ব্যক্তিত্বের বিকৃতির নাটকীয়/ক্ষেপাটে গুচ্ছ ও উদ্বিগ্ন/ভীতি গুচ্ছ

Table of Contents

নাটকীয়/খেপাটে গুচ্ছ (Dramatic/Erratic Cluster)

এই গুচ্ছের অন্তর্গত ব্যক্তিত্ব-বিকৃতি বা পারসোনালিটি ডিজর্ডারসমূহের মধ্যে রয়েছে – সীমান্তবর্তী ব্যক্তিত্ব-বিকৃতি বা বর্ডারলাইন পারসোনালিটি ডিজর্ডার, নাটকীয় ব্যক্তিত্ববিকৃতি বা হিস্ট্রিয়োনিক পারসোনালিটি ডিজর্ডার, আত্মপ্রেমিক ব্যক্তিত্ববিকৃতি বা নারসিসিস্টিক পারসোনালিটি ডিজর্ডার, এবং সমাজবিরোধী ব্যক্তিত্ববিকৃতি বা এন্টাইসোশ্যাল পারসোনালিটি ডিজর্ডার।

সীমান্তবর্তী ব্যক্তিত্ববিকৃতি বা বর্ডারলাইন পারসোনালিটি ডিজর্ডার (Borderline Personality Disorder)

লক্ষণ, ইতিহাস ও এপিডেমিওলজি

এই বিকৃতিটিকে ১৯৮০ সাল থেকে DSM-এর অন্তর্ভূক্ত করা হচ্ছে। এই বিকৃতিটিকে শনাক্ত করতে হলে নিম্নলিখিত লক্ষণগুলো থাকতে হবে –

  1. সামাজিক সম্পর্কের স্থায়িত্বহীনতা (Instability in relationships)
  2. আবেগের অস্থিরতা বা দ্রুত পরিবর্তনশীলতা (instability) এবং
  3. সুস্পষ্ট, সমন্বিত আত্মধারণার স্থিতিশীলতার অভাব (Instability of self-image)

সমাজের অন্যান্য ব্যক্তিদের প্রতি বর্ডারলাইন পারসোনালিটি ডিজর্ডার সম্পন্ন ব্যক্তিদের মনোভাব ও অনুভূতি ক্ষণে ক্ষণে পরিবর্তিত হয় এবং এর পেছনে কোন কারণ খুঁজে পাওয়া যায়না। তাদের আবেগ অনেকটা খামকেয়ালীভাবে পরিবর্তিত হয়। কখনও তীব্র আবেগাপ্লুত ভালোবাসা দেখায়, পরক্ষণেই হয়তো ঘৃণা এবং ক্রোধ প্রদর্শন করে। এরা তর্কপ্রিয়, খিটখিটে (Irritable) বা সহজে উত্তেজিত হয়ে ওঠে, শ্লেষাত্মক, সহজে দোষ ধরে, এবং এদের সঙ্গে বসবাস করা বা একত্রে চলাফেরা করা কঠিন। তাদের আচরণগুলো আত্মহননমূলক (নিজের জন্য ক্ষতিকারক), যেমন তাদের আচরণ আবেগচালিত (ঝোঁকের বশে কাজ করে), অপ্রত্যাশিত। তারা জুয়া খেলে টাকাপয়সা ওড়ায়, প্রচুর খায়, যৌন-সম্ভোগ করে, ইত্যাদির মাধ্যমে জীবনী শক্তি ক্ষয় করে। এদের নিজেদের সম্বন্ধে সুস্পষ্ট আত্মধারণা নেই, তারা তাদের মূল্য এবং বৃত্তি নির্বাচন সম্পর্কে অনিশ্চিত। তারা একাকী থাকতে পারেনা, পরিত্যক্ত হবার ভয়ে ভীত থাকে, এবং অন্যের মনোযোগ দাবী করে। ঝড়ো গতিতে একের পর এক সরাসরি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপন করে, এবং এসব সম্পর্ক ক্ষণস্থায়ী হয়। কখনও কারও সাথে মধুর সম্পর্ক স্থাপন করে, আবার পরক্ষণেই তাকে অবমূল্যায়ন করে। তারা দীর্ঘস্থায়ী বিষণ্ণতায় আক্রান্ত এবং শূন্যতাবধে পীড়িত, প্রায়শঃ আত্মহত্যার চেষ্টা করে এবং আত্মহননমূলক আচরণ করে – যেমন ক্ষুর বা রেজার ব্লেডের সাহায্যে পায়ের মাংস কেটে ফেলে।

তীব্র পীড়নের সম্মুখীন হলে তাদের মধ্যে সন্দেহবাদী বা ভ্রমাত্মক ধারণা, মানে প্যারানয়েড আইডিয়েশন (Paranoid ideation) এবং বিচ্ছিন্নতামূলক লক্ষণ দেখা দিতে পারে। এসব বিভিন্ন লক্ষণের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লক্ষণ হলো তীব্র এবং অস্থায়ী পারস্পরিক সম্পর্ক। (“Of all these varied symptoms (of borderline personality disorder), unstable and intense interpersonal relationships appear as a critical feature”. Modesten, 1987, as quoted by Davison and Neale, 1998, p-338).

বেশ কিছুদিন ধরেই মনোচিকিৎসকগণ ও গবেষকগণ বর্ডারলাইন পারসোনালিটি ডিজর্ডার শব্দগুলো ব্যবহার করে আসছেন। কিন্তু তারা এই বিকৃতিটিকে বহু অর্থে ব্যবহার করেছেন।

বর্ডারলাইন পারসোনালিটি ডিজর্ডার কথাটি দ্বারা সর্বপ্রথম বোঝানো হতো যে, এই রোগীর লক্ষণগুলো নিউরোসিস এবং সিজোফ্রেনিয়ার লক্ষণের মাঝামাঝি। কিন্তু DSM এর শ্রেণী বিন্যাসে বর্ডারলাইন পারসোনালিটি ডিজর্ডারকে সেই অর্থে ব্যবহার করা যায়না। বর্তমানে বর্ডারলাইন পারসোনালিটি ডিজর্ডার বলতে যে ধারণাটি প্রচলিত আছে তা বহু উৎস থেকে সৃষ্টি হয়েছে। বর্ডারলাইন পারসোনালিটি ডিজর্ডারসম্পন্ন ব্যক্তিদের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করে এবং প্রাসঙ্গিক গবেষণা সাহিত্য পর্যালোচনা করে গুন্ডারসন, কোলব, এবং অস্টিন (Gunderson, Kolb and Austin, 1981) কতকগুলো সুস্পষ্ট মানদণ্ড প্রস্তাব করেছিলেন, যেগুলো DSM-III-তে অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছিল। তার আগে স্পিটজার, এন্ডিকোট, এবং গিবন (Spitzer, Endicott and Gibbon, 1995) এর একটি গবেষণায় বর্ডারলাইন পারসোনালিটি ডিজর্ডারের নিদানিক মানদণ্ডগুলো প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তারা স্কিজোফ্রেনিয়ার সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ একটি ব্যক্তিত্বের বিকৃতি শনাক্ত করেন যেগুলো স্কিজোটাইপাল ব্যক্তিত্ব থেকে আলাদা। সেই লক্ষণগুলোকেই SM-III তে বর্ডারলাইন পারসোনালিটি ডিজর্ডার বলা হয়েছে।

DSM-IV অনুসারে বর্ডারলাইন পারসোনালিটি ডিজর্ডারের নির্ণায়কসমূহ (Criteria) নিচে দেয়া হলো –

বর্ডারলাইন পারসোনালিটি ডিজর্ডারের বৈশিষ্ট্যসমূহ হলো পারস্পরিক সম্পর্কের অস্থিতিশীলতা, আত্মধারণা ও আবেগের অস্থিতিশীলতা এবং ঝোঁকের বশে কাজ করার প্রবণতা যা যৌবনের প্রথম দিকে শুরু হয় এবং বহু ধরণের পরিস্থিতিতে আত্মপ্রকাশ করে যার মধ্যে নিম্নলিখিত লক্ষণগুলোর অন্তত ৫টি বর্তমান থাকে –

  1. অস্থায়ী কিন্তু জোড়ালো পারস্পরিক সম্পর্ক। এই মুহূর্তে কাউকে চরম প্রশংসা করে, পরমুহূর্তে চরম ঘৃণা বা অবমাননা।
  2. আত্মপরিচয়ের সমস্যা (Identity disturbance) – যার বৈশিষ্ট্য হলো অস্পষ্ট বা অস্থায়ী আত্ম ধারণা।
  3. ঝোঁকের বশে নিম্নলিখিত যেকোন ধরণের কাজ করে (যেমন – অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করা, যৌনক্রিয়া, মদ্যপান বা মাদকাসক্তি, ভোজন, বেপরোয়া গাড়ি চালনা ইত্যাদি)।
  4. প্রায়শ আত্মহত্যার প্রচেষ্টা, এমন ভাবভঙ্গি প্রদর্শন অথবা ভীতি প্রদর্শন, অথবা আত্মহননমূলক কাজ করা।
  5. পারিপার্শ্বিক অবস্থার প্রতি অতিশয় সক্রিয়তার জন্য দ্রুত আবেগীয় পরিবর্তন ঘটে – যেমন তীব্র বিষাদ, উত্তেজনশীলতা (সহজে ক্রুদ্ধ হবার প্রবণতা, বিরক্ত হওয়া), অথবা উদ্বেগ সৃষ্টি হয় যা কয়েক ঘণ্টা স্থায়ী হয় (শুধু ব্যতিক্রমী ক্ষেত্রে কয়েক দিন স্থায়ী হতে পারে।)
  6. দীর্ঘস্থায়ী শূন্যতাবোধ (chronic feelings of emptiness) ।
  7. কোন কারণ ছাড়াই ভীষণ রাগ করে, ক্রোধ নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনা, যেমন ক্রোধে ঘনঘন হাত পা ছোড়ে, ক্রমাগত ক্রোধ প্রকাশ করে, প্রায়শ শারীরিকভাবে আক্রমণ বা মারামারি করে।
  8. পীড়ন-সৃষ্ট স্বল্পস্থায়ী ভ্রমাত্মক চিন্তা অথবা তীব্র বিচ্ছিন্নতামূলক প্রতিক্রিয়া।

আমেরিকার অধিবাসীদের মধ্যে এই বিকৃতিতে আক্রান্ত লোকের সংখ্যা ১% থেকে ২%, এবং পুরুষের চেয়ে নারীর মধ্যে বেশি (Swartz et al, 1990) । এই বিকৃতিতে আক্রান্ত অনেকেই মেজাজের বিকৃতিতে বা মুড ডিজর্ডারে (Mood Disorder) আক্রান্ত হয় – যা DSM-IV এর ১ নং অক্ষে আলোচনা করা হয়েছে। এই ব্যক্তিত্ব-বিকৃতির পেছনে বংশগতির কিছুটা ভূমিকা থাকতে পারে, কারণ, এই রোগে আক্রান্ত রোগীদের আত্মীয়দের মধ্যে আবেগীয় গোলযোগ বা মুড ডিজর্ডার হবার সম্ভাবনা স্বাভাবিকের চেয়ে কিছুটা বেশি।

বর্ডারলাইন পারসোনালিটি ডিজর্ডারের রোগীদের মধ্যে যে ধরণের বিষণ্ণতা দেখা যায়, তা একমুখী মেজাজের বিকৃতি বা ইউনিপোলার মুড ডিজর্ডার (Unipolar mood disorder) থেকে আলাদা। যেমন তাদের দৈহিক কষ্ট (Somatic Complaints), অপরাধবোধ, অসহায় বোধ, এবং একঘেয়েমিভাব একমুখী মেজাজের বিকৃতির চেয়ে কম থাকে। বর্ডারলাইন পারসোনালিটি ডিজর্ডারের সঙ্গে মাদকাসক্তি সহাবস্থান করতে পারে। আবার নাটকীয় ব্যক্তিত্ব বা হিস্ট্রিয়োনিক পারসোনালিটি ডিজর্ডার, আত্মপ্রেমিক ব্যক্তিত্ব-বিকৃতি বা নার্সিসিস্টিক পারসোনালিটি ডিজর্ডার, নির্ভরশীল ব্যক্তিত্ব, পরিহারকারী ব্যক্তিত্ব এবং সন্দেহবাদী ব্যক্তিত্ব বিকৃতির সঙ্গে সহাবস্থান করতে পারে।

জোনাথান কেলারম্যান (Jonathan Kellerman) নামক একজন চিকিৎসা মনোবিজ্ঞানী, যিনি পরে রহস্যোপন্যাস লেখক হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন, তার লেখায় বর্ডারলাইন পারসোনালিটি ডিজর্ডারের বর্ণাঢ্য বিবরণ পাওয়া যায়। তিনি লিখেছেন, “বর্ডারলাইন পারসোনালিটি ডিজর্ডারের রোগী চিকিৎসকের দুঃস্বপ্ন। কারণ এরা কখনও ভালোর দিকে যায়না। আপনার জন্য সবচেয়ে উত্তম কর্তব্য হবে তাদের অসুস্থতার সঙ্গে নিজেকে না জড়িয়ে তাদের আপন গতিতে চলতে দেয়া। তারা বিষণ্ণতায় চির আক্রান্ত, আসক্তিতে দৃঢ়সংকল্প, বাধ্যতামূলকভাবে বিচ্ছিন্ন (divorced); তারা একটি আবেগীয় বিপর্যয় থেকে আরেকটি বিপর্যয়ের মধ্যে জীবন ধারণ করে বিছানায় অস্থিরভাবে ছটফট করে, পাকস্থলী ভরে রাখে (Stomach Pumpers), রাস্তায় লাফায় (freeway jumpers), বিষণ্ণচোখে বেঞ্চে বসে থাকে, ফুটবলের মত হাতগুলো সেলাই করা, আড়ষ্ট। তাদের হৃদয়ে অনেক ক্ষত থাকে – যেগুলো শেলাই করে জোড়া দেয়া সম্ভব নয়। তাদের অহংবোধ ভঙ্গুর – যেন চিনির মিশ্রণ, তাদের মন (Psyche) অপরিবর্তনীয়ভাবে শতধাবিভক্ত, একটি ধাঁধার মত – যার মধ্যে থেকে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ খণ্ড হারিয়ে গেছে। তারা উদ্যম-পরতার সাথে বিভিন্ন ভূমিকা পালনে পারদর্শী, শুধু তাদের নিজস্ব ভূমিকা ছাড়া। তারা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপন করতে প্রচণ্ডভাবে ইচ্ছুক, কিন্তু যখন কেউ ঘনিষ্ঠ হতে চায়, তখন তাকে প্রত্যাখ্যান করে। তাদের কেউ কেউ নাট্যমঞ্চের দিকে ঝুঁকে পড়ে, আবার কেউ কেউ সুক্ষ্মভাবে তাদের অভিনয় করে।

বর্ডারলাইন পারসোনালিটি ডিজর্ডারের রোগীদের তাদের অসহনীয় শূন্যতার অনুভূতিকে ভরাট করার জন্য একটি যাদুর ঔষধের আশায় একের পর এক চিকিৎসকের কাছে ধর্ণা দেয়। তারা রাসায়নিক ঔষধ সেবন করে, প্রশান্তিকর এবং বিষণ্ণতা বিরোধী ঔষধ রাক্ষসের মত গেলে। মদ পান করে, কোকেইন সেবন করে। জীবনের ব্যাথা থেকে মুক্তি পাবার জন্য গুরু ও স্বর্গের রাস্তা দেখবার জন্য ঐশ্বরিক শক্তিসম্পন্ন গুরুর শরণাপন্ন হয়। অবশেষে জেলখানার কুঠুরিতে বা মানসিক হাসপাতালে ভর্তি হয়ে জীবন থেকে সাময়িকভাবে ছুটি নেয়, তারপর সেখান থেকে আপাতঃসুস্থ মানুষ হিসেবে ফিরে আসে এবং প্রত্যেকের মনে আশার আলোক ছড়ায়। কিন্তু কিছুদিন পর আবার অধঃপতন ঘটে, বাস্তব অথবা কাল্পনিক যাই হোক না কেন, তারপর আবার আত্মবিধ্বংসী পথে নবযাত্রা। তারা যা করেনা, তা হলো নিজেদের পরিবর্তন।“(Kellerman, 1989, p-113-114).

