আন্দোলনের দর্শন : আন্দোলন সবসময় গুরুত্বপূর্ণ, পরবর্তীতে ক্ষমতায় যেই আসুক

ভূমিকা

আমি একটা কথা বারবার বলি, রাজনৈতিক আন্দোলন নিজেই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এতে ক্ষমতার পরিবর্তন হবে কিনা, হলে কারা আসবে এসব প্রশ্নের চাইতেও গুরুত্বপূর্ণ। আগে আন্দোলনটা হতে হবে, এরপর অন্য কিছু। রাজনৈতিক আন্দোলনের পর কারা ক্ষমতায় আসবে সেটা নির্বিশেষেই আন্দোলনটি গুরুত্বপূর্ণ। তাই এই পার্টি ক্ষমতা থেকে চলে গেলে বিকল্প আর কে থাকে, বা বিকল্প হিসেবে যে দল আসবে তাতে আরও খারাপ হবে, এইসব কথা ইম্পরটেন্ট নয়। আন্দোলন হওয়াটাই সবচেয়ে ইম্পরটেন্ট। পরে কারা ক্ষমতায় আসবে তা নিয়ে পরে ভাবা যাবে, কিন্তু সেটা নিয়ে চিন্তা করে বর্তমান সমস্যার ক্ষেত্রে চুপ করে থাকা যায়না, সহ্য করা যায়না, আর বর্তমান সরকার অসহনীয় হয়ে গেলে তাকে টিকিয়ে রাখা যায়না।

Albert O. Hirschman, Economist and Resistance Figure, Dies at 97 - The ...
আলবার্ট হির্শম্যান

এক্ষেত্রে অন্যান্য আলোচনায় যাবার পূর্বে আলবার্ট হির্শমানকে আমি টেনে আনতে চাই, একেবারে এই ভূমিকা আলোচনাতেই। আলবার্ট হির্শমান তার প্রভাবশালী বই “Exit, Voice, and Loyalty” তে যে ধারণাগুলো তুলে ধরেছেন, তা সমাজের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে জনগণের প্রতিক্রিয়া এবং তাদের কার্যকলাপের উপর আলোকপাত করে। হির্শমানের তত্ত্ব অনুযায়ী, যখন কোনো প্রতিষ্ঠান, যেমন একটি সরকার, জনগণের চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হয় বা জনগণ তার কার্যক্রমের সঙ্গে অসন্তুষ্ট হয়, তখন জনগণ দুটি প্রধান উপায়ে প্রতিক্রিয়া জানাতে পারে—”এক্সিট” এবং “ভয়েস”। “এক্সিট” বলতে বোঝানো হয় যে, জনগণ প্রতিষ্ঠান বা সরকারের প্রতি তাদের সমর্থন প্রত্যাহার করে এবং বিকল্প উপায় খোঁজে। এক্সিট একটি সরে যাওয়ার প্রক্রিয়া, যেখানে জনগণ সেই প্রতিষ্ঠান বা সরকারের নিয়ন্ত্রণ থেকে বেরিয়ে আসে, যা তাদের প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, যদি একটি সরকার তার নাগরিকদের চাহিদা মেটাতে ব্যর্থ হয়, তাহলে জনগণ তাদের সমর্থন প্রত্যাহার করতে পারে বা কোনো বিকল্প ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারে। এক্সিট প্রায়ই ব্যক্তিগত বা গোষ্ঠীগত সিদ্ধান্তের মাধ্যমে ঘটে এবং এটি প্রতিষ্ঠানটির উপর একটি তাৎক্ষণিক প্রভাব ফেলে। অন্যদিকে, “ভয়েস” হলো একটি সক্রিয় প্রতিক্রিয়া, যেখানে জনগণ তাদের অসন্তোষ প্রকাশ করে এবং পরিবর্তনের দাবি জানায়। এটি একটি প্রতিবাদের রূপ, যেখানে জনগণ তাদের মতামত, চাহিদা, এবং অভিযোগ প্রকাশ করে এবং প্রতিষ্ঠান বা সরকারের কার্যক্রমে প্রভাব ফেলার চেষ্টা করে। হির্শমানের মতে, আন্দোলন হলো “ভয়েস” এর একটি শক্তিশালী রূপ, যেখানে জনগণ তাদের অসন্তোষকে সংঘবদ্ধভাবে প্রকাশ করে এবং সমাজের মধ্যে একটি পরিবর্তনের দাবি তোলে। ভয়েস ব্যবহারের মাধ্যমে জনগণ সরকারকে তাদের কার্যক্রম সংশোধন করতে বাধ্য করে। হির্শমানের তত্ত্বে “লয়্যালটি” (Loyalty) একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, কারণ এটি নির্ধারণ করে যে মানুষ “এক্সিট” এবং “ভয়েস” এর মধ্যে কোন পথটি বেছে নেবে। যদি জনগণের মধ্যে সরকারের প্রতি লয়্যালটি বা আনুগত্য বেশি থাকে, তবে তারা প্রথমেই এক্সিটের পরিবর্তে ভয়েসের পথ বেছে নেবে। তারা সরকারকে সংশোধনের সুযোগ দেবে এবং পরিবর্তনের জন্য আওয়াজ তুলবে। এই লয়্যালটি এবং ভয়েসের সমন্বয় একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক আন্দোলনের জন্ম দেয়, যা সরকারের ওপর জনগণের চাহিদার প্রতি সংবেদনশীল হওয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করে।

এবার আসি বিকল্প দেখাও বা বিকল্প কী – এই প্রসঙ্গে। বিকল্প নেই বা বিকল্প দেখাও – এই টাইপ কথা তখনই আসে যখন লয়্যালটি বলে কিছু থাকেনা বা অনেক কমে যায়। যদি লয়্যালটি এত না পড়তো তাহলে তাহলে মানুষে এক্সিটের জায়গায় ভয়েসের কথা ভাবতো, বিকল্পের প্রশ্ন আসতোই না। কিন্তু লয়্যালটির লেভেল অনেক ড্রপ যদি করে তখনই মানুষ এক্সিটের দিকে যায়, সরকার পতনের আন্দোলন করে, আর এই সময়ে যদি দেখা যায় বিকল্পগুলো খারাপ, তখনই সবাই বলতে শুরু করে এটার বিকল্প নেই, তাই লয়্যালটি না থাকলেও এক্সিটে যাওয়া যাবেনা, ভয়েসেই থাকতে হবে। তাই “বিকল্প নেই” টাইপের কথাগুলো সরকারের প্রতি লয়্যালটির অভাবের ভীতি থেকে আসা জিনিস, যখন লয়্যালটির অভাবের কারণে মানুষ অলরেডি এক্সিটের দিকে যেতে শুরু করেছে। আর অন্যভাবে দেখতে গেলে এই বিকল্প নেই – কথাটি আসলে নিপীড়ক সরকারের লয়্যালটির উৎপাদন ও পুনরুৎপাদনেরই একটি কৌশল হয়ে যায়।

Biografia Antonio Gramsci, vita e storia
অ্যান্টোনিও গ্রামশি

যাই হোক, লয়্যালটির অভাব থাকা সত্ত্বেও জনতা কি বিকল্পের অভাবের জন্য এক্সিটে না গিয়ে কেবল ভয়েস তোলার মোডেই থাকবে? যেহেতু হির্শম্যান এক্ষেত্রে কিছু বলেননি, তাই ধরে নিতে পারি, যদি “বিকল্প নেই” দাবিটা যাদের মধ্যে লয়্যালটি পুনরুজ্জীবিত করবে তারা ভয়েসে যাবে, আর যাদের ক্ষেত্রে করতে পারবে না তারা এক্সিটে যাবে। মানে ব্যাপারটা “বিকল্প নেই” মতাদর্শের ক্ষমতা, হেজিমনি এসবের উপর নির্ভর করবে, যেগুলোর উপর নির্ভর করবে এটি জনতার কতজনের মধ্যে লয়্যাল্টির উৎপাদন ও পুনরুৎপাদন করতে পারছে সেটা। এখানে গ্রামসির হেজিমনি তত্ত্বের একটা দিক আনা প্রাসঙ্গিক হবে। অ্যান্টোনিও গ্রামসির হেজিমনি ধারণার একটি অন্যতম মূল বিষয়ই হলো, ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী তাদের আদর্শ, বিশ্বাস এবং মূল্যবোধকে এমনভাবে প্রতিষ্ঠিত করে যে, সাধারণ মানুষ তা মেনে নিতে বাধ্য হয়। আর যদি তাই হয়, তাহলে এই হেজিমনি তত্ত্ব থেকেই বলতে পারি যে, একটা এক্সট্রিম পর্যায়ে তারা মানুষকে বিশ্বাস করাতে সক্ষম হয় যে, বর্তমান শাসনব্যবস্থা বা সামাজিক কাঠামোই একমাত্র সঠিক ও একমাত্র সম্ভবপর উপায়, এই ব্যবস্থার বাইরে অন্য কোনো বিকল্প নেই, তারা যে অবস্থায় আছে, সেটাই তাদের জন্য সবচেয়ে ভালো, অথবা তারা ভিন্ন কোনো পথে গেলে আরও খারাপ পরিস্থিতির সম্মুখীন হবে, বিদ্যমান শাসনব্যবস্থা ছাড়া অন্য কোনো কার্যকর ব্যবস্থা সম্ভব নয়… ইত্যাদি। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী তাদের শাসনকে ন্যায্যতা দেয় এবং জনগণের প্রতিরোধকে দুর্বল করে। আর হির্শম্যানের তত্ত্বটাকে যা একটু এক্সপ্যান্ড করলাম তা অনুসারে এভাবেই “বিকল্প নেই” মতাদর্শের ভিত্তিতে সরকারের লয়্যালটির নতুন করে উৎপাদন-পুনরুৎপাদন হতে থাকে।

