রাশিয়া ও ইউক্রেইন সংবাদ

Table of Contents

ঐতিহাসিক বিরোধ নিরসনে ইউক্রেন ও পোল্যান্ডের অগ্রগতি (সংক্ষিপ্ত) (১৬ জানুয়ারি, ২০২৫)

ইউক্রেনের দাবি: রাশিয়ায় দুইজন উত্তর কোরিয়ান সৈন্য আটক (সংক্ষিপ্ত) (১৩ জানুয়ারি, ২০২৫)

ট্রাম্প-পুতিন বৈঠকের সম্ভাবনা (সংক্ষিপ্ত) (১০ জানুয়ারি, ২০২৫)

ইউরোপে রাশিয়ান গ্যাস ট্রাঞ্জিট বন্ধ করল ইউক্রেইন, শীতে তীব্র জ্বালানি সংকটে ইউরোপ (৩ জানুয়ারি, ২০২৫)

ইউরোপে রাশিয়ান গ্যাস যুগের সমাপ্তি (২ জানুয়ারি, ২০২৫)

ইউক্রেনে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন সহায়তা (US aid) – বাইডেন বনাম আসন্ন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প (সংক্ষিপ্ত) (২ জানুয়ারি, ২০২৫)

রাশিয়ায় জেনারেল হত্যার সন্দেহভাজন আটক: ইউক্রেনের সম্পৃক্ততা সন্দেহ (১৮ ডিসেম্বর, ২০২৪)

গতকালের ডেইলি ব্রিফিং (Daily Briefing)-এর মূল খবরের হালনাগাদে জানা যাচ্ছে, রাশিয়া (Russia) বলছে তারা একজন সন্দেহভাজনকে আটক করেছে, যিনি মস্কোতে (Moscow) উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ইগর কুরিলভ (Igor Kurilov)-কে হত্যার দায় স্বীকার করেছেন। মঙ্গলবার এই বোমা হামলার ঘটনায় ইগর কুরিলভ (Igor Kurilov) (যিনি রাশিয়ার (Russia) পারমাণবিক, জীবাণু ও রাসায়নিক প্রতিরক্ষা বাহিনীর প্রধান ছিলেন) তার বাসভবনের বাইরে নিহত হন। একই সাথে তার সহযোগীরাও নিহত হন। একটি ইলেকট্রিক স্কুটারে রাখা বোমাটি বিস্ফোরিত হয়।

ইউক্রেনের এসবিইউ (SBU) গোয়েন্দা সংস্থা এই হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করে। তারা অভিযোগ করে যে রাশিয়া (Russia) ইউক্রেনীয় সৈন্যদের বিরুদ্ধে রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করেছে, যা রাশিয়া (Russia) অস্বীকার করে।

রাশিয়া (Russia) জানায়, সন্দেহভাজন ব্যক্তি ইউক্রেনীয় বিশেষ পরিষেবার (Ukrainian special services) নির্দেশে এই হত্যাকাণ্ড ঘটান। এফএসবি (FSB) – রাশিয়ার গোয়েন্দা সংস্থার প্রকাশিত এক ভিডিওতে এক গম্ভীর চেহারার কৃষ্ণকেশী ব্যক্তি ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে স্বীকারোক্তি দেন যে তাকে ১,০০,০০০ মার্কিন ডলার এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নে (European Union) প্রবেশের সুযোগের বিনিময়ে কুরিলভকে (Kirilov) হত্যার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল।

এফএসবি (FSB) জানায়, ইউক্রেনের (Ukraine) নির্দেশে ওই ব্যক্তি মস্কোতে (Moscow) গিয়েছিলেন এবং সেখানেই একটি হাতে-তৈরি বিস্ফোরক ডিভাইস (homemade explosive device) পান। সেটি তিনি একটি ইলেকট্রিক স্কুটারে স্থাপন করে কুরিলভের (Kirilov) অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিংয়ের প্রবেশমুখে রেখে যান। এরপর তিনি একটি গাড়ি ভাড়া করেন এবং ড্যাশবোর্ডে একটি ক্যামেরা স্থাপন করেন, যা ইউক্রেনের দনিপ্রো (Dnipro) শহরে তার নির্দেশদাতাদের কাছে সরাসরি সম্প্রচার করছিল। এফএসবি (FSB)-র ভাষ্যমতে, যখন তারা দেখল কুরিলভ (Kirilov) বাড়ি থেকে বেরিয়েছেন, তখন ওই ব্যক্তিকে দূরবর্তী নিয়ন্ত্রকের মাধ্যমে বোমা বিস্ফোরণ ঘটানোর নির্দেশ দেওয়া হয়।

রাশিয়া (Russia) এই হত্যাকাণ্ডের জবাব দিতে অঙ্গীকার করেছে। এটি এমন একটি হত্যা, যা রাশিয়ান (Russian) ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের লক্ষ্য করে শত্রুপক্ষের বেশ গভীরে গিয়ে পরিচালিত হয়েছে, এবং ইউক্রেনীয় (Ukrainian) কর্মকর্তাদের লক্ষ্য করে পাল্টা ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে হুমকি দেওয়া হয়েছে। রাশিয়ার (Russia) নিরাপত্তা পরিষদের (Security Council) উপপ্রধান দিমিত্রি মেডভেদেভ (Dmitry Medvedev) নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে যারা আছে তাদের ধ্বংস করার আহ্বান জানিয়েছেন।

তথ্যসূত্র

https://www.reuters.com/world/europe/russia-detains-suspect-over-murder-general-investigative-committee-says-2024-12-18/
https://www.ft.com/content/b3a24ce6-5d1a-4773-b6eb-96f5cf676a6b
https://www.bbc.co.uk/news/articles/cge9rv38x98o

কোরিয়ান মডেল কি ইউক্রেনের জন্য একমাত্র “গ্রহণযোগ্য” সমাধান? (১৮ ডিসেম্বর, ২০২৪)

ভূমিকা

যুদ্ধটা খুব ভয়াবহ ছিল। এমন এক সংঘাত যা বৈশ্বিক মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছিল এবং ইতিহাসকে স্থায়ীভাবে পরিবর্তন করেছিল। এই যুদ্ধে ১০ লক্ষেরও বেশি সৈন্য প্রাণ হারায়, ২০ লক্ষেরও বেশি সাধারণ নাগরিক নিহত হয় এবং মোট দেশটির ৭% জনগোষ্ঠী পৃথিবী থেকে মুছে যায়। তার চেয়েও ভয়ংকর বিষয় হল, এটি ছিল কেবল শুরু – এমন এক দুঃস্বপ্নের শুরু যা লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবনে চিরস্থায়ীভাবে থেকে গেছে, আজ অবধিও শেষ হয়নি। ওই ভূখণ্ডের (Territorial Unit) বিভাজন ঘটে দুটি ভাগে, আর লক্ষ লক্ষ পরিবার চিরতরে আলাদা হয়ে যায়।

মনে করিয়ে দিতে চাই কোরিয়ান উপদ্বীপের (Korean Peninsula) সেই বেদনাদায়ক ইতিহাসের কথা। ৭০ বছরেরও বেশি সময় ধরে এই উপদ্বীপ বিভক্ত রয়েছে দুটি অংশে – পুঁজিবাদী দক্ষিণ (Capitalist South) ও সাম্যবাদী উত্তর (Communist North)। এই দুই রাষ্ট্রের মাঝে রয়েছে একটি সুরক্ষিত সীমান্ত (Fortified Border), যা কাঁটাতার ও ল্যান্ডমাইন (Mines)-এ পূর্ণ, কঠোর প্রহরায় সুরক্ষিত, এবং কার্যত অতিক্রমণযোগ্য নয়। এটি প্রায় অদম্য একটি অসামরিকায়িত অঞ্চল (Demilitarized Zone) – যেখানে উত্তর থেকে হাতে গোনা কয়েকজনই পেরোতে পেরেছেন ভাগ্যগুণে, কিন্তু স্বাধীনতার খোঁজে পাড়ি দিতে গিয়ে অসংখ্য মানুষ তাদের জীবন হারিয়েছে। এই অসামরিকায়িত অঞ্চলের চারপাশে বিশ্বে অন্যতম বৃহৎ সামরিক শক্তির ঘনবসতি রয়েছে।

এখন আপনার মনে প্রশ্ন আসতে পারে: আমরা কেন এই প্রসঙ্গ তুলছি? কেন কোরিয়ার কথা বলছি যখন এই লেখাটি মূলত ইউক্রেনের যুদ্ধ (War in Ukraine) শেষ হওয়ার সম্ভবনাময় উপায় নিয়ে আলোচনা করার কথা? আসলে ইতিহাস হয়তো আবারও নিজেকে পুনরাবৃত্তি করতে যাচ্ছে। ২০০৬ সালে ইসরায়েল (Israel) ও হেজবোল্লাহর (Hezbollah) মধ্যে লেবাননে (Lebanon) এক ধরনের “কোরীয় মডেল” চুক্তির চেষ্টা করা হয়েছিল, যদিও তা সফল হয়নি। কিন্তু এখন যে পথটি প্রস্তাবিত, তা হল ইউক্রেনে যুদ্ধ বন্ধের ক্ষেত্রে একটি “কোরীয় পদ্ধতি” অবলম্বন।

ট্রাম্পের পরিকল্পনা: “কোরিয়ান” মডেল?

ডোনাল্ড ট্রাম্পের (Donald Trump) ঘনিষ্ঠ মহলে শোনা যাচ্ছে যে, তিনি ইউক্রেনের যুদ্ধ বন্ধের জন্য একটি পরিকল্পনা করছেন, যা আংশিকভাবে কোরিয়ান পদ্ধতির অনুরূপ। অর্থাৎ, যুদ্ধ-বরাবর বর্তমানে যে অবস্থানে এলাকা দখল রয়েছে, সেই সীমারেখায় একটি অসামরিকায়িত অঞ্চল (Demilitarized Zone) স্থাপন, যুদ্ধ ‘ফ্রিজ’ করে দেয়া, এবং স্পষ্ট প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা।

সম্পর্কিত দুটো শিরোনাম সংবাদ:

এই প্রথম জেলেনস্কি স্পষ্টভাবে ইঙ্গিত দিয়েছেন যে, একটি যুদ্ধবিরতির (Ceasefire) চুক্তিতে তিনি আপাতত হারানো ভূখণ্ড ফিরে না পেলেও রাজি হতে পারেন – যদি ন্যাটো অন্তর্ভুক্তির পথ সুগম হয়।

ট্রাম্প এই যুদ্ধ শেষ করা নিয়ে বেশ আগ্রহী। তবে ঠিক কী পরিকল্পনা তার হাতে রয়েছে তা স্পষ্ট নয়। তিনি হয়তো ইউক্রেনের প্রতি মার্কিন সহায়তা কমাবেন, রাশিয়ার ওপর কিছু নিষেধাজ্ঞা শিথিল করবেন, কিন্তু এর বেশি কিছু এখনও জানা যায়না। এদিকে ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠরা ইউক্রেনে যুদ্ধ ‘ফ্রিজ’ করে, বর্তমান দখলকৃত সীমান্ত বরাবর একটি অসামরিকায়িত অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করে, প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা (deterrence) গড়ে তুলতে চান বলে গুঞ্জন রয়েছে।

কিন্তু কিভাবে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হতে পারে? এটি কি কোরিয়ার মতো সফল হতে পারবে? ইউক্রেনীয়রা এ বিষয়ে কী ভাবছে? চলুন বিশদে দেখা যাক।

ট্রাম্পের পরিকল্পনা: কোরিয়াকে নকল করা?

কোরিয়া ভ্রমণে গেলে একটি সাধারণ পর্যটনস্থল হল যৌথ নিরাপত্তা এলাকা (Joint Security Area) – যেখানে নীল রঙের হাটগুলোর মধ্যে দিয়ে দক্ষিণ ও উত্তর কোরিয়ার বিভাজন স্পষ্ট। ডোনাল্ড ট্রাম্প এখানে কিম জং-উনের (Kim Jong Un) সঙ্গে প্রথমবার দেখা করেন এবং তিনিই প্রথম মার্কিন প্রেসিডেন্ট যিনি টেকনিকালি উত্তর কোরিয়ার মাটিতে পা রাখেন। এটি কেবলমাত্র ২৪০ কিমি দীর্ঘ সীমান্তের একটি বিন্দু, যা সম্পূর্ণভাবে সুরক্ষিত। এখানে লক্ষ লক্ষ মাইন (Mines) পুঁতে রাখা এবং হাজার হাজার সৈন্য এখানে টহল দেয়।

ট্রাম্পের দল ইউক্রেন-রাশিয়া (Ukraine-Russia) ভবিষ্যতে একই ধরনের চিত্র কল্পনা করছে। এই পরিকল্পনা অনুসারে, অসামরিকায়িত অঞ্চল (Demilitarized Zone) তৈরি হবে ইউক্রেনের বর্তমান দখলকৃত ভূখণ্ডের সীমারেখা বরাবর। সেখানে স্থাপন করা হবে দুর্ভেদ্য সুরক্ষা ব্যবস্থাপনা, টহল, দুর্গ (Fortifications) এবং নজরদারি ব্যবস্থা। এই সীমান্ত হতে পারে ১,২০০ কিমি বা তারও বেশি দীর্ঘ – যা ইউক্রেনকে কার্যত দুটি অংশে ভাগ করে দেবে। সেইসঙ্গে হয়তো পুরো সীমান্তজুড়ে পাতা হবে মাইন (Mines) এবং দুই পক্ষের বিপুল সেনা মোতায়েন করা হবে।

তবে এখানে এক বড় সমস্যা হল: কোরিয়ার ক্ষেত্রে সীমান্ত অপেক্ষাকৃত ছোট, কিন্তু রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে সীমান্ত বিশাল। কেবলমাত্র সীমান্ত সুরক্ষা যথেষ্ট নয়; ইউক্রেনকে একটি দুর্ভেদ্য দুর্গে পরিণত করতে হবে, যাতে রাশিয়া ভবিষ্যতে আবার আক্রমণ করতে না পারে। এমনকি হয়তো আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষী বাহিনী (International Troops) পাঠানোর কথাও ভাবতে হতে পারে। তবে ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ মহল বলছে, “আমেরিকানদের পাঠাব না। বরং পোল, জার্মান, ব্রিটিশ আর ফরাসিদের পাঠাও।” ইউরোপীয়ান (European) সেনা পাঠানো নিয়ে ফ্রান্স-যুক্তরাজ্যের মধ্যে কথাবার্তা চলছে বলে জানা গেছে।

তবে এটি এত সহজ নয়। এটি বাস্তবায়নে ইউরোপীয় দেশগুলোর সম্মতি ও সামর্থ্য প্রয়োজন। হতে পারে পোল্যান্ড (Poland) এ ব্যাপারে আগ্রহী, কারণ তারা বিশাল সামরিক শক্তি গড়ে তুলছে। তবুও, ইউক্রেন ন্যাটোতে না গেলে (অর্থাৎ ন্যাটোর অনুচ্ছেদ ৫ এর সুরক্ষা না পেলে), এই বিদেশি সেনা উপস্থিতি যুদ্ধ ঘটলে সরাসরি ন্যাটোর ওপর আক্রমণ হিসেবে গণ্য হবে না। কাজেই আরও বড় পদক্ষেপ দরকার।

মনে রাখবেন, ইউক্রেনকে প্রকৃতপক্ষে অস্ত্রে সুসজ্জিত (Militarize) করতে হবে – প্রচুর অস্ত্র, সরঞ্জাম ও অর্থ প্রয়োজন হবে, যা হয়তো ইউরোপকেই বহন করতে হবে। ট্রাম্পের ভাবনা হতে পারে – “আমরা যুদ্ধ থামালাম। রাশিয়া দখলকৃত ভূমি রাখল। আমরা ইউক্রেনকে অস্ত্র বিক্রি করব, ইউরোপিয়ানরা বিল দেবে। আমরা ব্যবসাও করব।” এই পরিস্থিতিতে ইউক্রেন দীর্ঘমেয়াদে শৃঙ্খলাপূর্ণ, ভালোভাবে সুরক্ষিত হয়ে বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে পারে। তবে শর্ত হল, যুদ্ধবিরতির পরে আন্তর্জাতিক সাহায্য আসবেই এমন নিশ্চয়তা কে দেবে?

এদিকে মার্কিন রিপাবলিকানরা আগে থেকেই জানিয়ে দিয়েছে যে আপাতত তারা আর বাড়তি সহায়তা দেবে না। কাজেই জেলেনস্কির কাছে হয়তো এই কোরীয় মডেলের সমাধানটাই সব থেকে ভালো বিকল্প।

রাশিয়ার গ্রহণযোগ্যতা

কিন্তু রাশিয়া কেন এই চুক্তি মানবে? বিশেষ করে যদি ট্রাম্প ইতোমধ্যে ইউক্রেনের সহায়তা কমাতে তৈরি থাকেন, তবে তারা কেন পশ্চিমের অধীনে ইউক্রেনকে ছেড়ে দেবে?

আসলে রাশিয়ারও কিছু সুবিধা আছে। যুদ্ধক্ষেত্রে তাদের প্রচুর ক্ষতি হচ্ছে। অর্থনীতিতে ধস নামছে – রাষ্ট্রের বিশাল যুদ্ধ ব্যয়, প্রতিরক্ষা খাতে অতিরিক্ত বিনিয়োগ, মূল্যস্ফীতি (Inflation) ১০% ছাড়িয়েছে, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম ২৫% পর্যন্ত বেড়েছে, রুবলের (Ruble) দরপতন অব্যাহত। এক বছর আগে ৯০ রুবলে ১ ডলার মিলতো, এখন ১০৫ রুবলেরও বেশি লাগছে।

ফলে সরকারকে সুদের হার (Interest Rate) ২১%-এ তুলতে হয়েছে – এটি কয়েক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ। পুতিনের (Putin) জন্য এই পরিস্থিতি টেকসই নয়। যুদ্ধ বন্ধ করে যে ভূখণ্ড দখল হয়েছে তা ধরে রাখলে, পুতিন এটিকে প্রোপাগান্ডা হিসেবে উপস্থাপন করতে পারে: “ইউক্রেন শেষ পর্যন্ত হার মানল, পশ্চিম ক্লান্ত হয়ে অস্ত্র সমর্পণ করল, আমাদের মাতৃভূমি (Motherland) বড় হল।” হয়তো পুরো ইউক্রেন দখল হয়নি, কিন্তু নেওভোরোসিয়া (Novorossiya) পুনরুজ্জীবিত হওয়ার প্রথম ধাপ হিসেবে কিছু ভূখণ্ড রাশিয়া পেয়েছে, যা ১৮শ শতকে ক্যাথরিন দ্য গ্রেটের (Catherine the Great) আমলে রুশ সাম্রাজ্যে যুক্ত হয়েছিল।

এছাড়া, ট্রাম্প যদি হুমকি দেন – “তুমি বসে আলোচনায় আসো, নইলে আমি ইউক্রেনকে আগের চেয়েও বেশি সহায়তা দেব” – তাহলে রাশিয়া হয়তো বাধ্য হবে কিছুটা নমনীয় হতে।

“কোরীয় মডেল” নিয়ে সংশয়

তবে মনে রাখা দরকার, এই কোরিয়ান পদ্ধতি এখনো কেবল একটি অনুমান মাত্র। অনেক সময় এমন পরিকল্পনা ঘোষণা হয়, কিন্তু ফলাফল শূন্যে গিয়ে দাঁড়ায়। ইউক্রেনের জন্য এটি ঝুঁকিপূর্ণ। কেননা যুদ্ধ শেষে যদি আন্তর্জাতিক সাহায্য না আসে, তবে ইউক্রেন আরও দুর্বল অবস্থানে পড়বে – বিশাল ধ্বংসযজ্ঞের পর, আগের চেয়ে কম ভূখণ্ড নিয়ে আবার শূন্য থেকে শুরু করতে হবে।

এর চেয়েও বড় বিষয় হল, ট্রাম্পের পরিকল্পনায় ইউক্রেনের ন্যাটো সদস্যপদ (NATO Membership) ২০ বছর পিছিয়ে দেওয়ার কথা রয়েছে। এদিকে রাশিয়া এর আগেও ১৯৯৪ সালের বুদাপেস্ট স্মারকলিপি (Budapest Memorandum) লঙ্ঘন করেছে, সুতরাং নতুন চুক্তিও তারা লঙ্ঘন করতে পারে। কোরিয়ার ক্ষেত্রে দক্ষিণ কোরিয়ার পাশে ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যারা যেকোনো উত্তেজনা নিরসনে কার্যকর ভূমিকা নিয়েছে। কিন্তু ইউক্রেনের ক্ষেত্রে যদি এমন নিশ্চয়তা না থাকে, তবে রাশিয়া আবার চুক্তি ভঙ্গ করতে পারে।

এছাড়াও নিরাপত্তার অভাব ইউক্রেনের ইউরোপীয় ইউনিয়নে (European Union) যোগদানের পথকে আরও কঠিন করবে। ইউক্রেনের দুর্বল আইনশৃঙ্খলা (Weak Rule of Law), ব্যাপক দুর্নীতি (Corruption), দারিদ্র্য – এর মধ্যে আবার অনিশ্চিত নিরাপত্তা পরিস্থিতি যুক্ত হলে, ইইউ তাকে নিতে চাইবে না। ইইউতে যোগ দিতে প্রচুর অর্থ, কাঠামোগত সমর্থন প্রয়োজন, যা সবাই দিতে রাজি হবে না।

সুতরাং জেলেনস্কির সর্বোচ্চ চেষ্টা হবে এমন একটি সমাধান খুঁজে পাওয়া যা দেশকে ভবিষ্যতে ঠাণ্ডায় ফেলে দেবে না। কোরিয়ান মডেল হয়তো এই মুহূর্তে তার হাতে থাকা সেরা বিকল্প।

ইউক্রেনীয়দের মনোভাব

কিন্তু ইউক্রেনীয়রা কী ভাবছে? সামরিক বাহিনীর (Military) অনেক সদস্যের কাছে এই ধরনের সমঝোতা অর্থ হলো বিশ্বাসঘাতকতা। অনেকে মনে করে, স্পষ্ট বিজয় ছাড়া যুদ্ধ থামানো মানে হলো রাশিয়ার সামনে নতজানু হওয়া। ফ্রন্টলাইনে যেসব সৈন্যরা জীবন-মৃত্যুর মুখোমুখি, তাদের ১৫%-এর মতো একটি অংশ সশস্ত্র প্রতিবাদেও যেতে পারে যদি তারা চুক্তিকে সরাসরি পরাজয় মনে করে।

অন্যদিকে কিছু সৈন্য, বিশেষ করে নবীনরা, দীর্ঘদিনের ক্লান্ত যুদ্ধে অতিষ্ঠ। তাদের কিছুটা শান্তি ও স্বস্তি দরকার। কিন্তু সামগ্রিকভাবে সামরিক বাহিনীর বড় অংশ কোনো “পরাজয়মূলক” চুক্তি চায় না।

তবে বেসামরিক (Civilian) জনসাধারণের মধ্যে ছবিটা ভিন্ন। একসময় ৭৩% ইউক্রেনীয় বলেছিল যে তারা শেষ পর্যন্ত লড়বে। ২০২৩ সালেও এটি ছিল ৬০%-এর ওপরে। কিন্তু এখন গ্যালাপের (Gallup) সাম্প্রতিক, অর্থাৎ ২০২৪ সালের অক্টোবরের জরিপ অনুযায়ী, মাত্র ৩৮% এখন চায় শেষ পর্যন্ত লড়তে। অপরদিকে ৫০%-এর বেশি মানুষ এখন আলোচনা ও শান্তি চায়, এমনকি তার জন্য কিছু ভূখণ্ড ছাড়তেও প্রস্তুত।

এটি খুব অস্বাভাবিক নয়। ২০২৪ সাল খুব কঠিন গেছে ইউক্রেনের জন্য – জীবনযাত্রার ব্যয়, বিদ্যুৎ ও পানীয় জলের স্থাপনায় রুশ হামলা, দিনের পর দিন দুঃসহ পরিস্থিতি মানুষকে ক্লান্ত করে তুলেছে। অনেকেই কিছুটা স্বাভাবিকতা ফিরে পেতে চায়।

এটি সারা দেশজুড়েই লক্ষণীয়। আগে সমগ্র দেশে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার মানসিকতা ছিল প্রবল, এখন তা হ্রাস পেয়েছে। ফলে সামরিক-বেসামরিক দৃষ্টিভঙ্গিতে ফাঁরাক বাড়ছে।

ভবিষ্যৎ: পশ্চিমের সমর্থন কী আসবে?

