Table of Contents
ভূমিকা
গত প্রায় ৪০ বছরে ইরান (Iran) মধ্যপ্রাচ্যে (Middle East) একটি প্রক্সি নেটওয়ার্ক (proxy network) গড়ে তুলেছিল, যার সাহায্যে তারা সরাসরি শাস্তির সম্মুখীন না হয়েই ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পেরেছে। এই নীতি ছিল আশ্চর্যজনকভাবে সফল, এবং পররাষ্ট্র বিশ্লেষকরা (foreign policy analysts) প্রায়ই একটি “ইরান-নেতৃত্বাধীন (Iran-led) প্রতিরোধ অক্ষ” (“axis of resistance”) সম্পর্কে আলোচনা করতেন, যা ইরানের আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বী সৌদি আরবকে (Saudi Arabia) চার দিক থেকে ঘিরে রেখেছিল।
কিন্তু গত এক বছরের মধ্যে এই নেটওয়ার্ক মারাত্মকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছে। হামাস (Hamas) এবং হেজবোল্লাহ (Hezbollah) গাজা (Gaza) এবং দক্ষিণ লেবাননে (Southern Lebanon) ইসরায়েলি (Israeli) অভিযানের ফলে গুরুতরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত (degraded) হয়েছে। আর সাপ্তাহিক ছুটির সময়ে সিরিয়ার (Syria) একনায়ক বাশার আল-আসাদ (Bashar al-Assad) (যিনি ইরানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আঞ্চলিক মিত্রদের (regional ally) একজন) আকস্মিকভাবে ক্ষমতাচ্যুত (ousted) হয়েছেন। এই আর্টিকেলে আমরা বিশ্লেষণ করবো ইরানের এই কৌশলগত সংকট (strategic crisis) কীভাবে তাদের পূর্ব-বিদ্যমান অভ্যন্তরীণ সমস্যাগুলোকে আরও জটিল করে তুলছে এবং ভবিষ্যতে কী ঘটতে পারে।
প্রেক্ষাপট
ইরান দীর্ঘদিন ধরেই তথাকথিত “প্রক্সি” (proxy) গোষ্ঠীর ওপর নির্ভর করে মধ্যপ্রাচ্যে ক্ষমতা ও প্রভাব বিস্তার করে আসছে। এই প্রক্সিগুলো মূলত অ-রাষ্ট্রীয় সশস্ত্র গোষ্ঠী (non-state actors or militias) যারা ইরানের সহায়তার ওপর নির্ভরশীল। ফলে কার্যত তারা ইরানের নিয়ন্ত্রণাধীনে থাকে।
এই নীতির বিকাশ ঘটে ৮০’র দশকে ইরানের ইসলামি বিপ্লবের (Islamic Revolution) পর মাত্র কয়েক বছরের মাথায়। তখন ইরান ইসরায়েলের (ইরানের চিরশত্রু বা arch-nemesis) বিরুদ্ধে হেজবোল্লাহকে সমর্থন দিতে শুরু করে, বিশেষ করে যখন ইসরায়েল ডিফেন্স ফোর্স (IDF – Israeli Defense Forces) দক্ষিণ লেবানন দখল করে। ইরানের এই ঝুঁকি সুফল দিয়েছিল। হেজবোল্লাহ অবিরাম ও ব্যয়বহুল গেরিলা যুদ্ধ (guerrilla war) চালিয়ে ইসরায়েলি বাহিনীকে ২০০০ সালে ওই অঞ্চল থেকে সরে যেতে বাধ্য করে। এরপর হেজবোল্লাহ কেবল দক্ষিণ লেবাননে একটি “ডি ফ্যাক্টো (de facto)” সরকার হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেনি, বরং লেবাননের (Lebanon) রাজনীতিতেও একটি প্রভাবশালী শক্তিতে পরিণত হয়।