কিন্তু সেই “বিকল্প-নেই”-মতাদর্শোদ্ভূত লয়াল্টিই নিজেই বা কতটা সাস্টেইনেবল হয়, কতদিনই বা এটা এক্সিটকে আটকে রাখতে সক্ষম হয়? এই ব্যাপারে হির্শম্যান সাহেব নিরব। আমার মনে হয়না তা বেশিদিন সম্ভব, স্বৈরাচারী-নিপীড়ক সরকার, স্বৈরাচার-নিপীড়ন চালিয়েই যায়, আর তা এই “বিকল্প নেই” মতাদর্শোদ্ভূত নতুন লয়্যালটিতেও চিড় ধরাতে শুরু করে। আর এটাই এরপর নিয়ে আসে আন্দোলনের আরেক দর্শন – আন্দোলন নিজেই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, আন্দোলনের পর যে সরকার বসবে তা কেমন হবে তা নির্বিশেষেই আন্দোলন গুরুত্বপূর্ণ, সেটা না ভেবেই আন্দোলন কন্টিনিউ করতে হবে – এই দর্শন। কেন পরবর্তীতে কে ক্ষমতায় আসবে সেই চিন্তা নির্বিশেষেই আন্দোলন করা দরকার, দরকারে সরকার পতনের আন্দোলন করা দরকার, সেটার গুরুত্ব কী তা নিয়েই এই লেখাটি।

আন্দোলনের দর্শন

ক্ষমতায় থাকা গোষ্ঠী কেবলমাত্র রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক শক্তির মাধ্যমে শাসন করে না, বরং সাংস্কৃতিক এবং আদর্শগত নেতৃত্বের মাধ্যমে শাসন প্রতিষ্ঠা করে এবং নিজেদের অবস্থানকে মজবুত করে তোলে। এই পদ্ধতিটি আন্তোনিও গ্রামসি তার “Selections from the Prison Notebooks” বইয়ে হেজিমনি তত্ত্বের মাধ্যমে বিশদভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। গ্রামসি দেখান যে, শাসক গোষ্ঠী তাদের আদর্শ এবং মূল্যবোধকে সমাজে এতটাই প্রভাবশালী করে তোলে যে, সাধারণ মানুষ সেই আদর্শকে স্বাভাবিক এবং ন্যায্য হিসেবে গ্রহণ করে। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে, শাসক গোষ্ঠী তাদের ক্ষমতা শুধু শক্তির ওপর নির্ভর করে রাখে না, বরং সাংস্কৃতিক প্রভাব ও সামাজিক সম্মতির মাধ্যমে তাদের আধিপত্য নিশ্চিত করে। গ্রামসির মতে, এই সাংস্কৃতিক নেতৃত্ব বা হেজিমনি যদি চ্যালেঞ্জ না করা হয়, তাহলে একটি স্থিতাবস্থা তৈরি হয়। এই স্থিতাবস্থা এমন একটি পরিস্থিতি সৃষ্টি করে যেখানে ক্ষমতাসীন দল তাদের আদর্শকে সমাজের মূলধারায় মূর্ত করে তোলে, ফলে সমাজের অন্যান্য গোষ্ঠী এবং ব্যক্তিদের পক্ষে এই আদর্শকে চ্যালেঞ্জ করা কঠিন হয়ে পড়ে। এই স্থিতাবস্থা বা হেজিমনি চ্যালেঞ্জ না করলে, প্রকৃত সামাজিক পরিবর্তন অসম্ভব হয়ে পড়ে। গ্রামসি মনে করেন যে, সামাজিক পরিবর্তনের জন্য সাংস্কৃতিক হেজিমনিকে চ্যালেঞ্জ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কেবলমাত্র রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করলেই প্রকৃত পরিবর্তন আনা সম্ভব নয়; বরং সাংস্কৃতিক এবং আদর্শগত লড়াইয়ের মাধ্যমেই সমাজের গভীরে পরিবর্তন ঘটানো সম্ভব। আন্দোলনের মাধ্যমে যখন এই হেজিমনি চ্যালেঞ্জ করা হয়, তখন ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর আদর্শ এবং মূল্যবোধের ভিত্তি নড়বড়ে হয়ে যায়, যা পরিবর্তনের একটি সুযোগ তৈরি করে। তাই গ্রামসি অনুসারে, আন্দোলনের ফলে যে বিকল্প হিসেবে অন্য দল আসবে এবং পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে—এ ধরনের ধারণা মূলত বর্তমান হেজিমনিক শক্তিকে স্থিতিশীল রাখার পক্ষে যুক্তি। এই ধরনের চিন্তা প্রকৃত সামাজিক পরিবর্তনের পথে বাধা সৃষ্টি করে এবং বিদ্যমান শাসনব্যবস্থার অবসানকে বাধাগ্রস্ত করে। গ্রামসির দৃষ্টিতে, ক্ষমতার রূপান্তরের চেয়ে সাংস্কৃতিক এবং আদর্শগত লড়াই বেশি গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি সমাজের ভিত্তি পরিবর্তন করতে পারে। এই প্রসঙ্গে গ্রামসি আরও বলেন, সমাজে যখন কোনও গোষ্ঠী তাদের হেজিমনিকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে, তখন সেটিই প্রকৃত রাজনৈতিক আন্দোলনের সূচনা করে। এই আন্দোলন সমাজের প্রচলিত আদর্শ, মূল্যবোধ, এবং চিন্তার ধারা বদলাতে সক্ষম হয়। তাই রাজনৈতিক আন্দোলন নিজেই গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এর মূল উদ্দেশ্যই হলো ক্ষমতায় থাকা গোষ্ঠীর হেজিমনিকে চ্যালেঞ্জ করা এবং সমাজে নতুন আদর্শ ও মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করা।

Chantal Mouffe Y Ernesto Laclau Factory Sale | head.hesge.ch
আর্নেস্টো ল্যাকলাউ এবং শান্টাল মউফ

এদিকে আর্নেস্টো ল্যাকলাউ এবং শান্টাল মউফ তাদের “Hegemony and Socialist Strategy” বইয়ে গণতন্ত্রের ধারণার একটি নতুন এবং গভীরতর দিক তুলে ধরেছেন, যা প্রচলিত গণতন্ত্রের ধারণা থেকে অনেকটাই ভিন্ন। তারা তাদের র‍্যাডিক্যাল ডেমোক্রেসি তত্ত্বে গণতন্ত্রকে শুধুমাত্র ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ বা ক্ষমতা পরিবর্তনের বিষয় হিসেবে দেখেননি; বরং তারা গণতন্ত্রকে একটি ক্রমাগত দ্বন্দ্ব এবং আলোচনা প্রক্রিয়া হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন। ল্যাকলাউ এবং মউফের মতে, গণতন্ত্রের প্রকৃত শক্তি এবং এর মূল ধারণা লুকিয়ে রয়েছে বিভিন্ন গোষ্ঠী এবং দলের মধ্যে ক্রমাগত লড়াই এবং প্রতিযোগিতার মধ্যে। তারা বলেন যে, সমাজের বিভিন্ন গোষ্ঠী নিজেদের স্বার্থ এবং অধিকার রক্ষার জন্য অবিরত প্রতিযোগিতা করে এবং এই প্রতিযোগিতাই গণতন্ত্রকে জীবন্ত এবং কার্যকর রাখে। এই তত্ত্বের মূল ভিত্তি হলো, গণতন্ত্র একটি স্থিতিশীল বা একক প্রক্রিয়া নয়; বরং এটি একটি গতিশীল এবং বহুমাত্রিক প্রক্রিয়া, যা ক্রমাগত বিবর্তিত হচ্ছে। র‍্যাডিক্যাল ডেমোক্রেসি তত্ত্বে ল্যাকলাউ এবং মউফ আরও উল্লেখ করেন যে, ক্ষমতায় থাকা দলকে চ্যালেঞ্জ করা এবং বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে লড়াইয়ের মাধ্যমে গণতন্ত্র আরও শক্তিশালী হয়। এই চ্যালেঞ্জ এবং লড়াইয়ের মাধ্যমে ক্ষমতার বিন্যাস নতুনভাবে গড়ে ওঠে, যা সমাজের বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে নতুন শক্তির সম্পর্ক তৈরি করে। এই পরিবর্তন প্রয়োজনীয়, কারণ এটি গণতন্ত্রকে আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং অংশগ্রহণমূলক করে তোলে। তাদের মতে, একটি ক্ষমতাসীন দলের পরিবর্তে অন্য দল ক্ষমতায় এলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে, এই ধারণাটি র‍্যাডিক্যাল ডেমোক্রেসির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। কারণ, গণতন্ত্রের প্রকৃত শক্তি দেখা দিতে পারে এবং ইতিবাচক পরিবর্তন আসতে পারে ক্ষমতার পরিবর্তন এবং রাজনৈতিক লড়াইয়ের মাধ্যমে। এই লড়াই এবং ক্ষমতার রূপান্তর গণতন্ত্রকে আরও কার্যকর করে তোলে এবং এটি শুধুমাত্র ক্ষমতার কেন্দ্রিকতার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। এই তত্ত্ব থেকে বোঝা যায় যে, গণতন্ত্রের শক্তি কেবলমাত্র একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠী বা দলের হাতে কেন্দ্রীভূত নয়; বরং এটি একটি ক্রমাগত প্রতিযোগিতা এবং আলোচনার প্রক্রিয়া, যা সমাজের বিভিন্ন স্তরে বিস্তৃত। সুতরাং, ক্ষমতা পরিবর্তন এবং রাজনৈতিক লড়াই গণতন্ত্রের উন্নয়নে বাধা নয়; বরং এটি গণতন্ত্রের অগ্রগতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এই পরিবর্তনের মাধ্যমে নতুন সামাজিক সম্পর্ক এবং নতুন শক্তি সম্পর্ক তৈরি হয়, যা একটি জীবন্ত এবং শক্তিশালী গণতন্ত্রের জন্য অপরিহার্য।

