সাইকোলজিকাল প্রোজেকশন ও ফলস কনসেন্সাস এফেক্ট

Table of Contents

সাইকোলজিকাল প্রোজেকশন বা মনস্তাত্ত্বিক প্রক্ষেপন

ভূমিকা

সাইকোলজিকাল প্রোজেকশন বা মনস্তাত্ত্বিক প্রক্ষেপন (psychological projection) হলো একটি প্রতিরক্ষা প্রক্রিয়া বা ডিফেন্স মেকানিজম (defense mechanism), যা “ভেতরের” বিষয়বস্তুকে “বাইরের” অন্যের (Other) থেকে আসা বলে ভুল করে। এটি সহানুভূতির (empathy) ভিত্তি তৈরি করে, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাগুলিকে ব্যবহার করে অন্যের ব্যক্তিগত পৃথিবী বোঝার জন্য। এর ক্ষতিকর রূপগুলিতে, এটি এমন একটি প্রতিরক্ষা প্রক্রিয়া, যেখানে অহং (ego) নিজেকে অস্বীকৃত এবং অত্যন্ত নেতিবাচক অংশগুলি থেকে রক্ষা করতে নিজ অস্তিত্ব অস্বীকার করে এবং অন্যদেরকে দায়ী করে, যা ভুল বোঝাবুঝির জন্ম দেয় এবং ব্যাপকভাবে আন্তঃব্যক্তিক ক্ষতি করে। প্রক্ষেপন বা প্রোজেকশনের মধ্যে দোষ স্থানান্তর (blame shifting) অন্তর্ভুক্ত এবং এটি লজ্জা আরোপণ (shame dumping) হিসেবে প্রকাশিত হতে পারে। প্রক্ষেপনকে অন্তর্জ্ঞানের (introjection) একটি প্রাথমিক পর্ব হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে।

ঐতিহাসিক পূর্বসূরি

প্রক্ষেপন নীতির প্রণয়নের একটি প্রধান পূর্বসূরি ছিলেন জিয়ামবাটিস্তা ভিকো (Giambattista Vico)। ১৮৪১ সালে, লুডউইগ ফয়ারবাখ (Ludwig Feuerbach) প্রথম এনলাইটেনমেন্ট যুগের চিন্তাবিদ ছিলেন, যিনি ধর্মের সমালোচনার জন্য এই ধারণাটি ব্যবহার করেছিলেন।

বাবিলীয় তালমুদে (Babylonian Talmud) (খ্রিস্টাব্দ ৫০০) প্রক্ষেপনের প্রতি মানুষের প্রবণতা উল্লেখ করা হয়েছে এবং এর বিরুদ্ধে সতর্ক করা হয়েছে: “তোমার নিজের যে ত্রুটি রয়েছে তা নিয়ে তোমার প্রতিবেশীকে উপহাস করো না।” নিউ টেস্টামেন্টে (New Testament), যিশু প্রক্ষেপনের বিরুদ্ধে সতর্ক করেছিলেন: “তুমি কেন তোমার ভাইয়ের চোখে করাতের গুঁড়ো দেখছো এবং তোমার নিজের চোখে থাকা মস্ত কাঠের টুকরোটি লক্ষ্য করছো না? তুমি কীভাবে তোমার ভাইকে বলতে পারো, ‘আমি তোমার চোখ থেকে করাতের গুঁড়োটি বের করি,’ যখন পুরো সময় তোমার নিজের চোখে একটি মস্ত কাঠের টুকরো আছে? তুমি ভণ্ড, প্রথমে তোমার চোখ থেকে মস্ত কাঠের টুকরোটি বের করো, তারপর তুমি স্পষ্টভাবে দেখতে পারবে যে কীভাবে তোমার ভাইয়ের চোখ থেকে করাতের গুঁড়োটি সরাতে হবে।”

মনস্তাত্ত্বিক বিকাশ (Psychoanalytic Developments)

প্রক্ষেপন (জার্মান: Projektion) ধারণাটি সিগমুন্ড ফ্রয়েড (Sigmund Freud) তার বন্ধু উইলহেম ফ্লিস (Wilhelm Fliess)-এর কাছে পাঠানো চিঠিগুলিতে প্রথম উল্লেখ করেছিলেন। পরবর্তীতে কার্ল আব্রাহাম (Karl Abraham) এবং আনা ফ্রয়েড (Anna Freud) এই ধারণাটি আরও পরিমার্জিত করেন। ফ্রয়েড মনে করতেন যে প্রক্ষেপনে (projection), চিন্তা, প্রেরণা, আকাঙ্ক্ষা এবং অনুভূতিগুলি, যা একজন ব্যক্তির নিজের বলে মেনে নেওয়া যায় না, বাইরের পৃথিবীতে স্থানান্তরিত হয় এবং অন্য কারও উপর আরোপিত হয়। যা অহং (ego) মেনে নিতে অস্বীকার করে তা পৃথক করা হয় এবং অন্যের মধ্যে স্থাপন করা হয়।

পরবর্তীতে ফ্রয়েড বিশ্বাস করতে শুরু করেন যে প্রক্ষেপন (projection) ইচ্ছাকৃতভাবে ঘটে না, বরং এটি এমন একটি উপাদানকে জোর দিয়ে তুলে ধরে যা ইতিমধ্যেই অন্য ব্যক্তির মধ্যে ছোট আকারে বিদ্যমান। প্রক্ষেপন সনাক্তকরণ (projective identification) এবং প্রকৃত প্রক্ষেপন (projection proper) এর মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। প্রক্ষেপন সনাক্তকরণে, একজন ব্যক্তি তাদের নিজস্ব অবাঞ্ছিত আবেগ বা আকাঙ্ক্ষাগুলি অন্য ব্যক্তির ওপর আরোপ করার পাশাপাশি ওই ব্যক্তিকে তাদের সেই আবেগ বা আকাঙ্ক্ষার সাথে সনাক্তকরণের প্রত্যাশা করে। এটি এমনভাবে কাজ করে যে, প্রকল্পকর্তা এবং যার ওপর প্রকল্প করা হয়েছে উভয়ের মধ্যে একটি সম্পর্ক বা সংযোগ গড়ে ওঠে।

অন্যদিকে, প্রকৃত প্রক্ষেপনে (projection proper), একজন ব্যক্তি তাদের অবাঞ্ছিত আবেগ বা আকাঙ্ক্ষাগুলি অন্যের ওপর স্থানান্তর করে এবং তাদের নিজের সাথে সম্পর্ক সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার করে। এখানে প্রকল্পকর্তা শুধুমাত্র সেই আবেগ বা আকাঙ্ক্ষাকে অস্বীকার করে এবং তা সম্পূর্ণভাবে অন্যের ওপর আরোপিত মনে করে, প্রকল্পিত আবেগের সাথে নিজের কোনো সংযোগ বজায় রাখে না।