এই পরিস্থিতি বলছে, ইউক্রেনীয়রা এখন আলোচনা সমর্থন করে। তবে সেই আলোচনা কেমন হবে তা গুরুত্বপূর্ণ। যদি সেটি “কোরীয় মডেল” অনুসরণ করে, যেখানে ইউক্রেনকে ভালভাবে সুরক্ষিত করা হয়, আন্তর্জাতিক সহায়তা নিশ্চিত হয়, তবে এর একটি ভবিষ্যৎ আছে। কিন্তু যদি আলোচনার ফলাফল হয় ইউক্রেনকে ‘বিক্রি’ করে দেওয়া, তবে দেশ চির অনিশ্চয়তায় পড়ে যাবে।

জেলেনস্কির এখনকার প্রধান লক্ষ্য সম্ভবত যুদ্ধের পরের দিনগুলি। কীভাবে দেশকে সুরক্ষিত রাখা যাবে? কীভাবে পশ্চিমা সহায়তা নিশ্চিত করা যাবে? সেই অস্ত্র, অর্থ, এবং রাজনৈতিক সমর্থনই কোরিয়াকে টিকে থাকতে সাহায্য করেছে, ইসরায়েলকেও (Israel) চরম প্রতিকূল পরিবেশে বেঁচে থাকতে সাহায্য করেছে।

প্রশ্ন হল, ব্রাসেলস (Brussels) বা ইউরোপ এই দায়িত্ব নিতে পারবে তো? ইউক্রেনকে মজবুত করতে প্রচুর অর্থ, অস্ত্র ও রাজনৈতিক ইচ্ছাশক্তি লাগবে। ইউক্রেনের সীমান্ত সুরক্ষার জন্য ঠিক কী দরকার – এ নিয়ে আপনাদের মতামত কী? মন্তব্যে জানান, চলুন আলোচনা শুরু করি।

সিরিয়ার অপসারিত নেতা বাশার আল আসাদের নীরবতা ভাঙা (১৭ ডিসেম্বর, ২০২৪)

সিরিয়ার ক্ষমতাচ্যুত নেতা বাশার আল আসাদ, যিনি এক সপ্তাহ আগে দ্রুতগতিতে ক্ষমতা হারিয়েছেন, অবশেষে নীরবতা ভেঙেছেন। সিরিয়ার প্রেসিডেন্সির টেলিগ্রাম (telegram) চ্যানেলে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে আসাদ জানান যে তিনি ৮ ডিসেম্বর দামেস্ক (Damascus) ত্যাগ করেন। এর এক দিন আগে বিরোধী বাহিনী (anti regime forces) শহরটি দখল করে, যার মাধ্যমে তার ২৪ বছরের শাসনের অবসান ঘটে।

আসাদ দাবি করেন যে তিনি বিদ্রোহী বাহিনীর (rebel forces) বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যেতে চেয়েছিলেন এবং শেষ অবধি দায়িত্ব পালন করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু যে বিমানঘাঁটিতে (airbase) তিনি অবস্থান করছিলেন, সেখানে হামলার পর রুশ বাহিনী (Russian forces) তাকে উদ্ধার করে নিয়ে যায়। তার অবস্থান আগে অজ্ঞাত ছিল, তবে রাশিয়া জানায় যে বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর সাথে আলোচনা শেষে আসাদ সিরিয়া ত্যাগ করেন।

বিবৃতিতে আসাদ বলেন, তিনি কখনও পদত্যাগ বা দেশত্যাগের মাধ্যমে আশ্রয় নেওয়ার চিন্তা করেননি এবং ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্য কখনও পদ চাননি। তবে কয়েক ডজন সূত্র রয়টার্সকে (Reuters) জানায় যে আসাদ অন্তত ২ ডিসেম্বর থেকেই দেশ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার উপায় খুঁজছিলেন এবং প্রথমে সংযুক্ত আরব আমিরাতে (UAE) আশ্রয় চাইলে তা প্রত্যাখ্যাত হয়।

তথ্যসূত্র

মস্কোতে রাশিয়ান পরমাণু বাহিনীর প্রধান নিহত (১৭ ডিসেম্বর, ২০২৪)

আজ (Today) রাশিয়ার পরমাণু বাহিনীর প্রধান (head of Russia’s nuclear forces) ইগর কিলিলভ (Igor Kililov), যিনি রাশিয়ান পারমাণবিক, রাসায়নিক ও জৈব প্রতিরক্ষা বাহিনীর (Nuclear, Chemical and Biological Defense Forces) লেফটেন্যান্ট জেনারেল (Lt. Gen.) ছিলেন, মস্কো (Moscow) শহরে নিহত হয়েছেন। ইউক্রেনের নিরাপত্তা সংস্থা (Security Service of Ukraine, SBU) মূল সন্দেহভাজন হিসেবে চিহ্নিত হলেও এখনো পর্যন্ত কেউ দায় স্বীকার করেনি।

প্রাথমিক তথ্য অনুযায়ী, আজ সকালে কিলিলভের মস্কোর বাসভবনের বাইরে স্কুটারে (scooter) রাখা বোমা বিস্ফোরণে তিনি নিহত হন। ওই বিস্ফোরণে (explosion) কিলিলভের একজন সহকারীও নিহত হয়েছেন। এই হামলা ২০২২ সালে ইউক্রেনে রাশিয়ান আক্রমণ শুরুর পর থেকে সবচেয়ে উচ্চপদস্থ কোনো রাশিয়ান সামরিক কর্মকর্তার মৃত্যু।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, বিস্ফোরণের অভিঘাত কাছাকাছি ভবনগুলিকে কাঁপিয়ে দেয়, জানালার কাঁচ চুরমার হয় এবং শrapnel (শ্র্যাপনেল) ছড়িয়ে পড়ে। তদন্তকারী সূত্রের বরাত দিয়ে জানা যায়, বোমাটিতে প্রায় ১০০ থেকে ৩০০ গ্রাম টিএনটি (TNT) ছিল।

রাশিয়ার অনুসন্ধানী কমিটি (Investigative Committee) জানায় যে কিলিলভের হত্যাকাণ্ডের আগে ইউক্রেনের এসবিইউ (SBU) তাকে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে সন্দেহভাজন হিসেবে চিহ্নিত করে একটি নোটিশ ইস্যু করেছিল। অভিযোগ ছিল যে তিনি ইউক্রেনীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে রাসায়নিক অস্ত্র (chemical weapons) ব্যবহার করেছিলেন। যদিও ইউক্রেন সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে এ ঘটনার ওপর মন্তব্য করেনি, একজন ইউক্রেনীয় গোয়েন্দা কর্মকর্তা ইঙ্গিত দিয়েছেন যে কিলিলভকে লক্ষ্যবস্তু করা যুক্তিযুক্ত ছিল, কেননা অভিযোগ অনুযায়ী তার আদেশেই ৪,৮০০ বারের বেশি রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছিল।

অপরদিকে মস্কো এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে। কিলিলভ যুক্তরাজ্যের (UK) নিষেধাজ্ঞার (sanctions) আওতায় ছিলেন, যা গত অক্টোবর মাসে তার বিরুদ্ধে রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের দায়ে আরোপিত হয়েছিল। যুক্তরাজ্য তাকে ক্রেমলিনের (Kremlin) দুষ্প্রচারের (disinformation) একজন মুখপাত্র হিসেবেও চিহ্নিত করেছিল। তিনি প্রকাশ্যে করা বক্তব্যে (public briefings) নিয়মিত কিয়েভকে (Kyiv) রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার, নিউক্লিয়ার ডার্টি বোমা (nuclear dirty bomb) তৈরী এবং মশার মাধ্যমে রুশ বাহিনীতে ম্যালেরিয়া (malaria) ছড়ানোর ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তুলে আসছিলেন।

তথ্যসূত্র

আসাদের পতন কীভাবে ইউক্রেনে পুতিনকে দুর্বল করে দিল? (১৭ ডিসেম্বর, ২০২৪)

ভূমিকা

গত সপ্তাহটি সিরিয়ার এখনকার সাবেক একনায়ক বাশার আল-আসাদের (Bashar al-Assad) জন্য অত্যন্ত বিধ্বংসী ছিল। ঘটনাটি শুরু হয় ৩ ডিসেম্বর, যখন বিপ্লবী ইসলামপন্থী মিলিট্যান্ট গ্রুপ হায়াত তাহরির আল-শাম (Hayat Tahrir al-Sham, HTS) একটি আকস্মিক আক্রমণ চালায়। অতি অল্প সময়ের মধ্যে, এই গোষ্ঠী আলেপ্পো (Aleppo) দখল করে, যা তখন সিরিয়ার দক্ষিণ দিকে প্রসারিত হওয়ার ঘাঁটি হিসেবে কাজ করে। পরদিনগুলোতে সিরিয়াজুড়ে এগিয়ে যেতে থাকে তারা। ৭ ডিসেম্বর হোমস (Homs) দখল হওয়ার পর দামাস্কাস (Damascus) অভিমুখে অগ্রযাত্রার পথ সুগম হয়। এর পরের দিনই, অর্থাৎ ৮ ডিসেম্বর, আসাদ তার লোহার মুঠোয় শাসন করা দেশটি লজ্জাজনকভাবে পরিত্যাগ করে পালিয়ে যান। আসাদ শাসনের অবসান হয়েছে। এবং এই পতনের কারণে ইউক্রেনে (Ukraine) রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের (Vladimir Putin) অবস্থান মারাত্মকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছে।

কিন্তু সিরিয়ার এই পতন ইউক্রেনের ক্ষেত্রে কেন বা কীভাবে প্রভাব ফেলবে? এক দেশ থেকে আরেক দেশে এতদূর কীভাবে সামরিক অভিযান প্রভাবিত হতে পারে? এই লেখায় বিশ্লেষণ করা হবে কীভাবে আসাদের পতন রাশিয়ার (Russia) ইউক্রেন দখলের প্রচেষ্টাকে ব্যয়বহুল করে তুলেছে।

আসাদের বর্তমান অবস্থা

আমরা ইতোমধ্যেই আসাদ শাসনের পতনের মূল ঘটনা জেনেছি। এই বিদ্যুৎগতির HTS হামলা সিরিয়াকে (Syria) গ্রাস করে আসাদের ২৪ বছরের শাসনের ইতি টেনেছে। “ইতি টানা” বলতে আসলেই সমাপ্তি—কারণ আসাদ এখন আর দেশে থেকে বিদ্রোহীদের প্রতিহত করার সাহস দেখাচ্ছেন না। তিনি দেশ ত্যাগ করেছেন।

সিরিয়ার সাবেক একনায়ক দেশ ছেড়ে পালানোর আগে চূড়ান্ত আদেশ দিয়েছেন শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তরের। এই নির্দেশ থেকেই স্পষ্ট তিনি কোথায় গিয়েছেন। ৮ ডিসেম্বর রাশিয়ান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় (Russian Foreign Ministry) থেকে প্রকাশিত এক বিবৃতি জানায়, সিরিয়ার একনায়ক রাশিয়ায় আশ্রয় নিয়েছেন—তার দীর্ঘদিনের পৃষ্ঠপোষক ভ্লাদিমির পুতিনের নিরাপদ সান্নিধ্যে।

রাশিয়া দাবী করছে তারা আসাদের প্রস্থানে কোনো ভূমিকা রাখেনি, শুধু তাকে আশ্রয় দিয়েছে। তারা সিরিয়ার ভেতরে সব পক্ষকে সহিংসতা থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানাচ্ছে, অন্যদিকে পুতিনের বাহিনী ইউক্রেনে অগ্রসর হচ্ছে। এটি এক ধরনের ভণ্ডামিপূর্ণ (hypocritical) বার্তা, কিন্তু পুতিনের শাসন এমন দ্বিমুখী কথাই বলে আসছে। অন্যদিকে HTS বিদ্রোহীরা তাদের বিজয় উদযাপন করছে। হোয়াটসঅ্যাপ (WhatsApp)-এ প্রকাশিত এক বার্তায় গ্রুপটির এক শীর্ষ কমান্ডার লিখেছেন, “আমরা দামাস্কাস শহরকে (Damascus) একনায়ক বাশার আল-আসাদের নিপীড়ন থেকে মুক্ত ঘোষণা করছি। বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে থাকা উদ্বাস্তুদের বলছি, মুক্ত সিরিয়া (Free Syria) এখন আপনাদের জন্য অপেক্ষা করছে।”

‘মুক্ত সিরিয়া’—এই শব্দযুগল দীর্ঘকাল আসাদ পরিবারের শাসনে প্রায় অকল্পনীয় ছিল। সোশ্যাল মিডিয়ায় পাওয়া ভিডিওগুলোতে দেখা যাচ্ছে সিরিয়ায় উৎসবমুখর পরিবেশ বিরাজ করছে। মানুষ রাস্তায় নেচে-গেয়ে, পতাকা উড়িয়ে আর আকাশে গুলি ছুঁড়ে আনন্দ প্রকাশ করছে। গাড়িগুলো হর্ন দিচ্ছে, বিদ্রোহী আর সাধারণ মানুষ একসঙ্গে রাশিয়ান ট্যাঙ্কের (Russian tanks) ধ্বংসাবশেষের ওপর দাঁড়িয়ে সেলফি তুলছে—যেসব ট্যাঙ্ক আসাদ তার পতনোন্মুখ শাসন টিকিয়ে রাখতে ব্যবহার করেছিল।

সিরিয়ার ভবিষ্যৎ এখন দেশটির মানুষের হাতে—এমনটাই বলছেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ গাজি আল-জালালি (Mohammed Ghazi al-Jalali), যিনি আসাদের দ্বারা তিন মাস আগে নিয়োগ পেয়ে দায়িত্ব পালন করছিলেন। যদিও আসাদ পালিয়েছেন, আল-জালালি নিজ বাড়িতেই থেকে গেছেন বিদ্রোহীদের দামাস্কাসে প্রবেশকালে। HTS ঘোষণা করেছে, নতুন সরকার ব্যবস্থা গঠিত না হওয়া পর্যন্ত তিনি অন্তর্বর্তী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। আল-জালালি জানিয়েছেন, তিনি দেশ ছেড়ে যেতে ইচ্ছুক নন। “আমি কেবল শান্তিপূর্ণ উপায়ে স্থানান্তরের মাধ্যমে জনপ্রতিষ্ঠান ও রাষ্ট্রীয় অবকাঠামোর কার্যকারিতা নিশ্চিত করতে চাই, নাগরিকদের নিরাপত্তা ও আশ্বাস দেওয়ার জন্য,”—তিনি বলেন। পাশাপাশি তিনি জানান যে, দেশটির জনগণ যে কোনো সরকার গঠন করবে, তিনি তার সঙ্গে সহযোগিতা করতে প্রস্তুত।

সিরিয়া এখন মুক্ত। যুক্তরাষ্ট্রের (United States) প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন (Joe Biden) বলেছেন, “শেষ পর্যন্ত আসাদ শাসনের পতন ঘটেছে।” কিন্তু এখন স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠে—এর সঙ্গে পুতিনের ইউক্রেন দখল প্রচেষ্টার কী সম্পর্ক?

আসাদের পতন ও পুতিনের ইউক্রেন অভিযান: সম্পর্ক কী?

ইউক্রেনে পুতিনের “বিশেষ সামরিক অভিযান” (special military operation) চলছেই। অন্য দেশে একনায়কের পতন কীভাবে ইউক্রেনের যুদ্ধের গতিপ্রকৃতি প্রভাবিত করতে পারে?

মানবাধিকার কর্মী ও পুতিনের কট্টর সমালোচক বিল ব্রাউডার (Bill Browder) ৮ ডিসেম্বর টাইমস রেডিওর (Times Radio) এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “আসাদ ছিল একজন নৃশংস একনায়ক (brutal dictator), যিনি তার নিজের পাঁচ লাখের বেশি মানুষকে হত্যা করেছেন এবং এক কোটি শরণার্থী সৃষ্টির জন্য দায়ী। তিনি এইসব করেছেন ভ্লাদিমির পুতিন ও ইরানের (Iran) সাথে অংশীদারিত্বে।”

এখানেই প্রথম সূত্র পাওয়া যায়—কেন আসাদের পতন পুতিনের জন্য এত ধ্বংসাত্মক। আসাদকে টিকিয়ে রেখে পুতিন বিশ্বমঞ্চে নিজের ক্ষমতা প্রদর্শন করতে পারছিলেন। সিরিয়া ছিল রাশিয়ার এক ক্লায়েন্ট রাষ্ট্র (client state) বা মক্কেল রাষ্ট্রের মতো। সিএনএন (CNN) বলছে, আসাদের পতন রাশিয়ার মধ্যপ্রাচ্যে ক্ষমতা প্রকল্পের ওপর গুরুতর আঘাত হেনেছে। আসাদ ছিলেন পুতিনের মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে শক্তি প্রক্ষেপণের পাদুকাস্বরূপ।

প্রতীকী তাৎপর্য ও ভূরাজনৈতিক ব্যর্থতা

ইউক্রেনে আসাদের পতন বিশেষ এক প্রতীকী বার্তা দেয়। যখন আসাদ রাশিয়ায় পালাচ্ছেন, তখনই ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি (Volodymyr Zelenskyy) যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট-ইলেক্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প (Donald Trump) ও ফ্রান্সের (France) প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ (Emmanuel Macron)-এর পাশে দাঁড়িয়ে প্যারিসের (Paris) বিখ্যাত নটর ডেম ক্যাথেড্রাল (Notre Dame Cathedral)-এর পুনঃউদ্বোধন অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। ২০১৯ সালে আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত এই স্থাপনার পুনরায় উদ্বোধন পুতিনের পক্ষেই এক পরোক্ষ বার্তা।

একদিকে, আসাদের পতন রাশিয়ান প্রভাবের পতনকে প্রতীকীভাবে তুলে ধরে। ইউক্রেনে পুতিনের সাম্রাজ্যবাদী আকাঙ্ক্ষা এখন স্পষ্ট। তার হাতে সম্পদ ফুরিয়ে আসছে এবং তিনি সিরিয়াসহ কয়েকটি মিত্র রাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীল ছিলেন। আসাদ ছিলেন পুতিনের শুরু থেকেই “বিশেষ সামরিক অভিযানের” উচ্ছ্বসিত সমর্থক। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে অভিযান শুরু হলে আসাদ একে “ইতিহাসের সংশোধন” ও সোভিয়েত ইউনিয়নের (Soviet Union) পতনের পর হারানো ভারসাম্য পুনরুদ্ধার হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন।

কিন্তু এখন সেই আসাদই পালিয়ে গেছে। পুতিনের মধ্যপ্রাচ্যের ভিত্তি ভেঙে পড়েছে। অন্যদিকে, জেলেনস্কি বন্ধু জোগাড়ে সক্ষমতার প্রমাণ দিচ্ছেন। নটর ডেম পুনরুদ্ধারের দিনে জেলেনস্কির উপস্থিতি এই বার্তা দেয়—ইউক্রেনের বৈশ্বিক বন্ধুত্ব এখনও দৃঢ়, whereas রাশিয়ার বন্ধনগুলো ভাঙতে শুরু করেছে।

রুশ বাহিনীর সংস্থান সংকট (Resource Crisis)

আসাদের পতন ইউক্রেনের সৈন্যদের মনোবলও বাড়াবে। কীভাবে? প্রশ্ন উঠতে পারে, কেন পুতিন আসাদকে রক্ষা করতে এগিয়ে গেল না? এতদিন তো রাশিয়া আসাদের শাসন টিকিয়ে রেখেছে। HTS আক্রমণের শুরুতে রাশিয়া কয়েকটি বিমান হামলা চালিয়েছিল বিদ্রোহীদের অগ্রগতি রুখতে। কিন্তু তারা সফল হয়নি। আলেপ্পোর এক হাসপাতালে (hospital in Aleppo) রাশিয়ান হামলায় ১২ জন নিহত হয়েছিল, এবং ইদলিবে (Idlib) বিদ্রোহী ঘাঁটিতে কিছু ছোটখাট লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানা ছাড়া রাশিয়ার সাফল্য ছিল নামমাত্র।

