কমফোর্ট উইমেন (Comfort Women)

১৪ আগস্ট, ১৯৪৪-তে তোলা একটি ছবি, যেখানে দেখানো হচ্ছে, মিতকিনার অবরোধের পর কোরিয়ান কমফোর্ট উইমেনদের যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর দ্বারা জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।

কমফোর্ট উইমেন (Comfort Women) শব্দটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানের সামরিক বাহিনীর সৈন্যদের যৌন সেবা প্রদানকারী নারীদের বোঝাতে ব্যবহৃত একটি ইউফেমিজম। জনশ্রুতিতে কটূ শোনায় এমন কোন কিছুকে জনসমাজে গ্রহণযোগ্য করে উপস্থাপনের রেটোরিকাল কৌশলটাই হলো ইউফেমিজম। এই কমফোর্ট উইম্যানরা সাধারণত যৌনদাসত্বের (sexual slavery) শিকার ছিলেন। প্রায়শই ধারণা করা হয় যে, এতে প্রায় ২,০০,০০০ নারী এখানে জড়িত ছিলেন, তবে প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে। এই নারীদের অধিকাংশই কোরিয়া (যেটি তখন জাপানের প্রটেক্টোরেট ছিল) থেকে আসা, যদিও চীন, তাইওয়ান এবং এশিয়ার অন্যান্য অংশের নারীরাও এতে অঙ্গীভূত হয়েছিলেন—যেমন জাপান এবং ইন্দোনেশিয়ায় থাকা ডাচ নাগরিকরাও এই প্রক্রিয়ার শিকার হন।

১৯৩২ সাল থেকে ১৯৪৫ সালে যুদ্ধের শেষ পর্যন্ত, কমফোর্ট উইমেনদের রাখা হয়েছিল ব্রোথেলগুলোতে, যেগুলোকে “কমফোর্ট স্টেশন” (comfort stations) বলা হতো। এবং সেগুলো জাপানি সৈন্যদের মনোবল বাড়ানোর জন্যই করা হয়, আর মনে করা হয়েছিল তা জাপানি সৈন্যদের র‍্যান্ডম যৌন নিপীড়ন কমাতে সাহায্য করবে। কিছু নারীকে চাকরির মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রলুব্ধ করা হয়েছিল, এবং তারা আসলে একটি বৃহৎ মানব পাচারের (human trafficking) শিকার হয়েছিল যা পরিচালিত হয়েছিল জাপানি সামরিক বাহিনীর দ্বারাই। অন্য অনেক নারীকে সরাসরি অপহরণ করা হয় এবং তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কমফোর্ট স্টেশনে পাঠানো হয়, যা চীন এবং বার্মা (মিয়ানমার) সহ জাপান দ্বারা দখলকৃত সমস্ত এলাকায় ছিল। এছাড়াও জাপান এবং কোরিয়াতেও এই ধরনের স্টেশনগুলো ছিল। এই নারীরা সাধারণত কঠোর পরিস্থিতিতে বসবাস করতেন, যেখানে তারা অবিরাম ধর্ষণের শিকার হতেন এবং প্রতিরোধ করলে তাদেরকে প্রহার বা হত্যা করা হতো।

জাপান সরকার সৈন্যদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়ে আগ্রহী ছিল এবং যৌন সেবাগুলোকে নিয়ন্ত্রিত অবস্থায় রাখতে চেয়েছিল, তাই নিয়মিতভাবে নারীদের যৌনরোগ এবং সংক্রমণের জন্য পরীক্ষা করা হতো। বিভিন্ন প্রতিবেদনে, বিশেষ করে ১৯৯৬ সালে প্রকাশিত জাতিসংঘের (UN) স্পন্সর করা এক গবেষণায় উল্লেখ করা হয় যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে অনেক কমফোর্ট উইমেনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। যারা বেঁচে গিয়েছিলেন, তারা প্রায়শই শারীরিক রোগ (যেমন বন্ধ্যাত্ব) এবং মানসিক রোগে ভুগতেন এবং নিজ নিজ পরিবার ও সম্প্রদায় থেকে প্রত্যাখ্যাত হতেন। অনেক জীবিত নারী বিদেশে পরিত্যক্ত অবস্থায় ছিলেন এবং তাদের আয় বা যোগাযোগের উপায় না থাকায় তারা নিজ দেশে ফিরে যেতে পারেননি।