মেলানি ক্লেইন (Melanie Klein) প্রক্ষেপনের (projection) কিছু স্বতন্ত্র প্রভাব সম্পর্কে বিশ্বাস পোষণ করতেন। তিনি মনে করতেন যে, একজন ব্যক্তি তার নিজের ভালো গুণাবলী বা দিকগুলি অন্যের ওপর প্রকল্পিত করলে, সেই ব্যক্তি বা বস্তুর অতিরিক্ত আদর্শায়ন (over-idealization) হতে পারে। অর্থাৎ, ভালো দিকগুলির প্রক্ষেপনের মাধ্যমে সেই ব্যক্তি বা বস্তুকে অতিমাত্রায় মহিমান্বিত বা পূজ্য হিসেবে দেখা হতে পারে।

একইভাবে, কেউ যদি নিজের বিবেক (conscience) প্রকল্পিত করে, তবে সেটি হতে পারে তাদের নিজের বিবেকের নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্তি পাওয়ার প্রচেষ্টা। অর্থাৎ, নিজের বিবেকের কঠোরতা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য তা অন্যের ওপর আরোপ করা। এর একটি কম ক্ষতিকর রূপ হলো, এটি বাইরের কর্তৃপক্ষের (authority) সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে সাহায্য করে। অন্য কথায়, বাইরের কোনো নিয়ম বা কর্তৃত্বকে মেনে নিতে, ব্যক্তি তার নিজের বিবেককে বাইরের পরিবেশ বা মানুষের ওপর প্রকল্পিত করতে পারে।

তাত্ত্বিক উদাহরণ (Theoretical Examples)

প্রক্ষেপন (projection) সাধারণত স্বাভাবিক মানুষের মধ্যে ব্যক্তিগত বা রাজনৈতিক সংকটের সময় সামনে আসে এবং এটি প্রায়শই আত্মপ্রেমিক ব্যক্তিত্ব বিকৃতি বা নারসিসিস্টিক পারসোনালিটি ডিজর্ডার (narcissistic personality disorder), সীমান্তবর্তী ব্যক্তিত্ব বিকৃতি বা বর্ডারলাইন পারসোনালিটি ডিজর্ডার (borderline personality disorder) বা প্যারানয়েড ব্যক্তিত্বের মধ্যে পাওয়া যায়।

কার্ল ইয়ুং (Carl Jung) বিশ্বাস করতেন যে পশু আদিরূপ বা শ্যাডো আর্কেটাইপ (Shadow archetype) দ্বারা প্রতিনিধিত্ব করা ব্যক্তিত্বের অগ্রহণযোগ্য অংশগুলি বিশেষভাবে প্রক্ষেপনের জন্ম দিতে পারে, যা ছোট বা বৃহৎ আকারে, এমনকি জাতীয় বা আন্তর্জাতিক স্তরে ঘটতে পারে। মেরি-লুইস ভন ফ্রান্জ (Marie-Louise Von Franz) তার প্রক্ষেপনের দৃষ্টিভঙ্গি প্রসারিত করে বলেছিলেন যে “যেখানেই জানা বাস্তবতা শেষ হয়, যেখানে আমরা অজানাকে স্পর্শ করি, সেখানেই আমরা একটি প্রতীকী চিত্র প্রকল্প করি।”

মনস্তাত্ত্বিক প্রক্ষেপন (psychological projection) ১৬৯২ সালে সালেমের (Salem) আক্রান্ত শিশুদের আচরণ ব্যাখ্যা করার জন্য বশিকরণের (bewitchment) চিকিৎসাগত ব্যাখ্যাগুলির মধ্যে একটি। ১৯৭০ সালে ঐতিহাসিক জন ডেমোস (John Demos) লিখেছিলেন যে আক্রান্ত মেয়েদের দ্বারা প্রদর্শিত বশিকরণের লক্ষণগুলি তাদের দমন করা আগ্রাসনের মনস্তাত্ত্বিক প্রক্ষেপনের কারণে হতে পারে।

বাস্তব উদাহরণসমূহ (Practical Examples)

ভিক্টিম ব্লেইমিং বা ভুক্তভোগীকে দোষারোপ (Victim Blaming): কোন ব্যক্তি অন্য কারো কর্মকাণ্ড বা দুর্ভাগ্যের শিকার হয়েও সমালোচনার মুখোমুখি হতে পারে, যাকে ভিক্টিম ব্লেইমিং বলে। এক্ষেত্রে ধারণা করা হয় যে, ভুক্তভোগী হয়তো অন্য ব্যক্তির শত্রুতা আকর্ষণ করার কারণে দোষী বা তার নিজের দোষেই সে অন্যের শত্রু হয়েছে ও ক্ষতি ডেকে এনেছে। এমন ক্ষেত্রে ব্লেইমার বা দোষ দিচ্ছে যে সেই ব্যক্তির মন (psyche) নিজের দুর্বলতা বা অসহায়তার অভিজ্ঞতাগুলি প্রকল্পিত বা প্রোজেক্ট করে, যাতে তার মধ্যকার সেই দুর্বলতা বা অসহায়তার অনুভূতিগুলি দূর করার যায়, যেটা সে করে ভুক্তভোগীদের প্রতি অবজ্ঞার মাধ্যমে বা দোষারোপের মাধ্যমে। আর এর মধ্য দিয়ে সেই ব্যক্তি নিজের অহং (ego)-এর সাথে সংঘাত থেকে মুক্তি পাওয়ার চেষ্টা করে।

বৈবাহিক অপরাধবোধের প্রক্ষেপন (Projection of Marital Guilt): পার্টনারের প্রতি অবিশ্বস্ততার (infidelity) চিন্তাগুলি আত্মরক্ষার্থে পার্টনারের উপর প্রকল্পিত হতে পারে, যাতে এই চিন্তাগুলির সাথে যুক্ত অপরাধবোধকে অস্বীকার করা যায় বা দোষারোপ করা যায়। উদাহরণস্বরূপ, একজন ব্যক্তি যিনি পরকিয়ায় লিপ্ত, তিনি হয়তো ভয় পান যে তার সঙ্গীও হয়তো পরকিয়ায় লিপ্ত হতে চলেছেন অথবা তিনি তার নির্দোষ সঙ্গীকে ব্যভিচারের জন্য দোষারোপ করতে পারেন।

