মমতা, হেজিমনি, পপুলিজম, রাজ্যের ইকোনমি ও আর জি কর কাণ্ড

হেজিমনির পরিবর্তন?

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পশ্চিমবঙ্গে তার শাসনকালে জনকল্যাণমূলক প্রকল্পগুলোর মাধ্যমে একটি শক্তিশালী হেজিমনি গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন। সাংস্কৃতিক নেতৃত্ব এবং নৈতিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে জনগণের মধ্যে একটি সামাজিক সম্মতি তৈরি করতে পেরেছিলেন। এই সম্মতির ফলে সাধারণ মানুষ মমতার জনকল্যাণমূলক নীতিগুলোকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে মেনে নেয় এবং তার শাসনব্যবস্থা দীর্ঘদিন ধরে পশ্চিমবঙ্গে প্রভাবশালী হয়ে ওঠে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তার হেজিমনি গঠনের জন্য বিভিন্ন জনকল্যাণমূলক প্রকল্প চালু করেছিলেন, যেমন ‘কন্যাশ্রী’, ‘সবুজ সাথী’, এবং ‘স্বাস্থ্য সাথী’, যা সমাজের নীচের স্তরের মানুষের মধ্যে একটি ভালোবাসা এবং সমর্থন তৈরি করেছিল। এই প্রকল্পগুলো মমতার রাজনৈতিক অবস্থানকে শক্তিশালী করেছিল এবং তাকে পশ্চিমবঙ্গের জনমানসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে পৌঁছে দিয়েছিল। কিন্তু হেজিমনি তৈরি করা বেশিরভাগ শাসকদের বেলায় যেটা হয়, তারা একে শোষণ, দুর্নীতির জাস্টিফিকেশন হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করে। পশ্চিমবঙ্গেও তাই হয়ে থাকবে। তবে রিসেন্টলি মমতার হেজিমনি পড়তে শুরু করেছিল, বিশেষ করে মধ্যবিত্তদের মধ্যে, ডিএ নিয়ে সমস্যা, নিয়োগ বন্ধ থাকা ইত্যাদি বিভিন্ন কারণে। আর এর চূড়ান্ত রূপটা দেখা যাচ্ছে সাম্প্রতিক আন্দোলনে, যেখানে সরাসরি মমতার শাসনকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হচ্ছে।

গ্রামসি থেকে আমরা দেখতে পারি, যখন একটি ক্ষমতাসীন দল বা শ্রেণি তাদের হেজিমনি হারিয়ে ফেলে বা সেই ঐকমত্য দুর্বল হয়ে যায়, তখন তাদের জন্য শাসনব্যবস্থা টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়ে। এই অবস্থায়, ক্ষমতাসীন দল সাধারণত আরও কঠোর পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হয়, যেমন: বলপ্রয়োগের বৃদ্ধি, তারা আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী এবং সেনাবাহিনীর মতো বলপ্রয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের ওপর নির্ভরশীলতা বাড়িয়ে তোলে; প্রচার ও আদর্শিক নিয়ন্ত্রণ, নিজেদের প্রভাব ফিরিয়ে আনার জন্য তারা প্রচার ও আদর্শিক নিয়ন্ত্রণ বাড়ানোর চেষ্টা করে, যেমন, গণমাধ্যম, শিক্ষা, এবং সংস্কৃতির ওপর অধিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা; বিরোধী দল ও মতামতের দমন, ক্ষমতাসীন দল তাদের বিরোধী দল, মতামত বা আন্দোলনকে দমন করার জন্য কঠোর পদক্ষেপ নিতে পারে, যাতে তারা শাসনব্যবস্থার প্রতি চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে পারে। আর জি করের ধর্ষণের ঘটনা হয়তো বলপ্রয়োগ বৃদ্ধির একটা ফল, যেখানে মানুষের কণ্ঠস্বরকে দমন করার চূড়ান্ত রূপ হিসেবে আসে ধর্ষণ ও হত্যা। এখন দেখছি আন্দোলনকারী বিভিন্ন দলের লোকদের ওপর লাঠিচার্জ চলছে, গ্রেফতার করা হচ্ছে, সেটা বিরোধী দল ও মতামতের দমনেরই অংশ।

