প্রাচীন গ্রিক রাষ্ট্রচিন্তা

The Political thought as we know it in the West, was the invention of the Greek. Before the Greeks governments and subjects, had, of course, existed, but hardly politics as we understand them.
-Wayper.

The ancient Greeks are said to have invented political theorising, but the sense in which they invented it is frequently misunderstood…. politics were not first thing that the ancients reflected systematically about, nor was it the case that when they did begin to think about politics they had nothing else in their heads.
J. S. Mc. Clelland, A History of Western Political Thought, p.4

Table of Contents

কয়েকটি মৌলিক ধারণা

এই আলোচনায় কয়েকটি মৌলিক বিষয়ের ওপর আলোকপাত করা প্রয়োজন। প্রথমে আমরা দেখব রাজনীতি (Politics) বলতে কী বুঝি? একটি সাধারণ সংজ্ঞা হল- Politics means the practice of the art or science of directing and administrating states or other political units. অর্থাৎ রাষ্ট্র বা অন্যান্য রাজনীতিক এককগুলির পরিচালনা বা প্রশাসন-সংক্রান্ত বিজ্ঞান বা কৌশলের নাম হল রাজনীতি বা রাষ্ট্রনীতি (politics),

রাজনীতী ও রাষ্ট্রতত্ত্ব : কোনো কোনো পন্ডিতব্যক্তি ভিন্নভাবে রাজনীতি বা রাষ্ট্রনীতির সংজ্ঞা দিয়ে থাকেন। এই সংজ্ঞাটিকে আমরা প্রতিনিধিত্বমূলক বলে মনে করি কারণ রাষ্ট্র পরিচালনার কৌশল হল রাষ্ট্রনীতি বা রাজনীতি। অবশ্য কোনো কোনো সময় রাজনীতি শব্দটিকে লঘু অর্থে ব্যবহার করা হয় এবং এই বিদ্যাবিষয়ক আলোচনায় তার প্রসঙ্গ আনছি না। এবার দেখা যাক রাষ্ট্রতত্ত্ব বলতে আমরা সচরাচর কী বুঝে থাকি? সরকার, রাষ্ট্র অথবা বৈধ রাজনীতিক সংগঠন বা প্রতিষ্ঠানের কাজকর্ম, নীতি নির্ধারণ অথবা উদ্দেশ্য-সংক্রান্ত বিষয়গুলি সম্পর্কে সমালোচনায়ক ও প্রণালীবদ্ধ বিশ্লেষণ হল রাষ্ট্রতত্ত্ব,সরকার, রাষ্ট্রনাগরিক, রাজনীতিক প্রতিষ্ঠান ইত্যাদির রাজনীতি বিষয়ক পদ্ধতি, কাজ, কৌশল প্রভৃতি সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট বিশ্লেষণ রাষ্ট্রতত্ত্বের এক্তিয়ারে এসে যায়। রাষ্ট্রতত্ত্ব সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে স্যাবাইন বলেছেন যে সামগ্রিকভাবে বিচার করে বলা যায় যে রাষ্ট্রতত্ত্ব কদাচিৎ সত্য হয়। এর মুখ্য উপাদানগুলি হল ঘটনা সম্পর্কে সুচিন্তিত মতামত, সম্ভাব্যতা বিষয়ে মূল্যায়ন, যে-সমস্ত উপাদান বা বিষয় নিয়ে মতামত তৈরি করা হয় তাদের মধ্যেকার সামঞ্জস্য বিষয়ে বিশ্লেষণ, ভবিষ্যদবাণী ‘সম্পর্কে যেসব মন্তব্য করা হয় তাদের যথাযথ মূল্যায়ন। তিনি আরও বলেছেন যে রাষ্ট্রতত্ত্ব সবসময় রাষ্ট্রদর্শনের (political philosophy) একটি অংশ। শুধু তাই নয় একে বিজ্ঞানের একটি অংশ বলা যেতে পারে। কারণ Political theory is an application to politics of the relevant intellectual and critical apparatus, which is at the moment available. It is a reflection upon morals, economics, government, religion and law (p. VI)

রাষ্ট্রচিন্তা কি এবং কেন?: রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাস বিষয়টি পাঠের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে পন্ডিতমহলে মতভেদ রয়েছে। যেমন বার্কি বলেন যে পন্ডিতদের মতে রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাস পাঠের বিশেষ উপযোগিতা হল রাজনীতিক প্রতিষ্ঠান এবং রাজনীতিক কার্যাবলির স্বরূপ জানতে নাকি এটি সাহায্য করে। কিন্তু রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাস সম্পর্কে এমন ঢালাও মন্তব্য খুবই অনভিপ্রেত এবং বিষয় সম্বন্ধে অবমূল্যায়ন (an un- warranted devaluation of our subject. p. 1.)। বার্কি (Berki) মনে করেন, যে রাষ্ট্রচিন্তা বা রাষ্ট্রতত্ত্ব বা রাষ্ট্রদর্শন সম্পর্কে অবহিত হওয়ার জন্য রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাস পাঠের প্রয়োজনীয়তা নেই। তাঁর কথায় the history of political thought is an end in itself, the highest peak of political education. এখানে দুটি শব্দের ওপর আমরা গুরুত্ব দেব-রাজনীতিক শিক্ষা। প্রাচীন গ্রিসের রাষ্ট্রচিন্তা থেকে আরম্ভ করে অদ্যাবধি রাজনীতি বা রাষ্ট্রতত্বের যেসব ঘটনা ঘটেছে সেগুলি জানতে হলে রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাস পাঠ বিশেষ প্রয়োজন, আর তা না হলে রাষ্ট্রতত্ত্ব রাজনীতিক ক্রিয়াকলাপ সম্পর্কে আমাদের সম্যকরূপে অবহিত হওয়া অপূর্ণ থেকে যাবে। যে-কারণে বার্কি বলেছেন যে রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাস নিজেই একটি উদ্দেশ্য (is an end in itself)। তিনি আরও দাবি করে বলেছেন যে মানুষ, সমাজ ও রাষ্ট্রের যে ‘ভিশন’ (Vision) সেগুলি অতীতের একাধিক বা প্রায় সমস্ত রাষ্ট্রচিন্তাবিদের (political thinkers) লেখায় স্পষ্ট আকারে উপস্থিত এবং সেই ‘ভিশন’ সম্পর্কে জানতে হলে কেবল রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাস নিয়ে পড়াশোনা করতে হয়। যেমন প্লেটো ও অ্যারিস্টট্ল-এর ‘ভিশন’ ছিল, আদর্শ রাষ্ট্রের। চুক্তি মতবাদের চিন্তানায়কদের ‘ভিশন’ ছিল নতুন রাষ্ট্রের গোড়াপত্তনে ও রাষ্ট্রিক কাঠামো তৈরিতে ব্যক্তির স্বতন্ত্র এবং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। হেগেল ছিলেন ভাববাদী দর্শনের অন্যতম প্রবক্তা। বিশ্বের আপামর শোষিত মানুষের মুক্তি কীভাবে আসতে পারে তা নিয়ে মার্কস চিন্তাভাবনা করেছিলেন। রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাস না পড়লে আমরা এই সমস্ত ‘ভিশন’ সম্পর্কে অবহিত হওয়ার সুযোগ পেতাম না। তবে রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাস পাঠ যে রাজনীতিক প্রতিষ্ঠান এবং কার্যাবলি বিষয়ে জানতে সাহায্য করে এই যুক্তিকে নস্যাৎ করে দেওয়ার সময় এখনও আসেনি। রাষ্ট্রচিন্তা বা রাষ্ট্রতত্ত্ব কেবল ব্যক্তির চিন্তাভাবনার লিখিত দলিল নয়। এক-একটি যুগের ভাবনা ও রাজনীতিক ক্রিয়াকর্মের বিবরণ রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাসে পাওয়া যায়। পুঁজিপতিদের আচরণ, বুর্জোয়া সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি ইত্যাদি অনেক বিষয় আমরা রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাস থেকে পাই। আর এগুলি জানা না থাকলে অতীতের সমাজব্যবস্থার রাজনীতিক স্বরূপ আমাদের নিকট অজ্ঞাত থেকে যেত। সুতরাং রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাসকে ঘটনাবলির নীরস বর্ণনা বলে মনে করলে খুবই ভুল হবে।

রাষ্ট্রদর্শন, রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাস, রাষ্ট্রনীতি:  রাষ্ট্রবিজ্ঞানের এই তিনটি মৌলিক ধারাকে আপাতদৃষ্টিতে পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন বলে মনে হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু উদার দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে যদি ব্যাপক অনুসন্ধানের কাজে ব্যাপৃত হওয়া যায় তাহলে দেখা যাবে যে এরা আদৌ পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন নয় এবং রাষ্ট্রচিন্তা বা পাশ্চাত্য রাষ্ট্রচিন্তা বলতে আমরা যা মনে করি তার মধ্যে রাষ্ট্রদর্শনের একটি বিশেষ স্থান আছে। সাধারণভাবে রাষ্ট্রদর্শন বলতে আমরা বুঝি কী করা হয়েছে বা হচ্ছে এবং কী করা উচিত- উভয়কে। এই উচিত বা ঔচিত্যকে কেন্দ্র করে রাষ্ট্রদর্শন তৈরি হয়েছে। বলাবাহুল্য, রাষ্ট্রচিন্তার মধ্যে অনেক সময় এই ঔচিত্যের প্রাধান্য থাকায় রাষ্ট্রদর্শন বিষয়টি সামনে এসে হাজির হয়েছে। প্লেটো থেকে আরম্ভ করে মার্কস পর্যন্ত দীর্ঘ দু’হাজার বছর ধরে পশ্চিমে যে রাষ্ট্রচিন্তা জন্মলাভ করেছে এবং যার শ্রীবৃদ্ধি ঘটেছে তার মধ্যে ঔচিত্যের একটি বড়ো ভূমিকা আছে। বিশেষ করে প্লেটো, অ্যারিস্টটল, রুশো প্রমুখেরা রাষ্ট্রচিন্তাকে ঔচিত্যের প্রেক্ষাপটে বিচার করেছেন। সুতরাং আমরা বলতে পারি যে পাশ্চাত্য রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাস, রাষ্ট্রনীতি সবই পরস্পরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। স্যাবাইন তো বলেই  দিয়েছেন রাষ্ট্রতত্ত্ব সবসময় রাষ্ট্রদর্শনের একটি অংশ। রাষ্ট্রদর্শন যেমন  ঔচিত্যের তেমনিভাবে ধর্ম, নৈতিকতা, আদর্শ, মূল্যবোধ ইত্যাদির কথা। বিগত দু-হাজার বছর ধরে পশ্চিমের যে রাষ্ট্রচিন্তা বা রাষ্ট্রতত্ত্ব আত্মপ্রকাশ করেছে ও বিকশিত হয়েছে তার মধ্যে এগুলি ভীষণভাবে উপস্থিত। সুতরাং পশ্চিমের রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাস পর্যালোচনা করতে গেলেই রাষ্ট্রতত্ত্ব এবং রাষ্ট্রনীতি অবধারিতভাবে এসে যায়। আর একটি বিষয়ের অবতারণা এখানে করা যেতে পারে। আজকের দিনে আমরা যাকে রাষ্ট্রতত্ত্ব বা রাষ্ট্রনীতি নামে অভিহিত করছি তা একদিনে গড়ে ওঠেনি। রাষ্ট্রনীতির নানা মূলসূত্র প্লেটোর আমল থেকে আজ পর্যন্ত নানা পণ্ডিত- সবিস্তারে ব্যাখ্যা করেছেন এবং নানা যুগে এদের , পরিবর্ধন, সংশোধন ইত্যাদি ঘটেছে। সুতরাং প্রত্যেকটি মূলসূত্রের আদি-অন্ত জানতে হলে আমাদের রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাসের দ্বারস্থ হতেই হবে, বার্কি বলেছেন: though it would make sense to imagine politics without political thought, political thought is inconceivable without history, অর্থাৎ রাষ্ট্রতত্ত্ব বা রাষ্ট্রচিন্তা বা রাষ্ট্রনীতি যা-হোক না কেন সবকিছু সম্পর্কে জ্ঞানার্জনের জন্য দরকার ইতিহাস জানা। বিশেষ করে রাষ্ট্রবিজ্ঞান যেখানে একটি সমাজবিজ্ঞান সেখানে অতীতকে বাদ দিয়ে রাষ্ট্রনীতি বা রাষ্ট্রতত্ত্ব’ সম্পর্কে প্রয়োজনীয় জ্ঞানার্জন করা একেবারে সম্ভব নয়। সুতরাং রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাসকে রাষ্ট্রনীতি, রাষ্ট্রদর্শন ও রাষ্ট্রতত্ত্ব থেকে স্বতন্ত্র বলে গণ্য করতে যাওয়া একেবারে সম্ভব নয়। আবার স্যাবাইন বলেন যে রাষ্ট্রতত্ত্ব, রাষ্ট্রনীতি থেকে স্বতন্ত্র বিষয় নয়। কারণ প্রায়োগিক ক্ষেত্রে রাজনীতি-সংক্রান্ত যেসমস্ত সিদ্ধান্ত বা নীতি গৃহীত হয় সেগুলি থেকে রাষ্ট্রতত্ত্বের সাধারণ সূত্র প্রস্তুত করা হয়ে থাকে। এইভাবে বিশ্লেষণ করে বলা যেতে পারে যে রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাস, রাষ্ট্রদর্শন, রাষ্ট্রতত্ত্ব ও রাষ্ট্রনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন ধারণা নয়। রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাস পাঠের গুরুত্ব অপরিসীম বলে অনেকেই মনে করেন এবং এঁদের মধ্যে ম্যাক্সে (Maxey) অন্যতম। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্রছাত্রীরা অনেক সময় জানতে চান অতীতে তার বিষয়টি কোন অবস্থায় অথবা কেমন আকারে ছিল। আর এই জাতীয় ঔৎসুক্য খুবই স্বাভাবিক। সেই ঔৎসুক্যের তৃপ্তিসাধনের নিমিত্ত আমাদের অতীতের দিকে তাকাতে হয় এবং রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাস সে প্রয়োজনীয়তা মেটায়। এ কথা সত্য যে সবসময় ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটে না। কিন্তু in every age there is large carry over of past political thinking and a heavy seeding of ideas that will bear fruit in year to come (p. 2)।

রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাস পাঠের প্রয়োজনীয়তা: বর্তমানকে খুব ভালোভাবে জানতে হলে অতীতের দিকে তাকানো বিশেষ প্রয়োজন। আর সে-কারণে রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাস পাঠের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। মস্কো থেকে প্রকাশিত রাজনীতিক মতবাদের ইতিহাসের লেখকগণ মনে করেন যে রাষ্ট্র, রাজনীতি, আইন ইত্যাদি ধারণার ব্যাপক গবেষণা রাজনীতিক মতবাদের স্বরূপ উদ্‌ঘাটনের জন্য প্রয়োজন। কারণ এগুলি অতীতে কী অবস্থায় ছিল তা না জানতে পারলে বর্তমানকালের গবেষকগণ কোনো সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারবেন না। আর সে-কারণে রাজনীতিক মতবাদের ইতিহাস জানা খুবই দরকার। অর্থাৎ রাজনীতিক মতবাদের গবেষণার জন্য এর ইতিহাসের প্রতি দৃষ্টিপাত অবশ্যই দরকার। লেখকদের কথায়: “আধুনিককাল হল পরিবিকাশমান। ঐতিহাসিক বাস্তবতা। বর্তমান ঘটনাবলির সমস্ত রহস্যই যে কেবল তার উদ্ভব ও অতীতের রহস্যোদ্ধার করে জানা যাবে না তা বলাই বাহুল্য। পক্ষান্তরে, অতীতের জ্ঞান না থাকলে কিন্তু বর্তমানের পরিপূর্ণ ও নির্ভুল উদ্‌ঘাটনের রাজনীতিক আইনি তত্ত্বের ভবিষ্যৎ বিকাশের যে পরিপ্রেক্ষিত বর্তমানে খুলে যাচ্ছে তা বোঝার সম্ভাবনা থাকে না।” বর্তমানকালের রাষ্ট্রতত্ত্ব ভাবাদর্শীয় হয়ে পড়েছে যার অর্থ হল মতাদর্শ বা ভাবাদর্শের সাহায্যে রাষ্ট্রতত্ত্ব বা রাজনীতি বিচার-বিশ্লেষণ করার পর একটি সিদ্ধান্তে উপস্থিত হওয়া। গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, গণতান্ত্রিক সমাজবাদ, উদারনীতিবাদ, নয়া উদারনীতিবাদ ইত্যাদি নানা ধরনের মতাদর্শ বা ভাবাদর্শ রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রাঙ্গণে অবাধে বিচরণ করে বেড়াচ্ছে। পণ্ডিতগণ মনে করেন এই ভাবাদর্শের রমরমার যুগে রাজনীতিক চিন্তার ইতিহাসের দিকে তাকাতেই হয়। কারণ এইসব মতাদর্শের অস্তিত্ব অতীতে ছিল কি না এবং থাকলে তা কেমন অবস্থায় ছিল তা জানা প্রয়োজন। প্রতিটি মতবাদ বা ভাবাদর্শ বা তত্ত্বের একটি তাত্ত্বিক ভিত্তি বা শেকড় অবশ্যই আছে এবং বিশ্লেষকগণ জ্ঞানস্পৃহাকে তৃপ্ত করার জন্য সেই উৎসের সন্ধান অবশ্যই করতে চাইবেন। সুতরাং রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাসকে কেবল একটি সাধারণ বিষয় বলে গণ্য করে এর গুরুত্ব অস্বীকার করা সঠিক পদক্ষেপ হতে পারে না। সুতরাং রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাসের বিরোধিতার পথে যদি অগ্রসর হওয়া যায় তা প্রকারান্তরে একদেশদর্শিতায় যে রূপান্তরিত হবে সে-বিষয়ে সন্দেহ নেই। সহজ কথা হল অতীতকে অস্বীকার বা উপেক্ষা করে বর্তমানকে সম্যকরূপে জানা যাবে না এবং তা সম্ভব নয়। সে কারণে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্রছাত্রীদের বিষয়টির ঐতিহাসিক প্রেক্ষিত জানতেই হবে।

রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাস একটি বৌদ্ধিক ঐতিহ্য: সমাজবিজ্ঞানের বিষয়গুলির মধ্যে চিন্তার একটি ধারাবাহিকতা রয়েছে এবং সেই ধারাবাহিকতা মেনে নিতে হলে ইতিহাসের আশ্রয় নিতেই হবে। কারণ কেবল ইতিহাস থেকে ওই বিষয়ের অতীত ও ঐতিহ্য (tradition) জানা যাবে। একে আমরা বলি বৌদ্ধিক ঐতিহ্য (intellectual tradition)। প্লেটো ও অ্যারিস্টট্ল যে আদর্শ রাষ্ট্রের কল্পনা করেছিলেন তা অবাস্তব। কিন্তু আমরা যদি ভাবি যে রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাস প্রকৃতপক্ষে একটি সর্বতোভাবে জনকল্যাণের কল্যাণের নিমিত্ত রাষ্ট্রের চরিত্র কেমন হওয়া উচিত তাহলে প্লেটো এবং অ্যারিস্টস্টলকে অবশ্যই স্মরণ করতে হবে। তা ছাড়া গ্রিক রাষ্ট্রচিন্তার অনেক বিষয় আজও প্রাসঙ্গিকতা হারায়নি। আইন সম্পর্কে রোমান ধারণা, প্রাকৃত অধিকার ইত্যাদি বিষয়ে আমরা জানতে আগ্রহী। বার্কি বলেছেন: The political thought of ancient Greeks and Romans, medieval nations of law and kingship, seventeenth century concepts of natural rights etc. are not and cannot be “alien” to us since our total vocabulary of political discourse is the outgrowth of our, more or less conscious collective preservation and recollection of these notions and thoughts (p. 24)। রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাস পর্যালোচনা করা মানে কেবল অতীতকে জানা নয়, অতীতের জ্ঞানভান্ডারকে উজাড় করে তার সম্পদ আহরণ করে বর্তমানকে আরও সমৃদ্ধ করে তোলা। রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাস অধ্যয়ন করা মানে একটি নতুন বিষয় পড়া নয়, একটি বৌদ্ধিক ঐতিহ্যের গভীরে প্রবেশ করে তার অলিতে-গলিতে অবাধে বিচরণ করে জ্ঞানস্পৃহা তৃপ্ত করা, অতীত সম্বন্ধে প্রয়োজনীয় তথ্যাদি সংগ্রহ করে সেগুলিকে বর্তমানের গবেষণার কাজে ব্যবহার করা। The study of the history of political thought…. is an effort of remembering, recalling, recovering, laying bare the hidden constituents of our own intellectual being. (p. 25) আজকের দিনের একজন মানুষকে অতীত থেকে বিচ্ছিন্ন করে চিন্তা করা যায় না। He is the epitome of the earlier epochs, একইভাবে আমরা রাষ্ট্রচিন্তার ক্ষেত্রে দেখতে পাই। সক্রেটিস, প্লেটো, অ্যারিস্টট্ল-এঁরা সবাই গণতন্ত্রের কথা ভেবেছিলেন আজও আমরা সবাই গণতন্ত্রের জয়গান করি। সর্বযুগে সকলের নিকট গণতন্ত্র একটি অত্যন্ত প্রিয় ধারণা ও রাজনীতিক কাঠামো হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। রাজনীতি বিষয়ে বৌদ্ধিক চিন্তার উত্তরাধিকার আমরা, কিন্তু উত্তরাধিকারের হকদারিত্বকে সুন্দরভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে হলে তো অতীতকে জানতে হয়। অতীত থেকে আমরা কতখানি অগ্রসর হতে পেরেছি সে সম্বন্ধে জানার আগ্রহ অনেকের থাকে। আর তার জন্য দরকার ইতিহাস জানা, সুতরাং রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাসকে একটি বৌদ্ধিক ঐতিহ্য বলে বিবেচনা করা হয়। সমাজের পরিবর্তন বা রূপান্তরের সঙ্গে সঙ্গে রাজনীতিক ভাবনাচিন্তারও রূপান্তর হচ্ছে। কিন্তু সেই রূপান্তর বিষয়টিকে সমৃদ্ধির দিকে নিয়ে যাচ্ছে কিনা তা দেখা দরকার। আর একটি বিষয়কে গবেষণাধর্মী করে তুলতে হলে এই মানসিকতাটি প্রয়োজন।

প্রাচীন গ্রিসের রাষ্ট্রচিন্তার বৈশিষ্ট্য: পাশ্চাত্য রাষ্ট্রচিন্তার কোনো কোনো বিশ্লেষক মনে করেন যে গ্রিক পন্ডিতেরা সর্বপ্রথম রাষ্ট্রনীতিকে তাত্ত্বিকীকরণের (theorisation) আবরণে আবৃত করার চেষ্টা করেছিলেন। প্লেটোর ‘রিপাবলিক’ অ্যারিস্টটলের ‘পলিটিক্স’ ইত্যাদি বহু পঠিত ও বহু আলোচিত প্রশ্নে রাজনীতির তাত্ত্বিকীকরণ ঘটেছে। কিন্তু গ্রিক চিন্তানায়কগণ রাজনীতি বা রাষ্ট্রতত্ত্ব আলোচনাকালে কেবল রাজনীতির মধ্যে নিজেদের বন্দি করে রাখেননি, এরসঙ্গে অনেক বিষয়ের অবতারণা ঘটিয়েছেন যার ফলে রাজনীতি একটি মিশ্র বিষয়ে পরিণত হয়েছে। তাঁরা রাষ্ট্রনীতি আলোচনাকালে সাহিত্য, দর্শন, জীববিদ্যা, গৃহস্থালি (household) বিষয়াদি, ভগবান, নৃতত্ত্ব ইত্যাদি বিষয়সমূহ নিয়েও আলোচনা করতেন। রাজনীতি তার স্বাতন্ত্র্য বা স্বকীয়তা হারিয়ে এক মিশ্র বিষয়ে পরিণত হয়েছিল। আবার যাঁরা কাব্য ও সাহিত্য সম্পর্কে নিজেদের ব্যাপৃত রাখতেন তাঁদের কাব্যে ও সাহিত্যে রাজনীতি, দর্শন, আতিথেয়তা, রাজার কর্তব্য বা কাজ স্থান করে নিত। এমনকি ধর্ম, পুরাকথা, লোককথা প্রভৃতি নিয়ে গ্রিকরা আলোচনা করত। সুতরাং গ্রিক রাষ্ট্রচিন্তাকে বিশুদ্ধ রাষ্ট্রনীতির পর্যায়ভুক্ত করতে যাওয়া ঠিক হবে না (The list of things which the Greeks had thought about before they began to think systematically about politics gives us a clue to have their minds worked. Mc Clelland, p. 4)। হোমার-এর দুটি মহাকাব্য ‘ইলিয়াড’ ও ‘ওডিসি’কে নিছক সাহিত্য বলে মনে করলে ভুল হবে। নাগরিকের সঙ্গে নাগরিকের সম্পর্ক, তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য, শাসক ও শাসিতের মধ্যে সম্পর্ক ইত্যাদি বিষয় এই দুটি মহাকাব্যে স্থান পেয়েছিল। আবার যারা রাষ্ট্রনীতি চর্চা করতেন এই দুটি মহাকাব্যের প্রসঙ্গ উল্লেখ ভুলতেন না।

বিচিত্র উপাদানে প্রাচীন গ্রীসের রাষ্ট্রচিন্তা গঠিত: নাগরিকের প্রতি রাজার কর্তব্য এবং রাজার প্রতি নাগরিকের দায়বদ্ধতা উপাদানে প্রাচীন ইত্যাদি ধারণাগুলি নিয়ে গ্রিকগণ খুব ভাবনাচিন্তা করতেন এবং এগুলিতে স্বাভাবিক আবির্ভাব ঘটত। হঠাৎ প্রাকৃতিক এলে বা দেখা দিলে অথবা নাগরিক জীবন চরম সংকটের মধ্যে পড়লে রাজনীতিবিদ থেকে আরম্ভ করে মানুষ সবাই মনে করত যে ভগবানের অসন্তোষের সাধারণ ফসল হল এই সমস্ত অঘটন বা বিপর্যয়। সেই কারণে এগুলি মোকাবিলার জন্য যেমন রাষ্ট্রনেতাদের সতর্কতা ও কর্মতৎপরতা অবলম্বনের কথা বলা হত তেমনি ভগবানকে তুষ্ট করার উপদেশ থাকত। প্রাচীন গ্রিসের রাষ্ট্রনীতির বিশেষকগণের মনে এই প্রত্যয় গড়ে উঠেছিল যে রাজ্যশাসন করার সময় রাজাদের উচিত ভগবানের নির্দেশ মেনে চলা এবং প্রজাদের মঙ্গলের জন্য রাজার সেই সমস্ত কাজ করা উচিত যেগুলি ভগবান অনুমোদন করবেন। ভারতের প্রাচীন এবং মধ্যযুগের রাষ্ট্রচিন্তার ওপর ধর্ম ও নীতির যে অপরিসীম প্রভাব ছিল তা আমরা জানি। কেবল ভারত নয় প্রাচীন চিন, মিশর প্রভৃতি দেশে অতীতে যে রাষ্ট্রচিন্তার বিকাশ ঘটেছিল তার ওপর ধর্ম, নীতিবোধ, আদর্শ, মূল্যবোধ ইত্যাদির স্পষ্ট প্রভাব পড়েছিল। কারণ হল প্রাচীন নাগরিকরা ধর্ম থেকে নিজেদের মুক্ত করতে পারেনি। প্রাচীন গ্রিসের নগর-রাষ্ট্রগুলিতে যে ধরনের শাসনব্যবস্থা প্রচলিত ছিল তাকে বিশেষ শ্রেণিভুক্ত করার অবকাশ আছে বলে মনে হয় না। কারণ প্রাচীন গ্রিকগণ দাবি করত যে নগর-রাষ্ট্রগুলিতে গণতন্ত্র ছিল। তারা সবাই প্রকাশ্য সভায় উপস্থিত হয়ে আলোচনার মাধ্যমে দেশ শাসন করত। কিন্তু এই সমস্ত সভায় কেবল নাগরিকদের প্রবেশাধিকার বা অংশগ্রহণের অধিকার ছিল। আবার ‘নাগরিক’ কথাটি খুবই সীমিত অর্থে ব্যবহৃত হত। অর্থাৎ একটি নগর-রাষ্ট্রের সকল অধিবাসী নাগরিক মর্যাদায় ভূষিত হওয়ার সুযোগ পেত না। একটি নগর-রাষ্ট্রের অর্ধেক অধিবাসী নাগরিকের মর্যাদার অধিকারী ছিল এবং কেবল নাগরিকেরাই প্রশাসনে অংশ নেওয়ার যোগ্য ছিল (The free citizens rarely constituted more than half and often much less than half of the total population, but they alone enjoyed political rights and privileges. Maxey p. 28)। এই হল প্রাচীন গ্রিসের গণতন্ত্রের নমুনা। একটি নগর-রাষ্ট্রের মোট জনসংখ্যার খুব অল্প অংশই প্রশাসনের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার সুযোগ পেত এবং সুদূরতম অর্থে একে গণতন্ত্র বলা যায় না। তবে নামকাওয়াস্তে গণতন্ত্র যে ছিল সে-বিষয়ে সন্দেহ নেই।

মিশ্র শাসনব্যবস্থা ছিল : প্রাচীন গ্রিসের অধিকাংশ নগর- রাষ্ট্রে রাজতান্ত্রিক সরকার প্রবর্তিত ছিল বলে ইতিহাস থেকে জানা যায়। রাজতন্ত্র ছিল বহুল-প্রচলিত ও তথাকথিত জনপ্রিয় সরকার। কিন্তু রাজার হাতে তত্ত্বগতভাবে শাসনভার অর্পিত থাকলেও প্রকৃতপক্ষে তিনি সেই দায়িত্ব পালনের সুযোগ পেতেন না। অভিজাত পরিবারের লোকেরা রাজার নামে শাসন চালাতেন (Though monarchical forms were preserved in some of the Greek states the actual power of the government soon fell into the hands of the nobility. Maxey, p. 28)। অভিজাত সম্প্রদায় ছাড়া বিশেষ প্রভাবশালী ব্যক্তিদের নিয়ে তৈরি গোষ্ঠীর হাতে কোথাও কোথাও শাসনভার অর্পিত থাকত। এর নাম সংকীর্ণ গোষ্ঠীতন্ত্র বা Oligarchy। স্বৈরতন্ত্র অনেক নগর- রাষ্ট্রে দেখা যেত এবং অনেকে এই স্বৈরতন্ত্রকে হিটলারের স্বৈরতন্ত্রের সঙ্গে তুলনা করে থাকেন। নানাবিধ উপায়ে স্বৈরতান্ত্রিক সরকার জনসাধারণকে প্রলুব্ধ করে নিজের কার্যসিদ্ধি ও স্বার্থসিদ্ধি করত। অনেকে মনে করেন যে এই স্বৈরতান্ত্রিক সরকার ছিল নিকৃষ্ট জাতের সরকার। অনেক পন্ডিত মনে করেন যে প্রাচীন গ্রিসের নগর-রাষ্ট্রে গণতন্ত্রের প্রচলন যথেষ্ট ছিল। বিশেষ করে পণ্ডিতেরা বলেন যে এথেন্স-এর গণতন্ত্র ছিল বিখ্যাত। নির্দিষ্ট সময় অন্তর ওই নগর-রাষ্ট্রের নাগরিকেরা প্রকাশ্য সভায় বা সমাবেশে উপস্থিত
হয়ে শাসনকার্য পরিচালনা করত। বার্কার, ম্যাক্সে প্রমুখেরা এথেনীয় গণতন্ত্রের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন। পন্ডিতেরা বলেছেন যে এথেন্স এর মোট জনসংখ্যা ৩০০,০০০ থেকে ৪০০,০০০-এর মধ্যে ছিল এবং এর মধ্যে ১৬০,০০০ ছিল নাগরিক। অর্থাৎ প্রায় অর্ধেক লোক নাগরিক মর্যাদা পেত। আর কেবল নাগরিকরাই শাসনকাজে অংশ নিতে পারত। আমরা মনে করি যে এথেনীয় গণতন্ত্র ছিল খুবই সীমিত অর্থে গণতন্ত্র। গ্রিসের অনেক নগর-রাষ্ট্রে স্বৈরতান্ত্রিক সরকার থাকলেও গণতন্ত্র, আইন, আইনি শাসনের প্রতি গ্রিসের সাধারণ মানুষ এবং শাসকগোষ্ঠীর বিশেষ আনুগত্য ছিল। গায়ের জোরে ক্ষমতা দখলকে গ্রিকরা পছন্দ করত না যদিও স্বৈরতান্ত্রিক সরকার গ্রিক নগর-রাষ্ট্রগুলিতে প্রচলিত ছিল। সরকারকে বৈধ হতেই হবে এবং একটি বৈধ সরকার আইন মোতাবেক শাসনকার্য পরিচালনা করবে এই ছিল প্রাচীন গ্রিকদের ধারণা। গ্রিকরা মনে করত যেখানে আইন অনুযায়ী শাসন পরিচালিত হয় না সেখানে ঔদ্ধত্য এবং অহঙ্কার প্রাধান্য পাবে। শাসকদের মধ্যে যাতে অহঙ্কার গড়ে উঠতে না পারে এবং রাষ্ট্র যাতে আইন অনুযায়ী শাসিত হয় সেদিকে সাধারণ মানুষের নজর থাকত। আবার শাসকরা অহঙ্কারী হলে রাজনীতিতে অস্থিতিশীলতা দেখা দেবে এই ছিল সাধারণ মানুষের ধারণা।

আইন ও ন্যায়বিচারের প্রাধান্য: ইতিহাস থেকে জানা যায় যে গ্রিকরা আইন বা নোমোস (nomos)-এর প্রতি বিশেষভাবে অনুরক্ত ছিল। তারা মনে করত যে সমাজ আইন অনুযায়ী আইন ও ন্যায়বিচারের শাসিত না হলে একদিকে রাজনীতির ওপর যেমন অস্থিতিশীলতা নেমে আসবে তেমনি সাধারণ মানুষ ভগবানের বিরাগভাজন হবে এবং তা সমাজের পক্ষে অকল্যাণজনক হয়ে দাঁড়াবে। প্রাচীন গ্রিসে যে ধরনের আইন ছিল তাকে অলিখিত আইন বলা যেতে পারে এবং অলিখিত আইন মানে নৈতিক আইন। অবশ্য লিখিত আইন আদৌ ছিল না তা নয়। তবে অলিখিত আইন বা নৈতিক আইনের প্রাবল্য বেশি ছিল বলে অভিজ্ঞরা দাবি করে থাকেন (The early heroes of the polis were all law givers who mapped out what the relations between men should be part of the law was what we call constitutional law because it dealt with what the arrangements for holding public office should be, part of the law dealt with religious observations. Mc Clelland, p. 10)। আইন যে কেবল শাসক ও শাসিতের মধ্যে সম্পর্ক নির্ধারণ করত তা নয় নগর-রাষ্ট্রের জনগণ যাতে সুন্দর জীবনযাত্রা নির্বাহ করতে পারে সেদিকে আইনের সতর্ক নজর থাকত। গ্রিকদের ধারণা জন্মেছিল যে কেবল আইনের শাসন কায়েম করে একটি সুন্দর ও সুস্থ নাগরিক জীবন গড়ে তোলা যেতে পারে। আর তা যদি সম্ভব হয় সমাজে ন্যায়বিচার অবশ্যই আসবে। গ্রিকরা মনে করত যে যদি সমাজে ন্যায়বিচার না থাকে সমাজ সুন্দর ও সুপরিচালিত হতে পারে না। গ্রিকগণ তাদের দেবতা জিউস (Zeus)-কে সর্বজনীন ন্যায়বিচারের প্রতীক বলে ভাবত। সুতরাং যদি একজন শাসক এই ন্যায়বিচার লঙ্ঘন করে তাহলে সে অনতিবিলম্বে দেবতার কোপানলে পড়বে এবং এই ভয় শাসকের মনে থাকায় সহসা ন্যায়বিচার লঙ্ঘনের কথা শাসক ভাবত না। প্রাচীন ভারতের রাষ্ট্রচিন্তা অনুধাবন করলে দেখা যায় যে রাজারা ভগবানের কোপদৃষ্টি থেকে অব্যাহতি পাওয়ার জন্য সহজে ন্যায়বিচার লঙ্ঘন করতে চাইতেন না। তবে সর্বত্র যে আইনের শাসন ও ন্যায়বিচারের অপ্রতিহত প্রাধান্য বিরাজ করত এমনটি মনে করার কারণ নেই। প্রাচীন গ্রিসে ও ভারতে স্বৈরাচারী শাসকও ছিল। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য গ্রিক শাসকগণ আইনের আশ্রয় নিত। স্বৈরতন্ত্রে যেমন নাগরিকের ওপর বলপূর্বক আইন চাপিয়ে দেওয়া হত গ্রিসে তেমনটি ছিল না বলে অনেকের অনুমান। ন্যায়বিচারহীন সমাজকে গ্রিকরা নীতিহীন সমাজ বলে মনে করত। প্রাচীন গ্রিসের রাষ্ট্রচিন্তা সম্পর্কে আলোচনা করতে গেলে ওখানকার সমাজব্যবস্থার শ্রেণিবিন্যাসের দিকটি স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা বিশেষ প্রয়োজন বলে মনে করি কারণ এই শ্রেণিবিন্যাস রাজনীতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত।

গ্রীক সমাজের শ্রেণীবিন্যাস: ইতিহাস থেকে আমরা জানতে পারি যে প্রাচীন গ্রিক নগর-রাষ্ট্রগলিতে প্রধানত তিনটি শ্রেণি ছিল। একটি হল ক্রীতদাস শ্রেণি বাঁ slave, গ্রিসের নগর-রাষ্ট্রগুলির মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ ছিল ক্রীতদাস। ক্রীতদাস গ্রিক জনজীবন ও রাজনীতিক জীবনের সঙ্গে এমন ওতপ্রোতভাবে মিশে গিয়েছিল যে গ্রিসের সমাজ, গ্রিক সমাজের শ্রেণি- রাজনীতি ও অর্থনীতিকে এই ক্রীতদাস  থেকে আদৌ স্বতন্ত্র করা যায় না। গ্রিসে ক্রীতদাস প্রথা কার্যত একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে উঠেছিল। স্যাবাইন বলেছেন, In Greek political theory slave’s existence was taken for granted, just as the feudal ranks were taken for granted in the Middle Ages (p. 4)। ক্রীতদাস শ্রেণি ছাড়া গ্রিক- নগর-রাষ্ট্রগুলিতে আর একটি শ্রেণির অস্তিত্বের কথা আমরা ইতিহাস থেকে জানতে পারি এবং সেটি হল অবসর (leisure) শ্রেণি। প্লেটো, অ্যারিস্টট্ল থেকে শুরু করে অনেক পণ্ডিতব্যক্তি অবসরভোগী শ্রেণির প্রয়োজনীয়তার কথা বলে গেছেন। তাঁদের বক্তব্য হল অবসরভোগী শ্রেণিকে যদি কায়িক পরিশ্রমের ঝক্কি এবং ঝামেলা পোয়াতে হয় তাহলে তাদের পক্ষে জ্ঞান ও দর্শন চিন্তায় মনোনিবেশ করা সম্ভব হবে না। আর অবসরভোগী শ্রেণি জ্ঞান ও দর্শন চিন্তা করার সুযোগ না পেলে জ্ঞানচর্চা ভীষণভাবে বিঘ্নিত হবে। এ কারণে প্রাচীন গ্রিসের আর্থ- সামাজিক-রাজনীতিক ব্যবস্থায় অবসরভোগী শ্রেণির ভীষণ প্রয়োজনীয়তা ছিল। গ্রিসের দার্শনিকগণ ক্রীতদাস প্রথা ও অবসরভোগী শ্রেণির অপরিসীম প্রয়োজনীয়তার কথা বলে গেছেন। গ্রিক রাষ্ট্রচিন্তা খোলাখুলিভাবে ক্রীতদাস শ্রেণি ও অবসর শ্রেণিব্যবস্থাকে আদর্শ বলে ঘোষণা করে গেছে। জ্ঞানবিজ্ঞানের চর্চায় নিয়োজিত ব্যক্তিগণ কায়িক পরিশ্রমে ব্যাপৃত থাকলে সমাজের পক্ষে ক্ষতিকর হবে। সর্বশেষ শ্রেণি হল নাগরিক শ্রেণি (class of citizens)। গ্রিসে ক্রীতদাস এবং বিদেশিরা নাগরিক মর্যাদা থেকে বঞ্চিত ছিল। কোথাও কোথাও মোট জনসংখ্যার অর্ধেক মাত্র নাগরিক মর্যাদা পেত এবং এই নাগরিকরাই নগর-রাষ্ট্রের প্রশাসনে অংশগ্রহণের সুযোগ পেত (What citizenship entitled a man to was membership, that is, some mini- mum share of political activity or participation in public business. Sabine, p. 5)। লক্ষ করার বিষয় হল প্রাচীন গ্রিসে নাগরিক শ্রেণির বিশেষ ভূমিকা ছিল। কেবল নাগরিক পদবাচ্য হলে চলবে না তাদের দায়িত্ব পালনও করতে হত। যেমন সরকারি কাজে বা প্রশাসনে অংশ নিতে নাগরিকরা বাধ্য হত। নাগরিক শ্রেণি ও অবসরভোগী শ্রেণি ছিল বিশেষ সুবিধাভোগী শ্রেণি। রাষ্ট্রের যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা এই দুই শ্রেণি ভোগ করত এবং এই প্রসঙ্গে আমরা প্রখ্যাত ঐতিহাসিক এইচ. জি. ওয়েলস- এর মন্তব্য স্মরণ করতে পারি: One obvious result of this monopolisation of state by the class of citizens was that the patriotism of these privileged people took an intense and narraow form they would form alliances, but never coalesce with other city-states. Quoted by Maxеу, р. 29. ক্রীতদাস প্রথা গ্রিক সমাজজীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ এবং বহুসমর্থিত একটি সামাজিক প্রথা হলেও এটি যে নিন্দনীয় ছিল সে-বিষয়ে সন্দেহ নেই। ক্রীতদাসের মালিকরা নিজেদের সম্মানীয় ব্যক্তি বলে মনে করত। প্লেটোর ধারণা ছিল ক্রীতদাস না থাকলে সমাজে অবসর- ভোগী শ্রেণি জ্ঞানচর্চায় মনোনিবেশ করতে পারবে না এবং সমাজের ক্ষতি হবে। অ্যারিস্টটল-এর মতে পরিবার গঠিত হয় স্বামী, স্ত্রী, পুত্র, কন্যা সন্তানসহ ক্রীতদাসদের নিয়ে। অর্থাৎ এরা পরিবারের অংশ, আবার কেউ কেউ ক্রীতদাসদের গোরু-ছাগলের পর্যায়ভুক্ত বলে মনে করত। এই ধারণার প্রেক্ষিতে আমরা প্রাচীন গ্রিসের সমাজব্যবস্থায় ক্রীতদাসদের করুণ অবস্থার কথা অনুমান করতে পারি। পন্ডিত জ্ঞানীগুণী থেকে সাধারণ মানুষ কেউই ক্রীতদাসদের ভালো চোখে দেখতেন না, অথচ এরাই ছিল সমাজ গঠনের প্রধান কারিগর এবং সমাজের সত্যিকারের স্তম্ভ। সাম্প্রতিককালে অনেকেই প্রাচীন গ্রিসের ক্রীতদাস প্রথা নিয়ে গবেষণা করে জানতে পেরেছেন যে ক্রীতদাসরা জানত যে তারা তাদের মালিকদের দ্বারা ভয়ঙ্করভাবে শোষিত ও নির্যাতিত। অত্যাচারে তাদের বুক ফেটে গেলেও মুখে ভাষা বের হত না কারণ তাদের পক্ষে ঐক্যবদ্ধ হয়ে মালিকদের বিরোধিতা করা সম্ভব ছিল না। বিরোধিতা করার জন্য যে সংহতি প্রয়োজন তা প্রাচীন গ্রিসের ক্রীতদাসদের ছিল না। গবেষকগণ বলেছেন যে প্রাচীন চীনে কৃষকরাও অত্যাচারিত এবং নিগৃহীত হত এবং তার বিরুদ্ধে কৃষকরা মাঝে মাঝে বিদ্রোহ ঘোষণা করত। কিন্তু গ্রিসে সেই পরিস্থিতি দেখা দেয়নি কারণ গ্রিসের ক্রীতদাসরা সংঘবদ্ধ হয়ে আন্দোলন করার সুযোগ পায়নি। এই যে সংঘবদ্ধতার অভাবহেতু গ্রিসে ক্রীতদাসদের আন্দোলন বাঁধতে পারেনি। একজন সমালোচক যথার্থই বলেছেন গ্রিসের ও রোমের ক্রীতদাসদের সাংগঠনিক ব্যবস্থা না থাকায় আন্দোলন হয়নি (The character of Greece, and later Ro- man slavery made it very difficult for the slaves to organise against the exploiters. Chris Harman, A People’s History of the World, p. 65)।

শ্রেণী সংগ্রাম: তবে বলকান ও ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের ক্রীতদাসরা অনেক সময় অত্যাচারের বিরোধিতা করত। কিন্তু গ্রিসে বা রোমে তা দেখা যায়নি। অজ্ঞতা এবং অসচেতনতা ছিল আন্দোলন না করার প্রধান কারণ। কিন্তু প্রাচীন গ্রিসে অন্য এক ধরনের শ্রেণিসংগ্রাম দেখা যেত এবং তা হল ধনী কৃষক ও দরিদ্র কৃষকদের মধ্যে সংগ্রাম। ধনী কৃষকরা অনেকসংখ্যক ক্রীতদাস রেখে চাষবাস করত। কিন্তু দরিদ্র কৃষকদের সে সুযোগ ছিল না। ফলে এই দুই সম্প্রদায়ের কৃষকদের মধ্যে সংঘাত প্রায়ই দেখা দিত। প্রাচীন গ্রিসে আর-এক প্রকার শ্রেণিসংগ্রাম দেখা যেত। বিভিন্ন প্রভাবশালী গোষ্ঠীর নেতারা বাহুবলে সমাজের ওপর প্রভুত্ব স্থাপন করত এবং আনুগত্য আদায় করত। কিন্তু পরে যে-সমস্ত সম্পন্ন কৃষক বহুসংখ্যক ক্রীতদাস রেখে একই ব্যাবসাবাণিজ্যে মূলধন লগ্নি করে সম্পদশালী হত তারা ওই সমস্ত গোষ্ঠীর নেতাদের মাতব্বরি মানতে চাইত না যে-কারণে এই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে সংঘর্ষ দেখা দিত এবং প্রাচীন গ্রিসের সমাজব্যবস্থায় এটি বিরল ঘটনা ছিল না। তাই বলা হয়েছে: This was a world of bitter conflicts among the clites. Chris Harman, p. 64.

