জেন্ডার ডিজ্যাপয়েন্টমেন্ট ও পুত্রসন্তানের প্রতি পক্ষপাতিত্ব

জেন্ডার ডিজ্যাপয়েন্টমেন্ট বা লিঙ্গ-নৈরাশ্য (Gender Disappointment)

জেন্ডার-ডিজ্যাপয়েন্টমেন্ট হল সেই দুঃখবোধ যা পিতামাতারা অনুভব করেন যখন তাদের পছন্দের লিঙ্গের সন্তান লাভের ইচ্ছা পূরণ হয় না। এটি এমন এক অনুভূতির জন্ম দিতে পারে যা সবসময় প্রকাশ্যে প্রকাশ করা যায় না। এটি প্রায়শই এমন সংস্কৃতিতে দেখা যায় যেখানে নারীদের নিচু স্তরের হিসাবে দেখা হয় এবং পছন্দের সন্তান হয় একটি ছেলে শিশু, অর্থাৎ পুত্রসন্তানের প্রতি বিশেষ আকর্ষণ (son preference)। এর ফলস্বরূপ লিঙ্গ-নির্বাচনী হত্যা (sex-selective killing) বা কন্যা শিশুদের অবহেলা ঘটতে পারে।

জেন্ডার-ডিজ্যাপয়েন্টমেন্ট প্রসবের আগে বা পরে ঘটতে পারে। এটি একটি স্বতন্ত্র মানসিক অসুস্থতা হিসাবে বিবেচিত হতে পারে কিনা বা এটিকে অন্যান্য মানসিক ব্যাধি, যেমন বিষণ্ণতা (depression) (যেমন প্রসব-পরবর্তী বিষণ্ণতা- postpartum depression) অথবা সমন্বয় ব্যাধি (adjustment disorders) -এর সাথে যুক্ত করা উচিত কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এর চিকিৎসা জটিল হতে পারে কারণ পুনরুদ্ধারের জন্য কোনও নির্দিষ্ট পথ এখনও পর্যন্ত নির্ধারণ করা যায়নি। তা সত্ত্বেও, কিছু চিকিৎসা উপলব্ধ আছে যা সফল বলে প্রমাণিত হয়েছে।

তত্ত্ব (Theories)

বেশ কয়েকটি তত্ত্ব প্রচলিত আছে যার মাধ্যমে সাধারণভাবে জেন্ডার-ডিজ্যাপয়েন্টমেন্ট ব্যাখ্যা করা হয়: লিঙ্গ বৈষম্য তত্ত্ব (gender discrimination theory), লিঙ্গ সারতত্ত্ব (gender essentialism theory) এবং পিতামাতার বিনিয়োগ তত্ত্ব (parental investment theory)।

লিঙ্গ বৈষম্য তত্ত্ব (Gender discrimination theory)

এই তত্ত্ব অনুসারে, এশিয়ার দেশগুলোতে প্রচলিত পিতৃতান্ত্রিক আত্মীয়তা ব্যবস্থা (patriarchal kinship system) একটি নির্দিষ্ট লিঙ্গের, বিশেষত পুত্রের প্রতি প্রবল আগ্রহ সৃষ্টি করে। এই ধরনের ব্যবস্থায় পুত্রদের “সমৃদ্ধির অগ্রদূত এবং কন্যাদের এমন দায় হিসাবে বিবেচনা করা হয় যাদের জীবনকালে প্রচুর সম্পদের প্রয়োজন হয়”। এই সমাজে, পুত্র সন্তানের আকাঙ্ক্ষার অন্তর্নিহিত চাপ ব্যাপক। এই চাপ সামাজিক (social) ও সাংস্কৃতিক (cultural) চাপ (যেমন- শুধুমাত্র পুত্ররাই বংশের নাম বহন করবে, কিছু ধর্মীয় আচার শুধুমাত্র পুরুষরাই পালন করতে পারবে) থেকে শুরু করে অর্থনৈতিক বিবেচনা (economic considerations) (যেমন- বৃদ্ধ বয়সে পুত্রদের তাদের পিতামাতার অর্থনৈতিক অবস্থার যত্ন নেওয়ার বাধ্যবাধকতা থাকে) এবং নিরাপত্তা উদ্বেগ (safety concerns) পর্যন্ত বিস্তৃত। বলার অপেক্ষা রাখে না, এই বিষয়গুলো পুত্র সন্তানের জন্মকে উৎসাহিত করে এবং নবজাতক কন্যা হলে লিঙ্গ-বৈষম্য সৃষ্টি করে।

লিঙ্গ সারতত্ত্ব (Gender essentialism theory)