লাকলাউ ও মউফের তত্ত্ব অনুযায়ী মমতার পপুলিজমভিত্তিক হেজিমনি

মমতার হেজিমনিটা একটু বিশেষ ধরণের হেজিমনি। এটা হচ্ছে পপুলিজমের মাধ্যমে হেজিমনি যা নিয়ে বিস্তারিত কাজ করেছেন আর্নেস্তো লাকলাউ (Ernesto Laclau) এবং শ্যান্টাল মউফ (Chantal Mouffe)। তাদের মতে, পপুলিজম হলো একটি সামাজিক ও রাজনৈতিক কৌশল, যা সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি এবং গোষ্ঠীর মধ্যে একটি সাধারণ ‘চাহিদা’ বা ‘দাবি’ (demand) তৈরি করে এবং সেই দাবির ভিত্তিতে তাদের মধ্যে একটি ঐক্য (unity) গড়ে তোলে। এই প্রক্রিয়ায় পপুলিজম একটি শক্তিশালী হেজিমনি প্রতিষ্ঠার মাধ্যম হিসেবে কাজ করে। লাকলাউ এবং মউফের তত্ত্বে ‘জনগণ বনাম এলিট’ (People vs. Elite) কাঠামোটি একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। তাদের মতে, পপুলিস্ট রাজনীতি মূলত একটি বিরোধী কাঠামোর (antagonistic framework) উপর ভিত্তি করে কাজ করে, যেখানে জনগণ (People) এবং এলিট (Elite) এর মধ্যে একটি দ্বন্দ্বময় সম্পর্ক তৈরি করা হয়। পপুলিজমের মূল লক্ষ্য হলো জনগণের সাধারণ চাহিদা বা দাবি নিয়ে একটি ঐক্য তৈরি করা, যা এলিট শ্রেণির বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। এলিট শ্রেণি (Elite Class) সাধারণত সমাজের ক্ষমতাবান, প্রভাবশালী এবং সম্পদশালী গোষ্ঠী হিসেবে চিহ্নিত হয়, যারা পপুলিস্ট রাজনীতিতে একটি শত্রু বা প্রতিপক্ষ হিসেবে উপস্থাপিত হয়। পপুলিস্ট দলগুলো এই এলিটদের বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী জনমত গঠন করে এবং তাদের ‘জনগণ’ (the People) হিসেবে চিহ্নিত একটি বৃহত্তর সামাজিক গোষ্ঠীর পক্ষে সমর্থন জোগায়। লাকলাউ-এর তত্ত্বের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো “এম্পটি সিগ্নিফায়ার” (Empty Signifier) ধারণা। তিনি ব্যাখ্যা করেছেন যে, পপুলিজম একটি এম্পটি সিগনিফায়ার হিসেবে কাজ করে, যা বিভিন্ন শ্রেণি ও গোষ্ঠীর চাহিদাগুলোর মধ্যে একটি সাধারণতা (commonality) তৈরি করতে সক্ষম হয়। এই খালি সিগ্নিফায়ার হলোএমন একটি প্রতীক বা শব্দ, যা বিভিন্ন শ্রেণির মানুষদের বিভিন্ন চাহিদাকে একত্রিত করে একটি সাধারণ দাবিতে পরিণত করে। উদাহরণস্বরূপ, ‘পরিবর্তন’ (Change) বা ‘ন্যায়বিচার’ (Justice) এর মতো শব্দগুলো পপুলিস্ট রাজনীতিতে খালি সাইনিফায়ার হিসেবে কাজ করে। এই শব্দগুলো বিভিন্ন মানুষের বিভিন্ন চাহিদার প্রতীকী রূপে ব্যবহৃত হয়, যা তাদের মধ্যে একটি ঐক্য তৈরি করতে সক্ষম হয়। এই ঐক্যের ভিত্তিতেই পপুলিস্ট দলগুলো একটি হেজিমনি গড়ে তোলে এবং তাদের রাজনৈতিক ক্ষমতা টিকিয়ে রাখে। মমতার ক্ষেত্রে এরকমই একটা এম্পটি সিগ্নিফায়ার হচ্ছে “মা-মাটি-মানুষ”!

