Table of Contents
পটভূমি
ফরাসি বিপ্লবের পরবর্তী সময়ে ইউরোপের রাজনীতি এবং সমাজ ব্যবস্থায় পরিবর্তন
ফরাসি বিপ্লবের (১৭৮৯) পর ইউরোপের আসরে নেপোলিয়নের দক্ষযজ্ঞ চলল। দেড়শ বছরের রাষ্ট্রবিন্যাস লণ্ডভণ্ড করে, বংশগত রাজমুকুট ও রাজদণ্ড ভেঙেচুরে ধুলিসাৎ করে তিনি চারদিকে আতঙ্ক সৃষ্টি করলেন। ইউরোপের জাতীয়তা স্বাধীনতার সংগ্রামে রুখে দাঁড়াল। এই জনশক্তির আঘাতে নেপোলিয়নের পতন হল। রাজরাজন্যরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন, স্বৈরাচারী রাজতন্ত্রের পুনরভিষেক করলেন। পনের বছর ধরে তাদের শাসনের চাপে ইউরোপীয় জাতিগুলির প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে উঠল। ১৮৩০ সালে প্যারিসের রাজপথে আবার বেরিয়ে এল বিক্ষুব্ধ জনত, বুরবোঁ রাজতন্ত্র ভেঙে পড়ল, দেখাদেখি অন্যান্য দেশেও জনবিদ্রোহ সংক্রামিত হল। বেলজিয়াম হল্যাণ্ডের অধীনতা থেকে মুক্ত হল। কিন্তু ইউরোপের ওপর প্রতিবিপ্লবী শাসনের বজ্রমুষ্ঠি শিথিল হল না। অবশেষে ১৮৪৮ সালে এলো হিসাব নিকাশের পালা। প্যারিসের বিস্ফোরণের আগুন ইউরোপের নগরে নগরে দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়ল। রুদ্রদণ্ড নেমে এল পুরাতন বিধানের ওপর। ইতিহাসের মোড় ঘুরল। আরম্ভ হল জাতীয়তা ও স্বাধীনতার যুগ। এই ব্যাপারটা নিয়ে একটু বিস্তারিত বলে নেয়া যাক শুরুতেই।
ফরাসি বিপ্লবের পর, ইউরোপের রাজনৈতিক এবং সামাজিক প্রেক্ষাপটে এক বিশাল পরিবর্তন আসে। এই পরিবর্তনের প্রধান কেন্দ্রবিন্দু ছিল নেপোলিয়ন বোনাপার্টের উত্থান ও পতন, যা এই সময়ের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে গণ্য হয়। ফরাসি বিপ্লবের মাধ্যমে ফ্রান্সে রাজতন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে একটি গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। তবে, বিপ্লবের পরবর্তী বিশৃঙ্খলায় দেশের অবস্থা অত্যন্ত জটিল হয়ে ওঠে। এই পরিস্থিতিতে, নেপোলিয়ন বোনাপার্ট, একজন প্রতিভাবান সামরিক নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন। ১৭৯৯ সালে, তিনি একটি ক্যু এর মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করেন এবং প্রথম কনসাল হিসেবে নিজেকে ঘোষণা করেন। এর মাধ্যমে নেপোলিয়নের যুগের সূচনা হয়।
নেপোলিয়ন তার সামরিক কৌশল ও বিজয়ের মাধ্যমে ইউরোপের বিভিন্ন দেশকে তার নিয়ন্ত্রণে আনতে শুরু করেন। তার শাসনামলে, তিনি ইউরোপের দেড়শ বছরের পুরনো রাষ্ট্রবিন্যাস সম্পূর্ণ লণ্ডভণ্ড করে ফেলেন। বংশগত রাজমুকুট ও রাজদণ্ড ভেঙে চুরমার করে, চারদিকে আতঙ্কের সৃষ্টি করেন তিনি। তার সামরিক অভিযানগুলির ফলে ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চল তার নিয়ন্ত্রণে আসে এবং নতুন এক শাসন ব্যবস্থার সূচনা হয়। তিনি ফরাসি আইন ব্যবস্থার সংস্কার করেন এবং নেপোলিয়নিক কোড চালু করেন, যা ইউরোপের বিভিন্ন দেশে আইন প্রণয়নের ভিত্তি হয়ে ওঠে।
নেপোলিয়নের সাম্রাজ্য বিস্তৃত হতে থাকলে, ইউরোপের অন্যান্য দেশগুলো উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে। তারা তাদের নিজ নিজ জাতীয়তা ও স্বাধীনতা রক্ষার জন্য সংগঠিত হয়। ১৮১২ সালে রাশিয়া অভিযান এবং ১৮১৫ সালের ওয়াটারলু যুদ্ধে পরাজয়ের পর, নেপোলিয়নের পতন ঘটে। তার পতনের ফলে ইউরোপীয় রাজন্যবর্গ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে এবং পুনরায় স্বৈরাচারী রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে। নেপোলিয়নের পতনের পর, ইউরোপে রাজতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হলেও জনগণের মাঝে অসন্তোষ ক্রমশ বাড়তে থাকে। ১৮৩০ সালে, প্যারিসের রাজপথে আবারও বিক্ষুব্ধ জনতা বেরিয়ে আসে। এই বিদ্রোহের ফলে বুরবোঁ রাজতন্ত্রের পতন ঘটে এবং এই বিদ্রোহ ইউরোপের অন্যান্য দেশগুলিতেও ছড়িয়ে পড়ে। বেলজিয়াম, হল্যান্ডের অধীনতা থেকে মুক্ত হয় এবং বিভিন্ন দেশে জনগণের বিদ্রোহ শুরু হয়। তবে, ইউরোপের প্রতিবিপ্লবী শাসনের বজ্রমুষ্ঠি তখনও শিথিল হয়নি।
অবশেষে, ১৮৪৮ সালে আসে এক বিশাল গণআন্দোলন। এই গণআন্দোলনের আগুন প্যারিস থেকে শুরু হয়ে ইউরোপের নগরে নগরে দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়ে। ১৮৪৮ সালের এই বিপ্লবকে বলা হয় ‘জনতার বসন্ত’। এই গণআন্দোলনের ফলে পুরাতন বিধানের ওপর রুদ্রদণ্ড নেমে আসে এবং ইতিহাসের মোড় ঘুরে যায়। এই সময়েই ইউরোপে জাতীয়তা ও স্বাধীনতার যুগের শুরু হয়। বিভিন্ন দেশ তাদের নিজস্ব জাতীয়তা ও স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম শুরু করে।
১৮৪৮ থেকে ১৮৭১ সালের মধ্যে এই যুগটি ইউরোপীয় ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়। এই সময়টি সংঘাত ও বিপ্লবের যুগ ছিল, যেখানে প্রাচীন ও নবীন, দীর্ঘদিনের পিতৃতন্ত্র ও জাতীয়তার আশা আকাঙ্ক্ষা যুগের অংশ হয়ে ওঠে। এই সময়ে বিভিন্ন জাতি তাদের নিজস্ব পরিচিতি ও স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করে। ইতালির পুনরায় একীকরণ ছিল ১৮৪৮ সালের বিপ্লবের একটি গুরুত্বপূর্ণ ফলাফল। ১৮৬১ সালে ইতালি একটি সংযুক্ত রাষ্ট্রে পরিণত হয় এবং এটি জাতীয়তার একটি প্রধান উদাহরণ হয়ে ওঠে। ইতালির পুনরায় একীকরণের পেছনে জিউসেপ্পে গারিবাল্ডি, কাভ্যুর এবং মাৎসিনি ছিলেন প্রধান নেতৃত্ব। ১৮৭১ সালে জার্মানির একীকরণ সংঘটিত হয়। অটো ভন বিসমার্কের নেতৃত্বে প্রুশিয়া, অস্ট্রিয়া ও ফ্রান্সের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে জার্মান একীকরণ সম্পন্ন করে। এর ফলে, একটি সংযুক্ত জার্মান সাম্রাজ্যের সৃষ্টি হয়, যা ইউরোপের শক্তি ভারসাম্যে একটি বড় পরিবর্তন আনে। ১৮৫২ সালে লুই নেপোলিয়ন নিজেকে তৃতীয় নেপোলিয়ন হিসেবে সম্রাট ঘোষণা করেন এবং দ্বিতীয় ফরাসি সাম্রাজ্যের সূচনা করেন। ১৮৭০ সালে ফ্রান্স-প্রুশিয়া যুদ্ধের পর, তৃতীয় নেপোলিয়নের পতন ঘটে এবং তৃতীয় ফরাসি প্রজাতন্ত্রের জন্ম হয়। অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি দ্বৈত রাজত্ব ১৮৬৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়, যা হাঙ্গেরির জনগণের স্বায়ত্তশাসনের দাবির ফলাফল ছিল। এই দ্বৈত রাজত্ব ইউরোপের একটি গুরুত্বপূর্ণ শক্তি হয়ে ওঠে। ১৮৩০ সালে বেলজিয়াম হল্যান্ডের অধীনতা থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত হয়। এই স্বাধীনতা সংগ্রাম ছিল ইউরোপে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের একটি প্রধান উদাহরণ। ১৮৪৮ সালের বিপ্লবগুলি জাতীয়তাবাদ ও উদারনীতিবাদের উত্থান ঘটায়। জনগণ তাদের নিজস্ব জাতীয়তা, ভাষা এবং সংস্কৃতি রক্ষার জন্য সংগ্রাম করতে শুরু করে। উদারনীতিবাদীরা ব্যক্তিগত স্বাধীনতা, আইনের শাসন এবং গণতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আন্দোলন করে।
ফরাসি বিপ্লবের পরবর্তী সময়ে ইউরোপের রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে এই বিশাল পরিবর্তনগুলি ঘটে। নেপোলিয়নের উত্থান ও পতন, ১৮৩০ এবং ১৮৪৮ সালের বিপ্লবগুলি ইউরোপের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হয়ে ওঠে। এই সময়ে জাতীয়তা ও স্বাধীনতার জন্য বিভিন্ন জাতি তাদের নিজস্ব সংগ্রাম চালায় এবং নতুন শাসন ব্যবস্থা ও সমাজ কাঠামোর উদ্ভব ঘটে। এভাবেই ইতিহাসের মোড় ঘুরে আরম্ভ হয় জাতীয়তা ও স্বাধীনতার যুগ।
১৮৪৮ থেকে ১৮৭১ : সংঘাত ও বিপ্লবের এক অনন্য অধ্যায়
১৮৪৮ থেকে ১৮৭১ সাল পর্যন্ত বিস্তৃত এই সময়টি পৃথিবীর ইতিহাসে তুলনাহীন। এই যুগটি ছিল সংঘাত ও বিপ্লবের যুগ, যেখানে প্রাচীন ও নবীন, দীর্ঘদিনের স্থিতাবস্থা ও জনতার আশা-আকাঙ্ক্ষা যুদ্ধের মগ্নতায় মেতে ওঠে। সারা পৃথিবী জুড়ে এই সময়ে ঝড়ের মতো পরিবর্তন ঘটে, যা আমেরিকা থেকে চীন পর্যন্ত কম্পিত করে দেয়।
