গবেষকগণ একটি ৪০৯ মিলিয়ন বছর পূর্বের মাছের ফসিলের স্কাল বা মাথা নিয়ে গবেষণা করেছেন। তারা আবিষ্কার করেছেন, এই লোবড-ফিনড শিকারি মাছটি সিলাক্যান্থদের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কযুক্ত। মাছটির প্রজাতির নাম হচ্ছে Qingmendous (কুইংমেনডাস)। এটি অনিকোডন্টস গ্রুপের অন্তর্ভূক্ত। সিলাক্যান্থ একটি বিলুপ্তপ্রায় মাছ যা আজও পৃথিবীতে পাওয়া যায়, কিন্তু এদের সংখ্যা ক্রমশ কমছে। এই আবিষ্কারটি সম্প্রতি সায়েন্স এডভান্সেস জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। এই আবিষ্কারটি বিজ্ঞানীদেরকে প্রথম ডাঙ্গায় উঠে আসা প্রাণীর আবির্ভাব সম্পর্কে বুঝতে সহায়তা করবে।
কিভাবে বুঝতে সহায়তা করবে এটা জানতে হলে আমাদের বেশ কিছু বিষয় সম্পর্কে আগেভাগে জেনে নেয়া জরুরি।
ক্লেড(Clade) : ক্লেড হল একটিও মনোফাইলেটিক ট্যাক্সন, অরগানিজমদের একটি গ্রুপ যার মধ্যে মোস্ট রিসেন্ট কমন এনসেস্টর বা সবচেয়ে সাম্প্রতিক পূর্বপুরুষ এবং সেই পুরবপুরুষ থেকে আসা সকল বংশধর প্রজাতি থাকে। একটি ক্লেডোজেনেসিস ইভেন্ট এর পর একটি ক্লেড এর জন্ম হয়।
ক্রাউন গ্রুপ (Crown Group): ক্লেডের যে সদস্য প্রজাতিগুলো এখনও বেঁচে আছে তাদেরকে ক্রাউন গ্রুপ বলা হয়।
স্টেম গ্রুপ (Stem Group): ক্লেডের যে সদস্য প্রজাতিগুলো এখন আর বেঁচে নিয়, ফসিল হিসেবে পাওয়া যায় তাদেরকে স্টেম গ্রুপ বলে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই ফসিলগুলো কোন ক্লেডের তা সনাক্ত করা কঠিন হয় কারণ মরফোলজিকাল দিক দিয়ে ক্রাউনগ্রুপের সদস্যদের থেকে এদের অনেক অমিল লক্ষ্য করা যায়।
সারকোপ্টেরিজি (Sarcopterygii): সারকোপটেরিজিকে সহজ ইংরেজিতে লোব-ফিনড ফিশ বলা হয়। ট্যাক্সনমি অনুযায়ী এটি একটি ক্লাস বা শ্রেণী। এদের ক্লেডে সকল প্রকার হাড় যুক্ত মাছ, এবং মেরুদণ্ডী প্রাণী পড়ে। এদের লিভিং ক্লেড বা ক্রাউন গ্রুপে রয়েছে সকল প্রকার সিলাকান্থ, লাং ফিশ এবং সকল প্রকার টেট্রাপড বা চতুষ্পদ প্রাণী। ডাঙ্গার সকল চতুষ্পদ প্রাণী এই সারকোপ্টেরেজি ক্লাসের একটি গ্রুপের অন্তরভূক্ত যার নাম Tetrapodomorpha. সারকোপটেরিজি গ্রুপের প্রাণীদেরকে সারকোপটেরিজিয়ান বলা হয়।