লাকলাউ এবং মউফের মতে, পপুলিজমের মাধ্যমে হেজিমনি প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়াটি একটি সামাজিক ঐক্য গড়ে তোলার উপর নির্ভর করে। পপুলিস্ট দলগুলো প্রথমে জনগণের সাধারণ চাহিদাগুলোকে চিহ্নিত করে এবং সেগুলিকে একটি এম্পটি সিগ্নিফায়ারের মাধ্যমে প্রতীকী রূপ দেয়। এরপর তারা এই চাহিদাগুলোর ভিত্তিতে একটি বৃহত্তর সামাজিক আন্দোলন তৈরি করে, যা জনগণের মধ্যে একটি ঐক্য স্থাপন করে। এই আন্দোলন এবং ঐক্যের মাধ্যমেই পপুলিস্ট দলগুলো তাদের হেজিমনি প্রতিষ্ঠা করে এবং ক্ষমতা অর্জন করে। ‘জনগণ বনাম এলিট’ কাঠামোটি পপুলিজমের মাধ্যমে হেজিমনি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই কাঠামোর মাধ্যমে পপুলিস্ট দলগুলো একটি শক্তিশালী বিরোধী শক্তি হিসেবে এলিট শ্রেণিকে চিহ্নিত করে এবং জনগণের মধ্যে তাদের বিরুদ্ধে একটি সামগ্রিক ক্ষোভ তৈরি করে। এই ক্ষোভ এবং ঐক্যের মাধ্যমে পপুলিস্ট দলগুলো তাদের রাজনৈতিক অবস্থান শক্তিশালী করে এবং হেজিমনি প্রতিষ্ঠা করে। এই প্রক্রিয়ায়, পপুলিজম জনগণের সমর্থন আদায় করে এবং ক্ষমতাসীন দলের বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী প্রতিরোধ গড়ে তোলে, যা শেষ পর্যন্ত তাদের রাজনৈতিক ক্ষমতাকে স্থায়ী করতে সহায়ক হয়।

মমতার পপুলিজম

কিন্তু মমতার তৃণমূল কংগ্রেস কি পপুলিস্ট দল? আর এটা কি আসলেই জনগণ বনাম এলিট কাঠামো দাঁড় করাচ্ছে? আমার উত্তর হচ্ছে হ্যাঁ।

মমতার পপুলিজমটা হচ্ছে লেফট উইং পপুলিজম। লেফট উইং পপুলিজম সাধারণত সমাজের শ্রমিক শ্রেণি, প্রান্তিক গোষ্ঠী এবং দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে একটি ঐক্য তৈরি করে। এই ঐক্যের মাধ্যমে লেফট উইং পপুলিস্টরা শাসক শ্রেণির বিরুদ্ধে সংগ্রামের ডাক দেয় এবং সাধারণ জনগণের দাবিগুলোকে রাজনৈতিক এজেন্ডায় রূপান্তরিত করে। এই প্রক্রিয়ায়, তারা একটি শক্তিশালী জনমত তৈরি করে এবং ক্ষমতাসীন শ্রেণির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। লাকলাউ এবং মউফের মতে, এই প্রক্রিয়াটি হেজিমনি প্রতিষ্ঠার জন্য অত্যন্ত কার্যকরী। যখন একটি লেফট উইং পপুলিস্ট আন্দোলন সফলভাবে জনগণের দাবিগুলোকে রাজনৈতিকভাবে চিহ্নিত করতে পারে, তখন তারা একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক শক্তিতে রূপান্তরিত হয়। এই প্রক্রিয়াটি শাসক শ্রেণির বিরুদ্ধে শক্তিশালী প্রতিরোধ গড়ে তুলতে এবং ক্ষমতায় আসার জন্য প্রয়োজনীয় জনসমর্থন লাভ করতে সাহায্য করে। লেফট উইং পপুলিজম প্রায়ই ধনী শ্রেণি এবং কর্পোরেট এলিটদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়, এবং সাধারণ জনগণের জন্য উচ্চতর কর, শ্রমিকদের অধিকার, এবং সামাজিক সুরক্ষা বৃদ্ধির পক্ষে সমর্থন জোগায়। যদিও এই ধরনের নীতি প্রাথমিকভাবে জনপ্রিয়তা অর্জন করতে পারে, তবে অনেক ইকোনমিস্ট বিশ্বাস করেন যে এই নীতিগুলো অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে ব্যাহত করতে পারে এবং দীর্ঘমেয়াদে অর্থনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারে।

মমতাকে লেফট উইং পপুলিস্ট বলি বেশ কিছু কারণে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তার শাসনামলে বিভিন্ন জনকল্যাণমূলক প্রকল্প চালু করেছেন, যেমন ‘কন্যাশ্রী’, ‘সবুজ সাথী’, এবং ‘স্বাস্থ্য সাথী’। এসব প্রকল্পের লক্ষ্য ছিলো সমাজের দরিদ্র এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে সরাসরি উপকারিতা প্রদান করা। এই ধরনের প্রকল্পগুলি লেফট উইং পপুলিজমের একটি মূল বৈশিষ্ট্য, যেখানে জনগণের স্বার্থে অর্থনৈতিক এবং সামাজিক নীতি প্রণয়ন করা হয়। তিনি প্রায়ই তার রাজনৈতিক বক্তৃতায় এবং নীতিগুলোর মাধ্যমে এলিটবিরোধী অবস্থান নিয়েছেন। তিনি নিজেকে সাধারণ মানুষের প্রতিনিধি হিসেবে উপস্থাপন করেন এবং প্রায়ই ধনী শ্রেণি এবং ক্ষমতাবানদের বিরুদ্ধে কথা বলেন। এই এলিটবিরোধী মনোভাব লেফট উইং পপুলিজমের একটি অন্যতম লক্ষণ। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রায়ই জনপ্রিয়তাবাদী নীতিগুলোকে প্রাধান্য দেন, যা সাধারণ মানুষের মধ্যে জনপ্রিয়তা অর্জন করতে এবং ভোটারদের আকৃষ্ট করতে সহায়ক। লেফট উইং পপুলিস্ট নেতারা প্রায়ই এই ধরনের নীতি গ্রহণ করে তাদের জনসমর্থন বৃদ্ধি করে এবং ক্ষমতায় থাকার চেষ্টা করেন। সবচেয়ে বড় কথা হলো দরিদ্রদের সহায়তা করতে গিয়ে ভাতার ব্যাপারটা। আর এসব করা হচ্ছে রাজ্যের ইকোনমি ও মধ্যবিত্তের এক্সপেন্সে।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে পশ্চিমবঙ্গের বাজেট ঘাটতি এবং ঋণের পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে রাজ্যের বাজেট ঘাটতি GSDP-এর ৩.৬৩% হিসাবে নির্ধারিত হয়েছে, যা কেন্দ্রীয় সরকারের নির্ধারিত ৩.৫% সীমার চেয়েও বেশি। এই ঘাটতির ফলে রাজ্যের সঞ্চিত ঋণের পরিমাণ ৬.৪৭ লক্ষ কোটি রুপি ছাড়িয়ে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে​। এই ঋণ এবং বাজেট ঘাটতি প্রাথমিকভাবে মমতার পপুলিস্ট নীতির মাধ্যমে বিভিন্ন জনকল্যাণমূলক প্রকল্পে অতিরিক্ত ব্যয়ের ফল। মমতার পপুলিজমের কারণে মধ্যবিত্ত শ্রেণি সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সরকারি চাকরির নিয়োগ প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে, যা শিক্ষিত যুবকদের মধ্যে বেকারত্বের হার বৃদ্ধি করেছে। এছাড়া, মহার্ঘ ভাতা (ডিএ) প্রদান না করার সিদ্ধান্তটি মধ্যবিত্ত সরকারি কর্মচারীদের জন্য আর্থিক চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে, যা তাদের ক্রয়ক্ষমতা কমিয়ে দিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে, মধ্যবিত্ত শ্রেণি তাদের আর্থিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে হিমশিম খাচ্ছে। বাজেট ঘাটতি এবং ঋণ বৃদ্ধির কারণে সরকার অবকাঠামো উন্নয়নে পর্যাপ্ত বিনিয়োগ করতে পারেনি, যা রাজ্যে বিনিয়োগকারীদের জন্য একটি নিরুৎসাহিত পরিবেশ তৈরি করেছে। বিনিয়োগের অভাবে রাজ্যের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হয়েছে, যা দীর্ঘমেয়াদে কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য ক্ষতিকর। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তার পপুলিস্ট নীতির মাধ্যমে নিম্নবিত্ত শ্রেণির উপর বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন এবং তাদের জন্য ভাতা ও জনকল্যাণমূলক প্রকল্প চালু করেছেন। এই প্রকল্পগুলো রাজ্যের আর্থিক স্থিতিশীলতাকে নষ্ট করেছে এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণির স্বার্থের বিপরীতে কাজ করেছে। নিম্নবিত্ত শ্রেণির উপর অতিরিক্ত নির্ভরশীলতা যখন সরকারের জনকল্যাণমূলক নীতিগুলোর মাধ্যমে প্রকাশ পায়, তখন তা আর্থিক বৈষম্য বাড়িয়ে তুলতে এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণির জন্য আর্থিক সুযোগ কমিয়ে দিতে পারে, আর এটাই হচ্ছে।

