রাষ্ট্রকূট রাজবংশ (৭৩৫-৯৮২ খ্রিস্টাব্দ)

Table of Contents

রাজবৃত্ত

ভূমিকা

বাদামির চালুক্য রাজবংশের অবসানের পর মহারাষ্ট্র কর্ণাটক অঞ্চলে এক নতুন রাজবংশ আত্মপ্রকাশ করে। অচিরেই এই রাজবংশ সমকালীন ভারতের এক বৃহত্তম রাষ্ট্রশক্তিরূপে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। পশ্চিম ভারতের গুর্জর প্রতীহার বাংলা-বিহারের পাল রাজাদের সমকালবর্তী অশেষ প্রতাপশালী এই রাষ্ট্রশক্তি ভারতবর্ষের ইতিহাসে রাষ্ট্রকূট রাজবংশ নামে পরিচিত।

উদ্ভব ও আদি ইতিহাস : রাষ্ট্রকূট কথাটি ‘রাষ্ট্র’ শব্দ হতে উদ্ভূত। ‘রাষ্ট্র’ বলতে সাধারণত এক প্রশাসনিক বিভাগ বোঝায়। রাষ্ট্রের ভারপ্রাপ্ত রাজপুরুষ বা রাষ্ট্রমুখ্য রাষ্ট্রকূট নামে অভিহিত হতেন। অর্থাৎ প্রথম দিকে রাষ্ট্রকূট পদটি বৃত্তি অর্থে ব্যবহৃত হত কিন্তু পরবর্তিকালে এর অর্থের প্রসার ঘটে এবং এক বিশেষ জাতি বা গোষ্ঠী অর্থে শব্দটি প্রযুক্ত হয়। ‘দেশমুখ’ ও ‘দেশাই’ পদ দু’টির উদ্ভব ঠিক এভাবেই হয়েছে।

  • প্রাক্‌-দন্তিদুর্গ পর্বে দক্ষিণ-ভারতের বিভিন্ন স্থানে কয়েকটি রাষ্ট্রকূট রাজপরিবারের অভ্যুদয় হয়। খ্রিস্টীয় ৬ষ্ঠ শতকের প্রথমার্ধে মধ্যপ্রদেশের হোসাঙ্গাবাদ অঞ্চলে এক রাষ্ট্রকূট রাজবংশ প্রতিষ্ঠিত হয়।
  • ৭ম শতকের মধ্যভাগে কর্ণাটকের উত্তরাঞ্চলে আর একটি রাষ্ট্রকূট রাজবংশ আত্মপ্রকাশ করে।
  • প্রায় একই সময় মহারাষ্ট্রের বিদর্ভে এক রাষ্ট্রকূট রাজবংশের অভ্যুদয় হয়। প্রাচীন অচলপুর বা বর্তমান এলিচপুর ছিল সম্ভবত এই রাষ্ট্রকূট রাজ্যের রাজধানী। বাদামির চালুক্যদের হতমান করে যে রাষ্ট্রকূটরা মহারাষ্ট্র-কর্ণাটকে একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেন, তাঁরা বিদর্ভের এই রাষ্ট্রকূটদেরই বংশধর।

কিন্তু বিদর্ভ এই রাষ্ট্রকূটদের আদি নিবাস নয়। রাষ্ট্রকূট রাজাদের অনেকেই ‘লট্টলূর পুরবরেশ্বর’ অভিধা ধারণ করেছেন। এ থেকে অনুমিত হয়, তাঁরা লট্টলূর শহরের অধিবাসী ছিলেন। মহারাষ্ট্রের দক্ষিণাঞ্চলে অবস্থিত লাটুরই প্রাচীন লট্টলূর। এ অঞ্চলে কন্নড় ভাষা প্রচলিত। রাষ্ট্রকূটরা কন্নড়ভাষী ছিলেন। প্রতীয়মান হয়, রাষ্ট্রকূটরা আদি বাসভূমি লট্টলূর ত্যাগ করে ভাগ্যান্বেষণে বিদর্ভে গমন করেন এবং সেখানে কালক্রমে একটি রাজ্য স্থাপন করেন। প্রাচীন ভারতের ইতিহাসে এরূপ ঘটনা অভূতপূর্ব নয়। সেন রাজাদের আদি নিবাস কর্ণাটকে কিন্তু বাংলায় এসে তাঁরা রাজদণ্ড ধারণ করেন। গঙ্গরা কর্ণাটকের অধিবাসী ছিলেন; তাঁরা পরবর্তিকালে ওড়িশা-অন্ধ্রপ্রদেশে এক বিশাল রাজ্য গঠন করেন।

এলোরা দশাবতার গুহালেখে দন্তিদুর্গের পাঁচজন পূর্বসূরির নাম উল্লিখিত হয়েছে। তাঁরা হলেন দন্তিদুর্গের পিতা দ্বিতীয় ইন্দ্ৰ, পিতামহ প্রথম কর্ক, প্রপিতামহ গোবিন্দরাজ, বৃদ্ধ প্রপিতামহ প্রথম ইন্দ্র পৃচ্ছকরাজ এবং অতিবৃদ্ধ প্রপিতামহ দন্তিবর্মা। দন্তিবর্মা সম্ভবত বিদর্ভ অঞ্চলের আঞ্চলিক রাষ্ট্রকূটরাজ নন্নরাজের পুত্র বা ভ্রাতুষ্পুত্র ছিলেন। দন্তিদুর্গের পূর্বপুরুষদের সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায় না। কিন্তু তাঁর পিতা দ্বিতীয় ইন্দ্র সম্পর্কে রাষ্ট্রকূট লেখমালায় কিছু মূল্যবান তথ্য পরিবেশিত হয়েছে। উচ্চাভিলাষী রাজা ছিলেন দ্বিতীয় ইন্দ্ৰ (আ. ৭১৫-৩৫ খ্রিস্টাব্দ)। সমকালীন চালুক্য সম্রাট বিজয়াদিত্যের (আ. ৬৯৬–৭৩৩ খ্রিস্টাব্দ) তিনি আনুগত্যাধীন ছিলেন। ইন্দ্রের শাসনভুক্ত অঞ্চলের ঠিক দক্ষিণেই রাজত্ব করতেন বিজয়াদিত্য। ইন্দ্রের এলাকার পশ্চিমে চালুক্যদের গুজরাত শাখার রাজ্য অবস্থিত ছিল। সে রাজ্যের রাজা ছিলেন মঙ্গলরাজ বিনয়াদিত্য (৭০০-৩২ খ্রিস্টাব্দ)। পশ্চিমে একটি গুর্জর রাজ্যও ছিল। তৃতীয় জয়ভট (আ. ৭০০-৩৫ খ্রিস্টাব্দ) ছিলেন সেখানকার রাজা। তখন উত্তর গুজরাত ছিল বলভীরাজ পঞ্চম শীলাদিত্যের অধীন। ইন্দ্র চালুক্য রাজকুমারী ভবনাগাকে রাক্ষসমতে বিবাহ করেন। চালুক্যদের গুজরাত শাখাভুক্ত মঙ্গলরাজ বিনয়াদিত্য বা তাঁর অনুজ পুলকেশী সম্ভবত ভবনাগার পিতা ছিলেন। ঘটনাকাল সম্ভবত ৭২৫ খ্রিস্টাব্দ।

দন্তিদুর্গ (আ. ৭৩৫-৫৬ খ্রিস্টাব্দ)

আনুমানিক ৭৩৫ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় ইন্দ্রের মৃত্যু হলে তাঁর সুযোগ্য পুত্র দন্তিদুর্গ বা দস্তিবর্মা বিদর্ভের রাষ্ট্রকূট সিংহাসনে আরোহণ করেন। তিনি তখন বিশ বছরের এক অনভিজ্ঞ তরুণ। কিন্তু রাজনৈতিক নৈপুণ্য ও অসামান্য বীর্যবত্তা প্রদর্শন করে তিনি শীঘ্রই ক্ষুদ্র আঞ্চলিক পৈতৃক রাজ্যটিকে এক সার্বভৌম, পরাক্রান্ত রাষ্ট্রে পরিণত করেন। রাষ্ট্রকূট সাম্রাজ্যের তিনিই প্রতিষ্ঠাতা। তাঁর সিংহাসনে আরোহণের অব্যবহিত পরই পশ্চিম-ভারতের রাজনৈতিক আকাশে দুর্যোগের কালো মেঘ পুঞ্জীভূত হয়। সিন্ধুর তদানীন্তন আরব প্রশাসক জুনায়েদ এ সময় পশ্চিম ভারতে একাধিক সামরিক অভিযান পরিচালনা করেন। বলভীর মৈত্রকরাজ পঞ্চম শীলাদিত্যগুর্জর নৃপতি তৃতীয় জয়ভট পরাজিত হন। বিজয়ী আরব বাহিনী নবসারী আক্রমণ করেন। এবার কিন্তু আরব সৈন্যদলের ভাগ্যবিপর্যয় ঘটল। গুজরাতের আঞ্চলিক চালুক্যরাজ পুলকেশী ৭৩৮ খ্রিস্টাব্দে বা তার কিছুকাল পূর্বে তাঁদের পরাজিত করেন। বাদামির চালুক্য নৃপতি দ্বিতীয় বিক্রমাদিত্য তাঁর অধীনস্থ এই আঞ্চলিক রাজার কৃতিত্বে সন্তুষ্ট হয়ে তাঁকে ‘চালুক্যকুলালঙ্কার’, ‘পৃথিবীবল্লভ’, ইত্যাদি অভিধায় বিভূষিত করেন।

মনে হয়, রাষ্ট্রকূটরাজ দন্তিদুর্গ আরবদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে পুলকেশীর দিকে সাহায্যের হস্ত প্রসারিত করেন। এ ধারণা সত্য হলে স্বীকার করতে হবে, আরবদের বিরুদ্ধে নবসারীর যুদ্ধে পুলকেশীর বিজয়লাভে দন্তিদুর্গ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেন। ৭৪২ খ্রিস্টাব্দে উৎকীর্ণ তাঁর এলোরা তাম্রশাসনে দন্তিদুর্গ ‘পৃথিবীবল্লভ’ ও ‘খড়্গাবলোক’ অভিধায় ভূষিত হয়েছেন। হতে পারে, আরবদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে পুলকেশীকে সহযোগিতা করায় চালুক্যরাজ দ্বিতীয় বিক্রমাদিত্য তাঁকে অভিধা দু’টিতে ভূষিত করে সম্মানিত করেন। কিন্তু দন্তিদুর্গ যে আরব সৈন্যদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন, তা সংশয়াতীত নয়; ‘পৃথিবীবল্লভ’ এবং ‘খড়্গাবলোক’ অভিধা দু’টি তাঁর স্বোপার্জিতও হতে পারে।

নাতিদীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে বহু যুদ্ধবিগ্রহে অংশগ্রহণ করেন দন্তিদুর্গ। যতদিন দ্বিতীয় বিক্রমাদিত্য জীবিত ছিলেন ততদিন তিনি চালুক্যদের তেমন বিরুদ্ধাচরণ করেননি। উপরক্ত তিনি নানাভাবে চালুক্যদের সহায়তাই করেছেন। দ্বিতীয় বিক্রমাদিত্যের রাজত্বকালে যুবরাজ দ্বিতীয় কীর্তিবর্মা পল্লব ও শ্রীশৈল রাজ্য দু’টি আক্রমণ করেন। তখন নন্দিবর্মা পল্লবমল্ল পল্লবদের রাজা। তেলুগু-চোলদের অধীনস্থ শ্রীশৈল রাজ্য অন্ধ্রপ্রদেশের কুর্মুল অঞ্চলে অবস্থিত ছিল। দন্তিবর্মা সম্ভবত উভয় যুদ্ধে দ্বিতীয় কীর্তিবর্মার সহযোগী ছিলেন এবং চালুক্য যুবরাজকে পল্লব ও তেলুগু-চোল রাজাদের পরাজিত করতে সাহায্য করেন। (নীলকান্ত শাস্ত্রী অভিমত প্রকাশ করেছেন, পল্লব ও শ্রীশৈল রাজাদের বিরুদ্ধে দস্তিদূর্গের সংঘর্ষ তাঁর রাজত্বের শেষ পর্বে অনুষ্ঠিত হয়।)

আনুমানিক ৭৪৪-৪৫ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় বিক্রমাদিত্য মৃত্যুমুখে পতিত হলে দন্তিদুর্গ নিজের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠায় বদ্ধপরিকর হন। তাঁর মাতা চালুক্য রাজপরিবারের দুহিতা ছিলেন। চালুক্য রাজপরিবারের সঙ্গে সম্পর্কের নৈকট্য তাঁর রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষকে উদ্দীপ্ত করে। অতি সন্তর্পণে অগ্রসর হন দন্তিদুর্গ। দ্বিতীয় কীর্তিবর্মার সঙ্গে কোনও প্রত্যক্ষ সংঘর্ষে অবতীর্ণ না হয়ে তিনি ধীর ও সুনিশ্চিত পদক্ষেপে নিজের শক্তি বৃদ্ধি করেন।

তখন পার্শ্ববর্তী অঞ্চল গুজরাতে অবস্থিত চালুক্য রাজ্য গুর্জর রাষ্ট্র জুড়ে এক বিশৃঙ্খল অবস্থা বিরাজ করছে ; আরব অভিযানের ফলে রাজ্য দু’টি দুর্বল হয়ে পড়েছে। এই সুযোগের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করে দন্তিদুর্গ রাজ্য দু’টি আত্মসাৎ করেন। তাঁকে এ কাজে সাহায্য করেন তাঁর খুল্লতাত ধ্রুবের পুত্র গোবিন্দ। কৃতজ্ঞ দন্তিদুর্গ খুল্লতাতপুত্রকে দক্ষিণ গুজরাতের প্রশাসক পদে নিযুক্ত করেন।

এরপর দন্তিদুর্গের দৃষ্টি পড়ে পূর্বদিকে। তিনি মালব আক্রমণ করে উজ্জয়িনী অধিকার করেন। সেখানে হিরণ্যগর্ভ যজ্ঞ অনুষ্ঠিত হয়। পরাজিত গুর্জর-প্রতীহার নৃপতি প্রথম নাগভট সে যজ্ঞানুষ্ঠানে প্রতীহারীর দায়িত্ব পালন করেন। বিজিত মালবে স্বাধিপত্য প্রতিষ্ঠা না করে তিনি অচিরে স্বরাজ্যে প্রত্যাবর্তন করেন। মালবে তাঁর এই উদ্যম নিছকই এক ক্ষণস্থায়ী সামরিক অভিযান। অতঃপর তিনি মহাকোসল বা ছত্তীসগঢ় অঞ্চল বিজয়ে বহির্গত হন। তাঁর এক লেখে দাবি করা হয়েছে, তাঁর হস্তিবাহিনী মহানদীর জলরাশিতে অবগাহন করে। পরাজিত মহাকোসলরাজের পরিচয় অপরিজ্ঞাত। নিজ রাজ্যে প্রত্যাবর্তনের পথে তিনি সম্ভবত কলিঙ্গের কতিপয় আঞ্চলিক রাজাদের হতমান করেন। এভাবে দন্তিদুর্গ মধ্যপ্রদেশ, ছত্তীসগঢ়, কলিঙ্গ এবং মধ্য ও দক্ষিণ গুজরাতে নিজের রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করেন। বিদর্ভ তো পূর্ব থেকেই তাঁর অধিকারভুক্ত ছিল। তাঁর শক্তিবৃদ্ধিতে চালুক্য নৃপতি দ্বিতীয় কীৰ্তিবর্মা শঙ্কিত হন। তিনি উপলব্ধি করলেন, আর বিলম্ব নয়; দন্তিদুর্গকে যত শীঘ্র সম্ভব প্রতিহত করতে হবে।

শেষ পর্যন্ত বিবদমান দু’টি পক্ষ মধ্য মহারাষ্ট্রের কোনও এক স্থানে পরস্পরের সম্মুখীন হয়। রাষ্ট্রকূট লেখে সদম্ভে দাবি করা হয়েছে, দন্তিদুর্গ অবলীলাক্রমে চালুক্য বাহিনীকে পরাজিত করেন। চালুক্য লেখমালায় স্বীকার করা হয়েছে, দ্বিতীয় কীর্তিবর্মার রাজত্বকালে চালুক্য রাজ লক্ষ্মী অন্তর্হিতা হন। প্রমাণিত হয়, দন্তিদুর্গের বিরুদ্ধে যুদ্ধে কীর্তিবর্মা শোচনীয়রূপে ব্যর্থ হন। অনন্ত সদাশিব অলতেকর অভিমত প্রকাশ করেছেন, সুকৌশলে, বিনা রক্তপাতে দন্তিদুর্গ কীর্তি বর্মাকে পরাভূত করেন। এই যুদ্ধে বিজয়লাভের ফলে মহারাষ্ট্রে রাষ্ট্রকূট আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। ৭৫৪ খ্রিস্টাব্দে দন্তিদুর্গ সাতারা জেলায় একটি গ্রাম সম্প্রদান করেন বলে একটি লেখে উল্লিখিত আছে। এই ঘটনা প্রমাণ করছে, মহারাষ্ট্রে দন্তিদুর্গের কর্তৃত্ব সুদৃঢ়রূপে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

দন্তিদুর্গ মহারাষ্ট্র থেকে চালুক্যদের বিতাড়িত করলেন বটে কিন্তু কীর্তিবর্মাকে উচ্ছেদ করতে পারেননি। তখনও কর্ণাটকে চালুক্যরাজের আধিপত্য সুপ্রতিষ্ঠিত। স্বাভাবিক কারণেই দন্তিদুর্গ কীর্তিবর্মাকে কর্ণাটক থেকে উচ্ছেদ করতে সংকল্পবদ্ধ হন। এ সংকল্প রূপায়িত হওয়ার পূর্বেই আনুমানিক ৭৫৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি লোকান্তরিত হন। কীর্তিবর্মা তখনও কর্ণাটকে রাজত্ব করছেন। ৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি বক্কলেরি তাম্রশাসনখানি উৎকীর্ণ করেন। লেখটি থেকে জানা যায়, চালুক্য রাজ তখন ভীমা নদীর উত্তর তীরে অবস্থান করছেন।

গুণবান রাজা ছিলেন দন্তিদুর্গ। বিভিন্ন ধর্মীয় কার্যে তিনি অংশগ্রহণ করেন। বহু বৈদিক যাগ যজ্ঞের অনুষ্ঠান করেন তিনি। ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের অনুকূলে অজস্র গ্রাম অকাতরে দান করেন তিনি। প্রজাদের প্রতি তাঁর ছিল অকৃত্রিম অনুরাগ। তাঁরই রণনৈপুণ্যে ও কুশলতায় বিদর্ভের ক্ষুদ্র রাষ্ট্রকূট রাজ্যটি এক বৃহৎ রাষ্ট্রশক্তিরূপে আত্মপ্রকাশ করে। দ্বিতীয় কীর্তিবর্মাকে তিনি সম্পূর্ণরূপে উচ্ছেদ করতে পারেননি সত্য কিন্তু পল্লবরাজ নন্দিবর্মা পল্লবমল্লের সঙ্গে নিজ কন্যা রেবার বিবাহ দিয়ে তিনি কাঞ্চীপুরম থেকে তাঁর প্রতিপক্ষের সম্ভাব্য সাহায্যলাভের পথ অবরুদ্ধ করেন।

প্রথম কৃষ্ণ (আ. ৭৫৬-৭২ খ্রিস্টাব্দ)

দন্তিদুর্গ অপুত্রক অবস্থায় দেহত্যাগ করলে তাঁর পিতৃব্য প্রথম কৃষ্ণ আনুমানিক ৭৫৬ খ্রিস্টাব্দে সিংহাসনে আরোহণ করেন। (প্রথম কৃষ্ণের আরও দুই ভ্রাতা ছিলেন। তাঁরা হলেন ধ্রুব এবং নগ্ন।) ৮১২-১৩ খ্রিস্টাব্দে উৎকীর্ণ বড়োদরা তাম্রশাসনে বলা হয়েছে, প্রথম কৃষ্ণ এক অধার্মিক আত্মীয়কে উচ্ছেদ করে পারিবারিক স্বার্থে (গোত্রহিতায়) রাজ্যের শাসনভার স্বহস্তে গ্রহণ করেন। অনুমিত হয়, দন্তিদুর্গের মৃত্যুর পর রাষ্ট্রকূট রাজপরিবারেরই এক সদস্য সিংহাসন অধিকার করেন কিন্তু কৃষ্ণ তাঁকে পদচ্যুত করে রাজপদ গ্রহণ করেন। কে এই অধার্মিক রাজকুমার তা জানা যায় না। সিংহাসনে আরোহণ করে কৃষ্ণ ‘শুভতুঙ্গ’ ও ‘অকালবর্ষ’ অভিধা ধারণ করেন।

রাজপদ লাভ করেই প্রথম কৃষ্ণ দক্ষিণ গুজরাতে রাষ্ট্রকূট কর্তৃত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট হন। দন্তিদুর্গ এতদঞ্চল জয় করে তাঁর খুল্লতাতপুত্র গোবিন্দকে অধিকৃত ভূখণ্ডের প্রশাসক পদে নিযুক্ত করেন। কিন্তু গোবিন্দের পুত্র দ্বিতীয় কর্ক ৭৫৭ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। কর্ককে পরাজিত করে প্রথম কৃষ্ণ পুনরায় দক্ষিণ গুজরাতে রাষ্ট্রকূট শাসন প্রতিষ্ঠা করেন।

অতঃপর কৃষ্ণ চালুক্যরাজ দ্বিতীয় কীর্তিবর্মার বিরুদ্ধে সসৈন্যে অগ্রসর হন। বিগতশ্রী কীর্তি বর্মার আধিপত্য তখন কর্ণাটক অঞ্চলে সীমাবদ্ধ। এই যুদ্ধ কতদিন ধরে চলে তা জানা যায় না। তবে ৭৫৮ খ্রিস্টাব্দে উৎকীর্ণ কৃষ্ণের নিজের এক লেখে চালুক্যদের বিরুদ্ধে তাঁর বিজয়লাভের কোনও উল্লেখ নেই। মনে হয়, ৭৫৮ খ্রিস্টাব্দের অব্যবহিত পরই কৃষ্ণ দ্বিতীয় কীৰ্তিবর্মাকে যুদ্ধে পরাজিত করেন। সপুত্র কীর্তিবর্মা যুদ্ধক্ষেত্রে নিহত হন। চালুক্যসূর্য অস্তমিত হল। উত্তর কর্ণাটকে রাষ্ট্রকূট প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠিত হল।

দক্ষিণ গুজরাত ও উত্তর কর্ণাটক অধিকার করেই কৃষ্ণ পরিতুষ্ট হলেন না; কোঙ্কণ, গঙ্গবাড়ি ও অন্ধ্রপ্রদেশে স্বাধিপত্য প্রতিষ্ঠায় তিনি উদ্যোগ গ্রহণ করেন। কোঙ্কণ সহজেই তাঁর পদানত হয়। বিজিত অঞ্চলের শাসনভার শণফুল্ল নামে জনৈক সামন্তের স্কন্ধে ন্যস্ত হয়। এই সামন্ত শণফুল্লই কোঙ্কণের শিলাহার রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা। গঙ্গবাড়ি অভিযানে কৃষ্ণ তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার সম্মুখীন হন। গঙ্গবাড়ির রাজা তখন শ্রীপুরুষ। গঙ্গ রাজকুমার সিয়গল্প রাজ্যরক্ষার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। শ্রীরেমনের মতো বিদ্বজ্জনেরা মসি ছেড়ে অসি ধারণ করেন এবং যুদ্ধক্ষেত্রে বীরের ন্যায় মৃত্যু বরণ করেন। প্রথমদিকে কয়েকটি যুদ্ধে গঙ্গসৈন্যরা জয়লাভ করেন কিন্তু শেষপর্যন্ত কৃষ্ণের নিকট তাঁরা পরাজিত হন। রাষ্ট্রকূট রাজ গঙ্গরাজ্যের প্রচুর ধনসম্পদ লুণ্ঠন করেন। লুণ্ঠিত অর্থের কিয়দংশে গঙ্গ রাজধানী মান্যপুরমে কয়েকটি দাতব্য প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হয়। রাষ্ট্রকূট নৃপতি এ স্থানে একখানি লেখও উৎকীর্ণ করেন।

শ্রীপুরুষকে পরাজিত করে কৃষ্ণ গঙ্গবাড়ির বৃহদংশ স্বীয় অধিকারভুক্ত করেন। গঙ্গবাড়ির এক ক্ষুদ্রাঞ্চলে শ্রীপুরুষ কৃষ্ণের সামন্তরূপে রাজকার্য পরিচালনা করেন। অন্ধ্রপ্রদেশে অবস্থিত বেঙ্গীর চালুক্যদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করেন যুবরাজ গোবিন্দ। তিনি সসৈন্যে অগ্রসর হয়ে ৭৬৯ খ্রিস্টাব্দের জুন মাসে কৃষ্ণা ও মুসী নদীর সঙ্গমস্থলে উপনীত হন। বেঙ্গীর চালুক্যরাজ চতুর্থ বিষ্ণুবর্ধন রাষ্ট্রকূট বাহিনীর সম্মুখীন না হয়ে রাজ্যের এক বৃহদংশ ও ক্ষতিপূরণ প্রদানে গোবিন্দের সন্তোষবিধান করেন। গোবিন্দের বেঙ্গী অভিযানের ফলে অন্ধ্র প্রদেশের এক সুবিস্তীর্ণ অঞ্চল রাষ্ট্রকূটদের অধিকারভুক্ত হয়।

একাধিক রাষ্ট্রকুট লেখে ঘোষিত হয়েছে, রাজা রাহপ্পকে পরাভূত করে কৃষ্ণ পালিধ্বজ আত্মসাৎ করেন এবং রাজাধিরাজ ও পরমেশ্বর অভিধায় ভূষিত হন। ফ্লিট সাহেবের মতে রাহ ও দক্ষিণ গুজরাতের বিদ্রোহী প্রশাসক দ্বিতীয় কর্ক এক ও অভিন্ন ব্যক্তি ছিলেন। আবার রাহপ্প এবং দ্বিতীয় কীর্তিবর্মা একই ব্যক্তি ছিলেন, এরূপ অভিমত কোনও কোনও ঐতিহাসিক ব্যক্ত করেছেন। কিন্তু রাহপ্পের সঠিক পরিচয় আজও রহস্যই রয়ে গেছে।

যুদ্ধবিগ্রহে সুনিপুণ এই রাজা শিক্ষা ও সংস্কৃতির অকৃত্রিম অনুরাগী ছিলেন। তিনি ব্রাহ্মণ ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্যে বহু গ্রাম ও জমি দান করেন। তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় বহু সুউচ্চ ও দৃষ্টিনন্দন মন্দির নির্মিত হয়। কাঞ্চীপুরমের কৈলাসনাথ মন্দিরের অনুকরণে নির্মিত এলোরার সুবিখ্যাত কৈলাস মন্দির তাঁরই কীর্তি। পূর্বে এই মন্দিরটি কৃষ্ণেশ্বর বা কন্নেশ্বর নামে পরিচিত ছিল। মন্দিরের কোথাও তাঁর নাম উৎকীর্ণ হয়নি। এতে তাঁর স্বভাবসিদ্ধ বিনয় ও প্রচার বিমুখতাই প্রকাশ পেয়েছে।

