সিরিয়ায় আসাদের শাসনের পতন হলো, এরপর কী? 

গত কয়েক বছর ধরে সিরিয়ার (Syria) পরিস্থিতি তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীল ছিল। প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ (Bashar al-Assad) দেশের বেশিরভাগ অঞ্চলের উপর পুনরায় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তবে ২০২০ সালে তুরস্ক (Turkey) এবং রাশিয়া (Russia) দ্বারা মধ্যস্থতায় স্বাক্ষরিত একটি যুদ্ধবিরতির কারণে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে বিদ্রোহীরা (rebel) নিজেদের একটি ঘাঁটি ধরে রাখে। অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের (United States) সামরিক উপস্থিতি উত্তর-পূর্বাঞ্চলে কুর্দি (Kurdish) নিয়ন্ত্রিত একটি ডি-ফ্যাক্টো (de facto) স্বায়ত্তশাসিত রাষ্ট্রকে সুরক্ষা দিয়ে আসছিল। তবুও সব মিলে কয়েক সপ্তাহ আগেও মনে হচ্ছিল আসাদ (Assad) সিরিয়ার নিয়ন্ত্রণ দৃঢ়ভাবে নিজের হাতে রেখেছেন। তার বাহিনী দেশের প্রায় ৬০% ভূখণ্ড এবং অধিকাংশ জনগোষ্ঠীর উপর কর্তৃত্ব করছিল। ধীরে ধীরে তিনি আবারও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার পথে এগোচ্ছিলেন।

কিন্তু খুব দ্রুত পরিস্থিতি সম্পূর্ণ পাল্টে যায়। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে ইসরায়েল (Israel) ও আশপাশের অঞ্চলে অস্থিরতা বৃদ্ধির ফলে সিরিয়ায় আবারও সহিংসতা মাথাচাড়া দেয়। বিশেষ করে ২৭শে নভেম্বর আসাদ-বিরোধী বিদ্রোহীরা (anti-Assad rebels) সিরিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর আলেপ্পোর (Aleppo) উপশহরের দিকে একটি চমকপ্রদ সফল আক্রমণ চালায়। আর এর পর সপ্তাহ যেতে না যেতেই ঘটনার মোড় এমনভাবে ঘুরে গেছে যা কেউ কল্পনাও করেনি। অল্প সময়ের মধ্যে তারা আলেপ্পো (Aleppo) দখল করে এবং এখন দক্ষিণে দামেস্কের (Damascus)-এর দিকে অগ্রসর হয়। দামেস্কের দিকে অগ্রসর হতে হতে তারা হামা (Hama) শহর দখল করে নেয়। এরপর তারা খুব দ্রুত হোমস (Homs) দখল করে দামেস্ক ঘিরে ফেলে ও দামেস্ক দখলে নেয়।

এভাবে অর্ধ শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় থাকার পর ৮ ডিসেম্বরে আসাদ (Assad) যুগের অবসান ঘটে। সিরিয়ার ইদলিব (Idlib) প্রদেশের ইসলামপন্থী বিদ্রোহীরা (Islamist Rebels) মাত্র দুই সপ্তাহের কম সময়ের মধ্যে আকস্মিক এক আক্রমণ শুরু করার পর, প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের (Bashar al-Assad) অনুগত বাহিনী অস্ত্র সমর্পণ করেছে। বিদ্রোহীরা ঘোষণা করেছে যে প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন এবং সিরিয়া এখন মুক্ত। শোনা যাচ্ছে আসাদ দেশ ছেড়ে পালিয়ে এখন মস্কোতে (Moscow) অবস্থান করছেন, যেখানে তাকে রাজনৈতিক আশ্রয় দেওয়া হয়েছে।

বিদ্রোহী গোষ্ঠী হায়াত তাহরির আল-শাম (এইচটিএস) বলেছে, এই ঘটনাটি একটি অন্ধকার যুগের অবসান ঘটিয়ে এক নতুন যুগের সূচনা করেছে। দামেস্কের রাস্তায় জনগণের উল্লাস দেখা গেছে, আর বিদ্রোহীরা বলছে, নিপীড়নের শিকার মানুষ এখন নিরাপদে বাড়ি ফিরতে পারবেন। রাজধানীর সেদনায়া কারাগার থেকে হাজার হাজার বন্দিকে মুক্ত করা হয়েছে। হেজবুল্লাহ তাদের সৈন্য প্রত্যাহার করেছে। বিশ্লেষকরা ঘটনাটিকে ‘৫৪ বছরের স্বৈরশাসনের চূড়ান্ত মুহূর্ত’ বলে বর্ণনা করেছেন।

তাই এই লেখায় সিরিয়ার এই অবিশ্বাস্য ঘটনাপ্রবাহ এবং আসাদ-পরবর্তী সিরিয়ার সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা করা হবে।

ঐতিহাসিক পটভূমি

সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ (Syrian Civil War) শুরু হয়েছিল ২০১১ সালে, আরব বসন্তের (Arab Spring) সময়, যখন দেশের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ দীর্ঘদিনের একনায়ক বাশার আল-আসাদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। বাশার আল-আসাদ ২০০০ সালে ক্ষমতায় আসেন। তার পিতা হাফেজ আল-আসাদ (Hafez al-Assad) ১৯৭১ সাল থেকে সিরিয়া শাসন করছিলেন। তার মৃত্যুবরণ করার পর বাশার আল-আসাদ ক্ষমতায় বসেন। জনগণের এই শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ স্বল্পসময়ের মধ্যেই একটি সর্বাত্মক গৃহযুদ্ধে রূপ নেয়, কারণ সিরিয়ার নিরাপত্তা বাহিনী বরাবরের মতোই নিষ্ঠুর দমনপীড়ন চালায়। এই গৃহযুদ্ধ অত্যন্ত জটিল এবং দীর্ঘস্থায়ী। একে মূলত তিনটি পর্যায়ে ভাগ করা যায়:

  • প্রথম পর্যায় (২০১১-২০১৫): প্রথম পর্যায়ে সিরিয়ান বিদ্রোহীরা পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটো (NATO) সদস্য রাষ্ট্র এবং উপসাগরীয় রাজতন্ত্রগুলোর (Gulf monarchies) পরোক্ষ সমর্থন পায়। এর ফলে তারা উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করে। ২০১৩ সালে তারা রাক্কা (Raqqa) শহর নিয়ন্ত্রণে নেয়, যা ছিল একটি আঞ্চলিক রাজধানী। ২০১৫ সালে তারা ইদলিব (Idlib) শহর দখল করে। বিদ্রোহীদের এ উন্নতির ফলে আসাদের অবস্থান বেশ নড়বড়ে হয়ে পড়েছিল।
  • দ্বিতীয় পর্যায় (২০১৪-২০১৭), আইএস (ISIS) পর্ব: এই পর্যায়টি প্রথম পর্যায়ের সঙ্গে আংশিকভাবে ওভারল্যাপ করে। ২০১৪ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত সময়ে আইএস (ISIS: Islamic State of Iraq and Syria) দৃশ্যপটে আবির্ভূত হয়। সিরিয়া ও প্রতিবেশী ইরাকের (Iraq) রাজনৈতিক অস্থিরতার সুযোগ নিয়ে আইএস একটি কথিত “খিলাফত” (caliphate) প্রতিষ্ঠা করে, যার বিস্তৃতি প্রায় ১ লক্ষ বর্গকিলোমিটার এলাকায় এবং জনসংখ্যা প্রায় ১ কোটির কাছাকাছি পৌঁছায়। তবে ২০১৭ সালের শেষ নাগাদ আইএস প্রায় পুরোপুরি পরাজিত হয়। আইএসকে প্রতিহত করতে পশ্চিমা বিশ্ব, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র, কুর্দিদের (Kurds) সমর্থন জোরদার করে। কুর্দিরা একটি রাষ্ট্রহীন জাতিগোষ্ঠী, যারা দক্ষিণ-পূর্ব তুরস্ক, উত্তর-পশ্চিম ইরান (Iran), উত্তর ইরাক এবং উত্তর সিরিয়ায় বাস করে। অন্যদিকে, আইএসকে হটাতে এবং তাদের মিত্র আসাদকে রক্ষা করতে রাশিয়া ও ইরান সিরিয়ায় তাদের সামরিক উপস্থিতি বৃদ্ধি করে।
  • তৃতীয় পর্যায় (২০১৬-২০২০): এই পর্যায়ে কুর্দিরা যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় সিরিয়ার উত্তরের এক বিশাল ডি-ফ্যাক্টো (de facto) স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল গড়ে তোলে। একই সময়ে, রাশিয়া ও ইরানের সহায়তায় আসাদ বিরোধী বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রিত এলাকা ধীরে ধীরে পুনরুদ্ধার করতে থাকে। ২০২০ সালের শুরুর দিকে বিদ্রোহীরা ইদলিব অঞ্চলে (Idlib) অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে এবং মনে হচ্ছিল তারা হয়তো সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। কিন্তু সেই মার্চ মাসে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান (Recep Tayyip Erdoğan) ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন (Vladimir Putin) এক যুদ্ধবিরতি (ceasefire) চুক্তি সম্পন্ন করেন।

যুদ্ধবিরতি ও এর প্রভাব: এই যুদ্ধবিরতির ফলে সিরিয়ার ভেতরে কার্যত চারটি ডি-ফ্যাক্টো রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়েছিল:

  1. উত্তর-পূর্বাঞ্চলে কুর্দি স্বশাসিত এলাকা (Kurdish autonomous zone) – যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনে গঠিত।
  2. এর ঠিক পাশেই তুরস্কের সুরক্ষিত একটি বাফার অঞ্চল (buffer zone), যা তুরস্ক ২০১৬ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে বেশ কয়েকটি হামলার মাধ্যমে তৈরি করে, মূলত কুর্দি বিদ্রোহীদের ঠেকাতে (যারা তুরস্কের কাছে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে বিবেচিত, যেমন কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টি (Kurdistan Workers’ Party বা PKK))।
  3. ইদলিবে বিদ্রোহীদের একটি শক্ত ঘাঁটি। ইদলিবের বিদ্রোহী অঞ্চলটি ছিল তুরস্ক-সমর্থিত, কারণ তুরস্ক কুর্দি বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন ঠেকাতে বিদ্রোহীদের ব্যবহার করতে চায় এবং আসাদের সঙ্গে তাদের ঐতিহাসিক বৈরিতাও আছে।
  4. বাকি দেশটির প্রায় ৬০% এলাকায় আসাদের নিয়ন্ত্রণ, যেখানে সিরিয়ার বেশিরভাগ জনগণ বাস করে।