অর্থনীতির এক্সপেন্সে ক্ষমতা

শিক্ষা খাতে নিয়োগের স্থবিরতা, সরকারি চাকরিতে নিয়োগ বন্ধ, ডিএ প্রদান না করা, সরকারি স্কুল বন্ধ হয়ে যাওয়া, বিনিয়োগ কমা – এসবের ডিরেক্ট ভিক্টিম তো মধ্যবিত্তরাই। এর প্রসঙ্গে গেলামই না, ইকোনমির দিকে একটু তাকানো যাক। পশ্চিমবঙ্গের ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য রাজস্ব ঘাটতি ৩১,৯৫২ কোটি টাকা বা জিডিপির ১.৭% হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে। এই রাজস্ব ঘাটতি অর্থনীতির জন্য একটি বড় উদ্বেগের বিষয়, কারণ এটি রাজ্যের ব্যয় এবং আয় এর মধ্যে বড় ফাঁককে নির্দেশ করে। এর ফলে রাজ্যকে সেই সমস্ত ব্যয় বহন করতে ঋণ নিতে হয়, যা সম্পদ বৃদ্ধি বা দেনা কমাতে সহায়তা করে না। ২০২৪-২৫ সালের জন্য রাজ্যের ঋণের পরিমাণ জিডিপির ৩৬.৯% হিসেবে অনুমান করা হয়েছে, যা পশ্চিমবঙ্গের জন্য একটি বড় আর্থিক বোঝা। এই ঋণের বোঝা সীমাবদ্ধতা তৈরি করে নতুন প্রকল্প এবং উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে অর্থ বিনিয়োগের ক্ষেত্রে। রাজ্যের নিজের ট্যাক্স থেকে আয় ২০২৪-২৫ সালে ১,০২,৩৪৯ কোটি টাকা হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে, যা মাত্র ১০% বৃদ্ধি নির্দেশ করে। এর মানে রাজ্য পর্যাপ্তভাবে নিজের রাজস্ব বাড়াতে পারছে না, যা একটি বড় সমস্যা। বিভিন্ন উন্নয়নমূলক খাতে যেমন আবাসন, গ্রামীণ উন্নয়ন, এবং কৃষিতে নির্ধারিত ব্যয়ের চেয়ে অনেক কম ব্যয় হয়েছে (যদিও ভাতা দেয়া হয়েছে অনেক)। উদাহরণস্বরূপ, ২০২২-২৩ অর্থবছরে আবাসন খাতে বাজেটের ৪৮% কম ব্যয় হয়েছে। এই ধরনের খাতগুলোতে কম ব্যয় অবকাঠামো এবং অন্যান্য উন্নয়নমূলক কাজের ক্ষেত্রে রাজ্যের অগ্রগতিতে প্রভাব ফেলছে। রাজ্যের আয়ের একটি বড় অংশ কেন্দ্রীয় সরকার থেকে প্রাপ্ত কর ভাগ ও অনুদানের ওপর নির্ভরশীল, যা রাজ্যের নিজস্ব অর্থনৈতিক সক্ষমতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। বিশেষ করে, বিভিন্ন কেন্দ্রীয় স্পন্সরড স্কিমের জন্য প্রাপ্ত অনুদানও কমে যাচ্ছে।

