উৎসব-অনুষ্ঠানে উচ্চস্বরে গানবাজনার নিষিদ্ধকরণ কেন সমর্থন করি না : ফাংশনালিস্ট ও কনফ্লিক্ট থিওরির পারস্পেক্টিভে

সুনামগঞ্জে চিকসা গ্রামে সম্প্রতি উৎসব-অনুষ্ঠানে উচ্চস্বরে গানবাজনা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সেই প্রসঙ্গেই লেখাটা।

ফাংশনালিস্ট থিওরি

ফাংশনালিস্ট থিওরি অনুসারে সমাজে বিদ্যমান সব কিছুরই ফাংশন থাকে। উৎসবে-অনুষ্ঠানে উচ্চস্বরে গানবাজনার বেলায়ও থাকে। আর তাই গ্রামে উৎসবে-অনুষ্ঠানে উচ্চস্বরে গানবাজনা নিষিদ্ধ করা না করার আলোচনায় ফাংশনগুলোর কথা বিবেচনায় আনতেই হয়।

এমিল দুর্খেইমের থিওরি অফ সোশ্যাল সলিডারিটি দিয়েই শুরু করা যাক। এটি মূলত সমাজের স্থিতিশীলতা, ঐক্য, এবং সামাজিক সম্পর্কের মজবুতকরণকে কেন্দ্র করে গঠিত। দুর্খেইমের মতে, সমাজের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড এবং সামাজিক অনুষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে মানুষের মধ্যে একটি সমবেত অভিজ্ঞতা তৈরি হয়, যা তাদের মধ্যে সামাজিক সম্পর্ককে দৃঢ় করে এবং সমাজের সংহতি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখে। সমাজের সংহতি প্রধানত দুরকম। যান্ত্রিক সংহতি (Mechanical Solidarity) হলো প্রথাগত, যা ছোট সমাজে পাওয়া যায়, যেখানে মানুষের মধ্যে সমজাতীয়তা বা মিল থাকা সমাজের সংহতির ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। আর জৈব সংহতি (Organic Solidarity) পাওয়া যায় আধুনিক ও বড় সমাজে, যেখানে মানুষের মধ্যে বৈচিত্র্য ও আন্তঃনির্ভরতা সমাজের সংহতির ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। দুর্খেইমের মতে, উৎসব ও সামাজিক অনুষ্ঠানগুলো হলো “সামাজিক চেতনার” (collective consciousness) প্রকাশ। সামাজিক অনুষ্ঠানগুলো সমাজের সদস্যদের একত্রিত করে এবং তাদের মধ্যে একটি সমবেত চেতনা সৃষ্টি করে, যা সমাজের সংহতি বৃদ্ধিতে সহায়ক। উদাহরণস্বরূপ, যখন মানুষ একটি নির্দিষ্ট অনুষ্ঠান উদযাপন করে, তারা একটি সাধারণ অভিজ্ঞতা এবং আবেগ ভাগাভাগি করে, যা তাদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ককে মজবুত করে এবং সমাজের সামগ্রিক ঐক্যকে শক্তিশালী করে। উৎসব এবং সামাজিক অনুষ্ঠানগুলোর সময় উচ্চস্বরে গানবাজনা দুর্খেইমের সামাজিক সংহতির তত্ত্ব অনুসারে যান্ত্রিক সংহতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এটি এমন এক ধরনের সংহতি, যেখানে সাধারণত সমাজের সদস্যরা সমজাতীয় (homogeneous) এবং অভিন্ন মূল্যবোধ, বিশ্বাস, এবং অভিজ্ঞতা শেয়ার করে। এই সংহতির মূল ভিত্তি হলো সমাজের সদস্যদের মধ্যে সমজাতীয়তা এবং অভিন্নতা।

