(১১ সেপ্টেম্বর, ২০২৪-এ মার্কিস্ট অর্গে অ্যালান উড Lessons of Chile 1973 | Chile | Americas (marxist.com) – আর্টিকেলটি ফিচার করেন। এখানে সেটারই সারমর্ম করা হচ্ছে। এই ওয়েবসাইটটি মার্ক্সবাদের ট্রটস্কাইট ধারা অনুসরণ করে, এবং ওয়েবসাইটটির প্রতিষ্ঠাতা অ্যালান উড একজন ব্রিটিশ ট্রটস্কাইট পলিটিকাল থিওরিস্ট। তাই পড়ার সময় এই বিষয়টি খেয়াল রাখা প্রয়োজন।)
এই লেখাটি চিলির সামরিক অভ্যুত্থান, সালভাদর আয়েন্দের সরকার, এবং চিলির শ্রমিক শ্রেণির আন্দোলনের ইতিহাসকে বিশদভাবে ব্যাখ্যা করে। এতে ১৯৭৩ সালে সালভাদর আয়েন্দের জনপ্রিয় ঐক্য (Popular Unity) সরকারের পতন এবং জেনারেল অগাস্টো পিনোশেটের নেতৃত্বে সামরিক শাসনের সূচনার পেছনের রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করা হয়েছে। অ্যালান উডস ১৯৭৯ সালে লিখিত এই নথিতে চিলির ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলো তুলে ধরেছেন, বিশেষ করে চিলির শ্রমিক আন্দোলন, সামন্ততান্ত্রিক অভিজাতদের ভূমিকা এবং সাম্রাজ্যবাদের প্রভাব।
লেখাটির প্রথম দিকে চিলির সামরিক অভ্যুত্থান এবং সাম্রাজ্যবাদের ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। ১৯৭৩ সালের ১১ সেপ্টেম্বর সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সালভাদর আয়েন্দেকে ক্ষমতা থেকে সরানো হয় এবং পিনোশেটের নেতৃত্বে চিলিতে একটি নির্মম সামরিক একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। এই সামরিক শাসনের পেছনে মূলত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্বার্থ ছিল, যা তারা চিলিতে স্থিতিশীল একটি পুঁজিবাদী ব্যবস্থা বজায় রাখতে চেয়েছিল।
চিলির ইতিহাসের প্রথম দিকে যেসব ঘটনা প্রভাব ফেলেছিল, সেগুলো উল্লেখ করা হয়েছে। ডিয়েগো ডি আলমাগ্রো ১৫৩৬ সালে চিলি বিজয় শুরু করেন এবং পরবর্তীতে পেদ্রো দে ভালদিভিয়া এটি সম্পন্ন করেন। তবে চিলিতে স্বর্ণের বড় কোনো খনি না থাকায় স্পেনের জন্য চিলি ছিল একটি আর্থিকভাবে অপ্রয়োজনীয় এলাকা। এছাড়া আরাউকানিয়ার স্থানীয় আদিবাসীরা দীর্ঘদিন ধরে স্প্যানিশ বিজেতাদের প্রতিরোধ করে। এই প্রতিরোধ ছিল বীরত্বপূর্ণ এবং আদিবাসীরা তাদের কৌশল বদলে ক্রমাগত যুদ্ধ চালিয়ে যান। তবে চিলির জমিদার শ্রেণি আদিবাসীদের অত্যন্ত নির্মমভাবে দমন করে।
চিলির কেন্দ্রীয় সমস্যাগুলোর মধ্যে ভূমি এবং সাম্রাজ্যবাদের নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্তির বিষয়টি বারবার সামনে আসে। চিলির সবচেয়ে উর্বর ভূমিগুলো কয়েকজন বড় জমিদারের হাতে কেন্দ্রীভূত ছিল, যারা আধুনিক কৃষির উন্নয়নে কোনো আগ্রহ দেখায়নি। এতে চিলির কৃষিক্ষেত্রের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়েছিল। শুধুমাত্র জার্মান অভিবাসীরা দক্ষিণে ছোট ছোট খামার গড়ে তোলে এবং চাষাবাদ শুরু করে। কিন্তু চিলিতে জমির সংস্কার কখনোই সম্পূর্ণভাবে বাস্তবায়িত হয়নি। চিলির পুঁজিবাদী শ্রেণি জমিদারদের সাথে একীভূত হয়ে একটি শক্তিশালী অলিগার্কি গড়ে তোলে, যা দেশের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করে। ফলে প্রকৃত অর্থে কোনো বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব ঘটেনি, বরং একটি শাসকগোষ্ঠীর অধীনে দেশটি চলতে থাকে।