জাপান তাদের দায়িত্ব অস্বীকার করলে ১৯৯০ সালে, দক্ষিণ কোরিয়ায় ৩০টিরও বেশি নারীবাদী সংগঠন একত্রিত হয়ে কোরিয়ান কাউন্সিল ফর দ্য উইমেন ড্রাফটেড ফর মিলিটারি সেক্সুয়াল স্লেভারি বাই জাপান (Korean Council for the Women Drafted for Military Sexual Slavery by Japan) প্রতিষ্ঠা করে। এই কাউন্সিল অপরাধ স্বীকার, ক্ষমা প্রার্থনা, স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ, ক্ষতিপূরণের দাবি জানায় এবং জাপানি পাঠ্যপুস্তকে যৌনদাসত্বের বাস্তবতা প্রতিফলিত করার প্রস্তাব দেয়। জাপান সরকার তখন নারীদেরকে বাধ্যতামূলকভাবে যৌন সেবায় নিযুক্ত করার যেকোনো প্রমাণ অস্বীকার করে এবং দাবি করে যে, ১৯৬৫ সালের জাপান এবং দক্ষিণ কোরিয়ার মধ্যে চুক্তির মাধ্যমে সমস্ত বিষয় সমাধান করা হয়েছে।

কমফোর্ট উইমেনের ইস্যুটি ১৯৯১ সালে আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিতি পায়, যখন কয়েকজন বেঁচে থাকা নারী কয়েক দশকের নীরবতা ভেঙে জাপান সরকারের বিরুদ্ধে একটি যৌথ মামলা দায়ের করেন। নারীরা এবং তাদের সমর্থকরা মানবাধিকার লঙ্ঘনের ভিত্তিতে ক্ষতিপূরণের দাবি করেন। একই সময়ে, টোকিওর চুয়ো বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসবিদ ইয়োশিমি ইয়োশিয়াকি জাপানের সেল্ফ-ডিফেন্স ফোর্সের আর্কাইভ থেকে কিছু নথি আবিষ্কার করেন এবং সেগুলো প্রকাশ করেন। এই নথিতে দেখা যায় যে, জাপানের যুদ্ধকালীন সামরিক বাহিনী এবং সরকার কমফোর্ট উইমেন ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যুক্ত ছিল।

১৯৯১ সালে, জাপান সরকার প্রথমবারের মতো স্বীকার করে যে, যুদ্ধের সময় কমফোর্ট স্টেশনগুলো এক্সিস্ট করতো। দুই বছর পর, প্রধান মন্ত্রিপরিষদের একজন মন্ত্রীর একটি বিবৃতিতে সরকার কমফোর্ট উইমেন নিয়োগে নিজেদের জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে এবং নারীদের সম্মানহানির জন্য ক্ষমা চায়। যদিও জাপান সরকার যৌন নিপীড়নের জন্য আইনি দায় অস্বীকার করে, তারা ১৯৯৫ সালে একটি প্রস্তাব আনে, যার মাধ্যমে এশিয়ান উইমেন ফান্ড (Asian Women’s Fund) প্রতিষ্ঠা করা হয়। তবে, এই ফান্ডটি সরকারী তহবিলের পরিবর্তে ব্যক্তিগত দান থেকে সংগ্রহ করা হতো এবং কোরিয়ান কর্মীরা এই ফান্ডের বিরোধিতা করেন। ফান্ডটি ২০০৭ সালে বন্ধ হয়ে যায়।

কমফোর্ট উইমেনের ইস্যুটি জাপানে অত্যন্ত সংবেদনশীল ছিল। যদিও যুদ্ধকালীন প্রোগ্রামের অস্তিত্ব সেখানে সাধারণভাবে স্বীকৃত হয়েছিল, অনেক জাপানি, বিশেষত ডানপন্থী জাতীয়তাবাদীরা এটি অস্বীকার করে। বিশেষ করে নারীদের কমফোর্ট স্টেশনে কাজ করতে বাধ্য করা হয়েছিল – এই দাবি তারা অস্বীকার করে। ২০০৭ সালে আবে শিনজো (Abe Shinzo), তার প্রথম প্রধানমন্ত্রিত্বকালে, বলেছিলেন যে নারীদের জোরপূর্বক নিয়োগের কোনো প্রমাণ নেই, যদিও পরে তিনি তার মন্তব্য প্রত্যাহার করেন। এই বিষয়টি ২০১৪ সালে আবারও আলোচনায় আসে, যখন আবে দ্বিতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হন। একটি জাপানি সংবাদপত্র জানায় যে, তারা ১৯৮০ এবং ৯০-এর দশকে নারীদের জোরপূর্বক নিয়োগ সম্পর্কে যে প্রতিবেদনগুলো প্রকাশ করেছিল, সেগুলোর তথ্য তারা প্রত্যাহার করেছে। এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল কারণ প্রতিবেদনে যে জাপানি ব্যক্তি নারীদের জোরপূর্বক নিয়োগে নিজের সম্পৃক্ততার দাবি করেছিলেন, তিনি পরে সেই দাবি অস্বীকার করেন এবং বলেন যে, তিনি আসলে এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। এরপর কয়েকজন সরকারি কর্মকর্তা ১৯৯৩ সালের ক্ষমাপ্রার্থনার বিবৃতিটি সংশোধন করার বিষয়ে আলোচনা শুরু করেন, তবে আন্তর্জাতিক চাপের (যেমন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে) কারণে সেই ধারণা দ্রুত পরিত্যাগ করা হয়। ২০১৪ সালে আবে সরকারের পক্ষ থেকে জাতিসংঘকে (UN) ১৯৯৬ সালের রিপোর্টটি সংশোধন করার অনুরোধ করা হয়, তবে জাতিসংঘ কর্মকর্তারা দ্রুত সেই অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেন।