লিঙ্গ সারতত্ত্ব হল এমন একটি তত্ত্ব যা অনুসারে পুরুষ ও নারীদের মধ্যে অন্তর্নিহিত গুণাবলী আরোপ করা হয় এবং তাদের একটি নির্দিষ্ট সত্তা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। প্রায়শই, এগুলি স্বতন্ত্র জৈবিক সক্ষমতা (biological capacities) এর পরিপ্রেক্ষিতে সংজ্ঞায়িত করা হয়, তবে এগুলি সামাজিক স্টেরিওটাইপ (social stereotypes) এর উপরও ভিত্তি করে তৈরি হতে পারে।

যখন কোনো নির্দিষ্ট লিঙ্গের সন্তানের জন্য পিতামাতার আকাঙ্ক্ষা এই ধরনের স্টেরিওটাইপ (বর্ণনামূলক বা নির্দেশমূলক) এর উপর ভিত্তি করে তৈরি হয়, তখন লিঙ্গ-সম্পর্কিত পক্ষপাতিত্ব (gender-related biases) জেন্ডার-ডিজ্যাপয়েন্টমেন্ট সৃষ্টি করতে এবং আরও শক্তিশালী করতে পারে।

কিছু সংস্কৃতিতে লিঙ্গ সারতত্ত্ব একটি ভূমিকা পালন করতে পারে, তবে এটি সাম্প্রতিক ধারণার সাথে সাংঘর্ষিক যেখানে লিঙ্গকে জৈবিক কারণ (biological factors) এবং পরিবেশগত পরিস্থিতির (environmental circumstances) দ্বারা প্রভাবিত একটি জটিল গঠন হিসেবে দেখা হয়। যদিও পুরুষ ও নারীদের মধ্যে জৈবিক পার্থক্য (biological differences) রয়েছে, এমন কোনো বৈজ্ঞানিক প্রমাণ নেই যে সমস্ত শিশু ঐতিহ্যবাহী দুটি লিঙ্গের মধ্যে পড়ে। তাই পিতামাতার লিঙ্গ (sex) এবং জেন্ডার (gender) এর মধ্যে পার্থক্য সম্পর্কে সচেতন হওয়া উচিত কারণ এই দুটি জীবনের গতিপথে এক নাও হতে পারে।

পিতামাতার বিনিয়োগ তত্ত্ব (The parental investment theory)

বিবর্তন তত্ত্বে (evolutionary theory), পিতামাতার বিনিয়োগ হল এমন যেকোনো ব্যয় যা সন্তানের উপকার করে এবং সম্ভাব্যভাবে তার বেঁচে থাকার সম্ভাবনা বাড়াতে পারে। এর মধ্যে প্রয়োজনীয় এবং অপ্রয়োজনীয় পণ্যের উপর অর্থ ব্যয়, বিভিন্ন কাজের উপর সময় ব্যয় এবং মনোযোগ ও শক্তি ব্যয় অন্তর্ভুক্ত। এটি পিতামাতাকে একটি ব্যয়-সুবিধা বিশ্লেষণ (cost-benefit analysis) করতে এবং তাদের সন্তানদের মধ্যে ব্যয়ের তুলনা করতে বাধ্য করে। গবেষণায় দেখা গেছে যে উদাহরণস্বরূপ ভারতের মতো দেশে, পিতামাতারা তাদের কন্যাদের তুলনায় তাদের পুত্রদের জন্য সময় এবং অর্থের মতো সম্পদ বরাদ্দ করার সম্ভাবনা বেশি, যার ফলে টিকাকরণ (vaccination) এবং স্বাস্থ্যসেবার (healthcare) উন্নত সুবিধা পাওয়া যায়।

ব্যক্তিগত কারণ (Personal Factors)

লিঙ্গ-নিরুৎসাহ (Gender disappointment) শুধুমাত্র উপরে উল্লিখিত সাধারণ তত্ত্বগুলির মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা যায় না। বেশ কয়েকটি ব্যক্তিগত কারণ লিঙ্গের ক্ষেত্রে কমবেশি হতাশাজনক অনুভূতির প্রবণতাকে প্রভাবিত করতে পারে:

