Table of Contents
পুঁথিসাহিত্যের পরিচয়
আঠারো শতকের শেষার্ধে আরবি-ফারসি শব্দযুক্ত এক বিশেষ ভাষাশৈলীতে যে কাব্য রচিত হয়েছিল, তা বাংলা সাহিত্যে পুঁথি সাহিত্য নামে পরিচিত। ১৭৬০ থেকে ১৮৬০ সাল পর্যন্ত এই সংকটকালে বাংলা সাহিত্যের বৈশিষ্ট্য কবিওয়ালাদের কবিগান ও মিশ্র ভাষারীতির কাব্যরচনাকারী শায়েরদের অবদানের মাধ্যমে গঠিত হয়। মধ্যযুগের শেষের দিকেই এই ধারার সূচনা ঘটে এবং আধুনিক যুগের শুরু হওয়ার পরও এর অস্তিত্ব বজায় থাকে। একসময় গ্রামীণ মুসলমান সমাজে এটি বেশ জনপ্রিয় ছিল। পুঁথিপাঠ তখন চিত্তবিনোদনের আকর্ষণীয় একটি মাধ্যম হিসেবে প্রচলিত ছিল, যা আজও পুরোপুরি হারিয়ে যায়নি।
পুঁথিসাহিত্য প্রসঙ্গে ড. মুহম্মদ এনামুল হক লিখেছেন, ‘ইংরেজ আমলের গোড়া থেকে রাজনৈতিক কারণে মুসলমানেরা বিমাতাসুলভ ব্যবহার পেতে থাকে এবং হিন্দুরা ইংরেজদের হাতে প্রাধান্য লাভ করে। ফলে, নিম্নবঙ্গের সাধারণ মুসলমানেরা তাদের বাংলা ভাষাকে হিন্দুদের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রাধান্যের প্রতিবাদস্বরূপ ফারসি ও উর্দু ভারাক্রান্ত করে এক স্বতন্ত্র ভাষার সৃষ্টি করতে থাকেন। এই ভাষা ওহাবী বা ফরায়েজী আন্দোলন থেকে শক্তি সঞ্চয় করে এবং এক বিশাল ধর্মীয় সাহিত্য সৃষ্টির প্রচেষ্টা পায়। কলকাতার বটতলার কল্যাণে হাওড়া, হুগলী ও চব্বিশ পরগনার মুসলমানেরা এই সাহিত্য মুদ্রিত করে দেশে ছড়িয়ে ভাল ব্যবসা ফাঁদতে বসে। … এতে সাহিত্য আছে, রস আছে, শিল্পও আছে তবে, তার বেশিরভাগই মোগলাই।’ (চলিতায়িত)
পুঁথিসাহিত্য নামে চিহ্নিত এই সাহিত্যের নামকরণে যথেষ্ট মতানৈক্য পরিদৃষ্ট হয়। ১৮৫৫ সালে প্রকাশিত রেভারেন্ড জে. লং-এর পুস্তক তালিকায় এই শ্রেণির কাব্যকে মুসলমানি বাংলা সাহিত্য এবং এর ভাষাকে মুসলমানি বাংলা বলা হয়েছে। ১৮৮৫ সালে এক গ্রন্থ তালিকায় ব্ল্যুমহার্ট একই নাম অনুসরণ করেছেন। পরবর্তী পর্যায়ে ড. দীনেশচন্দ্র সেন, ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় ও ড. সুকুমার সেনের মত পণ্ডিতেরা এই নামই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ব্যবহার করেছেন। কিন্তু বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে কথ্য ভাষারীতি হিসেবে এই ভাষার সমাদর সম্পর্কে সন্দেহ আছে। ড. আনিসুজ্জামান তার ‘মুসলিম মানস ও বাংলা সাহিত্য’ গ্রন্থে এই শ্রেণির কাব্যের নাম সম্পর্কে যে আলোচনা করেছেন তা উল্লেখ করা হল: ‘কলকাতার সস্তা ছাপাখানা থেকে মুদ্রিত হয়ে এই ধারার কাব্য দেশময় প্রচারিত হয়েছিল