কারণ

মনোসমীক্ষণ তত্ত্বের একটি বিশেষ সংস্করণ হলো বস্তু-সম্পর্ক বিষয়ক তত্ত্ব বা অবজেক্ট রিলেশনস থিওরি (object-relations theory), যা শিশু তার পিতামাতা ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির মূল্যবোধগুলো কিভাবে আত্তীকরণ করে তার উপর জোর দেয়। অন্য কথায়, এই তত্ত্ব মনে করে যে, যে সব ব্যক্তির সঙ্গে শিশুর আবেগীয় বন্ধন বা সম্পর্ক থাকে তাদের সঙ্গে শিশু কিভাবে একাত্ম অনুভব করে সেটাই মূল বিচার্য বিষয়। ঐসব বস্তু-প্রতিভূ বা অবজেক্ট রিপ্রেজেন্টেশনগুলোকে (object representation) শিশু আত্মস্থ করে এবং এগুলো শিশুর অহংসত্তার সঙ্গে অঙ্গীভূত হয়ে যায়। কিন্তু বয়ঃপ্রাপ্ত হবার সময় ঐসব ব্যক্তির আদর্শ ও মূল্যবোধগুলোর সঙ্গে তার ইচ্ছা-আকাঙ্ক্ষা, লক্ষ্য এবং আদর্শগুলোর দ্বন্দ্ব হয়। উদাহরণস্বরূপ, একটি মেয়ে শিশু সমাজে একজন নারীর ভূমিকা কী হবে তা তার মায়ের ধারণা থেকে আত্মস্থ করেছে, কিন্তু মেয়েশিশুটি যখন কলেজে পড়ে, তখন সে তার আধুনিক সমাজের নারীদের মূল্যবোধগুলোর প্রতি আকর্ষণ অনুভব করে। বস্তু-সম্পর্ক বিষয়ক তাত্ত্বিকগণ মনে করেন যে, প্রত্যেক ব্যক্তি তাদের ছোট বেলাকার গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, যেমন পিতামাতা, অথবা যারা তাকে যত্ন করতেন, তাদের দৃষ্টিভঙ্গি দিয়েই বাইরের জগতের বিভিন্ন বিষয়ের প্রতি প্রতিক্রিয়া করে। অনেক সময় এইসব দৃষ্টিভঙ্গি, যা অতীতে তারা গঠন বা অর্জন করেছিল, যেগুলোর সঙ্গে ব্যক্তির নিজস্ব চাহিদা বা আগ্রহের দ্বন্দ্ব উপস্থিত হয়। এসব দ্বন্দ্বই বর্ডারলাইন পারসোনালিটি ডিজর্ডারের মূলে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। দুজন বস্তু-সম্পর্ক বিষয়ক তাত্ত্বিক হলেন হাইনজ কহোট (Heinz Kahut) এবং অটো কার্নবার্গ (Otto Kernberg)। হাইনজ কহোট বিশেষভাবে আলোচনা করেছেন আত্ম-প্রেমিক বা নার্সিসিস্ট ব্যক্তি নিয়ে, অটো কার্নবার্গ আলোচনা করেছেন বর্ডারলাইন পারসোনালিটি ডিজর্ডার নিয়ে।

কার্নবার্গ (Kernberg, 1985) মনে করেন যে, শৈশবের প্রতিকূল বা বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতা শিশুর মনের মধ্যে অনিশ্চিত অহংসত্তাগঠনের জন্য দায়ী, যা বর্ডারলাইন পারসোনালিটি ডিজর্ডার গঠন করে। উদাহরণস্বরূপ, যাদের পিতামাতা সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে ভালোবাসা এবং মনোযো দেয়না, সম্ভবতঃ শিশু ক্রিতিত্ব দেখালে প্রশংসা করে, কিন্তু আবেগীয় সমর্থন এবং উষ্ণ স্নেহ প্রদানে ব্যর্থ হয়, সেই সব শিশু যখন বড় হয় তখন তাদের অহং সত্তার মধ্যে অনিশ্চয়তাবধ জন্মলাভ করে এবং বর্ডারলাইন পারসোনালিটি ডিজর্ডারের সৃষ্টি করে। যদিও বর্ডারলাইন পারসোনালিটি ডিজর্ডারসম্পন্ন ব্যক্তিদের অহং সত্তা দুর্বল থাকে এবং তারা সব সময় সমর্থন চায় কিন্তু তারা বাস্তবকে পরীক্ষা করার ক্ষমতা অক্ষুণ্ণ রাখে। ফলশ্রুতিতে বর্ডারলাইন পারসোনালিটি ডিজর্ডারে ভোগা ব্যক্তিরা বাস্তব জগতের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখে, কিন্তু অনেক সময়ই তারা একটি আত্মরক্ষামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে – সেটি হলো বিচ্ছিন্নকরণ বা স্প্লিটিং (Splitting), অর্থাৎ তারা বস্তুসমূহকে দুইভাবে ভাগ করে। একদিকে “সব ভালো বস্তু”, অন্যদিকে “সব খারাপ বস্তু”। সেজন্য তারা অন্য একজন ব্যক্তির ভালো ও মন্দ দিকগুলোকে একত্রে নিয়ে একটি সমন্বিত অখণ্ড ব্যক্তি হিসেবে দেখতে পারেনা। অন্যান্য ব্যক্তির এবং নিজের পরস্পর বিপরীত দিকগুলোকে মিলিয়ে দেখতে না পারার জন্য তারা তাদের আবেগীয় প্রতিক্রিয়াগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনা। কারণ তারা নিজেকে এবং পৃথিবীর অন্যসব কিছুকে সাদা-কালো হিসেবে দেখে। সম্ভবতঃ এই প্রতিরক্ষা কৌশল বর্ডারলাইন পারসোনালিটি ডিজর্ডারে ভোগা ব্যক্তিদের দুর্বল অহংবোধকে অসহনীয় উদ্বেগ থেকে রক্ষা করে।

অনেকগুলো গবেষণা থেকে কার্নবার্গের তত্ত্বের সমর্থনযোগ্য প্রমাণ পাওয়া গেছে। পূর্বানুমান অনুযায়ী বর্ডারলাইন পারসোনালিটি ডিজর্ডারে ভোগা ব্যক্তিরা বলেছে যে তারা তাদের মায়ের কাছ থেকে খুব কম আদর-যত্ন পেয়েছে। তারা মনে করে যে তাদের পরিবারের সদস্যগণ আবেগ প্রকাশ করত না (emotionally unexpressive), তাদের মধ্যে সম্পৃত্তি বা ঘনিষ্ঠতা কম ছিল, এবং দ্বন্দ্ব-সংঘাত উচ্চমাত্রায় ছিল। তারা প্রায়শঃ শারীরিক শাস্তি এবং যৌননিপীড়নের শিকার হয়েছিল (Silk et al, 1995) এবং শৈশবে তাদের পিতামাতার থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার অভিজ্ঞতা হয়েছিল (Paris, Zweig & Guzder, 1994)। অনেকেই ধারণা করেছেন যে, বর্ডারলাইন পারসোনালিটি ডিজর্ডার আসলে শৈশবের কঠন শাস্তি বা তীব্র নিপীড়নের ফলে উদ্ভূত আঘাত্মূলক ঘটনার পরবর্তী পীড়নমূলক বিকৃতি বা পোস্ট ট্রমেটিক স্ট্রেস ডিজর্ডার (post-traumatic stress disorder) অথবা বিচ্ছিন্নতামূলক আত্মপরিচয়ের বিকৃতি বা ডিসোসিয়েশন আইডেন্টিটি ডিজর্ডার (dissociation identity disorder) এর অংশবিধেষ (ডেভিসন নীয়েল, ১৯৯৮)।

ব্যারন ও তার সহকর্মীরা (Baron et al, 1985) তাদের গবেষণার ফলাফল থেকে বলেছেন যে, বর্ডারলাইন পারসোনালিটি ডিজর্ডারে বংশগতির ভূমিকা থাকতে পারে, কারণ এটা পারিবারিক সূত্রে সংক্রমিত হতে দেখা গেছে। বর্ডারলাইন পারসোনালিটি ডিজর্ডারের রোগীদের মধ্যে নিউরোটিক প্রবণতা বা নিউরোটিসিজম (neuroticism) বেশি দেখা যায় এবং এটা বংশগতভাবে সংক্রমিত হয়। শারীরবৃত্তীয় গবেষনায় দেখা যায়, এসব রোগীর মস্তিষ্কের সম্মুখভাগ (frontal lobe) ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মস্তিষ্কের সম্মুখভাগ ঝোঁকের বশে কাজ করার ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করে। উদাহরণস্বরূপ, যেসব স্নায়ুশারীরবৃত্তীয় পরীক্ষায় মস্তিষ্কের সম্মুখভাগের কর্মক্ষমতা পরিমাপ করা হয় বর্ডারলাইন পারসোনালিটি ডিজর্ডারের রোগীরা সেইসব পরীক্ষায় খারাপ ফলাফল করে (Goyer et al., 1994, Van Ruckum et al., 1993)। ঝোঁকের বশে কাজ করার সঙ্গে সেরোটোনিন (Serotonin) স্নায়বিক বার্তাবাহক পদার্থ বা নিউরোট্রান্সমিটারের সম্পর্ক রয়েছে। যাদের মস্তিষ্কে সেরোটোনিক কমে যায়, তারা ঝোঁকের মাথায় কাজ করা থামাতে পারেনা। বর্ডারলাইন পারসোনালিটি ডিজর্ডারে ভোগা লোকেদের শরীরে সেরোটোনিন ইনজেকশন দেয়ার পর তাদের ক্রোধের মাত্রা কমে যায়। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, বর্ডারলাইন পারসোনালিটি ডিজর্ডারের রোগীদের আবেগীয় নিয়ন্ত্রণ বা ঝোঁকের বশবর্তী আচরণ বা ইম্পালসিভ বিহ্যাভিয়র (Impulsive behavior) ব্যাখ্যা করতে হলে স্নায়ুশারীরবৃত্তীয় বা জৈবিক গবেষণা নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে পারে।

নাটকীয় ব্যক্তিত্ব বিকৃতি বা হিস্ট্রিয়োনিক পারসোনালিটি ডিজর্ডার (Histrionic personality disorder)

লক্ষণ, ইতিহাস ও এপিডেমিওলজি

নাটকীয় ব্যক্তিত্ব বা হিস্ট্রিয়োনিক পারসোনালিটিকে পূর্বে হিস্টিরিয়াগ্রস্ত ব্যক্তিত্ব বা হিস্টেরিকাল পারসোনালিটি (Hysterical Personality) বলা হতো। এই নিদান যাদের বেলায় প্রযোজ্য তারা অতিমাত্রায় নাটুকে বা ড্রামাটিক (dramatic) এবং সর্বদা অন্যের মনোযোগ আকর্ষণ করতে চায়। অন্য লোকদের দৃষ্টি আকর্ষন করার জন্য তারা অনেক সময় তাদের শারীরিক বৈশিষ্ট্যের বিভিন্নদিক ব্যবহার করে যেমন, অসাধারণ পোষাক, ব্যতিক্রমধর্মী সাজসজ্জা (makeup), অথবা চুলে রঙ করা ইত্যাদি। এসব ব্যক্তি যদিও অসংযতভাবে আবেগ প্রকাশ করে, কিন্তু মনে করা হয় যে তাদের আবেগের গভীরতা নেই, অর্থাৎ এগুলো ভাসাভাসা, আন্তরিকতাবিহীন। তারা আত্মকেন্দ্রিক, তাদের শারীরিক সৌন্দর্য নিয়ে অতিরিক্ত সচেতন ও উদ্বিগ্ন এবং তারা যদি মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু না হয় তাহলে অস্বস্তিবোধ করে। তারা অনুপযুক্ত স্থান কাল বা পাত্রে যৌন আবেদন জানাতে পারে, যৌনক্রিয়ায় প্রলুধ করতে পারে এবং সহজে অন্যের দ্বারা প্রভাবিত হয়। তারা আভাসে, ইঙ্গিতে কথা বলে, বিস্তৃতভাবে কিছু বলেনা। উদাহরণস্বরূপ, তারা হয়তো কোন বিষয়ের প্রতি জোরালো মতামত প্রকাশ করে, কিন্তু এর সমর্থনে আরো বেশী তথ্য প্রদান করতে পারেনা।

আমেরিকার অধিবাসীদের মধ্যে ২ থেকে ৩% এর মধ্যে হিস্ট্রিয়োনিক পারসোনালিটি ডিজর্ডার লক্ষ্য করা যায়। করবিট ও উইডিগার (Corbitt & Widiger, 1995) এর গবেষণা অনুযায়ী এই বিকৃতিটি পুরুষদের চেয়ে নারীদের মধ্যে বেশি দেখা যায়। এটি বিচ্ছিন্ন এবং তালাকপ্রাপ্তদের মধ্যে বেশি দেখা যায়, এবং এই বিকৃতির সঙ্গে সংযুক্ত থাকে বিষণ্ণতা বা ডিপ্রেশন (depression) এবং ভগ্ন শারীরিক অবস্থা। বর্ডারলাইন পারসোনালিটি ডিজর্ডারের সঙ্গে এই রগটির সহাবস্থান অন্যান্য বিকৃতির চেয়ে বেশি (Morey, 1988) ।

কারণ

হিস্ট্রিয়োনিক পারসোনালিটি ডিজর্ডারের কারণ নিয়ে খুব বেশি গবেষনা করা হয়নি। যে কয়টি মতবাদ হিস্ট্রিয়োনিক পারসোনালিটি ডিজর্ডারকে ব্যাখ্যা করতে চেষ্টা করেছে সেগুলর মধ্যে মনোসমীক্ষণ তত্ত্ব প্রধান। মনোসমীক্ষণবাদীরা মনে করেন যে, নাটকীয় আবেগ প্রবণতা (emotionality) এবং যৌন-প্রলোভন দেখানোর প্রবণতা পিতামাতার এ ধরণের আচরণ থেকে উৎসাহিত হএয়ছে। বিশেষ করে পিতার নিকট থেকে কন্যার প্রতি। মনে করা হয় যে, হিস্ট্রিয়োনিক পারসোনালিটি ডিজর্ডারসম্পন্ন ব্যক্তিদের ছোটবেলা থেক এমন পারিবারিক পরিবেশে মানুষ করা হয়েছে, যেখানে পিতামাতা যৌনক্রিয়াকে অত্যন্ত নোংরা ব্যাপার বলে আলাপ আলোচনা করেছে। তারা এমনভাবে আচরণ করত যেন যৌনক্রিয়া নোংরা হলেও উত্তেজনাকর এবং আকাঙ্ক্ষিত ব্যাপার। এধরণের পরিবেশে বড় হবার ফলে তাদের মনে যৌনক্রিয়া সম্পর্কে একটি বিশেষ ধরণের সংবেদনশীলতা সৃষ্টি হয় এবং যৌনবিষয়ক চিন্তা তাদের মনকে দখল করে রাখে। অথচ একই সাথে মনে ভয় থাকে কখন বুঝি যৌন আচরণ প্রকাশিত হএয় পড়বে। হিস্ট্রিয়োনিক পারসোনালিটি ডিজর্ডারে ভোগা ব্যক্তিরা যে আবেগের আতিশয্য প্রকাশ করে সেগুলো প্রকৃতপক্ষে এই ধরণের দ্বন্দ্বের অভ্যন্তরীণ বহিঃপ্রকাশ। আর তারা যে অন্য মানুষের মনোযোগের কেন্দ্র হতে চায় সেটা হলো তাদের নিচুমাত্রার আত্মমর্যাদাবধ সম্পর্কে তাদের সত্যিকার অনুভূতি থেকে আত্মরক্ষার একটি কৌশল (Apt & Hurlbert, 1994, Stone, 1993)।

আত্মপ্রেমিক ব্যক্তিত্ব-বিকৃতি বা নারসিসিস্টিক পারসোনালিটি ডিজর্ডার (Narcissistic Personality Disorder)

লক্ষণ, ইতিহাস ও এপিডেমিওলজি

নারসিসিস্টিক পারসোনালিটি ডিজর্ডার (Narcissistic Personality Disorder) নামটি এসেছে গ্রীক পুরাণের নার্সিসাস (Narcissus) – নামক চরিত্রটি থেকে। নার্সিসাস একটি হ্রদের জলে তার নিজের প্রতিবিম্ব দেখে তার প্রেমে পড়ে যায় এবং প্রেমের আকাঙ্ক্ষায় তার শরীর ক্ষয় হয়ে যায় এবং সে একটি  ফুলে পরিণত হয়। সেই ফুলটির নাম নার্সিসাস।