হেজবোল্লাহর সাফল্য ইরানের শাসকদের তাদের প্রক্সি নেটওয়ার্ককে আরো সম্প্রসারিত করতে উৎসাহিত করে। এজন্য তারা ভূ-রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতাকে কাজে লাগায়। ২০০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র-নেতৃত্বাধীন আক্রমণে (US-led invasion) ইরাক (Iraq) বিশৃঙ্খলায় ডুবে গেলে ইরান কিছু ইরান-পন্থী মিলিশিয়াকে (Iran-aligned militias) সমর্থন দিতে শুরু করে। এর মাধ্যমে তারা এমন এক প্রক্সি নেটওয়ার্ক তৈরি করে যা এখনো ইরাকি রাজনীতিতে কর্তৃত্ব করছে।
২০১০-এর দশকে ইরান ইয়েমেনে একই কৌশল প্রয়োগ করে। সৌদি আরব-নেতৃত্বাধীন জোটের বিরুদ্ধে হুথি (Houthi) বিদ্রোহীদের সমর্থন দেয়। আসাদ (Assad) যদিও হেজবোল্লাহর মত প্রক্সি নয়, তবু ২০১১ সালের আরব বসন্তের (Arab Spring) পর তার শাসন টিকিয়ে রাখতে ইরান যে বিশাল সহায়তা দিয়েছিল, তা সিরিয়াকে ইরানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আঞ্চলিক মিত্রে পরিণত করে। এছাড়া সিরিয়া ইরানের জন্য স্থলপথে সরবরাহ করিডোর (land corridor) হিসেবে কাজ করতো, যা লেবাননে হেজবোল্লাহ আর গাজায় হামাসকে সহায়তা দিত।
প্রক্সি নেটওয়ার্ক কেন কার্যকর ছিল
এই প্রক্সিগুলো যে এত ফলপ্রসূ ছিল, তার অন্তত দুটি প্রধান কারণ রয়েছে। প্রথমত, এগুলো সস্তা। ইরান বর্তমানে ধনী দেশ নয়; গত দশকে এর মাথাপিছু জিডিপি (GDP per capita) কমে গেছে। তাই পুরো মধ্যপ্রাচ্যে স্থায়ী সেনা মোতায়েন করার সামর্থ্য তাদের নেই। কিন্তু প্রক্সির মাধ্যমে ইরান তুলনামূলক কম খরচে আঞ্চলিক ক্ষমতা ও প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছে।
দ্বিতীয়ত, এসব প্রক্সি ইরানকে একটি “সম্ভাব্য অস্বীকারযোগ্যতার” (plausible deniability) সুযোগ দেয়, অর্থাৎ এর মাধ্যমে ইরান দাবি করতে পারে যে তারা কোন কিছুতে জড়িত নয়। ইরান জানে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে পূর্ণ মাত্রার যুদ্ধে জড়ানো তাদের পক্ষে অসম্ভব। কিন্তু প্রক্সির মাধ্যমে ইরান তাদের আঞ্চলিক শত্রুদের মাঝে মাঝে “রক্তাক্ত আঘাত” হানতে পারে, তাও আবার এমনভাবে যে ইরানের ওপর সরাসরি পাল্টা আক্রমণ ন্যস্ত করতে অসুবিধা হয়। যেমন, ইরান-সমর্থিত মিলিশিয়ারা গত এক বছর ধরে ইরাকে নিয়মিতভাবে মার্কিন সেনাদের উত্ত্যক্ত করছে। কিন্তু এটি যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ইরানের ওপর সরাসরি পাল্টা জবাবের যৌক্তিকতা গড়ে তুলতে যথেষ্ট হয়নি, কারণ ইরান সবসময় দায় দোষ প্রক্সির ওপর চাপাতে পারে।
প্রক্সি নেটওয়ার্কের সাম্প্রতিক বিপর্যয়
