কার্ল ইয়ুং (১৮৭৫-১৯৬১) ও তার বিশ্লেষণাত্মক মনোবিজ্ঞান

Table of Contents

ভূমিকা

Carl Jung’s Exploration of Self in ‘Man and His Symbols’ | by Dr ...
কার্ল গুস্টাভ ইয়ুং

কার্ল গুস্টাভ ইয়ুং (Carl Gustav Jung) ছিলেন একজন সুইডেন বাসী মনোচিকিৎসক। প্রথম দিকে ফ্রয়েডের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিলেন। কিন্তু মতবিরোধের কারণে অচিরেই ফ্রয়েডের সাথে তার সম্পর্কের পরিসমাপ্তি ঘটে। তিনি ছিলেন ভিন্নপন্থী মনোসমীক্ষণ (Deviant Psycho-analysis) ধারার অন্যতম পুরোধা। যে সমস্ত ব্যক্তিবর্গ প্রথমে ফয়েডের ঘনিষ্ঠ সহযোগী রূপে কাজ করেছেন এবং পরবর্তীকালে মতবিরোধের জন্য ফ্রয়েড থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে তাদের নিজস্ব চিন্তাধারার বিকাশ ঘটিয়েছেন, তাদের মতবাদকে ভিন্নপন্থী মনোসমীক্ষন রূপে আখ্যায়িত করা হয়। এখানে রয়েছেন ফ্রয়েডের দলের চারজন সদস্য, যারা প্রথমে ফ্রয়েডের অনুসারী ছিলেন এবং প্রিয়পাত্র ছিলেন, তারা পরবর্তীকালে ফ্রয়েডের তত্ত্বের কতগুলো বিষয়ের প্রতি দ্বিমত পোষণ করেন এবং পৃথক সম্প্রদায় গঠন করেন। এরা হলেন আলফ্রেড আডলার (A.Adler), কার্ল গুস্তাভ ইয়ুং (C G.Jung). অটো র‍্যাংক (Otto Rank) এবং ফেরেঞ্জি (Ferenczi)। এই চারজন যে ফ্রয়েডীয় মূল ধারা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলেন, তার জন্য অনেকেই ফ্রয়েডকে দায়ী করেন। তারা বলেন, ফ্রয়েড সমালোচনা সহ্য করতে পারতেন না এবং তিনি ছিলেন অনেকটা স্বৈরাচারী নেতৃত্বের অধিকারী। কিন্তু অনেকেই বলেন, এই সব নব্য চিকিৎসাবিদদের সঙ্গে ফ্রয়েডের কিছু কিছু মৌলিক পার্থক্য ছিল, সেকারণেই তাদের মধ্যে ছাড়াছাড়ি হয়।

ফ্রয়েডের তত্ত্বের দুটো দিক সম্পর্কে তিনি অত্যন্ত অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন। প্রথমতঃ সকল বিষয়ে ফ্রয়েডের যৌনতা সংক্রান্ত গুরুত্বকে তিনি অস্বীকার করেছেন। দ্বিতীয়তঃ ফ্রয়েডীয় তত্ত্ব মূলতঃ অস্বভাবী ব্যক্তিদের মন মানসিকতার ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। এটাও ইয়ুং এর কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি। তিনি সুস্থ ও স্বাভাবিক মানুষের বিষয়ে আগ্রহী ছিলেন এবং মানুষের মানবীয় ও আধ্যাত্মিক দিকের প্রতি তিনি অধিক গুরুত্ব আরোপের পক্ষপাতী ছিলেন। সেজন্যই তিনি ফ্রয়েড থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বতন্ত্র মতবাদ প্রতিষ্ঠা করেন। তার মতবাদ বিশ্লেষণাত্মক মনোবিজ্ঞান বা এনালাইটিকাল সাইকোলজি (Analytical Psychology) নামে পরিচিত। উল্লেখ্য যে শেষের দিকে তার তত্ত্বে মানুষের আধ্যাত্মিক জীবনের প্রতিফলনই বেশী ঘটেছে। ফলে শেষ জীবনে তিনি বেশ কিছুটা অতীন্দ্রিয়বাদী হয়ে উঠেছেন এবং তার তত্ত্ব বেশ জটিল ও দুর্বোধ্য হয়ে উঠেছে।

ইয়ুং-এর তত্ত্বে মনটি ফ্রয়েডতত্ত্বের মনের মতো ইদ্ ইগো সুপার-ইগো, এ তিন প্রকোষ্ঠ ভিত্তিক নয়। তিনি মনকে কল্পনা করেছেন পরস্পর ক্রিয়াশীল কতগুলো তন্ত্রের সমাহার বলে। মানব শিশু জন্মায় ‘সমষ্টি-অচেতন’ (the collective unconscious) মন নিয়ে। যা ক্রমে বিভিন্ন তন্ত্রে পৃথকীকৃত ও বিকশিত হয়।

সমষ্টি-অচেতনের ব্যাপ্তিটি বিশাল। এতে যেমন রয়েছে প্রজাতি হিসাবে মানব প্রজাতি উদ্ভবের জান্তব স্মৃতি, তেমনি রয়েছে মানব ইতিহাসের সাংস্কৃতিক স্মৃতি। মানুষ হিসাবে আমরা যেমন একই রকম মস্তিষ্কের উত্তরাধিকারী, তেমনি একটি সমষ্টি-অচেতনেরও উত্তরাধিকারী। মানব প্রজাতির এই জান্তব স্মৃতি ও সাংস্কৃতিক স্মৃতির ভাণ্ডারটিতে, স্মৃতিসমূহ বিভিন্ন ‘আদিরূপ’ (archetypes) আকারে সংরক্ষিত থাকে। আদিরূপ বিভিন্ন ধারণা ও আবেগের এক সংশ্লেষ; যেমন, মা, বাবা, নারী, পুরুষ। এসব আদিরূপ অচেতনে পরস্পর অনুপ্রবিষ্ট এবং যুক্ত হয়ে অবস্থান করে। ইয়ুং-এর তত্ত্বে সমষ্টি-অচেতনই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এই ভিত্তিতেই ‘ব্যক্তি-অচেতন’ (the personal unconscious) এবং ইগো গড়ে উঠে। ব্যক্তি-অচেতন, ব্যক্তির জন্ম মুহূর্ত থেকে যাপিত জীবনের যেসব অভিজ্ঞতা সম্পর্কে সে সচেতন নয়, তারই সমাকলন। ব্যক্তির সচেতন মনটিই ইগো। এটি ব্যক্তির আমিত্বের বোধ ও জীবনব্যাপী আমিত্বের ধারাবাহিকতার বোধের জন্য দায়ী। আদিরূপগুলোর একটি বিকশিত হয়ে ব্যক্তির সামাজিক ব্যক্তিত্ব বা the persona গড়ে উঠে। ইয়ুং পুরুষের ব্যক্তিত্বে নারীত্বের দিকটিকে বলেন anima এবং নারীর ব্যক্তিত্বে পুরুষত্বের দিকটিকে বলেন animus। এসবও আদিরূপরই বিকাশ। মানুষের জৈব প্রবৃত্তিসমূহ তার ভাষায় the shadow। আদিরূপসমূহের একটি, উপরে বর্ণিত ব্যক্তিত্বের সব দিকগুলোকে ঐক্য, ভারসাম্য এবং স্থিরতা দান করতে চায়। সেটি ‘আত্ম’ (the self)।

সংক্ষিপ্ত জীবনী

কার্ল গুস্তাভ ইয়ুং ১৮৭৫ খৃস্টাব্দের ২৬শে জুলাই সুইজারল্যন্ডের কেসিল (Kesswil) নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা প্রটেস্টান্ট চার্চের একজন ধর্মযাজক ছিলেন, মা গৃহবধূ, যিনি প্রায়শই মানসিক অসুস্থতায় ভুগতেন। তিনি বেসেল নগরে বড় হয়ে উঠেছেন এবং ওখানেই তার শিক্ষাজীবন কেটেছে। শৈশব ও বাল্যকালে তার মানসিক বিকাশ ও পরিপক্কতার মাত্রা বয়সের তুলনায় বেশী হওয়ায় তার পরিবারের সদস্যবৃন্দ বা তার সঙ্গী সাথীরা তাকে ঠিক বুঝতে পারত না। ফলে তার প্রথম জীবনটা প্রায় একাকী ও নিঃসঙ্গ অবস্থায় কেটেছে। ঐ সময় তিনি বেশীর ভাগ সময়ে একাকীই ঘুরে বেড়িয়েছেন এবং তার নিজের বক্তব্য অনুসারে ঐ সময় তিনি স্বীয় অন্তর্জগৎকে উপলব্ধি করার চেষ্টা করেছেন। তার প্রথম জীবনের এই নিঃসঙ্গতা ও অন্তর্মুখিতা তার পরিণত জীবনের ধ্যান ধারণাকে প্রভাবিত করেছে এবং সেজন্যই হয়ত শেষ জীবনে তিনি অতীন্দ্রিয়বাদী হয়ে উঠেছেন।

প্রথম জীবনে স্থাপত্যবিদ্যা ও প্রত্নতত্ত্ব অধ্যয়নের ইচ্ছা থাকলেও অর্থাভাবে তিনি সে ইচ্ছা পূরণ করতে পারেননি। ফলে তিনি চিকিৎসা বিজ্ঞানে অধ্যয়ন শুরু করেন এবং ১৯০০ খৃস্টাব্দে বেসেল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চিকিৎসা শাস্ত্রে স্নাতক ডিগ্রী নিয়ে তিনি জুরিখের মানসিক হাসপাতালে সহকারী রূপে কর্মে যোগদান করেন। তিনি জুরিখ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাইকিয়ট্রিক ক্লিনিকেও কাজ করেছেন। ১৯০২ সালে তিনি প্যারিসে পিয়ারে জ্যানের অধীনে এক সেমেস্টার অধ্যয়ন করেছেন। জুরিখের বারগোলজী মানসিক হাসপাতালে তিনি প্রখ্যাত সাইকিয়াট্রিস্ট ব্লুয়েলারের সাথেও কাজ করেছেন। ১৯০৩ সালে তিনি এমা রওসেনবেক (Emma Rauschernbech) এর সাথে বিবাহ সূত্রে আবদ্ধ হন। বিবাহিত জীবনে তিনি চার কন্যা ও এক পুত্র সন্তান লাভ করেন। ১৯০৬ সালে তিনি “The Psychology of Schizophrenia” নামক গ্রন্থটি প্রকাশ করেন এবং প্রকাশিত গ্রন্থের একটি কপি ফ্রয়েডের কাছে প্রেরণ করেন। ইয়ুং ফ্রয়েডের “স্বপ্নের ব্যাখ্যা” (Interpretation of Dreams, 1900) নামক বইটি পড়ে ফ্রয়েডের প্রতি আকৃষ্ট হন এবং ১৯০৭ সালে ভিয়েনায় গিয়ে বুধবারের সমিতিতে ফ্রয়েডের সাথে সাক্ষাৎ করেন। এই সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে উভয় মনীষী উভয়ের প্রতিভার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। ফলে তাদের মধ্যে ঘনিষ্ট সংযোগ ও সহযোগিতা অব্যাহতভাবে চলতে থাকে। তিনি ফ্রয়েডের প্রথমদিককার শিষ্য। ফ্রয়েড তাকে নিজের উত্তরসূরী বিবেচনা করতেন। ১৯০৯ সালে ইয়ং এবং ফ্রয়েড ক্লার্ক বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা করার জন্য আমেরিকায় যান। এর পরে আবার ইয়ুং একাই আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে মনোসমীক্ষণ সম্পর্কে বক্তৃতা করেন। ১৯১১ সালে ইয়ুং আন্তর্জাতিক মনোসমীক্ষণ সমিতির সভাপতি নির্বাচিত হন। এডলারের নেতৃত্বে ফ্রয়েডের ভিয়েনা চক্রের সদস্যরা ইয়ুং-এর সভাপতি পদে মনোনয়নের বিরোধিতা করেছিলেন। ফ্রয়েড তাদের যুক্তি দেখিয়েছিলেন ইয়ুং বর্ণে আর্য, ধর্মে খ্রিস্টান এবং আন্তর্জাতিক যোগাযোগ সম্পন্ন ব্যক্তি। অন্য যোগ্য প্রর্থীরা সবাই ইহুদি। ইউরোপে ক্রমবর্ধমান ইহুদি বিদ্বেষের কালে কোনো ইহুদি সাইকোএনালাইটিক সমিতির সভাপতি হলে, সংগঠনটি ইহুদি পরিচয়ে আক্রান্ত হতে পারে। ১৯১১ সালে তার রচিত “The Psychology of the Unconscious” নামক পুস্তকটি প্রকাশিত হয়। ঐ পুস্তকেই তিনি ফ্রয়েডের মতের বিরোধিতা করে নিজস্ব ধারণা ব্যক্ত করেন। ফলে ফ্রয়েডের সাথে তার সম্পর্কের অবনতি ঘটে। তাছাড়া ফ্রয়েড যেমন আশা করেছিলেন ইয়ুং প্রেসিডেন্ট হিসাবে তার দায়িত্ব সেভাবে পালন করছিলেন না। তার বক্তৃতায় এবং মনোসমীক্ষণে তিনি যৌন প্রেষণার উপর কম গুরুত্ব দিতেন এবং লিবিডো (libido) এর সংজ্ঞা পরিবর্তন করেছিলেন। ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দের দ্বন্দ্ব ক্রমশঃ প্রকট হয়ে উঠে এবং ১৯১২ সালের দিকে তারা পত্রালাপ বন্ধ করে দেন। ১৯১৩ সালে তিনি ফ্রয়েড ও মনোসমীক্ষণ সমিতি থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে তার নিজস্ব মতবাদ প্রতিষ্ঠার কাজে আত্মনিয়োগ করেন।ইয়ুং এর নতুন মতবাদের নাম দেওয়া হয় Analytical Psychology বা বিশ্লেষণমূলক মনোবিজ্ঞান। ইয়ুং-এর সঙ্গে ছাড়াছাড়ির পর ফ্রয়েড অভিযোগ করেছিলেন, ইয়ুং শুধু বাহারূপেই আর্য নন, অন্তরেও আর্যবাদী। ইয়ুং গুরুর এ অভিযোগকে সত্য প্রমাণ করেছিলেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নাৎসিদের সহযোগিতা করে। ১৯১৩ সাল থেকে ১৯১৭ সাল পর্যন্ত সময়ে তিনি কিছুটা মানসিক অস্থিরতার মধ্যে কাটিয়েছেন এবং ঐ সময তিনি জুরিখ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাইকিয়াট্রিক ক্লিনিকের ইন্সট্রাক্টর পদ থেকেও ইস্তফা দান করেন। তার নিজের বক্তব্য অনুসারে তিনি ঐ সময়ে স্বীয় অন্তর্জগত ও আত্মসত্তা উদ্ঘাটনের কাজে আত্মনিয়োগ করেছিলেন। ঐ সময় থেকেই তিনি মানুষের আধ্যাত্মিক জীবন ও অতীন্দ্রিয়বাদের দিকে ঝুঁকে পড়েছিলেন।

মানুষের আদি আধ্যাত্মিক সত্তা ও আদিম জীবনযাত্রা সম্পর্কে তার কৌতুহল নিবৃত্ত করার জন্য তিনি বিভিন্ন উপজাতীয় আদিবাসীদের সাথে অনেক দিন একত্রে বাস করেছেন। ১৯২১ সালে উত্তর আফ্রিকায় এবং ১৯২৪-২৫ সালে আমেরিকার আরিজোনা রাষ্ট্রের রেড ইণ্ডিয়ান উপজাতীয় মানুষের সাথে তিনি বসবাস করেছেন। ১৯২৬ সালে তিনি আফ্রিকার কেনিয়াতে বাস করেছেন। ১৯৩৭ সালে তিনি ভারত ভ্রমন করেন এবং ঐ সময়ে বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় ও এলাহাবাদ মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় তাকে সম্মানজনক ডি.লিট. (D.Litt.) উপাধিতে ভূষিত করে। ঐ সময়ই কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাকে সম্মানজনক ডি.এস-সি. (D.Sc.) ডিগ্রী প্রদান করে। ১৯৩৮ সালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় তাকে ডি.এস-সি. ডিগ্রী প্রদান করে। ঐ সময় তিনি জুরিখের পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটে পুনরায় অধ্যাপনার কাজ শুরু করেন। কিন্তু ১৯৪২ সালে স্বাস্থ্যগত কারণে তিনি আবারও কর্মত্যাগ করেন। ১৯৪৪ সালে বেসেল বিশ্ববিদ্যালয় তার সম্মানার্থে চিকিৎসাশাস্ত্রীয় মনোবিজ্ঞানে (Medical Psychology) তার জন্য একটি অধ্যাপকের চেয়ার স্থাপন করে। কিন্তু অসুস্থতার জন্য তিনি উক্ত পদে এক বছরের বেশী কাজ করতে পারেননি। তবে চিকিৎসক রূপে তিনি তার কাজ চালিয়ে গিয়েছেন। এছাড়া তার শিষ্যদের চিকিৎসা পদ্ধতি সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দানের কাজও তিনি চালিয়ে গিয়েছেন। তিনি প্রচুর লেখালেখির কাজও করেছেন এবং তিনি পঁয়ত্রিশটি পুস্তক রচনা করেছেন। ১৯৬২ সালের জুন মাসের ৬ তারিখে ৮৭ বছর বয়সে ইয়ুং মৃত্যুবরণ করেন।

তাত্ত্বিক ধারণা

ইয়ুং ফ্রয়েডের মতই মানুষের মনকে বিভিন্ন স্তরে বিভক্ত করেছেনে এবং বিশ্লেষণের মাধ্যমে মনের বিভিন্ন স্তরগুলো তিনি উদ্ঘাটনের চেষ্টা করেছেন। সেজন্যই তিনি তার তত্ত্বের নামকরণ বিশ্লেষণাত্মক মনোবিজ্ঞান করেছেন। এদিক দিয়ে তিনি ফ্রয়েডের দৃষ্টিভঙ্গিই অনুসরণ করেছেন। তবে তিনি মনের গঠনকে ভিন্নভাবে দেখিয়েছেন। এছাড়া তিনি ফ্রয়েডের যৌনতা সংক্রান্ত ধারণাকে সম্পূর্ণ বর্জন করেছেন। তিনি লিবিডো (libido) শব্দটিকে সম্পূর্ণ ভিন্ন অর্থে ব্যবহার করেছেন। তার মতে লিবিডো হচ্ছে একটি সাধারণ জৈব শক্তি, যা মানুষের যাবতীয় কর্যকলাপের পেছনে চালিকাশক্তি রূপে কাজ করে। যৌনতার পরিবর্তে তিনি মানুষের আধ্যাত্মিক জীবনের ওপর বেশী জোর দিয়েছেন এবং মানব আচরণ ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে তিনি সমষ্টি-অচেতন ও আদিরূপের ওপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করেছেন। নিম্নে তার প্রধান তাত্ত্বিক ধারণাগুলো আলোচনা করা হল।

মানব মনের গঠন

ইয়ুং এর মানসিক সংগঠন সমূহের ধারণা চিত্তাকর্ষক। মানব মনের সামগ্রিক কাঠামোকে ইয়ুং সাইকি (psyche) বা মন নামে অভিহিত করেছেন। ইয়ুং এর মতে সমগ্র ব্যক্তিত্ব বা সাইকি (psyche)-অন্য কথায়, মানসিক সত্তা, কতগুলো পৃথক কিন্তু পারস্পরিক ক্রিয়াশীল তন্ত্র বা system নিয়ে গঠিত। এগুলো হলো অহংবোধ (Ego), ব্যক্তি-অচেতন (personal unconscious), গৃঢ়ৈষাসমূহ (comeplexes) এনিমা বা এনিমা সমূহ (Anima), এবং ছায়া (Shadow) এসব পরস্পর নির্ভরশীল তন্ত্র বা প্রক্রিয়া ছাড়াও রয়েছে অন্তর্মুখীতা বা বহির্মুখীতা সম্বন্ধীয় মনোভাব এবং চিন্তন, অনুভূতি, সংবেদন, এবং সজ্জা (intuition)-র মত মানসিক ক্রিয়া সমূহ। সর্বশেষে হলো আত্মধারণা (sell)। আত্মধারণাই হলো ব্যক্তির সম্পূর্ণ বিকশিত এবং সম্পূর্ণভাবে সমন্বিত ব্যক্তিসত্তা। যাই হোক, গঠনগত দিক দিয়ে তিনি মানুষের মনকে তিনটি অংশে বিভক্ত করেছেন। এগুলো হচ্ছে ইগো, ব্যক্তি-অচেতন ও সমষ্টি-অচেতন। এগুলো নিম্নে আলোচনা করা হল –

ইগো (ego)

মনের সচেতন অংশটিকেই ইয়ুং ইগো বা অহংবোধ নামে আখ্যায়িত করেছেন। ইগো হলো বাস্তবের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত মনের চেতন অংশ এবং সচেতন স্মৃতির আধার। ইয়ুং এর এই ইগোকে ফ্রয়েডের চেতন স্তরের সমতুল্য বলে ধরা যায়। সচেতন চিন্তা- ভাবনা, স্মৃতি, কল্পনা, আবেগ, অনুভূতি, সংবেদন, প্রভৃতি এই ইগোর মধ্যে অবস্থান করে। এই ইগোর মাধ্যমেই মনোজগত ও বহির্জগতের মধ্যে সংযোগ স্থাপিত হয়। আত্মসত্তা (self) উৎপত্তি লাভ না করা পর্যন্ত এই ইগোই মনের কেন্দ্রস্থল রূপে কাজ করে। এই ইগোই ব্যক্তিত্বের মধ্যে চলমানতা ও নিরবিচ্ছিন্নতা নিয়ে আসে এবং ইগোই আত্ম-পরিচিতির ধারক রূপে কাজ করে। ব্যক্তির অনন্যতা, আত্মপরিচয় এবং সমন্বিত ব্যক্তিসত্তার কেন্দ্র বিন্দু হলো ইগো বা অহংবোধ।

ব্যক্তি-অচেতন বা পারসোনাল আনকনশাস (personal unconscious)

ব্যক্তি-অচেতন বা পারসোনাল আনকনশাস (personal unconscious): ইগোর নীচেই বা ভেতরের অংশেই এই ব্যক্তি-অচেতনের অবস্থান। যেহেতু এই তন্ত্রটির সঙ্গে ইগো বা অহং এর সংযোগ রয়েছে, সেহেতু ইগো এর থেকে স্মৃতি বা অভিজ্ঞতা অচেতন মনের গভীরে অবদমিত হতে পারে। ব্যক্তি-অচেতনকে ফ্রয়েডের প্রাক-চেতন স্তরের সমতুল্য বলে মনে করা গেলেও এটি ফ্রয়েডের অচেতন ও প্রাক চেতনের সংমিশ্রণে গঠিত নয়। ব্যক্তি-অচেতনের স্মৃতিগুলো সচেতন মনে সহজেই আনা যায় এবং ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও সমষ্টি-অচেতন থেকে আসা বিভিন্ন প্রবৃত্তির সমষ্টির দ্বারা এ অংশ গঠিত। অতীতের যে সব চিন্তা-ভাবনা, আবেগ-অনুভূতি বা অভিজ্ঞতাসমূহ ব্যক্তি বিস্মৃত হয়েছে, সেগুলো এই ব্যক্তি-অচেতনে অবস্থান করে। এছাড়া যে সব সংবেদন বা ইন্দ্রিয়গত উদ্দীপনা ব্যক্তির চেতনায় সাড়া জাগাতে পারেনি, সেগুলোও এই ব্যক্তি-অচেতনে থাকে। সুতরাং ব্যক্তির অতীত জীবনের বিস্মৃত অভিজ্ঞতাসমূহ এবং ক্ষীণ ও দুর্বল সংবেদনসমূহ ব্যক্তি-অচেতনে অবস্থান করে।

