শরিয়া বা ইসলামী আইনের (সুন্নি) সংক্ষিপ্ত ইতিহাস : কেন শরিয়ার প্রতি অনুগত না থাকলেই মুসলিমকে অমুসলিম বলা যায়না

আজকে অনেককেই লিখতে দেখছিলাম, “মুসলিম হয়েও দেশের মানুষ কেন শরিয়া সমর্থন করেনা?”, “শরিয়া আইনের প্রতি অনুগত না থেকেও কিকরে কোন ব্যক্তি নিজেকে মুসলিম দাবি করতে পারে?”। তাদের মতে, কোন মুসলিম শরিয়া না মানতে পারলেও শরিয়ার প্রতি তার আনুগত্য না থাকলে সে আর মুসলিম থাকবেনা। আমার বক্তব্য হচ্ছে শরিয়ার প্রতি কোন মুসলিমের আনুগত্য না থাকলেও তাকে অমুসলিম বলা যায়না। কেন বলা যায় না সেটা শরিয়ার ইতিহাসের দিকে তাকালেই বোঝা যাবে। তো শরিয়ার ইতিহাস শুরু করা যাক…

ইল্‌ম ও ফিক্‌হ : প্রথমে আসি ইল্‌ম ও ফিক্‌হ এর কথায়। মুহম্মদের মৃত্যুর পর প্রথম কিছুকাল ধরে শুধু কোরান ও সুন্নাহকে শরিয়তের উৎস হিসেবে স্বীকার করা হতাে। কিন্তু সময় যেতে থাকলে বিভিন্ন নতুন সমস্যা দেখা যায় যা নিয়ে কোরান-সুন্নাহ্‌তে সেভাবে কিছু লেখা নেই। এই অবস্থায় কোরান ও সুন্নাহ্‌ এর সাথে যুক্ত হয় জ্ঞান বা শিক্ষা (ইল্‌ম) এবং বােধ বা উপলব্ধি (ফিক্‌হ) – এই দুটি নতুন নীতি। ইল্‌ম দ্বারা কোরান-সুন্নাহ্‌ এর সাথে পরিচিতি ও ফিক্‌হ দ্বারা কোরান ও হাদিসের অন্তর্নিহিত অর্থ অনুধাবন করে সেখান থেকে কোন নতুন সিদ্ধান্তে যাবার ক্ষমতাকে বোঝায়। মানে ফিক্‌হ হয়ে যাচ্ছে কোরান-সুন্নাহ্‌ এর ভিত্তিতে সুচিন্তিত অভিমত, যা অবশ্যই সাবজেক্টিভ, একেকজনের ফিক্‌হ একেক রকম হতে পারে। আবার সময়ের সাথে সাথে চিন্তা ও আলোচনায় ধর্মীয় বিষয়াদি বাড়তে থাকলে ফিক্‌হ শব্দটা সেই সুচিন্তিত অভিমত থেকে সীমিত হয়ে হয়ে যায় ধর্মীয় বিশ্বাস ও কর্ম, আইন ও আচরণ, এক কথায় ধর্মীয় চিন্তার গােটা পরিমণ্ডল, যেমন টা আমরা হানাফি সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা ইমাম আবু হানিফার (মৃ. ৭৬৭) গ্রন্থ ফিক্‌হ-তে দেখি, এই নতুন অর্থেই ফিক্‌হ শব্দটা ইউজ করা হয়েছে। এই অবস্থায় ফিক্‌হ মানে আর ব্যক্তিগত বা সাবজেক্টিভ অভিমত থাকলো না, একরকম কাঠামোবদ্ধ জ্ঞানব্যবস্থা বা শৃঙ্খলা হয়ে গেল। এখন আর ফিক্‌হ ব্যবহার করতে হয়না, জানতে-পড়তে হয়। এরপর যখন ফিক্‌হ শব্দটির অর্থ আরও বেশি সংকুচিত হয়, তখন এর অর্থ হয়ে দাঁড়ায় আইনবিজ্ঞান বা জুরিসপ্রুডেন্স। মানে শুরুতে যে কোরান-সুন্নাহ্‌ এর আলোকে একটা সাবজেক্টিভ চিন্তার বিষয় ছিল, অভিমতের ব্যাপার ছিল, সেখান থেকে এটা পরিণত হলো এমন কিছুতে যেখানে সাবজেক্টিভিটি বা ব্যক্তিগত চিন্তার অপশনই আর থাকেনা, পরিণত হলো একটি কাঠামোবদ্ধ, বিধিবদ্ধ আইনব্যবস্থায়।

কিয়াস : যাই হোক, ইতিহাসে ফিরে যাই। ইসলাম বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়ায়, বিভিন্ন কালচারের সাথে পরিচিত হয়, তাতে বিভিন্ন নতুন নতুন সমস্যা দেখা যায়, যেগুলোর উত্তর কোরান-হাদিসে নেই, তাই কোরান-হাদিসের আলোকে সমাধানের জন্য বিভিন্ন রকম নীতির আবির্ভাব। প্রথমেই এলো কিয়াস, যার মানে হলো সাদৃশ্যানুমানিক (analogical) যুক্তি। এই নীতি অনুসারে, কোনাে একটি নির্দিষ্ট নীতি যদি পূর্ববর্তী কোনাে ঘটনায় প্রযুক্ত হয়ে থাকে, তাহলে সেই একই নীতি পরবর্তী কোনাে নতুন সদৃশ ঘটনার বেলায়ও প্রযােজ্য। মানে কোন সমস্যা দেখা গেলে কোরান-হাদিসে সিমিলারলি কী আছে তা দেখে অনুরূপ সমাধানে যাওয়া। যেমন কোরান-হাদিসে আঙ্গুরের মদ নিষিদ্ধ, আর যেকোন মাদকে আঙ্গুরের মদের মত একই রকম অপকারিতা থাকে বলে যেকোন রকম মাদককেই নিষিদ্ধ করা। পরবর্তীতে কিয়াসকে সহানুমানিক যুক্তি (syllogism) হিসেবে ব্যবহার করা হয়, এগুলো গ্রিক প্রভাব। যাই হোক, এই সাদৃশ্যানুমানিক যুক্তি প্রয়ােগের আদিতম রূপটিকে ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত বা সুচিন্তিত ব্যক্তিগত অভিমত, আরবিতে “রায়” বলা হতো। কিন্তু সমস্যা হলো, এখানে ব্যক্তিগত অভিমতের গুরুত্ব অনেক বেশি ছিল বলে এখানে ধর্মীয় ও আইনগত ব্যাপারাদি নিয়ে বিভিন্ন আইনজ্ঞ ও ধর্মবেত্তার মধ্যে প্রচুর মতভেদ লক্ষ্য করা যায়। কোরান বা হাদিসের যে দৃষ্টান্ত বা নীতির আলােকে এই সিদ্ধান্ত নেয়া হত, তার সঙ্গে যেমন নতুন ঘটনার সাদৃশ্য নিয়ে মতবিরােধ দেখা দিত, তেমনি সিদ্ধান্তের প্রক্রিয়া নিয়েও মতবিরােধ দেখা দিত এবং কিয়াসের ভিত্তিতে গৃহীত সিদ্ধান্তকে কোনাে কোনাে সময় যথেচ্ছ বলে সমালােচনা করা হতাে। এভাবে বেশ কয়েক দশক অতিক্রান্ত হওয়ার পর সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে এই ব্যক্তিগত অভিমতের যথার্থতা নিয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয় এবং ৮ম শতকের প্রথমার্ধে মদিনা ও ইরাকে আরাে সুসংবদ্ধ চিন্তার উদ্ভব ঘটে। মানে শরিয়া বা ফিক্‌হ এর ভিত্তি হিসেবে কিয়াস আর টিকলো না। কী হয়েছিল এই এলাকাগুলোতে?