যাদের আত্মপ্রেমিক ব্যক্তিত্ব বা নার্সিসিস্টিক পারসোনালিটি ডিজর্ডার আছে, তারা তাদের নিজেদের সম্বন্ধে অত্যন্ত উচ্চ ধারণা পোষণ করে। তারা মনে করে তারা অনন্য, অসাধারণ, এবং তাদের সাফল্য সম্পর্কে দিবাস্বপ্নে মসগুল থাকে। তাদের আত্মকেন্দ্রিক বললে কম বলা হয়। তারা চায় যে অন্যেরা তার প্রতি মনোযোগ দিক এবং অতিরিক্ত প্রশংসা করুক। অর্থাৎ অন্যের মনোযোগ আকর্ষণ করার চাহিদা এবং স্বীকৃতির চাহিদা তাদের মধ্যে প্রবল। তারা বিশ্বাস করে যে, সকলে তাদের বুঝতে পারেনা, শুধু উচ্চমর্যাদা সম্পন্ন ও বিশেষ ধরণের ব্যক্তিরা তাদের বুঝতে পারে। তাদের মধ্যে সহমর্মিতার অভাব থাকে, ঈর্ষা থাকে, অবাধ্যতা থাকে, এবং তারা অন্যের নিকট থেকে সুযোগ নেয়। এজন্য তাদের সামাজিক সম্পর্ক বিঘ্নিত হয়। তাছাড়া তারা মনে করে তারা অন্যের কাছ থেকে সব কিছু পাওয়ার অধীকারী, এবং সবারই তাদের জন্য বিশেষ কিছু করা উচিৎ, কিন্তু তাদের প্রতিদান দেয়ার প্রয়োজন নেই। তারা সমালোচনা সহ্য করতে পারেনা। সরে জমিনে পর্যবেক্ষণ করেও আত্মপ্রেমিক ব্যক্তিদের মধ্যে শুধু সহমর্মিতার অভাব এবং সমালোচনার প্রতি চরম প্রতিক্রিয়া ছাড়া, অন্য সবগুলো বৈশিষ্ট্যের উপস্থিতি প্রমাণিত হয়েছে। আমেরিকার জনসংখ্যায় এ ধরণের ব্যক্তিত্ব বিকৃতি ১% এর চেয়ে কম সংখ্যক লোকের মধ্যে দেখা যায়। এই বিকৃতিটি সীমাতবর্তী ব্যক্তিত্বের (Borderline Personality Disorder) সাথে সহাবস্থান করতে পারে (Morey, 1988)।

কারণ

নার্সিসিস্টিক পারসোনালিতি ডিজর্ডারের ভিত্তি রচিত হয়েছে আধুনিক কালের মনোসমীক্ষণবাদী রচনাসমূহের দ্বারা। অনেক মনোসমীক্ষণবাদী মনোচিকিৎসক মনে করেন আত্মপ্রেমিক ব্যক্তিত্বের বাইরের স্তরে আছে প্রচণ্ড আত্ম-শ্লাঘাবোধ, সম্পূর্ণ আত্মনিমগ্নতা এবং অসীম সাফল্য সম্পর্কে স্বপ্ন। কিন্তু এগুলোর আড়ালে থাকে একটি ভঙ্গুর আত্মমর্যাদাবোধ (lower self-esteem)। তারা সর্বদা মনোযোগ আকর্ষণ ও প্রশংসা পাওয়ার জন্য উদগ্রীব, সমালোচনার প্রতি অতি-সংবেদনশীল এবং ব্যর্থতা সম্পর্কে ভীত। অনেক সময় তারা এমন একজনকে খুঁজে পেতে চায় যাকে আদর্শস্থানীয় ভাবা যায়। কারণ তারা নিজেদের নিয়ে অসন্তুষ্ট থাকে। কিন্তু সাধারণতঃ তারা কাউকে নিজেদের সাথে ঘনিষ্ঠ হতে দেয়না। তারা খুব কম লোকের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করে এবং এসব সম্পর্ক খুব ভাসা, যখন কেউ তাদের অবাস্তব প্রত্যাশা পূরণে অবশ্যম্ভাবীভাবে ব্যর্থ হয়, তখন তারা ক্রুদ্ধ হয় এবং তাকে পরিত্যাগ করে। জীবনের গভীরতম স্থানে তারা দরিদ্র, কারণ তাদের নিজেদের সম্বন্ধে ফোলানো ফাপানো বড় ধারণা থাকা সত্ত্বেও সত্যিকারভাবে নিজেদের সম্বধে খুব কম চিন্তা কাজ করে।

আত্মপ্রেমিক ব্যক্তিত্ব বা নারসিসিস্টিক পারসোনালিটি ডিজর্ডারের প্রতি আধুনিক যুগের মনোবিজ্ঞানীদের আগ্রহের মূলে আছে হেইনজ কহোট (Heinz Kohut) এর দুটি গ্রন্থ। একটির নাম The Analysis of the Self (1981), এবং অন্যটির নাম  The Restoration of the Self (1977)। এই দুটি গ্রন্থে কহোট মনোসমীক্ষণের একটি নতুন সংস্করণ প্রতিষ্ঠিত করেছেন যাকে বলা হয় আত্ম-মনোবিজ্ঞান (self psychology)। কহোট মনে করেন আত্ম ধারণা (self) শৈশবেই বিকাশ লাভ করে এবং এর দুটি প্রান্ত বা মেরু থাকে। একটি মেরুতে থাকে অপরিপক্ব আত্মশ্লাঘা (immature grandiosity), অন্য প্রান্তে থাকে একটি নির্ভরশীল সত্তা যা অন্য মানুষের মধ্যে আদর্শ খোঁজে, বা অন্য মানুষকে আদর্শ হিসেবে মনে করে। অনেক শিশু স্বাস্থ্যসম্মত বা সুস্থ আত্ম-মর্যাদাবোধ (self esteem) গঠন করতে ব্যর্থ হয়। কারণ হলো শিশুরা যখন কোন কাজের মাধ্যমে তাদের ক্ষমতা প্রদর্শন করে তখন পিতামাতা তাদের প্রতি ইতিবাচকভাবে সাড়া দেয়না। অর্থাৎ শিশুটি তার ক্ষমতার জন্য এবং সাফল্যগুলোর জন্য উপযুক্তভাবে মূল্যায়িত হয়না, বরং শিশুটি পিটামাতার আত্ম-মর্যাদাবোধ কিভাবে বৃদ্ধি করল সেই মানদণ্ডেই শিশুটিকে মূল্যায়ন করা হয়। শিশুর পিতামাতা যদি শিশুর প্রতি উষ্ণ ভালোবাসা, সহমর্মিতা, এবং সম্মান নিয়ে প্রতিক্রিয়া করে, তখন তারা শিশুটির মধ্যে স্বাভাবিক আত্মমর্যাদাবোধ, এবং সুস্থ আত্মমূল্যায়ন গঠনে সহায়তা করেন। কিন্তু পিতামাতা যদি শিশুদের সরাসরি সমর্থন না করে শিশুর মাধ্যমে নিজেদের চাহিদাপূরণ করতে চান, তাহলে শিশুটির মধ্যে আত্মপ্রেমিক বা স্বার্থপর ব্যক্তিত্ব-বিকৃতি দেখা দেবে।

একটি উদাহরণ দিয়েছেন কহোট এবং ওলফ (Kohut and Wolf, 1978, p-418)। একটি ছোট মেয়ে স্কুল থেকে ফিরেই তার মাকে তার বিরাট সাফল্য সম্পর্কে বলার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছে। কিন্তু তার মা গর্বভরে তা না শুনে, তাদের আলাপ-আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুকে শিশুটির উপর থেকে সরিয়ে নিজের উপরে নিয়ে আসে এবং তার নিজের সাফল্য সম্পর্কে বলতে শুরু করে – যাতে করে ছোট্ট কন্যাটির সাফল্যগুলো আড়ালে পড়ে যায়।

এভাবে শিশুদের অবহেলা করা হলে, তাদের মনের ভেতরে বা অস্তিত্বের ভেতরে সুস্থ আত্ম-মর্যাদাবোধ গড়ে ওঠেনা এবং তারা নিজেদের দোষ ত্রুটিগুলো সহজে গ্রহণ করতে পারেনা। তারা আত্মপ্রেমিক ব্যক্তিত্ব বা নার্সিসিস্টিক পারসোনালিটি ডিজর্ডার গড়ে তোলে এবং তাদের আত্ম মর্যাদাবোধ বৃদ্ধি করার জন্য অন্যের ভালোবাসা ও স্বীকৃতি পাবার জন্য অবিরাম প্রচেষ্টা চালায়।

সমাজ-বিরোধী ব্যক্তিত্ব-বিকৃতি বা অ্যাটাই-সোশ্যাল পারসোনালিটি ও সাইকোপ্যাথি (Anti-Social Personality Disorder and Psychopathy)

লক্ষণ ও ইতিহাস

আজকের দিনে সমাজ-বিরোধী ব্যক্তিত্ব-বিকৃতি এবং সাইকোপ্যাথি (Psychopathy) – যাকে অনেক সময় সোসিওপ্যাথি (sociopathy) ও বলা হয়, শব্দগুলোকে একই অর্থে ব্যবহার করা হয়। তবে সমাজ-বিরোধী ব্যক্তিত্ব-বিকৃতি এবং সাইকোপ্যাথির মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। এ উভয় ধরনের ব্যক্তিত্ব-বিকৃতিতে আইন ভঙ্গ করা একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হিসাবে বিদ্যমান থাকে।

কিছু কিছু সমাজবিরোধী আচরণকে মানসিক অস্বাভাবিকতার প্রতিফলন হিসাবে দেখা হয়। এর একটি ঐতিহাসিক কারণ রয়েছে। উনবিংশতি শতাব্দীর গোড়ার দিকে ফিলিপ পিনেল (Phillipe Pinel) সমাজ-বিরোধী ব্যক্তিকে প্রচণ্ড উন্মাদ হিসাবে আখ্যায়িত করেছিলেন, যাদের মধ্যে মানসিক রোগীদের মত অন্যান্য জ্ঞানীয় বিকৃতির লক্ষণসমূহ উপস্থিত নেই। তারপর ১৯৩৫ সনে জেমস প্রিচার্ড (James Prichard) নামের একজন সাইকিয়াট্রিস্ট সমাজ-বিরোধী ব্যক্তিত্ব-বিকৃতিকে “নৈতিক উন্মত্ততা” (moral insanity) হিসাবে আখ্যায়িত করেন এবং যেসব আক্রমণাত্মক বা প্রচণ্ড আচরণ প্রচলিত আইন এবং নৈতিক বিচারের আওতায় আসেনা এবং যে আচরণগুলোকে উন্মত্ত বা অস্বাভাবিক বলে মনে হয়, সেসব আচরণকে নির্দেশ করেন। যে ব্যক্তির মভাব প্রিচার্ডকে “নৈতিক উন্মত্ততা” শব্দগুলো ব্যবহার করতে প্রণোদিত করেছিল সেই ব্যক্তিটি ছিল একজন সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি যে সহজেই রেগে যেত। এই লোকটি একটি ঘোড়াকে প্রচণ্ডভাবে চাবুক মেরেছিল, একটি কুকুরকে লাথি দিতে দিতে মেরে ফেলে ছিল এবং একজন কৃষাণীকে কুয়ায় নিক্ষেপ করেছিল। এই উভয় ক্ষেত্রেই সমাজ-বিরোধী আচরণগুলোর মধ্যে একটি নীচাশয়তা (depravity), দূরাচারত্ব বা নৈতিক কলুষতাসহ এক ধরনের অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য ছিল যা বেশিরভাগ অপরাধমূলক এবং আক্রমণাত্মক কাজের মধ্যে থাকে না।

DSM-IV-এ সমাজ-বিরোধী ব্যক্তিত্ব বিকৃতির (Antisocial personality disorder = APD) মধ্যে দুটো উপাদান বা শ্রেণী অর্ন্তভুক্ত। প্রথমটি হল ১৫ বছর বয়সের কম বয়সের ছেলে মেয়েদের চারিত্রিক বিকৃতির (Conduct disorder) উপস্থিতি। চারিত্রিক বিকৃতির লক্ষণ হলঃ স্কুল-পালানো, বাড়ী থেকে পালিয়ে যাওয়া, নিরুদ্দেশ হওয়া, ঘনঘন মিথ্যা কথা বলা, চুরি করা, অগ্নিসংযোগ করা, এবং ইচ্ছাকৃতভাবে সম্পত্তির ক্ষতিসাধন করা। সমাজ-বিরোধী ব্যক্তিত্বের দ্বিতীয় উপাদানটি হল প্রাপ্ত বয়সে উল্লিখিত সমাজবিরোধী আচরণগুলোর পুনরায় চলতে থাকা। সেজন্য DSM-IV অনুসারে সমাজ-বিরোধী ব্যক্তিত্ব বলতে শুধু কিছু ধরনের সমাজ-বিরোধী আচরণকেই বোঝায় না, বরং এ ধরনের আচরণের একটি প্যাটার্নকে বোঝায়, যা শৈশবে শুরু হয়ে প্রাপ্ত বয়সেও বহাল থাকে। সমাজ-বিরোধী ব্যক্তিত্ব বিকৃতি সম্পন্ন প্রাপ্ত বয়স্ক ব্যক্তি দায়িত্বজ্ঞানহীন অসামাজিক আচরণ প্রদর্শন করে; তারা পরস্পর সামঞ্জস্যহীন কাজ করে, আইন ভঙ্গ করে, সহজে ক্রুদ্ধ হয় বা মেজাজ খারাপ করে, শারীরিকভাবে আক্রমণাত্মক হয়, ঋণ শোধ করে না এবং বেপরোয়া কাজ করে। তারা আকাঙ্ক্ষা অবদমন করতে পারে না, ঝোঁকের বশে কাজ করে, আগে থেকে ভেবে বা পরিকল্পনা করে কোন কাজ করে না। সে তার মিথ্যাচার সম্পর্কে এবং দুষ্কর্ম সম্পর্কে সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল কিন্তু তবু তার সত্যনিষ্ঠা নেই, কিংবা অনুশোচনা নেই।

আমেরিকার প্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষদের মধ্যে ৩% এবং মহিলাদের মধ্যে ১% সমাজ-বিরোধী ব্যক্তিত্বের অধিকারী (Robins et al. 1984) । এধরনের ব্যক্তি বাংলাদেশে প্রচুর। যুবকদের মধ্যে এর সংখ্যা পৌঢ়দের তুলনায় বেশি। আমেরিকা ও বাংলাদেশের নিম্ন আর্থসামাজিক স্তরে এ ধরনের লোকের সংখ্যা বেশি। সমাজবিরোধী ব্যক্তিত্বের সঙ্গে অন্যান্য মানসিক ব্যাধি সহাবস্থান করে, বিশেষ করে, মাদকাসক্তির সঙ্গে সমাজবিরোধী ব্যক্তিত্ব-বিকৃতির সহাবস্থান (Comorbidity) সবচেয়ে বেশি।

সাইকোপ্যাথিক ব্যক্তিত্ব-বিকৃতির ধারণাটি হারভে ক্লেকলের (Harvey Cleckley) অবদানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। তার চিরায়ত গ্রন্থ “The Mask of Sanity (1976)” সাইকোপ্যাথিক ব্যক্তিত্ব বিকৃতিকে ঘনিষ্ঠভাবে বর্ণনা করেছে। দীর্ঘদিনের চিকিৎসামূলক অভিজ্ঞতার উপরে ভিত্তি করে ক্লেক্সে সাইকোপ্যাথিক বিকৃতিকে শনাক্ত করার জন্য কতকগুলো মানদণ্ডের প্রস্তাব করেছেন। DSM-IV এর মানদণ্ডের সঙ্গে ক্লেক্সের মানদন্ডের পার্থক্য হল এই যে, তিনি সাইকোপ্যাথদের সমাজবিরোধী আচরণের চেয়ে তাদের অনুভূতি ও চিন্তাধারার উপর বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন।