Georg Wilhelm Friedrich Hegel – Movies, Bio and Lists on MUBI
হেগেল

এই প্রসঙ্গে দ্বান্দ্বিকতার প্রসঙ্গটাও এসে যায়। হেগেলীয় দ্বান্দ্বিকতা হলো একটি ধারণা বা অবস্থানের (থিসিস) বিরুদ্ধে একটি বিরোধী ধারণা বা অবস্থানের (অ্যান্টিথিসিস) সংঘর্ষের মাধ্যমে একটি নতুন অবস্থান বা সমাধানে (সিন্থেসিস) পৌঁছানোর প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়াটি ধারাবাহিকভাবে চলতে থাকে এবং এর মাধ্যমে ইতিহাসের অগ্রগতি ঘটে। মার্কস এবং এঙ্গেলস হেগেলের এই তত্ত্বকে গ্রহণ করেন এবং একে ভৌত বাস্তবতার ভিত্তিতে স্থাপন করেন, যা তাদের ঐতিহাসিক বস্তুবাদ (Historical Materialism) তত্ত্বের ভিত্তি গড়ে তোলে। এটি অনুসারে, সমাজে বিদ্যমান শ্রেণি সংগ্রাম এবং দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে ইতিহাসের অগ্রগতি ঘটে, যেমন বুর্জোয়া শ্রেণির শোষণমূলক ব্যবস্থা (থিসিস) এবং প্রলেতারিয়েতের বিপ্লবী আন্দোলন (অ্যান্টিথিসিস) সংঘর্ষের মাধ্যমে একটি নতুন সমাজব্যবস্থা (সিন্থেসিস) গড়ে তোলে, যা সমাজতন্ত্র এবং পরবর্তীতে শ্রেণিহীন সমাজের দিকে অগ্রসর হয়। এখানে আন্দোলনের গুরুত্ব হলো, এটি সমাজের বর্তমান অবস্থার বিরুদ্ধে একটি অ্যান্টিথিসিস হিসেবে কাজ করে। এই সংঘর্ষের মাধ্যমে যে নতুন সমাধান বা সমাজিক কাঠামো গড়ে ওঠে, সেটিই ইতিহাসের অগ্রগতি নিশ্চিত করে। হেগেলীয় দ্বান্দ্বিকতা এবং এর মার্কসীয় বিকাশ অনুযায়ী, এই সংঘর্ষ বা আন্দোলন ছাড়া ইতিহাসের অগ্রগতি সম্ভব নয়। তাই আন্দোলন শুধু ক্ষমতার পরিবর্তনের জন্য নয়, বরং ইতিহাসের অগ্রগতির জন্য অপরিহার্য।

Zehn Jahre nach dem Tod von Ralf Dahrendorf bleiben seine Analysen ...
রালফ ডারেনডর্ফ

এছাড়াও, সমাজতত্ত্বের কনফ্লিক্ট থিওরি (Conflict Theory) এই ধারণাকে আরও শক্তিশালী করে। কনফ্লিক্ট থিওরির মূল ভিত্তি হলো, সমাজে বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে সংঘর্ষ এবং দ্বন্দ্বের মাধ্যমেই সামাজিক পরিবর্তন ঘটে। মার্কস এই তত্ত্বের একজন প্রধান প্রবক্তা হলেও, পরবর্তীতে রালফ ডারেনডর্ফ (Ralf Dahrendorf) এবং লুইস কজার (Lewis Coser) এর মতো তাত্ত্বিকরা এই ধারণাকে আরও সম্প্রসারিত করেছেন।রালফ ডারেনডর্ফ তার “Class and Class Conflict in Industrial Society” বইয়ে উল্লেখ করেছেন যে, সামাজিক কাঠামোতে সংঘর্ষ একটি অনিবার্য ঘটনা এবং এই সংঘর্ষই সমাজের পরিবর্তনের প্রধান চালিকা শক্তি। সামাজিক সংঘর্ষের মাধ্যমে বিদ্যমান স্থিতাবস্থা চ্যালেঞ্জ করা হয় এবং নতুন সমাজিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এই সংঘর্ষ মূলত সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি ও গোষ্ঠীর মধ্যে বিদ্যমান দ্বন্দ্বের প্রতিফলন, যা সমাজের ভেতরে গভীর পরিবর্তনের পথ তৈরি করে। লুইস কজার তার “The Functions of Social Conflict” বইয়ে দেখিয়েছেন যে, সামাজিক সংঘর্ষ কেবল বিভাজনের সৃষ্টি করে না, বরং এটি সামাজিক সংহতিরও একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হতে পারে। সংঘর্ষের মাধ্যমে সমাজের বিভিন্ন অংশ একে অপরের সঙ্গে সম্পর্কিত হয় এবং নতুন সংহতির ভিত্তিতে একটি পরিবর্তিত সমাজ গড়ে ওঠে। এই সংঘর্ষ সমাজকে কেবল বিভক্ত করে না, বরং তা একটি যৌথ লক্ষ্য বা সমস্যার দিকে সকলের মনোযোগ আকর্ষণ করে, যা সমাজের ভেতরে সংহতি ও একাত্মতার সৃষ্টি করে। এই তত্ত্বগুলোর আলোকে রাজনৈতিক আন্দোলনের ইতিবাচকতার দিকে আমরা সহজেই যেতে পারি। রাজনৈতিক আন্দোলন একটি সামাজিক সংঘর্ষের রূপ, যেখানে বিদ্যমান শাসনব্যবস্থা ও সামাজিক কাঠামোকে চ্যালেঞ্জ করা হয়। ডারেনডর্ফের মতে, এই ধরনের সংঘর্ষই সমাজের পরিবর্তনের প্রধান চালিকা শক্তি, যা পুরাতন কাঠামোকে ভেঙে নতুন সম্পর্ক ও শাসনব্যবস্থার জন্ম দেয়। অন্যদিকে, কজার বলছেন যে, এই সংঘর্ষের মাধ্যমে সমাজে নতুন সংহতি ও সংহতির একটি প্রক্রিয়া তৈরি হয়, যেখানে বিভিন্ন গোষ্ঠী একটি সাধারণ উদ্দেশ্যের দিকে একত্রিত হয়। রাজনৈতিক আন্দোলন তাই কেবল শাসন পরিবর্তনের হাতিয়ার নয়, বরং এটি একটি বৃহত্তর সামাজিক পুনর্গঠনের প্রক্রিয়া, যেখানে বিদ্যমান সমস্যাগুলোর সমাধান এবং নতুন সমাজিক কাঠামোর প্রতিষ্ঠার সুযোগ তৈরি হয়। এই প্রেক্ষাপটে, আন্দোলনের ইতিবাচকতা শুধু বর্তমান শাসনব্যবস্থা পরিবর্তনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না, বরং এটি সমাজের সামগ্রিক অগ্রগতির পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

হেগেলের দ্বান্দ্বিক পদ্ধতির প্রক্রিয়া চলমান থাকে এবং প্রতিটি নতুন সিন্থেসিসই ভবিষ্যতের জন্য নতুন থিসিস হিসেবে কাজ করে। তাই যদি একটি আন্দোলনের পরবর্তী সরকার ত্রুটিপূর্ণ হয়, তবে সেটিও ইতিহাসের অগ্রগতির অংশ। নতুন সংঘর্ষ এবং আন্দোলনের মাধ্যমে আবারও এই ত্রুটিপূর্ণ সরকারকে চ্যালেঞ্জ করা হবে এবং আরও উন্নত একটি শাসনব্যবস্থা গড়ে ওঠার সুযোগ তৈরি হবে। আর মার্কসের দৃষ্টিতে, সামাজিক পরিবর্তন ধারাবাহিক শ্রেণি সংগ্রামের ফলাফল। আন্দোলন শুধুমাত্র একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য নয়, বরং এটি দীর্ঘমেয়াদী পরিবর্তনের একটি অংশ। যদি একটি আন্দোলনের পরবর্তী সরকার বর্তমান শাসনব্যবস্থার চেয়েও খারাপ হয়, তবে সেটি নতুন সংগ্রামের সূচনা হতে পারে, যা ভবিষ্যতে আরও উন্নত ও সুষ্ঠু একটি সমাজব্যবস্থার প্রতিষ্ঠার দিকে নিয়ে যাবে। ইতিহাসের অগ্রগতি একধাপ একধাপ করে আসে, যেখানে প্রতিটি সংগ্রামই পরবর্তী উন্নতির ভিত্তি গড়ে তোলে। রালফ ডারেনডর্ফের মতে, যদিও একটি আন্দোলনের পরবর্তী সরকার প্রত্যাশিত না-ও হতে পারে, আন্দোলন নিজেই একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে কারণ এটি বিদ্যমান সামাজিক কাঠামোকে চ্যালেঞ্জ করে এবং পরিবর্তনের পথ তৈরি করে। এমনকি যদি নতুন সরকার ত্রুটিপূর্ণ হয়, তবে এটি সেই প্রক্রিয়ারই একটি অংশ, যা সমাজকে তার বর্তমান অবস্থার চেয়ে আরও উন্নত একটি পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারে। আন্দোলনের মাধ্যমেই সমাজকে তার শাসনব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে সচেতন করা হয় এবং তা নতুন সম্ভাবনার দিকে নিয়ে যায়। লুইস কজার থেকেও একই সিদ্ধান্তে আসা যায়, এমনকি যদি পরবর্তী সরকার ত্রুটিপূর্ণ হয়, তবুও আন্দোলনের মাধ্যমে সমাজে নতুন ধরনের সংহতি এবং সচেতনতা সৃষ্টি হয়, যা ভবিষ্যতে আরও শক্তিশালী ও কার্যকরী পরিবর্তনের পথ তৈরি করতে পারে।

