(এই লেখাটার জন্য বিশেষভাবে ওয়াকিল আহমদের বাংলার লোক-সংস্কৃতি গ্রন্থটির ঋণ স্বীকার করা হচ্ছে। লেখাটির তথ্যগুলো মূলত এখান থেকেই সংগ্রহ করা হয়েছে। লেখাটি অসম্পূর্ণ। এবং লেখাটির সকল মত লেখক, অর্থাৎ আমার মত নয়।)
Table of Contents
পীরদরবেশদের ইসলাম প্রচার
খ্রিস্টীয় দশম থেকে দ্বাদশ শতকের মধ্যে বাংলায় পীর, দরবেশ, এবং সুফি সাধকরা ইসলাম ধর্ম প্রচার শুরু করেন। মধ্যযুগে মুসলিম বিজয়ের পর শাসকদের সহায়তায় এই প্রচার আরও ব্যাপকতা লাভ করে। মুসলমান সুলতানগণ প্রধানত ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা, রাজ্য রক্ষা, বিস্তার, এবং শাসনকার্য পরিচালনায় ব্যস্ত ছিলেন। কিছু এলাকায় সরকারি অর্থানুকূল্যে মক্তব ও মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা হয়েছিল, এবং কিছু পীরদরবেশ নিষ্কর ভূমি বা মাসোহারা পেতেন। ইতিহাসে এর অনেক উদাহরণ রয়েছে। যেমন –
- ইবন বতুতা (১৩৪৬ খ্রিস্টাব্দে বাংলায় আগমন) তার ভ্রমণবৃত্তান্তে উল্লেখ করেছেন যে মেঘনা নদী পারাপারের সময় পীরদরবেশদের কোন পারানি দিতে হতো না, আর মুসলমান ফকিরেরা হবংক শহরে প্রবেশ করলে লোকদের কাছ থেকে আধ দিনার করে দান পেতেন, যা নিয়ে সরকারি ফরমানও ছিল। (ড. মেহেদি হুসেন, সম্পা. ‘দ্য রেহলা অব ইবন বতুতা’, ওরিয়েন্টাল ইনস্টিটিউট, বারোদা, ১৯৫৩)
- শেখ আলাওল হক (মৃত্যু ১৩৯৮ খ্রিস্টাব্দ) প্রথমদিকে গৌড়ের রাজকোষ থেকে অর্থ সাহায্য পেতেন, যা তিনি গরিব, ভিখারি ও পথিকদের খাওয়ানোর কাজে ব্যবহার করতেন। (ড. আব্দুল করিম, ‘সোশ্যাল হিস্ট্রি অব দ্য মুসলিমস ইন বেঙ্গল’, পৃষ্ঠা ১০৪)
- সুলতান হুসেন শাহ (১৪৯২-১৫১৯) শেখ নূর কুতব আলমকে তার দরগাহর পাশের কয়েকটি গ্রামের ভোগস্বত্ব দান করেন। (ঐ, পৃষ্ঠা ১০৮)
- রাজশাহীর ‘সত্যপীরের ভিটা’র স্বত্বাধিকারী লাখেরাজ জমি ভোগ করতেন। (ড. আব্দুল রহিম, ‘সোশ্যাল অ্যান্ড কালচারাল হিস্ট্রি অব বেঙ্গল’, ভলিউম ১১, পৃষ্ঠা ৩৮৯)
- শাহ সৃজা (১৬৩১-৫২) মাদারিয়া সম্প্রদায়ের খাদেমদের একটি সনদে ‘মদারী মিছিল’ উদ্যাপন করার অধিকার দেন এবং কিছু পীরপাল বা মাসোহারারও ব্যবস্থা করেন। (মুহম্মদ এনামূল হক, ‘মুসলিম বাংলা সাহিত্য’, পৃষ্ঠা ১২৯, দ্বিতীয় সংস্করণ)
তবে দেশের সর্বত্র ইসলাম ধর্ম প্রচারের জন্য সুলতান, সুবেদার বা নবাবেরা কোনও সুনিয়ন্ত্রিত পরিকল্পনা গ্রহণ করেননি। এ অবস্থায় ধর্ম প্রচারের ভার পীর, দরবেশ, ওলি-আউলিয়াদের উপরেই ন্যস্ত ছিল। তারা দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে সাধারণ মানুষের কাছে ইসলামের বাণী, আদর্শ ও রীতি প্রচার করেন। তাদের জন্য গ্রাম-নগর, শহর-বন্দরের কোনও ভেদ ছিল না; তাদের মক্তব-মাদ্রাসার প্রয়োজন ছিল না, এবং তারা কোনও বড় সংগঠনও প্রতিষ্ঠা করেননি। লোকালয়ের আশেপাশে টিলায় বা গাছতলায় একটু স্থান করে নিয়ে তারা নিজেরা সাধনা করতেন এবং সেই সাধনার ফল সর্বসাধারণের মধ্যে বিতরণ করতেন।
দেশের বিভিন্ন স্থানে যে অসংখ্য আস্তানা, খানকাহ, দরগাহ, চিল্লাখানাহ, মাজার ও মকবরা ছড়িয়ে আছে, সেগুলো সেই যুগের পীরদরবেশদের একনিষ্ঠ ধর্মকর্মেরই সাক্ষ্য বহন করে। তাদের চরিত্র-মাহাত্ম্য, আত্মত্যাগ, মানবসেবা ও ধর্মনিষ্ঠায় সাধারণ মানুষ আকৃষ্ট হয়ে তাদের চারপাশে জড়ো হতো এবং ইসলামের আলোকে চিত্তশুদ্ধি, সাম্য ও মৈত্রীর আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে দীক্ষা গ্রহণ করত, মুরিদ হতো। অবশ্য তাদের কাজকর্ম ও প্রভাব-প্রতিপত্তি শুধু এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না; তারা নিজেদের প্রভাব নানাভাবে ছড়িয়ে দিয়ে দেশের গভীরে প্রবেশ করেছিলেন এবং নানা মত ও পথের সন্ধান দিয়ে দুর্ভাগ্যপীড়িত দেশবাসীর চিত্তলোকে স্থায়ী আসন লাভ করেছিলেন।