দ্বিতীয় গোবিন্দ (আ. ৭৭২-৮০ খ্রিস্টাব্দ)

প্রথম কৃষ্ণের মৃত্যুর পর তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র দ্বিতীয় গোবিন্দ রাজপদে অভিষিক্ত হন। দৌলতাবাদ লেখ থেকে জানা যায়, তিনি গোবর্ধন ও পারিজাত নামে দু’জন প্রতিদ্বন্দ্বী রাজাকে পরাজিত করেন। কিন্তু এই রাজাদের বংশপরিচয় বা তাঁদের রাজ্যের অবস্থান সম্পর্কে সঠিক কিছু জানা যায় না।

সিংহাসনে আরোহণের কিছুকাল পরই দ্বিতীয় গোবিন্দ বিলাসব্যসনের স্রোতে গা ভাসিয়ে দেন এবং রাজ্যের পরিচালন-দায়িত্ব তাঁর অনুজ ধ্রুবের হস্তে অর্পণ করেন। ধ্রুব ছিলেন নাসিক খান্দেশ অঞ্চলের প্রাদেশিক শাসনকর্তা। ক্ষমতা পেয়ে ধ্রুবের উচ্চাশা আরও বৃদ্ধি পায় এবং তিনি জ্যেষ্ঠভ্রাতাকে সিংহাসনচ্যুত করতে উদ্যত হন। দ্বিতীয় গোবিন্দ অনুজের অভিসন্ধি বুঝতে পেরে তাঁকে পদচ্যুত করেন ও রাজ্যের শাসনভার স্বহস্তে গ্রহণ করেন। ধ্রুব ভ্রাতাকে গদিচ্যুত করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন। গোবিন্দ নিশ্চেষ্ট হয়ে বসে থাকলেন না। তিনি গঙ্গবাড়ি, কাঞ্চীপুরম, বেঙ্গী ও মালবের রাজাদের সঙ্গে মৈত্রী স্থাপন করেন। এই রাজগণের সঙ্গে রাষ্ট্রকূটদের ছিল চিরশত্রুতা। ফলে গোবিন্দের এই কাজে রাজ্যের বহু পদস্থ রাজপুরুষ ক্রুদ্ধ হন ও ধ্রুবের পক্ষে যোগদান করেন। মিত্র রাজাদের কাছ থেকে সাহায্য আসার পূর্বেই ধ্রুব দ্বিতীয় গোবিন্দকে পরাজিত করে সিংহাসন অধিকার করেন। গোবিন্দ সম্ভবত যুদ্ধক্ষেত্রে নিহত হন কিংবা অনুজের হাতে বন্দি হয়ে জীবনের অবশিষ্ট দিনগুলি কারাগারে অতিবাহিত করেন। রাষ্ট্রকূট রাজ্যের ভাগ্যবিধাতারূপে আবির্ভূত হলেন ধ্রুব।

ধ্রুব ধারাবর্ষ (আ. ৭৮০-৯৩ খ্রিস্টাব্দ)

আনুমানিক ৭৮০ খ্রিস্টাব্দে ধ্রুব রাষ্ট্রকূট সিংহাসনে আরোহণ করেন। রাষ্ট্রকূট রাজবংশের এক শ্রেষ্ঠ রাজা তিনি। শুধু দক্ষিণ ভারতে নয়, বিন্ধ্য পর্বতমালা অতিক্রম করে উত্তর ভারতেও তিনি বিজয়াভিযান পরিচালনা করেন। তাঁরই রাজত্বকালে রাষ্ট্রকূট রাজ্যটি এক অপ্রতিরোধ্য সাম্রাজ্যবাদী শক্তিরূপে আত্মপ্রকাশ করে। ‘ধারাবর্ষ’, ‘নিরুপম’, ‘কলিবল্লভ’ ইত্যাদি অভিধায় তিনি ভূষিত হন।

রাজপদ অধিগ্রহণ করে তিনি রাজ্যে শান্তি-শৃঙ্খলা স্থাপনে মনোনিবেশ করেন। রাজপরিবারে গৃহবিবাদের সুযোগে অনেক পদস্থ রাজপুরুষ, সামন্ত বিদ্রোহ ঘোষণা করেন, কেউবা প্রকাশ্যে দ্বিতীয় গোবিন্দের পক্ষে যোগদান করেন। ধ্রুব তাঁদের সকলকে স্ববশে এনে রাজ্যে নিজের নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন।

এবার তাঁর দৃষ্টি পড়ল বিরুদ্ধাচারী প্রতিবেশী রাজন্যবৃন্দের প্রতি। গঙ্গবাড়ি, বেঙ্গী, কাঞ্চীপুরম ও মালবের রাজারা গোবিন্দের পক্ষ সমর্থন করায় স্বাভাবিক কারণেই তাঁর বিরাগভাজন হন। তাঁদের সমুচিত শিক্ষা দিতে অগ্রসর হন তিনি।

ধ্রুব গঙ্গবাড়ির রাজা শ্রীপুরুষ মুত্তরসের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করেন। শ্রীপুরুষ তখন বৃদ্ধ ও অশক্ত ; রাজ্যের প্রকৃত পরিচালক যুবরাজ শিবমার। রাজনীতি অপেক্ষা বিদ্যাচর্চাতেই যুবরাজের অধিক আগ্রহ। প্রথমদিকে কয়েকটি যুদ্ধে তিনি জয়লাভও করেন। কিন্তু ভাগ্যলক্ষ্মী তাঁর প্রতি বিরূপ ছিলেন। শিবমার পরাজিত ও বন্দি হন। সমগ্র গঙ্গবাড়ি ধ্রুবের পদানত হয়। রাজকুমার স্তম্ভ রণাবলোক গঙ্গবাড়ির শাসনভার প্রাপ্ত হন।

ধ্রুবের বেঙ্গী অভিযানের কাহিনি বর্ণিত হয়েছে পম্পভারত কাব্যে। এই অভিযানে তাঁকে সাহায্য করেন বেমুলবাড়ের বিশ্বাসভাজন সামন্ত প্রথম অরিকেশরী। যুদ্ধে বেঙ্গীরাজ চতুর্থ বিষ্ণুবর্ধন পরাজিত হন। শেষে বিবদমান রাজপরিবার দু’টির মধ্যে সন্ধি স্থাপিত হয়। বেঙ্গী রাজ্যের কিয়দংশ রাষ্ট্রকূট রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। অরিকেশরী বিজিত অঞ্চলের প্রশাসক নিযুক্ত হন। চতুর্থ বিষ্ণুবর্ধন নিজ কন্যা শীলমহাদেবীর সঙ্গে ধ্রুবের বিবাহ দেন। শীলমহাদেবী হন রাষ্ট্রকূটরাজের প্রধানা মহিষী।

এরপর ধ্রুব পল্লবরাজ দন্তিবর্মার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। রাষ্ট্রকূট লেখে দাবি করা হয়েছে, একদিকে বিপুল বারিধি এবং অন্যপ্রান্তে সুবিশাল রাষ্ট্রকূট সৈন্যবাহিনী কর্তৃক অবরুদ্ধ হয়ে পল্লবনৃপতি আতঙ্কিত হন এবং ধ্রুবকে প্রচুর রণহস্তী উপঢৌকনস্বরূপ প্রদান করেন। লক্ষ করবার বিষয়, রাষ্ট্রকূট লেখে কাঞ্চীপুরম বিজয়ের দাবি উত্থাপিত হয়নি। অনুমিত হয়, ধ্রুব পল্লব রাজ্যের সীমান্তে কয়েকটি যুদ্ধে জয়লাভ করেন এবং পল্লবরাজের রণহস্তী উপহারে সন্তুষ্ট হয়ে বিজয়াভিযান প্রত্যাহার করেন। এ অভিযানে তাঁর শ্বশুর বেঙ্গীরাজ চতুর্থ বিষ্ণুবর্ধন তাঁকে সৈন্য দিয়ে সাহায্য করেন।

অতঃপর ধ্রুব তাঁর সুযোগ্য পুত্রদ্বয় গোবিন্দইন্দ্র সহ সসৈন্যে উত্তর ভারত অভিমুখে অগ্রসর হন। তখন উত্তর ভারতের আধিপত্যকে কেন্দ্র করে মধ্য ও পশ্চিম ভারতের গুর্জর প্রতীহার এবং বাংলা-বিহারের পাল রাজাদের মধ্যে সংঘর্ষ চলছে। গুর্জর-প্রতীহার নৃপতি বৎসরাজ গঙ্গা-যমুনা দোয়াবে পালনৃপতি ধর্মপালকে পরাজিত করেছেন। নিজের শক্তিকে সংহত করে ধর্মপাল পুনর্বার বৎসরাজের বিরুদ্ধে শক্তি পরীক্ষায় অবতীর্ণ হতে চলেছেন।

ধ্রুব নর্মদা নদী অতিক্রম করে অবলীলাক্রমে বৎসরাজের রাজ্যভুক্ত মালব অধিকার করেন। এরপর তিনি কান্যকুব্জ অভিমুখে অগ্রসর হন। তাঁর লক্ষ্য বৎসরাজ। অনন্ত সদাশিব অলতেকর মনে করেন, ঝাঁসির সন্নিকটবর্তী কোনও এক স্থানে উভয়পক্ষে যুদ্ধ অনুষ্ঠিত হয়। যুদ্ধে বৎসরাজ শোচনীয়রূপে পরাস্ত হন। রাজস্থানের মরু অঞ্চলে তিনি পলায়ন করেন। বৎসরাজের বিরুদ্ধে বিজয়লাভের পর ধ্রুব ধর্মপালের সম্মুখীন হন। এ সময় পালরাজ সসৈন্যে গঙ্গা-যমুনা দোয়াবে অবস্থান করছিলেন। ধর্মপাল যুদ্ধে পরাজয় বরণ করেন। রাষ্ট্রকূট লেখ দাবি করছে, যুদ্ধে পরাজিত হয়ে পালনৃপতি রণে ভঙ্গ দেন।

যুদ্ধে জয়লাভ করে রাষ্ট্রকূটরাজ কিছুকাল দোয়াবে অবস্থান করেন। তিনি আর অগ্রসর হলেন না, কান্যকুব্জও অধিকার করলেন না। দীর্ঘদিন তিনি প্রবাসে। বার্ধক্যের ভারও ছিল। আর কালবিলম্ব না করে তিনি রাজধানীতে প্রত্যাবর্তন করেন। দোয়াবে বিজয়লাভের স্মারকরূপে এখন থেকে রাষ্ট্রকূট পতাকায় গঙ্গা ও যমুনার প্রতিকৃতি চিত্রায়িত হতে থাকে।

স্বরাজ্যে প্রত্যাবর্তনের পর ধ্রুব উত্তরাধিকার সমস্যার সমাধানে সচেষ্ট হন। তাঁর অন্যূন চার পুত্র–কর্ক, স্তম্ভ, গোবিন্দ ও ইন্দ্র। কর্ক পিতার জীবিতকালে পরলোক গমন করেন। ধ্রুব উপলব্ধি করেন, গোবিন্দ স্তম্ভের কনিষ্ঠ হলেও রাজকুমারদের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম, রাজ্যের গুরুভার বহনের যোগ্যতম পাত্র। স্বীয় সিদ্ধান্তে অটল থেকে তিনি গোবিন্দকেই তাঁর উত্তরাধিকারী রূপে মনোনীত করেন। স্তম্ভকে গঙ্গবাড়ির প্রদেশপালের পদে সম্মানিত করা হয়। ইন্দ্রকে দেওয়া হয় গুজরাত মালবের শাসনকর্তৃত্ব। ৭৯১-৯২ খ্রিস্টাব্দে গোবিন্দ মহাসমারোহে যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত হন। এর অনতিকাল পর ধ্রুবের জীবনাবসান হয়।

প্রাচীন ভারতের রাজনৈতিক আকাশের এক উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক ধ্রুব। তিনি মাত্র ত্রয়োদশ বৎসরকাল রাজত্ব করেন। কিন্তু এই অত্যল্প সময়ের মধ্যেই রাষ্ট্রকূট রাজ্য গৌরব ও সমৃদ্ধির উচ্চ শিখরে আরোহণ করে। গঙ্গ, চালুক্য এবং পল্লবদের পরাভূত করে তিনি রাষ্ট্রকূট রাজ্যের পরিধি বিস্তৃত করেন। বৎসরাজ ও ধর্মপালের মতো দু’জন সার্বভৌম নরপতিকে শোচনীয়রূপে পরাজিত করে তিনি উত্তর ভারতেও তাঁর পরাক্রম প্রদর্শন করেন। তাঁর সময়কালে অখিল ভারতে এমন কোনও রাজা ছিলেন না যিনি তাঁর সমকক্ষ হতে পারেন। জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা গোবিন্দকে সিংহাসনচ্যুত করায় তাঁর চারিত্রিক গৌরব কিছুটা নিষ্প্রভ হয়েছে ঠিকই কিন্তু এ কথাও সত্য, গোবিন্দের মতো দুর্বল ও তরলমতি ব্যক্তি সিংহাসনে অধিষ্ঠিত থাকলে রাষ্ট্রকূট রাজ্যের অস্তিত্বই বিপন্ন হত।

তৃতীয় গোবিন্দ (আ. ৭৯৩-৮১৪ খ্রিস্টাব্দ)

ধ্রুবের মৃত্যুর পর তাঁর সুযোগ্য পুত্র তৃতীয় গোবিন্দ পিতৃসিংহাসনে আরোহণ করেন। রাজপদ লাভ করেই তিনি ‘প্রভূতবর্ষ’ ও ‘জগত্তুঙ্গ’ অভিধায় ভূষিত হন। পরবর্তিকালে তিনি ‘জনবল্লভ’, ‘কীর্তিনারায়ণ’ এবং ‘ত্রিভুবনধবল’ অভিধা ধারণ করেন। তাঁর এক মহিষীর নাম গামুন্দব্বে।

রাষ্ট্রকূট রাজবংশের সর্বশ্রেষ্ঠ নরপতি তিনি। ধ্রুবের নেতৃত্বে রাষ্ট্রকূট রাজ্যের যে বিজয় যাত্রা শুরু হয়, তাঁরই সুদক্ষ পরিচালনায় তা পরিপূর্ণতা লাভ করে। তৃতীয় গোবিন্দের রাজত্বকাল রাষ্ট্রকূট ইতিহাসের উজ্জ্বলতম পর্ব। রাজপদ গ্রহণ করেই তৃতীয় গোবিন্দ রাজ্যের পদস্থ রাজপুরুষ ও সামন্তবর্গের আনুগত্য লাভে সচেষ্ট হন। পিতা তাঁকে রাজপদে মনোনীত করায় তাঁদের অনেকেই তাঁর প্রতি রুষ্ট হন। গোবিন্দ আশ্বাস দিলেন, তাঁরা সকলেই তাঁর পিতৃপ্রতিম।

গোবিন্দের সিংহাসনলাভ স্তম্ভ হৃষ্টচিত্তে গ্রহণ করলেন না। তিনি তাঁর অনুজকে পদচ্যুত করতে বদ্ধপরিকর হন। একক শক্তিতে কার্যসিদ্ধি অসম্ভব জেনে তিনি কয়েকজন সামন্ত ও প্রতিবেশী রাজাদের নিয়ে এক শক্তিশালী বিরুদ্ধগোষ্ঠী গঠন করে ভ্রাতার বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে প্রস্তুত হন। স্তম্ভের দলে ছিলেন নোলম্ববাড়ির রাজা চরুপোন্নের, বনবাসির রাজা কত্তিয়ির, ধারবাড়ের সামন্তরাজ মারুশর্ব এবং আরও অনেকে।

গোবিন্দ গুপ্তচর মারফৎ স্তম্ভের গতিবিধির সব খবরই অবগত হন। গঙ্গবাড়িতে স্তম্ভের প্রভাব খর্ব করার উদ্দেশ্যে তিনি শিবমারকে রাষ্ট্রকূট কারাগার থেকে মুক্তি দেন। তিনি ভেবেছিলেন, গঙ্গরাজকুমার স্বরাজ্যে প্রত্যাবর্তন করে স্তম্ভের বিরুদ্ধাচরণ করবেন। কিন্তু ফল হল বিপরীত। গঙ্গবাড়িতে ফিরে শিবমার স্তম্ভের পক্ষে যোগদান করেন।

গোবিন্দ আর বিলম্ব করলেন না। অনুগত ভ্রাতা ইন্দ্রের হস্তে রাজ্যভার অর্পণ করে তিনি স্তম্ভের বিরুদ্ধে যুদ্ধে বহির্গত হন। মিত্রদের কাছ থেকে কোনও সাহায্য আসার পূর্বেই স্তম্ভ আক্রান্ত ও বন্দি হন। পরাজিত ভ্রাতার প্রতি গোবিন্দ সদয় আচরণ করেন। তাঁকে বোঝান, স্বর্গত পিতার ইচ্ছাক্রমেই তিনি রাজপদ গ্রহণ করেছেন। ইন্দ্রের প্রচেষ্টায় বিবদমান দুই ভ্রাতার মধ্যে হৃদ্যতা স্থাপিত হয়। স্তম্ভ পুনরায় গঙ্গবাড়ির প্রদেশপাল নিযুক্ত হন। কিন্তু বিদ্রোহী শিবমারের অবস্থা হল শোচনীয়। গোবিন্দ ও স্তম্ভ একযোগে তাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধে অগ্রসর হন। তিনি পরাজিত ও বন্দি হন। শিবমারের কনিষ্ঠ ভ্রাতা রাষ্ট্রকূট বাহিনীর বিপক্ষে আরও কিছুদিন যুদ্ধ পরিচালনা করেন কিন্তু শেষে তিনিও পরাজয় বরণ করেন। স্তম্ভ আর কখনও অনুজের বিরুদ্ধাচরণ করেননি।

গঙ্গবাড়ি অভিযানের পর গোবিন্দ নোলম্ববাড়ির রাজা চরুপোন্নেরের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করেন। শিবমারের করুণ পরিণতি দেখে চরুপোন্নের বিনাযুদ্ধে গোবিন্দের বশ্যতা স্বীকার করেন। তাঁকে স্বরাজ্যে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করা হয়।

গোবিন্দ অতঃপর কাঞ্চীরাজ দন্তিগ বা দন্তিবর্মার বিরুদ্ধে অগ্রসর হন ও তাঁকে পরাভূত করেন। এভাবে গোবিন্দ ৭৯৬-৯৭ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ নিজেকে দক্ষিণ ভারতের অপ্রতিদ্বন্দ্বী সম্রাট রূপে প্রতিষ্ঠিত করেন। দক্ষিণ ভারতে নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করে তৃতীয় গোবিন্দ উত্তর ভারতের দিকে দৃষ্টি প্রসারিত করেন। তাঁর পিতার অভিযানের পর উত্তর ভারতের রাজনৈতিক রঙ্গমঞ্চে বহু দৃশ্য অভিনীত হয়েছে। ধ্রুব ধর্মপালবৎসরাজ উভয় নৃপতিকেই পরাজিত করেছিলেন। কিন্তু বিগত কয়েক বছরের মধ্যে ধর্মপাল তাঁর শক্তিকে সংগঠিত করেন, ইন্দ্রায়ুধকে বিতাড়িত করে অনুগত এবং বিশ্বাসভাজন চক্রায়ুধকে কান্যকুব্জের রাজসিংহাসনে মনোনীত করেন। ইতিমধ্যে বৎসরাজ পরলোকগমন করেন, তাঁর পুত্র দ্বিতীয় নাগভট পিতার স্থলাভিষিক্ত হন। দ্বিতীয় নাগভট ছিলেন এক শক্তিমান ও বিচক্ষণ নরপতি। তিনি অল্পদিনের মধ্যেই প্রায় সমগ্র রাজস্থান, মালব এবং গুজরাতের উত্তরাঞ্চলে নিজের কর্তৃত্ব সুপ্রতিষ্ঠিত করেন, শুধু তাই নয়, অন্ধ্র, সিন্ধু, বিদর্ভ ও কলিঙ্গের রাজাদের সঙ্গে আবদ্ধ হয়ে এক শক্তিশালী মিত্রজোট গঠন করেন। এক শক্তিধর রাষ্ট্ররূপে প্রতীহার রাজ্যের পুনরভ্যুদয় ঘটল।

ঠিক এই মুহূর্তে তৃতীয় গাবিন্দের উত্তর ভারত অভিযান। এই অভিযানের প্রকৃত কারণ আজও রহস্যাবৃত। অনেকে বলেন, পালরাজ ধর্মপাল তাঁকে ক্রমবর্ধমান প্রতীহাররাজের বিরুদ্ধে যুদ্ধে প্ররোচিত করেন। এ মত কিন্তু প্রমাণসিদ্ধ নয়। হয়তো গুজরাত ও মালবে রাষ্ট্রকূট অধিকার বিস্তারের উদ্দেশ্যেই তৃতীয় গোবিন্দের এই উত্তরাপথ অভিযান।

উত্তর ভারত অভিযানের পূর্বে গোবিন্দ রাজ্যের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সুদৃঢ় করেন। কনিষ্ঠ ভ্রাতা ইন্দ্ৰকে লাট প্রদেশের শাসনকর্তা নিযুক্ত করা হয়। দ্বিতীয় নাগভট যাতে লাট বা মালবের পথে দক্ষিণ ভারত আক্রমণ না করেন, সেদিকে তাঁকে সতর্ক থাকতে বলা হয়। মধ্যপ্রদেশের কয়েকটি স্থানে সেনা-শিবির স্থাপন করা হয়। এর পিছনে দু’টি উদ্দেশ্য ছিল। এক, স্থানীয় রাজারা রাষ্ট্রকূটদের বশীভূত থাকবেন। দুই, প্রয়োজনে এই সৈন্যবাহিনী অগ্রগামী রাষ্ট্রকুট সৈন্যদের সাহায্য করবে।

তৃতীয় গোবিন্দ ভুপাল ও ঝাঁসির পথে প্রতীহার রাজ্য অভিমুখে অগ্রসর হন। ঝাঁসি ও গ্বালিয়রের মধ্যবর্তী কোনও এক স্থানে দ্বিতীয় নাগভট গোবিন্দকে প্রতিহত করার চেষ্টা করেন কিন্তু শত্রুসেনার হাতে পরাজিত হন। উত্তর ভারতের রাজনৈতিক ভারসাম্য বিনষ্ট হবে, এই বিবেচনায় গোবিন্দ দ্বিতীয় নাগভটকে সম্পূর্ণরূপে উচ্ছেদের চেষ্টা থেকে বিরত হন। ধর্মপাল চক্রায়ুধ বিনাযুদ্ধে গোবিন্দের নিকট আত্মসমর্পণ করেন।

উত্তর ভারত অভিযানকালে তৃতীয় গোবিন্দ কতদূর পর্যন্ত অগ্রসর হন, তা এক বিতর্কিত বিষয়। পুত্র প্রথম আমোঘবর্ষের সঞ্জান তাম্রশাসনে সদম্ভে ঘোষিত হয়েছে, তৃতীয় গোবিন্দের হস্তী, অশ্ব ও রণবাদ্যের ধ্বনি হিমালয়ের গুহা কন্দরে প্রতিধ্বনিত হয়। এই বর্ণনার পরিপ্রেক্ষিতে নীলকান্ত শাস্ত্রী অনুমান করেন, উত্তর ভারত অভিযানে গোবিন্দ হিমালয়ের পাদদেশ পর্যন্ত অগ্রসর হন। অনন্ত সদাশিব অলতেকরের অভিমত, রাষ্ট্রকূট বাহিনী কান্যকুব্জে পৌঁছবার পূর্বেই চক্রায়ুধ বশ্যতা স্বীকার করেন; ফলে গোবিন্দ আর উত্তর দিকে অগ্রসর না হয়ে এলাহাবাদ, বারাণসী ও গয়ার মতো পবিত্র তীর্থস্থানসমূহ পরিদর্শন করে চিত্রকূট ও সগরের পথ ধরে স্বরাজ্যে প্রত্যাবর্তন করেন। সে যা হোক, গোবিন্দের উত্তর ভারত অভিযান নিছকই এক ক্ষণস্থায়ী সমরাভিযান; উত্তরাপথে স্থায়ী রাষ্ট্রকূট আধিপত্য প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে এই অভিযান পরিচালিত হয়নি। উত্তর ভারতে রাজ্য স্থাপনের বাসনা তাঁর ছিল না। বিজিত রাজাদের আনুগত্যের প্রতিশ্রুতিতে সন্তুষ্ট চিত্ত হয়ে তিনি আনুমানিক ৮০০ খ্রিস্টাব্দে গ্রীষ্মাবসানে দক্ষিণ ভারত অভিমুখে যাত্রা করেন।

অনুমিত হয়, রাষ্ট্রকূট সৈন্যদল উত্তর ভারত থেকে প্রস্থান করলে দ্বিতীয় নাগভট পুনরায় শক্তি সঞ্চয় করেন এবং প্রতিদ্বন্দ্বী ধর্মপালকে পরাজিত করেন। তিনি রাষ্ট্রকূট অধিকৃত লাট অঞ্চলে অনুপ্রবেশের চেষ্টা করেন কিন্তু স্থানীয় প্রশাসক কর্কের কর্মতৎপরতায় তাঁর সে চেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।

দক্ষিণ ভারতে প্রত্যাবর্তনকালে তৃতীয় গোবিন্দ মধ্য ভারতে এসে উপনীত হন। সেখানে তাঁর সেনানায়কেরা ইতিমধ্যেই কতিপয় স্থানীয় রাজাদের পরাজিত করেছেন। চন্দ্রগুপ্ত ছিলেন পরাজিত রাজাদের একজন। তিনি ছত্তীসগঢ় অঞ্চলের পাণ্ডুবংশী রাজা ছিলেন।

তৃতীয় গোবিন্দ নর্মদা নদীর তীরে শিবির স্থাপন করেন। দূতমুখে গোবিন্দের উপস্থিতির সংবাদ পেয়ে বিন্ধ্যাঞ্চলের অধিপতি শর্ব সভয়ে রাষ্ট্রকূটরাজের বশ্যতা স্বীকার করেন। গোবিন্দ শর্বের রাজধানী শ্রীভবন নগরে বর্ষাযাপন করেন। এখানে অবস্থানকালে তাঁর পুত্র প্রথম অমোঘবর্ষের জন্ম হয়। মহাসমারোহে পুত্রের জন্মদিন উদযাপিত হয়। জ্যোতিষীরা ভবিষ্যদ্বাণী করলেন, নবজাতক রাজচক্রবর্তী হবেন। ভরোচ জেলার সরভোনই প্রাচীন শ্রীভবন।

