হাসিনা সরকারের ক্ষমতায় টিকে থাকা, স্বৈরাচার ও দুর্নীতি-লুটপাটের পেছনে ভারতীয় ফ্যাক্টরসমূহ

(ভুল থাকলে সংশোধনী আনা যেতে পারে, পরে মনে পড়লে বা কেউ সাজেস্ট করলে নতুন বিষয় অ্যাডেড হতে পারে)

বাংলাদেশে ভারতের স্বার্থ

প্রশ্ন দুটো। (১) হাসিনা সরকারকে বিভিন্ন সুবিধা দিয়ে ভারত কী কী সুবিধা পেত? (২) ভারতকে বিভিন্ন সুবিধা দিয়ে হাসিনা সরকার কী কী সুবিধা পেত? বুঝতেই পারছেন, দুটো প্রশ্নের উত্তর একে অন্যের কারণ হবে। প্রথম প্রশ্নের উত্তরের কারণ দ্বিতীয়টার উত্তর, আর দ্বিতীয়টার উত্তরের কারণ প্রথমটার উত্তর। মানে দুটোর উত্তরের মধ্যে পারস্পরিক বিনিময় সম্পর্ক কাজ করবে।

হাসিনা সরকারকে বিভিন্ন সুবিধা দিয়ে ভারত কী কী সুবিধা পেত সেটা অনেকটাই বাংলাদেশের ওপর ভারতের স্বার্থের সাথে সম্পর্কিত, যদিও পুরোপুরি না। এখন বাংলাদেশে ভারতের স্বার্থ কী কী তা নিয়ে বেশ কিছু টেক্সটবুক পয়েন্ট আছে, যেমন নিরাপত্তা ও সীমান্ত ব্যবস্থাপনা, আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা ও কৌশলগত প্রভাব, অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক স্বার্থ, চীনের প্রভাব মোকাবেলা, জলবণ্টন ও নদী ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি। এগুলো একটু বর্ণনা করে নিচ্ছি –

নিরাপত্তা ও সীমান্ত ব্যবস্থাপনা : ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে দীর্ঘ সীমান্ত রয়েছে যা প্রায় ৪,০৯৬ কিলোমিটার। এই সীমান্ত দিয়ে অবৈধ প্রবেশ, পাচার, এবং সন্ত্রাসী কার্যকলাপ ঘটে। ভারত, বিশেষ করে উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশের সাথে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতা প্রয়োজন। হাসিনা সরকারের অধীনে, ভারত-বাংলাদেশের সীমান্ত নিরাপত্তা এবং সন্ত্রাসী কার্যকলাপ দমনে ব্যাপক অগ্রগতি হয়েছে। বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহার করে উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ভারতবিরোধী সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে।

আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা ও কৌশলগত প্রভাব : বাংলাদেশে স্থিতিশীল সরকার থাকা ভারতের আঞ্চলিক কৌশলগত স্বার্থের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান ভারতকে দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে সংযোগ স্থাপনে সহায়তা করে। এ অঞ্চলে প্রভাব বজায় রাখতে এবং চীনের প্রভাব মোকাবেলা করতে ভারত বাংলাদেশে একটি স্থিতিশীল ও বন্ধুত্বপূর্ণ সরকারকে সমর্থন করে।

অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক স্বার্থ : বাংলাদেশ ভারতের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য অংশীদার। দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য সম্পর্কের মাধ্যমে ভারত বাংলাদেশের বাজারে প্রবেশাধিকার পায় এবং বিভিন্ন শিল্প ও বিনিয়োগের সুযোগ সৃষ্টি করে। হাসিনা সরকারের অধীনে ভারত-বাংলাদেশ বাণিজ্য সম্পর্ক আরও দৃঢ় হয়েছে এবং ভারতীয় সংস্থাগুলো বাংলাদেশের বিভিন্ন সেক্টরে বিনিয়োগ করছে।

চীনের প্রভাব মোকাবেলা : চীন বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য ও উন্নয়ন অংশীদার। চীন বাংলাদেশে বিভিন্ন অবকাঠামোগত প্রকল্পে বিনিয়োগ করেছে, যা ভারতের জন্য কৌশলগত চ্যালেঞ্জ। ভারতের জন্য বাংলাদেশের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রাখা গুরুত্বপূর্ণ যাতে চীনের প্রভাব সীমিত করা যায় এবং বাংলাদেশে ভারতের কৌশলগত উপস্থিতি বজায় থাকে।

জলবণ্টন ও নদী ব্যবস্থাপনা : বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বেশ কয়েকটি আন্তঃসীমান্ত নদী রয়েছে, যার মধ্যে গঙ্গা ও তিস্তা নদী উল্লেখযোগ্য। এই নদীগুলোর পানি বণ্টন নিয়ে দুই দেশের মধ্যে বিভিন্ন চুক্তি ও আলোচনা হয়েছে। এই ভারত যাতে এই অভিন্ন নদীগুলোর পানি তার নিজ স্বার্থে ব্যবহার করতে পারে, বা বাংলাদেশ এমন কিছু না করে যাতে তার এই পানির ব্যবহারে সমস্যার সৃষ্টি হয় সেজন্যেও বাংলাদেশে ভারতের স্বার্থ রয়েছে।