পীরের আধ্যাত্মিক গুরুত্ব এবং সুফিবাদ ও গুরুবাদের তুলনা
‘পীর’ শব্দটি ফার্সি, যার ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হলো ‘বৃদ্ধ ব্যক্তি’। তবে প্রচলিত ব্যবহারে এটি ‘আধ্যাত্মিক গুরু’ হিসেবে মুসলমান সাধকদের নির্দেশ করে। পীর হলেন আধ্যাত্মিক জ্ঞানে মহাজ্ঞানী এবং অতিমানবিক ও অতিলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী। তিনি পাপমুক্তির এবং চিত্তশুদ্ধির পথ প্রদর্শন করেন। পীরের মাধ্যমে মানুষ আল্লাহর কাছে পৌঁছাতে পারে। (তসলীমুদ্দীন আহমদ, ‘পীর, সত্যপীর, পীরবরহক, বড়পীর’, রঙ্গপুর-সাহিত্য-পরিষৎ- পত্রিকা, ১০ম ভাগ, ১ম সংখ্যা, পৃ. ৩২২) লোকমতে, পীর আল্লাহর ‘প্রতিমূর্তি’। পীরের অন্যান্য সমার্থবাচক শব্দগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘শেখ’, ‘মুর্শিদ’, ‘ওস্তাদ’, ‘হুজুর’ ইত্যাদি। হিন্দুদের ‘যোগী’ বা বৌদ্ধদের ‘থের’ শব্দগুলোর সমার্থবাচকও পীর। ইসলামের সুফি মতবাদের মাধ্যমে পীরের গুরুতত্ত্বের উদ্ভব হয়। শুদ্ধ এবং সিদ্ধ ব্যক্তিই সুফি, এবং তিনিই পীর বা মুর্শিদ।
সুফি মতবাদের পীরবাদ ও হিন্দুধর্মের গুরুবাদ একই আধ্যাত্মিক চেতনার ফল। উভয়ই আধ্যাত্মিক সাধনার বিষয় হলেও তাদের অবস্থান ও সাধনার পথ আলাদা। হিন্দু যোগতন্ত্রে গুরুবাদ, বিশেষ করে তান্ত্রিক যোগাচারে গুরুদের ভূমিকা বেশি। তান্ত্রিক যোগাচারের লক্ষ্য কায়াসাধনার মাধ্যমে সিদ্ধিলাভ করা। ভারতে তান্ত্রিক যোগধর্ম বেশ পুরনো; বেদে তন্ত্রাচারের আভাস পাওয়া যায়।
বৈদিক যোগধর্ম বাংলায় প্রবেশ করার পর এটি বিভিন্ন আচার-সংস্কারে পরিবর্তিত হয়। বৌদ্ধধর্ম, নাথধর্ম, শাক্তধর্ম, বাউলধর্ম ইত্যাদি গুরুবাদের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত। মুসলমান সুফিরা মূলত শরিয়তপন্থী না হয়ে মারিফত বা মরমিপন্থী ছিলেন। শরিয়তপন্থায় কোরান-হাদিসের নির্দেশনাই ধর্মসাধনার মূল পথ। সুফি মরমিবাদের লক্ষ্য বাহ্যিক ক্রিয়াকাণ্ডের পরিবর্তে আল্লাহর প্রেম ও ভক্তির মাধ্যমে তার সাথে একাত্ম হওয়া। সুফি মতবাদে আধ্যাত্মিক উন্নতি হলো এক ধরনের ‘যাত্রা’, যার মাধ্যমে যাত্রী আল্লাহর পরিপূর্ণ জ্ঞান (মারিফত) অর্জন করেন। পীর-মুর্শিদের কাছ থেকে মুরিদরা এই সাধনার শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে।
দশম শতকের দিকে পীর-দরবেশগণ ভারতবর্ষে আসতে শুরু করেন এবং সুফি মতবাদের আদর্শ নিয়ে আসেন। ভারতে এসে তারা তান্ত্রিক যোগধর্মের প্রভাবে আনুষ্ঠানিক পীরাচারে রূপান্তরিত হন। উল্লেখযোগ্য যে, মুসলমান সুফিরা হিন্দু যোগশাস্ত্রের সাথে পরিচিত ছিলেন এবং প্রভাবিতও হয়েছিলেন। এর প্রমাণ হলো সংস্কৃত ‘অমৃতকুণ্ডে’র ফার্সি ও আরবি অনুবাদ, যা কাজী রুকন-অল-দীন অল-সমরকন্দী করেছিলেন।
বাংলা ভাষায় মুসলমান কবিদের কিছু যোগতত্ত্বের গ্রন্থ পাওয়া যায়, যেমন:
- ক. আদ্যপরিচয়- শেখ জাহিদ (পনেরো শতক)
- খ. জ্ঞান-প্রদীপ- সৈয়দ সুলতান (ষোল শতক)
- গ. যোগ-কলন্দর- সৈয়দ মর্তুজা (সতেরো শতক)
- ঘ. আগম ও জ্ঞানসাগর- আলি রজা (আঠারো শতক)।
বাংলায় পীরদের দেবত্ব
বাংলায় পীর শুধু গুরু নন, অনেক ক্ষেত্রে হিন্দু দেবতার মতোই পূজিত। জীবিত অবস্থায় তাদের কেউ কেউ মানুষ হিসেবে গুরু হিসেবে পরিচিত ছিলেন, তবে মৃত্যুর পর তাদের অনেকেই দেবত্ব লাভ করেছেন। বাঙালি লোকাচারে পীরদের দেবত্বের ধারণা স্পষ্ট। সাধারণ মানুষ ঐতিহাসিক, পৌরাণিক বা কাল্পনিক পীরদের দেবতা মনে করে পূজা করে এবং বিভিন্ন আচার পালন করে। তাই বাংলায় পীরবাদ সুফি মতবাদের প্রভাবে হলেও দেবত্বের ধারণায় আলাদা বৈশিষ্ট্য অর্জন করেছে।