দুর্ভাগ্যজনকভাবে ইরানের জন্য, বিগত কয়েক মাসে এর প্রক্সি নেটওয়ার্ক কঠিন সময়ের মুখোমুখি হয়েছে। সবচেয়ে স্পষ্ট উদাহরণ হল হামাস। ৭ অক্টোবর ২০২৩ সালের হামলার পর থেকে গাজায় হামাস টানা আক্রমণের মুখে পড়েছে। কতগুলো হামাস ব্যাটালিয়ন এখনও সক্রিয় সে বিষয়ে মতভেদ থাকলেও, তাদের অধিকাংশ নেতৃত্ব নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। এছাড়া জনমত জরিপ ইঙ্গিত করছে যে হামাস গাজার অভ্যন্তরীণ জনপ্রিয়তা হারাচ্ছে।
ফিলিস্তিনি জনমতের ওপর পরিচালিত “প্যালেস্তিনিয়ান সেন্টার ফর পলিসি অ্যান্ড সার্ভে রিসার্চ” (Palestinian Center for Policy and Survey Research) দ্বারা সেপ্টেম্বর মাসের জরিপ অনুসারে, যদি গাজায় এখনই নির্বাচন হয়, তবে মাত্র ২৯% ফিলিস্তিনি হামাসকে ভোট দেবে, যেখানে এক বছর আগে এই হার ছিল ৪১%। আর এখন গাজার অধিকাংশ ফিলিস্তিনি মনে করে হামাস ৭ অক্টোবরের হামলা চালিয়ে ভুল করেছে, যেখানে গত মার্চে (March) এই মত ছিল মাত্র ২৩% এর। একইভাবে, গাজার ফিলিস্তিনিদের মধ্যে মাত্র ২৮% মনে করে হামাস এই যুদ্ধে জয়ী হবে (আগে ৫৬%), এবং ৪০% এখন চুক্তির ভিত্তিতে সমাধানের পক্ষে (আগে ২৩%)।
হামাস পরবর্তী সময়ে অন্য কোনো গাজাভিত্তিক সশস্ত্র গোষ্ঠী দ্বারা প্রতিস্থাপিত হলেও, সেই নতুন গোষ্ঠী ইরানের প্রতি খুব সম্ভবত সহানুভূতিশীল হবে না। কেননা ৭ অক্টোবরের পর থেকে হামাসকে ইরান তেমন কার্যকর সহায়তা দিতে পারেনি, যা তাদের সুনাম ক্ষুণ্ন করেছে।
হেজবোল্লাহর ক্ষেত্রেও (Hezbollah) প্রায় একই চিত্র দেখা যায়। হেজবোল্লাহ এখনো নিশ্চিহ্ন হয়নি, তাদের হাতে ৫ অঙ্কের ঘরে যোদ্ধা আছে, কিন্তু তাদের নেতৃত্বের একটা বড় অংশ নির্মূল হয়ে গেছে। ইসরায়েলের সাথে সাম্প্রতিক যুদ্ধও (war with Israel) হেজবোল্লাহর জন্য খুব একটা ফলপ্রসূ হয়নি। উপরন্তু, আসাদ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার ফলে (ousting of Assad) হেজবোল্লাহ অতীতের মত সহজে সিরিয়া হয়ে সরবরাহ পাবে না। আগে ইরান সিরিয়া পথ ধরে (land corridor) সরবরাহ পাঠাত, এখন সেই পথ আর আগের মত নিশ্চিত নয়।
ফলে, গত এক বছরে ইরানের সবচেয়ে বড় দুটি প্রক্সি—হামাস ও হেজবোল্লাহ—সংকটাপন্ন হয়েছে, এবং তাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আঞ্চলিক মিত্র আসাদ ক্ষমতা হারিয়েছেন। এর ফলে ইরানের হাতে এখন মূলত ইরাকের মিলিশিয়া (Iraqi militias) আর ইয়েমেনের হুথি (Houthi) বিদ্রোহীরাই থাকে। কিন্তু এখানেও কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে।
প্রথমত, প্রায় দুই দশক ধরে ইরাকের ওপর ইরানের প্রভাব সাধারণ ইরাকিদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। ২০১৯ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে আমরা ইরাকে ইরান-বিরোধী বিশাল বিক্ষোভ (anti-Iran protests) দেখেছি।