উৎসব ও অনুষ্ঠানে উচ্চস্বরে গানবাজনা একত্রে সঙ্গীতের অভিজ্ঞতা শেয়ার করার মাধ্যমে সমাজের সদস্যদের মধ্যে একটি সাধারণ চেতনা তৈরি করে, যা যান্ত্রিক সংহতির ভিত্তি গঠন করে। যখন সমাজের অনেক মানুষ একই সুরে গান গায়, নাচে, বা উৎসব উদযাপন করে, তখন তারা একটি অভিন্ন অভিজ্ঞতা অর্জন করে। এই অভিন্ন অভিজ্ঞতা এবং সাধারণ চেতনা সমাজের সদস্যদের মধ্যে শক্তিশালী সংযোগ এবং ঐক্য তৈরি করে, যা যান্ত্রিক সংহতির একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। এটি একটি শক্তিশালী সাংস্কৃতিক মাধ্যম হিসেবে কাজ করে যা একটি সম্প্রদায় বা সমাজের মূল্যবোধ, ঐতিহ্য, এবং চেতনার প্রতিফলন করে। উৎসবে উচ্চস্বরে গানবাজনা সমাজের সাংস্কৃতিক ঐক্যকে প্রকাশ করে এবং সেই সাংস্কৃতিক ঐক্য মানুষের মধ্যে একটি সামাজিক বন্ধন তৈরি করে। এটি মানুষের আবেগকে উদ্দীপ্ত করে এবং একই সময়ে অনেক মানুষ একই আবেগ অনুভব করে। এই ধরনের সমবেত আবেগের শেয়ারিং সমাজের সদস্যদের মধ্যে একটি শক্তিশালী সংযোগ তৈরি করে, যা সমাজের সংহতিকে আরও মজবুত করে। আবার উৎসব ও অনুষ্ঠানগুলোতে উচ্চস্বরে সঙ্গীত সমাজের প্রথা ও রীতিগুলোকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে সহায়ক। মানুষ যখন একটি নির্দিষ্ট রীতি বা প্রথা পালন করে, তখন তারা সেই প্রথার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে এবং নিজেদের মধ্যে সেই সামাজিক নিয়ম ও রীতির প্রতি সংহতি তৈরি করে। সমাজের স্থায়িত্ব এবং সংহতি বজায় রাখার জন্য সামাজিক নিয়ম এবং কাঠামো প্রয়োজন। উচ্চস্বরে গানবাজনা সামাজিক নিয়ম এবং কাঠামোর প্রতিফলন ঘটায়। যখন মানুষ একটি উৎসব বা অনুষ্ঠানে উচ্চস্বরে সঙ্গীতের সঙ্গে অংশগ্রহণ করে, তারা নিজেদের মধ্যে সেই সামাজিক নিয়মের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে এবং সমাজের কাঠামোকে মজবুত করে। এই প্রক্রিয়া সামাজিক সংহতিকে আরও মজবুত এবং স্থিতিশীল করে তোলে। সব মিলে দুর্খেইমের সামাজিক সংহতির তত্ত্ব অনুসারে, উৎসব এবং অনুষ্ঠানে উচ্চস্বরে গানবাজনা সমাজের সদস্যদের মধ্যে একটি শক্তিশালী সামাজিক সংযোগ এবং ঐক্য তৈরি করে। এটি সমবেত অভিজ্ঞতা, সাংস্কৃতিক অভিব্যক্তি, আবেগের শেয়ারিং, এবং সামাজিক নিয়মের পুনঃপ্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সমাজের সংহতি এবং স্থিতিশীলতাকে শক্তিশালী করে, আর তাই এটা সমাজের জন্য গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।

