সম্প্রতি একটি আবিষ্কার নির্দেশ করছে সিন্ধু সভ্যতা অন্ততপক্ষে ৮,০০০ বছর প্রাচীন। পূর্বের ধারণা ছিল এটি ৫,৫০০ বছর প্রাচীন। এছাড়াও গবেষকগণ দেখিয়েছেন যে এই সভ্যতার ধ্বংস হবার কারণ হল দুর্বল আবহাওয়া বা উইক মনসুন। এই আবিষ্কারটি সিন্ধু সভ্যতাকে মিসরীয় সভ্যতা (খ্রিষ্টপূর্ব ৭,০০০ থেকে ৩,০০০ অব্দ) এবং মেসোপটেমিয়া সভ্যতা (খ্রিষ্টপূর্ব ৬,৫০০ থেকে ৩,১০০ অব্দ) এর সাথে বিশ্বের প্রাচীনতম সভ্যতার স্থানে অধিষ্ঠিত করেছে। গবেষণাটি করেন আইআইটি খড়গপুর এবং আর্কিওলজিকাল সারভে অব ইন্ডিয়া এর গবেষকগণ এবং এটি নেচার জার্নালে ২৫শে মে প্রকাশিত হয়েছে।
এই আবিষ্কারটির অর্থ হল ইতিহাসের বই আবার নতুন করে লিখতে হবে কারণ পূর্বের বইগুলোতে লেখা সিন্ধু সভ্যতার জন্ম ৫,৫০০ বছর পূর্বে। এই প্রোজেক্টটির পরিচালক অনিন্দ্য সরকার মনে করেন, তাদের এই গবেষণাটি সাক্ষ্যপ্রমাণ দেয় যে এই সভ্যতা জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণে ধ্বংস হয় নি কিন্তু জলবায়ুর পরিবর্তন দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল। দলটি এই সভ্যতার প্রাচীনতম মৃৎশিল্প উদ্ধার করে যা ছিল আর্লি ম্যাচিওর হরপ্পান পিরিয়ড (Early Mature Harappan) (আনুমাণিক ৬,০০০ বছর পূর্বে) এবং প্রি হরপ্পান হাকরা দশা (pre-Harappan Hakra phase) (৮,০০০ বছর পূর্বের পূর্বে) এর মধ্যেবর্তী সময়ের।
গবেষকগণ ভারতের লোথাল, ঢোলাভিরা এব কালিবানগান এ সাইট এক্সপ্লোর করার জন্য যান। তারা ভিরান্নার বেশিরভাগ অনাবিষ্কৃত অঞ্চলগুলোতেও যান। তারা প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন সিন্ধু সভ্যতা পাকিস্তানের হরপ্পা ও মোহেনজোদারো অঞ্চল ছাড়াও ভারতের হরিয়ানা প্রদেশের ভিরান্না ও রাখিগাড়ি অঞ্চলেও বিস্তৃত ছিল। কিন্তু এটা খুঁজতে গিয়ে তারা এর চেয়েও অনেক বেশি ইন্টারেস্টিং বিষয় খুঁজে পেয়েছেন।
দলটি প্রচুর পরিমাণে প্রাণীদের দেহাবশেষ উদ্ধার করে যার মধ্যে গরু, ছাগল, এন্টিলোপ এবং হরিণের দাত, শিং এর কোর ছিল। এই অবশেষগুলোকে কার্বন-১৪ ডেটিং করা হয়। ডেকান কলেজের আরতি দেশপাণ্ডে মুখার্জি, গবেষকদেরকে আহমেদাবাদের ফিজিকাল রিসার্চ ল্যাবরেটরিতে এই অবশেষগুলোকে এনালাইস করতে সাহায্য করেন। তিনি বলেন, “আমরা ক্লাইমেট প্যাটার্ন সম্পর্কে ধারণা পাবার জন্য এই অবশেষগুলোর হাড় ও দাঁতের ফসফেটে অক্সিজেন আইসোটোপের কম্পোজিশন বিশ্লেষণ করেছি। এই স্তন্যপায়ী হাড় ও দাঁতের অক্সিজেন আইসোটোপগুলোতে এনশিয়েন্ট মেটেওরিক ওয়াটার (পানির জন্ম যদি প্রেসিপিটেশন যেমন তুষার, বৃষ্টিপাত থেকে হয় তাহলে তাকে মেটেওরিক ওয়াটার বলে। পরোক্ষভাবে প্রেসিপিটেশন থেকে আসা লেক, আইসমেল্ট, নদী ইত্যাদির পানিও মেটেওরিক ওয়াটার) এবং তখনকার বৃষ্টিপাতের ইন্টেনসিটি বা মাত্রার পরিমাণ সংক্রান্ত তথ্য সংরক্ষিত থাকে। আমাদের গবেষণা দেখিয়েছে যে, প্রি হরপ্পান হিউম্যান বা হরপ্পা-পূর্ব মানুষেরা ঘাগগার-হাকরা নদীর তীরবর্তী বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে বাস করত এবং এখানকার জলবায়ুও তাদের বসবাস এবং কৃষির জন্য অনুকূল ছিল। আজ থেকে ৯,০০০ থেকে ৭,০০০ বছর পূর্ব পর্যন্ত সময়ে আবহাওয়া বা মনসুন অনেক শক্তিশালী ছিল যেকারণে এই নদীগুলো যথেষ্ট শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল এবং আরও বড় ফ্লাডপ্লেইন তৈরি হয়েছিল”।