এর পর আর কিছুই করেনি রাশিয়া। ব্রাউডারের মতে, কারণ রাশিয়ার কাছে সম্পদ ছিল না। তিনি বলেন, “আমি মনে করি না এটি সচেতন সিদ্ধান্ত, বরং পুতিন এখন চরমভাবে চাপের মুখে। তিনি তার প্রায় সব সামরিক সম্পদ ইউক্রেনে নিয়োজিত করেছেন।”

এই বিষয়টি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। পুতিনের জন্য আসাদকে সমর্থন ধরে রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল, কারণ সিরিয়াতে তিনি মধ্যপ্রাচ্যে শক্ত ঘাঁটি বানিয়েছিলেন। তবুও তিনি তা পারেননি। কারণ তার হাতে পর্যাপ্ত সামরিক সম্পদ নেই। পশ্চিমা সমর্থিত ইউক্রেনীয় বাহিনী রুশ বাহিনীর ওপর এত বিশাল ক্ষয়ক্ষতি চাপিয়ে দিয়েছে যে, রাশিয়া এখন তাদের অতি গুরুত্বপূর্ণ মিত্রকেও রক্ষা করতে অক্ষম।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেন ৮ ডিসেম্বর বলেন, “রাশিয়ান বাহিনীর ওপর পশ্চিমা সমর্থিত ইউক্রেনীয় বাহিনীর দ্বারা আঘাত হানা ব্যাপক ক্ষতি (‘massive damage’), যার ফলে আসাদ তার সবচেয়ে কাছের মিত্রের কাছ থেকে সাহায্য পায়নি।” বাইডেনের মতে, ইউক্রেনে রাশিয়ার বিপর্যয়কর ক্ষয়ক্ষতি সিরিয়ায় পুতিনের কর্তৃত্ব ধরে রাখার ক্ষমতাকে দুর্বল করে দিয়েছে।

অন্য মিত্রদের পরিত্যাগ ও দুর্বল জোটনীতির নজির

ব্রাউডার বলেন, এটি সিরিয়া প্রথম নয় যেখানে পুতিন সম্পদ স্বল্পতার কারণে মিত্রদের পরিত্যাগ করেছেন। আগে আর্মেনিয়াকেও (Armenia) তিনি সহযোগিতা করেননি। ২০২৪ সালের গ্রীষ্মে আর্মেনিয়ার প্রধানমন্ত্রী নিকোল পাশিনিয়ান (Nikol Pashinyan) অভিযোগ করেন, রাশিয়া তাদের প্রতিশ্রুতি রক্ষা না করে বরং আজারবাইজানের (Azerbaijan) সঙ্গে ষড়যন্ত্র করছে।

রাশিয়ার সামরিক সম্পদের সংকট শুধু যুদ্ধক্ষেত্রেই নয়, এর তথাকথিত ‘হাইব্রিড যুদ্ধ’ (hybrid warfare) বা নির্বাচনী প্রভাব বিস্তারের ক্ষেত্রেও স্পষ্ট। ব্রাউডার বলেন “মোল্দোভায় (Moldova) সে (পুতিন) নির্বাচনে হেরেছে”। রোমানিয়াতেও (Romania) রুশ প্রভাব বিস্তার ব্যর্থ হয়েছে। রোমানিয়া ৬ ডিসেম্বর তাদের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন স্থগিত করেছে রাশিয়া-নেতৃত্বাধীন “রাজনৈতিক প্রভাব অপারেশন” (political influence operations)-এর অভিযোগে।

যুদ্ধের পরিসংখ্যান ও ইউক্রেনের মনোবল

ইউক্রেনের অর্থ মন্ত্রণালয় (Ministry of Finance) প্রদত্ত পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে রাশিয়া প্রায় ৭,৫৫,০০০ সৈন্য হারিয়েছে, যারা নিহত বা আহত। ৯,৫০০টির বেশি ট্যাঙ্ক অকার্যকর হয়েছে, ২১,০০০-এর বেশি আর্টিলারি ব্যবস্থা ধ্বংস হয়েছে, প্রায় ২০,০০০ সাঁজোয়া যান হারিয়েছে। প্রতিদিন রাশিয়া নতুন করে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে।

এখন ইউক্রেন দেখছে যে, রাশিয়া এতটাই সম্পদ সংকটে যে আসাদকে রক্ষার মতো সামান্য সামর্থ্যও তাদের নেই। এটি ইউক্রেনীয় সেনাদের মনে আশা জোগাচ্ছে। তারা দেখতে পাচ্ছে রাশিয়ান যুদ্ধযন্ত্রের (war machine) বলের ঘাটতি এতটাই চরম যে, পুতিনকে তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মিত্রকেও ত্যাগ করতে হচ্ছে। এ থেকে ধারণা করা যায়, ইউক্রেনে রাশিয়ান যুদ্ধযন্ত্রের থেমে যাওয়ার সময় খুব বেশি দূরে নয়।

পুতিনের মর্যাদাহানি (Prestige Loss)

আসাদের পতন শুধু সম্পদ সংকটকেই নয়, পুতিনের মর্যাদাও ক্ষুন্ন করেছে। ব্রাউডার বলেন, “এই মুহূর্তটি পুতিনের জন্য চূড়ান্ত অপমানজনক। তিনি তার নাম আর সম্পদ আসাদের পেছনে দিয়েছিলেন। এখন আসাদ অপমানিত, আর সেই অপমান পুতিনকেও স্পর্শ করবে।”

দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে পুতিন নিজেকে রাশিয়ান রাজনীতির “শক্তিশালী মানুষ” (strongman) হিসেবে তুলে ধরেছেন—যাকে কেউ স্পর্শ করতে পারবে না। কিন্তু ২০১৫ সালে শুরু হওয়া সিরিয়ায় রুশ সেনা উপস্থিতি পশ্চিমা আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করে পুতিনকে এক “বিশ্ব নিয়ন্ত্রক শক্তি” হিসেবে উপস্থাপন করতে চেয়েছিল। আসাদ তার কৃতজ্ঞতায় পুতিনকে তার তারতুস (Tartous) নৌ ঘাঁটি ও হমেইমিম (Hmeimim) বিমানঘাঁটি ৪৯ বছরের লিজে দিয়েছিল। এখন সেগুলোও হুমকির মুখে।

রাশিয়ান রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে (state TV) দায় চাপানো হচ্ছে সিরিয়ান সেনাবাহিনীর ওপর। উপস্থাপক ইয়েভগেনি কিসেলেভ (Yevgeny Kiselev) বলছেন, রাশিয়ার অগ্রাধিকার এখন “বিশেষ সামরিক অভিযান অঞ্চলে যা ঘটছে” সেটাই। অর্থাৎ, রাশিয়া সম্পদ স্বল্পতায় ভুগছে। পুতিনের বিশ্বব্যাপী শক্তিমত্তার ভাবমূর্তি নষ্ট হয়েছে।

ইউক্রেনে ইতিবাচক বার্তা ও মিত্র সংগ্রহে সুবিধা

ইউক্রেনের যুদ্ধক্ষেত্রে এই বার্তা প্রতিধ্বনিত হবে। ইউক্রেনীয় বাহিনী জানতে পারবে যে তাদের দৃঢ় প্রতিরোধ পুতিনের সাম্রাজ্যবাদী আকাঙ্ক্ষায় শুধু ইউক্রেন নয়, মধ্যপ্রাচ্যেও এক বিরাট ফাটল ধরিয়েছে। অন্য মিত্রদের জন্যও এটি সতর্কবার্তা—রাশিয়া তার মিত্রদের রক্ষা করতে পারছে না।

পুতিনের এই ব্যর্থতা তাকে নতুন জোট গঠনে আরও অক্ষম করে তুলবে। স্বৈরাচারী নেতৃত্বদেরকে পুতিনের দেয়ার মতো মূল সম্পদ যা আছে তা হচ্ছে তার সামরিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতা। এখন যখন সেটি ক্ষয়িষ্ণু, তখন আর্মেনিয়া, সিরিয়ার মতো জায়গায় পুতিনের সমর্থিত নেতারা হয় পতিত হচ্ছেন, নয়তো পেছন ফিরছেন।

মনে রাখতে হবে, পুতিন সম্প্রতি আরও অপমানের শিকার হয়েছেন—যেমন ২০২৪ সালের আগস্টে কুরস্ক (Kursk) আক্রমণ ও মস্কোতে (Moscow) ইউক্রেনীয় ড্রোন হামলার জন্য। রাশিয়ান জনগণও বুঝতে পারছে পুতিন “শক্তিমান” নন, বরং সঙ্কটে আছেন।

পশ্চিমা সমর্থন ও ট্রাম্পের অবস্থান পরিবর্তন

আসাদের পতনের পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট-ইলেক্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তার ট্রুথ সোশ্যাল (Truth Social) অ্যাকাউন্টে পোস্ট করে জানান, “আসাদ পালিয়েছে। রাশিয়া, রাশিয়া, রাশিয়া, ভ্লাদিমির পুতিনের নেতৃত্বে তাকে আর রক্ষা করতে চায়নি। ইউক্রেনে বিপুল ক্ষয়ক্ষতির পর তাদের আর কোনো আগ্রহ নেই সিরিয়ায়।”

ট্রাম্প বলেন, “এই যুদ্ধ (ইউক্রেন যুদ্ধ) যা কখনোই শুরু হওয়া উচিত ছিল না, তা অনন্তকাল চলতে পারে।” তিনি অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানান, উল্লেখ করেন যে জেলেনস্কি একটি চুক্তিতে আগ্রহী।

ব্রাউডার বলেন, আগে ট্রাম্প জেলেনস্কির প্রতি কিছুটা অবজ্ঞার স্বর প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু এখন তার পোস্ট দেখে মনে হচ্ছে তিনি ইউক্রেনের পক্ষে কিছুটা ঝুঁকছেন। প্যারিসে জেলেনস্কির পক্ষে উষ্ণ সমর্থনও ট্রাম্পকে প্রভাবিত করতে পারে। জেলেনস্কি এর আগে স্কাই নিউজকে (Sky News) বলেছিলেন, যদি ইউক্রেনের এখনও নিয়ন্ত্রণাধীন অংশগুলো ন্যাটোর (NATO) সুরক্ষায় আসতে পারে, তবে তিনি কূটনৈতিকভাবে ভবিষ্যতে রাশিয়া-নিয়ন্ত্রিত অংশগুলো পুনরুদ্ধারের কথা ভাবতে পারেন। যদিও এটি ট্রাম্পের কথিত পরিকল্পনা (যেখানে কিছু দশক ইউক্রেনের ন্যাটো সদস্যপদ হবে না) থেকে কিছুটা ভিন্ন, তবু এটি দেখায় যে জেলেনস্কি একটি সমঝোতার পথে হাঁটতে ইচ্ছুক।

এই পরিস্থিতে আসাদের পতন পুতিনকে দুর্বল দেখাচ্ছে, যা ইউক্রেনকে শান্তির আলোচনায় ভালো অবস্থান এনে দিতে পারে। এটি ট্রাম্পের মতো প্রভাবশালী নেতাদের সমর্থন অর্জনে সহায়ক হতে পারে।

ইউক্রেনের কৌশলগত সুবিধা

প্যারিসে জেলেনস্কির উষ্ণ অভ্যর্থনা দেখিয়েছে যে বিশ্ব এখনও ইউক্রেনের পাশে আছে। ব্রাউডার বলেন, “ট্রাম্পের নিজেদের চোখে বিশ্বে ইউক্রেনের প্রতি সমর্থন দেখা দরকার ছিল। এটি সম্ভবত ইউক্রেনের জন্য খুবই সহায়ক হয়েছে।”

এখন ইউক্রেন এই দূর্বলতা ও গ্লানি কাজে লাগাতে চাইছে। আসাদের পতনের পর ইউক্রেনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে জানায়, “সিরিয়ায় ঘটে যাওয়া ঘটনা দেখায় পুতিন শাসন কতটা দুর্বল। তারা দুই ফ্রন্টে যুদ্ধ করতে অক্ষম এবং ইউক্রেনের বিরুদ্ধে আগ্রাসন অব্যাহত রাখতে তাদের ঘনিষ্ঠ মিত্রদেরও ছেড়ে দিচ্ছে।” এটি সরাসরি ট্রাম্প ও অন্যান্য দেশের প্রতি বার্তা—রাশিয়ান যুদ্ধযন্ত্র ভেঙে পড়ছে।

ইউরোপীয় ইউনিয়নের (European Union) পররাষ্ট্র ও নিরাপত্তা নীতির উচ্চ প্রতিনিধি কায়া কাল্লাস (Kaja Kallas) এক্স (X, সাবেক টুইটার)-এ ৮ ডিসেম্বর পোস্ট করে বলেছেন, “সিরিয়ান শাসনের পতন দেখিয়ে দিচ্ছে আসাদের পৃষ্ঠপোষক রাশিয়া ও ইরানের দুর্বলতা।” ‘দুর্বলতা’ (weak) শব্দটি বারবার ঘুরে ফিরে আসছে—এটি পুতিনের একেবারেই অপছন্দনীয়।

ইউক্রেন এই সুযোগকে হাতছাড়া করতে চায় না। তারা পশ্চিমা দেশগুলোর কাছে আরও অস্ত্র দাবি করছে, “রাশিয়ান সেনাবাহিনীর ওপর চূড়ান্ত আঘাত হানতে”। একই সাথে তারা আলোচনা করার পথও খোলা রাখছে। অর্থাৎ, জেলেনস্কি দেখাতে চাইছেন যে, তিনি শান্তির পথও রেখেছেন, আবার যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার রসদও রাখছেন—যেখানে রাশিয়ার হাত প্রায় শূন্য।

উপসংহার

আসাদের পতন রাশিয়ার জন্য বড় ধাক্কা। এটি দেখিয়েছে যে রাশিয়া তার মিত্রদের রক্ষা করতে অক্ষম, রাশিয়ান সম্পদের ঘাটতি আরও গভীর, পুতিনের ভূরাজনৈতিক ক্ষমতা অনিশ্চিত এবং তার মর্যাদা প্রশ্নের সম্মুখীন। ইউক্রেনের জন্য এটি এক সুবর্ণ সুযোগ—এখন তারা আন্তর্জাতিক সমর্থন আরও জোরদার করতে পারবে, সামরিক ও কূটনৈতিক চাপ অব্যাহত রাখতে পারবে এবং পুতিনের সাথে আলোচনায় আরো সুবিধাজনক অবস্থান অর্জন করতে পারবে।

তথ্যসূত্র

  1. https://www.bbc.co.uk/news/articles/c2ex7ek9pyeo
  2. https://www.youtube.com/watch?v=xYF4Tl0aBvs
  3. https://news.sky.com/story/syrian-president-leaves-damascus-on-plane-reports-13269339
  4. https://www.nbcnews.com/news/world/syrian-rebels-claim-captured-capital-damascus-rcna183263
  5. https://en.wikipedia.org/wiki/Mohammad_Ghazi_al-Jalali
  6. https://edition.cnn.com/2024/12/09/europe/syria-russia-bashar-al-assad-analysis-intl-hnk/index.html
  7. https://www.independent.co.uk/news/world/notre-dame-reopening-macron-trump-zelensky-live-b2660508.html
  8. https://www.friendsofnotredamedeparis.org/notre-dame-cathedral/fire/
  9. https://www.aljazeera.com/news/2022/2/25/syrias-assad-praises-russias-ukraine-invasion-as-correction
  10. https://kyivindependent.com/biden-russia-syria/
  11. https://www.bbc.co.uk/news/articles/czr7rkzz2gmo
  12. https://www.politico.eu/article/armenia-ends-military-alliance-with-russia-pm-nikol-pashinyan-confirms/
  13. https://news.sky.com/story/russias-hybrid-attack-on-romanian-election-could-trigger-nato-response-if-proven-13268126
  14. https://index.minfin.com.ua/en/russian-invading/casualties/
  15. https://www.bbc.co.uk/news/articles/clygege97qwo
  16. https://www.atlanticcouncil.org/blogs/new-atlanticist/ukraines-kursk-offensive-marks-putins-third-major-humiliation-of-the-war/
  17. https://www.bbc.co.uk/news/articles/cx28jd0114ro
  18. https://www.yahoo.com/news/trump-sends-warning-shot-putin-142439255.html
  19. https://www.nbcnews.com/politics/2024-election/zelenskyys-meeting-harris-spat-trump-reveal-growing-partisan-divide-uk-rcna172648
  20. https://news.sky.com/story/zelenskyy-suggests-hes-prepared-to-end-ukraine-war-in-return-for-nato-membership-even-if-russia-doesnt-immediately-return-seized-land-13263085
  21. https://www.kyivpost.com/post/41884
  22. https://kyivindependent.com/collapse-of-syrias-assad-regime-highlights-weakness-of-russia-and-iran-eu-representative-for-foreign-affairs-says/
  23. https://www.removepaywall.com/search?url=https://www.reuters.com/world/ukraine-says-assads-fall-underscores-russian-weakness-2024-12-08/#google_vignette

সিরিয়ায় আসাদের পতনের অন্যতম কারণ রাশিয়ার সিরিয়াকে পরিত্যাগ (৭ ডিসেম্বর, ২০২৪)

ভূমিকা

রাশিয়া এখন সমস্ত সামরিক মনোযোগ ইউক্রেনে কেন্দ্রীভূত করেছে এবং সেখানে সামরিক ব্যয় ২০২৫ সালে ১৪৫ বিলিয়ন ডলারে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করছে, যা ২০২৪ সালে প্রায় ১১৬ বিলিয়ন ডলার থেকে প্রায় ২৫% বেশি। এই সংখ্যাগুলো বিশাল। ইউক্রেন যুদ্ধে তারা এখন স্বাস্থ্যসেবা (healthcare) ও শিক্ষা (education)-র চেয়ে বেশি খরচ করছে। এই ক্রমবর্ধমান সামরিক ব্যয় রাশিয়াকে অন্যান্য ক্ষেত্র থেকে পিছিয়ে আসতে বাধ্য করছে। এরকমই একটি ক্ষেত্র হলো সিরিয়ায় (Syria) তাদের সহায়তা।

রাশিয়ার সাড়া ও সাম্প্রতিক পটপরিবর্তন

সিরিয়ায় বিদ্রোহীদের বিজয় ও আসাদের পতনের ক্ষেত্রে একটি অদ্ভুত বিষয় হলো, গত ৯ বছর ধরে সিরিয়া রাশিয়া ও ইরান-সমর্থিত হেজবোল্লাহ বাহিনীর সাহায্য পেয়ে আসছিল। এটি ছিল সিরিয়ান সরকারের পক্ষে “শান্তি” বজায় রাখার এক ধরনের সহায়তা, যার বার্ষিক খরচ আনুমানিক ৪০০-৫০০ মিলিয়ন ডলার রাশিয়ার পক্ষ থেকে। কিন্তু এখন রাশিয়া ইউক্রেনে (Ukraine) বিপুল পরিমাণ অর্থ ও জনবল বিনিয়োগ করছে, যার ফলে তাদের কাছে বাড়তি সম্পদ বা সৈন্য বাহিনী নেই যে সিরিয়ায় পাঠাবে। এর পাশাপাশি ইরান-সমর্থিত হেজবোল্লাহ বাহিনীকেও এখন ইসরায়েলের (Israel) সাথে উদ্ভূত উত্তেজনার কারণে লেবাননে (Lebanon) নিজেদের প্রতিরক্ষায় মনোযোগ দিতে হচ্ছে।

একসময় সিরিয়ায় রাশিয়ান স্বার্থ রক্ষায় ভাড়াটে বাহিনী ওয়াগনার গ্রুপ (Wagner Group) নিয়োজিত ছিল। কিন্তু ওয়াগনার প্রধান ইয়েভজেনি প্রিগোঝিন (Yevgeny Prigozhin)-এর মৃত্যুর পর (যিনি আগে প্রেসিডেন্ট পুতিনের ঘনিষ্ঠ মিত্র ছিলেন কিন্তু পরবর্তীতে বিদ্রোহের চেষ্টা করেন এবং পরে একটি বিমানের দুর্ঘটনায় নিহত হন), ওয়াগনার গ্রুপ কার্যত ভেঙে যায়। ফলে রাশিয়ার হাতে এখন আর সেই ভাড়াটে বাহিনী নেই যা তাদের সিরিয়ায় মোতায়েন করার সুযোগ দিত।

এছাড়া মানুষজনের ঘাটতি থাকায় রাশিয়া অতিরিক্ত সৈন্য পাঠাতে পারেনি, কারণ তাদের প্রায় সব সামরিক মনোযোগ এখন ইউক্রেনে নিবিষ্ট। ফলস্বরূপ, এইচটিএস সিরিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে সহজেই প্রবেশ করে শহরগুলির নিয়ন্ত্রণ নিচ্ছে, আর সিরিয়ান সরকারও তাতে বাস্তবসম্মত কোনো প্রতিরোধ দেখাতে পারেনি।

ইরান ও হেজবোল্লাহর মনোযোগ এখন অন্যত্র, ইসরায়েলের সঙ্গে লড়াইরত অবস্থায় তারা লেবাননের সীমান্তে নিজেদের শক্তি সংহত করতে ব্যস্ত। সুতরাং সিরিয়া এখন কার্যত উন্মুক্ত মাঠে পরিণত হয় বিদ্রোহী এইচটিএসের জন্য।

উপসংহার

গত নয় বছর বা তারও বেশি সময় ধরে রাশিয়া ও ইরান সিরিয়ায় বিরাট প্রভাব বিস্তার করে আসছিল। তারা আসাদ সরকারের পাশে দাঁড়িয়ে পশ্চিমা-সমর্থিত বিদ্রোহীদের ঠেকিয়েছিল। কিন্তু এখন রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধে অতিব্যস্ত এবং অর্থনৈতিক ও সামরিক সম্পদে সংকটাপন্ন। ইরান ও হেজবোল্লাহ নিজেদের ইসরায়েল সংলগ্ন বিষয় নিয়ে ব্যস্ত। ফলে সিরিয়া কার্যত নিষ্করণ অবস্থায় পড়েছে।

