অবস্থায় সুইডেন ও ফিনল্যান্ড – এই দুই দেশের পিকেকে-কে সাপোর্ট করার কোন প্রমাণ না থাকার পরও তুরস্ক এই দুটো দেশকে পিকেকে এর প্রতি বেশি সফট হবার জন্য অনেক দিন ধরেই অভিযুক্ত করে আসছে। এদিকে বরং সুইডেন ও ফিনল্যান্ড আসলে পিকেকে-কে টেরোরিস্ট অর্গানাইজেশন হিসেবেই বিবেচনা করে, আর সুইডেনই ছিল ইউরোপের প্রথম দেশ যারা পিকেকে-কে টেরোরিস্ট অর্গানাইজেশন ঘোষণা করেছিল, পিকেকে এর বিরুদ্ধে ২০০২ সালে ইইউ এর স্যুটেরও প্রায় ২০ বছর পূর্বে দেশটি সেটা করে।
তাহলে কেনই বা তুরস্ক মনে করেছিল যে এরা পিকেকে এর প্রতি বেশি নরম? প্রথমত, উভয় দেশেই বেশ ভাল পরিমাণে কুর্দরা বসবাস করে। সেই সাথে দেশগুলোতে বসবাসরত কুর্দরা প্রায়ই কুর্দদের স্বায়ত্তশাসনের জন্য ক্যাম্পেইন করে। দ্বিতীয়ত, তুরস্ক দাবি করে যে, ইউরোপের টার্কিশ গ্রুপগুলো পিকেকে ফান্ডিং করে সহায়তা করছে। তৃতীয়ত, সুইডেন কিছু প্রো-পিকেকে মিডিয়া আউটলেট হোস্ট করে, যেগুলোর মধ্যে একটি হলো সারদাশ টিভি। চতুর্থত, তুরস্ক দেশ দুটোকে কতিপয় কুর্দকে তুরস্কে পাঠিয়ে দিতে বলেছে, যাদেরকে তুরস্ক পিকেকে এর সদস্য বা পিকেকে এর সদস্যদের সাথে সম্পর্কিত বলে মনে করে, কিন্তু দেশ দুটো তাতে অসম্মত হয়েছে। টার্কিশ জাস্টিস সেক্রেটারি অনুসারে, গত ৫ বছরে তুরস্কের এই এক্সট্রাডিশনের রিকোয়েস্ট ছিল ৩৩টি, যেগুলোর একটিও অনুমোদিত হয়নি। তুরস্ক থেকে বলা হয়েছে এই ৩৩ জনের সাথে হয় পিকেকে এর সম্পর্ক রয়েছে, অথবা তারা তুরস্কে ২০১৬ সালের মিলিটারি ক্যুতে কোনভাবে জড়িত ছিল। এদের এক্সট্রাডিশন না হওয়ায় তুরস্ক সবসময়ই আপসেট ছিল। শুধু এখানেই শেষ নয়। ইইউ, সুইডেন ও ফিনল্যান্ড – সকলেই ২০১৯ সালে নর্দার্ন সিরিয়ায় সৈন্য পাঠানোর জন্য তুরস্কের সমালোচনা করেছিল। এমনকি সুইডেন এর জন্য তুরস্কের ওপর পারশাল আর্ম এম্বার্গোও বসিয়েছিল। ইইউ যেখানে সিরিয়ায় তুরস্কের ইন্টারফিয়ারেন্সকে ফরেইন ইনভ্যাশন হিসেবে দেখে, সেখানে এরদোয়ান বলেন, সিরিয়ায় কাজ করা কুর্দিশ গ্রুপ আসলে পিকেকে-এরই এক্সটেনশন, যাকে আবার তুরস্ক টেরোরিস্ট সংগঠন বলে মনে করে। আর সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাপারটা আরও দূরে চলে গেছে। তুরস্ক ইরাকি সিকিউরিটি ফোর্সের সাথে মিলে এখন উত্তর ইরাকে পিকেকে-দেরকে টারগেট করতে শুরু করেছে। এসব ছাড়াও সুইডেনে ২০১৮-২২ মেয়াদের সরকারের পার্লামেন্টে একজন ইন্ডিপেন্ডেন্ট কুর্দিশ মেম্বার অফ পার্লামেন্ট ছিলেন (এখন নেই)। তিনি হচ্ছেন আমিনেহ্ কাকাবাভেহ্। তাকে এরদোয়ান টেরোরিস্ট বলে বর্ণনা করেছেন, এবং তুরস্কের পররাষ্ট্র মন্ত্রী তাকে তুরস্কে পাঠিয়ে দেবার দাবি করে। একজন একক এমপি হিসেবে তিনি গত বছরে সুইডেনের সরকারকে কনভিন্স করিয়েছিলেন যাতে সুইডেন নর্দার্ন সিরিয়ার অটোনোমাস রেজিয়ন নিয়ন্ত্রণ করা “ডেমোক্রেটিক ইউনিয়ন পার্টি”-কে দেয়া সহায়তা বৃদ্ধি করে, যারা হলো সেই অঞ্চলের কুর্দিশ পলিটিকাল পার্টি, যারা সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে পিপলস প্রোটেকশন ফোর্স বা YPG এর সাথে সম্পর্কিত। স্বাভাবিকভাবেই এটাকে এরদোয়ানের ভাল লাগার কথা নয়, কারণ তুরস্ক সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের শুরু থেকেই YPG এর ঘোরতর বিরোধী এবং তাদের বিরুদ্ধেই দেশটি সিরিয়ায় মিলিটারি পাঠায়। বলতে গেলে তুরস্কে PKK যা, সিরিয়াতেও YPG ঠিক তাই। তুরস্ক এই YPG-কেও একটি টেরোরিস্ট অর্গানাইজেশন বলেই মনে করে। কিন্তু কিছুদিন আগেও ফিনল্যান্ড ও সুইডেন এদেরকে তেমন কোন তকমা দেয়নি।
তাহলে এতক্ষণে আসল ঘটনাটা বুঝে গেছেন নিশ্চই। তুরস্ক পিকেকে-কে সাংঘাতিকভাবে ঘৃণা করে, কিন্তু সুইডেন-ফিনল্যান্ড সহ অন্যান্য অনেক ওয়েস্টার্ন রাষ্ট্রই পিকেকে নিয়ে অত দ্রুত নিজেদের সিদ্ধান্ত দানে অপারগ, তারা এদের নিয়ে তেমন ভাবিতও নয়, তার ওপর এরা মনে করে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের ওপর তুরস্কের নাক গলানোটাও মাত্রাতিরিক্ত। আর এই মতানৈক্যই তুরস্ক ও নর্ডিক রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে গুরুতর উত্তেজনার সৃষ্টি করে। আর ঠিক এই কারণেই যখন সুইডেন ও ফিনল্যান্ড ন্যাটোতে যোগদান করতে চায়, যেখানে জয়েন করতে ন্যাটোর এক্সিস্টিং মেম্বারদের সকলেরই ভোটের প্রয়োজন হয়, এরদোয়ান সেখানে ন্যাটোতে তার এই ক্ষমতাকে ব্যবহার করে নিজের পক্ষে লাভের একটা সুযোগ পেয়ে যায়। তিনি তাই পিকেকে ইস্যুকে কেন্দ্র করে এদের মেম্বারশিপ ব্লক করে দেন। আর কয়েক সপ্তাহ ধরে দর কষাকষির পর এরদোয়ান তাতে সফলও হয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত, ন্যাটো ঘোষণা করে যে, তুরস্ক, সুইডেন ও ফিনল্যান্ড তাদের মধ্যকার ইস্যুকে রিজল্ভ করে ফেলে, সেই সাথে বলা হয় তিনটি দেশ একটি ট্রাইল্যাটারাল মেমোরেন্ডামেও সাইন করেছে।
তো সেই মেমোরেন্ডামে কী ছিল? নর্ডিকরা তুরস্কের চাপে ঠিক কোন ব্যাপারগুলোকে কম্প্রোমাইজ করতে বাধ্য হলো? আসলে এই এগ্রিমেন্টের শুরুতে বেশ কিছু অস্পষ্ট ব্যাপার স্যাপার দেখা যায়, যেখানে বিভিন্ন নীতিকে জাস্ট রিঅ্যাফার্ম করা হয়। কিন্তু প্রথম কনক্রিট একশনটা পাওয়া যায় পেইজের মাঝামাঝিতে এসে, যেখানে লেখা হয়, সুইডেন ও ফিনল্যান্ড “YPG বা PYD-কে কোন সাপোর্ট দান করবে না” যারা হচ্ছে নর্দার্ন সিরিয়ার পিকেকে এর এফিলিয়েট। এখন এর মধ্যে হয়তো এই উভয় অর্গানাইজেশনকেই টেরোরিস্ট অর্গানাইজেশন হিসেবে ডেজিগনেশন দেয়াটাও জড়িত থেকে থাকবে, সেই সাথে হয়তো এই সংগঠনগুলোর সাথে সম্পর্কিত যেসব লোক ফিনল্যান্ড ও সুইডেনে বাস করছে তাদের এক্সট্রাডাইট করার ব্যাপারটাও হয়তো এখানে জড়িত থাকবে। এরপর মেমোরেন্ডামে দেখা যায়, উভয় দেশই পিকেকে এর বিরুদ্ধে তুরস্ককে সমর্থন করায় সম্মত হয়েছে, সেই সাথে তুরস্কে আরোপ করা যেকোন আর্মস এম্বার্গোও তুলে নিতে সম্মত হয়েছে। বলা হয়েছে, এই তিনটি দেশ কো-অপারেশনের জন্য একটি জয়েন্ট কমিটি তৈরি করবে, এবং এও উল্লেখ করা হয়েছে যে, ফিনল্যান্ড ও সুইডেন “তুরস্কের পেন্ডিং ডিপোর্টেশন ও এক্সট্রাডিশন রিকুয়েস্টগুলোকে অ্যাড্রেস করবে।” মেমোরেন্ডাম স্বাক্ষরিত হবার পর, টার্কিশ জাস্টিস মিনিস্ট্রি স্পষ্ট বলে দিয়েছে যে, এখন তিনি আশা করেন যে, সুইডেন ও ফিনল্যান্ড এখন তাদের পূর্বে অনুরোধকৃত ৩৩ জন লোকের সকলকেই এক্সট্রাডাইট করার কথা বিবেচনা করবে, যা নিঃসন্দেহেই একটা বিগ মুভ। সেই সাথে মেমোরেন্ডামে, ফিনল্যান্ড ও সুইডেন সম্মত হয়েছে যে, তারা তুরস্কের ইইউ এর কমন সিকিউরিটি ও ডিফেন্স পলিসিতে তুরস্কের ফুলেস্ট পসিবল এংগেজমেন্টকে সহায়তা করবে, যাদের মধ্যে একটি হচ্ছে মিলিটারি মোবিলিটিতে PESCO প্রোজেক্ট।”