টেট্রাপোডোমরফা (Tetrapodomorpha): টেট্রাপডোমরফা বলতে বোঝায় চার পা আছে এমন প্রাণী। পূর্বে চতুষ্পদ জন্তুদের একটি সুপার ক্লাস ছিল যার নাম ছিল টেট্রাপডা। টেট্রাপডা গ্রুপের প্রাণীদেরকে টেট্রাপড বলা হত। এই টেট্রাপডা চারটি গ্রুপে বিভক্ত। এরা হল এমফিবিয়ান বা উভচর, রেপ্টাইল বা সরীসৃপ, ম্যামাল বা স্তন্যপায়ী এবং বার্ডস বা পাখি। আর ছিল একান্থসটেগা। একান্থস্টেগা ছিল সেই সময় আবিষ্কৃত একটি প্রাচীন বিলুপ্ত চতুষ্পদ মেরুদণ্ডী প্রাণী যা কিনা স্থলে নয় জলে বাস করত। যাই হোক, বর্তমানে আমরা যে সকল চতুষ্পদ মেরুদণ্ডী প্রাণীদেরকে দেখি তারা সকলেই এই টেট্রাপড সুপারক্লাসের অন্তর্ভূক্ত ছিল। কালক্রমে দেখা গেল যে এই সকল টেট্রাপডই সারকোপটেরিজি গ্রুপের বংশধর। আর এরপর এই টেট্রাপড সুপারক্লাসটিকে টেট্রাপডোমরফা নামের একটি গ্রুপে ভেতরে রাখা হল আর এই টেট্রাপডোমরফাকে রাখা হল সারকোপটেরিজি গ্রুপের মধ্যে। এবারে টেট্রাপডা গ্রুপ থেকে একান্থস্টেগাকে বের করে নিয়ে আসা হল আর টেট্রাপডা গ্রুপে রাখা হল কেবল স্থলে বা ডাঙ্গায় থাকা চতুষ্পদদেরকে। আর বাদবাকি যত প্রকার জলজ টেট্রাপড ছিল একান্থস্টেগার মত সেগুলোকে টেট্রাপডোমরফার অন্যান্য গ্রুপে রেখে দেয়া হল। টেট্রাপড ছাড়াও টেট্রাপডোমরফা এর অনেক গ্রুপ আছে যেগুলোর প্রাণীরা চতুষ্পদ এবং জলে বাস করে, কিন্তু দুঃখের বিষয় হল এদের একটিও আর বেঁচে নেই। সুতরাং টেট্রাপডোমরফা ক্লেডের ক্রাউন গ্রুপ কেবল টেট্রাপডা গ্রুপেই রয়েছে। টেট্রাপডা বাদে টেট্রাপোডোমরফা এর অন্য সকল গ্রুপই এখন স্টেম গ্রুপ।
পূর্বেই বলা হয়েছে যে স্টেম গ্রুপকে সনাক্ত করা খুব কঠিন কারণ ক্রাউন গ্রুপের সাথে এদের অনেক পার্থক্য থাকে। আর এদের সনাক্ত করার একমাত্র উপায় হল অসিফাইড ফসিল যা খুব একটা নেই। সুতরাং সারকোপটেরিজি থেকে যে চতুষ্পদী টেট্রাপডরা এসেছে এবিষয়ে একটি শূন্যস্থান থেকেই গিয়েছিল যা পূরণ করার জন্য এই ক্লেডের স্টেম গ্রুপের প্রাণীগুলোর প্রয়োজন। কারণ এটার জন্য যে ট্রাঞ্জিশনাল প্রজাতিগুলো দরকার সেগুলোই টেট্রাপড ভিন্ন টেট্রাপডোমরফা ক্লেডের স্টেম গ্রুপ যেগুলো আজ আর নেই।
কিন্তু আশার আলো দেখিয়েছে সিলাক্যান্থ ও ল্যাং ফিশ। সিলাক্যান্থ ও ল্যাং ফিশ হল সারকোপ্টেরিজি গ্রুপের দুটো মেজোর গ্রুপ যারা টেট্রাপডোমরফা গ্রুপের বাইরের। কিন্তু দেখা গেছে অন্যান্য রে-ফিনড ফিশের তুলনায় টেট্রাপডদের সাথেই এদের বেশি মিল। রে-ফিনড ফিশ হল সেইসব মাছ, মাছ নিয়ে চিন্তা করলেই যে সব মাছ আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে যেমন স্যালমন, ক্লোনফিশ ইত্যাদি। তাই যদি কোন স্টেম গ্রুপের প্রাণীর অসিফাইড ফসিলে একই সাথে টেট্রাপডের ক্রাউন গ্রুপ এর মরফোলজিকাল ক্যারেক্টারিস্টিক এবং টেট্রাপডোমরফা ভিন্ন অন্যান্য সারকোপ্টেরিজি যেমন সিলাক্যান্থের মরফোলজিকাল ক্যারেক্টারিস্টিক পাওয়া যায় তাহলে এই শূণ্যস্থানটি পূরণ করা সম্ভব হবে।
এবার আসল কথায় আসা যাক। স্টেম গ্রুপের একটি গ্রুপ হল অনিকোডন্টস। এই গ্রুপের মাছগুলোতে একই সাথে স্টেম এবং ক্রাউন সারকোপটেরেজিয়ানদের বৈশিষ্ট্য থাকতে পারে। অর্থাৎ এই ট্রাঞ্জিশনাল প্রজাতিটিতে একইসাথে ক্রাউন টেট্রাপডের বৈশিষ্ট্য আছে আবার বিলুপ্ত স্টেম টেট্রাপডোমরফাদেরও বৈশিষ্ট্য আছে। তারা চারশো মিলিয়ন বছর পূর্বে তাদের প্রোট্রুডিং ফিনের সাহায্যে ডেভোনিয়ান যুগের সমুদ্রগুলোতে সাঁতরে বেড়াতো। এই প্রোট্রুডিং ফিন (protruding fins) মাংশপেশি এবং হাড় নিয়ে গঠিত ছিল যা পরবর্তীতে তাদেরকে ডাঙ্গায় জীবন ধারণ করতে সাহায্য করে। অনিকোডন্টস গ্রুপের প্রাণীদেরকে অনিকোডন্ট বলা হয়।
চীনে সম্প্রতি একটি অনিকনডন্ট মাছের ফসিল আবিষ্কৃত হয়েছে। এই প্রজাতিটির নাম হল Qingmendous বা কুইংমেন্ডাস। পূর্বেও এরকম অনেক প্রজাতি পাওয়া গিয়েছিল কিন্তু এগুলোর সাথে এই নতুন প্রাপ্ত ফসিলের পার্থক্য হল এটার স্কাল অসিফাইড বা অস্থিভূত। এর পূর্বের ফসিলগুলো এর মত এত ভালোভাবে অসিফাইড ছিল না। এর স্কালটি অসিফাইড হবার কারণে হাই রেজোল্যুশন সিটি স্ক্যানিং এর সাহায্যে চাইনিজ একাডেমি অব সায়েন্স এর জিং লু ও মিন ঝু কুইংমেন্ডাস এর ব্রেইনকেসের ইন্টারনাল স্ট্রাকচার ইমেজ করেছেন এবং তারপর একটি ভারচুয়াল ক্রেনিয়াল এন্ডোকাস্ট রিকনস্ট্রাক্ট করেছেন। এর ব্রেইনকেসের একটি অংশে স্টেম সারকোপটেরেজিয়ানদের (টেট্রাপডোমরফা গ্রুপের স্টেমগ্রুপ) সাথে মিল আছে এবং অন্যদিকে এটি সিলাক্যান্থ (টেট্রাপডোমরফা এর বাইরের ক্রাউন গ্রুপ) এর মত নিউরোক্রেনিয়াল বৈশিষ্ট্যগুলো দেখায়। সুতরাং এবার তাদের আবিষ্কৃত এই কুইংমেন্ডাস(Qingmendous), স্টেম সারকোপ্টেরেজিয়ান এবং সিলাক্যান্থদের মধ্যবর্তী মরফোলজিকাল গ্যাপ বা শূন্যস্থানকে পূর্ণ করতে সক্ষম হয়েছে। ইভোল্যুশনারি বায়োলজি এভাবে আরও এক ধাপ এগিয়ে গেল।
http://advances.sciencemag.org/content/2/6/e1600154
– বুনোস্টেগস
Leave a Reply