বুলিং (Bullying): একজন বুলির নিজের দুর্বলতার অনুভূতি বুলিংয়ের লক্ষ্য ব্যক্তির উপর প্রকল্পিত হতে পারে। যদিও একজন বুলির সাধারণত নিন্দামূলক কর্মকাণ্ডগুলি বুলির লক্ষ্য ব্যক্তিদের দিকে পরিচালিত হয়, তবে এমন নেতিবাচকতার প্রকৃত উৎস প্রায়ই বুলির নিজের ব্যক্তিগত অনিরাপত্তা বা দুর্বলতা থেকে আসে। বিরূপ আবেগের এমন আক্রমণাত্মক প্রক্ষেপন আন্তঃব্যক্তিক সম্পর্কের ক্ষুদ্র স্তর থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক রাজনীতি, বা এমনকি আন্তর্জাতিক সশস্ত্র সংঘাত পর্যন্ত যে কোনো স্তরে ঘটতে পারে।

মানুষ প্রেমে পড়লে একে অপরের মন “পড়ার” প্রচেষ্টা (People in Love “Reading” Each Other’s Mind): এটি একটি পদ্ধতিতে নিজেকে অন্যের মধ্যে প্রকল্পিত করার মাধ্যম।

সাধারণ অপরাধবোধের প্রক্ষেপন (Projection of General Guilt): একটি কঠোর বিবেকের (severe conscience) প্রক্ষেপন আরেকটি প্রতিরক্ষা পদ্ধতি, যা মিথ্যা অভিযোগ (ব্যক্তিগত বা রাজনৈতিক) তৈরির সাথে সম্পর্কিত হতে পারে।

আশার প্রক্ষেপন (Projection of Hope): একটি আরও ইতিবাচক দৃষ্টিতে, কখনও কখনও একজন রোগী তার আশার অনুভূতিগুলিকে থেরাপিস্টের উপর প্রকল্পিত করতে পারে।

পাল্টা প্রক্ষেপন (Counter-Projection)

কার্ল ইয়ুং (Carl Jung) লিখেছেন, “যখন একটি বস্তুর উপর কোন গুণাবলী প্রকল্পিত করা হয় এবং তা নিয়ে ব্যক্তি অবগত থাকেননা, তখন সমস্ত প্রক্ষেপন পাল্টা প্রক্ষেপনকে উস্কে দেয়।” অর্থাৎ, প্রাপক যে গুণাবলীর প্রতি অজ্ঞান বা অনবগত, তা প্রক্ষেপক (projector)-এর উপর পাল্টা প্রকল্পিত হবে, যা পারস্পরিক আচরণের একটি রূপকে ত্বরান্বিত করবে।

অন্যরকম ব্যবহারে, হ্যারি স্ট্যাক সুলিভান (Harry Stack Sullivan) পাল্টা প্রক্ষেপনকে থেরাপিউটিক প্রসঙ্গে একটি পদ্ধতি হিসেবে দেখেছিলেন যা একটি মনস্তাত্ত্বিক আঘাতের বাধ্যতামূলক পুনরাবৃত্তি থেকে রক্ষা করার জন্য ব্যবহৃত হয়, মূল আঘাতের কল্পিত অপরাধীর সাথে প্রকল্পিত অবসেশন এবং বর্তমান পরিস্থিতির মধ্যে পার্থক্যকে জোর দেওয়ার মাধ্যমে।

একটি উদাহরণ সাহায্যে পাল্টা প্রক্ষেপন (counter-projection) বুঝতে পারা যায়:

প্রক্ষেপন (Projection): একজন ব্যক্তি, নাম ধরা যাক রাহুল, নিজে খুব নিরাপত্তাহীন এবং অসফল বোধ করেন, কিন্তু তিনি এটা স্বীকার করতে পারেন না। এই মানসিক চাপ থেকে মুক্তি পেতে রাহুল অন্যদের উপর এই ধারণা প্রক্ষেপন করেন এবং বলেন যে তারা সবসময় তাকে দোষারোপ করছে বা তার সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা পোষণ করছে। তিনি সহকর্মী সুমনকে বলছেন যে সে তার উপর বেশি চাপ দিচ্ছে এবং তাকে সফল হতে বাধা দিচ্ছে, যদিও সুমনের এমন কোন উদ্দেশ্য ছিল না।

পাল্টা প্রক্ষেপন (Counter-Projection): সুমন, যিনি প্রকৃতপক্ষে এধরনের নিরাপত্তাহীনতা এবং সামাজিক বিচ্ছিন্নতার সাথে লড়াই করছেন, রাহুলের প্রতিক্রিয়া দেখে তার নিজের নিরাপত্তাহীনতাকে অনুভব করেন। তার অনবগত বা অজ্ঞান মনের অংশে লুকিয়ে থাকা এই ভাবনা উঠে আসে যে মানুষ তাকে কম মূল্যায়ন করছে বা তার সাথে ভালো আচরণ করছে না।

ফলস্বরূপ, সুমন নিজেকে রাহুলের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষা করতে শুরু করেন, মনে করতে থাকেন যে রাহুলই তার পিছনে ষড়যন্ত্র করছেন। সুমনের মনে রাহুলকে তার প্রতি ঈর্ষান্বিত এবং প্রতারণামূলক হিসেবে প্রক্ষেপণ করেন, যদিও রাহুল তার নিজস্ব অনুভূতির সাথে লড়াই করছিল।

এমন পরিস্থিতিতে, পাল্টা প্রক্ষেপন ঘটে যখন সুমন তার নিজের নিরাপত্তাহীনতাকে রাহুলের উপর প্রকল্পিত করেন, এবং দুজনের মধ্যে পারস্পরিক বিশ্বাস এবং বোঝাপড়ার অভাব দেখা দেয়।

থেরাপিউটিক প্রসঙ্গের উদাহরণ: একটি থেরাপিউটিক প্রেক্ষাপটে পাল্টা প্রক্ষেপনের উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে যেখানে একজন থেরাপিস্ট একজন ক্লায়েন্টের মানসিক আঘাতের বাধ্যতামূলক পুনরাবৃত্তি থেকে বাঁচাতে চেষ্টা করছেন:

ধরা যাক, এক ক্লায়েন্ট, নাম সুমন, একটি বিশেষ আঘাতের (trauma) জন্য একজন থেরাপিস্টের কাছে আসেন। থেরাপিস্ট, রাহুল, লক্ষ্য করেন যে সুমন অনেক সময় অনুগ্রহ বা বোঝাপড়ার সুযোগে থেরাপিস্টের কথা অনুযায়ী চলেন। রাহুল বুঝতে পারেন যে সুমন থেরাপিস্টকে তার জীবনের পুরানো “অপরাধী” হিসেবে দেখতে পারেন, এবং একই সাথে রাহুলকে প্রয়োজনীয় বিশ্বাসের সাথে মানিয়ে নিতে পারেন।

