অমুসলিমের সাথে বন্ধুত্ব, শায়খ আহমাদুল্লাহ, সম্পর্কিত ধর্মতাত্ত্বিক অবস্থানসমূহ

মুতাযিলাদের মতে কোরান নিত্য নয়, অর্থাৎ চিরকালই এটা ছিলনা। সবকিছুর মত আল্লাহ্‌ তার বাণী বা কালামকেও, মানে কোরানকেও সৃষ্টি করেছে। কোরানকে নিত্য বা অসৃষ্ট বলার অর্থ হবে আল্লাহর সাথে কোরানের সহনিত্যতা যা বহুঈশ্বরবাদিতা ও শিরক হয়ে যায়। কোরানকে কোন এক সময়ে আল্লাহ্‌ তার ন্যায়পরায়ণতার ভিত্তিতেই সৃষ্টি করেছেন, তাই কোন কিছু কোরানে আছে বলে তা নৈতিক নয়, তা নৈতিক বলেই কোরানে আছে। কোরান না পড়েও সেই ন্যায় কাজ করা যায়, আর আল্লাহ্‌কে ন্যায়পরায়ণ হতেই হয়, কারণ সেটার বিরুদ্ধে গিয়ে আল্লাহ্‌র দ্বারা কোন কাজ করা তার মানে নিজেরই বিরুদ্ধে যাওয়া, আল্লাহ্‌ তাই নিজের ন্যায়পরায়ণতার বিরুদ্ধে গিয়ে কাউকে ক্ষমাও করতে পারেননা, কারও সুপারিশ বা শাফাহ্‌ও গ্রহণ করতে পারেননা। ইহজগতে মানুষ যা করে তাতে আল্লাহ্‌র কোন হাত থাকতে পারেনা, কারণ আল্লাহ্‌ অন্যায় কিছু করতে পারেনা, এসব কাজের দায় সব মানুষেরই, এর পরিণাম সৃষ্টির জন্যেও মানুষই দায়ী, যদিও আল্লাহ্‌ বিশেষ কিছু ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করে থাকেন মাত্র পৃথিবীর স্বাভাবিক গতির ব্যতিক্রম তৈরিতে যেমন নবী-রাসুল প্রেরণ।

সেই সময় ইসলামের রক্ষণশীল ধারা যেমন হাম্বলী সম্প্রদায়, আহলে হাদিসের মত অক্ষরবাদীদের মতে, মুতাযিলাদের এই ধর্মতত্ত্ব মানুষকে স্বাধীন করে আল্লাহ্‌র সার্বভৌমত্বের হ্রাস ঘটায়, তাকে একটা মেকানিকাল সিস্টেমে পরিণত করে যেখানে আল্লাহ বিশেষ ন্যায়পরায়ণতার নিয়মে বন্দী, যার বাইরে তিনি যেতে পারেননা, ইচ্ছা হলেও নিজের আইনের বিরুদ্ধে গিয়ে ক্ষমা করতে পারেননা। এই অবস্থায় দুই অবস্থানের মধ্যবর্তী অবস্থান হিসেবে আশ’আরী, হানিফা, মাতুরিদিদের মত তাত্ত্বিকদের আগমন। হানাফি সম্প্রদায়ের হানাফি মাজহাবে মূলত আশারি ও মাতুরিদির দেয়া আশারি ও মাতুরিদি আকিদা গৃহীত হয়। ভারতবর্ষের হানাফিদের মধ্যে মাতুরিদি আকিদাই চলে। এই দুই আকিদার মধ্যে পার্থক্য মূলত মানুষের স্বাধীন ইচ্ছার ক্ষেত্রেই, কোরানের সৃষ্টতা প্রসঙ্গে দুটো মোটামুটি একমত। এখানে বলা হয়, আল্লাহ্‌র বাণী বা কালাম সৃষ্ট নয়, বরং নিত্য, যা দেশ-কালের ঊর্ধ্বে, সবসময়ই আছে। এর দুটো স্তর আছে কালাম নাফসি ও কালাম লাফজি। কালাম নাফসি আল্লাহ্‌র জ্ঞানের সাথে চিরন্তনভাবে যুক্ত, গুণাবলীর অংশ, যা সময়, স্থান, এবং মানুষের বোধগম্যতার বাইরে ও মানুষের কাছে এটি সম্পূর্ণভাবে উপলব্ধি করা অসম্ভব। (সুফিরা অবশ্য মনে করেন জিকর, ধ্যান, আধ্যাত্মিক পথনির্দেশনার দ্বারা ইলহাম বা কাশফের মাধ্যমে মারিফা বা ফানা লাভ করতে পারে যাকে কালাম নাফসির একটি প্রতিফলন বা আভাস বলা যায়)। এদিকে কালাম লফজি হলো সেই চিরন্তন কালাম নাফসির একটি বাস্তবিক এবং ভাষাগত প্রকাশ, যা মানুষের কাছে একটি নির্দিষ্ট প্রেক্ষাপটে প্রকাশিত রূপ, যা মানুষের কাছে বোধগম্য, যাকে আল্লাহ্‌ মানুষের জন্য বোঝার উপযোগী করে নির্দিষ্ট পেক্ষাপটে পৃথিবীতে পাঠান।