গৃঢ়ৈষা বা কমপ্লেক্স (complex): ব্যক্তি-অচেতনের সাংগঠনিক উপাদানকে ইয়ুং গূঢ়ৈষা (complex) নামে আখ্যায়িত করেছেন। ইয়ুং এর গূঢ়ৈষার ধারণা ফ্রয়েডের গৃঢ়ৈষার ধারণা থেকে ভিন্ন ধরনের অর্থ বহন করে। ইয়ুং এর মতে ব্যক্তি-অচেতনের সমজাতীয় চিন্তাভাবনাগুলো যখন একত্রে সংঘবদ্ধ হয়ে একটি ধারণাপুঞ্জের সৃষ্টি করে, তখন সেটাকে গৃঢ়ৈষা বলা হয়। অর্থাৎ সমজাতীয় ধারণাসমূহের পরস্পর সংঘবদ্ধ অবস্থাকে গৃঢ়ৈষা বলা হয়। এই ধারণাপুঞ্জের একটি কোষকেন্দ্র (nucleus) থাকে। সাধারণতঃ কোন আদিরূপ (archetype) এই ধারণাপুঞ্জের কোষকেন্দ্র রূপে কাজ করে। এই কোষকেন্দ্রের আকর্ষণমূলক শক্তি রয়েছে। এই আকর্ষণমূলক শক্তির দ্বারা সমজাতীয় ধারণাগুলো গৃঢ়ৈষার কোষকেন্দ্রের প্রতি আকৃষ্ট হয় এবং একটি নির্দিষ্ট আবেষ্টনীর মধ্যে আবদ্ধ হয়ে পড়ে। যেমন মাতৃ আদিরূপ (mother archetype) মাতৃ গূড়ৈষা (mother complex) এর কোষকেন্দ্র রূপে কাজ করে এবং এই কোষকেন্দ্র মাতৃ সংক্রান্ত আমাদের যাবতীয় চিন্তা, ভাবনা ও অভিজ্ঞতাসমূহকে একত্রে সংঘবদ্ধ করে মাতৃ গূঢ়ৈষার উৎপত্তি ঘটায়।

গুঢ়ৈষার নিজস্ব শক্তি থাকে এবং এগুলো স্বয়ংশাসিত (autonomous) হয়ে ওঠে। গূঢ়ৈষার নিজস্ব শক্তির দ্বারা ব্যক্তির বিশেষ বিশেষ আচরণ নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত হয় এবং এরূপ আচরণের ওপর সার্বিক ব্যক্তিত্বের কোন নিয়ন্ত্রণ থাকে না। বরং কোন কোন সময় গৃঢ়ৈষা এতই শক্তিশালী হয়ে ওঠে যে, তা সার্বিক ব্যক্তিত্বের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা লাভ করতে পারে। ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তির মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন গৃঢ়ৈষা শক্তিশালী হয়ে পড়তে পারে। ব্যক্তির অধিকাংশ আচার আচরণ তার শক্তিশালী গৃঢ়ৈষার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত হয়। ব্যক্তির আচরণ নিয়ন্ত্রণ ও ব্যক্তিত্ব পরিচালনার ক্ষেত্রে গূঢ়ৈষার ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ফলে কোন মানুষের ব্যক্তিত্বকে জানার জন্য তার গূঢ়ৈষা সম্পর্কে অনুসন্ধান করার প্রয়োজন হয়। ব্যক্তির এই গূঢ়ৈষা উদ্ঘাটন করার জন্যই ইয়ুং শব্দানুষঙ্গ অভীক্ষা বা ওয়ার্ড এসোসিয়েশন টেস্ট (word association test) নামক এক বিশেষ পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছেন। উল্লেখ্য যে শব্দানুষঙ্গ অভীক্ষা প্রণয়ন ইয়ুং এর একটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান।

গূঢ়ৈষার কোষকেন্দ্র যেমন ব্যক্তি-অচেতনের উপাদানকে আকর্ষণ করে, তেমনি তা সচেতন মনের সমজাতীয় কিছু উপাদানকেও আকর্ষণ করে এর অন্তর্ভুক্ত করতে পারে। সুতরাং গূঢ়ৈষা ব্যক্তি-অচেতনে অবস্থিত হলেও তা মনের সচেতন অংশে বিস্তার লাভ করতে পারে এবং সচেতন মনকেও প্রভাবিত করে। এই গৃঢ়ৈষার মাধ্যমেই সচেতন ও অচেতন মনের মধ্যে একটি যোগসূত্র স্থাপিত হয়।

সমষ্টি-অচেতন বা কালেক্টিভ আনকনশাস (collective unconscious)

সমষ্টি-অচেতন বা কালেক্টিভ আনকনশাস (collective unconscious): ব্যক্তি-অচেতনের নীচে বা গভীরে সমষ্টি-অচেতনের অবস্থান। এটি হলো মনের একটি অন্ধকার রহস্যময় অংশ যেখানে লুকিয়ে থাকে বংশ পরস্পরায় উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত পূর্বপুরুষদের যাবতীয় অভিজ্ঞতা সমূহ। সুতরাং পূর্বপুরুষদের অভিজ্ঞতাসমূহ এই সমষ্টি-অচেতনে সুপ্ত স্মৃতি রূপে সঞ্চিত থাকে। শুধু মানুষ পূর্বপুরুষই নয়, পশু পূর্বপুরুষদের অভিজ্ঞতাও সমষ্টি-অচেতনে নিহিত থাকে। বিবর্তনবাদ অনুসারে ইয়ুং মনে করতেন যে পশু থেকেই বিবর্ততনের মাধ্যমে মানব জাতির উৎপত্তি হয়েছে এবং সেই পশু পূর্বপুরুষদের অভিজ্ঞতাগুলোও সুপ্ত স্মৃতি রূপে মানুষের সমষ্টি-অচেতনে থেকে যায়। উল্লেখ্য যে পূর্বপুরুষদের অভিজ্ঞতার স্মৃতি মানুষ সরাসরি লাভ করে না। পূর্বপুরুষদের স্মৃতি মানুষের মস্তিষ্ক-কাঠামোতে সুপ্ত অবস্থায় নিহিত থাকে এবং পরবর্তী প্রজন্মের মানুষ সেই মস্তিষ্ক কাঠামো বংশগতির সূত্র অনুযায়ী লাভ করে। ফলে এই মস্তিষ্ক কাঠামোর মাধ্যমে পূর্বপুরুষদের স্মৃতি বংশধরদের মধ্যে চলে আসে। এভাবেই পূর্বপুরুষদের স্মৃতি ভাণ্ডার বংশপরম্পরায় মানুষের মধ্যে হস্তান্তরিত হতে থাকে।

যেহেতু মানুষের আদি-পুরুষ এক ও অভিন্ন, সেহেতু মানুষের সমষ্টি-অচেতন প্রায় এক রকম হয়। স্থান, কাল, পাত্র ভেদে সমষ্টি-অচেতনের তেমন পার্থক্য হয় না। একই জাতির অন্তর্ভুক্ত মানুষদের উৎপত্তি স্থল একই হওয়ায় তাদের সমষ্টি-অচেতন একেবারে অভিন্ন হয়। সেজন্যই সমষ্টি-অচেতনকে জাতিগত নির্জ্ঞান মন বা রেশিয়াল আনকনশাস (racial unconscious) নামেও উল্লেখ করা হয়। যেহেতু আদি কাল থেকে পূর্বপুরুষদের অভিজ্ঞতাসমূহ এই সমষ্টি-অচেতনে সঞ্চিত রয়েছে, সেহেতু এটাকে মানুষের একটি মূল্যবান সম্পদের ভাণ্ডার রূপে গণ্য করা হয়। পূর্বপুরুষদের সেই বিপুল পরিমাণ অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে মানুষ তার বর্তমান জীবনের বহুবিধ সমস্যার সমাধান করতে পারে। অর্থাৎ মানুষের বর্তমান জীবনের অনেক সমস্যার সমাধানই এই সমষ্টি-অচেতনে নিহিত রয়েছে। কিন্তু মানুষ সমষ্টি-অচেতন সম্পর্কে সচেতন নয় বলে এই মূল্যবান সম্পদকে তারা কাজে লাগাতে পারে না। তবে সমষ্টি-অচেতন সম্পর্কে মানুষ তেমন সচেতন না থাকলেও এর দ্বারা প্রতিনিয়ত তাদের নানাবিধ আচরণ পরোক্ষভাবে প্রভাবিত হয়ে থাকে। সমষ্টি-অচেতনকে অতিরিক্ত মাত্রায় অবদমন করে রাখলে তা স্বপ্নের আকারে বা মনোরোগের লক্ষণ রূপে আত্মপ্রকাশ করতে গারে।

আদিরূপ বা আর্কেটাইপ (archetype): কোন কোন বিষয় সম্পর্কে যুগ যুগ ধরে মানুষের মধ্যে বংশ পরম্পরায় অনুরূপ অভিজ্ঞতার পুনরাবৃত্তি ঘটে। ফলে সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে মানুষের মনে একটি সার্বজনীন ধারণার সৃষ্টি হয়। এই সার্বজনীন ধারণাকেই ইয়ুং আদিরূপ বলেছেন। ইয়ুং অনুসারে এই আদিরূপই সমষ্টি-অচেতনের সাংগঠনিক উপাদান। যেসব অভিজ্ঞতা, স্মৃতি বা প্রবৃত্তি উত্তরাধিকার সূত্রে আসে সেগুলোই আদিরূপ (Archetype)। এগুলো হলো আদিম বা মৌলিক প্রতিরূপ (images), যেগুলো বংশগত প্রতিক্রিয়ার প্রবণতা সমূহকে ধারণ করে এবং বাস্তব জগতে মানসিক ও শারীরিকভাবে পূর্ণতা ঘটায় অথচ শারীরিক ও মানসিক বহিঃপ্রকাশগুলো একে অপরকে প্রভাবান্বিত করেন না।” “Archetypes are premordial images that entail Inherited response tendncies, and are supposed to fulfill them selves psychically and physically within real world at the same time withont the two manifstations being causally related.” – Marx and Hillix, 1973, 57. এখানে ইয়ুং এর ধারণাটিকে হিউমের কার্যকারণ সম্পর্কিত ধারণা (causality) এবং সমসাময়িকতার (contemporaneity) সঙ্গে আবার অন্যদিকে, মনোদৈহিক সমান্তরালবাদের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ বলে মনে হয়।

আদিরূপ হলো সংকেত এবং প্রবণতার মাঝামাঝি এক ধরণের বৈশিষ্ট্য যেগুলো মানুষকে প্রত্যক্ষণ ও প্রতিক্রিয়ার বিশেষ ধরণের প্রবণতা সৃষ্টি করে। অর্থাৎ এই আরকেটাইপগুলোর জন্যই মানুষ পরিবেশের বিভিন্ন উদ্দীপককে বিশেষভাবে দেখে এবং সেগুলোর প্রতি বিশেষভাবে প্রতিক্রিয়া করে। মানুষ বিবর্তনের ধারায় যেসব চিরন্তন বা সার্বজনীন অভিজ্ঞতা লাভ করে সেগুলোর সমষ্টিই হলো আদিরূপসমূহ (archetypes)। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, ইয়ুং অর্জিত বৈশিষ্ট্যের উত্তরাধিকার স্বীকার করেছিলেন। যেহেতু কতগুলো অনুমিত অভিজ্ঞতা চিরন্তন বলে মনে করা হয়, সেজন্য কতগুলো মূল আদর্শ ও চিরন্তন। বিভিন্ন যুগের এবং বিভিন্ন সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর পৌরাণিক কাহিনী (মিথ) এবং চারু শিল্প বিশ্লেষণ করে ইয়ুং এসব মূল-আদর্শের অস্তিত্ব আবিষ্কার করেন। ইযুং মনে করেন, বিভিন্ন সংস্কৃতির মধ্যে কোন যোগাযোগ না থাকা সত্ত্বেও কতগুলো “সংকেত” বা প্রতীক (symbols) সব সংস্কৃতিতে সাধারণভাবে বিদ্যমান। এসব মূল আদর্শের মধ্যে আছে জন্ম, মৃত্যু, শিশু, বীর (Hero) এবং ঈশ্বর সম্পর্কিত ধারণা বা সংকেত সমূহ।

মানুষের আচরণ নির্ধারণ ও পরিচালনার ক্ষেত্রে আদিরূপসমূহকে ইয়ুং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে তিনি মনে করেছেন এবং এগুলোকে primordial image, imagos, universal image, behaviour pattern, প্রভৃতি বিভিন্ন নামে তিনি আখ্যায়িত করেছেন। কতকগুলো বিষয় সম্পর্কে সর্বস্থানের ও সর্বকালের মানুষ প্রায় অভিন্ন ধারণা পোষণ করে। কারণ ঐ বিষয়গুলো সম্পর্কে মানুষের জীবনে পুরুষানুক্রমে একই অভিজ্ঞতার পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। যেমন সূর্য দৈনিক পূর্ব দিকে উদিত হয়ে পশ্চিম দিকে অস্তমিত হয়। এই সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের ঘটনা সেই আদি কাল থেকেই মানুষের জীবনে বার বার ঘটে যাচ্ছে। এই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি সূর্য সম্পর্কে যে নির্দিষ্ট একটি ধারণা মানুষের মনে চিত্রের মত মুদ্রিত করেছে, সেটাকেই সূর্য আদিরূপ (sun archetype) বলা হয়। সুতরাং মানুষের জীবনে বংশ পরম্পরায় যে অভিজ্ঞতাগুলোর পুনরাবৃত্তি ঘটে, সেগুলো মানুষের মনে একটি নির্দিষ্ট ধারণার ছাপ সৃষ্টি করে। এই সার্বজনীন ধারণাকেই আদিরূপ বলা হয়। এগুলো সার্বজনীন বলেই এগুলোর মধ্যে স্থানভেদে বা কালভেদে কোনরূপ পার্থক্য দেখা যায় না। এগুলোই মানুষের আচরণের দিক-নির্দেশক রূপে কাজ করে এবং এভাবেই সমষ্টি-অচেতন মানব আচরণ নিয়ন্ত্রণ করে।

বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে অসংখ্য আদিরূপ গঠিত হয়ে তা মানুষের সমষ্টি-অচেতনে স্থান লাভ করেছে এবং এগুলো বংশ পরম্পরায় পরবর্তী প্রজন্মে হস্তান্তরিত হয়েছে। এই আদিরূপে মানুষের পূর্বপুরুষদের অভিজ্ঞতা যেমন থাকে, তেমনি ব্যক্তির নিজের জীবনের অভিজ্ঞতাও এর মাধ্যমেই প্রতিফলিত হয়। ব্যক্তি তার জীবনের পারিপার্শ্বিক ঘটনাবলিকে এই আদিরূপের নিরিখেই প্রত্যক্ষণ ও মূল্যায়ন করে এবং সেভাবেই সে প্রতিক্রিয়া করে। অসংখ্য আদিরূপ মানুষের সমষ্টি-অচেতনে রয়েছে। বিজ্ঞ ব্যক্তি (wise man), দার্শনিক (philosopher), রাজা (king), বিজ্ঞ প্রবীণ ব্যক্তি (old wise man), প্রভৃতি দৃষ্টান্ত রূপে কিছু আদিরূপের কথা উল্লেখ করা যায়। কতকগুলো আদিরূপকে ইয়ুং বেশী গুরুত্ব প্রদান করেছেন। গুরুত্বপূর্ণ আদিরূপগুলো প্রায় স্বতন্ত্র শক্তি রূপে ব্যক্তির মধ্যে কাজ করে। কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ আদিরূপ নিম্নে আলোচনা করা হল।

বিভিন্ন আদিরূপ বা আর্কেটাইপ (archetype)

নারী আদিরূপ বা এনিমা (anima): পুরুষদের মনে নারী সম্পর্কে যে একটি সার্বজনীন ধারণা থাকে, সেটাকেই নারী আদিরূপ নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে। আদি কাল থেকেই পুরুষরা নারীদের সাথে বসবাস করছে। ফলে যুগ যুগ ধরে নারীদের সংস্পর্শে এসে ও নারীদের সাথে মেলামেশা করে পুরুষরা নারী সম্পর্কে একই ধরনের অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে। যে অভিজ্ঞতাগুলোর পুনরাবৃত্তি ঘটেছে, সেগুলোর ওপর ভিত্তি করেই পুরুষদের মনে নারী সম্পর্কে একটি সার্বজনীন ধারণা মুদ্রিত হয়ে গিয়েছে এবং এর ফলেই পুরুষদের মনে এই নারী আদিরূপের উৎপত্তি ঘটেছে।

সুতরাং নারী সংক্রান্ত একটি সার্বজনীন ধারণাই হচ্ছে নারী আদিরূপ। এটাকে একটি আদর্শ নারীর রূপও বলা যায়। নারী সংক্রান্ত এই সার্বজনীন ধারনার ভিত্তিতেই একজন পুরুষ নারীদের যথার্থভাবে উপলব্ধি করতে পারে এবং নারীদের সাথে সন্তোষজনকভাবে খাপ খাইয়ে চলতে পারে। তবে বাস্তবের নারী রূপ ও আদর্শগত নারী রূপের মধ্যে অবশ্যই কিছু পার্থক্য থেকে যায়। এই আদর্শ নারীরূপ ও বাস্তব নারীরূপের মধ্যে পার্থক্য যদি বেশী হযে যায়, তবে নারী পুরুষের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি শুরু হয় ও তাদের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটে। এর ফলেই স্বামী স্ত্রীর মধ্যে অনেক সময় তীব্র বিরোধ ও তিক্ততার সৃষ্টি হয়।

যুগ যুগ ধরে নারীদের সাথে মেলামেশার জন্য পুরুষদের মধ্যে যেমন নারী আদিরূপের উৎপত্তি হয়েছে, তেমনি তাদের মধ্যে কিছু নারীসুলভ বৈশিষ্ট্যও সৃষ্টি হয়েছে। অর্থাৎ যুগ যুগ ধরে নারীদের সাথে মেশার জন্য পুরুষরাও কিছুটা নারীসুলভ হয়ে পড়েছে। সেজন্যই ইয়ুং মানুষকে উভলিঙ্গ জীব রূপে গণ্য করেছেন এবং পুরুষদের মধ্যেও কিছু মেয়েলী বৈশিষ্ট্য আছে বলে উল্লেখ করেছেন। তার মতে নারী আদিরূপ এনিমার কারণেই পুরুষদের মধ্যে কিছু মেয়েলী বৈশিষ্ট্যের প্রতিফলন ঘটে।

পুরুষ আদিরূপ বা এনিমাস (animus): নারীদের মনে আদর্শ পুরুষ সম্পর্কে যে একটি সার্বজনীন ধারণা থাকে, সেটাকেই পুরুষ আদিরূপ বলা হয়। সেই আদি কাল থেকেই পুরুষদের সংস্পর্শে এসে ও পুরুষদের সঙ্গে বসবাস করে নারীরা পুরুষ সম্পর্কে প্রায় একই ধরনের অভিজ্ঞতা লাভ করেছে। বংশ পরম্পরায় যে অভিজ্ঞতাগুলোর পুনরাবৃত্তি ঘটেছে, সেগুলোর ওপর ভিত্তি করেই নারীদের মনে পুরুষ সম্পর্কে একটি সার্বজনীন ধারণা মুদ্রিত হয়ে গিয়েছে এবং এর ফলেই তাদের মনে পুরুষ আদিরূপের উৎপত্তি ঘটেছে।

সুতরাং পুরুষ সংক্রান্ত নারীদের একটি সার্বজনীন ধারণাই হচ্ছে পুরুষ আদিরূপ। এটাকে একটি আদর্শ পুরুষ রূপও বলা যায়। এই সার্বজনীন ধারণার ভিত্তিতেই একজন নারী পুরুষদের যথার্থভাবে উপলব্ধি করতে পারে এবং তাদের সাথে সন্তোষজনকভাবে খাপ খাইয়ে চলতে পারে। তবে বাস্তবের পুরুষ ও আদর্শ পুরুষ রূপের মধ্যে অবশ্যই কিছু পার্থক্য থাকে। এই পার্থক্য যদি বেশী হয়ে যায়, তবে নারী পুরুষের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি শুরু হয় এবং নারী পুরুষের সম্পর্কের অবনতি ঘটে।

পুরুষদের সাথে যুগ যুগ ধরে মেলা মেশার জন্য নারীরাও কিছুটা পুরুষালী বৈশিষ্ট্য লাভ করে। পুরুষ আদিরূপ এনিমাস থেকেই মেয়েদের মধ্যে এই পুরুষালী বৈশিষ্ট্যের উৎপত্তি হয়।

মুখোশ বা পারসোনা (persona): মানুষ যেভাবে নিজেকে অন্যের কাছে উপস্থাপন করে, সেই বাহ্যিক রূপটিকেই মুখোশ বলা হয়। এই মুখোশের অন্তরালে ব্যক্তি নিজের আসল চেহারাকে ঢেকে রাখে এবং নিজেকে অন্যদের কাছে অধিকতর মোহনীয় ও গ্রহণযোগ্য রূপে উপস্থাপন করে। এই মুখোশ হচ্ছে মানুষের সামাজিক রূপ। মানুষ সামাজিক রীতি-নীতি, ভব্যতা, শিষ্টাচার, প্রভৃতির দ্বারা নিজের কদর্য ও কুৎসিত দিকটিকে ঢেকে রেখে সামাজিকভাবে নিজেকে অধিকতর আকর্ষণীয় করে তোলে। মানুষের সামাজিকভাবে আকর্ষণীয় এই বাহ্যিক দিকটিই হচ্ছে মুখোশ। তবে এই মুখোশ তার সত্যিকার চরিত্র গোপন করতে পারে অথবা না-ও পারে।

প্রাচীন কালে গ্রীক অভিনেতা অভিনেত্রীরা বিভিন্ন মুখোশ ধারণ করে মঞ্চে অভিনয় করত। এই মুখোশকেই persona বলা হ’ত। সেখান থেকেই এই persona শব্দটি গৃহীত হয়েছে। পৃথিবীর রঙ্গমঞ্চে মানুষ বিভিন্ন ধরনের সামাজিক ভূমিকায় অভিনয় করে। একই ব্যক্তিকে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ধরনের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হয়। কোন সময় পুত্রের ভূমিকা, কোন সময় পিতার ভূমিকা, কোন সময় ছাত্র, কোন সময় শিক্ষক, কোন সময় ঊর্ধ্বতন কর্তা, কোন সময় অধস্তন কর্মচারী, প্রভৃতি বিভিন্ন ভূমিকা একই ব্যক্তিকে গ্রহণ করতে হয়। যুগ যুগ ধরে মানুষের পূর্বপুরুষরা পিতা-পুত্র, ছাত্র-শিক্ষক, কর্তা-কর্মচারী, প্রভৃতি ভূমিকা পালন করে যে অভিজ্ঞতা সমূহ অর্জন করেছে, তার ওপর ভিত্তি করেই বিভিন্ন সামাজিক ভূমিকা সম্পর্কে একটি সার্বজনীন ধারণা গড়ে উঠেছে এবং এই সামাজিক ভূমিকাগুলোই সমাজে বসবাস রত সকলেই স্থান-কাল-পাত্র অনুসারে গ্রহণ করছে। সমাজে নিজেকে গ্রহণযোগ্য করার জন্য মানুষ সর্বজন স্বীকৃত ভূমিকাগুলোই পালন করে এবং এগুলোর মাধ্যমেই মানুষ তার প্রকৃত স্বরূপকে আড়াল করে রাখে।