ইজমা : মদিনায় মালেকি সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা মালেক ইবনে আনাস (মৃ. ৭৯৫) তার পদ্ধতিকে কিয়াস বা “রায়” হিসেবেই অভিহিত করতেন। কিন্তু তিনি এতে ব্যক্তিবাচকতা বা অভিমতের জায়গাটিকে কমিয়ে দেন ও এতে আরও সুসংবদ্ধতা যোগ করেন। এদিকে এই সময়ে মদিনার একাধিক পণ্ডিতব্যক্তির ঐকমত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত ইজমা নীতি চালু হয়ে যায়। মানে আলেমরা ঐকমত্যের ভিত্তিতে যেটাকে ঠিক বলবে সেটাই ঠিক বলে বিচার্য হবে – এটাই হলো ইজমার ধারণা। কিন্তু ইরাকের কাহিনী ছিল আবার ভিন্ন। সেখানে ইসলামী আইনের ক্ষেত্রে যুক্তিবাদী চিন্তার অনুসারী বলে পরিচিত ও হানাফি সম্প্রদায়ের প্রবর্তক আবু হানিফা ও তার অনুসারীরা সিদ্ধান্ত নেয়ার নতুন ক্ষেত্রে যেকোনাে বিশেষ ঘটনাকে একটি নীতি বা ক্যাটেগরিতে স্থাপনের চেষ্টা শুরু করেন। একই সঙ্গে সেখানে ইজতেহাদ বা স্বাধীন সুসংবদ্ধ মৌলিক চিন্তা (যা ৮ম শতকের দিকে প্রথম শুরু হয়) একটি শক্তিশালী নীতিতে পরিণত হয়। তার মানে দেখুন, মদিনায় শরিয়া বা ফিক্‌হ তখন ছিল ইজমা নির্ভর, আর ইরাকে সেটা ছিল ইজতেহাদ নির্ভর। পরবর্তীকালে ৯ম শতকে দাউদ (মৃ: ৮৮২)-এর নেতৃত্বে আক্ষরিকবাদী (জাহেরি) নামে পরিচিত একটি ক্ষুদ্র আইন সম্প্রদায় কিয়াস নীতি প্রত্যাখ্যান করেন। এভাবে ৮ম শতকের শেষ ও ৯ম শতকের দিকে কিয়াস নীতির বিলোপ ঘটল, আর থেকে গেল ইজমা ও ইজতেহাদ। ইজমা নিয়ে একটু ডিটেইলে বলা যাক। এর আক্ষরিক অর্থ হলো মতের ঐক্য বা ঐকমত্য। মানে কোনাে বিতর্কিত বিষয়ে শেষ পর্যন্ত সর্বসম্মত সিদ্ধান্তই ইজমা। এ নীতি অনুসারে সেসব বিশ্বাস ও আচরণই বৈধ যেগুলাে বিদ্বৎসমাজ, বিশেষত আলেমদের স্বীকৃতি ও অনুমােদন লাভ করে। আর যেসব সিদ্ধান্ত জনমতের ওপর প্রতিষ্ঠিত নয়, নিছক ব্যক্তিগত অভিমতের ওপর প্রতিষ্ঠিত, সেগুলাে ইজমা-পরিপন্থী ও আইনগত দিক থেকে অগ্রাহ্য। মানে একাধিক মানুষের সিদ্ধান্ত হলেও এখানে মানুষের ব্যক্তিবাচকতাই চলে আসছে। তবে এর ডিফেন্সে ইজমার সমর্থনরা বলেন, কোরান-সুন্নাহ্‌তেই সব জিনিসকে চিন্তাভাবনা করে উপলব্ধি করার জন্য মানুষকে বারবার তাগিদ দেয়া হয়েছে।

ইজতেহাদ : এবারে ইজতেহাদ নিয়ে বলা যাক। এর আক্ষরিক অর্থ হলো বুদ্ধির প্রয়ােগ তথা আপন সত্তাকে কাজে লাগানাে। অর্থাৎ মুক্তবুদ্ধি বা স্বাধীন বিচার-বিশ্লেষণের মাধ্যমে এবং কোরান ও হাদিসের মূলনীতিমালার আলােকে ধর্মীয় সমস্যাবলিসহ জীবনের যাবতীয় সমস্যার সমাধান, মানে অনেকটা ১৬শ শতকে রক্ষণশীল ক্যাথলিকদের বিরুদ্ধে মার্টিন লুথারের সবিচার আন্দোলনের মতই একটা ব্যাপার। কিন্তু ইজতেহাদের ক্ষেত্রে যে সমস্যাটা হয় সেটা হলো ধর্মীয় সমস্যা সমাধানে ব্যক্তিগত যুক্তিবিচার প্রয়ােগের এ অধিকারকে সব মহলের মুসলমানরা একই অর্থে নেয়নি। রক্ষণশীল মহল অনুসারে ইজমার অনুমােদন লাভ করলেই কেবল ইজতেহাদ অনুমােদনযােগ্য হয়, আর অপেক্ষাকৃত প্রগতিশীলরা মনে করেন, ইজতেহাদের সঠিক প্রয়ােগ দ্বারা অতীতের যেকোনাে প্রতিষ্ঠিত নীতির খণ্ডন বা প্রত্যাখ্যান সম্ভব। এ অর্থে ইজতেহাদ অনুসারে, ব্যক্তি ও সমাজের জন্য যা কল্যাণকর বলে প্রমাণিত হয়, তাই গ্রহণযােগ্য ও বৈধ। মানে ইজতেহাদ নিয়েও একটা বিতর্ক শুরু হয়ে গেল ইরাকে।