এই বিপ্লবের লীলাভূমি ছিল ফ্রান্স। ১৮৪৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে প্যারিসে গণ-অভ্যুত্থানের ফলে অর্লিয়ানিস্ট রাজতন্ত্রের পতন ঘটে এবং দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা হয়। এই প্রজাতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা ইউরোপের অন্যান্য দেশগুলিতেও প্রভাব ফেলে এবং বিভিন্ন দেশে গণআন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে।
শিল্পবিপ্লব ও নতুন সমাজদর্শনের উদ্ভব :১৮৪৮ সালের বিপ্লবের পর, ইউরোপ জুড়ে এক নতুন সমাজব্যবস্থার সূচনা হয়। শিল্পবিপ্লবের ফলে সমাজের বিভিন্ন স্তরে ব্যাপক পরিবর্তন আসে এবং নতুন নতুন ধারণার উদ্ভব ঘটে। এই পরিবর্তনের প্রভাব ইউরোপীয় সমাজে গভীরভাবে পড়ে এবং বিভিন্ন সমাজ সংস্কারক ও দার্শনিক এই সময়ে সমাজের নতুন নকশা তৈরিতে মনোনিবেশ করেন।
- স্যাঁ সিম : স্যাঁ সিম (Henri de Saint-Simon, ১৭৬০-১৮২৫) একজন প্রভাবশালী ফরাসি দার্শনিক এবং সমাজতত্ত্ববিদ ছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে বিজ্ঞান ও শিল্পের উন্নতি সমাজকে উন্নতির পথে নিয়ে যেতে পারে। স্যাঁ সিমের মতে, সমাজের প্রকৃত উন্নতি তখনই সম্ভব, যখন সমাজের উৎপাদনশীল শ্রেণি (যেমন বিজ্ঞানী, শিল্পী, শ্রমিক) নেতৃত্ব দেবে। তার দর্শন ছিল এক ধরনের ইউটোপিয়ান সমাজতন্ত্র, যেখানে সম্পদ ও সম্পত্তি সমানভাবে ভাগ করা হবে এবং সমাজের সব মানুষ সমান সুযোগ পাবে। স্যাঁ সিমের এই ধারণা পরবর্তী কালে সমাজবাদী আন্দোলনে গভীর প্রভাব ফেলে।
- ফুরিয়ে : ফুরিয়ে (Charles Fourier, ১৭৭২-১৮৩৭) একজন ফরাসি সমাজতাত্ত্বিক এবং দার্শনিক ছিলেন। তিনি “ফ্যালানস্টেরি” নামে একটি আদর্শ কমিউনাল সমাজব্যবস্থা প্রস্তাব করেছিলেন, যেখানে মানুষ তাদের প্রাকৃতিক প্রবৃত্তি অনুযায়ী কাজ করবে এবং সম্পদ ও সম্পত্তি সমানভাবে ভাগ করা হবে। ফুরিয়ে বিশ্বাস করতেন যে, মানুষের প্রকৃত স্বভাব এবং তাদের চাহিদা বুঝে যদি একটি সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলা যায়, তবে সেখানে কোনো দ্বন্দ্ব বা সংঘাত থাকবে না। তার এই ধারণা পরবর্তী কালে বিভিন্ন ইউটোপিয়ান সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনে প্রভাব ফেলে।
- লুই ব্লাঁক : লুই ব্লাঁক (Louis Blanc, ১৮১১-১৮৮২) একজন ফরাসি রাজনৈতিক তাত্ত্বিক এবং সাংবাদিক ছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, রাষ্ট্রের উচিত সমাজের প্রত্যেক নাগরিককে কাজের সুযোগ করে দেওয়া। ব্লাঁক প্রস্তাব করেছিলেন যে, রাষ্ট্রের তত্ত্বাবধানে “সামাজিক কর্মশালা” গড়ে তোলা উচিত, যেখানে সবাই কাজ করতে পারবে এবং তাদের শ্রম অনুযায়ী পুরস্কৃত হবে। তিনি শ্রমিকদের অধিকার এবং শ্রমিক শ্রেণির ক্ষমতায়নের পক্ষে ছিলেন। তার এই ধারণা পরবর্তী কালে ফরাসি এবং ইউরোপীয় সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনে প্রভাব ফেলে।
স্বাধীনতা ও জাতীয়তার সংগ্রাম: এই সময়ে স্বাধীনতা ও জাতীয়তার মন্ত্র প্রচারিত হয় এবং বিভিন্ন জাতি তাদের স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম শুরু করে। ইতালির ম্যাটসিনি তার সংগ্রামের নেতৃত্ব দেন এবং গ্যারিবল্ডি ও কসাথ তার সাথে যোগ দেন। তাদের সংগ্রামের ফলে ইতালির পুনরায় একীকরণ ঘটে এবং একটি সংযুক্ত ইতালি গঠিত হয়।
- ম্যাটসিনি : জিউসেপ্পে ম্যাটসিনি (Giuseppe Mazzini, ১৮০৫-১৮৭২) ছিলেন একজন ইতালীয় বিপ্লবী নেতা, যিনি ইতালির পুনরায় একীকরণ এবং স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করেছিলেন। ম্যাটসিনি বিশ্বাস করতেন যে, একটি স্বাধীন ও একক ইতালি জাতীয় উন্নতি এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের জন্য অপরিহার্য। তিনি “ইতালিয়ান যুব সমিতি” (Giovine Italia) নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন, যা ইতালির বিভিন্ন অঞ্চলে স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতৃত্ব দেয়। ম্যাটসিনির আদর্শ ছিল গণতন্ত্র, স্বাধীনতা, এবং জাতীয় সংহতি।
- গ্যারিবল্ডি : গিউসেপ্পে গ্যারিবল্ডি (Giuseppe Garibaldi, ১৮০৭-১৮৮২) একজন ইতালীয় সামরিক নেতা এবং জাতীয়তাবাদী ছিলেন। তিনি ইতালির পুনরায় একীকরণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। গ্যারিবল্ডির নেতৃত্বে “রেড শার্টস” নামে একটি গেরিলা বাহিনী গঠিত হয়, যারা ইতালির বিভিন্ন অঞ্চলে যুদ্ধ করে এবং স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করে। গ্যারিবল্ডির সাহসী নেতৃত্ব এবং যুদ্ধকৌশল ইতালির জনগণের মধ্যে জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটায়।
- কসাথ : লাজলো কসাথ (Lajos Kossuth, ১৮০২-১৮৯৪) ছিলেন একজন হাঙ্গেরীয় রাজনৈতিক নেতা এবং স্বাধীনতা সংগ্রামী। তিনি হাঙ্গেরির স্বাধীনতার জন্য অস্ট্রিয়া-বিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। ১৮৪৮ সালে, তিনি হাঙ্গেরির প্রথম স্বায়ত্তশাসিত সরকারের প্রধান হিসেবে নির্বাচিত হন। কসাথের নেতৃত্বে হাঙ্গেরির জনগণ স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করে এবং অস্ট্রিয়া-বিরোধী যুদ্ধ চালিয়ে যায়।
নৈরাজ্যবাদ ও সমাজবাদী চিন্তাধারা : এই সময়ে নৈরাজ্যবাদের বাণী উচ্চারণ করেন পিয়ের জোসেফ প্রদঁঁ, ম্যাক্স স্টার্নার এবং মিখাইল বাকুনিন। তারা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে এবং ব্যক্তির স্বাধীনতার পক্ষে নিজেদের মতবাদ প্রচার করেন। অন্যদিকে, কার্ল মার্কস তার সমাজবাদী চিন্তাধারা বিকাশ করেন।
- পিয়ের জোসেফ প্রদঁঁ : পিয়ের জোসেফ প্রদঁঁ (Pierre-Joseph Proudhon, ১৮০৯-১৮৬৫) ছিলেন একজন ফরাসি দার্শনিক এবং নৈরাজ্যবাদের প্রবক্তা। তিনি বিখ্যাত তার উক্তি “সম্পত্তি হলো চুরি” (Property is theft) এর জন্য। প্রদঁঁ বিশ্বাস করতেন যে, ব্যক্তিগত সম্পত্তি সমাজের শোষণ এবং বৈষম্যের মূল কারণ। তিনি রাষ্ট্রবিহীন সমাজের পক্ষে ছিলেন এবং ব্যক্তিগত স্বাধীনতা এবং স্বনির্ভরতার পক্ষে মতপ্রকাশ করেন। প্রদঁঁর চিন্তাধারা পরবর্তী কালে নৈরাজ্যবাদী আন্দোলনে গভীর প্রভাব ফেলে।
- ম্যাক্স স্টার্নার : ম্যাক্স স্টার্নার (Max Stirner, ১৮০৬-১৮৫৬) একজন জার্মান দার্শনিক ছিলেন, যিনি নৈরাজ্যবাদের একটি চরমপন্থী রূপ প্রস্তাব করেছিলেন। তার বই “দ্য ইগো অ্যান্ড ইটস ওউন” (The Ego and Its Own) এ তিনি ব্যক্তিবাদী নৈরাজ্যবাদের ধারণা উপস্থাপন করেন। স্টার্নার বিশ্বাস করতেন যে, প্রতিটি ব্যক্তি সর্বোচ্চ স্বাধীনতা এবং স্বায়ত্তশাসন লাভের অধিকারী। তার মতে, রাষ্ট্র, সমাজ এবং ধর্ম সবই ব্যক্তির স্বাধীনতার উপর জুলুম এবং শোষণের মাধ্যম।
- মিখাইল বাকুনিন : মিখাইল বাকুনিন (Mikhail Bakunin, ১৮১৪-১৮৭৬) একজন রুশ বিপ্লবী এবং নৈরাজ্যবাদের প্রবক্তা ছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, রাষ্ট্র এবং ধর্ম ব্যক্তির স্বাধীনতার উপর জুলুম এবং শোষণের মাধ্যম। বাকুনিন নৈরাজ্যবাদের পক্ষে ছিলেন এবং তার মতে, সত্যিকারের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য রাষ্ট্র এবং ধর্মের অবসান প্রয়োজন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, ব্যক্তি ও সমাজের মধ্যে একটি স্বতঃস্ফূর্ত এবং স্বাধীন সম্পর্ক থাকা উচিত, যা কোনোরূপ নিয়ন্ত্রণ বা শোষণের উপর নির্ভর করবে না।
- কার্ল মার্কস : কার্ল মার্কস (Karl Marx, ১৮১৮-১৮৮৩) হেগেলের দ্বান্দ্বিক নিয়ম থেকে প্রভাবিত হয়ে তার নিজস্ব সমাজবাদী চিন্তাধারার উদ্ভাবন করেন। মার্কস বিশ্বাস করতেন যে, ইতিহাসের প্রগতিশীল প্রক্রিয়াটি অর্থনৈতিক দ্বন্দ্বের মাধ্যমে বিকশিত হয়। তার মতে, সমাজের সকল পরিবর্তন এবং বিপ্লব অর্থনৈতিক দ্বন্দ্বের ফলাফল। তিনি একটি শ্রেণিহীন সমাজের স্বপ্ন দেখতেন, যেখানে শ্রমিক শ্রেণির শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠিত হবে।