  • পিতামাতার বয়স (Parent’s age): ১৯ থেকে ২৫ বছর বয়সী পিতামাতারা লিঙ্গ-নিরুৎসাহ অনুভব করার দিকে বেশি ঝুঁকে থাকেন। বয়স বাড়ার সাথে সাথে, বন্ধ্যাত্বের (infertility) ঝুঁকি বাড়ার কারণে নির্দিষ্ট লিঙ্গের সন্তানের আকাঙ্ক্ষার চেয়ে তাদের সন্তান ধারণের আকাঙ্ক্ষা বেশি হয়।
  • পিতামাতার লিঙ্গ (Parent’s gender): হরমোনের মাত্রার অস্থিরতার কারণে মহিলারা লিঙ্গ-নিরুৎসাহ বেশি অনুভব করেন, যা প্রসব-পরবর্তী বিষণ্ণতা (postpartum depression) এর মতো অন্যান্য মানসিক রোগেরও কারণ হতে পারে।
  • পিতামাতার ব্যক্তিত্ব (Parent’s personality): পিতামাতার ব্যক্তিত্বের বৈশিষ্ট্যের সাথে লিঙ্গ-নিরুৎসাহের একটি স্পষ্ট সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে। “বিগ ফাইভ পার্সোনালিটি ট্রেইটস” (The Big Five Personality traits) এর মনস্তাত্ত্বিক তত্ত্বের সাথে সম্পর্কিত, গবেষণা থেকে জানা যায় যে স্নায়ুবিকতা (Neuroticism), বহির্মুখিতা (Extraversion) এবং কর্তব্যপরায়ণতা (Conscientiousness) লিঙ্গ-নিরুৎসাহের মডারেটর। উদাহরণস্বরূপ, বহির্মুখী লোকেরা মিশুক হন এবং এমন একটি লিঙ্গের প্রত্যাশা করেন যা তাদের আরও বেশি মনোযোগ এনে দেবে। যদি এমনটা না হয় তবে তারা হতাশ হবেন। কর্তব্যপরায়ণ ব্যক্তিরা, উদাহরণস্বরূপ, পরিকল্পনা করতে এবং আগে থেকে ভাবতে পছন্দ করেন: অপ্রত্যাশিত লিঙ্গের সন্তান জন্ম নিলে এর ফলে হতাশা সৃষ্টি হতে পারে।

সমাধান এবং চিকিৎসা (Solutions and Treatment)

জেন্ডার-ডিজ্যাপয়েন্টমেন্ট মোকাবেলা ব্যক্তিগত পর্যায়ে এবং পেশাদার সহায়তার মাধ্যমে করা যেতে পারে। শেষ পর্যন্ত, সামাজিক পর্যায়ে দীর্ঘমেয়াদী সমাধান খোঁজা উচিত।

  • ব্যক্তিগত পর্যায় (Personal level): গোষ্ঠীগতভাবে বা ব্যক্তিগতভাবে, জেন্ডার-ডিজ্যাপয়েন্টমেন্ট থেকে উদ্ভূত নেতিবাচক আবেগ প্রকাশ এবং ভাগ করে নেওয়া, লজ্জার অনুভূতি কমাতে সাহায্য করতে পারে।
  • পেশাদার সহায়তা (Professional help): জেন্ডার-ডিজ্যাপয়েন্টমেন্টের ক্ষেত্রে পেশাদার চিকিৎসা সাধারণত কাউন্সেলিংয়ের (counseling) মাধ্যমে হয়ে থাকে যা পিতামাতাকে বুঝতে সাহায্য করে যে তাদের সন্তানের লিঙ্গ তাদের অভিভাবকত্বের অভিজ্ঞতা নির্ধারণ করে না। একদিকে যেকোনো মানসিক রোগের সাথে আসা বিষয়নিষ্ঠতার মাত্রা এবং অন্যদিকে বিদ্যমান সামাজিক কুসংস্কারের কারণে এটি কিছু অনন্য চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়। ফলস্বরূপ, লিঙ্গ-নিরুৎসাহের চিকিৎসা সবসময় সহজে পাওয়া যায় না।
  • সামাজিক পর্যায় (Social level): বেশিরভাগ গবেষণায় ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে যে দীর্ঘমেয়াদী সমাধান ব্যক্তিগত পর্যায়ে নয়, বরং সামাজিক পর্যায়ে খুঁজে পাওয়া যায়। তারা জোর দেয় যে সমাজে লিঙ্গবাদকে (sexism) একটি সামাজিক ব্যাধি হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া উচিত এবং লিঙ্গবৈষম্যমূলক সামাজিক কাঠামো ভেঙে দেওয়া উচিত।

পুত্রসন্তানের প্রতি পক্ষপাতিত্ব (Son Preference)

