কেন অনেকের জ্যোতিষীর কথাকে সঠিক বা ফলে যায় বলে মনে হয়?

জ্যোতিষে বিশ্বাসের পেছনে অনেক ধরনের কগনিটিভ বায়াস (cognitive bias) কাজ করে, যা মানুষের চিন্তাধারাকে প্রভাবিত করে এবং তাদের যুক্তি ও বাস্তবতা বিবেচনায় বাধা দেয়। এই বায়াসগুলো ব্যক্তির মানসিক প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে কাজ করে, যা বিভিন্ন পরিস্থিতিতে ভুল সিদ্ধান্ত বা ধারনা তৈরি করতে পারে। নিচে এই বায়াসগুলো আরও বিস্তৃতভাবে ব্যাখ্যা করা হলো:

১. কনফার্মেশন বায়াস (Confirmation Bias)

বর্ণনা: কনফার্মেশন বায়াস হলো মানুষের মানসিক প্রবণতা, যেখানে তারা নিজের মতামত, বিশ্বাস বা ধারণার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ তথ্য খুঁজে বেড়ায় এবং সেই তথ্যগুলোকেই প্রাধান্য দেয়। এমনকি বিরোধী তথ্য পাওয়া গেলে তা উপেক্ষা করে। এটি মানুষের মানসিক সংকীর্ণতা বাড়াতে সহায়তা করে, কারণ তারা নতুন ও বিপরীতমুখী তথ্যকে অবচেতনভাবে এড়িয়ে যায়। ফলে, ব্যক্তিরা তাদের নিজস্ব ধারণাগুলোকে আরও শক্তিশালী মনে করে এবং পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে না।

উদাহরণ:

  • জ্যোতিষী যদি বলেন, “আপনার জীবনে কোনো বড় পরিবর্তন ঘটবে,” এবং আপনার জীবনে কোনো ধরনের পরিবর্তন ঘটে, তাহলে আপনি বিশ্বাস করতে পারেন যে, জ্যোতিষী সঠিক ছিলেন। তবে, এই ধরনের পরিবর্তন প্রায়ই ঘটে এবং এটি স্বাভাবিক জীবনের একটি অংশ। কিন্তু আপনি সেই পরিবর্তনের সাথে জ্যোতিষীর কথাকে মিলিয়ে দেখতে পছন্দ করবেন।
  • যদি জ্যোতিষী বলেন, “আপনার স্বাস্থ্য সম্পর্কে সতর্ক থাকতে হবে,” এবং পরবর্তীতে আপনি কোনো সাধারণ সর্দি-কাশি বা রোগে আক্রান্ত হন, তাহলে আপনি মনে করতে পারেন যে জ্যোতিষী সঠিকভাবে ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন, যদিও এরকম ঘটনা স্বাভাবিকভাবে ঘটে।

২. বার্নাম এফেক্ট (Barnum Effect)

বর্ণনা: বার্নাম এফেক্ট একটি মনস্তাত্ত্বিক প্রক্রিয়া যেখানে মানুষ এমন অস্পষ্ট এবং সাধারণ বিবরণগুলোকেও নিজের সাথে সম্পর্কিত মনে করে, যা অনেকের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হতে পারে। এই এফেক্টের কারণে মানুষ জ্যোতিষীদের দেওয়া ভবিষ্যদ্বাণীগুলোকে ব্যক্তিগত বলে মনে করে এবং তাদের জীবনযাত্রায় তা প্রযোজ্য মনে করে। জ্যোতিষীরা এই প্রক্রিয়াটি ব্যবহার করে যখন তারা অস্পষ্ট ও সাধারণ ভাষায় ভবিষ্যদ্বাণী করে, যাতে অনেকেই তাদের কথার সাথে মিল খুঁজে পায়।

উদাহরণ:

  • জ্যোতিষীরা প্রায়শই বলেন, “আপনি মাঝে মাঝে নিজের সিদ্ধান্ত নিয়ে দ্বিধায় ভোগেন,” যা প্রায় সবার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হতে পারে। অধিকাংশ মানুষই জীবনের বিভিন্ন মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নিয়ে দ্বিধায় পড়ে। তাই এই ধরনের কথা শুনলে মনে হয় জ্যোতিষী আমাদের মনস্তাত্ত্বিক অবস্থাকে বুঝতে পারছেন।
  • আরেকটি উদাহরণ হতে পারে, “আপনার মধ্যে প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে, কিন্তু আপনি মাঝে মাঝে আপনার ক্ষমতাগুলো নিয়ে সন্দিহান।” এই ধরনের বক্তব্য প্রায় সব মানুষের জন্য সত্য হতে পারে, কারণ আমরা সকলেই নিজেদের ক্ষমতা ও সম্ভাবনা নিয়ে মাঝে মাঝে সন্দিহান হই।

৩. রেট্রোস্পেক্টিভ বায়াস (Retrospective Bias)

বর্ণনা: রেট্রোস্পেক্টিভ বায়াস হলো অতীতের ঘটনাগুলোকে বর্তমান তথ্যের আলোকে মূল্যায়ন করা এবং সেই ঘটনাগুলোর সাথে বর্তমানের সামঞ্জস্য খুঁজে বের করা। এই বায়াসের কারণে আমরা অতীতের ঘটনাগুলোকে বর্তমানের তথ্যের সাথে সংযুক্ত করার চেষ্টা করি এবং মনে করি যে, অতীতের ঘটনাগুলো পূর্বেই নির্ধারিত ছিল। এটি আমাদের অতীতের অভিজ্ঞতাকে বর্তমানের বাস্তবতার সাথে মেলাতে বাধ্য করে।

উদাহরণ:

  • যদি কোনো জ্যোতিষী বলেন, “আপনার ক্যারিয়ারে বড় পরিবর্তন আসছে,” এবং আপনি কয়েক মাস পরে চাকরি পরিবর্তন করেন বা নতুন কোনো পদে উন্নীত হন, তাহলে আপনি মনে করতে পারেন যে এটি সেই ভবিষ্যদ্বাণীর কারণে ঘটেছে। কিন্তু বাস্তবে ক্যারিয়ারে পরিবর্তন একটি সাধারণ প্রক্রিয়া, যা অনেক সময় মানুষের প্রচেষ্টা ও পরিস্থিতির ফলাফল।
  • জ্যোতিষী যদি বলেন, “আপনি শীঘ্রই ভ্রমণে যাবেন,” এবং আপনি কোনো সময় ভ্রমণে গেলে মনে হতে পারে যে জ্যোতিষীর কথাই সত্য হয়েছে, যদিও এটি হতে পারে কাকতালীয়।

৪. অ্যাভেইলেবিলিটি হিউরিস্টিক (Availability Heuristic)

বর্ণনা: অ্যাভেইলেবিলিটি হিউরিস্টিক একটি মানসিক প্রবণতা, যেখানে আমরা সেই তথ্যগুলোকে বেশি বিশ্বাসযোগ্য মনে করি যা আমাদের কাছে সহজলভ্য বা সম্প্রতি পাওয়া গেছে। আমরা প্রায়ই নতুন তথ্য বা অভিজ্ঞতাকে কম গুরুত্ব দিই এবং পূর্বের সহজলভ্য তথ্যের ওপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি। এটি আমাদের চিন্তাধারাকে প্রভাবিত করে এবং নতুন বা ভিন্নমুখী তথ্য গ্রহণে বাধা দেয়।

উদাহরণ:

  • যদি কোনো জ্যোতিষী বলে যে আপনি আগামী মাসে ভালো অর্থ উপার্জন করবেন, এবং আপনি কোনো কারণে অর্থ উপার্জন করেন (যেমন বোনাস বা অতিরিক্ত কাজের জন্য পেমেন্ট), তাহলে এটি আপনার মনে থাকবে এবং আপনি ভাবতে পারেন যে জ্যোতিষী সঠিক ছিলেন।
  • যদি কোনো জ্যোতিষী বলেন, “আপনার সম্পর্কের ক্ষেত্রে কিছু পরিবর্তন আসতে পারে,” এবং আপনার সম্পর্কের মধ্যে কোনো ধরনের পরিবর্তন ঘটে (যেমন সম্পর্কের উন্নতি বা নতুন বন্ধুত্ব), তখন আপনি সেই পরিবর্তনকে জ্যোতিষীর কথার সাথে মিলিয়ে দেখতে পারেন।

৫. ইল্যুশরি করেলেশন (Illusory Correlation)