তবে, এই সব চিন্তাধারার ভিত্তি ছিল জার্মান দার্শনিক হেগেলের দ্বান্দ্বিক নিয়ম, যা প্রকৃতপক্ষে নিরঙ্কুশ সার্বভৌম রাষ্ট্রের পক্ষে ছিল। জার্মান দার্শনিক গিয়র্গ ভিলহেল্ম ফ্রিডরিখ হেগেল (Georg Wilhelm Friedrich Hegel, ১৭৭০-১৮৩১) একটি গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিক প্রবাহের জন্ম দেন, যা হেগেলীয় দর্শন নামে পরিচিত। হেগেল বিশ্বাস করতেন যে, ইতিহাস একটি প্রগতিশীল প্রক্রিয়া, যা দ্বান্দ্বিক নিয়মের মাধ্যমে বিকশিত হয়। তার মতে, প্রতিটি ধারণার (থিসিস) বিপরীতে একটি বিরোধী ধারণা (অ্যান্টিথিসিস) থাকে এবং এদের দ্বন্দ্বের মাধ্যমে একটি নতুন ধারণা (সিন্থিসিস) উদ্ভূত হয়। হেগেলের এই দর্শন তার শিষ্যদের উপর গভীর প্রভাব ফেলে। কার্ল মার্কস, পিয়ের জোসেফ প্রদঁঁ, ম্যাক্স স্টার্নার এবং মিখাইল বাকুনিন সবাই হেগেলের ছাত্র ছিলেন। কিন্তু হেগেলের নিরঙ্কুশ সার্বভৌম রাষ্ট্রের ধারণার বিপরীতে, তার শিষ্যরা বিভিন্নমুখী চিন্তাধারার জন্ম দেন।
নিয়তির এমনই পরিহাস, যে দর্শনে এদের এবং কার্ল মার্কসের হাতেখড়ি জার্মান দার্শনিক হেগেলের কাছে। হেগেল তার দর্শনে নিরঙ্কুশ সার্বভৌম রাষ্ট্রের স্তব করে গেছেন। কিন্তু তার দ্বান্দ্বিক নিয়মকে প্রমাণ করবার জন্যেই হেগেলবাদ তার প্রতিবাদের জন্মদান করে। তবে হেগেলের এই প্রতিবাদী শিষ্যদের মধ্যেই বা কতটুকু সামঞ্জস্য ও মিল খুঁজে পাওয়া যায়, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। হেগেলের শিষ্যরা যদিও তার দ্বান্দ্বিক নিয়ম থেকে প্রভাবিত হয়েছিলেন, তবুও তাদের চিন্তাধারায় যথেষ্ট বৈচিত্র্য এবং পার্থক্য ছিল। প্রদঁঁ, স্টার্নার এবং বাকুনিন রাষ্ট্র এবং ধর্মের বিপরীতে ছিলেন, যেখানে মার্কস একটি নতুন রাষ্ট্রের পক্ষে ছিলেন, যা সমাজের সকল শোষণ এবং বৈষম্য দূর করবে। তাদের এই পার্থক্য সত্ত্বেও, তারা সবাই হেগেলের দ্বান্দ্বিক নিয়ম থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে নিজেদের চিন্তাধারা বিকাশ করেন।
১৮৪৮ থেকে ১৮৭১ সাল পর্যন্ত সময়টি ছিল ইউরোপের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এই সময়ে সংঘাত, বিপ্লব এবং নতুন নতুন সামাজিক ও রাজনৈতিক ধারণার উদ্ভব ঘটে। স্যাঁ সিম, ফুরিয়ে, লুই ব্লাঁক, ম্যাটসিনি, গ্যারিবল্ডি, কসাথ, প্রদঁঁ, স্টার্নার, বাকুনিন এবং কার্ল মার্কস তাদের নিজ নিজ চিন্তাধারা এবং আন্দোলনের মাধ্যমে এই সময়কে সমৃদ্ধ করে তোলেন। তাদের চিন্তাধারা এবং কর্মকাণ্ড পরবর্তী কালের সামাজিক এবং রাজনৈতিক পরিবর্তনে গভীর প্রভাব ফেলে।
ম্যাক্স স্টার্নার ব্যতীত অন্যান্য নৈরাজ্যবাদী ও সমাজবাদীরা সর্বপ্রথম ব্যক্তি সম্পত্তিকে আক্রমণ করল। নৈরাজ্যবাদীরা আরও অগ্রসর হয়ে তাদের বাক্যবান প্রয়োগ করল ধর্ম, নীতি ও রাষ্ট্রের ওপর। কিন্তু তাদের আসল ও মৌলিক লক্ষ্য হল সম্পত্তি। কারণ সম্পত্তিই যাবতীয় বৈষম্যের মূল, যা ব্যক্তির স্বাধীন সত্তার বিকাশে বিঘ্ন ঘটায়। শিল্পবিপ্লবের পর এই বৈষম্য প্রকট হয়ে উঠেছে। শিল্পপতিরা বেপরোয়াভাবে শ্রমিকদের শোষণ করে চলেছে, যেমন –
- শ্রমিকদের শোষণের প্রক্রিয়া: শিল্পপতিরা শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি না দিয়ে কম বেতনে কঠোর পরিশ্রম করিয়ে অধিক মুনাফা অর্জন করতেন। এই শোষণের ফলে শ্রমিকদের জীবনযাত্রার মান নিম্নগামী হয়। উদাহরণস্বরূপ, ১৮০০ শতকের ইংল্যান্ডে, কারখানার শ্রমিকরা দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করত, কিন্তু তাদের মজুরি ছিল অত্যন্ত কম। এই শোষণের ফলে শ্রমিকদের স্বাস্থ্য ও সামাজিক অবস্থার অবনতি ঘটে।
- কঠোর শ্রমিক নিয়মাবলী: শিল্পপতিরা শ্রমিকদের উপর কঠোর নিয়মাবলী আরোপ করতেন। শ্রমিকরা প্রায়ই ১২-১৪ ঘণ্টা কাজ করতে বাধ্য হতেন এবং তাদের কাজের পরিবেশ ছিল অত্যন্ত প্রতিকূল। ১৮৩৩ সালের ইংল্যান্ডে “Factory Act” পাশ হয়, যা শিশু শ্রম ও অতিরিক্ত কাজের সময় সীমিত করার চেষ্টা করে। কিন্তু এই আইনের বাস্তবায়ন প্রায়ই দুর্বল ছিল এবং শিল্পপতিরা এই নিয়মাবলী উপেক্ষা করতেন।
- মেয়াদোত্তীর্ণ বেতন: শ্রমিকদের প্রায়ই মেয়াদোত্তীর্ণ বেতন দেওয়া হতো। শিল্পপতিরা তাদের মুনাফা বাড়ানোর জন্য শ্রমিকদের বেতন প্রদঁান বিলম্ব করতেন। এর ফলে শ্রমিকরা আর্থিক সমস্যায় পড়তেন এবং প্রায়ই ঋণগ্রস্ত হতেন। ১৮৪০ সালের ইংল্যান্ডে, কারখানার শ্রমিকরা অতিরিক্ত কাজের জন্য কম বেতন পেত এবং প্রায়ই মেয়াদোত্তীর্ণ বেতনে কাজ করতে বাধ্য হতেন।
রাষ্ট্র ছিল এই শিল্পপতিদের তাঁবেদার। তাদের শোষণতন্ত্র দাঁড়িয়ে ছিল রাষ্ট্রশক্তির ওপর ভর করে। রাষ্ট্রশক্তি প্রায়শই শিল্পপতিদের সমর্থন করত। রাষ্ট্রের আইন এবং শাসন ব্যবস্থা শিল্পপতিদের শোষণতন্ত্রকে সুরক্ষিত রাখত। রাষ্ট্র শ্রমিক আন্দোলন দমনে শিল্পপতিদের পাশে দাঁড়াত। শ্রমিকরা যখন তাদের অধিকার ও ন্যায্য মজুরির জন্য আন্দোলন করত, তখন রাষ্ট্রশক্তি পুলিশ ও সেনাবাহিনী ব্যবহার করে এই আন্দোলন দমন করত। রাষ্ট্র প্রায়ই শ্রমিকদের বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রণয়ন করত, যা শিল্পপতিদের স্বার্থ রক্ষা করত। এই ধরনের আইন শ্রমিকদের সংগঠিত হওয়া এবং তাদের অধিকার আদায়ের প্রচেষ্টাকে বাধাগ্রস্ত করত। শোষণতন্ত্রের মূল ভিত্তি ছিল রাষ্ট্রশক্তি। রাষ্ট্রের আইন এবং শাসন ব্যবস্থা শিল্পপতিদের শোষণকে বৈধতা দিত এবং সুরক্ষিত রাখত। উদাহরণস্বরূপ, ফরাসি বিপ্লব পরবর্তী সময়ে নেপোলিয়নের শাসনামলে, শিল্পপতিদের স্বার্থ রক্ষা করার জন্য বিভিন্ন আইন প্রণয়ন করা হয়, যা শ্রমিকদের শোষণের পথ প্রশস্ত করে। রাষ্ট্রশক্তির প্রভাব শিল্পপতিদের শোষণ তন্ত্রকে আরও সুসংহত করে তোলে। রাষ্ট্রশক্তি শিল্পপতিদের শোষণের বিরুদ্ধে যে কোনো ধরনের প্রতিবাদকে দমন করত এবং তাদের স্বার্থ রক্ষায় সর্বদা সক্রিয় থাকত। উদাহরণস্বরূপ, ১৮৪৮ সালের বিপ্লবের পর, ইউরোপের বিভিন্ন দেশে রাষ্ট্রশক্তি শিল্পপতিদের স্বার্থ রক্ষা করতে সক্রিয় ছিল এবং শ্রমিক আন্দোলন দমনে কঠোর ভূমিকা পালন করত।
সরকার যে বিত্তবান শ্রেণীর একটি হাতিয়ার এ কিছু নতুন কথা নয়। সমাজবাদী ও নৈরাজ্যবাদীদের অনেক আগে এরিস্টটল থেকে এডাম স্মিথ পর্যন্ত বিত্তবান শ্রেণীর দার্শনিকরা এই তিক্ত সত্য স্বীকার করে গেছেন। “সরকারি শাসন যে পরিমাণে সম্পত্তির নিরাপত্তা বিধানের জন্য গঠিত হয়েছে, সে পরিমাণে আসলে ইহার কাজ দরিদ্রের বিরুদ্ধে ধনীকে রক্ষা করা, অথবা যাহাদের কোনো সম্পত্তি নাই তাদের হাত হইতে যাহাদের সম্পত্তি আছে তাদিগকে রক্ষা করা।” – এ উক্তি মার্কস্ অথবা বাকুনিনের নয়, নতুন ধনবিজ্ঞানের স্রষ্টা বুর্জোয়া অর্থশাস্ত্র এডাম স্মিথের (ওয়েল্থ অব নেশন্স্, খণ্ড ২, ২০৭ পৃষ্ঠা), ১৭৭৬ সালের লেখা। সত্তর বৎসর পরে প্রদঁ, মা ও বাকুনিন শত শত পৃষ্ঠা জুড়ে এই মন্তব্যেরই বিস্তার করেছেন।
প্রদঁঁর জীবন
জীবনকাল