গোবিন্দের স্বরাজ্যে দীর্ঘদিন অনুপস্থিতির সুযোগে পল্লব, চোল, পাণ্ড্য, কেরল ও গঙ্গ রাজারা এক মিত্র জোট গঠন করে সমবেতভাবে রাষ্ট্রকূট রাজ্য আক্রমণ করেন। সংবাদ অবগত হয়ে গোবিন্দ ত্বরিতগতিতে নিজ রাজ্যে প্রত্যাবর্তন করেন। তুঙ্গভদ্রা নদীর তীরে বিবদমান দু’টি পক্ষ পরস্পরের সম্মুখীন হয়। আনুমানিক ৮০২-০৩ খ্রিস্টাব্দে অনুষ্ঠিত এই যুদ্ধে শত্রুবাহিনী সম্পূর্ণরূপে পরাজিত হয়। গঙ্গরাজ যুদ্ধক্ষেত্রে নিহত হন। রাষ্ট্রকূট সৈন্যগণ কাঞ্চীপুরম ও তঞ্জাবৃরে প্রবেশ করেন। ৮০৪ খ্রিস্টাব্দের মে মাসে গোবিন্দ সসৈন্যে রামেশ্বরমে উপস্থিত হন।

বিজয়ী রাষ্ট্রকূট বাহিনী যখন কাঞ্চীপুরম ও তঞ্জাবূরে অবস্থান করছেন তখন সিংহলনৃপতি গোবিন্দের মনোতুষ্টির জন্য তাঁর নিজের এবং প্রধানমন্ত্রীর দু’টি প্রতিমূর্তি তাঁকে উপঢৌকনস্বরূপ প্রেরণ করেন। গোবিন্দ মূর্তি দু’টি গ্রহণ করেন। রাজধানী মালখেড়ের এক শিবমন্দির চত্বরে মূর্তি দু’টি বিজয়স্তম্ভরূপে স্থাপিত হয়।

যতদিন মাতামহ চতুর্থ বিষ্ণুবর্ধন বেঙ্গীর রাজপদে সমাসীন ছিলেন ততদিন রাষ্ট্রকূটদের সঙ্গে চালুক্যদের মধুর সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল। কিন্তু আনুমানিক ৭৯৯ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় বিজয়াদিত্যের বেঙ্গীর সিংহাসনে আরোহণের সঙ্গে সঙ্গে এই প্রীতিপূর্ণ সম্পর্কের অবসান হয়। রাজা হয়েই দ্বিতীয় বিজয়াদিত্য গোবিন্দের আনুগত্য অস্বীকার করেন, স্বাধীন রাজার ন্যায় আচরণ করেন। কিন্তু চালুক্য রাজপরিবারে শীঘ্রই অন্তর্দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। বিজয়াদিত্যের অনুজ ভীম সলুকি জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। তৃতীয় গোবিন্দ কনিষ্ঠ রাজকুমারের পক্ষ অবলম্বন করেন। আনুমানিক ৮০২ খ্রিস্টাব্দে বিজয়াদিত্য রাষ্ট্রকূট বাহিনীর নিকট পরাজিত হন। ভীম বেঙ্গীর সিংহাসনে আরোহণ করেন। বেঙ্গীতে রাষ্ট্রকূট আধিপত্য পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়।

আনুমানিক ৮১৪ খ্রিস্টাব্দে তৃতীয় গোবিন্দ পরলোক গমন করেন। রাষ্ট্রকূট রাজবংশের সর্বশ্রেষ্ঠ নরপতি তৃতীয় গোবিন্দ। উত্তরে কান্যকুব্জ থেকে দক্ষিণে রামেশ্বরম এবং পূর্বে বারাণসী থেকে পশ্চিমে ব্রোচ পর্যন্ত বিস্তীর্ণ ভূখণ্ডে তিনি সফলতার সঙ্গে সামরিক অভিযান পরিচালনা করেন। দ্বিতীয় নাগভট ও ধর্মপালের মতো পরাক্রান্ত রাজারা তাঁর নিকট নতি স্বীকার করেন; কান্যকুব্জাধীশ চক্রায়ুধ তাঁর আনুগত্যাধীন ছিলেন ; বেঙ্গী রাজ্যে তাঁর কর্তৃত্ব অটুট ছিল; দ্রাবিড় রাজারা তাঁর নিকট পরাজয় বরণ করেন; সিংহলের রাজা তাঁর অনুগত ছিলেন। তাঁর রাজত্বকালে গঙ্গবাড়ি রাষ্ট্রকূট শাসনভুক্ত হয় ; মালব অঞ্চল রাষ্ট্রকূটদের অধীনতা পাশে আবদ্ধ হয়। সমরনৈপুণ্য, রাজনৈতিক বিচক্ষণতা ও সংগঠনশক্তির অপূর্ব সমন্বয় ঘটে ছিল তৃতীয় গোবিন্দের চরিত্রে। কান্যকুব্জ থেকে রামেশ্বরম পর্যন্ত বিস্তৃত শত্রুরাজাদের যেভাবে অবলীলাক্রমে তিনি পরাজিত করেছেন তা মোটেই সহজসাধ্য ছিল না। যে কৌশলে তিনি স্তম্ভকে স্বপক্ষে আনয়ন করেন তা তাঁর গভীর রাজনৈতিক জ্ঞানের পরিচায়ক। মালব জয় করে তিনি রাষ্ট্রকূট রাজ্যের নিরাপত্তা নিচ্ছিদ্র করেন। ভারতে যত সমরনিপুণ ও বিচক্ষণ রাজা জন্মগ্রহণ করেছেন তাঁদের পুরোভাগে গোবিন্দের অবস্থান।

প্রথম অমোঘবর্ষ (আ. ৮১৪-৮০ খ্রিস্টাব্দ)

তৃতীয় গোবিন্দের মৃত্যুর পর তাঁর একমাত্র পুত্র শর্ব পিতার স্থলাভিষিক্ত হন। রাজপদে অধিষ্ঠিত হয়ে তিনি ‘অমোঘবর্ষ’ অভিধা ধারণ করেন। পরবর্তিকালে এই অভিধাতেই তিনি সমধিক প্রসিদ্ধি লাভ করেন। ‘নৃপতুঙ্গ’, ‘রট্টমার্তগু’, ‘বীরনারায়ণ’, ‘অতিশয়ধবল’, ‘বল্লভ’, ‘পৃথিবীবল্লভ’ ইত্যাদি বহু অভিধায় তিনি ভূষিত হন।

চতুর্দশ বা পঞ্চদশ বৎসর বয়সে তিনি সিংহাসনে আরোহণ করেন। তাঁর খুল্লতাত পুত্র কর্ক অভিভাবকরূপে রাজ্যের শাসনকার্য পরিচালনা করেন।

তাঁর সিংহাসনলাভের অনতিকালমধ্যে রাজ্যে বিদ্রোহের দামামা বেজে ওঠে। স্তম্ভের পুত্র শঙ্করগণ সম্ভবত এই বিদ্রোহের এক নায়ক ছিলেন। এই বিদ্রোহের আর এক হোতা বেঙ্গীর দ্বিতীয় বিজয়াদিত্যশিবমারও গঙ্গবাড়িতে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। রাষ্ট্রকূট রাজ্যের কতিপয় মন্ত্রী ও পদস্থ রাজপুরুষও বিদ্রোহীদের দলে যোগদান করেন। রাষ্ট্রকূট অভিলেখে বিদ্রোহীদের তালিকায় শৌল্কিক ও রাষ্ট্রকূটদের নাম উল্লিখিত হয়েছে। রাষ্ট্রকূটেরা সম্ভবত রাজপরিবার বা বিভিন্ন রাষ্ট্রকূট শাখার সদস্য ছিলেন। কিংবা তাঁরা হয়তো রাষ্ট্র বা জেলার প্রশাসক ছিলেন।

প্রথমদিকে বিদ্রোহীদের সাফল্য ছিল রীতিমতো চমকপ্রদ। সর্বত্রই তাঁদের জয়জয়কার। অমোঘবর্ষ রাজধানী ছেড়ে পলায়ন করেন। সমকালীন এক রাষ্ট্রকূট লেখে এই ঘটনার উল্লেখ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, ‘সূর্য অস্তমিত, আকাশে চন্দ্র-তারা দীপ্তোজ্জ্বল’। দ্বিতীয় বিজয়াদিত্য কনিষ্ঠ ভ্রাতা ভীমকে পদচ্যুত করে বেঙ্গীর সিংহাসন অধিকার করেন। রাষ্ট্রকূট বাহিনী অবশ্য গঙ্গ বাড়িতে কিছুটা সাফল্য লাভ করে। টুমকুর জেলায় অবস্থিত কগিমোগেয়ুরের যুদ্ধে গঙ্গরাজ শিবমার নিহত হন। শিবমারের মৃত্যুতে তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র রাজমল্ল গঙ্গ সিংহাসনে আরোহণ করেন। তিনি রাষ্ট্রকূটদের বিরুদ্ধে সংঘর্ষ অব্যাহত রাখেন।

কর্ক পাতালমল্লের নিরলস চেষ্টায় ৮২১ খ্রিস্টাব্দের মে মাসের মধ্যে বিদ্রোহ অনেকটা প্রশমিত হয়। প্রথম অমোঘবর্ষ সিংহাসনে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হন। কিন্তু তখনও দ্বিতীয় বিজয়াদিত্য বেঙ্গী অধিকার করে আছেন, গঙ্গবাড়িতে রাজমল্লের সঙ্গে রাষ্ট্রকূটদের যুদ্ধ চলছে।

শীঘ্রই গঙ্গবাড়ির উত্তরাঞ্চলে রাষ্ট্রকূট কর্তৃত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। সেনাপতি বঙ্কেয় অধিকৃত অঞ্চলের প্রাদেশিক শাসনকর্তা নিযুক্ত হন। রাষ্ট্রকূটদের বিরুদ্ধে রাজমল্লের সংঘর্ষ তখনও অব্যাহত। গঙ্গবাড়ির দক্ষিণার্ধ তাঁর অধিকারভুক্ত কিন্তু বেঙ্গীতে রাষ্ট্রকুট বাহিনী অধিকতর সাফল্য লাভ করে। আনুমানিক ৮৩০ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় বিজয়াদিত্য পরাজিত হন ও অমোঘবর্ষের আনুগত্য স্বীকারে বাধ্য হন। তিনি ও তাঁর পুত্র পঞ্চম বিষ্ণুবর্ধন উভয়েই দের অনুগত ছিলেন।

প্রায় এ সময় কর্কের মৃত্যু হয়। তিনি শুধু লাট-মালবের প্রদেশপালই ছিলেন না, প্রথম অমোঘবর্ষের অভিভাবকও ছিলেন। পিতৃব্য তৃতীয় গোবিন্দ তাঁকে অমোঘবর্ষের অভিভাবক রূপে মনোনীত করেছিলেন। কর্ক সে দায়িত্ব পরম নিষ্ঠা ও বিশ্বস্ততার সঙ্গে পালন করেন।

কর্কের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র দ্বিতীয় ধ্রুব লাট-মালবের প্রদেশপালের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। তাঁর শাসনকার্যের প্রথম পাঁচ বছর শান্তিতেই অতিবাহিত হয়। কিন্তু শেষে উভয়ের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটে। হয় উচ্চাভিলাষে তাড়িত হয়ে নতুবা অমোঘবর্ষের উদ্ধত আচরণে ক্ষুব্ধ হয়ে তিনি বিদ্রোহী হন। কিন্তু পিতার সামরিক প্রতিভা তাঁর ছিল না। আনুমানিক ৮৪৫ খ্রিস্টাব্দে অমোঘবর্ষ তাঁকে পরাজিত ও নিহত করেন। ধ্রুবের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র অকালবর্ষ অমোঘ বর্ষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ৮৫০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ তিনি লাট-মালবের এক বিস্তীর্ণ অঞ্চলে নিজ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করেন। অকালবর্ষের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র তৃতীয় ধ্রুব অমোঘবর্ষের বিরুদ্ধে সংগ্রামে লিপ্ত হন। তাঁকে সাহায্য করেন তাঁর কনিষ্ঠ ভ্রাতা গোবিন্দরাজ। বিপদ উপলব্ধি করে অমোঘবর্ষ সেনাপতি বঙ্কেয়কে গঙ্গবাড়ি থেকে ডেকে পাঠান, তাঁর হস্তে তৃতীয় ধ্রুবের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনার দায়িত্ব অর্পণ করেন। ইতিমধ্যে রাষ্ট্রকূট রাজ্যের উত্তর সীমান্তে রাজা মিহির ভোজের নেতৃত্বে প্রতীহার রাজশক্তির পুনরভ্যুত্থানপর্ব শুরু হয়েছে। তৃতীয় ধ্রুব ও অমোঘবর্ষ উপলব্ধি করলেন, একক শক্তিতে ভোজের অগ্রগতি রুদ্ধ করা তাঁদের সাধ্যাতীত। আনুমানিক ৮৬০ খ্রিস্টাব্দে বিবদমান দু’টি রাষ্ট্রকূট রাজপরিবারের মধ্যে সন্ধি স্থাপিত হয়। প্রতীহারনৃপতি অবশ্য শেষপর্যন্ত তৃতীয় ধ্রুবকে উত্তর গুজরাত থেকে বিতাড়িত করেন। কিন্তু দক্ষিণ গুজরাতে ধ্রুবের অধিকার অক্ষুণ্ণ থাকে। অনুমিত হয়, ভোজের বিরুদ্ধে সংঘর্ষে ধ্রুব প্রথম অমোঘবর্ষের সাহায্য লাভ করেন।

অমোঘবর্ষ যখন তৃতীয় ধ্রুবের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত প্রায় সেই সময় দ্বিতীয় বিজয়াদিত্যের পৌত্র গুণগ বিজয়াদিত্য বেঙ্গী পুনরুদ্ধারে সচেষ্ট হন। আনুমানিক ৮৫০ খ্রিস্টাব্দে তিনি রাষ্ট্রকূট অধিকারভুক্ত কুর্ণল জেলায় অবস্থিত স্তম্ভপুরী আক্রমণ করেন। কিন্তু অমোঘবর্ষ কুত্তমের যুদ্ধে তাঁকে পরাজিত করেন। তৃতীয় বিজয়াদিত্য অমোঘবর্ষের বশ্যতা স্বীকার করেন। বেঙ্গীর সিংহাসন তাঁকে প্রত্যর্পণ করা হয়। পরবর্তিকালে গঙ্গরাজ নীতিমার্গের বিরুদ্ধে যুদ্ধে তিনি রাষ্ট্রকূট বাহিনীর সেনাধ্যক্ষের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন।

গঙ্গবাড়িতে রাজমল্লকে উচ্ছেদের চেষ্টায় প্রথম অমোঘবর্ষ বিশেষ সফলকাম হননি। যতদিন বঙ্কেয় উত্তর গঙ্গবাড়ির প্রাদেশিক শাসনকর্তা পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন ততদিন তিনি নানাভাবে রাজমল্লকে ব্যতিব্যস্ত করেন। বঙ্কেয়ের আক্রমণের তীব্রতায় রাজমল্ল কাবেরী নদীর উত্তর তট থেকে প্রস্থান করেন। কিন্তু শীঘ্রই অমোঘবর্ষের আদেশে বিদ্রোহ দমনের জন্য বন্ধেয় লাট-মালবে গমন করেন। এই সুযোগে রাজমল্ল তাঁর পৈতৃক রাজ্যের বৃহদংশ পুনরধিকার করেন। অমোঘবর্ষ গঙ্গবাড়ি জয়ের আশা বিসর্জন দিলেন না। তিনি তাঁর অনুগত মিত্র বেঙ্গীরাজ তৃতীয় বিজয়াদিত্যকে সসৈন্যে গঙ্গবাড়িতে প্রেরণ করেন। (অনন্ত সদাশির অলতেকর অভিমত প্রকাশ করেছেন, তৃতীয় বিজয়াদিত্য প্রথম অমোঘবর্ষের মৃত্যুর পর নতুন রাষ্ট্রকূটনৃপতি দ্বিতীয় কৃষ্ণের প্রভাব খর্ব করার উদ্দেশ্যে নোলম্ববাড়ি ও গঙ্গবাড়ি আক্রমণ করেন। কিন্তু বেঙ্গীরাজের নোলম্ববাড়ি ও গঙ্গবাড়ি অভিযানের তারিখ সঠিক নির্ধারিত না হওয়ায় তাঁর এই দু’টি অভিযানের উদ্দেশ্য ও প্রকৃতি সম্পর্কে পণ্ডিতমহলে স্বভাবতই বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে।) নীতিমার্গ তখন গঙ্গবাড়ির সিংহাসনে। তিনি রাজমল্পের পুত্র। যুদ্ধে নীতিমার্গ পরাজিত হন এবং বেঙ্গালুরু জেলার শিবগঙ্গা পর্বতে আশ্রয় গ্রহণ করেন। অবশেষে দু’পক্ষে সন্ধি স্থাপিত হয়। অমোঘবর্ষের কন্যা চন্দ্রোব্বলব্বা বা অবলব্বার সঙ্গে গঙ্গ রাজকুমার বূতুগের বিবাহ হয়। এর ফলে দুই রাজপরিবারের দীর্ঘস্থায়ী বৈরিতার অবসান হয়।

বিদ্রোহ দমন ও রাজ্যে শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার কাজে প্রথম অমোঘবর্ষ সদা ব্যস্ত ছিলেন। উত্তর ভারতে সমরাভিযান পাঠানোর অবকাশ তাঁর ছিল না। ৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে উৎকীর্ণ সিরুর অভিলেখে দাবি করা হয়েছে, অঙ্গ, বঙ্গ ও মগধের রাজারা তাঁর বশ্যতা স্বীকার করেছেন। তাঁর সমকালীন পালনৃপতি নারায়ণপালও দাবি করেছেন, তিনি দ্রবিড়নাথকে পরাভূত করেছেন। হয়তো কখনও কখনও কোসল বা ওড়িশায় পাল ও রাষ্ট্রকূট সৈন্যদলের মধ্যে সীমান্ত সংঘর্ষ ঘটত। সেক্ষেত্রে কখনও পালরা কখনওবা রাষ্ট্রকূটরা জয়লাভ করতেন।

মধ্য ভারতের কলচুরি-চেদি রাজবংশের সঙ্গে তিনি বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করেন। কলচুরি রাজ প্রথম কোক্কল্লের এক কন্যার সঙ্গে যুবরাজ দ্বিতীয় কৃষ্ণের বিবাহ অনুষ্ঠিত হয়।

যুদ্ধবিগ্রহে নয়, ধর্মানুশীলন ও সাহিত্যচর্চায় প্রথম অমোঘবর্ষের অধিক আগ্রহ ছিল। তাঁর সঞ্জান তাম্রশাসনে ঘোষিত হয়েছে, সংসারের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে তিনি একাধিকবার রাজপদ থেকে অবসর গ্রহণ করে সাধুসঙ্গ ও উপাসনায় দিন যাপন করেন। বিদ্বান ও সুলেখক ছিলেন তিনি। বহু কবি ও বিদ্বজ্জনের তিনি পৃষ্ঠপোষকতা করেন। অলংকারবিষয়ক আদি কন্নড় গ্রন্থ কবিরাজমার্গ। অমোঘবর্ষই সম্ভবত গ্রন্থখানির রচয়িতা। এমনও হতে পারে, তাঁরই আগ্রহে ও অনুপ্রেরণায় অন্য কোনও ব্যক্তি গ্রন্থখানি রচনা করেন। জীবনের সায়াহ্ন বেলায় তিনি জৈনধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হন। আদিপুরাণের রচয়িতা জিনসেন দাবি করেছেন, তিনি অমোঘবর্ষের আচার্য ছিলেন। তবে তিনি ব্রাহ্মণ্যধর্ম সম্পূর্ণরূপে পরিহার করেছিলেন বলে মনে হয় না। সঞ্জান তাম্র শাসনে বলা হয়েছে, রাজ্য হতে অমঙ্গল দূরীকরণের উদ্দেশ্যে তিনি বামহস্তের একটি অঙ্গুলি মহা লক্ষ্মীকে উৎসর্গ করেন। ভট্টকলঙ্ক তাঁর কর্ণাটকশব্দানুশাসনম গ্রন্থে অমোঘবর্ষের এই ত্যাগকে শিবিরাজ ও দধীচির আত্মত্যাগের সঙ্গে তুলনা করেছেন। রাজারা নিজেদের ব্যক্তিস্বার্থে অন্যদের রক্ত ঝরান; অমোঘবর্ষ প্রজাসাধারণের হিতার্থে নিজের রক্ত ঝরিয়েছেন। ইতিহাসে এরূপ ঘটনা বিরল বৈকি।

দ্বিতীয় কৃষ্ণ (আ. ৮৮০-৯১৪ খ্রিস্টাব্দ)

আনুমানিক ৮৮০ খ্রিস্টাব্দে প্রথম অমোঘবর্ষের পুত্র দ্বিতীয় কৃষ্ণ রাষ্ট্রকূট সিংহাসনে আরোহণ করেন। ‘শুভতুঙ্গ’, ‘অকালবর্ষ’, ‘বল্লভ’, ‘পৃথিবীবল্লভ’ ইত্যাদি অভিধায় তিনি ভূষিত হন।

সিংহাসনে আরোহণের পর দ্বিতীয় কৃষ্ণ বেঙ্গীরাজ তৃতীয় বিজয়াদিত্যের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হন। যতদিন প্রথম অমোঘবর্ষ জীবিত ছিলেন ততদিন তৃতীয় বিজয়াদিত্য রাষ্ট্রকূটদের প্রতি অনুগত ছিলেন। কিন্তু দ্বিতীয় কৃষ্ণ রাজপদে অভিষিক্ত হলে তিনি স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। তাঁকে বশীভূত করার সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়। উপরন্তু কৃষ্ণ বিজয়াদিত্যের নিকট শোচনীয়রূপে পরাজিত হন এবং চেদি রাজসভায় তাঁর শ্বশুর প্রথম কোক্কল্ল ও শ্যালক শঙ্করগণের আশ্রয় গ্রহণ করেন। এবার বিজয়াদিত্য সেনাধ্যক্ষ পাণ্ডুরঙ্গকে সসৈন্যে চেদিরাজ্য অভিযানে প্রেরণ করেন। বেঙ্গী সৈন্যদল কলিঙ্গ ও দক্ষিণ কোসলের পথ ধরে চেদিরাজ্য অভিমুখে অগ্রসর হয়। কলিঙ্গ, কোসল ও বেমুলবাড়ের রাজারা সকলেই চেদি ও রাষ্ট্রকূটদের প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন ছিলেন। পাণ্ডুরঙ্গকে প্রতিহত করার তাঁদের সব আয়োজন ব্যর্থ হয়। পাণ্ডুরঙ্গ চেদিরাজ্যের অভ্যন্তরে প্রবেশ করেন। ডাহল বিধ্বস্ত হয়, চেদিরাজ্যের দু’টি প্রধান শহর কিরণপুর ও অচলপুর অগ্নিদগ্ধ হয়। যুদ্ধে দ্বিতীয় কৃষ্ণ ও শঙ্করগণ পরাজিত হন। শেষে উভয়পক্ষে সন্ধি স্থাপিত হয়। দ্বিতীয় কৃষ্ণ বেঙ্গী রাজের আনুগত্য স্বীকার করেন ও রাজধানী মান্যখেটে প্রত্যাবর্তন করেন। তৃতীয় বিজয়াদিত্য নিজেকে ত্রিকলিঙ্গ ও অখিল দক্ষিণাপথের অধীশ্বররূপে ঘোষণা করেন।

এ অপমান কৃষ্ণ বেশি দিন সহ্য করেননি। আনুমানিক ৮৮৮ খ্রিস্টাব্দে তৃতীয় বিজয়াদিত্যের মৃত্যুতে তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র প্রথম ভীম রাজপদ লাভ করেন। ভীমের অভিষেক অনুষ্ঠানের পূর্বেই কৃষ্ণ সসৈন্যে বেঙ্গী আক্রমণ করেন। এ অভিযানে তাঁকে প্রভূত সাহায্য করেন বেমুলবাড়ের চালুক্যরাজ বড্ডেগ। ভীম বড্ডেগের হাতে বন্দি হন। তাঁকে অবশ্য মুক্তি দেওয়া হয়। দ্বিতীয় কৃষ্ণের অনুগত মিত্ররূপে তিনি স্বপদে বহাল থাকেন। বেঙ্গীর বিস্তীর্ণ অঞ্চল রাষ্ট্রকূট রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়।

বছর দশেক বেঙ্গীরাজ্যে দ্বিতীয় কৃষ্ণের কর্তৃত্ব অটুট থাকে। ইতিমধ্যে ভীম নিজের শক্তি বৃদ্ধি করেন ও রাষ্ট্রকূটদের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করেন। যুদ্ধে রাষ্ট্রকূট সেনাধ্যক্ষ গুণ্ডয় নিহত হন। ভীমের বীরপুত্র ইরিমণ্ডিগণ্ড গুরুতররূপে আহত হন। অযথা লোকক্ষয় নিবারণের উদ্দেশ্যে উভয়পক্ষের মধ্যে সন্ধি স্থাপিত হয়। কৃষ্ণ বেঙ্গীরাজ্যের বিজিত অঞ্চল প্রত্যর্পণ করেন। ভীমও রাষ্ট্রকূট রাজ্য আক্রমণের বাসনা পরিত্যাগ করেন। এরপর কৃষ্ণ ও ভীম আর কখনও পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হননি।

রাজত্বের প্রারম্ভিক পর্বে দ্বিতীয় কৃষ্ণ গুর্জর প্রতীহার নৃপতি প্রথম ভোজের সঙ্গে সংগ্রামে অবতীর্ণ হন। ভোজ যখন কাশ্মীররাজ শঙ্করগণের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত তখন সম্ভবত দক্ষিণ গুজরাতের রাষ্ট্রকূট প্রশাসক কৃষ্ণরাজ উজ্জয়িনী অবরোধ করেন। এই রাষ্ট্রকূট প্রশাসক দাবি করছেন, তিনি রাজা বল্লভ অর্থাৎ দ্বিতীয় কৃষ্ণের উপস্থিতিতে উজ্জয়িনীতে শত্রু রাজাকে পরাভূত করেন। কিন্তু শেষপর্যন্ত ভোজের প্রবল প্রতিরোধে কৃষ্ণরাজ পশ্চাদপসরণ করেন। কৃষ্ণ রাজকে পশ্চাদ্ধাবন করে ভোজ দক্ষিণ গুজরাতে এসে উপস্থিত হন। নর্মদা তীরে বিবদমান পক্ষ পরস্পরের সম্মুখীন হয়। দ্বিতীয় কৃষ্ণ তাঁর আঞ্চলিক প্রশাসক কৃষ্ণরাজকে ভোজের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সহায়তা করেন। যুদ্ধে রাষ্ট্রকূট বাহিনী পরাজিত হয়। কৃষ্ণরাজ সম্ভবত যুদ্ধে নিহত হন। তিনিই রাষ্ট্রকূটদের গুজরাত শাখার সর্বশেষ আঞ্চলিক রাজা। খেটক-মণ্ডল প্রতীহারদের অধিকারভুক্ত হয়। দ্বিতীয় কৃষ্ণ অবশ্য তাঁর রাজত্বের শেষের দিকে অর্থাৎ ৯১০ খ্রিস্টাব্দের কিছুকাল পূর্বে দক্ষিণ গুজরাত পুনরুদ্ধার করেন। রাষ্ট্রকূট লেখে বলা হয়েছে, দ্বিতীয় কৃষ্ণ খেটক-মণ্ডল থেকে অমিত্রদের উচ্ছেদ করেন। রাষ্ট্রকূট লেখে যাঁদের অমিত্র বলা হয়েছে, তাঁরা নিঃসন্দেহে গুর্জর প্রতীহার। তখন প্রথম ভোজ লোকান্তরিত ; প্রতীহার সিংহানে প্রথম মহেন্দ্রপাল সমাসীন।