ড. এনামুল হক মনে করেন, পীরবাদের ‘গুরুকল্প’ এবং ‘দেবকল্প’ ধারণা বাংলায় জন্ম নেয়নি, বরং বাইরে থেকে এসেছে। তার মতে, যেসব পীর-দরবেশ বাংলায় ইসলাম প্রচার করেন, তারা মূলত বিকৃত সুফি মতবাদের ধারক ছিলেন। তিনি মনে করেন, পীরবাদ বৌদ্ধ ‘থেরবাদ’ দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে – পীরপূজা থেরপূজার মতো, আর গোরপূজা চৈত্যপূজার মতো। পারস্য, বোখারা, সমরকন্দ এবং আফগানিস্তানের বৌদ্ধরা একাদশ-দ্বাদশ শতকে ইসলাম গ্রহণ করেছিল এবং সেই সময় তাদের মধ্যে আচারমূলক বৌদ্ধ মতবাদের প্রভাবে শরিয়ত-বিরোধী পীরবাদের জন্ম হয়। (বঙ্গে সুফি প্রভাব, পৃষ্ঠা ২২৯-৩০)
সাধারণভাবে হিন্দুরা ঈশ্বরের ‘অবতারবাদে’ বিশ্বাসী। যোগতন্ত্র মতে মানুষ হলো ঈশ্বরের প্রতিফলন। তাই অবতাররূপী মানবপূজা হলো ঈশ্বর পূজারই আরেক রূপ, যেখানে জীবাত্মার মধ্যে পরমাত্মার বসবাস। বৌদ্ধরা হিন্দুদের প্রভাবে পূজা করতে গিয়ে মানুষকেই দেবতার আসনে বসিয়েছে। থের বা ধর্মগুরু সেই দেবতুল্য মর্ত্যমানব। মুসলমান সুফিরা যখন বিধর্মী প্রভাবে অনুশাসনহীন আচারে প্রভাবিত হয়েছিলেন, তখন তারা পীরদের পূজা করতে শুরু করেন। পীরবাদ, থেরবাদ এবং অবতারবাদের এই ধারণাগুলো পীরবাদের সাথে থেরবাদের মিল তৈরি করে। ড. হকের মতে, ধূপ-ধুনা, চন্দন, পুষ্পাদি দিয়ে বৌদ্ধদের চৈত্যপূজা এবং মুসলমানদের গোলাপ, আতর, লোবান, ধূপবাতি ইত্যাদি দিয়ে পীর-দরগাহ পূজা একই প্রেরণা থেকে এসেছে; শুধু দ্রব্যগুলোর পরিবর্তন ঘটিয়ে ইসলামি রূপ দেওয়া হয়েছে। (পৃ. ২৩১)
ত্রয়োদশ শতকের গোড়ার দিকে তুর্কিরা বাংলা দখল করলে সুফিদের জন্য এখানে আসার পথ সুগম হয়। বাংলার মনোরম প্রকৃতি তাদের আকৃষ্ট করেছিল। জৌনপুরের সুলতান ইব্রাহিম শর্কীকে (ষোড়শ শতক) সুফি সাধক মীর সৈয়দ আশরাফ জাহাঙ্গীর সিমনানী এক পত্রে লিখেছিলেন, “আল্লাহর প্রশংসা করো। কী অসাধারণ দেশ সেই বাংলা, যেখানে বহু সাধু এবং তপস্বীরা বিভিন্ন দিক থেকে এসে তাদের বাসস্থান ও ঘর বানিয়েছেন। বাংলার দেশে শুধুমাত্র শহরে নয়, এমন কোনো শহরতলী বা গ্রাম নেই যেখানে পবিত্র সাধুরা এসে বসতি স্থাপন করেননি।” (অনুবাদিত) (Quot, from Hasan Askari in Bengal: Past and Present, Vol, XVII, pp. 35-36.)
সুফিরা এদেশে এসে গ্রাম, শহর, নগরে আশ্রয় নিয়েছিলেন এবং ইসলাম প্রচারে নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন। বাংলার সাধারণ মানুষের জীবনবোধ এবং ধর্মবিশ্বাসের সাথে তাদের আদর্শের কোনো বিরোধ ছিল না, বরং তৎকালীন সমাজে অসহায় মানুষদের জন্য সুফি সাধকদের উদার ছায়ায় আশ্রয় পাওয়া সম্ভব হয়েছিল। এজন্য বাংলায় সুফি মতবাদের প্রচার সহজ হয়েছিল।
মুসলিম বিজয়ের পর থেকে ভারতে প্রধান দরবেশদের নামে যে তরিকা বা মতবাদগুলি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তার অনেকগুলোই বাংলায় জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ভারত উপমহাদেশে এরকম কিছু সম্প্রদায়ের নাম হলো চিশতিয়া, কাদরিয়া, সুহরওয়ার্দিয়া, নকশবন্দিয়া, কলন্দরিয়া, মদারিয়া, অদহমিয়া, পাঁচপীরিয়া ইত্যাদি। এর মধ্যে বাংলায় বিশেষত কলন্দরী, মদারী এবং অদহমী মতবাদের প্রভাব বেশি দেখা যায়। (মুসলিম বাংলা সাহিত্য, পৃ. ১২৭-২৮) এছাড়াও, লৌকিক সত্যপীরকে কেন্দ্র করে আরও একটি মতবাদ গড়ে ওঠে, যা বাংলার হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল।