কালাম লাফজি মানুষের কাছে আসে তানযিল বা রিভিলেশনের মাধ্যমে। এভাবেই আশারিয়া ও মাতুরিদি আকিদায় মনে করা হয়, আল্লাহর কালাম চিরকালীন হলেও, এর প্রকাশ মানব ইতিহাসের নির্দিষ্ট মুহূর্তে নির্দিষ্ট প্রেক্ষাপটে ঘটে। আর এভাবে এই প্রেক্ষাপট বা সিয়াক (context) কোরানের আয়াতগুলিকে একটি নির্দিষ্ট ঘটনা, চ্যালেঞ্জ বা পরিস্থিতির সাথে সংযুক্ত করে, যা সেই সময়ে মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এজন্যই কালাম লাফজিকে, তথা নাযিলকৃত কোরানকে বোঝার জন্য শুধু কোরানের কথা নয়, সিয়াক বা কনটেক্সট বুঝতে হবে, কারণ কালাম লাফজির ধারণার মধ্যেই বিশেষ পরিস্থিতিতে এর তানযিলের ব্যাপারটি জড়িত। তাই সিয়াক ছাড়া কোরানের অর্থ বোঝা সম্ভবই নয়। আশারিয়া ও মাতুরিদিরা কোরান বোঝায় যে কনটেক্সট বা সিয়াকের গুরুত্ব নিয়ে আসছে তা বিচার-বুদ্ধি বা আকল প্রসূত। আর তারা এই বিচার-বুদ্ধির প্রয়োগের ব্যাপারটিকে কোরানের বিভিন্ন আয়াত দিয়েই জাস্টিফাই করে, যেমন “নিশ্চয়ই আল্লাহর কাছে সবচেয়ে নিকৃষ্ট জীব তারা যারা বধির, মূক এবং বিচার-বিবেচনা করে না।” (আল-আনফাল ৮:২২), “আমি তোমার প্রতি (ওহি) নাজিল করেছি, যাতে তুমি মানুষদের কাছে যা তাদের প্রতি অবতীর্ণ হয়েছে তা স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করতে পার এবং তারা চিন্তা করতে পারে।” (আন-নাহল ১৬:৪৪)।