সংবিধানতন্ত্রের জন্ম প্রাচীন গ্রীসে: পাশ্চাত্য রাষ্ট্রচিন্তার ব্যাখ্যাকারগণ দাবি করে বলেন যে প্রাচীন গ্রিসের নগর-রাষ্ট্রগুলি প্রশাসনে, শাসক ও শাসিতের মধ্যে সম্পর্ক নির্ধারণে ও অন্যান্য বহুবিধ বিষয়ে সর্বতোভাবে আইনের শাসন অর্থাৎ আইন অনুযায়ী সবকিছু করার ওপর এত বেশি জোর দিত যে আইনের বাইরে শাসক বা শাসিত কারোর কিছু করার সামান্য ক্ষমতা ছিল না এবং কার্যত সব মহলই আইন অনুযায়ী কাজ করার কথা ভাবত যার থেকে সবাই ধরে নিয়েছেন যে প্রাচীন গ্রিসের শাসকগোষ্ঠী আইনের শাসন কায়েম করে সংবিধানতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা করে গেছে। এই প্রসঙ্গে জনৈক সমালোচকের মন্তব্য নিম্নরূপ: The early heroes of the polis were all lawgivers who mapped out what the relations between men should be. Part of the law was what we would call constitutional law because it dealt with what the arrangements for holding public office should be. J. S. Mc Clelland, p. 10. এ কথা সত্য, যে প্রাচীন গ্রিসের নগর-রাষ্ট্রগুলিতে আইনের দৃষ্টিতে সাম্য, অধিকার ও সাম্যরক্ষার নিমিত্ত আইন ইত্যাদি ছিল না। আইনকে সকলে নিজ নিজ অধিকার রক্ষার নিমিত্ত ব্যবহার করার সুযোগ পেত না। ক্রীতদাসদের সামাজিক মর্যাদা না থাকায় তারা আইনের সাহায্য থেকে বঞ্চিত ছিল। কিন্তু এই সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও বলা যেতে পারে যে গ্রিসে সমাজ শাসনে ও অন্যায় নিবারণে আইনের একটি বিশেষ ভূমিকা ছিল। সাধারণ মানুষ আইনের সুযোগ গ্রহণে বঞ্চিত থাকলেও সমাজের শীর্ষস্থানীয়রা আইনের যথেচ্ছ ব্যবহারের সুযোগ পেত না। আইন এমনভাবে রচনা ও প্রয়োগ করা হত যে ক্ষমতাবানরা এর অপপ্রয়োগের সুযোগ পেত না। অষ্টাদশ শতকে আমেরিকার সংবিধান প্রণেতারা প্রাচীন গ্রিসের এই সংবিধানতন্ত্রের দ্বারা যে অনুপ্রাণিত হয়েছিল সে-বিষয়ে সন্দেহ নেই। আমরা জানি যে মার্কিন সংবিধান প্রণেতাদের ওপর মন্টেস্কুর একটি প্রবল প্রভাব ছিল। কিন্তু প্রাচীন গ্রিসের প্রভাবকে আদৌ অগ্রাহ্য করা যায় না। প্রাচীন গ্রিসে আইনকে প্রাধান্য দিয়ে এবং আইনের শাসন বলবৎ করে পন্ডিতেরা উদারনীতিবাদের গোড়াপত্তন করে গেছেন। কারণ উদারনীতিবাদের মূল বক্তব্য হল আইন অনুযায়ী সবাইকে চলতে হবে। ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী নয়, আইন সার্বভৌম ক্ষমতা ভোগ করবে। অবশ্য ব্রিটেনে সংসদকে সর্বোচ্চ ক্ষমতার আধার হিসেবে গণ্য করা হয়। কিন্তু এটি হল সম্পূর্ণ’ আলাদা বিষয়।

সংবিধানতন্ত্র এবং আইনের অগ্রাধিকারত্ব বজায় থাকায় প্রাচীন গ্রিসে সার্বভৌমতা অপ্রতিহত ছিল না। আমরা একে সীমিত সার্বভৌমতা তত্ত্ব নামে অভিহিত করতে পারি। এর প্রধান কারণ হল শাসক ও শাসিত উভয়েই আইনের বেড়াজালে বন্দি। আইন লঙ্ঘন করার ক্ষমতা কারোর নেই। ভাবলে আশ্চর্য হতে হয় যে প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে প্রাচীন গ্রিসের শাসকগণ সার্বভৌম ক্ষমতাকে সীমিত গণ্ডির মধ্যে রেখে সুন্দর ও সমৃদ্ধিশালী নাগরিক জীবন গড়ে তোলার কথা ভেবেছিলেন। অবশ্য এই উচ্চাকাঙ্ক্ষাপূর্ণ লক্ষ্য তাঁরা কী পরিমাণে অর্জন করতে পেরেছিলেন সে বিষয়ে সন্দেহ আছে। কারণ ক্রীতদাস প্রথা সমগ্র গ্রিক সভ্যতার নিকট কলঙ্ক স্বরূপ হয়ে উঠেছিল।

অস্থিতিশীল গ্রীক সমাজ:   গ্রিক নগর-রাষ্ট্রের সমাজে নানা কারণে বিভিন্ন শ্রেণি ও গোষ্ঠী গড়ে উঠেছিল এবং কালক্রমে এইসব গোষ্ঠী বা শ্রেণির নেতারা যারা দলপতি বা গোষ্ঠীপতি (chieftains) নামে পরিচিত তারাই এক-একটি এলাকা বা অঞ্চলের শাসক হতেন এবং নিজেদেরকে রাজা নামে ঘোষণা করতেন। গ্রিসের নগর-রাষ্ট্রগুলিতে এই প্রথা দীর্ঘকাল ধরে চলে আসছিল। কিন্তু পরে দেখা গেল একটি গোষ্ঠীর মধ্যে দলাদলি দেখা দেওয়ায় কোনো কোনো গোষ্ঠীতে একাধিক ব্যক্তি দলপতি হওয়ার দাবি জানায় এবং এইভাবে একাধিক দাবিদারের মধ্যে সংঘাত অনিবার্য আকার নেয়। প্রথমে বিরোধের সূত্রপাত হয় দলপতিদের মধ্যে এবং ক্রমে তা গোষ্ঠীগুলির মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে এবং শেষপর্যন্ত দুই বা ততোধিক গোষ্ঠীর মধ্যে বিরোধ একটি সাধারণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। গ্রিসের নগর-রাষ্ট্রের সমাজ-জীবনে নেমে আসে অস্থিতিশীলতার ঘনঘটা। খ্রি. পূ. চতুর্থ এবং তৃতীয় শতকে অনেক নগর-রাষ্ট্র ব্যাবসাবাণিজ্যের মাধ্যমে সমৃদ্ধিশালী হয়ে ওঠে। এক শ্রেণির মানুষ বিভিন্ন নগর-রাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য করে প্রচুর সম্পদের মালিক হয়, কিন্তু সকলের কপালে সেই সম্পদ আহরণ না জোটায় সম্পদহীন ও সম্পদশালীদের মধ্যে বিরোধ দেখা দিতে আরম্ভ করে। তা ছাড়া অনেক সম্পন্ন কৃষক অনেক ক্রীতদাস রেখে প্রচুর জমিজমা চাষ করে বিপুল সম্পদের মালিক হয় এবং তাদের সঙ্গে ব্যাবসাবাণিজ্য থেকে সম্পদ আহরণকারী ধনী গোষ্ঠীর লোকেদের বিরোধ দানা বাঁধে এবং কিছুকাল পরে তা প্রকাশ্যে আসায় বিবাদ একটি স্থায়ী বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়। আর-এক ধরনের বিরোধ গ্রিক সমাজে দেখা যেত। যেমন অতীতে বিভিন্ন গোষ্ঠীর দলপতি হওয়ার সুবাদে অনেকে নানা সুযোগসুবিধা ভোগ করত। পরে যারা ব্যাবসাবাণিজ্য করে সম্পদ সংগ্রহ
করল তারা ওইসব দলপতিকে অতীত থেকে চলে আসা সুযোগ থেকে বঞ্চিত করার দাবি জানাতে লাগল। ক্ষমতা ও সম্পদে নতুন গড়ে ওঠা গোষ্ঠী ও ব্যক্তিরা অতীতের দলপতি ও গোষ্ঠী থেকে কমজোরি ছিল না। নতুন গোষ্ঠী ও তাদের নেতারা পুরনোদের মর্যাদা এবং স্থান থেকে অপসারিত করার দাবি জানাতে লাগল এবং দাবি না মিটলে লড়াই-এর পথে তারা নামতে বাধ্য হল। এই লড়াইকে ক্রিস হার্মান (Chris Harman) পরম্পরাগত গোষ্ঠীর সঙ্গে নতুন তৈরি হওয়া গোষ্ঠীর বিরোধ নামে অভিহিত করেছেন। অতীতে দলপতিরা কয়েকজন অনুগত ব্যক্তিকে নিয়ে শাসন করতেন যাকে সংকীর্ণ গোষ্ঠীতন্ত্র বা oligarchy বলে। বিরোধের ফলে যে নতুন গোষ্ঠীর আবির্ভাব ঘটল সেই গোষ্ঠী সমাজের শাসনভার হাতে নেওয়ার দাবি জানায় এবং দাবি না মেটায় সংঘর্ষ দেখা দেয়। এই সংঘর্ষকে দুই বা ততোধিক গোষ্ঠীর মধ্যেকার সংঘর্ষ নামে গণ্য করা হয় এবং এই দ্বন্দ্ব সীমিত আকারে না থেকে ব্যাপকতা অর্জন করায় বহু নগর-রাষ্ট্রে বিক্ষিপ্তভাবে সংঘাত দেখা দিতে থাকে যা রাজনীতিক স্থিতিশীলতা এবং সামগ্রিকভাবে সামাজিক স্থিতিশীলতার ওপর আঘাত হানে। অনেক নগর-রাষ্ট্র সম্পদশালী সংকীর্ণ গোষ্ঠীর শাসনে চলে যায় কিন্তু তা রাজনীতিক স্থিতিশীলতার প্রতিশ্রুতি দিতে পারেনি। ধনীরা শাসনক্ষমতা হাতে পেয়ে পুরনোদের ক্ষমতা খর্ব করার কাজে আদা-জল খেয়ে নেমে পড়ে। একে আমরা নতুন বনাম পুরানোর লড়াই বলতে পারি। অতীত দিনের দলপতিরা সহজে স্থান ছেড়ে দিতে চায়নি। আর নতুনরা ক্ষমতা দখল না করে ছাড়বে না।

গণতন্ত্র বনাম সংকীর্ণ গোষ্ঠীতন্ত্র: প্রাচীন গ্রিসের অনেক নগর-রাষ্ট্রে গণতান্ত্রিক শাসন- ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল। কিন্তু সমাজের বিভিন্ন অংশ এবং গোষ্ঠীর মধ্যে সংঘর্ষ দেখা দেওয়ার ওই সমস্ত নগর-রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক কাঠামো সংকটের মধ্যে পড়ে এবং তাদের স্থিতিশীলতা নিয়ে সংশয় দেখা দেয়। কোথাওবা গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার পতন ঘটত। কেউ কেউ আবার গণতন্ত্রকে অশিক্ষিত লোকেদের শাসনব্যবস্থা বলে সমালোচনা করতেন। অনেক জায়গায় গোষ্ঠী-কোন্দলের দরুন গণতন্ত্রের পতন ঘটে এবং নগর-রাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থা সংকীর্ণ গোষ্ঠীর হাতে চলে যায়। যার ফলে অনেক জায়গায় স্বৈরতন্ত্র গণতন্ত্রের স্থান দখল করে নেয়। প্রাচীন গ্রিসের অনেক খ্যাতিমান পন্ডিত ও দার্শনিক গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার অন্তর্কলহের জন্য একে rule of the mob বা অনভিজ্ঞ সাধারণ মানুষের শাসন নামে অভিহিত করতেন। অ্যারিস্টটল তো গণতন্ত্রকে আদর্শ সরকারের শ্রেণিতে রাখেননি। যা হোক নানাবিধ কারণে প্রাচীন গ্রিসের নগর-রাষ্ট্রগুলিতে (সর্বত্র নয়) গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা স্থায়িত্বলাভ করার সুযোগ পায়নি। একে আমরা গণতন্ত্রের সংকট নামে গণ্য করতে পারি। প্রখ্যাত ঐতিহাসিক এইচ. জি. ওয়েলস বলেছেন: The Greek city-states had leaders and noble families, but no quasi-divine monarch surrounded by an elaborately organised court. Rather their organisation was aristocratic with leading families which kept each other in order. Even their so-called “democracies” were aristocratic, every citizen had a share in public affairs and came to the assembly in a democracy, but everybody was not a citizen. The Greek democracies were not like our modern “democracies” in which everyone has a vote. A Short History of the World, p. 94. প্রাচীন গ্রিসের নগর-রাষ্ট্রে এই জাতীয় গণতন্ত্র গড়ে উঠেছিল। ক্লিস হারমান বলেছেন নগর-রাষ্ট্রে যেসমস্ত ধনবান ও গণতন্ত্র বনাম সংকীর্ণ গোষ্ঠীতন্ত্র সম্পন্ন পরিবার বাস করত তারা গণতন্ত্রকে মেনে নিতে পারেনি। কারণ গণতন্ত্র মানে অশিক্ষিত সাধারণ মানুষের শাসন। এলিট সম্প্রদায়ের পরিবারগুলি সে-কারণে ষড়যন্ত্র করে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার বিলোপসাধনের ছক তৈরি করত। হারমান তাই বলেছেন: The upper classes did not simply express verbal resentment. When they could they staged armed seizure of power a full counter revolution. (p. 68). এই আলোচনা থেকে যে বিষয়টি বেরিয়ে আসছে তা হল ক্ষমতার লড়াই গ্রিক নগর- রাষ্ট্রগুলিকে গিলে ফেলেছিল। আর এই লড়াই-এ নেতৃত্ব দিত অভিজাত পরিবারের সদস্যরা। তারা জানত যে গণতন্ত্র স্থায়ী শাসনে পরিণত হলে সমস্ত প্রকার সুযোগ থেকে তারা বঞ্চিত হবে। ইতিহাস থেকে জানা যায় যে ক্ষমতার দ্বন্দ্বে এবং অন্যান্য কারণে প্রাচীন গ্রিসের নগর-রাষ্ট্রে গণতন্ত্র টিকে থাকতে পারেনি। দ্বন্দ্ব-বিপ্লব, প্রতি-বিপ্লব প্রভৃতি গ্রিক সমাজব্যবস্থার প্রধান বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আর এই গন্ডগোলে অভিজাত পরিবারের লোকেরা সংকীর্ণ গোষ্ঠীতন্ত্র স্থাপনের সুযোগ পেয়ে গিয়েছিল। ফলে রাজনীতিক চিত্রটি ছিল গণতন্ত্র বনাম সংকীর্ণ গোষ্ঠীতন্ত্র।

গ্রিসের রাজনীতিক প্রতিষ্ঠান ও আদর্শ: পণ্ডিতেরা প্রায়শই বলে থাকেন যে আধুনিক যুগে রাষ্ট্রচিন্তা নামে যা পরিচিত তার গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলির উৎস হল গ্রিক রাষ্ট্রচিন্তা এবং প্রাচীন গ্রিসে যেসমস্ত রাজনীতিক, প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছিল এবং সাফল্যের সঙ্গে কাজ করত’ সেইসব কাজ। প্রাচীন গ্রিসের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ রাজনীতিক প্রতিষ্ঠান হল প্রকাশ্য সভা (open assembly) – যা কেবল নাগরিকদের নিয়ে গঠিত হত। একজন গ্রিক- নাগরিকের বয়স ২০ বছর হলে সে প্রকাশ্য সভায় যোগ দিয়ে শাসনকার্য, আইন প্রণয়ন ও নীতি নির্ধারণ কাজে সরাসরি-অংশ নিতে পারত। এই প্রকাশ্য সভাকে গ্রিকদের ভাষায় Ecclesia বলা হত। বছরে দশবার প্রকাশ্য সভার অধিবেশন বসত এবং পাঁচশত-র পরিষদ-এর (Council of Five Hundred) অনুরোধে বিশেষ অধিবেশন আহ্বানের ব্যবস্থা ছিল। পন্ডিতেরা বলেন যে এই প্রকাশ্য সভার প্রচলন গ্রিসের যে-সমস্ত নগর-রাষ্ট্রে ছিল তাদের মধ্যে এথেন্স হল সর্বাগ্রগণ্য। বর্তমানে প্রকাশ্য সভায় মিলিত হয়ে আইন প্রণয়ন বা নীতি নির্ধারণের প্রথার ব্যাপকতা নেই। এখন জনগণের প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত আইনসভা এ কাজ করে। কিন্তু যে বিষয়টি আমাদের বিস্মিত করে তা হল প্রাচীন গ্রিসের রাজনীতিক প্রতিষ্ঠানের স্থপতিরা ২০ বছর বয়সকে প্রাপ্তবয়স্ক বলে মনে করতেন এবং বর্তমানকালেও তার ব্যাপকতা অক্ষুণ্ণ। এখন অবশ্য অনেক রাষ্ট্রে প্রাপ্তবয়স্কের বয়সসীমা কমিয়ে ফেলা হয়েছে। এই দুই-তিন বছর বয়স কমানো বড়ো কথা নয়। আড়াই হাজার বছর আগে গ্রিকরা প্রাপ্তবয়স্ক সম্বন্ধে যে ধারণা পোষণ করতেন তা আজও মোটামুটি বজায় আছে। প্রকাশ্য সভা ও পাঁচশত-র পরিষদ চুক্তি মতবাদের প্রখ্যাত প্রবক্তা রুশো প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র চালু করার কথা ভেবেছিলেন এবং তা অষ্টাদশ শতকের শেষভাগের ঘটনা। এ কথা সত্য, প্রাচীন গ্রিসে যে প্রকাশ্য সভার কথা বলা হয়েছে সেই সভায় কেবল নাগরিকরা যোগ দিতে পারত। ক্রীতদাস ও বিদেশিরা যোগদানের অধিকার থেকে বঞ্চিত ছিল। অথচ নগর-রাষ্ট্রের মোট জনসংখ্যার অর্ধেকের বেশি ছিল ক্রীতদাস ও বিদেশি। সুতরাং গ্রিসের প্রকাশ্য সভাকে প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র বললে সত্যের অপলাপ করা হবে। প্রকাশ্য সভার হাতে আইন রচনা ও নীতি স্থির করার দায়িত্ব থাকলেও প্রশাসনিক কাজের ভার পাঁচশত-র পরিষদের ওপর ন্যস্ত করা ছিল। একে বলা হত Council of Five Hundred। সমগ্র এথেন্সকে প্রায় ১০০টি অঞ্চলে ভাগ করে প্রতিটি অঞ্চল থেকে প্রতিনিধি নিয়ে এই পাঁচশত-র পরিষদ গঠন করা হত। এক-একটি অঞ্চল বা এলাকাকে demes বলা হত। পাঁচশত-র পরিষদ আজকালকার ভাষায় শাসনবিভাগ। স্যাবাইন বলেছেন: In substance the Council of Five Hundred was an executive and steering committee for the Assembly. লটারির মাধ্যমে ডেমেসগুলি পাঁচশত-র পরিষদে প্রতিনিধি নির্বাচন করত। ডেমেসগুলিকে স্থানীয় সরকারের নামাঙ্কিত সংস্থা বলা যেতে পারে। অথবা আজকালকার দিনে আমরা যে যুক্তরাষ্ট্রব্যবস্থার কথা বলে থাকি প্রাচীন গ্রিসের এই ডেমেসগুলি তারই ভিন্ন নাম। পরিষদের প্রধান কাজ ছিল আইনের খসড়া প্রস্তুত, বিদেশে রাষ্ট্রদূত প্রেরণ ও বিদেশের দূতদের গ্রহণ, প্রতিরক্ষা ‘ব্যবস্থার ওপর নজরদান, অপরাধীকে সাজা দেওয়া, সরকারি সম্পত্তি তদারকি করা ইত্যাদি, প্রকাশ্য সভা ও পরিষদ নিজেদের মধ্যে সম্পর্ক বজায় রেখে নগর-রাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থা পরিচালনা করত।

অন্যান্য প্রতিষ্ঠান:  প্রাচীন গ্রিসে বিশেষ করে এথেন্স-এ আদালত ছিল একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। স্যাবাইনের ভাষায়: The Athenian Courts were undoubtedly the keystone of the whole democratit system. আদালতের সামনে যে-সমস্ত মামলা রাখা হত আদালত তাদের মীমাংসা করে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করত। ফৌজদারি এবং দেওয়ানি, উভয়প্রকার মামলার বিচার আদালতকে করতে হত। কেবল বিচার-সংক্রান্ত কাজ যে আদালত করত তা নয়, আরও নানাধরনের কাজ আদালত করত যাদেরকে আইন ও প্রশাসন-সংক্রান্ত কাজ বলা যেতে পারে। আদালতের বিচারকগণ এক বছরের জন্য ৬০০০ প্রতিনিধিকে নিয়ে গঠিত প্যানেলের ভেতর থেকে মনোনীত হতেন এবং এই প্যানেলের (panel ) সদস্যরা ডেমেস-এর দ্বারা মনোনীত হতেন, যে-কোনো এথেনীয়র বয়স ৩০ বছর হলে তিনি আদালতের বিচারক হওয়ার জন্য যোগ্য বলে বিবেচিত হতেন। এথেনীয় আদালতের বিচারকের সংখ্যা ২০১-এর কম হত না। তবে সচরাচর সংখ্যা ৫০১-এ থাকত। এমনকি বিচারকের সংখ্যা ৫০১ ছাড়িয়ে যেত। আদালতের রায়কে চূড়ান্ত বলে মনে করা হত কারণ আপিল জানাবার প্রথা এথেন্সে স্বীকৃত ছিল না। আদালতের অন্যতম কাজ ছিল ম্যাজিস্ট্রেট হওয়ার আগে ওই পদের যোগ্য কি না তা আদালত বিচার করে দেখত। ম্যাজিস্ট্রেট কীভাবে তার কর্ম সম্পাদন করছেন তা আদালত দেখত। ম্যাজিস্ট্রেট জনসাধারণের অর্থ ব্যয় করার সময় অনিয়ম করেছেন কি না তা দেখা আদালতের কাজ ছিল। প্রকাশ্য সভা যেসব আইন প্রণয়ন করত তাদের যাথার্থ্য বিচারের ভার ন্যস্ত ছিল আদালতের ওপর। স্যাবাইন বলেছেন যে, আদালত কেবল মানুষের বিচার করত না, আইনেরও বিচার করত। এথেন্সের সামরিক কার্যাদি দেখাশোনার জন্য দশজন জেনারেলকে নিয়ে একটি সংগঠন তৈরি করা হয়েছিল। জেনারেলগণ জনসাধারণের দ্বারা নির্বাচিত হতেন এবং পুনরায় নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ পেতেন। এথেন্সের সার্বভৌমতা ও স্বাধীনতার প্রতি নজর দেওয়া ছিল জেনারেলদের প্রধান কাজ, ক্রীতদাস প্রথাকে এথেন্সের একটি প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা দেওয়া হয়। ক্রীতদাসদের গ্রিক সমাজব্যবস্থা থেকে স্বতন্ত্র করে দেখার অবকাশ নেই। সমাজের উঁচু শ্রেণির বিশেষ করে অবসরভোগী শ্রেণি যাতে বিদ্যাচর্চায় মনোনিবেশ করতে পারে তার জন্য ক্রীতদাস প্রথার প্রবর্তন করা হয়েছিল। অবশ্য আরও কারণ ছিল। অনেকে ক্রীতদাস প্রথাকে সমর্থন করে বলেন যে এরা অবসরভোগী শ্রেণিকে কায়িক পরিশ্রমের হাত থেকে অব্যাহতি দিয়ে পরোক্ষে বিদ্যাচর্চাকে সমৃদ্ধ করে গেছে। আজকের দিনে ক্রীতদাস প্রথা নিন্দনীয় হলেও প্রাচীন গ্রিসে তা নিন্দিত ছিল না। সামাজিক কাঠামো এমনভাবে গড়ে উঠেছিল যে ক্রীতদাস ছাড়া উচ্চশ্রেণির পক্ষে জীবনযাত্রা নির্বাহ করা অসম্ভব ছিল। ক্রীতদাসদের সংখ্যা প্রমাণ করে গ্রিসের সমাজব্যবস্থায় এর অবদান, তবে এর অন্ধকারাচ্ছন্ন দিকটি হল ক্রীতদাসরা সমাজের উচ্চবর্গের লোকেদের জন্য যে অমানুষিক পরিশ্রম করত তার বিনিময়ে তারা ন্যূনতম সুযোগসুবিধা থেকেও বঞ্চিত ছিল। যা হোক আর্নেস্ট বার্কার থেকে আরম্ভ করে রাষ্ট্রচিন্তার ব্যাখ্যাকারগণ একবাক্যে স্বীকার করেছেন যে গ্রিসের নগর-রাষ্ট্রের আর্থ-সামাজিক রাজনীতিক ব্যবস্থা আলোচনা করতে গেলে ক্রীতদাস নামক প্রতিষ্ঠানটিকে বিবেচনা করতেই হবে।

গণতান্ত্রিক আদর্শ : গ্রিসের কতগুলি নগর-রাষ্ট্রে প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রের ব্যবস্থ ছিল তা আমাদের জানা নেই। তবে এথেন্সে যে ছিল তা পন্ডিতদের অনুসন্ধান থেকে জানা যায় এবং অন্যান্য নগর- রাষ্ট্রেও ছিল। হয়তো তাদের সংখ্যা খুব বেশি ছিল না। গ্রিকরা মনে করত যে রাষ্ট্রের শাসনকাজে ও আইন প্রণয়নে প্রতিটি প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকের অংশগ্রহণের অধিকার অবশ্যই আছে এবং সে-কারণে সমস্ত সরকারি অফিস ও দায়িত্বকে আবর্তনমূলক করা হয়েছিল। সরকারি কর্মচারী মনোনয়নে বা নির্বাচনে যাতে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ না ওঠে সে কারণে লটারির মাধ্যমে নির্বাচন করা হত। অর্থাৎ এই ব্যবস্থা স্বজনপোষণ নীতিকে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়েছিল। স্যাবাইন বলেছেন Rotation in office, the filling of offices by lot and the enlargement of governing bodies even to unwieldiness were all designed to give more citizens a share in the government. (p. 13). সবাই আসুক সরকার পরিচালনায় অংশ নিতে আর গ্রিক নগর রাষ্ট্রের নাগরিকেরা চাইত যে তাদের গণতন্ত্র সত্যিকারে গণতন্ত্র হয়ে উঠুক। কে সরকারি পরিচালনে সক্ষম ও দক্ষ সে-বিচার গ্রিকরা করেনি। ধরে নেওয়া হত যে সবাই দক্ষ এবং সেই ধারণা অনুযায়ী প্রকাশ্য সভা, বিচারালয় প্রভৃতি সদস্যগণকে লটারি প্রথার মাধ্যমে মনোনীত করা হত। এই প্রথার যৌক্তিকতা নিয়ে আমরা প্রশ্ন তুলতেই পারি কিন্তু প্রাচীন গ্রিসে একে ত্রুটিহীন বলে মনে করা হত। গ্রিকরা জনগণের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য এই প্রথার প্রবর্তন করেছিল এবং এর ত্রুটির দিকটি তারা গ্রাহ্যের মধ্যে আনেনি। অবশ্য বিকল্প কিছু ছিল না। মূল্যবান রাজনীতিক জীবন প্রতিষ্ঠা করার জন্য গ্রিকরা নিজেদের মতো করে প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রের প্রবর্তন করেছিল। গ্রিকরা যেসব রাজনীতিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিল সেগুলির উদ্দেশ্য ছিল নাগরিক জীবনে, প্রশাসনে, আইন প্রণয়নে এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা, নিরপেক্ষতা ও সততা আনা। তারা ভাবত প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র গ্রিকদের দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করে তুলবে এবং দেশের জন্য সকলপ্রকার স্বার্থত্যাগ করতে পারবে বা প্রস্তুত থাকবে। গ্রিকরা নাগরিকের মর্যাদা প্রাপ্তিকে খুবই সম্মানের বিষয় বলে গণ্য করত। আর একটি অত্যন্ত উন্নতমানের আদর্শের উল্লেখ স্যাবাইন করেছেন। গ্রিকরা নগর-রাষ্ট্রকে আদর্শ ও মূল্যবোধের প্রতীক বলে মনে করত এবং সে-কারণে এর পরিচালনে অংশগ্রহণ তাদের নিকট ছিল অবশ্য পালনীয় কর্তব্য। For Greeks the city was a life in common, its constitution was a mode of life rather than a legal structure and consequently the fundamental thought in all Greek political theory was the harmony of this common life…. For the Greek the theory of the city was at once ethics, sociology, and economics, as well as politics in the narrower modern sense. (p. 13).

প্লেটো-পূর্ব কয়েকজন চিন্তাবিদ

পাশ্চাত্য রাষ্ট্রচিন্তার বিশ্লেষকগণের অনেকে মনে করেন যে প্লেটো থেকে গ্রিক রাষ্ট্রচিন্তার সূত্রপাত। কিন্তু প্রকৃত ঘটনা তা নয়। প্লেটোর অনেক আগে গ্রিসে নানা সময়ে অনেকে বিক্ষিপ্তভাবে রাষ্ট্র, আইন, ন্যায়বিচার, শাসক- শাসিতের সম্পর্ক ইত্যাদি বিষয় নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা- ভাবনা করেছিলেন। যাঁরা করেছিলেন তাদের মধ্যে সপ্ত প্রাজ্ঞ (Seven Sages)-এর নাম সবার আগে করতে হয়। সপ্ত প্রাজ্ঞরা হলেন: থালেস (Thales), পিট্টাকাস (Pittacas), পেরিআন্ডার (Periandar), বিয়াস (Bias), সোলোন (Solon), ক্লিওবুলুস (Cleobulus) এবং চিলো (Chilo)। খ্রি. পৃ. সপ্তম শতক থেকে খ্রি. পূ. ষষ্ঠ শতকের প্রথম কয়েক দশক অবধি এই সপ্ত প্রাজ্ঞরা প্রাচীন গ্রিসের রাষ্ট্রচিন্তা ও দর্শন বিষয়ে আলোচনা করতেন। সপ্ত প্রাজ্ঞদের কেউ কেউ মিশর, পারস্য প্রভৃতি অঞ্চল ভ্রমণে গিয়ে ওইসব দেশের আর্থ-সামাজিক-রাজনীতিক অবস্থা দেখে নিজেদের জ্ঞানভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করে তুলেছিলেন। থালেস মনে করতেন যে প্রাচুর্য ও দারিদ্র্য এই দুই অবস্থা পাশাপাশি শান্তিতে সহাবস্থান করতে পারে না। সে-কারণে শাসকদের উচিত কাজ হল সরকারি নিয়মের সাহায্যে এই দুই চরমাবস্থার অবসান ঘটিয়ে মধ্যপন্থা স্থির করে দেওয়া। সপ্ত প্রাজ্ঞরা চাইতেন যে সমাজের সকল শ্রেণি ও গোষ্ঠীর লোকেদের মধ্যে সমন্বয় (harmony) বজায় থাকুক এবং সরকার যদি তা করতে ব্যর্থ হয় তাহলে শ্রেণি-সংগ্রাম হবে অনিবার্য পরিণতি। সপ্ত প্রাজ্ঞদের সবাই বলতেন যে সকলের উচিত আইন মেনে চলা, তাঁদের শ্লোগান ছিল: “আইন মেনে চলো”। সর্বোৎকৃষ্ট রাষ্ট্র (Polis) হল সেই রাষ্ট্র যেখানে সবাই আইন মেনে চলে। পিট্টাকাস হলেন সপ্ত প্রাজ্ঞ-এর একজন। তিনি বলতেন আইন হল সার্বভৌম ক্ষমতাসম্পন্ন। আইনের ঊর্ধ্বে কেউ নয়। পিট্টাকাস আরও বলতেন যে অন্যকে নির্দেশ দেওয়ার আগে নিজে নির্দেশ পালন করো। সপ্ত প্রাজ্ঞ-এর কেউ কেউ ক্রীতদাস প্রথার ‘বিরোধী ছিলেন বলে ইতিহাস থেকে জানা যায়। সবাই যদি আইন মেনে চলে তাহলে দেশে স্বৈরাচারী শাসনের সূত্রপাত ঘটার সম্ভাবনা থাকবে না। সপ্ত প্রাজ্ঞ-এর একজন বলেছিলেন যে সর্বোৎকৃষ্ট রাষ্ট্র হল সেই রাষ্ট্র যেখানে সবাই নিষ্ঠাসহকারে আইন মেনে চলে-The best polis was the one where citizens obey the law. সপ্ত প্রাজ্ঞ-এর সদস্যরা মনে করতেন যে অপরাধীকে শাস্তি দিতেই হবে। তবে অপরাধী যাতে আর অপরাধে লিপ্ত হতে না পারে তার জন্য প্রয়োজন তাকে সংশোধন করা এবং সে ব্যবস্থা রাষ্ট্র করবে। তাঁরা একটি বাণী প্রচার করতেন এবং তা হল: Correct not only the offenders, but also those who are on the point of offending, সপ্ত প্রাজ্ঞরা আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন।

সোলোন:   সপ্ত প্রাজ্ঞ-এর একজন প্রাজ্ঞ হলেন সোলোন (খ্রি. পূ. ৬৩৮-৫৫৯) যিনি আর্থিক অবস্থার বিচারে একজন মধ্যবিত্ত ছিলেন এবং পরে উত্তরাধিকারসূত্রে কিছু পরিমাণ সম্পত্তির মালিক হন। সোলোন-এর সময়কার সমাজ নানা গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ে বিভক্ত ছিল এবং তাদের মধ্যে সংঘাত প্রায়ই লেগে থাকত। বহু দরিদ্র মানুষ দেনার দায়ে নিজেদের সম্পত্তি ঋণদাতাদের নিকট বিক্রি করতে বাধ্য হত এবং এর ফলে সমাজের গরিষ্ঠসংখ্যক নাগরিক সম্পত্তির মালিকানা হারাতে বাধ্য হয়েছিল এবং সোলোন আইনপ্রণেতা হয়ে সমস্ত ঋণ মওকুফ করে দেন যার ফলে যারা ঋণের দায়ে ক্রীতদাস হয়েছিল তাদের সেই দাসত্ব থেকে মুক্তি ঘটে এবং সোলোন এথেন্সকে ক্রীতদাসমুক্ত রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হন। এথেন্সে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য সোলোন খুবই তৎপর হয়েছিলেন। শাসক ও শাসিত সকলেই আইন অনুযায়ী কাজ করবে এবং আইন লঙ্ঘন করার সুযোগ কাউকে দেওয়া হবে না। আইনের কাজ হল দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন এবং আইন ও তার প্রয়োগ হবে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ। সমাজ আইন অনুযায়ী শাসিত হলে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পূর্ণ সুযোগ পাবে এবং সোলোন মনে করতেন যে সুচিন্তিত আইন এবং তার যথাযথ প্রয়োগই কেবল ন্যায়বিচার স্থাপনে পারঙ্গম। বলা বাহুল্য তাঁর আইন ও প্রয়োগবিষয়ক ধারণা এথেন্স-এ এক বৈপ্লবিক চিন্তা ও চেতনার উন্মেষ ঘটিয়েছিল। আইনের অনুপস্থিতি সমাজে অরাজকতা ডেকে আনে। এই সুযোগ সমাজে নানা গোষ্ঠীর মধ্যে সংঘাতের সূত্রপাত ঘটায়, অরাজকতা প্রগতির পথে প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। তিনি ব্যক্তি-মালিকানার বিরোধিতা করেননি কিন্তু এই প্রথা যেন সমাজে চরম বৈষম্যের পরিবেশ সৃষ্টি করে সংঘাতকে আমন্ত্রণ না জানায়, তাই তাঁকে ব্যক্তিমালিকানার ওপর বিধি সোলোন আরোপ পদ্ধতিকে সমর্থন করতে দেখি। দরিদ্র মানুষদের দারিদ্র্য থেকে মুক্তিদানের জন্য সোলোন ঋণ মকুবের প্রথা প্রবর্তন করলেও সাধারণ মানুষের অকুণ্ঠ সমর্থন লাভ করতে পারেননি কারণ তাঁর অনেক আইন ও পদক্ষেপ অভিজাত সম্প্রদায় ও ধনীদের অনুকূলে গিয়েছিল। ফলে তিনি সমাজের সবাইকে খুশি করতে পারেননি। কেউ কেউ মনে করেন যে সোলোন ‘অভিজাত শ্রেণি ও ধনী ব্যক্তিদের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন ছিলেন। তবে সমস্ত দোষত্রুটি সত্ত্বেও সোলোন আজও স্মরণীয়। এঙ্গেলস এক জায়গায় বলেছেন: Thus an entirely new element was introduced into the constitution: private property. The rights and duties of the citizens were graduated according to the amount of land they owned, as the propertied classes gained influence, the old groups were driving background. The gentile constitution suffered, Nersesyants. (p. 21).

পিথাগোরাস: পিথাগোরাস হলেন আর একজন প্লেটো-পূর্ব দার্শনিক যিনি জ্যামিতি, দর্শন ও নীতিশাস্ত্র সম্বন্দ্বে কতকগুলি মৌলিক ধারণা প্রচার করে গেছেন। তিনি (খ্রি.পৃ. ৫৮০-৫০০) একটি ধনী ব্যবসায়ী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। গ্রিসের বিভিন্ন জায়গা ভ্রমণ করে সমাজ, সংস্কৃতি, রাজনীতি ইত্যাদি বিষয়ে তিনি জ্ঞানার্জন করেন। যদিও তাঁর প্রধান উৎসাহ ছিল সংখ্যাবিষয়ে তবুও পরে তিনি রাজনীতিতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। পিথাগোরাস দ্বান্দ্বিকতা নীতি সর্বপ্রথম প্রচার করেন বলে পণ্ডিতেরা বলেন। তিনি দশ জোড়া বৈপরীত্যের কথা বলেছেন, এরা হল: সীমা ও অসীম, জোড় ও বিজোড়, এক ও বহু, ডান ও বাম; পুরুষ ও নারী; চলমানতা ও নিশ্চলতা, সোজা ও বাঁকা, আলো এবং অন্ধকার, ভালো ও মন্দ, চতুষ্কোণ এবং অ-চতুস্কোণ। তাঁর মতে এই বিপরীত গুলির মধ্যে দ্বন্দ্ব অনিবার্য। তবে দ্বন্দ্ব মানে ধ্বংসাত্মক কিছু নয়, অথবা আলো থেকে অন্ধকারে যাওয়া নয়। দ্বন্দের অর্থ হল সংগ্রাম যা প্রগতির দ্যোতক। এই পরস্পরবিরোধী বিষয়গুলি আছে বলেই সমাজ প্রতিনিয়ত সচলতা পাছে এবং এগিয়ে চলছে। পরে দ্বান্দ্বিকতাকে ইতি ও নেতি দিয়ে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। পিথাগোরাস এবং তাঁর অনুগামীরা মনে করতেন যে সমাজের সবচেয়ে বড়ো শত্রু হল নৈরাজ্য। যে-সমাজে আইনের শাসন নেই সেই সমাজে শান্তি বাস করতে পারে না। আর শান্তি-শৃঙ্খলা ও প্রগতি সুনিশ্চিত করতে হলে দরকার আইন ও তার যথাযথ প্রয়োগ। মানুষের স্বভাব খুবই জটিল। অস্থিতিশীল ও আবেগপূর্ণ। তারে নিয়ন্ত্রণ করতে হলে দরকার স্পষ্ট আইন ও তার যথাযথ প্রয়োগ। সে-কারণে তিনি আইনের শাসনের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিলেন। মানুষকে সঠিকপথে পরিচালিত করে সমাজের বিকাশ ঘটাতে হলে একজন দক্ষ শাসক বা নেতার প্রয়োজন। আবার কেবল একজন দক্ষ প্রশাসক হলে চলবে  না, তাকে মানবিক হতে, হবে। জনসাধারণের সমস্যা বুঝে তার সমাধান একজন দক্ষ প্রশাসক করবেন। সমাজের সকল শ্রেণিঃ মানুষের মধ্যে যাতে সদ্ভাব গড়ে ওঠে শাসক তা অবশ্যই করবেন। সম্ভাব না থাকলে সমাজের বিকাশ বিঘ্নিত হবে। সবকিছু বিচার করার পর পিথাগোরাস এই সিদ্ধান্তে উপনীয় হয়েছিলেন যে অভিজাততন্ত্রই হল সবচেয়ে ভালো সরকার। যারা দক্ষ এবং বহু বিষয়ে পারদর্শী কেবল তারাই একা দেশকে সুশাসনে রাখতে পারে। তিনি ও তাঁর অনুগামীর গণতন্ত্রের প্রতি আস্থাশীল ছিলেন না কারণ দক্ষতার সঙ্গে শাসনকার্য পরিচালনা করা সাধারণ মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। জনসাধারণের মতের ওপর আস্থাশীল হওয়া অনুচিত কারণ সাধারণ মানুষ মতপ্রকাশে সক্ষম নয়। অন্যান্য প্রিয় পন্ডিতদের মতো পিথাগোরাস ও তাঁর অনুগামীরা রাষ্ট্রে ন্যায়বিচার স্থাপনের কথা ভেবেছিলেন। আর আইন ছাড়া ন্যায়বিচার কোনোভাবে সম্ভব নয়। কেবল আইনের যথাযথ প্রয়োগ সমাজের সকলের মধ্যে সম্প্রীতি আনতে পারে পিথাগোরাস একটি ত্রুটিহীন আদর্শ সমাজ স্থাপন করার কথা বলেছিলেন, আইনের শাসন, ন্যায়বিচার, নৈতিকতা ইত্যাদি থাকলে তবেই তা হবে আদর্শ সমাজ।

হেরাক্লিটাস: পিথাগোরাস ছাড়া আর একজন গ্রিক দার্শনি দ্বান্দ্বিকতার সাহায্যে সমাজ, রাজনীতি, দর্শন ইত্যাদি সবকিছু বিশ্লেষণ করতেন এবং তিনি হলেন হেরাক্লিটাস (Heraclitus BC 530-470)।-তিনি বিশ্বের কোনো কিছুকে পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন বলে মনে করতেন না, সমগ্র বিশ্বের সবকিছুই পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল এবং তাদের মধ্যে একটি অবিমিশ্র ও নিরন্তর মিথস্ক্রিয়া চলছে। সুতরাং আমরা যাকে ক্ষুদ্র সমাজ বা রাষ্ট্র নামে অভিহিত করি আসলে তা মহাবিশ্ব (cosmos) থেকে স্বতন্ত্র নয়। প্রতিটি শক্তি বা বিষয়ের মধ্যে নিরন্তর ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়া চলছে এবং তা সম্ভব হচ্ছে সারা বিশ্বে যেসব ঘটনা বা শক্তি রয়েছে তারা সবাই পরস্পরবিরোধী। আর এজন্যই তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব বা সংঘাত দেখা দিচ্ছে। দিন ও রাত্রি, ভালো এবং মন্দ, সোজা এবং বাঁকা এরা বৈশিষ্ট্যে বা চরিত্রে আলাদা হলেও আসলে এক। তবে বৈপরীত্যের কারণে এদের মধ্যে সংঘাত দেখা যায়। The road up and road down are one and the same. পিথাগোরাস-এর মতো হেরাক্লিটাস গণতন্ত্রকে অযোগ্য লোকের শাসন বলে মনে করতেন এবং সে-কারণে তিনি এই জাতীয় সরকারের বিরোধিতা করেছিলেন। তাঁর মতে অভিজাততন্ত্র হল সর্বোৎকৃষ্ট শাসন কারণ যোগ্য লোকেরাই যোগ্যতার সঙ্গে শাসন চালাতে পারে। তবে অভিজাততন্ত্র যদি বংশগতির ধারা অনুযায়ী চলে তাহলে সেই অভিজাততন্ত্রকে স্বীকার করা যায় না। অভিজাত বলতে জ্ঞানে, বুদ্ধিতে, মেধায়, দক্ষতায় আচরণে আভিজাত্য থাকবে এবং এগুলি যেসব ব্যক্তির মধ্যে দেখা যায় কেবল তারা শাসন পরিচালনার অধিকারী। আবার he had little sympathy for the nobles who took for granted all their privileges, the political ones inclusive, as a natural endowment, as something belonging to them by the right of birth। সর্বশক্তিমান ভগবান বা মহাবিশ্ব রাষ্ট্র (polis)-কে পরিচালিত করছে। আর সেখান থেকে উৎসারিত আইন, polis, ন্যায়বিচার এবং সমাজ শাসনের যাবতীয় উপকরণ। সুতরাং মহাবিশ্বকে অগ্রাহ্য করে polis বা রাষ্ট্র শাসিত হতে পারে না। আবার মহাবিশ্ব পরিচালিত হচ্ছে সর্বশক্তিমান ভগবানের নির্দেশে। তবে সাধারণ মানুষ মহাবিশ্ব ও ভগবানের নির্দেশটি মাথায় রেখে আইন প্রণয়ন ও শাসনকার্য পরিচালনা করবে। আর এই কাজ কেউ না করলে সমাজের ওপর নেমে আসবে বিশৃঙ্খলা ও অবিচার এবং তার ফলভোগ সবাইকে করতে হবে। অন্যান্য প্লেটো-পূর্ব দার্শনিকের মতো হেরাক্লিটাস-এর রাজনীতিক দর্শনের প্রধান উপাদান হল আইন, শৃঙ্খলা, ন্যায়বিচার এবং যোগ্য শাসক। তাঁর মতে সারা বিশ্ব দ্বান্দ্বিক নিয়মে চলছে এবং সেখানে রয়েছে আইনের শাসন যার ফলে ন্যায়বিচার লঙ্ঘিত হওয়ার সম্ভাবনা নেই। তেমনি মানবসমাজ যদি আইন অনুযায়ী এবং বিশ্বব্রহ্মান্ডের নির্দেশ- মতো চলে তাহলে এখানেও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হবে। তবে যোগ্য মানুষকে সেই কাজ সম্পাদন করার জন্য নিয়োগ করা দরকার। গণতন্ত্রের প্রবর্তন বা অযোগ্যের ওপর দায়িত্ব অর্পণ সেই লক্ষ্যসাধনে অক্ষম।

ডেমোক্রিটাস: প্লেটো-পূর্ব চিন্তাবিদদের মধ্যে ডেমোক্রিটাস (খ্রি. পূ. ৪৬০-৩৭০) একমাত্র ব্যক্তি যিনি দর্শনচিন্তার পাশাপাশি রাজনীতি নিয়েও গভীরভাবে ভেবেছিলেন। এখন আমরা যাকে রাষ্ট্রচিন্তা বলি তার অনেকগুলি দিক তাঁর চিন্তায় স্থান পেয়েছিল। তাই তাঁকে একজন encyclopedic thinker and one of the most prolific writers of antiquity. নামে অভিহিত করা হয়েছে। তাঁর ধারণায় মানবসমাজের উদ্ভব ঘটেছে বিবর্তনের ফলে। আদিতে সমাজ ছিল প্রাকৃত অবস্থায় এবং আস্তে আস্তে তার বিবর্তন তাকে বর্তমান অবস্থায় এনে হাজির করেছে। তবে এই বিবর্তনে মানুষের দক্ষতা ও প্রতিভা সক্রিয়ভাবে উপস্থিত ছিল। তিনি আরও বলেছেন প্রয়োজনই মানুষকে সমাজ গড়ে তোলার কাজে সাহায্য করেছে। তিনি ন্যায়বিচার ও প্রকৃতিকে সমগোত্রীয় বলে গণ্য করতেন। তাঁর নিকট প্রকৃতি ছিল ন্যায়বিচারের প্রতীক। প্রকৃতিতে অন্যায় নেই এবং ন্যায়বিচার বিরাজ করে বলে সবার উচিত প্রকৃতিকে অনুসরণ করে সমাজ গঠন করা ও তার শাসনের দায়িত্ব নেওয়া। মনুষ্যসমাজের উচিত প্রকৃতিকে অনুসরণ করে সামাজিক আইনকানুন রচনা করা। স্বাধীনতা সম্পর্কে তাঁর ধারণা হল প্রথা (convention) এবং কৃত্রিম বিধিনিষেধ থেকে মুক্তি। এগুলি মানুষকে স্বাধীন ও গঠনমূলকভাবে চিন্তা করতে দেয় না। প্রাকৃতিক নিয়ম- কানুন প্রথাগত নিয়মের ওপরে এবং সমাজের কর্ণধারগণের উচিত প্রাকৃতিক নিয়ম অনুসরণ করে সমাজ শাসন করা। সম্পত্তির ওপর যৌথ বা সকলের মালিকানা ধারণাটি তিনি গ্রহণ করেননি। কারণ যৌথ মালিকানাধীন সম্পত্তি সঠিকভাবে পরিচালিত হয় না। ডেমোক্রিটাস পোলিসকে সুন্দরভাবে পরিচালিত করার কথা বলেছিলেন কারণ কেবল এই ধরনের রাষ্ট্রই জনগণের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ও সমৃদ্ধি নিশ্চিত করতে পারে। একটি সুপরিচালিত রাষ্ট্রের লক্ষ্য হবে গোষ্ঠীস্বার্থকে উপেক্ষা করে সামগ্রিক স্বার্থকে প্রাধান্য দেওয়া। তাঁর লেখায় আমরা ‘অভিন্ন স্বার্থ’ কথাটি পাই যা পরবর্তীকালে রুশো ‘সাধারণ ইচ্ছা’ নাম দিয়ে একটি তত্ত্ব প্রচার করেছিলেন। ডেমোক্রিটাস রাষ্ট্রকে একটি নৈতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেখতে চেয়েছিলেন এবং তার নিকট এটি কেবল একটি আইনি প্রতিষ্ঠান ছিল না। আমরা জানি রুশো রাষ্ট্র সম্বন্ধে একই ধারণা পোষণ করতেন। তিনি রাষ্ট্রকে একটি moral person বলেছিলেন। রাষ্ট্রের সঙ্গে ব্যক্তির সম্পর্ক কেবল আইনের নিগড়ে বাঁধা নয়। আনুগত্যের ধারণাটি নিয়ে ডেমোক্রিটাস’ খুবই চিন্তা-ভাবনা করেছিলেন। তিনি মনে করতেন যে-রাষ্ট্র যদি সুচারুরূপে নীতি, মূল্যবোধ প্রভৃতিকে সামনে রেখে আইন প্রণয়ন করে তাহলে নাগরিকের উচিত সেই আইনের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করা। কেবল আদর্শবান, সৎ, দক্ষ শাসকই প্রকৃত নাগরিক তৈরি করতে পারে। আইন সম্পর্কে তিনি যেসব কথা বলেছিলেন সেগুলির প্রাসঙ্গিকতা আজও পুরোমাত্রায় বজায় আছে। মানুষের মন যদি উন্নত, দুর্নীতিমুক্ত না হয় তাহলে সমাজে নানা সমস্যা দেখা দেবে এবং বিরোধ সমাজকে দূষিত করে ফেলবে। অপরাধ ও অপরাধীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে। রাষ্ট্রের উচিত কাজ হবে অপরাধীকে শাস্তি দিয়ে এমন দৃষ্টান্ত স্থাপন করা যাতে অন্যেরা অপরাধ করতে সাহস না পায়।

সক্রেটিস:  মানবজাতির ইতিহাসে সবচেয়ে খ্যাতিমান পন্ডিত সক্রেটিস (খ্রি. পৃ. ৪৬৯-৩৯৯)। অন্যান্য গ্রিক চিন্তাবিদদের মতো সক্রেটিস দ্বান্দ্বিকতাকে দর্শন ও অন্যান্য বিষয় বিশ্লেষণের নিমিত্ত নির্বাচন করে’ নিয়েছিলেন। গ্রিসের অ্যাপোলো মন্দিরে লেখা ছিল know thyself  নিজেকে চেনো। এই লেখাটি তাঁর মনে এক নতুন চিন্তার ঝলক এনে দেয়। ছোটোবেলা থেকে তিনি রাষ্ট্র, আইন, ন্যায়বিচার, রাজার কর্তব্য, নাগরিকের দায়দায়িত্ব ইত্যাদি নানা বিষয়ে আগ্রহী হয়েছিলেন। ডেমোক্রিটাস, হেরাক্লিটাস প্রমুখদের মতো সক্রেটিস গ্রিক নগর-রাষ্ট্র বা পোলিস-এর সুশাসন ও শ্রীবৃদ্ধির জন্য আইনকে অন্যতম কারক বা উপাদান বলে মনে করতেন। পোলিস (polis)-এর ভিত্তি হল আইন। অন্যান্য দার্শনিকের মতো তিনি পোলিসকে একটি নৈতিক প্রতিষ্ঠান বলে গণ্য করতেন এবং এরকম একটি নৈতিক সংগঠন আইন ছাড়া সুশাসিত হতে পারে না। তিনি আইনকে দুটি ভাগে ভাগ করেছিলেন একটি হল প্রাকৃতিক আইন (natural law) এবং অন্যটি হল ইতিবাচক (positive) আইন যা মানুষ রচনা করে। আবার তাঁর মতে অলিখিত আইন হল দৈব আইন। সমাজে ন্যায়বিচার স্থাপন করতে হলে দু- প্রকার আইন দরকার কারণ আইন ছাড়া ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। Justice is nothing but the observance of the laws, তিনি আরও বলেছিলেন-All that is rational is real and all that is real is rational, আমরা জানি পরে হেগেল এটি তাঁর দর্শন ব্যাখ্যার জন্য গ্রহণ করেছিলেন। আইনের প্রতি অকৃত্রিম আনুগত্য ব্যতীত পোলিস টিকে থাকতে পারে না এবং ন্যায়বিচারের প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। রাষ্ট্র এবং নাগরিক উভয়কে আইনের প্রতি দ্বিধাহীন আনুগত্য দেখাতে হবে। তাহলে দেখা যাচ্ছে যে সক্রেটিস রাষ্ট্র বা পোলিসের শ্রীবৃদ্ধি, স্থিতিশীলতা, ন্যায়বিচার এবং আইনকে একসঙ্গে বিশ্লেষণ করেছেন। তিনি সরকারকে এই ভাগগুলিতে বিভক্ত করেছিলেন-রাজতন্ত্র, অভিজাততন্ত্র, স্বৈরতন্ত্র, ধনিকতন্ত্র ও গণতন্ত্র। আইন অনুযায়ী যে রাষ্ট্র শাসিত হয় তাকে রাজতন্ত্র বলে। তবে শাসক কারা হবে তা তাদের মত নিয়ে স্থির করা হবে। অর্থাৎ রাজতন্ত্রে শাসক ও শাসিতের মধ্যে ঐকমত্য থাকবে। কিন্তু স্বৈরতন্ত্রে শাসিতের মতামত নেওয়ার সুযোগ নেই। অনিচ্ছুক জনগণের ওপর একজন বা একাধিক শাসক জোর করে মত চাপিয়ে দেয়। অল্প কয়েকজন ব্যক্তি আইন অনুযায়ী শাসন করার প্রতি নজর দিলে তা অভিজাততন্ত্র হয়। কয়েকজন ধনী যদি শাসকের আসনে বসে তখন তাকে ধনিকতন্ত্র বলা হয়। সাধারণ মানুষের শাসন হল গণতন্ত্র। তাঁর এই শ্রেণিবিন্যাস প্লেটো এবং অ্যারিস্টটলের ওপর প্রবল প্রভাব ফেলেছিল। সক্রেটিস গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার প্রতি সমর্থন জানাতে পারেননি কারণ এটি ছিল অযোগ্যের শাসন। তবে যোগ্য, শিক্ষিত ও বিচক্ষণ ব্যক্তিরা শাসনক্ষমতায় বসুক তাই তিনি চাইতেন। বংশানুক্রমে শাসন করার প্রথার তীব্র বিরোধী ছিলেন। দুর্নীতিকে তিনি রাষ্ট্রের পতনের অন্যতম কারণ হিসেবে মনে করতেন এবং সে কারণে কঠোর হাতে দুর্নীতি দমনের কথা বলেছিলেন। এথেনীয় সমাজের পতনের অন্যতম কারণ হল দুর্নীতি। তিনি একটি ঐক্যবন্ধ পোলিসের অস্তিত্ব ভেবেছিলেন এবং তার জন্য তিনি যে সুপারিশ করেছিলেন তা হল প্রতিটি নাগরিক পোলিস ও আইনের প্রতি আনুগত্য দেখাবে। তাঁর মতে প্রতিটি ব্যক্তি পোলিসের সদস্য হচ্ছে এই শর্তে যে সে এর আইনকানুন মেনে চলবে। একে সামাজিক চুক্তি মতবাদ বলে। পুরুসমাজের সদস্য হওয়ার চুক্তিতে আবদ্ধ বলে সে এর আইন মেনে চলতে বাধ্য, একজন সৎ নাগরিকের কর্তব্য হল আইন মেনে চলা। অবশ্য তার সমালোচনা করারও অধিকার আছে। নাগরিক প্রয়োজনে আইনের রদবদল করতে পারে। কিন্তু আইন অমান্য করে অরাজকতা সৃষ্টি করতে পারে না।

একটি মূল্যয়ন:  প্লেটো ও, তাঁর উত্তরসূরিরা রাষ্ট্রতত্ত্ব, রাষ্ট্রনীতি এবং অন্যান্য আনুষঙ্গিক বিষয়ের ওপর যে-সমস্ত আলোচনা করেছিলেন সেগুলির অধিকাংশই প্লেটো-পূর্ব চিন্তাবিদগণের লেখায় পাওয়া যায়। যেমন প্লেটো দ্বান্দ্বিক পদ্ধতি প্রয়োগ করে ‘রিপাবলিক’ গ্রন্থে যেসব আলোচনা করেছেন সেই দ্বান্দ্বিকতা তাঁর একাধিক পূর্বসূরি সে-বিষয় নিয়ে আলোচনা করে গেছেন। পিথাগোরাস আলোচনাকালে আমরা দেখেছি যে তিনি দশ জোড়া উপাদানের কথা বলেছেন যেগুলি পরস্পরবিরোধী এবং এদের মধ্যে যে ক্রিয়া এবং মিথস্ক্রিয়া ঘটে তা দ্বান্দ্বিকতার নামান্তর। হেরাক্লিটাস ও ডেমোক্রিটাস এঁরাও দ্বান্দ্বিক পদ্ধতি প্রয়োগ করে দর্শন, রাজনীতি ও অন্যান্য বিষয় আলোচনা করে গেছেন। গ্রিক দার্শনিকদের দ্বান্দ্বিকতা পরবর্তীকালে হেগেল ও মার্কস অনুসরণ করে যেভাবে ইতিহাস ও সমাজবিকাশ বিশ্লেষণ করেছেন তা থেকে আমরা অনুমান করতে পারি যে দ্বান্দ্বিকতা প্রয়োগ করে পিথাগোরাস, হেরাক্লিটাস ও ডেমোক্রিটাস চিন্তাজগতে বিপ্লব তৈরি করে গেছেন এবং প্লেটো-পূর্ব চিন্তানায়কগণ অন্য যেসমস্ত ধারণার সূত্রপাত করে গেছেন সেগুলি আমরা বিস্মৃত হলেও দ্বান্দ্বিকতার ক্ষেত্রে তাঁদের অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। আইন সম্বন্ধে ডেমোক্রিটাস-এর বক্তব্য, আজও সমুজ্জ্বল। একে আমরা আইনের পরমলক্ষ্যবাদ তত্ত্ব teleological theory of law)  বলতে পারি, ডেমোক্রিটাস- The aim of law is to benefit human life, but it can only do so when men are willing to accept   its benefits, it reveals its excellence to who   obey. বিশ শতকের প্রথম ভাগে হ্যারল্ড ল্যাস্কি এই পরমলক্ষ্যবাদ তত্ত্বটি প্রচার করেন। তাঁর আগে ইংরেজ ভাববাদী গ্রিন, ভাববাদী দৃষ্টি দিয়ে এই প্রচার করেছিলেন। আবার কেউ কেউ বলেন যে  Democritus was an outstanding precursor of Socrates. হেরাক্লিটাস যেসব দার্শনিক তত্ত্ব প্রচার করেছিলেন সেগুলি exerted profound legal influence on subsequent political and legal thought. সক্রেটিস ও প্লেটো বলেছিলেন যে কেবল দক্ষ ও বিজ্ঞ লোকেদের হাতে প্রশাসনের দায়িত্ব অর্পণ করা উচিত। বলা বাহুল্য তাঁদের আগে হেরাক্লিটাস একই কথা বলেছিলেন। আজ থেকে আড়াই হাজার বছর আগে পণ্ডিতেরা ভাবতেন যে কেবল যোগ্যরাই শাসন চালাতে পারেন। আজ আমরা গণতন্ত্র পেলেও হেরাক্লিটাস, সক্রেটিস ও প্লেটোর ধারণা বাতিল হয়নি। ‘The Open Society and its Enemies’ বইতে কার্ল পপারকে বলতে শুনি: Hegel, the source of all contemporary historicism was a direct follower of Heraclitus, Plato and Aristotle. প্রকৃতির রাজ্যে এবং সমাজের সমস্ত স্তরে যে দ্বন্দ্ব দেখা যায় তাকে হেরাক্লিটাস বিশ্বজনীন বলে ঘোষণা করেছেন। আজও অনেককে বলতে শোনা যায় যে, সামাজিক ডারউইনবাদ (Social Darwinism) বলে যে ধারণা গড়ে উঠেছে তার উদ্ভব হেরাক্লিটাস-এর হাতে। পরস্পরবিরোধী শক্তিসমূহের মধ্যে যে সংঘাত দেখা যায় তার মাধ্যমেই সমাজের বিকাশ ঘটছে। মার্কস এই সমাজ-বিকাশের স্তরগুলি দ্বান্দ্বিক নিয়মের সাহায্যে ব্যাখ্যা করেছেন। কিন্তু জনৈক বিশ্লেষকের ধারণা হল অনেক আগে হেরাক্লিটাস সামাজিক ডারউইনবাদ ধারণাটির অবতারণা করে গেছেন। আজকাল আমরা সবাই বিবর্তনবাদকে রাষ্ট্রের উৎপত্তির অন্যতম হেতু বলে মনে করি। ডেমোক্রিটাস তো সেই বিবর্তনবাদ তত্ত্বট প্রচার করে গেছেন। তিনি প্রয়োজনকে সামাজিক প্রগতির কারণ বলেছেন যা আজকাল অনেকেই বলে থাকেন।

প্লেটো (Plato)

Identifications of a direct relationship between politics and virtue is one of the central themes of the Western tradition of political thought. This tradition originated in the writings of Plato and Aristotle. John Morrow, A History of Political Thought-A Thematic Introduction p. 51.

