এটা আমাদের খাওয়া খাদ্যকে স্পর্শ করে, আমাদের শ্বাস নেয়া বায়ুকে স্পর্শ করে, আমাদের পরিহিত পোশাককে স্পর্শ করে এবং সম্ভবত যে ডিভাইসটির সাহায্যে আপনি এই লেখাটি পড়ছেন তাকেও স্পর্শ করেছে। এর নাম স্লেভারি বা দাসপ্রথা। কিন্তু এই দাসপ্রথা আজ একটি প্যারাডক্স। দাসপ্রথা এখন সমাজে এমনভাবে লুকিয়ে আছে যা পূর্বে কোনদিনও ছিল না। কিন্তু এর প্রভাব সকলক্ষেত্রেই। যদি স্লেভারি বা দাসপ্রথা একটি দেশ হত তাহলে এই দেশের জনসংখ্যা কানাডার সমান হত আর জিডিপি কুয়েতের সমান হত। কিন্তু এর কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গমনের পরিমাণ হত চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের পর তৃতীয়।
বৈশ্বিক দাসপ্রথার সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী পৃথিবীতে মোট স্লেভ বা দাসের সংখ্যা প্রায় ৩৬ মিলিয়ন যা সকল দেশেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। জাতিসংঘ বলছে, স্লেভারির দ্বারা প্রতিবছর ১৫০ বিলিয়ন ইউএস ডলার উৎপাদিত হয়। এই অর্থকে দেখে অনেক বেশি মনে হচ্ছে। কিন্তু দাস এর সংখ্যা মোট গ্লোবাল পপুলেশনের একটি ছোট ভগ্নাংশ হলেও ১৫০ বিলিয়ন ইউএস ডলার মোট গ্লোবাল ইকোনমির একেবারেই নগণ্য ভগ্নাংশ যা কয়েক মিলিয়ন লোকাল ক্রিমিনাল এন্টারপ্রাইজগুলোতে বা আঞ্চলিক অপরাধী চক্রে ছড়িয়ে আছে।
কোন মানব সমাজেই স্লেভারি আমাদের জীবনের এত ক্ষুদ্র অংশ ছিল না। প্রত্যেক দেশেই স্লেভারি বা দাসপ্রথা আইনত নিষিদ্ধ। আমাদের বৈশ্বিক সমাজে স্লেভারিকে কোণঠাসা করে দেয়া হয়েছে। কিন্তু এটা তবুও আসঙ্কাজনক হারে জীবন এবং প্রাকৃতিক পরিবেশকে ধ্বংশ করে চলেছে। এর কারণ হল যেসব ক্রিমিনাল গ্যাং এই স্লেভদেরকে কাজে নিয়জিত করে তারা তাদের কাজের একটি অংশ হিসেবে দূষণ এবং বৃক্ষনিধন বা ডিফরেস্টেশনে যুক্ত থাকে।
ইজি মানি বা সহজ অর্থ
ইউনিভার্সিটি অব হালের কনটেম্পোরারি স্লেভারি বিষয়ক প্রফেসর কেলভিন ব্যালেস তার গবেষণার কাজে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের একটি গ্রামে ১৯ বছর বয়সী সুমির নামে এক ব্যক্তির সাথে সাক্ষাত করেন। সাক্ষাতের আগের দিনেই সে একটি মাছ ধরার নৌকা থেকে পালিয়ে স্লেভারি এর হাত থেকে রেহাই পেয়েছিল। তাকে লোভ দেখিয়ে দাস বানানো হয়েছিল। সে বলে,
“একজন রিক্রুটার আমার বাবা-মাকে বলেন তিনি তাদেরকে ২০০০ টাকা (২৯ ইউ এস ডলার) দেবেন যদি তারা আমাকে একটি ফিশ ক্যাম্পে কাজ করতে পাঠান… লোকটি বলেন, কাজটি সহজ এবং আমাকে যথেষ্ট পরিমাণে খাদ্যও দেয়া হবে। আমার বাবা-মার অর্থের প্রয়োজন ছিল আর আমিও তাদের সাহায্য করতে চেয়েছিলাম। তাই আমি রিক্রুটারের সাথে চলে যাই।”
এটা একটা মিথ্যা ছিল। সুমির এবং আরও কয়েক ডজন লোক প্রায়ই দিনে ২৪ ঘণ্টা টানা কাজ করত। সে বলে, “আমি যত বেশি কাজ করতাম ততই ক্লান্ত হয়ে যেতাম। কখনও কখনও আমি কাজ করতে গিয়ে নিজেকে ছুড়ি দিয়ে বিদ্ধ করতাম অথবা পা পিছলে ড্রাইং র্যাক থেকে পড়ে যেতাম। যখনই আমি এরকম ভুল করতাম, বস আমাকে মারত”।
“তবুও বসের চেয়ে বনের বাঘ আরও বেশি ভয়ানক ছিল। যে সব বালকের সাথে আমি ফিশ ক্যাম্পে সাক্ষাত করেছিলাম তাদের প্রত্যেকেই কোন না কোন চাইল্ড স্লেভকে বাঘের আহার্যে পরিণত হতে দেখেছে”।