১৮০৯ সালের পনেরোই জানুয়ারী ফ্রান্সের পশ্চিম প্রান্তে বেসাঁস শহরের উপকণ্ঠে গ্রাম্য পরিবেশে পিয়ের জোসেফ প্রদঁঁর জন্ম হয়। পিতার ছিল সামান্য মদ চোলাইর ব্যবসা, মা এককালে ছিলেন রাঁধুনি। শৈশব কাটল জুরার মাঠে ও জঙ্গলে। “বারো বৎসর আমার জীবনের প্রায় সবটাই কেটেছে গ্রামে, গরু চরান বা ঐরকম ছোটখাটো কাজে।” ছেলেবয়সের স্মৃতিতে কায়েম হয়ে বসল মাটির টান। “প্রায়ই জুন মাসের উষ্ণ প্রভাতে আমি কাপড়চোপড় খুলে ফেলে ঘাসের শিশিরে গড়াগড়ি দিতাম।” ছেলে মানুষ হল প্রকৃতির কোলে, তার জীবনবোধ বদ্ধমূল হল চাষীর নিস্তরঙ্গ জীবন-যাত্রায়। তারপর এল শহরের অভিজ্ঞতার সঙ্গে অভাব অনটন। গ্রামের গরীব ছেলে বেসাঁসর কলেজে ভর্তি হল, বেতন মাপ হল কিন্তু বই কিনবার পয়সা নেই। সে খবর কে রাখে? বই জোটে না তাই পড়া হয় না, ক্লাসে শাস্তি পেতে হয়। এদিকে বাপ মা অনাহারে। উনিশ বৎসর বয়সে কলেজ ছেড়ে প্রদঁঁ এক ছাপাখানায় চাকরি নিলেন। এখন থেকে তার লেখার বাতিক দেখা দিল। ১৮৩০ সালে শুরু হল তার ভবঘুরের যাত্রা। “পকেটে পঞ্চাশ ফ্রাঙ্ক, পিঠে একটা ঝোলা, আর আমার দর্শনের পাণ্ডুলিপি, এই সম্বল করে আমি ফ্রান্সের দক্ষিণ দিকে বেরিয়ে পড়লাম।” পথে পথে ছাপাখানার কাজ করে খাওয়াপরা জুটত। অবসর পেলেই পড়াশুনা করতেন, কারণ সাধ ছিল নিজের ভবিষ্যতকে অন্যভাবে তৈরি করবার বছর কয়েক পরে দেশে ফিরে নিজে ছাপাখানা খুললেন। বেশীদিন এ ব্যবসা চলল না। কিন্তু ভাগ্যলক্ষ্মী এবার মুখ তুলে চাইলেন। ১৮৩৮ সালে তার রচনার গুণে বেসাঁসর কলেজ থেকে প্রদঁঁকে তিন বছরের জন্য একটা বৃত্তি দেওয়া হল। এই উপলক্ষে নানা জনের কাছ থেকে অভিনন্দন এল। উত্তরে প্রদঁঁ তার সম্বর্ধনা সভায় ঘোষণা করলেন যে তিনি জীবন উৎসর্গ করবেন আপন সগোত্র দুর্গত শ্রেণীর কল্যাণের জন্যে। এ প্রতিশ্রুতি তিনি কোনোদিন ভোলেন নি। নিজের সাহিত্য প্রতিভা ও রচনাশক্তি বিকিয়ে তিনি আরামে জীবন কাটিয়ে যেতে পারতেন, কিন্তু তিনি বেছে নিলেন জন্মসঙ্গী দারিদ্র্যকে এবং আজীবন লড়লেন দরিদ্রের হয়ে।
প্রদঁঁ ছিলেন একান্ত নিষ্ঠাবান নীতিবান সৎ ব্যক্তি। তার লেখা সর্বত্র সংযত, মার্জিত ও নিরপেক্ষ নয়। কিন্তু মার্কস্ ও বাকুনিনের মত তাতে গা-এর ঝাল নেই। ১৮৪৯ সালে একটি প্রবন্ধে ফ্রান্সের একনায়ক লুই নেপোলিয়নের সমালোচনা করার অপরাধে তার কারাদণ্ড হয়। জেলে থাকতে তিনি একটি বিত্তহীন যুবতীকে বিবাহ করেন। বেরিয়ে আসার কিছু পরে আবার তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারী পরোয়ানা প্রস্তুত হল। প্রদঁঁ বেলজিয়ামে পালিয়ে গেলেন। ১৮৬৩ সালে রাজবন্দীদের ওপর সম্রাটের রোষ প্রশমিত হলে তিনি দেশে ফিরলেন। তার দেহ তখন ভাঙতে শুরু করেছে। দীর্ঘকাল রোগ-ভোগের পর ১৮৬৫ সালের ১৬ই জানুয়ারি পোয়াসীতে প্রিয়তমা জীবনসঙ্গিনীর বাহুবন্ধনে তার প্রাণবিয়োগ হল।
রচনাবলি
প্রদঁঁর প্রধান এবং প্রথম রচনা- কেক্ লা প্রপ্রিয়েতে? (১৮৪০) অর্থাৎ “সম্পত্তি কী?”- বইয়ের নামকরণ প্রশ্নে, মুখবন্ধ উত্তরে উত্তর, সম্পত্তি চোরাই মাল। বুর্জোয়া বন্ধুদের চমক ভাঙতে ১৮৪৬ সালে বেরুল হেগেলের দ্বান্দ্বিক দৃষ্টিতে সম্পত্তিগত অর্থনীতির বিচার- সিস্ক্রেম দে কঁত্রাদিশিয় একনমিক (“অর্থনৈতিক দ্বন্দ্বের ধারা”) নামক পুস্তকে। ১৮৪৮ সালে বিপ্লবের সময়ে দুইটি পুস্তিকায় তিনি নির্বিত্ত অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পরিকল্পনা দিলেন। কারাবাসের অবকাশে তিনি লিখলেন লে কঁফেসিয় দ্য রেভল্যুশিয়নের (“বিপ্লবীর আত্মজীবনী,” ১৮৪৯) এবং ইদে জেনেরাশ দ্য ল্য রেভল্যুশিয় ও দিজ্ নোভিয়েম সিএল্ (“উনিশ শতকের মূল আদর্শ,” ১৮৫৯)। ১৮৫৮ সালে তিন খণ্ডে বেরুল চার্চদ্রোহী তার বৃহত্তম গ্রন্থ- স্কলাজুস্তিস্ দাঁ লা রেল্যুশিয় এদ লেগলিজ (“বিপ্লব এবং চার্চের ন্যায়নীতি প্রসঙ্গে”)। ১৮৬৩ সালে দ্যু প্র্যাসিপ ফেদেরাতিফ (“ফেডারেশনের নীতি”) পুস্তিকায় নিরাজ সমাজের রূপরেখা আঁকা হল। তার শেষ গ্রন্থ দ্য লা কাপাসিতে পলিতিক দে ক্লাসে জুভরিয়েরে (“শ্রমিক শ্রেণীর রাষ্ট্রনৈতিক শক্তি”) তার মৃত্যুর পর ১৮৬৫ সালে প্রকাশিত হল। এতে তিনি ভবিষ্যতের রচয়িতা জাগ্রত শ্রমিক শ্রেণীকে আশীর্বাদ জানালেন।
প্রদঁঁর রাষ্ট্রদর্শন
তত্ত্ব ও প্রতিষ্ঠানের নাশাত্মকতা ও পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা
প্রদঁ আত্মজীবনীতে বলছেন হেগেলের দ্বন্দ্ববাদ থেকে তিনি কি সূত্র উদ্ধার করেছেন- “যে কোনো তত্ত্বকে তার শেষ পরিণাম পর্যন্ত নিয়ে গেলে দেখা যায় যে তা এক অসঙ্গতিতে উপনীত হয়েছে। তখন এ তত্ত্বকে অসত্য ও খণ্ডিত বলে মানতে হবে এবং এই অসত্য যদি কোনো প্রতিষ্ঠানের জন্ম দিয়ে থাকে তবে তাকেও কৃত্রিম ও কাল্পনিক বস্তু বলে মনে করতে হবে।” নাশাত্মক নিয়ম জীবন ও গতির নিয়ম। একে ধরেই জীবনপথে এগিয়ে যেতে হবে। এই নিয়মটি সমাজসমস্যার চাবিকাঠি, এই নিয়ম খাটিয়ে খুঁজে পাওয়া যাবে সমাজ-ব্যাধির ধন্বন্তরী। এই অস্ত্র হাতে নিয়ে তিনি সমাজের আসল রোগ সম্পত্তিপ্রথার উপচারে অগ্রসর হলেন। দ্বন্দ্ববাদে কল্পনাবিলাসের জায়গা নেই। সমাজ একটা যন্ত্র নয় যা বুদ্ধি খাটিয়ে মেরামত করে চালানো যাবে। সমাজ জৈবধর্মী, তার জীবন নিরন্তর গতিশীল। “এই ধারণা যদি আমরা শ্রমসংগঠনে প্রয়োগ করি তাহলে অর্থনীতিবিদ এবং সমাজবাদীদের কারো সঙ্গেই আমরা একমত হতে পারি না। অর্থনীতিবিদ বলেন যে শ্রম ঠিকঠাক সংগঠিত হয়ে গেছে, সমাজবাদীরা বলেন শ্রমকে আদর্শ মাফিক সংগঠিত করতে হবে। বাস্তবে শ্রম ক্রমশ সংগঠিত হয়ে চলেছে।” (কত্রাদিকশিয়ঁ একনমিক, খণ্ড ১, ৪৫ পৃষ্ঠা)
অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে পুঁজিবাদ ও সমাজবাদ-বিরোধিতা
ব্যক্তিসম্পত্তির ভিত্তির ওপর যে অর্থনৈতিক কাঠামো তৈরি হয়েছিল বনেদী অর্থশাস্ত্রীদের ধনবিজ্ঞান ছিল তার পক্ষে ওকালতি। আর সমাজবাদীরা চাচ্ছিল ব্যক্তিসম্পত্তির উচ্ছেদ করে ধনবৈষম্যের নিরসন এবং সামাজিক ধন-বিজ্ঞানের প্রবর্তন। প্রুদঁ এদের কারও পক্ষপাতী ছিলেন না। যে সম্পত্তিকে প্রদঁ চোরাই মাল বলে আক্রমণ করলেন, তাকেই আবার মুক্তির দিশারী বলে অভিনন্দন করলেন। এই হেঁয়ালিটা বোঝা কিছু কঠিন নয়। মালিক যখন কোন কাজ না করে আয়ের অধিকারী হয়, তখন বস্তুত সে অপরের পরিশ্রমের রোজগারের ওপর ভাগ বসায়। জমি ও পুঁজি কিছু উৎপাদন করতে পারে না। উৎপাদন করে শ্রম। যখন জমিদার ও পুঁজিপতি লাভের অংশ দাবি করে তখন তারা কিছু চায় যার বদলে কিছু দেয় না। এটাই হল অনর্জিত আয় বা চোরাই মাল। সম্পত্তি হল, “অন্যের উদ্যোগ বা পরিশ্রমের ফল ভোগ করার এবং সেই ফল নিজের ইচ্ছামত বেচাকেনা করার অধিকার।” (প্রপ্রিয়েতে? অধ্যায় ১, ১৩৩ পৃষ্ঠা) নিজের শ্রমফলের ওপর প্রত্যেকের দাবি অবিসংবাদিত, প্রত্যেকের অধিকার আছে নিজের শ্রমফল বাজারে ইচ্ছামত বিনিময় করবার। মেহনত করে যে যা গড়েছে কিংবা সঞ্চয় করেছে সে তা ভোগ করবে, দান করবে, বিক্রি করবে যেমন তার খুশি এই বিত্তাধিকার স্বাধীনতার গোড়ার কথা। এ হিসাবে সম্পত্তি মুক্তির দিশারী।
মজুরের পরিশ্রমের আয় কেমন করে মালিকের পকেটে যায়? একক ব্যক্তির মেহনতের ওপর যৌথ উদ্যোগের যে উদ্বৃত্ত আয় সেটি চুরি করে, মালিক যাকে বলে মুনাফা। “বহুলোকের এককালীন সংঘবদ্ধ উদ্যম থেকে যে বিরাট শক্তির উদ্ভব হয়, তার মূল্য ধনিকেরা কিছু দেয় না। দুইশো মজুর লুক্সরের প্রকাণ্ড মূর্তিটিকে কয়েক ঘণ্টায় তুলতে পারে, যা একজন মজুর দুইশো দিনেও পারবে না। ধনিকের হিসেবে উভয় ক্ষেত্রেই মজুরি সমান হবে। (প্রপ্রিয়েতে? অধ্যায় ১, ৯৪ পৃষ্ঠা) মজুর মনে করে সে তার কাজ মত মজুরি পেল। আসলে সে পেল কাজের আংশিক মূল্য।
এর পর প্রুদঁ সমাজবাদীদের ধরলেন। সম্পত্তি অর্জন, প্রতিযোগিতা, ভোগ, এসব মানুষের মজ্জাগত প্রবৃত্তি, এই প্রবৃত্তিগুলি ধনসৃষ্টির উৎস। এ উৎস সমাজবাদীরা বুঝিয়ে দিতে চায়। “শ্রমবিভাগ, যৌথশক্তি, প্রতিযোগিতা, বিনিময়, বিত্ত, এমনকি স্বাধীনতা—এগুলিই আসল অর্থনৈতিক শক্তি, ধনসৃষ্টির উপাদান। এগুলি মানুষকে অন্যের দাস বানায় না; বরং উৎপাদককে পূর্ণ স্বাধীনতা দেয়, তার পরিশ্রম লাঘব করে, তার উৎসাহ জাগিয়ে তোলে এবং তার উৎপাদনকে দ্বিগুণ করে।” (ইদে জেনেরাল, ৯৫ পৃষ্ঠা)
এই অর্থনৈতিক প্রথা ও প্রবৃত্তিগুলোকে নষ্ট করা সমাজবিপ্লবীর কাজ নয়, এদের অন্তর্বিরোধের মীমাংসা করা তার কাজ। তার কাজ এদের মধ্যে একটা সামঞ্জস্য বিধান করা। “এই অর্থনৈতিক প্রভাবগুলি, যেগুলির শক্তি এত ফুলে উঠেছে, সেগুলিকে দমন করার পরিবর্তে আমাদের উচিত তাদের মধ্যে একটি ভারসাম্য আনা। এটি সম্ভব হবে সেই নিয়মের মাধ্যমে, যা অনেকেই ভালো করে জানে না বা বোঝে না—যে বিপরীত বস্তু পরস্পরকে বিনাশ করে না, বরং তাদের বিপরীত স্বভাবের জন্যই পরস্পরকে রক্ষা করে।” (দ্য লা জুসতিস, খণ্ড ১, ২৬৫-৬৬ পৃষ্ঠা) খুব সহজ তত্ত্ব। বাড়ির খিলান ও গম্বুজ তৈরি হয় ভিন্নমুখী ভারের সমন্বয় করে- বিপরীত ভার পরস্পরকে ঠেকিয়ে রাখে, কেউই ভূমিসাৎ হয় না। বলবিদ্যার এই নিয়ম সমাজেও বলবৎ। সমাজবাদী চায় সব বৈপরীত্য নিঃশেষ করে যৌথ উদ্যোগের প্রবর্তন। তার মানে স্বাধীনতার সৎকার।