এই সুযোগে এইচটিএস নিজের কর্তৃত্ব বাড়ানোর সুযোগ পায়। তারা কোনো প্রতিরোধের সম্মুখীন না হয়েই একে একে আলেপ্পো, হামা, হোমস ও দামেস্ক দখল করে নেয়। এটি দেখিয়ে দিল যে, বৈশ্বিক অর্থনীতি ও ভূরাজনীতি কতটা আন্তঃসংযুক্ত। ইউক্রেন ও রাশিয়ার মধ্যে যুদ্ধ শুধু এই দুই দেশকে নয়, বরং পরোক্ষভাবে সিরিয়ার মতো দেশেও ক্ষমতার ভারসাম্য বদলে দিচ্ছে। রাশিয়া যখন আর আগের মতো অর্থ ও সৈন্য দিতে পারছে না, তখন বিভিন্ন গোষ্ঠীর জন্য নতুন সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে। আফ্রিকার (Africa) কিছু দেশেও রাশিয়া তাদের প্রভাব পুনর্বিবেচনা করতে বাধ্য হতে পারে, কারণ রাশিয়ার রিসোর্স এখন সীমিত।

সার্বিকভাবে, রাশিয়ান অর্থনীতির এই দুরাবস্থা এবং ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সামরিক মনোযোগ কেন্দ্রীভূত হওয়া বিভিন্ন স্থানে নতুন অস্থিরতার সৃষ্টি করতে পারে। অতীতে যেখানে রাশিয়া সামরিক সহায়তা দিয়ে ক্ষমতার ভারসাম্য বজায় রাখত, এখন সেই সহায়তা কমে যাওয়াতে সেখানে উগ্রপন্থী গোষ্ঠী বা অন্যান্য বাহিনী শক্তি সঞ্চয় করতে পারে। ফলত বিশ্বে নতুন করে সামরিক সংঘাতের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।

রাশিয়া কি একটি রিয়েল এস্টেট সংকটের দিকে এগোচ্ছে? (৭ ডিসেম্বর, ২০২৪)

ভূমিকা

রাশিয়ার অর্থনীতি এই মুহূর্তে চরম অস্থিরতার মধ্যে রয়েছে। দেশটি তীব্র শ্রমিক সংকট (Labor Shortages), উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি (High Inflation) এবং আগামী বছরে প্রবৃদ্ধিতে বড় ধরনের মন্দার আশঙ্কার সম্মুখীন। এসবের পাশাপাশি, সম্প্রতি এক ভয়াবহ রিয়াল এস্টেট সংকটের (Real Estate Crisis) আশঙ্কা দানা বেঁধেছে। এর পেছনে মূল কারণ হলো উদার মনে দেওয়া এক মর্টগেজ (Mortgage) ভর্তুকি (Subsidy) কর্মসূচির হঠাৎ প্রত্যাহার। এই কর্মসূচির প্রত্যাহার রাশিয়ার অর্থনীতিকে আরও গভীর মন্দার দিকে ঠেলে দিতে পারে। এই প্রেক্ষাপটে খতিয়ে দেখা হবে কেন রাশিয়া রিয়াল এস্টেট সংকটের দিকে এগোচ্ছে এবং কেন এটি রাশিয়ার অর্থনীতির জন্য এত খারাপ খবর।

প্রেক্ষাপট: ২০২০ সালে অস্থিরতার শুরু ও স্বল্পসুদের মর্টগেজ স্কিমের প্রভাব

রাশিয়ার সম্পত্তি বাজারে (Property Market) অস্থিরতার প্রকৃত তীব্র ধাপ সম্ভবত ২০২০ সাল থেকেই শুরু হয়। সেই সময়, সরকার নির্মাণ খাত (Construction Sector) ও সম্পত্তি বাজারকে পতনের হাত থেকে রক্ষা করতে একটি বিশেষ মর্টগেজ কর্মসূচি (Preferential Mortgage Program) চালু করে। কোভিড (COVID) লকডাউনের সময়, কেন্দ্রীয় ব্যাংক (Central Bank) যখন মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সুদের হার বাড়াচ্ছিল, তখন এই কর্মসূচি মর্টগেজে সুদের হার কৃত্রিমভাবে ৮% রাশি পর্যন্ত ধরে রাখত। এর ফলে মাসিক লোন পরিশোধযোগ্যতা (Monthly Loan Payments) অনেক কমে যায়। এটি অনেক রুশ নাগরিকের জন্য একটি দারুণ সুযোগ হয়ে ওঠে এবং ব্যাপকভাবে জনপ্রিয়তা পায়। এমনকি ২০২২ সালে মোট মর্টগেজ লোনের এক-চতুর্থাংশের বেশি এই কর্মসূচির অন্তর্ভুক্ত ছিল।

যদিও এই পরিকল্পনা শুরুতে মাত্র এক বছরের জন্য হওয়ার কথা ছিল, এটি বারবার বাড়ানো হয় এবং অবশেষে ২০২৪ সালের জুলাই পর্যন্ত চলতে থাকে। এর পেছনে অন্তত দুটি বড় কারণ ছিল –

  • প্রথমত, ইউক্রেইনে আগ্রাসনের (Invasion of Ukraine) পর রাশিয়ার সামনে যখন একের পর এক পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা (Western Sanctions) ও অস্থির অর্থনীতির চ্যালেঞ্জ আসে, তখন ব্যবসা ও ব্যক্তি উভয়েই রিয়াল এস্টেটকে স্থিতিশীল বিনিয়োগ (Stable Investment) হিসেবে গ্রহণ করে। নিষেধাজ্ঞার কারণে বিদেশে নগদ অর্থ পাঠানো কিংবা রাশিয়ান শেয়ারে বিনিয়োগ করা কঠিন হয়ে পড়ে, তাই অনেকে সম্পত্তি কেনাকাটায় ঝুঁকে পড়ে।
  • দ্বিতীয়ত, অনেক সম্পত্তি ডেভেলপার (Property Developers) ক্রেমলিনকে (Kremlin) এই কর্মসূচি চালিয়ে যেতে তদবির করে, কারণ এটি তাদের বিক্রয় ব্যাপকভাবে বাড়িয়ে তোলে। ক্রেমলিনও এ বিষয়ে সায় দেয়, কারণ এটি রাশিয়ার মোট দেশজ উৎপাদনের (GDP – Gross Domestic Product) পরিসংখ্যানে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে এবং নির্মাণ শিল্পকে (Construction Industry) চাঙা রাখে। রাশিয়ান সংবাদ সংস্থা তাস (Tass)-এর তথ্যমতে, নির্মাণ শিল্পের প্রবৃদ্ধি উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি পেয়েছে।

আবাসন খাতে ব্যয় বৃদ্ধি

২০২৩ সালে নতুন আবাসন নির্মাণের পরিমাণ ছিল ১৯৯০ সালের পর সর্বোচ্চ। সেই বছর আবাসন ক্রয় মোট সম্পদ বিনিয়োগের (Asset Investment) বড় অংশ দখল করে। আবাসন খাতে এই উত্থান এবং প্রতিরক্ষা ব্যয় (Defence Spending) বৃদ্ধি মিলিয়ে রাশিয়ার জিডিপি (GDP) পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও বৃদ্ধি অব্যাহত রাখতে সক্ষম হয়েছে। অন্যদিকে, এই মর্টগেজ স্কিম চার বছর চালু রাখার কারণে ক্রেমলিনের ব্যয় প্রায় ৬০০ বিলিয়ন রুবল (Rubles) ছাড়িয়ে গেছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক যখন মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সুদের হার বাড়াচ্ছিল, তখন এই স্কিম আরও ব্যয়বহুল হয়ে ওঠে। রাশিয়ার অর্থ মন্ত্রণালয়ের (Finance Ministry) হিসাব অনুযায়ী, ২০২৬ সাল পর্যন্ত কর্মসূচিটি চালিয়ে যেতে হলে সরকারের আরও ১ ট্রিলিয়ন রুবল ব্যয় করতে হতো।

যুদ্ধের আগের সময়ে রাশিয়ান রাষ্ট্র খুব বেশি ব্যয় কিংবা ঋণ নিত না, যার ফলে তাদের একটি উল্লেখযোগ্য আর্থিক পরিসর (Fiscal Space) তৈরি হয়েছিল: ঋণ থেকে জিডিপির অনুপাত (Debt to GDP Ratio) ছিল কম, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ (Foreign Exchange Reserves) ছিল পর্যাপ্ত। এছাড়াও, যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর পশ্চিমা জ্বালানি নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হলেও তা ছিল তুলনামূলক শিথিল, এবং সামগ্রিক জ্বালানি দামের ঊর্ধ্বগতি রাশিয়াকে তেল বিক্রি থেকে বড় অঙ্কের মুনাফা এনে দেয়। ফলে সরকারের পক্ষে এ কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়া আপাতত সহজ হয়ে দাঁড়ায়।

কিন্তু সাম্প্রতিক মাসগুলোতে পরিস্থিতি নাটকীয়ভাবে বদলে গেছে। এখনো রাশিয়ার কিছুটা আর্থিক পরিসর আছে, ঋণ-জিডিপির অনুপাত তুলনামূলক কম, কিন্তু অর্থনীতি এখন অত্যধিক উত্তপ্ত (Overheating)। এর বড় একটি কারণ হলো অনন্য মাত্রার সামরিক ব্যয় (Military Spending) যা এখন জিডিপির ৮%।

সুদের হারের বৃদ্ধি ও স্কিমটির নিয়ন্ত্রণ

অর্থনীতি এখন এমন গতিতে বাড়ছে যা স্থায়ী নয়। সরবরাহ চাহিদা মেটাতে পারছে না, ফলে শ্রমিক সংকট ও মুদ্রাস্ফীতি তীব্রতর হচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সরকারকে পরামর্শ দিয়েছে প্রতিরক্ষা ব্যয়, যা ফেডারেল বাজেটের এক-তৃতীয়াংশ, কমানোর জন্য। কিন্তু পুতিন (Putin) যখন ইউক্রেইনে আগ্রাসী অপারেশন আরও তীব্র করছেন, তখন প্রতিরক্ষা ব্যয় কমার সম্ভাবনা নেই। বরং আগামী বছরে তা প্রায় ৩০% বৃদ্ধির পথে।

ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাধ্য হয়ে সুদের হার আগ্রাসীভাবে বাড়াচ্ছে। কিন্তু এই সুদের হার বৃদ্ধির প্রভাব মর্টগেজ স্কিমের কারণে ধাক্কা খাচ্ছে, কারণ মর্টগেজ ধারকরা এখনো ৮% হারের গণ্ডিতে নিরাপদে রয়েছে। এই পরিস্থিতি মুদ্রাস্ফীতিকে (Inflation) কমানো কঠিন করে তুলছে, যা এখনো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের লক্ষ্যমাত্রা ৪%-এর দ্বিগুণেরও বেশি।

এ কারণে জুলাই মাসে সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরামর্শ অনুসারে কর্মসূচিটি বেশিরভাগের জন্য বন্ধ করে দেয়, শুধুমাত্র যেসব পরিবারের অন্তত দুটি সন্তান আছে তাদের জন্য তা চালু রাখে। এর ফলে রাশিয়ার রিয়াল এস্টেট বাজারে বড় ধরনের অস্থিরতা দেখা দিয়েছে এবং অনেকে ধারণা করছেন দেশটি পূর্ণাঙ্গ একটি সম্পত্তি সংকটের পথে।

সমস্যার মূলে রয়েছে সম্পত্তির অতিমূলায়ন (Overvaluation)। মর্টগেজ ঋণ ব্যাপক বৃদ্ধি পেয়েছিল এবং গত তিন বছরে রাশিয়ার বড় শহরগুলোতে সম্পত্তির দাম প্রায় ১৭০% বেড়েছে বলে দ্য ইকোনমিস্ট (The Economist) জানিয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে মর্টগেজ ভর্তুকি প্রত্যাহার সম্পত্তির দামে বড় রকমের পতন ঘটাতে পারে।

স্কিম প্রত্যাহারের পর এখন মর্টগেজের সুদের হার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রেফারেন্স (Benchmark) হারের সঙ্গে যুক্ত, যা বর্তমানে প্রায় ১৫%। সম্প্রতি রাশিয়ার সবচেয়ে বড় কয়েকটি ব্যাংকের মর্টগেজ হার ৮% থেকে বেড়ে ২২%-এরও বেশি হয়েছে। দেশের সবচেয়ে বড় মর্টগেজ প্রদানকারী ব্যাংক স্পেয়ারব্যাংক (SberBank) সুদের হার ২৮%-এ নিয়ে গেছে। ফলে মাসিক পরিশোধ অনেক বেশি বেড়ে গেছে, আগের তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি। এতে অনেক বাড়ির মালিককে হয় সম্পত্তি বিক্রি করতে হবে অথবা ছোট বাসস্থানে চলে যেতে হবে।

সংকটময় পরিণতি

রিয়াল এস্টেট কোম্পানিগুলোর সংকট: সুদের হার বৃদ্ধির কারণে এখন আর কেউ আগের দামে বাড়ি কিনতে পারছে না। এ জন্য স্কিম প্রত্যাহারের পর মর্টগেজ অনুমোদন (Mortgage Approval) অর্ধেকে নেমে এসেছে। নতুন নির্মিত অ্যাপার্টমেন্ট (New Build Apartments)-এর চাহিদাও ব্যাপকভাবে কমেছে। মস্কোতে (Moscow) ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত নতুন সম্পত্তি বিক্রি ৪৮% কমে গেছে। অন্য অনেক অঞ্চলে পরিস্থিতি আরও খারাপ। ক্রাসনোইয়ার্সকে (Krasnoyarsk) বিক্রি পতন ৬২%। ফলে রিয়াল এস্টেট কোম্পানিগুলো গভীর সংকটে পড়েছে, এবং ধারনা করা হচ্ছে দেশের সবচেয়ে বড় ডেভেলপার যেমন পিক (Pik) এবং সামোলেট (Samolet) হয়তো দেউলিয়া হওয়ার (Bankruptcy) দ্বারপ্রান্তে। এখনো সম্পত্তির দাম ব্যাপকভাবে পড়ে যায়নি, কারণ যেসব ক্রেতা বাড়ি কিনতে পারছেন না তারা ভাড়ার (Rental) দিকে ঝুঁকছেন। ফলে ভাড়ার মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে।

মর্টগেজ হার বৃদ্ধি ও সম্পত্তি ক্রয়ের অক্ষমতা: সিআইএম (CIAM) ডেটা অনুযায়ী, রাশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে ১ বেডরুমের অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া আগস্ট থেকে ১০% থেকে ৬১% পর্যন্ত বেড়েছে। মস্কো ও সেন্ট পিটার্সবার্গে (St. Petersburg) ভাড়া আরও বেশি বেড়েছে, কিছু ক্ষেত্রে প্রায় দ্বিগুণ পর্যন্ত। মস্কোতে ১ বেডরুমের অ্যাপার্টমেন্টের গড় ভাড়া এখন ৬৮,২০০ রুবল, যা প্রায় ৬১৭.৪০ ইউরো (Euro)। এটি জাতীয় গড় মাসিক মজুরিের সমান প্রায়। অর্থাৎ, এখন এক মাসের পুরো মজুরি খরচ করে মাত্র এক মাসের ভাড়া মেটানো যাচ্ছে।

মূল্য হ্রাসের সাথে ভাড়া বৃদ্ধির পাল্টা প্রভাব: এখন প্রশ্ন উঠতে পারে: সম্পত্তির অতিমূলায়ন যদি কমে আসে, তাহলে কি তা খারাপ? একটি নিয়মিত মূল্য সংশোধন (Correction) তো স্বাভাবিক ঘটনা। কিন্তু সমস্যা হলো, এই ধরনের বড় ধরনের মূল্য সংশোধন স্বল্পমেয়াদে অর্থনীতিতে প্রচণ্ড ধাক্কা দেয়, যা রাশিয়া এখন বহন করতে পারবে না। অনেক সময় এর সমাধান হিসেবে আর্থিক উদ্দীপক বা ফিসকাল স্টিমুলাস (Fiscal Stimulus) প্রয়োজন হয়, যা চীন (China) এখন চেষ্টা করছে। কিন্তু ক্রেমলিনের পক্ষে এটি করা কঠিন, কারণ তারা ইতিমধ্যেই বিপুল অর্থ ব্যয় করছে এবং বাজেটের বড় অংশ প্রতিরক্ষায় যাচ্ছে।

উপসংহার

সারসংক্ষেপে, মর্টগেজ ভর্তুকি কর্মসূচির অবসান রাশিয়ার রিয়াল এস্টেট খাতকে চাপে ফেলেছে। সম্পত্তির মূল্য অত্যধিক উঁচু হয়ে গিয়েছিল, সুদের হার বেড়ে যাওয়ার ফলে মানুষ আর আগের দামে বাড়ি কিনতে পারছে না, বিক্রি কমে যাচ্ছে, ডেভেলপাররা দেউলিয়া হওয়ার ঝুঁকিতে পড়েছে, আর ভাড়া মহার্ঘ হয়ে উঠছে। এ অবস্থায় দীর্ঘমেয়াদে মূল্য সংশোধন প্রয়োজন হতে পারে, কিন্তু স্বল্পমেয়াদে এটি রাশিয়ার আগে থেকেই চাপে থাকা অর্থনীতিকে আরও সঙ্কটে ফেলবে। আর ক্রেমলিনের হাতে খুব বেশি বিকল্প নেই, কারণ প্রতিরক্ষা ব্যয় ও অন্যান্য খাতে আগেই প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে। সব মিলিয়ে, রাশিয়া এখন এমন এক মোড়ে দাঁড়িয়ে আছে, যেখানে রিয়াল এস্টেট সংকটের সম্ভাব্য অভিঘাত তাদের অর্থনীতিতে গভীর এক মন্দার ঝুঁকি তৈরি করেছে।

তথ্যসূত্র

Russia ends housing mortgage subsidy
https://www.themoscowtimes.com/2024/10/18/russias-real-estate-market-rocked-by-the-end-of-generous-mortgage-subsidies-a86738
https://www.bloomberg.com/news/articles/2024-07-01/russia-ends-housing-mortgage-subsidy-that-stoked-a-property-boom
https://www.intellinews.com/russia-s-mortgage-loan-applications-halved-in-july-by-end-of-subsidies-programme-337189/
https://wavellroom.com/2024/06/20/russias-collapsing-housing-market/

Construction industry
https://tass.com/economy/1701819

Central bank rate hikes and inflation
https://www.intellinews.com/russia-s-central-bank-surprises-market-with-100bp-rate-hike-to-19-343316/

KSE institute paper on Russian economy
https://kse.ua/wp-content/uploads/2024/08/Chartbook_August2024.pdf

Russia’s predicted 2025 GDP growth
https://www.statista.com/chart/30484/forecast-for-real-gdp-growth-in-the-worlds-largest-economies/

বিশ্ববাজারে তেল ও গ্যাসের শক্তির পরিবর্তন: যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি আরব ও রাশিয়ার ভূ-রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা (৩০ নভেম্বর, ২০২৪)

ভূমিকা

বিশ্বরাজনীতিতে (Geopolitics) একটি সাধারণ নিয়ম সবসময় প্রাসঙ্গিক থেকেছে— ক্ষমতা (Power) আসে জ্বালানি (Energy) থেকে। অর্থনীতি (Economy) ও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা বহুলাংশে নির্ভর করে পর্যাপ্ত জ্বালানি সম্পদের প্রাপ্যতার ওপর। যে কেউ জ্বালানি নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবহার করতে পারবে, সেই অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে পারবে, প্রভাব খাটাতে পারবে এবং প্রতিদ্বন্দ্বীদের পেছনে ফেলতে পারবে। তাই তেল (Oil) ও গ্যাস (Gas) জিওপলিটিক্সে একটি শক্তিশালী অস্ত্র (Weapon) এবং রাষ্ট্রশক্তির (State Power) জন্য অতি মূল্যবান সম্পদ।

বিশেষ করে ২০২০-এর দশকে এই সত্য আরও স্পষ্ট হয়েছে। কোভিড-১৯ মহামারি (Pandemic) এবং ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যে (Middle East) যুদ্ধের প্রাদুর্ভাবে বিশ্ব ক্রমেই অস্থির হয়ে উঠেছে। একদিকে দীর্ঘমেয়াদি নেট জিরো (Net Zero) বাস্তবায়নের স্বপ্ন কিছুটা থমকে গেছে, অন্যদিকে রাষ্ট্রগুলোকে তড়িঘড়ি করে শক্তি-নিরাপত্তা (Energy Security) পুনরুদ্ধারে মনোযোগী হতে হচ্ছে। ভাগ্যক্রমে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রে (US) শেল বুম (Shale Boom) হওয়ায় প্রচুর পরিমাণে তেল ও গ্যাস সরবরাহ রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র এখন বিশ্বে অপরিশোধিত তেল (Crude Oil) এবং গ্যাস উৎপাদনে শীর্ষস্থানীয়। ফলে যে ত্রিমুখী ক্ষমতার সমীকরণ—সৌদি আরব (Saudi Arabia), রাশিয়া (Russia) এবং যুক্তরাষ্ট্র (US)—তারা মিলে বিশ্বে মোট অপরিশোধিত তেলের ৪০% ও প্রাকৃতিক গ্যাসের (Natural Gas) ৪৩% উৎপাদন করে। এদের সঙ্গে জোটগত সম্পর্ক ও বৈদেশিক বিনিয়োগের (Foreign Investment) সূত্রে বিশ্ববাজারের (Global Market) আরও বড় একটি অংশকে নিয়ন্ত্রণ করে। অন্যান্য দেশও অবশ্য তেল-গ্যাস উৎপাদন করে, তবে প্রকৃত কর্তৃত্বে তারাই প্রধান শক্তি।

বর্তমান অস্থিরতা এবং পরিবর্তনের সময়ে, এই তিন শক্তি তেল-গ্যাস বাণিজ্যের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সংগ্রামে লিপ্ত। যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপীয় বাজার (European Market) রাশিয়ার কাছ থেকে কেড়ে নিচ্ছে এবং বৈশ্বিক বাজারের মূল্য-ব্যবস্থাপক হিসেবে সৌদি আরব ও ওপেকের (OPEC) কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করছে। যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বিষয়টি লাভজনক হলেও রাশিয়া ও সৌদি আরবের জন্য তেল-গ্যাস শুধু অর্থনীতির অংশ নয়; সেটাই আসলে তাদের অর্থনীতি। তাদের প্রধান ক্ষমতার উৎস। তাই তাদের আয় যখন হুমকিতে পড়ে, তখন তারা পাল্টা পদক্ষেপ নিতেই বাধ্য হয়। রাশিয়ার ক্ষেত্রে আমরা ইতোমধ্যেই এর উদাহরণ দেখেছি। আর ইতিহাস বলে, সৌদি আরবের পক্ষ থেকেও যে কোনো সময় বড় ধরনের প্রতিশোধাত্মক পদক্ষেপ নেওয়া অসম্ভব নয়। বিশেষ করে এমন কিছু, যা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বিপর্যয়কর হতে পারে।

তাহলে কীভাবে যুক্তরাষ্ট্রের উদীয়মান তেলশিল্প (Oil Industry) পুরনো শক্তির ভারসাম্য বদলে দিচ্ছে? কেন রাশিয়ার ডার্ক ফ্লিট (Dark Fleet) জাহাজগুলো তাদের অবস্থান গোপন বা ভুয়া লোকেশন দেখিয়ে তেল ও গ্যাস সরবরাহ করছে? এবং কীভাবে সৌদি আরব যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়াকে চাপে ফেলে আবারও ক্ষমতার শীর্ষে ফেরার চেষ্টা করতে পারে?

যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরবের পুরনো সম্পর্ক

বর্তমান বৈশ্বিক শক্তি সরবরাহের পালাবদল বুঝতে হলে জানতে হবে যে সৌদি আরব ও যুক্তরাষ্ট্র কখনোই এমন প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল না। আসলে তেলের বিশ্বে এই দুই দেশের সম্পর্ক প্রায় ১০০ বছরের পুরনো, এবং শুরুতে তা ছিল পারস্পরিক লাভজনকতার ভিত্তিতে। মহামন্দা (Great Depression) কাটিয়ে ওঠার সময় যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি যখন দ্রুতগতিতে শিল্পায়িত হচ্ছিল, তখন জ্বালানির চাহিদা বাড়তে থাকে। তাই যুক্তরাষ্ট্রের তেল কোম্পানিগুলো বিদেশি উৎসে তেল খুঁজতে ঝুঁকে পড়ে।

এরপর আসে ১৯৩২ সাল। মধ্যপ্রাচ্যের (Middle East) চারটি অঞ্চলকে একীভূত করে ইবনে সাউদ (Ibn Saud) নামে এক শাসকের অধীনে জন্ম নেয় নতুন একটি দেশ—যা আজকের সৌদি আরব। সদ্য প্রতিষ্ঠিত রাজ্যটি উন্নয়ন ও আধুনিকায়নের স্বপ্ন দেখছিল। তাই ১৯৩৩ সালে সৌদি আরব স্ট্যান্ডার্ড অয়েল অব ক্যালিফোর্নিয়াকে (Standard Oil of California) তাদের ভূখণ্ডে তেল অনুসন্ধানের অধিকার দেয়। এর মাধ্যমেই তৈরি হয় ক্যালিফোর্নিয়া-আরাবিয়ান স্ট্যান্ডার্ড অয়েল কোম্পানি, যা পরে অ্যারাবিয়ান-আমেরিকান অয়েল কোম্পানি নাম নেয়। সংক্ষেপে যার নাম—আরামকো (Aramco)। আজকের দিনে সৌদি আরবের সবচেয়ে বড় রাষ্ট্রীয় তেল কোম্পানি (State Control Industry) আরামকো একসময় ১০০% আমেরিকান মালিকানাধীন ছিল, এবং এর নামেই সেই ঐতিহাসিক বন্ধনের ছাপ রয়ে গেছে।

১৯৩৮ সালে প্রথম বড় তেলক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয় এবং এর পরবর্তী কয়েক দশক ধরে সৌদি আরবের তেলশিল্প দ্রুত প্রসারিত হয়। এ সময়টি ছিল সৌদি সরকারের, যুক্তরাষ্ট্রের বড় বড় তেল কোম্পানি এবং মার্কিন সরকারের পরস্পর নির্ভরশীলতার যুগ—সৌদি শাসকের নিরাপত্তায় (Military Protection) সাহায্য করত যুক্তরাষ্ট্র, আর বিনিময়ে তারা পেত তেল। কিন্তু সৌদিরা ধীরে ধীরে উপলব্ধি করে যে তাদের কাছে বিশাল সম্পদ রয়েছে, আর এ সম্পদ অন্যের নিয়ন্ত্রণে রাখতে তারা নারাজ। ফলে ১৯৬০ ও ১৯৭০-এর দশকে তেলের মালিকানা আস্তে আস্তে মার্কিন কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে সৌদি সরকারের হাতে চলে যায়। সৌদির তেলমন্ত্রী আহমেদ জাকি ইয়ামানি (Ahmed Zaki Yamani) এই পথনির্দেশনা দিয়েছিলেন।

সে সময় শুধু সৌদিতেই নয়, আরও অনেক দেশে—যেমন ভেনেজুয়েলা (Venezuela), লিবিয়া (Libya), ইরাক (Iraq), কুয়েত (Kuwait)—তেলশিল্প জাতীয়করণ চলছিল। একই সময়ে, সৌদি আরব সোভিয়েত ইউনিয়নের (Soviet Union) প্রভাব থেকেও রেহাই পাচ্ছিল না। ১৯৫০ ও ১৯৬০-এর দশকে সোভিয়েতরা নিজেদের স্যাটেলাইট রাষ্ট্রগুলো (Satellite States)—পূর্ব ইউরোপ (Eastern Europe), উত্তর কোরিয়া (North Korea), কিউবা (Cuba)—এসব জায়গায় তেল সরবরাহ করত। সেই বাড়তি তেল তারা বিশ্ববাজারে ছেড়ে দিয়ে দাম কমিয়ে দিত। এতে সৌদির রপ্তানি (Export) আয়ে চাপ পড়ে। সৌদিরা এই অতিরিক্ত সরবরাহের প্রতিক্রিয়ায় অন্যান্য বড় তেল-রপ্তানিকারী দেশের সঙ্গে সমন্বয় শুরু করে, যাতে তারা নিজেদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যগুলো পুরণ করতে পারে। এভাবেই ১৯৬০ সালে তৈরি হয় অর্গানাইজেশন অব পেট্রোলিয়াম এক্সপোর্টিং কান্ট্রিজ (OPEC), যা আজকের দিনে বিশ্বের প্রমাণিত তেল মজুদের (Proven Oil Reserves) ৮০%-এর বেশি উত্তোলনের হার নিয়ন্ত্রণ করে।

১৯৭৩-এর আরব অয়েল ইমবার্গো থেকে শেল বুম পর্যন্ত

১৯৭৩ সালে আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ (Yom Kippur War) চলাকালীন, ইসরায়েলকে (Israel) পশ্চিমা বিশ্বের সামরিক সহায়তার প্রতিবাদে সৌদি আরব এবং অন্যান্য আরব ওপেক দেশগুলো যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের বিরুদ্ধে তেল আমবার্গো (Embargo) আরোপ করে। তখন বিশ্ববাজারে তেলের দাম দ্রুত আকাশচুম্বী হয়, মার্কিন ব্যবসাগুলো তেল-সংকটে ধুঁকতে থাকে, আর যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। এটি ছিল প্রথমবারের মতো, কিন্তু শেষবার নয়, যখন যুক্তরাষ্ট্রের ওপর মধ্যপ্রাচ্যের তেলনির্ভরতাকে নগ্নভাবে প্রকাশ করে দিল।

এই দুর্যোগ সামাল দিতে যুক্তরাষ্ট্র দেশের অভ্যন্তরীণ তেলের ওপর ৪০ বছরের জন্য রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা (Export Ban) দেয়। সৌদি আরব বিশ্বকে দেখিয়ে দিল যে তারাই প্রধান তেল-ক্ষমতা এবং বিশ্বপরিস্থিতিকে নিজেদের পক্ষে নিয়ে আসতে তারা নির্দ্বিধায় নিষেধাজ্ঞা ব্যবহার করতে পারে। পরবর্তী কয়েক দশক এভাবেই চলতে থাকে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের (Collapse of the USSR) আগে এবং পরে, রাশিয়ায় (তখন সোভিয়েত ইউনিয়ন) তেল উৎপাদন কমতে থাকে—বিশেষত ১৯৮০-এর দশকের শেষ ভাগ থেকে ১৯৯০-এর দশক পর্যন্ত—যার ফলে ওপেকের হাতে বাজারের নিয়ন্ত্রণ আরও মজবুত হয়।

এদিকে, ওপেকের ওপর নির্ভরশীলতা থেকে যেন আর বিপাকে পড়তে না হয়, যুক্তরাষ্ট্র জ্বালানি আমদানি (Import) বৈচিত্র্যময় করার কৌশল নেয়। তাদের অভ্যন্তরীণ তেল উৎপাদনও ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছিল। এরই মধ্যে বিশ্লেষক ও সামরিক বিশেষজ্ঞরা বারবার বলে আসছিলেন—যুক্তরাষ্ট্রের জ্বালানি নিরাপত্তা (Oil Security) এবং বিদেশি জ্বালানি উৎপাদনের ওপর নিয়ন্ত্রণহীনতা তাদের একটি প্রধান দুর্বলতা হয়ে উঠেছে। অনেকে মনে করেন, ২০০৩ সালে ইরাকে (Iraq) মার্কিন হামলার অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য ছিল ইরাকের তেলক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের প্রবেশাধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা। কারণ ৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে সেখানে মার্কিন তেল কোম্পানিগুলোর কাজ করার সুযোগ ছিল না। পরবর্তীতে সেখানে হলিবার্টন (Halliburton) নামের একটি তেল পরিষেবা কোম্পানি—যার সঙ্গে তৎকালীন মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট ডিক চেনির (Dick Cheney) সংশ্লিষ্টতা ছিল—তারা আবারও কাজ শুরু করে।

রাষ্ট্রীয়ভাবে তখন যুক্তরাষ্ট্র বলছিল, ইরাকের স্বৈরশাসক সাদ্দাম হুসেইনের (Saddam Hussein) কাছে ব্যাপক বিধ্বংসী অস্ত্র (Weapons of Mass Destruction) আছে এবং তিনি বিশ্বশান্তির জন্য হুমকি। কিন্তু আজ পর্যন্ত সে দাবির কোনো প্রমাণ মেলেনি। যাই হোক, ইরাকে ঢোকার পর যুক্তরাষ্ট্র ইরাকি তেল-আমদানি বাড়ানোর সুযোগ পেল। যদিও এর ফলে বাইরের তেলের ওপর মার্কিন নির্ভরশীলতা বড় কোনো পরিবর্তন হয়নি।

এরপর আসে ২১ শতকের hydraulic ফ্র্যাকিং (Fracking) আবিষ্কার ও শেল বুম (Shale Boom)। যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ তেল মজুদ এত বেড়ে গেল যে, ২০১৫ সালে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা (Barack Obama) প্রায় ৪০ বছর পর কাঁচা তেল রপ্তানির নিষেধাজ্ঞা তুলে নেন। যুক্তরাষ্ট্র আবার বড়সড় তেল রপ্তানিকারী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করল। কিন্তু একই সময় সৌদি আরবসহ বড় সব তেল উৎপাদনকারী দেশগুলোও বিপুল পরিমাণে তেল সরবরাহ বাড়িয়ে দিচ্ছিল, যার ফলে ২০১৪-১৫ নাগাদ তেলের দাম প্রায় ৭০% পর্যন্ত পড়ে যায়।

এই পরিস্থিতিতে ওপেক (OPEC) বেশ কিছু পদক্ষেপ নেয়। তারা অতিরিক্ত ১০টি তেল-উৎপাদক দেশের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়—যাকে এখন ওপেক প্লাস (OPEC Plus) বলা হয়—যাতে মিলিতভাবে উৎপাদন নিয়ন্ত্রণ করে দাম স্থিতিশীল রাখা যায়। ওই ১০টি দেশের মধ্যে রাশিয়া অন্যতম বড় উৎপাদক। সৌদি আরব ও রাশিয়ার এই ঐক্য প্রমাণ করে যে, যুক্তরাষ্ট্রের শেল বুম তাদের জন্য কতখানি হুমকি তৈরি করেছে।

রাশিয়া-ইউক্রেইন যুদ্ধ, ইউরোপীয় বাজার ও মার্কিন ভূমিকায় পরিবর্তন

যুক্তরাষ্ট্রের শেল বুমের আরেকটি ফলাফল হলো—পশ্চিমা বিশ্ব এখন তেলের উৎস নির্বাচন করতে আরও সাবধানী হতে পারছে। রাশিয়া ২০২২ সালে ইউক্রেইনে (Ukraine) আগ্রাসন শুরু করলে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (EU) রুশ তেলের ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে সক্রিয় হয়ে ওঠে। ঐতিহাসিকভাবে রাশিয়া ছিল ইইউর একটি প্রধান জ্বালানি সরবরাহকারী। কিন্তু যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর, রাশিয়ান তেল ও গ্যাস আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা (Sanction) আরোপ করে ইইউ—তাদের ছয় দফা প্যাকেজে (যা ২০২২ ও ২০২৩ সালে কার্যকর হয়) রাশিয়ান সিবর্ন (Seaborn) অপরিশোধিত তেল ও পেট্রোলিয়াম পণ্য আমদানি নিষিদ্ধ করা হয়। এর ফলে ইইউতে রাশিয়ান তেল আমদানি ৯০% পর্যন্ত কমে যায় এবং গ্যাসের ক্ষেত্রেও রাশিয়ান আমদানির হার ৪০% থেকে ১৫%-এ নেমে আসে। এটি আগামীতে আরও কমবে বলে ধারণা করা হচ্ছে, কারণ ইইউ প্রথমবারের মতো রুশ গ্যাসের ওপরও সরাসরি নিষেধাজ্ঞা চাপাতে শুরু করেছে।

এই শূন্যস্থান পূরণে এগিয়ে আসে যুক্তরাষ্ট্র। শেল বুমে তাদের উৎপাদিত অতিরিক্ত তেল ও এলএনজি (LNG) অর্থাৎ লিকুইফায়েড ন্যাচারাল গ্যাস (Liquefied Natural Gas) রপ্তানি করে ইউরোপে বড় সরবরাহকারী হয়ে ওঠে তারা। ইউরোপের কাছে যুক্তরাষ্ট্রের তেল ও গ্যাস কেনা ছিল অপেক্ষাকৃত সহজ একটি সমাধান—কারণ সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিকভাবে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ অনেকটাই সমমনা। এছাড়া সৌদি আরব বা রাশিয়ার মিত্র কাজাখস্তানের (Kazakhstan) মতো রাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীল হওয়ার ঝুঁকি ইউরোপ চায়নি। তাই শুধু নতুন এলএনজি টার্মিনালগুলো দ্রুত তৈরি করে ইউরোপ রাশিয়ান গ্যাসের পরিবর্তে মার্কিন গ্যাস আমদানি শুরু করে। ফলস্বরূপ, রাশিয়া যেসব দেশে মোটামুটি অর্ধেক তেল ও তার বেশি গ্যাস রপ্তানি করত—সেই ইউরোপীয় বাজারে বড় ধাক্কা খায়। নতুন ক্রেতা হিসেবে ভারত (India), চীন (China) ও তুরস্ক (Turkey) রাশিয়ান তেল কিনতে এগিয়ে এলো বটে, তবে রাশিয়াকে তখন বিশ্ববাজারে ব্যাপক ছাড় দিতে হলো।

ডার্ক ফ্লিট (Dark Fleet) ও নিষেধাজ্ঞা রাশিয়ানদের ফাঁকি

ইইউর সিবর্ন রাশিয়ান তেল নিষেধাজ্ঞার পাশাপাশি জি-৭ (G7) একটি মূল্যসীমা (Price Cap) বেঁধে দেয়: প্রতি ব্যারেল রাশিয়ান সিবর্ন তেলের দাম ৬০ ডলারের বেশি হতে পারবে না। যদি কেউ এই সীমার ওপরে রাশিয়ান তেল বিক্রি করে ধরা পড়ে, তাহলে সেই রাশিয়ান তেল ট্যাংকারকে (Tanker) বিমা (Insurance) সেবাদাতা—যেমন আমেরিকা ক্লাব (American Club), ওয়েস্ট অব ইংল্যান্ড (West of England), গার্ড (Guard) ইত্যাদি—বিমা দেবে না। এতে ট্যাংকার চালানো খুবই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়বে।

ফলে রাশিয়ানরা নিষেধাজ্ঞা এড়াতে একটি ডার্ক ফ্লিট গড়ে তুলেছে। ধারণা করা হয়, বিশ্বে মোট অপরিশোধিত তেলবাহী জাহাজের (Crude Oil Vessel) প্রায় ২০%—প্রকৃত হিসাব করা কঠিন বলে “রাফ এস্টিমেট (Rough Estimate)”—এই ডার্ক ফ্লিটের অন্তর্ভুক্ত। এরা জাহাজের ট্র্যাকিং সিস্টেম (Location Signal) বন্ধ বা জাল লোকেশন দেখায় যাতে কেউ বুঝতে না পারে এই ট্যাংকার কোথায় যাচ্ছে, কী করছে। এভাবেই তারা বিশ্ববাজারের নিয়ম ও নিষেধাজ্ঞা এড়িয়ে চলেছে।

নতুন শীতল যুদ্ধ (New Cold War) চলছে কিনা, তা বোঝার এক বড় লক্ষণ হলো—গোপনে থাকা এই রাশিয়ান তেলবাহী জাহাজগুলো “কোভার্ট অপারেশন (Covert Operation)” চালাচ্ছে। কিংবা, ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে নর্ডস্ট্রিম (Nord Stream) গ্যাস পাইপলাইন বিস্ফোরণও তো এ অভিযোগকে দৃঢ় করতে পারে। রাশিয়া থেকে জার্মানিতে (Germany) গ্যাস পরিবহনের জন্য এই পাইপলাইন স্থাপন করা হয়েছিল, যা এখন অচল। কে বা কারা এটি ধ্বংস করেছে, আজও তার কোনো চূড়ান্ত প্রমাণ মেলেনি। জার্মানি, সুইডেন (Sweden) ও ডেনমার্ক (Denmark) তদন্ত চালিয়েও হামলাকারী কে, আদেশ দিয়েছিল কে—এসব প্রশ্নের জবাব পায়নি।

এরই মধ্যে রাশিয়া ইউরোপে তেল ঢোকানোর অন্য উপায় খুঁজে নিয়েছে। ডার্ক ফ্লিটের সাহায্যে রাশিয়ান অপরিশোধিত তেল ভারতে পাঠানো হয়। পরে ভারতে পরিশোধিত (Refined) হলে সেটি আর “রাশিয়ান তেল” হিসেবে গণ্য হয় না। তখন সেই তেল এলোপাথাড়ি ইউরোপেই ফেরত যাচ্ছে। ইইউর নিষেধাজ্ঞা এখানেই ফাঁকি পড়ে। তাই নিষেধাজ্ঞার তোয়াক্কা না করেই রাশিয়া উপার্জন করছে। তবে তা আগের তুলনায় অনেক কম। রাশিয়ার কেন্দ্রীয় তহবিলে (Federal Revenue) তেল-গ্যাস থেকে আগের মতো অঢেল অর্থ আসছে না। এর কারণে ইউক্রেইন যুদ্ধে (War in Ukraine) পুতিনের (Putin) অর্থায়নও চাপে পড়েছে।

মধ্যপ্রাচ্যের অস্থিরতা ও বিশ্ববাজারে প্রভাব

রাশিয়া-ইউক্রেইন যুদ্ধের কারণে বিশ্ব তেল ও গ্যাস বাজারে যে বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে, সেখানে মধ্যপ্রাচ্যও যোগ দিয়েছে। গাজায় (Gaza) সংঘাত এবং লেবাননের (Lebanon) হিজবুল্লাহ (Hezbollah) ও ইরান (Iran) যুক্ত হয়ে ঝুঁকি বাড়িয়েছে। তেলের বাজারে মধ্যপ্রাচ্য বরাবরই গুরুত্বপূর্ণ, কারণ বিশ্বে এক-তৃতীয়াংশ তেল মধ্যপ্রাচ্য থেকে আসে। ইরানের ওপর আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা নতুন কিছু নয়, কিন্তু ইয়েমেনে (Yemen) ইরান-সমর্থিত হুথি (Houthi) বিদ্রোহীরা রেড সি (Red Sea)-তে বাণিজ্যিক জাহাজ হাইজ্যাক ও মিসাইল (Missile) হামলা শুরু করায় ওই রুট দিয়ে তেল পরিবহন কমে গেছে। ফলে অনেক জাহাজই এখন আর রেড সি ব্যবহার করছে না; বরং আফ্রিকার দক্ষিণ প্রান্ত কেপ অব গুড হোপ (Cape of Good Hope) ঘুরে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিচ্ছে। এতে পরিবহন খরচ ও সময়—দুটোই বেড়ে যাচ্ছে।

সৌদি আরবের অবস্থান: ১৯৭৩-এর পুনরাবৃত্তি নেই কেন?