সাইকোপ্যাথদের একটি মৌলিক বৈশিষ্ট্য হল ইতিবাচক ও নেতিবাচক- উভয় ধরনের আবেগের দৈন্য (poverty of emotions) । তাদের লজ্জাবোধ নেই। এমনকি তারা যখন অন্যের জন্য ইতিবাচক অনুভূতি প্রকাশ করে- যেমন সমবেদনা কিংবা ভালবাসা, সেটাও একটা অভিনয় মাত্র। সাইকোপ্যাথরা বাহ্যিকভাবে চিত্তাকর্ষক এবং তারা নিজের স্বার্থের জন্য অন্যকে ব্যবহার করে। তাদের মধ্যে নেতিবাচক আবেগ (যেমন লজ্জা, ভয়, অনুশোচনা) না থাকার কারণে তারা ভুল থেকে শিক্ষা লাভ করতে পারে না এবং ইতিবাচক আবেগ না থাকার কারণে তারা অন্যের প্রতি দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণ করে। ক্লেকলে কর্তৃক সাইকোপ্যাথদের বর্ণনার আরেকটি মূল বৈশিষ্ট্য হল এই যে, সাইকোপ্যাথদের আচরণে যথেষ্ট পরিমাণে প্রেষণার অভাব। অর্থাৎ তাদের আচরণ অর্থের প্রয়োজনীয়তা অথবা এমনি ধরনের কোন কারণ থেকে উদ্ভুত হয় না। কিন্তু তার বদলে সেগুলো সুযোগ বা ক্ষণিক উত্তেজনার বশে সৃষ্টি হয়, যেমন অন্য কোন প্রেষণার বদলে “রোমাঞ্চ বা শিহরণ” উপভোগ করার জন্য সৃষ্টি হয়।

অনেক গবেষক সাইকোপ্যাথির নিদানের জন্য হেয়ার ও তার সহকর্মীদের দ্বারা নির্মিত একটি চেক লিস্ট বা প্রশ্নতালিকা ব্যবহার করেন (Hare et al. 1990)। এই চেকলিস্টে সাইকোপ্যাথির আচরণের দুটি গুচ্ছ শনাক্ত করা হয়: প্রথমগুচ্ছটি আবেগীয় নির্লিপ্ততা (emotional detachment) সম্পর্কিত। এতে সাইকোপ্যাথকে একজন স্বার্থপর, অনুশোচনা বিহীন ব্যক্তি হিসাবে বর্ণনা করা হয়- যে নিজের আত্মমর্যাদা সম্পর্কে ফোলানো ফাঁপানো উচ্চ ধারণা পোষণ করে এবং যে অন্যকে প্রতারণা করে বা নিজের স্বার্থে ব্যবহার করে। দ্বিতীয় গুচ্ছটিতে সাইকোপ্যাথকে একজন সমাজ-বিরোধী জীবন ধারার অধিকারী ব্যক্তি হিসাবে বর্ণনা করা হয়, যার প্রধান বৈশিষ্ট্য হল ঝোঁকের বশে/মুহূর্তের উত্তেজনায় কাজ করার প্রবণতা (Impulsivity) এবং দায়িত্বজ্ঞানহীনতা (Irresponsibility)। সাইকোপ্যাথিক ব্যক্তিত্ব-বিকৃতির সঙ্গে প্রথম অক্ষের (Axis-1) ব্যাধিগুলোর মধ্যে এলকোহল ও অন্যান্য মাদকাসক্তি প্রায়শঃ সহাবস্থান করে।

সুতরাং দুটি পরস্পর সম্পর্কযুক্ত ব্যক্তিত্ব বিকৃতি শনাক্ত করা যাচ্ছে- একটি সমাজ-বিরোধী ব্যক্তিত্ব বিকৃতি (Antisocial Personality), ও অন্যটি সাইকোপ্যাথি (Psychopathy)। এ দু’ধরনের ব্যক্তিত্ব বিকৃতি সম্পর্কযুক্ত হলেও এক নয়। প্রসঙ্গত এখানে DSM-IV অনুসারে সমাজ-বিরোধী ব্যক্তিত্ব বিকৃতির নির্ণায়কসমূহ উল্লেখ করা যায়।

DSM-IV অনুসারে সমাজবিরোধী ব্যক্তিত্বের নির্ণায়কসমূহ

  • (ক) ১৫ বছর বয়সের পর থেকে অন্যের অধিকার অস্বীকার বা অশ্রদ্ধা এবং লঙ্ঘন করার পরিব্যাপক আচরণগত বৈশিষ্ট্য যা নিম্নলিখিত তিনটি (বা তার বেশি) আচরণের মাধ্যমে নির্দেশিত হয়।
    • (১) আইনসম্মত আচরণের সামাজিক মানদণ্ডের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনে ব্যর্থতা- যার নির্দেশক হল সেইসব আচরণের পুনরাবৃত্তি যেগুলোর কারণে সে বারবার গ্রেফতার হয়।
    • (২) প্রবঞ্চনা বা শঠতা- যার নির্দেশক হল মিথ্যা কথা বলা, বিভিন্ন নাম (ছদ্ম নাম) ব্যবহার করা এবং নিজের স্বার্থের জন্য অন্যকে ব্যবহার করা বা চালিত করা।
    • (৩) ঝোঁকের বশে কাজ করা অথবা পূর্ব থেকে পরিকল্পনা করার ব্যর্থতা।
    • (৪) সহজে উত্তেজিত হওয়া (irritability) এবং আক্রমণাত্মক আচরণ করা যার নির্দেশক হল পুনঃপুনঃ শারীরিক সংঘর্ষ বা মারামারি করা।
    • (৫) অন্যের বা নিজের নিরাপত্তার প্রতি বেপরোয়া অবজ্ঞা প্রদর্শন করা।
    • (৬) ক্রমাগত দায়িত্বহীনতা- যার নির্দেশক হল সঙ্গতিপূর্ণভাবে কাজ করার ব্যর্থতা, অথবা অর্থনৈতিক প্রতিশ্রুতি পালনে ব্যর্থতা।
    • (৭) অনুশোচনার অভাব- যার নির্দেশক হল অন্যকে আঘাত করা অসদাচরণ করা- অথবা অন্যের নিকট থেকে কিছু চুরি করার স্বপক্ষে যুক্তি প্রদর্শন করা।
  • (খ) ব্যক্তির বয়স কমপক্ষে ১৮ বছর
  • (গ) চারিত্রিক বিকৃতি সম্পর্কে প্রমাণ থাকতে হবে, এবং তা ১৫ বছর বয়স থেকে শুরু হয়েছিল এমন প্রমাণ থাকতে হবে।
  • (ঘ) সমাজ-বিরোধী আচরণ শুধু স্কিজোফ্রেনিয়া বা ম্যানিক পর্যায়ে ঘটে না- এ বিষয়ে নিশ্চিত হতে হবে।

হেয়ার, হার্ট এবং হারপুর (Hare, Hart and Harpur. 1991)-DSM-IV এর সমাজ-বিরোধী ব্যক্তিত্বের সংজ্ঞা বা নিদান (Diagnosis) সম্পর্কে আপত্তি তুলেছেন। তার কারণ হল, এই সংজ্ঞায় সমাজবিরোধী ব্যক্তিত্ব-বিকৃতিকে চিহ্নিত করতে হলে বহু বছর পূর্বে তাদের জীবনের ঘটনাগুলো বলতে হয় এবং তাদের মিথ্যাকথা বলা অভ্যাস থাকে। (দ্রষ্টব্যঃ সমাজ-বিরোধী ব্যক্তিত্ব বিকৃতির শুরু হয় ১৫ বছর বয়স থেকে।) তদুপরি মনোবিকার (Psychopathology)-এর ক্ষেত্রে একটি নিদানিক ধারণা শুধু অপরাধমূলক আচরণের মধ্যে সীমিত রাখা উচিত নয়। অর্থাৎ অপরাধ প্রবণতা (Criminality) এবং সাইকোপ্যাথি সমার্থক হতে পারে না। কিন্তু গুরুতর অপরাধীদের (যেমন খুনী, লুণ্ঠনকারী, অগ্নিসংযোগকারীদের) মধ্যে ৭৫% থেকে ৮০% ব্যক্তি সমাজ-বিরোধী ব্যক্তিত্ব-বিকৃতির মানদণ্ডগুলো পূরণ করে। বিপরীত পক্ষে, গুরুতর অপরাধের জন্য দন্ডিত ব্যক্তিদের মধ্যে মাত্র ১৫% থেকে ২০% ব্যক্তিকে সাইকোপ্যাথ বলে চিহ্নিত করা যায়। সেজন্য সাইকোপ্যাথির ধারণাটির বেশ কিছু সুবিধা রয়েছে।

সাইকোপ্যাথির কারণ সম্পর্কিত গবেষণা পর্যালোচনা করার পূর্বে ড্যান নামক একজন সাইকোপ্যাথ এর জীবন বৃত্তান্ত আলোচনা করা যাক। এই জীবন বৃত্তান্তটি সংগ্রহ করেছেন মনোবিজ্ঞানী ম্যাকনীল (Mc Neil, 1967)- যিনি ড্যানের বন্ধু ছিলেন। ড্যানের জীবন বৃত্তান্ত থেকে একজন সাইকোপ্যাথের চিরায়ত বৈশিষ্ট্যগুলো সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। তবে অন্যান্য সাইক্যোপাথদের সঙ্গে ড্যানের পার্থক্য হল এই যে, অন্যান্য সাইকোপ্যাথরা অপরাধ করে আইনে সোপর্দ হয় অথবা চিকিৎসা কেন্দ্রে চিকিৎসাধীন থাকে, কিন্তু কিন্তু ড্যান ড্যান আইন ভঙ্গ করেনি এবং পুলিশের কাছে ধরা পড়েনি। অন্ততঃ পক্ষে সে একবারও বিচারে দণ্ডিত হয়নি।

ড্যানের জীবন বৃত্তান্ত (The case of DAN)

ড্যানের জীবন বৃত্তান্ত লিপিবদ্ধ করেছিলেন তার বন্ধু এবং মনোবিজ্ঞানী ম্যাকনীল (Mc Neil, 1967)। এই বৃত্তান্তটি আমরা ডেভিসন ও নীয়েল (১৯৯৮) এর গ্রন্থ থেকে বঙ্গানুবাদ করা হচ্ছে।

ড্যান ছিল একজন ধনাঢ্য অভিনেতা (actor) এবং ডিস্ক ব্যবহারের জকি (Disc Jockey)। সে শহরতলীর একটি সম্ভ্রান্ত এলাকায় থাকত এবং সাধারণতঃ এলাকার লোকদের বিপদের হাত থেকে রক্ষা করতে এগিয়ে আসত। একদিন সন্ধ্যা বেলা সে (ড্যান) এবং ম্যাকনীল ডিনার খেতে গেলে তাদের ফরমায়েশ অনুযায়ী হোটেলে যে চিংড়ি মাছের বিশেষ রান্না (Shrimp de Johnge) পরিবেশন করা হয়, তা নিয়ে ড্যান মহা চৈ চৈ বাঁধিয়ে ফেলে। ম্যাকনীল বুঝতে পারেন যে, ড্যান কিছু একটা উদ্দেশ্য নিয়েই এই পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে।

ম্যাকনীল: আমার মনে একটা সন্দেহ উঁকি দিচ্ছে যে, তুমি প্রকৃত পক্ষে ক্ষুধার্ত ছিলে না, আর ঠিক এজন্যই এই ঘটনাটা ঘটেছে।

ড্যান: (হো হো করে হেসে সম্মতি জানিয়ে) জাহান্নামে যাক। এর পর থেকে ব্যাটারা তটস্থ থাকবে।

ম্যাকনীল: তুমি যা করেছ সেটা কি শুধু এজন্যই যে এর পর থেকে তারা সতর্ক থাকবে?

ড্যান: না। আমি তোমাকে দেখাতে চেয়েছি যে আমি ছাড়া পৃথিবীর আর সবাই কেমন মেরুদণ্ডহীন।
তুমি যদি একটু ধাক্কা দাও, অমনি ওরা লাফিয়ে পাগারপার হয়। এরপর যখনই আমি এখানে খেতে আসব,
সবকটা হুজুর হুজুর করবে, আর ঠিক আমি যেভাবে চাইব সেভাবেই সব কিছু করার জন্য যত্নবান থাকবে।
এভাবেই তাদের শিক্ষা দিতে হয় প্রথম শ্রেণীর লোকদের তৃতীয় শ্রেণীর লোকদের থেকে আলাদা করতে।
আমি যখন কোথাও ভ্রমণ করি তখন আমি প্রথম শ্রেণীতেই যাই।

ম্যাকনীল: আচ্ছা, তুমি একজন ব্যক্তি হিসাবে নিজেকে কেমন মনে কর? একজন সঙ্গী হিসাবে?

ড্যান: থোরাই কেয়ার করি (হাসি)। তারা যদি আমার চেয়ে বড় হত, তাহলে তারাও আমার প্রতি এমনই ব্যবহার করত। তুমি যতই তাদের মাড়িয়ে যাবে, ততই তারা এটা বেশি পছন্দ করবে। এটা হল সেই পুরানো দিনের রাজভক্তির মত। প্রত্যেকেই যদি অন্য সবার সমান হয়, তাহলে তারা নার্ভাস হয়ে যায়। লক্ষ্য কর আমি কি করি। আমরা যখন হোটেলটি ত্যাগ করব তখন আমি ঐ ওয়েট্রেস মেয়েটার কোমর জড়িয়ে ধরব এবং জিজ্ঞাসা করব সে আমাকে এখনও ভালবাসে কিনা। তার নিম্নাংগে হাত বুলাব এবং তারপর দেখবে যেকোন সময় আমি আঙ্গুলে ইসারা করার সাথে সাথে সে আমার সঙ্গে শুয়ে পড়তে রাজী হবে। (Mc Neil. 1967.
p. 85)।

আরেকদিনের ঘটনা। শোনাগেল যে ড্যানের এক বন্ধু আত্মহত্যা করেছে। অন্যান্য সব বন্ধুরা মিলে ম্যাকনীলের কাছে আসল যদি লোকটির আত্মহত্যার কারণ সম্পর্কে কোন তথ্য দিতে পারে। ড্যান এলো না। পরে আরেকদিন ম্যাকনীল যখন ড্যানের নিকট উক্ত বন্ধুর আত্মহত্যার কথা বলল, তখন ড্যান শুধু বলল যে, এভাবেই তো সব বল লাফায়। তবে প্রকাশ্যে এই আত্মহত্যার ঘটনাটির প্রতি তার আচরণ ছিল সম্পূর্ণ অন্যরকম। সেই একমাত্র ব্যক্তি যে অর্থ সংগ্রহ করে বিধবা বন্ধু-পত্নীর হাতে ব্যক্তিগত ভাবে তুলে দিয়েছিল। তার চরিত্রের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে সে মন্তব্য করেছিল যে বিধবা মহিলাটির শরীরে যৌন-আবেদন আছে এবং ড্যান তার প্রতি সত্যি আগ্রহী।

এই দুটো ঘটনা ড্যানের আচরণের বৈশিষ্ট্য উম্মোচন করে। ম্যাকনীল ড্যানের এ ধরনের আরো অসংখ্য আচরণ পর্যবেক্ষণ করে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন, “এসব ঘটনা থেকে তার ভয়ঙ্কর নষ্ট চরিত্রের চিত্র পাওয়া যায়। ড্যান সারাজীবন অন্য মানুষকে তার চিত্তবিনোদন ও আর্থিক লাভের জন্য ব্যবহার করেছে। অফিসের রাজনীতিতে সে ছিল দক্ষ এবং তার প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য কত অসম্ভব রকমের চতুর এবং গোপন ষড়যন্ত্র করেছে সেগুলো সে আমাকে বলেছে। চরিত্র হনন, গুজব ছড়ানো, ব্ল‍্যাকমেইল করা, যৌন লালসা চরিতার্থ করা, এবং চোখেমুখে মিথ্যা কথা বলা ছিল তার ন্যূনতম গুণাবলী। বিনোদনের বাগানে সে ছিল একটি ধূর্ত শেয়াল, সে যাদের পেশাগত জীবন ধ্বংস করে দিত তাদের লাশ নিয়ে আনন্দ ভোজ করত।