সব মিলিয়ে বলতে হয়, দেশ দুটিকে ন্যাটোতে ঢুকবার জন্য তুরস্কের অনেক কিছুকেই হজম করতে হয়েছে। কিন্তু ন্যাটোর ক্ষেত্রে এর অর্থ কী? স্বাভাবিকভাবেই এই এগ্রিমেন্টটা কুর্দিশ কজের প্রতি সিম্প্যাথেটিক এমন কারও জন্য খুব একটা ভাল খবর নয়, বিশেষ করে যারা সুইডেন ও ফিনল্যান্ডে বাস করছে তাদের জন্য। কিন্তু অন্যদিকে এটা আবার ন্যাটোর ইউনিটির জন্য ভাল খবর। খুব কম মানুষই আশা করেছিল যে, দেশ তিনটি একটি এগ্রিমেন্টে পৌঁছতে পারবে। দেশ দুটোর সাথে যে তুরস্কের সংঘাতের অবসান হলো, তাকে ন্যাটোর জন্য একটি সাফল্যই বলতে হয়। একই সাথে এটা ন্যাটোর ইস্টার্ন ফ্ল্যাংককেও শক্তিশালী করছে। কেন? এটা ঠিক যে সুইডেনের ডিফেন্স বাজেট অত বেশি না, তাদের বাজেটের মাত্র ১.৩% মিলিটারি স্পেন্ডিং-এ যায়, যা তারা বাড়িয়ে ২% করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। হবে। কিন্তু ফিনল্যান্ডের ব্যাপারটা পুরো ভিন্ন। এদের মিলিটারি গোটা ইউরোপের মধ্যে সবচেয়ে ইম্প্রেসিভগুলোর মধ্যে একটি। তাদের প্রায় ৯ লক্ষ রিজার্ভ পারসোনেল আছে, যেখানে তাদের জনসংখ্যা মাত্র ৫৫ লক্ষ! এদের এক্টিভ ফাইটিং ফোর্স ২২ হাজার লোকের। আর ফিনল্যান্ডের ডিফেন্স ১.৫% হলেও (ওরাও তা বাড়িয়ে ২% করতে যাচ্ছে) এদের আর্টিলারি সিস্টেম ইউরোপের মধ্যে অন্যতম শক্তিশালী, সেই সাথে এদের এয়ারফোর্সও খুব শক্তিশালী যেখানে প্রায় ১৬০টি প্লেইন আছে। তাই বলতেই হয় যে, দেশ দুটো ন্যাটোর ইস্টার্ন ফ্ল্যাংকের শক্তি অনেকটাই বাড়িয়ে দেবে, আর তাই তারা ন্যাটোর জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ অ্যাসেটও হবে।
চলমান আর্মেনিয়া-আজারবাইজান সংঘর্ষ কি রাশিয়ার দুর্বলতা, এবং তুরস্ক-আজারবাইজানদের বিশেষ প্যান-তুর্কিস্ট পরিকল্পনাকে নির্দেশ করছে? (২ অক্টোবর, ২০২২)
গত কয়েক দিন ধরে আর্মেনিয়ান ও আজারবাইজানের বাহিনীর পুনরায় সংঘর্ষ শুরু হয়েছে, যেখানে দুপক্ষে মৃতের সংখ্যা এখন ২৮২ জন (নিজেদের দাবি), আর আহতের সংখ্যা আরও অনেক। এমনকি সিভিলিয়ানদের মধ্যেও হতাহতের সংখ্যা অনেক। যাইহোক, ৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে চলা দ্বন্দ্বপূর্ণ এই লড়াইটি আসলে কী, এখানে প্রধান আন্তর্জাতিক খেলোয়াড়দের কীভাবে রয়েছে এবং এই দ্বন্দ্বে এই আন্তর্জাতিক শক্তিগুলো উভয় পক্ষের সাথে কিভাবে ডিল করছে তা খতিয়ে দেখা উচিত। সেই সাথে দেখা উচিৎ মধ্য এশিয়া ও ককেশাস অঞ্চলে ভবিষ্যতের সম্ভাব্য প্রতিযোগিতার ব্যাপারেও।
যুদ্ধের ব্যাকগ্রাউন্ড
ঐতিহাসিক ব্যাকগ্রাউন্ড দিয়ে শুরু করছি। এই আলোচনাটা একটু বোরিং আর বড় হবে। আর্মেনিয়া এবং আজারবাইজান উভয়ই ১৯১৮ সালের ২৮শে মে একই দিনে ট্রান্সককেশিয়ান ডেমোক্রেটিক ফেডারেটিভ রিপাবলিক থেকে তাদের স্বাধীনতা ঘোষণা করে, রাশিয়ান সাম্রাজ্যের পতনের পর। কিছু কিছু অঞ্চলের ক্ষেত্রে দেখা যায় তার দাবিদার উভয় রাষ্ট্রই, যা দ্বন্দ্বের কারণ হয়ে ওঠে। যাইহোক, এই যুদ্ধ শেষ হয় যখন ১৯২০ সালের দিকে উভয় রাষ্ট্রই সোভিয়েত ইউনিয়ন দ্বারা সংযুক্ত হয়। সমস্যাটি হ’ল এই উভয় রাষ্ট্রের দ্বারা দাবিকৃত অঞ্চলটি জাতিগত আর্মেনীয়দের দ্বারাই পূর্ণ ছিল এবং এখনও রয়েছে। এই অঞ্চলটাই হলো বিতর্কিত নাগার্নো-কারাবাখ অঞ্চল। এটি হচ্ছে দক্ষিণ ককেশাসের একটি স্থলবেষ্টিত ও পর্বতঘেরা অঞ্চল। এই অঞ্চলটি মূলত একটি পাহাড়ি ও বনভূমি অঞ্চল, আয়তন ৪,৪০০ বর্গ কিমি। এখন এটি একটি বিতর্কিত অঞ্চল, যা আন্তর্জাতিকভাবে আজারবাইজানের অংশ হিসাবে স্বীকৃত, তবে এর বেশিরভাগই প্রথম নাগোরনো-কারাবাখ যুদ্ধের পর থেকে অস্বীকৃত আর্টসাখ প্রজাতন্ত্র দ্বারা পরিচালিত হয়, যা নাগোর্নো-কারাবাখ প্রজাতন্ত্র নামেও পরিচিত। এই রিপাবলিক অফ আর্টসাখ একটি এককক্ষবিশিষ্ট আইনসভা সহ একটি প্রেসিডেন্সিয়াল গণতন্ত্র। দেশটি আর্মেনিয়ার উপর নির্ভরশীল এবং ঘনিষ্ঠভাবে সংহত, অনেক উপায়ে আর্মেনিয়ার অংশ হিসাবে কার্যত কাজ করে। দেশটির জনসংখ্যার ৯৯.৭% জাতিগত আর্মেনীয়, এবং প্রাথমিক কথ্য ভাষা আর্মেনিয়ান ভাষা। এই জনসংখ্যা ব্যাপকভাবে খ্রিস্টান, বেশিরভাগই আর্মেনিয়ান অ্যাপোস্টোলিক চার্চের সাথে যুক্ত। ১৯৯৪ সালে যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর থেকে আর্মেনিয়া ও আজারবাইজান সরকারের প্রতিনিধিরা এই অঞ্চলের বিতর্কিত অবস্থা নিয়ে ওএসসিই মিনস্ক গ্রুপের মধ্যস্থতায় শান্তি আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন।
এর ইতিহাসে যাওয়া যাক। সোভিয়েত ইউনিয়ন এই অঞ্চলের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার পরে এই বিরোধটি মূলত বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল এবং ১৯২৩ সালে আজারবাইজান এসএসআরের মধ্যে নাগোরনো-কারাবাখ স্বায়ত্তশাসিত ওব্লাস্ট তৈরি করেছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর এই অঞ্চলটি আর্মেনিয়া ও আজারবাইজানের মধ্যে বিরোধের উৎস হিসেবে পুনরায় আবির্ভূত হয়। ১৯৯১ সালে নাগোরনো-কারাবাখ স্বায়ত্তশাসিত ওব্লাস্ট এবং পার্শ্ববর্তী শাহুমিয়ান প্রদেশে অনুষ্ঠিত একটি গণভোটের ফলে স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়। জাতিগত সংঘাতের ফলে ১৯৯১-১৯৯৪ সালের নাগোর্নো-কারাবাখ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। ১৯৮৭-৮৮ সালে নাগোর্নো-কারাবাখ এবং সোভিয়েত আর্মেনিয়ায় একটি গণআন্দোলন শুরু হয়, যাতে সোভিয়েত কর্তৃপক্ষকে এই অঞ্চলটি আর্মেনিয়ায় স্থানান্তর করার আহ্বান জানানো হয়। ১৯৮৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে আজারবাইজানের সুমগাইত শহরে আর্মেনীয়দের বিরুদ্ধে গণহত্যা থেকে শুরু করে, এই সংঘাত ক্রমবর্ধমান সহিংস হয়ে ওঠে এবং মস্কোর পক্ষ থেকে বিরোধ সমাধানের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। ১৯৮৮ সালের গ্রীষ্মে, সোভিয়েত আর্মেনিয়ার আইনসভা এবং নাগোরনো-কারাবাখ স্বায়ত্তশাসিত ওব্লাস্ট আর্মেনিয়ার সাথে নাগোর্নো-কারাবাখকে একীভূত করার ঘোষণা দিয়ে রেজোলিউশন পাস করে, যা আজারবাইজানি এবং কেন্দ্রীয় সোভিয়েত কর্তৃপক্ষ দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল। ১৯৯১ সালের ডিসেম্বরে, নাগোর্নো-কারাবাখের আর্মেনীয়রা সদ্য স্বাধীন আর্মেনিয়ার সাথে পুনরায় একত্রিত হওয়ার উদ্দেশ্যে নাগোর্নো-কারাবাখ প্রজাতন্ত্র হিসাবে তাদের স্বাধীনতা ঘোষণা করে। নতুন স্বাধীন আজারবাইজান এই ঘোষণা প্রত্যাখ্যান করে, যার ফলে আর্মেনিয়া এবং নাগোর্নো-কারাবাখ এর সাথে আজারবাইজানের সাথে ফুল-স্কেল যুদ্ধ শুরু হয়। ১৯৯৪ সালের মে মাসে যুদ্ধবিরতির মাধ্যমে প্রথম নাগোর্নো-কারাবাখ যুদ্ধ শেষ হয়, আর্মেনীয় বাহিনী সাবেক নাগোর্নো-কারাবাখ স্বায়ত্তশাসিত ওব্লাস্টের পুরো অঞ্চল এবং আজারবাইজানের সাতটি সংলগ্ন জেলার বেশিরভাগ নিয়ন্ত্রণ করে। আর্টসাখ প্রজাতন্ত্র একটি কার্যত স্বাধীন দেশে পরিণত হয়, যদিও আর্মেনিয়ার সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সংহত হয়, যদিও এর অঞ্চলটি আন্তর্জাতিকভাবে আজারবাইজান প্রজাতন্ত্রের অংশ হিসাবে স্বীকৃত ছিল।