দ্বিতীয়ত, হুথিরা অনেক বিশ্লেষকের মতে ইরানের “প্রক্সি” না হয়ে বরং “মিত্র” (ally) বা “অংশীদার” (partner) হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। ইরানের কাছ থেকে সহায়তা পেলেও, এই গোষ্ঠী ২০১০-এর দশক থেকে ইরানের সহায়তা পায় এবং তার আগেও (১৯৯০-এর দশক থেকে) ইয়েমেনের সুন্নি-নিয়ন্ত্রিত সরকারের সঙ্গে অনবরত লড়াই করে আসছে। হুথিদের আর্থিক স্বচ্ছলতাও বেশি, কারণ তারা ইয়েমেনের অধিকাংশ জনবহুল এলাকাগুলো নিয়ন্ত্রণ করে, যেখানে তারা যথেষ্ট পরিমাণে কর (tax) আদায় করতে পারে। পাশাপাশি কিছু তেল ও গ্যাসক্ষেত্র (oil and gas fields) থেকেও তারা উপার্জন করে। ফলে তারা অন্য ইরান-নিয়ন্ত্রিত গোষ্ঠীগুলোর মত সম্পূর্ণ নির্ভরশীল নয়।
সব মিলিয়ে, ইরানের প্রক্সি নেটওয়ার্ক কার্যত সাময়িকভাবে ভেঙে পড়েছে বলে মনে করা যেতে পারে, যা ইরানকে আগের চেয়ে অনেক বেশি দুর্বল অবস্থানে নিয়ে গেছে।
দেশীয় সংকটের ওপর বিদেশনীতি সংকটের সংযোজন
বিদেশনীতি ক্ষেত্রে এই সংকট ইরানের অন্তর্নিহিত অভ্যন্তরীণ সংকটগুলোকে আরও বাড়িয়ে তুলছে। দেশে ইতোমধ্যে চলমান অর্থনৈতিক সংকট (economic crisis) রয়েছে, যা সম্ভবত নতুন মার্কিন নিষেধাজ্ঞার (US sanctions) মাধ্যমে আরও খারাপ হবে, বিশেষ করে আসন্ন ট্রাম্প প্রশাসন (incoming Trump administration) যদি নতুন করে কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে।
এছাড়া ইরান শিগগিরই একটি নেতৃত্ব বদলের সংকটের (looming succession crisis) মুখোমুখি হচ্ছে। বর্তমান সর্বোচ্চ নেতা আয়াতোল্লাহ আলী খামেনি (Ayatollah Ali Khamenei) এখন প্রায় ৮৫ বছর বয়সী, এবং তার পরবর্তী উত্তরাধিকারী স্পষ্ট নয়। কারণ বর্তমান শাসকগোষ্ঠী সাধারণ মানুষের মধ্যে অত্যন্ত অজনপ্রিয়।
রাইভালদের অবস্থান
এখানে স্পষ্ট করে বলার দরকার যে, ইরান দুর্বল হচ্ছে মানেই এর প্রতিদ্বন্দ্বীরা জয়ী হচ্ছে তা নয়। ইসরায়েলের আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি গাজা যুদ্ধের (war in Gaza) কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, আর যুক্তরাষ্ট্র (US) স্পষ্টতই তার বহুমুখী পররাষ্ট্রনীতি লক্ষ্যগুলোকে সামঞ্জস্য করতে হিমশিম খাচ্ছে।
এছাড়া এটা বলা প্রয়োজন, আয়াতোল্লাহদের তাদের প্রতিপক্ষের ভুলগুলো কাজে লাগানোর দীর্ঘদিনের একটি সাফল্যের ইতিহাস রয়েছে—হোক সেটা ২০০৩ সালে ইরাকে মার্কিন ভুল বা ‘৮০’র দশকে দক্ষিণ লেবাননে ইসরায়েলের ভুল। তাই দীর্ঘমেয়াদে এগুলোকে পুরোপুরি গণনা থেকে বাদ দেওয়া নির্বুদ্ধিতা হবে। তবুও, বর্তমান অবস্থায় ইরান স্পষ্টতই দুর্বল এবং সামনে ইরানের শাসকদের কঠিন কয়েকটি বছর অপেক্ষা করছে।
Leave a Reply