দ্বিতীয় কৃষ্ণ চোলসম্রাট প্রথম আদিত্যের সঙ্গে নিজের এক কন্যার বিবাহ দেন। রাষ্ট্রকূট রাজ কন্যার গর্ভে আদিত্যের একটি পুত্র হয়। তাঁর নাম কন্নরদেব। আদিত্যের মৃত্যুর পর পরান্তক রাজা হলে কৃষ্ণ তাঁর দৌহিত্র কন্নরদেবের দাবির সমর্থনে, বাণদের সাহায্যপুষ্ট হয়ে, চোলরাজ্য আক্রমণ করেন। কিন্তু পরান্তক তাঁর গঙ্গমিত্র দ্বিতীয় পৃথিবীপতি বা পৃথ্বীপতির সহায়তায় উত্তর আর্কট জেলায় বল্লালের যুদ্ধে শত্রুবাহিনীকে পরাজিত করেন। এই যুদ্ধে পরাভবের ফলে বাণরাজ্যের স্বাধীনতা বিনষ্ট হয় ও বাণরাজ্য চোলদের অধিকারভুক্ত হয়। দ্বিতীয় পৃথিবীপতি অধিকৃত অঞ্চলের প্রশাসক নিযুক্ত হন। পরান্তকের বিরুদ্ধে সংঘর্ষে দ্বিতীয় কৃষ্ণের লাভ কিছুই হয়নি বরঞ্চ তাঁকে পরাজয়ের গ্লানি বহন করতে হয়।

দ্বিতীয় কৃষ্ণের নিজস্ব লেখে পূর্ব ভারত বিজয়ের কোনও দাবি উচ্চারিত হয়নি। কিন্তু উত্তরকালীন রাষ্ট্রকূট লেখমালায় ঘোষণা করা হয়েছে, গৌড়রাজকে তিনি সহবত শিক্ষা দেন ; অঙ্গ, কলিঙ্গ ও মগধের রাজারা তাঁর বশ্যতা স্বীকার করেন। কৃষ্ণের সভাকবি গুণচন্দ্র বলেন, তাঁর রণ হস্তীরা গঙ্গার সুমিষ্ট জলে তৃপ্ত হয় এবং কন্যাকুমারিকায় বনরাজির স্নিগ্ধ ছায়াতলে বিশ্রাম-সুখ উপভোগ করে। অতিশয়োক্তিমূলক এসব দাবির মধ্যে কোনও বাস্তব ঘটনার প্রতিফলন নেই, এ কথা অবশ্যই বলা চলে না। দক্ষিণ ভারতের প্রান্তসীমায় তিনি হয়তো কখনও পদার্পণ করেননি কিন্তু রাষ্ট্রকূট লেখে তাঁর গৌড়-মগধ অভিযানের যে দাবি ঘোষিত হয়েছে, তা সর্বৈব অসত্য বলে বোধ হয় না। তাঁর এই অভিযান পূর্ব ভারতের, বিশেষত পালরাজ্যের, ধন-সম্পদ আহরণের উদ্দেশ্যে পরিকল্পিত ও পরিচালিত নিছকই এক সমরাভিযান। তবে এ কথা অনস্বীকার্য, ধ্রুব বা তৃতীয় গোবিন্দের সামরিক নৈপুণ্য তাঁর ছিল না। কিন্তু পৈতৃক রাজ্যের অখণ্ডতা রক্ষায় তাঁর সাফল্য নিঃসন্দেহে সপ্রশংস উল্লেখের দাবি রাখে।

প্রায় চৌত্রিশ বৎসর রাজত্ব করার পর ৯১৪ খ্রিস্টাব্দের শেষার্ধে দ্বিতীয় কৃষ্ণ পরলোক গমন করেন। তাঁর দুর্ভাগ্য, তাঁর জীবদ্দশায় তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র জগত্তুঙ্গ প্রয়াত হন। জগত্তুঙ্গের দুই পুত্র ছিলেন। ইন্দ্র ছিলেন জ্যেষ্ঠ। তিনি চেদি রাজকুমারী লক্ষ্মীর গর্ভজাত। (লক্ষ্মী ছিলেন দ্বিতীয় কৃষ্ণের শ্যালক শঙ্করগণের কন্যা।) কনিষ্ঠ পুত্র অমোঘবর্ষ ছিলেন লক্ষ্মীর ভগিনী গোবিন্দম্বার সন্তান। দ্বিতীয় কৃষ্ণের মৃত্যুর পর তাঁর পৌত্র ইন্দ্ৰ পিতা মহের সিংহাসনে আরোহণ করেন।

তৃতীয় ইন্দ্ৰ (আ. ৯১৪-২৮ খ্রিস্টাব্দ)

রাষ্ট্রকুট রাজবংশের এক পরাক্রান্ত নরপতি তৃতীয় ইন্দ্র। তাঁর মহিষী বিজম্বা। প্রথম কোক্কল্লের পৌত্র অম্মনদেবের কন্যা তিনি।

সিংহাসনে আরোহণ করেই ইন্দ্র মালব পুনরুদ্ধারে মনোনিবেশ করেন। মনে হয়, দ্বিতীয় কৃষ্ণ যখন চোলরাজ পরান্তকের বিরুদ্ধে সংগ্রামে লিপ্ত তখন গুর্জর-প্রতীহাররা মালব অধিকার করে পরমারবংশীয় উপেন্দ্ররাজকে বিজিত অঞ্চলের শাসনকর্তারূপে নিযুক্ত করেন। উপেন্দ্ররাজ মালবের অধিকার পেয়েই সন্তুষ্ট হলেন না। তিনি রাষ্ট্রকূট রাজ্যভুক্ত নাসিকের গোবর্ধন শহর অবরোধ করেন। ইন্দ্র গোবর্ধন হতে উপেন্দ্ররাজকে বিতাড়িত করে মালবে প্রবেশ করেন। উপেন্দ্ররাজ পুনরায় পরাজিত হয়ে ইন্দ্রের বশ্যতা স্বীকার করেন।

মালব পুনরুদ্ধার করে তৃতীয় ইন্দ্র ৯১৬ খ্রিস্টাব্দের শরৎকালে সসৈন্যে কান্যকুব্জ অভি মুখে যাত্রা করেন। তখন কান্যকুব্জের অধিপতি প্রতীহাররাজ প্রথম মহীপাল। ভুপাল ঝাঁসির পথ ধরে অগ্রসর হয়ে ইন্দ্র যমুনা নদী অতিক্রমপূর্বক কান্যকুব্জ আক্রমণ করেন। রাষ্ট্রকূট সৈন্যদের বিরুদ্ধে কোনও প্রতিরোধ রচনা না করে মহীপাল রাজধানী অরক্ষিত রেখে পলায়ন করেন। ইন্দ্র বেমুলবাড়ের চালুক্য সামন্ত দ্বিতীয় নরসিংহকে মহীপালকে অনুসরণ করতে আদেশ দেন। দ্বিতীয় নরসিংহের পুত্র অরিকেশরীর অনুগ্রভাজন কবি পম্পের ‘বিক্রমার্জুনবিজয়’ কাব্যে বলা হয়েছে, মহীপাল যেন বজ্রাহত ; তাঁর আহার-বিশ্রামের সময় নেই; তিনি পলায়মান। মহী পালের পশ্চাদ্ধাবন করতে করতে দ্বিতীয় নরসিংহ গঙ্গা-যমুনা সঙ্গম পর্যন্ত অগ্রসর হন। সন্দেহ নেই, তৃতীয় ইন্দ্রের এই অভিযানের ফলে মহীপাল কান্যকুব্জের আধিপত্য বিসর্জন দেন এবং পলায়ন করে আত্মরক্ষা করেন। কিন্তু তৃতীয় ইন্দ্রের দক্ষিণ ভারতে প্রস্থানের অব্যবহিত পরই প্রতীহাররাজ কান্যকুব্জ পুনরধিকার করেন। ৯১৭ খ্রিস্টাব্দের পূর্বেই মহীপাল কান্যকুব্জে স্বীয় কর্তৃত্ব সুদৃঢ় করেন।

উত্তর ভারত থেকে প্রত্যাবর্তনের পর ইন্দ্র বেঙ্গীতে রাষ্ট্রকূট প্রভুত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হন। সুযোগও এসে উপস্থিত হয়। চালুক্যরাজ ভীম দেহত্যাগ করেন, তাঁর পুত্র চতুর্থ বিজয়াদিত্য বেঙ্গীর রাজপদ অলংকৃত করেন। ইন্দ্র নতুন বেঙ্গীরাজের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। বীর্যপুরী নামক স্থানে উভয় পক্ষের মধ্যে যুদ্ধ অনুষ্ঠিত হয়। চালুক্য লেখে দাবি করা হয়েছে, যুদ্ধে চালুক্য সৈন্য জয়লাভ করেন কিন্তু বিজয়াদিত্য মৃত্যুবরণ করেন। অনুমিত হয়, তৃতীয় ইন্দ্রের বিজয়াভিযানের ফলে বেঙ্গীর একাংশ রাষ্ট্রকূটদের অধিকারভুক্ত হয়। বেঙ্গীর বৃহদংশ অবশ্য বিজয়াদিত্যের পুত্র ও উত্তরাধিকারী প্রথম অম্মের কর্তৃত্বাধীন থাকে।

এ পর্বে বেঙ্গীর রাজনৈতিক ইতিহাস ততটা স্পষ্ট নয়। রাজাদের রাজত্বের স্থায়িত্ব ও ঘটনার পারম্পর্য সম্পর্কে বিদ্বজ্জন বিভিন্ন মত পোষণ করেন। নীলকান্ত শাস্ত্রীর অভিমত, প্রথম অন্ম ৯২৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সগৌরবে বেঙ্গীতে রাজত্ব করেন। কিন্তু অনন্ত সদাশিব অলতেকর মনে করেন ৯২৫ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ প্রথম অম্লের মৃত্যুর পর তাঁর নাবালক পুত্র পঞ্চম বিজয়াদিত্য বেঙ্গীর রাজপদ অলংকৃত করেন; তাঁকে পদচ্যুত করে তৃতীয় ইন্দ্র চালুক্য রাজপরিবারের সদস্য প্রথম তালপকে বেঙ্গীর সিংহাসন অর্পণ করেন; প্রথম ভীমের পুত্র দ্বিতীয় বিক্রমাদিত্য এক মাসের মধ্যেই তালপকে নিহত করে বেঙ্গীর সিংহাসন অধিকার করেন; ইন্দ্র তাঁকে বিতাড়িত করে ৯২৮ খ্রিস্টাব্দে তালপের পুত্র যুদ্ধমল্লকে বেঙ্গীর রাজপদে নিযুক্ত করেন; রাষ্ট্রকূটদের সহায়তায় যুদ্ধমল্ল ৯৩৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত স্বপদে বহাল থাকেন। অনন্ত সদাশিব অলতেকরের এ অভিমত গ্রাহ্য হলে স্বীকার করতে হবে, প্রতিকূলতা সত্ত্বেও তৃতীয় ইন্দ্র তাঁর রাজত্বের অন্তিম পর্বে বেঙ্গীতে রাষ্ট্রকূট প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। আনুমানিক ৯২৮ খ্রিস্টাব্দের মধ্যভাগে তিনি লোকান্তরিত হন। রাষ্ট্রকূট রাজবংশের একজন শ্রেষ্ঠ রাজা তৃতীয় ইন্দ্ৰ। তেজস্বিতা, বিচক্ষণতা ও উচ্চাভিলাষের সমন্বয় ঘটেছিল তাঁর চরিত্রে। কান্যকুব্জ বিজয় তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ কীর্তি। মালব ও বেঙ্গী পুনরুদ্ধার তাঁর কৃতিত্বের পরিচায়ক।

দ্বিতীয় অমোঘবর্ষ (আ. ৯২৮-৩০ খ্রিস্টাব্দ)

তৃতীয় ইন্দ্রের দুই পুত্র, দ্বিতীয় অমোঘ বর্ষ ও চতুর্থ গোবিন্দ। পিতার মৃত্যুর পর জ্যেষ্ঠ পুত্র দ্বিতীয় অমোঘবর্ষ রাজপদ গ্রহণ করেন। তিনি মাত্র কিঞ্চিদধিক এক বৎসরকাল রাজত্ব করেন। কীভাবে তাঁর রাজত্বের অবসান হয় তা অনিশ্চিত। হয়তো তিনি অকালে মৃত্যুমুখে পতিত হন। কিংবা হয়তো তিনি তাঁর অনুজের হাতে নিহত হন। তাঁর পুত্রদের কথা কিছু জানা যায় না। রাষ্ট্রকূট রাজবংশের পরবর্তী রাজা তাঁর অনুজ চতুর্থ গোবিন্দ । তিনি আনুমানিক ৯৩০ খ্রিস্টাব্দের প্রারম্ভে সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন।

চতুর্থ গোবিন্দ (আ. ৯৩০-৩৬ খ্রিস্টাব্দ)

গোবিন্দ উচ্চাভিলাষী ছিলেন কিন্তু চারিত্রিক দৃঢ়তা বা বিচক্ষণতা কোনওটাই তাঁর ছিল না। উচ্ছৃঙ্খল চরিত্রের লোক ছিলেন তিনি। রাজকার্য অপেক্ষা নারীসঙ্গ ও লঘু আমোদ-প্রমোদে তাঁর অধিক আগ্রহ ছিল। এরূপ অমিতাচারী ও তরল মতির রাজা রাজ্য পরিচালনায় স্বভাবতই চূড়ান্ত ব্যর্থতার পরিচয় দেন।

চতুর্থ গোবিন্দের রাজত্বকালে যুদ্ধমল্ল বেঙ্গীর সিংহাসনে সমাসীন ছিলেন। তৃতীয় ইন্দ্ৰ তাঁকে বেঙ্গীর সিংহাসনে মনোনীত করেন। কিন্তু তিনি সুশাসক বা প্রজাবৎসল ছিলেন না। ৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় ভীম তাঁকে বিতাড়িত করে সিংহাসন অধিকার করেন। বেঙ্গী পুনরুদ্ধারের কোনও চেষ্টাই করেননি চতুর্থ গোবিন্দ।

গোবিন্দ বেমুলবাড়ের আঞ্চলিক রাজা দ্বিতীয় অরিকেশরীর সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িত হন। অরিকেশরী সম্পর্কে চতুর্থ গোবিন্দের ভগিনীপতি। তিনি বেঙ্গীর পূর্বতন নৃপতি পঞ্চম বিজয়াদিত্যকে আশ্রয় দান করে গোবিন্দের বিরাগভাজন হন। গোবিন্দ অরিকেশরীকে আদেশ করেন, বিজয়াদিত্যকে তাঁর হস্তে সমর্পণ করতে হবে। অরিকেশরী তাতে সম্মত না হওয়ায় গোবিন্দ তাঁকে আক্রমণ করেন। বহু রাষ্ট্রকূট মন্ত্রী ও সামন্তরাজ প্রকাশ্যে অরিকেশরীর পক্ষ অবলম্বন করেন। যুদ্ধে গোবিন্দ পরাজিত ও সম্ভবত নিহত হন। অরিকেশরীর সভাকবি পম্পের ‘বিক্রমার্জুনবিজয়’ কাব্যে এই যুদ্ধের বিশদ বর্ণনা লিপিবদ্ধ আছে।

পম্প দাবি করেছেন, অরিকেশরী বড্ডেগ বা তৃতীয় অমোঘবর্ষকে রাজপদে অভিষিক্ত করেন। পম্পের এই দাবি অত্যুক্তিমূলক। অনুমিত হয়, চতুর্থ গোবিন্দ যখন দক্ষিণ কর্ণাটকে অরিকেশরীর সঙ্গে মরণপণ সংগ্রামে লিপ্ত তখন বড্ডেগ বা তৃতীয় অমোঘবর্ষ সসৈন্যে মান্যখেট অভিমুখে অগ্রসর হন। গোবিন্দের অনুগত সৈন্যবাহিনী তাঁর গতিরোধ করার চেষ্টা করে কিন্তু অমোঘবর্ষ তাঁদের পরাজিত করে রাজধানীতে এসে উপনীত হন। সেখানে মন্ত্রী ও সামন্তবর্গ তাঁকে সাদরে বরণ করেন ও রাজপদ গ্রহণে প্ররোচিত করেন। ৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে ঘটনাটি ঘটে। ৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে উৎকীর্ণ তৃতীয় অমোঘবর্ষের একখানি লেখ আবিষ্কৃত হয়েছে। অর্থাৎ ৯৩৭ খ্রিস্টাব্দের পূর্বেই তিনি রাজপদে অধিষ্ঠিত হন।

তৃতীয় অমোঘবর্ষ (আ. ৯৩৬-৩৯ খ্রিস্টাব্দ)

তাঁর ব্যক্তিগত নাম ছিল বড্ডেগ। তৃতীয় অমোঘবর্ষ নামেই অবশ্য তাঁর সমধিক প্রসিদ্ধি। তাঁর পত্নী কুন্তকদেবীচেদিরাজ প্রথম যুবরাজের কন্যা ছিলেন। বৃদ্ধ বয়সে তিনি সিংহাসনে আরোহণ করেন। তাঁর পুত্রদের অনেকেই তখন বয়ঃপ্রাপ্ত ছিলেন। জ্যেষ্ঠ পুত্র কৃষ্ণ। পিতার সিংহাসন অধিকারে তিনি সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করেন। অন্যান্য পুত্রদের মধ্যে ছিলেন জগত্তুঙ্গ, নিরুপম ও খোট্টিগ। অমোঘবর্ষের রেবকনিম্মডী নামে এক কন্যা ছিলেন। গঙ্গবাড়ির নৃপতি তৃতীয় রাজমল্লের কনিষ্ঠ ভ্রাতা বুতুগের সঙ্গে তাঁর পরিণয় হয়।

আধ্যাত্মিক জগতের লোক ছিলেন তৃতীয় অমোঘবর্ষ। ধর্মভীরু ও সত্যনিষ্ঠ বলে তাঁর সুখ্যাতি ছিল। প্রশাসনিক কার্য অপেক্ষা ধর্মীয় ক্রিয়াকলাপেই তাঁর বেশি সময় অতিবাহিত হত। ব্রাহ্মণ সম্প্রদায় ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে তিনি বহু দান-ধ্যান করেন। বহু শিবমন্দিরের নির্মাতা তিনি। রাজ্য পরিচালনার ভার যুবরাজ তৃতীয় কৃষ্ণের স্কন্ধে অর্পিত হয়। মনে হয়, সিংহাসনে আরোহণ করেই অমোঘবর্ষ পুত্রকে যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত করেন।

তৃতীয় কৃষ্ণের রাজত্বকালে উৎকীর্ণ দেওলি তাম্রশাসনে যুবরাজরূপে তাঁর সামরিক ক্রিয়া কাণ্ডের কিছু পরিচয় বিধৃত আছে। এই লেখে বলা হয়েছে, কৃষ্ণ অসাধু দন্তিগ ও বপ্পুগকে নিহত করেন; রচ্ছায়মল্লরূপ বিষবৃক্ষ উৎপাটন করেন, গঙ্গবাড়িতে ভূতার্থরূপ এক পবিত্র পাদপ প্রতিষ্ঠা করেন, তাঁর শৌর্য-বীর্যের কথা গুর্জরনাথের কর্ণগোচর হলে তিনি কালঞ্জর ও চিত্রকূট জয়ের আশা পরিত্যাগ করেন।

তৃতীয় কৃষ্ণের হস্তে দস্তিগ, বপ্পুগ ও রচ্ছায়মল্লের পরাজয় ও নিধন নিঃসন্দেহে তাঁর গঙ্গবাড়ি অভিযানে সাফল্যের পরিচায়ক। যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত হয়ে কৃষ্ণ গঙ্গবাড়িতে রাষ্ট্রকূট কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে সংকল্প গ্রহণ করেন। তিনি তৃতীয় রাজমল্লকে পদচ্যুত করে ভগিনীপতি বূতুগকে গঙ্গবাড়ির রাজপদে অভিষিক্ত করতে উদ্যত হন। কৃষ্ণ প্রথমে তৃতীয় রাজমল্লের দুই মিত্র দন্তিগ ও বপ্পুগকে আক্রমণ ও নিহত করেন। অতঃপর তিনি গঙ্গবাড়ি অভিমুখে যাত্রা করেন। যুদ্ধক্ষেত্রে তৃতীয় রাজমল্ল মৃত্যুবরণ করেন। ৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে বূতুগ রাষ্ট্রকূটদের অনুগতরূপে গঙ্গবাড়ির শূন্য সিংহাসনে অভিষিক্ত হন।

গুর্জররাজ কালঞ্জর ও চিত্রকূট জয়ের আশা পরিত্যাগ করেন, রাষ্ট্রকূট লেখের এই উক্তির তাৎপর্য সম্পর্কে ঐতিহাসিক মহলে বাগ্‌বিতণ্ডার সৃষ্টি হয়েছে। অনন্ত সদাশিব অলতেকর মনে করেন, কৃষ্ণ ৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে চেদিদের পরাজিত করে বুন্দেলখণ্ডে প্রবেশ করেন এবং গুর্জরদের অধিকৃত কালঞ্জর এবং চিত্রকূট দুর্গ দু’টি অধিগ্রহণ করেন। কিন্তু চেদি রাজপরিবারের সঙ্গে রাষ্ট্রকূটদের সম্প্রীতির সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল; তৃতীয় অমোঘবর্ষ এবং যুবরাজ কৃষ্ণ উভয়েই চেদি রাজপরিবারে বিবাহ করেন। যে পরিবারের সঙ্গে তাঁর মিত্রতার সম্পর্ক সেই পরিবারের বিরুদ্ধাচরণ করে তাকে অযথা বৈরিভাবাপন্ন করবেন, কৃষ্ণ সম্পর্কে এমন ভাবনা সংগত বোধ হয় না। আসলে দক্ষিণ ভারতে কৃষ্ণের সাফল্য গুর্জররাজের মনে সমীহের উদ্রেক করে। কৃষ্ণ ছিলেন চেদিদের মিত্র। কালঞ্জর ও চিত্রকূট দুর্গ দু’টি তখন চেদিরাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। অথচ একদিন এই দু’টি দুর্গের উপর গুর্জরদেরই অধিকার ছিল। স্বভাবতই কৃষ্ণের প্রতিকূলতার ভয়ে সমকালীন গুর্জরনৃপতি দুর্গ দু’টি জয় করার বাসনা থেকে নিরস্ত হন। এই সমকালীন গুর্জর নৃপতি অবশ্যই বিনায়কপাল। ৯৩৯ খ্রিস্টাব্দের গ্রীষ্মকালে তৃতীয় অমোঘবর্ষের মৃত্যু হয়।

তৃতীয় কৃষ্ণ (আ. ৯৩৯-৬৭ খ্রিস্টাব্দ)

তৃতীয় অমোঘবর্ষের মৃত্যুর পর তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র যুবরাজ তৃতীয় কৃষ্ণ রাজপদ গ্রহণ করেন। ‘অকালবর্ষ’, ‘বল্লভনরেন্দ্র’ এবং ‘পৃথিবীবল্লভ’ অভিধায় তিনি ভূষিত হন। পরবর্তিকালে কাঞ্চীপুরম ও তঞ্জাবূর অধিকার করে তিনি ‘কচ্চিয়ুম তঞ্জাইয়ুম-কোণ্ড’ উপাধি ধারণ করেন। অসামান্য সামরিক দক্ষতার অধিকারী ছিলেন তৃতীয় কৃষ্ণ। পিতার রাজত্বকালে তিনি তাঁর সামরিক প্রতিভা প্রদর্শন করেন। রাজপদ গ্রহণ করে তিনি বহুবার তাঁর সামরিক নৈপুণ্যের স্বাক্ষর রাখেন।

পরাক্রমশালী চোলনৃপতি পরান্তকের বিরুদ্ধে বিজয়লাভ তাঁর রাজনৈতিক জীবনের এক শ্রেষ্ঠ কীর্তি। পরান্তকের বিরুদ্ধে তাঁর সংঘর্ষ ঠিক কখন শুরু হয় তা অনিশ্চিত। অনন্ত সদাশিব অলতেকর মনে করেন, সিংহাসনে আরোহণের অব্যবহিত পরই রাষ্ট্রকূটরাজ চোলরাজ্য আক্রমণ করেন। দক্ষিণ আর্কট জেলায় প্রাপ্ত রাষ্ট্রকূটনৃপতির একখানি লেখের ভিত্তিতেই তাঁর এরূপ অভিমত। তিনি মনে করেন, লেখখানি তৃতীয় কৃষ্ণের রাজত্বের পঞ্চম বৎসরে উৎকীর্ণ। কিন্তু লেখের এই তারিখের যাথার্থ্য সম্পর্কে সন্দেহের অবকাশ আছে। চোলরাজ্যে প্রাপ্ত তৃতীয় কৃষ্ণের রাজত্বের সর্বাপেক্ষা পূর্ববর্তী লেখটি তাঁর রাজত্বের পঞ্চদশ বৎসরে অর্থাৎ ৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে উৎকীর্ণ। কিন্তু পরান্তকের সঙ্গে তৃতীয় কৃষ্ণের সংঘর্ষ ৯৫৪ খ্রিস্টাব্দের বেশ কয়েক বছর পূর্বে শুরু হয়।

গঙ্গবাড়ির রাজা দ্বিতীয় বূতুগের সহায়তায় তৃতীয় কৃষ্ণ চোলরাজ্য আক্রমণ করেন। বাণ ও বৈদুম্বরাও সম্ভবত রাষ্ট্রকূট পক্ষে যোগদান করেন। ৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে উত্তর আর্কট জেলার তক্কোলমের প্রান্তরে বিবদমান রাষ্ট্রকূট ও চোল বাহিনী পরস্পরের সম্মুখীন হয়। পরান্তকের পুত্র যুবরাজ রাজাদিত্য চোল সৈন্যদলের পরিচালনভার গ্রহণ করেন। কিন্তু এই যুদ্ধে তিনি নিহত হন, তাঁর সৈন্যগণ ছত্রভঙ্গ হয়ে পলায়ন করেন। তক্কোলমের যুদ্ধে জয়লাভের ফলে উত্তর ও দক্ষিণ আর্কট, চিঙ্গলেপুট ও ভেল্লোর অঞ্চলসহ চোলরাজ্যের একটি বিস্তীর্ণ ভূখণ্ড রাষ্ট্রকূট রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। এই যুদ্ধের পর বেশ কয়েক বছর পর্যন্ত এসব অঞ্চলে কোনও চোল লেখ উৎকীর্ণ হয়নি। অথচ এই অঞ্চলে তৃতীয় কৃষ্ণের রাজত্বের পঞ্চদশ থেকে অষ্টাবিংশতি বৎসরের মধ্যে উৎকীর্ণ কয়েকখানি লেখ আবিষ্কৃত হয়েছে। এসব লেখে কৃষ্ণ নিজেকে ‘কচ্চিয়ুম-তঞ্জাইয়ুম কোণ্ড’ বা কাঞ্চীপুরম-তঞ্জাবূর-বিজেতা বলে বর্ণনা করেছেন। ভগিনীপতি বূতুগের অমূল্য সাহায্যের প্রতিদানস্বরূপ কৃষ্ণ তাঁকে বনবাসি ১২,০০০, বেলবোলা ৩০০, পুরিগেরে ৩০০, কিসুকদ ৭০ এবং বগেনদ ৭০ উপহার দানে সম্মানিত করেন।