উল্লেখযোগ্য আঞ্চলিক পরিবর্তন ছাড়াই ১৯৯৪ সালের যুদ্ধবিরতির পরে এই অঞ্চলের উপর বিরতিহীনভাবে লড়াই অব্যাহত ছিল। ১৯৯৪ সালে যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর থেকে আর্মেনিয়া ও আজারবাইজান সরকারের প্রতিনিধিরা এই অঞ্চলের বিতর্কিত অবস্থা নিয়ে ওএসসিই মিনস্ক গ্রুপের মধ্যস্থতায় শান্তি আলোচনা চালিয়ে যায়। তবে বিক্ষিপ্তভাবে সংঘর্ষ চলছিলই। ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরের শেষ থেকে নভেম্বরে ঘটে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য যুদ্ধটি, যা ২০২০ নাগোর্নো-কারাবাখ যুদ্ধ নামে পরিচিত। প্রথম নাগোর্নো-কারাবাখ যুদ্ধের (১৯৮৮-১৯৯৪) পরে প্রতিষ্ঠিত যোগাযোগের লাইন বরাবর আজারবাইজানের আক্রমণের মাধ্যমে যুদ্ধ শুরু হয়, যার প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল দক্ষিণ নাগোরনো-কারাবাখের কম পার্বত্য জেলাগুলি পুনরুদ্ধার করা, যা এই অঞ্চলের সুপ্রতিষ্ঠিত অভ্যন্তরের চেয়ে গ্রহণ করা সহজ ছিল। ২০২০ সালের ২৭শে সেপ্টেম্বরে শুরু হওয়া নাগোর্নো-কারাবাখ এবং পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলিতে ঘটা এই নতুন যুদ্ধে আজারবাইজান এবং আর্মেনিয়ার সশস্ত্র বাহিনী উভয়ই সামরিক ও বেসামরিক দিক দিয়ে ব্যাপক হতাহতের শিকার হয়। আর্মেনিয়ার প্রায় ৩৮০০ ও আজারবাইজানের প্রায় ২৮০০ সৈন্য মারা যায়, দুই পক্ষেরই ১১,০০০ এর মত সৈন্য আহত হয়। যুদ্ধের সময় আজারবাইজান উল্লেখযোগ্য অর্জন করে। যুদ্ধে আজারবাইজান ৫টি শহর, ৪টি শহর, ২৮৬টি গ্রাম দখল করে এবং সমগ্র আজারবাইজান-ইরান সীমান্তের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে। এভাবে আজারবাইজান নাগোর্নো-কারাবাখের আশেপাশের বেশিরভাগ দখলকৃত অঞ্চল এবং নাগোর্নো-কারাবাখের বড় অংশ তারা পুনরুদ্ধার করে, যার মধ্যে সাংস্কৃতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ শহর শুশাও অন্তর্ভুক্ত ছিল। ২০২০ সালের ১০ই নভেম্বর যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে, যখন আজারবাইজান, আর্মেনিয়া এবং রাশিয়ার মধ্যে একটি ত্রিপক্ষীয় যুদ্ধবিরতি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যা আর্মেনিয়াকে নাগোর্নো-কারাবাখের আশেপাশের অবশিষ্ট সমস্ত দখলকৃত অঞ্চল ফিরিয়ে দিতে বাধ্য করে। সব মিলে যুদ্ধ বিরতির পর আজারবাইজান যুদ্ধের সময় দখলকৃত অঞ্চলগুলির নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখে, নাগোর্নো-কারাবাখের আশেপাশের সমস্ত আর্মেনীয়-অধিকৃত অঞ্চলগুলি ১ ডিসেম্বর ২০২০ সালের মধ্যে আজারবাইজানে ফিরে আসে। সেই সাথে যুদ্ধ বিরতির চুক্তির ফলে এই অঞ্চলের সমস্ত অর্থনৈতিক ও পরিবহন সংযোগ অবরোধমুক্ত করা হয়, যার মধ্যে তুরস্কের বর্ডারের নিকট আজারবাইজান থেকে বিচ্ছিন্ন এনক্লেইভ নাখচিভান এবং আজারবাইজানের মেইনল্যান্ডের মধ্যে পরিবহন সংযোগও রয়েছে, যার জন্য পূর্বে আজারবাইজানকে ইরানের ওপর নির্ভর করতে হতো।
যাই হোক, যুদ্ধবিরতির পরও সংঘর্ষ চলতে থাকে। ২০২১ সালের ১২ ই মে আজারবাইজানের সৈন্যরা সুনিক ও গেঘরকুনিক প্রদেশের কয়েক কিলোমিটার অতিক্রম করে আর্মেনিয়ায় প্রবেশ করে এবং আর্মেনিয়ান ভূখণ্ডের প্রায় ৪১ বর্গ কিলোমিটার দখল করে নেয়। ইউরোপীয় পার্লামেন্ট, সেইসাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ফ্রান্স – ওএসসিই মিনস্ক গ্রুপের তিনটি সহ-সভাপতির মধ্যে দুটি – আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত আর্মেনিয়ান অঞ্চল থেকে আজারবাইজানকে তার সৈন্য প্রত্যাহারের আহ্বান জানায়। এরপর জুলাই ও নভেম্বরে আরও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে, উভয় পক্ষ থেকে হতাহতের খবর পাওয়া যায়। ২০২১ সালের ১৭ নভেম্বর এক যৌথ বিবৃতিতে ইইউ সংবাদদাতারা আজারবাইজানের ১৬ নভেম্বরে শুরু করা সামরিক অভিযানকে ২০২০ সালের নাগোর্নো-কারাবাখ যুদ্ধবিরতি চুক্তির তখন পর্যন্ত সবচেয়ে খারাপ লঙ্ঘন বলে অভিহিত করে। এরপরই শুরু হয় ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে নতুন করে নাগার্নো-কারাবাখ কনফ্লিক্ট, যা নিয়ে আজকের প্রধান আলোচনা।
যুদ্ধের বিবরণ
শুরু করা যাক। প্রথমত এই যুদ্ধটা আগেরগুলোর চেয়ে ভিন্ন, কেননা এখানে আক্রমণটা হয়েছে একেবারে আর্মেনিয়াতেই, যা আগে হয়নি। শুরুটা হয় আর্মেনিয়া ও আজারবাইজানের পাল্টাপাল্টি দোষারোপের মধ্য দিয়ে। ১২ই সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় আর্মেনীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানায় যে আজারবাইজানের সশস্ত্র বাহিনীর ইউনিটগুলি গোরিস, আর্তানিশ, সোটক, জারমুক, কাপান এবং ইশখানাসারের আর্মেনীয় অবস্থান এবং বেসামরিক এলাকার দিকে আর্টিলারি এবং ভারী অস্ত্র দিয়ে তীব্রভাবে গুলি বর্ষণ শুরু করেছে। আর্মেনীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় আরও উল্লেখ করেছে যে আজারবাইজানের পক্ষ থেকে ইউএভি (আনম্যানড এয়ার ভেহিকল) ব্যবহার করা হয়েছিল এবং কিছু দিক থেকে তারা আর্মেনিয়ার দিকে তাদের অবস্থানগুলোর অগ্রগতির অপারেশন, অর্থাৎ অঞ্চলগুলো দখল করার অভিযান পরিচালনা করেছিল। এদিকে আজারবাইজানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় বলেছে যে আর্মেনিয়া দাশকাসান, কালবাজার এবং লাচিন অঞ্চলের কাছে “বড় আকারের উস্কানি” প্রদর্শন করেছে এবং সেনাবাহিনী পাঠানোর সড়কের পাশে মাইন স্থাপন করেছে। তারা আরও জানায়, তারা ‘আর্মেনীয় সশস্ত্র বাহিনীর ফায়ারিং পয়েন্টগুলো দমন করতে এবং সংঘাতের মাত্রা বৃদ্ধি রোধ করতেই’ এই পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করেছে। যাই হোক, এরপর রাশিয়া ১৩ সেপ্টেম্বর ঘোষণা করে যে তারা যুদ্ধবিরতির মধ্যস্থতা করেছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই মধ্যস্থতাটি সফল হয়নি। কিন্তু উভয় পক্ষই নিশ্চিত করে যে, মধ্যস্থতাটি কার্যকর হবার কয়েক মিনিট পরে ভেঙে যায়।