হানাফি সম্প্রদায় : তো ইরাকের এই রক্ষণশীল ও প্রগতিশীল মহলের মধ্যে পার্থক্য নিয়ে বলতে গেলে চার আইনি সম্প্রদায় নিয়ে বলতে হয়। হানাফি সম্প্রদায়ের আবু হানিফা (৬৯৯-৭৬৭) আইনতত্ত্বের সূত্র ও নীতি প্রণয়নে তিনি ব্যক্তিগত বিচারবুদ্ধির ওপর সবিশেষ গুরুত্ব আরোপ করতেন বলে তার প্রতিষ্ঠিত হানাফি মজহাবকে অভিমতবাদী (আহলুর রায়) বলে অভিহিত করা হয়। তার আগে আইনের সহায়ক উৎস হিসেবে কিয়াস প্রচলিত থাকলেও তিনিই এ নীতিকে মুসলিম আইনের উৎস হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। তার প্রবর্তিত আইনের নীতিমালা ইসতিহসান নামে পরিচিত। বাস্তবতার সঙ্গে আইনের সাযুজ্য অনুসন্ধানই ছিল এ নীতির মূলকথা। স্বাধীন মতবাদ প্রয়োগের জন্যই এই সম্প্রদায় বিখ্যাত ছিল, তাই এই সম্প্রদায়টিকে আব্বাসীয় খলিফারা বিশেষ সম্মানের চোখে দেখতেন। কিন্তু স্বাধীন যুক্তি প্রয়োগের কারণেই তারা ৮ম ও ৯ম শতকের দিকে স্বাধীন মতবাদবিরোধী আহলে আল-হাদিস সম্প্রদায় দ্বারা কঠোরভাবে সমালোচিত হয়েছিলেন। লক্ষণীয়, এই আহলে হাদিস অনেক পরে ভারতে উদ্ভূত আহলে হাদিস নয়, বরং এটি ভিন্ন। আহলে হাদিস শব্দটি সর্বপ্রথম ব্যবহার করেন মালেকী সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা ইমাম মালিক ইবনে আনাস। তিনি হাদিস সংগ্রহের জন্যে একটি সংগঠন করেছিলেন, যার নাম ছিল ‘আহলে হাদিস’। এই সংগঠনের তত্ত্বাবধানে এবং ইমাম মালিকের এর শিষ্য মুহম্মদ ইবনে ইয়াহিয়ার সম্পাদনায় ‘কিতাবুল মুয়াত্তা’ নামে একটি হাদিস সংকলন প্রকাশিত হয়।

মালেকি সম্প্রদায় : তো সেই মদিনার মালেক ইবনে আনাসের (৭১৩-৯৫) কথায় যাওয়া যাক। আবু হানিফার যেখানে ব্যক্তিগত অভিমতের ক্ষেত্রে গুরুত্বারোপ করেন, সেখানে তিনি ব্যক্তির অভিমতের চেয়ে হাদিসের ওপর বেশি গুরুত্ব আরোপ করেন। এ ছাড়া মদিনায় প্রচলিত রীতিনীতিগুলোকেও তিনি আইনের উপকরণ হিসেবে গ্রহণ করেন, যদিও প্রামাণিক হাদিস অনুসারেই তিনি এগুলোকে সমর্থনের প্রয়োজন মনে করেন। আর ইজমার ব্যাপারটা তো আছেই।

শাফি সম্প্রদায় : আবার ইমাম মালেকের ছাত্র ইদ্রিস আস-শাফি (৭৬৭-৮১৯) প্রতিষ্ঠা করেন শাফি সম্প্রদায়। তিনি বিরাজমান প্রয়োগপদ্ধতির তীব্র সমালোচনা করে হাদিস উপকরণসমূহকে আইনের উৎস হিসেবে গ্রহণের পক্ষে ছিলেন। তার মতে দুটি হাদিসের পরষ্পরবিরোধী হওয়া সম্ভবই নয়। যেসব ক্ষেত্রে বিরোধটা খুবই স্পষ্ট বলে চিহ্নিত হতো সেখানেও তিনি সংশ্লিষ্ট হাদিসের এমন ব্যাখ্যা দাঁড় করাতেন, যার ফলে একটি হাদিসকে আর অপরটির বিরোধী বলে মনে হতো না। মানে হাদিস ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে তার ব্যক্তিবাচকতা বা ব্যক্তি অভিমতের একটা ব্যাপার দেখা যায়। সেই তার মতে হাদিস কখনও কোরানেরও বিরুদ্ধে যাবেনা, এটি শুধু কোরআনের অর্থকেই বিশিষ্টরূপে চিহ্নিত করে। তার মতে, মুহম্মদের হাদিস ও খলিফাদের অনুসৃত রীতির মধ্যে কোনো বিরোধ দেখা দিলে হাদিসকে গ্রহণ এবং সেসব রীতিকে বাতিল করতে হবে। অন্যান্য ক্ষেত্রে ধর্মপ্রাণ খলিফাদের রীতি চূড়ান্ত বলে গ্রাহ্য হবে। সেই সাথে মহানবীর প্রত্যেকটি হাদিসকে বিশ্বাসযোগ্য ব্যক্তিদের ধারাবাহিক প্রমাণ দ্বারা সমর্থিত হতে হবে। তার মতেও ইসলামের আইনের উৎস হিসেবে প্রথমে কোরান, এরপর সুন্নাহ্, এরপর ইজমা, তারপর ইজতেহাদ বা মৌলিক চিন্তার প্রয়োগ। যাই হোক, হাম্বলি সম্প্রদায় পরে আসে বলে সেটা নিয়ে পরে বলছি। তার আগে মুতাযিলা সম্প্রদায়ের কথা বলা যাক।