বলে বটতলার পুঁথি নামেও একে চিহ্নিত করার প্রচেষ্টা চলেছে। সেটাকে সুভাষিত করতে যেয়েই বোধ হয় পুঁথিসাহিত্য কথাটির উদ্ভব হয়। পুঁথি-সাহিত্য বা পুথিসাহিত্য বলে একে যথার্থ ভাবে চিহ্নিত করা চলে না। কেননা, আধুনিক কালে বই বলতে আমরা যা বুঝি আগে পুথি বা পুঁথি বলতে তাই বোঝাত। সুতরাং ‘বইসাহিত্য’ কথাটার মত ‘পুঁথিসাহিত্য’ কথাটাও অর্থহীন। পুঁথি শব্দটাকে সংকীর্ণ অর্থে Manuscript বলেও গণ্য করা হয়। এই প্রয়োগ সন্তোষজনক কিনা, সে বিতর্কে প্রবৃত্ত না হয়েও বলা যায় যে, পুঁথি শব্দের এই সীমাবদ্ধ ব্যবহারও আমাদেরকে পুঁথিসাহিত্য কথাটির অর্থ গ্রহণে কোন সাহায্য করে না। কেননা, ছাপা হবার পরই এই কাব্যগুলো সারা দেশে ছড়িয়ে গিয়ে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল।’
কিছু গবেষক এই ধরনের কাব্যকে আরবি-ফারসি শব্দের ব্যাপক ব্যবহারের কারণে ‘দোভাষী পুঁথি’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তবে এই ভাষায় শুধু দুটি ভাষাই নয়, বরং বাংলা, হিন্দি, ফারসি, আরবি, ও তুর্কি ভাষার শব্দগুলির মিশ্রণ ঘটেছে। এ প্রসঙ্গে ড. আনিসুজ্জামান মন্তব্য করেছেন, ‘বিদেশি শব্দের প্রাচুর্যের কথা বিবেচনা করে এটিকে মিশ্র ভাষা বলা অসংগত নয় এবং সেই হিসেবে এই কাব্যধারাকেও মিশ্র ভাষারীতির কাব্য বলা যেতে পারে।’ তবে ড. আহমদ শরীফ এই সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত না হয়ে উল্লেখ করেছেন যে, আরবি শব্দ ফারসির মাধ্যমে এসেছে, আর ফারসি ও তুর্কি শব্দ মিলিয়ে গঠিত হয়েছে উর্দু ভাষা, যার প্রভাব হিন্দি ভাষায়ও রয়েছে। এ দুটোর আদি ও সাধারণ নাম ছিল হিন্দুস্থানি। তার মতে, ‘এই হিন্দুস্থানি তথা উর্দুর সঙ্গে বাংলার মিশ্রণে আমাদের দোভাষী রীতি গড়ে উঠেছে। সুতরাং, দোভাষী রীতিই এই ভাষার জন্য উপযুক্ত ও যথার্থ অভিধা।’
মধ্যযুগের মুসলমান কবিদের রচিত কাব্যগুলো যখন স্থূল আকার, পরিশ্রুত ও সংস্কৃতঘেঁষা ভাষার কারণে জনপ্রিয়তা হারায়, তখন দোভাষী পুঁথি তার সংক্ষিপ্ত আকার, সহজ ভাষা এবং স্থূল রসিকতার গল্পের জন্য জনপ্রিয়তা অর্জন করে। এর পাশাপাশি প্রশাসকদের পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে এবং ছাপাখানার মাধ্যমে সহজলভ্য হয়ে ওঠে। ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে, দোভাষী পুঁথিতে শতকরা বত্রিশটি শব্দ হিন্দুস্থানি হওয়ার কারণে এটি সহজেই জনপ্রিয়তা লাভ করে।