Plato was the first person in the history of the world to produce a great all embracing system of philosophy, which has its ramifications in all departments of thought and reality. Stace, p. 164.

প্লেটোর জীবনী, রাজনীতি, সততা ও রাষ্ট্রচিন্তা

প্লেটোর জীবনী ও সময়কাল: প্লেটোর প্রকৃত জন্মতারিখ নিয়ে পন্ডিতদের মধ্যে মতভেদ থাকলেও খ্রি. পূ. ৪২৯-৪২৭’ এর মধ্যে যে তাঁর জন্ম হয়েছিল সে-বিষয়ে সন্দেহ নেই। তবে অধিকাংশ পন্ডিত মনে করেন যে ৪২৭ খ্রি. পূ-তেই তাঁর জন্ম হয়েছিল। তিনি তাঁর শিক্ষা ও জীবন দর্শনের দিশারি সক্রেটিস-এর চেয়ে বয়সে বেশ ছোটো ছিলেন। সক্রেটিস-এর জন্ম ৪৬৯ খ্রি. পূ.-এ। এথেন্সের এক অভিজাত পরিবারে তাঁর জন্ম। ছোটোবেলায় তাঁর জীবনে কতকগুলি ঘটনা ঘটে গিয়েছিল। প্লেটোর এক কাকা সেই সময়কার কুখ্যাত ‘তিরিশ স্বৈরাচারী- দের’ মধ্যে একজন ছিলেন এবং সেই সুবাদে স্বৈরতন্ত্রের সঙ্গে তাঁর সম্যক পরিচয় ঘটে। প্লেটোর কাকা তিরিশজন স্বৈরাচারী শাসকের  একজন হলেও সফিস্ট (Sophist) গোষ্ঠীর সঙ্গে তাঁর সদ্ভাব ছিল। ফলে সফিস্ট বা যুক্তিদর্শন- বিদদের সঙ্গে প্লেটোর পরিচয় ঘটে। এখান থেকে প্লেটো সক্রেটিস-এর সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পেয়ে যান। সক্রেটিস-এর সঙ্গে তাঁর যে কেবল পরিচয় হয়েছিল তা নয় তাঁর জীবন ও দর্শন সক্রেটিস-এর প্রভাবে পড়ে অনেকখানি বদলে গিয়েছিল। কাকার মাধ্যমে প্লেটো জানতে পারেন যে স্বৈরাচারী শাসন কী পরিমাণ ভয়াবহ। একেবারে ছোটোবেলা থেকে তাই তিনি স্বৈরতন্ত্রের ঘোর বিরোধী ছিলেন। এথেন্সে স্বৈরতন্ত্রের অবসান ঘটলেও অবস্থার বিশেষ পরিবর্তন হয়নি। কারণ গণতন্ত্র স্বৈরতন্ত্রের স্থান দখল করে গণতান্ত্রিক সরকার সক্রেটিসকে ৩৯৯ খ্রি. পূ.-এ মৃত্যুদণ্ডে দন্ডিত করে। গুরুর এই চরম পরিণতি প্লেটোর মনে গভীর রেখাপাত করে। আগেই তিনি স্বৈরতন্ত্রের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েছিলেন, পরে সক্রেটিসকে এইভাবে অকালে এবং বিনা অপরাধে প্রাণ দিতে হওয়ায় প্লেটো খুবই হতাশ হয়ে পড়েন। স্বৈরতন্ত্র, গণতন্ত্র ও অন্যান্য শাসনব্যবস্থাকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে, ন্যায় ও সততার ওপর প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা চালিয়েছিলেন। কিন্তু কোথাও তিনি সাফল্যের মুখ দেখতে পাননি। তিনি চেয়েছিলেন যে রাজনীতি সততা, নিষ্ঠা এবং ন্যায়বোধের ওপর গড়ে উঠবে। এই চিন্তা মাথায় রেখে এথেন্সের “শ্যামল উপকণ্ঠে যা পুরাণের বীর আকাদেম নামাঙ্কিত, সেখানে প্লেটো একটি কুঞ্জবন সংগ্রহ করে স্থাপন করেন নিজের বিদ্যালয়-প্রখ্যাত আকাদেমি যা চালু ছিল ১০০০ বছর (৫২৯ অব্দে সম্রাট ইউস্টিনিয়ান তা বন্ধ করে না দেওয়া পর্যন্ত)- ‘রাজনীতিক মতবাদের ইতিহাস’; প্রথম খণ্ড, পৃ. ১২৩।

রাজনীতি ও সততা বা মূল্যবোধ:   প্লেটোর রাষ্ট্রচিন্তা ও দর্শনের ওপর তাঁর পূর্বসূরিদের অনেকের সরাসরি প্রভাব ছিল। কিন্তু সবচেয়ে বেশি প্রভাব ছিল সক্রেটিস-এর। পন্ডিতেরা যদিও প্রায়ই বলে থাকেন, রাজনীতি যে সততা বা মূল্যবোধ (values) বর্জিত নয় এই ধারণাটি প্লেটো ব্যাপকভাবে তাঁর রাষ্ট্রচিন্তায় স্থান দিয়ে গেছেন। কিন্তু তাঁর পূর্বসূরিদের দর্শন ও রাজনীতিক চিন্তা বিশ্লেষণ করলে আমরা জানতে পারি যে প্লেটোর শিক্ষক সক্রেটিস এই বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিশ্লেষণ করে গেছেন। এমনকি সক্রেটিস-এর আগেই কেউ কেউ এই বিষয়টির ওপর আলোকপাত করেছেন। সক্রেটিস মনে করতেন যে রাজনীতি, মূল্যবোধ বা সততা বর্জিত হবে না। একেবারে ছোটোবেলা থেকে প্লেটো রাজনীতিতে আগ্রহী ছিলেন এবং খুবই মনোনিবেশসহকারে রাজনীতিক ঘটনাবলি বিশ্লেষণ করতেন। সমকালের মূল্যবোধ রাজনীতিক ঘটনা বিশ্লেষণ করার পর তাঁর মনে এই প্রত্যয় জন্মেছিল যে: The consequences of divorcing politics from virtue could be seen in the instability, moral dissolution and political unscrupulousness that Plato thought disfigured contemporary politics. Morrow, p. 53. রাজনীতিকে যদি সঠিকপথে পরিচালিত ও কর্তব্য সম্পাদনে সক্ষম করে তুলতে হয় তাহলে বিশেষ উপায় হল একে সততা বা মূল্যবোধের সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত করতে হবে। তা করতে না পারলে রাজনীতি অবশ্যই বিপথগামী হবে অর্থাৎ লক্ষ্যসাধন করতে পারবে না। সক্রেটিস এই কথাটি প্রচার করেছিলেন যে রাজনীতির লক্ষ্য কেবল প্রশাসন পরিচালনা করা নয়, সততা-ন্যায়বোধ-মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করা, আর রাজনীতি যদি নিজেই মিথ্যাচার, অসত্য ও দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়, তার পক্ষে সততা বা মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব নয়। তাই আমরা দেখি যে প্লেটোর চিন্তা বিশ্লেষণ করে জন মরো বলেছেন: The polis was a cooperative order directed towards the realisation of goodness and the attainment of human perfection. (p. 54). মানুষকে সৎ, ন্যায়বান করে গড়ে তোলা ও সমাজে মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করাই হবে রাজনীতির প্রধান উদ্দেশ্য, সে-কারণে প্লেটো তাঁর রিপাবলিক গ্রন্থের আদ্যোপান্ত ন্যায়বিচার, সততা, পরিপূর্ণতা (perfection) ইত্যাদি শাশ্বত ধারণা নিয়ে সবিস্তারে আলোচনা করেছেন। দুর্নীতিগ্রস্ত রাষ্ট্রের চরম পরিণতি কী হতে পারে এবং নাগরিকদের অবস্থা কোথায় গিয়ে উপস্থিত হয় তা নিয়ে তিনি ‘রিপাবলিক’-এ বিশ্লেষণ করেছেন। একজন সাধারণ নাগরিক সততা, নীতি, মূল্যবোধ ইত্যাদি বিসর্জন দিয়ে উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাপন শুরু করলে সে পতনের দিকে দ্রুত অগ্রসর হবে। ব্যক্তির ক্ষেত্রে যা সত্য রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে তা ব্যতিক্রম বলে বিবেচিত হতে পারে না। একটি অমিতব্যয়ী উচ্ছৃঙ্খল রাষ্ট্র তার নাগরিকদের শান্তিপূর্ণ ও সুস্থ জীবন উপহার দিতে পারে না। নিয়ন্ত্রিত ও সংযত জীবনযাপন যেমন ব্যক্তিকে উন্নতির শীর্ষে আরোহণে সাহায্য করে তেমনি যে রাষ্ট্র সততা, ন্যায়বোধ, আদর্শ ইত্যাদিকে অনুসরণ করে শাসন চালায় সেই রাষ্ট্রই কেবল উন্নতিলাভে সক্ষম।

সততা আদর্শ এবং রাষ্ট্রচিন্তা: এ পর্যন্ত আমরা যা আলোচনা করলাম তা থেকে একটি বিষয় স্পষ্ট যে প্লেটো এমন এক রাজনীতিক ভাবনা গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন যা আগাগোড়া আদর্শ, সততা, মূল্যবোধ ও নীতির দ্বারা আচ্ছাদিত থাকে এবং এই বিষয়টি তিনি ‘রিপাবলিক’ গ্রন্থে এইভাবে প্রকাশ করেছেন: the actual state in every respect will concide with the ideal. বাস্তবে যে রাষ্ট্র রয়েছে তা আমাদের আদর্শ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকবে না। এই একটিমাত্র মন্তব্য স্পষ্ট করে দিয়েছে যে প্লেটো যে রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রচিন্তার কথা ভেবেছিলেন তা সত্যিকারের আদর্শের অনুগামী হবে। নৈতিকতার মধ্যে তিনি সর্বজনীনতা আনতে চেয়েছিলেন। Moral relativism-কে তিনি মনেপ্রাণে মেনে নিতে পারেননি। একটি আদর্শ রাষ্ট্রে অনেক জনগোষ্ঠী থাকতে পারে এবং থাকে। তারা যদি প্রত্যেকে নিজ নিজ নীতিবোধ ও সততার দ্বারা পরিচালিত হয় শেষপর্যন্ত দেখা যাবে যে একটি রাষ্ট্রে একাধিক নীতিবোধ ও সততার মান (standard) গড়ে উঠেছে এবং এই পরিস্থিতি থেকে এমন ধারণা তৈরি করা সম্ভব না যে রাজনীতিক ধ্যানধারণা একটি গৃহীত বা সর্বজনীন সততাবোধের দ্বারা অনুশাসিত। নানা জনগোষ্ঠী যদি নিজ নিজ সততা অনুযায়ী চলে শেষপর্যন্ত দেখা যাবে যে সমাজে নির্দিষ্ট সততা নেই। প্লেটো আর-একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ধারণার প্রবর্তন এই প্রসঙ্গে করে গেছেন এবং তা হল রাজনীতি এবং সততাকে প্রায়োগিক দিক থেকে বিচার করেছেন। সততা, ন্যায়, মূল্যবোধ ইত্যাদি কেবল ধারণাগত বিষয় নয়। বাস্তব পরিস্থিতির সঙ্গে এদের নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। অর্থাৎ বাস্তবে এরা প্রয়োগযোগ্য এবং রাষ্ট্রের কর্ণধারগণের উচিত প্রয়োগ করা। তিনি মনে করতেন যে আদর্শ, সততা, মূল্যবোধকে বাস্তবে কার্যকর করা যাবে না বা সম্ভব নয় এমন আদর্শ ও সততাকে তিনি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বলে বিবেচনার মধ্যে স্থান দেননি। রাষ্ট্র সর্বজনস্বীকৃত আদর্শের দ্বারা পরিচালিত না হলে এবং রাষ্ট্রের সামনে সর্বজনস্বীকৃত আদর্শ, সততা না থাকলে সমাজের নানা স্তরে সততা, রাষ্ট্রচিন্তা দুর্নীতি, গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব, কুচক্রীদের আধিপত্য ইত্যাদি মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে এবং এগুলিকে নির্মূল করে সততা ও ন্যায়বিচারের পথকে মসৃণ করে তোলা চাট্টিখানি ব্যাপার নয় এবং সে-কারণে রাষ্ট্রকে কতকগুলি প্রতিষ্ঠিত সততা ও আদর্শকে রাষ্ট্রের লক্ষ্য হিসেবে স্থির করে নিতে হবে। আর এগুলির বাস্তবায়নের দিকে রাষ্ট্র সতত সতর্ক নজর দেবে। প্লেটো আরও বলেছেন যে ন্যায়বিচার, সততা, মূল্যবোধ ইত্যাদিকে গড়ে তোলার কাজটি প্রতিটি ব্যক্তির ওপর ছেড়ে দিলে এগুলি উপেক্ষিত হওয়ার সম্ভাবনা থেকেই যায় কারণ ব্যক্তি বা গোষ্ঠী তাৎক্ষণিক লাভের জন্য এগুলিকে উপেক্ষা করতেই পারে এবং সেক্ষেত্রে সততার জগতে এক সংকট দেখা দেবে। তাই প্লেটো আদর্শ রাষ্ট্রের কল্পনা করে এর মাধ্যমে সততার বাস্তবায়নের পরিকল্পনা করেছিলেন। অতএব রাষ্ট্রের রাজনীতিক ও সামাজিক কাঠামো সম্পূর্ণরূপে নীতিবোধ, আদর্শ, সততা প্রভৃতির ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠবে এবং শাসক ও শাসিত এদের সংরক্ষণে তৎপর হবে।

প্লেটোর সমকাল: প্লেটোর রাষ্ট্রচিন্তা সম্পর্কে পুরোপুরি ওয়াকিবহাল হতে হলে তাঁর সমকালের রাজনীতিক ও অন্যান্য পরিস্থিতি আমাদের জানা প্রয়োজন। প্লেটোর সময়ের রাজনীতিবিদরা সমাজের ওপর দাপিয়ে বেড়াত। আর এরা ছিল আপাদমস্তক দুর্নীতিগ্রস্ত এবং অযোগ্যতার মূর্তপ্রতীক। সচরাচর দেখা যায় যে যারা যে পেশায় বা কাজে নিযুক্ত তারা সে-সম্বন্ধে পরিচিত। কিন্তু ব্যতিক্রম হল রাজনীতিবিদ। রাজনীতির কোনো কিছু সম্বন্ধে তারা পরিচিত ছিল না। ফলে তাদের রাজত্বে নগর-রাষ্ট্রে বিশৃঙ্খলা, নৈরাজ্য ও দুর্নীতি স্থায়ী আসন বানিয়ে ফেলেছিল। এই অবস্থা তাঁর মনে রাজনীতিবিদ সম্পর্কে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল। তিনি মনে করতেন যে রাষ্ট্রে আইন, নৈতিকতা, সততা ইত্যাদির প্রাধান্য থাকলে এই শোচনীয় পরিণতির আবির্ভাব ঘটত না। তাঁর সমকালের স্পার্টা (Sparta) সামরিক ও অন্যান্য নানাদিক থেকে সুশাসিত ছিল। কিন্তু একটি রাষ্ট্র জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চাকে উপেক্ষা করে কেবল সামরিক দিক থেকে অগ্রগণ্যতা অর্জন করুক তা তিনি চাননি। তাঁর সময়ে কয়েকটি রাষ্ট্রে গণতান্ত্রিক শাসন চালু ছিল কিন্তু সেগুলি প্রতি পদক্ষেপে অযোগ্যতার চিহ্ন রাখত যা দেখে প্লেটোর মনে হয়েছিল যে গণতান্ত্রিক সরকার দক্ষ হয় না। দক্ষ সরকার গড়তে হলে দক্ষ, নির্লোভ ও জ্ঞানী ব্যক্তির সরকারের গদিতে বসা উচিত। তা ছাড়া গণতান্ত্রিক সরকার মানে দলীয় শাসন। রাজনীতিক দলগুলি ক্ষমতা দখলের জন্য নিজেদের মধ্যে প্রায়ই সংঘাতে লিপ্ত হত। রাজনীতিক দলগুলির মধ্যে কোন্দল, নিম্ন বা নিকৃষ্টমানের দলীয় কাজকর্মাদি, সততা, নিষ্ঠা ইত্যাদির নির্বাসন গ্রিক নগর-রাষ্ট্রগুলির সরকারকে অস্থিতিশীল এবং কলঙ্কময় করে তুলেছিল। অল্প কয়েকজন ধান্দাবাজ ব্যক্তি সম্পত্তি ও সম্পদ কুক্ষিগত করে রাখত এবং সমাজের গরিষ্ঠ- সংখ্যক নাগরিক ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত থাকত। স্যাবাইন বলেছেন: যে প্লেটোর সমকাল গ্রিসের ক্ষুদ্রতম নগর-রাষ্ট্রের মধ্যে দুটি আরও ছোটো নগর-রাষ্ট্র বিরাজ করত, একটি ছিল ধনীদের এবং অন্যটি দরিদ্রদের। জনগণ দুটি স্পষ্ট গোষ্ঠীতে বিভক্ত হয়ে পড়ায় তাদের মধ্যে সংঘাত একটি সাধারণ বিষয়ে পরিণত হয়ে পড়েছিল। নগর-রাষ্ট্রে ন্যায়বিচারের বালাই ছিল না। গণতন্ত্রের নামে চলত স্বৈরাচারী শাসন। সাধারণ নাগরিক স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশের সুযোগ এবং অধিকার থেকে বঞ্ছিত ছিল। সংকীর্ণতা, প্রাদেশিকতার ছিল রমরমা অবস্থা। একদিকে সাধারণ মানুষ সরকারের ত্রিসীমানায় যেতে পারত না এবং অন্যদিকে যারা সরকার চালাত তারা সকল দিক থেকে ছিল অযোগ্য। এক কথায় বলা যেতে পারে গ্রিসের নগর- রাষ্ট্রগুলির অবস্থা প্লেটোর মনে রাজনীতি, দলীয় শাসন, গণতন্ত্র সমাজের আর্থ-সামাজিক অবস্থা আশার সঞ্চার করতে পারেনি। সমাজে ব্যাবসাবাণিজ্য থেকে যে সম্পদ আসত তার সুবণ্টনের ব্যবস্থা না থাকায় বিশৃঙ্খলা দেখা দিত। রাষ্ট্র বা সরকার সৎ ও সুনাগরিক গড়ে তোলার ব্যাপারে আগ্রহী ছিল না।

প্লেটোর রাষ্ট্র: একটি শ্রেণি

আদর্শ ও বাস্তবের মহামিলন ক্ষেত্র: প্লেটো মনে করতেন যে ব্যক্তির পক্ষে যা কল্যাণজনক ও আদর্শ রাষ্ট্রের পক্ষেও তাই হবে এবং সে-কারণে তিনি কতকগুলি আদর্শ, সততা, নীতিবোধ, মূল্যবোধকে বাস্তবে কার্যকর করার মাধ্যম হিসেবে একটি রাষ্ট্রের পরিকল্পনা করেছিলেন। এগুলি ব্যক্তির পক্ষে এককভাবে বাস্তবায়িত করা সম্ভব নয়। তদুপরি সমাজের সকল মানুষ একই আদর্শ এবং সততায় অনুপ্রাণিত হয়ে এগুলিকে কাজে পরিণত করবে এমন নিশ্চয়তা নেই। সে-কারণে প্লেটো এমন একটি রাষ্ট্র গড়ে তোলার পরিকল্পনা নিয়েছিলেন যে রাষ্ট্র হবে শাশ্বত সততা ও নৈতিকতার মূর্তপ্রতীক, এই কথাটি জনৈক বুশ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী নিম্নোক্তভাবে উপস্থাপিত করেছেন: The ideal state as presented by Plato in Republic is the realisation of divine ideas in earthly socio- political life with maximum possible accuracy (p. 112). প্লেটো যে আদর্শ রাষ্ট্রের কল্পনা করেছিলেন তার প্রেক্ষিতে ছিল তাঁর সমকালের গ্রিক নগর-রাষ্ট্র বা পোলিস- এর শোচনীয় অবস্থা। তিনি চেয়েছিলেন যে রাষ্ট্রের গঠন, প্রশাসন এমন হবে যা একদিকে প্রতিটি নাগরিককে আদর্শবান ও নীতিজ্ঞানসম্পন্ন করে তোলা যায় এবং অন্যদিকে একটি বাস্তব রাষ্ট্রের যেমন কাজ করা দরকার সেগুলিও সে করতে সক্ষম হয়। রাষ্ট্র কেবল সামরিকশক্তিতে বলীয়ান হয়ে মহাপরাক্রমশালী হলে চলবে না, তাকে নীতি, সততা ও আদর্শ অনুযায়ী চলতে হবে। তাঁর পূর্বসূরিরা যেমন বিশ্ব- ব্রহ্মান্ডের সঙ্গে রাষ্ট্র, সমাজ ও ব্যক্তির মধ্যে মহামিলন ঘটাতে চেয়েছিলেন প্লেটো কার্যত সেই দৃষ্টি দিয়ে আদর্শ রাষ্ট্রের পরিকল্পনা করেছিলেন। তিনি মনে করতেন যে রাষ্ট্র চিরস্থায়ী নয় এবং হতে পারে না। কিন্তু তাই বলে একেবারে ক্ষণস্থায়ী হবে এমনটি নয়। তাই তিনি রাষ্ট্রের সঙ্গে সমগ্র বিশ্বের মহামিলন ঘটাবার কথা বলেছিলেন। অর্থাৎ তাঁর মতে রাষ্ট্র হল কসমস (cosmos)-এর একটি অচ্ছেদ্য অঙ্গ এবং অতি পরিবর্তনশীল ধ্যানধারণাগুলির অধীন একটি সংস্থা। রাষ্ট্র প্রচলিত রীতি, নীতি, প্রথা প্রভৃতির প্রতি নজর দেবে তবে সেগুলি যেন স্থায়ী সততা ও মূল্যবোধের পরিপন্থী না হয়। “প্লেটোর ব্যাখ্যায় আদর্শ রাষ্ট্র হল ভাবের বাস্তবায়ন, ভাবজগতের পার্থিব সামাজিক রাজনীতিক জীবনে, রাজ্যশাসনব্যবস্থায় যথাসম্ভব রূপায়ণ।” আদর্শ ন্যায়পরায়ণ রাষ্ট্রের নির্মিতিতে প্লেটো এগিয়েছেন তাঁর এই অভিমত থেকে যে সমগ্র বিশ্বজগৎ, রাষ্ট্র এবং এক-একটি মানবাত্মার মধ্যে সামঞ্জস্য আছে।” রাজনীতিক মতবাদের ইতিহাস, প্রথম খন্ড, পৃ. ১২৪। তাহলে দেখা যাচ্ছে যে প্লেটোর কল্পিত রাষ্ট্র একটি গতানুগতিক সাধারণ শ্রেণির রাষ্ট্র নয়। মানুষ যেমন কিছু কিছু আদর্শ, নীতি ও সততার ধারণা নিয়ে সমাজে বাস করে এবং নিজের কাজের মাধ্যমে তাদের বাস্তবায়নের কথা ভাবে রাষ্ট্র সেইরূপ। তিনি আরও বলেছেন যে রাষ্ট্র হল বিশ্বজগৎ বা কসমস, সর্বোৎকৃষ্ট আদর্শ, বিশ্বজনীন সততার অবাধ বিচরণক্ষেত্র। এদের মধ্যে বিচ্ছেদের পাঁচিল টানতে যাওয়া অনুচিত। সমস্ত মানবসমাজের পক্ষে যা কল্যাণজনক তাকেই বাস্তবে পরিণত করার দায়িত্ব রাষ্ট্র নেবে। ব্যক্তি তো এ কাজ করলেই পারে। কিন্তু প্লেজে এককভাবে ব্যক্তির ওপর আস্থা স্থাপন করতে পারেননি। রাষ্ট্র আদর্শ হলে ব্যক্তির পক্ষে এ কাজ করা সহজ।

আদর্শ রাষ্ট্র ও তার নাগরিক: আদর্শ রাষ্ট্রের নাগরিক সম্বন্ধে প্লেটো এমন কতকগুলি মন্তব্য করেছেন যেগুলি বর্তমান যুগে প্রাসঙ্গিক না হলেও আদর্শ রাষ্ট্রের স্বরূপ জানতে হলে তাদের সঠিক উল্লেখ প্রয়োজন। রিপাবলিক গ্রন্থে তিনি বলেছেন: We cannot suppose that states are made of oak and rock and not out of human natures which are in them…. States are as the men are. They grow out of human characters (p. 293). রাষ্ট্র জনসাধারণকে নিয়ে গঠিত হয়, গাছপালা বা অন্যান্য মনুষ্যেতর জীবকে নিয়ে রাষ্ট্র। গঠিত হয় না। আমরা আগেই বলেছি যে গ্রিক পন্ডিতদের লেখায় ধর্ম, ও পুরাকথার বিস্তর প্রভাব ছিল এবং প্লেটো ব্যতিক্রম ছিলেন না। গ্রিসে অনেকরকম পুরাকথা ছিল এবং তাদের একটি হল রাষ্ট্রের নাগরিকদের কীভাবে বিভাজন করা যাবে এবং ওই পুরাকথায় যা আছে তার সারার্থ হল- সকল নাগরিক যদিও পরস্পরের ভাই তবুও তাদের দৈহিক ক্ষমতা, আচরণ, বুদ্ধি ইত্যাদি সমপরিমাণ নয়। কিছুসংখ্যক নাগরিককে সোনা (gold) বলা যায় কারণ তাদের দক্ষতা, মেধা ইত্যাদি অন্যদের তুলনায় অনেক বেশি। দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হল রুপো কারণ এদের মেধা ও অপরাপর গুণ প্রথম শ্রেণির নাগরিকদের তুলনায় কম হলেও উপেক্ষণীয় নয়। রাষ্ট্রের নানা প্রকার কাজে এরা প্রথম শ্রেণিভুর নাগরিকদের সাহায্য করে। তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে সেসমস্ত ব্যক্তি যাদের তিনি লোহা ও তামার সঙ্গে তুলনা করেছেন। তামা ও লোহা শ্রেণির নাগরিকদের কাজ হল অন্য দুই শ্রেণিকে রাষ্ট্রশাসনে যথাযথ সাহায্য করা এবং যাবতীয় কায়িক পরিশ্রম সম্পন্ন করা। তবে তিনি বলেছেন যে মা বাবা সোনা বা রুপো হলেও পুত্র-কন্যারা লোহা বা তামা হতেই পারে। প্রকৃতি এই পরিবর্তন ঘটিয়েছে এবং এ বিষয়ে মানুষের কিছু করণীয় নেই। সোনা ও রূপো শ্রেণিভুক্ত নাগরিকদের কাজ খুবই গুরুত্বপূর্ণ কারণ রাষ্ট্রের প্রশাসন এক প্রতিরক্ষার কাজে তারা নিযুক্ত থাকে। তবে অন্যান্য কাজ যারা করে তাদের একেবারে গুরুত্বহীন বলে মনে করার কার নেই। রাষ্ট্রের মধ্যে বংশগতি বজায় থাকবে এমন ধারণ মনে পোষণ করা যায় না এবং প্লেটো সে-বিষয়ে সম্যক অবহিত ছিলেন বলে তিনি সোনা শ্রেণির মা-বাবার লোহা সন্তান জন্মাতে পারে বলে মনে করতেন। আবার উলটো ঘটনা যে ঘটতে পারে তার উল্লেখও তিনি করেছেন। একে তিনি transposition of rank বলেছেন। আদর্শ রাষ্ট্রের জনগণের যে শ্রেণিবিন্যাস প্লেটো করেছেন সে-বিষয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে মার্কস বলেছেন: Plato’s Republic, in so far as the division of labour is treated in it, as the formative principle of the state, is merely the Athenian idealisation of the Egyptian system of castes, Egypt having served as the model of industrial country to many of his contemporaries (‘Capital’ Vol I p. 366). রাষ্ট্রের নাগরিকদের এইভাবে শ্রেণিবিন্যাস করে প্লেটো পরোক্ষে শ্রমবিভাগ নীতি প্রবর্তন করে গেছেন। তবে প্লেটোর শ্রমবিভাগ নীতি পুঁজিবাদী ব্যবস্থার শ্রমবিভাগ থেকে আলাদা। রাষ্ট্রের নাগরিকদের এই শ্রেণি-বিন্যাস ব্যবস্থাকে অধ্যাপক আর্নেস্ট বার্কার প্লেটোর সমগ্র দর্শনচিন্তার এক অচ্ছেদ্য অঙ্গ বলেছেন। এটি তাঁর আদর্শ রাষ্ট্রের একটি মামুলি ধরনের কাঠামো নয়, ন্যায়বিচার তত্ত্বের সঙ্গে এর যোগাযোগ রয়েছে। তা ছাড়া তাঁর আদর্শ রাষ্ট্র সাধারণ শ্রেণির নয়, আভিজাত্যে পরিপূর্ণ তাও এই শ্রেণিবিন্যাসে স্পষ্ট।

আদর্শ রাষ্ট্রের প্রশাসন ও শিক্ষা

আদর্শ রাষ্ট্র কী?: প্লেটোর রাষ্ট্রচিন্তার অন্যতম বা প্রধান বিষয় হল তাঁর আদর্শ রাষ্ট্র (Ideal State), পরবর্তীকালে এই ধারণাটি বিস্তর বিতর্কের সূচনা করলেও রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা একে অবাস্তব বলে উড়িয়ে দিতে পারেননি। প্রথমে দেখা যাক আদর্শ রাষ্ট্র বলতে তিনি প্রকৃতপক্ষে কী বোঝাতে চেয়েছিলেন? তিনি মনে করতেন যে একটি রাজনীতিক সংগঠন বা প্রতিষ্ঠানের স্থিতিশীলতা এবং সফলতার সঙ্গে যাবতীয় কর্তব্য সম্পাদনের নিমিত্ত কতকগুলি উপাদানের উপস্থিতি প্রয়োজন কারণ রাষ্ট্র কখনও স্থায়ী হতে পারে না যদি ওই সংগঠন সঠিকভাবে তার নাগরিকদের তৈরি করে। এর কতকগুলি উদ্দেশ্য, আদর্শ এবং কর্মপদ্ধতি থাকা একান্ত দরকার। আর এগুলির অনুপস্থিতি মানে রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতাকে একটি বিরাট প্রশ্নচিহ্নের সামনে এনে হাজির করা। এই পূর্বশর্ত বা উপাদানগুলি আদতে বাস্তবায়িত করা সম্ভব কি না তা ভিন্ন প্রশ্ন কিন্তু রাষ্ট্রকে আদর্শ হতে হলে এগুলির বাস্তব রূপায়ণ অত্যাবশ্যক। It is easy to exaggerate his remoteness from actual conditions, but as he understood the problem, the question whether his ideal state could be produced was irrelevant. He was trying to show what in principle a state must be. (Sabinc, p. 46)। তিনি যে আদর্শ রাষ্ট্রের কল্পনা করেছিলেন তার প্রেক্ষাপটে ছিল কতকগুলি কল্পিত আদর্শ এবং তিনি মনে করেছিলেন যে এগুলি রাষ্ট্রের মাধ্যমে কার্যকর হওয়া বিশেষ দরকার। এই কল্পিত আদর্শগুলি, হল ঐশ্বরিক আদর্শ যেগুলির বাস্তবায়ন সমাজ ও রাষ্ট্রকে পূর্ণাঙ্গ ও সুন্দর করে তুলবে। আগেই বলেছি যে তাঁর পূর্বসূরিগণ Cosmos বা মহাবিশ্বের সঙ্গে বস্তুগত সমাজের মিলন ঘটাবার কথা বলেছিলেন। সুতরাং ঈশ্বরের রাজ্যে যা আছে তাদের মনুষ্যসমাজে আনতে পারলে রাষ্ট্র তো আদর্শ হয়ে যাবে। তিনি মহাবিশ্ব, রাষ্ট্র, সমাজ ও ব্যক্তি সবকিছুকে একটিমাত্র বৃত্তের মধ্যে আনার পরিকল্পনা মাথায় নিয়ে আদর্শ রাষ্ট্রের রূপরেখা বানিয়েছিলেন। ম্যাক্সে মনে করেন (পৃ. ৪৩) যে প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্র একটি কল্পনামাত্র নয়। It is to be a state which not only should but could be. তিনি আদর্শ রাষ্ট্রের যেসমস্ত গুণ বা বৈশিষ্ট্যের কথা বলেছেন সেগুলির বাস্তব অস্তিত্ব নিয়ে চিন্তিত ছিলেন না। এগুলি তাঁর নিকট বস্তুগত উপাদান বলে মনে হয়েছিল, মনোগত নয়। তাই তিনি একটি আদর্শ রাষ্ট্র গড়ে তোলার কথা বলেছিলেন। তিনি লক্ষ করেছিলেন সততা, সদভাবনা, মূল্যবোধ ইত্যাদি সম্পর্কে সাধারণ মানুষ এবং বহু বিজ্ঞজনের বিচিত্র ধারণা রয়েছে। তাঁরা ভাবেন ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের ধারণা ভিন্নধর্মী অর্থাৎ এই সমস্ত শাশ্বত ধারণা প্রধানত ব্যক্তি অনুশীলন করে নিজেকে সমৃদ্ধিশালী করে তুলবে। রাষ্ট্র একটি জড় সংগঠন এবং শাশ্বত মূল্যবোধগুলি তার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। প্লেটো এই চলে আসা ধারণাটিকে বাতিল করে দিতে চেয়েছিলেন। তাঁর আদর্শ রাষ্ট্র হল ব্যক্তির পক্ষে যা ভালো, মঙ্গলজনক বা কল্যাণকর তা রাষ্ট্রের ক্ষেত্রেও। অর্থাৎ ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে স্বতন্ত্র মূল্যবোধ এবং আদর্শ থাকতে পারে না। সুতরাং প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্র হল শাশ্বত মূল্যবোধ ও নৈতিকতার বাস্তবায়নের পীঠস্থান। ব্যক্তি তার চরিত্রের অপূর্ণতাগুলি যে প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে পূর্ণ করে তুলবে সেটি হল আদর্শ রাষ্ট্র।

ধারণাটি এল কীভাবে?: আদর্শ রাষ্ট্র সম্পর্কে প্লেটোর ধারণা একেবারে শূন্যে তৈরি হয়নি, বাস্তবের সঙ্গে এর একটি যোগসূত্র যে আছে তা অস্বীকার করার উপায় নেই। তাঁর সমকালে গ্রিসের অনেকগুলি নগর-রাষ্ট্র বা পোলিস চরম বিশৃঙ্খলা, নৈরাজ্য, অপশাসন ও অস্থিতিশীলতার শিকার হয়েছিল। বিশেষ করে গণতন্ত্রের নামে যা হত বা শাসক ও শাসিতরা করত সে-সম্পর্কে তিনি চরম হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন। তাঁর শিক্ষক সক্রেটিস-এর মৃত্যু তাঁকে গণতন্ত্র সম্পর্কে নতুন করে কিছু ভাবতে প্রেরণা জুগিয়েছিল। পোলিসগুলির মধ্যে নৈরাজ্য, দুর্নীতি, কপটতা এবং ভ্রষ্টাচার স্থায়ী আসন তৈরি করে নিয়েছিল। সুস্থ ও সুন্দর জীবন তাঁর সমকালের পোলিস (polis)-গুলিতে দুর্লভ বস্তুতে পরিণত হয়েছিল এবং এই হতাশাজনক অবস্থা থেকে কীভাবে নিষ্কৃতি পাওয়া যেতে পারে তা নিয়ে তিনি খুবই ভাবিত ছিলেন। তাঁর সময়ে গ্রিসের নগর-রাষ্ট্রগুলির মধ্যে যে পচন ধরেছিল তাকে তিনি সর্বব্যাপী এবং ভীষণ ক্ষতিকর বলে মনে করতেন। কেবল মনে করা নয় এই পচনশীলতা কোথায় গিয়ে উপস্থিত হয়েছিল তাও তিনি তীব্র বেদনার সঙ্গে উপলব্ধি করেছিলেন, আর তিনি ভেবেছিলেন: the process of degeneration as the danger to be guarded against if the Ideal State were to be set up at some time in the future. Mc Clelland (p. 41) সমকালীন পোলিস-গুলির ক্রমবর্ধমান পচনশীলতাকে নির্বাসন দিতে হলে আদর্শ রাষ্ট্র গড়ে তুলতে হবে এবং এটি হবে ওই পচনশীলতার একমাত্র প্রতিষেধক। অস্থিতিশীল ও ক্ষতিকারক উপাদানগুলি বিদ্যমান নগর- রাষ্ট্রের প্রশাসনে ও জনজীবনে অবাধে প্রবেশ করায় রাষ্ট্রের এই চরম-দুর্গতি দেখা দিয়েছে। নগর-রাষ্ট্রের সমস্ত স্তরে নানা ক্ষতিকারক উপাদান দানা বেঁধেছে এবং বিদ্যমান কোনো উপায়ের সাহায্যে যেগুলির নির্বাসন সম্ভব নয়। রিপাবলিক’ গ্রন্থের একটি অধ্যায় আছে যার নাম-Imperfect Societies, এই অধ্যায়ে তিনি বলেছেন যে গণতন্ত্র, সংকীর্ণ গোষ্ঠীতন্ত্র, অভিজাততন্ত্র ইত্যাদি সকলপ্রকার শাসনব্যবস্থাই অস্থিতিশীলতা, দুর্নীতি, অপশাসন ইত্যাদির কবলে পড়েছে এবং এগুলি থেকে রক্ষা পাওয়ার একমাত্র উপায় হল আদর্শ রাষ্ট্র স্থাপন করা। তিনি বলেছেন যে মানুষের চরিত্রের তিনটি দিক আছে। কেউ যুক্তির দ্বারা প্রভাবিত হয়। কেউ কেউ আবার spirit-এর নির্দেশে কাজ করে। অনেকে appetite-এর প্রভাবে কাজ করে থাকে। তবে দেখা গেছে যে যুক্তি বা reason-এর প্রভাব সকলের ওপর পড়ে না। সহজ কথা হল অধিকাংশ মানুষ তাৎক্ষণিক লাভের আশায় কাজ করতে এগিয়ে যায়। এখানে লোভ বা স্বার্থপরতা প্রাধান্য পায়। পরার্থপরতা, সমাজের সামগ্রিক কল্যাণ তার নিকট তুচ্ছ বলে প্রতিভাত হয়। লোভ ও সংকীর্ণ স্বার্থ মানুষের মনকে কলুষিত করলে সে সমাজের স্বার্থের কথা ভাবে না। তাই প্লেটো বলেছেন যে মানুষ এই কাজ করে কারণ সে যথোচিত শিক্ষা পায়নি বলে। এই শিক্ষা সে কেবল রাষ্ট্রের কাছ থেকে পেতে পারে এবং সে-কারণে প্রয়োজন একটি আদর্শ রাষ্ট্রের।

আদর্শ রাষ্ট্রের প্রশাসনের জন্য দরকার দার্শনিক রাজা: একজন চিন্তাবিদ ও দার্শনিক হিসেবে প্লেটোর অনন্য “আবিষ্কার” হল দার্শনিক রাজা (Philosopher King), একে “আবিষ্কার” বলা উচিত কি না তা বিচার করবেন পণ্ডিতেরা। কারণ তাঁর আগে কোনো কোনো চিন্তাবিদ রাষ্ট্রের সুশাসনের নিমিত্ত জ্ঞানী এবং যোগ্য শাসকের প্রয়োজনীয়তার কথ বলেছিলেন। কিন্তু প্লেটো যেভাবে দার্শনিক রাজা তত্ত্বটি গুরুত্বসহকারে বিশ্লেষণ করেছেন অন্য কেউ তা করেননি এবং এখানেই তাঁর কৃতিত্ব। ‘রিপাবলিক’ গ্রন্থের এক জায়গায় তিনি বলেছেন: Until philosophers are kings or the kings and princes of this world have the spirit and power of philosophy, and political greatness and wisdom meet in one, and those commoner natures who pursue either to the exclusion of the other are compelled to stand aside, cities will never have rest from their evils. এখানে প্লেটো কয়েকটি বিষয়ের ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তিনি তাঁর সমকালীন নগর-রাষ্ট্রগুলিতে যেসব অন্যায়, অপরাধ লক্ষ করেছিলেন সেগুলি নাগরিক জীবনের পক্ষে সম্পূর্ণরূপে অনভিপ্রেত ছিল। সুস্থ, সৎ নাগরিক জীবন তৈরি করা সম্ভবপর ছিল না। একমাত্র প্রতিষেধক ছিল দার্শনিকরা যদি রাজা হন। তখনই এই অভিশাপ থেকে সাধারণ মানুষ মুক্তি পেতে পারে। আর একটি বিকল্প কথাও তিনি বলে গেছেন। দার্শনিক রাজা নাও পাওয়া যেতে পারে। তবে রাজা বা রাজপুত্রের দর্শনের spirit power থাকবে। তিনি ভেবেছিলেন যে কেবল দার্শনিক ব দর্শনচিন্তায় সমৃদ্ধ ব্যক্তি শাসনকার্য পরিচালনা করতে পারেন। প্রশ্ন হতে পারে কেন প্লেটো দার্শনিককে বা দর্শনজ্ঞানের অধিকারীকে আদর্শ রাষ্ট্রের যোগ্য শাসক করার কথা ভেবেছিলেন? প্লেটোর রাষ্ট্রচিন্তা বিশ্লেষণ করলে দেখ যায় যে দু-একটি বিরল ঘটনা ছাড়া সর্বত্রই শাসক বা রাজার তাৎক্ষণিক লাভ, লোভ, প্রভৃতির শিকার। প্রশাসনে দক্ষতা এনে সমাজের কল্যাণ করার চেয়ে ব্যক্তিগত সুযোগসুবিধ আদায় করাকে কাঙ্ক্ষিত বন্ধু বলে মনে করেন। ব্যক্তিগত সুখ ও সকলের সুখ এ দুটির মধ্যে অনেকেই প্রথমটিকে প্রাধান্য দেয় যার ফলে সমগ্র রাষ্ট্র দুর্নীতি, অপশাসন প্রভৃতিতে নিমজ্জিত হয়ে পড়ে। সামগ্রিক সুখ এবং সমৃদ্ধিরে ব্যক্তিগত সুখ ও সমৃদ্ধির ওপরে স্থান দিতে হবে এবং এ পদ্ধতি নগর-রাষ্ট্রকে সমৃদ্ধ করে তুলতে পারে। সর্বোপরি একজন দার্শনিক রাজাই রাষ্ট্রের নাগরিকগণকে আদর্শ নীতিবোধ, মূল্যবোধ, সততা প্রভৃতিতে উদ্‌বুদ্ধ করে তুলতে পারেন। তিনি লক্ষ করেছিলেন তাঁর সমকালের নগর রাষ্ট্রগুলির শাসকদের মধ্যে সততা, নিষ্ঠা, পরার্থপরতা ছি না। ব্যক্তিগত সুখকে তারা প্রাধান্য দিত এবং তা-করতে গিয়ে সমাজের সামগ্রিক সুখ ও কল্যাণ উপেক্ষিত হত। তাঁর প্রত্যয় ছিল যে কেবল দার্শনিক রাজা সমাজের বিকাশ ঘটাতে পারেন।