করহাদ তাম্রশাসনে কৃষ্ণ দাবি করেছেন, চের, পাণ্ড্য ও সিংহলের রাজারা তাঁর বশ্যতা স্বীকার করেছেন, রামেশ্বরমে তিনি বিজয়স্তম্ভ স্থাপন করেছেন। অনুমিত হয়, পরান্তককে পরাজিত করে কৃষ্ণ আরও দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হন এবং চের ও পাণ্ড্য রাজাদের পরাজিত করেন। আতঙ্কিত সিংহলরাজ সশরীরে উপস্থিত হয়ে তাঁর নিকট নতিস্বীকার করেন। তাঁর নির্মিত কৃষ্ণেশ্বর এবং গণ্ডমার্তণ্ডাদিত্য মন্দির দু’টি আজও রামেশ্বরমে তৃতীয় কৃষ্ণের বিজয়বার্তা ঘোষণা করছে।

অতঃপর তৃতীয় কৃষ্ণ বেঙ্গীতে রাষ্ট্রকূট আধিপত্য বিস্তারে উদ্যোগী হন। যতদিন দ্বিতীয় ভীম রাজপদে অধিষ্ঠিত ছিলেন ততদিন তিনি বেঙ্গীর রাজনীতিতে কোনওরূপ হস্তক্ষেপ করেননি। কিন্তু ৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় ভীমের মৃত্যুর পর তাঁর দ্বাদশবর্ষীয় বালকপুত্র দ্বিতীয় অম্ম পিতার স্থলাভিষিক্ত হলে কৃষ্ণ বেঙ্গীতে স্বকৰ্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় তৎপর হন। তিনি যুদ্ধমল্লের দুই পুত্র বাদপ ও দ্বিতীয় তালপের পক্ষ সমর্থন করেন এবং সৈন্য দিয়ে তাঁদের সাহায্য করেন। কৃষ্ণের সহায়তায় বাদপ দ্বিতীয় অম্মকে সিংহাসনচ্যুত করে বেঙ্গীর রাজদণ্ড ধারণ করেন। দ্বিতীয় অম্ম স্বরাজ্য থেকে বিতাড়িত হয়ে অন্যত্র আশ্রয় গ্রহণ করেন। এরপর বেঙ্গীর রাজা হন তাঁর অনুজ দ্বিতীয় তালপ। কিন্তু তাঁকে নিহত করে দ্বিতীয় অম্ম পুনরায় বেঙ্গী অধিকার করেন। তৃতীয় কৃষ্ণ দ্বিতীয় অম্মের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা দানার্ণবের পক্ষ অবলম্বন করেন। দানার্ণব দ্বিতীয় ভীমের জ্যেষ্ঠ পুত্র ছিলেন। সিংহাসনের উপর তাঁর ন্যায্য অধিকার ছিল। কিন্তু কোনও কারণে অনুজের অনুকূলে তাঁর দাবি উপেক্ষিত হয়। তৃতীয় কৃষ্ণের সাহায্যপুষ্ট হয়ে দানার্ণব ৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে কনিষ্ঠ ভ্রাতাকে পরাজিত করে বেঙ্গীর রাজপদ অধিকার করেন। পরাজিত দ্বিতীয় অম্ম কলিঙ্গে পলায়ন করেন। দানার্ণবের সাহায্যার্থে একদল রাষ্ট্রকূট সৈন্য বেঙ্গীরাজ্যে মোতায়েন থাকে।

চোল অভিযানে যিনি কৃষ্ণের প্রধান সহায় ছিলেন সেই গঙ্গবাড়িরাজ দ্বিতীয় বূতুগ লোকান্তরিত হন। তাঁর মৃত্যুতে তদীয় পুত্র দ্বিতীয় মারসিংহ ৯৬৩ খ্রিস্টাব্দে গঙ্গবাড়ির সিংহাসনে আরোহণ করেন। এই নতুন রাজা কৃষ্ণের ভগিনী রেবকনিম্মডীর পুত্র নন, তিনি তাঁর সতীনপুত্র। কৃষ্ণ মারসিংহের রাজ্যাভিষেক অনুমোদন করেন এবং স্বয়ং সে অনুষ্ঠানে যোগদান করে গঙ্গরাজ পরিবারের সঙ্গে মৈত্রীর বন্ধন সুদৃঢ় করেন। পিতার মতো মারসিংহও কৃষ্ণের অনুগত ছিলেন।

দক্ষিণ ভারতে নিজকর্তৃত্ব সুপ্রতিষ্ঠিত করে তৃতীয় কৃষ্ণ উত্তর ভারত অভিমুখে দৃষ্টি নিক্ষেপ করেন। ৯৬৩ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় মারসিংহের অভিষেক অনুষ্ঠানের পরই তিনি উত্তর ভারত অভিযানে বহির্গত হন। হয়তো কালঞ্জর ও চিত্রকূট দুর্গ পুনরুদ্ধারের জন্য তাঁর এই উত্তর ভারত অভিযান। কিংবা হয়তো মালব পুনরধিকারের জন্যই তাঁর এই উদ্যোগ। উত্তর ভারত অভিযানে গঙ্গবাড়ির অধিপতি দ্বিতীয় মারসিংহ সদলে তৃতীয় কৃষ্ণের অনুগামী হন।

দ্বিতীয় মারসিংহ তাঁর শ্রবণবেলগোলা লেখে দাবি করেছেন, কৃষ্ণরাজের অনুকূলে উত্তর ভূখণ্ড জয় করে তিনি গুর্জরনাথরূপে পরিচিতি লাভ করেন। অনুমিত হয়, কৃষ্ণ গুর্জরদের আক্রমণ করেন। কৃষ্ণ সসৈন্যে মালবেও প্রবেশ করেন। মালব তখন পরমারনৃপতি সীয়কের অধীনস্থ। মালবের এক বিস্তীর্ণ অঞ্চল কৃষ্ণের অধিকারভুক্ত হয়।

৯৬৭ খ্রিস্টাব্দে এই সফল রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের জীবনদীপ নির্বাপিত হয়। তাঁর দুর্ভাগ্য, তাঁর জীবদ্দশায় তাঁর সব কটি পুত্র অকালে দেহত্যাগ করেন। তাঁর এক পৌত্র ইন্দ্ৰ। কিন্তু তিনি অল্পবয়স্ক। তাই রাষ্ট্রকূট সিংহাসনে বসলেন তাঁরই অনুজ খোট্টিগ।

রাষ্ট্রকূট রাজবংশের এক শ্রেষ্ঠ সন্তান তৃতীয় কৃষ্ণ। উত্তর ভারত অভিযানে তিনি হয়তো ধ্রুব, তৃতীয় গোবিন্দ বা তৃতীয় ইন্দ্রের মতো সফল হননি কিন্তু দক্ষিণ ভারতে তিনি অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করেন। রামেশ্বরমের কৃষ্ণেশ্বর ও গণ্ডমার্তণ্ডাদিত্য মন্দির দু’টি প্রমাণ করছে, দক্ষিণ ভারতের প্রত্যন্ত অঞ্চলও একদা তাঁর অধিকারভুক্ত ছিল। অন্য কোনও রাষ্ট্রকূট নৃপতি দক্ষিণ ভারতে তাঁর মতো সাফল্য লাভ করেননি। সঙ্গে সঙ্গে এ কথাও স্বীকার্য, তাঁর অনুসৃত কিছু নীতি বা কর্মধারা রাষ্ট্রকূট রাজ্যের স্বার্থের পক্ষে শুভ হয়নি। তক্কোলমের যুদ্ধে জয়লাভ করে তিনি গঙ্গরাজ বূতুগকে বিস্তীর্ণ ভূখণ্ড প্রদান করে কৃতজ্ঞতা বা মিত্রপ্রীতির পরিচয় দিয়েছেন ঠিকই কিন্তু এতে তাঁর রাজনৈতিক বিচক্ষণতার দীনতাই প্রকাশ পেয়েছে। তাঁর এই কাজে তাঁর নিজের কর্তৃত্বের পরিধি সংকুচিত হয়েছে কিন্তু অনুগত, মিত্র রাজার ক্ষমতা প্রসারিত হয়েছে। সত্যাশ্রয় পরিবারভুক্ত আহবমল্ল তৈলপকেও তিনি অনুরূপভাবে জায়গির প্রদান করেন। এই তৈলপের নিক্ষিপ্ত মৃত্যুবাণেই রাষ্ট্রকূট রাজ্যের প্রাণবায়ু নিঃশেষিত হয়।

খোট্টিগ (আ. ৯৬৭-৭২ খ্রিস্টাব্দ)

তৃতীয় কৃষ্ণের দেহাবসানের সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রকূট রাজ্যের সৌভাগ্যরবি পশ্চিমাকাশে ঢলে পড়ে। সুবিস্তীর্ণ রাজ্য পরিচালনা ও প্রতিরক্ষায় যে দক্ষতা, ব্যক্তিত্ব ও সামরিক নৈপুণ্যের প্রয়োজন তা তৃতীয় কৃষ্ণের উত্তরাধিকারীদের ছিল না। ফলে রাজ্যে অশান্তির দাবানল জ্বলে ওঠে, একটির পর একটি বৈপ্রান্তিক অভিযানের ঢেউ রাজ্যের উপর আছড়ে পড়ে। রাষ্ট্রকূট রাজ্যটির পতন আসন্ন হয়।

৯৬৭ খ্রিস্টাব্দে তৃতীয় কৃষ্ণের দেহাবসানের পর তাঁর অনুজ খোট্টিগ রাষ্ট্রকূট সিংহাসনে আরোহণ করেন। কিন্তু শীঘ্রই পরমাররাজ হর্ষ সীয়ক রাষ্ট্রকূট রাজ্য আক্রমণ করেন। সীয়ক তৃতীয় কৃষ্ণের হস্তে বিপর্যস্ত হয়েছিলেন। এবার তিনি প্রত্যাঘাত হানতে উদ্যত হন। রাষ্ট্রকুট বাহিনী সীয়কের বিরুদ্ধে নর্মদা নদীর তীরে প্রবল প্রতিরোধ রচনা করে। যুদ্ধে কঙ্কদেব নামে এক পরমার সেনাধ্যক্ষ নিহত হন। রাষ্ট্রকূটদের প্রবল চাপের মুখে নতিস্বীকার করে সীয়ক অভিযান প্রত্যাহার করেন।

প্রথম অভিযানে আশানুরূপ সাফল্য অর্জিত না হওয়ায় সীয়ক পুনর্বার রাষ্ট্রকূট রাজ্য আক্রমণ করেন। সকল প্রতিবন্ধকতা ও প্রতিরোধ অগ্রাহ্য করে তিনি নর্মদা নদী অতিক্রম করেন। সন্ত্রস্ত খোট্টিগ গঙ্গরাজ দ্বিতীয় মারসিংহের নিকট সাহায্য প্রার্থনা করেন। কিন্তু গঙ্গরাজ্য থেকে সাহায্য আসার পূর্বেই সীয়ক আনুমানিক ৯৭২ খ্রিস্টাব্দে মান্যখেট অধিকার করেন। রাজকোষাগার লুণ্ঠিত হল, রাষ্ট্রকূট রাজ্যের প্রচুর ধন-রত্ন সীয়কের হস্তগত হল।

এদিকে খোট্টিগের আবেদনে সাড়া দিয়ে মারসিংহ সসৈন্যে মান্যখেটে আগমন করেন। মারসিংহ মান্যখেট থেকে পরমারদের বিতাড়িত করেন, না ততদিনে পরমার সৈন্যগণ লুণ্ঠিত ধন রত্নসহ স্বরাজ্যে প্রস্থান করেছেন, তা স্পষ্ট নয়। সে যা হোক, মারসিংহের সহায়তায় খোট্টিগ মান্যখেটের সিংহাসনে পুনরধিষ্ঠিত হন। সীয়কের হাতে পরাজয়ের গ্লানি তাঁকে বেশিদিন সহ্য করতে হয়নি ; কয়েক মাসের মধ্যেই তিনি ভগ্নহৃদয়ে প্রাণত্যাগ করেন। তিনি অপুত্রক ছিলেন। তাঁর মৃত্যুতে তাঁর কনিষ্ঠ ভ্রাতা নিরুপমের পুত্র দ্বিতীয় কর্ক রাজপদে অভিষিক্ত হন।

দ্বিতীয় কর্ক (আ. ৯৭২-৭৩ খ্রিস্টাব্দ)

দ্বিতীয় কর্ক আনুমানিক ৯৭২ খ্রিস্টাব্দে সিংহাসনে আরোহণ করে ‘অমোঘবর্ষ’, ‘নুতনপার্থ’, ‘অহিতমার্তণ্ড’, ‘বীরনারায়ণ’, ‘নৃপতুঙ্গ’ ও ‘রাজত্রিনেত্র’ অভিধা গ্রহণ করেন। এ যেন ঝলমলে পোশাকে নিজের আর্থিক দীনতা আড়ালের ব্যর্থ প্রচেষ্টা! সমকালীন একটি লেখে তিনি ‘গুর্জরত্রাস’ এবং ‘চোল-পাণ্ড্যগর্বহরণ রূপে বর্ণিত হয়েছেন। কিন্তু এ বর্ণনা কৃতজ্ঞ রাজকবির রাজপ্রশস্তি।

অতি দুর্বল প্রকৃতির লোক ছিলেন দ্বিতীয় কর্ক। রাজ্যের অখণ্ডতা রক্ষায় যে শৌর্য ও বিচক্ষণতার প্রয়োজন তার একান্তই অভাব ছিল তাঁর চরিত্রে। উপরন্তু যে গঙ্গরাজ মারসিংহ এতদিন বিপদে-আপদে রাষ্ট্রকূটদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন, শত ঝড়-ঝঞ্ঝার হাত থেকে রাষ্ট্রকূট রাজ্যতরণীকে রক্ষা করেছেন, তিনিও তাঁর প্রতি বিরূপ ছিলেন। তৃতীয় কৃষ্ণের পৌত্র চতুর্থ ইন্দ্ৰ ছিলেন তাঁর নিজের ভাগিনেয়। এই ইন্দ্রকে বঞ্চিত করে দ্বিতীয় কর্ক রাজপদ গ্রহণ করায় মারসিংহ স্বাভাবিক কারণেই রুষ্ট হন। তাছাড়া দ্বিতীয় কর্ক নিজের দুর্বিনীত ও নীতিবিহর্গিত আচরণের জন্য রাজ্যের পদস্থ রাজপুরুষ ও প্রজাসাধারণের নিকট অপ্রিয় হন।

এ সুযোগ পূর্ণমাত্রায় গ্রহণ করলেন চালুক্য দ্বিতীয় তৈলপ। ৯৭৩ খ্রিস্টাব্দের শেষের দিকে তিনি সসৈন্যে দ্বিতীয় কর্কের বিরুদ্ধে অগ্রসর হন। সম্ভবত উত্তর কর্ণাটকের কোনও এক স্থানে উভয় পক্ষে তুমুল যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে দ্বিতীয় তৈলপ জয়লাভ করেন। দ্বিতীয় কর্ক যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পলায়ন করে কর্ণাটকের এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে আশ্রয় গ্রহণ করেন। সেখানে ৯৯১ খ্রিস্টাব্দে তিনি একটি লেখ উৎকীর্ণ করেন। তখনও কাগজে-কলমে তিনি মহারাজাধিরাজ, পরমেশ্বর ও পরমভট্টারক।

চতুর্থ ইন্দ্র (আ. ৯৭৩-৯৮২ খ্রিস্টাব্দ)

দ্বিতীয় কর্কের পরাজয়ের সঙ্গে সঙ্গেই দ্বিতীয় তৈলপের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রকূটদের প্রতিরোধের সমাপ্তি ঘটল না। গঙ্গরাজ মারসিংহ তাঁর ভাগিনেয় চতুর্থ ইন্দ্রের সমর্থনে দ্বিতীয় তৈলপের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। মাতুল ও ভাগিনেয় উভয়েই পরাজিত হন এবং পরে জৈন রীতি অনুসারে প্রায়োপবেশনে মৃত্যুবরণ করেন। মারসিংহ দেহত্যাগ করেন ৯৭৫ খ্রিস্টাব্দের আগস্ট মাসে, চতুর্থ ইন্দ্ৰ ৯৮২ খ্রিস্টাব্দের মার্চে। ৯৭৫ খ্রিস্টাব্দে মারসিংহের মৃত্যুর পর তাঁর অনুগত সামন্ত পঞ্চালদের তৈলপকে রাষ্ট্রকূট রাজ্য থেকে উচ্ছেদের একবার শেষ চেষ্টা করেন। কিন্তু তিনি পরাজিত ও নিহত হন। রাষ্ট্রকূট রাজ্য ধ্বংসস্তূপে পরিণত হল। দ্বিতীয় তৈলপের নেতৃত্বে এক নতুন রাজ্যের অভ্যুদয় ঘটল। সে রাজ্য পাশ্চাত্য চালুক্য রাজ্য

রাষ্ট্রকূট রাজধানী

রাষ্ট্রকূটরা প্রথম যখন বিদর্ভ অঞ্চলে রাজত্ব করতেন তখন প্রাচীন অচলপুর বা বর্তমান এলিচপুর সম্ভবত তাঁদের রাজধানী ছিল। অনুমিত হয়, দন্তিদুর্গ তাঁর রাজত্বের শেষের দিকে এলিচপুর থেকে এলোরা বা সন্নিকটবর্তী কোনও এক স্থানে রাজধানী স্থানান্তরিত করেন। দন্তিদুর্গের বৃহত্তম লেখটি এলোরার দশাবতার গুহাগাত্রে উৎকীর্ণ হয়েছে। তাঁর পিতৃব্য প্রথম কৃষ্ণ সুবিখ্যাত কৈলাস মন্দির নির্মাণের জন্য এলোরাকেই নির্বাচন করেছিলেন। আরও পরবর্তিকালে প্রথম অমোঘবর্ষ মান্যখেট শহরটি প্রতিষ্ঠা করে তথায় রাজধানী স্থাপন করেন। কর্ণাটকের গুলবর্গা জেলার বর্তমান মালখেড়ই প্রাচীন মান্যখেট।

প্রশাসন-ব্যবস্থা 

রাজপুরুষগণ

  • রাজা : রাষ্ট্রকূট রাজ্য ছিল রাজতান্ত্রিক। প্রশাসনের শীর্ষদেশে রাজার অবস্থান। পরমভট্টারক, মহারাজাধিরাজ, পরমেশ্বর ইত্যাদি জাঁকজমকপূর্ণ উপাধিতে তিনি ভূষিত। তিনি নিজেকে পরমপূজ্য ও পরম বা মহান দেবতারূপে উপস্থাপিত করেছেন। প্রজাসাধারণ ও সামন্ত বর্গের আনুগত্য লাভের উদ্দেশ্যে তাঁর দেবত্বের দাবি। তিনি শুধু রাজ্যের সর্বোচ্চ প্রশাসকই নন, নীতিগতভাবে রাজ্যের প্রধান বিচারপতি ও সৈন্যবাহিনীর সর্বাধিনায়কও বটে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে রাজা সীমিত কর্তৃত্বের অধিকারী ছিলেন। প্রত্যক্ষ শাসনভুক্ত অঞ্চলে নিঃসন্দেহে তাঁর অধিকতর ক্ষমতা ছিল কিন্তু তিনি ব্যক্তিত্বসম্পন্ন, উদ্যোগী ও বিচক্ষণ না হলে সেখানেও শক্তিশালী ও ক্ষমতালিপ্স আমলাতন্ত্র স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠত। খুব কম রাজাদেরই সেই ব্যক্তিত্ব, উদ্যম ও বিচক্ষণতা ছিল। তাছাড়া রাজ্যের একটি বিস্তীর্ণ অঞ্চল ছিল সামন্ত, মহাসামন্ত ও আঞ্চলিক, মিত্র রাজাদের অধীনস্থ। সামরিক শক্তির অধিকারী এসব পদাধিকারীরা স্বশাসিত অঞ্চলে স্বাধীন নরপতির ন্যায় আচরণ করতেন। দিগ্বিজয়ে বা শত্রুরাজার আক্রমণ মোকাবিলায় রাজা প্রায়ই শক্তিশালী সামন্তবর্গের দ্বারস্থ হতেন। সামন্তবর্গের উপর নির্ভরতা রাজশক্তিকে সুনিশ্চিতরূপে দুর্বল করেছিল।
  • রাজপুত্র ও যুবরাজ : রাজপদ ছিল পুরুষানুক্রমিক। রাজার মৃত্যু হলে সাধারণত তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্রই রাজপদ লাভ করতেন। কখনও কখনও এই রীতি লঙ্ঘিত হত। ধ্রুবের মৃত্যুর পর তৃতীয় গোবিন্দ সিংহাসনে আরোহণ করেন। তিনি পিতার জ্যেষ্ঠ পুত্র ছিলেন না। জ্যেষ্ঠ রাজকুমার বা পিতার ইচ্ছাক্রমে অন্য কোনও রাজপুত্র বয়ঃপ্রাপ্ত হলে যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত হতেন। যুবরাজ সাধারণত রাজধানীতে অবস্থান করতেন এবং পিতাকে প্রশাসনিক কাজকর্মে সাহায্য করতেন। তিনি যুদ্ধে পিতার অনুগমন করতেন, কখনওবা সৈন্যপরিচালনার দায়িত্বভার গ্রহণ করতেন। কনিষ্ঠ রাজকুমারেরা সাধারণত প্রাদেশিক শাসনকর্তার পদে নিযুক্ত হতেন। রাজকন্যারা শাসনকার্যে অংশগ্রহণ করেছেন, এমন ঘটনা এ পর্বে বিরল। সমকালীন লেখে এরূপ একটি ঘটনার উল্লেখ আছে। প্রথম অমোঘবর্ষের এক কন্যা চন্দ্রোবলব্বা। ৮৩৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি রায়চুর দোয়াবের প্রশাসিকার পদ অলংকৃত করেন।
  • রাণী : রাজা নাবালক হলে রাজপরিবারের এক গুরুস্থানীয় ব্যক্তি তাঁর অভিভাবকের দায়িত্ব গ্রহণ করতেন; কোনও রাষ্ট্রকূট মহিষী কখনও এই ভূমিকায় অবতীর্ণ হননি। রানিরা ভূমিদান, মন্দির নির্মাণ ইত্যাদি বিভিন্ন দাতব্য কার্যে অংশগ্রহণ করেছেন। ধ্রুবের মহিষী শীলমহাদেবীর নাম এ প্রসঙ্গে উল্লেখের দাবি রাখে।
  • মন্ত্রী  : রাজা নিছক যুবরাজের সহযোগিতায় রাজকার্য সম্পাদন করতে পারেন না, তাঁকে অভিজ্ঞ মন্ত্রীদের সাহায্য ও পরামর্শ গ্রহণ করতে হয়। আশ্চর্যের বিষয়, রাষ্ট্রকূট লেখে সান্ধিবিগ্রহিক ছাড়া অন্য কোনও মন্ত্রীর উল্লেখ নেই। তৃতীয় কৃষ্ণের রাজত্বকালে রচিত সোমদেবসূরির যশস্তিলক চম্পু কাব্যে অবশ্য বিভিন্ন মন্ত্রীদের উল্লেখ আছে, মন্ত্রীদের দুর্নীতি ও পদচ্যুতির কথাও আছে। রাষ্ট্রকূট রাজ্যে প্রধানমন্ত্রীর পদ ছিল, অনন্ত সদাশিব অলতেকর এরূপ অভিমত ব্যক্ত করেছেন। রাষ্ট্রকূট লেখমালায় সেরূপ কোনও তথ্য নেই।

প্রশাসনিক বিভাগ

  • প্রদেশ : রাজার প্রত্যক্ষ শাসনাধীন অঞ্চল কয়েকটি প্রদেশে বিভক্ত ছিল। এই প্রদেশগুলিকে রাষ্ট্র বলা হত। রাষ্ট্রপাল বা রাষ্ট্রপতিদের সিংহভাগই ছিলেন রাজপরিবারের সদস্য, কেউবা ছিলেন দক্ষ সেনানায়ক। প্রাদেশিক শাসনকর্তারা যথেষ্ট ক্ষমতাবান ছিলেন। তাঁদের নিজস্ব সৈন্যবাহিনী ছিল। রাষ্ট্রকূট লেখে রাষ্ট্রমহত্তরদের উল্লেখ আছে। রাষ্ট্রপতিরা হয়তো প্রয়োজনবোধে রাষ্ট্র মহত্তরদের পরামর্শ গ্রহণ করতেন।
  • বিষয় বা জেলা : এক একটি রাষ্ট্র কয়েকটি বিষয় বা জেলায় বিভক্ত ছিল। লেখমালার সাক্ষ্যে অনুমিত হয়, এক একটি বিষয়ে ১ হাজার থেকে ৪ হাজার গ্রাম অন্তর্ভুক্ত ছিল। পুণক বিষয়ের গ্রামের সংখ্যা ছিল ১ হাজার। পক্ষান্তরে করহাটক-বিষয় ৪ হাজার গ্রাম নিয়ে গঠিত ছিল। বিষয়ের প্রধান যিনি তিনি বিষয়পতি। বিষয়পতি পরিস্থিতি অনুসারে বিষয়-মহত্তরদের সাহায্য গ্রহণ করতেন।
  • ভুক্তি : প্রতিটি বিষয় আবার কয়েকটি ভুক্তিতে বিভক্ত ছিল। ৫০ থেকে ৭০টি গ্রাম নিয়ে এক একটি ভুক্তি গঠিত হত। ভুক্তির শাসনকর্তা ভোগপতি বা ভোগিক। ভুক্তিরও উপবিভাগ ছিল। ১০ থেকে ২০টি গ্রাম নিয়ে এক একটি উপবিভাগ গঠিত হত।
  • গ্রাম ও মহাজনদের ভূমিকা : সর্বনিম্ন প্রশাসনিক বিভাগ গ্রাম। মহারাষ্ট্রে গ্রামপ্রধানেরা গ্রামকূট নামে পরিচিত ছিলেন। কর্ণাটকে তাঁদের গাবুণ্ড বলা হত। রাষ্ট্রকূট লেখে গ্রামপতিরও উল্লেখ আছে। গ্রামপতি ও গ্রাম কূটক সমার্থক নয়। গ্রামভোক্তা, এই অর্থে গ্রামপতি। আর গ্রামকূট তো গ্রামমুখ্য বা গ্রামপ্রধান। গ্রামের শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা এবং গ্রাম থেকে আহৃত রাজস্ব সরকারি কোষাগার বা কোষ্ঠাগারে পাঠানোর দায়িত্ব ছিল তাঁর। প্রতিটি গ্রামে গ্রামপ্রধানের পরিচালনাধীন একটি রক্ষী বাহিনী ছিল। গ্রামপ্রধান নিষ্কর জমি ভোগ করতেন আর গ্রামবাসীদের রাজাকে দ্রব্যে প্রদেয় রাজস্বের একটি নির্দিষ্ট ভাগ গ্রহণ করতেন। গ্রামের প্রশাসন ও উন্নয়নে মহাজনদের এক বড় রকমের ভূমিকা ছিল। মহাজন বলতে কেবল পরিবারপ্রধানদেরই বোঝাত না, গ্রামের সকল বয়স্ক ব্যক্তিই মহাজনরূপে পরিচিত ছিলেন। মহাজনেরা তাঁদের কাজকর্ম সুসম্পাদনের উদ্দেশ্যে নিজেদের মধ্য থেকে সদস্য নিয়ে বিভিন্ন সমিতি গঠন করতেন। সাধারণত এক একটি সমিতি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন, কৃপ-পুষ্করিণী খনন, মন্দির নির্মাণ এবং রাস্তাঘাট নির্মাণ ও সংরক্ষণের মতো এক একটি কাজের দায়িত্ব গ্রহণ করত। সমিতির সদস্যরা গ্রামপ্রধানের সহযোগিতায় কাজকর্ম সম্পন্ন করতেন। এসব জনকল্যাণমুখী কাজকর্মে যে অর্থ বা সামর্থ্যের প্রয়োজন হত তা অনেক সময় মহাজনেরা নিজেরাই বহন করতেন ; কখনও কখনও গ্রামরাজস্বের একটি অংশ সেসব কাজে ব্যয় করা হত। গ্রামবাসীদের মধ্যে ছোটখাটো বিরোধ দেখা দিলে মহাজনেরা তার নিষ্পত্তি করতেন।