এই পরিস্থিতিতে, রাহুল, তার নিজের সীমাবদ্ধতার মাধ্যমে, সুমনের প্রকল্পিত গুণাবলী বুঝতে পারছেন এবং তাকে সাহায্য করার জন্য সুমনের বর্তমান অবস্থা এবং মূল আঘাতের মধ্যে পার্থক্য তৈরি করতে চেষ্টা করছেন। তিনি সুমনের সাথে পরিষ্কারভাবে কথা বলেন যে তিনি তার প্রকল্পিত অবসেশন এবং বর্তমান পরিস্থিতির মধ্যে পার্থক্য বুঝতে পারেন। এর মাধ্যমে সুমন তার অতীতের আঘাত থেকে পুনরুদ্ধার করতে পারেন এবং থেরাপিস্টের সাহায্যে বর্তমানের বাস্তবতায় স্থিতিশীলতা আনতে পারেন।

এভাবে পাল্টা প্রক্ষেপন থেরাপির ক্ষেত্রে ক্লায়েন্টকে বাস্তব পরিস্থিতিতে ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করতে পারে, যখন থেরাপিস্ট প্রকল্পিত অবসেশন এবং বর্তমান বাস্তবতার মধ্যে পার্থক্যকে জোর দিয়ে দেখতে সাহায্য করেন।

ক্লিনিক্যাল পদ্ধতি (Clinical Approaches)

গর্ডন অলপোর্টের (Gordon Allport) আত্ম-প্রকাশের ধারণার ওপর ভিত্তি করে ব্যক্তিত্ব মূল্যায়নের (personality assessment) জন্য প্রক্ষেপনমূলক কৌশল (projective techniques) তৈরি করা হয়েছে, যার মধ্যে ররশাচ ইঙ্কব্লট (Rorschach ink-blots) এবং থিম্যাটিক অ্যাপারসেপশন টেস্ট (Thematic Apperception Test, TAT) অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।

প্রক্ষেপন একটি দুর্বল বা ভঙ্গুর অহংকে (fragile ego) উদ্বেগ কমাতে সাহায্য করতে পারে, কিন্তু কিছু বিচ্ছিন্নতার (dissociation) বিনিময়ে, যেমন বিভাজিত পরিচয় বিকৃতি বা ডিসোসিয়েটিভ আইডেন্টিটি ডিজর্ডারের (dissociative identity disorder) ক্ষেত্রে। চরম ক্ষেত্রে, একজন ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব গুরুতরভাবে হ্রাস পেতে পারে। এমন ক্ষেত্রে, থেরাপি প্রয়োজন হতে পারে, যেখানে এই ধরনের প্রক্ষেপনগুলিকে “ফিরিয়ে আনার” মাধ্যমে ধীরে ধীরে ব্যক্তিত্ব পুনর্নির্মাণ অন্তর্ভুক্ত থাকবে।

নিয়ন্ত্রিত প্রক্ষেপন (Managed Projection) পদ্ধতি একটি প্রক্ষেপনমূলক কৌশল। এই পদ্ধতির মৌলিক নীতি হলো বিষয়টিকে তার নিজের মৌখিক প্রতিকৃতি যা অন্য ব্যক্তির নামে নামকরণ করা হয়েছে এবং তার কল্পিত বিরোধের একটি প্রতিকৃতি উপস্থাপন করা হয় (V. V. Stolin, 1981)।

এই কৌশলটি মনস্তাত্ত্বিক পরামর্শে (psychological counseling) প্রয়োগের জন্য উপযুক্ত এবং এটি আত্মসম্মানের (self-esteem) রূপ এবং প্রকৃতি সম্পর্কে মূল্যবান তথ্য প্রদান করতে পারে (বোদালেভ, এ Bodalev, A. (2000). General Psychodiagnostics).

সমালোচনা (Criticism)

কিছু গবেষণায় ফ্রয়েডের তত্ত্বের সমালোচনা করা হয়েছে। সামাজিক প্রক্ষেপনের উপর গবেষণা একটি মিথ্যা-সংকল্প প্রভাব বা ফলস কনসেনসাস এফেক্টের (false-consensus effect) অস্তিত্বকে সমর্থন করে, যার মাধ্যমে মানুষ সাধারণত বিশ্বাস করে যে অন্যরা তাদের মতোই, এবং এভাবে তাদের ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্যগুলি অন্যদের ওপর প্রকল্প করে। এটি ভাল এবং খারাপ উভয় বৈশিষ্ট্যের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য; এটি আত্ম বা সেলফের মধ্যে বৈশিষ্ট্যের অস্তিত্ব অস্বীকার করার জন্য একটি প্রতিরক্ষা পদ্ধতি নয়। ডেল এবং সোমার (১৯৯৮) এর একটি রেঞ্জের প্রতিরক্ষা প্রক্রিয়ার জন্য এম্পিরিকাল প্রমাণের একটি গবেষণায় তারা সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে, “মানুষের নিজস্ব খারাপ বৈশিষ্ট্যগুলোকে অন্যদের ওপর প্রকল্প করার প্রতিরক্ষামূলক পদ্ধতির ধারণাটি ভালভাবে সমর্থিত নয়।”

তবে, নিউম্যান, ডাফ এবং বাউমিস্টার (১৯৯৭) প্রতিরক্ষামূলক প্রক্ষেপনের একটি নতুন মডেল প্রস্তাব করেছেন যেখানে রেপ্রেসরের (repressor’s) তাদের অপ্রিয় বৈশিষ্ট্যগুলির চিন্তাভাবনাকে দমন করার প্রচেষ্টা সেই বৈশিষ্ট্য বিভাগগুলিকে (trait categories) অত্যন্ত অ্যাক্সেসযোগ্য করে তোলে – ফলে এগুলি অন্যদের ছাপ (impressions) গঠনের সময় আরও বেশি ব্যবহৃত হয়। প্রক্ষেপনটি তখন প্রকৃত প্রতিরক্ষামূলক প্রক্রিয়ার শুধুমাত্র একটি উপজাত হিসেবে কাজ করে।