আসাদের অঞ্চলগুলোর মধ্যে আলেপ্পো (Aleppo) সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের শুরু থেকেই এর কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল। ২০১৬ সালের ডিসেম্বর মাসে যখন আসাদ আলেপ্পোর নিয়ন্ত্রণ পুনরুদ্ধার করে, তখন গৃহযুদ্ধ কার্যত শেষের দিকে চলে যায়। দেশের কিছু অংশ তখনও সরকারের নাগালের বাইরে থাকলেও আসাদ টিকে যান এবং সিরিয়ার মূল ভূখণ্ডে (Heartland) ক্ষমতা সংহত করেন। এই মূল ভূখণ্ড বলতে বোঝায় আলেপ্পো থেকে লাতাকিয়া (Latakia) উপকূল পর্যন্ত, সেখান থেকে হামা ও হোমস হয়ে দক্ষিণে দামেস্ক পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চল। এই অংশ সিরিয়ার সবচেয়ে জনবহুল এলাকা, তাই একে হার্টল্যান্ড বলা হয়। ইদলিব (Idlib) সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে ছিল, সেখানেই বিদ্রোহীরা আশ্রয় নিয়েছিল। তবে আসাদের এই বিজয়ের পেছনে মূল কৃতিত্ব ছিল রুশ বিমান সহায়তা (Russian air support) এবং ইরানি স্থলবাহিনীর (Iranian ground forces)। যখন যুদ্ধ থেমে গেল, আসাদ তখন সম্পূর্ণভাবেই তার মিত্রদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়লেন। অল্পদিনের মধ্যেই রাশিয়া ও ইরান পরস্পরের বিরুদ্ধে অবস্থান নিল। তারা উভয়েই সিরিয়ার ভবিষ্যৎ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছিল।

এরপর ২০২২ সালে ইউক্রেনে (Ukraine) রাশিয়ার আগ্রাসন গুরুত্বপূর্ণ মোড় ঘুরিয়ে দেয়। ইউক্রেনে জড়িয়ে পড়ে রাশিয়া আর পূর্বের মতো সিরিয়ায় সম্পূর্ণ মনোযোগ দিতে পারল না। সুযোগ পেয়ে ইরান আরও সক্রিয় হয়ে উঠল এবং সিরিয়ায় প্রধান পৃষ্ঠপোষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হলো। এই ফাঁকে আসাদ পুরোনো সহযোগীদের প্রভাব থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছিলেন। ইরানের করাল গ্রাস থেকে মুক্তি পেতে তিনি সংযুক্ত আরব আমিরাত (UAE) ও সৌদি আরবের (Saudi Arabia) সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের চেষ্টা করলেন। উদাহরণস্বরূপ, ২০২৩ সালের আগস্টে আসাদ আরব লীগে (Arab League) সিরিয়ার প্রত্যাবর্তনের সময় উষ্ণ অভ্যর্থনা পেলেন। এটি ছিল একটি বড় সাফল্য। কিন্তু তবুও ইরানের প্রভাব থেকে পুরোপুরি বেরিয়ে আসা সম্ভব হয়নি।

এরপর আরেকটি মোড় আসে। ৭ অক্টোবর হামাসের (Hamas) হামলা ইসরায়েলকে আহত ও ক্ষুব্ধ করে তোলে। ইসরায়েল পাল্টা আক্রমণে নামে। লক্ষ্য ইরানি স্বার্থ ও প্রক্সিদের (Proxies) ধ্বংস করা। লেবানন (Lebanon) ছিল এই সংঘাতের কেন্দ্রবিন্দু। আসাদ জানতেন যে খুব বেশিদিন লাগবে না, লেবাননের এই সংঘাত সিরিয়ায় গড়াবে। এর প্রতিক্রিয়া হিসেবে তিনি তুরস্কের (Turkey) সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার উদ্যোগ নেন। তুরস্কের বাহিনী ও তাদের প্রক্সিরা সিরিয়ার উত্তরের কিছু এলাকা দখল করে রেখেছিল এবং আঙ্কারা (Ankara) ছিল ইদলিবে (Idlib) সিরিয়ান বিদ্রোহী দল এইচটিএস (Hayat Tahrir al-Sham বা HTS) এর প্রধান পৃষ্ঠপোষক।

তুরস্কের সঙ্গে আলোচনা শুরু থেকেই আশা জেগেছিল। আসাদ সম্মত হন যে উত্তর-পূর্বে অবস্থিত এসডিএফ (Syrian Democratic Forces – SDF) একটি হুমকি। কিন্তু আলোচনা ব্যর্থ হয়। আসাদ তুরস্কের আশ্রয়ে থাকা লাখো সিরিয়ান শরণার্থী ফেরত নিতে অস্বীকার করেন, অথচ তুরস্কের জন্য এটাই ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। গত এক দশকের বেশি সময় ধরে তুরস্কে অবস্থানরত সিরীয় শরণার্থীদের নিয়ে স্থানীয় তুর্কি জনগোষ্ঠীর সঙ্গে সামাজিক চাপ ও বিরোধ দেখা দিয়েছে। তাই তুরস্ক কোনো সমাধান খুঁজছিল। কিন্তু আসাদ উল্টো কাজ করেন। তিনি ইদলিবে গোলাবর্ষণ শুরু করেন, যা তুরস্কের দিকে নতুন করে শরণার্থীর ঢল সৃষ্টি করে। এভাবে তিনি তুরস্কের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন। এটা সত্যিই চাপ তৈরি করেছিল, তুরস্কের প্রেসিডেন্ট পুতিনের কাছে হস্তক্ষেপের অনুরোধ জানান, কিন্তু পুতিন তখন ইউক্রেনে ব্যস্ত এবং আসাদের ওপর আগের মতো প্রভাব হারিয়েছেন। রাশিয়ার পক্ষে কিছু করা সম্ভব ছিল না।

এদিকে, ইসরায়েল মাসের পর মাস ইরান ও হিজবুল্লাহকে (Hezbollah) বোমাবর্ষণ করে দুর্বল করে আসছে। ফলে তারা তাদের সম্পদ অন্যত্র সরিয়ে নিতে বাধ্য হচ্ছে। এভাবেই একটি স্থানীয় ক্ষমতার শূন্যতা (Power vacuum) তৈরি হচ্ছে। বিদ্রোহীরা আলেপ্পো এত দ্রুত দখল করতে পেরেছে তার একটি বড় কারণ ইরানের প্রভাব দুর্বল হয়ে পড়া। যাই হোক, তুরস্ক যখন কূটনৈতিক পথে ব্যর্থ হলো, তখন তারা কৌশল বদলে নিজেদের প্রক্সি বাহিনীকে কাজে লাগাল। আর এভাবেই এলো বর্তমান পরিস্থিতি। বিদ্রোহীরা সিরিয়ার দখল নিল।

ভূরাজনৈতিক পটভূমি

সিরিয়া এমন এক অঞ্চলে অবস্থিত যেখানে যে-কোনো ঘটনা প্রতিবেশী দেশগুলোতে প্রভাব ফেলে। তুরস্কের জন্য এর মানে আরও বেশি শরণার্থী, ইসরায়েলের জন্য মানে হলো সীমান্তে সুন্নি জিহাদিস্টদের উপস্থিতি, রাশিয়ার জন্য এটি জোট গঠনের বিশ্বাসযোগ্যতা ও ভাবমূর্তির প্রশ্ন। তাই সিরিয়া নিয়ে প্রতিটি শক্তির ভূমিকাও আলাদা করে বিশ্লেষণ করা দরকার।

ইরান (Iran): ইতোমধ্যে এক দশকের বেশি সময় ধরে ইরান সিরিয়ার সংঘর্ষের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। তাদের কার্যকলাপ সিরিয়াকে বিধ্বস্ত করেছে, লক্ষাধিক বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছে, বাস্তুচ্যুত হয়েছে ১ কোটিরও বেশি মানুষ। ইরান এটি করেছে আসাদকে ক্ষমতায় রাখতে। কিন্তু এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো, ইরান চায় একটি স্থলপথের সংযোগ বা “ল্যান্ডব্রিজ (Land Bridge)” যা ইরানকে সরাসরি লেবাননে তাদের প্রক্সি হিজবুল্লাহর কাছে পৌঁছাতে দেবে। এই পথ ইরাক (Iraq) ও সিরিয়া হয়ে লেবাননে যায়, যার মাধ্যমে ইরান সহজেই সরঞ্জাম, অস্ত্র ও জনবল পাঠাতে পারে। এই ল্যান্ডব্রিজ ছাড়া ইরানের জন্য তাদের প্রক্সি আর শক্তি বিস্তার সুনিশ্চিত করা সম্ভব হতো না।

এছাড়াও এই ল্যান্ডব্রিজ সুন্নি ক্ষমতাগুলো (যেমন: সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরব, কাতার (Qatar), তুরস্ক) এর বিরুদ্ধে ভারসাম্য রক্ষা করে। এভাবে ইরান আঞ্চলিক শিয়া সম্প্রদায়ের ওপর প্রভাব বিস্তার করে থাকে। একই সাথে ইরান সিরিয়াকে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ফ্রন্টলাইন হিসেবে ব্যবহার করে—সিরিয়াতে তারা সৈন্য ও অস্ত্র মোতায়েন করে যা ইসরায়েলকে প্রতিহত করার কৌশল হিসেবে ব্যবহৃত হয়। কিন্তু এখন ইরানের অবস্থান গত এক দশকের মধ্যে সবচেয়ে দুর্বল। ইসরায়েলি বোমাবর্ষণে হিজবুল্লাহ দুর্বল হয়ে পড়েছে, ইরানের নিয়ন্ত্রণ শিথিল হয়ে যাচ্ছে।

ইসরায়েল (Israel): আলেপ্পো দখল ইসরায়েলের জন্য প্রত্যাশিত ছিল না, বরং একটি অপ্রত্যাশিত ফলাফল। ইসরায়েল চায় না যে আসাদ ক্ষমতা হারাক, কারণ এতে একটি শূন্যতা সৃষ্টি হবে যা সুন্নি জঙ্গিরা পূরণ করতে পারে। ইরান হুমকি হলেও সুন্নি জঙ্গিরাও কম বড় চ্যালেঞ্জ নয়। ইসরায়েলের একমাত্র সম্ভাব্য মিত্র হল এসডিএফ (SDF) যারা সিরিয়ার উত্তর-পূর্বাঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করে এবং যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সহায়তা পায়। যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় ইসরায়েল সিরিয়ার পূর্বাঞ্চল বরাবর এসডিএফ নিয়ন্ত্রিত এলাকার সঙ্গে সংযোগকারী একটি করিডোর (Corridor) তৈরি করতে পারে। ২০ জানুয়ারিতে ডোনাল্ড ট্রাম্প (Trump) পুনরায় ক্ষমতায় আসার পর এটি আরও সম্ভবপর হতে পারে। এই করিডোর ইরানের ল্যান্ডব্রিজকে কার্যকরভাবে বিচ্ছিন্ন করে দেবে। কিন্তু এর একটি বড় সমস্যা রয়েছে। সিরিয়ার এই পূর্বাঞ্চল জনবসতিশূন্য ও অবকাঠামোহীন। লজিস্টিক সাপোর্টের অভাব রয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা, এ ধরনের একটি করিডোর তুরস্কের সঙ্গে ইসরায়েলের সম্পর্ক পুরোপুরি ধ্বংস করে দেবে, কারণ তুরস্ক এসডিএফকে হুমকি মনে করে। তাছাড়া এসডিএফ মূলত পিকেকে (PKK)-র শাখা, যা তুরস্ক, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন দ্বারা সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত।