যাই হোক, হাসিনার আমলে দুর্নীতি, লুটপাট, অর্থনৈতিক ক্ষতির আলোচনায় এই সব বিষয়ে ডিটেইলে আলোচনার মানে হয়না। তবে বর্তমানে আলোচিত বিষয়গুলোর উপর ভিত্তি করে বাংলাদেশ নিয়ে ভারতের কেবল দুটো স্বার্থ তুলে ধরা যায় – (১) বাংলাদেশ ও ভারতের ট্রান্সবাউন্ডারি রিভারগুলোর জল যাতে ভারত কোন আন্তর্জাতিক চাপ, বিচার ও কোনরকম চুক্তি ছাড়াই ইচ্ছা মতো ব্যবহার করতে পারে, বাঁধ বসাতে পারে তা তার আধিপত্যের মাধ্যমে নিশ্চিত করা, যেটা নিয়ে অলরেডি বাংলাদেশের ট্রান্সবাউন্ডারি রিভারগুলোতে ভারতের আধিপত্য নিয়ে আমার লেখায় এনেছি; (২) বাংলাদেশে ভারতের, বা ভারতের পুঁজিপতিদের দ্বারা মেগা প্রকল্পসমূহ ও এগুলোর জন্য বিপুল পরিমাণ ঋণ প্রদান বা বিনিয়োগ। এখন ভারত কেন বাংলাদেশে মেগা প্রকল্পগুলো বানাতে চাইবে সেটার উত্তরেও সেই প্রায় একই রকম টেক্সটবুক পয়েন্টগুলোর কথাই বারবার টানা হয়, যথা – অর্থনৈতিক প্রভাব বিস্তার, কৌশলগত ও নিরাপত্তা স্বার্থ, চীনের প্রভাব মোকাবেলা, রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক প্রভাব ইত্যাদি, কিন্তু যেটা টেক্সট বুকে থাকে না সেটা হলো, এর মাধ্যমে মোদি সরকার তার পছন্দের পুঁজিপতিদেরকে বাংলাদেশে মেগা প্রকল্প রিলেটেড বিভিন্ন অর্থনৈতিক স্বার্থোদ্ধারের সুযোগ করে দেয় আর বিনিময়ে তাদের থেকে লাভবান হয় মোদি সরকার। যাই হোক, এই দুটো কারণ ও টেক্সট বুক কারণগুলো ছাড়াও ভারতের হাসিনা সরকারকে টিকিয়ে রাখার পেছনে রয়েছে বেশ কিছু কারণ, যেমন – নর্থ ইস্টের সেপারেটিজম, জঙ্গিবাদ ও ভারত-বিদ্বেষ প্রমোট করা দলগুলোকে বাংলাদেশের ক্ষমতায় আসতে না দেয়া ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ভারতের সাথে আওয়ামী লীগের সম্পর্ক।

মেগা প্রকল্পসমূহে দুর্নীতি-লুটপাট-অর্থ পাচারের সুযোগ এবং ভারতের স্বার্থ

হাসিনা ও মোদি সরকার স্বার্থ

এখন মেগা-প্রকল্প এমন জিনিস যেখানে ভারতের সরকারের ও বাংলাদেশের হাসিনা সরকারের উভয়েরই লাভ আছে। এখানে এই লাভটা কেবল ভারতের লাভ ও বাংলাদেশের লাভের কথা বলে রিডিউস করা যায়না, যেগুলো টেক্সবুক স্বার্থের কথা। এখানে মোদি সরকারের ও হাসিনা সরকারের লাভের কথা ভাবতে হয়। পছন্দের পুঁজিপতিদেরকে মেগা-প্রকল্পগুলো পাইয়ে দেয়া ও এর মাধ্যমে রাজনৈতিক সুবিধা অর্জন করা, ক্রোনি ক্যাপিটালিজমের দিক দিয়ে মোদি সরকারের সুবিধা আছে। এর বাইরে ভারতের টেক্সটবুক স্বার্থগুলোর ক্ষেত্রে আছে এর এই প্রকল্পগুলোতে ভারতের অর্থনৈতিক, কৌশলগত এবং বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে স্বার্থ। এই মেগা প্রকল্পগুলোতে ভারতীয় কোম্পানির অংশগ্রহণ ভারতের শিল্প খাতের জন্য বিশাল বাজার সৃষ্টি করেছে। ভারতীয় প্রতিষ্ঠানগুলো প্রযুক্তি সরবরাহ এবং নির্মাণ কাজে জড়িত থেকে লাভবান হয়েছে। বাংলাদেশের অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পগুলোতে ভারতের অংশগ্রহণের ফলে, ভারত কৌশলগত ও বাণিজ্যিক সুবিধা অর্জন করেছে। উদাহরণস্বরূপ, আখাউড়া-আগরতলা রেল সংযোগ প্রকল্পে ভারতীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর সরাসরি অংশগ্রহণ এবং বিনিয়োগ ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বাজার প্রসারে সাহায্য করেছে। এগুলো অর্থনৈতিক স্বার্থ। ভারতের সাথে সরাসরি যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি এবং বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে অংশগ্রহণ ভারতের কৌশলগত স্বার্থ রক্ষা করেছে। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর সাথে যোগাযোগের উন্নতির মাধ্যমে ভারতের নিরাপত্তা এবং প্রভাব বিস্তার নিশ্চিত করা হয়েছে, এগুলো কৌশলগত স্বার্থ। বাংলাদেশের অবকাঠামো উন্নয়ন ভারতীয় পণ্যের জন্য নতুন বাজার তৈরি করেছে এবং বাণিজ্য সম্প্রসারণে সহায়ক হয়েছে। এই প্রকল্পগুলোর মাধ্যমে ভারত বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নিজেদের উপস্থিতি এবং প্রভাব বৃদ্ধির সুযোগ পেয়েছে। এগুলো বাণিজ্যিক স্বার্থ। এই সব প্রকল্পের মাধ্যমে ভারত তাদের অর্থনৈতিক ও কৌশলগত স্বার্থ সংরক্ষণে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে, যা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করেছে এবং আওয়ামীলীগ সরকারের ক্ষমতা ধরে রাখার প্রক্রিয়ায় সহায়ক হয়েছে।

