Table of Contents
ট্রান্সবাউন্ডারি নিয়ে ভারতের আধিপত্য
ট্রান্সবাউন্ডারি (transboundary) নদীগুলোতে কোনো দেশের সরকার চাইলেই অন্য দেশের সাথে চুক্তি না করে বাঁধ দিতে পারে না, কারণ হলো ট্রান্সবাউন্ডারি নদীগুলো একাধিক দেশের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হয়, এবং এসব নদীর পানি ব্যবস্থাপনা ও ব্যবহার নিয়ে আন্তর্জাতিক আইন এবং চুক্তির ভিত্তিতে নির্দিষ্ট নীতিমালা অনুসরণ করা হয়। যখন একটি দেশ ট্রান্সবাউন্ডারি নদীতে বাঁধ নির্মাণ করতে চায়, তখন সেই বাঁধের প্রভাব অন্যান্য নিম্নগতির দেশগুলোর ওপর পড়তে পারে, ফলে আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী, সংশ্লিষ্ট দেশগুলোকে একে অপরের সঙ্গে আলোচনা এবং সমঝোতা করতে হয়। উদাহরণস্বরূপ, ১৯৯৭ সালের জাতিসংঘের “Convention on the Law of the Non-Navigational Uses of International Watercourses” চুক্তি অনুসারে, নদীগুলোর ব্যবহার অবশ্যই ন্যায্য এবং যুক্তিসংগত হতে হবে, এবং কোনো দেশ এমন কোনো পদক্ষেপ নিতে পারে না যা অন্য দেশের ক্ষতি করবে। এছাড়া, ঐতিহাসিকভাবে, অনেক দেশের মধ্যে এমন ট্রান্সবাউন্ডারি নদীর বিষয়ে বিশেষ চুক্তি রয়েছে, যেখানে নদীর পানি ভাগাভাগি এবং ব্যবস্থাপনার জন্য নীতিমালা নির্ধারণ করা হয়েছে।
কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে আমরা কী দেখি? এই রিসেন্ট বন্যার কথা বলা যাক। ত্রিপুরার ডম্বুর হাইড্রোইলেক্ট্রিক পাওয়ার প্রজেক্ট (Dumbur Hydroelectric Power Project) হলো ত্রিপুরা রাজ্যের গোমতী নদীতে নির্মিত একটি জলবিদ্যুৎ প্রকল্প। এই প্রকল্পের মূল অংশ হলো ডম্বুর বাঁধ (Dumbur Dam), যা গোমতী নদীর উপর নির্মিত হয়েছে। এটার গেইট খুলে দেবার ফলেই আকস্মিক বন্যা হচ্ছে আর এত ক্ষয়ক্ষতি। ডম্বুর বাঁধটি ১৯৭৪ সালে নির্মিত হয়েছিল ও ১৯৭৬ সালে চালু হয়েছিল। এটি নিয়ে ভারতের সাথে বাংলাদেশের কোন চুক্তি হয়নি। সেই সময় ১৯৯৭ সালের সেই নদী কনভেনশন ছিলনা, কিন্তু ১৯৬৬ সালের হেলসিংকি রুলস ছিল, যা ইন্টারন্যাশনাল ল’ অ্যাসোসিয়েশন (International Law Association) দ্বারা প্রণীত হয়, যা আন্তর্জাতিক নদীগুলোর ক্ষেত্রে পানির ন্যায্য বণ্টন ও ব্যবহারের উপর দিকনির্দেশনা প্রদান করে। এতে বলা হয়েছিল যে, একটি নদী যখন একাধিক দেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়, তখন সব দেশের উচিত নদীর পানি ন্যায্য ও যুক্তিসঙ্গতভাবে ব্যবহার করা এবং একে অপরের স্বার্থ বিবেচনা করা। তাছাড়া ছিল বিভিন্ন উদাহরণ যেমন ১৯৬০ সালের ইন্দাস ওয়াটার ট্রিটি, ১৯৫৯ সালের নীল নদের চুক্তি, ট্রান্সবাউন্ডারি নীতিমালা। কিন্তু এত কিছুর পরও কোন রকম চুক্তিই হয়নি, ভারত সেই ডম্বুর বাঁধ নির্মাণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সাথে কোনরকম চুক্তিতে যায়নি।
যদি ভুল না করে থাকি, ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রবাহিত নদীগুলোর মধ্যে প্রধানত ৫৪টি নদী রয়েছে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো গঙ্গা, তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র, মেঘনা ইত্যাদি। এসব নদীর ওপর ভারতের মোট ৩০টি বাঁধ রয়েছে। এর মধ্যে গঙ্গা নদীর ওপর ফারাক্কা বাঁধ এবং তিস্তা নদীর ওপর গজলডোবা বাঁধ উল্লেখযোগ্য। এছাড়া অন্যান্য নদীর ওপরও বিভিন্ন ধরনের ছোট-বড় বাঁধ এবং ব্যারেজ রয়েছে, যা বাংলাদেশের পানির প্রবাহে প্রভাব ফেলছে। আর এতগুলো বাঁধের মধ্যে বাংলাদেশের সাথে ভারতের চুক্তির আলোচনা হয়েছে মাত্র দুটো ক্ষেত্রে, আর চুক্তি হয়েছে একটি ক্ষেত্রে। চুক্তি যেটাতে হয়েছে সেটা হলো হলো গঙ্গা নদীর ফারাক্কা বাঁধের ক্ষেত্রে। ১৯৬১ সালে এর নির্মাণকাজ শুরু হয় এবং ১৯৭৫ সালে এটি সম্পূর্ণ হয়। ১৯৭৭ সালে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ফারাক্কা বাঁধ নিয়ে প্রথম দ্বিপাক্ষিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তি ৫ বছর মেয়াদী ছিল। এর পর বিভিন্ন সময়ে পানি বণ্টন নিয়ে আলোচনার মাধ্যমে চুক্তি নবায়ন করা হয়েছে। সর্বশেষ ১৯৯৬ সালে একটি দীর্ঘমেয়াদী ৩০ বছরের চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যা এখনো কার্যকর রয়েছে। আর চুক্তি যেটায় হয়নি সেটা হলো তিস্তা নদীর গজলডোবা বাঁধ। এটি ১৯৮৭ সালে তিস্তা নদীর ওপর তৈরি করা হয়। তিস্তা নদীর পানি বণ্টন নিয়ে এখন পর্যন্ত ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে একটি পূর্ণাঙ্গ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়নি। ১৯৮৩ সালে একটি আদর্শিক সমঝোতা হয়েছিল, যা অস্থায়ীভাবে কার্যকর ছিল, কিন্তু পরবর্তীতে তিস্তা নদীর পানি বণ্টন নিয়ে কোনো স্থায়ী চুক্তি হয়নি। চুক্তির বিষয়ে আলোচনা এখনও চলমান। এই দুটো ছাড়া ভারতের আরও যেসব বাঁধ রয়েছে সেগুলো নিয়ে ভারতের সাথে কোনরকম চুক্তি নেই।
এই অবস্থায় প্রশ্ন আসে দ্বিপাক্ষিক চুক্তিই কেন করতে হবে? আন্তর্জাতিক আইন তো আছেই যা অনুসারে সব নির্ধারিত হবে। এখানেই সবচেয়ে মজার ব্যাপারটা। বাংলাদেশ তো জাতিসংঘের ১৯৯৭ সালের নদী কনভেনশনটাতে সাক্ষরই করেনি। বাংলাদেশ এইসব সমস্যার ক্ষেত্রে বরাবরই ভারতের সাথে দ্বিপাক্ষিক চুক্তির উপর আস্থাশীল থেকেছে আর তাতে চুক্তি হয়েছে মাত্র একটি। কিন্তু এরপরও বাংলাদেশ সেই ১৯৯৭ এর নদী কনভেনশনের দিকে যায়নি। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের যুক্তি ছিল দেশের সার্বভৌমত্বে আঘাত! সেটা কিরকম? এই যেমন ধরুন, আন্তর্জাতিক নদী কনভেনশন সাক্ষর করলে বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক নিয়মাবলী এবং শর্ত মেনে চলতে হবে, যা দেশের অভ্যন্তরীণ নদীর পানি ব্যবহারের উপর বিধিনিষেধ আরোপ করতে পারে। এটি দেশের নিজস্ব পানি সম্পদের উপর নিয়ন্ত্রণ সীমিত করতে পারে এবং দেশের কৃষি, শিল্প এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ খাতের জন্য পর্যাপ্ত পানি সংরক্ষণে চ্যালেঞ্জ তৈরি করতে পারে। এরপর ধরুন বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নীতিমালার উপর প্রভাব, আন্তর্জাতিক কনভেনশনে সাক্ষর করার ফলে বাংলাদেশের পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনা নীতিমালা আন্তর্জাতিক আইনের আওতায় চলে আসবে, যা দেশের অভ্যন্তরীণ আইন এবং নীতিমালার সাথে সংঘর্ষ হতে পারে, দেশের সার্বভৌম সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতাকে সীমিত করে দেশের নিজস্ব প্রয়োজন অনুযায়ী সিদ্ধান্ত গ্রহণে বাধা সৃষ্টি করতে পারে। এরপর ধরুন সাক্ষর করলে আন্তর্জাতিক মহল থেকে চাপ সৃষ্টি হতে পারে, যেখানে অন্যান্য দেশ বা আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো বাংলাদেশের নদী ব্যবস্থাপনা বা পানি বণ্টনের বিষয়ে মতামত দিতে পারে। সেই সাথে যেকোনো নদী-সম্পর্কিত বিরোধের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক আদালত বা সংস্থার উপর নির্ভরশীল হতে হবে। আর এসবের ফলে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব বলে আর কিছু থাকবে না। তো এগুলোই হলো এতদিন যাবত বাংলাদেশের অযুহাতসমূহ। তো সুতরাং এসব বাদ দিয়ে, ভারতের সাথে দ্বিপাক্ষিক আলোচনাতেই সব বুঝে নাও, কিন্তু তাতে কিনা চুক্তি হলো মাত্র একটা, আর পেলাম খরা ও বন্যা।