পিকেকে (PKK) হলো একটি কুর্দি বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন, যারা তুরস্ক, ইরান, ইরাক ও অন্যান্য স্থানে বেসামরিক লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালিয়েছে। পশ্চিমা মিডিয়া এসডিএফ ও তাদের সামরিক শাখা ওয়াইপিজি (YPG)-কে প্রায়শই কুর্দি গোষ্ঠী বলে পরিচয় দেয়, কিন্তু এটা সাধারণ কুর্দি জনগোষ্ঠীর জন্য অবমাননাকর। সিরিয়ার উল্লেখযোগ্য সংখ্যক কুর্দি, আসিরীয় (Assyrian), ইয়াজিদি (Yazidi) সহ অনেক সংখ্যালঘু এসডিএফ ও ওয়াইপিজির বাধ্যতামূলক নিয়োগ, শিশু অপহরণ, উগ্রবাদী শিক্ষাক্রম ইত্যাদি নীতির কারণে বহিষ্কৃত ও পালাতে বাধ্য হয়েছে। তাই এসডিএফ (SDF) প্রকৃতপক্ষে মিডিয়ায় প্রচারিত “নায়কোচিত” চেহারার সংগঠন নয়। সাবেক মার্কিন স্পেশাল অপারেশনস কমান্ডার রেমন্ড থমাস (Raymond Thomas) এটা স্পষ্ট করে বলেছিলেন যে কৌশলগত প্রয়োজনে এসডিএফ নামটি নেওয়া হয়েছিল—আগে তারা ওয়াইপিজি নামে পরিচিত ছিল, যা পিকেকের সমার্থক হিসাবে দেখা হতো। মার্কিন পরামর্শে তারা নাম বদলে “সিরিয়ান ডেমোক্রেটিক ফোর্সেস” রাখে, নামটিতে “ডেমোক্রেটিক” শব্দটি যোগ করে।

তুরস্ক (Turkey): সিরিয়ার সঙ্গে ৯১১ কিলোমিটার সীমান্ত থাকা দেশ তুরস্ক এই সংঘাতে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত। যদিও অনেক মিডিয়া আউটলেট দাবি করে তুরস্ক সরাসরি হায়াত তাহরির আল-শাম (HTS) নিয়ন্ত্রণ করে, বাস্তবে তা সঠিক নয়। এইচটিএস আল-কায়েদা (Al-Qaeda) থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এখন আসাদকে পতন ঘটানোর দিকে মনোযোগী। এইচটিএস আন্তর্জাতিকভাবে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে স্বীকৃত—যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, তুরস্ক, রাশিয়া, ইরান সবাই একমত এই বিষয়ে।

তুরস্কের কিছু প্রভাব এইচটিএসের ওপর আছে, কারণ তাদের ভূখণ্ড একে অপরের সীমান্তে রয়েছে, কিন্তু এইচটিএস স্বাধীনভাবে কাজ করে। বছর ধরে তুরস্ক চেষ্টা করেছে এইচটিএসকে সিরিয়ান ন্যাশনাল আর্মির (Syrian National Army – SNA) সঙ্গে একীভূত করতে, কিন্তু ব্যর্থ হয়েছে। ফলে তুরস্ক শুধু তাদের সহ্য করছে, কারণ এইচটিএসের ওপর যে কোনো হামলা নতুন করে বড় শরণার্থী স্রোত তুরস্কে নিয়ে আসতে পারে। কিন্তু আলেপ্পো দখলের পর এইচটিএস যথেষ্ট সম্পদ ও শক্তি অর্জন করে, ফলে তারা তুরস্কের ওপর নির্ভরতা ছেড়ে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র পথে যায় ও দামেস্ক দখলে নেয়। তাই যদিও অনেক মিডিয়া এইচটিএসকে তুরস্কের প্রক্সি বলছে, বাস্তবে এইচটিএস নিজেদের স্বার্থে কাজ করছে। বরং এখন এইচটিএসের স্বার্থ তুরস্কের স্বার্থের সঙ্গে বিরোধময় হয়ে উঠছে।

আরেকটি বিদ্রোহী দল হলো সিরিয়ান ন্যাশনাল আর্মি (SNA), যারা মূল সিরিয়ান অন্তর্বর্তী সরকার (Syrian Interim Government)-এর সামরিক শাখা। এটাই ছিল মূল বিরোধী দল যা গৃহযুদ্ধের শুরুতে জন্ম নিয়েছিল। তাদের পতাকায় সবুজ-সাদা-কালো রঙ সিরিয়ান বিরোধীপক্ষের পরিচায়ক। যদিও সময়ের সাথে সাথে এসএনএ অনেকটা তুরস্কের প্রক্সিতে পরিণত হয়েছে—তুরস্কের নিজের বৈশ্বিক কার্যক্রমে এসএনএকে ওয়াগনার গ্রুপ (Wagner Group) বা ফ্রান্সের ফরেন লিজিওন (Foreign Legion)-এর মতো ব্যবহার করতে দেখা গেছে। এসএনএ আগে আল-কায়েদা এবং আইসিস (ISIS)-এর বিরুদ্ধে লড়াই করেছে এবং এখন আসাদকে উচ্ছেদ করতে চায়, একইসঙ্গে পিকেকে ও এসডিএফকে প্রতিহত করতে চায়। সম্প্রতি আলেপ্পো দখলের সময় এসএনএ এইচটিএসের সঙ্গে জোট বাঁধে, কিন্তু পরে এইচটিএস এসএনএকে কিছু এলাকা থেকে বিতাড়িত করে। ফলে এখন এই দুই বিদ্রোহী গোষ্ঠীর মধ্যেও উত্তেজনা বৃদ্ধি পায়। এদিকে এইচটিএস রাশিয়ার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে, যদিও রাশিয়া কোন সাড়া দেয়নি।

রাশিয়া (Russia): রাশিয়ার লক্ষ্য অন্যান্য পক্ষ থেকে আলাদা। সিরিয়ার উপকূলে রাশিয়ার একটি নৌঘাটি (Naval Facility) রয়েছে, কিন্তু এটি খুব বড় নয়। ঐতিহাসিকভাবে রাশিয়া-আসাদ সম্পর্ক সবসময় অস্থিতিশীল ছিল। রাশিয়াকে সিরিয়ায় টেনে এনেছে তাদের বৈশ্বিক ভাবমূর্তি গড়ার চেষ্টা। আসাদকে সহায়তা করে রাশিয়া দেখিয়েছে মধ্যপ্রাচ্যে ও বিশ্বমঞ্চে তার ‘কিং-মেকার (Kingmaker)’ ভূমিকা। এভাবে রাশিয়া নিজেকে এক বিশ্বশক্তি হিসেবে তুলে ধরতে পেরেছে, এমন একটি শক্তি যে তার মিত্রদের রক্ষা করতে পারে। বাস্তবে রাশিয়ার বিশ্বশক্তি হয়ে ওঠার মতো সম্পদ থাক বা না থাক, সিরিয়ায় তারা যে পাল্টা চাল দিয়েছে তাতেই একটি শক্তিশালী ভাবমূর্তি তৈরি হয়েছে। ২০১৫ সালে পুতিনের সামরিক হস্তক্ষেপ ছিল রাশিয়ার জন্য এক যুগান্তকারী সাফল্য। এর মাধ্যমে রাশিয়ার গ্রহণযোগ্যতা বৈশ্বিক দক্ষিণে (Global South) বেড়ে যায়। এমনকি যারা আগে রাশিয়ার অবস্থান মেনে নেয়নি, সেই আরব দেশগুলোও পরে রাশিয়ার সঙ্গে নতুনভাবে সম্পর্ক স্থাপন করে।

সুতরাং, রাশিয়ার জন্য সিরিয়া কোনো কেবলমাত্র নৌঘাটি বা স্থানীয় প্রভাবের বিষয় নয়, বরং নিজেদের বৈশ্বিক ক্ষমতাধর ভাবমূর্তি রক্ষা করা। আসাদের পতন হলে রাশিয়ার বিশ্বাসযোগ্যতা তাই নিশ্চিতভাবেই আঘাত পাচ্ছে, এবং সেই সাথে অ-পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো ভবিষ্যতে রাশিয়ার নিরাপত্তা সহযোগিতাকে ঝুঁকিপূর্ণ মনে করতে পারে। এ কারণে রাশিয়া এখনো সিরিয়ায় যুদ্ধবিমান পাঠাচ্ছে, যদিও তাদের ইউক্রেনেও বিমান দরকার। রাশিয়া হয়তো কূটনৈতিকভাবে বিদ্রোহীদের আটকে দিতে পারতো। কিন্তু স্থলে রাশিয়া নিজেও ইউক্রেন যুদ্ধে ব্যস্ত, তাই আসলে ইরানই মূল ভূমিকা রাখতে পারতো এই সংঘাতে। কিন্তু ইরান সেটা পারেনি।

ঘটনাপ্রবাহ

আলেপ্পো দখল

কিছুদিন আগে সহিংসতা ফের মাথাচাড়া দেয়। ২৭শে নভেম্বর বুধবার ইদলিব (Idlib) প্রদেশে অবস্থানরত আসাদ-বিরোধী বিদ্রোহীরা সিরিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর আলেপ্পো ও তার আশেপাশের সরকারি অনুগত সেনাদের অবস্থানের ওপর আকস্মিক হামলা চালায়। বিদ্রোহীদের মধ্যে প্রধান ছিল ইসলামী বিদ্রোহী গোষ্ঠী হায়াত তাহরির আল-শাম (Hay’at Tahrir al-Sham বা HTS)। তারা বুধবার ইদলিব থেকে আলেপ্পোর দিকে অগ্রসর হয়ে সিরিয়ান সরকারের নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে আক্রমণ করে। আগেই বলা হয়েছে, আলেপ্পো শহরটি একসময় বিদ্রোহীদের ঘাঁটি ছিল, তবে ২০১৬ সালে এক দীর্ঘ অবরোধের পর সরকার তা পুনরুদ্ধার করে।

এই নতুন আক্রমণের শুরুতে HTS সিরিয়ান সেনাবাহিনীর ৪৬তম রেজিমেন্টের ঘাঁটি এবং কয়েকটি গ্রাম মাত্র ২৪ ঘণ্টার মধ্যে দখল করে। এরপর বৃহস্পতিবার তারা সিরিয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সড়ক এম৫ (M5 Highway) এর দুটি পয়েন্ট বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। এ দুটো পয়েন্ট ছিল আলেপ্পোর উপশহর খান আল-আসাল (Khan al-Asal) এবং সারাকিব (Saraqib) শহর। এম৫ মহাসড়কটি রাজধানী দামেস্ক (Damascus) ও আলেপ্পোকে সংযুক্ত করে, যা সিরিয়ায় অত্যন্ত কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ।

সিরিয়ান অবজারভেটরি ফর হিউম্যান রাইটস (Syrian Observatory for Human Rights) এর তথ্যানুসারে তখন পর্যন্ত এই নতুন সহিংসতায় ২০০ জনেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছে। শুক্রবার সকাল নাগাদ বিদ্রোহীরা আলেপ্পোর পশ্চিমাঞ্চলীয় উপকণ্ঠে পৌঁছে গিয়েছিল বলে জানা যায়, যা আসাদের জন্য অত্যন্ত অস্বস্তিকর খবর।