তবে হাসিনা সরকারের সুবিধাগুলোর সাথেই এই আলোচনা বেশি সম্পর্কিত। মেগা প্রকল্পগুলোর ক্ষেত্রে হাসিনা সরকার যে ডিরেক্ট সুবিধাগুলো পেয়েছে সেগুলো হচ্ছে দুর্নীতি ও লুটপাটের সুবিধা। লুটপাটের মধ্যে অর্থ পাচারও আছে। এখন মেগা প্রকল্প ভারতের হোক বা চীন, রাশিয়া বা অন্যান্য দেশেরই হোক, এগুলো থেকে হাসিনা সরকার দুর্নীতির, লুটপাট, অর্থ পাচারের সুযোগ পেয়েছে ও সেই সুযোগ নিয়েছে। এখানে বাংলাদেশের সম্ভাব্য আর্থিক ক্ষতিটা দুদিক থেকে আসছে, বিপুল পরিমাণে ঋণ গ্রহণ ও সুদের হারের দিকটা থেকে, আর দুর্নীতি-লুটপাটের জায়গা থেকে। দুর্নীতি-লুটপাটে আবার দেশে লুটপাটের জায়গা আছে, আবার অর্থ পাচারের ব্যাপারটাও আছে। বিপুল পরিমাণে ঋণের ব্যাপারে ও তার ক্ষতি সম্পর্কে আগেই বলেছি। উচ্চ সুদের হারের ব্যাপারটা সাধারণত বাণিজ্যিক ঋণের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, যেমন রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং আখাউড়া-আগরতলা রেল সংযোগ প্রকল্পের ক্ষেত্রে। এই উচ্চ সুদের ঋণগুলো বাংলাদেশের জন্য দীর্ঘমেয়াদে আর্থিক চাপ সৃষ্টি করতে পারে, কারণ ঋণের সুদ পরিশোধের জন্য সরকারের বাজেটে বড় অংশ বরাদ্দ করতে হয়। উচ্চ সুদের ঋণগুলো সাধারণত কম সুবিধাজনক এবং দীর্ঘমেয়াদে ঋণ পরিশোধে ব্যর্থতার ঝুঁকি বাড়ায়, যা দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। যাই হোক, দুর্নীতি-লুটপাটের প্রসঙ্গে আসা যাক। কিভাবে মেগা প্রকল্পের ক্ষেত্রে বিভিন্নভাবে লুটপাট করা যায় সেটা নিচে বর্ণনা করছি। এটা শুধু ভারতের না, যেকোন মেগা প্রকল্পের ক্ষেত্রেই কাজ করে। একে দুইভাগে ভাগ করে আলোচনা করছি – অর্থ পাচার রিলেটেড লুটপাট, আর অর্থ-পাচারের বাইরের লুটপাট –

অর্থ পাচার রিলেটেড লুটপাট

মূলত কিকব্যাক ও ওভার ইনভয়েসিং এর মাধ্যমে মেগা প্রকল্পগুলোতে অর্থ পাচার হয়। কিকব্যাক (Kickback) হলো একটি অবৈধ অর্থ লেনদেনের প্রক্রিয়া যেখানে প্রকল্পের সাথে জড়িত পক্ষ (সাধারণত ঠিকাদার বা সরবরাহকারী) চুক্তি পেতে বা সুবিধা আদায়ের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের অর্থ প্রদান করে। উদাহরণস্বরূপ, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের ক্ষেত্রে অভিযোগ করা হয়েছে যে রাশিয়ান কোম্পানি রোসাটম থেকে পারমাণবিক চুল্লির ক্রয়ের সময় বড় অঙ্কের কিকব্যাক নেওয়া হয়েছে। এই অর্থ সাধারণত প্রকল্পের বাজেটের অতিরিক্ত খরচ হিসাবে দেখানো হয় এবং পরবর্তীতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা গোপনভাবে বিদেশে তা স্থানান্তর করে থাকেন।

ওভার ইনভয়েসিং (Over-Invoicing) হলো একটি প্রক্রিয়া যেখানে প্রকল্পের জন্য প্রয়োজনীয় পণ্য বা সেবার মূল্য ইচ্ছাকৃতভাবে বেশি দেখানো হয়। প্রকল্পের সঠিক ব্যয়ের চেয়ে অধিক খরচ দেখিয়ে অতিরিক্ত অর্থ আদায় করা হয়। এই অতিরিক্ত অর্থ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বা ঠিকাদাররা গ্রহণ করেন এবং তা বিভিন্ন পদ্ধতিতে (যেমন বিদেশি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে স্থানান্তর) পাচার করেন। ওভার ইনভয়েসিং এর সাথে সম্পর্কিত রয়েছে প্রকল্পের কাজের জন্য নিম্নমানের উপকরণ বা সাব-স্ট্যান্ডার্ড ম্যাটেরিয়ালস সরবরাহ করার ব্যাপারটা, যা প্রকল্পের গুণগত মানকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। তবে কাগজে-কলমে উচ্চ মানের উপকরণের দাম দেখানো হয়, এবং নিম্নমানের উপকরণ সরবরাহ করার মাধ্যমে বাঁচানো টাকা পাচার করা হয়। ওভার ইনভয়েসিং এর সাথে সম্পর্কিত রয়েছে ভুয়া ব্যয় বা ফলস এক্সপেন্সেস, যেখানে প্রকল্পের খরচের হিসাবের মধ্যে ভুয়া বা অপ্রয়োজনীয় খরচ দেখানো হয়। এই খরচগুলো প্রকৃতপক্ষে কখনোই হয় না, কিন্তু হিসাবের কাগজে দেখানো হয় এবং এই অর্থ প্রকল্পের বাইরে ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টে বা বিদেশে স্থানান্তরিত হয়। ওভার ইনভয়েসিং এর সাথে সম্পর্কিত রয়েছে বৈধ খরচের আড়ালে অর্থ লেনদেন (Under the Cover of Legitimate Expenses), যেখানে প্রকল্পের বিভিন্ন বৈধ খরচের আড়ালে অতিরিক্ত অর্থ পাচার করা হয়। যেমন, পরামর্শক ফি, প্রশিক্ষণ ব্যয়, বা অন্যান্য পরিষেবার জন্য অতিরিক্ত অর্থ প্রদানের মাধ্যমে অর্থ পাচার করা হয়।