ফলস কনসেন্সাস এফেক্ট বা কন্সেন্সাস বায়াস

ভূমিকা

মনোবিজ্ঞানে, ফলস কনসেন্সাস এফেক্ট (false consensus effect) (যা কন্সেন্সাস বায়াস (consensus bias) নামেও পরিচিত) একটি ব্যাপক পরিচিত কগনিটিভ বায়াস যা মানুষকে “তাদের নিজস্ব আচরণগত পছন্দ এবং বিচারকে তুলনামূলকভাবে সাধারণ এবং বিদ্যমান পরিস্থিতির উপযোগী হিসাবে দেখাতে বাধ্য করে। অন্য কথায়, তারা ধারণা করে যে তাদের ব্যক্তিগত গুণাবলী, বৈশিষ্ট্য, বিশ্বাস এবং ক্রিয়াকলাপগুলি সাধারণ জনসংখ্যার মধ্যে তুলনামূলকভাবে বেশি বিস্তৃত।

এই ফলস কনসেন্সাস এফেক্ট গুরুত্বপূর্ণ কারণ এটি আত্ম-মর্যাদা বা সেলফ এস্টিম বৃদ্ধি করে করে, যাকে ওভারকনফিডেন্স এফেক্ট (overconfidence effect) বলা যায়। এটি একটি সামাজিক পরিবেশে অন্যদের দ্বারা গ্রহণযোগ্যতা লাভের অথবা সকলকে মেনে চলা বা কনফর্ম করার ইচ্ছা থেকে উদ্ভূত হতে পারে। এই বায়াসটি বিশেষভাবে গ্রুপ সেটিংসে প্রচলিত যেখানে একজন বিশ্বাস করেন যে তাদের নিজস্ব গোষ্ঠীর সম্মিলিত মতামত বৃহত্তর জনসংখ্যার সাথে মেলে। যেহেতু একটি গোষ্ঠীর সদস্যরা একমত হন এবং বিরোধিতার মুখোমুখি হন না, তারা বিশ্বাস করেন যে সবাই একইভাবে চিন্তা করে। ফলস কনসেন্সাস এফেক্ট শুধুমাত্র এমন ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ নয় যেখানে মানুষ বিশ্বাস করে যে তাদের মূল্যবোধগুলি সংখ্যাগরিষ্ঠ লোকেরও মূল্যবোধ, বরং সেই সাথে তারা অন্যেরা তাদেরকে কতটা মেনে চলছে, তার বিশ্বাসের সাথে একমত তা নিয়েও ওভারএস্টিমেট বা অতিরঞ্জিত করে। তাছাড়া, যখন এই বায়াসে থাকা কোন ব্যক্তি দেখতে পারে যে মানুষেরা তাদের সাথে আসলে সম্মত নয় বা তার বিশ্বাস বা মূল্যবোধ তারা শেয়ার করছে না, তখন সেই ব্যক্তি প্রায়ই অনুমান করে বসে যে, তার সাথে একমত না হওয়া লোকেরা কোনভাবে ত্রুটিপূর্ণ বা ভুল করছে।

এই কগনিটিভ বায়াসের পেছনে কোনও নির্দিষ্ট একক কারণ নেই। এভেইলেবিলিটি হিউরিস্টিক (availability heuristic), সেলফ-সার্ভিং বায়াস (self-serving bias), এবং নাইভ রিয়ালিজম (naïve realism) বায়াসগুলো অন্তত আংশিকভাবে এর পেছনে দায়ী বা প্রাথমিক কারণ হিসেবে প্রস্তাব করা হয়েছে। এই বায়াসটি অ-সামাজিক উদ্দীপনা-পুরস্কার এসোসিয়েশন (non-social stimulus-reward associations) থেকেও উদ্ভূত হতে পারে। এই কগনিটিভ বায়াসকে মেইন্টেইন করে চলার সাথে ব্যক্তির মধ্যে তুলনামূলকভাবে কম তথ্য ব্যবহার করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রবণতার সম্পর্ক থাকতে পারে। যখন ব্যক্তি অনিশ্চয়তার মুখোমুখি হয় ও সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য স্যাম্পলের পরিমাণ সীমিত থাকে, তখন ব্যক্তি প্রায়ই নিজেকেই সেই পরিস্থিতির উপর “প্রক্ষেপণ” করে। এক্ষেত্রে যখন এই ব্যক্তিগত জ্ঞান জেনারালাইজেশন বা সাধারণীকরণ তৈরির জন্য ইনপুট হিসাবে ব্যবহৃত হয়, তখন এটি প্রায়শই নিজেকে সংখ্যাগরিষ্ঠের অংশ হিসেবে একটি মিথ্যা ধারণা তৈরি করে। এক্ষেত্রে ফল্টি জেনারালাইজেশন ঘটে থাকে।

ফলস কনসেন্সাস এফেক্ট বায়াসটিকে ব্যাপকভাবে পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে এবং এটি প্রমাণ দ্বারা সমর্থিত। পূর্ববর্তী গবেষণায় প্রস্তাবিত হয়েছে যে কগনিটিভ এবং ধারণাগত (perceptional) ফ্যাক্টরগুলো (উদ্দীপিত প্রক্ষেপণ (motivated projection), তথ্যের প্রবেশযোগ্যতা, আবেগ, ইত্যাদি) এই কন্সেন্সাস বায়াসের ক্ষেত্রে অবদান রাখতে পারে, যখন সাম্প্রতিক গবেষণায় এর স্নায়বিক প্রক্রিয়াগুলির উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করা হয়েছে। একটি সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে যে, কন্সেন্সাস বায়াস অন্য লোকেদের পছন্দ সম্পর্কে নেয়া সিদ্ধান্তসমূহকে উন্নত করতে পারে। রস, গ্রিন এবং হাউস প্রথম ১৯৭৭ সালে ফলস কনসেন্সাস এফেক্টকে সংজ্ঞায়িত করেছিলেন তাদের নিজস্ব প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে মানুষের তুলনামূলক সাধারণতা বা কমননেসের উপর জোর দিয়ে; তবে, অনুরূপ প্রক্ষেপণ ঘটনাগুলি ইতিমধ্যেই মনোবিজ্ঞানে মনোযোগ আকর্ষণ করেছিল। বিশেষভাবে, ব্যক্তির ব্যক্তিগত প্রবণতা এবং তাদের সহকর্মীদের অনুমানের মধ্যে সংযোগ সম্পর্কিত উদ্বেগগুলি একাডেমিক সাহিত্যে উপস্থিত ছিল। উদাহরণস্বরূপ, ১৯৩১ সালে কাটজ এবং অলপোর্ট দেখিয়েছিলেন যে শিক্ষার্থীদের প্রতারণার ফ্রিকোয়েন্সি সম্পর্কে অন্যদের পরিমাণের অনুমান তাদের নিজস্ব আচরণের সাথে ইতিবাচকভাবে সম্পর্কিত ছিল। পরে, প্রায় ১৯৭০ সালে, একই ঘটনা রাজনৈতিক বিশ্বাস এবং প্রিজনারস ডিলেমা (prisoner’s dilemma) পরিস্থিতিতে পাওয়া যায়। ২০১৭ সালে, গবেষকরা দেখতে পান যে যখন অংশগ্রহণকারীরা অন্যদের স্ন্যাক-ফুড পছন্দ সম্পর্কে জানতে পারে তখন তাদের মধ্যে একটি লাগাতার ইগোসেন্ট্রিক বায়াস (egocentric bias) কাজ করে। তাছাড়া, সাম্প্রতিক গবেষণায় প্রস্তাবিত হয়েছে যে ফলস কনসেন্সাস এফেক্ট পেশাদার সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীদেরও প্রভাবিত করতে পারে; বিশেষ করে, দেখা গেছে যে এমনকি অভিজ্ঞ মারকেটিং ম্যানেজাররা তাদের ব্যক্তিগত পণ্যের পছন্দগুলি গ্রাহকদের উপর প্রক্ষেপণ বা প্রোজেক্ট করেন।