দলটি মনে করে, এই সভ্যতাটি ভারতের একটি বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে ছিল। কিন্তু এই দাবীর একমাত্র এভিডেন্স পাওয়া যায় ব্রিটিশদের খননকার্য থেকে। ভারতীয় দলটির সবচেয়ে সাম্প্রতিক গবেষণা বলছে যে খুব সম্ভব জলবায়ুর পরিবর্তন এই সভ্যতার ধ্বংস হবার একমাত্র কারণ নয়। দেখে মনে হয় না সিন্ধু সভ্যতার লোকজন দুর্বল আবহাওয়া বা উইক মনসুন সত্ত্বেও এত সহজে হাল ছেড়ে দিয়েছিল। তারা একেবারে হাল ছেড়ে উধাও হয়ে যায় নি, বরং তারা তাদের কৃষির পদ্ধতিটাই পরিবর্তন করেছিল। তারা অধিক পানি দরকার এরকম শস্যের বদলে খরা উপযোগী কম পানিতেই উৎপাদিত হয় এমন শস্য উৎপাদন করা শুরু করেছিল। এটা ছিল এই সভ্যতার অস্তিত্বের আরেক নতুন যুগের সূচনা।
গবেষকগণ মনে করেন, তাদের কৌশলের এই পরিবর্তনটির কারণে তাদের ক্রপ প্যাটার্ন বদলে যায়। যখন মসসুন শক্তিশালী ছিল বা আবহাওয়া ভাল ছিল তখন তাদের ক্রপ প্যাটার্ন ছিল বড় বড় দানাদার শস্যের সিরিয়াল যেমন গম ও বারলি। মনসুন দুর্বল হয়ে যাওয়ায় তাদের ক্রপ প্যাটার্ন বদলে যায়। এসময় তারা খরা প্রতিরোধক স্মল মিলেট এবং ধান উৎপাদন শুরু করে। ক্রপ প্যাটার্নের এই পরিবর্তনই এই সিন্ধু সভ্যতার ধ্বংসের একটি অন্যতম কারণ ছিল বলে মনে করেন গবেষকগণ। এছাড়াও গবেষকগণ আবিষ্কার করেন যে, আজ থেকে ৭,০০০ বছর পূর্বে মনসুম দুর্বলতর হয়েই চলেছিল।
সিন্ধু সভ্যতার প্রথম হদিস পাওয়া যায় ব্রিটিশদের দ্বারা উনিশ শতকে। ১৮২৬ খ্রিষ্টাব্দে একজম ব্রিটিশ আর্মি ডিজার্টার জেমস লুইস পাঞ্জাবের একটি ছোট শহর হরপ্পায় কিছু ধ্বংসাবশেষের অস্তিত্ব দেখতে পান। একারণেই এই সভ্যতাকে হরপ্পা সভ্যতাও (Harappan Civilization) বলা হয়।
হরপ্পা সভ্যতায় নগরায়ন করা হয়েছিল এবং বিভিন্ন স্যাটেলমেন্ট বা বাড়িঘর দিয়ে এটি ছিল সুসজ্জিত। তাদের মধ্যপ্রাচ্যের মেসোপটেমিয়া সভ্যতার সাথে নিয়মিত বাণিজ্য চলত। তাদের মেটারিয়াল এবং ক্রাফট কালচার অনেক উন্নত ছিল। কিন্তু হরপ্পান এক্সিস্টেন্স এর পরবর্তী দশায় এই সভ্যতার মোট জনসংখ্যা কমে যায় এবং অনেকেই বাড়িঘর ত্যাগ করে চলে যায়। কয়েক দশক ধরে গবেষকগণ বের করার চেষ্টা করছেন এই পরিবর্তনের পেছনে আসল কারণটা কি ছিল। এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজের জন্য প্রথম খননকার্যটি করা হয় ১৯২০ এর দশকে যার পরিচালক ছিলেন জন মারশাল। কিন্তু সবচেয়ে বড় খননকার্যটি সম্পাদিত হয় ১৯৮৬ সালে যখন ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফর্নিয়ার জর্জ ড্যালেস প্রথম হরপ্পান আর্কিওলজিকাল প্রোজেক্ট প্রতিষ্ঠা করেন। যাই হোক এই নতুন আবিষ্কারটি গবেষকদের সিন্ধু সভ্যতা সম্পর্কে জানতে আরেক ধাপ এগিয়ে নিয়ে গেল।
http://www.nature.com/articles/srep26555
– ভেলোসিটি হেড
Leave a Reply