তো এভাবেই মধ্যবিত্ত এলিট ও নিম্নবিত্ত জনসাধারণের মধ্যে একটা ডিকোটমি তৈরি করা হয়েছে, এমনকি এখন রাজ্যের ইকোনমিক স্বার্থের জন্য মধ্যবিত্তরা যদি মমতার সমালোচনা করেও সেটাকেও এলিট বনাম জনতা ডিকোটমিতে ফেলে দেয়া হয়, আর এটা হয় মমতার পপুলিজমের হেজিমনির মাধ্যমেই। এই হেজেমনির কথাই আর্নেস্তো লাকলাউ এবং শ্যান্টাল মউফ দেখিয়েছেন। আর এরকম ইকোনমির এক্সপেন্সে জনতোষণ করা হয় বলে লেফট উইং পপুলিজম ভয়ানক হয়ে ওঠে। ভয়টা কোথায়?

অলরেডি পশ্চিমবঙ্গের ইকোনমিক্সের বিভিন্ন অবস্থা তুলে ধরেছি। এবার একটু সাধারণভাবে বলি। পপুলিস্ট সরকারগুলো প্রায়ই জনগণকে তুষ্ট করার জন্য অতিরিক্ত অর্থ খরচ করে থাকে, যা সরকারের বাজেটে ঘাটতি সৃষ্টি করতে পারে। এই ধরনের অতিরিক্ত সরকারি খরচ অর্থনীতিতে মুদ্রাস্ফীতি সৃষ্টি করতে পারে। সরাসরি নগদ অর্থ প্রদান, ভর্তুকি, এবং জনকল্যাণমূলক প্রকল্পের জন্য অতিরিক্ত অর্থ মুদ্রণের ফলে মুদ্রাস্ফীতি বেড়ে যায়, যা অর্থনীতির জন্য দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতিকর হতে পারে। বিশেষ করে যদি এটি উৎপাদনশীল বিনিয়োগের পরিবর্তে কেবলমাত্র ভোগান্তির খরচে ব্যবহৃত হয়। পপুলিস্ট নীতিগুলোর কারণে বাজেট ঘাটতি সৃষ্টি হতে পারে, যা একটি দেশের আর্থিক স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি হতে পারে। যখন সরকার অতিরিক্ত অর্থ ঋণ নিয়ে জনকল্যাণমূলক প্রকল্পে ব্যয় করে, তখন এটি দীর্ঘমেয়াদে দেশের ঋণ বোঝা বাড়ায়। এটি পরবর্তীতে দেশের ঋণ নেওয়ার সক্ষমতা এবং আর্থিক স্বাধীনতাকে কমিয়ে দেয়, যার ফলে ভবিষ্যতে অর্থনৈতিক সংকট তৈরি হতে পারে। এরকম নীতিগুলো প্রায়ই স্থায়ী সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা তৈরি করতে ব্যর্থ হয়। যদিও প্রাথমিকভাবে এসব নীতিগুলো জনপ্রিয়তা অর্জন করতে পারে, তবে যদি অর্থনীতির আয়-ব্যয়ের মধ্যে সামঞ্জস্য না থাকে, তবে এসব প্রকল্প দীর্ঘমেয়াদে টিকে থাকতে পারে না। ফলে, ভবিষ্যতে সরকার এই ধরনের প্রকল্প চালিয়ে যেতে অক্ষম হতে পারে, যা সামাজিক অস্থিরতা এবং অর্থনৈতিক সংকট তৈরি করতে পারে। সেই সাথে পপুলিস্ট অর্থনৈতিক নীতি প্রায়ই দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। যখন সরকার অতিরিক্ত খরচ করে এবং করের মাধ্যমে ধনী শ্রেণি বা কর্পোরেট এলিটদের ওপর বোঝা চাপায়, তখন এটি ব্যবসায়িক আস্থা কমিয়ে দেয় এবং নতুন বিনিয়োগের প্রবাহকে বাধাগ্রস্ত করে। দীর্ঘমেয়াদে, এটি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে ধীরগতি করে এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ কমিয়ে দেয়। এই ক্ষতিগুলোর অনেকগুলোই অলরেডি পশ্চিমবঙ্গে আসতে শুরু করেছে, মমতার পপুলিজম কন্টিনিউ করলে এগুলো আরও বাড়তে থাকবে।