Foucault, Michel | Internet Encyclopedia of Philosophy
মিশেল ফুকো

মিশেল ফুকোর ক্ষমতা সম্পর্কের তত্ত্ব থেকে আন্দোলনের গুরুত্ব বোঝার জন্য, প্রথমে ক্ষমতার সম্পর্কের পরিবর্তন কেন গুরুত্বপূর্ণ তা স্পষ্ট করা প্রয়োজন। ফুকো মনে করেন যে, ক্ষমতা শুধু শাসন করার একটি মাধ্যম নয়, বরং এটি মানুষের চিন্তাভাবনা, আচরণ, এবং সমাজের প্রতিটি দিককে প্রভাবিত করে। ক্ষমতা সম্পর্ক কেবলমাত্র রাজনৈতিক কাঠামোর মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; বরং এটি ভাষা, জ্ঞান, এবং ডিসকোর্সের (discourse) মাধ্যমে সমাজে কাজ করে। ফুকোর দৃষ্টিতে, এই ক্ষমতা সম্পর্ক সমাজে একটি নির্দিষ্ট আদর্শ এবং নিয়ম চাপিয়ে দেয়, যা ব্যক্তিদের জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং তাদের আচরণকে সীমাবদ্ধ করে। ফুকো “The History of Sexuality, Vol. 1” বইয়ে উল্লেখ করেছেন যে, ক্ষমতা সম্পর্ক কেবল দমনমূলক নয়, এটি উৎপাদনশীলও বটে। অর্থাৎ, ক্ষমতা সম্পর্ক কেবল নিষিদ্ধ করে না, বরং এটি নতুন নিয়ম, ধ্যান-ধারণা, এবং সামাজিক আদর্শও তৈরি করে। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে একটি সমাজের ডিসকোর্স তৈরি হয়, যা সমাজের সদস্যদের চিন্তাভাবনা ও আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। ফুকো দেখান যে, এই ডিসকোর্সের মাধ্যমে মানুষকে নির্দিষ্ট সামাজিক কাঠামো এবং নিয়মের মধ্যে সীমাবদ্ধ করা হয়, যা ক্ষমতার চক্রকে আরও শক্তিশালী করে। যদি এই ক্ষমতা সম্পর্কের পরিবর্তন না ঘটে, তাহলে একটি নির্দিষ্ট ডিসকোর্স সমাজে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করে এবং মানুষের স্বাধীনতা, সৃজনশীলতা, এবং বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করে। ফলে, সমাজের ক্ষমতা কাঠামোতে একটি স্থিতাবস্থা তৈরি হয়, যা ব্যক্তিদের চিন্তা ও কাজ করার স্বাধীনতাকে সীমিত করে। এই স্থিতাবস্থা ভাঙার জন্য আন্দোলনের প্রয়োজন হয়, যা সমাজের ভেতরে নতুন ক্ষমতার বিন্যাস তৈরি করতে পারে এবং পুরানো ডিসকোর্সকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে। তাই আন্দোলন করতেই হয়।

Jacques Derrida
জ্যাক দেরিদা

একই ব্যাপার পাই অন্যান্য পোস্টমডার্নিস্টের লেখায়। জ্যাক দেরিদা তার ডিকন্সট্রাকশন তত্ত্বের মাধ্যমে দেখান যে, সামাজিক কাঠামো এবং ক্ষমতার সম্পর্কগুলোকে ডিকন্সট্রাক্ট করা প্রয়োজন। দেরিদা মনে করেন, আন্দোলন বা প্রতিবাদ সমাজের প্রচলিত ভাষা, নিয়ম, এবং ক্ষমতার বিন্যাসকে চ্যালেঞ্জ করে এবং নতুন ভাবনার সুযোগ তৈরি করে। তিনি ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণে বিশ্বাসী, যেখানে একক কেন্দ্রীভূত ক্ষমতা না থাকলেও বিভিন্ন স্তরে ক্ষমতার বিভিন্ন রূপ কার্যকর হতে পারে। লিয়োতারের মতে, ক্ষমতার কোনও একক আখ্যান বা কেন্দ্র থাকতে পারে না। লিয়োতার দেখিয়েছেন যে, সমাজে একাধিক ছোট ছোট আখ্যান বা মাইক্রোন্যারেটিভসের মাধ্যমে ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকৃত হয়। আন্দোলন সেই ছোট ছোট আখ্যানগুলির একটি উদাহরণ, যেখানে বিভিন্ন গোষ্ঠী তাদের নিজস্ব পরিচয় ও ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করতে চেষ্টা করে। পরবর্তী শাসক কে হবে, তার চেয়ে এই ছোট ছোট আখ্যানগুলির সংঘর্ষই বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে লিয়োতার মনে করেন। দ্যলোজ এবং গাতারি তাদের “Anti-Oedipus” এবং “A Thousand Plateaus” বইগুলোতে দেখিয়েছেন যে, ক্ষমতা একটি রাইজোম্যাটিক (rhizomatic) কাঠামোর মতো, যা বিভিন্ন দিকে বিস্তার লাভ করে। আন্দোলন এই রাইজোম্যাটিক কাঠামোর অংশ, যেখানে বিভিন্ন স্থানে, বিভিন্ন প্রেক্ষিতে ক্ষমতার নতুন রূপ ও সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তাদের মতে, ক্ষমতার কোনও নির্দিষ্ট কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ নেই, বরং এটি বিভিন্ন স্থানে বিকশিত হয়। এই ধারণা থেকে বোঝা যায়, আন্দোলনই মূলত নতুন ক্ষমতার সম্পর্ক তৈরি করার মাধ্যম, এবং পরবর্তী শাসক কে হবে, তা অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ। অতএব, ফুকো এবং অন্যান্য পোস্টমডার্নিস্ট তাত্ত্বিকদের দৃষ্টিতে আন্দোলনের গুরুত্ব অপরিসীম, কারণ এটি ক্ষমতা সম্পর্কের পুনর্গঠন এবং নতুন ডিসকোর্সের সৃষ্টি করে, যা মানুষের স্বাধীনতা এবং সমাজের উন্নতির জন্য অপরিহার্য। ক্ষমতার স্থিতাবস্থা ভাঙার জন্য আন্দোলন প্রয়োজন, যা সমাজকে নতুন পথে অগ্রসর হতে সহায়তা করে।

Jean-Paul Sartre “Every existing thing is born without reason ...
জ্যঁ পল সার্ত্র

এখানে চলে আসে এক্সিস্টেনশিয়ালিজমও যা মূলত ব্যক্তির স্বাধীনতা, অর্থহীনতা, এবং দায়িত্বের ওপর জোর দেয়। জ্যঁ-পল সার্ত্রের মতে, মানুষ নিজের অস্তিত্বের অর্থ তৈরি করার জন্য সম্পূর্ণ স্বাধীন, এবং এই স্বাধীনতা একটি বড় দায়িত্বের সাথেও আসে। এক্সিস্টেনশিয়ালিস্ট চিন্তাধারায়, ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে তার অস্তিত্ব এবং মূল্যের জন্য আন্দোলন করতে হয়, যা বিদ্যমান কাঠামো বা শাসনব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করে। সার্ত্রের তত্ত্ব অনুযায়ী, আন্দোলন একটি নৈতিক বাধ্যবাধকতা হয়ে দাঁড়ায় যখন এটি ব্যক্তি বা সমাজকে তাদের নিজস্ব অস্তিত্ব এবং স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা করতে সহায়তা করে। আন্দোলনের মাধ্যমে ব্যক্তি বা গোষ্ঠী তাদের নিজস্ব অর্থ ও পরিচয় গড়ে তোলে, যা এক ধরনের মুক্তি এনে দেয়। এই দৃষ্টিকোণ থেকে, আন্দোলনের পর কে ক্ষমতায় আসবে তা গৌণ হয়ে যায়, কারণ মূল লক্ষ্য হলো স্বাধীনতার প্রতিষ্ঠা এবং অর্থপূর্ণ জীবনের সন্ধান। এই অর্থে, এক্সিস্টেনশিয়ালিজম আন্দোলনের গুরুত্বকে এমনভাবে তুলে ধরে, যেখানে ক্ষমতায় কারা থাকবে তা কম গুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়ে। মূল কথা হলো, আন্দোলন মানুষের মুক্তির পথ তৈরি করে এবং তাদের নিজস্ব অর্থ ও স্বাধীনতার প্রতিষ্ঠা ঘটায়। সার্ত্রের দৃষ্টিতে, এই আন্দোলনই মানুষের অস্তিত্বের একটি স্বীকৃতি এবং এটি কোনও নির্দিষ্ট শাসক বা সরকারের অধীনে থাকা থেকে মুক্তি পাওয়ার একটি মাধ্যম হিসেবে কাজ করে। সুতরাং, এক্সিস্টেনশিয়ালিজম আন্দোলনের গুরুত্বকে স্বীকৃতি দেয়, যা বিদ্যমান ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করে এবং মানুষের স্বাধীনতার জন্য পথপ্রদর্শক হয়, যা পরবর্তী শাসকের চেয়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ।

