সিরিয়ায় আক্রমণ করলো ইসরায়েল

ভূমিকা

সপ্তাহান্তে সকলের নজর ছিল সিরিয়ার পশ্চিম উপকূলের দিকে, যেখানে বিদ্রোহীরা হামা (Hama) থেকে দামেস্ক (Damascus) পর্যন্ত এম৫ (M5) মহাসড়ক ধরে অগ্রসর হচ্ছিল। তবে একই সময়ে, দেশের দক্ষিণাংশেও গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলী ঘটছিল। সেখানে ইসরায়েলি বাহিনী (Israeli Forces) গোলান হাইটস (Golan Heights) এলাকা থেকে অগ্রসর হয়ে আগে জাতিসংঘ প্রশাসিত একটি বাফার জোন (UN administered buffer zone) অতিক্রম করে কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলো দখল করে নেয়। বিশেষ করে তারা মাউন্ট হারমনের (Mount Hermon) আশপাশের অঞ্চল এবং সম্ভবত উত্তরদিকে কাটানা (Katana) শহর পর্যন্ত এগিয়েছে, যা দামেস্ক শহর থেকে মাত্র ২০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এই আর্টিকেলে ইসরায়েলের এই সিরিয়া আক্রমণ, এর পেছনের প্রেরণা এবং পরবর্তী পরিস্থিতি কী হতে পারে তা বিশ্লেষণ করা হবে।

ইতিহাসগত প্রেক্ষাপট

এই ঘটনার শিকড় একেবারে ১৯৬৭ সালের ছয় দিনের যুদ্ধে (Six Day War)। সেই যুদ্ধে ইসরায়েল মিশরের সাথে যুদ্ধে জড়ায়। যুদ্ধের প্রত্যক্ষ কারণ ছিল মিশরের দ্বারা টাইরান প্রণালী (Strait of Tiran) ইসরায়েলি জাহাজ চলাচলের জন্য বন্ধ করে দেওয়া। তবে ইসরায়েল এবং এর আরব প্রতিবেশীদের মধ্যে উত্তেজনা আগেই বাড়ছিল, মূলত ফিলিস্তিনি সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো প্রতিবেশী দেশগুলোর ভূখণ্ড ব্যবহার করে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে অভিযান চালানোর কারণে। ১৯৬৭ সালের যুদ্ধ শেষ হয় ইসরায়েলের নিরঙ্কুশ জয়ের মাধ্যমে। ইসরায়েল তখন মিশরের কাছ থেকে সিনাই উপদ্বীপ (Sinai Peninsula) ও গাজা উপত্যকা (Gaza Strip), জর্দানের (Jordan) কাছ থেকে পশ্চিম তীর (West Bank) ও জেরুজালেমের পুরাতন শহর (Old City of Jerusalem), এবং সিরিয়ার (Syria) কাছ থেকে গোলান হাইটস দখল করে।

ইসরায়েল যুদ্ধের শেষ দিনগুলোতে গোলান হাইটস দখল করে। এর কারণ ছিল এর কৌশলগত গুরুত্ব। যুদ্ধের সময় সিরিয়ান বাহিনী এই উঁচু মালভূমি ব্যবহার করে নিচে হুলা ভ্যালি (Hula Valley) অঞ্চলে অবস্থিত ইসরায়েলি গ্রামগুলোতে গোলাবর্ষণ করেছিল। ইসরায়েল মনে করতো যে গোলান হাইটস দখল না রাখলে ভবিষ্যতে তারা আবারও শেলিং-এর সম্মুখীন হতে পারে। অঞ্চলটির ভৌগলিক বৈশিষ্ট্য বুঝতে টোপোগ্রাফিক মানচিত্র (topographical map) দেখা দরকার। গোলান হাইটস একটি উচ্চ মালভূমির মতো, যা গ্যালিলি সাগরের (Sea of Galilee) উপরে অবস্থিত। গোলান হাইটস-এর উত্তরে আছে মাউন্ট হারমোন (Mount Hermon), যা এন্টি-লেবানন (Anti Lebanon) পর্বতমালার শেষ প্রান্তের একটি পর্বত, এবং এটি এই আলোচনায় পরে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে।

গোলান হাইটস দখল রাখার ফলে যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে ইসরায়েলের কূটনৈতিক অবস্থান শক্তিশালী হয় এবং ইসরায়েল জর্দান নদীর (Jordan River) উপনদী বানিয়া স্প্রিং (Banya Spring)-এর প্রবাহ নিশ্চিত করতে পারে।

১৯৭৩ সালে ইয়ম কিপুর যুদ্ধ (Yom Kippur War)-এ সিরিয়া হঠাৎ করে গোলান হাইটসে ব্যাপক আক্রমণ চালায়, একই সময়ে মিশর সিনাই উপদ্বীপে ইসরায়েলের ওপর হামলা চালায়। যুদ্ধের প্রাথমিক পর্যায়ে সিরিয়া কিছুটা অগ্রগতি অর্জন করলেও, ইসরায়েল পাল্টা আক্রমণে সফল হয় এবং ১৯৬৭ সালের তুলনায় আরও বেশি গোলান হাইটস এলাকা দখল করে।