“সামুদায়িকতার অর্থ প্রত্যেকে অপরের জন্য দায়ী এবং অক্ষম ও সক্ষম, তরুণ ও বৃদ্ধ সকলের কদর সমান। এতে অসাম্য দূর হয় বটে কিন্তু অযোগ্যতা ও অক্ষমতা প্রশ্রয় পায়।” (ইদে জেনেরাল, ৮৯ পৃষ্ঠা)। সুতরাং ব্যক্তিসম্পত্তির মত যৌথসম্পত্তিও বর্জনীয়। “হেগেলের ছকে ফেলে বলতে গেলে সমাজবিকাশের প্রথম পর্যায়ে আসে যৌথ সত্তা, এটি হলো থীসিস বা ভাব; এর প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে আসে ব্যক্তি- সম্পত্তি, এটি হলো এন্টিথিসিস বা প্রতিভাব। সমাধানে পৌছবার আগে খুঁজে বের করতে হবে তৃতীয় পর্যায়ের সিন্থেসিস বা সদ্ভাবটিকে।” এই সিনথেসিস বা সমন্বয়টি কী? বিত্ত থাকবে শ্রমের স্বাধীনতা ও বিনিময়ের অধিকার নিয়ে। কিন্তু বিত্তের আনুষঙ্গিক যে অনর্জিত লাভের দাবি তা বাতিল হবে। নিজের শ্রমফল ভোগ করবার অধিকার হবে সম্পত্তির মর্ম। একে অন্যের চাহিদা মেটাবে, পরস্পরের সাহায্যের জন্য গড়ে উঠবে বিনিময় প্রথা, সম্পত্তির অন্তর্দ্বন্দ্বের এই হল সমাধান। ব্যক্তিসম্পত্তি নয়, যৌথসম্পত্তি নয়, ব্যক্তিঅধিকার ও সহযোগিতাতেই হবে সমাজদ্বন্দ্বের নিরসন, যাকে প্রদঁ বলেছেন ম্যুতুয়ালিতে।
বিনিময় ব্যাংক ও সমবায় ব্যাংকের প্রস্তাবনা
সমস্যাটা অর্থনৈতিক, রাষ্ট্রনৈতিক নয়। রাষ্ট্রবিপ্লবে এর সমাধান নেই। তাই ১৮৪৮-এর ফরাসী বিপ্লব প্রদঁঁর মনে সাড়া জাগাতে পারেনি। এ যেন অকালপ্রসূত ভ্রূণ সন্তান। কিন্তু একে এড়িয়ে যাবারও যো নেই। এতদিন চলেছে কেবল সমালোচনা ও দার্শনিক তত্ত্বকথা। এবার বিপ্লবের তাড়ায় কাজের রাস্তা খুঁজতে হল, আবিষ্কার করতে হল এমন কর্মপন্থা যাতে ধনবৈষম্য দূর হয়। প্রদঁ বের করলেন বিনিময় ব্যাঙ্কের পরিকল্পনা। তিনি দেখালেন এতদিন সম্পত্তির বিরুদ্ধে সমালোচনা হয়েছে এর মারফত ধন উৎপাদন ও বণ্টনের ব্যাপারে মালিকের ক্ষমতা বর্তায় বলে। বিনিময়ের মধ্য দিয়েও যে বৈষম্য আসতে পারে এবং প্রধানত আসে তা কেউ খেয়াল করেনি। বিনিময়ের মাধ্যম হল মুদ্রা। যে কোনো উৎপাদনের কাজে মুদ্রার দরকার। মূলধনের জন্যে চাই সুদ, জমি ও যন্ত্রের জন্যে চাই ভাড়া, সব দিতে হয় মুদ্রায়। এই প্রকারে মুদ্রা হয়ে দাঁড়ায় অনর্জিত আয়ের বাহন, পরস্বভোগের হাতিয়ার। মুদ্রার এই পাপবৃত্তি যদি দূর করা যায়, যদি শ্রমিক বিনা সুদে পুঁজি ও বিনা ভাড়ায় জমি পায় তাহলে সে তার পরিশ্রমের ফল পুরোপুরি ভোগ করতে পারে এবং পুঁজিপতি তাতে ভাগ বসাতে পারে না।
বিনিময় ব্যাঙ্কের কাজই হবে এই। এই ব্যাঙ্ক উৎপাদনকারীকে বিনা সুদে ধার দেবে। চলতি ব্যাঙ্ক পুঁজিবাদীদের ঘাটি। এর কাজ পণ্যের বদলে কিছু বাটা রেখে মুদ্রা অথবা হুণ্ডি দেওয়া এবং এই বাটার আয় ব্যাঙ্কের মূলধনের অংশীদারদের মধ্যে বিলি করা। বিনিময় ব্যাঙ্কের কোন মূলধন ও অংশীদার থাকবে না এবং এ কোন লাভ করবে না। পণ্যের বদলে এই ব্যাঙ্ক দেবে হুণ্ডি কিংবা নোট যা মুদ্রায় রূপান্তরিত করা যাবে না। নোটগুলি ব্যাঙ্কের মক্কেলদের মধ্যে বিনিমেয় হবে এবং কারেন্সি নোটের মত চলবে। মক্কেলদের মধ্যে বোঝাপড়া থাকবে যে তারা তাদের পণ্যের দাম বাবদ এই নোট নিতে আপত্তি করবে না। ব্যাঙ্ক সাধারণত পণ্যের বদলে নোট দেবে, দাম স্থির হবে উৎপাদনের খরচ ও মেহনতের অনুপাতে। কেউ যদি নতুন কারবার অথবা কারখানা খুলতে চায় তাহলে ব্যাঙ্ক তাকে কিছু আগাম টাকা কিংবা নোটও দিতে পারবে, পরে তার উৎপন্ন পণ্য নিয়ে এই ধার উসুল করবে। এইরূপে কারবারিরা বিনা সুদে মূলধন পাবে। মূলধনের অভাবে উৎপাদককে ধনিকের দাসত্ব করতে হয় কিংবা তাকে মোটা হারে জমি ও যন্ত্রের ভাড়া দিতে হয়। বিনিময় ব্যাঙ্কের সাহায্যে সে নিজে যন্ত্র কিনে তার মালিক হতে পারবে এবং নিজের মেহনতের রোজগার সম্পূর্ণভাবে ভোগ করতে পারবে। মূলধন প্রত্যেকের আয়ত্তের মধ্যে এলে কোন উদ্যোগী লোককে বেকার থাকতে হবে না। পণ্যের ন্যায্য বিনিময় এবং উৎপাদকদের স্বাধীন চুক্তি, এই হবে বাজারের রেওয়াজ, শ্রম ও পুঁজি এক পাত্রে এসে মিলবে, শোষণ ও শ্রেণীভেদ দূর হবে। সমাজ হবে শাসনমুক্ত, স্বাবলম্বী।
পরিকল্পনাটি সুন্দর, কিন্তু এতে কিছু গলদ আছে, যা রচয়িতার নজরে পড়েনি। তিনি দেখেছেন বিনিময় নোটে বিক্রেতাদের মস্ত সুবিধে যে এতে বাটা নেই। ব্যাঙ্ক নোট বাটা নেয়। ব্যাঙ্ক নোটের সুবিধার দিকটা তিনি দেখেন নি। ব্যাঙ্ক নোট ইচ্ছামত মুদ্রায় ভাঙানো যায়। সুতরাং ব্যাঙ্ক নোট লেনদেনের ব্যাপারে সকলেরই গ্রাহ্য। বিনিময় নোট মুদ্রায় বাঙানো যায় না। এ কেবল ব্যাঙ্কের মক্কেলদের কাছে গ্রাহ্য। কাজেই এর চলাচল নির্ভর করে মক্কেলদের সচ্ছলতার ওপর। তাদের কারবারে মন্দা পড়লে বিনিময় নোটের কদর কমে যাবে। তাই ব্যাঙ্ক নোটের মত বিনিময় নোটের ওপর জনসাধারণের আস্থা আসতে পারে না। আরও একটা কথা আছে। মূলধন তৈরি হয় এবং সমাজের ধনবৃদ্ধি হয় সঞ্চয় থেকে। তার মানে সম্পদের সৃষ্টি বাড়ানো দরকার, ভোগ কমিয়ে উদ্বৃত্ত সম্পদ জমিয়ে আবার উৎপাদনে খাটানো দরকার। এই প্রকারে সমাজের বিত্ত বৃদ্ধি পায়। এর আয়োজন না করে কেবল বিনিময়ের সুবিধা ও ঋণের সুযোগ দেবার জন্যে নোট ছাড়লে বাজার ফেঁপে উঠবে, জিনিসপত্রের দাম চড়বে।
এই সব ত্রুটিবিচ্যুতি সত্ত্বেও বিনিময় ব্যাঙ্কের পরিকল্পনায় একটা খুব কাজের কথা আছে- সে হল পারস্পরিক ঋণের ব্যবস্থা। জনসাধারণের টাকায় ব্যাঙ্ক চলে। ব্যাঙ্ক একজনের টাকা গচ্ছিত রাখে, সে টাকা লগ্নি করে আর একজনের কাছে। ধার দেয় একজন আর একজনকে, ব্যাঙ্ক শুধু মধ্যস্থ। অংশীদারদের দেওয়া মূলধন একটা অতিরিক্ত নির্ভর, আপৎকালের ভরসা। এখন ব্যাঙ্কের মধ্যস্থতা কী তুলে দেওয়া যায় না? বিলক্ষণ যায়। সমবায় সমিতি দোকানদারকে বাদ দিয়ে সভ্যদের বিনা লাভে জিনিস যোগায়। তেমন সমবায় ঋণ সমিতি ব্যাঙ্ককে বাদ দিয়ে সভ্যদের বিনা সুদে ধার দিতে পারে। এত বেশী মূলধন লাগবে না। সভ্যদের চাঁদায় কাজ চলে যাবে এবং ব্যাঙ্কের দায় হবে সভ্যদের যৌথ।
“উনিশ শতকের বিপ্লবের মূল আদর্শ” গ্রন্থে প্রদঁ সরাসরি এই সমবায় ব্যাঙ্কের প্রস্তাব দিলেন। সে ১৮৫১ সালে, বিনিময় ব্যাঙ্কের প্রচেষ্টা বানচাল হবার পর। ১৮৪৯ সালের ৩১ জানুয়ারি, প্রুদঁ বাঁক দ্য পোল্ বা ‘জনতা ব্যাঙ্ক’ নাম দিয়ে তার কল্পনাকে রূপায়িত করলেন। মূল পরিকল্পনার কিছু কিছু অঙ্গ অবশ্য বাদ দিতে হল। কিছু মূলধন শেয়ার ছেড়ে যোগাড় করতে হল, শতকরা দুই হারে সুদ ধার্য হল এবং কয়েকটি মাত্র জিনিসের লেনদেনে বিনিময় নোট চালু হল, বাকি জিনিসগুলির বেচা কেনায় মুদ্রা বহাল রইল। এই সংকুচিত পরিধির মধ্যেও ব্যাঙ্কের কাজ চলল না। ১১ই এপ্রিল কারাগমনের আগে প্রদঁ ব্যাঙ্কের পাট তুললেন। মুদ্রার বদলে বিনিময় নোটের পরিকল্পনার এইখানেই সমাপ্তি।
প্রচলিত অর্থে প্রদঁ আদৌ সমাজবাদী ছিলেন না। তিনি ছিলেন খাঁটি ব্যক্তিবাদী। তিনি খুঁজেছেন এমন একটা সমাধান যাতে কারও স্বাধীনতা খর্ব না হয় অথচ সকলের ন্যায় সঙ্গত পাওনা ঠিক থাকে, যাতে সবাই স্বাধীনভাবে ও ন্যায্যভাবে আপন আপন কাজ নিয়ে লেনদেন করতে পারে, প্রত্যেকে যা দেয় ঠিক তার সমান পায়, কারও কোনো একাধিকার অথবা মধ্যস্বত্ব নেই। এই হল প্রদঁর ম্যুতুয়ালিতে বা সহযোগী স্বেচ্ছাতন্ত্র যেখানে যৌথসমাজের কোনো রকম জোর জুলুম খাটে না। এই বন্দোবস্তে রাষ্ট্রশাসনের কোনো জায়গা নেই। সমাজ দ্বন্দ্বে ভরপুর। কত বিরোধী অধিকার দাবিদাওয়া পরস্পরকে ঠেকিয়ে রেখেছে এবং আপোসে এসেছে, তাদের সংঘাত থেকেই এসেছে সমন্বয়। অধিকারের রক্ষাকর্তা অধিকার নিজেই। রাষ্ট্রের উদ্যত মুষ্ঠির কী প্রয়োজেন? এইখানেই প্রদঁঁর সঙ্গে সমাজবাদীদের বিবাদ। শ্রমিক তার শ্রমের পূর্ণ ফল ভোগ করবে এবং এই উদ্দেশ্যে আর্থিক সংস্কার হবে- এ বিষয়ে উভয়ে একমত। কিন্তু লুই ব্লাঁক প্রমুখ সমাজবাদীরা চাইতেন রাষ্ট্রের আওতায় এই পরিবর্তন আনতে। আর প্রদঁঁ চাইতেন জনসাধারণের স্বেচ্ছাকৃত উদ্যোগে এই সংস্কার আপনি আসুক। বিপ্লবের লক্ষ্য জনকল্যাণ নয়, জনমুক্তি স্বাধীনতা। সম্পত্তি কেন্দ্রীভূত হলে যেমন শোষণ চলে, ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হলে তেমন শাসন চলে। দুয়েরই উচ্ছেদ করা বিপ্লবীর লক্ষ্য।