যুদ্ধবিরতি ভঙ্গ হবার কারণ

৪ বছর ধরে স্থিতিশীল থাকা যুদ্ধবিরতি হঠাৎ ভেঙে পড়ার পেছনে মূলত দুটি কারণ দেখা যাচ্ছে:

১. ইসরায়েল ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের অস্থিরতা: ইসরায়েলের অভিযানের কারণে হেজবোল্লাহ (Hezbollah) ও ইরান (Iran), যারা আসাদকে সমর্থন করে, তাদের মনোযোগ দক্ষিণ লেবাননে (Lebanon) সরাতে হয়েছে। আবার, ইসরায়েল সম্ভবত লেবানন সীমান্তে একধরনের যুদ্ধবিরতি বা অস্থায়ী বন্ধ অবস্থার ঘোষণা করেছিল, আর HTS ঠিক এই মুহূর্তকে কাজে লাগাতে চেয়েছে। হেজবোল্লাহ ও ইরানের বাহিনী লেবাননে ব্যস্ত থাকার ফলে তারা সিরিয়ায় ততটা উপস্থিতি ও শক্তি কেন্দ্রীভূত করতে পারেনি। তাছাড়া, ইসরায়েলি বিমান হামলা সিরিয়ার অভ্যন্তরে হেজবোল্লাহ ও ইরানি অবস্থানকে দুর্বল করে দিয়েছে, যা আসাদের বাহিনীকেও দুর্বল করেছে।

২. ইদলিবে সিরিয়ান ও রাশিয়ান বিমান হামলার বৃদ্ধি ও এরদোয়ানের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নে ব্যর্থতা: গত মাসগুলোতে আসাদপন্থী সরকারী বাহিনী ইদলিব অঞ্চলে বিদ্রোহী লক্ষ্যবস্তুতে হামলা জোরদার করে। অনেক বিশ্লেষকের ধারণা ছিল এটি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে নতুন আক্রমণের পূর্বপ্রস্তুতি। প্রশ্ন হলো, হেজবোল্লাহ ও ইরান যখন ইসরায়েল সংলগ্ন ফ্রন্টে মনোযোগী, তখন আসাদ কেন বিদ্রোহীদের ওপর চাপ বাড়াতে চাইবে? সম্ভবত তারা ধারণা করেছিল যে, লেবাননে স্থিতিশীলতা বা কোনো সমঝোতার পর তারা ফের ফ্রন্টে ফিরে আসবে। এছাড়া, সাম্প্রতিক সময়ে আসাদ তুরস্ককে বিদ্রোহীদের প্রতি সমর্থন কমাতে রাজি করানোর চেষ্টা করছিল, যাতে পুরো সিরিয়ায় রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরে আসে এবং এরদোয়ান দেশে থাকা ৩.৬ মিলিয়ন সিরিয়ান শরণার্থীকে ফিরিয়ে দিতে পারেন। এরদোয়ানের সাথে আসাদের সম্পর্ক উন্নয়নের প্রচেষ্টা কিছুটা অগ্রসর হচ্ছিল—যেমন জুলাই মাসে এরদোয়ান বলেছিলেন তিনি এক দশকের বেশি সময় পর আসাদের সাথে সাক্ষাৎ করতে চান। কিন্তু ঘটনার মোড় ঘুরে যায়। কয়েক দিন আগে পুতিনের সাথে ফোনালাপের পরেও এরদোয়ানের অবস্থান বদলানোর আভাস পাওয়া যায়না। ধারণা করা যায়, এ অবস্থায় বিদ্রোহী আক্রমণটি সরকারী আক্রমণকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য এবং স্থানীয় ইদলিববাসীর (যারা নিয়মিত বিমান হামলার শিকার হচ্ছিল) সমর্থন পাবার জন্য চালানো হয়েছে।

আলেপ্পোর পর হামা

প্রাথমিকভাবে মনে হয়েছিল বিদ্রোহীরা মি-৫ (M5) মোটরওয়ে (Motorway) (যা আলেপ্পোকে সিরিয়ার দক্ষিণাঞ্চল এবং দামেস্কাসের সঙ্গে সংযুক্ত করা একটি কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ সড়ক) কেটে দেওয়ার লক্ষ্যে এগোচ্ছে। কিন্তু বিদ্রোহীরা প্রত্যাশার চেয়ে অনেক বেশি দ্রুত অগ্রসর হয়। মাত্র কয়েক দিনের মধ্যেই তারা আলেপ্পোর প্রায় পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। প্রো-আসাদ (Pro-Assad) বাহিনী দ্রুত পিছু হটে যায়।

আসাদের জন্য এটি ইতোমধ্যেই একটি বিশাল ধাক্কা ছিল। কিন্তু বিদ্রোহীরা সেখানেই থেমে থাকেনি; তারা এম৫ (M5) মোটরওয়ে বরাবর দক্ষিণে আরো অগ্রসর হয়ে, পূর্বে আসাদ-সমর্থিত বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে থাকা এলাকা দখল করতে থাকে। ২ নভেম্বর সোমবার সন্ধ্যার দিকে খবর পাওয়া যায় যে বিদ্রোহীরা হামা (Hama) শহরের উত্তর উপকণ্ঠ পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। হামার জনসংখ্যা প্রায় ১০ লক্ষ এবং এটি আলেপ্পো ও দামেস্কাসের মাঝামাঝি অবস্থিত।

আসাদের বাহিনীর এই সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ার কারণ হল তার প্রধান মিত্র ইরান (Iran), হেজবোল্লাহ (Hezbollah), এবং রাশিয়া (Russia)- প্রত্যেকে অন্য কোনোভাবে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। ইরান এখন ইসরায়েল (Israel)-এর সাথে সম্ভাব্য সংঘাত নিয়ে ব্যস্ত। হেজবোল্লাহ ইসরায়েলি হামলায় নেতৃত্বহীন হয়ে পড়েছে এবং দক্ষিণ লেবাননে (Lebanon) ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (IDF) এর সাথে লড়াই নিয়ে ব্যস্ত ছিল। অন্যদিকে রাশিয়া ইউক্রেন (Ukraine) যুদ্ধ নিয়ে প্রবলভাবে জড়িয়ে রয়েছে।

পরিস্থিতি আসাদের জন্য আরো খারাপ হয়ে ওঠে। কারণ বিদ্রোহীরা এবার সম্পূর্ণরূপে প্রো-আসাদ বাহিনীর ওপর মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করেছে। বিদ্রোহী ও কুর্দ (Kurds) বাহিনীর মধ্যে তুলনামূলকভাবে বেশ কম সংঘর্ষ ঘটে, যদিও কুর্দরা সিরিয়ার উত্তর-পূর্বাঞ্চলের (Northeastern Syria) বিশাল এলাকা নিয়ন্ত্রণ করে।

৫ নভেম্বর বৃহস্পতিবার বিদ্রোহীরা আসাদের বাহিনীর কাছ থেকে প্রায় কোনো বাধাই না পেয়ে হামা দখল করে নেয়। আর এরপর তারা হোমসের দিকে রওনা দেয়।

বিদ্রোহীরা

বিদ্রোহীরা মূলত দুটি প্রধান গোষ্ঠীর সমন্বয়ে গঠিত: হায়াত তাহরির আশ-শাম (Hayat Tahrir al-Sham বা HTS) নামে একটি জিহাদিপন্থী (Jihadist) জোট এবং সিরিয়ান ন্যাশনাল আর্মি (Syrian National Army বা SNA)। এই দুটো গোষ্ঠীই তুরস্কের (Turkey) সমর্থন পায়। তবে HTS, আসাদ-বিরোধী লড়াইয়ের দিকে বেশি মনোযোগী এবং তাদের স্বায়ত্তশাসন তুলনামূলকভাবে বেশি। অন্যদিকে SNA মূলত তুরস্কের প্রক্সি বাহিনী যা মূলত উত্তর-পূর্ব সিরিয়ার কুর্দদের বিরুদ্ধে তুরস্কের স্বার্থ রক্ষা করে।

তুরস্ক কেন কুর্দ-নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলের বিরুদ্ধে? কারণ তারা মনে করে, উত্তর-পূর্ব সিরিয়ায় একটি কুর্দ রাষ্ট্রের উদ্ভব তুরস্কের অভ্যন্তরে কুর্দ বিচ্ছিন্নতাবাদকে উসকে দেবে এবং তুরস্কের ভেতরে সক্রিয় কুর্দ মিলিট্যান্ট গ্রুপগুলোর জন্য একটি নিরাপদ ঘাঁটি তৈরি করবে।

প্রথমদিকে অনেক বিশ্লেষক ধারণা করেছিল যে বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে, বিশেষ করে SNA ও কুর্দ বাহিনীর মধ্যে যুদ্ধ লেগে যাবে। কারণ কুর্দরা আলেপ্পোর উত্তরে তাল রিফাত (Tal Rifaat) সহ কয়েকটি শহর নিয়ন্ত্রণ করে। এমনকি কুর্দরা উত্তর-পূর্ব অঞ্চল থেকে কিছু শক্তি সরিয়ে আলেপ্পোর কাছে পাঠিয়েছিল সম্ভাব্য সংঘাতের জন্য প্রস্তুতি নিতে।

কিন্তু অবাক করা বিষয় হল এখন পর্যন্ত বড় ধরনের সংঘর্ষ খুব একটা হয়নি। কিছু ছোটখাটো সংঘর্ষ ছাড়া অবস্থান বেশ শান্ত। এমনকি শোনা যেয় যে বিদ্রোহীদের মধ্যে এবং কুর্দদের সাথে একটি অস্থায়ী সমঝোতা বা যুদ্ধবিরতি হয়েছে যাতে বিদ্রোহীরা তাদের সম্পূর্ণ শক্তি আসাদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে পারে। এটি আসাদ শাসনের জন্য অত্যন্ত বড় একটি দুঃসংবাদ হয়ে ওঠে।

হামার পর হোমস

সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ শুরুর পর থেকে আসাদ দুইটি প্রাদেশিক রাজধানী হারিয়েছিল: ২০১৩ সালে রাক্কা (Raqqa) এবং ২০১৫ সালে ইদলিব (Idlib)। কিন্তু মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যে সে হারায় সিরিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর আলেপ্পো (Aleppo) এবং চতুর্থ বৃহত্তম শহর হামা (Hama)। এরপর বিদ্রোহীদের সামনে হোমস (Homs)। হোমস (Homs) শহরটি হামার (Hamah) কাছাকাছি অবস্থিত, যা সিরিয়ার চতুর্থ বৃহত্তম নগরী। যদি এখন বিদ্রোহীরা হোমস (Homs) দখল করে নেয়, তাহলে আসাদের পক্ষে পরিস্থিতি কার্যত অচল হয়ে যায়।