মুতাযিলা সম্প্রদায় : এই সময়ে নতুন নতুন বিতর্কও আসতে থাকলো। শুরুতে ফিক্‌হ আর ইল্‌মকে একে অপরের সম্পূরক ভাবা হতো, প্রজ্ঞা ও প্রত্যাদেশ বা প্রজ্ঞা ও শরিয়তের মধ্যে পার্থক্য করা হতো না। কিন্তু ৮ম ও ৯ম শতকের দিকে মুতাযিলা বুদ্ধিজীবীরা প্রজ্ঞা (আকল) ও প্রাধিকার (সাম) বা শরিয়তের মধ্যে পার্থক্য নির্দেশ করেন। সেই সময় মদিনায় তো ইজমার প্রাধান্য আছেই, বাগদাদের ইজতেহাদেও রক্ষণশীলদের মতে ইজমাকে প্রাধান্য দিতে হবে। তো ইজমার মাধ্যমেই আইন এবং আইন প্রণয়নের পদ্ধতি তখন প্রতিষ্ঠিত। তখন থেকে আইন পরিণত হয়ে যায় প্রাধিকার (authority) কিংবা প্রথার অংশে। এই জায়জ্ঞায় মুতাযিলারা প্রচলিত আইনের কাঠামােকে এবং আইনের অন্তর্ভুক্ত নৈতিক নিয়মাবলিকে নির্বিচারে মেনে নেয়ার পক্ষপাতী ছিলেন না। তাদের মতে নীতিবােধ আইনের অধীন নয়, বরং স্বাধীন বিচারের ওপর প্রতিষ্ঠিত; ধর্মতত্ত্ব ও নৈতিক নিয়মাবলিকে বুদ্ধির আলােকে অনুসন্ধান করতে হবে; নৈতিক নিয়ম এজন্য গ্রহণযােগ্য নয় যে, তা ঈশ্বর-নির্দেশিত, বরং এজন্য যে তা যুক্তিসিদ্ধ; যেমন ঈশ্বর হত্যাকাণ্ড নিষিদ্ধ করেছেন বলেই যে তা খারাপ তা নয়, বরং খারাপ বলেই ঈশ্বর একে নিষিদ্ধ করেছেন। যেসব বিষয়ে তারা বুদ্ধির অবাধ প্রয়ােগের পক্ষপাতী ছিলেন সেসব নৈতিক, ধর্মতাত্ত্বিক ও দার্শনিক বিষয় থেকে তারা শরিয়তকে আইনের পর্যায়ে সীমিত রেখে দেন এবং একে স্বতন্ত্র বলে মনে করেন। মানে এখানে দেখা দিল শরিয়ার পরিসর কতটা হবে তা নিয়ে বিতর্ক।

হাম্বলি সম্প্রদায় : যাই হোক, ৯ম শতকের আব্বাসীয় খলিফা মুতাযিলাদের বিরোধিতা করেন ও হাম্বলিদের পৃষ্ঠপোষকতা করেন। সেই মুতাওয়াক্কিলের রাজত্বকালে আহমদ ইবনে হাম্বলের (৭৮০-৮৫৫) নেতৃত্বে একটি নতুন সম্প্রদায় শাফি সম্প্রদায় থেকে বেরিয়ে আসে। হাদিসের সর্বাত্মক ও সঠিক অনুসরণই তার প্রবর্তিত আইনের মূল সূত্র। মুহম্মদের বাণী ও রীতির অনুশীলনকে হাম্বলিরা ধর্মীয় দায়িত্বের অংশ বলে মনে করেন। বিশেষত হাম্বলি মতের প্রতিষ্ঠাতা ইবনে হাম্বল হাদিস ব্যাখ্যায় অনমনীয় মনোভাব পোষণ করেন। তিনি ইজমা বা কিয়াসের ব্যাপারে উৎসাহী ছিলেন না, এবং তার মতে ব্যাখ্যার মাধ্যমে হাদিসের প্রসারণ কিংবা সংকোচন অনুমোদনযোগ্য নয়। তিনি ছিলেন শাফির অনুসারী, এবং ধর্মতাত্ত্বিক বিষয়ে যেন কোনো প্রগাঢ় আলোচনা করা না হয় সেজন্য তিনি এক নতুন ধরনের যুক্তির অবতারণা করেন। তার মতে, মুহম্মদ আলোচনা করেননি এমন যে-কোনো বিষয়ের আলোচনা ভ্রান্তিজনক এবং সেজন্যই অবাঞ্ছনীয়। মোট কথা, হাম্বলিরা হাদিস বিষয়ে কোনোরকম প্রশ্ন উত্থাপন করাকে অনুচিত বলে মনে করতেন। এভাবে বিনা প্রশ্নে ও নির্বিচারে কোনোকিছু মেনে নেয়ার মানসিকতাকে তারা শুধু ধর্মীয় ব্যাপারেই সীমাবদ্ধ রাখেননি, বিস্তৃত করেন জীবনের সর্বক্ষেত্রে। ধর্মীয় ব্যাপার নিয়ে আলোচনা করা অনুচিত, এ যুক্তিতে ইবনে হাম্বল ধর্মবিরুদ্ধতা নিয়েও আলোচনা করার বিরোধিতা করেন এবং বলেন যে, ধর্মবিরুদ্ধতা খণ্ডনও অবাঞ্ছিত ; কারণ ধর্মবিরোধী মতাবলি খণ্ডন করতে হলে সেসব মত পাঠ ও অধ্যয়ন করতে হবে এবং তাতে মানুষ ধর্মবিরোধী মত জানতে আগ্রহী হয়ে উঠবে। হাম্বল ছিলেন একজন নিষ্ঠাবান নিরাপোস হাদিসপন্থী ধর্মতাত্ত্বিক। তার মতে, বিনা আলোচনায় ও বিনা প্রশ্নে হাদিসকে গ্রহণ করতেই হবে। কোরআন ও মুহম্মদের সুন্নাহর অধ্যয়নে বুদ্ধির প্রয়োগকে তিনি কঠোরভাবে নিন্দা করেন। মানে এই মতে শরিয়ায় ইজমার প্রতি গুরুত্বও কমে যাচ্ছে। হাম্বলিরা রাজনীতিতেও জড়িয়ে যায়। বুয়ায়হিদদের আধিপত্যের আমলে সুন্নি রক্ষণশীলতা স্তব্ধ হয়ে যায়। খলিফা আল-কাদির বিল্লাহ এবং তার পুত্র বুয়ায়হিদদের ক্ষমতাচ্যুত করার পথ সুগম করেন। এ কাজে তাদের সহায়তা করেন গজনির মাহমুদ। হাম্বলি সম্প্রদায় বুয়ায়হিদদের বিরুদ্ধে বাগদাদে ও সামারায় বিক্ষোভের আয়োজন করে। তারা এই মর্মে আন্দোলন শুরু করে যে, আব্বাসীয়রা কুরাইশ বংশের এবং মুহম্মদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত; সুতরাং তারাই যথার্থ খলিফা হতে পারে। তারা ঘোষণা করে, খলিফা আল-কাদির বিল্লাহকে মান্য করা এবং দেশের অখণ্ডতা ও শৃঙ্খলারক্ষায় তাকে সহায়তা করা প্রত্যেক ধর্মপ্রাণ মুসলমানের কর্তব্য। যাই হোক, পরবর্তীতে বিকশিত ওয়াহাবীরা হাম্বলী সম্প্রদায়ের অনুসারী।