এখন মেগা প্রকল্পের ক্ষেত্রে টাকা পাঠানোর জন্য বিভিন্ন রকম পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। যেমন ফ্রন্ট কোম্পানি এবং অফশোর অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে। সেক্ষেত্রে পাচারকারীরা সাধারণত ভুয়া কোম্পানি তৈরি করে বা তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে টাকা অফশোর ব্যাংক অ্যাকাউন্টে স্থানান্তর করে। এই প্রক্রিয়ায় পাচারের অর্থ সহজে শনাক্ত করা কঠিন হয়, কারণ এটি বিভিন্ন আইনগত এবং আর্থিক বাধা অতিক্রম করে। এক্ষেত্রে ফ্রন্ট কোম্পানি বা পুতুল কোম্পানি তৈরি করে এবং অফশোর অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে অর্থ স্থানান্তরের ফলে, পাচারকৃত অর্থ বৈধভাবে বিদেশে সঞ্চিত হয় এবং তা আয়কর ও অন্যান্য আইনগত ঝামেলা থেকে মুক্ত থাকে। এছাড়াও আছে ক্যাশ হ্যান্ডলিং পদ্ধতি, যেখানে প্রকল্পের অতিরিক্ত অর্থ সরাসরি নগদ অর্থে তোলা হয় এবং স্থানীয়ভাবে বা বিদেশে অবৈধভাবে স্থানান্তরিত করা হয়। ক্যাশ হ্যান্ডলিং এর মাধ্যমে অর্থ পাচার করা সহজ, তবে এটি সাধারণত ছোট পরিসরে ব্যবহৃত হয়, কারণ বড় অঙ্কের টাকা ক্যাশ হিসেবে হস্তান্তর করা কঠিন এবং ঝুঁকিপূর্ণ।

অর্থ-পাচারের বাইরের লুটপাট

মেগা প্রকল্পে দুর্নীতি শুধু অর্থ পাচারের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; আরও বিভিন্ন উপায়ে এই ধরনের প্রকল্পগুলোতে দুর্নীতি ঘটে থাকে। ওভার ইনভয়েসিং (Over-Invoicing) পদ্ধতিতে প্রকল্পের উপকরণ, সরঞ্জাম বা সেবার দাম ইচ্ছাকৃতভাবে বেশি দেখানো হয়। প্রকল্পে ব্যবহৃত পণ্য বা সেবার জন্য প্রকৃত দামের তুলনায় অতিরিক্ত খরচ দেখানো হয়, যা প্রকল্প বাজেটকে অতিরিক্তভাবে বাড়িয়ে তোলে। এর ফলে প্রকল্পে ব্যয় বৃদ্ধি পায় এবং এই অতিরিক্ত অর্থ দুর্নীতির মাধ্যমে ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টে স্থানান্তরিত হয়। অনেক সময় প্রকল্পে সাব-স্ট্যান্ডার্ড ম্যাটেরিয়ালস (Sub-Standard Materials) বা নিম্নমানের উপকরণ ব্যবহার করা হয়, যা প্রকল্পের মান কমিয়ে দেয় এবং এর দীর্ঘমেয়াদি কার্যকারিতা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তবে কাগজে-কলমে উচ্চ মানের উপকরণের দাম দেখানো হয়, যা প্রকৃতপক্ষে প্রকল্পের ব্যয় বাড়িয়ে তোলে। ভূয়া দরপত্র এবং প্রতিযোগিতা হ্রাসের (Fake Bidding and Reduced Competition) এর সুযোগ থাকে, এক্ষেত্রে প্রকল্পের টেন্ডার প্রক্রিয়ায় ভুয়া দরপত্র জমা দিয়ে প্রতিযোগিতা কমিয়ে আনা হয়। এর ফলে প্রকল্পটি যে কোম্পানিকে দেওয়া হয়, তারা কম মানের কাজ করে এবং দুর্নীতির মাধ্যমে বড় অঙ্কের অর্থ আদায় করে। প্রকল্পের সময়কাল বাড়িয়ে দেওয়ার (Project Delays and Extensions) ব্যাপার কাজ করতে পারে, যেখানে প্রকল্পের কাজ ইচ্ছাকৃতভাবে বিলম্বিত করা হয় যাতে সময়ের সাথে সাথে বাজেট বাড়ানো যায়। এই বিলম্বিত প্রকল্পগুলোতে অতিরিক্ত খরচ যুক্ত করা হয়, যা প্রকল্পের মোট ব্যয়কে বৃদ্ধি করে এবং এই অতিরিক্ত অর্থ দুর্নীতির মাধ্যমে ব্যবহার করা হয়। বিষয়ভিত্তিক পরামর্শক নিয়োগ (Hiring Biased Consultants) এর বিষয়টিও কাজ করতে পারে, যেখানে প্রকল্পে পরামর্শক হিসেবে এমন ব্যক্তিদের নিয়োগ দেওয়া হয় যারা প্রকল্পের মান নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে দুর্বল ভূমিকা পালন করেন। এর ফলে, প্রকল্পের গুণগত মান বজায় থাকে না, এবং দুর্নীতির সুযোগ বাড়ে।

ভারতের মেগা প্রকল্পগুলো

এবারে ভারতের মেগা প্রকল্পগুলোর আলোচনায় চলে যাই। আওয়ামীলীগ সরকারের অধীনে বাংলাদেশে বেশ কিছু মেগা প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে, যার মধ্যে কয়েকটি ভারতের স্বার্থ এবং অংশগ্রহণের সাথে সরাসরি সম্পর্কিত। এই প্রকল্পগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু প্রকল্প এবং সেগুলোর সাথে ভারতের স্বার্থের সম্পর্ক নীচে তুলে ধরা হলো:

রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র : রামপাল কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটি একটি বিতর্কিত প্রকল্প, যা ভারতীয় কোম্পানি “ন্যাশনাল থার্মাল পাওয়ার কর্পোরেশন” (NTPC) এবং বাংলাদেশ পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ডের (BPDB) যৌথ উদ্যোগে নির্মিত হচ্ছে। প্রকল্পটি সুন্দরবনের নিকটবর্তী হওয়ায় পরিবেশবাদী আন্দোলনকারীদের বিরোধিতার মুখে পড়েছে। তবে, ভারতের স্বার্থের দিক থেকে এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি ভারতীয় কয়লার জন্য একটি স্থায়ী বাজার তৈরি করেছে এবং ভারতের শক্তি উৎপাদন খাতকে একটি নির্ভরযোগ্য অংশীদার করেছে। এই প্রকল্পটির জন্য ভারতের বিভিন্ন ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান ঋণ সরবরাহ করেছে, যার মধ্যে এক্সিম ব্যাংক অফ ইন্ডিয়া (Exim Bank of India) অন্যতম। এই ধরনের ঋণ সাধারণত বাণিজ্যিক সুদের হার অনুসারে প্রদান করা হয়, যা ২% থেকে ৫% পর্যন্ত হতে পারে। এক্সিম ব্যাংক সাধারণত মধ্যমেয়াদি ঋণ প্রদান করে, যার মধ্যে ১৫ থেকে ২০ বছর সময়ে ঋণ পরিশোধের শর্ত থাকে। এর সাথে প্রায় ৫ বছরের গ্রেস পিরিয়ড থাকে। NTPC এবং BPDB এর সমান অংশীদারিত্বে এই প্রকল্পের মোট ব্যয় প্রায় ২ বিলিয়ন ডলার।

আখাউড়া-আগরতলা রেল সংযোগ প্রকল্প : আখাউড়া-আগরতলা রেল সংযোগ প্রকল্পটি ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের সাথে বাংলাদেশের সংযোগ বৃদ্ধির লক্ষ্যে বাস্তবায়িত হচ্ছে। এই প্রকল্পটি ভারতের জন্য কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলোর সাথে বাংলাদেশের বাণিজ্য ও পরিবহন সংযোগ উন্নত করবে। ভারত এই প্রকল্পের মাধ্যমে তাদের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর সাথে কেন্দ্রের সরাসরি সংযোগ স্থাপন করতে পারবে, যা তাদের অর্থনৈতিক এবং সামরিক উভয় ক্ষেত্রেই সহায়ক হবে। এই প্রকল্পটি ভারতীয় সরকারের অনুদান এবং ঋণের মাধ্যমে অর্থায়িত হয়েছে। ভারত সরকার বাংলাদেশকে এই প্রকল্পের জন্য প্রায় ৯৬৮ কোটি টাকা (প্রায় ১২৫ মিলিয়ন ডলার) অনুদান হিসেবে প্রদান করেছে। প্রকল্পটি বাংলাদেশ রেলওয়ে এবং ভারতীয় রেলওয়ের যৌথ অংশীদারিত্বে বাস্তবায়িত হচ্ছে, যেখানে ভারতীয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলোও জড়িত। অর্থাৎ এই প্রকল্পটি ভারতীয় সরকারের অনুদান এবং ঋণের মাধ্যমে অর্থায়িত হয়েছে। অনুদান অংশে সুদের হার প্রযোজ্য নয়, তবে ঋণ অংশে বাণিজ্যিক সুদের হার প্রযোজ্য হয়েছে, যা ২% থেকে ৫% হতে পারে। ঋণের ক্ষেত্রে স্ট্যান্ডার্ড বাণিজ্যিক শর্তাবলী প্রযোজ্য হচ্ছে।

এগুলো ছাড়াও ভারত তিস্তা-ব্যবস্থাপনা প্রকল্প প্রস্তাব করেছে।

এখন মেগা প্রকল্পগুলো কিভাবে হাসিনা সরকারকে দুর্নীতি, লুটপাট, অর্থ পাচারের সুযোগ করে দেয় সেটা আগেই বলেছি। ভারতের সহযোগিতায় বাস্তবায়িত মেগা প্রকল্পগুলোতে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে প্রচুর অর্থ বরাদ্দ করা হয়েছে, যা দুর্নীতির জন্য একটি সুযোগ সৃষ্টি করেছে। ভারত বাংলাদেশের মেগা প্রকল্পগুলোতে তাদের প্রতিষ্ঠানগুলোর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার মাধ্যমে একটি বিশেষ প্রভাব বিস্তার করেছে। ভারতীয় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কারণে, এই অতিরিক্ত খরচ এবং দুর্নীতির বিষয়গুলো সহজে আড়াল করা সম্ভব হয়েছে। বাংলাদেশ সরকার এই ধরনের দুর্নীতির অভিযোগকে আন্তর্জাতিক চাপ থেকে বাঁচানোর জন্য ভারতের সঙ্গে সম্পর্ককে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছে। এক্ষেত্রে ভারতীয় কোম্পানির অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ সরকার ভারতের প্রতি নির্ভরশীলতাও দেখিয়েছে, যার ফলে ভারতীয় প্রতিষ্ঠানের সাথে সংশ্লিষ্ট দুর্নীতি এবং অপচয় বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে সহজেই আড়াল করার সুযোগ তৈরি হয়। আবার ভারতের সঙ্গে সম্পর্ককে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে বাংলাদেশ সরকার আন্তর্জাতিক চাপ থেকে রেহাই পেয়েছে। ভারতীয় সমর্থনের কারণে আন্তর্জাতিক মহল থেকে পর্যাপ্ত সমালোচনা বা তদন্তের সম্মুখীন হতে হয়নি, যা দুর্নীতির আড়াল করতে সাহায্য করেছে।

ভারতের দ্বারা হাসিনা সরকারকে ক্ষমটায় টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে সহায়তা