অনেক সময় মানুষ নিজেকে তার এই মুখোশের সাথে অভিন্ন বলে ভাবে। ইয়ুং এর মতে এ ধরনের মানুষের ব্যক্তিত্বে কোন গভীরতা থাকে না। তাদের ব্যক্তিত্ব কৃত্তিম ও স্বকীয়তাহীন হয়ে পড়ে এবং এ অবস্থায় আত্মসত্তা (self) বিকাশের পথে বিঘ্ন সৃষ্টি হয়।

পশু আদিরূপ (shadow): মানুষের মধ্যে পশুসুলভ যে বৈশিষ্ট্য ও প্রবৃত্তি সমূহ রয়েছে, সেটাকেই পশু আদিরূপ নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এটা হলো প্রাণি সুলভ জন্মগত প্রবণতা (instinct) সমূহের সমষ্টি। মানুষের মধ্যে যে সব নীতিবহির্ভূত (immoral) এবং কামুক (passionate) প্রবণতা রয়েছে সেগুলো প্রধানত শ্যাডো থেকে জন্মলাভ করে। পশু থেকেই বিবর্তনের মাধ্যমে মানুষের উৎপত্তি হয়েছে এবং এই পশু পূর্বপুরুষদের অভিজ্ঞতাগুলোও মানুষের সমষ্টি-অচেতন বা কালেক্টিভ আনকনশাসে সুপ্ত অবস্থায় সঞ্চিত রয়েছে। পশু পূর্বপুরুষদের জীবনে যে অভিজ্ঞতাগুলোর পুনরাবৃত্তি ঘটেছে, সেগুলো থেকেই এই পশু আদিরূপের উৎপত্তি হয়েছে। এই পশু জীবনের অভিজ্ঞতা থেকেই হীন স্বার্থপরতা, বর্বরতা, হিংস্রতা, প্রভৃতি সংক্রান্ত যে ধারণা সমূহ মানুষের সমষ্টি-অচেতনে সঞ্চিত হয়েছে, সেটাই পশু আদিরূপের উৎপত্তি ঘটিয়েছে। এই পশু আদিরূপই মানুষের যাবতীয় পশু প্রবৃত্তি ও প্রবণতার জন্য দায়ী। এসব প্রবৃত্তি যখন মনের সচেতন স্তরে উপস্থিত হয়, তখন এগুলির বহিঃপ্রকাশ হতে পারে অথবা অবদমিত হতে পারে। এভাবে দেখা যাচ্ছে যে, অবদমনের ফলে কিছু কিছু প্রবৃত্তি বা কামনা যেগুলো ব্যক্তিগত অচেতনে অবস্থান করে সেগুলো পশু আদিরূপ বা শ্যাডো থেকে সৃষ্ট।

এই পশু আদিরূপ থেকেই মানুষের মনে ‘আদি পাপ’ ও ‘শয়তান’ এর ধারণার উৎপত্তি হয়েছে। তবে মানুষ সাধারণতঃ তার এই পাশবিক দিকটি সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার করে এবং পারসোনা (persona) বা সামাজিক মুখোশের অন্তরালে নিজের পশুত্বকে আড়াল করে রাখার চেষ্টা করে। ইয়ুং এর মতে যারা নিজেদের এই পশুসুলভ দিকটিকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা ও অস্বীকার করে, তাদের ব্যক্তিত্বের সজীবতা ও গভীরতা হারিয়ে যায়। ব্যক্তিত্বে এই পশুসুলভ দিকটি সমন্বয় সাধনের মাধ্যমেই একজন মানুষ একটি প্রাণবন্ত সত্তারূপে গড়ে ওঠে।

আত্মসত্তা (self): এই পঞ্চম আদিরূপ আত্মসত্তাই সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। প্রথম দিকে ইয়ুং অহমকেই ব্যক্তিত্বের কেন্দ্র বলে ধারণা করেছিলেন। কিন্তু মনের একটি ক্ষুদ্র ও সীমিত অংশ নিয়ে গঠিত অহম সমগ্র মনের প্রতিনিধিত্ব করতে পারে না বলে তিনি পরে উপলব্ধি করতে পারেন। ফলে তিনি এই আত্মসত্তা সংক্রান্ত ধারণার অবতারণা করেন। এই আত্মসত্তাই মনের কেন্দ্রে অবস্থান নিয়ে ব্যক্তির পরস্পরবিরোধী ও বৈষম্যপূর্ণ বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে সমন্বয় সাধন ও সামঞ্জস্য বিধান করে। ঐক্য ও সমন্বয় সাধনকারী শক্তি রূপে কাজ করে এই আত্মসত্তাই ব্যক্তিকে একটি একক সত্তায় পরিণত করে। তবে এই আত্মসত্তার বিকাশ ঘটে অনেক দেরীতে। ব্যক্তিত্বের সব দিকগুলোর বিকাশ ও পূর্ণতা প্রাপ্তি না ঘটা পর্যন্ত আত্মসত্তার বিকাশ ঘটে না। চেতন ও অচেতন মন, অন্তর্মুখী ও বহির্মুখী মনোবৃত্তি, বিভিন্ন মনোকার্যপ্রণালী (psychic function), বিভিন্ন আদিরূপ, প্রভৃতি বিষয়গুলোর পূর্ণতা প্রাপ্তি (individuation) ঘটার পরই আত্মসত্তার উন্মেষ ঘটতে শুরু করে। সেজন্যই আত্মসত্তার বিকাশ বিলম্বিত হয়।

এই আত্মসত্তা মনের বিভিন্ন বিরোধ ও বৈষম্যকে সমন্বিত করে মনোজগতে ঐক্য স্থাপন করে। ইয়ুং লক্ষ্য করেন যে, এই মূল আদর্শটি বিভিন্ন সমাজ বা সংস্কৃতিতে বিভিন্ন সংকেতের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়-যেগুলোকে তিনি বলেছেন, মণ্ডল (mandala) বা ম্যজিক সার্কেল (magic circle) আত্মধারণা (self) ব্যক্তির ঐক্য, অখন্ডতা এবং সমন্বয়কারী শক্তি হিসাবে কাজ করে। আত্মধারণা (বা self) যেহেতু একটি সমন্বয়কারী সূত্র, সুতরাং এটি ব্যক্তির অন্যান্য সব মানসিক তন্ত্রগুলোকে একত্রিত করে বা সংঘবদ্ধ করে। আত্মধারণা ধর্মীয় অভিজ্ঞতার মাধ্যমে ব্যক্তির সঙ্গে জগতের ঐক্য স্থাপনে চেষ্টা করে এবং ব্যক্তির অভ্যন্তরীণ তন্ত্রগুলোর মধ্যেও ঐক্য স্থাপনের চেষ্টা করে। ইয়ুং মনে করেন, মধ্য বয়সে ব্যক্তির বিভিন্ন মানসিক তন্ত্র যখন পৃথক হয়ে যায় এবং সেগুলোর মধ্যে সমন্বয় সাধনের প্রয়োজন দেখা দেয়, তখনই আত্মধারণার উদ্ভব ঘটে।

ইয়ুৎ মনে করেন, সাধারণতঃ মধ্যবয়সের দিকেই আত্মসত্তার বিকাশ শুরু হয়। মধ্য বয়সে ব্যক্তির বিভিন্ন মানসিক তন্ত্র যখন পৃথক হয়ে যায় এবং সেগুলোর মধ্যে সমন্বয় সাধনের প্রয়োজন দেখা দেয়, তখনই আত্মধারণার উদ্ভব ঘটে। ফ্রয়েডের যৌন কামনার ধারণা সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে ইয়ুং বলেন যে, মধ্য বয়সের পূর্বে যৌন কামনার গুরুত্ব সম্পর্কে ফ্রয়েডের মতবাদ সঠিক হলেও মধ্য বয়সের পরে ব্যক্তিত্বের যেসব পরিবর্তন ঘটে সেগুলো সম্পর্কে ফ্রয়েড সচেতন ছিলেন না। মধ্য বয়সের পরে যৌন কামনার তেমন কোন গুরুত্ব থাকে না, তখন আত্মধারণার বিকাশ ঘটে এবং তা ব্যক্তিত্বের সমন্বয়কারী শক্তি হিসাবে কাজ করে।

বিভিন্ন ধর্মীয় মতবাদের দ্বারা প্রভাবিত হয়েই ইয়ুং আত্মসত্তার ধারণা লাভ করেছেন। বিশেষ করে প্রাচ্য দেশীয় ধর্মীয় তত্ত্ব তার চিন্তাধারাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। বিভিন্ন ধর্মে মণ্ডল (mandala) বা ম্যজিক সার্কেল (magic circle) নামে একটি প্রতীকের ব্যবহার তিনি লক্ষ্য করেছেন। এই মণ্ডলকে ঐক্যের প্রতীক বলে মনে করা হয় এবং এটাকেই আত্মসত্তার প্রতীক রূপে তিনি মনে করেছেন। এই আত্মসত্তা শুধু মনোজগতেই ঐক্য স্থাপনে প্রয়াসী নয়; আত্মসত্তা মনোজগৎ ও বহির্জগৎ, জীব ও জড়জগৎ, ব্যক্তিসত্তা ও বিশ্বজগৎ, আত্মা ও পরমাত্মার মধ্যে ঐক্য ও সংহতি স্থাপনে প্রয়াসী হয়। এ ধরনের ঐক্য ও সংহতি একমাত্র ধর্মীয় অনুভব ও অনুশাসনের দ্বারাই অর্জন করা সম্ভব বলে তিনি মনে করেছেন। এই দিক দিয়ে ইয়ুং ক্রমশঃ আধ্যাত্মবাদের দিকে ঝুঁকে পড়েছেন এবং তার তত্ত্ব পরিণামে গূঢ়ার্থমূলক ও দুর্বোধ্য হয়ে পড়েছে। তার মতে মধ্যবয়সে মানুষের মধ্যে যখন ধীরতা ও স্থিরতা আসে, মানুষ যখন জাগতিক আসক্তি থেকে কিছুটা মুক্ত হয়ে পড়ে, তখনই তার মধ্যে ধর্মীয় অনুভব ও চেতনার উন্মেষ ঘটে এবং সে ধর্মপরায়ণ হয়ে ওঠে। ঐ সময়েই ব্যক্তি ধর্মীয় চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে নিজেকে ও বিশ্বজগতকে উপলব্ধি করার চেষ্টা করে এবং তার মধ্যে আত্মসত্তার বিকাশ ঘটে। এই আত্মসত্তার মাধ্যমেই ব্যক্তি স্বীয় সত্তা ও বিশ্বজগতের মাঝে বিরাজমান ঐক্য ও অখণ্ডতাকে উপলব্ধি করার চেষ্টা করে। ঐ সময়ে আত্মসত্তার বিকাশ ঘটানোই মানব জীবনের পরম লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়। তার মতে আত্মসত্তার বিকাশ ঘটানোই মানব জীবনের মূল লক্ষ্য হলেও খুব কম সংখ্যক ব্যক্তিই ঐ লক্ষ্য অর্জন করতে সমর্থ হয়। অধিকাংশ লোকের জীবনেই আত্মসত্তার বিকাশ অসমাপ্ত থেকে যায় এবং এমন ব্যক্তিও অনেক থাকে, যাদের মধ্যে কখনও আত্মসত্তার বিকাশ ঘটেনা।

ব্যক্তিত্বের বিকাশ

ইয়ুং-এর ব্যক্তিত্ব বিকাশের রূপরেখাটি ফ্রয়েড থেকে একেবারেই আলাদা। বংশগতির নিয়মে যেমন আমাদের দেহ গঠিত হয়, তেমনই মনও গঠিত হয়। ইয়ুং-এর মতে বংশগতিতে আমরা শুধু জৈব উত্তরাধিকার পাই না, সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারও পাই। বংশগতি এবং পরিবেশের মিথস্ক্রিয়ায় ব্যক্তিত্বের বিকাশ কার্যকারণ (causality) নিয়মাধীন। কিন্তু ব্যক্তিত্বের বিকাশে শুধু এ নিয়মই কার্যকর নয়। কার্যকর রয়েছে একটি পরম উদ্দেশ্য (teliology)। এ পরম উদ্দেশ্য বলতে ইয়ুং ব্যক্তির সচেতন লক্ষ্য বা আদর্শকে বোঝাচ্ছেন না। ভ্রূণটি একটি ব্যক্তিত্বে রূপান্তরিত হবে, এ লক্ষ্যেই এটি বিকশিত হয়। এক্ষেত্রে এটিই পরম উদ্দেশ্য। ইয়ুং-এর মতে, ব্যক্তির বর্তমানকে যখন তার অতীত দিয়ে ব্যাখ্যা করা হয়, তখন তা কার্যকারণ। আর যখন তা ভবিষ্যৎ দিয়ে ব্যাখ্যা করা হয়, তখন তা পরম উদ্দেশ্য। প্রকৃতিতে কার্যকারণ বা পরম উদ্দেশ্য, কোনটিরই অস্তিত্ব নেই। এগুলো প্রকৃতিকে বুঝতে মানুষের আরোপিত চিন্তা-পদ্ধতি মাত্র। এ দুটি উপায় ছাড়াও ব্যক্তিত্ব বিকাশের ব্যাখ্যায় অন্য একটি ধারণা ব্যবহার করা প্রয়োজন, তা সমাপতন (synchronicity)। যেমন আপনার মনে হলো, কিংবা স্বপ্ন দেখলেন, আপনার দূরবাসী কোনো আত্মীয় রোগাক্রান্ত হয়েছেন। পরে খবর পেলেন ব্যাপারটি সত্যি। ইয়ুং এসব ঘটনাকে কাকতালীয় মনে করেন না। কাকতালীয় ঘটনা, টেলিপ্যাথি (দু জন পরস্পর বিচ্ছিন্ন থেকে একই সময় একই কথা ভাবা), দূরেক্ষণ (দৃষ্টিসীমার বাইরের কিছুও দেখা), এসবের উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, সমাপতন প্রকৃতির একটি নীতি। এ নীতিতে কোনো আদিরূপ একই সঙ্গে মানসিকভাবে পূর্ণতা পায় এবং নিজেকে বর্হিজগতে শারীরিক ভাবে প্রকাশ করে। এ দুটি প্রক্রিয়ার মধ্যে কোনো কার্যকারণ সম্পর্ক পাওয়া যাবে না।

শিশু জন্মের সময় একটি অপৃথকীকৃত অখণ্ড মন নিয়েই জন্মায়। ব্যক্তিত্বের বিকাশ প্রক্রিয়ায় এ অপৃথকীকৃত মন, মানসিক তন্ত্রসমূহে পৃথকীকৃত, বিকশিত ও প্রকাশিত হয়। তবে বিকাশ প্রক্রিয়ায় অগ্রগতির মতো কখনও পশ্চাদগতিও হতে পারে। অবশ্য এ পশ্চাদগতি চূড়ান্ত নয়। বাধাপ্রাপ্ত মানসিক শক্তি অচেতনে সঞ্চিত হয়ে বিকাশের নতুন পথ খুঁজে নেয়। ইয়ুং এ সামগ্রিক প্রক্রিয়াটিকে বলেন স্বাতন্ত্র্যায়ন প্রক্রিয়া। তবে এটিই বিকাশের চূড়ান্ত রূপ নয়। বিকাশ চূড়ান্ত হয় পৃথকীকৃত বিকশিত তন্ত্রগুলোর সমাকলনে সমন্বিত-সমগ্র মন গঠনের মাধ্যমে। এ সমাকলনের প্রক্রিয়াটিকে ইয়ুং বলেন ‘অনুপম প্রক্রিয়া’ (transcendent function)। এটিই ‘আত্ম বাস্তবায়ন’ (self realization)। তার মতে মানব ভ্রূণকোষে যে সামগ্রিকতা প্রচ্ছন্ন আকারে লুক্কায়িত থাকে, আত্ম-বাস্তবায়নের মাধ্যমে তা প্রকটিত হয়।

বিকাশই উদ্‌গতি (sublimation)। বিকশিত হতে না পারলে মানুষের শক্তি অচেতনে প্রত্যাগমন করে, বিলুপ্ত হয় না। এটি অবদমন (repression)। চেতন মনে আত্ম বাস্তবায়ন সম্ভব না হলেও অচেতনে এ আকাঙ্ক্ষাটি বর্তমান থাকে। তা প্রকাশিত হয় স্বপ্নে, পুরাণে, এবং প্রতীকে। এ পূর্ণতার প্রতীক, ‘মণ্ডল’ প্রতীক। তাই পুরাণে, স্বপ্নে, স্থাপত্যে, ধর্মে এর বহুল ব্যবহার লক্ষ করা যায়। ইয়ুং-এর নিকট প্রতীক খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটি একই সঙ্গে সহজাত প্রবণতার প্রকাশ হিসাবে মানব জাতির অতীতের ফসল। আবার সম্ভাবনা হিসাবে মানবজাতির চূড়ান্ত লক্ষ্যের প্রকাশ। এটি যেহেতু একই সঙ্গে কার্যকারণ ও পরম উদ্দেশ্যের প্রকাশ, তাই এটি শুধুমাত্র কার্যকারণের মাধ্যমে প্রাপ্ত ফল থেকে বৃহৎ।

ব্যক্তিত্বের চালিকা শক্তি লিবিডো (libido)

ইয়ুং মানুষের মধ্যে যে মৌলিক শক্তির কল্পনা করেছিলেন তা ফ্রয়েডের ধারণার চেয়ে সাধারণ মানুষের কাছে বেশী বোধগম্য ছিল। ব্যক্তিত্বের চালিকা শক্তি রূপে ইয়ুং লিবিডো (libido) এর কথাই বলেছেন। তবে তার লিবিডোর ধারণা ফ্রয়েডের ধারণা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের। ইয়ুং লিবিডো বা আদিম কামনাকে প্রধানতঃ যৌনকামনা বলে বিবেচনা না করে এটাকে সাধারণ জীবনী শক্তি হিসাবে কল্পনা করেছেন। ফ্রয়েড যেমন মনে করতেন যে, যৌনকামনা বিকাশের বিভিন্ন স্তরে শরীরের বিভিন্ন স্থানে কেন্দ্রীভূত হয় যেমন-মৌখিকস্তর, পায়ুস্তর, লিঙ্গত্তর, সুপ্তিকাল এবং যৌনস্তর। ইয়ুৎ মনে করতেন যে, মানুষের জীবনের একটি বিশেষ মুহূর্তে খাদ্য গ্রহণ, রেচন, বর্জন এবং যৌন ক্রিয়া এগুলোর মধ্যে যেটি সবচেয়ে বেশী গুরুত্বপূর্ণ সেটির মাধ্যমেই জীবনী শক্তি আত্মপ্রকাশ করে। শৈশবে শিশুর আনন্দের কেন্দ্রস্থল হলো মুখ; কারণ মুখের সাহায্যে সে খাদ্য গ্রহণ করে। অর্থাৎ ফ্রয়েডের মত ইয়ুৎ শিশুর মুখমন্ডলের উত্তেজনাকে যৌন উত্তেজনা বলে মনে করেন নি, এবং মুখের অঞ্চলের আনন্দকে যৌন আনন্দ বলে মনে করেন নি। ফ্রয়েডের মত ইয়ুং সব রকম সুখকর বা আনন্দ দায়ক অনুভূতিকে যৌন অনুভূতি বলে মনে করেননি।

ইয়ুৎ যেহেতু যৌনকামনাকে একমাত্র মৌলিক শক্তি বলে মনে করেন নি, সেহেতু মনোসমীক্ষণের অন্যান্য তথ্যকেও তিনি অন্যভাবে ব্যাখ্যা করতে চেষ্টা করেছেন। ইডিপাস কমপ্লেক্স বা ইডিপাস গৃঢ়েষণাকেও তিনি ফ্রয়েডের চেয়ে ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করেছেন, যেমন করেছিলেন এডলার (Adler)। ইয়ুৎ মনে করেন, মায়ের প্রতি শিশুর মনোভাব প্রথমে নির্ধারিত হয় মায়ের পুষ্টিদান কাজের মাধ্যমে, পরবর্তী বয়সে আরো কিছু জন্মগত আদিম কামনার সঙ্গে শৈশবকালীন ধারণার সংমিশ্রন ঘটে। এসব অভিজ্ঞতা একযোগে মায়ের প্রতি শিশুর সম্পর্ক ও প্রতিক্রিয়া নির্ধারণ করে অর্থাৎ ইডিপাস গৃঢ়ৈষণা সম্পূর্ণভাবে যৌনতার দ্বারা নির্ধারিত নয়, যেমনটি ফ্রয়েড মনে করতেন।

ইয়ুং লিবিডো বলতে একটি সাধারণ জৈব শক্তিকে বুঝিয়েছেন। এই জৈব শক্তি জীবন ধারণের জৈবিক প্রক্রিয়া থেকে উৎপন্ন হয়। অর্থাৎ দেহের বিপাকক্রিয়া থেকে এই জৈব শক্তির উৎপত্তি হয় এবং এই শক্তিই ব্যক্তিত্বের যাবতীয় কার্যাবলী সম্পাদনের পেছনে চালিকাশক্তি রূপে কাজ করে। অর্থাৎ লিবিডো মনোশক্তি রূপেও কাজ করে। তবে কিভাবে লিবিডোর জৈব শক্তি মনোশক্তিতে রূপান্তরিত হয়, সে সম্পর্কে ইয়ুং কিছু বলেননি। বরং তিনি লিবিডো ও মনোশক্তিকে অভিন্ন অর্থে ব্যবহার করেছেন। লিবিডোর দ্বারা ব্যক্তিত্বের যে সমস্ত কার্যাবলী সম্পাদিত হয়, তার মধ্যে যৌনমূলক কার্যাবলী শুধু একটি মাত্র দিক। মানুষের শিক্ষামূলক কার্যাবলী, পেশামূলক কার্যাবলী, পরিণত বয়সে ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক কার্যাবলী, প্রভৃতি যাবতীয় বিষয় এই লিবিডোর শক্তি দ্বারাই পরিচালিত হয়। শেষের দিকে অবশ্য ইয়ুং মানুষের আধ্যাত্মিক জীবনের ওপরই বেশী গুরুত্ব আরোপ করেছেন। ফলে শেষ জীবনে তিনি বেশ কিছুটা অতীন্দ্রিয়বাদী হয়ে উঠেছেন।

ইয়ুং লিবিডোর কার্যাবলীকে দ্বিবিধ শ্রেণীতে বিভক্ত করেছেন। একটি হচ্ছে জৈবিক কার্যাবলী ক্ষুধা নিবৃত্ত করা বা যৌন স্পৃহা স্পৃহা চরিতার্থ করার আচরণ জৈবিক কার্যাবলীর অন্তর্ভুক্ত। এ ধরনের কার্যাবলীর মাধ্যমে ব্যক্তি স্বীয় অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখে ও বংশবিস্তার করে। অপর শ্রেণীর কার্যাবলী হচ্ছে সাংস্কৃতিক ও আধ্যাত্মিক প্রকৃতির। এ ধরনের কার্যাবলীর মাধ্যমে ব্যক্তি তার সামাজিক-সাংস্কৃতিক ক্রিয়াকর্ম পালন করে এবং স্বীয় ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক জীবনের উন্নতি সাধন করে।