এই লেখায় শ্রমিক শ্রেণির উত্থান এবং তাদের রাজনীতিতে প্রবেশের কথাও বিশদভাবে আলোচনা করা হয়েছে। ১৯০৭ সাল থেকে চিলির শ্রমিক শ্রেণি সংগঠিত হতে শুরু করে এবং প্রথমে বামপন্থী রাজনীতি ও ট্রেড ইউনিয়নগুলোর মাধ্যমে নিজেদের দাবিগুলো তুলে ধরে। তবে ১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লবের প্রভাব চিলির শ্রমিক শ্রেণিকে ব্যাপকভাবে র্যাডিকাল করে তোলে। চিলির কমিউনিস্ট পার্টির উত্থান এবং তাদের রাজনৈতিক লাইন নিয়ে লেখায় গভীরভাবে সমালোচনা করা হয়েছে। বিশেষ করে স্তালিনবাদী কমিউনিস্ট পার্টির ভুল নীতিগুলো, যেমন “তৃতীয় পর্ব” নীতি এবং “জনগণের ফ্রন্ট” কৌশল, শ্রমিক আন্দোলনের ব্যর্থতার কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এই ব্যাপারটাকে একটু বিস্তারিত লেখা যাক।
চিলির শ্রমিক শ্রেণির উত্থান এবং তাদের রাজনীতিতে প্রবেশের প্রাথমিক ধাপগুলো মূলত ১৯০৭ সাল থেকে শুরু হয়, যখন শ্রমিক শ্রেণি বামপন্থী রাজনীতি এবং ট্রেড ইউনিয়নের মাধ্যমে সংগঠিত হতে শুরু করে। চিলির শ্রমিকরা প্রথমে তাদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক দাবিগুলো তুলে ধরার জন্য ট্রেড ইউনিয়ন এবং রাজনৈতিক সংগঠন গঠনের মাধ্যমে নিজেদের অবস্থান শক্তিশালী করতে থাকে। কিন্তু ১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লবের পর চিলির শ্রমিক শ্রেণির মধ্যে ব্যাপক র্যাডিকালাইজেশন ঘটে, যা তাদের আরও র্যাডিকাল রাজনীতির দিকে ঠেলে দেয়। এই সময়ে চিলিতে বামপন্থী রাজনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড় আসে। রুশ বিপ্লবের প্রভাবে চিলির শ্রমিকরা বুঝতে পারে যে, পুঁজিবাদী ব্যবস্থা এবং জমিদার শ্রেণির বিরুদ্ধে একটি সফল বিপ্লব করা সম্ভব। এই প্রেক্ষাপটে চিলির শ্রমিক শ্রেণির মধ্যে মার্কসবাদী চিন্তাধারা এবং বিপ্লবী চেতনা বৃদ্ধি পেতে থাকে। এর ফলে ১৯২২ সালে চিলির সোশ্যালিস্ট ওয়ার্কার্স পার্টি (POS) নিজেকে কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালে যুক্ত করার শর্ত হিসেবে “২১টি শর্ত” গ্রহণ করে এবং নাম পরিবর্তন করে চিলির কমিউনিস্ট পার্টি (CP) হয়ে ওঠে। চিলির কমিউনিস্ট পার্টির উত্থান শ্রমিক শ্রেণির রাজনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হলেও, লেখাটিতে স্তালিনবাদী কমিউনিস্ট পার্টির ভুল নীতি এবং শ্রমিক আন্দোলনের ব্যর্থতার কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। বিশেষত, চিলির কমিউনিস্ট পার্টির অনুসৃত নীতিগুলো শ্রমিক আন্দোলনকে শক্তিশালী করতে ব্যর্থ হয় এবং শ্রমিক শ্রেণির দীর্ঘমেয়াদী সফলতার পথে বড় অন্তরায় সৃষ্টি করে। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দুটি নীতি হলো “তৃতীয় পর্ব” (Third Period) নীতি এবং “জনগণের ফ্রন্ট” (Popular Front) কৌশল, যা বিশেষভাবে শ্রমিক আন্দোলনের ব্যর্থতার কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