বাংলাদেশে ভারতের স্বার্থ খালি মেগা প্রকল্পভিত্তিকই নয়। আগেই দেখিয়েছি ভারতের অনেক রকম স্বার্থই আছে বাংলাদেশে। আর এর মধ্যে অভিন্ন নদীর জল নিয়ে যে স্বার্থ আছে সেটা অনৈতিক ও আধিপত্যবাদী। এইসব স্বার্থরক্ষার জন্য ও ভারতের ক্ষতি হবার সম্ভাবনা থাকে এরকম দলকে ক্ষমতায় আসা আটকাবার জন্য ভারত আওয়ামী লীগ সরকার বা হাসিনা সরকারকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখার প্রয়োজন হয়। এখানে আওয়ামী লীগকে টিকিয়ে রাখা মানে এক দিক দিয়ে যেমন আওয়ামী লীগকে প্রত্যক্ষভাবে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে হেল্প করা, অন্যদিকে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদেরকে দমনে সহায়তা করা। আর ভারতের আধিপত্য ও হাসিনা সরকারের দুর্নীতি-লুটপাটের ক্ষেত্রে এই আলোচনাটা সঙ্গত কারণেই প্রাসঙ্গিক, এগুলোর পেছনে হাসিনার ক্ষমতায় টিকে থাকাটাই পূর্বশর্ত হিসেবে কাজ করেছে। পয়েন্ট দুটো বর্ণনা করা যাক –

ক. হাসিনা সরকারকে রাজনৈতিক সহায়তা প্রদান

ভারত বাংলাদেশে আওয়ামীলীগ সরকারের স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে রাজনৈতিক সমর্থন দিয়েছে, বিশেষ করে ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের নির্বাচনের সময়। এই সমর্থনের বিনিময়ে ভারত বিভিন্ন রকম বেনিফিট পেয়েছে, যেমন আওয়ামীলীগ সরকারের মেগা প্রকল্পগুলোতে ভারতীয় কোম্পানির অংশগ্রহণ এবং বিনিয়োগকে সহজতর করেছে, যেখানে এসব প্রকল্পে নিয়ম-নীতি অনুসরণ না করে প্রকল্প খরচ বাড়িয়ে, দুর্নীতির মাধ্যমে সরকারী তহবিলের অপব্যবহার ঘটানো হয়েছে। এখানে মেগা প্রকল্পগুলোতে ভারতীয় কোম্পানিগুলোকে অংশগ্রহণের বিনিময়ে বাংলাদেশকে রাজনৈতিক সুবিধা দেবার ব্যাপারটা কাজ করেছে। সেই সাথে আরও বিভিন্ন সুবিধা ভারত পেয়েছে, যেমন পানিবণ্টন সহ বিভিন্ন ইস্যুর ক্ষেত্রেও ভারতের ওপর চাপ পড়েনি। বাংলাদেশকে রাজনৈতিক সহায়তা প্রদানের ব্যাপারটা মূলত দুই রকমের। একটি হলো নির্বাচনে সহ বিভিন্নভাবে আওয়ামী লীগকে সরাসরি সহায়তার মাধ্যমে, আরেকটি হলো আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের দমনের মাধ্যমে। এখানে সরাসরি সহায়তার কথা বলা হবে, রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের দমনেরটা পরের পয়েন্টে বলব। এখন মেগা প্রকল্পগুলো পাইয়ে দেবার ফলে আওয়ামী লীগ যে দুর্নীতি ও লুটপাট করেছে সেই অর্থকে তারা পুরো নির্বাচনকে নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যবহার করেছে, এই অভিয়াস ও পরোক্ষ কারণের বাইরে গিয়েই ভারতের ইনফ্লুয়েন্সের ব্যাপারটা তুলে আনছি। আমার মতে প্রভাবটা চার রকমের।

প্রথমত, নির্বাচনকালীন কূটনৈতিক সমর্থন, যেখানে নির্বাচনের সময় ভারতের সরকার আওয়ামীলীগ সরকারের প্রতি কূটনৈতিক সমর্থন প্রদান করে। নির্বাচনী বৈধতা ও সরকারের স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে ভারত সরকারের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তারা আওয়ামীলীগ সরকারকে সমর্থন জানান। ভারতের সমর্থনের ফলে আন্তর্জাতিক মহল থেকে আসা সমালোচনার পরিমাণ কমে যায় এবং নির্বাচনের বৈধতা প্রতিষ্ঠা পায়। ২০১৮ এর নির্বাচনের আগে ও পরে তো ভারতীয় সরকার আওয়ামীলীগ সরকারের প্রতি প্রকাশ্যে সমর্থন জানায়। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি শেখ হাসিনার সরকারের প্রতি প্রকাশ্যে সমর্থন জানিয়ে বলেন যে বাংলাদেশের উন্নয়ন এবং স্থিতিশীলতার জন্য শেখ হাসিনার নেতৃত্ব প্রয়োজনীয়। এই সমর্থনের ফলে, আওয়ামীলীগ সরকার নির্বাচনকালীন সময়ে অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক চাপ মোকাবিলা করতে সক্ষম হয়।

দ্বিতীয়ত আন্তর্জাতিক মঞ্চে সমর্থন। ভারত আন্তর্জাতিক মঞ্চে বাংলাদেশের আওয়ামীলীগ সরকারকে সমর্থন জানিয়েছে, যা তাদের বৈধতা এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক স্থিতিশীল রাখতে সাহায্য করেছে। ভারতের সমর্থন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জন্য একটি শক্তিশালী বার্তা পাঠিয়েছে যে ভারত আওয়ামীলীগ সরকারের পাশে রয়েছে। ভারত বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে বাংলাদেশ সরকারের স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নের প্রশংসা করেছে এবং শেখ হাসিনার নেতৃত্বকে সমর্থন জানিয়েছে। এই সমর্থনের ফলে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বিশেষ করে পশ্চিমা দেশগুলো বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করতে দ্বিধা করেছে, কারণ ভারত তাদের অন্যতম প্রধান মিত্র হিসেবে বাংলাদেশ সরকারকে সমর্থন দিয়েছে।

