বাকাটক রাজবংশ (২৫০-৫০০ খ্রিস্টাব্দ)

Table of Contents

ভূমিকা

সাতবাহন রাজ্যের পতনের পর মধ্যপ্রদেশের এক বৃহদংশ এবং মহারাষ্ট্রের পূর্বাঞ্চলে এক শক্তিশালী রাজবংশের প্রতিষ্ঠা হয়। এই রাজবংশ ভারতের ইতিহাসে বাকাটক রাজবংশ নামে পরিচিত। শুধু সমরকুশলী নরপতিরূপে নয়, সাহিত্য ও সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকরূপেও বাকাটক রাজারা ভারতের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছেন। কাব্য ও সুভাষিতের রচয়িতারূপে এই বংশীয় রাজগণ সর্বভারতীয় খ্যাতি অর্জন করেছিলেন, তাঁদের রাজত্বকালে নির্মিত অজন্তা ও গুলবাড়ার সুদৃশ্য গুহাবিহার ও চৈত্য এবং অনুপম ভাস্কর্য ও গুহাচিত্র এই যুগকে অবিস্মরণীয় করে রেখেছে।

রাজবৃত্ত

বংশ পরিচয়, আদি রাজ্য ও আবির্ভাবকাল

বংশ-পরিচয় : বাকাটক বংশের আদি ইতিহাস রহস্যাবৃত। বংশের নাম কী করে বাকাটক হল তাও আমাদের অজানা। হয়তো কোনও ব্যক্তি বা স্থান বিশেষের নাম থেকে বংশের এই নামকরণ। ব্যক্তি বা স্থান বিশেষের নাম বকাট হওয়া সম্ভব। বকাটের বংশধর বা বকাটের অধিবাসী, এই অর্থে বাকাটক। বকাট নামে কোনও স্থানের অস্তিত্ব এখনও প্রমাণিত হয়নি। কাশী প্রসাদ জায়সওয়াল অভিমত প্রকাশ করেছেন, বুন্দেলখণ্ডের অন্তর্গত বাগাট স্থানটির নাম থেকেই বাকাটক পদটি নিষ্পন্ন হয়েছে। কিন্তু বাগাট আর বকাট এক নয়। এই ব্যাখ্যা সে কারণে যুক্তিগ্রাহ্য নয়। বাকাটক রাজারা জাতিতে ব্রাহ্মণ ছিলেন। লেখমালার সাক্ষ্যে তা স্পষ্ট। তাঁদের গোত্র বিষ্ণুবৃদ্ধ। অন্ধ্রপ্রদেশের গুণ্টুর জেলার অমরাবতীতে আবিষ্কৃত খ্রিস্টীয় ৩য় শতকের একখানি ভগ্ন প্রাকৃত লেখে বাকাটক নামে জনৈক গৃহপতির উল্লেখ আছে। তিনি অমরাবতীতে তীর্থভ্রমণে এসেছিলেন। বাসুদেব বিষ্ণু মিরাশি মনে করেন, গৃহপতি বাকাটকই বাকাটক বংশের আদি পুরুষ; তাঁর নাম থেকেই বংশের নাম হয়েছে বাকাটক এবং তিনি অমরাবতীর নিকটবর্তী কোনও এক স্থানে বসবাস করতেন। তাঁর অভিমত, বাকাটক রাজগণের আদি বাসভূমি অন্ধ্রপ্রদেশেই অবস্থিত ছিল। কিন্তু এ অভিমত বিতর্কিত।

  • প্রথমত, গৃহপতি বাকাটকের সঙ্গে বাকাটক রাজবংশের সম্পর্ক এখনও প্রতিষ্ঠিত হয়নি।
  • দ্বিতীয়ত, গৃহপতি বাকাটক অন্ধ্রপ্রদেশের অধিবাসী ছিলেন, এ কথাও নিঃসংশয়ে বলা যায় না।

আদি বাকাটক রাজ্য : আদি বাকাটক রাজ্যের ভৌগোলিক অবস্থান সম্পর্কেও অনিশ্চয়তা রয়েছে।

  • রাজ্যটি প্রথমে আর্যাবর্তে গড়ে ওঠে, এরূপ এক অভিমত আছে। বলা হয়ে থাকে, গুপ্ত সম্রাট সমুদ্রগুপ্তের হাতে পরাজিত আর্যাবর্তরাজ রূদ্রদেবই বাকাটক প্রথম রুদ্রসেন। কিন্তু মহারাষ্ট্রের এক বৃহদংশ প্রথম রুদ্রসেনের রাজ্যভুক্ত ছিল; তিনি ছিলেন মূলত দক্ষিণাপথের রাজা।
  • আদি বাকাটক রাজ্য বিদিশার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে অবস্থিত ছিল, এরূপ এক মতও ব্যক্ত হয়েছে। পৌরাণিক সাক্ষ্য এই মতের ভিত্তিস্বরূপ। পুরাণে বিদিশার নাগরাজগণের সঙ্গে বাকাটক রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা বিন্ধ্যশক্তির নাম উল্লিখিত হয়েছে। এ থেকে অনুমিত হয়েছে, বিন্ধ্যশক্তি বিদিশার নিকটবর্তী অঞ্চলে রাজত্ব করতেন। কিন্তু বিন্ধ্যশক্তি সম্পর্কে পৌরাণিক বর্ণনা খুব একটা স্পষ্ট নয়। বিদিশার নাগ রাজপরিবারের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক সম্বন্ধেও কোনও সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই। ফলে পৌরাণিক তথ্যের ভিত্তিতে আদি বাকাটক রাজ্যের অবস্থান নির্ধারণ করা দুঃসাধ্য হয়ে পড়েছে।
  • তবে মধ্যপ্রদেশের এক সুবিস্তীর্ণ অঞ্চল বাকাটক রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। এখানে বাকাটক রাজাদের কয়েকখানি লেখ আবিষ্কৃত হয়েছে। হয়তো আদি বাকাটক রাজ্য মধ্যপ্রদেশের একাংশে গড়ে উঠেছিল। কিন্তু মধ্য ভারতে গুপ্ত আধিপত্য ক্রমশ বিস্তার লাভ করায় বাকাটকরা পরবর্তী কালে মহারাষ্ট্রে প্রভুত্ব স্থাপনে উদ্যোগী হন।
  • লক্ষ করবার বিষয়, বাকাটক রাজ্যের দু’টি প্রতিষ্ঠিত রাজধানী নন্দিবর্ধন ও বৎস্যগুল্ম (বৎসগুল্ম), কোনওটিই মধ্যপ্রদেশে অবস্থিত নয়। এদের অবস্থান যথাক্রমে মহারাষ্ট্রের নাগপুর ও অকোলা জেলায়। দু’টি রাজধানীই মহারাষ্ট্রের পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত হওয়ায় মনে হতে পারে, আদি বাকাটক রাজ্য বিদর্ভের কিয়দংশেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এখান থেকেই পরে বাকাটক আধিপত্য মধ্যপ্রদেশে বিস্তৃত হয়।
  • আদি বাকাটক রাজ্য পশ্চিম মধ্যপ্রদেশ না পূর্ব মহারাষ্ট্রে অবস্থিত ছিল, তা এখনও সুনিশ্চিত নয়। (অজয়মিত্র শাস্ত্রী (The Age Of The Vākālaks, পৃষ্ঠা ১০) অভিমত প্রকাশ করেছেন আদি বাকাটক রাজ্য মধ্যপ্রদেশের বুন্দেলখণ্ড-বাঘেলখণ্ড অঞ্চলে অবস্থিত ছিল। যে রাজ্য পশ্চিমে বুন্দেলখণ্ড থেকে পূর্বদিকে বাঘেলখণ্ড পর্যন্ত বিস্তৃত, সে রাজ্য আয়তনে বিশালই ছিল, বলতে হবে। বিন্ধ্যশক্তি এরূপ বিশাল রাজ্যের অধিপতি ছিলেন, এ ধারণা কষ্টকল্পিত। সম্ভবত বুন্দেলখণ্ডের পূর্বদিকবর্তী অঞ্চল তাঁর রাজ্যভুক্ত ছিল না।)

আবির্ভাব কাল :

  • বাকাটক রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা বিন্ধ্যশক্তি ২৪৮-৪৯ খ্রিস্টাব্দের কলচুরি-চেদি অব্দের প্রতিষ্ঠাতা বলে বহুদিন পূর্বে কাশীপ্রসাদ জায়সওয়াল অভিমত প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু বাকাটক লেখমালায় কলচুরি-চেদি অব্দের কথা নেই, আছে রাজাদের রাজ্যবর্ষের উল্লেখ ৷ বিন্ধ্যশক্তি কোনও অব্দ প্রচলন করলে বাকাটক লেখে তার ব্যবহার দেখা যেত। বিন্ধ্যশক্তি কোনও অব্দ প্রবর্তন করেছেন, এমনটি বোধ হয় না। শুধু একটিমাত্র বাকাটক লেখে এক প্রচলিত অব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। সে অব্দ শকাব্দ। লেখটি মহারাজ দেবসেনের হিস্সে বোরালা প্রস্তর লেখ। ৩৮০ শকাব্দে (খ্রিস্টাব্দ ৪৫৮) লেখটি উৎকীর্ণ।
  • পৌরাণিক সাহিত্যে বাকাটক রাজবংশের প্রতিষ্ঠাকাল সম্পর্কে কিছু ইঙ্গিত আছে। পুরাণের রাজবংশাবলি সম্পর্কিত অধ্যায়ে গুপ্ত রাজপরিবারের কথা আছে ; প্রয়াগ, সাকেত ও মগধে গুপ্ত রাজ্য বিস্তারের উল্লেখ আছে কিন্তু গুপ্ত রাজাদের নাম অনুক্তই থেকে গেছে। এতে স্পষ্ট হয়, পুরাণের বংশানুচরিত অধ্যায় খ্রিস্টীয় ৪র্থ শতকের দ্বিতীয় পাদে রচিত হয়েছিল। সমুদ্রগুপ্তের আর্যাবর্ত অভিযান তখনও শুরু হয়নি। পুরাণে বিন্ধ্যশক্তি এবং তাঁর পুত্র প্রবীরের উল্লেখ আছে। অনুমিত হয়, বিন্ধ্যশক্তি ও তাঁর পুত্রের রাজত্বপর্ব খ্রিস্টীয় ৪র্থ শতকের দ্বিতীয় পাদের পূর্বেই সমাপ্ত হয়। সেক্ষেত্রে বিন্ধ্যশক্তি খ্রিস্টীয় ৩য় শতকের দ্বিতীয়ার্ধে রাজত্ব করেন, এমন অনুমানই যুক্তিযুক্ত বোধ হয়।
  • বিষয়টিকে একটু অন্যভাবেও দেখা যেতে পারে। বিন্ধ্যশক্তি ছিলেন প্রথম পৃথিবীষেণের বৃদ্ধ প্রপিতামহ। পৃথিবীষেণের এক পুত্রের সঙ্গে সমুদ্রগুপ্তের পুত্র দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের (আ ৩৭৬ ৪১৫ খ্রিস্টাব্দ) কন্যা প্রভাবতীগুপ্তার বিবাহ হয়। পৃথিবীষেণ সম্ভবত খ্রিস্টীয় ৪র্থ শতকের তৃতীয়-চতুর্থ পাদে রাজত্ব করেন। তাঁর সঙ্গে বিন্ধ্যশক্তির চার পুরুষের ব্যবধান। ফলে খ্রিস্টীয় ৩য় শতকের তৃতীয় পাদে বিন্ধ্যশক্তি রাজপদে অধিষ্ঠিত ছিলেন, এমন ধারণাই সংগত বোধ হয়। বিন্ধ্যশক্তি প্রায় দু’দশক কাল রাজত্ব করেন। তাঁর রাজপদলাভের সম্ভাব্য তারিখ ২৫০ খ্রিস্টাব্দে ধার্য করা যায়।

বিন্ধ্যশক্তি (আ ২৫০-৭০ খ্রিস্টাব্দ)

বাকাটক রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা বিন্ধ্যশক্তি। হরিষেণের রাজত্বকালে উৎকীর্ণ অজন্তা লেখে তাঁকে ‘দ্বিজ’ এবং ‘বাকাটক-বংশ-কেতু’ বলে পরিচিত করা হয়েছে কিন্তু রাজা বা মহারাজরূপে বর্ণনা করা হয়নি। স্বহস্তে রাজদণ্ড ধারণ করলেও তিনি হয়তো আনুষ্ঠানিকভাবে কোনও রাজকীয় অভিধা গ্রহণ করেননি। খ্রিস্টপূর্ব ২য় শতকে সেনাপতি পুষ্যমিত্র রাজপদে সমাসীন হয়েও রাজা উপাধিতে ভূষিত হননি। বিদর্ভের একাংশে না পশ্চিম মধ্যপ্রদেশের খণ্ডিতাংশে কিংবা উভয় অঞ্চলের কিয়দংশে বিন্ধ্যশক্তি রাজত্ব করেন, তা সঠিক বলা যায় না। তবে সাতবাহন রাজ্যের দুর্বলতার সুযোগেই যে তাঁর রাজনৈতিক অভ্যুত্থান, তা নিশ্চিত।

প্রথম প্রবরসেন (আ. ২৭০-৩৩০ খ্রিস্টাব্দ)

বিন্ধ্যশক্তির মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র হারিতী পুত্র প্রথম প্রবরসেন পৈতৃক সিংহাসনে আরোহণ করেন। তাঁর রাজত্বকালে বাকাটক রাজ্য চতুর্দিকে প্রসারিত হয়। মহারাজ উপাধিধারী এই রাজা পুরাণে প্রবীর নামে প্রসিদ্ধ। বংশের শ্রেষ্ঠ রাজা তিনি। পুরাণ থেকে জানা যায়, শিশুক নামে এক প্রতিদ্বন্দ্বী নরপতিকে পরাজিত করে তিনি পুরিকা অধিকার করেন। সম্ভবত সাতপুরা পাহাড়ের পাদদেশে শহরটি অবস্থিত ছিল। পৈতৃকসূত্রে যে রাজ্য তিনি লাভ করেন তা আয়তনে ছিল ক্ষুদ্র, সংকীর্ণ। প্রবরসেন বাকাটক রাজ্যের সীমানা চতুর্দিকে বিস্তৃত করেন। মহারাষ্ট্রের প্রায় সর্বত্র বাকাটক অধিকার প্রসারিত হয়। বাকাটক রাজ্য উত্তর-পশ্চিমে নর্মদা নদী পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। পূর্বদিকেও তিনি উল্লেখযোগ্য সাফল্য লাভ করেন। মধ্যপ্রদেশের এক বিস্তীর্ণ অঞ্চল তাঁর পদানত হয়। দক্ষিণ কোসলও সম্ভবত তাঁর অধিকারভুক্ত হয়। এ সময় দক্ষিণ ভারতে কদম্বপল্লব রাজগণ রাজত্ব করতেন। কৃষ্ণা নদীর উত্তর কূলে তাঁরা কখনও রাজ্য বিস্তার করেননি। কৃষ্ণা নদীর উত্তর তীরবর্তী অঞ্চল প্রবরসেনের রাজ্যভুক্ত ছিল। অর্থাৎ অন্ধ্রপ্রদেশের বৃহদংশ বাকাটক রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। উত্তরে বুন্দেলখণ্ড থেকে দক্ষিণে কৃষ্ণা নদী পর্যন্ত বিস্তৃত ভূখণ্ডের অধিপতি ছিলেন প্রবরসেন। এ সময় গুজরাতে শক রাজারা রাজত্ব করতেন। শক শাসক দ্বিতীয় রুদ্রসিংহদ্বিতীয়যশোদামা প্রবরসেনের সমকালীন ছিলেন। তাঁদের পূর্বসূরিরা সকলেই মহাক্ষত্রপ উপাধি ধারণ করেছেন কিন্তু তাঁরা দু’জনে আজীবন ক্ষত্ৰপ উপাধিতেই সন্তুষ্ট ছিলেন। তাঁরা যে স্বাধীন, সার্বভৌম ছিলেন না, তাঁদের উপাধিতেই তা প্রমাণিত হয়। তাঁরা সম্ভবত প্রবরসেনের অনুগত ছিলেন। মধ্যপ্রদেশের পদ্মাবতীর ভারশিব বংশীয় নরপতি ভবনাগ তাঁর এক কন্যার সঙ্গে প্রবর সেনের জ্যেষ্ঠ পুত্র গৌতমীপুত্রের বিবাহ দেন। বাকাটক লেখে এই বৈবাহিক সম্পর্কের উপর প্রভূত গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। ভবনাগ হয়তো প্রবরসেনকে রাজ্য বিস্তারে সহায়তা প্রদান করেন। বৈদিক ধর্মের অনুরাগী ছিলেন প্রথম প্রবরসেন। পুরাণে ও লেখমালায় তাঁর বহু যাগ-যজ্ঞানুষ্ঠানের উল্লেখ আছে। তিনি অগ্নিষ্টোম, আপ্তোর্যাম, জ্যোতিষ্টোম, বৃহস্পতিসব, সাদ্যসস্ক্র, উক্‌থ্য, ষোড়শী, অতিরাত্র ইত্যাদি বিভিন্ন বৈদিক যজ্ঞের অনুষ্ঠান করেন। তাছাড়া তিনি চার চারটি অশ্বমেধ যজ্ঞেরও আয়োজন করেন। সামরিক প্রতিভা, সংগঠন শক্তি ও ধর্মানুরাগের সমন্বয় ঘটেছিল প্রথম প্রবরসেনের চরিত্রে। তৎকালীন ভারতে তাঁর মতো পরাক্রমশালী রাজা আর কেউ ছিলেন না। সংগত কারণেই পারিবারিক লেখমালায় তাঁকে সম্রাটরূপে বর্ণনা করা হয়েছে। এ প্রশংসা অপর কোনও বাকাটক রাজার ভাগ্যে জোটেনি। পুরাণে উল্লেখ আছে, তিনি ৬০ বৎসর রাজত্ব করেন। ঐতিহাসিকেরা পৌরাণিক সাক্ষ্যের সত্যতা স্বীকার করেছেন।

প্রথম রুদ্রসেন (আ. ৩৩০-৬০ খ্রিস্টাব্দ)

প্রথম প্রবরসেনের জীবদ্দশায় তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র গৌতমীপুত্রের দেহাবসান হয়। ফলে গৌতমীপুত্রের পুত্র প্রথম রুদ্রসেন তাঁর পিতামহের মৃত্যুর পর রাজপদ লাভ করেন। কিন্তু তিনি সমগ্র বাকাটক ভূখণ্ডের অধীশ্বর হলেন না, রাজ্যের একাংশের কর্তৃত্ব লাভ করলেন। রাজ্যের অপরাংশের রাজা হলেন প্রবরসেনেরই এক পুত্র সর্বসেন। বৎসগুল্ম (বৎস্যগুল্ম) বা অকোলা জেলার বর্তমান বাশিম হল তাঁর রাজধানী। বৎসগুল্মের বাকাটকরা গৌণ বাকাটক শাখা নামে পরিচিত। প্রাচীন নন্দিবর্ধনে বা নাগপুর জেলার অন্তর্ভুক্ত আধুনিক নন্দর্ধন বা নগর্ধনে সম্ভবত প্রথম রুদ্রসেনের প্রশাসনিক কেন্দ্র স্থাপিত হয়। (নগর্ধন বা নন্দধন নাগপুর শহরের আনুমানিক ২১ কি.মি. উত্তরে অবস্থিত। এ প্রসঙ্গে আরও একটি স্থানের নাম করা হয়। সে স্থান নন্দপুর। স্থানটি নগর্ধন বা নন্দধন থেকে আরও ৩৩ কি.মি. উত্তরে। বিষয়টি অবশ্যই বিতর্কিত। বাসুদেব বিষ্ণু মিরাশির অভিমত, প্রথম রুদ্রসেনের রাজধানী ছিল পুরিকা, আর রুদ্রসেনের পুত্র প্রথম পৃথিবীষেণই সম্ভবত নন্দিবর্ধনে রাজধানী স্থানান্তরিত করেন। ঠিক কখন নন্দিবর্ধনে রাজধানী স্থানান্তরিত হয় সে সম্পর্কে দীনেশচন্দ্র সরকারেরও সংশয় রয়েছে। প্রথম পৃথিবীষেণ বা দ্বিতীয় রুদ্রসেনের কোনও অভিলেখ আবিষ্কৃত হয়নি। দেওটেকে প্রথম রুদ্রসেনের যে লেখটি পাওয়া গেছে তা অতিশয় ভগ্ন, তাতে রাজধানীর উল্লেখ নেই। তথ্যের অপ্রতুলতায় এ মুহূর্তে এ সম্পর্কে কোনও সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্তে পৌঁছানো সম্ভব নয়। প্রথম রুদ্রসেন বা প্রথম পৃথিবীষেণের কোনও পূর্ণাঙ্গ লেখ আবিষ্কৃত হলে হয়তো এ সমস্যার সমাধান হবে।) রুদ্রসেনের বংশধারা মুখ্য বাকাটক শাখার পরিচিতি লাভ করেছে।