একটু মাথা খাটালেই বোঝা যায় যে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক নদী কনভেনশনে সাক্ষর না করার কারণটা কী। আন্তর্জাতিক রাজনীতির পরিভাষায় মেইন কারণটা হলো ইন্ডিরেক্টলি বললে ভারতের সাথে দ্বিপাক্ষিক চুক্তির মাধ্যমে স্থিতিশীল সম্পর্ক বজায় রাখা, আর ডিরেক্টলি বললে ভারতের আধিপত্য। তো স্থিতিশীল সম্পর্ক বজায় রাখা মানেটা কী? মানে হলো সীমান্তে এলাকায় যাতে উত্তেজনা ও সংঘর্ষের আশঙ্কা বেড়ে গিয়ে স্থিতিশীলতা না কমে, দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্কে ব্যাঘাত ঘটে যাতে স্থিতিশীলতা না কমে, কূটনৈতিক যোগাযোগ ব্যহত হয়ে স্থিতিশীলতা না কমে, যৌথ উন্নয়ন প্রকল্পগুলো ব্যহত হয়ে স্থিতিশীলতা না কমে ইত্যাদি বিষয়ে খেয়াল রাখা। মানে সোজা কথায় ব্যাপারটা অনেকটা ব্ল্যাকমেইলের মতো কাজ করে। নদী নিয়ে যা করবে সব আমার সাথে দ্বিপাক্ষিক চুক্তির মধ্য দিয়েই করবে, তাতে চুক্তি মোটে একটা হলে হোক, কিন্তু যদি আমার সাথে চুক্তির বদলে আন্তর্জাতিক আইনের হেল্প নিতে গেছো তো আমার সাথে সীমান্ত, বাণিজ্য, কূটনীতি, উন্নয়ন প্রকল্প কিছুই আর ঠিক থাকবে না! ব্যাস এটাই। আর সোজা কথায় এটাই হলো আধিপত্য, দুর্বল দেশের ওপর সবল দেশের আধিপত্য।
এই আধিপত্যের নেচারটা কী তা নিয়ে বিভিন্ন রকমের তত্ত্ব আছে, এবং প্রত্যেক তত্ত্বই আমাদেরকে এই আধিপত্যকে ট্যাকল করার কিছু উপায় বলে দেয়। এই লেখায় এইসব বিষয়ই আলোচনা করা হবে, অবশ্যই আমাদের মূল ফোকাস ট্রান্সবাউন্ডারি (transboundary) নদীতে বাঁধের ব্যাপারটা ফোকাসে রেখে।
বিভিন্ন আন্তর্জাতিক রাজনীতি তত্ত্ব ও এগুলোর আলোকে ভারতের আধিপত্যবাদ
রিয়ালিজম (Realism) তত্ত্ব
রিয়ালিজম (Realism) তত্ত্ব আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি প্রধান এবং প্রভাবশালী তত্ত্ব, যা রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে শক্তি এবং জাতীয় স্বার্থের ভূমিকা ব্যাখ্যা করে। এই তত্ত্বের প্রধান দার্শনিক এবং তত্ত্ববিদদের মধ্যে হান্স জে. মরগেনথাউ (Hans J. Morgenthau) অন্যতম, এবং তার লেখা Politics Among Nations (1948) রিয়ালিজম তত্ত্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি স্থাপন করেছে। রিয়ালিজম তত্ত্ব অনুযায়ী, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের প্রধান লক্ষ্য হলো রাষ্ট্রগুলোর জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করা এবং তাদের ক্ষমতার ভারসাম্য বজায় রাখা। এই তত্ত্বের প্রধান কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা হলো জাতীয় স্বার্থ (National Interest), ক্ষমতার ভারসাম্য (Balance of Power) ও বাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গি (Realist Perspective)। একটু বর্ণনা করা যাক। রিয়ালিজম তত্ত্বে প্রতিটি রাষ্ট্রের প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে তার জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করা। জাতীয় স্বার্থ বলতে বোঝানো হয় রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব, নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষা করা। এই স্বার্থ রক্ষা করতে রাষ্ট্রগুলো প্রয়োজন হলে অন্য দেশগুলোর ওপর প্রভাব বিস্তার করে বা তাদের স্বার্থকে উপেক্ষা করতে পারে। আবার রিয়ালিজম তত্ত্ব অনুযায়ী, আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে সব রাষ্ট্রেরই ক্ষমতার ভারসাম্য বজায় রাখার চেষ্টা করা উচিত, যাতে কোনো একক রাষ্ট্র বা গোষ্ঠী অত্যধিক শক্তিশালী হয়ে উঠতে না পারে। ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষা করতে রাষ্ট্রগুলো কৌশলগত জোট তৈরি করে, যুদ্ধের হুমকি দেয়, বা প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তির ওপর চাপ সৃষ্টি করে। সেই সাথে রিয়ালিজম তত্ত্বে বলা হয় যে, আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে একটি নৈরাজ্যপূর্ণ (anarchic) পরিবেশ হিসেবে দেখা উচিত, যেখানে প্রতিটি রাষ্ট্র নিজের স্বার্থ রক্ষার জন্য কাজ করে। রাষ্ট্রগুলো সাধারণত নৈতিকতা বা আদর্শিক মূল্যবোধের চেয়ে তাদের শক্তি ও স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেয়।
তো ডুম্বুর হাইড্রোইলেক্ট্রিক প্রজেক্টের ক্ষেত্রে ভারতের পদক্ষেপকে রিয়ালিজম তত্ত্বের আলোকে ব্যাখ্যা করলে কী দাঁড়াচ্ছে? ভারতের দৃষ্টিকোণ থেকে, ডুম্বুর বাঁধ নির্মাণের প্রধান লক্ষ্য ছিল তার জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করা, বিশেষ করে বিদ্যুৎ উৎপাদন ও জলসম্পদ ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা। জাতীয় স্বার্থের ক্ষেত্রে বলা যায়, ডুম্বুর বাঁধের মাধ্যমে ভারত ত্রিপুরার বিদ্যুৎ চাহিদা পূরণ এবং সেচের জন্য পানির যোগান দিতে চেয়েছিল, যা তার জাতীয় স্বার্থের অন্তর্ভুক্ত। ভারতের দৃষ্টিতে, এই প্রকল্পটি ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, এবং তাই তারা এটি সম্পন্ন করেছে। রিয়ালিজম দিয়ে বাংলাদেশে এই বাঁধের প্রভাব উপেক্ষা করার ব্যাপারটাও ব্যাখ্যা করা যায়। রিয়ালিজম তত্ত্ব অনুযায়ী, শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলো প্রায়শই দুর্বল রাষ্ট্রের স্বার্থকে উপেক্ষা করে, বিশেষ করে যদি তা তাদের জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে বিরোধপূর্ণ হয়। ডুম্বুর বাঁধের ক্ষেত্রে, ভারত সম্ভবত বাংলাদেশের ওপর প্রভাব বিবেচনা না করেই এই প্রকল্প সম্পন্ন করেছে, কারণ তাদের মূল লক্ষ্য ছিল নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করা। রিয়ালিজম অনুযায়ী এখানে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের নৈরাজ্য (Anarchy) ধারণাটিও এসে যায়। রিয়ালিজম তত্ত্বে আন্তর্জাতিক পরিবেশকে নৈরাজ্যপূর্ণ হিসেবে দেখা হয়, যেখানে কোনো কেন্দ্রীয় ক্ষমতা বা কর্তৃপক্ষ নেই। এই নৈরাজ্যপূর্ণ পরিবেশে রাষ্ট্রগুলো নিজেদের স্বার্থ রক্ষায় স্বয়ংসম্পূর্ণভাবে কাজ করে। ভারত হয়তো এই নৈরাজ্যপূর্ণ পরিবেশের সুযোগ নিয়ে ডুম্বুর বাঁধ নির্মাণ করেছে, কারণ তারা জানত যে, বাংলাদেশের পক্ষে আন্তর্জাতিক মঞ্চে তাদের চ্যালেঞ্জ করা কঠিন হবে।