প্রচলিত বিপ্লবের ধারণায় অনাস্থা
১৮৪৮-এর বিপ্লবে রাজতন্ত্র উচ্ছন্ন হল, প্রজাতন্ত্র প্রবর্তিত হল কিন্তু বিপ্লব দায়মুক্ত হল না। তার যে প্রতিশ্রুতি নতুন সমাজসম্পর্ক, স্বাধীন জীবনযাত্রা তা পূর্ণ হল না। প্রুদঁ তখন “প্যেপ্ল্” বা “জনতা” পত্রিকার সম্পাদক এবং গণপরিষদে সাইন জেলার প্রতিনিধি। অস্থায়ী সরকার প্রথমেই সর্বসাধারণকে ভোটাধিকার দিল। সবাই যখন প্রশংসায় পঞ্চমুখ। প্রুদঁ বললেন এ বিধান প্রতিবিপ্লবী। প্রজাতন্ত্রীরা তো অবাক, বিপ্লবী প্রুদঁ বলে কী? পরে “বিপ্লবের মূল আদর্শ” পুস্তকে তিনি দেখিয়েছেন কেমন করে তার উক্তির সত্যতা প্রমাণিত হয়েছিল। গণভোটে অধিক সংখ্যায় নির্বাচিত হল প্রতিক্রিয়াশীল দলের লোক, যারা সব রকম সমাজ সংস্কারের বিরোধী। কারণ ভোটের পরিচালনা ছিল এদের হাতে।
মেকি প্রজাতন্ত্র বেশীদিন টিকল না। ফ্রান্সের আকাশে ধূমকেতুর মত উদিত হলেন তৃতীয় নেপোলিয়ন, গণভোটের জোরে প্রজাতন্ত্র ভেঙে দিয়ে প্রথমে হলেন একনায়ক তারপর সম্রাট। এই ভুঁইফোঁড় জনপ্রিয় সম্রাটকে লক্ষ্য করে প্রুদঁ লিখলেন “জনতাকে দিয়ে মিথ্যাচার করাবার শ্রেষ্ঠ উপায় সার্বজনীন ভোটাধিকার।” প্রভুভক্তির দাস্যভাব জনতার অস্থিমজ্জায়। তিনি প্রায়ই বলতেন, “বাস্তবপক্ষে জনতার চেয়ে অগণতান্ত্রিক আর কিছু নয়।” সুতরাং আইন ও বিধানের বেড়া দিয়ে স্বাধীনতা রক্ষা হয় না। বিপ্লবের পরাহ্নে গণপরিষদ যখন প্রজাতান্ত্রিক সংবিধান গ্রহণ করছিল, তখন প্রুদঁ দাঁড়িয়ে বললেন: “আমি সংবিধানের বিরুদ্ধে ভোট দিচ্ছি, এতে আমার অসমর্থনীয় বিধি আছে বলে নয়, এতে আমার সমর্থনীয় বিধি নেই বলেও নয়। আমি সংবিধানের বিরুদ্ধে ভোট দিচ্ছি কারণ এটি একটি সংবিধান।” গডউইনের মত তিনিও মনে করতেন সংবিধান মাত্রই দুষ্ট, পরিত্যাজ্য। ফ্রান্সের তথাকথিত উদারনৈতিক রাষ্ট্রচিন্তার প্রতি তার বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধা ছিল না। “শুরুতে যতই জনপ্রিয় হোক, সরকার সর্বত্র দরিদ্র অশিক্ষিত জনতার বিরুদ্ধে শিক্ষিত ও সঙ্গতিপন্ন শ্রেণীর পক্ষ নিয়েছে।” (ইদে জেনেরাল, ১১৯ পৃষ্ঠা)
সমাজে বিপ্লব সাধন করা রাষ্ট্রের পক্ষে কোনো কালে সম্ভব নয়। রাষ্ট্র-জীবনের দুই বিপরীত প্রেরণা মুক্তি ও শৃঙ্খলা। বিপ্লব চায় প্রথমটি, সরকার চায় দ্বিতীয়টি। সরকার তার স্বভাবধর্মবশত বিপ্লবী হতে পারে না। আদিমতম নৃপতির রাজ্যাভিষেক থেকে ১৭৮৯ সালে মানবাধিকারের ঘোষণা পর্যন্ত যাবতীয় বিপ্লব ঘটেছে জনতার উদ্দীপনায়। সরকার শুধু বাধা দিয়েছে, পীড়ন করেছে। সরকার চিরকাল রক্ষণধর্মী। জনতা বিপ্লবকামী। স্বেচ্ছায়, স্বচেষ্টায় তারা যখন বিপ্লব আনবে তখনই বিপ্লব সার্থক হবে। ১৮৪৮ সালের বিপ্লব এনেছেন কয়েকজন উপরতলার নেতা। তারা ক্ষমতায় আসীন হয়েছেন এবং বিপ্লব পঞ্চত্ব পেয়েছে।
সে কালের রাষ্ট্রচিন্তায় যে দুটি ইষ্টমন্ত্র ছিল জাতীয়তা ও গণতন্ত্র – তার কোনোটিতে প্রদঁর কোনো মোহ ছিল না। ম্যাটসিনির জাতীয়তার আবেদনে সারা ইউরোপের তরুণ জেগে উঠেছিল, প্রদঁর রক্তে কোনো ঢেউ লাগেনি। হাঙ্গেরী ও পোল্যান্ডের ওপর জারের অত্যাচারে তার বিবেকবুদ্ধিতে আঁচড় পড়েনি। কারণ তার মতে জাতীয়তার নেশা বড় মারাত্মক। আজকের নির্যাতিত পরাধীন জাতি কাল স্বাধীন হয়ে বসলে এক কেন্দ্রায়িত রাষ্ট্র গঠন করবে এবং নির্যাতনে হাত পাকাবে। তার চেয়ে বরং ঢিলেঢালা অস্ট্রিয় সাম্রাজ্য ভালো যার অধীনে অনেক জাতি উপজাতির বাস। ফ্রান্সে যে বহু ফ্লেমিং, জার্মান, ইটালীয় ও বাস্ক জাতির লোক আছে এও মন্দ নয়, এদের জন্যে ফ্রান্স জাতিসর্বস্ব হতে পারে না। বহুজাতির শিথিল রাষ্ট্রের মধ্যেই নিহিত আছে তার ভাঙনের বীজ এবং জনতার সহযোগী প্রতিষ্ঠানের সম্ভাবনা।
রাষ্ট্রের বিকল্প প্রতিষ্ঠান
রাষ্ট্রের বিকল্প এই প্রতিষ্ঠানের রূপটি কী? “আত্মজীবনী” এবং “ফেডারেশনের নীতি” এই দুই পক্ষকে প্রুদঁ নিরাজ সমাজ ব্যবস্থার ছক এঁকেছেন। সমাজের যে সকল কাজকারবার সরকারি তত্ত্বাবধানে চলছে সেগুলোকে পরস্পর থেকে পৃথক করে গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে দিতে হবে। যেমন যেখানে দরকার তেমন সেখানে আঞ্চলিক সভা গড়ে উঠবে, তারা স্থানীয় কাজকর্ম চালাবে- বৃহত্তর ক্ষেত্রে সহযোগিতা করবে এবং প্রয়োজনমতো উচ্চতর সভা গড়ে তুলবে। কৃষি, বাণিজ্য, শিক্ষা, অর্থ, বিচার, দেশরক্ষা ইত্যাদি যে সমস্ত কাজের দেখাশুনা এখন সরকারি দপ্তর থেকে হয় সব তদারক করবে জনসাধারণ অথবা তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধি। সরকারি কর্মচারী কিংবা সরকারের মনোনীত প্রতিনিধি কোথাও থাকবে না। শৃঙ্খলা ও পরিচালনা থাকবে, বৈধানিক কর্তৃত্ব উঠে যাবে। কৃষি, বাণিজ্য ইত্যাদির পরিচালনার জন্য সমব্যবসায়ীরা নিজ নিজ সংঘ গড়ে তুলবে। সংঘের থাকবে আলোচনা সভা ও কার্যকরী সভা, মাথার ওপর থাকতে পারে একজন নির্বাচিত সচিব। এরাই সব কাজ চালাবে। কী দরকার সরকারি কৃষি দপ্তর ও বাণিজ্য দপ্তরের? খনি ইজারা দেওয়া, রেলগাড়ি চালানো, খাল কাটা, রাস্তাঘাট ও সেতু নির্মাণ ইত্যাদি সব আসবে জনসভার এক্তিয়ারে। এ সকল ব্যবসায়ের ও জনহিতের কাজ সরকারের হাতে থাকা মানে কতগুলো ঠিকাদার, সুদখোর ও ফক্কাবাজের পকেটে টাকা ঢালা যে টাকা খেটে খাওয়া মজুরের পাওনা।
জনশিক্ষা বিভাগে শিক্ষকরা নির্বাচিত ও নিযুক্ত হবে পৌরসভা বা অঞ্চল সভা থেকে। ডিগ্রি দেবে বিশ্ববিদ্যালয়। যেমন সেনাবিভাগে রেওয়াজ আছে তেমন। শিক্ষা বিভাগেও যোগ্যতা হবে উন্নতির সোপান। নিচের ক্লাসে পড়িয়ে কৃতিত্ব দেখাতে পারলে তবে শিক্ষক কলেজে ও ইউনিভার্সিটিতে অধ্যাপনা করবার সুযোগ পাবে। অর্থদপ্তরটিকে লোকায়ত্ত করার যুক্তি আরো জোরাল। যে কোন কাজ চালাতে হলে টাকার দরকার এবং টাকা যোগায় করদাতা। যারা টাকা দেয় তাদের হাতেই জমাখরচ থাকা উচিত, যারা টাকা ওড়ায় তাদের হাতে নয়। অর্থাৎ আয়ব্যয়ের নীতি ঠিক করবে দেশ, সরকার নয়। জনতার অর্থভাণ্ডার থেকে রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব সরিয়ে দিলে অপচয়, ঘাটতি এবং দুর্নীতি অনেক কমে যাবে।
জনস্বার্থের কাজগুলি পৃথকভাবে সংগঠিত হবার পর তাদের নির্বাচিত প্রধানরা এক যুক্তসভায় মিলিত হবে। এই যুক্তসভা রাষ্ট্রসভার জায়গা নেবে। এর কাজ হবে বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে যোগাযোগ ও সহযোগ রক্ষা করা। এর ওপর গোটা দেশের নির্বাচিত একটি জাতীয় সভাও থাকতে পারে- যার কাজ হবে আইন প্রণয়ন, হিসাব পরীক্ষা, আন্তর্বিভাগীয় বিবাদের নিষ্পত্তি। এই ব্যবস্থায় একদিকে যেমন আছে স্বাধীনতা ও লোকায়ত্ত সংগঠন অন্য দিকে তেমন আছে দায়িত্বশীলতা ও কেন্দ্রীকরণ। জনতার স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থনে এই বিধান হবে রাষ্ট্র বিধানের চেয়ে শক্তিশালী।
ফেডারেশন বা যুক্তকরণের নীতির ওপর নির্মিত এই হল প্রদঁর নিরাজ সমাজের স্বপ্নসৌধ। ছোট ছোট আঞ্চলিক কেন্দ্রের স্বেচ্ছাকৃত সংযোজনে গাঁথা হবে বৃহত্তর কেন্দ্র- সৃদৃঢ় লোকভিত্তির ওপর দাঁড়াবে সমাজ ব্যবস্থার শীর্ষচূড়া। ফরাসী বিপ্লবের (১৭৮৯) পুরোধা জিরোঁদ্য দলের কাছ থেকে পাওয়া এই বিকেন্দ্রন ও স্বায়ত্তশাসন পরিকল্পনাকে প্রুদঁ একটি নিঃশাসন নিরাজ সমাজের চেহারা দিলেন। (জিরোদ্য দলের চিন্তানায়ক ভার্জিনো ও ব্রিসো এই পরিকল্পনার স্রষ্টা। এরা নৈরাজ্যবাদী ছিলেন না। ব্রিসো তার “রেশের্শে ফিলজফিক স্যুর ল ব্রোয়া দ্য প্রপ্রিয়েতে দাঁ লা নাত্যুর” নামক পুস্তকে সম্পত্তিকে চৌর্য বলে অভিহিত করেছেন- যে কথাটা প্রদঁর কলমে এসে চিরস্মরণীয় হল। (লেকি: ডেমোক্রাসি এন্ড লিবার্টি, খণ্ড য, সোস্যালিজম।)) এই রূপায়ণকে আশ্রয় করে অগ্রসর হল উনিশ শতকের নৈরাজ্যবাদ।