কাজ, কর্তব্য এবং স্থান: দার্শনিক রাজার ওপর রাষ্ট্রের প্রশাসনিক দায়িত্ব অর্পণ করার পেছনে প্লেটোর একটি সুদুরবিস্তারী পরিকল্পনা ছিল কারণ তিনি নিছক খেয়ালবশে এ কাজ করেননি। তাঁর প্রথম কাজ হল রাষ্ট্রকে দুর্নীতিমুক্ত করে একটি স্থিতিশীল আদর্শ এবং ন্যায়বিচার-ভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তোলা যা তাঁর সময়কালে গ্রিসের অন্যান্য নগর-রাষ্ট্রে ছিল না। আর এ কাজ করার আগে দার্শনিক রাজা জেনে নেবেন স্বর্গে বা ঈশ্বরের রাজ্যে কী ধরনের আদর্শ রাষ্ট্র বিরাজ করত। তারই আদলে তিনি পার্থিব জগতে আদর্শ রাষ্ট্র তৈরির উদ্যোগ নেবেন। দ্বিতীয়ত, দার্শনিক রাজা রাষ্ট্রকে তাঁর এবং তাঁর পরিবারের স্বার্থরক্ষার কাজে আদৌ ব্যবহার করবেন না কারণ দার্শনিক রাজারা রাষ্ট্রের সর্বাবিধ কল্যাণে নিয়োজিত। রাষ্ট্রকে রাজারা অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে সুখ অর্জন করতে পারবেন না। তৃতীয়ত, তাঁর সমকালের নগর-রাষ্ট্রগুলির প্রশাসন থেকে প্লেটোর এই প্রত্যয় জন্মেছিল যে একটি রাষ্ট্রের সম্পদ সকলের মধ্যে সমভাবে বণ্টিত না হলে ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে বিস্তর ব্যবধান দেখা দেবে যা এই দুই শ্রেণির মধ্যে তিক্ততা ও সংঘাতে ইন্ধন জোগাবে এবং এই অবস্থা রাষ্ট্রের স্বার্থের পক্ষে খুবই ক্ষতিকর। চতুর্থত, রাষ্ট্রের মধ্যে যেসমস্ত শ্রেণি রয়েছে তাদের নিজ নিজ কর্তব্য স্থির হয়ে আছে। দার্শনিক রাজা দেখবেন এইসব শ্রেণির লোকেরা যাতে স্ব স্ব কর্তব্য সম্পাদনে অবহেলা না দেখায়। এই কাজ সম্পাদনের মাধ্যমে রাজা তাঁর রাষ্ট্রকে ন্যায়বিচারের পীঠস্থানে পরিণত করবেন। পঞ্চমত, একটি শ্রেণি অন্যান্য শ্রেণির বিনিময়ে যেন সুখ- সমৃদ্ধি কুক্ষিগত করতে না পারে। অর্থাৎ দার্শনিক রাজা দেখবেন সমস্ত সম্পদ সকলের মধ্যে যথাযথভাবে বণ্টিত হয়েছে এবং এর ফলে সকলের সর্বাপেক্ষা বেশি সুখ নিশ্চিত করতে পেরেছেন। ষষ্ঠত, দার্শনিক রাজা নিজে সহজ অনাড়ম্বর, মহৎ ও আদর্শ জীবনযাপনের মাধ্যমে রাজ্যে নজির স্থাপন করবেন এবং সবাই যাতে তাঁকে অনুসরণ করে সে-দিকে দৃষ্টি দেবেন। সপ্তমত, তিনি রাজ্যে আইন প্রণয়নে উদ্যোগ নেবেন কিন্তু এমনভাবে শাসন পরিচালনা করবেন যাতে আইন প্রয়োগের প্রয়োজনীয়তা দেখা না দেয়। ওয়েপার বলেছেন যে, এই ক্ষেত্রে দার্শনিক রাজা চিনের বিখ্যাত দার্শনিক কনফুসিয়াসকে অনুসরণ করেছেন। তিনি বলেছিলেন: Where the prince is virtuous laws are unnecessary, where the prince is not virtuous laws are useless. অষ্টমত, একদিকে রাজা ত্যাগস্বীকার, সততার সঙ্গে প্রশাসন পরিচালনার মাধ্যমে ঐতিহ্য গড়ে তুলবেন এবং নজির সৃষ্টি করবেন, অন্যদিকে রাষ্ট্রের অতীত দিনের ঐতিহ্যকে খুবই শ্রদ্ধার সঙ্গে মেনে চলবেন। নবমত, প্লেটো জানতেন যে, তাঁর সমকালে গ্রিসের অন্যান্য পোলিস-এ ন্যায়, নীতি, আদর্শ, সততা, মূল্যবোধ ইত্যাদির বালাই নেই। এই অবস্থায় পাশের রাষ্ট্রগুলির কুপ্রভাব তাঁর রাষ্ট্রের ওপর পড়তে পারে এবং সেই পরিস্থিতির উদ্ভব যাতে না হয় দার্শনিক রাজা সেদিকে নজর দেবেন। দশমত, রাজা রাষ্ট্রকে স্বয়ম্ভর করে তোলার চেষ্টা চালাবেন এবং তার জন্য যা যা দরকার তিনি তা করবেন। কিন্তু রাষ্ট্রকে আদর্শচ্যুত হতে দেবেন না। সর্বতোভাবে আদর্শের সুরক্ষার ব্যবস্থা নেবেন।

আদর্শ রাষ্ট্রের শিক্ষা: আদর্শরাষ্ট্রের শিক্ষাব্যবস্থার ওপর প্লেটোকে বিস্তর গুরুত্ব আরোপ করতে আমরা দেখি। তিনি জানতেন যে একটি রাষ্ট্রকে আদর্শ করে গড়ে তুলতে হলে শিক্ষার বিশেষ ভূমিকা আছে। তিনি আরও জানতেন যে আদর্শ করে তৈরি করার কাজটি রাজা খুবই দক্ষতার সঙ্গে সম্পাদন করবেন কিন্তু রাজা যাই করুন না কেন আদর্শের অনুসারী একটি শিক্ষাব্যবস্থা থাকা বিশেষ দরকার। শিক্ষাব্যবস্থা এমনভাবে প্রস্তুত করা হবে যা নাগরিক গ্রহণ করে তারাও আদর্শ রাষ্ট্রের উপযোগী হয়ে উঠবে। আর শিক্ষা আদর্শ নাগরিক তৈরি করতে না পারলে রাষ্ট্র আদর্শ হওয়ার সুযোগই পাবে না। Plato frankly assumes that the state is first and foremost an educational institution. (Sabine, p. 59)। ‘রিপাবলিক’ গ্রন্থের নানা জায়গায় বিভিন্ন প্রসঙ্গে প্লেটো আদর্শ রাষ্ট্রের শিক্ষা নিয়ে আলোচনা করেছেন এবং শিক্ষা বলতে তিনি কেবল সাধারণ শিক্ষা ও সবার শিক্ষার কথা বলেননি, সামরিক বিভাগের কর্মচারীদের শিক্ষা, মেয়েদের, অভিভাবকদের শিক্ষার কথা বলেছেন। রুশো প্লেটোর শিক্ষা পরিকল্পনার ভূয়সী প্রশংসা করে বলেছেন যে ‘রিপাবলিক’ বইটিকে রাজনীতির ওপর গ্রন্থ না বলে শিক্ষা-সংক্রান্ত গ্রন্থ বলা ভালো। এর মধ্যে একটু অতিরঞ্জন আছে। তবে তিনি যে শিক্ষাকে আদর্শ রাষ্ট্রের একটি অপরিহার্য উপাদান বলে মনে করেছিলেন সে-বিষয়ে সন্দেহ নেই। তাঁর ধারণায় সততা বা মূল্যবোধ (virtue) আদর্শ রাষ্ট্রের জন্য বিশেষ প্রয়োজন আবার একে তিনি জ্ঞান (knowledge) বলেছেন। শিক্ষা ব্যতীত এই জ্ঞান অর্জন করা একেবারে সম্ভব নয় এবং তাই প্লেটো আদর্শ রাষ্ট্রের পরিকল্পনায় শিক্ষাকে বিশেষ আসনে বসিয়েছেন (If virtue is knowledge, it can be taught, and the educational system to teach it is the one indispensable part of a good state. Sabine, p. 59)। একটি সর্বাঙ্গসুন্দর পরিকল্পিত শিক্ষা-ব্যবস্থার সাহায্যে নাগরিককে শিক্ষিত করে তোলা সম্ভব। শিক্ষার উদ্দেশ্য হল মানুষের মন ও আচরণ থেকে অন্ধকার দূর করে আলোয় উপস্থিত করা। শিক্ষা না থাকলে নাগরিক জানবে না ন্যায় ও অন্যায়ের; সৎ ও অসতের, সততা ও মিথ্যাচারের মধ্যে পার্থক্য। তিনি জানতেন বা মনে করতেন যে মানুষের নিকট যা ন্যায়, সত্য ও মূল্যবোধ সমন্বিত সেটাই রাষ্ট্রের নিকট সততা, মূল্যবোধ সমন্বিত ও ন্যায়। তিনি আরও বলেছেন যে মানুষের মনে দুটি বিরোধী শক্তি সমানভাবে উপস্থিত। একটি হল যুক্তি (reason) এবং অন্যটি হল ব্যাক্তিগত আকাঙ্ক্ষা বা নিন্দা (or appetite)। মানুষের মন শিক্ষার আলোক থেকে বঞ্চিত হলে অপগুণ প্রাধান্য বিস্তার করে এবং আদর্শ রাষ্ট্রের ভিত্তিকে নড়বড়ে করে দেয়। অতএব আদর্শ রাষ্ট্রের ভিত্তি ও কাঠামোকে শক্ত-পোক্ত করে তুলতে হলে এর নাগরিকদের মধ্যে শিক্ষার ব্যাপক প্রচার দরকার এবং এই কাজ রাষ্ট্র করবে।

প্লেটোর পরিকল্পনা:  ‘রিপাবলিক’-এর দ্বিতীয় ও তৃতীয় খণ্ডে (book) প্লেটো আদর্শ রাষ্ট্রের শিক্ষা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন এবং ম্যাক্সের মতে তাঁর শিক্ষা-বিষয়ক পরিকল্পনা fascinatingly modern in many respects। ম্যাক্সের (Maxey) এই মন্তব্যের সঙ্গে আমরা একমত পোষণ করি। তাঁর শিক্ষা পরিকল্পনার মধ্যে আমরা দুটি অংশ পাই-একটি হল প্রাথমিক শিক্ষা এবং অন্যটি বয়স্কশিক্ষা। প্রাথমিক শিক্ষাকে তিনি আবশ্যিক করেছেন। এই শিক্ষা সমস্ত নাগরিক ২০ বছর বয়স পর্যন্ত গ্রহণের সুযোগ পাবে। প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণের পর নাগরিক সামরিক শিক্ষা নেবে। ২০ বছরের পর যারা শিক্ষা নেবে সেই শিক্ষাকে তিনি বয়স্কশিক্ষা বলেছেন। সামরিক শিক্ষার পাশাপাশি নাগরিক অন্যান্য বিষয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের সুযোগ পাবে। নাগরিক ৩৫ বৎসর বয়স পর্যন্ত উচ্চশিক্ষা গ্রহণের সুযোগ পাবে। কারা উচ্চশিক্ষা গ্রহণের উপযুক্ত সে-বিষয়ে বিশেষ কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নেবে। স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলেই শিক্ষাগ্রহণের অধিকারী। কেবল পুথিগত শিক্ষার কথা তিনি বলেননি, সংগীত, শরীরচর্চা, শারীরশিক্ষা ইত্যাদিকেও তিনি শিক্ষার আওতায় এনেছেন। তবে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের সুযোগ কেবল সমাজের দুটি উচ্চ শ্রেণির লোক পাবে। আগেই বলা হয়েছে প্লেটোর নিকট শিক্ষা বলতে দেহ ও মনের সম্যক বিকাশসাধন। তাই তিনি সংগীতকে এবং শারীরশিক্ষাকে সমান গুরুত্ব দিয়েছেন। একজন সুনাগরিকের পক্ষে দেহ ও মনের যুগপৎ বিকাশ প্রয়োজন। তিনি আরও বলেছেন যে রাষ্ট্র শিক্ষার এমন পরিকল্পনা নেবে এবং প্রদানের জন্য এমন ব্যবস্থা প্রবর্তন করবে যাতে বাইরের কুপ্রভাব তার মনকে কলুষিত করতে না পারে। যদিও প্লেটো বয়স্কদের শিক্ষার কথা বলেছেন তবুও তাঁর ধারণা ছিল যে মনকে পবিত্র করতে হলে বাল্যকালেই ছেলেমেয়েদের মধ্যে যথার্থ শিক্ষা প্রদানের ব্যবস্থা রাষ্ট্রকে নিতে হবে। ‘রিপাবলিক’ গ্রন্থের এক জায়গায় তিনি বলেছেন: you know that the beginning is the most important part of any work, especially in the case of any young and tender thing, for that is the time at which the character is being formed and the desired impression is more readily taken. Republic. Book II, p. 72. Jowett’s translation. ক্ষতিকারক বই ও আলোচনাকে শিক্ষাপরিকল্পনার অন্তর্ভুক্ত করার তীব্র বিরোধিত তিনি করেছেন। নাগরিকের মনকে বিষাক্ত করে তুলতে এদের জুড়ি পাওয়া মুশকিল। তিনি ধর্মীয় শিক্ষাকে শিক্ষা- পরিকল্পনার অন্তর্ভুক্তির কথা বললেও এই শিক্ষার মধ্যে নরক সম্পর্কিত আলোচনা আদৌ থাকবে না। ধর্ম সম্পর্কে যথাযথ আলোচনা মানুষকে সৎ ও আনন্দঘন জীবনযাপন করতে উদ্বুদ্ধ করে। নরকের ভয় মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরিতে সাহায্য করে। নীতিশাস্ত্র বা নৈতিকতা সম্পর্কে নার্স এবং, মা-বাবারা বাচ্চাদের এমন শিক্ষা দেবে না যা বাচ্চাদের নিকট ভুল সংকেত পাঠায়। প্রতিটি শিশুকে এমন খাদ্য দিতে হবে যা পুষ্টিকর ও স্বাস্থ্যসম্মত। অর্থাং শরীরচর্চার পাশাপাশি শরীর গঠনের জন্য যে স্বাস্থ্যসম্মত আহার দরকার সে-বিষয়ে প্লেটো অবহিত ছিলেন। অভিভাবক শ্রেণির লোকেরা দর্শনশাস্ত্র অধ্যয়ন করবে। কেবল দর্শন জ্ঞানভান্ডার স্ফীত করে তুলতে পারে।

ন্যায়বিচার তত্ত্ব

সংহতিসাধনকারী উপাদান: ন্যায়বিচার তত্ত্বটি আদর্শ রাষ্ট্রের অচ্ছেদ্য অঙ্গ হওয় সত্ত্বেও এটি স্বতন্ত্র আলোচনার দাবি রাখে কারণ প্লেটোর সমস্ত রাষ্ট্রচিন্তার মধ্যে একে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধারণা বলে কমবেশি সবাই মনে করেন। ন্যায়বিচার তত্ত্বের একটি বিশেষ দিক হল প্লেটো যেভাবে একে ‘রিপাবলিক’ বইতে নান প্রসঙ্গে আলোচনা করেছেন তাতে বলা হয় যে এটি একটি সংহতিসাধনকারী ধারণা। Justice is the integrating principle in Plato’s Ideal State. It both binds the classes to each other and is the basis for unity in the ruling group… justice must touch every body. Mc Clelland, p. 32. আমরা মনে হয় ন্যায়বিচার সম্পর্কে এই মূল্যায়নটি প্রাসঙ্গিক এবং তাৎপর্যপূর্ণ। প্লেটে যে আদর্শ রাষ্ট্রের ছক আমাদের উপহার দিয়ে গেছেন তার মধ্যে নানা শ্রেণির লোকজন বসবাস করবে বা করার সুযোগ বা ব্যবস্থা থাকবে। ধনী, দরিদ্র, মধ্যবিত্ত সবাই পাশাপাশি বাস করে স্ব স্ব কর্তব্য সম্পাদন করে যাবে। কিন্তু তারা যাতে নিজেদের মধ্যে সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির বাতাবরণ তৈরি করে রাষ্ট্রকে আদর্শসম্পন্ন করতে পারে সেজন্য তিনি ন্যায়বিচার নামক ধারণার প্রবর্তন ঘটিয়েছেন। কোনো শ্রেণি, গোষ্ঠী বা ব্যক্তি সম্পর্ককে তিক্ত করে তুলতে না পারে তার জন্য তিনি ন্যায়বিচার ধারণাটিকে ‘রিপাবলিক’-এর অসংখ্য জায়গায় নানা প্রসঙ্গে ব্যবহার করেছেন এবং তারই প্রেক্ষিতে একজন ব্যাখ্যাকার বলেছেন Justice is the proper relationship between the parts in a whole, where proper relationship means something like a working relationship. (p. 37) তিনি ধরে নিয়েছিলেন যে তাঁর কল্পিত আদর্শ রাষ্ট্রে তিনটি শ্রেণি থাকবে এবং তাদের মধ্যে সমন্বয়, সহযোগিতা গড়ে তোলা এবং সম্প্রীতির পরিবেশ আনার জন্য একটি নীতি প্রবর্তন প্রয়োজন এবং সেই নীতি হল ন্যায়বিচার। এই তিনটি শ্রেণির উপস্থিতি মার্কসীয় ভাষায় শ্রেণি-সংগ্রামের পূর্বাভাস কি না সে-কথা বলা যায় না। তবে তিনি বুঝতেন যে বিরোধ দেখা দিতেই পারে এবং তা যাতে দেখা না দেয় সে-কারণে প্লেটো এমন এক নীতি প্রবর্তনের কথা বলেছেন যা সমাজের সবাইকে বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশে এবং শান্তিতে বসবাসের প্রেরণা জোগাবে। সেই নীতিটি হল ন্যায়বিচার। সংহতিসাধনকারী উপাদান হিসেবে ন্যায়বিচারকে দেখতে গিয়ে প্লেটো যা বলেছেন তা হল এটি একটি প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাপনা (institutional arrangement)। তাঁর অভিমত হল ন্যায়বিচার সুনিশ্চিত করার জন্য আদর্শ রাষ্ট্রের ব্যবস্থাপনার পুনর্বিন্যাস বা কেবল বিন্যাস দরকার। এই বিন্যাসের চরিত্র কেমন হবে তার ওপর সংক্ষিপ্ত ও বিক্ষিপ্ত আলোকপাত করেছেন। ন্যায়বিচার আলোচনা প্রসঙ্গে তিনি একটি অত্যন্ত মূল্যবান কথা বলে গেছেন। রাষ্ট্রের প্রশাসনের বিন্যাসসাধন করা হবে মূলত ন্যায়বিচারকে সামনে রেখে এবং তা করলে কারোর কোনো অভিযোগ থাকবে না। তিনি বলেছেন: Our aim in founding the State was not the disproportionate happiness of any one class, but the greatest happiness of the whole, we thought that in a State which is ordered with a view to the good of the whole we should find Justice. (Republic, p. 129).

ন্যায়বিচারের সংজ্ঞা: ন্যায়বিচার সম্পর্কে প্লেটোর বক্তব্য পূর্ণাঙ্গরূপে বিশ্লেষণ করার আগে ‘রিপাবলিক’ বইতে তিনি কী বলেছেন তা দেখে নেওয়া যাক। … in the case of the citizens generally each individual should be put to the use for which nature intended him, one to one work, and then everyman would do his business, and be one and not many and so the whole city would be one and not many. (p. 134)… justice was doing one’s own business, and not being a busy boy…. then to do one’s own business, and not being a certain way may be assumed to be justice. ন্যায়বিচার সম্পর্কে প্লেটো যা বলতে চেয়েছিলেন এই দুটি মন্তব্যে তা খুবই স্পষ্ট। অধ্যাপক স্যাবাইন প্লেটোর বক্তব্য বিশ্লেষণ করে বলেছেন যে ন্যায়বিচার হল এক ধরনের বন্ধন যা সমাজের নানা গোষ্ঠী এবং শ্রেণিকে একত্রিত করে। আদর্শ রাষ্ট্রের আওতায় এসে প্রত্যেকে তার ন্যায্য পাওনা পাবে এবং কেউ ক্ষতির মুখে পড়বে না। এই প্রসঙ্গে স্যাবাইন আর একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন যা হল ন্যায়বিচারের বিচরণক্ষেত্র হল সমগ্র সমাজ যার ফলে একে সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত জীবনে দেখা যায় এবং একই সঙ্গে রাষ্ট্রিক জীবনের নানা আঙিনায় এ বিচরণ করে। অর্থাৎ ব্যক্তি ও রাষ্ট্র উভয়কে এর বাস্তবায়নের বিষয়ে সচেষ্টতা অবলম্বন করতে হয়। ওপরে যে দুটি মন্তব্য আমরা ‘রিপাবলিক’ থেকে দিয়েছি তাতে দেখা যায় যে প্লেটোর ন্যায়বিচার হল: giving to every man his due. প্রত্যেকের পাওনা প্রত্যেকে পেয়ে গেলে ন্যায়বিচার বাস্তবায়িত হয়েছে বলে ধরে নেওয়া হবে। সমাজের সদস্য হিসেবে প্রত্যেকের একটি স্পষ্ট ও নির্দিষ্ট অবস্থান রয়েছে এবং সেই অবস্থানে থেকে সে ন্যায়সঙ্গতভাবে সমাজের কাছ থেকে কিছু দাবি করতেই পারে। কিন্তু এখানে আবার একটি বিষয় দেখা দিচ্ছে এবং তা হল সমাজের সদস্য হিসেবে ব্যক্তি যা দাবি করছে তার পেছনে পর্যাপ্ত পরিমাণে যৌক্তিকতা আছে কি না তাও বিচার্য বিষয়। কারণ নাগরিক কেবল সমাজের সদস্য হিসেবে পাওনা দাবি করতে পারে না। সমাজের শ্রীবৃদ্ধির জন্য তাকে কিছু কর্তব্য সম্পাদন করতেই হবে এবং যে-কোনো কর্তব্য করলে চলবে না। সে যে-কাজ করছে তা সমগ্র সমাজের কল্যাণসাধনের পক্ষে উপযোগী। সমাজ ব্যক্তিকে যে স্থান ও মর্যাদা দিয়েছে সেই স্থানে অবস্থান করে এবং মর্যাদা অনুযায়ী ব্যক্তি তার কর্তব্য সম্পাদন করে যাওয়ার পরে ন্যায্য পাওনা দাবি করতে পারবে। প্লেটো তাঁর সংজ্ঞায় একটি কথা বলেছেন প্রত্যেকে তার কাজ করে যাবে যার অর্থ হল একজন নাগরিক অন্যের কাজে হস্তক্ষেপ করবে না। এই ধরনের শর্ত আরোপের অন্যতম উদ্দেশ্য হল প্রত্যেকে যদি নিজ নিজ কাজ নিষ্ঠাসহকারে করে যায়, বিভিন্ন লোকের মধ্যে সংঘাতের সম্ভাবনা তিরোহিত হবে এবং সমস্ত নগর-রাষ্ট্র একটি অবিভাজ্য এককের আকার ধারণ করবে যাকে প্লেটো বলেছেন: The whole city would be one and not many, ন্যায়বিচারকে আমরা (প্লেটোকে অনুসরণ করে) একপ্রকার শৃঙ্খলা (order) বলতে পারি যার অর্থ হল প্রতিটি ব্যক্তি ও শ্রেণি নির্ধারিত কর্তব্য করে যাবে এবং অন্যের বিষয়ে হস্তক্ষেপ করবে না। এই অর্থে ন্যায়বিচার একপ্রকার শৃঙ্খলা।

ন্যায়বিচার তত্ত্বের বিশ্লেষণ: প্লেটোর ন্যায়বিচার তত্ত্ব বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যে তিনি একে একপ্রকার সম্পর্ক (relationship) বলে অভিহিত করেছেন। প্লেটো-বর্ণিত সমাজে কয়েকটি শ্রেণি থাকবে। এরা গঠনগতভাবে পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন বা স্বতন্ত্র হলেও এদের মধ্যে একটি বা একাধিক সম্পর্ক রয়েছে কারণ এরা সকলে আদর্শ রাষ্ট্রের অংশ এবং প্রত্যেকে নিজ নিজ দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে রাষ্ট্রের সেবা করে যায় এবং এর ফলে সমাজ অগ্রগতির স্বাদগ্রহণ করতে পারে। তাই বলা হয়েছে: Justice is the proper relationship between the parts in a whole, where proper relationship means something like a working relationship. Mc Clelland, (p. 37), কিন্তু এই কার্মিক (working) সম্পর্ক কার ওপর নির্ভর করে তৈরি হবে। অর্থাৎ কারা সম্পর্ককে বাস্তবে রূপায়িত করবে? এ প্রশ্নের সরাসরি উত্তর প্লেটো দেননি। তবে ‘রিপাবলিক’ গ্রন্থে তিনি ন্যায়বিচার নিয়ে যেসমস্ত আলোচনা করেছেন তার থেকে আমরা ধরে নিতে পারি যে সমাজের তিনটি শ্রেণির মধ্যে সম্পর্ক এবং সমাজের গতিময়তা যুক্তির দ্বারা পরিচালিত হবে। প্লেটো বলেছেন যুক্তি (reason) এই কার্মিক সম্পর্কের প্রকৃত চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করবে। প্রত্যেকের কাজের মধ্যে যুক্তি এবং যুক্তিসিদ্ধতা (rationality) থাকবে। কেউ অবুঝের মতো কাজ করবে না। ন্যায়বিচার তত্ত্বে তিনি একজন ব্যক্তিকে একটির, বেশি কাজ সম্পন্ন করার দায়িত্ব দেননি। আর কেউ তা করতে গেলে তা হবে ন্যায়বিচারের পরিপন্থী। তিনি বলেছেন: one man should practise one thing only, the thing to which his nature was best adapted, now just is this principle or a part of it. (p. 147). প্লেটোর ন্যায়বিচার তত্ত্বকে সামাজিক ন্যায়বিচার (social justice) বলা যেতে পারে, অন্তত বার্কার তাই মনে করেন। বার্কার সামাজিক ন্যায়বিচার ধারণাটিকে যেভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন তা প্লেটোর ন্যায়বিচার তত্ত্বের ভাষান্তর মাত্র। তিনি বলেছেন যে সামাজিক ন্যায়বিচার হল সমাজের একটি নীতি যা অনেকরকম ব্যক্তিকে নিয়ে গঠিত। সমাজস্থ ব্যক্তিবর্গ একত্রিত হয়েছে পরস্পরকে সাহায্য করার প্রেরণা নিয়ে। তারা মানুষ হিসেবে স্বতন্ত্র হলেও কাজ বা দায়িত্ব তাদের আলাদা কিন্তু নিজেদের মধ্যে সহযোগিতা বজায় রেখে স্বতন্ত্র দায়িত্ব পালন করে চলে। সৌহার্দ্য এবং সম্প্রীতির যে বাতাবরণ তারা গড়ে তুলেছে তা একেবারে নিখাদ। বার্কার প্লেটোর ন্যায়বিচার তত্ত্বকে এইভাবে পুনরায় ব্যাখ্যা করেছেন। আমরা মনে করি প্লেটো ন্যায়বিচার তত্ত্বের মাধ্যমে বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেছেন। প্রতিটি ব্যক্তি তার নিজস্ব পেশা বা কাজ স্বাধীনভাবে করে যাওয়ার সুযোগ ও স্বাধীনতা অবশ্যই পাবে। অন্যের কাছে এবং স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করতে পারবে না। আর একই সঙ্গে সমাজের ঐক্য ও সংহতির প্রতি সতর্ক নজর রাখবে। অথবা বলা যেতে পারে ঐক্য বিনষ্ট হতে দেবে না। প্রতিটি শ্রেণির সদস্যরা নিজ নিজ কাজ সাফল্যের সঙ্গে সম্পন্ন করে আস্তে আস্তে বিশেষজ্ঞ হয়ে উঠবে কিন্তু সামাজিক সহযোগিতা আদৌ বিঘ্নিত হবে না। প্লেটোর ন্যায়বিচার তত্ত্ব সেই বিষয়টির ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছে।

রাষ্ট্র এবং ন্যায়বিচার: রিপাবলিক-এ প্লেটো বলেছেন in the good state justice would be found. এই ছোট্ট মন্তব্য থেকে একটি বিষয় স্পষ্ট যে তিনি রাষ্ট্র (আদর্শ) এবং ন্যায়বিচারকে পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন বলে মনে করেননি। অর্থাৎ কেবল ভালো রাষ্ট্রেই (good state) ন্যায়বিচার থাকতে পারবে। আমরা মনে করি প্লেটোর এই উক্তির মধ্যে যথেষ্ট তাৎপর্য রয়েছে। ন্যায়বিচারহীন রাষ্ট্র কদাপি আদর্শ নামধারী হয়ে পারে না। রাষ্ট্রকে আদর্শ হতে গেলে কেবল আইন-শৃঙ্খল রক্ষা করলে চলবে না, মানুষের জন্মগত ও প্রকৃতিগত যে বৈশিষ্ট্য তার ভিত্তিতে সমাজের শ্রেণিবিন্যাস স্থির হবে এক আদর্শ রাষ্ট্র সযত্নে সেই বিন্যাস রক্ষা করবে। এই শ্রেণিবিন্যাস ধ্বংস করা মানে প্রকৃতির বিরুদ্ধে যাওয়া। আমরা আগেই বলেছি যে প্লেটো তাঁর ধ্যানধারণা বিশ্লেষণ করার সময়  মহাবিশ্ব (cosmos) এবং পোলিস বা এ নগর-রাষ্ট্রকে একই বন্ধনীর মধে রেখেছিলেন। সুতরাং সমাজের যে শ্রেণিবিন্যাস তা প্রকৃতিদত্ত এবং সে-কারণে পার্থিব জগতের একটি পোলিসের পক্ষে সেই বিন্যাস নস্যাৎ করা সম্ভব নয়। প্লেটো বলেছেন: An a state was thought by us to be just when the three classes in the state severally did their own business, and also thought to be temperate an valiant and wise by reason of certain other affections and qualities of the same classes ? (p 150)। অর্থাৎ রাষ্ট্রকে আদর্শ হতে হলে দেখতে হবে যেসকল শ্রেণি রয়েছে সেগুলি যেন তাদের চরিত্রগত স্বাতন্ত্র্য না হারিয়ে ফেলে এবং যদি হারিয়ে ফেলে তাহলে রাষ্ট্র আর আদর্শ রাষ্ট্র থাকবে না। অর্থাৎ আদর্শ রাষ্ট্রের দার্শনিক রাজা ও অভিভাবক শ্রেণি রাষ্ট্রের শ্রেণিগত বৈশিষ্ট্য বজায় রাখার জন্য প্রশাসনকে ব্যবহার করবে। তাই জনৈক রুশ বিশেষজ্ঞ প্লেটোর ন্যায়বিচার তত্ত্বের বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বলেছেন: justice demands a corresponding state structure, social hierarchy ensuring a harmonious unity of the three principles for the common good, Wisdom, courage and temperence. আদর্শ রাষ্ট্রের দার্শনিক রাজা ও অভিভাবক শ্রেণি যদি মনে করেন যে রাষ্ট্রর শৃঙ্খলা (order) বা শ্রেণিবিন্যাস বিনষ্ট হওয়ার মুখে অথবা মুষ্টিমেয় কয়েকজন বিপুল সম্পদের অধিকারী হয়ে প্রচুর সুখ পাচ্ছে এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ সুখ থেকে বঞ্চিত তাহলে রাষ্ট্র সেই অবস্থার অবসান ঘটাবার উদ্যোগ নেবেন। এই ভূমিকাটি প্লেটো বারংবার তাঁর বইতে নানা স্থানে নানা প্রসঙ্গে উল্লেখ করেছেন। আমরা একটু অন্যভাবে বিষয়টি উপস্থাপিত করতে পারি। প্লেটোর ধারণার রাষ্ট্র ও ন্যায়বিচার পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল এবং কিছু পরিমাণে পরিপুরকও, বটে।

মূল্যায়ন

ন্যায়বিচার ধারনাটি খুবই ব্যপক: সংকীর্ণ দৃষ্টি বা প্রেক্ষাপটে প্লেটোর ন্যায়বিচার ধারণাটিকে বিচার করা ঠিক নয় এবং করতে গেলে তাঁর প্রতি অবিচার করা হবে। আর. এন. বার্কি বলেছেন: Plato’s notion of justice is much wider than today’s term: it does not mean legal or administrative justice so much as, moral duty, righteousness or right ordering of state. It is the summary expression of the good or ideal form of human society. (p. 49), আমাদের ধারণা প্লেটোর সমগ্র রাষ্ট্রদর্শন বা রাষ্ট্রচিন্তার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হল এই ন্যায়বিচার তত্ত্ব। তাঁর সমকালের নগর-রাষ্ট্রগুলির শোচনীয় এবং নৈরাজ্যজনক অবস্থা দেখে একটি আদর্শ রাষ্ট্র গড়তে চেয়েছিলেন। এই জাতীয় রাষ্ট্র একদিকে যেমন রাজনীতিক স্থিতিশীলতা, দায়িত্বশীল প্রশাসন, আইন মোতাবেক শাসন ও সুবিচার সুনিশ্চিত করবে অন্যদিকে তেমনি সুনাগরিক গড়ে তুলতে সক্ষম হবে। সুনাগরিক বলতে প্লেটো সৎ, দায়িত্বজ্ঞানসম্পন্ন, সহানুভূতিশীল এবং আদর্শ ব্যক্তি বুঝিয়েছেন। তাঁর মতে কেবল সৎ ও দায়িত্বজ্ঞানসম্পন্ন নাগরিক রাষ্ট্রের অধোগামিতা বা পচনশীল অবস্থার গতি রোধ করতে পারে। কিন্তু তিনি জানতেন যে ব্যক্তির মধ্যে মৃত ও অশুভ উভয়-প্রকার শক্তি আছে এবং পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতির চাপে পড়ে অশুভ শক্তি প্রাধান্য পায় বলে নাগরিক সততা, নীতিবোধ প্রভৃতি অনুযায়ী কাজ করার সুযোগ পায় না। সুতরাং বাইরের এমন এক শক্তি বা প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি করতে হবে যা নাগরিকের মনে যুক্তি চেতনা এবং rationality জাগিয়ে তুলতে ও দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে। তাঁর মনে এই প্রত্যয় জন্মেছিল যে কেবল আদর্শ রাষ্ট্রই নাগরিককে সৎ, নীতিজ্ঞানসম্পন্ন, সুবিবেচক করে তুলতে পারে। তাঁর ধারণা হয়েছিল যে ব্যক্তির সর্বোৎকৃষ্ট আদর্শ, সততা, নীতিবোধ, মূল্যবোধ এবং রাষ্ট্রের সততা, আদর্শ ও মূল্যবোধের মধ্যে পার্থক্য নেই। সুতরাং রাষ্ট্রের নেতৃত্বে এবং সক্রিয় সহযোগিতায় ব্যক্তি এগুলি অর্জন করতে পারে। আর রাষ্ট্রেরও এ ব্যাপারে একটি ইতিবাচক এবং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। ব্যক্তি আদর্শ না হলে রাষ্ট্র আদর্শ হতে পারে না এবং সে-কারণে রাষ্ট্রের প্রাথমিক দায়িত্ব হল আদর্শ নাগরিক গড়ে তোলা। আর একটি বিষয়ের উল্লেখ খুবই প্রয়োজন। মোটামুটি সমস্ত গ্রিক পন্ডিত মূল্যবোধের বা সততার রাজনীতির কথা বললেও প্লেটোর হাতে তা যেন একটি বিশাল মহিরুহে পরিণত হয়েছে। তিনি চাইতেন যে রাষ্ট্র মানে রাজনীতি কিন্তু এই রাজনীতি আপাদমস্তক নীতি ও আদর্শের দ্বারা আবৃত হবে। সংকীর্ণ এবং সততাবর্জিত রাজনীতি রাষ্ট্রের চালিকাশক্তির আসনে বসতে পারে না। নীতি ও মূল্যবোধ সংবলিত রাজনীতি রাষ্ট্র পরিচালনা করবে। আর তার জন্য প্রয়োজন ন্যায়বিচারের একাধিপত্য। সূতরাং আমরা দেখতে পাচ্ছি যে প্লেটো ন্যায়বিচার ধারণাটিকে রীতিমতো ব্যাপক অর্থে ব্যবহার করে আদর্শ রাষ্ট্রের বিশেষ অঙ্গে পরিণত করেছেন।

প্লেটোর মূল দর্শনচিন্তার সঙ্গে: সামঞ্জস্যপূর্ণ প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্র ও ন্যায়বিচার তত্ত্বকে তাঁর মূল দর্শনচিন্তার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ বলে মনে করা হয়। বিশেষ করে তিনি যে ন্যায়বিচার তত্ত্বের কথা বলেছেন তার প্রকৃত প্রেক্ষিত হল আদর্শ রাষ্ট্র। কারণ আদর্শ রাষ্ট্রের জন্য প্রয়োজন আদর্শ নাগরিকের এবং আদর্শ বস্তুগত পরিবেশের, কিন্তু যেহেতু নাগরিকের মধ্যে নীতিবোধ, সততা, আদর্শ সম্যকরূপে বিকশিত হয়নি তার জন্য আদর্শ রাষ্ট্রের প্রয়োজন। তিনি  যে ধারণা করেছেন তা হল রাষ্ট্রের তিনটি শ্রেণির প্রত্যেকে নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করে গেলে নানা শ্রেণির মধ্যে সংঘাত দেখা দিতে পারে না এবং এই পরিস্থিতি শ্রেণি-সংগ্রামের সম্ভাবনাকে ধ্বংস করে দেবে। একদিকে শ্রেণি-সংঘাতের সম্ভাবনাকে বিনষ্ট করে দেওয়া অন্যদিকে প্রত্যেককে নিজ নিজ দায়িত্ব পালনের সুযোগ করে দেওয়াকে তিনি ন্যায়বিচার বলেছেন। কথা হল আমরা একে ন্যায়বিচার নাও বলতে পারি। এই মতের গরমিলের জন্য আমরা তাঁর সমালোচনা করতে পারি কিন্তু তাঁর মতকে নস্যাৎ করে দিতে পারি না। শ্রেণি-সমাজে প্রতিটি শ্রেণি কী কী কাজ করবে সে-বিষয়ে প্লেটো যে সমাধান-সূত্র বের করেছেন তার চেয়ে বাস্তব সমাধান অন্য কেউ দিতে পারতেন কি না আমরা বলতে পারি না। তবে শ্রেণিবিন্যস্ত সমাজের পক্ষে এটি খুবই প্রাসঙ্গিক। ভারতের অতীত দিনের ইতিহাসের দিকে দৃষ্টিপাত করলে আমরা দেখতে পাই যে একই প্রথার উপস্থিতি ছিল। গীতায় বলা হয়েছে:

চাতুর্বণ্যং ময়া সৃষ্টং গুণকর্মবিভাগশঃ
তস্যকর্তারমপি মাং বিদ্ধ্যকর্তারমধ্যয়ম।।

গীতার চতুর্থ অধ্যায়ে শ্লোক ১৩ নং-এ ভগবান বলেছেন যে তিনি গুণ, কর্ম ইত্যাদি বিচার করে চারটি শ্রেণি সৃষ্টি করেছেন। আর প্রতিটি শ্রেণিকে বলা হয়েছে কী কী কাজ করবে। প্রাচীন ভারতের সমাজব্যবস্থার প্রেক্ষিতে এই শ্রেণিবিভাজন খুবই প্রয়োজনীয় ছিল, বর্তমানে তা নেই। সুতরাং বর্তমানের প্রেক্ষিতে তাকে নস্যাৎ করে দেওয়ার প্রশ্ন ওঠে না। প্লেটো দার্শনিক রাজা ও অভিভাবক শ্রেণিকে কায়িক পরিশ্রম থেকে মুক্তি দিয়ে জ্ঞান, দর্শনচিন্তায় আত্ম- নিয়োগের কথা বলেছিলেন এবং তাঁর এই প্রস্তাব অনুমোদন করতে হলে দরকার প্রতিটি শ্রেণি কী কাজ করবে তা স্থির করা। অর্থাৎ শ্রমবিভাগ স্বীকার করে নিতেই হবে। সুতরাং ন্যায়বিচার তত্ত্বে তিনি যে কাজের মধ্যে বিভাজনের প্রস্তাব দিয়েছেন তা আমাদের নিকট গ্রহণযোগ্য নাও হতে পারে। কিন্তু এ সম্পর্কে শেষ কথাটি উচ্চারণের আগে আমাদের জানতে হবে তাঁর আসল পরিকল্পনাটি কী ছিল। ন্যায়বিচার তত্ত্ব বাতিল করতে হলে আদর্শ রাষ্ট্র বাতিল করতে হবে। কার্ল পপার বলেছেন: Republic is probably the most elaborate monograph on justice ever written. It examines a variety of views about justice and it does this in a way which leads us to believe that Plato omitted none of the more important theories known to him. p. 93.

আদর্শ রাষ্ট্র ও ন্যায়বিচার সমষ্টিবাদের জন্মদাতা: গণতন্ত্র ও উদারনীতিবাদের উপাসকরা প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্র এবং ন্যায়বিচার তত্ত্বের মধ্যে সমষ্টিবাদের (totalitarianism) অস্তিত্ব খুঁজে পেয়েছেন। প্রখ্যাত দর্শনিক রাসেল বলেছেন যে প্লেটো এই দুটি ধারণার প্রবর্তন ঘটিয়ে রাজনীতি শাস্ত্রে কর্তৃত্ববাদের (authoritarianism in politics) আনতে চেয়েছিলেন। রাসেল প্রমুখদের বক্তব্য হল তাঁর এই প্রচেষ্টাকে একেবারে মেনে নেওয়া যায় না। একই সুরে কার্ল পপার তাঁর সুবিখ্যাত গ্রন্থ Open Society and Its Enemies-এ বলেছেন: Plato’s demand for justice leaves his programme at the level of totalitarianism. এখানে সমষ্টিবাদ বা কর্তৃত্ববাদ ধারণাটিকে উদারনীতিবাদের প্রেক্ষাপটে দেখা হয়েছে। কারণ উদারনীতিবাদ কোনো ব্যক্তি, ব্যক্তিগোষ্ঠী বা শ্রেণির প্রাধান্য স্বীকার করতে চায় না, জনগণই সবকিছুর উৎস। শ্রেণিশাসন থাকলেও থাকতে পারে কিন্তু তার একাধিপত্য বর্তমানকালের পন্ডিতেরা মানতে চান না। সেই অর্থে তাঁরা প্লেটোর ন্যায়বিচার ধারণাটির মধ্যে সমষ্টিবাদের অস্তিত্ব খুঁজে পেয়েছেন। আমরাও মনে করি যে একটিমাত্র শ্রেণির হাতে সমস্ত আদর্শ রাষ্ট্রের কল্যাণে ও প্রশাসন পুঞ্জীভূত থাকবে তা মেনে নেওয়া যায় না। আসল ঘটনা হল প্লেটো তাঁর সমকালের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলির শোচনীয় অবস্থা দেখার পর হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন এবং জনগণের বিচারবুদ্ধি ও দক্ষতার ওপর আস্থা স্থান করতে পারেননি। প্রশ্ন হল কারা রাষ্ট্র শাসন করবে?। কোনো কারণেই হোক তাঁর মনে এই প্রত্যয় তৈরি হয়ে যে একজন সর্বজ্ঞ দার্শনিক ব্যক্তির হাতে প্রশাসনিক কজ অর্পণ করলে তিনি রাষ্ট্রকে সুশাসন উপহার দিতে পারেন। আবার ওই দার্শনিক সর্বজ্ঞ ব্যক্তি, ধরে নেওয়া যেতে পারে নির্লোভ হবেন। সুতরাং দার্শনিক শাসক  নিজের ব্যক্তিগত স্বার্থের প্রয়োজনে প্রশাসন ও রাষ্ট্রের সম্পদকে ব্যবহার করবেন না। এই ধারণা থেকে জন্ম নিয়েছে দার্শনিক রাজা তত্ত্বটি। আসলে এর থেকে জন্ম নিয়েছে সমষ্টিবাদ যা তিনি ধারণা করতে পারেননি। তা ছাড়া তিনি যেভাবে অভিভাবক শ্রেণির হাতে সমস্ত ক্ষমতা তুলে দিতে চেয়েছিলেন তাকেও সমষ্টিবাদের নামান্তর বলা যেতে পারে। কেবল অভিভাবক শ্রেণি প্রশাসন চালাবার কাজে দক্ষতা অর্জন করেছে এ ধারণা তিনি কোথেকে সংগ্রহ করলেন তা আমাদের জানা নেই। তবে তার জানা উচিত ছিল যে একটিমাত্র শ্রেণির হাতে সমস্ত ক্ষমতা জমা হলে তার অপব্যবহার হতেই পারে। তাঁর মতো একজন সর্বজ্ঞ ব্যক্তি কেন যে এই সম্ভাবনা জানলেন না তা আমাদের অজ্ঞাত। সার্বিক বিচারে আমরা বলব তাঁর ন্যায়বিচার তত্ত্ব ও আদর্শ রাষ্ট্র আদৌ গণতন্ত্রের পথে অনুকূল নয়। বরং স্বৈরতন্ত্রের আগমনের পথকে প্রশস্ত করে তুলবে যেমন করেছিল ১৯১৭ খ্রি.-এ সোভিয়েত যুক্তরাষ্ট্র একটি দল সমস্ত ক্ষমতার কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল।

প্লেটোর সাম্যবাদ তত্ত্ব

রিপাবলিক-এ সাম্যবাদসম্পর্কিত ধারণা:  প্লেটোর সাম্যবাদ তত্ত্বটি (theory of communism) তাঁর আদর্শ রাষ্ট্রের একটি অংশমাত্র। তাঁর আলোচনা থেকে আমরা জানতে পারি যে অভিভাবক শ্রেণির জীবনযাত্রা কেমন হবে বা হওয়া উচিত সে-বিষয়ে তিনি যৎপরোন চিন্তিত ছিলেন। কারণ তিনি জানতেন যে তাঁর মানসম্মত আদর্শ রাষ্ট্র অভিভাবক শ্রেণির দ্বারা পরিচালিত বা শাসিত হবে। কিন্তু এই প্রশাসনের গুণগত মান-অভিভাবক শ্রেণীর জীবনযাত্রা আদর্শ ও চরিত্রের ওপর নির্ভর করে এবং এই বিষয়টি তিনি ‘রিপাবলিক’ গ্রন্থের তৃতীয় খন্ডের ৪১৬নং অংশে ব্যাখ্যা করেছেন। অভিভাবক শ্রেণির যারা সামরিক বিভাগে ও প্রশাসনে নিযুক্ত থাকবে তাদের সমস্ত বিষয়ে বিশেষ দক্ষতা ও পটুতা থাকবে এবং এই গুণ আসবে কতকগুলি উৎস থেকে। একটি হল শিক্ষা যা মানুষকে মানবিক জ্ঞানসম্পন্ন, সচেতন ও বুদ্ধিবৃত্তির অধিকারী করে তোলে। অবশ্য শিক্ষা বলতে তিনি আদর্শ রাষ্ট্রের শিক্ষার কথা বলতে চেয়েছেন। True education will civilise and humanise the guardians. (p. 126)। কিন্তু পরক্ষণেই তিনি বলেছেন যে কেবল শিক্ষাই অভিভাবক শ্রেণিকে আদর্শ রাষ্ট্রের উপযুক্ত অভিভাবক করে তুলতে পারে না। তাহলে কী দরকার? তিনি বলেছেন: not only their education, but their habitations, and all that belongs to them, should be such as will neither impair their virtue as guardians, not tempt them to prey upon the other citizens. (pp. 126-127). অভিভাবক শ্রেণি যাতে প্রলুদ্ধ না হয় সে ব্যবস্থা থাকা একান্ত দরকার। সম্পত্তি, সম্পদ, বাসস্থান পরিবারবর্গ ইত্যাদির প্রতি আকর্ষণ অভিভাবক শ্রেণির মধ্যে গড়ে উঠতে পারে এবং তাহলে অভিভাবক শ্রেণি অন্যান্য শ্রেণি থেকে স্বতন্ত্র হয়ে থাকবে না। এই মর্যাদা হ্রাস অভিভাবক শ্রেণিকে শাসনের পক্ষে অনুপযুক্ত করে তুলবে। সমাধান কোথায়? তাদের কারোর ব্যক্তিগত সম্পত্তি এমনকি নিজেদের বাসস্থানও থাকবে না। তবে যেটুকু নিছক প্রয়োজন কেবল সেটুকুই তারা পাবে। একজন প্রশিক্ষিত সেনার যুদ্ধে যাওয়া বা জীবনযাত্রা নির্বাহের জন্য যা প্রয়োজন সেটুকু তাকে দেওয়া হবে (None of them should have any property of his own beyond what is absolutely necessary, neither should they have a private house or store.  … their provisions should be only such as are required by trained warriors …they should agree to receive from the citizens a fixed rate of pay, enough to meet the expenses of the year and no more and they will go to mess and live like soldiers in a camp. (p. 127)। সেনারা প্রয়োজন মেটাবার জন্য যেটুকু দরকার তাই পাবে। কেবল তারা নয়, অভিভাবক শ্রেণির সদস্যরাও তাই পাবে। একে তিনি অভিভাবক শ্রেণির জীবনযাত্রার পদ্ধতি বলেছেন।

আদর্শ রাষ্ট্রের জন্য সাম্য প্রয়োজন: বিশেষ উদ্দেশ্যসাধনের নিমিত্ত প্লেটো আদর্শ রাষ্ট্রের পরিকল্পনা করেছিলেন এবং তাঁর যে কালজয়ী গ্রন্থ ‘রিপাবলিক’ তাকেই পাশ্চাত্য রাষ্ট্রচিন্তার ব্যাখ্যাকারগণ আদর্শ রাষ্ট্র বা Ideal State বলেছেন। আদর্শ রাষ্ট্র বা রিপাবলিক স্থাপনের সময় কী করা হবে বা করা উচিত তা নিয়ে তিনি সবিস্তারে সবকিছু আলোচনা করেছেন। এই জাতীয় রাষ্ট্রের একটি উপাদান যে সাম্যবাদ বা কমিউনিজম তা আমরা একটু আগে আলোচনা করেছি। আদর্শ রাষ্ট্রের আর একটি উপাদান হল সাম্য বা equality, অবশ্য চূড়ান্ত বিশ্লেষণে সাম্যবাদ ও সাম্য সমগোত্রীয়, সাম্যবাদী সমাজের একটি বিশেষ লক্ষ্য হল অসাম্যের অবসান ঘটানো বা তার তীব্রতা হ্রাস করা। ‘রিপাবলিক‘-এর চতুর্থ খণ্ডে এবং ৪২০ অংশে তিনি বলেছেন রাষ্ট্র গঠনে আমাদের উদ্দেশ্য হল একটি শ্রেণিকে বিপুল পরিমাণে সুখী করা নয়, সকলকে অথবা সমস্ত শ্রেণির লোককে সর্বাধিক পরিমাণে সুখী করে তোলা। একটি রাষ্ট্র সকলের কল্যাণসাধনে নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যদি লক্ষ্যসাধনে সাফল্য অর্জন করে তাহলে সেই রাষ্ট্রে ন্যায়বিচার স্থাপিত হয়েছে বলে মনে করা হবে। আর যে- রাষ্ট্রে শৃঙ্খলা থাকে না সেখানে ন্যায়বিচারও থাকে না। এরপরে প্লেটো একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের অবতারণা করেছেন। বিষয়টি হল অভিভাবক শ্রেণি যদি মনে করে যে তাদের কৃচ্ছ্রসাধনের জন্য বাধ্য করা হচ্ছে এবং তারা  তাদের ইচ্ছামতো স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ পাচ্ছে না তাহলে আদর্শ রাষ্ট্রের পক্ষে তা ক্ষতিকর হবে । এই সম্ভাবনার বিষয়টি মাথায় রেখে প্লেটো আদর্শ রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলি নিয়ে আলোচনা করেছেন। তাঁর মত হল আদর্শ রাষ্ট্রের অন্যতম কাজ হল নাগরিকদের উপযুক্ত শিক্ষা দিয়ে রাষ্ট্রের পক্ষে উপযোগী করে তোলা। কেন তিনি সাম্যবাদকে আদর্শ রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা ও ন্যায়বিচারের জন্য অপরিহার্য মনে করেছিলেন সে-সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে ওয়েপার বলেছেন যে, তাঁর সময়ে অনেক গ্রিক নগর- রাষ্ট্র বৈষম্য, শিক্ষার ক্ষেত্রে অনগ্রসরতা, সততা, মূল্যবোধের অনুপস্থিতিহেতু চরম সংকটের মধ্যে পড়েছিল। এমনকি অনেক রাষ্ট্র ধ্বংসের মুখে এসে দাঁড়িয়েছিল। তাই তিনি অভিভাবক শ্রেণির সদস্যদের মধ্যে সাম্যবাদ প্রবর্তনের ওপর জোর দিয়েছিলেন। আর একটি বিষয় হল অন্যান্য শ্রেণির প্রয়োজনীয়তা থাকলেও তিনি অভিভাবক শ্রেণিকে আদর্শ রাষ্ট্রের পক্ষে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলে ভেবেছিলেন। তাঁর ধারণায় এই শ্রেণি হল রাষ্ট্রের মস্তিষ্ক, আর মস্তিষ্ক যদি সঠিকভাবে কাজ না করে রাষ্ট্রের ক্ষতি হবে অপূরণীয়। তাঁর সাম্যবাদী ধারণার সঙ্গে রাজনীতির লক্ষ্য এবং রাজনীতির সঙ্গে সততা বা মূল্যবোধের সম্পর্ক বিষয়টিও নিবিড়ভাবে জড়িত। সকলের সর্বাধিক সুখ নিশ্চিত করার জন্য দরকার সাম্যবাদ। রাষ্ট্রকে স্থিতিশীল করার জন্য প্রয়োজন সাম্যবাদ ও অভিভাবক শ্রেণির সুশাসন। সবকিছুই মূল্যবোধের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত বলে জন মরো মনে করেন।