ডানপন্থী ও বামপন্থী ইকোনমিস্টদের সমালোচনা

অনেক ইকোনমিস্ট লেফট উইং পপুলিজমের এই অর্থনৈতিক দিকের সমালোচনা করেছেন। আমি ডানপন্থী-বামপন্থী সবার কথাই বলব। ফ্রিডরিখ হায়েক পপুলিজমের নেতিবাচক অর্থনৈতিক প্রভাবের বিষয়ে সতর্ক করেছেন। তার মতে, সরকারি হস্তক্ষেপের মাধ্যমে অর্থনীতিতে অতিরিক্ত খরচ এবং সম্পদের পুনর্বন্টন অর্থনীতির স্বাভাবিক প্রবাহকে বিঘ্নিত করতে পারে এবং দীর্ঘমেয়াদে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি হয়ে উঠতে পারে। মিল্টন ফ্রিডম্যান তার মুদ্রানীতির তত্ত্বে দেখিয়েছেন যে, অতিরিক্ত সরকারি ব্যয় এবং অর্থ মুদ্রণের মাধ্যমে অর্থনীতিকে উদ্দীপিত করার প্রচেষ্টা দীর্ঘমেয়াদে মুদ্রাস্ফীতি সৃষ্টি করে এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ধীরগতি করে। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, অর্থনীতিতে সরকারি হস্তক্ষেপের পরিবর্তে বাজারের নিজস্ব শক্তিকে কাজ করতে দেওয়া উচিত। রুডিগার ডর্নবুশ পপুলিস্ট অর্থনৈতিক নীতির বিষয়ে বিশেষভাবে সতর্ক করে দিয়েছেন। তার মতে, পপুলিজম প্রায়ই স্বল্পমেয়াদী জনপ্রিয়তা অর্জনের জন্য দীর্ঘমেয়াদী অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বিসর্জন দেয়। তিনি বিশেষ করে লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশগুলোর উদাহরণ দিয়ে দেখিয়েছেন, কীভাবে পপুলিস্ট নীতিগুলো অর্থনৈতিক সংকট সৃষ্টি করেছে।