ইয়ম কিপুর যুদ্ধের পর জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় ১৯৭৪ সালের একটি বিচ্ছিন্নকরণ চুক্তি (1974 Agreement on Disengagement) স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তি অনুযায়ী ইসরায়েল অল্প কিছু এলাকা থেকে সরে গিয়ে একটি ছোট বাফার জোন তৈরি করে, যা ইসরায়েল-অধিকৃত গোলান হাইটস এবং সিরিয়ার বাকি অংশের মধ্যে অন্তরায় হিসেবে কাজ করে। এই বাফার জোন খুবই ক্ষুদ্র, কোথাও কোথাও মাত্র এক কিলোমিটার চওড়া, এবং এটি জাতিসংঘের নেতৃত্বাধীন শান্তিরক্ষী বাহিনী এনডিএএফ (NDAF)-এর নিয়ন্ত্রণে ছিল।

১৯৮১ সালে ইসরায়েল একতরফাভাবে গোলান হাইটসকে ইসরায়েলের অংশ হিসাবে ঘোষণা করে (annexed), তবে এই দখল প্রক্রিয়া আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন বলে বিবেচিত এবং শুধু যুক্তরাষ্ট্র (US) এটি স্বীকৃতি দেয়। বিগত ৫০ বছর ধরেই এই পরিস্থিতি ছিল স্বাভাবিক চিত্র – ইসরায়েল গোলান হাইটসকে কার্যত নিয়ন্ত্রণ করে এবং জাতিসংঘ একটি ক্ষুদ্র বাফার জোন পরিচালনা করে আসছিল।

আসাদের পতনের পরবর্তী পরিবর্তন

তবে আসাদ (Assad) ক্ষমতা হারানোর পর, ইসরায়েল এই বর্তমান অবস্থান বদলাতে উদ্যত হয়েছে। রবিবার ভোরে, আসাদ রাশিয়ায় পালিয়ে যাওয়ার একদিনেরও কম সময়ের মধ্যে, ইসরায়েলি স্থলবাহিনী (IDF – Israeli Defense Forces) জাতিসংঘ বাফার জোনে প্রবেশ করে, লেবানন (Lebanon) সীমানা ঘেঁষে উত্তর দিকে মাউন্ট হারমোনের দিকে অগ্রসর হয়। মঙ্গলবার সকালে এই লেখা পর্যন্ত, ইসরায়েলি ডিফেন্স ফোর্স (IDF) এখনও অগ্রসর হচ্ছে, এবং বিচ্ছিন্ন কিছু প্রতিবেদনে জানা গেছে যে ইসরায়েলি ট্যাংক কাটানা শহরের উপকণ্ঠে পৌঁছেছে। কাটানা মাউন্ট হারমোনের পাদদেশে অবস্থিত, জাতিসংঘের বাফার জোনের বাইরে, এবং দামেস্ক থেকে মাত্র ২০ কিলোমিটার দূরে।

এই অগ্রযাত্রার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ইসরায়েল পুরো সিরিয়া জুড়ে বিমান হামলা (airstrikes) চালিয়েছে, যার ফলে সিরিয়ার প্রায় সকল বিমান ও নৌযান ধ্বংস হয়েছে। এছাড়াও কিছু রাসায়নিক অস্ত্র (chemical weapons)-কেন্দ্র লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে। ইসরায়েল দাবি করেছে যে এই হামলা ছিল উগ্রপন্থীদের হাতে এই অস্ত্র চলে যাওয়া ঠেকানোর জন্য। অবশ্য সিরিয়ায় ইসরায়েলি হামলা নতুন কিছু নয়। ইসরায়েল বহু বছর ধরেই ইরান (Iran) ও হেজবোল্লাহ (Hezbollah)-র সাথে যুক্ত লক্ষ্যবস্তুর ওপর হামলা চালিয়ে আসছে। তবে এবার হামলার ব্যাপ্তি ছিল নজিরবিহীন। এতে ১০০টিরও বেশি হামলা করা হয়, এবং আইডিএফ একে ইসরায়েলের ইতিহাসের সর্ববৃহৎ বিমান অভিযান বলে অভিহিত করেছে।

ইসরায়েলের এ পদক্ষেপের কারণ কী?