প্রধান তাত্ত্বিক পদ্ধতি

ফলস-কনসেন্সাস এফেক্টের (False-Consensus Effect) উৎপত্তি এবং তাত্ত্বিক ভিত্তি

ফলস কনসেন্সাস এফেক্ট দুটি সমান্তরাল সামাজিক ধারণা তত্ত্বের সাথে সম্পর্কিত, যা অন্যদের সম্পর্কে আমাদের ধারণা এবং অনুমান করার প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা করে। প্রথম তত্ত্বটি হল লিওন ফেস্টিঙ্গারের (Leon Festinger) সামাজিক তুলনা তত্ত্ব বা সোশ্যাল কম্প্যারিজন থিওরি (Social Comparison Theory) (১৯৫৪), যা দাবি করে যে ব্যক্তি তাদের চিন্তা এবং মনোভাবকে অন্যদের সাথে তুলনা করে মূল্যায়ন করে। এটি নিজেকে ভাল অনুভব করার এবং নিশ্চিতকরণের (Confirmation) আকাঙ্ক্ষা দ্বারা প্রভাবিত হতে পারে। এই তত্ত্বের সম্প্রসারণ হিসাবে, মানুষ সামাজিক বাস্তবতাকে সংজ্ঞায়িত এবং আচরণ নির্দেশ করার জন্য অন্যদেরকে তথ্যের উৎস হিসাবে ব্যবহার করতে পারে, যা তথ্যগত সামাজিক প্রভাব বা ইনফরমেশনাল সোশ্যাল ইনফ্লুয়েন্স (Informational Social Influence) নামে পরিচিত। তবে, মানুষ প্রায়ই সঠিকভাবে সামাজিক নিয়ম এবং অন্যদের প্রকৃত মনোভাব বুঝতে অক্ষম হয়। গবেষণায় দেখা গেছে যে, মানুষ অত্যন্ত দুর্বল “ইনটুইটিভ সাইকোলজিস্ট” এবং আমাদের সামাজিক রায় প্রায়ই অপ্রমাণিত। এই সন্ধানগুলি পক্ষপাতমূলক প্রক্রিয়াকরণ এবং ভুল সামাজিক ধারণা গ্রহণ করার ভিত্তি স্থাপন করে। ফলস কনসেন্সাস এফেক্ট এমন একটি ভুল ধারণার উদাহরণ।

দ্বিতীয় প্রভাবশালী তত্ত্বটি হল প্রক্ষেপন (Projection) এর ধারণাটি, যেখানে মানুষ তাদের নিজস্ব মনোভাব এবং বিশ্বাস অন্যদের উপর প্রক্ষেপণ করে। এই ধারণাটি নতুন নয় এবং সিগমুন্ড ফ্রয়েডের (Sigmund Freud) প্রক্ষেপনের প্রতিরক্ষা প্রক্রিয়া (Defense Mechanism of Projection), ডি.এস. হোমসের (D.S. Holmes) “অ্যাট্রিবিউটিভ প্রোজেকশন” (Attributive Projection) (১৯৬৮) এবং গুস্তাভ ইচহাইসারের (Gustav Ichheisser) সামাজিক ধারণা (Social Perception) (১৯৭০) সম্পর্কিত কাজের মধ্যে পাওয়া যায়। ডি.এস. হোমস সামাজিক প্রকল্পনকে বর্ণনা করেছেন – যেভাবে মানুষ “তাদের বিশ্বাসগুলি যাচাই করার জন্য তাদের নিজস্ব বৈশিষ্ট্যগুলি অন্য ব্যক্তিদের উপর প্রক্ষেপণ করে।”

সামাজিক তুলনা তত্ত্ব এবং প্রকল্পনের মধ্যে একটি সংযোগ রয়েছে। সামাজিক তুলনা তত্ত্ব অনুযায়ী, ব্যক্তি ক্রমাগত সমকক্ষদের একটি রেফারেন্স গ্রুপ হিসাবে দেখে এবং ব্যক্তি তার নিজস্ব মনোভাব এবং বিশ্বাসের নিশ্চিতকরণের জন্য তাদের উপর প্রক্ষেপণ করে, যার মাধ্যমে প্রকল্পন হয়।

রস, গ্রিন এবং হাউস দ্বারা ১৯৭৭ সালে সংজ্ঞায়িত হওয়া ফলস কনসেন্সাস এফেক্ট এই সম্পর্কিত তত্ত্বগুলি থেকে উদ্ভূত হয়েছিল। রস এবং সহযোগীরা তাদের বিখ্যাত চারটি গবেষণার সিরিজে অনুমান করেছিলেন এবং প্রদর্শন করেছিলেন যে মানুষ তাদের নিজস্ব বিশ্বাস এবং পছন্দের জনপ্রিয়তাকে অতিরিক্তভাবে অনুমান করে। গবেষণাগুলি প্রশ্নাবলী জরিপ এবং বাস্তব সংঘাত পরিস্থিতিতে উভয়ই পরিচালিত হয়েছিল। প্রশ্নাবলী গবেষণার জন্য, অংশগ্রহণকারীদেরকে কাল্পনিক ঘটনা উপস্থাপন করা হয়েছিল এবং তাদের নিজস্ব আচরণগত পছন্দ এবং বৈশিষ্ট্যগুলি উল্লেখ করতে বলা হয়েছিল। এছাড়াও, তাদের “অভিনেতা” হিসাবে উল্লেখিত সমকক্ষদের প্রতিক্রিয়া এবং বৈশিষ্ট্যগুলি রেট করতে বলা হয়েছিল। বাস্তব অনুষ্ঠানের গবেষণায়, অংশগ্রহণকারীদেরকে সংঘাত পরিস্থিতির সাথে মুখোমুখি করা হয়েছিল যেখানে তাদের আচরণগত বিকল্পগুলি বেছে নিতে এবং দুটি তথাকথিত বাস্তব ব্যক্তির বৈশিষ্ট্য এবং সিদ্ধান্তগুলি বিচার করতে বলা হয়েছিল যারা গবেষণায় অংশ নিয়েছিল। সাধারণত, রেটাররা তাদের পছন্দের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ না এমন অভিনেতাদের ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে আরও “চরম পূর্বাভাস” (extreme predictions) দিয়েছে। প্রকৃতপক্ষে, রেটাররা এমনকি ভাবতে পারে যে বিকল্প প্রতিক্রিয়া প্রকাশকারী লোকেদের কিছু ভুল ছিল।