সমাজ-জীবন

বর্ণ ও সামাজিক শ্রেণী

রাষ্ট্রকূট রাজ্যে বহুজাতিক সমাজ গড়ে উঠেছিল। একদিকে ব্রাহ্মণ্য থেকে ইসলাম, অপরদিকে ব্রাহ্মণ থেকে হরিজন ইত্যাদি বিভিন্ন ধর্ম ও জাতির লোক নিয়ে এই বহু জাতিক সমাজ গঠিত ছিল –

  • ব্রাহ্মণ : সমাজে সর্বাগ্রে ছিল ব্রাহ্মণদের স্থান। যজন, যাজন এবং অধ্যাপনা ছিল তাঁদের প্রধান জীবিকা। কোনও কোনও ব্রাহ্মণ সাহিত্য রচনা ও জ্যোতিষশাস্ত্র চর্চা করতেন, কেউবা রাজকার্যে অংশগ্রহণ করতেন। সমকালীন স্মৃতিগ্রন্থাদিতে বলা হয়েছে, অবস্থার বিপাকে ব্রাহ্মণেরা কৃষি ও বাণিজ্য জীবিকারূপে গ্রহণ করতে পারেন। এ সময় বেঙ্গী, গুজরাত, পাটলিপুত্র, পুণ্ড্রবর্ধন বা উত্তর বঙ্গ প্রভৃতি ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল বা স্থান থেকে বহু ব্রাহ্মণ পরিবার রাষ্ট্রকূট রাজ্যে বসতি স্থাপন করেন। সরকারের পক্ষ থেকে এসব উচ্চশিক্ষিত পরিবারের অনুকূলে দরাজহস্তে জমি প্রদত্ত হয়। নবাগত ব্রাহ্মণ পরিবার ছাড়া রাজ্যে বসবাসকারী যেসব ব্রাহ্মণ যাগ-যজ্ঞ ও ধর্মীয় আচারে পারদর্শী ছিলেন বা বিদ্যানুশীলন ও অধ্যাপনাকার্যে দক্ষতা অর্জন করেছিলেন, তাঁদের অনেককেই ভূসম্পত্তিদানে সম্মানিত করা হত। গ্রহীতা ব্রাহ্মণদের সাধারণত রাজস্ব দিতে হত না। সম্ভবত বিদ্বান ব্রাহ্মণদেরও রাজস্বের ভার বহন করতে হত না, রাজস্ব দিতে হত সাধারণ ব্রাহ্মণদের। রাজ্যে জরুরি পরিস্থিতির উদ্ভব হলে রাজা ব্রাহ্মণ ও দেবতার সম্পত্তির কিয়দংশ অধিগ্রহণ করবেন, সোমদেবসূরি এরূপ বিধান দিয়েছেন। ব্রাহ্মণদের শত অপরাধ সত্ত্বেও সম্ভবত মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হত না কিন্তু অপরাধের গুরুত্ব অনুসারে তাঁদের নির্বাসনে পাঠানো হত ও সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হত। আল বেরুনি বলেন, কোনও দুর্মূল্য দ্রব্য অপহরণের দায়ে দোষী সাব্যস্ত হলে ব্রাহ্মণদের দৃষ্টিশক্তি হরণ করা হত, তাঁদের দক্ষিণ হস্ত ও বাম পদ ছেদন করা হত। আল বেরুনির এই মন্তব্য কতদূর সত্য বলা কঠিন।
  • ক্ষত্রিয় : সমাজে ব্রাহ্মণদের ঠিক নিচেই ক্ষত্রিয়দের অবস্থান। যুদ্ধোপজীবী ছিলেন তাঁরা। কোনও কোনও ক্ষত্রিয় চাষ-আবাদের কাজে জীবিকা নির্বাহ করতেন। লেখমালায় ব্রাহ্মণদের গোত্র ও প্রবরের উল্লেখ আছে কিন্তু ক্ষত্রিয়দের গোত্র-প্রবরের উল্লেখ নেই। বৈদিক যাগ-যজ্ঞের অনুষ্ঠানে যজমানের গোত্র-প্রবরের উল্লেখ বাধ্যতামূলক কিন্তু পৌরাণিক ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানে তা নয়। হয়তো ক্ষত্রিয়সমাজে বৈদিক ধর্ম অপেক্ষা পৌরাণিক আচার-অনুষ্ঠান অধিক সমাদৃত ছিল।
  • বৈশ্য : কৃষি ও বাণিজ্য বৈশ্যদের উপজীবিকা ছিল। রাষ্ট্রকূট লেখে বৈশ্য মহাজনদের উল্লেখ আছে। তৃতীয় কৃষ্ণের একটি লেখ থেকে জানা যায়, রাজস্থানের ভিনমাল শহরবাসী একদল বৈশ্য রাষ্ট্রকূট নগর সঞ্জানে বসতি স্থাপন করেন। বেদাধ্যয়নে বৈশ্যদের অধিকার ছিল না।
  • শূদ্র : বেদপাঠে শূদ্রদেরও অধিকার ছিল না। কিন্তু বৈশ্যদের মতো তাঁরাও পৌরাণিক আচার অনুষ্ঠানের অধিকারী ছিলেন। তাঁদের মধ্যে অনেকেই সৈন্যবাহিনীতে যোগ দেন। কোনও কোনও শূদ্র সেনানায়কের পদে উন্নীত হন, কেউবা আঞ্চলিক রাজার মর্যাদা লাভ করেন।
  • অন্যান্য জাতি : এছাড়া সমাজে তন্তুবায়, বংশকার, ধীবর, রজক, ঝাড়ুদার, চণ্ডাল, নিষাদ প্রভৃতি বিভিন্ন জাতির লোক ছিলেন। গ্রাম বা শহরের উপকণ্ঠে ছিল তাঁদের বাস। হাড়ি, ডোম, ঝাড়ুদার ও চণ্ডালেরা ছিলেন সকলের নীচে। তাঁরা ছিলেন অস্পৃশ্য।
  • মুসলিম : বেশ কিছু সংখ্যক ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের বাস ছিল রাষ্ট্রকুট রাজ্যে। তাঁদের অনেকেই ছিলেন ব্যবসায়ী। সমকালীন মুসলমান পর্যটক সুলেমান (৮৫১ খ্রিস্টাব্দ) ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের প্রতি রাষ্ট্রকূট রাজাদের সদয় ব্যবহারের প্রশংসা করেছেন। তৃতীয় ইন্দ্রের ‘চিঞ্চিনি তাম্রশাসনে’ এক বিষয়-প্রশাসকের উল্লেখ আছে। তিনি আরবদেশীয় মুসলমান ছিলেন। (চিঞ্চিনি তাম্রশাসনে উল্লিখিত এই ‘তাজীক’ প্রশাসকের নাম মধুমতি-সুগতিপ। আরবি শব্দ মোহাম্মদের সংস্কৃত রূপান্তর মধুমতি। এই প্রশাসক স্থানীয় অঞ্চলে একটি ব্রাহ্মণ্য মন্দির নির্মাণে সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করেন। মন্দিরের সঙ্গে একটি দাতব্য ভোজনাগারও স্থাপিত হয়।) অনুমিত হয়, রাষ্ট্রকূট রাজারা মুসলমানদের ধর্মীয় অধিকার ও সুবিচারের স্বার্থে কাজি নিয়োগ করতেন।

বিবাহ ও নারী

  • বিবাহের ধরণ : সাধারণত পিতা বা অভিভাবকের তত্ত্বাবধানেই পুত্র-কন্যাদের বিবাহ অনুষ্ঠিত হত। সমকালীন কাব্য মহাপুরাণ ও লেখে রাক্ষস বিবাহের উল্লেখ আছে। দন্তিদুর্গের পিতা প্রথম ইন্দ্র চালুক্য রাজকুমারী ভবনাগাকে রাক্ষসমতে বিবাহ করেন। মহাপুরাণে স্বয়ংবর বিবাহেরও কথা আছে। স্বয়ংবর বিবাহে কন্যা কখনও কখনও আমন্ত্রিত ব্যক্তিদের মধ্য থেকে বিশেষ কোনও একজনকে স্বেচ্ছায় পতিরূপে বরণ করতেন। কখনও কখনও কন্যা বা অভিভাবকের সম্মতিক্রমে স্বয়ংবর সভায় বিশেষ এক প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হত। এই প্রতিযোগিতায় যিনি জয়ী হতেন, কন্যা তাঁকেই পতিরূপে নির্বাচন করতেন।
  • সবর্ণ ও অসবর্ণ বিবাহ : সবর্ণ বিবাহই বাঞ্ছনীয় ছিল। অসবর্ণ বিবাহও অনুষ্ঠিত হত। অসবর্ণ বিবাহ ছিল দু’প্রকারের, অনুলোম ও প্রতিলোম। আল বেরুনি সমকালীন ভারতে অনুলোম বিবাহের উল্লেখ করেছেন। উচ্চ বর্ণ বা জাতিভুক্ত পাত্রের সঙ্গে নিম্নতর বর্ণ বা জাতির পাত্রীর বিবাহই অনুলোম বিবাহ। এ যুগে প্রতিলোম বিবাহ প্রায় ছিল না বললেই চলে। নিম্ন বর্ণ বা জাতির পাত্রের সঙ্গে উচ্চতর বর্ণ বা জাতির পাত্রীর পরিণয় প্রতিলোম বিবাহ। এ ধরনের বিবাহ ভারতে নিষিদ্ধ ছিল বলে আল বেরুনি মন্তব্য করেছেন।
  • বাল্যবিবাহ : বাল্যবিবাহের বহুল প্রচলন ছিল। সাধারণত ১২ বছরের পূর্বেই মেয়েদের বিবাহ হত; ছেলেদের বিবাহ হত ১৬ বছরের পূর্বে। স্বামীরা সাধারণত ১ থেকে ৪ জন পত্নী গ্রহণ করতেন।
  • বিধবাবিবাহ : উচ্চবিত্ত সমাজে বিধবাদের পুনর্বিবাহ প্রচলিত ছিল না। সতীপ্রথা দক্ষিণ ভারতে জনপ্রিয় ছিল না। কোনও রানি স্বামীর প্রজ্বলিত চিতায় আত্মাহুতি দিয়েছেন, সমকালীন দক্ষিণ ভারতে এরূপ ঘটনা অশ্রুতপূর্ব। তবে নিঃসন্তান রমণী স্বেচ্ছায় সহমরণ বরণ করেছেন, এরূপ দুই একটি ঘটনার উল্লেখ আছে সমকালীন সাহিত্যে।
  • মৃত স্বামীর সম্পত্তিতে অধিকার : মৃত স্বামীর সম্পত্তিতে স্ত্রীর অধিকার ছিল।
  • পর্দাপ্রথা : সমাজে পর্দাপ্রথার প্রচলন ছিল না।

বিদ্যাচর্চা

রাষ্ট্রকূট রাজ্যে জ্ঞানের বিভিন্ন শাখার চর্চা হত। মহাপুরাণে বেদ, ব্যাকরণ, জ্যোতিষ, সাহিত্য, মীমাংসা, ধর্মশাস্ত্র, পুরাণ, ন্যায়, তন্ত্র, চিত্রাঙ্কন, দারুশিল্প, ভাস্কর্য, সংগীত, নাটক ও অস্ত্রানুশীলনের উল্লেখ আছে। মহিলাদের হস্তলিপি, গণিত, কাব্য, ভাষাবিজ্ঞান, যন্ত্রসংগীত ইত্যাদি বিষয়ের অনুশীলনের কথাও আছে এই কাব্যে। রাষ্ট্রকূট লেখমালায় বেদ, বেদাঙ্গ, ইতিহাস, পুরাণ, ব্যাকরণ, মীমাংসা, ন্যায়, নিরুক্ত প্রভৃতি শাস্ত্রে পারঙ্গম বহু ব্রাহ্মণের উল্লেখ আছে। সাধারণত মঠ, অগ্রহার গ্রাম ও ঘটিকাগুলিতে উচ্চশিক্ষার চর্চা হত। শুধু রাজা-মহারাজেরা নন, সাধারণ ব্যক্তিরাও এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অনুকূলে অকাতরে দান করতেন।

অর্থনৈতিক জীবন

কৃষি

কৃষিকার্যই ছিল লোকদের জীবিকার প্রধান উৎস। গত হাজার বছরে দক্ষিণ ভারতের জলবায়ুর বিশেষ কিছু পরিবর্তন হয়নি। সহজেই অনুমিত হয়, বর্তমানকালে এই অঞ্চলে যেসব ফসল উৎপন্ন হয় রাষ্ট্রকূটপর্বেও তার উৎপাদন অব্যাহত ছিল। কৃষিজাত দ্রব্যসমূহ –

  • কার্পাস : খ্রিস্টীয় ১৩শ শতকে মার্কো পোলো এবং আরও চার শতক পর টাভার্নিয়ের এ অঞ্চলে উৎপন্ন কার্পাসসুতো ও কার্পাসবস্ত্রের উল্লেখ করেছেন। খ্রিস্টীয় ১ম শতকে রচিত ‘পেরিপ্লাস’ গ্রন্থেও এতদঞ্চলের কার্পাসশিল্পের উল্লেখ আছে। নিঃসঙ্কোচে বলা যায়, এ সময় দক্ষিণ ভারতে, বিশেষত গুজরাত ও বিদর্ভে প্রচুর পরিমাণ কার্পাস উৎপন্ন হত।
  • নীল : খ্রিস্টীয় ১৩শ ও ১৭শ শতকে গুজরাত ও থানা থেকে বহির্দেশে নীল রপ্তানির উল্লেখ আছে। মনে হয়, রাষ্ট্রকূট রাজ্যে নীলের চাষ হত। কোঙ্কণ উপকূলে ধান, বার্লি, যব, নারকেল ও সুপারি জন্মাত।
  • কাঠ : কর্ণাটকে উৎপন্ন হত চন্দন, সেগুন ও মেহগনি।
  • ইক্ষু, তৈলবীজ, কমলালেবু, লেবু, আম : আরব পর্যটকদের বৃত্তান্তে ভারতে ইক্ষু, তৈলবীজ, কমলালেবু ও লেবু উৎপাদনের উল্লেখ আছে। আরব পর্যটকেরা প্রায় সকলেই পশ্চিম ভারতীয় উপকূল পরিদর্শন করেন। ভারতে সুমিষ্ট আমের উৎপাদন ও আরবের বাজারে তার বিপুল চাহিদার কথাও বলেছেন তাঁরা।
  • জোয়ার, বাজরা, মধু : রাষ্ট্রকূট রাজ্যে জোয়ার, বাজরা এবং মধুও উৎপন্ন হত।

নর্মদা, তাপ্তী, গোদাবরী, কৃষ্ণা, তুঙ্গভদ্রা এবং তাদের অসংখ্য শাখা-প্রশাখা প্রবাহিত এই অঞ্চল স্বভাবতই কৃষিকার্যের অনুকূল ছিল। কিন্তু কৃষির খেতে ফলনের জন্য শুধু নদীর জলের উপরই নির্ভর করা হত না; সমকালীন লেখে কূপ, পুষ্করিণী ও খাল খনন ও সংস্কারের সুপ্রচুর উল্লেখ আছে। গ্রামবাসীরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে দীর্ঘ পুষ্করিণীর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন, বিবাহ, উপনয়ন ও প্রায়শ্চিত্ত অনুষ্ঠানে নিজেদের মধ্য থেকে নির্দিষ্ট হারে সামগ্রী বা অর্থ সংগ্রহ করে পুষ্করিণীর রক্ষণাবেক্ষণের ব্যয়ভার বহন করেছেন, এরূপ ঘটনার উল্লেখ রাষ্ট্রকূট লেখমালায় বিরল নয়।

জমি ছিল ব্যক্তিগত মালিকানাধীন। রাষ্ট্রকূট লেখে জমি ক্রয়-বিক্রয়ের প্রসঙ্গ বার বার উত্থাপিত হয়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত বা রাজকীয় জমিও ছিল। বনাঞ্চল, পতিত জমি ও খনি ছিল রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন। উর্বরতা বৃদ্ধির জন্য জমিকে কখনও কখনও দীর্ঘ মেয়াদে অকর্ষিত রাখা হত। কখনওবা সমুদ্রতীরবর্তী ভূমিতে উঁচু বাঁধ তুলে ফসল ফলানো হত।

কারিগরি শিল্প ও খনিজ দ্রব্য

  • সুতিবস্ত্র : সুচারু ও অতিসূক্ষ্ম সুতিবস্ত্র তৈরি হত রাষ্ট্রকূটরাজ্যে।  প্রতিষ্ঠান এবং টগর সুতিবস্ত্রের প্রধান কেন্দ্র ছিল।
  • চর্মশিল্প, রজ্জু ও নৌশিল্প : চর্মশিল্পেরও বিপুল চাহিদা ছিল। নারকেলের ছোবড়া দিয়ে রজ্জু তৈরি হত। ভারতের পশ্চিম উপকূলে কয়েকটি নৌশিল্পকেন্দ্র গড়ে উঠেছিল।
  • সোনা : রাষ্ট্রকূটরাজ্য খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ ছিল। কর্ণাটকের কোলার ও অন্ধ্রপ্রদেশের অনন্তপুর জেলার রামগিরিতে সোনার খনি ছিল।
  • হীরা : অন্ধ্রপ্রদেশের হীরার সর্বভারতীয় খ্যাতি ছিল।
  • লোহা ও তামা : কুড্ডাপা, কুর্মুল, বেল্লারি, চান্দা, আহম্মদনগর, বিজাপুর ও ধারবাড় অঞ্চলে লোহা ও তামা পাওয়া যেত।
  • পাথর ও প্রস্তরশিল্প : গোলকোণ্ডা ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চল ছিল কার্নেলিয়ন, এ্যাগেট, ক্যালসেদনি, জ্যাসপারের মতো পাথরের উৎসভূমি। পুঁতি ও অলংকাররূপে দামি পাথর ব্যবহৃত হত। সমকালীন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন সে যুগের ধাতু ও প্রস্তরশিল্পের উন্নতির স্বাক্ষর বহন করছে। স্থাপত্য ও ভাস্কর্যের কাজেও প্রস্তরের বহুল প্রয়োগ ছিল।
  • ধাতুশিল্প : ধাতু দিয়ে কৃষির যন্ত্রপাতি, যুদ্ধাস্ত্র ও গৃহস্থালির নানা উপকরণ তৈরি হত।

বণিক ও বাণিজ্য

এ পর্বের লেখে শ্রেষ্ঠীদের ব্রাহ্মণ ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্যে জমি ও অর্থদানের প্রসঙ্গ বারবার উত্থাপিত হয়েছে। শ্রেষ্ঠী-শ্রেণী বা বণিক সংগঠনের কথাও বলা হয়েছে। ধনাঢ্য ব্যক্তিরা বণিক সংগঠনে স্থায়িভাবে টাকা জমা রাখতেন। গচ্ছিত অর্থ থেকে বার্ষিক শতকরা ১২ টাকা হারে সুদ পাওয়া যেত। পূর্ব শর্ত মতো সুদের টাকা থেকে বিশেষ বিশেষ প্রতিষ্ঠানকে নির্দিষ্ট পরিমাণে সাহায্য করা হত।

বণিকেরা বলদ এবং গাধার পিঠে পণ্যসম্ভার চাপিয়ে স্থান স্থানান্তরে যাতায়াত করতেন। রাষ্ট্রকূট রাজ্যের বিভিন্ন শহর বাণিজ্যিক পথে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের সঙ্গে সংযুক্ত ছিল। কুবলয়মালাকহায় রাষ্ট্রকূট রাজ্যের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নিম্নোক্ত অন্তর্বাণিজ্যিক পথের উল্লেখ আছে :

  • ক. অযোধ্যা—বিজয়পুরী পথ। বিজয়পুরী বর্তমান রত্নগিরি জেলার বিজয়দুর্গ ;
  • খ. উজ্জয়িনী—নর্মদা পথ ; গ. বারাণসী নর্মদা পথ ;
  • ঘ. তক্ষশিলা—সোপারা পথ ;
  • ঙ. বিন্ধ্যাবাস—ভরুকচ্ছ পথ ;
  • চ. বিন্ধ্যাটবী—নর্মদা পথ ;
  • ছ. দেব-অটবী—ভরুকচ্ছ পথ।

আল বেরুনির ভারত-বৃত্তান্তেও কয়েকটি প্রাসঙ্গিক বাণিজ্যিক পথের উল্লেখ আছে। পথগুলি নিম্নরূপ :

  • ক. কান্যকুব্জ—বনবাসি পথ ;
  • খ. ধর—গোদাবরী পথ ;
  • গ. ধর— থানা পথ ;
  • ঘ. বাজানা— সোমনাথ পথ ;
  • ঙ. অনহিলবাড়—থানা পথ।

এ সময় সোপারা, কল্যাণ, নবসারী, থানা ইত্যাদি পশ্চিম উপকূলে অবস্থিত বন্দরগুলি বহির্বাণিজ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে। এসব বন্দরে আরব বণিকদের বসতিও গড়ে ওঠে। বন্দররূপে সোপারার গুরুত্ব উদ্যোতনসূরির লেখা কুবলয়মালাকহা কাব্যেও স্বীকৃতি পেয়েছে। এই কাব্যে বলা হয়েছে, সোপারা বন্দরের সঙ্গে সমুদ্রপথে বব্বরকুল, সুবর্ণদ্বীপ, চিন, মহাচিন, মহিলারাজ্য ও রত্নদ্বীপের সংযোগ ছিল। দক্ষিণ ভারত থেকে বহির্দেশে চন্দন, সেগুন, মেহগনি, বাঁশ, বনৌষধি, সুগন্ধি, সূক্ষ্ম সুতিবস্ত্র, হীরা প্রভৃতি দ্রব্য রপ্তানি হত। খ্রিস্টীয় ১৩শ শতকে থানা ও ভারোচ থেকে আরব ও পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলে চর্মজাত দ্রব্যের রপ্তানির কথা বলেছেন ইতালীয় পর্যটক মার্কো পোলো। এ সময় পশ্চিম এশিয়া থেকে দক্ষিণ ভারতীয় রাজ্যসমূহে কাঁচ, রুপা, তামা, টিন, খেজুর, ক্রীতদাস-ক্রীতদাসী, অশ্ব ইত্যাদি জিনিস আমদানি হত।

মুদ্রাব্যবস্থা

জিনিসপত্রের ক্রয়-বিক্রয়ে দ্রব্যবিনিময় ব্যবস্থা কার্যকরী ছিল। তবে মুদ্রারও প্রচলন ছিল। রাষ্ট্রকূট লেখমালায় দ্রম্ম, কাঞ্চন-দ্রম্ম, সুবর্ণ, গদ্যাণ, কাশু প্রভৃতি বিভিন্ন শ্রেণির মুদ্রার উল্লেখ আছে। রাষ্ট্রকূট লেখে দ্রম্ম ও কাঞ্চন-দ্রন্মের উল্লেখ থেকে মনে হয়, রৌপ্য ও স্বর্ণ উভয় ধরনের দ্রম্মই রাষ্ট্রকূট রাজ্যে প্রচলিত ছিল। সাধারণত এক একটি দ্রম্মের ওজন ছিল ৬৫ গ্রেন। গদ্যাণও এক ধরনের স্বর্ণমুদ্রা। এক একটি গদ্যাণের ওজন ৯৬ গ্রেন। সুবর্ণ বলতে স্বর্ণমুদ্রা বোঝায়। কাশুও এক ধরনের স্বর্ণমুদ্রা। (দীনেশচন্দ্র সরকার (Studies In Indian Coins (Delhi, 1968), পৃষ্ঠা ১৭) কাশুকে এক শ্রেণির তাম্রমুদ্রারূপে চিহ্নিত করেছেন।) লেখ থেকে জানা যায়, ২০টি কাশু ৭টি কলঞ্জুর সমতুল্য ছিল। এক একটি কাশুর ওজন কিঞ্চিদধিক ১৬ গ্রেন। অনুমিত হয়, কলঞ্জু কোনও মুদ্রার নাম নয়, মূল্য বা ওজনের একক। এক একটি কলঞ্জু বিচির ওজন সম্পর্কে বিদ্বজ্জনেরা সহমত নন। ওয়াল্টার ইলিয়ট, আলেকজান্ডার কানিংহাম ও দীনেশচন্দ্র সরকার একটি কলঞ্জুর ওজন যথাক্রমে ৪৮, ৫৭.৩৬ এবং ৭৩.২ গ্রেনে ধার্য করেছেন। (তদেব, পৃষ্ঠা ৩)। দীনেশচন্দ্র সরকার মনে করেন, ১ কলঞ্জ ওজনের স্বর্ণ বা রৌপ্যমুদ্রাও কলঞ্জু নামে অভিহিত হত। এ অভিমত বিতর্কিত।