চার্চের বিরোধিতা
ফয়েরব্যাক প্রমুখ হেগেলের জার্মান শিষ্যদের মত প্রদঁঁ চার্চকেও আক্রমণ করলেন। তিনি চাইলেন ঐশ্বরিক নয়, মানবিক ধর্ম ও নীতিশাস্ত্র। বেসাঁসর কার্ডিন্যাল আর্কবিশপের উদ্দেশে লেখা “বিপ্লব ও চার্চের ন্যায়নীতি প্রসঙ্গে” বইতে তিনি চার্চকে দাসত্বের শিক্ষাগার বলে ধিক্কার দিলেন। পৃথিবীতে ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা করা দূরে থাকুক, ধর্ম এক তুরীয় আদর্শবাদের নামে ধনের যারা স্রষ্টা তাদের অন্যায়ভাবে বঞ্চিত করে এসেছে। পাপের আতঙ্কে খ্রীষ্টানরা মানব জীবনকে ভেবেছে অশুচি, সহজ প্রবৃত্তিকে তারা দমন করেছে, শ্রমকে তারা বিধাতার অভিশাপ বলে অপমান করেছে। “আমি ঈশ্বরে বিশ্বাস হারিয়েছি এবং বিশ্বাস ফিরে পেয়েছি মানুষে।” খ্রীষ্টানদের ধর্ম “জনতার দারিদ্র্য, লোকের হতাশা এবং দাসদের অবনতির পরিচয়।” “খ্রীষ্টান ধর্মের যুগ মানবজাতির পতনের যুগ।” খ্রীষ্টানদের সন্ন্যাসবাদ ও যৌন দমন নারীর অমর্যাদা করেছে, বিবাহকে যথাযোগ্য সম্মান দেয় নি। খ্রীষ্টান ধর্মের দার্শনিক দোসর হল পরমাদ্বৈতবাদ। (এই পরামাদ্বৈতবাদের সর্বশ্রেষ্ঠ দার্শনিক পঁদর গুরু হেগেল।) প্রদঁ তার বইয়ের তৃতীয় খণ্ডে এক অধ্যায় জুড়ে এর অপপ্রভাবের বর্ণনা দিয়েছেন।
এতদিন সমাজ নৈতিক প্রেরণা পেয়েছে লোকোত্তর বাণী ও আধ্যাত্মিক তত্ত্ব থেকে। ফরাসী বিপ্লব এই বুজরুকির মুখোশ খুলে দিয়েছে। “ভালো ও মন্দ, যার পার্থক্য আমরা আগে চলতি ছকে ফেলিয়া স্থির করিতাম, এখন তা অস্পষ্ট ও নিরাকার, দুটা বাঁধাধরা বুলি বই আর কিছু নয়। অধিকার, কর্তব্য, নীতিজ্ঞান, ধর্ম ইত্যাদি যার কথা প্রার্থনাসভায় ও বিদ্যালয়ে ফলাও করে বলা হয়, সেগুলির এখন কাজ নিরালম্ব বাক্যজাল বিস্তার, অসার কল্পনাবিলাস এবং প্রমাণহীন সংস্কারকে আবরণ করা।” (দ্য লা জুসতিস, খণ্ড ১, ৭০ পৃষ্ঠা।) প্রদঁ ধর্মীয় অতীন্দ্রিয়তা থেকে মুক্ত এক লৌকিক নীতিমানের সন্ধান করছিলেন। তিনি এর উৎস খুঁজে পেলেন বিপ্লবের দেওয়া সামাজিক ন্যায়নীতির মধ্যে। ফরাসী বিপ্লব (১৭৮৯) মানুষকে তার মর্যাদা ফিরিয়ে দিয়েছে- এক নতুন ন্যায়ের বিধান এনেছে যা মানবমূল্যে অধিষ্ঠিত। এর ইঙ্গিতকে অনুসরণ করে সমাজের সকল ক্ষেত্রে আমাদের এই মানবিক নীতিমানকে প্রবর্তন করতে হবে।
পরিবর্তনের পথ হলো প্রজ্ঞা
প্রদঁর স্বপ্নরাজ্যে যে যার খুশিমত কাজ বেছে নেবে। বাজারে অবাধ বিনিময় চলবে- বিনা লাভে। কাজের পরিমাণ হবে বিনিময়ের হার। সমান পরিশ্রমের মাল সমানে সমানে বিনিময় হবে। যেখানে যে পণ্যের দরকার সেখানে সে পণ্য অবাধে চলাচল করবে, চাহিদা ও সরবরাহ সমান হবে। উৎপাদক- গোষ্ঠীগুলি সমস্বার্থে মিলিত হবে, বিশেষজ্ঞ নির্বাচন করে তাদের দিয়ে আন্তর্গোষ্ঠিক কাজ চালাবে। সরকারি শাসন হবে অবান্তর। রাষ্ট্রীয় জীবন অর্থনৈতিক জীবনে মিশে যাবে। ধর্মীয় ব্যাপার লোকায়ত ব্যাপার থেকে পৃথক থাকবে। সমাজ নিজের চলৎশক্তিতে চলবে, সেনাবল বিচারশালা ও আমলাতন্ত্র দিয়ে তাকে চালাতে হবে না।
কেমন করে এমন আমূল পরিবর্তন সম্ভব হবে? ধাপে ধাপে ধীরে ধীরে আসবে পরিবর্তন। জোর জবরদস্তি করে, হিংসাত্মক কাজের দ্বারা আচমকা সমাজের চেহারা বদলে দেওয়া যায় না। এই পরিবর্তন সাধনেই বিপ্লবের সার্থকতা, শুধু রক্তগঙ্গা বওয়ালে বিপ্লব হয় না। “বিপ্লব হলো জৈবশক্তির বিচ্ছুরণ। এটি সমাজের অন্তঃস্থল থেকে বহু মানুষদের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়। স্বতঃস্ফূর্ত, শান্তিপূর্ণ এবং ক্রমবর্ধমান হলে তবেই এটি সমর্থনযোগ্য। জোর করে বিপ্লব ঘটানো যেমন জুলুমবাজি, তেমনই জোর করে বিপ্লব দমন করাও জুলুমবাজি।” (কফেসিয়, ৬১ পৃষ্ঠা।)
গডউইনের মত প্রদঁরও বিশ্বাস ছিল যে ইতরজনের মনে বুদ্ধির আলো জ্বলে উঠলে আপনিই পরিবর্তন আসবে, বিপ্লবের ভার তারা নিজ হাতে নেবে। “সমাজ ও প্রকৃতি যে সকল নিয়মে পরিচালিত হয়, যেগুলি অনিবার্য ও অবধার্য, প্রজ্ঞা অভিজ্ঞতার সাহায্যে সেই নিয়মের স্বরূপ আমাদের সামনে মেলে ধরে। এই নিয়ম মানুষ তৈরি করে না, এবং এই নিয়ম তার নির্দেশে সমাজে আরোপিত হয়নি।” (ইদে জেনেরাল, ২৮১ পৃষ্ঠা।) সুতরাং প্রজ্ঞানের দুর্বার গতিকে রুখবার সাধ্য কোন সরকারের নেই। মানুষ যতই বুদ্ধির বলে সমাজের নিয়মগুলো আয়ত্ত করতে পারে ততই সে এই নিয়ম খাটিয়ে স্বাধীনতার পথে অগ্রসর হয়। বুদ্ধির বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে সমাজ প্রভুতন্ত্রকে ছাড়িয়ে নিরাজ মুক্তির দিকে এগিয়ে যায়। সরকারের আসনে বসে প্রজ্ঞান তার আধিপত্য নিয়ে।
“যে কোনো সমাজে মানুষের উপর মানুষের কর্তৃত্ব সেই সমাজের বিচারবুদ্ধির স্তরের বিপরীত অনুপাতে ওঠানামা করে।… ঠিক যেমন ন্যায়ের নিশ্চিত অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে বলপ্রয়োগ ও প্রতারণার অধিকার পিছিয়ে যায় এবং অবশেষে সমাজসাম্যে বিলীন হয়, তেমনি মানুষের খেয়ালের রাজত্ব প্রজ্ঞানের রাজত্বকে পথ ছেড়ে দেয়।… মানুষ যেমন ন্যায়ের সন্ধান করে সাম্যে, তেমনি সমাজ শৃঙ্খলা খোঁজে নৈরাজ্যে।” (প্রপ্রিয়েতে? ৫, ২২।)
সমাজ শিশু অবস্থায় ছিল প্রভুনির্ভর, প্রাপ্ত বয়সে হবে আত্মনির্ভর। সকলের মধ্যে বুদ্ধির বিকাশ হবার পরও কিছু সমাজবিরোধী লোক থাকতে পারে। তাদের শাসন করবে জনমত। আবার চুক্তি দ্বারা পরস্পরের সম্বন্ধ নিয়ন্ত্রিত হবে এবং চুক্তিভঙ্গের অপরাধের জন্যে নিয়ম মত শাস্তি পেতে হবে। “চুক্তিবদ্ধ হয়ে তুমি স্বাধীন মানুষের সমাজের সদস্য হও। তোমার বা তাদের যে কোনো পক্ষ চুক্তি ভঙ্গ করলে, সে অপরের কাছে দায়ী হবে, এবং এই দায়ের পরিণাম নির্বাসন বা মৃত্যুও হতে পারে।” (ইদে জেনেরাল, ৩৪৩ পৃষ্ঠা।) রাষ্ট্রবিজ্ঞানের এই লক্ষ্য- প্রভুসমাজের স্থানে নিরাজ সমাজের অবতারণা। সুন্দর একটি সংবিধান রচনা করে রাজশক্তি ও ব্যক্তি-অধিকারের মধ্যে গণ্ডি টেনে দেওয়া, রাষ্ট্রের অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলির মধ্যে রাষ্ট্রকৃত্য ভাগ করে দেওয়া, এ কাজ নয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞান মুক্তির বিজ্ঞান, শাসনবিজ্ঞান দাসত্বের বিজ্ঞান, তাকে যে নাম দিয়েই ঢাকবার চেষ্টা কর না কেন। “শাসনহীন শৃঙ্খলার মধ্যে সমাজের চরম বিকাশ।”
প্রদঁর মূল্যায়ন
গডউইন অরণ্যে রোদন করে গিয়েছিলেন, প্রুদঁ বিফল সংগ্রামে শক্তিপাত করে গেলেন। রাষ্ট্রের বিশাল ইমারত থেকে একটি ইটের টুকরাও তিনি খসাতে পারেন নি। কালধর্ম ছিল তার বিপক্ষে। সে যুগের প্রচণ্ড বিপ্লবী উচ্ছ্বাসের সঙ্গে তিনি তাল রাখতে পারেন নি। শ্রেণীসংগ্রাম, জাতিবিদ্রোহ চমক লাগানো রোমাঞ্চকর ঘাত-প্রতিঘাত, এতে তার কোনো নেশা ছিল না। অথচ সে যুগের আশা ভরসা এসবের ভেতর দিয়েই ফুটে উঠেছে। এদিক দিয়ে প্রদঁর বাস্তব জ্ঞানের অভাব ছিল। “অর্থনৈতিক দ্বন্দ্ব”, যে বইয়ের বিকল্প নাম দিয়েছিলেন তিনি “দারিদ্র্যের দর্শন” তাতে তিনি দারিদ্র্য সমস্যার সমাধান করতে চেয়েছিলেন সমাজের ও উৎপাদনের দ্বান্দ্বিক শক্তিগুলির সামঞ্জস্য করে। এই তত্ত্বকথাটিকে তিনি বাস্তব আকার দিতে পারেন নি, আদর্শের অনুগামী প্রত্যক্ষ কর্মপদ্ধতি দিতে পারেন নি। এই দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে কার্ল মার্কস্ তার পুস্তকের কঠোর সমালোচনা করলেন। প্রদঁঁর “দর্শনের দারিদ্র্য” তার অমূল্য তত্ত্ব নিয়ে বিস্মৃতির গর্ভে ডুবে গেল, মার্কস্-এর “দারিদ্র্যের দর্শন” তার নিষ্ঠুর শ্লেষের ধারে স্মরণীয় হয়ে রইল।