প্লেটোর স্থান

উত্তরসূরিদের ওপর প্রভাব: আজ থেকে পঁচিশটি শতক আগে প্লেটো নামে একজন গ্রিক দার্শনিক রাজনীতি শাস্ত্র নিয়ে নানা আলোচনা করেছিলেন এবং আপাতদৃষ্টিতে ওই সমস্ত আলোচনা এবং তাদের ঘিরে নানা বিশ্লেষণ মূল্যহীন বা অপ্রাসঙ্গিক। কিন্তু বৃহত্তর প্রেক্ষিতে বিচার করলে আমরা এই সিদ্ধান্তে উপস্থিত হব যে আজও তাঁর বিস্তর গুরুত্ব রয়েছে এবং বিগত পঁচিশটি শতকে তিনি নানাভাবে রাষ্ট্রচিন্তার পুরোধা ব্যক্তিদের প্রভাবিত করেছেন। পাশ্চাত্য রাষ্ট্রচিন্তার একজন রুশ বিশেষজ্ঞ বলেছেন: The intellectual heritage of Plato has been exercising the mind of philosophers, political thinkers and sociologists for over twenty-five centuries. (Political Thought of Ancient Greece. p. 130). অ্যারিস্টটল এবং ঐতিহাসিক পলিবিয়াস (Polybius) প্লেটোর নিকট ঋণী। প্লেটোর ভাবধারা ও দর্শনের দ্বারা অগাস্টাইন উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন। সিটি অফ গড লেখার আগে তিনি প্লেটোর ‘রিপাবলিক’ কয়েকবার পড়েছিলেন। টমাস আকুইনাস (১২২০-১২৭৪) প্লেটোকে অনুসরণ করে সরকারের শ্রেণিবিভাগ করেছিলেন। অনেকে বলেন যে সামন্ততান্ত্রিক সমাজের শ্রেণিবিন্যাসের সঙ্গে প্লেটো-বর্ণিত শ্রেণিবিন্যাসের সাদৃশ্য লক্ষ করা যায়। প্লেটো বলতেন যে প্রতিটি শ্রেণি তার নিজ দায়িত্ব পালন করবে এবং তার মাধ্যমেই সমস্ত ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হবে। প্যাডুয়ার মার্সিলিও এই নীতি অনুসরণ করে যাজকদের বলেছিলেন যে তারা যেন ধর্ম ছাড়া অন্য বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করে। প্লেটো বৈধ রাজতন্ত্রের সমর্থক ছিলেন এবং তাঁর এই ধারণা পরবর্তীকালের স্বৈরতন্ত্রের ওপর আঘাত হেনেছিল। টমাস মুর ও কাম্পানেল্লা যে- কাল্পনিক সমাজ গঠনের কথা বলেছিলেন তাকে প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রের প্রতিফলন বলা যেতে পারে। মার্কসীয় সমাজবাদের প্রেরণা হল প্লেটোর সাম্যবাদ। যদি আমরা প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্র ও সাম্যবাদকে কাল্পনিক বলি তাহলে মার্কসীয় সমাজবাদকে একই অভিধা দিতে বাধ্য হব। পন্ডিত ব্যক্তিরা বলেন যে স্পিনোজা এবং হবস্ জ্যামিতিক উপায়ে সমাজ ও রাজনীতি বিশ্লেষণ করেছিলেন। এই ধারণাটি প্লেটোর দর্শন থেকে গৃহীত। রুশোর নৈতিক সমাজ ও প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রের মধ্যে বিশেষ পার্থক্য দেখি না। মন্টেস্কু প্লেটোর দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন বলে দাবি করা হয়। প্রবুদ্ধকরণ (Enlightenment), যুগের অনেকে প্লেটোর প্রভাবে পড়েছিলেন। হেগেল ও মার্কস প্লেটোর দ্বান্দ্বিকতার প্রভাব আদৌ এড়াতে পারেননি। বস্তুত হেগেল এবং মার্কস্ যেভাবে তাঁদের দ্বান্দ্বিকতা নিয়ে আলোচনা করেছেন তা প্লেটোর তৈরি। তফাৎ যে নেই তা নয়। তবে মূল ধারণা প্লেটোর। জার্মানির বুর্জোয়া সমাজ গড়ে তোলার এক পরিকল্পনা জার্মান দার্শনিক ফিকটে (Fichte) করেছিলেন এবং সেটি নাকি প্লেটোর অনুকরণে। কোনো কোনো রুশ চিন্তাবিদের ওপর প্লেটোর প্রভাব লক্ষ করা যায়। পপার বলেন মধ্যযুগের কর্তৃত্ববাদ (authoritarianism) এবং আধুনিক সমষ্টিবাদের উৎস প্লেটোর দর্শনচিন্তা।

সামাজিক ভাববাদ এবং সাম্যবাদের উৎস ও তিনি: পাশ্চাত্য রাষ্ট্রচিন্তার প্রখ্যাত ব্যাখ্যাকার ম্যাকসে মনে করেন যে আজকাল আমরা যাকে সামাজিক ভাববাদ (বা social idealism) বলি তার সৃষ্টিকর্তা হলেন প্লেটো। তিনি বলেন, Milton, Locke, Rousseau, Goethe and other, great apostles of social idealism have drawn heavily upon him (p.  55)। কঠোর বাস্তবজগতে যা ঘটেছে বা ঘটতে পারে কেবল তারই নিরিখে প্লেটো তাঁর ভাববাদী বা আদর্শ রাষ্ট্র বা ন্যায়বিচার তত্ত্ব বিশ্লেষণ করেননি। একটি রাষ্ট্রের কী হওয়া উচিত সে ধারণার দ্বারা পরিচালিত হয়ে তিনি তাঁর আদর্শ রাষ্ট্রের পরিকল্পনা রচনা করেছিলেন। আর এই পরিকল্পনার পেছনে ছিল সমকালের রাষ্ট্রগুলির শোচনীয় ও সংকটজনক অবস্থা। সুতরাং তাঁর আদর্শ রাষ্ট্রকে শেকড়হীন বা অপ্রাসঙ্গিক বলে মনে করার  কারণ নেই। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন যে সমাজে ধনী-দরিদ্রের মধ্যে প্রকট ব্যবধান, সংঘাতের প্রধান কারণ এবং সেইজন্য তিনি এমন এক সমাজ গড়ে তোলার কথা বলেছিলেন যে সমাজে এই প্রকট বৈষম্য থাকবে না। ‘রিপাবলিক’-এর অনেক জায়গায় তিনি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় তা প্রকাশ করেছেন। বুঝতে অসুবিধা হয় না যে তাঁর নিকট আর্থনীতিক সংকট গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ম্যাক্সে-কে বলতে শোনা যায় our own day, wrestling with difficulties said to result from economic disbalance a polite name of unrestrained profiteering is hearing afresh the ancient doc- trines of Plato. (p. 55)। মার্কস এবং এঙ্গেলস যে প্লেটোর সাম্যবাদী দর্শনের জন্য প্লেটোর নিকট ঋণী সে প্রসঙ্গের উল্লেখ আগেই করেছি। কার্যত প্লেটোই প্রথম সাম্যবাদের কথা প্রচার করেন। আদর্শ রাষ্ট্রকে দক্ষ প্রশাসনিক ব্যবস্থার অধীনে আনার জন্য তিনি সাম্যবাদ প্রবর্তনের কথা বলেছিলেন। কিন্তু মার্কস-এঙ্গোলস-এর সাম্যবাদের লক্ষ্য স্বতন্ত্র। আমাদের বিষয় সাম্যবাদের লক্ষ্যকে নিয়ে নয়। সাম্যবাদ ধারণাটির সৃষ্টি প্লেটোর হাতে। আর ম্যাক্সে বলেছেন: Virtually all socialistic and communistic thought has its roots in Plato. Were he alive today, Plato would be the reddest of Reds and would no doubt hasten to Russia with the same expectant enthusiasm he displayed in answering the call of the ancient tyrant of Syracuse. (p. 55)। আর একজন সমালোচক বলেছেন যে প্লেটোর আদশ রাষ্ট্র এবং রাশিয়ার সাম্যবাদী রাষ্ট্রের মধ্যে বিস্তর সাদৃশ্য রয়েছে। উভয়ক্ষেত্রে সম্পত্তির ব্যক্তিমালিকানাকে সমস্ত প্রকার অপকর্মের উৎস বলে গণ্য করা হয়, উভয়েই চায় সম্পদ ও দারিদ্র্যের অবসান ঘটুক। প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্র ও সাম্যবাদ কেন্দ্র-নিয়ন্ত্রিত মতাদর্শের কথা বলে। দুই ব্যবস্থাই মতাদর্শ ও বিজ্ঞানকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে চায়। আদর্শ রাষ্ট্র ও সাম্যবাদের বক্তব্য একই।

মেধা বনাম বংশগত শাসন: প্লেটোর দার্শনিক রাজার শাসন বহুজন-সিঞ্চত একটি ধারণা। কিন্তু দার্শনিক রাজা বা অভিভাবক শ্রেণি কর্তৃক প্রশাসন ধারণাটিকে বৃহত্তর প্রেক্ষিতে বিচার করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। ইতিহাসের পাতায় বংশানুক্রমিক শাসকের বিবরণ আমরা পড়েছি। দেখা গেছে যে অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই বংশানুক্রমিক শাসকরা শাসন পরিচালনার ব্যাপারে যোগ্যতার অধিকারী নয়। অপদার্থতা, অযোগ্যতা, দুর্নীতি ইত্যাদি সমস্ত প্রশাসনকে একটি আস্তাবলে পরিণত করে ফেলে। বোধবুদ্ধি, ন্যায়পরায়ণতা প্রভৃতি তাদের মধ্যে বিকাশলাভের সুযোগ পায় না। কেবল প্রশাসন যে ক্ষতিগ্রস্ত হয় তা নয়, রাষ্ট্রের বিকাশও ব্যাহত হয়। সুতরাং বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্র বা শাসনব্যবস্থাকে আদর্শ বা কাম্য বলে মনে করা হয় না। এই পরিস্থিতি দিয়ে যদি আমরা প্লেটোর দার্শনিক রাজা এবং অভিভাবক শ্রেণির শাসন বিচার করি তাহলে দেখতে পাব যে প্লেটো নিঃসন্দেহে গ্রহণযোগ্য। কারণ তিনি দার্শনিক রাজার শাসনব্যবস্থা প্রবর্তনের যেসমস্ত সুপারিশ করেছেন সেগুলি খুবই চমকপ্রদ। তিনি জ্ঞানী হবেন, লোভ থাকবে না। রাষ্ট্রের প্রশাসন হবে তাঁর একমাত্র ধ্যান-জ্ঞান, প্রজার মঙ্গলসাধন- ও উন্নতির বাইরে তিনি বিকল্প কিছু ভাববেন না। সততা, ন্যায়-নিষ্ঠা হবে তাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, অভিভাবক শ্রেণি পরিচালিত শাসনব্যবস্থা সম্পর্কে তিনি ভেবেছিলেন যে এই শ্রেণিতে প্রতিষ্ঠিত হবে সাম্যবাদ। অভিভাবক শ্রেণির সদস্যরা ব্যক্তিগত ও পারিবারিক স্বার্থে বা প্রয়োজনে কিছু করার সুযোগ পাবে না। এই ধারণাকে বাস্তবে প্রয়োগ করা সম্ভব যে নয় তা প্লেটো জানতেন কি না জানি না, কিন্তু আমরা জানি। তা সত্ত্বেও এই পরিকল্পনার মধ্যে অভিনবত্ব আছে। রাষ্ট্রের প্রশাসনে যারা নিযুক্ত হবেন তাঁরা দক্ষ ও নির্লোভ হবেন এবং তা না হলে প্রশাসনের সকল স্তরে দেখা দেবে দুর্নীতি এবং কলুষতা। আধুনিককালের প্রায় অধিকাংশ রাষ্ট্রের দিকে তাকালে এর সত্যতার প্রমাণ পাওয়া যাবে। সুতরাং বংশানুক্রমিক শাসনব্যবস্থার চেয়ে প্লেটো- কল্পিত দার্শনিক রাজা ও অভিভাবক শ্রেণির শাসন অনেক বেশি কাম্য। তদুপরি প্রশাসন চালাবার জন্য প্রয়োজন অভিজ্ঞতা, দক্ষতা, বিশেষ জ্ঞান ইত্যাদি। প্লেটো জানতেন ও আমরা, জানি। প্লেটো যে অভিভাবক শ্রেণির শাসনের কথা বলেছেন আধুনিক যুগের আমলাতন্ত্রের শাসনকে তার সঙ্গে সহজে তুলনা করা চলে। তবে প্লেটোর অভিভাবক শ্রেণির শাসন আমলাতন্ত্রের শাসনের চেয়ে অনেক উন্নত যদিও তা বাস্তবে আদৌ সম্ভব নয়। লক্ষ করলে দেখা যাবে যে প্লেটোর অভিভাবক শ্রেণির শাসন পেছনের দরজা দিয়ে আজকের দিনের শাসনব্যবস্থায় প্রবেশ করেছে। আমেরিকার প্রশাসন রাজনীতিবিদগণ চালান না, চালায় বুর্জোয়া শ্রেণির শীর্ষ নেতারা ও আমলা শ্রেণির সদস্যরা। কেবল আমেরিকা নয়, আর্থিক দিক থেকে ক্ষমতাবান শ্রেণির সদস্যরা প্রশাসনের হর্তা, কর্তা, বিধাতা। প্রশ্ন হল পার্থক্য তাহলে কোথায়?

রাজনীতিক অবক্ষয় রাজনীতিক পরিকল্পনা প্লেটোর প্রাসঙ্গিকতা : বর্তমানকালে আমরা আর্থনীতিক পরিকল্পনা ধারণাটির সঙ্গে পরিচিত। রাজনীতিক পরিকল্পনার অস্তিত্ব থাকলেও তা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা বা মাতামাতি আমরা তেমন দেখি না। অথবা পরিকল্পিতভাবে একটি নতুন রাজনীতির কাঠামো প্রস্তুতের কথা আমরা তেমন গভীরভাবে ভাবি না। কিন্তু প্লেটো ভেবেছিলেন। অর্থাৎ তিনি একটি আদর্শ রাষ্ট্র, তার অর্থনীতি, প্রশাসন, শিক্ষা ইত্যাদি নিয়ে একটি সুন্দর পরিকল্পনা তৈরি করেছিলেন। এই পরিকল্পনা বাস্তবে কী পরিমাণ সফলতা অর্জন করতে সক্ষম হবে তা নিয়ে আমরা হয়তো চিন্তিত। কিন্তু পরিকল্পনার অভিনবত্ব আমাদের বিস্মিত করে। আমাদের বুঝতে অসুবিধা হয় না যে তিনি তাঁর সমকালের রাজনীতিক অবক্ষয় (political degeneration) থেকে গ্রিক নগর-রাষ্ট্রের জনসাধারণকে রক্ষা করার নিমিত্ত এই আকর্ষণীয় (এবং তৎসহ অবাস্তব) পরিকল্পনার ব্লু প্রিন্ট’ বানিয়েছিলেন। আমাদের নিকট প্লেটোর পরিকল্পিত আদর্শ রাষ্ট্রের নকশা বা ব্লু প্রিন্ট-এর চেয়ে বড়ো হল গ্রিক নগর-রাষ্ট্রগুলির রাজনীতিক অবক্ষয়। তাঁর রাজনীতিক পরিকল্পনা বাস্তবায়িত না হোক তাতে কিছু আসে যায় না, বা তার জন্য আমরা হা-হুতাশ করি না। কিন্তু রাজনীতিক অবক্ষয় অত্যন্ত পীড়াদায়ক এবং অসহনীয়। গণতন্ত্রের ওপর তাঁর বীতশ্রদ্ধা আমাদের বিস্মিত করে না কারণ তার বাস্তব ভিত্তি রয়েছে। তিনি জানতেন যে সরকারের একটি রূপ হিসেবে গণতন্ত্র আকর্ষণীয় হলেও এটি অস্থিতিশীলতা রোগে আক্রান্ত। আজ আমরা এশিয়া, আফ্রিকাসহ তৃতীয় দুনিয়ার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার হালহকিকত দেখলে বুঝতে পারব যে তাঁর ধারণা একশো ভাগ খাঁটি। আর একটি কথা হল মানুষের চরিত্র যে গণতন্ত্রের এই দুরবস্থার জন্য দায়ী তা তিনি জানতেন। আজও আমরা মনে করি যে মানুষের চরিত্র সরকারের চরিত্র ও অন্যান্য বিষয় স্থির করে দেয়। আমরা মনে করি যে তাঁর কী পরিমাণ দূরদৃষ্টি ছিল যা তাঁকে একটি রাজনীতিক পরিকল্পনা রচনাকাজে উদ্বুদ্ধ করেছিল। আমরা আজও রাজনীতিক পরিকল্পনা করি সুস্থ ও জনকল্যাণকামী জনপ্রশাসনের জন্য, তিনিও তাই করেছিলেন। বিশ্বের সর্বত্রই জনপ্রশাসনকে আধুনিক বা সময়োপযোগী ও কল্যাণমুখী করে তোলার জন্য প্রশাসনিক সংস্কার কমিটি বানানো হয়। প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রে তারই ভ্রূণাকার উপস্থিতি আমরা লক্ষ করি। মস্কো থেকে প্রকাশিত রাজনীতিক মতবাদের ইতিহাস- এ বলা হয়েছে “আমাদের থেকে সুদূর অতীতে নিবেদিত প্লেটোর রাজনীতিক দর্শনের অনেক কিছুই সেকেলে, তুচ্ছ, ভ্রান্ত এবং আমাদের কাছে অপ্রযোজ্য,” প্লেটোনিক মতবাদের একসারি দার্শনিক-রাজনীতিক প্রস্তাবের প্রতিক্রিয়াশীলতা সুস্পষ্ট। কিন্তু এ মতবাদে এমন জিনিসও আছে যা অবধারণার দিক থেকে মূল্যবান। প্লেটোর মতো একজন বিশালাকায় লেখকের সৃজনশীল উত্তরাধিকারে যা নঞর্থক তাও সদর্থকের চেয়ে কম শিক্ষাপ্রদ নয়। আমরা হয়তো তাঁর রাষ্ট্রে বাস করতে চাইব না।’ কিন্তু কী রকম রাষ্ট্রে বাস করতে চাই তা তিনি বলে গেছেন।

অ্যারিস্টটল এবং রাজনীতির বিজ্ঞান (Aristotle and Science of Politics)

Works written about the science of politics may be said to fall into two classes, one of which may be called prescriptive, the other descriptive. … the politics of Aristotle belongs to both these classes and moves in and out of them. It is the only work of an ancient author of which that could be said. Aristotle The Politics. Translated with an Introduction by Sinclair. p. 14-15.

জীবনী, রচনা, সমকাল ও মূল্যবোধের রাজনীতি

জীবনী ও রচনা: গ্রিসের অন্তর্গত স্ট্যাগিরা (Stageira) নামক স্থানে ৩৮৪ খ্রি. পূ. অ্যারিস্টট্ল জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা রাজা আমিস্তাস-এর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ছিলেন। মাত্র ১৭ বছর বয়সে তিনি প্লেটোর আকাডেমিতে পড়াশোনার জন্য ভর্তী হন। আকাডেমিতে অধ্যয়ন শেষ করে ওখানেই অধ্যাপনা করেন। প্লেটোর আকাডেমিতে থাকাকালীন তিনি অঙ্ক, নীতি- শাস্ত্র ও রাষ্ট্রনীতি পড়াশোনা করেন। কিন্তু তিনি তাঁর জ্ঞান- স্পৃহাকে এই তিনটি বিষয়ের মধ্যে বন্দি করে রাখতে চাননি, যে কারণে প্লেটোর আকাডেমি ছেড়ে সামুদ্রিক জীববিদ্যা (marine biology) ও অন্যান্য বিষয় নিয়ে পড়াশোনার জন্য অন্যত্র পাড়ি দেন। মাতৃভূমিতে প্রত্যাবর্তন করে অ্যারিস্টটল অন্যান্য বিষয় সম্পর্কে গবেষণার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। রাজা ফিলিপের কনিষ্ঠসন্তান মহামতি আলেকজান্ডার-এর গৃহশিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত হন। আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর এথেন্সে রাজনীতিক অস্থিরতা দেখা দেয় এবং আরিস্টটল ঝামেলার মধ্যে পড়েন। যদিও প্রত্যক্ষ রাজনীতির সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিল না তবুও নানা গোষ্ঠীর লোক তাঁর সম্পর্কে নানা কুৎসা রটনা এবং গল্প বানাতে শুরু করে। বাস্তব রাজনীতি এথেন্সের পরিস্থিতি এবং গ্রিসের অন্যান্য নগর-রাষ্ট্রের অবস্থা তাঁর মনকে আলোড়িত করে। দর্শন, রাজনীতি, বিজ্ঞান ও নীতিশাস্ত্র ‘ইত্যাদি বিষয় সম্পর্কে গবেষণা করার জন্য অ্যারিস্টট্ল প্লেটোর আকাডেমির আদলে একটি গবেষণাকেন্দ্র স্থাপনের উদ্যোগ নেন এবং লিকেয়াম (Lyceum) স্থাপন করেন। লিকেয়াম-এ তিনি উদ্ভিদবিদ্যা, জীববিদ্যা, সমুদ্রশাস্ত্র, রাজনীতি, দর্শন, নীতিবিদ্যা ইত্যাদি নানা বিষয় নিয়ে গবেষণার ব্যবস্থা করেন। এমনকি অঙ্ক, ধর্মশাস্ত্র প্রভৃতিও বাদ যায়নি। নীতিবিদ্যা, পলিটিক্স, রেটরিক, পোয়েটিকস্ প্রভৃতি গ্রন্থ তিনি রচনা করেছিলেন। এই সমস্ত গ্রন্থ রচনা করার সময় তিনি তাঁর সময় যেসব তথ্য পাওয়া যেত সেগুলির ব্যবহার করেছিলেন। তাঁর লেখাগুলিকে আমরা কালজয়ী বলতে পারি। এথেন্সের জনগণের একটি অংশ মনে করত যে অ্যারিস্টট্ল-এর মধ্যে মেসিডন-প্রীতি রয়েছে এবং সে-কারণে তারা তাঁর বিরুদ্ধাচরণ করার পথ নেয়। এই পরিস্থিতি তাঁর মনের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। ৩২২ খ্রি. পু.-এ মাত্র ৬২ বছর বয়সে তিনি পরলোকগমন করেন।

আলোচনা পদ্ধতি, সমকাল, বিজ্ঞান -মনষ্কতা ও মূল্যবোধের রাজনীতি: অ্যারিস্টল-এর রাষ্ট্রদর্শন সম্পর্কে অবহিত হতে গেলে তাঁর বিজ্ঞানমনস্কতা ও সমকাল সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা প্রয়োজন। পারিবারিকসূত্রে তিনি ছিলেন বিজ্ঞান- মনস্ক। তাঁর পরিবারের অন্যরা বৈজ্ঞানিক দৃষ্টি নিয়ে সমস্ত বিষয় অনুসন্ধান করতেন এবং তিনিও ব্যতিক্রম ছিলেন না। বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোয় অ্যারিস্টটল সমস্ত বিষয়ের সত্যাসত্য যাচাই করার পর সিদ্ধান্ত নিতেন। এই পদ্ধতিকে পন্ডিতগণ আরোহী (inductive) পদ্ধতি বলেন। তথ্য  সংগ্রহের জন্য তিনি নানা জায়গায় ভ্রমণ করতেন। জীববিদ্যা, উদ্ভিদবিদ্যা, সমুদ্রশাস্ত্র ইত্যাদি বিষয় সম্পর্কে তাঁর আগ্রহ ছিল অপরিসীম। নমুনা সংগ্রহ করে তিনি তা পরীক্ষা করতেন এবং এইভাবে প্রতি বিষয় সম্পর্কে তাঁর বাস্তব অভিজ্ঞতা ছিল, প্লেটোর আকাডেমিতে গবেষণাকালে এই পদ্ধতির আশ্রয় নিয়েছিলেন এবং নিজে লিকেয়াম স্থাপন করে এর প্রয়োগ ঘটান। তাঁর সমকালে এথেন্সে যেসমস্ত ঘটনা ঘটেছিল সেগুলি তাঁর চিন্তা-ভাবনার ওপর ছাপ ফেলেছিল বলে অনুমান করা হয়। তাঁর সময়কার ঘটনাবলির নেতিবাচক প্রভাব থেকে তিনি দূরে সরে থাকতে চেয়েছিলেন। তিনি দেখেছিলেন যে রাজনীতির মধ্যে সততা, মূল্যবোধ, নীতি ও আদর্শ বলতে কিছুই নেই। অধ্যাপক বার্কার তাঁর গবেষণামূলক গ্রন্থ ‘পলিটিকস্ অফ অ্যারিস্টট্ল’-এ বলেছেন যে তিনি রাজনীতিকে মূল্যবোধ ও সততা-নির্ভর করে তুলতে চেয়েছিলেন। রাজনীতি কেবল রাজ্যশাসন ও দেশজয় নিয়ে ব্যস্ত থাকবে না, নাগরিকের জীবনকে সুন্দর ও নীতিবোধ-সমন্বিত করে তুলবে। সত্যিকারের রাজনীতির স্বরুপ কেমন হবে সে নিয়ে তিনি ব্যাপক অনুসন্ধান চালিয়েছিলেন বলে আমরা জানতে পারি। অ্যারিস্টট্ল-এর গবেষণাগারে কেবল বিজ্ঞানবিষয়ক গবেষণা যে হত তা নয়, রাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে গবেষণাও হত বলে আমরা তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘রাষ্ট্রনীতি’ থেকে জানতে পারি। ডানিং বলেছেন (History of Political Theories Vol I, p. 51) যে তাঁর আরোহী পদ্ধতিকে পন্ডিতেরা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি নামে অভিহিত করেছেন। ডানিং অবশ্য বলেছেন যে আরোহী উপায়কে পুরোপুরি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি বলা যায় না। তিনি আরও বলেছেন যে অ্যারিস্টট্ল দেড়শতাধিক নগর-রাষ্ট্রের সংবিধান পর্যালোচনা করার পর রাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে তাঁর নিজের মতামত ব্যক্ত করে গেছেন। এখানেই তাঁর কৃতিত্ব। ডানিং -এর মত হল যে তাঁর দর্শনচিন্তা, হেলেনীয় (Hellenic) চিন্তা ও আরোহী পদ্ধতির মধ্যে বিস্তর সাদৃশ্য রয়েছে। আমরা মনে করি যে রাজনীতি বিষয়ে তাঁর যে অনুসন্ধান তার আর একটি দিক রয়েছে। তিনি তাঁর সময়কার ঘটনাসমূহ থেকে এই ধারণা তৈরি করেছিলেন যে রাজনীতির এক বিশাল অধঃপতন হয়েছে। এর মধ্যে নোংরামি, নীতিহীনতা, ভ্রষ্টাচারিতা প্রভৃতি স্থান করে নিয়েছে। কিন্তু রাজনীতিকে যদি তার লক্ষ্যসাধন করতে হয় তাহলে এই পঙ্কিল অবস্থা থেকে যে-কোনো মূল্যে একে বের করে আনতে হবে এবং তার জন্য দরকার রাজনীতিকে সত্যতা, মূল্যবোধ, আদর্শ, নৈতিকতা ইত্যাদির ওপর প্রতিষ্ঠিত করা। এই লক্ষ্যকে সামনে রেখে তিনি প্লেটোর মতো মূল্যবোধের রাজনীতির প্রস্তুতির দিকে অগ্রসর হয়েছিলেন। সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠান হিসেবে রাষ্ট্র সর্বোৎকৃষ্ট নীতিবোধের প্রতীক হবে।

রাজনীতির বিজ্ঞান :ম্যাক্সে অ্যারিস্টটলকে প্রথম রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর মর্যাদা দিয়েছেন। অ্যারিস্টট্ল সম্পর্কিত আলোচনার অধ্যায়টির নাম হচ্ছে The First Political Scientist। প্রশ্ন হল কেন অ্যারিস্টট্লকে প্রথম রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বলা হয়। ম্যাকসে প্রখ্যাত ইংরেজ কবি কোলরিজ-এর মন্তব্যের উল্লেখ করে বলেছেন যে প্রতিটি মানুষ হয় প্লেটো নতুবা অ্যারিস্টট্ল-এর অনুগামী। (Everyman may be a Platonist or Aristotelian), প্লেটোর কৌশল ছিল সাধারণ থেকে বিশেষে উপস্থিত হওয়া (from general to particular reasoning), অন্যদিকে অ্যারিস্টটল-এর পদ্ধতি ছিল বিশেষ থেকে সাধারণে উপস্থিত হওয়া (from particular to general process)। যদিও অ্যারিস্টটল প্লেটোর ছাত্র ছিলেন তবুও চিন্তা ও মানসিকতার দিক থেকে দুজন নাকি অনেকখানি দুই মেরুর অধিবাসী ছিলেন। যা হোক, আমাদের বক্তব্য হল কেন আমরা অ্যারিস্টটলকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর আসনে বসাবো বা তাঁর রাষ্ট্র- চিন্তাকে বিজ্ঞানের মর্যাদা দেব। আধুনিক চিন্তাবিদগণ তাঁর রাষ্ট্রচিন্তার মধ্যে বিজ্ঞানত্বের সন্ধান পেয়েছেন। অ্যারিস্টটল রাষ্ট্রবিজ্ঞান বা রাষ্ট্রচিন্তার প্রবর্তন করতে চেয়েছিলেন তাকে অভিজ্ঞতামূলক বলে গণ্য করা যায়। কারণ গ্রিসের নানা নগর-রাষ্ট্রের প্রশাসন ও সাংবিধানিক কাঠামো বিশ্লেষণ করার পর তিনি তাঁর ‘পলিটিক্‌স’ গ্রন্থখানি রচনা করেছিলেন বলে পন্ডিতেরা অনুমান করেন। (Aristotle’s political science is empirical in the way that Aristotelian biology is empirical. Aristotle’s contribution to political science is to bring the subject matter of politics within the scope of the methods which he was already using to investigate other aspects of nature. Mc Clelland, op. cit. p. 55)। জীববিজ্ঞানীরা যেমন জীব এবং জীবন সম্পর্কে গবেষণা করার পর সিদ্ধান্ত টানেন, একই কৌশল তিনিও প্রয়োগ করেছিলেন। বিজ্ঞানী অপরীক্ষিত বিষয়ের ওপর মন্তব্য প্রকাশ থেকে বিরত থাকেন এবং অ্যারিস্টটলকে একই পথ অনুসরণ করতে আমরা দেখি। For Aristotle, part of the political experience is what men have thought of that experience (op. cit. p. 53) এখানেই তাঁর কৃতিত্ব এবং বিশেষত্ব। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের কোনো বিষয়কে তিনি বিচারবিশ্লেষণ না করে গ্রহণ করেননি। রাষ্ট্রবিজ্ঞান বা রাষ্ট্রচিন্তা বা রাষ্ট্রনীতির সম্পর্কে কোনো বিষয় পুরোপুরি যাচাই করার পর সিদ্ধান্ত নিতেন। তাঁর একটি ধারণা তৈরি হয়েছিল যে মানুষ রাজনীতি ও অন্যান্য বিষয় সম্পর্কে ভাবনাচিন্তা করার পর কাজে হাত দেয়। রাজনীতি হল সেই জাতীয় বিষয়। অ্যারিস্টটলকে কেন প্রথম রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বলা হবে। সে প্রসঙ্গে ম্যাক্সের মন্তব্য সবিশেষ প্রণিধানযোগ্য বলে মনে করি। Aristotle’s thought was based on the assumption that reality is not to be found in perfect ideas. Everything we know, experience and perceive has its own essential substance or reality. (p. 60), বিজ্ঞানমনস্কতা নিয়ে সমস্ত বিষয় বিশেষ করে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিশ্লেষণ করে একে একটি বিজ্ঞানভিত্তিক বিষয়ে উন্নীত করে গেছেন এবং আজ আমরা তার উত্তরাধিকারী।

রাষ্ট্র: উৎপত্তি ও বিকাশ

স্বাভাবিকতাই রাষ্ট্রের জন্মের জন্য দায়ী: প্লেটোর মতো অ্যারিস্টট্ল মনে করতেন যে রাষ্ট্র সৃষ্টির পেছনে স্বাভাবিকতা রয়েছে, ব্যক্তিবিশেষের ভূমিকা রাষ্ট্রকে বাস্তব সত্যে পরিণত করেনি। প্রথম খন্ডের দ্বিতীয় অধ্যায় কেবল রাষ্ট্রের উৎপত্তির স্বাভাবিক প্রক্রিয়াটি তিনি ব্যাখ্যা করেছেন। স্বাভাবিক ধারণাটি বিশ্লেষণ করতে গিয়ে তিনি বলেছেন যে প্রকৃতির নিয়ম হল একটি পরিবার গঠিত হবে স্বামী-স্ত্রী, লাঙ্গলের জন্য বলদ এবং অন্যান্য কাজ করার জন্য চাকর বা ক্রীতদাস, অর্থাৎ একটি পরিবারের মধ্যে এদের থাকতেই হবে নইলে পরিবার গঠিত হবে না। স্বামী ও স্ত্রীর ভেতরের সম্পর্ক যেমন স্বাভাবিক এবং তার সঙ্গে বলদ ও ক্রীতদাস না থাকলে সেই স্বাভাবিকতা (naturalness) টিকে থাকতে পারবে না। কিন্তু একটি সমাজের পরিবারকে একমাত্র সংগঠন বলা যাবে না। কারণ পরিবার হল সমগ্র সমাজব্যবস্থার ক্ষুদ্রতম অংশ মাত্র। পরিবারের সম্প্রসারণ গ্রামে পরিণত হয়। অর্থাৎ অনেকগুলি পরিবার নিয়ে গঠিত হয় গ্রাম এবং অনেকগুলি গ্রাম একত্রিত হয়ে রাষ্ট্রের রূপলাভ করে। গ্রাম থেকে নগর- রাষ্ট্র বা পোলিস (polis) গঠিত হয়। এই বিবর্তন বা প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ার অগ্রগমন কোনো কৃত্রিম প্রচেষ্টা বন্ধ করতে পারে না, পরিবার গ্রাম ও পোলিস সমস্তই প্রাকৃতিক উপায়ে এসেছে বলে মানুষের কৃত্রিম প্রচেষ্টা অথবা ইচ্ছা বা অনিচ্ছার ভূমিকা আদৌ নেই। The city-state is a perfectly natural form of association, তাহলে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে পরিবার গঠন থেকে আরম্ভ করে রাষ্ট্রের উৎপত্তি পর্যন্ত সমগ্র প্রক্রিয়াটির পেছনে প্রকৃতি বা প্রাকৃতিক ব্যাপার উপস্থিত। কিন্তু প্রকৃতি কিছুই উদ্দেশ্যহীনভাবে তৈরি করে না। প্রতিটি সৃষ্টির পেছনে তার একটি উদ্দেশ্য থাকে। Nature does nothing, without some purpose and for the purpose of making man a political animal she has endowed him alone among the animals with the power of reasoned speech. এখানে রাজনীতিক জীব (political animal) শব্দ দুটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করি। মানুষের সঙ্গে অন্যান্য জীবজন্তুর মৌলিক পার্থক্য হল মানুষ রাজনীতিক জীব’ বলে সে যুক্তিসহকারে সবকিছু বিচারবিবেচনা করার ক্ষমতার অধিকারী। অর্থাৎ মানুষের মধ্যে যে সচেতনতা রয়েছে তা অন্য জীবের নেই। আর রাজনীতিক জ্ঞান বা সচেতনতাই তাকে পরিবার সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনের বিরাট প্রক্রিয়ায় উদ্যোগী ভূমিকা পালনে প্রণোদিত করেছে। রাজনীতিক জীব কথাটিকে তিনি আরও ব্যাখ্যা করে বলেছেন যে, সমস্ত জীবের মধ্যে মানুষই কেবল ভালো এবং মন্দের মধ্যে পার্থক্য নির্দেশপূর্বক সঠিক কাজটি সম্পাদনে সক্ষম। আবার ভালো ও খারাপের মধ্যে পার্থক্য টানার ক্ষমতাটিও মানুষ প্রকৃতি থেকে পেয়েছে। প্রাকৃতিক প্রেরণা বলে মানুষ পরিবার, সমাজ ও পোলিস গঠন করেছে। প্রকৃতি যদি মানুষকে বুদ্ধিবৃত্তিসম্পন্ন করে না তুলত তাহলে সে এই সমস্ত গঠনমূলক কাজ করতে পারত না। প্রকৃতি ও মানুষের সচেতনতা উভয়ে মিলে তৈরি হয়েছে রাষ্ট্র। The final association formed of several villages is the city or state. For all practical purposes the process is now complete, self sufficiency has been reached. The city-state is perfectly a natural form of association.

রাষ্ট্র এবং মূল্যবোধের রাজনীতি: রাষ্ট্রকে একটি স্বাভাবিক বা প্রাকৃতিক সংগঠন বলে অ্যারিস্টটল দায়িত্ব শেষ করেননি। তিনি বলেছেন যে প্রতিটি সংগঠন বা প্রতিষ্ঠান বা সমিতি যেমন গঠিত হয় কিছু পরিমাণ কল্যাণসাধনের জন্য রাষ্ট্রও সেই উদ্দেশ্যে গঠিত হয়েছে। তবে তাঁর মতে রাষ্ট্র সর্বোচ্চ সমিতি বা সংগঠন বলে এটি যে কল্যাণ করবে তাও হবে সর্বোচ্চ বা সর্বোৎকৃষ্ট। তাঁর কথাতেই বলি-an association which may be said to have reached the height of full self- sufficiency… we may say that while it grows for the sake of more life… it exists for the sake of good life. নাগরিক যাতে সৎ জীবনযাপন করে নিজেদের জীবন উন্নত করে তুলতে পারে তা দেখা রাষ্ট্রের কর্তব্য। যেসমস্ত নাগরিককে নিয়ে পোলিস (polis) গঠিত তাদের মধ্যে সহযোগিতা থাকবে কারণ ছোটো সমিতি বা পরিবারের মধ্যেও সহযোগিতা থাকে এবং এটি না থাকলে কেউই টিকে থাকতে পারত না। আর এই সহযোগিতার মাধ্যমেই তারা সৎ জীবনযাত্রা নির্বাহ করতে পারে। প্লেটো এবং অ্যারিস্টটল উভয়েই মনে করতেন সর্বোৎকৃষ্ট উন্নত ও সৎ জীবনযাত্রা নির্বাহ রাষ্ট্র ব্যতিরেকে অন্য কোথাও সম্ভব নয়। প্লেটো এবং অ্যারিস্টট্ল যে ফর্মুলাটি প্রচার করে গেছেন তা হল রাষ্ট্র সর্বোৎকৃষ্ট আদর্শ ও সততার বহিঃপ্রকাশ এবং সেই আদর্শ ও সততা পেতে গেলে সমস্ত ব্যক্তিকে রাষ্ট্রে আসতেই হবে। অ্যারিস্টট্ল আরও বলেছেন যে, সমস্ত জীবের মধ্যে মানুষ হল শ্রেষ্ঠ। কিন্তু তার এই শ্রেষ্ঠত্ব মুহূর্তের মধ্যে বিলীন হয়ে যাবে যদি তার জীবন থেকে মূল্যবোধ এবং নৈতিকতা বিদায় নেয়। প্লেটোর মতে সততা, মূল্যবোধ, ন্যায়বোধ, নৈতিকতা প্রভৃতি গুণসমূহ মানুষের সহজাত। আর রাষ্ট্রের মধ্যে এসে এদের সম্যক বিকাশ ঘটে। কিন্তু অ্যারিস্টট্ল ভিন্নমত পোষণ করতেন। তাঁর মতে এগুলি সব মানুষের মধ্যে থাকে না। সৎ আদর্শ ও রাষ্ট্র মানুষের গুণাবলির বিকাশের সব ব্যবস্থা করে দেয়। এখন প্রশ্ন হল অ্যারিস্টটল-এর রাষ্ট্র বিচারে সততা বলতে কী বোঝাত? জন মরো তার একটি সংক্ষিপ্ত তালিকা দিয়েছেন সাহস, ন্যায়বিচার, মহানু- ভবতা, সততা, নিয়ন্ত্রিত আচরণ, বন্ধুত্ব, নৈতিক গুণ ইত্যাদি। এ বৈশিষ্ট্য ব্যক্তির মধ্যে থাকলে তাকে সদ্গুণসম্পন্ন নাগরিক বলা যাবে। অ্যারিস্টট্ল-এর রাষ্ট্রদর্শনের অনেক ব্যাখ্যাকার বলেন যে তাঁর সমকালে গ্রিসের একাধিক নগর-রাষ্ট্রে এসব গুণের অস্তিত্ব লক্ষ করা যেত। তাই তিনি এদের অনুশীলন এবং বাস্তবায়নের ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপের কথা বলেছেন (These virtues are related to the type of political community familiar to Greeks. Seen from this point of view, the practice of ethical virtue is inseparable from membership of the polis.)। অ্যারিস্টট্ল পোলিস সম্পর্কে যেসব আলোচনা করেছেন তাতে সততা, ন্যায়, নৈতিকতা এত বেশি প্রাধান্য পেয়েছে যে এসব সদগুণকে রাজনীতিক ব্যবস্থা থেকে স্বতন্ত্র করা একেবারে সম্ভব ছিল না। অন্যভাবে বলা যায় রাজনীতি, সততা, মূল্যবোধ, নীতি, আদর্শ এরা সবাই একই ছাতার তলায় থাকে। 

পরমলক্ষবাদ ও রাষ্ট্র : এরিষ্টটল-এর রাষ্ট্র পরমলক্ষ্যবাদ (বা teleology) ধারণার ওপর প্রতিষ্ঠিত এবং এই কথাটি তিনি তাঁর বই- এর একেবারে গোড়ায় বলে গেছেন। সমস্ত সমিতি কিছু না কিছু মঙ্গল বা কল্যাণসাধনের নিমিত্ত গঠিত হয় এবং সদস্যদের কল্যাণ করেও থাকে। রাষ্ট্র সর্বোচ্চ সংগঠন বলে সর্বোচ্চ মঙ্গল করা এর কাজ (All associations aim at some good, that one which is supreme and embraces all others will have also as its aim the supreme good.)। এখানে supreme good কথা দুটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করি। রাষ্ট্রকে তিনি একটি সাধারণ স্তরের সংগঠন বলে মনে করতেন না। সর্বোচ্চ সংগঠন হিসেবে সর্বোচ্চ আদর্শ, লক্ষ্য ও সততা থাকবে। একেই পন্ডিতেরা পরমলক্ষ্যবাদ নামে অভিহিত করেছেন। রাষ্ট্রের জন্ম ও বিকাশের পেছনে রয়েছে উপযোগিতা (utility)। কিন্তু কেবল রাষ্ট্রের যে উপযোগিতা আছে তা নয়, সমস্ত সংগঠনের আছে। উপযোগিতার বিষয়ে রাষ্ট্রের সমকক্ষ অন্য প্রতিষ্ঠান নয়। এ ধারণা অ্যারিস্টটল যেমন করতেন তেমন আমরাও একই ধারণা পোষণ করে থাকি। মানুষের সততা, ন্যায়, নীতিবোধের সম্যকবিকাশের জন্য অনুকূল পরিবেশ গড়ে তোলা রাষ্ট্রের কাজ। আর তা যদি অপারগ হয় তাহলে এর অস্তিত্ব একটি বিরাট প্রশ্নচিহ্নের মুখে এসে উপস্থিত হবে। সুতরাং রাষ্ট্রের পরম- ধারণাটিকে আমরা হাল্কা করে দেখতে পারি না। পরমলক্ষ্যবাদ বা উপযোগিতার প্রসঙ্গ আলোচনা- কালে আমরা বিষয়টি দর্শন উনিশ শতকে হিতবাদী (utilitarian) দর্শন উত্থাপন করতে পারি। বেনথাম ও মিল হিতবাদী প্রচারকালে বলেছিলেন যে ব্যক্তি যে-কোনো বিষয় বিশেষ গ্রহণ বা বর্জনকালে তার উপযোগিতা বিচার করবে। তবে আমাদের এখানে সতর্কতা অবলম্বনের প্রয়োজনীয়তা আছে বলে মনে করি দেখেছিলেন । অ্যারিস্টটল রাষ্ট্রের উপযোগিতার দিকটি দেখেছিলেন সম্পূর্ণরূপে ভাববাদের প্রেক্ষাপটে। তবে অ্যারিস্টট্ল-এর উপযোগবাদ ও হিতবাদীদের উপযোগবাদকে এক করে চাহিদাকে দেখা অনুচিত। নিছক ব্যক্তিগত প্রয়োজন বা তিনি মুখ্য আসনে বসাতে চাননি। নৈতিকতা বিকাশে রাষ্ট্র সাহায্য করবে। এই প্রসঙ্গে আমরা আবার পুরোনো প্রসঙ্গে ফিরে যাব। তিনি রাষ্ট্রবিজ্ঞান, সততা, নৈতিকতা, রাষ্ট্র প্রভৃতি ধারণাকে একসঙ্গে বিশ্লেষণ করেছেন। যদিও রাষ্ট্রবিজ্ঞান পোলিসের বিজ্ঞান তবুও নীতিবোধ, আদর্শ, সততা থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিচ্ছিন্ন নয়। এখানে রাষ্ট্রের পরমলক্ষ্যবাদ ধারণাটি প্রচ্ছন্নভাবে উপস্থিত এবং বিষয়টিকে স্পষ্ট করে তোলার নিমিত্ত আমরা একজন পণ্ডিতের মন্তব্য তুলে দিচ্ছি: Aristotle identified political science- the science of the polis-with the realisation of human good. Since polis is the most all embracing of human communities, one that is directed to the good of all the members of the community (John Morrow. A History of Political Thought, p. 58), তবে চূড়ান্ত বিশ্লেষণে এই পরমলক্ষ্যবাদ, রাজনীতি এবং সততার মধ্যে নিবিড় সহাবস্থান প্রভৃতিকে স্বতন্ত্র করে দেখার অবকাশ নেই। তাঁর কল্পনার রাষ্ট্রবিজ্ঞান হল all embracing.

আদর্শ রাষ্ট্র

আদর্শ রাষ্ট্র এবং সর্বোৎকৃষ্ট সম্ভাব্য রাষ্ট্র: অ্যারিস্টটল একতরফাভাবে আদর্শ রাষ্ট্র বা সর্বোৎকৃষ্ট রাষ্ট্র বলতে তেমন কিছু আলোচনা করেননি। অথবা প্লেটো যেমন আদর্শ রাষ্ট্রের একটি সুন্দর পরিকল্পনা আমাদের দিয়ে গেছেন অ্যারিস্টটল তা করেননি। ‘পলিটিকস্ ‘বই-এর সপ্তম ও অষ্টম খণ্ডে (book) তিনি আদর্শ বা সর্বোৎকৃষ্ট পলিটি (polity) নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। কিন্তু এই আলোচনাকে এককভাবে দেখলে চলবে না। কারণ তিনি যখন সর্বোৎকৃষ্ট (best) রাষ্ট্র নিয়ে আলোচনা করেন তখন এর মধ্যে তুলনামূলক বিশ্লেষণটি অনিবার্যবশত এসে গেছে। তিনি দু-প্রকার রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ দিক সম্পর্কে আলোচনার পর সর্বোৎকৃষ্ট রাষ্ট্র বা পলিটি নিয়ে আলোচনা করেছেন এবং এই দু-প্রকার রাষ্ট্র হল গণতন্ত্র এবং অন্যটি হল সংকীর্ণ গোষ্ঠীতন্ত্র (oligarchy)। অ্যারিস্টট্ল তাঁর সময়ে গ্রিসের বিভিন্ন নগর-রাষ্ট্রে গণতন্ত্র এবং সংকীর্ণ গোষ্ঠীতন্ত্রের একাধিক প্রকারভেদ লক্ষ করেছিলেন। কিন্তু গণতন্ত্রের একটি বিরাট ও জটিল সমস্যা তাঁর নজরে এসেছিল বলে আমরা মনে করি এবং সেটি হল কেবল জনগণের হাতে ক্ষমতা দিলে চলবে না, সেই ক্ষমতা যারা প্রয়োগ করবে তাদের সেই যোগ্যতা থাকা প্রয়োজন। কিন্তু তিনি দেখেছিলেন যে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলিতে ক্ষমতা ও বুদ্ধির সহাবস্থান ছিল না। সংকীর্ণ গোষ্ঠীতন্ত্র যেসব রাষ্ট্রে প্রবর্তিত হয়েছিল সেগুলিতে সম্পত্তির মালিকানাকে সরকারে আসীন হওয়ার মাপকাঠি হিসেবে ধরা হত। আবার সংকীর্ণ গোষ্ঠীতন্ত্রকে তিনি সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য সরকার হিসেবে মেনে নিতে পারেননি। কারণ এই জাতীয় সরকারে সম্পত্তির মালিকানা হল সরকারে যাওয়ার অন্যতম যোগ্যতা। যেহেতু সমাজে ধনীব্যক্তির সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম সে-কারণে ধনীরা ক্ষমতাসীন হলে ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে বিরোধ অনিবার্য হয়ে উঠবে। এসব দিক চিন্তা করে অ্যারিস্টট্ল আদর্শ রাষ্ট্রের বিষয়টি আলোচনা করেছেন। তিনি যে ধরনের আদর্শ রাষ্ট্রের কথা ভেবেছিলেন তা হল অধিকাংশ রাষ্ট্রের পক্ষে যা সম্ভব। সুতরাং আদর্শ রাষ্ট্র ধারণাটি তাঁর নিকট নিছক একটি তাত্ত্বিক কাঠামো নয় যা বাস্তবে দেখা যাবে না। আদর্শ রাষ্ট্রের ছক তৈরি করতে গিয়ে তিনি আদর্শের সঙ্গে বাস্তবের একটি মেলবন্ধন গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। অ্যারিস্টটল-এর বক্তব্য ব্যাখ্যা করে স্যাবাইন বলেছেন: What form of government is best for most states, leaving aside special circumstances that may be peculiar to a given case and assuming no more virtue of political skill than states can usually muster ? Such a form of government is in no sense ideal, it is merely the best practicable average which results from avoiding the extremes in democracy and oligarchy that experience has shown to be dangerous. This sort of state Aristotle calls polity, (p. 112).