erevoktonos: Fr. Nietzsche: Πόσο ηθική είναι η ηθική;
নীটশে

আরেক এক্সিস্টেনশিয়ালিস্ট নীটশের দর্শনও এক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক হবে। নীটশের দর্শন বিশেষভাবে বিদ্যমান মূল্যবোধ, সামাজিক নিয়ম এবং প্রতিষ্ঠিত কাঠামোকে চ্যালেঞ্জ করার উপর জোর দেয়, যা আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তার সাথে গভীরভাবে সম্পর্কিত। নীটশে মনে করেন যে, প্রচলিত মূল্যবোধ এবং সামাজিক নিয়মগুলো প্রায়ই মানুষের সৃজনশীলতা এবং স্বাধীনতাকে সীমাবদ্ধ করে। তার বিখ্যাত ধারণা “Übermensch” (অতিমানব) হলো এমন একজন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী, যারা বিদ্যমান মূল্যবোধকে চ্যালেঞ্জ করে এবং নতুন মূল্যবোধ সৃষ্টি করে। নীটশে মনে করেন, সামাজিক পরিবর্তনের জন্য পুরানো মূল্যবোধকে ধ্বংস করে নতুন মূল্যবোধের প্রতিষ্ঠা অপরিহার্য। এই প্রক্রিয়া একটি আন্দোলনের মাধ্যমে ঘটতে পারে, যা বিদ্যমান শাসন এবং প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ হিসেবে কাজ করে। নীটশে বলেন, “মানুষ হলো এমন কিছু যা অতিক্রম করতে হবে,” এবং এই অতিক্রম করার প্রক্রিয়াটাই আন্দোলনের মাধ্যমে ঘটে। নীটশে তার লেখায় নীহিলিজমের বিপদের কথা উল্লেখ করেন, যা তখন দেখা দেয় যখন মানুষ উপলব্ধি করে যে প্রচলিত মূল্যবোধ অর্থহীন হয়ে পড়েছে। নীহিলিজমের বিপরীতে, নীটশে বিশ্বাস করেন যে, নতুন অর্থ এবং নতুন মূল্যবোধ সৃষ্টি করার জন্য সংগ্রাম করতে হবে। এই সংগ্রাম বা আন্দোলন কেবলমাত্র একটি নির্দিষ্ট শাসককে উৎখাত করার জন্য নয়, বরং নতুন সামাজিক কাঠামো এবং মূল্যবোধের প্রতিষ্ঠা করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা এখানে প্রধান হয়ে ওঠে, কারণ এটি নীহিলিজমকে অতিক্রম করার একটি উপায় হিসেবে কাজ করে। নীটশের অন্যতম প্রধান ধারণা হলো “Will to Power” বা শক্তির ইচ্ছা, যা মানুষের মধ্যে সৃজনশীলতা, স্বাধীনতা, এবং নিজেকে অতিক্রম করার আকাঙ্ক্ষাকে চালিত করে। নীটশে মনে করেন যে, শক্তির এই ইচ্ছাই মানুষকে বিদ্যমান কাঠামো এবং শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে এবং নতুন কিছু তৈরি করতে প্ররোচিত করে। এই দৃষ্টিকোণ থেকে, আন্দোলন হলো শক্তির ইচ্ছার প্রকাশ, যা কেবল ক্ষমতার পরিবর্তন নয়, বরং নতুন শাসন ও মূল্যবোধের প্রতিষ্ঠা করে। জ্যঁ-পল সার্ত্র যেমন ব্যক্তির স্বাধীনতার ওপর জোর দেন এবং মনে করেন যে আন্দোলন নৈতিক দায়িত্ব, তেমনি নীটশেও মনে করেন যে, আন্দোলন পুরানো মূল্যবোধকে ধ্বংস করে নতুন মূল্যবোধের সৃষ্টি করতে সহায়ক। নীটশের দৃষ্টিতে, আন্দোলন শুধু রাজনৈতিক ক্ষমতার পরিবর্তনের জন্য নয়, বরং মানুষের জীবনে নতুন অর্থ এবং মূল্যবোধের প্রতিষ্ঠা করার জন্য অপরিহার্য। সার্ত্রের মতো নীটশেও মনে করেন যে, আন্দোলনের ফলে কে ক্ষমতায় আসবে তা গৌণ হয়ে যায়, কারণ মূল লক্ষ্য হলো মানুষের মুক্তি এবং নতুন ধ্যানধারণার প্রতিষ্ঠা।

আন্দোলন মানুষের রাজনৈতিক চেতনার সৃষ্টি করে যা ভবিষ্যৎ স্বৈরাচার-নিপীড়নকে প্রতিহত করে

আন্দোলনের ফলে মানুষের সামগ্রিক চেতনার বিকাশ ঘটে যা পরবর্তিতে আসা সরকারের নিপীড়ন ও স্বৈরাচারকে আরও বেশি করে বাধা দেয়। এটা হয় মানুষের সামগ্রিক চেতনার বিকাশের জন্যই। এই বিষয়ে কয়েকজন তাত্ত্বিক ও তাদের তত্ত্বেরর কথা আনা যাক।

Émile Durkheim biografia, sociologia e pedagogia Studenti.it
এমিল ডুরখাইম

এমিল ডুরখেইমের মতে, সমাজের স্থিতিশীলতা এবং সংহতি বজায় রাখতে “কালেক্টিভ কনশাসনেস” বা সমষ্টিগত চেতনা একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ডুরখেইমের সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে, সমাজের সদস্যদের মধ্যে একধরনের অভিন্ন মূল্যবোধ এবং সামাজিক নীতি গড়ে ওঠে, যা তাদের সংহতি বজায় রাখে এবং সামাজিক কাঠামোকে স্থিতিশীল করে। ডুরখেইমের মতে, একটি সফল আন্দোলন সমাজের মানুষের মধ্যে এই কালেক্টিভ কনশাসনেসকে আরও শক্তিশালী করে। আন্দোলন মানুষকে তাদের অভিন্ন লক্ষ্য এবং মূল্যবোধের দিকে ধাবিত করে, যা সমাজে নতুন ধরনের সংহতি সৃষ্টি করে। যখন একটি সমাজ বড় ধরনের পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যায়, যেমন রাজনৈতিক আন্দোলনের সময়, তখন নতুন সামাজিক সংহতির জন্ম হয়। এই সংহতি শুধু আন্দোলনের সময় নয়, বরং পরবর্তী সময়েও সমাজকে দৃঢ়ভাবে একত্রিত করে রাখে। এই ধরনের সংহতি একটি শক্তিশালী কালেক্টিভ কনশাসনেসের ভিত্তিতে গড়ে ওঠে, যা নতুন সরকারকে বাধ্য করে সমাজের চাহিদার প্রতি সংবেদনশীল হতে। কারণ, যখন মানুষ আন্দোলনের মাধ্যমে একক শক্তি হিসেবে কাজ করতে শিখে, তখন তারা সরকারের উপর তাদের চাহিদা চাপিয়ে দিতে সক্ষম হয়। ডুরখেইম বিশ্বাস করেন যে, এই সংহতি এবং কালেক্টিভ কনশাসনেস সমাজের স্থিতিশীলতার জন্য অপরিহার্য। এটি শুধু সামাজিক শৃঙ্খলা বজায় রাখে না, বরং সমাজকে অগ্রগতির পথে নিয়ে যায়। ডুরখেইমের তত্ত্ব অনুযায়ী, যখন একটি আন্দোলন সফল হয় এবং একটি নতুন সরকার গঠিত হয়, তখন এই কালেক্টিভ কনশাসনেস নতুন সরকারের কার্যক্রমকে নিয়ন্ত্রণ করে। নতুন সরকার যদি আগের মত স্বৈরাচারী আচরণ করতে চায়, তবে এই সংহতির কারণে সমাজ পুনরায় আন্দোলনে জড়িয়ে পড়তে পারে, যা ক্ষমতার ভারসাম্যকে পুনরায় গড়ে তোলে। তাই, ডুরখেইমের দৃষ্টিতে, এই ধরনের আন্দোলন এবং এর ফলে গড়ে ওঠা কালেক্টিভ কনশাসনেস সমাজের জন্য একটি অগ্রগতি, যা দীর্ঘমেয়াদী স্থিতিশীলতা এবং সামাজিক উন্নতির জন্য অপরিহার্য।

Les effets de la socialisation sur « l’habitus », vus par Pierre ...
পিয়েরে বুর্দিয়ে