রস এট আল এর প্রভাবশালী গবেষণাটির পরের দশ বছরে ফলস কনসেন্সাস এফেক্ট নিয়ে প্রায় ৫০টি পেপার  তথ্য সহ প্রকাশিত হয়েছিল। তাত্ত্বিক পদ্ধতিগুলিও প্রসারিত হয়েছিল এবং এগুলোকে চারটি বিভাগে বিভক্ত করা যায়: (ক) নির্বাচনমূলক প্রকাশ বা সিলেক্টিভ এক্সপোজার এবং জ্ঞানগত প্রাপ্যতা বা কগনিটিভ এভেইলেবিলিটি, (খ) উল্লেখযোগ্যতা এবং মনোযোগের ফোকাস, (গ) যৌক্তিক তথ্য প্রক্রিয়াকরণ, এবং (ঘ) প্রেরণামূলক প্রক্রিয়া। গবেষক এবং তাত্ত্বিকরা সাধারণত একমত হন যে এর কোনও একক সঠিক উত্তর নেই। বরং, তারা তত্ত্বগুলির মধ্যে ওভারল্যাপ স্বীকার করে, যা পরামর্শ দেয় যে ফলস-কন্সেন্সাস এফেক্ট সম্ভবত এই সমস্ত কারণের সংমিশ্রণ দ্বারা ঘটে।

নির্বাচনমূলক প্রকাশ এবং জ্ঞানগত প্রাপ্যতা (Selective Exposure and Cognitive Availability)

এই তত্ত্বটি প্রাপ্যতার অনুমানগত পদ্ধতি বা এভেইলেবিলিটি হিউরিস্টিকের (Availability Heuristic) সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত, যা প্রস্তাব করে যে সাদৃশ্য (বা পার্থক্য) এর ধারণাগুলিকে কত সহজে সেগুলি স্মৃতি থেকে প্রত্যাহার করা যেতে পারে তার দ্বারা প্রভাবিত হয়। এবং আপনি যেমন আশা করতে পারেন, নিজের এবং অন্যদের মধ্যে সাদৃশ্যগুলি পার্থক্যের তুলনায় সহজেই মনে রাখা যায়। এর অংশত কারণ হল মানুষ সাধারণত তাদের মতো মানুষের সাথে মেলামেশা করে। এই একই মানুষের প্রতি নির্বাচিত প্রবণতা বৃহত্তর সামাজিক পরিবেশে মতামতের প্রকৃত বৈচিত্র্য সম্পর্কে “তথ্যের নমুনাকে” পক্ষপাতমূলক বা বায়াসড বা সীমিত করতে পারে। সিলেক্টিভ এক্সপোজার এবং এভেইলেবিলিটি হিউরিস্টিকের ফলস্বরূপ, নিজের চিন্তায় সাদৃশ্য প্রাধান্য পাওয়া স্বাভাবিক।

বোটভিন এট আল. (Botvin et al.) (১৯৯২) একটি নির্দিষ্ট কিশোর সম্প্রদায়ের মধ্যে ফলস-কনসেন্সাস এফেক্টের (False-Consensus Effect) প্রভাবগুলির উপর একটি জনপ্রিয় গবেষণা করেছিলেন যাতে এটি নির্ধারণ করা যায় যে ছাত্ররা বৃহত্তর সমাজের তুলনায় তাদের সরাসরি সহকর্মীদের মধ্যে একটি উচ্চ স্তরের ফলস-কনসেন্সাস এফেক্ট প্রদর্শন করে কিনা। এই পরীক্ষায় ১৮ থেকে ২৫ বছর বয়সী (গড় বয়স ১৮.৫) ২০৩ জন কলেজ ছাত্র অংশগ্রহণ করেছিল। অংশগ্রহণকারীদের একটি প্রশ্নাবলী দেওয়া হয়েছিল এবং বিভিন্ন সামাজিক বিষয় সম্পর্কে প্রশ্নের উত্তর দিতে বলা হয়েছিল। প্রতিটি সামাজিক বিষয়ে তাদের এই বিষয়ে কেমন অনুভূত হয়েছিল এবং তাদের কত শতাংশ সহপাঠী তাদের সাথে একমত হবে তার অনুমান করতে বলা হয়েছিল। ফলাফল নির্ধারণ করে যে ফলস-কনসেন্সাস এফেক্টটি অংশগ্রহণকারীরা যখন তাদের কলেজ সম্প্রদায়ের বাকি অংশের বর্ণনা করছিল তখন অত্যন্ত বিদ্যমান ছিল; ২০টি বিষয়ের মধ্যে, ১৬টি বিষয় বিশিষ্টভাবে ফলস-কনসেন্সাস এফেক্ট প্রদর্শন করেছিল। এই গবেষণায় দেখা উচ্চ স্তরের ফলস-কনসেন্সাস এফেক্টকে অধ্যয়ন করা গোষ্ঠীর কারণে দায়ী করা যেতে পারে; কারণ অংশগ্রহণকারীদের তাদের চারপাশে প্রতিনিয়ত থাকা (এবং নিজের মতো খুব অনুরূপ হিসাবে দেখা) একটি সহকর্মী দলের সাথে নিজেদের তুলনা করতে বলা হয়েছিল, ফলস-কনসেন্সাস এফেক্টের মাত্রা বেড়ে গিয়েছিল।

উল্লেখযোগ্যতা এবং মনোযোগের ফোকাস (Salience and Focus of Attention)