ইয়ুং এর মতে লিবিডো একটি চলমান বা গতিশীল শক্তি রূপে চারটি নির্দিষ্ট দিকে ধাবিত হতে পারে। যখন লিবিডোর শক্তি বহির্জগতের দিকে ধাবিত হয়, তখন সেটাকে লিবিডোর বহির্গমন (outward movement) বলা হয়। সেক্ষেত্রে ব্যক্তির মধ্যে বহির্মুখী ব্যক্তিত্বের বৈশিষ্ট্য সৃষ্টি হয়। যখন লিবিডোর শক্তি ব্যক্তির অন্তর্জগতের দিকে ধাবিত হয়, তখন সেটাকে লিবিডোর অন্তর্গমন (inward movement) বলা হয়। সেক্ষেত্রে ব্যক্তির মধ্যে অন্তর্মুখী ব্যক্তিত্বের বৈশিষ্ট্য সৃষ্টি হয়। যখন লিবিডোর শক্তি সম্মুখের দিকে ধাবিত হয়, তখন সেটাকে লিবিডোর অগ্রগমন (forward movement or progression) বলা হয়। সেক্ষেত্রে ব্যক্তিত্বের যথাযথ ক্রমবিকাশ ঘটতে থাকে এবং ব্যক্তি ক্রমশঃ উন্নতির দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। যখন লিবিডোর শক্তি পশ্চাৎ অভিমুখে ধাবিত হয়, তখন সেটাকে লিবিডোর পশ্চাৎগমন (backward movement or regession) বলা হয়। সেক্ষেত্রে ব্যক্তিত্বের বিকাশ রুদ্ধ হয়ে যায় এবং ব্যক্তি ক্রমশঃ বিকাশের পূর্বস্তরের দিকে পিছিয়ে যেতে থাকে। ইয়ুং এর মতে এই পশ্চাৎগমনেরও অবশ্য প্রয়োজন রয়েছে। বর্তমানের কোন সমস্যা সমাধান করতে ব্যর্থ হলেই ব্যক্তির ক্রমবিকাশ বন্ধ হয়ে যায় এবং তখনই ব্যক্তি তার পূর্বপুরুষদের জীবনধারার দিকে পিছিয়ে যায়। উল্লেখ্য যে পূর্বপুরুষদের অভিজ্ঞতাসমূহের বিশাল ভাণ্ডার সমষ্টি-অচেতনে সঞ্চিত রয়েছে। সেখান থেকে ব্যক্তি তার সমস্যার সমাধান পেয়ে গেলেই সে বাধামুক্ত হয় এবং তার লিবিডোর অগ্রগতি পুনরায় সূচিত হয়। সুতরাং বলা যায় যে লিবিডোর অগ্রগতি অব্যাহত রাখার জন্যই কোন কোন সময় পশ্চাৎগমন প্রয়োজন হয়ে পড়ে।

ফ্রয়েডের মতো ইয়ুংও মনকে কল্পনা করেছেন একটি আংশিক রুদ্ধ শক্তিতন্ত্র (closed energy system) হিসাবে। তিনি তাপশক্তির মতো ‘মানসিক শক্তির’ (psychic energy) কল্পনা করেছেন। তার মতে শারীরিক ও মানসিক শক্তির উভয়মুখী রূপান্তর ঘটতে পারে। মানসিক শক্তি শুধু যৌনাকাঙ্ক্ষা (libido) রূপে বর্তমান, ফ্রয়েডের এ মতকে তিনি মানেননি। তার মতে মানসিক শক্তি অনির্দিষ্ট শক্তিরূপেই থাকে এবং বিভিন্ন মানসিক কাজে ব্যয়িত হয়। ব্যক্তিত্বের কোন উপাদানে কতটুকু মানসিক শক্তি নিয়োজিত আছে, তা দ্বারা সেই উপাদানের আপেক্ষিক মূল্য নির্ধারিত হয়। পদার্থবিদ্যার নিত্যতার সূত্র কিন্তু মনোশক্তির ক্ষেত্রে পুরোপুরি প্রযোজ্য হয় না। কারণ মনোশক্তি জাগতিক শক্তির মত সম্পূর্ণ রুদ্ধতন্ত্র (closed system) নয়। জাগতিক শক্তির ক্ষেত্রে বাইরের কোন শক্তির যেমন আগমন ঘটে না, তেমনি অভ্যন্তরীণ শক্তিরও কোনরূপ নির্গমন ঘটে না। মন যেহেতু আংশিক রুদ্ধ তন্ত্র, তাই এখানে শক্তি-সংরক্ষণের নিয়ম শতভাগ কার্যকর নয়; প্রায় শতভাগ কার্যকর। মনোশক্তি পুরোপুরি রুদ্ধতন্ত্র নয় বলে ক্ষেত্র বিশেষে এর সামগ্রিক শক্তির কিছুটা হ্রাস বৃদ্ধি ঘটতে পারে। যেমন আহার, নিদ্রা বা পরিতৃপ্তি লাভের ফলে মানুষের মধ্যে নব উদ্যমের সৃষ্টি হ’তে পারে। আবার শ্রম, ক্লান্তি বা হতাশার জন্য মানুষের উদ্যম হ্রাসপ্রাপ্ত হ’তে পারে। তবে মনোশক্তি সম্পূর্ণরূপে রুদ্ধতন্ত্র না হলেও তা মোটের ওপর রুদ্ধতন্ত্রের মতই কাজ করে এবং দুটো নীতির ওপর ভিত্তি করে মনোশক্তি মনের মধ্যে ভারসাম্য অর্জনের কাজ চালিয়ে যায়।

কী সেই দুটো নীতি? ব্যক্তিত্বের এই চালিকা শক্তির প্রকৃতি ও কার্যাবলী ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে ইয়ুং পদার্থবিদ্যার দুটো নীতি অনুসরণ করেছেন। একটি সূত্রকে বলা হয় তাপগতিবিদ্যার সমতুল্যতার নীতি (principle of equivalence)। এটাকে শক্তির নিত্যতা নীতি বা conservation of energy principle রূপেও আখ্যায়িত করা হয়। এই সূত্র অনুসারে শক্তির কোনরূপ ক্ষয় বা বিলুপ্তি ঘটে না। তবে শক্তির রূপ পরিবর্তিত হয়। শক্তি এক রূপ বা এক অবস্থা থেকে অন্য রূপ বা অন্য অবস্থায় পরিবর্তিত হতে পারে। এক ক্ষেত্রে বা অবস্থায় শক্তি ব্যয়িত হলে অন্য ক্ষেত্রে বা অবস্থায় শক্তি সঞ্চিত হয়ে ওঠে। অর্থাৎ এক ক্ষেত্রের শক্তি কমলে অপর ক্ষেত্রের শক্তি বেড়ে যায় বা এক ক্ষেত্রে শক্তি বেড়ে গেলে অপর ক্ষেত্রে শক্তি কমে যায়। ফলে সমগ্র শক্তির পরিমাণ অপরিবর্তিত থাকে। মনোবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায় যে, ব্যক্তির কোন একটি মূল্যবোধের শক্তি যদি বেড়ে যায়, তবে অপর কোন একটি মূল্যবোধের শক্তি কমে যাবে। কিংবা বলা যায় যে, কোন একটি শখের প্রতি যদি একজন ব্যক্তির আকর্ষণ বেড়ে যায়, তবে অপর একটি শখের প্রতি তার আকর্ষণ কমে যাবে। অথবা একটি শখের প্রতি যদি আকর্ষণ কমে যায়, তবে অপর কোন একটি শখের প্রতি তার আকর্ষণ বেড়ে যাবে।

এ ধারণাটি ফ্রয়েডের তত্ত্বেও বিদ্যমান ছিল। যেমন ফ্রয়েড বলেছেন, অব্যবহৃত মানসিক শক্তি অন্য উপায়ে আত্মপ্রকাশ করতে পারে, যেমন, যৌন কামনা উদ্‌গতি লাভ করে সৃজনশীল ক্রিয়াকর্মে বা ললিতকলায় প্রকাশিত হতে পারে। তবে ইয়ুং মনে করতেন যে, প্রাপ্তব্য মানসিক শক্তি সব সময় সমান থাকেনা, কারণ ঐ শক্তি কিছুটা পরিবেশের সঙ্গে প্রতিক্রিয়ার জন্য মাংসপেশীর সঙ্কোচনের জন্য ও খাদ্য পরিপাকের জন্য ব্যায়িত হয়। শক্তি যেহেতু একটি মানসিক প্রণালী থেকে অন্য আরেকটি প্রণালীতে প্রবাহিত হতে পারে, সেহেতু যেসব কেন্দ্রে শক্তির উচ্চচাপ রয়েছে, সেসব স্থান থেকে নিম্নচাপ বিশিষ্ট কেন্দ্রের দিকে ধাবিত হতে পারে। এভাবে মানসিক ব্যবস্থায় একটি ভারসাম্য প্রতিষ্ঠিত হয়। আর এখানেই আসে দ্বিতীয় নীতি।

দ্বিতীয় নীতিটির নাম হচ্ছে তাপগতিবিদ্যার বিশৃংঙ্খলার নীতি (principle of entropy)। এটা হচ্ছে তাপগতিবিদ্যা (thermo-dynamics) এর দ্বিতীয় সূত্র। এটি অনুযায়ী ব্যক্তিত্বের তন্ত্রগুলি সবসময় একটি শক্তি ভারসাম্যের অবস্থায় আসতে চায়। ভিন্ন তাপমাত্রাবিশিষ্ট দুটো বস্তুর মধ্যে যদি পারস্পরিক সংস্পর্শ ঘটে, তবে অধিক উষ্ণ বস্তুর তাপ নিম্ন তাপসম্পন্ন বস্তুতে সঞ্চারিত হবে এবং দুটো বস্তুর তাপ মাত্রায় সমতা এসে যাবে। অর্থাৎ দুটো বস্তুই সমান তাপবিশিষ্ট হয়ে পড়বে। জলের উচ্চতার মাত্রা (level) রক্ষার ক্ষেত্রেও ঐ একই সূত্রের প্রতিফলন দেখা যায়। দুটো জলপাত্রে জলের উচ্চতা যদি অসম হয় এবং দুটো পাত্রের মধ্যে যদি সংযোগ স্থাপিত হয়, তবে এক পাত্রের জল (যে পাত্রে জলের উচ্চতা বেশী) অপর পাত্রে (যে পাত্রে জলের উচ্চতা কম) স্থানান্তরিত হবে এবং দুটো পাত্রের জলের উচ্চতা সমান হয়ে পড়বে। মনোবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে বলা যায় যে, ব্যক্তিত্বের বিভিন্ন ‘তন্ত্রগুলো (systems) এর মধ্যে যখন পারস্পরিক সংযোগ ঘটে, তখন ওগুলোতে বিদ্যমান শক্তির মধ্যেও তেমনি একটি সমতা স্থাপিত হবে। অর্থাৎ অধিক শক্তি সম্পন্ন তন্ত্রের শক্তি নিম্ন শক্তি সম্পন্ন তন্ত্রে স্থানান্তরিত হবে। ফলে ওগুলোর শক্তির মধ্যে একটি ভারসাম্য স্থাপিত হয় এবং ওগুলো সমশক্তি সম্পন্ন হয়ে পড়ে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় যে, দুটো অসম শক্তি সম্পন্ন মূল্যবোধের মধ্যে যদি সংযোগ স্থাপিত হয়, তবে অধিক শক্তি সম্পন্ন মূল্যবোধের শক্তি দুর্বল শক্তি সম্পন্ন মূল্যবোধে সঞ্চারিত হবে এবং দুটো মূল্যবোধের শক্তির মধ্যে একটি ভারসাম্য এসে যাবে। যেমন কোন ব্যক্তির মধ্যে যদি ধর্মীয় মূল্যবোধ খুব শক্তিশালী হয় এবং অন্যের প্রতি করুণাবোধ যদি দুর্বল হয়, তবে এ দুটো একত্রে সংযুক্ত হলেই ধর্মীয় মূল্যবোধের শক্তি অপরের প্রতি করুণাবোধে সঞ্চারিত হবে। ফলে দুটো মূল্যবোধই সম শক্তি সম্পন্ন হয়ে পড়বে।

তবে ভারসাম্য কখনও সম্পূর্ণভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। এমনকি একটি মোটামুটি ধরণের ভারসাম্য প্রতিষ্ঠিত হলেও বাহ্যিক পৃথিবীর বিভিন্ন ঘটনাবলীর সাথে পারস্পরিক ক্রিয়ার ফলে পুনরায় ভারসাম্যচ্যুতি ঘটে। উদাহরণ স্বরূপ ব্যক্তিগত অচেতন সত্তায় যখন শক্তি অধিক মাত্রায় কেন্দ্রীভূত হয় তাহলে তা অন্যান্য তন্ত্রেও ছড়িয়ে পড়তে থাকবে, যেমন অহং এর মধ্যেও তা ছড়িয়ে পড়বে। এর ফলে বাইরের জগতের সঙ্গে এই শক্তির আদান প্রদান ঘটবে। আবার অহং তার শক্তির সরবরাহ বাড়িয়ে দিবে, ফলে শক্তি পুনরায় বিপরীত মুখে প্রবাহিত হবে।

বিভিন্ন তন্ত্রের শক্তি সঞ্চয়ে অতিরিক্ত তারতম্য ব্যক্তিত্বের ভারসাম্য নষ্ট করে। তাই ব্যক্তিত্বের বিভিন্ন তন্ত্রের অসম বিকাশ, মনে সংঘাত উৎকণ্ঠা ও চাপ তৈরি করে। এক্ষেত্রে দ্বন্দ্ব, বিরোধ, অভাববোধ, প্রভৃতি প্রতিনিয়ত মনের ভারসাম্য বিঘ্নিত করে এবং মনোশক্তি বা লিবিডো ভারসাম্য অর্জনের উদ্দেশ্যে ব্যক্তিকে বিভিন্ন ক্রিয়া কর্মে লিপ্ত করার জন্য শক্তি যোগায়। এখানে আরও উল্লেখ্য যে, ইয়ুং তার তত্ত্বে অনেকগুলো পরস্পর বিরোধী তন্ত্রের কথা বলেছেন। চেতন ও অচেতন মন, মুখোশ ও পশুসত্তা, বহির্মুখী ও অন্তর্মুখী মনোবৃত্তি, বিপরীতধর্মী মনোকার্যপ্রণালী, প্রভৃতি এরূপ পরস্পর বিরোধী তন্ত্র। এগুলোর দ্বন্দ্ব ও বিরোধ থেকেই মনে একটি ভারসাম্যহীন উত্তেজনাকর অবস্থার সৃষ্টি হয়। আবার এই উত্তেজনা প্রসূত মনোশক্তিই মনের দ্বন্দ্ব ও বিরোধের নিরসন ঘটিয়ে মনোরাজ্যে ভারসাম্য আনার জন্য ব্যক্তিকে চালিত করে। মনোরাজ্যে ভারসাম্যহীন অবস্থার সৃষ্টি ও ভারসাম্য অর্জনের ঘটনা পালাক্রমে চলতে থাকে। তবে ইয়ুং এর মতে একমাত্র আত্মসত্তার পূর্ণ বিকাশের মাধ্যমেই মনোরাজ্যে স্থায়ী ভারসাম্য অর্জন করা সম্ভব হয়। তন্ত্রসমূহের সুষম বিকাশ, মনে নিয়ে আসে সুসামঞ্জস্যতা, নিশ্চিন্তি ও সন্তুষ্টি। কোনো ব্যক্তির মোট মানসিক শক্তি সীমাবদ্ধ। তাই জৈব প্রয়োজনে বেশি শক্তি ব্যয়িত হলে, সাংস্কৃতিক প্রয়োজনে শক্তির অভাব পড়তে পারে। আত্মসত্তার বিকাশ ঘটানোই মানব জীবনের চরম লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু খুব কম সংখ্যক ব্যক্তিই এরূপ লক্ষ্য অর্জন করতে সক্ষম হয়। যাই হোক, ফ্রয়েডীয় ধারার মনস্তত্ত্বে যেহেতু মানসিক শক্তির গতিপ্রক্রিয়া অনুযায়ী ব্যক্তির মানসিক ক্রিয়াকে বর্ণনা ও ব্যাখ্যা করা হয়, তাই এটি সাইকোডায়নামিক ধারা নামে পরিচিত।

ইয়ুং-এর তত্ত্ব গঠনের প্রধান উপায় তুলনামূলক পাঠ। তার এ পাঠের অন্তর্গত; প্রাচীন পুরাণ থেকে আধুনিক রূপকথা, আদিম জীবনযাত্রা থেকে আধুনিক সভ্যতা, প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের ধর্ম, আলকেমি, জ্যোতিষশাস্ত্র, টেলিপ্যাথি ও দূরেক্ষণ, ঘুমন্ত ও জাগ্রত অবস্থার স্বপ্ন, নৃতত্ত্ব, ইতিহাস, শিল্প-সাহিত্য, শব্দশাস্ত্র, ক্লিনিক্যাল ও পরীক্ষামূলক গবেষণা। তিনি ঘোষণা করেন, ‘আমার কোনো তন্ত্র (system) নেই, আমি তথ্য (fact) পরিবেশন করি মাত্র।’

মৌলিক মনোবৃত্তি (basic attitudes)

ইয়ুং-এর মতে জগতের প্রতি মানুষের দুটি দৃষ্টিভঙ্গি বা অভিমুখিতা বা অভিমুখীনতাকে পৃথক করা যায়। এই দু’রকমের মনোবৃত্তি অনুসারে দু’রকমের বৈশিষ্ট্যাবলী মানুষের ব্যক্তিত্বে পরিলক্ষিত হয়। এর একটিকে বলা হয় বহির্মুখী রূপ (extraverted type) ও অপরটিকে বলা হয় অন্তর্মুখী রূপ (introverted type)। ইয়ুং-এর অন্তর্মুখীতা এবং বহির্মুখীতা এ দুটি ধারণা তার অন্যান্য ধারণাগুলির চেয়ে বেশী পরিচিত। বহির্মুখীতায় ব্যক্তির বেশীর ভাগ মনোযোগ বাহ্যিক জগতের প্রতি পরিচালিত হয়। আর অন্তর্মুখীতায় তার বিপরীত প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। ইয়ুং এর মতে ব্যক্তির লিবিডো (libido) বা জৈবশক্তি যখন বহির্জগতের প্রতি ধাবিত হয়, তখন ব্যক্তির মধ্যে বহির্মুখী মনোবৃত্তির প্রকাশ ঘটে এবং লিবিডো যখন অন্তর্জগতের প্রতি ধাবিত হয়, তখন তার মধ্যে অন্তর্মুখী মনোবৃত্তির প্রকাশ ঘটে। বহির্মুখী ব্যক্তিরা বা এক্সট্রোভার্টরা সামাজিক মেলামেশা, সামাজিক আচার অনুষ্ঠান ও সামাজিক ক্রিয়াকর্মে অধিক আগ্রহ বোধ করে এবং সামাজিক ক্রিয়াকর্মে অধিকতর সক্রিয়ভাবে অংশ গ্রহণ করে। সমাজকর্মী ও সমাজ সেবক, সমাজ সংস্কারক, সমাজের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি, রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীরা এ ধরনের বহির্মুখী মনোবৃত্তির অধিকারী হয়। অপর পক্ষে অন্তর্মুখী ব্যক্তিরা বা এক্সট্রোভার্টরা নিজের অভ্যন্তরীণ জগতের প্রতি বেশী আগ্রহী হয় এবং এ ধরনের ব্যক্তিরা বহির্জগত থেকে নিজেকে কিছুটা বিচ্ছিন্ন করে রাখে এবং নিজের অন্তরর্জগৎ ও অভ্যন্তরীণ বিষয়াবলী নিয়ে নিজেকে অধিকতর নিমগ্ন রাখে। কবি, সাহিত্যিক, বিজ্ঞানী, চিন্তাবিদ, প্রভৃতি ব্যক্তিবর্গ অন্তর্মুখী মনোবৃত্তির অধিকারী হয়।

এই উভয়বিধ মনোবৃত্তিই অবশ্য অগ্রগতি সম্পন্ন (progressive) বা পশ্চাদগতি সম্পন্ন (regressive) হতে পারে। এক্ষেত্রে এই অগ্রগতি বা পশ্চাদগতি শব্দ দুটো যথাক্রমে ভাল বা মন্দ অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে বলে মনে করা হয়। অর্থাৎ এই উভয়বিধ মনোবৃত্তি কখনও মঙ্গলজনক হতে পারে, আবার কখনও অমঙ্গলজনক হতে পারে। যেমন কোন বহির্মুখী ব্যক্তি সামাজিক সুসম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে সহজেই অপরের সুপরামর্শ ও সহযোগিতা লাভ করতে পারে এবং এর ফলে সে নিজের ও সমাজের মঙ্গল সাধন করতে পারে। আবার একজন বহির্মুখী ব্যক্তি অপরের মতামতের ওপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করতে পারে এবং অপর ব্যক্তিবর্গের ওপর অধিক নির্ভরশীল হয়ে পড়তে পারে। এর ফলে উক্ত ব্যক্তি অপরের অনুপযোগী পরামর্শ দ্বারা পরিচালিত হয়ে নিজের ও সমাজের অমঙ্গল ঘটাতে পারে। পক্ষান্তরে অন্তর্মুখী ব্যক্তি নিজের অভ্যন্তরীণ শক্তির বিকাশ ঘটিয়ে কোন সৃজনশীল কর্ম সম্পাদন করতে পারে। এ ধরনের ব্যক্তি শিল্প, সাহিত্য বা বিজ্ঞানে অসামান্য সাফল্য অর্জন করতে পারে। আবার অন্তর্মুখী ব্যক্তি কোন নঞর্থক চিন্তা ভাবনায় নিজেকে সর্বদা নিমগ্ন রেখে অহেতুক আত্মদহন ভোগ করতে পারে। এ ধরনের ব্যক্তিরা অপরের সহানুভূতি ও সহযোগিতা থেকে নিজেদের বঞ্চিত রেখে স্বীয় জীবনকে ব্যর্থতায় পর্যবসিত করতে পারে।

তবে একথা উল্লেখ করা প্রয়োজন যে কোন ব্যক্তিই সাধারণতঃ পুরোপুরি অন্তর্মুখী বা পুরোপুরি বহির্মুখী ব্যক্তিত্বের অধিকারী হয় না। প্রায় সকলের মধ্যেই অন্তর্মুখী ও বহির্মুখী মনোবৃত্তি কিছুটা মিশ্রিত অবস্থায় থাকে। কিন্তু কারো মধ্যে অন্তর্মুখী প্রবণতা অধিক প্রকট হয়ে ওঠে এবং কারো মধ্যে বহির্মুখী প্রবণতা অধিক প্রকট হয়ে ওঠে। যাদের মধ্যে অন্তর্মুখী প্রবণতা অধিক প্রকট হয়, তাদের মধ্যে বহির্মুখী প্রবণতা নির্জ্ঞান মনে কিছুটা সুপ্ত অবস্থায় বিরাজ করে। পক্ষান্তরে বহির্মুখী প্রবণতা যাদের মধ্যে প্রকট হয়, তাদের মধ্যে অন্তর্মুখী প্রবণতা নির্জ্ঞান মনে কিছুটা সুপ্তভাবে অবস্থান করে। আত্মসত্তার সম্যক বিকাশ ঘটার জন্য অবশ্য এ দুটো মনোবৃত্তির সমভাবে বিকাশ লাভের প্রয়োজন হয়। পরস্পরবিরোধী প্রবণতার একটি ভারসাম্যপূর্ণ বিকাশ ঘটার পরেই কেন্দ্রীয় অবস্থানে আত্মসত্তার বিকাশ ঘটা সম্ভব হয়ে ওঠে।

সাধারণত অহং (Ego) এবং ব্যক্তি-অচেতন (personal unconscious)-এর অভিমুখিতা বা দৃষ্টিভঙ্গী বিপরীতমুখী হয়ে থাকে। কারণ, ব্যক্তিসত্তায় সব সময়ই কিছু পরিমাণে উভয় ধারণের দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থিত থাকে। যে দৃষ্টিভঙ্গিটি অপ্রবল (non-dominant) সেটি অবদমিত থাকে, আর যে দৃষ্টিভঙ্গিটি প্রবল সেটি প্রকাশিত হয়। একটি দৃষ্টিভঙ্গির সচেতন প্রকাশ তীব্রতর হলে অন্যটির অচেতন স্তরে প্রবলতর বিকাশ ঘটে। কোন কোন সময় অচেতন দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে সংযুক্ত সহজাত প্রবণতার শক্তি বৃদ্ধি ঘটে এবং অবদমনের বাধা ডিঙ্গিয়ে সচেতন স্তরে প্রকাশিত হয়ে পড়ে। এভাবে প্রবল দৃষ্টিভঙ্গিটিকে অতিক্রম করে।