ডুরখেইমের কালেক্টিভ কনশাসের ধারণার সাথে পিয়েরে বুর্দিয়ের হ্যাবিটাস ধারণাটির কিছু মিল পাওয়া যায়। পিয়েরে বুর্দিয়ে তার “Distinction: A Social Critique of the Judgement of Taste” এবং “Outline of a Theory of Practice” বইগুলিতে সমাজের ভেতরে বিদ্যমান সামাজিক কাঠামো এবং হ্যাবিটাসের (habitus) ধারণা বিশদভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। বুর্দিয়ে “হ্যাবিটাস” এবং “ফিল্ড” তত্ত্বের মাধ্যমে সমাজের মধ্যে ক্ষমতার সম্পর্ক কীভাবে গড়ে ওঠে এবং কীভাবে তা প্রভাবিত হয়, তা বিশ্লেষণ করেছেন। তার মতে, হ্যাবিটাস হলো একটি সামাজিক কাঠামোর মাধ্যমে গঠিত অভ্যাস, ধ্যানধারণা, এবং আচরণের একটি সংকলন, যা ব্যক্তির চিন্তাভাবনা ও ক্রিয়াকলাপকে প্রভাবিত করে। বুর্দিয়ের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে, একটি সফল আন্দোলন সমাজের মানুষের মধ্যে একটি নতুন ধরনের হ্যাবিটাস তৈরি করতে পারে। আন্দোলনের মাধ্যমে জনগণের মধ্যে যে চেতনা ও অভ্যাসের পরিবর্তন ঘটে, তা দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ফেলে এবং ভবিষ্যতের সামাজিক ও রাজনৈতিক কাঠামোতে গভীর প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়। উদাহরণস্বরূপ, যখন একটি আন্দোলন সফল হয়, তখন এটি কেবল রাজনৈতিক শাসন পরিবর্তনের মাধ্যমেই সীমাবদ্ধ থাকে না, বরং এটি সমাজের মানুষের মনোভাব, মূল্যবোধ, এবং সাংস্কৃতিক প্রথাগুলোকে পুনর্গঠন করে। এই পরিবর্তিত হ্যাবিটাস পরবর্তী সময়ে নতুন শাসনব্যবস্থার কার্যক্রমের ওপর প্রভাব ফেলে এবং তাদের কার্যক্রমে আরও সংবেদনশীল হতে বাধ্য করে। বুর্দিয়ের “ফিল্ড” ধারণাটি সামাজিক জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে কার্যকরী প্রতিযোগিতার স্থান বা ক্ষেত্র বোঝায়। এই ফিল্ডে বিভিন্ন ধরণের “ক্যাপিটাল” (মূলধন) বা সম্পদ রয়েছে, যেমন অর্থনৈতিক ক্যাপিটাল, সাংস্কৃতিক ক্যাপিটাল, সামাজিক ক্যাপিটাল, এবং প্রতীকী ক্যাপিটাল। প্রতিটি ক্যাপিটাল ফিল্ডের মধ্যে ক্ষমতা সম্পর্ককে প্রভাবিত করে এবং সেই ফিল্ডে ব্যক্তির অবস্থান নির্ধারণ করে। একটি আন্দোলন যদি সফল হয়, তবে তা সাংস্কৃতিক ক্যাপিটাল ও প্রতীকী ক্যাপিটালের নতুন সংস্থান তৈরি করতে পারে। নতুন হ্যাবিটাসের মাধ্যমে এই ক্যাপিটালগুলো পুনর্বিন্যাসিত হয় এবং সমাজের ভেতরে ক্ষমতার ভারসাম্য পরিবর্তিত হয়। উদাহরণস্বরূপ, একটি সফল সামাজিক আন্দোলন কেবলমাত্র রাজনৈতিক শাসককে চ্যালেঞ্জ করে না, বরং তা সাংস্কৃতিক ও প্রতীকী ক্যাপিটালের নতুন সংস্থান তৈরি করে, যা সামাজিক হায়ারার্কিকে পরিবর্তন করতে সহায়ক হয়। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে, নতুন হ্যাবিটাস ও ক্যাপিটালের বিন্যাস নতুন সামাজিক সম্পর্ক এবং রাজনৈতিক কাঠামোকে প্রভাবিত করে। বুর্দিয়ের মতে, একটি আন্দোলনের মাধ্যমে গঠিত নতুন হ্যাবিটাস এবং ক্যাপিটাল ভবিষ্যতের জন্য একটি ভিত্তি তৈরি করে, যা নতুন সরকার বা শাসনব্যবস্থার ওপর দ্রুত প্রভাব ফেলতে পারে। আন্দোলনের সময় গঠিত এই নতুন হ্যাবিটাস ভবিষ্যতে আন্দোলনের ধারাবাহিকতা রক্ষা করে এবং প্রয়োজনে পুনরায় একটি শক্তিশালী সামাজিক প্রতিক্রিয়া তৈরি করতে সহায়ক হয়। এই ধারণা থেকে বোঝা যায় যে, একটি সফল আন্দোলনের মাধ্যমে গঠিত নতুন সামাজিক অভ্যাস ও ক্ষমতার সম্পর্ক ভবিষ্যতে সমাজের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কাঠামোকে রক্ষা এবং উন্নত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

Charles Tilly – Store norske leksikon
চার্লস টিলি

চার্লস টিলি তার “প্রোটেস্ট সাইকেল” (Protest Cycles) ধারণার মাধ্যমে সামাজিক আন্দোলন এবং এর ধারাবাহিকতা সম্পর্কে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিশ্লেষণ প্রদান করেছেন। টিলি এবং অন্যান্য সামাজিক আন্দোলন তাত্ত্বিকরা প্রোটেস্ট সাইকেলের ধারণাটি ব্যবহার করে বোঝাতে চেয়েছেন যে, একবার একটি সফল আন্দোলন গড়ে উঠলে, তা সমাজের ভেতরে একটি ধারাবাহিক পরিবর্তনের প্রক্রিয়ার সূচনা করে। প্রোটেস্ট সাইকেল হলো আন্দোলনের একটি পুনরাবৃত্তিমূলক চক্র, যেখানে আন্দোলনের সাফল্য বা ব্যর্থতা ভবিষ্যতে নতুন আন্দোলনের সম্ভাবনা এবং শক্তিকে প্রভাবিত করে। টিলি এই ধারণা থেকে বোঝাতে চেয়েছেন যে, যখন একটি সমাজে বড় ধরনের সামাজিক বা রাজনৈতিক আন্দোলন ঘটে, তখন তা একটি সাইকেল বা চক্রের মাধ্যমে কাজ করে। একটি আন্দোলন সফল হলে, তা ভবিষ্যতে নতুন আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য একটি ভিত্তি তৈরি করে। এই সাফল্য জনগণের মধ্যে নতুন ধরনের রাজনৈতিক সচেতনতা এবং সংগঠনের জন্ম দেয়, যা পরবর্তী সময়ে নতুন আন্দোলনের সম্ভাবনা ও কার্যকারিতাকে বাড়ায়। টিলি বলেন যে, যদি একটি আন্দোলন সফল হয়, তাহলে তা সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার অংশ হয়ে যায়। এই সাফল্য একটি “পাঠ” হিসাবে কাজ করে, যা জনগণ এবং ভবিষ্যতের রাজনৈতিক নেতাদের কাছে একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। জনগণ শিখতে পারে যে, আন্দোলন করে সফল হওয়া সম্ভব, যা তাদের মধ্যে নতুন ধরনের আত্মবিশ্বাস এবং সংগঠনের ইচ্ছা গড়ে তোলে। ফলে, একবার একটি শক্তিশালী সামাজিক প্রতিক্রিয়া বা আন্দোলন গড়ে উঠলে, তা ভবিষ্যতে আরও দ্রুত এবং শক্তিশালী হয়ে ওঠে, কারণ জনগণের মধ্যে ইতিমধ্যেই একটি সক্রিয় এবং সুসংগঠিত চেতনা গড়ে উঠেছে। অন্যদিকে, যদি একটি আন্দোলন ব্যর্থ হয়, তবে তা প্রায়ই সাময়িকভাবে আন্দোলনের শক্তি হ্রাস করতে পারে। তবে টিলি দেখিয়েছেন যে, ব্যর্থতা সবসময় নেতিবাচক ফল দেয় না; এটি একটি পুনর্গঠন প্রক্রিয়া হিসেবেও কাজ করতে পারে। জনগণ ব্যর্থ আন্দোলন থেকে শিক্ষা নিতে পারে এবং পরবর্তীতে আরও শক্তিশালী এবং সুসংগঠিত আন্দোলন গড়ে তুলতে পারে। এই চক্রটি আন্দোলনের প্রক্রিয়াকে অব্যাহত রাখতে সহায়ক হয় এবং সমাজের মধ্যে গণতান্ত্রিক চেতনা এবং সচেতনতা বৃদ্ধি করে। প্রোটেস্ট সাইকেলের ধারাবাহিকতা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, কারণ এটি দেখায় যে, আন্দোলনের প্রভাব একবার শুরু হলে তা সহজেই থেমে যায় না। আন্দোলনের সফলতা জনগণের মধ্যে একটি স্থায়ী রাজনৈতিক সচেতনতা এবং ক্ষমতার সম্পর্কে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করে। ফলে, পরবর্তী সময়ে নতুন আন্দোলন গড়ে ওঠার সম্ভাবনা বাড়ে এবং এই আন্দোলনগুলি আরও ত্বরান্বিত হয়ে ওঠে। এই ধারাবাহিকতা সামগ্রিকভাবে সমাজের ভেতরে রাজনৈতিক পরিবর্তন এবং ক্ষমতার ভারসাম্যকে প্রভাবিত করে।