এদিকে আলেপ্পো ও হামা হারিয়ে আসাদ এরই মধ্যে আর্থিকভাবে কোণঠাসা হয়ে পড়েন। আলেপ্পো ও হামার কর-রাজস্ব আসাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ আয়ের উৎস ছিল। এখন সেগুলো হারিয়ে তার আয় আরও কমবে, যা তাকে নতুন করে ব্যয় সংকোচন (Spending Cuts) করতে বাধ্য করবে। আর এই ব্যয় সংকোচনের জন্য তার খুব একটা রাজনৈতিক মূলধন (Political Capital) অবশিষ্ট নেই।

ব্যয় হ্রাসের কারণে গত কয়েক বছর ধরে SAA (Syrian Arab Army)-এর কার্যক্ষমতা কমে গেছে। আসাদকে বহু সৈন্যকে ডিমোবিলাইজ (Demobilize) করতে হয়েছে, তাদের বেতন বাড়াতে পারেননি। এতে অনেক সৈন্য পালিয়ে বিদ্রোহীদের পক্ষে যোগ দিচ্ছে। তহবিল স্বল্পতার কারণে SAA সৈন্যরা স্থানীয় জনগণের কাছ থেকে অর্থ আদায় করতে চেকপয়েন্ট (Checkpoints) বা টোল (Tolls) বসায়, যা সাধারণ মানুষের মধ্যে গভীর অসন্তোষ সৃষ্টি করে। ফলে বিদ্রোহীরা যখন আলেপ্পো ও হামায় ঢুকছে তখন তারা সেখানকার মানুষ তাদের স্বাগত জানায়।

তাই হোমস (Homs) হারানোটা আসাদের জন্য সম্পূর্ণ বিপর্যয়। কারণ হোমস হারালে রাজধানী দামেস্ক (Damascus) থেকে উপকূলীয় এলাওয়াইট (Alawite) অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোর সাথে সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। এই উপকূলীয় অঞ্চলগুলোই আসাদের শক্ত ঘাঁটি এবং তার নিজের এলাওয়াইট জনগোষ্ঠী সেখানেই কেন্দ্রীভূত।

শেষ পর্যন্ত হোমস আর টেকানো যায়নি। ৫ নভেম্বর বৃহস্পতিবার বিদ্রোহীরা আসাদের বাহিনীর কাছ থেকে প্রায় কোনো বাধাই না পেয়ে হামা দখল করে। হামার পরই হাসে হোমস। আসাদের সৈন্যরা পিছু হটে পরের শহর হোমস (Homs)-এ চলে যায়। এর থেকেও খারাপ হলো, একাধিক প্রতিবেদন অনুযায়ী সিরিয়ান আরব আর্মি (Syrian Arab Army – SAA)-র বহু সৈন্য বিদ্রোহীদের পক্ষে চলে যায়, বিশেষ করে যখন তারা হামায় প্রবেশ করে। এমনকি শোনা যায়, আসাদের বাহিনী ইতোমধ্যেই হোমস (Homs) শহর থেকেও সরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে।

উল্লেখ্য, আসাদ এলাওয়াইট (Alawite) সম্প্রদায়ভুক্ত, যা সিরিয়ার রাজনীতিতে ১৯৭১ সালে যখন আসাদের পিতা হাফেজ আল-আসাদ (Hafez al-Assad) ক্ষমতা দখল করেন, তখন থেকে প্রাধান্য বিস্তার করে রেখেছে। কিন্তু এলাওয়াইটরা সিরিয়ার মোট জনসংখ্যার একটি ক্ষুদ্র অংশ, আনুমানিক মাত্র ১৫% (CIA-র অনুমান অনুযায়ী), যেখানে সুন্নি আরব (Sunni Arab)-রা সংখ্যাগরিষ্ঠ। এলাওয়াইটরা মূলত সিরিয়ার উপকূলীয় অঞ্চল—যেমন তারতুস (Tartus) ও লাটাকিয়া (Latakia)—এর আশেপাশে বসবাস করে। আসাদের সেনাদের হোমস (Homs) হারানো মানে ছিল দামেস্কের এলাওয়াইট ঘাঁটি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া। যার ফলে আসাদের নিয়ন্ত্রণ কেবল রাজধানীতেই সীমাবদ্ধ থাকে।

হোমসের পর দামেস্ক

৭ নভেম্বর শনিবার সন্ধ্যায় আসাদের বাহিনী শুধু হোমস নয়, রাজধানী দামেস্কও ত্যাগ করে। এর পেছনে প্রধান কারণ ছিল আসাদের বাহিনীর সার্বিক ভঙ্গুর অবস্থা। SAA খুবই দুর্বল পারফর্ম করেছে। পাশাপাশি দামেস্ক কার্যত চারদিক থেকে ঘিরে ফেলা হয়েছিল। উত্তরে বিদ্রোহীরা হেমস থেকে দক্ষিণে অগ্রসর হচ্ছিল, আবার দক্ষিণে দারা (Dara) প্রদেশ থেকেও আরেকটি নতুন বিদ্রোহী বাহিনী দামেস্কের দক্ষিণ উপকণ্ঠে অগ্রসর হয়। ইরান (Iran) ও রাশিয়া (Russia) তার প্রধান মিত্র হলেও তারা পর্যাপ্ত সহায়তা দিতে পারছিল না। ইরান ইরাক (Iraq) থেকে কিছু মিলিশিয়া পাঠানোর চেষ্টা করেছে, কিন্তু তাতে তেমন কাজ হয়নি। ইসরায়েল (Israel) ইরানকে সতর্ক করেছে যাতে তারা সিরিয়ায় বড় ধরনের সাহায্য না পাঠায়, বিশেষ করে এমন সাহায্য যা হিজবুল্লাহ (Hezbollah)-র হাতে অস্ত্র শক্তি বাড়িয়ে দিতে পারে। ইরান চাইলেও নিজস্ব সৈন্য প্রেরণে অন্তত এক সপ্তাহ লাগতো, যা বিদ্রোহীদের অগ্রগতির গতির তুলনায় খুবই ধীর ছিল। অন্যদিকে রাশিয়া এখনও বিমান হামলা চালালেও (Air Strikes) ইউক্রেন (Ukraine) নিয়ে ব্যস্ত থাকায় স্থলবাহিনী পাঠাতে পারছিল না। শনিবার সকাল নাগাদ পরিষ্কার হয়ে যায় যে, দীর্ঘদিনের মিত্র রাশিয়া (Russia) ও ইরান (Iran) – কেউই আসাদকে বাঁচাতে আসবে না।

ইরাকে (Iraq) ইরান-সমর্থিত মিলিশিয়া গোষ্ঠীর ছাতার মতো সংস্থা ‘পপুলার মোবিলাইজেশন ফোর্সেস’ (Popular Mobilization Forces) এক বিবৃতিতে জানায় যে, সিরিয়ায় যা হচ্ছে তা সম্পূর্ণভাবে দেশটির অভ্যন্তরীণ বিষয়। অন্যদিকে, দামেস্কের রাশিয়ান দূতাবাস রাশিয়ান নাগরিকদের দ্রুত সিরিয়া ত্যাগের আহ্বান জানায়। এমনকি ব্লুমবার্গ (Bloomberg) রিপোর্ট করে যে, রাশিয়া আসাদকে বাঁচাতে কোনো পরিকল্পনা করেনি, কারণ আসাদের সেনারা অব্যাহতভাবে তাদের অবস্থান ত্যাগ করছিল। ক্রেমলিন (Kremlin)-ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র উল্লেখ করে জানানো হয় যে, সিরিয়ান প্রেসিডেন্টের পক্ষে পরিস্থিতি এতটাই ঝুঁকিপূর্ণ যে রাশিয়ার হস্তক্ষেপের আগ্রহ কমে যায়।

ফলে দেখা যায়, রাশিয়া ও ইরান দুপক্ষই হিসাব করে দেখে যে আসাদের পতনের সম্ভাবনা তুলনামূলক বেশি, তাই তাকে সমর্থন দিয়ে কোনো লাভ নেই। আসাদের পতনের সম্ভাবনা যত বাড়ে, তাকে সমর্থন করার প্রেরণা ততই কমে যায়। এভাবে এক ধরণের চক্রবৃদ্ধি হারে আসাদের অবস্থান আরও দুর্বল হয়। শোনা যায়, আসাদ মরিয়া হয়ে সংযুক্ত আরব আমিরাত (UAE), মিশর (Egypt) এবং জর্দান (Jordan)-সহ আরব প্রতিবেশীদের কাছ থেকে সাহায্য চেয়েছিলেন। তিনি বোঝাতে চেয়েছিলেন যে বিদ্রোহীরা সিরিয়াকে অস্থিতিশীল জিহাদী (jihadist) শাসনে পরিণত করবে, আইসিস (ISIS)-এর মতো উচ্চাকাঙ্ক্ষা নিয়ে সামনে এগোবে। কিন্তু কেউ এতে সাড়া দেয়নি। অবশেষে রোববার ভোরে পরিষ্কার হয়ে যায় যে আসাদের শাসন দীর্ঘস্থায়ী হবে না। সিরিয়ান প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ আল-জালালি (Muhammad Al Jalali) এক ভিডিও বার্তায় জানান যে, সরকার বিদ্রোহীদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের উদ্দেশ্যে একটি “সংক্রমণকালীন সরকার” (transitional government) গঠনের পরিকল্পনা করছে।

এরপর কী হবে?: আশাবাদী ও নৈরাশ্যবাদী দৃশ্যপট

পরবর্তী পরিস্থিতি অনেকটাই নির্ভর করছে নতুন বিদ্রোহী নেতৃত্বাধীন সরকারের উপর। এ সরকারে সম্ভবত প্রধান প্রভাব থাকবে এইচটিএস (HTS – Hay’at Tahrir al-Sham) নামের বিদ্রোহী গোষ্ঠীর, যারা ইদলিব থেকে আক্রমণ পরিচালনা করেছিল।

এইচটিএস-এর নেতা আহমেদ হুসেইন আল-শার (Ahmed Hussein Al-Shar), যিনি আবু মুহাম্মদ আল-জোলানি (Abu Mahammad Al-Jolani) বা সংক্ষেপে জোলানি (Jolani) নামে পরিচিত। জোলানি একসময় আল-কায়েদার (Al-Qaeda) সিরিয়া শাখা আল-নুসরা ফ্রন্টের (Al-Nusra Front) নেতা ছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর তাকে এখনো সন্ত্রাসী (terrorist) হিসাবে গণ্য করে এবং তার মাথার দাম ১০ মিলিয়ন ডলার।

এখন সিরিয়ায় আগামীতে কী হবে সেই ব্যাপারে একদিকে নৈরাশ্যবাদী দৃশ্যপট (Pessimistic Take), অন্যদিকে অপেক্ষাকৃত আশাবাদী দৃশ্যপট (Optimistic Take) রয়েছে।