মনোকার্যপ্রণালী (psychic functions)

ইয়ুং এর মতে মানসিক কার্যাবলী চারটি প্রক্রিয়ায় সম্পাদিত হয়। এগুলো হচ্ছে চিন্তন (thinking), অনুভূতি (feeling), সংবেদন (sensation) ও সজ্ঞা (intuition)। ইয়ুং সাধারণ ক্রিয়া সমূহের যেমন চিন্তন, অনুভূতি (feeling) সংবেদন (sensing) এবং সজ্জা (intuiting) ইত্যাদির কোন বিশেষ সংজ্ঞা দেন নি। অর্থাৎ এই মানসিক ক্রিয়াগুলিকে তিনি সাধারণ অর্থেই গ্রহণ করেছেন। নিচে এগুলো সম্পর্কে কিছু বর্ণনা দেয়া হলো। নায়াগ্রা জলপ্রপাতের সামনে উপস্থিত হয়ে কোন দর্শক কী করবেন এই উদাহরণের সাহায্যে এই চার রকম মনোকার্যপ্রণালীকে অধিকতর ভালোভাবে তুলে ধরা যায়।

  • চিন্তন (thinking): চিন্তন প্রক্রিয়া প্রয়োগের ক্ষেত্রে ব্যক্তির মানসিক কার্যাবলী তার চিন্তন ও যুক্তি তর্কের দ্বারা পরিচালিত হয়। অর্থাৎ চিন্তন ও যুক্তি তর্কের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহের ভিত্তিতে ব্যক্তির মানসিক কার্যাবলী সম্পাদিত হয়। নায়াগ্রা জলপ্রপাতের সামনে উপস্থিত হয়ে সেই দর্শক যদি এই জলপ্রপাত সৃষ্টির ভূ-তাত্ত্বিক কার্যকারণ সংক্রান্ত বিষয়ে নিজের মনকে নিমগ্ন করে, তবে তার মধ্যে চিন্তন প্রক্রিয়া সক্রিয় হয়ে উঠবে। অর্থাৎ চিন্তন প্রক্রিয়ার দ্বারা তার যাবতীয় মানসিক কার্যাবলী সম্পাদিত হবে।
  • অনুভূতি (feeling): অনুভূতি প্রক্রিয়া প্রয়োগের সময় ব্যক্তির মানসিক কার্যাবলী তার মনের ভাবাবেগ ও অনুভূতির দ্বারা পরিচালিত হয়। নায়াগ্রা জলপ্রপাতের সামনে উপস্থিত হয়ে যদি সেই দর্শক জলপ্রপাতের অপরূপ সৌন্দর্যে বিমোহিত ও অভিভূত হয়ে পড়ে, তবে তার মধ্যে অনুভূতি কার্যপ্রণালী সক্রিয়ভাবে কাজ করবে।
  • সংবেদন (sensation): সংবেদন প্রক্রিয়া প্রয়োগের সময় ইন্দ্রিয় যন্ত্রের দ্বারা প্রত্যক্ষণ ও তথ্য সংগ্রহের মাধ্যমে ব্যক্তির মানসিক কার্যাবলী পরিচালিত হয়। নায়াগ্রা জলপ্রপাতের সামনে উপস্থিত হয়ে যদি সেই দর্শক এই জলপ্রপাতের গভীরতা, বিপুল জলরাশীর বিস্তার, জলকণার বিচ্ছুরণ ও কুয়াশা সৃষ্টি, প্রভৃতি বিষয়ে নিজের মনকে নিয়োজিত করে, তবে তার মধ্যে সংবেদন প্রক্রিয়ায় মানসিক কার্যাবলী সম্পাদিত হবে।
  • সজ্ঞা (intuition): সজ্ঞা প্রক্রিয়া প্রয়োগের সময় অবপ্রত্যক্ষণ (subliminal perception) ও গূঢ় চিন্তন প্রক্রিয়ার দ্বারা ব্যক্তির মানসিক কার্যাবলী পরিচালিত হয়। আভ্যন্তরিকভারে ইন্দ্রিয়াতীত এক রহস্যময় প্রক্রিয়ায় কোন বিষয় সম্পর্কে ধারণা লাভ করাকেই সজ্ঞা প্রক্রিয়া বলা হয়। বাংলা ভাষায় এটাকে ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় রূপে উল্লেখ করা হয়। নায়াগ্রা জলপ্রপাতের সামনে উপস্থিত হয়ে যদি সেই দর্শক বিশ্বপ্রকৃতির সৃষ্টি রহস্য ও সৃষ্টিকর্তা সংক্রান্ত গূঢ় বিষয়ে আত্মনিমগ্ন হয়ে পড়ে, তবে তার মধ্যে সজ্ঞা কার্যপ্রণালী সক্রিয় হবে এবং তার মানসিক কার্যাবলী সজ্ঞা প্রক্রিয়ায় সম্পাদিত হবে।

ইয়ুং উপরোক্ত চারটি মনোকার্যপ্রণালীর মধ্যে চিন্তন ও অনুভূতিকে যুক্তিভিত্তিক (rational) প্রক্রিয়া বলেছেন। কারণ এগুলোর ক্ষেত্রে মানুষ চিন্তন, যুক্তি, কল্পনাশক্তি প্রভৃতি উচ্চতর মনন শক্তিকে প্রয়োগ করে তার পারিপার্শ্বিক অবস্থাকে বিচার, বিশ্লেষণ ও মূল্যায়ন করে থাকে। অপর পক্ষে সংবেদন ও সজ্ঞা মনোকার্যপ্রণালীকে যুক্তি-বর্জিত (irrational) প্রক্রিয়া রূপে আখ্যায়িত করা হয়। কারণ এগুলোর দ্বারা শুধু প্রাথমিক তথ্য বা কাঁচা মাল মশলা সংগৃহীত হয় এবং এগুলোতে মানুষের উচ্চ মননশীলতার কোন ব্যবহার থাকে না।

এই চারটি কার্যপ্রণালী সমানভাবে মানুষের মধ্যে বিকাশ লাভ করে না। এই চারটি কার্যপ্রণালীর মধ্যে যে কোন একটি একজন ব্যক্তির মধ্যে অধিক বিকশিত ও সক্রিয় হয়। বিভিন্ন ব্যক্তির মধ্যে বিভিন্ন প্রণালী অধিক সক্রিয় হয়ে ওঠে। এই অধিক বিকশিত কার্যপ্রণালীকে উৎকৃষ্ট কার্যপ্রণালী বা সুপিরিয়র ফাংশন (superior function) বলা হয়। যুক্তিভিত্তিক ও যুক্তি-বর্জিত কার্যপ্রণালীর দুটো জোড়া (যথাক্রমে চিন্তন ও অনুভূতি এবং সংবেদন ও সজ্ঞা) রয়েছে। ঐ জোড়াদ্বয়ের যে কোন একটি জোড়ার একটি কার্যপ্রণালী কোন বিশেষ ব্যক্তির মধ্যে অধিক বিকাশপ্রাপ্ত হয়ে উৎকৃষ্ট কার্যপ্রণালীতে পরিণত হয়। এই উৎকৃষ্ট কার্যপ্রণালীটি ব্যক্তির মনের সচেতন স্তরে বিরাজ করে এবং এর দ্বারাই ব্যক্তির যাবতীয় মানসিক কার্যাবলী সম্পাদিত হয়। যে কার্যপ্রণালীটি ব্যক্তির মধ্যে সবচেয়ে কম বিকাশ লাভ করে, সেটাকে নিকৃষ্ট কার্যপ্রণালী ইনফেরিয়র ফাংশন (inferior function) বলা হয়। এই নিকৃষ্ট কার্যপ্রণালী অচেতন স্তরে বিরাজ করলেও তা একেবারে নিষ্ক্রিয় থাকে না। এই কার্যপ্রণালী ব্যক্তির অজ্ঞাতসারে তার মনের অচেতন স্তরে কাজ করে থাকে। কোন একটি জোড়ার একটি কার্যপ্রণালী উৎকৃষ্ট কার্যপ্রণালীতে পরিণত হলে, অপর জোড়ার কোন একটি কার্যপ্রণালী তুলনামূলকভাবে অধিক বিকাশ লাভ করে এবং এটি উৎকৃষ্ট কার্যপ্রণালীর সাহায্যকারী কার্যপ্রণালী (auxiliary function) রূপে কাজ করে। মনের সচেতন স্তরে উৎকৃষ্ট কার্যপ্রণালী যদি কখনও কোন কারণবশতঃ বাধাগ্রস্ত হয়, তখন এই সাহায্যকারী কার্যপ্রণালী কাজ করতে শুরু করে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় যে, যুক্তিভিত্তিক জোড়ার চিন্তন বা অনুভূতি যদি কোন ব্যক্তির উৎকৃষ্ট কার্যপ্রণালী হয়, তবে যুক্তি-বর্জিত জোড়ার সংবেদন বা সজ্ঞা প্রক্রিয়ার যে কোন একটি সাহায্যকারী কার্যপ্রণালী রূপে কাজ করবে। আবার যুক্তি-বর্জিত জোড়ার কোন একটি যদি উৎকৃষ্ট কার্যপ্রণালী হয়, তবে যুক্তিভিত্তিক কার্যপ্রণালীর কোন একটি সাহায্যকারী কার্যপ্রণালী রূপে কাজ করবে।

সুতরাং ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তির মধ্যে উৎকৃষ্ট কার্যপ্রণালী ভিন্ন রকমের হয়। তবে এই চারটি কার্যপ্রণালীর কোনটিরই গুরুত্ব কিন্তু ব্যক্তির জীবনে কোন অংশে কম নয়। ব্যক্তিত্বের পূর্ণতা খাভের জন্য এই চারটি মনোকার্যপ্রণালীরই সমভাবে বিকাশ ঘটা বাঞ্ছনীয় এবং আত্মসত্তা বিকাশের মাধ্যমেই এরূপ পূর্ণতা অর্জন করা সম্ভব হয়। এখানে উল্লেখ্য যে এই চারটি কার্যপ্রণালী সমভাবে বিকাশপ্রাপ্ত হওয়ার পরই আত্মসত্তার বিকাশ ঘটে। আত্মসত্তার বিকাশ ঘটলে এই চারটি মনোকার্যপ্রণালী আত্মসত্তাকে কেন্দ্র করে এর চারপাশে সম দূরত্বে অবস্থান করে ও এগুলো সমানভাবে বিকাশ লাভ করে। এই চারটি কার্যপ্রণালীর সংশ্লেষণই আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত।

ব্যক্তিত্বের প্রকারভেদ (Types of personality)

পূর্বে বলা হয়েছে, সাধারণত অহং (Ego) এবং ব্যক্তি-অচেতন (personal unconscious)-এর অভিমুখিতা বিপরীতমুখী হয়ে থাকে। ইন্ট্রোভার্শন ও এক্সট্রোভার্শনের মধ্যে যেটা প্রবল সেটাই সচেতন মনে আর যেটা অন্যটি অপ্রবল বলে ব্যক্তি-অচেতনে চলে যায়। সচেতন স্তরে একটির বিকাশ ঘটলে, অচেতন স্তরে অন্যটির প্রবলতর বিকাশ ঘটে। কোন কোন সময় ইন্ট্রোভারশন ও এক্সট্রোভারশনের মধ্যে যেটা অপ্রবল সেটার সাথে সংযুক্ত সহজাত প্রবণতার শক্তি বৃদ্ধি ঘটে ও তা অবদমনের বাধা ডিঙ্গিয়ে সচেতন স্তরে প্রকাশিত হয়ে পড়ে ও এভাবে প্রবল দৃষ্টিভঙ্গিটিকে অতিক্রম করে। এখন এই মনোকার্যপ্রণালীগুলোর মধ্যে যেকোন দুটি ক্রিয়া অন্য দুটির ওপর প্রাধান্য বিস্তার করে। যাদের মধ্যে একটি হয় যুক্তিভিত্তিক মানে চিন্তন ও অনুভূতি – এই দুটির একটি থেকে, আরেকটি আসে যুক্তি-বর্জিত দুটি, মানে সংবেদন ও সজ্ঞা – এই দুটির মধ্য থেকে। এই দুটির মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী যেটা, সেটা আবার উৎকৃষ্ট কার্যপ্রণালী বা সুপিরিয়র ফাংশন (superior function), দুটোর আরেকটা হয় তখন সাহায্যকারী কার্যপ্রণালী বা অক্সিলিয়ারি ফাংশন (auxiliary function)। তার মানে যদি সুপিরিয়র ফাংশন যুক্তিভিত্তিক থেকে আসে, অক্সিলিয়ারি ফাংশন যুক্তিবর্জিত থেকে আসবে, আবার যদি সুপিরিয়র ফাংশন যুক্তি-বর্জিত থেকে আসে তাহলে অক্সিলিয়ারি ফাংশন যুক্তিভিত্তিক থেকে আসবে। এই দুটিই হলো সচেতন মনের বা ইগো এর ফাংশন যা ইগো বা সচেতন মনের অভিমুখিতা বা দৃষ্টিভঙ্গী (তা ইন্ট্রোভারশন বা এক্সট্রোভারশন যাই হোক) এর সাথে সম্পর্কিত হয়। যাই হোক, এই দুটি কার্যপ্রণালী ছাড়া বাকি যে দুটো ফাংশন বা কার্যপ্রণালী থাকে সেই দুটো হচ্ছে নিকৃষ্ট কার্যপ্রণালী ইনফেরিয়র ফাংশন (inferior function)। এগুলোর প্রভাব কম থাকে, কম বিকশিত হয়, এবং বিকশিত হয় অচেতন মন বা ব্যক্তি-অচেতনে। সুপিরিয়র ও অক্সিলিয়ারি ফাংশন এই দুটোর ওপরে প্রাধান্য বিস্তার করে।

দু’রকমের মনোবৃত্তি সম্পন্ন ব্যক্তি (যথা, বহির্মুখী ব্যক্তি ও অন্তর্মুখী ব্যক্তি) এবং চার প্রকার মনোকার্যপ্রণালীর (যথা চিন্তন, অনুভূতি, সংবেদন ও সজ্ঞা) ধারণা ইয়ুং তার তত্ত্বে তুলে ধরেছেন। বহির্মুখী ও অন্তর্মুখী ব্যক্তিদের মধ্যে চার প্রকার মনোকার্যপ্রণালীর যে কোন একটি উৎকৃষ্ট কার্যপ্রণালী রূপে কাজ করতে পারে। সুতরাং দু’রকম ব্যক্তিত্বের মধ্যে চার রকম কার্যপ্রণালীর পার্থক্য হওয়ায় মোট আট প্রকার বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ব্যক্তিত্বের উদ্ভব হতে পারে। প্রকৃতপক্ষে ইয়ুং এর তত্ত্ব অনুসারে ষোল প্রকার ব্যক্তিত্বের কথা বলা যায়। কারণ প্রতিটি ব্যক্তির মধ্যে তার উৎকৃষ্ট কার্যপ্রণালীর সাথে একটি সাহায্যকারী কার্যপ্রণালী (auxilliary function) অধিক বিকাশ লাভ করে এবং উৎকৃষ্ট কার্যপ্রণালীর অনুপস্থিতিতে তা সচেতন পর্যায়ে কাজ করে। উল্লেখ্য যে উৎকৃষ্ট কার্যপ্রণালী যে জোড়া থেকে নির্ধারিত হয়, সাহায্যকারী কার্যপ্রণালী তার বিপরীত জোড়া থেকে নির্ধারিত হয়। অর্থাৎ উৎকৃষ্ট কার্যপ্রণালী যদি যুক্তিসম্পন্ন জোড়ার একটি হয়, তবে সাহায্যকারী কার্যপ্রণালী যুক্তি-বর্জিত জোড়ার যে কোন একটি হবে। আবার উৎকৃষ্ট কার্যপ্রণালী যদি যুক্তি-বর্জিত জোড়ার হয়, তবে সাহায্যকারী কার্যপ্রণালী যুক্তিসম্পন্ন জোড়ার যে কোন একটি হবে।

কোন ব্যক্তিকে তার দৃষ্টিভঙ্গি ও মানসিক ক্রিয়ার সাহায্যে বর্ণনা করা হলে আমরা একটি টাইপ বা জাতিরূপ (type) পেতে পারি। যেমন-যে ব্যক্তিকে অনুভূতিশীল চিন্তাশীল এবং অন্তমুখী হিসাবে বর্ণনা করা যায় তিনি হয়ত একজন প্রবক্তা (prophet), বা সন্যাসী। সবগুলি ক্রিয়া এবং উভয়বিধ দৃষ্টিভঙ্গিই সফলভাবে জীবন ধারণের জন্য প্রয়োজন। সেজন্য কোন ব্যক্তিকে বিশুদ্ধ একটি টাইপে শ্রেণীভূক্ত করা যায় না। অর্থাৎ বিশুদ্ধ টাইপ বলতে কিছু নেই। একজন ব্যক্তির মধ্যে সবগুলো উপাদান সামঞ্জস্যপূর্ণ ভাবে বিদ্যমান থাকে। বিশুদ্ধ টাইপ শুধুমাত্র অস্বাভাবিক বা বিকৃত ব্যক্তিত্বেরই লক্ষণ।

সুতরাং উপরে উল্লেখিত আট রকম ব্যক্তিদের মধ্যে দু’রকম সাহায্যকারী প্রণালীর পার্থক্য ঘটতে পারে এবং মোট ষোল প্রকার ব্যক্তিত্বের উৎপত্তি হতে পারে। তবে ইয়ুং এর রচনাবলীতে আট প্রকার ব্যক্তিত্বের বৈশিষ্ট্যসমূহ অধিকতর স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। নিম্নে আট প্রকার ব্যক্তিত্বের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেয়া হল –

  • বহির্মুখী চিন্তনপ্রবণ ব্যক্তিত্ব (extraverted thinking type): এ রকম মানুষ বহির্মুখী ব্যক্তিত্বের অধিকারী হয় এবং এদের মধ্যে চিন্তন প্রক্রিয়াই অধিক বিকাশ লাভ করে এবং এটাই উৎকৃষ্ট মনোকার্যপ্রণালী রূপে কাজ করে। বহির্মুখী ব্যক্তি রূপে এরা বাইরের জগতের প্রতি আকৃষ্ট হয় এবং সামাজিক মেলামেশা ও অপর ব্যক্তিবর্গ সম্পর্কে আগ্রহী হয়ে ওঠে। এরা চিন্তাপ্রবণ ব্যক্তি হয় এবং এদের চিন্তা ভাবনার উপকরণ বাইরের বস্তুজগৎ থেকে সংগৃহীত হয়। এরা বাস্তববাদী হয় এবং বুদ্ধিবৃত্তীয় কিছু নীতির দ্বারা এদের আচরণ নির্ধারিত হয় এবং সেভাবেই এদের জীবন পরিচালিত হয়। এদের বুদ্ধিবৃত্তীয় নীতি যদি উদার, প্রশস্ত ও নমনীয় হয়, তবে এ ধরনের ব্যক্তি সমাজের জন্য কিছু হিতকর কাজ করে যেতে পারে। আর এদের বুদ্ধিবৃত্তীয় নীতি যদি সংকীর্ণ ও অনমনীয় হয়, তবে তারা চতুর, তার্কিক ও বাকসর্বস্ব ব্যক্তিতে পরিণত হয়।
  • অন্তর্মুখী চিন্তনপ্রবণ ব্যক্তিত্ব (introverted thinking type): এ ধরনের মানুষ বহির্জগত অপেক্ষা নিজের মনোজগতের প্রতি বেশী আগ্রহী হয়। এদের মধ্যেও চিন্তন প্রক্রিয়া উৎকৃষ্ট মনোকার্যপ্রণালী রূপে কাজ করে। তবে এদের চিন্তা ভাবনার উপকরণসমূহ বাইরের জগৎ থেকে না এসে এদের অভ্যন্তরীণ মনোজগত থেকে উৎপন্ন হয়। এরাও বুদ্ধিবৃত্তীয় নীতির দ্বারা পরিচালিত হয়। তবে এদের নীতি অভ্যন্তরীণ চিন্তা ভাবনার দ্বারা নির্ধারিত হয়। অন্তর্মুখী ব্যক্তি রূপে এরা অপরের প্রতি নিস্পৃহ ও নিরাসক্ত হয়। এরা সামাজিকভাবে অপটু ব্যক্তিতে পরিণত হয় এবং অন্যের সাথে ভাব বিনিময়ের ক্ষেত্রে এদের অদক্ষতা প্রকাশিত হয়।
  • বহির্মুখী অনুভূতিপ্রবণ ব্যক্তিত্ব (extraverted feeling type): এরা বহির্মুখী ব্যক্তি রূপে বহির্জগতের প্রতি বেশী আগ্রহী হয়। অনুভূতিই এদের প্রধান মনোকার্যপ্রণালী হওয়ায় আবেগ অনুভূতি এদের মধ্যে বেশী মাত্রায় পরিলক্ষিত হয়। তবে বহির্মুখী ব্যক্তি রূপে এরা সামাজিকতার প্রতি বেশী গুরুত্ব প্রদান করে। ফলে এদের আবেগ অনুভূতি সামাজিক রীতি, নীতি ও মূল্যবোধের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। অপর পক্ষও যদি সমাজের প্রচলিত রীতি, নীতি ও মূল্যবোধের দ্বারা পরিচালিত হয়, তবে এরা একজন আদর্শ স্বামী বা পত্নী, আদর্শ পিতা বা মাতা, আদর্শ পুত্র বা কন্যা রূপে অন্যদের কাছে প্রতীয়মান হবে। এদের জীবন ও আচরণ মূলতঃ সামাজিক মূল্যবোধের দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে।
  • অন্তর্মুখী অনুভূতিপ্রবণ ব্যক্তিত্ব (introverted feeling type): সাধারণতঃ মেয়েদের মধ্যেই এরূপ ব্যক্তিত্ব পরিলক্ষিত হয়। অন্তর্মুখী ব্যক্তি রূপে বহির্জগত ও অন্য ব্যক্তিবর্গের প্রতি এদের কোনরূপ আগ্রহ দেখা যায় না। অনুভূতিই এদের প্রধান মনোকার্যপ্রণালী হয়। তবে এরা অত্যন্ত চাপা প্রকৃতির হয় এবং এদেরকে সহজে বোঝা যায় না। বাইরে থেকে এদেরকে সম্পূর্ণ নিরাসক্ত ও অনুভূতিহীন বলে মনে হলেও এদের অভ্যন্তরে কিন্তু তীব্র আবেগ অনুভূতি বিরাজ করে। এদের মনের অবরুদ্ধ আবেগ অনুভূতি অনেক সময় ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান বা কবিত্ব সৃষ্টির মাধ্যমে তীব্র আকারে প্রকাশ লাভ করতে পারে।
  • বহির্মুখী সংবেদনপ্রবণ ব্যক্তিত্ব (extraverted sensing type): বহির্মুখী ব্যক্তি রূপে এরা বাইরের জগতের প্রতিই বেশী আগ্রহ প্রকাশ করে এবং বহির্জগতকে কেন্দ্র করেই এদের জীবন আবর্তিত হয়। এদের মধ্যে সংবেদনই প্রধান মনোকার্যপ্রণালী হয় এবং বাইরের জগৎ থেকে প্রাপ্ত সংবেদনই এদের জীবনকে পরিচালিত করে। এদিক দিয়ে এদেরকে বাস্তববাদী বলা যায়। তবে এদের মন মানসিকতা বাস্তব থেকে প্রাপ্ত সংবেদনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। সংবেদনের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করা বা এগুলোকে মূল্যায়ন করার সামর্থ্য এদের থাকে না। এদিক দিয়ে এদেরকে ইন্দ্রিয়বাদী ব্যক্তিও বলা যায়। ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্যের ওপর ভিত্তি করেই এরা জীবন যাপন করে।
  • অন্তর্মুখী সংবেদনপ্রবণ ব্যক্তিত্ব (introverted sensing type): অন্তর্মুখী ব্যক্তি রূপে এদের মধ্যে বাইরের জগৎ, অপর ব্যক্তিবর্গ বা সামাজিকতার প্রতি কোনরূপ আগ্রহ থাকে না। এদের মধ্যেও সংবেদনই প্রধান মনোকার্যপ্রণালী রূপে কাজ করে। তবে এরা বহির্জগত থেকে প্রাপ্ত সংবেদনকে গুরুত্ব না দিয়ে এদের অন্তর্জগতে যে প্রতিক্রিয়ামূলক উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়, সেটাকেই এরা একান্তভাবে গুরুত্ব প্রদান করে। অর্থাৎ স্বীয় মনোজগত থেকে প্রাপ্ত সংবেদনের ভিত্তিতেই এরা সব কিছু অনুধাবন করে এবং সেভাবেই নিজেদের জীবন পরিচালনা করে। মেয়েদের মধ্যেই এরূপ ব্যক্তিত্ব বেশী দেখা যায় এবং অন্যদের কাছে এরা দুর্বোধ্য ব্যক্তি রূপে প্রতীয়মান হয়।
  • বহির্মুখী সজ্ঞাপ্রবণ ব্যক্তিত্ব (extraverted intuiting type): বহির্মুখী ব্যক্তি রূপে এরা বাইরের জগৎ ও সমাজের প্রতি আগ্রহী হয় এবং অন্যদের সাথে সুসম্পর্ক স্থাপন করতে পারে। এদের মধ্যে সজ্ঞা প্রক্রিয়া প্রধান মনোকার্যপ্রণালী রূপে কাজ করে। ফলে পারিপার্শ্বিক সকল বিষয় ও ঘটনাবলির একটি গূঢ় অর্থ উদ্ঘাটনের জন্য এরা সর্বদাই সজ্ঞা প্রক্রিয়ায় আশ্রয় গ্রহণ করে। অভ্যন্তরীণ কোন অচেতন প্রক্রিয়ায় কোন বিষয় সম্পর্কে ধারণায় উপনীত হওয়াকেই সজ্ঞা প্রক্রিয়া বলা হয়। এরূপ ব্যক্তি এই সজ্ঞা প্রক্রিয়া ব্যবহার করে জাগতিক ঘটনাবলির রহস্যময় গূঢ় অর্থ উদঘটনের জন্য সর্বদা সচেষ্ট থাকে। এরূপ ব্যক্তি অন্যদের কাছে প্রেরণার উৎস হয়ে দাঁড়ায় এবং এদের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে অন্যরা জীবনে কৃতিত্ব অর্জন করতে সক্ষম হয়। তবে অন্যদের প্রতি অতিরিক্ত আগ্রহী হওয়ায় এরা নিজেরা নিজেদের ক্ষেত্রে তেমন উৎকর্ষ সাধন করতে পারে না।
  • অন্তর্মুখী সজ্ঞাপ্রবণ ব্যক্তিত্ব (introverted intuiting type): অন্তর্মুখী ব্যক্তি রূপে এরা সম্পূর্ণভাবে আত্মকেন্দ্রিক হয়। অন্যদের প্রতি এরা সম্পূর্ণ নিস্পৃহ ও নিরাসক্ত হয়ে পড়ে। অন্যদের সংসর্গ ত্যাগ করে এরা একান্তভাবে মনোজগতে নিজেদেরকে আবদ্ধ রাখে। এদের মধ্যেও সজ্ঞা প্রক্রিয়াই উৎকৃষ্ট মনোকার্যপ্রণালী রূপে কাজ করে। এই সজ্ঞা প্রক্রিয়া প্রয়োগ করে জাগতিক যাবতীয় বিষয়াবলীর রহস্য ও গূঢ় অর্থ উদ্ঘাটনের কাজে এরা আত্মনিমগ্ন থাকে। এরা সমাজ, সংসার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে এবং অন্যদের সাথে ভাব বিনিময় করার ক্ষেত্রেও এরা অদক্ষ হয়ে পড়ে। তবে কোন কোন সময় এরা নিজেদের এত বেশী আত্মোন্নয়ন ঘটাতে পারে যে, এরা সমাজের অন্যদের কাছে একজন অনুকরণীয় আদর্শ বা অবতার রূপে পরিগণিত হতে পারে।