১৩ই সেপ্টেম্বর দুপুর দুটোয় আর্মেনিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ঘোষণা করে যে আর্মেনিয়ান-আজারবাইজান সীমান্তের কিছু অংশে পরিস্থিতি অত্যন্ত উত্তেজনাপূর্ণ হয়ে উঠছে কারণ আজারবাইজান অবস্থানগত অগ্রগতির চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, বিশেষ করে নেরকিন হ্যান্ড, ভেরিন শোরঝা, আরতানিশ এবং সোটকের দিকে। আর্মেনীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আরও বলেছে যে আজারবাইজানের গোলাবর্ষণের ফলে, কুট গ্রামে অনেক আবাসিক বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, এবং নারী ও শিশুদেরকে সেখান থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। আর্মেনিয়ার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে যে, হামলার প্রথম দিনে আজারবাইজানের বেসামরিক এলাকায় গোলাবর্ষণের ফলে তিনজন বেসামরিক নাগরিক আহত হয়েছে। আর্মেনিয়ার প্রধানমন্ত্রী নিকোল পাশিনিয়ানের মতে, কমপক্ষে ২০৪ জন আর্মেনিয়ান সেনা নিহত বা নিখোঁজ হয়েছে। এদিকে আজারবাইজানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় তার ৮০ জন সৈন্যের মৃত্যুর ঘোষণা দেয়, যাদের মধ্যে ৪২ জন আজারবাইজানি সেনাবাহিনীর সদস্য ছিলেন এবং ৮ জন রাষ্ট্রীয় সীমান্ত পরিষেবার লোক ছিলেন।
১৪ ই সেপ্টেম্বর সকালে, আজারবাইজানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় রিপোর্ট করে যে আর্মেনীয় সশস্ত্র বাহিনী রাতে কেলবাজার এবং লাচিন দিক থেকে অবস্থিত আজারবাইজানের সেনা ইউনিটগুলিকে লক্ষ্য করে মর্টার ও আর্টিলারি গুলি চালিয়েছে এবং সেনাবাহিনী “পর্যাপ্ত প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা” নিচ্ছে। এদিকে আর্মেনীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এটিকে “আরেকটি ভুল তথ্য” বলে অভিহিত করে ও দাবি করে যে, আজারবাইজান “আর্মেনিয়া প্রজাতন্ত্রের সার্বভৌম অঞ্চলের মধ্যে সামরিক আগ্রাসন চালানোর জন্যই এসব প্রোপাগান্ডা ছড়াচ্ছে।” তারা আরও জানায়, আজারবাইজান আর্টিলারি, মর্টার এবং বড় ক্যালিবারের ছোট অস্ত্র ব্যবহার করে জেরমুক এবং ভেরিন শোরঝাকে গোলাবর্ষণ করছে। সকাল ১১টায় আজারবাইজানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রসিকিউটর জেনারেলের কার্যালয় একটি যৌথ বিবৃতি জারি করে দাবি করে যে আর্মেনিয়ান সশস্ত্র বাহিনীর গোলাবর্ষণের ফলে আজারবাইজানের দুই বেসামরিক নাগরিক আহত হয়েছে। আর্মেনিয়ার প্রধানমন্ত্রী নিকোল পাশিনিয়ান বলেন, আজারবাইজান আর্মেনীয় ভূখণ্ডের কিছু কিছু এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে… আর্মেনিয়া আর্মেনিয়ার ইতিহাসে প্রথমবারের মতো কালেকটিভ সিকিউরিটি ট্রিটি অর্গানাইজেশনের (সিএসটিও) ৪ নং অনুচ্ছেদে আবেদন করেছে। সেদিনই আর্মেনিয়ার এক নিরাপত্তা কর্মকর্তা বলেন, তারা আর্মেনিয়া ও আজারবাইজানের মধ্যে যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছেন। এদিকে মস্কো টাইমস বলে, পুতিন আর্মেনিয়ার প্রধানমন্ত্রী পাশিনিয়ানের সামরিক সহায়তার অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেছেন, যেখানে রাশিয়ান নেতৃত্বাধীন সিএসটিও এর নীতি অনুসারে চুক্তিতে স্বাক্ষর করা প্রত্যেকটি দেশই কারও ওপর আক্রমণ এলে সহায়তা একে অপরকে সহায়তা করার বাধ্যবাধকতা গ্রহণ করেছিল।
এরপর ১৬ সেপ্টেম্বর আজারবাইজানের প্রেসিডেন্ট ইলহাম আলিয়েভ পুতিনকে বলেন, উত্তেজনা স্থিতিশীল করা হয়েছে। আর্মেনীয় এক এমপির বলেন, আর্মেনিয়া সীমান্তে এর আগে হারিয়ে যাওয়া ছয়টি অবস্থানের উপর নিয়ন্ত্রণ ফিরে পাওয়া গেছে। কিন্তু এখানেই সব শেষ হয়ে যায়নি। ২১শে সেপ্টেম্বর আর্মেনীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়, আজারবাইজানের সশস্ত্র বাহিনী সীমান্তের পূর্ব অংশে আর্মেনিয়ান অবস্থানগুলিতে মর্টার এবং বড় ক্যালিবার আগ্নেয়াস্ত্র নিক্ষেপ করেছে এবং এর ফলে একজন আর্মেনিয়ান সৈন্য আহত হয়েছে। ২২শে সেপ্টেম্বর আর্মেনিয়ার পক্ষ থেকে জানানো হয় যে হামলার প্রথম দিনগুলিতে আহত বেসামরিক নাগরিকদের মধ্যে একজন হাসপাতালে মারা গেছে, যার ফলে বেসামরিক হতাহতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪। বেশ কয়েকটি বিদেশী প্রতিনিধি, মার্কিন দূতাবাস, ডাচ দূতাবাস, ফরাসি দূতাবাস হাই রিস্ক সিকিউরিটি অ্যালার্ট জারি করে আর্মেনিয়া-আজারবাইজান বর্ডারের কাছে নন-এসেনশিয়াল ট্রাভেলে নিষেধাজ্ঞা দেয়। সাংবাদিকদের প্রশ্নে ইউএস এম্বাসি থেকে আজারবাজানকে তাদের তাদের সৈন্যদেরকে ইনিশিয়াল পজিশনে ফিরে আসার ও সিজফায়ার মেইন্টেইন করতে পুনরায় বলা হয়।
এই ১৬ তারিখেই আজারবাইজানের সেনাদের দ্বারা বেশ কিছু নারকীয় যুদ্ধাপরাধ বা অসদাচরণের কথা জানা যায়। আজারবাইজানে কমপক্ষে সাতজন আর্মেনীয় যুদ্ধবন্দীকে আটক করা হয়েছিল বলে জানানো হয়, তবে ভিডিওভিত্তিক প্রমাণগুলো অনুসারে সংখ্যাটি আরও বেশি বলেই মনে হয়। সেদিনে টেলিগ্রামে ছড়িয়ে পড়া ফুটেজে দেখা গেছে, আনুশ আবেতিয়ান নামে একজন নারী আর্মেনীয় সৈনিককে আজারবাইজানের বাহিনী বিকৃত করেছে। ভিডিওতে দেখা গেছে, ওই নারী নগ্ন, তার স্তন ও পেট জুড়ে বেশ কিছু শব্দ লেখা। তার চোখের সকেটটিতে একটি পাথর ঢোকানো, এবং তার মুখে একটি কাটা আঙুল স্থাপন করা হয়েছে। আর্মেনীয় সশস্ত্র বাহিনীর জেনারেল স্টাফরা বলেছিলেন যে “আজারবাইজানের সশস্ত্র বাহিনী আর্মেনিয়ার ভূখণ্ডে অনুপ্রবেশের পরে নৃশংসতা চালিয়েছিল; তারা একজন মহিলা সেবা সদস্যের শরীরকে কর্তন করেছে, তার পা, আঙ্গুলগুলি কেটে ফেলেছে এবং তাকে নগ্ন করেছে। আর্মেনিয়া আজারবাইজানকে বন্দী অবস্থায় আরেকটি যুদ্ধবন্দীকে হত্যা করার জন্য অভিযুক্ত করেছিল। আজারবাইজানের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া একটি অপেশাদার ভিডিওতে দাভিট গিশিয়ান নামে এক যুদ্ধবন্দীকে আহত ও অপমানিত হতে দেখা গেছে। পরে আর্মেনিয়ায় তার লাশ পাঠানো হয়।