এই ব্যাপারটা রক্ষণশীল অক্ষরবাদীরা মানতে পারেনি। তারা বরাবরই বিচার-বুদ্ধির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। হাম্বল সম্প্রদায় প্রথমে ইজমা (বিতর্কিত বিষয়ে শেষ পর্যন্ত সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত) ও কিয়াসের (সাদৃশ্যানুমানিক (analogical) যুক্তি) বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। ইজমা কোরান ও হাদিসের বিরােধী নয়, বরং এদেরই ব্যাখ্যা ও সম্প্রসারণমূলক পরিপূরক নীতি যা কোরান ও হাদিসে স্বীকৃত। কিয়াস হচ্ছে পূর্ববর্তী কোনাে ঘটনায় প্রযুক্ত নীতিকে পরবর্তী কোনাে নতুন সদৃশ ঘটনার বেলায়ও প্রযােজ্য ধরার নীতি। এই ইজমা ও কিয়াসে বিচার-বুদ্ধির প্রয়োগ বলে তা কোরান-হাদিসের বক্তব্যকে কলুষিত করে বলে ইবনে হাম্বল তা নাকোচ করে দেন। ইজতেহাদ নামে ইজমার একটি পরিপুরক নীতি আছে, যেখানে মুক্তবুদ্ধি বা স্বাধীন বিচার-বিশ্লেষণের মাধ্যমে এবং কোরান ও হাদিসের মূলনীতিমালার আলােকে ধর্মীয় সমস্যাবলির সমাধান করা হয়। একেও ইবনে হাম্বল রিডিউস করে কেবল কোরান, হাদিস ও সাহাবাদের মতামতে সীমাবদ্ধ রাখেন। তার মতে ব্যাখ্যার মাধ্যমে হাদিসের সংকোচন-প্রসারণ করা যাবেনা। তার মতে, বিনা প্রশ্নে ও নির্বিচারে কোনোকিছু মেনে নেয়ার মানসিকতা শুধু ধর্মীয় ব্যাপারে নয়, জীবনের সর্বক্ষেত্রে প্রযোজ্য। ধর্মীয় ব্যাপার নিয়ে আলোচনা করা তো অনুচিতই, এমনকি ধর্মবিরুদ্ধতা নিয়েও আলোচনা করা যাবেনা, পাছে যদি মানুষ ধর্মবিরোধিতা নিয়ে পাঠ করতে গিয়ে নিজেও ধর্মবিরোধী হয়ে যায়। ইবনে হাম্বলের কিছু শিষ্য আহ্‌লে হাদিস সম্প্রদায় তৈরি করে আর তারা সকল মাজহাব ও ফিকহ্‌ শাস্ত্রকেই নাকোচ করে দেয়, এমনকি হাম্বলী সম্প্রদায়কেও। তাদের মতে, কোরান হাদিসের সাথে অন্য কোন মতাদর্শের কোন আপস হতে পারে না, প্রত্যেক মুসলমানের উচিত কোরান ও সুন্নাহকে অবিকলভাবে অনুসরণ করা। কোরান ও হাদিস ইসলামি জীবনব্যবস্থার জন্য পর্যাপ্ত বলে ফিকাহশাস্ত্রের দরকার নেই। পরবর্তীতে ইবনে হাজাম ও ইবনে তাইমিয়া এই অক্ষরবাদকে আরও বেশি প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। তাইমিয়ার মতে, কোরান ও হাদিসে ফিরে যেতে হবে, সবরকম অভিনবত্ব (বিদাহ) এর বিরোধিতা করতে হবে, ইসলামে ধর্মতাত্ত্বিক বিতর্ক ও দর্শনের কোনো স্থান নেই, ধর্মতাত্ত্বিকদের প্রকাশ্যে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া উচিত। এই অক্ষরবাদী ধারার আকিদাটাই আথারি বা আছারি নামে পরিচিত। সালাফি, ওয়াহাবিরা এটাই অনুসরণ করে। জামায়াতে ইসলামীর প্রতিষ্ঠাতা সৈয়দ আবুল আলা মওদুদিও ইবনে তাইমিয়ার ধারাটাকেই অনুসরণ করেছেন।