তৃতীয় পর্ব নীতি (Third Period Policy) ছিল স্তালিনের নেতৃত্বাধীন কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের একটি কৌশল, যা ১৯২৮ সালে প্রণীত হয়েছিল। এই নীতির মূল বক্তব্য ছিল যে, পুঁজিবাদ তার শেষ পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে এবং ফ্যাসিবাদ এবং পুঁজিবাদী শাসন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সরাসরি সংঘর্ষের সময় এসে গেছে। এই নীতির আওতায়, কমিউনিস্ট পার্টিগুলোকে অন্যান্য বামপন্থী দলগুলোকে “সোশ্যাল ফ্যাসিস্ট” হিসেবে ঘোষণা করতে বলা হয়েছিল। এর ফলে চিলির কমিউনিস্ট পার্টিও অন্যান্য বামপন্থী দল, বিশেষ করে সোশ্যালিস্ট পার্টির সাথে একত্রে কাজ করতে অস্বীকৃতি জানায়। তারা মনে করেছিল যে, সমস্ত বুর্জোয়া এবং সংস্কারপন্থী দলগুলো শ্রমিক শ্রেণির শত্রু। এই বিভাজনমূলক নীতি শ্রমিক শ্রেণির ঐক্য ভেঙে দেয় এবং বিপ্লবী আন্দোলনের ভেতরে বিভক্তি তৈরি করে। তৃতীয় পর্ব নীতির (Third Period Policy) কারণে শ্রমিক শ্রেণির আন্দোলন প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে এবং এর ফলে চিলির শ্রমিক আন্দোলন নিজেকে সংগঠিত করতে ব্যর্থ হয়। চিলির সমাজে যে ঐতিহাসিক সুযোগ তৈরি হয়েছিল, যেখানে শ্রমিক শ্রেণি ক্ষমতা দখল করতে পারত, তা এই নীতির কারণে ভেস্তে যায়। এই বিভাজন এবং ভুল রাজনৈতিক কৌশলের ফলে শ্রমিক শ্রেণি পূর্ণ বিপ্লবের পথে এগিয়ে যেতে ব্যর্থ হয়।
তৃতীয় পর্ব নীতির (Third Period Policy) ব্যর্থতার পর, ১৯৩৫ সালে স্তালিনবাদী কমিউনিস্ট পার্টি তার রাজনৈতিক কৌশলে ১৮০ ডিগ্রি পরিবর্তন আনে এবং “জনগণের ফ্রন্ট” (Popular Front) কৌশল গ্রহণ করে। এই কৌশলের মূল বক্তব্য ছিল ফ্যাসিবাদ প্রতিরোধের জন্য বুর্জোয়া “প্রগতিশীল” দলগুলোর সাথে জোট করা। এর ফলে কমিউনিস্ট পার্টি শুধু সোশ্যালিস্ট পার্টির সাথে জোট গঠন করে না, বরং বুর্জোয়া দলগুলোর সাথেও সহযোগিতা করতে শুরু করে। এই নীতি শ্রমিক শ্রেণির বিপ্লবী সংগ্রামের ক্ষতি করে, কারণ এটি বুর্জোয়া শ্রেণির সাথে আপসের মাধ্যমে একটি সংস্কারপন্থী সরকারের পথ প্রশস্ত করে। লেখাটিতে উল্লেখ করা হয়েছে যে, জনগণের ফ্রন্ট কৌশল (Popular Front Strategy) শ্রমিক শ্রেণির স্বার্থের বিরুদ্ধে গিয়েছিল। চিলির শ্রমিক শ্রেণির আসল লক্ষ্য ছিল বুর্জোয়া শ্রেণির বিরুদ্ধে একটি সফল বিপ্লব, কিন্তু এই কৌশলের ফলে শ্রমিক শ্রেণি বুর্জোয়া শ্রেণির অধীনেই সীমাবদ্ধ থেকে যায়। জনগণের ফ্রন্ট কৌশল সরাসরি বিপ্লবের পথে বাধা সৃষ্টি করে এবং সামরিক অভ্যুত্থানের প্রস্তুতি নেওয়া পুঁজিবাদী শক্তিগুলোর জন্য সুযোগ তৈরি করে।
১৯৭০ সালে সালভাদর আয়েন্দের নেতৃত্বে চিলিতে জনপ্রিয় ঐক্য জোট সরকার গঠিত হয়। সালভাদর আয়েন্দের জনপ্রিয় ঐক্য (Popular Unity) সরকারের মূল লক্ষ্য ছিল একটি সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক নীতি বাস্তবায়ন করা, যা শ্রমিক শ্রেণি, কৃষক এবং গরিব মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি ঘটাবে। এই নীতির আওতায় বিভিন্ন বড় শিল্প এবং খনি, বিশেষ করে তামার খনি, জাতীয়করণ করা হয়েছিল। এছাড়াও, ভূমি সংস্কার এবং কৃষিজমি পুনর্বণ্টনের মাধ্যমে ভূমিহীন কৃষকদের মাঝে জমি বিতরণ করা শুরু হয়। শ্রমিকদের মজুরি বাড়ানো, খাদ্য বিতরণ এবং দারিদ্র্য দূরীকরণে নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। কিন্তু এই পদক্ষেপগুলো চিলির অভিজাত শ্রেণি এবং বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ছিল অগ্রহণযোগ্য। আয়েন্দের সরকার প্রথমে কিছু জাতীয়করণ এবং সমাজকল্যাণমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করে, যা শ্রমিক ও কৃষকদের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। তামার খনি, কয়লা, লোহা, এবং টেক্সটাইল শিল্প জাতীয়করণ করা হয়। এছাড়া গরিবদের জন্য খাদ্য সরবরাহ এবং পেনশন বাড়ানোর মতো পদক্ষেপ নেওয়া হয়।
কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চিলির অভিজাত শ্রেণি এই সরকারের নীতিগুলোকে সহ্য করতে পারেনি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অর্থনৈতিক অবরোধ এবং অন্যান্য উপায়ে চিলির অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করার চেষ্টা করে। চিলির অভিজাতরা অর্থনীতিকে ধ্বংস করতে শুরু করে এবং একপর্যায়ে তেল ট্যাঙ্কার ধর্মঘটের মাধ্যমে পুরো দেশের পরিবহন ব্যবস্থা স্তব্ধ করে দেয়। সামরিক বাহিনীও ধীরে ধীরে অভ্যুত্থানের জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। এসময় জনপ্রিয় ঐক্যের ভেতরেও বিভক্তি দেখা দেয়, যেখানে কমিউনিস্ট পার্টি বুর্জোয়া শ্রেণির সাথে সমঝোতা করার পক্ষে ছিল, আর সোশ্যালিস্ট পার্টির কিছু অংশ একটি পূর্ণ বিপ্লব চেয়েছিল। এটা নিয়েও বিস্তারিত লেখা যাক।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন সরকার আয়েন্দের এই নীতিগুলোকে মার্কিন পুঁজিপতিদের জন্য হুমকি হিসেবে দেখছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চিলির অর্থনীতিতে ব্যাপকভাবে বিনিয়োগ করেছিল, বিশেষ করে তামার খনি এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদে। যখন আয়েন্দের সরকার এই সম্পদগুলোর জাতীয়করণ শুরু করল এবং আমেরিকান কোম্পানিগুলোকে ক্ষতিপূরণ না দিয়ে তাদের খনির মালিকানা দখল করল, তখন যুক্তরাষ্ট্র তা মেনে নিতে পারেনি। আয়েন্দের সরকারকে দুর্বল করার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নানা ধরনের কৌশল অবলম্বন করে, যার মধ্যে অন্যতম ছিল অর্থনৈতিক অবরোধ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চিলির প্রতি অর্থনৈতিক সহায়তা বন্ধ করে দেয় এবং আন্তর্জাতিক বাজারে চিলির পণ্য, বিশেষ করে তামা রপ্তানির ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করে। এই অবরোধের ফলে চিলির অর্থনীতি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (IMF) এবং বিশ্বব্যাংকের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোকেও চিলির প্রতি সহায়তা না দিতে চাপ প্রয়োগ করে। এই অর্থনৈতিক অবরোধ চিলির অর্থনীতির ওপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করে এবং আয়েন্দের সরকারকে অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল করে দেয়।
চিলির অভিজাত শ্রেণি, যারা মূলত বড় শিল্পপতি, জমিদার, এবং ব্যবসায়িক মহলের অন্তর্ভুক্ত ছিল, আয়েন্দের সমাজতান্ত্রিক নীতিগুলোকে তাদের ক্ষমতা এবং সম্পদের জন্য হুমকি হিসেবে দেখেছিল। এই শ্রেণি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে মিলিত হয়ে আয়েন্দের সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করতে শুরু করে। অভিজাত শ্রেণি আয়েন্দের নীতিগুলোকে ব্যর্থ করার জন্য বিভিন্নভাবে অর্থনৈতিক অন্তর্ঘাত চালায়। তারা দেশের বিভিন্ন অর্থনৈতিক খাতকে অচল করে দিতে শুরু করে। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিল ১৯৭২ সালে তেল ট্যাঙ্কার ধর্মঘট। চিলির অর্থনীতিতে তেল এবং জ্বালানি পরিবহন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কিন্তু ১৯৭২ সালে চিলির তেল ট্যাঙ্কার মালিকরা এবং শ্রমিকরা সরকারের বিরুদ্ধে এক বিশাল ধর্মঘট শুরু করে। এই ধর্মঘটের ফলে পুরো দেশের পরিবহন ব্যবস্থা কার্যত অচল হয়ে যায়। কৃষি পণ্য থেকে শুরু করে দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র পরিবহন করা সম্ভব হয়নি। এই ধর্মঘটের পেছনে অভিজাত শ্রেণি এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মদদ ছিল বলে ধারণা করা হয়, কারণ এই ধর্মঘট চিলির অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ধ্বংস করার একটি কৌশল ছিল। শ্রমিকদের জোর করে ধর্মঘটে অংশগ্রহণ করানো হয়, এবং অনেক ক্ষেত্রে ধর্মঘট ভাঙার প্রচেষ্টা রোধ করার জন্য হুমকি দেওয়া হয়। তেল ট্যাঙ্কার ধর্মঘট এবং অন্যান্য অর্থনৈতিক অন্তর্ঘাতের ফলে চিলিতে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বাড়তে থাকে। সামরিক বাহিনী এই অস্থিতিশীলতার সুযোগ নিয়ে অভ্যুত্থানের জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও সামরিক বাহিনীর সাথে যোগাযোগ বাড়ায় এবং তাদের সমর্থন দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়। সামরিক বাহিনী এবং অভিজাত শ্রেণি মিলিতভাবে আয়েন্দের সরকারকে ক্ষমতা থেকে সরানোর পরিকল্পনা করতে শুরু করে।
এই সংকটময় সময়ে জনপ্রিয় ঐক্য (Popular Unity) জোটের ভেতরেও মতপার্থক্য দেখা দেয়। চিলির কমিউনিস্ট পার্টি (Communist Party of Chile) মূলত বুর্জোয়া শ্রেণির সাথে সমঝোতা করার পক্ষে ছিল এবং তারা মনে করেছিল যে, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য তাদের সাথে সহযোগিতা করা প্রয়োজন। তারা গণতান্ত্রিক উপায়ে ক্ষমতায় টিকে থাকার চেষ্টা করছিল এবং সরাসরি বিপ্লবী পদক্ষেপ নেওয়ার বিরোধিতা করছিল। অন্যদিকে, চিলির সোশ্যালিস্ট পার্টির (Socialist Party of Chile) একটি অংশ মনে করছিল যে, বুর্জোয়া শ্রেণির সাথে আপস করার কোনো উপায় নেই এবং একটি পূর্ণ বিপ্লব দরকার। এই অংশটি বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে শ্রমিক শ্রেণির হাতে ক্ষমতা তুলে দেওয়ার পক্ষে ছিল। তারা মনে করেছিল যে, শুধুমাত্র একটি বিপ্লবের মাধ্যমেই চিলির অর্থনৈতিক এবং সামাজিক সমস্যাগুলো সমাধান করা সম্ভব। এই বিভক্তি আয়েন্দের সরকারের অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা বাড়িয়ে তোলে এবং সামরিক অভ্যুত্থানের সম্ভাবনাকে আরও জোরদার করে। কমিউনিস্ট পার্টির আপসকামী মনোভাব এবং সোশ্যালিস্ট পার্টির বিপ্লবী অংশের মধ্যে দ্বন্দ্ব আয়েন্দের সরকারের কার্যকারিতা কমিয়ে দেয় এবং সরকারকে একটি দুর্বল অবস্থানে ফেলে।