যাই হোক, যে অপরাধী চক্রের কথা বলা হল তারা সুন্দরবনের ফিশ প্রোসেসিং ক্যাম্প এর কাজ করে। সুন্দরবন একটি বিরাট জায়গা জুড়ে থাকা ম্যানগ্রোভ বন যা এশিয়ার একটি বড় কার্বন ডাই অক্সাইড সিংক হিসেবে কাজ করে। এর অর্থ হল এটা এমন একটি জায়গা যা যতটুকু কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গত করে তার চাইতেও বেশি কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করে আর এটাই পরিবেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই বনটি সমুদ্র তীরবর্তী অঞ্চলগুলোকে সাইক্লোন থেকে রক্ষা করার জন্যও অনেক গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু অপরাধী চক্রের খপ্পরে পড়ে তাদের স্লেভরা বৃক্ষনিধন করে যার ফলে পরিবেশের অনেক ক্ষতি হয়। যে লাভের কারণে এই বৃক্ষনিধন করা হয় তা আসে চিংড়ি ও গৃহপালিত পশুদের খাবারের গ্লোবাল মারকেট থেকে। কিন্তু এর এরকম হবার প্রয়োজন নেই।
নতুন সূচনা
যে ফিশ ক্যাম্পে সুমিরকে দাস বানিয়ে রাখা হয়েছিল তা ছিল কৃষি, মাইনিং, ইট তৈরি, কয়লা তৈরি ও অন্যান্য বিজনেসের জন্য হাজার হাজার দাস ভিত্তিক অপরাধী চক্রের একটি যা পৃথবীর ইকুইটোরিয়াল বেল্টে বা বিষুবীয় অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। এদের একটি বিরাট অংশই তাদের দৈনন্দিন কাজের অংশ হিসেবে বৃক্ষনিধন করে থাকে। দাসপ্রথা এবং জলবায়ুর পরিবর্তনের মধ্যবর্তী সম্পর্ক বোঝা সম্ভব হলে এই দুটি সমস্যারই (দাসপ্রথা এবং জলবায়ু পরিবর্তন) সমাধান করা সম্ভব হবে।
ব্রাজিলে কেভিন ব্যালেস হোসে বারস নামে একজন প্রাক্তন দাসের সাথে সাক্ষাত করেছিলেন যিনি পূর্বে মাইনে কাজ করেছেন। তার জীবনের পরিবর্তন ঘটে যখন ২০০৫ সালে তাকে অ্যামাজন জঙ্গলের ১০০ একর জমিতে কাজ করার অধিকার দেয়া হয়। তাকে একটি স্থানীয় ক্ষুদ্র কৃষকের দল সাহায্য করত। এই প্রোজেক্টটিকে নেয়া হয়েছিল একই সাথে স্লেভারি এবং ক্লাইমেট চেঞ্জকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য। এই প্রোজেক্টে বারোসকে কোকোয়া এর বীজ দেয়া হয় যা তিনি ক্যানোপি গাছের নিচে বপন করেন। এর ফলে তিনি ৬০ শতাংশ বনাঞ্চলকে অক্ষত রাখতে সক্ষম হন। এর মাধ্যমে বারোসের জীবনেও সচ্ছলতা আসে। বনটি এখন সংরক্ষিত অবস্থায় আছে। বারোস সেখানে ব্রাজিল নাটের মত অন্যান্য অর্থকরী ফসল উৎপাদন করছে যা প্রাকৃতিকভাবেই উৎপাদিত হচ্ছে।
সারা বিশ্বে স্লেভারিকে দমন করার জন্য যে অর্থ খরচ করতে হবে তা আসলেই অনেক বড় ইনভেস্টমেন্ট। কিন্তু এতে বৈশ্বিক প্রভাবও অনেক বেশি হবে। অ্যান্টি স্লেভারি আইন প্রত্যেকটি দেশে কেবল কাগজে কলমেই আছে। এটার সঠিক প্রয়োগ সম্ভব হলে খুব দ্রুত কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ কমিয়ে আনা সম্ভব। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে স্লেভারি সমাপ্ত হলে সেই সব দেশ অর্থনৈতিকভাবেও সচ্ছল হবে। তার সাথে রাইসিং সি লেভেল নিয়ন্ত্রণ করা এবং বণ্যপ্রাণী সংরক্ষণ এর ব্যাপার তো থাকছেই। মুক্ত হওয়া দাসদেরকে তারা যে সব অঞ্চলে বৃক্ষনিধন করেছে সেগুলো জায়গায় বীজ বপন করে পুনরায় আগের মত করে তুলতে নিয়োজিত করা যেতে পারে। এটা কেবল ভূমির পুনর্বাসনই করবে না, বরং এটা অনেকের বেকার সমস্যা ঘুচিয়ে তাদের জন্য কাজের সন্ধানও করে দেবে।
http://www.npr.org/sections/goatsandsoda/2016/01/20/463600820/todays-slaves-often-work-for-enterprises-that-destroy-the-environment
https://www.amazon.co.uk/Blood-Earth-Modern-Slavery-Ecocide/dp/0812995767
http://scholarship.richmond.edu/cgi/viewcontent.cgi?article=1027&context=polisci-faculty-publications
http://www.penguinrandomhouse.com/books/234046/blood-and-earth-by-kevin-bales/9780812995763/
https://www.amazon.co.uk/Ending-Slavery-Free-Todays-Slaves/dp/0520257960
– ভেলোসিটি হেড
Leave a Reply