সামাজিক সংহতিরটাই একটু ডিটেইলে বললাম। কিন্তু এরকম আরও অনেক ফাংশন আছে উৎসব-অনুষ্ঠানে উচ্চস্বরে গানের। ক্লিফোর্ড গিয়ার্টজের সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার তত্ত্ব (Cultural Heritage Theory) অনুসারে সংস্কৃতি হলো মানুষের প্রতীকী কাজের একটি পদ্ধতি, যা তাদের বিশ্বাস, মূল্যবোধ এবং ঐতিহ্যকে প্রকাশ করে। উচ্চস্বরে গানবাজনা সমাজের সাংস্কৃতিক অভিব্যক্তি হিসেবে কাজ করে এবং সমাজের সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার সংরক্ষণে ভূমিকা পালন করে। সিগমুন্ড ফ্রয়েডের মানসিক উত্তেজনা ও সেফটি ভালভ তত্ত্বও এখানে আনা যায়। ফ্রয়েডের মতে, আবেগের মুক্তি মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। উৎসবে উচ্চস্বরে গানবাজনা মানসিক উত্তেজনা কমাতে এবং আবেগের মুক্তি দিতে সহায়ক হয়, যা ব্যক্তির মানসিক সুস্থতা এবং সমাজের স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সহায়ক। ট্র্যাভিস হির্শির সোশ্যাল কন্ট্রোল থিওরি অনুসারে, সমাজের নিয়ম ও নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে সামাজিক অনুষ্ঠান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এটি অনুসারে, উৎসবে উচ্চস্বরে গানবাজনা সামাজিক নিয়ম ও কাঠামো পুনঃপ্রতিষ্ঠায় সাহায্য করে এবং সমাজের স্থায়িত্ব নিশ্চিত করে। ট্যালকট পার্সন্সের ইকোনমিক ফাংশনালিজম অনুসারে, সমাজের প্রতিটি উপাদান একটি নির্দিষ্ট অর্থনৈতিক ভূমিকা পালন করে। সেক্ষেত্রে উৎসবে উচ্চস্বরে গানবাজনা স্থানীয় অর্থনীতিতে অবদান রাখতে সহায়ক হয়, যেমন ব্যবসা-বাণিজ্যের বিকাশ এবং স্থানীয় অর্থনৈতিক কার্যকলাপ বৃদ্ধি। জর্জ হোম্যান্সের সোশ্যাল এক্সচেঞ্জ থিওরি অনুসারে, সামাজিক বিনিময়ের মাধ্যমে মানুষ নতুন সম্পর্ক তৈরি করে। উৎসবে উচ্চস্বরে গানবাজনা মানুষকে একত্রিত করে এবং নতুন সামাজিক সম্পর্ক গঠনে সহায়ক হয়, যা সমাজের সামাজিক নেটওয়ার্ককে শক্তিশালী করে। হেনরি তাজফেলের সোশ্যাল আইডেন্টিটি থিওরি অনুসারে, মানুষ তার গোষ্ঠীর সাথে সম্পর্কিত হয়ে একটি গোষ্ঠী পরিচয় তৈরি করে। সেক্ষেত্রে বলা যায়, উৎসবে উচ্চস্বরে গানবাজনা এই গোষ্ঠী পরিচয় প্রতিষ্ঠায় সহায়ক হয় এবং সমাজের সংহতি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সাহায্য করে।

এখন বলতেই পারেন, উচ্চস্বরে গানবাজনার এত ভাল ভাল ফাংশন তো বাস্তবে অত দেখা যাচ্ছেনা। হ্যাঁ, সেটা হয়। ফাংশনালিজমের তত্ত্ব অনুসারেই, উৎসব-অনুষ্ঠানে উচ্চস্বরে গানবাজনার ফাংশনালিস্ট দৃষ্টিকোণ থেকে যে ইতিবাচক প্রভাব বা ফাংশনগুলোকে আমরা আলোচনা করেছি, তা বাস্তবে সর্বদা কার্যকর না হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এই ব্যর্থতা বা অকার্যকারিতাকে “ডিসফাংশন” (Dysfunction) হিসেবে ব্যাখ্যা করা যায়, যেখানে কোনও উপাদান প্রত্যাশিত ইতিবাচক প্রভাব না ফেলে বরং নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। উচ্চস্বরে গানবাজনা ক্ষেত্রেও এমন কিছু পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে, যা তার মূল ফাংশনগুলোকে বাধাগ্রস্ত করে এবং উৎসবের উদ্দেশ্য ব্যাহত করে। কেন ডিসফাংশন হচ্ছে? অনেক কারণেই, যেমন একটি কারণ হচ্ছে – উচ্চস্বরে গানবাজনা কখনও কখনও মাত্রাতিরিক্ত শব্দ দূষণ সৃষ্টি করে, যা মানুষের মানসিক চাপ বাড়ায় এবং স্বাস্থ্যের ক্ষতি করে। এর ফলে মানুষ উল্টো বিরক্তি এবং অসন্তোষ প্রকাশ করতে পারে, যা সামাজিক সংহতির বদলে সামাজিক বিভাজন তৈরি করতে পারে। এছাড়াও আছে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের দিকটি। সকলেই একই ধরনের সঙ্গীত পছন্দ করেন না। উৎসবের সময় বাজানো সঙ্গীত কখনও কখনও বিশেষ গোষ্ঠীর পছন্দমতো না হওয়ার কারণে মানুষ একে অসহনীয় মনে করতে পারে। এতে সমাজের বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে মতবিরোধ এবং দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হতে পারে, যা সংহতির পরিবর্তে বিরোধ সৃষ্টি করে। সেই সাথে আছে সংস্কৃতির আধিপত্য এবং দমনের সমস্যা, আধুনিক প্রযুক্তি এবং জটিলতার সমস্যা, অপসংস্কৃতির সমস্যা ইত্যাদি।

