বিশ্বজিৎ দাস ও আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ড

বিশ্বজিৎ দাস হত্যাকাণ্ড

বিস্বজিৎ দাস ছিলেন ঢাকার শাঁখারী বাজারের একজন ২৪ বছর বয়সী দর্জি, যিনি ৯ ডিসেম্বর ২০১২ সালে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ (BSL) এর সদস্যদের দ্বারা নিহত হন। ছাত্রলীগ হল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ছাত্র শাখা। সেদিন ১৮ দলীয় জোটের ডাকা সারা দেশব্যাপী সড়ক অবরোধ চলছিল। সেই সকালে, বিশ্বজিৎ দাস তার দোকান আমন্ত্রণ টেইলার্সের দিকে যাচ্ছিলেন যখন ছাত্রলীগের কর্মীদের একটি অবরোধবিরোধী মিছিলের নিকটে এক বা একাধিক ছোট বোমা বিস্ফোরিত হয়। ছাত্রলীগের একটি দল ভুলবশত দাসকে বিরোধী দলের সমর্থক ভেবে তাকে বাহাদুর শাহ পার্কের নিকট থেকে একটি ভবনের ভিতরে তাড়া করে। তারা তাকে চাপাতি, লোহার রড এবং হকি স্টিক দিয়ে আক্রমণ করে। দাস পালানোর চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু শাঁখারী বাজার রোডে পড়ে যান। এক রিকশাচালক দাসকে মিটফোর্ড হাসপাতালে নিয়ে গেলে তিনি কিছুক্ষণ পরে তার আঘাতে মারা যান।

এই হত্যাকাণ্ডটি সরাসরি টেলিভিশনে সম্প্রচারিত হয় এবং জাতিকে স্তম্ভিত করে। কয়েক দিনের মধ্যেই, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় তিনজন শিক্ষার্থীকে বহিষ্কার করে এবং আরও দুজনের সনদপত্র বাতিল করে। পরের সপ্তাহে তারা আরও চারজনকে বহিষ্কার করে।

২৫ ডিসেম্বরের মধ্যে, সাতজন সন্দেহভাজন পুলিশ হেফাজতে ছিল। ২৬ মে ২০১৩ সালে অষ্টম ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়। এই আটজন সহ মোট একুশ জনকে দাসের হত্যাকাণ্ডে অভিযুক্ত করা হয়। তাদের বিচার ১৪ জুলাই শুরু হয়। ১৮ ডিসেম্বর ২০১৩ সালে, সকল একুশজনকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। আটজনকে মৃত্যুদণ্ড এবং তেরজনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। তেরজন, যাদের মধ্যে দুইজন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত অনুপস্থিত ছিল এবং ২০১৭ সালের আগস্ট পর্যন্ত তাদের ধরা যায়নি।

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের ২০১২ সালের মানবাধিকার চর্চার রিপোর্টে, বিস্বজিৎ দাসের হত্যাকাণ্ডকে বাংলাদেশে সাধারণ ধর্মঘটের সঙ্গে সম্পর্কিত রাজনৈতিক সহিংসতার উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ড

ভূমিকা

আবরার ফাহাদ (ফেব্রুয়ারি ১২, ১৯৯৮ – অক্টোবর ৭, ২০১৯) ছিলেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং (EEE) বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। তাকে বুয়েটের শেরে বাংলা হলে বুয়েট ছাত্রলীগের নেতাদের দ্বারা নির্মমভাবে নির্যাতন ও হত্যা করা হয়। এই ঘটনাটি জাতীয় ক্ষোভের সৃষ্টি করে এবং ক্যাম্পাসে সহিংসতার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ শুরু হয়। ব্যাপক প্রচারিত এক বিচারিক প্রক্রিয়ার পরে আবরারের হত্যাকারীদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। একটি ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনে পরে নিশ্চিত করা হয় যে, ফাহাদ গুরুতর আঘাতজনিত কারণে মারা গেছেন।

প্রাথমিক জীবন ও শিক্ষা

আবরার ফাহাদ ১২ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৮ সালে কুষ্টিয়া, বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ঢাকার নটরডেম কলেজে শিক্ষাগতভাবে অসাধারণ কৃতিত্ব অর্জন করেন এবং উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় ঢাকা বোর্ডের শীর্ষ ২০ শিক্ষার্থীর মধ্যে ছিলেন। তিনি ৩১ মার্চ ২০১৮ সালে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) তার পড়াশোনা শুরু করেন।