অখণ্ড বাকাটক রাজ্যের এই দ্বিধা বিভাজন প্রক্রিয়ার পিছনে অবশ্যই কোনও কারণ ছিল। হয়তো প্রবরসেনের এরূপই নির্দেশ ছিল। কিংবা হয়তো রাজ্যের অধিকার নিয়ে প্রথম রুদ্রসেন ও তাঁর খুল্লতাত সর্বসেনের মধ্যে সংঘটিত সংঘর্ষের পরিণামেই এই বিভাজন। লেখমালায় প্রথম রুদ্রসেনের পরিচিতি প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, তিনি ভবনাগের দৌহিত্র। হতে পারে, পিতামহের রাজ্যে স্বাধিকার প্রতিষ্ঠায় তিনি মাতামহ ভবনাগের অকুণ্ঠ সহযোগিতা লাভ করেছিলেন।

এ সময় রাজ্যের পূর্ব সীমান্তে গোলযোগ দেখা দেয়। বাকাটক রাজ্যে উদ্ভূত পরিস্থিতির সুযোগে কয়েকজন রাজনৈতিক ভাগ্যান্বেষী বা পূর্বতন প্রশাসক দক্ষিণ কোসল এবং কলিঙ্গ অন্ধ্রপ্রদেশের উপকূলভাগে স্বাধীন রাজ্য স্থাপন করেন। এঁদের মধ্যে ছিলেন কোসলের মহেন্দ্র, মহাকান্তারের ব্যাঘ্ররাজ, কুরালের মণ্টরাজ, পিষ্টপুরের মহেন্দ্রগিরি এবং আরও কয়েকজন। এদিকে মধ্যপ্রদেশের এক বিস্তীর্ণ অঞ্চল থেকেও বাকাটকরা বিতাড়িত হলেন। সেখানে কয়েকটি নতুন রাজতান্ত্রিক ও গণরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রথম রুদ্রসেনের রাজ্য আয়তনে সংকুচিত হয়ে উত্তর বিদর্ভ এবং মধ্যপ্রদেশের কিয়দংশে সীমাবদ্ধ হয়। গুজরাতের শক শাসকবৃন্দও আর বাকাটকদের অনুগত রইলেন না। আনুমানিক ৩৪০ খ্রিস্টাব্দ থেকে তাঁরা পুনরায় মহাক্ষত্রপ উপাধি ধারণ করতে থাকেন। শৈবধর্মের অনুরাগী ছিলেন রুদ্রসেন। লেখমালায় ‘মহাভৈরবভক্ত বলে তিনি বর্ণিত হয়েছেন। নাগপুরের কাছে দেওটেকে তিনি একটি শিবমন্দির প্রতিষ্ঠা করেন।

প্রথম পৃথিবীষেণ (আ. ৩৬০-৪০০ খ্রিস্টাব্দ)

প্রথম রুদ্রসেনের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র প্রথম পৃথিবীষেণ নন্দিবর্ধনের সিংহাসনে আরোহণ করেন। পিতার মতো তিনিও শিবের ভক্ত ছিলেন। লেখে তাঁকে ‘ধর্মবিজয়ী’ আখ্যা দেওয়া হয়েছে এবং সত্যনিষ্ঠ যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে।

বুন্দেলখণ্ডের নাচনে কী তলাঈ ও গঞ্জ নামে দু’টি স্থানে জনৈক ব্যাঘ্রদেবের দু’খানি লেখ পাওয়া গেছে। লেখ দু’টিতে ব্যাঘ্রদেব নিজেকে পৃথিবীষেণের অনুগত (বাকাটকানাং মহারাজ শ্রীপৃথিবীষেণ-পাদানুধ্যাত) বলে পরিচয় দিয়েছেন। অনেকেই এই পৃথিবীষেণকে দ্বিতীয় পৃথিবী ষেণরূপে শনাক্ত করেছেন। এ অভিমত গ্রহণ করলে ব্যাঘ্রদেবের আবির্ভাবকাল খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতকের দ্বিতীয়ার্ধে ধার্য করতে হয়। তখন উচ্ছকল্প বংশীয় রাজগণ বুন্দেলখণ্ডে রাজত্ব করতেন। তাঁরা ‘মহারাজ’ অভিধায় ভূষিত ছিলেন। তাঁরা লেখে একটি অব্দও ব্যবহার করেছেন। অব্দটি সম্ভবত গুপ্তাব্দ। ব্যাঘ্রদেব কোনও অভিধা ব্যবহার করেননি। তাঁর লেখ দু’টিতে কোনও অব্দেরও উল্লেখ নেই। ব্যাঘ্রদেব দ্বিতীয় পৃথিবীষেণের সমকালবর্তী ছিলেন না, তিনি ছিলেন প্রথম পৃথিবীষেণের অধীনস্থ এক আঞ্চলিক প্রশাসক। ব্যাঘ্রদেবের লেখ দু’টি প্রমাণ করছে, বুন্দেলখণ্ড প্রথম পৃথিবীষেণের অধিকারভুক্ত ছিল। তবে তিনি বুন্দেলখণ্ড অধিকার করেন, না উত্তরাধিকারসূত্রে লাভ করেন, তা স্পষ্ট নয়। কিন্তু সমুদ্রগুপ্ত অচিরে এ অঞ্চল জয় করেন।

পৃথিবীষেণের পুত্র দ্বিতীয় রুদ্রসেনের সঙ্গে গুপ্ত সম্রাট দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের কন্যা প্রভাবতী গুপ্তার বিবাহ বাকাটক রাজপরিবারের ইতিহাসে এক স্মরণীয় ঘটনা। এই বিবাহ যে পৃথিবীষেণের রাজত্বকালেই অনুষ্ঠিত হয়েছিল, এমন কথা নিশ্চিতরূপে বলা যায় না। ঘটনাটি দ্বিতীয় রুদ্রসেনের রাজত্বকালেও অনুষ্ঠিত হতে পারে। উভয় পরিবারের রাজনৈতিক স্বার্থের খাতিরে এই বিবাহ জরুরি হয়ে দেখা দেয়। বুন্দেলখণ্ডে গুপ্ত প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় বাকাটকগণ আতঙ্কিত হন। গুপ্ত রাজপরিবারের সঙ্গে মৈত্রী স্থাপন করে দক্ষিণ দিকে গুপ্তদের আগ্রাসনের অবসান ঘটাতে তাঁরা বদ্ধপরিকর হলেন। এদিকে গুপ্ত সিংহাসনে তখন সমুদ্রগুপ্তের পুত্র দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত। শক মহাক্ষত্রপদের বিতাড়িত করে গুজরাত এবং সংলগ্ন অঞ্চলে আধিপত্য বিস্তারে তিনি সংকল্পবদ্ধ। শকদের প্রতিবেশী বাকাটকগণের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক তাঁর উদ্দেশ্য সিদ্ধির পথ প্রশস্ত করবে, এমনটি ভাবাই তাঁর পক্ষে স্বাভাবিক ছিল। অনুমান করা যায়, বাকাটকগণ শকদের বিরুদ্ধে অভিযানে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তকে প্রভূত সাহায্য করেছিলেন। লেখে প্রথম পৃথিবীষেণকে ‘পুত্রপৌত্ৰিণঃ’ বলা হয়েছে। অর্থাৎ তিনি পুত্র-পৌত্র পরিবৃত ছিলেন। তিনি দীর্ঘকাল রাজত্ব করেন।

দ্বিতীয় রুদ্রসেন (আ. ৪০০-০৫ খ্রিস্টাব্দ)

প্রথম পৃথিবীষেণের পর তাঁর পুত্র দ্বিতীয় রুদ্রসেন পিতার স্থলাভিষিক্ত হন। তাঁর পত্নী প্রভাবতীগুপ্তা দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত ও রাজমহিষী কুবেরনাগার কন্যা ছিলেন। এতদিন বাকাটক রাজারা শৈবধর্মানুরাগী ছিলেন কিন্তু পত্নী ও শ্বশুরকুলের প্রভাবে দ্বিতীয় রুদ্রসেন চক্রপাণি বা বিষ্ণুর ভক্ত হন। দীনেশচন্দ্র সরকারের অভিমত, এ সময় থেকে নন্দি বর্ধনের বাকাটক রাজগণের আর স্বাধীন সত্তা থাকল না, তাঁরা গুপ্ত সম্রাটদের অনুগত মিত্রে পরিণত হন। লক্ষ করবার বিষয়, বাকাটক লেখে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের উল্লেখ প্রসঙ্গে বার বার ‘মহারাজাধিরাজ’ অভিধা ব্যবহার করা হয়েছে অথচ বাকাটকেরা নিজেদের কেবল ‘মহারাজ’ রূপে বর্ণনা করেছেন। বাকাটক প্রশাসন উদ্দেশ্যহীনভাবে সরকারি নথিপত্রে ‘মহারাজ’ ও ‘মহারাজাধিরাজ’ অভিধা দু’টি ব্যবহার করেছেন, এটা স্বাভাবিক ঘটনা নয়। কিন্তু এ মত সঠিক নাও হতে পারে। বাকাটক লেখে সমুদ্রগুপ্তকেও ‘মহারাজ’ বলা হয়েছে। বাকাটক লেখমালায় গুপ্তাব্দের ব্যবহার নেই। ফলে বাকাটকরা গুপ্তদের অধীন ছিলেন, এ সিদ্ধান্তে সংশয়ের অবকাশ আছে।

অল্প দিন রাজত্ব করার পর দ্বিতীয় রুদ্রসেন অকালে প্রাণত্যাগ করেন। তখন তাঁর দুই পুত্ৰই নাবালক ছিলেন। তাঁরা হলেন দিবাকরসেন এবং দামোদরসেন। (দামোদরসেন এবং প্রবরসেন এক ব্যক্তি ছিলেন, এ মত কেউ কেউ স্বীকার করেন না। তাঁদের ধারণা, দ্বিতীয় রুদ্রসেনের তিন পুত্র–দিবাকরসেন, দামোদরসেন এবং প্রবরসেন। কিন্তু এ মত ভ্রান্ত।) এই দামোদরসেন পরবর্তী কালে সিংহাসনে আরোহণ করে প্রবরসেন নাম গ্রহণ করেন। পুত্ররা দু’জনেই মহিষী প্রভাবতী গুপ্তার গর্ভজাত।

প্রভাবতীগুপ্তার প্রতিনিধিত্বমূলক প্রশাসনিক ভূমিকা (আ. ৪০৫-২০ খ্রিস্টাব্দ)

দ্বিতীয় রুদ্রসেনের মৃত্যুকালে তাঁর পুত্ররা নাবালক ছিলেন। রাজ্যের এই দুঃসময়ে জ্যেষ্ঠ পুত্র দিবাকরসেন যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত হন। কিন্তু তিনি অল্পবয়স্ক হওয়ায় রানিমা প্রভাবতীগুপ্তা পুত্রের প্রতিনিধিরূপে বাকাটক রাজ্যের শাসনভার স্বহস্তে গ্রহণ করেন। তাঁর শাসনকালের ত্রয়োদশ বৎসরে নন্দিবর্ধন থেকে প্রদত্ত একখানি তাম্রশাসন মহারাষ্ট্রের পুণে শহরে আবিষ্কৃত হয়েছে। এই লেখে তিনি যুবরাজ দিবাকরসেনের মাতারূপে বর্ণিত হয়েছেন। অর্থাৎ তখনও তিনি জ্যেষ্ঠ পুত্রের প্রতিনিধিত্ব করছেন।

পুণে তাম্রশাসনের বর্ণমালা গুপ্ত বর্ণমালার অনুরূপ। বাকাটক লেখেও একই বর্ণমালা তবে তা আকারে ও ধরনে একটু ভিন্ন। তাছাড়া পুণে লেখে গুপ্ত বংশ-তালিকা দেওয়া হয়েছে, বাকাটক বংশ তালিকার উল্লেখ নেই। মনে হচ্ছে, বাকাটক রাজ্যের পরিচালন ব্যবস্থায় গুপ্ত প্রশাসনের এক সক্রিয় ভূমিকা ছিল। কন্যার কাজে সাহায্য করার জন্য দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত সম্ভবত পাটলিপুত্র থেকে একদল সুদক্ষ রাজপুরুষকে নন্দিবর্ধনে প্রেরণ করেন। মহাকবি কালিদাসও হয়তো চন্দ্রগুপ্তের অনুরোধে কিছুকাল বিদর্ভে অবস্থান করেন। অনুমান করার যথেষ্ট কারণ আছে, এখানে অবস্থানকালে কালিদাস তাঁর অমর কাব্য মেঘদূত রচনা করেন। এই কাব্যে বিরহী যক্ষের নিবাসস্থল রামগিরির এক মনোজ্ঞ বর্ণনা আছে। নাগপুর শহরের নিকটবর্তী রামটেক পাহাড়ই ঐতিহ্যমণ্ডিত সেই রামগিরি।

পরবর্তী কালে প্রভাবতীগুপ্তা ঋদ্ধপুর তাম্রশাসন উৎকীর্ণ করেন। তখন তিনি বাকাটক রাজ্যের শাসনকর্ত্রী নন, তখন তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র দ্বিতীয় প্রবরসেনের রাজত্বের ঊনবিংশতি বৎসর। দিবাকরসেন সম্ভবত সিংহাসনে আরোহণ করেননি। অপ্রাপ্ত বয়সেই তিনি দেহত্যাগ করেন। প্রভাবতীগুপ্তা দীর্ঘদিন জীবিত ছিলেন। ঋদ্ধপুর লেখে তাঁকে ‘সাগ্রবর্ষশত-জীব-পুত্রপৌত্রা বলে বর্ণনা করা হয়েছে। রমেশচন্দ্র মজুমদার মনে করেন, পুত্র-পৌত্র পরিবৃত প্রভাবতীগুপ্তা এক শতকেরও অধিককাল জীবিত ছিলেন। তাহলে স্বীকার করতে হয়, প্রভাবতীগুপ্তার ৩৪০ খ্রিস্টাব্দেরও পূর্বে জন্ম হয়েছিল। কিন্তু তখন হয়তো দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তেরই জন্ম হয়নি। বর্ণনাটি নিঃসন্দেহে অত্যুক্তিমূলক। বাসুদেব বিষ্ণু মিরাশি কথাটিকে অন্যভাবে ব্যাখ্যা করেছেন।

তাঁর অভিমত, ‘সাগ্রবর্ষশত’ কথাংশটি প্রভাবতীগুপ্তার পুত্র-পৌত্রদের বিশেষণ, এবং তাঁর পুত্র-পৌত্রদের শত বৎসরের পরমায়ু হোক, বৃদ্ধা রাজমাতার এই শুভকামনাই এখানে ধ্বনিত হয়েছে। রাজকার্য থেকে অবসর গ্রহণের পর রাজমাতা ধর্ম-কর্মে মনোনিবেশ করেন। ‘শ্রীরামচন্দ্রের পদরঞ্জিত’ রামগিরি পরিদর্শন করে কতিপয় ব্রাহ্মণদের অনুকূলে তিনি ভূমি ও গৃহ দান করেন। (এখানে সম্ভবত দেবতা রামস্বামীর একটি মন্দির ছিল।) ঋদ্ধপুর তাম্রশাসন এই উপলক্ষেই উৎকীর্ণ হয়। দ্বিতীয় প্রবরসেনের ২৩শ রাজ্যবর্ষে তিরোদি লেখ উৎকীর্ণ হয়। প্রভাবতীগুপ্তা তখনও জীবিত।

দ্বিতীয় প্রবরসেন (আ. ৪২০-৫৫ খ্রিস্টাব্দ)

বাকাটক বংশের পরবর্তী রাজা দ্বিতীয় প্রবরসেন। অনেকেই মনে করেন, দ্বিতীয় প্রবরসেনের সিংহাসনে আরোহণের পূর্বে তাঁর মধ্যম ভ্রাতা দামোদরসেন দীর্ঘদিন রাজত্ব করেন। এ মতের সমর্থনে দু’টি যুক্তি দেওয়া হয়।

  • প্রথমত, ঋদ্ধপুর তাম্রশাসনে প্রভাবতীগুপ্তাকে ‘মহারাজ শ্রীদামোদরসেন-প্রবরসেন-জননী’ বলা হয়েছে। এর অর্থ, প্রভাবতীগুপ্তা মহারাজ দামোদরসেন এবং প্রবরসেনের জননী ছিলেন।
  • দ্বিতীয়ত, ঋদ্ধপুর লেখের সম্প্রচারকালে প্রভাবতীগুপ্তার বয়স একশো বছরেরও অধিক ছিল। তখন দ্বিতীয় প্রবরসেনের রাজত্ব সবেমাত্র ঊনবিংশতি বৎসরে পদার্পণ করেছে। দামোদরসেন দীর্ঘদিন রাজত্ব না করলে প্রভাবতীগুপ্তার অত বয়স হয় কী করে?

কিন্তু এ যুক্তি ঠিক নয়।

  • দ্বিতীয় প্রবরসেনের রাজত্বকালেই ঋদ্ধপুর লেখখানি উৎকীর্ণ হয়। কিন্তু আলোচ্যমান বাক্যাংশে প্রবর সেনের নামের পূর্বে মহারাজ অভিধা নেই, মহারাজ উপাধি আছে দামোদরসেনের নামের পূর্বে। এর অর্থ, দামোদরসেন এবং প্রবরসেন একই ব্যক্তি ছিলেন। দামোদরসেনেরই অভিষেক নাম প্রবরসেন। প্রবরসেনের নামের পূর্বে ‘শ্রী’ শব্দের অনুল্লেখ এবং দামোদরসেনের নামের পূর্বে তার ব্যবহার একই ইঙ্গিত বহন করছে।
  • দ্বিতীয়ত, প্রবরসেনের ঊনবিংশতি রাজ্যবর্ষে প্রভাবতীগুপ্তা শত বর্ষ অতিক্রম করেছিলেন, এ যুক্তিও ত্রুটিপূর্ণ।

মিরেগাঁও তাম্রশাসনের সিলমোহরে প্রসবতীগুপ্তাকে দু’জন পরাক্রান্ত বাকাটক ‘নরেন্দ্র’-এর জননী (বিক্রান্তয়ো = জর্নন্যা = স্তু বাকাটক-নরেন্দ্রয়োঃ) বলা হয়েছে। অজয় মিত্র শাস্ত্রী মনে করেন, দু’জন পরাক্রান্ত বাকাটক নরেন্দ্রের একজন দামোদরসেন, অন্যজন প্রবরসেন। (Ajay Mitra Shastri, Early History of The Deccan (Delhi, 1987), পৃষ্ঠা ৫১-৫২।) তাঁর অভিমত, দিবাকরসেন এই বাকাটক নরেন্দ্র দু’জনের একজনও নন, তিনি ছিলেন যুবরাজ। অজয়মিত্র শাস্ত্রীর এ অভিমত সম্পর্কে দু’চারটি কথা বলার আছে।

  • প্রথমত, দামোদরসেন ও প্রবরসেনকে দুই স্বতন্ত্র ব্যক্তিরূপে স্বীকার করলে শেষোক্ত জনের নামের পূর্বে মহারাজ ও শ্রী শব্দের অনুল্লেখ ইত্যাদি কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে অযথা লঘু ভাবে গ্রহণ করতে হয়।
  • দ্বিতীয়ত, পুণে তাম্রশাসনে দিবাকরসেনকে যুবরাজ বলা হলেও তাঁকে সংশ্লিষ্ট সিলমোহরে উত্তরাধিকারসূত্রে নৃপশ্রী অর্থাৎ রাজৈশ্বর্যের অধিকারী রূপে (ক্রমপ্রাপ্ত-নৃপশ্রিয়ঃ) বর্ণনা করা হয়েছে। এ হেন পুত্র মরণোত্তর পর্বে তাঁর মায়ের দৃষ্টিতে নরেন্দ্ররূপে প্রতিভাত হবেন, এ তো স্বাভাবিক ঘটনা। মনে রাখতে হবে, বাকাটক রাজাদের আনুষ্ঠানিক রাজকীয় অভিধা মহারাজ, নরেন্দ্র নয়। প্রভাবতীগুপ্তা নিজেকে দু’জন মহারাজের জননীরূপে বর্ণনা করেননি, দু’জন নরেন্দ্রের জননী বলে নিজেকে আখ্যাত করেছেন। প্রশাসনিক তাৎপর্যে নরেন্দ্র ও মহারাজ পদ দু’টি ঠিক সমার্থক নয়।
  • তৃতীয়ত, নরেন্দ্রয়োঃ পদটি নরেন্দ্র শব্দের ষষ্ঠি বিভক্তির দ্বিবচন। এর অর্থ নরেন্দ্র দু’জনের। অর্থাৎ প্রভাবতীগুপ্তা দু’জন নরেন্দ্রের জননী। ধরা যাক, দামোদরসেন ও প্রবরসেনই এই দুই নরেন্দ্র।