যাই হোক এমন না যে অক্ষরবাদী বা আথারিরা প্রেক্ষাপট বা সিয়াককে একেবারে গুরুত্বই দেয়না। তারা কোরান ও হাদিসের স্পষ্ট আক্ষরিক অর্থকে অনেক বেশি গুরুত্ব দেবার কারণে প্রেক্ষাপট বা সিয়াকের ব্যাপারটাকে অনেক সংকুচিত করে ফেলে। আর প্রেক্ষাপট আক্ষরিক অর্থের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হলেই তাকে তারা গ্রহণ করে। তারা যেকোন রকম তাওয়িল বা রূপক ব্যাখ্যাও এড়িয়ে যায়, কারণ তাদের মতে কোরান-হাদিসে যা লেখা তা সরাসরি মানতে হবে। আর এই জায়গাগুলোতেই আশারিয়া ও মাতুরিদি আকিদার সাথে এর বিরোধ। কিন্তু সব কিছু আক্ষরিকভাবে নিলে অনেক প্র্যাক্টিকাল সমস্যা তৈরি হয়। যেমন, “নিশ্চয়ই তোমাদের জন্য রাসূলের মধ্যে উত্তম আদর্শ রয়েছে।” (আল-আহযাব ৩৩:২১) – এই আয়াতকে যদি আক্ষরিকভাবে নেয়া হয় তাহলে নবী মুহাম্মদের জীবনযাপনের প্রতিটি ছোট ছোট দিক যেমন—খাদ্যাভ্যাস, পোশাক, ও বসবাসের ধরনকেও আক্ষরিকভাবে অনুসরণ করতে হয়, যা সবার জন্য পালন করা অসম্ভব। “হে যারা ঈমান এনেছ! তোমাদের জন্য কিসাস (প্রতিশোধ) নির্ধারণ করা হয়েছে হত্যা সম্পর্কে।” (আল-বাকারাহ ২:১৭৮)। এখানে যে প্রতিশোধ গ্রহণের কথা বলা হয়েছে তাও বর্তমানে প্র্যাক্টিকাল নয়। বরং এই আয়াত নাজিলের সময়কার প্রেক্ষাপট বিবেচনা করেই এই প্রতিশোধ গ্রহণকে আধুনিক বিচার ব্যবস্থার আশ্রয় নেয়ার ব্যাপারটি দ্বারা প্রতিস্থাপনযোগ্য হতে পারে। যুদ্ধ এবং সহিংসতা, মহিলাদের শাসন ও নেতৃত্ব, অমুসলিমদের সাথে সম্পর্ক, শাস্তি ও প্রতিশোধ ইত্যাদি সম্পর্কিত আয়াতগুলো নিয়েও আথারি ও আশারি-মাতুরিদি ব্যাখ্যায় একই কারণে পার্থক্য দেখা যাবে।

শায়খ আহমাদুল্লাহ-এর ছবি ফলাফলহিন্দুদের সাথে বন্ধুত্ব করা যাবে কিনা সেই ব্যাপারে আস সুন্নাহ ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা শায়খ আহমাদুল্লাহর বক্তব্যটি বেশ ভাইরাল হয়েছে। উইকিপিডিয়ায় দেখলাম তার মাজহাবে হানাফি সালাফি লেখা। সালাফিরা আথারি আকিদা অনুসরণ করে। উইকিপিডিয়ায় তার নামও দেয়া আছে “Shaykh Ahmadullah Al Athari”, আথারি বা আছারি আকিদার অনুসারীরারাই নামের শেষে আছারি বা Al Athari যুক্ত করে। তিনি যার সাথে আলোচনা করে মুগ্ধ হয়ে বাংলাদেশে কাজ করতে এসেছিলেন সেই খন্দকার আবদুল্লাহ্‌ জাহাঙ্গীরও আথারি ছিলেন। অনেকেই বলেন শায়খ আহমাদুল্লাহ্‌র কথায় তারা লেইট খন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীরের ছায়া পান। যাই হোক, শায়খ আহমাদুল্লাহ্‌ যদি আথারি হয়ে থাকলে তিনি কোরানের অমুসলিমদের সাথে বন্ধুত্ব নিয়ে আয়াতের ক্ষেত্রেও আক্ষরিকতাই গ্রহণ করবেন, সিয়াক বা কন্টেক্সটকে আক্ষরিকতার অনুগামী বিচার করবেন, আর তিনি তাই করেছেন।

কোরানে অমুসলিমদের সাথে বন্ধুত্ব নিয়ে যতগুলো আয়াত দেখা যায় সেগুলোর বেশিরভাগই মাদানি সুরার, মানে মুহম্মদ মদিনায় যাবার পর সেগুলো নাযিল হয়। একটা পাই মক্কী সুরার, মানে সেটা মক্কায় থাকার সময় নাযিল হয়। মদিনা পর্বে, যখন মুসলমানরা মদিনায় হিজরত করেছিল, আয়াতগুলিতে মুসলিম রাষ্ট্র গঠনের নির্দেশনা ও অন্যান্য ধর্মের সাথে সম্পর্কের বিষয়ে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। মদিনায় ইসলামিক সমাজ প্রতিষ্ঠার পর মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ দেখা দেয়। ইহুদি, খ্রিস্টান, এবং মুশরিক (বহু-ঈশ্বরবাদী) সম্প্রদায়ের সাথে তাদের সম্পর্ক এবং সামাজিক নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে নির্দেশনামূলক আয়াতগুলি এ সময় নাযিল হয়েছিল। মদিনার ইহুদি সম্প্রদায় এবং আশেপাশের আরব গোত্রগুলোর সঙ্গে মুসলিম সম্প্রদায়ের বিভিন্ন দ্বন্দ্ব ও সম্পর্ক এসব আয়াতের নাযিল হওয়ার প্রেক্ষাপট হিসেবে কাজ করেছে। অমুসলিমদের সাথে বন্ধুত্ব নিয়ে মাদানি সুরাগুলোতে মুমিনদেরকে আউলিয়া হিসেবে গ্রহণ করতে নিষেধ করা হচ্ছে। যেমন, একটি মাদানি সুরা হচ্ছে, “বিশ্বাসীরা অবিশ্বাসীদেরকে তাদের আউলিয়া হিসেবে গ্রহণ না করুক বরং বিশ্বাসীদের মধ্যে থেকে তা করুক। আর তোমাদের মধ্যে যারা এমনটি করবে, তার সাথে আল্লাহর কোন সম্পর্ক নেই, তবে যদি তাদের থেকে সাবধানতার কারণে কিছুটা প্রতিরক্ষা গ্রহণ করা হয়। আর আল্লাহ তোমাদেরকে নিজের সম্পর্কে সাবধান করছেন, এবং আল্লাহর কাছেই চূড়ান্ত গন্তব্য।” (আল ইমরান ৩:২৮)।