মুসলিম বিজয়ের সময় থেকেই বাংলায় পীর ও তাদের অলৌকিক ক্ষমতা নিয়ে গ্রন্থ রচনা শুরু হয়। ‘সেখ শুভোদয়া’ নামক গ্রন্থে শেখ জালালউদ্দিন তাব্রিজীর অলৌকিক কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। এর রচয়িতা হলায়ুধ মিশ্র, যিনি লক্ষ্মণ সেনের সভাকবি ছিলেন। (ঐ, পৃ. ২৭) পীর শাহ মাদারের জিকর ধ্বনি ‘দম্বদারে’র (দম-ই-মদার) উল্লেখ পাওয়া যায় রামাই পণ্ডিতের ‘শূন্যপুরাণে’, যেখানে ‘ফকির’ তথা দরবেশেরও উল্লেখ আছে। পনেরো শতকের শেষার্ধে ‘রসুল বিজয়ে’র কবি জৈনুদ্দিন তার নিজের পীরের বন্দনা করেছেন। (ঐ, পৃ. ৬১) ষোলো শতকের শুরুতে কবি কঙ্ক সত্যপীরের মাহাত্ম্য প্রচারের জন্য ‘বিদ্যাসুন্দর’ কাব্য রচনা করেন। ঐ শতকের শেষের দিকে শেখ ফয়জুল্লাহ ‘সত্যপীর’ কাব্য রচনা করেন, যেখানে সত্যপীরের অলৌকিকতার বর্ণনা আছে। তার আরেকটি কাব্য ‘গাজী বিজয়’ হলো পীর ইসমাইল গাজীর মাহাত্ম্যসূচক। ষোলো শতকের মাঝামাঝি সময়ে কবি কঙ্কণ মুকুন্দরাম তার ‘চণ্ডীমঙ্গল’ কাব্যে পীরের উদ্দেশ্যে শিরনি দেওয়ার এবং দরগায় বাতি জ্বালানোর উল্লেখ করেছেন। তিনি লিখেছেন –
ছিলিমিলি মালাধরে জপে পীর পয়গম্বরে
পীরের মোকামে দেয় সাঁজ।।
সাঁজে ডালা দেয় হাটে পীরের শীরনী বাঁটে
সাঁজে বাজে দগড় নিশান।।
– চন্ডীমঙ্গল, বঙ্গবাসী কার্যালয় সংস্করণ, পৃ. ৮৬
ঐ শতকের শেষ ‘চৈতন্যচরিতামৃত’ গ্রন্থে কালবস্ত্র পরিহিত পীরের কথা আছে –
সেই মেচ্ছ মধ্যে এক পরম গম্ভীর।
কালবন্ত্র পরে সেই লোকে কহে পীর।।
– শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত, পৃ. ২২৬
সতেরো শতকের বেশিরভাগ মুসলিম কবি তাদের কাব্যের শুরুতে পীরের বন্দনা করেছেন। সৈয়দ সুলতান, নুসরুল্লাহ খান, মুহম্মদ খান, শেখ মুত্তালিব, আবদুল হাকিম প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। সৈয়দ সুলতান এবং মুহম্মদ খান নিজের কাব্যে উল্লেখ করেছেন যে তারা তাদের পীরের নির্দেশে কাব্য রচনা করেছিলেন।
আঠারো শতকের দোভাষী পুঁথি লেখকরা একদিকে লৌকিক পীরদের নিয়ে কাব্য রচনা করেছেন, অন্যদিকে পীরদের প্রশংসা করে তাদের মহিমা প্রচার করেছেন। ‘কালুগাজী-চম্পাবতী’, ‘সত্যপীরের পাঁচালি’, ‘মানিকপীরের গীত’, ‘বনবিবির জহুরনামা’ প্রভৃতি পুঁথিতে লৌকিক পীরদের মাহাত্ম্য ও পূজার বিষয়বস্তু রয়েছে। ফকির গরীবুল্লাহ তার সত্যপীরের পুঁথিতে পীর বড় খান গাজীকে আধ্যাত্মিক গুরু হিসেবে উল্লেখ করেছেন এবং পীরের স্বপ্নাদেশে কাব্য রচনা শুরু করেন। এগুলো মূলত মঙ্গলকাব্যের দেবীবন্দনা ও দেবীপূজার মতো। এসব থেকে বোঝা যায় যে পীরবাদ বাঙালির সমাজ ও মানসিকতার গভীরে প্রভাব বিস্তার করেছিল।
শিক্ষাবঞ্চিত মানুষের মধ্যে পীরদের প্রভাব ছিল আরও ব্যাপক, গভীর ও সুদূরপ্রসারী। ঐতিহাসিক, পৌরাণিক ও লৌকিক পীররা সাধারণ মানুষের চিন্তায় দেবতারূপে পরিণত হয়েছেন। তারা শুধু ধর্মজীবন নয়, সাংস্কৃতিক জীবন ও দৈনন্দিন কাজের মধ্যেও মানুষের মনে জায়গা করে নিয়েছিলেন। লোকসাহিত্যের বিভিন্ন শাখা, যেমন- লোকসঙ্গীত, পালাগান, ছড়া, প্রবাদ, কিংবদন্তি এবং ব্রতকথায় পীরদের প্রভাব দেখা যায়। শিরনি, মানত, কবরপূজা, দরগাহপূজা, উরসপালন ইত্যাদি লোকাচারে পীরদের উপস্থিতি অনুভূত হয়। যদিও এসব ধ্যানধারণা অনেকাংশে অজ্ঞতা থেকে উদ্ভূত, তবুও তা সাধারণ মানুষের গোপন বিশ্বাসের প্রতিফলন ছিল। রোগ-শোক বা অভাব-অনটনে পীরদের সাহায্য ও আশীর্বাদ মানুষের নিত্য প্রয়োজন ছিল, তাই তাদের সন্তুষ্ট করার জন্য পূজা-অর্চনা করা হত।
এখানে সমাজতত্ত্বের আরেকটি দিক উল্লেখযোগ্য। পীর-পীরানিদের বাৎসরিক উরস পালনের সময় মাজার, আস্তানা বা দরগাহে মেলার আয়োজন করা হত। এই মেলা গ্রামীণ বাংলার অন্যতম লৌকিক উৎসব ছিল। মেলায় দূর-দূরান্ত থেকে ভক্তরা আসত এবং ধর্মীয় অনুষ্ঠান ছাড়াও গান-বাজনা, খেলাধুলা ও প্রদর্শনীর আয়োজন হত। হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সবাই এই মেলায় অংশ নিতে পারত। ভক্তরা পীরের উদ্দেশ্যে শিরনি, প্রাণী বা অর্থ দান করত এবং মেলায় আনন্দ উপভোগ করত। এই বাৎসরিক মেলা দুঃখ-দারিদ্র্যের জীবনে কিছুক্ষণের জন্য হলেও আনন্দের আশ্রয়স্থল ছিল। পীর ভক্তরা পরিষ্কার পোশাক পরিধান করে, পবিত্র মনে এবং আনন্দিত চিত্তে এই দিনটি উদযাপন করত। পীরদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের কারণেই তারা সাধারণ মানুষের মনে স্থায়ী জায়গা করে নিয়েছিলেন। বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে গাজী মেলা, বনবিবির মেলা ও মাদারের মেলা এখনও অনুষ্ঠিত হয়।