মিরেগাঁও তাম্রশাসনখানি যখন উৎকীর্ণ হয় তখন প্রবরসেনের রাজত্বের বিংশতি বৎসর। তখন আর দামোদরসেন জীবিত নন, দিবাকরসেন তো তাঁর অনুজের পূর্বেই লোকান্তরিত হয়েছেন। তাহলে দেখা যাচ্ছে, দ্বিতীয় প্রবরসেনের রাজত্বের বিংশতি বৎসরে প্রভাবতীগুপ্তা তাঁর পরলোকগত দুই পুত্রের মধ্যে শুধু কনিষ্ঠের কথাই বলছেন, জ্যেষ্ঠ সম্পর্কে নীরব রয়েছেন। এটা কি করে সম্ভব? তিনি তো জ্যেষ্ঠপুত্র দিবাকরসেনেরও জননী। নিজ সন্তানের প্রতি জননীর এ ধরনের বিমাতৃসুলভ আচরণ অনভিপ্রেত। বিশেষত সে সন্তান যখন লোকান্তরিত। সেক্ষেত্রে স্বভাবতই মনে হয়, দামোদরসেন ও প্রবরসেন দু’জন স্বতন্ত্র ব্যক্তি হলে বিক্রান্ত ও নরেন্দ্র পদ দু’টি দ্বিবচনান্ত না হয়ে বহু বচনে ব্যবহৃত হত। তাহলে প্রভাবতীগুপ্তার তিন পুত্রেরই প্রচ্ছন্ন উল্লেখ থাকত। কিন্তু পদ দু’টি দ্বিবচনে ব্যবহৃত হয়েছে। অর্থাৎ রাজমাতা প্রভাবতীগুপ্তার দুই পুত্র। পুত্রদের একজন দামোদরসেন, যাঁর অভিষেক নাম প্রবরসেন, অপরজন দিবাকরসেন।

তাছাড়া আরও একটি কারণে দামোদরসেন ও প্রবরসেনকে দু’জন স্বতন্ত্র মহারাজরূপে ভাবতে অসুবিধে হচ্ছে। প্রবরসেনের কম করেও আঠারোখানি লেখ আবিষ্কৃত হয়েছে অথচ মহারাজ দামোদরসেনের একখানি লেখেরও সন্ধান পাওয়া গেল না। দামোদরসেন যদি প্রবরসেন হতে পৃথক ব্যক্তি হতেন তাহলে সম্ভবত তাঁরও লেখ পাওয়া যেত। কিন্তু তা হয়নি। এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে দামোদরসেন ও প্রবরসেনকে এক ও অভিন্ন ব্যক্তি বলেই মনে হয়।

দ্বিতীয় প্রবরসেনের রাজত্বকালে উৎকীর্ণ লেখগুলি মধ্যপ্রদেশের ছিন্দোয়ারা, সিওনি, বালাঘাট, ও বেতুল এবং মহারাষ্ট্রের ওয়ার্ধা, নাগপুর, ইয়ত্খল, ভণ্ডারা ও অমরাবতী জেলায় আবিষ্কৃত হয়েছে। লেখসমূহ তাঁর দ্বিতীয় রাজ্যবর্ষ থেকে দ্বাত্রিংশ রাজ্যবর্ষের মধ্যে উৎকীর্ণ। এ থেকে দু’টি জিনিস স্পষ্ট হচ্ছে। এক, মধ্যপ্রদেশের দক্ষিণাঞ্চল ও বিদর্ভ তাঁর রাজ্যভুক্ত ছিল। দুই, তিনি অন্তত বত্রিশ বৎসর রাজত্ব করেন। বলা হয়, দ্বিতীয় প্রবরসেনের রাজ্য উত্তরে জবলপুরের নিকটবর্তী প্রাচীন ত্রিপুরী পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। সত্যি বটে, বাকাটকরাজের ইনদউর তাম্রশাসন ত্রিপুরী হতে সম্প্রদত্ত (ত্রিপুরীবাসকাৎ) হয়। লক্ষ করবার বিষয়, ত্রিপুরীকে আবাসরূপে বর্ণনা করা হয়েছে, স্কন্ধাবার বা জয়স্কন্ধাবাররূপে নয়। এরূপ বর্ণনা থাকলে দ্বিতীয় প্রবরসেনের ত্রিপুরী অভিযানের প্রকৃত উদ্দেশ্য জানা যেত। এ সময় জবলপুর ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চল ছিল গুপ্ত রাজাদের প্রভাবাধীন। তখন প্রথম কুমারগুপ্ত গুপ্তদের রাজা। মাতুল প্রথম কুমারগুপ্তের সঙ্গে ভাগিনেয় দ্বিতীয় প্রবরসেনের যে বৈরিতা ছিল তার কোনও প্রমাণ নেই। দ্বিতীয় প্রবরসেনের ত্রিপুরী গমনের পিছনে ধর্মীয় বা অন্য কোনও কারণ ছিল, রাজ্যজয় নয়।

তাঁর রাজত্বের আদি পর্বে উৎকীর্ণ লেখগুলি নন্দিবর্ধন থেকে সম্প্রচারিত হয়েছে কিন্তু পরবর্তী পর্যায়ের বেশির ভাগ শাসনাবলি প্রবরপুর থেকে প্রদত্ত হয়েছে। প্রবরপুর শহরের তিনিই প্রতিষ্ঠাতা। নন্দিবর্ধন হতে প্রবরপুরেই রাজধানী স্থানান্তরিত হয়। দ্বিতীয় প্রবরসেনের মানঢল তাম্রশাসন প্রবরপুর হতে সম্প্রদত্ত। এই লেখে যে জমিদানের উল্লেখ আছে তা তাঁর রাজত্বের ষোড়শ বৎসরে প্রদত্ত হয়। তাঁর বেলোয়া তাম্রশাসন রাজত্বের একাদশ বৎসরেনন্দি বর্ধন হতে বিজ্ঞাপিত হয়েছে। বোঝা যায় দ্বিতীয় প্রবরসেন তাঁর রাজত্বের একাদশ বৎসরের পর কিন্তু ষোড়শ রাজ্যবর্ষের কিছুকাল পূর্বে বা ষোড়শ রাজ্যবর্ষের প্রারম্ভে প্রবরপুরে রাজধানী স্থানান্তরিত করেন। এখানে এক বিশাল রাম-মন্দির নির্মিত হয়। নতুন রাজধানী সম্ভবত বর্তমান ওয়ার্ধা শহরের সন্নিকটে অবস্থিত ছিল। সম্ভবত আধুনিক পওনার প্রাচীন প্রবরপুর। এ স্থানে প্রাচীন যুগের বহু নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে।

প্রবরসেন তাঁর পুত্র যুবরাজ নরেন্দ্রসেনের সঙ্গে কুন্তলরাজের কন্যা অজ্‌ঝিতভট্টারিকার বিবাহ দেন। এই কুন্তলরাজ ছিলেন সম্ভবত কর্ণাটকের কদম্ব বংশীয় নরপতি কাকুৎস্থবর্মা। বাসুদেব বিষ্ণু মিরাশি এই কুন্তল রাজকন্যাকে রাষ্ট্রকূটনৃপতি অবিধেয়ের কন্যারূপে শনাক্ত করেছেন। দ্বিতীয় প্রবরসেনের উপর তাঁর মাতামহের খুব একটা প্রভাব পড়েছিল বলে মনে হয় না। তাঁর মাতামহ ছিলেন পরমভাগবত। তাঁর প্রভাবে বাকাটক রাজ্যে বৈষ্ণবধর্ম প্রসার লাভ করে। প্রবরসেন কিন্তু আজীবন পরমমাহেশ্বর ছিলেন। সাহিত্যসেবী ছিলেন প্রবরসেন। অনেকেই মনে করেন, মহারাষ্ট্রী প্রাকৃতে রচিত ‘সেতুবন্ধ’ কাব্য তাঁরই রচনা। শোনা যায়, কবিশ্রেষ্ঠ কালিদাস এই কাব্যটির পরিমার্জন করেন। বৈষ্ণবধর্ম অবলম্বনে ‘সেতুবন্ধ’ রচিত কিন্তু প্রবরসেন নিজে শৈব ছিলেন। প্রবরসেন সেতুবন্ধের রচয়িতা, এ কথা সকলে স্বীকার করেন না। তাঁর রচিত বহু প্রাকৃত গাথা ‘গাথাসপ্তশতী’তে স্থান পেয়েছে। সংস্কৃত ভাষায়ও তিনি বহু কবিতা রচনা করেন। কখনও কখনও বলা হয়, প্রবরসেন আদ্য ভাগে হস্তে রাজ্যভার সমর্পণ করে ভোগৈশ্বর্যময় জীবনযাপন করেন। কিন্তু এ মত অসমর্থিত, অপ্রমাণিত।

নরেন্দ্রসেন (আ. ৪৫৫-৭০ খ্রিস্টাব্দ)

দ্বিতীয় প্রবরসেনের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র নরেন্দ্র সেন পিতৃসিংহাসনে আরোহণ করেন। দ্বিতীয় পৃথিবীষেণের বালাঘাট লেখের সাক্ষ্য থেকে মনে হয়, নরেন্দ্রসেন তাঁর রাজত্বের প্রথম পর্বে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেন। লেখটিতে বলা হয়েছে, কোসলা, মেকলা এবং মালবের রাজারা নরেন্দ্রসেনের অনুগত ছিলেন। কোসলা এবং মেকলা সম্ভবত কোসল ও মেকল রাজ্যের রাজধানী ছিল। পুরোনো রায়পুর, বিলাসপুর ও সম্বলপুর জেলা নিয়ে প্রাচীন কোসল বা দক্ষিণ কোসল জনপদ গঠিত ছিল। অমরকণ্টক পর্বত ও সন্নিহিত অঞ্চলে মেকল রাজ্য অবস্থিত ছিল। মালবের অবস্থিতি ছিল মধ্যপ্রদেশে। দক্ষিণ কোসলে এ সময় শরভপুরীয় রাজগণ রাজত্ব করতেন। মেকল ছিল পাণ্ডুবংশী রাজাদের কর্তৃত্বে। এসব অঞ্চলের স্থানীয় রাজারা গুপ্ত রাজশক্তির প্রভাবাধীন ছিলেন। নরেন্দ্রসেন সম্ভবত এসব রাজ্যে গুপ্ত আধিপত্যের অবসান ঘটিয়ে বাকাটক অধিকার প্রতিষ্ঠিত করেন।

তবে মালবে নরেন্দ্রসেনের রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবি কতদূর সত্য বলা কঠিন। নরেন্দ্রসেন স্বয়ং মালব জয় করেন বলে মনে হয় না। গুপ্ত সম্রাট প্রথম কুমারগুপ্তের রাজত্বের অন্তিমপর্বে গুপ্ত সাম্রাজ্যে রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা দিলে মালবের স্থানীয় শাসকেরা সম্ভবত নিরাপত্তার খাতিরে নরেন্দ্রসেনের আনুগত্য স্বীকার করেন। কিন্তু মালবে বাকাটকদের এ আধিপত্য দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। অচিরে স্কন্দগুপ্তের নেতৃত্বে এ অঞ্চলে গুপ্তাধিপত্য পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। হূণরাজ তোরমাণের সামরিক অভিযানের পূর্বকাল পর্যন্ত মালবে গুপ্তাধিকার অক্ষুণ্ণ থাকে।

শুধু বালাঘাট নয়, দ্বিতীয় পৃথিবীষেণের মানঢল ও মাহুরঝরী তাম্রশাসনেও নরেন্দ্রসেনের কোসলা, মেকলা ও মালবে আধিপত্য বিস্তারের উল্লেখ আছে। অনেকে এ দাবিকে অত্যুক্তিমূলক বলে ব্যাখ্যা করেছেন। এ কথা স্বীকার্য, কোসল, মেকল ও মালব অঞ্চলে নরেন্দ্রসেন বা দ্বিতীয় পৃথিবীষেণের কোনও লেখ আবিষ্কৃত হয়নি। ফলে এ দাবির সত্যতা সম্পর্কে সংশয়ের যে অবকাশ নেই, তা নয়। তবে এ দাবিকে পুরোপুরি নস্যাৎ করাও হয়তো ঠিক হবে না। নরেন্দ্রসেন সম্পর্কে আরও কয়েকটি অভিমত ব্যক্ত হয়েছে। বলা হয়েছে, তিনি কৌশলে পৈতৃক সিংহাসন অধিকার করেন কিন্তু পরবর্তিকালে তাঁর জনৈক ভ্রাতা কিংবা জ্ঞাতি, সমকালীন বৎসগুল্মরাজ তাঁর রাজ্যের সমগ্রাংশ বা কিয়দংশ অধিকার করেন। (অসমাপ্ত দুর্গ তাম্রশাসন পদ্মপুর হতে প্রদত্ত। শাসনখানি সম্ভবত দ্বিতীয় পৃথিবীষেণের। বিপদের দিনে বাকাটকরাজ পদ্মপুরে রাজধানী স্থানান্তরিত করেন এরূপ ধারণা সঙ্গত বোধ হয়। বাসুদেব বিষ্ণু মিরাশি (Corpus Inscriptionum Indicarum, Vol. V (Ootcamund, 1963), পৃষ্ঠা ৭৭) মনে করেন, অসম্পূর্ণ এ লেখ নরেন্দ্রসেনের রাজত্বকালে উৎকীর্ণ হয়েছে। সেক্ষেত্রে দ্বিতীয় পৃথিবীষেণ নন, তাঁর পিতা নরেন্দ্রসেনই পদ্মপুরে রাজধানী স্থানান্তরিত করেন।) বালাঘাট ইত্যাদি লেখে অস্পষ্ট ও বিনষ্ট অংশের এক বিশেষ পাঠের উপর এ মত প্রতিষ্ঠিত। সেই বিশেষ পাঠ অর্থাৎ ‘দায়াদ’ পদটি সংশ্লিষ্ট বাক্যাংশের অন্তর্ভুক্ত ছিল কিনা সে সম্পর্কে বিতর্কের অবকাশ আছে। তাছাড়া নরেন্দ্রসেনের রাজত্বকালে তাঁর কোনও এক ভ্রাতা তাঁর রাজ্যাংশ অধিকার করেন বা বৎসগুল্মরাজ তাঁর রাজ্যের একাংশ আত্মসাৎ করেন, এ ধারণার সমর্থনে কোনও সুনিশ্চিত প্রমাণ নেই। তাঁর রাজত্বের একেবারে শেষের দিকে নরেন্দ্রসেন সম্ভবত এক ঘোর বিপর্যয়ের সম্মুখীন হন। ছত্তীসগঢ় অঞ্চলের নলবংশীয় রাজা ভবদত্তবর্মা বাকাটক রাজ্য আক্রমণ করেন এবং নন্দিবর্ধন অধিকার করেন। মহারাষ্ট্রের অমরাবতী জেলার ঋদ্ধপুরে ভবদত্তবর্মার পুত্র অর্থপতির একখানি তাম্রশাসন আবিষ্কৃত হয়েছে। নন্দিবর্ধন হতে সম্প্রচারিত এই লেখ থেকে জানা যায়, ভবদত্তবর্মা ইয়মল অঞ্চলে একখানি গ্রাম দান করেছিলেন। বাকাটক রাজ্যের এক বিস্তীর্ণ অঞ্চলে নল আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। এই দুঃসময়ের মধ্যেই নরেন্দ্রসেনের জীবনাবসান হয়।

দ্বিতীয় পৃথিবীষেণ (আ.৪৭০-৯০ খ্রিস্টাব্দ)

নরেন্দ্রসেনের পর তাঁর পুত্র দ্বিতীয় পৃথিবীষেণ রাজপদে অভিষিক্ত হন। বাকাটক রাজ্যে তখন সংকট। রাজধানী নন্দিবর্ধনসহ রাজ্যের এক বিস্তীর্ণ অঞ্চল তখনও নলদের অধিকারভুক্ত। বাকাটক রাজধানী তখন পদ্মপুরে স্থানান্তরিত। ভণ্ডারা জেলার বর্তমান পদমপুর প্রাচীন পদ্মপুর। পৃথিবীষেণ শক্তি সঞ্চয় করে নলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। বাকাটক রাজ্য থেকে নলগণ বিতাড়িত হলেন। পৃথিবীষেণ নল রাজধানী পুষ্করী অবরোধ করেন। নল লেখে পুষ্করীর পতনের ইঙ্গিত আছে। বাকাটক রাজ্য বিপদমুক্ত হয়। অতঃপর পৃথিবীষেণ পদ্মপুর থেকেই রাজকার্য পরিচালনা করেন, না নন্দিবর্ধনে রাজধানী স্থানান্তরিত করেন, তা জানা যায় না। বালাঘাট লেখে দাবি করা হয়েছে, পৃথিবীষেণ দু’বার পারিবারিক লুপ্ত গৌরব পুনরুদ্ধার করেন (দ্বি-ভগ্নবংশস্য উদ্ধঃ)। নলদের বিতাড়িত করে তিনি একবার বাকাটক রাজ্যকে বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করেন। হতে পারে, বৎসগুল্ম শাখার হরিযেণও মূল বাকাটক ভূখণ্ড আক্রমণ করেছিলেন কিন্তু পৃথিবীষেণ তা প্রতিহত করেন। এমনও হতে পারে, উত্তর কোঙ্কণের ত্রৈকূটক নৃপতি ধরসেন (আ. ৪৪৫-৭৫ খ্রিস্টাব্দ) বাকাটক রাজ্যে সামরিক অভিযান প্রেরণ করেন কিন্তু পৃথিবীষেণ সতর্ক থাকায় তা ব্যর্থ হয়। পৃথিবীষেণই তাঁর বংশের সর্বশেষ রাজা। আনুমানিক ৪৯০ খ্রিস্টাব্দে তাঁর মৃত্যুর পর এ রাজ্যটি বৎসগুল্ম শাখার বাকাটকরাজ হরিষেণের অধিকারভুক্ত হয়। সার্ধ শতাব্দী কাল রাজত্ব করার পর দাক্ষিণাত্যের রাজনৈতিক রঙ্গমঞ্চ থেকে প্রধান বাকাটক শাখাটির চিরপ্রস্থান ঘটল।

বৎসগুল্ম শাখার সর্বসেন, দ্বিতীয় বিন্ধ্যশক্তি, দ্বিতীয় প্রবরসেন, দ্বিতীয় সর্বসেন ও দেবসেন

সর্বসেন (আ.৩৩৫-৫০ খ্রিস্টাব্দ) : প্রথম প্রবরসেনের এক কনিষ্ঠ পুত্র সর্বসেন বৎসগুল্ম শাখার প্রতিষ্ঠাতা। বাশিম ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে তিনি রাজত্ব করেন। পুরাণে বলা হয়েছে, সর্বসেন তাঁর পিতার কাছ থেকেই এই রাজ্যটি লাভ করেন। বৎসগুল্ম হল নতুন রাজ্যের রাজধানী। অকোলা জেলার আধুনিক বাশিমই প্রাচীন বৎসগুল্ম। সাহিত্যানুরাগী ছিলেন সর্বসেন। প্রাকৃত ভাষায় তিনি ‘হরিবিজয়’ নামে একখানি কাব্য রচনা করেন। দণ্ডী, আনন্দবর্ধন ও অভিনবগুপ্তের মতো বিদ্বজ্জন এই কাব্যের সুখ্যাতি করেছেন। তিনি প্রাকৃতে বেশ কিছু গাথাও প্রণয়ন করেন। এরূপ কয়েকটি গাথা ‘গাথাসপ্তশতি’ সংকলনে উদ্ধৃত আছে। সর্বসেনের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র দ্বিতীয় বিন্ধ্যশক্তি বৎসগুল্মের সিংহাসনে আরোহণ করেন।

দ্বিতীয় বিন্ধ্যশক্তি (আ. ৩৫০-৪০০ খ্রিস্টাব্দ) : দ্বিতীয় বিন্ধ্যশক্তি তাঁর ৩৭শ রাজ্যবর্ষে বাশিম লেখটি উৎকীর্ণ করেন। লেখটিতে একটি গ্রাম দানের কথা বলা হয়েছে। গ্রামটি নান্দীকট নামে এক প্রশাসনিক বিভাগের অন্তর্ভুক্ত ছিল। আধুনিক নান্দেড় প্রাচীন নান্দীকটের স্মৃতি বহন করছে। লেখটি থেকে দু’টি জিনিস প্রমাণিত হচ্ছে। প্রথমত, দ্বিতীয় বিন্ধ্যশক্তি দীর্ঘদিন রাজত্ব করেন। দ্বিতীয়ত, তাঁর রাজ্য মহারাষ্ট্রের অকোলা-নান্দেড় অঞ্চলে অবস্থিত ছিল। অজন্তা গুহায় একটি ভগ্ন লেখের সন্ধান পাওয়া গেছে। লেখটি একেই ভগ্ন, তার উপর অস্পষ্ট। লেখটির ব্যাখ্যা নিয়ে স্বাভাবিক কারণে পণ্ডিতমহলে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। কেউ কেউ মনে করেন, লেখটিতে প্রথম প্রবরসেন, তাঁর পৌত্র প্রথম রুদ্রসেন ও প্রপৌত্র প্রথম পৃথিবীষেণের নাম উল্লিখিত আছে। আবার অনেকের অভিমত, লেখে প্রবরসেন, তাঁর পুত্র সর্বসেন এবং সর্বসেনের পুত্র বিন্ধ্যসেনের নামোল্লেখ আছে। আবার কারোর ধারণা, লেখটিতে বিন্ধ্যসেনের নাম নেই, নাম আছে সর্বসেনের অপর এক পুত্র পৃথিবীষেণের। লেখটিতে যে রুদ্রসেনের নাম নেই, আছে সর্বসেনের নাম, তা বোধহয় মেনে নেওয়া ভালো। কিন্তু তৃতীয় রাজার নামটি সম্পর্কে অনিশ্চয়তা রয়েই গেছে। অজন্তা লেখে যদি সর্বসেনের পুত্ররূপে বিন্ধ্যসেনের নামই উল্লিখিত হয়ে থাকে, তাহলে বুঝতে হবে, এই বিন্ধ্যসেনই বাশিম লেখের দ্বিতীয় বিন্ধ্যশক্তি। সেক্ষেত্রে বলা চলে, দ্বিতীয় বিন্ধ্যশক্তির পুত্র-পৌত্ররাই পুরুষানুক্রমে বৎস গুল্মে রাজত্ব করেছেন। কিন্তু যদি নির্দিষ্ট নামটি পৃথিবীষেণেরই হয়, তাহলে স্বীকার করতে হবে, দ্বিতীয় বিন্ধ্যশক্তি অপুত্রক অবস্থায় মারা গেলে বা তাঁকে পদচ্যুত করে তাঁরই অনুজ পৃথিবীষেণ বৎসগুল্মের সিংহাসন অধিকার করেন। তবে অজন্তা লেখের এই বাকাটক নৃপতি যিনিই হোন না কেন, লেখের সাক্ষ্যে অনুমিত হয়, তিনি জনৈক কুন্তলরাজকে যুদ্ধে পরাজিত করেন। এই পরাজিত কুন্তলরাজ ছিলেন বনবাসির কদম্ব বংশীয় এক নরপতি।