ইসরায়েলি সরকারের দাবি, সিরিয়ান সেনাবাহিনী তাদের অবস্থান ত্যাগ করায় ইসরায়েল এখন আরও অরক্ষিত হয়ে পড়েছে, আর এটি কার্যত ১৯৭৪ সালের যুদ্ধবিরতি (ceasefire) চুক্তিকে বাতিল করে তুলেছে। এছাড়াও ইসরায়েল পরোক্ষভাবে বিদ্রোহীদের “উগ্রবাদী (extremists)” বলে বর্ণনা করেছে। এইচটিএস (HTS – Hay’at Tahrir al-Sham) নামে প্রধান বিদ্রোহী গোষ্ঠীটি ক্ষমতায় এলে ইসরায়েলের সাথে তাদের সম্পর্ক যে মসৃণ হবে না, এমন ধারণা করা যাচ্ছে। কেননা, এইচটিএস হলো একটি জিহাদি দল, যার নেতার ছদ্মনাম (nom de guerre) সরাসরি গোলান হাইটসের প্রতি ইঙ্গিত করে। তাছাড়া এইচটিএস-এর প্রধান আন্তর্জাতিক পৃষ্ঠপোষক তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যিপ এরদোগান (Recep Erdogan), যিনি অক্টোবর ৭ তারিখের পর থেকে ইসরায়েলের অন্যতম সমালোচক।

এছাড়া ইসরায়েলি সরকার যুক্তি দিতে পারে যে, লেবানন-সিরিয়া সীমান্ত বরাবর আরও এলাকা দখলের মাধ্যমে তারা দক্ষিণ লেবাননে হেজবোল্লাহকে সরবরাহের পথ বন্ধ করতে পারবে। কিন্তু আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এই যুক্তিগুলো বিশেষভাবে গ্রহণ করছে না।

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া

জাতিসংঘ মনে করে না যে ১৯৭৪ সালের চুক্তি বাতিল হয়ে গেছে। তাই তারা ইসরায়েলের এই অগ্রযাত্রাকে আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন বলে অভিহিত করেছে। অন্যদিকে, এইচটিএস এখন পর্যন্ত ইসরায়েল আক্রমণ সম্পর্কে কিছু বলেনি, এবং বাস্তবিকভাবেও তাদের পক্ষে ইসরায়েল আক্রমণ করা খুব একটা সম্ভব নয়। আর হেজবোল্লাহর সরবরাহ রুট নিয়ে যে যুক্তি ইসরায়েল দিয়েছে তা-ও নড়বড়ে, কারণ আসাদ ক্ষমতা হারানোর পর সরবরাহ লাইন এমনিতেই বিপদে আছে। তাছাড়া এই পথ মাউন্ট হারমোন হয়ে গিয়েছে এমনও নয়, কারণ এলাকা ভৌগোলিকভাবে এমন পথে ছিল না।

পরবর্তী পরিস্থিতি কী হতে পারে?

“এক্স (X)” নামক সামাজিক মাধ্যমে দেওয়া এক বিবৃতিতে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু (Benjamin Netanyahu) বলেছেন, এই অনুপ্রবেশ সাময়িক (temporary) একটি প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা, যতক্ষণ না একটি উপযুক্ত চুক্তি বা বন্দোবস্ত পাওয়া যায়। তবে ইসরায়েল সিরিয়ার নতুন এইচটিএস-নেতৃত্বাধীন সরকারের সাথে কি “উপযুক্ত বন্দোবস্ত” করতে পারবে কিনা, সেটাই এখন প্রশ্ন।

উল্লেখ্য, “সাময়িক” (temporary) শব্দটি কিন্তু কোন হিব্রু (Hebrew) ভাষার প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে ব্যবহার করা হয়নি। নেতানিয়াহুর ইংরেজি ভাষার প্রেস বিজ্ঞপ্তিগুলো সাধারণত আন্তর্জাতিক অঙ্গনের জন্য কিছুটা মেপে দেওয়া হয়, কিন্তু তার হিব্রু ভাষার বিবৃতিগুলো বরাবরই ভবিষ্যৎ পদক্ষেপের ভালো নির্দেশক হিসেবে কাজ করে। অতীতে দেখা গেছে হিব্রু ভাষার বিবৃতিগুলোই পরে নীতিগত পদক্ষেপে প্রতিফলিত হয়েছে।

যদি ইসরায়েল স্থায়ীভাবে (permanently) এই নতুন এলাকা দখল করে থাকে, তাহলে তারা মাউন্ট হারমোনে একটি রাডার সিস্টেম (radar system) স্থাপন করতে পারে, যা ইসরায়েলের উত্তরাঞ্চলের আগাম সতর্কীকরণ ব্যবস্থাকে উল্লেখযোগ্যভাবে উন্নত করবে। এটি ইসরায়েলের নিরাপত্তা উদ্বেগ কিছুটা লাঘব করতে পারে, কিন্তু একথাও সত্য যে এটি সিরিয়ায় ইসরায়েলের নতুন প্রতিবেশীদের সাথে সম্পর্ককে জটিল করে তুলবে। এমন একটি নাজুক পরিস্থিতির মধ্যে এটি দেশটিকে আরও অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে, এবং আঞ্চলিক শান্তির সম্ভাবনাকে দুর্বল করে দেবে।

তথ্যসূত্র

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.