কোনটি সর্বোৎকৃষ্ট রাষ্ট্র?: অ্যারিস্টটল প্লেটোর আকাডেমিতে দীর্ঘকাল পড়াশোনা এবং অধ্যাপনা করলেও গুরুদেবের সব ধারণাকে তিনি অভ্রান্ত বলে স্বীকার করে নেননি। আদর্শ রাষ্ট্র ধারণাটি তাঁর সমর্থন- লাভে সক্ষম হলেও বাস্তবে সম্ভব হতে পারে এমন একটি আদর্শ রাষ্ট্রের কথা অ্যারিস্টট্ল ভেবেছিলেন। সেইজন্য স্যাবাইন অ্যারিস্টটল-এর রাষ্ট্রকে সর্বোৎকৃষ্ট রাষ্ট্র না বলে সম্ভাব্য সর্বোৎকৃষ্ট রাষ্ট্র (best practicable state) এই নাম দিয়েছেন। তাঁর বক্তব্য বিশ্লেষণ করে স্যাবাইন বলেছেন: In any case the distinctive feature of the best practicable sate is that it is a mixed form of constitution in which elements are judiciously combined from oligarchy and democracy. Its social foundation is the existence of a large middle class composed of those who are neither very rich nor very poor. (p. 113). সম্ভাব্য আদর্শ রাষ্ট্র হবে সেই রাষ্ট্র যেখানে ধনী ও দরিদ্রের সংখ্যা মাত্রাতিরিক্ত-ভাবে বেশি বা কম হবে না। অর্থাৎ সম্ভাব্য আদর্শ বা সর্বোৎকৃষ্ট রাষ্ট্র মধ্যবিত্ত শ্রেণির লোকেদের নিয়ে গঠিত হবে। তিনি মনে করতেন মধ্যবিত্ত শ্রেণির প্রাধান্য থাকবে এমন রাষ্ট্রে একটি ভারসাম্য (balance) গড়ে ওঠার সম্ভাবনা প্রবল থাকে বা ভারসাম্য থাকে। আর এই ভারসাম্যই রাষ্ট্রকে বাস্তবের পক্ষে উপযোগী করে তোলে। ভারসাম্য কাদের মধ্যে? সংকীর্ণ গোষ্ঠীতন্ত্রে সম্পদ, বংশগত মর্যাদা, সম্মান, শিক্ষা ইত্যাদির মালিকেরা অহঙ্কারে ডুবে থাকে এবং এগুলি যাদের মধ্যে নেই তাদেরকে তাচ্ছিল্য করে। আবার সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ সংখ্যা ও গায়ের জোরে বংশমর্যাদা অর্থ, সম্পদের মালিকদেরকে উপেক্ষা করতে থাকে। অ্যারিস্টটল বলতে চেয়েছেন যে এই দুই বিপরীত প্রবণতা সমাজে সংঘাতের পরিবেশ সৃষ্টি করে এবং এই সংঘাত নাগরিক জীবনে ডেকে আনে অনেকরকম অসুবিধা। সুতরাং স্থিতিশীলতাকে কাঙ্ক্ষিত বন্ধু বলে বিবেচনা করতে হলে ভারসাম্য যাতে স্থাপিত হয় সেদিকে নজর দেওয়া একান্ত প্রয়োজন। তবে তিনি মুষ্টিমেয় কয়েকজন বিজ্ঞ লোকের চেয়ে কম বিজ্ঞ এমন বহুসংখ্যকের ওপর আস্থা স্থাপনের পক্ষপাতী ছিলেন। কারণ তিনি মনে করতেন যে অল্প কয়েকজন বিজ্ঞজনের যৌথ জ্ঞান অনেকজনের যৌথ জ্ঞানের চেয়ে বেশি হতে পারে না। সুতরাং অ্যারিস্টটল ভেবেছিলেন যে বিজ্ঞতা এবং সংখ্যা এই দুয়ের মধ্যে সমতা রক্ষা করতে যে রাষ্ট্র পারবে সেই রাষ্ট্র হবে বাস্তবে সম্ভাব্য সর্বোৎকৃষ্ট রাষ্ট্র বা আদর্শ রাষ্ট্র। বলা বাহুল্য যে তিনি আদর্শ রাষ্ট্র ও সর্বোৎকৃষ্ট রাষ্ট্র এই দুটি ধারণাকে একই অর্থে ব্যবহার করেছেন। আরও বলা চলে যে রাষ্ট্র ও সংবিধানকে তিনি সমার্থক করে গেছেন।

রাজনীতি, সততা ও মধ্যপন্থার সমাহরণ: অ্যারিস্টট্ল বলেছেন যে নীতিশাস্ত্রে (Ethics) সবসময় মধ্যপন্থার (mean) ওপর জোর দেওয়া হয়। দুটি চরমের (extreme) মাঝখানের পথটিকে সবচেয়ে ভালো বা কাঙ্ক্ষিত বলে গণ্য করা হয়। অর্থাৎ নীতিশাস্ত্র কখনও একটি চরম পথের কথা বলে না। একই নীতি রাজনীতি বা নগর-রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা উচিত। তিনি যা বলতে চেয়েছেন তার সারার্থ হল চরম দারিদ্র্য ও বিপুল সম্পদ এই দুটি চরমাবস্থাকে নিয়ে যে নগর-রাষ্ট্র বা পোলিস গঠিত তা স্থায়ী হতে পারে না, দুই শ্রেণি বা গোষ্ঠীর মধ্যে সংঘাত অনিবার্য হয়ে উঠবে এবং সেই অবস্থা পোলিসকে পতনের দিকে ঠেলে দেবে। তিনি বলেছেন: The state aims to consist as far as possible of those who are like and equal, a condition found chiefly among the middle section…. The middle class is also the steadiest element, the least eager for change. (p. 172)। কেন মধ্যবিত্ত শ্রেণির শাসনকে সম্ভাব্য সর্বোৎকৃষ্ট রাষ্ট্র বলেছেন? কারণ হল মধ্যবিত্তরা গরিব মানুষদের মতো অন্যের সম্পত্তি ও সম্পদের প্রতি আকর্ষণ অনুভব করে না। অথবা যেসব ধনী রয়েছে তারা মধ্যবিত্ত হওয়ার বাসনা পোষণ করে না। খুব বেশি সততা বা খুব বেশি মিথ্যাচার বা অসততা-দুই-ই অকাম্য, তাই তিনি মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে রাষ্ট্রশাসনের পক্ষে সর্বাপেক্ষা বেশি উপযুক্ত বলে বিবেচনা করেছেন। আলোচনা প্রসঙ্গে তিনি তাঁর সময়ের একজন বিজ্ঞ ব্যক্তির মন্তব্যকে উদ্ধৃতি হিসেবে ব্যবহার করেছেন। “Those in the middle class have many advantages; that is where I wish to be in society.” মধ্যবিত্তের শাসনকে তিনি রাজনীতিক অংশীদারিত্ব (political partnership) নামে অভিহিত করেছেন। তাঁর মনে এই প্রত্যয় সৃষ্টি হয়েছিল যে কেবল মধ্যবিত্ত শ্রেণির দ্বারা শাসিত রাষ্ট্রে সুশাসন থাকার সম্ভাবনা সবচাইতে বেশি। এই শ্রেণির লোকেরা পরস্পরের প্রতি হিংসার ভাব পোষণ করে না এবং সবাই মিলেমিশে প্রশাসন পরিচালনা করে। একে তিনি রাজনীতিক অংশীদারিত্ব বলেছেন। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় অযোগ্যতা ও স্বার্থপরতা প্রকট আকারে দেখা দেয় এবং যারা ক্ষমতার অলিন্দ থেকে দূরে অবস্থান করে। তারা ক্ষমতালাভের জন্য সুযোগের সন্ধানে ব্যাপৃত থাকে এবং তেমন সুযোগের সম্ভাবনা দেখা দিলে ক্ষমতালোভীরা ঝাঁপিয়ে পড়ে। এইভাবে গণতন্ত্র শেষপর্যন্ত স্বৈরতন্ত্রে রূপান্তরিত হয়। সংকীর্ণ গোষ্ঠীতন্ত্র পারস্পরিক রেষারেষি এবং দলীয় কোন্দল থেকে মুক্ত নয়। ফলে সংকীর্ণ গোষ্ঠীতন্ত্র কিছুদিন পরে সংঘাতপূর্ণ রাজনীতির আখড়ায় পরিণত হয়। তিনি লিখেছেন: The superiority of the middle type of constitution is clear from the fact that it alone is free from fighting among factions. (p. 173). মধ্যবিত্ত শ্রেণির শাসনকে তিনি সবচেয়ে নিরাপদ শাসন বলেছেন। আর এই রাষ্ট্র হল সম্ভাব্য সর্বোৎকৃষ্ট রাষ্ট্র।

আদর্শ রাষ্ট্রের উপাদান: ‘পলিটিকস্’-এর সপ্তম ও অষ্টম খণ্ডে অ্যারিস্টটল আদর্শ রাষ্ট্রের উপাদান কী হতে পারে তা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। সপ্তম খণ্ডের তৃতীয় অধ্যায় থেকে পরবর্তী অধ্যায়গুলিতে আদর্শ রাষ্ট্রের বস্তুগত উপাদান- সমূহের আলোচনা পাওয়া যায়। এই আলোচনার আগে তিনি দেখিয়েছেন যে একজন নাগরিকের সর্বাপেক্ষা কাঙ্ক্ষিত জীবন কী হতে পারে? ব্যক্তির জীবনযাত্রা নির্বাহের জন্য যেসমস্ত বস্তু প্রয়োজন তাদের সহজলভ্যতা আদর্শ রাষ্ট্র বা যাকে তিনি পলিটি (Polity) বলেছেন তার মধ্যে পাওয়া যাবে। জীবনযাপনের সাবলীলতা পলিটিতে থাকবে। এই রাষ্ট্রে আরও থাকবে বৌদ্ধিক ও নৈতিক বোধসমূহের সম্যক বিকাশসাধনের অনুকূল পরিবেশ। পলিটিতে থাকবে কায়িক ও মানসিক বিকাশসাধনের যাবতীয় উপাদান। এহেন অবস্থায় একটি আদর্শ রাষ্ট্রের পক্ষে কী কী উপাদান থাকা একান্ত দরকার সেগুলি নিয়ে তিনি বিস্তৃত আলোচনা করেছেন। বস্তুগত উপাদানগুলি হল রাষ্ট্রের অবস্থান, জলবায়ু, আকার, প্রতিষ্ঠান, ভূসম্পত্তি এবং তাদের মালিকানা, জনসাধারণের সামাজিক ও আর্থিক শ্রেণিবিন্যাস প্রভৃতি। তিনি বলেছেন রাষ্ট্রের অন্যতম উপাদান হল জনসংখ্যা এবং নারী ও পুরুষের মধ্যে তার বিভাজন। পুরুষরা কায়িক পরিশ্রমে আগ্রহী এবং সক্ষম হবে, একটি আদর্শ রাষ্ট্রের পক্ষে আদর্শ জনসংখ্যা কত হবে তা নিয়ে তিনি মন্তব্য করেননি। তবে তিনি বলেছেন যে জনসংখ্যা খুব বেশি হলে তা প্রশাসনের পক্ষে কষ্টকর হয়ে দাঁড়াবে। সুতরাং কম জনসংখ্যা দরকার। আবার খুব কম হলে চলবে না। পলিটির আকার সম্পর্কে তাঁর মন্তব্য প্রায় একই রকম। আদর্শ রাষ্ট্রের আকার খুব বড়ো হলে পরিচালন ব্যবস্থায় সমস্যা দেখা দেবে। আবার একেবারে ছোটো হলে মানুষের প্রয়োজন মেটাবার সামর্থ্য রাষ্ট্রের থাকবে না। সহজে প্রশাসনের মধ্যে রাখা যায় এমন আয়তনের কথা তিনি ভেবেছিলেন। তাঁর সময়ে অধিকাংশ পোলিসের আয়তন খুব বড়ো ছিল না এবং অ্যারিস্টট্ল তা চাইতেন না। এ বিষয়ে তিনি নিশ্চিত করে কিছুই বলেননি। কেবল বলেছেন: There must be a proper norm for the size of the city. আদর্শ রাষ্ট্রের যোগাযোগের দিকটি তাঁর নজর এড়িয়ে যায়নি। রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাতায়াতের সুব্যবস্থা অবশ্যই থাকবে। কেবল যাতায়াত নয় ব্যাবসাবাণিজ্যের জন্যও যোগাযোগব্যবস্থা উন্নত হওয়া দরকার এবং সে-কারণে তিনি যোগাযোগব্যবস্থার ওপর জোর দিয়েছেন। জনসাধারণের চরিত্র ও আচরণের ওপর জলবায়ুর একটি অবশ্যম্ভাবী প্রভাব দেখা যায়। যে এলাকায় জলবায়ু অনুকুল সেই এলাকার জনগণ কায়িক পরিশ্রমে পটু,বৌদ্ধিক ক্ষমতা উন্নতমানের। তিনি বলেছেন: The Hellenic race occupies a mid position geographically. Hence it continues to be free, to have the best political institutions. (p. 269), আদর্শ রাষ্ট্রের এমন সব প্রতিষ্ঠান থাকবে যেগুলি জনগণের বৌদ্ধিক বিকাশের সহায়ক হয়। নৈতিকতা, মূল্যবোধ, সততা ইত্যাদির উন্নতিতে প্রতিষ্ঠানসমূহ সাহায্য করে। নাগরিকের সামাজিক, রাজনীতিক ও ধর্মীয় ক্রিয়াকলাপে বিশেষ সাহায্য করে। মানুষের আর্থিক-ভিত্তিতে শ্রেণিবিন্যাসের ওপর জোর দিয়েছেন। তিনি মনে করতেন যে বিভিন্ন লোকের বা জনগোষ্ঠীর মধ্যে সম্পদ বণ্টনে যেন বিরাট ফারাক না থাকে। এই সমস্ত উপাদানের সমাবেশ ঘটলে তবে একটি রাষ্ট্র আদর্শ পদবাচ্য হতে পারবে। মানসিক, বৌদ্ধিক ও বস্তুগত সমস্ত উপাদান একত্র মিলিত না হলে রাষ্ট্র আদর্শ হবে না।

সরকারের শ্রেণিবিভাগ

প্রাধিকার, সংবিধান শ্রেণিবিভাগের ভিত্তি: রাষ্ট্রবিজ্ঞান সম্পর্কে প্রারম্ভিক আলোচনা করতে গেলে সরকারের শ্রেণিবিভাগ নিয়ে আলোচনা করতেই হয় এবং সেই আলোচনার মধ্যে অবশ্যই অ্যারিস্টটল-এর শ্রেণিবিভাগ থাকবে। আমরা মনে করি তাঁর রাষ্ট্রদর্শনের সবকিছু যদি বিস্মৃতিতে নিমজ্জিত হয় তবুও তিনি যে শ্রেণিবিভাগ নির্দেশ করে গেছেন তা আজও স্মরণীয়। তৃতীয় খণ্ডের ষষ্ঠ অধ্যায়ে তিনি অধিকার (authority) সম্বন্ধে যে আলোচনা করেছেন তাতে আমরা দেখতে পাই যে অধিকার তিন প্রকার। প্রথমটি হল ক্রীতদাসের ওপর প্রভুর কর্তৃত্ব বা অধিকার। ক্রীতদাসের ওপর প্রভুর কর্তৃত্বে প্রভুরই লাভ হয়, ক্রীতদাসের লাভ হয় কদাচিৎ। দ্বিতীয় প্রকার কর্তৃত্বের কথা যে তিনি বলেছেন তাতে দেখা যায় পরিবারের সমস্ত সদস্যের ওপর গৃহকর্তার কর্তৃত্ব যাকে বলা যেতে পারে ঘর-গৃহস্থালির পরিচালন (household management)। এই জাতীয় প্রাধিকার প্রথমটির চেয়ে ভিন্ন ধরনের কারণ রাজনীতিতে আমরা যে প্রাধিকার বা কর্তৃত্বের কথা বলি তার সঙ্গে এর সাদৃশ্য রয়েছে। এই জাতীয় কর্তৃত্বের ফলে গৃহ-কর্তা ও সদস্য সবার উপকার হয়ে থাকে। তৃতীয় ক্ষেত্রে, আমরা পাই রাজনীতিক কর্তৃত্বের অস্তিত্ব। একটি রাজনীতিক সংগঠনের সদস্যদের ওপর প্রাধিকারের যে কর্তৃত্ব সেটাই হল রাজনীতিক প্রাধিকার। তবে এই প্রাধিকার প্রয়োগের সময় কর্তৃত্ব প্রয়োগকারী ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ মনে রাখে যে রাজনীতিক সংগঠনের সদস্যরা সবাই স্বাধীন। কারণ অ্যারিস্টটল-এর মতে: The state is an association of free men. অ্যারিস্টট্ল সরকার, রাষ্ট্র, সংবিধান প্রভৃতি ধারণাগুলিকে প্রায় একই অর্থে ব্যবহার করেছেন যদিও আমরা আজকাল এদেরকে সমার্থক বলে মনে করি না। তিনি বলেছেন যে নির্দিষ্ট সার্বভৌম প্রাধিকারে বিভিন্ন কর্তৃত্বের সংগঠন হল সংবিধান (By the constitution we mean the organisation of the various authorities and in particular the sovereign authority that is all others. p. 113)। অন্যত্র তিনি সংবিধানের সংজ্ঞা এইভাবে, দিয়েছেন: সার্বভৌমতার নির্ধারণ এবং সরকারি কাজকর্মের বিতরণের জন্য যে ব্যবস্থাপনা তাকে সংবিধান বলে (Constitution is the arrangement which states adopt for the distribution of offices of power, and for the determination of sovereignty. p. 151) তাহলে দেখা যাচ্ছে যে সংবিধান হল নগর-রাষ্ট্র বা পোলিসের সংগঠন যার উদ্দেশ্য হল রাষ্ট্রের কাজ বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া এবং এই বিভাজনে সার্বভৌমতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করা যাবে না। এইবার আমরা বিভিন্ন প্রকার সংবিধানের শ্রেণিবিভাগ করব। প্রতিটি পোলিস- এর একটি করে সংবিধান অবশ্যই থাকবে। কিন্তু সকল সংবিধানের চরিত্র একরকম হবে না। তাই অ্যারিস্টল সংবিধানকে দুটি প্রধান শ্রেণিতে ভাগ করেছেন। প্রথমটি হল: আদর্শরূপ (good form) এবং দ্বিতীয়টি হল বিকৃতরূপ (corrupt form)। আদর্শরূপের মধ্যে আছে রাজতন্ত্র, অভিজাততন্ত্র (aristocracy) এবং পলিটি। বিকৃতরূপ হল: স্বৈরতন্ত্র, সংকীর্ণ গোষ্ঠীতন্ত্র ও গণতন্ত্র, তিনি এই শ্রেণিবিভাগকে চূড়ান্ত বা আদর্শ বলে মনে করেননি। তবে তাঁর সময়ে এই সকল সরকারের অস্তিত্ব ছিল। প্রতিটি সরকার চরম ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে গঠিত হত। তবে সর্বত্র একই প্রকার ন্যায়বিচার দেখা যেত না বলে সরকারের প্রকারভেদ ঘটত।

সংক্ষিপ্ত বর্ণনা: সরকারের শ্রেণিবিভাগ করতে গিয়ে তিনি দুটি নির্ণায়ক (criterion) বেছে নিয়েছিলেন। একটি হল গুণগত মান এবং অন্যটি সংখ্যা। আদর্শরূপের মধ্যে আছে রাজতন্ত্র। রাজা একাই শাসন করেন যদিও তাঁর অনেক পরামর্শদাতা থাকেন। এর বিপরীতে আছে স্বৈরতন্ত্র। এই জাতীয় সরকার পরিচালিত হয় কেবল একজনের দ্বারা। রাজতন্ত্র আদর্শরূপ এই কারণে যে ভালো রাজা নিজের ও পরিবারবর্গের কল্যাণের কথা না ভেবে রাষ্ট্রের মঙ্গলের বিষয়টি অগ্রাধিকার দিয়ে থাকেন। স্বৈরতন্ত্রে একজন শাসক থাকেন এবং তার প্রধান বিবেচ্য হল নিজের মঙ্গলকে প্রাধান্য দেওয়া যাকে বলা যেতে পারে নিকৃষ্ট ধরনের স্বার্থপরতা। তাই তিনি একে বিকৃতরূপ (corrupt form) বলেছেন। অল্প কয়েকজনের শাসনের মধ্যেও আদর্শ এবং বিকৃত রূপ দুইই আছে যেমন অভিজাততন্ত্র এবং সংকীর্ণ গোষ্ঠীতন্ত্র। অভিজাতদের শাসনকে তিনি আদর্শ এবং সংকীর্ণমনা গোষ্ঠীর শাসনকে বিকৃত শ্রেণির শাসন নামে বিবেচনা করেছেন। কেন তিনি এমন শ্রেণিবিন্যাস করলেন তা আমাদের অজ্ঞাত, তবে মনে হয় তাঁর সময়ে কোনো কোনো নগর-রাষ্ট্রে অভিজাত শ্রেণির শাসন উন্নতমানের ছিল। অভিজাত সম্প্রদায়ের লোকেরা শিক্ষা, দীক্ষা ও অন্যান্য গুণে অনেকের চেয়ে উন্নত ছিলেন এবং তাদের শাসন সমাজের কল্যাণ সাধন করত। পক্ষান্তরে, গোষ্ঠীর শাসনকে তিনি মেনে নিতে পারেননি। গোষ্ঠীর শাসন মানে দলবাজি, কলহ ইত্যাদি এবং এই জাতীয় পরিস্থিতি রাষ্ট্রের কল্যাণ করতে পারে না। অভিজাততন্ত্র ও সংকীর্ণ গোষ্ঠীতন্ত্র অল্প কয়েকজনের শাসন বলে কথিত হলেও প্রকৃতপক্ষে কতজনের শাসন সে-বিষয়ে অ্যারিস্টটল স্পষ্ট করে কিছু বলে যাননি। সবশেষে যে জুটিটি রয়েছে তা হল অনেকের শাসন। এটির একদিকে আছে পলিটি বা সর্বোৎকৃষ্ট রাষ্ট্র এবং বিপরীতে রয়েছে গণতন্ত্র। গণতন্ত্রকে তিনি নিকৃষ্ট শাসন বলেছেন কারণ এই সরকার পরিচালিত হয় জনগণের দ্বারা যারা শাসন পরিচালনায় দক্ষ তো নয়-ই উপরন্তু সমগ্র পোলিসে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে। দলাদলি, সংঘাত ও বিশৃঙ্খলাই গণতন্ত্রের অন্যতম চরিত্র। বহুজনের শাসনের উল্টো দিকে আছে পলিটি যার সম্বন্ধে তিনি খুবই আশাবাদী এবং আদর্শরূপে এর বিশিষ্ট স্থান আছে। পলিটিকে তিনি নানা কারণে আদর্শ সরকার বলেছেন। এই শ্রেণির রাষ্ট্রে ধনী ও দরিদ্রের সংখ্যার মধ্যে বিশেষ ফারাক নেই। ফলে বিশৃঙ্খলা দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা থাকে না। হিংসা, দ্বেষ, মারামারি প্রভৃতি খুব কম। এই শাসনব্যবস্থায় বিভিন্ন শ্রেণির মধ্যে কলহ থাকে না, থাকে ভারসাম্য, ধনী-দরিদ্রের মধ্যে মাত্রাতিরিক্ত ফারাক যে রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ কলহ ও অশান্তির প্রধান কারণ সেই ধারণা আজ থেকে আড়াই হাজার বছর আগে তিনি উপলব্ধি করেছিলেন। আজ আমরা একুশ শতকের প্রারম্ভে এসে ভাবছি যে রাজনীতিক বুদ্ধি কী পরিমাণে পরিপক্কতা অর্জন করেছিল, তবে তিনি যে মধ্যবিত্তের শাসনের প্রস্তাব বা রূপরেখা দিয়ে গেছেন প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রের মতো এটিও অবাস্তব বা সর্বতোভাবে কাল্পনিক। ‘পলিটিক্‌স্’ গ্রন্থের একাধিক স্থানে এই অবাস্তবতার ইঙ্গিতও তিনি দিয়েছেন। তবে আমরা মনে করি যে প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রের বিকল্প হিসেবে তিনি একে গড়েছেন।

রাষ্ট্র সম্পর্কিত ধারণা

রাষ্ট্রের সংজ্ঞা: আকাডেমিতে থাকাকালীন অ্যারিস্টটল প্লেটোর সংস্পর্শে আসেন এবং তাঁর চিন্তার ওপর প্লেটোর প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়ে। পরে তিনি যখন নিজে অনুরূপ একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন সেখানে প্লেটোর কিছু কিছু দর্শনচিন্তা স্থান পায় এবং রাষ্ট্র সম্পর্কিত ধারণা তাদের অন্যতম। তাঁর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান লিকেয়াম (Lyceum)-এ রাজনীতি চর্চার বিশেষ স্থান ছিল এবং প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রের অবাস্তবতার দিকগুলি সযত্নে পরিত্যাগ করে তিনি এক নতুন আদর্শ রাষ্ট্রের রূপরেখা তৈরি করেছিলেন। এটি তাঁর পলিটি যা নিয়ে আমি আগেই আলোচনা করেছি। কিন্তু পলিটিকে তাঁর রাষ্ট্র-সম্পর্কিত ধারণার সবকিছু বলে মনে করলে মারাত্মক ভুল হবে। পলিটি বা আদর্শ রাষ্ট্রের বাইরেও ‘রাষ্ট্র সম্বন্ধে তিনি আগ্রহী ছিলেন এবং ‘পলিটিক্‌স’ গ্রন্থে বিভিন্ন স্থানে তিনি রাষ্ট্র বিষয়ে তাঁর মতামত ব্যক্ত করে গেছেন। তাঁর ধারণায় রাষ্ট্র হল একটি স্বাভাবিক বা প্রাকৃতিক সংগঠন এবং পরিবার সমিতি, গ্রাম প্রভৃতির বিবর্তনের সর্বশেষ পর্যায়ে এসে রাষ্ট্রের আবির্ভাব ঘটেছে। সংগঠন হিসেবে রাষ্ট্রের স্থান যেহেতু সর্বোচ্চে, সর্বোচ্চ কল্যাণসাধন করাও এর কাজ। অর্থাৎ রাষ্ট্র হল জনসাধারণ বা নাগরিকের জন্য সবচেয়ে বেশি কল্যাণসাধন করার জন্য একটি রাজনীতিক প্রতিষ্ঠান। ‘পলিটিকস্’ গ্রন্থের তৃতীয় খণ্ডের নানা জায়গায় তিনি এ সম্পর্কে যা বলেছেন তা হল, রাষ্ট্র জনসাধারণ-অধ্যুষিত একটি সাধারণ প্রতিষ্ঠান বা লোকসমাজ (community) নয়। লোকসমাজ থেকে রাষ্ট্র আলাদা, কল্যাণসাধনকারী একটি প্রতিষ্ঠান। তাঁর কথায় বলি: The state is intended to enable all, in their households and their kingships, to live well, meaning by that a full and satisfying life, অতএব এই আলোচনার প্রেক্ষিতে আমরা বলতে পারি যে রাষ্ট্র হল সেই জাতীয় রাজনীতিক প্রতিষ্ঠান যা নাগরিকের জন্য নানা প্রকার কল্যাণজনক কাজ করে তাদের জীবনকে তৃপ্তিপূর্ণ ও আনন্দঘন করে তুলতে পারে বা করে তোলে। এইবার দেখা যাক তৃতীয় খণ্ডের নবম অধ্যায়ে তিনি কী বলেছেন, the political organisation which we call state exists not simply for the purpose of living together but for the sake of noble actions. রাষ্ট্র হল এমন একটি রাজনীতিক সমিতি যার কাজ হল নাগরিকের জীবনকে মহৎ করে তোলা। কিন্তু রাষ্ট্র নিজে মহৎ ও আদর্শ না হলে নাগরিকের জীবনকে মহৎ করে তোলা তার পক্ষে *সম্ভব নয়। সুতরাং রাষ্ট্র বা পোলিস হল সততা, মূল্যবোধ, ন্যায়পরায়ণতা ইত্যাদির প্রতীক। প্রথম খন্ডের প্রথম অধ্যায়ে তিনি রাষ্ট্র সম্পর্কে যে মন্তব্য প্রকাশ করেছিলেন বই-এর সর্বত্র তারই বিভিন্ন প্রকার বিকাশ ঘটেছে। তাঁর পূর্বসূরিরা রাষ্ট্রকে যেভাবে দেখতেন তিনি তা থেকে আদৌ ব্যতিক্রম নন। অ্যারিস্টটল-এর রাষ্ট্র একাধারে একটি রাজনীতিক সংগঠন, virtuous state এবং কল্যাণরতী রাষ্ট্র। এসব -ভূমিকার একটিকে অন্য অপেক্ষা কম গুরুত্বপূর্ণ বলে ভাবার অবকাশ নেই। তবে রাষ্ট্র যে সততার প্রতীক এই চরিত্রটি সবচেয়ে মূল্যবান। এখানে তিনি রাজনীতি এবং সততার মধ্যে মিলন ঘটিয়েছেন এবং এর ফলে রাষ্ট্র হয়ে দাঁড়িয়েছে মূল্যবোধ ও সততার প্রতীক।

রাষ্ট্রের পূর্বিতা ও অবিচ্ছিন্নতা: রাষ্ট্র সম্পর্কে অ্যারিস্টঈল-এর ধারণা বিশ্লেষণ করলে জানা যায় যে তিনি এর জৈবতত্ত্বে বিশ্বাসী ছিলেন। এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনায় প্রবেশের আগে পূর্বিতা (priority) বলতে তিনি কী বোঝাতে চেয়েছিলেন সে বিষয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা দরকার। রাষ্ট্রের উৎপত্তি নিয়ে আলোচনাকালে আমরা দেখেছি যে তাঁর মতে রাষ্ট্রের উৎপত্তির জন্য বিবর্তনবাদ দায়ী। প্রথমে গঠিত হয় পরিবার, পরিবার থেকে আসে সমিতি এবং সবার শেষে তৈরি হয় রাষ্ট্র। কিন্তু তিনি বলছেন যে যদিও বিবর্তনবাদের নিয়ম অনুযায়ী রাষ্ট্রের আবির্ভাব সবার শেষে তবুও পূর্বিতা বা অগ্রগামিতার বিচারে রাষ্ট্রের স্থান সবার ওপরে বা আগে। কারণ সমিতি হিসেবে রাষ্ট্র হল সর্বোচ্চ সংগঠন বা সমিতি। এবং আদর্শ, সততা, নৈতিকতা ও মূল্যবোধের বিচারে এর স্থান সবার ওপরে। কারণ পরিবার বা সমিতির যা সততা যা আদর্শ রাষ্ট্রের আদর্শ তার চেয়ে অনেক বেশি হবে বা হতে বাধ্য এবং এই বিচারে রাষ্ট্র হল সবার আগে। কিন্তু সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠান হলেও রাষ্ট্রের গহ্বরে পরিবার, সমিতি বা গ্রাম এরা সবাই নিহিত। রাষ্ট্র থেকে এরা স্বাতন্ত্র্য দাবি করতে পারে না। তিনি লিখেছেন: the city state is a perfectly natural form of association, রাষ্ট্রের জন্ম প্রাকৃতিক হওয়ার জন্য পরিবার, গ্রাম বা সমিতি আস্তে আস্তে রাষ্ট্রের মধ্যে নিজেদের মিশিয়ে দিয়েছে। মিশিয়ে দেওয়ার অর্থ এই নয় যে এদের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে গেছে। এরা রাষ্ট্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গে পরিণত হয়েছে। এই অবিচ্ছেদ্য অঙ্গে পরিণত হওয়া বা অবিচ্ছিন্নতা মর্যাদা অর্জন করাকে আমরা রাষ্ট্রের জৈব ধারণার একটি দিক বলে মনে করতে পারি। জৈব ধারণার সারাৎসার হল সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের পারস্পরিক নির্ভরশীলতা এবং তার অনিবার্যতা। অর্থাৎ পরিবার, সমিতি বা গ্রাম বা অন্যান্য সংগঠন রাষ্ট্রের জন্মের আগে হলেও পূর্বিতা (priority) তত্ত্ব মোতবেক এরা রাষ্ট্রের পরে স্থান পাবে। আবার রাষ্ট্রের সঙ্গে ব্যক্তির সম্পর্ক ভয়ঙ্কর ঘনিষ্ঠ। কারণ অ্যারিস্টটল লিখেছেন: As man is the best of all animals when he has reached his full development, so he is worst of all when divorced from law and morals. (Politics, p. 29). এখানে একটু ব্যাখ্যার প্রয়োজন। আইন ও নৈতিকতা থেকে ব্যক্তি বিচ্ছিন্ন হলে সে নিকৃষ্টতম জীবে পরিণত হবে। কারণ এ দুটির সঙ্গে তার সম্পর্ক এত গভীর ও নিবিড় যে বিচ্ছিন্ন হওয়ার প্রশ্ন ওঠে না। কিন্তু আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে অ্যারিস্টটলীয় ধারণা অনুযায়ী আইনের উৎস রাষ্ট্র এবং নৈতিকতার প্রতীক ও উৎস রাষ্ট্র। অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় নৈতিকতার বাইরে ব্যক্তি স্বতন্ত্র নৈতিকতা দাবি করতে পারে না। এখানে জৈব ধারণাটি অবধারিতভাবে এসে যাচ্ছে। রাষ্ট্রের সদাচার ও ব্যক্তির সদাচারের মধ্যে পার্থক্যের অস্তিত্ব তিনি স্বীকার করেননি। ব্যক্তির নৈতিকতা, আদর্শ, মূল্যবোধ, ব্যক্তিত্ব ইত্যাদির পূর্ণাঙ্গ্য বিকাশ রাষ্ট্রের মাধ্যমে হয় এবং সে-কারণে বিচ্ছিন্নতা ব্যক্তিকে মনুষ্যত্ব থেকে বঞ্চিত করবে। প্লেটো মনে করতেন যে, যাবতীয় নৈতিকতা, আদর্শ ও সততার সত্যিকারের বিকাশ ঘটেছে রাষ্ট্রে এবং রাষ্ট্রের সদস্য হিসেবে ব্যক্তি এগুলি অর্জন করতে সক্ষম হবে। তাহলে দেখা যাচ্ছে যে গুরু-শিষ্য উভয়েই এই অবিচ্ছিন্নতা তত্ত্ব প্রচার করে রাষ্ট্রের জৈব তত্ত্বকে প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন।

অংশ ও সমগ্র এক হতে পারেনা: রাষ্ট্রের জৈব তত্ত্বটিকে অন্য দৃষ্টিকোণ থেকেও ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। একটি জীবদেহের অনেকগুলি অঙ্গ- প্রত্যঙ্গ আছে এবং তারা সবাই পারস্পরিক নির্ভরশীলতা নীতিতে আবদ্ধ। যার ফলে একটি অঙ্গকে দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করলে দেহ যেমন ত্রুটিপূর্ণ হয় ঠিক তেমনি বিচ্ছিন্ন অঙ্গ তার কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলে। তাঁর মনে এই ধারণা গড়ে ওঠার পেছনে একটি কারণ কাজ করেছিল। তিনি প্লেটোর আকাডেমিতে অবস্থানকালে জীববিদ্যা নিয়ে অধ্যয়ন ও গবেষণা করেছিলেন। আবার যখন নিজে একটি আলাদা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তৈরি করেন তখন জীববিদ্যার ওপর গবেষণার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নিয়েছিলেন। সুতরাং আমরা বলতে পারি যে জীববিদ্যা বিষয়ে তাঁর একটি বিশেষ আগ্রহ ছিল যার বশবর্তী হয়ে তিনি বিষয়টি নিয়ে প্রচুর পড়াশোনা করেন। জীববিদ্যার প্রতি তাঁর আকর্ষণ ও জ্ঞান তাঁকে জীববিদ্যার আলোয় রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিশ্লেষণে প্রণোদিত করেছিল। তিনি ভাবতেন যে রাষ্ট্রও জীবদেহের মতো। ব্যক্তি তার জীবনে পূর্ণতা পাচ্ছে এবং নৈতিকতা, সততা ইত্যাদির সফল বিকাশসাধন করতে সক্ষম হচ্ছে কেবল রাষ্ট্র নামক প্রতিষ্ঠানের সদস্য হওয়ার সুবাদে। রাষ্ট্র-বিচ্ছিন্ন ব্যক্তি পশুর পর্যায়ভুক্ত এবং মূল্যহীন। জীব ও তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ এবং এরাষ্ট্র ও তার নাগরিক এই দুই জোড়াকে তিনি পাশাপাশি রেখেছেন। পারস্পরিক নির্ভরশীলতাকে তিনি চরম বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। জীবদেহের নানা অঙ্গের পূর্ণতা এবং তাদের কার্যকারিতা সমস্ত জীবের সঙ্গে জড়িত। অনুরূপভাবে ব্যক্তি তার জীবনের পূর্ণতাকে একটি বাস্তব সত্যে পরিণত করতে পারবে যখন সে রাষ্ট্রের নিকট নিঃশর্ত সমর্থন জানাবে। এখানে আমরা লক্ষ করছি যে তাঁর ধারণায় পূর্ণতম একতাতত্ত্বটি এসেছে। জীবদেহের মস্তিষ্ক যেমন প্রত্যেকটি অঙ্গকে পরিচালিত করে এবং মস্তিষ্ক না থাকলে দেহের বাস্তব প্রয়োজনীয়তা শূন্যের কোঠায় নেমে আসবে। তেমনি সমাজজীবনে রাষ্ট্রের স্থান সবার ওপরে। রাষ্ট্রই মস্তিষ্ক এবং এই রাষ্ট্র সকল মানুষ, প্রতিষ্ঠান, সংগঠন ইত্যাদিকে পরিচালিত করে। রাষ্ট্র অস্তিত্বহীন হয়ে পড়লে এদের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে সংশয় দেখা দেয়। রাষ্ট্রের জৈবতত্ত্বের সঙ্গে পূর্ণাঙ্গ ঐক্য তত্ত্বটিকে পাশাপাশি রাখা যেতে পারে। কোনোপ্রকার বিচ্ছিন্নতা, মতবিরোধ প্রভৃতিকে তিনি আমল দিতে চাননি। কারণ তাঁর মনে এই প্রত্যয় তৈরি হয়েছিল যে পূর্ণতম ঐক্য না থাকলে রাষ্ট্র তার লক্ষ্যসাধনে বিফল হবেই যা রাষ্ট্রকে তার কার্যকারিতা বিষয়ে দোলাচলে ফেলে দেবে। জীববিদ্যার জ্ঞান তাঁকে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে সাহায্য করেছিল। মস্তিষ্ক যেমন চায় না যে নানা অঙ্গ- প্রত্যঙ্গ স্বাধীনভাবে চলুক তেমনি রাষ্ট্র চায় না তার সদস্য বা নাগরিকগণ, অসংখ্য সংগঠন প্রভৃতি স্ব স্ব মত অনুযায়ী কর্মসাধনে ব্যাপৃত থাকুক। এখানেই তাঁর পূর্ণতম ঐক্য তত্ত্বটি এসেছে। সুতরাং রাষ্ট্রের জৈব তত্ত্বকে পূর্ণাঙ্গ বা পূর্ণতম ঐক্যতত্ত্ব থেকে আলাদা করে বিচার করার অবকাশ নেই। আর কেউ বিচার করতে গেলে অ্যারিস্টটল-এর রাষ্ট্রদর্শন একটি জোর ধাক্কা খাবে যা হবে সুনামির মতো।

মূল্যায়ন

চরম ঐক্য, ব্যক্তি স্বাধীনতা ও সমষ্টিবাদ: রাষ্ট্রের জৈব তত্ত্ব থেকে পণ্ডিতেরা যে কয়টি অনুমান তৈরি করেছেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল এই তত্ত্বটির সাহায্যে অ্যারিস্টট্ল সমষ্টিবাদ (totalitarianism) ধারণাটি প্রচার করে গেছেন। কারণ হল: রাষ্ট্রের নৈতিকতা, সততা ও মূল্যবোধের বাইরে ব্যক্তির সততা, নৈতিকতা ইত্যাদি থাকতে পারে না-এ হতে পারে না। রাষ্ট্র একটি জড়বস্তু এবং তার এগুলি থাকবে এমন ধারণা সম্পূর্ণরূপে অবাস্তব। সুতরাং রাষ্ট্রকে সততা ও নৈতিকতার বহিঃপ্রকাশ বলে ঘোষণা করে এবং ব্যক্তিকে তার নিকট নিঃশর্তে আত্মসমর্পণের কথা বলে অ্যারিস্টটল সমষ্টিবাদের প্রতি তাঁর আস্থা ব্যক্ত করে গেছেন। এমন মনে হওয়া খুবই স্বাভাবিক যে তাঁর মতে ব্যক্তি রাষ্ট্রের নিকট বলিপ্রদত্ত। কিন্তু অনেকে তা মনে করেন না। পাশ্চাত্য রাষ্ট্রচিন্তার ব্যাখ্যাকার ওয়েপার বলেন (পৃ. ৩৯) যে, নিঃশর্তে আত্মসমর্পণের যুক্তিতে অ্যারিস্টটলকে সমষ্টিবাদী বলা যায় না। প্লেটো এবং অ্যারিস্টটল-এর আগে গ্রিসে রাষ্ট্রচিন্তা, নৈতিকতা ও সততার যে পরিমন্ডল গড়ে উঠেছিল তারই প্রেক্ষিতে তাঁরা রাষ্ট্রকে সর্বোচ্চ নীতি ও আদর্শের বহিঃপ্রকাশ বলে ভাবতে শিখেছিলেন। তাঁরা ভুলেও মনে করেননি যে একজন সত্যিকারের ন্যায়নিষ্ঠ, নীতিজ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তির আদর্শ ও নীতি রাষ্ট্রের নীতি থেকে স্বতন্ত্র হবে। গ্রিক রাষ্ট্রদর্শনের ধারা ও তাঁদের জীবনদর্শন এই জাতীয় সমষ্টিবাদ দর্শনচিন্তার কাঠামো প্রস্তুতিতে প্রেরণা জুগিয়েছিল। নৈতিকতা, সততার অখণ্ড ধারণাও মহাবিশ্বের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। অতএব ব্যক্তি বা রাষ্ট্র মহাবিশ্ব থেকে স্বতন্ত্র হওয়ার কথা ভাবতে পারে না। আজকালকার ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদীরা বলেন যে, ব্যক্তিত্বের পূর্ণাঙ্গ বিকাশের জন্য কতকগুলি অলঙ্ঘনীয় অধিকার তাকে দেওয়া প্রয়োজন। রাষ্ট্র সেগুলির রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব নেবে। কিন্তু অ্যারিস্টটল এর-সময় চিন্তা অন্যরকম ছিল। তিনি ব্যক্তির জন্য স্বতন্ত্র অধিকার ও স্বাধীনতার গুচ্ছ তৈরি করে যাননি বলে এমনটি বলা যুক্তিসংগত নয় যে তিনি ব্যক্তির কল্যাণ সম্পর্কে উদাসীন ছিলেন। গেটেল অন্তত তাই মনে করেন। তিনি বলেছেন: Aristotle was more concerned with the welfare of, the citizens as individuals than with the abstract conception of the good of the social whole. He viewed the state as a means of securing the highest welfare of the aggregate of its citizens. (Gettell, p. 65), পলিটিক্স বইটি পড়লে জানা যায় যে তিনি নাগরিকদের কল্যাণসাধনের বিষয়টি অতীব গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করতেন। ব্যক্তির কল্যাণের প্রতি তাঁর উদাসীনতার নজির পাওয়া যায় না। তিনি ব্যক্তির মঙ্গল ও মনের বিকাশকে ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখতেন। নৈতিকতা ও আদর্শের পূর্ণ বিকাশ ঘটলে অধিকার ও স্বাধীনতা অর্জনের পথ প্রশস্ত হবে। কথা হল বর্তমানের ব্যক্তি- স্বাতন্ত্র্যবাদীরা যেভাবে বিষয়টি দেখে থাকেন অ্যারিস্টটল তা দেখেননি। কিন্তু তাই বলে তাঁকে সমষ্টিবাদী বলা যায় না।
রাষ্ট্রের উৎপত্তি বিষয়ক ব্যাখ্যা ত্রুটিহীন নয়, জৈবতত্ত্বও ঠিক নয়: রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্পর্কে তিনি যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন তা অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু রাষ্ট্রবিজ্ঞানীগণ মনে করেন যে কেবল স্বাভাবিক উপায়ে বা বিবর্তনের ফলে রাষ্ট্র তৈরি হয়নি। এর উদ্ভবের পেছনে অন্যান্য উপাদানও উপস্থিত ছিল। ধর্ম, বলপ্রয়োগ, রক্তের সম্পর্ক ইত্যাদি উপাদানও রাষ্ট্রের জন্মের জন্য দায়ী। তিনি এগুলির উল্লেখ না করে ইতিহাসকে অস্বীকার করেছেন। তা ছাড়া মানুষ তার প্রয়োজন মেটানোর জন্য রাষ্ট্র তৈরি করেছে। একটি যৌথ এবং বিধিসম্মত জীবন যাযাবরী জীবনের চেয়ে অনেক বেশি কাম্য। বরং এই দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করে আমরা বলতে পারি যে চুক্তি- মতবাদের প্রবক্তারা রাষ্ট্রকে মানুষের তৈরি বলে ঘোষণা করে অনেক বাস্তবজ্ঞানের পরিচয় দিয়ে গেছেন। সমালোচকগণ তাঁর রাষ্ট্রের উৎপত্তি তত্ত্বের আর একটি ত্রুটি বের করেছেন। পরিবার, সমিতি গঠিত হওয়ার আগে সমাজের অবস্থা কীরকম ছিল তিনি তার ওপর আলোকপাত করেননি। অধ্যাপক বার্কার মনে করেন যে ইতিহাস ও নৃবিদ্যাকে বিবেচনার মধ্যে না এনে রাষ্ট্রের জন্ম- বিষয়ক ধারণাটিকে অসম্পূর্ণ করে গেছেন। এই সব কারণে অ্যারিস্টটল- এর রাষ্ট্রের উৎপত্তি-সংক্রান্ত জৈবতত্ত্ব সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছে। অ্যারিস্টট্ল-এর পক্ষাবলম্বন করে তাঁর সমর্থকগণ যাই বলুন না কেন জৈবতত্ত্ব ধারণাটি ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের ভেতরের ফারাকটিকে বেমালুম অস্বীকার করে বসে আছে। জীবদেহের সঙ্গে রাষ্ট্রকে তুলনা করে ব্যক্তিকে রাষ্ট্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গে পরিণত করা মেনে নেওয়া যায় না। যে-অর্থে জীবদেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল এবং বিচ্ছিন্নতা তাদের যে- ভাবে অকেজো করে তোলে ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে তা সমানভাবে প্রযোজ্য নয়। কারণ আজও অনেক ব্যক্তি আছে যারা কোনো রাষ্ট্রের সদস্য বা নাগরিক নয়। এই নাগরিকহীনতা তাদের অস্তিত্বহীন করে ফেলেনি। অনেকে বলেন যে তাঁর জৈবতত্ত্ব রক্ষণশীল ও গণতন্ত্র-বিরোধী। নৈতিকতা আদর্শ ও সত্তার বিকাশসাধনের নিমিত্ত ব্যক্তিকে রাষ্ট্রের নিকট নিঃশর্তে আত্মসমর্পণ করতে হবে এমন ধারণা বিভ্রান্তিজনক ও ক্ষতিকর। আর একটি বিষয় হল একটি রাষ্ট্রের সকল নাগরিক রাষ্ট্রের নীতি, সততা প্রভৃতির নিকট দ্বিধাহীন আনুগত্য দেখাবে তা হতে পারে না। এগুলি সম্পর্কে তার নিজস্ব মতামত থাকতেই পারে। আর তা যদি থাকে তাকে দোষ দেওয়া যায় না। এই প্রসঙ্গে তিনি ধরে নিয়েছিলেন। যে সকলে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে রাষ্ট্রের নীতি, সততা সম্পর্কিত ধারণা মেনে চলবে। সমস্যা হল কেউ যদি তা করতে অস্বীকার করে তখন সেই পরিস্থিতির মোকাবিলা কীভাবে হবে তিনি সে-বিষয়ে কিছু বলে যাননি। সমস্যা হল অ্যারিস্টটল-এর জৈবতত্ত্ব অথবা রাষ্ট্র সর্বোৎকৃষ্ট আদর্শ ও সততার প্রতীক-এই সব ধারণা বাতিল করলে তাঁর সমস্ত ভাববাদী রাষ্ট্রদর্শনটি মুখ থুবড়ে পড়বে। আমরা মনে করি সমালোচনার স্বার্থে সমালোচনা তাঁর রাষ্ট্রদর্শনকে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়ার উদ্দেশ্যে নয়।

রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাসে তাঁর স্থান

নতুন ও সাধারণ রাষ্ট্র বিজ্ঞানের সৃষ্টিকর্তা: রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাসে অ্যারিস্টট্স-এর সঠিক স্থান নির্ধারণ নানা প্রেক্ষাপট থেকে পন্ডিতেরা করে গেছেন। স্যাবাইন মনে করেন যে তাঁকে এক নতুন ও সাধারণ ধরনের রাষ্ট্রচিন্তার সৃষ্টিকর্তার আসনে বসানো যেতে পারে। রাষ্ট্রকে তিনি একটি নিছক রাজনীতিক সংগঠন হিসেবে দেখেননি। নৈতিকতা, সততা, আদর্শ; মূল্যবোধের বহিঃপ্রকাশ বা প্রতিভূ হিসেবে দেখেছিলেন। ‘পলিটিক্স’ গ্রন্থের প্রথম থেকে প্রায় শেষ অবধি তিনি একটি বিষয়ের ওপর জোর দিয়েছেন এবং তা হল রাষ্ট্র ও রাজনীতিকে সততা ও নৈতিকতা থেকে বিচ্ছিন্ন করা চলবে না। রাষ্ট্রের যে একটি ethical meaning রয়েছে সেটাই তিনি ক্লান্তিহীনভাবে প্রতিষ্ঠিত করার প্রয়াস চালিয়েছেন। এই ধারণাটির সৃষ্টিকর্তা হয়তো তিনি নন, কিন্তু রাষ্ট্রনীতিকে একটি বিজ্ঞানের আসনে বসানোর পর একে নানা প্রেক্ষিত থেকে তিনি বিশ্লেষণ করে গেছেন। রাষ্ট্রের প্রশাসন থেকে স্থিতিশীলতা সর্বত্র তিনি রাষ্ট্রকে একটি নীতিনিষ্ঠ মূল্যবোধ- সমন্বিত রাজনীতিক প্রতিষ্ঠান বলে মনে করতেন অথবা বলা উচিত রাষ্ট্র এইভাবে নিজেকে গড়ে তুলুক বা প্রতিষ্ঠিত করুক তাই তিনি চাইতেন। রাষ্ট্রের সত্যিকারের অর্থ হল এটি নীতিনিষ্ঠ কি না এবং নাগরিকগণকে নীতি এবং সততার প্রতি অনুরক্ত করতে পেরেছে কি না। আমরা মনে করি যে এই দৃষ্টি দিয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে বিশ্লেষণ করে তিনি এর দেহে একটি নতুন পাখনা জুড়ে দিয়ে গেছেন। নৈতিকতা ও সততার আবাসস্থল হতে গিয়ে রাষ্ট্র (অ্যারিস্টটল-এর নিকট) একটি free intellectual construction হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাজনীতির কচকচানি এবং প্রশাসনের জটিলতার গোলকধাঁধা থেকে তিনি রাষ্ট্রনীতি এবং রাষ্ট্রকে বের করে আনার নিরলস প্রয়াস চালিয়েছেন এবং আমরা মনে করি এটি রাষ্ট্রবিজ্ঞানের একটি বিশিষ্ট দিক। রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে একটি বিজ্ঞান পদবাচ্য বিষয়ের মর্যাদাদানের নিমিত্ত তিনি অভিজ্ঞতামূলক পদ্ধতি প্রয়োগ করে গেছেন। বিভিন্ন পোলিসে আর্থনীতিক ও রাজনীতিক শক্তিগুলি কীভাবে কাজ করছে এবং তাদের সঙ্গে রাষ্ট্রের প্রাত্যহিক প্রশাসন ও কাজকর্ম কতখানি জড়িত সে-সম্পর্কে তথ্যনিষ্ঠ অনুসন্ধানের নিমিত্ত বিভিন্ন নগর-রাষ্ট্রের সংবিধান সংগ্রহের কাজে ব্রতী হন। স্যাবাইন বলেছেন: For Aristotle political science became empirical and the art included improve- ment of political life. (p. 116)। তত্ত্ব, তথ্য, বাস্তব, আদর্শ, নৈতিকতা, সততা ইত্যাদির সংমিশ্রণে তিনি রাষ্ট্রনীতিকে নতুন সাজে সজ্জিত করে তোলার মানসিকতা নিয়ে পলিটিকস্ গ্রন্থটি রচনার কাজে হাত দিয়েছিলেন। আর এ কাজ করতে গিয়ে তিনি রাষ্ট্র ধারণাটিকে নানাভাবে সংজ্ঞায়িত করার কাজে প্রয়াসী হয়েছেন। তবে রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ বিজ্ঞান করার জন্য আরও কিছু কিছু কাজ করার প্রয়োজনীয়তা ছিল যা তিনি করে উঠতে পারেননি। প্রশাসন ও আর্থিক কাজকর্মের অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণ প্রয়োজন ছিল। তা তিনি করেননি। মনে হয় তা করাও তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিল না।

উত্তরসূরিদের ওপর তার প্রভাব: ইউরোপীয় রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে উত্তরসুরিদের ওপর তাঁর বিস্তর প্রভাব পড়েছিল। অগাস্টাইন, ভগবানের রাজ্যের কথা কল্পনা করেছিলেন, তার সূত্র হল অ্যারিস্টটল-কল্পিত আদর্শ রাষ্ট্র যার ভিত্তি হবে আদর্শ, নীতিবোধ, মূল্যবোধ ও সততা। অগাস্টাইন কল্পনা করেছিলেন যে ভগবানের রাজ্যে থাকবে সততা, ধর্ম, আদর্শ ন্যায়পরায়ণতা। অ্যারিস্টট্ল মর্ত্যভূমিতে একটি ন্যায়পরায়ণ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠার কথা ভেবেছিলেন আর অগাস্টাইন স্বর্গে সেই ধরনের রাষ্ট্র গড়ে তোলার চিন্তা করেছিলেন। পন্ডিতেরা অনুমান করেন যে অগাস্টাইন প্রেরণা পেয়েছিলেন অ্যারিস্টটলের থেকেই। মধ্যযুগের একাধিক চিন্তাবিদ তাঁর সরকারের শ্রেণিবিভাগকে অনুসরণ করে সরকারের শ্রেণিবিন্যাস করেছিলেন। এমনকি বিশ শতকেও কেউ কেউ অ্যারিস্টটল-এর শ্রেণিবিভাগের উল্লেখ করে থাকেন। তিনি সরকারকে আদর্শ ও বিকৃত এই দুই রূপে ভাগ করেছিলেন। আমরা এই নীতি মানি না। কিন্তু আজও আমরা বলি রাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, স্বৈরতন্ত্র ইত্যাদি। সহজ কথা হল বিগত আড়াই হাজার বছরেও সরকারের চরিত্র সম্বন্ধে আমাদের ধারণা আদৌ বদলে যায়নি অথবা গেলেও তাকে তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করা যায় না। একজন সমালোচক বলেছেন: A number of Aristotle’s ideas were borrowed and reoriented in a peculiar way by Marsilio of Padua who adduced the great philosopher of antiquity in support of his own theory of the right of a people to legislative power. V. S. Nersesyants, Political Thought of Ancient Greece, p. 169। আইন, ন্যায়বিচার ইত্যাদি সম্পর্কে তিনি যেসব কথা বলেছিলেন সেগুলি টমাস অ্যাকুইনাস থেকে আরম্ভ করে অনেকে মেনে নিয়েছিলেন ও তাঁদের চিন্তার অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। মস্কো থেকে প্রকাশিত রাজনীতিক মতবাদের লেখক বলেছেন: পরবর্তী সমস্ত দার্শনিক ও রাজনীতিকের আইনি ভাবনাচিন্তায় অ্যারিস্টটল-এর প্রভাব বিপুল। প্রাচীন, মধ্য ও আধুনিক যুগের রাজনীতিক মতবাদের ইতিহাসে এমন কোনো বড়ো দরের মনীষী নেই যিনি অ্যারিস্টটল- এর সৃজনশীল উত্তরাধিকার থেকে দূরে থেকেছেন (পৃ. ১৬৭)। আমরা মনে করি এই মূল্যায়ন খুবই যথার্থ। নীতি- নিষ্ঠ রাষ্ট্র সম্পর্কিত প্রতিচ্ছবি আমরা রুশো-কল্পিত রাষ্ট্রচিন্তার মধ্যে পাই। রুশো যে রাষ্ট্রকে একটি moral person বলেছেন তা তো অ্যারিস্টট্ল থেকে নেওয়া। যে চিন্তাবিদকে আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তার জনক বলা হয় সেই মেকিয়াভেলি অ্যারিস্টটল-এর দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন বলে মনে করা হয়। বলা হয়েছে: The hoary political doctrine of Aristotle remodeled by Machiavelli, an ideologist of rising bourgeoisie blossomed as an original theory of politics freed from the influence of ethics and characteristic of the spirit of modern times. (p. 169). অ্যারিস্টট্ল-এর মতো মেকিয়াভেলিও আইনের রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন। জাঁ বোদাঁ (Jean Bodin) তাঁকে অনুসরণ করে ধর্মমুক্ত রাজনীতির গোড়াপত্তনের কথা ভেবেছিলেন। রাজনীতির ওপর ভূগোল ও জলবায়ুর প্রভাব সম্পর্কে তিনি যা বলেছিলেন পরে মঁতেস্কু তা স্বীকার করে নিয়েছিলেন। নীতি ও সততাভিত্তিক রাজনীতির কথা আজও আমরা বলি। কিন্তু এদের সৃষ্টিকর্তা প্লেটো ও অ্যারিস্টটল।

অপ্রাসঙ্গিক নয়: অ্যারিস্টটল-এর রাষ্ট্রচিন্তাকে আজও পন্ডিতেরা প্রাসঙ্গিক বলে মনে করেন। আইনের শাসন এবং ন্যায়বিচারের প্রাধান্য-দুইই অর্জনের জন্য রাষ্ট্র চেষ্টা চালাবে এবং এক্ষেত্রে রাষ্ট্র ব্যর্থ হলে সমগ্র সমাজের ওপর নেমে আসবে বিশৃঙ্খলা ও অরাজকতা। তিনি বারংবার বলেছেন যে পলিটির শাসকগোষ্ঠী প্রশাসন চালাতে গিয়ে যেন ন্যায়বিচার লঙ্ঘন না করেন ও আইনের অনুশাসন মেনে চলেন। তাঁর এই ধারণা আজ আদৌ গুরুত্ব হারায়নি। বিশ্বের সর্বত্রই আইনের প্রাধান্য স্বীকৃতি লাভ করেছে। রাষ্ট্রের সমস্ত গোষ্ঠীকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য এবং অন্যান্য উদ্দেশ্যে প্লেটো সম্পত্তির ক্ষেত্রে ব্যক্তিমালিকানার বিলোপসাধন করে যৌথ মালিকানা বা সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠার কথা বলেছিলেন। অ্যারিস্টটল তা গ্রহণ না করে সম্পত্তির ব্যক্তিমালিকানা ধারণাটির প্রবর্তন করতে চেয়েছিলেন। সোভিয়েত রাশিয়ার বলশেভিক শাসন সম্পত্তির ওপর থেকে ব্যক্তিমালিকানা প্রথা তুলে দিয়ে খুব ভালো কাজ করেনি। ব্যক্তিগত সম্পত্তি প্রথা না থাকায় সেখানে জনগণের মধ্যে ব্যাপক অসন্তোষ দেখা দেয় এবং ১৯৯১ খ্রিস্টাব্দে সোভিয়েত ব্যবস্থার পতনের কারণগুলির মধ্যে এটি একটি। চিনের শাসনতন্ত্রেও সম্পত্তির ওপর ব্যক্তিগত মালিকানা স্বীকৃতি লাভ করেনি। কিন্তু পরে সংবিধান সংশোধন করে ব্যক্তিমালিকানার পুনঃপ্রবর্তন করা হয়। সম্পত্তির ওপর মালিকের যে নিজস্ব অধিকার থাকা বিশেষ দরকার এই সহজ সত্যটুকু তিনি বুঝতে পেরেছিলেন। আর এ-জন্য আজও আমরা কৃতজ্ঞচিত্তে তাঁকে স্মরণ করি। বিভিন্ন সম্প্রদায় শ্রেণি বা গোষ্ঠীর মধ্যে সম্পদ বণ্টনের ক্ষেত্রে বৈষম্য যে সংঘাত ও অন্যান্য অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির জন্মদাতা তা আমরা সবাই জানি। তিনিও তা জানতেন এবং সে-কারণে এমন একটি রাষ্ট্র গঠনের চিন্তা করেছিলেন যার মধ্যে নানা গোষ্ঠী ও শ্রেণির মধ্যে সম্পদ বণ্টনে বিরাট পার্থক্য থাকবে না। আয় ও সম্পদের ক্ষেত্রে বৈষম্যকে তিনি বিপ্লব বা রাজনীতিক অশান্তির অন্যতম কারণের মর্যাদা দিয়েছিলেন। তাই তিনি চেয়েছিলেন যে তাঁর মানসসন্তান ‘পলিটি’ গঠিত হবে কেবল মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে নিয়ে। বলতে বাধা নেই যে মার্কস তো শ্রেণিহীন সমাজ গঠনের কথা ভেবেছিলেন। দুটির মধ্যে পার্থক্য কী খুব বেশি আছে? মার্কস শ্রেণি- সংগ্রামের কথা বলেছিলেন। তিনি তা বলেননি। কিন্তু প্রকট বৈষম্য যে সংঘাত তৈরি করতে পারে সে-কথা তো তিনি বলেই গেছেন। রাষ্ট্রের শাসকগোষ্ঠীর যে রাজনীতিক বিজ্ঞতা ও দূরদর্শিতা থাকা একান্ত দরকার তা প্লেটো ও অ্যারিস্টটল-এর মতো আমরাও মনে করি। বিজ্ঞতা ও দূরদর্শিতা কীভাবে আসবে তা নিয়ে মতভেদ থাকতে পারে, তবে এদের অপরিহার্যতা নিয়ে বিতর্কের অবকাশ নেই। তিনি যে রাষ্ট্র সম্পর্কে ভাবনাচিন্তা করেছিলেন তাকে আমরা কল্যাণ-রাষ্ট্র বলতে পারি। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর ব্রিটেনে এই ধারণাটি বিশেষ জনপ্রিয়তা অর্জন করে এবং তারপর থেকে বিশ্বের সর্বত্র জনসাধারণের সার্বিক কল্যাণসাধনের জন্য এক রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তোলার কথা বলা হয় যা কল্যাণ রাষ্ট্র নামে পরিচিত। অবশ্য তিনি এই শব্দ দুটি ব্যবহার করেননি। কিন্তু যেভাবে অ্যারিস্টট্ল রাষ্ট্রের কাঠামো, গঠন এবং প্রশাসনব্যবস্থা প্রস্তুতের কথা বলেছিলেন তাকে আমরা অবশ্যই কল্যাণ-রাষ্ট্র বলতে পারি। বৈষয়িক বিকাশকে তিনি কল্যাণ-রাষ্ট্রের ভিত্তি বলে মনে করেছিলেন। আজও আমরা অনেকখানি সেরকমভাবে ভাবি।

প্রাচীন গ্রিসের রাষ্ট্রচিন্তা: প্লেটো এবং অ্যারিস্টটল

সৃজনশীল প্রতিভা রাষ্ট্রচিন্তাকে সমৃদ্ধ করে তুলেছিলো: প্লেটো অ্যারিস্টটলসহ গ্রিক চিন্তাবিদগণের দর্শন ও রাষ্ট্রচিন্তা গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে একটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে যায় যে তাঁদের সৃজনশীল প্রতিভা ও অসাধারণ অন্তর্দৃষ্টি সমগ্র গ্রিক রাষ্ট্রচিন্তা এবং দর্শনকে সমৃদ্ধ করে তুলেছিল।তাঁদের দর্শন বা রাষ্ট্রচিন্তা বাস্তবে প্রয়োগ করা সম্ভব কি না সে প্রশ্ন উঠতেই পারে কিন্তু ওই প্রশ্নকে আমরা অপ্রাসঙ্গিক বলে মনে করি। কারণ একজন চিন্তাবিদের চিন্তা বাস্তবে প্রয়োগ নাও করা যেতে পারে। কিন্তু তাই বলে সেই চিন্তাকে মূল্যহীন বলে মনে করা যুক্তিযুক্ত নয়। একজন সমালোচক বলেছেন: The Greek thinkers with their brilliant insight laid the foundation of science at large and formulated basic principles and conceptions in numerous spheres of theory and practice. V.S Nersesyants, p. 205). এই মূল্যায়নকে আমরা যথার্থ মনে করি। সরকারের রূপ, রাষ্ট্রের কাজ, রাজনীতির সঙ্গে মূল্যবোধের নিবিড় সম্পর্ক, রাজনীতিতে আইনের স্থান রাজনীতিক ব্যবস্থাতে ন্যায়বিচারের ভূমিকা সর্বোপরি দ্বান্দ্বিকতা আজও যে-কোনো রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্রছাত্রীবে আকৃষ্ট করে। উনিশ শতকের দ্বিতীয়- ভাগে মার্কস সমাজে সত্যিকারের ন্যায়বিচার স্থাপন এবং অন্যান্য কারণে সাম্যবাদ স্থাপনের চিন্তা করেছিলেন। কিন্তু প্লেটো একটি আদর্শ রাষ্ট্র গড়ে তোলার নিমিত্ত মায়াবন্ধনমুক্ত একশ্রেণির শাসকগোষ্ঠী গঠনের কথা ভেবেছিলেন এবং তার জন্য তিনি অভিভাবক শ্রেণির জন্য সাম্যবাদের সুপারিশ করেছিলেন। রাজনীতিক সংঘর্ষ ও বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধে রেষারেষি রাজনীতি ও রাষ্ট্রকে অধোগামিতার কোন স্তরে নিয়ে যায় তা প্লেটো এবং অ্যারিস্টট্ল খুব ভালো করে বুঝতে পেরেছিলেন এবং সেই অনাকাঙ্ক্ষিত অবস্থার হার থেকে রাজনীতিকে রক্ষা করার জন্য তাঁরা বিকল্পের কথ অত্যন্ত যুক্তিসংগতভাবে ভেবেছিলেন। বিশ্বে শান্তি স্থাপন ও বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের জন্য প্রথম মহাযুদ্ধের পর আন্তর্জাতিক সংগঠন স্থাপনের উদ্যোগ শুরু হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর নতুন করে উদ্যোগ দেখা দেয় এবং তারই ফলশ্রুতি হল রাষ্ট্রসংঘ। আজ থেকে আড়াইহাজার বছর আগে এই ধরনের আন্তর্জাতিক সংগঠন স্থাপনে চিন্তাভাবনা করার সুযোগ ছিল না। কিন্তু গ্রিক পন্ডিতগণ সংঘর্ষহীন দ্বন্দ্বহীন পরিবেশ স্থাপনের কথা ভেবেছিলেন এবং তাঁদের সৃজনশীল প্রতিভা ও গভীর অন্তর্দৃষ্টি পোলিসের পুনর্গঠনের কথা ভেবেছিল। তাঁদের এই ধারণা জন্মেছিল যে প্রতিটি পোলিস বা নগর-রাষ্ট্রের ভিত্তি যদি সততা, ন্যায়পরায়ণতা, মূল্যবোধ ইত্যাদি হয় তাহলে তাদের মধ্যে সংঘাতের বারংবার আবির্ভাব তিরোহিত হবে। প্রাচীন গ্রিসের পন্ডিতগণ রাজনীতিকে ধর্ম, নীতি, আদর্শ, সততা প্রভৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন বলে মনে করেননি। তাঁদের ধারণা জন্মেছিল যে এগুলিকে ভিত্তি করে রাজনীতি গড়ে উঠলে সেটাই হবে আদর্শ রাজনীতি। একটু বিশ্লেষণিক দৃষ্টি দিয়ে বিচার করলে দেখা যাবে যে, বিপুল পরিমাণ অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে প্রাচীন গ্রিসের পন্ডিতেরা সমস্ত বিষয়টি দেখতে সক্ষম হয়েছিলেন বলে রাজনীতি, প্রশাসন ও সমাজের অন্ধকারাচ্ছন্ন দিকসমূহ সহজে বুঝতে পেরেছিলেন। বিগত আড়াই হাজার বছর ধরে বিশ্বের নানা প্রান্তে রাষ্ট্রচিন্তা সম্পর্কে যেসব বিশ্লেষণ হয়েছে তাদের একটি বড়ো অংশ এসেছে গ্রিক সৃজনশীল প্রতিভাজাত দর্শনচিন্তা ও রাষ্ট্রচিন্তা থেকে।

গণতন্ত্র সম্বন্ধে প্লেটোর ধারণা আজও অনবদ্য: প্লেটো অ্যারিস্টট্ল অথবা তাঁদের পূর্বসূরিগণের গণতন্ত্র বিরোধিতা প্রমাণ করে না যে এই জাতীয় সরকার তাঁরা পছন্দ করতেন না। এই ধরনের সরকার সম্বন্ধে তাঁরা যা কিছু বলেছেন সবই অভিজ্ঞতামূলক। অগণতান্ত্রিক সরকারের অযোগ্যতা, অস্থিতিশীলতা, দুর্নীতিপরায়ণতা ইত্যাদি তারা তাঁদের সমকালের ঘটনায় লক্ষ করেছিলেন। তাঁদের সময়ে গ্রিক নগর-রাষ্ট্রগুলিতে গণতান্ত্রিক সরকারের ক্রিয়াকলাপ চরম হতাশা সৃষ্টি করেছিল। সক্রেটিস থেকে আরম্ভ করে অধিকাংশ গ্রিক দার্শনিক গণতন্ত্রকে আদর্শ কাম্য বা জনগণের প্রয়োজনসিদ্ধকারী একটি সরকার বলে মনে করেননি। J. S. Mc Clelland-এর দুটি উক্তি আমি এখানে তুলে দিচ্ছি। উদ্দেশ্য হল ছাত্রছাত্রীরা মিলিয়ে দেখবেন গণতন্ত্র সম্পর্কে প্লেটো যা বলেছিলেন আজও তা কী পরিমাণে প্রাসঙ্গিক। What democracy gains by its attractiveness it loses by its instability. Plato’s treatment of democracy is different from his treatment of other forms of rule because he has very clear grasp of the stages of its political development. (p. 44). এই সমালোচকের অন্য একটি মন্তব্য নিম্নরূপ: Democracy is also the ideal breeding ground for a new class of money-makers now that the old tich have gone or have gone underground. (p. 45): গণতন্ত্র স্থিতিশীলতার প্রতিশ্রুতি দিতে পারে না। সম্ভব নয়। জনসাধারণ ইচ্ছামতো সরকার গড়তে পারে এবং সে-কারণে এই জাতীয় সরকারের উত্থান-পতন বিচিত্র ঘটনা নয়। সবাই শাসক হাতে চায় এবং সরকার ফেলে দেওয়ার বা পরিবর্তন করার সামান্য সুযোগ উপস্থিত হলে তার ‘সদ্‌ব্যবহার’ করতে সামান্য বিলম্ব করে না। আড়াই হাজার বছর আগে গ্রিসের পোলিসগুলিতে এই অবস্থা ছিল এবং আজও এশিয়া, আফ্রিকার দেশে তা দেখা যাচ্ছে। সমাজ- সংস্কৃতি-অর্থনীতি-রাজনীতি-বিজ্ঞান-সভ্যতা সবকিছু বদলে গেছে। কিন্তু গণতন্ত্র সম্পর্কে প্লেটো এবং অ্যারিস্টলের ভাবনাচিন্তা বদলায়নি। পোশাক বদলেছে স্বভাব বদলাতে পারেনি। গণতন্ত্র হল দুর্নীতির উৎসভূমি। একদল শাসক সাধারণ মানুষের অর্থ আত্মসাৎ করার পর ক্ষমতাচ্যুত হয়। অন্য একগোষ্ঠী শাসন ক্ষমতা হাতে পেয়ে একই কাজ করে। জনসাধারণের অর্থ আত্মসাৎ করার “ট্রাডিশন” আজও সমানে চলে আসছে। গ্রিক পণ্ডিতগণ এই সত্যটি খুব ভালোভাবে বুঝতে পেরেছিলেন এবং সে-কারণে তাঁরা গণতন্ত্রকে তাঁদের প্রথম পছন্দের তালিকা থেকে চিরতরে বাতিল করে গেছেন। চোখ-কান-মন উন্মুক্ত রেখে দুনিয়ার দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাব যে গণতন্ত্র সম্পর্কে প্রাচীন গ্রিসের পন্ডিতগণের ধারণা আদৌ বেঠিক নয়। প্লেটো এবং অন্যরা লক্ষ করেছিলেন যে গণতন্ত্রের ব্যর্থতা বারবার ঘটার ফলে শেষপর্যন্ত স্বৈরতন্ত্রের আবির্ভাব ঘটে। গ্রিক পণ্ডিতগণের এই মূল্যায়ন কি ভুল ছিল? আমরা মনে করি তা নয়। আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র পাকিস্তানে গণতন্ত্র। কী পরিমাণে সফল তা আমরা দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু তাই বলে অভিজাততন্ত্র বা রাজতন্ত্র বা সংকীর্ণ গোষ্ঠীতন্ত্র যে আদর্শরূপ তা নয়। গ্রিক দার্শনিকদের আমলে এর বাইরে অন্যকিছু ছিল না। গণতন্ত্র সম্পর্কে গ্রিক পন্ডিতদের চিন্তাধারা থেকে আমাদেরও কিছু শেখার আছে। রাষ্ট্রের কাজ হল সাধারণ মানুষকে উপযুক্ত করে তোলা। গণতন্ত্র তা পারেনি। তাই এর এমন দুরবস্থা।

উপসংহার: আমরা প্রায় ২৫টি শতক পেছনে ফেলে এসেছি। এই দীর্ঘকালের মধ্যে সামাজিক-রাজনীতিক-আর্থনীতিক ক্ষেত্রে দেখা দিয়েছে ব্যাপক ও সুদূরবিস্তারি পরিবর্তন। মানুষের জীবন, চিন্তা ও অন্যান্য ক্ষেত্রে এসেছে যুগান্তকারী ঘটনা। বিজ্ঞান আজ মঙ্গলগ্রহে প্রাণ আছে কি না তা নিয়ে অনুসন্ধান চালাতে ব্যস্ত। অসংখ্য রাজনীতিক পালাবদল ও গড়াপেটা বহুরাষ্ট্রের সীমানা বদলে দিয়েছে। মার্কস-এঙ্গেলস শ্রেণি-সংগ্রামকে হাতিয়ার করে শ্রেণিহীন শোষণহীন সমাজ গড়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন। তাঁদের সেই স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে গেছে। Yet on the whole the cardinal problems of the human society raised by the Greek thinkers have never lost their theoretical and political significance. Moreover, present day political writers devote increasing attention of the ideas and notions of the classics and we have good cause to assert that the interest of the Contemporary science in ancient tradition tends to grow. গ্রিক পন্ডিতগণ যে ঐতিহ্য তৈরি করে গিয়েছিলেন তা আজও অম্লান। তাঁরা আইনের শাসন কায়েম করতে ও ন্যায়বিচারের কাঠামো প্রস্তুত করার কথা ভেবেছিলেন। তাঁরা সুখী, তৃপ্ত ও সমৃদ্ধিশালী নাগরিক সমাজ গড়ে তোলার স্বপ্নে বিভোর ছিলেন। আজও আমরা একই স্বপ্ন দেখি। এর জন্য প্রাচীন গ্রিসের লোকেরা সংবিধান রচনা করেছিলেন। নানাপ্রকার সরকার গড়ার পরিকল্পনা নিয়েছিলেন। আজও আমরা তাই করছি। অ্যারিস্টটল তাঁর ‘পলিটিকস্ এর এক জায়গায় লিখেছেন: Though the state owed its origin to the bare necessities of life, it continues to exist for the sake of good life. Hence the earlier forms of society are natural, so too is the state, গ্রিক দার্শনিকগণের ধারণায় রাষ্ট্রের কাজ কেবল আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার মধ্যে বন্দি থাকবে না, নাগরিকের জীবন যাতে সর্বাঙ্গসুন্দর হয় সেদিকে নজর দেওয়া হবে এর কাজ। আমরা আজ কল্যাণ-রাষ্ট্রের কথা ভাবছি, গণতন্ত্র নিয়ে নানারকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাচ্ছি। একটি জায়গায় মৌলিক পার্থক্য থেকে গেছে। গণতন্ত্রের নানা ত্রুটির জন্য তাঁরা বিকল্প হিসেবে অভিজাততন্ত্র ও রাজতন্ত্রের সুপারিশ করেছিলেন। আমরা ওই পথে না গিয়ে গণতন্ত্রকে সময়ের উপযোগী করে তোলার চেষ্টা চালাচ্ছি। চরম লক্ষ্য এক থেকে গেছে-কীভাবে সমাজ বা নাগরিক জীবনকে সুন্দর করে তোলা যায়। তাঁরা সমাজ পরিচালনে আইনের শাসন চেয়েছিলেন এবং আজও আমরা চাই। আড়াই হাজার বছর আগে গ্রিক সমাজ যা চাইত আজও আমাদের সমাজ তা চায়। তবে চাওয়ার ধরনধারণ বদলেছে। লক্ষ্যার্জনের কৌশল বদলেছে। এখানেই গ্রিক রাষ্ট্রচিন্তার অবদান। নতুন প্রজন্ম যাই করুক না কেন গ্রিকরা যে কাঠামো রচনা করে গেছে তাকে সম্পূর্ণরূপে বাতিল করতে পারছে না। আগামী কয়েক শতকে পারবে বলে মনে হয় না।

গ্রিক রাষ্ট্রচিন্তা: একটি মূল্যায়ন

রাজনীতি ও নৈতিক উৎকর্ষ : প্লেটো ও অ্যারিস্টটল

প্লেটোর সমকালীন ঘটনা এবং রাজনীতি ও নৈতিক উৎকর্ষ: রাজনীতির সঙ্গে নৈতিক উৎকর্ষের সম্বন্ধটি বর্তমানকালে বিদগ্ধমহলে গভীর উৎসাহের সঞ্চার করলেও প্লেটো এবং অ্যারিস্টটলের আমলে এই ধারণাটি অনুপস্থিত তো ছিলই না বরং এই দুই দার্শনিক বিষয়টি নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করেছিলেন, এবং আশ্চর্যের বিষয় হল এঁদের মৃত্যুর পরেও কয়েক শতক ধরে রাজনীতি ও নৈতিক উৎকর্ষ পন্ডিতব্যক্তিদের মনকে আলোড়িত করেছিল। প্লেটোর জন্ম হয় আনুমানিক ৪২৮ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে। ওই সময় চলছিল পেলোপোনেসিয়ান যুদ্ধ। এখনও যেসমস্ত কারণে যুদ্ধ হয় তখনকার দিনেও সেই সমস্ত কারণ উপস্থিত ছিল। রাষ্ট্রসমূহের আগ্রাসী মনোভাব ছিল যুদ্ধের প্রধান কারণ। আনুমানিক ৩৪৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দে প্লেটোর মৃত্যু হয় এবং মৃত্যুর আগে তিনি স্পার্টার (Sparta) হাতে এথেন্সের পরাজয় দেখে যান। উভয় ঘটনাই প্লেটোর মনে গভীর রেখাপাত করে। নীতি ও উৎকর্ষ-বিচ্যুত রাজনীতির করুণ অবস্থা দেখে তিনি রীতিমতো ব্যথিত হন। তাঁর মনে প্রশ্ন জাগে রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য কি কেবল সাম্রাজ্য স্থাপন এবং আগ্রাসী মানসিকতাকে উৎসাহিত করা? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে তিনি নৈতিক উৎকর্ষের (virtue) সঙ্গে রাজনীতির একটি নিবিড় সম্পর্ক আছে বলে ভাবলেন। আর-একটি ঘটনা উল্লেখ এখানে প্রয়োজন। প্লেটোর মৃত্যুর ৯ বছর পরে আলেকজান্ডার সমগ্র গ্রিস দেশকে নিজ সাম্রাজ্য অর্থাৎ ম্যাসিডন রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করে নেন। এই ঘটনার প্রত্যক্ষ দর্শক ছিলেন অ্যারিস্টটল এবং তিনিও তাঁর গুরুদেব প্লেটোর সঙ্গে রাজনীতি ও নৈতিক উৎকর্ষের মধ্যেকার নিবিড় সম্পর্কের ব্যাপারে সহমতপোষণ করেছিলেন (The relationship originated in the writings of Plato and Aristotle. John Morrow: A History of Political Thought, p. 51)1

এথেনীয় গণতন্ত্রের অধোগামিতা: এ কথা সত্য যে সমকালের ঘটনাবলি প্লেটোর রাজনীতিক চিন্তাধারাকে প্রভাবিত করেছিল। তার একটি উল্লেখযোগ্য প্রমাণ হল এথেনীয় গণতন্ত্রের অধোগামিতা। তিনি লক্ষ করেছিলেন যে তাঁর সমসময়ে এথেনীয় গণতন্ত্র দ্রুত অধোগামিতার দিকে অগ্রসর হচ্ছে এবং এই অধোগামিতার প্রধান কারণ হল আবেগনির্ভর জননেতা ও বক্তাদের (demagogue) ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির তীব্র বাসনা। নেতারা আবেগপূর্ণ ভাষণের সাহায্যে জনগণকে বিপথে চালিত করেন বা বলা যেতে পারে সম্মোহিত করেন, এবং সেই সুযোগে নিজেদের সংকীর্ণ স্বার্থ পূরণ করে নেন। গ্রিসের নগর-রাষ্ট্রগুলিতে (যেসমস্ত নগর-রাষ্ট্রে গণতন্ত্র ছিল) এই চিত্র প্রায়শই দেখা যেত এবং প্লেটো শেষপর্যন্ত গণতন্ত্র সম্বন্ধে হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। আবেগনির্ভর জননেতারা রাষ্ট্রের কল্যাণ, জনসাধারণের নৈতিক উৎকর্ষ প্রভৃতিকে তাৎপর্যহীন বলে ভাবতেন। তিনি মনে করতেন যে আবেগনির্ভর জননেতারা নানা উপায়ে জনগণকে বোকা বানাতেন এবং এইভাবে রাজনীতির সঙ্গে নৈতিক উৎকর্ষের বিচ্ছেদ সাধিত হয়েছিল। প্লেটো এক জায়গায় লিখেছেন: Demagogy pays no regard ephemerelfare but catches fools with the bait of pleasure. Now I call this sort of thing pandering and I declare that it is dishonourable because it makes pleasure its aim instead of good. প্লেটোর এই মন্তব্যের মধ্যে একটি বিষয় খুবই স্পষ্ট যে আবেগনির্ভর জননেতাদের রাজনীতির আচরণ ও দৃষ্টিভঙ্গি এবং সর্বোপরি রাজনীতিক ক্রিয়াকলাপ নৈতিক উৎকর্ষ বিচ্যুত হয়ে পড়েছিল এবং সেইজন্য তিনি এদের মধ্যে সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের কথা ভাবতেন।

বিচ্ছেদের ফলাফল কি হয়েছিলো?: রাজনীতির প্রশস্ত আঙিনা থেকে নৈতিক উৎকর্ষ বিদায় নেওয়ার অবশ্যম্ভাবী ফল হয়েছিল অস্থিতিশীলতা। সমাজের বুক থেকে নৈতিকতা বিদায় নিয়েছিল। রাজনীতিক অসদাচরণ সমগ্র সমাজকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছিল। সবকিছু মিলে রাজনীতি একটি কুৎসিত রূপ পরিগ্রহ করেছিল। (All these disfigure contemporary politics) ‘রিপাবলিক’ গ্রন্থে প্লেটো দুর্নীতিগ্রস্ত রাষ্ট্রের হুবহু বর্ণনা দিয়ে গেছেন। এহেন (দুর্নীতিগ্রস্ত) রাষ্ট্রের জনগণ কখনও সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারে না। জনসাধারণের মধ্যে একটি মনস্তাত্ত্বিক অস্থিরতা দেখা দেয়। রাষ্ট্রের মুষ্টিমেয় কয়েকজন লোক জনগণের অর্থে বিলাসবহুল জীবনযাপন করত। অগণিত জনগণের দুঃখদুর্দশার প্রতি তাদের কোনো ভ্রুক্ষেপ ছিল না। তিনি আরও বলেছেন যে নৈতিক উৎকর্ষ রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার ফলে ন্যায়বিচার সংকটের মধ্যে পড়েছিল। জনগণ নৈতিক উৎকর্ষগুলি অর্জনের ব্যাপারে অনাগ্রহী হয়ে উঠেছিল। প্লেটো ভাবতেন যে-কোনো অবস্থাতে রাজনীতি থেকে নৈতিক উৎকর্ষের (virtue) বিচ্ছিন্ন হওয়া কল্যাণজনক হতে পারে না। কারণ নৈতিক উৎকর্ষই হল রাজনীতি বা রাষ্ট্রের একমাত্র বা প্রধান লক্ষ্য। ‘রিপাবলিক’ এবং ‘অন্যন্য গ্রন্থের বহু জায়গায় প্লেটো এ কথাটি অত্যন্ত জোর দিয়ে বলে গেছেন। বিশেষ করে ‘রিপাবলিক’ গ্রন্থের দ্বিতীয় অনুচ্ছেদে তিনি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছেন যে যদি নৈতিক উৎকর্ষকে রাজনীতি থেকে পৃথক বলে ভাবা যায় অথবা পৃথক করে ফেলা হয় তাহলে রাজনীতির অস্তিত্বের সংকট ঘনীভূত হয়ে আসবে। রাজনীতি ও নৈতিক উৎকর্ষের মধ্যেকার সম্পর্ককে পরিণত আকারে গড়ে তোলার জন্য প্লেটো আদর্শ রাষ্ট্রের কল্পনা করেছিলেন।

অ্যারিস্টটল, রাজনীতি এবং নৈতিক উৎকর্ষ: যেসমস্ত কারণে প্লেটো রাজনীতি এবং নৈতিক উৎকর্ষের মধ্যে সুসম্পর্ক স্থাপনের কথা ভেবেছিলেন সেই সমস্ত কারণেও অ্যারিস্টটল সম্পর্কের কথা বলেছিলেন। তবে অ্যারিস্টলের বিশ্লেষণভঙ্গি আলাদা। তিনি বলেছেন যে, যে-কোনো সমিতির (association) লক্ষ্য হল এর সভ্যগণের কল্যাণসাধন করা এবং যেহেতু রাষ্ট্র সর্বোচ্চ সমিতি, এর উদ্দেশ্য নিঃসন্দেহে সর্বোচ্চ কল্যাণ। অ্যারিস্টটলের কথাতেই বলা যাক-The state exists for the sake of good life, অ্যারিস্টটল একটি সুন্দর যুক্তির সাহায্যে রাজনীতির সঙ্গে উৎকর্ষের সম্পর্কটি ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি বলেছেন যে, যেসমস্ত বিষয় বা প্রতিষ্ঠান স্বাভাবিক উপায়ে গড়ে ওঠে ও বিকশিত হয় সেগুলির মধ্যে নৈতিক উৎকর্ষ ও সর্বোচ্চ মূল্যবোধ পূর্ণাঙ্গরূপে বিকশিত হওয়ার সুযোগ পায়। রাষ্ট্রের বিকাশসম্পর্কিত ধারণাটি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে অ্যারিস্টটল বলেছেন যে পরিবার থেকে সমিতি এবং তার থেকে রাষ্ট্রের জন্ম এবং সবটাই সাধিত হয় ধাপে ধাপে। চুক্তির সাহায্যে রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়নি। অ্যারিস্টটল এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন যে স্বাভাবিকত্বের মধ্যেই সর্বোৎকৃষ্ট মূল্যবোধ থাকবে (Aristotle believed that natural things are endowed with supreme value, because they have realised their innate potentialities and have thereby attained their end.)।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানও নৈতিক উৎকর্ষ থেকে, বিচ্ছিন্ন নয়: অ্যারিস্টটল-এর বিশ্লেষণের অভ্যন্তরে প্রবেশ করলে আমরা দেখতে পাব যে তিনি কেবল রাষ্ট্র বা polis-কে একটি নৈতিক ও কল্যাণকামী প্রতিষ্ঠান বলেননি। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের উদ্দেশ্য হল নৈতিক উৎকর্ষসাধন করা। তাঁর মতে রাষ্ট্র বা polis-এর বিজ্ঞান হল রাষ্ট্রবিজ্ঞান বা political science-এই রাষ্ট্রবিজ্ঞান নাগরিকের কল্যাণ বাদ দিয়ে অন্য কোনো কিছু ভাবতে পারে না। অর্থাৎ রাষ্ট্রবিজ্ঞানের উদ্দেশ্য হল কীভাবে নাগরিকের মঙ্গল সাধিত হবে সে-উপায় বাতলে দেওয়া (Aristotle identified political science the science of the polis with the realisation of “human good”. Since the polis is the most all embracing of the communities one that is directed to the good of all the members of the community. Morrow, p. 58)। তাহলে দেখা যাচ্ছে যে রাষ্ট্র বা polis এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞান উভয়েই নৈতিক উৎকর্ষের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।

নৈতিক উৎকর্ষগুলি কি কি?: প্লেটো রাজনীতি ও নৈতিক উৎকর্ষের মধ্যেকার সম্পর্কের কথা উল্লেখ করলেও কী কী নৈতিক উৎকর্ষ আছে সেগুলির উল্লেখ করেননি। কিন্তু অ্যারিস্টট্ল সেগুলির কথা বলেছেন। যেমন সাহসিকতা, ন্যায়বিচার, সমাজের সকলের প্রতি উদার মনোভাব অবলম্বন করা, অত্যন্ত ঠান্ডা মেজাজ, বন্ধুবৎসল হওয়া, আত্মসংযম, অহেতুক উচ্চাকাঙ্ক্ষী না হওয়া ইত্যাদি। অ্যারিস্টটল বলতেন যে এই সদ্‌গুণগুলি রাষ্ট্রের অভিভাবকত্বের মাধ্যমেই অর্জিত হতে পারে। অর্থাৎ এগুলিকে কার্যকর করে তুলতে হলে রাষ্ট্রকে সক্রিয় উদ্যোগ গ্রহণ করতেই হবে। তার জন্য রাজনীতি ও নৈতিক উৎকর্ষ হাত ধরাধরি করে চলবে। সেই কারণে অ্যারিস্টটল প্লেটোর মতো আদর্শ-রাষ্ট্রের পরিকল্পনা করেছিলেন। অ্যারিস্টটল-এর আমলে গ্রিসের নগর-রাষ্ট্রগুলিতে সদ্‌গুণগুলির ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়নি। আলেকজান্ডার কর্তৃক ম্যাসিডন সাম্রাজ্য স্থাপন তিনি দেখেছিলেন এবং এই ঘটনা তাঁর অনুমোদনলাভে ব্যর্থ হয়েছিল।

প্লেটো এবং অ্যারিস্টট্ল-এর রাষ্ট্রচিন্তার ওপর প্রাচীন গ্রিসের রাষ্ট্রচিন্তার প্রভাব

ধারাবাহিকতা লক্ষ করা যায়: প্লেটো এবং অ্যারিস্টটলকে আমরা গ্রিসের দুজন দিকপাল হিসেবেই জানি। রাষ্ট্রচিন্তা, রাষ্ট্রদর্শন এবং সামগ্রিকভাবে দর্শন নিয়ে যে-কোনো সময় আলোচনা করতে গেলে প্লেটো এবং অ্যারিস্টটল-এর নামোল্লেখ করতেই হয়। কিন্তু রাষ্ট্রচিন্তা, বা রাষ্ট্রদর্শনের গভীরে প্রবেশ করলে দেখা যাবে যে এই দুই মহান চিন্তানায়ক বহু ব্যাপারে প্রাচীন গ্রিক রাষ্ট্রচিন্তার নিকট ঋণী ছিলেন। তাঁদের রাষ্ট্রচিন্তার মূলসূত্রের অনেকগুলি অংশ নিহিত ছিল প্রাচীন গ্রিসের রাষ্ট্রচিন্তার মধ্যে। সেই দিক চিন্তা করে বলা যেতে পারে যে প্রাচীন গ্রিসের রাষ্ট্রচিন্তার মূল বিষয়গুলি থেকে প্লেটো এবং অ্যারিস্টটল-এর রাষ্ট্রচিন্তার মূল বিষয় সম্পূর্ণ আলাদা নয়, একটি সুন্দর ধারাবাহিকতা আছে। অন্যভাবে বলা যেতে পারে যে প্লেটো এবং অ্যারিস্টটল- পূর্ব গ্রিক রাষ্ট্রচিন্তা থেকে তাঁদের রাষ্ট্র- চিন্তাকে বিচ্ছিন্ন করা যায় না। আমরা জানি প্লেটো, অ্যারিস্টটল গণতন্ত্রকে একটি আদর্শ সরকার হিসেবে মেনে নিতে পারেননি। কিন্তু তাঁদের এই ধারণার সঙ্গে প্রাচীন গ্রিসের ধারণার মধ্যে বিস্তর সামঞ্জস্য লক্ষ করা যায়। সক্রেটিসসহ প্রাচীন গ্রিসের বহু চিন্তাবিদ মনে করতেন যে গণতন্ত্র হল অযোগ্য লোকের শাসন। প্রশাসন পরিচালনার জন্য প্রয়োজন যোগ্য ব্যক্তি। কিন্তু গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় যোগ্য ব্যক্তির স্থান নেই। অযোগ্যরা ক্ষমতার তত্ত্বে অবস্থান করে বলে গণতন্ত্রের এই দুরবস্থা। ডেমোক্রিটাস ছিলেন প্রাচীন গ্রিসের একজন বিশিষ্ট চিন্তাবিদ। তিনিও গণতন্ত্রের প্রতি সমর্থনজ্ঞাপন করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেননি। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে গণতন্ত্র সম্পর্কে প্লেটো ও অ্যারিস্টটল যে মনোভাব পোষণ করতেন তা তাঁদের পূর্বসূরিদের চেয়ে স্বাতন্ত্র্যসম্পন্ন ছিল না।

দার্শনিক রাজা ও যোগ্যের শাসন: আমরা জানি প্লেটো তাঁর ‘রিপাবলিক’ গ্রন্থে দার্শনিক রাজার প্রয়োজনীয়তা সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। এই প্রেক্ষিতে মনে করা যেতে পারে যে এই ধারণাটির আবিষ্কর্তা কিন্তু প্লেটো ছিলেন না, সক্রেটিস দার্শনিক রাজা বা রাজা- দার্শনিক ধারণার জন্মদাতা। একটি রাষ্ট্র (polis) কদাপিও সুষ্ঠুভাবে সাধারণ মানুষের দ্বারা পরিচালিত হতে পারে না, প্রয়োজন যোগ্য ব্যক্তির এবং এই যোগ্য ব্যক্তি গণতন্ত্রে সচরাচর পাওয়া যায় না। সেই কারণে সক্রেটিস রাজা-দার্শনিক ধারণাটির প্রবর্তন করেছিলেন। ডেমোক্রিটাস-এর মনে এই ধারণা জন্মেছিল যে অযোগ্য ব্যক্তিকে ক্ষমতায় বসানো হলে শাসন রসাতলে যেতে বাধ্য (According to Democritus bad citizens promoted to high positions which they do not deserve show negligence, stupidity and insolence in the conduct of state affairs.)। প্রাচীন গ্রিসের প্রায় সমস্ত চিন্তাবিদই যোগ্য ব্যক্তির শাসনের পক্ষে মত ব্যক্ত করেছিলেন। প্রাচীন গ্রিসে এবং প্লেটো ও এরিস্টটলের সমকালে একটি সুন্দর প্রবচন তৈরি হয়েছিল-It is better for the fools to obey than to rule.