নৈরাশ্যবাদী দৃশ্যপট: নৈরাশ্যবাদী দৃশ্যপট হচ্ছে, ৭০-এর দশকে খোমেনি (Khomeini in the 70s) বা সাম্প্রতিক বছরগুলিতে তালেবানের মতোই, জোলানি হয়তো এখন কেবল ক্যামেরার সামনে আকর্ষণীয় সাজ নিচ্ছেন। ক্ষমতা নিশ্চিত হওয়ার পর তিনি হয়তো একটি কঠোর ইসলামী শাসন ব্যবস্থা চাপিয়ে দেবেন। এমনও হতে পারে যে জোলানি নিজে মধ্যপন্থী থাকার চেষ্টা করলেও, সিরিয়ায় এইচটিএস তাদের নিয়ন্ত্রণ বিস্তারকালে স্থানীয় জঙ্গি গোষ্ঠীগুলোর সহযোগিতার প্রয়োজন পড়বে, যাদের নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হবে এবং তারা হয়তো আরও কঠোর শরিয়াহ আইন চাপিয়ে দিতে চাইবে। সব মিলে নৈরাশ্যবাদী দৃশ্যপট অনুযায়ী এইচটিএস (HTS) (যা মূলত আল-কায়েদা (Al-Qaeda) সংশ্লিষ্ট) একটি কঠোর ইসলামপন্থী শাসনব্যবস্থা কায়েম করতে পারে। এতে সাধারণ সিরিয়ানদের অবস্থা শোচনীয় হয়ে উঠবে, এবং সম্ভবত আবারও গৃহযুদ্ধের সূত্রপাত হতে পারে।

আশাবাদী দৃশ্যপট: আশাবাদীদের দৃশ্যপট হচ্ছে, আবু মোহাম্মদ আল-জোলানি (Abu Muhammad al-Jolani) এবং এইচটিএস (HTS) ইদানীং মধ্যপন্থী এবং তুলনামূলক অন্তর্ভুক্তিমূলক (inclusive) প্রশাসন পরিচালনার দিকে ঝুঁকছে। জোলানি সিএনএনকে (CNN) দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন যে, তারা একটি “ইসলামী শাসন” (Islamist style of government) চাইলেও তা কাঠামোগত প্রতিষ্ঠান নির্মাণের মাধ্যমে হবে, যেখানে সবার অধিকার রক্ষা করা হবে।

জোলানি দাবি করেছেন যে, তার চিন্তাভাবনা সময়ের সাথে বদলেছে। একসময় তিনি আল-কায়েদার (Al-Qaeda) সিরিয়ান শাখা জাভহাত আল-নুসরা (Jabhat al-Nusra)-র নেতা ছিলেন। এখন তার লক্ষ্য একটি আইনি কাঠামো (legal framework) তৈরি করা, যা সকল সম্প্রদায়ের অধিকার নিশ্চিত করবে। ইদলিব (Idlib) অঞ্চলে এইচটিএস একটি তুলনামূলক অন্তর্ভুক্তিমূলক শাসন ব্যবস্থা পরিচালনা করেছে বলে জানা যায়। সেখানে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, বিশেষ করে খ্রিস্টান এবং দ্রুজদের (Druze) সাথে ভালো সম্পর্ক গড়ে তোলা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, খ্রিস্টানদের মিসা (mass) পালনের অনুমতি দেওয়া হয়েছে এবং জোর করে দখল করা জমি তাদের মূল মালিকদের ফেরত দেওয়া হয়েছে।

এইচটিএস-এর শাসন কখনোই উদার গণতন্ত্রের (liberal democracy) মতো ছিল না। সেখানে নির্বাচনের কোনো ব্যবস্থা ছিল না, এবং রাজনৈতিক বিরোধীদের কারাবন্দী করা হয়েছে। তবু এটি তালেবান-শাসিত (Taliban-style) ইসলামিক থিওক্রেসির (Islamic theocracy) মতোও নয়, যা অনেক সিরিয়ান ভয় পেয়েছিল। এইচটিএস বর্তমানে সিরিয়া-কেন্দ্রিক ইসলামপন্থী জাতীয়তাবাদের (Islamist-tinged Syrian nationalism) দিকে ঝুঁকছে, যা আন্তর্জাতিক খিলাফতের (transnational caliphate) ধারণা থেকে দূরে সরে এসে আসাদবিরোধী (anti-Assad) ফ্রেমওয়ার্কে গড়া।

ইদলিবে এইচটিএস “সালভেশন গভর্নমেন্ট” (Salvation Government) গঠন করেছে, যেখানে ১১টি মন্ত্রণালয় কাজ করছে। এই মন্ত্রণালয়গুলো গত কয়েক বছরে কিছু প্রযুক্তিগত দক্ষতা এবং অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে। এ ছাড়া, আলেপ্পো (Aleppo) দখলের পর সংখ্যালঘু খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের ওপর নৃশংসতার আশঙ্কা থাকলেও, বাস্তবে তা ঘটেনি। বরং শোনা যায়, এইচটিএস আলেপ্পোর মেয়র হিসেবে একজন খ্রিস্টান বিশপ (Christian Bishop) নিয়োগের কথা ভাবছে।

তবে অনেকে মনে করেন যে, জোলানি কেবল আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন পাওয়ার জন্য মিথ্যা বলছেন। তার ক্ষমতালিপ্সু মানসিকতা এবং বাস্তববাদী অবস্থান তাকে মধ্যপন্থী শাসনের দিকে ঠেলে দিয়েছে। তিনি হয়তো বুঝেছেন যে, নিজেকে দেশের সাধারণ মানুষ এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলাই তার ক্ষমতা ধরে রাখার একমাত্র উপায়। এর ফলে আসাদের পতনের পরপরই আরেকটি গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার সম্ভাবনাও কিছুটা কমতে পারে।

এদিকে এটাও বিবেচ্য যে, এইচটিএস (HTS) অতি মাত্রায় বিভক্ত গোষ্ঠীদের সমন্বয়—একটি উগ্রপন্থী জোট। একারণে তাদের বৃহত্তর সিরিয়া পরিচালনা করার ক্ষমতা সীমিত। এক পর্যায়ে তুরস্ক চাইতেই পারে, এইচটিএসকে ভেঙে দিয়ে আলেপ্পো এসএনএ ও সিরিয়ান অন্তর্বর্তী সরকারের (Syrian Interim Government) হাতে তুলে দিতে।

সিরিয়ার ভূখণ্ড নিয়ে সংশয়, কুর্দি সমস্যা ও বিদেশী হস্তক্ষেপ

বিদ্রোহীরা এখন সিরিয়ার বেশিরভাগ জনবহুল কেন্দ্র নিয়ন্ত্রণ করলেও পুরো দেশ নয়। রোববার দুপুরে ইসরায়েল (Israel) গোলান হাইটস (Golan Heights) এলাকার আশপাশে একটি “বাফার জোন” (buffer zone) তৈরির ঘোষণা দেয়। অন্যদিকে কুর্দিরা (Kurds) এখনো দেশের উত্তর-পূর্ব অংশ নিয়ন্ত্রণ করছে, যেখানে ইউফ্রেটিস নদী (Euphrates River) একটি অস্থায়ী বিভাজনকারী সীমান্তরেখার মতো কাজ করছে।

ইসরায়েলের সাথে বিদ্রোহীদের এখনই কোনো যুদ্ধ শুরু করার সম্ভাবনা কম। তবে কুর্দিদের ভাগ্য এখনো অনিশ্চিত। উল্লেখ্য, যদি বিদ্রোহীদের সাথে কুর্দদের বড় কোনো সংঘর্ষ হতো, তবে কিছুটা হলেও আসাদের জন্য উপকার হতো। বিদ্রোহীরা মূলত দুই দল নিয়ে গঠিত: এইচটিএস (HTS – Hay’at Tahrir al-Sham), যা ইসলামপন্থী (Islamist) সংগঠন, এবং এসএনএ (SNA – Syrian National Army), যা তুরস্কের (Turkey) সমর্থিত প্রক্সি (Proxy) বাহিনী। এসএনএ সাধারণত উত্তর-পূর্ব সিরিয়ায় কুর্দদের বিরুদ্ধে লড়াই করে।

নতুন বিদ্রোহী অভিযান শুরু হলে অনেকেই ভেবেছিল কুর্দদের সাথে সংঘর্ষ হবে। কিন্তু সেরকম হয়নি। কিছু ছোটখাট সংঘর্ষ ছাড়া বড় সংঘাত অনুপস্থিত। এমনকি এইচটিএস (HTS) একটি বিবৃতি দিয়ে কুর্দিদের “সিরিয়ার অবিচ্ছেদ্য অংশ” বলে উল্লেখ করেছে। এইচটিএস বারবার ঘোষণা করেছে যে তারা সিরিয়ার সংখ্যালঘুদের (যার মধ্যে কুর্দিরাও আছে) অধিকার রক্ষা করবে। কিন্তু এটা এইচটিএস এর কথা। তাদের প্রধান আন্তর্জাতিক পৃষ্ঠপোষক তুরস্ক (Turkey), আর তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের (Erdogan) কৌশলগত লক্ষ্য হল উত্তরপূর্ব সিরিয়ার কুর্দি রাষ্ট্রের সম্ভাবনাকে নস্যাৎ করা। তাই কুর্দদের বিষয়ে এইচটিএস ও তুরস্ক সমর্থিত এসএনএ-র মধ্যে মতানৈক্য থাকতেই পারে।

এমনকি যদি এইচটিএস কুর্দদের থাকতে দেয়, তবুও তুরস্কের সামরিক বাহিনী ও তুরস্ক-সমর্থিত সিরিয়ান ন্যাশনাল আর্মির (Syrian National Army) মতো বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো এই সুযোগে কুর্দি নিয়ন্ত্রিত এলাকায় পূর্ণাঙ্গ হামলা শুরু করতে পারে। ইতোমধ্যেই গত ২৪ ঘন্টায় খবর পাওয়া গেছে যে তুরস্ক-সমর্থিত মিলিশিয়ারা ইউফ্রেটিস নদীর পশ্চিম পাশে কুর্দি-নিয়ন্ত্রিত অবস্থানে আক্রমণ চালিয়েছে, যার মধ্যে মানবিজ (Manbij) ও দেইর আজ-যোর (Deir Ezzor) অঞ্চলের নাম শোনা যাচ্ছে।

যদি এই আক্রমণ ইউফ্রেটিসের পূূর্বাঞ্চলে মূল কুর্দি-অঞ্চলের দিকে অগ্রসর হয়, তাহলে কুর্দরা মারাত্মক সমস্যায় পড়বে, যদি না যুক্তরাষ্ট্র (US) – যাদের এখনো ওই অঞ্চলে অল্প সংখ্যক সৈন্য রয়েছে – তারা তাদের দীর্ঘদিনের মিত্র কুর্দদের পক্ষে এগিয়ে না আসে। আসলে কীভাবে এই আলোচনার শেষ রূপ গড়ে উঠবে তা অনেকাংশে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের (US) অবস্থানের ওপর নির্ভর করে। আসাদ ও এরদোয়ান (Erdogan) উভয়েই উত্তর-পূর্বের ডি-ফ্যাক্টো (de facto) কুর্দ রাষ্ট্রটিকে (যাকে সাধারণত রোজাভা (Rojava) বলে) ধ্বংস করতে চায়। কুর্দদের নিরাপত্তার পেছনে এক বড় কারণ হল প্রায় ৯০০ মার্কিন সেনার উপস্থিতি, যারা মূলত আইসিস-এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের অজুহাতে সেখানকার কুর্দ-নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে মোতায়েন রয়েছে।

কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্প (Donald Trump) এর প্রথম মেয়াদে তিনি কুর্দদের প্রতি তেমন গুরুত্ব দেননি। ২০১৯ সালে তার আংশিক সেনা-প্রত্যাহার তুরস্ককে কুর্দ নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে আক্রমণ শুরু করার পথ উন্মুক্ত করে। এমনকি ওভাল অফিস (Oval Office) ব্রিফিংয়ে তিনি নাকি প্রশ্ন তুলেছিলেন কেন তাকে কুর্দদের বিষয়ে “দুশ্চিন্তা করতে হবে”—এমন অভিযোগ অ্যাডাম কিন্জিংগার (Adam Kinzinger)-এর নতুন বইয়ে (book) উল্লেখ আছে। সামনের ২০ জানুয়ারি থেকে শুরু হওয়া ট্রাম্পের নতুন প্রশাসন যদি সিরিয়া থেকে অবশিষ্ট আমেরিকান সেনাদের প্রত্যাহার করেন, তবে কুর্দরা বড় ধরনের সমস্যায় পড়বে। কুর্দদের রক্ষা করার মতো শক্তি তখন অনেকটাই কমে যাবে, যা আসাদ ও এরদোয়ানের পক্ষে কুর্দ রাষ্ট্র কাঠামো ভেঙে দেওয়া সহজ করবে। আর তেমনটাই হতে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প ট্রুথ সোশ্যালে পোস্ট করে বলেছেন, সিরিয়া যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র নয়, এবং যুক্তরাষ্ট্র সিরিয়ায় কোন রকম হস্তক্ষেপ করবে না।

এদিকে ইসরায়েল ট্রাম্প প্রশাসনের (Trump Administration) কাছে সাহায্যের অনুরোধ জানাবে, যাতে তারা ইসরায়েলের স্বার্থে হস্তক্ষেপ করে। আগেই বলা হয়েছে, ইসরায়েলের স্বার্থের সাথে কুর্দদের স্বার্থের সম্পর্ক আছে। যদি ট্রাম্পকে শেষ পর্যন্ত টলানো যায়, তাতে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাপক সম্পদ ও শক্তি ব্যয় হতে পারে। তবে এটা মনে রাখা দরকার যে যুক্তরাষ্ট্র এখানকার সবচেয়ে বড় গেম-চেঞ্জার। দীর্ঘদিন বিরোধ করে গেলে একসময় দেখা যাবে আকাশে যুক্তরাষ্ট্রের বিমান ঘোরাফেরা শুরু করবে এবং তখন চিত্র আরও বদলে যাবে। তবে আবারও বলছি, ট্রাম্পের পোস্টের পর এই সম্ভাবনাটা এখন বেশ ক্ষীণ।

এই সাম্প্রতিক সাফল্য তুরস্কের জন্য একটি বিশাল সুবিধা এনে দেয়। যদিও নিশ্চিত নয় যে তুরস্ক সরাসরি এই সাম্প্রতিক হামলাকে অনুমোদন দিয়েছে কিনা, তবু এখন একটি উল্লেখযোগ্য ভূখণ্ড তাদের মদদপুষ্ট প্রক্সিদের (Proxies) দখলে রয়েছে। এটি ভবিষ্যৎ আলোচনা বা দর কষাকষিতে আঙ্কারার (Ankara) প্রভাব বাড়াবে। এটি ইসরায়েলের জন্যও একদিক দিয়ে ভালো খবর। কারণ আসাদ ইরান ও হেজবোল্লাহর অন্যতম মিত্র এবং সিরিয়ায় এ ধরনের অস্থিরতা ইরানের জন্য হেজবোল্লাহকে অস্ত্র ও রসদ সরবরাহ করা কঠিন করে তুলবে।

এখানে বিশ্বাসযোগ্য প্রতিশ্রুতি সমস্যার (credible commitment problem) ধারণাটি প্রাসঙ্গিক

কেন এত দিন গৃহযুদ্ধ চলল, কেন এক ঝটকায় যুদ্ধ শেষ হলো, কেন আসাদকে পালাতে হলো – এসবের ব্যাখ্যায় আজ গৃহযুদ্ধ বিষয়ক একটা তাত্ত্বিক দিক নিয়ে আসব। বাংলাদেশে গণঅভ্যুত্থানের ক্ষেত্রেও বিষয়টা প্রাসঙ্গিক। তাত্ত্বিক দিকটা হচ্ছে – বিশ্বাসযোগ্য প্রতিশ্রুতি সমস্যা (credible commitment problems)। একটি যুদ্ধ, একটি আক্রমণাত্মক অভিযান (offensive), এবং একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত—সব কিছুর মূলেই রয়েছে একই ভিত্তি। এই পুনরাবৃত্ত সমস্যা প্রায় সব গৃহযুদ্ধেই দেখা যায়। যদি আপনি সংক্ষিপ্ত উত্তরের খোঁজে আসেন, তাহলে সংক্ষেপে বলতে গেলে, রাশিয়ার (Russia) আর আসাদ শাসনকে সহায়তা করার সক্ষমতা ছিল না। এর ফলে বহুমুখী আক্রমণ (multi-pronged offensive) দামেস্ককে সবদিক থেকে চেপে ধরে, যা পরিস্থিতিকে অসম্ভব করে তোলে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা এই অভিন্ন কারণকে একটা মজার নাম দিয়ে থাকেন – “বিশ্বাসযোগ্য প্রতিশ্রুতি সমস্যা (credible commitment problem)”।

যুদ্ধ অবসানের ধরন

একটু ব্যাপক পরিসরে তাকাই। ব্যাপকভাবে বলতে গেলে, যুদ্ধ দুটি উপায়ে শেষ হয়:

  • ১) কোনো এক পক্ষের সম্পূর্ণ সামরিক পরাজয়, যেখানে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া আর বাস্তবসম্মত নয়।
  • ২) আলোচনার মাধ্যমে একটি সমঝোতা (negotiated settlement), যখন উভয় পক্ষই যুদ্ধ চালিয়ে যেতে পারে, কিন্তু তবুও চুক্তিতে পৌঁছানোর সিদ্ধান্ত নেয়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ (World War II) একটি সম্পূর্ণ সামরিক পরাজয়ের উদাহরণ। অন্যদিকে, কোরিয়ান যুদ্ধ (Korean War) একটি সমঝোতার মাধ্যমে শেষ হওয়া যুদ্ধের উদাহরণ। কখনও কখনও এইসব আলোচনা প্রকৃত বৈঠকের টেবিলে হয়, আবার কখনও যুদ্ধ হঠাৎ শেষ হয়ে যায়, সবাই বোঝে যে তখনকার পরিস্থিতিই পরবর্তী সময়ের স্থিতাবস্থা (status quo) হবে।

এবার একটু চিন্তা করুন। আন্তঃরাষ্ট্রীয় যুদ্ধের (interstate wars) কত শতাংশ আলোচনার মাধ্যমে শেষ হয়? যদিও সামরিক পরাজয়ের উদাহরণ নিয়ে আমাদের ঐতিহাসিক উৎসাহ বেশি, তবু প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ আন্তঃরাষ্ট্রীয় যুদ্ধ কোনো না কোনো চুক্তির মাধ্যমে শেষ হয়। বাস্তবে এর সংখ্যাটি আরও বেশি হতে পারে, কারণ অনেক ক্ষেত্রে সমঝোতা এত দ্রুত ঘটে যে হতাহতের পরিমাণ যুদ্ধ হিসেবে গণ্য হওয়ার আগে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু গৃহযুদ্ধ (civil war) আলাদা। মাত্র প্রায় এক-পঞ্চমাংশ গৃহযুদ্ধ সমঝোতায় শেষ হয়। আর এর কারণই হলো সেই “বিশ্বাসযোগ্য প্রতিশ্রুতি সমস্যা (credible commitment problem)”।

গৃহযুদ্ধে বিশ্বাসযোগ্য প্রতিশ্রুতি সমস্যা

দেখুন, যখন দুই রাষ্ট্রের মধ্যে সমঝোতা হয়, তখন উভয় পক্ষই নিজেদের সামরিক সক্ষমতা ধরে রাখে। যে কারণে এই সমঝোতাগুলো টিকে থাকে, তা হলো চুক্তির শর্তাবলী মোটামুটি যুদ্ধের সম্ভাব্য ফলাফলের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ, কিন্তু কেউই যুদ্ধের ব্যয় বহন করতে চায় না। কিন্তু গৃহযুদ্ধ শেষ হলে সরকারকে আবার শাসনে ফিরতে হয়। আর এটা কার্যকরী করতে হলে বিরোধী পক্ষকে তাদের অস্ত্র সমর্পণ করতে হয়।

আপনি কল্পনা করুন, যদি দেখা যায় সরকার প্রায় নিশ্চিতভাবে জয়ী হবে, তাহলে সরকার বিদ্রোহীদের (rebels) অস্ত্র ত্যাগ করতে বলবে এবং সরকারের বৈধ কর্তৃত্ব মেনে নিতে বাধ্য করবে। এর বিনিময়ে সরকার বিদ্রোহীদের ক্ষমার (amnesty) প্রতিশ্রুতি দেবে। কিন্তু সমস্যা হলো, একবার বিদ্রোহীরা অস্ত্র নামিয়ে রাখলে, সরকারের সেই প্রতিশ্রুতি রাখার আর কোনও প্রণোদনা (incentive) থাকবে না। বিদ্রোহীদের কাছে আর কোনও শক্তি নেই, তারা এখন হাতের মুঠোয়। তাছাড়া, গৃহযুদ্ধ শেষ হয়েছে, দুপক্ষের একে অপরের প্রতি ঘৃণা প্রবল, ফলে সুযোগ পেলে সরকার নিশ্চয়ই বিদ্রোহীদের ওপর প্রতিশোধ নেবে।

ফলে বিদ্রোহীরা এই শর্ত মানবে না, কারণ তারা জানে সরকার এই ক্ষমার প্রতিশ্রুতি বিশ্বাসযোগ্যভাবে রাখতে পারবে না। তাই আরো একদিন বেঁচে লড়াই চালিয়ে যাওয়াই তাদের কাছে ভালো। দুনিয়া বাস্তবেই এভাবে চলে কি না নিশ্চিত না হলে, রাশিয়ায় ইয়েভগেনি প্রিগোঝিন (Yevgeny Prigozhin) এর সাথে কী হয়েছিল দেখে নিতে পারেন।

এই সমস্যার সবচেয়ে কুৎসিত দিকটা হচ্ছে, যদি বিদ্রোহীরা পাল্টা পরিস্থিতি ঘুরিয়ে দিতে পারে, তাহলে এবার তারা সরকারের অস্ত্র সমর্পণ চাইবে। অর্থাৎ সমস্যা উল্টো দিক থেকেও থেকে যায়। এই কারণেই খুব কম গৃহযুদ্ধ সমঝোতায় শেষ হয়। আর এ কারণে গৃহযুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হয়—যখন পর্যন্ত না কোনো পক্ষ সামরিকভাবে সম্পূর্ণ পরাজিত হয়, যুদ্ধ থামে না।