এই পরিস্থিতি রিয়ালিজম তত্ত্বের মূল ধ্যান-ধারণার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ, যেখানে শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলো তাদের স্বার্থ রক্ষার জন্য দুর্বল রাষ্ট্রের প্রভাব বা অধিকারকে উপেক্ষা করতে পারে। ডুম্বুর বাঁধের নির্মাণে ভারতের ভূমিকা রিয়ালিজম তত্ত্বের একটি উদাহরণ হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে, যেখানে ভারতের জাতীয় স্বার্থকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, এবং বাংলাদেশের স্বার্থ বিবেচনায় নেওয়া হয়নি।
নব্য-ঔপনিবেশবাদ (Neocolonialism) তত্ত্ব
নব্য-ঔপনিবেশবাদ (Neocolonialism) তত্ত্বটি উপনিবেশ পরবর্তী যুগে স্বাধীনতা অর্জনকারী দেশগুলোর ওপর অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, এবং সাংস্কৃতিক শোষণ ও নিয়ন্ত্রণের প্রক্রিয়া ব্যাখ্যা করে। ফ্রান্তস ফানঁ (Frantz Fanon) এই তত্ত্বের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন, এবং তার কাজ The Wretched of the Earth (1961) এই ধারণার বিকাশে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে। পরে ক্বামে নক্রুমাহ (Kwame Nkrumah) এই তত্ত্বের অন্যতম প্রধান প্রবক্তা হয়ে ওঠেন, এবং তার কাজ Neo-Colonialism: The Last Stage of Imperialism (1965) এই ধারণার বিকাশে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে। নব্য-ঔপনিবেশবাদ তত্ত্ব অনুযায়ী, উপনিবেশ থেকে মুক্তি পাওয়ার পরও প্রাক্তন উপনিবেশগুলো অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী রাষ্ট্রগুলোর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত থাকে। এই প্রক্রিয়াটি সরাসরি সামরিক দখলদারির পরিবর্তে অর্থনৈতিক নির্ভরতা, সাংস্কৃতিক আধিপত্য, এবং রাজনৈতিক প্রভাবের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। মূলত, নব্য-ঔপনিবেশবাদ একটি অদৃশ্য শোষণ প্রক্রিয়া, যা স্বাধীন দেশগুলোকে তাদের নিজস্ব উন্নয়ন এবং সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠায় বাধা দেয়। নব্য-ঔপনিবেশবাদের প্রধান উপাদানসমূহ হচ্ছে অর্থনৈতিক শোষণ, সাংস্কৃতিক আধিপত্য ও রাজনৈতিক প্রভাব। অর্থনৈতিক শোষণের ক্ষেত্রে নব্য-ঔপনিবেশবাদী রাষ্ট্রগুলো তাদের অর্থনৈতিক প্রভাব ব্যবহার করে দুর্বল বা উন্নয়নশীল দেশগুলোর সম্পদ আহরণ করে। এটি মূলত বহুজাতিক কোম্পানি, ঋণ, এবং বাণিজ্যিক সম্পর্কের মাধ্যমে ঘটে থাকে, যা প্রাক্তন উপনিবেশগুলোকে উন্নত দেশগুলোর ওপর নির্ভরশীল করে রাখে। সাংস্কৃতিক আধিপত্যের ক্ষেত্রে নব্য-ঔপনিবেশবাদী রাষ্ট্রগুলো তাদের সংস্কৃতি, ভাষা, এবং মূল্যবোধ অন্য দেশগুলোর ওপর চাপিয়ে দেয়, যা স্থানীয় সংস্কৃতিকে দুর্বল করে এবং পশ্চিমা সংস্কৃতিকে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে সাহায্য করে। রাজনৈতিক প্রভাবের ক্ষেত্রে নব্য-ঔপনিবেশবাদে প্রভাবশালী রাষ্ট্রগুলো উন্নয়নশীল দেশগুলোর ওপর রাজনৈতিকভাবে প্রভাব বিস্তার করে। এটি প্রায়শই দুর্বল দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপের মাধ্যমে ঘটে, যেখানে তারা স্থানীয় সরকারকে প্রভাবিত করতে বা নিয়ন্ত্রণ করতে চেষ্টা করে।
ফ্রান্তস ফানঁ তার বই The Wretched of the Earth (1961)-এ উপনিবেশোত্তর শোষণ এবং বঞ্চনার বিরুদ্ধে জোরালো বক্তব্য রাখেন। তিনি তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোকে তাদের প্রাক্তন ঔপনিবেশিক শোষকদের প্রভাব থেকে মুক্ত হওয়ার আহ্বান জানান এবং নিজেদের স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রামের প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করেন। যদিও ফানঁ সরাসরি নব্য-ঔপনিবেশবাদী শোষণের কথা বলেননি, তার কাজগুলো নব্য-ঔপনিবেশবাদের ধারণার সাথে মিল খুঁজে পাওয়া যায়, বিশেষ করে যখন এটি তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোকে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিকভাবে প্রভাবিত করার প্রক্রিয়ার কথা বলা হয়।
ক্বামে নক্রুমাহর (Kwame Nkrumah) মতে, নব্য-ঔপনিবেশবাদে শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলো তাদের অর্থনৈতিক প্রভাব, ঋণ, এবং বহুজাতিক কোম্পানির মাধ্যমে দুর্বল দেশগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করে। এই প্রক্রিয়ায় প্রাক্তন উপনিবেশগুলো তাদের প্রাকৃতিক সম্পদ এবং শ্রম ব্যবস্থার মাধ্যমে উন্নত দেশগুলোর ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে, যা তাদের প্রকৃত সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠায় বাধা দেয়। নক্রুমাহ এই শোষণ প্রক্রিয়াকে উপনিবেশবাদের একটি নতুন এবং উন্নত রূপ হিসেবে বর্ণনা করেন, যেখানে সামরিক বা রাজনৈতিক দখলদারি ছাড়াই অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা হয়। তার মতে, নব্য-ঔপনিবেশবাদ হলো আধুনিক শোষণের একটি অদৃশ্য প্রক্রিয়া, যা প্রাক্তন উপনিবেশগুলোকে সার্বভৌমত্ব থেকে বঞ্চিত করে এবং তাদের উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করে। তিনি বলেন, নব্য-ঔপনিবেশবাদ মোকাবেলার জন্য তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে এবং নিজেদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্বার্থ রক্ষায় সচেতন হতে হবে।