দ্বিতীয় প্রবরসেন (আ. ৪০০-১৫ খ্রিস্টাব্দ) : বিন্ধ্যসেন বা পৃথিবীষেণের পুত্র দ্বিতীয় প্রবরসেন বৎসগুল্ম রাজ্যের পরবর্তী নৃপতি। তিনি অল্প বয়সে দেহত্যাগ করেন। (পৃথিবীষেণই যদি দ্বিতীয় প্রবরসেনের পিতা হন তাহলে আ. ৩৯০-৪০০ খ্রিস্টাব্দই হবে তাঁর রাজত্ব কাল। সেক্ষেত্রে স্বীকার করতে হবে, আনুমানিক ৩৯০ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় বিন্ধ্যশক্তির রাজত্বের অবসান হয়।) তখন তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র আট বৎসর বয়স্ক এক বালক মাত্র।

দ্বিতীয় সর্বসেন (আ. ৪১৫-৪৫০ খ্রিস্টাব্দ) : দুর্ভাগ্যের বিষয়, দ্বিতীয় প্রবরসেনের এই পুত্র ও উত্তরাধিকারীর নাম অজন্তা লেখের যে অংশে উল্লিখিত ছিল, সে অংশের অক্ষরগুলির চিহ্নমাত্র নেই। ফলে অজন্তা লেখে উল্লিখিত এই বাকাটক রাজার নামটি আজ আর পড়া যায় না। কিন্তু তিনি যে সর্বসেন তা নিঃসন্দেহ। সাম্প্রতিককালে আবিষ্কৃত দু’টি তাম্রশাসনে এই সর্বসেনের নাম উল্লিখিত আছে। তাম্রশাসন দু’টির একটি দেবসেনের বিদর তাম্রলেখ, অন্যটি দেবসেনপুত্র হরিষেণের থালনের তাম্রপট্ট। লেখ দু’টিতে সর্বসেনকে দেবসেনের পিতা বলে বর্ণনা করা হয়েছে। এই সর্বসেন অবশ্যই দ্বিতীয় সর্বসেন। বৎসগুল্ম শাখার প্রতিষ্ঠাতাই তো প্রথম সর্বসেন। দ্বিতীয় সর্বসেন আনুমানিক ৪১৫ থেকে ৪৫০ খ্রিস্টাব্দ কাল পর্যন্ত রাজপদে সমাসীন ছিলেন বলে অনুমিত হয়। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র দেবসেন বৎসগুল্মের সিংহাসনে আরোহণ করেন।

দেবসেন (আ. ৪৫০-৭৫ খ্রিস্টাব্দ) : মহারাজ দেবসেনের একখানি তাম্রশাসন দক্ষিণ •বিদর্ভের কোনও এক স্থানে আবিষ্কৃত হয়েছে। শাসনখানি বৎসগুল্ম থেকে প্রদত্ত হয়েছিল। শাসনকার্যে দেবসেন অনাগ্রহী ছিলেন। রাজ্য পরিচালনার দায়িত্বভার গ্রহণ করেন বিশ্বস্ত ও বিচক্ষণ মন্ত্রী হস্তিভোজ। দেবসেনের একখানি তাম্রশাসন কর্ণাটকের বিদরে আবিষ্কৃত হয়েছে প্রমাণিত হয়, কর্ণাটকের কিয়দংশ এ সময় বাকাটক রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল।

শেষ প্রধান রাজা হরিষেণ (আ. ৪৭৫-৫০০ খ্রিস্টাব্দ)

হরিষেণ (আ. ৪৭৫-৫০০ খ্রিস্টাব্দ) : দেবসেন লোকান্তরিত হলে তাঁর পুত্র হরিষেণ বৎস গুল্মের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন। অশেষ পরাক্রমশালী নরপতি ছিলেন হরিষেণ। বরাহদেবের অজন্তা লেখে দাবি করা হয়েছে, হরিষেণ কুন্তল, অবন্তি (পশ্চিম মালব), কলিঙ্গ (শ্রীকাকুলম বিশাখাপত্তনম অঞ্চল), কোসল (রায়পুর-বিলাসপুর-সম্বলপুর অঞ্চল), ত্রিকূট (উত্তর কোঙ্কণ), লাট (নবসারী-ব্রোচ অঞ্চল) এবং অন্ধ্র (গোদাবরী ও কৃষ্ণা নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চল) জয় করেন বা উক্ত অঞ্চলসমূহে স্বীয় প্রভাব বিস্তার করেন। সন্দেহ নেই, হরিষেণের রাজত্বের শেষপর্বে এই লেখটি উৎকীর্ণ হয়েছে। অজন্তা অভিলেখের সাক্ষ্য সত্য হলে স্বীকার করতে হবে, হরিষেণের শাসনকালের শেষপর্বে মুখ্য বাকাটক শাখার রাজত্বের অবসান ঘটেছে। মুখ্য বাকাটক শাখাভুক্ত পৃথিবীষেণের রাজ্যটি অধিকার না করে হরিষেণের পক্ষে মালবে প্রভুত্ব বিস্তার করা সম্ভবপর ছিল না। সম্ভবত পৃথিবীষেণের মৃত্যুর পরই তাঁর রাজ্য হরিষেণের হস্তগত হয়। এমনও হতে পারে, পৃথিবীষেণকে পদচ্যুত করেই হরিষেণ তাঁর রাজ্য অধিগ্রহণ করেন। তবে সেরূপ সম্ভাবনা ক্ষীণ।

তাঁর প্রভাবাধীন সমগ্র অঞ্চলে যে হরিষেণ প্রত্যক্ষ শাসন বলবৎ করেছিলেন, এমনটি মনে হয় না। কলিঙ্গে এ সময় একটি নতুন রাজবংশের অভ্যুত্থান ঘটেছিল। বংশটির নাম কলিঙ্গনগরের গঙ্গ রাজবংশ। অন্ধ্রে সে সময় বিষ্ণুকুণ্ডী নামে এক নতুন রাজবংশের প্রতিষ্ঠা হয়। এই বংশের প্রথম দু’জন রাজা হলেন বিক্রমহেন্দ্র বা প্রথম বিক্রমেন্দ্রবর্মা এবং তাঁর পুত্র মহারাজ গোবিন্দবর্মা বিক্রমাশ্রয়। কোসলে তখন শরভপুরীয় রাজাদের রাজত্ব। অজন্তা লেখ ইঙ্গিত করছে, এসব রাজারা প্রথমদিকে হরিষেণের অনুগত ছিলেন। মহামহোপাধ্যায় বাসুদেব বিষ্ণু মিরাশি অভিমত প্রকাশ করেছেন, মহারাষ্ট্রের খান্দেশ অঞ্চল হরিষেণের রাজ্যভুক্ত ছিল। তাঁর অভিমত, যে অজ্ঞাতনামা রাজা অজন্তার সপ্তদশ গুহালেখ উৎকীর্ণ করেছেন তিনি ঋষিক অঞ্চলের অধিপতি ছিলেন। এই লেখে হরিষেণ পৃথিবীপালরূপে বন্দিত হয়েছেন ঋষিকরাজ নিঃসন্দেহে হরিষেণের অনুগত ছিলেন। মহামহোপাধ্যায় মিরাশি মনে করেন, মহারাষ্ট্রের খান্দেশ অঞ্চল প্রাচীনকালে ঋষিক নামে পরিচিত ছিল। কিন্তু খান্দেশ যে হরিষেণের অধিকারভুক্ত ছিল তা বোধহয় সুনিশ্চিত নয়। অজন্তার সপ্তদশ গুহালেখ যিনি উৎকীর্ণ করেন সেই অজ্ঞাতনামা রাজা ঋষিকের অধিপতি ছিলেন, লেখটিতে এ ধরনের কোনও তথ্য নেই। দণ্ডীর দশকুমারচরিতে অবশ্য বিদর্ভের এক করদরাজ্য রূপে ঋষিকের উল্লেখ আছে। দণ্ডীর বিদর্ভ হরিষেণের সমকালীন বিদর্ভ, প্রাচীন ঋষিক আধুনিক খান্দেশ আর অজন্তা লেখের অজ্ঞাতনামা রাজা ঋষিকের অধিপতি, এসব ভাবনা অবশ্যই কল্পনালালিত। মহারাষ্ট্রের খান্দেশ অঞ্চ হয়তো তাঁর শাসনভুক্ত ছিল কিন্তু হরিষেণের রাজনৈতি কর্তৃত্বের পরিমণ্ডল ছিল সুদূর বিস্তৃত। অপেক্ষাকৃত এক ক্ষুদ্র অঞ্চলেই কিন্তু তাঁর প্রত্যক্ষ শাসন বলবৎ ছিল। অনুমিত হয়, মহারাষ্ট্রের বৃহদংশ এবং মধ্যপ্রদেশ ও কর্ণাটকের কিয়দংশ তাঁর প্রত্যক্ষ শাসনভুক্ত ছিল। হরিষেণের সচিব ছিলেন বরাহদের। তিনি সম্ভবত হস্তিভোজের পুত্র ছিলেন। অজন্তার ষোড়শ গুহালেখ এবং গুলবাড়ার ঘটোৎকচ গুহালেখ তিনিই উৎকীর্ণ করেন। বৎসগুল্ম শাখার ইতিহাসের উপর প্রভূত আলোকপাত করছে এই লেখ দু’খানি।

হরিষেণোত্তর পর্ব ও বাকাটকদের পতন

হরিষেণোত্তর পর্ব (আ. ৫০০-৫০ খ্রিস্টাব্দ) : হরিষেণের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র এবং সম্ভবত পৌত্ররা কয়েক বৎসর রাজত্ব করেন। দুর্ভাগ্যের বিষয়, তাঁদের নাম এবং কীর্তিকলাপ সম্পর্কে কিছুই জানা যায় না। পরাক্রমশালী বিষ্ণুকুণ্ডী নৃপতি প্রথম মাধববর্মা জনাশ্রয় (আ. ৫৩৫-৮৫ খ্রিস্টাব্দ) দাবি করেছেন, তিনি এক বাকাটক রাজকন্যার পাণিগ্রহণ করেন। হতে পারে, এই বাকাটক রাজকন্যা হরিষেণের পৌত্রী ছিলেন।

বাকাটকদের পতন : শাসকরূপে হরিষেণের উত্তরসূরিরা চরম ব্যর্থতার পরিচয় দেন। সুবিস্তীর্ণ রাজ্য রক্ষাকল্পে যে সাহস ও বিচক্ষণতার প্রয়োজন ছিল, তাঁদের চরিত্রে তার একান্তই অভাব ছিল। ফলে কিছু দিনের মধ্যেই বাকাটক রাজ্য ধ্বংসস্তূপে পরিণত হল। ৫৫০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ ঐতিহ্যমণ্ডিত বাকাটক রাজ্যের অবলুপ্তি ঘটল। পারিবারিক অন্তর্দ্বন্দ্ব বাকাটক রাজ্যের পতনের অবশ্যই এক প্রধান কারণ। মূল শাখার সঙ্গে বৎসগুল্ম শাখার নিরন্তর সংঘর্ষে বাকাটক রাজশক্তি নিঃসন্দেহে দুর্বল হয়ে পড়ে। আভ্যন্তরীণ কলহে জীর্ণ বাকাটক রাজ্য বহিঃশত্রুর বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ প্রতিরোধ রচনায় সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়। মাহিষ্মতীর কলচুরি রাজশক্তির অভ্যুত্থান বাকাটক রাজ্যের পতনের আর এক মুখ্য কারণ। কলচুরিরাজ কৃষ্ণরাজের নামাঙ্কিত রৌপ্যমুদ্রা মধ্যপ্রদেশ ও মহারাষ্ট্রের বিভিন্ন স্থানে আবিষ্কৃত হয়েছে। একদা এই অঞ্চল বাকাটক রাজগণের অধিকারভুক্ত ছিল। বোঝা যায়, কৃষ্ণরাজের আক্রমণে বাকাটক রাজ্য ধসে পড়ে। আনুমানিক ৫৭৩-৭৪ খ্রিস্টাব্দে স্বামিরাজ নামে এক আঞ্চলিক প্রশাসক নন্দিবর্ধন থেকে ভূদান-সম্পর্কিত একখানি তাম্রশাসন সম্প্রদান করেন। এই নন্দিবর্ধন একদিন বাকাটক রাজ্যের রাজধানী ছিল। স্বামিরাজ সম্ভবত কৃষ্ণরাজের অধীনস্থ এক পদস্থ রাজপুরুষ ছিলেন। কলিঙ্গে গঙ্গ, অন্ধ্রপ্রদেশে বিষ্ণুকুণ্ডী, দক্ষিণ কোসলে পাণ্ডুবংশী বা সোমবংশী এবং কোঙ্কণ অঞ্চলে মৌর্য রাজবংশ স্বাধীন, সার্বভৌম রাজনৈতিক শক্তিরূপে আত্মপ্রকাশ করল। বস্তার-জয়পুর অঞ্চলেও নল রাজশক্তির পুনরভ্যুত্থান ঘটল। বাকাটক রাজ্যের পতন-প্রক্রিয়ায় এদের সকলেরই অল্পবিস্তর অবদান রয়েছে। সুদীর্ঘ তিন শতাব্দী স্থায়ী বাকাটক রাজ্য অতীত স্মৃতিতে পর্যবসিত হল।

প্রশাসন-ব্যবস্থা

রাজা

বাকাটক রাজ্যটি ছিল রাজতান্ত্রিক। প্রশাসনের শীর্ষদেশে রাজার অবস্থান। আইনত তিনি অসীম ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন। কিন্তু তাঁকে পরম্পরা মেনে চলতে হত। এই পরম্পরা স্মৃতির অনুশাসনে বিধৃত। প্রজাদের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের প্রতি তাঁদের ছিল সজাগ দৃষ্টি। লেখে প্রথম পৃথিবীষেণ ধর্মবিজয়ী, যুধিষ্ঠিরের ন্যায় সত্যনিষ্ঠ নৃপতিরূপে আখ্যাত হয়েছেন। দ্বিতীয় প্রবরসেন সম্পর্কে বলা হয়েছে, তাঁর সুশাসনের ফলে রাজ্যে কৃতযুগের প্রতিষ্ঠা হয়েছে। হরিষেণ সপ্তদশ গুহালেখে প্রজাসাধারণের হিতকারী রূপে পরিচিত হয়েছেন। অর্থাৎ, বাকাটক রাজারা স্বেচ্ছাচারী ছিলেন না, তাঁরা ছিলেন সুশাসক, প্রজাপালক। লেখমালায় বাকাটক রাজাদের এই ভাবমূর্তিই উপস্থাপিত হয়েছে। কালিদাস রঘুবংশ কাব্যে বিদর্ভকে ‘সৌরাজ্য-রম্য’ অর্থাৎ সুশাসন-সমৃদ্ধ বলে বর্ণনা করেছেন। হয়তো প্রজাকল্যাণকামী বাকাটক রাজগণের প্রতি মহাকবির এই প্রচ্ছন্ন স্তুতি। বাকাটক রাজারা প্রায় সকলেই মহারাজ বলে পরিচয় দিয়েছেন, গুপ্ত রাজাদের মতো পরম ভট্টারক, মহারাজাধিরাজ, পরমেশ্বর ইত্যাদি গালভরা অভিধা ধারণ করেননি। দেবত্বের দাবিদারও তাঁরা ছিলেন না। তাঁরা লেখমালায় বার বার অকপটে ব্যক্ত করে গেছেন, তাঁদের যা কিছু বৈভব, যা কিছু কৃতিত্ব, সবেরই মূলে রয়েছে ইষ্টদেবতার আশীর্বাদ। রাজপদ ছিল পুরুষানুক্রমিক। উত্তরাধিকারসূত্রে রাজপদ লাভ করেছেন (ক্রমপ্রাপ্তনৃপশ্রীঃ), বাকাটক রাজারা তাঁদের লেখে প্রায়ই এই দাবি করেছেন। রাজার মৃত্যুর পর তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্রই রাজপদে অভিষিক্ত হতেন। প্রথম প্রবরসেন তাঁর রাজ্যটিকে পুত্রদের মধ্যে বিভক্ত করেন। কিন্তু এই বিভাজন রাজ্যের সার্বিক স্বার্থের পক্ষে শুভ হয়নি। ফলে পরবর্তী কালে এ ধরনের বিভাজন ব্যবস্থা আর কখনও কার্যকরী হয়নি।

রানি, যুবরাজ ও সচিব

রানি : বাকাটক লেখে মাত্র দু’জন রানির উল্লেখ আছে। এঁদের একজন প্রভাবতীগুপ্তা। অন্যজন নরেন্দ্রসেনের মহিষী অজ্‌ঝিতভট্টারিকা। অগ্রমহিষী প্রভাবতীগুপ্তা যুবরাজ দিবাকরসেনের প্রতিনিধি রূপে অন্যূন ত্রয়োদশ বৎসরকাল বাকাটক রাজ্যের শাসনকার্য পরিচালনা করেন।

যুবরাজ : যুবরাজেরা হয়তো শাসনকার্যে রাজাদের সহায়তা করতেন। এ বিষয়ে অবশ্য কোনও সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই। যুবরাজ তথা রাজপুত্রদের সুশিক্ষার প্রতি সতর্ক দৃষ্টি দেওয়া হত। কালিদাস সম্ভবত দ্বিতীয় প্রবরসেনের গৃহশিক্ষকের পদে নিযুক্ত ছিলেন।

সচিব : বাকাটক লেখমালায় সচিবের উল্লেখ আছে কিন্তু মন্ত্রী বা মন্ত্রিপরিষদের উল্লেখ নেই। তবে অন্যান্য সমকালীন রাজ্যগুলিতে যেমন ছিল, বাকাটক রাজ্যে রাজার সহকারী ও পরামর্শদাতারূপে একদল মন্ত্রী অবশ্যই ছিলেন।

কেন্দ্রের প্রত্যক্ষ শাসন

বাকাটক রাজ্যের অনেকটা অংশেই কেন্দ্রের প্রত্যক্ষ শাসন বলবৎ ছিল। পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের রাজারা কখনও কখনও বাকাটকদের আনুগত্য স্বীকার করেছেন সত্য কিন্তু স্ব স্ব রাজ্যে তাঁরা কার্যত স্বাধীনই ছিলেন। সেসব অঞ্চলে বাকাটক রাজারা নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় বড় একটা আগ্রহ প্রকাশ করেননি। কিন্তু মূল রাজ্যের এক বৃহদংশে নিজেদের নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় বাকাটক রাজারা যে উদ্যম গ্রহণ করেন ঠিক তেমনটি দেখা গিয়েছিল মৌর্য রাজাদের শাসনকালে। বাকাটক লেখে সম্ভবত রাজা উপাধিধারী কোও ও নারায়ণ নামে দু’জন পদস্থ রাজপুরুষের উল্লেখ আছে। পদ মর্যাদায় সামন্ত হলেও এই দুই ব্যক্তি সীমিত কর্তৃত্বের অধিকারী ছিলেন। নিজেদের প্রশাসনিক এলাকায় জমিদানের অধিকার তাঁদের ছিল না। সে কাজে তাঁদের কেন্দ্রীয় সরকারের অনুমতি গ্রহণ করতে হত। কিন্তু কোণ্ড ও নারায়ণ যে সামন্তরাজের পর্যায়ভুক্ত ছিলেন তা সন্দেহাতীত নয়। এমনও হতে পারে, তাঁরা দু’জনে রাজান্ত নাম ধারণ করেছিলেন। (কোণ্ডরাজ ও নারায়ণরাজ। অনন্ত সদাশিব অলতেকর (গোলাম ইয়াজদানি সম্পাদিত The Early History Of The Deccan, Parts I-VI (London, 1960), পৃষ্ঠা ১৯২) অভিমত প্রকাশ করেছেন কোণ্ডরাজ ও নারায়ণ রাজা ও মহারাজ অভিধা গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু নামটি কোওরাজ হলে তাঁর রাজা উপাধি গ্রহণের কোনও সম্ভাবনা থাকে না। নামটি কোণ্ড হলেই সে সম্ভাবনা বর্তমান থাকে। লেখে নারায়ণকে মহারাজ আখ্যা দেওয়া হয়নি, তাঁকে নারায়ণরাজ বলা হয়েছে। কোণ্ডরাজ ও নারায়ণরাজ ব্যক্তিনামও হতে পারে। সেক্ষেত্রে তাঁদের রাজা উপাধি ধারণের কোনও প্রশ্ন ওঠে না।)