সৌদি আরব মধ্যপ্রাচ্যের ডি-ফ্যাক্টো (De Facto) নেতা এবং ওপেকের মূল চালিকাশক্তি। ১৯৭৩ সালে তারা ইসরায়েলকে সমর্থনকারী পশ্চিমাদের ওপর তেল নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল। এবার যদিও ইসরায়েলের সঙ্গে আবার সংঘাত চলছে, সৌদি আরব এখনো আক্রমণাত্মকভাবে কার্ড খেলেনি। এর কারণ একাধিক। একদিকে, বিগত কয়েক দশকে সৌদি আরব ও যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদার হয়েছে। সৌদি আরব এখন বিনিয়োগে বৈচিত্র্য আনতে চায়—তেলনির্ভরতা কমিয়ে বিনোদন (Entertainment), পর্যটন (Tourism), প্রযুক্তি (Technology) প্রভৃতি ক্ষেত্রে এগোতে চায়। এ সময় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শত্রুতা তাদের ক্ষতি করতে পারে।

অন্যদিকে, পশ্চিমা বিশ্ব এখন সৌদি তেলের ওপর সেই পর্যায়ের নির্ভরশীল নয়। যুক্তরাষ্ট্রের শেল বুমের কল্যাণে আজ ১৯৭০-এর দশকের মতো তেলের ঘাটতি হলে পশ্চিমারা অচল হয়ে যাবে—এমন আশঙ্কা নেই। কাজেই, এখন সৌদি আরব যদি আরেকটি তেল অবরোধ (Embargo) চাপায়ও, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ সহজেই অন্য উৎস থেকে জোগান পেতে পারে। এতে সৌদির নিজেরই ক্ষতি হবে বেশি। তাই এমন কোনো চরম পদক্ষেপ নেওয়া এখন তাদের পক্ষে সঙ্গত নয়।

বিশ্ববাজারে দর-যুদ্ধ: সৌদি আরব বনাম যুক্তরাষ্ট্র

সৌদি আরব ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে দৃশ্যমান মিত্রতা থাকলেও, তেল ও গ্যাসের বিশ্ববাজারে দুটি পক্ষই প্রতিযোগী। গত দুই বছর ধরে সৌদি আরবের নেতৃত্বে ওপেক তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি ১০০ ডলারে নিয়ে যেতে চায়। বাজারে সংকট তৈরি করে দাম বাড়াতে তারা উৎপাদন কেটে (Production Cut) সরবরাহ কমাচ্ছে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা (Canada) এবং নতুন খেলোয়াড় গায়ানা (Guyana)—যার তেলশিল্প মূলত মার্কিন কোম্পানিগুলো পরিচালনা করে—তারা উৎপাদন বাড়িয়ে দিচ্ছে। ফলে বিশ্ববাজারে দাম তেমন বাড়ছে না; ব্যারেলপ্রতি ৭০-৮০ ডলারের আশেপাশেই আটকে থাকছে।

এছাড়া চীনের (China) অর্থনীতিতে চাহিদা দুর্বল হয়েছে, তারা বিশ্ববাজারের সবচেয়ে বড় তেল আমদানিকারক (Importer)। ফলে সৌদির আয় কমছে, আর বাজেট ঘাটতি (Budget Deficit) সামাল দিতে তাদের সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। এখন সৌদি আরবের কাছে দুটি পথ খোলা। এক, তারা চায় যদি মার্কিন শেলের বাজারদখল আর না বাড়ে, তাহলে ওপেক ও ওপেক প্লাসকে (OPEC Plus) নিয়ে করা উৎপাদন কাটা প্রত্যাহার করে তারা উৎপাদন বাড়াতে পারে। সৌদি আরব একাই প্রতিদিন ৩০ লাখ ব্যারেল বেশি তেল উত্তোলন করতে সক্ষম। এমনটা করলে বাজারে সরবরাহ বেড়ে দামের পতন হবে, যাকে বলে প্রাইস ওয়ার (Price War)। স্বল্প মেয়াদে সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তবে উচ্চ খরচের (High-Cost) মার্কিন শেল উৎপাদন সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে পড়বে। আর রাশিয়ার (Russia) ক্ষেত্রেও এই কম দাম যুদ্ধ অর্থায়নে বড় ধাক্কা দেবে।

দ্বিতীয় বিকল্প হলো, সৌদি আরব ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করবে। শেল বুমের চূড়ান্ত স্তর প্রায় পার হয়ে গেছে বলে অনেক বিশ্লেষক মনে করেন। যুক্তরাষ্ট্রের পারমিয়ান বেসিনে (Permian Basin) নতুন কূপের উৎপাদনও কমতে শুরু করেছে। ওয়াল স্ট্রিট (Wall Street) বিনিয়োগে সংযমী হচ্ছে। সৌদি আরবের হাতে যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে প্রায় সাত গুণ বেশি প্রমাণিত তেল মজুদ রয়েছে। দীর্ঘ সময় ধরে উচ্চ উৎপাদন রাখার সক্ষমতা তাদের আছে। তাই যুক্তরাষ্ট্রের রিসার্ভ (Reserve) শেষ হতে শুরু করলে সৌদি আরব বিশ্ব তেলের “লিডিং পাওয়ার (Leading Power)” হিসেবে পুরনো অবস্থান ফিরে পেতে পারে।

উপসংহার

এই মুহূর্তে তেল ও গ্যাসের বাজারে যে অস্থিরতা, তা শুধু অর্থনৈতিক নয়—এর সঙ্গে জড়িত ব্যাপক ভূ-রাজনৈতিক (Geopolitical) উত্তেজনা। রাশিয়ার ডার্ক ফ্লিট নিষেধাজ্ঞা এড়িয়ে তেল বেচছে, সৌদি আরব ওপেকের শীর্ষস্থান বজায় রাখার চেষ্টা চালাচ্ছে, আর যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপের বাজারে নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করছে। যে শক্তি গত শতকে একবার আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের সময় বিশ্বকে কাঁপিয়ে দিয়েছে, সেই তেলের প্রভাব যে এখনো অটুট—তা ইতিহাস ও বর্তমান যুগ মিলিয়ে আমরা বারবার দেখছি।

যুক্তরাষ্ট্রের শেল বুম, ইউরোপের নিষেধাজ্ঞা, রাশিয়ার যুদ্ধে অর্থায়নের চেষ্টা, সৌদির নেতৃত্বে দাম নির্ধারণের লড়াই—সবগুলো মিলে আক্ষরিক অর্থেই একটি নতুন সমীকরণ তৈরির পথে। এই সমীকরণে জ্বালানি নিরাপত্তা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি ভূ-রাজনৈতিক অবস্থানও সমান গুরুত্বপূর্ণ। সামনে পৃথিবীর শক্তির ভারসাম্য কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়, তা দেখার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। একদিকে ডার্ক ফ্লিট, অন্যদিকে সৌদি আরবের সম্ভাব্য কৌশলগত পদক্ষেপ—সব মিলিয়ে বৈশ্বিক তেল ও গ্যাস বাণিজ্যের ভবিষ্যৎ যে আরও বেশ কিছু নাটকীয় মোড় নেবে, তা বলাই বাহুল্য।

কেন রাশিয়ার মুদ্রা রুবলের পতন ঘটছে? (২৮ নভেম্বর, ২০২৪)

ভূমিকা

অতীতে খুব বেশি দিন হয়নি, যখন মনে হচ্ছিল রাশিয়ান রুবল (Russian ruble) নিষেধাজ্ঞার (sanctions) যুদ্ধে জয়লাভ করেছে। পুতিনের (Putin) আগ্রাসনের ফলে মুদ্রাটির তাৎক্ষণিক দরপতন সত্ত্বেও, রুবল খুব দ্রুতই পুনরুদ্ধার করে এবং ২০২২ সালের জুনে ডলারের (dollar) বিপরীতে ৫০ রুবলের পরিমাণে পৌঁছে ৭ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ বিনিময় হার অর্জন করে। কিন্তু এরপর স্থিতিশীল থেকে প্রায় এক বছর ৯০ রুবল প্রতি ডলারের আশেপাশে থাকার পর, চলতি আগস্ট মাস থেকে রুবলের দর অত্যন্ত দ্রুতগতিতে নিম্নমুখী হতে থাকে এবং গত বুধবার তা ডলারের বিপরীতে ১০৮ রুবলের নতুন সর্বনিম্ন অবস্থানে পৌঁছায়। এই আর্টিকেলে রুবলের সাম্প্রতিক পতন, এর পেছনের চালিকাশক্তি এবং কেন এটি ক্রেমলিনের (Kremlin) জন্য খারাপ সংবাদ — তা বিশদভাবে আলোচনা করা হবে।

রুবলের মূল্যমান কীভাবে পরিমাপ করা হয়?

প্রথম যে প্রশ্নটি উঁকি দিতে পারে, তা হল: রুবলের মূল্য কীভাবে নির্ধারণ করা হয়? বাস্তবিকই, স্থানীয় মানি এক্সচেঞ্জে (currency exchange) রুবল সরাসরি বিনিময়যোগ্য নয়। ২০২৩ সালের জুনে যুক্তরাষ্ট্র (US) মস্কো এক্সচেঞ্জ (Moscow exchange)-এর ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে, যেটি ছিল রুবল লেনদেনের শেষ স্বীকৃত কেন্দ্র। তার পর থেকে রাশিয়ান কেন্দ্রীয় ব্যাংক (Russian central bank) রুবলের মূল্য নির্ধারণ করে তথাকথিত ‘ওভার দ্য কাউন্টার ট্রেড’ (over the counter trades) এর মাধ্যমে।

এর মানে হলো, যখন ব্যাংকগুলো বা বড় রপ্তানিকারক সংস্থাগুলো — যেমন গ্যাজপ্রম (Gazprom), যারা এসময়ের রাশিয়ায় উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা সংগ্রহ করে — ডলার বা অন্যান্য বিদেশি মুদ্রার বড় অঙ্কের বিনিময় করে, তখন সেই লেনদেনকে ভিত্তি করেই রুবলের মূল্যমান নির্ধারণ করা হয়। রাশিয়ান কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সরবরাহকৃত তথ্যের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে সংশয় থাকা স্বাভাবিক, কিন্তু এটি আশ্চর্যজনকভাবে বেশ নির্ভরযোগ্য। রাশিয়ান সংবিধান (Russian Constitution) অনুযায়ী, রাশিয়ান কেন্দ্রীয় ব্যাংক কার্যত স্বাধীনভাবে কাজ করে। ধারনা করা হয় যে যুদ্ধের পরেও এই স্বাধীনতা বহাল রয়েছে। এর প্রমাণ হল, ২০২২ সালে প্রথম ধাপের নিষেধাজ্ঞার পর এবং সাম্প্রতিক কয়েক মাসে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্তৃক ধারাবাহিক সুদের হারের (interest rate) বড় বৃদ্ধি। রাজনৈতিক বা ব্যবসায়িক অভিজাতদের আপত্তি সত্ত্বেও সুদের হার বাড়ানো প্রমাণ করে যে ব্যাংক এখনো কার্যকরভাবে স্বাধীন।

রুবলের সাম্প্রতিক পতন

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত এক মাস বা তার একটু বেশি সময় ধরে রুবলের ক্রমাগত পতন আরও বেগ পেয়েছে। প্রসঙ্গত, ২০২২ সালের জুনে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর রুবল ডলারের বিপরীতে প্রায় ৫০ রুবলের বিনিময় হারে পৌঁছেছিল, কিন্তু তারপর থেকে এক বছর ধরে তা ক্রমাগত কমতে কমতে ২০২৩ সালের শুরুতে ডলারের বিপরীতে প্রায় ৯০ রুবলে স্থিতিশীল হয়। তবে দুই-তিন সপ্তাহ আগে এর দর আবার কমতে শুরু করে। আগস্টের শুরুতে ডলারের বিপরীতে ৮৫ রুবল থাকলেও দ্রুত তা নেমে নতুন রেকর্ড নিম্ন বিনিময় হার স্পর্শ করে। স্বভাবতই, এটি পুতিন এবং সাধারণ রুশ জনগণের উভয়ের জন্য খারাপ সংবাদ। যদিও দুর্বল রুবল রপ্তানিকারকদের (exporters) জন্য সহায়ক হতে পারে, এটি আমদানি পণ্যের দাম বাড়ায়, যা মূল্যস্ফীতি (inflation) উস্কে দেয়। স্বাভাবিক অবস্থায় এটি অস্বাভাবিক কিছু হত না, কিন্তু রাশিয়ায় ইতোমধ্যেই বার্ষিক মূল্যস্ফীতি ৮%-এর উপরে এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংক তার বেঞ্চমার্ক সুদের হার (benchmark interest rate) ২১%-এ উন্নীত করেছে। তুলনার জন্য, ইউরোপ (Europe) এবং যুক্তরাষ্ট্রে সুদের হার এখন প্রায় ৫%, এবং এটাকেও খুব বেশি বলেই মনে করা হচ্ছে।

রুবল পতনের কারণসমূহ

তাহলে কেন রুবল পড়ে যাচ্ছে? এর অন্তত পাঁচটি প্রধান কারণ রয়েছে।

  • ১. অর্থ সরবরাহ বৃদ্ধি: রাশিয়ান সরকার যুদ্ধ অর্থায়নের জন্য প্রচুর অর্থ ব্যয় করছে। এর ফলে বাজারে রুবলের সরবরাহ (money supply) নাটকীয়ভাবে বেড়ে গেছে। ইতিহাসের বেশিরভাগ সময়ে রাশিয়ায় অর্থ সরবরাহ বছরে গড়ে প্রায় ১০% বেড়েছে। কিন্তু আগ্রাসনের পর থেকে তা বছরে ২০% বা এমনকি ২৫%-এ পৌঁছেছে। আমরা এটা বলছি না যে কেবলমাত্র অর্থ সরবরাহই মুদ্রাস্ফীতি বা মুদ্রার মান নির্ধারণে একমাত্র বিষয়। তবে ধরুন, রুবলের প্রতি সামগ্রিক চাহিদা অপরিবর্তিত থাকলে, সরবরাহের উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধিতে রুবলের মান হ্রাস পায়। যাতে এটি না ঘটে, তার জন্য রুবলের চাহিদাও তুলনামূলকভাবে বাড়তে হবে। কিন্তু তা হয়নি। নিষেধাজ্ঞার কারণে রপ্তানি করা কঠিন হয়ে পড়েছে, আর বিশ্বব্যাংকের (World Bank) হিসেবে রাশিয়ার জিডিপি (GDP) ২০২২ সালের মাত্র সামান্য উপরে। অর্থাৎ উৎপাদন বাড়েনি উল্লেখযোগ্যহারে।
  • ২. নিষেধাজ্ঞা: দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে নতুন নিষেধাজ্ঞা। রুবলের দরপতন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে গ্যাজপ্রম ব্যাংক (Gazprombank)-এর ওপর আরোপিত নতুন বিধিনিষেধের সঙ্গে মিল রেখেই হয়েছে। গ্যাজপ্রম ব্যাংক এতদিন ছিল রাশিয়ার শেষ বড় অ-নিষেধাজ্ঞাপ্রাপ্ত ব্যাংক। আগে ইউরোপীয় দেশগুলো রাশিয়া থেকে কেনা গ্যাসের (gas) মূল্য পরিশোধের জন্য এই ব্যাংককে ব্যবহার করত। এটিই ছিল রাশিয়ার বাকি থাকা সামান্য কয়েকটি বৈদেশিক মুদ্রা প্রাপ্তির পথের একটি। কিন্তু ডিসেম্বর থেকে যে দ্বিতীয় ধাপের নিষেধাজ্ঞা (secondary sanctions) আরোপ শুরু হয়েছে, তাতে চীন (China) ও তুরস্কের (Turkey) মতো দেশের ব্যাংকগুলোও রুশ প্রতিষ্ঠানের সাথে ব্যবসা করতে নিরুৎসাহিত হয়েছে। ফলে রাশিয়ার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের পথ আরও সংকীর্ণ হয়েছে।
  • ৩. রাশিয়ান অর্থনীতির বাস্তব অবস্থা: তৃতীয় কারণটি আরও সাধারণ: রাশিয়ান অর্থনীতি আগের বছরের মতো আর এতটা শক্তপোক্ত নেই। গত বছর যখন মনে হচ্ছিল রাশিয়া পশ্চিমের অর্থনৈতিক যুদ্ধ (economic warfare) সামাল দিতে পারছে, তখনকার চিত্র এখন আর নেই। সংক্ষেপে বললে, যুদ্ধজনিত সরকারি ব্যয় মুদ্রাস্ফীতির আরেকটি ঢেউ সৃষ্টি করেছে, যা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণে আসছে না সহজে। এই অবস্থায় আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীরা শঙ্কিত হয়ে উঠেছে এবং রাশিয়ানরা তাদের অর্থ বিদেশে সরিয়ে নিচ্ছে, কারণ দেশীয় ব্যাংকে রাখা রুবল আমানতের মান মূল্যস্ফীতির কারণে কমে যাচ্ছে।
  • ৪. রপ্তানিকারকদের ওপর নিয়ন্ত্রণ শিথিলকরণ: চতুর্থ কারণ হল ক্রেমলিন কর্তৃক গৃহীত নীতিগত পরিবর্তন। এতদিন রপ্তানিকারকদের তাদের বৈদেশিক মুদ্রার আয়ের অর্ধেক (৫০%) রুবলে রূপান্তর করতে বাধ্য করা হত। এটি কৃত্রিমভাবে রুবলের মূল্য বৃদ্ধি করে রেখেছিল। কিন্তু কয়েক মাস আগে এই বাধ্যবাধকতা ৫০% থেকে ২৫%-এ নামিয়ে আনা হয়। একইসঙ্গে, আরেকটি নিয়ম যা রপ্তানিকারকদের তাদের ৬০% আয় রাশিয়ায় রাখতে বাধ্য করত, সেটিও জুলাইয়ে ৪০%-এ নামানো হয়। ফলে রপ্তানিকারকরা আর আগের মতো প্রচুর পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রা বিক্রি করে না, যার ফলে রুবলের ওপর নিম্নমুখী চাপ বেড়েছে।
  • ৫. সামরিক উত্তেজনা বৃদ্ধির আশঙ্কা: পঞ্চম এবং শেষ কারণ হল ইউক্রেনে (Ukraine) সামরিক পরিস্থিতি আরও খারাপ হওয়ার আশঙ্কা। এটি ইউরোপীয় ও রাশিয়ান উভয় অর্থনীতির জন্য খারাপ হবে। গত সপ্তাহে রাশিয়া একটি আন্তঃমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র (intercontinental ballistic missile) ব্যবহার করে, যা সামরিক উত্তেজনা বৃদ্ধির আশঙ্কাকে তীব্র করেছে। এর পর থেকেই রুবলের দরপতন আরও বেগবান হয়েছে।

রাশিয়ান রাষ্ট্রের করণীয় কী?

তাহলে রাশিয়া কি এই পতন থামাতে কিছু করতে পারবে? কিছুটা পারলেও তা দীর্ঘমেয়াদে কার্যকর সমাধান বলে মনে হয় না। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ (foreign exchange reserves) ব্যয় করে রুবলকে কৃত্রিমভাবে চাঙা রাখতে পারে, অথবা রাশিয়ান নাগরিক ও রপ্তানিকারকদের ওপর বিদেশে রুবল বিক্রি করা নিষিদ্ধ করার মতো অধিকতর কঠোর মূলধন নিয়ন্ত্রণ (capital controls) আরোপ করতে পারে। কিন্তু এসবই স্বল্পমেয়াদী সমাধান। প্রকৃতপক্ষে, মাত্র দুটি উপায়ে দীর্ঘমেয়াদে রুবলকে শক্তিশালী করা সম্ভব:

  • ১) বৈশ্বিক জ্বালানি (energy) মূল্যের বড় ধরনের বৃদ্ধির মাধ্যমে রাশিয়ার রপ্তানি আয় বাড়ানো।
  • ২) সরকারী ব্যয় হ্রাস করা, যা যুদ্ধের কারণে ফুলে ফেঁপে উঠেছে। তবে ইউক্রেনে অন্তত কিছুটা উত্তেজনা নিরসন না করলে সরকারের ব্যয় কমানোও কঠিন।

উপসংহার

রুবলের সাম্প্রতিক পতন রাশিয়ান অর্থনীতি ও শাসকদের জন্য একটি অস্বস্তিকর বার্তা বহন করে। একদিকে রপ্তানিকারকরা সাময়িকভাবে কিছু লাভবান হতে পারে, কিন্তু সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা ও জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যায়। উচ্চ সুদের হার এবং ইতোমধ্যেই উচ্চ মূল্যস্ফীতি রাশিয়ার অর্থনীতিকে একটি চাপে রাখা অবস্থায় রেখেছে। নিষেধাজ্ঞা, সামরিক উত্তেজনা, এবং সরকারী ব্যয়ের চাপের মধ্যে রুবলের ঘুরে দাঁড়ানোর পথ ক্রমেই কঠিন হয়ে পড়ছে।

সূত্র –

1 – https://www.bloomberg.com/news/articles/2024-11-19/russian-ruble-falls-to-13-month-low-after-ukraine-missile-strike
2 – https://www.bofit.fi/en/monitoring/weekly/2024/vw202435_1/
3 – https://tradingeconomics.com/russia/currency
4 – https://tradingeconomics.com/russia/inflation-cpi
5 – https://tradingeconomics.com/russia/interest-rate
6 – https://www.ceicdata.com/en/indicator/russia/m2-growth
7 – https://www.bloomberg.com/news/articles/2024-10-15/russia-is-willing-to-let-ruble-weaken-to-ease-sanctions-pressure
8 – https://www.bloomberg.com/news/articles/2023-08-09/ruble-weakens-toward-100-per-dollar-for-first-time-in-16-months

রাশিয়ার যুদ্ধ অর্থনীতি (War Economy) উত্তপ্ত: এরপর কী? (১৯ নভেম্বর, ২০২৪)

ভূমিকা

ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরু হওয়ার প্রায় তিন বছর হয়ে গেছে। এই সময়ে রাশিয়ার অর্থনীতি অনেকাংশেই সেই দুর্যোগময় পূর্বাভাসগুলোকে অস্বীকার করেছে যা অনেকেই আগে প্রত্যাশা করেছিলেন। তবে গত কয়েক সপ্তাহে অর্থনৈতিক চিত্র উল্লেখযোগ্যভাবে খারাপ হয়েছে, কারণ ক্রেমলিনের (Kremlin) বিশাল সামরিক ব্যয় এখন অর্থনীতির ওপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করতে শুরু করেছে। এই লেখায় ব্যাখ্যা করা হবে কেন প্রাথমিকভাবে রাশিয়ার অর্থনীতি প্রত্যাশার তুলনায় ভালো পারফর্ম করছিল, কীভাবে তাদের নজিরবিহীন প্রতিরক্ষা ব্যয় (defence spending) এখন সমস্যার সৃষ্টি করছে এবং পরবর্তীতে কী হতে পারে।