Jürgen Habermas: biografía de este filósofo alemán
ইউর্গেন হ্যাবারমাস

ইয়ুর্গেন হাবারমাসের “পাবলিক স্ফিয়ার” তত্ত্ব আধুনিক গণতন্ত্র এবং সামাজিক আলোচনার প্রক্রিয়াকে বোঝার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা। হাবারমাসের মতে, “পাবলিক স্ফিয়ার” একটি এমন জায়গা যেখানে সমাজের নাগরিকরা স্বাধীনভাবে এবং সমানভাবে নিজেদের মতামত প্রকাশ করতে পারে এবং গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে পারে। এটি মূলত একটি সামাজিক ক্ষেত্র, যেখানে ব্যক্তিগত মতামত এবং যুক্তি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় পরিণত হয়। হাবারমাস তার “The Structural Transformation of the Public Sphere” বইয়ে পাবলিক স্ফিয়ারের ধারণা বিশদভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি দেখিয়েছেন, ১৭শ ও ১৮শ শতাব্দীতে ইউরোপে কফিহাউজ, সালুন, এবং অন্যান্য সামাজিক মিলনস্থলগুলোতে একটি নতুন ধরনের পাবলিক স্ফিয়ার গড়ে ওঠে, যেখানে মানুষ ব্যক্তিগত মতামত প্রকাশ এবং বিতর্কের মাধ্যমে রাজনৈতিক এবং সামাজিক ইস্যুতে নিজেদের মতামত প্রকাশ করতে শুরু করে। এই ধরনের পাবলিক স্ফিয়ার গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে শক্তিশালী করে এবং জনগণের চাহিদা এবং মতামত সরকার এবং প্রতিষ্ঠানের কাছে পৌঁছে দেয়। হাবারমাসের মতে, যখন একটি আন্দোলন গড়ে ওঠে, তখন এটি নতুন একটি পাবলিক স্ফিয়ার তৈরি করতে পারে, যেখানে জনগণ তাদের মতামত এবং দাবি জানাতে সক্ষম হয়। আন্দোলনের মাধ্যমে গঠিত এই পাবলিক স্ফিয়ার সরকার এবং প্রতিষ্ঠানের ওপর একটি স্থায়ী প্রভাব ফেলতে পারে। এই স্ফিয়ারে বিভিন্ন সামাজিক গোষ্ঠী এবং নাগরিকরা একত্রিত হয়ে বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে আলোচনা করে, এবং এই আলোচনার ফলাফল সরকারকে বাধ্য করে তাদের চাহিদার প্রতি সংবেদনশীল হতে। হাবারমাস বিশ্বাস করেন যে, যদি আন্দোলনের মাধ্যমে একটি শক্তিশালী পাবলিক স্ফিয়ার গড়ে ওঠে, তবে তা দীর্ঘমেয়াদে নতুন সরকারগুলির কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণে রাখতে সহায়ক হতে পারে। সরকার এবং রাজনৈতিক নেতৃত্ব পাবলিক স্ফিয়ারে জনসাধারণের আলোচনার ভিত্তিতে তাদের নীতিমালা এবং কার্যক্রম গড়ে তোলে, কারণ পাবলিক স্ফিয়ারে গঠিত মতামতগুলি একটি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বৈধতা পায়। এটি সরকারকে তাদের কার্যক্রমে আরও বেশি স্বচ্ছ এবং সংবেদনশীল হতে বাধ্য করে। হাবারমাসের মতে, একটি শক্তিশালী পাবলিক স্ফিয়ার কেবলমাত্র সাময়িক প্রভাব নয়, বরং এটি দীর্ঘমেয়াদী সামাজিক পরিবর্তনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। একবার একটি পাবলিক স্ফিয়ার গঠিত হলে, তা সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার অংশ হয়ে যায় এবং ভবিষ্যতের জন্য একটি শক্তিশালী ভিত্তি তৈরি করে। এটি জনগণকে তাদের মতামত প্রকাশ করতে এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করতে উদ্বুদ্ধ করে। এইভাবে, পাবলিক স্ফিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হয়ে ওঠে, যার মাধ্যমে সামাজিক এবং রাজনৈতিক পরিবর্তন সম্ভব হয়।

নিরন্তর আন্দোলনের রাজনৈতিক দর্শন

এবারে এমন কিছু রাজনৈতিক দর্শনের দিকে যাওয়া যাক যেখানে একবার আন্দোলন করার পরই সব শেষ বলে মনে করা হয়না, বরং আন্দোলনের পর গঠিত সরকার পুনরায় নিপীড়ন করবে তারা ধরেই নেয় ও পরবর্তীতে পুনরায় আন্দোলনের জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকে। এক্ষেত্রে দুরকম দৃষ্টিভঙ্গি থাকে – একটি হচ্ছে এন্ড অফ হিস্ট্রি টাইপের ধারণা যেখানে বারবার আন্দোলন চলতে চলতে এমন একটা সময় আসবে বলে মনে করা হয় যখন পূর্ণাঙ্গ সাম্য বা মঙ্গলময় সমাজের আগমন ঘটবে যার পর আর আন্দোলন লাগবে না, ও ততদিন পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে; আরেকটি হচ্ছে আন্দোলন কোনদিন শেষ হবে না, এটা চলতেই থাকবে।

প্রথমেই আসছি অ্যানার্কিজমে। অ্যানার্কিজম এবং বিকেন্দ্রীকরণ সম্পর্কে বিশদভাবে আলোচনা করলে বোঝা যায় যে, এই তত্ত্বগুলি কীভাবে ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণের বিরুদ্ধে এবং জনগণের অধিকারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অ্যানার্কিস্ট তাত্ত্বিকরা মনে করেন যে, তাদের মতে ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ সাধারণত একটি ছোট গোষ্ঠীর হাতে কেন্দ্রীভূত হয়, যা স্বৈরাচারী শাসনের জন্ম দেয়। এবং এটি সমাজে বৈষম্য, নিপীড়ন এবং অবিচারের মূল কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এই ক্ষমতা সাধারণত গণতন্ত্রের আদর্শের বিপরীতে কাজ করে এবং সাধারণ মানুষের চাহিদা এবং ইচ্ছাকে উপেক্ষা করে। কেন্দ্রীভূত ক্ষমতা জনগণের প্রতি সংবেদনশীল না হয়ে শাসকদের স্বার্থ রক্ষা করে। ফলে, ক্ষমতার এই কেন্দ্রীকরণ সাধারণত বৈষম্য, নিপীড়ন এবং সামাজিক অবিচারের সৃষ্টি করে। এই তত্ত্বের অনুসারীরা বিশ্বাস করেন যে, ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ একটি কার্যকর পদ্ধতি, যা জনগণকে তাদের নিজেদের জীবনের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে সহায়ক করে এবং শাসকদের উপর তাদের ইচ্ছা চাপিয়ে দিতে সক্ষম করে।

The Bohemian Budgie: Peter Kropotkin: The Conquest of Bread (1892)
পিওতর ক্রোপটকিন

অ্যানার্কিজম তত্ত্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের জন্য আন্দোলন অপরিহার্য। আন্দোলনের মাধ্যমেই জনগণ তাদের অধিকার এবং ক্ষমতার পুনঃবন্টন দাবি করতে পারে। আর অ্যানার্কিস্টদের মতে আন্দোলন কেবল একটি স্বল্পমেয়াদী লক্ষ্য নয়, বরং এটি একটি অবিচ্ছিন্ন প্রক্রিয়া যা সমাজের প্রতিটি স্তরে ক্ষমতার ভারসাম্য বজায় রাখতে সহায়ক হয়। অ্যানার্কিস্ট তাত্ত্বিকদের মধ্যে আন্দোলনের পরবর্তী অবস্থা নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। তবে সাধারণভাবে তারা দুটি ধারণার মধ্যে অবস্থান নেয়। অনেক অ্যানার্কিস্ট তাত্ত্বিক, বিশেষ করে পিওতর ক্রোপটকিনের মতো ব্যক্তিত্বরা, বিশ্বাস করেন যে, প্রতিবারের আন্দোলনের মাধ্যমে আস্তে আস্তে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ ঘটে এবং সমাজ ধীরে ধীরে পূর্ণাঙ্গ বিকেন্দ্রীভবনের দিকে এগিয়ে যায়। তাদের মতে, প্রতিটি সফল আন্দোলন সমাজের কেন্দ্রীভূত ক্ষমতাকে দুর্বল করে এবং ক্ষমতা আরও বেশি বিকেন্দ্রীকৃত হয়, যার ফলে সমাজে স্বাধীনতা ও সাম্যের পরিমাণ বাড়তে থাকে। অন্যদিকে, কিছু অ্যানার্কিস্ট তাত্ত্বিক যেমন মিখাইল বাকুনিন, বাস্তববাদী দৃষ্টিকোণ থেকে বলেন যে, যদিও আন্দোলনের মাধ্যমে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ সম্ভব, তবে এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া। তাদের মতে, ক্ষমতা স্বভাবতই কেন্দ্রীভূত হওয়ার প্রবণতা রাখে, এবং এটি পুনরায় কেন্দ্রীভূত হতে পারে। এই কারণে, তারা মনে করেন যে, আন্দোলন কখনোই শেষ নয় এবং এটি একটি অবিরাম প্রচেষ্টা। এই দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী, অ্যানার্কিস্টরা আন্দোলনের পর কেন্দ্রীভূত ক্ষমতার পুনরাবৃত্তি সম্পর্কে সতর্ক থাকেন এবং এই পুনরাবৃত্তিকে চ্যালেঞ্জ করতে পুনরায় আন্দোলনের প্রস্তুতি রাখেন।

Leon Trotsky | Лев Троцкий | Soviet history, Léon trotsky, Russian history
লিওন ট্রটস্কি