রাজ্যের মুখ্য বিভাগ

প্রশাসন-কার্যের সুবিধার জন্য বাকাটক রাজ্য কয়েকটি মুখ্য বিভাগে বিভক্ত ছিল। লেখমালায় এই প্রশাসনিক বিভাগকে কখনও ‘রাষ্ট্র’, কখনওবা ‘রাজ্য’ বলা হয়েছে। অঞ্চলভেদে নামের এই বিভিন্নতা। ‘রাষ্ট্র’ বা রাজ্যগুলির মধ্যে পাক্কণ-রাষ্ট্র, ভোজকট-রাজ্য, বারুছ-রাজ্য এবং আরশ্মি রাজ্য সবিশেষ উল্লেখযোগ্য।

  • এক একটি ‘রাষ্ট্র’ বা ‘রাজ্য’ কয়েকটি ‘আহার’ এবং ‘ভোগ’-এ বিভক্ত ছিল। লেখে সুপ্রতিষ্ঠ-আহার, বেগ্গাকার্পর-ভোগ, লোহনগর-ভোগ এবং হিরণ্যপুর-ভোগের উল্লেখ আছে। ‘আহার’ ও ‘ভোগ’ সমার্থক, না স্বতন্ত্র দু’টি উপবিভাগ তা স্পষ্ট নয়।
  • দ্বিতীয় প্রবরসেনের বেলোরা তাম্রশাসনে অসি-ভুক্তি নামে একটি ভুক্তির উল্লেখ আছে। কিন্তু এই ‘ভুক্তি’ রাষ্ট্র বা রাজ্যের সমার্থক নয়, ক্ষুদ্রায়তনের এক প্রশাসনিক বিভাগ মাত্র।
  • বাকাটক রাজ্যের আর এক প্রশাসনিক বিভাগ মার্গ। দ্বিতীয় প্রবরসেনের বেলোরা তাম্রশাসনে একটি গ্রাম প্রসঙ্গে বলা হয়েছে গ্রামটি শৈলপুরমার্গস্থিত অসিভুক্তির অন্তর্ভুক্ত। পক্ষান্তরে বাকাটকরাজের পট্টন তাম্রলেখে বরদাখেট নামে একটি মার্গ লৌহনগরভোগের অঙ্গরূপে বর্ণিত হয়েছে। প্রমাণিত হয়, মার্গ ভুক্তির তুলনায় বৃহৎ কিন্তু ভোগ হতে অধস্তন এক প্রশাসনিক বিভাগ।
  • বাকাটক রাজ্যের এক প্রশাসনিক বিভাগ পট্ট এরূপ এক অভিমত ব্যক্ত হয়েছে। নির্দ্বিধায় বলা যায়, বাকাটক লেখে এ ধরনের কোনও প্রশাসনিক বিভাগের উল্লেখ নেই। দ্বিতীয় প্রবরসেনের মানঢল তাম্রশাসনে ময়সগ্রাম সম্পর্কে বলা হয়েছে গ্রামটি ‘বেগ্গাতটস্য অপরপট্টে’ অবস্থিত ছিল। আবার একই বাকাটক নৃপতির তিরোডী লেখে কোশম্বখণ্ড গ্রামকে ‘বেগ্গাকস্য অপরপট্টে বিদ্যমান বলে উল্লেখ করা হয়েছে। বলা বাহুল্য, এখানে যে প্রশাসনিক বিভাগের উল্লেখ আছে সেটি বেগ্গাতট বা বেগ্গাকট, অপরপট্ট বা পট্ট নয়। অপরপট্ট-এর অর্থ পশ্চিম ভাগ বা পশ্চিমাঞ্চল। অর্থাৎ গ্রামটি বেগ্গাতট বা বেগ্গাকটের পশ্চিমাংশে অবস্থিত ছিল। পট্ট শব্দ কোনও স্থানবাচক বিশেষ্যপদের সঙ্গে প্রযুক্ত হলে তবেই প্রশাসনিক বিভাগ অর্থে গৃহীত হবে। বাকাটক লেখে সে অর্থে বা প্রসঙ্গে পট্টের প্রয়োগ নেই।
  • সর্বনিম্ন প্রশাসনিক বিভাগ গ্রাম। কখনও কখনও বলা হয়, বাকাটক রাজ্যে স্থান নামে এক প্রশাসনিক কেন্দ্র ছিল। বস্তুত, বাকাটক লেখে নিছক স্থান বলে কোনও শব্দ নেই, আছে ‘ধর্মস্থান’ বা ‘বৈজয়িক-ধর্মস্থান’-এর উল্লেখ। ধর্মীয় স্থান বা তীর্থস্থান, এ অর্থে ‘ধর্মস্থান’ বা ‘বৈজয়িক-ধৰ্মস্থান।’ বাকাটক রাজারা অনেক সময় ধর্মীয় স্থান বা তীর্থক্ষেত্র হতে তাম্রশাসন প্রদান করতেন।

রাজপুরুষগণের বিভিন্ন শ্রেণি

বিভিন্ন শ্রেণির রাজপুরুষের কথাও পাওয়া যায় –

  • বাকাটক লেখে সর্বাধ্যক্ষ নামে এক শ্রেণির পদস্থ রাজপুরুষের উল্লেখ আছে। বাসুদেব বিষ্ণু মিরাশি মনে করেন, তিনি কেন্দ্রীয় প্রশাসনিক অধিকরণের অধ্যক্ষ ছিলেন। অনন্ত সদাশিব অলতেকরের মতে, তিনি ছিলেন বাকাটক রাজ্যের প্রধানমন্ত্রী।
  • আর এক শ্রেণির রাজকর্মচারী কুলপুত্র। রাজ্যের শান্তি-শৃঙ্খলার রক্ষণাবেক্ষণ ছিল তাঁদের কাজ।
  • এ কাজে ভট এবং চাট সংজ্ঞক রাজপুরুষেরা তাঁদের সাহায্য করতেন। ভটের অর্থ সৈন্য। আমরা যাঁদের পুলিশ বলি, চাটরা ছিলেন তাই। রাজস্ব সংগ্রহ তাঁদের আর একটি কাজ ছিল। কুলপুত্র, চাট এবং ভটরা কখনও কখনও তাদের এলাকা পরিদর্শনে বের হতেন। পরিদর্শনকালে গ্রাম ও শহরবাসীদের তাঁদের আহার ও বাসস্থানের ব্যবস্থা করতে হত। অনুমান করা যায়, তাঁরা অনেক সময় প্রজাদের উৎপীড়ন করতেন। ব্রাহ্মণদের অনুকূলে প্রদত্ত অগ্রহার গ্রামে তাঁদের প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল। তবে গ্রহীতা ব্রাহ্মণ হত্যা, ব্যভিচার, রাজদ্রোহ ইত্যাদি অপরাধে জড়িত হলে এই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহৃত হত। অনন্ত সদাশিব অলতেকরের অভিমত, কুলপুত্ররা পরিদর্শক শ্রেণির রাজপুরুষ; কেন্দ্রীয় অনুশাসন রাষ্ট্রের অধস্তন রাজপুরুষেরা যথাযথ পালন করছেন কিনা, তা পর্যবেক্ষণ করা ছিল তাঁদের কাজ। এ অভিমত গ্রাহ্য হলে বুঝতে হবে, বাকাটক রাজারা সারা রাজ্যে তাঁদের কর্তৃত্ব সুদৃঢ় ও নিরঙ্কুশ করতে সচেষ্ট ছিলেন।
  • বাকাটক লেখমালায় রজুক, সেনাপতি ও দণ্ডনায়ক নামে আরও তিন শ্রেণির রাজপুরুষের উল্লেখ আছে। সেনানায়ক অর্থে সেনাপতি। ভূমিদান প্রসঙ্গে বাকাটক লেখে সেনাপতির কথা বলা হয়েছে। মনে হচ্ছে, তাঁকে বেসামরিক দায়িত্বও বহন করতে হত। দ্বিতীয় প্রবরসেনের অষ্টাদশ রাজ্যবর্ষের সিওনি ও তাঁর রাজত্বের পঞ্চবিংশ বর্ষে উৎকীর্ণ বড়গাঁও তাম্রশাসনে সেনাপতি বাপ্পদেবের উল্লেখ আছে। আবার তাঁর ত্রয়োবিংশ রাজ্যবর্ষের দুদিয়া তাম্রশাসনে নমিদাস নামে এক সেনাপতির কথা বলা হয়েছে। এ থেকে মনে হতে পারে, সামরিক প্রয়োজনে বাকাটক রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন সেনাপতি নিযুক্ত হতেন। কিন্তু এ ধারণার ভিত্তিতে সেনাপতিকে প্রাদেশিক শাসনকর্তারূপে চিহ্নিত করা সমীচীন হবে না। সেনাপতির মূল কাজ যুদ্ধ-বিগ্রহ, প্রাদেশিক শাসকের আশু কর্মকাণ্ড প্রশাসনকে ঘিরে অবর্তিত হয়। তাছাড়া এমনও হতে পারে, প্রথম তাম্রশাসন দু’টিতে একই নামের দু’জন স্বতন্ত্র সেনাপতির কথা বলা হয়েছে। সেক্ষেত্রে এক এক অঞ্চলে এক একজন সেনাপতি, এ অভিমত ভিত্তিহীন হয়। বস্তুত বাকাটক পর্বে সেনাপতিরা প্রদেশপালের পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন এ ধারণা নিতান্তই আনুমানিক। সেনাপতি ও সর্বাধক্ষ এক ও অভিন্ন, বহুদিন পূর্বে অনন্ত সদাশিব অলতেকর এ মত ব্যক্ত করেছেন। এ ধারণা ও ভ্রমাত্মক। রাষ্ট্রাধিকৃত সংজ্ঞক রাজপুরুষেরাই সম্ভবত প্রদেশের শাসনকর্তা ছিলেন।)
  • রজ্জু বা দড়ি থেকে রজুক। নাম থেকে মনে হয়, রজুক রাজস্ব বিভাগের এক কর্মচারী ছিলেন এবং রাজস্ব নির্ধারণের জন্য জমি মাপ-জোখ করতেন।
  • সামরিক বা বিচার বিভাগের পদস্থ রাজপুরুষ দণ্ডনায়ক। তিরোডী
  • তাম্রশাসনে ‘রাজ্যাধিকৃত’ নামে এক রাজপুরুষের উল্লেখ আছে। তিনি সম্ভবত রাজ্য বা রাষ্ট্রের শাসনকর্তা ছিলেন।
  • অনন্ত সদাশিব অলতেকর ‘সন্তক’ নামে জেলাপ্রশাসক পর্যায়ের এক শ্রেণির রাজপুরুষদের কথা বলেছেন। কিন্তু বাকাটক লেখমালায় এ ধরনের কোনও রাজপুরুষের উল্লেখ নেই। কুলপুত্রদের বিশেষণরূপে ব্যবহৃত ‘সচরন্তক’ (সঞ্চরন্তঃ) পদটিকে ভুলক্রমে ‘সন্তক’ পাঠ করা হয়েছে।
  • বাকাটক লেখে গ্রামবৃদ্ধদের উল্লেখ আছে। গ্রামিক বা গ্রামপ্রধান গ্রামমহত্তর, গ্রামকুটুম্বী ও গ্রামবাসীদের সহায়তায় গ্রামের শাসনকার্য পরিচালনা করতেন। গ্রামিক বা গ্রামমহত্তরাদির কী ক্ষমতা ছিল, তাঁদের উপর জেলার বা ঊর্ধ্বতন প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষের কতখানি নিয়ন্ত্রণ ছিল, সে সম্পর্কে বাকাটক লেখে কোনও তথ্য পরিবেশিত হয়নি। কিন্তু একটি বিষয় সুনিশ্চিত, সমকালীন গুপ্তলেখে বিষয়, বীথী ও গ্রাম প্রশাসনে বেসরকারি ব্যক্তিবর্গের যে ভূমিকার সুস্পষ্ট উল্লেখ আছে বাকাটক তাম্রশাসনে বা প্রস্তরলেখে তার কোনও আভাস নেই। তবে এ কথাও স্বীকার্য, বাকাটক লেখে প্রশাসনিক তথ্য বড়ই অপ্রতুল।

সমাজ-জীবন

অসবর্ণ বিবাহের চল : বাকাটক পর্বে বর্ণব্যবস্থা যে কঠোরতার সঙ্গে পালিত হত, তা বোধ হয় না। শাস্ত্রে ব্রাহ্মণের রাজপদ গ্রহণ নিষিদ্ধ বলে ঘোষিত হয়েছে। তা সত্ত্বেও বাকাটকরা ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ভুক্ত হয়েও রাজদণ্ড ধারণ করেছেন। বিবাহের ক্ষেত্রেও তাঁরা বর্ণধর্ম পালন করেননি। এ বিষয়ে হয়তো তাঁদের রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা ছিল।

  • বাকাটক রাজা দ্বিতীয় রুদ্রসেন গুপ্ত সম্রাট দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের কন্যা প্রভাবতীগুপ্তার পাণিগ্রহণ করেন। গুপ্ত রাজারা সম্ভবত জাতিতে বৈশ্য ছিলেন। সমকালীন যুগে অসবর্ণ বিবাহের উল্লেখ আছে হরিষেণের রাজত্বকালে উৎকীর্ণ ঘটোৎকচ গুহালেখে।
  • মন্ত্রী হস্তিভোজের এক পূর্বপুরুষ সোম। বল্লুরনিবাসী এই বিদগ্ধ ব্রাহ্মণ, ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয় পরিবারে বিবাহ করেন। তাঁর ব্রাহ্মণবংশীয় পত্নীদের গর্ভজাত সন্তানেরা অধ্যয়ন-অধ্যাপনায় আত্মনিয়োগ করেন। কিন্তু তাঁর ত্রিয় স্ত্রীর গর্ভজাত পুত্ররা সামরিক বৃত্তি জীবিকারূপে গ্রহণ করেন।

বিদ্যাচর্চা : সে সময় ব্রাহ্মণদের অনেকেই উচ্চশিক্ষিত ছিলেন। লেখে দু’টি বেদ (দ্বিবেদ) ও চতুর্বেদে বিশেষজ্ঞ (চাতুর্বৈদ্য) ব্রাহ্মণদের উল্লেখ আছে। আজীবন নিষ্ঠার সঙ্গে ব্রহ্মচর্য পালন করেছেন, সমাজে এমন ব্রাহ্মণও ছিলেন। ব্রাহ্মণদের নামের শেষে সাধারণত শৰ্মা, আর্য, আচার্য বা স্বামী কথাটি থাকত। যজন, যাজন ও অধ্যাপনা ব্রাহ্মণদের প্রধান বৃত্তি ছিল। রাজকার্যেও তাঁরা অংশ গ্রহণ করতেন। বিদগ্ধ ব্রাহ্মণদের গৃহকে কেন্দ্র করেই এক একটি শিক্ষায়তন গড়ে উঠত। অধ্যাপনার সঙ্গে জড়িত ব্রাহ্মণেরা সাধারণত শহর ও তীর্থক্ষেত্রে বাস করতেন। উচ্চশিক্ষার্থী ছাত্ররা এসব স্থানেই ভিড় করতেন। কিছু কিছু ব্রাহ্মণ অবশ্য অগ্রহার গ্রামেই বাস করতেন। এ পর্বে নাসিক, প্রবরপুর, বৎসগুল্ম ও পৈঠান শিক্ষাকেন্দ্ররূপে প্রসিদ্ধি অর্জন করে। অগ্রহার গ্রামগুলিও বিদ্যা-চর্চার কেন্দ্র ছিল।

নারী : সাধারণত ঋতুমতী হওয়ার পূর্বেই মেয়েদের বিবাহ হত। অন্তত ব্রাহ্মণ পরিবারে এটিই ছিল রীতি। অল্প বয়সে বিবাহ হওয়ায় মেয়েদের উচ্চশিক্ষার পথ রুদ্ধ হয়ে পড়ে। অজন্তার সমকালীন গুহাচিত্র থেকে মনে হয়, পরিবারে তথা সমাজে মহিলারা সম্মানের পাত্রী ছিলেন। সতীপ্রথা ছিল কিন্তু তা ব্যাপক ছিল না।

পোশাক-পরিচ্ছদ ও অলঙ্কার : পোশাক-পরিচ্ছদের মধ্যে ছিল অন্তরাবাসক বা অন্তরীয়ক (নিম্নাঙ্গের পরিধেয় বস্ত্র), উত্তরাসঙ্গ বা সঙ্কক্ষিকা বা উত্তরীয় এবং সংঘাটী বা ঢিলা আলখাল্লা। সম্পন্ন ঘরের মহিলারা সূক্ষ্ম বস্ত্র পরিধান করতেন। বস্তুগুলি এত সূক্ষ্ম ছিল যে একটু হাওয়াতেই তা উড়ে যেত (নিঃশ্বাস-হাৰ্য্য)। স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলেরই অলংকারের প্রতি আকর্ষণ ছিল। কুণ্ডল, অঙ্গদ, কনক বলয়, কণ্ঠহার, ললাটিকা, মণিমেখলা ইত্যাদি অলংকার নর-নারীর ভূষণরূপে অজন্তার চিত্রাবলিতে রূপায়িত হয়েছে।

অর্থনৈতিক ইতিহাস

ধান চাষ : বাকাটক লেখমালায় সমকালীন অর্থনৈতিক জীবন সম্পর্কে অতি স্বল্প তথ্য পরিবেশিত হয়েছে। সে সময়ের কৃষি ও কারিগরি শিল্প সম্পর্কে লেখমালা প্রায় নীরবই বলা চলে। বাকাটক রাজ্যের অচলপুর অঞ্চলে শালি ধান উৎপাদনের পরোক্ষ উল্লেখ আছে দ্বিতীয় প্রবরসেনের পৌনী তাম্রশাসনে। লেখে কতিপয় ব্রাহ্মণের অনুকূলে কৃষ্ণালেশালি কটক বিভাগের অন্তর্ভুক্ত অচলপুর গ্রামের কিছু জমি দানের কথা বলা হয়েছে। উল্লেখ্য, প্রশাসনিক বিভাগের নাম কৃষ্ণালেশালি-কটক। অনুমিত হয়, এ অঞ্চলে প্রচুর পরিমাণে শালি ধান উৎপন্ন হত বলে প্রশাসনিক বিভাগটির এরূপ নামকরণ হয়েছে। অনেকের মতে অমরাবতী জেলার বর্তমান এলিচপুর পৌনী তাম্রশাসনের অচলপুর। মনে রাখতে হবে, লেখটি আবিষ্কৃত হয়েছে মহারাষ্ট্রের ‘শস্যভাণ্ডার’ ভণ্ডারা জেলায়। লেখের অচলপুর সম্ভবত বর্তমান পৌনীরই সন্নিকটবর্তী কোনও এক স্থানে অবস্থিত ছিল। বাকাটক লেখে গর্তসভা নামে এক প্রকার জমির উল্লেখ আছে। গর্তসভা বলতে নিচু জমি বোঝায়।

ভূমি ক্রয়-বিক্রয় : বাকাটক লেখে ভূমি ক্রয়-বিক্রয়ের উল্লেখ নেই, এরূপ একটি ধারণা প্রচলিত আছে। কিন্তু এ এক ভ্রান্ত ধারণা।

  • দ্বিতীয় প্রবরসেনের ইনদউর তাম্রশাসনে চন্দ্র নামে জনৈক বণিকের (বাণিজক) উল্লেখ আছে। তিনি একটি গ্রামের অর্ধাংশ ক্রয় করে (ক্রয়ক্রীতং) তা কতিপয় ব্রাহ্মণের অনুকূলে প্রদান করেন।
  • দ্বিতীয় প্রবরসেনের রামটেক লেখেও সম্ভবত জমি ক্রয়-বিক্রয়ের (ক্রয়োদ্ভবং) উল্লেখ আছে।

অগ্রহার-ব্যবস্থা : সমকালীন লেখে ব্রাহ্মণদের অনুকূলে বাকাটক রাজাদের নিষ্কর গ্রাম বা জমি দানের প্রচুর আছে। বেদবিদ ব্রাহ্মণ তিন গ্রাম গ্রহণ করেছেন এমন ব্রাহ্মণের যেমন উল্লেখ আছে তেমনি ৮ নিবর্তন পরিমাণ জমি দানসূত্রে লাভ করেছেন এমন ব্রাহ্মণদের সংখ্যাও বড় কম নয়। তবে কয়েকটি কথা নিঃসংশয়ে বলা যায়।