নৈতিকতা, এবং রাজনীতিক ন্যায়বিচার: আমরা মনে করি যে এই প্রবচনটি আজও প্রাসঙ্গিকতা হারায়নি। গণতন্ত্রের প্রতি আমাদের যে আসক্তি তার মূলে রয়েছে আবেগ ও গণতন্ত্রের প্রতি আমাদের অস্বাভাবিক দুর্বলতা। প্রাচীন গ্রিক পন্ডিতগণ এই আবেগ ও দুর্বলতা থেকে মুক্ত ছিলেন বলে গণতন্ত্র সম্বন্ধে এমন একটি দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে পেরেছিলেন। প্রাচীন গ্রিসের দার্শনিকগণ রাজনীতিকে নৈতিকতা, মূল্যবোধ প্রভৃতি থেকে আলাদা করেননি। বরং তাঁরা মনে করতেন যে ন্যায়বোধ-নীতিবোধ- নৈতিকতা ইত্যাদির সঙ্গে রাজনীতির একটি নিবিড় সম্পর্ক বিদ্যমান। অযোগ্য ও নীতিহীন ব্যক্তিরা রাজনীতির অঙ্গনে এসে দাপাদাপি করলে রাজনীতি কলুষিত হতে বাধা এবং যোগ্য ও সৎ’ব্যক্তিরা রাজনীতি থেকে দূরে সরে যাবে বা যেতে বাধ্য হবে। বলা বাহুল্য, প্লেটো এবং অ্যারিস্টটল একই ধারণা পোষণ করতেন। এঁদের আদর্শ রাষ্ট্রের মুখ্য বিষয় ছিল সৎ ও নীতিবোধ-সমন্বিত রাজনীতি। সে-কারণে তাঁরা আদর্শ রাষ্ট্রের ছক এঁকেছিলেন। প্লেটো জানতেন যে আদর্শ রাষ্ট্রের পরিকল্পনা কখনও বাস্তবায়িত হবে না। কিন্তু রাজনীতিকে নৈতিকতা, মূল্যবোধ, আদর্শ ইত্যাদির আবরণে আবৃত করতে হলে আদর্শ রাষ্ট্রের পরিকল্পনা করা ছাড়া উপায় ছিল না। ন্যায়বিচার ধারণাটি বস্তুতপক্ষে প্রাচীন গ্রিসের সমস্ত চিন্তাবিদের চিন্তা ও বক্তব্য বিষয়ের প্রধান চালিকাশক্তি ছিলো বলে আমরা জানতে পারি। এই ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য তাঁরা একদিকে আইন ও রাষ্ট্রশক্তি ও অন্যদিকে ভগবানের উপর দায়িত্ব অর্পণ করেছিলেন। বিশেষ করে অঙ্কশাস্ত্রবিদ জ্যামিতিবিদ পিথাগোরাস ভাবতেন ভগবান হলেন বিশ্ব জগতের পরিচালক এবং তিনি চান না ন্যায়বিচার পদদলিত হোক। তাঁর ইচ্ছাশক্তিকে কার্যকর করে তুলতে হলে রাষ্ট্রশক্তিকে তৎপর হতে হবে। প্রাচীন গ্রিকগণ মনে করতেন জিউস হলেন ন্যায়বিচারের প্রতীক ও প্রতিষ্ঠাতা। সমাজে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হলেই ন্যায়বিচার বাস্তবায়িত হবে। সপ্তপ্রাজ্ঞ, হেরাক্লিটাস, ডেমোক্রিটাস, সোলোন প্রমুখেরা সকলেই ন্যায়বিচার ধারণাকে নিজ নিজ আলোচনার মুখ্য বিষয়ে পরিণত করেছিলেন। প্লেটো এবং অ্যারিস্টটল আলোচনা করতে গিয়ে আমরা দেখতে পাই যে এই দুই দার্শনিক ন্যায়বিচারকে রাজনীতিক চিন্তাভাবনার কেন্দ্রবিন্দুতে স্থাপিত করেছেন। বিশেষ করে প্লেটোর ‘রিপাবলিক’ গ্রন্থের যে আলোচনা তার বৃহদংশ জুড়ে রয়েছে ন্যায়বিচার। অন্যভাবে বলা যেতে পারে যে ন্যায়বিচারকে যদি ‘রিপাবলিক’ গ্রন্থের আলোচনা থেকে অপসারিত করা হয়, তাহলে গ্রন্থটির ঔজ্জ্বল্য বহুলাংশে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কেবল প্লেটো নন অ্যারিস্টটলও ন্যায়বিচার সম্বন্ধে বিস্তর চিন্তা-ভাবনা করেছিলেন। তাঁর ‘পলিটি’ নামক ধারণাটি হল মধ্যবিত্তের শাসন। তিনি বলতেন যে, সমাজে ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে বিস্তর পার্থক্য থাকলে অশান্তি, বিশৃঙ্খলা ও নানা শ্রেণির মধ্যে বিরোধ প্রায়শই লেগে থাকবে এবং এই পরিস্থিতি শান্তি ও ন্যায়বিচারের প্রতিকূল। তাই তিনি মধ্যবিত্তের শাসনকে ন্যায়বিচারের পক্ষে যথার্থ অনুকূল বলে মতপ্রকাশ করে গেছেন।

দ্বান্দ্বিকতা: সক্রেটিস, প্লেটো-পূর্ব চিন্তাবিদগণের মধ্যে সর্বাগ্রগণ্য ছিলেন। প্লেটোর মতো সক্রেটিস সুবিন্যস্তভাবে তাঁর চিন্তাধারা লিপিবদ্ধ করে যাননি। তা সত্ত্বেও তাঁর মুখ্য কৃতিত্ব হল তিনি প্লেটো ও অ্যারিস্টলের রাষ্ট্রদর্শনের গোড়াপত্তন করে দিয়েছেন। আমরা রাষ্ট্রচিন্তা বা রাষ্ট্রদর্শনের মধ্যে যে দ্বান্দ্বিকতার অস্তিত্ব খুঁজে পাই তার সৃষ্টি সক্রেটিসের হাতে। দ্বান্দ্বিক যৌক্তিকতাকে সক্রেটিস তাঁর আলোচনার পদ্ধতি হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন এবং এটা ‘রিপাবলিক’ গ্রন্থে তা প্রয়োগ করে গেছেন। এই দ্বান্দ্বিকতা পরে হেগেল ও মার্কস নেন। তাহলে দেখা যাচ্ছে যে পাশ্চাত্য রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাসে সক্রেটিস কেবল তাঁর দ্বান্দ্বিক যুক্তিবাদিতার জন্য স্মরণীয় হয়ে থাকবেন আর প্লেটো স্বরণীয় হয়ে থাকবেন এই দ্বান্দ্বিক নীতিকে ব্যাপকহারে প্রয়োগের জন্য। পাশ্চাত্য রাষ্ট্রচিন্তার একজন বিশিষ্ট ব্যাখ্যাকার বলেছেন যে আমরা যাকে প্লেটোর রাষ্ট্রচিন্তা বলে জানি তা genuine Socratic origin, ম্যাকসে আরও সুন্দর করে বলেছেন যে প্লেটোর মধ্যে ম্যাকসে পুনরাবির্ভাব ঘটেছে। সক্রেটিস এবং প্লেটোকে পাশাপাশি রেখে পড়লে এর যথার্থ প্রমাণিত হবে।

সরকারের শ্রেণিবিভাগ: প্লেটো যেভাবে সরকারের শ্রেণিবিভাগ করেছেন তা কিন্তু তাঁর নিজস্ব নয়। তাঁর পূর্বসূরিরা তা করে গেছেনা বা বলা যেতে পারে যে পূর্বসূরিগণের আলোচনা এর রূপরেখা তৈরি করেছিল। এ ব্যাপারে অ্যারিস্টটলও সক্রেটিস ও সরকারের শ্রেণিবিভাগ অন্যান্য প্রাচীন গ্রিক পন্ডিতগণের নিকট ঋণী। প্লেটো এবং অ্যারিস্টটল উভয়েই নৈতিকতা, আদর্শ, জনকল্যাণ ইত্যাদিকে সরকারের শ্রেণিবিভাগের নির্ধারক হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। একই জিনিস ভিন্ন আকারে সক্রেটিস ও অন্যান্য প্রাচীন গ্রিক চিন্তানায়কদের মধ্যে পাই।

গণতন্ত্র সম্পর্কে প্লেটোর ধারণা

গণতন্ত্র সম্বন্ধে প্লেটোর ধারণার মূল্যয়ন: সাম্প্রতিককালের একাধিক গবেষক (যেমন-J. S. McClelland) সামগ্রিকভাবে প্লেটোর রাষ্ট্রদর্শন এবং বিশেষভাবে গণতন্ত্র সম্বন্দ্বে তিনি কী ধারণা পোষণ করতেন সে-সম্পর্কে গবেষণা করেছেন। এই গবেষণার একটি সুচিন্তিত ফসল হল সাধারণভাবে বলা হয় যে প্লেটো গণতন্ত্র বিরোধী ছিলেন তা কিন্তু ঠিক নয়। বরং বলা যেতে পারে যে, গণতন্ত্র সম্পর্কে তাঁর উৎসাহ ছিল অপরিসীম এবং সেই কারণে তাঁর সমকালে গ্রিসের যেসমস্ত নগর-রাষ্ট্রে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রবর্তিত ছিল সেগুলির উত্থান, বিকাশ ও পতন নিয়ে দীর্ঘ অনুসন্ধান কাজ চালিয়ে কতকগুলি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন এবং এগুলি থেকে প্রমাণিত হয় যে গণতন্ত্র সম্পর্কে তিনি যা কিছু বলেছেন তা গণতন্ত্র সম্বন্ধে প্লেটোর অভিজ্ঞতালব্ধ। Mc Clelland বলেছেন যে প্লেটোর মতে গণতন্ত্র হল একটি আকর্ষণীয় শাসনব্যবস্থা বা সরকার। শাসক ও শাসিত উভয়ের নিকট এটি আকর্ষণীয়। যুদ্ধ বা অন্য কোনো অস্বাভাবিক পরিস্থিতি থেকে গণতন্ত্রের জন্ম হয়। হঠাৎ করে কিছু ব্যক্তি নেতা হয়ে যান ও জনগণের কাছে তারা গ্রহণযোগ্য ও সম্মানীয় ব্যক্তিতে পরিণত হন। জনসাধারণও নিজেদের মনের মতো নেতা নির্বাচিত করে খুশি হয়। তারা তাদের পছন্দানুযায়ী সরকার গড়ে তুলতে পারে। কেবল সরকার গঠন করা নয়, জনগণ নিজেদের সুবিধামতো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে। নেতারা প্রতিশ্রুতির বন্যা বইয়ে দেন। এইভাবে নেতা সাধারণ মানুষের নিকট আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। আকর্ষণীয়তার আর-একটি দিক হল সহজ, সরল ও স্বাধীন জীবনযাত্রা এবং শাসক ও শাসিতের মধ্যেকার অনাড়ম্বর সম্পর্ক। গ্রিক নগর-রাষ্ট্রগুলির গণতন্ত্র থেকে তিনি এই সিদ্ধান্তে উপস্থিত হয়েছিলেন।

গণতন্ত্রের অস্থিতিশীলতা দুর্নীতিগ্রস্ততা: প্লেটো বলেছেন যে গণতন্ত্র আকর্ষণীয় হলেও এটি রীতিমতো অস্থিতিশীল সরকার (Democracy is the least stable of the forms of government. What democracy gains by its attractiveness it loses by its instability. Mc Clelland, p. 44), কেন গণতন্ত্র অস্থিতিশীল? প্লেটো কারণ অনুসন্ধানে জেনেছিলেন যে গণতন্ত্রে একজন নেতা থাকেন না-থাকেন একাধিক নেতা। তাদের মধ্যে মতবিরোধ ও সংঘাত শেষপর্যন্ত গণতন্ত্রকে অস্থিতিশীল করে তোলে। জনসাধারণ ও নেতা কারোর মধ্যেই শৃঙ্খলাপরায়ণতা দেখা যায় না। নেতাদের উদ্দেশ্য হল জনগণকে তুষ্ট করা। কিন্তু সে-কাজে তারা সবসময় সফল হতে পারেন না। ফলে নেতাদের সঙ্গে জনসাধারণের বিরোধ উপস্থিত হয় এবং তা গণতন্ত্রের পতন ডেকে আনে। প্লেটো অভিযোগ করে বলেছেন যে গণতন্ত্রে নানাপ্রকার দুর্নীতি দেখা গেছে। অন্ততপক্ষে গ্রিক নগর-রাষ্ট্রগুলিতে তাই তিনি দেখেছিলেন। এই দুর্নীতি গণতন্ত্রকে অস্থিতিশীল করে তোলে। নেতারা, নানারকম দুর্নীতিমূলক কাজে জড়িয়ে পড়েন এবং জনগণও ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির জন্য দুর্নীতির আশ্রয় নেয়। বিশেষ করে সম্পদ আহরণের প্রবণতা গণতন্ত্রে বেশ প্রকট (Democracy is also the ideal breeding ground of money-makers)। প্লেটো বলেছেন যে গণতন্ত্রের জন্মের বা আবির্ভাবের আগে অভিজাততন্ত্র কায়েম ছিল। অভিজাত সম্প্রদায় ক্ষমতাচ্যুত হওয়ায় সেই শূন্যস্থান পূরণ করেছেন কিছু কিছু নেতা। অভিজাতদের সম্পত্তি ও সম্পদ লুণ্ঠনের কাজে এদের দেখা যায়। সুতরাং অর্থোপার্জন ও দুর্নীতি দুইই গণতন্ত্রকে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ করে তোলে এবং শেষপর্যন্ত এর রন্ধ্রে রন্দ্রে ঘুণ ধরিয়ে দেয়।

গণতন্ত্র সম্পর্কে প্লেটোর চিন্তাধারার প্রাসঙ্গিকতা: গণতন্ত্র সম্পর্কে প্লেটো যে সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন তা আজও প্রাসঙ্গিক বলে আমরা মনে করি। বর্তমানকালে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা সর্বাপেক্ষা গ্রহণযোগ্য ও জনপ্রিয়। কিন্তু তাই বলে একে ত্রুটিহীন সরকার বলে গণ্য করার কারণ নেই। প্লেটোর আমলে গ্রিসের নগর-রাষ্ট্রগুলিতে গণতন্ত্র অস্থিতিশীল ছিল এবং আজও তৃতীয় দুনিয়ায় গণতন্ত্রকে আমরা স্থিতিশীল বলতে পারি না। এশিয়া ও আফ্রিকার বহু রাষ্ট্রে গণতান্ত্রিক সরকার স্থিতিশীল হতে পারেনি। অস্থিতিশীলতার যেসমস্ত কারণের উল্লেখ প্লেটো করেছিলেন সেগুলির, বর্তমান পরিস্থিতিতে, বিদ্যমানতা আমরা সবিস্ময়ে প্রত্যক্ষ করি। এখন আমরা গণতন্ত্রের নানাপ্রকার ভেদ দেখছি। কিন্তু কোনো প্রকার গণতন্ত্র দুর্নীতিমুক্ত নয়। প্লেটো দুর্নীতিগ্রস্ত গণতন্ত্র দেখে এর বিরোধিত করেছিলেন। গণতন্ত্রে নেতা ও সাধারণ মানুষ উভয়েই দুর্নীতির জালে জড়িয়ে পড়ে। প্লেটোর গণতন্ত্র সম্পর্কিত্ব চিন্তাধারা ব্যাখ্যা করে J. C. Mc Clelland বলেছেন Democratic leader degenerates into tyranny, গণতন্ত্র সম্বন্ধে এই ধারণা আজও সর্বাংশে সত্য। নেতারা জনগণের অজ্ঞতা ও অযোগ্যতার সুযোগ গ্রহণ করে দুর্নীতিগ্রস্ত ও স্বৈরতান্ত্রিক মনোভাবাপন্ন হয়ে পড়ে। তৃতীয় বিশ্বের যে কোনো দেশের গণতন্ত্রের হালহকিকতের দিকে তাকালে মনে হবে যে গণতন্ত্র সম্বন্দ্বে প্লেটোর মূল্যায়ন কতখানি সঠিক বা বাস্তবানুগ ছিল। তিনি মনে করতেন যে গণতন্ত্রে সাফল্য ও ব্যর্থতা দুইই নির্ভর করে জনসাধারণের চরিত্র ও মানসিকতার ওপর। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ভাগে জন স্টুয়ার্ট মিল গণতন্ত্রের সাফল্যের জন্য ব্যক্তিচরিত্র গঠনের ওপর জোর দিয়েছিলেন। পরিশেষে বলি প্লেটো গণতন্ত্রকে সমগ্র রাজনীতিক ব্যবস্থা থেকে আলাদা বলে মনে করেননি। রাজনীতিক ব্যবস্থাকে আদর্শ করে তোলা সম্ভব হলে গণতন্ত্র সফল হবে।

গ্রিক নগর-রাষ্ট্রের সংকট এবং প্লেটো ও অ্যারিস্টটল

এথেন্সের উত্থান ও রাজনীতিক সংকট: প্রাচীন গ্রিসের রাষ্ট্রচিন্তা যেমন প্লেটো এবং অ্যারিস্টটলের ওপর প্রভাব ফেলেছিল ঠিক তেমনি গ্রিক নগর-রাষ্ট্রের সংকট তাঁদের চিন্তাশক্তি ও দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রভাবিত করেছিল। সংকটের প্রধান কারণ ছিল নগর-রাষ্ট্রগুলির ক্রমবর্ধমান আগ্রাসী মনোভাব। কোনো কোনো নগর-রাষ্ট্র বিপুল পরিমাণ ক্ষমতার অধিকারী হয়েছিল এবং ক্ষমতার শীর্ষে আরোহণ তাদের এত বেশি পরিমাণ আত্মপ্রত্যয়ী করে তুলেছিল যে একাধিক নগর-রাষ্ট্র বাহুবল বা সামরিক শক্তিকে যাবতীয় সমস্যার সমাধানের একমাত্র হাতিয়ার বলে ভেবেছিল এবং এর ফলে নগর-রাষ্ট্রগুলির মধ্যে সংকট ঘনীভূত হয়েছিল। দুই কালজয়ী দার্শনিক এই সংকট থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে রাখতে পারেননি যার ফলে তাঁদের দর্শনচিন্তা লক্ষণীয়ভাবে প্রভাবিত হয়েছিল। ইতিহাসবিদরা বলেন যে খ্রি.পূ. ৪৯০ থেকে খ্রি.পূ. ৪০৪-এর মধ্যে এথেন্স ক্ষমতা শীর্ষে আরোহণ করেছিল। এথেন্সের এই উত্থান পাশাপাশি অবস্থিত নগর-রাষ্ট্রগুলির নিকট আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তাদের আশঙ্কা জন্মেছিল যে এথেন্স যে কোনো সময় তাদের গ্রাস করে ফেলবে এবং বলাবাহুল্য সেই আশঙ্কা অমূলক ছিল না। পারস্যের ওপর একাধিকবার আগ্রাসন চালিয়ে এথেন্স নিজের প্রমত্ত রূপ প্রতিপন্ন করতে সক্ষম হয়েছিল। দুর্ভাগ্যবশত শিক্ষা, দর্শনচিত্তা, মূল্যবোধ ইত্যাদি পূর্ণাঙ্গরূপে বিকশিত হয়নি। রাজনীতি সদ্‌গুণ থেকে আদৌ বিচ্ছিন্ন নয় সেই বোধ ক্ষমতাদর্পী এথেন্সের নীতি- নির্ধারকগণ উপলব্ধি করেননি। সামরিক শক্তির ‘অবাধ অগ্রগমন এবং নৈতিকতা সদ্‌গুণ ইত্যাদির অধোগমন এথেন্সের আকাশে ঘন কালো ছায়া সৃষ্টি করেছিল আর প্লেটো ও অ্যারিস্টটল তার অপসারণের কাজে নেমেছিলেন।

স্পার্টা এবং নগর রাষ্ট্রের সংকট: স্পার্টা ছিল গ্রিসের আর-একটি নগর-রাষ্ট্র। এথেন্স নৌশক্তিতে বলীয়ান হলেও স্পার্টা ছিল সামরিক শক্তিতে বলীয়ান। অর্থাৎ স্পার্টার স্থলশক্তি এথেন্সের নৌশক্তির সমতুল থাকায় দুই নগর-রাষ্ট্রের মধ্যে রেষারেষি তীব্র আকার ধারণ করেছিল। এথেন্স চেয়েছিল Delian Confederacy-কে একটি নৌ সাম্রাজ্যে রূপান্তরিত করতে। বাধা দিল স্পার্টা। স্পার্টা চায়নি এথেন্স তার চেয়ে সামরিক ও অন্যান্য শক্তিতে এগিয়ে যাক। সামরিক শক্তিকে সুসংহত ও শক্তিশালী করার জন্য একজন প্রতিভাবান ব্যক্তি বা কূটনীতিবিদ দরকার। এথেন্সে এই রকম একজন ছিলেন যাঁর নাম থেমিস্টোক্লেস (Themestocles)। থেমিস্টোক্লেস-এর পর আবির্ভাব ঘটে পেরিক্লেস-এর। পেরিক্লেস-এর আকাশচুম্বী দক্ষতা, প্রতিভা ও কূটনীতিক জ্ঞান এথেন্সকে এগিয়ে যেতে অনেকখানি সাহায্য করেছিল। কিন্তু স্পার্টা এসবকে তোয়াক্কা করেনি। ক্ষমতাদর্পিতা তাকে এথেন্সের বিরুদ্ধাচরণ করতে এমন প্ররোচিত করেছিল যে দুই রাষ্ট্রের মধ্যে সশস্ত্র সংগ্রাম অনিবার্য হয়ে উঠেছিল। শেষ পর্যন্ত খ্রি.পৃ. ৪০৪ অব্দে এথেন্স পাকাপাকিভাবে স্পার্টার অধীনতা স্বীকার করে।

সক্রেটিসের প্রাণদণ্ড: আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে গ্রিসের নগর-রাষ্ট্রগুলি জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চাকে অপ্রয়োজনীয় বলে মনে করায় জ্ঞান- চর্চার প্রতি তাদের অনীহা প্রকট হয়ে ওঠে। আর সেই অনীহা তাদের ক্ষমতা অর্জনে উদ্বুদ্ধ করেছিল। জ্ঞানচর্চার প্রতি অনীহার চরম বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল সক্রেটিস-এর প্রাণদণ্ডের মধ্যে। ৩৯৯ খ্রি.পূর্বাব্দে গ্রিসের গণতন্ত্রের স্ব-ঘোষিত নেতারা বললেন যে সক্রেটিস যুব সম্প্রদায়ের মনকে কলুষিত করে তুলছেন (He is guilty of corrupting youth. The penalty demanded his death.)। এথেনীয় আদালতে বিচারকের সংখ্যা ছিল ৫০১ জন। গরিষ্ঠসংখ্যক বিচারক রায় দিলেন যে সক্রেটিস যে অপরাধ করেছেন তার জন্য তাঁর প্রাণদণ্ডই প্রাপ্য। অতএব এক কাপ বিষ (হেমলক) তাঁকে দেওয়া হল এবং তিনি তা অম্লানবদনে পান করে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন। সক্রেটিসের মৃত্যু বড়ো কথা নয়, একদিন তাঁকে মরতেই হত। সমস্যা হল একজন ব্যক্তি স্বাধীন মতপ্রকাশ করতে চেয়েছিলেন। তিনি ক্ষমতার পুঞ্জীভবনের চেয়ে জ্ঞানের অনুশীলনকে অগ্রাধিকার দিতে চেয়েছিলেন। এথেন্সবাসীরা তা মেনে নিতে পারেনি। একদিকে ক্ষমতার রাজ্যে সংকট অন্য দিকে শিক্ষা, দর্শনচিন্তা ইত্যাদির অনুশীলনে সংকট। এই দ্বিবিধ সংকটে গ্রিসের নগর- রাষ্ট্রগুলিতে নাভিশ্বাস উপস্থিত হয়েছিল।

প্রচার সর্বস্ব রাজনীতি: ক্ষমতার দালালদের ষড়যন্ত্র, আবেগসর্বস্ব জননেতাদের বাকচাতুর্য ইত্যাদি রাজনীতিক পরিস্থিতিকে জটিল ও সংকটজনক করে তুলত। সততা, নিষ্ঠা, মূল্যবোধ সদগুণের প্রাধান্য এই সমস্ত আবেগনির্ভর নেতাদের জীবনে ছিল না। সংকীর্ণ গোষ্ঠী বা ব্যক্তিস্বার্থের দ্বারা তাঁরা চালিত হতেন। গ্রিক নগর-রাষ্ট্রগুলির যেসমস্ত স্থানে গণতন্ত্র ছিল সেগুলি আসল অর্থে গণতন্ত্র ছিল না। সেইজন্য প্লেটো এবং অ্যারিস্টটল এমন এক আদর্শ রাষ্ট্র স্থাপন করতে চেয়েছিলেন যার মধ্যে আবেগনির্ভর জননেতা ও ক্ষমতার দালালদের স্থান থাকবে না। প্লেটো দার্শনিক রাজার পরিকল্পনা করেছিলেন। আর অ্যারিস্টটল মধ্যবিত্তের শাসনের কথা ভেবেছিলেন। প্রচার- সর্বস্ব রাজনীতি রাষ্ট্রের কল্যাণ করতে পারে না। আবেগ- নির্ভর রাজনীতির জন্য সমাজে ন্যায়বিচার পর্যুদস্ত হয়ে পড়েছিল বলে প্লেটো মনে করতেন। তাই ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে তিনি বিশেষ আগ্রহ দেখিয়েছিলেন। মোট কথা, প্রাচীন গ্রিসের রাষ্ট্রচিন্তা ও গ্রিক নগর-রাষ্ট্রগুলির সংকট উভয় মিলে দুই দার্শনিকের চিন্তাধারাকে প্রভাবিত করেছিল।

সমন্বয়সাধনকারী ও সুস্বনতা আনয়নকারী ন্যায়বিচার

ন্যায়বিচারের বিশেষ স্থান: আমরা আগে একাধিকবার বলেছি যে প্লেটোর রাষ্ট্রচিন্তায় ন্যায়বিচার বিশেষ স্থানাধিকারী। তিনি একে একটি সাধারণ নীতি হিসেবে মনে করেননি। তাঁর আদর্শ রাষ্ট্রের মূল স্তম্ভ ছিল ন্যায়বিচার। আদর্শ রাষ্ট্রের সমস্ত শ্রেণি, গোষ্ঠী ও ব্যক্তির মধ্যে সমন্বয়সাধন ও সুস্বনতা (harmony) আনার ব্যাপারে ন্যায়বিচারের বিশেষ ভূমিকা আছে বলে তিনি মনে করতেন আর এই ধারণা তাঁর মনের মধ্যে দৃঢ়ভাবে প্রোথিত হবার জন্য তিনি যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে ন্যায়বিচার ধারণাটি ব্যাখ্যা করেছিলেন। J. S. Mc Clelland লিখেছেন- Justice is the integrating principle in Plato’s ideal, State. It both binds the classes to each other and is the basis of unity in the ruling group. (History of Western Political Thought, p. 32.)

কেন ন্যায়বিচারের এই বিশেষ ভূমিকা?: প্রশ্ন জাগা খুবই স্বাভাবিক’যে, কেন প্লেটো ন্যায়বিচারকে এই বিশেষ আসনে বসাতে চেয়েছিলেন? ন্যায়বিচার কেবল কতকগুলি-এটা করো না, ওটা করো ইত্যাদির সমন্বয় বা মিলন নয়। প্লেটো রাষ্ট্রকে সমাজের সকল ব্যক্তি, শ্রেণি বা গোষ্ঠীর মহামিলনস্থল হিসেবে দেখতে চেয়েছিলেন। এই মহামিলন মঠে ব্যক্তিতে-ব্যক্তিতে বা গোষ্ঠীতে-গোষ্ঠীতে সংঘাত থাকবে না। সকলের মধ্যে গড়ে ওঠা হার্দিক সম্পর্ক হবে রাষ্ট্রের প্রকৃত ভিত্তি। এই উচ্চাকাঙ্খা লক্ষ্যস্থলে উপস্থিত হতে হলে একটি বিশেষ নীতি অবশ্যপালনীয় এবং তা হল প্রতিটি নাগরিককে যোগ্যতা অনুযায়ী যথাযোগ্য স্থানে বসাতে হবে। প্রত্যেকে দায়িত্ব পালনের যে সুযোগ পাবে সেটি যেন তার যোগ্যতা ও ক্ষমতার অনুসারী হয়। কায়িক পরিশ্রমে পটু ব্যক্তি কায়িক শ্রম সম্পাদনের সুযোগ পাবে। অসাধারণ সাহসী ব্যক্তি সেনাদলে যাবে।

রাষ্ট্রিক কাঠামোর পূনর্বিন্যাস দরকার: প্লেটো মনে করতেন বিশেষ শ্রেণি বা ব্যক্তি যদি অযৌক্তিকভাবে অধিক পরিমাণে আনুকূল্য পেয়ে যায় তাহলে তা অন্যান্য গোষ্ঠী বা ব্যক্তির মনে রাষ্ট্রিক কাঠামোর বিরুদ্ধে অসন্তোষ উৎপাদন করবে যা সমাজের স্থিতিশীলতা ও শান্তির পরিপন্থী হয়ে দাঁড়াবে। সেই কারণে প্লেটো রাষ্ট্রিক কাঠামোর পুনর্বিন্যাসের কথা গভীরভাবে ভেবেছিলেন। কীভাবে এই পুনর্বিন্যাসটি ঘটবে। প্লেটোর বক্তব্য বিশ্লেষণ করে জনৈক ব্যাখ্যাকার বলেছেন-Justice demands a corresponding state structure, a social hierarchy ensuring a harmonious unity of the three principles for the common good. অর্থাৎ সমাজের অভিন্ন কল্যাণের নিমিত্ত তিনটি নীতিকে ভিত্তি করে রাষ্ট্রিক কাঠামোর পুনর্বিন্যাস বিশেষ প্রয়োজন। এই তিনটি নীতি হল প্রাজ্ঞতা (wisdom), সাহসিকতা (courage) এবং সহনশীলতা (temperance)। এই তিনটি নীতির ওপর ভিত্তি করে রাষ্ট্রিক কাঠামোর পুনর্বিন্যাসটি সাধিত হলে বিভিন্ন শ্রেণি এবং ব্যক্তির মধ্যে সুস্বনতা (harmony) বজায় থাকবে বলে তিনি মনে করতেন। প্লেটো বলেছেন যে সমাজের অসংখ্য ব্যক্তি নিজের শ্রম, বিদ্যা, বুদ্ধি ইত্যাদির সাহায্যে প্রয়োজনে লাগে এমন সমস্ত সামগ্রী সংগ্রহ করে থাকে এবং সেই উদ্দেশ্যে তারা পরিশ্রমও করে। কিন্তু প্রত্যেকে নিজ নিজ প্রয়োজনে পরিশ্রম করলেও রাষ্ট্রের অভিন্ন কল্যাণের কথাটি বিস্তৃত হয় না বা হওয়া উচিত নয়। প্লেটো বলতে চেয়েছেন যে রাষ্ট্রিক কাঠামোকে এমনভাবে গড়ে তুলতে হবে যাতে করে কোনো ব্যক্তি বা ব্যক্তিগোষ্ঠীর প্রয়োজন অপূর্ণ না থাকে। একইসঙ্গে সমাজের সার্বিক কল্যাণের দিকটিও পুনর্বিন্যাস হবে।

সাম্যবাদ, সমন্বয়সাধন ও সুস্বনতা আনয়ন: প্লেটো ন্যায়বিচার ধারণার মাধ্যমে সমাজের মধ্যে সমন্বয়সাধন ও সুম্বনতা আনতে চেয়েছিলেন। বলা বাহুল যে, তাঁর সাম্যবাদ (communism) ধারণাটিও ন্যায়বিচার ধারণাটির সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পর্কযুক্ত। কেন? সাম্যবাদ ধারণার মূল বক্তব্য হল অভিভাবক শ্রেণির নিজের সম্পত্তি বা পুত্র-কন্যা-স্ত্রী বলতে কিছুই থাকবে না। এগুলি হবে যৌথ। অর্থাৎ যে-কোনো মহিলা যে-কোনো পুরুষের পত্নী হিসেবে বিবেচিত হবেন। শিশুদের ক্ষেত্রেও একই নিয়ম। প্রযোজ্য। কোনো শিশুর নির্দিষ্ট পিতামাতা থাকবে না। প্লেটো সমকালীন সমাজব্যবস্থা অনুধাবন করে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন যে সাম্যবাদ প্রবর্তিত হলে সমাজস্থ ব্যক্তিবর্গের মধ্যে বিভেদ থাকবে না। ঐক্য ও সংহতি গড়ে উঠবে এবং সেখান থেকে আসবে সমস্ত অংশের মধ্যে সুম্বনতা বা সংগতি। ন্যায়বিচার ও সাম্যবাদ উভয় ধারণাই পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। তিনি বলেছেন যে সমাজের মধ্যে সংহতি ও সুস্বনতা আনতে হলে এমন ব্যবস্থাপনা (arrangements) প্রস্তুত করতে হবে যাতে কেউ অতিরিক্ত পরিমাণে সন্তুষ্ট এবং অসন্তুষ্ট না হয়। সমাজে পুরুষ এবং নারী উভয়ের সমানাধিকার থাকবে। এই সমানাধিকার নীতি সুপ্রতিষ্ঠিত হলে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হবে। সাম্যবাদের প্রতিষ্ঠা সেই লক্ষ্যে পৌঁছাতে সাহায্য করবে বলে তিনি মনে করতেন। পাশ্চাত্য রাষ্ট্রচিন্তার একজন ব্যাখ্যাকার বলেছেন: By doing away with individual family among the guardians Plato hoped to unite them in a single ruling family in which all members are relatives. (V. S. Nersesyants. Political Thought of Ancient Greece, p. 114).

প্লেটো ও অ্যারিস্টটলের রাষ্ট্র-দর্শনের ব্যর্থতা

দুজন দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলতে পারেননি: গ্রিক নগর-রাষ্ট্রের জ্ঞানবিজ্ঞানের চর্চায় প্লেটো এবং অ্যারিস্টট্ল-এর স্থান সবার ওপরে হলেও তাঁদের মৃত্যুর পর এই দুই দার্শনিকের প্রভাব দীর্ঘস্থায়ী ছিল না। পাশ্চাত্য রাষ্ট্রচিন্তার অন্যতম বিশিষ্ট ব্যাখ্যাকার অধ্যাপক স্যাবাইন বলেন (A History of. Politica Theory, p. 123) যে তাঁরা কেবল গ্রিসের নগর-রাষ্ট্রের পরিধির মধে আলোচনা ও বিশ্লেষণ সীমাবদ্ধ রেখেছিলেন। সুতরা স্বাভাবিক কারণে তাঁদের মৃত্যুর পর সেই আলোচনাকে কেউ চালিয়ে নিয়ে যাননি। নগর-রাষ্ট্রের রাষ্ট্রদর্শন বিষয়ে সকলে বিশেষ উৎসাহী ছিলেন না। স্যাবাইন আরও বলেছেন যে এই দুই দার্শনিকের রাষ্ট্রদর্শনের বিস্তর তাৎপর্য থাকলেও প্লেটো এবং অ্যারিস্টটলের পরবর্তীকালের পন্ডিতগণ নাগর-রাষ্ট্রের বাইবের রাজনীতিক ব্যবস্থাগুলিতে তাঁদের ভাবধারা প্রয়োগের কোনো চেষ্টা করেননি।

কারণ: কী কী কারণে প্লেটো এবং অ্যারিস্টটল পরবর্তীকালের চিন্তাবিদগণের ওপর প্রভাব ফেলতে ব্যর্থ হয়েছিলেন তার কারণ অনুসন্ধান একেবারে কষ্টসাধ্য নয়। এই দুই চিন্তানায়ক অতিমাত্রায় ভাববাদী এবং সেই সুবাদে অবাস্তববাদী ছিলেন। বিশেষ করে প্লেটোর রাষ্ট্রদর্শনের সঙ্গে বাস্তবের সম্পর্কই ছিল না। আদর্শ রাষ্ট্রের ছক ও চিন্তাধারা আদর্শ হিসেবে অনবদ্য এবং কেউ এর বিরুদ্ধাচরণ করতে পারে না। কিন্তু এই ছককে কঠোর বাস্তবের মধ্যে ফেলে দিলে দেখা যাবে যে এটি আস্তে আস্তে উবে যেতে শুরু করেছে। নগর- রাষ্ট্রকেন্দ্রিক সভ্যতা কখনও দিকদর্শনকারী হতে পারে না। অথচ প্লেটো এবং অ্যারিস্টট্ল-এর মনে এমন একটি ধারণা তৈরি হয়েছিল যে নগর-রাষ্ট্রের সভ্যতা সবার নিকট একটি আদর্শ ও অনুকরণীয় হয়ে দাঁড়াবে। আর-একটি কারণ আমরা এখানে উল্লেখ করতে পারি। জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন দিক আলোচনার জন্য যে দক্ষতা পান্ডিত্যের বহুমুখী প্রতিভা প্রয়োজন তা এঁদের দুজনের থাকলেও পরবর্তীকালের পন্ডিতগণের ছিল না। প্লেটো এবং অ্যারিস্টটল অতিমাত্রায় প্রজ্ঞা ও সদ্‌গুণের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। প্রজ্ঞা ও সদ্‌গুণ শাশ্বত সে- বিষয়ে সন্দেহ নেই। কিন্তু এগুলির ব্যক্তিক্ষেত্রে যতখানি প্রযোজ্য রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে ততখানি নয়। উপরন্তু দুজন চিন্তানায়ক স্বয়ম্ভরতা অর্জনকে রাষ্ট্রের বিশেষ লক্ষ্য হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন কিন্তু এ কাজও বাস্তবসম্মত নয়।

নগর রাষ্ট্রের ব্যর্থতা: পণ্ডিতগণ বলে থাকেন যে নগর-রাষ্ট্র নানা কারণে বার্থ হয়েছিল। রাজনীতি এবং অর্থনীতি কোনো ক্ষেত্রেই নগর-রাষ্ট্র স্বাবলম্বিতা বা স্বয়ম্ভরতা অর্জন করতে পারেনি। স্বাবলম্বিতা অর্জন করতে হলে গ্রিক নগর-রাষ্ট্রকে পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতে হত। কিন্তু তদানীন্তনকালে তা সম্ভব ছিল না। নগর-রাষ্ট্রগুলির আর্থ-সামাজিক, রাজনীতিক, সাংস্কৃতিক বাতাবরণ এমনভাবে গড়ে উঠেছিল যে তারা পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকতে পারেনি এবং বাস্তবে তা সম্ভবও ছিল না। বিচ্ছিন্ন হওয়ার সুযোগ ছিল না বলেই তারা স্বয়ম্ভরতা অর্জনে ব্যর্থ হয়েছিল। সুতরাং পরবর্তীকালে যখন গ্রিস নতুন পরিস্থিতি ও চ্যালেঞ্জের মুখে এসে উপস্থিত হয়েছিল তার মোকাবিলা করা নগর-রাষ্ট্রের পক্ষে সম্ভব ছিল না।

বিদেশ সম্পর্ক সূচারুরুপে বিন্যস্ত ছিলোনা: পন্ডিতগণের ধারণা যে একটি রাষ্ট্রকে সাফল্যের সঙ্গে টিকে থাকতে অথবা উত্তরোত্তর শ্রীবৃদ্ধির পথে অগ্রসর হতে হলে প্রয়োজন বিদেশি রাষ্ট্রের সঙ্গে সুচারুরূপে সম্পর্ক গড়ে তোলা। নগর-রাষ্ট্রের কর্ণধারগণ অথবা তাঁদের উপদেষ্টা মন্ডলী আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ওপর এবং তাকে নগর- রাষ্ট্রের বিকাশের পক্ষে অনুকূল করে তোলার ব্যাপারে বিশেষ আগ্রহী ছিলেন না। জ্ঞান-বিজ্ঞানের অনুশীলন অভ্যন্তরীণ, বিষয়ের পরিচালনার ব্যাপারে হয়তো প্রভুত পরিমাণে সহায়ক ছিল। কিন্তু যে মুহূর্তে গ্রিসের সঙ্গে ইউরোপের অন্যান্য রাষ্ট্রের এবং অন্য মহাদেশের রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়টি দেখা দিল তখনই জ্ঞান-বিজ্ঞানের অনুশীলন নিয়ে ব্যস্ত থাকার মানসিকতা রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে অপর্যাপ্ত বলে প্রতিপন্ন হল। অ্যারিস্টটলোত্তর রাজনীতি বিশ্লেষণ করলে আমরা এই সিদ্ধান্তে উপস্থিত হই যে রাষ্ট্রের কর্ণধারগণ জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চার চেয়ে সাম্রাজ্য জয়, প্রশাসন ইত্যাদির ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপের কথা ভেবেছিলেন, তাঁদের নিকট নৈতিকতা, আদর্শ, মূল্যবোধ অনেকখানি গৌণ অবস্থায় নেমে এসেছিল। অথচ প্লেটো এবং তাঁর ছাত্র এদের সর্বাধিক প্রয়োজনীয় বলে মনে করেছিলেন।

রাজনীতিক কাঠামোর পূবর্বিন্যাস ঘটেছিলো: ঐতিহাসিকরা বলেন যে অ্যারিস্টটল-এর মৃত্যুর পর ইউরোপ তথা গ্রিসের রাজনীতিক কাঠামোর পুনর্বিন্যাস হয়েছিল। আগে নগর-রাষ্ট্রগুলি স্ব স্ব নীতি অনুসরণ ও প্রয়োগে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিল। পরে রাষ্ট্রগুলি নিজেদের মধ্যে সম্পর্কের পুনর্বিন্যাস সাধন করে নতুন কাঠামো গড়ে তোলে যা যুক্তরাষ্ট্রব্যবস্থার রূপ নেয়। রাজনীতি, অর্থনীতি ইত্যাদি বহুবিধ পরিস্থিতির চাপে পড়ে শাসকগোষ্ঠী রাষ্ট্রিক কাঠামোর পুনর্বিন্যাস করেছিল। এই পরিবর্তন পূর্ববর্তী ব্যবস্থাকে অপ্রাসঙ্গিক করে তোলে।

নতুন যুগের সূচনা

একটি যুগের অবসান: অ্যারিস্টটল-এর মৃত্যুর পর একটি যুগের অবসান ঘটে। ইউরোপীয় রাষ্ট্রচিন্তা ও ভাবধারা নতুনপথের সন্ধানে যাত্রা শুরু করে (In the history of political philosophy the death of Aristotle in 322 marks the close of an era and marks the beginning of a new era in politics and the history of European civilisation. p. 141) স্যাবাইনের এই মন্তব্য যথাযথ। নগর-রাষ্ট্রকেন্দ্রিক রাষ্ট্রচিন্তা ও সভ্যতা পরবর্তীকালের পক্ষে বেমানান হয়ে উঠেছিল। কার্লাইল যথার্থই বলেছেন যে, একটি ‘সময়ে রাষ্ট্রদর্শনের গতি বা ধারাবাহিকতা একটি স্থানে এসে থমকে যায়। অর্থাৎ ধারাবাহিকতাটি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। অ্যারিস্টলের মৃত্যুকে সেই বিচ্ছিন্নতার পর্যায় হিসেবে গণ্য করা চলে।

নতুন রাষ্ট্রচিন্তার আবির্ভাব: যে নতুন রাষ্ট্রচিন্তার আবির্ভাব ঘটেছিল তার বহুমুখিতা সম্পর্কে সন্দেহ নেই। প্রথমত, ব্যক্তিকে দিয়েই শুরু করা যাক। প্লেটো এবং অ্যারিস্টটল-এর চিন্তাজগতে ব্যক্তির স্থান ছিল অদ্ভুত। সে polis-এর একটি অত্যন্ত নগণ্য অংশ। নৈতিকতা, আদর্শ, মূল্যবোধ ইত্যাদির পেছনে ধাবমান একটি একক। এগুলি সে নিজে স্বাধীনভাবে বিকশিত করে তুলতে পারে না। তার জন্য সে রাষ্ট্র নামক প্রতিষ্ঠানের দ্বারস্থ। ব্যক্তিতে-ব্যক্তিতে যে সামাজিক এবং পরস্পর নির্ভরশীলতাযুক্ত একটি সম্পর্ক তা প্লেটো এবং অ্যারিস্টটল-এর রাষ্ট্রদর্শনের মধ্যে বিশেষ স্থানাধিকারী হওয়ার ‘সুযোগ থেকে বঞ্চিত। ব্যক্তি সমাজবদ্ধ জীব এবং অন্যান্যদের সঙ্গে সম্পর্কের বন্ধনে আবদ্ধ। এই মৌলিক ধারণাকে ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিল এক নতুন রাষ্ট্রচিন্তা ও রাজনীতিক কাঠামো। রাষ্ট্র কোনো অবস্থাতে ব্যক্তিকে উপেক্ষা করতে পারে না। রাষ্ট্র শেষকথা নয়, শেষকথা ব্যক্তি। তার সার্বিক কল্যাণে রাষ্ট্র নিয়োজিত। এই ধারণা থেকে তৈরি হল নতুন রাষ্ট্রিক কাঠামো, আইন, প্রশাসন, ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের সম্পর্ক ইত্যাদি। আদর্শ, মূল্যবোধ, নৈতিকতা ইত্যাদি পুরোমাত্রায় অপ্রাসঙ্গিক না হয়ে পড়লেও বাস্তব পরিস্থিতি ও সমস্যা সমস্ত ক্ষেত্রেই অগ্রাধিকার পেতে লাগল।

নতুন রাষ্ট্রিক কাঠামোর জন্ম: আগেই বলা হয়েছে যে গ্রিসের নগর-রাষ্ট্রগুলি নতুন পরিস্থিতির সঙ্গে সাযুজ্যবিধান করে চলতে পারেনি বলে নতুন রাষ্ট্রিক কাঠামো গড়ে উঠেছিল। গ্রিসে গঠিত হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রব্যবস্থা। কিন্তু রাজনীতির গতি-প্রকৃতি একটিমাত্র জায়গায় স্তব্ধ হয়েছিল। সাম্রাজ্যবাদের উন্মেষও এইসঙ্গে হয়েছিল। সাম্রাজ্যবাদের বিস্তৃতি নগর-রাষ্ট্রকে বহুলাংশে তাৎপর্যহীন করে তোলে। অতীতের গৌরব ও মর্যাদা হারিয়ে নগর-রাষ্ট্রগুলি অথর্ব এককে পরিণত হয়। হার্মন (Harmon) যর্থাথই বলেছেন: The city-states were unable to develop and hold together a federation that could withstand the pressure of Macedonian imperialism. নগর-রাষ্ট্রগুলির অতীতের অভিজ্ঞতা ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। এর সরাসরি প্রভাব গিয়ে পড়ে গ্রিক জগতের ওপর।

ধর্মীয় চিন্তার উন্মেষ: প্রাচীন এবং তার পরবর্তীকালের চিন্তাবিদগণ আদর্শ রাষ্ট্র, ন্যায়বিচার, নৈতিকতা, আদর্শ, মূল্যবোধ ইত্যাদি নিয়ে খুবই ব্যস্ত ছিলেন। ধর্মের ওপর তাঁরা বিশেষ নজর দেননি বা দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেননি। সমাজ ও রাষ্ট্রচিন্তার মধ্যে ধর্ম-বিষয়ক চিন্তা ও ভাবধারা যে বিশেষ গুরুত্ব পেতে পারে তা তাঁরা ভাবেননি। কিন্তু অ্যারিস্টটলোত্তর রাষ্ট্রদর্শনের বিশ্লেষকগণ ধর্মকে অপাঙক্তেয় করে রাখতে অনিচ্ছুক ছিলেন না। ধর্ম-সম্পর্কিত ভাবনার আবির্ভাবের সঙ্গে খ্রিস্টধর্মও নিজ আসন তৈরি করে নিতে সক্ষম হয়েছিল। ফলে ধর্মও রাজনীতির আঙিনায় কেবল আবির্ভূত হয়নি, রাজনীতির একটি অন্যতম নিয়ামকের আসনে উপবেশন করেছি আর এই স্রোত চলেছিল মেকিয়াভেলি পর্যন্ত। সমগ্র মধ্যযুগে রাজনীতির ওপর ধর্মের যে আধিপত্য তার সূত্রপাত হয়েছিল এই সময়। রাজনীতির ওপর ধর্মের এই প্রভাবকে নিছক আপতিক বলে গণ্য করা অনুচিত। কারণ মধ্যযুগে এবং তারপরেও জনসাধারণ নানা কারণে ধর্মের দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত হত। এই বাস্তব পরিস্থিতিকে চিন্তাবিদগণ অস্বীকার করেননি।

নৈতিকতা ও আদর্শ গৌণ হয়ে গেলো: প্লেটো এবং অ্যারিস্টট্ল-এর পরবর্তী যুগে নৈতিকতা, আদর্শ ও মূল্যবোধের স্থান গৌণ আকার ধারণ করায় রাষ্ট্র দর্শনের চেহারা বদলে যায়। মূল্যবোধ-ভিত্তিক রাজনীয় সমাজকে নিয়ন্ত্রিত করতে সক্ষম হয়নি। এই প্রবণতা আজও চলছে। মধ্যযুগ ও আধুনিক যুগের অনেক চিন্তাবিদ ও দার্শনিক নৈতিকত ও আদর্শের পুনরুজ্জীবন ও পুনর্বাসনে কথা ভেবেছিলেন কিন্তু লক্ষণীয় সাফল্য তাঁদের ভাগে জোটেনি। প্রসঙ্গক্রমে আমরা রুশোর নামোল্লেখ করতে পারি। প্লেটোর রিপাবলিক-এর দ্বারা প্রভাবিত হয়ে তিনি একটি নতুন পুর-সংগঠনের কথা ভেবেছিলেন। কিন্তু তা হয়নি।

একের সঙ্গে সমগ্রের মিলন: অ্যারিস্টটল-এর মৃত্যুর পর যে নতুন রাষ্ট্রনীতির ভাবধারার উন্মেষ ঘটেছিল তাকে নিম্নোক্তভাবে উপস্থাপিত করা যেতে পারে। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে এই পর্বে ব্যক্তিকে নতুন আলোতে ও দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বিচার-বিশ্লেষ করার প্রবণতা দেখা দেয়। কিন্তু এখানেই এই প্রবণতা পরিসমাপ্তি ঘটেনি। ব্যক্তি সবকিছু নয়। সমাজ ও বহির্জগৎ থেকে সে বিচ্ছিন্ন থেকে জীবনযাত্রা নির্বাহ করতে ও ব্যক্তিসত্তাকে বিকশিত করে তুলতে পারে না। তাই ব্যক্তি সঙ্গে সমগ্রের মিলনসেতু রচনার প্রয়াস লক্ষ করা গেল ব্যক্তির নিজস্ব ভাবধারা ও জীবনযাপনকে সমগ্রের মিলনসেতু রচনার প্রয়াস লক্ষ করা গেল। ব্যক্তির নিজস্ব ভাবধারা জীবনযাপনকে গৌণ করা হল না। কিন্তু বলা হতে লাগল সে একাকী নয় এবং নিঃসঙ্গ জীবনযাপনের মাধ্যমে ব্যক্তি জীবনে লক্ষ্যার্জন করতে সক্ষম হবে না। কারণ ব্যক্তি জীবনের সঙ্গে সমাজ ও রাষ্ট্রিক জীবন এমন কঠিন সম্পর্কে আবদ্ধ যা অস্বীকার করা ব্যক্তির পক্ষে সম্ভব নয়। একক ও সমগ্রের মধ্যে মিলনসেতু সমাজকে সত্য-সুন্দর ও জনকল্যাণ-সুন্দর করে তুলতে পারে। গ্রিক নগর-রাষ্ট্রে ব্যক্তি অনেকখানি কাব্যে উপেক্ষিতার মতো উপেক্ষিত ছিল। নতুন যুগের সূচনায় তার মর্যাদাও নতুন ও তাৎপর্যপূর্ণ মাত্রা পেল।

নৈতিকতা, মূল্যবোধ ইত্যাদির নতুন ব্যাখ্যা: নৈতিকতা, মূল্যবোধ, আদর্শ প্রভৃতিকে নতুনভাবে ব্যাখ্যা করা হতে লাগল। ব্যক্তি আত্মকেন্দ্রিক হয়ে থাকতে পারে না। সে সমগ্রের একটি অচ্ছেদ্য অংশ। সমগ্রের কল্যাণ সাধিত হলে তার কল্যাণ হবে। খ্রিস্টধর্মের আবির্ভাব এই বোধকে উৎসাহিত ও সমৃদ্ধিশালী করে তুলেছিল। ব্যক্তি একক প্রচেষ্টায় বিশ্বজনীন ভাবধারা ও বিশ্বসভ্যতাকে সমৃদ্ধিশালী করে তুলতে পারে না। কিন্তু এ কাজ করার অধিকার তার আছে এবং তার থেকে তাকে কেউ বঞ্চিত করতে পারে না। এটি হয়ে উঠল নৈতিকতার এক নতুন ব্যাখ্যা যা নগর-রাষ্ট্রে পরিলক্ষিত হয়নি। ব্যক্তি স্বতন্ত্র এবং বহুর মধ্যে এক হলেও বহুর সঙ্গে মেলবন্ধনে আবদ্ধ। এই ভাবধারাকে নানা চড়াই-উতরাই পথ অতিক্রম করে অগ্রসর হতে হয়েছে। কিন্তু স্তিমিত বা বিলুপ্ত হয়ে যায়নি।

ক্ষমতা ধারণার আবির্ভাব: অ্যারিস্টটল এবং তাঁর গুরুদেব ক্রীতদাস প্রথার উচ্ছেদ চাননি। তাঁরা সমতা (Equality) নীতির কথা বলতেন। কিন্তু সেই নীতি কেবল নাগরিকদের মধ্যে বিরাজমান ছিল। ক্রীতদাসরা নাগরিকের মর্যাদায় ভূষিত না থাকায় নাগরিকের সঙ্গে তারা সমতা নীতির অধিকারী ছিল না। নতুন যুগে দেখা গেল সম্যনীতির পরিধি ও ধারণাকে সম্প্রসারিত করা হয়েছে। এটি একটি লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য। নাগরিক ও ক্রীতদাস সকলেই সাম্যের অধিকারী (The new conception posited for all men even for the slave, the foreigner and barbarian. Sabine, p. 144)। এর ফলে সামাজিক কাঠামো গেল বদলে। সমাজের সকল শ্রেণির মানুষ নতুনভাবে মর্যাদায় বসার সুযোগ পেল।

পোলিস থেকে কসমোপলিসে উত্তরণ: গ্রিক নগর-রাষ্ট্রকে সচরাচর পোলিস (Polis) নামে আখ্যায়িত করা হত। এই নগর-রাষ্ট্রগুলির ও সীমাবদ্ধতা ছিল সুবিদিত। প্রতিটি নাগরিকের জীবন নগররাষ্ট্রের সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পর্কযুক্ত ছিলো। একটি নগররাষ্ট্র বা পোলিসের নাগরিক অন্য একটি পোলিসের নাগরিকের সঙ্গে তুলনা করত। কিন্তু একটি পোলিসের জনগণের জীবন, চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গি সেই পোলিসের সঙ্গে এমনভাবে জড়িয়ে থাকত যে সেই বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে বৃহত্তর পরিবেশে পদার্পণ করা তাদের পক্ষে সম্ভব হত না। ফলে পোলিসের নাগরিকদের মনে সংকীর্ণতা একটি আসন তৈরি করে নিয়েছিল। মুক্ত মন নিয়ে উন্নত চিন্তা করার মানসিকতা গড়ে ওঠেনি। J. S. Mc Clelland লিখেছেন, (পূর্বোক্ত গ্রন্থ, পৃঃ ৭৪) You had an identity within the polis and an identity in relation to members of other cities. The city-state was far from being a recipe for universal happiness, সুতরাং বলা যেতে পারে যে অ্যারিস্টটল-এর মৃত্যুর পর একটি স্পষ্ট প্রবণতা দেখা গেল এবং সেটি হচ্ছে ক্ষুদ্র থেকে বৃহতে উত্তরণে প্রবল আগ্রহ। যে পোলিস বা নগর-রাষ্ট্র নিয়ে মানুষ দীর্ঘকাল সন্তুষ্ট ছিল তার গন্ডি থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা চালাতে লাগল। ম্যাসিডনীয় সাম্রাজ্য পোলিসের জনগণকে সেই সুযোগ এনে দিল। ম্যাসিডনীয় সাম্রাজ্যের কর্ণধারগণ নগররাষ্ট্র সমূহকে নিজেদের অধীনে আনেন। তাদের প্রশাসন ও অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থাপনা সাম্রাজ্যের শাসকগণ নিয়ন্ত্রণ করেন। এই নতুন পরিস্থিতির মধ্যে এসেও polis-গুলি অতীতের স্বাতন্ত্র্য সম্পূর্ণরূপে বিসর্জন দেয়নি। নতুনের সঙ্গে পুরোনোর মিলনসেতু রচিত হল। পোলিস থেকে কসমোপোলিস (Cosmopolis)-এ ঘটল উত্তরণ।

তথ্যসূত্র

  • রাষ্ট্রচিন্তার ইতিবৃত্ত, প্রাণগোবিন্দ দাশ, নিউ সেন্ট্রাল বুক এজেন্সি (প্রা.) লিমিটেড, ২০১৯

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.