পুঁথি সাহিত্যের ভাষার বৈশিষ্ট্য হলো আরবি-ফারসি-হিন্দি শব্দের ব্যাপক ব্যবহার, আরবি-ফারসি শব্দের নামধাতুরূপে ব্যবহার এবং হিন্দি ধাতুর প্রয়োগ, অনুসর্গ ও উপসর্গ হিসেবে বাংলা, আরবি, ফারসি, এবং হিন্দি শব্দের প্রয়োগ, ফারসি বহুবচনের ব্যবহার, এবং পুংলিঙ্গে বাংলা স্ত্রীবাচক শব্দের প্রয়োগ। এতে আরবি, ফারসি, হিন্দি শব্দ, প্রত্যয়, বাক্য বা বাক্যাংশের সঙ্গে বাংলাকে মিশিয়ে একটি কৃত্রিম ভাষারীতি হিসেবে গঠন করা হয়েছে।
বিষয়বস্তু অনুসারে পুঁথি সাহিত্যকে কয়েক ভাগে বিভক্ত করা যায় –
- ১. প্রণয়োপাখ্যান জাতীয় কাব্য: ইউসুফ-জোলেখা, সয়ফুলমুলুক-বদিউজ্জামাল, লায়লী- মজনু, গুলে- বকাওলী ইত্যাদি।
- ২. যুদ্ধ সম্পর্কিত কাব্য: জঙ্গনামা, আমীর হামজা, সোনাভান, কারবালার যুদ্ধ ইত্যাদি।
- ৩. পীর পাঁচালি গাজী-কালু চম্পাবতী, সত্যপীরের পুঁথি ইত্যাদি।
- ৪. ইসলাম ধর্ম, ইতিহাস নবী-আউলিয়ার জীবনী ও বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠান সম্পর্কিত কাব্য: কাসাসুল আম্বিয়া, তাজকিরাতুল আউলিয়া, হাজার মসলা ইত্যাদি।
এসব বিষয়বস্তু থেকে লক্ষ করা যাবে যে, বিচিত্র ধরনের উপকরণ পুঁথি সাহিত্যের উপজীব্য হয়েছিল।
মধ্যযুগের শেষ পর্যায়ে এই কাব্যধারার উৎপত্তির পিছনে যুগের প্রভাব বিশেষভাবে কার্যকর ছিল। আঠারো শতকের শুরুর দিকে মোগল শাসনের শেষ সময়ে বাংলাদেশে ফারসি ভাষা ও সাহিত্যের ব্যাপক প্রভাব পড়ে। এই সময়ে ইরান থেকে আগত শিয়াদের মাধ্যমে ফারসি সংস্কৃতির বিকাশ ঘটে। বাংলাদেশে আগত ধর্মনেতা ও পীর-ফকিরদের শিক্ষার প্রেরণায় ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিপন্ন করার চেষ্টা চলতে থাকে। তখন ধর্মশাস্ত্রের অনুবাদ-অনুকরণ, ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে কাল্পনিক কাফের দলনকাহিনি, পীরের কাছে দেবদেবীর পরাজয় ও পীরের প্রতিষ্ঠালাভের উপাখ্যান বাংলায় রূপান্তরিত করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। ফারসির প্রভাব মূলত নগর-বন্দরগুলোতেই বেশি ছিল। হুগলি বন্দর এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হয়, এবং এখান থেকেই পুঁথি সাহিত্যের উদ্ভব ঘটে। আঠারো শতকে হুগলি সীমান্ত অঞ্চলে ভুরসুট-মান্দারনে বড়-খাঁ গাজী বা ইসমাইল গাজীর পীঠস্থানকে কেন্দ্র করে এই সাহিত্যের বিকাশ ঘটে।