নব্য-ঔপনিবেশবাদ তত্ত্বের আলোকে ভারতের ভূ-রাজনৈতিক প্রভাব ও ডুম্বুর বাঁধ নির্মাণের প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করা যেতে পারে। ভারত একটি প্রভাবশালী আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর ওপর রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক প্রভাব বিস্তার করতে পারে। অর্থনৈতিক প্রভাবের ক্ষেত্রে বলা যায়, ভারত তার অর্থনৈতিক ও অবকাঠামোগত ক্ষমতা ব্যবহার করে বাংলাদেশের মতো প্রতিবেশী দেশগুলোর ওপর প্রভাব বিস্তার করতে পারে। ডুম্বুর বাঁধের মতো প্রকল্পগুলোর মাধ্যমে ভারত তার জলসম্পদ ব্যবস্থাপনায় আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে এবং সম্ভবত বাংলাদেশের ওপর তার অর্থনৈতিক নির্ভরতা বাড়ায়। রাজনৈতিক প্রভাবের ক্ষেত্রে বলা যেতে পারে, ভারত তার রাজনৈতিক প্রভাবের মাধ্যমে বাংলাদেশের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় প্রভাব ফেলতে পারে। এটি নব্য-ঔপনিবেশিক শোষণের একটি উদাহরণ হতে পারে, যেখানে ভারত তার শক্তিশালী অবস্থানের কারণে বাংলাদেশের স্বার্থকে উপেক্ষা করে বা ক্ষতিগ্রস্ত করে। সাংস্কৃতিক আধিপত্যের ক্ষেত্রে বলা যায়, ভারত তার সাংস্কৃতিক প্রভাবের মাধ্যমে বাংলাদেশের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে পারে, যা স্থানীয় সংস্কৃতির ওপর একটি নব্য-ঔপনিবেশিক প্রভাব ফেলতে পারে। এটি বাংলাদেশে ভারতের সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক মডেলের প্রভাব বৃদ্ধির মাধ্যমে ঘটতে পারে।
ডুম্বুর বাঁধ নির্মাণ এবং এটির মাধ্যমে ভারতের বাংলাদেশের ওপর প্রভাব বিস্তারকে নব্য-ঔপনিবেশবাদ তত্ত্বের আলোকে শোষণের একটি উদাহরণ হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। ফানঁর তত্ত্ব অনুযায়ী, এটি একটি আধিপত্যশীল রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে একটি দুর্বল রাষ্ট্রের প্রতি শোষণমূলক আচরণ, যেখানে শক্তিশালী রাষ্ট্র তার জাতীয় স্বার্থ রক্ষার জন্য দুর্বল রাষ্ট্রের স্বার্থ উপেক্ষা করে। ফ্রান্তস ফানঁর নব্য-ঔপনিবেশবাদ তত্ত্বের আলোকে ডুম্বুর বাঁধ নির্মাণে ভারতের ভূমিকা এবং বাংলাদেশের প্রতি তার আচরণকে একটি শক্তিশালী রাষ্ট্রের শোষণমূলক নীতির প্রতিফলন হিসেবে দেখা যেতে পারে, যা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রভাবের মাধ্যমে দুর্বল রাষ্ট্রকে নিয়ন্ত্রণ করার প্রক্রিয়া।
হেজেমনি (Hegemony) তত্ত্ব
আন্তর্জাতিক রাজনীতির হেজেমনি তত্ত্বের উৎপত্তি আন্তোনিও গ্রামশির (Antonio Gramsci) Prison Notebooks (1929-1935) থেকেই। এই তত্ত্ব অনুযায়ী শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলো তাদের সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, এবং রাজনৈতিক ক্ষমতা ব্যবহার করে দুর্বল রাষ্ট্রগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং তাদের স্বার্থকে চাপিয়ে দেয়। তবে গ্রামশি মূলত হেজেমনি তত্ত্বটি এক জাতির অভ্যন্তরীণ শ্রেণি বা গোষ্ঠীর মধ্যে আদর্শিক ও সাংস্কৃতিক প্রভাবের আলোকে তত্ত্বায়ন করেছেন। তবে এক রাষ্ট্রের দ্বারা অন্য রাষ্ট্রের ওপর হেজেমনি প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে তত্ত্বায়ন করেছেন বেশ কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক সম্পর্ক তত্ত্ববিদ। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন রবার্ট কক্স (Robert W. Cox)। রবার্ট কক্স হেজেমনির ধারণাকে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের প্রেক্ষাপটে নতুনভাবে বিশ্লেষণ করেছেন। তার কাজগুলিতে, বিশেষত “Social Forces, States and World Orders: Beyond International Relations Theory” (1981) প্রবন্ধে, তিনি হেজেমনির একটি গ্লোবাল বা আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপন করেন।
কক্সের তত্ত্ব দিয়ে ভারতের কার্যকলাপের বিশ্লেষণ করা যাক। আন্তর্জাতিক হেজেমনির ক্ষেত্রে কক্সের তত্ত্বের আলোকে বলা যায়, ভারতের শক্তিশালী অবস্থান তাকে বাংলাদেশের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম করেছে। ডুম্বুর বাঁধ নির্মাণ এবং পানি ব্যবস্থাপনায় ভারতের একতরফা সিদ্ধান্তগুলো এই হেজেমনির উদাহরণ হিসেবে দেখা যেতে পারে। ভারত একটি হেজেমনিক ব্লকের অংশ হিসেবে তার শক্তি এবং প্রভাব ব্যবহার করে বাংলাদেশের ওপর নিজের স্বার্থ চাপিয়ে দিয়েছে। এর ফলে, বাংলাদেশের মতো দুর্বল রাষ্ট্রের কণ্ঠস্বর এবং স্বার্থ উপেক্ষিত হয়েছে। আদর্শিক ও রাজনৈতিক প্রভাবের ক্ষেত্রে কক্সের তত্ত্ব অনুযায়ী, হেজেমনি শুধুমাত্র অর্থনৈতিক নয়, বরং আদর্শিক এবং রাজনৈতিক প্রভাবের মাধ্যমেও কার্যকর হয়। ভারতের সিদ্ধান্তগুলো বাংলাদেশের সাথে সমঝোতার প্রয়োজন অনুভব না করে নিজের স্বার্থে নেওয়া হয়েছে, যা হেজেমনির আদর্শিক প্রতিফলন। এটি প্রমাণ করে যে, ভারতের রাজনৈতিক এবং আদর্শিক অবস্থান বাংলাদেশের স্বার্থের উপর প্রাধান্য পেয়েছে। এই তত্ত্ব দেখায়, হেজেমনি প্রতিষ্ঠার জন্য শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলো সাধারণত দুর্বল রাষ্ট্রের সাথে সমানভাবে আলোচনা করতে ইচ্ছুক হয়না। ভারতের একতরফা সিদ্ধান্তগুলোকে হেজেমনির উদাহরণ হিসেবে ধরা যায়, যেখানে তারা বাংলাদেশকে অবহিত না করেই বাঁধ নির্মাণ ও পরিচালনা করেছে, এসব নিয়ে চুক্তি বা আলোচনায় উৎসাহ দেখায় না।
আন্তর্জাতিক আইন ও ন্যায্যতা (International Law and Justice) তত্ত্ব
জন রলস (John Rawls) তার বিখ্যাত গ্রন্থ A Theory of Justice (1971) এ ন্যায্যতা (justice) এবং নৈতিকতা নিয়ে গভীর বিশ্লেষণ করেছেন, যা পরবর্তীতে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক এবং আন্তর্জাতিক আইনেও প্রভাব ফেলেছে। রলসের ন্যায্যতা তত্ত্ব (Theory of Justice) মূলত একটি অভ্যন্তরীণ নৈতিক এবং রাজনৈতিক তত্ত্ব, কিন্তু এর ধারণাগুলো আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেও প্রয়োগ করা যায়। বিশেষ করে, আন্তর্জাতিক আইন এবং ন্যায্যতা তত্ত্বের আলোকে রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে রলসের তত্ত্ব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। রলসের ন্যায্যতা তত্ত্ব মূলত সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য একটি নীতিগত কাঠামো প্রদান করে। এর মূল ধারণাগুলো হলো ন্যায্যতা এবং সমান অধিকার, মূল নীতি হিসেবে স্বাধীনতার নীতি (Principle of Liberty) ও