বর্ণনা: ইল্যুশরি করেলেশন হলো মানসিক প্রক্রিয়া, যেখানে আমরা ভুল করে দুটি ঘটনাকে পরস্পরের সাথে সম্পর্কিত বলে মনে করি। এটি ঘটে যখন দুটি ঘটনা একসাথে ঘটে এবং আমরা মনে করি যে একটি ঘটনার কারণ হলো অন্যটি। এই বায়াসের কারণে আমরা ভুলভাবে ঘটনা বা পরিস্থিতির মধ্যে সম্পর্ক খুঁজে পাই, যা বাস্তবে প্রমাণিত হয় না।

উদাহরণ:

  • যদি জ্যোতিষী বলেন, “আপনার জীবনে সম্পর্কের সমস্যা হবে,” এবং পরবর্তীতে যদি আপনার প্রেমজ জীবনে কোনো সমস্যা হয়, তাহলে আপনি ভেবে নিতে পারেন যে এটি সেই ভবিষ্যদ্বাণীর ফলে ঘটেছে। যদিও বাস্তবে এই ধরনের ঘটনা প্রায়ই ঘটে এবং জ্যোতিষীর ভবিষ্যদ্বাণীর সাথে এর কোনো সম্পর্ক নেই।
  • যদি জ্যোতিষী বলেন, “আপনার স্বাস্থ্য নিয়ে কিছু সমস্যা হতে পারে,” এবং আপনি সাধারণ কোনো অসুস্থতায় ভোগেন, তাহলে আপনি এই অসুস্থতাকে জ্যোতিষীর ভবিষ্যদ্বাণীর সাথে যুক্ত করতে পারেন।

৬. সেলফ-ফুলফিলিং প্রফেসি (Self-fulfilling Prophecy)

বর্ণনা: সেলফ-ফুলফিলিং প্রফেসি হলো এমন একটি প্রক্রিয়া, যেখানে কোনো ভবিষ্যদ্বাণী বা প্রত্যাশা মানুষের আচরণ ও চিন্তাধারাকে প্রভাবিত করে এবং সেই কারণে ভবিষ্যদ্বাণী সত্যি হয়ে যায়। এটি ঘটার পেছনে কারণ হলো, মানুষ যখন কোনো ভবিষ্যদ্বাণী বিশ্বাস করে, তখন তাদের আচরণ সেই বিশ্বাসের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয় এবং সেই অনুযায়ী কার্যক্রম পরিচালিত হয়।

উদাহরণ:

  • যদি জ্যোতিষী বলেন, “আপনি সফল হবেন,” এবং আপনি সেই বিশ্বাসে অনুপ্রাণিত হয়ে কঠোর পরিশ্রম করেন, তবে আপনার সফলতা অর্জিত হতে পারে, যা ভবিষ্যদ্বাণীকে সত্য প্রমাণিত করবে। যদিও আপনার পরিশ্রমই এই সফলতার মূল কারণ।
  • জ্যোতিষী যদি বলেন, “আপনার স্বাস্থ্য ভালো থাকবে,” এবং আপনি সেই বিশ্বাসে সুস্থ জীবনযাপন শুরু করেন, তবে আপনার স্বাস্থ্য সত্যিই ভালো হতে পারে, যা সেই ভবিষ্যদ্বাণীকে সঠিক প্রমাণিত করবে।

উপসংহার

এই কগনিটিভ বায়াসগুলো জ্যোতিষবিদ্যা এবং অন্যান্য অনুরূপ পদ্ধতির প্রতি মানুষের বিশ্বাসকে প্রভাবিত করতে সহায়ক হয়। এই বায়াসগুলো প্রায়শই মানুষের মানসিক প্রক্রিয়ায় ঘটে এবং তাদের যুক্তি, বিবেচনা এবং বাস্তবতার বিশ্লেষণে বাধা সৃষ্টি করে। জ্যোতিষবিদ্যায় এসব বায়াস ব্যবহার করে মানুষকে প্রভাবিত করা হয়, যা মানুষের মানসিকতা ও বিশ্বাসকে পরিবর্তন করতে সহায়ক হয়। মানুষের উচিত এই বায়াসগুলো সম্পর্কে সচেতন হওয়া এবং যুক্তিবাদী বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা।

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.