আর্মেনিয়ার টেরিটোরিয়াল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন অ্যান্ড ইনফ্রাস্ট্রাকচারের উপমন্ত্রী কর্তৃক প্রকাশিত প্রাথমিক তথ্য অনুযায়ী, আজারবাইজানের গোলাবর্ষণের ফলে, আর্মেনীয় প্রদেশ সুনিক, গেঘরকুনিক এবং ভায়োতস ডিজোর-এ ১৯২টি আবাসিক বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং এর মধ্যে ৬০টি সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আর্মেনিয়ার মানবাধিকার কর্মী বলেন যে ৭,৫০০ এরও বেশি লোক তাদের বাড়িঘর থেকে বাস্তুচ্যুত হয়েছে। ১৪ই সেপ্টেম্বর, এটি রিপোর্ট করা হয়েছিল যে আজারবাইজানের ক্ষেপণাস্ত্রগুলি গেঘরকুনিক প্রদেশে একটি রাশিয়ান এফএসবি অফিসেও আঘাত হেনেছে। ১৩ সেপ্টেম্বর আর্মেনিয়ার জরুরি অবস্থা বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র জানান, আজারবাইজানের গোলাবর্ষণের ফলে জেরমুকে বনে আগুন ধরে যায়। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের এক বৈঠকে আর্মেনিয়ার স্থায়ী প্রতিনিধি মেহের মারগারিয়ান জারমুকে আজারবাইজানের হামলার নিন্দা জানিয়ে বলেন: “জারমুকের রিসোর্ট শহরের গোলাবর্ষণে কোন সামরিক লক্ষ্য নেই, এটি যুদ্ধাপরাধের চেয়ে কম কিছু নয়, এবং কেচুট জলাধারের বিরুদ্ধে হামলায় যেমন মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তেমনি তার পরিবেশগত প্রভাবও রয়েছে।”
যাই হোক, মনে হয়েছিল এখানেই দুই দেশের সংঘর্ষের ইতি ঘটেছে। কিন্তু না তা ঘটেনি। এরপর ২৩শে সেপ্টেম্বর আর্মেনিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় পুনরায় একটি যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘনের খবর দেয়, যেখানে বলা হয়, আজারবাইজানের সশস্ত্র বাহিনী আর্মেনিয়ান সীমান্তের পূর্ব দিকে অবস্থিত আর্মেনীয় যুদ্ধ ঘাঁটিগুলির একটির পেছন দিয়ে অনুপ্রবেশের চেষ্টা করেছিল। আর এরপর আবার আজারবাইজানের আক্রমণের কথা শোনা গেল এই ২৯শে সেপ্টেম্বরে। ২৯শে সেপ্টেম্বর আর্মেনিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় রিপোর্ট করেছে যে আজারবাইজানি বাহিনী আর্মেনিয়ান-আজারবাইজান সীমান্তের পূর্ব অংশে গোলাবর্ষণ করে, বড় ক্যালিবারের মর্টার এবং অস্ত্র ব্যবহার করে, যার ফলে ৩ জন আর্মেনিয়ান সৈন্য মারা যায়। আর্মেনিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, এই ঘটনাটি আজারবাইজানের “যুদ্ধবিরতি বজায় রাখার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এবং ইউনাইটেড ন্যাশনস এর নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য দেশগুলির আহ্বানের প্রতি স্পষ্ট অসম্মান”। আর্মেনিয়ার প্রধানমন্ত্রী এর জন্য “আর্মেনিয়া-আজারবাইজান সীমান্তে একটি আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক মিশন স্থাপনের” আহ্বান জানান।
সমগ্র সংঘর্ষে এখন পর্যন্ত আজারবাইজানের সৈন্যদের মধ্যে নিহত ৮০ ও আহত ২৮১ জন। অন্যদিকে আর্মেনিয়ায় নিহত বা নিখোঁজ ২০২ জন, আহত ২৯৩ জন ও ধৃত ২০ জন। তবে আজারবাইজান বলছে, আর্মেনিয়ার ৪৫০ সৈন্য নিহত হয়েছে ও তাদের দুটো এস-৩০০ লাঞ্চারকে তারা ধ্বংস করেছে। এগুলো ছাড়াও ৪ জন আর্মেনিয়ান সিভিলিয়ান নিহত হয়েছে, ২ জন সিভিলিয়ান নিখোঁজ, ৭ জন আর্মেনিয়ান সিভিলিয়ান আহত হয়েছে। আজারবাইজানি সিভিলিয়ানদের মধ্যে আহত ৩ জন। সব মিলে আর্মেনিয়ানদের ক্ষতি তুলনায় অনেক বেশি। যাই হোক, ২৯ তারিখের এই ঘটনা নির্দেশ করছে যে সংঘর্ষের ইতি এত সহজে ঘটছে না, এটা চলতেই থাকবে। আর মনে হচ্ছে সংঘর্ষের দোষটা আজারবাইজানের ঘাড়েই বেশি যায়।
কিন্তু আজারবাইজান কেন সংঘর্ষটা বাঁধাচ্ছে? লরেন্স ব্রোয়ার্সের মতে, আজারবাইজান এখন আক্রমণ করেছে কারণ এখনই যতটা পারা যায় তাদের ক্ষমতার ব্যবহার করার সুযোগ। কারণ যে রাশিয়া এতদিন যাবৎ আর্মেনিয়া এবং আজারবাইজানের মধ্যে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করে আসছিল, সেই দেশ ইউক্রেনে তার যুদ্ধের জন্য ব্যস্ত। আর্মেনিয়া সিএসটিও এর নীতি অনুসারে রাশিয়ার কাছে সহায়তা চাইলেও রাশিয়া থেকে কোন সহায়তা আসেনি। তিনি বলেন, আর্মেনিয়ার অন্তত দক্ষিণাঞ্চলে নতুন বাফার জোন তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে এবং বাইরের প্লেয়াররা এটি ঘটতে বাধা দেওয়ার ক্ষেত্রে এখন দুর্বল। এই বিষয়টা নিয়েই নিচে ডিটেইলে লিখছি…
বাইরের শক্তিরা
এই ছিল যুদ্ধের কথা। কিন্তু আমাদের আলোচনা কেবল যুদ্ধটা নিয়ে নয়, সেই সাথে যুদ্ধের উত্তেজনা সীমানার বাইরে কিরকম প্রভাব ফেলছে তা নিয়েও। আর্মেনিয়া এবং আজারবাইজানের মধ্যে এই উত্তেজনা উভয়ের সীমানার বাইরেও প্রভাব ফেলেছে, কারণ আর্মেনিয়া রাশিয়া নেতৃত্বাধীন সিএসটিও বা সমষ্টিগত নিরাপত্তা চুক্তি সংস্থার একটি অংশ। সিএসটিও কিছুটা হলেও ন্যাটোর বিরুদ্ধে রাশিয়ার একটি জোট হিসেবে কাজ করে। সিএসটিও মূলত একটি সামরিক জোট, এটি ন্যাটোর কাউন্টারপার্ট, এবং এর একটি ম্যুচুয়াল ডিফেন্স ক্লজ আছে যা আর্টিকেল ফোর নামে পরিচিত, যার ফাংশনটাও ন্যাটোর মতই। অনুচ্ছেদ ৪ এর অধীনে সিএসটিও এর কোন একটি দেশের উপর আক্রমণ হলে যদি প্রয়োজন হয় তখন সিএসটিও এর অন্যান্য সদস্য রাষ্ট্রগুলিকে অবিলম্বে সামরিক সহায়তা সহ অন্যান্য সহায়তা প্রদান করতে হবে। অন্য কথায়, অনুচ্ছেদ ৪ এর প্রবর্তনের পরে রাশিয়া এবং এর অন্যান্য সদস্যদেরকে আর্মেনিয়ার সমর্থনে আসতে হবে। কিন্তু সময়টা এখন রাশিয়ার জন্য ভাল চলছে না। রাশিয়ান বাহিনী বর্তমানে ইউক্রেনে তাদের হৃত বেশ কিছু অবস্থান পুনরুদ্ধারের জন্য লড়াই করছে। ফলে এখন রাশিয়ার পক্ষে আর্মেনিয়ায় শত শত সৈন্য পাঠানোর জন্য যথেষ্ট সক্ষমতা নেই, নেই আর্মেনিয়াকে সমর্থন দানের জন্য প্রয়োজনীয় সামরিক সরঞ্জামও। আর যদি রাশিয়ার সেই সক্ষমতা থেকেও থাকে, তাহলেও প্রশ্ন আসে এদের সেটা করার রাজনৈতিক ইচ্ছা নিয়ে।