বাংলার মুসলমান সমাজে ইসলামি শরিয়তের বাইরে যে ‘বেশরা বেদাত’ পীরবাদ থেকে নতুন ধর্মীয় ধারা গড়ে উঠেছিল, তা পণ্ডিতরা ‘লৌকিক ইসলাম’ নামে অভিহিত করেছেন। (বঙ্গে সূফী প্রভাব, পৃ. ২১৭) এই লোকধর্মীয় ব্যবস্থার কোন দার্শনিক ভিত্তি না থাকায় এটি সার্বজনীন হতে পারেনি এবং বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন রূপ ধারণ করেছে। তাই বাংলার ‘লৌকিক ইসলাম’ আঞ্চলিক প্রেক্ষাপটে গৃহীত ও বিবেচিত।
বাংলায় পীরবাদ তথা লৌকিক ইসলামের প্রাধান্য লাভের পেছনে কী কারণ ছিল, তা অনুসন্ধানের বিষয়। ড. হক লৌকিক ইসলামের উদ্ভব ও প্রভাবের তিনটি কারণ উল্লেখ করেছেন: হিন্দু ও বৌদ্ধদের ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তর গ্রহণ, হিন্দুয়ানি পরিবেশের প্রভাব এবং পূর্ববর্তী সংস্কারের পুনরুজ্জীবন। (ঐ, পৃ. ২১৭-২০) বাঙালি মুসলমানের জাতিগত এবং মনস্তাত্ত্বিক দিক থেকে ড. হকের এই মত সমর্থনযোগ্য। তবে মধ্যযুগের বাঙালির জাতীয় জীবনের আরও অনেক দিক রয়েছে, যেমন ধর্মীয়, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক জীবনের প্রেক্ষাপট। সাহিত্য, শিল্প, ইতিহাস, কিংবদন্তি প্রভৃতি নানা সূত্রে পীরদের সম্পর্কে লোকধারণা গড়ে উঠেছিল, যার একটি সার্বিক ধারণা হল:
-
ক. পীরগণ ধর্মগুরু; তারা আধ্যাত্মিক ক্ষমতায় সমৃদ্ধ। তারা সাধারন, পবিত্র জীবনযাপন করেন এবং ভোগবিলাস বর্জন করে ত্যাগকেই জীবনের মূলমন্ত্র হিসেবে গ্রহণ করেন। তাদের চরিত্র ছিলো সাধনাভজনে এবং পরার্থপরতায় ভরপুর।
-
খ. পীরগণ অতিমানবিক ক্ষমতার অধিকারী বলে মনে করা হয়। তারা অলৌকিক কেরামতির মাধ্যমে যেকোনো স্থানে যেতে পারেন, রূপ পরিবর্তন করতে পারেন, এবং প্রাকৃতিক ঘটনা নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম। তাদের আশীর্বাদে কেউ জীবন ফিরে পেতে পারে, আবার অভিশাপে কারও জীবন চলে যেতে পারে।
-
গ. তারা ভবিষ্যৎ বলে দিতে পারেন। মানুষের জীবনের অতীত ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে জানিয়ে তারা উপযুক্ত পরামর্শ দেন।
-
ঘ. পীরগণ সম্মোহনী শক্তির অধিকারী। তাদের ব্যক্তিত্বের দ্বারা শত্রুরা হতচেতন এবং মিত্ররা মুগ্ধ হয়ে যায়। এই ক্ষমতা বৌদ্ধ ডাক-ডাকিনীদের সাথেও তুলনীয়।
-
ঙ. তারা মানুষের মনোবাসনা পূর্ণ করেন। নিঃসন্তানকে সন্তান দান করেন, নিষ্ফলা বৃক্ষকে ফলবান করেন। তাদের অনুগ্রহে মানুষ তার কাজ সফলভাবে সম্পন্ন করতে পারে এবং বিবাদে শত্রুকে জয় করতে পারে।
-
চ. তারা রোগ-বালাই দূর করার ক্ষমতা রাখেন। তাদের প্রার্থনায় অন্ধ দেখতে পায়, খঞ্জ স্বাভাবিক চলাফেরা করতে পারে। মহামারী প্রতিরোধ ও আক্রান্তদের নিরাময়ের ক্ষেত্রেও তারা সফল হন। তাদের ঝাড়ফুঁক মন্ত্রের মতো কাজ করে।
-
ছ. তারা দুঃস্থদের সহায়তা করেন। দরিদ্রদের অন্ন, অসহায়দের আশ্রয়, পীড়িতদের সেবা, এবং অজ্ঞদের জ্ঞান দিয়ে সাহায্য করেন। পরোপকার তাদের মূল ব্রত।
-
জ. তারা জীবজন্তুর ওপরও কর্তৃত্ব রাখেন। সাপ, বাঘ, কুমির প্রভৃতি হিংস্র প্রাণী তাদের বশে চলে এবং তাদের নির্দেশ মানে। পীরের অনুগত হলে মানুষ এদের আক্রমণ থেকে রক্ষা পায়। গরু-বাছুরের জীবন-মৃত্যুও পীরের হাতে নির্ভরশীল।
-
ঝ. তারা আগুন এবং পানির ওপরও ক্ষমতা রাখেন। বিপদে তাদের দোহাই দিলে বা আশ্রয় নিলে ভক্তরা দুর্যোগ থেকে মুক্তি পায়। এমনকি কখনো কখনো তারা স্বশরীরে উপস্থিত হয়ে ভক্তদের বিপদমুক্ত করেন।
-