এই ধারায় প্রথম কাব্য রচনা করেন পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগণার কবি কৃষ্ণরাম দাস ১৬৮৬-৮৭ সালে। তার কাব্যের নাম ‘রায়মঙ্গল’। তবে, মিশ্র ভাষারীতির প্রথম প্রয়োগের কৃতিত্ব অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষার্ধের কবি ফকির গরীবুল্লাহ্র। তিনি খ্যাতিমান কবি ছিলেন। তার মতোই সৈয়দ হামজা যথেষ্ট খ্যাতির অধিকারী হন। এরপর মালে মুহম্মদ, জনাব আলী, মুহম্মদ খাতের, আবদুর রহিম, মনিরুদ্দিন, আয়েজুদ্দিন, মুহম্মদ মুনশী, তাজউদ্দিন, দানেশ, আরিফ, রেজাউল্লাহ্, সাদ আলী, আবদুল ওহাব প্রমুখ প্রায় আড়াই শ শায়ের কয়েক শ কাব্য রচনা করেছেন।
উনিশ শতকের শেষ দিকে কলকাতা, হাওড়া ও হুগলি অঞ্চলের বাইরের কবিরাও এই শ্রেণির কাব্যরচনায় আত্মনিয়োগ করেন এবং এই ধারা সাম্প্রতিক কাল পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয়েছে। তবে গতানুগতিকতা ও নিম্নমানের কারণে এর জনপ্রিয়তা খুবই সীমিত হয়ে পড়েছে।
ফকির গরীবুল্লাহ্
পুঁথি সাহিত্যের প্রথম সার্থক ও জনপ্রিয় কবি ছিলেন ফকির গরীবুল্লাহ্। তিনি হুগলি জেলার বালিয়া পরগনার অন্তর্গত হাফিজপুর গ্রামের অধিবাসী ছিলেন। তার জীবনকাল সম্পর্কে সঠিক তথ্য পাওয়া যায় নি। গরীবুল্লাহ ছিলেন পীরের খানদান। তিনি বড় খাঁ গাজীর ভক্ত ছিলেন এবং গাজী অনুগ্রহ করে গোপনে তাকে সাক্ষাৎ দান করেছিলেন বলে কবি উল্লেখ করেছেন। কবির রচনায় ‘ফকির গরীব’, ‘গরীব’ ও ‘গরীব ফকির’ প্রভৃতি ভণিতা ব্যবহার করেছেন। তিনি আঠার শতকের মধ্যভাগে (কারও মতে ১৭৬০-৮০) কাব্য সাধনা করেছিলেন বলে মনে করা হয়। মিশ্র ভাষারীতিতে তার রচিত কাব্যগুলো হচ্ছে: ১. ইউসুফ-জোলেখা, ২. আমীর হামজা (প্রথম অংশ) ৩. জঙ্গনামা, ৪. সোনাভান এবং ৫. সত্যপীরের পুঁথি। রোমান্টিক প্রণয়োপাখ্যান, ছদ্মঐতিহাসিক যুদ্ধ কাহিনি এবং লৌকিক দেব বা পীর মাহাত্ম্যজ্ঞাপক পাঁচালি-মিশ্র ভাষারীতির এই তিনটি প্রধান ধারাই তিনি পুষ্ট করেছেন।
‘ইউসুফ-জোলেখা’ কাব্যে ফকির গরীবুল্লাহ্ কবিপ্রতিভার শ্রেষ্ঠত্বের পরিচয় দিয়েছেন। কুরআন শরীফ ও বাইবেলে ইউসুফ-জোলেখার কাহিনি নৈতিক উপাখ্যান হিসেবে ব্যক্ত হয়েছে। ফারসি সাহিত্যে ও বাংলায় এই কাহিনি নিয়ে কাব্য রচনাও বিদ্যমান। কবি ফারসি কাব্যের অনুসরণে তার কাব্য রচনা করেন। তবে তাতে তার নিজস্ব কৃতিত্বের পরিচয় মেলে। কাব্যে আল্লাহর মহিমা ও ফকিরীর মাহাত্ম্য প্রচার কবির উদ্দেশ্য ছিল। তবে প্রণয়কাব্য হিসেবে এর মূল্যও কম নয়। বাংলার লৌকিক প্রভাব এ কাব্যে বিশেষভাবে লক্ষ করা যায়। প্রণয়াবেগ রূপায়ণে তার বিশিষ্টতা ছিল।
রূপবর্ণনায় কবি মধ্যযুগের প্রণয়কাব্যের রীতি অনুসরণ করেছেন। এমন কি ভাষা ব্যবহারেও মিশ্র ভাষারীতির সীমানা অনেকাংশে ছাড়িয়ে গেছেন। যেমন:
পূর্ণিমার চন্দ্র যেন মুখের ছুরাত।
ত্রিভুবন জিনে দেখি রূপের মুরাত ॥