  • এক. গুপ্ত শাসন কালে উত্তর বাংলায় ব্রাহ্মণদের যে আয়তনের জমি দান করা হত বাকাটক রাজ্যে ব্রাহ্মণেরা তার তুলনায় বেশি পরিমাণ জমি লাভ করতেন। বিশেষ এক ব্রাহ্মণের অনুকূলে পুরো একটি গ্রাম দান করা হচ্ছে গুপ্তকালীন উত্তর বাংলায় এ দৃশ্য ছিল অভাবনীয় অথচ বাকাটক রাজ্যে এরূপ ঘটনা প্রায়শই ঘটত।
  • দুই. উত্তর বঙ্গে জমি দানের পিছনে ধর্মের বিশেষ এক ভূমিকা ছিল কিন্তু বাকাটক রাজ্যে অগ্রহার ব্যবস্থাপনায় ধর্মের সেরূপ কোনও ভূমিকা ছিল বলে মনে হয় না।
  • তিন. উত্তর বাংলায় যে জমি দান করা হত তা ছিল মূলত অনাবাদি, পতিত, কিন্তু বাকাটক রাজ্যে যে গ্রাম দান করা হত সেখানে ব্রাহ্মণ ও কুটুম্বীদের বাস ছিল, যে ভূখণ্ড দান করা হত তা ছিল চাষের জমি।

তবে কি বুঝতে হবে মূলত শিক্ষা ও ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির প্রসারকল্পেই বাকাটক রাজ্যে অগ্রহার ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়েছে? এ কাজে সফল হতে হলে অধ্যাপক-ব্রাহ্মণকে শিক্ষার্থীদের ভরণ পোষণের দায়িত্বভার গ্রহণ করতে হয়। যথোচিত পরিমাণ সম্পদের অধিকারী না হলে ব্রাহ্মণের পক্ষে এ কাজে অগ্রসর হওয়া অসম্ভব। হয়ত সে কারণেই বাকাটক রাজ্যে ব্রাহ্মণকে উর্বর বা অধিক পরিমাণ জমি দান করা হত। কখনও কখনও প্রদত্ত খেতে খামারবাড়ি (অভ্যন্তর-নিবেশন) ও চাষিদের ঘরবাড়িও (কর্ষক-নিবেশন) থাকত। জমি হস্তান্তরকালে খামারবাড়ি ও চাষিদের আবাসও হস্তান্তরিত হত। (Ajay Mitra Shastri (Ed.) : The Age Of The Vakārakas (New Delhi, 1992), পৃষ্ঠা ১০১-০৯।) দান গ্রহণের ফলে ব্রাহ্মণ যে গ্রাম বা জমির অধিকারী হলেন তা হত নিষ্কর, লেখের ভাষায় ‘অকরদায়ী’। অর্থাৎ ব্রাহ্মণ-গ্রহীতাকে কোনও রাজস্ব দিতে হত না। কিন্তু এতদিন গ্রামের যে রাজস্ব রাজা বা রাষ্ট্রের ভোগ্য ছিল এখন হতে তিনিই হলেন সে রাজস্বের অধিকারী। বাকাটক লেখে বারবার বলা হয়েছে, ব্রাহ্মণকে প্রদেয় গ্রাম বা জমিতে চাট ও ভট নামের দু’শ্রেণির রাজপুরুষের প্রবেশ নিষিদ্ধ (ভটচ্ছাত্রপ্রাবেশ্যঃ, অচাটভটপ্রবেশ্যঃ)। মহারাজ ভরতবলের বমহনী তাম্রশাসনে অচাটভটপ্রবেশ্যঃ কথা প্রসঙ্গে ‘চোরদণ্ডবজম্’ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। মনে হয়, চাট ও ভটদের সাধারণত অগ্রহার গ্রামে প্রবেশ নিষিদ্ধ হলেও চোরের অনুসন্ধান বা চোরকে শাস্তি প্রদানের উদ্দেশ্যে তাঁদের অগ্রহার গ্রামে প্রবেশে কোনও বাধা ছিল না। চাট ও ভট বলতে সম্ভবত পুলিশ ও সৈন্যদের কথা বলা হয়েছে। দীনেশচন্দ্র সরকার চাট ও ভটদের যথাক্রমে পাইক ও বরকন্দাজরূপে শনাক্ত করেছেন।

ব্রাহ্মণকে দেয়া ভূ-সম্পদ নিঃশর্ত ছিল না : বাকাটক রাজ্যে ব্রাহ্মণকে যে ভূ-সম্পদ দান করা হত তা নিঃশর্ত ছিল না। দ্বিতীয় প্রবরসেনের চন্মক তাম্রশাসনে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলা হয়েছে, প্রদত্ত জমিতে নিজের অধিকার বলবৎ রাখতে হলে গ্রহীতাকে কয়েকটি আচরণ-বিধি অবশ্যই পালন করতে হবে। তাঁকে ব্রহ্মহত্যা, চৌর্য, ব্যভিচার ও রাজদ্রোহিতা হতে বিরত হতে হবে, যুদ্ধ বর্জন করতে হবে, অন্য গ্রামের ক্ষতি হতে পারে এরূপ কর্ম পরিহার করতে হবে। এসব নির্দেশ অমান্য করলে ব্রাহ্মণ গ্রহীতা জমিচ্যুত হতে পারেন। এরূপ ব্রাহ্মণকে ভূমিচ্যুত করলে নরপতি চৌর্যের অপবাদে কলঙ্কিত হবেন না (অতোঽন্যথা কুর্বতামনুমোদতাং বা রাজ্ঞঃ ভূমিচ্ছেদং কুর্বতঃ অস্তেয়মিতি)।

রাজস্ব : বাকাটক লেখে ‘ভাগকর’, ‘ভোগকর’, ‘উদ্ভঙ্গ’ বা ‘উপরিকর’ নামে কোনও রাজস্বের উল্লেখ নেই। আছে ‘ক্লিপ্ত’ ও ‘উপক্লিপ্ত’-এর উল্লেখ। এগুলোতেও ব্রাহ্মণ-গ্রহীতার মত গ্রহীতার রাজস্ব ভোগের অধিকারই সুপ্রমাণিত হচ্ছে।

  • ক্লিপ্ত সম্ভবত ভাগের সমার্থক। তাহলে উৎপন্ন শস্যের যে ষষ্ঠাংশ রাষ্ট্রের প্রাপ্য, তা এই ক্লিপ্ত। এ রাজস্ব সম্ভবত শস্যে দিতে হত।
  • মনুসংহিতায় বলা হয়েছে, মাংস, মধু, ঘি, ওষধি, গন্ধদ্রব্য, বৃক্ষ, ফল, মূল, রসদ্রব্য, পুষ্প, তৃণ, পত্র, শাক, মৃন্ময়পাত্র, বংশপাত্র, চর্মপাত্র এবং প্রস্তর নির্মিত দ্রব্যাদির লাভের ষষ্ঠাংশ রাষ্ট্রের প্রাপ্য। এসব দ্রব্যাদিতে রাজপ্রাপ্য অংশই সম্ভবত উপক্লিপ্ত।
  • হিরণ্য বর্তমান প্রসঙ্গে সোনা নয়, কয়েকটি সুনির্দিষ্ট পণ্যের উপর নগদে প্রদেয় রাজস্বই হিরণ্য। প্রদত্ত গ্রামে ধনরত্নের (সনিধিঃ সোপনিধিঃ) সন্ধান পাওয়া গেলে গ্রহীতাই হতেন সে সম্পদের মালিক।

আয়ের আরও উৎস : তাছাড়া রাজা বা রাষ্ট্রের আয়ের আরও উৎস ছিল।

  • বাকাটক লেখে দেখা যায়, গ্রহীতাকে প্রায়শই লবণের খনি, মৃত্তিকাগর্ভে নিহিত রত্ন ও খনিজ দ্রব্য এবং গ্রামের চারণভূমির উপর ভোগাধিকার দেওয়া হয়েছে। অনুমিত হয়, লবণখনি, গুপ্ত ধনরত্নাদি এবং রাজ্যের জলা বা ঊষর জমির উপর রাষ্ট্রের মালিকানা প্রতিষ্ঠিত ছিল। সম্ভবত বনাঞ্চলও রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বাধীন ছিল। বা
  • স্তু ও কৃষির খেতে ভূস্বামীদের ব্যক্তিগত মালিকানা বলবৎ ছিল। রাজস্ব বাকি পড়লে বা ভূস্বামীর কোনও উপযুক্ত উত্তরাধিকারী না থাকলে সে জমি রাষ্ট্রায়ত্ত হত।
  • রাজাদের নিজস্ব খাস জমি ছিল।

বেগার শ্রম : রাষ্ট্রের স্বার্থে প্রজাদের বেগার শ্রমের জোগান দিতে হত। তখনকার দিনে রাজা বা রাষ্ট্রকে বেগার শ্রম (সর্ববিষ্টি) জোগানের যে রীতি ছিল তার দায়িত্ব হতে গ্রহীতাকে রেহাই দেওয়া হত, রাজা বা রাজপুরুষদের ব্যবহারের জন্য তাঁকে গরু ও বলদের সংস্থান করতে হত না, আপৎকালীন করের (প্রণয়) বোঝাও তাঁকে বহন করতে হত না। সর্বপ্রকার পরিহারমুক্ত (সর্ব-পরিহার-পরিহৃতঃ) ছিল সে গ্রাম।

ভূমি পরিমাণের একক ছিল নিবর্তন : বাকাটক রাজ্যে ভূমি পরিমাণের একক ছিল নিবর্তন। ১ নিবর্তন বলতে কি পরিমাণ জমি বোঝায় সে সম্পর্কে বিদ্বজ্জনেরা সুনিশ্চিত নন। অনন্ত সদাশিব অলতেকরের মতে ১ নিবর্তন ৫ একরের সমতুল্য। অধ্যাপক মহালিঙ্গমের অভিমতে ১ নিবর্তন ২০০ বর্গহস্তের সমার্থক। এক বিশেষ পদ্ধতিতে জমি পরিমাপ করা হত। বাকাটক লেখে এ পদ্ধতিকে রাজমান, রাজন্যমান বা রাজকীয় মান আখ্যা দেওয়া হয়েছে।

জল-প্রকল্প : সরকারি উদ্যোগে এ পর্বে কয়েকটি জল-প্রকল্প রূপায়িত হয়।

  • দেবসেনের হিস্সে বোরালা প্রস্তরলেখে এরূপ একটি বৃহৎ জল-প্রকল্পের উল্লেখ আছে। ৩৮০ শকাব্দে বা ৪৫৮ খ্রিস্টাব্দে দেবসেনের অধীনস্থ পদস্থ আধিকারিক (আজ্ঞাকর) স্বামিল্লদেব মহারাষ্ট্রের অকোলা জেলায় একটি হ্রদ নির্মাণ করেন। বপ্প নামে জনৈক কর্মোপদেষ্টা হ্রদের নির্মাণ কার্য পরিচালনা করেন। গুজরাতের ইতিহাস প্রসিদ্ধ সুদর্শন হ্রদের নামানুসারে জলাধারটির নামকরণ হয়।
  • দ্বিতীয় পৃথিবীষেণের মাহুরঝরী তাম্রশাসন পৃথিবীসমুদ্র নামে একটি স্থান হতে প্রদত্ত হয়। অনুমিত হয়, বাকাটকরাজ এ স্থানে স্বনামে এক বৃহৎ জলাশয় (সমুদ্র) খনন করান এবং জলাধারের মতো স্থানটিও পৃথিবীসমুদ্র নামে পরিচিত হয়। কিন্তু কি উদ্দেশ্যে জলাধার দু’টি নির্মিত হয়েছিল? স্থানীয় অঞ্চলে পানীয় জলের সংস্থান, না খেতে চাষ-আবাদের কাজে জলের জোগান? এমনও হতে পারে দু’টি লক্ষ্য সাধনের উদ্দেশ্যেই জলাধার দু’টি খনন করা হয়। সে ক্ষেত্রে জলাধার দু’টির নির্মাণে সেচব্যবস্থা তথা কৃষির সম্প্রসারণে বাকাটক সরকারের গভীর আগ্রহই প্রতি ফলিত হয়েছে বলা যায়।

শুল্কবট : দ্বিতীয় পৃথিবীষেণের মানঢল তাম্রশাসনে একটি অগ্রহার গ্রামের সীমানা চিহ্নিতকরণ প্রসঙ্গে শুল্কবটের উল্লেখ আছে। শুল্ক-চৌকির নিকটবর্তী হওয়ায় সম্ভবত বটবৃক্ষের এরূপ নামকরণ হয়েছে। অর্থাৎ মানঢল তাম্রশাসনে শুল্ক চৌকির ইঙ্গিত আছে।

কৃষির সম্প্রসারণ এবং বাণিজ্য ও নগরায়নের অবনতি : বাকাটক রাজ্যের অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে কৃষ্ণমোহন শ্রীমালী কিছু বক্তব্য রেখেছেন। তিনি বলেন, এ সময় কৃষির সম্প্রসারণ হচ্ছে, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জনপদ গড়ে উঠছে কিন্তু অবনতি ঘটছে শিল্পের ও বাণিজ্যের, রুদ্ধ হয়েছে নগরায়ণের গতি। সমকালীন লেখে ব্যবসা-বাণিজ্যের উল্লেখ নেই বললেই চলে ; রাজারাও মুদ্রা উৎকীর্ণ করেননি, বড় ধরনের সৌধও নির্মিত হয়নি এ যুগে; এ অঞ্চলে যা কিছু হয়েছে তা হয়েছে প্রাক্-বাকাটক পর্বে। বাকাটক পর্বে কৃষির সম্প্রসারণ সম্বন্ধে কৃষ্ণমোহন শ্রীমালীর বক্তব্য নিয়ে কোনও সংশয় নেই কিন্তু সংশয় আছে শিল্পের ও বাণিজ্যের তথাকথিত অবক্ষয় সম্পর্কিত তাঁর মন্তব্য সম্পর্কে। ভুললে চলবে না, কৃষির সম্প্রসারণ বাণিজ্যের পরিধি প্রসারিত করে, শিল্পোদ্যোগের পথ সুগম করে। বাণিজ্য শুধু শিল্পনির্ভর নয়, বাণিজ্যে কৃষিরও বিরাট ভূমিকা আছে। সমকালীন লেখে কাংস কারগ্রাম, সুবর্ণকারগ্রাম, কর্মকারগ্রাম, চর্মাঙ্কগ্রাম (চর্মকারগ্রাম), শঙ্খিকাগ্রাম, লবণ-তৈলকগ্রাম ও লোহনগরের যেমন উল্লেখ আছে তেমনি আছে পুর ও নগর নামান্ত বহু স্থানের কথা যা নগরায়ণের ইঙ্গিত দেয়। বাকাটক লেখে শুল্ক-চৌকিরও প্রচ্ছন্ন উল্লেখ আছে। বাকাটক রাজ্যে মুদ্রার প্রচলন ছিল না বা রাজারা কোনও মুদ্রা উৎকীর্ণ করেননি, এ ধরনের বক্তব্য সত্যবর্জিত। স্থাপত্য, ভাস্কর্য ও চিত্রকলার ক্ষেত্রে এ পর্বে যে ব্যাপক সৃষ্টিধর্মী কর্মযজ্ঞ অনুষ্ঠিত হয়েছে তা অবিস্মরণীয়। লেখে ও কালিদাসের রচনায় যে সমকালীন বিদর্ভের চিত্র অঙ্কিত হয়েছে সে বিদর্ভ ঐশ্বর্যময়, রম্য, ঋদ্ধ।

বাণিজ্য : বাণিজ্য যে লাভজনক বৃত্তি ছিল তার ইঙ্গিত আছে ইনদউর তাম্রশাসনে বর্ণিত বণিকচন্দ্রের দৃষ্টান্তে। গ্রামের অর্ধাংশ ক্রয় করে তা কতিপয় ব্রাহ্মণের অনুকূলে প্রদান করেন। বাণিজ্য যে লাভজনক বৃত্তি ছিল, এই দৃষ্টান্তে তার ইঙ্গিত আছে।

কারিগর, ভাস্কর ও চিত্রকর : অজন্তার ষোড়শ, সপ্তদশ ও ঊনবিংশ গুহা তিনটি এ পর্বে উৎকীর্ণ হয়। গুহাগুলি অপরূপ ভাস্কর্যমণ্ডিত এবং দৃষ্টিনন্দন চিত্রাবলিতে শোভিত। বাকাটক রাজ্যের কারিগর, ভাস্কর ও চিত্রকরেরা তাঁদের কালজয়ী শিল্প কর্মে অসাধারণ প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে গেছেন। লেখে সুবর্ণকারদের উল্লেখ আছে। মূলত স্বর্ণ অলংকার নির্মাণ তাঁদের পেশা হলেও তাঁরা তাম্রপট্টও উৎকীর্ণ করতেন। হরিষেণের থালনের তাম্রশাসনে কাংসকার গ্রামের উল্লেখ আছে।

মুদ্রা : কতিপয় বাকাটক নৃপতি কিছু তাম্রমুদ্রা উৎকীর্ণ করেছেন। এঁদের একজন পৃথিবীষেণ। কিন্তু এই পৃথিবীষেণ প্রথম রুদ্রসেনের পুত্র প্রথম পৃথিবীষেণ না নরেন্দ্রসেনের পুত্র দ্বিতীয় পৃথিবীষেণ তা স্পষ্ট নয়। নরেন্দ্রসেনের নামাঙ্কিত তাম্রমুদ্রাও আবিষ্কৃত হয়েছে। তাছাড়া বাকাটক বা বাকাটক-অনুরূপ কিছু সংখ্যক তাম্রমুদ্রারও সন্ধান পাওয়া গেছে। ছোট-খাটো বেচা-কেনার কাজে নিম্নমানের এই তাম্রমুদ্রাগুলি ব্যবহৃত হত। অনুমিত হয়, বাকাটক রাজ্যে পশ্চিমা ক্ষত্রপ, ত্রৈকূটক, গুপ্ত এবং পুরোনো কার্যাপণ মুদ্রাও প্রচলিত ছিল। অনুমান করা যায়, বিভিন্ন শ্রেণির মুদ্রার আপেক্ষিক মূল্য নির্দিষ্ট ছিল। জিনিসপত্রের ক্রয়-বিক্রয় কার্যে কড়িও ব্যবহৃত হত। হয়তোবা দ্রব্য-বিনিময় ব্যবস্থারও চলন ছিল।

ধর্মীয় জীবন ও সাহিত্য

ধর্মীয় জীবন

যাগযজ্ঞ : বাকাটক রাজারা ব্রাহ্মণ্য ধর্মাবলম্বী ছিলেন। প্রথম প্রবরসেন অগ্নিষ্টোম, আপ্তোর্যাম, জ্যোতিষ্টোম, বৃহস্পতিসব, সাদ্যসন্ত্র, উথ্য, ষোড়শী, অতিরাত্র, বাজপেয়, অশ্বমেধ ইত্যাদি বহু বৈদিক যাগ-যজ্ঞের অনুষ্ঠান করেন। অন্য কোনও বাকাটক রাজা বৈদিক যাগ-যজ্ঞের অনুষ্ঠান করেছেন বলে শোনা যায় না। হয়তো যাগ-যজ্ঞ অপেক্ষা মূর্তি প্রতিষ্ঠা, মন্দির নির্মাণ, তীর্থভ্রমণের মতো কার্যকলাপের প্রতি মানুষের দৃষ্টি অধিকতর আকৃষ্ট হয়।

শৈবধর্ম : বেশির ভাগ বাকাটক রাজাই ছিলেন পরমমাহেশ্বর অর্থাৎ ধর্মমতে শৈব। তাঁরা কয়েকটি শিবমন্দিরও প্রতিষ্ঠা করেন।

  • প্রথম প্রবরসেন প্রবরেশ্বর নামে একটি শিবমন্দির নির্মাণ করেন।
  • তাঁর পৌত্র প্রথম রুদ্রসেনের উপাস্য দেবতা মহাভৈরব। ইষ্টদেবতার উদ্দেশ্যে তিনি একটি ধর্মস্থান বা মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন।

বৈষ্ণবধর্ম : বিষ্ণুও রাজপরিবারে অনাদৃত ছিলেন না।

  • মহিষী প্রভাবতীগুপ্তা বিষ্ণুর অনুরাগিণী ছিলেন। রাজধানীর অনতিদূরে শ্রীরামচন্দ্রের স্মৃতি বিজড়িত রামগিরি পাহাড়ে রামগিরিস্বামীর এক মন্দির ছিল। প্রভাবতীগুপ্তা প্রায়ই এই মন্দির পরিদর্শন করতেন এবং দান-ধ্যানাদি কার্যে অংশগ্রহণ করতেন। প্রভাবতীগুপ্তার স্বামী দ্বিতীয় রুদ্রসেনও চক্রপাণি বা বিষ্ণুর ভক্ত ছিলেন।
  • বেতুল জেলার পট্টনে আর একটি বিষ্ণুমন্দির নির্মিত হয়েছিল। দ্বিতীয় প্রবরসেন এই মন্দিরে একটি সত্র প্রতিষ্ঠা করেন। সেখানে ভক্তজনদের নিখরচায় অন্ন বিতরণ করা হত। সত্রের এ খরচ নির্বাহের জন্য রাজা ৪০০ নিবর্তন পরিমাণ জমি দান করেন। ওয়ার্ধার নিকট রামস্বামীর আর একটি মন্দির ছিল।

সহনশীলতা : বাকাটক রাজারা মূলত শৈব হলেও অন্যান্য ধর্মের প্রতিও তাঁরা শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। দ্বিতীয় প্রবরসেন ধর্মে শৈব ছিলেন। কিন্তু তাঁর লেখা সেতুবন্ধ কাব্যে রাম তথা বিষ্ণুর মাহাত্ম্য কীর্তিত হয়েছে।