সমতা এবং অগ্রাধিকার নীতি (Difference Principle), এবং ভেইল অব ইগনোরেন্স (Veil of Ignorance)। ন্যায্যতা এবং সমান অধিকারের ক্ষেত্রে রলসের মতে, ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার জন্য প্রতিটি ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর সমান অধিকার থাকা উচিত। সমাজে ন্যায্যতার মানদণ্ড অনুযায়ী সমান সুযোগ এবং স্বাধীনতা প্রদান করতে হবে। মূলনীতির ক্ষেত্রে তার স্বাধীনতার নীতি (Principle of Liberty) হচ্ছে, প্রতিটি ব্যক্তি বা রাষ্ট্রের স্বাধীনতা এবং অধিকারকে সম্মান করা উচিত, আর তার সমতা এবং অগ্রাধিকার নীতি (Difference Principle) হচ্ছে, যারা সুবিধাবঞ্চিত বা দুর্বল অবস্থানে রয়েছে, তাদের স্বার্থকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে এবং তাদের সমর্থন করতে হবে। তার ভেইল অব ইগনোরেন্স (Veil of Ignorance) এর ধারণা অনুযায়ী, সমাজের ন্যায্যতা বিচার করতে হলে এমন একটি অবস্থানে থাকা উচিত, যেখানে ব্যক্তিরা তাদের নিজস্ব অবস্থান, সম্পদ, বা ক্ষমতার বিষয়ে জানে না। এই ধারণা থেকে বোঝা যায় যে, ন্যায্যতার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় ব্যক্তি বা রাষ্ট্রের স্বার্থ পরিপন্থী হবে না।
যদিও রলসের ন্যায্যতা তত্ত্ব মূলত অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ন্যায্যতার বিষয়ে ছিল, তবে তার নীতি আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে এই তত্ত্বের প্রধান পয়েন্টগুলো নিয়ে একটু বলা যাক। এখানে চলে আসে আন্তর্জাতিক সমানাধিকারের ধারণাটি। রলসের ন্যায্যতা তত্ত্বের আলোকে, প্রতিটি রাষ্ট্রের জন্য সমানাধিকার এবং স্বাধীনতা নিশ্চিত করা উচিত। কোনো একটি রাষ্ট্র যদি অন্য রাষ্ট্রের অধিকার এবং স্বাধীনতাকে উপেক্ষা করে, তবে তা আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচারের লঙ্ঘন হিসেবে গণ্য করা হবে। এখানে চলে আসে ন্যায্যতা এবং সমঝোতার ধারণা। রলসের নীতির আলোকে, শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলোর উচিত দুর্বল রাষ্ট্রগুলোর স্বার্থ রক্ষা করা। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় ন্যায্যতা এবং সমঝোতা বজায় রাখতে হবে। একই সাথে আন্তর্জাতিক আইনের মধ্যে ন্যায্যতা এবং ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার জন্য রলসের নীতিগুলো প্রয়োগ করা যায়, যেখানে আন্তর্জাতিক চুক্তি এবং আলোচনা এই ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম।
ডুম্বুর বাঁধের প্রেক্ষিতে ভারত এবং বাংলাদেশের মধ্যে ন্যায্যতা তত্ত্বের আলোকে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উঠে আসে। এখানে ন্যায্যতা লঙ্ঘনের ব্যাপারটি আসছে। রলসের তত্ত্ব অনুযায়ী, ভারত এবং বাংলাদেশ উভয় রাষ্ট্রের স্বার্থ এবং অধিকার সমানভাবে বিবেচনা করা উচিত ছিল। ডুম্বুর বাঁধের ক্ষেত্রে ভারতের একতরফা সিদ্ধান্ত এবং বাংলাদেশের সাথে কোনো চুক্তি না করে বাঁধ নির্মাণ ন্যায্যতার নীতি লঙ্ঘন করেছে। এখানে দুর্বল রাষ্ট্রের স্বার্থ রক্ষার ব্যাপারটি আসছে। রলসের সমতা এবং অগ্রাধিকার নীতির আলোকে, ভারতের মতো শক্তিশালী রাষ্ট্রের উচিত ছিল বাংলাদেশের মতো দুর্বল রাষ্ট্রের স্বার্থ এবং অধিকারের প্রতি সম্মান দেখানো। কিন্তু ডুম্বুর বাঁধ নির্মাণের সময় এ ধরনের কোন সম্মান বা সমর্থন প্রদান করা হয়নি, যা আন্তর্জাতিক ন্যায্যতার বিরুদ্ধে যায়। এখানে আমরা দেখছি আলোচনা এবং সমঝোতার অভাবের ব্যাপারটাও। রলসের ন্যায্যতা তত্ত্ব অনুযায়ী, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে প্রতিটি রাষ্ট্রের স্বার্থ এবং অধিকারকে বিবেচনা করে চুক্তি এবং আলোচনা করা উচিত। ডুম্বুর বাঁধের ক্ষেত্রে ভারতের পক্ষ থেকে এই সমঝোতার অভাব ন্যায্যতার লঙ্ঘন হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। একই সাথে এখানে ট্রান্সবাউন্ডারি রিভারের সব বাঁধ ও পানির বণ্টন এর ব্যাপারে জাতিসংঘের নদী কনভেনশনে বাংলাদেশের সাক্ষর না করা বা করতে না দেয়াটাও কনসার্নের, সেই সাথে মাত্র একটি বাঁধ নিয়ে চুক্তি হবার ব্যাপারটাও।
জন রলসের ন্যায্যতা তত্ত্বের আলোকে, ভারতের ডুম্বুর বাঁধ নির্মাণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সাথে চুক্তি না করা এবং তার স্বার্থ উপেক্ষা করা আন্তর্জাতিক ন্যায্যতার একটি বড় লঙ্ঘন হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। রলসের তত্ত্ব অনুযায়ী, শক্তিশালী রাষ্ট্রের উচিত দুর্বল রাষ্ট্রের স্বার্থ রক্ষা করা এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে সমানাধিকার এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা। এই প্রেক্ষিতে, ভারতের আচরণ রলসের ন্যায্যতা তত্ত্বের বিরোধী এবং আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য এর পুনর্মূল্যায়ন প্রয়োজন।
বিশ্ব-ব্যবস্থা তত্ত্ব (World-Systems Theory)
ইমানুয়েল ওয়ালারস্টাইন তার The Modern World-System গ্রন্থে বিশ্ব-ব্যবস্থা তত্ত্ব দান করেন ও এই তত্ত্বে তিনি বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক সম্পর্কের কাঠামো বিশ্লেষণ করেছেন। এই তত্ত্ব অনুসারে, বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা কেন্দ্রীয়, আধা-প্রান্তিক এবং প্রান্তিক রাষ্ট্রগুলোতে ভাগ করা হয়। শক্তিশালী কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রগুলো দুর্বল প্রান্তিক রাষ্ট্রগুলোর ওপর প্রভাব বিস্তার করে এবং তাদের সম্পদ শোষণ করে। ভারতের ডুম্বুর বাঁধ নির্মাণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ওপর ভারতের প্রভাব ও স্বার্থের প্রতিফলন ওয়ালারস্টাইনের কেন্দ্র-প্রান্ত মডেলের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ, যেখানে কেন্দ্রীয় রাষ্ট্র প্রান্তিক রাষ্ট্রের স্বার্থকে উপেক্ষা করে নিজের স্বার্থ রক্ষা করে।