ঞ. পীরের অনুগ্রহে মানুষের ইহলোকের অভিলাষ যেমন পূর্ণ হয়, তেমনি তাদের মাধ্যমে পরলোকে আল্লাহর সান্নিধ্যও লাভ করা যায়। মুরিদদের জন্য তাদের দোয়া আল্লাহর কাছে পৌঁছায় এবং তা মঞ্জুর হয়।
বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে আর্য বা সেমীয় রক্তের মিশ্রণ খুবই কম। অনেক নিপীড়িত বৌদ্ধ ও নিম্ন শ্রেণির হিন্দু ইসলাম গ্রহণ করে বৃহত্তর একটি লোকসমাজ গড়ে তুলেছে। তাদের শরীরে মূলত অনার্য রক্তের প্রভাব প্রবল। ইসলামের উদার আদর্শ, সাম্য এবং মৈত্রীর গুণে তারা সহজেই আকৃষ্ট হয়ে ধর্মান্তরিত হয়। পীর ও দরবেশরা বিভিন্ন স্থানে গিয়ে ধর্ম প্রচারের প্রধান ভূমিকা পালন করলেও সত্যিকারের দীক্ষা সর্বত্র সম্ভব হয়নি। একটি কলেমা পাঠ করেই মুসলমান হওয়া সম্ভব হলেও, বহুদিনের প্রতিষ্ঠিত জীবনব্যবস্থা হঠাৎ করে বদলানো কঠিন ছিল। হিন্দু নমঃশূদ্র কৃষক মুসলমান হয়ে ‘চাষা’ হলো, তাতি হলো ‘জোলা’, জেলে কৈবর্ত হলো ‘নিকারী’, কিন্তু তাদের পেশাগত কাজ যেমন লাঙল টানা, তাত বোনা বা মাছ ধরা অপরিবর্তিত রয়ে গেল। রাজপ্রাসাদের আনুকূল্য এবং অর্থিক সুবিধা কিছু মানুষের ভাগ্যে জুটলেও, গ্রামীণ দরিদ্র জনগণের অবস্থার তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি। সামন্তবাদী রাষ্ট্রের লক্ষ্য সাধারণ মানুষের কল্যাণ নয়; রাজার স্বার্থই ছিল মুখ্য। রাজকর্মচারীরা রাজাকে সাহায্য করতেই বেশি মনোযোগী ছিলেন, প্রজারা ছিল প্রায় উপেক্ষিত। ফলে দরিদ্রদের জন্য সহানুভূতির কোনো জায়গা ছিল না। এদিকে রোগ-শোক, মহামারী, জীবজন্তু, আগুন, পানি এবং ডাকাতির ভয় তেমনই থেকে গেল। সাধারণ মানুষ সাপে কাটলে ওঝার আশ্রয় নিত এবং মনসাদেবীর পূজা করত সাপের ভয় দূর করতে। মহামারীর সময় শত শত মানুষ মারা যেত, আর লোকেরা ভাবত, কোনো অপদেবতার কোপে তারা আক্রান্ত হয়েছে, আর তাকে সন্তুষ্ট করলেই রক্ষা পাওয়া যাবে। এই কারণে হিন্দুরা বহুকাল ধরে বসন্তের দেবী শীতলা, কলেরার দেবী ওলা, এবং খোস-পাঁচড়ার দেবতা ঘেঁটু প্রমুখের পূজা করে আসছে। মনসা, দক্ষিণরায়, কালুরায়ের মতো দেবতাদের পূজাও একই মানসিকতার প্রতিফলন। বহু দেবতার এই ধারাটি অব্যাহত ছিল, এবং যেসব হিন্দু এই লৌকিক দেবতাদের পূজা করত, তাদেরই এক অংশ ইসলাম গ্রহণ করেছিল। কিন্তু তাদের পূর্বের অসহায় জীবনযাত্রা এবং নৈরাশ্য, ধর্ম পরিবর্তনের পরও দূর হয়নি, ফলে তাদের মধ্যে আগের সংস্কারও থেকে গিয়েছিল।
ইসলাম একেশ্বরবাদী ধর্ম, এবং মুসলমানদের দেবপূজা করার অনুমতি নেই। কিন্তু রাজা এবং ধনী ব্যক্তিরা যখন সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়াননি, তখন তারা সাহায্যের জন্য পীরদের কাছে গেছে। পীরদের দান, সেবা এবং সাহচর্যে সাধারণ মানুষ সান্ত্বনা ও নির্ভরতা খুঁজে পেয়েছে। তাই পীরদের ধীরে ধীরে দেবতার মতো সম্মান দেওয়া শুরু হয়। বাস্তব জীবনের অভাব-অনটন এবং দুঃখের মধ্যে মানুষ মানসিক আশ্রয়ের জন্য এমন কিছু খুঁজে নেয়, যা তাকে শক্তি এবং স্থিরতা দেয়। এভাবেই বাঙালি মুসলমানদের মানসিকতায় পীরবাদ আধ্যাত্মিক দেবতার রূপ পেয়েছে। এটি কোনো পরিকল্পিত বা যত্নসহকারে তৈরি ধারণা নয়, বরং গ্রামীণ বাংলার নিভৃত কোণে, যেখানে দুঃখ-কষ্ট এবং বিপদ-আপদ মানুষের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছিল, সেখানেই এমন ধারণার জন্ম হয়েছে। লোকপূজিত পীরদের দেবতুল্য রূপ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এটি মূলত হিন্দু-বৌদ্ধ দেবতার ধারণার বিকল্প আধ্যাত্মিক রূপ।
অধিপতি দেবতা | দেবদেবী | পীরপীরানী |
পানি | বরুণ | খোয়াজ খিজির |
নৌকা | – | বদরপীর |
আগুন | ইন্দ্র | মাদারপীর |
সম্পদ | লক্ষ্মীদেবী | লক্ষ্মীবিবি |
সন্তান | ষষ্ঠী, পাঁচু ঠাকুর | মনাই পীর |
গোরু | গোরক্ষনাথ | মানিকপীর, সোনাপীর |