ময়ূরের পর জিনে কেশ মাথা পরে।
রাহু যেন গ্রাসিল আসিয়া চাঁদেরে ॥
ত্রিভঙ্গ নয়ন যেন খঞ্জনের আঁখি।
ভুবন ভুলাতে নারে সেই রূপ দেখি ॥
দুই খানি ঠোঁট যেন কমলের ফুল।
তাহার বদন যেন চাঁদ সমতুল ॥
বত্রিশ দন্ত দেখি যেন মুক্তার হার।
বিদ্যায় পণ্ডিত যেন সরস্বতী পার ॥
‘আমীর হামজা’ ফকির গরীবুল্লাহর আরেকটি কাব্য, তবে তিনি কাব্যটির প্রথমাংশ মাত্র রচনা করেছিলেন। পরে সৈয়দ হামজা কাব্যটি সমাপ্ত করেন। ফারসি ও উর্দু সাহিত্যে আমীর হামজার কাহিনি কাব্য আকারে রূপায়িত হয়েছিল, এবং ফকির গরীবুল্লাহ্ সেই কাহিনিগুলির অনুসরণে এটি বাংলায় রচনা করেন। ‘আমীর হামজা’ কাব্যে ইরানের শাহ নওশেরওয়ানের সঙ্গে নবী মুহাম্মদের চাচা আমীর হামজার যুদ্ধকাহিনি বর্ণিত হয়েছে, যেখানে পুঁথি সাহিত্যের বৈশিষ্ট্য অনুসারে অলৌকিক ঘটনাগুলিও স্থান পেয়েছে।
‘জঙ্গনামা’ ফকির গরীবুল্লাহর অন্যতম বিশিষ্ট কাব্য। এই কাব্যের মূল উপজীব্য হলো কারবালার বিষাদময় কাহিনি। ফারসি কাব্যের অনুপ্রেরণায় কবি এই জঙ্গনামা রচনা করেছিলেন। কাব্যটিতে একদিকে যুদ্ধের বর্ণনা যেমন রয়েছে, অন্যদিকে তেমনি গভীর বেদনার সুরও ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। কবির কল্পনা বাস্তবতার সীমা অতিক্রম করে নানা অলৌকিক বিষয় তুলে ধরেছে, যেখানে অসাধারণ বীরত্ব ও অস্বাভাবিক বীরবিক্রম বড় হয়ে উঠেছে। কারবালার এই একই কাহিনি অবলম্বনে আরও অনেক ‘জঙ্গনামা’ কাব্য রচিত হয়েছিল। কবি মোহাম্মদ খানের ‘মকতুল হোসেন’ এই ধরনের আরেকটি কাব্য। কবি হায়াত মামুদ, শফিউদ্দীন প্রমুখও ‘জঙ্গনামা’ কাব্য রচনা করেছিলেন, তবে ফকির গরীবুল্লাহ্ এই ধারার সবচেয়ে জনপ্রিয় কবি হিসেবে পরিচিত।
‘সোনাভান’ নামে ফকির গরীবুল্লাহ্র রচিত আরেকটি কাব্য যুদ্ধকাহিনি সম্বলিত, যেখানে বীর হানিফার সঙ্গে সোনাভানের লড়াইয়ের কাহিনি বর্ণিত হয়েছে, তবে প্রণয়ের কথাও এতে বাদ পড়েনি। ‘সত্যপীরের পুঁথি-মদন কামদেবের পালা’ নামে তার রচিত আরেকটি কাব্যও উল্লেখযোগ্য। ড. আনিসুজ্জামান মন্তব্য করেছেন, ‘গরীবুল্লাহর প্রতিভা ছিল, পর্যাপ্ত শিক্ষা ছিল না। কাব্যসৃষ্টির প্রেরণা তার ছিল, কিন্তু লোকমনোরঞ্জন ছিল তার আশু লক্ষ্য। তাই গরীবুল্লাহ জনপ্রিয় হলেন, কিন্তু একজন প্রথম শ্রেণির কবি হতে পারলেন না। তবে একটি বিশেষ কাব্যধারার পদকর্তা হিসেবে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে তিনি স্থায়ী আসন লাভ করবেন, এইটুকু আমাদের সান্ত্বনা।’
সৈয়দ হামজা