একাদশী ব্রত : এ সময় ব্রাহ্মণ্য সমাজে একাদশী ব্রত সমাদৃত ছিল। একাদশীর পুণ্য তিথিতে মহিলারা উপবাস পালন করতেন এবং দান-ধ্যানাদি কার্যে অংশগ্রহণ করতেন। একাদশী তিথিসমূহের মধ্যে প্রবোধিনী বা কার্তিকী শুক্লা একাদশী পবিত্রতম। এই পুণ্য তিথি মেঘদূতের নির্বাসিত যক্ষের শাপাবসানের তিথি (মেঘদূত, উত্তরমেঘ, ৪৯)। কথিত আছে, এই পুণ্য তিথিতে বিষ্ণু চার মাস নিদ্রাসুখ উপভোগের পর অনন্তশয্যা ত্যাগ করে উত্থান করেন।

জৈনধর্ম : বাকাটক রাজ্যে জৈনধর্ম তেমন জনপ্রিয়তা অর্জন করেনি। এ পর্বের কোনও লেখে জৈনধর্মের উল্লেখ নেই। সন্দেহ নেই, বাকাটক রাজ্যে জৈনরা স্বল্পসংখ্যকই ছিলেন।

বৌদ্ধধর্ম : বাকাটক রাজ্যে বৌদ্ধধর্ম মোটামুটি জনপ্রিয়ই ছিল বলা চলে।

  • হরিষেণের মন্ত্রী বরাহদেব অজন্তার ষোড়শ গুহা বিহারটি নির্মাণ করে তা বৌদ্ধসংঘের অনুকূলে প্রদান করেন। অজন্তার সপ্তদশ গুহা বিহার ও ঊনবিংশ গুহা চৈত্যটিও হরিষেণের রাজত্বকালে খোদিত হয়।
  • গুলবাড়ায় বরাহদেব আর একটি বৌদ্ধবিহার খনন করেন। সেই গুহাবিহারে বুদ্ধদেবের এক ধর্মচক্র প্রবর্তন মূর্তি উৎকীর্ণ হয়।
  • বরাহদেব সম্ভবত আরও একটি বৌদ্ধবিহার নির্মাণ করেন।
  • বাকাটক রাজাদের শাসনকালে পাহাড় কুঁদে একাধিক বৌদ্ধ চৈত্য ও বিহার নির্মিত হয়। বাকাটক পর্বের তিনটি লেখে বৌদ্ধবিহার ও চৈত্য নির্মাণের উল্লেখ আছে। পক্ষান্তরে এ পর্বের কম করেও পনেরোটি লেখে ব্রাহ্মণ ও ব্রাহ্মণ্য দেব-দেবীর উদ্দেশ্যে দান-ধ্যানের কথা বলা হয়েছে। অথচ পূর্ববর্তী সাতবাহন যুগের বেশির ভাগ লেখই বৌদ্ধসংঘের অনুকূলে দান সম্পর্কিত। এতে বোঝা যায়, সাতবাহন যুগের তুলনায় এ পর্বে বৌদ্ধধর্মের জনপ্রিয়তা হ্রাস পায়।

সাহিত্য

প্রাকৃত ও সংস্কৃত সাহিত্যের ইতিহাসে বাকাটক যুগ এক স্মরণীয় অধ্যায়রূপে চিহ্নিত। বাকাটক রাজাদের অনেকেই সাহিত্য প্রতিভার অধিকারী ছিলেন।

হরিবিজয় : বৎসগুল্ম শাখার সর্বসেন প্রাকৃত ভাষায় ‘হরিবিজয়’ নামে একখানি কাব্য রচনা করেন। কাব্যটি বর্তমানে অবলুপ্ত। পত্নী সত্যভামার অনুরোধে কৃষ্ণের স্বর্গ হতে পারিজাত আহরণ সম্ভবত এ কাব্যের প্রতিপাদ্য বিষয়। ‘হরিবিজয়’ কাব্য থেকে আনন্দবর্ধন তাঁর ধ্বন্যালোকে একটি শ্লোক উদ্ধার করেছেন। শ্লোকটি মহারাষ্ট্রী প্রাকৃতে রচিত। মনে হয়, ‘হরিবিজয়’ কাব্যখানি মহারাষ্ট্রী প্রাকৃতে রচিত হয়েছিল। আনন্দভট্ট, উদ্যোতন ও হেমচন্দ্রের মতো প্রাচীন ভারতের প্রথিতযশা লেখকেরা এই কাব্যের নামোল্লেখ করেছেন বা এর কয়েকটি শ্লোক উদ্ধৃতিরূপে ব্যবহার করেছেন। রচনা উচ্চশ্রেণির না হলে এরূপ সমাদর হয় না।

দিবাকরসেন রচিত একটি সুভাষিত : শ্রীধরদাসের ‘সদুক্তিকর্ণামৃত’-এ যুবরাজ দিবাকরসেন রচিত একটি সুভাষিতের উল্লেখ আছে। এই দিবাকরসেন সম্ভবত বাকাটক রাজকুমার দিবাকরসেন। ‘সদুক্তিকর্ণামৃত’-এ প্রবরসেন রচিত কয়েকটি সুভাষিতের উদ্ধৃতি আছে। এই প্রবরসেন বাকাটক নৃপতি দ্বিতীয় প্রবরসেন।

সেতুবন্ধ : দ্বিতীয় প্রবরসেন মহারাষ্ট্রী প্রাকৃতে ‘সেতুবন্ধ’ বা ‘রাবণবহো’ কাব্য রচনা করেন। টীকাকার রামদাস বলেন, বিক্রমাদিত্যের আদেশে কালিদাস প্রবরসেনের নামে এ কাব্যখানি রচনা করেন। সেতুবন্ধের প্রথম অধ্যায়ের নবম শ্লোকে বলা হয়েছে, প্রবরসেন সিংহাসনে আরোহণ করেই কাব্য রচনায় হাত দেন কিন্তু কাব্য রচনাকালে তিনি বিস্তর বাধাবিঘ্নের সম্মুখীন হন। সেতুবন্ধ রচনার কাজে দ্বিতীয় প্রবরসেন যে কোনও এক প্রতিভাবান কবির সাহায্য গ্রহণ করেন, তার হয়তো এক প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত রয়েছে এই শ্লোকে। অনুমান করা যায়, মহাকবি কালিদাস দ্বিতীয় প্রবরসেনের এ কাব্যখানিকে সংশোধিত ও পরিমার্জিত করে আরও সুষমামণ্ডিত করেন। ১৩৬২টি শ্লোকে রচিত ও পঞ্চদশ আশ্বাসে বিভক্ত এই কাব্যে রাবণের বিরুদ্ধে রামচন্দ্রের সামরিক অভিযান, সমুদ্র পারের জন্য সেতু নির্মাণ এবং পরিশেষে রাবণকে নিহত করে রামের সপরিবার অযোধ্যায়। প্রত্যাবর্তন, বর্ণিত হয়েছে। বাণভট্ট তাঁর হর্ষচরিত কাব্যে সেতুবন্ধের প্রশংসা করে বলেছেন, সেতুবন্ধ রচনা করায় প্রবরসেনের যশ সমুদ্র পেরিয়ে বহুদূর বিস্তৃত হয়। খ্রিস্টীয় ৯ম শতকে আনন্দবর্ধনও এই কাব্যের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন।

গাথা : দ্বিতীয় প্রবরসেন বেশ কিছু প্রাকৃত গাথাও রচনা করেন। এরূপ ৯টি গাথা গাথাসপ্তশতীতে উদ্ধৃত আছে।

মেঘদূত : বাকাটক রাজধানী নন্দিবর্ধনে অবস্থানকালে কালিদাস সম্ভবত তাঁর অমর কাব্য মেঘদূত রচনা করেন। কাব্যের নায়ক যক্ষ বিরহ-সন্তপ্ত। কুবেরের অভিশাপে তিনি অলকা হতে নির্বাসিত হয়ে রামচন্দ্রের স্মৃতিবিজড়িত রামগিরিতে দিন যাপন করছেন। তাঁর মন পড়ে রয়েছে অলকায় যেখানে তাঁর ‘তন্বী শ্যামা শিখরদশনা’ প্রিয়ার বাস। ‘আষাঢ়স্য প্রথম দিবসে মেঘ দেখে তাঁর চিত্ত উদ্বেল হয়ে উঠে। মেঘকে তিনি তাঁর বেদনাবার্তা অলকায় তাঁর প্রিয়ার নিকট পৌঁছে দেওয়ার মিনতি জানান। রামগিরি থেকে মেঘের অলকায় গমন, এই নিয়ে মেঘদূতের পূর্বমেঘ। অলকা ও বিরহিণী যক্ষ প্রিয়ার বর্ণনা হল উত্তরমেঘের বস্তুরূপ। রাজধানী নন্দিবর্ধনের অতি নিকটবর্তী এই রামগিরি। এখানে রামচন্দ্র বা রামগিরিস্বামীর একটি মন্দির ছিল। অগ্রমহিষী প্রভাবতীগুপ্তা কয়েকবারই রামগিরি পরিদর্শন করেন। এই স্থান দর্শন করেই কালিদাস সম্ভবত মেঘদূত রচনায় উদ্বুদ্ধ হন।

মহাভারত, পুরাণের সংকলন, স্মৃতিশাস্ত্রের প্রণয়ন : বাকাটক যুগে মহাভারত ও পুরাণগুলি সংকলিত হচ্ছিল; যাজ্ঞবল্ক্য, নারদ ও কাত্যায়নের স্মৃতিগ্রন্থগুলি রচিত হচ্ছিল; পদার্থসংগ্রহ, শবরভাষ্য, ব্যাসভাষ্য, সাঙ্খ্যকারিকা, লঙ্কাবতারসূত্র ইত্যাদি গ্রন্থগুলি প্রণীত হচ্ছিল। এসব গ্রন্থকার ও সংকলকদের কেউই ব্রাহ্মণ্যধর্মাবলম্বী বাকাটক রাজগণের আনুকূল্য লাভ করেননি, এমনটি ভাবা হয়তো ঠিক নয়। তবে এই প্রশ্নের সদুত্তর এই মুহূর্তে পাওয়া যাবে না।

নাট্যকার : শূদ্রক ও বিশাখদত্তের মতো যশস্বী নাট্যকারেরাও ঠিক এই সময় আবির্ভূত হয়েছিলেন। বাকাটক রাজগণের সঙ্গে তাঁদের সম্পর্ক সম্বন্ধেও কোনও সুনিশ্চিত তথ্য নেই। কিন্তু একটি জিনিস সুনিশ্চিত।

কাব্য রচনায় বৈদর্ভী রীতি : সংস্কৃত ও প্রাকৃত সাহিত্যের ইতিহাসে বাকাটক পর্বের গুরুত্ব অপরিসীম। কাব্য রচনার যে আদর্শ বাকাটক রাজ্যে তথা বিদর্ভে অনুসৃত হয়েছিল তা বৈদর্ভী রীতি নামে সর্বভারতীয় খ্যাতি লাভ করে। আলংকারিক দণ্ডী (খ্রিস্টীয় সপ্তম শতক) কাব্য রচনায় এই রীতিকে সর্বোত্তম বলে ঘোষণা করেছেন। স্বয়ং কালিদাস কাব্য রচনায় এই রীতি গ্রহণ করেন। বাকাটক যুগকে বৈদভী রীতির উদ্ভব ও বিকাশকাল বলে চিহ্নিত করা যায়।

স্থাপত্য, ভাষ্কর্য ও চিত্রকলা

মন্দির-স্থাপত্য 

বাকাটক লেখমালায় সেযুগে নির্মিত কয়েকটি মন্দিরের উল্লেখ আছে। এই মন্দিরগুলির মধ্যে চিকম্বুরির ধর্মস্থান, প্রবেরশ্বর-ষড়বিংশতি-বাটকের প্রবরেশ্বর মন্দির, রামগিরির রামগিরিস্বামী মন্দির, অশ্বত্থখেটকের মহাপুরুষ মন্দির এবং প্রবরপুরের রামচন্দ্র মন্দির সবিশেষ উল্লেখযোগ্য।

  • রামটেক পাহাড়ে সম্ভবত বাকাটক পর্বে নির্মিত এক প্রাচীন মন্দিরের সন্ধান পাওয়া গেছে। বর্তমানে এই মন্দিরের মণ্ডপটি ছাড়া কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। মণ্ডপটির ছাদ সমতল, ৬টি স্তম্ভ। ৪টি স্তম্ভেরই অবয়বে পদ্মের নকশার অলংকরণ। এটি সম্ভবত একটি বিষ্ণু মন্দির।
  • বাকাটক যুগের আর একটি প্রাচীন মন্দির জবলপুর জেলার তিগোওয়ায় আবিষ্কৃত হয়েছে। বর্গক্ষেত্রাকার গর্ভগৃহ, ৪টি স্তম্ভসজ্জিত মণ্ডপ্ ও একটি মুখমণ্ডপ, এই ছিল মন্দিরটির আদি রূপ। কিন্তু পরবর্তী কালে মুখমণ্ডপটিকে একটি মণ্ডপে রূপান্তরিত করা হয় এবং এই মণ্ডপটির সম্মুখভাগে একটি নতুন মুখমণ্ডপ তৈরি করা হয়। আদি মণ্ডপটির ৪টি স্তম্ভ নির্মাণে শিল্পী তাঁর দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। স্তম্ভগুলি পাদদেশে চতুষ্কোণ কিন্তু তারপর ক্রমান্বয়ে অষ্টকোণ, ষোড়শকোণ, বর্তুলাকার ও চতুষ্কোণ। স্তম্ভশীর্ষে খাঁজকাটা ঘণ্টা। মন্দিরটির নির্মাণকাল সম্ভবত খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতকের মধ্যভাগ।
  • তিগোওয়ায় আরও কয়েকটি প্রাচীন মন্দির নির্মিত হয়েছিল।
  • নাচনা কুঠারার সমতল ছাদবিশিষ্ট দ্বিতল পার্বতী মন্দির এ পর্বের কীর্তি। এই মন্দিরে একটি প্রদক্ষিণা পথ রয়েছে। মন্দিরটি সম্ভবত খ্রিস্টীয় ৫ম শতকের শেষপাদে নির্মিত হয়েছিল।

গুহা-স্থাপত্য

বাকাটক পর্বে অজন্তার ষোড়শ ও সপ্তদশ গুহাবিহার দু’টি এবং ঊনবিংশ গুহাচৈত্যটি খোদিত ও অলংকৃত হয়।

  • ষোড়শ গুহাবিহার : অজন্তার সুষমামণ্ডিত ষোড়শ গুহাবিহারটি মহারাজ হরিষেণের মন্ত্রী বরাহদেবের আনুকূল্যে খোদিত হয়। মণ্ডপ ও মুখমণ্ডপ, এই নিয়ে এই বৌদ্ধবিহার। মুখমণ্ডপ আয়তাকার কিন্তু মণ্ডপ বর্গক্ষেত্রাকার। মুখমণ্ডপের ৬টি নিরলংকার, আটকোনা স্তম্ভ, ২টি সুচারুরূপে অলঙ্কৃত অর্ধস্তম্ভ। মুখমণ্ডপ পেরলেই মণ্ডপ। মণ্ডপের তিনটি দরজা। মধ্যম দরজাটি প্রধান। প্রধান দরজার দু’পাশে দু’টি অর্ধস্তম্ভ। অর্ধস্তম্ভের গায়ে মকরবাহিনী গঙ্গার দণ্ডায়মান মূর্তি উৎকীর্ণ। মণ্ডপের ২০টি স্তম্ভ। এদের ১৬টিই নিরলংকার ও আটকোনা। সামনের ও পিছনের সারির মধ্যিখানে দু’টি করে স্তম্ভ ক্রমান্বয়ে চারকোনা, আটকোনা, ষোড়শকোনা ও চারকোনা। মণ্ডপের দু’পাশে ৬টি করে সর্বসমেত ১২টি, পিছনের দিকে ২টি এবং মুখমণ্ডপের দু’পাশে ২টি, এই নিয়ে সর্বসমেত ১৬টি কক্ষ। মণ্ডপের পিছন দিকে চৈত্যমন্দির বা গর্ভগৃহ। চৈত্যমন্দিরে ভগবান বুদ্ধদেবের প্রলম্বপাদ আসনে উপবিষ্ট ধর্মচক্রপ্রবর্তন মূর্তি। বুদ্ধদেবের ডান দিকে বজ্রপাণি, বাঁদিকে পদ্মপাণি। চৈত্য মন্দিরের চতুষ্পার্শ্বে প্রদক্ষিণা পথ।
  • সপ্তদশ গুহাবিহার : হরিষেণের রাজত্বকালে খোদিত অজন্তার সপ্তদশ গুহাবিহার ষোড়শ গুহাবিহারেরই প্রায় অনুরূপ। এই গুহাবিহারের দু’টি অঙ্গ—আয়তক্ষেত্রাকার মুখমণ্ডপ এবং বর্গক্ষেত্রাকার মণ্ডপ। মুখমণ্ডপে ৬টি নিরলংকার, আটকোনা স্তম্ভ এবং দু’প্রান্তে দু’টি ভাস্কর্য খচিত অর্ধস্তম্ভ। মণ্ডপে সর্বসমেত ২০টি স্তম্ভ। এদের ১৬টিই আটকোনা ও নিরাভরণ। কিন্তু সামনের আর পিছনের সারির মাঝখানের দু’টি করে স্তম্ভ চিত্র ও ভাস্কর্যে সমুজ্জ্বল। অলংকৃত স্তম্ভগুলি ক্রমান্বয়ে চারকোনা, আটকোনা ও ষোড়শকোনা। মণ্ডপের পিছন দিকে আয়তাকার অন্তরাল। অন্তরালের পিছনেই বর্গাকার চৈত্যমন্দির বা গর্ভগৃহ। গর্ভগৃহের তোরণ দণ্ডায়মান ও উপবিষ্ট বুদ্ধমূর্তিতে অলংকৃত। তোরণের উপরদিকে দু’পার্শ্বে মকরবাহিনী গঙ্গার দণ্ডায়মান মূর্তি উৎকীর্ণ। গর্ভগৃহে পদ্মাসনে উপবিষ্ট বুদ্ধদেবের এক বিরাট যোগাসীন, ধর্মচক্রপ্রবর্তন মূর্তি উৎকীর্ণ হয়েছে। বুদ্ধ দেবের ডান দিকে দণ্ডায়মান পদ্মপাণি, বাঁদিকে দণ্ডায়মান বজ্রপাণি। গুহাটিতে সর্বসমেত ১৮টি কক্ষ। মুখমণ্ডপের দু’পাশে দু’টি, মণ্ডপের দু’পাশে ৬টি করে মোট ১২টি, আর মণ্ডপের পিছন দিকে তোরণের দু’পাশে দু’টি করে মোট ৪টি কক্ষ। উৎকীর্ণ লেখ হতে জানা যায়, মণ্ডপে একটি জলাধার ছিল। সপ্তদশ গুহাবিহারের এক অমূল্য সম্পদ তার অতুলনীয় চিত্রসম্ভার।
  • ঊনবিংশ গুহাচৈত্য : হরিষেণের সময় উৎকীর্ণ অজন্তার ঊনবিংশ গুহাটি একটি গুহাচৈত্য। লেখে এই গুহা চৈত্যটিকে গন্ধকূটী আখ্যা দেওয়া হয়েছে। গুহার সম্মুখভাগে বর্গাকার এক প্রশস্ত অঙ্গন। অঙ্গনের দু’পাশে দু’টি ক্ষুদ্রাকারের উপাসনা গৃহ। সম্মুখস্থ সুদৃশ্য মুখমণ্ডপ ও অভ্যন্তরস্থ ক্ষুদ্রাকারের এক আয়তাকার চৈত্যকক্ষ বা মণ্ডপ, যার পিছনটা অর্ধচন্দ্রাকার, এই নিয়ে এই গুহাচৈত্য। ৩.৩৫ মিটার উচ্চতাসম্পন্ন ১৫টি সুদৃশ্য স্তম্ভ মণ্ডপটিকে তিনটি ভাগে বিভক্ত করেছে—পার্শ্বদেয়াল থেকে স্তম্ভসারি পর্যন্ত বিস্তৃত দু’টি পার্শ্বপথ এবং মধ্যবর্তী প্রশস্ত মূল অংশ। স্তম্ভগুলি ক্রমান্বয়ে বর্গাকার, আটকোনা ও বর্তুলাকার। স্তম্ভশীর্ষে আমলক ও উপবিষ্ট বুদ্ধমূর্তি। স্তম্ভগাত্রে লতা, পাতা, ঘট, প্রস্ফুটিত পদ্ম, বুদ্ধ, আকাশবিহারী গন্ধর্ব, সিদ্ধযোগী ও পশুমূর্তি উৎকীর্ণ। পাহাড় কুঁদে মণ্ডপের ছাদের নিম্নতলকে কড়াই-এর অন্তর্ভাগের আকার দেওয়া হয়েছে। মণ্ডপের পিছন দিকে একটি স্তূপ। স্তূপটির সর্বনিম্ন অংশ বর্গাকার উঁচু মঞ্চ বা বেদিকা। এরপর ক্রমান্বয়ে মেধি, অণ্ড, হর্মিকা, ক্রমহ্রস্বায়মান ছত্রাবলি ও কলস। স্তূপের সামনের দিকে সুগভীর কুলুঙ্গির মধ্যে এক দণ্ডায়মান, নয়নাভিরাম বুদ্ধমূর্তি উৎকীর্ণ হয়েছে। মুখমণ্ডপের বহির্ভাগ অতি রমণীয়, অপূর্ব সুন্দর। পদ্ম পাপড়ির মতো আকৃতিবিশিষ্ট, দৃষ্টিনন্দন একটি চৈত্যগবাক্ষ মুখমণ্ডপের বহির্ভাগের ঠিক কেন্দ্রস্থলে বিরাজমান। গবাক্ষের চতুষ্পার্শ্বে রয়েছে অত্যাশ্চর্য ভাস্কর্যের উপস্থাপনা। গবাক্ষের ডান দিকে বিরাজ করছে যক্ষ পূর্ণভদ্র, আর বাঁদিকে দণ্ডায়মান যক্ষ পঞ্চিক। বীরত্বব্যঞ্জক তাদের ভঙ্গি; পেশল, গুরুভার তাদের দেহকাণ্ড। সপ্তদশ গুহাবিহারের মতো এই গুহাচৈত্যটিও চিত্র সম্ভাৱে অতি সমৃদ্ধ ৷

ভাস্কর্য

এ যুগের ভাস্কর্যের নিদর্শন ছড়িয়ে আছে রামটেক পাহাড়, বিনোবাজির আশ্রম ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চল, তিগোওয়া, নাচনা কুঠারা এবং অজন্তার ষোড়শ, সপ্তদশ ও ঊনবিংশ গুহায়।

  • রামটেক পাহাড়ে এক পুরোনো বিষ্ণুমন্দিরের ধ্বংসাবশেষের মধ্যে একটি ত্রিবিক্রম মূর্তি পাওয়া গেছে। মূর্তিটির বহু স্থানই ভগ্ন। দেবতার মস্তকে মুকুট, মুখমণ্ডলে প্রভাবলি। দেবতার বাম পদ ভূমিতলে স্থাপিত। দক্ষিণ পদের নিম্নাংশ ভগ্ন। বীরত্বব্যঞ্জক, দৃপ্ত দেবতার ভঙ্গি। বলি ত্রিভঙ্গ ভঙ্গিতে দেবতার পাদদেশে দণ্ডায়মান। পাশে তাঁর স্ত্রী। মূর্তিটির অনেকটাই বিনষ্ট হয়ে গেছে তবু বোঝা যায়, এটি প্রথমাবস্থায় তৎকালীন ভাস্কর্যশিল্পের একটি উৎকৃষ্ট নিদর্শন ছিল।
  • ধাম নদীর বামতটে বিনোবাজির আশ্রমের সন্নিকটে বাকাটক যুগের কয়েকখানি প্রস্তরফলক আবিষ্কৃত হয়েছে। এদের একটি ভরতভেট। ফলকের এই নামটি বিনোবাজির দেওয়া। এই ফলকে সীতা, রাম, ভরত ও লক্ষ্মণের প্রতিকৃতি উৎকীর্ণ। সীতা রামের বাহুলগ্না। রাম ও ভরত কথোপকথনরত। রামের বাম হস্ত ভরতের দক্ষিণ করতলে ন্যস্ত। রাম ও ভরত উভয়েরই মুখে আনন্দের দ্যুতি। অনাগ্রহী ও অপ্রসন্ন লক্ষ্মণের দৃষ্টি অন্যদিকে নিবদ্ধ।
  • চিত্রকূট পাহাড়ে রাম-ভরতের মিলনদৃশ্য এই ফলকে সুন্দরভাবে রূপায়িত হয়েছে। বাকাটক পর্বীয় আরও বহু প্রস্তর ফলকের সন্ধান এখানে পাওয়া গেছে। রামের জন্ম, দশরথের তিরোধান, রামের বনবাসগমন, সুগ্রীব ও বালীর যুদ্ধের মতো রামায়ণের নানা ঘটনা এই ফলকগুলিতে সুনিপুণভাবে রূপায়িত হয়েছে।
  • তিগোওয়া মন্দিরের সুদৃশ্য স্তম্ভগুলি ভাস্কর্যশিল্পের সুন্দর নিদর্শন। স্তম্ভগুলি ক্রমান্বয়ে চারকোনা, আটকোনা, ষোড়শকোনা এবং বর্তুলাকার হয়ে উপরের দিকে উঠে গেছে। স্তম্ভশীর্ষ খাঁজকাটা ঘণ্টাকৃতি। সর্বোপরি বিপরীতমুখী উপবিষ্ট এক যুগল সিংহমূর্তি। মন্দির-তোরণে গঙ্গা ও যমুনা মূর্তি উৎকীর্ণ। মকরবাহিনী গঙ্গা দণ্ডায়মানা। কূর্মবাহিনী যমুনার ভঙ্গিও তাই। সালংকরা দেবীদের ছন্দায়িত, লীলায়িত দেহভঙ্গি। প্রসন্ন তাঁদের দৃষ্টি। নাচনা কুঠারার পার্বতী মন্দিরের গর্ভগৃহের তোরণও সুদৃশ্যরূপে অলংকৃত। গঙ্গ-যমুনা, মিথুন ও দেবীমূর্তিতে তোরণ সুসজ্জিত। পেলব ও রমণীয় নারীমূর্তির দেহগড়ন। দেহভঙ্গিমায় কোনও জড়তা বা আড়ষ্টতার চিহ্ন নেই। দেবী ও নারীমূর্তি রূপায়ণে পার্বতী মন্দিরের ভাস্কর শিল্পনৈপুণ্যের স্বাক্ষর রেখেছেন।
  • ভাস্কর্য-শিল্পোৎকর্ষের প্রকাশ ঘটেছে অজন্তার ষোড়শ ও সপ্তদশ গুহাবিহার এবং ঊনবিংশ গুহাচৈত্যের স্তম্ভ ও অর্ধস্তম্ভের, গড়নে ও অলংকরণে। গুহাত্রয়ের অভ্যন্তরস্থ মণ্ডপগুলিতে বিশাল বুদ্ধমূর্তি উপস্থাপিত হয়েছে। বুদ্ধদেব ধর্মচক্রপ্রবর্তন মুদ্রায় রূপায়িত। বুদ্ধদেবের অনুগামী রূপে দর্শিত হয়েছেন বোধিসত্ত্বদ্বয় বজ্রপাণি ও পদ্মপাণি। অজন্তার বুদ্ধ-বোধিসত্ত্ব মূর্তিগুলি নিঃসন্দেহে সুষম ও বলিষ্ঠ দেহগঠনবিশিষ্ট। কিন্তু এই মূর্তিগুলিতে সারনাথ-বুদ্ধের সে দীপ্তি ও আত্মনিমগ্নতার পরিচয় নেই, প্রাণৈশ্বর্যেরও তেমন আভাস নেই।
  • ঊনবিংশ গুহাচৈত্যের বহিরঙ্গে তক্ষণশিল্প স্বমহিমায় ভাস্বর। মুখমণ্ডপের বহিরঙ্গে ভাস্কর্যের ঐশ্বর্যে প্রথম দৃষ্টিপাতেই মন আনন্দে আপ্লুত হয়। বহিরঙ্গের ঠিক কেন্দ্রস্থলে, পদ্মপাপড়ির আকৃতির এক অতি দৃষ্টিনন্দন চৈত্যগবাক্ষ। চৈত্যগবাক্ষের দু’পাশে দৃপ্তভঙ্গিতে যক্ষ পূর্ণভদ্র ও যক্ষ পঞ্চিক দণ্ডায়মান। সমগ্র বহিরঙ্গ নানা ভঙ্গির বুদ্ধ, বোধিসত্ত্ব, নাগ, গন্ধর্ব, কিন্নর মূর্তিতে আপাদ মস্তক মণ্ডিত। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নাতিদীর্ঘ চৈত্যগবাক্ষের অলংকরণ। সমস্ত কারুকার্যই সাধিত হয়েছে শক্ত পাহাড় কুঁদে, শিল্পীর ছেনি-হাতুড়ির সুনিপুণ ব্যবহারে।

চিত্রকলা

অজন্তার গুহাবিহার ও গুহাচৈত্যে বৌদ্ধ চিত্রকলা : বাকাটক পর্বের অনুপম চিত্রকলার সুমহান ইতিহাস বিধৃত আছে ষোড়শ ও সপ্তদশ গুহাবিহার আর ঊনবিংশ গুহাচৈত্যের স্তম্ভগাত্রে, দেয়ালে এবং ছাদের তলদেশে। বুদ্ধদেবকে কেন্দ্র করেই অজন্তার চিত্রজগৎ আবর্তিত হয়েছে। এই বুদ্ধ শুধু গৌতম বুদ্ধ নন, তিনি জন্ম জন্মান্তরের বুদ্ধ। ফলে মহর্ষি অসিতের দেবশিশু দর্শন, গৌতমের বিদ্যাভ্যাস, গৃহত্যাগ, উরুবিন্ধে নতজানু সুজাতার পায়সান্ন নিবেদন, বণিকদ্বয় তপস্সু ও ভল্লিকের বুদ্ধ সমীপে শ্রদ্ধার্ঘ অর্পণ, নন্দের প্রব্রজ্যা গ্রহণ, কপিলবস্তু আগমন, সদ্ধর্ম প্রচার, বিম্বিসারের সঙ্গে সাক্ষাৎকার, অজাত শত্রুর বুদ্ধ দর্শনের মতো গৌতম বুদ্ধের জীবনের নানা ঘটনা যেমন চিত্রায়িত হয়েছে, তেমনি অসংখ্য জাতককাহিনিও শিল্পীর তুলিতে সুনিপুণরূপে রূপায়িত হয়েছে। একই সঙ্গে শিল্পী তুলে ধরেছেন পৃথিবীকে বর্ণময়, রূপময়, মহিমময় ও প্রাণবন্ত করে। বুদ্ধদেব তাঁর ভাবনার কেন্দ্রবিন্দু, তবু পৃথিবীর রূপ, রস ও গন্ধে শিল্পী আমোদিত, উদ্‌বেলিত। লতা-পাতা, ফুল-ফল, পশু-পাখি, জীব-জন্তু, কীট-পতঙ্গ, নর-নারী, নর্তক-নর্তকী, ধনী-দরিদ্র, রাজা-রানি, দেব-দেবী, যক্ষ যক্ষী, কিন্নর-কিন্নরী, সাধু-সন্ন্যাসী, যান-বাহন, বিলাস-বৈভব, প্রাসাদ-কুটির, বস্ত্র-অলঙ্কার—সব কিছুই শিল্পীর তুলির টানে মূর্ত হয়ে উঠেছে।

খণ্ড চিত্র ও কথা চিত্র : চিত্রাঙ্কনের পিছনে শিল্পীর মনে এক বিশেষ পরিকল্পনা কাজ করেছে। কখনও তিনি এঁকেছেন খণ্ড চিত্র। এগুলি একক ও স্বয়ংসম্পূর্ণ। বিশেষ একটি মুহূর্তকে, বা বিশেষ একটি ভাবকে, শিল্পী তাঁর চিত্রে শাশ্বত করে রেখেছেন। ষোড়শ গুহার প্রসাধনরতা নারীত্রয়ের আলেখ্য বা সপ্তদশ গুহাবিহারের বুদ্ধদেব, গোপা এবং রাহুলের (মতান্তরে, বুদ্ধদেব, কৃপাপ্রার্থিণী জনৈকা রমণী ও তাঁর শিশুপুত্রের) চিত্রখানি এ প্রসঙ্গে স্মরণীয়। আবার কখনও শিল্পী জাতকের এক একটি কাহিনি বা বুদ্ধদেবের জীবনের এক একটি ঘটনা অবলম্বন করে কথাচিত্র রচনায় উদ্বুদ্ধ হয়েছেন। ঘটমান দৃশ্যকে কয়েকটি অঙ্কে বিন্যস্ত করে তারই চিত্ররূপ রূপায়ণে তিনি সচেষ্ট হয়েছেন। এভাবে শিল্পী বহু চিত্রের মাধ্যমে বহু অঙ্কের এক একটি কাহিনির চিত্ররূপ রূপায়িত করেছেন। এখানে কোনও চিত্রই স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়; কাহিনিটির সঙ্গে পরিচিত হতে হলে চিত্র থেকে চিত্রান্তরে পরিক্রমণ করতে হয়। চিত্র থেকে চিত্রান্তরের মাঝখানের ফাঁকে শিল্পী উপস্থাপিত করেছেন কোথাও তোরণদ্বার, কোথাও তরুরাজি, কোথাও অলিন্দ, কোথাও স্তম্ভ, কোথাওবা দু’টি সমান্তরাল রেখা চিহ্ন। এগুলি ঘটনার পর্যায় থেকে পর্যায়ান্তরে, অঙ্ক থেকে অঙ্কান্তরে, সময় থেকে সময়ান্তরে যাবার ইঙ্গিত। আবার কখনওবা শিল্পী অতিরিক্ত দৃশ্যের অবতারণা না করে নারী বা পুরুষের মুখভঙ্গিমার যথাযথ রূপায়ণের মাধ্যমে দৃশ্যান্তরের ইঙ্গিত দিয়েছেন। ঘটনার যবনিকাপাতের ইঙ্গিতের নিদর্শনও রেখেছেন শিল্পী। এক একটি কাহিনি চিত্রমালা যেন এক একটি কয়েক অঙ্কের নাটক।

ক্লান্তি বা একঘেয়েমিতা রুখতে চিত্র : ছবি দেখতে বসে দর্শকমনে যাতে ক্লান্তি বা একঘেয়েমি না আসে সে দিকে শিল্পীর সতর্ক দৃষ্টি। সে কারণেই গুহার দেয়ালে, স্তম্ভগাত্রে ও ছাদের তলদেশে ফুল-ফল, লতা-পাতা, পশু পাখি, কীট-পতঙ্গ, কাল্পনিক জীব-জন্তুর নকশা বা অলংকরণ-চিত্রের উপস্থাপনা। নানা ধরনের মনোহারী আলপনাও অঙ্কিত হয়েছে। এগুলিতে কোনও কাহিনি নেই, আছে ভাবের ব্যঞ্জনা। প্রতিটি নকশাই অভিনব ও মৌলিক। কেউ কারও অনুকৃতি নয়। প্রতিটি নকশাতেই শিল্পীর নিত্যনতুন সৃষ্টির স্বাক্ষর। শিল্পী তাঁর তুলির রেখা ও রঙের সাহায্যে এই নকশাগুলি অঙ্কন করেছেন। নকশাগুলির চিত্রায়ণে শিল্পী বাস্তবানুগতার দিকে দৃষ্টি দেননি, তিনি তাদের আপন মনের মাধুরীতে সুন্দরের বিচিত্র প্রকাশরূপেই উপস্থাপিত করেছেন।

বাস্তবের বদলে আদর্শ রূপায়ন : শুধু নকশার উপস্থাপনাতেই নয়, নরদেহের চিত্রায়ণেও শিল্পী বাস্তবানুগতার বশবর্তী হননি। তিনি তাঁর তুলিতে শাস্ত্র কাব্যে বর্ণিত, তাঁর ধ্যানদৃষ্টিতে উদ্ভাসিত আদর্শ নরদেহই রূপায়িত করেছেন। তাঁর ধ্যানের দৃষ্টিতে দেবতা ও মানুষের কোমর হবে সিংহকটি কিন্তু দেবী ও রমণীর কটিদেশ হবে ডমরুমধ্য। দেবী ও নারীর ঠোঁট হবে পরিপক্ক বিশ্বফলের মতো (বিম্বাধরৌষ্ঠী), গ্রীবা হবে কম্বু বা শাঁখসদৃশ, পদযুগল হবে পদ্ম (চরণকমল) বা পল্লবতুল্য (পদপল্লব)। তাঁরা হবেন মীননয়না। পুরুষের দেহকাণ্ড হবে গোমুখের মতো, হাতির মাথার মতো হবে স্কন্ধ, আজানুলম্বিত বাহু হবে কলাগাছের কাণ্ডের মতো, সর্বাঙ্গ জুড়ে থাকবে কোমলতা ও পেলবতার স্পর্শ। মানব দেহের অঙ্গ-প্রতঙ্গের নির্ভুল রূপায়ণে নয়, তাঁর ধ্যানদৃষ্টিতে প্রত্যক্ষীভূত আদর্শ মানব-মানবীর দেহাবয়ব চিত্রায়ণের নির্মল আনন্দে অজন্তার শিল্পী মাতোয়ারা।

রাজকন্যা : ষোড়শ গুহাবিহারে চিত্রায়িত মরণাহতা রাজকন্যা জনপদকল্যাণীর শাশ্বত আলেখ্যটি অজন্তা চিত্রকলার এক শ্রেষ্ঠ নিদর্শন। ছন্দায়িত, কুসুম-কোমল রাজকুমারীর দেহখানি অর্ধশায়িত। সখী বা সেবিকারা তাঁর শুশ্রূষারত। তাঁদের সকলের চোখে-মুখে উদ্বেগ ও হতাশার ছায়া। একটু দূরে দণ্ডায়মান চিকিৎসক। তাঁর বাম হস্তে ঔষধ-ভৃঙ্গার, দক্ষিণ হস্তের করাঙ্গুলি নির্দেশের ভঙ্গিতে উত্তোলিত। অসীম মমতাভরে শিল্পী রাজকুমারীর চিত্র অঙ্কন করেছেন।

অপ্সরা : সপ্তদশ গুহাবিহারের কৃষ্ণা অপ্সরা অজন্তার আর এক শ্রেষ্ঠ নারীচিত্র। আকাশপথে ভেসে চলেছেন অপ্সরা। তাঁর কণ্ঠের শতনরী বাতাসে আন্দোলিত হচ্ছে ; মুকুটের মুক্তার ঝালরগুলিও একদিকে হেলে পড়েছে। এ চিত্রের আসল আবেদন কৃষ্ণা অপ্সরার অর্ধনিমীলিত দু’টি স্বপ্নালু নয়নের কটাক্ষপাতে।

সপ্তদশ গুহাবিহারে বুদ্ধদেব, যশোধরা ও রাহুলের চিত্র : বুদ্ধদেব, যশোধরা ও রাহুলের চিত্রখানি নিঃসন্দেহে সপ্তদশ গুহাবিহারের সর্বশ্রেষ্ঠ চিত্র। অতি মর্মস্পর্শী এই ছবিটি। কপিলবস্তুতে এসে ভিক্ষুর বেশে বুদ্ধদেব স্ত্রী যশোধরা ও পুত্র রাহুলের কাছ থেকে ভিক্ষা গ্রহণ করছেন। চিত্রে দেখা যাচ্ছে, অতি বিশাল বুদ্ধদেবের সম্মুখে ক্ষুদ্রাকারের যশোধরা ও রাহুল দাঁড়িয়ে। বুদ্ধদেবের পরিধানে পীত অজিন, মাথায় প্রভাবলি, হাতে ভিক্ষাপাত্র। লক্ষ করবার বিষয়, শিল্পী বুদ্ধদেবের দেহাবয়বকে সুস্পষ্ট রেখায় চিহ্নিত করেননি। বুদ্ধদেব যেন কোনও রক্ত-মাংসের মানুষ নন, তিনি যেন এক অলৌকিক সত্তা। তিনি অতি বিশাল, মহিমময়, তিনি রঙ ও রেখার বন্ধনে ধরা দেন না। অপরপক্ষে গোপা ও রাহুল ক্ষুদ্রাকৃতি কিন্তু তাঁদের দেহরেখা, অলংকার ও পরিধেয়ের প্রতিটি পরিচয় সুস্পষ্ট। যশোধরার পিছনে একটি তোরণদ্বার। এই চিত্রের ভারসাম্য রক্ষা করছে। রাহুলের নিষ্পাপ দৃষ্টিতে অপার বিস্ময়। শিল্পীর তুলির ছোঁয়ায় যশোধরার হাতের করাঙ্গুলি বাঙ্ময় হয়ে উঠেছে। অনেকে ছবিটির অন্য ব্যাখ্যা করেছেন। তাঁদের অভিমত, এ চিত্রে যশোধরা ও রাহুল রূপায়িত হননি, রূপায়িত হয়েছেন এক ভক্তিমতী নারী ও তাঁর বিস্ময়াবিষ্ট এক নিষ্পাপ শিশু।

গ্রন্থপঞ্জি

  • নারায়ণ সান্যাল অপরূপা অজন্তা (কলকাতা, ১৯৮৩)।
  • Majumdar, R. C. (Ed.) : The Vakataka-Gupta Age (Lahore, 1946); The Classical Age (Bombay, 1962); A Comprehensive History of India, Vol. III, Part I (New Delhi, 1981).
  • Mirashi, V. V. Corpus Inscriptionum Indicarum (Calcutta, 1963).
  • Shastri, A. M.: Early History Of The Deccan (Delhi, 1987).
  • Shastri, A. M. (Ed) : The Age Of The Vākātakas (New Delhi, 1992).
  • Sircar, D. C.: Select Inscriptions, I (Calcutta, 1965).
  • Yazdani, G.: The Early History Of The Deccan, Parts I-VI (London, 1960)

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.