ব্যক্তিত্বের মূল্যায়ন ও চিকিৎসা পদ্ধতি

বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি সম্পর্কে ইয়ুৎ এর ধারণা ক্রমশঃ পরিবর্তিত হয়েছে বলে মনে হয়। প্রথমে তিনি প্রাতিষ্ঠানিক মনোবিজ্ঞান (Academic psychology) এবং মনোসমীক্ষণ এর মধ্যেকার ফাঁকটুকু অনুষঙ্গমূলক পরীক্ষণের সাহায্যে ভরাট করার কথা চিন্তা করেছিলেন। অর্থাৎ অনুষঙ্গ বিষয়ক পরীক্ষণগুলির সাহায্যে তিনি মনোসমীক্ষণকে আরো বেশী বৈজ্ঞানিক মর্যাদাসম্পন্ন করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ক্রমশঃ ইয়ুং সেই চিরাচরিত পরীক্ষণের সাহায্যে প্রকল্প প্রমাণ করণ জাতীয় বিশ্লেষণের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। ইয়ুং এবং তার দল ক্রমশঃ আর্ট (শিল্পকর্ম) ও পৌরাণিক কাহিনী সংগ্রহ ও বিশ্লেষণের প্রতি বেশী আগ্রহী হয়ে উঠেন। তারা মনে করলেন যে এই পদ্ধতিতে অচেতন সম্পর্কে আরো বেশী তথ্য জানা যাবে। এভাবে ইয়ুং অভিজ্ঞতা লব্ধ বিজ্ঞানের ভিত্তি স্বরূপ চিরাচরিত পরীক্ষণ পদ্ধতির প্রবল বিরোধী হয়ে উঠেন। ইয়ুং এর চিকিৎসা পদ্ধতি তার উল্লিখিত মতামতগুলোর সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। তিনি ব্যক্তির অতীতের উপর কম গুরুত্ব দিয়েছেন, বরং তার বর্তমান পরিস্থিতি এবং ভবিষ্যতের আশা আকাঙ্খার উপর বেশী গুরুত্ব দিয়েছেন। ফ্রয়েডের সঙ্গে ইয়ুং এর পার্থক্য হলো এই যে, ফ্রয়েড মনে করতেন যে, ব্যক্তি পরিবেশের প্রভাব নিষ্ক্রিয়ভাবে গ্রহণ করে, কিন্তু ইয়ুং মনে করতেন ব্যক্তি অতটা নিষ্ক্রিয় নয়, বরং সে সৃজনশীল এবং সক্রিয়। সেজন্য ইয়ুং এর মনোবিজ্ঞান ছিল আশাবাদী। ফ্রয়েড মনে করতেন ইয়ুং এর মনোচিকিৎসা আর পুরোহিতের উপদেশ প্রদানে কোন পার্থক্য নেই। ইয়ুং নৈতিক আবেদন (moral exhortations), ইচ্ছা শক্তির প্রতি আবেদন (appeal to will power) এবং মানুষের অন্তরে ঈশ্বরের আকাঙ্খা জাগানোর চেষ্টার মাধ্যমে চিকিৎসা করতেন। তিনি মনে করতেন মানুষের আদিম প্রবৃত্তি/কামনাগুলিকে সুপথে পরিচালিত করে তার ভেতরে ঈশ্বরের প্রতি আকাঙ্খা জাগিয়ে সৎকর্ম এবং আত্মোপলব্ধির পথে নিয়ে যাওয়া যায়। এই শক্তিটাকে যদি সনাক্ত করা না যায় এবং ইগো বা অহং কর্তৃক ঠিকমত ব্যবহৃত না হয়, তাহলে এটা মানুষের ক্রিয়াকর্মকে এমনভাবে জড়িয়ে ফেলতে পারে যে সে হয়ত নিউরোটিক, না হয় সাইকোটিক ব্যক্তিতে পরিণত হবে।

ইয়ুংও ফ্রয়েডের মতই মানুষের অচেতন মন, উদ্ঘাটন ও বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেছেন। তবে অচেতন মন উদ্ঘাটনের জন্য তিনি কিছু স্বকীয় কৌশল ব্যবহার করেছেন। নিম্নে তার ব্যবহৃত কয়েকটি কৌশল সংক্ষেপে বর্ণনা করা হল।

স্বপ্ন বিশ্লেষণ (dream analysis)

ইয়ুং-এর তত্ত্বে স্বপ্নের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। স্বপ্নকে তিনি ফ্রয়েডের মতো ইদ্‌-এর আকাঙ্ক্ষা পূরণের উপায় মনে করেন না। তার মতে ব্যক্তিত্বের যে দিকটি জাগ্রত অবস্থায় প্রকাশিত হয় না, স্বপ্নে তাই প্রকাশিত হয়। এভাবে স্বপ্ন ব্যক্তিত্বে ভারসাম্য আনে।

ফ্রয়েডের মত ইয়ুংও স্বপ্ন বিশ্লেষণের মাধ্যমে মানুষের অচেতন মন উদ্ঘাটনের চেষ্টা করেছেন। এদিক দিয়ে তিনি নিঃসন্দেহে ফ্রয়েডের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন। তবে তার স্বপ্ন তত্ত্ব ফ্রয়েডের স্বপ্ন তত্ত্ব থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের। ফ্রয়েডের মতে অবদমিত যৌন তাড়না বা আগ্রাসী তাড়নাই স্বপ্নের উৎপত্তি ঘটায়। কিন্তু ইয়ুং এর মতে স্বপ্ন ব্যক্তির অচেতন মনে অবস্থিত কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের ইঙ্গিত বহন করে। ব্যক্তি অনেক সময় মনের এমন কিছু উপাদানকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে অচেতন স্তরে প্রেরণ করে, যেগুলোর বিশেষ গুরুত্ব ব্যক্তির জীবনে রয়েছে। ব্যক্তিত্বের পূর্ণতা ঘটার জন্য ব্যক্তিসত্তার সবদিকেরই ভারসাম্যপূর্ণ বিকাশ ঘটা প্রয়োজন। কিন্তু ব্যক্তি যখন মনের কোন উপাদানকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে, তখন ব্যক্তির মনোরাজ্যে ভারসাম্যহীনতার সৃষ্টি হয়। স্বপ্ন মানুষের মনের সেই উপেক্ষিত বিষয়েরই ইঙ্গিত বহন করে। অনেক সময় ব্যক্তির বর্তমান জীবনের কোন সমস্যার সমাধান এই স্বপ্নে নিহিত থাকে। সমষ্টি-অচেতন কালেক্টিভ আনকনশাস আমাদের পূর্বপুরুষদের স্মৃতির এক সুবিশাল ভাণ্ডার। সেই ভাণ্ডারে আমাদের জীবনের বহুবিধ সমস্যার সমাধান নিহিত রয়েছে। সেই অচেতন মনে অবস্থিত সমাধানই সরাসরি বা কোন ইঙ্গিতের মাধ্যমে স্বপ্নে প্রতিভাত হয়। উদাহরণ রূপে বলা যায় যে হয়ত কোন ব্যক্তি একটি গাণিতিক সমস্যার সমাধান করতে ব্যর্থ হয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। তারপর স্বপ্নে সে তার অংকের যথার্থ সমাধান খুঁজে পেয়ে গেল। এক্ষেত্রে অচেতন মনে নিহিত সমাধানই স্বপ্নের মাধ্যমে সরাসরি উদ্ঘাটিত হয়েছে।

স্বপ্নে অচেতন মনের বহিঃপ্রকাশ অনেক সময়ই পরোক্ষভাবে বা ইঙ্গিতের মাধ্যমে ঘটে। ফলে স্বপ্নদ্রষ্টার কাছে এর প্রকৃত তাৎপর্য উদ্ঘাটিত হয় না। সেজন্যই স্বপ্নের কোন বিশেষ অংশ বা স্বপ্নে উল্লেখিত কোন বিশেষ ইঙ্গিত বা প্রতীককে কেন্দ্র করে ব্যক্তির যাবতীয় অনুষঙ্গসমূহ (associations) তাকে ব্যক্ত করতে বলা হয় এবং এরূপ অনুষঙ্গসমূহ বিশ্লেষণ করেই স্বপ্নের প্রকৃত তাৎপর্য উদঘাটন করা সম্ভর হয়।

ইয়ুং কোন কোন সময় অনুক্রমিক স্বপ্ন বিশ্লেষণ (dream series analysis) পদ্ধতি ব্যবহার করেছেন। এক্ষেত্রে ব্যক্তির অনেকগুলো স্বপ্ন ধারাবাহিকভাবে বিশ্লেষণ করা হয়। অনেক সময় অচেতন মনের কিছু বিষয় ব্যক্তির একাধিক স্বপ্নে আত্মপ্রকাশ করে। অর্থাৎ ব্যক্তির একাধিক স্বপ্নে কিছুটা ভিন্ন রূপে একই বিষয়ের পুনরাবৃত্তি ঘটে। সুতরাং অনুক্রমিক স্বপ্ন বিশ্লেষণের মাধ্যমে সহজেই ঐ বিষয়টিকে শনাক্ত করা যায়। অনুক্রমিক স্বপ্ন বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে বিভিন্ন স্বপ্নের কিছু গুরুত্বপূর্ণ উপাদান সম্পর্কে ব্যক্তির অনুষঙ্গসমূহ গ্রহণ করা হয় এবং ঐ অনুষঙ্গসমূহ বিশ্লেষণ করে ব্যক্তির অচেতন মনের কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উদ্ঘাটন করা সম্ভব হয়।

সম্প্রসারণ পদ্ধতি (method of amplification)

এক্ষেত্রে একই বিষয় বা প্রতীককে কেন্দ্র করে ব্যক্তির মনে যত রকম অনুষঙ্গবদ্ধ ধারণা থাকে, তা পর্যায়ক্রমে ব্যক্ত করার জন্য ব্যক্তিকে পুনঃ পুনঃ নির্দেশ দেয়া হয়। অর্থাৎ কোন নির্দিষ্ট বিষয় বা প্রতীকের সাথে জড়িত বা অনুষঙ্গবদ্ধ ধারণাসমূহকে ক্রমে ক্রমে আরও বিস্তৃত বা সম্প্রসারিত করার জন্য ব্যক্তিকে বার বার নির্দেশ দেয়া হয়। ফলে কোন বিষয় বা প্রতীকের সাথে জড়িত অনুষঙ্গসমূহের ক্রমশঃ বিস্তৃতি বা পরিব্যাপ্তি ঘটে।

এখানে উল্লেখ্য যে ফ্রয়েডের অনুষঙ্গ পদ্ধতি ও ইয়ুং এর অনুষঙ্গ পদ্ধতির মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। ফ্রয়েডের অনুষঙ্গ পদ্ধতিকে মুক্ত বা অবাধ অনুষঙ্গ পদ্ধতি বলা হয়। কারণ ব্যক্তি এখানে অবাধে বা স্বাধীনভাবে যে কোন বিষয় বা প্রসঙ্গের অবতারণা করতে পারে এবং তৎসংক্রান্ত অনুষঙ্গসমূহ ব্যাক্ত করতে পারে। কিন্তু ইয়ুং এর পদ্ধতিতে এভাবে স্বাধীনভাবে কোন বিষয় বা প্রসঙ্গ পরিবর্তনের সুযোগ ব্যক্তির থাকে না। কারণ একই বিষয়কে কেন্দ্র করে ব্যক্তির অনুষঙ্গসমূহ ক্রমশঃ সম্প্রসারিত করার জন্য তাকে নির্দেশ দেয়া হয়। অর্থাৎ নির্দিষ্ট একটি প্রসঙ্গের মধ্যে আবদ্ধ থেকে ব্যক্তিকে তার ধারণাগুলোকে ক্রমশঃ বিস্তৃত করতে হয়।

আরও উল্লেখ্য যে ইয়ুং এর পদ্ধতিতে ব্যক্তি একাই শুধু অনুষঙ্গসমূহ উত্থাপন করে না, চিকিৎসকও সংশ্লিষ্ট বিষয়ের সাথে জড়িত অনেক ধরনের অনুষঙ্গ উপস্থাপন করেন। কোন বিষয় বা প্রতীকের সাথে জড়িত সামাজিক-সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় বা আধ্যাত্মিক, পৌরাণিক বা ঐতিহাসিক, কলা বা সাহিত্য বিষয়ক অনুষঙ্গসমূহ চিকিৎসক উপস্থাপন করেন এবং এগুলো ব্যক্তির ধারণার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ কি না, তা যাচাই করে দেখেন। এভাবেই চিকিৎসক ব্যক্তির অনুষঙ্গসমূহ সম্প্রসারণ করার ক্ষেত্রে তাকে সরাসরি সাহায্য করেন।

শব্দানুষঙ্গ পদ্ধতি (word association method)

শব্দনুষঙ্গ পদ্ধতি ইয়ুং এর দ্বারাই প্রথম উদ্ভাবিত হয়েছে এবং ব্যক্তিত্বের কিছু দিক উদ্ঘাটনের জন্য তিনিই প্রথম এই পদ্ধতি প্রবর্তন করেন। শব্দানুষঙ্গ পদ্ধতি নিঃসন্দেহে ইয়ুং এর একটি অনন্য অবদান। ব্যক্তিত্বের মূল্যায়ন ও মানুষের মন মানসিকতা উদঘাটনের জন্য আধুনিক যুগেও এটাকে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদ্ধতি রূপে ব্যবহার করা হয়।

এই পদ্ধতিতে কিছু শব্দ উদ্দীপক রূপে ব্যক্তির সামনে উপস্থাপন করা হয় এবং উদ্দীপক শব্দের প্রেক্ষিতে ব্যক্তিকে তার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে বলা হয়। অনেকগুলো উদ্দীপক শব্দ ধারাবাহিকভাবে একের পর এক ব্যক্তির সামনে উপস্থাপন করা হয় এবং প্রতিটি উদ্দীপক শব্দ শোনার সাথে সাথে ব্যক্তির মনে প্রথম যে শব্দটি আসে, সেটাই তাকে তাৎক্ষণিকভাবে ব্যক্ত করতে বলা হয়। ব্যক্তির প্রতিক্রিয়া কাল (উদ্দীপক শব্দ উপস্থাপন ও প্রতিক্রিয়া শব্দ উচ্চারণের মধ্যবর্তী সময়) ও প্রতিক্রিয়া শব্দের ধরন বিশ্লেষণ করে ব্যক্তির মানসিকতা সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ ধারণা পাওয়া যায়। প্রতিক্রিয়া কাল যদি বেশী হয় এবং প্রতিক্রিয়া শব্দ যদি অবান্তর বা অর্থহীন হয়, প্রতিক্রিয়া শব্দ আংশিক বা পুরোপুরি পুনরাবৃত্তিমূলক হয়, প্রতিক্রিয়া শব্দ যদি উদ্দীপক শব্দের পরিবর্তিত রূপ (যেমন ঘৃণা থেকে ঘৃণিত) হয়, তবে তা ব্যক্তির আবেগ জড়িত কিছু জটিলতার ইঙ্গিত বহন করে। ব্যক্তিগত গৃঢ়ৈষা (pesonal complex) সম্পর্কে কিছু সংকেত পাওয়ার জন্যই ইয়ুং এই শব্দানুষঙ্গ পদ্ধতি ব্যবহার করেছেন। এই সংকেতকে কেন্দ্র করে তিনি ব্যক্তিকে তার যাবতীয় অনুষঙ্গসমূহ ব্যক্ত করার নির্দেশ দিতেন এবং প্রাপ্ত অনুষঙ্গসমূহ বিশ্লেষণ করে তিনি ব্যক্তির গৃঢ়ৈষা উদঘাটন করতেন।

উল্লেখ্য যে শব্দানুষঙ্গ পদ্ধতিতে সাধারণ কিছু আবেগ যুক্ত শব্দকেই উদ্দীপক শব্দ রূপে ব্যবহার করা হয়। আধুনিক কালের শব্দানুষঙ্গ অভীক্ষায় (word association test) ১০০টি আদর্শায়িত (standardized) উদ্দীপক শব্দ নির্দিষ্ট করা আছে। এছাড়া প্রতিক্রিয়া শব্দগুলোরও বিভিন্ন শ্রেণীবিভাগ করা হয়েছে। বিশেষ বিশেষ শ্রেণীর প্রতিক্রিয় শব্দ ব্যক্তির বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের ইঙ্গিত বহন করে।

চিকিৎসা

ইয়ুং এর তত্ত্বে উল্লিখিত ব্যক্তিত্বের বিভিন্ন দিক ও তন্ত্রগুলো কোন কোন ক্ষেত্রে প্রকৃতিগত ভাবে পরস্পরবিরোধী হয়। যেমন অহম ও পশুসত্তা, অন্তর্মুখী ও বহির্মুখী প্রবণতা, চেতন ও অচেতন মন, বিভিন্ন ধরনের মনোকার্যপ্রণালী, প্রভৃতি উপাদানগুলো অনেক ক্ষেত্রে পরস্পর বিরোধী শক্তি রূপে কাজ করে। কিন্তু ব্যক্তিত্বের পূর্ণ বিকাশ ও সুষ্ঠু কার্যাবলীর জন্য এই পরস্পর বিরোধী শক্তিগুলোর মধ্যে একটি ভারসাম্য রক্ষিত হওয়া প্রয়োজন। কারণ ব্যক্তির সুস্থ জীবনের জন্য সবগুলো উপাদানেরই প্রয়োজন রয়েছে। সুতরাং ব্যক্তির অভ্যন্তরে সবগুলো উপাদানেরই একটি ভারসাম্যপূর্ণ বিকাশ ঘটা প্রয়োজন। কিন্তু সাধারণভাবে মানুষ তার বিশেষ বিশেষ দিকগুলোর ওপর বেশী গুরুত্ব আরোপ করে এবং তার অন্য দিকগুলো উপেক্ষিত হয়ে অচেতন স্তরে প্রেরিত হয়। অচেতন মনে অবদমন করে রাখা বিষয়ের পরিমাণ যখন মাত্রাহীনভাবে বেড়ে যায়, তখন চেতন ও অচেতন মনের মধ্যে বিরাজিত ভারসাম্য সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে যায় এবং এ ধরনের অবস্থাতেই অচেতন মনের কিছু শক্তিশালী উপাদান জোরপূর্বক চেতন স্তরে প্রবেশ করে সেখানে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করে। ফলে ব্যক্তি এরূপ অস্বাভাবিক ও বেখাপ্পা আচরণ করে, যা তার ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্য বা পারিপার্শ্বিক অবস্থার সাথে মোটেও সঙ্গতিপূর্ণ হয় না। এ অবস্থাকেই ব্যক্তির আচরণ বৈকল্য রূপে গণ্য করা হয়।