লেখাটি সামগ্রিকভাবে দেখায় যে, আয়েন্দের সরকার মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ, অভ্যন্তরীণ পুঁজিপতি শ্রেণি এবং সামরিক বাহিনীর যৌথ ষড়যন্ত্রের কারণে ব্যর্থ হয়। পিনোশেটের সামরিক শাসন শ্রমিক শ্রেণির সকল অর্জন ধ্বংস করে দেয় এবং হাজার হাজার লোককে হত্যা ও বন্দি করে। সামরিক বাহিনীর উত্থান এবং এই কঠোর সামরিক শাসন চিলির অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাঠামোকে ভেঙে ফেলে। এই লেখাটি চিলির শ্রমিক শ্রেণির ইতিহাস, সামরিক শাসনের উত্থান, এবং সালভাদর আয়েন্দের সরকারের পতনের গভীর বিশ্লেষণ প্রদান করে, যা বামপন্থী রাজনীতির শিক্ষা এবং শ্রমিক শ্রেণির সংগ্রামের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
এই লেখাটিতে লেখক যেসব শিক্ষা বা সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন সেগুলোকে পয়েন্ট আউট করলে পাচ্ছি –
- শ্রমিক শ্রেণির ঐক্যের প্রয়োজন: চিলির শ্রমিক শ্রেণির অভ্যন্তরে ঐক্যের অভাব এবং বিভক্তি বিপ্লবী আন্দোলনের অন্যতম প্রধান দুর্বলতা ছিল। কমিউনিস্ট পার্টির স্তালিনপন্থী নীতির কারণে তারা অন্যান্য বামপন্থী দলগুলোকে সহযোগিতা করতে অস্বীকৃতি জানায়, যা শ্রমিক শ্রেণির বিপ্লবী আন্দোলনকে ব্যর্থতার দিকে ঠেলে দেয়।
- সশস্ত্র সংগ্রামের ভুল ধারণা: সামরিক অভ্যুত্থানের পর কিছু বিপ্লবী গোষ্ঠী সশস্ত্র সংগ্রাম ও গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমে পরিবর্তন আনার চেষ্টা করেছিল, যা বিপর্যয় ডেকে আনে। আর্টিকেলে বলা হয়েছে যে, এসব কৌশল শুধুমাত্র জীবনের অযৌক্তিক ক্ষতি এবং আন্দোলনের পুরোপুরি ভেঙে যাওয়ার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
- বুর্জোয়া শ্রেণির সাথে আপস বিপজ্জনক: চিলির কমিউনিস্ট পার্টির বুর্জোয়া শ্রেণির সাথে সমঝোতা করার প্রবণতা এবং তাদের উপর নির্ভরশীলতার কারণে বিপ্লবী সংগ্রাম ধ্বংস হয়। বুর্জোয়া শ্রেণির সাথে আপস করার ফলাফল হলো বিপ্লবী শক্তির দুর্বলতা এবং সামরিক অভ্যুত্থান সহজতর হওয়া।
- বুর্জোয়া রাষ্ট্রের নিরপেক্ষতার ধারণা ভুল: আয়েন্দের সরকার এবং তার সমর্থকরা ভুলভাবে বিশ্বাস করেছিল যে, সামরিক বাহিনী এবং বুর্জোয়া রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান নিরপেক্ষ থাকবে। কিন্তু সামরিক বাহিনী শেষ পর্যন্ত অভিজাত শ্রেণির স্বার্থ রক্ষার জন্য অভ্যুত্থান ঘটায়, যা একটি বড় শিক্ষা দেয় যে, বিপ্লবী নেতৃত্বকে সামরিক বাহিনী এবং বুর্জোয়া রাষ্ট্রের প্রকৃত চরিত্র সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে।
- অর্থনৈতিক অবরোধ ও ষড়যন্ত্র: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চিলির অভিজাত শ্রেণি আয়েন্দের সরকারকে অর্থনৈতিক অবরোধ এবং ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে দুর্বল করে দেয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার অর্থনৈতিক শক্তি ব্যবহার করে চিলির সরকারকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করে, যা একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা দেয় যে, বিপ্লবী সরকারকে আন্তর্জাতিক চাপ মোকাবিলা করার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।
- নেতৃত্বের দৃঢ়তা এবং সঠিক কৌশলের প্রয়োজন: শ্রমিক শ্রেণির মধ্যে বিপ্লবী নেতৃত্বের অভাব একটি বড় শিক্ষা। আর্টিকেলে বলা হয়েছে যে, বিপ্লবী দলগুলোর সঠিক নেতৃত্ব এবং সুস্পষ্ট কৌশল ছাড়া শ্রমিক শ্রেণি ক্ষমতা দখল করতে পারে না। এ ক্ষেত্রে নেতৃত্বের অযোগ্যতা বিপ্লবকে ব্যর্থতায় নিয়ে যায়।
Leave a Reply