সুতরাং এই বিশ্বাসযোগ্য প্রতিশ্রুতি সমস্যাই (credible commitment problems) ১৩ বছর ধরে গৃহযুদ্ধটি চলার কারণ।

পরাজিত সৈন্যদের মনোবল সমস্যার (Morale Problems) বিষয়

এই পরিস্থিতি পরাজিত পক্ষের সৈন্যদের মধ্যে হতাশা জন্ম দেয়। তাদের উদ্দীপনা নেতাদের মত নয়। যদি তারা কোনো সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠী (ethnic minority) থেকে আসে, তাহলে তাদের ভাবতে হবে পরাজয়ের পর বিজয়ী পক্ষ প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে বৈষম্যমূলক আইন পাস করতে পারে। কিছু গৃহযুদ্ধে পরাজিত সৈন্যদের পরবর্তী পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে। তবে এও সত্য যে অনেক ক্ষেত্রে তারা যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে সাধারণভাবে জীবনযাপন করতে পারে।

কিন্তু পরাজিত পক্ষের নেতা (leaders) সাধারণত এমন সৌভাগ্য পান না। বিজয়ী পক্ষের ভয় থাকে, ভবিষ্যতে পরাজিত নেতা নতুন করে বিদ্রোহের সুযোগ পেলে আবার তা শুরু করবে। ফলে, কেউ কেউ পরাজয় স্বীকার করে দেশে থাকার বদলে নির্বাসনে (exile) যাওয়ার চেষ্টা করেন, যদি কেউ তাকে আশ্রয় দেয়। যদি নির্বাসন সম্ভব না হয়, তাহলে জীবনের বাকি দিনগুলো জেলে কাটানোটাই পরাজিত নেতার কাছে তুলনামূলক ভালো পরিণতি। কারাগারে থাকা অবস্থায়ও তাদের সুযোগ আসতে পারে আবার ক্ষমতায় ফেরার, আর সুযোগ এলে নিশ্চয়ই সেই সুযোগ পরাজিত নেতা ছাড়বে না। কেবলমাত্র তাদের পুরোপুরি পৃথিবী থেকে সরিয়ে ফেললে (execute) নিশ্চিত করা যায় যে তারা আর কখনও ফিরে আসবে না। সুতরাং পরাজিত পক্ষ পুনরায় বিদ্রোহ না করার বিশ্বাসযোগ্য প্রতিশ্রুতি দিতে না পারার ফলে, বিজয়ী পক্ষও তাদেরকে মুক্তি বা নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি বিশ্বাসযোগ্যভাবে দিতে পারে না।

কিন্তু এটি আবার একটি সাংঘর্ষিক অবস্থা তৈরি করে। যুদ্ধ এক সময় এমন একটি পর্যায়ে পৌঁছাতে পারে যে সৈন্যরা আর লড়তে আগ্রহী নয়, যদিও নেতা লড়াই চালিয়ে যেতে চায়। সিরিয়াতে এই মুহূর্তটি খুব দ্রুত এসেছিল। যখন স্পষ্ট হয়ে গেল যে ইউক্রেন (Ukraine) সংকটের কারণে রাশিয়া আসাদকে আর সাহায্য করতে পারবে না, এবং ইসরায়েল (Israel) হেজবোল্লাহ (Hezbollah)-কে নিষ্ক্রিয় করে ফেলেছিল, যার ফলে হেজবোল্লাহ-ও সাহায্য করতে অক্ষম হয়ে পড়ে, তখন আসাদের সৈন্যদের যুদ্ধের আগ্রহ দ্রুত ফিকে হয়ে যায়। এইভাবে মাত্র দশ দিনেই পরিস্থিতি দ্রুত পরিবর্তিত হয়ে গেল।

সুতরাং এই বিশ্বাসযোগ্য প্রতিশ্রুতি সমস্যাই (credible commitment problems) এক ঝটকায় যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটানোর কারণ।

রাশিয়া (Russia) এবং কেন আসাদকে পালাতে হলো

রাশিয়া সংক্রান্ত বিষয়টি ছিল ডাবল ‘হোয়ামি’ (double whammy)। বিশ্বাসযোগ্য প্রতিশ্রুতি সমস্যা সমাধানের প্রচলিত উপায় হলো কোনো তৃতীয় পক্ষের (third-party) শর্তগুলি রক্ষা করার গ্যারান্টি দান করবে। এতে একটি পক্ষ অস্ত্র নামিয়েও নিশ্চিন্ত থাকতে পারে যে, বিজয়ী পক্ষ চুক্তি লঙ্ঘন করলে তৃতীয় পক্ষ হস্তক্ষেপ করবে। এই তৃতীয় পক্ষের উপস্থিতি সম্ভাব্য নিপীড়নকে নিরুৎসাহিত করে।

তবে এর জন্য দরকার এমন একটি তৃতীয় পক্ষ, যে:

  • ১) চুক্তি ভঙ্গ হলে তা দমনের মতো যথেষ্ট শক্তিশালী,
  • ২) ওই অঞ্চলে সামরিক বাহিনী মোতায়েনের মতো অতিরিক্ত ক্ষমতা রাখে,
  • ৩) রাজনৈতিকভাবে তা করতে আগ্রহী,
  • ৪) এবং সত্যিকারের ইচ্ছা রাখে সংশ্লিষ্ট পক্ষকে রক্ষা করার।

এই শেষ শর্তটি আসাদের ক্ষেত্রে পশ্চিমা বিশ্বের (Western powers) জন্য প্রযোজ্য নয়, কারণ তারা আসাদকে দ্য হেগ (The Hague)-এ পাঠিয়ে বিচারের সম্মুখীন করতে আগ্রহী। সুতরাং আসাদকে রক্ষা করার জন্য একমাত্র যথেষ্ট শক্তিশালী এবং সম্ভাব্য ইচ্ছুক পক্ষ ছিল রাশিয়া। কিন্তু এখন, ইউক্রেনের কারণে, রাশিয়ার সেই রাজনৈতিক ইচ্ছেও আর নেই। ফলে, এমনকি যদি আসাদের বাহিনী দীর্ঘদিন দামেস্ক ধরে রাখতে পারতো, তবুও আসাদকে রক্ষা করার মতো কোনো বাস্তবসম্মত শান্তি নিশ্চয়তা পাওয়া যেত না। এ কারণে আসাদ রাতে গোপনে পালিয়ে গেল।

সুতরাং এই বিশ্বাসযোগ্য প্রতিশ্রুতি সমস্যাই আসাদকে পালাতে বাধ্য করেছে।

তথ্যসূত্র

  1. Map of survey regions and governorates in Syria.  | Download Scientific Diagram
  2. Ten years of war have broken Syria into pieces
  3. Syria: what is Turkey’s grand plan?
  4. Syrian insurgents cut off key road as 200 die in escalating violence | Syria | The Guardian
  5. The Republic of Türkiye Directorate of Communications
  6. X-এ (((Tendar))): “Turkish-backed Syrian rebels (SNA) have moved into Tal Rifaat without a fight, 8 years after SDF has taken the important town from the FSA. Meanwhile, Syrian rebel forces offered SDF forces to withdraw to Manbij and Raqqa with all their weapons, emphasizing that the enemy is https://t.co/nHoXlwz1Vn” / X
  7. Trump made crude Oval Office remark about fate of Kurds in Syria, book says | Books | The Guardian
  8. X-এ Kareem Shaheen: “Sources in Homs are already saying that the city is essentially empty of regime forces now and they are preparing for the rebel takeover.” / X
  9. X-এ Charles Lister: “From 2011 to 2023, #Assad lost control of two provincial capitals — #Raqqa & #Idlib. In the space of 8 days, he’s just lost two more — #Aleppo & #Hama, #Syria’s 2nd & 4th biggest cities. Extraordinary.” / X
  10. Syria – The World Factbook
  11. File:Syria Ethnoreligious Map.png – Wikimedia Commons
  12. X-এ Saul Sadka: “This map explains why capturing Homs is the end for Assad: The large lake that extends from Homs to the edge of the Anti-Lebanon mountains means that the coastal Alawite zone will be connected extremely tenuously to Damascus. https://t.co/q1meUDFSuR” / X
  13. X-এ Aaron Y. Zelin: “HTS’s Political Affairs Department addresses another message to the Kurds. Interesting they note the IS angle. Future collab with SDF? If you want to learn more about HTS’s anti-IS campaign read this long-read I wrote on the issue in February 2023: https://t.co/WOeelMpiVb https://t.co/WiVhggvc5R” / X
  14. X-এ Kareem Shaheen: “There are rumors circulating that Jolani and HTS are preparing to announce Bishop Hanna Jallouf, the current Apostolic Vicar of Aleppo, as the city’s mayor. Unconfirmed as of now but an extraordinary step if true.” / X
  15. X-এ Ragıp Soylu: “Abu Woke Jolani says there must be a legal framework in Syria to protect all minorities and sects. “No one has a right to erase another group” he says https://t.co/gB8QRJulLs” / X
  16. X-এ Arash Azizi آرش عزیزی: “Al Qaeda/ISIS generation of Islamic fundamentalists were against the modern nation-state system and hoped to rebuild some sort of an ‘Emirate’ as an alternative to it. They found that out to be futile. Now, the post-Al Qaeda Syrian Islamists led by Jolani have re-invented” / X
  17. X-এ Saul Sadka: “If the reports that Assad’s forces have retreated from Hama, handing it the rebels, are true, they will be retreating to mount a last stand at Homs. If the rebels capture the Homs area, it is all over for Assad. His Alawite coastal heartland and all the ports (circled in pink) https://t.co/VDWM9WJLSx” / X
  18. X-এ (((Tendar))): “SAA forces have surrendered the Thala air base in the Suwayda province to opposition forces. The Daraa province is now almost entirely under rebel control, with the rest falling within the next hours. The provinces of Quneitra and Suwayda will follow, shortly after. Rebel https://t.co/4NS84zSyfH” / X
  19. X-এ Rudaw English: “#BREAKING: PMF chief Faleh al-Fayyadh says what is happening in Syria is an ‘internal matter’ and has ‘no connection to Iraq’ https://t.co/qSjpO0JChq” / X
  20. Syrian Rebels Eye Next Prize With Assad Lacking Russian Help – Bloomberg
  21. CNN.com – Transcripts
  22. HTS rebel group sweeping Syria tries to shed its jihadist image
  23. Post | Truth Social
  24. Post | Truth Social
  25. الإمام الخامنئي يستقبل السيد بشار الأسد رئيس الجمهورية العربية السورية
  26. Khamenei.ir – Ayatollah Khamenei met with Syrian President, Bashar al-Assad
  27. Открытие Кремля – виртуальный тур по резиденции Президента России
  28. Президент Сирии Башар Асад посетил Россию с рабочим визитом • Президент России
  29. Vladimir Putin visited Khmeimim Air Base in Syria • President of Russia
  30. Парад Победы на Красной площади • Президент России
  31. Meeting with Prime Minister of Israel Benjamin Netanyahu • President of Russia

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.