ইয়ুং এর মতে নিউরোসিসসাইকোসিস গোলযোগের মধ্যে তেমন কোন গুণগত পার্থক্য নেই। এ দু’রকম গোলযোগের মধ্যে পার্থক্য শুধু মাত্রাগত। নিউরোসিস গোলযোগই যখন গুরুতর রূপ ধারণ করে, তখন তা সাইকোসিস গোলযোগে পরিণত হয়। সুতরাং গুরুতর মনোবৈকল্যই হচ্ছে সাইকোসিস। তার মতে এই গুরুতর, মনোবৈকল্যের ক্ষেত্রে আসলে সমষ্টি-অচেতন বা কালেকটিভ আনকনশাসে অবস্থিত প্রাচীনতম পূর্বপুরুষদের আদিমতম মন মানসিকতা ও বৈশিষ্ট্যের বহিঃপ্রকাশ ঘটে। সেজন্যই এরূপ আচরণ চরমভাবে বেখাপ্পা ও অদ্ভুত বলে মনে হয়। ইয়ুং এর মতে অলীকপ্রত্যক্ষণ ও বিভ্রান্তি (hallucination and delusion) হচ্ছে সমষ্টি-অচেতনের আদিমতম অভিজ্ঞতার প্রতিফলন। ব্যক্তির মধ্যে অতিরিক্ত মাত্রায় পশ্চাৎগমন (regression) ঘটার ফলেই আদিম পূর্বপুরুষদের অভিজ্ঞতাগুলো অলীকপ্রত্যক্ষণ ও বিভ্রান্তির রূপ নিয়ে তার মধ্যে ফিরে আসে।

ইয়ুং প্রথমদিকে মনে করতেন যে, স্কিজোফ্রেনিয়া (সাইকোসিসের একটি প্রকরণ) নামক মারাত্মক মানসিক রোগের জন্য কিছু শারীরিক পরিবর্তন দায়ী হতে পারে। এর দ্বারা বোঝা যায় যে, ইয়ুৎ ফ্রয়েডের চিন্তা ধারা থেকে সম্পূর্ণ পৃথক দৃষ্টি ভঙ্গি গ্রহণ করেছিলেন। ফ্রয়েড নিউরোসিসের কারণের জন্য যেখানে ঐতিহাসিক ঘটনাবলীকে (অর্থাৎ ব্যক্তির অতীত ইতিহাসকে। দায়ী করেছিলেন, সেখানে ইয়ুৎ সমসাময়িক ঘটনাবলীর উপর অধিকতর গরুত্ব আরোপ করেছিলেন। যদিও স্কিজোফ্রেনিয়ার কারণ নির্ণয়ে শারীরিক ঘটনাবলীর প্রভাব সম্পর্কে ফ্রয়েড ইয়ুং এর সাথে একমত পোষণ করতেন, কিন্তু ফ্রয়েড সাধারণভাবে নিউরোসিস এর কারণ হিসাবে বর্তমান ঘটনাবলীর প্রভাব সম্পর্কে ইয়ুৎ এর সাথে একমত হতে পারেন নি। এ বিষয়ে ফ্রয়েডের ধারণা ছিল অনেকটা আচরণবাদীদের বা বিহ্যাভিওরিস্টদের মত। আচরণবাদীরা ব্যক্তির আচরণে অতীত ঘটনাবলীর প্রভাবকে গুরুত্ব দেন। ইয়ুং এর ধারণা ছিল অনেকটা গেস্টাল্টবাদীদের মত। গেস্টাল্টবাদীরা আচরণের নির্ধারক হিসাবে সমসাময়িক প্রভাবের গুরুত্ব দেন। ইয়ুং শুধুমাত্র বর্তমানকে গুরুত্ব দেন নি, তিনি বলেছেন, মানুষের আচরণকে বুঝতে হলে তার ভবিষ্যৎ সম্ভাবনাগুলিও বুঝতে হবে। মানুষের আচরণের গতি নির্ধারণে তার অতীত যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি তার ইচ্ছা, আকাঙ্খা এবং লক্ষ্যগুলো। তিনি শুধুমাত্র অতীতের ঘটনাবলী দ্বারা আচরণকে ব্যাখ্যা করার ফ্রয়েডের নীতি মোটেই সমর্থন করেন নি এবং ফ্রয়েডের এই তত্ত্বকে হ্রাসকরণমূলক (reductive) এবং যান্ত্রিক তত্ত্ব বলে দোষারূপ করেন। পরবর্তীকালে ইয়ুং সমসাময়িকতার অনুরূপ একটি ধারণা, synchronicity, তৈরী করেন। এই ধারণাটি দ্বারা তিনি বুঝাতে চেয়েছেন, যে সব ঘটনা একই সঙ্গে একই সময়ে ঘটে, অথচ একটি আরেকটিকে প্রভাবান্বিত করে না।

(নিচে টীকা অংশে নিউরোসিস, সাইকোসিস ও স্কিজোফ্রেনিয়া সম্পর্কে ধারণা দেয়া হয়েছে)

ইয়ুং এর মতে মানসিক গোলযোগের চিকিৎসার জন্য ব্যক্তির মনোজগতে একটি ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থা সৃষ্টি করা প্রয়োজন। সুতরাং রোগীর ব্যক্তিত্বের উপেক্ষিত ও অবদমিত বিষয়গুলোকে উন্মোচন করা ও ওগুলোকে চেতন মনের সাথে সমন্বিত করাই হচ্ছে মনোচিকিৎসকের উদ্দেশ্য। সেজন্যই ইয়ুং বিভিন্ন কৌশল প্রয়োগ করে রোগীর অচেতন মনের অবদমিত ও উপেক্ষিত বিষয়গুলো উদ্ঘাটন ও বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেন এবং এগুলোর যথাযথ বিকাশ ঘটানোর জন্য রোগীকে সাহায্য করেন এবং তার মানসিক গঠনে একটি ভারসাম্য সৃষ্টির চেষ্টা করেন।

সুতরাং রোগীর ব্যক্তিত্বের বিভিন্ন দিকের বিকাশ ঘটিয়ে তার মানসিক গঠনে একটি ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থা সৃষ্টি করাই মনোচিকিৎসার মূল উদ্দেশ্য। এই উদ্দেশ্য সাধনের জন্য ইয়ুং চারটি ধাপে অগ্রসর হয়েছেন। এই চারটি ধাপ হচ্ছে স্বীকারোক্তিকরণ (confession), বিশদকরণ (elucidation), শিক্ষণ (education) ও রূপান্তরকরণ (transformation)।

  • স্বীকারোক্তিকরণ (confession): চিকিৎসকের সাথে একটি হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপিত হওয়ায় রোগী আত্মত্মবিশ্লেষণের মাধ্যমে নিজের দুর্বলতা ও সীমবদ্ধতা উপলব্ধি করতে পারে এবং চিকিৎসকের সহানুভূতিশীল মনোভাবের প্রেক্ষিতে সে তার নিজের ত্রুটিগুলো চিকিৎসকের সামনে সহজেই তুলে ধরতে পারে। এটাই হচ্ছে স্বীকারোক্তিমূলক ধাপ।
  • বিশদকরণ (elucidation): ব্যক্তির দোষ, ত্রুটি বা দুর্বলতা সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য লাভের জন্য দ্বিতীয় ধাপের কাজ শুরু হয়। এ পর্যায়ে ব্যক্তিকে তার দুর্বলতা সংক্রান্ত যাবতীয় অনুষঙ্গবদ্ধ ধারণাগুলো ব্যক্ত করতে বলা হয়। উল্লেখ্য যে ব্যক্তিকে নির্দিষ্ট বিষয় সম্পর্কে তার অনুষঙ্গসমূহ ব্যক্ত করার নির্দেশ দেয়া হয়। চিকিৎসকও অনেক সময় ঐ বিষয় সম্পর্কে কিছু অনুষঙ্গ উপস্থাপন করে ব্যক্তির ধারণাকে আরও সম্প্রসারিত করেন। এভাবেই রোগীর ব্যক্তিত্বের দুর্বল ও উপেক্ষিত দিকগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করার প্রক্রিয়াকেই বিশদকরণ বলা হয়েছে।
  • শিক্ষণ (education): সমস্যা চিহ্নিত হওয়ার পর তা অপসারণ করার জন্য ব্যক্তির মানসিক গঠন ও ব্যক্তিত্বে কিছু পরিবর্তন আনা প্রয়োজন হয়। কি ধরনের পরিবর্তন আনতে হবে এবং কিভাবে সেই পরিবর্তন ঘটাতে হবে, সে সম্পর্কে চিকিৎসক রোগীকে কিছু উপদেশ ও নির্দেশ প্রদান করেন। চিকিৎসকের এরূপ উপদেশ ও নির্দেশ পালন ও অনুশীলন করার প্রক্রিয়াকেই শিক্ষণমূলক ধাপ বলা হয়।
  • রূপান্তরকরণ (transformation): রোগী যখন চিকিৎসকের উপদেশ ও নির্দেশ যথাযথভাবে পালন ও অনুশীলন করতে সক্ষম হয়, তখনই তার মানসিক গঠন ও ব্যক্তিত্বে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন সাধিত হয়। ব্যক্তির অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন তন্ত্র ও প্রবণতা সমূহের মধ্যে একটি সুসামঞ্জস্যপূর্ণ সমন্বয় ঘটে এবং তার ব্যক্তিত্ব নতুন রূপে সংগঠিত হয়। নতুনভাবে ব্যক্তিত্বের এই সুসংগঠিত রূপ ধারণ করাকেই রূপান্তরকরণ বলা হয়েছে। ইয়ুং এর মতে রূপান্তরকরণ প্রক্রিয়ায় ব্যক্তির ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক চেতনা একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক চেতনা শুধু মনোজগতেই ঐক্য স্থাপন করে না, এরূপ চেতনা বিশ্বজগৎ ও বিশ্বজগতের স্রষ্টার সাথেও ব্যক্তির একটি একাত্মবোধের সৃষ্টি করে। এরূপ ঐক্য ও একাত্মবোধের প্রেক্ষিতে ব্যক্তির কাছে তার নিজের জীবন ও অস্তিত্ব অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে ওঠে এবং তার মনের সকল প্রকার অসামঞ্জস্য ও অস্থিরতা দূর হয়ে সেখানে এক পরম প্রশান্তিময় অবস্থার সৃস্টি হয়।

মূল্যায়ন

ইয়ুং-এর অবদানের মূল্যায়ন করা কঠিন। জোনস (Jones, 1951)-এর মতে তার মানসিকতা সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট ছিল না। তার একজন সহকারী বলেছেন, বাল্যে ইয়ুং-এর চিন্তাধারা বিভ্রান্ত ও অস্পষ্ট ছিল। ইয়ুং নিজেই তার রচনার ত্রুটিগুলি সম্পর্কে অবহিত ছিলেন। লেখার জন্য তিনি প্রয়োজনীয় শ্রম ও সময় দিতে পারেননি। পদ্ধতিগতভাবে এসব রচনা ত্রুটিমুক্ত ছিলনা।

ইতিবাচকতা

ঊনবিংশ শতাব্দীর সন্ধিক্ষণে ফ্রয়েড প্রদত্ত তত্ত্বের অভিনবত্ব মানুষকে যেমন চমৎকৃত ও অভিভূত করেছে, তেমনি তার তত্ত্বের কিছু দিক মানুষের আত্মাভিমানে আঘাত হেনে মানুষকে বিমূঢ় ও বিচলিত করে তুলেছে। এই প্রেক্ষিতে ইয়ুং প্রদত্ত বিশ্লেষণাত্মক মনোবিজ্ঞান মানুষের জন্য অনেকখানি স্বস্তি বহন করে এনেছে। প্রথমেই উল্লেখ করা যায় যে, ইয়ুং ফ্রয়েডের লিবিডো তত্ত্বকে যৌনতার রাহুগ্রাস থেকে মুক্ত করেছেন এবং লিবিডোর শক্তিকে তিনি অত্যন্ত ব্যাপক অর্থে ব্যাখ্যা করেছেণ। এদিক দিয়ে বলা যায় যে, ইয়ুং ফ্রয়েডীয় তত্ত্বের সংকীর্ণতাকে অতিক্রম করতে পেরেছেন এবং অধিকতর প্রশস্ত দৃষ্টিকোণ থেকে তিনি মানব আচরণকে ব্যাখ্যা করতে সক্ষম হয়েছেন।

ইয়ুং প্রদত্ত ব্যক্তিগত গৃঢ়ৈষা (personal complex) এর ধারণাকেও তার একটি অনন্য অবদান রূপে গণ্য করা হয়। এ ধরনের গূঢ়ৈষা বা অচেতন স্তরের সুসংগঠিত ধারণাপুঞ্জ শুধু আপন স্বাতন্ত্র্যই অর্জন করে না, তা অনেক সময়ই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ব্যক্তিত্বের ওপরও পূর্ণ নিযন্ত্রণ ক্ষমতা লাভ করে। ফলে এই গূঢ়ৈযার ধারণা দিয়ে মানুষের অনেক আচরণই ব্যাখ্যা করা সম্ভব হয়।

ইয়ুং প্রদত্ত আদিরূপ বা আর্কেটাইপ (archetype) এর ধারণাও তার একটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান। এমন অনেক সার্বজনীন ধারণা মানুষের রয়েছে, যা সর্বদেশে ও সর্বকালে মানুষের আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করে। যেমন মাতৃ আদিরূপ (mother architype) সর্বকালে ও সর্বদেশে মা ও সন্তানের মধ্যে বিরাজিত সম্পর্ককে চিরাচরিতভাবে নিয়ন্ত্রিত করে এসেছে। এরূপ আদিরূপ এর ধারণা দিয়েও মানুষের অনেক আচরণকে সহজেই ব্যাখ্যা করা যায়।

ব্যক্তিত্বের অভিমুখীনতা বা অভিমুখিতা (orientation) হিসাবে অন্তর্মুখী ও বহির্মুখী এ ইয়ুংগীয় বিভাগটি মনোবিজ্ঞানে আত্মীকৃত। তার ‘আত্ম-বাস্তবায়ন’ ধারণাটি মনোবিজ্ঞানের ‘মানবতাবাদী’ (humanistic) ধারায় প্রধান প্রত্যয়।

ইয়ুং প্রবর্তিত ব্যক্তিত্বের অভিমুখীনতা বা অভিমুখিতা (orientation) হিসেবে বহির্মুখী ও অন্তর্মুখী ব্যক্তিত্বের ধারণাও তার একটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান, যা মনোবিজ্ঞানে আত্মীকৃত। বহির্মুখী ও অন্তর্মুখী ব্যক্তিত্বের ধারণা আধুনিক মনোবিজ্ঞানে একটি স্থায়ী আসন লাভ করেছে এবং মনোবিজ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ও তত্ত্বে তার এ সংক্রান্ত ধারণা বহুলভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে।

ইয়ুং তার ‘তত্ত্বে যে ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক বিষয়ের অবতারণা করেছেন, সেটাকেও গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচনা করা হয়। মানুষের সংঘাতময় জীবনে ধর্মীয় অনুভূতি নিঃসন্দেহে একটি রক্ষাকবচ রূপে কাজ করে। প্রচণ্ড মানসিক আঘাতের মুখেও মানুষ তার ধর্মীয় অনুভূতি দিয়ে স্বীয় মনোবল ও মানসিক সুস্থতাকে অক্ষুণ্ণ রাখতে পারে। আধুনিক যুগে প্রায়শঃই মানুষ তার জীবনের অর্থ ও তাৎপর্য এবং তার অস্তিত্বের মূল্য হারিয়ে ফেলছে। ফলে মানুষের মনে একটি অসহনীয় শূন্যতাবোধের সৃষ্টি হচ্ছে। ধর্মীয় মূল্যবোধ ও আধ্যাত্মিক চেতনা মানুষের জীবনকে অর্থপূর্ণ করে তুলতে সাহায্য করে এবং তার শূন্যতাবোধের পরিসমাপ্তি ঘটাতে পারে। আধুনিক যুগের অস্তিত্ববাদী মনোচিকিৎসা প্রণালীতে মানুষের এই শূন্যতাবোধের পরিসমাপ্তি ঘটাবার ওপরই সম্পূর্ণ গুরুত্ব আরোপ করা হয়।

ইয়ুং এর ‘আত্ম-বাস্তবায়ন’ ধারণাটি মনোবিজ্ঞানের ‘মানবতাবাদী’ (humanistic) ধারায় প্রধান প্রত্যয়।

শূন্যের প্রাসাদ

তাপশক্তির অনুকরণে ইয়ুং ‘মানসিক শক্তি’র কল্পনা করেছেন। কিন্তু মানসিক শক্তির প্রকৃতি কী, তা তিনি ব্যাখ্যা করেননি। তিনি শারীরিক শক্তি ও মানসিক শক্তির উভয়মুখী রূপান্তরের কথা বলেছেন। এ রূপান্তরের নিয়ম কী, এবং কোথায় তা সংঘটিত হয় তাও বলেননি। তিনি সমষ্টি-অচেতনকে তার তত্ত্বের কেন্দ্রে স্থাপন করেছেন। বলেছেন তা জন্মলব্ধ। তার বর্ণনা থেকে এটি স্পষ্ট যে, এর পীঠস্থান মস্তিষ্ক। কিন্তু তার তত্ত্বে মন এর সঙ্গে মস্তিষ্কের সম্পর্ক কী তার যেমন উল্লেখ নেই, তেমনি তিনি মস্তিষ্কের কর্মপ্রক্রিয়ার ধারে কাছেও যান না। এভাবে তিনি কার্যত শূন্যের উপরই তার মনের প্রাসাদটি নির্মাণ করেছেন।

তিনি বলেছেন সমষ্টি-অচেতনে মানুষের প্রজাতিগত বির্বতনের স্মৃতি এবং মানবেতিহাস বিধৃত থাকে। এটি শিশু জন্মগত ভাবেই পায়। বিবর্তনে লব্ধ জৈব স্মৃতিকে প্রবৃত্তি, জন্মগত প্রবণতা, অসাপেক্ষিত প্রতিবর্ত, এসব বলে ব্যাখ্যা করা যায়। কিন্তু মানবেতিহাসের স্মৃতি শিশু জন্মগতভাবে (জৈবিক ভাবে) পাবে কি করে? জীববিজ্ঞানের পরিভাষায় বললে তা দাঁড়ায়, ‘ব্যক্তির অর্জিত বৈশিষ্ট্য বংশগতিতে স্থানান্তরিত হয়।’ ল্যামার্কীয় এ তত্ত্বটি, ইয়ুং-এর তত্ত্ব রচনা কালেই জীববিজ্ঞানে পরিত্যক্ত হয়েছে। অর্থাৎ তার তত্ত্বটি গড়ে উঠেছে একটি ভুল অনুমানের উপর ভিত্তি করে।

বিজ্ঞানের ছদ্মবেশে ধর্মতত্ত্ব

ইয়ুং নিঃসন্দেহে তার তত্ত্বে অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ ধারণা দিয়েছেন। তবে শেষের দিকে তার চিন্তাধারা বেশ রহস্যময় হয়ে উঠেছে। শেষ দিকে তিনি তার লেখায় এমন সব গূঢ় ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক বিষয়ের অবতারণা করেছেন, যা তার তত্ত্বকে ক্রমশঃ জটিল ও দুর্বোধ্য করে তুলেছে। অর্থাৎ শেষদিকে তিনি ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিজ্ঞানের রাজ্য পরিত্যাগ করে এমন এক অতীন্দ্রিয় জগতে প্রবেশ করেছেন যে, সাধারণ লৌকিক যুক্তিবুদ্ধির দ্বারা তাকে অনুধাবন করা দুষ্কর হয়ে পড়েছে।

তবে তার চিন্তা ধারায় নতুনত্ব ছিল এবং তার ধারণাগুলো অনুসন্ধিৎসার জন্ম দিয়েছে। ফ্রয়েডের নৈরাশ্যবাদী চিন্তাধারার বিপরীতে ইয়ুং-এর তত্ত্ব আশাবাদী এবং ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। ইয়ুং নিজে পৌরাণিক কাহিনী এবং পাশ্চাত্য ধর্মগুলোর প্রতি আগ্রহী ছিলেন। যারা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির কঠোর শৃঙ্খলায় বীতশ্রদ্ধ হয়ে উঠেছেন, তাদের জন্য ইয়ুং-এর তত্ত্ব ক্ষণিকের জন্য হলেও আরামদায়ক বিশ্রামস্থল প্রদান করতে পারে। ইয়ুং-এর মনোবিজ্ঞান আধুনিক অস্তিত্ববাদী চিন্তাধারার সঙ্গে সহজেই খাপ খায়। প্রাচ্য ধর্মতত্ত্ব, অতিন্দ্রীয়বাদ এবং অস্তিত্ববাদ এগুলোর পুরুজ্জীবনের ফলে ইয়ুং-এর সমর্থন ক্রমশঃ বৃদ্ধি পাচ্ছে।

ইয়ুৎ-এর ধারণাসমূহের অন্যতম ত্রুটি হলো এই যে, এগুলো চিরাচরিত বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি দ্বারা সমর্থিত নয়। সেজন্য যারা গবেষাণাগার ভিত্তিক প্রমাণাদিকে বৈজ্ঞানিক সত্যের মাপকাঠি বলে মনে করেন, তাদের কাছে ইয়ুৎ গ্রহণযোগ্য নয়। ইয়ুং-এর তত্ত্ব সুশৃঙ্খল নয় এবং এর মধ্যে যৌক্তিক নিয়মশৃঙ্খলা নেই। তিনি কোন স্বতঃসিদ্ধ তৈরী করেন নি বা কোন অনুসিদ্ধান্ত গঠন করেন নি।

ব্যক্তিত্বের বিকাশ বর্ণনায় ইয়ুং বলেছেন, ব্যক্তিত্বের বিকাশ যেমন অতীতের নির্ণায়ক যথা বংশগতি ও পরিবেশ দ্বারা নির্ধারিত হয়, তেমনি নির্ধারিত হয় ব্যক্তিটি যে বিশেষ ব্যক্তিতে রূপান্তরিত হবে এ উদ্দেশ্য, অর্থাৎ ভবিষ্যৎ নির্ণায়ক দ্বারাও। তিনি প্রথম দৃষ্টিভঙ্গিটিকে বলেছেন কার্যকারণবাদ এবং দ্বিতীয়টিকে পরম উদ্দেশ্যবাদ। তিনি এটিও বলেছেন, প্রকৃতি নিজে কার্যকারণবাদী কিংবা পরম উদ্দেশ্যবাদী নয়। এগুলো প্রকৃতিতে আরোপিত মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি। পরক্ষণে তিনি বলেছেন, প্রকৃতিতে আমরা অনেক আপতিক ঘটনা দেখি। কার্যকারণহীন সমাপতন প্রকৃতির একটি নীতি। যেহেতু কার্যকারণ ও পরম উদ্দেশ্য প্রকৃতির নীতি নয়। তাহলে কার্যকারণহীন সমাপতনই কি প্রকৃতির একমাত্র নীতি? ব্যক্তিত্ব বিকাশের প্রক্রিয়ায় তিনি ‘অনুপম প্রক্রিয়া’ বলে আরেকটি ধারণার বর্ণনা করেছেন। এ অনুপম প্রক্রিয়ার ফলেই ভ্রূণকোষে লুক্কায়িত আদি সুপ্ত সামগ্রিক ব্যক্তিত্ব, তার সমস্ত দিকসহ প্রস্ফুটিত হয়ে উঠে।

সংক্ষেপে, ইয়ুং-এর মতে, পূর্ণপ্রস্ফুটিত ব্যক্তিত্বটি ভ্রূণকোষেই প্রচ্ছন্ন অবস্থায় বর্তমান ছিল, অনুপম প্রক্রিয়া তাকে প্রকাশ করেছে মাত্র। ব্যক্তিত্বের প্রকাশের গতিপথে অন্য যা কিছু সম্পর্কিত বলে মনে হয়, সেসব নিছক সমাপতন মাত্র। পূর্ণব্যক্তিত্বে প্রকাশিত হবে বলেই ভ্রূণকোষের পূর্ণাঙ্গ ভ্রূণে রূপান্তর, শিশু হিসাবে জন্মগ্রহণ এবং ক্রমে বড় হয়ে ওঠা। কাজেই পুরা প্রক্রিয়াটিকে পরম উদ্দেশ্যবাদী বলা যেতে পারে। আবার অন্য দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ভ্রূণকোষটিই তো বিকশিত হয়ে ব্যক্তিত্বে পরিণত হলো। তাই প্রক্রিয়াটিকে কার্যকারণবাদীও বলা যায়। এভাবে ধর্মতত্ত্ব (পরম উদ্দেশ্যবাদ) ও বিজ্ঞান (কার্যকারণবাদ) একাকার হয়ে গেছে। ধর্মতত্ত্ব ও বিজ্ঞানের এ অনুপম খিচুরিটিই আধুনিক রহস্যবাদ। ছদ্মযুক্তিজালে বুদ্ধিকে গুলিয়ে রহস্যে বুঁদ করাই এ উদ্দেশ্য।