রাষ্ট্রকূট রাজারা নিশ্চিতরূপে উৎকীর্ণ করেছেন এরূপ কোনও স্বর্ণ, রৌপ্য বা তাম্রমুদ্রার সন্ধান আজও পাওয়া যায়নি। মহারাষ্ট্রের নাসিক ও অন্যান্য কয়েকটি স্থানে কৃষ্ণরাজের নামাঙ্কিত কতিপয় রৌপ্যমুদ্রা আবিষ্কৃত হয়েছে। কেউ কেউ এই কৃষ্ণরাজকে রাষ্ট্রকূট বংশীয় প্রথম কৃষ্ণরূপে শনাক্ত করেছেন। কিন্তু বেশির ভাগ পণ্ডিতের অভিমত, কলচুরিনৃপতি কৃষ্ণরাজ এই মুদ্রাগুলি খ্রিস্টীয় ৬ষ্ঠ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে উৎকীর্ণ করেন। মালখেড়ের সন্নিকটবর্তী এক গ্রামে ৪টি তাম্রমুদ্রার সন্ধান পাওয়া গেছে। মুদ্রাগুলি দ্বিতীয় কর্ক উৎকীর্ণ করেছেন বলে দিনকর রাও অভিমত ব্যক্ত করেছেন। দীনেশচন্দ্র সরকার মুদ্রাগুলিকে কাকতীয় রাজা প্রথম বা দ্বিতীয় প্রতাপ রুদ্রদেবের বলে মত প্রকাশ করেছেন। অধ্যাপক সরকারের অভিমতই গৃহীত হয়েছে। ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দে পুণে জেলায় ‘গধিয়া’ মুদ্রার একটি ভাণ্ডার আবিষ্কৃত হয়েছে। মুদ্রাগুলি রাষ্ট্রকূট রাজারা উৎকীর্ণ করেছেন, এই মর্মে এক অভিমতও ব্যক্ত হয়েছে। কিন্তু রাষ্ট্রকূট রাজ্যে এই ধরনের মুদ্রা কমই পাওয়া গেছে, পশ্চিম ও মধ্য ভারতেই এই মুদ্রার বহুল প্রচার ছিল। রাষ্ট্রকূট রাজারা এই মুদ্রা উৎকীর্ণ করেছেন, এ কথা সম্ভবত ঠিক নয়। পশ্চিম বা মধ্য ভারত থেকে হয়তো কোনও বণিক বা তীর্থযাত্রী সঙ্গে করে মুদ্রাগুলি এনেছিলেন।

ধর্মীয় জীবন

বৌদ্ধ ও জৈনধর্ম

বৌদ্ধধর্ম : খ্রিস্টীয় ৭ম শতকে দক্ষিণ ভারতে প্রায় ২০০টির মতো বৌদ্ধবিহার বিরাজমান ছিল। কিন্তু রাষ্ট্রকূট রাজাদের আমলে বৌদ্ধবিহারের সংখ্যা যথেষ্ট হ্রাস পায়। সমকালীন লেখে তিনটি মাত্র বৌদ্ধবিহারের উল্লেখ আছে। এদের একটি অবস্থিত ছিল কানহেরিতে, দ্বিতীয়টি শোলাপুর জেলার কম্বিলে, আর তৃতীয়টি ধারবাড় জেলার দম্বলে। বিহার তিনটির মধ্যে কানহেরি বৌদ্ধবিহারটিরই বেশি প্রসিদ্ধি ছিল। অমূল্য পুঁথিসম্ভারে এই বিহার সমৃদ্ধ ছিল। অজন্টা ও এলোরাতেও বৌদ্ধশাস্ত্রের চর্চা হত। এ দু’টি কেন্দ্রে এ পর্বে বৌদ্ধধর্মের প্রভাব ছিল ক্ষীয়মাণ।

জৈনধর্ম : এ সময় জৈনধর্ম বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করে। এর কারণও ছিল। রাজাদের মধ্যে অনেকেই জৈনধর্মের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। জৈনধর্মের একান্ত অনুরাগী ছিলেন প্রথম অমোঘবর্ষ। তিনি তাঁর পুত্র দ্বিতীয় কৃষ্ণের সুশিক্ষার দায়িত্ব অর্পণ করেন তখনকার দিনের প্রখ্যাত জৈনাচার্য গুণভদ্রের উপর। দ্বিতীয় কৃষ্ণ এবং তাঁর উত্তরাধিকারী তৃতীয় ইন্দ্রও জৈন প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে অকাতরে দানধ্যান করেন। বহু রাষ্ট্রকূট প্রশাসক ও সেনাধ্যক্ষ জৈনধর্মাবলম্বী ছিলেন। সমকালীন অনেক গঙ্গ রাজা জৈনধর্মে দীক্ষিত ছিলেন। জৈন প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে রাজপরিবারের দানধ্যান, রাজকার্য ও সামরিক বাহিনীতে বহু সংখ্যক জৈনদের নিয়োগ ও এ পর্বে রচিত জৈন সাহিত্যের বিপুল কলেবরের পরিপ্রেক্ষিতে অনুমিত হয়, মহারাষ্ট্র কর্ণাটকে বিশাল সংখ্যক জৈনদের বসবাস ছিল। সন্দেহ নেই, এ অঞ্চলে জৈনধর্মের সম্প্রচারে গুণভদ্র, শাকটায়ন ও সোমদেবসূরির মতো আচার্যরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেন।

ব্রাহ্মণ্যধর্ম

জৈনধর্মের অসাধারণ জনপ্রিয়তা সত্ত্বেও এ কথা স্বীকার করতে হয়, রাষ্ট্রকূট রাজ্যের বেশির ভাগ মানুষই ছিলেন ব্রাহ্মণ্যধর্মাবলম্বী। রাষ্ট্রকূট রাজারা প্রায় সকলেই ব্রাহ্মণ্য ধর্মাবলম্বী ছিলেন। শাস্ত্রবিদ ব্রাহ্মণ ও ব্রাহ্মণ্যধর্মীয় সংস্থার অনুকূলে তাঁদের অকৃপণ দানের উল্লেখ আছে সমকালীন লেখে।

কিন্তু এ পর্বে বৈদিক যাগযজ্ঞের অনুষ্ঠান হ্রাস পায়। বৈদিক যাগযজ্ঞে রাজাদের তেমন উৎসাহ ছিল না। বৈদিক যাগযজ্ঞ যে একদম অনুষ্ঠিত হত না, তা নয়; কিন্তু এরূপ ঘটনা সেকালে বিরলই ছিল। কুমারিল খ্রিস্টীয় ৮ম শতকে বৈদিক যাগযজ্ঞের পুনরুজ্জীবনে সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করেন কিন্তু তাঁর প্রচেষ্টা বিশেষ ফলপ্রসূ হয়নি। বৈদিক ধর্ম নয়, পৌরাণিক ধর্মই এই পর্বে জনপ্রিয়তা অর্জন করে। বৈদিক যাগযজ্ঞের প্রতি নয়, পৌরাণিক দেবদেবী, আচার-আচরণ ও কর্মকাণ্ডের প্রতিই লোকদের আগ্রহ বৃদ্ধি পায়। বৈদিক যাগযজ্ঞ ব্যয়সাধ্য, দীর্ঘস্থায়ী ; পশুবলি সে যজ্ঞের এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। পক্ষান্তরে পৌরাণিক অনুষ্ঠান ছিল সরল ও অনাড়ম্বর, পশুবলি ছিল অনভিপ্রেত। বৌদ্ধ ও জৈনধর্মের প্রচারের ফলে সাধারণ লোক পশুবলির প্রতি বিতৃষ্ণ হন। ব্রাহ্মণ্য দেবদেবীদের মধ্যে বিষ্ণু, শিব, লক্ষ্মী এবং সূর্যই প্রধান ছিলেন। এ পর্বে বিষ্ণু ও শিবের উদ্দেশ্যে বহু মন্দির নির্মিত হয়। এলোরার সুবিখ্যাত কৈলাস মন্দির প্রথম কৃষ্ণের রাজত্বকালে নির্মিত হয়। এই মন্দিরের সুবৃহৎ গর্ভগৃহে বিশাল শিবলিঙ্গ স্থাপিত, আর মন্দিরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গে ঈশ্বরের অগণিত লীলামূর্তি সংরক্ষিত। শিবের মানবিক রূপ অপেক্ষা প্রতীক বা লিঙ্গসাধনাই অধিক জনপ্রিয়তা লাভ করে। শিবের বিভিন্ন রূপতত্ত্ব এ পর্বে অপরিজ্ঞাত ছিল না। শিবের অর্ধনারীশ্বর মূর্তিও এ সময় অধিক সংখ্যায় নির্মিত হয়। সমকালীন এলিফ্যান্টা গুহামন্দিরের অর্ধনারীশ্বর মূর্তি এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য। এই অর্ধনারীশ্বর মূর্তিতে একদিকে অভিব্যক্ত হয়েছে জগৎপিতার সৌম্য ও উগ্র রূপ, অপরদিকে প্রকাশিত হয়েছে জগৎপিতা ও জগন্মাতার সমন্বিত রূপতত্ত্ব।

মন্দিরগুলি ছিল ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতি বিস্তারের কেন্দ্র। ভক্তজনেরা দলবদ্ধভাবে মন্দিরে সমবেত হতেন। মন্দিরে শুধু পূজা-অৰ্চনাই অনুষ্ঠিত হত না, ধর্ম, দর্শন, সদাচার ইত্যাদি বিষয়েও মনোগ্রাহী আলোচনা হত। উচ্চশিক্ষারও চর্চা হত মন্দিরে। সংগতিহীন ছাত্র, দীনদরিদ্র এবং সন্ন্যাসীদের অন্ন বিতরণ করা হত। মন্দিরে মনোরঞ্জনেরও যথেষ্ট আয়োজন ছিল। নিয়মিত নৃত্যগীত অনুষ্ঠিত হত। দেবদাসীরা নৃত্য ও সংগীত পরিবেশন করতেন। রাষ্ট্র এবং ধনাঢ্য ব্যক্তিবর্গ মন্দিরের অনুকূলে অকৃপণ হস্তে জমি ও অর্থ দান করতেন। এই দানেই মন্দিরের ব্যয়ভার নির্বাহ হত। কথিত আছে, চতুর্থ গোবিন্দ তাঁর রাজ্যাভিষেক অনুষ্ঠানে বিভিন্ন মন্দিরের উন্নতিকল্পে ৪০০টি গ্রাম এবং ৩২ লক্ষ মুদ্রা দান করেন। তখনকার দিনের লোকেরা বিশ্বাস করতেন, ধর্মীয় কার্যে দানধ্যান করলে দেবতারা প্রসন্ন হন। এ ধারণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে বহু ধনী ব্যক্তি মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনা করেছেন, পুষ্করিণী ও কূপ খনন করেছেন, দাতব্য ভোজনালয় স্থাপন করে দরিদ্র নর-নারায়ণের সেবা করেছেন। তীর্থযাত্রা সমাজে জনপ্রিয় হয়। গোমাতার প্রতি সাধারণের ভক্তি বৃদ্ধি পায়।

শঙ্করাচার্য (৭৮৮-৮২০ খ্রিস্টাব্দ)

অদ্বৈতবাদের প্রখ্যাত প্রবক্তা শঙ্করাচার্য এই পর্বেই আবির্ভূত হন। জন্ম তাঁর কেরলে, নাম্বুদিরি ব্রাহ্মণকুলে। গৌরপাদ তাঁর গুরু, পদ্মপাদ ও সুরেশ্বর তাঁর দুই স্বনামধন্য শিষ্য। মাত্র ৩২ বৎসরকাল তিনি জীবিত ছিলেন। এরই মধ্যে সারা ভারত তিনি পরিভ্রমণ করেছেন, ভারতের চার চারটি প্রান্তে মঠ স্থাপন করেছেন। এদের একটি শৃঙ্গেরী মঠ। কর্ণাটকের চিকমাঙ্গালুর জেলার শৃঙ্গেরীতে এই মঠ অবস্থিত। উপনিষদ্, ব্রহ্মসূত্র এবং শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার উপর জ্ঞানগর্ভ ভাষ্য রচনা করে তিনি অদ্বৈতবাদ প্রচার করেন। অদ্বৈতবাদের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে শঙ্করাচার্য বলেন, “শ্লোকার্ধেন প্রবক্ষ্যামি যদুক্তং গ্রন্থকোটিভিঃ। ব্রহ্ম সত্যং জগন্মিথ্যা জীবো ব্রহ্মেব নাপরঃ ॥”

কোটি কোটি গ্রন্থে যে কথা বলা হয়েছে, আমি শ্লোকার্ধেই তা বলছি : ব্রহ্মই সত্য, জগৎ মিথ্যা। জীবই ব্রহ্ম। শঙ্করাচার্য মনে করেন, যে বস্তু অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ, এই তিনকালেই বর্তমান, জ্ঞানান্তরের দ্বারা অবাধিত, তাই সৎ, তাই সত্য। ব্রহ্মই একমাত্র সদ্বস্তু। কিন্তু জগৎ মিথ্যা। এর অর্থ এই নয়, জগৎ অলীক। ‘আকাশকুসুম’, ‘বন্ধ্যাসুত’ প্রভৃতি বস্তুর অস্তিত্ব লৌকিক জগতে নেই। আমাদের জ্ঞানের দৃষ্টিতেও তারা আভাসিত হয় না। তারা অসৎ বা অলীক। কিন্তু জীব ও জগৎ আমাদের বাহ্য চেতনায় বর্তমান। তাই তারা অলীক নয়। কিন্তু জীব ও জগৎ অনাদি নয়। এক সময় তাদের সৃষ্টি হয়েছে এবং যথাক্রমে মৃত্যু ও কল্পান্তে তাদের বিনাশ হবে। তারা ত্রৈকালিক সত্য নয়। তারা শুধু বর্তমানকালেই বিরাজমান। তাই শঙ্করের মতে জীব ও জগৎ সত্ত নয়, অসত্ত নয়, সদসৎ ভিন্ন এক অনির্বচনীয় বস্তু। ব্রহ্মজ্ঞানের উপলব্ধি হলে মানুষের অবিদ্যা দূর হয়, জগৎ আর সৎ বস্তুরূপে প্রতিভাত হয় না, ব্রহ্মজ্ঞানের দ্বারা জগৎ বাধিত হয়। যা জ্ঞানান্তরের দ্বারা বাধিত তাই মিথ্যা। ‘জ্ঞানান্তরবাধিতত্বং মিথ্যাত্বম্’। সুতরাং জগৎ মিথ্যা। ব্রহ্মজ্ঞানীর নিকট সবকিছুই ব্রহ্ম। জীবও ব্রহ্ম। উপাস্য ও উপাসক অভেদ। নিখিল জগৎ ব্রহ্মময়।

ইসলামধর্ম

রাষ্ট্রকূট রাজ্যে ইসলামধর্ম যথেষ্ট সমাদৃত ছিল। মহারাষ্ট্র ও কর্ণাটকের বন্দর সমূহে বহু সংখ্যক আরবদেশীয় মুসলমান বণিক বাস করতেন। তাঁদের অবাধ ধর্মাচরণের জন্য বেশ কয়েকটি মসজিদ এ সময় নির্মিত হয়। রাষ্ট্রকূট রাজারা মূলত ব্রাহ্মণ্যধর্মাবলম্বী ছিলেন কিন্তু ইসলাম ধর্মমতের প্রতি তাঁরা সশ্রদ্ধ ছিলেন। তাঁদের আমলে ইসলামধর্মাবলম্বী ব্যক্তি উঁচু প্রশাসনিক পদে অধিষ্ঠিত হয়েছেন। সমকালীন লেখে এমন ঘটনার উল্লেখ আছে। তখনকার দিনের বহু আরব পর্যটক ইসলামধর্মের প্রতি রাষ্ট্রকূট রাজাদের উদার মনোভাবের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন।

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি এ যুগের ধর্মীয় জীবনের এক উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। রাষ্ট্রকূট রাজ্যে বিভিন্ন ধর্মের লোক বাস করতেন; তাঁদের পারস্পরিক সম্পর্ক ছিল প্রীতিপূর্ণ। মাঝে মাঝে বিতর্কসভার আয়োজন করা হত; সেখানে বিভিন্ন বক্তা নিজ নিজ ধর্মমত ব্যাখ্যা করতেন, স্বধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিপন্ন করতে সচেষ্ট হতেন। বক্তারা যুক্তিতর্কের সাহায্যে তাঁদের বক্তব্য পেশ করতেন, অন্ধবিশ্বাসের বশে নয়। তখন এটিই ছিল স্বাভাবিক। রাজন্যবর্গ ও পদস্থ রাজপুরুষেরা বিভিন্ন ধর্মের প্রতি সমান শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। প্রথম অমোঘবর্ষ ব্রাহ্মণ্য ও জৈনধর্মের প্রতি সমান অনুরক্ত ছিলেন। গুজরাত রাষ্ট্রকূট শাখার দন্তিবর্মা স্বয়ং ব্রাহ্মণ্যধর্মাবলম্বী ছিলেন কিন্তু বৌদ্ধ প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে তিনি প্রচুর দানধ্যান করেন। বহু ব্রাহ্মণ জৈন প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে দান করেছেন। ব্রাহ্মণ্য, বৌদ্ধ ও জৈনধর্মের অনুশাসন অনুসরণ করেছেন, লেখমালায় এমন ধার্মিক, সদাশয় ব্যক্তিদের উল্লেখ আছে। কখনও কখনও একই ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে জৈন ও ব্রাহ্মণ্য দেবদেবীর পূজা-অর্চনা অনুষ্ঠিত হত, এরূপ সন্দেশও সমকালীন লেখে পরিবেশিত হয়েছে। এ সময় ইসলামধর্মাবলম্বী আরব বণিকেরা পশ্চিম ভারতীয় উপকূলস্থ বন্দরগুলিতে বসতি স্থাপন করেন। আরব বণিকদের প্রতি রাষ্ট্রকূট রাজাদের সদয় আচরণের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন সমকালীন মুসলমান পর্যটকেরা। আরব বণিকদের নিরুপদ্রবে ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালনের জন্য বন্দরে বন্দরে মসজিদ নির্মিত হয়, মুসলমান অপরাধীদের ন্যায় বিচারের স্বার্থে কাজি নিযুক্ত হন। পক্ষান্তরে মুসলমান প্রশাসক ব্রাহ্মণ্যধর্মাবলম্বীদের সুবিধার্থে নিজে উদ্যোগী হয়ে মন্দির নির্মাণ করেছেন, এমন দৃষ্টান্ত রাষ্ট্রকূটপর্বে অশ্রুতপূর্ব নয়।

ভাষা ও সাহিত্য

সংস্কৃত সাহিত্য

রাষ্ট্রকূটদের রাজত্বকালে মহারাষ্ট্র ও কর্ণাটকে সংস্কৃত ভাষা বিপুল প্রসারলাভ করে। রাষ্ট্রকূট রাজারা সংস্কৃত ভাষার অনুরাগী ছিলেন। প্রথম অমোঘবর্ষের মতো কোনও কোনও রাষ্ট্রকূট নৃপতি তো সুসাহিত্যিকই ছিলেন। বেমুলবাড়ের চালুক্য সামন্তরাও সংস্কৃত ভাষার পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন। এ পর্বের বেশির ভাগ লেখই সংস্কৃতে রচিত। ছন্দমাধুর্য, অর্থগৌরব ও পদলালিত্যে লেখের ভাষা কখনও কখনও রসোত্তীর্ণ সাহিত্যে উন্নীত হয়েছে। ধর্ম, দর্শন, ব্যাকরণ, গণিত, রাজনীতি প্রভৃতি বিষয়ের উপর বহুসংখ্যক সংস্কৃত গ্রন্থ এ সময় রচিত হয়। রামায়ণ, মহাভারত ও পৌরাণিক কাহিনি অবলম্বনে সংস্কৃতে কয়েকখানি কাব্যও রচিত হয়। এ যুগে রচিত বেশ কয়েকখানি গ্রন্থ আজও সমাদৃত।

  • অদ্বৈতবাদের প্রখ্যাত প্রবক্তা শঙ্করাচার্য উপনিষদ্, ব্রহ্মসূত্র ও শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার উপর জ্ঞানগর্ভ ভাষ্য রচনা করেন। তাঁর অমূল্য রচনাসম্ভারে ভারতীয় দর্শন মহিমান্বিত হয়েছে। তাঁর রচিত ভক্তিস্তোত্র আজও ভারতের মন্দিরে মন্দিরে পরিবেশিত হচ্ছে।
  • শঙ্কর-শিষ্য পদ্মপাদ ‘পঞ্চপাদিকা’ নামে একটি গ্রন্থ প্রণয়ন করেন।
  • শঙ্করের আর এক বিশ্রুতকীর্তি শিষ্য সুরেশ্বর রচনা করেন ‘বৃহদারণ্যক-শ্লোকবার্তিক’, ‘তৈত্তিরীয়-শ্লোকবাৰ্তিক’, ‘নৈষ্কর্মসিদ্ধি’ প্রভৃতি কয়েকটি গ্রন্থ। তাঁদের উভয়েরই কর্মভূমি কর্ণাটক।
  • বিশ্বরূপের যাজ্ঞবল্ক্যস্মৃতির উপর ‘বালক্রীড়া’ নামে একখানি বিখ্যাত টীকাগ্রন্থ আছে। অনেকের অনুমান, ‘বালক্রীড়া’-প্রণেতা বিশ্বরূপ এবং শঙ্করশিষ্য সুরেশ্বর একই ব্যক্তি।
  • এ পর্বে কয়েকখানি ব্যাকরণ-গ্রন্থ রচিত হয়। সে যুগের এক যশস্বী বৈয়াকরণ দুর্গাসিংহ। তিনি কাতন্ত্রসূত্রের উপর একখানি প্রামাণ্য বৃত্তি বা টীকা প্রণয়ন করেন।
  • প্রথম অমোঘবর্ষের প্রসাদ ধন্য জৈন বৈয়াকরণ শাকটায়ন ‘শব্দানুশাসন’ ও ‘অমোঘবৃত্তি’ নামে দু’খানি ব্যাকরণ-গ্রন্থ রচনা করেন।
  • ৮ম শতকের দ্বিতীয়ার্ধে মাণিক্যনন্দী তর্কশাস্ত্রের উপর ‘পরীক্ষামুখশাস্ত্র’ নামে একখানি গ্রন্থ লেখেন। প্রায় পাঁচ দশক পর প্রভাচন্দ্র এই গ্রন্থের একটি টীকা প্রকাশ করেন।
  • প্রভাচন্দ্র ‘ন্যায়কৌমুদীচন্দ্রোদয়’ নামে আর একখানি গ্রন্থের রচয়িতা।
  • সে যুগের এক শ্রেষ্ঠ গণিতজ্ঞ মহাবীরাচার্য। প্রথম অমোঘবর্ষের সমকালবর্তী তিনি গণিতশাস্ত্রের উপর লেখা তাঁর গ্রন্থটির নাম ‘গণিতত্সারসংগ্রহ’।
  • প্রায় একই সময় উগ্ৰাদিত্য চিকিৎসাবিজ্ঞানের উপর ‘কল্যাণকারক’ নামে একখানি প্রামাণ্য গ্রন্থ প্রণয়ন করেন।
  • সুসাহিত্যিক ছিলেন প্রথম অমোঘবর্ষ। আর্যা ছন্দে, সরল সংস্কৃতে ‘প্রশ্নোত্তররত্নমালিকা’ নামে তিনি প্রশ্নোত্তরমূলক একখানি নীতিকাব্য রচনা করেন। কাব্যকার স্বয়ং প্রশ্নকর্তা ও উত্তরদাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ। প্রশ্নগুলি যেমন সুচিন্তিত, উত্তরগুলিও তেমনি মনোগ্রাহী। কয়েকটি প্রশ্ন ও তাদের উত্তর দৃষ্টান্তরূপে উল্লেখ করা যায় :
    • প্রশ্ন : নরক কী?
    • উত্তর : পরনির্ভরশীলতা।
    • প্রশ্ন : মানুষের নিকট ভীতিপ্রদ বস্তু কী?
    • উত্তর : মৃত্যু।
    • প্রশ্ন : দারিদ্র্য কী? উত্তর : অতৃপ্তি।
    • প্রশ্ন : কে বুদ্ধিমান?
    • উত্তর : যিনি বুদ্ধির বড়াই করেন না।
    • প্রশ্ন : কোন্ বস্তু অনুধাবন করা যায় না?
    • উত্তর : নারীচরিত্র।
  • প্রথম অমোঘবর্ষের গুরু জৈনাচার্য জিনসেন ‘আদিপুরাণ’ রচনার কাজ আরম্ভ করেন। গ্রন্থখানি তিনি অসম্পূর্ণ রেখে যান। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর খ্যাতিমান শিষ্য গুণচন্দ্র ৮৯৭ খ্রিস্টাব্দে গ্রন্থখানি সমাপ্ত করেন। বহু জৈনসাধুর জীবনী আলোচিত হয়েছে এই গ্রন্থে। পার্শ্বনাথের জীবনী অবলম্বন করে জিনসেন ‘পার্শ্বাভ্যুদয়’ কাব্য রচনা করেন। প্রথম অমোঘবর্ষের গুরু জিনসেন এবং জৈন হরিবংশ-পুরাণের প্রখ্যাত রচয়িতা আচার্য জিনসেন এক ব্যক্তি নন। শেষোক্ত ব্যক্তি খ্রিস্টীয় ৮ম শতকের দ্বিতীয়ার্ধে আবির্ভূত হন। হরিবংশ-পুরাণের রচনাকাল ৭৮৩-৮৪ খ্রিস্টাব্দ।
  • তৃতীয় ইন্দ্রের সভাকবি ত্রিবিক্রম। গদ্য ও পদ্যের সংমিশ্রণে তিনি চম্পু নামে এক নতুন ধরনের কাব্য রচনা করেন। পূর্ববর্তী যুগে গদ্য ও পদ্যের মিলনে বহু কাব্য ও নাটক রচিত হয়েছে। কিন্তু সেখানে পদ্যের ভূমিকা গৌণ। চম্পুকাব্যে গদ্য ও পদ্যের সমান গুরুত্ব। বহুশ্রুত নল ও দময়ন্তীর কাহিনি আশ্রয় করে তিনি ‘নলচম্পু’ বা ‘দময়ন্তীকথা’ রচনা করেন। কাহিনিটি মূলত মহাভারত থেকে গৃহীত হলেও ত্রিবিক্রম ঘটনার বর্ণনা ও উপস্থাপনায় সৃজনশীলতার পরিচয় দেন।
  • প্রখ্যাত সাহিত্যিক সোমদেবসূরি তৃতীয় কৃষ্ণের সমকালীন ছিলেন। তিনি ছিলেন বেমুলবাড়ের চালুক্য সামন্ত দ্বিতীয় অরিকেশরীর পুত্র তৃতীয় বড্ডেগ ও পৌত্র তৃতীয় অরিকেশরীর অনুগ্রহভাজন। রাজনীতি ও জৈনশাস্ত্রে তাঁর প্রগাঢ় পাণ্ডিত্য ছিল। রায়চুর জেলার প্রাচীন গঙ্গধারা শহরে অবস্থিত শুভধাম জিনালয় জৈনমঠের অধ্যক্ষ ছিলেন তিনি। তাঁর লেখা একখানি কাব্য ‘যশস্তিলকচম্পূ’ বা ‘যশোধর-চরিত’। উজ্জয়িনীর পৌরাণিক রাজা যশোধরের জীবনী এই কাব্যের প্রতিপাদ্য বিষয়। জৈনধর্মের মাহাত্ম্য প্রচারের উদ্দেশ্যে রচিত হলেও সমকালীন ধর্মীয় ও সমাজ-জীবনের এক মূল্যবান দর্পণরূপে গ্রন্থখানি সমাদৃত। তাঁর রাজনীতিবিষয়ক গ্রন্থ ‘নীতিবাক্যামৃত’। কৌটিলীয় অর্থশাস্ত্রের অনুকরণে গ্রন্থখানি রচিত। ‘স্যাদ্বাদোপনিষদ্’, ‘মহেন্দ্ৰমাতলিসঙ্কল্প’, ‘যুক্তিচিন্তামণিসূত্র’ ইত্যাদি আরও কয়েকখানি গ্রন্থ তিনি রচনা করেন।
  • হলায়ুধ তৃতীয় কৃষ্ণের সভায় ‘কবিরহস্য’ কাব্য রচনা করেন। কাব্যখানিতে তৃতীয় কৃষ্ণের গুণ কীর্তিত হলেও কাব্যটি মূলত ধাতুপ্রকরণ-সম্পর্কিত। তিনি ‘অভিধানরত্নমালা’ নামে একখানি অভিধান রচনা করেন। ছন্দপ্রকরণের উপর লেখা তাঁর একটি গ্রন্থ আছে। গ্রন্থটির নাম ‘মৃতসঞ্জীবনী’।
  • দর্শনাচার্য কুমারিল, বৈয়াকরণ বাচস্পতি, স্মৃতিকার কাত্যায়নযম এবং বিদগ্ধ কাব্যকার রাজশেখর এ পর্বেই আবির্ভূত হন। এসব লেখকদের সঙ্গে রাষ্ট্রকূট রাজ্যের কোনওরূপ সম্পর্ক ছিল কিনা তা অনিশ্চিত। এঁদের অন্তত একজন মহারাষ্ট্রে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি রাজশেখর। তাঁর জীবনের সিংহভাগই উত্তর ভারতে অতিবাহিত হয়।