তার বিশ্ব-ব্যবস্থা তত্ত্ব মূলত বিশ্ব অর্থনীতি এবং রাজনীতির কাঠামোগত অসমতা এবং শোষণের মডেলকে বোঝায়। ওয়ালারস্টাইনের তত্ত্বের মূল পয়েন্টগুলোর মধ্যে আছে কেন্দ্র-প্রান্ত মডেল (Core-Periphery Model), অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক কাঠামো ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক এবং ক্ষমতার ভারসাম্যের দিকগুলো। কেন্দ্র-প্রান্ত মডেলের (Core-Periphery Model) ক্ষেত্রে ওয়ালারস্টাইনের তত্ত্বে বিশ্বকে কেন্দ্র (core), আধা-প্রান্ত (semi-periphery), এবং প্রান্তিক (periphery) রাষ্ট্রে ভাগ করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রগুলো (যেমন, যুক্তরাষ্ট্র, পশ্চিম ইউরোপ) অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী এবং তারা প্রান্তিক রাষ্ট্রগুলোর (যেমন, বাংলাদেশ, আফ্রিকার অনেক দেশ) সম্পদ শোষণ করে তাদের ওপর প্রভাব বিস্তার করে। আধা-প্রান্তিক রাষ্ট্রগুলো এই দুই স্তরের মধ্যে পড়ে, যেগুলো কিছুটা শক্তিশালী হলেও কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রের অধীনস্থ থাকে। অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক কাঠামোর ক্ষেত্রে ওয়ালারস্টাইনের তত্ত্ব অনুসারে, আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক কাঠামো কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রগুলোর পক্ষে ঝোঁক থাকে এবং তারা এই কাঠামোর মাধ্যমে প্রান্তিক রাষ্ট্রগুলোর ওপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে। প্রান্তিক রাষ্ট্রগুলো মূলত কাঁচামাল এবং শ্রমের যোগানদাতা হিসেবে কাজ করে, যা কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রগুলোর শিল্প এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নে সহায়ক হয়। কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রগুলো আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ব্যবহার করে নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করে। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক এবং ক্ষমতার ভারসাম্যের ক্ষেত্রে ওয়ালারস্টাইনের তত্ত্ব অনুসারে, ক্ষমতার ভারসাম্য কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রগুলোর পক্ষে থাকে এবং তারা প্রান্তিক রাষ্ট্রগুলোর ওপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখে। কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রগুলো তাদের অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক শক্তি ব্যবহার করে প্রান্তিক রাষ্ট্রগুলোর স্বার্থকে উপেক্ষা করে।
ভারতের ডুম্বুর বাঁধ নির্মাণ এবং এর প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের ওপর প্রভাবকে ওয়ালারস্টাইনের বিশ্ব-ব্যবস্থা তত্ত্বের মাধ্যমে বিশ্লেষণ করা যেতে পারে। ভারতের অবস্থান কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রের মতো এবং বাংলাদেশের অবস্থান প্রান্তিক রাষ্ট্রের মতো, যা ওয়ালারস্টাইনের তত্ত্বের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এখানে কেন্দ্রীয় রাষ্ট্র হিসেবে ভারতের ভূমিকার ক্ষেত্রে দেখা যায়, ভারত তার অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক শক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশের ওপর প্রভাব বিস্তার করেছে। ডুম্বুর বাঁধের মাধ্যমে জলপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করে ভারত তার ক্ষমতা ব্যবহার করে এবং বাংলাদেশের স্বার্থকে উপেক্ষা করে। এটি ওয়ালারস্টাইনের কেন্দ্র-প্রান্ত মডেলের একটি প্রতিফলন, যেখানে কেন্দ্রীয় রাষ্ট্র তার শক্তির মাধ্যমে প্রান্তিক রাষ্ট্রের ওপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে। আবার ভারতের ডুম্বুর বাঁধ নির্মাণ আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক কাঠামোর অংশ হিসেবে দেখা যেতে পারে, যেখানে ভারত একটি শক্তিশালী অবস্থান থেকে তার স্বার্থ রক্ষা করেছে। এই কাঠামোতে বাংলাদেশের মতো দুর্বল রাষ্ট্রের স্বার্থ উপেক্ষিত হয়েছে এবং শোষণের শিকার হয়েছে। এদিকে ওয়ালারস্টাইনের তত্ত্ব অনুসারে, ক্ষমতার ভারসাম্য কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রগুলোর পক্ষে থাকে, এবং এটি আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে প্রতিফলিত হয়। ভারতের শক্তি এবং প্রভাবের কারণে বাংলাদেশ এই সম্পর্কের মধ্যে দুর্বল অবস্থানে রয়েছে এবং তার স্বার্থকে পূর্ণভাবে রক্ষা করতে পারছে না। ভারতের একতরফা সিদ্ধান্ত এবং বাংলাদেশের ওপর তার প্রভাব ওয়ালারস্টাইনের তত্ত্বের আলোকে একটি অসম শক্তি ভারসাম্যের উদাহরণ হিসেবে দেখা যেতে পারে, যেখানে প্রান্তিক রাষ্ট্রের স্বার্থকে গুরুত্ব না দিয়ে কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে।
যেসব তত্ত্ব আলোচনায় আনা হয়নি
- ১. লিবারালিজম (Liberalism) তত্ত্ব: লিবারালিজম তত্ত্ব বিশ্বাস করে যে, আন্তর্জাতিক সহযোগিতা, প্রতিষ্ঠানের গুরুত্ব, এবং অর্থনৈতিক আন্তঃনির্ভরতা আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে শান্তি এবং স্থিতিশীলতা আনতে পারে। এই তত্ত্বের অনুসারীরা মনে করে যে, রাষ্ট্রগুলো কেবল নিজেদের স্বার্থেই পরিচালিত হয় না; বরং আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান এবং আইনের মাধ্যমে সহযোগিতা ও সমঝোতা তৈরি করা সম্ভব। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে লিবারালিজম তত্ত্বের প্রস্তাবিত পন্থা প্রাসঙ্গিক হতে পারত, তবে রিয়ালিজম, নব্য-ঔপনিবেশবাদ, এবং হেজেমনি তত্ত্বের তুলনায় এটি ভারতের মতো শক্তিশালী রাষ্ট্রের প্রভাব মোকাবেলার জন্য সরাসরি কার্যকরী সমাধান প্রদান করে না। লিবারালিজমের প্রস্তাবিত প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যকারিতা অনেক ক্ষেত্রেই শক্তিশালী রাষ্ট্রের প্রভাব দ্বারা প্রভাবিত হতে পারে, যা বাংলাদেশের ক্ষেত্রে কার্যকর না-ও হতে পারে।
- ২. কন্সট্রাক্টিভিজম (Constructivism) তত্ত্ব: কন্সট্রাক্টিভিজম তত্ত্বের মূল ধারণা হলো, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক সামাজিকভাবে গঠিত এবং রাষ্ট্রের পরিচয়, বিশ্বাস, এবং ধারণার ওপর ভিত্তি করে পরিচালিত হয়। রাষ্ট্রের আচরণ আন্তর্জাতিক সমাজের আদর্শ, নিয়ম, এবং পরিচয় দ্বারা প্রভাবিত হয়। এই তত্ত্বের মূল ফোকাস আন্তর্জাতিক সম্পর্কের সামাজিক ও আদর্শিক গঠন নিয়ে, যা সরাসরি বাংলাদেশের জন্য কার্যকর নীতি বা কৌশল নির্ধারণের জন্য তেমন উপযোগী নয়। যদিও কন্সট্রাক্টিভিজম তত্ত্ব আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বৈচিত্র্যময় চরিত্র বোঝার জন্য গুরুত্বপূর্ণ, তবে ভারতের প্রভাব মোকাবেলায় এটি সরাসরি প্রাসঙ্গিক সমাধান প্রদান করে না।