মার্কস্-এর মত প্রদঁ একান্তভাবে বিশ্বাস করতেন যে ধনিকশ্রেণীর দিন ফুরিয়ে এসেছে। সংখ্যায়, কীর্তিতে, প্রতিভায়, সব দিক দিয়ে এরা ক্ষয়িষ্ণু। এ বিশ্বাস যে কত ভ্রান্ত তা পরবর্তী একশ বছর ধরে প্রমাণিত হয়েছে। বিজ্ঞান ও যন্ত্রশিল্প কী দ্রুতগতিতে বুর্জোয়াদের নেতৃত্বে এগিয়ে চলেছে, এই প্রগতির যারা বাহক তাদের সামনে যে কত সম্ভাবনা, গডউইনের মতো প্রদঁঁও ছিলেন এ বিষয়ে অন্ধ। উৎপাদক শ্রেণীর প্রতি দরদে তাদের বাস্তব দৃষ্টি আচ্ছন্ন হয়ে গিয়েছিল। সাম্যবাদী ও প্রত্যক্ষবাদী বা পজিটিভিস্টরা ঠিকই বুঝেছিলেন যে বিজ্ঞান ও যন্ত্রশিল্প সমাজকে কেন্দ্রায়িত কর্তৃত্বের আওতায় নিয়ে যাচ্ছে। প্রদঁর ভরসা ছিল উৎপাদকরা সম্মিলিত হলে বৈজ্ঞানিক প্রণালী আয়ত্ত করতে পারবে। কেমন করে আয়ত্ত করবে, কেমন করে উৎপাদনে বিজ্ঞানকে প্রয়োগ করবে, বলপ্রয়োগ ছাড়া কি উপায়ে মূলধন ও যন্ত্র তাদের হাতে আসবে এ সম্বন্ধে তার কোন কার্যকরী ধারণা ছিল না। শিল্পযুগের উৎপাদনে যে বিপুল মূলধনের প্রয়োজন তা যোগানো বিনিময় ব্যাঙ্ক বা সমবায় ব্যাঙ্কের সাধ্য ছিল না। প্রদঁর যুগটা ছিল লড়াইয়ের যুগ, লড়াই না করে কোনো পাওনা আদায় হওয়া ছিল অসম্ভব। প্রুদঁ লড়াইকে এড়িয়ে ভাবনার পরিবর্তনের অপেক্ষায় থাকতে চেয়েছিলেন। সঙ্কটের সময়ে বসে থাকলে তলিয়ে যেতে হয়। মধ্য উনিশ শতকের প্রচণ্ড রাষ্ট্রবিপ্লবের ঝাপটায় প্রদঁও তলিয়ে গেছেন।
গডউইন ও প্রদঁর মূল্যবিচারে সমাজ ও রাষ্ট্রের মধ্যে দুস্তর ব্যবধান। সমাজ নিষ্পাপ, রাষ্ট্র যত নষ্টের মূল। প্রদঁ রাষ্ট্র ভেঙে দিয়ে সমাজকে আত্মনির্ভর করতে চেয়েছেন, ঊর্ধ্বতন কাজ চালাবার জন্যে গণভোটে নির্বাচন ও প্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থা আনতে চেয়েছেন। বণিক সংঘ যেমন গণতান্ত্রিক প্রথায় ব্যবসায়ের স্বার্থ রক্ষা এবং নিজেদের যৌথ কাজকর্ম চালিয়ে যায়, তেমন রাষ্ট্রকৃত্যও লোকায়ত্ত হয়ে স্বাধীন সংঘশক্তি দ্বারা পরিচালিত হবে, তাতে সরকারের দুর্নীতি ও নিপীড়ন বন্ধ হবে- এই ছিল তার ধারণা। রাষ্ট্রের এক্তিয়ারের বাইরে এমন স্বশাসিত জনসংঘ সকল দেশে আছে, সর্বত্র জেলায় জেলাসভার নগরে পৌরসভার শাসন অল্পবিস্তর স্বায়ত্ত। সরকারি বিভাগে যে দুর্নীতি, অপচয় ও অত্যাচার চলে এদের মধ্যে তার ব্যতিক্রম দেখা যায় না। এগুলো গণতান্ত্রিক সরকারের ছোট সংস্করণ। যে দেশে যেমন মানুষ সে দেশে তেমন সরকার, তেমন জনসংঘ, তেমন পৌরসভা। কাঠামো বদলালে মানুষ বদলায় না, প্রশাসনের সংস্কার হয় না। গডউইন ও প্রদঁঁ উভয়ের বিশ্বাস ছিল যে বুদ্ধির বিকাশ হলে সব দোষ শুধরে যাবে। আঠার শতক ও আদি উনিশ শতক প্রজ্ঞান বা এনলাইটেনমেন্টের যুগ। বুদ্ধির ওপর আদর্শবাদীর অসীম নির্ভরতা যুগধর্মের গুণ। বুদ্ধি দিয়ে যে চরিত্র তৈরি হয় না, স্বার্থ ও অধিকারের চেতনা জন্মালেই যে সহযোগবৃত্তি জেগে ওঠে না, বুদ্ধিসর্বস্ব দার্শনিকের পক্ষে তা বোঝা সম্ভব নয়। গডউইন ও প্রুদঁ আদর্শ দিয়েছেন, পথ দেখাননি। তারা বোঝেননি যে মুক্ত শুদ্ধ সমাজগঠনের জন্যে বুদ্ধির অতিরিক্ত আরো কিছু মসলার দরকার।
আদর্শ সমাজবিন্যাস হিসাবে এনার্কি শব্দের প্রয়োগ প্রদঁঁর কলমে প্রথম নয়, তার আগে গডউইন এই শব্দ ব্যবহার করে গেছেন। বরং প্রদঁর এনার্কি একটু ফিকে, গডউইনের মত তিনি আইন ও আইনসভাকে একেবারে খারিজ করতে পারেননি। যে মনমাতানো বুলির জন্যে প্রদঁ অমর হয়ে আছেন- “সম্পত্তি চোরাই মাল” তাও তার মৌলিক নয়, তার মর্মার্থ পূর্বসূরীদের কাছ থেকে পাওয়া। (প্রদঁর আগে ব্রিসো এবং তার আগে এ ধরনের কথা বলে গেছেন নিউ টেস্টামেন্টে সেন্ট জেম্স্ এবং জার্মানীর কৃষক বিদ্রোহের নেতা মুনৎসার)। তবুও নিঃসন্দেহে তিনি আধুনিক নৈরাজ্যবাদের জন্মদাতা। গডউইনের দায় বহন করবার মত দার্শনিক ইংল্যান্ড অথবা ইউরোপে ছিল না। তিনি তার চিন্তাধারার বিস্তার করবার জন্যে কোনো শিষ্য গড়ে যাননি। প্রদঁ এমন একজন লোককে দীক্ষিত করে গেলেন যাঁর কথায় এবং কাজে মানুষকে মাতিয়ে তুলবার শক্তি ছিল। ইনি উনিশ শতকের শ্রেষ্ঠ বিপ্লবী বাকুনিন। মুক্ত নিরাজ সমাজ বহুধা বিস্তৃত ছোট ছোট গ্রামসভা ও পৌরসভার সন্নিবেশে গড়ে উঠবে, এই বীজমন্ত্র তিনি গ্রহণ করলেন। প্রদঁঁর “বিপ্লবের মূল আদর্শ” থেকে তিনি পাতার পর পাতা তার নিজের প্রচার পুস্তিকাগুলিতে আহরণ করেছেন। প্রদঁর আদর্শ তিনি নিয়েছেন; তার নির্ধারিত উপায় তিনি নেননি, শান্তিপূর্ণ নিরামিষ সংগ্রামে তার কোনো বিশ্বাস ছিল না। হেগেলীয় দ্বন্দ্ববাদের পাঠও বাকুনিন পেয়েছিলেন প্রুদঁ ও মার্কস্ থেকে। বাকুনিনের বন্ধু হারৎজেন তার আত্মকথায় কার্ল ভট্-এর একটি গল্প উদ্ধৃত করেছেন। প্রুদঁ ও বাকুনিন হেগেলের ফেনোমেনলজি নিয়ে আলোচনায় বসেছেন। সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হয়ে যায় দেখে ভট্ ক্লান্ত মনে বাড়ি চলে গেলেন। পরদিন সকালে তিনি বাকুনিনের ঘরে এসে দেখেন চিনীর পোড়া ছাইগুলোর পাশে বসে দুই বন্ধু তাদের আলোচনা শেষ করছেন।
হেগেলের দ্বন্দ্ববাদ প্রসঙ্গে মার্কস্ও প্রদঁঁর সংস্পর্শে এসেছিলেন ১৮৪৪ সালে প্যারিসে। আবার এই দ্বন্দ্ববাদ নিয়েই উভয়ের দ্বন্দ্ব শুরু হল। মার্কস্ বলতেন প্রদঁ জার্মান জানতেন না তাই হেগেলের তত্ত্ব তিনি হজম করতে পারেননি। প্রদঁঁকে তিনি পাতি বুর্জোয়া বলে গালাগালি দিলেন। মার্কস্-এর সমালোচনার নমুনা: “তিনি হইতে চান সমন্বয়, হয়েছেন বিভ্রান্তির সমাবেশ। তিনি চান বৈজ্ঞানিক হয়ে বুর্জোয়া ও প্রলিতারিয়দের ঊর্ধ্বে উড়তে, আসলে তিনি ধন ও শ্রম, অর্থনীতি ও সাম্যবাদ উভয়ের মাঝে অবিরাম দোদুল্যমান একজন পাতি বুর্জোয়া (“দর্শনের দারিদ্র্য”)।”
কিন্তু মার্কস্ স্বীকার না করলেও ঐতিহাসিক প্রদঁঁর প্রতি তার দেনার হিসাব ভুলবেন না। যে বই নিয়ে তিনি নিষ্ঠুরভাবে ব্যঙ্গ করেছেন সে বইয়ের তত্ত্ব তিনি ধার করেছেন। অবাধ বাণিজ্যের নামে যে শ্রমিক শোষণ চলেছে, নিজের শ্রমমূল্য লাভ করবার অধিকার যে প্রত্যেকের থাকবে, আর শ্রমমূল্য যে হবে ন্যায্য বিনিময়ের হার এসকল হক কথা মার্কস্-এর আগে শুনিয়েছেন প্রদঁ, যা “ক্যাপিট্যাল”-এর পাতায় পাতায় বহু তথ্য সম্ভারে বিস্তারিত।
প্রদঁর মৃত্যুর কিছু আগে প্যারিসের ষাটজন শ্রমিক কর্মী প্রজাতন্ত্রী দল থেকে বেরিয়ে এসে একটা ইস্তাহার প্রচার করে। প্রদঁ দেখলেন যে শ্রমিকশক্তি এতদিন বুর্জোয়া নেতৃত্বের পেছনে পেছনে চলেছে, এবার তাদের চৈতন্য হয়েছে, এবার দেখা দিয়েছে যথার্থ প্রলিতারিয় নেতৃত্ব। তার শেষ গ্রন্থ “শ্রমিক শ্রেণীর রাষ্ট্রনৈতিক শক্তি” এদের লক্ষ্য করে লেখা। প্যারিসের শ্রমিকদের সিদ্ধান্তকে তিনি ‘উনিশ শতকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা’ বলে স্বাগত জানালেন। “শ্রমিক শ্রেণীর মধ্যে বিদগ্ধ মনের অভাব নেই, এবং সেখানে যথেষ্টসংখ্যক মানুষ আছেন যারা নেতৃত্ব নিতে পারেন… এতদিন যেসব উকিল, সাংবাদিক, লেখক, চক্রান্তকারী ও সুবিধাবাদী তাদের ভোট নিয়ে এসেছেন, তাদের তুলনায় এরা বিশগুণ যোগ্য এবং জনসাধারণের প্রতিনিধিত্ব করার উপযুক্ত।”
শ্রমিক আন্দোলনের ওপর প্রদঁঁর প্রভাব এই বই থেকে বর্তিয়েছে। শ্রমিক আন্তর্জাতিকের অধিবেশনে ফরাসী শ্রমিক প্রতিনিধিরা সরকারি হস্তক্ষেপ ও প্রলিতারিয় একনায়কত্বের বিরোধিতা করল, বিনা সুদে ধার ও সমশ্রমমূল্যের হারে বিনিময় প্রথার দাবি পেশ করল। বাকুনিনের বহিষ্কারের পর আন্তর্জাতিক থেকে প্রদঁর ভাবধারাও অপসৃত হল। শতাব্দীর শেষে যখন ফার্নাদ পেলুতিয়ে ও জর্জ সরেল শ্রমিকদের নিয়ে সিন্ডিক্যালিজম-এর মতবাদ খাড়া করলেন এবং সমাজবাদীদের সঙ্গে সংস্রব ত্যাগ করলেন তখন শ্রমিকশ্রেণীকে বুর্জোয়াদের প্রভাব থেকে মুক্ত করবার কাজে তারা প্রদঁর যুক্তিরই শরণাপন্ন হয়েছিলেন।
তথ্যসূত্র –
- নৈরাজ্যবাদ, ডঃ অতীন্দ্রনাথ বসু, হাওলাদার প্রকাশনী, ২০১৭
- অনেক তথ্যসূত্র লেখার মধ্যেই রয়েছে
Leave a Reply