এবার যথাযথ যুক্তির সাহায্যে ইয়ুং-এর তত্ত্বটি বিশ্লেষণ করা যায়। এটি সত্য, ব্যক্তিত্ব বিকাশে মানুষের বংশগতি ও পরিবেশ যেমন কার্যকর, তেমনি কার্যকর ব্যক্তির উদ্দেশ্য। কিন্তু এই উদ্দেশ্যকে পরম উদ্দেশ্যবাদ দিয়ে ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই। মানুষের উদ্দেশ্যও বংশগতি ও পরিবেশের মতো ব্যক্তিত্ব বিকাশের একটি নির্ণায়ক। এ তিন ধরনের নির্ণায়কের মিথস্ক্রিয়াতেই ব্যক্তিত্ব বিকশিত হয়। এ সমগ্র প্রক্রিয়াটি কার্যকারণ নিয়মাধীন। এ কার্যকারণ নিয়ম প্রকৃতিতে ক্রিয়াশীল। আবার কার্যকারণের ধারণাটি মানুষের উদ্ভাবনও বটে। মানুষের উদ্ভাবিত এ ধারণাটির সত্যতা প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের মিথস্ক্রিয়ায় প্রমাণিত হয়। বিপরীতে পরম উদ্দেশ্যবাদ প্রসঙ্গে এ কথা বলা চলে না। প্রকৃতিকে ব্যাখ্যার জন্য পরম উদ্দেশ্যবাদও মানুষের উদ্ভাবন। কিন্তু প্রকৃতির সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ায় এর সত্যতা প্রমাণিত হয়নি।

পাশ্চাত্ত্যে প্রকৃতি ব্যাখ্যায় এর প্রথম পদ্ধতিবদ্ধ ব্যবহার দেখি এরিস্টটলের রচনায়। এরিস্টটল কোনো বিষয়ের অস্তিত্বের জন্য চার ধরনের কারণকে নির্দেশ করেছেন। এগুলি উপাদানগত, ক্রিয়াগত, আকারগত এবং পরম কারণ। কোনো শিল্পী যখন মাটি দিয়ে কোনো মূর্তি গড়েন, তখন মাটি মূর্তিটির উপাদানগত্য কারণ। মূর্তি গড়তে গিয়ে শিল্পীর কাজ হলো ক্রিয়াগত কারণ। শিল্পীর যে কল্পনার অবয়বে মূর্তি গড়া হলো, এটি তার আকারগত কারণ। এবং সর্বোপরি শিল্পীর মূর্তি গড়ার উদ্দেশ্যটি পরম কারণ। এরিস্টটল মানুষের কাজের এ অভিজ্ঞতাটি, প্রকৃতির ঘটনাবলী ব্যাখ্যায় ব্যবহার করেছেন। এখানে পরম উদ্দেশ্যটি সৃষ্টিকর্তার। আকারের ধারণাটি তাঁর মনেই বিধৃত।

ধর্মতত্ত্বেরও কেন্দ্রীয় প্রত্যয় এই পরম উদ্দেশ্যবাদ। (সবকিছু তাঁর ইচ্ছাতেই ঘটে।) সমগ্র মধ্যযুগে বিজ্ঞানের বিকাশকে রুদ্ধ করেছে পরম উদ্দেশ্যবাদ। এরিস্টটলীয় পরম উদ্দেশ্যবাদকে সূচনালগ্নেই বিরোধিতা করেছে এপিকিউরীয় দর্শনডিমোক্রিটাস-এপিকিউরাসের পরমাণুবাদে, শূন্যতায় অনাদি অভাজ্য স্বতন্ত্র পরমাণুসমূহের গতিই বিশ্বের সবকিছুর কারণ। সেখানে আকার এবং পরম উদ্দেশ্যগত কারণের কোনো ঠাঁই নেই। ধর্মধ্বজীরা নাস্তিকতার দোহাই দিয়ে এপিকিউরীয় দর্শনকে কোনঠাসা করে রেখেছে। রেনেসাঁ পর্বের ইতালীয় পণ্ডিত তেলেসিও বার্ণারদিনো (Telesio Bernardino), এপিকিউরীয় দর্শনে উদ্বুদ্ধ হয়ে, এরিস্টটলের কারণ চতুষ্ঠয় থেকে আকারগত ও পরম কারণকে খারিজ করে দেন। তার প্রস্তাবিত পথেই আধুনিক বিজ্ঞানের সূচনা হয়। তারপরও বিজ্ঞানের প্রতিটি শাখাকেই, পরম উদ্দেশ্যবাদের বিরুদ্ধে পদে পদে কঠোর সংগ্রাম করে অগ্রসর হতে হয়েছে। জ্যোতির্বিজ্ঞান, পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, ভূতত্ত্ব, জীববিজ্ঞান, প্রতিটি বিজ্ঞানের ইতিহাসে সে সংগ্রামের চিহ্ন বর্তমান। প্রকৃতিবিজ্ঞানে পরম উদ্দেশ্যবাদের কফিনে শেষ পেরেকটি ঠুকে, ডারউইনের জৈববিবর্তন তত্ত্ব। বিবর্তন তত্ত্বের প্রতি ধর্মতত্ত্বের রুষের কারণ এটি। বিবর্তন তত্ত্ব বিরোধী ছদ্মবৈজ্ঞানিক তত্ত্ব ‘ইনটেলিজেন্ট ডিজাইন’-এর (ID) ভিত্তিও পরম উদ্দেশ্যবাদ। প্রকৃতিবিজ্ঞান থেকে অপসৃত হলেও পরম উদ্দেশ্যবাদ এখনও বিভিন্ন ভাবাদর্শের ক্ষেত্রে বিভিন্ন রূপে কার্যকর রয়েছে।

আধুনিক ইউরোপীয় দর্শনে সমাপতন-এর ধারণা, রেনে দেকার্তের দর্শনের সঙ্গে সম্পর্কিত। দেকার্ত বিশ্বকে পরস্পর বিচ্ছিন্ন দুটি জগতে ভাগ করেন, একটি বস্তুর জগৎ এবং একটি আত্মার জগৎ। বস্তুর জগতে যান্ত্রিকতার (mechanism) নিয়ম এবং আত্মার জগতে অভিজ্ঞতা-ঊর্ধ্ব যুক্তিবাদের (rationalism) নিয়ম কার্যকর। মানুষের মননশীলতাতেই আত্মার প্রকাশ। বস্তু ও চিন্তা পরস্পর বিচ্ছিন্ন হলে, আমাদের চিন্তার সঙ্গে বাস্তবের মিল হয় কিভাবে? এর উত্তরে দেকার্তশিষ্য জিউলিংক্স (Geulinex) বলেন, এর কারণ সমাপতন। দুটি ঘড়ি যেমন কার্যকারণ নিয়মে সংযুক্ত না থেকেও একই সময় নির্দেশ করে, এটিও তেমনি। ঈশ্বর বিশ্বাসীরা এ দেকাতীয় যুক্তিকে ঈশ্বরের অস্তিত্বের একটি প্রমাণ হিসাবে ব্যবহার করেন। কারণ দুটি ঘড়িকে একই সময়ে বেঁধে দেওয়ার জন্য, একজন আদি সমাপতনকারীর প্রয়োজন।

আইনস্টাইন তার আপেক্ষিক তত্ত্বে প্রমাণ করেন, দুটি ঘটনার সমাপতন পর্যবেক্ষকের অবস্থানের উপর নির্ভরশীল। একটি অবস্থান থেকে দুটি ঘটনাকে যুগপৎ মনে হলেও, অন্য অবস্থান থেকে ঘটনা দুটিকে পূর্বাপর মনে হতে পারে। অর্থাৎ প্রকৃতিতে সমাপতন দেখা গেলেও, সমাপতন প্রকৃতির নিয়ম নয়। পর্যবেক্ষকের অবস্থান সাপেক্ষে দুটি ঘটনার সমসাময়িকতার বর্ণনা মাত্র। সমাপতনের পেছনেও কার্যকারণ নিয়ম কার্যকর। কার্যকারণের দুটি পৃথক ধারার কোনো দুটি ঘটনা, যখন কোনো পর্যবেক্ষকের অবস্থান সাপেক্ষে, একই সঙ্গে সংঘটিত হয়, তখনই এ দুটি ঘটনাকে পর্যবেক্ষকের নিকট সমাপতন বলে মনে হয়। (কাক যে তাল গাছের উপর দিয়ে উড়ে গেল, তা কার্যকারণ নিয়মাধীন। তাল যে গাছ থেকে খসে পড়ল, তাও কার্যকারণ নিয়মের ফল। তবে দুটি ঘটনাকে কারো কাছে যে একই সময়ে ঘটেছে বলে মনে হলো, এটি দর্শকটির সঙ্গে ঘটনা দুটির সম্পর্কের প্রকাশ। কাক আর তালের কার্যকারণ সম্পর্ক নয়। দর্শকের পর্যবেক্ষণটি অবশ্য কার্যকারণ নিয়মেই ঘটেছে।) কেউ কার্যকারণকে অস্বীকার করলে, তার কাছে সবই সমাপতিত মনে হয়, যা রহস্যবাদকে পুষ্ট করে। আর সমাপতন দিয়ে কোনো প্রক্রিয়াকে ব্যাখ্যা করতে গেলে, ‘অনুপম প্রক্রিয়ার’ আমদানি ছাড়া গত্যন্তর থাকে না। এটিও রহস্যময়।

পরম উদ্দেশ্যবাদ, সমাপতন, অনুপম প্রক্রিয়া এসবের মাধ্যমে ব্যক্তিত্ব বিকাশের ব্যাখ্যার সঙ্গে, ইয়ুং-এর ধর্মতত্ত্ব, আলকেমি, জ্যোতিষ এসব ছদ্মবিজ্ঞানের প্রতি আকর্ষণ, একই কার্যকারণ সূত্রে গ্রথিত। ফ্রয়েড ধর্মকে অধ্যাস (illusion) বলে আখ্যায়িত করেছেন। আর ইয়ুং ধর্মকে মানব সমাজের সর্বোচ্চ অর্জনের কৃতিত্ব দিয়েছেন। যদিও ফ্রয়েডের তত্ত্ব অধিমনস্তত্ত্বের (meta-psychology) স্তরেই আটকে গেছে, তবু তার উদ্দেশ্য ছিল ব্যক্তিত্বের বিজ্ঞানের সূচনা করা। কিন্তু তার বিদ্রোহী শিষ্য ইয়ুং, তার অধিমনস্তত্ত্বকে পরামনস্তত্ত্বে (parapsychology) অবনমিত করেছেন।

টীকা

নিউরোসিস (Neurosis)

নিউরোসিস (neurosis) শব্দটি প্রধানত ফ্রয়েডীয় চিন্তার (Freudian thinking) অনুসারীদের দ্বারা ব্যবহার করা হয়, যা অতীতের উদ্বেগ দ্বারা সৃষ্ট মানসিক ব্যাধিগুলিকে বর্ণনা করতে ব্যবহৃত হয়, যেগুলোকে প্রায়ই অবদমিত রাখা চেপে রাখা হয়। সাম্প্রতিক ইতিহাসে, শব্দটি সাধারণভাবে উদ্বেগ-সম্পর্কিত অবস্থা বা এনজাইটি-রিলেটেড কন্ডিশনসমূহকে (anxiety-related conditions) উল্লেখ করতে ব্যবহৃত হয়েছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (World Health Organization) আন্তর্জাতিক রোগ শ্রেণীবিভাগ (International Classification of Diseases, ICD) বা আমেরিকান সাইকিয়াট্রিক অ্যাসোসিয়েশনের (American Psychiatric Association) ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড স্ট্যাটিস্টিক্যাল ম্যানুয়াল অফ মেন্টাল ডিসঅর্ডারস (Diagnostic and Statistical Manual of Mental Disorders, DSM)-এ কন্ডিশন বা বিকৃতির নাম বা বিভাগগুলিতে “নিউরোসিস” শব্দটি আর ব্যবহৃত হয় না। আমেরিকান হেরিটেজ মেডিকেল ডিকশনারি (American Heritage Medical Dictionary) ২০০৭ অনুসারে, এই শব্দটি “আর মানসিক রোগের নির্ণয়ে ব্যবহৃত হয় না।”

নিউরোসিসকে সাইকোসিস (psychosis) থেকে পৃথক করা হয়, যেখানে সাইকোসিস দ্বারা বাস্তবতার সাথে সংযোগ হারানোর দিকে ইঙ্গিত করে। এর উৎপত্তিক শব্দ, নিউরোটিসিজম (neuroticism), উদ্বিগ্নতা এবং মানসিক ভাঙনের প্রবণতা প্রকাশকারী একটি ব্যক্তিত্ব বৈশিষ্ট্যকে নির্দেশ করে। নিউরোটিসিজম শব্দটি আর DSM বা ICD অবস্থার জন্য ব্যবহৃত হয় না; তবে এটি বিগ ফাইভ ব্যক্তিত্ব বৈশিষ্ট্য বা পারসোনালিটি ট্রেইটসমূহের (Big Five personality traits) মধ্যে একটি সাধারণ নাম। অনুরূপ একটি ধারণা আইসিডি-১১ (ICD-11) এ “নেগেটিভ অ্যাফেকটিভিটি” (negative affectivity) কন্ডিশন হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

সাইকোসিস (Psychosis)

সাইকোসিস (psychosis) হলো মনের একটি অবস্থা যা বাস্তব এবং অবাস্তবের মধ্যে পার্থক্য নির্ধারণে অসুবিধা তৈরি করে। এর উপসর্গগুলোর মধ্যে বিভ্রম (delusions) এবং অলীক প্রত্যক্ষণ বা হেলুসিনেশন (hallucinations) অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে। এছাড়াও, অসংলগ্ন বক্তৃতা এবং পরিস্থিতির সাথে বেমানান আচরণও এর লক্ষণ হতে পারে। এছাড়া, ঘুমের সমস্যা, সামাজিক বিচ্ছিন্নতা, অনুপ্রেরণার অভাব এবং দৈনন্দিন কাজকর্মে অসুবিধা দেখা দিতে পারে। সাইকোসিস গুরুতর প্রতিকূল ফলাফল আনতে পারে।

সাইকোসিসের বিভিন্ন কারণ থাকতে পারে, যেমন:

প্রসূতিপর সাইকোসিস (postpartum psychosis) নামে এক ধরনের সাইকোসিস সন্তান জন্মদানের পর দেখা দিতে পারে।

ডোপামিন (dopamine) নামক নিউরোট্রান্সমিটারটি সাইকোসিসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে বলে মনে করা হয়। তীব্র সাইকোসিসকে প্রাথমিক (primary) বলা হয় যখন এটি মানসিক অবস্থার ফলাফল হিসেবে দেখা দেয় এবং গৌণ (secondary) বলা হয় যখন এটি অন্য কোনো শারীরিক অবস্থা বা মাদকের কারণে ঘটে। মানসিক স্বাস্থ্য শর্তের নির্ণয় করার সময় অন্যান্য সম্ভাব্য কারণগুলি বাদ দেওয়া প্রয়োজন। সেন্ট্রাল নার্ভাস সিস্টেম রোগ, টক্সিন, বা অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যাগুলি কারণ হিসেবে চিহ্নিত করতে পরীক্ষা করা হতে পারে।

সাইকোসিসের চিকিৎসায় এন্টিসাইকোটিক ওষুধ (antipsychotic medication), মনোচিকিৎসা (psychotherapy), এবং সামাজিক সহায়তা অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে। প্রাথমিক চিকিৎসা ভালো ফলাফল দিতে পারে। ওষুধগুলো সাধারণত মাঝারি প্রভাব ফেলে। ফলাফল নির্ভর করে অন্তর্নিহিত কারণের উপর।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ৩% মানুষ তাদের জীবনের কোনো এক পর্যায়ে সাইকোসিসের শিকার হয়। এই অবস্থাটি কমপক্ষে খ্রিস্টপূর্ব ৪র্থ শতাব্দীতে হিপোক্রেটিস (Hippocrates) দ্বারা এবং সম্ভবত খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ সালে মিশরীয় ইবার্স প্যাপিরাসে (Ebers Papyrus) বর্ণনা করা হয়েছে।

স্কিজোফ্রেনিয়া (Schizophrenia)

স্কিজোফ্রেনিয়া (schizophrenia) একটি মানসিক রোগ যা পুনরাবৃত্ত সাইকোসিসের (psychosis) পর্বগুলির মাধ্যমে চিহ্নিত করা হয় এবং বাস্তবতার সাধারণ ভুল ধারণার (misperception of reality) সাথে সম্পর্কিত। অন্যান্য সাধারণ লক্ষণগুলির মধ্যে অলীক প্রত্যক্ষণ বা হেলুসিনেশন (hallucinations) (সাধারণত কণ্ঠ শোনা), বিভ্রম (delusions) (যেমন, প্যারানয়া বা ভ্রান্ত বিশ্বাস), বিশৃঙ্খল চিন্তা এবং আচরণ (disorganized thinking and behavior), এবং ফ্ল্যাট বা অযথাযোগ্য আবেগ (flat or inappropriate affect) অন্তর্ভুক্ত থাকে। এই লক্ষণগুলি ধীরে ধীরে বিকশিত হয় এবং সাধারণত তরুণ প্রাপ্তবয়স্ক অবস্থায় শুরু হয় এবং কখনও সম্পূর্ণভাবে সমাধান হয় না। স্কিজোফ্রেনিয়ার নির্ণয়ের জন্য কোনো বস্তুগত পরীক্ষার ব্যবস্থা নেই; নির্ণয়টি পর্যবেক্ষিত আচরণ, ব্যক্তির মনোবিজ্ঞানের ইতিহাস এবং পরিচিতদের প্রতিবেদনগুলির উপর ভিত্তি করে করা হয়। স্কিজোফ্রেনিয়ার নির্ণয়ের জন্য DSM-5 অনুযায়ী বর্ণিত লক্ষণগুলি অন্তত ছয় মাস এবং ICD-11 অনুযায়ী এক মাস ধরে উপস্থিত থাকতে হবে। অনেক স্কিজোফ্রেনিয়া রোগীর অন্যান্য মানসিক রোগ যেমন হতাশা (depressive disorders), উদ্বেগজনিত ব্যাধি (anxiety disorders), এবং অবসেসিভ–কম্পালসিভ ডিসঅর্ডার (obsessive–compulsive disorder) থাকে।

প্রায় ০.৩% থেকে ০.৭% মানুষ তাদের জীবদ্দশায় স্কিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত হন। ২০১৭ সালে, আনুমানিক ১.১ মিলিয়ন নতুন রোগী ছিল এবং ২০২২ সালে বিশ্বব্যাপী মোট ২৪ মিলিয়ন রোগী ছিল। পুরুষরা বেশি আক্রান্ত হয় এবং গড়ে নারীদের চেয়ে আগে রোগের সূচনা ঘটে। স্কিজোফ্রেনিয়ার কারণগুলির মধ্যে জিনগত (genetic) এবং পরিবেশগত (environmental) কারণ থাকতে পারে। জিনগত কারণগুলির মধ্যে বিভিন্ন সাধারণ এবং বিরল জিনগত বৈচিত্র্য অন্তর্ভুক্ত। সম্ভাব্য পরিবেশগত কারণগুলির মধ্যে শহরে বড় হওয়া, শৈশবের প্রতিকূলতা, কৈশোরে গাঁজা সেবনের (cannabis use) সময়কাল, সংক্রমণ, মায়ের বা বাবার বয়স, এবং গর্ভাবস্থায় অপুষ্টি অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে।

স্কিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্তদের প্রায় অর্ধেকের দীর্ঘমেয়াদে উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয় এবং তারা পুনরায় আক্রান্ত হয় না, এবং এদের মধ্যে একটি ছোট অংশ পুরোপুরি সুস্থ হয়ে ওঠে। অন্য অর্ধেকের আজীবন প্রভাব থাকে। গুরুতর ক্ষেত্রে, মানুষকে হাসপাতালে ভর্তি করা হতে পারে। দীর্ঘমেয়াদী বেকারত্ব, দারিদ্র্য, গৃহহীনতা, শোষণ এবং শিকার হওয়ার মতো সামাজিক সমস্যা সাধারণত স্কিজোফ্রেনিয়ার সাথে সম্পর্কিত। সাধারণ জনসংখ্যার তুলনায় স্কিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের আত্মহত্যার হার (প্রায় ৫% মোট) এবং শারীরিক স্বাস্থ্য সমস্যা বেশি, যা গড়ে ২০ থেকে ২৮ বছরের আয়ুষ্কাল হ্রাস করে। ২০১৫ সালে, আনুমানিক ১৭,০০০ মৃত্যুর সাথে স্কিজোফ্রেনিয়া সম্পর্কিত ছিল।

স্কিজোফ্রেনিয়ার চিকিৎসার মূল উপাদান হলো এন্টিসাইকোটিক ওষুধ (antipsychotic medication), যেমন ওলানজাপিন (olanzapine) এবং রিসপেরিডোন (risperidone), পাশাপাশি কাউন্সেলিং, চাকরির প্রশিক্ষণ এবং সামাজিক পুনর্বাসন। এক-তৃতীয়াংশ লোক প্রাথমিক এন্টিসাইকোটিকগুলির জন্য সাড়া দেয় না, এই ক্ষেত্রে ক্লোজাপিন (clozapine) মার্কিন খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসন দ্বারা চিকিৎসার জন্য অনুমোদিত। একটি নেটওয়ার্ক তুলনামূলক মেটা-বিশ্লেষণে ১৫টি এন্টিসাইকোটিক ওষুধের মধ্যে, ক্লোজাপিন সব অন্যান্য ওষুধের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে কার্যকর ছিল, যদিও ক্লোজাপিনের ব্যাপক বহুমুখী কার্যকলাপ উল্লেখযোগ্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে। যেখানে ডাক্তাররা নিজের বা অন্যদের ক্ষতির ঝুঁকি আছে বলে মনে করেন, সেখানে তারা স্বল্পকালীন অনৈচ্ছিক হাসপাতালে ভর্তি হতে পারেন। দীর্ঘমেয়াদী হাসপাতালে ভর্তি সামান্য সংখ্যক গুরুতর স্কিজোফ্রেনিয়া রোগীর জন্য ব্যবহার করা হয়। কিছু দেশে যেখানে সমর্থনমূলক সেবা সীমিত বা অনুপলব্ধ, সেখানে দীর্ঘমেয়াদী হাসপাতালে অবস্থান বেশি সাধারণ।

তথ্যসূত্র –

  • মনোসমীক্ষণ মতধারা (ফ্রয়েড ও ফ্রয়েদোত্তর), মঞ্জুর আহমদ, জ্ঞানকোষ প্রকাশনী, ঢাকা, ২০১৬
  • সিগমুন্ড ফ্রয়েড এবং অফ্রয়েডীয় ফ্রয়েডবাদীগণ, বিরঞ্জন রায়, সংহতি, ঢাকা, ২০২১
  • মনোবিজ্ঞানের ইতিহাস ও মতবাদ, নীহাররঞ্জন সরকার, মনুরুল হক, ডঃ আবদুল খালেক, জ্ঞানকোষ প্রকাশনী, ঢাকা, ২০২২

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.