আশারিয়া সম্প্রদায় : তো রক্ষণশীল মহল থেকে মুতাযিলাদের এই ধারণার বিরােধিতা আসে। তারা নীতিবিদ্যা ও ধর্মতত্ত্বকে আইনের মতােই শরিয়তের অন্তর্ভুক্ত রাখার চেষ্টা করে এবং ঈশ্বরের সর্বময় কর্তৃত্বের কথা বলে সবকিছুকে মানুষের তর্কবিচারের ঊর্ধ্বে বলে অভিমত দেয়। ১০ম শতকে আল-আশারি তার কালামতত্ত্বে এই দুই মতের সমন্বয় করার চেষ্টা করেন। আল-আশারি (মৃ. ৯৩৫) প্রথম ইবনে হাম্বলের অনুগামী ছিলেন এবং যারা ঈশ্বরের দেহ আছে বলে মত পোষণ করে তাদের বিরুদ্ধে প্রচুর লেখালেখি করেন। মুতাযিলাদেরও তিনি তীব্র সমালোচনা করেন। পরবর্তী জীবনে তিনি হাম্বলিদেরও প্রবল বিরোধিতা করেন এবং কোরআন ও সুন্নাহয় উল্লেখ নেই এমন বিষয়ের আলোচনাকে নিষিদ্ধ করায় তাদের নিন্দা করেন। হাম্বলিদের মতের বিরোধিতা করে তিনি বলেন যে, কোরআন ও সুন্নাহর ব্যাখ্যা করতে হবে বুদ্ধির আলোকে এবং আমাদের বুদ্ধিকে ব্যবহার করতে হবে কোরআন ও সুন্নাহর আলোকে। আল আশারি বলেন, আইন ও নীতিবিদ্যাসহ ব্যবহারিক জীবনের সব কর্ম ও আচরণকে শরিয়তের অন্তর্ভুক্ত এবং ধর্মতাত্ত্বিক ও অধিবিদ্যক বিষয়াদি শরিয়ার বাইরে ‘আকল’ বা বিচারবুদ্ধির আওতাভুক্ত হবে, যার ফলে আইন বা নীতিবিদ্যা থেকে ধর্মতত্ত্ব আলাদা হয়ে যায়। এখানে ধর্মতত্ত্ব ও ধর্মের নীতিমালার (উসুল আল-দীন) দিকটি ধর্মতত্ত্বের এবং নৈতিক ও আইনগত বিষয়াদি শরিয়তের অন্তর্গত। এক্ষেত্রে আল-আশারির যুক্তি ছিল, বুদ্ধি বা প্রজ্ঞার সাহায্যে কোনাে সার্বিক নৈতিক নিয়ম আবিষ্কার করা যায় না, তাই নৈতিকতাকে শরিয়াতেই রাখতে হবে। ভালাে-মন্দ, ন্যায়-অন্যায়ের ধারণা প্রভৃতি মানুষের আবেগ-অনুভূতির ওপর নির্ভরশীল, কোনাে সার্বিক নিয়মের ওপর নয়, তাই ঐশ্বরিক বিধান বা শরিয়া দ্বারা নৈতিকতাকে নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়ােজন।

নিজামুল মুলক ও নিজামিয়া মাদ্রাসা : আল-আশারির এ যুক্তিতেই আল-গাজালিও বলেন, কোনাে দায়িত্ববােধ যুক্তিবিচার থেকে অনুসৃত হয় না, হয় শরিয়া থেকে। তো এভাবে নৈতিকতা ও আইন যে শরিয়া থেকে উদ্ভূত এই দাবি করা হলো, তবে ধর্মতত্ত্ব? এ প্রসঙ্গে আল-গাজালি রক্ষণশীল সুফিদের সমর্থক এবং মধ্যপথের অনুসারী। ডিটেইলে যাবার আগে আল-গাজালির সময় ইসলামী চিন্তাধারার অবস্থা কী ছিল বলে নেই। সেলজুকদের শাসনামলে সুন্নি রক্ষণশীল মতবাদ সুদৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। নিজামুল মুলক ছিলের সেলজুক সুলতান মালিক শাহের মুখ্যমন্ত্রী। নিজামুল মুলক তার বিখ্যাত সিয়াসাত নামাহ রচনা করেন এবং একে দেশের আইন বলে ঘোষণা করেন, যেখানে শাসককে ঈশ্বরের পার্থিব প্রতিনিধি বলে বর্ণনা করা হয়। এ মতে, ঈশ্বরই যথার্থ সার্বভৌম শাসক, আর মানুষ তার প্রতিনিধি, ধর্মীয় আইন নিয়ে কোনো ব্যাখ্যা বিতর্ক অবাঞ্ছনীয়। আর এ যুক্তিতেই নিজামুল মুলক ধর্মীয়, এমনকি পার্থিব বিষয়াদি নিয়েও দার্শনিক আলোচনার পথ রুদ্ধ করে দেন। তিনি বয়স্কশিক্ষার জন্য নিজামিয়া মাদ্রাসা স্থাপন করেন, যার পাঠ্যসূচি নিয়ন্ত্রিত ছিল রক্ষণশীল ধর্মীয় ভাব দ্বারা এবং এর মূল পাঠ্যসূচি ছিল ধর্ম ও আইনবিজ্ঞান, দর্শনপাঠ ছিল নিষিদ্ধ। খেলাফতের রাজনৈতিক অবক্ষয়ের ফলে মুসলিম বিদ্যাচর্চায় স্থবিরতার সূত্রপাত হয় এবং কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রম ছাড়া সব বিষয়ের লেখকরা কাজ করেন নিছক ভাষ্যকার হিসেবে, বিচারমূলক আলোচক হিসেবে নয়। আল-মালির নেতৃত্বে পরিচালিত মূল নিজামিয়া মাদ্রাসায় আল-গাজালি পড়াশোনা করেন। কিন্তু ওখানকার রক্ষণশীল পরিবেশ তাকে সন্তুষ্ট করতে পারেননি। ফলে শেষ পর্যন্ত তিনি সুফিবাদের দিকে ঝুঁকে পড়েন।