বাঘ | দক্ষিণরায় | গাজীপীর |
ব্যাধি | শীতলা, ওলাদেবী | ওলাবিবি |
বন | বনদুর্গা, বনদেবী | বনবিবি, জঙ্গলীপীর |
অনেক পীরের মধ্যে মিশ্র গুণ দেখা যায়। যেমন গাজীপীর ভক্তদের বিভিন্ন ইচ্ছা পূরণ করতে সক্ষম, সত্যপীরও মনোবাঞ্ছা পূরণকারী হিসেবে পরিচিত। পাঁচপীর মূলত মঙ্গল এবং অমঙ্গলের দেবতা হিসেবে দেখা হয়। মাদারপীর ব্যাধি নিরাময়ে সক্ষম বলে বিশ্বাস করা হয়। হিন্দু দেবপূজার তুলনায় মুসলমানের পীরপূজার একটি মূল পার্থক্য হল, মুসলমানরা সাধারণত পীরের মূর্তি তৈরি করেন না। তবে কিছু পীরের প্রতীক আছে, যেমন ‘আসা’ গাজীপীরের প্রতীক, ‘বাঁশ’ মাদারপীরের প্রতীক, এবং ‘পাট’ সত্যপীরের প্রতীক। কেবলমাত্র ‘গাজীর পটে’ ব্যাঘ্রারোহী গাজীপীরের মূর্তি আঁকা হয়েছে। এটি পূজার জন্য ব্যবহৃত হয় না, বরং পটুয়ারা তাদের ব্যবসায়ের জন্য এটি আঁকে।
গোপেন্দ্রকৃষ্ণ বসু তার ‘বাংলার লৌকিক দেবতা’ গ্রন্থে মানবাকৃতির ‘মানিকপীর’ ও ‘বনবিবি’র আলোকচিত্র দিয়েছেন। চিত্র দেখে মনে হয় তারা পটাঙ্কিত নয় বরং দরগার মৃন্ময় মূর্তি হতে পারেন। (‘বাংলার লৌকিক দেবতা’ গ্রন্থে প্রদত্ত আলোকচিত্র দ্রষ্টব্য)। কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক প্রকাশিত ‘Folk Deities of Bengal’ (১৯৯৮) শীর্ষক এ্যালবামে গাজীপীর ও বনবিবির মাটির মূর্তির চিত্র আছে। তাদের মূর্তির সৃষ্টি এবং পূজা-মানত লোকধর্মের দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ ধরনের মূর্তির নির্মাতা হিন্দু না মুসলমান তা গোপেন্দ্রকৃষ্ণ বা এ্যালবামের সম্পাদক স্পষ্ট করে উল্লেখ করেননি। তবে তাদের ভক্ত হিন্দু-মুসলমান উভয়ই। হিন্দুরা লৌকিক দেবদেবীর প্রতীক ও প্রতিমা নির্মাণ করে পূজা করে। তারা পীরের পূজা করলেও পীরের মূর্তি সাধারণত গড়েনি।
পীরদের লোকমনে তিনটি রূপে ধরা হয়: ব্যক্তি, প্রতীক এবং আত্মা। ব্যক্তিত্ব এবং অস্তিত্বের দিক থেকে পীরদের তিনটি ভাগে ভাগ করা যেতে পারে:
- এক. ঐতিহাসিক- বদরপীর, মাদারপীর, গাজীপীর।
- দুই. পৌরাণিক খোয়াজ খিজির, হাওয়া বিবি, ত্রিনাথপীর।
- তিন. লৌকিক- সত্যপীর, মানিকপীর সোনাপীর, বনবিবি, জঙ্গলীপীর, মনাইপীর, ঠুনকাপীর, কাউয়াপীর, নোরাপীর, ঘোড়াপীর।
যে কোনো ঐতিহাসিক, পৌরাণিক বা লোকজ পীরদের কথা বলা হোক না কেন, তারা লোকজনের মাঝে আত্মিক শক্তির প্রতীক বা অলৌকিক ক্ষমতার প্রতিচ্ছবি হিসেবে জায়গা করে নিয়েছেন। লোকসংস্কৃতির সাথে এসব পীরপীরানীর সম্পর্ক গভীরভাবে জড়িত। কিছু লৌকিক পীর আঞ্চলিকভাবে প্রতিষ্ঠিত, আবার কেউ কেউ সারা দেশ জুড়ে পরিচিতি পেয়েছেন। বাড়িতে কেউ অসুস্থ হলে গাজীপীরের নামে শিরনি দেওয়া হয়। ‘আয়নাবিবি’ পালায় দেখা যায়, মামুদ-উজ্জ্বল যখন ফসল ফলিয়ে ঘরে তুলেছে, তখন তার মা প্রথম কুলার ধান মাদারপীরের উদ্দেশ্যে শিরনি হিসেবে দিয়েছে।
আগ কুলা হইতে মায় যতনে রাখিল।
সেই ধানে পীর মাদারের সিন্নী যে করিল।।
– পূর্ববঙ্গ গীতিকা, ৩য় খণ্ড, ২য় সংখ্যা, পৃ. ১৯৪
রুজিতে বরকত ও মঙ্গল কামনা করাই এ প্রথার উদ্দেশ্য। যখন মামুদ-উজ্জ্বল বাণিজ্যযাত্রা শুরু করেছিল, তখন খোয়াজের উদ্দেশ্যে শিরনি দিয়েছিল। (পূর্ববঙ্গ গীতিকা, ৩য় খণ্ড, ২য় সংখ্যা, পৃ. ২০৮)
পীরবাদ মধ্যযুগে হিন্দু, বৌদ্ধ এবং মুসলমান সব বাঙালির মিলিত সংস্কৃতির নতুন মানসিক ফসল। সুকুমার সেন এটিকে বাঙালির অজানা ‘নব-পৌরাণিক’ ধারা হিসেবে উল্লেখ করেছেন। (সুকুমার সেন, ইসলামি বাংলা সাহিত্য, পৃ. ৮২)