কিন্তু যদি এটি এরকম ডিসফাংশনাল হয়ে আসে তাহলে যেটা করা উচিৎ সেটা হলো এই ডিসফাংশনগুলোকে কিকরে ফাংশনে কনভার্ট করা যায় সেটার কথা ভাবা, কখনই নিষিদ্ধ করা নয়। কারণ নিষিদ্ধ করলে এর যে ফাংশন বা ইতিবাচকগুলো ছিল সেগুলোও আর থাকবে না, এতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে সমাজই। এক্ষেত্রে এই ডিসফাংশনগুলো এড়াতে বেশ কিছু জিনিস করা যেত। শব্দের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ এবং সীমাবদ্ধতার ব্যবস্থা করা যেত, যেখানে নির্দিষ্ট ডেসিবেল সীমা নির্ধারণ করে উচ্চস্বরে সঙ্গীতের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, যাতে শব্দ দূষণ কমে এবং সবাই একসঙ্গে অংশগ্রহণ করতে পারে। শব্দের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য স্থানীয় প্রশাসন ও আয়োজকদের মধ্যে সহযোগিতা প্রয়োজন। সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের সম্মানের দিকটা রক্ষা করা যেতে পারে। সেজন্য উৎসবে বিভিন্ন ধরনের সঙ্গীত বাজানো, যা সমাজের সব গোষ্ঠীর সংস্কৃতি ও পছন্দের প্রতি সম্মান জানায়। এর মাধ্যমে সমাজের বিভিন্ন গোষ্ঠীর মানুষ একত্রিত হতে পারবে এবং সংহতি বৃদ্ধি পাবে। এখানে সামাজিক সংলাপ এবং সচেতনতা বৃদ্ধির উদ্যোগ নেয়া যেত, যেখানে উচ্চস্বরে গানবাজনার প্রভাব সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে সামাজিক সংলাপ ও আলোচনা চালু করা যেতে পারে। এর মাধ্যমে মানুষ সঙ্গীতের ইতিবাচক এবং নেতিবাচক দিকগুলো সম্পর্কে সচেতন হতে পারে এবং সামাজিক সংহতির ক্ষেত্রে সঙ্গীতের ভূমিকা আরও সুদৃঢ় হতে পারে। সেই সাথে এখানে সাম্প্রদায়িক সহাবস্থান এবং সাংস্কৃতিক অন্তর্ভুক্তি, প্রযুক্তি এবং সাউন্ড ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন, নিয়ম এবং আইন প্রয়োগের ব্যাপারগুলোও আনা যেত।

কিন্তু নিষিদ্ধ করার ফলে ক্ষতিটাই বাড়বে। সামাজিক সংহতি হ্রাস, সাংস্কৃতিক অভিব্যক্তি ও সংরক্ষণে প্রতিবন্ধকতা, আবেগের মুক্তির অভাব এবং মানসিক চাপ বৃদ্ধি, নিয়ন্ত্রণ এবং নিয়মের অভাব, অর্থনৈতিক প্রভাব, নতুন সামাজিক সম্পর্কের গঠনে প্রতিবন্ধকতা, আত্মপরিচয় ও গোষ্ঠী পরিচয়ের দুর্বলতা, বিকল্প বিনোদনের অভাব সবই এখানে বিবেচ্য।