আল-গাজালি : আল-আশারীদের কালামের নৈয়ায়িক আকারবাদের (formalism) প্রতি অসন্তুষ্ট হয়ে আল গাজালি সুফিপদ্ধতিকে কালাম প্রণয়নের সঙ্গে যুক্ত করার চেষ্টা করেন এবং একধরনের আধ্যাত্মিক বিশুদ্ধি বা পরিষ্করণের মাধ্যমে বৌদ্ধিক বিশ্বাসসমূহকে ঢালাই করার কথা বলেন। এ প্রক্রিয়ায় অগ্রসর হয়েই তিনি ঈশ্বরের বিশুদ্ধ প্রগাঢ় প্রেমকে শরিয়তের প্রকৃত অর্থ বলে ব্যাখ্যা করেন। বিশ্বাসের এই অন্তর্মুখিনতাকেই তিনি দ্বীন বলে ঘােষণা করেন। এ অর্থে দ্বীন শরিয়তের নির্যাসের অন্তর্নিহিত প্রাণ। দ্বীন ছাড়া শরিয়ত কেবলই একটি শূন্য খােলস, এবং শরিয়ত ছাড়া দ্বীনও অচল। তবে আল-গাজালির এত চেষ্টার পরও দ্বীন ও শরিয়তের মধ্যে পার্থক্য বহাল থেকে যায়। বিশেষত, পরবর্তীকালের সুফিবাদ ও শরিয়তের মধ্যে বিবাদ দেখা দেয়। তখন থেকে রক্ষণশীল কালামতত্ত্ব ও সুফিবাদের অনুধ্যানিক ধর্মতত্ত্ব – এ দুই স্বতন্ত্র প্রকারে ধর্মতত্ত্ব বিভক্ত হয়ে যায়। শরিয়ত ও মরমিবাদী পথের পার্থক্যের স্বীকৃতির মধ্য দিয়ে সুফিবাদী ধর্মতত্ত্বের বিকাশ ঘটে। রক্ষণশীল ধর্মতত্ত্ব (কালাম) শরিয়তের মৌল কাঠামােকে যুক্তি দিয়ে সমর্থনের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়। কিন্তু এর ফলে ধর্মতত্ত্বের বৈজ্ঞানিক পাঠ ও অধ্যয়নের সম্ভাবনা সম্পর্কে প্রশ্ন দেখা দেয়। কেউ কেউ ধর্মতত্ত্ব ও অধিবিদ্যাকে পৃথক করার কথা বলেন। তাদের মতে, ধর্মতত্ত্বের কাজ হলো শাস্ত্রের সমর্থনদান, আর অধিবিদ্যার কাজ হলো যথার্থ দর্শনের মৌল প্রশ্নাবলি অনুসন্ধান। এ প্রসঙ্গে অধিকাংশ ধর্মবেত্তার মতে, এর ফলে শরিয়তবহির্ভূত নতুন জ্ঞানের বিস্তার ঘটবে, এবং এ আশঙ্কায়ই তারা এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। তাদের মতে, যৌক্তিক প্রমাণাদি দ্বারা শাস্ত্রীয় বিধানসমুহের সমর্থন এবং যৌক্তিক পদ্ধতিতে তাদের অনুসন্ধান ও ভাষ্যপ্রদানই কেবল ধর্মতত্ত্বের কাজ। সুফিবাদে ঝুঁকে পড়ার পর আল-গাজালি চেষ্টা করেন রক্ষণশীল বিশ্বাসে মরমি অভিজ্ঞতা সন্নিবেশ দ্বারা সুফি ও রক্ষণশীল সম্প্রদায়সমূহকে সমন্বিত করতে। কিন্তু তার এ চেষ্টা এমনকি সেলজুক আমলেও সফল হয়নি; কারণ মালেকি, হানাফি, শাফি ও হাম্বলি—এ চারটি আইন সম্প্রদায়কে সমন্বিত করার সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়। মুসলিম আইনবিজ্ঞানীদের আইনকানুন মানবাচরণের একটি আদর্শ প্রতিষ্ঠায় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে বটে; কিন্তু একে সর্বতোভাবে কার্যকর করার কোনো চেষ্টা করা হয়নি। ফলে আইনের কার্যকারিতা ক্রমশ শিথিল হয়ে যায়। এর ফলে ইসলামি আইনের সঙ্গে বিদেশী আচারাদি মিশ্রিত হতে শুরু করে। বিভিন্ন অঞ্চল ও বিভিন্ন পরিবেশ থেকে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত ব্যক্তিরা নিজ নিজ আঞ্চলিক রীতি-নীতি ও প্রথা প্রচলনকে ইসলামি আচারের সঙ্গে মিশিয়ে ফেলে।