এখন এই আয়াতগুলোর ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে আথারিরা আউলিয়া শব্দটিকে আক্ষরিকভাবে গ্রহণ করে একে ব্যাপকভাবে “বন্ধু,” “অভিভাবক,” “সহযোগী,” বা “মিত্র” হিসেবে ব্যাখ্যা করে (মাদানি সুরাগুলোতে আউলিয়া শব্দটিই ব্যবহৃত হয়েছে), আর তাদের মতে, এই আয়াতটি মুসলমানদের জন্য একটি স্পষ্ট নির্দেশনা প্রদান করে যে, তারা যেন অমুসলিমদের সাথে গভীর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বা এমন সহযোগিতা না গড়ে তোলে, যেহেতু তা তাদের ধর্মীয় বিশ্বাস ও অনুশীলনের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। কিন্তু আশারিয়া ও মাতুরিদিরা ভিন্নভাবে এই আয়াতগুলোকে ব্যাখ্যা করেন, অবশ্যই সিয়াক বা প্রেক্ষাপটকে বিবেচনায় নিয়ে। উদাহরণ দেয়া যাক। আল ইমরান ৩:২৮ এর তাফসিরে আশারিয়া তাত্ত্বিক আল-কুশায়রি আউলিয়াকে প্যাট্রন, অর্থাৎ অভিভাবক, পৃষ্ঠপোষক অর্থ করেছেন, আর বলেছেন অবিশ্বাসীদের মধ্যে এমন কারও সাথে বন্ধুত্ব করা যাবে না যা তাকে তার নিজের লোয়ার সেলফ বা নফস আল আম্মারার বশবর্তী করে ফেলে, যেখানে ব্যক্তি শুধু আমার দ্বারা, আমার মাধ্যমে – এরকম ইগোতে ভোগে, ঠিক এই অবস্থাতেই আল্লাহ্‌ সেই ব্যক্তির নাগালের বাইরে চলে যায়। সেই সাথে তিনি বলেছেন, এটা কেবল তাদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হবে যারা মারিফার জন্য আধ্যাত্মিকতার চর্চা করেন, কারণ তাদের ক্ষেত্রেই আল্লাহ্‌র নিকটে আসার ব্যাপারটি প্রাসঙ্গিক। আল-কুশায়রি এখানে অবিশ্বাসীদের মধ্যে এমন ব্যক্তিদেরকে সঙ্গী হিসেবে গ্রহণ করতে সতর্কতার কথা বলছেন যা বিশ্বাসীদেরকে বিপথে চালিত করতে পারে। আরেক আশারিয়া তাত্ত্বিক আল জালালাইনও একই কথা বলছেন। অন্যদিকে মাতুরিদি তাত্ত্বিক আল কাশিয়ানির কাছে এই আউলিয়া এর অর্থ কমরেডের মত, যাদের মধ্যে আদর্শগত মিল আছে। কাশিয়ানি এখানে অবিশ্বাসীর আদর্শের দ্বারা কলুশিত হওয়াটাকেই আল্লাহ্‌র থেকে দূরে সরে যাবার শর্ত হিসেবে উল্লেখ করছেন। এই ব্যাপারটা কমরেডদের বেলাতে ঘটতে পারে যেখানে সম্পর্কটা আদর্শিক মিলের, যেখানে আদর্শিক মিল না থাকার পরও কমরেড থাকাটা হয় ভণ্ডামি নয় বিপথগামিতা নির্দেশ করে। কিন্তু ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্বের বেলায় তো আদর্শিক মিলের কনসেপ্টটা নেসেসারি নয়।