এই তত্ত্বটি পরামর্শ দেয় যে যখন কোনও ব্যক্তি কেবলমাত্র তাদের পছন্দের অবস্থানের উপর মনোযোগ দেয়, তখন তারা এর জনপ্রিয়তা অতিরঞ্জিত করার সম্ভাবনা বেশি থাকে, এইভাবে ফলস-কনসেন্সাস এফেক্টের শিকার হয়। এটি এমন কারণ যে অবস্থানটি তাদের তাৎক্ষণিক চেতনাতে একমাত্র। অবস্থানটিকে উন্নীত করে এমন একটি কর্ম সম্পাদন করলে এটি আরও উল্লেখযোগ্য হতে পারে এবং ফলস-কনসেন্সাস এফেক্ট বাড়াতে পারে। তবে, যদি ব্যক্তিকে আরও অবস্থান উপস্থাপন করা হয় তবে ফলস-কনসেন্সাস এফেক্টের ডিগ্রি উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেতে পারে।

যৌক্তিক তথ্য প্রক্রিয়াকরণ (Logical Information Processing)

এই তত্ত্বটি অনুমান করে যে সক্রিয় এবং দৃশ্যত যৌক্তিক চিন্তাভাবনা অন্যদের মধ্যে সাদৃশ্যের ব্যক্তির অনুমানের অন্তর্নিহিত। ফক্স (Fox), ইয়িনন (Yinon) এবং মায়রাজের (Mayraz) দ্বারা করা একটি গবেষণায়, গবেষকরা নির্ধারণ করার চেষ্টা করছিলেন যে বিভিন্ন বয়সের গোষ্ঠীতে ফলস-কনসেন্সাস এফেক্টের মাত্রা পরিবর্তিত হয় কিনা। একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর জন্য, গবেষকদের তাদের অংশগ্রহণকারীদের চারটি ভিন্ন বয়সের দলে বিভক্ত করা প্রয়োজন ছিল। দুই শতাধিক অংশগ্রহণকারীকে ব্যবহার করা হয়েছিল এবং লিঙ্গকে একটি কারণ হিসাবে বিবেচনা করা হয়নি। আগের উল্লেখিত গবেষণার মতো, এই গবেষণায় তথ্যের প্রধান উৎস হিসাবে একটি প্রশ্নাবলী ব্যবহার করা হয়েছিল। ফলাফলগুলি দেখিয়েছে যে সমস্ত গোষ্ঠীতে ফলস-কনসেন্সাস এফেক্ট অত্যন্ত বিদ্যমান ছিল, তবে সবচেয়ে বেশি বিদ্যমান ছিল প্রবীনতম বয়সের গোষ্ঠীতে (যারা “বয়স্ক-বয়সের বাড়ির বাসিন্দা” হিসাবে চিহ্নিত)। তাদের জিজ্ঞাসা করা ১২টি ক্ষেত্রে তারা ফলস-কনসেন্সাস এফেক্ট দেখিয়েছে। প্রবীনতম বয়সের গোষ্ঠীতে দেখা ফলস-কনসেন্সাস এফেক্টের বৃদ্ধিটি তাদের সিদ্ধান্তের পিছনে তাদের উচ্চ স্তরের “যৌক্তিক” যুক্তির জন্য দায়ী করা যেতে পারে; প্রবীনতম বয়সের গোষ্ঠী স্পষ্টতই সবচেয়ে দীর্ঘকাল ধরে জীবিত এবং তাই তারা তাদের বিশ্বাসগুলি সমস্ত বয়সের গোষ্ঠীতে প্রোজেক্ট বা প্রক্ষেপ করতে পারে কারণ তাদের (বোধগম্য) অতীত অভিজ্ঞতা এবং জ্ঞানের কারণে। ছোট বয়সের গোষ্ঠীগুলি তাদের চেয়ে পুরোনোদের সাথে যুক্তিযুক্তভাবে সম্পর্ক করতে পারে না কারণ তাদের সেই অভিজ্ঞতা নেই এবং তারা এই উদ্দেশ্যমূলক সত্যগুলি জানার ভান করে না। এই ফলাফলগুলি বয়স্ক ব্যক্তিদের পরিস্থিতিগত বৈশিষ্ট্যের উপর আরও বেশি নির্ভর করার প্রবণতাকে প্রদর্শন করে (জীবনের অভিজ্ঞতা) অভ্যন্তরীণ বৈশিষ্ট্যের পরিবর্তে।

প্রেরণাদায়ক প্রক্রিয়াকরণ (Motivational Processes)

এই তত্ত্বটি ফলস-কনসেন্সাস এফেক্টের সুবিধাগুলির উপর জোর দেয়: যথা, সামাজিক বৈধতার বর্ধিত ধারণা, সামাজিক সমর্থন এবং আত্মসম্মান। অনুরূপতাগুলি বাড়াতে সামাজিক পরিস্থিতিতে অতিরঞ্জিত করাও উপকারী হতে পারে যাতে পছন্দ বৃদ্ধি পায়।

বিশ্বাসের উপর একটি অনুকূল ভবিষ্যত (Belief in a Favorable Future)

ফলস কন্সেন্সাস এফেক্ট ধারণা ভবিষ্যতের অন্যদের সম্পর্কের পূর্বাভাস পর্যন্ত প্রসারিত করা যায়। একটি অনুকূল ভবিষ্যতে বিশ্বাস হল সেই বিশ্বাস যে ভবিষ্যতের অন্যরা তাদের পছন্দ এবং বিশ্বাসকে নিজের সাথে সামঞ্জস্য রেখে পরিবর্তন করবে।

রজার্স, মুর, এবং নর্টন (২০১৭) এই ধারণাটি নিয়ে আলোচনা করেছেন যে কেন একটি অনুকূল ভবিষ্যতে বিশ্বাস ফলস কন্সেন্সাস এফেক্টের তুলনায় বৃহত্তর মাত্রায় বিদ্যমান:

  1. এটি ভবিষ্যতের অন্যদের উপর ভিত্তি করে, যাদের বিশ্বাস সরাসরি পর্যবেক্ষণযোগ্য নয়।
  2. এটি ভবিষ্যতের বিশ্বাসের উপর ফোকাস করে, যা এই ভবিষ্যতের অন্যদের “সত্য” আবিষ্কার করতে এবং তাদের বিশ্বাস পরিবর্তন করার জন্য সময় দেয়।

এতে দেখা যায়, ব্যক্তি সাধারণত ধারণা করেন যে ভবিষ্যতে অন্যরা তাদের মতাদর্শকে গ্রহণ করবে, যা অনেক সময় নিজের আদর্শের সঠিকতার উপর অতিরঞ্জিত বিশ্বাসের কারণ হতে পারে।

তথ্যসূত্র –

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.