পুঁথি সাহিত্যের ধারায় কবি ফকির গরীবুল্লাহর অনুসারী হিসেবে কবি সৈয়দ হামজার আবির্ভাব। তিনি ১৭৩৩-৩৪ সালে হুগলি জেলার ভুরসুট পরগনার উদনা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। কবিতা, পাঁচালি ও ছড়া রচনায় তার বিশেষ আগ্রহ ছিল। আনুমানিক ১৭৮৮ সালে তিনি ‘মধুমালতী’ নামে একটি প্রণয়কাব্য রচনা করেন। তবে কাব্যটি পুঁথি সাহিত্যের ধারার অনুসারী নয়, এর ভাষা পুঁথি সাহিত্যের মত মিশ্র ভাষারীতি ছিল না। কবি সম্ভবত ফারসি কাব্য থেকে বঙ্গানুবাদ করে এ কাব্যের রূপ দেন। এই কাব্যে মনুহর ও মধুমালতীর যে প্রেমকাহিনি বর্ণিত হয়েছে তা সম্পূর্ণ কাল্পনিক এবং রোমান্টিক রসাশ্রিত। কবির ভাষার নিদর্শন:
সহজে রূপের ভারে আপনি চলিতে নারে
নবীন যৌবন তাহে ভার।
রূপের মুরারি বালি ক্ষীণমধ্যা পড়ে হেলি
কেমনে বহিবে অলঙ্কার।
চন্দ্রের জিনিয়া রূপ সূর্যের জিনিয়া ধূপ
আভরণ কিবা প্রয়োজন।
আয়তির চিহ্ন যত দেশের চলন মত
আনিল কিঞ্চিৎ আভরণ।
মধ্যযুগের রোমান্টিক কাব্যের অবাস্তবতা এবং রহস্য স্বীকার করেও সৈয়দ হামজার মধুমালতী বাঙালির সংস্কার, আচারনিষ্ঠা, রীতিনীতি, গৃহগত সৌজন্য, কৌতুক ও আনন্দ নিয়ে উদ্ভাসিত হয়েছে। সৈয়দ হামজা কবি গরীবুল্লাহর অসামপ্ত কাব্য আমির হামজা সমাপ্ত করতে গিয়ে পুঁথি সাহিত্যের ভাষারীতির প্রতি আকৃষ্ট হন এবং সে ভাষায় তিনটি কাব্য রচনা করেন। ‘আমীর হামজা’ কাব্যের দ্বিতীয় অংশ তিনি বিরাট আকারে রূপ দেন। কাব্যরচনার উদ্দেশ্য সম্পর্কে কবি বলেছেন:
লোগের খায়েশ দেখি ভাবি মনে মনে।
আখেরি শায়েরি পুঁথি হইবে কেমনে।
না পারিনু এড়াইতে লোকের নেহেরা।
এ খাতেরে কবিতার খাহেশ হৈল মেরা।
পীর শাহা গরীবুল্লা কবিতার গুরু।
আলমে উজালা যার কবিতার শুরু ॥
আমার শায়েরি নয় কেতাব সমান।
কেবল বুঝিবে লোগ কেচ্ছার বয়ান॥
‘আমির হামজা’ কাব্যে কবি অসংখ্য যুদ্ধের কাহিনি বর্ণনা করেছেন। অন্যান্য পুঁথির মত এই কাব্যেও অলৌকিকতা বিদ্যমান। ‘জৈগুনের পুথি’ নামে সৈয়দ হামজা অপর একটি কাব্য রচনা করেছিলেন। ১৭৯৭ সালে এ কাব্য রচিত। এরেমের বাদশাজাদী অসাধারণ বীর্যবর্তী বিবি জৈগুনের সঙ্গে হানিফার যুদ্ধ এবং পরিণামে তাদের পরিণয় বর্ণনা এই কাব্যের উদ্দেশ্য। ইসলামের জয় ঘোষণা এ কাব্যে প্রাধান্য পেয়েছে। জৈগুনের যে সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে কাহিনি রূপলাভ করে তা এ রকম:
জৈগুন নামে বাদশাজাদী এরেম সহরে।
কারার করেছে বিবি বাপের হুজুরে॥
মহিমে যে কেহ মোরে পাছাড়িবে জোরে।
সাদী বেহা কবুল করিব আমি তারে॥
আমার মহিমে যদি হারে পাহালওয়ান।