কনফ্লিক্ট থিওরি

যাই হোক, পুরোটাই ফাংশনালিস্ট পারস্পেক্টিভ থেকে লেখা। কিন্তু আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব হচ্ছে কনফ্লিক্ট থিওরি, যা সমাজের ভেতরে বিদ্যমান শ্রেণি, ক্ষমতা, এবং সম্পদের অপ্রতুল বণ্টনকে কেন্দ্র করে সামাজিক সম্পর্ক ও কাঠামো বিশ্লেষণ করে। এই দৃষ্টিকোণ থেকে, উৎসব-অনুষ্ঠানে উচ্চস্বরে গানবাজনার নিষিদ্ধতার বিষয়টি ক্ষমতার দ্বন্দ্ব, সামাজিক অসমতা, এবং নিয়ন্ত্রণের প্রক্রিয়া হিসেবে ব্যাখ্যা করা যায়। উচ্চস্বরে গানবাজনা নিষিদ্ধের ক্ষেত্রে এই দ্বান্দ্বিকতার জায়গাটি বিদ্যমান। এই নিষিদ্ধের ক্ষেত্রে এখানে শ্রেণি ও ক্ষমতার দ্বন্দ্ব, সাংস্কৃতিক আধিপত্য এবং সাংস্কৃতিক নিপীড়ন, নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ার হিসেবে আইন ও নীতি, সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ এবং প্রতিক্রিয়া ইত্যাদি বিষয় সামনে চলে আসে, বিশেষ করে সরকার-পতন পরবর্তী সময়ে। সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ এবং প্রতিক্রিয়ার ক্ষেত্রে যেমন বলা যায়, উৎসব এবং অনুষ্ঠানে উচ্চস্বরে গানবাজনার নিষিদ্ধতা প্রান্তিক গোষ্ঠীর মধ্যে সাংস্কৃতিক প্রতিরোধের জন্ম দিতে পারে, আবার এই নিষিদ্ধতার পেছনেও একটি গোষ্ঠীর প্রতিক্রিয়ার হাত থাকতে পারে। এটি একটি প্রক্রিয়ার অংশ, যেখানে কোন গোষ্ঠী তাদের সাংস্কৃতিক পরিচয় ও অধিকারের পক্ষে লড়াই করে। নিউজে ইসলামে গানবাজনা নিষিদ্ধের ব্যাপারটাকেও গানবাজনা বন্ধ করার পেছনে যুক্তি দেয়া হয়েছিল, আবার বলা হয়েছিল হিন্দুদের জন্য এটা প্রযোজ্য নয়। যদি কারণ কেবল সেক্যুলার হতো তাহলে হিন্দুদের জন্য প্রযোজ্য-অপ্রযোজ্য হবার প্রসঙ্গই এখানে আসতো না। তাই ধর্মীয় সংস্কৃতিভিত্তিক কনফ্লিক্টের ব্যাপার এখানে আছেই।