তৃতীয়ত নিরাপত্তা এবং বাণিজ্যিক সহযোগিতা। নির্বাচনের সময়, আগে আগে এবং পরপর দেখা যায় ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে নিরাপত্তা ও বাণিজ্যিক সহযোগিতা বাড়িয়ে দেয়। এই সহযোগিতার মাধ্যমে বাংলাদেশ সরকারকে কৌশলগতভাবে সমর্থন জানানো হয়, যা তাদের ক্ষমতা ধরে রাখার প্রক্রিয়াকে সহজতর করেছে। এখানে নিরাপত্তা সহযোগিতাগুলোর মধ্যে আছে ভারতের সাথে যৌথ নিরাপত্তা উদ্যোগগুলি, যেমন সীমান্ত নিরাপত্তা ও সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান। এগুলো আওয়ামীলীগ সরকারের জন্য একটি বড় সমর্থন হিসেবে কাজ করেছে। এই সহযোগিতা নির্বাচনের সময় সরকারকে বিরোধী দলগুলোর ওপর কঠোর অবস্থান নিতে সাহায্য করেছে, যেটা নিয়ে পরে বলব। আর বাণিজ্যিক চুক্তির ক্ষেত্রে বলতে পারি, নির্বাচনের আগে এবং পরে, ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে বিভিন্ন বাণিজ্যিক চুক্তি করে, যা দেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। এর ফলে, আওয়ামীলীগ সরকার তাদের উন্নয়নের ম্যান্ডেটকে শক্তিশালী করতে এবং নির্বাচনের বৈধতা নিশ্চিত করতে সক্ষম হয়েছে।

চতুর্থত গণমাধ্যম এবং জনমত প্রভাবিত করার ব্যাপারটা। ভারতীয় গণমাধ্যম এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বাংলাদেশে আওয়ামীলীগ সরকারের স্থিতিশীলতা এবং উন্নয়নের প্রশংসা করেছেন, যা ভারতীয় জনগণ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মধ্যে একটি ইতিবাচক ধারণা তৈরি করেছে। এই ধরনের প্রচার প্রচারণা আওয়ামীলীগের পক্ষে জনমত তৈরি করতে সাহায্য করেছে। এখানে আমরা বিভিন্ন প্রভাবশালী মন্তব্য ও প্রবন্ধ দেখতে পাই। ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে শেখ হাসিনার নেতৃত্ব এবং তার সরকারের উন্নয়নের উদ্যোগ নিয়ে প্রভাবশালী মন্তব্য এবং প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। এই ধরনের প্রচারণা বাংলাদেশে আওয়ামীলীগ সরকারের জন্য একটি ইতিবাচক আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি তৈরি করেছে, যা নির্বাচনের সময় সহায়ক হয়েছে।

খ. হাসিনা সরকারের স্থানীয় রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের দমন

ভারতের কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক সমর্থন পাওয়ার কারণে, আওয়ামীলীগ সরকার স্থানীয় বিরোধী দলগুলোকে কোণঠাসা করতে সক্ষম হয়েছে। মেগা প্রকল্পের ক্ষেত্রে যেমন দেখা যায় রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পের ক্ষেত্রে, বিরোধী দলগুলো এবং পরিবেশবাদী আন্দোলনকারীরা প্রকল্পের বিরোধিতা করলেও, ভারতীয় সমর্থনের কারণে আওয়ামীলীগ সরকার এই প্রকল্প বাস্তবায়ন চালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে ও সেই সাথে কোন রকম বিরোধিতার কোন কেয়ার না করে প্রকল্প বাস্তবায়নের নামে দুর্নীতির মাধ্যমে বিপুল অর্থ আত্মসাৎ করেছে। ভারতের সমর্থনের ফলে, স্থানীয় বিরোধী দলগুলোর প্রচেষ্টাগুলো দুর্বল হয়ে পড়েছে এবং লুটপাটের সুযোগ বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু আমি এই অভিয়াস ও পরোক্ষ ব্যাপারটা এখানে বলব না। এর আগের পয়েন্টে যেগুলো লেখা হয়েছে সেগুলোর জন্য আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের এমনিতেই দুর্বল হয়ে পড়ার কথা। তাই কূটনৈতিক চাপের মাধ্যমে বিরোধীদের দমন, লীগকে নির্বাচনী বৈধতা দেবার মাধ্যমে বিরোধীদের দমন, মেগা প্রকল্পগুলোতে ভারতের সহায়তার জন্য আওয়ামীলীগ সরকারের কৌশলগতভাবে অর্থনৈতিক উন্নয়নের ম্যান্ডেট ধরে রাখতে সক্ষম হওয়ায় বিরোধীদের ক্ষতি – এসবের আলোচনা এখানে হবেনা, ওগুলো আগের পয়েন্টটারই অভিয়াস ফলাফল। এখানে আমি আওয়ামী লীগের প্রতিদ্বন্দ্বীদের সরাসরি দমনের ব্যাপারগুলো আনব। –

প্রথমত, ভারতীয় সমর্থন পাওয়ার ফলে আওয়ামীলীগ সরকার বিরোধী দলগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিতে সক্ষম হয়েছে। বিরোধীদের দমন এবং রাজনৈতিক ক্ষমতা ধরে রাখার ক্ষেত্রে ভারতীয় সমর্থন আওয়ামীলীগকে আত্মবিশ্বাস যুগিয়েছে, যে আত্মবিশ্বাসের কারণে আওয়ামীলীগ সরকার পুলিশ, র‍্যাব, এবং অন্যান্য নিরাপত্তা সংস্থাগুলোকে ব্যবহার করে বিরোধী দলগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে পেরেছে। উদাহরণস্বরূপ, বিরোধী দলগুলোর নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা, গ্রেফতার, এবং নির্যাতনের মাধ্যমে তাদেরকে কোণঠাসা করা হয়েছে, যা বিরোধী রাজনীতির জন্য একটি বড় প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছে।