ড্যানের সঙ্গে আলাপ করে ম্যাকনীল তার জীবন ইতিহাস উদ্ঘাটন করেছিলেন। ড্যান তার প্রথম জীবনের একটি ঘটনার বর্ণনা দিয়েছিল ম্যাকনীলের কাছে। সেই ঘটনা থেকে তার সাইকোপ্যাথিক বৈশিষ্ট্যের পূর্বাভাষ পাওয়া যায়।

ড্যান বলেছে, “একটি ঘটনার কথা আমার মনে আছে যা থেকে আমি জীবনের প্রথম বুঝতে পারি যে, আমি অন্য সকলের চেয়ে পৃথক। আমি যখন উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়ি তখন আমার সবচেয়ে ঘনিষ্ট বন্ধুর লিউকেমিয়া (রক্তের ক্যানসার) ধরা পড়ে। সে মারা যাওয়ার পর আমি তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় যোগদান করি। প্রত্যেকেই কান্নাকাটি করছিল এবং নিজেদের জন্য দুঃখ করছিল। তারা যখন আমার মৃত বন্ধুর আত্মার স্বর্গারোহনের জন্য প্রার্থনা করছিল, তখন আমি হঠাৎ বুঝতে পারলাম যে আমি কোনকিছুই অনুভব করছিনা। আমার বন্ধুটি ভাল লোক ছিল, কিন্তু তাতে কি? সেই রাতে আমি আরও কিছু চিন্তা করেছি, তারপর আমার মনে হল, আমার বাবা এবং মা যদি মারা যায়, তাহলে তাদের জন্যও আমার কোন দুঃখ হবে না এবং আমার ছোট ভাই বোনদের জন্যও আমি খুব একটা পাগল ছিলাম না। এটা আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে উঠল যে, এমন কেউ নেই যার জন্য আমার সহানুভূতি আছে। পৃথিবীতে আমি কারো জন্য কেয়ার করি না এবং আমার কারো প্রয়োজন নেই। এরপর আমি গড়াগড়ি খেলাম এবং ঘুমিয়ে পড়লাম।”

পিনেল এবং প্রিচার্ড (Pinel and Prichard) সাইকোপ্যাথিক ব্যক্তিত্বের যে বর্ণনা দিয়েছিলেন, ড্যানের ব্যক্তিত্বে সেই সব লক্ষণ উপস্থিত রয়েছে। একজন ব্যক্তি যুক্তিপূর্ণভাবে আচরণ করতে পারে, বাস্তবের সঙ্গে কোন ধরনের বিচ্ছিন্নতা দেখা যায় না; কিন্তু সে স্বভাবগতভাবে এবং ক্রমশঃ বেশি করে নীতি বিগর্হিত (বা অনৈতিক) আচরণ করতে থাকে। ড্যানের জীবন বৃত্তান্তের শেষ অনুচ্ছেদটিতে দেখা যায়, ড্যানের মধ্যে অন্যের জন্য বিন্দুমাত্র সহানুভূতি বা ভালবাসা নেই। এটিই সাইকোপ্যাথিক আচরণের একটি বড় কারণ।

সাইকোপ্যাথিক ব্যক্তিত্বের কারণ (Etiology of Psychopathy)

সাইকোপ্যাথিক ব্যক্তিত্ব-বিকৃতির কারণ অনুসন্ধান করার জন্য যেসব গবেষণা হয়েছে, সেগুলোর বেশিরভাগই করা হয়েছে যেসব অপরাধীর (Criminal) সাজা হয়েছে তাদের নিয়ে। সেজন্য এসব গবেষণার ফলাফল সকল সাইকোপ্যাথদের জন্য সাধারণীকরণ করা যাবে না, বিশেষভাবে এসব ফলাফল যেসব সাইকোপ্যাথ পুলিশের কাছে ধরা পড়েনি, তাদের বেলায় সত্যি না-ও হতে পারে।

বংশগতি বা জীনের প্রভাব (Hereditary/Genetic influence)

গবেষণার মাধ্যমে প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে যে, অপরাধ প্রবণতা এবং সমাজ-বিরোধী ব্যক্তিত্বের মূলে বংশগত উপাদানের ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু সমাজ-বিরোধী ব্যক্তিত্বের বিকাশ সম্পর্কে ক্লেকলে এবং হেয়ার (Cleckley and Hare) যে তত্ত্ব দিয়েছেন, তার উপরে ভিত্তি করে কোন জীন-সম্পর্কিত গবেষণা এখনও হয়নি।

একত্রে প্রতিপালিত এবং ভিন্ন পরিবারে প্রতিপালিত অভিন্ন যমজ (Monozygous Twins-MZ) নিয়ে গবেষণা করে, এবং পালিত সন্তানদের নিয়ে গবেষণা করে যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া গেছে যে, সমাজ-বিরোধী এবং সাইকোপ্যাথিক ব্যক্তিত্ব বিকৃতিতে বংশগতির ভূমিকা রয়েছে (Gottesman and Goldonith. 1944)। লিয়নস (Lyons et al, 1995)-এর একটি গবেষণায় দেখা যায়, অভিন্ন যমজদের মধ্যে একজনের সমাজবিরোধী ব্যক্তিত্ব বিকৃতি থাকলে অন্য জনের মধ্যেএই বিকৃতি ঘটার সম্ভাবনা ভিন্ন যমজদের চেয়ে বেশি। ঠিক তেমনিভাবে পালিত পুত্রদের গবেষণায় দেখা গেছে, সন্তানদের সমাজ-বিরোধী আচরণের সহ-সম্পর্ক পালক পিতাদের চেয়ে আসল পিতাদের সঙ্গে বেশি ধনাত্মক।

তবে যমজ গবেষণা এবং পালিত সন্তানদের নিয়ে যেসব গবেষণা হয়েছে সেগুলোতে সমাজ-বিরোধী ব্যক্তিত্বের গঠনে পরিবেশের গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব লক্ষ্য করা গেছে। কেডরেট ও তার সহকর্মীদের একটি গবেষণায় (Cadoret et al., 1995) দেখা গেছে পালক পিতাদের মধ্যে সমাজ-বিরোধী আচরণ থাক বা না থাক পালক পিতাদের গৃহপরিবেশ বিরূপ থাকলে (যেমন দাম্পত্য কলহ, মাদকাসক্তি) পালিত সন্তানদের মধ্যে সমাজ-বিরোধী ব্যক্তিত্ব-বিকৃতি বেশি হয়।

রেইস ও তার সহকর্মীদের (Reiss et al., 1995) অভিন্ন যমজদের নিয়ে একটি গবেষণায় দেখা যায়, পিতামাতার মধ্যে উচ্চ মাত্রায় দ্বন্দ্ব, নেতিবাচক আচরণ (negativity) এবং শিশুর প্রতি পিতামাতার উষ্ণ আদর যত্নের অভাব- এগুলো সমাজ-বিরোধী ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারে।

পরিবারের ভূমিকা (Role of The Family)

সাইকোপ্যাথিক ব্যক্তিদের বেশিরভাগ আচরণই যেহেতু সামাজিক আদর্শের পরিপন্থী সেহেতু অনেকে মনে করেন যে, এই সব ব্যক্তিদের সামাজিকীকরণের মাধ্যম অর্থাৎ পরিবারের ভূমিকাই সবচেয়ে বেশি দায়ী। ম্যাককর্ড ও ম্যাককর্ড (Me Cord and Mc Cord, 1964)-অনেকগুলো গবেষণা পর্যালোচনা করে বলেছেন যে, সাইকোপ্যাথিক আচরণের জন্য পিতামাতার স্নেহের অভাব, এবং পিতামাতা কর্তৃক শিশুর প্রতি চরম অবহেলা প্রদর্শন বা প্রত্যাখ্যান (rejection) দায়ী। আরো কতকগুলো গবেষণায় দেখা গেছে যে, শিশুদের শৃঙ্খলা শিক্ষা বা নিয়মানুবর্তিতা (discipline) এবং অন্যের প্রতি দায়িত্বপূর্ণ আচরণ শিক্ষাদানের সময় পিতামাতা যদি অসামঞ্জস্যপূর্ণভাবে শাস্তি দেয় তাহলে শিশুদের মধ্যে সমাজবিরোধী ব্যক্তিত্ব গড়ে উঠে। (Bennett, 1960)। তাছাড়া, সাইকোপ্যাথদের পিতাদের মধ্যে সমাজ-বিরোধী আচরণ করার সম্ভাবনা বেশি দেখা যায়।
তবে শৈশবের শিশু পালন সম্পর্কিত তথ্য অতটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। কারণ এগুলো যোগাড় করা হয়েছে অতীত ঘটনার স্মৃতির উপরে ভিত্তি করে। কারণ একজন যখন তার পিতার বর্তমান মর্যাদা সম্পর্কে অবহিত থাকে তখন তা তার পিতার সম্পর্কে অতীতের স্মৃতিকে প্রভাবিত করতে পারে। সে যখন দেখে যে, তার পিতার অতীতের ভালো আচরণগুলো বর্তমান চরিত্রের সঙ্গে খাপ খায়না, তখন সে শুধু অতীতের খারাপ আচরণগুলো সম্পর্কে বলে। তাছাড়া সাইকোপ্যাথরা নিজেরাই মিথ্যাভাষণে অভ্যস্থ। সেজন্য তাদের বিবরণ বিশ্বাসযোগ্য নয়।

আরেকটি পদ্ধতি হল, যে সব শিশু অসদাচরণের জন্য পরামর্শদান কেন্দ্র বা Child Guidance Clinic-এ আসে তাদের প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া পর্যন্ত অনুসরণ করা। এ ধরনের গবেষণার মাধ্যমে বিশ্বাসযোগ্য ফলাফল পাওয়া যায়। এমনি একটি গবেষণা করেছিলেন রবিনস্ (Robins, 1966)। পরামর্শদান কেন্দ্রে যেসব শিশু নাম লিখিয়েছিল, তিনি তাদের সমস্যা, পারিবারিক তথ্য, কেন সে পরামর্শদান কেন্দ্রে এসেছে এসব তথ্য লিপিবদ্ধ করেছিলেন। এধরনের শিশুদের ৫৪৮ জনের মধ্যে ৯০% কে ৩০ বছর পরে আবার খুঁজে বের করা হয়। ঠিক একই বয়সের এবং একই এলাকায় বসবাসকারী আরো ১০০ জন ব্যক্তির নিকট থেকেও তথ্য সংগ্রহ করা হয়। শেষের ১০০ জন হল “নিয়ন্ত্রিত দল” যাদের কোন অসামাজিক আচরণ ছিল না (অর্থাৎ তাদের কোনদিন পরামর্শ কেন্দ্রে পাঠানো হয়নি)। এরপর উভয় দলের ব্যক্তিদের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করা হয় এবং কোন প্রকার মানসিক ব্যাধি থাকলে বা অভিযোজনমূলক সমস্যা থাকলে তা শনাক্ত করা হয়। এরপর ঐসব ব্যক্তির শৈশবের তথ্যগুলোর সঙ্গে মিলিয়ে দেখা হয় কোন কোন তথ্য বয়ঃপ্রাপ্তির পর সমাজ-বিরোধী আচরণ সম্পর্কে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য পূর্বাভাষ দিতে পারে।

রবিনস্-এর গবেষণায় দেখা যায়, যেসব শিশুর মধ্যে নিম্নলিখিত বৈশিষ্ট্যগুলো বর্তমান থাকে, প্রাপ্ত
বয়সে তাদের মধ্যে সাইকোপ্যাথিক ব্যক্তিত্ব দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি থাকে:

  • (১) যাদের বিরুদ্ধে চৌর্যবৃত্তি ও আক্রমণাত্মক আচরণের অভিযোগ থাকে।
  • (২) যারা বহু ধরনের সমাজ-বিরোধী আচরণ ইতিপূর্বে প্রদর্শন করেছে, যেগুলোর মধ্যে অন্ততঃ একটি দৃষ্টান্ত এমন যে তাকে কিশোর আদালতে সোপর্দ করা যায়।
  • (৩) তাদের সমাজ-বিরোধী আচরণগুলো তাদের অপরিচিত ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, পিতামাতা অথবা শিক্ষকদের বিরুদ্ধে সংঘটিত হয়েছে, অথবা তাদেরকে জড়িত করে করা হয়েছে।

পরামর্শদান কেন্দ্রে উপস্থিত হওয়ার সময় যেসব শিশুর মধ্যে উল্লিখিত বৈশিষ্ট্যগুলো বিদ্যমান ছিল পরবর্তীকালে তাদের অর্ধেকের বেশি সংখ্যককেই সমাজ-বিরোধী ব্যক্তিত্ব (Sociopathic Parsonality) হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। ছোট বেলায় এসব শিশুর স্কুল পালানোর ইতিহাস ছিল, চুরি করার ইতিহাস ছিল, অনেক রাতে বাসায় ফিরত, পিতামাতার কথা শুনতনা (তাদের আদেশ মান্য দ্রুত না)। তারা প্রচণ্ড মিথ্যাবাদী ছিল, এবং তাদের অপরাধের জন্য অনুতপ্ত হত না। তারা তাদের দায়িত্ব পালন করত না এবং প্রত্যাশিত আচরণ করত না, অথবা টাকা পয়সা খরচের বিষয়ে দায়িত্বপূর্ণ আচরণ করত না।

তাদের পরিবারিক পরিবেশ কেমন ছিল?

  • (১) তাদের পরিবারে নিয়ম শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য সামঞ্জস্যপূর্ণ নিয়ম ছিল না (inconsistent discipline) অথবা কোন নিয়মশৃঙ্খলা ছিল না।
  • (২) পিতা সমাজ-বিরোধী আচরণ করত।

তবে একই ধরনের পারিবারিক পরিবেশ থেকে আসলেও অনেকের মধ্যে সমাজ-বিরোধী ব্যক্তিত্ব গঠিত হয় না অথবা অন্য কোন মানসিক বিকৃতিতে আক্রান্ত হয় না। সেজন্য মনে হয়, সাইকোপ্যাথিক ব্যক্তিত্ব গঠনের জন্য পারিবারিক অভিজ্ঞতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করলেও, এটিই একমাত্র শর্ত নয়।

আবেগ ও সাইকোপ্যাথি (Emotion and Psychopathy)

সমাজ-বিরোধী ব্যক্তিত্বের জন্য আবেগীয় অক্ষমতা বা অসম্পূর্ণতা গুরুত্বপূর্ণ বলে প্রমাণিত হয়েছে। সাইকোপ্যাথিক লক্ষণাবলীর সংজ্ঞা দিতে গিয়ে ক্লেকলে (Cleckley) বলেছিলেন যে, এ ধরনের ব্যক্তিরা অভিজ্ঞতা থেকে লাভবান হয় না, এমনকি শাস্তির মাধ্যমেও তারা কিছু শেখেনা। সামাজিক অসদাচরণের জন্য তাদের যে নেতিবাচক পরিণাম বা শাস্তি হয়, সেগুলোও তারা এড়িয়ে যেতে শেখেনা। বারবার জেল খাটলেও তারা ক্রমাগত আইন ভঙ্গ করতে থাকে। অন্যকে আঘাত দিলে, মিথ্যা বললে, অথবা আইন ভঙ্গ করলে আমাদের সাধারণ মানুষদের যে উদ্বেগ হয়, বিবেকের দংশন হয়, যা এসব কাজ থেকে আমাদের বিরত রাখে সে ধরনের উদ্বেগ এবং বিবেকের দংশন থেকে তারা মুক্ত। অর্থাৎ উদ্বেগ এবং বিবেকের দংশন থেকে মুক্ত থাকার জন্য তারা যেন একটি প্রতিরোধ ব্যবস্থা তৈরী করে। তাছাড়া, তারা তাদের কর্মপ্রবণতা বা চিত্তাবেগকে (Impulse) অবদমন করতে পারে না।

উল্লিখিত চিকিৎসামূলক পর্যবেক্ষণসমূহের উপরে ভিত্তি করে লাইক্কেন (Lykken, 1957) সিদ্ধান্ত
গ্রহণ করেন যে, যেহেতু সাইকোপ্যাথিক ব্যক্তিদের মধ্যে ভবিষ্যতের শাস্তি সম্পর্কে কোন উদ্বেগ থাকে না
সেজন্য সমাজ-বিরোধী কর্মকাণ্ড সংঘটিত করতে তাদের বাধে না, অর্থাৎ সমাজ-বিরোধী কর্মকাণ্ড ঘটানোর বিরুদ্ধে তাদের মধ্যে কোন অবদমন প্রক্রিয়ার সৃষ্টি হয় না, তিনি সাইকোপ্যাথদের মধ্যে সত্যি সত্যি উদ্বেগের পরিমাণ কম কিনা তা পরীক্ষা করার জন্য লাইক্কেন কতকগুলো পরীক্ষণ করেছিলেন। এ ধরনের একটি পরীক্ষণ ছিল পরিহারমূলক শিক্ষণ নিয়ে।