করিবে খেদমতগারি হইয়া গোলাম॥
সৈয়দ হামজার চতুর্থ রচনা ‘হাতেম তাই’ কাব্য, যা উর্দু ‘আরায়েশ মহফিল’ কাব্যের অনুবাদ। এই কাব্যের মূল বর্ণনীয় বিষয় হল সওদাগরজাদী হুসনাবানুর রূপমুগ্ধ মনীর শামীর মনোবাসনা পূরণ করতে সাতটি দুরূহ প্রশ্নের উত্তরের সন্ধানে পরোপকারী হাতেম তাইয়ের বিচিত্র অভিযান। সৈয়দ হামজার কবি প্রতিভার মূল্যায়নে ড. আনিসুজ্জামান মন্তব্য করেছেন, ‘গরীবুল্লাহর মতো হামজারও শ্রেষ্ঠ রচনা তার প্রণয়কাব্য। মনে হয়, উভয় কবিরই স্বাভাবিক প্রতিভা এই ধরনের কাব্য রচনার পক্ষে ছিল। কিন্তু সমসাময়িক ফারসি যুদ্ধকাহিনি কাব্যের জনপ্রিয়তায় বিভ্রান্ত হয়ে তারা ‘জঙ্গনামা’ ধরনের কাব্য রচনায় মনোযোগ দেন। তাদের শ্রোতারাও এতে সন্তুষ্ট হয়েছিলেন। মুহূর্তের জন্য কবিরা তাদের নিরুত্তাপ ও বৈচিত্র্যহীন জীবনে উত্তেজনার সঞ্চার করেছিলেন এবং তাদের মূঢ় কল্পনার খোরাক জুগিয়েছিলেন। সেই বিশেষ মুহূর্তের এবং পরিমণ্ডলের অপসারণের সঙ্গে সঙ্গেই কবিদের দায়িত্ব শেষ হয়েছে। কেবল সেই প্রণয়কাব্যই হয়তো কালের আঘাত কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হবে, কারণ সেখানে চিরন্তন সুর ধ্বনিত হয়েছে।’
দোভাষী পুঁথি সাহিত্য সাধারণ মানুষের বোধগম্য ভাষা ও আকর্ষণীয় আবেগের সাথে সম্পৃক্ত থাকায় বিশেষ সময়ে এর ব্যাপক প্রসার ঘটে। এতে উদ্বুদ্ধ হয়ে অনেক কবিই পুঁথি সাহিত্যের ধারায় কাব্য রচনায় আত্মনিয়োগ করেছিলেন। তবে, সত্যিকারের কৃতিত্বের নিদর্শন ফকির গরীবুল্লাহ্ ও সৈয়দ হামজার কাব্যেই প্রতিফলিত হয়েছে। এই দুজন কবিই স্বাভাবিক কবিপ্রতিভার অধিকারী ছিলেন, এবং প্রণয়কাব্য রচনায় তা সার্থকভাবে প্রকাশ পেয়েছে। তবে, তারা সমকালীন বিশেষ কাব্যরসিকদের জন্য ‘জঙ্গনামা’ জাতীয় কাব্যও রচনা করেছিলেন।
পরবর্তীকালের পুঁথিসাহিত্য
পরবর্তীকালে পুঁথিসাহিত্যে অনেক শায়েরই নিজ নিজ প্রতিভার পরিচয় দিয়েছেন। উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে মোহাম্মদ দানেশ ‘চাহার দরবেশ’ কাব্য রচনা করেন। সম্ভবত উর্দুর মাধ্যমে ফারসি ‘কিসসা-ই-চাহার দরবেশ’ গ্রন্থের অনুবাদ হিসেবে এ কাব্যের রূপ দেওয়া হয়। ‘চারজন প্রণয়ী তাদের বাঞ্ছিতা নারীর সন্ধানে বেরিয়ে ফকির হয়ে গেছেন। ভগ্নহৃদয়ে দরবেশরা যখন আত্মহত্যা করতে যাচ্ছেন, তখন হযরত আলী আবির্ভূত হয়ে তাদের ভবিষ্যতের আশা দিয়ে অন্তর্হিত হলেন। এই আশায় উজ্জীবিত হয়ে দরবেশরা আবার প্রণয়িনীদের অনুসন্ধানে বের হলেন – এটাই এই কাহিনীর সার। বাংলায় এই কাহিনি পরিবেশনের কারণ সম্পর্কে কবি বলেছেন:
কেতাব করিল মর্দ ফারসি জবানে।
ফারসি লোক যারা তারা খুসি হালে শুনে॥
বাঙ্গালার লোক সবে নাহি জানে ভেদ।
যে কেহ শুনিল তাহা দেলে করে খেদ ॥…
এ খাতেরে ফকিরে হইল সওক।
আফছোছ না করে যেন বাঙ্গালার লোক॥
চলিত বাঙ্গালায় কেচ্ছা করিনু তৈয়ার।
সকলে বুঝিবে ভাই কারণে ইহার॥
আসল বাঙ্গালা সবে বুঝিতে না পারে।
এ খাতেরে না লিখিলাম শোন বেরাদরে॥
‘চাহার দরবেশ’ ছাড়া মোহাম্মদ দানেশ ‘গোলবে ছানুয়ার’, ‘নুরুল ইমান’ ও ‘হাতেম তাই’ কাব্য রচনা করেছিলেন।
পুঁথি সাহিত্যে পীরফকিরদের প্রতিষ্ঠার কথা পাওয়া যায় ‘গাজী কালু ও চম্পাবতী’ পুঁথির মধ্যে। বৈরাট নগরের রাজা সেকান্দর শাহের দ্বিতীয় পুত্র গাজী ও তার সহচর কালুর সংসার বিরাগের কাহিনি এবং গাজীর সঙ্গে ব্রাহ্মণ নগরের রাজকন্যা চম্পাবতীর প্রণয়কাহিনি এই শ্রেণির কাব্যের বিষয়বস্তু। গাজীর ব্যাঘ্র-বাহিনীর সঙ্গে দক্ষিণ রায়ের যুদ্ধের কাহিনিও এতে স্থান পেয়েছে। গাজীর মাহাত্ম্যকাহিনি কবির অন্যতম প্রেরণার উৎস ছিল। এই কাহিনি অবলম্বনে আবদুল গফুর, আবদুল হাকিম প্রমুখ কবিগণ কাব্য রচনা করেন। আবদুল হাকিম ‘গাজী কালু ও চম্পাবতী’ রচনায় বিশিষ্টতা অর্জন করেছিলেন।
উপসংহার
পুঁথিসাহিত্য ‘সম্পূর্ণত ইসলাম সম্মত না হয়েও অশিক্ষিত মুসলমান সমাজে তার আবেদন সীমাবদ্ধ হয়ে রইল।’ তবে এই কাব্যধারায় চিন্তার মত রচনাভঙ্গির দৈন্যও বিদ্যমান ছিল। মিশ্র ভাষারীতির কাব্য শুধু গতানুগতিক ও জৌলুসহীন নয়, ক্ষয়িষ্ণুতার চিহ্নও স্পষ্ট। কারণ এতে আছে বাস্তব জীবন থেকে সরে থাকার চেষ্টা, নারীর প্রতি শ্রদ্ধাবোধের অভাব, আদর্শবাদের অভাব এবং সমকালীন জীবনের সঙ্গে বিচ্ছেদ।
আধুনিক যুগে পুঁথিসাহিত্যে কেউ কোন আবেদনের সৃষ্টি করতে পারে নি। ‘বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত’ গ্রন্থে সৈয়দ আলী আহসান এ সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন, ‘উনিশ শতকের দোভাষী পুঁথি সাহিত্যের কাব্যগত কোন মূল্য নেই, তার কারণ, প্রথমত এবং প্রধানত প্রতিভাবান কবির অভাব; দ্বিতীয়ত, ইংরোজ শিক্ষা ও সাহিত্যের সঙ্গে যোগসূত্রের ফলে বাংলা সাহিত্যের যে পরিবর্তন এল, সে পরিবর্তনের সঙ্গে পুঁথি রচয়িতাদের কোন সম্পর্ক ছিল না। তৃতীয়ত, জীবন ও জগৎ সম্পর্কে অনুসন্ধিৎসার অভাব কাব্যকে প্রাণহীন করেছিল।’ তবু একটি ক্ষীণ ধারা এখনও অস্তিত্ব রক্ষা করে চলেছে।
তথ্যসূত্র –
- বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস, মাহবুবুল আলম, খান ব্রাদার্স অ্যান্ড কোম্পানি, ২০১৮
Leave a Reply