পুত্রসন্তানের প্রতি পক্ষপাতিত্ব হলো প্রাচীন এবং বিভিন্ন সংস্কৃতিতে প্রচলিত একটি মানবিক প্রবণতা, যেখানে মানুষ কন্যা সন্তানের তুলনায় পুত্র সন্তান বেশি পছন্দ করে। রাজপরিবারের উত্তরাধিকার আইন থেকে শুরু করে কৃষক পরিবারের জমি বণ্টন পর্যন্ত, সকল সামাজিক শ্রেণীতেই পুত্রসন্তানের প্রতি এই পক্ষপাতিত্ব দেখা যায়। পুত্রসন্তানকে একইসাথে সামাজিক মর্যাদা এবং বংশগত ও অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতামূলক সুবিধার প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

পুত্রসন্তানের প্রতি পক্ষপাতিত্ব জন্মহার এবং এর মাধ্যমে জনসংখ্যা বৃদ্ধিতে প্রভাব ফেলতে পারে। পিতামাতারা তাদের কাঙ্ক্ষিত সংখ্যক পুত্র সন্তান না হওয়া পর্যন্ত সন্তান জন্ম দিতে থাকেন; কন্যা সন্তানের ক্ষেত্রে এমন আচরণ দেখা যায় না। দেখা গেছে যে, পুত্র সন্তান আছে এমন পরিবারগুলোতে “বৈবাহিক স্থিতিশীলতা এবং বৈবাহিক সন্তুষ্টি” (marital stability and marital satisfaction) এর মাত্রা বেশি থাকে এবং পুত্র সন্তানের উপস্থিতি সন্তান পালনে পিতার সম্পৃক্ততা বাড়াতে পারে। একবিংশ শতাব্দীতে, দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়ায় পুত্রসন্তানের প্রতি পক্ষপাতিত্ব ব্যাপকভাবে নথিভুক্ত করা হয়েছে, তবে পশ্চিমা দেশগুলোতেও এটি লক্ষ্য করা যায়।

নাইজেরিয়ার ইগবো (Igbo) সম্প্রদায়ের ঐতিহ্য এর একটি উদাহরণ: “একজন পুরুষের মর্যাদা আংশিকভাবে তার কতজন পুত্র আছে তার দ্বারা মূল্যায়ন করা হয়। অনেক পুত্র আছে এমন একজন পুরুষকে ধনী বা সফল মানুষ হিসেবে দেখা হয়।” যে ইগবো পুরুষরা পুত্র সন্তান ছাড়াই মারা যায়, তাদেরকে “অপূর্ণ বা বেমানান” (unaccomplished or a misfit) হিসেবে দেখা হয় এবং তাদের আনুষ্ঠানিক দ্বিতীয় দাফন করা হয় না।

পুত্রসন্তানের প্রতি পক্ষপাতিত্ব সাংস্কৃতিকভাবে মধ্যস্থতাকৃত এবং এর প্রকাশ পরিস্থিতির সাথে পরিবর্তিত হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, জার্মানিতে আসা তুর্কি অভিবাসীদের “পরবর্তী প্রজন্মগুলোতে” (subsequent generations) পুত্রসন্তানের প্রতি পক্ষপাতিত্বের প্রকাশ হ্রাস পেয়েছে। এছাড়াও, গবেষকরা দেখেছেন যে, “লিঙ্গ নিরপেক্ষতা” (gender indifference) বৃদ্ধি এবং পুত্রসন্তানের প্রতি পক্ষপাতিত্ব হ্রাস (যেমন ১৯৯০ সাল থেকে তাইওয়ানে নথিভুক্ত করা হয়েছে) মায়ের শিক্ষার স্তরের সাথে সম্পর্কযুক্ত হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রে এশীয় অভিবাসী পরিবারগুলোতে, একই দেশের দম্পতিদের মধ্যে এবং মিশ্র বংশোদ্ভূত বিবাহের ক্ষেত্রে (যেখানে পুরুষ সঙ্গী অভিবাসী) পুত্রসন্তানের প্রতি পক্ষপাতিত্ব বেশি।

পুত্রসন্তানের প্রতি পক্ষপাতিত্ব লিঙ্গ নির্বাচন অনুশীলনের কারণ হতে পারে। যেসব সমাজে পুত্রসন্তানের প্রতি প্রবল পক্ষপাতিত্ব রয়েছে, সেখানে কন্যা সন্তানের জন্ম জেন্ডার-ডিজ্যাপয়েন্টমেন্টে (gender disappointment) পরিণত হতে পারে। কন্যা সন্তানের প্রতি পক্ষপাতিত্ব বা পুত্রসন্তানের প্রতি পক্ষপাতিত্ব কখনও কখনও পছন্দের লিঙ্গের সন্তানের জন্য পরিবারের বেশি বিনিয়োগের মাধ্যমে প্রকাশ পায়।

তথ্যসূত্র –

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.