আসলে আধ্যাত্মিক শক্তির অধিকারী পীরদের আবির্ভাব এবং তাদের কেরামতি নিয়ে নানা লোককাহিনীর সৃষ্টি হয়েছে, যা লোকমনে গভীর বিশ্বাস ও আচার-আচরণের সাথে যুক্ত হয়েছে। এটি হিন্দুদের পুরনো লোকপুরাণের সাথে মিলে গঠিত পীরপাঁচালি, যা ইসলামি ভাবনায় একটি স্বতন্ত্র এবং অভিনব পৌরাণিকতার বিষয়। বাঙালির নিজস্ব চিন্তাভাবনা ও পূজাচারের প্রেক্ষাপটে পীরগণ একটি পৌরাণিক চরিত্র হিসেবে রূপ নিয়েছেন। পল্লীবাসীরা তাদের অনুগত ভক্ত ও পূজারী। একেই জীবনযন্ত্রণা ও দুঃখ-দুর্দশায় জর্জরিত মানুষ দৈব অনুগ্রহের প্রত্যাশায় যে ধর্মাচার পালন করেছে, তাতে মিলনই সম্ভব হয়েছে, বিরোধ নয়। সত্যপীর ও সত্যনারায়ণ, কালুগাজী ও দক্ষিণরায়, বনবিবি ও বনদেবীর মধ্যে তাই খুব বেশি পার্থক্য করা হয়নি। মুসলমানের পীর হিন্দুর দেবতা হয়েছেন, হিন্দুর দেবতা মুসলমানের পীর হিসেবে মেনে নেওয়া হয়েছে। কে কার স্থানে ভাগ নিয়েছে, তা অনেক ক্ষেত্রে নিশ্চিতভাবে বলা যায় না। সত্যপীর ও সত্যনারায়ণকে নিয়ে এই প্রশ্নেরও কোনো স্পষ্ট উত্তর পাওয়া যায়নি।
পীরপূজার লৌকিক প্রভাব
লোকগাথায় অনেক সময় দেখা যায়, নতুন কোনো পীরের সঙ্গে স্থানীয় দেবতার বিরোধের গল্প আছে, যেখানে পীর দেবতাকে পরাজিত করেছেন। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পরিণামে সেই বিরোধ মিটিয়ে তাদের মধ্যে আত্মীয়তার সম্পর্ক গড়ে ওঠে এবং তারা সহাবস্থান শুরু করেন। যেমন, কালুগাজী ও দক্ষিণরায়ের মধ্যে সংঘর্ষ ক্ষমতা ও প্রভাব প্রতিষ্ঠার জন্যই হয়েছিল। গাজীর পালাগানে বাঘ সৈন্য নিয়ে সংঘর্ষের দৃশ্যও দেখা যায়। পরে দক্ষিণরায় নিজের অঞ্চলের একাংশ ছেড়ে দিয়ে এবং পূজার অধিকার দিয়ে গাজীর সঙ্গে মিত্রতা স্থাপন করেন। (কালুগাজী-চম্পাবতী, সুনাই কন্যার পালাগান প্রভৃতি গাজী বিষয়ক রচনা দ্রষ্টব্য)। বনবিবি ও দক্ষিণরায়ের মধ্যে সংঘর্ষও মূলত আধিপত্য ও পূজার প্রসার কেন্দ্র করে। বনবিবি ও জঙ্গলীপীরের ভাইবোনের সম্পর্ক এবং দক্ষিণরায়ের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষের গল্প ‘বনবিবির জহুরানামা’ শীর্ষক পুঁথিকাব্যে বর্ণিত হয়েছে। পরবর্তীতে বড় খান গাজীর মধ্যস্থতায় সব বিরোধের অবসান ঘটে এবং বনবিবি দক্ষিণরায়কে নিজের সখী ও সন্তান হিসেবে বরণ করেন। (ইসলামি বাংলা সাহিত্য, পৃ. ৮২-৯৩)। চম্পাবতী কন্যার পালাগানে গাজীপীর গঙ্গাদেবীকে মাসী বলে সম্বোধন করেছেন। লোককবির বর্ণনা অনুযায়ী, গাজীমাতা অজুপা ও গঙ্গাদেবী সহোদরা বোন। এক কাঠুরিয়াকে ধন দিয়ে সাহায্য করার জন্য গাজী গঙ্গার শরণাপন্ন হন। (লোকসাহিত্য, ১ম খণ্ড, বাংলা একাডেমী, ১৩৭০, পৃ. ৮২-৮৩)। গাজীর পটে বাঘের পিঠে বসে থাকা গাজীপীরের পাশেই মকরবাহনা গঙ্গাদেবীর চিত্রও অঙ্কিত হয়। শুধু হিন্দু দেবতাই নয়, হিন্দু রাজাদের সঙ্গেও মুসলিম পীরদের বিরোধের কাহিনী রয়েছে, যেখানে রাজকুমারীর সঙ্গে পীরের বিবাহের মাধ্যমে সেই বিরোধের সমাধান ঘটে। (চম্পাবতী কন্যার পালাগান দ্রষ্টব্য)। দেবতা ও পীরের সংঘর্ষ এবং মিলনের এসব কাহিনী সেই যুগের সমাজজীবনের প্রতিফলন।
মধ্যযুগের লোকসাহিত্য এবং উচ্চ সাহিত্যে হিন্দু দেবতা ও মুসলিম পীররা সমানভাবে ভক্তদের বন্দনা পেয়েছেন। এটি কৃত্রিম কোনো সমন্বয় নয়। ধর্মীয় আশ্রয়, মানবিক সেবা এবং সামাজিক মেলবন্ধনের পাশাপাশি বৈষয়িক কারণেও সাধারণ মানুষ পীরদের ভক্তি করত। তারা ছিলেন অত্যন্ত প্রভাবশালী। রাজা-বাদশা, জমিদার, এবং সামন্তপ্রভুরাও তাদের সম্মান করতেন। ফলে তাদের সুপারিশে চাকরি পাওয়া বা বিচার-সালিশিতে সুবিধা পাওয়া যেত। এই কারণে, পরাজিত মন নিয়ে হলেও হিন্দুরাও পীরদের ভক্ত হয়ে পড়ত। মুসলিম পীর বা গাজী সহজেই হিন্দু দেবতার বেদীতে স্থান পেয়ে যেতেন এবং দেবতাদের মতোই পূজা ও শিরনি পেতেন। এই যুগ এবং জীবনের প্রেক্ষাপটে পীরপূজা, পীরাচার বাঙালির জাতীয় সংস্কৃতির অংশ হয়ে উঠেছিল। এটি বিভিন্ন প্রভাবের মধ্যে গড়ে ওঠা একটি নতুন সংস্কৃতির নিদর্শন, যা বাঙালির মানসিক পরিচর্যায় নিজস্ব সম্পদে পরিণত হয়েছে।
Leave a Reply