জেলখানায় আটক কয়েদীদের মধ্য থেকে গবেষণার জন্য একদল কয়েদীকে নির্বাচিত করা হল-যারা লাইক্কেনের সংজ্ঞা অনুসারে সাইকোপ্যাথদের বৈশিষ্ট্যগুলো পূরণ করে। একটি পরিহারমূলক শিক্ষণের পরীক্ষায় তাদের সাফল্যাঙ্কের সাথে আরেক দল জেল খানার কয়েদী যাদের মধ্যে সাইকোপ্যাথিক বৈশিষ্ট্য ছিল না এবং এক দল কলেজ ছাত্রের উক্ত পরীক্ষার সাফল্যাঙ্কের তুলনা করা হয়। এখানে স্মরণ করা উচিত যে, এধরনের পরীক্ষণে এটা নিশ্চিত হওয়া উচিত যে, শুধু পরিহারমূলক শিক্ষণ ঘটছে, অন্য কোন পুরস্কারের মাধ্যমে শিক্ষণ ঘটছে না। উদাহরণ স্বরূপ, একজন ব্যক্তি যদি দেখে যে তার তার কাজটি হল ব্যাথ্যা পরিহার করতে শেখা তাহলে শুধু ব্যথা এড়িয়ে যাওয়াই তার একমাত্র প্রেষণা হবে না। এর সাথে সে পরীক্ষকের নিকট প্রমাণ করতে চাইবে যে সে একজন চতুর (Smart) ব্যক্তি। শুধু পরিহার-প্রেষণা ছাড়া অন্য কোন প্রেষণা যাতে পরীক্ষণে উপস্থিত না থাকে তার জন্য লাইক্কেন পরিহার শিক্ষণের কাজটিকে এমনভাবে উপস্থিত করলেন যাতে সেটিকে একটি আকস্মিক শিক্ষণ বলে মনে হয়। প্রকৃত পক্ষে আকস্মিক শিক্ষণ পরীক্ষণের একটি গৌণ দিক ছিল। তিনি নিম্নলিখিত যন্ত্রটি ব্যবহার করেন।

চিত্র: লাইক্কেন (১৯৫৭)

উপরের চিত্রের মত এই যন্ত্রটি সাইকোপ্যাথদের পরিহার শিক্ষণ সম্পর্কে গবেষণা করার জন্য উদ্ভাবন করেন। প্রথমবার লিভারে (চাবিতে) চাপ দেওয়ার সময় ধরা যাক ৩নং চাবিটি সঠিক। সুতরাং তিন (৩) নম্বর চাবিতে চাপ দিলে সবুজবাতি জ্বলে উঠবে, ১নং ও চার নং চাবিগুলো ভুল চাবি, এবং এগুলোতে চাপ দিলে লাল বাতি জ্বলবে। কিন্তু ২নং চাবিতে চাপ দিলে লাল বাতি জ্বলে উঠবে এবং সঙ্গে সঙ্গে পরীক্ষণ পাত্রকে বৈদুতিক আঘাত দেওয়া হবে। দ্বিতীয়বার লিভারে চাপ দেওয়ার সময় (অর্থাৎ দ্বিতীয় প্রচেষ্টায়) এই চাবিগুলোর অর্থ বদলে যেতে পারে। যেমন ২নং লিভার সঠিক হতে পারে, ৩নং ও ৪নং চাবি ভুল হতে পারে, এবং ১নং চাবিতে বৈদ্যুতিক আঘাত দেওয়া হতে পারে। পরীক্ষণ-পাত্রকে বিশটি অনুক্রমে সঠিক প্রতিক্রিয়া শিখতে হবে।

এই যন্ত্রটিতে পরীক্ষণপাত্রের সম্মুখে উপস্থিত করার জন্য একটি প্যানেল ছিল। এই প্যানেলে সবচেয়ে উপরের সারিতে ছিল চারটি লাল বাতি, ২য় সারিতে ছিল চারটি সবুজ বাতি এবং সবচেয়ে নিচের সারিতে প্রত্যেক কলামের নিচে একটি করে মোট চারটি চাবি।

পরীক্ষণ পাত্রের কাজ ছিল, বিশটি অনুক্রমে সঠিক প্রতিক্রিয়া করা। প্রত্যেকটি অনুক্রমে তাকে প্রচেষ্টা ও ভুলের মাধ্যমে শিখতে হত কোন্ চাবিটি সঠিক। সঠিক চাবিটিতে চাপ দিলে সবুজ বাতি জ্বলে উঠবে। অন্য দুটি চাবি হল “ভুল”-এবং এগুলোতে চাপ দিলে লাল বাতি জ্বলে উঠবে। তৃতীয় “ভুল” চাবিটিতে চাপ দিলে বৈদ্যুতিক আঘাত পাওয়া যাবে। সঠিক চাবিটির অবস্থান একেক প্রচেষ্টায় একেক রকম করা হত। পরীক্ষণ পাত্রদের বলা হত সঠিক চাবিটি খুঁজে বার করতে। এভাবে তাকে বিশবার সঠিক প্রতিক্রিয়া করতে শিখতে হত। প্রত্যেকবারই সঠিক চাবির অবস্থান পরিবর্তন করা হত। বৈদ্যুতিক আঘাত পরিহার করা বাঞ্ছনীয় বা সম্ভব সে কথা পরীক্ষণ পাত্রদের বলা হয়নি। শুধু পরীক্ষণ পাত্ররা যাতে ভালভাবে শিখতে পারে তার জন্য তাদের উদ্দীপিত করার জন্য শুধু মাঝে মাঝে অনিয়মিতভাবে বৈদ্যুতিক আঘাত দেওয়া হয়েছিল।

লাইক্কেন যেসব পরীক্ষণমূলক দলের উপর পরীক্ষণ চালিয়েছিলেন, শিক্ষণ পরিস্থিতিতে সামগ্রিক ভুলের সংখ্যার দিক থেকে তাদের মধ্যে তেমন কোন পার্থক্য ছিল না। তবে সাধারণতঃ কলেজ ছাত্ররা ভুল প্রতিক্রিয়ার সংখ্যা (যার ফলে বৈদ্যুতিক আঘাত পাওয়া যায়) অন্যান্যদের চেয়ে কম করেছিল।

সবচেয়ে বেশি সংখ্যক ভুল করেছিল সাইকোপ্যাথরা এবং সেজন্য তারা সবচেয়ে বেশি বার বৈদ্যুতিক আঘাত পেয়েছিল। এসব ফলাফল থেকে লাইক্কেন সিদ্ধান্ত করেন যে, যেহেতু সাইকোপ্যাথরা প্রায়ই বৈদ্যুতিক আঘাত এড়িয়ে যায়নি, সেহেতু মনে করা যায় যে, তাদের মধ্যে অন্যান্য সাধারণ লোকদের চেয়ে কম উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছিল।

ভীতি-উৎপাদনকারী উদ্দীপকের প্রতি সাইকোপ্যাথরা যে কম উদ্বেগের সাহায্যে প্রতিক্রিয়া করে তা স্বয়ংক্রিয় স্নায়ুতন্ত্রের কার্যাবলী সম্মন্ধীয় গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে। বিশ্রামরত অবস্থায় (resting situation) সাইকোপ্যাথদের ত্বকের বিদ্যুৎ পরিবাহিতা (skin conductance) স্বাভাবিকের চেয়ে কিছুটা কম থাকে এবং তারা যখন একটি তীব্র বা বর্জনমূলক উদ্দীপকের সম্মুখীন হয়, তখন তাদের ত্বকের বিদ্যুৎ পরিবাহিতায় খুব বেশি পরিবর্তন দেখা যায় না, এমনকি একটি বর্জনমূলক উদ্দীপক প্রত্যাশা করলেও তাদের গ্যালভানিক ত্বক প্রতিক্রিয়ার কোন পরিবর্তন ঘটে না (Harpar and Hare, 1990)। তবে তাদের হৃৎপিণ্ডের গতি পরিমাপ করলে ভিন্ন চিত্র পাওয়া যায়। বিশ্রামরত অবস্থায় সাইকোপ্যাথদের হৃৎপিণ্ডের গতি স্বাভাবিক থাকে, এবং যখন তাদের সম্মুখে নিরপেক্ষ বা সাধারণ উদ্দীপক (Neutral stimuli) উপস্থিত করা হয়, তখনও তাদের হৃৎস্পন্দন স্বাভাবিক থাকে, কিন্তু যেসব পরিস্থিতিতে সাইকোপ্যাথরা একটি পীড়নমূলক উদ্দীপক আসছে বলে প্রত্যাশা করে, তখন তাদের হৃৎপিণ্ড, স্বাভাবিক মানুষদের যারা একই ধরনের পীড়নমূলক উদ্দীপক প্রত্যাশা করে তাদের চেয়ে বেশি দ্রুতগতিতে চলে।

এসব শারীরবৃত্তীয় প্রতিক্রিয়া এটাই নির্দেশ করে যে, সাইকোপ্যাথদের শুধু কম উত্তেজনা প্রবণ (less aroused) বলা যায় না, কারণ তাদের ত্বকের গ্যালভানিক পরিবহনশীলতা (Skin Conductance) এবং হৃৎপিণ্ডের গতির হার অসামঞ্জস্যপূর্ণ। লেসীর গবেষণার (Lacey, 1967)-উপরে ভিত্তি করে হেয়ার (Hare. 1978) সাইকোপ্যাথদের শারীরবৃত্তীয় প্রতিক্রিয়া সমূহের বিশেষ ধরনের প্যাটার্ন বা নমুনার উপরে গুরুত্ব দেন। তিনি মনে করেন যে, সাইকোপ্যাথদের হৃদপিণ্ডের বর্ধিত ক্রিয়া সংবেদী তথ্যপ্রবাহকে কমিয়ে দেয়, বা বের করে দেয় (gating out)-যার ফলে তাদের করটেক্সের উত্তেজনা কমে যায়। সুতরাং সাইকোপ্যাথরা যখন একটি বর্জনমূলক বা পীড়নমূলক উদ্দীপক প্রত্যাশা করে তখন যে তাদের হৃৎপিণ্ডের ক্রিয়া বেড়ে যায় তার অর্থ হল, তারা উক্ত উদ্দীপকটিকে মনোযোগের বাইরে পাঠিয়ে দিচ্ছে। একটি পীড়নমূলক উদ্দীপকের প্রতি তখন তাদের ত্বকের পরিবহনশীলতা কমে যাওয়ার কারণ হল তারা উক্ত উদ্দীপকটিকে সফলভাবে উপেক্ষা বা অস্বীকার করতে পেরেছে। অর্থাৎ আমরা যদি ত্বকের বিদ্যুৎ পরিবাহিতাকে উদ্বেগের একটি সূচক হিসাবে ধরি, তাহলে একটি পীড়নমূলক বা উদ্বেগ সৃষ্টিকারী উদ্দীপক উপস্থিত করার পর তাদের মধ্যে ত্বকের বৈদ্যুতিক পরিবাহিতা বৃদ্ধি না পাওয়ার কারণ হল এই যে তারা ইতোমধ্যে উক্ত উদ্দীপকটিকে মনোযোগের বাইরে পাঠিয়ে দিয়ে সমস্যাটির সমাধান করে ফেলেছে। এই ব্যাখ্যাটি লাইক্কেনের পরিহারমূলক শিক্ষণের গবেষণার ফলাফলের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। তাছাড়া আরো কয়েকটি গবেষণায় এ ধরনের ব্যাখ্যার সমর্থন পাওয়া গেছে (Ogloff & Wong, 1990)। জুটাই ও তার সহকর্মীদের (Jutai and Hare, 1983)-এর গবেষণায় দেখা গেছে যে, আচরণ ও জৈবিক প্রতিক্রিয়ার দিক থেকে বিচার করলে, সাইকোপ্যাথরা উদ্দীপকসমূহকে অগ্রাহ্য করতে এবং তাদের নিজস্ব আগ্রহের বিষয়ে মনোনিবেশ করতে অত্যন্ত পারদর্শী।

অন্য পদ্ধতিতে সাইকোপ্যাথদের আবেগীয় প্রতিক্রিয়া পরিমাপ করেও লাইক্কেনের তত্ত্বের সমর্থন পাওয়া গেছে। এ ধরনের একটি পদ্ধতি হল বিস্ময়মূলক প্রতিক্রিয়ার (Startle response) সঙ্গে উপস্থিত চোখের মিটমিটানি বা চোখের পলক ফেলার প্রতিক্রিয়ার বিশ্লেষণ করা। বিস্ময়মূলক প্রতিক্রিয়ার সময় চোখের মিটমিটানি (Eyeblink)-প্রতিক্রিয়ার পরিমাপ একজন ব্যক্তির ধনাত্মক বা ঋণাত্মক আবেগীয় অবস্থার সবচেয়ে ভালো অবাচনিক নির্দেশক হিসেবে বর্তমানে গৃহীত হয়েছে। পরীক্ষণ পাত্রদের বিভিন্ন বিষয়বস্তু সম্মলিত কতকগুলো “স্লাইড” (Slide) বা খন্ডচিত্র দেখানো হয়। এগুলোর মধ্যে কিছুসংখ্যক থাকে ধনাত্মক (যেমন নগ্ন নারীচিত্র), আর কিছু থাকে ঋণাত্মক (যেমন, এসিড দগ্ধ নারী), অন্য কতকগুলো থাকে নিরপেক্ষ (neutral)। এই ছবিগুলো দেখার সময় মাঝে মাঝে তাদের হঠাৎ করে বিকট বিস্ফোরণের আওয়াজ শোনানো হয়। যা তাদের মধ্যে বিস্ময়মূলক প্রতিক্রিয়া (Startle response) সৃষ্টি করে। বিস্ময় প্রতিক্রিয়াটি কত শক্তিশালী হবে তা নির্ভর করে পরীক্ষণপাত্র শব্দটি শোনার সময় কোন ধরদের আবেগীয় অবস্থায় ছিল তার উপর। পরীক্ষণ পাত্র যদি ধনাত্মক আবেগীয় অবস্থায় থাকে, তাহলে শব্দ শুনে তার বিস্ময়মূলক প্রতিক্রিয়া কম হয়, আর নেতিবাচক আবেগীয় অবস্থায় থাকলে তার বিস্ময়মূলক প্রতিক্রিয়া বেশি হয়।

বিস্ময়মূলক প্রতিক্রিয়া ব্যবহার করে জেলখানা থেকে চার ধরনের কয়েদীকে নির্বাচন করা হয়েছিল হেয়ার (Hare) এর চেকলিষ্ট-এর উপরে ভিত্তি করে।

  • (১) সাইকোপ্যাথ নয় (non-psychopaths): সমাজ-বিরোধী আচরণ কম, আবেগীয় বিচ্ছিন্নতা (emotional detachment) কম।
  • (২) বিচ্ছিন্ন অপরাধী (detached offenders): এরা শুধু আবেগীয় বিচ্ছিন্নতার দিক থেকে (বেশি নম্বর পায় বা) উচ্চমানের।
  • (৩) সমাজ-বিরোধী অপরাধী (antisocial offenders): এদের মধ্যে শুধু সমাজ-বিরোধী আচরণ বেশি ছিল।
  • (৪) সাইকোপ্যাথ (Psychopath): এদের মধ্যে সমাজ-বিরোধী আচরণ ও আবেগীয় বিচ্ছিন্নতা দুটোই বেশি ছিল।

এসব পরীক্ষণ পাত্রদের প্রথমে একটি ভিত্তিরেখামূলক পরিস্থিতির সম্মুখীন করা হয়- যাতে তাদের একটি সাধারণ দৃশ্য সংকেত দেখানো হয় এবং মাঝে মাঝে তীব্র শব্দ উপস্থিত করা হয়। তারপর তাদের আরেকটি পরিস্থিতির সম্মুখীন করা হয় যেখানে তারা পূর্বের দৃশ্যটি দেখে এবং তাদের বলা হয় যে এই দৃশ্যটি অপসারণ করার পর একটি তীব্র শব্দ শোনা যাবে।