২০১৫ সালে দক্ষিণ কোরিয়া এবং জাপানের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যেখানে জাপান ১ বিলিয়ন ইয়েন প্রদান করে এবং উভয় দেশ ঘোষণা করে যে এই ইস্যুটি “চূড়ান্তভাবে এবং অপরিবর্তনীয়ভাবে” সমাধান হয়েছে। জাপান সরকারও ক্ষমা চায় এবং কমফোর্ট উইমেনদের মানসিক ক্ষত নিরাময়ের জন্য সহায়তা প্রদানের জন্য একটি ফাউন্ডেশন স্থাপনের প্রতিশ্রুতি দেয়।তবে, চুক্তিটি দক্ষিণ কোরিয়ায় ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয়, বিশেষ করে কমফোর্ট উইমেনদের অনেকেই এটিকে টাকা দিয়ে সমস্যার সমাধান করার চেষ্টা হিসেবে দেখেন এবং আরও আন্তরিক ক্ষমাপ্রার্থনা ও সরাসরি পুনঃপ্রতিষ্ঠার দাবি করেন। ২০১৭ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার নতুন প্রেসিডেন্ট মুন জে-ইনের প্রশাসন চুক্তিটি পুনঃমূল্যায়ন করে এবং ফাউন্ডেশনটি ২০১৯ সালে ভেঙে দেয়, যা কার্যত চুক্তির অবসান ঘটায়।

এছাড়াও, জাপানে এই ইস্যুটি নিয়ে বিভিন্ন বিতর্ক হয়, বিশেষত ডানপন্থী রাজনীতিবিদরা দাবি করে যে নারীদের জোরপূর্বক নিয়োগের প্রমাণ নেই, যা ঐ চুক্তির লক্ষ্যকে নষ্ট করেছে। আন্তর্জাতিক চাপের পরেও, এই ইস্যুতে দুই দেশের মধ্যে এখনও পরিপূর্ণ সমাধান আসেনি। ২০২০ সাল পর্যন্ত, কমফোর্ট উইমেনদের অধিকাংশই চুক্তিতে প্রদত্ত অর্থ গ্রহণ করলেও, ইস্যুটিতে দুই দেশের মধ্যে রাজনৈতিক বিতর্ক ও সামাজিক অস্থিরতা এখনও অব্যাহত আছে, এবং এটি সমাধান হয়নি। ২০২৩ সালে সিউলের উচ্চ আদালত একটি ঐতিহাসিক রায় দেয়, যেখানে জাপানকে অবশিষ্ট কমফোর্ট উইমেনদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। এই মামলাটি ২০১৬ সালে দায়ের করা হয়েছিল, কিন্তু প্রথমে নিম্ন আদালত এটি রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের ভিত্তিতে বাতিল করে। তবে উচ্চ আদালত সিদ্ধান্ত দেয় যে, মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য আন্তর্জাতিক আইনে সার্বভৌমত্বের কোনো রক্ষাকবচ নেই। এটি জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার মধ্যে সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি বড় প্রভাব ফেলেছে, বিশেষ করে যখন কূটনৈতিক সম্পর্ক উন্নত করার প্রচেষ্টা চলছে। এছাড়াও, ২০১৫ সালের চুক্তির সীমাবদ্ধতার কারণে, আরও মামলাগুলো দায়ের করা হয় এবং অনেক ভুক্তভোগী চুক্তিটি যথেষ্ট নয় বলে দাবি করেন, কারণ এতে জাপানের দায়িত্ব পর্যাপ্তভাবে স্বীকার করা হয়নি। এই পরিস্থিতি জাপান এবং দক্ষিণ কোরিয়ার মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যাটি সমাধানের পথে বাধা তৈরি করেছে।

তথ্যসূত্র –

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.