মৃত্যুর সময়, ফাহাদ ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের (টার্ম ১) শিক্ষার্থী ছিলেন।

মৃত্যু

রবিবার, ৬ অক্টোবর ২০১৯, রাত ৮ টার দিকে তৃতীয় বর্ষের ছাত্ররা ফাহাদ এবং অন্যান্য দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রদের শেরে বাংলা হলের ২০১১ নম্বর কক্ষে ডেকে আনে, বলে জানিয়েছেন বুয়েট ছাত্রলীগের সহ-সম্পাদক আশিকুল ইসলাম বিতু। চতুর্থ বর্ষের যান্ত্রিক প্রকৌশল বিভাগের ছাত্র ও বুয়েট ছাত্রলীগের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক আনিক সরকার এবং একই ইউনিটের আইন বিষয়ক উপ-সম্পাদক অমিত সাহা আবরারকে মারাত্মকভাবে আক্রমণ ও নির্যাতন করে। পুলিশ সোমবার ভোর ৩ টার দিকে শেরে বাংলা হলের নীচতলায় আবরারের মরদেহ আবিষ্কার করে। বুয়েট মেডিকেল অফিসার ডা. মো. মাসুক এলাহী তাকে মৃত ঘোষণা করেন। হলের দ্বিতীয় তলার ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরার ফুটেজে দেখা যায়, কয়েকজন ব্যক্তি আবরারকে তার হাত ও পায়ে ধরে করিডোর দিয়ে টেনে নিয়ে যাচ্ছে।

ফেসবুক সম্পৃক্ততা

আবরার ফাহাদকে ভারত-বাংলাদেশ সাম্প্রতিক চুক্তি (সেপ্টেম্বর-অক্টোবর ২০১৯) সমালোচনা করার জন্য হত্যা করা হয়েছিল।

পরবর্তী ঘটনা

  • বুয়েট এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সহ দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তাদের ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে, আবরার ফাহাদ হত্যার জন্য দায়ীদের কঠোর শাস্তির দাবি জানায়।
  • ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, শিক্ষার্থীরা সন্ত্রাসবিরোধী রাজু ভাস্কর্যের সামনে প্রতিবাদ সমাবেশে জড়ো হয়।
  • জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা একত্রে ক্যাম্পাসে মানববন্ধন করে এবং আবরারের হত্যাকারীদের মৃত্যুদণ্ডের দাবি জানায়।
  • খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে, শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান গেটের সামনে মানববন্ধন করে, ক্যাম্পাসের সামনে মহাসড়ক অবরোধ করে এবং আবরারের হত্যার প্রতিবাদে কালো ব্যাজ পরিধান করে।
  • রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে, শিক্ষার্থীরা রাজশাহী-ঢাকা মহাসড়ক আধা ঘণ্টা অবরোধ করে প্রতিবাদ করে।
  • শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে, শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসের প্রধান গেটের সামনে মানববন্ধন করে এবং পরে সিলেট-সুনামগঞ্জ মহাসড়ক ধরে একটি প্রতিবাদ মিছিল বের করে।
  • বুয়েট কর্তৃপক্ষ ক্যাম্পাসে সকল রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ করে এবং আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ডে অভিযুক্ত ১৯ শিক্ষার্থীকে সাময়িক বরখাস্ত করে।
  • ২০২৪ সালে, বুয়েটে ছাত্রলীগের রাজনীতি প্রবেশের নতুন চেষ্টার বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়জুড়ে ব্যাপক প্রতিবাদ ও একাডেমিক কার্যক্রম বর্জনের মুখে পড়তে হয়।

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া

জাতিসংঘ, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ফ্রান্স এবং যুক্তরাষ্ট্র আবরার ফাহাদ হত্যার কঠোর নিন্দা জানিয়েছে।

বিচার

বুয়েট ছাত্রলীগের ১৮ জন সদস্যকে হত্যার ঘটনায় আটক করা হয়ে।

৮ ডিসেম্বর ২০২১-এ, বাংলাদেশ আদালত ২০ জন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রকে মৃত্যুদণ্ড এবং আরও পাঁচজনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদান করে।

তথ্যসূত্র –

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.