- ৩. মার্কসবাদ (Marxism) তত্ত্ব: মার্কসবাদ তত্ত্ব মূলত অর্থনৈতিক সম্পর্ক এবং শ্রেণি সংঘাতের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষণ করে। এটি বিশ্বাস করে যে, শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলো মূলত পুঁজিবাদী শোষণের মাধ্যমে দুর্বল রাষ্ট্রগুলোকে শোষণ করে। মার্কসবাদ তত্ত্ব অর্থনৈতিক শোষণের উপর জোর দেয়, তবে বাংলাদেশ ও ভারতের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের প্রেক্ষাপটে এটি সরাসরি প্রাসঙ্গিক ছিল না। যদিও নব্য-ঔপনিবেশবাদ তত্ত্বের মাধ্যমে অর্থনৈতিক শোষণ বোঝানো হয়েছে, মার্কসবাদ তত্ত্বের সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি এখানে প্রয়োজনীয় ছিল না।
- ৪. ফেমিনিজম (Feminism) তত্ত্ব: ফেমিনিজম তত্ত্ব আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে লিঙ্গভিত্তিক অসমতা, নারীর অবস্থান, এবং পিতৃতান্ত্রিক কাঠামোর প্রভাব বিশ্লেষণ করে। এই তত্ত্বের অনুসারীরা মনে করে যে, লিঙ্গভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গি আন্তর্জাতিক সম্পর্কের নীতি নির্ধারণে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ফেমিনিজম তত্ত্ব লিঙ্গভিত্তিক বিশ্লেষণে কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করে, যা বাংলাদেশের সাথে ভারতের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে সরাসরি প্রাসঙ্গিক নয়। এই আলোচনায় মূলত রাষ্ট্রের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য, অর্থনৈতিক শোষণ, এবং সার্বভৌমত্ব রক্ষার মতো বিষয়গুলো গুরুত্ব পেয়েছে, যেখানে ফেমিনিজম তত্ত্বের সরাসরি প্রাসঙ্গিকতা কম ছিল।
যদিও লিবারালিজম, কন্সট্রাক্টিভিজম, মার্কসবাদ, এবং ফেমিনিজম তত্ত্বগুলো আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশ্লেষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, এই নির্দিষ্ট প্রেক্ষাপটে এগুলো সরাসরি প্রাসঙ্গিক বা কার্যকর সমাধান প্রদান করতে সক্ষম নয় বলে বিবেচিত হয়েছে। বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা এবং ভারতের প্রভাব মোকাবেলায় যেসব তত্ত্বের আলোকে কার্যকরী পদক্ষেপ প্রস্তাব করা হয়েছে, সেগুলো রিয়ালিজম, নব্য-ঔপনিবেশবাদ, হেজেমনি, স্ট্রাকচারালিজম, এবং ন্যায্যতা তত্ত্বের সাথে বেশি সঙ্গতিপূর্ণ এবং প্রাসঙ্গিক ছিল।
বাংলাদেশের করণীয়
আন্তর্জাতিক আইন এবং সমঝোতা প্রতিষ্ঠা
বাংলাদেশকে ১৯৯৭ সালের জাতিসংঘের “Convention on the Law of the Non-Navigational Uses of International Watercourses” চুক্তিতে সাক্ষর করতে হবে ও সেই অনুযায়ী বাংলাদেশের স্বার্থ বিবেচনায় আন্তর্জাতিক আদালতের দ্বারস্থ হতে হবে, আর ন্যায়বিচার চাইতে হবে। রিয়ালিজম তত্ত্ব অনুসারে, বাংলাদেশের উচিত তার জাতীয় স্বার্থ রক্ষার জন্য সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা। ভারতের একতরফা সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষার জন্য আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা করা একটি কার্যকর কৌশল হতে পারে। আন্তর্জাতিক আদালতে ন্যায়বিচার প্রার্থনার মাধ্যমে বাংলাদেশ তার জাতীয় স্বার্থের পক্ষে সমর্থন আদায় করতে পারে এবং ভারতের উপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে, যা তাকে চুক্তি বা সমঝোতায় বাধ্য করতে পারে। এই প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব এবং জাতীয় স্বার্থ সুরক্ষিত থাকবে। রলসের ন্যায্যতা তত্ত্ব অনুসারে, বাংলাদেশের উচিত আন্তর্জাতিক আদালতে ন্যায়বিচার প্রার্থনা করা, যা আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপায়। রলসের তত্ত্ব অনুসারে, দুটি রাষ্ট্রের মধ্যে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য চুক্তি ও সমঝোতার মাধ্যমে একটি ন্যায্য ও সমানাধিকারমূলক সমাধান খুঁজে বের করা উচিত। আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা করে এবং চুক্তির মাধ্যমে সমঝোতা প্রতিষ্ঠা করে বাংলাদেশ ন্যায়বিচার এবং সমানাধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারে। ওয়ালারস্টাইনের বিশ্ব-ব্যবস্থা তত্ত্বের আলোকে, বাংলাদেশকে একটি প্রান্তিক রাষ্ট্র হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে, যেখানে কেন্দ্রীয় রাষ্ট্র (যেমন, ভারত) তাকে শোষণ করছে। এই শোষণ থেকে মুক্তি পেতে বাংলাদেশের উচিত আন্তর্জাতিক কাঠামোর সহায়তা নেওয়া এবং শক্তিশালী আইনি ভিত্তি তৈরি করা। আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা করা এবং চুক্তি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বাংলাদেশ তার অবস্থানকে মজবুত করতে পারে এবং আন্তর্জাতিক কাঠামোর সুবিধা গ্রহণ করতে পারে, যা প্রান্তিক রাষ্ট্র হিসেবে তার শোষণ কমাতে সহায়ক হবে।
আন্তর্জাতিক সমর্থন এবং জোট গঠন, আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক সহযোগিতা
বাংলাদেশের ক্ষেত্রে নব্য-ঔপনিবেশবাদ তত্ত্ব (Neo-colonialism Theory) তত্ত্ব অনুযায়ী ভারতের মতো শক্তিশালী প্রতিবেশী রাষ্ট্রের প্রভাব থেকে মুক্তি পেতে এবং তার স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধীনতা রক্ষা করতে, আন্তর্জাতিক সমর্থন এবং আঞ্চলিক জোট গঠন করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আঞ্চলিক সহযোগিতা এবং আন্তর্জাতিক মঞ্চে সমর্থন আদায় করে বাংলাদেশ এই ধরনের শোষণমূলক পরিস্থিতি থেকে রক্ষা পেতে পারে। রবার্ট কক্সের হেজেমনি তত্ত্ব (Hegemony Theory) অনুসারে বলা যায়, বাংলাদেশের উচিত আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক জোট গঠন করে ভারতের হেজেমনির প্রভাব কমানো। এ ধরনের জোট বাংলাদেশের পক্ষে সমর্থন আদায় করতে সহায়ক হবে এবং ভারতের প্রভাবকে সীমিত করবে, যা বাংলাদেশকে তার সার্বভৌমত্ব এবং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সহায়তা করবে। ইমানুয়েল ওয়ালারস্টাইনের বিশ্ব-ব্যবস্থা তত্ত্ব (World-systems Theory) অনুযায়ী, বাংলাদেশ একটি প্রান্তিক রাষ্ট্র হিসেবে, আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক জোটের মাধ্যমে এই কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রের শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে। আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বাংলাদেশের জন্য একটি শক্তিশালী প্রতিরোধ ব্যবস্থা হতে পারে, যা তাকে কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রের শোষণ থেকে রক্ষা করবে এবং তার নিজস্ব উন্নয়ন ও স্বার্থ রক্ষা করতে সাহায্য করবে। রিয়ালিজম তত্ত্ব (Realism Theory) অনুযায়ী, বাংলাদেশ আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক জোট গঠন এবং সমর্থন আদায়ের মাধ্যমে তার জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করতে পারে। শক্তিশালী কূটনৈতিক প্রচেষ্টা এবং জোটের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক মঞ্চে বাংলাদেশের অবস্থানকে শক্তিশালী করা যাবে এবং প্রতিবেশী ভারতের মতো শক্তিশালী রাষ্ট্রের প্রভাব থেকে নিজেকে রক্ষা করা যাবে। এই তত্ত্ব অনুযায়ী, বাংলাদেশ তার কৌশলগত স্বার্থ রক্ষায় এবং আঞ্চলিক শক্তি ভারসাম্য বজায় রাখতে সক্ষম হবে।
অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা এবং বিকল্প উৎস প্রতিষ্ঠা, অর্থনৈতিক বিকল্পের সন্ধান ও স্থানীয় সম্পদের উন্নয়ন
নব্য-ঔপনিবেশবাদ তত্ত্ব অনুসারে, প্রাক্তন উপনিবেশ বা দুর্বল রাষ্ট্রগুলোকে শোষণ থেকে মুক্ত হতে হলে অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা অর্জন করতে হবে। বাংলাদেশের পক্ষে বিকল্প অর্থনৈতিক অংশীদার খুঁজে বের করা এবং স্থানীয় সম্পদের উন্নয়নের মাধ্যমে ভারতের ওপর নির্ভরশীলতা কমানো সম্ভব। ওয়ালারস্টাইনের বিশ্ব-ব্যবস্থা তত্ত্ব অনুসারে, বাংলাদেশকে তার অর্থনৈতিক ভিত্তি শক্তিশালী করতে হবে এবং বিকল্প অর্থনৈতিক অংশীদার খুঁজে বের করতে হবে, যাতে কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রের শোষণ কমানো যায়। কক্সের হেজেমনি তত্ত্ব অনুসারে, অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা অর্জন করলে হেজেমনির প্রভাব কমানো সম্ভব। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক বিকল্প এবং স্থানীয় সম্পদের উন্নয়ন তাকে হেজেমনির হাত থেকে মুক্তি দিতে সহায়ক হবে। রিয়ালিজম তত্ত্ব অনুসারে, বাংলাদেশকে তার জাতীয় স্বার্থ রক্ষার জন্য অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা এবং বিকল্প অর্থনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। এই কৌশলটি শক্তিশালী রাষ্ট্রের প্রভাব থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
সাংস্কৃতিক শক্তি বৃদ্ধি এবং আদর্শিক প্রতিরোধ, সাংস্কৃতিক পুনর্জাগরণ এবং শিক্ষার মাধ্যমে সচেতনতা বৃদ্ধি
হেজিমনি তত্ত্ব অনুযায়ী, সাংস্কৃতিক এবং আদর্শিক শক্তি বৃদ্ধি হেজেমনির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সহায়ক। বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক পরিচয় রক্ষা এবং জনসচেতনতা বৃদ্ধি তাকে ভারতীয় সাংস্কৃতিক হেজেমনির প্রভাব থেকে রক্ষা করতে পারে। নিওকলোনিয়ালিজম তত্ত্ব অনুসারে, সাংস্কৃতিক পুনর্জাগরণ এবং জাতীয় চেতনা বৃদ্ধি করে বাংলাদেশ নব্য-ঔপনিবেশিক প্রভাব থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারে। সাংস্কৃতিক প্রতিরোধই জাতির মধ্যে আত্মনির্ভরশীলতা ও জাতীয়তাবোধ বাড়াবে। বিশ্ব-ব্যবস্থা তত্ত্ব অনুসারে, আদর্শিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ গড়ে তোলার মাধ্যমে প্রান্তিক রাষ্ট্রগুলো কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রের শোষণমূলক কার্যকলাপের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে। রিয়ালিজম তত্ত্বের দৃষ্টিতে, সাংস্কৃতিক শক্তি এবং জাতীয়তাবোধ শক্তিশালী করার মাধ্যমে বাংলাদেশ তার জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করতে পারে এবং বাহ্যিক প্রভাব থেকে মুক্ত হতে পারে।
আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচারের প্রচার ও মানবাধিকারের সুরক্ষা, আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার ও মানবাধিকার প্রচার
ন্যায্যতা তত্ত্ব অনুসারে আন্তর্জাতিক ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা করতে হলে বাংলাদেশের উচিত মানবাধিকার এবং ন্যায়বিচার প্রচারে সক্রিয় ভূমিকা পালন করা। আন্তর্জাতিক মঞ্চে এ ধরনের প্রচারণা ভারতের একতরফা কার্যকলাপের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে সহায়ক হবে। হেজেমনি তত্ত্বের আলোকে, মানবাধিকার এবং ন্যায়বিচার প্রচারের মাধ্যমে হেজেমনির বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক সমর্থন লাভ করা সম্ভব, যা বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষায় সহায়ক হবে। নব্য-ঔপনিবেশবাদ তত্ত্ব অনুসারে, মানবাধিকার এবং ন্যায়বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক প্রচারণা নব্য-ঔপনিবেশিক শোষণের বিরুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। বাংলাদেশের জন্য এ ধরনের প্রচারণা ভারতের প্রভাব কমাতে সহায়ক হবে। বিশ্ব-ব্যবস্থা তত্ত্ব অনুসারে, আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচারের প্রচারণা এবং মানবাধিকার সুরক্ষা প্রান্তিক রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, যাতে সে কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রের শোষণ থেকে মুক্তি পেতে পারে। রিয়ালিজম তত্ত্ব অনুসারে, আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার এবং মানবাধিকার প্রচারের মাধ্যমে বাংলাদেশ তার জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করতে পারে এবং আন্তর্জাতিক সমর্থন পেতে পারে, যা ভারতের বিরুদ্ধে কৌশলগত সুবিধা প্রদান করবে।
উপরে উল্লেখিত পদক্ষেপগুলো রিয়ালিজম, নব্য-ঔপনিবেশবাদ, হেজেমনি, স্ট্রাকচারালিজম, এবং ন্যায্যতা তত্ত্বের সমন্বিত দৃষ্টিকোণ থেকে প্রস্তাবিত। প্রতিটি তত্ত্বের আলোকে এসব সমাধান বাংলাদেশের জন্য কার্যকরী হতে পারে। আন্তর্জাতিক সমর্থন, অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা, সাংস্কৃতিক শক্তি বৃদ্ধি, এবং আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বাংলাদেশ তার সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতা রক্ষা করতে পারবে এবং ভারতের শোষণ ও আধিপত্য থেকে মুক্তি পাবে।
Leave a Reply