ইবনে তাইমিয়া ও আবদুল ওয়াহাবের রিভাইভালিজম : ধর্মতত্ত্বে আল-গাজালির শরিয়ত ও সুফিবাদের সমন্বয় প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে সোচ্চার হন দামেস্কের মামলুক সুলতানদের আমলের একজন বিশিষ্ট হাম্বলি আইনবিজ্ঞানী ইবনে তাইমিয়া (১২৬৩-১৩২৮) প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন, যার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল শরিয়া আইনের পুনবর্ণনা এবং ধর্মীয় মূল্যবোধের সমর্থন। তার মতে, শরিয়া একটি ব্যাপক ধারণা, এবং তাই সুফিদের আধ্যাত্মিক সত্য (হাকিকা), দার্শনিক ও ধর্মতাত্ত্বিকদের যৌক্তিক সত্য (আকল) এবং আইন—এ সবই শরিয়ার অন্তর্ভুক্ত। কোনো পর্যায়ে গতানুগতিক প্রাধিকার ও বুদ্ধির মধ্যে বিরোধ দেখা দিলেও আসলে এ দুয়ের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই, থাকতে পারে না। একইভাবে শরিয়া নিতান্তই কতকগুলো বাহ্যিক আইনবিষয়ক নীতি বা সিদ্ধান্ত নয়, এবং সুফিদের বিরুদ্ধে গিয়ে বলেন শরিয়ার আধ্যাত্মিক বা অভ্যন্তরীণ ভিত্তিও আছে। তিনি বলেন, শরিয়াকে এ ব্যাপক অর্থে ব্যবহার করার পর পরবর্তী প্রয়োজন ধর্মতত্ত্ব ও আইনের মধ্যে একটি বাস্তব ও সজীব যোগাযোগ স্থাপন; নাহলে ধর্মতত্ত্ব একটি শূন্য, কঠিন ও নিষ্প্রাণ খোলসে পরিণত হয়ে যেতে পারে। এজন্যই ধর্মতত্ত্বকে নতুন করে উপস্থাপন করা প্রয়োজন, যাতে ঈশ্বরের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটে। সুফিরা এর ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে নৈতিক নৈরাজ্যের অবতারনা করেছে। ওলামা সমাজ কোরআন ও সুন্নাহ থেকে বিচ্যুত হয়েছে। আলেমদের ঐকমত্যের ভিত্তিতে গৃহীত অনেক আইনবিষয়ক সিদ্ধান্ত ধর্মানুগ না হয়ে হয়েছে ধর্মবিরুদ্ধ। কারণ, আলেমরা তাদের সিদ্ধান্ত শাস্ত্রের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ কি না, তা পরীক্ষা করে দেখতেও নারাজ। তাইমিয়া বিশেষত অসন্তুষ্ট ছিলের সেসব সুফি দরবেশদের আচরণে, যারা তার মতে গানবাজনা ও নাচ (সামা ও রাকস) এবং পীর-দরবেশদের মাজার উপাসনার প্রথা প্রবর্তন দ্বারা ইসলামি আইনকে দূষিত করেছে। তার মতে, আল-গাজালির সময় রক্ষণশীল ইসলামের সঙ্গে সুফিবাদের এই যে মিশ্রণ ঘটেছে তা ঠিক হয়নি, সুফিবাদই ইসলামকে বিশ্বশক্তির মর্যাদা থেকে অধঃপতিত করার জন্য দায়ী। তিনি বিশুদ্ধ ইসলামকে সুফিদের হাত থেকে রক্ষা করে পূর্বমর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করতে চায় ও সেজন্য তিনি ধর্মপ্রাণদের কোরআন ও সুন্নাহয় ফিয়ে যাওয়ার জন্য আহ্বান করেন। তিনি সুন্নি রক্ষণশীল ধর্মমতকে সেখানে নিয়ে যেতে চান যেখানে একে রেখে গিয়েছিলেন ইবনে হাম্বল। হাম্বলের পরবর্তী সময়ে সুন্নি রক্ষণশীল মতে যেসব অনাবশ্যক নতুন জিনিস সংযোজিত হয়, তিনি সেগুলো বর্জন করার চেষ্টা করেন। এ বিষয়ে তিনি ক্ষমতাসীন শাসকদের সবকিছু অনুমোদন করার জন্য সরকারি আলেমদের দায়ী করেন। ইবনে তাইমিয়ার মতের তাৎক্ষণিক প্রভাবে কোনো বিরাট বিশাল আন্দোলন গড়ে না উঠলেও ক্রমশ এ মতের প্রভাব বিদ্বৎসমাজে পরিব্যাপ্ত ও অনুভূত হতে থাকে। ১৮শ শতকের ওয়াহাবি আন্দোলন এর প্রভাবেরই একটি লক্ষণীয় দৃষ্টান্ত। ওয়াহাবি আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা আবদুল ওয়াহাব (১৭০৩-৮৭) ইবনে তাইমিয়ার মতোই হাম্বলি পন্থি ছিলেন। তিনি পীর-দরবেশের মাজার উপাসনাসহ বিভিন্ন সুফি আচার-অনুশীলনকে অনৈসলামিক বলে প্রত্যাখ্যান করেন। তার মতে, কোরআন ও সুন্নাহর ওপর প্রতিষ্ঠিত নয়, এমন যে-কোনো চিন্তা ও কর্ম অধার্মিকতার নামান্তর। ইসলামি আইনবিজ্ঞানে ইবনে তাইমিয়া ও আবদুল ওয়াহাবের এই পুনরুজ্জীবনীমূলক বা রিভাইভালিস্ট প্রচেষ্টার প্রভাব অনস্বীকার্য।

সুন্নি মতবাদের চূড়ান্ত রূপ : সুন্নি মতবাদের চূড়ান্ত রূপ দেয়া হয় সুলতান ব্যাবার-এর শাসনামলে। ফাতেমীয়দের কাছ থেকে মিশর জয় করে তিনি কায়রোতে আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর নির্দেশ জারি করেন যে, চারটি আইন সম্প্রদায়ের সবগুলোই সুন্নি বিশ্বাসের এবং সুন্নি পদ্ধতির অন্তর্গত। আইন অনুশীলনে ও প্রয়োগে চারটি সম্প্রদায়ের অনুসারীরা যেন সমান মর্যাদা পেতে পারে সেজন্য তিনি কায়রোতে প্রত্যেক সম্প্রদায়ের একজন করে কাজি নিযুক্ত করেন। ১৫৬১ খ্রিস্টাব্দে মিশর বিজয়ের পর অটোমান সুলতান প্রথম সেলিম নিজেকে একাধারে খলিফা ও সুলতান বলে প্রতিষ্ঠিত করেন এবং তার উত্তরসূরিরাও এভাবেই চলতে থাকেন। এমনিতে সেলজুকদের সময় থেকেই নিজামিয়া মাদ্রাসাগুলোতে চিন্তার নিয়ন্ত্রণ অনেক বেশি ছিল। অটোমান সুলতানদের মতে, নিজামিয়া মাদ্রাসাগুলোর এই চিন্তার নিয়ন্ত্রণও অনেক কম, খুব একটা কার্যকর না। তাই তারা এই নিয়ন্ত্রণ আরো কঠোরভাবে আরোপ করে এবং চারশো বছর ধরে সুনির্দিষ্ট প্রশিক্ষণ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বিভিন্ন প্রশাসনিক উঁচু পদে লোক নিয়োগ করতে থাকে। ব্যাবার সুন্নি মতবাদের যে চূড়ান্ত রূপ দেন তার ফলে প্রারম্ভিক পর্বের ধর্মতাত্ত্বিক ও আইনবিষয়ক বিতর্কের অবসান ঘটে। মালেকি, হাম্বলি, শাফি ও হানাফি – এ চারটি বিশিষ্ট মুজতাহিদ সম্প্রদায়ের প্রত্যেকটির অভিমতকে কোরানের ব্যাখ্যায় এবং যেকোনো বিচারবিষয়ক সিদ্ধান্তে চূড়ান্ত বলে মনে করা হয়। (চারটি আইন সম্প্রদায়ের প্রবক্তারা মিলে যেসব গ্রন্থে আইনবিষয়ক নীতিমালা প্রণয়ন করেন সেগুলো ‘হেদায়াহ’ বলে পরিচিত। উত্তরাধিকার, বিবাহ, বিবাহবিচ্ছেদ, যুদ্ধ, সন্ধি ও করনীতি সহ বিভিন্ন ধর্মীয় আচার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হেদায়াহর অন্তর্গত।) একজন বিচারক যে সম্প্রদায়ের অনুসারী বিচার ক্ষেত্রে তিনি সেই সম্প্রদায়ের নিয়ম (হেদায়াহ) থেকে বিচ্যুত হতে পারেন না, শুধু সেই সিদ্ধান্তই ঘোষণা করতে পারেন অনুরূপ ক্ষেত্রে অতীতে যা করা হয়েছিল। এখানে অতীতে দৃষ্টান্ত নেই এমন কোনো নতুন বিষয় যদি বেশ কিছুদিন ধরে সাধারণ্যে অনুমোদন লাভ করে, তা হলে তা ইজমা দ্বারা বাধ্যতামূলক হিসেবে অনুমোদন লাভ করে।