এবার আসি মার্ক্সবাদে। মার্ক্সবাদে, বিশেষ করে কার্ল মার্ক্স এবং ফ্রিডরিখ এঙ্গেলসের তত্ত্বে, শ্রেণি সংগ্রামকে ইতিহাসের প্রধান চালিকা শক্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তারা বিশ্বাস করতেন যে, সকল সমাজ বিভিন্ন শ্রেণীসংগ্রামের লড়াই এর ফসল, পুঁজিবাদী সমাজে এসে তা বুর্জোয়া (ধনী মালিক শ্রেণি) এবং প্রলেতারিয়েত (শ্রমিক শ্রেণি) এর সংঘর্ষে পরিণত হয়। মার্ক্সবাদ অনুসারে, সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের মাধ্যমে বুর্জোয়া শ্রেণিকে উৎখাত করা সম্ভব, তবে প্রলেতারিয়েতের সংগ্রাম তখনো শেষ হয় না যতক্ষণ না একটি শ্রেণিহীন সমাজ বা কমিউনিস্ট সমাজ প্রতিষ্ঠিত হয়। মার্ক্সবাদীরা নতুন শাসক শ্রেণির ওপর অন্ধ আস্থা রাখতে সতর্ক থাকেন, কারণ তাদের মতে, শাসক শ্রেণির স্বার্থ প্রায়ই শোষণমূলক হয়। সুতরাং, শ্রেণি সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়া এবং সমাজের বিভিন্ন স্তরে ক্ষমতার সম্পর্ক নিয়ে সচেতন থাকা প্রয়োজন। এদিকে লিওন ট্রটস্কি “স্থায়ী বিপ্লব” (Permanent Revolution) ধারণা তুলে ধরেন, যা পরে ত্রোৎস্কিবাদ হিসেবে পরিচিত হয়। এই তত্ত্বে বলা হয় যে, বিপ্লবী সংগ্রাম একটি আন্তর্জাতিক এবং ধারাবাহিক প্রক্রিয়া, যা একবার শুরু হলে থামানো যায় না। নতুন শাসক শ্রেণির প্রতি অন্ধ আস্থা রাখতে তিনি সতর্ক করেন এবং বিশ্বাস করেন যে, বিপ্লবী সংগ্রামকে আন্তর্জাতিক ও দীর্ঘস্থায়ী করতে হবে। লেনিনের দৃষ্টিভঙ্গি যদিও কিছুটা ভিন্ন, তবে তিনি ও তার অনুসারীরা নতুন শাসকদের সন্দেহের চোখে দেখার পরামর্শ দেন এবং বিপ্লবী সজাগতা বজায় রাখার ওপর জোর দেন। মাও সেতুং চিনে “সাংস্কৃতিক বিপ্লব” (Cultural Revolution) এর মাধ্যমে বোঝাতে চেয়েছিলেন যে, বিপ্লব কেবল রাজনৈতিক পরিবর্তনেই সীমাবদ্ধ নয়; বরং এটি সংস্কৃতি, সামাজিক মূল্যবোধ এবং জনগণের দৈনন্দিন জীবনে পরিবর্তন আনতে হবে। মাওবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে, নতুন সরকার প্রতিষ্ঠিত হলেও শাসকগোষ্ঠীর মধ্যে স্বৈরাচারী প্রবণতা ফিরিয়ে আনার ঝুঁকি থাকে। এই কারণে, মাওবাদী বিপ্লবীরা সামাজিক বিপ্লবকে অব্যাহত রাখতে এবং শাসকগোষ্ঠীর প্রতি সন্দেহ বজায় রাখতে জোর দেন।

বিভিন্ন ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনেও নতুন সরকার প্রতিষ্ঠার পর তাদের কার্যক্রমের প্রতি সন্দেহ এবং সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করা হয়। ফ্যাসিবাদ একটি কর্তৃত্ববাদী এবং স্বৈরাচারী রাজনৈতিক মতবাদ, যা সাধারণত একনায়কতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, এবং সামরিক শক্তির উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে। ফ্যাসিবাদী শাসন সাধারণত গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় এবং ব্যক্তিগত স্বাধীনতা, মানবাধিকার, এবং বহুত্ববাদী সমাজকে হুমকির মুখে ফেলে। ইতালিতে বেনিতো মুসোলিনি এবং জার্মানিতে অ্যাডলফ হিটলারের নেতৃত্বে ফ্যাসিবাদ শক্তিশালী হয়ে ওঠে এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইউরোপের বিভিন্ন দেশে প্রসার লাভ করে। ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনগুলি বিশেষত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপে এবং অন্যান্য অঞ্চলে গুরুত্ব সহকারে গড়ে ওঠে। এই আন্দোলনগুলির মধ্যে একটি মূল বিশ্বাস ছিল যে, ফ্যাসিবাদ একটি তাত্ত্বিক বা রাজনৈতিক প্রপঞ্চ হিসেবে একবার নির্মূল হয়ে গেলে তা পুনরায় ফিরে আসতে পারে, নতুন রূপে এবং নতুন কৌশলে। তাই, ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনগুলি নতুন সরকার গঠন হওয়ার পরেও সতর্কতা বজায় রাখার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর, ফ্যাসিবাদী শাসন এবং তার প্রভাবের বিপরীতে ইউরোপে বিভিন্ন ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলন গড়ে ওঠে। এই আন্দোলনগুলি বিশেষত ইতালি, ফ্রান্স, স্পেন, এবং জার্মানিতে দৃঢ়ভাবে দেখা যায়। যুদ্ধ-পরবর্তী ইউরোপে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হলেও, ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনকারীরা মনে করেন যে, ফ্যাসিবাদী চিন্তাধারা নতুন রূপে ফিরে আসতে পারে, যেমন—উগ্র জাতীয়তাবাদ, বর্ণবাদ, এবং কর্তৃত্ববাদী প্রবণতা।

Max Horkheimer and Theodor Adorno – The Occidental Observer
থিওডর আদোরনো (ডানে) এবং ম্যাক্স হর্কহেইমার (বামে)

ফ্রাংকফুর্ট স্কুলের তাত্ত্বিকরা, বিশেষত থিওডর আদোরনো এবং ম্যাক্স হর্কহেইমার, ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনের তাত্ত্বিক ভিত্তি স্থাপন করেন। তাদের মতে, ফ্যাসিবাদ একটি সাংস্কৃতিক ও সামাজিক প্রবণতা যা শুধু রাজনৈতিক পরিবর্তনের মাধ্যমে সম্পূর্ণভাবে নির্মূল করা সম্ভব নয়। আদোরনো তার “The Authoritarian Personality” (1950) বইয়ে উল্লেখ করেন যে, ফ্যাসিবাদী প্রবণতা সমাজের গভীরে প্রোথিত এবং এগুলির বিরুদ্ধে নিরন্তর সাংস্কৃতিক সংগ্রাম ও সচেতনতা প্রয়োজন। তিনি দেখিয়েছেন, ফ্যাসিস্ট মানসিকতা এবং ব্যক্তিত্বের বৈশিষ্ট্যগুলি যে কোনও সমাজে পুনরায় উদ্ভূত হতে পারে, যদি সেগুলি মোকাবেলা না করা হয়। ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনের আরেকটি দিক হলো গণতন্ত্র এবং মানবাধিকারের সুরক্ষা। এই আন্দোলনকারীরা মনে করেন যে, নতুন সরকার গঠন করার পরেও জনগণের প্রতি সরকারের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে আন্দোলন অব্যাহত রাখতে হবে। ইতালির অ্যান্তোনিও গ্রামসি, ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে তার লেখাগুলিতে সামাজিক আন্দোলন ও সাংস্কৃতিক হেজিমনির প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আলোচনা করেছেন। তার মতে, ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী যদি সংস্কৃতির মাধ্যমেও ফ্যাসিস্ট আদর্শকে বিস্তার করে, তবে এই হেজিমনির বিরুদ্ধে সাংস্কৃতিক এবং সামাজিক আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে। ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনকারীরা বিশ্বাস করেন যে, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার রক্ষা করতে হলে নতুন শাসকদের কার্যক্রমের প্রতি অবিচ্ছিন্ন সমালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গি রাখা প্রয়োজন।

Simone de Beauvoir, la filósofa que inspiró la lucha feminista
সিমোন দে বোভোয়ার

নারীবাদী তাত্ত্বিকরা যেমন সিমোন দে বোভোয়ার এবং বেটি ফ্রিডান, তাদের লেখায় বারবার উল্লেখ করেছেন যে, পুরুষতন্ত্র একটি গভীরভাবে প্রোথিত কাঠামো, যা আইন ও নীতি পরিবর্তনের মাধ্যমে সহজে দূর করা যায় না। তারা দেখিয়েছেন যে, এমনকি নতুন সরকার বা আইন প্রণীত হওয়ার পরেও পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা এবং কাঠামো সমাজে থেকে যেতে পারে। এজন্য নারীবাদীরা মনে করেন যে, আন্দোলন সবসময় চালিয়ে যেতে হবে, যাতে সমাজে লিঙ্গ সমতা এবং নারীর অধিকার নিশ্চিত করা যায়। মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র এবং ম্যালকম এক্স-এর মতো নেতারা বুঝতে পেরেছিলেন যে, বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াইটি শুধুমাত্র আইনগত পরিবর্তনের মাধ্যমে অর্জিত হতে পারে না। নাগরিক অধিকার আন্দোলনের পরও, তারা বারবার উল্লেখ করেছেন যে, সামাজিক বর্ণবৈষম্য, প্রাতিষ্ঠানিক বর্ণবাদ, এবং সাংস্কৃতিক বৈষম্য অব্যাহত থাকতে পারে, যা নতুন রূপে ফিরে আসতে পারে। এজন্য এই আন্দোলনকারীরা মনে করেন যে, বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই একটি চলমান প্রক্রিয়া, যা কখনো থামানো যাবে না।

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.