মক্কী সুরার অমুসলিমদের সাথে বন্ধুত্ব নিয়ে আয়াতটা হলো – “তুমি আশা করো না যে এই কিতাব তোমার মধ্যে অনুপ্রাণিত হবে; কিন্তু এটি তোমার প্রভুর দয়া, তাই তুমি কখনো অবিশ্বাসীদের সহায়ক (তহীরান) হবে না।” (আল কাসাস ২৮:৮৬)। এই আয়াতের সময়টাও মুসলিমদের জন্য বেশ কঠিন ছিল। তারা মক্কার অবিশ্বাসীদের দ্বারা বিরোধিতার শিকার হয়েছিল, কুরাইশ নেতারা তাদেরকে সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে বয়কট করেছিল, মুসলিমদেরকে ঈমান থেকে বিচ্যুত হবার জন্য চাপ দিচ্ছিল। আথারিরা এই আয়াতকেও অমুসলিমদের সাথে বন্ধুত্ব না করার নির্দেশনা হিসেবে গ্রহণ করে। কিন্তু আশারিয়া ও মাতুরিদিরা সেই সময়কার প্রেক্ষাপট বা সিয়াক বিবেচনা করে এর অর্থ ভিন্নভাবে বিবেচনা করেন। যেমন আশারিয়া তাত্ত্বিক আল জালাইলিন বলছেন, এর দ্বারা অমুসলিমরা মুসলিমদেরকে যে তাদের ঈমান থেকে বিচ্যুত করার জন্য চেষ্টা করছিল তাদের পূর্বেকার ধর্মে ফিরিয়ে নেবার চেষ্টার মাধ্যমে, মুসলিমদের সেটা থেকে বিরত থাকতে বলা হচ্ছে। মানে এখানে সহায়ক বা তহীরান এর অর্থ হচ্ছে অমুসলিমদের দ্বারা ঈমান থেকে বিচ্যুতির কাজে সহায়ক হওয়া।

যেসব আশারিয়া ও মাতুরিদি তাফসিরের কথা বললাম সেগুলোর লিংক কমেন্টে দিয়ে দেব। আমার এই পোস্টের মূল বক্তব্য এটাই যে, অমুসলিমদের সাথে বন্ধুত্ব নিয়ে কোরানের আয়াতগুলোকে আথারিরা তাদের দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারেই ব্যাখ্যা করবেন, যেমনটা শায়খ আহমাদুল্লাহ করেছেন। এখন কেউ আয়াতকে গ্রহণ করুন বা সলালোচনা করুন, সেটাকেই সঠিক ধরে নেয়াটা হবে ইসলামকে একটি আকিদায় রিডিউস করে ফেলা। আর এভাবে কোন ধর্মকে এর বিশেষ একটি সেক্টের ব্যাখ্যায় রিডিউস করাটাই অর্থোডক্সি-অর্থোপ্র্যাক্সি বা গোড়ামি হচ্ছে যা অনুচিৎ। ইসলাম মানে কেবল আথারি আকিদা নয়, এখানে আশারিয়া, মাতুরিদি আকিদাও বিবেচ্য, এমনকি মুতাযিলা আকিদাও (ভারতীয় উপমহাদেশে মাতুরিদি আকিদাটাই প্রধান)। তবে যারা আথারি তারা তাদের ভাষ্য মতেই ধর্মের ব্যাখ্যা করে যাবেই। সেক্ষেত্রে আমার সাজেশন হচ্ছে এই বক্তাদেরকে অন্ধভাবে অনুসরণ না করা, ও তারা কোন ধর্মতাত্ত্বিক অবস্থানগুলো থেকে এই ব্যাখ্যাগুলো প্রদান করছেন সেগুলো বিবেচনা করা ও খোদ সেই ধর্মতাত্ত্বিক অবস্থান বা আকিদাগুলো নিয়ে বিচার করা।

তথ্যসূত্র

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.