পরীক্ষণের দ্বিতীয় পর্যায়ে, বিস্ময়মূলক প্রতিক্রিয়ার দিক থেকে চারটি দলের মধ্যে উল্লেখযোগ্য পার্থক্য দেখা দিয়েছিল। সাইকোপ্যাথ এবং বিচ্ছিন্ন অপরাধী-এই উভয় দলেই বিস্ময়মূলক প্রতিক্রিয়ার বৃদ্ধি খুব কম পরিমাণে হয়েছিল। এতে বোঝা যায় যে তাদের মধ্যে ভীতির পরিমাণ কম হয়েছিল। এই ধরনের ফলাফল খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। তার কারণ হল, এই ফলাফলের দ্বারা বোঝা যায় যে, সাইকোপ্যাথদের আবেগীয় বিচ্ছিন্নতার সঙ্গে তাদের সমাজবিরোধী আচরণ নয়, বরং তাদের আবেগীয় দারিদ্র্য বা আবেগের অভাবই বেশি সম্পর্কযুক্ত।

প্রতিক্রিয়ার মড্যুলেশন (Response modulation)

সাইকোপ্যাথিক আচরণের কারণ নির্ণয়ে এখন কিছু নতুন তথ্য সংযোজিত হয়েছে যেগুলো আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের সহায়ক। অনেক মনোবিজ্ঞানী মনে করছেন যে, আমাদের শরীরের ভেতরে এমন কিছু ঘটে যা আমাদের সমাজ-বিরোধী আচরণের দিকে ঠেলে দেয়। প্রাণীদের মস্তিষ্কের সেপ্টাম অঞ্চল (Septum), হিপোক্যাম্পাস এবং করর্টেক্সের সম্মুখ অংশের পূর্বভাগ বা প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স (Prefrontal cortex)– ইত্যাদিসহ মস্তিষ্কের কিছু অংশে অস্ত্রোপচার করে ধ্বংস করে দিলে তারা বেশি আবেগপ্রবণ (impulsive) হয়ে পড়ে। এবং লক্ষ্যাভিমুখী আচরণ বজায় রাখতে পারে না। এসব দৃষ্টান্ত পর্যবেক্ষণ করে মনোবিজ্ঞানীরা বলেছেন যে, মস্তিষ্কের এসব অঞ্চলের ক্রিয়ার সঙ্গে সাইকোপ্যাথিক আচরণের সম্পর্ক রয়েছে। যেসব প্রাণীর মস্তিষ্কে উল্লিখিত অস্ত্রোপচার করা হয়েছে সেগুলোর মধ্যে পরিহার শিক্ষণের অক্ষমতা এবং অব্যবহিত পুরস্কারের প্রতি নিয়ন্ত্রণবিহীন (Impulsive) বা তাৎক্ষণিক আচরণ লক্ষ্য করা যায়। সাইকোপ্যাথদের আচরণেও এধরনের নিয়ন্ত্রণহীনতা বা ঝোঁকের বশে আচরণ করার প্রবণতা (Impulsivity) লক্ষ্য করার মত। সাইকোপ্যাথদের আচরণে নিয়ন্ত্রণহীনতা (Impulsivity) এর আরেকটি প্রমাণ হল মস্তিষ্কের তরঙ্গ সম্পর্কিত গবেষণা থেকে প্রাপ্ত। মস্তিষ্ক-তরঙ্গের গবেষণায় দেখা গেছে, সাইকোপ্যাথদের মস্তিষ্কের নিম্নভাগে (Temporal lobe) ধীরগতি সম্পন্ন ও স্পাইক (spike) বা সূক্ষাগ্র তরঙ্গ পাওয়া যায়। এ ধরনের তরঙ্গের সঙ্গে ঝোঁকের বশে কাজ করার প্রবণতার ধনাত্মক সম্পর্ক রয়েছে (Syndulko, 1978)।

সাইকোপ্যাথদের যখন এমন কোন কাজ বা সমস্যা দেওয়া হয় যাতে ব্যর্থতা বা সাফল্যের উপর ভিত্তি করে তাদের প্রতিক্রিয়া পরিবর্তন করতে হয়, তখন তাদের মধ্যে ঝোঁকের বশে কাজ করার প্রবণতা (impulsivity) ধরা পড়ে। একটি গবেষণায় ঝোঁকের বশে কাজ করার বৈশিষ্ট্যটি দেখানো হয়েছে। পরীক্ষণ পাত্রদের একটি কম্পিউটারের পর্দায় একটি তাসের খেলা দেখানো হয়। খেলাটি ছিল এমন যে কোন একটি ফেসকার্ড (face card)) (ফেসকার্ড বলতে বোঝায় রাজা, রাণী এবং গোলাম এর যেকোন একটি ভাসকে।) উপস্থিত হলে খেলোয়ার পাঁচ সেন্ট জিতবে, আর অন্যকার্ড আসলে পাঁচ সেন্ট হারবে। প্রত্যেকবার খেলার পর পরীক্ষণ পাত্র ইচ্ছা করলে খেলা চালিয়ে যেতে পারে অথবা বন্ধ করে দিতে পারে। পরীক্ষক হার জিতের সম্ভাবনা ঠিক করে ছিলেন। প্রথম দিকে হারবার সম্ভাবনা ছিল ১০%। তারপর প্রতি দশটি তাস খেলার পর হারবার সম্ভাবনা ১০% করে বাড়ানো হয় এবং এভাবে ১০০% পর্যন্ত করা হয়। পরীক্ষণে দেখা যায়, সাইকোপ্যাথরা, যারা সাইকোপ্যাথ নয়-তাদের তুলনায় দীর্ঘক্ষণ খেলা চালিয়ে যায়। বার (১২) জন সাইকোপ্যাথের মধ্যে নয় (৯) জনই শেষের বিশ প্রচেষ্টার মধ্যে উনিশ বার হারার পরও খেলা ত্যাগ করেনি। অর্থাৎ তারা তাদের অনুপযোগী আচরণ পরিবর্তন করতে অক্ষম।

একই খেলা একটু ভিন্ন পদ্ধতিতে খেলা হয়েছিল। যেমন, একবার তাস ছোড়ার পর ফলাফল ঘোষণা করার পর পাঁচ সেকেন্ডের বিশ্রাম দেওয়া হয়েছিল- এই সময়ের মধ্যে তারা সিদ্ধান্ত নিতে পারত খেলা চালিয়ে যাবে কিনা। এবার দেখা গেল সাইকোপ্যাথরা তাদের খেলায় প্রচেষ্টার সংখ্যা (number of trials) কমিয়ে দিয়েছে। অর্থাৎ খেলায় হেরে যাবার পর খুব বেশি বার চেষ্টা করছে না। এর অর্থ হল একবার প্রতিক্রিয়ার পর দ্বিতীয়বার প্রতিক্রিয়ার মধ্যবর্তী সময় বিলম্বিত করা হলে সাইকোপ্যাথরা চিন্তা করতে বাধ্য হয় এবং তারা কি ফলাফল লাভ করল তার হিসাব করে এবং ঝোঁকের বশে কম কাজ করে।

মনে হচ্ছে যে যেসব ঘটনা চোখের সম্মুখে উপস্থিত নেই সেগুলো সম্পর্কে সাইকোপ্যাথরা কল্পনা করতে পারে না। অর্থাৎ জ্ঞানীয় জগতে (Cognitive level) এসব ঘটনা প্রতিফলিত হয় না। অথবা দূর্বলভাবে উপস্থিত থাকে। সেজন্য তাদের আচরণ দীর্ঘ মেয়াদী লক্ষ্য বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে পরিচালিত না হয়ে শুধু যেসব উদ্দীপক বর্তমানে উপস্থিত থাকে সেগুলো দ্বারা অপরিমিতভাবে পরিচালিত হয়।

এইসব পর্যালোচিত গবেষণাগুলো থেকে দেখা যাচ্ছে যে, আমরা বেশিরভাগ লোক যেভাবে প্রতিক্রিয়া করি সাইকোপ্যাথরা সেভাবে করে না। বিশেষতঃ তাদের মধ্যে তেমন কোন উদ্বেগ থাকে না, সেজন্য এটা তাদের আচরণকে বাধা দিতে পারে না। যেহেতু সাইকোপ্যাথরা তাদের নেতিবাচক আবেগীয় প্রতিক্রিয়াগুলোর দ্বারাই বেশি নিয়ন্ত্রিত, সেজন্য তারা উত্তেজনা খোঁজে। যেহেতু তাদের অবদমন প্রক্রিয়া দূর্বল এবং পরিকল্পনা করতে পারে না, সেজন্য তারা ঝোঁকের মাথায় কাজ করে। সেজন্য সাইকোপ্যাথরা দুষ্কৃতি করে অথচ দুঃখ বা অনুশোচনা করে না, এবং আনন্দ বা শিহরণ চায়, কিন্তু সামাজিক রীতিনীতির প্রতি শ্রদ্ধা দেখায় না।

“Because the Psychopaths are in greater control of their negative emotional reactions, they actually seek arousal: and because psychopaths are deficient in planning and in inhibition, they behave impulsively.” (Davison & Neale. 1998, p-347) । (“কারণ সাইকোপ্যাথরা (Psychopaths) তাদের নেতিবাচক আবেগগত প্রতিক্রিয়াগুলোর উপর বেশি নিয়ন্ত্রণ রাখে, তারা আসলে উত্তেজনা খোঁজে: এবং কারণ সাইকোপ্যাথরা পরিকল্পনা এবং নিয়ন্ত্রণে অপূর্ণ, তারা আচরণে অপ্রতিরোধ্য।”)

উদ্বিগ্ন/ভীত গুচ্ছ বা এনশাস/ফিয়ারফুল ক্লাস্টার (Anxious/Fearful Cluster)

এই গুচ্ছে তিনটি বিকৃতিকে অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে –

  1. পরিহারমূলক ব্যক্তিত্ব বিকৃতি বা এভয়ডেন্ট পারসোনালিটি ডিজর্ডার (Avoidant Personality Disorder)
  2. নির্ভরশীল ব্যক্তিত্ব বিকৃতি বা ডিপেন্ডেন্ট পারসোনালিটি ডিজর্ডার (Dependant Personality Disorder), এবং
  3. বাধ্যতাধর্মী আচরণ ও চিন্তামূলক ব্যক্তিত্ব বিকৃতি বা অবসেসিভ-কম্পালসিভ পারসোনালিটি ডিজর্ডার (Obsessive-Compulsive Personality Disorder)

সংক্ষেপে, যেসব ব্যক্তি সামাজিক পরিস্থিতিকে ভয় করে বা এসব পরিস্থিতিতে উদ্বেগ বধ করে তাদের পরিহারমূলক ব্যক্তিত্ব-বিকৃতি বা এভয়ডেন্ট পারসোনালিটি ডিজর্ডারের রোগী বলা হয়। যাদের আত্মনির্ভরশীলতা নেই এবং বেশি মাত্রায় অন্যের উপর নির্ভরশীল তাদের নির্ভরশীল ব্যক্তিত্ব বিকৃতি বা ডিপেন্ডেন্ট পারসোনালিটি ডিজর্ডার বলা হয়, এবং যারা খুঁতখুতে স্বভাবের, সব কিছুতে পূর্ণমাত্রায় উৎকর্শতা অর্জন না করা পর্যন্ত অধীরবোধ করে – তাদের বাধ্যতাধর্মী আচরণ ও চিন্তামূলক ব্যক্তিত্ব বিকৃতি বা অবসেসিভ-কম্পালসিভ পারসোনালিটি ডিজর্ডারের রোগী বলা হয়।

পরিহারমূলক ব্যক্তিত্ব বিকৃতি বা এভয়ডেন্ট পারসোনালিটি ডিজর্ডার (Avoidant Personality Disorder)

এভয়ডেন্ট পারসোনালিটি ডিজর্ডারে ব্যাপক সামাজিক অবদমন, অক্ষমতাবধ, নেতিবাচক মূল্যায়নের প্রতি অতিসংবেদনশীলতার একটি সমন্বয় লক্ষ্য করা যায় যা যৌবনের প্রথম দিকে শুরু হয় এবং বিভিন্ন পরিস্থিতিতে আত্মপ্রকাশ করে। এভয়ডেন্ট পারসোনালিটি ডিজর্ডার শনাক্তকরণের জন্য নিম্নলিখিত লক্ষণগুলোর অন্ততঃ চারটি বা তার বেশি সংখ্যক লক্ষণ উপস্থিত থাকতে হবে –

  1. যে সমস্ত বৃত্তিমূলক কাজে অন্যান্য ব্যক্তির সঙ্গে সংস্পর্শে আসতে হয়, বা পারস্পরিক সংযোগ ঘটে, সমালোচনার ভয়, প্রত্যাখ্যাত হবার ভয়, অথবা স্বীকৃতি না পাওয়ার ভয়ে ব্যক্তি ঐসব কাজ এড়িয়ে চলে।
  2. তাকে পছন্দ করবে – এ বিষয়ে নিশ্চিত না হয়ে সে অন্য লোকের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করতে অনিচ্ছুক।
  3. লজ্জা পাবার ভয়, অথবা হাস্যাস্পদ হবার ভয়ে সে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপনে সতর্কতা ও সংযম অবলম্বন করে।
  4. সামাজিক পরিস্থিতিতে সমালোচিত বা প্রত্যাখ্যাত হবার দুশ্চিন্তায় আচ্ছন্ন থাকে।
  5. অক্ষমতাবোধে আক্রান্ত হবার দরুন নতুন করে কারও সাথে পারস্পরিক সম্পর্ক স্থাপনে অনাগ্রহী, অবদমিত।
  6. নিজেকে সামাজিকভাবে অদক্ষ, ব্যক্তিগতভাবে নিজেকে আবেদনহীন, অনাকর্ষণীয়, বা হীন মনে করে।
  7. বিব্রতকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হবার ভয়ে ব্যক্তিগতভাবে ঝুঁকি নিতে নারাজ, অথবা নতুন কোন কাজে আত্মনিয়োগ করতে অস্বাভাবিকভাবে অনিচ্ছুক।

অর্থাৎ যেসব ব্যক্তি সমালোচিত হতে অত্যন্ত ভয় পায়, প্রত্যাখ্যাত হতে ভয় পায়, স্বীকৃতি পাবে না বলে মনে করে এবং এসব পরিস্থিতির প্রতি অতিশয় সংবেদনশীল, এবং তাদের অপছন্দ করা হবে না এ বিষয়ে নিশ্চিন্ত না হয়ে কারও সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনে অনিচ্ছুক তাদের এভয়ডেন্ট পারসোনালিটি ডিজর্ডারের রোগী হিসেবে শনাক্ত করা হয়। কেউ যদি তাদের প্রতি ভালোবাসা দেখায়, বা সম্পর্ক স্থাপনে আগ্রহ প্রকাশ করে, তাহলে তারা তাদের আন্তরিকতা সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করে। তারা সামাজিক পরিস্থিতিতে জড়সড় হয়ে থাকে কারণ তারা আশঙ্কা করে হয়তো কখনও বোকার মত কিছু বলে ফেলবে, অথবা তারা লজ্জার কারণে বা উদ্বেগের কারণে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়বে। তারা মনে করে তারা অদক্ষ অক্ষম বা অন্যের তুলনায় হীন। সেজন্য দৈনন্দিক রুটিন কাজের বাইরে তারা কোন কাজ করতে গিয়ে অসুবিধাগুলোকে, বিপদের ঝুঁকিকে অতিরঞ্জিত করে। আমেরিকায় এধরণের রোগীর সংখ্যা প্রায় ১% (Weissman, 1993)। এই বিকৃতির সঙ্গে নির্ভরশীল ব্যক্তিত্ব বিকৃতি বা ডিপেন্ডেন্ট পারসোনালিটি ডিজর্ডারের লক্ষণগুলো সহাবস্থান করতে পারে। আবার বর্ডারলাইন পারসোনালিটি ডিজর্ডারের সঙ্গেও এটি সহাবস্থান করতে পারে। এই বিকৃতির লক্ষণগুলোর সঙ্গে সাধারণীকৃত সামাজিক ভীতি বা সশ্যাল ফোবিয়ার (Social phobia) লক্ষণগুলোর সাদৃশ্য থাকায় সামাজিক ভীতির সঙ্গেও এর সহাবস্থান দেখা যায় (Hoffmann et al. 1995)।