এর নিষিদ্ধকরণের ফলে ঘটছে সাংস্কৃতিক দমন এবং ঐতিহ্যের ক্ষতি। উচ্চস্বরে গানবাজনা নিষিদ্ধ করার ফলে প্রান্তিক গোষ্ঠীগুলোর সাংস্কৃতিক অভিব্যক্তির সুযোগ সীমিত হয়ে যায়। এর ফলে তাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এবং অভ্যাসগুলো হারিয়ে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে। নিষিদ্ধকরণ প্রক্রিয়াটি প্রান্তিক গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে সাংস্কৃতিক দমনের অনুভূতি তৈরি করতে পারে এবং তাদের সাংস্কৃতিক পরিচয়ের প্রতি হুমকি হয়ে উঠতে পারে। নিষিদ্ধ করার পরিবর্তে একটি সহনশীল এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক নীতি গ্রহণ করা যেতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, বিভিন্ন সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর মতামত এবং অভ্যাসের প্রতি সম্মান জানিয়ে একটি সমন্বিত পরিকল্পনা তৈরি করা যেতে পারে, যেখানে সবার জন্য সমান সুযোগ তৈরি হবে। সংস্কৃতির বৈচিত্র্যকে সম্মান জানিয়ে একটি সামগ্রিক কৌশল গ্রহণ করা উচিত, যাতে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য বজায় থাকে। এই নিষিদ্ধকরণের ফলে সামাজিক বিভাজন এবং উত্তেজনার বৃদ্ধি পাচ্ছে, সমাজের বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে বিভাজন এবং মতবিরোধ তৈরি হতে পারে। কনফ্লিক্ট থিওরি অনুযায়ী, ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী যদি এই নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে, তবে প্রান্তিক গোষ্ঠীগুলো এটিকে তাদের উপর আরোপিত অন্যায় এবং নিপীড়ন হিসেবে দেখতে পারে। এর ফলে সমাজে সামাজিক উত্তেজনা এবং সংঘাতের সৃষ্টি হতে পারে। নিষিদ্ধকরণের পরিবর্তে সামাজিক সংলাপ এবং পারস্পরিক বোঝাপড়ার মাধ্যমে একটি সমঝোতা তৈরি করা উচিত। বিভিন্ন গোষ্ঠীর প্রতিনিধিদের মধ্যে আলোচনা ও সমন্বয়ের মাধ্যমে একটি গ্রহণযোগ্য নীতি তৈরি করা যেতে পারে। সমাজের বিভিন্ন অংশের মতামত এবং উদ্বেগগুলো বিবেচনা করে একটি সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত, যাতে সবার অধিকার এবং স্বাধীনতা রক্ষা করা হয়।

এর ফলে সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ এবং প্রতিক্রিয়ার সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে। নিষিদ্ধকরণ নতুন প্রান্তিকীকৃত গোষ্ঠীর মধ্যে প্রতিরোধ এবং প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিতে পারে। তারা নিজেদের সংস্কৃতিকে রক্ষা করতে এবং তাদের অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে আন্দোলন শুরু করতে পারে, যা সমাজে অস্থিরতা এবং সংঘাতের সৃষ্টি করতে পারে। এই ধরনের পরিস্থিতি এড়াতে সরকারের উচিত একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং সহনশীল সংস্কৃতি গড়ে তোলা, যেখানে প্রতিটি গোষ্ঠীর সংস্কৃতি ও ধর্মীয় অভিব্যক্তি সুরক্ষিত থাকবে। একটি ন্যায়সঙ্গত আইনী কাঠামো প্রতিষ্ঠা করা উচিত, যা সব ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য হবে এবং কোন গোষ্ঠীর উপর অন্যায়ভাবে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হবে না। এছাড়াও শ্রেণি এবং ক্ষমতার দ্বন্দ্বের তীব্রতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। নিষিদ্ধকরণের ফলে সমাজের বিত্তবান ও ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর সঙ্গে প্রান্তিক ও নিম্নবিত্ত গোষ্ঠীর মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব তীব্র হতে পারে। ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী এই নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে তাদের আধিপত্য বজায় রাখতে চাইতে পারে, যা প্রান্তিক গোষ্ঠীর মধ্যে ক্ষোভ এবং বিদ্রোহের জন্ম দিতে পারে। এ ধরনের সংঘাত এড়াতে নীতি নির্ধারকদের উচিত বিভিন্ন গোষ্ঠীর প্রতিনিধিদের মধ্যে বোঝাপড়া এবং আলোচনা বৃদ্ধি করা। শ্রেণি এবং ক্ষমতার দ্বন্দ্ব কমিয়ে আনার জন্য একটি ন্যায্য এবং সমান নীতি গ্রহণ করা উচিত, যা সমাজের সব স্তরের মানুষের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করবে এবং তাদের সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় অধিকার রক্ষা করবে।

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.