তথ্য ঘাটতি ও মূল্যায়ন

এখানে প্রথমেই যেটা বলার আছে তা হলো, কেউই রাশিয়ার অর্থনীতি এখন ঠিক কী অবস্থায় আছে, তা নির্দিষ্টভাবে জানে না। কারণ, ইউক্রেনের যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে রাশিয়ান কর্তৃপক্ষ তাদের অনেক অর্থনৈতিক তথ্য প্রকাশ বন্ধ করে দিয়েছে। যদিও ক্রেমলিন (Kremlin) কিছু তথ্য প্রকাশ আবার শুরু করেছে, সেখানে প্রায়ই অনেক রকম, বিশেষ করে অনুত্তেজক পরিসংখ্যান বাদ দেওয়া হয়। তবুও, আইএমএফ (IMF) এবং বিশ্বব্যাংক (World Bank)-এর মতো আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অনুমান প্রায়ই রাশিয়ান সরকারের পরিসংখ্যান সংস্থা রসস্ট্যাটের (Rosstat) সঙ্গে মোটামুটি সামঞ্জস্যপূর্ণ। এটি ইঙ্গিত দেয় যে, অন্তত বড় ধরনের ম্যাক্রো-ইকোনমিক পরিসংখ্যানগুলোতে রাশিয়ার অভ্যন্তরীণ ডেটা মোটের ওপর সঠিক।

প্রত্যাশার চেয়ে ভালো পারফরম্যান্সের কারণ, এবং কেন এগুলো সাস্টেইনেবল নয়

শুরুতে দেখা যাক, কেন এবং কীভাবে রাশিয়ার অর্থনীতি এত দিন যাবৎ প্রত্যাশার চেয়ে ভালো পারফর্ম করে এসেছে। রাশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের (Russian Central Bank) তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে রাশিয়ার মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বা জিডিপি (GDP) প্রায় ১.২% হ্রাস পেয়েছিল এবং ২০২৩ সালে জিডিপি (GDP) প্রায় ৩.৬% হারে বৃদ্ধি পেয়েছে।

এই বছরের জুনে বিশ্বব্যাংক (World Bank) জানায় যে, ইতোমধ্যে জার্মানিকে ছাড়িয়ে রাশিয়া ক্রয়ক্ষমতা সমতার (purchasing power parity) ভিত্তিতে চীন (China), যুক্তরাষ্ট্র (US) এবং ভারতের (India) পরেই বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম অর্থনীতি। এছাড়াও, জুলাই মাসে বিশ্বব্যাংক (World Bank) রাশিয়াকে উপরের মধ্যম আয়ের দেশ থেকে উন্নীত করে উচ্চ আয়ের দেশের কাতারে নিয়ে গেছে, যেখানে সাধারণত জি-সেভেন (G7) নেতৃস্থানীয় শিল্পোন্নত দেশগুলো অবস্থান করে।

এই বৃদ্ধির বেশিরভাগই এসেছে বিপুল সামরিক ব্যয় (military spending) থেকে, যা রাশিয়া মূলত চালাতে পেরেছে যুদ্ধ শুরুর পূর্বে তাদের হাতে থাকা বড় আর্থিক অবকাশের (fiscal space) কারণে। কারণ যুদ্ধের আগে রাশিয়া খুব বেশি ব্যয় বা ঋণ (borrowing) নেয়নি, তাই তারা সহজেই যুদ্ধ অর্থায়নের জন্য ব্যয় বাড়াতে পেরেছে। এছাড়াও, পশ্চিমা জ্বালানি নিষেধাজ্ঞার (energy sanctions) তুলনামূলকভাবে শিথিল প্রয়োগ এবং ইউক্রেন যুদ্ধ-পরবর্তী জ্বালানি দামের উর্ধ্বগতির কারণে রাশিয়া তেল থেকে প্রচুর লাভ করছে। ফলে রাষ্ট্র যখন নগদ অর্থ হাতে পাচ্ছে, তখন ক্রেমলিন (Kremlin) যুদ্ধের খরচ মেটানো বেশ সহজ ভাবেই চালিয়ে যেতে পারছে।

বর্তমানে রাশিয়ার সামরিক ব্যয় (defence spending) জিডিপির (GDP) প্রায় ৭.৯% ছুঁয়েছে, যা প্রায় ফেডারেল বাজেটের এক-তৃতীয়াংশ। তবে সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে রসস্ট্যাট (Rosstat), রাশিয়ান ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দ এবং অর্থনীতিবিদরা এই নজিরবিহীন সামরিক ব্যয় সম্পর্কে সতর্কতা প্রকাশ করেছেন, এবং এর পেছনে দুটি কারণ উল্লেখ করেছেন।

  • প্রথমত, সামরিক ব্যয় জিডিপিতে (GDP) যুক্ত হলেও এটি ভালো ধরনের জিডিপি নয়, কারণ আপনি ট্যাঙ্ক বানাচ্ছেন, যা পরে ধ্বংস হয়ে যাবে। একইভাবে, ইউক্রেনে যুদ্ধে নিযুক্ত করার জন্য সৈন্য নিয়োগ করা, যাদের অনেকে মারা যাবে, অর্থনীতির জন্য দীর্ঘমেয়াদে কোনো ইতিবাচক বিনিয়োগ নয়।
  • দ্বিতীয়ত, আরও গুরুত্বপূর্ণ হলো, এই বিশাল সরকারি ব্যয় বৃদ্ধির ফলে অর্থনীতির বাকি খাতগুলোতে প্রচণ্ড চাপ তৈরি হচ্ছে, মুদ্রাস্ফীতি (inflation) বাড়ছে এবং কিছু কিছু খাতে অর্থনীতি অতিরিক্ত উত্তপ্ত (overheating) হয়ে উঠছে।

সাম্প্রতিক মুদ্রাস্ফীতির বৃদ্ধি

রাশিয়ায় মুদ্রাস্ফীতি (inflation) ধীরে ধীরে বাড়ছিল এবং এখন প্রত্যাশা করা হচ্ছে যে এ বছর এটি ৮.৫% পর্যন্ত উঠতে পারে। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর যখন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়, তখন অনেক বিশ্লেষক ধারণা করেছিলেন যে রুবলের (ruble) মূল্যহ্রাস ও আমদানির খরচ বৃদ্ধি রাশিয়ায় নজিরবিহীন মুদ্রাস্ফীতি ঘটাবে। তবে যুদ্ধ শুরুর পরপরই সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য মুদ্রাস্ফীতি ২০২২ সালের এপ্রিল মাসে ১৭.৮% ছুঁয়েছিল বটে, কিন্তু রুবলের (ruble) পুনরুদ্ধার এবং তীব্র সুদের হারের (interest rate) বৃদ্ধির ফলে মুদ্রাস্ফীতি তুলনামূলকভাবে দ্রুত কমে আসে।

কিন্তু ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে মুদ্রাস্ফীতি ২.৩% এ নেমে যাওয়ার পর তা আবার বাড়তে শুরু করেছে এবং বর্তমানে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের (Central Bank) ৪% লক্ষ্যের তুলনায় এটি দ্বিগুণেরও বেশি। এমনকি পশ্চিমা অর্থনীতিবিদরা বলছেন, প্রকৃত মুদ্রাস্ফীতি যা ক্রয়ক্ষমতার দিক থেকে সমন্বয় করা হয়, সেটি ২৭% পর্যন্ত হতে পারে।

মুদ্রাস্ফীতি হ্রাস করতে সুদের হার বৃদ্ধি ও এর ফলে রুবলের দরপতন সহ বিভিন্ন সমস্যা

গত অক্টোবর মাসে রাশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংক (Central Bank) জানায় যে, উচ্চ মুদ্রাস্ফীতির মূল কারণ বেড়ে যাওয়া সরকারি ব্যয় এবং ক্রমবর্ধমান বাজেট ঘাটতি (budget deficit)। ব্যাংকটি আরও জানায় যে মুদ্রানীতি (monetary policy) আরও কঠোর করা প্রয়োজন। ফলে ব্যাংকটি ২০২৩ সালের অক্টোবরে আবারও সুদের হার (interest rate) বাড়িয়ে ২১% এ নিয়ে গেছে। এটি ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে জারি করা জরুরি সুদের হারের চেয়েও বেশি এবং ২০০৩ সালের পর সর্বোচ্চ। সুদের হার বৃদ্ধিতে ব্যবসায়িক খাতে ঋণের খরচ বেড়ে যাওয়ায় ব্যবসাগুলো ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

চলতি বছরের অক্টোবর মাসে রুশ সিনেটরদের সামনে বিরল এক প্রকাশ্য অসন্তোষের নমুনা দেখিয়ে প্রতিরক্ষা বিষয়ক কনগ্লোমারেট রস্তেকের (Rostec) সিইও উদ্বেগ প্রকাশ করেন যে এত উচ্চ সুদের হার (interest rate) তাদের লাভ গিলে খাচ্ছে। তিনি সতর্ক করে দেন যে এই উচ্চ ঋণব্যয় শেষ পর্যন্ত ব্যাপক দেউলিয়া (bankruptcy) পরিস্থিতি ডেকে আনতে পারে, যা ইতোমধ্যে এ বছরে ২০% বেড়েছে।

উচ্চ সুদের হার (interest rate) রাশিয়ান স্টক মার্কেটকেও (stock market) নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করেছে, যা আগস্টের শেষ নাগাদ প্রায় ২৫% পড়ে গেছে। অর্থনীতির অবস্থা নিয়ে অনিশ্চয়তা রুবলের (ruble) দরপতনও ঘটিয়েছে, যা অক্টোবরে নতুন নিম্নস্তরে পৌঁছেছে। সাধারণত সুদের হার বাড়লে মুদ্রার মান শক্তিশালী হওয়ার কথা, কারণ সঞ্চয়ের আকর্ষণ বাড়ে। কিন্তু এখানে বিপরীত পরিস্থিতি ঘটছে।

অন্য ব্যবসাগুলো অভিযোগ করছে যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের (Central Bank) মুদ্রানীতি (monetary policy) তাদের অর্থায়নের খরচ এতটাই বাড়িয়ে দিয়েছে যে তারা বিনিয়োগ করতে পারছে না, যা রাশিয়ার শিল্প সক্ষমতাকে (industrial capacity) খর্ব করছে।

অন্যদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক (Central Bank) তাদের মুদ্রানীতির পক্ষে যুক্তি দেখাচ্ছে যে সামরিক ব্যয় সংশ্লিষ্ট খাতে শ্রমের (labor) ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে। ইতোমধ্যে অর্ধ মিলিয়নেরও বেশি কর্মী বেসামরিক খাত থেকে প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত প্রতিষ্ঠানে স্থানান্তরিত হয়েছে, যেখানে অধিক মজুরি ও সুবিধার লোভে তারা যাচ্ছে। এটি উভয় খাতে মজুরি বাড়িয়ে দিয়েছে, এবং রাশিয়ার শ্রম মন্ত্রণালয়ের (Labour Ministry) পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২০২৭ সাল নাগাদ দেশটি প্রায় ২৪ লাখ শ্রমিকের ঘাটতিতে পড়তে পারে।

মজুরি-মূল্য বৃদ্ধির চক্রের আগমন ও মুদ্রাস্ফীতির বৃদ্ধি

ক্রেমলিনের (Kremlin) জন্য এখন সবচেয়ে বড় ঝুঁকি হলো রাশিয়ান অর্থনীতি একটি মজুরি-মূল্য বৃদ্ধির চক্রে (wage-price spiral) প্রবেশ করবে; অর্থাৎ উচ্চ মজুরি বেশি মুদ্রাস্ফীতি ডেকে আনবে, যা আবার উচ্চ মজুরির দাবি তৈরি করবে, এবং এই চক্র চলতেই থাকবে।

মজুরি বাড়লে মূল্য বাড়ে কারণ –

  • উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি: শ্রমিকদের মজুরি বাড়লে কোম্পানির উৎপাদন খরচ বেড়ে যায়। অধিক খরচ পুষিয়ে নিতে কোম্পানিগুলো পণ্যের মূল্য বাড়িয়ে দেয়।
  • গ্রাহক চাহিদা বৃদ্ধি: শ্রমিকদের মজুরি বাড়লে তাদের হাতে বেশি অর্থ থাকে, যা তারা ব্যয় করে। ফলে চাহিদা বাড়ে। অতিরিক্ত চাহিদা পণ্যের মূল্য বাড়িয়ে দেয়, বিশেষত যদি সরবরাহ সীমিত হয়।
  • মুদ্রাস্ফীতির চাপে দাম বৃদ্ধি: মজুরি বৃদ্ধি পণ্যের খরচ বাড়িয়ে দেয়, যা পুরো অর্থনীতিতে মুদ্রাস্ফীতি সৃষ্টি করে।

আবার মূল্য বাড়লে মজুরি বাড়ে কারণ –

  • জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি: পণ্যের মূল্য বাড়লে শ্রমিকদের জীবিকার ব্যয় বেড়ে যায়। শ্রমিকরা তখন অধিক মজুরি দাবি করে, যাতে তাদের জীবনযাত্রার মান বজায় থাকে।
  • শ্রমিক ইউনিয়নের চাপ: শ্রমিক সংগঠনগুলো মজুরি বৃদ্ধির দাবি তোলে, যদি মূল্যবৃদ্ধির কারণে বাস্তব আয় (real income) কমে যায়।
  • শ্রমের বাজারের প্রতিযোগিতা: মূল্যবৃদ্ধির সময় কোম্পানিগুলো দক্ষ শ্রমিক ধরে রাখতে উচ্চ মজুরি দিতে বাধ্য হয়।

এভাবে একটি মজুরি-মূল্য চক্রের সৃষ্টি হয়। সামষ্টিক অর্থনীতি বা (macroeconomics) ম্যাক্রোইকোনমিক্সে এই মজুরি-মূল্য চক্র (wage-price spiral) মুদ্রাস্ফীতির (inflation) একটি সম্ভাব্য ব্যাখ্যা প্রদান করে। মজুরি বৃদ্ধি ও মূল্য বৃদ্ধি উভয়ই মুদ্রার ক্রয়ক্ষমতাকে কমিয়ে দেয়, যাকে মুদ্রাস্ফীতি বলে। মূল্যবৃদ্ধির (Price Increase) ফলে দেখা যায়, একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ দিয়ে আগের মতো একই পরিমাণ পণ্য বা সেবা কেনা সম্ভব হয় না। আবার মজুরি বৃদ্ধির (Wage Increase) ফলে কর্মীদের হাতে অতিরিক্ত টাকা আসে। কিন্তু যদি মজুরি বৃদ্ধির হার পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির চেয়ে কম হয়, তাহলে প্রকৃত আয় (real income) কমে যায়, যার মানে হলো তারা আগের মতো একই পণ্য বা সেবা কিনতে পারে না।

শ্রমবাজারে সংকট

ইতোমধ্যে রাশিয়ায় মজুরি-মূল্য বৃদ্ধির চক্রের কিছু লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। শুধু যে মুদ্রাস্ফীতি (inflation) অনেক উচ্চ হারে চলছে তা নয়, বেকারত্বের হারও (unemployment rate) রেকর্ড নিম্ন ২.৪% এ নেমে এসেছে। বেকারত্বের হার এতটা কম আসলে ভালো লক্ষণ নয়, কারণ এটি শ্রমবাজারে চরম ঘাটতির ইঙ্গিত দেয়। শ্রমবাজারের ঘাটতি হচ্ছে কারণ শ্রম বা শ্রমিকদের নিয়ে ইন্ডাস্ট্রিগুলোর ডিমান্ড সাপ্লাই এর তুলনায় কমে গেছে, অর্থাৎ ইন্ডাস্ট্রিগুলো বেশি শ্রমিক নিতে বা রাখতে চাচ্ছে না। চরম মুদ্রাস্ফীতি এর অন্যতম কারণ, কারণ এর ফলেই ইন্ডাস্ট্রিগুলোর উৎপাদন খরচ অনেক বেড়ে যায় (যার অন্যতম কারণ আবার শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি), আর সেই খরচ কমিয়ে আনতে তারা শ্রমিকদের পেছনে খরচ কমাতে চায় ও শ্রমিকদের ছাটাই করে। রাশিয়ায় এই শ্রমঘাটতি ইতোমধ্যেই কিছু বিশেষ খাতে, যেমন নির্মাণ খাতে (construction), তীব্র প্রভাব ফেলেছে, যেখানে অর্থনৈতিক কার্যক্রম উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে। কেননা নির্মাণ খাতের মতো শ্রমঘন শিল্পে শ্রমিক কমলে উৎপাদন কমতে বাধ্য। এদিকে নির্মাণ খাতের মত খাতকে সবসময় চালু রাখতে হয়। কম সংখ্যার দক্ষ শ্রমিকদের ধরে রাখতে, আর তাদের দিয়ে অনেক কাজ করিয়ে নেয়ার চাপের কারণে মজুরি দ্রুত বাড়তে থাকে। এটি গত কয়েক বছরে রাশিয়ায় দ্রুত এবং ক্রমবর্ধমান মজুরি বৃদ্ধির মূল কারণ।

ভবিষ্যত চিত্র ও সম্ভাবনা

রাশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংক (Central Bank) এবং একাধিক আন্তর্জাতিক সংস্থা সতর্ক করেছে যে রাশিয়ার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি আগামী বছর উল্লেখযোগ্যভাবে মন্থর হয়ে আসবে। তা সত্ত্বেও, মনে হচ্ছে পুতিন (Putin) তার বর্তমান পথ পরিবর্তনের কোনো পরিকল্পনা করছেন না, এবং প্রতিরক্ষা ব্যয় (defence expenditure) আগামী বছর আরও প্রায় ৩০% বৃদ্ধি পাওয়ার কথা রয়েছে।

যদি বৈশ্বিক জ্বালানি মূল্যে (global energy prices) বড় ধরনের বৃদ্ধি না ঘটে, যা রাশিয়ার যুদ্ধ অর্থায়নের সক্ষমতাকে উল্লেখযোগ্যভাবে উন্নত করতে পারে, তাহলে রাশিয়ার বর্তমান অর্থনৈতিক গতিপথ আসলেই টেকসই নয় বলে মনে হচ্ছে।

সারাংশ

সংক্ষেপে, ইউক্রেন যুদ্ধের প্রায় তিন বছর পর রাশিয়ার অর্থনীতি আরম্ভে পূর্বাভাস চেয়ে ভালো টিকে ছিল, মূলত বাড়তি সামরিক ব্যয় এবং জ্বালানি থেকে প্রাপ্ত আয়ের কারণে। কিন্তু এখন এই সামরিক ব্যয় অর্থনীতিকে অতিরিক্ত চাপে ফেলছে, মুদ্রাস্ফীতি বাড়াচ্ছে, সুদের হার রেকর্ড পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছে, শ্রমবাজারে ঘাটতি তৈরি করছে এবং সামগ্রিকভাবে অর্থনীতিকে অস্থিতিশীল করছে। এই প্রবণতা অব্যাহত থাকলে, এবং যদি বৈশ্বিক জ্বালানি দর উল্লেখযোগ্যভাবে না বাড়ে, তবে রাশিয়ার বর্তমান অর্থনৈতিক কৌশল টেকসই হবে না।

সূত্র –

1 – https://www.gisreportsonline.com/r/a-somber-outlook-for-the-russian-economy/
2 – https://cepr.org/system/files/publication-files/203674-policy_insight_131_russian_economy_on_war_footing_a_new_reality_financed_by_commodity_exports.pdf
3 – https://mronline.org/2024/06/22/russia-overtakes-japan-to-become-the-fourth-largest-economy-in-the-world-in-ppp-terms/
4 – https://en.thebell.io/russian-military-spending-to-rise-rise/
5 – https://tradingeconomics.com/russia/inflation-cpi
6 – https://www.kyivpost.com/post/40513
7 – https://www.bloomberg.com/news/articles/2023-05-11/russia-budget-gap-hits-45-billion-exceeding-full-year-goal
8 – https://tradingeconomics.com/russia/interest-rate
9 – https://www.the-express.com/news/world-news/154764/russian-economy-on-brink-of-disaster
10 – https://www.express.co.uk/news/world/1976692/russia-economy-ruble-inflation-interest-rates-putin
11 – https://www.reuters.com/markets/rates-bonds/russian-central-bank-blames-labour-shortages-not-high-rates-investment-slowdown-2024-11-07/
12 – https://en.thebell.io/russias-acute-labor-shortage/
13 – https://kse.ua/wp-content/uploads/2024/08/Chartbook_August2024.pdf
14 – https://www.ft.com/content/3e2b2e63-082e-4058-ba92-dea580d4f40c
15 – https://www.statista.com/chart/30484/forecast-for-real-gdp-growth-in-the-worlds-largest-economies/

রাশিয়ার জনসংখ্যাগত সংকট ও এতে ইউক্রেইনের যুদ্ধের প্রভাব (১০ মার্চ, ২০২৩)

ভূমিকা

সাম্প্রতিক বিভিন্ন সমস্যাগুলোর পাশাপাশি পুতিনকে আরও একটি দীর্ঘস্থায়ী সমস্যার মুখোমুখি হতে হচ্ছে, যা রাশিয়ার জনসংখ্যা সম্পর্কিত: রাশিয়ার জনসংখ্যাগত সংকট (Russia’s demographic crisis)। অনেক উন্নত বিশ্বের (developed world) দেশের মতোই, রাশিয়ার প্রজনন হার (fertility rate) তথাকথিত রিপ্লেসমেন্ট রেটের (replacement rate) অনেক নিচে। সেই সাথে অভিবাসনের (Immigration) অভাবের কারণে রাশিয়ার জনসংখ্যা ২০১৭ সাল থেকেই কমতে শুরু করে। এটি এমন এক বিষয় যা পুতিন নিজেও গভীরভাবে নিয়ে চিন্তিত। ২০২১ সালের নভেম্বরে, যখন তাকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল কোন বিষয় তাকে রাত জাগিয়ে রাখে, তিনি উত্তর দিয়েছিলেন যে রাশিয়ার জনমিতিক সংকটই তার এক নম্বর উদ্বেগ।