তো, লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে, শরিয়তের বিকাশ কার্যত বন্ধ হয়ে যায় ১২শ শতক থেকে। ইজমার ওপর অতিশয় নির্ভরশীলতা আইনের স্বাভাবিক বিকাশকে মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত করে। খেলাফতের অবসান এবং সুন্নি রক্ষণশীল মতের প্রভাব বৃদ্ধি নির্বিচার বিশ্বাসের দাবিকে জোরদার করে। কর্তৃপক্ষীয় মহল থেকে দাবি করা হয় যে, শাস্ত্রের প্রতি বিশ্বাস হতে হবে নিঃশর্ত ও বিচারবিহীন, এবং যথার্থ বিশ্বাসী বলে ঘোষণা করা হয় তাদের যারা নির্বিচারে সব নির্দেশ মেনে নেয় (মুকাল্লিদ)। কোনো ধর্মীয় ব্যাপারে, এমনকি কোরআন ও হাদিসের সমর্থনের বরাত দিয়েও প্রশ্ন উত্থাপন করা যাবে না; কারণ, সব ধর্মীয় প্রশ্নের সদুত্তর আগেই চূড়ান্তভাবে নির্ণীত হয়েছে এবং আচার ও আইনসংক্রান্ত যাবতীয় বিশ্বাসও অকাট্যভাবে প্রণীত হয়েছে এক সর্বাঙ্গীণ ঐশ্বরিক আইনব্যবস্থার আওতায়। মোট কথা, তাকলিদ, অর্থাৎ নির্বিচারে প্রচলিত আইনকে মেনে নেয়ার নীতি, তখন আইনের বিকাশের পথে এক অপ্রতিরোধ্য প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়। এর পরবর্তী প্রজন্মের আলেমরা পূর্ববর্তীকালের আলেমদের ঐকমত্যের ভিত্তিতে গৃহীত আইন পরিবর্তনের সাহস পাননি। স্বাভাবিকভাবেই আইনবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে তা সৃজনশীলতার অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। তাকলিদ বা নির্বিচার বিশ্বাসকে যখন এভাবে বাধ্যতামূলক করা হলো, তখন আইনের স্বাভাবিক বিকাশ যে স্তব্ধ হবে, তাতে বিস্ময়ের কিছু নেই।

তো পুরো আলোচনা থেকে বলতে পারি, কোন ব্যক্তি শরিয়ার উপর আস্থাশীল বা অনুগত না হলেও মুসলিম থেকে যেতে পারেন, কেননা –

  • (১) শরিয়ায় সাবজেক্টিভিটি বা ব্যক্তিগত অভিমতের সুযোগ থাকে, যা ভুল হতে পারে, যা কোরান-সুন্নাহ্‌ এর ইন্টারপ্রিটেশন-ভেদে বিভিন্ন হতে পারে, যা সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তিত হতে পারে। এই অবস্থায় একজন মুসলিমকে শরিয়া শাসনের কোন নীতির উপর আস্থাশীল হতেই হবে এমনটা দাবি করা যায়না। হতে পারে শরিয়া শাসনের নীতির বদলে কোরান-সুন্নাহ বিবেচনায় তিনি যে অভিমত দেবেন সেটাই সঠিক, কোন অথোরিটি বা প্রাধিকারের দাবি সত্যই যে সর্বোতপ্রকারে সত্য হবে তার নিশ্চয়তা দেয়া যায়না।
  • (২) শরিয়া আইন নিয়ে বিতর্ক অনেক। উপরে যা লেখা হলো তার সূচনা থেকেই শরিয়া নিয়ে বিভিন্ন মতভেদ ও বিতর্ক দেখা যাচ্ছে। এই বিতর্কিত বিষয়ে বিশ্বাস থেকে যে কেউ বিশ্বাস স্থাপন করতেই পারেন, কিন্তু সকল মুসলিমকেই বিশ্বাস স্থাপন করতে হবে, এবং বিশ্বাস স্থাপন না করলে তিনি মুসলিম থাকবেন না সেটা দাবি করা যায়না। শরিয়া আইন নিয়ে কোন সম্প্রদায়ই সব বিষয়ে একমত নয়, এমনকি আহলে হাদিসের মতো কোন আইনি সম্প্রদায়ে বিশ্বাস না করা সম্প্রদায়ও আছে, আবার ধর্মতাত্ত্বিক ক্ষেত্রে শরিয়া বিরোধী সুফি সম্প্রদায়সমূহও আছে, আর এরা সকলেই মুসলিম।
  • (৩) শরিয়া আইনের ইতিহাস থেকে দেখি যে, বিভিন্ন কারণে শরিয়া আইনের ক্ষেত্রে কেবল রক্ষণশীল মতই টিকে ছিল, প্রগতিশীল বা উদারনৈতিক ধারা টিকতে পারেনি বা ব্যহত হয়েছে। এর মানে হচ্ছে বর্তমানে কোন মুসলিমকে শরিয়ার প্রতি অনুগত হতে হলে তাকে কোরান-সুন্নাহ্‌-ভিত্তিক আইনের রক্ষণশীলতম অংশটাকেই বেছে নিতে হবে, কেননা ইসলামী আইন বা শরিয়ার বিকাশের ক্ষেত্রে উদারনৈতিক ধারার অস্তিত্ব দেখা গেলেও তা টিকে নেই। এই অবস্থায় কোন উদারনৈতিক বা প্রগতিশীল মুসলিম শরিয়া গ্রহণ করতে নাও চাইতে পারে, আর তারপরও তিনি মুসলিমই থাকবেন।

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.