কিন্তু এরা তো ডানপন্থী বা বাজার অর্থনীতিবিদ। কিন্তু কথা হলো বামপন্থী অর্থনীতিবিদরাই লেফট উইং পপুলিজমের সমালোচনা করেন। পল ক্রুগম্যান একজন নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত বামপন্থী অর্থনীতিবিদ, যিনি সাধারণত বামপন্থী নীতিগুলোর সমর্থক। তবে তিনি লেফট উইং পপুলিজমের কিছু নির্দিষ্ট দিক নিয়ে সমালোচনা করেছেন। ক্রুগম্যান তার লেখায় প্রায়ই উল্লেখ করেছেন যে, পপুলিস্ট নীতিগুলো প্রায়শই বাস্তবায়নযোগ্য না হওয়ার সম্ভাবনা থাকে এবং এগুলো যদি অর্থনৈতিক বাস্তবতার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ না হয়, তবে তা দীর্ঘমেয়াদে অর্থনীতির ক্ষতি করতে পারে। ক্রুগম্যান বিশেষভাবে সতর্ক করেছেন যে, লেফট উইং পপুলিজম যদি শুধুমাত্র উচ্চাভিলাষী জনকল্যাণমূলক প্রকল্পের প্রতিশ্রুতি দেয়, কিন্তু সেগুলোর জন্য যথাযথ অর্থায়নের পরিকল্পনা না থাকে, তবে এটি বাজেট ঘাটতি, ঋণ বৃদ্ধি, এবং অর্থনৈতিক অস্থিরতার দিকে নিয়ে যেতে পারে। তিনি মনে করেন যে, জনকল্যাণমূলক নীতি প্রণয়ন করা উচিত, তবে তা অবশ্যই অর্থনৈতিক বাস্তবতার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হতে হবে এবং দীর্ঘমেয়াদী স্থায়িত্ব নিশ্চিত করতে হবে।

জোসেফ স্টিগলিৎস, যিনি সাধারণত বামপন্থী অর্থনীতির পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন, তিনিও লেফট উইং পপুলিজমের কিছু দিক নিয়ে সমালোচনা করেছেন। যদিও তিনি সামাজিক ন্যায়বিচার এবং অর্থনৈতিক সমতার পক্ষে সমর্থন জানিয়েছেন, তবে তিনি সতর্ক করেছেন যে, যদি এই নীতিগুলো বাস্তবায়নের জন্য যথাযথ অর্থায়ন না থাকে বা যদি অর্থনীতির উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ না করা হয়, তবে এটি অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করতে পারে। স্টিগলিৎস বিশেষ করে লাতিন আমেরিকার দেশগুলোর উদাহরণ দিয়ে দেখিয়েছেন, কীভাবে কিছু লেফট উইং পপুলিস্ট নীতি প্রাথমিকভাবে জনপ্রিয়তা অর্জন করলেও, দীর্ঘমেয়াদে অর্থনৈতিক সংকটের দিকে নিয়ে যেতে পারে। তিনি বিশ্বাস করেন যে, একটি টেকসই অর্থনৈতিক নীতি গ্রহণ করা জরুরি, যা সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করবে এবং একই সাথে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখবে।

উপসংহার

তো এই হচ্ছে মমতার হেজিমনি ও পপুলিজম, যা পশ্চিমবঙ্গকে অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। মমতা তার ক্ষমতার জন্য পপুলিজম ভিত্তিক হেজিমনি টিকিয়ে রাখেন তার এলিট বনাম পিপলের হেজিমনি ইউজ করে, মা-মাটি-মানুষ এর মত এম্পটি সিগ্নিফায়ারগুলো ব্যবহার করে, ক্ষমতা সংহত করেন আর আর সেই হেজিমনি যখন দুর্বল হতে থাকে তখন বল প্রয়োগ করেন যার এক্সট্রিম রূপে দেখা যায় এরকমই হত্যা ও ধর্ষণ। আর জি কর ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডকে কখনই এই হেজিমনি ও পপুলিজমের মেকানিজম থেকে বিচ্ছিন্ন কিছু নয়, যার সাথে সরাসরি মমতার শাসনতন্ত্র জড়িত। এটাই বুঝতে হবে ও আগামীর আন্দোলনের নকশা তৈরি করতে হবে।

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.