শুধু সিএসটিও এর কারণে নয়, আরেকটা কারণেও এই সংঘাতটি রাশিয়ার জন্য খুব একটা ভাল নয়। সেটা হচ্ছে আজারবাইজানের সাথে তুরস্কের ঘনিষ্ঠতা। এই দুই দেশ ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত বলেই মনে করা যায় যে, আজারবাইজানের পক্ষ থেকে শুরু হওয়া যেকোন রকম ওয়ার এস্কেলেশনে এরদোয়ানেরও ভূমিকা রয়েছে। এখন আপনি মনে করতে পারেন, এরদোয়ানের সাথে রাশিয়ার সম্পর্ক মোটামুটি ভালই, সুতরাং এরদোয়ান উলটে আজারবাইজানকে সতর্ক করে থাকবে যাতে এখন তারা বাড়াবাড়ি না করে, নাহলে অন্ততপক্ষে এরদোয়ান অন্তত এই আক্রমণের জন্য আজারবাইজানকে নিন্দা জানাবে। কিন্তু সেটা হয়নি। প্রথমত তুরস্কের সাথে রাশিয়ার সম্পর্ক এখন আর সেরকম ভাল না, এই ব্যাপারটা নিয়ে পরে বিস্তারিত লিখব। দ্বিতীয়ত তুরস্কের কাছে সবসময়ই “অন্য স্বার্থ” আগে, যার কারণে তারা উলটে আজারবাইজানকেই সমর্থন করবে ও আর্মেনিয়াকে নিন্দা করবে। আর তারা করেছেও ঠিক তাই। তুরস্কের ডিফেন্স মিনিস্টার উলটে আর্মেনিয়াকেই তার “এগ্রেসিভ এটিচুড” ও “উষ্কানিমূলক কাজের” জন্য নিন্দা জানিয়েছে। শুধু তাই নয়, আজারবাইজানের ওপর তুরস্কের সাপোর্টও রয়েছে। যুদ্ধের একটি ফুটেজে দেখা গেছে আজারবাইজানিরা এই যুদ্ধে তুর্কি টিবি২ বায়রাক্তার ড্রোন ব্যবহার করছে! সেই সাথে অনেক আগে থেকেই তুরস্ক আজারবাইজানকে সম মিসাইল সহ গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্র প্রদান করে আসছে, যেগুলো তারা এখন আর্মেনিয়ার ওপর ব্যবহার করছে।
এরদোয়ান জানে যে, তার এই কাজ রাশিয়ার মনে বিরক্তির সঞ্চার করবে। ইতিমধ্যেই একটা আর্গুমেন্ট শুরু হয়ে গেছে, যা বলছে রাশিয়া এই অঞ্চলের রেজিওনাল সিকিউরিটি গ্যারান্টর ছিল বলেই এই সংঘাতটা আবার শুরু হয়েছে, যা কেবল রাশিয়ার জন্য অপমানজনকই নয়, সাথে বর্তমানে রাশিয়ার দুর্বলতা, অক্ষমতা ও দীনতাও প্রকাশ করে। ইউক্রেইনে আক্রমণের পূর্বে রাশিয়াকে একটি মিলিটারি সুপারপাওয়ার ভাবা হতো। যদি বা ভাবা নাও হতো, তাহলেও অন্তত মিলিটারি সুপারপাওয়ারের কাছাকাছি কিছু ভাবা হতো। সারা পৃথিবী এক্সপেক্ট করত যে, রুশ বাহিনী খুব দ্রুত ইউক্রেনীয় ডিফেন্সকে ধ্বংস করে দিয়ে দেশটির বিশাল অংশ কব্জা করে নেবে। কিন্তু বলাই বাহুল্য যে এটা ঘটেনি। ইউক্রেইনের যুদ্ধটি দেখিয়ে দিয়েছে যে, রাশিয়াকে এই অঞ্চলের স্ট্যাবিলিটি ও সিকিউরিটির আয়রনগার্ড ভাবাটা একটা ফ্যালাসি ছিল। আর ঠিক এই ফ্লসটাই আজারবাইজানকে আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠার সুযোগ করে দিয়েছে। আর এর ফলেই দেশটি তার ধারণা অনুসারে আনরিজলভড টেরিটোরিয়াল ডিসপুটকে রিজল্ভ করতে চাইছে। এই আজারবাইজান ও আর্মেনিয়ার মধ্যকার নতুন সংঘাতটি তুরস্ক ও রাশিয়ার মধ্যকার সম্পর্ক নিয়ে কিছু কঠিন প্রশ্ন উত্থাপন করেছে।
যাই হোক, তুরস্ক যে তার অন্য স্বার্থ্যের কথা ভেবেই এই কাজগুলো করছে তা উল্লেখ করেছিলাম। তার এই অন্য স্বার্থ্য কী সেই ব্যাপারে একটু আঁচ পাওয়া যাবে আজারবাইজানের এই যুদ্ধে স্বার্থ কী সেই ব্যাপারে অনুমান করার মাধ্যমে। অনেকে বলছিলেন, আজারবাইজান আর্মেনিয়ার কিছু অঞ্চল নিয়ে একটি বাফার জোন প্রতিষ্ঠা করতে চায়। হতে পারে, কিন্তু রাশিয়া যদি এটার অনুমোদন না দেয় তবে এটা হওয়া কঠিন। আজারবাইজান আসলে চায় আর্মেনিয়া নাগারনো-কারাবাখে তার সব দাবি ত্যাগ করুক। সেই সাথে আজারবাইজান চায় তুরস্কের বর্ডারে আজারবাইজানের যে নাকিচেভান নামের এনক্লেইভটি আছে সেটার সাথে এর মেইনল্যান্ডের ট্রান্সপোর্ট কোরিডর, সেই সাথে পাসপোর্ট ও কাস্টোম কন্ট্রোলের অব্যাহতি। এটা হলে তুরস্কের সাথে আজারবাইজানের যোগাযোগ অনেক সহজ হয়ে যাবে। এদিকে আর্মেনিয়া সেটা চায়না, কেননা এটা তাদের টেরিটোরিয়াল ইন্টিগ্রিটিকে দুর্বল করবে। অনেকে ভয় পান যে, এর মাধ্যমে আজারবাইজান আর্মেনিয়ার অনেক অঞ্চলও দখল করে নেবে। আরেকটা সুবিধা আছে এতে, তা হচ্ছে আজারবাইজান থেকে তুরস্কের ওপর দিয়ে এই পরিকল্পিত জাঙ্গেজৌর (Zangezour) কোরিডরটির আরমেনিয়ার সাথে ইরানের বর্ডার একেবারে বিচ্ছিন্ন করে দেয়া যাবে, কেননা কোরিডরটি একেবারে ইরান-আর্মেনিয়ার বর্ডার দিয়ে যাবে। যার ফলে আর্মেনিয়া তার বর্ডার অঞ্চলে থাকা মিত্র ইরানের সাথে সরাসরি সংযোগ হারাবে।
উল্লেখ্য, ইরান আর্মেনিয়ার মিত্র ও আজারবাইজানকে এরা হুমকি ভাবে। এই ব্যাপারটা ডিটেইলে লেখার মত বিষয়, কিন্তু আপাতত জাস্ট একটা পয়েন্ট সামনে আনছি। ইরান ও আজারবাইজান উভয়ই শিয়া মুসলিম হলেও এদের মধ্যে কিছু শত্রুতাও রয়েছে। ইরান আজারবাইজানের ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলোকে সহায়তা করে, কিন্তু সেক্যুলার আজারবাইজান এইসব রিলিজিয়াস এক্সট্রিমিস্ট গোষ্ঠীকে নিজেদের নিরাপত্তার জন্য থ্রেট মনে করে। অন্যদিকে আজারবাইজানের দ্বিতীয় রাষ্ট্রপতি আবুলফাজ এলচিবে-র সময়কালে আজারবাইজানে প্যান-তুর্কি রাজনৈতিক রেটোরিকগুলো বৃদ্ধি পায়। অন্যদিকে ইরানে রয়েছে প্রচুর জাতিগত আজেরি বা আজারবাইজানি জনসংখ্যা। ইরান এতে ভীত হয়, কেননা আজার বাইজানে প্যান তুর্কী জাতীয়তাবাদ বৃদ্ধি পাওয়ায় ইরানের আজেরিদের মধ্যেও এই জাতীয়তাবাদ বৃদ্ধি পেতে পারে, যা এদেরকে ইরানের থিওক্রেসির বিরুদ্ধে সঞ্চালিত করবে। ফলে ইরান আজারবাইজানকে হুমকি হিসেবে গ্রহণ করে ও এদের থ্রেটকে সামাল দিতে তারা আর্মেনিয়ার সাথে শক্তিশালী মৈত্রী স্থাপন করে।
এই জাঙ্গেজৌর কোরিডর হয়ে গেলে ইরান তার দুটো জিওপলিটিকাল এডভান্টেজ থেকে বঞ্চিত হবে। প্রথমত, ইরানের ইউনিক পজিশন তাদেরকে আজারবাইজানের এনক্লেইভ নাখচিভান ও আজারবাইজানের মেইনল্যান্ডকে ইরানিয়ান টেরিটোরি থেকে এক্সেস দেয়। দ্বিতীয়ত, ইরানের সাথে আর্মেনিয়ার ল্যান্ড বর্ডার। কয়েক দশক ধরে আজারবাইজান তাদের এনক্লেইভ নাখচিভানে যাবার জন্য ইরানের ওপর নির্ভরশীল ছিল, যা ২০২০ সালের যুদ্ধের পর চলে যায়। কারণ, ২০২০ সালের যুদ্ধে জয়ের পর আজারবাইজানে যুদ্ধ বিরতির চুক্তি অনুযায়ী নাখচিভানের সাথে আজারবাইজানের মেইনল্যান্ডের মধ্যে সংযোগ স্থাপন হয়। এখন ইরান-আর্মেনিয়ান বর্ডারের ওপর দিয়ে যদি আজারবাইজানের কোরিডর যায় তাহলে তা আর্মেনিয়া আর ইরান উভয়ের জন্যই ক্যাটাস্ট্রফি হবে, আর আজারবাইজান ও তুরস্কের জন্য লাভজনক। কিন্তু তুরস্কের স্বার্থ কেবল এটা দিয়েই বোঝা যাবে না, সেই সাথে বোঝা যাবে না রাশিয়ার ওপর আসা তুরস্ক ও অন্যান্য তুর্কিক রাষ্ট্রসমূহের থ্রেট সম্পর্কে। এটা সম্পর্কে জানতে হলে জানতে হবে প্যান-তুর্কিজম নামে এক বিশেষ মতাদর্শ সম্পর্কে। এটা নিয়ে পরে লেখা হবে…
তুরস্কের ও অন্যান্য তুর্কিক রাষ্ট্রের প্যান-তুর্কিজম
এবারে যাচ্ছি তুরস্কের নিজস্ব স্বার্থের ব্যাপারে। এই ব্যাপারে যা লিখব তাতে কিছুটা স্পেক্যুলেশন থাকবে। পোস্ট-সোভিয়েত জগতে এখন প্যান-তুর্কিজমের একটি পুনরুজ্জীবন দেখা যাচ্ছে, যা এমনকি মস্কোকেও উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। ২০১৯ সালে আজারবাইজানের বাকুতে অরগানাইজেশন অফ তুর্কিক স্টেইটস এর তুর্কিক কাউন্সিলের সপ্তম শীর্ষ সম্মেলনে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগান বেশ সাহসিকতার সঙ্গে বলেছিলেন, ‘আমরা ছয়টি রাষ্ট্র, এক জাতি হিসেবে সবচেয়ে শক্তিশালী হব।” উল্লেখ্য, অর্গানাইজেশন অফ তুর্কিক স্টেইটসের সদস্য সংখ্যা ৫টি দেশ (তুরস্ক, আজারবাইজান, কিরগিজিস্তান, উজবেকিস্তান, তুরস্ক) আর অবজারভার দেশ ২টি (হাঙ্গেরি ও তুর্কমেনিস্তান)। হাঙ্গেরী বাদে বাকি ৬টি তুর্কিক রাষ্ট্রের কথাই এরদোয়ান উল্লেখ করেছেন।