দুর্ভাগ্যজনকভাবে পুতিনের জন্য, যুদ্ধ এই পরিস্থিতিকে আরও মারাত্মক করে তুলেছে। রাশিয়ানরা রেকর্ড হারে দেশ ছেড়ে পালাচ্ছে। রাশিয়ার জন্মহার (Fertility rate) এবং ইকোনমিস্ট (The Economist)-এর তথ্য অনুযায়ী, এখন ১৫ বছর বয়সী রাশিয়ান পুরুষদের জন্য প্রত্যাশিত আয়ুষ্কাল (Life expectancy) পাঁচ বছর কমে হাইতির মতো সংকট-জর্জরিত দেশের স্তরে নেমে গেছে। এই লেখায় আমরা রাশিয়ার জনসংখ্যাগত সংকট পরীক্ষা করব, দেখব কিভাবে যুদ্ধ এটি তীব্রতর করেছে এবং পুতিন বা ক্রেমলিনের (Kremlin) পক্ষ থেকে এ বিষয়ে কিছু করার মতো সুযোগ আদৌ আছে কিনা।

জনসংখ্যা (Demographics) সম্পর্কে সাধারণ ধারণা

রাশিয়ার সমস্যায় যাওয়ার আগে, আসুন সামগ্রিকভাবে জনসংখ্যা (demographics) সম্পর্কে কিছু কথা বলি। একটি দেশের জনসংখ্যা স্থিতিশীল রাখতে, সেই দেশের প্রজনন হার (fertility rate) – অর্থাৎ প্রতি নারীর জীবদ্দশায় জন্ম দেওয়া সন্তানের সংখ্যা – প্রায় ২.১ হতে হয়। এখানে অতিরিক্ত ০.১ যুক্ত করা হয় শিশু মৃত্যু (childhood mortality) এবং অকালমৃত্যুর (premature death) ক্ষতিপূরণ হিসেবে।

যদি কোনো দেশের প্রজনন হার ২.১-এর নিচে থাকে, তবে উল্লেখযোগ্য অভিবাসন (immigration) বা জীবন প্রত্যাশা (life expectancy) উল্লেখযোগ্যভাবে না বাড়লে, সেই দেশের জনসংখ্যা হ্রাস পাওয়া শুরু করবে।

এটা শুনে খুব খারাপ মনে নাও হতে পারে, কিন্তু কম প্রজনন হার অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে জটিল। কারণ এর ফলে জনসংখ্যার গড় বয়স বেড়ে যায় (older population), যা কার্যরত তরুণ জনগোষ্ঠীর ওপর করের বোঝা (tax burden) বাড়ায়। উন্নত বিশ্বের অনেক দেশের প্রজনন হারই ২.১-এর নিচে। যেমন, যুক্তরাষ্ট্র (US) ও যুক্তরাজ্যের (UK) প্রজনন হার প্রায় ১.৭।

যুদ্ধের আগে রাশিয়ার জনসংখ্যাগত সংকট

শুধু প্রজনন হার দেখলে পশ্চিমা মানদণ্ডে রাশিয়ার চিত্রটি খুব খারাপ মনে নাও হতে পারে। যুদ্ধের আগে রাশিয়ার প্রজনন হার (fertility rate) প্রায় ১.৫ ছিল, যা ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের (EU) গড়ের কাছাকাছি। কিন্তু পুতিনের জন্য তখনও এটা দুঃখের বিষয় ছিল। কারণ এই সংখ্যাটি রাশিয়ার আসল সংকটের মাত্রা আড়াল করে রাখছিল। তিনটি প্রধান কারণে রাশিয়ার পরিস্থিতি খারাপ:

  • ১. উচ্চ মৃত্যুহার (death rate)
  • ২. ব্যাপক দেশত্যাগ বা অভিবাসন হার (emigration rate)
  • ৩. জনসংখ্যার উচ্চ বয়সক্রম (population age)

এগুলি স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি উদ্বেগজনক।

রাশিয়ার উচ্চ মৃত্যুহার

শুরু করা যাক মৃত্যুহার (death rate) দিয়ে। একজন তরুণ হিসেবে আপনি রাশিয়ায় অন্য সমমানের উন্নত দেশের চেয়ে বেশি মৃত্যুঝুঁকিতে থাকেন, যা আপনাকে ভবিষ্যতে সন্তান নেওয়ার আগেই মৃত্যুর মুখে ফেলতে পারে।

রাশিয়ায় গড় আয়ুষ্কাল (life expectancy) মাত্র ৭৩ বছর, আর পুরুষদের আয়ুষ্কাল (male life expectancy) মাত্র ৬৮ বছর। তুলনা হিসেবে, পোল্যান্ডে (Poland), যার মাথাপিছু জিডিপি (GDP per capita) ২০১৪ সাল পর্যন্ত রাশিয়ার চেয়ে কম ছিল, গড় আয়ুষ্কাল ৭৮ বছর এবং পুরুষদের আয়ুষ্কাল ৭৪ বছর।

কম আয়ুষ্কালের সঙ্গে তাল মিলিয়ে রাশিয়ার বার্ষিক মৃত্যুহার (mortality rate) অস্বাভাবিকভাবে বেশি। সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, রাশিয়ার বার্ষিক মৃত্যুহার প্রতি ১০০০ জনে প্রায় ১৩.৩ জন। অনুরূপভাবে উন্নত দেশের তুলনায় এটি উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি।

উচ্চ মৃত্যুহার ও মাঝারি প্রজনন হারের দরুন গত তিন দশক ধরে রাশিয়ায় মৃত্যুর সংখ্যা জন্মের সংখ্যাকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে, ফলে জনসংখ্যা ক্রমশ ছোট হয়ে আসছে। আর শুধু বয়স্ক লোকেরাই মারা যাচ্ছে তা নয়। ২০১৮ সালে রাশিয়ায় মোট মৃত্যুর ২৫% ঘটেছে ৬০ বছরের আগেই, যা অন্য অনেক দেশের তুলনায় মারাত্মক উচ্চ। ফলশ্রুতিতে, পুরুষদের গড় আয়ুষ্কাল যুদ্ধের আগে মাত্র ৬৮ বছরে গিয়ে ঠেকেছিল।

অভিবাসন ও দেশত্যাগ (Immigration & Emigration): ঘাটতি মেটানোর চেষ্টা ও ব্যর্থতা

রাশিয়ার স্বাভাবিকভাবে কমে যাওয়া জনসংখ্যাকে (natural population decline) মোকাবেলা করতে পুতিন অভিবাসন (immigration) উৎসাহিত করেছেন। এতে কিছুটা সাফল্যও এসেছে। রাশিয়া প্রতিবছর প্রায় ২০০,০০০ থেকে ৫০০,০০০ অভিবাসী গ্রহণ করে এবং বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র (US), জার্মানি (Germany) ও সৌদি আরবের (Saudi Arabia) পর চতুর্থ বৃহত্তম অভিবাসী জনসংখ্যার দেশ।

কিন্তু সমস্যা হল, অভিবাসীরা আসলেও রাশিয়ানরা দেশ ছাড়ছেন (emigrate) অনেক। জরিপে দেখা যাচ্ছে, ক্রমবর্ধমান সংখ্যক তরুণ রাশিয়ান বিদেশে যাওয়ার পরিকল্পনা করেন, আর গত এক দশকে অভিবাসনের হার (emigration) অনেক বেড়ে গেছে। আরও উদ্বেগের বিষয় হল, যারা দেশ ছাড়ছেন তাদের প্রায় ৪০% তৃতীয় পর্যায়ের শিক্ষা (tertiary education) সম্পন্ন, অর্থাৎ তারা উচ্চশিক্ষিত।

ফলস্বরূপ, উল্লেখযোগ্য অভিবাসন সত্ত্বেও রাশিয়া তার প্রাকৃতিক জনসংখ্যা হ্রাসের ক্ষতিপূরণ করতে পারছে না। এ কারণেই গত তিন বছর ধরে রাশিয়ার জনসংখ্যা প্রতি বছর কমে যাচ্ছে।

জনসংখ্যার বয়সক্রম ও অতীতের প্রভাব (Aging Population & Past Demographic Shocks)

রাশিয়ার জনসংখ্যাগত সমস্যার তৃতীয় প্রধান কারণ হচ্ছে বয়স্ক জনগোষ্ঠীর অনুপাত বৃদ্ধি (aging population)। সোভিয়েত ইউনিয়ন (Soviet Union) ভেঙে পড়ার পর রাশিয়া একটি মারাত্মক জনমিতিক ধাক্কার (demographic shock) সম্মুখীন হয়েছিল। সে সময়:

  • প্রজনন হার ২.১% থেকে ১.৪% এ নেমে যায়।
  • পুরুষ মৃত্যুহার (male mortality rate) দ্বিগুণের কাছাকাছি বেড়ে যায়।
  • গড় আয়ুষ্কাল (life expectancy) প্রায় ৫ বছর কমে যায়।

ফলে ১৯৯০-এর দশকে (the ’90s) রাশিয়ায় খুব কম শিশু জন্মেছে। এর প্রভাব রাশিয়ার বর্তমান জনসংখ্যা পিরামিডে (population pyramid) স্পষ্ট: ২০ ও ৩০ বছরের মানুষের সংখ্যা এখন খুবই কম। সাধারণত এই বয়সের মানুষরাই সন্তান নেয়। অতএব, স্বল্প যুবজনসংখ্যা মানেই ভবিষ্যতে আরও কম জন্মহার।

জাতিসংঘের (UN) পূর্বাভাস অনুযায়ী, এই প্রবণতা অব্যাহত থাকবে এবং ২১শ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে রাশিয়ার জনসংখ্যা হ্রাস পেতে পেতে ২০৫০ সালে প্রায় ১৩৫ মিলিয়নে পৌঁছাবে, যা ১৯৭৫ সালের জনসংখ্যার সমান।

এভাবে নিম্ন জন্মহার, অভিবাসনের অভাব এবং উচ্চ মৃত্যুহারের যৌথ প্রভাবে রাশিয়ার জনসংখ্যা ২০১৮ সাল থেকে ধীরে ধীরে কমতে থাকে। আরও উদ্বেগজনক বিষয় হল, যুদ্ধের আগে জাতিসংঘ (UN) পূর্বাভাস দিয়েছিল যে রাশিয়ার জনসংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেতে থাকবে। এসব কারণে যুদ্ধের আগেও রাশিয়া জনমিতিক পতনে ভুগছিল।

পুতিনের উদ্বেগ, নীতিমালা, কার্যকারিতা ও সীমাবদ্ধতা

পুতিন এই অবনতিশীল চিত্র সম্পর্কে ভালোভাবেই অবগত। রুশ ও ইউক্রেনীয়দের ঐতিহাসিক ঐক্য নিয়ে তার সেই বহুল আলোচিত নিবন্ধে, পুতিন সতর্ক করেছেন যে রাশিয়ান জনসংখ্যা কয়েক লক্ষ বা এমনকি কয়েক মিলিয়ন কমে যেতে পারে।

২০২০ সালে দুমায় (Duma) দেওয়া তার ১৬তম বার্ষিক ভাষণে (16th annual address) পুতিন বলেছিলেন যে রাশিয়ার ভাগ্য এবং এর ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গি নির্ভর করে আমরা কতজন রাশিয়ান আছি তার ওপর। এরপর তিনি বেশ কিছু প্রজনন-বর্ধক নীতি (pro-natalist policies) ঘোষণা করেন, যেমন:

  • মাতৃত্ব মূলধন (maternity capital) নামক আর্থিক সহায়তা এক সন্তানের পরিবারকেও দেয়া হবে।
  • ৩-৭ বছর বয়সী শিশুদের জন্য স্বল্প আয়ের পরিবারে কল্যাণ ভাতা (welfare benefits)।
  • স্কুলের প্রথম চার বছর বিনামূল্যে খাবার (free school meals) প্রদান।

পশ্চিমা মানদণ্ডে হয়তো এগুলো খুব বড় পদক্ষেপ নয়, তবে মনে রাখতে হবে রাশিয়া আর্থিকভাবে খুবই সংযমী (fiscally conservative) একটি দেশ এবং গত ১০ বছরে ৫ বছরই বাজেট উদ্ধৃত্ত (budget surplus) রেখেছে।

কিন্তু দুঃখের বিষয়, পুতিনের এসব নীতির তেমন ফল পাওয়া যাচ্ছে না। মাতৃত্ব মূলধন (maternity capital), যা মূলত ৭০০০ ডলার মূল্যের এককালীন বন্ধক-সহায়তা (one-off mortgage payment), ২০০৭ সালে চালু হয়েছিল। তখন সাময়িকভাবে প্রজনন হার ২০১৭ সালে ১.৭ পর্যন্ত উঠলেও আবার কমে বর্তমানে সেই ২০০৭-এর স্তর অর্থাৎ ১.৫-এ চলে এসেছে।

রাশিয়া একমাত্র দেশ নয় যারা এই সমস্যায় ভুগছে। উন্নত অনেক দেশই দেখেছে যে সবচেয়ে উদার প্রজনন উৎসাহমূলক নীতি (pro-natalist policies) গ্রহণ করেও প্রজনন হার কৃত্রিমভাবে তেমন বাড়ানো যায় না।

যুদ্ধ পরিস্থিতি জনমিতিক সংকটকে কিভাবে বৃদ্ধি করেছে

স্বভাবতই, যুদ্ধ কমপক্ষে তিনট কারণে পরিস্থিতিকে আরো খারাপ করে তুলেছে –

  • মৃত্যু এবং লোকসান: যুদ্ধ অনেক তরুণ রাশিয়ান পুরুষের মৃত্যু ঘটিয়েছে—সংখ্যাটি কয়েক দশ-হাজার না হয় লাখের কাছাকাছি হতে পারে।
  • জন্মহার ও অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা: অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা তরুণ রাশিয়ান দম্পতিদের পরিবার গঠনে নিরুৎসাহিত করেছে।
  • অভিবাসন সমস্যার গভীরতা: নিষেধাজ্ঞার কারণে দেশত্যাগও (emigration) বেড়ে গেছে। প্রায় ২০০,০০০ রাশিয়ান সম্ভবত যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর দেশ ছেড়েছেন, যার ফলাফল প্লেন টিকিটের দাম ৯০০% পর্যন্ত বেড়ে যাওয়া। সেই সাথে মধ্য এশিয়া (Central Asia) থেকে অভিবাসন কমে গেছে।

এছাড়া নিষেধাজ্ঞার (sanctions) কারণে রাশিয়ান অর্থনীতি সংকুচিত হবার কথা। অর্থনৈতিক সংকটের ফলে:

  • ১. দরিদ্র রাশিয়ানরা সন্তান নেওয়ার ব্যাপারে নিরুৎসাহিত হবে।
  • ২. রাশিয়া সরকার প্রজনন-বর্ধক নীতি বাস্তবায়ন ও অর্থায়ন করতে আরও কঠিন অবস্থায় পড়বে, বিশেষ করে যেগুলো আগেই খুব একটা কাজে দিচ্ছিল না।

এগুলো জনসংখ্যাগত সংকট আরও বাড়িয়ে তুলবে। যাই হোক, উল্লিখিত তিনটি পয়েন্ট বিস্তারিত করে লেখা হচ্ছে –

মৃত্যু এবং লোকসান

কোনো পক্ষই ঠিকমতো জানে না কত রাশিয়ান এ যুদ্ধে মারা গেছে। পশ্চিমা অনুমান বলছে সংখ্যা ২,০০,০০০ পর্যন্ত হতে পারে, আর রাশিয়া দাবি করছে সংখ্যাটি দশ হাজারের কিছু উপরে। সত্য হয়তো মাঝামাঝি কোথাও। যা-ই হোক, এটি রাশিয়ার জনমিতির জন্য একটি বিপর্যয়।

সোভিয়েত ইউনিয়ন (Soviet Union) এবং রাশিয়ান অর্থনীতির পতনের পর ’৯০ দশকে জন্মহার তীব্রভাবে কমে যায়, ফলে এই সময়ে খুব কম সংখ্যক শিশু জন্মগ্রহণ করে। বর্তমানে রাশিয়ায় ২০-৩০ বছর বয়সী মানুষের সংখ্যা খুবই কম, যার ফলে দেশটির জনসংখ্যা পিরামিডে এই বয়স স্তরে এক ধরণের “উর্ধ্বমুখী ফাঁকা ভাব” (Upward slump) দেখা যায়।

যুদ্ধের আগে থেকেই এটি ছিল রাশিয়ার জনমিতির জন্য খুব খারাপ সংবাদ, কারণ এই বয়সের মানুষরাই সাধারণত সন্তান ধারণের জন্য উপযুক্ত। কিন্তু যুদ্ধ সবকিছুকে আরও খারাপ করেছে, কারণ পুতিনের আংশিক সামরিক সংগ্রহ (Partial mobilization) ১৮-৩৫ বছর বয়সী পুরুষদের লক্ষ্য করে। অর্থাৎ ইতোমধ্যেই সংকটাপন্ন বয়সী তরুণদের যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠানো হচ্ছে, অনেকে মারা যাচ্ছে।

জন্মহার ও অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা

এর পাশাপাশি, যারা যুদ্ধে মারা যায়নি, সেই তরুণ রাশিয়ানদের মধ্যেও জন্মহার কমে গেছে। এটি অস্বাভাবিক কিছু নয়, কারণ রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ অস্থির থাকলে পরিবার গঠনে মানুষ পিছপা হয়। ২০২২ সালের এপ্রিল মাসে, অর্থাৎ যুদ্ধ শুরুর মাত্র দুই মাস পর, রাশিয়ায় নিবন্ধিত জন্মের সংখ্যা ছিল ১৮শ শতকের পর সর্বনিম্ন। অনুমান করা হচ্ছে যে আগামী বছরগুলোতে রাশিয়ার জন্মহার বিশ্বের অন্যতম সর্বনিম্নে নেমে আসবে।

অভিবাসন সমস্যার গভীরতা

যুদ্ধ রাশিয়ার অভিবাসন পরিস্থিতিকেও আরও সংকটময় করেছে। অনেকে দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছে, একই সাথে মধ্য এশিয়া থেকে আগত অভিবাসীর সংখ্যাও হ্রাস পাচ্ছে। যুদ্ধের আগেই অভিবাসন বৃদ্ধির হার কমছিল, এবং ক্রমবর্ধমান সংখ্যক তরুণ রাশিয়ান দেশ ছাড়তে চাইছিল।

কোনো নির্দিষ্ট সংখ্যা পাওয়া না গেলেও, বিশ্লেষকরা অনুমান করেন যে ২০২২ সালে কমপক্ষে কয়েকশ হাজার রাশিয়ান দেশ ত্যাগ করেছে। এদের বেশির ভাগই মধ্য এশিয়া, জর্জিয়া (Georgia) এবং তুরস্কে (Turkey) চলে গেছে।

সাধারণত, রাশিয়া এই ঘাটতি পূরণ করতো মধ্য এশিয়া থেকে আসা অর্থনৈতিক অভিবাসীদের দ্বারা। যুদ্ধের আগে, রাশিয়া প্রতিবছর প্রায় ২,০০,০০০ থেকে ৫,০০,০০০ অভিবাসী গ্রহণ করতো। যার ফলে বিশ্বে অভিবাসী সংখ্যা গ্রহণের দিক থেকে রাশিয়া ছিল চতুর্থ স্থানে।

কিন্তু এখন আশা করা হচ্ছে মধ্য এশিয়া থেকে রাশিয়ায় অভিবাসন কমে যাবে। কারণ মধ্য এশিয়ার সরকার এবং জনসাধারণ রাশিয়াকে ক্রমশ শোষণমুখী এবং সাম্রাজ্যবাদী হিসেবে দেখছে। উপরন্তু, রাশিয়ার অর্থনীতি দীর্ঘমেয়াদে যদি নিষেধাজ্ঞার (Sanctions) প্রভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে, তবে মধ্য এশিয়ান অভিবাসীদের জন্য রাশিয়া আর আকর্ষণীয় থাকবে না।

এভাবে যুদ্ধ রাশিয়ার জনমিতিক পতনকে আরও ত্বরান্বিত করছে।

পুতিনের করণীয় কি?

পুতিন ও ক্রেমলিন এ বিষয়ে কি করতে পারে? যেহেতু পুতিন নিজেই এই বিষয়টি সম্পর্কে সচেতন, ২০২০ সালে তিনি একগুচ্ছ জন্মহার বৃদ্ধির (Pro-natalist) নীতি গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে, এগুলো উল্লেখযোগ্য ফল আনতে পারেনি। ২০১২ সালে রাশিয়ার জন্মহার অল্প কিছুটা বেড়ে ১.৭ পর্যন্ত উঠেছিল, কিন্তু তারপর থেকে আবার কমতে থাকে।

যুদ্ধ শুরুর অনেক আগেই, কর্মকর্তারা নীরবে স্বীকার করেছিলেন যে ক্রেমলিনের ২০৩০ সালের মধ্যে রাশিয়ার জনমিতিক পতন ঠেকানোর পরিকল্পনা অবাস্তব। কেবল রাশিয়াই নয়, চীনও (China) দেখেছে যে কৃত্রিমভাবে জন্মহার বাড়ানো খুব কঠিন।

উপসংহার

সুতরাং, রাশিয়ার জনমিতিক সংকট খারাপের দিকেই যাচ্ছে এবং পুতিনের পক্ষে এটি বন্ধ করা অত্যন্ত কঠিন। তবে এটি বিশ্বের শেষ নয়। অনেক উন্নত দেশ জনসংখ্যা হ্রাসের সমস্যার মুখোমুখি, এবং যুদ্ধের পর রাশিয়ার অর্থনীতি এবং ভূরাজনৈতিক অবস্থান কেমন হবে তার উপর ভবিষ্যত অনেকাংশে নির্ভর করে। তবুও, এটি পুতিন এবং সামগ্রিকভাবে রাশিয়ার জন্য খারাপ সংবাদ।

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.