দ্বিতীয়ত, আগের পয়েন্টটাতে ভারতের যে নিরাপত্তা ও সামরিক সহযোগিতাগুলোর কথা বলা হয়েছে, সেগুলোর কারণে আওয়ামীলীগ সরকার নিজস্ব নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী করতে সক্ষম হয়েছে, যা বিরোধী দলগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে সহায়ক হয়েছে। ভারত-বাংলাদেশের যৌথ সন্ত্রাসবিরোধী সহযোগিতার ফলে আওয়ামীলীগ সরকার দেশের অভ্যন্তরে যে কোনও ধরনের সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপকে দমন করতে সক্ষম হয়েছে। এটি বিরোধী দলগুলোর মধ্যে উগ্রপন্থী গোষ্ঠীর সমর্থনের সম্ভাবনা হ্রাস করেছে এবং সরকার বিরোধী দলগুলোর ওপর আরও নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে পেরেছে। এখানে বিশেষভাবে যেটা উল্লেখ্য সেটা হলো ভারত এবং বাংলাদেশ সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় একে অপরের সঙ্গে তথ্য বিনিময় এবং যৌথ অভিযান পরিচালনার ব্যাপারগুলো। বিশেষ করে সীমান্ত এলাকায় উগ্রপন্থী গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে অভিযানের ক্ষেত্রে এই সহযোগিতা অত্যন্ত কার্যকরী হয়েছে।

এখন তথ্য বিনিময়ের ক্ষেত্রে যেটা দেখা যায়, ভারতীয় নিরাপত্তা সংস্থাগুলো বাংলাদেশের নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর সঙ্গে নিয়মিত তথ্য বিনিময় করে থাকে। এর মধ্যে হুমকি সম্পর্কে আগাম সতর্কতা, সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর কার্যক্রম, এবং সম্ভাব্য সন্ত্রাসী হামলার পরিকল্পনা সম্পর্কে তথ্য থাকে। আর যৌথ অভিযানের উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী যেমন উলফা (ULFA) এবং অন্যান্য উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় গোষ্ঠীগুলোর নেতাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের ভূখণ্ডে যৌথ অভিযান পরিচালিত হয়েছে। এই অভিযানের ফলে উগ্রপন্থী গোষ্ঠীগুলোর কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণে এসেছে এবং ভারত ও বাংলাদেশের নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর মধ্যে সম্পর্ক আরও দৃঢ় হয়েছে। তো এগুলো বাংলাদেশের নিরাপত্তার জন্য উপকারী, কিন্তু এর সাইড এফেক্টে যেটা হচ্ছে সেটা হলো এই যৌথ সহযোগিতা এবং নিরাপত্তা বাহিনীর উন্নত কার্যক্রম আওয়ামীলীগ সরকারকে বিরোধী দলগুলোর ওপর কঠোর পদক্ষেপ নিতে সুযোগ করে দিয়েছে। সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের অজুহাতে বিরোধী দলগুলোর ওপর বিভিন্ন সময়ে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। আওয়ামীলীগ সরকার মাঝে মাঝে বিরোধী দলগুলোর নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদের অভিযোগ তুলে তাদের গ্রেফতার বা নির্যাতন করেছে। উদাহরণস্বরূপ, বিএনপির কিছু নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ তুলে তাদের আটক বা হয়রানি করা হয়েছে। সেই সাথে, আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে বিরোধী দলগুলোর কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণে ব্যবহার করা হয়েছে। ভারতীয় সহযোগিতা এবং প্রশিক্ষণের কারণে এসব সংস্থার কার্যকারিতা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে, যা বিরোধীদের ওপর কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার ক্ষেত্রে কার্যকর হয়েছে।

ভারত-বাংলাদেশের যৌথ সন্ত্রাসবাদবিরোধী অভিযান এবং সহযোগিতা বিরোধী দলগুলোর উপর একটি কৌশলগত চাপ সৃষ্টি করেছে, যেখানে বিশেষ করে, বিএনপি এবং জামায়াত-ই-ইসলামী দলের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার ইতিহাস আছে, বারবার অভিযোগ তোলা হয়েছে, যা তাদের রাজনৈতিক অবস্থানকে দুর্বল করেছে। সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে অভিযানের অজুহাতে বিরোধী দলের নেতাদের রাজনৈতিকভাবে কোণঠাসা করা হয়েছে। এর ফলে, বিরোধী দলগুলো সংগঠিত হয়ে সরকারের বিরুদ্ধে কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছে।

তৃতীয়ত, এখানে আন্তর্জাতিক সমর্থন এবং বৈধতার দাবির ব্যাপারও আছে। সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ভারতের সঙ্গে সহযোগিতা করায়, আওয়ামীলীগ সরকার আন্তর্জাতিকভাবে বৈধতা দাবি করতে পেরেছে। আন্তর্জাতিক মহলে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সক্রিয় ভূমিকা পালন করার জন্য আওয়ামীলীগ সরকারকে প্রশংসা করা হয়েছে, যা তাদের রাজনৈতিক অবস্থানকে শক্তিশালী করেছে। এখন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, বিশেষ করে পশ্চিমা দেশগুলো, সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে আওয়ামীলীগ সরকারের কঠোর অবস্থানকে সমর্থন করেছে। এর ফলে, দেশীয় রাজনীতিতে বিরোধী দলগুলোর ওপর কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য আওয়ামীলীগ আন্তর্জাতিক চাপের মুখোমুখি হতে হয়নি। এই সমর্থন সরকারকে আত্মবিশ্বাসী করেছে এবং বিরোধী দলগুলোর বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে সহায়তা করেছে।

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.