অপভ্রংশ

এ পর্বে অপভ্রংশেও কয়েকখানি কাব্য রচিত হয়। খ্রিস্টীয় ৮ম বা ৯ম শতকে চতুর্মুখ ‘পৌমচরিউ’ ও ‘রিট্‌ঠনেমিচরিউ’ নামে দু’খানি কাব্য রচনা করেন। কিন্তু অপভ্রংশের সর্বশ্রেষ্ঠ কবি পুষ্পদন্ত। রাষ্ট্রকুটরাজ তৃতীয় কৃষ্ণের সমকালবর্তী তিনি। সম্ভবত বিদর্ভে তাঁর জন্ম। আজীবন ব্রহ্মচারী এই কবি ধর্মমতে জৈন ছিলেন। তিনি ‘মহাপুরাণ’ কাব্যের রচয়িতা। গ্রন্থটির দু’টি খণ্ড, আদিপুরাণ ও উত্তরপুরাণ। সমগ্র গ্রন্থটিতে ৬৩ জন জৈন মহাপুরুষের জীবন কাহিনি বর্ণিত হয়েছে। ছন্দ ও পদের অনুপম ব্যবহারে কাব্যখানি সুষমামণ্ডিত হয়েছে। পুষ্পদন্ত অপভ্রংশে ‘নয়কুমারচরিউ’ ও ‘যসহরচরিউ’ নামে আরও দু’খানি কাব্য রচনা করেন। পুষ্পদন্তের মহাপুরাণের অনুকরণে কনকামর ‘করকণ্ডচরিউ’ নামে একখানি কাব্য প্রণয়ন করেন।

কন্নড় সাহিত্য : রাষ্ট্রকূট রাজারা কন্নড় সাহিত্যেরও পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন। এ সময় কন্নড় সাহিত্যের অভূতপূর্ব বিকাশ ঘটে। কন্নড় ভাষায় রচিত এ যুগের গ্রন্থাদির মধ্যে ‘কবিরাজমার্গ’ নিঃসন্দেহে শীর্ষস্থানীয় । গ্রন্থখানি রচনা করেন রাষ্ট্রকূটরাজ প্রথম অমোঘবর্ষ। অনেকে মনে করেন, গ্রন্থখানির প্রকৃত রচয়িতা রাষ্ট্রকূটরাজের অনুগ্রহভাজন এক সাহিত্যসেবী; তিনি কৃতজ্ঞতাবশত তাঁর অন্নদাতা নৃপতুঙ্গ তথা প্রথম অমোঘবর্ষের নামে গ্রন্থটি রচনা করেন। কাব্যের প্রতিপাদ্য বস্তু, গুণাগুণ, উদ্দেশ্য ইত্যাদি বিষয়ের চিন্তাগর্ভ বিচার-বিশ্লেষণ আছে এই গ্রন্থে। বহু প্রাচীন কন্নড় কাব্যকারদের নাম এই গ্রন্থে উল্লিখিত হয়েছে।

  • প্রথম পম্প বা আদি পম্প এ পর্বের সর্বশ্রেষ্ঠ কন্নড় কবি। খ্রিস্টীয় ১০ম শতকীয় এই কবি বেমুলবাড়ের চালুক্য সামন্ত তৃতীয় বড্ডেগ ও তাঁর পুত্র তৃতীয় অরিকেশরীর অনুগ্রহপুষ্ট ছিলেন। তাঁর লেখা দু’টি বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ, ‘আদিপুরাণ’ ও ‘বিক্রমার্জুনবিজয়’ বা ‘পম্পভারত’। প্রথম কাব্যে তিনি জৈন তীর্থঙ্কর ঋষভনাথের জীবনী বর্ণনা করেছেন। দ্বিতীয় কাব্যখানি বেমুলবাড়ের চালুক্য সামন্ত বংশের ইতিহাস সম্পর্কিত। এই কাব্যে তৃতীয় অরিকেশরীকে পাণ্ডুতনয় অর্জুনের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে, তৃতীয় ইন্দ্রের উত্তর ভারত অভিযান সম্পর্কে বহু মূল্যবান তথ্য পরিবেশিত হয়েছে। তাঁর কাব্যে বীরধর্ম ও হৃদয়বত্তার জয়গান ঘোষিত হয়েছে। তিনি বলেন, যে রাজা শত্রুদমনে ব্যর্থ, শরণাগতকে আশ্রয় প্রদানে অপারগ ও দান-ধ্যানে বিগতস্পৃহ, তিনি মনুষ্যপদবাচ্য নন। নিজের পরিচয় প্রসঙ্গে তিনি বলেন, তিনি নিছক একজন কবি নন, ক্ষাত্রধর্মে তিনি দীক্ষিত।
  • এ যুগের অপরাপর কন্নড় লেখকদের মধ্যে রত্ন, নাগবর্মা, চামুণ্ডাচার্য, অসঙ্গ ও জিনচন্দ্রের নাম সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। রঙ রচনা করেন দু’খানি কাব্য, ‘অজিতপুরাণ’ ও ‘গদাযুদ্ধ’। নাগবর্মার ‘ছন্দোম্বুধি’ ছন্দবিষয়ক গ্রন্থ। চামুণ্ডাচার্যের ‘চামুণ্ডরায়-পুরাণ’ তীর্থঙ্করদের জীবনীগ্রন্থ। শেষোক্ত গ্রন্থটি আদ্যপ্রান্ত কন্নড় গদ্যে রচিত।
  • এ পর্বের সাহিত্যাকাশের এক উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক পোন্ন। সংস্কৃত, কন্নড় ও তেলুগু ভাষায় গ্রন্থ প্রণয়ন করে তিনি খ্যাতিলাভ করেন। তাঁর লেখা সংস্কৃত গ্রন্থ ‘শান্তিপুরাণ’। গ্রন্থখানিতে তীর্থঙ্করদের জীবনবৃত্তান্ত বর্ণিত হয়েছে। তাঁর আদিপুরাণ গ্রন্থটি তেলুগু ভাষায় রচিত। রাষ্ট্রকূট নৃপতি তৃতীয় কৃষ্ণ তাঁকে দু’টি ভাষায় ব্যুৎপত্তির জন্য ‘উভয়কবিচক্রবর্তী’ উপাধিতে ভূষিত করেন। ভাষা দু’টির একটি অবশ্যই সংস্কৃত। কিন্তু অন্য ভাষাটি কী? সেটি তেলুগু কিংবা কন্নড়।

স্থাপত্য, ভাষ্কর্য ও চিত্রকলা

স্থাপত্য

ভারতীয় গুহা-স্থাপত্যের ইতিহাসে রাষ্ট্রকূট পর্ব এক স্মরণীয় অধ্যায়রূপে চিহ্নিত। এ পর্বে পাহাড় কুঁদে নির্মিত গুহা-মন্দিরের মধ্যে এলোরার দশাবতার, ইন্দ্রসভা, জগন্নাথসভা ও কৈলাস গুহা-মন্দির সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। গুহা-মন্দিরগুলির তুলনায় এ পর্বে নির্মিত সৌধ স্থাপত্যের নিদর্শনসমূহ শুধু ক্ষীণকলেবরই নয়, শৈল্পিক সৌকর্যেও হীনপ্রভ।

  • দ্বিতল দশাবতার গুহা-মন্দির আয়তনে বিশাল। গুহা-মন্দিরের প্রবেশমুখে রাষ্ট্রকূট নৃপতি দন্তিদুর্গের একখানি লেখ উৎকীর্ণ আছে। অনুমিত হয়, এই গুহা-মন্দির খ্রিস্টীয় ৮ম শতকের মধ্যভাগে খনিত হয়। গুহা-মন্দিরের সম্মুখবর্তী অঙ্গনের ঠিক কেন্দ্রস্থলে চারস্তম্ভের একটি বিচ্ছিন্ন নন্দিমণ্ডপ। মণ্ডপের সামনে ও পিছনদিকে সিঁড়ি। গুহা-মন্দিরের সামনের দিকে প্রতি তলেই এক সারির স্তম্ভ। উপর-নিচের দু’টি স্তম্ভসারি একই রেখায় বিন্যস্ত। স্তম্ভগুলি বর্গাকার। দ্বিতীয় তল একটি সস্তম্ভ মণ্ডপ। মণ্ডপের পশ্চাদ্ভাগে দেবকক্ষ বা গর্ভগৃহ। দেবকক্ষে বর্তুলাকার লিঙ্গপীঠে শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠিত। মণ্ডপের পশ্চাদভাগের কিয়দংশ দেবকক্ষের সম্মুখস্থ অন্তরাল বা অর্ধমণ্ডপের রূপ পরিগ্রহ করেছে। মণ্ডপ বর্গাকার ঔত্তরাজিতে সজ্জিত। দু’চারটি স্তম্ভ অলংকৃত, সিংহভাগই নিরাভরণ। মণ্ডপের অন্তর্দেয়ালে বিভিন্ন দেবদেবীর মূর্তি সুদৃশ্যরূপে উৎকীর্ণ।
  • এলোরার ইন্দ্রসভা ও জগন্নাথসভা গুহা-মন্দির দু’টি পরস্পরের সন্নিকটবর্তী। দু’টিই জৈন মন্দির ও দ্বিতল। ইন্দ্রসভার সম্মুখভাগে একশিলা চৌমুখ মন্দির। গুহা-মন্দিরের সম্মুখ ভাগ সুচারুরূপে অলংকৃত। গুহা-মন্দিরের আদিতল অর্ধসমাপ্ত। দ্বিতল একটি নবরঙ্গ-মণ্ডপ। মণ্ডপে তীর্থঙ্করদের মূর্তি উৎকীর্ণ। মণ্ডপটির সম্মুখভাগ একটি সস্তম্ভ মুখমণ্ডপের মতো বিন্যস্ত।
  • জগন্নাথসভা ইন্দ্রসভারই অনুরূপ। কিন্তু এর আদিতল সম্পূর্ণরূপে নির্মিত ও তিনটি স্বয়ংসম্পূর্ণ অঙ্গে বিন্যস্ত। প্রতিটি অঙ্গে রয়েছে দেবকক্ষ, মণ্ডপ এবং সম্মুখবর্তী অগ্রমণ্ডপ। দ্বিতল একটি নবরঙ্গ মণ্ডপ।
  • এলোরার সুবিখ্যাত কৈলাস গুহা-মন্দির রাষ্ট্রকূট পর্বের শ্রেষ্ঠতম স্থাপত্যকীর্তিরূপে স্বীকৃত। পাহাড় কুঁদে নির্মিত সুবিশাল এই মন্দির কৈলাসনিবাসী শিবের উদ্দেশ্যে নিবেদিত। দন্তিদুর্গ সম্ভবত এই মন্দিরের নির্মাণকার্য শুরু করেন আর প্রথম কৃষ্ণের রাজত্বকালে মন্দিরটি পূর্ণতা লাভ করে। কাঞ্চীর কৈলাসনাথ মন্দির ও পট্টদকলের বিরূপাক্ষ মন্দিরের সঙ্গে এই গুহা মন্দিরের সাদৃশ্য সহজেই নজরে পড়ে। শেষোক্ত মন্দিরটিই হয়তো কৈলাস গুহা মন্দিরের আদর্শ সৌধরূপে গৃহীত হয়েছিল। কৈলাস গুহা-মন্দির একটি আয়তাকার প্রাঙ্গণে অবস্থিত। প্রাঙ্গণটি দৈর্ঘ্যে ৯১.৪৪ মি., প্রস্থে ৬০.৯৬ মি.। আচ্ছাদিত দেবকক্ষের একটি সারি প্রাঙ্গণটিকে পরিবেষ্টন করে আছে। প্রাঙ্গণের প্রবেশমুখে প্রায় গোপুরমের মতো একটি দ্বিতল প্রবেশকক্ষ। পশ্চিমাভিমুখী কৈলাস গুহা মন্দিরের প্রধান অঙ্গ তার সু-উচ্চ চতুস্তল বিমান ও সম্মুখস্থ মণ্ডপ। বিমান ও গ্রুপ ৭.৬২ মি. উঁচু একটি অধিষ্ঠানের উপর দণ্ডা যান। অধিষ্ঠানের নিম্ন ও উপরাংশ নকশা-খচিত। অন্তর্বর্তী অংশ হস্তী ও সিংহের মূর্তি-ভাস্কর্যে মণ্ডিত। মণ্ডপের সামনেই সিঁড়ি। মণ্ডপের ছাদ সমতল। ১৬টি স্তম্ভ ছাদের ভার বহন করছে। মণ্ডপ থেকে অন্তরাল বা অর্ধমণ্ডপ দিয়ে গর্ভগৃহে প্রবেশ করা যায়। বিমানের আদিতলস্থ গর্ভগৃহটি সন্ধার শ্রেণির। গর্ভগৃহকে ঘিরে রয়েছে একটি আচ্ছাদিত প্রদক্ষিণা পথ। গর্ভগৃহ ও প্রদক্ষিণা পথের তিনদিকে ৫টি ক্ষুদ্রাকৃতির দেবকক্ষ। বিমানশীর্ষে গম্বুজাকৃতির স্তূপিকা। বিমানটি উচ্চতায় ২৮.৯৫৬ মি.।
  • মণ্ডপের সম্মুখবর্তী একটি বিচ্ছিন্ন, সমতল ছাদ বিশিষ্ট নন্দিমণ্ডপ। নন্দিমণ্ডপের দু’টি পাশে ১৫.২৪ মি. উচ্চতাবিশিষ্ট দু’টি ধ্বজস্তম্ভ। ধ্বজস্তম্ভের শীর্ষদেশে ত্রিশূল। পাহাড় কুঁদে এই গুহা-মন্দির নির্মাণে স্থপতি যে কারিগরি নৈপুণ্য ও পরিকল্পনা-সৌকর্যের পরিচয় দিয়েছেন তা বিস্ময়কর। বিমান, মণ্ডপ, নন্দিমণ্ডপ ও দ্বিতল প্রবেশকক্ষ সবই যেন একসূত্রে গ্রথিত। অথচ নন্দিমণ্ডপ এবং প্রবেশকক্ষ মূল মন্দির থেকে বিচ্ছিন্ন। এই বিচ্ছিন্নতা সত্ত্বেও তারা এক বৃহৎ মন্দির-প্রকল্পের অত্যাবশ্যিক অঙ্গরূপে প্রতিভাত। মন্দিরটির সামগ্রিক পরিকল্পনায় এক ঐকতান অনুরণিত। তবু এই গুহা-মন্দিরে স্থাপত্য নয়, ভাস্কর্যই যেন মূল আকর্ষণ। এই গুহা-মন্দিরের অধিষ্ঠানে, স্তম্ভদেশে, দেয়ালগাত্রে ও বিমানের বহিরঙ্গে ভাস্কর্যশিল্প বৈচিত্র্য ও ঐশ্বর্যের সাবলীল অভিব্যক্তিতে স্বমহিমায় বিরাজমান। ভাস্কর্যের অত্যাশ্চর্য দ্যুতিতে স্থাপত্যশিল্প যেন হীনপ্রভ।
  • রাষ্ট্রকূট পর্বীয় সৌধাবলির মধ্যে ৮ম শতকের শেষপাদে, পট্টদকলের নাতিদূরে মুখ্যত বালুপাথরে নির্মিত, ত্রিতল মন্দিরটি বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে। মন্দিরের বিমান বর্গাকার, ত্রিতল। প্রধান গর্ভগৃহ আদিতলে অবস্থিত। একটি আচ্ছাদিত প্রদক্ষিণা পথ গর্ভগৃহকে পরিবেষ্টন করে আছে। গর্ভগৃহের সম্মুখভাগে একটি সংকীর্ণ অন্তরাল বা অর্ধমণ্ডপ। অন্তরালের সম্মুখবর্তী একটি নবরঙ্গ মণ্ডপ। মণ্ডপের পুরোভাগে বহু স্তম্ভশোভিত এক উন্মুক্ত মুখমণ্ডপ। বিমানের দ্বিতীয় তলেও একটি গর্ভগৃহ রয়েছে। গর্ভগৃহকে ঘিরে রয়েছে একটি উন্মুক্ত প্রদক্ষিণা পথ। দ্বিতীয় তলের সম্মুখভাগ থেকে প্রলম্বিত শুকনাসিকা অন্তরালের ছাদের উপরিদেশ পর্যন্ত প্রসারিত। তৃতীয় তলটি সংকীর্ণতর। তৃতীয় তলটিতেও শুকনাসিকা সংযোজিত হয়েছে। বিমানের বহিরঙ্গ ভাস্কর্যখচিত।

ভাস্কর্য

চালুক্য যুগের মতো রাষ্ট্রকুট পর্বের দেব-দেবীদের মূর্তিগুলিও গুরুভার ও বিশালকায়। দেব-দেবীদের বলিষ্ঠ দেহগঠনে আভাসিত হয়েছে শক্তিমত্ততা ও প্রাণশক্তির প্রকাশ। এই শক্তি মত্ততা ও প্রাণশক্তির অভিব্যক্তি প্রতিফলিত হয়েছে এ পর্বে নির্মিত দশাবতার ও কৈলাস গুহা মন্দিরের শৈব ও বৈষ্ণব ভাস্কর্যে।

  • দশাবতার ও কৈলাস গুহা মন্দিরে বহু শৈব ও বৈষ্ণব ভাস্কর্য-ফলক খোদিত হয়েছে। বেশিরভাগ ফলকে শিব ও বিষ্ণুর সংহারমূর্তি রূপায়িত হয়েছে। দশাবতার মন্দিরের দ্বিতলে, প্রবেশমুখের সন্নিকটে ভৈরবমূর্তি উৎকীর্ণ আছে। মূর্তিটি বিশালকায়। দেবতার দেহগঠনে বলিষ্ঠতা ও শক্তিমত্ততার অভিব্যক্তি। ভৈরবের কণ্ঠে নরমুণ্ডমালা। ব্যদিত তাঁর মুখমণ্ডল। বিশাল বিশাল তাঁর দন্ত। ত্রিশূল দিয়ে তিনি রত্নাসুরকে নিধন করছেন। অপর একটি হাত দিয়ে তিনি আর এক অসুরকে নিপীড়ন করছেন। পৈশাচিক আনন্দে তিনি উন্মত্ত। হাতে তাঁর রক্ত। এই রক্ত তিনি পান করবেন। ভৈরবের পাশে কালী। তিনি কঙ্কালকায়া। বিরাট তাঁর মুখ। অবিন্যস্ত তাঁর কেশরাশি। কোটরগত তাঁর চক্ষু। তাঁর একহাতে ছুরি, অন্যহাতে পাত্র। অসুরের রক্তে তিনি তৃষ্ণা নিবারণ করবেন। ভাস্কর অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে একটি নাটকীয় মুহূর্ত রচনা করেছেন।
  • ভাস্কর শুধু শিবের সংহারমূর্তিই রূপায়িত করেননি তিনি শিবের সৌম্যমূর্তিও পরিবেশন করেছেন। এ প্রসঙ্গে কৈলাস গুহা মন্দিরের রাবণানুগ্রহমূর্তি ফলকটি স্মরণীয়। অমিতশক্তির অধিকারী রাবণ প্রাণপণ চেষ্টা সত্ত্বেও কৈলাস পর্বতকে একচুলও নাড়াতে পারছেন না অথচ প্রশান্তচিত্ত শিব পদাঙ্গুলের মৃদু স্পর্শে পাহাড়টিকে তুলে ধরেছেন। শিল্পী সুনিপুণভাবে পরমেশ্বরের অতীন্দ্রিয় শক্তির প্রকাশ রূপায়িত করেছেন।
  • বিষ্ণুমূর্তির উপস্থাপনাতেও দেবতার শক্তিমত্ততা ও লীলা রূপায়িত হয়েছে। দশাবতার ও কৈলাস গুহা-মন্দিরে বিষ্ণুর বামনরূপে বলি দমন, নরসিংহরূপে হিরণ্যকশিপুকে নিধন এবং বরাহরূপে কালীয়নাগকে মর্দন ও পৃথিবীকে উদ্ধার রূপায়িত হয়েছে।
  • কিন্তু এ যুগের ভাস্কর আবার এমন কিছু মূর্তি গড়েছেন যা নমনীয়, পেলব দেহগঠন ও মধুর ভঙ্গিমায় মহিমান্বিত। কৈলাস গুহা-মন্দিরে খোদিত আকাশবিহারী অপ্সরাদের মূর্তি অপূর্ব সুষমায় মণ্ডিত। মনোহর অপ্সরাদের দেহভঙ্গিমা, মনোমুগ্ধকর তাদের নবনীয়, পেলব দেহসৌষ্ঠব। তাদের আকাশবিহারের ভঙ্গি ছন্দায়িত, মনোরম।

চিত্রকলা

এ পর্বের কিছু চিত্র ইন্দ্রসভা গুহা-মন্দিরের ছাদের নিম্নতলদেশে অঙ্কিত আছে। চিত্রগুলি কুঙ্কুম বা সিন্দুর ও গাঢ় বাদামি রঙে তৈরি। এই গুহা-মন্দিরের অপ্সরাদের চিত্রগুলি দৃষ্টিনন্দন। সন্ধ্যা সমাগমে অপ্সরাদের দল মেঘের মধ্য দিয়ে স্বচ্ছন্দে বিহার করছে। কোমল, নমনীয় তাদের দেহ-গঠন, তাদের অঙ্গে অলংকরণ ও গহনার বাহার, অপরূপ তাদের দেহ ভঙ্গি। তবে অপ্সরাদের চিত্র চিত্রণে শিল্পী স্বকীয়তার পরিচয় দেননি, তিনি নিষ্ঠাভরে অজণ্টা শৈলীর অনুকরণ করেছেন মাত্র।

উপসংহার

রাষ্ট্রকূট পর্ব নিঃসন্দেহে ভারতের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়রূপে চিহ্নিত। পরাক্রান্ত রাষ্ট্রকূট রাজারা মহারাষ্ট্র ও কর্ণাটক এবং মধ্যপ্রদেশ, অন্ধ্রপ্রদেশ ও তামিলনাড়ুর বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে এক শক্তিশালী রাজ্য গঠন করেন। এই রাজ্য কখনও কখনও উত্তরে মালব থেকে দক্ষিণে সুদূর তঞ্জাবূর পর্যন্ত বিস্তৃতি লাভ করে। ধ্রুব, তৃতীয় গোবিন্দ ও তৃতীয় ইন্দ্রের মতো অশেষ পরাক্রমশালী রাজারা বাধার বিন্ধ্যাচল অতিক্রম করে উত্তর ভারতে সমরাভিযান পরিচালনা করেন, শক্তিশালী গুর্জর-প্রতীহারপাল নৃপতিদের পদানত করে সমকালীন ভারতীয় রাজনীতিতে দক্ষিণা শক্তির প্রাধান্য স্থাপন করেন। শুধু সমরাঙ্গনে নয়, শিল্প, বাণিজ্য, শিক্ষা, সাহিত্য, স্থাপত্য, ভাস্কর্য ইত্যাদি বিভিন্ন ক্ষেত্রেও রাষ্ট্রকূট রাজারা প্রশংসনীয় সাফল্যের পরিচয় দেন। তাঁদের আমলে বিদেশি বণিক সমাদরে গৃহীত হয়েছেন, ইসলামধর্মাবলম্বী পদস্থ রাজপুরুষের পদে নিযুক্ত হয়েছেন, রাষ্ট্রের আনুকূল্যে মসজিদ স্থাপিত হয়েছে, জৈনধর্মের অভূতপূর্ব বিস্তৃতি হয়েছে, জীব ও শিবের অভেদত্ব উচ্চারিত হয়েছে, দক্ষিণ ভারতে সংস্কৃত শিক্ষার প্রসার ঘটেছে, কন্নড়, তেলুগু ইত্যাদি আঞ্চলিক ভাষা বিকশিত হয়েছে। এরূপ বিবিধ ঘটনার সমাবেশে রাষ্ট্রকূট যুগ অবিস্মরণীয় হয়েছে।

গ্রন্থপঞ্জি

  • Altekar, A. S.: The Rashtrakutas And Their Times (Poona, 1967).
  • Banerjea, J. N. : The Development of Hindu Iconography (New Delhi, 1985).
  • Chattopadhyaya, B. D.: Coins And Currency System In South India: C. A. D. 225-1300 (New Delhi, 1977).
  • Desai, P. B. : Jainism In South India And Some Jain Epigraphs (Sholapur, 1957).
  • Majumdar, R. C. (Ed.) : The Age Of Imperial Kanauj (Bombay, 1955); A Comprehensive History of India, Vol. III, Pt. I (New Delhi, 1981).
  • Mishra, Jayashri : Social And Economic Conditions Under The Imperial Rashtrakūtas (New Delhi, 1992).
  • Murthy, A. V. N. The Coins Of Karnataka (Mysore, 1975).
  • Murthy, H. V. Sreenivas & R. Ramakrishna: A History of Karnataka (Delhi, 1977).
  • Rajan, K. V. Soundara: Art Of South India (Delhi, 1980).
  • Ramesh, K. V. : A History of South Kanara (Dharwar, 1970).
  • Sastri, K. A. Nilakanta: A History of South India (Oxford University Press, 1958).
  • Srinivasan, K. R.: Temples Of South India (New Delhi, 1985).
  • Yazdani, G.: The History Of The Deccan, Parts VII-XI (London, 1960).

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.