আপনার মনে হতে পারে, হাঙ্গেরীয়রা তো তুর্কিক জাতি নয়, অর্থাৎ তারা তো তুর্কিক ভাষায় কথা বলেনা, বা হাঙ্গেরীয় ভাষা তুর্কিক না, তবে তারা কেন এই অর্গানাইজেশন যোগ দিল। আসলে হাঙ্গেরীয়রা নিজেদেরকে আত্তিলা দ্য হান এর উত্তরসুরি বলে ভাবে, আর হানদেরকে তারা তুর্কিদের সাথে সম্পর্কিত বলে মনে করে, আর তাই হাঙ্গেরীয় ভাষাকেও তারা তুর্কী ভাষার রিলেটিভ মনে করে। কিন্তু এই ধারণাটি ভুল। ডিটেইলে ব্যাখ্যায় যাচ্ছিনা। সংক্ষেপে বলছি, হাঙ্গেরীয় ভাষা একটি উরালিক ভাষা, যা তুর্কিক ভাশাগুলো থেকে খুবই আলাদা, এদের অরিজিন এক নয়। পূর্বে মনে করা হতো উরালিক ভাষাপরিবার ও “আলতাইক ভাষাপরিবার” দুটি একই ভাষা-পরিবার উরাল-আলতাইক ভাষা পরিবার থেকে উদ্ভূত, তাই হাঙ্গেরীয়রা ও তুর্কিকরা সম্পর্কিত। কিন্তু পরে দেখা গেল, উরালিক ও আলতাইক ভাষার সাধারণ উৎপত্তির ধারণাটি যে ভুল শুধু তাই নয়, সেই সাথে আলতাইক ভাষা পরিবারের ধারণাটিই ভুল, কেননা যেসব ভাষাকে আলতাইক ধরা হয়, সেই তুর্কিক, মঙ্গোলিক, তুঙ্গুসিক ভাষা পরিবারগুলো (কখনও কখনও জ্যাপোনিক ও কোরিয়ানিক ভাষাপরিবারগুলো ও খুব কম সময়ে আইনু ভাষাপরিবারকেও আলতাইক ধরা হয়) পরিবারগুলোরও উৎপত্তি এক নয়। ফলে এরকম ধারণা ভিত্তিহীন। কিন্তু হাঙ্গেরীয় সরকার এখনও এই ধারণাটি ধরে রেখেছে। আর এই ধারণাটির সাথে বিশেষ রাজনৈতিক ও জাতীয়তাবাদী মতাদর্শও জড়িত, যার নাম হলো তুরানিজম বা প্যান-তুরানিজম। এটি একটি প্যান-ন্যাশনালিস্ট কালচারাল ও পলিটিকাল মুভমেন্ট, যা ইনার এশিয়া ও সেন্ট্রাল এশিয়ান অরিজিনের কালচারালি, লিংগুইস্টিকালি বা এথনিকালি রিলেটেড জনগোষ্ঠীর মধ্যকার ঘনিষ্ঠ সহযোগিতামূলক সম্পর্ক বা রাজনৈতিক একীকরণ দাবি করে, যাতে তারা শেয়ারড ইন্টারেস্টে কাজ করতে পারে এবং ইউরোপ ও পূর্ব এশিয়ার সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক প্রভাবের বিরোধিতা করতে পারে। এই জাতিগুলোর মধ্যে রয়েছে ফিন বা ফিনিশ, সামি, সামোয়েড, বুলগেরিয়ান, হাঙ্গেরিয়ান, তুর্ক, মোঙ্গল, মাঞ্চু ও অন্যান্য ছোট ছোট গোষ্ঠী। ১৯শ শতকে প্যান-জার্মানিজমের মত আদর্শের বিরোধিতা করতে গিয়ে এর জন্ম হয়, আর এই প্যান-তুরানিজম ধারণার বিকাশে প্যান-স্লাভিজমের প্রভাব আছে, তুরানিয়ান ব্রাদারহুড এন্ড কলাবরেশনের ধারণাটি স্লাভিক ব্রাদারহুড এন্ড কলাবরেশনের প্যান-স্লাভিক কনসেপ্টটি থেকেই ধার করা।
যাই হোক, আলোচনাটি প্যান-তুর্কিজম নিয়ে। তো এরদোয়ান ৬টি রাষ্ট্রকে এক জাতি ধরে যে বক্তব্যটা দিল সেই এক জাতির ব্যাপারটা এখানে গুরুত্বপূর্ণ। এটাকে কেবলই একটি রেটোরিক বলে মনে হতে পারে। কিন্তু সম্ভবত এটি রেটোরিকের চেয়ে বেশি কিছুই, যা প্যান-তুর্কিজমকে ইঙ্গিত করে। এরদোয়ানের কথাগুলো সাধারণ ভাষাগত ও ঐতিহাসিক ঐতিহ্যের একটি সাধারণ স্বীকৃতির চেয়েও বেশি কিছু ছিল, যা গত তিন দশক ধরে সোভিয়েত-পরবর্তী বিশ্বে তুরস্কের প্যান-তুর্কিজম মতাদর্শকে মূর্ত করে তুলছে। ১৮৮০ এর দশকে রাশিয়ার কাজান, ককেশাস (বর্তমান আজারবাইজান), ও অটোমান সাম্রাজ্যের (বর্তমান তুরস্ক) ইন্টেলেকচুয়ালরা ধারণাটির উত্থান ঘটায়, যা পৃথিবীর সকল তুর্কিক জনগোষ্ঠীর লোকেদের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক একীকরণকে তাদের লক্ষ্য হিসেবে নির্ধারণ করে। একটু আগে যে তুরানিজমের কথা বললাম, প্যান-তুর্কিজম তার থেকে আরও বিশেষ, কারণ এটি কেবল তুর্কিক জনগোষ্ঠীসমূহের একীকরণ চায়। তবে দেখা যায়, প্যান-তুর্কিজম ও তুরানিজম শব্দগুলো আসলে অনেক সময় একই অর্থে ব্যবহৃত হচ্ছে। তুরানিজমের সাথে যেমন উরালিক-আলতাইক ভাষাপরিবারের বাতিল থিসিজগুলো সম্পর্কিত, তেমনি প্যান-তুর্কিজম সম্পর্কিত স্যুডো-তুর্কোলজি নামক কিছু উদ্ভট ও বানোয়াট মানবেতিহাসের কাহিনী, যেখানে নেটিভ আমেরিকানদের পর্যন্ত তুর্কিক বলে দাবি করা হয়। তবে সেই দিকে আর আলোচনা বাড়াব না। আপাতত যেটুকু জানা ইম্পরটেন্ট তা হচ্ছে, প্যান-তুর্কিজমকে বিশ্বজুড়ে তুর্কিক জনগণ, যেমন আজেরি, তাতার, কাজাখ, উজবেক এবং কিরগিজ জাতি, যারা একটি শেয়ারড তুর্কিক ঐতিহ্য বহন করে, তাদের মধ্যে একটি শক্তিশালী জোট তৈরি করা যা, ইতিমধ্যে প্রতিষ্ঠিত আঞ্চলিক শৃঙ্খলাকে চ্যালেঞ্জ করতে চায়। ২০০৯ সালে তুর্কি কাউন্সিল প্রতিষ্ঠার পেছনে এটিই ছিল মূল ধারণা। আর গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক হচ্ছে এই প্যান-তুর্কিজমের সাথে রাজনৈতিক ইসলামও ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। উদাহরণ হিসেবে তুরস্ক ও আজারবাইজানের গ্রে ওল্ভস রিলেটেড পার্টিগুলোর কথা বলা যায় যারা প্যান-তুর্কিজম আদর্শ প্রমোট করে। এই পার্টিগুলো একই সাথে তুর্কিশ-ইসলামোন্যাশনালিজমও প্রমোট করে। তাছাড়া গ্রে ওলভস ছাড়াও তুরস্কের এরদোয়ানের পার্টি জাস্টিস এন্ড ডেভলপমেন্ট পার্টিরও তুর্কিশ-ইসলামিজমের আদর্শ রয়েছে।
অনেকে প্যান-তুর্কিজম আর নিও-অটোমানিজমকে গুলিয়ে ফেলেন। বর্তমানে প্যান-তুর্কিজম বিশেষভাবে সোভিয়েত-পরবর্তী জগত, অর্থাৎ পূর্বে সোভিয়েত ইউনিয়ন যেসব অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করত সেসব অঞ্চল নিয়ে ভাবিত। অন্যদিকে নিও-অটোমানিজম ভাবিত হয় অটোমান সাম্রাজ্য যেসব অঞ্চল পূর্বে নিয়ন্ত্রণ করত সেগুলো নিয়ে। এখন সোভিয়েত ইউনিয়নে থাকা অঞ্চলগুলোর ওপর অটোমান সাম্রাজ্যের নিয়ন্ত্রণ ছিলনা, আর তাই যেসব তুর্কিক রাষ্ট্রের কথা বলা হচ্ছে সেগুলোতে তুর্কি-প্রভাবের জন্যও নিও-অটোমানিজমের আদর্শ যথেষ্ট নয়, তাই প্যান-তুর্কিজমই তাদের দরকার। ASRIE Analytica এর ফাউন্ডার গিউলিয়ানো বিফোলচি বলছেন, তুরস্কে এখন নিও-অটোমানিজম ওল্ড ফ্যাশনড হয়ে গেছে, তাদের এজেন্ডার সামনের সারিতে রয়েছে এখন প্যান-তুর্কিজমের মাধ্যমে সেন্ট্রাল এশিয়া ও ককেশাস অঞ্চলের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা। পূর্বে সোভিয়েত ইউনিয়নে আলোচ্য তুর্কিক অঞ্চলগুলো নিজেদের দখলে রেখেছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্টরা ছিল এথনো-ন্যাশনালিজম ও রিলিজিয়াস আইডেন্টিটির বিরোধী, তাই তাদের সময়ে এরকম প্যান-তুর্কিজম বা তুর্কিক এথনিক জাতীয়তাবাদ এরকম মাথাচাড়া দেয়নি। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙ্গনের পর সদ্য স্বাধীন রাষ্ট্রগুলো তাদের পুরনো তুর্কী ও ইসলামিক ঐতিহ্যকে রিভাইভ করতে থাকে, আর সেই সাথে শক্তিশালী হতে থাকে প্যান-তুর্কিজমের আদর্শ। এদিকে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর রাশিয়াও প্রাক্তন সোভিয়েত অঞ্চলগুলোতে প্রভাব বিস্তার করতে চায়, আলেকজান্ডার দুগিন ও অন্যান্যদের নিও-ইউরেশিয়ানিজম বা ইউরেশিয়া মুভমেন্ট দিয়ে। কিন্তু স্বাভাবিকভাবেই প্যান-তুর্কিজমের আদর্শের সাথে এর সংঘাত লাগছে। ফলে তুরস্ক ও রাশিয়ার মধ্যেও সংঘাত বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা মূর্ত হয়ে উঠছে ইউক্রেইন-রাশিয়ার যুদ্ধের পর। যাই হোক, ২০০৯ সালের তুর্কিক কাউন্সিল গঠনের পর থেকে কাজাখস্তানের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি নুরসুলতান নাজারবায়েভ ইউরোপীয় ইউনিয়নের অনুরূপ ভাবে একটি “তুর্কিক ইউনিয়ন” এর ধারণাটি উত্থাপন করেছেন।
তো এই প্যান তুর্কিজমের প্রকাশ কিভাবে হচ্ছে? তুরস্ক এক্টিভলি হাজার হাজার শিক্ষার্থীকে মধ্য এশিয়া ও আজারবাইজানের মধ্যকার সাংস্কৃতিক বন্ধনকে শক্তিশালী করার কাজের জন্য স্কলারশিপ দিচ্ছে। ২০১৭ সালে আজারবাইজান, তুরস্ক, কাজাখস্তান ও কিরগিজিস্তান মিডল স্কুল এইজড বাচ্চাদের ক্ষেত্রে একটি সাধারণ পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন করে, যার নাম হচ্ছে “জেনারেল তুর্কিক হিস্ট্রি” বা সাধারণ তুর্কী ইতিহাস। এটা ছাড়াও অন্যান্য বিষয়েও একই রকম প্যান-তুর্কিক প্রোজেক্ট রয়েছে তাদের। এই সব বইতে যে ন্যারেটিভ শেখানো হয় সেগুলো ইনকন্সিস্টেন্সি ও হিস্টোরিকাল ফলসহুডে ভর্তি। এই ব্যাপারে বলতে শুরু করলে একটা বিশাল নিবন্ধ লেখা যাবে। ইউনিভার্সিটি অফ গেন্টের ঐতিহাসিক ব্রুনো ডে করডিয়ের বলছেন, এই ধরণের বিকৃত ন্যারেটিভ চাপিয়ে দেয়ার উদ্দেশ্য পরিষ্কার, এরা সকল তুর্কিক জাতিগুলোর মধ্যে আইডিওলজিকাল ইন্টিগ্রেশন বা মতাদর্শিক একীকরণ চায়। যদিও রাশিয়া এখনও এই অঞ্চলে সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রভাবের একটি উল্লেখযোগ্য মাত্রা বজায় রেখেছে, কিন্তু গিউলিয়ানো বিফোলচি মনে করেন, তুরস্ক এখানে এমন কিছু দিতে পারে, যা রাশিয়া কখনও দিতে পারেনা, তা হচ্ছে সেন্স অফ কমোনালিটি বা সাধারণতার অনুভূতি… তুরস্ক তুর্কিক জাতিগুলোকে একটি অভিন্ন সাংস্কৃতিক পটভূমি দিতে পারে, আর পারুক বা না পারুক, দেশটি তুর্কিক লোকেদেরকে এই ধারণাটি দান করতে পারে যে এই অঞ্চলে একটি শক্তিশালী জাতি শাসন করতে পারে, যা ইউরেশিয়ার “ন্যাটো” হয়ে উঠবে, যা রাশিয়া ও চীন উভয়কেই কাউন্টার করতে পারবে।
এর ফলে আশঙ্কা দেখা দিয়েছে, কারণ এর ফলে তারা তাদের বেশিরভাগ প্রভাব হারাতে পারে। অনেক কারণেই মধ্য এশীয় লোকেরা এখন রুশদের চেয়ে নিজেদের ধর্ম ও ভাষাভাষী লোকেদেরই বেশি আপন মনে করে। এর একটি কারণ হিসেবে রাশিয়ায় মধ্য এশীয় অভিবাসী শ্রমিকদের প্রতি তাদের দুর্ব্যবহারের বিষয়টি নিয়ে অনেকে বলে থাকেন। মধ্য এশিয়া ও ককেশাসে তুরস্কের প্রভাব রাশিয়ার অর্থনৈতিক ইন্টারেস্টের জন্যেও ক্ষতিকর, কেননা রাশিয়া এখন প্রাক্তন সোভিয়েত রাষ্ট্রগুলোরর সাথে মিলিটারি ও ট্রেড ইন্টিগ্রেশনের মাধ্যমে মস্কো নেতৃত্বাধীন এক্সিস তৈরি করতে চায়। এক্ষেত্রে রাশিয়ার অবজেক্টিভের দুটো প্রধান উপাদান হচ্ছে কালেক্টিভ সিকিউরিটি ট্রিটি অরগানাইজেশন (সিএসটিও) এবং ইউরেশিয়ান ইকোনমিক ইউনিয়ন (ইএইইউ)। কাজাখস্থান ও কিরগিজিস্তান এই উভয় সংগঠনেরই সদস্য। এখন মিলিটারি ও ইকোনমিক সেক্টরে তুর্কিক কাউন্সিল মেম্বারদের মধ্যকার শক্তিশালী পার্টনারশিপ এই সিএস্টিও ও ইএইইউ এর জন্যই ক্ষতিকর হবে। এদিকে তুর্কমেনিস্তান থেকে আজারবাইজান এবং তুরস্ক হয়ে ইউরোপে একটি গ্যাস পাইপলাইন যাবার প্রস্তাব আছে, যেটা, ইউরোপীয় গ্যাস বাজারে রাশিয়ার আধিপত্যের জন্য নিঃসন্দেহে একটি হুমকি। অবশ্য এটা এখনও একটি ধারণা মাত্র, অনেক কিছুর ওপরই এটা নির্ভর করছে। আর কেবল তুর্কিকরা হলে একটা কথা ছিল, কিন্তু এখন রাশিয়াকে এই অঞ্চলে প্রভাব বিস্তারের জন্য চীনের সাথেও প্রতিযোগিতায় যেতে হবে। এর ফলে ককেশাস ও সেন্ট্রাল এশিয়ায় তুরস্ক, রাশিয়া ও চীনের মধ্যে একটি নতুন খেলার সূচনা হয়েছে, যা আগামীতে পরিস্থিতিকে ক্রমশ উত্তপ্ত করবে।
এখান থেকেই বোঝা যায়, তুরস্কের সাথে আজারবাইজানের মেইনল্যান্ডে কোরিডরটা তৈরি হলে তুরস্কের লাভটা কোথায়। ভাল কথা, প্যান-তুর্কিজম নিয়ে আজারবাইজান একটু বেশিই আহ্লাদ দেখায়। তাদের প্যান-তুর্কিস্ট আদর্শ অনুসারে নাগার্নো-কারাবাখ আর আর্মেনিয়া আসলে পশ্চিম আজারবাইজান, এখানে আজেরি তুর্কিরাই আদি বাসিন্দা, আর আর্মেনীয়রা সেখানে বহিরাগত, যারা বর্তমান আর্মেনিয়ায় প্রবেশ করে আজেরিদের বিতাড়িত করেছে। এসবের কোন সত্যতা নেই, কিন্তু তারা এগুলোই শেখায় তাদের শিক্ষার্থীদের। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে, রাশিয়া-ইউক্রেইন যুদ্ধের সুযোগ নিয়ে কেবল আজারবাইজানই আর্মেনিয়ায় আক্রমণ করেনি, সাথে তাজিকিস্তান ও কিরগিজিস্তানের মধ্যেও বর্ডার ক্ল্যাশ ঘটেছে, যার শুরু হয় ১৪ই সেপ্টেম্বরে, আর ১৬ই সেপ্টেম্বরে তার সমাপ্তি ঘটে। উল্লেখ্য, তাজিকিস্তানের লোকেরা মূলত তাজিক, যারা একটি ইরানীয় ভাষাভাষী গোষ্ঠী। অন্যদিকে কিরগিজিস্তানের লোকেরা তুর্কিক, যারা তুর্কিক কাউন্সিলের সদস্য। এটা অন্যান্য ক্ল্যাশের মত স্পোরাডিক ছিলনা, ভাল মতই এস্কেলেশন হয়েছিল। এতে কিরগিজরা তুরস্কের দেয়া ড্রোন ব্যবহার করে বলে জানা যায়। যুদ্ধে তাজিকিস্তানের ৭৪ জন ও কিরগিজিস্তানের ৫৯ জন নিহত হয়। তুজন তাজিক বর্ডার গার্ডকে গুলি করে হত্যার মাধ্যমে যুদ্ধের সূচনা হয়েছিল, কিরগিজিস্তানের পক্ষ থেকে বলা হয়, সেই বর্ডার গার্ডরা তাদের ডিমার্কেটেড এরিয়ার বাইরে এসে পড়েছিল। শেষে উজবেকিস্তানের সমরখন্দে অনুষ্ঠিত সাংহাই কোঅপারেশন অরগানাইজেশন (SCO) এর সামিটে দুই দেশের সরকার প্রধানের মধ্যে মিটমাট হয়। এই যুদ্ধটিও একইভাবে রাশিয়ার দুর্বলতা প্রকাশ করেছে। এখানে একটা বিষয় স্পষ্ট হচ্ছে। হয়তো আমরা পশ্চিমা বিশ্বকে রাশিয়ার যত বড় শত্রু বলে মনে করছি, এর চেয়েও বড় শত্রুরা হয়তো রাশিয়ার ঘরের কাছেই বসে আছে…
Leave a Reply