নির্ভরশীল ব্যক্তিত্ব বিকৃতি বা ডিপেন্ডেন্ট পারসোনালিটি ডিজর্ডার (Dependant Personality Disorder)

ডিপেন্ডেন্ট পারসোনালিটি ডিজর্ডারসম্পন্ন রোগীদের আত্মবিশ্বাস এবং আত্মনির্ভরশীলতার অভাব থাকে। এসব ব্যক্তি কোথায় থাকবে, কেমন বাসা ভাড়া নেবে, কী ধরণের চাকরি করবে, কার সাথে বন্ধুত্ব করবে – এসব ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবার দায়িত্ব নিষ্ক্রীয়ভাবে তাদের স্বামী বা স্ত্রীর উপর ছেড়ে দেয়। যেহেতু তারা তাদের ওপর থেকে সমর্থন বা স্বীকৃতি প্রত্যাহার করা হবে বলে ভয় করে, সেজন্য অন্যেরা ভুল বা অন্যায় করছে জেনেও তাদের সাথে একমত পোষন করে বা তাদের সমর্থন করে। তারা নিজেরা উদ্যোগী হয়ে কোন কাজ শুরু  করতে পারেনা এবং নিজেরা কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারেনা।

তারা অন্যের আদর যত্ন পেতে চায় এবং সেজন্য একাকী থাকতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেনা এবং তার আত্মীয়/স্বজন তাকে একাকী ফেলে চলে যাবে এই ভয়ে অস্থির থাকে। তারা অন্যের কাছে কিছু দাবী করতে পারে না, এবং অন্যের সুরক্ষিত আশ্রয় থেকে বঞ্চিত হবার ভয়ে নিজের চাহিদাগুলো প্রকাশ করেনা। যখন কোন ঘনিষ্ঠ বন্ধুর সাথে বিচ্ছেদ ঘটে যায়, তাহলে তারা পুরনো সম্পর্কের স্থানটি পুরণ করার জন্য আরেকটি নতুন সম্পর্ক স্থাপন করতে ব্যাকুল হয়ে ওঠে।

আমেরিকার জনসংখ্যায় ডিপেন্ডেন্ট পারসোনালিটি ডিজর্ডারে আক্রান্ত ব্যক্তির হার প্রায় ১.৫%, এবং এটি পুরুষদের চেয়ে নারীদের মধ্যে বেশি দেখা যায়। সম্ভবতঃ সামাজিক শিক্ষার ফলে মেয়েরা বেশি নম্র এবং স্বার্থত্যাগী হয় বলে (Corbitt & Widiger, 1995; Weisman, 1993)। তাছাড়া, এ রোগের কারণ পুরুষ ও নারীদের বেলায় ভিন্ন হতে পারে। রাইখ (Reich, 1990) এক গবেষণায় দেখেছেন যে, ডিপেন্ডেন্ট পারসোনালিটি ডিজর্ডারে আক্রান্ত পুরুষ রোগীদের আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে বিষণ্ণতার রোগী বেশি।

ডিপেন্ডেন্ট পারসোনালিটি ডিজর্ডারে আক্রান্ত পুরুষ রোগীদের আত্মীয় স্বজনদের মধ্যে বিষণ্ণতায় আক্রান্ত হবার হার বেশী। আর নারী রোগীদের আত্মীয়দের মধ্যে আতঙ্কজনিত মনোবিকৃতি বা প্যানিক ডিজর্ডারের (Panic Disorder) হার বেশি। ডিপেন্ডেন্ট পারসোনালিটি ডিজর্ডার বর্ডারলাইন পারসোনালিটি ডিজর্ডার, এভয়ডেন্ট পারসোনালিটি ডিজর্ডার, এক্সিস ১ এর অন্তর্গত বহুসংখ্যক ব্যাধি এবং দুর্বল শারীরিক স্বাস্থ্যের সঙ্গে উপস্থিত হতে পারে।

বাধ্যতাধর্মী আচরণ ও চিন্তামূলক ব্যক্তিত্ব বিকৃতি বা অবসেসিভ-কম্পালসিভ পারসোনালিটি ডিজর্ডার (Obsessive-Compulsive Personality Disorder)

ইংরেজি অবসেশন (Obsession) অর্থ হলো বাধ্যতাধর্মী চিন্তা, আর কম্পালশন (Compulsion) অর্থ হলো বাধ্যতাধর্মী আচরণ বা কাজ। সুতরাংশ ইংরেজি অবসেসিভ-কম্পালসিভ পারসোনালিটি ডিজর্ডার-কে বাংলায় প্রকাশ করলে দাঁড়ায়, যে ব্যক্তিত্বের বিকৃতিতে বাধ্যতাধর্মী চিন্তা ও কাজ প্রাধান্য বিস্তার করে। অবসেসিভ-কম্পালসিভ পারসোনালিটি ডিজর্ডারের প্রধান লক্ষণগুলো হলো –

  1. ব্যক্তি পূর্ণমাত্রায় উৎকর্ষতা অর্জনে অধীর (perfectionist), কাজের বা কর্মপরিকল্পনার খুঁটিনাটি বিষয়ে ব্যস্ত, কোন তালিকা প্রণয়নে নির্ভুলতা সম্পর্কে অতি সচেতন, নিয়ম-শৃঙ্খলা ইত্যাদি বিষয়ে অত্যন্ত খুঁতখুতে স্বভাবের; কিন্তু কাজের মূল লক্ষ্য হারিয়ে ফেলে। তারা কাজের খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে এত বেশি ব্যাপৃত থাকে যে শেষ পর্যন্ত কাজ বা প্রকল্প শেষ করতে পারেনা।
  2. কাজের ডিটেইল নিয়ে ব্যস্ত থাকার দরুন এবংনিখুঁত মান অর্জনে বেশি মনোযোগ দেবার কারণে কাজটির অগ্রগতি ব্যাহত হয় এবং শেষ পর্যন্ত কাজের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে পারেনা।
  3. কাজ ও উৎপাদনের প্রতি অতিরিক্ত মাত্রায় অনুরক্ত বা নিয়োজিত থাকার দরুন বিশ্রাম, চিত্তবিনোদন ও বন্ধুবান্ধবের প্রতি মনোযোগ দিতে পারেনা (কিন্তু এই আচরণ অর্থনৈতিক উদ্দেশ্যে নিয়োজিত নয়)।
  4. নৈতিকতা (morality), মূল্যবোধ, ইত্যাদি বিষয়ে অতিবিবেকবান, খুঁতখুঁতে এবং অনমনীয় (কিন্তু তা তার সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় পরিচয়ের দ্বারা ব্যাখ্যা করা যায়না)।
  5. ক্ষয়ে যাওয়া, বা অকেজো জিনিসপত্র বর্জন করতে পারেনা, এমন কি এগুলর কোন স্মারক বা আবেগীয় তাৎপর্য না থাকা সত্ত্বেও।
  6. সে নিজে যেমনভাবে কাজ করে তেমনভাবে করতে অঙ্গীকার না করলে কারও উপর দায়িত্ব হস্তান্তর করতে চায় না, বা কারও সাথে কাজ করতে চায়না।
  7. নিজের জন্য বা অন্যের জন্য অর্থব্যয়ে অতিশয় কৃপণ, মনে করে টাকা পয়সা শুধু ভবিষ্যৎ বিপদের জন্য সঞ্চয় করার বস্তু।
  8. অনমনীয়তা ও একগুঁয়েমিভাব প্রদর্শন করে।

সুতরাং অবসেসিভ-কম্পালসিভ পারসোনালিটি ডিজর্ডার হলো ব্যক্তিত্বের এমন একটি ব্যাপক নমুনা যার বৈশিষ্ট্য হলো নিয়মনিষ্ঠা, সবকিছুতে সর্বোৎকৃষ্টমান অর্জনে অধীর হওয়া, নমনীয়তা, উদারতা, মুক্ত মানসিকতা বর্জিত হয়ে সামাজিক ও মানসিক নিয়ন্ত্রণের মধ্যে জীবন যাপন করা। তার দৃষ্টি থাকে কাজের দিকে, আনন্দ লাভের দিকে নয়। পিছে ভুল হয়ে যায় সেই আশঙ্কায় সিদ্ধান্ত নিতে অসুবিধাবোধ করে, ভুল কাজে মনোযোগ চলে যাবে – সে ভয়ে কাজের সময় স্থির করতে পারেনা। তারা যেভাবে চায় ঠিক সেভাবে কাজ করতে হবে বলে দাবী করে এবং কোন শৈথিল্য বা নমনীয়তা দেখায় না, সেজন্য তাদের সামাজিক সম্পর্ক খুব কম লোকের সাথেই গড়ে ওঠে। প্রত্যেক কাজে নিখুঁত মান অর্জন করতে চায়। কট্টর নীতিবাগীশ। অবসেসিভ-কম্পালসিভ পারসোনালিটি ডিজর্ডার নারীর চেয়ে পুরুষদের মধ্যে বেশিদ এখা যায়। বাধ্যতাধর্মী চিন্তা ও আচরণ বিকৃতি বা অবসেসিভ-কম্পালসিভ ডিজর্ডার (obsessive-compulsive disorder) এর সাথে অবসেসিভ-কম্পালসিভ পারসোনালিটি ডিজর্ডারের যথেষ্ট পার্থক্য আছে। কারণ অবসেসিভ-কম্পালসিভ ডিজর্ডারে যে ধরণের বাধ্যতাধর্মী আচরণ ও চিন্তা থাকে, সেগুলো অবসেসিভ-কম্পালসিভ পারসোনালিটি ডিজর্ডারে থাকেনা। অবসেসিভ-কম্পালসিভ পারসোনালিটি ডিজর্ডারে আক্রান্ত লোকেরা অনেক সময় কাজ পাগল হতে পারে, কিন্তু তাদের অতিরিক্ত কাজ তাদের নিজেদের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলার চিন্তার বিরুদ্ধে একটি প্রতিরক্ষা কৌশল বা ডিফেন্স মেকানিজম হতে পারে। এই দুটি এক না হলেও কিছু সংখ্যক অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিজর্ডারের লোকেদের মধ্যে অবসেসিভ-কম্পালসিভ পারসোনালিটি ডিজর্ডার থাকতে পারে।

অবসেসিভ-কম্পালসিভ পারসোনালিটি ডিজর্ডার অনেক ক্ষেত্রে এভয়ডেন্ট পারসোনালিটি ডিজর্ডারের সঙ্গে সহাবস্থান করতে পারে। আমেরিকায় এধরণের ব্যক্তিত্ব বিকৃতিতে আক্রান্ত লোকের সংখ্যা প্রায় ১% (Lassano et al. 1993)।

এনশাস/ফিয়ারফুল ক্লাস্টারের কারণ

এই শ্রেণীর পারসোনালিটি ডিজর্ডারের কারণ নির্ণয়ে খুব বেশি গবেষণা হয়নি। এ সম্পর্কে যারা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন তাদের একটি অনুমান হলো এই যে, এ ধরণের ব্যক্তিত্ব বিকৃতির জন্য পিতামাতার সঙ্গে শিশুর ত্রুটিপূর্ণ সম্পর্কই সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

DSM-IV অনুসারে ডিপেন্ডেন্ট পারসোনালিটি ডিজর্ডারে দুই ধরণের লক্ষণ উপস্থিত থাকে –

  1. যেসব লক্ষণ ডিপেন্ডেন্ট বা নির্ভরশীল আচরণ প্রকাশ করে।
  2. যেসব লক্ষণ কারও সঙ্গে আসক্তি বা বন্ধন বা অনুরাগ সম্বন্ধীয় সমস্যা প্রকাশ করে।

বিকাশ মনোবিজ্ঞানীরা আসক্তি বা এটাচমেন্ট (attachment) বা বন্ধন সম্পর্কে গবেষণা করেছেন, এবং তারা বলেছেন যে ব্যক্তিত্ব বিকাশে এর গুরুত্ব রয়েছে।

আসক্তির প্রভাবের মূল কথাটি হলো, ছোট শিশু একজন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি যেমন বাবা, মার সঙ্গে আসক্ত বা ঘনিষ্ঠ হয়ে পড়ে এবং তাকে অবলম্বন করে সে বাইরের পৃথিবীতে ঘুরে বেড়ায় এবং লক্ষ্য অর্জনের চেষ্টা করে। অর্থাৎ সেই প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিটি তার জন্য একটি নিরাপদ ভিত্তি বা সিকিউর বেইজ (secure base) হিসেবে কাজ করে। সুতরাং প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিটির কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে তার ক্রোধ হয় এবং কষ্ট হয়। বিকাশ আরও কিছুদূর অগ্রসর হলে শিশু নিরাপত্তার জন্য শিশু নিরাপত্তার জন্য প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিটির উপর অর্থাৎ যার সঙ্গে তার আসক্তি ছিল, তার উপর আর নির্ভর করে না। ডিপেন্ডেন্ট পারসোনালিটি ডিজর্ডারে আসক্তি বা বন্ধন সম্পর্কিত যেসব অস্বাভাবিক আচরণ প্রকাশ পায়, সেগুলোকে বিকাশ প্রক্রিয়ার ত্রুটি বা ব্যর্থতা হিসেবে গণ্য করা যায়, যা শৈশবের পিতামাতার সম্পর্কের বিশৃঙ্খলা থেকে সৃষ্টি হয়। এসব বিশৃঙ্খলা পিতামাতার মৃত্যু, অবহেলা, প্রত্যাখ্যান অথবা অতিরিক্ত আগলে রাখা ইত্যাদি হতে পারে। ডিপেন্ডেন্ট পারসোনালিটি ডিজর্ডারে ভোগা একজন লোক অন্য লোকের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখার জন্য বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করতে  পারে – যে কৌশলগুলো সে শৈশবে পিতামাতার সঙ্গে সম্পর্ক রাখার জন্য ব্যবহার করত। যেমন যেকোন মূল্যে  সম্পর্ক বজায় রাখা, সব সময় তাদের মতামত মেনে চলা, তাদের খুশিমত আচরণ করা ইত্যাদি।

অমূলক ভীতির মতই, এভয়ডেন্ট পারসোনালিটি ডিজর্ডার পরিবেশের প্রভাবে সৃষ্টি হতে পারে। সাধারণ মানুষেরা যেসব পরিস্থিতি বা ব্যক্তিকে নিরীহ, নিষ্কণ্টক বলে মনে করে, পিতামাতা যদি শিশুকে সেইসব পরিস্থিতিকে বা ব্যক্তিকে ভয় পেতে শেখায়, তাহলে শিশুর মধ্যে এভয়ডেন্ট পারসোনালিটি ডিজর্ডার গড়ে উঠতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে পিতামাতার এসব ভয়ভীতি থাকে এবং তারা শিশুর মধ্যেও এ ভয় সংক্রমিত করে। পিতামাতা শিশুর মডেল বা আদর্শ হিসেবে কাজ করে।

অবসেসিভ-কম্পালসিভ পারসোনালিটি ডিজর্ডারকে ফ্রয়েড শৈশবের পায়ুপর্যায়ে সংবন্ধনের ফল হিসেবে ব্যাখ্যা করেছিলেন। আধুনিককালের মনোসমীক্ষণবাদীরা মনে করেন যে, ব্যক্তি যখন মনে করে যে নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলবে, তখন এর বিরুদ্ধে অতি ক্ষতিপুরণমূলক প্রতিক্রিয়া বা ওভার কম্পেনসেশন (Over compensation) হিসেবে বাধ্যতামূলক আচরণ সৃষ্টি করে। যেমন কেউ যদি এটা ভেবে শঙ্কিত হয় যে, সে বিশ্রাম নিলে বা মজা করলে তার জীবন ওলটপালট হয়ে যাবে, তাহলে সে অতিরিক্ত কাজের মধ্যে আত্মনিয়োগ করে সেই চিন্তাকে দূরে রাখতে চেষ্টা করতে পারে। এর ফলেই তার মধ্যে বাধ্যতাধর্মী আচরণ তৈরি হবে।

তথ্যসূত্র –

  • অস্বাভাবিক মনোবিজ্ঞান : মানসিক ব্যাধির লক্ষণ, কারণ ও আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতি, অধ্যাপক নীহাররঞ্জন সরকার, ডাঃ তনুজা সরকার, জ্ঞানকোষ প্রকাশনী, ঢাকা, ২০১০

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.